নরক সংকেত – ৩২

৩২

সেপ্টেম্বর ১৯৩৩

বার্লিনের অ্যালপাইন মাউন্টেনিয়ারিং ক্লাবের অফিসরুমে ঝড়ের বেগে একটা ছেলে ঢুকল, বিধ্বস্ত, কিন্তু উত্তেজিত, ‘আজ কোথায় যাচ্ছে জুনিয়র টিম? বাইরে দেখলাম সব গোছগাছ করছে?’

‘কেন?’ মুখটা একবার তুলেই আবার নামিয়ে নিয়ে কাজ করতে লাগল রিসেপশনে বসে থাকা রেজিস্ট্রার, ‘ওহ! আবার তুমি এসেছ এই সাতসকালেই? তোমাকে তো আগেই বলেছি বেসিক লেভেল ট্রেনিং করা থাকলে যাওয়া যাবে না, অন্তত বি লেভেল কমপ্লিট করতে হবে। টাকা ফ্যালো, সেটা করে ফ্যালো, তারপর যাও।’

ছেলেটা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল, তারপর হঠাৎ সরে এল রেজিস্ট্রারের একদম গা ঘেঁষে, ‘একটু দ্যাখো না এডমন্ড! তুমি চাইলে সব হবে।’

এডমন্ড বলে লোকটা দ্রুত গতিতে মাথা নাড়ল, ‘আমি? আমি আবার কী করব? ম্যানেজমেন্ট অ্যালাউ—ই করবে না।’

ছেলেটা একটু তোষামোদের ভঙ্গিতে বলল, ‘আগেরবার তো অ্যালয়েস বলে ওই ছেলেটাকে সব ব্যবস্থা করে দিলে তুমি। ও তো বেসিকও করেনি এডমন্ড!’

এডমন্ড গম্ভীরভাবে বলল, ‘কার কথা বলছ তুমি জানো? ফোর্ড কোম্পানির মালিকের ছেলে ওই অ্যালয়েস। হেনরি ফোর্ড নিজে এসেছিলেন ওকে নিয়ে।’

ছেলেটা চোখ পিটপিট করল, ‘তো কী? তোমাকে কি ফোর্ড গাড়ি গিফট করেছে একটা?’

এডমন্ড লোকটা অল্পেতেই রেগে যায়, রসিকতা বিশেষ বোঝে না, ঝাঁঝিয়ে উঠল সে, ‘তুমি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারছ ফ্রেডরিক? হেনরি ফোর্ড এখন চ্যান্সেলরের সবচেয়ে কাছের লোক তুমি জানো না? আগের সপ্তাহেও তো কাগজে ছবি বেরিয়েছিল দুজনের। আর্মির সব ট্রাক সাপ্লাই করছে ফোর্ড। ওকে চটাব, আমার ঘাড়ে ক—টা মাথা? দেখলে না ওই ‘স্ট্রেট পাথ’—এর জার্নালিস্টটার কী হাল করল? কাল দাচাউয়ের ক্যাম্পে নিয়ে গেল, আর আজ সকালেই মেরে ফেলার খবর বেরিয়ে গেল রেডিয়োতে।’ বলতে বলতে এডমন্ডের গলাটা কি ঈষৎ কেঁপে উঠল? ‘আহা রে, চাবুকের মতো ধারালো লিখত লোকটা!’

ফ্রেডরিক এবার হাসল। সম্পূর্ণ অভিনয় করা মেকি হাসি। কীভাবে যে হাসছে, সেটা ও—ই জানে, বিশেষত যখন বুকের ভেতর রক্ত ঝরছে অবিরাম। কাল রাতে ফ্রিৎজ স্যারের বাড়ি গিয়ে ওই পরিণতি শুনে ও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি। তারপর শোকের থেকেও বেশি ওর কাছে বড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল কর্তব্য। পালিয়েছিল দূরের এক জনশূন্য বনে। কনকনে ঠান্ডার মধ্যে সেখানেই লুকিয়ে বসে কাটিয়েছে বিনিদ্র রাত। ওই অন্ধকারেই ক্যামেরা থেকে কালকের সেই ছবির ফিল্ম রোলটা বের করেছে সাবধানে, তারপর ভোর হতে—না—হতেই ছুটে এসেছে এখানে।

ফ্রেডরিক চুপ করে থাকলেও এডমন্ডের হাত চালানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখও চলছিল, ‘তবে ওকে যে মারা হবে সে তো সবাই জানত। ওইসব লিখলে কি চ্যান্সেলরের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়! কিন্তু …!’ লোকটা মুখ দিয়ে একটা দুঃখের আওয়াজ করল, ‘বাচ্চাটা তো কোনো দোষ করেনি! ওইটুকু প্রাণটাকে শেষ করার কী দরকার ছিল?’

‘বাচ্চাটা মানে? কার বাচ্চা?’ ফ্রেডরিক কম্পিতস্বরে প্রশ্ন করল।

এডমন্ড বলল, ‘ওই যে ওই জার্নালিস্টটার। বউটা তো ইহুদি, পুলিশ স্বামীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাটার হাত ধরে সে ছুটেছিল পুলিশের কাছে। আরে, একে ইহুদিদের এইরকম করে মারছে, তার ওপর একা একা কেউ যায়? একটু তো বুদ্ধি থাকা দরকার মানুষের!’

‘এডমন্ড, বাচ্চাটার কী হয়েছে?’ স্থান কাল ভুলে চিৎকার করল ফ্রেডরিক।

‘এডমন্ড একটু থমকে গেল ওর ভাবভঙ্গি দেখে, বলল, ‘তখন কয়েকটা পুলিশ সবে নাকি খেতে বসেছিল, জার্নালিস্টটার বউ সামনে তাদের হাতে—পায়ে ধরে কান্নাকাটি করছিল, একেই ওপরমহলের আদেশ, তার ওপর ইহুদি, একটা পুলিশ বিরক্ত হয়ে বউটার কোল থেকে বাচ্চাটাকে টেনে নিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে নীচে ফেলে দিয়েছে। সঙ্গেসঙ্গেই মরে গেছে।’

ফ্রেডরিক মুখ দিয়ে অজান্তেই ‘আঁক’ করে একটা শব্দ বেরিয়ে এল। হঠাৎ ওর মনে হল ওর দারুণ জ্বর আসতে শুরু করেছে। এডমন্ডের টেবিলের কোনা ধরে মাটিতে যেন ও এলিয়ে পড়ল।

এডমন্ড শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘আরে,কী হল তোমার? ওঠো ওঠো, জল খাও। তুমি চেনো নাকি ওদের?’ তারপর ওকে ধরে ধরে সামনের সোফায় বসাল।

ফ্রেডরিক পাহাড়প্রমাণ কষ্টটাকে ঢাকতে ঢাকতে একটা হেঁচকি তুলল। ঠোঁটটা কামড়ে ধরল কিছুক্ষণের জন্য।

ওর বুকের ভেতর এত কষ্ট হচ্ছে যে ওর মনে হল ও এক্ষুনি মরে যাবে।

উফ! ও কেন মরে যাচ্ছে না?

ও কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু ওর গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, খালি ক্লান্ত কুকুরের মতো হাঁপাচ্ছিল।

ফ্রিৎজ স্যার যে আর নেই, তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে সেটা ফ্রেডরিক জানত। আজ সকালেই একটা দোকানের রেডিয়োতে শুনেছিল।

কিন্তু এমিলিয়া?

যে ছোট্ট শিশুটা ঘুম ভেঙে কাল ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে চেয়েছিল, যার কাল সকালেও ও গাল টিপে দিয়েছিল, তাকে আছড়ে মেরে ফেলল নাতসি পুলিশ?

অবোধ প্রাণটা জানলও না কী ওর অপরাধ, পৃথিবীর রূপ রস গন্ধ কোনো কিছু অনুভব করার আগেই শেষ হয়ে গেল।

ফ্রেডরিক মরিয়া হয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছিল। যতই কষ্ট হোক, ওকে এখন আবেগে ভেসে গেলে চলবে না।

ও যেন মানসচক্ষে দেখতে পেল সারা দেশের হাজার হাজার এমিলিয়া ওর দিকে আশা নিয়ে জলভরা চোখে তাকিয়ে রয়েছে, ফ্রিৎজ স্যারের অবর্তমানে সে—ই পারে তাদের বাঁচাতে!

সোজা হয়ে বসে ও চোখের জল মুছল।

ফ্রেডরিককেও এখন সরকার পাগলের মতো খুঁজছে, সেটা ফ্রেডরিক জানে। তবু গায়ে ওর শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত ফ্রিৎজ স্যারের স্বপ্নকে ও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

সত্যি করতে না পারুক, অন্তত ব্যর্থ হতে কিছুতেই দেবে না।

ফ্রেডরিক এবার কঠিন গলায় বলল, ‘না! চিনি না, তবু খারাপ লাগল বাচ্চাটার খবর শুনে। যাই হোক, তোমার ছবি তোলার কী খবর?’ নিজের অভিনয়ে ও নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।

এডমন্ডের মুখটা এবার হতাশায় মুষড়ে পড়ল, ‘ধুর! টাকা নেই পয়সা নেই। ওই এক আদ্যিকালের ক্যামেরা দিয়ে কী হয় বলো তো?’

এডমন্ড যে একজন শখের ফটোগ্রাফার সেটা ফ্রেডরিক জানে। বেচারার সাধ থাকলেও সাধ্য নেই খুব একটা। তবু তেপায়া স্ট্যান্ডের উপর সাধারণ একটা ক্যামেরা ফিট করে সামনে কালো কাপড় দিয়ে ঢেকে সে ছবি তোলে, আর এগজিবিশনও করে মাঝেমধ্যে।

ফ্রেডরিক এবার একটু ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার কাছে একটা দুর্দান্ত ক্যামেরা আছে, জানো!’ টুপি থেকে ক্যামেরাটা খুলে আগেই ঝোলায় রেখেছিল, এবার সেটা বের করল ও।

‘এটা কী?’ এডমন্ড হাঁ।

‘ক্যামেরা।’

‘ক্যামেরা? এত ছোটো? সে আবার হয় নাকি?’ এডমন্ড এবার আরও অবাক হয়ে গেল।

‘হয় যে, তা তো দেখতেই পাচ্ছ। হাতে নিয়ে দেখবে? দ্যাখো না।’ এডমন্ডের হাতে তুলে দিল ফ্রেডরিক, ‘আমেরিকা থেকে আনানো। একদম লেটেস্ট মডেল।’

এডমন্ড মুগ্ধ চোখে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল ক্যামেরাটা। শাটারটা টিপল, লেন্সে চোখ রাখল, ফোকাস করল, কী দারুণ!

‘অনেক দাম, না?’

‘অনেক দাম। আমার এক মামা এনে দিয়েছে আমেরিকা থেকে।’

এডমন্ডের চোখে একইসঙ্গে মুগ্ধতা আর দুঃখ ফুটে ওঠাটা ফ্রেডরিকের চোখ এড়াল না। ও বলল, ‘কোনো ঝক্কি নেই, ঝামেলা নেই। যেখানে সেখানে ক্যারি করা যাবে।’

‘খুব ভালো। ভালো ভালো ছবি তোলো।’ কয়েক মিনিট আগের সেই রুক্ষ স্বর এডমন্ডের গলা থেকে প্রায় উধাও, বরং সেখানে এখন ফুটে উঠেছে কিঞ্চিৎ না পাওয়ার হতাশা।

এবার ফ্রেডরিক আস্তে করে একটা চাল দিল, ‘না আমি তো ছবি—টবি তুলি না, ওসবের শখ আমার নেই। তুমি চাইলে তোমাকে এটা দিয়ে দিতে পারি।’

এডমন্ডের চোখগুলো বড়ো বড়ো হয়ে গেল, ‘মানে? সত্যি সত্যি? এত দামি জিনিসটা? এই তুমি ইয়ার্কি করছ না তো?’

‘ইয়ার্কি করতে যাব কেন? আমার শখ পাহাড়ে ওঠার, তোমার শখ ছবি তোলার। তুমি আমার শখটা পূর্ণ করো, আমিও তোমারটা করব।’ ফ্রেডরিক খোলসা করল এতক্ষণে।

এডমন্ড কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ‘তু—তুমি কি আজকের টিমের সঙ্গেই যেতে চাইছ?’ ফিসফিস করে বলল এডমন্ড।

‘হ্যাঁ। আজকেই। আমার সরঞ্জাম তো এখানেই রাখা আছে লকারে।’

এডমন্ড কয়েক মুহূর্তের জন্য ক্যামেরাটার দিকে তাকিয়ে নিল, ‘কিন্তু, আজকের টিম খুব কঠিন এক্সপিডিশনে যাচ্ছে। সেই আইসল্যান্ডে। ভাটনাজুকল হিমবাহ। তুমি পারবে কী করে? তোমার তো সেরকম এক্সপিরিয়েন্স নেই।’

‘আলবাত পারব এডমন্ড! তুমি শুধু আমাকে পারমিটটা দাও। তুমি কোনও বিপদে পড়বে না এটুকু বলতে পারি।’ আশ্বস্ত করল ফ্রেডরিক, ‘ক্যামেরাটার জন্য অলরেডি দুজন মোটা দাম দিয়েছে আমায়, কিন্তু নেহাত তুমি ছবি তুলতে ভালোবাসো তাই, না হলে…!’

‘না, না!’ প্রায় আঁতকে উঠল এডমন্ড, ‘ক্যামেরাটা আমাকে দাও, প্লিজ! আমি এখুনি পারমিট রেডি করছি তোমার। খুব সাবধানে যাবে কিন্তু। তোমার কোনো বিপদ হলে আমি ফেঁসে যাব।’

মৃদু হেসে ফ্রেডরিক বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ!’ তারপর আর নিজেকে সামলাতে পারল না ও, প্রায় দেড়দিন কিচ্ছু মুখে তোলেনি, ‘আচ্ছা, কিছু খাবার হবে তোমার কাছে?’ নিজের অজান্তেই পকেটে রাখা ফিল্ম রোলের কৌটোটার উপর ও চাপ দিল।

অনেক দূর নিয়ে যেতে হবে এটাকে। লুকিয়ে ফেলতে হবে সবার চোখের অন্তরালে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *