নরক সংকেত – ৬

বাইরে প্রায় সন্ধে হয়ে এসেছে। সকাল থেকে অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছিল, তাই এখন বেশ খিদে খিদে পাচ্ছে। তবু ড শ্যুমাখারের কথা শুনতে শুনতে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল রুদ্র।

গত এক ঘণ্টা ধরে ড শ্যুমাখার ওঁর রিসার্চের ধরনটা সহজবোধ্য করে ব্যাখ্যা করেছেন ওদের কাছে। ওঁর বোঝানোর ধরনটা বেশ সহজ সরল, যে কেউই বুঝতে পারবে। জিন কীভাবে বংশগতির ধারক, ক্রোমোজোম, ডি এন এ, নিউক্লিক অ্যাসিড কী, ক্যান্সারের ক্ষেত্রে জিনের ভূমিকা, সব কিছুর একটা ওপর ওপর ধারণা হয়েছে রুদ্র আর প্রিয়মের।

উলটোদিকে মাদাম তুসোর দরজা অবশেষে বন্ধ হয়ে যেতে একটা নিশ্বাস ফেলে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে রুদ্র বলল, ‘কাল বাড়ি থেকে ব্রেকফাস্ট করেই মাদাম তুসোয় চলে আসব, কেমন? আজ তো আর হল না।’

প্রিয়মের মুখটা অনেকক্ষণই কালো হয়ে গিয়েছিল, এবার গলে যাওয়া মোমবাতির মতো নিভে গেল। অস্ফুটে বলল, ‘কাল তো অফিস!’

রুদ্র একটু চোখের ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল প্রিয়মকে, তারপর ড শ্যুমাখারের দিকে তাকাল, ‘আপনার পুরো রিসার্চ টপিকটাই বুঝলাম। এখন বলুন আমি কী করতে পারি।’

ড শ্যুমাখার এবার একটু দম নিলেন, প্রিয়মের দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বলছি। তার আগে আপনাকে জানাচ্ছি, আমার এই কাজটায় আমি সাকসেসফুল হই, সেটা কিন্তু অনেকেই চায় না। তারা মোটামুটি পুরো ইউরোপে জাল ফেলে রেখেছে আমার রিসার্চটাকে ভেস্তে দেওয়ার জন্য। ইন ফ্যাক্ট এই কারণেই আমি কোনো প্রফেশনাল ইনভেস্টিগেটরের বদলে আপনার মতো বিদেশি একজনের হেল্প চাই। আপনি হেল্প করলে আপনাকে চট করে কেউ সন্দেহই করবে না।’

রুদ্র এবার একটু বিস্মিত হল, ‘ভেস্তে দিতে চাইছে! কিন্তু কেন? এটা তো একটা নোবল কাজ! সবাই চাইবে।’

ড শ্যুমাখার এবার বিষণ্ণ হাসলেন, ‘ম্যাডাম, নোবল কাজ করতে যাওয়ার রাস্তাতেই তো বিপদ আসে বেশি। ভালো কাজই তো লোকে নিতে পারে না, না! সেই কোপারনিকাস, গ্যালিলিওর সময় থেকেই হয়ে আসছে। এই যে সারা পৃথিবী জুড়ে ইনভেস্টমেন্ট ছড়ানো রয়েছে ক্যান্সারের ওপর, এত বিলিয়ন ডলার টার্ন ওভার সেইসব ফার্মা কোম্পানিগুলোর, কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন, স্টেম সেল ট্রান্সপ্লান্টেশনের ওপর দাঁড়ানো এত বড়ো একটা ইন্ডাস্ট্রি, পুরোটাই ধসে পড়বে যে এক লহমায়। রোগটাই যদি উধাও হয়ে যায়, তারা তো পথে বসবে রাতারাতি। হাজার হাজার মানুষের চাকরি তো যাবেই, পুরো ইন্ডাস্ট্রিটাই উঠে যাবে। ফার্মা জায়ান্টগুলোর শেয়ার প্রাইস কোথায় যাবে বলুন তো? রাতারাতি ধসে পড়বে স্টক মার্কেট।’

রুদ্র মাথা নাড়ল। এদিকটা ও ভেবে দেখেনি। বাংলায় একটা মজার কথা প্রচলিত আছে, মানুষের অসুখ না হোক এটা ডাক্তাররা কখনোই চাইবেন না, তাতে তাঁদের রুটিরুজিতে যে টান পড়বে। তাই তাঁরা চান অসুখ হোক, চিকিৎসা করে সুস্থ করে তুলবেন তাঁরা।

নির্মম সত্যি।

এও অনেকটা সেরকমই।

শ্যুমাখার বলে চলছিলেন, ‘তাই তারা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছে যাতে আমি প্রিভেন্টিভ প্রসেসে বেশি এগোতে না পারি। কিন্তু রিসেন্টলি এই ব্যাপারটা জানার পর আরও ডেসপ্যারেট হয়ে উঠেছে তারা। যেকোনো উপায়ে আমার রিসার্চটা আটকাতে চায়। এমনকী, আমার নিজের ল্যাবেতেই বেশ কিছু ইনফর্মার হয়তো আছে, আমি তাদের ঠিক ধরতে পারছি না। তারা আমার রিসার্চ সিক্রেট পাচার করে দিলে আমার অপোনেন্টরা এই রিসার্চটা এগোনো দূর, আমাকেই বাঁচিয়ে রাখবে কিনা সন্দেহ!’ ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘তাই এত গোপনীয়তা মেইনটেইন করে আপনার কাছে আসা।’

রুদ্র বাধা দিল, ‘এক মিনিট। রিসেন্ট কোন ব্যাপারটার কথা বলছেন?’

ড শ্যুমাখার এবার একটু এদিক—ওদিক চাইলেন। আশপাশে তেমন কেউ নেই। যদিও ঘড়িতে এখন প্রায় সন্ধে সাতটা, বাইরে দিনের আলো ঝলমল করছে। তাই যে ক—জন গোনাগুনতি খদ্দের, সব বাইরেই বসে আছে। এদের এখানে মাত্র দুটো মাস গরম থাকে, অন্য সময় হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। বৃষ্টিও এখানে ভীষণ অনিশ্চিত, শুরু হয়ে যায় যখন তখন। তাই রোদ ঝলমলে দিন এরা খুব এনজয় করে, রোদের তাপ এরা মিস করতে চায় না একটুও।

তাই ভেতরের এই স্যাঁৎসেঁতে আলোআঁধারিতে ওরা তিনজন আর কফিশপের দুজন ওয়েটার ছাড়া কেউ নেই।

ড শ্যুমাখার একটু ইতস্তত করলেন, তারপর শার্টের ওপরের দুটো বোতাম চট করে খুলে ভেতর থেকে একটা ছোটো খাম করে আনলেন।

লম্বায় আড়াই ইঞ্চি, চওড়ায় দু—ইঞ্চি মতো আকারের একটা এনভেলপ।

রুদ্র দেখল ড শ্যুমাখার সামান্য কাঁপা হাতে খামটা খুলে ছোটো ছোটো পোস্টকার্ডের আদলে কয়েকটা শক্ত কাগজ বের করলেন।

রুদ্র কিছু না বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।

ড শ্যুমাখার একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আমার ওই দাদু আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে এমন একটা আবিষ্কার করেছিলেন যেটা দেখলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। অনেক অসুখেরই ওষুধ বের করেছিলেন তিনি তবে তাঁর নিজের লেখাতেই বোঝা যায়, শেষের দিকে উনি দিনরাত পড়ে থাকতেন ক্যান্সারের ওষুধ নিয়ে।’

রুদ্র বলল, ‘অতদিন আগে ক্যান্সার নিয়ে রিসার্চ শুরু হয়ে গিয়েছিল?’

ড শ্যুমাখার তাঁর খয়েরি ভ্রূ দুটোকে বেশ কিছুটা ওপরে তুলে বললেন, ‘কী বলছেন ম্যাডাম! প্রাচীন গ্রিস আর মিশরে পর্যন্ত কার্সিনোমো নিয়ে গবেষণা হয়েছে। তবে হ্যাঁ, আধুনিক যুগে বলতে গেলে শুরু হয় ১৮৫০ সাল নাগাদ, ইথার দিয়ে যে অ্যানাস্থেশিয়া, মানে টেম্পোরারি অজ্ঞান করা যায়, সেটা যখন আবিষ্কার করা হয়, তখন থেকে। তারপর সেই টেকনোলজি দিয়ে টিউমর অপারেশনও শুরু হয়। সেগুলোই হল ক্যান্সার রিসার্চের ফার্স্ট স্টেপ।’

রুদ্র বলল, ‘উনিও কি আপনার মতো প্রিভেন্টিভ মেজার নিয়ে কাজ করতেন?’

শ্যুমাখার বললেন, ‘কাকতালীয়ভাবে তাই। ওঁর ডায়েরিতেই আমি জানতে পারি, উনি এমন একটা কেমিক্যাল এলিমেন্ট তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছিলেন যা খোলা বাতাসে নাইট্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে একটা কম্পাউন্ড তৈরি করবে, যেটা মানবশরীরে প্রবেশ করলে জিনটাকে এমনভবে মডিফাই করে দেবে, তার শরীরেও কোনোদিন ক্যান্সার দেখা দেবে না আর তার নেক্সট জেনারেশনেও ক্যান্সার থাবা বসাতে পারবে না। ডি এন এ স্ট্রাকচারের বদলের ফলে রোগটাই উধাও হয়ে যাবে পৃথিবী থেকে।’

এবার প্রিয়মও ওর ছটফটানি থামিয়ে বেশ অবাক হয়ে গেল, ‘এটা কি সম্ভব? মানে, উনি তৈরি করেছিলেন?’

ড শ্যুমাখার এবার একটা বড়ো নিশ্বাস ফেললেন, ‘ইয়েস! উনি করেছিলেন কিন্তু মনে হয় ইমপ্লিমেন্ট করার আগেই হঠাৎ মারা যান উনি। তারপর থেকে ওঁর ওই থিসিসটা অবহেলায় পড়েছিল ডায়েরির ভাঁজে, এত বছর কেউ বোঝেইনি কী সম্পদ লুকোনো আছে তাতে। আমি সেটাকে উদ্ধার করেছি।’

রুদ্র চুপ করে শুনছিল, কিন্তু প্রিয়ম আরও উত্তেজিত হয়ে উঠল, ‘আপনি তৈরি করে ফেলেছেন, তাহলে সেটা অ্যাপ্লাই করছেন না কেন? সারা পৃথিবী টলে যাবে তো!’

ড শ্যুমাখার বললেন, ‘সেখানেই আটকে গেছি। উনি এমনভাবে লিখে গেছেন ওই এলিমেন্ট তৈরির প্রসেসটা, কিছুতেই আমি বুঝে উঠতে পারছি না।’

রুদ্র এবার মুখ খুলল, ‘আচ্ছা, আপনার রিসার্চ টপিকটায় অনেকেই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করছে জেনেও আপনার দাদুর ডায়েরি থেকে পাওয়া এই জিনিসটার ব্যাপারে আপনি কাদের বলেছেন?’

ড শ্যুমাখার মুখ দিয়ে চুক চুক করে আফশোসের একটা শব্দ করলেন, ‘ওখানেই আমি আবেগের বশে একটা ভুল করে ফেলেছি ম্যাডাম। আমার খুব ঘনিষ্ঠ কয়েকজন কো—রিসার্চারকে বলে ফেলেছিলাম উত্তেজনার বশে। তখনও বুঝিনি যে, ওদের মধ্যেই ইনফর্মার থাকতে পারে। ইনফ্যাক্ট তারপর থেকেই বিভিন্নভাবে আমাকে থ্রেট করা হচ্ছে। কখনো রাস্তায় জোরে কোনো গাড়ি চেপে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, কখনো কোনো ফোন আসছে যে এই ব্যাপারে আমি এগোলে ফল ভালো হবে না। যেকোনো সময় এটা খোওয়া যেতে পারে।’

রুদ্র বলল, ‘আপনাদের এখানকার পুলিশ তো ভীষণ এফিশিয়েন্ট বলেই জানি। আপনাদের গভর্নমেন্ট তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিয়ে ভীষণ কেয়ারিং। তাদের সাহায্য নিচ্ছেন না কেন?’

ড শ্যুমাখার সামান্য হাসলেন, ‘বাইরে থেকে ওরকম অনেক কিছুই মনে হয় ম্যাডাম।’ ওঁর মুখটা হঠাৎ কঠিন হয়ে গেল, ‘আমাদের গভর্নমেন্ট এখন মিডল ইস্টের শরণার্থীদের আশ্রয় দিতেই ব্যস্ত, আমাদের দিকে তাদের নজর পড়বে ভোটের আগে আগে। আর শুধু আমাদের সরকারই বা বলি কেন? গোটা ইউরোপের সব গভর্নমেন্টই বলতে গেলে এখন লিবিয়া, সিরিয়া, টিউনিশিয়ার লোকেদের হেল্প করতে গিয়ে নিজেদের সিটিজেনদের অবহেলা করা শুরু করেছে। এগুলো সবই ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্সের খেলা, বুঝলেন না।’ কথা শেষ করে কাগজের টুকরোগুলো তিনি বাড়িয়ে দিলেন সামনের দিকে।

রুদ্র একটু ঝুঁকে দেখল, ও যেগুলোকে দূর থেকে কাগজের টুকরো ভাবছিল, সেগুলো ফটোগ্রাফ, আগেকার দিনে যেমন ছোটো ছোটো চৌকো আকৃতির সাদা কালো ফটো হত। ও অবাক হয়ে বলল, ‘ফটোগ্রাফ?’

ড শ্যুমাখার বললেন, ‘হ্যাঁ। মোট দশটা ফটো। আসলে ভদ্রলোক তাঁর সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন। পন্ডিচেরির ওই সমুদ্রের পাড়ে বসে এমন সমস্ত চিন্তাভাবনা করে গেছেন যা আজকের দিনেও লোকে ভাবতে পারে না, ওঁর ডায়েরিটা পড়লে অবাক হতে হয়। এই ফটোগুলোর মধ্যে ওই মৌলটা তৈরির লেখা আছে কিন্তু একটু অদ্ভুতভাবে, যেটা আমি বুঝতে পারছি না। তবে ডায়েরির লেখা যদি ঠিক হয়, ওই মৌল যদি সত্যিই তৈরি করতে পারি, সেটাকে নাইট্রোজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করিয়ে শরীরে প্রবেশ করানোর সঙ্গে সঙ্গে সেটা কাজ শুরু করবে। আর তাতে মানবসভ্যতা এক মহা অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে।’ ড শ্যুমাখার চোখ থেকে চশমাটা খুললেন, ‘আপনি ভুটানে এইরকমই একটা কঠিন পাজল সলভ করে একটা সুপারন্যাচারাল স্পিসিস তৈরি করা আটকেছিলেন না?’

রুদ্র ছবিগুলো দেখছিল। সাদা কালো চৌকো আকৃতির, ওপরনীচে পুরোনো দিনের নেগেটিভের খোপগুলোও বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট। ও মাথা নাড়ল, ‘আমি একা নয়। প্রিয়ম ছিল, আরও অনেকেই ছিলেন সেটায়।

শ্যুমাখার বললেন, ‘আমি পড়েছিলাম সেটা। ওটা ভালো কাজ তো ছিলই, কিন্তু এই মিশনে যদি আপনি আমাকে হেল্প করতে পারেন, জানবেন সারা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ আপনাকে দু—হাত তুলে আশীর্বাদ করবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *