১. হিমেল হাওয়া

মাউসট্রাপ – আগাথা ক্রিস্টি 

হিমেল হাওয়া দেহের হাড় কাঁপাচ্ছে। চারদিকে তখন নেমে এসেছে সন্ধ্যার আঁধার, আকাশের বুকে তখন ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা পেঁজা বরফ। তার ফলেই চারদিকে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে।

এবার দেখা গেল কালো ওভারকোট পরা লোকটিকে। মাফলারটা গলার ওপর দিয়ে থুতনিরও এক অংশ ঢাকা দেওয়া। চোখের কোণ পর্যন্ত টানা কালো টুপি। কার্লভার স্ট্রীট ধরেই পায়ে পায়ে এগিয়ে লোকটি চুয়াত্তর নম্বর বাড়ির সামনে এসে থামল। বন্ধ দরজা সংলগ্ন কলিংবেলের লাল বোতামটি হাত বাড়িয়ে টিপে দিল। দূরে কোথায় একটা অস্বস্তিকর ক্রিরিং…ক্রিরিং শব্দ বাতাসে শোনা গেল। কান পেতে শোনা গেল সেই আওয়াজ।

শ্ৰীমতী ক্যাসির দুহাতই তখন কাজে জোড়া, অথচ বেলের দাবি না মানলেই নয়। ক্যাসি আপন মনে গজগজ করে বলতে থাকে, জাহান্নামে যাক ঘন্টি। সারা জীবনটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে। দরজা খুলে বাইরে উঁকি মারল।

দরজা খুলতেই শোনা গেল খসখসে ও মৃদু কণ্ঠস্বর। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে লোকটা যেন একটা পটে আঁকা ছবি। মিসেস লিয়ন…?

ক্যাসি কাটছাঁট উত্তর দিল, তিন তলায় পাবেন। তার মনের ঝাল এখনো মেটেনি। সে আবার বলল–এই সোজা সিঁড়ি। আপনার আসবার কথা কি তার আগে থেকে জানা আছে?

কোনো কথা না বলে আগন্তুক শুধু ঘাড় ঘোরালো একবার ডাইনে, তারপর বাঁয়ে।

ক্যাসি আবার বলল তাহলে এই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে চলে যান। দরজায় নক করলেই তার সাড়া পাবেন। মলিন কার্পেট পাতা সিঁড়ি বেয়ে অপরিচিত আগন্তুক যখন ওপরে উঠে গেল তখন পেছনে থেকে তার দিকে তাকিয়ে ছিল ক্যাসি। পরে অবশ্য ক্যাসি স্বীকার করেছিল– প্রথম দর্শনে আগন্তুককে দেখে তার একটু কেমন কেমন ঠেকছিল ঠিকই, তবে ও ভেবেছিল হয়তো ঠান্ডা লাগার জন্যেই গলা বসে গেছে আগন্তুকের। সেইজন্যেই কণ্ঠস্বর এত মৃদু আর খসখসে। তাছাড়া আবহাওয়া এমন ছিল যাতে এই ধরনের ঠান্ডা লাগা কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। সিঁড়ির বাঁক নেবার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু নরম সুরে শিস দিতে শুরু করে ছিল আগন্তুক। অনেক দিনের পুরনো ছেলে ভোলানো ছড়ার সুরই ধ্বনিত হলো তার শিসের মাধ্যমে। তিনটে ইঁদুর অন্ধ, ডাহা তিনটে ইঁদুর অন্ধ।

মলি ডেভিস গেটের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন লাগানো ঝকমকে সাইন বোর্ডটার দিকে চোখ তুলে তাকালো।

.

মঙ্কসওয়েল ম্যানর অতিথিশালা

মলি প্রসন্ন খুশিখুশি ভঙ্গিতে মাথা দোলালো। হ্যাঁ, এতক্ষণে কিছুটা পেশাদারী ভাব ফুটে উঠলো; সকলেই স্বীকার করবে সে কথা। তবে অতিথি শব্দের মাঝের অক্ষরটা একটু যেন বড় হয়ে গেছে আকারে। ম্যানরের শেষ অংশটুকুও কেমন যেন ঘেঁষাঘেঁষি। তাহলে মোটের উপর খুব ভালোই দেখাচ্ছে সাইন বোর্ডটা। জিল সত্যিই বেশ ভাল কাজ করেছে। সব ব্যাপারেই জিল বেশ চালাক চতুর। আর তাছাড়া কত রকমের কাজই যে ও করতে পারে। প্রতিদিনই মলি যেন নতুন করে আবিষ্কার করছে তার এই স্বামীটিকে। সত্যিই তার পতিদেবতাটি অসংখ্য গুনের আধার। আর নিজ সম্বন্ধে সে এত কম কথা বলে জিল যে তার প্রতিটি গুণ নিদর্শনগুলিকে খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। নৌ-বাহিনীর লোকেরা খুবই কাজের অন্ততঃ স্বামী হিসাবে– এমন একটা প্রবাদ সে শুনে আসছে বহুদিন ধরেই, এখন সে এই কথাটা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করলো।

অবশ্য তারা যে নতুন ঝুঁকি নিতে চলেছে তাতে জিলের মত এমন একজন সর্বগুণসম্পন্ন লোকের একান্ত প্রয়োজন। কারণ হোটেল চালাবার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা জিল এবং তার মধ্যে নেই। এ বিষয়ে তারা একেবারেই অজ্ঞ। তবে এর মধ্যে একধরনের মজাও আছে। এবং বর্তমান গৃহ-সমস্যা সমাধানেরও একটা ভূমিকা এর মধ্যে আছে।

মলির মাথায় এই প্রথম একটা অভিনব পরিকল্পনার উদ্ভব এল। বেমক্কা একদিন যখন তার অশীতিপর বৃদ্ধা পিসি ক্যাথারিন মারা গেলেন এবং পিসির অ্যাটর্নি তাকে খবর পাঠালেন যে বৃদ্ধা তার একমাত্র আদুরে ভাইঝিকে তার প্রাসাদের মত বিশাল মঙ্কসওয়েল ম্যানরটা দিয়ে গেছেন তখন স্বাভাবিকভাবেই এই দম্পতি ভেবেছিল সেটাকে বিক্রি করে দেবে। ঠাট্টার সুরে তখন জিল বলেছিল, ওঃ সে এক বিরাট প্রাসাদ বললেই চলে। সাবেকী আমলের আসবাবপত্র সেখানে ঠাসা, তার ওপর বাড়ির চারদিকে কি বিরাট বাগান। তবে সে বাগানের হাল যা হয়েছে তা চোখে দেখা যায় না। আগাছায় চারদিকে ভর্তি কারণ মালীদের যা আকাল। গতযুদ্ধের পর থেকে অবশিষ্ট আছে শুধু একজন মাত্র বুড়ো মালী। তার একার পক্ষে বাগানের ওপর নজর দেওয়া দুষ্কর।

সেইজন্য দুজনের সংসারে ব্যবহারের উপযোগী সামান্য কিছু হালকা ধাঁচের আসবাবপত্র সরিয়ে রেখে পুরো বাড়িটাই তারা বিক্রি করে দিতে মনস্থ করল। সেই টাকা থেকে অনায়াসে একটা ছোটখাটো ফ্ল্যাটও কিনে নেওয়া যাবে। কিন্তু অসুবিধা দেখা দিল দুটো।

প্রথমতঃ বাজারে তাদের মনোমত কোনো ছোট ফ্ল্যাটবাড়ী খুঁজে পাওয়া গেল না। আর দ্বিতীয়তঃ বুড়ি পিসির ভিক্টোরিয়ান যুগের আসবাবপত্রগুলো সমস্তই এত বেশি ভারী আর জবরজং তাদের নাড়াচাড়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। তার ওপর সন্দেহ আছে সেগুলো লোকেরা কিনবে বিনা।

মলি বললো, তাহলে। সে বলল –আমার মনে হয় আসবাবপত্র যেখানে যা আছে সেই সমেত পুরো বাড়িটাই তো আমরা বিক্রি করে দিতে পারি, এতে খদ্দেরের অভাব হবে না।

সলিসিটার তাদের এ বিষয়ে ভরসা দিয়েছিলেন। সবকিছুই আজকালকার দিনে বিক্রি হয়। এমনকি হোটেল বা অতিথিশালার জন্যেও কেউ হয়তো বাড়িটা কিনতে চাইবে। তখন ফার্নিচারগুলোও দরকার হবে। তার ওপর স্বগীয়া মিস মরি যুদ্ধের আগে বিস্তারিত ভাবে বাড়িটা মেরামত করে নিয়েছিলেন। তিনি আধুনিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরও নানা রকম ব্যবস্থা করেছিলেন। সমস্ত বাড়িটা এখন খুব ভালো অবস্থাতেই আছে।

তারপরেই মলির মাথায় মতলবটা খেলে গেল। সে বলল, জিল, আমরা নিজেরাই তো একটা অতিথিশালা চালু করতে পারি। জিল প্রথমে উড়িয়েই দিয়েছিলো মলির এই আষাঢ়ে ধ্যান-ধারণা। মলি কিন্তু নাছোড়বান্দা। কেন প্রথম প্রথম আমরা না হয় দু-চার জন অতিথি নেবো। একেবারে গোড়াতেই বেশি বাড়াবাড়ি করবার কোনো দরকার নেই, বাড়িটা এমনিতেই বেশ ঝকঝকে তকতকে। প্রতিটি শয়নকক্ষে ঠান্ডা এবং গরম দুরকম জলের বন্দোবস্ত আছে, ঘর গরম রাখবার জন্যে বড় বড় চুল্লি, তাছাড়া রান্নাঘরে গ্যাসের ব্যবস্থা খুব ভালো, বাগানের একপাশে হাঁস-মুরগীও পুষতে পারি আমরা, বাগানটায় নানা ধরনের তরিতরকারিও লাগানো যায়।

এতসব ঝামেলা ঝক্কি সামলাবেটা কে? চাকর-বাকর পাওয়া যে কি দুঃসাধ্য ব্যাপার সে তো তুমি জানোই।

হাঁ সে কথা ঠিক। কাজ আমাদের কিছু করতে হবে বটে তবে আমরা নিজেরাও যদি বাড়ি কিনে বাস করি সেখানেও তো সেই একই কাজের ঝামেলা এসে পড়বে। অবশ্য এক্ষেত্রে কাজের চাপ একটু বাড়বে এই যা। সেটা আর এমন কি?

ব্যবসাটা পুরোদমে চালু হবার পর দু-একজন ঝি-দাসীও আমরা নিশ্চয় পেয়ে যাবো। তার ওপর মনে করো আমরা যদি প্রথমে পাঁচজন অতিথি নিয়ে হোটেল চালু করি এবং তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সপ্তায় সাত গিনি করে পাই…মাঝপথে কথা থামিয়ে মলি মনে মনে তার কল্পিত ব্যবসার লাভ-লোকসানের অঙ্ক নিয়ে মেতে উঠলো। তাছাড়া আর একটা কথা আছে, মলি আবার বোঝাতে চেষ্টা করলো জিলকে, বাড়িটাতো আমাদের থাকবে। আসবাবপত্রে সুসজ্জিত এমন একটা বাড়ি থাকাও কম কথা নয়। আমাদের দুজনের বাসের উপযোগী কোনো ছোট বাসাবাড়ি দু-এক বছরেও খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। মলির এই শেষের যুক্তিটা জিল উড়িয়ে দিতে পারলো না।

বিয়েটা তার খুব তাড়াতাড়িই সেরে নিয়েছিলো কিন্তু তারপর থেকে দুজনে ঘর বেঁধে বাস করবার মতো তেমন কোনো অখণ্ড অবসর খুঁজে পায়নি। এখন একটা ছোট সংসার পাতবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ওরা দুজন। তার মনে প্রথম সূত্রপাত এই বৃহৎ প্রচেষ্টার স্থানীয় সংবাদপত্রে এবং লন্ডন টাইমস-এ বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। তার উত্তর নানারকম ভাবে এল।

আজকেই উদ্বোধন হবে, অতিথিশালার প্রথম অতিথিটিরও আসবার কথা আজ। সাত সকালেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে জিল। সেনাবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু পুরোন তারের জাল নিলামে বিক্রি হবে, তাই যদি সুবিধা দামে পাওয়া যায় এই ছিল তার আশা। নিলাম ঘরটি এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। শহরের অপর প্রান্তে। মলি জানিয়ে রেখেছিল ও একবার পায়ে পায়ে গ্রামের দিকে যাবে। শেষবারের মত প্রয়োজন আছে কিছু কেনাকাটার।

ওদের কাছে এখন প্রতিকূল আবহাওয়া বইছে। গত দুদিন ধরে যা ঠান্ডা পড়ছে তা বলার নয়। তার সঙ্গে আবার নতুন উপদ্রব যুক্ত হল–তুষারপাত। মেঠো পথ ধরে মলি দ্রুত পা চালালো। তার একরাশ উজ্জ্বল কোকড়া চুলের ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র তুষার জড়িয়ে আছে। বাহারি ওয়াটারপ্রুফের খাঁজে খাঁজেও পেঁজা তুলোর মত বরফের কুচি পড়ে আছে। আবহাওয়া সম্বন্ধে রীতিমত বেতারে আশঙ্কাজনক ভবিষ্যৎবাণী করা হয়েছে। শীগগিরই নাকি প্রবল বেগে পড়তে থাকবে বরফ।

জলের পাইপগুলোর মধ্যে যদি বরফ জমে যায় তাহলে তো প্রচণ্ড সর্বনাশ। মলি ক্ষণে ক্ষণে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। প্রারম্ভিক সূচনাতেই এধরনের বিপর্যয় অশুভ নিদর্শনের সূচনা। হাতের ঘড়িটা একপলক দেখ নিল সে। বৈকালিক চায়ের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। তার একবার মনে পড়ল জিল কি ইতিমধ্যে ফিরে এসেছে। তাকে না দেখতে পেয়ে জিলের একটু ভাবনা চিন্তা হচ্ছে।

সে ভাবছিল জিল যদি প্রশ্ন করে কি করব বল, কতগুলো দরকারী জিনষ ভুলে যাবার জন্য আবার আমাকে গ্রামের দিকে ছুটতে হল। তাহলে মলি ভেবেই রেখেছিল কি দেবে সে এর উত্তর, সে ভাবছিল উত্তরটা শুনে হয়ত জিল একটু ঠাট্টা করবে। বলবে, তোমার সেই টিনের খাবার তো?

টিনের খাবার নিয়ে প্রায় সময়ই জিল ঠাট্টা তামাশা করে। এ বিষয়ে বাতিক আছে বলা চলে মলির। রাশিকৃত খাবারের প্যাকেট ঘরের মধ্যে জমা করা হয়। কখন কোনোটার দরকার পড়বে তার কি ঠিক আছে। তাছাড়া দুজনের ঘর গৃহস্থালির পক্ষে টিনের ভালো খাবার তো আছেই। বিশেষ ঝামেলা পোহাতে হয় না রান্নাবান্নার ব্যাপারে।

মলি অপ্রসন্ন অবস্থায় আকাশের দিকে একবার তাকালো। সত্যিই পরিস্থিতিটা খুব ঘোরালো মনে হচ্ছে তার।

বাড়িতে এসে দেখল, এখনো জিল পৌঁছয়নি। আগের মতই ঘর এখন ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে, রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল মলি। যদিও করবার কিছুই ছিল না, তবু বাসনগুলোকে একবার নেড়েচেড়ে গুছিয়ে রেখে দিল। তারপর উঠে গেল চওড়া সিঁড়ি বেয়ে। সমস্ত শোবার ঘরগুলো এখন নিখুঁতভাবে সাজানো গোছানো। দক্ষিণ দিকের বড় ঘরটা মিসেস বয়েলের জন্যে নির্দিষ্ট আছে। ঘরের মধ্যে একটা পালঙ্ক আছে মেহগনি কাঠের। পালঙ্কের চারকোণে মশারি টাঙাবার জন্য ছাতা লাগানো। আকাশী রঙের বাহারি কাগজে মোড়া ঘরটায় মেজর মেটকাফ থাকবেন বলেছেন। পশ্চিম দিকের বড় খোলামেলা ঘরটা হল মিঃ রেনের। সমস্ত ঘরগুলোই এখন খুব ছিমছাম পরিপাটি দেখায়। তার ওপর বৃদ্ধা ক্যাথারিনের যে এত লিনেনের স্টক ছিল তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকবে মলি। এখন সেগুলো খুব কাজে লাগছে।

হাত দিয়ে বিছানার চাদরটা মলি ঝেড়ে দেয়। তারপর আবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল। ইতিমধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। বাড়িটা যেন তার কাছে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। খুব বেশি নির্জন ঘরটা। এখান থেকে নিকটবর্তী গ্রামের দূরত্ব দু-মাইল মত। শহরে যেতে গেলেও এই দু-মাইল পেরিয়েই যেতে হয়। অর্থাৎ দু-মাইলের মধ্যে কোনো লোকালয়ের চিহ্ন নেই।

এর আগেও সে এই বাড়ির মধ্যে অনেকবার একা একা কাটিয়েছে। কিন্তু আজকের এই নির্জনতা তার কাছে বড় অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে। স্নায়ুর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে তার।

কাঁচের জানালার ওপর বরফ এসে পড়ায় এক ধরনের মৃদু খসখসে শব্দ হচ্ছে। একনাগাড়ে কেউ যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। অস্বস্তিতে মলি কেঁপে উঠল, যদি জিল কোনো কারণে পৌঁছতে না পারে। এই ভয় তার মনের কোণে উঁকি মারে। সে ভাবতে থাকে তুষার পাতের ফলে যদি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায় তাহলে? যদি সত্যিই তাকে এই নির্জন বাড়িতে একা একা থাকতে হয়? ঈশ্বর না করুন, যদি প্রকৃতই সেই রকম অবস্থা হয় তবে কদিনের জন্যে যে তাকে এখানে বন্দী হয়ে থাকতে হবে তার কি কোনো অনিশ্চয়তা আছে? একদিনের মধ্যে যে রাস্তাঘাট পরিষ্কার হবে, এমন আস্থাও সে রাখতে পারছে না।

মলি একবার রান্নাঘরটার মধ্যে চোখ বোলাল। আকারে প্রকারে বেশ বড় ঘরটা। বিরাট চেহারার একজন পাঁচক না হলে এ ঘর মানায় না। শক্ত কেকের সঙ্গে দুধবিহীন কালো চা পান করতে করতে মনে মনে এই কথাটাই ভাবছিল। আর পাঁচকের একজন সাহায্যকারীও চাই, সে হবে একজন বয়স্কা। সেই সঙ্গে একজন ছিপছিপে চেহারার তরুণী ঝিও চাই।

তাছাড়া রান্নাঘর পরিষ্কারের জন্য আরো একজন বুড়ি ঝি-এরও একান্ত প্রয়োজন, যে বাবুদের খাওয়া দাওয়ার সময় দূরে দাঁড়িয়ে ভয়ের চোখে লক্ষ্য করবে সবকিছু। কিন্তু এখন মলি সম্পূর্ণ একা। এবং তাকে যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে সেটাও তার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত নতুন এই মুহূর্তে তার সমস্ত জীবনটাই ঠেকছে অস্বাভাবিক ও অবাস্তব। এমন কি জিলও এখন যেন স্বাভাবিক নয়। মলি যেন শুধু একটা নির্দিষ্ট ভূমিকায় অভিনয় করে যাচ্ছে, নিছকই অভিনয়।

জানলার ওপাশে কার যেন কালো ছায়া পড়ল; মলি চমকে লাফিয়ে উঠলো। তুষারের ওপর দিয়ে একজন অপরিচিত আগন্তুক দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে। সদর দরজায় মলি শুনতে পেল কে যেন ঠকঠক শব্দ করছে। অপরিচিত আগন্তুক এখন উন্মুক্ত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বর্ষাতির ওপর থেকে হিমের কুচিগুলো ঝেড়ে ফেলছে। তারপর সে বাড়ির মধ্যে বেশ ধীরে সুস্থে ঢুকে পড়ল।

মলির পলকের মধ্যে দৃষ্টি বিভ্রম হল। আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। ওঃ জিল। তুমি ফিরে এসেছে, জেনে বা দেখে আমার খুব ভালো লাগছে।

আজকের আবহাওয়াটা এত জঘন্য যে, আমি ঠান্ডায় প্রায়ই জমে গেছি বললেই চলে।

জিল ভেতরে ঢুকে সানবাঁধানো মেঝের ওপর পা ঝাড়ল জোরে জোরে। হাত দিয়ে হাতটা ঘষে শরীরের মধ্যে উষ্ণতা সঞ্চারে ব্যর্থ প্রয়াস করল সে।

সহজাত অভ্যাস বলেই মলি জিলের ছুঁড়ে দেওয়া কোটটা হ্যাঁঙ্গারে টাঙ্গিয়ে রাখলো। কোটের পকেট থেকে একগাদা জিনিষপত্র বের করে টেবিলের ওপর গুছিয়ে রাখল। একটা মাফলার, ঘরের কাগজ, এক বাণ্ডিল গুলিসুতো আর সকালের ডাকে আসা কয়েকটা চিঠি পত্র। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে গ্যাসের উনুনে কেটলি করে জল চাপালো।

মলি প্রশ্ন করল, তুমি কি তারের জাল পেয়েছ? সামান্য একটা জিনিষ কিনতে গিয়ে যেন একটা যুগ কাটিয়ে ফিরে এলে।

না যে ধরনের জালের কথা ভেবেছিলাম এগুলো সেরকম নয়, এতে আমাদের কাজ হবে না, খবর পেয়ে অন্য আরেক জায়গাতেও খোঁজ করলাম। কিন্তু সেগুলোও দেখতে একই রকম। এদিকে তুমি এতক্ষণ কি করছিলে? ইতিমধ্যে নিশ্চয় কেউ আসেনি?–জিল প্রশ্ন করল মলিকে।

মিসেস বয়েল সকালের আগে এসে পৌঁছচ্ছেন না।

 মেজর মেটকাফ আর মিঃ রেনের তো আজকেই আসার কথা ছিল।

মেজর ভদ্রলোক চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, তিনিও কাল সকালের আগে আসছেন না।

তাহলে তো ডিনারের জন্য কেবল মিঃ রেনই অবশিষ্ট রইলেন। তিনি কেমন লোক হবেন বলে তোমার ধারণা? আমার তো মনে হয় ভদ্রলোক কেমন গম্ভীর প্রকৃতির অবসরপ্রাপ্ত সরকারী কর্মচারী।

উত্তর এল, না না, আমার মনে হয় তিনি একজন শিল্পী।

ঠাট্টার সুরে জিল বলল। তোমার আশঙ্কাই যদি সত্য হয় তবে তার কাছ থেকে আমরা একসপ্তার অগ্রিম নিয়ে রাখবো।

মলি বলল, তুমি যে কি বোকার মত কথা বল। আমাদের এত ভাবনার কি আছে? তিনি তো শুধু হাতে এখানে থাকছেন না। মালপত্র নিশ্চয় কিছু সঙ্গে থাকবে। যদি সত্যিই বিল তিনি মেটাতে না পারেন তবে আমরা তার মাল আটকে রাখব।

কিন্তু ধর যদি দেখা যায় যে তার মালপত্র কেবল পুরনো খবরের কাগজে মোড়া বড় বড় পাথরের টুকরো তাহলে? জিল বলল। তারপর আবার বলতে শুরু করে আসল সমস্যাটা হচ্ছে এই ব্যবসার নাড়িনক্ষত্র আমরা কিছু জানি না। কোনো অভিজ্ঞতাই আমাদের নেই। আরেকটা কথা, আমরা যে সম্পূর্ণ অজ্ঞ, সেটাও যেন আমাদের অতিথিরা বুঝতে না পারেন।

সন্দেহের সুরে মলি বলল, মিসেস বয়েলের কাছে কিন্তু ব্যাপারটা গোপন রাখা খুবই কষ্টকর হবে। কেননা তিনি হচ্ছেন সেই প্রকৃতির মহিলা…।

জলি বলল, কি করে তুমি টের পেলে? এখনও তো চোখে দেখনি তুমি তাকে।

মলি কোনো উত্তর দিল না। টেবিলের ওপর পরিষ্কার কাগজ পেতে তার ওপর কতকগুলো মশলা দেওয়া ছানার কেক সাজিয়ে রাখলো। তারপর একটা পাথরের সাহায্য পিষতে লাগলো। সেগুলো দেখে–এগুলো আমার কি কাজে লাগবে? বিস্ময়ের সুরে প্রশ্ন করলো জিল।

গরম টোস্টের ওপর এই কেকের গুঁড়োগুলো পুরু করে লাগিয়ে দেওয়া হবে। ঠোঁটের ফাঁকে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে জবাব দিল মলি।

প্রথমে নরম রুটির টুকরোর সঙ্গে সেদ্ধ আলুর টুকরো মিশিয়ে স্যাণ্ডউইচ তৈরি করবো।

তারপর গরম স্যাণ্ডউইচের ওপর এই কেকের গুঁড়ো গুলো পুরু করে মাখালে এক নতুন ধরনের খাবার তৈরি হবে।

সত্যিই তুমি একজন পাকা রাঁধুনী। প্রশংসার সুরে বলে উঠলো জিল।

এ বিষয়ে আমার মাঝে মাঝে সন্দেহ জাগে।

যে-কোনো একটা দিকে মন দিলে আমি সেটা খুব ভালোই করতে পারি।

কিন্তু অনেকগুলো ঝামেলা এক সঙ্গে ঘাড়ে এসে চাপলে তখনই দুচোখে অন্ধকার দেখতে হয়।

বিশেষ করে ব্রেকফাস্টের জোগান দেওয়া তো আমার কাছে খুবই পরিশ্রম সাধ্য ব্যাপার।

কেন?

 কারণ তখন দশভূজা রূপ না ধরলে সমস্ত কিছু সামাল দেওয়া যায় না।

একই সঙ্গে ডিম সেদ্ধ, শুয়োরের মাংস, গরম দুধ, কফি, টোস্ট সবই দরকার।

 দুধটা হয়তো উথলে উঠলো, কিংবা টোস্টটা বোধহয় পুড়ে গেলো

আবার মাংসটা যেন বেশি ভাজা না হয় বা ডিমটাও সেদ্ধ হতে হতে শক্ত না হয়ে যায় সেদিকেও সজাগ লক্ষ্য রাখতে হবে।

শিকারী বেড়ালের মতো ক্ষিপ্ত এবং তৎপর না হলে এঁটে ওঠা দুঃসাধ্য।

তাহলে একই সঙ্গে তোমার দশভূজা রূপ আর বিড়ালমূর্তি দেখে নয়ন সার্থক করবার জন্য কাল সারাদিনই আমি অলক্ষ্যে থেকে রান্নাঘরের আশেপাশে ঘোরাফেরা করব।

মলি বলল, জল ফোঁটানোর সময় হয়েছে, আমি কি জিনিষপত্র লাইব্রেরী ঘরে নিয়ে যাবো? খবর তো এক্ষুনি হবে। টি. ভি. তে খবর শুনতে শুনতেই না হয় আজকের চা খাওয়া পর্বটা শেষ করবো দুজনে।

জলি বলল, তুমি আজকাল যে পরিমাণে রান্নাঘরে কাটাতে শুরু করেছ তাতে ওখানেও একটা টিভির বন্দোবস্ত করলে মন্দ হয় না।

মলি বলল, তা ঠিকই বলেছো এই রান্নাঘরটা আমি খুব ভালোবাসি। এতবড় রান্নাঘর কোথায় পাবো? সমস্ত কিছুর জন্যেই কেমন সুন্দর পরিপাটি ব্যবস্থা আছে এবং আর একটা ব্যাপার এই ঘরটা বেশ বড়সড়ও আছে। এত বড় একটা রান্নাঘরের মধ্যে আমি ঢুকলে বেশ একটা স্বচ্ছলতা অনুভব করি। মনে হয় জীবনে যেন কোনো কিছুরই আর অভাব নেই। তবে এখনো পর্যন্ত নিজে হাতে যে রান্না করতে হয়নি তা ভাগ্য অনেক ভালো।

জলি বলল–আমার ধারণা এতবড় রান্নাঘর ব্যবহার করলে রেশনে এক বছরে যে জ্বালানি বরাদ্দ করা হয়েছিল তা এখানে একদিনেই শেষ হয়ে যাবে।

মলি বলল, সে তো হবেই। আপনি আর মলির সংসারের জন্যে তো আর এ রান্নাঘর তৈরি। হয়নি। এখানে যজ্ঞ বাড়ির রান্না বাঁধা যাবে। সেইসব দিনগুলোর কথা একবার ভাবো তো। এখানে ঘরে ঘরে ভেড়ার রাঙ আর গোরুর নিতম্ব ঝলসানো হচ্ছে। বিরাট কাঁচের পাত্রে সুরক্ষিত রাখা আছে চিনির আরকে জরানো ঘরে তৈরি সুস্বাদু স্ট্রবেরির আচার। ভিক্টোরিয়ান যুগের লোকেরা কি সুখেই না কাটিয়ে গেছে তাদের দিনগুলো। দোতলায় আসবাবপত্রগুলো দেখিয়ে দিও, সমস্ত কেমন মজবুত আর আরামদায়ক। ব্যবহার করা যায় সেগুলো কত সহজেই। আর সেই সঙ্গে আমাদের ভাড়া করা ফ্ল্যাটের কথাও চিন্তা কর।

আসবাবপত্রগুলোও কত হাল্কা। ঠিক মতো ব্যবহারের উপযোগীও নয়। কোনো ড্রয়ার যদি একবার বন্ধ করা যায় তাহলে হাজার টানাটানিতেও তা আর খোলা যাবে না। জানলাটা খুলতে গেলে দেখা যায় যে তার গায়ে ছিটকিনির ব্যবস্থা নেই।

জিল বাধিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে বলল, হ্যাঁ, তা অবশ্য ঠিক। সময় সময় খুবই বিরক্তি ধরিয়ে দেয়।

চল, খবর শুনতে যাই। বোধ হয় খবর শুরু হয়ে গেছে।

প্রাত্যহিক খবরে আবহাওয়া সম্বন্ধে উদ্বেগজনক ভবিষ্যদ্বাণী করা হল। বৈদেশিক পররাষ্ট্র নীতিতে আগের মতোই অনড় অচল অবস্থা। পার্লামেন্টের ওপর দিয়ে বির্তকের ঝড় বইছে বাত-প্রতিবাদিমূলক। প্যাডিংটন অঞ্চলে কার্লভার স্ট্রীটে সংঘটিত হয়েছে একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ড। শিকার হয়েছেন এই দুর্ভাগ্য এক মহিলা।…

মলির কণ্ঠে ক্ষুণ্ণ অভিযোগের সুর বেরিয়ে এল, আঃ! হাত বাড়িয়ে অফ করে দিল সুইচটা। কেবল অভাব আর অভিযোগের একঘেয়ে ক্লান্তিকর ধারাবিবরণী। আমি কিন্তু ওদের কম জ্বালানি কাজে লাগান আবেদনে আর কোনো কর্ণপাত করবো না। এই কনকনে ঠান্ডায় ওরা কি আমাদের জমে যেতে অনুরোধ জানাচ্ছে। তবে আমাদের যে মস্ত একটা বড় ভুল হয়েছে মানতেই হবে সেটা প্রথম সূত্রপাত হিসেবে শীতকালটা বেছে নেওয়া উচিত হয়নি। বসন্তকালে আরম্ভ হলে ভালো হত। মলি একটু চুপ করে আবার ভিন্ন সুরে বলল, যে মেয়েটা খুন হয়েছে। ভাবতেই অবাক লাগে তার কথাটা।

কে? মিসেস লিয়ন?

ওর নাম কি লিয়ন? কে যে মেয়েটাকে খুন করল আর তার উদ্দেশ্যই বা কি ছিল?

হয়ত ওর ঘরের মেঝেয় অনেক ধন সম্পত্তি লুকনো ছিল।

আচ্ছা, রেডিওতে বললো যে ঘটনাস্থলের আশে পাশে ওই সময় এক জন সন্দেহভাজন লোককে ঘোরাফেরা করতে দেখা গেছে, তার সন্ধান পাবার চেষ্টা করছে পুলিস। তার মানে কি, ওই লোকটাই মেয়েটাকে খুন করছে?

তাই হয়তো হবে তবে নিশ্চিত কোনো প্রমাণ পাবার আগে এই রকম ভদ্র ভাষাই প্রয়োগ করা বিধেয়। ঝনঝনিয়ে কলিংবেল বেজে উঠলো।

সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো দুজনে। সদর দরজার বেল বাজছে। জিল বললে, এখন একজন মুনীর অনুপ্রবেশ! রহস্যময় ভঙ্গিতে শেষ করলো কথাটা।

হ্যাঁ, এটা কোনো নাটকের দৃশ্য হলে সেই রকমই ঘটতো!

 মন্তব্য করলো মলি।

তাড়াতাড়ি চল, বোধহয় মিঃ রেন এসেছেন। এখন দেখা যাক কার কথা শেষ পর্যন্ত সত্যি হয়। তোমার না আমার।

এক ঝলক তুষারের সঙ্গে সঙ্গে মিঃ রেন ভেতরে ঢুকলেন।

লাইব্রেরীর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে মলি তাকে স্পষ্ট করে দেখতে পেলো না। শুধু বাইরের রুপোলি তুষারের পটভুমিকায় একজন অচেনা ব্যক্তির কালো অবয়বটুকুই সে প্রত্যক্ষ করলো।

সভ্য মানুষের পোশাক-আশাক সর্বদাই কেমন একই রকমের হয়।

মনে মনে চিন্তা করলো মলি।

কালো ওভার কোট, মাথায় ধুসর রঙের টুপি। গলায় জড়ানো পশমের মাফলার।

 মিঃ রেন ভেতরে প্রবেশের পর জিল আবার সদর দরজাটা বন্ধ করে দিল।

পোশাক পরিচ্ছদের ওপর থেকে ব্যস্ত হাতে তুষার ঝাড়তে লাগলেন রেন।

হাতে ধরা স্যুটকেসটার ওপর পুরু হয়ে তুষার জমে আছে। সেগুলোও ঝেড়ে ঝেড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। সেই সঙ্গে বকে চললেন এক নাগাড়ে। তার গলার স্বর কিছুটা সরু ও তীক্ষ্ণ। দূর থেকে শুনলে মনে হয় কেউ যেন ঝগড়া করছে।

 আলোয় আসতে দেখা গেল ভদ্রলোক এখনো যুবক।

রোদে পোড়া তামাটে চুল। ছোট ছোট চোখে জ্বলজ্বলে অশান্ত দৃষ্টি।

কি ভয়াবহ, কি সাংঘাতিক আবহাওয়া! অসুখী কণ্ঠে বিড়বিড় করলেন তিনি। শীতকালীন ইংলণ্ডের এমন চরম দপ আর কখনো দেখা যায়নি।

মনে হয় যেন ভিকেন্সের সে বিখ্যাত ক্রিস্টমাসের বর্ণনাকে ছাপিয়ে গেছে। বাইরে দাঁড়িয়ে এর ধকল সামলানো সহজ কথা নয়।

আপনারাও নিশ্চয় তা স্বীকার করবেন? আমাকে ওয়ে থেকে এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসতে হয়েছে। আপনিই কি মিসেস ডেভিস?

বাঃ–খুবই চমৎকার!

দ্রুত হাত বাড়িয়ে মলির সঙ্গে করমর্দন করলেন তিনি।

আমি কিন্তু মনে মনে আপনাকে যেভাবে কল্পনা করেছিলাম বাস্তবের সঙ্গে কোনো মিল নেই তার। ভেবেছিলাম ভারত প্রত্যাগত সেনাবাহিনীর কোনো অধিনায়কের বিধবা স্ত্রী বা ওই জাতীয় কেউ হবেন। আচার ব্যবহারও একেবারে খাঁটি মেমসাহেবের মত কড়া আর রাশভারী। পান থেকে চুন খসলেই মুস্কিল। কিন্তু এখন আপনাকে দেখে খুব আনন্দ হচ্ছে আমার। কেমন একটা স্বর্গীয় মনোরম পরিবেশ মনে হচ্ছে। আপনি কি মোমের তৈরি রংবেরঙের ফুল দিয়ে সাজিয়ে রেখেছেন ঘরদোর। অথবা স্বর্গের পাখিদের খাঁচায় ভরে বাগানে রেখে দিয়েছেন? যদিও তার প্রয়োজন ছিল না, কারণ এমনিতেই আমার জায়গাটা খুব ভালো লেগেছে। আমার ধারণা ছিল এটা হয়তো ভিক্টোরিয়ান যুগের কোনো জরাজীর্ণ সাবেকী প্রাসাদ। কড়ি-বরগা জানলা সব খুলে খুলে পড়ে যায়। কিন্তু ভেতরে পা দিয়ে আমার ধারণা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। বাড়িটার অবস্থা তো বেশ ভালোই, উপরন্তু হাল আমলের যাবতীয় সুখ সুবিধেরও ব্যবস্থা আছে এখানে। আচ্ছা শোবার ঘরে নিশ্চয় বনেদী আমলের মেহগনি কাঠের পালঙ্ক পাতা আছে। — যার গায়ে নানা রকমের ফুল-পাতা লতাপাতার ছবি থাকে আঁকা?

একটু ফাঁক পেয়ে মলি বলল, সত্যি কথা বলতে কি আমাদের অতিথিদের জন্য বিলাসবহুল মেহগনি খাটের বন্দোবস্ত করে রেখে দিই।

বিস্ময় মেশানো সুরে তিনি বলে উঠলেন–তাই নাকি? কি আশ্চর্য! দয়া করে একবার দেখাবেন আমায়?

ভদ্রলোক এত ব্যগ্রস্বরে কথাটা বলে উঠল যে মলি কিছুটা লজ্জা পেয়ে গেল। ইতিমধ্যে দরজার হাতল ঘুরিয়ে ডাইনিং হলের মধ্যে মিঃ রেন পা দিয়েছেন।

নিজের হাতে তিনি সুইচ টিপে আলো জ্বালালেন। মলি তার পেছন পেছন চলল। পিছনে ফিরে দেখল জিল বিরক্তি মুখে বসে আছে।

মিঃ রেন ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগল ঘরের আসবাবপত্রগুলো। অবশেষে ঈষৎ অভিযোগের সুরে সে মলিকে বলল–কিন্তু বনেদী ধাঁচের বড়সড় ডাইনিং টেবিল তো দেখতে পাচ্ছি না। তার বদলে আধুনিক ফ্যাশানের এই ছোট টেবিল পাতলেন কেন?

নিরাসক্ত সুরে মলি জবাব দিল, আমাদের মনে হল, আজকালকার লোকেরা এই ধরনের ডাইনিং টেবিলই বেশি পছন্দ করে।

রেন ডাইনে-বাঁয়ে ঘাড় দুলিয়ে বলল, তা অবশ্য ঠিক! আমি আমার নিজের স্বপ্নেই বিভোর। শুধুমাত্র মেহগনির টেবিল থাকলেই চলে না, টেবিলের চারপাশের বনেদী সম্ভ্রান্ত পরিবারের জমকালো উপস্থিতিরও একটা প্রয়োজন। বিরাট একটা চেয়ার জুড়ে পরিবারের কর্তা বসে থাকবেন। তার গালে সাদা দাড়ি। লম্বা চওড়া চেহারার মানুষ হবেন তিনি। পাশের চেয়ারে মূর্তিমতী করুণার প্রতীক থাকবেন তার স্ত্রী। তাদের আশেপাশে তাদের দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে। গম্ভীর মুখের একজন পরিচারিকাও সেখানে থাকা আবশ্যক। পরিবারের অন্যান্য দাসীরাও আশেপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে। এইরকম পরিবেশের মাঝখানেই মেহগনি কাঠের ডাইনিং টেবিল শোভা পায়।…

রেনের বক্তৃতার মাঝখানে জিল গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, আমি আপনার স্যুটকেসটা ওপরে নিয়ে যাচ্ছি। সিঁড়ি দিয়ে উঠে পশ্চিম দিকের বড় ঘরটাই ঠিক করা হয়েছে আপনার জন্যে।

মলিও মাথা নেড়ে বলল : হ্যাঁ, তাই ভালো।

স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে জিল সিঁড়ি বেয়ে পরে উঠে গেল। ততক্ষণে রেন আবার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন হল ছেড়ে। রেন বলল–আচ্ছা খাটের চারপাশে নিশ্চয় মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে, আর মশারিটাও নিশ্চয় বাহারি ধরনের? মশারির মাথায় সুতো দিয়ে নিশ্চয় ফুলের নকশা করা।

ওপরে উঠতে উঠতে জিল জবাব দিল–না, না, ওসব কিছুই করা নেই।

 জিল চলে যাবার পর মিঃ রেন বলে, আমার বিশ্বাস, আপনার স্বামীটি আমায় খুব একটা ভালো নজরে দেখেন না। উনি আগে কি করতেন? ও নিশ্চয় নৌবাহিনীর লোক।

ছোট্ট করে মলি জবাব দিল–হ্যাঁ।

মিঃ রেন বলেন, আমি ঠিকই আন্দাজ করেছি তাহলে। স্থলবাহিনী বা বিমানবাহিনীর লোকেদের চেয়ে স্বভাবতই ওদের সহনশীলতা কিছু কম থাকে।… আচ্ছা কতদিন হলো আপনাদের বিয়ে হয়েছে? আপনি কি আপনার স্বামীকে গভীরভাবে ভালোবাসেন?

মলি বলল চলুন আপনাকে ঘরটা দেখিয়ে দিই, আপনি নিশ্চয় ঘরটা দেখবার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছেন।

মিঃ রেন বললেন–হ্যাঁ, একটু কৌতূহল তো আছেই। কিন্তু এই প্রশ্নটার জবাব পেতেও আমি আগ্রহী খুব। এটা আমার একধরনের নেশাও বলা যেতে পারে। একধরনের বাহ্যিক পরিচয়টুকু যথেষ্ট নয় আমার কাছে। তারা কি অনুভব করছে বা চিন্তা করছে সে সম্বন্ধেও আমার একটা অপরিসীম আগ্রহ করছে।

গম্ভীর কণ্ঠে মলি প্রশ্ন করল, মনে হয় আপনিই মিঃ রেন।

যুবকটি মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে সহজাত অভ্যাসবশতঃ নিজের মাথার ঝাঁকড়া চুলটা কয়েক বার আঁকালেন।

কি আশ্চর্য আমার নিজের পরিচয়টাই এখনো ভালোভাবে জানানো হয়নি। অথচ এটাই তো সবচেয়ে জরুরী। এই অধমের নামই ক্রিস্টোফার রেন। দয়া করে নামটা শুনে হেসে উঠবেন না। আমার বাপ-মা ছিলেন কিছুটা রোমান্টিক ধাঁচের। তাদের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে আমি একজন উঁচুদরের শিল্পী হব। সেইজন্য বিশ্ববিখ্যাত স্থপতির অনুসরণে তারা আমার নাম রেখেছিলেন ক্রিস্টোফার। যেন কেবলমাত্র এই নামের জোরেই আমার স্থপতি হবার পৃথ একেবারে সুগম হয়ে উঠবে। অবাস্তব ধ্যান-ধারণা একবার ভেবে দেখুন তো?

মলি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল–আপনি কি একজন সত্যিই স্থপতি? অনেক চেষ্টা করেও সে তাদের হাসিটুকু দমন করতে পারল না।

বেশ গর্বের সুরে মিঃ রেন বলল–হ্যাঁ, নিশ্চয় অন্ততঃ কিছুটা তো বটে। অবশ্য পুরোপুরি স্থপতি হবার মত যোগ্যতা এখনো অর্জন করিনি। কিন্তু মনে মনে কল্পনা করতে ক্ষতি তো কিছু নেই। তবে দয়া করে একটা কথা মনে রাখা উচিত। পিতৃদত্ত এই নামটাই আমার স্থপতি হবার পথে প্রধান অন্তরায়। কারণ হাজার চেষ্টা করলেও ঐ স্থপতি রেনের সমতুল্য হতে পারা যাবে না। তবে ক্রিস্টোফার রেনের স্বকৃত পথই হয়ত একদিন আমাকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেবে।

জিল ইতিমধ্যে নিচে নেমে গেছে। মলি রেনকে তাড়া দিয়ে বলল–আপনার ঘরটা দেখবেন চলুন। মিনিটকয়েক বাদে মলি যখন নিচে নেমে এল জিল জিজ্ঞেস করল-ব্যাপার কি, ওক কাঠের ছোট ছোট আসবাবপত্রগুলো কি ভদ্রলোকের পছন্দ হয়েছে?

মলি বলল, ভদ্রলোক ছাতা লাগানো মেহগনি কাঠের জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ফুলের নকশা করা মশারি তার চাই। তাই একরকম বাধ্য হয়েই পাশের ঘরটাই বন্দোবস্ত করে দিয়েছি।

বিরক্ত কণ্ঠে জিল গজগজ করে বলতে থাকে–যত সব বখাটে চ্যাংড়াদের দল!

মলি তাকে যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল–শোন জিল, আমার কথাটা মন দিয়ে শোন। আমরা এখানে কোনো নিমন্ত্রিত অতিথি আদর আপ্যায়নের ব্যবস্থা করিনি এটা ব্যবসা আমাদের। এখন প্রশ্ন এই ভদ্রলোককে অর্থাৎ ক্রিস্টোফার রেনকে তুমি পছন্দ কর কিনা।

অকপটে জিল বললনা, মোটেই পছন্দ করি না।

মলি বলল–কিন্তু আমার মতে ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপর খুব একটা জোর দেওয়াটা আমাদের উচিত নয়, ভদ্রলোক সপ্তাহের শেষে সাত গিনি দিতে রাজী হয়েছেন– এইটুকুই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট।

হ্যাঁ তিনি যদি ঠিকঠিক পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দেন তাহলেই–জিল বলল।

মলি বলল–তাকে তো আমাদের সাপ্তাহিক চার্জের কথা বলা হয়েছে এবং তাতে তিনি রাজীও আছেন বলে আমাদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন। সে চিঠি আমাদের কাছে আছে।

জিল বলল–তুমি কি নিজের হাতে ভদ্রলোকের স্যুটকেসটা পাশের ঘরে রেখে এসেছ?

মলি বলল–না। তিনি তার স্যুটকেসটা উঠিয়ে নিয়ে গেলেন।

জিল বলল–খুব ভালো কথা। তবে আমার পক্ষে এটা বওয়া খুব একটা অসুবিধা হত না। ওর মধ্যে যে পাথরের নুড়ি ভরা নেই এ বিষয়ে নিশ্চিত আমি। জিনিষপত্র আছে কিনা সে সম্বন্ধে এখন সন্দেহ জাগছে আমার মনে!

মলি ইশারায় সচেতন করে দিয়ে জিলকে বলে উঠল স.স.. চুপ ভদ্রলোক বোধহয় নেমে আসছেন।

ক্রিস্টোফার রেন নিচে নেমে লাইব্রেরীর ঘরের দিকে এগিয়ে এলেন। এই লাইব্রেরী ঘরটা নিয়ে একটা গর্ব আছে মলির। ঘরটা বেশ প্রশস্ত এবং খোলামেলা। চেয়ারগুলোও ছিল বেশ মজবুত আর বড়সড়। উষ্ণতা সঞ্চারের জন্য দুধারে চুল্লীর ব্যবস্থা মনোরম। আধঘণ্টার মধ্যে ডিনার পরিবেশন করা হবে বলে জানিয়ে দেওয়া হল। রেন ছাড়া বর্তমানে অন্য কোনো অতিথি নেই সে কথাও মলি বলল। ভদ্রলোক জানালেন যে সে ক্ষেত্রে তিনি রান্নাঘরে এসে মলির কাজের সাহায্য করতে পারেন।

রেন বেশ সাগ্রহে বলে উঠল, প্রয়োজন হলে আমি ওমলেটও ভেজে সাহায্য করতে পারি। মলিও বিশেষ কোনো আপত্তি দেখালো না। রান্না ঘরে ঢুকে কাপপ্লেট ধোয়া পোঁছার, কাজেও যথেষ্ট সাহায্য করলেন ভদ্রলোক। যদি ব্যাপারটা ঠিক প্রথাসিদ্ধ নয়, রাত্রে নিজের বিছানায় শুয়ে মনে মনে চিন্তা করলো মলি।

অতিথিশালার রীতিনীতি ঠিকমতো পালিত হলো না। এবং জিলও এজন্যে খুবই অপ্রসন্ন। তবে আগামীকাল অন্যান্য অতিথিরা উপস্থিত হবার পর তখন তো আর এ ধরনের বেনিয়মের কোনো সুযোগ থাকবে না।

সবকিছু নির্দিষ্ট আইন ধরেই চলবে। এই কথা ভাবতে ভাবতেই তার দুই চোখ জুড়ে ঘুমের খোলা বন্য নেমে এলো। সকালেও কিন্তু তরুণ সূর্যের সপ্তরঙ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো না।

ঘন মেঘে সমাচ্ছন্ন হয়ে রইলো সারা আকাশ। তার সঙ্গে শুরু হলো অবিশ্রান্ত তুষারপাত। জিলের মুখচোখ গম্ভীর হয়ে উঠলো। মলির মুখে ব্যাপ্ত হলো বিষাদের মলিনতা।

সমস্ত আবহাওয়াটাই যেন তাদের এক ভয়াবহ প্রতিকূল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় ট্যাক্সিতে চেপেই মিসেস বয়েল হাজির হলেন।

তুষার কেটে পথ চলার জন্যে এই ট্যাক্সির চাকাগুলোয় বিশেষ এক ধরনের চেন লাগানো থাকে।

ট্যাক্সিড্রাইভারও রাস্তাঘাটের বিপর্যস্ত অবস্থার আশঙ্কাজনক বর্ণনা দিল। এই তুষারপাত বন্ধ হবার আপাতত কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রকৃতি দেবী কবে যে শান্ত হবেন একমাত্র ঈশ্বরই তা বলতে পারেন। গম্ভীর কণ্ঠে ভবিষ্যৎবাণী করলো ড্রাইভার।

মিসেস বয়েল নিজেও এই বিষাদ বিধুর পারিপার্শ্বিকের মাঝখানে কোনোরকম উজ্জ্বলতার দীপ্তি ফোঁটাতে পারবেন না। তার আকৃতি বেশ লম্বা চওড়া দশাসই ধরনের, দেখলেই বুকের মধ্যে গুরগুর করে ওঠে, কণ্ঠস্বরও বেশ চড়া আর কর্কশ।

আচার আচরণ পুরুষালি ঢঙের। রীতিমতো দাপটের সঙ্গে আশেপাশের সবকিছুকে দাবিয়ে রাখাই যেন তার সহজাত অভ্যাস।

যদি আমি এটা একটা চালু প্রতিষ্ঠান বলে ধারণা না করতাম, তাহলে কখনোই এখানে আসতে রাজী হতাম না।

বেজার কণ্ঠে শুরু করলেন তিনি। স্বাভাবিক ভাবেই আমি ভেবে ছিলাম নিশ্চয় কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত অতিথিশালা।

যথারীতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই হোটেল পরিচালিত হয়, আপনাকে যে এখানে থাকতেই হবে তারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ক্ষোভের সুরে জবাব দিল জিল। যদি জায়গাটা আপনার সত্যিই মনে না ধরে তবে অনায়াসে অন্যত্র চলে যেতে পারেন।

সে তো অবশ্যই।

আমার পছন্দ না হলে থাকতেই বা যাবো কেন? হোটেলের কি কোনো অভাব আছে দুনিয়ায়?

আবার মুখ খুললো জিল, আমার মনে হয়, মিসেস বয়েল, আপনার জন্যে কোনো ফিরতি ট্যাক্সির বন্দোবস্ত করে দিলেই আপনি সব থেকে স্বস্তিবোধ করেন।

রাস্তাঘাট এখনো সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়নি। যদি প্রকৃতই কোনো ভুল বোঝাবুঝি ঘটে থাকে। তবে বেশিদূর গড়াতে দেবার আগেই, তার প্রতিকারের চেষ্টা করা বাঞ্ছনীয়।

একটু থেমে বাকিটা শেষ করলো জিল, এত বেশি আবেদন পত্র আমরা পেয়েছি যে আপনার জন্যে নির্দিষ্ট ঘরটা অন্য কাউকে বন্দোবস্ত করে দিতেও আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।

তাছাড়া অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ঘরের দৈনন্দিন ভাড়া কিছুটা বাড়িয়ে দেবো ঠিক করেছি।

মিসেস বয়েল জিলের দিকে এক ঝলক ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।

সে দৃষ্টিতে খরতর দহনের দীপ্তি।

এখানকার রীতিনীতি ভালো করে বুঝে না নিয়েই আমি অন্য কোথাও উঠে যাবার চেষ্টা করছি না–দয়া করে এ কথাটাও স্মরণ রাখবেন।

আর হ্যাঁ, স্নান ঘরে আমার জন্যে বড়সড় তোয়ালের বন্দোবস্ত করে দেবেন।

রুমালের মতো ছোট সাইজের তোয়ালে দিয়ে গা মুছতে আমি আদপেই অভ্যস্ত নই।

মিসেস বয়েল সামনের দিকে কয়েক পা অগ্রসর হবার পর জিল মলির দিকে তাকিয়ে চোখ মটকালো।

সত্যিই জিল, তুমি অদ্ভুত।

চাপা খুশিখুশি কণ্ঠে মলি বললো, যে ভাবে তুমি পরিস্থিতির হাল ধরলে.., ভদ্রমহিলার মুখে আর কথাটি নেই। একবারে ফাটা বেলুনের মতোই চুপসে গিয়েছে।

ঠিকমতো দাওয়াই পড়লে সব ফোঁস-ফাসই ঠান্ডা হতে বাধ্য। মন্তব্য করলো জিল।

আমি ভাবছি, মলির কণ্ঠে নতুন করে আশঙ্কার সুর ঘণীভূত হলো, ক্রিস্টোফার রেনকে ভদ্রমহিলা কি ভাবে গ্রহণ করবেন?

তিনি যে সুনজরে দেখবেন না–এ কথা বলাই বাহুল্য। জিলের ধারণা যে কত অভ্রান্ত সেদিন বিকেলেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল।

ভদ্রমহিলা মলিকে ডেকে বললেন, ভদ্রলোকের চালচলন কেমন যেন কিম্ভুত প্রকৃতির। তার রীতিমতো বিরক্তির সুর সহজে কানে বাজে। রুটি বিক্রেতা যখন রুটি দিতে এলো তখন তার চেহারা দেখে মনে হলো যেন কোনো মেরু অভিযাত্রী। এবং আগামী দুচার দিন তার পক্ষে হয়তো আর রুটিন মাফিক রুটি ফেরি করা সম্ভব হবে না সে কথাও সবিনয়ে জানিয়ে দিলো।

চারদিকের রাস্তাঘাট বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে, ঘোষণা করলো লোকটি।

 ভালো চান তো এই বেলা বেশি পরিমাণ পাঁউরুটি ভাঁড়ারে মজুত করে রাখুন।

হ্যাঁ, নিশ্চয়।

মলিও মাথা নেড়ে সায় দিলে সে প্রস্তাবে। এখানে খালি টিনের অভাব নেই।

রাখবার কোনো অসুবিধে হবে না। তুমি বরং কিছু বেশি পরিমাণেই দিয়ে যাও। যদি সত্যিই সেরকম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় তবে শুধু পাঁউরুটির সাহায্যে কি কি খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করা যায় আপনা থেকে সে চিন্তাও তার মাথার মধ্যে উদয় হলো। সঙ্গে সঙ্গে তার একটা তালিকার মনে মনে প্রস্তুত করে নিল মলি।

দৈনিক খবরের কাগজটা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল রুটিওলা কাগজটা টেবিলের ওপর রেখে একবার চোখ মেলল। সবকটি পররাষ্ট্রের নীতিই সবার আগে প্রাধান্য পেয়েছে। মোটামোটা হরফে হেডিং-এর নিচে বিস্তারিত ভাবে সরবরাহ করা হয়েছে সেই সমস্ত কূটকচালি ইত্যাদি। তারপর আবহাওয়ার খবর। প্রথম পাতার নিজের দিকে নগ্ন ছবিসহ মিসেস লিয়নের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সম্পূর্ণ বিবরণ।

কাগজের পাতায় যদিও ছবিটা ভালো করে ফুটে ওঠেনি। কেমন যেন অস্পষ্ট। সেই দিকে মলি অস্পষ্টভাবে তাকিয়ে ছিল। এমন সময় পেছন থেকে ক্রিস্টোফার রেনের ডাকে চেতনা ফিরে এল।

ছবি দেখে মনে হয় নিম্নশ্রেণীর অসৎ চরিত্রের কোনো মহিলা তাই নয় কি? বেশ্যাদের মুখের চেহারা সাধারণত এই রকমই হয়ে থাকে। তাছাড়া পাড়াটাও খুব নোংরা। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো নিগূঢ় তথ্য আছে বলে তো আমার মনে হয় না।

বিরক্তি সহকারে নাক কুঁচকিয়ে মিসেস বয়েল বললেন–মেয়েটা যে তার যোগ্য শাস্তিই পেয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

মিঃ রেন বেশ আগ্রহের সুরে কথা বলে মহিলার দিকে তাকালেন। পরে বললেন, তাহলে আপনার ধারণা এটা কোনো যৌন অপরাধমূলক ঘটনা?

মহিলা উত্তর দিলেন, সে বিষয়ে আমি কোনো উত্তর বা ইঙ্গিত করিনি, মিঃ রেন।

তিনি বললেন কিন্তু মেয়েটাকে তো গলাটিপেই মারা হয়েছে তাই নয় কি? আমি ভাবছি –ভদ্রলোক তার দীর্ঘ সাদা হাতদুটো সামনে মেলে ধরে বললেন, কাউকে গলা টিপে খুন করার সময় হত্যাকারীর মনের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

তাই নাকি মিঃ রেন?–ভদ্রমহিলা বললেন।

ক্রিস্টোফার রেন ভদ্রমহিলার দিকে দুপা এগিয়ে গিয়ে বললেন–আচ্ছা মিসেস বয়েল, আপনাকে কেউ যদি খুন করে তাহলে আপনার মনে কি ধরনের প্রতিক্রিয়া হবে সে বিষয়ে কোনোদিন চিন্তাভাবনা করেছেন?

মিসেস বয়েল আগের মত উদ্ধত সুরে বলে উঠলেন, তাই নাকি মিঃ রেন? আপনি তো খুব…

মলি এবার বাকি অংশটুকু খবরের কাগজ থেকে পড়লেন। এই ব্যাপারে জোর জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য পুলিস কর্তৃপক্ষ যে ব্যক্তির সন্ধান করছে তার গায়ে কালো ওভার কোট, মাথায় হোমবার্গ টুপি, উচ্চতা মাঝারি, গলায় একটা পশমের মাফলার জড়ানো।

রেন মন্তব্য করলেন, প্রকৃতপক্ষে চেহারার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে লোকটিকে দেখতে আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতই। তার ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসির রেখা দেখা দিল।

মলি মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল- হ্যাঁ, সাধারণ যে কোনো লোকের চেহারার সঙ্গেই এ বর্ণনা অবিকল মিলে যায়।

ইনসপেকটর পারমিন্টার স্কটল্যাণ্ডের ইয়ার্ডে তার নিজের ঘরেই বসে ছিলেন। সামনের চেয়ারে বসে ছিলেন ডিটেকটিভ সার্জেন্ট কেন।

পারমিন্টার বলনে আমি ঐ শ্রমিক দুজনকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই।

হা স্যার, আমি খবর পাঠাচ্ছি আর্দালিকে।

 পারমিন্টার প্রশ্ন করলেন, ওদের চালচলন কেমন?

উত্তরে বললেন– দেখলে মনে হয় শ্রমিক হিসাবে খুবই দক্ষ। হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে পড়ে না। তাছাড়া ওদের ওপর নির্ভর করা যায়।

গম্ভীর ভাবে পারমিন্টার মাথা নাড়িয়ে বললেন।

অনতিবিলম্বে দুজন শ্রমিক ঘরের মধ্যে ঢুকল। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, চোখেমুখে একটা ইতস্ততঃ ভাব। পারমিন্টার একনজরে দুজনের আপাদমস্তক দেখলেন। লোকের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে তিনি অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেছেন।

মৃদু সুরে পারমিন্টার প্রশ্ন করলেন তাহলে তোমাদের বিশ্বাস মিসেস লিয়নের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তোমরা কিছু প্রয়োজনীয় খবরাখবর দিতে পারবে? তোমাদের সুবিবেচিত মতামতের জন্য ধন্যবাদ। তারপর তিনি একটা চেয়ারের দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে বললেন বসতে। খোলা সিগারেটটাও তাদের সামনে এগিয়ে দিলেন।

শ্রমিক দুজন চেয়ারে বসে সিগারেট ধরাবার আগে পর্যন্ত স্থিরভাবে অপেক্ষা করলেন এবং তারপর বললেন–কি জঘন্য আবহাওয়া।

হা স্যার, যা বলেছেন! গাছ পাথর সব জমে যাওয়ার অবস্থা।

আচ্ছা এখন কাজের কথা শুরু হয়ে যাক। তোমরা কে কি দেখেছ বল?

শ্রমিক দুজন এবার কিছুটা ইতস্ততঃ বোধ করল। দুজনের চোখেই একটা কুণ্ঠিতভাব দেখা গেল। ঘটনার যথাযথ বর্ণনা দেওয়াটা তাদের কাছে যেন ছিল এক দুঃসাধ্য ব্যাপার।

মোটাসোটা লোকটা তার সঙ্গীকে অনুরোধের সুরে বলল–তুমিই না হয় বলনা জো!

অল্প কেশে জো বলল–না… মানে আসল ব্যাপারটা হচ্ছে তখন আমাদের কাছে কোনো দেশলাই ছিল না।

প্রশ্ন করা হল–তোমরা তখন কোথায় ছিলে?

 উত্তর দিল– জারম্যান স্ট্রীটে। রাস্তার ধারে গ্যাস সরবরাহের পাইপ মেরামত করছিলাম।

মাথা দোলা দিলেন ইনসপেক্টর পারমিন্টার। পরে তিনি স্থান এবং কালের নিখুঁত বিবরণ সংগ্রহ করতে পারবেন। জারম্যান স্ট্রীট যে অকুস্থলের খুব কাছে তা তিনি জানেন।

উৎসাহ দেবার সুরে তিনি বললেন, তোমাদের কাছে তখন কোনো দেশলাই ছিল না?

উত্তর দিল না স্যার। আর যখন আমার দেশলাইটা ফুরিয়ে গিয়েছিল, বিলের লাইটারটাও তখন জুলছিল না। সেইজন্য একজন পথচারী ভদ্রলোককে ডেকে তার কাছে দেশলাই আছে কিনা তা জানতে চাইলাম। তখন তাকে দেখে বিশেষ কিছুই মনে হয়নি… নেহাৎ একজন সাধারণ ভদ্রলোক বলেই মনে হল।…

আবার মৃদুভাবে মাথা নাড়লেন পারমিন্টার।

তিনি পকেট থেকে দেশলাই বার করে এগিয়ে দিলেন। কিন্তু মুখে কোনো কথা বললেন না। বিল-ই ভদ্রতার খাতিরে বলল–কি জঘন্য ঠান্ডা। হাত পা যেন সব অসাড় হয়ে যাচ্ছে। হ্যাঁ তা বটে। ছোট্ট করে জবাব দিলেন তিনি। তার কণ্ঠস্বরের মধ্যে যেন একটা রুক্ষস্বর। মনে হল বুকে সর্দি জমেছে। অগ্রিম ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোককে দেশলাইটা দিলাম ফেরত। তখনই আমার নজরে পড়ল তার পকেট থেকে কি যেন একটা মাটিতে পড়ে গেছে। কিন্তু তাকে ডেকে সে বিষয়ে কিছু বলবার আগেই দ্রুত পায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন ভদ্রলোক। তবু আমি পেছন থেকে কয়েকবার তাকে ডাকাডাকি করলাম, তবে তিনি ততক্ষণে বাঁদিকে মোড় ঘুরিয়ে চোখের বাইরে চলে গেলেন। তাই না বিল?

বিল ঘাড় নেড়ে বলল, হ্যাঁ ঠিকই তো, তাড়া খাওয়া খরগোসের মতই ছুটছিলেন ভদ্রলোক। একটু থেমে আবার বলল, তিনি তখন হ্যাঁরো রোড ধরেই যাচ্ছিলেন এবং এত দ্রুত গতিতে হাঁটছিলেন যে পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে তার নাগাল পাওয়া খুবই অসম্ভব মনে হল। তাছাড়া ভাবলাম মানিব্যাগ বা ওই জাতীয় কিছু নয়, হয়ত সামান্য একটা নোটবই মাত্র…হয়তো এটা তার বিশেষ কোনো কাজেই লাগবে না। কিছুক্ষণ থেমে দম নিল জো। তারপর আবার বলতে শুরু করল-ভদ্রলোকের চালচলনও যেন কেমন একটা ঠেকছিল। টুপিটা চোখের কোল পর্যন্ত নামানো ছিল। ওভার কোটের বোতামগুলোও আঁটা ছিল। সিনেমায় ঠক-জোচ্চরদের যেমন চেহারা হয় ঠিক তাকে তেমনই অনেকটা লাগছিল। এ সম্বন্ধে বিলের কাছে তখন কি একটা মন্তব্য করেছিলাম।

বিল সায় দিয়ে বলল-হা হা, মনে আছে আমার।

তবে কেবলমাত্র মতলববাজ ভদ্রলোক ছাড়া এবিষয়ে তখন আর কিছু মনে হয়নি। ভাবলাম, বাড়ি ফেরবার জন্য হয়ত খুব তাড়া আছে তার। এই জন্যেই তাকে কোনো দোষ দেওয়া যায় না। কারণ যা তখন ঠান্ডা পড়েছে।…

বিলও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বলল–দারুণ ঠান্ডা।

সেইজন্য বিলকে বললাম, নোটবইটা খুলে দেখ ভেতরে কোনো দরকারী কাগজপত্র আছে কিনা। কিন্তু দু-একটা ঠিকানা ছাড়া আর কিছুই পাওয়া গেল না। তার মধ্যে একটা হচ্ছে চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট, আর একটা কোনো হতচ্ছাড়া ম্যানর হাউসের।

মুখ বেঁকিয়ে বিল উচ্চারণ করল বিটজি।

 বুকের মধ্যে জো এবার আস্থা ফিরে পেয়েছে। কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তার আভাস শোনা গেল।

সে বলল, চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীটে, ঠিকানাটা পড়ে আমি বিলকে শোনালাম। যে রাস্তায় আমরা কাজ করছিলাম সেখান থেকে জায়গাটা বেশি দূরত্ব ছিল না। দুজনে পরামর্শ করে নিলাম, ফেরবার পথে ঐ বাড়িতে না হয় একবার খোঁজ নেওয়া যাবে। পাতা উলটে দেখা গেল ভেতরে এক জায়গায় কি একটা লেখা আছে মজার কথা। বিল আমার হাত থেকে নোটবইটা কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে লাগল সেই জায়গাটা। ছেলে ভুলনো একটা ছড়ার লাইন। তিনটি ইঁদুর অন্ধ… নিশ্চয় তামাশা করেই কেউ লিখে রেখেছে। এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই…হা স্যার ঠিক সেই মুহূর্তে একটা গোলমাল, একটা চেঁচামেচি আমাদের কানে এল একজন স্ত্রীলোক খুন –খুন বলে চীৎকার করছে। চীৎকারটা আমাদের কাছ থেকে খুব একটা দূরে ছিল না। কয়েকটা রাস্তার পরেই।

জো কিছুক্ষণের জন্য চুপ করল। যেন রহস্য নাটকের চরমতম উত্তেজনার মুহূর্তে এসে শ্রোতাদের উৎকণ্ঠিত চিত্তে যেন সুড়সুড়ি দিয়েছে–এরকম যেন একটা পরিস্থিতি।

আমি তখন বিলকে ব্যাপারটার খোঁজ আনতে পাঠালাম। অল্প পরে ও ফিরে এসে খবর দিল যে কিছু দূরে একটা বাড়ির সামনে অনেক লোকের ভিড় জমে গেছে। কয়েকজন পুলিসও সেখানে দাঁড়িয়ে গেছে। সেই ফ্ল্যাটবাড়ির একজন ভাড়াটে মহিলা খুন হয়েছেন। বাড়ির কত্রীই ঘটনাটা জানতে পারেন সর্বপ্রথম। তিনিই লোক জড়ো করেন চেঁচামেচি করে আর পুলিসকে খবর দেয়। বিলকে আমি প্রশ্ন করলাম খুনটা কোনো রাস্তায় হয়েছে। বলল, কার্লভার স্ট্রীটে। তবে বাড়ির নম্বরটা দেখে আসতে ও ভুলে গেছে।

অস্বস্তিতে নড়েচড়ে উঠল চেয়ারের মধ্যে বিল। দুবার শব্দ করে আসতে করে কাশলো বিল। তার দুচোখে একটা নির্বোধ অসহায় ছায়া। যেন তার কাছে এই কাজটা খুবই অপরাধজনক হয়ে গেছে।

জো আবার বলতে শুরু করল আমি তখন বললাম, আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। ডিউটি শেষ করার পর, বাসায় ফেরার পথে ওদিকটা ঘুরে যাবো। খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম বাড়িটার নম্বর চুয়াত্তর। এই ভদ্রলোকের নোট বইয়ের মধ্যে ঐ ঠিকানাটা লেখা ছিল। বিলের ধারণা ছিল খুনটার সঙ্গে এর হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই। নেহাতই একটা কাকতালীয় ব্যাপার। কিন্তু পরে শুনলাম যখন পুলিস কোনো এক ভদ্রলোককে খোঁজ করছে যাকে খুনের ঘটনার কিছু আগে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেখা গিয়েছিল–তখন আর চুপচাপ বসে থাকা যুক্তিযুক্ত মনে হল না। যিনি এই মামলার তদন্তের ভার নিয়েছেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করলাম।….

বোধহয় আমি শুধু শুধু বাজে বকে আপনাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করছি না?

 নাঃ নাঃ তোমরা উচিত কাজই করেছে।

পারমিন্টার ভরসা দিলেন তাদের।

তোমরা যে বুদ্ধি করে নোটবইটা সঙ্গে নিয়ে এসেছে এ জন্যেও অনেক ধন্যবাদ। পেশাদারী দক্ষতা সহকারেই তিনি দুজনকে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করলেন।

স্থান এবং কালের সম্বন্ধে ও অবহিত হলেন সবকিছু। কেবল পাত্রর বিবরণ সম্বন্ধেই তিনি তাদের কাজ থেকে বিশেষ কিছু আদায় করতে পারলেন না। হিস্টিরিয়া গ্ৰস্তা গৃহকত্রী যে বর্ণনা দিয়েছিল এরাও তার পুনরাবৃত্তি করলো, চোখ পর্যন্ত নামানো টুপি, ওভার শেটের বোতামগুলো আটা, থুতনি পর্যন্ত মাফলারটা ঢেকে দিয়েছে। কণ্ঠস্বর ছিল তার রুক্ষ এবং দুই হাতে ছিল দস্তানা যেটা ছিল পশমের।

যখন শ্রমিক দুজন চলে গেলেন তারপর পারমিন্টার চেয়ারে গা এলিয়ে বসে রইলেন। পালিশ করা ঝকঝকে টেবিলের উপর ময়লা রংচটা খোলা অবস্থায় পড়ে আছে নোটবইটা। সেটা বিশেষজ্ঞের কাছে পাঠানো হবে ফিঙ্গার প্রিন্ট-এর জন্য।

তাদের সাহায্যে এর মধ্যে গুপ্ততথ্য আবিষ্কৃত হতে পারে। কিন্তু এখন তার দু-চোখের দৃষ্টি কালো কালিতে লেখা দুটো ঠিকানার দিকে নিবদ্ধ। দরজা ঠেলে সার্জেন্ট কেন্-কে ঘরে ঢুকতে দেখে পারমিন্টার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। এদিকে এসো কেন্ জিনিসটা একবার নিজের চোখে পরীক্ষা করে দেখে যাও।

খাতার দিকে তাকিয়ে মৃদু শিস দিয়ে উঠল কেন্। নিজের মনে বলতে থাকে তিনটি ইঁদুর অন্ধ আশ্চর্য! আমি তো একেবারে বেকুব বনে যাচ্ছি।

পারমিন্টার গম্ভীর চালে মাথা দুলিয়ে বললেন, হ্যাঁ, সামনের টানা থেকে একটুকরো কাগজ বের করে কেনের দিকে দিলেন এগিয়ে, মৃত মহিলার পোশাকের সঙ্গে পিন দিয়ে আটকানো ছিল এই কাগজটা।

কাগজটায় লেখা আছে–এই প্রথম। নিচে শিশুসুলভ অপটু হাতে তিনটি ইঁদুরের আঁকা ছবি। তারপরে বাদ্যসঙ্গীতের একটা লাইনের স্বরলিপি।

শিস দিয়ে কেন সুরটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করল। তিনটে ইঁদুর অন্ধ…জানলা কপাট বন্ধ?

ঠিক আছে, ঠিক আছে। তোমাকে আর সুর মেলাতে হবে না। ওটা যে এই গানের স্বরলিপি সেটা আমার কাছে জলের মত পরিষ্কার।

সে জিজ্ঞেস করল–কোনো পাগলের কাণ্ড তাই না স্যার?

পারমিন্টার ভ্রু কুঁচকে বললেন, হু মেয়েটার সম্বন্ধে যে সব খোঁজখবর পাওয়া গেছে তার মধ্যে কোনো ভুল নেই তো?

সে বলল, না স্যার সমস্তই খাঁটি। ফিঙ্গারপ্রিন্টের বিশেষজ্ঞের রিপোর্টটা একবার পড়ে দেখলেই সব জানা যাবে। মিসেস লিয়ন বলে যে মেয়েটা তার পরিচয় দিয়েছে তার আসল নাম মউরীন গ্রেগ। মেয়েটা দুমাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওই সময় তার জেলের মেয়াদও শেষ হয়ে গিয়েছিল।

পারমিন্টার চিন্তান্বিত কণ্ঠে বললেন–ছাড়া পাবার পর মেয়েটা চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীটে গিয়ে উঠল। নিজের নাম রাখল মউরীন লিয়ন। কখনো কখনো মদ খেয়ে বেহুশ হয়ে পড়ে থাকত। সপ্তায় এক-একদিন দু-একজন পুরুষ অতিথিও ওর ঘরে আনাগোনা করত। তবে ও বিশেষ কাউকে যে ভয় পেত তা কিন্তু নয়। নিজের আসন্ন বিপদ সম্বন্ধেও ওর কোনো ধারণা ছিল না। এই লোকটা প্রথমে এসে কলিংবেলের বোতাম টেপে। তার ঝি-এর কাছে মিসেস লিয়নের ঘর কোনোটা জেনে নেয়। সেও যদিও লোকটার বর্ণনা দিতে পারেনি। শুধু জানিয়েছে সে মাঝারি ধরনের উচ্চতা, আর গলার স্বর কিছুটা ভাঙ্গাভাঙ্গা। তারপর কাজ সারতে ঝি নিচের তলায় চলে যায়। কিন্তু সন্দেহজনক কোনো চেঁচামেচি তার কানে এসে পৌঁছায়নি। এমন কি লোকটা কখন নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে তাও বলতে পারে না সে।

মিনিটদশেক বা আরো কিছু পরে ও যখন মিসেস লিয়নের জন্য চা নিয়ে যায় তখনই দেখতে পায় মেয়েটাকে কে গলা টিপে মেরে গেছে।

হঠাৎ বেঁকের মাথায় কেউ এ খুন করেনি কেন্। খুবই সুচিন্তিত পরিকল্পনায় কাজটা শেষ করা হয়েছে। কিছুক্ষণ চুপ করে পারমিন্টার আবার বললেন, ইংলণ্ডে মঙ্কসওয়েল ম্যানর নামে কটা বাড়ি আছে…?

কেন জবাব দিল, খুব সম্ভবতঃ একটাই।

তাহলে তো বলতে হয় আমরা অসীম সৌভাগ্যবান। তবে এ বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া উচিত। বেশি দেরী করা উচিত হবে না।

সার্জেন্টের চোখের দৃষ্টিও এবার নোটবইয়ের পাতার ওপর স্থির হয়ে রইল। দুটো ঠিকানা লেখা আছে সেখানে একটা চুয়াত্তর নম্বর কার্লভার স্ট্রীট, অন্যাটা মঙ্কসওয়েল ম্যানর।

আপনি কি তাহলে মনে করেন…?

পারমিন্টার দ্রুত চোখ তুলে তাকালেন। তোমারও কি সেইরকম সন্দেহ হচ্ছে না…।

মঙ্কসওয়েল হতে পারে তাই না? কিন্তু…কিন্তু দু-চার দিনের মধ্যেই যেন নামটা কোথায় দেখলাম। আমি খুব নিশ্চিত ভাবেই বলতে পারি… অল্প কয়েক দিন আগেই?…

দেখলে কোথায়?

সেটাই তো মনে রাখবার চেষ্টা করছি। এক মিনিট ধৈৰ্য্য ধরুন… সম্ভবতঃ কোনো খবরের কাগজের পাতায়…বোধহয় দৈনিক টাইমসে। একেবারে শেষের পাতায় সেদিনের ক্রসওয়ার্ড পাজলটা সমাধানের চেষ্টা করছিলাম। তখনই যেন এক জায়গায় ছোট্ট করে নজরে পড়ল…

কেন্ কথা বলতে বলতে দ্রুত পায়ে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। একমুহূর্ত পর যখন ফিরে এলেন তখন তার চোখে মুখে জয়ের হাসি। বলল– এই যে স্যার, এখানে দেখুন, কয়েকদিন আগের দৈনিক পত্রিকার একটা পাতা এগিয়ে দিলেন পারমিন্টারের দিকে। পারমিন্টার চোখ বোলান তার ওপর।

মঙ্কসওয়েল ম্যানর হারগ্লেডন, বার্কস।–এই পড়ে আসতে আসতে চোখ তুললেন তিনি। তারপর বললেন, তুমি আমাকে বার্কায়ারের পুলিশ অফিসারের লাইনটা ধরিয়ে দাও।

মেজর মেটকাফের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মঙ্কসওয়েল ম্যানর একটা যেন রীতিমত হোটেলের মত পরিণত হল। কাজকর্ম চলতে লাগল সেই ভাবে। তিনি অবশ্য মিসেস বয়েলের মত উগ্রচণ্ডী স্বভাবের ছিলেন না, আর ক্রিস্টোফার রেনের মত অস্থির প্রকৃতিও তিনি ছিলেন না। শক্তসমর্থ চেহারার মাঝবয়সী সুপুরুষ ছিলেন তিনি।

চালচলনে মিলিটারি ভঙ্গি। চাকরি জীবনটা অধিকাংশ সময় ভারতবর্ষতেই কাটিয়েছেন তিনি। তার জন্য নির্দিষ্ট ঘর এবং ঘরের আসবাবপত্র দেখেও তিনি সন্তুষ্ট হলেন। মিসেস বয়েলের সঙ্গে তার আগে পরিচয় না থাকলেও ভদ্রমহিলার দু-একজন দূর সম্পর্কের ভাইকে তিনি চিনতেন। দু-দুটো নরম চামড়ার দামী স্যুটকেসে ভরা তার মালপত্র দেখেও মনে মনে জিল আশ্বস্ত হল। আর যা হোক বিল না মিটিয়ে কেটে পড়ার মানুষ নন মেটকাফ।

সত্যি কথা বলতে কি মলি এবং জিলও অতিথিদের সম্বন্ধে তাদের পারস্পরিক মনোভাব আদানপ্রদান করবার মতো কোনো নিশ্চিন্ত অবসর ইতিমধ্যে খুঁজে পায়নি। সারাদিনটা তাদের কেটে গেছে কাজের মধ্যে। লাঞ্চ এবং ডিনার তৈরি করা, পরিবেশন করা, কাপ ডিস ধোওয়া- আরও কতরকম যে কাজের ঝামেলা তার ঠিক ঠিকানা নেই কোনো। মেজর মেটকাফ অবশ্য কফির প্রশংসা করলেন খুব। এবং মলি ও জিল যখন সমস্ত কাজ শেষ করে রাত্রে বিছানায় শুতে এল তখন তারা রীতিমত ক্লান্ত হলেও দুজনের চোখে তখন ফুটে উঠছিল সাফল্যের দীপ্তি। বিজয়গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠেছিল। কিন্তু উষ্ণ শয্যার মদির আরামও বেশিক্ষণ জুটলো না তাদের কপালে। দুটো বাজতে না বাজতেই কলিংবেলের মর্মভেদী আর্তনাদে উঠে পড়তে হল বিছানা ছেড়ে।

জিল বিরক্তিসুরে বলে উঠল–দূর ছাই। এটা তো সদর দরজার ঘণ্টার আওয়াজ! এতরাত্রে আবার কে…।

ব্যস্ত সুরে মলি বলল-তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেখো।