১০
সারাদিন এত টায়ার্ড থাকা সত্ত্বেও রাতে বিছানায় শুয়ে রুদ্রর কিছুতেই ঘুম এল না, যদিও প্রিয়ম ঘুমিয়ে পড়েছে অনেকক্ষণ আগেই। কোথায় যেন একটা অস্বস্তি হচ্ছে, রুদ্র নিজেও বুঝতে পারছে না। আজ সারাদিনে এত কিছু ঘটল, এত জায়গায় ঘুরল, এরকম একটা নতুন ব্যাপারে ইনভলভড হল, সব কিছুর মধ্যে কোথায় যেন একটা খটকা লাগছে ওর।
সারাক্ষণ উশখুশ করছিল শুয়ে শুয়ে।
ওদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকছে প্রিয়মের নাক ডাকাও। একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লে অসুবিধা হয় না। কিন্তু পরে ঘুমোনোর চেষ্টা করলেই এই একটা প্রাচীন সমস্যা ওদের, রুদ্রর চুপচাপ শুয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কলকাতার দিনগুলো।
কম কাণ্ড করেছে ও প্রিয়মের এই ডাক ডাকা কমাতে? ঝগড়াঝাঁটি, ডাক্তার বদ্যি, মা—মাসিদের টোটকা। কিছুতেই কিছু হয়নি। একবার তো অনলাইনে একটা কী যেন ক্লিপই অর্ডার দিয়ে দিয়েছিল, সেটা কানে গোঁজা হেডফোনের মতো নাকের দুটো ফুটোয় গুঁজে শুতে হয়। সেটা লাগাতে গিয়ে তো প্রিয়মের নিশ্বাস প্রায় বন্ধ হবার জোগাড়। পরের দিন ফোনে শুনে মায়ের সে কী বকুনি! অন্ধকার ঘরে একা একা জেগে থাকতে থাকতে সেকথা মনে পড়তেই হেসে ফেলল ও।
কিন্তু এতদিন পর সেই একই প্রবলেম ফেস করতে গিয়ে রুদ্রর আর রাগ হচ্ছিল না, আগের মতো প্রিয়মকে দুম দুম করে ধাক্কা দিয়ে তোলেওনি।
দূরত্ব এমন একটা জিনিস, যে এতদিন বাদে কাছে পেয়ে ভালোমন্দ কোনো মুহূর্তই আর মিস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না।
আর কিছুক্ষণ এদিক—ওদিক করে শেষমেষ দেড়টা নাগাদ আর ঘুমোনোর চেষ্টা না করে প্রিয়মের নাকটা আলতো করে টিপে দিয়ে ও উঠে পড়ল।
প্রিয়মের অ্যাপার্টমেন্টটা ছোটো হলে কী হবে, ও বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে ভালোবাসে। যদিও এই কয়েকদিনেই বেশ নোংরা করে ফেলেছে রুদ্র, তবু প্রিয়মের ছোট্ট ল্যাপটপ টেবিলের লাগোয়া চেয়ারটায় বসে টেবিল ল্যাম্পের আলোয় বেশ ভালোই লাগছিল ওর। কাছেই রুম হিটারটা চলছিল, সেটা থেকে বেরোনো গরম হাওয়ায় বেশ আরাম হচ্ছিল।
প্রথমেই ও ব্যাগ থেকে ফটোগুলো বের করে একটার পর একটা সাজিয়ে ফেলল টেবিলের ওপর। সাদা কালো হলদেটে কাগজের ফোটোগ্রাফ। সব মিলিয়ে দশটা সাদাকালো ফটো। কোণগুলো আলতো মোড়ানো ছাড়া প্রায় অবিকৃত।
এত বছরের পুরোনো, অথচ নষ্ট হয়নি একটুও, নিশ্চয়ই খুব যত্নের সঙ্গে রাখা ছিল।
প্রতিটা ফটোই বোঝা যাচ্ছে তোলা হয়েছে একটা টেবিলের টপ ভিউ অর্থাৎ একদম উপর থেকে নব্বই ডিগ্রি অ্যাঙ্গলে। সেই টেবিলের ওপর রাখা একটা করে কাগজের ছবি তোলা রয়েছে একেকটা ফটোয়, প্রতিটা ফটোতেই অদ্ভুত সব হরফ।
তার মানে, রুদ্র চিন্তা করল, সম্ভবত একটাই লেখার প্যাড থেকে দশটা পাতা পরপর ছিঁড়ে এই নম্বরগুলো লিখে ফটো তোলা হয়েছে। কাগজটা ছবির মধ্যে থেকে খুঁটিয়ে দেখতে চেষ্টা করল রুদ্র। লেখার প্যাডের কাগজগুলো যে রুল টানা সেটা বোঝা যাচ্ছে, লাইনগুলো অস্পষ্ট হলেও একেবারে মিলিয়ে যায়নি ছবিতে।
কিন্তু এই অজস্র চিহ্ন, এগুলো কী?
কোনো এনক্রিপ্টেড সংকেত?
চিহ্নগুলো ভালো করে লক্ষ করল রুদ্র, হাতে লেখা, কিন্তু বেশ মোটা কালিতে। খুব অদ্ভুত ধরনের হরফে লেখা।
এই এত অজানা হরফের মধ্যে নতুন একটা মৌল বানানোর প্রসেস লেখা আছে?
আশ্চর্য তো।
ড শ্যুমাখারের দাদু শুধু ডাক্তারই নয়, এই সমস্ত ব্যাপারেও বেশ পোক্ত ছিলেন বোঝা যাচ্ছে।
ও প্রথমেই দশটা ফটোর ছবি তুলে নিল মোবাইলে, একদম উপর থেকে। ড শ্যুমাখারের মতো অভিজ্ঞ লোক যখন এটা ডিকোড করতে পারেননি, তখন ও কতটা কী পারবে জানে না। তবু চেষ্টা করতে তো দোষ নেই!
তেমন হলে না হয় প্রিয়মকেও বলবে একটু হেল্প করতে।
ও এবার রাইটিং প্যাডের কাগজগুলোর একটা বেছে নিয়ে সেদিকে কনসেনট্রেট করল। প্রাথমিক দৃষ্টিতে দেখলে হিজিবিজি মনে হলেও একটু লক্ষ করলেই বোঝা যায় এটা কোনো এনক্রিপটেড লেখা। পুরো লেখাটায় কোনো বক্ররেখা নেই, সোজা সোজা রেখাংশ দিয়ে ছোটো ছোটো হরফ তৈরি করা হয়েছে মোটা কালিতে, তার কোনো কোনোটার মধ্যে ছোট্ট ফুটকি দেওয়া।
এটা কি হায়ারোগ্লিফ টাইপের কোনো প্রাচীন ভাষা? মনে হতেই রুদ্র ল্যাপটপে হায়ারোগ্লিফ ভাষা দিয়ে সার্চ করল, কিন্তু সেটার সঙ্গে এইগুলোর কোনো মিল পেল না। আর তা ছাড়া ড শ্যুমাখারের দাদু ফ্রান্সের লোক ছিলেন, ভারতে থাকতেন, হায়ারোগ্লিফ বা ওই জাতীয় ভাষায় লিখতে যাবেনই বা কেন?
ফ্রান্সের কোনো প্রাচীন ভাষা হতে পারে কি? সেটা নিয়েও কিছুক্ষণ নেমে ঘাঁটাঘাঁটি করল, কিন্তু কিছুই পেল না।
খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আর একটা জিনিস ও লক্ষ করল, প্রতিটা ছবিতে বিভিন্ন প্যার্টার্নের হরফ থাকলেও একদম নীচে ডান দিকে যে দুটো হরফ রয়েছে সেটা প্রতিটা ছবিতেই একইভাবে রয়েছে এবং সেটার ছাপার হরফটাও একটু সরু।
সাদাকালো ছবি, ফলে রং বোঝার কোনো সুযোগ নেই। রুদ্র ভ্রূ কুঁচকে চিন্তা করছিল, একটা লেখার প্যাডের একদম নীচে প্রতিটা পাতায় একই ডিজাইনের ওই হরফ, তাহলে ওটা কোনো কিছুর লোগো? তাই যদি হয়, এটার মানেই বা কী?
এতক্ষণ ধরে দেখেও কোনোটারই কিছু মাথামুণ্ডু বুঝতে পারল না রুদ্র।
তবে কোনো সন্দেহ নেই এটা কোনো হিডন কোড। এগুলোকে বলে ক্রিপটোগ্রাফি। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় ফাইনাল ইয়ারে এই ক্রিপটোগ্রাফি আর ডিজিটাল এনক্রিপশনের ওপর একটা পেপার ছিল ওদের। প্রাচীন যুগ থেকেই কোনো গুপ্ত সংকেতের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের চোখ এড়িয়ে মেসেজ পাঠানোর চল ছিল। এখন ডিজিটাল যুগে এসে সেটা অনেক উন্নত হয়েছে। এই ধরনের সাংকেতিক কোডগুলোকে বলে সাইফার, মনে পড়ল রুদ্রর। এই সাইফারগুলোকে ডিকোড করার অনেকরকম টেকনিক ছিল, সেগুলো দিয়ে করে দেখতে হবে।
একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে ও উঠে দাঁড়াল। ঘড়িতে প্রায় সাড়ে তিনটে। এবার একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে বটে। মাথাটাও যন্ত্রণা করছে আলগা। সংকেতগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে ও বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল।
আচ্ছা, ড শ্যুমাখারের পেছনে না হয় এখন অনেক শত্রু রয়েছে, যারা নিজেদের স্বার্থে চায় না এই রিসার্চটা এগোক কিন্তু একশো বছর আগে পন্ডিচেরিতে সমুদ্রের ধারে বসে যখন ওঁর দাদু এটা নিয়ে গবেষণা করছিলেন, তখন কারা ওঁর রাস্তায় বাধা দিচ্ছিল যে ওঁকে এরকম জটিল কোডে ব্যাপারটা লিখে যেতে হল? এমনি এমনি নিশ্চয়ই কেউ এইরকম করে একটা ভালো রিসার্চকে ধোঁয়াশায় রেখে দেবে না! তাও আবার সেটাকে এইভাবে ছবি তুলে রেখে?
ড শ্যুমাখারকে জিজ্ঞাসা করতে হবে ওঁর দাদুর মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল।