০৮. সারা ঘরে মুহূর্তে স্তব্ধতা

সারা ঘরে মুহূর্তে স্তব্ধতা নেমে এল। ইনসপেক্টর জ্যাপের কণ্ঠস্বরে সকলের চমক ভাঙলো। পোয়ারোকে জ্যাপ ধন্যবাদ জানিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন সব সাক্ষীরা বিশ্বাসযোগ্য কিনা।

পোয়ারো জানাল সাক্ষীদের নাম ঠিকানা সে লিখে রেখেছে। জ্যাপ জানালেন তিনি পোয়ারোর কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ মিঃ ইঙ্গলথর্পপঁকে গ্রেপ্তার করলে কেলেঙ্কারির একশেষ হত।

এবার ইনসপেক্টর ইঙ্গলথর্পের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি ইঙ্গলথর্পের কাণ্ড দেখে অবাক হয়েছেন, জানতে চাইলেন কেন তিনি তদন্তের সময় ঐ ব্যাপারটা বলেননি।

পোয়ারো বলল, আসলে বাজারে একটা দারুণ গুজব চলছিল বলেই তিনি বলতে পারেননি। ইঙ্গলথর্প পোয়ারোকে বাধা দিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন যে সে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিদ্বেষ প্রসূত।

পোয়ারো বলে উঠল, মিঃ ইঙ্গলথর্প আবার কোনো কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়তে চাননি। ইঙ্গলথর্প বললেন সত্যিই তাই। তিনি তার প্রিয় পত্নী এমিলিকে কবরস্থ করার আগে আবার কোনো বাজে গুজবের শিকার হতে চাননি।

ইনসপেক্টর জ্যাপ বললেন খুনের দায়ে ধরা পড়ার চেয়ে ওরকম হাজারটা গুজবে জড়ানো অনেক ভালো। জ্যাপ ইঙ্গলথর্পপকে এও বলেন যাতে তিনি পোয়ারোকে ধন্যবাদ জানান কারণ তিনি থাকলেই ইঙ্গলথর্প গ্রেপ্তারির হাত থেকে রেহাই পেতেন না। ইঙ্গলথর্প স্বীকার করলেন যে তিনি বোকার মত কাজ করেছেন।

জ্যাপ এবার জনকে বললেন তিনি মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরটা একবার দেখতে চান, তবে এজন্য জনকে ব্যস্ত হতে হবে না, পোয়ারোই তাকে সব দেখিয়ে দেবে। এছাড়া তিনি চাকর বাকরদের কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান।

সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলে পোয়ারো আমাকে ইশারা করে ওর পেছনে যেতে বলল। সিঁড়ির কাছে যেতেই পোয়ারো আমার হাত ধরে টেনে বলল আমি যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঐ বাড়িটার অন্য দিকটাতে বড়ো দরজাটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। সে ওখানে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমি যেন এতটুকু না নড়ি, এ ব্যাপারে সে সাবধান করে দিল।

পোয়ারোর কথাবার্তা আমার কিছুই বোধগম্য হল না। তবুও ওর কথামতো বড়ো দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পোয়ারো কি আমাকে শেষ পর্যন্ত পাহারা দেবার জন্য পাঠাল তা বুঝে উঠলে পারলাম না। বহুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে উল্টোপাল্টা ভাবতে লাগলাম, কাউকে কোথাও দেখলাম না।

প্রায় মিনিট কুড়ি পরে পোয়ারোর দেখা পেলাম। সে জানতে চাইল আমার নজরে কিছু পড়েছে কিনা। আমি জানালাম না। পোয়ারো এবার বলল আমি নিশ্চয়ই কোনো ভারী কিছু পড়ার শব্দ শুনেছি, আমি জানালাম কোনো আওয়াজ শুনিনি। পোয়ারো হতভম্ব হয়ে গেল, বলল সেটা কি করে সম্ভব হতে পারে। হাত দিয়ে সামান্য ধাক্কা দিয়ে সে একটা টেবিল ফেলে দিয়েছে।

পোয়ারোকে দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না যে সে কোনো পরীক্ষা করতে চেয়েছিল, সফল না হাওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছে। আমি তাকে বেশি উত্তেজিত হতে বারণ করলাম।

হঠাৎ জানলার বাইরের দিকে তাকাতেই ডঃ বরস্টিনকে দেখতে পেলাম। আমি পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করালাম সেদিকে। পোয়ারো বিড়বিড় করে বলল নোকটা বড় বেশি চালাক। আমি বললাম বরস্টিনকে আমার রীতিমত শয়তান বলে মনে হয়। পোয়ারোকে আমি মঙ্গলবার রাতের সেই দৃশ্যটার কথা বললাম, সারা শরীরে কাদা মাখা অবস্থায় বরস্টিনকে কেমন লাগছিল তার বর্ণনা দিলাম। একথাও বললাম যে বরস্টিন ঐ কাদামাখা পোশাকে ঘরের ভেতরে আসতে চাইছিলেন না, ইঙ্গলথর্প তাকে জোর করায় তিনি ভেতরে আসেন। তখন আমাদের রাতের খাওয়াদাওয়া হয়ে গিয়েছিল।

পোয়ারো কথাগুলো শুনে আমার ওপর আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমার কাধ ধরে ঝাঁকুনি দিল।

আমি তার এই হাবভাবে চমকে গেলাম। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমি কেন তাকে একথা আগে বলিনি। আমি বললাম এই সামান্য ব্যাপারটা যে তাকে জানানো উচিত সেটা আমার একটুও মনে হয়নি। আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা খুব একটা দরকারী নয়।

পোয়ারো বলল ব্যাপারটা সত্যিই খুব দরকারী। সে বলতে লাগল ডাঃ বরস্টিন তাহলে খুনের ঘটনার রাতে এই বাড়িতেই ছিল এই তথ্যটা জানার জন্য তার সব ধারণা বদলে গেল।

কোনোদিন পোয়ারোকে এত উত্তেজিত হতে দেখিনি। সে বলল আর দেরি করা উচিৎ নয়। জনকে তার এই মুহূর্তে দরকার।

জনকে ধূমপানের ঘরে পাওয়া গেল। পোয়ারো সোজা ঘরে ঢুকে জনকে বলল একটা বিশেষ প্রয়োজনে তাকে একবার ট্যাডমিনস্টারে যেতে হবে। সেজন্য একটা গাড়ি তার দরকার।

জন সঙ্গে সঙ্গে ঘন্টা বাজিয়ে লোক ডেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে দিলে আমরা তৎক্ষণাৎ ট্যাডমিনস্টারের দিকে রওনা হলাম।

আমি ব্যাপারটা কি জানতে চাইলাম। কিছুদূর যাওয়ার পর পোয়ারো আমাকে মাথা খাটাতে বলল। তারপর আবার নিজেই বলতে শুরু করল যে মিঃ ইঙ্গলথর্প ছাড়া পাওয়ার পর সমস্ত চিন্তাধারণাটাই বদলে গেছে। এখন জানতে হবে মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে কে দোকান থেকে স্ট্রিকনিন কিনেছিল। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস ছাড়া সকলকেই এই ব্যাপারে সন্দেহ করা যেতে পারে। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস ঐ সময়ে আমার সঙ্গে টেনিস খেলছিলেন।

আরোও একটা জিনিষ জানতে হবে, সেটা হল মিঃ ইঙ্গলথর্প কফির কাপটা জলঘরে রেখে গেছিলেন ঐ কাপটা শেষ পর্যন্ত কে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে পৌঁছে দেয়। এছাড়া কাপটা যতক্ষণ হলঘরে টেবিলে ছিল কে কে ঐ ঘরে এসেছিল। পোয়ারো জানাল আমার কাছে সব কথা শুনে সে নিশ্চিত যে মিসেস ক্যাভেণ্ডিস এবং সিনথিয়া কফির কাছে মোটেই যাননি।

পোয়ারো এবার আত্মগতভাবে বলে যেতে লাগল একটা ব্যাপার তার কাছে খুবই চিন্তার বলে মনে হচ্ছে–অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপকে যে আর সন্দেহের তালিকায় রাখা হচ্ছে না সেটা হত্যাকারী বুঝতে পারলে সাবধান হয়ে যাবে। পোয়ারো হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল আমার কাউকে সন্দেহ হচ্ছে কিনা।

আমি একটু ইতস্ততঃ করতে লাগলাম, বুঝে উঠতে পারলাম না কি উত্তর দেব। তবুও আমি অভয় হয়ে বললাম আমার মনে হচ্ছে মিস হাওয়ার্ড অনেক কিছু গোপন করেছেন। মিস ওয়ার্ড যেহেতু ঘটনার দিন অকুস্থল থেকে অনেক দূরে ছিলেন সেজন্য তাকে আমরা সন্দেহের তালিকায় ফেলছি না। কিন্তু উনি স্টাইলস্ থেকে মাত্র পনেরো মাইল দূরে ছিলেন, ঐ পথ গাড়িতে মাত্র আধ ঘণ্টাতেই যাওয়া যায়, সেই রাত্রে মিস হাওয়ার্ড যে স্টাইলসে ছিলেন না সেকথা কেই বা বলতে পারে।

পোয়ারো মৃদু হেসে বলল সে বলতে পারে যে মিস হাওয়ার্ড সেই রাতে স্টাইলসে ছিলেন না, কারণ মিস হাওয়ার্ড যে হাসপাতালে কাজ করে পোয়ারো সেখানে ফোন করেছিল। আমি শুনে অবাক হলাম। পোয়ারো জানাল ফোন করে সে জানতে পেরেছে। মঙ্গলবার বিকালে মিস হাওয়ার্ড কাজে ব্যস্ত ছিলেন, কয়েকজন রোগী আসায় তিনি রাতে থাকতে চেয়েছিলেন এবং রাত্রেও কাজ করেছিলেন। সুতরাং তার সম্বন্ধে আর সন্দেহের অবকাশ রইল না।

এবার পোয়ারো আমার ওপর একটা কাজের ভার দিল, বলল, লরেন্স ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে দেখা হলে আমি যেন তাকে বাড়তি কফির কাপটা খুঁজে বের করতে বলি এবং এও বলি যে তাহলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না।

দারুণ অবাক হয়েই পোয়ারোর কথার পুনরাবৃত্তি করলাম। পোয়ারো বলল আমি যাতে ঠিক এইভাবেই কথাটা লরেন্সকে বলি। আমি কথাটার অর্থ জানতে চাইলাম। পোয়ারো আমাকে চিন্তা করে দেখতে বলল।

কথাটা বলতে বলতে আমরা ট্যাডমিনস্টারে পৌঁছে গেলাম। পোয়ারো একটা রাসায়নিক পরীক্ষাগারের সামনে গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। পোয়ারো ফিরে আসতেই আমি জানতে চাইলাম ওখানে তার কি দরকার ছিল।

পোয়ারো জানাল শোবার ঘর থেকে যে কোকোটা পাওয়া গেছিল সেটা সে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য দিতে গেছিল। আমি খুব অবাক হয়ে বললাম ঐ কোকো তো ডঃ বরস্টিন পরীক্ষা করেছেন। পোয়ারো বলল ব্যাপারটা সে জানে, তবুও আরেকবার পরীক্ষা করলে তো কোনো ক্ষতি নেই।

এরপর পোয়ারো আর কোনো কথা বলল না, একেবারে চুপ করে গেল।

পরদিন মিসেস ইঙ্গলথর্পের অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হল। তার পর দিন সোমবার–বেশ দেরি করেই সকালে চায়ের আসরে হাজির হলাম। খাওয়ার সাথে সাথেই জন আমাকে আড়ালে টেনে বলল মিঃ ইঙ্গলথর্প সেদিন সকালেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। জন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল এবার তারা সত্যিই হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে। জন আরও জানাল যে মিসেস ইঙ্গলথর্প অর্থাৎ তার মা বাড়িটা মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে দিয়ে যাননি।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম যে এই বাড়িটা রাখতে তার কোনো অসুবিধা হবে কিনা। জন বলল সেরকম কোনো অসুবিধা হবে না, তবে মৃত্যু কর দিতে হবে। তাহলেও তার বাবার রেখে যাওয়া টাকার অর্ধেকটাই তাদেরই থাকছে। লরেন্সও আপাতত তার কাছেই থাকবে, কারণ তারও একটা অংশ আছে।

ইঙ্গলথর্প বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে শুনে সকলকেই বেশ খুশী বলে মনে হতে লাগল। দুর্ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার ফলে বাড়ির আবহাওয়াটা খুব ভারী হয়ে পড়েছিল। সম্ভবতঃ সেদিনই সকলে বেশ ফুর্তির সঙ্গে প্রাতঃরাশ সারলো। শুধুমাত্র লরেন্সকেই অদ্ভুত গম্ভীর আর চিন্তিত মনে হতে লাগল।

সংবাদপত্রগুলোও এই দুর্ঘটনার বিবরণ ছেপে দিয়ে বেশ মেতে উঠেছিল। বাড়ির প্রায় সকল সদস্যের কথাই কাগজের পাতায় মুখরোচকভাবে পরিবেশন করা হচ্ছিল। পুলিশও কিছু সূত্র পেয়েছে বলে লেখা হচ্ছিল। আসলে যুদ্ধের হুজুগে ভাটা পড়ায় এই ঘটনাটা বেশ আলোচনার খোরাক হয়ে উঠেছিল। সংবাদদাতারা তো সময়ে অসময়ে স্টাইলসের লোকজনকে বিরক্ত করে ছেড়েছে। সুযোগ পেলেই বাড়ির সকলের ছবি তুলতে শুরু করল। এছাড়া স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ডের গোয়েন্দারাও আসা যাওয়া করছে বারবার, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে–সব মিলিয়ে প্রাণান্তকর এক অবস্থা।

সেদিন প্রাতঃরাশের পর একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। ডরকাস হঠাৎ আমার কাছে এসে বলল তার কিছু কথা বলার আছে। আমি জানতে চাইলাম, ব্যাপারটা কি? সে জিজ্ঞাসা করল পোয়ারোর সাথে আমার আর দেখা হবে কিনা। আমি মাথা নেড়ে সায় দিতেই ও আবার বলল, পোয়ারো জানতে চেয়েছিল মিসেস ইঙ্গলথর্পের কোনো সবুজ রঙের পোশাক আছে কিনা।

আমি বেশ আগ্রহান্বিত হয়ে জানতে চাইলাম সে পোশাকটা খুঁজে পেয়েছে কিনা। ডরকাস জানাল সে খুঁজে পায়নি, তবে চিলেকোঠার ঘরে একটা মস্ত বড় সিন্দুক রাখা আছে যাতে অনেক রকম পোশাক আছে। সবাই সিন্দুকটাকে পোশাকের বাক্স বলে। তাই তার ধারণা ঐ সিন্দুকে একটা সবুজ রঙের পোশাক থাকতেও পারে। এই কথাটা আমি যাতে পোয়ারোকে বলি সেজন্য ডরকাস আমাকে অনুরোধ করল। আমি তাকে বলব বলে আশ্বস্ত করলাম।

ডরকাসের দেওয়া খবরটা পোয়ারোকে এখনই জানানো দরকার মনে করে ওর খোঁজে বের হলাম। বেশি দূর যেতে হল না, রাস্তার মাঝেই পোয়ারোর সঙ্গে দেখা হল। খবরটা তাকে বলতেই সে সিন্দুকটা দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল।

আবার আমরা দুজনে বাড়িতে ঢুকলাম। হলঘরে কাউকে দেখতে পেলাম না। সোজা আমরা চিলেকোঠার ঘরে উপস্থিত হলাম। বড়ো একটা সিন্দুক দেখতে পেলাম, খুব সুন্দর পেতলের কাজ করা সিন্দুকটা। ভেতরে বিভিন্ন ধরনের বিচিত্র পোশাক বোঝাই রয়েছে। পোয়ারো পোশাকগুলো এক এক করে বাইরে স্তূপীকৃত করতে লাগল। দুএকটা হাল্কা সবুজ রঙের পোশাক পেলেও পোয়ারো সন্তুষ্ট হল না।

হঠাৎ পোয়ারো সিন্দুকের মধ্যে আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখতে বলল। দেখলাম প্রায় খালি সিন্দুকটার একেবারে তলায় একগোছা কালো কুচকুচে দাড়ি পড়ে আছে। পোয়ারো দাড়িটা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে বলল সেটা একেবারে নতুন বলে মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ দেখার পর সব কিছু আবার ঠিকমত রেখে দিল।

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। আমিও পেছনে পেছনে নামলাম। পোয়ারো সোজা ভাড়ার ঘরে ঢুকলো। সেখানে ডরকাস কিছু রুপোর বাসনপত্র একমনে মুছে ঝকঝকে করে রাখছিল।

ডরকাস তাকাতেই পোয়ারো বলল তার দেওয়া খবর পেয়েই সে সিন্দুকটা দেখে এল, সেখানে সত্যিই অনেক সুন্দর পোশাক রয়েছে। পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল ঐ পোশাকগুলো সকলে ঘন ঘন ব্যবহার করে কিনা।

ডরকাস জানাল আজকাল আর তেমন ব্যবহার হয় না। শুধু মাঝে মাঝে যখন সকলে পোশাক বিচিত্রা অনুষ্ঠান করেন তখন ব্যবহার হয়। ডরকাস বলল তখন বেশ মজা হয়–একবার মিঃ লরেন্স পারস্যের শাহ সেজেছিলেন, খুব মজা করে ছুরি হাতে লরেন্স নাকি ডরকাসকে বলেছিল তাকে না রাগাতে, রাগলেই সে এক কোপে মাথা দু-ফাঁক করে দেবে। ডরকাস আরও জানাল যে মিস সিনথিয়া এক খুনে গুণ্ডা সর্দার সেজেছিলেন, অত সুন্দরী মেয়েটাকে যে কী ভয়ানক দেখাচ্ছিল তা সে বলে বোঝাতে পারবে না।

পোয়ারো বলল তাহলে ঐ সন্ধ্যাগুলো তাদের বেশ ভালোই কাটত। সে জিজ্ঞাসা করল, মিঃ লরেন্স সিন্দুকে রাখা কালো দাড়িটা লাগিয়েছিল কিনা।

ডরকাস হেসে মাথা নেড়ে জানাল মিঃ লরেন্স তার কাছ থেকে খানিকটা কালো উল নিয়েছিলো দাড়ি বানাবার জন্য।

পোয়ারো ঘর থেকে বেরিয়ে আপন মনেই বলল তাহলে ঐ দাঁড়ির ব্যাপারটা ডরকাস জানে না।

আমি জানতে চাইলাম পোয়ারো কি এটাকে সেই দাড়িটা বলে ভাবছে। পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিল এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করল ওটা যে বেশ ছুঁচলো করে ছাঁটা হয়েছে সেটা আমি লক্ষ্য করেছি কিনা। আমি বললাম আমি তো সে রকম কিছু লক্ষ্য করিনি। পোয়ারো বলল কেউ ওটা মিঃ ইসলথর্পের দাড়ির মত করে হেঁটেছে, ওতে দু-এক গাছা চুলও লেগে রয়েছে।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম সিন্দুকের মধ্যে ওটা কে রাখতে পারে?

পোয়ারো বলল, ঐ সিন্দুকের মধ্যে দাড়িটা যে রেখেছে সে খুবই বুদ্ধিমান। দাড়িটা ওখানে রেখে সে যে কেশিলের আশ্রয় নিয়েছে তার ফলে কেউ তাকে সন্দেহ করতে পারবে না। পোয়ারো এও বলল যে এবার আমাদের আরও বুদ্ধির পরিচয় দিতে হবে, কিন্তু এমন ভাব। দেখাতে হবে সে যেন আমাদের বুদ্ধির পরিমাপ করতে না পারে।

এবার পোয়ারো বলল এই বাড়িতে তার একজন সহযোগী দরকার। আমি অসন্তুষ্ট হয়ে বললাম যে আমিই তো আছি। পোয়ারো বলল আমাকে ছাড়াও আরো একজনকে দরকার। পোয়ারোর কথাতে আমি মনে খুব আঘাত পেলাম। পোয়ারো সম্ভবত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই গভীর দৃষ্টি মেলে আমার দিকে তাকালো, বলল আমি তার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারিনি, আসলে আমি তার সঙ্গে যে কাজ করছি তা–সকলেই জানে, এমন আরেকজনকে দরকার সে আমাদের সঙ্গে নেই।

আমি ব্যাপারটা বুঝলাম, জনকে দিয়ে কাজ হবে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম।

 পোয়রো বলল জনকে দিয়ে হবে না। হঠাৎ দেখলাম মিস হাওয়ার্ড এদিকে আসছেন।

 পোয়ারো বলল, মিস হাওয়ার্ডই তার সহযোগী হবার কাজটা ঠিকমতো করতে পারবেন।

পোয়ারোর অনুরোধ শুনে মিস হাওয়ার্ড কয়েক মিনিট কথা বলতে রাজী হলেন। আমার মনে হল ভদ্রমহিলা পোয়ারোকে তেমন আমল দিতে চাইছেন না। আমরা একটা ঘরে ঢুকে বসতেই পোয়ারো দরজাটা বন্ধ করে দিল।

মিস হাওয়ার্ড তাড়া দিলেন। পোয়ারো বলল তার একটা জিজ্ঞাসা আছে এবং সে মিস হাওয়ার্ডের কাছ থেকে সঠিক উত্তর প্রত্যাশা করছে। মিস হাওয়ার্ড জানালেন তিনি মিথ্যে কথা বলেন না। পোয়ারো প্রশ্ন করল হাওয়ার্ড কি বিশ্বাস করেন যে মিসেস ইঙ্গলথর্পকে ওর স্বামীই বিষ খাইয়েছেন। মিস হাওয়ার্ড বললেন এ ব্যাপারে তিনি স্থির নিশ্চিত যে অ্যালফ্রেডই এমিলিকে বিষ খাইয়েছে।

পোয়ারো জানাল সে হাওয়ার্ডের কথা না হয় মানল। কিন্তু তার প্রশ্ন মিস হাওয়ার্ড কেন ইঙ্গলথর্পকে দোষী মনে করছেন। হাওয়ার্ড বললেন এটাই সত্যিই তাই।

পোয়ারো মৃদু হেসে বলল আসলে মিস হাওয়ার্ড মনে প্রাণে বিশ্বাস করতে চান যে ইঙ্গলথর্পপই অপরাধী। কিন্তু তার অবচেতন মন বলতে চায় ঐ অপরাধ সে করেনি। এর ফলে তিনি একটা মানসিক দ্বন্দ্বের শিকার হয়ে পড়েছেন।

মিস হাওয়ার্ড যেন পোয়ারোর কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনল, তারপরে চিৎকার করে বলে উঠল পোয়ারো যা বলছে সব মিথ্যা।

পোয়ারো কোনো কথা না বলে শুধু গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল।

মিস হাওয়ার্ড বললেন পোয়ারো যাতে তার সাহায্য না চায়, কারণ সে সাহায্য করতে পারবে না। পোয়ারো বলল সে সাহায্য চাইছে না, তার অনুরোধ মিস হাওয়ার্ড যেন শুধু তার সহযোগী হয়ে থাকেন।

মিস ওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করলেন তাকে সহযোগী হয়ে কি কাজ করতে হবে? পোয়ারো তাকে শুধু চোখ কান খুলে ল করতে বললেন।

মিস হাওয়ার্ড মাথা নেড়ে বললেন তাতে তার কোনো আপত্তি নেই। তিনি মনে প্রাণে চান ন্যায় তোক। একথা বলে তিনি ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে চলে গেলেন।

ওর গমনপথের দিকে পোয়ারো কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর অস্ফুট স্বরে বলল মহিলার হৃদয় আর বুদ্ধি দুই আছে তাই সে তাকে সহযোগী হিসাবে বেছে নিয়েছে।

মিস হাওয়ার্ড ও পোয়ারোর এই দীর্ঘ কথোপকথনের কিছুই আমার মাথায় ঢুকল না। পোয়ারোকে একথাটা জানাতে ও খুবই অবাক হল। আমি তাকে অনুরোধ করলাম ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে দিতে। পোয়ারো বলল সে আমাকে বোঝাতে পারবে না। কারণ সে চায় এই গোপনীয়তা তার আর মিস হাওয়ার্ডের মধ্যে থাকুক।

এই কাজটা যে রীতিমত অন্যায় একথা না বলে আমি পারলাম না।

পোয়ারো বলল সে কোনো কিছুই আমার কাছে গোপন করেনি, সব ব্যাপারই আমার জানা শুধু আমাকে এর থেকে সিদ্ধান্ত তৈরি করে নিতে হবে। পোয়ারোর কথার কোনো উত্তর দিলাম না। মনে মনে এই ভেবে দুঃখ হল যে পোয়ারো আমার কোনো মূল্যই দিতে চায় না। স্থির করলাম যদি কোনো সূত্র খুঁজে পাই তাহলে তা পোয়ারোকে জানাব না। একেবারে শেষে তাকে আশ্চর্য করে দেব। অনুভব করলাম যে নিজেকে এবার একটু জাহির করা দরকার।