২. এলিজাবেথের নোটের কাগজে

.

এলিজাবেথের নোটের কাগজে কালি ছিটিয়ে অন্তর্ঘাতমূলক কাজের কথা শুনে মিঃ চন্দ্রলাল উত্তেজিত হয়ে উঠলো। অত্যাচার নিপীড়ন। ইচ্ছাকৃতভাবে নেটিভদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। কালো চামড়ার মানুষের প্রতি এক অন্যায় নিপীড়ন। এর থেকে বড় উদাহরণ আজ হতে পারে না।

মিঃ চন্দ্রলাল! তীক্ষ্ণ স্বরে প্রতিবাদ করল মিসেস হার্বার্ড। এ ধরনের কথা তুমি বলতে পার না। কেউ জানে না, এ কাজ কে করেছে। আর কেনই বা করা হয়েছে। 

কিন্তু মিসেস হার্বার্ড, আমি ভেবেছিলাম, সিলিয়া নিজে এসে আপনার কাছে সব স্বীকার করেছে, বললো জিন টমনিকসন। এটা তার চমৎকার মনোভাবের পরিচয়। তার প্রতি আমাদের সবার দয়া হওয়া উচিত।

জিন মনে হচ্ছে তুমি যেন জেহাদ ঘোষণা করছো। রাগত ভাবে ভ্যালেরি জনহাউস বললো।

আমার মনে হয়, কথাটা নির্দয়ের মতো হয়ে গেল।

এমন একটা চরম বিদ্রোহের শর্ত! কঁপা গলায় বললো নিজেল! এতো সব বলার কারণ আমি বুঝতে পারছি না। অক্সফোর্ড গ্রুপ এটা ব্যবহার করে আর

ওহো, ঈশ্বরের দোহাই, আমরা অক্সফোর্ড গ্রুপ কি এখন প্রাতঃরাশ সারতে পারি?

মা, এসব কি শুনছি? আপনি কি বলেন, সত্যি কি সিলিয়া এসব জিনিষ চুরি করতে পারে? এজন্যই কি সে প্রাতঃরাশে যোগ দেয়নি?

মাঝখান থেকে মিঃ অ্যাকিমবো বলে উঠলো, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

এ ব্যাপারে কেউ তাকে কিছু জানাল না। সবাই নিজেদের কথায় চিন্তিত।

সত্যি কথা বলতে কি জানো, আমি একেবারেই অবাক হইনি, ধীরে ধীরে বললো সেলী। সব সময়ে আমার এরকমই একটা ধারণা ছিল…

তার মানে তুমি বলতে চাইছ যে, আমার নোটে সিলিয়াই কালি ছিটিয়ে দিয়েছিল? অবিশ্বাস ভরে তার দিকে তাকাল এলিজাবেথ জনস্টন।

না, সিলিয়া কালি ছেটায়নি, বললেন মিসেস হার্বার্ড। আর আমার ইচ্ছে তোমরা এ আলোচনা বন্ধ করো। পরে আমি তোমাদের সব কিছু বলব, কিন্তু…।

কিন্তু গতকাল জিন আপনার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। ভ্যালেরি বললো।

আসলে আমি ঠিক শুনবো বলে শুনিনি, ঘটনাচক্রে আমি সেখান দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন।

এখন এসো বেশ, খোলাখুলি ভাবেই তাহলে বলি, নিজেল বললো, আমি আমার সবুজ কালির বোতল থেকে কালি ছিটিয়েছি।

না না ও কালি ছিটায়নি। ও কেবল ভান করেছে, ওঃ নিজেল, তুমি কি করে এত বোকা হলে?

আমি মহৎ হয়ে তোমাকে আড়াল করতে চাইছি প্যাট গতকাল সকালে কে আমার কালি ধার নিয়েছিল? তুমিই নিয়েছিলে?

প্লিজ, তোমার কথা আমি বুঝতে পারছি না, বললো অ্যাকিমবো।

তুমি বুঝতে চাও না, সেলী তাকে কটাক্ষ করল। আমি তোমার অবস্থায় পড়লে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম। চোরের মায়ের বড় গলা করে চিৎকার করতাম না।

উঠে দাঁড়াল চন্দ্রলাল। তুমি জিজ্ঞাসা করেছ, মাও কি? তুমি আরো জিজ্ঞাসা করেছ সুয়েজ চ্যানেলের ব্যাপারে ইজিপ্ট কেন ক্রুদ্ধ।

ওহো ওসব বাজে কথা ছাড়, দারুণ উত্তেজিত হয়ে উঠল নিজেল।

প্রথম অক্সফোর্ড গ্রুপ, আর এখন রাজনীতির আলোচনা চলছে। তাও প্রাতঃরাশের সময়। আমি চললাম।

বাইরে ঠান্ডা হাওয়া বইছে, তোমার কোটটা সঙ্গে নিও। তার দিকে প্যাট্রিসিয়া ছুটে গেল।

অনেকক্ষণ কিছু বলার চেষ্টা করছিল কলিন ম্যাকনার। এবার সে রেগে বলে উঠলো–তোমরা সবাই একটু কথা কম বল, আমার কথা শোনো। মনঃস্তত্বের সঙ্গে আমাদের কি কারোর পরিচয় নেই? আমি বলছি এই মেয়েটাকে দোষ দেওয়া যায় না। অত্যন্ত মানসিক অশান্তিতে ভুগছে সে। আন্তরিক সহানুভূতি, যত্নের সঙ্গে চিকিৎসার প্রয়োজন তার। না হলে তার জীবনে অস্থিরতা থেকেই যাবে। আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি–তার এখনি সর্বতোভাবে যত্ন নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

কিন্তু হাজার হোক, স্পষ্ট ভাষায় জিন বলে, তার প্রতি সদয় হওয়ার পক্ষে আমিও আছি–এ ধরনের ঘটনার জন্য আমাদের অবশ্যই ক্ষমা করে দিতে হবে! মানে চুরির জন্য আর কি!

চুরি? বিরক্ত হল কলিন, ওঃ কতবার তোমাদের বলব, এসব আদৌ চুরি নয়। তুমি আমাকে মানে তোমরা সবাই আমাকে অসুস্থ করে তুলছ। কারো জিনিষ সে চুরি করেনি।

ওহো, এসো জিন। লেন বেটসন বললো, ওসব বাজে কথায় আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। তোমারও।

তারা একসঙ্গে বেরিয়ে গেল। সিলিয়াকে বলো সে যেন এসব ভুলে যায়। বেটসন বলল যাওয়ার সময়।

আনুষ্ঠানিক ভাবে আমি প্রতিবাদ করতে চাই, কুঁসে উঠল মিঃ চন্দ্রলাল। আমার চোখের জন্য বোরিক পাউডারের খুব প্রয়োজন। সেটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে, নেই।

তুমি খুব দেরি করে ফেলেছো মিঃ চন্দ্রলাল, মিসে হার্বার্ড বললো।

জেনেভিভ ফরাসী ভাষায় কি বললো বোঝা গেল না।

জেনেভিভ, তোমাকে অবশ্যই ইংরেজিতে কথা বলতে হবে–তুমি যখনি উত্তেজিত হবে, ইংরেজিতে তোমার উত্তেজনা প্রকাশ করতে না পারলে কখনো ইংরেজি শিখতে পারবে না। এই সপ্তাহে রোববার তুমি নৈশভোজ খেয়েছিল আমার সঙ্গে। কিন্তু আজও তুমি দামটা মিটিয়ে দাওনি।

আহ! আমার পার্সটা সঙ্গে নেই। আজ রাতে মিটিয়ে দেবো।

 প্লিজ, অ্যাকিমবো বলে উঠলো, আমি বুঝতে পারছি না।

আমার সঙ্গে এসো অ্যাকিমবো, সেলী বলল, ইনস্টিটিউট যাওয়ার পথে আমি তোমাকে সব বুঝিয়ে দেব।

ওহে প্রিয়, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো মিসেস হার্বার্ড। কেন যে এ চাকরিটা আমি নিতে গেলাম।

একমাত্র ভ্যালেরিই এখন ডাইনিংরুমে হাজির ছিল। বন্ধুসুলভ ভঙ্গিমায় দাঁত বার করে হাসলো সে। বললো, চিন্তা করবেন না মা, ভালো জিনিষ সব সময়েই বেরিয়ে আসে। এখন সবাই লম্ফ ঝম্ফ করার দিকে।

আমাকে বলতে হচ্ছে, আমি খুব অবাক।

হা। তুমি নও কি?

 অন্যমনস্ক ভাবে ভ্যালেরি বললো, সত্যি আমার ভাবা উচিত ছিল।

তুমি কি প্রথম থেকেই ভেবেছিলে?

ভালো কথা, একটা দুটো ব্যাপারে আমার খটকা লেগেছে। সে যাহোক সিলিয়া কলিনকে চেয়েছিল, পেয়েছেও।

হা। আবার আমি ভাবতেও পারছি না যে, এ ভুল, সম্পূর্ণ ভুল।

বন্দুক সমেত তোমার মনের মানুষকে তুমি পেতে পার না। হাসল ভ্যালেরি। বলল, এই প্রতারণা কি ক্লিপ্টোম্যানিয়ার পর্যায় পড়ে থাকে? কোনো চিন্তা করো না মা। আর ঈশ্বরের দোহাই, সিলিয়াকে বলল, সে যেন জেনেভিভের পাউডার ফেরত দেবার ব্যবস্থা করে। না হলে খাওয়ার সময় আমরা কেউ শান্তি পাব না।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিসেস হার্বার্ড। এসময় সিলিয়া ডাইনিংরুমে প্রবেশ করল। তার চোখ দুটো চোখের জলে লাল।

অনেক দেরী করেছ সিলিয়া। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। আর কোনো খাবার নেই। বলল মিসেস হার্বার্ড।

অন্যদের সঙ্গে আমি দেখা করতে চাইনি।

 আমি সেটা বুঝতে পারি। কিন্তু একদিন না একদিন তো তাদের সঙ্গে দেখা করতেই হবে।

ও হ্যাঁ, আমি জানি। কিন্তু আমার মনে হয় আজ সন্ধ্যায় সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আর এখানে থাকব না। এ সপ্তাহের শেষে আমি চলে যাব।

মিসেস হার্বার্ড অবাক হলেন।

আমার মনে হয় না তার প্রয়োজন আছে। হয়তো এখন তোমার একটু খারাপ লাগবে আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এসব তরুণতরুণীদের মন খুবই উদার, ওরা তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে। অবশ্য যতটা সম্ভব ওদের হারানো জিনিসের দাম তোমাকে মিটিয়ে দিতে হবে। তার জন্য তোমাকে

বাধা দিল সিলিয়া। ও হ্যাঁ, আমি আমার চেকবুক সঙ্গে এনেছি। আর একথাই আমি আপনাকে বলতে এসেছিলাম।

বেশ তো। এখন আমাদের হারানো জিনিষের একটা তালিকা তৈরি করতে হবে।

যতোটা সম্ভব আমি করে রেখেছি। তবে সেগুলো আমাকে কিনে দিতে হবে, না টাকা দিয়ে দেব বুঝতে পারছি না।

পরে ভেবে বলব। এখনি বলা শক্ত।

তালিকাটার ওপর চোখ বুলিয়ে সিলিয়া বলে, মোটামুটি অংকের একটা চেক আমি আপনাকে দিয়ে দিচ্ছি, বেশি হলে ফেরত দেবেন, কম পড়লে বলবেন, বাকিটা আমি দিয়ে দেব।

সেই ভালো। মিসেস হার্বার্ড আন্দাজে একটা অঙ্কের চেক দিতে বললো, সঙ্গে সঙ্গে সিলিয়া রাজী হয়ে গেল। সে তার চেকবুক বার করল। চেক সই করতে গিয়ে সিলিয়া দেখল তার পেনে কালি নেই। তখন সে দেয়ালে টাঙানো সেলফগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিজেলের সেই ভয়ঙ্কর সবুজ পেনের কালি ছাড়া অন্য ছাত্র-ছাত্রীদের পেনে কালি ছিল না। ওহো আমি ওর কালিই ব্যবহার করব। নিজেল কিছু মনে করবে না। বাইরে বের হলে ওর জন্য এক বোতল সবুজ কুইঙ্ক কালি আনব। সিলিয়া বলল।

অতঃপর সিলিয়া তার পেনে সবুজ কালি ভরে চেক লিখে মিসেস হার্বার্ডের হাতে দিল। মিসেস হার্বার্ড তাকে অনুরোধ করল যাতে সে কিছু অন্তত খেয়ে যায়। অন্তত মাখনরুটিও খেয়ে যায়। সিলিয়া কথা শুনল। এক টুকরো মাখনরুটি সে মুখে দিল।

ওদিকে ইতালীয় চাকর গেরোনিমো ঘরে ঢুকে জানাল, মিসেস নিকোলেটিস তাকে ডেকেছেন। মিসেস হার্বার্ড তাড়াতাড়ি চলে গেলেন।

চিড়িয়াখানার বাঘের মতো কুঁসছিলেন মিসেস নিকোলেটিস তার ঘরে পায়চারি করতে করতে। মিসেস হার্বার্ডকে দেখে সে রেগে বললো, এসব কি শুনছি? আমাকে না জানিয়ে তুমি পুলিশে খবর দিয়েছ? তুমি নিজেকে কি ভাব?

আমি পুলিশে খবর দেয়নি।

তুমি মিথ্যেবাদী। আমি ভুল করেছি তোমাকে বিশ্বাস করে, তোমার সব কাজে সম্মতি দিয়ে। সম্মানিত হস্টেলে পুলিশ

এটা প্রথম নয়, বললো মিসেস হার্বার্ড। আগের অপ্রীতিকর ঘটনার প্রসঙ্গ তুলে বললো সে, একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ছাত্র অসৎ উপায়ে এখানে এসেছিল টাকা রোজগার করতে। আর একজন কুখ্যাত কমিউনিস্ট বিক্ষোভকারী নাম ভাড়িয়ে এখানে এসে উঠেছিল আর।

আহ! এখানে কেউ নাম ভাড়িয়ে এসে আমাকে মিথ্যে পরিচয় দিলে সে কি আমার অপরাধ? আমার সেই দুর্ভাগ্যের কথা তুলে তুমি আমাকে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দেওয়ার চেষ্টা করছ?

সে সব আমি কিছুই করছি না, আমি শুধু বলছি এখানে বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রী মিশে গেছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য যদিও বা পুলিশ আসেই তা অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু পুলিসকে ডাকাই হয়নি। একজন প্রখ্যাত প্রাইটে ডিটেকটিভ ঘটনাচক্রে এখানে এসে পড়েন আর আমাদের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে তিনি অপরাধতত্ত্বের ওপর সুন্দর বক্তৃতা দেন।

যেন আমাদের ছাত্রছাত্রীদের অপরাধতত্ত্বের ব্যাপারে জ্ঞান দেওয়া খুবই জরুরী ছিল তাই না? ওসব বাজে কথা। ওরা ভালোভাবে জানে, এখানে যেসব জিনিষ চুরি গেছে, সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, এক ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ। আর এ ব্যাপারে এখনো কোনো কিনারা হয়নি।

কথাটা ঠিক নয়। আশা করি আমি কিছু করতে পেরেছি।

হা, তোমার কিছু করার মধ্যে এই বন্ধুটিকে আমাদের ঘরের কলঙ্কের কথা বলে দেওয়া এই তো? এক ভয়ঙ্কর বিশ্বাসভঙ্গের নজির বুঝলে?

একেবারেই না। এই হস্টেল চালানোর জন্য আমি দায়ী। এর পবিত্রতা রক্ষা করার ভার আমার উপরেই। আপনাকে একটা সুখবর দেই; ব্যাপারটা এখন মিটে গেছে। আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন ছাত্রী স্বীকার করেছে, সে এই দুষ্কর্মের জন্য দায়ী।

নোংরা মেয়ে, ঝাঝালো স্বরে বলে উঠলো মিসেস নিকোলেটিস। ওকে রাস্তায় বার করে দাও।

তার অরা দরকার হবে না। সে এই হস্টেল ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর সব হারানো জিনিষের দাম মিটিয়ে দিয়েছে।

তাতে কি লাভ? আমার এই সুন্দর স্টুডেন্ট হোমের এখন বদনাম হবে। কেউ আর এখানে আসবে না। সোফায় বসে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মিসেস নিকোলেটিস। কেউ আমার কথা চিন্তা করে না। কাল যদি আমি মরে যাই, কেই বা তোয়াক্কা করবে?

বুদ্ধিমতীর মতো তার এই সব অবান্তর প্রশ্ন অনুত্তর রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো মিসেস হার্বার্ড। ঈশ্বর আমাকে ধৈর্য ধরার ক্ষমতা দাও। নিজের মনে বলে রান্নাঘরে ঢুকল মিসেস হার্বার্ড, রাঁধুনী মারিয়ার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। মারিয়ার মুখ সবসময় গোমড়া ও অসহযোগী মনোভাব। পুলিশ-এর কথা হাওয়ায় তার কানে ভেসে এসে থাকবে।

দেখছি এবার আমাকেও অভিযুক্ত করা হবে। আমাকে আর গেরোনিমোকে। বিদেশে আমরা কি সুবিচার আশা করতে পারি? আমি আর এখানে রান্নার কাজ করতে পারব না।

বেশ, তুমি যা খুশী করতে পার। রাগত স্বরে বলে, রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল মিসেস হার্বার্ড।

সেদিন সন্ধ্যা ছটায় মিসেস হার্বার্ড আর একবার তার দক্ষতার পরিচয় দিলেন। ছাত্রছাত্রীদের জানিয়ে দিল, তারা যেন নৈশভোজের আগে তার সঙ্গে দেখা করে। তার আহ্বানে সবাই যখন সাড়া দিতে হাজির হল, সে তখন তাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে, সিলিয়া তাকে হারানো জিনিষগুলো কেনার ব্যবস্থা করতে বলেছে, আগাম একটা চেকও দিয়েছে সে। এ খবর শুনে সবাই খুশী। এমনকি একগুঁয়ে স্বভাবের জেনেভিভও তার হারানো পাউডার ফিরে পাওয়ার আনন্দে বলল, আমি জানি সিলিয়ার আর্থিক সচ্ছলতা আছে, ওর মতো মেয়ে কখনো চুরি করতে পারে না। এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র। মঁসিয়ে ম্যাকনার ঠিকই বলেছিলেন।

নৈশভোজের ঘন্টা বাজতেই সবাই ডাইনিংরুমে আসলো। সিলিয়া তখনও আসেনি। লেন বেটসন মিসেস হার্বার্ডকে বলল, হলের বাইরে আমি সিলিয়ার জন্য অপেক্ষা করব। আমি তাকে নিয়ে আসব। যাতে সে দেখতে পায় সব ঠিকঠাক চলছে।

সে তোমার বদান্যতার পরিচয় দেয়।

ঠিক আছে মা, চললাম।

ঠিক সময়ে নৈশভোজের টেবিলে স্যুপ পরিবেশিত হল। আর ঠিক এসময়েই সিলিয়ার গলার আওয়াজ পাওয়া গেল।

এসো সিলিয়া। বন্ধুরা সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।

কলিন ম্যাকনার সবার শেষে এল। নৈশভোজ শেষ হওয়ার ঠিক আগে সে উঠে দাঁড়িয়ে ধরা গলায় বলল, একজনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম, তাই দেরি হল। যাহোক, প্রথমে আমি তোমাদের একটা শুভ সংবাদ দেই–আগামী বছর আমার কোর্স শেষ হলে আশা করছি আমি আর সিলিয়া বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হব।

খবরটা শুনে সবাই লাফিয়ে উঠলো, বন্ধুদের অভিনন্দন আর ভালোবাসায় ডুবে গেল কলিন। সবাই তাকে ধন্য ধন্য করতে থাকলো তার এই নির্ভীক সিদ্ধান্তের জন্য। শেষ পর্যন্ত তাদের আলিঙ্গন থেকে কোনোরকমে ছাড়া পেয়ে পালিয়ে বাঁচলো সে, ভয়ঙ্কর লজ্জা তাকে পেয়ে বসেছিল। আর সিলিয়ার মুখটা তখন রক্তিমাভা ধারণ করেছিল। ওর মুখ দেখে মনে হল, বুঝি ওর শরীরের সমস্ত রক্ত উঠে এসেছে ওর সারা মুখে।

সিলিয়ার পক্ষে ও বিপক্ষে ভালো ও মন্দ মেশানো বন্ধুদের নানান মন্তব্যের উত্তরে সিলিয়া ম্লান স্বরে বললো, ওহো আমার মনে হয়, আমি এ কাজ করেছি–তবে আশা করি আগামীকাল সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমাদের মনের সন্দেহের সব জমা মেঘ সরে রৌদ্র ঝলমলিয়ে উঠবে। সত্যিই আমি তাই মনে করি। এলিজাবেথ, তোমার নোটে কালি ছেটানো পিঠে ঝোলানো ব্যাগ টুকরো টুকরো করে ছেঁড়া, এসব কুকাজ যে করেছে আমার মতো এগিয়ে এসে সেও যদি দোষ স্বীকার করে তো সব কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায়।

খুশীর হাসিতে ফেটে পড়ল ভ্যালেরি। তারপর আমরা আবার একসঙ্গে মিলেমিশে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারব।

তারপর সবাই মিলে কমনরুমে গিয়ে বসল। সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হল কে সিলিয়াকে কফির পেয়ালা এগিয়ে দেবে। কফি খাওয়া হলে সবাই কমনরুম ছেড়ে চলে গেল। তারপর ২৪ ও ২৬ নম্বর হিকরি রোডের বাসিন্দারা যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়ল।

ওদিকে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিয়ে মিসেস হার্বার্ড মনে মনে বলল, এই শুভ সূচনার জন্য ধন্যবাদ। এখন আমরা সব চিন্তা উদ্বেগ কাটিয়ে উঠেছি।

.

০৭.

 মিস লেমনের খুবই কদাচিত দেরি হয়। দশ মিনিট দেরিতে অফিসে ঢোকামাত্র সে ক্ষমা চাইল।

আমি অত্যন্ত দুঃখিত মঁসিয়ে পোয়ারো। অফিসে আসার জন্য বেরোতে যাব হঠাৎ ঠিক সেসময়ই বোন ফোন করল।

আহ, আমার বিশ্বাস, শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে নিশ্চয়ই সুস্থ সে।

নাঃ মাথা নাড়ল মিস্ লেমন। সত্যি কথা বলতে কি, অত্যন্ত বিপর্যস্ত সে। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেছে।

পোয়ারোর দৃষ্টি স্থির, পলক ফেলতে বুঝি ভুলে গেছে সে। আচ্ছা, তার নাম কি বলো তো?

সিলিয়া অস্টিন।

কি করে?

ওদের ধারণা মরফিয়া নিয়ে থাকবে সে।

 এটা কি দুর্ঘটনা বলে মনে হয়?

ওহো না, মনে হয় নোট সে লিখে গেছে।

এমনটা আশা করিনি। তবে এটা সত্যি যে আমি কিছু একটা আশা করেছিলাম। পোয়ারো বলল।

পেন্সিল আর প্যাড নিয়ে বসল মিস্ লেমন।

না, আজ আর কোনো নোট দেওয়া নয়। সকালের ডাকগুলো খুলে দেখ। চিঠিগুলো ফাইল করে দিও। উঠে দাঁড়ালো পোয়ারো, ফোন এলে যাহোক কিছু বলে দিও। আমি এখন হিকরি রোডে চললাম।

.

পোয়ারাকে আহ্বান করলো গেরোনিমো। আগের দুরাতের সম্মানিত অতিথিকে সে চিনতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে ফিসফিস করে স্বচ্ছন্দে বললো, আঃ সিনিয়ার, আপনি এসে গেছেন? আমরা এখানে একটা ভীষণ গণ্ডগোলের মধ্যে পড়েছি। সিলিয়া অস্টিনকে আজ সকালে মৃত অবস্থায় তার বিছানায় পাওয়া গেছে। প্রথমে ডাক্তার, তারপর পুলিস ইনসপেক্টরও তার দলবল নিয়ে এসে গেছে উপরে। কেন যে তিনি আত্মহত্যা করলেন? গতকাল রাতে আনন্দ উৎসবে তার বাগদান পাকা হল।

বাগদান?

হা, মিস্টার কলিনের সঙ্গে–বলিষ্ঠ চেহারা, মুখে সবসময় পাইপ।

জানি।

কমনরুমের দরজা খুলে সে চুপিচুপি পোয়ারোকে বলল : আপনি আপাতত এখানে থাকুন। পুলিস চলে গেলে সিনিয়ারকে বলব, আপনি তার জন্য এখানে অপেক্ষা করছেন। এই ভালো হ্যাঁ?

পোয়ারো বলল, ভালো। তারপর গেয়রানিমো চলে যেতেই ঘরের সব জিনিসগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকল।

ওদিকে ওপরতলায় ইনসপেক্টর শার্প-এর মুখোমুখি বসে তার বিনীত প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিল মিসেস হার্বার্ড। বিরাট চেহারা তার, নরম প্রকৃতির, তার আচরণের মধ্যেও একটা নম্র ভাব বিদ্যমান।

আমি জানি, আপনার সঙ্গে এ ঘটনা অত্যন্ত অস্বস্তিকর আর বিপর্যয়েরও বটে। নরম গলায় বললো সে। কিন্তু দেখুন ডঃ কোলস যেমন আপনাকে বললেন এ কেসের তদন্ত করতেই হবে। আর সেজন্য এ ঘটনার আগে ওপরের একটা সঠিক চিত্র আমাদের তুলে ধরতে হবে, এখন আপনি বলছেন যে, মেয়েটি সম্প্রতি বিপর্যস্ত ও অখুশী ছিল। প্রেমঘটিত কোনো ব্যাপারে?

না ঠিক তা নয়। ইতস্ততঃ করলো মিসেস হার্বার্ড।

দেখুন আপনি আমাকে সব খুলে বলুন, কোনো কিছু গোপন করবেন না, অনুরোধ করল ইনসপেক্টর শার্প। মেয়েটির আত্মহত্যা করার প্রকৃত কারণ যদি জানা থাকে তো বলুন। তার গর্ভবতী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা

আদৌ সেরকম কিছু নয়। ইনসপেক্টর শার্প, আমার বলতে দ্বিধা হচ্ছে ঘটনাটা নেহাতই সামান্য। মেয়েটি বোকার মতো কিছু কাজ করে। হ্যাঁ আমিও বোকামো করেছিলাম। সত্যি কথা তাহলে শুনুন–গত তিনমাসে বা তার কিছু আগে থেকে কতগুলো জিনিস এখান থেকে হঠাৎ হঠাৎ উধাও হয়। সামান্যই জিনিস। মানে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়।

ও টাকাকড়ি কিছু?

 না, যতদূর জানি টাকাপয়সা কিছু চুরি হয়নি।

 আহ, সেজন্য কি এই মেয়েটি দায়ী।

হ্যাঁ।

আপনি তাকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন।

না ঠিক সেরকম নয়, গত পরশু রাতে–আমার এক বন্ধু আসে এখানে নৈশভোজে যোগ দিতে। মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো–এ নামে কাউকে চেনেন কি?

মঁসিয়ে পোয়ারো? বললো সে। চিনি বৈকি, খুব চিনি! এখন আগ্রহ আমার আরো বেড়ে গেল। তারপর

নৈশভোজের পর তিনি চুরি নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করেন। তাদের সবার সামনে তিনি আমাকে পুলিসকে খবর দিতে বলেন। তারপরই সিলিয়া আমার ঘরে এসে দোষ স্বীকার করে। তখন সে খুবই বিপর্যস্ত ছিল।

তাকে অভিযুক্ত করার কোনো প্রশ্ন উঠেছিল?

মতামত নেই? যেমন ধরুন, মিস জনস্টনের রিসার্চের কাগজের ওপর কালি ছিটানোর ঘটনা?

ইনসপেক্টর শার্প আপনি যদি ভেবে থাকেন যে কাজ আমি করেছি, সেটা হবে সম্পূর্ণ অসত্য। অবশ্য আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে আমিই এ কাজ করেছি। কারণ আমিই একমাত্র সবুজ কালি ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এ ব্যাপারে যদি আমাকে প্রশ্ন করেন তো বলতে পারি, স্রেফ আমার প্রতি আক্রোশের বশে কেউ এ কাজ করেছে।

আক্রোশ কি রকম?

আমার কালি ব্যবহার করাটা। হয়তো কেউ ইচ্ছা করে আমার কালি ব্যবহার করেছে, যাতে মনে হয় এটা আমার কাজ। ইনসপেক্টর, এখানে অনেকেরই আমার ওপর আক্রোশ আছে।

আপনার উপর আক্রোশ আছে বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন? ইনসপেক্টর তাড়াতাড়ি জিজ্ঞাসা করলো।

সত্যি আমি অর্থ করতে চাই না। তবে এখানে অনেকে থাকে। কার মনে কি আছে কে জানে।

এরপর তালিকার নাম লিওনার্ড বেটসন। নিজেলের থেকে লেন বেটসন অনেক বেশি সহজবোধ্য তবে সে অন্যরকম, সন্দেহজনক ও নিষ্ঠুর।

ঠিক আছে! রুটিন মাফিক জেরা শেষ হবার পরই রেগে উঠল লিওনার্ড। হ্যাঁ, আমি কফির পেয়ালা তুলে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতে কি হয়েছে?

আপনিই তাহলে বলছেন যে নৈশভোজের পর আপনিই কফির পেয়ালা হাতে দিয়েছেন।

 হা, তবে আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন, কিন্তু তাতে মরফিয়া ছিল না।

 আপনি তাকে কফি খেতে দেখেছেন?

না, আমি তাকে কফি খেতে দেখিনি। কারণ আমরা তখন চারদিকে ঘুরছিলাম। আমার সঙ্গে আবার তখন একজনের তর্ক হয়। তাই সে তখন কফি পান করেছিল কিনা আমি লক্ষ্য করিনি। তার চারপাশে অনেকেই ছিল।

তাই বুঝি। তবে আপনার কথা শুনে মনে হয় কেউ তাকে কফিতে মরফিয়া মিশিয়ে দিতে পারে।

কিন্তু আপনি যদি কারো কাপে কিছু ঢালতে চান, সেটা কারোর দৃষ্টি এড়াতে পারে না।

সব সময় সেটা সম্ভব নাও হতে পারে। শার্প বললো।

লেন এবার সত্যি সত্যি রেগে গেল। আপনি কি ভেবেছেন আমি ঐ বাচ্চা মেয়েকে বিষ খাওয়াতে চেয়েছিলাম? তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অনুযোগ বা অভিযোগ নেই।

না, আমি বলছি না আপনি তাকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন।

 সে নিজেই হয়তো বিষ খেয়ে থাকবে। এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না।

সে চিন্তা আমরাও করতে পারি, যদি না সেই জাল আত্মহত্যার নোটটা না পাওয়া যেত।

জাল আত্মহত্যার নোট! কেন, সেটা সে নিজে লেখেনি?

সেদিন ভোর সকালে সেই চিঠির কিছু অংশ সে নিজে হাতে লিখেছিল?

বেশ–সে কাগজের কিছু অংশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে তার আত্মহত্যার নোট হিসাবে ব্যবহার করতে পারে।

তাহলে এখন আসল ঘটনায় আসুন মিঃ বেটসন। ধরুন আপনি যদি আপনার আত্মহত্যার নোট লিখতে চান, তাহলে নিশ্চয়ই অন্য কাউকে লেখা একটা চিঠি নিয়ে তার কিছু অংশ সাবধানে ছিঁড়বেন না।

আমি তা করতে পারি। মানুষ অনেকরকমের মজার কাজ করতে পারে।

 সেক্ষেত্রে চিঠির বাকি অংশটা কোথায় গেল?

আমি কি করে জানব? কারণ সেটা আপনার কাজ আমার নয়।

আমার কাজ আমি করব। তবে আপনাকে বলছি আপনি ভদ্রভাবে আমার কথার উত্তর দিন।

বেশ আপনি কি জানতে চান বলুন? মেয়েটিকে আমি খুন করিনি। আর তাকে খুন করার কোনো মোটিভও আমার নেই।

তাকে আপনি পছন্দ করতেন?

লেন এবার নরম গলায় বলল–হ তাকে আমি ভালোবাসতাম। চমৎকার মেয়ে ছিল সে, একটু বোকা, কিন্তু ভালো।

মেয়েটি যখন নিজে মুখে স্বীকার করে সে চুরি করেছিল আপনি বিশ্বাস করেছিলেন?

সে যখন নিজের মুখে বলেছিল, তখন অবশ্য তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু এর সঙ্গে আবার এও বলল সে, সেটা যেন একটু অদ্ভুত বলেই মনে হয়েছিল আমার।

সে যে এ কাজ করতে পারে, আপনি চিন্তা করতে পারেননি, এই তো!

না, সত্যিই নয়।

একটু আগে লিওনার্ডের সব নিষ্ঠুরতা এখন চাপা পড়ে গেছে। এখন তার আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়োজন নেই। সে যে ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহ্নিত হয়েছিল সেই সমস্যার সমাধান করার কাজে মন দিল সে।

তাকে ক্লিপ্টোম্যানিয়াক বলে আমার কখনো মনে হয়নি, আমি কি বলতে চাইছি আপনি যদি বুঝতে পারতেন, বলল সে, সে চোরও ছিল না।

সে যা করেছিল, তার অন্য কারণ কি আপনি ভাবতে পারেন?

অন্য কারণ মানে? আর কি অন্য কারণ থাকতে পারে?

কেন তার প্রতি মিঃ কলিন ম্যাকনারের আগ্রহ বানানোর জন্যও তো হতে পারে।

কিন্তু তা তো অনিশ্চিত ছিল, তাই না?

কার্যত সে সফল তো হয়েছিল।

হ্যাঁ, যে কোনো মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের প্রতি কলিন আকর্ষণ বোধ করে।

ভালো, যদি সিলিয়া এটা জানে

লেন মাথা নাড়ল। না, সেরকম চিন্তা কখনোই তার মাথাতে আসবে না। মানে, তার পরিকল্পনাতেও এরকম চিন্তা আসবে না। তাছাড়া সে এসব জানত না।

মানে আমি বলতে চাইছি, হয়তো আপনি কোনো সৎ উদ্দেশ্যে তাকে এরকম পরামর্শ দেবেন।

মৃদু হাসল লেন। আপনি ভাবছেন বোকার মতো আমি ও কাজ করব? অতই জেদীই কি আপনি?

এবার প্রসঙ্গ বদলালেন ইনসপেক্টর। আপনি কি মনে করেন এলিজাবেথ জনস্টনের ওপর কালি ছিটিয়েছিল সিলিয়া? কিংবা অন্য কেউ একাজ করতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

অন্য কেউ হবে। সিলিয়া বলেছে–সে একাজ করেনি। আমি তার কথা বিশ্বাস করি। আমি কখনো সিলিয়াকে বিরক্ত করিনি। যেমন কিছু লোক করে।

আর সিলিয়া কি কাউকে উত্ত্যক্ত করেছিল বলে মনে হয় আর কেনই বা?

জানেন সিলিয়া অনেককে তিরস্কার করেছিল। কয়েক মুহূর্ত ভাবল লেন। যে কেউ তাড়াতাড়ি কথা বললে সহ্য করতে পারতো না সে। টেবিলের দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমার আশঙ্কা, কোনো ঘটনা থেকে এ স্বভাবের জন্ম হয় না। পরিসংখ্যান থেকে বেশ ভালো ভাবে তার মনে গেঁথে গিয়েছিল–এধরনের কিছু একটা হবে। যাহোক, জানেন এটা তিরস্কারের সামিল–বিশেষ করে যারা হরবর করে দ্রুত কথা বলে থাকে, যেমন উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে নিজেল চ্যাপম্যান।

আহ, হা, নিজেল চ্যাপম্যান।

আর সবুজ কালির ব্যাপারটা ধরতে হবে।

 তাহলে আপনি মনে করেন নিজেলই একাজ করেছিল?

হ্যাঁ, অন্তত সেটা সম্ভব। জানেন এক ধরনের আক্রোশকারী সে। আর আমার মনে হয় তার একটা জাতিগত মনোভাব ছিল। আমাদের মধ্যে অন্য একজনের এরকম মনোভাব ছিল।

আপনার কি মনে হয় মিস্ জনস্টন ছাড়া অন্য কেউ তার নির্ভুল আর অপরের দোষত্রুটি শুধরে দেওয়ার অভ্যাস বরদাস্ত করতে পারত না, বিরক্ত বোধ করত?

হ্যাঁ, কলিন ম্যাকনার তেমন সন্তুষ্ট ছিল না এ ব্যাপারে।

আরো কয়েকটা এলোমেলো প্রশ্ন করল শাপ, কিন্তু লেন বেটসনের উত্তরগুলো তেমন কার্যকর হল না। এরপর ভ্যালেরি জনহাউসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলো শার্প।

ঠান্ডা প্রকৃতির ভ্যালেরির রুচি ছিল। তাকে একটু চিন্তিত বলেও মনে হল। অন্য পুরুষদের মতো অতটা স্নায়ু দুর্বলতা তার মধ্যে লক্ষ্য করা গেলো না। সিলিয়ার সে খুব ভক্ত। সে আরো বললো, সিলিয়ার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল ছিল, কিন্তু যে ভাবে সে তার হৃদয় দিয়ে কলিন ম্যাকনারকে গ্রহণ করেছিল, সেটা খুবই বেদনাদায়ক।

মিস জনহাউস, আপনি কি মনে করেন না, সিলিয়া ক্রিপ্টোম্যানিয়াক ছিলো?

 হ্যাঁ, আমি সেরকমই মনে করি। এ বিষয়ে আমার খুব বেশি কিছু জানা নেই।

আচ্ছা, অন্য কেউ জিনিসগুলো চুরি করে তার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেয়নি তো?

ভ্যালেরি তার কাধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো, তার মানে আপনি কি বলতে চাইছেন, ঐ গর্দভ কলিনকে আকর্ষণ করার জন্য?

মিস জনহাউস, ব্যাপারটা আপনি খুব তাড়াতাড়ি ধরে ফেললেন তো!

হ্যাঁ, আমি সেটাই বোঝাতে চাইছি। আমার অনুমান, আপনি তাকে এ ব্যাপারে পরামর্শ দেননি তো?

কৌতুক বোধ করল ভ্যালেরি।

না, তা কেন করতে যাবো? তাছাড়া আমার নিজের স্কার্ফ আমি তাকে টুকরো টুকরো করে কাটতে বলবো? আমি সেরকম পরের উপকার করার পাত্রী নই।

অন্য কেউ তাকে সেরকম পরামর্শ দিয়েছে বলে মনে হয় আপনার?

 আমার তা মনে হয় না। বরং আমার তো মনে হয় তার পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।

স্বাভাবিক বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

তাহলে শুনুন, প্রথমে সেলীর জুতো চুরি যাওয়ার সময়েই সিলিয়ার উপর আমার কেমন যেন একটু সন্দেহ হয়েছিল। সেলী ফিঞ্চ-এর প্রতি সিলিয়ার হিংসা ছিলো। এখানে সেলী অনেক মেয়ের থেকে বেশি আকর্ষণীয় ও সুন্দরী। তার প্রতি কলিনের দুর্বলতা ছিলো। তাই সেদিন রাত্রে তার সেই ফ্যান্সি ড্রেসের জুতোটা চুরি হওয়ার দরুন তাকে কালো জুতোর সঙ্গে কালো পোষাক পড়ে পার্টিতে যেতে হয়েছিল। অন্যদিকে সিলিয়াকে বেশ ভালো ও ফিটফাট দেখাচ্ছিল সেদিন। মনে রাখবেন, আমি কিন্তু অন্য জিনিস উধাও হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সিলিয়াকে সন্দেহ করিনি, যেমন ব্রেসলেট, পাউডার, কমপ্যাক্ট ইত্যাদি

সেগুলো চুরি করার জন্য কে দায়ী হতে পারে?

কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভ্যালেরি বলে, ওহো, আমি তো জানি না। আমি ভেবেছিলাম, হয়তো ঘর পরিষ্কার করার সেই মেয়েটি

আর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলা?

ওটার কোনো মানে হয় না।

আচ্ছা, মিস জনহাউস, আপনি তো এখানে অনেকদিন ধরে আছেন, তাই না?

হ্যাঁ, আমি বলতে পারি, আমি এখানকার পুরানো বাসিন্দা। তার মানে আমি এখনো দুবছরেরও বেশি সময় ধরে রয়েছি।

তাহলে অন্য সবার থেকে আপনি এখানকার সবচেয়ে পুরানো।

আমি তা বলতে পারি।

সিলিয়া অস্টিনের মৃত্যুর ব্যাপারে আপনার নিজের কি ধারণা বলবেন? ওর মোটিভ কি জানেন?

মাথা নাড়ল ভ্যালেরি। এবার সে গম্ভীর হয়ে গেলো।

না, বলল সে। ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর বলতে পারি। আমার তো মনে হয় না, এখানে কেউ সিলিয়ার মৃত্যু চায় বলে আমার জানা নেই। চমৎকার মেয়ে ছিলো সে, কখনো কারোর অপকার করেনি। সবেমাত্র তার বাগদান পর্ব শেষ হয়েছিল, আর…

হ্যাঁ, আর কি? সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল ইনসপেক্টর।

আমার আশঙ্কা। সে জন্যই কি, ধীরে ধীরে বললো, সেলী, কারণ তার বাগদান হয়ে গেছে। কারণ সে সুখী হতে যাচ্ছে। কিন্তু তাই বলে এমন কে পাগল আছে, যে তার মৃত্যু কামনা করতে পারে?

কথাগুলো বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে উঠল। তার দিকে চিন্তিত ভাবে তাকালো শার্প।

হা, বললো সে, পাগলামোর ব্যাপারটা আমরা একদম উড়িয়ে দিতে পারি না। বলে চলে সে, এলিজাবেথ জনস্টনের নোট আর কাগজ নষ্ট হওয়ার প্রসঙ্গে আপনার কোনো মতামত আছে?

না। ওটা আক্রোশের ব্যাপার। আমার মনে হয় না, সিলিয়া একাজ করতে পারে।

 কে করতে পারে, কোনো ধারণা আছে?

ঠিক আছে বলছি, হয়তো আমার অনুমান ভুল হতে পারে, তবে আমার যতদূর মনে হয়, একাজ প্যাট্রিসিয়া লেনের।

তাই বুঝি! মিস্ জনহাউস, আপনি তো আমাকে চমকে দিলেন। আমি জানতাম প্যাট্রিসিয়া লেন খুব অমায়িক মহিলা।

আমি বলছি না, একাজ সে করেছে। তবে আমার এ অনুমান মাত্র।

কারণটা কি জানতে পারি?

ব্ল্যাক বেককে পছন্দ করে না প্যাট্রিসিয়া। ওদিকে ব্ল্যাক বেক প্যাট্রিসিয়ার প্রেমিককে সবসময় তিরস্কার করে থাকে।

তার মানে আপনি কি মনে করেন, নিজেদের থেকে প্যাট্রিসিয়ারই এমন জঘন্য কাজ করার সম্ভাবনা বেশি?

ওহো, নিশ্চয়ই। আমার তো মনে হয় না নিজেল এ নিয়ে মাথা ঘামাতে যাবে। তাছাড়া সে তার নিজস্ব ব্র্যান্ডের কালি নিশ্চয়ই ব্যবহার করতে যাবে না। তার স্নায়ুকোষগুলো খুবই তীক্ষ্ণ। কিন্তু প্যাট্রিসিয়াও এরকম বোকার মতো কাজ করবে না, যাতে নিজেল জড়িয়ে পড়তে পারে, সে কি একথা না ভেবে কাজটা করেছে?

কিংবা এমনো হতে পারে অন্য কেউ সে কাজটা করে নিজেল চ্যাপম্যানকে জড়াতে চেয়েছে?

হ্যাঁ, এ আর এক সম্ভাবনা বটে।

নিজেল চ্যাপম্যানকে কে কে অপছন্দ করে?

 জিন টমকিনসন। সে আর লেন বেটসন অনেক সময় ভালো কাজও কাট-ছাঁট করে দেয়।

আচ্ছা মিস জনহাউস, সিলিয়া অস্টিনের কাছে মরফিয়া কি করে এলো, আপনার কোনো ধারণা আছে?

আমি ভাবছি, কেবল ভাবছি। অবশ্য আমার মনে হয় কফির মাধ্যমেই একমাত্র উপায়। সিলিয়া সবসময় ঠান্ডা পান করত, তার জন্য তাকে অপেক্ষা করতে হতো। সেদিনও সে অপেক্ষা করেছিল, তার পাশে ছোট একটা টেবিলের উপর কফির পেয়ালা রেখে দিয়ে। আমার ধারণা কেউ হয়তো তার কফির পেয়ালায় একটা ট্যাবলেট কিংবা ঐ রকম কিছু ফেলে দিয়ে থাকবে। কিন্তু তাতে অনেক ঝুঁকি থাকতে পারে। কারোর না কারোর চোখে পড়ারই কথা। এ এমনি একটা কাজ যা সহজেই চোখে পড়ার মতন।

মরফিয়া কিন্তু ট্যাবলেটের আকারে হয় না। বললো ইনসপেক্টর শার্প।

 তাহলে কি রকম? পাউডার?

হা।

 ভ্র কোঁচকালো ভ্যালেরি।

 তাহলে তো আরো কঠিন ব্যাপার তাই না?

কফি ছাড়া অন্য আর কিছু ভাবতে পারেন?

শুতে যাওয়ার আগ সে মাঝে মাঝে একগ্লাস দুধ খেতো, তবে আমার মনে হয় না, সেদিন সে দুধ খেয়েছিল।

সেদিন সন্ধ্যায় কমনরুমে ঠিক কি ঘটেছিল বলতে পারেন?

হ্যাঁ, কেন পারব না? আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। আমরা সবাই বসে গল্প করছিলাম। বেশিরভাগ ছেলে তখন বাইরে ছিল। একটু আগেই সিলিয়া শুতে চলে গিয়েছিল, এবং জিন টমকিনসনও! সেলী আর আমি অনেকক্ষণ বসেছিলাম সেখানে। আমি চিঠি লিখছিলাম, আর সেলী কতকগুলো নোটের ওপর চোখ বুলাচ্ছিল। আমার যতদূর মনে পরে, আমিই কেবল। সবার শেষে শুতে যাই।

তার মানে অন্য দিনের মতো সেই সন্ধ্যাটাও স্বাভাবিক ছিলো। ঘটনা তাই না।

সম্পূর্ণভাবে ইনসপেক্টর।

ধন্যবাদ মিস জনহাউস। আপনি এখন যেতে পারেন। তবে এখন মিস লেনকে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।

প্যাট্রিসিয়া লেনকে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছিল। তবে আশঙ্কাজনক কিছু নয়। প্রশ্নোত্তরের মধ্যে তেমন নতুনত্ব কিছু প্রকাশ পেল না। এলিজাবেথ জনস্টনের রিসার্চের কাগজপত্র নষ্ট হওয়ার প্রসঙ্গে প্যাট্রিসিয়া অভিযোগ করল সিলিয়াকে সরাসরি।

কিন্তু মিস লেন সেটা প্রচণ্ডভাবে অস্বীকার করেছিল।

হতে পারে লজ্জায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল সে। কিন্তু অন্য আরো সব ঘটনার সঙ্গে এটা কি মিলে যায় না?

জানেন, এই কেসটার ব্যাপারে আমি কি দেখতে পেয়েছি মিস লেন? কোনো মিলই আমি খুঁজে পাইনি।

আমার ধারণা, প্যাট্রিসিয়া বলে, তাহলে আপনি কি মনে করেন, বেক-এর কাগজ নষ্ট করার মূলে নিজেই? কারণ সেই সবুজ কালি ব্যবহার করে, তাইতো? কিন্তু নিজের কালি নিজে ব্যবহার করার মতো আহাম্মক নয় সে। সে যাহোক, আমি আপনাকে আবার বলছি সে এ কাজ করতে পারে না।

মিস জনস্টনের সঙ্গে তার সম্পর্ক সব সময় ভালো ছিল কি?

হ্যাঁ, এক এক সময় তার স্বভাব অত্যন্ত বিরক্তিকর বলে মনে হয়। কিন্তু সত্যি সে কিছু মনে করে না। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লো প্যাট্রিসিয়া লেন। দু-একটা জিনিস আপনাকে বোঝাবার চেষ্টা করব বুঝতেই পারছেন ইনসপেক্টর, আমি নিজেল চ্যাপম্যানের সম্বন্ধে বলছি। সে ইচ্ছা করেই তার শক্রবৃদ্ধি করেছে। আজ আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি সে ভীষণ কঠিন স্বভাবের লোক ছিল। এর ফলে অনেকেই তার বিরুদ্ধে ছিল। তাছাড়া সে সব সময় ঠাট্টাইয়ার্কি করত। কিন্তু এসব ঠাট্টাইয়ার্কি এমন বীভৎস পর্যায়ে চলে যেত যে লোকে তখন তাকে কিছুতেই সহ্য করতে পারত না। কিন্তু বাস্তবে সে ছিল অসুখী। কিন্তু তার বাইরের কঠিন দিকটা লোকে দেখে তার ভেতরের কোমল ও দুর্বল দিকটার কথা কেউ ভেবেও দেখে না। কিন্তু জানেন ইনসপেক্টর আমি দেখেছি, তার জন্য মনে মনে খুব কষ্টও পাই

আহ, বললো ইনসপেক্টর। এটা তাদের পক্ষে দুর্ভাগ্যও বটে।

হ্যাঁ। কিন্তু কি জানেন ইনসপেক্টর, সত্যি তারা সাহায্য করতে পারে না। একেবারে ছেলেবেলা থেকে দুর্ভাগ্য তার সাথী হয়ে গেছে। নিজেদের বাড়ির জীবন খুবই অসুখী। তার বাবা খুবই নিষ্ঠুর ছিলেন। নিজেকে বুঝতে চাইতেন না। আর তার বাবা তার মার সঙ্গে খুবই খারাপ ব্যবহার করেন। ছেলেবেলাতেই তার মা মারা যান। তারপর একদিন নিজেল তার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে, অজানা পথে। তার বাবা তাকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, নিজেলকে সে এক পেনিও দেবে না। তার তোয়াক্কা করে না নিলে। তার স্বাস্থ্যও ভালো নয়, তার মনটা চমৎকার। এখানে এসে থামল প্যাট্রিসিয়া। দীর্ঘ সময় ধরে এক নাগাড়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য হাঁপিয়ে উঠেছিল সে।

ইনসপেক্টর শার্প চিন্তিত হয়ে তার দিকে তাকাল। বহু প্যাট্রিসিয়া লেনদের দেখেছে সে, কিন্তু প্রেমিকদের এমন গভীর প্রেমের কথা সে এর আগে কখনো শোনেননি। অবাক হয়ে শার্প ভাবে, আচ্ছা সিলিয়া অস্টিনের প্রতি নিজেল চ্যাপম্যান আকর্ষণ বোধ করেনি তো। সেটা সম্ভব নয়, আবার একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর তাই যদি হয়, ভাবলো সে, প্যাট্রিসিয়া লেন নিশ্চয়ই ক্ষুব্ধ হয়ে থাকবে। আর এমনি ক্ষুব্ধ হয় যে, সিলিয়াকে আঘাত করার কথাও তার মনে হয়ে থাকবে। তার সেই ক্ষোভ, বিরক্তি এমনি চরমে উঠে থাকবে যে, শেষ পর্যন্ত সেকি সিলিয়াকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে? যে কারণেই হোক, নিশ্চয়ই নয়। কারণ কলিন ম্যাকনারের সঙ্গেই তার বাগদানের খবরটা শোনার পর অবশ্যই তাকে খুন করার মোটিভ বলতে আর কিছু থাকার কথা নয়। তাই ইনসপেক্টর শার্প তার সন্দেহের তালিকা থেকে প্যাট্রিসিয়া লেনকে বাদ দিয়ে এবার জিন টমকিনসনের খোঁজ করল।

.

০৮.

 মিস টমকিনসনকে দেখতে কঠোর প্রকৃতির যুবতীর মতো, বয়স সাতাশ, শার্পের সামনে বসে সে প্রথমে বললো, হ্যাঁ, ইনসপেক্টর, বলুন আপনার জন্য কি করতে পারি?

মিস টমকিনসন, আমার মনে হয় না, এই বিয়োগান্ত ঘটনার ব্যাপারে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারবেন।

সত্যি এটা খুবই বেদনাদায়ক ঘটনা। প্রথমে মনে হয়েছিল, নেহাতই আত্মহত্যা করার ঘটনা, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটা একটা খুনের ঘটনা–এখানে সে নীরবে মাথা নাড়ল।

আমরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছি, সিলিয়া কখনোই নিজে বিষ খেতে পারে না, শার্প বলল। সেই বিষ কোথাথেকে আসতে পারে আপনি জানেন?

মাথা নাড়ল জিন। জেনেছি সেন্ট ক্যাথেরিন হাসপাতাল থেকে, সেখানে সে কাজ করত। কিন্তু আত্মহত্যার ঘটনা বলেও তো মনে হতে পারে। কিন্তু সিলিয়া ছাড়া কে সেই বিষ জোগাড় করতে পারে?

অনেকেই, বললো ইনসপেক্টর শার্প, অবশ্য তারা যদি তাকে খুন করার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে থাকে। এমনকি আপনি নিজেও মিস টমকিনসন।

সত্যিই ইনসপেক্টর শার্প! জিনের কথায় ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছিল।

 ভালো কথা, মিস টমকিনসন, আপনি প্রায়ই তো ডিসপেনসারিতে যান, যান না?

হ্যাঁ যাই। সেখানে মিলড্রেড ক্যারির সঙ্গে দেখা করতে চাই। কিন্তু কখনোই বিষের কাপবোর্ডে হাত দেওয়ার স্বপ্নও আমি দেখিনি।

কিন্তু বাস্তবে আপনি সেটা করলেও করতে পারেন।

না অবশ্যই সেরকম আমি কিছু করতে পারি না।

হ্যাঁ, আমি বলছি আপনি পারেন। তাহলে শুনুন মিস টমকিনসন, মনে করুন আপনার বন্ধুটি কাজে ব্যস্ত ছিলো। বাইরের রোগীদের দেখার জন্য একটি মেয়ে ডিসপেনসারি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। অপর দুজন ডিসপেনসার তখন ঘরের সামনের দিকে ছিল। আর আপনি তখন ঘুরতে ঘুরতে বিষের কাপবোর্ডের সামনে যান আর মরফিয়ার একটা বোতল পকেটে ঢুকিয়ে দেন। সেই দুজন ডিসপেনসার যা ভাবতে পারে না, আপনি তাই করলেন।

ইনসপেক্টর, আপনার কথাগুলি আমার রাগ বাড়িয়ে দিচ্ছে এ এক বাজে অভিযোগ।

কিন্তু এটা অভিযোগ নয়। সেরকম কিছুই নয়। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আপনি বলছেন, এ কাজ আপনার দ্বারা সম্ভব নয়, আর আমি বলছি, হ্যাঁ সম্ভব। তা বলে আমি কখনো বলছি না যে আপনি সেটা করেছেন। আর কেনই বা করতেন তা বলুন?

ঠিক তাই। ইনসপেক্টর শার্প আপনি কেন বুঝতে পারছেন না, সিলিয়া আমার বন্ধু ছিল।

এমন বহু ঘটনা আছে যে বন্ধুরাই তাদের বিষ খাইয়ে হত্যা করেছে। এক এক সময় এমন কতগুলো প্রশ্ন থাকে আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে জিজ্ঞাসা করে থাকি। বন্ধু তখন আর বন্ধু থাকে না। বুঝলেন?

কিন্তু, আমার আর সিলিয়ার মধ্যে তো কোনো মতপার্থক্য ছিল না।

হস্টেলে কয়েকটা জিনিস চুরির ব্যাপারে আপনি তাকে সন্দেহ করতেন?

না, কখনো নয়। আমি সবসময় সিলিয়াকে উচ্চ আদর্শের মেয়ে বলে ভাবতাম। স্বপ্নেও ভাবিনি, সে এ কাজ করতে পারে।

অবশ্যই, সতর্কতার সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে শার্প বললো, সত্যিই ক্লিপ্টোম্যানিয়াকরা কখনোই নিজেদের সাহায্য করতে পারে না, পারে তারা?

আমি বলতে পারি না। এরকম ধারণা সহজেই আমি সমর্থন করতে পারি। পারে?

না, নিজেলের কাজ নয়। আমার মনে হয় মিঃ অ্যাকিমবো করতে পারে, তার সম্ভাবনাই বেশি।

সত্যি? এ কাজ কেনই বা সে করতে গেল?

বিদ্বেষ। এসব কালো চামড়ার মানুষরা পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ হয়।

এটা খুব আগ্রহের ব্যাপার মিস টমকিনসন। এখন বলুন আপনি শেষ কখন মিস সিলিয়াকে দেখেছিলেন?

শুক্রবার রাতে নৈশভোজের পর।

মিস অস্টিনের কফির পেয়ালায় কে মরফিন মেশাতে পারে বলে আপনার মনে হয়?

এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই।

আচ্ছা, এই বাড়ির কোথাও বা কোনো ঘরে মরফিয়া থাকতে দেখেননি?

না, না, আমার তো মনে হয় না।

 আপনি সেরকম মনে করেন না বলতে কি বোঝাতে চাইছেন মিস টমকিনসন?

তাহলে বলি শুনুন, আমি আজও অবাক হই সেই বাজে বাজী ধরার কথায়।

 কিসের বাজী?

ওঃ একদিন দু-তিনজন যুবক তর্ক করছিল খুনের ব্যাপারে। কিভাবে খুন করা হয়, বিশেষ করে বিষ খাইয়ে।

তা এ সব আলোচনায় কারা ছিল বলতে পারেন?

কেন বলতে পারব না। আমার মনে হয়, প্রশ্নটা প্রথমে সিলিয়া আর নিজেল তোলে। তারপর লেন বেটসন আসে। প্যাট্রিসিয়াও সেখানে ছিল।

আপনার মনে আছে, এই আলোচনায় কে কি বলেছিল আর তর্কই বা কি ভাবে হয়েছিল?

কয়েক মুহূর্ত ভাবল জিন টমকিনসন। তারপর বলতে লাগল–আমার মনে হয়েছে। বিষপ্রয়োগ করে কাউকে হত্যা করার ব্যাপারে প্রধান অসুবিধা হল প্রয়োজনীয় বিষ সংগ্রহ করা। আর এই বিষ সংগ্রহ করার জায়গা থেকে খুনীর সন্ধান পাওয়া যায়। সঙ্গে সঙ্গে নিজেল বলে ওঠে যদি তিনটি উপায়ে বিষ সংগ্রহ করা যায় তাহলে খুনীর ধরা পড়ার সম্ভাবনা নাও থাকতে পারে, ইনসপেক্টর শার্প। আমার মনোভাব সেকেলে ধরনের। আর এও বিশ্বাস করি, চুরি তা কোনো তুচ্ছ জিনিসই হোক না কেন, তা চুরিই।

তার মানে আপনি মনে করেন। সেই জিনিসগুলো নেবার জন্যই সিলিয়া চুরি করেছিল?

অবশ্যই আমি সেটা বিশ্বাস করি।

বস্তুত অসাধুতার লক্ষ্মণ এটা, এই তো?

 আমার আশঙ্কা তাই।

আহ! ইনসপেক্টর শার্প তার মাথা নেড়ে বললো, সেটা খুবই খারাপ। একটু থেমে সে আবার বলে, সে যা হোক, একজন ক্রিপ্টোম্যানিয়াককে সত্যিকারের চোর বলে ধরে নেওয়া, তারপর পুলিসকে খবর দেওয়ার কথা চিন্তা করা, তবু এসব সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, সবকিছুতেই শেষে একটা সুখের ইঙ্গিত ছিলো এই কেসেমিস অস্টিনের জীবনে বিয়ের ঘন্টা বাজতে চলেছিল।

হ্যাঁ, কলিন ম্যাকনার যা করেছে তার জন্য কেউ বিস্মিত হবে না, বললো জন টমকিনসন। জানি নিশ্চিত, সে একজন নাস্তিক, অবিশ্বাসী, উপহাসের পাত্র, অপ্রিয় যুবক। সবার সঙ্গে তার ব্যবহার খারাপ। আমার মতে সে একজন কমিউনিস্ট।

আহ! ইনসপেক্টর শার্প আবার বলে, এ খুবই খারাপ। মাথা নেড়ে সে বললো, সে যা হোক মিস অস্টিন নিজের মুখে দোষ স্বীকার করেছে।

ধরা পড়ার পর, শার্প বলে উঠলো।

তা কার কাছে ধরা পড়ল সে?

সেই মিস্টার কি যেন নাম? হ্যাঁ, মনে পড়েছে, পোয়ারো, যিনি আমাদের কাছে এসেছিলেন।

কিন্তু মিস অস্টিন যে তার কাছে ধরা পড়েছিল সে কথা আপনি ভাবছেন কেন? তিনি তো এধরনের কথা বলেননি। তিনি তো কেবল পুলিসকে খবর দিতে বলেছিলেন।

তিনি নিশ্চয়ই হাবেভাবে বুঝিয়ে দিলেন যে তিনি ব্যাপারটা জানেন। সিলিয়া নিশ্চয়ই জেনে গিয়েছিল, তার খেলা শেষ। তাই সে ছুটে যায়। স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য।

তা না হয় হলো, কিন্তু এলিজাবেথের কাগজের ওপর কালি ছেটানোর ঘটনা? সেটা কি সে অস্বীকার করেছিল?

আপনার ধারণা ভুল, বললো শার্প। এ অভিযোগ তীব্রভাবে অস্বীকার করেছিল সে। আর এ ব্যাপারে তার কোনো হাতই ছিল না। এখন আপনি কি বলবেন, জিজ্ঞাসা করলো শার্প।

এ কাজ নিজেল চ্যাপম্যান করতে পারে। লেন বেটসন তখন তাকে জিজ্ঞেসা করে, তার মাথার ঠিক আছে তো? নিজেল বলে, হ্যাঁ সজ্ঞানেই সে কথা বলছে। প্যাট তাকে সমর্থন করে বলে নিজেল ঠিকই বলেছে। সম্ভবতঃ লেন বা কলিন মনে করল যে কোনো হাসপাতাল থেকে বিষ সংগ্রহ করে নিয়ে আসতে পারে তারা।–নিজেল বাধা দিয়ে বলেছিল–আদৌ সে নিজেদের সম্পর্কে কথা বলেনি। আসলে সে বলতে চাইছিল, ডিসপেনসারি থেকে সিলিয়া যদি কিছু নিয়ে আসে তাহলে তা কারো না কারো নজরে পড়বেই। তখন প্যাট বলে, না তা : হতে পারে না। ধরা যাক সিলিয়া মরফিয়া বার করে নিয়ে অন্য কোনো পাউডার ভর্তি করে দিল সেই বোতলে। হাসল কলিন, তারপর সে বললো, তাতে রোগীদের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায় ও প্রচুর অভিযোগ আসতে পারে। নিজেল বলে, আমি অবশ্য বিশেষ সুযোগের কথা বলছি না, নিজেল আরো বলে, ডাক্তার বা ডিসপেনসারের খেতাব যদিও তার নেই, কিন্তু তিনটে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে অনায়াসে সে বিষের বোতল হাতাতে পারে। তখন লেন বেটসন জানতে চায়, ঠিক আছে, তোমার বক্তব্য আমি শুনলাম। এখন সেই তিনটি উপদেশের ব্যাখ্যা করে দেখাও তো। নিজেল বলে, এখন আমি তোমাকে বলবো না, তবে তিন সপ্তাহের মধ্যে আমি তোমার বাজী ধরার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। তখন আমি তিন ধরনের ভয়ঙ্কর বিষের নমুনা তুলে ধরব তোমাদের সামনে। আর লেন বেটসন তখন বলে, সে যদি জয়ী হয়ে ফিরতে পারে, তাহলে সে তখন পাঁচগুণ বেশি অর্থ দেবে।

ভালো কথা, আমি মনে করি এর থেকে বেশি ভালো আর কিছু আশা করা যায় না। নিজেল বলে, তাহলে ব্যস, এখন দেখো আমার কথামতোই আমিও লোকটা ভালো। এই বলে সে টেবিলের উপর তিনটি জিনিস ছুঁড়ে দিল। আর সেই তিনটি জিনিস যথাক্রমে : হিসিন ট্যাবলেট, টিনচার ডিজিটালিসের বোতল ওমরফিন টারট্রেটের বোতল।

সঙ্গে সঙ্গে ইনসপেক্টর শার্প বলল : মরফিন টারট্রেট? বোতলের ওপর কোনো কোবেল ছিল না?

হা সেন্ট ক্যাথেরিন হাসপাতালের লেবেল।

আর অন্যগুলোয়?

আমি লক্ষ্য করিনি। তবে বলতে পারি, ওগুলো হাসপাতালের ছিল না।

তারপর কি ঘটলো?

তারপর অনেক কথা, অনেক তর্ক চললো তাদের মধ্যে। লেন বেটসন বলে : এখন তুমি যদি খুন করো, ধরা পড়ে যাবে। উত্তরে নিজেল বলে, একদমই নয়। আমি অতি সাধারণ লোক। ক্লিনিক বা হাসপাতালের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। তাই কেউ আমার টিকিও স্পর্শ করতে পারবে না, আর ওগুলো কোনো ফার্মেসির কাউন্টার থেকেও কিনিনি।

কলিন ম্যাকনার বলে, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওগুলো তুমি কোনো কেমিস্ট-এর কাছ থেকেও কিনতে পার না, শেষে অনেক তর্কের পর লেন বলে, আমি এর মধ্যে নেই। আমার হাতে টাকা নেই। আমি ওগুলো তার বক্তব্যের প্রমাণ রেখেছি। তারপর সে বলে, আমরা ওই ভয়ঙ্কর জিনিসগুলো নিয়ে কি করব? দাঁত বার করে হেসে নিজেল বলে, দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ওগুলোর হাত থেকে আমাদের রেহাই পেতে হবে। তাই তারা টিউব থেকে ট্যাবলেটগুলো বার করে আগুনে ফেলে দেয়। আর মরফিন টারট্রেটের বোতল থেকে পাউডার বার করে আগুনে ফেলে দেয়। তবে টিনচার ডিজিটালিস ল্যাবেটারিতে ফেলে দেয়।

আর বোতলগুলো?

 জানি না। তবে মনে হয় বোতলগুলো ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেয়।

এ ঘটনা কবেকার?

মনে হয় ঠিক এক পক্ষকাল আগে।

তাই বুঝি। ধন্যবাদ মিস টমকিনসন।

 জিন চলে যাওয়ার পর শার্প কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে। তারপর নিজেল চ্যাপম্যানকে ডেকে পাঠায়।

নিজেল ঘরে ঢুকতেই সে বলে ওঠে, এইমাত্র মিস টমকিনসনের কাছ থেকে একটা জরুরী তথ্য পেলাম মিঃ চ্যাপম্যান।

ওঃ। তা সে আমার বিরুদ্ধে কিভাবে আপনার মনটাকে বিষাক্ত করে তোলে?

বিষের প্রসঙ্গে আলোচনা করছিল সে। আর তা আপনাকে কেন্দ্র করে।

 বিষের ব্যাপারে আমাকে কেন্দ্র করে? কেন কি ব্যাপার?

যেভাবেই হোক আপনি কয়েকটা মারাত্মক বিষ সংগ্রহ করেন। কিন্তু কেউ তার হদিশ পায় না–এ ব্যাপারে কয়েকদিন আগে মিঃ বেটসনের সঙ্গে আপনি বাজী ধরেছিলেন, তা আপনি অস্বীকার করতে পারেন?

ওহো, একথা? হঠাৎ নিজেলের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।

 হা। অবশ্যই। আশ্চর্য, আমি ভাবতেও পারিনি জিন সেখানে উপস্থিত থাকতে পারে।

আড়াল থেকে শুনলে কেউ জানতেও পারে না। সেকথা থাক, এখন আপনি বলুন, ঘটনাটা আপনি স্বীকার করে নিচ্ছেন তো?

ওহো, হা। আমরা এবিষয়ে আলোচনা করেছিলাম বৈকি। আমাদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল, কাউকে না জানিয়ে, কিংবা সবার অলক্ষ্যে বিষ সংগ্রহ করা যায় কিনা। কলিন আর লেনের ধারণা ছিল, সেটা অসম্ভব। কেউ না কেউ জানতে পারবে। তখন আমি তাদের প্রমাণ করে দেখিয়ে দিই, উদ্ভাবনী দক্ষতা দিয়ে সবার অজান্তে অবশ্যই বিষ সংগ্রহ করা যায়।

তারপর আপনি বিষ সংগ্রহ করে তিনটি উপায়ের কথা ওদের বলেন, সেগুলো কি কি জানতে পারি কি মিঃ চ্যাপম্যান?

নিজেকে অপরাধী করার জন্য জিজ্ঞাসা করছেন না তো? বললো নিজেল, নিশ্চয়ই আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।

আপনাকে হুমকি বা সতর্ক করার সময় এখনো আসেনি মিঃ চ্যাপম্যান। তবে নিজেকে দোষী মনে করার কোনো কারণ নেই। সত্যি বলতে কি অনায়াসে আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অস্বীকার করতে পারতেন

জানি না, আমি অস্বীকার করতে চাই কি? কয়েক মুহূর্ত কি যেন ভাবল নিজেল, তার ঠোঁটে সামান্য হাসিও দেখা গেল। অবশ্যই। তারপর অকপটে সে স্বীকার করল, আমি যা করেছি অবশ্যই আইন-বিরুদ্ধ কাজ, এর জন্য আপনি আমার কাছ থেকে কৈফিয়ৎ চাইতে পারেন। আর সিলিয়ার মৃত্যু একটা খুনের কেস। এ ঘটনার সঙ্গে যদি কোনো সম্পর্ক থাকে, তাহলে আমার মনে হয় আপনাকে সব খুলে বলা উচিত।

এ খুবই বিচক্ষণতার পরিচয়।

 ঠিক আছে, আমি বলছি।

সেই উপায় তিনটি কি কি?

নিজেল তার চেয়ারে আরাম করে বসে বলতে শুরু করল। প্রত্যেকেই সব সময় কাগজ পড়ে তাই না? তাহলে কোনো দিন কাগজে খবর থাকে, কোনো ডাক্তারের গাড়ি থেকে মারাত্মক ধরনের ড্রাগ খোয়া গেছে। এ সম্পর্কে জনসাধারণকে সতর্ক করে দেওয়া হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি

হ্যাঁ।

ভালো কথা। এর থেকে একটা অতি সহজ উপায় আমার মাথায় আসে। মফঃস্বলের দিকে কোনো ডাক্তারের অনুসরণ করা–তারপর সুযোগ মতো সেই ডাক্তারের গাড়ি খোলা, ডাক্তারের অ্যাটাচিকেস খুলে দেখা, তারপর আপনার প্রয়োজন মতো বিষাক্ত ড্রাগ বার করে নেওয়া। জানেন ডাক্তাররা মফঃস্বলে রোগী দেখতে গেলে অনেকরকম ড্রাগ নিয়ে যায়। কারণ কোনো রোগীর কোনো ড্রাগের প্রয়োজন হয় এ ভেবে তারা সব রকম ড্রাগ মজুত রাখে। এ হল একনম্বর উপায়। এভাবে তিনতিনটি ডাক্তারকে অনুসরণ করার পর আমার প্রয়োজনীয় বিষ, হিসিন হাইড্রোব্রোমাইডের সন্ধান পাই।

ওঃ! দু নম্বর উপায়টা কি শুনি?

ওহো! সেটা খুব একটা দুঃসাধ্য ব্যাপার নয়। সিলিয়াকে একটু পাম্প দিয়েই কাজটা হাসিল করি। আমি আপনাকে আগেই বলেছি মেয়েটি সরল ও বোকা। তাই সে বুঝতেই পারেনি তাকে দিয়ে আমি কি করাতে যাচ্ছি। তাকে আমি বলি ডাক্তারদের হিজিবিজি হাতের লেখার কথা, আমি তাকে বলি ডাক্তারদের মতো হিজিবিজি করে আমার জন্য টিনচার ডিজিটালিসের একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিতে। সে কোনো সন্দেহ না করেই লিখে দেয়। তারপর আমি ক্লাসিফারে ডঃ ডাইরেক্টরি দেখে লন্ডনের বহুদূরের ডিস্ট্রিক্ট-এর একজন ডাক্তারের নাম দেখে একটা সই করে দিই। বলতে পারেন বেআইনী সই। তারপর লন্ডনের সবচেয়ে ব্যস্ত দোকান থেকে তা সংগ্রহ করি। মফঃস্বলের সেই ডাক্তার সম্বন্ধে তারা হয়তো বেশি পরিচিত ছিলো না।

হ্যাঁ, এটা অত্যন্ত উদ্ভাবনী দক্ষতার পরিচয়, শুকনো গলায় বললো শার্প। আপনার কথা শুনেই আমি বুঝতে পারছি আমি নিজেকে অভিযুক্ত করলাম। আর তৃতীয় উপায়টা কি জানতে পারি?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না নিজেল। অনেকক্ষণ পরে মুখ খুললো : দেখুন উপায়টা কি ভাবে বর্ণনা দেব বুঝতে পারছি না!

গাড়ির দজা খুলে ড্রাগ চুরি করা, বললো ইনসপেক্টর শার্প। প্রেসক্রিপশন নকল করে।

না, এটা প্রেসক্রিপশন নকল করা নয়। বাধা দিয়ে বললো নিজেল, তখন আমার কাছে যথেষ্ট টাকা ছিল না। তাই এবার ডাক্তারের সই নকল করা নয়। এবার সম্পূর্ণ নতুন এক পন্থায় কাজ করতে হবে।

তা সেটা কি মিঃ চ্যাপম্যান? হঠাৎ আবেগ বিজড়িত কণ্ঠে বলে উঠলো নিজেল, খুন আমি পছন্দ করি না। একাজ জানোয়ারসুলভ, ভয়ঙ্কর। বেচারী সিলিয়া খুন হওয়া তার প্রাপ্য নয়। বরং আমি তাকে সাহায্য করতে চাই। কিন্তু তাতে কি তার কোনো সাহায্য হল। আমি তো তার কোনো লক্ষণ দেখতে চাই না। মানে, আমি আপনাকে আমার দোষ বা ত্রুটির কথা বলছি।

দেখুন মিঃ চ্যাপম্যান, পুলিসের সহৃদয়তা আছে। তারা সব দিক দিয়ে ভালো ভাবে বিচার-বিবেচনা করে তবেই কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে থাকে। আপনি যে এই মেয়েটির খুনের একটা সমাধান করতে চাইছেন, আপনার এই আশ্বাসবাণী আমি অবশ্যই বিশ্বাস করি। এখন আপনি দয়া করে সেই তৃতীয় উদ্ভাবনী দক্ষতার কথাটা বলুন।

ঠিক আছে, নিজেল বললো, আমরা সেটার প্রায় শেষ প্রান্তে এসে গেছি। আগের দুটোর থেকে এটার ঝুঁকি বেশি ছিল। তবে এক সঙ্গে একটা মজার ব্যাপারও ছিল। দেখুন সিলিয়ার ডিসপেনসারিতে মাত্র একবার কি দুবার আমি যাই। সেখানকার সব আঁটঘাঁট আমার জানা ছিল!

তার মানে আপনি কাপবোর্ড থেকে বোতলটা চুরি করেন?

না, না অত সহজ ছিল না। তাছাড়া ওটা ভালো দেখায় না। তাছাড়া যদি কেউ দেখে ফেলে তো আমাকে ধরে ফেলবে। যদিও কাউকে খুন করার মোটিভ নিয়ে আমি সেখানে যাইনি। আসলে ছয় মাস আগে সিলিয়ার ডিসপেনসারিতে যাই। আমি জানতাম, রোজ এগারোটা পনেরোতে সে ও আরো দুটো মেয়ে পিছনের ঘরে চলে যায় টিফিন করতে। আর একটি মেয়ে ছিল, সে ছিল নতুন। আমাকে চিনত না। সে তখন বাইরে রুগী দেখছিল। আমি তখন ডিসপেনসারিতে ঢুকে পড়ি। পরণে সাদা কোট আর গলায় স্টেথোস্কোপ। আমি সিজেনবিষের কাপবোর্ডের কাছে যাই। একটা বোতল বের করে একেবারে শেষ প্রান্তে পার্টিসনের কাছে চলে যাই। সেখান থেকে পিছন ফিরে মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করি, তুমি আমাকে কয়েকটা ভেগানিন ট্যাবলেট দিতে পারো? ভীষণ মাথা ধরেছে। মেয়েটি ভেগানিন ট্যাবলেট হাতে নিয়ে এসে আমার কাছে দাঁড়ায়, পিছন ফিরেই ট্যাবলেটগুলো আমি তার হাত থেকে নিই এবং গলাধঃকরণ করে ফেলি তার সামনেই। তার কখনো সন্দেহই হলো না, আমি সেখানকার কোনো ডাক্তার কিংবা মেডিক্যাল ছাত্র নই এ যেন এক শিশুসুলভ খেলা। এমনকি সিলিয়াও জানতে পারল না, আমি সেখানে গিয়েছিলাম, অথচ কাজ আমার হাসিল হয়ে গেলো।

সেই স্টেথোস্কোপটা, কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো ইনসপেক্টর শার্প, আপনি পেলেন কোথা থেকে?

হঠাৎ দাঁত বার করে হাসলো নিজেল, সেটা ছিলো লেন বেটসনের, বললো সে, আমি সেটা চুরি করেছিলাম।

এর থেকে বোঝা গেলো সিলিয়া সেটা চুরি করেনি।

হা তারপরেই একদিন সন্ধ্যায় আমি তাদের সঙ্গে মিলিত হই এবং সেই তিন-তিনটি বিষ তাদের সামনে মেলে ধরি।

তার মানে কাউকে বিষপ্রয়োগ করার জন্য তিনটি ভিন্ন ধরনের বিষ সংগ্রহের জন্য আপনাকে তিন-তিনটি উপায় বার করতে হয়েছিল, ইনসপেক্টর বলে উঠলো, আপনি তাই বলতে চাইছেন?

মাথা নাড়ল নিজেল।

যথেষ্ট ভালো পথগুলো, বললো সে, তবে এটা ঠিক মেনে নেওয়া যায় না অন্তত বর্তমান পরিস্থিতিতে, তবে কথা হচ্ছে সে সব বিষগুলোই নষ্ট করে ফেলা হয় আজ থেকে দিন পনেরো কিংবা তারও কিছুদিন আগে হবে হয়তো। হ্যাঁ আপনি যেটা চিন্তা করছেন মিঃ চ্যাপমান, কিন্তু সত্যি সেটা নাও হতে পারে।

স্থির চোখে তার দিকে তাকালো নিজেল, আপনি কি বলতে চাইছেন?

এই বিষগুলো আপনার কাছেই ছিলো, কতদিন ধরে?

চিন্তা করলো নিজেল।

তা প্রায় দশদিন। মরফিন টারট্রেট প্রায় বারদিন। আর টিনচার ডিজিটালিন সেই দিনই বিকেলে পেয়েছিলাম।

আর সেগুলো কোথায় আপনি রেখেছিলেন? মানে সেই হিসিন হাইড্রোব্রোমাইড আর মরফিন টারট্রেট।

আমার আলমারির ড্রয়ারে।

ওগুলো যে সেখানে ছিলো অন্য কেউ জানতো?

না, না, আমি এ ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত, তা কেউ জানতো না, বললো সে, তবে তার কথার মধ্যে একটু ইতস্ততঃ ভাব লক্ষ্য করলো ইনসপেক্টর শার্প। তবে ঠিক তখনি এ বিষয়ে চাপ দিতে চাইলো না।

আপনি কি করতে যাচ্ছেন, কাউকে সে কথা বলেছিলেন, মানে আপনার সেই উপায়গুলোর কথা? যেভাবে আপনি সেই বিষগুলো সংগ্রহ করেছিলেন?

না অন্তত নয়, আমি বলিনি।

 আপনি অন্তত বলছেন কেন মিঃ চ্যাপম্যান?

আসলে আমি বলিইনি, সত্যিকথা বলতে কি জানেন, আমি প্যাটকেই কেবল বলতে যাচ্ছিলাম–ডাক্তারের গাড়ি থেকে, প্রেসক্রিপশন নকল করে কিংবা হাসপাতাল থেকে মরফিয়া চুরি করবার কথা। কিন্তু পরক্ষণেই আবার পিছিয়ে যাই আমি এই ভেবে যে, সে হয়তো মেনে নেবে না। খুব কঠোর প্রকৃতির সে। তাই

তার মানে আপনি তাকে এমন কিছুই বলেননি?

হা বলেছিলাম, পরে তবে গাড়ি থেকে বিষ চুরির কথা তার কাছে চেপে যাই, ভাবলাম, আমার সম্পর্কে তার একটা খুব খারাপ ধারণা হয়ে যেতে পারে।

বাজী জেতার পর আপনি যে সেই বিষগুলো নষ্ট করতে যাচ্ছেন, বলেছিলেন তাকে?

হ্যাঁ, তাকে খুব চিন্তিত বলে মনে হয়েছিল, তবে কোনো ক্ষতি হয়নি।

মিঃ চ্যাপম্যান আপনি বলেছেন বটে, কিন্তু ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

কি করে তা সম্ভব, আমি তো বলেছি, সেগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

মিঃ চ্যাপম্যান আপনার কি কখনো মনে হয়েছে, সেগুলো আপনি যেখানে রেখেছিলেন, কেউ হয়ত দেখে থাকবে। পরে সম্ভবত মরফিয়ার বোতল খালি করে অন্য কোনো পাউডার রেখে থাকতে পারে।

হায় ঈশ্বর! তার দিকে স্থির চোখে তাকালো নিজেল, একথা আমি তো আগে কখনো ভাবিনি। বিশ্বাসও করি না।

কিন্তু মিঃ চ্যাপম্যান, সম্ভাবনা থেকেই যায়। ইনসপেক্টর শার্প এবার জিজ্ঞেস করলো, ছাত্রদের মধ্যে সাধারণত আপনার ঘরে কার যাতায়াত বেশি?

লেন বেটসন আমার রুমপার্টনার, তাছাড়া বেশিরভাগ ছেলে আমার ঘরে মাঝে মধ্যে এসে থাকে। অবশ্য কোনো মেয়ে আসে না। পুরুষদের শয়নকক্ষে তাদের আসতে মানা আছে। পবিত্রতা রক্ষা করার জন্যই বটে।

হয়তো তাদের আসতে নিষেধ আছে, কিন্তু আমার ধারণা গোপনে তারা তো আসতে পারে। যেমন ধরুন মিস লেন, কখনো আপনার ঘরে এসেছে?

ইনসপেক্টর আপনি যে সুরে কথা বলেছেন আশা করি আপনি সেরকম কোনো অর্থ করছেন না। হ্যাঁ প্যাট আমার ঘরে মাঝে মাঝে আসে, আমার জন্য ও একটা উলের মোজা, বুনছে, আমার পায়ের মাপ নেওয়ার জন্য তার আসা। এর বেশি কিছুই নয়।

মিঃ চ্যাপম্যান আপনার বোঝা উচিত যে লোকটি খুব সহজেই বোতল থেকে মরফিয়া বদল করে অন্য কোনো পাউডার রেখেছিল সে আর কেউ নয়, আপনারই লোক সে।

তার দিকে তাকালো নিজেল, হয়তো তার মুখটা কঠিন এবং কৃশ হয়ে উঠলো।

হ্যাঁ, বললো সে, মাত্র এক কি দেড় মিনিট আগে আমি তা দেখেছি। আমি ঠিক সেটাই করতে পারতাম, কিন্তু বিশ্বাস করুন ইনসপেক্টর, মেয়েটিকে পৃথিবী থেকে সরানোর কোনো কারণই আমার নেই। আমি তা করিওনি। তবু এর পরে একটা কিন্তু থেকে যায়, তাই না? যাহোক আমি বুঝতে পারছি এর জন্য আপনি আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন।

.

০৯.

 বাজী ধরা এবং বিষ নষ্ট করে ফেলার কাহিনী লেন বেটসন, কলিন ম্যাকনার দুজনেই সমর্থন করলো। কলিন ম্যাকনারকে রেখে দিলো শার্প। অন্য দুজন চলে গেলো।

আপনাকে আমি আর দুঃখ দিতে চাই না মিঃ ম্যাকনার, বললো ইনসপেক্টর শাপ। আমি বুঝতে পারি বাগদানের রাত্রেই আপনার প্রেমিকার বিষপ্রয়োগে খুন হওয়াটা আপনার কাছে কত বেদনাদায়ক।

আমার দুঃখের জন্য আপনাকে অহেতুক চিন্তা করতে হবে না, বরং আপনার যদি কোনো প্রশ্ন থাকে, যার উত্তর কাজে লাগাতে পারে বলে আপনি মনে করেন, করতে পারেন মিঃ শাপ।

সিলিয়া অস্টিনের ব্যবহারে মনস্তত্ত্বের ছাপ আছে, এটাই আপনার সুচিন্তিত মতামত তাই না?

হ্যাঁ, বিশেষ করে ওর ছেলেবেলাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ভাবলে আমিই

তা ঠিক, তা ঠিক, আর একটা অখুশি ছেলেবেলার কাহিনি এড়ানোর জন্য ইনসপেক্টর শার্প অন্য প্রসঙ্গে এলো, কিছুদিন আপনি তার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছিলেন, তাই না?

আপনি হয়তো শুনলে অবাক হবেন, নিঃশব্দে অবচেতন মনে হঠাৎ আমি ওর প্রতি আকৃষ্ট হই, কিন্তু ব্যাপারটা আমি ঠিক জানতাম না। অল্প বয়সে বিয়ে করার ইচ্ছে আমার একেবারেই ছিলো না। তাই ওভাবে নিজেকে সংযত করতে পেরেছিলাম। অবচেতনে মনে হয়তো ওকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম, কিন্তু বিয়ে পর্যন্ত গড়াতে দিইনি।

হ্যাঁ, তাই হবে, আপনার সাথে বাগদানে খুশিই হয়েছিল সিলিয়া অস্টিন। তার মধ্যে কোনো অনিশ্চয়তা ছিলো না, থাকলে নিশ্চয়ই বলতো সে। আর আপনি তাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিলেন–তা কখন?

খুব শিগগীর নয়, স্ত্রীর ভার নেওয়ার মতো ক্ষমতা এই মুহূর্তে আমার নেই।

সিলিয়ার কোনো শত্রু ছিলো বলে আপনার কি মনে হয়? মানে কেউ তাকে পছন্দ করতো না, এমন কেউ?

আমি বিশ্বাস করি না। কারণ এখানে সবাই তার মিত্র ছিলো, এটা কোনো ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়।

ব্যক্তিগত ব্যাপার বলতে আপনি কি বোঝাতে চাইছেন?

একটা অনুমান মাত্র। ব্যাপারটা আমার নিজের কাছেই স্পষ্ট নয়।

সেদিক থেকে তাকে এর বেশি নাড়াচাড়া করতে পারে না, ইনসপেক্টর শার্প, শেষ যে দুজন ছাত্রীর জবানবন্দী নেওয়া বাকী ছিলো তারা হলো সেলী ফ্রিঞ্চ এবং এলিজাবেথ জনস্টন। প্রথমে সেলী ফ্রিঞ্চকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করলো ইনসপেক্টর।

সেলী বেশ আকর্ষণীয়া, তবে মাথার চুলগুলো তার রূপ যেন আরো বেশি খুলে দিয়েছিল। চোখদুটো উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত। রুটিন মাফিক জিজ্ঞাসাবাদের পরেই সেলী নিজেই প্রশ্নকর ভূমিকা নিলো।

আমি কি করতে চাই জানেন ইনসপেক্টর? আমি যা ভেবেছি তাই আপনাকে বলতে চাই। এ আমার ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা। জানেন, এ বাড়ির সবকিছুই কেমন যেন গোলমেলে। এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।

সিলিয়া অস্টিনকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছে বলে?

না, আমি বলতে চাই তার আগে থেকেই। এখানে যেসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আমার একেবারেই পছন্দ নয়। ঝোলানো ব্যাগ কেটে কুচি কুচি করাটা আমি পছন্দ করি না, পছন্দ করি না অনুরূপ ভাবে ভ্যালেরির স্কার্ফটা ছিঁড়ে ফেলা। ব্ল্যাক বেকের নোটের ওপর কালি ছিটনোও আমার পছন্দ নয়। তাই আমি এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যেতে চাই।

ফিঞ্চ, তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, কোনো ব্যাপারে আপনি ভয় পাচ্ছেন?

হ্যাঁ, আমি ভীত কোনো কিছু কিংবা কেউ এমন এখানে অত্যন্ত নিষ্ঠুর। এখানকার সমস্ত জায়গাটা দুষিত–কে জানে আপনাকে ঠিক কি ভাবে যে বোঝাবো। না, না, ইনসপেক্টর আমি কমিউনিস্টদের কথা বলছি না। আমি দেখতে পাচ্ছি, আপনার ঠোঁট কাঁপছে। আবার বলছি কমিউনিস্টদের ভয়ে নয়, এমন কি কোনো তাপরাধীর ভয়েও নয়। তবে আপনাকে বাজী ধরে বলতে পারি যে এই ভয়ঙ্কর বয়স্ক মহিলা এ ব্যাপারে সবকিছুই জানেন।

কোনো বয়স্কা মহিলা? আপনি মিসেস হার্বার্ডের কথা বলছেন না তো?

না, না, উনি আমাদের অতিপ্রিয়, আমি বলতে চাইছি মিসেস নিকোলেটিসের কথা। সেই বৃদ্ধা মেয়ে নেকড়ে বাঘিনীর কথা।

মিস ফিঞ্চ এতে খুবই আগ্রহের ব্যাপার, মিস নিকোলেটিসের ব্যাপারে একটু বিশদ ভাবে বলতে পারে না?

সেলী মাথা নাড়লো, সঠিক ব্যাপারটা আমি জানি না। মনে হয় সিলিয়া কিছু জানতো। শেষদিন আমাকে এরকম একটা আভাও দিয়েছিল। এখানকার সেই সব অশুভ ঘটনা ঘটে যাওয়ার ব্যাপারে। পুরো খুলে না বললেও ভয়ে সে আমাকে বলেছিল, এমন কিছু একটা সে জানে যা সে আমার কাছে প্রকাশ করতে চায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার বলা হয়ে ওঠেনি। তাই বলছি ইনসপেক্টর কারোর ব্যাপারে সে নিশ্চয়ই কিছু জানত, আর আমার মনে হয়, সেই কারণেই খুন হয়েছিল সে।

কিন্তু ফল সেরকম কিছু ভয়ঙ্কর হবে সেটা—

 তাকে বাধা দিয়ে বলে উঠলো সেলী-সেটা যে কতো ভয়ঙ্কর এ সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই ছিলো না। জানেন খুব একটা চটপটে মেয়ে সে ছিলো না। নেহাতই বোকা বোকা গোছের মেয়ে ছিলো সে, এমন একটা কিছু সে জানতো, যার বিপদের সম্ভাবনা তার আদৌ জানা ছিল না। সে যাহোক, এই হলো আমার পর্যবেক্ষণ, এটা যে কতো মূল্যবান তা আমার জানা নেই।

তাই বুঝি। ধন্যবাদ–এখন বলুন রাতে নৈশভোজের পরে শেষবারের মতো সিলিয়াকে আপনি কমনরুমে দেখেছিলেন, এই তো?

হ্যাঁ ঠিক তাই। তবে আসলে তার পরেও আমি তাকে দেখেছিলাম।

তারপরেও আপনি তাকে দেখেছিলেন! কোথায়? তার ঘরে?

না, আমি যখন শুতে যাই, তখন কমনরুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তখন ওকে সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখি।

সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যেতে, মানে আপনি বলতে চাইছেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলেন তাকে?

হ্যাঁ।

খুব আশ্চর্যের ব্যাপার তো কেউ তো একথা বলেনি।

মনে হয় তারা জানে না। সিলিয়া নিশ্চয়ই তাদের শুভরাত্রি জানিয়ে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে থাকবে, তাই তারা ধরে নিয়েছিল ও শুতে যাচ্ছে। আর আমি যদি ওকে দেখতে না পেতাম, আমিও সেইরকম ভেবে নিতাম। মনে হয় বাইরে কারোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো ও।

বাইরের কারোর সঙ্গে, নাকি কোনো ছাত্রের সঙ্গে?

হ্যাঁ আমার ধারণা, বোধহয় কোনো ছাত্রের সঙ্গে। দেখুন, ও যদি গোপনে কোনো ছাত্রের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিল, সেতো এই বাড়িতেই করতে পারতো, হয়তো কেউ ওকে বলে থাকবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে কোথাও দেখা করার জন্য।

কখন সে আবার ফিরে এসেছিল, এ ব্যাপারে আপনার কোনো ধারণা আছে?

না, কোনো ধারণাই নেই।

পরিচারক গেরানিমো জানতে পারে?

কারণ এগারোটার পর দরজায় চেন লাগিয়ে তালা দিয়ে দেয় সে। এগারোটা পর্যন্ত যে কেউ তার নিজের চাবি দিয়ে দরজায় তালা খুলতে পারে।

ঠিক কখন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল মনে আছে?

মনে হয় রাত দশটা কিংবা দু-চার মিনিট পরে হবে তার বেশি নয়।

আপনি যা বললেন, তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ মিস ফিঞ্চ, ইনসপেক্টর শার্প শেষ জবানবন্দী নিলো এলিজাবেথ জনস্টনের। মেয়েটিকে দেখা মাত্র তার দক্ষতা সম্পর্কে বেশ ভালোরকমই উপলব্ধি করলো সে। মেয়েটি তার প্রশ্নের উত্তর দিলো বেশ বুদ্ধিমতীর মতো।

শুনেছি সিলিয়া অস্টিন আপনার কাজ নষ্ট করার ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তীব্রভাবে করেছিল। মিস জনস্টন আপনি কি তা বিশ্বাস করেন?

আমার বিশ্বাসই হয় না, এ কাজ সিলিয়া করতে পারে না, না, অসম্ভব।

 কিন্তু কে সে কাজ করেছিল, আপনি জানেন না?

এর স্পষ্ট উত্তর হলো, নিজেল চ্যাপম্যান, কিন্তু আমার কাছে আবার এও স্পষ্ট যে, নিজেল অত্যন্ত বুদ্ধিমান, সে কি নিজের কালি ব্যবহার করতে পারে?

বেশ তো নিজেল যদি না হয়, তাহলে অন্য কে সে?

সে তো আরো কঠিন ব্যাপার, তবে আমার ধারণা, কে এ কাজ রাতে করতে পারে? সিলিয়া জানতো, কিংবা অন্তত অনুমান করেছিল।

সেরকম কিছু কি সে বলেছিল আপনাকে?

ও বলেছিল, একটু থেমে জনস্টন বলল, ও বলেছিল আমি ঠিক নিশ্চিত নই, এর কারণ আমি জানি না-হয়তো সেটা একটা ক্ষণিকের ভুল কিংবা দুর্ঘটনা হতেও পারে–তবে আমি নিশ্চিত যেই সে কাজ করে থাকুক না কেন, সুখী নয় সে, আর সত্যিই সে তার কৃতকর্ম স্বীকার করবেই একদিন না একদিন। সিলিয়া বলে চলে, তবে যেদিন পুলিস এখানে আসে ইলেকট্রিক বাল্ব উধাও হওয়ার ঘটনাটা আমার ঠিক বোধগম্য হয় না।

বাধা দিলো শার্প, এই ইলেকট্রিক বাল্ব উধাও হওয়া পুলিস আসার ব্যাপারটা কিরকম?

আমি জানি না। তবে সিলিয়া যা বলেছিল তা এইরকম : আমি সেগুলো নিইনি, তারপর সে আরো বলে কিন্তু পাসপোর্টের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক আছে কিনা জানি না। আমি তখন ওকে জিজ্ঞেস করি, কোনো পাসপোর্টের কথা তুমি বলছো? উত্তরে বলে, আমার মনে হয় কেউ হয়তো পাসপোর্ট নকল করে থাকবে।

কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে ইনসপেক্টর জিজ্ঞেস করলো, আর কি বলেছিল সে?

এর বেশি কিছু নয়। এই রকমই বলেছিল সে, যাহোক এ সম্পর্কে আরো বেশি কিছু আমি জানতে পারবো আগামীকাল।

এরকম কথা বলেছিল সে? সেটা খুবই অর্থপূর্ণ মিস জনস্টন।

হা।

আবার নীরব হলো ইনসপেক্টর শার্প, সে তখন পুলিসের রেকর্ডের কথা ভাবছিল।–এ বাড়িতে পুলিস আসার কথা–হিকরি রোডে আসার আগে বেশ সতর্কতার সঙ্গেই ফাইল দেখছিল সে। এই বাড়িতেই বেশ কিছু বিদেশী ছাত্রছাত্রী থাকত, তাই পুলিসের বিশেষ নজর ছিলো এ বাড়িতে। তবে ২৬নং হিকরি রোড ভালো, একজন মহিলার অর্জিত আয়ে একজন ওয়েস্ট আফ্রিকান ছাত্রের খরচ চলে, সেলী ফিঞ্চ পুলিস তাকে খুঁজছিল। এই ছাত্রটি কিছুদিন হিকরি রোডে ছিলো, তারপর সে এখান থেকে অবশ্যই কোথাও চলে গিয়ে থাকবে। পুলিসকে সাহায্য করার জন্য রুটিন মাফিক সমস্ত হোস্টেলে এবং বোর্ডিং হাউসে পুলিস গিয়ে থাকে–বিশেষ করে একটি সরাইখানার মালিকের স্ত্রীর খুন হওয়ার কেসে কেমব্রিজ পুলিস একটি ইউরোপীয় ছাত্রকে খুঁজছিল। তবে সংশ্লিষ্ট সেই যুবকটি কোনো পুলিস স্টেশনে গিয়ে স্বেচ্ছায় ধরা দিতে সেই কেসটার সমাধান হয়ে যায়। তারপর বিদেশী ছাত্রদের কিছু আপত্তিকর প্যামপ্লেট বিতরণ করার ব্যাপারে অনুসন্ধান কাজ চালায় পুলিস। এসব ঘটনা ঘটে কিছুদিন আগে কিন্তু সিলিয়া অস্টিনের মৃত্যুর সঙ্গে এ সবের কোনো সম্পর্ক থাকার কথা নয়।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলিজাবেথ জনস্টনের গভীর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ দুটির দিকে তাকালো সে, তাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করার জন্য, আবেগে বলে উঠল সে, মিস জনস্টন এখানকার কোনো ঘটনার ব্যাপারে কখনো গোলমেলে বলে আপনার কি মনে হয়েছে?

বিস্মিত হয়ে তাকালো সে। গোলমেলে কিভাবে?

আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না। আমি ভাবছি মিস সেলী ফিঞ্চ এর কথা সে আমাকে বলেছিল

ওহো সেলী ফিঞ্চ! এলিজাবেথের কণ্ঠস্বরে এমন একটা ভাব ছিলো যা তার কানে বাজলো, তার আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো, তাই ইনসপেক্টর বলে চলে :–আমার মনে হয়েছে, মিস ফিঞ্চ একজন ভালো পর্যবেক্ষক। এখানে কিছু অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, তবে সে ব্যাপারে নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেনি সে।

তীক্ষ্ণস্বরে এলিজাবেথ বলে উঠলো, আমেরিকানদের চিন্তাধারা ঐরকম, তারা সবাই সমান। এই সব আমেরিকানদের স্নায়ুকোষগুলো অত্যন্ত দুর্বল, বোকার মতো সবকিছুই তারা সন্দেহের চোখে দেখে। তাদের বোকামোর বহর দেখুন–তারা সব অপরাধীকেই ডাইনীর চোখে দেখে থাকে, সমাজতান্ত্রিক দেশের সবাইকে তারা কমিউনিস্ট বলে ভেবে থাকে। এক অদ্ভুত ধরনের মেয়ে ওই সেলী ফিঞ্চ।

ইনসপেক্টরের আগ্রহ আরো বেড়ে গেলো, তার মানে সেলী ফিঞ্চকে অপছন্দ করে এলিজাবেথ। কিন্তু কেন? কারণ কি? সেলী একজন আমেরিকান বলে? কিংবা সেলী আমেরিকান বলেই কি সব আমেরিকানদের অপছন্দ করে এলিজাবেথ? অথবা কারোর লালচুল দেখলেই তাকে অপছন্দ করার পিছনে তার নিজস্ব একটা কারণ আছে? সম্ভবত স্রেফ একটা মেয়েলী ঈর্ষার জন্য। যাহোক সেটা সে প্রয়োজনীয় মনে করলো এবং নরম সুরে বললো, মিস জনস্টন এতো বড় একটা প্রতিষ্ঠানে একজনের সঙ্গে অপরজনের বিচারবুদ্ধির বিরাট ফারাক যে থাকতে পারে, আপনি নিশ্চয় স্বীকার করেন, তবে আমরা যখন প্রচণ্ড বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো লোকের সংস্পর্শে আসি

এখানে একটু থামলো সে। যেন একটু বেশি তোষামোদ হয়ে যাচ্ছে, ভাবলো সে মেয়েটি কি সাড়া দেবে?

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললো সে : আপনি কি বলতে চান, বুঝেছি ইনসপেক্টর। এখানে সাধারণ মানের বুদ্ধি কারোর নয়, যেমন আপনি বললেন, কেউ কেউ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। যেমন নিজেল চ্যাপম্যান, বুদ্ধি এতোই প্রখর যে, খুব দ্রুত যে কোনো ব্যাপার সে ধরে নিতে পারে, কিন্তু তার মনটা খুবই ভালো, তবে তার নজরটা ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গির দিকে। আর সে স্নায়ুকোষগুলো কাজে লাগাতে অত্যন্ত অলস। আপনি আলোকপ্রাপ্ত মনের খোঁজ করছেন, অন্যদের থেকে সেইরকম মনোভাবাপন্ন মানুষের সন্ধান করতে চাইছেন।

যেমন আপনার বেলায় প্রযোজ্য মিসেস জনস্টন, কোনোরকম আপত্তি না করেই তার সেই প্রশংসা মেনে নিলো এলিজাবেথ, তার উপলব্ধি হলো মেয়েটি সত্যিই মিষ্টি স্বভাবের। এই তরুণীটির গর্বিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। নিজের গুণাগুণ জাহির করার ঔদ্ধত্য বেমানান নয়। মিস জনস্টন আপনার সঙ্গী ছাত্রবন্ধুদের সম্পর্কে আপনার বিশ্লেষণ আমি সমর্থন করি। সত্যি চ্যাপম্যান চালাক বটে, তবে ছেলেমানুষ সে। ভ্যালেরি জনহাউসের বুদ্ধি আছে বটে কিন্তু জীবনটাকে উপভোগ করার মতো মনোভাব তার নেই। আপনি আলোকপ্রাপ্ত মনের কথা বলছেন। আমি আপনাকে সেই জাতের মেয়ে বলে গণ্য করি। আর সেই কারণেই আপনার মতামতের আমি গুরুত্ব দিচ্ছি আলাদা এক শক্তিধর বুদ্ধিমতীর মতামত।

জানেন ইনসপেক্টর এই জায়গাটার ক্ষেত্রে কোনো গোলমালই নেই। সেলী ফিঞ্চ-এর কথায় কোনো কান দেবেন না। খুব ভালো হোস্টেল এটা। এখানে কোনোরকম খারাপ চালচলন আপনি দেখতে পাবেন না। একটু বিস্মিত হলো ইনসপেক্টর শার্প। সত্যি কথা বলতে কি খারাপ চালচলনের কথা আদৌ ভাবছি না।

ওহো, তাই বুঝি–একটু পিছু হটলো সে। পাসপোর্টের ব্যাপারে সিলিয়া যা বলেছে, আমি তার সঙ্গে একটা যোগাযোগ খুঁজে বার করার চেষ্টা করছিলাম। তবে কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব না করেই আর সবরকম প্রমাণ অনুধাবন করে আমার মনে হয়েছে সিলিয়ার মৃত্যুর কারণ স্রেফ ব্যক্তিগত ব্যাপার-মনে হয় যৌন জটিলতার ব্যাপার আর কি। তবে তাই হলে এই বলবো না যে, এই হোস্টেলে এরকম ঘটনাই ঘটে চলেছে। আমি নিশ্চিত, এখানে সেরকম ঘটনার চল নেই। থাকলে আমি ঠিক জানতে পারতাম। আমার উপলব্ধি খুবই সূক্ষ্ম।

তাই বুঝি, তাহলে সেজন্য আপনাকে তত বাড়তি ধন্যবাদ দিতে হয় মিস জনস্টন। আপনার বদান্যতা আর সাহায্য সত্যিই প্রশসংনীয়।

এলিজাবেথ জনস্টন চলে যাওয়ার পর স্থির দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো ইনসপেক্টর শার্প। তার তন্ময়তা ভাঙাবার জন্য সার্জেন্ট কব দুদুবার চেষ্টা করেছিল।

ওহো, তুমি! সম্বিৎ ফিরে পেয়ে শার্প বলে, হ্যাঁ আরাম এখানে কি পেলাম? খুবই অল্প। কিন্তু আমি তোমাকে একটা কথা বলে রাখছি কব, সার্চ ওয়ারেন্ট নিয়ে আগামীকালই আমি এখানে ফিরে আসছি, ওরা হয়তো ভাবছে সবকিছুই বুঝি শেষ হয়ে গেছে, ভাবতে দাও ওদের। ওখানে যে একটা বড়রকম কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আমি নিশ্চিত। আগামীকাল এ কেসের ভোল আমি পাল্টে দেব।-তবে কাজটা খুব সহজ হবে না, কিন্তু আমার বিশ্বাস, আমি আমার একটা ক্লু ঠিক খুঁজে পাবোই। মিস জনস্টনের কথাবার্তা শুনে দারুণ আগ্রহ বোধ করছি। মেয়েটির মধ্যে নেপোলিয়নের অহংভাব আছে, আমার সন্দেহ মেয়েটি অবশ্যই কিছু জানে।