২.১ ফিলিপ ব্লেকের আখ্যান

দ্বিতীয় খণ্ড

ফিলিপ ব্লেকের আখ্যান

(পাণ্ডুলিপির সঙ্গে পাঠানো চিঠি)

প্রিয় মিঃ পোয়ারো,

পালন করছি প্রতিশ্রুতি। এর সঙ্গে অ্যামিয়াস ক্রেলের মৃত্যু সংক্রান্ত ঘটনাবলীর বিবরণ লেখা কাগজ পাঠালাম। এতোদিন পরের ঘটনা, তাই বাধ্য জানিয়ে রাখতে যে আমার স্মৃতিশক্তি নির্ভুলভাবে সব সময়ে কাজ নাও করে থাকতে পারে, তবে মনে করতে পেরেছি যতটা ততটা লিখেছি।

আপনার বিশ্বস্ত
ফিলিপ ব্লেক

 যে সব ঘটনার ফলে ১৯… সালের সেপ্টেম্বর মাসে

নিহত হন অ্যামিয়াস ক্রেল তার অগ্রগতি সম্পর্কিত বিবরণ।

আমার বন্ধুত্ব দীর্ঘকালের নিহত মানুষটির সঙ্গে। আমাদের দুজনেরই বাড়ি ছিলো গ্রামে পাশাপাশি। বন্ধুত্বও ছিলো পারিবারিক। আমার চেয়ে বছর দুয়েকের বড় অ্যামিয়াস ক্রেল। আমরা একসঙ্গে ছুটির দিনে খেলাধুলো করতাম এক স্কুলে না পড়লেও।

দীর্ঘদিনের পরিচয় সূত্রে মানুষটির সঙ্গে আমি মনে করি তার চরিত্র ও জীবন সম্বন্ধে, আমার বিশেষ অধিকার আছে তার সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গী সম্বন্ধে কিছু বলার। যারা ভালোভাবে অ্যামিয়াস ক্রেলকে জানে একথা তাদের কাছে আমি বলতে পারি খোলাখুলিভাবে যে ওর আত্মহত্যা ব্যাপারটা অবাস্তব সম্পূর্ণ। কিছুতেই আত্মহত্যা করতে পারে না অ্যামিয়াস। বরং ও বড় বেশি ভালোবাসতো বাঁচতে। ঘনিষ্ঠভাবে যারা ক্রেলকে চেনে তারা জানে যে আদালতে আসামীপক্ষের বক্তব্য–সে বিষ খায় অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে একেবারেই মিথ্যা একথা। আমি বরং বলবো বিবেক বলতে কিছুই অ্যামিয়াসের ছিলো না। যেটুকু ছিলো তার মধ্যে কোনো স্থান ছিলো না বিষাদের। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ওদের এমনই সম্পর্ক খারাপ ছিলো যে তা ভেঙে দেবার ব্যাপারে একটুও বিবেকের দংশন স্বামীর মনে হতো না। স্ত্রী ও মেয়ের ভরণপোষণের আর্থিক দিকটা দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিলো অ্যামিয়াস আর সে ব্যাপারে আমার ধারণা সে বেশ উদারতাই দেখাতো। অ্যামিয়াস খুব সদাশয় আর উদার মানুষ ছিলো। তার জুড়িমেলা ভার স্নেহ পরায়ণ ও আন্তরিকতায়। শুধু যে শিল্পী হিসেবে বড় ছিলো তা নয়, ওকে খুব ভালোবাসতো ওর বন্ধু-বান্ধবরা। ওর কোনো শত্রু ছিলো না যতদূর জানি।

আমি বহুদিন ধরে ক্যারোলিন ক্রেলকেও জানি বিয়ের আগে থাকতেই, ও যখন মাঝে মাঝে এসে থাকতে অ্যাল্ডারবেরিতে। তখন কিছুটা খ্যাপাটে মেয়ে ছিলো ক্যারোলিন, হঠাৎ মাঝে মাঝে খুব রেগে উঠতো। আকর্ষণ যে রূপের মধ্যে ছিলো না তা নয়, তবে এই ধরনের মেয়েদের সঙ্গে নিঃসন্দেহে কঠিন কাজ ঘর করা।

ও অ্যামিয়াসের ব্যাপারে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিজের অনুরাগ প্রকাশ করে ফেললো। সত্যি সত্যিই গভীরভাবে অ্যামিয়াস ক্যারোলিনকে ভালোবেসে ফেলেছিল আমার তা মনে হয় না। অথচ প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যেতো দুইজনকে, আর আগেই বলেছি আকর্ষণ ছিলো ক্যারোলিনের ফলে বিয়ে করা দুজনে পাকাপাকি করে ফেললো। অ্যামিয়াস ক্রেলের বন্ধুদের মধ্যে এই বিয়ের ব্যাপারে বেশ খানিকটা আশংকা যে ছিলো না তা নয়, কারণ ক্যারোলিন যোগ্য নয় অ্যামিয়াসের তা সবাই বুঝতো।

প্রথম কয়েক বছর এর ফলে অ্যামিয়াস ক্রেলের স্ত্রী আর অ্যামিয়াসের বন্ধুদের মধ্যে অসন্তোষের একটা চাপা প্রবাহ বয়ে চলেছিলো। কিন্তু ভীষণভাবে বন্ধুবৎসল ছিলো অ্যামিয়াস, তাই বন্ধুদের সে স্ত্রীর কথায় ছাড়েনি। আমি আর অ্যামিয়াস কয়েক বছর পরে আবার আগের মতোই বন্ধু হয়ে উঠলাম, অ্যান্ডারবেরিতে প্রায়ই যেতে শুরু করলাম। একথাও বলে রাখি প্রসঙ্গক্রমে ওদের মেয়ে কার্লার ধর্মপিতাও আমি হয়েছিলাম। আমার ধারণা এটাই বড় মস্ত প্রমাণ যে আমাকে অ্যামিয়াস তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু মনে করতো এবং তার ফলেই অধিকার জন্মেছে আমার সেই মানুষটি সম্বন্ধে কিছু বলার, যে নিজে ঊর্ধ্বে উঠে গেছে বলা কওয়ার।

যে বিষয়ে লিখতে বলা হয়েছে আমাকে তার আসল ঘটনায় এবার আসা যাক। আমি এসেছিলাম অ্যাল্ডারবেরিতে পাঁচদিন আগে অপরাধটা ঘটবার (পুরানো ডাইরী থেকে তাই আমি দেখতে পাচ্ছি) অর্থাৎ ১৩ই সেপ্টেম্বর তারিখে। যে একটা উত্তেজনা চলছে ওদের বাড়ির পরিবেশের মধ্যে এটা ওখানে আমি পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে পেরে গিয়েছিলাম বুঝতে। ঐ বাড়িতে সে সময় মিস এলসা গ্ৰীয়ারও ছিলেন। তার ছবি আঁকছিলো অ্যামিয়াস।

আগে থেকেই মিস গ্ৰীয়ার সম্বন্ধে অনেক কথা শুনেছিলাম, কিন্তু সশরীরে সেই প্রথম দেখলাম তাকে। অ্যামিয়াসের মুখে প্রায় মাসখানেক আগে ওঁর ভূয়সী প্রশংসা শুনেছিলাম। ও বলেছিলো, ওর আলাপ হয়েছে এক অসাধারণ চমৎকার মহিলার সঙ্গে। অ্যামিয়াস এত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলো মিস গ্ৰীয়ার সম্বন্ধে যে আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম, বুড়ো খোকা সাবধানে থেকো, নইলে তোমার মাথা আবার বিগড়োবে। ও উত্তরে বলেছিলো যেন আমি গাধামি না করি। শুধু মেয়েটার ছবি আঁকছে অ্যামিয়াস, এছাড়া তার পর আর কোনো ব্যক্তিগত আগ্রহ নেই। আমি বলেছিলাম, গাঁজাখোরদের তুমি ওসব কথা বুঝিয়ো বন্ধু, আমি অনেকবার এর আগে শুনেছি। ও বলেছিলো, আলাদা এবারের ব্যাপারটা, নিষ্ঠুরের মতো ব্যঙ্গ করে আমি বলেছিলাম, সে তো সব বারেই হলো। তখন বেশ চিন্তিত আর উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলো অ্যামিয়াস, বলেছিলো, বুঝতে পারছো না তুমি, একটা বাচ্চা মেয়ে ও নিতান্তই। এটাও বলেছিলো সেইসঙ্গে মেয়েটার দৃষ্টিভঙ্গী খুব আধুনিক আর একেবারে মুক্ত সেকেলের কুসংস্কার থেকে। মেয়েটা অত্যন্ত সৎ, স্বাভাবিক অ্যামিয়াস বলেছিলো, সে জানেই না ভয়ডর কাকে বলে।

মুখে না বললেও আমি মনে মনে বুঝেছিলাম এবার খুব খারাপভাবেই অ্যামিয়াস জড়িয়ে পড়েছে। অন্যদের মন্তব্য কয়েক সপ্তাহ পরে কানে আসতে লাগলো। কেউ বললো, একেবারে মজে গেছে এলসা মেয়েটা। অন্য একজনের মন্তব্য–একেবারেই গেছে অ্যামিয়াসের মাথাটা নইলে মেয়েটার বয়সের কথা চিন্তা করছে না একবারও। আবার নাকসিটকে অনেকে বললো নিজের পথটা এলসা গ্ৰীয়ার ভালোভাবে জানে। মেয়েটা বসে আছে টাকার গদিতে। অন্য একজনের বক্তব্য, যা চায়, তাই পায়। অনেক অশালীন কথা আরও বলাবলি করতো ওর সম্বন্ধে লোকেরা। কী ভাবতো এ ব্যাপারে অ্যামিয়াসের স্ত্রী এটা একটা বড় প্রশ্ন ছিলো এবং ক্যারোলিন ঐ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে যে ধরনের উত্তর দিতে বাধ্য হতো কেউ কেউ গম্ভীর হয়ে সে সম্বন্ধে বলতো যে মহিলা জ্বলে-পুড়ে মরতে ঈর্ষায় আর একেবারে নরক করে তুলেছিলো স্বামীর জীবন।

আমি প্রয়োজন মনে করছি এসব কথা উল্লেখ করা এই কারণে যে ওখানে আমি পৌঁছাবার আগে কী ধরনের ব্যাপার চলছিলো তা জানা দরকার সঠিকভাবে।

আমার দেখার আগ্রহও ছিলো মেয়েটাকে–সুন্দরী অসাধারণ আর দারুণ মোহময়ী স্বীকার করতে বাধ্য যে রুক্ষ ব্যবহার ক্যারোলিনের দেখে মনে মনে খুশি হয়েছিলাম আমি। এই খুশির মূলে এক ধরনের বিদ্বেষ ছিলো।

হালকা মেজাজে যতোটা থাকা উচিত অ্যামিয়াস জেল ততোটা ছিলো না। ওকে যারা ভালোভাবে চেনে না তারা কিন্তু স্বাভাবিকই মনে করতো ওর আচরণটাকে। কিন্তু এতো ঘনিষ্ঠভাবে ওকে চিনি বলেই বুঝতে পারছিলাম প্রচণ্ড চাপ পড়েছে ওর মনের ওপর, হঠাৎ হঠাৎ মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে, খুব খেয়ালী হয়ে পড়ছিলো মাঝে মাঝে, আর সব মিলিয়ে ভীষণ খিটখিটে।

অ্যামিয়াস ছবি আঁকার সময় প্রায়ই ভীষণ খেয়ালী হয়ে উঠতো, কিন্তু আঁকছিলো যে ছবিটা তার জন্যে মানসিক অতোটা চাপ হবার তেমন কোনো সঙ্গত কারণ দেখতে পাইনি আমি। ও খুব খুশি হয়েছিলো আমাকে দেখে যেই দুজন একা হয়েছি আমরা ও বললো আমাকে, ভালো হয়েছে খুব তুমি এসেছো ফিল। একটা বাড়িতে চারজন মেয়ে মানুষের সঙ্গে থাকতে হলে পাগল হয়ে যাবে যে কোনো মানুষ। ওরা মনে হচ্ছে পাগলাগারদে আমাকে না পাঠিয়ে ছাড়বে না।

খুব অস্বস্তিকর ছিলো সত্যিই পরিবেশটা। ক্যারোলিন ভীষণ রুক্ষ হয়ে উঠেছিলো তা আগেই বলেছি। আপত্তিকর কথা একটাও উচ্চারণ না করে অবিশ্বাস্যভাবে ক্যারোলিন শান্ত সংযত আর ভদ্র উপায়ে সবচেয়ে বেশি রুঢ় হয়ে উঠেছিলো এলসার ব্যাপারে। খোলাখুলি এবং অভব্য ক্যারোলিনের সঙ্গে এলসাও অভদ্র ব্যবহার করেছিলো। বিজয়িনী সেই যে, সেটা বুঝতো এলসা, এবং ভদ্র বংশের শিক্ষা-দীক্ষার রুচিও খোলাখুলিভাবে অভদ্র আচরণ করা থেকে তাকে পারেনি বিব্রত করতে। ফলে ছবি আঁকার সময়টুকু বাদ দিয়ে অ্যামিয়াস অন্য সময়ে অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে খুনসুটি করতো। দুজনের মধ্যে সম্পর্ক এমনিতে ছিলো খুবই মধুর। অবশ্য ঠাট্টা ফোকুড়ি করা পরস্পরকে, ঝগড়াঝাটি যে মাঝে মাঝে না হতো তা নয়। কিন্তু অ্যামিয়াস যেন বড় বেশি মাত্রায় সেবারে ক্ষেপে গিয়েছিলো এবং তার প্রতিটি আচরণে তা প্রকাশ পাচ্ছিলো। বড় বেশি রেগে উঠেছিলো অ্যামিয়াস আর অ্যাঞ্জেলা দুজনেই দুজনের ওপর। গভর্নেস ছিলেন চতুর্থ ব্যক্তি। ওকে অ্যামিয়াস বলতো, খিটখিটে ডাইনী বুড়ী। ভীষণ ঘেন্না করতে আমাকে। চুপচাপ ঠোঁট চেপে বসে বসে লক্ষ্য করে আমায় আর সব সময়ে আমাকে অপছন্দ করে।

অ্যামিয়াস ঐ সময়েই আমাকে বলেছিলো, নরকের দরজা মেয়েমানুষ জাতটাই, যদি কেউ জীবনে সুখ শান্তি চায় তবে শত হস্তেন দূরে থাকতে হবে মেয়েমানুষ থেকে।

বলেছিলাম আমি, অ্যামিয়াস বিয়ে করাই উচিত হয়নি তোমার। ঠিক হয়নি ঘর সংসারের বন্ধনে জড়ানো।

ও বলেছিলো ওসব আলোচনা এতোদিন পরে না করাই ভালো। এটাও বলেছিলো অ্যামিয়াস যে ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলে ভালোই হবে ক্যারোলিনের। আমি তখনই আভাস পেয়েছিলাম যে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে অস্বাভাবিক।

আমি বলেছিলাম, কি হচ্ছে কি এসব! ব্যাপারটা কি তাহলে সুন্দরী এলসার সঙ্গে সত্যিই চলে গেছে গুরুতর পর্যায়ে।

খুব সুন্দরী ও, তাই না, মনে হয় মাঝে মাঝে ওর সঙ্গে দেখা না হলেই যেন ভালো হতো। যন্ত্রণার আভাস অ্যামিয়াসের গলায় ফুটে উঠলো।

আমি বলেছিলাম, শোন হে বুড়ো খোকা, এবার একটু নিজের রাশটা সামলাও। জড়িয়ে পোড়ো না যেন আর কোনো মেয়েমানুষের সঙ্গে।

অ্যামিয়াস আমার কথা শুনে হেসে বললো, কথাটা তোমার পক্ষে বলা সহজ। আমি মুক্তি পেতে পারি না মেয়েদের বাঁধন থেকে, কিছুতেই পারি না, চেষ্টা করি যদিবা আমাকে একা থাকতে দেয় না ওরা।

অ্যামিয়াস তারপর নিজের চওড়া কাঁধটা ঝাঁকিয়ে হাসলো বিষণ্ণভাবে, শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়ে যাবে সবই বন্ধু, থাকবে না কিছুই। তবে ভালো যে আঁকছি ছবিটা নিশ্চয়ই এটা স্বীকার করবে?

যে ছবিটা এলসার ও আঁকছিলো তার কথাই অ্যামিয়াস বলছিলো। ছবির পরিভাষাটা আমি বুঝি না তেমন, তবে দারুণ যে হচ্ছে ছবিটা সেটা অসুবিধা হয় না বুঝতে।

অ্যামিয়াস ভিন্ন মানুষ ছবি আঁকার সময়। তর্জন-গর্জন, আর্তনাদ, বেপরোয়া গালাগালি করতো, তুলি-টুলি ছুঁড়ে কখনো কখনো ফেলে দিতো, কিন্তু সে যে সুখের জগতে ডুবে আছে মনে মনে এটা বোঝা যেতো।

যখন ও খাবার সময় একমাত্র বাড়ির ভেতরে আসতো তখন ঐ মহিলাদের বিষাক্ত আচরণে সে কাহিল হয়ে পড়তো, চরমে উঠেছিলো মহিলাদের শত্রুতা ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে। আমরা সবাই দুপুরে খাবার সময় বেশ বিব্রত বোধ করছিলাম। এলসা ছিলো ভীষণ…এককথায় উদ্ধত বললেই বোধ হয় বোঝানো যায়। সে ক্যারোলিনকে খোলাখুলিভাবে উপেক্ষা করতো এমনকি ঘরে ক্যারোলিন থাকলেও অ্যামিয়াসের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতো যেন কেউ আর ঘরে নেই। অবশ্য ক্যারোলিন হেসেটেসে হালকাভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলতো, কিন্তু কায়দা করে এমনভাবে বলতো যে খোঁচা মারার যেখানে ঠিক বিধবো সেখানে। ক্যারোলিনের মধ্যে এলসা গ্ৰীয়ারের অসহ্য সতোর ছিটেফোঁটা ছিলো না। সবকিছুই ক্যারোলিনের একটু তির্যক, আভাস ইঙ্গিতে বলাটাই তার স্বভাব সোজাসুজি না বলে।

আমরা যখন ড্রইংরুমে বসে কফি খাচ্ছিলাম দুপুরের খাবার পর তখন চরমে উঠলো ব্যাপারটা। ঘরে খুব পালিশ করা একটা কাঠ খোদাইয়ের মূর্তি ছিলো, দেখতে ভারী অদ্ভুত। ওটার প্রশংসা আমি করতেই বলেছিলো ক্যারোলিন, ওটা নরওয়ের একজন ভাস্করের তৈরি। ওঁর শিল্পকর্ম অ্যামিয়াস আর আমি দুজনেই পছন্দ করি দারুণ। দুজনেই যাবো ভাবছি আগামী গ্রীষ্মে। নিশ্চিন্ত এই ধরনের অধিকারবোধ অসহ্য হয়ে উঠলো এলসার কাছে। সে এড়িয়ে যেতে দেয় না কোনো রকমের চ্যালেঞ্জকে। এলসা দু-এক মিনিট অপেক্ষা করার পর বেশ স্পষ্টভাবে বিশেষ জোর গলার ওপর দিয়ে বলেছিলো, এই ঘরটাই ঠিক মতো সাজালে কত সুন্দর হয়ে উঠতে পারে। আসবাবপত্র বড্ড বেশি হয়ে গেছে। যখন এখানে থাকবো আমি তখন বাজে এইসব জঞ্জাল সরিয়ে দিয়ে মাত্র বাছা বাছা দু-একটা রেখে দেবো। তামাটে রঙের পর্দা লাগাবো যাতে অস্তগামী সূর্যের আলো পশ্চিমের জানলা দিয়ে এসে পড়ে তার ওপর। তারপর আমার দিকে ফিরে বললো, খুব সুন্দর হবে না? কি মনে হয় আপনার?

উত্তর দেবার সময়টুকু আমি পেলাম না। বলে উঠলো ক্যারোলিন, নরম আর মসৃণ তার কণ্ঠস্বর, বিপজ্জনক ছাড়া আর কিছু আমার কাছে মনে হয়নি। ক্যারোলিন বলেছিলো, বাড়িটাকে কেনার কথা তুমি চিন্তা করছো নাকি এলসা?

এলসার উত্তর, দরকার পড়বে না কেনার।

তুমি কি বলতে চাও? ক্যারোলিনের গলার স্বরে নরম ভাব সে আর নেই। কঠোর আর রুক্ষ হয়ে উঠেছে। হেসে উঠলো এলসা, আমাদের কি কোনো প্রয়োজন আছে বোঝার ভান করার, কেন আমার কথা কি ক্যারোলিন তুমি বুঝতে পারছো না? আমি কি বলতে চাইছি তা তুমি জানো।

না, আমি কিছুই জানি না। এলসা তখন বলে উঠেছিলো, চেষ্টা কোরো না উট পাখি হবার। আমি আর অ্যামিয়াস, দুজনেই পছন্দ করি দুজনকে। এই বাড়িটাও তোমার নয়, অ্যামিয়াসের ওর সঙ্গে বিয়ের পর এখানেই থাকবো আমি।

মাথা খারাপ হয়ে গেছে কি তোমার? বলেছিলো ক্যারোলিন। এলসা বলেছিলো, না, খারাপ হয়নি একটুও এবং তুমিও সেটা ভালো করে জানো। দুজনে যদি দুজনের কাছে আমরা খোলাখুলি সব কথা স্বীকার করি তাহলে বেশ সহজ হয়ে ওঠে জিনিসটা, তাই না? আমি আর অ্যামিয়াস পরস্পরকে ভালোবাসি–স্পষ্ট বুঝতেও পারছো এ ব্যাপারটা। সবচেয়ে শোভন কাজ হবে তোমার পক্ষ থেকে মুক্তি দেওয়া অ্যামিয়াসকে।

একটা কথাও তোমার বিশ্বাস করছি না। সেই দৃঢ়তা কিন্তু ক্যারোলিনের গলায় ছিলো না, ওর গোপন জায়গাতে এলসা আঘাত দিতে পেরেছে।

অ্যামিয়াস ক্রেল ঠিক সেই মুহূর্তে এসেছিলো ঘরের মধ্যে, ক্যারোলিনকে বললো হেসে এলসা, বিশ্বাস না হলে আমার কথা জিজ্ঞেস করে দেখো অ্যামিয়াসকে।

ক্যারোলিন বললো, করছি, অ্যামিয়াসের দিকে এই বলে ফিরে সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করলো, অ্যামিয়াস, তুমি ওকে বিয়ে করতে চাও এলসা বলছে। সত্যি কি কথাটা?

আমার দুঃখ হয়েছিলো বেচারা অ্যামিয়াসের জন্যে। ঘাড়ে এই ধরনের পরিস্থিতি চাপিয়ে দিলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানুষ বোকা হয়ে যায়। অ্যামিয়াস রাগে ফেটে পড়েছিলো লজ্জায় লাল হয়ে গিয়ে। প্রশ্ন করেছিলো এলসার দিকে তাকিয়ে কেন মনের কথা সে চেপে রাখতে পারেনি। জিজ্ঞেস করেছিলো ক্যারোলিন, সত্যি তাহলে কথাটা?

কোনো উত্তর না দিয়ে অ্যামিয়াস জামার কলারের তলাটা ঘষতে লাগলো, কোণঠাসা যে কোনো ভাবে হলে ওই রকম হাত বোলাতে কলারে ছোটবেলা থেকেই। অ্যামিয়াস সম্মান বজায় রেখে কথা বলার চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু বেচারা পারেনি। ও বলেছিলো, আলোচনা করতে চাই না ও নিয়ে।

ক্যারোলিন বলেছিলো, আলোচনা কিন্তু আমরা করতে চাইছি।

এলসা টুক করে টিপ্পনী কাটলো, সত্যি কথাটা ক্যারোলিনকে বলে দেওয়াই ভালো।

আবার শান্ত ভাবে ক্যারোলিন প্রশ্ন করলো? অ্যামিয়াস, সত্যি কি কথাটা?

অ্যামিয়াস লজ্জা পেয়েছে মনে হচ্ছিলো, সাধারণত স্বামী-স্ত্রীরা বেকায়দায় পড়লে লজ্জা পেয়ে থাকে যেভাবে।

আবার বললো ক্যারোলিন, দয়া করে উত্তর দাও। জানতেই হবে আমাকে।

কোণঠাসা ষাঁড়ের মতো হঠাৎ ঘাড় উঁচু করে অ্যামিয়াস দাঁড়ালো, হ্যাঁ, সত্যি, তবে এ নিয়ে এখন আলোচনা করবো না।

অ্যামিয়াস কথাটা বলেই ঘর থেকে বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলো, সঙ্গে সঙ্গে ঘর ছাড়লাম আমিও, ঐভাবে থাকতে মেয়েদের সঙ্গে একটুও ভালো লাগছিলো না। ওকে ধরলাম আমার বাইরের বারান্দায় গিয়ে। শাপ-শাপান্ত করছিলো অ্যামিয়াস, আমি কখনো এভাবে রাগ করতে দেখিনি। গর্জে উঠলো তারপর, কেন থাকতে পারে না মুখ বন্ধ করে? কেন পারে না? আগুনে এবার তো ঘি পড়েছে। ঠ্যালা বোঝ। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে ছবিটা।…ফিলিপ শুনছো আমার কথা? এটাই সবার সেরা আমার কাজ মতো ছবি জীবনে এঁকেছি তার মধ্যে কারুর সঙ্গে এটার তুলনা করা যায় না। আর মাথামোটা দুটো মেয়েমানুষ ঝগড়া করে নিজেদের মধ্যে ভণ্ডুল করতে চায় এটাকে।

একটু শান্ত হয়ে আস্তে আস্তে সে বললো, কোনো মাত্রাজ্ঞান থাকে না মেয়ে জাতটারই। আমি না হেসে থাকতে পারলাম না, বললাম, ছাড়তো এখন এসব কথা, এতো নিজের কৃতকর্মের ফল তোমার।

আমি কি তা আর জানি না।…কিন্তু নিশ্চয়ই তুমি স্বীকার করবে একটা কথা ফিলিপ, যদি কোনো পুরুষের এলসাকে দেখে মাথা ঘুরে যায় তবে দোষ দেওয়া যায় না তাকে। অন্ততঃ তা বোঝা উচিত ছিলো ক্যারোলিনের।

জিজ্ঞেস করলাম আমি, ক্যারোলিন যদি খুব কড়া হয়ে গিয়ে রাজী না হয় বিবাহ বিচ্ছেদে। তাহলে কি হবে।

অ্যামিয়াস ততক্ষণে চলে গেছে এক কল্পনার জগতে, দ্বিতীয়বার বললুম আমার কথাটা, ওর কানে সেটাও ঢুকলো না, কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবে বললো, কখনই কিন্তু ক্যারোলিন অতোটা প্রতিহিংসা পরায়ন হতে পারে না। বুঝতে পারছো না তুমি ভাই।

একটা বাচ্চা আছে তাছাড়া, আমি বললাম কালার কথা।

অ্যামিয়াস আমার হাত ধরে বলেছিলো, ভালো কথাই তুমি বলেছো ফিলিপ, কিন্তু ঘ্যানঘ্যান করে এইভাবে অমঙ্গলের কথা বলে লাভ কি। আমি সামলাতে পারবো আমার ব্যাপার। শেষ পর্যন্ত সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। না হলে তুমি দেখো।

আসলে অ্যামিয়াস হলো এই, উগ্রভাবে সব সময়ে আশাবাদী, যুক্তিতর্কের ধার পর্যন্ত ধারে না। তারপর হাসিখুশি মুখে সে বললো, ওদের ঝাড়ে বংশো নরকে পাঠানো উচিত।

আমাদের কোনো কথা তারপর হয়েছিলো কিনা মনে নেই, ক্যারোলিন ঘর থেকে কয়েক মিনিট পরে বেরিয়ে বারান্দায় এলো। একটা গাঢ় বাদামী রঙের অদ্ভুত ধরনের টুপি মাথায়।

কিছুই যেন ঘটেনি এমন স্বাভাবিক ভাবে বললো, ঐ রঙ লাগা কোটটা অ্যামিয়াস পাল্টে নাও। চায়ের নেমন্তন্ন আছে মেরিডিথের বাড়িতে, বসে আছে নাকি ভুলে?

তাকিয়ে রইলো বোকার মতো কিছুক্ষণ তারপর প্রায় তোতলাতে তোতলাতে বলেছিলো অ্যামিয়াস, ওহ,…হা ভুলেই গেছিলাম।..হ্যাঁ, হা…যাচ্ছি…নি…নিশ্চয়ই।

তাহলে যাও চেহারাটা একটু ভদ্র করে নাও পোযাক পাল্টে। গলার স্বর স্বাভাবিক হলেও ক্যারোলিনের, ও কিন্তু তাকাচ্ছিলো না অ্যামিয়াসের দিকে। কিছু ডালিয়া ফুল ফুটেছিলো সামনেই, ঝুঁকে পড়ে ক্যারোলিন তুলতে লাগলো খুব ফোঁটা ফুলগুলো।

ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতর অ্যামিয়াস চলে গেলো। আমার সঙ্গে ক্যারোলিন বকবক করতে শুরু করেছিলো আবহাওয়া সম্বন্ধে। মাছ ধরা যাবে কিনা এই সময়, যদি যায় তবে ও মাছ ধরতে যাবে অ্যামিয়াস আর অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। সত্যিই এই ক্যারোলিন অসাধারণ মহিলা। ওকে দিতেই হবে এ মর্যাদাটা।

তবে মনে হয় আমার ওর আসল রূপটাকে এই ঘটনাটাই ফুটিয়ে তোলে। ক্যারোলিনের মনের জোর ছিলো দারুণ আর আত্মবিশ্বাস ছিলো অদ্ভুত। ও তখনই স্বামীকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো কিনা জানি না, তবে নিলেও কিছু নেই আশ্চর্য হবার। তৈরি করা নিজের পরিকল্পনা এবং তা কার্যকর করার ক্ষমতাও ঠান্ডা মাথায় তার ছিলো।

দারুণ বিপজ্জনক মহিলা ছিলেন ক্যারোলিন ক্রেল। তখনই আমার বোঝা উচিত ছিলো যে মুখ বুজে ব্যাপারটা ও সহ্য করবে না। অথচ বোকার মতো আমি ভেবেছিলাম হয়তো ও নীরবে মেনে নেবার জন্যে ভাগ্যকে তৈরি হচ্ছে, কিংবা ভেবেছিলো হয়তো অ্যামিয়াসের মন স্বাভাবিক ব্যবহার করলে পাল্টাতেও পারে।

সকলেই তৈরি হয়ে একটু পরে বেরিয়ে পড়লো। একটু উদ্ধত এলসা, কিন্তু বিজয়িনীর ভাব মুখে। ওর দিকে তাকালোই না ক্যারোলিন। অ্যাঞ্জেলা সামাল দিলো পরিস্থিতির। তর্ক করতে লাগলো মিস উইলিয়ামসের সঙ্গে কিছুতেই ও পাল্টাবে না নিজের পোষাক। এসব দিকে মেরিডিথ নজর দেন না।

হাঁটছিলাম আমরা। ক্যারোলিন আর অ্যাঞ্জেলা এক সঙ্গে। আমি আর আমিয়াস। একা একা এলসা, মৃদু হাসি মুখে।

কখনো আমাকে এলসা মুগ্ধ করতে পারেনি–উগ্র প্রকৃতির মেয়ে বড় বেশি মাত্রায়। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে একথা যে তাকে সেদিন বিকেলে অপূর্ব সুন্দরী লাগছিলো। মেয়েদের মনের বাসনা পূর্ণ হলে যেমন দেখতে লাগে অসাধারণ।

বিকেলবেলার ঘটনাগুলো সেদিন আমার খুব ভালোভাবে মনে পড়ছে না। ঝাপসা হয়ে আছে সব ব্যাপারটা। তবে মনে আছে এটা যে বাড়ি থেকে মেরিডিথ বেরিয়ে এসেছিলেন আমাদের স্বাগত জানাবার জন্যে। প্রথমে মনে হয় আমরা বাগান ঘুরে হেঁটেছিলাম। অ্যাঞ্জেলার সঙ্গে টেরিয়ার কুকুরদের ট্রেনিং দিতে হয় কিভাবে এই নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। অ্যাঞ্জেলা আপেল খাচ্ছিলো পেটুকের মতো, আর জোর করছিলো আমাকেও খাবার জন্যে।

দেখলাম বাড়িতে ঢোকার পর বিরাট সিডার গাছের তলায় আয়োজন করা হয়েছে চায়ের। খুব বিব্রত লাগছিলো মেরিডিথকে। মনে হয় আমার, ক্যারোলিন বা অ্যামিয়াস কিছু বলেছিলো দাদাকে। সন্দেহের চোখে কেমন যেন একবার ক্যারোলিনের দিকে আর একবার তাকাচ্ছিলেন এলসার দিকে দাদা। মনে হয় খুব চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন।

কয়েকটা কথা দাদা চট করে চায়ের পর আমার সঙ্গে বলে নিয়েছিলেন, ফিলিপ দ্যাখ, এটা করতে পারে না অ্যামিয়াস।

আমি বলেছিলাম, আর কোরো না ও ভুলটা; ও করবেই।

ওই মেয়েটার সঙ্গে যাবার জন্যে নিশ্চয়ই ফেলে দিতে পারে না অ্যামিয়াস নিজের বৌ-মেয়েকে, তাছাড়া বড় জোর আঠার হবে ঐ মেয়েটার বয়স, ওর থেকে অনেক বড় অ্যামিয়াস।

দাদাকে আমি জানিয়েছিলাম পুরো কুড়ি বছরের মহিলা মিস এলসা গ্ৰীয়ার।

যাই হোক না কেন, কম বয়সটা, ওর বোঝার ক্ষমতা নেই কী করছে।

বেচারা মেরিডিথ বুড়ো, সব সময়ে অতি উৎসাহী পাক্কা সাহেব। আমি বলেছিলাম, চিন্তা কোরো না একটুও বুড়ো খোকা। ও কি করছে এলসা গ্ৰীয়ার জানে এবং ওর ভালোই লাগছে করতে।

আমরা পেয়েছিলাম ঐটুকুই বলার সুযোগ। মনে হয়েছিলো আমার স্বামী পরিত্যক্তা হতে চলেছে ক্যারোলিন এই কথাটা চিন্তা করে খুব সম্ভব মেরিডিথ বিচলিত হয়ে উঠেছিলেন। ক্যারোলিন অবশ্যই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলে আশা করবে যে আছে তার প্রতীক্ষায় এতোদিন ধরে তাকে সে নিশ্চয়ই বিয়ে করবে, এই দুর্বলতাটা মেরিডিথের আমি জানতাম এবং মজাও লাগতো আমার বেশ কথাটা ভেবে।

ঐ দুর্গন্ধে ভরা ঘরে গিয়ে মেরিডিথের কি করেছিলাম তা মনে নেই বললেই চলে। নিজের শখের নেশা মানুষ দেখাতে ভালোবাসে পাঁচজনকে। অথচ আমার খুব বিরক্তিকর মনে হয় ব্যক্তিগতভাবে জিনিসটা। মনে পড়ে যতদূর যখন দাদা ল্যাবরেটারিতে বিশদ ব্যাখ্যা করছিলেন কোনাইন বিষের তখন অন্যদের সঙ্গে সেখানে আমিও ছিলাম, তবে স্মরণ নেই ঠিক। এবং ক্যারোলিনকে ঐ জিনিসটা চুরি করতেও দেখিনি। যা বলেছিলাম, বড্ড বেশি চালাক আর চটপটে মেয়ে ক্যারোলিন। প্লেটো দিয়েছিলেন সক্রেটিসের মৃত্যুর যে বর্ণনা সেই অংশটা পড়ে শুনিয়েছিলেন মেরিডিথ। আমার ভালো লাগে না ওসব প্রাচীন সাহিত্য।

এর বেশি আমার আর সেদিনের ঘটনা মনে নেই। বেশ জমিয়ে অ্যামিয়াস আর অ্যাঞ্জেলা একপ্রস্থ ঝগড়া করে নিলো, আমরা বেশ রসিয়ে উপভোগও সেটা করেছিলাম। এর ফলে সম্ভব হয়েছিলো অন্য অসুবিধেগুলো এড়ানো। শেষ পর্যন্ত গালাগালি দিতে দিতে অ্যাঞ্জেলা রণে ভঙ্গ দিয়েছিলো, অ্যামিয়াসকে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে অভিশাপ দিয়েছিলো-১। সে এর বদলা নেবে, ২। অ্যাঞ্জেলা মরণ কামনা করছে অ্যামিয়াসের, ৩। অ্যামিয়াস কুষ্ঠ ব্যাধি হয়ে মরুক, তাহলেই শাস্তি হবে উপযুক্ত, ৪। অ্যামিয়াসের নাকে রূপকথার কাহিনীর মতো যেন সসেজ আটকে যায়, না খোলে কিছুতেই। ওর ছেলেমানুষী কথা শুনে খুব হেসেছিলাম আমরা।

বিছানায় তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছিলো ক্যারোলিন, মিস উইলিয়ামস চলে গেলেন তার ছাত্রীর সন্ধানে –এলসা আর অ্যামিয়াস বাগানে বেড়াতে গেলেন। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো যে আমাকে কেউ চাইছিলো না, তাই একা একা আমি বেড়াতে লাগলাম, ভারী সুন্দর ছিলো রাতটা।

নিচে নেমে এসে পরদিন সকালে বসলাম খাবার ঘরে, মাঝে মাঝে বেশ মজার জিনিস মানুষ মনে রাখে। তাই আমারও সেদিনের খাবারের কথাগুলো মনে আছে স্পষ্ট।

পরে ঘুরে ঘুরে আমি সবার খোঁজখবর শুরু করেছিলাম নিতে। গেলাম বাইরে, কোথাও নেই কেউ, সিগারেট একটা খেয়ে ফিরছি, দেখি মিস উইলিয়ামস খুঁজে বেড়াচ্ছেন তার ফাঁকিবাজ ছাত্রীকে। শুনতে পেলাম হলঘরে ফিরে এসে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন লাইব্রেরী ঘরে কথা কাটাকাটি করছে। ওরা বেশ জোরেই কথা বলছিলো, ক্যারোলিন বলছে আমি শুনলাম, তুমি আর তোমার ঐ মেয়ে মানুষটা। ইচ্ছা করছে তোমাকে খুন করতে, আমি তোমাকে এক দিন না একদিন খুন করবই। অ্যামিয়াস উত্তরে বলেছিলো, ক্যারোলিন বোকামি কোরো না। উত্তরে ক্যারোলিন বলেছিলো, করি কিনা দেখো।

আমার আড়াল থেকে আর ওদের ঝগড়া ইচ্ছে হয়নি শুনতে, বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি। এলসার সঙ্গে চত্বরে দেখা হাঁটতে হাঁটতে।

এলসা একটা লম্বা বেঞ্চে বসেছিলো, পাতা ছিলো বেঞ্চটা লাইব্রেরী ঘরের জানলার ঠিক নিচে। এলসা সব কথাই জানালাটা খোলা ছিল বলে শুনতে পেয়েছিলো এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অত্যন্ত শান্তভাবে এলসা এগিয়ে এলো আমাকে দেখে, হাসি মুখে, হাত ধরে আমাকে বললো, কি সুন্দর সকালটা, তাই না?

সকালটা সুন্দরই ছিলো বটে তার মতো নিষ্ঠুর মেয়ের পক্ষে। না, বলা ঠিক নয় অতোটা। মোটামুটি সৎ আর বড় বেশি গদ্যময় মেয়েটি। ও শুধু নিজের প্রয়োজন ছাড়া অন্য কিছু দেখে না।

ওর সঙ্গে প্রায় মিনিট পাঁচেক গল্প করলাম চত্বরে দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দড়াম করে লাইব্রেরীর দরজা বন্ধ করার শব্দে চমকে উঠে দেখলাম বেরিয়ে আসছে অ্যামিয়াস। মুখ চোখ লাল। তারপর ভদ্রতার ধার কোনোরকম না ধরেই এলসার কাঁধে হাত দিয়ে বললো, চলো সময় হয়েছে সিটিং হয়েছে, শেষ করতে হবে ছবিটা।

বললো এলসা, ঠিক আছে। শুধু একবারটি আমি গিয়ে আনবো সোয়েটারটা, শীত শীত করছে একটু।

বাড়ির ভেতরে গেলো এলসা। ভাবছিলাম আমি দেখি আমার সঙ্গে কথা বলে কি না অ্যামিয়াস। ঠিকই বললো, তবে কয়েকটা মাত্র শব্দ, এই সব মেয়েমানুষগুলো।

বুড়ো খোকা ওসব কথা বাদ দাও হাসতে হাসতে আমি বললাম।

ফিরে না আসা পর্যন্ত এলসা আর আমাদের কোনো কথা হয়নি।

কামান বাগানে ওরা দুজনেও চলে গেলে বাড়ির মধ্যে আমিও ফিরলাম। ক্যারোলিন দাঁড়িয়েছিলো হলঘরে, লক্ষ্য করলো কি না আমাকে জানি না। মাঝে মাঝে ও ওইরকম করতো। নিজেকে হঠাৎ ভীষণভাবে নিজের মধ্যে গুটিয়ে নিতো। আপন মনে বিড়বিড় করে ক্যারোলিন কি যেন বলছিলো। আমার কানে কয়েকটা কথা এসেছিলো, বড্ড বেশি নিষ্ঠুর…

ও ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলো। তারপর হেঁটে আমার পাশ দিয়ে ওপরে চলে গেলো সিঁড়ি দিয়ে। আমাকে তখন লক্ষ্য করেনি কিন্তু, ও যেন মনে হচ্ছিলো একটা স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে রয়েছে। নিজের ধারণা আমার (অবশ্য আমার কোনো অধিকার নেই একথা বলার, বলে রাখছি একথা আপনাকে) ও গিয়েছিলো ওপরে বিষটাকে নেবার জন্য এবং ও ঠিক করে নিয়েছিলো তখনই কি করবে।

সেই মুহূর্তে ঠিক বেজে উঠলো টেলিফোনটা, চাকররা এসে অন্য বাড়ি হলে ফোন ধরে, কিন্তু এতোবার আমি এসেছি অ্যাল্ডারবেরিতে যে ফোনটা নিজেই তুলে নিলাম।

ফোন করছিলেন আমার দাদা মেরিডিথ। ঘাবড়ে গেছেন বেশ। জানালেন যে আমাকে ল্যাবরেটরিতে সকালে গিয়ে দেখেছেন অর্ধেক খালি হয়ে আছে কোনাইনের শিশি।

দু’বার করে আর একই কথা বলার দরকার নেই। মনে হয় এখন আমার, তখন তাই করা উচিত ছিলো। আমায় দারুণ চমকে দেয় ব্যাপারটা, গিয়েছিলাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, সেই অবস্থা দাদারও। এমন সময় কার পায়ের শব্দ সিঁড়িতে শুনে বলেছিলাম–কথা হবে ঘরে। যেন এখুনি চলে আসেন দাদা।

আমি তারপর নিজেই দাদার সঙ্গে এগিয়ে গেলাম দেখা করার জন্যে। আপনার তো জানা নেই এ দিকটা, তাই লিখছি,একটা জমিদারী থেকে অন্য জমিদারীতে যাবার সবচেয়ে সহজ ও সংক্ষিপ্ত পথ হলো নৌকো করে যাওয়া। অতএব আমি এগিয়ে গেলাম জেটির দিকে, পথটা চলে গেছে কামান বাগানের পাশ দিয়ে। অ্যামিয়াস আর এলসা কথা বলছে যেতে যেতে শুনলাম, ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে। বেশ বেপরোয়া আর হাসিখুশি লাগছিলো ওদের। দারুণ গরম পড়েছে, অ্যামিয়াস বলছিলো (গরম পড়েছিলো সেপ্টেম্বরের পক্ষে বৈকি) আর সিটিং দিচ্ছিলো এলসা পাঁচিলের কাছে বসে। ওখানে শীত শীত ভাব সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ায়। হঠাৎ বলে উঠলো এলসা, আর ভালো লাগছে না পোজ দিয়ে বসে থাকতে। লক্ষ্মীটি একটু বিশ্রাম করে নেবো? গর্জে উঠেছিলো সঙ্গে সঙ্গে অ্যামিয়াস, না, এখন ওসব বিশ্রাম-টিশ্রাম চলবে না, বসে থাকো চুপ করে। বড়ো ঝামেলার মেয়ে তুমি। এগোচ্ছে ছবিটা, অতএব কথা নয় কোনো। এলসা হাসতে হাসতে আমার কানে এলো বলছে, জংলী জানোয়ার কোথাকার।

একাই নৌকো চালিয়ে এলেন মেরিডিথ। নৌকো বেঁধে ছোট্ট জেটিতে রাখার পর আমার কাছ ফ্যাকাশে মুখ করে দাঁড়ালেন।

ফিলিপ আমার চেয়ে তোমার বুদ্ধি অনেক বেশি। কি করা যায় এক্ষেত্রে বলল, ভীষণ বিপজ্জনক জিনিসটা। বলেছিলাম আমি, আপনার এ ব্যাপারে একটুও ভুল হচ্ছে না তো? বলে রাখি এখানে বরাবরই আমার দাদাটি একটু ভুলো টাইপের মানুষ, তাই ততো গুরুত্ব ওঁর কথায় দিইনি; অথচ উচিত ছিলো দেওয়া। কিন্তু ওঁর কোনো ভুল হয়নি দাদা বললেন, শিশিটা ভর্তি ছিলো গতকাল বিকেল পর্যন্ত।

আর চুরি কে করেছে সঠিক করে এ বিষয়েও কিছু বলতে পারছেন না আপনি?

বলতে পারলেন না উনি, উল্টে কী মনে হয় আমার জানতে চাইলেন সে কথা। কেউ করে থাকতে পারে কি চাকরদের মধ্যে? হতে পারে আমি বলেছিলাম, তবে তারা কেউ করেনি খুব সম্ভব আমার ধারণা। রোজই তো বন্ধ করে রাখা হতো দরজা, তাই না? তা রাখা হতো দাদা বলেছিলেন। তারপর এক দীর্ঘ বক্তৃতা অসংলগ্ন ভাব কেঁদেছিলেন, কীভাবে আবিষ্কার করেছিলেন উনি একটা জানলার পাল্লার তলার দিকে ফাঁক দেখা গিয়েছিলো বেশ কয়েক ইঞ্চি। কেউ ঢুকে থাকতে পারে ঐ পথে–এই সব।

হতে পারে কি সিদেল চোরের কাণ্ড? আমি প্রশ্ন করেছিলাম সন্দিগ্ধভাবে। এর পেছনে আমার তো মনে হচ্ছে অনেক কিছু নোংরা থাকতে পারে।

ঠিক কি কথা আমি চিন্তা করছি তা জানতে চেয়েছিলেন দাদা। তখন বলেছিলাম আমি বিষটা চুরি যাবার ব্যাপারটা ঠিক হয় যদি তার ধারণা হয় আমার চুরি করেছে ক্যারোলিন, এলসাকে খাওয়াবার জন্যে, চুরি করেছে এলসা। তার প্রেমের পথ থেকে ক্যারোলিনকে সরিয়ে দেবার জন্যে।

একটু উত্তেজিত হয়ে মেরিডিথ বলেছিলেন, অসম্ভব এটা, অতি-নাটকে চিন্তা এবং সত্যি হতে পারে না কখনই। আমি বলেছিলাম, আচ্ছা চুরি তো বিষটা হয়ে গেছে ঠিকই, এখন আপনি কি ব্যাখ্যা এ ব্যাপারে দিতে পারেন, বলুন? কোনো সঠিক ব্যাখ্যা উনি দিতে পারেননি। উনিও আসলে ঠিক আমার কথাটাই চিন্তা করছিলেন, কিন্তু মুখ ফুটে সাহস করে বলতে পারছিলেন না।

তখন প্রশ্ন করলেন মেরিডিথ, এক্ষেত্রে কি করা উচিত আমাদের?

এবং বোকার মতো আমিও বলেছিলাম, এ ব্যাপারে খুব ভালোভাবে আমাদের চিন্তা করতে হবে। হয় বিষটা সবার সামনে চুরি যাবার কথা ঘোষণা করুন, কিংবা এ ব্যাপারে চাপ দিন ক্যারোলিনকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাতে যদি মনে হয় আপনার ক্যারোলিন চুরি করেনি বিষ, তখন এলসার ওপর ওই ভাবে চাপ দেবেন। তখন মেরিডিথ বলেছিলেন ও কাজ এলসার মতো মেয়ে করতে পারে।

ঐ পথটা ধরে বাড়ির দিকে আমরা এগিয়ে আসছিলাম। শেষ মন্তব্যটির পরে আমরা আর কোনো কথা বলিনি। ক্যারোলিনের গলার স্বর শুনতে পেলাম কামান বাগানের কাছে এসে।

মনে হয়েছিলো আমার ঝগড়া হচ্ছে তিনজনের মধ্যে, অথচ ওরা আসলে আলোচনা করছিলো অ্যাঞ্জেলার ব্যাপার নিয়ে। প্রতিবাদ জানিয়ে ক্যারোলিন বললো, বড় বেশি নিষ্ঠুর ব্যবহার হয়ে যাবে মেয়েটার ওপর। বেশ অধৈর্য হয়ে আমিয়াসও সায় দিয়েছিলো তার কথায়। তারপর আমাদের ঢুকতে দেখে বাগানের দরজা খুলে বেশ অবাক হয়ে যায় অ্যামিয়াস। বেরিয়ে আসছিলো ক্যারোলিন, আমাদের দেখে বললো, হ্যালো মেরিডিথ আমরা অ্যাঞ্জেলাকে স্কুলে পাঠাবার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। ঠিক বুঝতে পারছি না আমি ওর পক্ষে এটা মঙ্গল হবে কিনা।

অ্যামিয়াস বলে উঠেছিলো, বেশি বাড়াবাড়ি করবে না মেয়েটাকে নিয়ে। ভালোই থাকবে মেয়েটা স্কুলে। নিষ্কৃতি পাবো আমরাও।

ঠিক সেই মুহূর্তে লাল টকটকে একটা সোয়টার হাতে এলসা বাড়ির দিক থেকে এলো। অ্যামিয়াস ওকে দেখে বলে, চলো চলো, পোজ দেবে চলো, আর সময় নষ্ট করতে চাই না। ইজলের সামনে গিয়ে মিয়াস দাঁড়ালো। ওর পা-টা একটু কঁপছিলো, তবে কি মদ খুব বেশি খেয়েছে। যে রকম চেঁচামেচি, ঝগড়াঝাটি চলছে তাতে ও এটা করবে আর আশ্চর্যের কি আছে!

বিরক্তির সুর গলায় ফুটিয়ে বললো, যেন আগুনের মতো গরম বিয়ারটা। কেন যে এখানে বরফ রাখা হয় না কে জানে?

তখন ক্যারোলিন বলেছিলো, আমি এখুনি ফ্রিজের ঠান্ডা বিয়ার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

 ধন্যবাদ, কোনো রকমে অসন্তোষ চাপা দিয়ে কথাটা অ্যামিয়াস বলেছিলো।

তারপর ক্যারোলিন আমাদের সঙ্গে নিয়ে কামান বাগানের দরজা ভেজিয়ে বাড়িতে এলো। চত্বরে বসে পড়লাম আমরা বাড়ির মধ্যে ক্যারোলিন ঢুকে গেলো। অ্যাঞ্জেলা মিনিট পাঁচেক পরে কয়েক বোতল বীয়ার আর গ্লাস নিয়ে এলো। বেশ গরম ছিল দিনটা, আমরা তার সদগতি করতে লাগলাম সানন্দে। এমন সময় দেখি ক্যারোলিন অ্যামিয়াসকে এক বোতল বীয়ার নিয়ে দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে চেয়েছিলেন যেতে মেরিডিথ, কিন্তু বাঁধা দিয়ে ক্যারোলিন জোর করেই চলে গেলো একলা। আমি ভেবেছিলাম ক্যারোলিন ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলছে। একলা থাকতে দিতে চাইছে না অ্যামিয়াস আর এলসাকে, অথচ মনে হয় আজ বোকার মতোই না আমি তখন ও কথা ভেবেছিলাম।

ওকে চলে যেতে দেখেছিলাম আঁকা-বাঁকা পথ দিয়ে আমি আর দাদা। কি করবো আমরা তখনও ঠিক করে উঠতে পারিনি। অ্যাঞ্জেলা এমন সময় ডাকলো আমাকে সমুদ্রে স্নান করতে যাবার জন্যে। একলা পাওয়া মেরিডিথকে মুস্কিল হচ্ছে দেখে শুধু বলে গেলাম যাবার সময় দুপুরে খাওয়ার পর। মাথা নেড়ে সায় দিলেন দাদা।

অনেকক্ষণ অ্যাঞ্জেলার সাথে সাঁতার কেটে রৌদ্র স্নান করছিলাম একটা পাথরের ওপর শুয়ে। আর বকবক করছিলো না অ্যাঞ্জেলা, ফলে আমি ভাববার সময় পেয়ে গেলাম। ঠিক করলাম আমি ক্যারোলিনকে দুপুরে খাওয়ার পর আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে চুরির ব্যাপারে প্রশ্ন করবো সরাসরি। চলবে না দাদাকে দিয়ে করলে, উনি বড্ড দুর্বল চিত্ত মানুষ। ক্যারোলিন বাধ্য হবে চাপ পড়লে ফিরিয়ে দিতে বিষটা, না দেয় যদি, ওটা কাজে আর লাগাতে পারবে না। আর বেশ পোড় খাওয়া মেয়ে এলসা, কম বয়স, নিশ্চয়ই গণ্ডগোল বাধাবে না বিষ নিয়ে। অত্যন্ত চালাক চতুর মেয়ে, নিজের চামড়া বাঁচিয়ে চলবেই। ক্যারোলিন আবার এ ব্যাপারে ভীষণ বিপজ্জনক মানুষ, ভারসাম্য নেই মনের। অনেক কিছু করে ফেলতে পারে আবেগের ঘোরে। ওর নার্ভগুলোও ভালো নয়। তবে একটা কথা আমি তখন পারছিলাম না মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে–কোনো ভুল করছেন না তো দাদা? আবার চুরি তো চাকর বাকরও করতে পারে? নিশ্চয়ই জানেন, অত্যন্ত রোমাঞ্চকর ব্যাপার বিষের ব্যাপারটা ভরসা করা যায় না এর ওপর।

এবং কিছু না ঘটে যতক্ষণ, কিছু বলাও যায় না।

অনেক সময় কেটে গেছে এইসব চিন্তা করতে করতে। ছুটলাম আমি আর অ্যাঞ্জেলা, সময় হয়ে গেছে লাঞ্চ খাওয়ার। সবাই টেবিলে বসে পড়েছে অ্যামিয়াস বাদে। অ্যামিয়াস কামান বাগানেই থেকে গেছে। ও প্রায়ই এ রকম করে, তবে আমার সেদিন মনে হয়েছিলো অ্যামিয়াস এলো না ঝঞ্জাট এড়াবার জন্যে।

কফি খেলাম চত্বরে বসে। কেমন দেখাচ্ছিল ক্যারোলিনকে, কী করছিলো ক্যারোলিন এটা মনে করতে পারছি না কিছুতেই, ভালো হতে পারলে। তবে একটুও ওকে মনে হয়নি উত্তেজিত। ও একটা আস্ত শয়তানি।

কারণ ঠান্ডা মাথায় বিষ খাইয়ে কাউকে মারাটা শয়তানি ছাড়া আর কি। ও যদি এর চেয়ে স্বামীকে রিভলবার চালিয়ে খুন করতো, তাহলেও ওর সম্বন্ধে যা হোক অন্য কিছু ধারণা করতাম। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় এইভাবে বিষ খাওয়ানো প্রতিশোধ নেবার জন্যে…এ যে ভাবাই যায় না।

ক্যারোলিন খুব স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো–অ্যামিয়াসকে কফি দিয়ে আসতে হবে। ও জানতো অথচ..যা হবার ততক্ষণে হয়ে গেছে, আর বেঁচে নেই অ্যামিয়াস। ওর সঙ্গে মিস উইলিয়ামস গেলো। তবে ডেকে ছিলো কিনা ক্যারোলিন তা মনে নেই।

চলে গেলো দুজনে। এমনি একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন মেরিডিথ। আমি দাদার কাছে একটা অজুহাত দেখিয়ে যাচ্ছিলাম। উনি ছুটতে ছুটতে আসছেন এমন সময় দেখি, সাদা হয়ে গেছে মুখটা, হাঁফাতে হাঁফাতে কোনো রকমে বললেন, ডাকতে হবে ডাক্তার…শিগগীর…অ্যামিয়াস…

চমকে উঠলাম আমি, ও কি অসুস্থ…মনে হচ্ছে মরে যাবে?

মেরিডিথ বললেন, মনে হয় তো আমার মরে গেছে।

মুহূর্তের জন্যে আমরা এলসার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। ওর তীব্র চিৎকার হঠাৎ কানে এলো। যেন বিলাপ করছেন বাস্তুলক্ষ্মী।

কেঁদে উঠলো, এলসা, মরে গেছে? মরে গেছে…। এলসা ছুটে চলে গেলো আহত হরিণীর মতো। ও যেন প্রতিশোধ নেবার হিংসাতে পাগল হয়ে উঠেছে।

কোনো রকমে মেরিডিথ বললেন, যাও ওর সঙ্গে। টেলিফোন করতে যাচ্ছি আমি। ওকে ধরো, বলা যায় না কি করে ফেলে।

আমি এলসার পেছনে যথাসাধ্য তাড়াতাড়ি ছুটলাম। আর একটু হলে ও ক্যারোলিনকে খুব সহজেই মেরে ফেলতে পারতো। জীবনে কখনো দেখিনি শোক আর ঘৃণার এমন অভিব্যক্তি। খুব পলেস্তারা বসে গেছে শিক্ষা-দীক্ষার। এলসার মিল মজদুর বাবা আর তার মায়ের রূপটা তার মধ্যে প্রকট হয়ে উঠেছে।

তার ভেতরের আদিম নারী সত্ত্বা প্রেমিকাকে হারিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। পাঁচিলের ওপর থেকে আঁচড়ে-কামড়ে ফেলে দিতে চাইছিলো ক্যারোলিনকে, কেমন যেন ধারণা হয়েছিলো এলসার অ্যামিয়াসকে ছুরি মেরেছে ক্যারোলিন। ও অবশ্য বুঝেছিলো, কোনো সন্দেহ নেই এ বিষয়ে।

ওকে ধরে ফেললাম আমি, তারপর ব্যাপারটা নিজের হাতে উইলিয়ামস তুলে নিলেন। সত্যি ভালো গভর্নেসটি, এ মানতেই হবে আমাকে। চেঁচামেচি যে এই পরিস্থিতিতে করতে নেই, শান্ত থাকতে হয় এই সব কথা বলে এলসাকে ঠান্ডা করে দিলো মিনিট খানেকের মধ্যে। সত্যিই বুদ্ধিমতী মহিলাটি, এবং যা ধরে তা আর ছাড়ে না। ফলে একপাশে দাঁড়িয়ে এলসা কাঁপতে লাগলো।

আর ক্যারোলিন..মনে পড়ে যতদূর, খুলে পড়েছিলো মুখোেশ। এক পাশে ভীষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিলো বলতে পারেন আপনি হতভম্ব হবার মতো হয়েছিলো। কিন্তু আসলে একটুও হয়নি। ওকে ধরিয়ে দিচ্ছিল ওর চোখ দুটোই। ক্যারোলিন ভীষণ সাবধানীর মতো লক্ষ্য করে চলেছিলো সব কিছু। মনে হয় আমার ভয় ওকে আস্তে আস্তে গ্রাস করছিলো…।

খুব আস্তে কথা বললাম আমি ওর কাছে গিয়ে, এতো আস্তে যা শুনতে পেলো না বাকি মহিলা। আমি বলেছিলাম, খুনী কোথাকার, শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধুকে তুমি খুন করলে।

নিজেকে অদ্ভুত ভাবে গুটিয়ে নিয়ে প্রায় আর্তনাদ করে বলে উঠলো ক্যারোলিন, না, …না, করেছে ও নিজেই…।

ক্যারোলিনের চোখে আমি চোখ রাখলাম, তুমি পুলিশকে ও সব গল্প বোলো। বলেও ছিলো ক্যারোলিন, কিন্তু বিশ্বাস করেনি পুলিশ।

ফিলিপ ব্রেকের বিবৃতির সমাপ্তি–

বিবৃতি মেরিডিথ ব্লেকের

প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
কথা দিয়েছিলাম আমি তাই ষোলো বছর আগে ঘটে গিয়েছিলো যে দুঃখজনক ঘটনা, তার মনে পড়ে যতোটা সেই বিবরণ আপনাকে জানাচ্ছি লিখিত ভাবে। বলে রাখি প্রথমেই সম্প্রতি আপনার সঙ্গে দেখা হবার সময়ে আপনি যা যা বলেছিলেন খুব গভীরভাবে সে সম্বন্ধে আমি চিন্তা করেছি। আমি ভেবে দেখলাম আগে যা বিশ্বাস করতাম এখন সেই কথাই বিশ্বাস করছি আরও বেশি পরিমাণে যে ক্যারোলিন ক্রেল বিষ দেয়নি তার স্বামীকে। সব সময়েই কথাটা বেখাপ্পা লাগতো আমার কাছে। কিন্তু কোনো অন্য কারণ না থাকায় এবং নিজের তার আচরণের জন্যে আমিও অন্যদের ভেড়ার মতো মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম অভিমতটাকে, তাছাড়া ও না খুন করলে আর কে করতে পারে খুন।

আপনার সঙ্গে দেখা হবার পর থেকে অনেক ভেবেছি বিষয়টা নিয়ে আমি। বিকল্প যে যুক্তি সে সময়ে দেখানো হয়েছিল এবং আসামীপক্ষ বিচারের সময় থেকে যা বলা হয়েছিলো বিশ্লেষণ করেছি সবকিছু। যুক্তিটা হলো সেই এই যে আত্মহত্যা করেছে অ্যামিয়াস ক্রেল। যতটুকু জানি আমি অ্যামিয়াসকে তার ভিত্তিতে সে সময়ে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিলো যুক্তিটাকে আমার। মনে করি বর্তমানে আমার বদলানো উচিত অভিমত। প্রথমেই বলি এবং গুরুত্ব আছে কথাটার যথেষ্ট যে ঐ কথাটা ক্যারোলিনও বিশ্বাস করতো। আমরা যদি এখন মেনে নিই একথা যে অন্যায় ভাবে ঐ সুন্দরী নম্র স্বভাবের মহিলাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিলো তবে মর্যাদা দিতে হয় তার বহুঁকালিক বিশ্বাসটিকে। ও অ্যামিয়াসকে আমাদের সকলের চেয়ে অনেক ভালোভাবে চিনতো। যদি ওটাকে ক্যারোলিন আত্মহত্যা মনে করে থাকে তবে অবিশ্বাসী অ্যামিয়াসের বন্ধুরা যাই বলে থাকুক না কেন ওটা আত্মহত্যাই।

একটা তত্ত্ব আমি খাড়া করছি–বিবেক বলে একটা বস্তু ছিলো অ্যামিয়াস ক্রেলের মধ্যে, চাপা অনুতাপও ছিলো মনের মধ্যে এর, ওই কাজটা ও করে থাকতে পারে। চরম হতাশার আবর্তে পড়ে এবং এই ধরনের ওর মানসিক যন্ত্রণার কথা বেশি ভালো করে স্ত্রী ছাড়া আর কে পারে জানতে বলুন। যদিও ঐ ধরনের কোনো কিছু কখনো শুনিনি বলতে আমি। তবে ঠিক এ কথাও অনেক গুজবের মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব থাকতে পারে এই ধরনের যা আদৌ সন্দেহ করা যায় না এবং তার প্রকাশ হঠাৎ হলে বেশ আশ্চর্য হয়ে যাই আমরা। সম্মানিত ও সংযমী মানুষের মধ্যে জীবনের অনেক স্থূল দিক লুকিয়ে থাকতে পারে। অনেক সময় অর্থলোভী মানুষের মধ্যে দেখা দেয় অসাধারণ শিল্পবোধ। কোমলতা, স্নেহ থেকে আপাত নিষ্ঠুর মানুষের হৃদয়ে। নিষ্ঠুর প্রবৃত্তির চাপ থাকে হাসিখুশি মানুষের মধ্যে।

ফলে হতে পারে এটা যে অ্যামিয়াস ক্রেলের মধ্যেও ছিলো একটা আত্মধিক্কারের বোধ। সে যতই চেঁচামেচি বাইরে করুক না কেন, তাকে সহ্য করতে হতো বিবেকের দংশন সংগোপনে। এটা অযৌক্তিক হলেও আপাত দৃষ্টিতে, আমার মনে হচ্ছে কেমন যেন অবিশ্বাস্য করার নয় কথাটা বারবার ক্যারোলিনও বলেছিলো। আর আমি বলছি আজ, উড়িয়ে দেবার নয় কথাটা।

এবারে আসা যাক প্রকৃত ঘটনায়, অর্থাৎ এই নতুন বিশ্বাসের আলোতে আমাদের প্রকৃত ঘটনার মূল্যায়ন করি।

মনে হয় আমার এক্ষেত্রে অ্যাল্ডারবেরিতে এলসার প্রথম আসার সময় অর্থাৎ কয়েক সপ্তাহ আগে ঐ দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটার ক্যারোলিনের সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছিলো আমার তার বর্ণনা দেওয়া অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

আগেই তো আমি বলেছি আপনাকে যে আমার ক্যারোলিনের প্রতি প্রগাঢ় স্নেহ আর বন্ধুত্বের মনোভাবটা অজানা ছিলো না তার। ফলে সহজেই আমার কাছে সে তার মনের গোপন কথা বলতে দ্বিধা করতো না। মনে মনে ও যে অশান্তিতে ভুগছে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, তবুও একদিন যখন প্রশ্ন করে বললো যে সত্যি সত্যিই কী অ্যামিয়াস জড়িয়ে পড়েছে এলসার ব্যাপারে, তখন পারিনি আশ্চর্য না হয়ে।

আমি বলেছিলাম শুধু ছবি আঁকার ব্যাপারে অ্যামিয়াস আগ্রহী। অ্যামিয়াসকে তুমি তো ভালোভাবেই চেনেনা।

ক্যারোলিন মাথা নেড়ে বলেছিলো, না, মেয়েটাকে ও ভালোবাসে।

তা একটু আধটু হতে পারে। ভীষণভাবে ভালোবাসে আমার ধারণা।

আমি বলেছিলাম, মেয়েটা দারুণ সুন্দরী স্বীকার করছি। আর এ ব্যাপারে আমরা জানি অ্যামিয়াসের দুর্বলতার কথা তবে এটাও ঠিক যে যদি মনে প্রাণে অ্যামিয়াস কাউকে চায়, সে তুমিই। ওর মোহ এ ব্যাপারে বরাবরই আছে। কিন্তু বেশিদিন তা টেকে না। আর খারাপ ব্যবহার তোমার সঙ্গে করলেও তুমিই সব ওর কাছে।

বলেছিলো ক্যারোলিন, সব সময়ে তাই মনে করতাম আমিও আগে।

ক্যারোলিন বিশ্বাস করো, তাই আছে এখনও।

না মেরিডিথ এবার কিন্তু অন্যরকম মনে হচ্ছে আমার। ঐ মেয়েটা..মনেপ্রাণে ভীষণভাবে চাইছে। প্রচণ্ড কম বয়সও…তীব্রতাও বেশি। কেমন যেন মনে হচ্ছে আমার বেশ জটিল এবারে ব্যাপারটা।

আমি বলেছিলাম, বয়েস যে ওর কম, আর প্রচণ্ড আন্তরিকতাও তাই তেমন কোনো ভাবনার কারণ দেখা দেবে না। অ্যামিয়াসের মেয়ে শিকারের ব্যাপারে কোনো বাছ-বিচার না থাকলেও ব্যাপারটা অন্যরকমের দাঁড়াবে এই ধরনের মেয়ের ক্ষেত্রে।

হ্যাঁ, আমি সে ভয়টাই খাচ্ছি, ব্যাপারটা দাঁড়াবে অন্যরকমের, ক্যারোলিন বললো, এখন আমার চৌত্রিশ চলছে। দশবছর হলো বিয়ে হয়েছে। আমার তুলনা করা চলে না ঐ এলসা মেয়েটার সঙ্গে আর আমি সেটা ভালোভাবেই জানি।

কিন্তু ক্যারোলিন তুমি তো জানো, যে সত্যি সত্যিই অ্যামিয়াস ভালোবাসে তোমাকে।

ক্যারোলিন তার উত্তরে বলেছিলো, সব সময় কী পুরুষদের চেনা যায়? একটু বিষাদের সুরে তারপর বললো, মেরিডিথ একটা আদিম নারীসত্ত্বা আছে আমার মধ্যে, ইচ্ছে করে আমার, একটা কাটারি হাতে মেয়েটির কাছে চলে যাই।

বুঝিয়েছিলাম আমি ক্যারোলিনকে যে হয়তো মেয়েটা বুঝতেই পারছে না যে ও কী করছে। দেবতার মতো ভক্তি করে অ্যামিয়াসকে এবং চিন্তাও করতে পারে না ওকে ভালোবেসে বসে আছে অ্যামিয়াস।

আমার কথাটা ক্যারোলিন হেসে উড়িয়ে দিলো এব বাগান সম্বন্ধে প্রসঙ্গ পাল্টে গল্প করতে লাগলো। ও বোধ হয় ভুলে গেছে আমি ভেবেছিলাম।

আমি বলেছিলাম, মেয়েটার ভীষণ আকর্ষণ আছে স্বীকার করছি। আর দুজনেই আমরা জানি যে অ্যামিয়াস একটু বেশি দুর্বল এ ব্যাপারে তবে একথাও সেইসঙ্গে তোমার জানা উচিত যে যদি কাউকে অ্যামিয়াস ভালবাসে তবে সে তুমিই। এইসব মোহ তার থাকলেও, কেটে যায় কদিন পরে। তুমিই একমাত্র মহিলা ওর কাছে, যতো ঝগড়াই হোক না কেন, ও নিশ্চিন্ত। তোমার ব্যাপারে।

তাইতো মনে করতাম এতোদিন।

 ক্যারোলিন বিশ্বাস করো আমার কথা, তাই আছে এখনও।

এবার কিন্তু মেরিডিথ বেশ ভয় করছে আমার। ভীষণভাবে মেয়েটা…অ্যামিয়াসকে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে চাইছে যে ভয় লাগছে আমার। বয়স কম…তীব্রতাও আছে আকাঙ্ক্ষায়।

আমি বলছিলাম ওর কথা শুনে, কম বয়স মেয়েটার, তার ওপর ভীষণভাবে আবার একনিষ্ঠ বলছে, তাহলে তো কমেই গেলো ভয়ের ব্যাপার। নিজেদের বাঁচিয়ে চলতে পারে এ ধরনের মেয়েরা। এটা তো ঠিক অ্যামিয়াস মেয়েদের নিয়ে খেলা করতে ভালোবাসে। ও অন্য পথ নেবে এই ধরনের মেয়ের পাল্লায় পড়লে।

হ্যাঁ, সেই ভয়ই তো হচ্ছে আমার, ও ধরতে পারে অন্য পথ, বললো ক্যারোলিন, এখন চৌত্রিশ চলছে আমার। বিয়ে হয়েছে দশ বছর হলো, পাল্লা দিতে এলসার সঙ্গে যে পারবো না সে কথা জানি ভালভাবেই আমি।

আমি তখন বলেছিলাম, কিন্তু ক্যারোলিন সেইসঙ্গে তুমি একথাও জানো তুমি জানো যে তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে অ্যামিয়াস।

ক্যারোলিন উত্তরে বললো, পুরুষদের ব্যাপারে কখনো কি সঠিকভাবে কিছু বলা যায়, তারপর বিষাদের হাসি একটু হেসে বললো, আমার মধ্যে কিন্তু একটা আদিম মেয়েমানুষ আছে। বলা যায় না ওর কাছে দা নিয়ে পৌঁছেও যেতে পারি।

আমি ক্যারোলিনকে অনেক বুঝিয়েছিলাম, বলেছিলাম এলসা মেয়েটা বাচ্চা, বোঝে না কি করবে কিছুই। ও অ্যামিয়াসের মুগ্ধ ভক্ত, কিন্তু নিশ্চয়ই একথা বুঝতে পারছে না যে ক্রমশঃ ওকে আমিয়াস ভালবেসে ফেলছে।

তার উত্তরে শুধু ক্যারোলিন বলেছিলো, তুমি সত্যিই সরল মানুষ মেরিডিথ, তারপর একরকম ইচ্ছে করেই বাগান করা নিয়ে কথা বলা শুরু করে দিলো। যেন সে পাল্টাতে চায় প্রসঙ্গটা।

এলসা এর কিছুদিন পরেই লন্ডনে চলে যায়। কয়েক সপ্তাহ বাইরে ছিলো অ্যামিয়াসও। প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম ওদের ব্যাপারটা। আবার জানলাম ফিরে এসেছে এলসা অ্যাল্ডারবেরিতে যাতে ছবিটা অ্যামিয়াস তাড়াতাড়ি শেষ করতে পারে।

আমাকে একটু বিচলিত করেছিলো খবরটা। কিন্তু যখন দেখা হলো ক্যারোলিনের সঙ্গে তেমন কিছুই আমাকে বললো না। ও সাধারণতঃ যেমন কোনো দিকে না কান দিয়ে যেতে থাকে নিজের কাজে তাই দেখলাম এবারও। ধরে নিয়েছিলাম আমিও, তাহলে ঠিক আছে সবকিছু।

কিন্তু ব্যাপারটা পরে অততদূর গড়িয়েছে শুনে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলাম আমি মনে।

যা কথাবার্তা হয়েছিলো অ্যামিয়াস ক্রেল আর এলসার সঙ্গে তা আপনাকে আমি জানিয়েছি। আলোচনা করার সুযোগ হয়নি ক্যারোলিনের সঙ্গে। মাত্র দু-একটা কথা হয়েছিলো, আপনাকে যার কথা আগেই জানিয়েছি।

এখনো আমি দেখতে পাই তার মুখখানা, বড় বড় কালো চোখের তারা, সমাহিত শান্ত দৃষ্টি। কানে ভাসে এখনও তার কথাটা, সব শেষ হয়ে গেছে…

যে হতাশা এই কটা কথার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছিলো তা আমি বর্ণনা করতে পারবো না ভাষায়। যেন বাণীরূপ দেওয়া হয়েছে পরম সত্যকে। এই বিচ্যুতির ফলে অ্যামিয়াসের সব যে হারিয়ে ফেলেছিলো ক্যারোলিন। ঐ তো একমাত্র পথ পালাবার। বোকার মতো বিষটা সম্বন্ধে যে বক্তৃতা দিয়েছিলাম তাতেই তো ক্যারোলিন পথের সন্ধান পেয়ে যায়। এবং যে অংশটা ফিডো থেকে পড়ে শোনাই তাতে এক মহান মৃত্যুর সুন্দর ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছিলো।

এখনো বিশ্বাস আমার ক্যারোলিন বিষ এনেছিলো আত্মহত্যা করার জন্যেই, পরিত্যাগ করেছে ওকে আমিয়াস এই হতাশা আর হয়তো দুঃখবোধ থেকেই ক্যারোলিন ঐ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এটাও আমার ধারণা যে ওকে বিষ চুরি করতে দেখেও থাকতে পারে অ্যামিয়াস, কিংবা কথাটা পরে জানতে পেরেছিলো।

জানতে পারায় ওটা নিশ্চয়ই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিলো তার মনের ওপর। তার ব্যবহারে ভয় পেয়েছিলো, আজ কত নীচে নামতে হচ্ছে ক্যারোলিনকে এই ভেবে। কিন্তু এলসাকে শত দুঃখ অনুশোচনা সত্ত্বেও ছাড়ার কথাও ভাবতে পারেনি। অবশ্য বোঝা যায় সেটা, এলসার আকর্ষণ এড়ানো কঠিন।

অ্যামিয়াস যেন চিন্তাই করতে পারে না এলসাকে বাদ দিয়ে বাঁচার কথা, আবার এটাও জানে যে ক্যারোলিন বাঁচতে পারে না ওকে বাদ দিয়ে। ফলে ও ঠিক করেছিলো জটিল এই জাল থেকে বেরিয়ে আসার একটিমাত্র পথ খোলা আছে এবং সেটা হচ্ছে কাজে লাগানো নিজের কোনাইনটাকে।

আর ও কোনাইন যেভাবে খেলো সেটা বেশ খাপ খেয়ে যায় ওর চরিত্রের সঙ্গে। ও বোধ হয় ছবি আঁকাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতো পৃথিবীতে। এবং আক্ষরিক অর্থে মনকে বরণ করার মতো হাতে তুলি নিয়ে সে পথটাই বেছে নিয়েছিলো। ভীষণ ভালোবেসেছিল যে মেয়েটাকে ও তাঁকে দেখতে দেখতে বোধ হয় মরাটাকেই জীবনের শেষ আকাঙ্ক্ষা হিসেবে বেছে নেয়। অ্যামিয়াস হয়তো ভেবেছিলো মেয়েটার মঙ্গল হবে ওর মৃত্যুতেই…।

এই তত্ত্বটাকে স্বীকার করছি যুক্তি দিয়ে খাড়া করতে চাইলে অসম্পূর্ণ থেকে যায় কিছু অদ্ভুত তথ্যের ব্যাখ্যা। যেমন ক্যারোলিনের শুধু আঙুলের ছাপ পাওয়া গেছে খালি কোনাইনের বোতলে কেন? আমার বক্তব্য তার উত্তরে ওটা অ্যামিয়াস ধরার পরে যেভাবে রাখা হয়েছিলো কাপড় জামার মধ্যে তাতে আঙুলের ছাপ ঘষা লেগে উঠে যাওয়াটা বিচিত্র নয়। এবং ওর মৃত্যুর পর ক্যারোলিন নিশ্চয়ই ঘেঁটেছিলো বোতলটা। হয়তো কেউ ওটা ছুঁয়েছে কি না দেখতে চেয়েছিলো। এটা নিশ্চয়ই সম্ভব, আর আঙুলের ছাপ বিয়ারের বোতল সম্বন্ধে সাক্ষীরাই তো বলেছিলো যে বিষ খাবার পর কাঁপা কাঁপা হাতের ছাপ মানুষের অমন বিকৃত হওয়া সম্ভব।

বুঝিয়ে বলতে হবে আর একটা জিনিস। ক্যারোলিনের মনোভাব বিচারের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমার এখন মনে হয় আমি জেনে গেছি তার কারণ। আমার ল্যাবরেটারি থেকে ক্যারোলিনই বিষটা চুরি করেছিলো। উদ্দেশ্য ছিলো স্বামীর পথ থেকে আত্মহত্যা করে সরে যাওয়া। ঐ রকম একটা মনের হয়তো বিষাদময় পরিস্থিতিতে নিজেকেই ক্যারোলিন স্বামীর মৃত্যুর কারণ বলে শুরু করেছিলো ভাবতে–নিজেকে হয়ত বুঝিয়ে ছিলো যে তার স্বামীকে সেই খুন করার অপরাধে অপরাধী–যদিও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিলো যে অপরাধের, সত্যি সত্যিই তেমন কোনো অপরাধ সে করেনি আক্ষরিক অর্থে অনুমান এমন করা অসঙ্গত নয় আমার পক্ষে।

মনে হয় আমার এটা হতে পারে। এবং যদি তাই হয় তবে কার্লাকে প্রকৃত ঘটনাটা বোঝানো আপনার পক্ষে বোধ হয় সহজ হবে। সে ঐ যুবককে স্বচ্ছন্দে বিয়ে করতে পারে। এবং সন্তুষ্ট থাকতে পারে এটা জেনে যে ওর মা আসলে অবসান ঘটাতে চেয়েছিলো নিজেরই জীবনের।

দুঃখের বিষয় এই যে আপনি এসব কথা জানতে চাননি আমার কাছ থেকে অথচ আসল ঘটনা হলো এটাই আমার মনে পড়ে যতদূর। বাদ পড়ে গিয়েছিলো যে সব কথা এবার আমি সে সব পূরণ করে দিতে চাই। অ্যামিয়াসের মারা যাবার আগের দিন ঘটেছিলো যা যা তাতো আপনাকে আগেই বলেছি। ঐ দিনটায় কথায় এবারে আসছি।

ঘুম ভালো হয়নি রাতে বন্ধুদের ব্যাপারে আমার যে বিপজ্জনকভাবে ঘটনাবলী মোড় নিয়েছিলো তার জন্যে আমার ভীষণ উদ্বেগ ছিলো। অনেক রাত পর্যন্ত আমি জেগে জেগে ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম চরম বিপর্যয়টাকে কীভাবে এড়ানো যায়। আমি ভোর ছ’টার সময় আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম গাঢ় ঘুমে। আমার ঘুম ভাঙাতে পারেনি ভোরের চা-ও, যখন শেষে উঠলাম তখন প্রায় সাড়ে ন’টা বাজে, ভীষণভাবে মাথা ভার হয়ে আছে। মনে হলো তার একটু পরে ঠিক তলার ঘরটাতে কে যেন চলাফেরা করছে, আমি যে ঘরটাকে ল্যাবরেটারি হিসেবে ব্যবহার করি।

একটা কথা এখানে বলে রাখি, শব্দ যেটা আসছিলো সেটা হতে পারে বেড়াল ঢুকে পড়ার জন্যেও। একটু ভোলা জানলার শার্সিটা, যেন অসাবধানে গতরাতে ওটা কেউ তুলে রেখে গেছিলো ওইভাবে। তবে বড়জোর একটা বেড়াল ঐ ফঁক দিয়ে ঢুকতে পারে। আমি শুধু শব্দের কথা উল্লেখ করলাম এইটুকু ব্যাখ্যা করার জন্যে যে আমি কেন ল্যাবরেটারিতে এসেছিলাম।

যেটুকু সময় লাগে পোষাক পরতে, আমি ল্যাবরেটারিতে ঢুকলাম তারপরেই, দেখলাম অন্য বোতলের সারি থেকে কোনাইনের বোতলটা একটু বেরিয়ে এসেছে। নজর ঐভাবে পড়ার পর চমকে উঠলাম আমি, খানিকটা বেশ খালি দেখাচ্ছে বোতলটা। বোতলটা প্রায় ভর্তি ছিলো আগেরদিন, আজ প্রায় খালি হয়ে আছে।

টেনে বন্ধ করলাম জানালাটা, তারপর বেরিয়ে এলাম দরজায় তালা দিয়ে। হতভম্ব তো বটেই খানিকটা বেশ বিচলিত হয়ে উঠেছি। চমকে উঠলে হঠাৎ আমার বুদ্ধি আর কাজ করতে চায় না ঠিকমতো।

উত্তেজিত হয়ে উঠলাম প্রথমে, তারপর ঘিরে ধরলো আশংকা এসে, শেষে ভয় পেলাম ভীষণ, জিজ্ঞেস করলাম বাড়ির লোকজনদের–না, কেউ তারা ঢোকেনি ল্যাবরেটারিতে। খানিকক্ষণ আরও চিন্তা করার পর ভাইকে আমি ফোন করে ঠিক করলাম তার মতামত নেওয়া।

আমার চেয়ে ফিলিপ বুদ্ধিমান, চট করে সবকিছু বুঝতে পারে। ঐ চুরি যাওয়ার ব্যাপারটার গুরুত্ব সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরে যেতে বললো আমাকে আলোচনা করার জন্যে ওর কাছে।

দেখা হলো বাইরে গিয়ে গভর্নেস মিস উইলিয়ামসের সঙ্গে। উনি এসেছিলেন ওপার থেকে ফাঁকিবাজ ছাত্রীর সন্ধানে। ও ব্যাপারে ওঁকে আমি কিছুই বললাম না। অ্যাঞ্জেলার ভীষণ প্রিয় ছিলো আমার বাগানের আপেল গাছটা, তাই বাগানে গিয়ে খোঁজ করতে বললাম মিস উইলিয়ামাসকে। তাড়াতাড়ি নৌকো বেয়ে তীরে গিয়ে অ্যাল্ডারবেরির দিকে চলে গেলাম। আমার ভাই ওখানে আগে থাকতেই অপেক্ষা করছিলো।

সেদিন যে পথ দিয়ে আমি আর আপনি গিয়েছিলাম বাড়ির দিকে, সেই পথ দিয়ে হাঁটতে লাগলাম আমরা। সেদিন তো ঐ জায়গাটা আপনি নিজে দেখেছেন, অতএব বুঝতে পারছেন কামান বাগানের পাঁচিলের পাশ দিয়ে সেদিন যেতে যেতে যা কথা হচ্ছিল বাগানের ভেতরে সবই আমরা শুনেছি। উপায় ছিলো না, না শুনে।

কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে অ্যামিয়াস আর ক্যারোলিন চটাচটি করছিলো। এটুকু জানা ছাড়া অবশ্য আমি মন দিয়ে আদৌ শুনিনি বলা হচ্ছিলো কি কি কথা।

তবে ভয় দেখানোর মতো ক্যারোলিনকে কোনো কথা বলতে শুনিনি। অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। যাতে স্কুলে ওকে না পাঠানো হয় এই নিয়ে ক্যারোলিন কাকুতি-মিনতি করছিলো, অথচ নাছোড়বান্দা অ্যামিয়াসও, গরগর করছিলো ও রাগে, না ঠিক যখন হয়ে গেছে সব ওকে যেতেই হবে তখন। যাতে গুছিয়ে নেয় জিনিসপত্র অ্যাঞ্জেলা সেটা ক্যারোলিনের দেখার ভার।

পৌঁছেছি কামান বাগানের দরজার কাছে হঠাৎ ক্যারোলিন দরজা খুলে বেরিয়ে এলো, বেশ বিচলিত দেখাচ্ছিলো ওকে। একটু হাসলো নিজের অজান্তেই আমাকে দেখে, বললো ওরা আলোচনা করছিলো অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। ঠিক সেই মুহূর্তে এলসা ঐ পথ দিয়ে এলো, তাড়াতাড়ি ছবিটা শষ করতে চাইছিলো অ্যামিসও।

আমরা কোনো ব্যবস্থা নিইনি সঙ্গে সঙ্গে বলে পরে ফিলিপ দোষ দিয়েছিলো নিজেকে। কিন্তু ওভাবে আমি তখন ভাবিনি। কল্পনাও করতে পারিনি আমরা যে খুন করার মতো একটা ব্যাপার নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে কেউ। (আমার তাছাড়া এখনও বিশ্বাস কেউ চিন্তাও করেনি খুনের কথা)। একথা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমরা যে আমাদের কিছু একটা করা উচিত, তবে এখনও আমি বলবো প্রথমে ব্যাপারটা নিয়ে সাবধানে চিন্তা করার কথা আলোচনা করে ভুল করিনি আমরা। কি ঠিক করা উচিত এটা প্রয়োজন ছিলো স্থির করা–আমি দু-একবার ভেবেছিলাম একথাও যে ভুল করছি না তো আমি। আগেরদিন কি বোতলটা সত্যি সত্যিই ভরা ছিলো? একেবারে সবকিছু সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে আমি পারি না (আমার ভাই ফিলিপ যেমন হয়)। স্মৃতিশক্তি মানুষকে অনেক সময় বিভ্রান্ত করে। যতো চিন্তা করতে লাগলাম আমি ঠিক কোথায় রেখেছিলাম বোতলটা ততোই সব গুলিয়ে ফেলতে লাগলাম। ফলে বেশ রেগে গিয়েছিলো ফিলিপ আমার ওপর।

আলোচনা স্থগিত রইলো তখনকার মতো, কথা ছিলো লাঞ্চ হবার পর হবে। (বলে রাখি একটা কথা অ্যান্ড’রবেরিতে ইচ্ছে করলেই স্বাধীনতা ছিলো আমার খুশিমতো লাঞ্চ খাবার)।

পরে বিয়ার এনে দিলো আমাদের অ্যাঞ্জেলা আর ক্যারোলিন। জিজ্ঞেস করলাম অ্যাঞ্জেলাকে কেন পড়াশোনায় ও কঁকি দিচ্ছে, মিস উইলিয়ামস ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন এও বললাম, ওর কপালে বকুনী আছে। স্নান করতে গিয়েছিলো সমুদ্রে, জানালো অ্যাঞ্জেলা, কিন্তু যখন সব জামাকাপড়ই ওর স্কুলে যাবার জন্যে নতুন হচ্ছে তখন ওকে দিয়ে কেন মিছিমিছি মিস উইলিয়ামস পুরনো জামাটা সেলাই করতে চাইছেন ওর সেটা মাথায় ঢুকছে না।

নিভৃতে ফিলিপের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে না দেখে ব্যাপারটা নিয়ে একা একা ভাববার জন্যে হাঁটতে শুরু করলাম আমি কামান বাগানের দিকে। ওদিকে একটা বেঞ্চ পাতা ছিলো গাছপালার ফাঁকে, আমি আপনাকে জায়গাটা দেখিয়েছিলাম। সিগারেট ধরালাম ওখানে বসে, তারপর চিন্তা করতে করতে দেখছিলাম চারপাশটা। এলসা পোজ দিয়ে বসে আছে চোখ পড়লো।

সেই দিনকার ওর রূপটা আমি ভুলবো না কোনোদিনও। সে কাঠ হয়ে বসেছিলো, একটা হলদে জামা গায়ে, প্যান্ট গাঢ় নীল রঙের আর গলায় জড়ানো লাল রঙের সোয়েটার।

যৌবন আর স্বাস্থ্যের উজ্জ্বল আভা ওর মুখে। ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনার কথা মিষ্টি গলায় বলে চলেছিলো। মনে হতে পারে এটা শুনে যে আড়ি পাতছিলাম আমি, কিন্তু তা নয়। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলো আমাকে এলসাও। অ্যামিয়াস আর এলসা দুজনেই জানতো যে ওখানে বসে আছি আমি। মেয়েটা আমাকে হাত নেড়ে ডেকে বলেওছিলো অ্যামিয়াস একেবারে অভদ্রের মতো ব্যবহার করছে সেদিন সকাল থেকে। একটুও বিশ্রাম নিতে দিচ্ছে না ওকে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে সারা শরীর। ব্যথাও করছে।

হুঙ্কার দিয়ে উঠলো অ্যামিয়াস। এলসার নিশ্চয়ই ওর মতো মাথা ব্যথা নেই, সারা শরীরে ওর বাত হয়েছে। এলসা ব্যঙ্গ করে বললো, আহা! বুড়ো মানুষ বেচারা, অ্যামিয়াস উত্তরে বলেছিলো এই অকর্মণ্য নড়বড়ে লোকটাকেই তো ও ঘাড়ে নিচ্ছে যেচে।

আমার খুব খারাপ লেগেছিলো কথাটা শুনে, তারা হালকাভাবে নিজেদের ভবিষ্যৎকে মেনে নিচ্ছিলো বটে কিন্তু বেশ কষ্ট যে পাচ্ছে সেটাতে দুজন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অথচ মেয়েটার ওপর বিরূপ হতে পারলাম না আমি। এতো অল্পবয়সী, আত্মবিশ্বাস এতো আর গভীরভাবে প্রেমে এলসা জড়িয়ে পড়েছে। আর কিযে সে করছে ঠিক তাও বুঝতে পারছে না। কাকে কষ্ট বলে তাও ঠিক জানা নেই। বসে আছে সরল বিশ্বাস নিয়ে এই ভেবে যে ক্যারোলিনের ব্যাপারটা ঠিক হয়ে যাবে আর শিগগীরই কাটিয়ে উঠতে পারবে সে সব বাধা। নিজেকে আর অ্যামিয়াসকে ছাড়া মেয়েটা অন্য কারুর কথা খেয়ালই করেনি। সুখে থাকবে দুজনে মিলে। আমাকে আগেই এলসা বলেছিলো আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা সেকেলে। মনে ওর ছিলো না কোনো সন্দেহ, না ছিলো বিবেকের দংশন-কারুর জন্যে করুণাও ছিলো না। কেউ কি দৃপ্ত যৌবনের কাছ থেকে আশা করতে পারে? বয়োবৃদ্ধদের ধর্ম ওটা। অবশ্য ওরা বেশি কথা বলেনি। কোনো শিল্পীই বকবক করতে চায় না কাজ করার সময়। এলসা দশ মিনিট অন্তর অন্তর একটা না একটা মন্তব্য করেছিলো আর ফুঁসতে ফুঁসতে অ্যামিয়াসও তার উত্তর দিচ্ছিলো। এলসা একবার বললো, যা বললে তুমি স্পেনের ব্যাপারটা সেটাই ঠিক ভেবে দেখলাম। আমরা প্রথমে ওখানেই যাবো। আমাকে তুমি ষাঁড়ের লড়াই দেখাতে নিয়ে যাবে। দারুণ হবে, তাই না। তবে ইচ্ছে আমার মানুষটাকে মারুক ষাঁড়টাই। যখন রোমের মহিলারা মরতে দেখতেন মানুষকে তখন তাদের যে মনোভাব হতো আমি সেটা অনুভব করতে পারি। জানোয়াররা অনেক বেশি সুন্দর মানুষের তুলনায়।

মনে হয় আমার মেয়েটি নিজেই ছিলো পশুর মতো যুবতী এবং আদিম মনোভাবাপন্না। মানুষের দুঃখের অভিজ্ঞতা বা দ্বিধা জড়িত জ্ঞান তার মধ্যে কোনোটিই ছিলো না। এলসা চিন্তা করতে পারে আমার মনে হয় না, শুধু অনুভূতি ছিলো ওর। বড় বেশি প্রাণবন্ত ছিলো তবে, অত প্রাণপ্রাচুর্য আমি আর দেখিনি কারুর মধ্যে।

আমার শেষ দেখা সেই ওকে, প্রাণোচ্ছল এবং আত্মপ্রত্যয়ে ভরপুর–যেন সে বিচরণ করছিলো স্বর্গে।

লাঞ্চ খাবার ঘণ্টা পড়তেই উঠে আমি পা বাড়ালাম বাড়ির দিকে। আমার সঙ্গে যোগ দিলো কামান বাগানের দরজার কাছে এলসা। গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসার পথে চোখ ধাঁধাচ্ছিলো আমার ওখানকার আলোকে। দেখতে পারছিলাম না ভালো। অ্যামিয়াস শুয়ে ছিলো হাত পা ছড়িয়ে। একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো ছাদটার দিকে। ওইভাবে আমি অনেকবার ওকে শুয়ে থাকতে দেখেছি। আমি কি করে জানবো যে তখন সেদিন শুরু হয়ে গেছে বিষের ক্রিয়া, হাত-পা ওর শক্ত হয়ে উঠেছে।

আমিয়াস ঘেন্না করতে অসুস্থতাকে। দুর্বলতা দেখাতো না কখনও এবং নিজের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে কখনও অভিযোগও করত না।

এলসা বললো, ও আসবে না লাঞ্চ খেতে। আমি মনে মনে অ্যামিয়াসের বুদ্ধির তারিফ করলাম, মুখে বললাম, আসছি তাহলে।

ছবির দিক থেকে চোখ সরিয়েও তাকালো আমার দিকে। সে এক বিচিত্র–বোঝাবো কি ভাবে ফুটে উঠেছিলো পরশ্রীকাতরতার চিহ্ন তার মুখে।

আমি তখন কিছুই বুঝতে পারিনি। মনের মতো ছবি অনেক সময় না হলে তার মুখের ভাব ঐরকম হিংস্র হয়ে উঠতো। সেরকমই মনে হয়েছিলো এবারও।

তার মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করিনি আমি বা এলসা–মনে হয়েছিলো শিল্পীর মেজাজ।

অ্যামিয়াসকে ফলে ওখানে একলা ফেলে রেখে হাসতে হাসতে আমি আর এলসা চলে গেলাম বাড়ির দিকে। তখন যদি বেচারী জানতে ও জীবনে আর কোনো দিনও দেখতে পাবে না অ্যামিয়াসকে…ভালোই হয়েছিলো অবশ্য যে জানতো না, আরও কিছুক্ষণ তো ও পেয়েছিলো সুখে থাকতে।

ক্যারোলিন খুব স্বাভাবিক ছিলো খাবার টেবিলে নিজেকে নিয়ে একটু যেন ব্যস্ত ছিলো, আর কিছু না। আর প্রমাণ কি এটাই নয় যে ও ব্যাপারে কোনো হাত ছিলো না ওর? সে তো অতো বড় অভিনেত্রী নয়।

আরও পরে গভর্নেস নীচে নেমে গিয়ে ঐভাবে আবিষ্কার করেছিলো অ্যামিয়াসকে। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছিলো মিস উইলিয়ামসের, ডাক্তারকে ফোন করতে উনিই বলেছিলেন।

আর ঐ বেচারী…ঐ এলসার কথা বলছি…বাচ্চার মতো বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলো সে শোকে। বিশ্বাসই করতে পারে না ওদের মতো মেয়েরা যে এই ধরনের ঘটনা জীবনে ঘটতে পারে। খুব শান্ত ছিলো ক্যারোলিন। হ্যাঁ বলতে হবে বেশ শান্তই ছিলো। অন্ততঃ ও নিজেকে এলসার তুলনায় বেশ সংযত রাখতে পেরেছিলো। কোনো অনুশোচনা ছিলো না ওর মধ্যে। শুধু বলেছিলো এটা অ্যামিয়াস নিজেই করেছে। অবশ্য তা আমরা বিশ্বাস করিনি। রাগে এলসা ফেটে পড়ে ক্যারোলিনের মুখের ওপরেই বলেছিলো যে তার দোষটা।

তবে ক্যারোলিনও বুঝতে পারছিলো ততক্ষণে যে তাকে সবাই সন্দেহ করবে।

নিঃসন্দেহ ছিলো তো ফিলিপ কাজটা করেছে ক্যারোলিনই।

তখন বেশ মিস উইলিয়ামস তৎপর হয়ে উঠে সাহায্য করেছিলেন নানাভাবে। জোর করে এলসাকে ঘুমোবার ওষুধ খাওয়ালেন শুইয়ে দিয়ে। অ্যাঞ্জেলাকে সরিয়ে দিলেন পুলিশ আসার আগেই। আর নিজে আকাশছোঁয়া ব্যক্তিত্ব নিয়ে মোকাবিলা করলেন পুরো ব্যাপারটার।

যেন পুরো ব্যাপারটাই এক দুঃস্বপ্ন। খানা তল্লাসী করছে পুলিশ, প্রশ্ন করছে সবাইকে, তারপর কাগজের রিপোর্টাররা পৌঁছে গেলো, ফ্ল্যাশ বা ঘন ঘন জ্বলে উঠতে লাগলো।

সে এক ঘোরতর দুঃস্বপ্নের জগৎ-এতগুলো বছর তারপর থেকে পার হবার পরও দুঃস্বপ্নের মতো ঘটনাকে মনে হয়। হে ঈশ্বর, প্রকৃত ঘটনাটা ছোট্ট কালার মন থেকে তুমি তো মুছেই দিয়েছিলে, চিরকালের জন্য আমরাও ভুলে যেতে চাই।

শোনাক না কেন যত অসম্ভব–আত্মহত্যাই করেছিলো অ্যামিয়াস।

 বক্তব্য শেষ মেরিডিথ ব্লেকের।

.

লেডী ডিটিশামের বিবৃতি

আমার অ্যামিয়াস ক্রেলের সঙ্গে দেখা হওয়ার সময় থেকে শোচনীয় তার মৃত্যু পর্যন্ত আমি এখানে লিখছি সমগ্র কাহিনী।

একটা স্টুডিয়ো পার্টিতে আমি ওকে প্রথম দেখি। ও দাঁড়িয়েছিলো। একটা জানলার ধারে যতদূর মনে পড়ে, ওকে আমি দেখেছিলাম দরজার কাছে আসার পর। ওকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম যেন ও বললো যে ও ক্রেল, শিল্পী। সঙ্গে সঙ্গে আমি বলেছিলাম পরিচিত হতে চাই ওর সঙ্গে।

আমরা সেবারে বোধ হয় কথা বলেছিলাম মিনিট দশেক। কিভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছিলো ও তা বর্ণনা করা কঠিন। তবে বলতে পারি এটুকু ওর পাশে আর সবাইকে মনে হয়েছিলো ভীষণ ম্লান।

ঐ দেখা হবার পরে যতগুলো আমি পারলাম দেখলাম ওর আঁকা ছবি। সেই সময় একটা প্রদর্শনী চলছিলো বণ্ড স্ট্রীটে। অ্যামিয়াসের ছবি ছিলো ম্যানচেষ্টার লীডস আর লন্ডনের দুটো ছবির গ্যালারীতে। সবগুলো দেখার পর দেখা করে ওকে বললাম,আপনার সবকটা ছবি আমি দেখেছি. সত্যিই অসাধারণ।

শুনে যে খুব খুশি হয়েছে ও তা বোঝা গেলো, ও বললো, কে বললো যে একজন ছবির সমঝদার আপনি? আমার তো মনে হয় না আপনি এ সম্বন্ধে কিছু জানেন।

আমি বলেছিলাম, কথাটা হয়তো ঠিক। কিন্তু অসাধারণ ছবিগুলো, চমৎকার।

ও দাঁত বের করে হেসে বলেছিলো, কথা বলবেন না অতি উৎসাহী বাচ্চার মতো।

আমি বললাম, বলছি না। আমি চাই আমার একটা ছবি আঁকুন আপনি।

অ্যামিয়াস বলেছিলো, যদি একটুও বুদ্ধি থাকতো আপনার মাথায় তবে দেখতেন যে সুন্দরী মহিলাদের প্রতিকৃতি আমি আঁকি না।

আঁকতে হবে যে প্রতিকৃতিই একথা আমি বলিনি, তাছাড়া সুন্দরীও নই আমি।

আমার দিকে ও তাকালো, যেন নতুন করে আমায় দেখতে শুরু করেছে, বললো, তা ঠিক, ঠিক তুমি সুন্দরী নও।

তাহলে কি আমার ছবি আঁকবেন?

অনেকক্ষণ ধরে ঘাড় কাৎ করে আমাকে দেখলো, একটা অদ্ভুত মেয়ে তুমি, তাই না? আমি বলেছিলাম, ভালোই টাকা পয়সা আছে আমার। ছবিটার জন্যে ভালো টাকাই দিতে পারবো।

ও বলেছিলো, আমাকে দিয়েই তুমি বা ছবি আঁকতে চাইছো কেন?

ইচ্ছে হয়েছে আমার।

 ওটাই কি কারণ?

 হা, যখন যা চাই আমি তাই পাই।

ও তখন বললো, আহারে একেবারে বাচ্চা তুমি।

আমি বললাম, তাহলে আমার ছবি আঁকছেন আপনি?

আমার কাধ ধরে ও মুখটা ভালোভাবে দেখলো আলোর দিকে ফিরিয়ে। তারপর সরে দাঁড়ালো একটু দূরে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম নিশ্চল হয়ে। ও বলেছিলো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আমার অস্ট্রেলিয়ার ম্যাকাও পাখি অবিশ্বাস্য রঙে রাঙানো সেন্টপলস গির্জার ওপর নামছে একরকম ছবি আঁকা একটা। যদি কোনো একটু প্রাচীন আমলের প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে আঁকতে পারি তোমায় তাহলে আমার হয়তো ইচ্ছেপূরণ হলেও হতে পারে।

আমি বললাম, আপনি তাহলে আমাকে আঁকছেন? বলেছিলো ও, যত মেয়ে আমি দেখেছি তুমি হলে তার মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর সবচেয়ে স্থূল, এক অসাধারণ অগ্নিশিখা বিচিত্র বর্ণের সংমিশ্রণে। তোমার ছবি আমি আঁকবো।

তাহলে পাকা কথা? ও তখন বলেছিলো, তোমায় কিন্তু আমি সাবধান করে দিচ্ছি, এলসা গ্ৰীয়ার, তোমার ছবি যদি আঁকি তাহলে হয়তো প্রেমও করতে পারি তোমার সঙ্গে।

আমি বলেছিলাম, তুমি আশাকরি করবে…। খুব শান্ত অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে আমি কথাটা বলেছিলাম, দম বন্ধ যে হয়ে গেছে আমার কথা শুনে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, পাল্টে গিয়েছিলো ওর চোখের দৃষ্টিও।

মিঃ পোয়ারো বুঝতে পারছেন, একেবারে হঠাৎই ঘটে গিয়েছিলো ব্যাপারটা।

আবার আমাদের দু-একদিন পরে দেখা হলো। আমাকে অ্যামিয়াস জানালো যে ধরনের পশ্চাদপট ও চাইছে আমাকে তার জন্যে যেতে হবে ডিভনশায়রে। আর আমি বিবাহিত জেনে রাখো। আমি খুব পছন্দও করি স্ত্রীকে।

নিশ্চয়ই সে খুব সুন্দর তা না হলে তাকে তুমি কেন পছন্দ করবে। বলেছিলাম আমি।

ও বলেছিলো স্ত্রীকে আমি সত্যি কথা বলতে কি শ্রদ্ধার চোখে দেখি। অতএব এলসা যদি তোমার অন্য কোনো মতলব থাকে, তবে পথ দেখো!

আমি বুঝেছি। ও আমার ছবি এক সপ্তাহ পরে আঁকতে শুরু করলো। বেশ ভালোভাবেই ক্যারোলিন ক্রেল আমাকে গ্রহণ করেছিলো। তবে পছন্দ করতো না খুব একটা, আর কেনই বা করবে? আমিয়াসের নজর থাকতো চারদিকে, ও চালাক ভীষণ। কথা যে ওর স্ত্রীর কানে যেতে পারে আমাকে সে সম্বন্ধে কিছুই বলেনি এবং ওর সঙ্গে আমিও খুব নম্র আর ভদ্র ব্যবহার করতাম। অবশ্য আমরা তলে তলে জানতাম দুজনেই।

ও আমাকে দশদিন পরে ফিরে যেতে বললো লন্ডনে। আমি বললাম, কিন্তু শেষ তো হয়নি ছবি।

উত্তর দিলো ও, এই তো মাত্র শুরু হয়েছে। এলসা আসল কথা কি, তোমার ছবি আমি আঁকতে পারছি না।

কেন?

কেন তার কারণটা এলসা তুমি ভালো করেই জানো। আর সেইজন্যেই কেটে পড়তে হবে তোমাকে এখান থেকে। আমি চিন্তাই করতে পারছি না ছবির কথা…আমার অন্য কিছু মাথাতেই আসছে না তুমি ছাড়া।

কামান বাগানে তখন ছিলাম আমরা। বেশ গরম ছিলো দিনটা, চারদিক সূর্যের আলোয় ভরা, গুন গুন করে বেড়াচ্ছিলো পাখি আর মৌমাছি। সুখের আর শান্তির হওয়ার উচিত ছিলো পরিবেশটা। কিন্তু তার উল্টো বাস্তব ক্ষেত্রে দুঃখে ভরা বড়। বেশি…যেন…যেন…প্রতিফলন ভবিষ্যতের ছবিটার সেদিনই গিয়েছিলো দেখা।

জানতাম আমি লন্ডনে ফিরে কোনো লাভ আমার হবে না। তবুও বললাম, ঠিক আছে, আমি ফিরে যাবো তুমি বলছো বলেই।

গিয়েছিলাম ফিরেও, কিন্তু চিঠি দিইনি ওকে। ও নিজেই দশদিন পরে চলে এলো, এ্যাতো রোগা ক্লান্ত আর বিপর্যস্ত ওকে লাগছিলো যে কষ্ট হলো আমার।

ও বললো, এলসা তোমাকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। তুমি ওকথা বলতে পারবে না যে, সাবধান করে দিইনি।

আমি বলেছিলাম, আমি তোমারই অপেক্ষায় আছি। তুমি আসবেই জানতাম।

এক ধরনের চাপা গোঙানির শব্দ ওর মুখ দিয়ে ভেসে এলো, কয়েকটা এমন জিনিস আছে যা শক্তিশালী মানুষের চেয়েও খেতে পারছি না আমি, পারছি না ঘুমোতে, তোমার অভাবে পারছি না কিছু করতে।

জানিয়েছিলাম আমি এরকম যে হবে আমি সেটা জানতাম। একই দশা আমারও। এবং আমি ডুবেছি প্রথম দিন থেকেই। নিয়তি ওটাই, কোনো মানে হয় না এর বিরুদ্ধে লড়াই করার।

অ্যামিয়াস বলেছিলো, তেমন কোনো লড়াই তোমাকে করতে হয়নি, এলসা তাই না।

ওসব করার কিছু চেষ্টা আমি করিনি।

ও বলেছিলো আমার বয়স কেন এতো কম, আমি বলেছিলাম তাতে আসে যায় না কিছু। বলতে পারি আমরা খুব সুখে ছিলাম তার পরের কয়েকটা সপ্তাহ। তবে সব বলা যাচ্ছে না সুখ কথাটায়, আরও গভীর তার চেয়েও, আর ভয়ানক কিছু।

পরস্পরের জন্যেই যেন আমরা জন্মেছিলাম, এবং এতোদিন পরে খুঁজে পেয়েছি দুজনে দুজনকে, আর চিরকাল দুজনকে, জানতাম একসঙ্গেই থাকতে হবে।

কিন্তু বাস্তবে ঘটলো অন্য ঘটনা। মন থেকে দূর করতে পারছিলো না অসমাপ্ত ছবিটার কথা অ্যামিয়াস। ও একদিন আমাকে বললো, মজার ব্যাপার কি কখনই তোমার ছবি আগে হলে আঁকতাম না, জোর করে তুমিই জড়িয়েছিলে এ ব্যাপারে আমাকে। এখন কিন্তু এলসা তোমার ছবি আঁকতে চাই। এমনভাবে আমি তোমাকে আঁকবো যাতে আমার শ্রেষ্ঠ শিল্পকীর্তি হবে ওটাই। ভেতরটা আমার ভীষণ ছটফট করছে, এখুনি সেই কামান বাগানে ইচ্ছে করছে চলে যাই। তুমি বুড়ো চেস্টনাস্ট গাছের তলায় কামানের ওপর বসবে, সেই চির পরিচিত সুনীল সমুদ্র থাকবে পেছনে আর বিচিত্র রঙের দেশী গাছ…আর তুমি…সুতীব্র আনন্দের একটা বেসুরো উচ্ছ্বাসের মতো বসে থাকবে।

ও বলেছিলো, তোমার ছবি ঐ ভাবেই আঁকবো। তবে আমাকে নিয়ে গণ্ডগোল বা বিরক্তি করা চলবে না আঁকার সময়। ছবিটা শেষ হলে সব কথা ক্যারোলিনকে আমিই বলবো, তখন চুকে যাবে সব ঝাট। আমি বলেছিলাম, ক্যারোলিন তোমাকে ডিভোর্স করার ব্যাপারে গণ্ডগোল করবে না তো? মনে তো হয় না। তবে মুস্কিল মেয়ে মানুষদের চেনা, বলেছিলো অ্যামিয়াস।

আমি বলেছিলাম এই ভাবে ক্যারোলিনের মেজাজ বিগড়ে দেওয়ার জন্যে দুঃখিত আমি, কিন্তু ঘটে তো এই রকমই।

ও বলেছিলো, তুমি কতো সুন্দর আর সমঝদার এলসা। কিন্তু একটুও বুঝতে চায় না ক্যারোলিন, কখনও চেষ্টাও করবে না বোঝবার। আমাকে ও ভালোবাসে।

আমি বলেছিলাম বুঝেছি, তবে অ্যামিয়াসকে ও যদি ভালোবাসে তাহলে স্বামীকে সবদিক দিয়ে সুখী করার চেষ্টা করা ওর উচিত, অন্ততঃ মুক্তি চাইলে স্বামী ওর উচিৎ হবে না তাকে ধরে রাখার চেষ্টা করা।

ও বলেছিলো, অসাধারণ সুন্দর সুন্দর বাণী দিয়ে ও বলেছিলো আধুনিক সাহিত্যের তো জীবনের সমস্যার সত্যিই সমাধান করা যায় না। প্রতিহিংসা পরায়ণা বড়ই প্রকৃতি, এটা মনে রেখো।

আমি বলেছিলাম, আমরা তো এখন সবাই সভ্য মানুষ। আমিয়াস হেসে উঠেছিলো উত্তরে, সভ্য মানুষ? হায় রে। মনে হয় ক্যারোলিন তো ছুটবে কাটারি নিয়ে তোমাকে মারতে। তুমি কি এটা বোঝো না যে এলসা এতে ও কষ্ট পাবে…কষ্ট পাবে। এলসা তুমি জানো না কাকে কষ্ট পাওয়া বলে?

তখন আমি বলেছিলাম, ওকে তাহলে বোলো না।

ও বলেছিলো, না, ছিন্ন তো করতেই হবে সম্পর্ক, এলসা তোমাকে চাই সম্পূর্ণভাবে। জগতের সকলের সামনে, একান্ত আপন করে।

ধরো যদি বিবাহ বিচ্ছেদে ও রাজী না হয়?

সে ভয় আমি করি না।

তখন আমি বললাম, তাহলে ভয় কি তোমার?

অ্যামিয়াস অস্ফুট স্বরে বলেছিলো, জানি না আমি…অতএব বুঝতে পারছেন মিঃ পোয়ারো, ঠিক চিনেছিলো ও ক্যারোলিনকে, পারিনি আমি।

মজার ব্যাপার হলো সবচেয়ে এই যে একেবারেই কোনো কিছুকে অ্যামিয়াস পরোয়া করছিলো না। ও পছন্দ করতো ক্যারোলিনকে, তাই সততা বা অসৎ হওয়ার প্রশ্নটা নিয়ে ঘামালেন না মাথা। পাগলের মতো সব ভুলে গিয়ে ছবি আঁকতে লাগলো। ওঁর এই তন্ময়তা দেখে পারলাম বুঝতে ও কত বড় শিল্পী। ও চিন্তাই করতো না ছোটখাটো ভালো মন্দর কথা। অথচ অবস্থা আমার সঙ্গীন হয়ে উঠেছে। ওর মতো তো আর আমি নই। আমার ওপর ক্যারোলিন অসন্তুষ্ট হয়ে উঠলো।

ওকে সব কথা বলা উচিত ছিলো, কিন্তু ছবি শেষ না হওয়া পর্যন্ত অ্যামিয়াস ও নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না।

আমি বলেছিলাম, এ ব্যাপারে আমি সৎ থাকতে চাই। ক্ষেপে গিয়ে অ্যামিয়াস বলেছিলো, তোমার সততা গোল্লায় যাক। শেষ করতে দাও আমাকে ছবি। ওর কথা আমি বুঝতে পারলাম, কিন্তু ও বোঝার চেষ্টাই করতো না আমার কথাটা।

আমিই শেষ কালে ভেঙে পড়লাম। ক্যারোলিনরা পরের শরৎকালে বেড়াতে যাবে কোথায় দুজনে আমাকে এসব কথা শোনাচ্ছিলো কায়দা করে, রাগ আমি আর সামলাতে পারিনি। মুখের ওপর আসল কথাটা বলে দিয়েছিলাম। না ভুল করিনি, মনে হয় আজও ঠিক করেছিলাম। তবে নিশ্চয়ই বলতাম না ভবিষ্যতের কথা জানলে।

সংঘর্ষ বাঁধলো এর ফলে, আমার ওপর অ্যামিয়াস চটে লাল হলেও আমার কথাটা স্বীকার করলো ঠিক।

ক্যারোলিনকে ঠিক আমি বুঝতে পারিনি। সবাই মিলে আমরা মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি গিয়েছিলাম, হেসে, কথা বলে ক্যারোলিন দারুণ অভিনয় চালিয়ে গেলো। আমি বোকার মতো ভেবেছিলাম ব্যাপারটাকে বোধ হয় মেনে নিচ্ছে ও ভালো মনে। ছাড়তেও পারছিলাম না বাড়িটা, তাহলে সর্বনাশ হয়ে যাবে অ্যামিয়াসের ভেবেছিলাম নিজের থেকেই চলে যাবে ক্যারোলিন।

আমি ওকে কোনাইন নিতে দেখিনি। সত্যি কথাটা আমি স্বীকার করতে চাই, ওর কথাটাই ঠিক আমার ধারণা, বিষ চুরি করে থাকতে পারে ও আত্মহত্যা করার জন্যেই। তবে ও বড় ঈর্ষা পরায়ণ মেয়ে মানুষ, গ্রাস করে নিতে চায় সব কিছু। ওর নিজস্ব সম্পত্তি ছিলো আমিয়াস। মনে হয় আমার অন্য কোনো মেয়ের হাতে স্বামীকে ছেড়ে দেবার বদলে ও মেরে ফেলতে তৈরি ছিলো তাকে। আর যখন খোলাখুলি ভাবে কোনাইনের কথা মেরিডিথ বলছিলেন ও তখনই মনে মনে প্ল্যান এঁটে নেয় খুন করার। ভীষণ নিষ্ঠুর ক্যারোলিন, প্রতিহিংসাপরায়ণ মেয়ে মানুষ। ওকে ঠিকই চিনেছিলো অ্যামিয়াস। আমি পারিনি চিনতে।

পরদিন ক্যারোলিনের সঙ্গে লেগে গেলো অ্যামিয়াসের। বাইরে চত্বরে বসে আমি শুনেছিলাম ওদের কথা। মেজাজ দারুণ ঠান্ডা রেখে অ্যামিয়াস বোঝাচ্ছিলো, যা করার করবে বৌ আর মেয়ের কথা খেয়াল রেখেই। ক্ষেপে গিয়ে শেষের দিকে বলেছিলো–জেনে রাখো তবে আমি বিয়ে করবোই এলসাকে। পরস্পরকে ছেড়ে স্বাধীনতা তো বরাবরই আমাদের দুজনের ছিলো। মানুষের জীবনে এরকম তো ঘটেই থাকে।

খুব শান্তভাবে ক্যারোলিন বলেছিলো, যা খুশি করো তোমার, তবে তোমায় সাবধান করে দিলাম আমি।

ক্যারোলিন এর মানে কি? প্রশ্ন করেছিলো অ্যামিয়াস।…

 উত্তর হয়েছিলো, আমার তুমি এবং তোমাকে খুন করবো আমি…।

ঠিক সেই সময়ে চত্বরে ফিলিপ ব্লেক আসতে আমি ওঁর কাছে উঠে চলে গেলাম, ওদের ঝগড়া ব্লেক শুনুক তা চাইছিলাম না।

অ্যামিয়াস একটু পরে বেরিয়ে এল। শেষ করতে চায় ছবিটা, তাই কামান বাগানে গেলো আমাকে নিয়ে। পথে বললো ভীষণ বাড়াবাড়ি করছে ক্যারোলিন, তবে যেন কোনো কথাবার্তা না হয় এ নিয়ে। আর একটা দিন লাগবে ছবিটি শেষ করতে।

ও বলেছিলো, আমার সবার সেরা কাজ হবে এটাই। এর জন্যে যদিও প্রচুর মূল্য দিতে হচ্ছে।

আমি একটু পরে বাড়ির মধ্যে গিয়েছিলাম সোয়েটার আনতে, ঠান্ডা লাগছিলো একটু। ফিরে দেখি ক্যারোলিন, হয়তো জানাতে এসেছিলো শেষ কাকুতি-মিনতি। ওখানে ফিলিপ আর মেরিডিথ ব্লেকও ছিলেন।

অ্যামিয়াস ঠিক তখনই খুব ঠান্ডা বিয়ার চেয়েছিলো। খুব স্বাভাবিক সুরে ক্যারোলিন বলে ছিলো পাঠিয়ে দিচ্ছে বরফ দেওয়া বিয়ার। কী অসাধারণ ও অভিনেত্রী ছিলো। কারণ ও নিশ্চয়ই ততক্ষণে কী করবে ঠিক করে ফেলেছিলো।

ক্যারোলিন দশ মিনিট পরে অ্যামিয়াসের সামনে বিয়ার এনে গ্লাসে ঢেলে রাখলো। দুজনেই আমরা তখন কাজে ব্যস্ত নিজের। নজর দিইনি ওর দিকে।

বিয়ার গলায় ঢাললো এক ঢোকে, অ্যামিয়াস বিয়ার খেতো ঐ ভাবেই। মুখ বিকৃত করে বললো, বিশ্রী লাগলো ভীষণ, তবে খুব ঠান্ডা।

আমার সন্দেহ তখনও হয়নি, শুধু হেসে আমি বলেছিলাম, লিভার।

ক্যারোলিন, অ্যামিয়াসকে বিয়ার খেতে দেখে চলে গেলো।

অ্যামিয়াস ব্যথা আর শরীর শক্ত হয়ে ওঠার কথা প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে বললো। বোধহয় ওর বাত হয়েছে পেশীতে, ওর মনে হয়েছিলো এটাই। একেবারে সহ্য করতে পারতো না অসুখ বিসুখ। তারপর বললো হালকা সুরে, বয়স হয়ে যাচ্ছে তো। এলসা শেষ পর্যন্ত একটা প্যানপেনে বুড়োকে পছন্দ করলে। ওর সুরে আমি সুর মেলালাম। কিন্তু লক্ষ্য করলাম পা-টা ওর শক্ত হয়ে উঠেছে, মুখও বিকৃত করলো দু-একবার। তবে ভাবিনি স্বপ্নেও অন্য কিছু বাত ছাড়া হতে পারে। ও বেঞ্চটা টেনে শুয়ে পড়লো হাত-পা ছড়িয়ে, ও প্রায়ই এরকম করতো ছবি আঁকতে আঁকতে। তাই ওটা আমার কাছে আশ্চর্য লাগেনি।

দুজনেই লাঞ্চের ঘণ্টার শব্দ শুনেছিলাম, কিছু খাবে না ও বললো। আশ্চর্য হইনি তাতেও, বোধ হয় ও চাইছিলো না ক্যারোলিনের মুখোমুখি হতে।

কথাগুলো ওর মুখ দিয়ে যেন কেমন করে বের হচ্ছিলো, ও রকম ভাবে ও কথা বলতে মেজাজ বিগড়ে থাকলে।

আমরা খেতে চলে গেলাম ওকে একলা ওখানে রেখে। আমার তেমন অসুখ বিসুখের সঙ্গে পরিচয় নেই। অ্যামিয়াস ভেবেছিলাম শিল্পীর খেয়ালে আছে। ঘুণাক্ষরেও যদি জানতাম, অসুস্থ ও…বুঝতে পারতাম যদি…তাহলে ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাম ডাক্তার এনে…হায় ভগবান…কেন যে করিনি…এখন অবশ্য চিন্তা করাও বৃথা। বোকা হাঁদা একেবারে আমি অন্ধ।

আমার আর বিশেষ কিছু বলার নেই।

খাওয়ার পরে ক্যারোলিন আর গভর্নেসটা নীচে নেমে গিয়েছিলো। মেরিডিথ যান তারপর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসেন উনি দৌড়ে। জানালেন যে মারা গেছে অ্যামিয়াস।

বুঝতে পেরেছিলাম তখনই। বুঝতে পেরেছিলাম মানে ক্যারোলিনেরই যে কাজ ওটা তা বুঝে ফেলেছিলাম। অবশ্য বিষের কথা তখনও মনে হয়নি আমার। ভেবেছিলাম আমি ক্যারোলিন হয় নীচে গিয়ে গুলি করেছে অথবা খুন করেছে ছুরি মেরে অ্যামিয়াসকে।

ওকে খুন করবার জন্যে ছুটলাম আমি…ও করলো কি করে একাজ? প্রাণ প্রাচুর্যে, জীবনী শক্তিতে ভরা এভাবে অ্যামিয়াসকে মারলো কেন? যাতে আমি ওকে না পাই এই জন্যেই কি।

কী ভয়ংকর মেয়ে মানুষ, ওকে আমি ঘৃণা করি।

ওকে ফাসী পর্যন্ত দিলো না ওরা। ওকে ফাঁসীতে ঝোলানো উচিত ছিলো।

বোধহয় ফাঁসী দিলেও ওর শাস্তি তেমন হতো না…

 সমাপ্তি লেডী ডিটিশামের বিবৃতি :

সিসিলিয়া উইলিয়ামসের বিবৃতি

প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
১৯… সালের সেপ্টেম্বর, আপনাকে একটি বিবরণ পাঠাচ্ছি সেইসব ঘটনার। খুবই খোলাখুলি ভাবে আমি বলছি আপনাকে এবং লুকোইনি কোনো কথাই। কার্লা ক্রেলকে এটা আপনি দেখাতেও পারেন, সব সময়েই আমি সত্যের পূজারী, ক্ষতি করে মিষ্টি কথা, আমাদের বাস্তব সত্যের মুখোমুখি হবার সাহস থাকা উচিত। বাস্তব সত্যকে যারা আড়ালে রাখতে চায় আমাদের তারাই বেশি ক্ষতি করে সবচেয়ে।
বিশ্বাস করুন
ভবদীয়
সিসিলয়া ইউলিয়ামস

আমার নাম সিসিলিয়া উইলিয়ামস। ১৯… সালে আমাকে মিসেস ক্রেল তার সৎ বোন অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের গর্ভনেস নিযুক্ত করেন। …আমার বয়স তখন ৪৮ বছর।

অ্যাল্ডারবেরিতে আমি কাজে যোগ দিলাম, দক্ষিণ ডিভনে একটা সুন্দর জমিদারীতে, মিঃ ক্রেলের পূর্বপুরুষদের সম্পত্তি ছিলো এটা। জানতাম যে একজন নামকরা শিল্পী ছিলেন মিঃ ক্রেল। কিন্তু তাকে আমি দেখিনি অ্যাল্ডারবেরিতে ওঠার আগে পর্যন্ত।

মিঃ আর মিসেস ক্রেল ঐ বাড়িতেই থাকতেন, অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেন (তার বয়স ছিলো তখন মাত্র ১৩ বছর) আর থাকতো তিনটে চাকর। এরা সবাই ওখানে চাকরী করছিলো দীর্ঘদিন ধরে।

আমরা ছাত্রীটিকে দেখলাম বেশ ভালো আর সম্ভাবনাময়। তার অনেক গুণ ছিলো, আনন্দ পেতাম ওকে পড়িয়ে। তবে স্বভাব ছিলো একটু বন্য আর উচ্ছল, সব মিলিয়ে আমার ভালোই লাগতো ওকে। তাদের মনের মতো করে প্রাণশক্তি থাকলে মানুষ করা যায়।

অ্যাঞ্জেলাকে মোটামুটিভাবে নিয়ম শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলা যেভাবে বুঝতে পারলাম সেটা। ও একটু দুষ্টু হয়ে উঠছিলো মিসেস ক্রেলের প্রশ্রয়ে। তবে আমার মতে মিঃ ক্রেলের প্রভাবটাও ঠিক ছিলো না। তিনি খুব প্রশ্রয় দিতেন মাঝে মাঝে, আবার রুক্ষ ব্যবহার কখনও করতেন, শিল্পী মানুষ তো, মেজাজ তো থাকবেই।

তবে আত্মসংযমের ক্ষমতাকে শিল্পী হলেই যে বিসর্জন দিতে হবে এর কোনো যুক্তি জানি না আমি। আমার ভালো লাগতো না মিঃ ক্রেলের ছবিও। ভালো নয় আঁকা, বড্ড চড়া রঙের ব্যবহারও।

আমার ঘনিষ্ঠতা খুব গাঢ় হয়ে উঠেছিলো মিসেস ক্রেলের সাথে খুবই তাড়াতাড়ি। তার শান্ত আচরণ বিপদ বা ঝাটের মুখে আমার খুব ভালো লাগতো। মিঃ ক্রেল স্বামী হিসেবে খুব বিশ্বস্ত ছিলো না, এবং মনে হয় তার জন্যে খুব কষ্ট পেতেন মিসেস ক্রেল। আরো একটু শক্ত মনের মহিলা হলে স্বামীকে ছেড়ে কবে চলে যেতেন। সে ধরনের কিছু মিসেস ক্রেল চিন্তা করতেন না। স্বামীকে মেনে নিয়েছিলো দোষ ত্রুটি সমেত। তবে ভীরুর মতো নয়–বেশ বকাঝকা, চেঁচামেচি মাঝে মাঝে করতেন। এবং মেজাজের সঙ্গেই।

স্বামী-স্ত্রী কুকুর-বেড়ালের মতো ঝগড়া করতেন বিচারের সময় তা বলা হয়েছিলো। আমি বলবো না অতোটা। কখনও মিসেস ক্রেলের মর্যাদা বোধ অতো নীচে তাঁকে নামতে দেয়নি, ঝগড়া হতো। এবং সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয় ঐ পরিস্থিতিতে আমার।

মিসেস ক্রেলদের দু বছর কাটার পর আবির্ভাব হলো ওখানে এলসা গ্ৰীয়ারের। ১৯… সালের গ্রীষ্মকালে উনি অ্যাল্ডারবেরিতে এসেছিলেন। তার আগে কখনো মিসেস ক্রেল দেখেননি এলসা গ্ৰীয়ারকে। এলসা মিঃ ক্রেলের বান্ধবী ছিলেন, নিজের ছবি আঁকাতে এসেছিলেন।

আর সঙ্গে সঙ্গে মিঃ ক্রেল মেয়েটির প্রতি আকর্ষণ অনুভব করছেন তা আমাদের চোখে পড়লেন আর তাকে বাধা দেবার কোনো চেষ্টা মেয়েটিও করছেন না। বরং ব্যবহার করতেন বড় বেশি নির্লজ্জের মতো এবং অভদ্র আচরণ করতেন মিসেস ক্রেলের প্রতি আর ঢলাঢলি করতেন খোলাখুলিভাবে মিঃ অমিয়াস ক্রেলের সঙ্গে।

আমাকে মুখ ফুটে মিসেস ক্রেল কিছু না বললেও আমি সব বুঝতে পারতাম। এলসা গ্ৰীয়ারকে নিয়ে ওদিকে ছবি আঁকতে বসলেও ছবির কাজ এগোতে দেখতাম না খুব একটা। বোধ হয় বেশির ভাগ সময়ই ওঁরা কাটাতেন গল্প করেই।

অবশ্য মিসেস ক্রেল স্বামী আর এলসা মেয়েটির সম্বৰ্কটাকে মনে করতেন বন্ধুত্বই। তবে ওকে অপছন্দ করতেন এলসার নির্বুদ্ধিতা। এবং মনে হয় আমার ঠিক ওঁর অনুমানটাই, বোধ হয় খুব ভালো ছিলো না এলসা গ্ৰীয়ারের শিক্ষা-দীক্ষা কখনো বই পড়তে বা আধুনিক সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করতে দেখিনি। সহ্য করতে পারতেন না কোনো উঁচুদরের আলোচনাও।

সব সময়ে মেয়েটি নিজের রূপ, পোষাক আর পুরুষদের নিয়ে ভালোবাসতেন ব্যস্ত থাকতে।

বোধ হয় অ্যাঞ্জেলাও বুঝতে পারেনি যে খুব অশান্তিতে দিন কাটাচ্ছেন ওর দিদি। অবশ্য সে সব বোঝার ক্ষমতাও তার ছিলো না। গেছো মেয়ে ছিলো একটু, গাছে চড়া, সাইকেল চালানো বেশি পছন্দ করতো। তবে খুব বই পড়তে এবং রুচিটাও সে ব্যাপারে খুব সুন্দর।

বোনের সামনে মিসেস ক্রেলও কখনো দুঃখে বা অশান্তির কথা প্রকাশ করতেন না।

লন্ডনে ফিরে গেলে মিস এলসা গ্ৰীয়ার সত্যি কথা বলতে কি সবাই খুশি হয়েছিলাম আমরা। অন্যদের অসুবিধেয় ফেলে এই ধরনের মেয়েরা এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না।

মিঃ ক্রেলও অল্পদিন পরে গেলেন এবং উনি মেয়েটির সন্ধানেই গেছেন আমি জানতাম। আমার যত দুঃখ মিসেস ক্রেলের জন্যে হয়েছিলো, ঠিক ততোটাই ওঁর স্বামীর ওপর রাগ হয়েছিলো। সুন্দর, ভদ্র, বুদ্ধিমতী স্ত্রী থাকতে মিঃ ক্রেলের ঐ রকম খারাপ ব্যবহার করার কোনো অধিকার ছিলো না।

আশা করছিলাম আমি আর মিসেস ক্রেল দুজনেই তাড়াতাড়ি শেষ হোক ব্যাপারটা। আলোচনা আমাদের মধ্যে না হলেও দুজনের মনের কথা দুজনে বুঝতাম।

কয়েক সপ্তাহ পরে দুর্ভাগ্যবশতঃ ফিরে এলে দুজনেই এবং আবার শুরু হলে ছবি আঁকার কাজ।

মিঃ ক্রেল এবারে ছবিটা শেষ করার জন্যে পাগলের মতো উঠে পড়ে লাগলেন। তার আকর্ষণ যেন মেয়েটার তুলনায় ছবির প্রতিই বেশি দেখা যাচ্ছিল, তবে স্বাভাবিক ঘটনা যে এটা নয় তা বুঝতে পারছিলাম। ওঁকে মুঠোয় পুরে ফেলেছে মেয়েটা এবং উনি ছাড়বার পাত্রী নন। যেন মিঃ ক্রেল ওঁর হাতের ময়লা শুধু।

ঘটনা চরমে উঠলো উনি মারা যাবার আগে অর্থাৎ ১৭ই সেপ্টেম্বর।

মিস এলসার উদ্ধত ব্যবহার শেষের কদিন একেবারে অসহ্য হয়ে উঠেছিলো। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিজের ব্যাপারে এসে যাওয়াতে নিজেকে সব ব্যাপারেই বেশ জাহির করতে উনি শুরু করেছিলেন। খাঁটি আভিজাত্যের মতো ব্যবহার ছিলো মিসেস ক্রেলের। শান্ত নম্র বরফের মতো, তবে নিজের মনের ভাবটা এলসা সম্বন্ধে যেমন করে তোক বুঝিয়ে দিতে ছাড়তেন না স্পষ্ট ভাবে।

ঐ ১৭ই সেপ্টেম্বর তারিখে, আমরা সবাই লাঞ্চের পর ড্রইংরুমে বসে আছি, তখন মিস গ্ৰীয়ার হঠাৎ বলে উঠলেন অ্যাল্ডারবেরিতে যখন উনি পাকাপাকি ভাবে শুরু করবেন থাকতে তখন কী ভাবে সাজাবেন ঘরটাকে।

এবং এ কথা স্বাভাবিক ভাবেই সহ্য করে নেবার মতো মহিলা নন মিসেস ক্রেল। চ্যালেঞ্জ করতেই উনি নির্লজ্জের মতো মিস এলসা আমাদের সকলের সামনে বললেন যে উনি শিগগীরই মিঃ ক্রেলকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন। স্ত্রীর মুখের ওপর বলা হচ্ছে অন্য একজন তার স্বামীকে বিয়ে করবে। আমি খুব চটে ছিলাম মিঃ ক্রেলের ওপর। আর একজন মহিলাকে দিয়ে নিজেই ড্রইংরুমে বসে নিজের স্ত্রীকে অপমান কেন উনি করাচ্ছেন? পালিয়ে গিয়ে চুপচাপ বিয়ে করলেই পারতেন।

যাই ভেবে থাকুন না কেন মনে মুখে মিসেস ক্রেল ভদ্রতা বজায় রেখেছিলেন। সেই সময়ে ঠিক ওখানে ওঁর স্বামী এলেন এবং মিসেস ক্রেল সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করে বসলেন এলসার কথা ঠিক কিনা।

মিঃ ক্রেল স্বাভাবিক ভাবেই জোর করে এই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করার জন্যে চটে গেলেন। এবং পুরুষেরা বড় অহংকারী হয়ে ওঠে অসুবিধের মধ্যে পড়লে।

সিংহের মতো মানুষটিকে তখন অসহায় লাগছিল ভেড়ার মতো। উনি বিড়বিড় করে জেরার মুখে স্বীকার করলেন কথাটি এলসার ঠিক। তবে কথাটি তাকে এখুনি জানানোর দরকার ছিলো না।

মিসেস ক্রেল নিদারুণ অবজ্ঞা দেখিয়ে ঘর থেকে মাথা উঁচু করে বেরিয়ে গেলেন। একে সুন্দরী মহিলা, তায় অহংকার, ওকে সব মিলিয়ে সম্রাজ্ঞীর মতো লাগছিলো।

 এভাবে এই মহৎ প্রাণ মহিলাকে অসম্মানিত করার জন্যে অ্যামিয়াস ক্রেলের শাস্তি হোক আমি মনে প্রাণে এটা চাইছিলাম।

সেই প্রথম মিসেস ক্রেলকে আমার মনের কথা বলতে যাচ্ছিলাম। আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনি বললেন, স্বাভাবিক ভাবেই যথাসম্ভব আমাদের থাকা কর্তব্য। মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি আমরা সকলে যাচ্ছি চায়ের নিমন্ত্রণ রাখতে।

আমি বলেছিলাম তখন, আমার কাছে মিসেস ক্রেল, আপনি এক অসাধারণ মহিলা।

উনি বলেছিলেন, জানো না তুমি…।

চলে যেতে যেতে আমাকে ফিরে এসে চুমু খেয়ে বললেন, আমার জীবনের বড় সান্ত্বনা তুমি।

তারপর নিজের ঘরে গিয়ে উনি কেঁদেছিলেন বোধ হয়। ওঁকে একেবারে দেখলাম চায়ের নিমন্ত্রণ রাখার জন্যে, সবাই যখন বেরোচ্ছি তখন। উনি বিরাট ফাঁদওলা একটা টুপি পরেছিলেন, তাই ছায়া পড়েছিলো চোখেমুখে। ওই টুপিটা তিনি সচরাচর পরতেন না।

নিজের অস্বাচ্ছন্দ্য ভাবটা মিঃ ক্রেল কাটবার জন্যে চেষ্টা করেছিলেন সব জিনিস হালকা করার। মনে হচ্ছিল মিস এলসা গ্ৰীয়ারকে বিড়াল যেন নাগালের মধ্যে পেয়ে গেছে দুধের বাটি।

সন্ধ্যা ছ’টার সময় ফিরে এলো। রাতে খাবার টেবিলে মিসেস ক্রেলকে দেখলাম। খুব শান্ত, গম্ভীর। খেয়ে তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেলেন।

অ্যামিয়াস ক্রে আর অ্যাঞ্জেলা ঝগড়া করে কাটিয়ে দিলেন সন্ধ্যে বেলাটা। জটিলতা দেখা গেলো সেই স্কুলে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে। হয়ে গেছে সব কেনাকাটা, এখন বেঁকে বসেছে অ্যাঞ্জেলা, যাবে না। মনে হয় ও খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলো দিদির ব্যাপারটা নিয়ে। শেষে মিঃ ক্রেলকে লক্ষ্য করে একটা পেপার ওয়েট ছুঁড়ে বেরিয়ে গেলো রাগে কাঁপতে কাঁপতে অ্যাঞ্জেলা।

ওকে গিয়ে ধমকাই আমি বাচ্চা মেয়ের মতো ব্যবহার করার জন্যে, অথচ বাগ মানানো যাচ্ছে না ওকে দেখে আমি কিছু না বলে ফিরে এলাম।

ঘরে যাবার ইচ্ছেটা মিসেস ক্রেলের দমন করলাম। মাঝে মাঝে মনের কথা বলার জন্যেও মানুষের তে দরকার হয়। মিঃ ক্রেলের সঙ্গে দেখা নিজের ঘরে যাবার সময়। উনি জানালেন শুভরাত্রি, আমি উত্তর দিলাম না।

ভারী সুন্দর ছিল পরদিন সকালটা, সবারই মন এমনদিনে প্রসন্নতায় ভরা থাকে। অ্যাঞ্জেলার ঘরে সকালবেলাতেই গেলাম, দেখি মেঝেতে পড়ে আছে ছেঁড়া স্কার্টটা, ও নেই। ঠিক করে রাখলাম ওকে দিয়ে সেলাই করাতে হবে।

নীচে নেমে শুনলাম ও রুটি আর জেলী রান্নাঘর থেকেই খেয়ে চলে গেছে। খুঁজতে বেরোলাম ওকে আমি। এসব কথা লেখার কারণ এই যে কেন সকালে সেদিন থাকতে পারিনি মিসেস ক্রেলের সঙ্গে।

স্নানের পোষাক নেই অ্যাঞ্জেলার তা দেখে সমুদ্রের তীরে আমি গেলাম। জলে বা ডাঙ্গায় পাথরের ওপর ওর চিহ্ন কোথাও দেখতে পেলাম না, ভাবলাম মিঃ মেরিডিথ ব্লেকের কাছে তাহলে গেছে। বেশ বন্ধুত্ব ছিলো ওঁদের দুজনে। ওকে পেলাম না ওখানে, ফিরে এসে দেখি মিসেস ক্রেল বসে আছেন চত্বরে, ফিলিপ আর মেরিডিথ ব্লেকও।

হাওয়া চত্বরটা ছিলো না বলে গরম লাগছিলো ভীষণ, বরফ দেওয়া বিয়ার খাওয়ার কথা মিসেস ক্রেল বললেন।

ভিক্টোরিয়ার আমলে তৈরি ঐ বাড়িতে একটা কাঁচঘরের বাগান ছিলো। ওটাকে মিসেস ক্রেল মদের বার করে তুলেছিলেন। ফ্রিজে বিয়ার আর জিঞ্জার বিয়ার থাকতো, তাকে থাকতো নানারকমের মদ।

ঐ ঘরে গেলাম মিসেস ক্রেলের সাথে। একটা বিয়ারের বোতল অ্যাঞ্জেলা ফ্রিজ থেকে বের করছিলো। মিসেস ক্রেল ছিলেন আমার আগে, বললেন, অ্যামিয়াসকে এক বোতল বিয়ার দিতে হবে।

আমার মনে তখন সন্দেহ হয়েছিলো কিনা বলা কঠিন। স্বাভাবিক ভাবেই ওঁর গলার স্বর শান্ত ছিলো। আমি পড়লাম অ্যাঞ্জেলাকে নিয়ে। ও অপরাধী-অপরাধী মন নিয়ে ফ্রিজের পাশে দাঁড়িয়েছিলো।

আমি যথারীতি বকতে শুরু করলাম। কিন্তু কি আশ্চর্য ও রইলো শান্ত হয়ে। ও যে স্নান করতে যায়নি সেকথা বলতে ও শুধু হাসলো। বোধহয় সমুদ্রতীরে সোয়েটারটা ফেলে এসেছে।

আমি এই কারণে এতো কথা বলছি যে আমি কথা বলতে ব্যস্ত ছিলাম বলেই কামান বাগানে মিসেস ক্রেলকে যেতে হয়েছিলো।

তারপর কি কি হয়েছিলো সেদিন সকালে আমার মনে নেই একটুও। অ্যাঞ্জেলা কথা না বাড়িয়ে সেলাই করে নিলো নিজের স্কার্টটা।

মিসেস ক্রেল লাঞ্চ খাওয়ার পর বললেন কামান বাগানে যাচ্ছেন উনি। তলায় নামলাম আমিও, অ্যাঞ্জেলার সোয়েটারটা সমুদ্রের পাড় থেকে আনতে হবে। কামান বাগানে ঢুকলেন উনি, পাশের পথ দিয়ে আমি এগোচ্ছি তীরের দিকে এমন সময় ফিরে এলাম মিসেস ক্রেলের চিৎকারে, তাড়াতাড়ি টেলিফোন করতে বললেন ডাক্তার ডাকার জন্যে। মেরিডিথ ব্লেকের সঙ্গে মাঝপথেই দেখা হলো, টেলিফোন করতে বলে ওঁকে আবার আমি ফিরে এলাম মিসেস ক্রেলের কাছে।

এই কথাই আমি বলেছিলাম করোনারের বিচারের সময় বা আদালতে, তবে যা এবার লিখতে যাচ্ছি তা কাউকে কখনও বলিনি। কিন্তু ঠিক এটাও বিচারের সময় বা আদালতে, তবে যা এবার লিখতে হয়েছিলো তার একটাও মিথ্যে উত্তর আমি দিইনি। তবে সত্যি কথা কিছু বলা হয়নি। এবং কোনো অনুশোচনাও নেই তার জন্যে আমার। এটাও জানি আমি লোকে আমার নিন্দে করতে পারে এই কথাগুলো বলার জন্যে, কিন্তু এ ব্যাপারটা নিয়ে এতোকাল পরে খুব যে কেউ মাথা ঘামাবে তা মনে হয় না আমার-বিশেষ করে এই কারণে যে আমার সাক্ষ্য ছাড়াই ক্যারোলিন ক্রেল সাজা পেয়েছিলেন।

ঘটনাটা এবার বলি–তাড়াতাড়ি কামান বাগানে ফিরে এলাম মিঃ মেরিডিথ ব্লেককে বলে। কোনো শব্দ হয়নি কারণ বালিতে হাঁটার জুতো পায়ে ছিলো বলে। আমি দেখলাম মিসেস ক্রেল নিজের রুমাল দিয়ে বিয়ারের বোতলের গাটা মুছলেন তাড়াতাড়ি, তারপর বোতলের গায়ে স্বামীর হাতটা নিয়ে আঙুলের ছাপ লাগিয়ে দিলেন। উনি সতর্ক ভাবে এটা করার সময় কান খাড়া রেখেছিলেন আর তাকাচ্ছিলেন চারপাশে, ভয়ের ভাবটা ফুটে উঠেছিলো মুখে।

তখনই বুঝে ফেলেছিলাম আমি তার স্বামীকে মিসেস ক্রেল বিষ দিয়েছেন। তাকে আমি এর জন্য দোষ দেবো না। কেননা মিঃ ক্রেল-সহ্য শক্তির চরম সীমায় মিসেস ক্রেলকে ঠেলে দিয়েছিলেন।

ক্যারোলিন ক্রেলের মেয়ের উচিত নয় নিজের জীবন মিথ্যের ওপর গড়ে তোলা। তার যত কষ্টই হোক না কেন সত্যটা জেনে, এটা উচিত জানা।

মেয়েটিকে আমার তরফ থেকে বলবেন, ও যেন মার বিচার না করতে বসে। সহ্য শক্তির ওপর প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়েছিলো একজন স্নেহশীলা মহিলার। মেয়ে যেন সে কথা বুঝে ক্ষমা করে মাকে।

সমাপ্তি সিসিলিয়া উইলিয়ামসের বিবৃতি :

.

অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের বিবৃতি

প্রিয় মিঃ পোয়ারো,
সেই দুঃসহ যন্ত্রণার ষোল বছর আগেকার দিনগুলোর যতোটুকু মনে পড়ছে তাই পাঠাচ্ছি। লিখে আপনাকে, পালন করেছি প্রতিশ্রুতি। আমি লেখাটা শুরু করার পর বুঝতে পারলাম কতো সামান্য অংশ মনে আছে আমার।

আমার স্মৃতিতে সেই গ্রীষ্মকালের স্মৃতি খুবই অস্পষ্ট হয়ে আছে–সেই বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোও, বিনা মেঘে বজ্রপাত যেন জামাইবাবুর মৃত্যু। তখন কি ঘটছে কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।

এবং ভাবছিলাম মনে রাখতে না পারাটা যুক্তিসঙ্গত কি না। আমারই মতো অন্ধ আর কার্লা হয় কি বছর পনেরোর কিশোরীরা, হয়তো হয়, চঞ্চলা মেয়ের মত ঐ বয়েসে আমি শুধু লক্ষ্য করতাম অন্যের মেজাজগুলোই, কিন্তু বোঝবার চেষ্টা করতাম না তার পেছনের কারণগুলো।

তাছাড়া সেই সময় ঠিক শব্দের মাদকতা আমি আবিষ্কার করতে শুরু করেছি। যা পড়তাম, কবিতা শেক্সপীয়ার…সবকিছু ঘুরপাক খেতো মাথার মধ্যে। কতদিন বাগানে মনে আছে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আবৃত্তি করেছি আপন মনে ঘন সবুজের দোলায় দোলায়…।

আর একটা নেশা এর সঙ্গে ধরেছিলো, সাঁতার কাটা, ফল খাওয়া গাছে উঠে। ঘোড়াদের ধাওয়ানো আর পেছনে লাগা আস্তাবলের বাচ্চা চাকরদের।

আমার জীবনের সবকিছু ছিলো দিদি আর জামাইবাবু। অথচ আমি একেবারেই ওদের কথা চিন্তা করতাম না, গুরুত্ব দিইনি এলসা গ্ৰীয়ারের আবির্ভাবটাকেও। এবং ও বোকা মনে হতো, আর তেমন কিছু আহামরি নয় দেখতেও। এক ধনী মেয়ের ছবি আঁকছে জামাইবাবু, ব্যাস আমি ক্ষান্ত ছিলাম এইটুকুই জেনে।

লাঞ্চ খাবার পর একদিন বসে আছি চত্বরে, এমনি সময় ওদের ঝঞ্ঝাটের ব্যাপারটা প্রথম কানে এলো আমার, শুনতে পেলাম এলসা বলছে সে বিয়ে করবে অ্যামিয়াসকে। আমার খুব হাস্যকর মনে হয়েছিলো ব্যাপারটা। হ্যান্ডসে মনে আছে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে জামাইবাবুকে এ নিয়ে আমি প্রশ্ন করেছিলাম।

কেন বলছে এলসা তোমাকে ও বিয়ে করবে? ও তো পারে না তা করতে। দুটো বউ তো লোকের থাকতে পারে না। তোমাকে জেলে দিয়ে দেবে।

ক্ষেপে লাল জামাইবাবু, কি করে এ সব কথা তোমার কানে যায়? লাইব্রেরীর জানলা দিয়ে বলেছিলাম আরো সেই শুনে ক্ষেপে গিয়ে আমাকে স্কুলে পাঠাবার কথা সে বললো। কাজ নেই কোনো কেবল আড়িপাতা পরের কথায়। জামাইবাবু বলেছিলো।

আমি খুব অপমানবোধ করেছিলাম জামাইবাবুর কথায় তবুও আমি রাগের চোটে বলেছিলাম, এলসা ওই ধরনের অসভ্য কথা, বলবে কেন?

জামাইবাবু বলেছিলো–ওটা ঠাট্টা, আমি মেনে নিয়েছিলাম জামাইবাবুর কথাটা, তবে বিশ্বাস করিনি পুরোপুরি।

এলসাকে ফেরার পথে ধরলাম, জামাইবাবুকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমাকে এলসা বিয়ে করবে বলছে, তার মানে কি, ও তাতে বললো ওটা ঠাট্টা করে বলেছো তুমি তাই কি?

এলসা এতেই জব্দ হবে ভেবেছিলাম। কিন্তু এলসা শুধু হাসলো উত্তর না দিয়ে, ভালো লাগেনি আমার হাসিটা, খাবার আগে দিদির ঘরে সেই রাতে, প্রশ্ন করেছিলাম সোজাসুজি জামাইবাবুর পক্ষে কি বিয়ে করা সম্ভব এলসাকে।

আজো আমার দিদির উত্তরটা কানে বাজে, না মরা পর্যন্ত আমি, তোর জামাইবাবু বিয়ে করতে পারবে না এলসাকে।

আমি একেবারে দিদির কথাতে নিশ্চিত হয়ে যাই। কারণ বহু দেরি মৃত্যু আসতে। তবে রাগ আমার যায়নি জামাইবাবুর ওপর–ওই স্কুলে পাঠাবার কথাটার জন্যে। খাবার সময়েও সেদিন রাতে এক পশলা জামাইবাবুর সঙ্গে ঝগড়া হয়ে গেলো। সারারাত সেদিন কেঁদেছিলাম।

সেদিন সন্ধ্যেবেলার মেরিডিথ ব্লেকের বাড়ি কথা তেমন ভালোভাবে আমার মনে নেই। তবে মেরিডিথ যখন সক্রেটিশের মৃত্যু বর্ণনা পড়েছিলেন, ভীষণ ভালো লেগেছিলো আমার।

আমার তার পরের দিনের কথা আরও মনে নেই, যদিও অনেক ভেবেছি ঐ নিয়ে, এইটুকু শুধু মনে পড়ে স্নানটান করার পর আমাকে কি একটা সেলাই দেওয়া হয়েছিলো করতে।

মেরিডিথ চত্বর থেকে ফ্যাকাশে মুখে ওপরে দৌড়ে আসার আগে পর্যন্ত অস্পষ্ট আর ধোয়াটে ছিলো সব কিছুই। মনে আছে টেবিল থেকে একটা কফিপেয়ালা পড়ে ভেঙে যায়, এলসা ফেলেছিলো মনে আছে এটাও। ভয়ংকর মুখ করে নীচে ছুটে নেমে যায় সে।

মনে মনে আমি বলেছিলাম, মরে গেছে জামাইবাবু! সত্যি কথাটা বলে আমার মনে হয়নি। কেউ জামাইবাবুর কাছে আমাকে যেতেও দেয়নি। পুলিশও এসেছিলো।

পরে আমাকে দিদির ঘরে নিয়ে যান মিস উইলিয়ামস। খুব অসুস্থ লাগছিলো দিদিকে। আদর করে আমাকে ওই বাড়ি ছেড়ে লোড্রী ট্রেসিলিনার বাড়ি চলে যেতে বললো, ওখানে কাল ও থাকবে।

আমি দিদিকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম আমি যাবো না ওকে ছেড়ে। অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে শেষ পর্যন্ত ওরা রাজী করালো আমাকে চলে যেতে।

আমাকে নিয়ে তারপর পুলিশের কাছে যাওয়া হয়েছিলো। একজন জামাইবাবু সম্বন্ধে খুব মিষ্টি করে অনেক প্রশ্ন করেছিলেন? তখন ভেবেছিলাম কোনো মানে হয় না এগুলোর। কিন্তু এখন বুঝি। ওঁরা আমাকে এসব শোনার পর ছেড়ে দিলেন লেডী ট্রেসিলিনার ওখানে যাবার জন্যে।

আমাদের খুব ভালো ভাবেই লেডী ট্রেসিলিনা নিলেন। পরে দিদিকে গ্রেপ্তার করেছে শুনলাম পুলিশ। আমি অসুস্থ হয়ে যাই কথাটা শুনে।

যে সব কিছু লিখতে আমি পারিনি তাতো দেখতেই পাচ্ছেন আপনি, ভালোভাবে অনেক ভেবেছি কিছুই মনে পড়ছে না। কোনো কিছুই তো নয়ই অপরাধ সংক্রান্ত, এলসার পাগলামী, দুঃশ্চিন্তায় মেরিডিথের মুখ ফ্যাকাশে, শোকার্ত ফিলিপ এবং ক্রুদ্ধ–এসব কিছুকেই তখন স্বাভাবিক মনে হয়েছিলো। তবে অভিনয় যে কেউ করে যাচ্ছে এটা মনে হচ্ছিল আমার। একটা কথাই আমি জানতামও আজ দিদি করেনি।

আমি এ ব্যাপারে ভুল করিনি, করছি না এখনও। অবশ্য আমি যতো দিদির চরিত্রকে ভালোভাবে চিনি তারই ওপর এটা বলছি নির্ভর করে, কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ এর পেছনে দিতে পারবো না।

সমাপ্ত অ্যাঞ্জেলা ওয়ারেনের বিবৃতির :–