১
দেওয়ালের যে কোণটা গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে ল্যাবের দরজায়, সেই কোণের ঠিক উলটো দিকে বিশাল চেহারার একটা লোক একই জায়গায় পায়চারি করতে করতে টহল দিচ্ছিল। অনেকটা যেন সরল দোলগতিতে। এপাশ থেকে ওকে দেখা না গেলেও দূরের ল্যাম্পপোস্টের আলোয় তৈরি হওয়া লম্বা ছায়াটায় ওকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।
ধীরে ধীরে সেই ছায়াটার দৈর্ঘ্য কাছে এলেই বাড়ছে। আবার দূরে সরে গেলে কমে যাচ্ছে।
একই লয়ে।
এপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কালো মুখোশ পরা লোকটা শেষ একবার ভালো করে সাজিয়ে নিল ছকটা। সে এসব কাজে পুরোপুরি পেশাদার, কালো রুমালটাকে পকেটে রাখা শিশির ভেতরের তরলে চপচপে করে ভিজিয়ে নিল। তারপর ছায়াটার দৈর্ঘ্য বাড়তে বাড়তে সবচেয়ে বড়ো হতেই শিকারি অজগরের মতো নিঃশব্দে ঘুরে গিয়ে বাঁ—হাত দিয়ে লোকটার গলাটা পেছন দিয়ে বেড়ির মতো আটকে ডান হাতে রুমালটা চেপে ধরল মুখে।
লোকটা অস্ফুটে একটা আওয়াজ করল, তারপর অত বড়ো শরীরটা সামান্য কেঁপে নিস্তেজ হয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
ধপ করে একটা শব্দ হল, একইসঙ্গে নিপুণ হাতে দেওয়ালের একটু উপরে রাখা ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরাটার উপর কালো রুমালটা দিয়ে পুরো স্ক্রিনটা মুড়ে দিল মুখোশ পরা লোকটা। ভাঙচুর সে কোনোকালেই পছন্দ করে না, তা ছাড়া অ্যালার্মও থাকতে পারে, ভাঙলেই হয়তো বেজে উঠবে।
একটা সাড়ে ছয় ইঞ্চির চকচকে ছুরি দিয়ে সে আড়াআড়ি চালিয়ে দিল অজ্ঞান হয়ে যাওয়া লোকটার গলায়।
সরু টাটকা রক্তের একটা ধারা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। মুখোশ পরা লোকটা বেশ তৃপ্ত ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ দেখল মুমূর্ষু মানুষটার আস্তে আস্তে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়াটা।
ওর হাতের কাজ এমনই। এতটাই পরিষ্কার, এতটাই নিখুঁত যে সেটাকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে ফেলা চলে, নিজের কাজে মুগ্ধ হয়ে ও নিজেকেই মনে মনে একবার তারিফ করে ফেলল। মুখোশের বাইরে বেরিয়ে থাকা বাদামী চোখদুটো যেন তৃপ্তিতে চকচক করে উঠলো।
তারপর ঠিক একটা কালো বিড়ালের মতোই সে নিঃসাড়ে ভেতরে ঢুকে গেল।
পেছন পেছন আরও একজন। তার মুখে অবশ্য কোনো মুখোশ জাতীয় কিছু নেই। তবে ক্যামেরা তো এখন ঢাকা।
* * *
এই ঘটনার প্রায় দু—ঘণ্টা পরে শহরের এক প্রধান রাজপথে একজন মানুষ দ্রুত পায়ে হাঁটছিল। ডান পায়ে বেশ চোট লেগেছে, জোরে হাঁটতে গিয়ে তাতে আরও লাগছে, তবু লোকটা থামছিল না।
আর মাত্র দশ মিনিট বাকি আছে এয়ারপোর্টের চেক ইন কাউন্টার বন্ধ হতে।
লোকটার নাম সিগফ্রেড।
এয়ারপোর্টের সামনে এসে সিগফ্রেড একটু অধৈর্য হয়ে পড়ল, বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তার গায়ে লেদারের জ্যাকেট থাকলেও মাথায় কোনো টুপি নেই, ফলে ধীরে ধীরে বরফের সাদা কুচোয় তার চুলগুলো ভিজে উঠছিল। মনে মনে এই কারণে একটু অসহিষ্ণু হয়ে পড়লেও নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে সে বেশ স্বস্তি পেল। পা দুটো ঢেকে রাখলে ঠান্ডাটা আর অতটা লাগে না, সেইজন্য হাঁটু অবধি বড়ো ফারে ফারে ঢাকা গামবুট পরেছে, কাজেই অতটা কষ্ট হচ্ছে না।
তবে আজ ঠান্ডাটা ভীষণ জাঁকিয়ে পড়েছে। নিউজ চ্যানেলের পূর্বাভাস অনুযায়ী আজ তুষারপাত তো হবেই, টেম্পারেচারও মাইনাসে চলে যাবে। যদিও মার্চ মাসের শেষাশেষি, এই সময় বরফ পড়াটা এখানে একটু অস্বাভাবিক, জানুয়ারি মাসের পর ঠান্ডাটা বেশ কমে যায় এদিকে।
কিন্তু আজ একটা ব্যতিক্রমী দিন।
এরকম ঘোষণায় তাই রাত আটটার মধ্যেই রাস্তাঘাট কিছুটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল।
শপিং মল, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরেও ঝাঁপ পড়ে গেছে। আর এখন রাত সাড়ে বারোটার সময় অবশেষে ঝিরিঝিরি বরফ পড়া শুরু হয়েছে।
এয়ারপোর্টের কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ার আগে সিগফ্রেড শেষবারের জন্য একবার পিছনে তাকাল, চোখ বুলিয়ে নিল চারদিকে। জনশূন্য বার্লিন শহর ঘন কুয়াশার মধ্যে কেমন হাইবারনেশনে থাকা সাপের মতো গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। লাইটপোস্টের আলোয় সেই জমাটবাঁধা কুয়াশাকে যেন আকাশের ধূমকেতুর মতো লাগছে অনেকটা। বিশাল বিশাল ডিজিটাল সাইনবোর্ডগুলো শুধু একটার পর একটা বিজ্ঞাপন দেখিয়ে নিজেদের ডিউটি করে চলেছে অবিরাম স্লাইড শোয়ে।
বার্লিন শহরের উত্তরদিকের এই টেগেল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট অন্য শহরের এয়ারপোর্টগুলোর মতো শহর থেকে খুব দূরে নয়, যাওয়া আসা বেশ সুবিধার, তাই এই এয়ারপোর্টটাকে সিগফ্রেড পছন্দই করে। বিশেষত এক নম্বর টার্মিনালের দুর্দান্ত আর্কিটেকচারাল ডিজাইনটা তো ওর দারুণ লাগে। একটা ষড়ভুজের আদলে পুরো ডিপারচার ক্যাম্পাসটা তৈরি করা হয়েছে, ঠিক যেন একটা বিশাল বেঞ্জিন।
ওর প্রিয় কেমিক্যাল কম্পাউন্ড বেঞ্জিনের সঙ্গে খুব মিল।
যদিও সুযোগসুবিধার দিক থেকে টেম্পলহফ এয়ারপোর্টকে কেউ টেক্কা দিতে পারবে না, কিন্তু সেটা তো এখন রাজনীতির ডামাডোলে দেশের সবচেয়ে বড়ো রিফিউজি ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে।
তাই এই টেগেল এয়ারপোর্টকেই মেনে নিতে হবে।
অন্তত কিছুদিনের জন্য।
বোর্ডিং পাস করে নিয়েই ও আর দাঁড়াল না, সিকিউরিটি চেক মিটিয়ে প্লেনে ওঠার করিডরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। সঙ্গে লাগেজ তেমন কিছুই নেই, একটা শুধু বড়ো পিঠের ব্যাগ। তবু সেটাকে ক্যারেজে দিয়ে দেবে, ওই বিশাল আয়তনের ব্যাগ কোলে করে নিয়ে প্লেনে বসে থাকতে বিরক্ত লাগে।
প্লেনে উঠে প্রথমেই ব্যাগ থেকে ফোন আর খুলে রাখা একটা সিম বের করে সিগফ্রেড ফোনটা চালু করল, ‘কাজ হয়ে গেছে। আসলটা পিটারকে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি প্লেনে উঠে গেছি। পৌঁছে কথা বলব।’ একটু থেমে ও বলল, ‘কিন্তু এখনও বুঝলাম না এত জায়গা থাকতে আমি লন্ডন কেন যাচ্ছি!’
ওপাশ থেকে গম্ভীর একটা গলা ভেসে এল, ‘বুঝলে তো তুমি আমার জায়গায় থাকতে, এরকম অপদার্থের মতো পরজীবী হয়ে জীবনটা কাটাতে হত না তোমায়। এইসব কথা ফোনে না বলে যেটা বলেছি সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করো।’
সিগফ্রেড দমে গেল। দোষটা ওরই, কেন যে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায়!
আরও দু—একটা দরকারি ফোন সেরে নিয়ে ও সিমটাকে খুলে ফেলে যত্ন করে রাখল পার্সে। ঝাড়া হাত পা হয়ে বসে জুতো—পরা পা দুটোকে সামনের দিকে এলিয়ে যতদূর সম্ভব আধশোয়া হয়ে ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করল।
আগে এইসব অপমানজনক কথায় খুব কষ্ট হত, রাগে অভিমানে নিজের মনেই নিজেকে আঘাত করত। আজকাল আর কিচ্ছু মনে হয় না।
যার জন্য পৃথিবীতে এসেছে, সে যখন জেনেশুনেই ওর প্রাণভোমরা অন্য একজনের হাতে তুলে দিয়ে গেছে, ও আর কী করবে?
আজ সারাদিন অনেক খাটুনি গেছে, তবু শেষ পর্যন্ত সাকসেসফুল হয়েছে, এটাই যা তৃপ্তির বিষয়। ও তো এখন অন্যের হাতের পুতুল ছাড়া কিছুই নয়, তবু বেঁচে থাকতে তো হবে, তার জন্য এই সাফল্য পাওয়াটা ওর ভীষণ দরকার ছিল।
আচ্ছা লোকটা সত্যিই মরে গেছে তো?
ভাবতেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল ওর। এইসব খুন—টুন করা ওর একদম পোষায় না, মনটাও খারাপ হয়ে যায়। তবু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে পালটাতেই হয়, নিজের অস্তিত্বের তাগিদে।
তবে ও নিজে পরীক্ষা করে দেখেনি, অপেক্ষা করছিল দূরে। পিটার আগে গিয়ে লোকটাকে অজ্ঞান করে ছুরি চালিয়েছিল লোকটার গলায়। এসব পিটারের বাঁ হাতের খেল সেটা ও জানে।
পিটারের কাজ মিটে যেতে ও পেছন পেছন গিয়েছিল। লোকটার গলা ফাঁক করা বীভৎস দেহটার দিকে ও ভুলেও তাকায়নি। ওইসব দেখলে মুহূর্তে নার্ভ বিকল হয়ে যেত ওর।
জিনিসটা খুঁজতে বেশি সময় লাগেনি। মিনিট দশেকের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ওরা দু—জন। পাওনাগণ্ডা আগেই মেটানো ছিল, পিটার রওনা দিয়েছিল অন্যদিকে, আর ও এদিকে।
হঠাৎ যেন ওর মনে হল ওর ঘাড়ের কাছে কে গরম নিশ্বাস ফেলল।
একমুহূর্তের জন্য চমকে উঠে প্লেনের ভেতরটা সিগফ্রেড দেখে নিল, সবই মনের ভুল। পেছনের সিটে একটা বাচ্চা মেয়ে বসে রয়েছে।
আসলে মাথায় চিন্তা কিলবিল করছে অজস্র, তবু কালকে সারাদিন যদি একটু রিল্যাক্স করা যায়। একটা চাপা শ্বাস নিয়ে ও মোবাইলে খবরের চ্যানেল খুলল। লাইভ নিউজ নয়, একটু ডকুমেন্টারি গোছের কিছু দেখবে।
ওর প্রায় কবরে চলে যাওয়া ইতিহাসবিদ হওয়ার শখটা এইভাবেই সিগফ্রেড মাঝে মাঝে মেটায়। ডকুমেন্টারি ভিডিয়োগুলো দেখতে দেখতে ও—ও চলে যায় সেই জায়গায়, রোমাঞ্চিত হতে থাকে নতুনের আবিষ্কারে।
এই জীবনে তো আর কিছু হল না। তবে আজও ও পায়ে শিকল বাঁধা ক্রীতদাসের মত স্বপ্ন দেখে, একদিন এই কলের পুতুলের মত জীবন শেষ হবে ওর। নিজের মতো বাঁচবে একদিন!