৩. গরম সুরুয়া

২১.

লুইজির জন্য মারপল গরম সুরুয়া নিয়ে এসে ডাকল। ক্যারি বিছানা থেকে উঠে মারপলের হাত থেকে বাটিটা নিল। মুখটা ম্লান। মারপল পাশে চেয়ারটা টেনে বসল।

লুইজি তিনটে মৃত্যু সম্পর্কে বলতে গিয়ে কেঁপে উঠল। এদের জন্য তারা কত কি করতে চেয়েছে। বর্তমান জীবন ধারাটাই বদলে গেছে। সবকিছু জটিল হয়ে পড়েছে।

মারপল একটা নখ কাটার কাচি তুলে নিল। কাচিটা বেশ নতুন রকমের। একদিকে একটা বাড়তি আঙুল ঢোকানোর জায়গা।

লুইজি জানাল সকালে অ্যালেক্স ওটা দিয়ে গেছে। ডান হাতের নখ কাটবার সুবিধা হয় এতে।

মারপলের মাথায় একরাশ চিন্তা ঘুরতে লাগল।

লুইজি তাকে বললো, সে কতটা বুঝতে পারছে, ঘটনাটা কোন দিকে গড়াবে?

 মারপল কিছু বলল না।

লুইজি তাকে শুধু বলল সে যেন যা করা উচিত তাই করে।

.

২২.

মিস মারপল ক্যারিকে তার সঙ্গে একবার হলঘরে যেতে বলল। একটা জিনিস দেখাবে।

হলঘরে এসে ক্যারিকে মারপল একজায়গায় দাঁড় করাল। এটাকে একটা অভিনয়মঞ্চ ভেবে সামনের দিকে তাকাতে বলল। ক্রিস্টিয়ান হত্যার রাতে যে যেভাবে ছিল সবটা ক্যারিকে কল্পনা করতে বলা হল।

ক্যারি বিস্মিত হলেন।

মারপল তার মনের অবস্থা বুঝল। তারপর সে জাদুর ভেলকির কথা বলতে লাগল। তরুণীকে করাত দিয়ে কাটার কথা ভাবতে ভাবতেই মারপল খুনের ব্যাপারটা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে।

ক্যারি ভাবলেন মারপল পাগল হয়ে গেছে।

মারপল সেই রোমহর্ষক খেলা দেখানোর পদ্ধতি বর্ণনা করে যেতে লাগল। আমরা ভাবি দুটো মানুষ আসলে কিন্তু একটা মানুষ।

ইনসপেক্টর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মারপল বলে চলল একটা মানুষ পার্ক থেকে ঢুকে বাড়ির বাইরে আবার বেরিয়ে যেতে দুমিনিট পয়তাল্লিশ সেকেণ্ড লাগে, এতে দুমিনিটেরও কম সময় লাগবে।

ক্যারি বুঝলেন না।

মারপল বুঝিয়ে দিল লিউইসের অফিসঘরে– স্টাডিরুমে দুজন নয় একজন লোক ছিল। ভেতর থেকে সেটা দেখা যাচ্ছে না। তাদের মধ্যে একজন জানলা খুলে রোয়াকে নামল। দৌড়ে গেল (অ্যালেক্স পদশব্দ শুনেছিল) ক্রিস্টিয়ানের ঘরে ঢুকে গুলি করল। দৌড়ে ফিরে এল। এদিকে ঘরের লোকটি একাই দুজনের গলায় কথা কাটাকাটি চালাল এতক্ষণ। ঐ দুএকমিনিট সময় বাদ দিলে অবশ্য ঘরে দুজনই ছিল।

ক্যারি নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিলেন। মানে এডগার খুন করেছে আর লুইজিকে বিষ দিয়েছে।

মারপল জানাল বিষ দেবার ব্যাপারটা একদম বাজে কথা। সবার দৃষ্টি ঐ দিকে যাবার জন্য ঘটনা ঐভাবে সাজানো হয়েছে। আর্সেনিকের প্রভাবের সঙ্গে বাতের মিল আছে বলে ঐ সুযোগটা নেওয়া হয়েছে। টনিকে আর্সেনিক বা টাইপরাইটারে চিঠিতে কয়েকটা লাইন জুড়ে দেওয়া ভেলকি ছাড়া কিছু নয়। ক্রিস্টিয়ান ট্রাস্টের ব্যাপারেই এসেছিল। গচ্ছিত টাকা এধার ওধার করেছে কেউ। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সন্দেহটা একজনের ওপরেই গিয়ে পড়ছে– লিউইস সেরাকোল্ড।

.

২৩.

মিসেস ড্যানি রাইডককে লেখা জিনা হেডের একটি চিঠির বক্তব্য হল, সে আগেই জানিয়েছে এডগার একেবারে বোকা লোক। ইনসপেক্টর কথার মারপ্যাঁচে যখন ওকে কাবু করতে লাগল তখন ভয় পেয়ে দৌড়তে দৌড়তে হ্রদে গিয়ে পড়ল। সেখানে একটা পচা নৌকা ছিল সেটাকে ধরল। লিউইস চীৎকার করল। তরপর দৌড়তে লাগল। এডগার সাঁতার জানে না। লিউইস জলে ঝাঁপ দিল তারপর দুজনেই শ্যাওলায় জড়িয়ে গেল। একটা পুলিস দড়ি দিয়ে ওদের টেনে আনল।

মিলড্রেড যখন বলল ওরা ডুবে যাবে এবার লুইজি তাতে শান্তস্বরে সায় দিল।

তারপর সব শেষ। অনেক চেষ্টা করা হল, বাঁচানো গেল না।

লুইজি মিলড্রেডকে নিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতর চলে গেল। বোঝা গেল, মা আর মেয়ের মধ্যে টানের ব্যাপকতা।

চিঠির শেষে জিনা আর ওয়ালির আমেরিকায় ফেরার কথা বলা হয়েছে।

.

২৪.

মারপল কিভাবে আন্দাজ করেছিল সেকথা লুইজি তাকে জিজ্ঞেস করল। তাকে একটু রোগা আর দুর্বল লাগছে। সে দুঃখ পেয়েছে তবে খুব একটা ধাক্কা খায়নি।

মারপল বলল, সবাই বলে লুইজি বাস্তব পৃথিবীর বাইরের মানুষ। কিন্তু সে দেখল একমাত্র লুইজিই বোঝাতে পারে কোনটা সত্যি আর কোনটা চোখের ভুল। এডগার সত্যিই লিউইসকে আর জিনা সত্যিই তার স্বামীকে ভালোবাসত। পাগলামিতে এডগার নিখুঁত অভিনয় করেছে।

লিউইসের টাকাকড়ির ব্যাপারে খুব মাথা ছিল। কাজেই সব কর্তৃত্ব তার হাতে চলে গিয়েছিল আর তাতেই মুস্কিলটা বাঁধল।

লিউইস অঙ্কের যাদুকর ছিল। হাজার হাজার টাকা সন্দেহ না জাগিয়ে সরানোর উপায় বের করে ফেলেছিল। ছেলেদের সে শেখাতো। তারা শেখা বিদ্যা নিয়ে লিউইসের সিন্দুক ভরাত তার অসৎ পন্থা ক্রিস্টিয়ান ধরে ফেলেছিল। লুইজিকে নিয়েই একমাত্র চিন্তা ছিল।

ক্রিস্টিয়ান ধরে ফেলেছে বুঝে তৈরি হয়েই ছিল লিউইস। এডগার লোমনের ধরনে আর একজন আছে। তাকেই আনা হয়েছিল লোমনের নাম দিয়ে। সমস্ত ঘটনাটা লিউইস সাজায়। অ্যালেক্স বুঝেছিল বলেই লুইজির কাটা নখ সংগ্রহ করে নিয়ে গিয়েছিল। কারণ দীর্ঘদিন আর্সেনিক দিলে নখে তার ছাপ পড়বেই।

মারপল বলল সে চেহারার মিল দেখেই বুঝতে পেরেছিল এডগার লিউইসের ছেলে। লিউইসই তাকে জানিয়েছে একথাও বলল। শেষ পর্যন্ত ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিল।

লুইজি তাদের দুজনের মধ্যেকার ভালোবাসা কত গভীর ছিল জানাল। তার মনে কোনো সন্দেহই হয়নি। সে জানে লিউইস তাকে বিষ দেবে না। তবে অ্যালেক্স আর আর্নির মৃত্যুর পর তার বিশ্বাস জন্মাল লিউইস ছাড়া আর কেউ একাজ করবে না। লুইজি খুব ভয় পেয়েছিল। এরপর না জানি কী ক্ষতি করে বসে এই ভেবে চিন্তা করত। সে বুঝতে পেরেছে ক্ষমতার সঙ্গে বিনয় ও নম্রতা থাকা চাই।

ডঃ গ্যালব্রেথ লুইজির বিনয়ের প্রশংসা করাতে সে সুন্দর দুটো নীল চোখ মেলে বিস্ময়ের দৃষ্টিতে চাইল। তার যে কোনও গুণই নেই। অন্যের মহত্ত্ব থাকলে সে চোখ মেলে দেখে।

মিস মারপলের মনে হল লুইজি ঠিক একইরকম রয়েছে।

জিনা মারপলকে বলল, তার মিলড্রেড মাসীর কাছেই দিদা ভালো থাকবে। মাসীও বেশ ভালো হয়ে গেছে।

মারপল তাতে সায় দিল। জিনা জানাল এবার সে স্টোনিগেটসের ইতালী, ছেলেমানুষী সমস্ত ভুলে খাঁটি আমেরিকান হয়ে যাবে।

মারপল বললো ওদের দেখে তারও সেই বহু পুরনো দিনের সমস্ত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই ছোটবেলা– সেই বন্ধুত্ব– কতশত অতীতের কাহিনী।