০১. স্টাইলস রহস্যের কথা

দি মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার্স অ্যাট স্টাইলস (এরকুল পোয়ারো সিরিজ) – আগাথা ক্রিস্টি

০১.

বসে বসে স্টাইলস রহস্যের কথা ভাবছিলাম। সারা পৃথিবী জুড়ে এই নিয়ে প্রচুর হৈ চৈ হল। উৎসাহের জোয়ারে যেই একটু ভাটা পড়েছে, তখনই এল বন্ধুবর পোয়ারো। সে জানাল স্টাইলস পরিবারের সকলের মিলিত অনুরোধ-ঘটনাগুলির একটা বিবরণ আমাকে লিখতে হবে। কারণ এ ব্যাপারে চতুর্দিকে প্রচুর দুর্নাম ছড়িয়েছে। সকলকে এবার আসল ব্যাপারটা জানানো একান্ত প্রয়োজন।

স্টাইলস পরিবারের সদস্য না হওয়া সত্ত্বেও, ঘটনাচক্রে ব্যাপারটার সঙ্গে শুরু থেকে জড়িয়ে পড়ায় লেখার দায়িত্বটা আমাকে নিতে হল।

অতএব, কাহিনীর সূচনা এখানেই।…

তখন চতুর্দিকে যুদ্ধের আগুন জ্বলছে। সেই আগুন আমাকেও স্পর্শ করল। অগত্যা একদিন সোজা আমি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে রওনা দিলাম। কিন্তু দিন কয়েক যেতে না যেতেই আহত হয়ে হাসপাতালে আশ্রয় নিতে হয়। কয়েক মাস সেখানে কাটানোর পর একটু সুস্থ হলাম। এর ফলে এক মাস ছুটিও পেয়ে গেলাম। এবারই দেখা দিল আসল সমস্যা। কারণ আত্মীয় স্বজন বা এমন কোনো বন্ধুবান্ধব আমার নেই যে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হব।

হঠাৎ দেখা হয়ে গেল জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে। জন আমার চেয়ে বছর পনেরোর বড়। বহুদিন পরে ওর সঙ্গে দেখা হল। ওর সঙ্গে আমার খুব একটা অন্তরঙ্গতা ছিল না, তবে ওদের এসেক্সের বাড়িতে আগে মাঝেমাঝে গেছি।

বিগত দিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতেই জন আমাকে তার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানাল, বলল আমাকে দেখলে নাকি তার মা খুশী হবেন। আমি জানতে চাইলাম তার মা কেমন আছেন। জন বলল ভালই এবং সেই সঙ্গে একটা অবাক করা কথাও শোনাল। জানাল তার মা নাকি বিয়ে করেছেন।

ওদের পারিবারিক ইতিহাস আমার অজানা নয়। জনের মা মারা যাওয়ার পর জনের বাবা আবার বিয়ে করলেন। এই ভদ্রমহিলাই জনের মা অর্থাৎ সৎ মা। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস মধ্যবয়স্কা মহিলা হলেও বেশ সুন্দরী, এখন বয়স প্রায় সত্তরের কাছাকাছি, ভদ্রমহিলাকে দেখে আমার বেশ কর্তৃত্বপরায়ণা বলেই মনে হয়েছে। ভদ্রমহিলা দান-ধ্যানও করতেন। তবে সমাজে যে অল্প বিস্তর নিন্দেও ছিল না তা নয়। তবে আসল কথা হল মহিলা বেশ হৈ চৈ করে নিজেকে জাহির করতে চাইতেন।

জনের বাবা মিঃ ক্যাভেণ্ডিস তার বিয়ের প্রায় পরেই তার দেশের বাড়ি স্টাইলস কোর্ট তার সম্পত্তি থেকে ছেলেদের বঞ্চিত করে জনের সৎ মা অর্থাৎ মিসেস ক্যাভেণ্ডিসকে দিয়ে গেলেন। সৎ মা হলেও মহিলা ছেলেদের খুব স্নেহ করতেন। বাবার বিয়ের সময় ওরা এত ছোট ছিল যে সত্যকেই নিজের মা বলে জেনে এসেছে।

জনের ছোট ভাই লরেন্সের শরীরটা বরাবরই খারাপ। ডাক্তারী পাস করার পর চিকিৎসা করার চেষ্টা না করে সে বাড়িতে বসে কাব্যচর্চা শুরু করে দিল। এতে অবশ্য কোনো সুনাম জুটল না।

জনও কিছুদিন ওকালতি করার পর সেসব পাট চুকিয়ে দিয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে এল। দুবছর আগে জন বিয়ে করেছিল। বউও স্টাইলেসে থাকত। আমার একটা কথা প্রায়ই মনে হত। জনের আসল ইচ্ছে হয়ত মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা কড়ি নিয়ে অন্য কোথাও বাসা বাঁধে।

মিসেস ক্যাভেণ্ডিস বেশ জাঁদরেল মহিলা ছিলেন। তিনি চাইতেন সবাই তার হুকুম মেনে চলুক। সব টাকাপয়সা তার হাতে থাকায় একাধিপত্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে সুবিধাটাও তিনি ভোগ করতেন।

তার বিয়ের কথা শুনে আমাকে বিস্মিত হতে দেখে জনের ঠোঁটে একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটে উঠল।

একটু পরে জন জানতে চাইল আমার ইভিকে মনে আছে কিনা। আমি মাথা নেড়ে জানালাম আমি তো ঐ নামে কাউকে চিনি না। জন বলল তারই ভুল হয়েছে। আসলে শেষবার আমি চলে আসার অনেক পরে নাকি ইভি এসেছে। মেয়েটা সব কাজে পারদর্শী, তবে চেহারাটা এমন কিছু নয়। কথা বলতে বলতে জন হঠাৎ থামল।

আমি প্রশ্ন করলাম জন কি বলতে গিয়ে থেমে গেল। জন জানাল, একদিন একটা লোক কোথা থেকে এসে হাজির হল আর নিজেকে ইভির দূর সম্পর্কের আত্মীয় বলে পরিচয় দিল। লোকটা দেখতে একেবারের বাউণ্ডুলের মত–একমুখ ভর্তি দাড়ি মুখটাও কুৎসিত, জনের মা লোকটার মধ্যে কি দেখলেন সেকথা জনের আজও বোধগম্য নয়। তিনি লোকটাকে একেবারে সেক্রেটারি করে নিলেন। তার বিভিন্ন সমিতির কাজকর্ম বেশ মন দিয়ে করে লোকটা মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের মন জয় করে ফেলেছিল। এরপর যা ঘটল সেটাই তাজ্জব ব্যাপার। মিসেস ক্যাভেণ্ডিস মাস তিনেক আগে জানালেন তিনি ঐ লোকটাকে বিয়ে করছেন। লোকটা মহিলার চেয়ে প্রায় কুড়ি বছরের ছোট। লোকটা খুবই ধুরন্ধর। তার নজর আসলে মহিলার ধনসম্পত্তির ওপর। শেষ পর্যন্ত বিয়েটাও হয়ে গেছে।

আমি বললাম তাহলে জনকে বেশ অস্বস্তির মধ্যেই দিন কাটাতে হচ্ছে। জন বলল একটা কদর্য আবহাওয়ার মধ্যে বাস করছে।

এরপর জনের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে পারলাম না। দিন তিনেক পর ট্রেনে করে পৌঁছে গেলাম স্টাইলসের সেন্ট মেরী স্টেশনে। স্টেশনটা বেশ ছোট, চারদিকে সবুজ মাঠ আর সরু সরু রাস্তার মাঝখানে যেন নিতান্তই বেমানান। জন আমার জন্য প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষা করছিল। ট্রেন থেকে নেমে ওর সাথে গাড়িতে উঠলাম।

স্টাইলসের সেন্ট মেরী গ্রামটা স্টেশন থেকে অন্ততঃপক্ষে মাইল দুই দূরে। আরও মাইল খানেক ভেতরে গেলে তবে স্টাইলস কোর্ট।

জুলাই মাস, গরমও পড়েছে প্রচণ্ড। এসেক্সের সবুজ প্রান্তর দেখে মনটা জুড়িয়ে গেল। এ দৃশ্য দেখলে কে বলবে, কিছু দূরে কি ভয়ানক যুদ্ধ চলছে। আমার মনে হল অন্য কোনো জগতে যেন এসে পড়েছি।

জন বলে উঠল এ জায়গাটা আমার বেশি শান্ত বলে মনে হতে পারে। আমি তাকে বললাম ঠিক এরকম পরিবেশই আমার চাই। কাজকর্ম না থাকলে এরকম জায়গাই সময় কাটানোর পক্ষে উপযুক্ত।

জন জানাল সে সপ্তাহে দুদিন স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কাটায়, খামার টামার দেখে। তার স্ত্রীও সকাল পাঁচটা থেকে দুধ দোয়ানোর কাজে লেগে যায়। তাদের সব কিছুই বেশ ভালোভাবে কাটছিল। কিন্তু ঐ অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প সব গোলমাল করে দিল। কথা বলতে বলতে জন ঘড়ি দেখে বলল সে সিনথিয়াকে তুলে নেবে কিনা ভাবছে নাকি এতক্ষণে সে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পড়েছে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম সিনথিয়া কি তার স্ত্রী। জন বলল সিনথিয়া হল তার মার আশ্রিতা–এক স্কুলের বান্ধবীর মেয়ে। সিনথিয়ার মা এক হতভাগ্য সলিসিটরকে বিয়ে করেছিলেন। লোকটা মেয়েটাকে অনাথ করে রেখে যায়। জনের মা দুবছর আগে ওকে। এখানে আশ্রয় দিয়েছে। সিনথিয়া সাত মাইল দূরে ট্যাডমিন্‌স্টার রেডক্রশ হাসপাতালে কাজ করে।

কথা বলতে বলতে আমরা একটা সুন্দর পুরনো বাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। দেখলাম, সেখানে একজন মহিলা ফুলগাছের ওপর ঝুঁকে কি যেন করছিলেন। তার পরনে আঁটোসাঁটো টুইডের পোশাক। আমাদের দেখতে পেয়েই তিনি উঠে দাঁড়ালেন।

জন সেই মহিলার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। মহিলার নাম বলল মিস ইভি হাওয়ার্ড। আর আমার পরিচয় দিল বীরপুঙ্গব হেস্টিংস বলে। নামের আগে জন বেশ বড়সড় একটা বিশেষণ যোগ করল।

মিস হাওয়ার্ড বেশ ঝাঁকুনি দিয়ে আমার সঙ্গে করমর্দন করলেন। আমি মিস ইভিকে বেশ ভালভাবে লক্ষ্য করলাম। বেশ রোদে ঝলসানো মুখ, নীল চোখের মণিবয়স প্রায় চল্লিশ, মুখের গড়নটা যেন একটু পুরুষালী। চেহারাটাও বেশ ভারিক্কী। তবে মহিলার কথাবার্তা কেমন যেন খাপছাড়া লাগল। আমাকে দেখে প্রথমেই বললেন এখানে অনেক আগাছার উৎপাত। আমি যেন সাবধানে থাকি, নাহলে জড়িয়ে পড়ব।

আমি বললাম সকলের সঙ্গেই না হয় মানিয়ে নেবার চেষ্টা করব। সঙ্গে সঙ্গে ইভি বললেন আমার প্রথমেই এ কথা বলা উচিৎ নয় কারণ পরে হয়ত আমার এজন্য পস্তাতে হতে পারে।

আমাদের কথা শুনে জন হাসতে হাসতে বলল ইভির কথার কোনো ছিরি ছাঁদ নেই। সে জানতে চাইল সেদিন চায়ের ব্যবস্থা ভেতরে হয়েছে না বাইরে হয়েছে। চা খাওয়ার জন্য জন তাগাদা দিতে লাগল।

হাতের দস্তানা খুলতে খুলতে মিস হাওয়ার্ড আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন। একটা ডুমুর গাছের নিচে চায়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এখানেই প্রথম জনের স্ত্রী মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে দেখলাম। জন আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে আমি মুগ্ধ চোখে দেখলাম–লম্বা ঋজু চেহারা, স্বপ্নালু বাদামী রঙের চোখ–যা আমি আগে কখনও দেখিনি। আকর্ষণ করার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে ওর, চেহারাটার মধ্যে একটা শিথিল বন্য উদ্দামতা আর শান্ত দৃঢ়তা অথচ দেখলে মনে হয় যেন কেমন কোমল। মেরী ক্যাভেণ্ডিসকে এই প্রথম দেখার ক্ষণটুকু আমার স্মৃতিপটে চিরদিনের মত গাথা হয়ে গেল।

শান্ত স্বরে মেরী আমাকে স্বাগত জানালেন। একটা বেতের চেয়ার টেনে আমি বসে পড়লাম আর মনে মনে জনের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি বলে আত্মতুষ্টি লাভ করলাম।

চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে মেরী ক্যাভেণ্ডিস দুএকটা কথা বললেন। আমিও প্রত্যুত্তর দিতে লাগলাম। আমার আরোগ্যকালীন স্বাস্থ্যবাসের দুএকটা মজার কাহিনীও বললাম। ভদ্রমহিলার মনে হয় শুনতে ভালোই লাগছিল। জন চুপচাপ বসে রইল, ও অবশ্য কোনোদিনই কথাবার্তায় পটু নয়।

কথাবার্তায় সময়টা বেশ ভালোই কাটছিল। হঠাৎ খোলা জানলা দিয়ে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল। বুঝতে অসুবিধা হল না ওই কণ্ঠস্বর জনের মা মিসেস ক্যাভেণ্ডিসের। তিনি কারও উদ্দেশ্য কিছু বলছিলেন। আলফ্রেড বলে কাকে সম্বোধন করছেন, বুঝতে পারলাম উনিই তার স্বামী, মিঃ ইঙ্গলথর্পৰ্প।

একটু পরে আমাদের সামনে এসে উপস্থিত হলেন শুভ্রকেশা এক মহিলা আর তার পেছনে এক আজ্ঞাবহ পুরুষ। আমাকে দেখেই জনের মা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন আমাকে দেখে তিনি খুবই আনন্দিত হয়েছেন। তিনি তার নতুন স্বামীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন।

আলফ্রেড ইঙ্গলথর্পকে আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখলাম। লোকটাকে দেখলেই মনে বিতৃষ্ণা জাগে। মুখে কালো একগোছা দাড়ি। চোখে সোনার ফ্রেমে বাঁধানো পাঁশনে, গলার স্বরটা কর্কশ এবং অদ্ভুত ধরনের। ভদ্রলোক যেন নিষ্প্রাণ হাত দিয়ে করমর্দন করলেন আর বললেন আমার সঙ্গে আলাপ করে নাকি তিনি আনন্দিত হয়েছেন। এরপর স্ত্রীর চেয়ারের কুশনটা গদগদ হয়ে বদলে দিলেন।

মিসেস ইঙ্গলথর্প অর্থাৎ জনের মারও দেখলাম বেশ গা ভাব, বুড়ো বয়সের প্রেম তে। এসব দেখে আমার বেশ মজাই লাগল।

মিঃ ইঙ্গলথর্প আসার পর থেকেই যে একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে পারলাম। লোকটাকে আমিও ঠিক সহ্য করতে পারছিলাম না। ..

মিসেস ইঙ্গলথর্প অর্থাৎ জনের মা সমানে কথা বলে চলেছেন। তিনি একেবারে আগের মতই আছেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন আমি প্রথম থেকেই সৈন্যদলে আছি কিনা। আমি বললাম, যুদ্ধের আগে লয়েড়সে কাজ করতাম। তিনি এবার জিজ্ঞাসা করলেন পরে আবার সেখানেই ফিরে যাব কিনা। আমি বললাম দেখা যাক, যদি অন্য কোথাও কিছু জুটে যায়।

এবার মেরী ক্যাভেণ্ডিস আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন কি রকম কাজ আমার পছন্দ। আমি বললাম সে কথা শুনলে উনি হাসবেন। মেরী হাসিমুখে তবুও জানতে চাইলেন। আমি জানালাম আমার ইচ্ছে গোয়েন্দাগিরি করা। মেরী জিজ্ঞাসা করলেন স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড শার্লক হোমস–কার মত আমি হতে চাই। আমি বললাম অবশ্যই শার্লক হোমস।

মিস হাওয়ার্ড জানালেন তারও গোয়েন্দাকাহিনী পড়তে মজা লাগে। কিন্তু আবার একথাও বললেন যে সেগুলি একেবারে গাঁজাখুরি ব্যাপার। গল্প শেষ হলে অপরাধীকে চেনাই যায় না। তবে এ ব্যাপারে তার মত হল সত্যি যদি কেউ অপরাধ করে তাহলে অপরাধীকে চিনে নেওয়া খুবই সহজ। কোনো পরিবারে এ রকম ঘটলে তা চেপে রাখা যায় না, কে দোষী তা সহজেই বোঝা যায়।

কথাগুলো শুনে আমার খুব মজা লাগল। বললাম তাহলে খুনের ব্যাপারে জড়িয়ে পড়লে মিস হাওয়ার্ড খুনীকে চিনে ফেলতে পারবেন। ইভি দৃঢ়স্বরে জানালেন নিশ্চয়ই পারবেন। প্রমাণ করতে না পারলেও খুনী লোকটা যদি তার কাছাকাছি থাকে তাহলে নিশ্চয়ই চিনতে পারবেন।

মেরী ক্যাভেণ্ডিস হঠাৎ বলে উঠলেন বিষ প্রয়োগে মৃত্যু ঘটলে কি করে বোঝা যাবে কে খুনী। মেরীর মুখে এই কথাগুলো শুনে চমকে উঠলাম।

মিসেস ইঙ্গলথর্প আমাদের আলোচনায় বাধা দিলেন, জানালেন এরকম আলোচনা তার মোটেই পছন্দ নয়।

এমন সময় হাসপাতালের পোশাক পরিহিতা এক তরুণীকে ঘাসের ওপর দিয়ে এদিকে আসতে দেখলাম। মিসেস ইঙ্গলথর্প জানতে চাইলেন যে আসতে এত দেরি করল কেন। তারপর আমার সঙ্গে তরুণীটির আলাপ করিয়ে দিলেন, জানালেন মেয়েটির নাম মিস সিনথিয়া মারডক।

সিনথিয়াকে দেখে আমার বেশ ভালো লাগল। মেয়েটি প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে ওকে দেখতে থাকলাম। মনে হল ওর চোখ দুটো কালো হলে ওকে নিখুঁত সুন্দরী বলা যেত।

একটা চায়ের কাপ নিয়ে সিনথিয়া জনের পাশে মাটিতে বসল। আমি এক প্লেট স্যাণ্ডউইচ ওর সামনে ধরলাম। সিনথিয়া হেসে আমাকে ঘাসের ওপর বসার আমন্ত্রণ জানাল। ওর পাশে বসে পড়লাম। এবার জানতে চাইলাম সে ট্যাডমিনস্টারের কাজ করে কি না। সিনথিয়া মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। আমি বললাম যে আমার এক আত্মীয়া নার্সিং শেখে অথচ নার্সিং-এর নামে তার ভীষণ ভয়। সিনথিয়া বলল ভয় পাবারই কথা। কারণ নার্সরা একেবারে যাচ্ছেতাই। তবে সে নার্স নয় বলে ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ। সে জানাল তার কাজ ডাক্তারখানায়। আমি হেসে বললাম রোজ কত লোককে তাহলে সে বিষ খাওয়ায়। সিনথিয়াও হাসতে হাসতে বলল প্রায় কয়েকশো হবে।

কিন্তু বেশিক্ষণ সিনথিয়ার সঙ্গে কথা বলা হল না। মিসেস ইঙ্গলথর্প কতকগুলো চিঠি লিখতে বললেন ওকে। সিনথিয়াও সঙ্গে সঙ্গে উঠে বাড়িতে চলে গেল।

মিসেস ইঙ্গলথর্প এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন জন আমার ঘরটা আমাকে দেখিয়ে দেবে। রাত্রে খাওয়ার সময়টা যে সাতটা তাও বলে দিলেন।

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। জনের সঙ্গে এবার বাড়ির মধ্যে গেলাম। চওড়া সিঁড়ি বেয়ে বাড়ির বাঁ দিকে আমার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটাতে এলাম। জানলা দিয়ে সবুজ মাঠের দিকে তাকালাম।

হঠাৎ দেখতে পেলাম একটা গাছের আড়াল থেকে কে একজন বেরিয়ে এসে বাড়ির দিকে হাঁটতে। লোকটার দাড়ি গোঁফ নিখুঁতভাবে কামানো। চোখেমুখে কেমন উদভ্রান্তের মত ভাব। লোকটা এদিকে তাকাতেই চিনতে পারলাম এ হল জনের ভাই লরেন্স। পনের বছর পরে দেখেও চিনতে কোনো অসুবিধা হল না।

রাত্রে ভালোই ঘুম হল। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে চারদিকে তাকাতেই মনটা আনন্দে ভরে উঠল। সুন্দর রোদে চারদিক ঝলমল করছে।

দুপুরবেলা খাওয়ার আগে মেরী ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে আমার দেখা হল না। খাওয়ার পর ওর অনুরোধে একটু ঘুরে আসার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ওর সাথে ঘুরতে লাগলাম, সত্যি বলতে ওর সঙ্গে আমার বেশ ভালোই লাগছিল।

বাড়িতে ফিরে এসে বড় হলঘরটাতে ঢুকতেই জনের সঙ্গে দেখা হল। বেশ বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঘটেছে। জন বলল একটা বাজে ব্যাপার ঘটেছে। ইভি অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করেছেন।

এই সময় ইভি ঘরে এসে ঢুকলেন। মুখ দেখেই বোঝা যায় যে মনের মধ্যে একটা ঝড় চলছে। জন জানতে চাইল ইভি কি বলছেন। ইভি জানালেন জনের মা অর্থাৎ এমিলিকে তিনি বলেছেন যে তার ভীমরতি ধরেছে বলেই তার চেয়ে বয়সে ছোট একটা লোককে তিনি বিয়ে করেছেন। আর লোকটারও একমাত্র মতলব হচ্ছে এমিলির সম্পত্তি হাতানো। এমনকি একথাও জানিয়েছেন যে, চাষী রেইকসের সুন্দরী বউ-এর সঙ্গে আলফ্রেড কতক্ষণ সময় কাটায় তা যেন নিজের চোখে দেখেন। ইভি বললেন আলফ্রেড যে কোনদিন এমিলি অর্থাৎ জনের মাকে খুন করতে পারে। একথাও তিনি জানিয়েছেন।

এসব শুনে এমিলির প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল তা জানতে চাইল জন। ইভি জানালেন তিনি একেবারে রেগে আগুন হয়ে গেছেন। তাকে হিংসুটে বলে গালাগাল দিয়েছেন। এমন কি বিদায় হতেও বলে দিয়েছেন।

জন তাকে যেতে নিষেধ করল। ইভি দৃঢ়স্বরে বললেন সে আর এক মুহূর্ত থাকতে রাজী নয়।

আমরা হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। জন যখন বুঝতে পারল ইভিকে বলে আর কোনো লাভ নেই তখন সে ট্রেনের সময় দেখার জন্য উঠে গেল। ওর স্ত্রীও জনের সঙ্গে গেল।

ওরা চলে যেতেই মিস হাওয়ার্ডের মুখের ভাব বদলে গেল। উনি আমার কাছে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বললেন তিনি আমাকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন তাই একথা বলছেন যে আমি যেন জনের মার প্রতি লক্ষ্য রাখি, কারণ, এখানকার সকলেই সুযোগসন্ধানী, এরা টাকা ছাড়া আর কিছুই চেনে না।

আমি মিস হাওয়ার্ডকে নিশ্চিন্ত হতে বললাম এবং জনের মার প্রতি লক্ষ্য রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করব বলে জানালাম। মিস হাওয়ার্ড আমাকে চোখ কান খোলা রেখে চলতে বললেন। একথা বলে তিনি বিদায় নিলেন।

মোটর গাড়ির শব্দ পেলাম। জানলার পাশে গিয়ে দেখলাম মিস ইভি গাড়ির দরজা খুলে ঢুকছেন। বাড়ির কর্তা ও কর্জী ছাড়া সবাই তাকে বিদায় জানাল।

গাড়িটা রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হতেই দেখলাম মেরী ক্যাভেণ্ডিস মাঠের ওপর দিয়ে এক ভদ্রলোকের দিকে এগিয়ে চলেছেন। লোকটাকে অভ্যর্থনা জানানোর সময় মেরীকে অতি মাত্রায় আনন্দিত বলে মনে হল আমার।

লোকটার এক মুখভর্তি দাড়ি। কেন যেন একে আমার একটুও ভালো লাগল না। আমি মুখ ফসকে জিজ্ঞাসা করে ফেললাম যে লোকটা কে। জন জানাল উনি ডাঃ বরস্টিন। এই গ্রামেই থাকেন। লণ্ডনের একজন বিশেষজ্ঞ তিনি। বিষের ওপর তিনি গবেষণা করেন। স্নায়ুদৌর্বল্যের কারণে তিনি এখানে বিশ্রাম নিতে এসেছেন।

সিনথিয়া পাশ থেকে বলে উঠল ডাঃ বরস্টিন মেরীর খুব ভালো বন্ধু, কথাটাতে জনকে একটু অসন্তুষ্ট মনে হল। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য সে আমাকে তার সঙ্গে বেড়াতে যেতে বলল।

গাছপালার মধ্য দিয়ে আমরা হাঁটতে লাগলাম। জনেদের জমিদারীর পথ ধরেই গ্রামের দিকে চললাম। কিছুক্ষণ পরে একটা খুব সুন্দরী মেয়েকে দেখতে পেলাম। মেয়েটি মৃদু হেসে মাথা ঝাঁকালো।

আমি বেশ প্রশংসাচ্ছলে বলে ফেললাম যে মেয়েটা বেশ সুন্দরী। জন বলল এই মেয়েটি হল মিসেস রেইক। আমার হঠাৎ মনে পড়ে গেল মিস হাওয়ার্ড এই মেয়েটির সঙ্গে মিঃ ইঙ্গলথর্পের সম্পর্কের কথা বলছিল।

মনের মধ্যে একটা অশুভ ছবি যেন ঝিলিক খেলে গেল। এক শুভ্রকেশ বৃদ্ধার মুখের পাশে দুষ্টুমি ভরা একটা সজীব মুখ ফুটে উঠল।

মন থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিয়ে জনকে বললাম যে স্টাইলস জায়গাটা সত্যিই খুব সুন্দর। গম্ভীরভাবে মাথা নেড়ে জন বলল সম্পত্তিটা যে লোভনীয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এটা হয়ত একদিন তারই হবে। জনের আক্ষেপ তার বাবা যদি একটু ভদ্রলোকের মত উইলটা করে যেতেন তাহলে, এতদিনে এই সম্পত্তির মালিক সেই হত। তাকে আর এরকম আর্থিক কষ্টে পড়তে হত না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম জনের আবার কীসের অভাব। সে বলল টাকার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে সে। আমি বললাম তার ভাই লরেন্স তাকে কোনো সাহায্য করতে পারে না? জন একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল লরেন্সের কিছুই নেই, যা ছিল সব তার কবিতা ছাপাতে খরচ করে ফেলেছে।

জন একথা স্বীকার করতে দ্বিধা করল না যে তার মা তাদের জন্য যথেষ্ট করেছেন, অবশ্য বিয়ের আগে পর্যন্ত। জন হঠাৎ চুপ করে গেল।

এই প্রথম বুঝলাম যে ইভিলিন হাওয়ার্ড চলে যাবার পর আবহাওয়াটা সত্যিই বদলে গেছে।