নরক সংকেত – ২

খুব ছোটোবেলায় বাড়ির ছাদ থেকে যখন মাথার অনেক ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া প্লেনগুলোকে দেখা যেত, কেমন যেন রূপকথার পুষ্পকরথের কথা মনে হত। মনে হত ওর কাছাকাছি গেলেই হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে দাদুর কোলে বসে শোনা সেই রাজা রানিদের, কিংবা সীতাকে নিয়ে রাবণের পালানোর দৃশ্য।

আবার কখনো কখনো প্লেন চলে যেত অনেকক্ষণ, কিন্তু পেছনে ছেড়ে যেত সাদা সরু রেখা ঝকঝকে নীল আকাশের বুক চিরে, তা দেখে যেন বিশ্বাসই হত না ওর ভেতরে কোনো মানুষ থাকতে পারে। মনে হত মহাকাশে পাঠানো কোনো রকেট বুঝি পৃথিবীর মায়া কাটানোর আগে শেষ মুহূর্তে রেখে গেছে নিজের অস্পষ্ট ছাপ।

তখন সবে সবে বইয়ের পাতায় পড়ছে মহাকাশে প্রথম পৌঁছোনো সেই রাশিয়ার মানুষ ইউরি গ্যাগারিনের কথা। কিংবা ভ্যালেন্টিনা টেরেসকোভা।

মনে হত ওই রকেটে করে এক্ষুনি যেন হুস করে চলে গেলেন ওঁরা মহাকাশের গোলকধাঁধায়।

কিন্তু বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্লেনে চড়তে শুরু করার পর থেকে সেই উত্তেজনা এখন অনেকটাই স্তিমিত। এমনিতে টেক অফের কিছুক্ষণ পর পর্যন্তই যা একটু ভালো লাগে আশপাশ দেখতে, বড়ো বড়ো আকাশচুম্বী বাড়িগুলো, রাস্তাঘাট কেমন আস্তে আস্তে ছোটো হতে হতে চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে যায়। মুক্তোর দানার মতো আলোর বিন্দুর মালা হয়ে ছোটো হতে থাকে শহরগুলো। তারপর সেটাও আর দেখা যায় না, একঘেয়ে সাদা অস্পষ্ট কুয়াশার মতো আচ্ছন্ন হয়ে থাকে পুরোটা সময়।

তবু আজ হিথরো এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করার আগে ওপর থেকে ছবির মতো সাজানো বাড়িঘর, প্রায় উল্কার গতিতে ছুটে চলা গাড়ি, সুন্দর প্ল্যানমাফিক তৈরি করা মসৃণ রাস্তা দেখতে দেখতে রুদ্রাণীর ছোটোবেলার কথাই যেন মনে পড়ে গেল। যদিও এই সাতাশ বছরের জীবনে বলতে গেলে ওর প্রথম এই এতদূরে আসা। ছোটোবেলায় বাবার দেখাদেখি আর্কিয়োলজিস্ট হতে চাইলেও পরিস্থিতির চাপে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে ও এখন একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে চাকরি করে। ওর ইঞ্জিনিয়ারিং—এর ক্লাসমেট প্রিয়মকে বিয়ে করেছে প্রায় বছর দুয়েক। তারপর দুজনেই কলকাতায় সেটল করেছিল।

কিন্তু, বছরখানেক আগে অফিসের কাজে প্রিয়মকে বেশ কিছুদিনের জন্য চলে আসতে হয়েছে লন্ডনে। আর রুদ্র তার অফিসের কারণে রয়ে গেছে কলকাতাতেই।

তাই অনেকদিন বাদে ওদের দুজনের আজ দেখা হবে।

রুদ্র লক্ষ করল প্লেন অনেকটাই নীচে নেমে আসায় ঘন নীল আকাশের মধ্যে ভেসে বেড়ানো ধবধবে সাদা পেঁজা তুলোর মতো কিউমুলাস মেঘগুলোকেও দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার।

উইন্ডো সিটে বসে ঝুঁকে নীচটা দেখতে দেখতে ও আধখোলা বইটা বন্ধ করে ব্যাগে ঢোকাল।

একমুহূর্তের জন্য মনে হল ইউরোপের আকাশ যেন ভারতের থেকে অনেক বেশি পরিষ্কার।

এমনিই হিথরো খুব বড়ো এয়ারপোর্ট, তার ওপর নেমে ইমিগ্রেশন মিটিয়ে লাগেজ নিতে নিতে আরও আধঘণ্টা মতো সময় লাগল, এখন সব এয়ারপোর্টেই বেশ কড়াকড়ি। কথা ছিল বেরিয়ে ও প্রিয়মকে ফোন করবে, কিন্তু তার আর দরকার হল না, লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে বাইরে আসতেই ও হাত নাড়তে থাকা প্রিয়মকে দেখতে পেয়ে গেল।

বাপরে, স্কাইপে তো বুঝতেই পারেনি, কত ফর্সা হয়ে গেছে প্রিয়ম! সবই এখানকার আবহাওয়ার গুণ। ইস, আর ও নিজে দিন দিন কলকাতার ভ্যাপসা গরমে কালো হয়ে যাচ্ছে` কত সানস্ক্রিন, কত ফেশিয়াল, কিছুতেই কিছু হয় না।

লাগেজ ট্রলিটা ঠেলে কাছাকাছি পৌঁছে রুদ্র একটু লাজুক হাসল। এমনিতে লজ্জা—টজ্জা ওর ধাতে নেই মোটেও, তবু এতদিন বাদে নিজের স্বামীকে দেখলে একটু লজ্জা আসে বই কী!

প্রিয়ম একটা উজ্জ্বল নীল হলুদ রঙের ডোরাকাটা টিশার্ট পরেছে, সঙ্গে গাঢ় মেরুন রঙের জিনস। পায়ে একটা ঝকঝকে কালো স্পোর্টস শু।

এইগুলোর কোনোটাই ও দেখেনি আগে। এখানেই কিনেছে নিশ্চয়ই।

রুদ্র প্রিয়মের দিকে এগোতে এগোতে আনন্দের মাঝেও একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলল। আগে প্রিয়মের সব জামা পছন্দ করে ও—ই কিনে আনত, কিংবা অর্ডার দিত অনলাইনে।

এখন আর সেটা নেই। প্রিয়মকে নিজেই নিজেরটা কিনতে হয়।

চুলটাও চকচক করছে, জেল লাগিয়েছে মনে হয়। বাবা, এতসব স্টাইল তো আগে জানতই না। রুদ্র ঠোঁট কামড়াল, প্রিয়ম কত পরিপাটি হয়ে গেছে!

আচ্ছা, ওদের মাঝের এই কয়েক হাজার মাইলের দূরত্ব কি ওকে প্রিয়মের জীবন থেকেও দূরে সরিয়ে দিচ্ছে?

মনখারাপটা জোর করে দূরে সরিয়ে দিতে—না—দিতেই প্রিয়ম একগাল হেসে এসে জড়িয়ে ধরল ওকে। রুদ্র প্রথমে এই প্রকাশ্য আলিঙ্গনে একটু আড়ষ্ট হয়ে গেলেও দেশটার কথা মনে পড়ে যেতে আর হেজিটেট করল না। এতদিন বাদে প্রিয়মের স্পর্শে ওর ভেতরটা কেঁপে উঠল কেমন, চোখ ঝাপসা হয়ে গেল হঠাৎ, তীব্র অভিমানে বুকটা মুচড়ে উঠল যেন।

কবে শেষ হবে ওদের এই আলাদা থাকার পালা?

অনেকদিন তো হল প্রিয়মকে ওর কোম্পানি অনসাইটে এখানে পাঠিয়েছে, প্রথমে এক বছরের জন্য পাঠালেও দিন দিন মেয়াদ বাড়িয়েই চলেছে। আর কতদিন এভাবে ও ইন্ডিয়ায়, প্রিয়ম ইংল্যান্ডে, এভাবে কাটাবে?

ওর মুখটা হঠাৎ ভারী হয়ে যেতে দেখে প্রিয়ম বলল, ‘কী হয়েছে? টায়ার্ড লাগছে? প্লেনে ঘুম হয়নি ভালো?’

রুদ্র কিছু না বলে মাথা নাড়ল, সোজাসুজি তাকাল প্রিয়মের দিকে। দিনরাত স্কাইপে যতই দেখুক, মুখোমুখি দেখার সঙ্গে তার কোনো তুলনা চলে না। আর তা ছাড়া ভিডিয়ো চ্যাটে ওর সব মানুষকেই কেমন টিভির লাইভ রিপোর্টারগুলোর মতো লাগে। সবার যেন একইরকমভাবে নাকটা অস্বাভাবিক বড়ো, কানগুলো খাড়া খাড়া হয়ে থাকে, হাসলে চোয়ালটা বড্ড বেশিই হাঁ হয়ে যায়, সব মিলিয়ে কেমন বোকা বোকা একটা প্যাকেজ! ওর এই মনে হওয়াটা প্রিয়মকেও বলেছে আগে, শুনে প্রিয়ম হেসেওছে একচোট, কিন্তু সত্যিটা তো সত্যিই!

এয়ারপোর্ট ক্যাম্পাসের একদম বাইরে বেরিয়ে এসে রুদ্রর আবার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিই আবার মনে হল এখানকার সব কিছুর মতোই আকাশটাও যেন অনেক বেশি পরিষ্কার, মিষ্টি নীল রঙের মাঝে সরু সরু সাদা প্লেন যাওয়ার রেখা যেন কাটাকুটি খেলছে অবিরাম।

প্রিয়ম কোথা থেকে একটা কালো ট্যাক্সি নিয়ে এসে ঝপাঝপ ওর লাগেজগুলো তুলে ফেলল। রুদ্র অবাক হয়ে দেখছিল এখানকার ট্যাক্সিগুলোও কী সুন্দর আর ঝকঝকে। অনেকটা সেই পুরোনো সিনেমায় দেখা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বেঁটে মোটা আর্মির ছোটো ছোটো ভ্যানগুলোর মতো। পেছনটাও বেশ চওড়া। সব মিলিয়ে ভিন্টেজ একটা লুক আছে।

এই তবে লন্ডনের বিখ্যাত ব্ল্যাক ক্যাব!

ও ভেতরে ঢুকে বসল। কানগুলো এখনো ভোঁ ভোঁ করছে।

প্রিয়ম বসতে—না—বসতেই ফোন বেজে উঠল। রুদ্র লক্ষ করল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়েই প্রিয়মের মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে গেল। একটু অসহিষ্ণুভাবে রিসিভ করে বলে উঠল, ‘শি হ্যাজ জাস্ট অ্যারাইভড! আই উইল কল ইউ লেটার, ওকে?’

রুদ্র বলল, ‘কে?’

প্রিয়ম ফোনটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলল, ‘আরে একটা লোক, তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে বলেছিলাম যে আমি ফোন করব, তা না, তর আর সইছে না যেন!’

রুদ্র অবাক হয়ে গেল, ‘আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে? এখানে? কে সে?’

‘পরে বলব। এখন বাড়ি চলো আগে।’ গাড়ি চলতে শুরু করতেই প্রিয়ম একটু ঝুঁঁকে এসে বলল, ‘মহারানি নামার পর থেকেই এমন চুপ করে আছেন কেন? শীত করছে, না, খিদে পেয়েছে?’

রুদ্র এবার ভ্রূ কুঁচকে প্রিয়মের দিকে তাকাল। শীত যে ওর একটুও করছে না তা নয়, এপ্রিল মাসের শেষ হলেও এখানে বেশ ভালোই ঠান্ডা, আগে বুঝতে পারলে বেরোবার আগেই গায়ে গরম কিছু একটা চাপিয়ে নিত ও, কিন্তু তাই বলে প্রিয়ম ইয়ার্কি করবে কেন? আর খিদে ওর মোটেও পায়নি।

ও কেন চুপ করে আছে সেটা কি প্রিয়ম সত্যিই বুঝতে পারছে না, নাকি, বুঝেও ইচ্ছে করে এমন করছে?

ভুটান থেকে ফিরে এসে দিনগুলো কী সুন্দর কেটেছিল,* রুদ্রর বাবা মা ছুটির দিন হলেই চলে আসতেন ওদের ফ্ল্যাটে, প্রিয়মের বাবা মা—ও কল্যাণী থেকে আসতেন, তারপর ছুটির দিনগুলো হইহই করে কাটত! ভুটানের ওই আন্তর্জাতিক চক্রের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়ায় মিডিয়া বেশ শোরগোল ফেলেছিল। তারপর বেশ কিছুদিন সরকারি, বেসরকারি তরফে ওকে সম্বর্ধনা দেওয়া, বেশ কয়েকটা পুরস্কারও পেয়েছিল রুদ্র, সব্বাই মিলে যেত সেই অনুষ্ঠানগুলোতে।

কিন্তু সুখ যেন ওর কপালে বেশিদিন সয় না। মাসছয়েকের মধ্যেই প্রিয়মের কোম্পানি হঠাৎ ওকে এখানে পাঠিয়ে দিল।

প্রথম প্রথম সে কী মন খারাপ, অফিস থেকে এসে কাটতেই চাইত না সময়, খালি মনে পড়ত প্রিয়ম থাকলে কী বলত, কী করত।

সারাক্ষণ খালি পুরোনো কথা মনে পড়ত।

আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে গেছে, এখন আর অতটা মন কেমন করে না। তবু একা জীবনে ক্লান্তি লাগে বড়ো!

এখন প্রিয়মের কাছে এসেছে ঠিকই, কিন্তু লন্ডনে রুদ্র থাকবে মাত্র এক সপ্তাহ। তারপরেই ওকে চলে যেতে হবে প্যারিস, ওর ব্যাঙ্কের তরফে প্যারিস স্কুল অফ বিজনেসে একটা পনেরো দিনের ওয়ার্কশপে যোগ দিতে এসেছে রুদ্র। সেই ওয়ার্কশপ শেষে লন্ডনে আরও দু—সপ্তাহ মতো কাটিয়ে দেশে ফেরার কথা ওর। কিন্তু ওই পনেরো দিন ওয়ার্কশপের সময়ে প্রথমে প্রিয়মের ওর সঙ্গে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটা এখন বাতিল করতে হবে। প্রিয়ম ওইসময় অফিস ছেড়ে প্যারিস যেতে পারবে না ওর সঙ্গে। নাকি সেইসময় প্রোজেক্টে ভীষণ চাপ থাকবে।

এই নিয়ে দুজনের বেশ কিছুদিন মন কষাকষি চলেছে এবং অবশেষে রুদ্রর মনে খুব চাপা একটা অভিমান জমা হয়েছে।

রুদ্র এখনও কথা বলছে না দেখে প্রিয়ম ওর হাতে আলতো একটা চাপ দিল, ‘কী হল? মন খারাপ?’

রুদ্র কোনো কথা না বলে ডান পাশে ছবির মতো সুন্দর লন্ডন শহর দেখতে লাগল। লাল টুকটুকে টেলিফোন বুথ, উঁচু উঁচু গথিক স্টাইলের প্রাসাদ, তারই সঙ্গে শপিং মল। রাজকীয় বনেদিয়ানা আর আধুনিকতার সার্থক মিশেল যেন এই শহর। রুদ্রর কলকাতার পার্কস্ট্রিট চত্বর মনে পড়ে গেল। ইংরেজদের দুশো বছরের শাসনের জন্য কলকাতাও তো অনেকটা এমনই ছিল। এখনও এরকম বহু বাড়ি আছে, কিন্তু উপযুক্ত দেখভালের অভাবে সেগুলো আজ প্রায় ধ্বংসের মুখে।

প্রিয়ম আবার বলল, ‘উফ, এতদিন বাদে এলে, চুপ করে থাকলে ভালো লাগে? এক কাজ করো, তোমাকেও যেতে হবে না প্যারিসের ওই ওয়ার্কশপে। মেডিক্যাল কিছু দেখিয়ে মেল করে দাও না তোমার অফিসে?’

রুদ্র এবার ম্লান হাসল, ‘ওরকম কখনো হয়! আমি এই এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়েই ওই ওয়ার্কশপ অ্যাটেন্ড করব, এরকমই কথা আছে।’

প্রিয়ম বলল, ‘আরে সে তো সুস্থ থাকলে। বরের শরীর খারাপ দেখিয়ে মেল করে দাও বরং। এমনিতেই আগের সপ্তাহে আইফেল টাওয়ারের সামনে ব্লাস্ট হয়েছে, যেতে হবে না তোমায়। এখানেই থাকো!’

রুদ্র আনমনে বলল, ‘কতক্ষণ লাগবে এখান থেকে তোমার বাড়ি?’

প্রিয়ম বলল, ‘বেশিক্ষণ নয়। আর পাঁচ মিনিট মতো। তোমায় তো বলেছিলাম এয়ারপোর্টের কাছেই থাকি আমি, হিলিংডন বলে একটা জায়গায়। ওটা ঠিক প্রপার লন্ডন শহরে নয়, গ্রেটার লন্ডন বলতে পারো। আমার অফিসটা ওখান থেকেই কাছে হয় তো!’

গাড়ি ততক্ষণে ব্যস্ত বাজার ছেড়ে ফ্লাইওভার ধরে নিয়েছে, ছুটে চলেছে ফাঁকা অঞ্চলের মধ্য দিয়ে। রাস্তার দু—ধারে বিশ্ববিখ্যাত সব ব্র্যান্ডের গাড়ির শোরুম দেখা যাচ্ছে একের পর এক। কোনোটা পাঁচতলা, কোনোটা বিশাল জাহাজের আকৃতির, আবার কোনোটা আরও অদ্ভুত ডিজাইনের।

ফ্লাইওভার থেকে নামতেই চারপাশে অসম্ভব সুন্দরভাবে সাজানো সব বাড়ি। সামনে একফালি করে সাজানো বাগান, আর প্রতিটা একইরকম প্যাটার্নের। তাদের প্রতিটার ওপরে তিনকোনা কালো রঙের ছাদ, তার ওপরে গোটাকতক লালচে চিমনি। বাড়িগুলোর রংও সব এক, গাঢ় খয়েরি ব্রিক স্টাইলে তৈরি, দরজা জানালাগুলো সব কাচের, তাতে ঘন পর্দা টানা। কোনোটাই দোতলার বেশি উঁচু নয়। আর অদ্ভুতভাবে প্রতিটা বাড়িই পরপর জোড়া, মানে একটার সঙ্গে অন্যটার দেওয়াল এক।

কী অদ্ভুত! সেই সিনেমায় দেখা, প্রচুর নভেলে পড়া ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের বাড়ি। মনে মনে ভাবল রুদ্র।

রুদ্রর দৃষ্টি অনুসরণ করে বাইরে তাকিয়ে প্রিয়ম বলল, ‘এই হল টিপিকাল ইউরোপিয়ান বাড়ি। বাড়িগুলো লক্ষ করে দ্যাখো, সব জোড়া। ওই যে মাঝে মাঝে কালো পাইপগুলো দেখছ, ওই দিয়ে একটার সঙ্গে অন্য বাড়ি আলাদা করে আইডেন্টিফাই করা হয়।’

রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘এগুলো ইউরোপিয়ান বাড়ি নয়, এগুলোকে বলে ভিক্টোরিয়ান হাউস। প্লেনে আসতে আসতে লিজা পিকার্ডের একটা বই পড়ছিলাম এই ভিক্টোরিয়ান যুগের লন্ডন নিয়ে। ডিটেইলে ছবি দিয়ে লেখা আছে সেখানে। রানি ভিক্টোরিয়া শাসন করেছিলেন মোটামুটি আঠেরোশো সাঁইত্রিশ থেকে উনিশশোর একদম গোড়ার দিক অবধি। ওই সময়েই এই স্টাইলের বাড়ি তৈরি হত। তার আগে অবধি ইংল্যান্ডে কাচ আর ইটের ওপর মোটা ট্যাক্স ছিল। ভিক্টোরিয়া সেইগুলো তুলে দেন।’

প্রিয়ম বলল, ‘ওহ, তাই? কাচ আর ইটের ওপরে কোনো ট্যাক্সই ছিল না?’

রুদ্র মাথা নাড়ল, ‘না। তার ওপর সেই সময় এখানে রেললাইন পাতা হয়, ট্রেন কানেক্টিভিটি শুরু হয়। ফলে একদিকে মালপত্রের দাম আর অন্যদিকে পরিবহণের খরচ দুটোই সস্তা হয়ে যায়। তখনই এই একধরনের মালমশলা একটা জায়গায় তৈরি করে নিয়ে এসে এইসব বাড়িগুলো করা হয়। তার ওপর ওই সময়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভলিউশনও শুরু হয়েছিল। রেনেসাঁসের পর পপুলেশন বাড়ছিল হু হু করে, তার সঙ্গে বাড়ছিল গ্রামগঞ্জ থেকে শহরে আসতে থাকা লেবারের সংখ্যা। পপুলেশন আর মাইগ্রেশন, মেইনলি এই দুটো কারণেই এই একটাইপের বাড়ি করা শুরু হয়েছিল। বইটা দারুণ ইন্টারেস্টিং, রেয়ার কিছু ছবিও আছে। এখানে রেখে যাব, পড়ে দেখো।’

প্রিয়ম প্রচণ্ড অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘উফ! এত নলেজ তুমি কোথায় রাখো রুদ্র? পেটে গ্যাস হয় না তোমার? অ্যাটলিস্ট পেটগরম?’

এবার এতক্ষণ ধরে জমে থাকা অভিমানকে আর ইগোর বোতলে আটকে রাখতে পারে না রুদ্র, রেগেমেগে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দেয় প্রিয়মের পিঠে, ‘আমার পেটে গ্যাসই হোক বা পেটগরম, তুমি তো আর আমার জন্য অফিসে ছুটি নিতে পারবে না, না! একবছর বাদে বউ এল, তবু তার জন্য কোনো টাইম নেই। ভালো!’

টুকটাক কথায়, খুনসুটিতে ওদের ট্যাক্সি পৌঁছে যায় গন্তব্যে। প্রিয়ম থাকে একটা হাইরাইজ কমপ্লেক্সে। নামার সঙ্গে সঙ্গে হিমেল হাওয়া এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যায় ওদের। রুদ্র এমনিই শীতকাতুরে, ওর বেশ ঠান্ডা লাগলেও এখন ইউরোপে সামার। প্রায় দিনই রোদ ওঠে, এখানকার বাসিন্দাদের জন্য অত্যন্ত আরামদায়ক আবহাওয়া। সারা বছরে এই সময়েই তাই সবচেয়ে বেশি টুরিস্টের আনাগোনা হয় এই অঞ্চলে।

অ্যাপার্টমেন্টে পৌঁছে প্রিয়ম প্রথমেই দু—কাপ কফি বসিয়ে দিল। রুদ্রর ভীষণ ঠান্ডা লাগছিল, ভীষণ অবসন্নও মনে হচ্ছিল তবু ও ফ্রেশ না হয়ে ভালো করে ঢেকেঢুকে আগে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল।

এখনও তেমন জেটল্যাগজনিত ক্লান্তি কিছু আসছে না, তবে মাথাটা বেশ ভার হয়ে রয়েছে।

এই জায়গাটা খুব সুন্দর। বেশ ফাঁকা ফাঁকা, রাস্তায় লোকজন নেই বললেই চলে, তবু ট্র্যাফিক সিগনাল ভাঙছে না কোনো গাড়ি। যদিও পাশেও একটা বড়ো ডিপার্টমেন্টোল স্টোর রয়েছে। রাস্তা দিয়ে সেকেন্ডে পাঁচটা করে গাড়ি ছুটে চলেছে, তবু কী শান্তশিষ্ট। কলকাতার মতো হইচই, জ্যামজট কিছুই নেই এখানে। এখানকার লোকজন নিয়ম মেনে চলে বলেই বোধ হয় সব কিছু এত সুন্দর। পরক্ষণেই নিজের দেশের সমর্থনে ঘুঁটি সাজায় ও মনে মনে, পপুলেশনটা একটা বড়ো ফ্যাক্টর, আর টাকাটাও। এদের লোকজন এত কম, তার ওপর প্রথম বিশ্বের দেশ, এরা তো ঝকঝকেভাবে থাকবেই। এদের নিয়ে গিয়ে ফেলে দেওয়া লোক না বাপু আমাদের বড়বাজার কিংবা হাওড়া স্টেশন চত্বরে, সব নিয়ম পালাবে অমনি। পরিস্থিতিই মানুষকে অবাধ্য, বেপরোয়া করে তোলে।

প্রিয়ম কফি নিয়ে আসতে রুদ্র দূরে আঙুল তুলল। এই এগারো তলা থেকে সবুজ উজ্জ্বল একটা ফাঁকা ঢেউ খেলানো জায়গা দেখা যাচ্ছে, তাতে কয়েকটা জিনিস উল্কার গতিতে ঘোরাফেরা করছে, এত উঁচু থেকে সেগুলো কী ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ‘ওই জায়গাটা কী?’

প্রিয়ম চোখ সরু করে, ‘ওটা তো পার্ক, তাতে বিভিন্ন খেলাধুলো হয় দেখি।’

হঠাৎ কী মনে পড়তে রুদ্র ভেতরে চলে গেল, ট্রলির একটা সাইড খাপ থেকে ওর বাইনোকুলারটা বের করে বাইরে এল, চোখ লাগিয়ে বলল, ‘আরে! কী অদ্ভুত জিনিস দেখেছ? একটা কিছু রেস হচ্ছে, লোকগুলো অদ্ভুত একেকটা গাড়ি চালাচ্ছে, ফর্মুলা ওয়ান? নাহ, তাও তো নয়, সামনেটা সাইকেলের মতো, অথচ চালাচ্ছে হাত দিয়ে…!’

প্রিয়ম এবার বলল, ‘ওহ! বুঝেছি। প্যারাসাইকেল কম্পিটিশন চলছে। প্রায়ই চলে ওখানে।’

রুদ্র চোখ থেকে বাইনোকুলারটা নামাল, ‘কী সেটা?’

প্রিয়ম বলল, ‘যাদের পা নেই, বা থাকতেও অকেজো, তাদের জন্য এই স্পেশাল টাইপের সাইকেল টুর্নামেন্ট হয় ওই গ্রাউন্ডটায়। সাইকেলই, ভালো করে খেয়াল করো, কিন্তু তিনটে চাকা, আর সামনের চাকাটাকে হাত দিয়ে খুব জোরে জোরে প্যাডল করতে হয়, চালানো বেশ টাফ, একদম শুয়ে চালাতে হয়।’

রুদ্র ঘড়ি দেখল, সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, অথচ এখনও দিব্যি দিনের আলো খটখট করছে। কী আশ্চর্য!

কিন্তু এত ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে আর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।

ও বলল, ‘এই চলো না, দেখে আসি! এখান থেকে ভালো বুঝতেই পারছি না!’

প্রিয়ম বলল, ‘এইমাত্র এলে, এখন আবার ওখানে যাবে? ফ্রেশ হবে না?’

রুদ্র বলল, ‘একটু পরে হব। এখন চলো না, প্লিজ! কীরকমভাবে চালাচ্ছে সাইকেলগুলো একটু দেখে আসি কাছ থেকে!’

রুদ্রর মাথায় একবার যখন কোনো জেদ চেপেছে, তখন সে যাবেই, এটা প্রিয়ম খুব ভালো করে জানে। কাজেই ও আর কিছু বলল না। প্রায় পনেরো ঘণ্টা জার্নি করে এসে রুদ্রর যদি যেতে এত উৎসাহ থাকে, প্রিয়মের আর কী অসুবিধা।

প্রিয়মের ফ্ল্যাট এগারো তলায়। দুটো লিফট পুরো অ্যাপার্টমেন্টটায় সমান্তরালভাবে চলে।

লিফটের ভেতরে ঢুকেই রুদ্র বলে উঠল, ‘কী স্লো গো লিফটটা! এর থেকে তো সিঁড়ি দিয়ে আমরা তাড়াতাড়ি নেমে যেতাম।’

প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, এই লিফট দুটো বড্ড স্লো। কী আর করা যাবে, কোম্পানি যে অ্যাকোমোডেশন দিয়েছে, এই ঢের।’

অ্যাপার্টমেন্টটার একদম নীচে গ্যারাজ, সেখানে সার দিয়ে গাড়ি দাঁড় করানো আছে। এন্ট্রান্সের ঠিক পাশেই প্রায় সাড়ে ছ—ফুট লম্বা একটা গাঁট্টাগোট্টা আফ্রিকান লোক বসে, সে ওদের দেখেই ধবধবে সাদা দাঁত বের করে হাসল।

প্রিয়মও হেসে বলল, ‘হ্যালো জন! কী খবর?’

জন বলে লোকটা কাঁধ নাচাল, ‘ফাইন।’

প্রিয়ম রুদ্রর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। জন এই অ্যাপার্টমেন্টের কেয়ারটেকার। এই এগারো তলা বিল্ডিংটা মেইটেন্যান্সের দায়িত্বে আছে। এছাড়া গ্যারাজ, লিফট সব কিছুরই সে দেখভাল করে। একতলায় গ্যারাজের পাশের ঘরে তার থাকার জায়গা।

টুকটাক কথা সেরে বেরোনোর আগে প্রিয়ম জনকে বলল, ‘একটু সাবধানে থেকো। পরপর যা সব হামলা হচ্ছে।’

জন আবার তার ধবধবে সাদা দাঁত বের করে হাসল, মাথা নাড়ল সম্মতির ভঙ্গিতে, ‘ইউ টু!’

এগারো তলার উপর থেকে দেখা গেলেও পার্কটায় হেঁটে যেতে প্রায় আট মিনিট মতো সময় লাগল। একটা বড়ো পার্কের মধ্যে ওই প্যারাসাইকেল টুর্নামেন্ট গ্রাউন্ড, তাতে উল্কার গতিতে হুস হুস করে হাত দিয়ে জোরে জোরে প্যাডল ঘুরিয়ে চলেছেন কিছু প্রতিযোগী। এছাড়া লোক প্রায় নেইই। একজন টাইম দেখছেন স্টপওয়াচ দিয়ে, অন্য একজন মহিলা খাতায় কিছু নোট করছেন মাঠের একপাশের ঘাসে বসে।

রুদ্রর চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছিল, ঠান্ডায় বেশ কাঁপুনি ধরলেও ওর খুব ভালো লাগছিল দেখতে। মাঠের একপাশের ঘাসে ও—ও বসে পড়ল।

সন্ধেবেলার পড়ন্ত নরম রোদের ওম মেখে পুরো জায়গাটা যেন স্নিগ্ধ হয়ে রয়েছে।

প্রিয়ম পাশে এসে বসতেই রুদ্র বলল, ‘কি ভালো লাগছে না!’

প্রিয়ম মাথা নাড়ল, ‘হ্যাঁ, এই জায়গাটা খুব সুন্দর। আমি তো প্রায় রোববারই বিকেলবেলা চলে আসি এখানে। ইনফ্যাক্ট এখানে এসে একজনের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে, সে—ব্যাপারেই তোমার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’

রুদ্র আনমনে বলল, ‘কে?’

প্রিয়ম বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম পরে বলব, কিন্তু তুমি যেভাবে এখনই এখানে চলে এলে। ওই যে দেখলে না গাড়িতে ফোন করেছিলেন? একজন জার্মান ভদ্রলোক। মাসখানেক আগে রবিবার সকালে কী করব, সময় কাটছিল না। তখন হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে বসেছিলাম। সেদিন অবশ্য কোনো টুর্নামেন্ট ছিল না, এমনিই প্র্যাকটিস চলছিল। দুজনেই এই ঘাসের উপর বসেছিলাম, উনিই এসে আলাপ করলেন। জার্মানির লোক, কিন্তু থাকেন লন্ডনেই। এখানকার বেশ নামকরা ডাক্তার। অঙ্কোলজিস্ট, মানে ক্যান্সারের ডাক্তার।’

রুদ্র কতটা শুনছিল বোঝা গেল না, একজন সাইক্লিস্ট চালানো থামিয়ে ওদের একদম কাছে এসে সাইকেল থেকে নেমেছেন, ও খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল তার সাইকেলটাকে।

প্রিয়ম বলল, ‘কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বাড়ি ফিরেছি, সন্ধেবেলা দেখি ফেসবুকে ভদ্রলোক ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছেন আমায়। অ্যাকসেপ্ট করলাম। তার দু—একদিন বাদেই দেখি আমাকে মেসেজ করে জানতে চেয়েছেন যে তুমি আমার বউ কি না।’

রুদ্র এবার প্রিয়মের দিকে তাকাল, ‘আমি তোমার বউ কি না, মানে?’

প্রিয়ম বলল, ‘আমিও এগজ্যাক্টলি এটাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তুমি আমার বউ কি না মানে? এ আবার কী আপত্তিজনক প্রশ্ন! দিব্যি দেখছে ফেসবুকে রিলেশনশিপ স্টেটাস, গাদাগাদা ছবি, তারপরেও এরকম অদ্ভুত জিজ্ঞাসা কেন? তখন উনি বললেন, যে আমার প্রোফাইলে তোমার নাম, ছবি এসব দেখে উনি চিনতে পেরেছেন তুমিই সেই বিখ্যাত ব্যক্তি যে কিনা ভুটানের ওই সাংঘাতিক কেসটা সলভ করে বাবার মতো ওরকম বিখ্যাত একজন আর্কিয়োলজিস্টকে উদ্ধার করেছিলে আর ওই গ্যাংটাকেও ধরেছিলে।’

রুদ্র এবার ধমক দিল, ‘বাজে কথা রাখো। ঠিক করে বলবে কি কেসটা কী?’

প্রিয়ম এবার হেসে ফেলল, ‘এই দ্যাখো, তুমি বিশ্বাস করছ না। সত্যি বলছি। আরে ওই কেসে সেই গ্যাঙের পাণ্ডারা এখানকার লোক ছিল, এই তো বেডফোর্ডশায়ারের। কাজেই এরা তো জানবেই। বিবিসি যে আর্টিকলটা বের করেছিল না ইন্টারনেটে, যেটা খুব পপুলার হয়েছিল, সেটা নাকি উনি পড়েছিলেন। বিবিসির দেখাদেখি আরও কিছু নিউজ মিডিয়াও কভার করেছিল কেসটা। সেইসব দেখেই উনি তোমাকে চিনতে পেরেছেন।’

রুদ্র বলল, ‘তারপর?’

প্রিয়ম মাথা দোলাল, ‘আমিও সেই সুযোগে আমার বউয়ের একটু ঢাক পিটিয়ে দিলাম। উনি তো কাগজে পড়েছিলেন, আর আমি আরও বিস্তৃতভাবে গুণকীর্তন করলাম। শুনে তো সে ব্যাটা ভারি ইমপ্রেসড!’

রুদ্র এবার চুপ করে গেল। এটা ঠিকই যে, বিবিসির প্রতিবেদনটা বেশ সাড়া ফেলেছিল। দেশেও ওটা পড়ে অনেকেই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

কিন্তু তাই বলে ছবি দেখে চিনতে পেরে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত নয় কি? এতটাও বিখ্যাত হয়ে যায়নি ও।

রুদ্র বলল, ‘কী নাম ভদ্রলোকের?’

প্রিয়ম বলল,’নামটাও বেশ মজার। সিগমুন্ড শ্যুমাখার। আমি তো নাম শুনে মজা করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে আপনি কোন তরফের রিলেটিভ, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের নাকি মাইকেল শ্যুমাখারের। তখন হেসে বললেন, কারুরই নয়।’

রুদ্র জিজ্ঞেস করল, ‘উনিও কি এদিকেই কোথাও থাকেন?’

প্রিয়ম বলল, ‘সেটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি, তবে কাছেপিঠেই থাকেন কোথাও নিশ্চয়ই, কারণ পরেও আরেকদিন আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তখনই আরও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানছিলেন তোমার ব্যাপারে।’

রুদ্র বলল, ‘আমার ব্যাপারে?’

প্রিয়ম বলল, ‘হ্যাঁ, ভারতবর্ষের ব্যাপারে দেখলাম খুব ইন্টারেস্ট, দু—বার ঘুরেও এসেছেন। ওঁর মায়ের দাদু না কে, তিনি ছিলেন ফ্রান্সের লোক, পন্ডিচেরিতে ফ্রেঞ্চ কলোনিতে চাকরি নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর ডায়েরি পড়েই ওঁর ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিশাল আগ্রহ জন্মেছে, এখনও রীতিমতো খবর রাখেন সব কিছুর। তো, তারপরই একদিন ফোন করে ব্যাটা বলে কি, তোমার সঙ্গে একবার কথা বলা যেতে পারে কি? ভীষণ দরকার, তোমার ফোন নম্বর দিলে ভালো হয়। তখন আমি বললাম যে তুমি তো এখানে আসছই ক—দিনের মধ্যে। তখন বললেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।’

রুদ্র এবার অবাক হয়ে গেল। কয়েকদিন ছুটি কাটিয়ে ওয়ার্কশপ সেরে একটু রিল্যাক্স করবে ভাবল, এ আবার কী দরকারে দেখা করতে চাইছে? ও জিজ্ঞেস করল, ‘দরকারটা কী সেটা বলেছেন কী?’

প্রিয়ম বলল, ‘না, সে—ব্যাপারে তো কিছু জিজ্ঞেস করিনি। দ্যাখো হয়তো ওই মায়ের দাদুর ডায়েরিতে ভারতের কিছু গুপ্তধন সম্পর্কে কোনো খোঁজ পেয়েছেন, ওঁর মনে হয়েছে তুমিই সেই ট্রেজার খুঁজে এনে দিতে পারবে।’

রুদ্র এবার একটু বিরক্ত হল, ‘সেই থেকে আজেবাজে বকে চলেছ!’

প্রিয়ম বলল, ‘আরে সত্যি! খুব আগ্রহ দেখলাম তোমার সঙ্গে কথা বলার জন্য। কাল বিকেলে আসবেন বলেছেন। আজই আসতে চাইছিলেন, আমি বললাম আজ ও এতটা জার্নি করে এল, টায়ার্ড আছে, তাই কাল আসুন।’

রুদ্র ফোনটা খুলে ফেসবুকে খুঁজছিল ভদ্রলোককে, বলল, ‘ডাক্তার বললে, না? কেমন বয়স?

প্রিয়ম বলল, ‘বয়স ওই পঁয়ত্রিশ মতো, তবে বেশ নামকরা ডাক্তার। অনেক দেশ—বিদেশের সেমিনারে লেকচার দেওয়ার ছবিও রয়েছে। আর বেশ ফিটও। এমনি জার্মানরা তো বিশাল লম্বা হয়, ইনি অত লম্বা নন, তবে বেশ মজবুত শরীর।’

রুদ্র ছবিটা দেখছিল। প্রিয়ম ঠিকই বলেছে। বেশ বলিষ্ঠ চেহারা, খুব ফর্সা আর টিকোলো নাক। জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরের একটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করে বর্তমানে লন্ডনের একটা ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত লেখা রয়েছে।

রুদ্রর এবার খুব শীত করছিল। টুর্নামেন্টও শেষ হয়ে গেছে, একের পর এক প্রতিযোগী তাদের সাইকেলগুলো পাশের একটা ঘরে রেখে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হয়ে আসছে।

হাওয়ার কনকনে ভাবটাও বাড়ছে ক্রমশ।

রুদ্র একটা হাই তুলে উঠে দাঁড়াল, ‘বুঝলাম। চলো, খুব টায়ার্ড লাগছে। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব আজ।’ পেছনে ফিরেও একবার তেরচা চোখে তাকাল ও, ‘আর কাল আসতে বলেছ মানে আমাদের লন্ডন আই, বিগ বেন, মাদাম তুসো, সব প্রোগ্রাম বাতিল?’

প্রিয়ম জোরে জোরে মাথা নাড়ল, ‘আরে না না, পাগল নাকি! সন্ধেবেলা আসতে বলেছি, আমরা তো তার মধ্যে ঘুরে চলে আসব।’

_____

* রুদ্র প্রিয়ম সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ঈশ্বর যখন বন্দি’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *