নরক সংকেত – ২৫

২৫

সকালবেলা রুদ্রর ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। আড়মোড়া ভেঙে অলস ভঙ্গিতে বার্থে উঠে বসে দেখল, ওপাশের বার্থে প্রিয়ম বেশ জুত করে বসে দুটো কাপে কফি তৈরি করছে। মিষ্টি রোদের আলো এসে পড়েছে ওর মুখে। জানলা দিয়ে বাইরের অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে ও মুগ্ধ হয়ে গেল। সবুজে ঢাকা চোখজুড়োনো উপত্যকার মধ্যে দিয়ে চলেছে এদের ট্রেন, চালু ভ্যালিগুলোর মাঝে একটা দুটো করে বাড়ি, ঠিক ক্যালেন্ডারের মতো।

এই তাহলে জার্মানি! আইনস্টাইনের দেশ, অ্যানা ফ্রাঙ্কের দেশ, কার্ল মার্ক্সের দেশ! বইতে কত পড়েছে এই দেশের কথা। উনিশ শতকের শিল্পবিপ্লব, বার্লিন শহরের গোটা জার্মানির প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠা। তারপর পরপর দুটো বিশ্বযুদ্ধ, দেশভাগ, বার্লিন ওয়াল এইরকম নানা ঐতিহাসিক উত্থান পতনের সাক্ষী থেকেছে এই শহরের ইট, কাঠ, পাথর।

ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

ওকে উঠতে দেখেই প্রিয়ম বলল, ‘গুড মর্নিং! ওয়েলকাম টু জার্মানি, ম্যাডাম! আপনার জন্য কফি বানাচ্ছি। চটপট খেয়ে নিন। আর ঘণ্টাদুয়েক বাদেই নামতে হবে আমাদের।’

রুদ্র ছোট্ট একটা হাই তুলল। কাল রাতে তাড়াহুড়োতে চুলটাও বাঁধা হয়নি ভালো করে, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। সব চুলগুলোকে একসঙ্গে নিয়ে চুড়ো করে মাথায় একটা টপ নট বাঁধল ও, তারপর প্রিয়মের হাত থেকে কফির কাপটা নিল, ‘গুড মর্নিং! ঘুম হয়েছে?’

প্রিয়ম ঠোঁট উলটে বলল, ‘তেমন একটা না। যা সব জিনিস শোনালে কাল রাতে! ঘুম উড়ে গেছিল। শ্যুমাখারের নীল চোখদুটো দেখি একেকটা কে সি দাশের রসগোল্লা হয়ে গেছে!’

রুদ্রর এত হাসি পেল, কফিটা গলায় আটকে গেল হঠাৎ, বিষম খেতে খেতে বলল। ‘তোমার তারস্বরে নাক ডাকতে ডাকতেও ঘুম হল না? নাহ, তোমারই হবে প্রিয়ম! শ্যুমাখারের মধ্যেও তুমি রসগোল্লা দেখতে পেলে?’

প্রিয়ম গম্ভীর মুখে তাকাল, ‘হেসো না। নিজে তো রেগুলার বেসিসে সাঁটাও, গিয়েও সাঁটাবে। বাইরে যারা থাকে, তাদের দেশের কোনো একটা ভালোবাসার জিনিসের সঙ্গে কোথাও কোনো মিল পেলেই মনটা হু হু করে ওঠে, বুঝলে! আর এ তো হল গিয়ে রসগোল্লা! সেটা তো প্রাণের শুধু নয়, একেবারে আত্মার আত্মীয়!’

রুদ্র হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়াল, বাথরুমে যাবে একটু, ‘তা আমার জন্য না হয় নাই—বা ফিরলে, আত্মার আত্মীয়র জন্যও তো অফিসে ইন্ডিয়া ফেরত পাঠানোর জন্য একটু তদবির করতে পারো!’

ক্যুপ থেকে বেরিয়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ও দেখল এখনও বার্লিন পৌঁছোতে দু—ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট। এখানকার ট্রেনগুলোতে পুরো প্লেনের কায়দায় সারাক্ষণ ডিসপ্লে করা হয়, ট্রেন কত গতিবেগ যাচ্ছে, এখন কোন অঞ্চলের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, গন্তব্যে পৌঁছোতে কত দেরি।

ওদের কম্পার্টমেন্টটার ডিজাইনটা ইন্ডিয়ার ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস কামরার মতো, একদিকে সরু প্যাসেজ, আর অন্যদিকে পরপর ক্যুপ। বাথরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ও ভালো করে চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিল, বার্লিনে পৌঁছে কেমন ঠান্ডার কবলে পড়তে হবে তা এখনও বুঝতে পারছে না, প্রথমে ঠিক করেছিল আগে গিয়ে কোনো হোটেলে উঠবে, কিন্তু এখন ও ভাবছে গিয়েই আগে ওই স্টুডিয়োতে চলে যাবে। নাকি আগে পুলিশের সঙ্গে দেখা করবে? কিন্তু তাতে যদি সুবিধার থেকে ঝামেলা বেশি হয়? চুরি যাওয়া এরকম একটা অ্যান্টিক জিনিস কী করে ওর কাছে গেল, কেনই—বা ওর কাছে রয়েছে সেটা নিয়েও হ্যারাসমেন্ট শুরু হয়ে যেতে পারে, তাতে এই দিকটা নিয়ে ও আর এগোতেই পারবে না।

বাথরুম থেকে বেরিয়েই করিডরে প্রিয়মকে দেখে অবাক হয়ে গেল, দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলে খুটখাট করছে। ও এগিয়ে গিয়ে বলল, ‘তুমি এখানে কেন?’

প্রিয়ম মোবাইলের দিকে তাকিয়েই বলল, ‘ওই ক্লিন করতে এসেছে। বলল, বাইরে গিয়ে ওয়েট করতে। তাই এখানটায় এলাম। এখানে দেখছি ওয়াই—ফাইটা ভালো ধরছে।’

রুদ্র চোখ কপালে তুলে বলল, ‘আমার হ্যান্ডব্যাগটা?’

প্রিয়ম বলল, ‘ওখানেই আছে। কিছু তো নেই তেমন, টাকাপয়সা তো সব আমার মানিব্যাগে।’ বলেই ঝট করে মুখটা তুলল, চোখে সাদা দৃষ্টি, ‘এই যা! আমি তো শুধু আমার পার্সটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম।’

রুদ্র ওকে মুহূর্তের মধ্যে ঠেলে সরিয়ে ছুটতে লাগল ওদের ক্যুপের দিকে। হন্তদন্ত হয়ে এসে সজোরে ওদের ক্যুপের দরজাটা খুলল, যা ভেবেছে ঠিক তাই।

ওদের একমাত্র রুকস্যাকটা চেন খোলা অবস্থায় উলটে পড়ে রয়েছে কার্পেটের ওপর, তার ভেতর থেকে নির্দয়ভাবে জামাকাপড়গুলো বের হয়ে এদিক—ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।

ওর হ্যান্ডব্যাগটাও খোলা, রুদ্র মুহূর্তের মধ্যে সেটাকে নিয়ে ভেতরটা দেখল, তারপর তীব্র হতাশায় ছুড়ে ফেলল বার্থের ওপর, ‘এতটা কেয়ারলেস তুমি আমি ভাবতেও পারিনি প্রিয়ম! তুমি আসলে পুরো ব্যাপারটাকেই অত্যন্ত ক্যাজুয়ালি নিয়েছিলে! একটু সিরিয়াসলি নিলে এরকমভাবে জিনিসটাকে ফেলে চলে যেতে না বাইরে!’

ওর পেছন পেছন প্রিয়মও চলে এসেছে, অপরাধীর গলায় ও বলল, আমার একদম মানে মাথাতেই ছিল না ব্যাপারটা! ছবিগুলো নেই?’

রুদ্রর রাগের থেকেও বেশি কান্না পাচ্ছিল। এত কাণ্ড করেও ও জিনিসটাকে বার্লিন নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত রক্ষা করতে পারল না। কোনোমতে নিজেকে কন্ট্রোল করে ও বলল, ‘যে ক্লিন করতে এসেছিল, সে কি জাপানি বা ওইরকম দেখতে?’

প্রিয়ম এবার জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘না তো! খাঁটি ইউরোপিয়ান একজন মহিলা। গায়ে ট্রেনের এমপ্লয়িদের ড্রেস। কী করে বুঝব বলো তো!’

রুদ্র বলল, ‘দেখতে কেমন?’

প্রিয়ম বলল, ‘মুখটা দেখিনি তেমন ভালো করে, টুপিতে ঢাকা ছিল। এখানে তো এভাবেই পরিস্কার করে যায়, কেউ কোনো সন্দেহ করে না।’

রুদ্র নিরাশভাবে উঠে দাঁড়াল। বাইরে গিয়ে কি একবার হেঁটে দেখে আসবে দু—পাশের কম্পার্টমেন্টগুলোর লোকজনদের?

কোনো লাভ নেই। জিনিসটা পেয়ে যখন গেছে, এত কাছেপিঠে নিশ্চয়ই সে রুদ্রর অপেক্ষায় বসে নেই।

প্রিয়মও বেশ মুষড়ে পড়েছে, ‘ছবিগুলোর কোনো কপিও তোমার কাছে নেই, না?’

রুদ্রর প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিল, কোনোমতে রাগটা কন্ট্রোল করে ও উত্তর দিল, ‘আমার মোবাইলে ছবি তোলা আছে।’

‘ওহ! তাহলে আবার কী!’ প্রিয়মের মুখ নিমেষে উদ্ভাসিত, ‘সেটা এতক্ষণ বলবে তো! ওখান থেকেই তো তুমি প্রসেসটা বের করতে পারবে! আমি তোমায় বার্লিনে পৌঁছেই ভালো কোয়ালিটির প্রিন্ট করে দেব।’

রুদ্র এবার ধমকে উঠল, ‘তুমি থামবে? আমার কাছে নেই সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল যে বা যারা ওটা হন্যে হয়ে খুঁজছিল তারা সেটা পেয়ে গেছে।’

রুদ্র বিরস মুখে কফিতে চুমুক দিল। একটু চুপ করে থেকে বলল, ‘তোমার ফোনে ফেসবুকটা একবার খোলো। এখানে স্পিড ভালোই।’

প্রিয়ম ফোনটা পকেট থেকে বের করতে করতে বলল, ‘হ্যাঁ, এখন ওয়াই—ফাই স্পিড ভালো দিচ্ছে, কিন্তু কাল রাতে বাইরের করিডরে বেরিয়েও কানেকশন পাচ্ছিলাম না। সেন্ট প্যানক্রাস স্টেশনেও পাইনি, ডেসমন্ডকে অফিসে একটা ফোন করার ছিল, বাধ্য হয়ে ব্যালেন্স খরচ করে করতে হল। আজ যে যাব না, সেটা জানিয়ে দিলাম, ওর পক্ষে এখন পুরোটা সামলানো মুশকিল হয়ে গেল খুব।’

রুদ্র বলতে যাচ্ছিল, ‘ছুটির কারণ কী বললে?’ কিন্তু সেটা বলার আগেই ও বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘তুমি ফোনের সুইচ অন করে ফেলেছ?’

প্রিয়ম বলল, ‘না না। কাল রাতে একবারই অন করেছিলাম, ডেসমন্ডকে ফোন করলাম, তোমার বাবার দেখলাম মেসেজ ঢুকেছিল, তোমাকে ফোনে পাচ্ছেন না বলে, তাই বাবাকেও ফোন করলাম। তারপরেই আবার অফ করে দিয়েছি।’

রুদ্র প্রায় ভস্ম করে দেওয়ার দৃষ্টিতে বলল, ‘তোমাকে বলেছিলাম ফোনটা অন না করতে!’

প্রিয়ম বলল, ‘আরে চিন্তার কিছু নেই, মুচিবাবু একবারও ফোন করেনি। না মিসড কল অ্যালার্ট, না কোনো মেসেজ!’

রুদ্র কটমট করে তাকাল, ‘মুচিবাবু! সেটা আবার কে?’

প্রিয়ম বলল, ‘ওই যে, শ্যুমাখার! আরে তখন তো লোকজনের প্রোফেশন অনুযায়ী নাম হত জার্মানিতে, জানো না? যেমন ফিশার সারনেম মানে ফিশারম্যান বা জেলে, জিমারম্যান মানে কাঠের মিস্ত্রি। ওই যে শ্যুমাখার, আসলে ও ছিল শ্যু—মেকার, মানে ওর পূর্বপুরুষ জুতো তৈরি করত। ফর্মুলা ওয়ানের মাইকেল শ্যুমাখারেরও তাই।’

রুদ্রকে একটু থমকে যেতে দেখে প্রিয়ম বলে যেতে লাগল, ‘দেখেছ, নলেজ শুধু তোমারই নেই বস, আমারও আছে। তবু একটুও অহংকার নেই আমার, নিজেই মাঝেমধ্যে অবাক হয়ে যাই ভেবে।’

রুদ্র পরিস্কার বুঝতে পারছিল নিজের আরেকটা অপকর্ম ঢাকার জন্য প্রিয়ম এখন এইসব বলে প্রসঙ্গটা ঘোরাবার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ও মোটেই দমল না, ‘তুমি কি জানো ওই যে কিছুক্ষণের জন্য ফোনটা অন করেছিলে, তাতেই যাদের আমাদের লোকেশনটা ট্র্যাক করার দরকার ছিল, তারা ঠিক ধরে ফেলেছে সেটা? শিট!’ ও কপালের দু’পাশের রগ—দুটো টিপে ধরল, ‘এত কাণ্ড করলাম, একগাদা খরচ করে রাতদুপুরে বেরিয়ে এতদূর এলাম, ওরা এয়ারপোর্টগুলোয় নজর রাখবে বলে ট্রেনে এত টাইম নষ্ট করে এলাম, আলটিমেটলি কোনো লাভ হল না। তাই আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম যে কী করে ট্রেন থেকে ওরা জিনিসটা হাতাতে পারল। এখন তো আমি শিয়োর কাল রাতে আমার গায়ে জল ফেলাটাও ইনটেনশনাল ছিল। পরিষ্কার একটু ভড়কে দেওয়া উদ্দেশ্য ছিল।

প্রিয়ম একটু কাঁচুমাচু মুখে বলল, ‘কী করব বল! আমাকে আমার চাকরিটা তো বাঁচাতে হবে! তুমি না হয় একটা অলটারনেট কেরিয়ার তৈরি করছ আস্তে আস্তে, এমনিতেও সরকারি কর্মচারী বলে কথা, আমি তো তা নই!’

রুদ্র বুঝল, প্রিয়ম আর কিছু বলতে না পেরে ইমোশনাল সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু করেছে এবার। ও বলল, ‘তুমি তো ডেসমন্ডকে আজ সকালেও ওয়াই—ফাই কানেকশনটা আসার পর হোয়াটসঅ্যাপ করে দিতে পারতে! সবেতে এত তাড়াহুড়ো কেন তোমার?’

কথাগুলো বলে ও মুখ দিয়ে আফশোসের আওয়াজ করল, ‘এমনিতেই আমি সেদিন ওই নকল শ্যুমাখারকে অনেক কিছু বলে ফেলেছিলাম, ওটা আমার একটা মস্ত ভুল হয়েছিল!’ হতাশ মুখে ও বার্থের ওপর বসল।

প্রিয়ম বলল, ‘নকল শ্যুমাখার! মানে?’

রুদ্র থম মেরে বসে ছিল, ‘অনেক কিছুই আমার কাছে এখন পরিষ্কার হয়েছে, প্রিয়ম। তোমার ওই ভদ্রলোক আর যা—ই হোক, বিখ্যাত অঙ্কোলজিস্ট ড সিগমুন্ড শ্যুমাখার নন।’

‘মানে!’ প্রিয়ম যেন খাবি খাচ্ছে এইভাবে বলল, ‘ড. শ্যুমাখার নন! তবে উনি, মানে ওই লোকটা কে!’

রুদ্র বলল, ‘শোনো, খটকাটা আমার প্রথম দিন থেকেই লেগেছিল। আচ্ছা, তোমাকে ড শ্যুমাখার ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট কবে পাঠিয়েছিলেন মনে করতে পারবে?’

প্রিয়ম বলল, ‘এগজ্যাক্ট তারিখটা তো মনে নেই, তবে প্রথম আলাপের পরপরই পাঠিয়েছিলেন এটা মনে আছে।’

রুদ্র বলল, ‘হুঁ।’ তারপর একটু থেমে বলল, ‘তুমি কি এটা খেয়াল করেছ যে তোমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবার ঠিক আগেই প্রোফাইলটা খোলা হয়েছে আর তুমি আর আমি ছাড়া ওই প্রোফাইলে কোনো জেনুইন ফ্রেন্ড নেই? যে ক—টা প্রোফাইল ফ্রেন্ডলিস্টে রয়েছে প্রত্যেকটাতেই কোনো ছবি নেই, শুধু নেট থেকে ডাউনলোডেড ছবি ছাড়া? মানে, সবকটাই ফেক প্রোফাইল, এটা খেয়াল করেছ কি? নিজে একটা ভুয়ো প্রোফাইল খুলে অ্যাবরাপ্টলি আরও কিছু ফেক প্রোফাইলে ফ্রেড রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়েছে, তারা অ্যাকসেপ্টও করেছে। ওঁর নিজের প্রোফাইলেও গুটিকয়েক ওইসব সেমিনারের ছবি অ্যাড করা হয়েছে, তাও তোমাকে রিকোয়েস্ট পাঠানোর একদম আগে আগেই। দেখেছ কি?’

প্রিয়ম অবাক হয়ে বলল, ‘না তো! আমি তো প্রোফাইলে ছবিটা দেখেই অ্যাকসেপ্ট করি, তারপর ফেসবুকেই মেসেজ করেন উনি।’

রুদ্র বলল, ‘ওইজন্যই বলি, যাকে তাকে অ্যাকসেপ্ট করবে না। কাল রাতে আমি ফেসবুকে অনেক কিছু সরেজমিনে তদন্ত চালিয়েছি। আরও একটা প্রোফাইল আছে, সিগমুন্ড অ্যালফ্রেড শ্যুমাখার নামে, সেটাতে কিন্তু ওর বিভিন্ন সেমিনারের ছবি থেকে শুরু করে ল্যাবের ছবি সব কিছুই রয়েছে এবং ওঁর অনেক বন্ধুও রয়েছে ওই প্রোফাইলে, ল্যাবের কলিগদের কমেন্টও রয়েছে প্রচুর। যেকোনো ফেসবুক ইউজ করা লোক দেখলেই বুঝতে পারবে ওটা জেনুইন প্রোফাইল।’

প্রিয়ম এবার আরও অবাক হয়ে গেল, ‘তুমি কাল থেকে একটার পর একটা যা বোম ফাটিয়ে চলেছ না, আমার মাথা সত্যিই কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে এবার! এই মুচিবাবু কি শুধু আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে বলে আলাদা প্রোফাইল খুলেছে নাকি?’

রুদ্র বলল, ‘আলফ্রেড যে ড শ্যুমাখারের জার্মান বাবার নাম সেটা বুঝতে পেরেছি একটা মেডিকেল জার্নালের সাইটে ওঁর বায়োডাটা দেখে, ভদ্রলোক বাবার নাম মিডল নেম হিসেবে ব্যবহার করতেই পারেন। কিন্তু এইরকম আলাদা প্রোফাইল রাখার মানেটা বুঝতে পারছিলাম না।’

প্রিয়ম বলল, ‘ওঁর ওই কলিগদের থেকে ব্যাপারটাকে লুকিয়ে রাখার জন্য কি?’

রুদ্র বলল, ‘কলিগদের থেকে লুকিয়ে রাখার জন্য একটা ফেক অ্যাকাউন্ট খোলার চিন্তাভাবনাটা হাস্যকর না?’

প্রিয়ম বলল, ‘তবে?’

রুদ্র বলল, ‘এর কারণ একটাই হতে পারে, শুধুমাত্র আমাদের দুজনের কাছে উনি নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা জোরদার করবার জন্যই এটা করেছেন।’ একটু থেমে ও বলল, ‘কাল সকালে আমি ড শ্যুমাখারের ওই ক্লিনিকে গিয়েছিলাম। ওঁর সঙ্গে দেখা করিনি, বাইরে আউটডোরে এমনি বসে ছিলাম কারুর জন্য ওয়েট করছি এইরকমভাবে। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ড শ্যুমাখার গাড়ি থেকে নেমে এসে তাঁর চেম্বারে ঢুকে গেলেন আমার সামনে দিয়ে।’

প্রিয়ম বলল, ‘তোমায় চিনতে পারলেন না?’

রুদ্র এবার হাসল, ‘আগে কোনোদিনও দেখলে তবে তো চিনবেন। আমার সামনে দিয়ে যিনি গটগট করে হেঁটে ভেতরে ঢুকে গেলেন, তাঁর চোখগুলো কুচকুচে কালো। আর চেহারাটাও ওই নকল শ্যুমাখারের থেকে বেশ মোটার দিকে। তবে হ্যাঁ, মুখে কোনো তফাত নেই।’

‘সে কী! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল প্রিয়ম।

রুদ্র বলল, ‘ড সিগমুন্ড আলফ্রেড শ্যুমাখার সত্যিই বেশ নামকরা মানুষ, ক্যান্সারের ওপর ওঁর বেশ কয়েকটা পেটেন্টও রয়েছে। কাল সকালে ওঁর ক্লিনিকে যাওয়ার আগেই আমি উইকিপিডিয়ায় ওঁর সম্পর্কে পড়েছিলাম। এটা ঠিকই যে, ওঁর বাবা জার্মান ছিলেন, মা ফ্রেঞ্চ। খুব ছোটোবেলায় বাবা আর মায়ের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। তারপর থেকে উনি ওঁর বাবার কাছেই মানুষ হন। তাই বাবার নামটা হয়তো উনি ইউজ করেন মিডল নেম হিসেবে।’

প্রিয়ম আবার জিজ্ঞেস করল, ‘এই লোকটা তাহলে কে!’

‘এখনও বুঝতে পারছি না। তবে শ্যুমাখারের সঙ্গে মুখশ্রীতে অসম্ভব মিল আর সেই মিলটাকেই কাজে লাগিয়ে আমাদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টা করেছে ওই নকল শ্যুমাখার, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তার মধ্যে তুমি এটাকেও হারিয়ে ফেললে।’ রুদ্র হতাশ গলায় বলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *