২. দ্বিতীয় পর্ব: যাত্রীদের জবানবন্দী

দ্বিতীয় পর্ব: যাত্রীদের জবানবন্দী

০১.

 কণ্ডাক্টর গার্ডের সাক্ষী

তদন্ত শুরু হলো।

একটা টেবিলের ধারে মঁসিয়ে পোয়ারো আর কুক বসলেন।

একটু দূরে ডাক্তার। পোয়ারোর সামনে ইস্তাম্বুল কাল কোচের যাত্রীদের নামের তালিকা, কোচের নকশা, লাল কালি দিয়ে কে কোথায় কোনো কামরায় চিহ্নিত করা আছে। টেবিলের উপর স্তূপাকৃতি পাসপোর্ট আর টিকিট। এছাড়াও লেখবার কাগজ। কালির দোয়াত, কলম আর পেন্সিল।

ব্যবস্থা চমৎকার।

কাজ শুরু হয়ে গেল প্রথমে কণ্ডাক্টর গার্ডের সাক্ষ্য নেওয়া দরকার মনে হয়। দয়া করে মঁসিয়ে কুক-এর সম্বন্ধে বলুন। ও কি বিশ্বাসভাজন?

নিশ্চয়ই। আমি হলফ করে বলতে পারি। পিয়ের মিশেল জাতিতে ফরাসী, পনের বছরের উপর রেলেঞ্চাকরী করছে। ফ্যালের কাছাকাছি এক জায়গায় থাকে এবং এর সম্বন্ধে কোনো অভিযোগ নেই। কোনো যাত্রীদের বা কর্তপক্ষের।

বেশ তাহলে ওকে ডাকা যাক।

পিয়ের মিশেল জবানবন্দী দিতে হবে শুনে তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায় আর কি, যাক সামলে নিয়েছে। তাকে বুঝিয়ে পোয়ারো শান্ত করলেন।

মিশেল ত্রস্ত গলায় বললেন। আমার কর্তব্যের কোনো গাফিলতি ছিল না এবং এটা খুবই দুঃখজনক যে রাশেট নিহত হয়েছেন। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি এর কিছুই জানি না। এর জন্য জানি না আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে কি না?

তাকে আশ্বস্ত করে তার সমস্ত কিছুই জেনে নিলেন তার সম্পর্কে। তারপর জিজ্ঞেস করলেন গতকাল মিঃ রাশেট রাত কটায় শুতে যান?

নৈশ আহারের ঠিক পরেই। তার আগের দিনও একই সময় শুয়ে পড়েন। যখনই তিনি খেতে যান আমাকে ওর বিছানাপত্র ঠিকঠাক রাখতে বলে যান এবং আমিও সেইমত করি।

তারপর তার কামরায় কেউ কি গিয়েছিলেন?

ওঁর পরিচারক আর সেক্রেটারী।

এ ছাড়া?

না আমি অন্ততঃ কাউকে দেখিনি।

তোমার সাথে আর তারপর কোনো কথা হয়নি তাই তো?

নাকে ডেকে ছিলেন ঘন্টি বাজিয়ে। ট্রেন সেই সময় থেমে ছিল।

ঠিক ঠিক কি হয়েছিল?

আমি দরজায় টোকা দিতে উনি বলেন, যে ঘন্টিটা ভুল করে টিপেছেন।

ইংরাজীতে না ফরাসীতে?

ফরাসীতে।

তোমার মনে আছে কথাগুলো।

স্য ন্য বিয়, জ্য মে সুই ঐ পে।

ঠিক বলছ। কথাগুলো আমিও শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর তুমি চলে গিয়েছিলে?

হুঁ।

 তুমি কি নিজের জায়গায় ফিরে গিয়েছিলে?

না আরো একজন যাত্রী ডেকেছিলেন তার কাছে যাই। মিশেল এবার ভেবেচিন্তে জবাব দাও গতকাল রাত সওয়া একটায় কোথায় ছিলে?

আমি? কেন? আমার নিজের জায়গায়, করিডোরের মুখোমুখি।

তুমি নিশ্চিত তো?

 হ্যাঁ তবে…..

 কি হল?

আমার সহকর্মী এথেন্সের বগিতে যাই অল্প সময়ের জন্য কথা বলতে। আমাদের মধ্যে বরফ ঝড় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। তবে মনে হয় রাত একটার পর ঠিক বলতে পারব না।

কখন ফিরলে?

আমার বগিতে সময় ঘন্টা বাজে। ও হ্যাঁ ওই আমেরিকান ভদ্রমহিলাটি। সেই যে…..অনেকবার ঘন্টি বাজিয়েছিলেন।

ঠিক তারপর? আমারও মনে পড়ছে।

তারপর আপনার কামরায় গিয়ে জল দিয়ে আসি এবং এর প্রায় আধঘন্টা পর মিঃ রাশেটের সেক্রেটারি বিছানা পেতে দিই তার কামরায়।

কামরায় কি মিঃ ম্যাককুইন তখন একলাই ছিলেন?

 না ওর সঙ্গে পনেরো নম্বরের কর্নেল ভদ্রলোক গল্প করছিলেন।

কর্নেল তার পর কোথায় যান?

 নিজের কামরায়।

তোমার বসার জায়গার খুব কাছেই না পনেরো নম্বর….

হ্যাঁ। দ্বিতীয় কামরা করিডোরের শেষ প্রান্তেই।

 ওঁর বিছানা কি করাই ছিল?

 হা। উনি খেতে যাওয়ার পর আমিই ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম।

 আচ্ছা এ সব যখন ঘটে তখন রাত কত হবে?

 ঠিক বলতে পারব না, তবে দুটো বেজে গিয়েছিল নিশ্চয়ই।

তারপর?

আমি বাকি রাতটুকু চেয়ারে বসেই কাটিয়ে দিই।

ঘুমিয়ে পড়েছিলে কি?

মনে হয় না। ট্রেন থেমে থাকলে ঘুম আসে না। দুলুনি হলে তবেই একটু ঝিমুনি আসে। কাউকে যেতে আসতে দেখেছিলে করিডোরে?

একটু চিন্তা করে বলল, ঐ প্রান্তে কোনো মহিলা বোধহয় বাথরুমে গিয়েছিলেন।

 কোনো জন?

ঠিক বলতে পারব না, আমার বসার জায়গার থেকে দূরে তো, আর তা ছাড়া মহিলার পিঠটুকু দেখেছিলাম একটা গাঢ় লাল রংয়ের কিমোননা ছিল ড্রাগন আঁকা।

মাথা নাড়লেন পোয়ারো।

তারপর?

 তেমন কিছু ঘটেনি সকাল হয়ে গেল।

 তুমি নিশ্চিত তো?

ও হা আপনি এক মুহূর্তের জন্য মুখ বের করেছিলেন কামরা থেকে।

খুব ভালো মিশেল, আমি ভেবেছিলাম তোমার হয়ত আমার কথাটা মনে নেই। আমার দরজার বাইরে ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ হয়েছিল এ ব্যাপারে কি কিছু জান?

না মঁসিয়ে। কোনো অদ্ভুত ব্যাপার হলে চোখ এড়াত না।

 তাহলে নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছিলাম।

হয়তো পাশের কামরায় কিছু ঘটে থাকবে।

পোয়ারো কোনো কথায় না গিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।

বাইরে থেকে কোনো লোক যদি ঢোকে সে কি পালাতে পারবে মিশেল?

মনে হয় না। এক যদি লুকিয়ে থাকে।

 সব কামরা আমরা খোঁজ করেছি ওসব ধারণার কিছু নেই।

 কুক বললেন।

তাছাড়া আমার চোখে তো পড়তই, মিশেল বলল।

শেষ কোথায় আমরা থামি মিশেল?

ভিনভোকিতে।

ট্রেন সেখান থেকে কটায় ছাড়ে?

এগারটা আটান্নয় ছাড়ার কথা ছিল কিন্তু আবহাওয়া খারাপ থাকায় কুড়ি মিনিট দেরি হয়।

কেউ যদি ট্রেনের অন্য বগি থেকে আসে?

না মসিয়ে। দুটো বগির মধ্যেকার দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয় খাবার পরেই।

তুমি কি ভিনভোকি স্টেশনে নেমেছিলে?

হ্যাঁ, হাত পা ছড়ানোর জন্য। তবে ট্রেনে উঠবার দরজার পাশেই ঠিক ছিলাম অন্য বগির কণ্ডাক্টরও ছিল।

একটা দরজা আছে না খানাকামরার পাশে বাইরে যাবার?

সেটা সবসময়ই ভেতর থেকে বন্ধ থাকে।

এখন তো বন্ধ নেই?

কোনো যাত্রী হয়ত দরজা খুলে বাইরের দিকে উঁকি দিয়ে থাকবেন তাই জন্য।

আপনি হয়ত ভাবছেন বোধ হয় এটা আমার কর্তব্যের ত্রুটি।

না না, তবে আমি একটু চিন্তিত এই ব্যাপারে।

 রাশেটের কামরার দরজায় টোকা দিয়েছিলে যখন তখন একটা কামরা থেকে ঘন্টা বেজে উঠে; সেই কামরাটা কার?

রাজকুমারী দ্রাগোমিরফের। উনি পরিচারককে ডেকে দিতে বলছিলেন।

তুমি কি ডেকেছিলে?

 নিশ্চয়।

তাহলে এই পর্যন্তই। বলে কুকের দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তোমার কোনো কর্তব্যে ত্রুটি হয়েছে বলে আমি মনে করি না, কুক বললেন এবং কোনো চিন্তার কারণ নেই।

প্রশংসা পেয়ে মিশেল চলে গেল।

.

০২.

সেক্রেটারীর সাক্ষ্য

মিশেলের সব কথা শুনে এবার পোয়ারো মিঃ ম্যাককুইনকে ডাকা যাক বললেন কিছুক্ষণ পর।

ম্যাককুইন এসে হাজির হলো।

কি ব্যাপার আপনাদের কাজ কতদূর এগোল?

 এই চলছে তবে আপনার মনিবের প্রকৃত পরিচয়টা জেনেছি।

ম্যাককুইন উগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি নাম মশাই?

আসল নাম কাসেট্টি, রাশেট তার ছদ্মনাম। ডেইজি হত্যার মামলার প্রধান আসামী।

 কিছুটা ক্রুদ্ধ এবং বিস্মিত হল ম্যাককুইন। ছি ছি, নরাধম পশু একটা।

এটা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেননি আপনি মিঃ ম্যাককুইন, তাই না?

না স্যার। জানলে কোনোদিনই ওঁর কাজকর্ম করতাম না এবং যে হাত দিয়ে কাজ করেছি সেই হাত কেটে ফেলতাম।

খুব খারাপ লাগছে তাই না?

লাগবে না বলেন কি? আমাকে আপনারা কি কসাই ভেবেছেন, আমিও একটা রক্তমাংসের মানুষ। আর তাছাড়া আমার বাবা তদন্তকারী অফিসার ছিলেন ডেইজি হত্যা মামলার, সেই কারণে অনেকবার এসেছেন ডেইজির মা মিসেস আর্মষ্ট্রং। তিনি কি সুন্দরী ছিলেন এবং কতই না কষ্ট পেয়েছেন। আমি সত্যিই খুব খুশী যে রাশেট না না কাসেট্টি তার সাজা পেয়েছে। যদি ও বেঁচে থাকত তবে সেটা সমাজের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর হতো।

আপনার এই কথা শুনে মনে হচ্ছে আগে যদি জানতেন তবে আপনিই খুন করতেন।

ম্যাককুইন এ কথায় ঈষৎ লজ্জিত হলেন।

না মানে…. আমি মনের ভাব চাপতে পারি না।

আপনার সঙ্গে একটু ঠাট্টা করছিলাম। যদি আপনি আপনার মনিবের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে দুঃখ পেতেন সন্দেহটা আরোও বেড়ে যেত আমার।

আমি চোখে জলও আনতাম না যদি ওর ফাঁসি হত। কিছু যদি না মনে করেন আপনারা ওর পরিচয়টা জানলেন কিভাবে।

একটু টুকরো কাগজে …পাওয়া গেছে ওর ঘরে তার মানে ওঁর সেটা বেশ বোকামী হয়েছিল।

সেটা কি নিশ্চিত করে বলা যায়?

ম্যাককুইন কথাটা না ধরতে পারার ফলে হা করে তাকিয়ে রইল পোয়ারোর দিকে।

আপনি কিছু মনে করবেন না ম্যাককুইন আমার কাজ যাত্রীদের গতিবিধি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেওয়া।

না আমায় যে কোনো প্রশ্ন করতে পারেন।

ধন্যবাদ। আপনি কোনো কামরায় আছেন, অবশ্য উত্তরও আমার জানা কারণ একসঙ্গে আমরা দুইজনেই রাত কাটিয়েছি। আপনি কি একাই আছেন ওখানে আপাতত?

আপনি ঠিকই বলেছেন।

 গতকাল আপনি খানাকামরা থেকে ডিনার সেরে কি কি করছিলেন?

খুব সোজা উত্তর। নিজের কামরায় ফিরে যাই কারণ পড়াশুনার কাজ ছিল। বেলগ্রেডে প্ল্যাটফর্মে নেমেছিলাম গাড়ি থামার পর পায়চারি করতে। ঠান্ডার জন্য ফিরে আসি। আমার সহযাত্রী কর্নেল আর্বাথনট এবং পাশের কামরায় ইংরেজ তরুণীটির সঙ্গে কথাবার্তা বলি। আপনি বোধহয় সেই সময় পাশ কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন। তারপর জরুরী কাগজপত্র নিয়ে মিঃ রাশেটের কামরায় যাই। আপনাকে এ কথা আগেও বলেছি। কাজ সেরে শুভরাত্রি জানিয়ে ফিরে আসছি কর্নেল ছিলেন করিডোরে, তাকে আড্ডা মারার জন্য আমার কামরায় আসতে বলি। এবং দু গ্লাস পানীয় আনতে দিই। রাজনীতি, ভারত সরকার, নিজেদের ব্যক্তিগত সমস্যা এই সব নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সাধারণত ইংরেজরা অমিশুকে হয় কিন্তু ইনি দিব্যি আমুদে।

আপনার কামরা থেকে কর্নেল যখন ফিরলেন তখন রাত কত হবে?

 তা প্রায় দুটো।

লক্ষ্য করেছিলেন কি যে ট্রেনটা থেমে গেছে?

হা হা। দু চারটে কথাও বলি এ বিষয়ে। বাইরে উঁকি মেরে দেখেছিলাম সব বরফে ঢাকা তবে যে এতটা গুরুতর তা ভাবিনি।

তারপর কর্নেল আপনাকে শুভরাত্রি জানিয়ে নিজের কামরায় চলে গেলেন।

হা। আমি কণ্ডাক্টরকে ডেকেছিলাম বিছানা করে দেবার জন্য।

বিছানা পাতার সময় আপনি কোথায় ছিলেন?

ঠিক বাইরের দরজায় এবং একটা সিগারেট ধরিয়ে ছিলাম।

তারপর?

 বিছানায় শুয়ে এক ঘুমে রাত কাবার।

রাতে একবারের জন্যও ট্রেন ছেড়ে বাইরে যাননি?

ট্রেনে বসে বসে গা ব্যথা হবার জন্য ভেবেছিলাম কর্নেল এবং আমি বাইরে নামব। ভিনভোকিতে একটু নেমেছিলাম কিন্তু থাকতে পারিনি ঠান্ডার কারণে।

কোনো দরজা দিয়ে নেমেছিলেন?

যে দরজাটা আপনাদের কাছাকাছি আছে?

খানাকামরার পাশের দরজা?

হা।

আপনারা নামবার সময় ওটা বন্ধ না খোলা ছিল?

বন্ধ ছিল ভেতরে, আমরা হুড়কোটা খুলে নামি।

ফিরে এসে বন্ধ করেছিলেন তো?

বোধহয়…. না..না…না বোধহয় ভুলে গেছিলাম কেননা শেষে আমিই উঠেছিলাম।

ব্যাপারটা খুব জরুরী ভালো করে মনে করুন।

না পারছি না।

কর্নেল এবং আপনারা যখন গল্প করছিলেন তখন নিশ্চয়ই করিডোরের কামরার দরজাটা খোলা ছিল।

হা।

ভিনভোকি ছাড়বার পর ট্রেনে কাউকে যেতে আসতে দেখেছিলেন কি?

খানা কামরার দিক থেকে যেন কণ্ডাক্টরকে যেতে দেখেছিলাম। এবং উল্টোদিক থেকে একজন মহিলা আসছিলেন।

কোনো জন?

কি জানি। তর্ক এবং গল্পে মশগুল ছিলাম নজর করিনি, তবে লাল রংয়ের পোশাক ছিল বোধহয়। এক ঝলক দেখেছি মাত্র। খানাকামরার মুখোমুখি তো আমার কামরাটা তাই যিনি খানাকামরার দিকে গিয়েছিলেন করিডোের ধরে তাই তার পেছন দিকটাই নজরে পড়েছে।

মহিলাটি হয়ত বাথরুমে গিয়েছিলেন। আচ্ছা ফিরে আসতে কি দেখেছিলেন?

বোধহয় না। অতটা খেয়াল করিনি, নিশ্চয় ফিরেছিলেন।

আর একটা কথা আপনি কি পাইপ খান ম্যাককুইন।

না।

 তাহলে এই পর্যন্তই, এক মুহূর্ত থেমে পোয়ারো বললেন।

আপনি দয়া করে রাশেটের পরিচারককে পাঠিয়ে দেবেন। আর একটা কথা আপনারা কি বরাবরই সেকেণ্ড ক্লাসে যাতায়াত করতেন?

না। আমরা ফার্স্ট ক্লাসেই যেতাম। এবারে জায়গা পাওয়া যায়নি অনেক চেষ্টা করেও।

বুঝেছি। ধন্যবাদ।

.

০৩.

পরিচারকের সাক্ষ্য

বিবর্ণ চেহারার পরিচারকটি প্রবেশ করার পর পোয়ারো বসতে বললেন তাকে।

মিঃ রাশেটের কাজকর্ম তুমিই তো কর?

হা স্যার।

তোমার পুরো নাম?

 এডওয়ার্ড হেনরি মাস্টারম্যান।

বয়স?

ঊনচল্লিশ

বাড়ির ঠিকানা?

 একুশ ফায়ার স্ট্রীট ক্লার্কেন ওয়েল।

তোমার মনিব নিহত হয়েছেন তুমি নিশ্চয় জান?

হা খুব দুঃখের ব্যাপার।

 তোমার শেষবারের মতো কখন মনিবের সাথে দেখা হয়?

একটু চিন্তা করে বলল, রাত নটা অথবা পরেও হতে পারে।

 ঠিকমত গুছিয়ে বলো।

আমি কোনো দরকার আছে কিনা জানতে যাই।

তোমাকে সাধারণত কি কাজ করতে হত?

ওঁর জামাকাপড় টাঙিয়ে রাখা, নকল দাঁতের প্লেটে জল দেয়া আর অন্য কিছু দরকার কিনা তা জানা।

ওঁকে কাল রাতে কি স্বাভাবিক দেখেছিলে?

চিন্তিত মনে হয়েছিল একটু যেন।

কি রকম?

উনি একটা চিঠি পড়ছিলেন। চিঠিটা আমি রেখে গেছি কিনা তা জানতে চাইলেন। কিন্তু চিঠির কথা আমি জানতামই না। উনি রেগে যান চিঠিটা পড়ে। প্রতিটি কাজের খুঁত ধরে উনি অকারণে বকাবকি করতে থাকেন আমাকে। অবশ্য সহ্য হয়ে গিয়েছিল আমার। তার মেজাজ সবসময়ই বিগড়ে থাকত কারণে অকারণে।

উনি কি কোনো ঘুমের ওষুধ খেতেন?

 হা স্যার। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে ঘুম না আসার ফলে।

 ওষুধের নাম কি তুমি জানতে?

না স্যার। নিদ্রার ওষুধ লেখা শিশির গায়ে।

উনি ওষুধ খেয়েছিলেন গত রাতে?

হা স্যার। আমিই টেবিলের উপর গ্লাসে ঢেলে রেখেছিলাম।

তুমি কি খেতে দেখেছিলে ওষুধটা ওঁকে?

না স্যার।

তারপর?

আমি সব ঠিকঠাক আছে কিনা জানতে চাইলাম আর কখন সকালে ডাকতে হবে ওঁকে। উনি বললেন ঘন্টা না বাজানো পর্যন্ত আসবার দরকার নেই। যেন কেউ ওঁকে বিরক্ত না করে।

উনি কি তাই করতেন বরাবর?

হা। উনি সকালে আমাকে ডাকবার জন্য কণ্ডাক্টরকে বলতেন।

একটু সকাল সকাল না দেরি করে উঠতেন?

 সেটা ওঁর মর্জির উপর।

আজ সকালে যখন কেউ তোমায় তলব করল না; তুমি অবাক হওনি?

না স্যার।

আচ্ছা তোমার মনিবের শত্রু ছিল তুমি কি জানতে?

 হা স্যার।

কি করে?

মিঃ ম্যাককুইনের সঙ্গে উড়ো কয়েকটা চিঠি নিয়ে আলোচনা করতে শুনেছি।

তুমি কি ওকে পছন্দ করতে, মাস্টারম্যান?

সেটা বলা উচিত হবে না স্যার। মুখ ভাবলেশহীন। তবে ব্যবহার উনি ভালোই করতেন।

তুমি কিন্তু ওঁকে পছন্দ করতে না তাই তো?

 তা ঠিক নয়। আমি আমেরিকানদের অতটা পছন্দ করি না।

তুমি আমেরিকায় গেছ কখনও?

না স্যার।

কখনও কাগজে আর্মস্ট্রং মামলার কথা পড়েছিলে?

 হ্যাঁ, খুবই মর্মান্তিক। একটা ছোট্ট মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছিল।

তোমার মনিবই সেই মামলার প্রধান আসামী জান?

নাতো! আমার বিশ্বাস হয় না।

যাই হোক সেটা সত্যি। কি করলে তোমার মনিবের কামরা থেকে বেরিয়ে?

মনিব তলব করছেন ম্যাককুইন সেটা বললেন। তাই নিজের কামরায় গিয়ে বই পড়ছিলাম।

তোমার কামরাটা।

খানাকামরার ঠিক পরেই সেকেণ্ড ক্লাস।

 তোমার কোনো বার্থটা?

 নিচেরটা।

 তোমার সঙ্গীটি কে?

ইটালিয়ান একটা দৈত্যের মতো।

ইংরাজী বলতে পারে?

এই যেমন তেমন করে। ও আগে আমেরিকার শিকাগোতে থাকত।

নিশ্চয়ই গল্পটল্প করলে তোমরা?

না স্যার বই পড়তেই বেশি ভালোবাসি আমি।

সাচ্চা ইংরেজ একেবারে, হাসলেন পোয়ারো।

বেশ বেশ কি বই?

মিসেস অ্যারাবেলা রিচার্ডসনের প্রেমের ফাঁদ।

কেমন বই?

 চমৎকার।

তারপর?

সাড়ে দশটায় আমার সঙ্গীটি শুতে যাবে বলায় কণ্ডাক্টর বিছানা করে দিল আমাদের।

তুমিও শুতে গেলে?

শুতে তো গেছিলাম কিন্তু ঘুমতে পারিনি, কারণ দাঁতের যন্ত্রণার জন্য। কিন্তু ওষুধ মেলেনি, দাঁতের গোড়ায় লবঙ্গের তেল দেওয়ার জন্য কিছুটা কমল। যাতে অন্যমনস্ক করা যায় তাই বই পড়ছিলাম।

তাহলে একটুও ঘুমোওনি?

একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল ভোর চারটায়।

 আর সঙ্গীটি?

সে বিছানায় নাক ডাকতে শুরু করেছিল।

 ও কি তার কামরা ছেড়ে বেরিয়েছিল?

না।

আর তুমি?

আমিও না।

 কোনো শব্দটব্দ শুনেছিলে?

না। ট্রেন থেমে থাকার ফলে নিস্তব্ধ ছিল।

এই খুনের বিষয়ে কিছু জান?

না স্যার।

 কখনও মনিবের সঙ্গে ম্যাককুইনের কথা কাটাকাটি হয়েছে?

না। চমৎকার লোক ম্যাককুইন।

মিঃ রাশেটের আগে কোথায় কাজ করতে?

গ্রসভেনার স্কোয়ারে, স্যার হেনরী টমলিনসনের বাড়িতে।

 ছাড়লে কেন?

পূর্ব আফ্রিকায় স্যার হেনরী চলে যাওয়ার জন্য আমাকে দরকার হল না। অবশ্য তিনি আমার সম্বন্ধে আশা করি প্রশংসাই করবেন।

ধন্যবাদ মাস্টারম্যান, ও হ্যাঁ তুমি কি পাইপ খাও?

না স্যার সিগারেট।

ঠিক আছে, এবার তুমি যেতে পার।

একটু থমকে মাস্টারম্যান বলল, স্যার একটা কথা। ঐ আমেরিকান প্রৌঢ়টি ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন খুন সম্পর্কে কিছু বলার জন্য।

পোয়ারো হেসে বললেন, তাহলে ওকে তো ডাকতে হয়।

আমি কি ওঁকে পাঠিয়ে দেব। উনি বড়কর্তার সঙ্গে কথা বলবার জন্য অনেকক্ষণ চেষ্টা করছেন মোটে সামলাতে পারছে না কণ্ডাক্টর।

ওঁর কি বক্তব্য শুনি তুমি পাঠিয়ে দাও।

.

০৪.

আমেরিকান মহিলার সাক্ষ্য

 শ্ৰীমতী হাবার্ড ব্যস্ততা এবং ভীতি প্রকাশ করে বললেন,আমার জানার আছে যে, কেউ কি এখানে কর্তৃপক্ষ স্থানীয় আছেন।

মহাশয়ার কিছু বলার থাকলে আমায় বলতে পারেন নির্দ্বিধায়, কিন্তু তার আগে দয়া করে একটু বসুন, বললেন পোয়ারো।

শ্রীমতি হাবার্ড বসে পড়লেন সামনের চেয়ারটিতে। এই ট্রেনে যে খুনটা হয়েছে কাল রাতে আমার কামরাতেই খুনিটা ছিল বললেন।

এই কথাগুলোর নাটকীয় প্রভাব লক্ষ্য করতে চাইলো শ্রীমতী হাবার্ড।

সত্যি।

তা নয়তো কি। কাল খাওয়া-দাওয়ার পর শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর হঠাৎ ঘুমটা ভেঙ্গে যাবার পর দেখলাম একটা লোক কামরায় ঢুকেছে। খুন জখম রাহাজানি তো ট্রেনে হয়ই অবশ্য গয়নাগাটির সম্বন্ধে ভয় নেই কারণ ওগুলো শোবার আগে মোজায় ভরে বালিশের নিচে রেখেছিলাম, প্রাণের ভয় তো আছে। যাই হোক কি বলছিলাম যেন?

ওই যে বললেন একজন লোক আপনার কামরায় ঢুকেছিল?

হা হা, আমি চুপটি করে মড়ার মত পড়ে থেকে কি করা যায় ভেবে ভগবানের নাম জপছি। ভাগ্যিস মেয়ে জানেনা এসব কাণ্ডের কথা নাহলে একেবারে কেঁদে ভাসিয়ে দিত। হঠাৎ মাথায় বুদ্ধি আসার ফলে ডাক ঘন্টিটা টিপে ধরতেও কোনোও লোক না আসতে ভাবলাম হয়ত বা সবাই খুন টুন হয়েছে। শেষে বাইরে আওয়াজ শোনার পর বুকে যেন বল এল। আমি চেঁচিয়ে কণ্ডাক্টরকে ভেতরে আসতে বলার পর দেখলাম আমি ও কণ্ডাক্টর ছাড়া কেউ নেই।

তারপর?

আমি কণ্ডাক্টরকে বলতে সে ব্যাটা বলল আমার নাকি ভুল হচ্ছে আমার কথা মেয়ে জামাই ও অক্ষরে অক্ষরে মানে ও বলে ভুল হচ্ছে। এই দেখুন আপনাদের সঙ্গে পরিচয়ই হয়নি আর আমি কখন থেকে বকে চলেছি।

আমি পোয়ারো, ইনি মঁসিয়ে কুক এই রেল কোম্পানির ডিরেক্টর আর ইনি ডাক্তার কনস্টানটাইন।

আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে খুশী হলাম। বুঝলেন মঁসিয়ে পোয়ারো আমার ঠিক সুবিধের মনে হল না ব্যাপারটা, আমার কামরায় তো ঢুকেছিল তা সে পাশের কামরা থেকে আসেনি তো? কণ্ডাক্টরকে বললাম মাঝের দরজা আটা আছে কিনা দেখতে। ভেবেছি তাই, সেইজন্য ভালো করে ভারী সুটকেশ দিয়ে এঁটে রাখতে বলে নিশ্চিন্তে শুলাম।

তখন রাত কটা?

কেমন করে বলব আমার সে অবস্থাই তখন ছিল না ঘড়ি দেখার।

তা তো বটে।

আমার কামরায় যে লোকটা ঢুকেছিল সেই আসলে খুনী। বলে হাবার্ড চোখ বন্ধ করলেন।

আপনার তাহলে কি মনে হয় সে আবার পাশের কামরাতেই চলে গিয়েছিল?

সে আমি বলতে পারব না। কারণ আমার তখন চোখ বন্ধ ছিল। আপনারা তো বিশ্বাস করছেন না। এই দেখুন, বলে নিজের হাতব্যাগটি টেবিলের উপরে উপুড় করলেন। ব্যাগ থেকে বেরুলো দুটো রুমাল, একটা চশমা, এক শিশি অ্যাসপিরিন, এক প্যাকেট হজমিগুলি, একটা কঁচি, পিপারমেন্ট এক গোছা, চাবি, চেকবই, একটা অতি সাধারণ চেহারার বাচ্চার ছবি। কয়েকটা চিঠি, এক ছড়া পাথরের মালা আর একটা ধাতুর তৈরি বোম।

শ্ৰীমতী হাবার্ড বোতামটা তুলে ধরলেন।

এই হচ্ছে প্রমাণ।

কি রকম?

এই বোতামটা! আমাদের মেয়েদের পোশাকে কি এই বোতাম থাকে? কি সব বুদ্ধি আপনাদের পুরুষদের।

মঁসিয়ে কুকু এবার সুযোগ পেলেন কিছু বলার। এতো রেলের কণ্ডাক্টর গার্ডের পোশাক। আপনার কামরায় তল্লাসী চালাবার সময় হয়তো পড়ে গিয়ে থাকবে।

নাও ঠেলা। এটা পেয়েছি কোথায় জানেন? কাল রাতে ঘুমানোর আগে একটা পত্রিকা পড়ছিলাম। ঘুম পেয়ে যাবার ফলে আলোটা নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সকালে এটা দেখি রয়েছে বই-এর উপর। কাল রাতে তো কণ্ডাক্টরকে জানালার কোথাও দেখিনি, আমার মেয়ে কিন্তু বলে যে আমার কাজের খুঁত ধরা খুব কঠিন। শ্রীমতী হাবার্ড কথাগুলো বলে নিজেকে গর্বিত অনুভব করলেন।

বেশ। রাশেট লোকটা সুবিধের নয় তো আগেই বলেছিলেন; তা হলে মাঝের দরজাটা বন্ধ করেননি কেন?

আমার কিন্তু ভুল হয়নি, মনে হয় কোনো ফাঁকে কেউ খুলে রেখেছিল। তবে শোবার আগে সুইডিস ভদ্রমহিলা এসেছিলেন তাকেও বলেছিলাম ছিটকিনিটা ভালো করে দেওয়া আছে কিনা দেখতে। উনি না লক্ষ্য করে বলেছিলেন বন্ধই আছে। আর তাছাড়া একটা ভোলো হুকে রাখা ছিল।

সেটা হয়ত চাপা পড়ে যাবার ফলে ওনার নজর এড়িয়ে গেছে। যখন ওনাকে দরজা দেখতে বলেছিলেন তখন কি নিজে শুয়ে পড়েছিলেন?

হা। বই পড়ছিলাম, উনি এসে অ্যাসপিরিন চেয়েছিলেন।

কাল আরও একটা কাণ্ড হয়েছে। আমার কামরায় আসতে গিয়ে উনি পাশের কামরায় গিয়ে পড়েছিলেন। এরকম তো মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়।

ভদ্রমহিলা তাড়াতাড়ি মাপও নিয়েছিলেন।

 কিন্তু রাশেট অভদ্র ভাষায় বললেন। দেবী, তুমি যে বড্ড বেশি বুড়ি লাভ নেই কিছু।

ডাক্তার হাসি চাপতে গিয়ে একটু কাশলেন।

গম্ভীর হল শ্রীমতী হাবাডের মুখ।

 ছি ছি, কেউ এরকম ভাবে বলে নাকি আর সেটা নিয়ে হাসাহাসি করাটাও অভদ্রতা।

ডাক্তার তাড়াতাড়ি ক্ষমা চেয়ে নিলেন।

কোনো আওয়াজ কি পেয়েছিলেন রাশেটের ঘর থেকে?

আওয়াজ।, নাকডাকার আওয়াজ ছাড়া কিছুই পাইনি।

লোকটা আপনাদের কামরা থেকে পালাবার পর আর কি নাক ডাকার আওয়াজ পেয়েছিলেন?

কি মুশকিল। রাশেট তো মরে গেছে আর কে নাক ডাকবে।

ওঃ হ্যাঁ। আচ্ছা আপনি ডেইজি মামলার কিছু জানেন?

জানি না আবার? সত্যিই কাজের নয় পুলিশগুলো, খুনিটাকে ধরতেই পারল না।

আপনি শুনে খুব খুশী হবেন রাশেটই সেই খুনী।

 ভদ্রমহিলা লাফিয়ে উঠলেন উত্তেজনায়।

লোকটা সুবিধের নয় আগেই বুঝেছিলাম।

আচ্ছা আপনি আর্মস্ট্রং পরিবারের কাউকে চিনতেন?

না। ওরা কারোর সঙ্গেই মিশত না। তবে অসাধারণ রূপ এবং চমৎকার স্বভাবের ছিল ডেইজির মা। পুরো পরিবারটাই নষ্ট হয়ে গেল।

আপনার পুরো নাম আর ঠিকানাটা?

ক্যারোলিন মার্থা হার্বার্ড।

তিনি নাম ঠিকানা লিখে দিলেন।

লাল রঙের ড্রেসিং গাউন কি আছে আপনার?

না তো, একটা গোলাপী আর বেগুনি রঙের, ব্যস।

আসলে কাল রাতে যে মহিলা কে রাশেটের কামরায় ঢুকতে দেখা গিয়েছিল।

তবে এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই ওটা তো আমার কামরা নয় ওটা রাশেটের।

 কোনো মহিলার গলার আওয়াজ তাহলে পাশের কামরায় পেয়েছিলেন?

হু।

কই আগে তো বলেননি?

ছিঃ, এসব আলোচনা কিন্তু খুব সুরুচির নয় যেহেতু আমি একজন ভদ্রমহিলা!

রাত কটার সময় আপনি মেয়েটির আওয়াজ শোনেন।

কে জানে। কারণ ঘুম ভাঙতে সাড়া পেয়েছিলাম। কি ঘেন্নার কথা রাশেটের চরিত্র জানতে আমার আর বাকি নেই।

সেটা আপনার কামরায় তোক ঢোকার আগে না পরে?

আচ্ছা গেরো দেখছি, রাশেট তো মরেই গেছে, পরে কি করে হবে?

ও হ্যাঁ, সত্যি খুব বিরক্ত করলাম আপনাকে।

শ্ৰীমতী হার্বাড ব্যাগটা গুছিয়ে খানাকামরার দরজা পর্যন্ত যেতে পোয়ারো বললেন, এই রুমালটাতো আপনার?

ও রুমাল আমার কেন হবে?

না মানে রুমালের কোণে এইচ অক্ষরটা তোলা দেখে ….

আমি প্রত্যেক রুমালে পি, এম. এইচ, এই প্রথম অক্ষরগুলো তুলে রাখি। একটা অক্ষরে কি হবে? তাছাড়া যা দামী রুমাল। বিবিয়ানা করবার বয়সও নেই। আর আমার নাকটা এমন কিছু হীরে জহরত দিয়ে বাঁধানো নয় যে রেশম বা মসলিন দিয়ে না মুছলে ক্ষয়ে যাবে। এই কথাগুলো বলে মহিলা বেরিয়ে গেলেন।

মঁসিয়ে কুক পিয়ের মিশেলের বোম নিয়ে দেখলো।

আমি বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো, মিশেল কি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত?

দাঁড়ান ওসব পরে ভাবব। আগে সুইডিস ভদ্রমহিলাকে ডাকা যাক এই যে ওঁর পাসপোর্ট। গ্রেটা অলসঁ। বয়স ঊনপঞ্চাশ।

ভদ্রমহিলাকে ডাকা হল।

ভালোমানুষ চেহারার বোকা বোকা ধূসর চুল চুড়ো করে বাঁধা, চোখে চশমা, ধীর শান্ত প্রকৃতির। মহিলাটি ফরাসী ভাষায় বুঝতে এবং বলতে পারেন কথাবার্তাও তাই ফরাসীতেই হচ্ছিল। প্রথমে নাম, ঠিকানা, বয়স জিজ্ঞাসা করলেন। যদিও এগুলো পোয়ারোর জানা। অবিবাহিতা, একটা মিশনারী স্কুলের মেট্রন ইস্তাম্বুল এবং ধাত্রীবিদ্যায় পাশ।

আচ্ছা মাদমোয়াজেল এই ট্রেনে একটা হত্যাকাণ্ড…..।

হা। খুনীটি নাকি ওঁর কামরাতেই লুকিয়ে ছিল আমেরিকান ভদ্রমহিলা বলেছিলেন।

মিঃ রাশেটকে শেষবারের মতো আপনিই জীবিত দেখেন খবর পেয়েছি।

ঠিক বলতে পারব না। তবে ভুল করে ওঁর কামরায় ঢুকে পড়াটা একটা লজ্জার ব্যাপার হয়েছিল।

ওঁর সঙ্গে কি দেখা হয়েছিল?

বই পড়ছিলেন ক্ষমা চেয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসি।

 আপনাকে কিছু কি বলেছিলেন?

না মানে কথাগুলো ঠিক বুঝতে পারিনি।

তারপর?

আমি অ্যাসপিরিনের জন্য আমেরিকান ভদ্রমহিলার কাছে গিয়েছিলাম।

উনি কি রাশেটের আর ওঁর কামরার দরজা বন্ধ আছে কিনা দেখতে বলেছিলেন।

হা।

বন্ধ ছিল?

হা।

 তারপর?

আমি অ্যাসপিরিন খেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম।

তখন কটা বাজে?

আমি ঘড়িতে দেখেছিলাম তখন বাজে এগারোটা বাজতে পাঁচ।

 ঘুমিয়ে কি তাড়াতাড়ি পড়েছিলেন?

খুব তাড়াতাড়ি নয় মাথা ব্যথাটা কমে যাবার ফলে কিছুক্ষণ তো জেগেই ছিলাম।

তখন ট্রেন কি থেমেছিল?

মনে হয় না। কেননা আধ ঘুমে ভেবেছিলাম হয়ত কোনো স্টেশন এল।

 ওটা ভিনভোকি স্টেশন। আপনার তো এইটা কামরা।

হা।

আপনার বার্থ আপার না লোয়ার?

নিচের দশ নম্বর।

কোনো সঙ্গী কি ঐ কামরায় আছে আপনার?

 হা। বাগদাদ থেকে একটি ইংরাজ ভালো, ভদ্র, মার্জিত মেয়ে আছেন।

উনি কি ভিনভোকি ছাড়বার পর কামরার বাইরে এসেছিলেন?

না।

 কি করে বুঝলেন? আপনি তো ঘুমিয়েছিলেন।

ওপরের বার্থ থেকে উনি নামলে আমি নিশ্চয় জেগে যেতাম কারণ আমার ঘুম খুব পাতলা।

আপনি নিজে কি বেরিয়েছিলেন?

আজ সকালের আগে নয়।

কোনো লাল রং-এর সিল্কের কিমোনো কি আছে আপনার?

নাতো? ড্রেসিং গাউন আছে তবে তার রং লাল।

আপনার সহযাত্রী ডেবেনহ্যামের?

 হাল্কা বেগুনী রং-এর।

আপনি বুঝি ছুটিতে যাচ্ছেন?

 হা, বাড়ি যাচ্ছি তবে ল্যাসনে আমার বোনের কাছে আগে যাব।

আপনার বোনের নাম ও ঠিকানাটা যদি একটু লিখে…..

কিন্তু কি আছে, দিন লিখে দিচ্ছি।

আপনি কোনোদিন আমেরিকায় গেছেন?

না। একজন পঙ্গুলোকের দেখাশোনার কাজের জন্য কথা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। এমনিতে শুনেছি খুব দিলদরাজ হয় আমেরিকানরা।

আর্মষ্ট্রং মামলার কথা শুনেছেন?

 না তো কি হয়েছিল?

 পোয়ারো বলার পর গ্রেটা অঁলস-এর চোখ জলে ভরে গেল।

ওঃ মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয়। ভাবুন তো, ডেইজির মায়ের কথা। বিদায় নিলেন সুইডিস মহিলাটি।

কি সব লিখছিলেন পোয়ারো।

কৌতূহল না চাপতে পেরে কুক বললেন, কি লিখছেন সব?

 সমস্ত পরিকল্পনা মাফিক এগোতে হয় বলে কাগজটা দেখালেন।

রাত নটা পনের : ট্রেন বেলগ্রেড ছাড়ল।
রাত নটা চল্লিশ : রাশেটের কামরা ছেড়ে পরিচারক ঘুমের ওষুধ গুছিয়ে বেরিয়ে আসা।
রাত দশটা : ম্যাককুইন রাশেটের কামরা ছেড়ে বেরিয়ে আসা।
 রাত দশটা চল্লিশ: গ্রেটা অঁলস–এর ভুল করে রাশেটের কামরায় ঢোকা এবং শেষ জীবিত দেখেন। রাশেট বই পড়ছিলেন।
রাত বারোটা : ট্রেন ভিনভোকি ছাড়ে।
রাত সাড়ে বারোটা : ট্রেন বরফ ঝড়ের কবলে পড়ে।
রাত বারোটা সাইত্রিশ : রাশেটের কামরা থেকে ঘন্টায় আওয়াজ শুনে দরজায় কণ্ডাক্টর টোকা দিলে ফরাসী ভাষায় রাশেট বলেন স্য ন্য রিয়, জ্য মে সুই ঐ পেঁ।
 আন্দাজ একটা সতেরো : লোক ঢুকেছে তার কামরায় ঘন্টি টিপে জানান শ্রীমতী হার্বার্ড।

বাঃ খুব পরিষ্কার, মঁসিয়ে কুক মাথা নাড়ালেন।

আপনার কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়ছে না?

 না। সবই তো ঠিক পর পর সাজানো আছে, বোঝাই যাচ্ছে খুনটা হয়েছিল রাত সোয়া এগারোটা নাগাদ আন্দাজ। ভাঙা ঘড়িটা, শ্ৰীমতী হাবাডের কথা সবই মিলে যাচ্ছে। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে ঐ হুমদো ইতালিয়ানটাই খুনী কেননা ওরা খুব রাগচটা হয় এবং কথায় কথায় ছুরি চালায়। এবং ও শিকাগোয় থাকত।

তা ঠিক।

রাশেট এবং ও একই দলের। ইতালীয় ঘেষা কাসেট্টি নামটাও। দুষ্কর্মগুলো ওরা মিলেমিশে করত। কোনো কারণে মনকষাকষির সময় ইতালিয়ানটা পিছু নিয়ে ঠিক রাশেটকে মেরে ফেলেছে।

পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন অত সহজে বলা যায় না বন্ধু।

কেন নয়? আমি তো নিশ্চিত।

আর রাশেটের পরিচারক। তার কথামতো ইতালিয়ানটি তো দাঁতের ব্যথার ফলে একবারও কামরা ছেড়ে বেরোয়নি।

সেটাই তো মুশকিল হয়েছে।

পোয়ারো হাসলেন।

আপনার সত্যিই দুর্ভাগ্য। ভাগ্যিস ইতালিয়ানটির দাঁতের ব্যথা হয়েছিল। সেটাই তার পরম সৌভাগ্য।

যাকগে, পাপ কখনও চাপা থাকে না। একদিন না একদিন সব জানা যাবেই।

পোয়ারো মাথা নাড়াল।

 মশাই সবকিছু অত জলবৎ তরলং নয়।

.

০৫.

রাজকুমারীর সাক্ষ্য

বোতামটার সম্পর্কে জানার জন্য মিশেলকে ডাকা হল।

মিশেল এসে দাঁড়ালো।

মিশেল এই বোতামটা সম্ভবত তোমার পোশাকের। ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলার কামরা তল্লাসীর সময় পড়ে গেছে।

মিশেল নিজের পোশাকে হাত রাখল।

না আমার জামার বোতাম তো হারায়নি।

 অদ্ভুত তো।

 আমি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।

সে যে নির্দোষ তার দৃঢ়তায় প্রকাশ পেল।

কাল রাতে শ্রীমতী হাবাডের কামরা থেকে যে বোতামটা পাওয়া গেছে তাহলে নিশ্চয় যে কামরায় ঢুকেছিল তারই পড়ে গিয়ে থাকবে।

কুক বললেন, কিন্তু ওঁর কামরায় কেউ ঢোকেনি।

এ বোতামটা নিশ্চয় হত্যাকারীর, মিশেল কিছুটা বিচলিত হল।

আপনারা মিথ্যেই সন্দেহ করছেন। আমি এ ব্যপারে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমি জীবনে যে ভদ্রলোককে প্রথম দেখলাম তাকে খুন করার আমার স্বার্থটা কি!

শ্ৰীমতী হার্বাডের ঘন্টা বাজানোর সময় তুমি কোথায় ছিলে?

আমি তো বলেছি পাশের কোচে সহকর্মীটির সঙ্গে কথা বলতে গেছিলাম

 তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে।

দয়া করে তাই করুন আঁসিয়ে।

পাশের কোচের কণ্ডাক্টরকে ডাকার পর সেও একই কথা বলল। এবং এও বলল যে বুখারেষ্ট কোচের কণ্ডাক্টর ও সে ওই সময় গল্প করছিল। সবাই বরফ পড়া নিয়েই কথা বলছিল। প্রায় মিনিট দশেক পর মিশেল বলে সে ঘন্টার আওয়াজ পাচ্ছে। সে যখন ক্যাল কোচের দিকে এগোয় তখন বাকি দুজনও আওয়াজ পেয়েছিল।

তাহলে এই বোতাম এল কোথা থেকে?

মিশেল ছাড়া বাকি দুজনও একই বলল যে তাদের বোম খোয়া যায়নি, কেননা তারা হার্বাডের কামরার ধারে কাছেই যায়নি।

শ্রীমতী হার্বাডের দরজার কাছে গিয়ে করিডোরে কি তোমার কারোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল? ভালো করে ভেবে বল, কুক বললেন।

না মঁসিয়ে।

অদ্ভুত তো।

অদ্ভুত কিছুই নয় আসলে ব্যবধান হচ্ছে সময়ের। শ্রীমতী হার্বাড জেগে উঠে লোকটাকে দেখেন এক দু মিনিট নিথর হয়ে চোখ বুজে থাকেন। তখনই হয়তো লোকটা দরজা খুলে করিডোরে বেরিয়ে আসে। সঙ্গে সঙ্গেই উনি ডাক ঘন্টা বাজাতে শুরু করেন। ওই সময়ের মধ্যে লোকটা হয়ত কোথাও পালিয়ে….।

কিন্তু কোথায় যাবে? বাইরে তো তখন তুমুল বরফ ঝড় চলছে।

দুটো পথ আছে এক হয়তো সে বাথরুমে নতুবা অন্য কোনো কামরায় ঢুকে পড়ে ছিল।

 কিন্তু সব কামরায় তো লোক ছিল?

হা…

তবে সে কি তার নিজের কামরাতেই ঢুকেছিল, পোয়ারো সম্মতি জানালেন।

কণ্ডাক্টরের অনুপস্থিতিতে লোকটি নিজের কামরা ছেড়ে এসে রাশেটকে হত্যা করে। হিসেবে দেখা যাচ্ছে। তারপর করিডোরের দিকের দরজাটা বন্ধ করে দেয় এবং শ্রীমতী হার্বাডের কামরা দিয়ে নিজের কামরায় চলে যায়।

ব্যাপারটা এত সহজ নয় সেটা ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলেই বুঝতে পারবেন, পোয়ারো বললেন।

এরপর মিশেলকে চলে যেতে বললেন।

 পোয়ারো যাত্রী তালিকায় নজর দিলেন।

এখন আটজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলা বাকি। পাঁচজন ফাস্ট ক্লাসের– রাজকুমারী দ্রাগোমিরফ, কাউন্ট অফ কাউন্টেস, আন্দ্রেনী, কর্নেল আবাথনট, আর মিঃ হার্ডম্যান। তিনজন সেকেণ্ড ক্লাসের মিস্ ডেবেনহ্যাম, আন্তেলিও ফলকারেন্নি, আর রাজকুমারীর পরিচারিকা শ্ৰীমতী ইল্ডগ্রেদ স্মিট।

ইতালিয়ানটিকে বরং ডাকা যাক আগে।

আগে উপর থেকে শুরু করা যাক। রাজকুমারী যদি না আসতে চান তবে ওঁর কামরাতেই আমাদের যেতে হবে।

মিশেলকে খবর দিয়ে পাঠালেন ওঁনাকে আসার জন্য।

রাজকুমারী মাথা উঁচু করে দৃঢ় ভঙ্গী এক মুখের বিবর্ণ হলুদ কুৎসিত মুখ এবং চোখ দুটো চকচকে। ভেতরে অসীম মানসিক শক্তি এবং ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী মহিলা।

পোয়ারোর সম্ভাষণ থামিয়ে দিয়ে বললেন, এই বিশ্রী হত্যাকাণ্ডের জন্য আপনাদের কর্তব্য এবং যথাসাধ্য সাহায্যের জন্য আমি প্রস্তুত। আপনাদের বিচলিত হবার কোনো কারণ নেই মঁসিয়ে।

আপনারা কি জানতে চান বলুন?

আপনার পুরো নাম এবং ঠিকানাটা লিখে দিন।

নাতালিয়া দ্রাগোমিরফ। সতেরো ফ্লেবার অ্যাভিনিউ, প্যারিস।

 মাদাম আপনি বোধহয় কনস্তান্তিপোল থেকে বাড়ি ফিরছেন?

 হা। আমি এবং আমার পরিচারিকা অষ্ট্রিয়ান দূতাবাসে ছিলাম।

আপনি গতরাত্রে ডিনারের পর কি করছিলেন?

খানাকামরায় থাকাকালীন কণ্ডাক্টরকে বিছানা ঠিকঠাক করে রাখতে বলেছিলাম এবং খাওয়ার পরই শুতে চলে যাই।

এগারটা পর্যন্ত বইপত্র পড়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু বাতের ব্যথায় কষ্ট পাবার জন্য রাত পৌনে একটা নাগাদ পরিচারিকাকে ডাকতে পাঠাই, সে এসে মালিশ করে এবং বই পড়ে শোনায়। তারপর ঘুম এসে যাবার ফলে ও যে কখন চলে গিয়েছিল আমার মনে নেই তবে মনে হয় আধ ঘন্টা মত ছিল।

ট্রেন কি তখন চলছিল?

না।

কোনো অস্বাভাবিক শব্দ কি পেয়েছিলেন যতক্ষণ জেগে ছিলেন?

না।

আপনার পরিচারিকার নাম?

ইল্ডগ্রেদ স্মিট।

আপনার কাছে উনি আছেন কতদিন?

 পনেরো বছর।

 বিশ্বাসভাজন?

 সন্দেহাতীত ভাবে। আমার স্বামীর খাস তালুকের প্রজা ছিল ওর বাবা।

 আপনি নিশ্চয় আমেরিকায় গেছেন মাদাম।

 রাজকুমারী একটু অবাক হলেন হঠাৎ বিষয়ের পরিবর্তনের ফলে।

হ্যাঁ, অনেকবার।

আচ্ছা ওখানে আর্মষ্ট্রং পরিবারকে চিনতেন? যাঁদের পরিণতি অত্যন্ত করুণ ও দুঃখজনক…।

বেদনা বিধূর হয়ে উঠল রাজকুমারীর গলার স্বর।

মঁসিয়ে ওঁরা আমার বন্ধুস্থানীয় ছিলেন।

কর্নেল আর্মষ্ট্রংকে তাহলে ভালোভাবেই চিনতেন আপনি?

ওঁকে তেমন নয় তবে ওঁর স্ত্রী সোনিয়া আমার মেয়ের মতো ছিল। ওঁর মা লিণ্ডা আর্ডেন আমার পুরনো বান্ধবী।

উনি কি মারা গেছেন?

না না, শোকে পাথর হয়ে যাবার ফলে একাকীত্ব নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন এবং আজকাল চলাফেরাও বেশি করতে পারেন না।

আর একটা মেয়ে ছিল তো ওঁর?

 হা। সে অবশ্য অনেক ছোট সোনিয়ার থেকে।

মেয়েটি নিশ্চয় জীবিত?

নিশ্চয়ই।

 বলতে পারেন কোথায় আছে?

রাজকুমারী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পোয়ারোর দিকে তাকালেন।

আচ্ছা এসব জিজ্ঞাসার কারণ, এর সঙ্গে হত্যাকাণ্ডের কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক থাকার ফলেই জিজ্ঞাস্য কারণ যিনি খুন হয়েছেন তিনি ডেইজির হত্যাকারী।

আমাকে ক্ষমা করবেন। সত্যিই এ খবরটা আমার কাছে অত্যন্ত আনন্দদায়ক।

আর লজ্জা দেবেন না সত্যি এটা স্বাভাবিক কারণ ওঁরা আপনার পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। আচ্ছা লিণ্ডা আর্ডেনের ছোট মেয়েটা কোথায় এখন?

আমি এ ব্যাপারে সঠিক জানি না, তবে শুনেছিলাম একজন ইংরেজ বিয়ে করে ইংল্যাণ্ডের বাসিন্দা। আর কিছু জানতে চান?

একটাই প্রশ্ন মাদাম। আপনার ড্রেসিং গাউনের রঙ কি?

অদ্ভুত প্রশ্ন। নীল রেশমের।

ধন্যবাদ আপনার সহযোগিতার জন্য।

রাজকুমারী হাত নাড়লেন।

ও কিছু নয়। আমার অপরাধ যদি না নেন তবে আপনার নামটা আমার খুব চেনা লাগছে।

এরকুল পোয়ারো।

মিনিট খানেক চুপ থাকার পর অস্ফুট স্বরে বললেন এরকুল পোয়ারো। হ্যাঁ এইবার মনে পড়েছে ভবিতব্য।

বেরিয়ে গেলেন দ্রাগোমিরফ।

আহা চমৎকার মহিলা।

মোহিত হয়ে গেলেন মঁসিয়ে কুক।

চিন্তিতভাবে পোয়ারো মাথা নেড়ে বললেন, আমাকে একটু ভাবিয়ে দিয়ে গেলেন বন্ধু। ভবিতব্য কথার মানে কি?

.

০৬.

কাউন্ট আর কাউন্টেস আন্দ্রেনীর সাক্ষ্য

ডেকে পাঠানো হল কাউন্ট আর কাউন্টেস আন্দ্ৰেনীকে। একাই এলেন কাউন্ট। দেখলে ইংরেজ বলে মনে হবে। ছ ফুট লম্বা, চওড়া কাঁধ। সুবেশ মার্জিত এক চমৎকার দেখতে।

কাউন্ট এসে বললেন, আমি কি করতে পারি আপনাদের জন্য বলুন? এবং কেন ডেকে পাঠিয়েছেন?

একটু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আপনাকে এখানে ডাকা হয়েছে যাত্রী এবং রেল কর্তৃপক্ষের তরফে কারণ মাঝ রাতে একটা ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড হবার ফলে।

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই। তবে এ ব্যাপারে আমি হয়ত কোনো সাহায্যই করতে পারব না, কেননা কাল রাতে আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনেই ঘুমিয়েছিলাম।

আপনি কি ওই মৃত ব্যক্তির পরিচয় জানেন?

 ওই টেবিলে রুক্ষ চেহারার আমেরিকান ভদ্রলোকটির!

হা। ঠিকই ধরেছেন।

নাতো। তবে ওর নামটাম নিশ্চয় পাসপোর্টে আছে।

পাসপোর্টে নাম আছে রাশেট কিন্তু ওটা ওর নাম নয়। ওঁর প্রকৃত নাম কাসেট্টি, আমেরিকান, কুখ্যাত খুনে ও ছেলেধরা।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে পোয়ারো নিরীক্ষণ করছিলেন কাউন্টকে তবে ভাবলেশহীনভাবে।

কাউন্ট বললেন, তাই নাকি। তাহলে রহস্যের কিছু আলোকপাত হবে। সত্যিই আমেরিকা–আজব দেশ।

আপনি আমেরিকায় গেছেন কোনোদিন?

 এক বছর ওয়াশিংটনে ছিলাম।

আর্মষ্ট্রং পরিবারকে চিনতেন?

এই নামে অনেকেই আছেন ঠিক বুঝতে পারছি না।

ওঁরা পাশাপাশি বারো এবং তেরো নম্বর কামরায় আছেন।

কখন শুতে গিয়েছিলেন কাল রাতে?

কাল রাতে খাচ্ছিলাম যখন তখন কণ্ডাক্টর আমাদের বিছানা পেতে দেয় ওখান থেকে ফিরে অন্য কামরায় কিছুক্ষণ তাস খেলি।

কোনো কামরায়?

তেরো নম্বরে। আমার স্ত্রী রাত এগারটায় শুয়ে পড়ে, আমি অন্য কামরায় শুতে যাই, আজ সকালের আগে ঘুম ভাঙেনি।

আপনার স্ত্রীর?

ওতো ঘুমের বড়ি খেয়ে শোয় ট্রেনে। আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারলাম না বলে দুঃখিত।

আপনার নাম ঠিকানাটা?

কাউন্ট নাম ঠিকানা লিখে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।

আমার মনে হয় না আমার স্ত্রীর এখানে আসার দরকার আছে কেননা ও কিছুই বলতে পারবে না।

তা ঠিক তবে দু একটা কথা বলা দরকার।

না না দরকার নেই।

দেখুন এটা আমাদের তদন্তের অপরিহার্য অঙ্গ।

 যা ইচ্ছে আপনাদের, বলে বেরিয়ে গেলেন।

পোয়ারো স্বামী-স্ত্রীর পাসপোর্টটা দেখলেন।

ভদ্রমহিলার নাম এলেনা মারিয়া প্রাকৃবিবাহ পর্বে গোল্ডেনবার্গ। বয়স : কুড়ি। পাসপোর্টে একটু দাগ আছে।

কুক বললেন, দেখবেন, আমাদের চাকরী আর সম্মান যেন না যায়; কেননা এঁরা সব উপর তলার মানুষ।

আপনার ঘাবড়ানোর কোনো কারণ নেই।

 রাজহংসীর মতো কাউন্টেস আন্দ্রেনী ঘরে ঢুকলেন।

আপনারা আমায় ডেকেছেন?

 হা মাদাম কর্তব্যের খাতিরেই।

আমি জানতে চাই কাল রাতে আপনি….

আমি ঘুমিয়েছিলাম।

ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলা অত হৈ চৈ করলেন পাশের কামরায়….।

একটা ওষুধ খাওয়ার ফলে ঘুম ভাঙেনি।

আপনার পাসপোর্টে নাম ধাম যা আছে সব সত্যি তো?

 নিশ্চয়ই।

তাহলে একটা সই করে দিন।

সই করে দিলেন কাউন্টেস এলেনা আন্দ্রেনী।

মাদাম আপনি কি স্বামীর সঙ্গে আমেরিকায় ছিলেন?

মেয়েটির মুখ ঈষৎ লাল হলো।

না। আমাদের মোটে এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে।

ধন্যবাদ। আচ্ছা আপনার স্বামী কি ধূমপান করেন?

হা।

পাইপ?

না। সিগারেট আর সিগার।

কাউন্টেস আন্দ্রেনী উঠে দাঁড়ালেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?

এমনটাই জানেন তো গোয়েন্দারা এরকম উদ্ভট প্রশ্ন করেই থাকে। আপনার ড্রেসিং গাউনটা কি রং-এর?

কাউন্টেস হেসে উঠলেন।

 গমের দানার রং-এর সিফন। সত্যিই অদ্ভুত প্রশ্ন কিন্তু এটা জানা কি দরকার ছিল?

 নিশ্চয়ই।

সত্যিই আপনি গোয়েন্দা! যুগোশ্লাভিয়ার কোনো গোয়েন্দা এই ট্রেনে থাকতে পারেন ভাবতেই পারিনি।

আমি কোনো একটা দেশের গোয়েন্দা নই আমার বিচরণ সর্বত্রই। বেশির ভাগ সময়ই লণ্ডনে থাকি। ইংরেজী বলতে পারেন আপনি?

ঠিক আছে আর আটকাব না।

মাথাটা নুইয়ে খানাকামরা ছেড়ে গেলেন এলেনা।

কুক রূপের প্রশংসা করে জিজ্ঞাসা করলেন তার কাজ এখনো কতদূর?

কোথায় আর এই দম্পতি তো ঘুমিয়েই কাটিয়েছেন।

এবার ইতালিয়ানটাকে ডাকা যাক।

পোয়ারো কোনো জবাব না দিয়ে ব্যস্ত ছিলেন পাসপোর্টের দাগ লাগা জায়গাটা নিয়ে।

.

০৭.

 কর্নেল আর্বাথনটের সাক্ষ্য

 কর্নেল আবাথনটের ফরাসী ভাষা জ্ঞান কম থাকার ফলে ইংরেজীতেই সমস্ত কিছু অর্থাৎ নাম, ধাম বয়স, পেশা জিজ্ঞাসা করার পর বললেন ভারতবর্ষ থেকে ছুটিতে কি দেশে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু জাহাজে গেলেন না কেন?

এটা একান্তই ব্যক্তিগত।

 ভারতবর্ষ থেকে সোজা আসছেন?

 একটু কাজ ছিল বাগদাদে।

কর্নেলকে এই সব প্রশ্ন করায় একটু অসন্তুষ্ট হলেন।

বাগদাদে তিনদিন ছিলেন। বাগদাদ থেকে তো ইংরেজ তরুণীটিও আসছেন, ওঁর সঙ্গে কি বাগদাদেই আলাপ?

না। ট্রেনেই কারকুক থেকে নিসিবিন যাওয়ার পথে।

কিছু মনে করবেন না কর্নেল একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি বলে। মিস্ ডেবেনহ্যাম সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?

আপনার এই প্রশ্নের তাৎপর্য না জানা পর্যন্ত উত্তর দিতে আমি অপারগ।

আমাদের অনুমান এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে কোনো মহিলা আছেন এই কারণে এবং কমপক্ষে বারোবার আঘাত করা হয়েছে। আমার কাজ হলো উপস্থিত সমস্ত মহিলাদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়া। অন্য সমস্ত মহিলাদের থেকে ডেবেনহ্যাম সম্পূর্ণ আলাদা তাই যদি-এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেন সেই হেতু জিজ্ঞাসা করা।

সত্যিকারের ভদ্রমহিলা যাকে বলে তিনি তাই।

 তাহলে আপনার মতে হত্যা করাটা ওঁর পক্ষে সত্যিই অসম্ভব?

হা। মিস ডেবেনহ্যামের সম্পূর্ণ অপরিচিত ওই নিহত ব্যক্তি, আর তাছাড়া লাভটাই বা কি?

আপনাকে বুঝি সেইরকমই বলেছেন?

হা। প্রথম দর্শনেই ওঁকে ওঁর খারাপ লেগেছে। যদি কোনো মহিলা এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকেন তবে ডেবেনহ্যাম সম্পর্কে আমার কথায় ভরসা করতে পারেন। আর যেই করুন না কেন ডেবেহ্যাম সম্পূর্ণ ভাবে এ ব্যাপারে নির্দোষ।

কি আশ্চর্য। উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?

জবাবে কর্নেল পোয়ারোর দিকে বিরক্তভাবে তাকালেন এবং কাগজ পত্রের দিকে চোখ নামালেন।

একটা কথা কর্নেল, আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাত সওয়া একটা নাগাদ খুন হয়েছে এবং এও জানতে হচ্ছে সেই সময় প্রত্যেক যাত্রী বা যাত্রীনিরা কি করছিলেন?

আমি ওই সময়ে নিহত ভদ্রলোকের সেক্রেটারীর সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম।

 উনি আপনার কামরায় এসেছিলেন নাকি আপনি গিয়েছিলেন?

আমি ওঁর কামরায় গিয়েছিলাম।

 মিঃ ম্যাককুইন তো?

হ্যাঁ।

উনি কি পূর্ব পরিচিত আপনার?

না। ট্রেনেই ওঁনার সঙ্গে গল্প করছিলাম, ভারতবর্ষ সম্পর্কে ভুল ধারণা থাকার ফলে ওই নিয়ে আলোচনা করছিলাম। অবশ্য আমেরিকানদের বিশেষ পছন্দ করি না তবে উনি বেশ ফুর্তিবাজ। রাজনীতি নিয়েও চলছিল হঠাৎ রাত পৌনে দুটো ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখেছিলাম।

আড্ডা থামিয়ে কি করলেন?

নিজের কামরায় শুয়ে পড়লাম।

বিছানা পাতা ছিল?

হা।

পনেরো নম্বর কামরা।

তার মানে খানাকামরার দিক থেকে হিসেব করলে সব শেষের ঠিক আগেরটা।

হ্যাঁ।

কণ্ডাক্টর কোথায় ছিল আপনি যখন কামরায় গেলেন?

কোণের টেবিলে বসে কাজ করছিল। অবশ্য আমি বেরিয়ে আসবার পরই মিঃ ম্যাককুইন তাকে ডেকে পাঠান।

কেন?

নিশ্চয়ই বিছানা করবার জন্য।

মিঃ ম্যাককুইনের কামরায় আপনারা দুজন যখন গল্প করছিলেন তখন কাউকে কি করিডোর দিয়ে যাতায়াত করতে দেখেছিলেন একটু ভেবে বলুন তো?

তা বেশ কয়েকজন হবে। লক্ষ্য করিনি।

না মানে, আপনাদের আলাপ আলোচনার শেষ দেড় ঘন্টার মধ্যে। ভিনভোকিতে আপনারা তো নেমেছিলেন?

হা। মিনিট খানেকের জন্য তবে ঠান্ডায় চলে এসেছি।

ভালো করে ভেবে দেখুন ঠান্ডা ছিল বাইরে, আপনারা আবার কামরায় এসে বসলেন। আপনি ধূমপান করছিলেন সিগারেট বা পাইপ….

পাইপ, ওটাই আমার পছন্দ।

বেশ রাত তখন অনেক হয়েছে। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। পৃথিবীর নানা সমস্যায় আপনারা আলোচনারত, বেশির ভাগই শুয়ে পড়েছে। সেই সময় কেউ কি করিডোর দিয়ে গেছিল?

আমি সত্যিই লক্ষ্য করিনি।

আপনি তো সেনাবাহিনীর লোক আপনার নিশ্চয় পর্যবেক্ষণ শক্তি অন্য কারো তুলনায় বেশি।

না মনে করতে পারছি না। একবার বোধহয় কণ্ডাক্টর গিয়েছিল। তারপর… একজন মহিলা। মৃদু খন খন আওয়াজ পেয়েছিলাম জামাকাপড়ের আর এক ঝলক মিষ্টি গন্ধ….

দামী সেন্টের? ভদ্রমহিলা বয়স্কা না তরুণী? হয়তো।

 তখন হতে পারে রাত তেমন গভীর নয়। আসলে সঠিক সময়টা বলতে পারব না। কিন্তু মনে হয় সেটা ভিনভোকি ছাড়ার পর।

এরকম মনে হল কেন?

 অনেক রাতে আমরা রাশিয়া নিয়ে আলোচনা করছিলাম সেটা নিশ্চিত।

 আপনি আমেরিকায় গেছেন কখনও?

না তেমন ইচ্ছাও নেই।

কর্নেল আর্মস্ট্রং নামে কাউকে চেনেন।

আর্মষ্ট্রং! আর্মস্ট্রং, দু তিনজনকে চিনি একজন টনি আর্মষ্ট্রং আর একজন সেলবি আর্মষ্ট্রং… কিন্তু উনি তো মারা গেছেন।

আমি যার কথা বলছি তিনি একজন আমেরিকান মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন এবং তার একমাত্র সন্তানকে অপহরণ করা হয়।

ও হা হা। কাগজে পড়েছিলাম তবে ওনার সঙ্গে আলাপ ছিল না। শুনেছি খুবই জনপ্রিয় এবং ভিক্টোরিয়া ক্রসও পেয়েছিলেন।

তিনিই হত্যাকারী ঐ শিশুটির যিনি এই ট্রেনে নিহত হয়েছেন।

কঠোর হয়ে উঠল কর্নেলের চোখ মুখ।

তবে তো ভালোই হয়েছে যদিও এইসব ক্ষেত্রে আইন আদালতের আশ্রয় নেওয়াই ভালো।

আপনি বোধ হয় ব্যক্তিগত প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করেন না?

না। অনর্থক রক্তপাত হৈ চৈ আমার রুচিবিরুদ্ধ।

আমার আর কোনো জিজ্ঞাসা নেই শুধু একটা কথা, কাল রাতে কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখেছিলেন?

কর্নেল দু এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেন।

না মানে। আমি কামরায় ফিরে যাবার সময় ষোলো নম্বরের ভদ্রলোক মাথা উঁচু করে উঁকি দিচ্ছিলেন। আমাকে দেখেই ভেতরে ঢুকে যান অবশ্য এ আর এমন কি?

ধন্যবাদ কর্নেল আমার আর কোনো প্রশ্ন নেই।

আমি শুধু বলতে চাই মিস ডেবেনহ্যামকে সন্দেহ করবেন না। উনি একজন সাচ্চা ইংরেজ।

মিঃ রাশেটের কামরা থেকে পাইপ ক্লিনার পাওয়া গেছে এবং কর্নেল পাইপ খান এবং মিঃ রাশেট শুধুই সিগার খেতেন। বললেন পোয়ারো।

আপনার ধারণা কি?

এক কর্নেল আবাথনটই স্বীকার করেছেন উনি পাইপ খান এবং আর্মষ্ট্রং-এর নাম শুনেছেন এবং যা বলেছেন তার থেকে বেশিও হতে পারে।

অর্থাৎ হতে পারে কর্নেলই….

না না। একজন সম্ভ্রান্ত ফৌজী অফিসার কখনই একাজ করতে পারেন না। এবং তা মনস্তাত্বিক দিক দিয়ে অসম্ভব।

.

০৮.

মিঃ হার্ডম্যানের সাক্ষ্য

প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের মধ্যে তিনিই সর্বশেষ ব্যক্তি। সুপ্রভাত, বলুন কি সাহায্য করতে পারি?

খুনের ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চয় শুনেছেন মিঃ হার্ডম্যান?

হ্যাঁ।

আমাদের সব যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা কর্তব্য। স্বচ্ছন্দে। এটাই তো কাজ।

পাসপোর্ট দেখলেন পোয়ারো, আপনি সাইরাস রেথম্যান হার্ডম্যান। আমেরিকার নাগরিক, বয়স একচল্লিশ। টাইপরাইটিং কোম্পানির ভ্রাম্যমান এজেন্ট।

হ্যাঁ।

 ইস্তাম্বুল থেকে প্যারিসে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ।

কারণ?

ব্যবসা।

প্রথম শ্রেণীতেই যাতায়াত করেন সবসময়?

 হ্যাঁ। কোম্পানির খরচাতেই।

কাল রাতের ব্যাপার কতটুকু বলতে পারেন?

 কিছু না।

সে তো হয় না। কালরাতে খাবার পর আপনি কি করছিলেন?

একটু ভেবে বললেন, আমি জানতে চাই আপনারা এসব জিজ্ঞাসা করার কে?

ইনি মঁসিয়ে কুক রেল কোম্পানির ডিরেক্টর আর উনি ডাক্তার মৃতদেহ পরীক্ষা করেছিলেন।

আর আপনি?

আমি এরকুল পোয়ারো, এই হত্যার তদন্তের ভার আমাকে নিয়োগ করা হয়েছে কোম্পানির তরফ থেকে।

আপনার নাম আমি শুনেছি। আমার সত্যি পরিচয়টা জানিয়ে দেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আমারও তাই মত।

আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না তবুও নৈতিক দায়িত্ব কিছু থেকেই যায় তাই বলছি। বলে একটা কার্ড দিলেন তিনি পোয়ারোকে।

মিঃ সাইরাস বি হার্ডম্যান।

ম্যাকনীলস ডিটেকটিভ এজেন্সী।

 নিউ ইয়র্ক।

 পোয়ারো এর আগেই এই ফার্মের সাথে পরিচিত তবুও বললেন, এর অর্থ?

আমি ইস্তাম্বুলে এসেছিলাম। ওখানে কাজ হয়ে যাওয়ার পর ফিরে যাব তারপর এই চিঠিটা পাই।

চিঠিটা পড়লেন পোয়ারো ওপরে তোকাতলিয়ান হোটেলের ঠিকানা :

প্রিয় মহাশয়,

বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারলাম আপনি ম্যাকনীলস ডিটেকটিভ কোম্পানির কর্মী। যদি অনুগ্রহপূর্বক আজ বিকেল চারটায় এই হোটেলে সাক্ষাৎ করেন তবে বিশেষ বাধিত হব।

নমস্কারান্তে
ভবদীয়
এম. ই. রাশেট

বুঝলাম।

 বললেন পোয়ারো।

আমি সময় মতোই রাশেটের সাথে দেখা করি উনি দুটো উড়ো চিঠি আমায় দেখিয়েছিলেন।

মিঃ রাশেট কি খুব ভয় পেয়েছিলেন?

ওনার মুখের ভাবে উনি প্রকাশ করেননি কিন্তু মনে মনে যথেষ্ট মুষড়ে পড়েছিলেন। একই ট্রেনের যাত্রী হওয়ার ফলে উনি চেয়েছিলেন যাতে ওঁর নিরাপত্তার সম্পূর্ণ ভার আমি নিই কিন্তু সব চেষ্টাই বৃথা হল।

উনি কি কোনো নির্দেশ দিয়েছিলেন নিরাপত্তার বিষয়ে?

হ্যাঁ। উনি বলেছিলেন ট্রেনে পাশের কামরাটাতেই আমি থাকব। কিন্তু ভাগ্যের বিপর্যয় আমার জুটল ষোল নম্বর কামরা। অবশ্য কাজ করার পক্ষে এটা সবচেয়ে সুবিধা ছিল। নজরও ভালো রাখা যেত। সামনে শুধু খানাকামরা আর প্ল্যাটফর্মে নামবার দরজাটা তাও সেটাতে হুড়কো লাগানো থাকে। একমাত্র বাইরে থেকে ঢুকবার রাস্তা পেছনের ছোট দরজাটা আর নয়তো ট্রেনের একদম পেছন থেকে করিডোর ধরে সোজা এগিয়ে আসা। আমার কামরাটা এমনই জায়গায় যে ফাঁকি দেওয়ার রাস্তাই নেই।

কিছু জানেন হত্যাকারী সম্পর্কে?

একটা বর্ণনা উনি আমায় দিয়েছিলেন।

একজন ছোটোখাটো মানুষ গাঢ় বাদামী চেহারা, মেয়েলি কণ্ঠস্বর। এবং এও বলেছিলেন যে প্রথম রাতে হয়তো কিছু হবে না অতর্কিতে দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় রাতে।

তাহলে সবই জানতেন মিঃ রাশেট, বললেন মঁসিয়ে কুক।

হ্যাঁ, সবই চেপে রেখেছিলেন অন্ততঃ ম্যাককুইনের কাছে ওঁর মনিব।

 আচ্ছা মিঃ হার্ডম্যান ওঁর জীবনহানির ভয় ছিল কেন জানেন?

না। উনি সেটা বলতে চাননি। আততায়ী ওঁর রক্তদর্শন করতে চায় এটাই বলেছিলেন।

আপনি কি ওঁর আসল পরিচয় জানেন?

কোনো লোকটির?

 রাশেটের।

আপনি কি বলতে চাইছেন সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না।

রাশেটের আসল নাম কাসেট্টি। আর্মষ্ট্রং হত্যা মামলার মূল গায়েন।

আচ্ছা তাই নাকি! না সত্যিই আমি চিনতে পারিনি। যখন ডেইজি মামলা চলছিল তখন আমি পশ্চিমে গেছিলাম। তবে ছবিটবি দেখেছিলাম তবু ফোটোগ্রাফারদের যা গুণ নিজের মা বাপকেই চিনতে অনেক সময় বেশ নষ্ট হয়। তাহলে রাশেটের তো অনেকজন শত্রু ছিল।

রাশেট বর্ণিত হত্যাকারীর সঙ্গে আর্মষ্ট্রং পরিবারের কারোর কি মিল আছে বলতে পারেন?

না। সবাই তো মারা গেছেন বলেই জানি।

 একটা মেয়ে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল জানালা দিয়ে মনে আছে।

হ্যাঁ হ্যাঁ। মেয়েটি বিদেশী ছিল। তাই তার আত্মীয়স্বজনের জানাটা বিচিত্র নয়। তবে আরও তো মামলা ঝুলছিল কাসেট্টির সেই সময় কাজেই সেটা ডেইজি হত্যা মামলা না হয়ে অন্য কোনোও হতে পারে।

ডেইজি হত্যার ঘটনা এই নৃশংস খুনের কারণ তার প্রমাণ আমাদের হাতে আছে।

 মিঃ পোয়ারো আমি ডেইজি হত্যা মামলা সম্পর্কে কিছুই জানি না।

কাল রাতে কি কি ঘটেছিল সেটা বলে যান।

আমার বক্তব্য খুবই কম। আমি দিনে ঘুমিয়ে রাতে জেগে নজর রাখতাম। প্রথম রাতে সন্দেহজনক কিছুই ঘটেনি। কাল রাতেও তাই দরজা ফাঁক করে উঁকিও দিয়েছিলাম কিন্তু কোনো আগন্তুকও চোখে পড়েনি।

আপনি নিশ্চিত?

নিশ্চয়ই। এ আমি হলফ করে বলতে পারি যে বাইরে থেকে কোনো লোক ট্রেনে ওঠেনি আর পেছনের কোচ থেকে কেউ এদিকে আসেনি।

আপনি দরজার ফাঁক দিয়ে কি কণ্ডাক্টরকে দেখতে পাচ্ছিলেন?

হ্যাঁ। ও তো বসে ছিল।

ভিনভোকি ছাড়বার পর একবারও নিজের জায়গা জেড়ে অন্যত্র গিয়েছিল কি?

– হ্যাঁ। দুবার। ট্রেন থেমে যাবার ঠিক পরেই ঘন্টার আওয়াজে সাড়া দিতে যায়। পেছনের কোচে যায় সে আমার সামেন দিয়েই, সেখানে মিনিট পনেরো ছিল। কেউ মনে হয় পাগলের মতো ডাক ঘন্টা বাজাচ্ছিল তাই শুনে দৌড়ে আসে। আমিও বাইরে বেরিয়ে যাই কি হয়েছে দেখতে। মনে হয় আমেরিকান প্রৌঢ়াটির কাণ্ড। তার অন্য কামরায় ডাক পড়তে সেখানে জলের বোতল নিয়ে যায়। শেষে বিছানা পাতার তলব আসে তারপর আর নড়েনি নিজের জায়গা ছেড়ে।

ঘুমোচ্ছিল কি?

 হতে পারে খুঁটিয়ে দেখিনি।

এই কাগজটাতে সই করে দিন।

আপনাকে যদি দরকার পড়ে কেউ কি এমন আছে যে আপনার প্রকৃত পরিচয় জানে।

এই ট্রেনে? না বোধহয়। তবে ম্যাককুইনের বাবার দপ্তরে কয়েকবার গেছি। কিন্তু অত ভীড়ে আময় চিনে রাখাটা মোটেই সম্ভব নয়। তবে নিউইয়র্কে আপনি বরং জেনে নিতে পারেন এবং আমি সত্যি কথাই বলছি এবং আপনার সাথে আলাপ করে আমি খুবই খুশী হয়েছি।

মিঃ হার্ডম্যানের দিকে সিগারেটকেসটা এগিয়ে দিলেন পোয়ারো।

আপনি কি পাইপ পছন্দ করেন?

না। হার্ডম্যান সিগারেট তুলে নিয়ে হালকা পায়ে বেরিয়ে গেলেন।

কি মনে হয় আপনাদের লোকটার পরিচয় কি সত্যি?

ডাক্তার কনস্টানটাইন বললেন।

হ্যাঁ। মনে হয় না সাহস পাবে মিথ্যে কথা বলবার।

উনি কিন্তু একটা দরকারী তথ্য দিলেন যা হলো হত্যাকারীর বর্ণনাটা, বললেন কুক।

হ্যাঁ।

পোয়ারো বললেন, বর্ণনাটি এমনই যে কোনো মিল নেই এই ট্রেনের যাত্রীদের সঙ্গে।

.

০৯.

ইতালিয়ান যাত্রীর সাক্ষ্য

আন্তেলিও ফলকারেল্লি হাজির হলেন সাক্ষ্য দেবার জন্য। ইতালিয়ান মার্কা চেহারা সুন্দর স্বাস্থ্য লালচে রঙ, মুখে শিশুর সারল্য। একটু ইতালিয় ঘেঁষা চমৎকার ফরাসী ভাষায় কথা বলেন।

আপনার নাম আস্তেলিও ফলকারেল্লি।

হ্যাঁ।

 বর্তমানে আমেরিকার নাগরিক?

হ্যাঁ, ব্যবসার সূত্রে।

 আপনি ফোর্ড মেরি কোম্পানির এজেন্ট?

 হ্যাঁ।

একবার কথা শুরু করলে থামতেই চান না। বললেন ব্যবসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য।

আপনি তাহলে আমেরিকায় বছর দশেক আছেন?

হ্যাঁ। তারপর স্মৃতিচারণ করলেন মা এবং বোনের।

যিনি খুন হয়েছেন আপনার সঙ্গে কি তার আলাপ পরিচয় ছিল?

না, ওরা ওপর তলার আর আমরা তার সঙ্গে মেশার সুযোগ পাব কি করে বলুন তবে বোঝা যায় উনি খুব সুবিধের ছিলেন না।

ঠিকই ধরেছেন ও কুখ্যাত খুনে আর ছেলে ধরা।

 দেখলেন তো এই শর্মা মানুষ চিনতে ভুল করে না।

আর্মস্ট্রং মামলার কথা মনে আছে?

মনে নেই তবে চেনা চেনা লাগছে একটা ছোট্ট মেয়েকে চুরি করা হয়েছিল…

হ্যাঁ খুবই দুঃখের।

 ঠিক কিন্তু খুবই আজব দেশ আমেরিকা।

আপনি আর্মষ্ট্রং পরিবারের কাউকে চিনতেন?

না। তবে বলা শক্ত যখন ওখানে গেলাম….।

হাতে সময় কম। পোয়ারো বললেন, কাজের কথায় আসি।

 কাল রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর কি করছিলেন?

রাতে খাওয়ার পর খাবার টেবিলে ঐ আমেরিকান ভদ্রলোকের সাথে কথা বলছিলাম। ঐ যে যিনি টাইপের রিবন বেচেন। তারপর নিজের কামরাতেই চলে আসি। আমার সহযাত্রীটি মশাই এক গোমড়া মুখো ইংরেজ, যিনি মারা গেছেন তার পরিচারক। আমি কামরায় গিয়ে ওকে দেখতে পাইনি বোধহয় প্রভুর খিদমদগারী করতে গিয়েছিল। ফিরলেন যখন গোমড়া মুখ করে। কথাবার্তা তো বললেনই না একখানা কেতাব খুলে বসলেন, তারপর কণ্ডাক্টর বিছানা ঠিক করে দিতে এল। চার আর পাঁচ নম্বর বার্থ তো?

হ্যাঁ। শেষের কামরাটা। আমার বার্থটা উপরে। ধূমপান করছি আর বই পড়ছি। দাঁতের ব্যথায় কাবু ইংরেজটি একটা বিটকেল গন্ধওয়ালা দাওয়াই লাগালেন তারপর শুয়ে শুয়ে কাতরাতে লাগলেন। একটু পরেই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিন্তু যখনই ঘুম ভেঙেছে দেখি ভদ্রলোক তখনও কাতরাচ্ছেন।

সারা রাতে বাইরে বেরিয়েছিলেন কি উনি?

না।

কখনও কোনো কথা উঠল ওনার মনিব সম্বন্ধে বলেছিলেন?

বলছি তো উনি বিশেষ কথা বলেন না।

আপনি পাইপ না সিগারেট খান।

 শুধু সিগারেট।

একটা সিগারেট দিলেন পোয়ারো।

 আপনি শিকাগোয় গেছেন কখনও, কুক বললেন?

 হ্যাঁ। চমৎকার। তবে নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, আর ডেট্রয়েট ভালো লাগে আমার।

পোয়ারো একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললেন, এইখানে নাম সই করে ঠিকানাটা লিখে দিন।

বেশ আর কোনো দরকার নেই তো। চলি তাহলে, ট্রেনটা যে কখন চলবে একটা ভালো কাজ মিলনে পেয়েছিলাম সেই দাঁওটাও মারা গেল।

বিদায় নিলেন ফলকারেল্লি।

আমেরিকায় তো উনি অনেকদিন আছেন আর জাতে ইতালীয় এবং এরা ছুরি চালাতে সিদ্ধহস্ত আর ভাষণে মিথ্যেবাদীও হয়, আমি এই জাতটাকে একদম সহ্য করতে পারি না। পোয়ারো আপনার মনস্তত্ব কি বলে?

পোয়ারো বললেন, তা ঠিক এই জাতটার মাথা খুব গরম কিন্তু এখানে খুব পরিকল্পনা মাফিক খুনটা করা হয়েছে এবং যে আছে এর পেছনে তিনি অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন।

.

১০.

মিস ডেবেনহ্যামের সাক্ষ্য

সুন্দরী এবং চমৎকার ব্যক্তিত্বের অধিকারী মেরী ডেবেনহ্যাম।

আপনার নাম মেরী ডেবেনহ্যাম? বয়স ছাব্বিশ?

হ্যাঁ।

আপনি ইংরেজ?

হ্যাঁ।

এই কাগজটায় আপনার নামও ঠিকানা লিখে দিন।

 তিনি চমৎকার এবং গোটা গোটা অক্ষরে লিখলেন।

এবার বলুন কাল রাতে আপনি কি করছিলেন?

আমার মনে হয় তেমন কোনো সাহায্যই করতে পারব না, আমি বিছানায় গিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।

এই ট্রেনে খুন হওয়ার ঘটনায় আপনি কি বিচলিত বোধ করছেন?

তেমন কিছু ভাবিইনি। তবে বিচলিত নই।

কেন? খুনটা কি দৈনন্দিন ব্যাপার?

না না, ব্যাপারটা খুবই বিশ্রী।

আপনি খাঁটি ইংরেজ অযথা আবেগে ভেসে যান না।

মেরী হাসলেন।

আমার ধাতে হৈ চৈ, চেঁচামেচি কান্নাকাটি পোযায় না। মানুষ হয়ে জন্মালে মরতে তাকে হবেই একদিন না একদিন তাই না?

এটা তো একটা হত্যাকাণ্ড?

তা তো বটেই।

মৃত ব্যক্তিটিকে আপনি কি চিনতেন?

না। ওঁকে গতকালই প্রথম দেখি খানাকামরায়।

কি মনে হয়েছিল আপনার প্রথম দর্শনেই?

 ভালো করে লক্ষ্যই করিনি।

 উনি বেশ খারাপ লোক কি মনে হয়েছিল?

সত্যিই আমি কিছুই ভাবিনি।

কিছুক্ষণ স্থির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকানোর পর বললেন পোয়ারো, আমার তদন্ত পদ্ধতি মনে হয় আপনার ঠিক পছন্দ নয়। কোনো ইংরেজ হলে হয়তো অপ্রাসঙ্গিক কোনো আলোচনা করতেন না কিন্তু পদ্ধতিটা অন্য, আমার প্রশ্ন ব্যক্তিত্ব বুঝে–তাই আপনার আগে যার সঙ্গে কথা বলেছিলাম তিনি একটু বেশি কথা বলতে ভালোবাসেন, তাই বাজে কথা বলার সুযোগ তাঁকে আমি দিইনি তাই একটু অন্যধরনের প্রশ্ন করছি আপনাকে।

মাপ করবেন। আমার ভুল বুদ্ধির কাছে অগম্য ঠেকছে এইটা ভেবে যে আমি রাশেটকে পছন্দ করতাম কিনা তার সঙ্গে এই হত্যাকাণ্ডের কি সম্পর্ক।

রাশেট লোকটি কে, সেটা কি আপনি জানেন?

তার সম্বন্ধে জানতে আর কারোর বাকি নেই শ্রীমতী হার্বাডের অনুগ্রহে।

আপনার কি মত আর্মষ্ট্রং মামলা সম্পর্কে?

 নৃশংস এবং ঘৃণ্য নিঃসন্দেহে।

বাগদাদ থেকে তো আপনি আসছেন তাই না?

হ্যাঁ।

লণ্ডনে যাবেন।

হ্যাঁ।

কি করেন বাগদাদে?

দুটি বাচ্চার গভর্নর তাদের দেখাশোনার কাজ।

বাগদাদে ছুটি ফুরিয়ে গেলেই কি ফিরবেন?

জানি না এখনও কিছু ঠিক নেই।

কেন?

বাড়ি ছেড়ে থাকা আর ভালো লাগে না। লণ্ডনে যদি পছন্দসই কাজ পাই লণ্ডনেই থেকে যাব।

ও এইবারে হয়তো বিয়ে থা করে সংসারী হবেন।

পোয়ারোর এই মন্তব্যে খুশী হতে পারলেন না মেরী ডেবেনহ্যাম এবং এটাকে অনধিকার চর্চা বলে মনে করলেন বোঝা গেল।

নিস্ অঁগাস কেমন মহিলা যিনি আপনার সহযাত্ৰীনী?

বেশ চমৎকার মিষ্টি স্বাভাবের সাধাসিধে।

ওঁর ড্রেসিং গাউনটা কি রং-এর? বা

দামী পশমের।

আলেপ্পো থেকে ইস্তাম্বুলে আসার পথে যেন দেখেছিলাম। আপনারটা বোধহয় হাল্কা বেগুনী তাই না?

হ্যাঁ।

 আপনার অন্য রং-এর…. মানে এইরকম লাল রং-এর ড্রেসিং গাউন আছে?

না ওটা আমার না।

পোয়ারো ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

 আপনার নয় তাহলে কার?

 জানি না আর এ কথায় উত্তেজিত হওয়ার কারণ।

না আপনি বলতে পারতেন যে ঐ ড্রেসিং গাউন আমার নেই।

 তার বদলে ওটা আমার নয় মানেটা তাহলে কি দাঁড়ায়, তার মানে আপনি নিশ্চিত জানেন। ওটা কার?

মেরী সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন।

এই ট্রেনের কোনো মহিলা যাত্রীর?

হ্যাঁ।

কার?

ভোর পাঁচটা নাগাদ যখন আমার ঘুম ভাঙ্গে ভাবলাম গাড়িটা বোধহয় কোনো স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। কামরার দরজা খুলে উঁকি দিতেই চোখে পড়ল লাল রং-এর কিমাননা পরা কেউ একজন করিডোর দিয়ে চলে গেলেন।

আপনি জানেন না তিনি কে? ফর্সা না বাদামী চেহারার, চুল পাকা না কঁচা।

আমি পেছন থেকে দেখেছি মাথায় টুপি ছিল আর কিমাননার উপর ড্রাগন আঁকা ছিল এমব্রয়ডারি করা। ভদ্রমহিলার গড়ন একটু লম্বাটে, ছিপছিপে ধরনের।

আপাতত প্রশ্ন শেষ আপনি আসতে পারেন।

মেরী ডেবেনহ্যাম চলে যেতে যেতে থমকালেন, বললেন ঐ সুইডিস মহিলা কিন্তু ভীষণ ভয় পেয়েছেন। উনি যে শেষ জীবিত দেখেন মৃত ব্যক্তিটিকে তাই হয়ত ভেবেছেন আপনাদের সন্দেহ ওঁনার দিকে। ভদ্রমহিলা সম্পর্কে বললে বলতে হয় যে উনি একেবারেই শান্তশিষ্ট এবং নিরীহ, ওনার দ্বারা কোনো মাছি মারাও কিন্তু অসম্ভব।

শ্ৰীমতী হার্বাডের কাছ থেকে উনি কখন অ্যাসপিরিন চাইতে যান?

এই সাড়ে দশটা নাগাদ।

কতক্ষণের জন্য বাইরে ছিলেন?

তা মিনিট দশেক হবে।

আর সারারাত বাইরে যাননি?

না। পোয়ারো ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার কি মনে হয় ঐ সময় রাশেটের খুন হয়েছে?

না মনে তো হয় না।

আপনার সহযাত্রিনীটিকে নিশ্চিন্ত থাকতে বলবেন ওনার কোনো সমস্যাই হবে না।

ধন্যবাদ। বেচারী ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলেন যে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

 মেরী ডেবেনহ্যাম চলে গেলেন।

.

১১.

 জার্মান পরিচারিকার সাক্ষ্য

আপনি ঠিক কি চাইছেন এখনও বোধগম্য হল না, বলে কুক তাকিয়ে রইলেন পোয়ারো দিকে।

কোথাও একটা ভুল হয়েছে সেটাই খুঁজতে হবে।

 ভুল?

হ্যাঁ। আমার তদন্তের ধারা সম্বন্ধে আগের তরুণীটির ধারণা ছিল না।

সন্দেহ কি তাহলে ওঁকেই করছেন। ওঁকে দেখলে তো বোঝাই যাবে না যে উনি এই ব্যাপারে জড়িত আছেন।

আমার এবং কুকের সেই একই মত।

 এই হত্যাকাণ্ডটা যে আকস্মিক এটা দুজনেই বেশ বলছেন বারবার।

 সত্যি বলতে কি মিস্ ডেবেনহ্যামকে সন্দেহ করি দুটো কারণে।

এক ওর সংলাপগুলো হঠাৎ শুনে ফেলার দরুণ আমার ঠিক ভালো লাগেনি।

মেরী ডেবেনহ্যাম কর্নেল আবাথনটকে যে কথাগুলো বলতে শুনেছিলেন সেই গুলো পোয়ারো জানালেন।

তাহলে তো মিস ডেবেনহ্যাম এবং কর্নেল দুজনেই জড়িত। কুক বললেন, দুজনে দুজনের হয়ে সাফাই গাইলেন এটাই তো স্বাভাবিক ছিল।

কিন্তু তা হয়নি। পোয়ারো বললেন, মিস ডেবেনহ্যামের গতিবিধি সম্পূর্ণ অপরিচিত সুইডিস মহিলা এবং কর্নেলের মিঃ ম্যাককুইন সমর্থন করেছেন। না না, ব্যাপারটার সমাধান এত সোজা নয়।

দ্বিতীয় বক্তব্যটা কি।

ও, ওটা পুরোপুরি মনস্তাত্বিক। আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম এই অপরাধ করা কি সম্ভব মিস ডেবেনহ্যামের পক্ষে; কারণ এর পেছনে বিচক্ষণ ঠান্ডা মাথার ব্যক্তি আছেন উত্তর পেলাম হা মিস্ ডেবেনহ্যাম অপরাধী হলেও হতে পারেন।

না না, এই ইংরেজ তরুণীটির উপর মনে হয় অযথা অবিচার করছেন।

যাক গে এবার ইল্ডগ্রেদ স্মিটকে ডাকুন।

ভদ্র, মার্জিত জার্মান পরিচারিকাটি এসে দাঁড়ালেন পরে বসতে বললেন পোয়ারো।

সম্পূর্ণ বিপরীত আচরণে কথাবার্তা বললেন পোয়ারো।

নাম, ঠিকানা লেখার পর কথাবার্তা চলছিল জার্মান ভাষায়।

আপনি কাল রাতে কি কি করেছিলেন যা হয়তো অনেক অপ্রাসঙ্গিক সেগুলোও তদন্তের স্বার্থে বলুন।

ঠিক বুঝলাম না মঁসিয়ে।

তাহলে প্রশ্ন করি কাল রাত্রে আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তো আপনার কর্ত্রী?

হ্যাঁ।

সময়টা মনে আছে?

না। আমাকে কণ্ডাক্টর যখন ডাকে আমি ঘুমিয়েছিলাম।

এমনটা কি প্রায়ই করেন আপনার কী?

হ্যাঁ। রাতে ভালো ওঁর ঘুমই হয় না অবশ্য শরীর তো খারাপ হতেই পারে।

আপনি তাড়াতাড়ি নিশ্চয় বেরিয়ে পড়েন ড্রেসিং গাউনটা চাপিয়ে?

না তাহলে তো উনি রাগ করতেন।

লাল রং-এর তো একটা ড্রেসিং গাউন আছে আপনার তাই তো?

না তো ওটা গাঢ়নীল ফানেলের।

ও! আপনি তো গেলেন তারপর?

একটু গা হাত পা টিপে দিই এবং বই পড়ে শোনাই। অবশ্য চেঁচিয়ে পড়া আমার পোষায় না। তার পর ওঁর ঘুম এসে যাবার ফলে নিজের কামরায় চলে আসি।

তখন কটা বেজেছে?

জানি না।

কতক্ষণ ছিলেন রাজকুমারীর কামরায়?

আধঘন্টা মতো হবে।

 তারপর?

উনি ঠান্ডায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে একটা বাড়তি কম্বল এবং খাবার জল দিই তারপর উনি চলে যেতে বলায় আমি আলো নিভিয়ে চলে আসি।

তারপর?

নিজের কামরায় এসে শুয়ে পড়ি।

করিডোরে ফেরার পথে কারোর সাথে দেখা হয়েছিল?

না তো।

 পিঠে ড্রাগন আঁকা লাল কিমাননা পরা কোনো মহিলা?

শুধু কণ্ডক্টর ছাড়া আর সবাই ঘুমোচ্ছিল।

 কণ্ডাক্টরকে দেখেছিলেন?

 হ্যাঁ।

সে কি করছিল?

একটা কামরা থেকে বেরিয়ে আসছিল।

 কোন কামরা?

ও নিয়ে অত ভাববার কিছুই নেই রাতবিরেতে দরকার পড়লে আমরা ডেকেই থাকি তবু যদি বলেন কোনো কামরা?

রাজকুমারীর কামরার দু তিনটে দরজা পরে কোচের মাঝামাঝি জায়গায়।

তারপর কি হলো?

আমি কম্বল নিয়ে ঠাকুরণের ঘরের দিকে যেতে ওর সঙ্গে প্রায় ধাক্কা লেগেছিল। ও তখন মাপ চেয়ে খানাকামরায় চলে যায়। অবশ্য এর মধ্যে অন্য একটা কামরা থেকে ঘন্টার আওয়াজ হয় সে কানও দেয়নি। আচ্ছা এসব জিজ্ঞাসা করার অর্থ কি?

না এমনিই। কণ্ডাক্টরদের অবস্থা দেখুন এদের অন্যের খিদমতগারী করতে করতেই কেটে যায়।

এই কণ্ডাক্টর আর যে ডেকেছিল আমাকে, তারা কিন্তু এক লোক নয়। এই কণ্ডাক্টর মানে যার সাথে ধাক্কা লাগে আমার।

সেকি? অন্য কেউ? একবারও তাকে দেখেছিলেন?

না।

যদি আবার দেখেন চিনতে পারবেন?

আশা করি পারব।

কুকের কানে কানে নির্দেশ দেবার পর উনি বেরিয়ে গেলেন।

 আপনি আমেরিকা গেছেন কখনও?

না তবে যা শুনেছি চমৎকার জায়গা।

 তা আপনি নিশ্চয় শুনেছেন নিহত ব্যক্তি একটি ফুটফুটে মেয়েকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল?

শুনেছি, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে মানুষ এত নৃশংস হয়।

 আচ্ছা এই রুমালটা কি আপনার?

রুমালটা নিয়ে দেখে বলল যে এটা তার নয়।

এইচ লেখা আছে। আপনার নামের প্রথম অক্ষরও এইচ সেইজন্যই ভেবেছিলাম রুমালটা আপনার।

না না, এত দামী রুমাল ব্যবহার করি না। সূতোর নকশা দেখে মনে হয় এটা প্যারিসের।

এটা আপনার বা আপনি জানেন না এটা কার?

না না আমি কেমন করে জানব!

শ্ৰীমতী স্মিটের গলায় মুহূর্তের দ্বিধা ছিল তা পোয়ারোর কাছে ধরা পড়ল।

আচ্ছা দেখুন তো এদের মধ্যে আপনার কারোর সাথে ধাক্কা লেগেছিল কিনা! এই তিনজন কণ্ডাক্টরের মধ্যে।

না এরা নয়।

আপনার নিশ্চয় কোনো ভুল হচ্ছে এরা ছাড়া তো আর কেউ নেই।

না। এরা তো বেশ লম্বা চওড়া চেহারার আমি যার কথা বলছি সে ছোটোখাটো। বাদামী চামড়ার গোঁফও ছিল। আমার কাছে মাপ চাইবার জন্য তার গলা শুনি মেয়েলি ধাঁচের এগুলো পরিষ্কার মনে আছে।

.

১২.

 যাত্রীদের সাক্ষের সংক্ষিপ্ত সার

কিছুক্ষণ আগে খানাকামরা থেকে তিনজন বেরোনোর পর কুক কিছুটা হতাশ হলেন কারণ বেঁটে লোক, রঙ বাদামী, গলার স্বর মেয়েলি কিছুই বুঝতে পারছি না। রাশেট খুনীর যে বর্ণনা দিয়েছিল সবই তো মিলে যাচ্ছে। সে তাহলে গেল কোথায়? আপনি আমায় কিছুটা আলোকপাত করুন। যা অসম্ভব তা সম্ভব হয় কি করে?

কোনো কিছুই অসম্ভব নয় সবই সম্ভব।

কি আশ্চর্য আমি তো আর যাদুকর নই, তোমারও একই ব্যাপার। রহস্য খুবই গভীর।

আমরা এক তিলও এগোতে পারিনি

 তা নয়। যাত্রীদের জবানবন্দীতে কিছুটা পাওয়া গেছে।

তারা আর কি বলেছেন?

না এ কথাটা মানতে পারলাম না।

শ্রীযুক্ত হার্ডম্যান আর শ্রীমতী স্মিট রহস্যের কিছুটা সাহায্য করেছেন বইকি কিন্তু তাতে বেড়েছে কমেনি।

তাহলে আপনিই বা কেন কিছু আলোকপাত করছেন না?

আমি তো চেষ্টা করছি সমাধানের জন্য। আমরা সন্দেহাতীত ভাবে কিছু তথ্য জানি যেমন রাশেট ওরফে কাসেট্টিকে হত্যা করা হয়েছে ছোরার আঘাত করে, বারো বার দেহের বিভিন্ন জায়গায়। এ ব্যাপারে ডাক্তারের সঙ্গে যা আলোচনা হয়েছে আমরা সেটা এখন সরিয়ে বলছি খুনের বিষয়টা হল সময়। সে তো আমরা জানিই যে রাত সওয়া একটা নাগাদ-আন্দাজ। তিনটে সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের সামনে।

এক : আমাদের ডাক্তার এবং স্মিটের সাক্ষ্যের তার মিল আছে।

 দুই : আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দিয়ে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল পরে।

তিন : হত্যাকাণ্ড হয়েছে ঐ সময়ের আগে ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে।

প্রথম নম্বরটা যদি ঠিক ধরি তাহলে পরিস্থিতি অনুযায়ী ট্রেন থেকে পালানো অসম্ভব ছিল। তাহলে লোকটিই বা কে আর গেলই বা কোথা থেকে।

যাত্রীদের সাক্ষ্যের বিশ্লেষণে যা পাওয়া যাচ্ছে তা হল।

মিঃ হার্ডম্যানের কাছে থেকে বেঁটে মেয়েলি গলার লোকের কথা শুনি তিনি আবার সেটা রাশেটের কাছ থেকে শুনেছিলেন। হার্ডম্যানের কথার সত্যতা যাচাই করা এখন সম্ভব নয়। তবে এর পরিচয়ের মতামত খুব শীঘ্রই পাব।

আপনি তাহলে সন্দেহের আওতায় রাখছেন না হার্ডম্যানকে।

না না। সমস্ত সম্ভাবনার কথা আমি ভাবছি যে যদি সে ভুয়ো পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করছেন বলে উঠি তবে পুলিশ দিয়ে আটকে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে। সুতরাং যাঁরা ঝুঁকি নেন তার কোনো পরোয়া না করেই করেন। উনি নিজের সম্বন্ধে যা যা বলেছেন সবই যদি মিথ্যে হয় ধরা পড়লে কিন্তু তিনি লজ্জিত হবেন আমার মুখোমুখি হতে। কোনো বিচিত্র নয় কঠিন রাশেট সে চরিত্রের ছিলেন তাকে খুন করতে চাওয়াটা। নিজের নিরাপত্তার জন্য রাশেট মিঃ হার্ডম্যানকে নিয়োগ করতে চাওয়াটাও অসম্ভব নয়। তবে কার্যক্ষেত্রে যদি তাই হয় তবে প্রমাণ সাপেক্ষ। আরও অদ্ভুত শ্ৰীমতী হার্বাডের কণ্ডাক্টরের বোম পাওয়াটা। খুনের প্রসঙ্গে আর একটা কথা ভুলে যাচ্ছি।

কি কথা?

কর্নেল আবাথনট আর হেক্টর ম্যাককুইন দুজনেই বলেছেন তাদের কামরার পাশ দিয়ে কণ্ডাক্টর গেছিল। এদিকে মিশেল নিজের জায়গা ছেড়ে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ওঠেনি এটা সে জোর গলায় বলেছে এবং যেদিকে ওঁরা আড্ডা মারছিলেন সেদিকে যেতেই হয়নি।

প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চারজনেরই সমর্থন আছে বেঁটে ও মেয়েলি লোকটির উপস্থিতি সম্বন্ধে।

ডাক্তার হাত তুললেন।

একটা ছোট্ট কথা, শ্রীমতী স্মিটের কথা যদি সত্যি হয় আমাদের কণ্ডাক্টর মিসেস হার্বাডের কামরায় টোকা দেবার সময় শ্রীমতী স্মিটকে দেখেনি কেন?

এই ব্যাখ্যা সহজ, কারণ তখন শ্রীমতী স্মিট তার কত্রীর সঙ্গে ছিল। আর নিজের কামরায় যখন সে যায় তখন হার্বাড কামরার ভেতরে।

কুকের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙল। বললেন, তাহলে অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকটি কোথায় গেল সে তো উপস্থিত ছিল?

লোকটি আদৌ ছিল কিনা সেটা বরং নিজেকে প্রশ্ন করুন। যার কোনো অস্তিত্বই নেই তাকে অদৃশ্য করে দেবার মতো সহজ কাজ আর বোধহয় নেই। তাহলে জানতে হবে লোকটার রক্তমাংসের কোনো অস্তিত্ব আদৌ ছিল কিনা?

আর যদি লোকটা থাকে তবে সে কোথায় যেতে পারে?

এ প্রশ্নের দুটো উত্তর হতে পারে।

 এক : লোকটা এমনই এক জায়গায় লুকিয়ে আছে তাই তাকে খোঁজা অসম্ভব।

দুই : এই ট্রেনেরই কোনো যাত্রী সে যে ছদ্মবেশে ধরায় রাশেট তাকে চিনতে পারেনি।

হ্যাঁ। হ্যাঁ। এটা হওয়া সম্ভব। কিন্তু….।

লোকটার উচ্চতা একমাত্র রাশেটের পরিচারক ছাড়া সকলেই লম্বা। তবে পরিচারকটাকে আমার সন্দেহ হয় না।

সম্ভাবনা অবশ্য একটা থেকে যায় যে লোকটার গলার স্বর মেয়েলি। কাজেই এমন হতে পারে সে মহিলার ছদ্মবেশে ছিল নতুবা সে সত্যিই মহিলা। পুরুষের পোশাক পরলে কোনো মহিলাকে কিন্তু বেঁটেই দেখাবে।

কিন্তু রাশেট তো….

হ্যাঁ। সে জানত। তাকে হয়ত অনেক আগেই এই স্ত্রীলোকটি হত্যার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারেনি। তাই এই চেষ্টা সে আবার করবে ভেবে মেয়েলি গলার পুরুষের কথা বলেছিল। বুঝতে পারছি বন্ধু খুবই জটিলতা এই হত্যাকাণ্ডে।

এ নিশ্চয় কোনো পাগলের কাণ্ড এবং অসম্ভব, অবাস্তব।

আমিও তাই ভাবছি। ট্রেনে দুজন আগন্তুক কাল রাতে ছিল।

একজন কণ্ডাক্টরের বেশে (পুরুষ) যাঁকে সমর্থন জানিয়েছেন মিঃ হার্ডম্যান, শ্রীমতী স্মিট। কর্নেল আর ম্যাককুইন। আর অন্যজন লাল কিমানো পরা মহিলা তার উপস্থিতি সমর্থন করেছেন তিনজন পিয়ের মিশেল, মিস্ ডেবেনহ্যাম এবং আমি নিজে। এই ট্রেনে তো লাল কিমানো নেই। তিনিও উবে গেছেন তার মানে তিনিও ছদ্মবেশে ছিলেন তাছাড়া কণ্ডাক্টরের পোশাক আর লাল কিমানো তো এগুলোই বা গেল কোথায়?

কুক লাফিয়ে উঠে বললেন, সমস্ত যাত্রীদের মালপত্র তল্লাসী করব যদি কোনো হদিশ পাওয়া যায়।

আমার অনুমান যদি না ভুল হয়ে থাকে তবে লাল কিমাননাটা কোনো পুরুষযাত্রীর বাঙ্কে এবং ইউনিফর্মটা শ্ৰীমতী স্মিটের জিনিষপত্রের মধ্যে খুঁজে পাবেন।

না আপনি যা ভাবছেন তা নয়। শ্রীমতী স্মিট যদি অপরাধী হন তাহলে কণ্ডাক্টরের ইউনিফর্মটা তার জিনিষপত্রের মধ্যে থাকলেও থাকতে পারে যদি নিরাপরাধ হন তবে অবশ্যই পাওয়া যাবে তার কাছে।

অবশ্য এগুলো সবই অনুমান….।

সশব্দে খানাকামরার দরজা খুলে শ্ৰীমতী হার্বাড চিৎকার করে উঠলেন।

ওঃ কী ভীষণ কাণ্ড….আমার ভোলোর মধ্যে…. একটা এতো বড়ো ছোরা ….বলে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে মূৰ্ছা গেলেন একেবারে মঁসিয়ে কুকের ঘাড়ের উপর।

.

১৩.

 হত্যার হাতিয়ার

 মিসেস হার্বাডকে কুক চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। ডাক্তার তোক ডাকলেন।

এভাবেই উনি থাকুন। জ্ঞান ফেরার পর একটু কনিয়াক দিতে বললেন।

তারপর তারা তিনজনই শ্রীমতী হার্বাডের কামরায় গেলেন।

জ্ঞান ফেরার পর মিসেস হাবার্ড কথা বলা শুরু করলেন ট্রেনের বেয়ারাটির সঙ্গে।

ওঃ কি ভয়ঙ্কর দৃশ্য যা আমি বোঝাতে পারব না এবং এতে অনেক স্নায়ুর চাপ পরে। আমার মন ভীষণ নরম সেই ছোট বেলা থেকে এবং রক্ত দেখলেই গা যেন গুলিয়ে উঠে। আমাদের কস্মিনকালেও কেউ মদ ছোয়নি কিন্তু ডাক্তার বলায় আমায় তাও খেতে হচ্ছে।

শ্ৰীমতী হার্বাডের কামরায় তখন প্রচণ্ড ভীড়। কণ্ডাক্টর সবাইকে ঠেকিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে।

সবাইকে সরিয়ে কুক বললেন, আমাদের একটু যেতে দিন। আপনারা এসে ভালোই করেছেন। যা করছিলেন উনি আমি তো ভেবেছি উনিই খুন হয়েছেন এবং সবাইকেই উনি বলছিলেন কি কি কাণ্ড হয়েছে। আপনারা গিয়ে অস্ত্রটা দেখুন আমি কিন্তু ওটা ছুঁইনি বলল কণ্ডাক্টর। শ্রীমতী হার্বাড আর রাশেটের কামরা দুটোর মাঝের দরজাটায় সেদিকে হাবাডের কামরা তার হাতলে একটা বড় চৌখুপি নকশাটা ভোলো তার ঠিক নিচেই পড়ে আছে চ্যাটালো ইস্পাতের একটা ছোরা সস্তার জিনিষ। ফলাটায় মরচের ছাপের মতো দাগ।

পোয়ারো ছোরাটাকে তুলে নিয়ে বললেন, কোনো ভুল নেই এটাই খুনের অস্ত্র।

 ছোরাটা হাতে নিলেন ডাক্তার।

সাবধানতার কিছু নেই কেননা এতে কোনো আঙুলের ছাপ পাওয়া যাবে না শ্ৰীমতী হাবার্ডের ছাড়া।

যথেষ্ট ধারালো, এটা দিয়েই হত্যা করা হয়েছে মসিয়ে।

 দুজন আততায়ী একই দিনে একই অস্ত্র দিয়ে রাশেটকে খুন করতে চাইবে এটা বুঝতে পারছি না।

অবশ্য হতেও পারে। কেননা এই ছোরা বাজারে সর্বত্রই পাওয়া যায়।

 ভোলোটা সরিয়ে হাতল ঘুরিয়ে দরজাটা খুলতে চাইলেন কিন্তু দরজা খুলল না।

আমরা তো আগেই রাশেটের কামরার দিক থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, ডাক্তার বললেন।

তবুও কি যেন চিন্তা করছেন পোয়ারো।

খুনী তাহলে এই দিক থেকে ঢুকেছিল। দু কামরার মাঝের দরজাটা বন্ধ করবার সময় তার হাত ঠেকে ভোলোয় তাই তাড়াহুড়ো করে ওর মধ্যেই ফেলে যায়। শ্রীমতী হার্বাড জেগে উঠলে পালায়।

হয়তো তাই, পোয়ারো বললেন।

কি হল কিছু একটা যেন ঠিক সন্তুষ্ট করতে পারছে না।

না। কিছুই চোখে পড়ছে না আপনার।

শ্ৰীমতী হাবড় ততক্ষণে এসে পড়েছেন।

দেখুন এই কামরায় আর থাকব না, আমাকে যত দামই দেন না কেন?

কিন্তু মাদাম….

না না আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না, আমি এই করিডোরেই বসে থাকব। কাঁদতে লাগলেন তিনি।

আমার মেয়ে যদি থাকত এখানে সে কিছুতেই আমার হেনস্থা মেনে নিত না।

ঠিক আছে আপনার জিনিষপত্র অন্য কামরাতেই দিয়ে আসবে।

শ্ৰীমতী রুমাল দিয়ে চোখ মুছে বললেন, বাবা এতক্ষণে স্বস্তি পেলাম।

কিন্তু কোথায় যাবো সবটাইতো ভর্তি।

আপনাকে বেলগ্রেড কোচে একটা কামরা দেওয়া হবে।

মিশেল ভদ্রমহিলাকে নিয়ে নতুন কোচে গেল।

আপনার পছন্দ তো মাদাম? একেবারে আপনার আগের কামরাটার মতোই।

হ্যাঁ তবে এটার মুখ অন্যদিকে।

 আপনার পছন্দ হলেই হল।

যা বরফ ঝড়ে আটকা পড়লাম আমরা, কাল বাদে পরশু স্টিমার ছাড়বে এখন ভালোয় ভালোয় পৌঁছতে পারলে বাঁচি।

আমাদের সকলের এই একই অবস্থা, কুক বললেন।

কিন্তু খুনীটা বেছে বেছে ঠিক আমারই কামরায় ঢুকেছিল সত্যিই কপালটা বড়ই মন্দ।

আচ্ছা আপনার কামরার দিক থেকে মাঝখানের দরজাটা যদি বন্ধই থাকে তবে লোকটা ঢুকলো কি করে? সত্যিই বন্ধ ছিল তো দরজাটা?

কেন? তাই তো বললেন সুইডিস মহিলাটি।

ধরুন আপনি শুয়ে আছেন হুড়কোটা তো দেখা আপনার পক্ষে সম্ভব নয়।

না দেখব কি করে ভোলোটা তো ছিল। ওটা দেখলেই বুক কাঁপছে, পৌঁছে একটা ব্যাগ কিনতে হবে।

ভোলোটা হাতলে টাঙালেন পোয়ারো।

এই দেখুন হুড়কোটা ঠিক ঠিক হাতলের নিচে-ভোলোটা সেটা আড়াল করছে। সত্যিই আপনার পক্ষে দেখাটা সম্ভব নয়।

এতক্ষণ ধরে তো সেটাই বলছি।

দাঁড়িয়ে দেখছিলেন তো সুইডিস মহিলাটি। সম্ভবত উনি ভুল করেছেন হাতলটা ডানদিকে ঘোরালে দরজাটা বন্ধ হয়। সোজা ভাবে থাকলে দরজাটা ভেজানো থাকে। উনি হয়তো হাতলটা ঘুরিয়ে ছিলেন। ভোলো আড়াল থাকায় হুড়কোটা দেখেননি, দরজা না খোলায় ভেবেছিলেন বন্ধ আছে। আসলে সেটা রাশেটের অন্যদিক থেকে মাঝ কামরার দিক থেকে লাগানো ছিল।

মহিলাটি তাহলে নির্বোধ।

ওরকম বলবেন না হয়তো বিচক্ষণ নন।

হবে হয়তো।

কোথায় কোথায় বেড়ালেন আপনি?

আমার মেয়ের এক বন্ধু মিঃ জনসন তার ওখানে অর্থাৎ ইস্তাম্বুলে যাই। তিনি শহরটা দেখালেন কিন্তু আমার ভালো লাগেনি জায়গাটা।

মিঃ জনসন নিজেই দেখা করেন আপনার সঙ্গে?

হ্যাঁ। ফেরার ব্যবস্থাও উনি করে দেন। দেখুন দেখি ওদিকে জামাই এসে অপেক্ষা করবে। একটা কোনোরকমে খবর দেওয়া যেত। মেয়েতো ভেবে ভেবেই সারা হবে একেবারে…।

পোয়ারো দেখলেন শ্রীমতী হার্বাড আবার কাদার উপক্রম করছেন তাই বললেন, চা আর বিস্কুট খান মাদাম খুব ভালো লাগবে।

আমার চা খেতে ভালো লাগে না।

 তাহলে কফি? একটা অনুরোধ আপনার জিনিসপত্রগুলো একবার আমরা পরীক্ষা করব?

কেন?

সমস্ত যাত্রীদেরই তল্লাসি করতে হবে কেন না আপনার ভোলো থেকে দেখলেন তো ছোরাটা পাওয়া গেল। কিছুই করার নেই এই কাজগুলো আমাদের নিয়মের মধ্যে পড়ে।

বেশ তো।

শ্ৰীমতী হার্বাডের কাছ থেকে কিছুই পাওয়া গেল না।

কুক বললেন, এবারে আমাদের পরের কাজ কি?

সব কামরাগুলো একে একে দেখা।

 প্রথমেই হার্ডম্যানের কামরা ষোলো নম্বর। কুক তাদের আমার উদ্দেশ্যটা জানালেন।

হার্ডম্যান নিঃসঙ্কোচে বললেন তিনি তাঁর বাক্স খুলে দেবেন কিনা?

 না মিশেলেই পারবে।

তার বাক্সে কয়েক বোতল মদ থাকার জন্য বললেন প্যারিসেই এটা শেষ করে ফেলবেন।

কণ্ডাক্টর সমস্ত জিনিষপত্র গুছিয়ে দিলেন দেখবার পর।

এরপর পাশের কামরায় কর্নেল আর্বাথনটের কাছে গেলেন এবং তাঁকে–তাদের আসার উদ্দেশ্য ব্যক্ত করলেন। তিনি নিজের দুটো চামড়ার বড় স্যুটকেশ বের করে দিলেন।

এই যা মালপত্র জাহাজে যাচ্ছে বাকিগুলো।

সবকিছু দেখার পর একটা জিনিসের প্রতি পোয়ারোর দৃষ্টি গেল। তা হল এক প্যাকেট পাইপ ক্লিনার।

এই ধরনের ক্লিনারই কি আপনি ব্যবহার করেন?

হ্যাঁ অবশ্য বাজারে যদি পাওয়া যায়।

এই রকমই একটা ক্লিনার রাশেটের কামরায় পাওয়া গেছে। রাজকুমারীর কামরার দরজা বন্ধ ছিল, বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। তিনজন দরজায় টোকা দিয়ে তাদের আসার উদ্দেশ্য বললেন।

রাজকুমারী সব শুনে বললেন তার পরিচারিকার কাছেই সব চাবি রাখা আছে। আপনারা দেখে নিতে পারেন।

সবসময়ই কি পরিচারিকার কাছে আপনার চাবি থাকে?

 নিশ্চয়ই।

যদি গভীর রাতে মালপত্র খোলবার দরকার হয় তখন?

 কণ্ডাক্টর তাকে ডেকে নিয়ে আসবে।

 মাদাম খুব বিশ্বাস করেন ওকে?

এ প্রশ্নের উত্তর তো আগেই দিয়েছি। যাকে বিশ্বাস করি না তাকে চাবিও দিই না।

 আমার তো মনে হয় যদি কোনো বুদ্ধিমতী ফরাসী মহিলাকে নিযুক্ত করতেন…।

আপনার কথা আমি ঠিক বুঝছি না। ইল্ডগ্রেদ অত্যন্ত বিশ্বাসী এবং বিশ্বাসের দাম আমার কাছে সবচেয়ে বেশি।

চাবি নিয়ে পরিচারিকাটি এল। তাকে রাজকুমারী প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে করিডোরে বেরিয়ে এলেন। পিছনে পোয়ারোও।

আপনার কি কোনো উৎসাহ নেই জিনিষপত্র দেখার?

মাদাম আমার নিয়মরক্ষার খাতিরেই এগুলো করতে হচ্ছে।

আমি সোনিয়া আর্মস্ট্রংকে ভালোবাসতাম। কিন্তু কাসেট্টির মতো একটা ছুঁচোকে মেরে হাত গন্ধ করার স্পৃহা আমার নেই। হয়ত চাকরদের ডেকেই বলতাম এই লোকটাকে কুকুর দিয়ে খাওয়া, আমাদের ছেলেবেলায় শাস্তিটা এমনই ছিল। সত্যিই আপনার দেহের শক্তি সম্বন্ধে আমার জানা নেই তবে মনে হয় অসীম শক্তি আপনার।

কি জানি হয়ত ঠিকই বলছেন।

তবে আপনারা যেটা করছেন সেই প্রথা মাফিক কাজ আপনাদের করতেই হবে কারণ কাজের এটা একটা অঙ্গ।

পরের কামরা দুটো ভেতর থেকে বন্ধ। কাউন্ট আর কাউন্টসের কামরা। কুক একটু দোনামোনা করছিলেন। কারণ উনি জানতেন ওরা বিদেশী দূতাবাসের কাজ করেন। যদি কোনো অভিযোগ উপর মহলে পাঠান এই ভেবেই। যদি না দেখলে হয় তবে থাক।

কেন? ওঁরা কিছুই মনে করবেন না। এমন তো হতে পারে দেখলেন না রাজকুমারী মেনে নিলেন।

সে কথা আলাদা।

কুকের কথার মাঝে তেরো নম্বর কামরায় পোয়ারো টোকা দিলেন। তাদের আসার কারণ বলার পর কাউন্ট বললেন, সবারই যখন তল্লাশী হচ্ছে আমারটাই বা বাদ হবে কেন, বলে বললেন, কি বল এলেনা।

মালপত্র দেখতে দেখতে হঠাৎ নীল মরক্কো চামড়ার ব্যাগ তুলে নিলেন। একটু ভিজে ভিজে যেন ওপরে নাম লেখা লেবেলটা। ওয়াশ বেসিনের ওপরের তাকে তোয়ালে, ক্রীম, পাউডার এক শিশি ঘুমের বড়ি।

এর পরের তিনটে কামরা পরপর শ্রীতী হার্বাডের (পুরোনো কামরা), রাশেটের আর পোয়ারোর।

এরপর দশ আর এগারো দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা। মেরী ডেবেনহ্যাম একটা বই পড়ছিলেন আর ঘুমোচ্ছিলেন গ্রেটা অলসঁ।

আমরা আপনার মালপত্র একটু পরীক্ষা করব ততক্ষণ যদি আপনি শ্ৰীমতী হার্বাডের কামরায় যান কেননা শ্রীমতী হার্বাডের কথা বলার সঙ্গী নেই। আপনি গেলে ওঁর ভালো লাগবে। তিনি তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। তার বাক্সে চাবি দেওয়া ছিল না তাই স্বচ্ছন্দে পরীক্ষা করা যায়। তার বাক্স ঘেঁটে বোঝা যায় তিনি অবগত নয় তার টুপির বাক্স থেকে জালটা বেপাত্তা। মেরী ডেবেনহ্যাম বললেন, আপনি ঐ আমেরিকান ভদ্রমহিলাকে বিদায় করলেন কেন?

আমি?

অযথা ছল করবেন না। আসলে আপনি আমার সঙ্গে নিভৃতে কথা বলতে চান তাই তো?

আপনি সত্যিই বুদ্ধিমতী।

আসল ব্যাপার হলো আপনি বুঝেছেন যে এই খুনের ব্যাপারে আমি কিছু জানি এই তো?

তাহলে মাদমোয়াজেল খুলেই বলি, সিরিয়া থেকে আসবার পথে কোনিয়া স্টেশনে কর্নেল আর আপনি পায়ের খিল ছাড়াতে নামেন। সেই সময় দুটো কথা আমার কানে আসে সেটা হল, না না এখন নয়, সব মিটে গেলে…কথাগুলোর মানে সত্যি বলবেন মাদমোয়াজেল….?

আশ্চর্য রকমের শান্ত মেরীর গলা।

আপনার কি মনে হয় তার মানে খুন?

 দুটো কথার মানে জানতে চাইছি মাদাম।

আমি আপনাকে বলতে পারছি না কারণ আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে রাশেটকে এর আগে কখনও দেখিনি তা আমি শপথ করে বলতে পারি।

তাহলে কেন আপনি প্রত্যাখান করছেন?

 সেভাবে ধরলে তাই। একটা কর্তব্যের দায়িত্ব প্রসঙ্গেও কথা বলেছিলাম।

এখন কি সেই কাজ শেষ হয়েছে?

আপনি কি বলতে চান? আপনার হঠাৎ এ কথা মনে হল কেন?

ইস্তাম্বুলে আসার দিন ট্রেন দেরি করার ফলে আপনি অত্যন্ত উত্তেজিত ছিলেন যেটা আপনার স্বভাবে নেই।

পরের ট্রেনটা ধরা জরুরী ছিল।

এই ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস তো সপ্তাহে সাতদিন ট্রেনটা চলে। বড় জোর চব্বিশ ঘন্টা দেরি হত সেটা এমন কিছু জীবনমরণ সমস্যা নয়।

একটা ট্রেন যদি ঠিকমত না ধরা যায় তবে পরের কাজগুলোও ভেস্তে যায়। আমি ব্যস্ত হয়ে থাকলেও অবাক হবার কারণ নেই।

তা ঠিক। তবে আমার আশ্চর্য লাগছে অন্য কারণে। আমরা তো এখানে অনেকক্ষণ ধরে আটকে আছি তাতে কোনো বিকার লক্ষ্য করছি না আপনার। কি হলো উত্তর দিন মাদাম। মেরী ডেবেনহ্যাম মনে মনে রেগে গেলেন।

আপনি কি বেশি কষ্ট কল্পনা করছেন না মঁসিয়ে পোয়ারো?

হতে পারে। একটু বেশি সন্দেহপ্রবণ হয় গোয়েন্দারা নিশ্চয় জানেন। কর্নেল আবাথনটকে আপনি কতটা চেনেন? একটু আশ্বস্ত মেরী কথার পরিবর্তনে।

এইবারেই আলাপ।

 রাশেট কে যে উনি চিনতেন এ বিষয়ে আপনার কি কোনো সন্দেহ হয়?

 না আমি নিঃসন্দেহ এ ব্যাপারে।

 কেমন করে বুঝলেন?

 ওঁর কথাবার্তায়।

আমরা একটা পাইপ ক্লিনার মিঃ রাশেটের কামরা থেকে পেয়েছি এবং একমাত্র কর্নেলই এই পাইপ খান।

তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছিলেন পোয়ারো কিন্তু মেরীর মুখের রেখার কোনো পরিবর্তন দেখলেন না।

কর্নেলের রাশেট কেন কাউকেই খুন করবার মানসিকতা নেই। ওঁর স্বভাববিরুদ্ধ অত নাটকীয়তা।

মনে মনে সমর্থন হয়তো বা করলেন পোয়ারো।

এতটা নিশ্চিত হলেন কি করে? আপনি তো ভালো করে ওঁকে চেনেনই না।

মানুষের ধরনধারণ দেখলেই বোঝা যায়।

ঐ কথাটার মানেটা তাহলে আপনি বলবেন না।

না।

আমি ঠিক বের করে ফেলব দেখবেন।

 মেরী আর কর্নেল দুজনকেই পরোক্ষভাবে কথাগুলো বলে কি ভালো হল, কুক বললেন।

দরকারে ফাদ একটু পাততেই হয়।

পরের কামরায় শ্রীমতী স্মিটের হাতব্যাগের জিনিষপত্র পরীক্ষা করার পর সুটকেশ খুললেন তাতে চাবি দেওয়া ছিল না।

 একটা কণ্ডাক্টরের পোশাক ওপরে ভাঁজ করা ছিল। শ্রীমতী স্মিট চেঁচিয়ে উঠলেন। বললেন, আমি এসবের কিছু জানি না। ইস্তাম্বুল ছাড়ার পর একবারও বাক্সই খুলিইনি।

আপনাকে আমরা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। আপনার ভেঙে পড়ার কিছুই নেই। আপনি সত্যিই ভালোমানুষ এবং আপনার রান্না প্রশংসার দাবী রাখে।

ইল্ডগ্রেদ ভয়ার্ত মুখে চুপ করে গেলেন।

এবার পোয়ারো আসল রহস্যটা বললেন এই যে শ্রীমতী স্মিটের সঙ্গে লোকটার ধাক্কা লাগার পর তাড়াতাড়ি পোশাকটা লুকিয়ে রাখতে চায় কিন্তু সমস্ত কামরায় তোক ভর্তি থাকার ফলে এই কামরা খালি পেয়ে সুটকেশ খুলে তাড়াতাড়ি রেখে দেয়।

দেখা যায় জামাটার বোম নেই এবং কণ্ডাক্টরের পকেটে চাবিটাও মজুত।

তাহলে ওসব দরজার হুড়কো ছিটকিনি কোনো কিছুই কাজে আসেনি। এই বাবাজীর কাছে সব খোল চাবিটিই। কুক বললেন।

তারপর মনে আছে শ্রীমতী হার্বাডের কামরার করিডোরের দিকের দরজাটাও বন্ধ ছিল ভেতর থেকে, মিশেল বলেছিল।

হ্যাঁ মঁসিয়ে, ভদ্রমহিলা যে স্বপ্ন দেখেছেন নিশ্চয় এটা সেইজন্যই বলেছিলাম।

এখন শুধু লাল কিমানোটা খুঁজতে বাকি, পোয়ারো বললেন।

হ্যাঁ শেষ কামরার দুটো দুজন পুরুষের।

ম্যাককুইন হেসে বলল, বুড়ো যদি একটা উইলটুইল করে থাকে তাহলে ফোকটে কিছু দাও মারা যাবে।

সন্দেহ ভরা চোখে কুক তাকাতে একটু অপ্রস্তুত হল ম্যাককুইন।

না না আমায় উনি টাকাপয়সা দিতে যাবেনই বা কেন। আমি ঠাট্টা করছি, আমি ওঁর চাকর ছাড়া আর কিছুই ছিলাম না।

মাস্টারম্যান আর ফলকারেল্লির কামরায় কিছুই পাওয়া গেল না।

সব কিছুর শেষে পোয়ারো বললেন, কিচেন কামরার দিকে যাওয়া যাক। তদন্ত শেষ, এবার বুদ্ধির খেলা।

সিগারেট ফুরিয়ে যাবার ফলে নিজের কামরায় যেতে পোয়ারো ভাবতে লাগেলেন যদি লাল কিমানোটা পাওয়া যেত তবে একটা সূত্র পাওয়া যেত। নিজের কামরায় এসে ছোট্ট বাক্সটা খুলে ভাবলেন যদি সিগারেট থাকে। তার চোখ বড় হয়ে উঠল।

সমস্ত জিনিষপত্রের উপর নিপুণভাবে ভাঁজ করে রাখা আছে একটা লাল সিল্কের কিমানো এবং তাতে ড্রাগন আঁকা আছে।

পোয়ারো মৃদুস্বরে বললেন, চ্যালেঞ্জ! বেশ আমি তা গ্রহণ করলাম।