নরক সংকেত – ২৭

২৭

প্রিয়ম কী করবে বুঝতে পারল না, নিজের অপরাধ লাঘব করার জন্যই হোক, কিংবা বউকে মানানোর জন্য, আরেক কাপ কফি তৈরি করে রুদ্রকে দিল, ‘এই নাও, কফি খাও।’

রুদ্র সেই তখন থেকে যে গম্ভীর হয়ে আছে তো আছেই, কী যে ভাবছে কে জানে!

প্রিয়ম একটু ইতস্তত করে বলল, ‘বলছি, এই কম্পার্টমেন্টের যে অ্যাটেন্ডেন্ট রয়েছে, তাকে গিয়ে একবার বলব কি এই চুরির ব্যাপারে?’

রুদ্র দু—দিকে মাথা নেড়ে বাইরের দিকে তাকাল। ভেতরে বসে বোঝার উপায় নেই কত জোরে ছুটছে ট্রেনটা। এখন একটা পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে কেটে তৈরি করা টানেলের মধ্যে চলছে বলে অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না।

ও কিছুক্ষণ চুপ করে একটা ছোটো নিশ্বাস ফেলল, ‘ছাড়ো। যা হবার তা হয়েছে। বার্লিনে পৌঁছে একটুও সময় নষ্ট করলে চলবে না। আসতে আর কতক্ষণ দেরি?’

প্রিয়ম উঠে বাইরে বেরিয়ে গেল। করিডরে ঘুরে এসে বলল,’দশ মিনিট দেখাচ্ছে।’

রুদ্র বলল, ‘চলো, বাইরে গিয়ে দাঁড়াই, ভালো লাগছে না আর একভাবে বসে থাকতে!’

প্রিয়ম বলল, ‘এগুলোকে এরকমভাবে ফেলে রেখে যাওয়াটা ঠিক হবে?’

রুদ্র কটমট করে তাকাল ওর দিকে, চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে বলে একটা কথা আছে, প্রিয়ম তার চেয়েও এক কাঠি ওপরে। যখন দরকার ছিল তখন ড্যাং ড্যাং করে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল, আর এখন ও চিন্তা করছে এগুলো রেখে যাবে কি না।

প্রিয়ম পরমুহূর্তেই বুঝতে পেরে আর ঘাঁটাল না।

ট্রেনটা আস্তে আস্তে গতি কমাতে শুরু করেছে এর মধ্যেই। বাইরের করিডরে এসে দূরের ডিজিটাল বোর্ডের দিকে চোখ পড়তেই ওরা দেখল ওদিকে বেশ ভিড়। প্রায় আট দশ জন দাঁড়িয়ে রয়েছে ওই ছোটো জায়গাটার মধ্যেই, রুদ্র বলল, ‘কী ব্যাপার বলো তো? ট্রেন খুব লেট চলছে সেটাই দেখাচ্ছে নাকি বোর্ডে?’

ইতিমধ্যে ট্রেন থেমে গেল মাঝপথে। বাইরে তাকালেই বোঝা যাচ্ছে বার্লিন শহরে ঢুকে গেছে ট্রেন, আর কিছুক্ষণের মধ্যে প্ল্যাটফর্মে ঢোকার কথা। সবুজ বনজঙ্গল সরে গিয়ে দু—পাশে বড়ো বড়ো বাড়ি রাস্তাঘাট জেগে উঠছে ধীরে ধীরে।

ইন্ডিয়ার মতো এখানেও কি সিগনাল না পেলে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়? রুদ্র মনে মনে ভাবল।

অদ্ভুতভাবে পাশের সমান্তরাল ট্র্যাকগুলোতে একে একে ট্রেন এসে দাঁড়িয়ে পড়ছে। এভাবে সার দিয়ে দিয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগে সব ট্রেনকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে কেন?

ওরা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াতেই দেখল, জার্মান ভাষায় কিছু একটা বার বার ডিসপ্লে হচ্ছে বোর্ডে।

ইংরেজিতেও দেখাবে নিশ্চয়ই, কিন্তু সেটুকু আর ওদের তর সইল না। একজন বোর্ডটা দেখে এদিকে আসছিল, প্রিয়ম তাকে প্রশ্নটা করতে না করতেই সে এক ঝলক তাকিয়ে, ‘নো ইংলিশ!’ বলে হন্তদন্ত হয়ে ঠেলেঠুলে চলে গেল ওদের পেছনের দিকে।

উত্তরটা দিয়ে দিলেন ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রমহিলা, ‘এখন অনেকক্ষণ ওয়েট করতে হবে স্টেশনে ট্রেন ঢোকার জন্য, সেটাই ডিসপ্লে করছে বোর্ডে।’

‘কেন?’ প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল।

‘যে ট্রেনই ঢুকছে, প্রতিটা প্যাসেঞ্জারকে ভালো করে চেক করে নামানো হচ্ছে তো, তাই সময় লাগছে। আসলে আমাকে রিসিভ করার জন্য একজন ওয়েট করছেন ওখানে, তিনিই ফোনে জানালেন। পুরো স্টেশন ক্যাম্পাসটা কড়া নিরাপত্তায় মুড়ে ফেলা হয়েছে। গোটা প্ল্যাটফর্মটায় থিক থিক করছে নাকি পুলিশ। ঢোকার সময়েও যাত্রীদের একে একে তল্লাশি করে তবে ট্রেনে উঠতে দেওয়া হচ্ছে।’ ভদ্রমহিলা ব্যাখ্যা করলেন।

প্রিয়ম জিজ্ঞেস করল, ‘এরকমই হয়? নাকি আজ স্পেশাল কিছু আছে?’

ভদ্রমহিলা এবার মাথা নাড়লেন, ‘কয়েকদিন আগে কোলনের সামনে ব্লাস্ট হয়েছে না? সেই থেকে দেশে ঢোকা বেরোনোর সময় খুব নজরদারি চলছে।’

রুদ্র বলল, ‘কোলনটা কোথায়? এই বার্লিনেই?’

ভদ্রমহিলা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন, ‘জার্মানিতে ফার্স্ট টাইম?’

রুদ্র অল্প হেসে বলল, ‘হ্যাঁ। আমরা ইন্ডিয়ান। এই প্রথম জার্মানিতে আসছি। আপনি কি এখানকারই বাসিন্দা?’

ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশের ওপরেই হবে, কিন্তু স্টাইলিশ ট্রাউজার আর ফুলহাতা গোলাপি শার্টে এককালে যে সুন্দরী ছিলেন, তা বোঝা যায়। নিখুঁত আইলাইনার পরা চোখ বন্ধ করে মিষ্টি হাসলেন, ‘একদম। খাঁটি জার্মান! এখানে কি ঘুরতে?’

রুদ্র বলল, ‘হ্যাঁ।’

ভদ্রমহিলা হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘আমি ইভা। এখানকার একটা কলেজে সোশ্যাল স্টাডিজ পড়াই। বার্লিনেই থাকি। ইংল্যান্ড গেছিলাম একটা সেমিনারে।’

রুদ্রও হাত মিলিয়ে বলল, ‘আমি রুদ্রাণী। ইন্ডিয়া থেকে আসছি।’ প্রিয়মের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার হ্যাজব্যান্ড, ও লন্ডনে আইটি—তে আছে, আমি ওর কাছে কয়েকদিনের জন্য ঘুরতে এসেছিলাম। সেখান থেকেই জার্মানি ঘুরতে আসা।’

ইভা বললেন, ‘যাহ, ঘোরাটা কেমন হবে জানি না এইসব ডামাডোলে, তবু বেস্ট উইশেজ! পাসপোর্ট সবসময় ক্যারি করবেন।’

প্রিয়ম বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’

ইভা মৃদু হেসে রুদ্রর দিকে ফিরলেন, ‘কোলন বার্লিনে নয়। এখান থেকে প্রায় ছ—ঘণ্টা দূরের একটা শহর। সেখানে ইউরোপের সবচেয়ে বড়ো ক্যাথিড্রাল চার্চ আছে, কোলন ক্যাথিড্রাল, আপনারা তো যাবেন নিশ্চয়ই। সবাই জার্মানি এলে ওটা দেখতে যায়। সেইখানেই ব্লাস্ট হয়েছিল কয়েকদিন আগে, দু—জন ইমিগ্র্যান্ট মারা গেছে, সিরিয়ার।’

রুদ্র চমকে উঠল। আবার সেই সিরিয়ার ইমিগ্র্যান্ট?

ভদ্রমহিলার কথা শেষ হল না, ভেস্টিবিউল দিয়ে পাশের কামরা থেকে কালো ইউনিফর্ম আর কালো টুপিতে একজন পুলিশ অফিসার এদিকে এগিয়ে এলেন। ওদের দিকে তাকাতে তাকাতে কথা বলতে বলতে পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন পরের কামরায়।

রুদ্র আর প্রিয়ম মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। এখানকার পুলিশদের চেহারাই এমন, এতটাই লম্বা চওড়া আর সুঠাম চেহারার, দেখলে আপনা থেকেই একটা সম্ভ্রম চলে আসে। তার ওপর ইউনিফর্মটাও খুব সুন্দর।

এখানেও রিফিউজি মারা গেছে? ইংল্যান্ডেও তো পরপর দু—বার অ্যাটাক হল, ওরাই মারা গিয়েছিল! নিজের মনেই চিন্তা করে যাচ্ছিল রুদ্র, কিছু একটা হিসেব করছিল নিজের মনে।

ট্রেন ছাড়ল প্রায় কুড়ি মিনিট বাদে। তারপর সিকিউরিটি চেকিং মিটতে আরও আধ ঘণ্টা। এগজিট গেটের আগে একটা লম্বা লাইন তৈরি হয়ে গেছে এর মধ্যেই। এয়ারপোর্টের কায়দায় প্রত্যেকের লাগেজ তো চেক হচ্ছেই, সঙ্গে বডিও চেক করা চলছে। বিশাল বিশাল দুটো কুকুর ঘোরাঘুরি করছে, তাদের গলার চেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে দুজন কালো উর্দিধারী পুলিশ, তারা ফোনে কথা বলছে ঘন ঘন।

ইভা বলে মহিলাটি ওদের সঙ্গেই আসছিলেন। তাঁর দুটি বিশাল লাগেজ ট্রলি থেকে নামাতে সাহায্য করে প্রিয়ম বলল, ‘লন্ডনেও এই রিফিউজিদের রেসিডেন্সিতে কয়েকদিন আগে পরপর হামলা হয়েছে।’

ইভার চোখে—মুখে একটা চিন্তার ছায়া ফুটে উঠল, ‘হ্যাঁ, পড়ছিলাম পেপারে। ফ্রান্সে আর গ্রিসেও হয়েছে। আসলে ওদিক থেকে এই যে হাজার হাজার ইমিগ্র্যান্টরা আসছে, সেটা সম্ভবত অনেকেই পছন্দ করছে না।’

প্রিয়ম বলল, ‘কেন? কাউকে বিপদের সময় আশ্রয় দিতে এত সমস্যা কেন?’

ইভা হাসলেন, হাসলে ওঁর গালে একটা ছোট্ট টোল পড়ে, ‘মাইগ্রেশনের সাইড এফেক্টটা তো অস্বীকার করা যায় না। দেশের নাগরিকদের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে সরকার ওদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান দেবে, তারপর তারা আস্তে আস্তে দেশের এমপ্লয়মেন্ট, রিসোর্স সবেতেই থাবা বসাবে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। দেশের জনসংখ্যা বাড়বে। ফলে অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী জি ডি পি কমবে, খাবারদাবারে টান পড়বে, পপুলেশন বাড়তে থাকলে যা যা সমস্যা তৈরি হয়, সবই শুরু হবে। শেষমেষ যারা দেশের আসল নাগরিক তাদের প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। এটাই তো মাইগ্রেশনের সেই আদি সমস্যা, যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।’

রুদ্র এতক্ষণ চুপ করে ছিল, এখন বলল, ‘কেন এদের কি পাকাপাকিভাবে এখানকার নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে নাকি? আমি তো পড়ছিলাম সাময়িক শেল্টার দেওয়া হচ্ছে?’

‘ঠিকই শুনেছেন। সেটাও কেউ বা কারা মেনে নিতে পারছে না। ফেসবুক বা অনেক মাইক্রোব্লগিং সাইটেই এই নিয়ে অনেক বিরূপ মন্তব্য পড়ছি। এই যে ধরুন টেম্পলহফ এয়ারপোর্টটা। ওটা ছিল আমাদের দেশের একসময়ের সবচেয়ে সক্রিয় এয়ারপোর্ট, বার্লিন শহরেরই দক্ষিণ দিকে। প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী যে কুড়িটা বছর জার্মানিতে শয়তানের রাজত্ব চলেছিল, সেই সময় এই এয়ারপোর্টটাই ছিল সবচেয়ে অ্যাক্টিভ। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী। আগে পুরো কম্পাউন্ডটা গভর্নমেন্টের তরফ থেকে একটা পার্ক করে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কিছুদিন আগে রিফিউজি ক্যাম্প করে দেওয়া হয়েছে গোটা ক্যাম্পাসটা। মিডল ইস্ট থেকে আসা হাজার হাজার শরণার্থীদের থাকার জায়গা দেওয়া হচ্ছে সেখানে। এখন, এইরকম একটা ঐতিহাসিক জায়গাটা রিফিউজিদের ক্যাম্প হয়ে নষ্ট হয়ে যাক, সেটা তো অনেকেই নাও চাইতে পারে, না!’ ইভা রুদ্রর দিকে সমর্থনের ভঙ্গিতে তাকালেন।

রুদ্র মাথা নাড়ল। ভদ্রমহিলা ভুল কিছু বলছেন না।

ইভা বলে চললেন, ‘আসলে সবাই এখন এতটাই আত্মকেন্দ্রিক, সবাই নিজের ক্ষমতা দেখাতে আর নিজের ক্ষমতা দেখাতে আর নিজের সুখটুকু দেখতে ব্যস্ত। আর এখন সব দেশের কাছেই এত শক্তিধর সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে, যুদ্ধ লাগলে সব নিমেষে শেষ হয়ে যাবে।’

প্রিয়ম বলল, ‘ঠিকই বলেছেন। ওই যে আইনস্টাইন বলেছিলেন না, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কী অস্ত্র ব্যবহার করা হবে বলতে পারব না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ পাথর আর লাঠি দিয়েই লড়া হবে, কারণ সভ্যতা তার আগেই ধ্বংস হয়ে যাবে, মানুষ আবার আদি যুগে ফিরে যাবে।

ইভা বললেন, ‘একদম! দিন দিন মানুষ যা নৃশংস হয়ে উঠছে! খুব ভয় হয় ভবিষ্যতের কথা ভেবে।’

স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসে ইভা হাসিমুখে হাত নাড়লেন, ‘আপনারা ভালো করে ঘুরুন। বার্লিন অসাধারণ সুন্দর শহর। ব্র্যান্ডেনবার্গ গেট, পারগ্যামন মিউজিয়াম এগুলো অবশ্যই দেখবেন। পুরো বার্লিনেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অসংখ্য ইতিহাস ছড়িয়ে আছে। হলোকাস্ট মেমোরিয়ালও যাবেন যেন।’

ইভা বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যেতেই প্রিয়ম বলল, ‘এই হলোকাস্ট নামটা কোথায় শুনেছি বলো তো? চেনা চেনা লাগছে কেমন?’

রুদ্র কী যেন ভাবছিল সেই থেকে, প্রিয়ম আরও একবার খোঁচাতে অন্যমনস্কভাবে বলল, ‘আরে, কাল রাতেই তো বললাম। হিটলার লক্ষ লক্ষ ইহুদিদের মাস মার্ডার করেছিল। এখন সেই স্মৃতির উদ্দেশে ওই হলোকাস্ট মেমোরিয়াল তৈরি করা হয়েছে।’

প্রিয়ম শুনে স্বগতোক্তি করল, ‘ওহ, তার মানে আমাদের জালিয়ানওয়ালাবাগ টাইপের।’ রুদ্রর মাথা নাড়া দেখে বলল, ‘মহিলা বেশ মিশুকে, বলো? জার্মানরা সাধারণত খুব গোমড়া টাইপ হয়, অচেনা লোকের সঙ্গে এত কথা বলেই না। ইনি এক্সেপশনাল। যাই হোক, আমরা তো বার্লিন পৌঁছে গেলাম অ্যাট লাস্ট! এবার কী করবে? হোটেল না ক্যাসপার ফটোগ্রাফি?’

রুদ্র বলল, ‘আচ্ছা, তোমাদের ওই যে জায়গা দুটোয় কয়েকদিন আগে ব্লাস্ট আর মার্ডার হয়েছিল, সেই জায়গা দুটোর কী নাম যেন?’

প্রিয়ম বলল, ‘ওই তো, কিংস্টন আর ইসলিংটন। কেন?’

রুদ্র উত্তর না দিয়ে ফোনে জায়গাজুলো দিয়ে সার্চ করল, তারপর বিড়বিড় করে কী হিসেব করতে লাগল।

প্রিয়ম আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। কাল সকালে শেষ ফ্রেশ হয়েছে ও, ‘কী ভাবছ বলো তো? আগে চলো হোটেলেই যাই, গিয়ে ফ্রেশ হই, তারপর না হয়…!’

প্রিয়মের মুখের কথা শেষ হল না, রুদ্র হঠাৎ মুখটা তুলে প্রিয়মের দিকে সাদা চোখে তাকাল, ‘আজ উনিশ তারিখ তো!’

রুদ্র বলল, ‘তার মানে কাল কুড়ি তারিখ!’ বলেই উদ্ভ্রান্ত মুখে দৌড়ে গেল স্টেশনের মধ্যে।

‘কী মুশকিল! আজ উনিশ হলে কাল তো কুড়ি হবেই, কিন্তু তুমি ছুটছ কোথায়!’ হতচকিত প্রিয়ম পেছন পেছন দৌড়ে গিয়ে দেখল, রুদ্র খুব উত্তেজিতভাবে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে একটা ন্যাড়া মাথার পুলিশকে, হাত—মুখ নেড়ে বকে যাচ্ছে অনর্গল।

প্রিয়ম কাছে যেতেই শুনতে পেল এই পুলিশ অফিসারটাও মাথা দোলাচ্ছে, ‘নো ইংলিশ!’

রুদ্র অধৈর্যভাবে চিৎকার করছিল, ‘বম্ব! ব্লাস্ট! এনি ইংলিশ স্পিকিং পার্সন হিয়ার?’

পুলিশ অফিসারটা এবার থমকে গেল, বম্ব আর ব্লাস্ট, এই দুটো ইংরেজি শব্দ সবাই প্রায় জানে। লোকটা একটুক্ষণ দেখল রুদ্রকে ভালো করে, তারপর দৌড়ে গেল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক সিনিয়র ইনস্পেকটরের কাছে। গিয়ে কিছু একটা বলতেই ওই সিনিয়র ভদ্রলোক এগিয়ে আসতে থাকলেন ওদের দিকে।

প্রিয়ম রুদ্রর দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকাল, ‘কী করছ বলো তো তুমি? আবার সেই পুলিশের ঝামেলায় জড়াচ্ছ?’

রুদ্র এবার প্রিয়মের দুটো কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, ‘প্রিয়ম, খুব শিগগিরই বিশাল বড়ো একটা ব্লাস্ট হতে চলেছে। যে করে হোক সেটা আটকাতে হবে।’

প্রিয়ম বলল, ‘ব্লাস্ট! কোথায়?’

ততক্ষণে ওই বয়স্ক ইনস্পেকটর এসে পড়েছেন ওদের কাছে, রুদ্রর দিকে তাকিয়ে পরিস্কার ইংরেজিতে তিনি বললেন, ‘এনি প্রবলেম ম্যাডাম?’

রুদ্র এবার যেন হাতে চাঁদ পেল, ঝড়ের গতিতে বলতে লাগল, ‘স্যার, যেকোনো মুহূর্তে একটা বিশাল ব্লাস্ট হতে পারে।’

ইনস্পেকটরটি কেমন সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন রুদ্রর দিকে, ‘কোথায়?’

রুদ্র বলল, ‘আমাকে আপনাদের অফিসে নিয়ে চলুন, আমি সব বুঝিয়ে বলছি। একটুও দেরি করবেন না, ইটস ভেরি আর্জেন্ট!’

ইনস্পেকটর এবার প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার স্ত্রী?’

প্রিয়ম ওপর নীচে মাথা নাড়ল।

ইনস্পেকটর আবার বললেন, ‘ইজ শি ওকে?’

রুদ্র এইবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনি প্লিজ হায়ার অথরিটির সঙ্গে কথা বলুন, কেন সময় নষ্ট করছেন?’

ইনস্পেকটর ভদ্রলোক আর দাঁড়ালেন না, মাথা নেড়ে চলে যেতে লাগলেন। ততক্ষণে আশেপাশে লোকজন ওদের দিকে তাকানো শুরু করেছে।

রুদ্র প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে বলল, ‘আরে! এ চলে যাচ্ছে কেন?’

প্রিয়ম এইবার বেশ অসন্তুষ্টভাবে বলল, ‘তোমার মাথায় গণ্ডগোল আছে ভাবছে, তাই চলে যাচ্ছে। দিব্যি ঠিকঠাক অবস্থা, কোথাও কোনো ব্লাস্টের চিহ্ন নেই, আর তুমি এইসব বলে যাচ্ছ। তোমাকে আগেও একবার বললাম, ফরেনার হয়ে এখানে এইসব টার্ম ইউজ কোরো না, বেকার হ্যারাস করবে এরা।’

রুদ্র এইবার প্রিয়মের দিকে আগুন চোখে তাকাল, তারপর ছুটে গেল ইনস্পেকটরটার দিকে, ‘স্যার, আমার কথা শুনুন একবার! ক্যাসপার ফটোগ্রাফি থেকে চুরি যাওয়া ফটোগুলো আর মার্ডারটার খোঁজ জানি আমি!’

ইনস্পেকটর এইবার ফিরে তাকালেন এইদিকে, চোখ দুটো বড়ো বড়ো হয়ে গেছে, রুদ্রর দিকে ভ্রূ কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেন, তারপর প্রিয়মের আপাদমস্তক দেখে অদ্ভুত উচ্চারণে বললেন, ‘রু—ড্রা—নি?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *