নরক সংকেত – ২৬

২৬

সেপ্টেম্বর ১৯৩৩,

ফ্রিৎজ দরজা খুলে ফ্রেডরিককে তাড়াতাড়ি ঘরের ভেতরে নিয়ে এলেন। বেচারি কোনো কারণে অনেকটা রাস্তা ছুটে এসেছে, এখন হাঁপাচ্ছে খুব। ঠান্ডায় ওঁর মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে, হাতের আঙুরগুলো সিঁটিয়ে গেছে।

এখন কাকভোর বললেও কম বলা হয়। ঘড়িতে চারটে বেজে কুড়ি মিনিট, কিন্তু বাইরে এখনও ভোর হওয়ার কোনো চিহ্ন নেই। প্রচণ্ড ঠান্ডায় এখনও সারা শহরই ঘুমে আচ্ছন্ন। ফ্রেডরিক এরই মধ্যে ছুটতে ছুটতে এসেছে।

তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে শান্ত ছেলেটার ওপর দিকে একটা বিশাল ঝড় বয়ে গেছে।

এত ভোরে ফ্রেডরিক এভাবে কেন এল ফ্রিৎজ বুঝতে পারলেন না। সোফিও পেছন পেছন উঠে এসেছেন ঘুমন্ত এমিলিয়াকে কোলে নিয়ে। তাঁর চোখেও জিজ্ঞাসা।

স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ফ্রিৎজ ইশারায় একটু কফি করাতে বললেন বাড়ির কাজের মহিলাটিকে দিয়ে।

গরম কফি খেয়ে ফ্রেডরিক একটু স্বাভাবিক হতেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘স্যার, আজ আমাকে একটা জায়গায় যেতে হবে, ভিক্টর নিয়ে যাবে। যা করার আজকেই করতে হবে।’

ফ্রিৎজ বললেন, ‘কোথায়? ভিক্টর কে?’

ফ্রেডরিক বলল, ‘আপনাকে সেদিন বললাম না, আমার ওই বন্ধুর নাম ভিক্টর। ও কাল রাতে এসেছিল আবার।’

সত্যি কাল রাতে দরজা খুলে ভিক্টরকে দেখে ও খুব আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল। এমনিই কাল ও একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিল, হালকা জ্বর জ্বর লাগছিল, তাই। তার মধ্যে ভিক্টরকে দেখে ও চমকে গিয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি আবার ও এল কেন?

তবে সেদিন রাতে নেশার ঘোরে ও যা যা বলেছিল, সেগুলো কিছুই খেয়াল ছিল না ভিক্টরের। ফ্রেডরিক ও ঘুণাক্ষরে সেকথা তোলেনি। ভিক্টরকে কাল বেশ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল, ‘ভাই আমার একটা কাজ করে দিতে হবে তোকে। গ্রিক পড়তে ভুলে যাসনি তো?’

ফ্রেডরিক অবাক হয়ে মাথা নেড়েছিল। হঠাৎ গ্রিক ভাষা কোত্থেকে এল?

ও কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই ভিক্টর থেবড়ে বসে পড়েছিল ওর খাটে, ‘কাল সকালে রেডি হয়ে থাকিস, তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব আমি। গাড়ি নিয়ে আসব।’

ফ্রেডরিক বলেছিল, ‘কোথায়?’

ভিক্টর পাশেই টেবিলে থাকা জলের জাগটা থেকে উঁচু করে জল খেতে খেতে বলেছিল, ‘একটা গ্রিক লেখাকে তোকে জার্মানে ট্রান্সলেট করে দিতে হবে। বেশি বড়ো নয়, দু—পাতা মতো।’

ফ্রেডরিক বলেছিল, ‘ওহ! তার জন্য যাওয়ার কী আছে, এখানে নিয়ে আয়, আমি করে দেব। কাল সকালে আমার ক্লাবে যাওয়ার আছে।’

ভিক্টর একটু থমকে গিয়ে বলেছিল, ‘না, এখানে আনা যাবে না। ব্যাপারটা মানে, একটু সিক্রেট আর কি! তুই জার্মান ভাষায় কনভার্ট করে দিলেই ওটা চলে যাবে অন্য জায়গায়। হাইকম্যান্ডের কনফিডেনশিয়াল ব্যাপার। তবে তুই মোটা টাকা পাবি ওইজন্য।’ পরক্ষণেই গলা চড়িয়েছিল, ‘তোর এইসব ক্লাব—টাব ছাড় তো! ওই করে করে তোর মাথা আরও যাচ্ছে।’

ফ্রেডরিক কিন্তু কিন্তু করেছিল, ‘সে ঠিক আছে, কিন্তু তোদের পার্টির ব্যাপারে আমি গিয়ে কী করব?’

এইবার ভিক্টর বিরক্ত হয়ে উঠেছিল, ‘উফ, তোর সবেতে এরকম আদর্শবাদী মনোভাবের জন্যই লাইফে কিচ্ছু হল না। পার্টির কাজ কেন হবে? সরকারের কাজ। এবার বল তাতেও তোর কোনো ইন্টারেস্ট নেই?’

ফ্রিৎজ ফ্রেডরিকের থেকে সব শুনে—টুনে বললেন, ‘তোমার কী মনে হচ্ছে?’

ফ্রেডরিক অবশিষ্ট কফিটা একচুমুকে শেষ করে দিয়ে বলল, ‘স্যার আমার তো মনে হচ্ছে ওই ব্যাপারেই আমাকে নিয়ে যেতে চাইছে। হয়তো গ্রিক ভাষায় কিছু লেখা আছে, যেটা ওরা বুঝতে পারছে না।’

ফ্রিৎজ চিন্তান্বিত হয়ে পড়লেন। সেদিন ফ্রেডরিক যা বলেছিল, সেইটা যদি সত্যি হয় তবে তার থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না। এর মধ্যে হিটলারের অনেকগুলো মিশন শুরু হয়ে গেছে। মাসখানেক হল ম্যারেজ মনিটরিং অফিসও খোলা হয়েছে, কেউ বিয়ে করতে গেলে প্রথমে সেখানে পাত্রপাত্রী দুজনকে নগ্ন অবস্থায় পরীক্ষা করছে ডাক্তাররা, সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ত্রুটিহীন কিনা দেখা হচ্ছে, রক্তপরীক্ষা ও আরও অনেক টেস্টের পর দু—পক্ষের সব রেজাল্ট ঠিকঠাক এলে তবেই ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে বিয়ের। বিকলাঙ্গ, অসুস্থ কোনো শিশু নাকি জন্মাতে দেওয়া যাবে না।

ফ্রিৎজ ভেবেই রেখেছেন ফ্রেডরিকের কাছ থেকে শোনা এই ব্যাপারটা নিয়ে তিনি, হোক বেনামে, তবু লেখায় তুফান তুলবেন। কিন্তু সরকারি তরফে কিছু ঘোষণার আগে তো আর লিখতে পারেন না, আবার ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করতে গেলে ততদিনে হয়তো ওই ওষুধের প্রয়োগও শুরু হয়ে যাবে।

ওই সাইকোপ্যাথের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়।

কিন্তু ততদিন ফ্রিৎজ নিজেও কি বেঁচে থাকবেন?

সেদিন ফ্রেডরিকের কাছ থেকে সব শোনার পর প্রথমে ফ্রিৎজ দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন, তারপরেই ছুটেছিলেন বার্লিন লাইব্রেরিতে। ফ্রান্সিস গ্যালটন, তাঁর চিন্তাভাবনা, ইউজেনিক্স নিয়ে কাজ এসব পড়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ফ্রেডরিকের কথা গুরুত্ব বুঝতে পেরে ভয়ে দুশ্চিন্তায় এই ক—দিন রাতে প্রায় ঘুমোতেই পারেননি ফ্রিৎজ। ঘুমের মধ্যেও পাশে অঘোরে ঘুমোনো এমিলিয়াকে দেখে তাঁর গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেছে।

হিটলার চায় খাঁটি জার্মানদের নিয়ে বিশুদ্ধ রক্তের দেশ বানাতে, সেখানে তিনি নিজে জার্মান হলেও তাঁর স্ত্রী সোফি ইহুদি। এমিলিয়াদের মতো এইরকম হাইব্রিড জার্মানরা ক্রমশ ব্রাত্য হয়ে পড়বে সমাজে।

একদিকে একটা শ্রেণি কৃত্রিমভাবে অতিমানব হয়ে উঠবে, অন্যদিকে এমিলিয়ারা বছরের পর বছর ধরে শোষিত অত্যাচারিত হতে থাকবে।

ওর এই ছোট্ট ফুলের মতো মেয়েটা আদৌ বেঁচে থাকবে তো?

কী করে বন্ধ করা যায় এই সাংঘাতিক কাজটাকে?

এদিকে ফ্রেডরিক ব্যাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

হঠাৎ তাঁর মধ্যে যেন একটা বৈপ্লবিক চেতনা জেগে উঠল। তাঁর মনে হল, তিনি যেন আবার তাঁর অকালে—বন্ধ—হয়ে—যাওয়া ‘স্ট্রেট পাথ’ কাগজের এডিটর হয়ে উঠেছেন।

তিনি বললেন, ‘বেশ তো, তুমি যাও। যা যা দেখলে, সব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এসে রিপোর্ট করবে আমায়।’

ফ্রেডরিক মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল। এমিলিয়ার লাল হয়ে থাকা গাল দুটোকে আলতো করে টিপে আদর করল একটু। বাচ্চাটার গাল দুটো এতটাই নরম, একবার নড়িয়ে দিলে বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে সে—দুটো নড়তে থাকে। এই অবস্থাতেও সেই নড়া দেখে ফ্রেডরিক হেসে ফেলল।

যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েও ফিরে তাকাল সে, ‘স্যার, রাস্তায় রাস্তায় নতুন পোস্টারগুলো দেখেছেন? আমার ছোটোবোন, আমার গ্রামের বাড়িতে থাকে, জন্মে থেকেই পঙ্গু, হাঁটাচলা করতে পারে না, কথাও বলতে পারে না, কিন্ত ওর মনটা যে কত বড়ো জানেন না স্যার। আমি বাড়ি গেলেই আমাকে জড়িয়ে ধরে, চোখ দিয়ে জল পড়ে, কেউ কিছু খাবার দিয়ে গেলে খায় না, রেখে দেয় আমার জন্য।’ বলতে বলতে ফ্রেডরিকের গলাটা কেঁপে গেল, ‘হিটলার কি ওকেও মেরে ফেলবে স্যার? ও হাঁটতে পারে না, কথা বলতে পারে না বলে ওর বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই?’

ফ্রিৎজ কিছু বলতে পারলেন না। ফ্রেডরিকের বলার ধরনে তাঁর চোখে জল চলে এল।

ফ্রেডরিক আবার ধরা গলায় বলল, ‘ও কত সুন্দর ছবি আঁকে স্যার, আমরা সুস্থরাও পারি না। সেটার কোনো দাম নেই?’

ফ্রিৎজ এবারেও চুপ করে রইলেন। ফ্রেডরিককে আটকে লাভ নেই। ওর ভেতরের কষ্টটা যদি কান্না হয়ে বেরিয়ে একটু কমে, তবে বেরোক।

ফ্রেডরিক ফোঁপাচ্ছিল, ‘আমার বাড়ি যাওয়ার পথে একটা রেস্টুরেন্টে একটি লোক রোজ বেহালা বাজাত, আমি শুনতে শুনতে যেতাম। বেশ ক—দিন হল তাকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। কাল গিয়ে জিজ্ঞেস করে জানলাম লোকটা একদিন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, ও যে ইহুদি সেটা বুঝতে পেরে পুলিশ কোনো কারণ ছাড়াই ঘাড়ে গুলি করে মেরে ফেলেছে। ইহুদিদের মারাটা এখন ওদের কাছে ফুর্তির একটা নতুন সাবজেক্ট স্যার! যাকে যখন পারছে মেরে ফেলছে? মানুষের জীবনের কি কোনো দাম নেই?’

ফ্রিৎজ শক্ত করে ফ্রেডরিকের কাঁধটা চেপে ধরলেন, ‘কে বলবে ফ্রেডরিক? কোনো বিরোধী পার্টির অস্তিত্বই রাখেনি, কোনো ইউনিয়ন অবধি নেই। কে গলা তুলবে? আমার কাগজটাকেও তো শেষ করে দিল।’

ফ্রেডরিক একটু শান্ত হল, নিজেকে শান্ত করতে করতে কোটের হাতায় চোখের জল মুছল, তারপর অস্ফুটে বলল, ‘আসছি, স্যার!’

‘দাঁড়াও, ফ্রেডরিক!’ ফ্রিৎজ মুহূর্তের মধ্যে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। মিনিট কয়েক বাদে যখন ফিরে এলেন, তাঁর হাতে একটা গোল কালো টুপি, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড়ো সাইজের, একপাশ দিয়ে একটা সরু সুতোও ঝুলছে, ‘এটা নিয়ে যাও।’

ফেডরিক বলল, ‘আমার তো টুপি আছে, স্যার!’

ফ্রিৎজ উত্তর না দিয়ে টুপিটাকে সামনে নিয়ে এলেন, কালো মিশমিশে বর্ডার লাইনের আড়ালে লুকোনো একটা চেন ধরে টানতেই টুপির ওপরের গোলাকার অংশটা ফাঁক হয়ে খুলে গেল। ভেতর থেকে যেটা বের করলেন সেটা দেখে চমকে উঠল ফ্রেডরিক, ‘ক্যামেরা! এত ছোটো!’

ফ্রিৎজ হাসলেন।

‘স্ট্রেট পাথ’ যখন সবে চলতে শুরু করেছে, তখন মনে ছিল প্রচুর উত্তেজনা। কলমের ধারে হাতুড়ির ঘা দেবেন সমাজের প্রতিটা খারাপ সিস্টেমকে, জার্নালিজমকে নিয়ে যাবেন এক অন্য স্তরে, এটাই তখন ছিল স্বপ্ন। মানুষকে যুদ্ধ পরবর্তী ঠিক দিশা দেখাতে যেন কেউ বিভ্রান্ত না করে, সেটা তখন ছিল তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান।

গোপনে ছবি তোলার জন্য অনেক দাম দিয়ে এই ছোটো ক্যামেরাসুন্ধ টুপিটা তখন আমেরিকা থেকে আনিয়েছিলেন তিনি। জার্মানিতে সরকারি কাজে যেসব ক্যামেরা দেখা যায় সেগুলো সব তেপায়া স্ট্যান্ডের ওপর বসিয়ে কালো কাপড়ে ঢেকে ছবি তুলতে হয়, কিন্তু এর ক্যামেরাটা আয়তনে একটা ছোটো স্লাইস পাউরুটির প্যাকেটের থেকেও ছোটো।

এই টুপির আকারের কভারটাও অদ্ভুত, ছবি তোলার জন্য টুপিটা খোলারও দরকার নেই, ক্যামেরার লেন্সের সামনে ছোট্ট একটা ফুটো করা আছে টুপিটায়, টুপির একপাশে স্টাইলের জন্য লাগানো সুতোটা আসলে লিভার, সেটা ধরে টানলেই ভেতরের শাটারে চাপ পড়ে ফটো উঠে যাবে ওই ফুটোটার মধ্য দিয়ে। কালো মিশমিশে কাপড়ের এই টুপি মাথায় পরে কোথাও গেলে কেউ ধারণাই করতে পারবে না যে ওর মধ্যে একটা আস্ত ক্যামেরা লুকোনো আছে।

ফ্রেডরিক চমৎকৃত হয়ে গেল।

এ যে দুর্দান্ত জিনিস!

ফ্রিৎজ বললেন, ‘শোনো, আমাদের আর দেরি করা ঠিক হবে না। কোনো দল যখন গলা তোলার জন্য নেই, তখন আমরাই তুলব সাধারণ নাগরিক হিসেবে, তবু এইসব সর্বনাশ ঘটতে দেব না কিছুতেই। অনেক হয়েছে এই চুপ করে থাকা। আমরা জেনেশুনে আমাদের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ শেষ করে দিতে পারি না। আমি এখনই পুরো ব্যাপারটা নিয়ে লিখতে বসছি, লেখা শেষ করে আজকেই পাঠাব ইন্টারন্যাশনাল কাগজগুলোতে, কমিটিতে। সবাই জানুক। তুমি এই ক্যামেরাটা নিয়ে যাও। যদি দ্যাখো তেমন কোনো এভিডেন্স পাচ্ছ, ছবি তুলে এনো। আমি এই দেশের ভরসায় আর নেই, কিন্তু জার্মানিতে কী ঘটছে, বা কী ঘটতে চলেছে সব আমি জানাব সারা পৃথিবীকে। কোনো অন্যায় বছরের পর বছর চলে না, ওই হিটলারকেও একদিন এর শাস্তি পেতে হবে।’

ফ্রেডরিক চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘আপনাকে বাঁচতে দেবে না, স্যার!’

ফ্রিৎজ ক্যামেরাটা টুপির মধ্যে ঢুকিয়ে চেন আটকে ওর হাতে তুলে দিলেন, ‘মরলে মরব, সেই মরাটাও গর্বের হবে। আর আমাকে বাঁচতে না দিক, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তো বাঁচবে! কিন্তু এভাবে চললে তো আমরাও মরব, তারাও জন্মানোর আগেই মরবে!’

ওদের কথার মাঝে সোফি এসে দাঁড়িয়েছিলেন, স্ত্রী আর কন্যার দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ফ্রেডরিকের দিকে তাকালেন ফ্রিৎজ, ‘আমার স্ত্রী ইহুদি, কিন্তু ও আমার চেয়েও বেশি এই দেশকে ভালোবাসে। কিন্তু হিটলারের বক্তব্য কী? শুধু সোফি নয়, আমার মেয়ে এমিলিয়াও অশুদ্ধ? তোমাকে ওই ভিক্টর কী বলেছে ফ্রেডরিক, ইহুদি জাতিটাকেই হিটলার শেষ করে দেবে?’ ফ্রিৎজ উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন, ‘তার আগে আমি ওকে শেষ করে দেব।’

এমিলিয়া হঠাৎ ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠল।

সোফি স্বামীর এইরকম ভয়ার্ত মূর্তি কখনো দেখেননি আগে, ভয় পেয়ে তিনি বললেন, ‘তুমি শান্ত হও, ফ্রিৎজ!’

ফ্রিৎজ উত্তর না দিয়ে ফ্রেডরিকের চোখে চোখ রাখলেন, ‘তুমি সেদিন চলে যাওয়ার পর ইউজেনিক্স কী, আমি ভালো করে জেনেছি। যদি সত্যিই ওই ওষুধটা কাজ করে, তবে সারা পৃথিবীতে একদল সর্বশক্তিমান সর্বগুণসম্পন্ন অতিমানবের উদ্ভব হবে, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম অন্য দুর্বল জাতিগুলোকে শোষণ করে অত্যাচার করে চলবে। সেই মধ্যযুগের ক্রীতদাস প্রথা আবার ফিরে আসবে। একজন সুস্থ মানুষ হয়ে জেনেশুনে আমি আর চুপ করে থাকতে পারব না ফ্রেডরিক!’

ফ্রেডরিক চুপচাপ টুপিটা হাতে নিল। তার আর নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে না।

ফ্রিৎজ বললেন, ‘যুগে যুগে এরকম শয়তানের আবির্ভাব পৃথিবীতে ঘটেছে। মানুষই তাদের শেষ করেছে। শুভ বুদ্ধির জয় হবেই ফ্রেডরিক! আমি জানি, তোমাকে অর্ডার করার কোনো এক্তিয়ারই আমার নেই, তবু আজ আমি তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি যদি সত্যিই দেশকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে যেকোনো উপায়ে এই নারকীয় কাজগুলো বন্ধ করতে চেষ্টা কোরো।’

ফ্রেডরিক আবেগমথিত চোখে মাথা নাড়ল, তারপর অস্ফুটে বলল, ‘চেষ্টা নয়, আমি করবই স্যার! আমি বিকেলেই আসব আপনার কাছে। আপনি অপেক্ষা করবেন যেন!’ কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে, মুহূর্তে মিলিয়ে গেল হালকা—আলো—দেখা —দেওয়া বাইরের সদ্য ভোরে।

সোফি আর ফ্রিৎজ কয়েক মুহূর্ত যে রইলেন সেইদিকে।

ফ্রিৎজ স্ত্রীর হাতে হাত রাখলেন, ‘চিন্তা কোরো না, সোফি। জার্মানিতে এবার নতুন ভোর হবে, নতুন সূর্যের আলোয় আমরা আবার আগের মতো হয়ে উঠব, তুমি দেখে নিয়ো। আমাদের এমিলিয়া মাথা উঁচু করে বাঁচবে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *