ভীষ্ম – ৫

॥ ৫ ॥

আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও একটা দৃশ্য হামেশাই চোখে পড়ত। বাড়িতে যেসব কচিকাঁচারা জন্ম নিত একটু বড় হলেই, তাদের শিক্ষাদীক্ষা এবং অভিভাবকত্বের ভার থাকত বৃদ্ধ ঠাকুরদাদাটির ওপর। উপার্জনকারী পিতা সংসারের অর্থনৈতিক চাহিদা মেটাতে ব্যস্ত থাকতেন বলে সংসারের মূল শাসনটা তাঁরই হাতে থাকত বটে, কিন্তু তাঁর সন্তানের শিক্ষা সংক্রান্ত প্রাথমিক ভাবনাগুলি ভাবার জন্য ঠাকুরদাদাই ছিলেন আদর্শ ব্যক্তি। মহাভারতে ভীষ্মকেও আমরা প্রায় সেই ভূমিকাতেই দেখছি। রাজ্যশাসনের সাধারণ ক্ষেত্রগুলিতে তিনি প্রায়ই আর কথা বলেন না। কেননা রাজ্যভারপ্রাপ্ত ধৃতরাষ্ট্রই একভাবে রাজ্যশাসন জারি করেন, মন্ত্রী অমাত্যরা তা শোনেন এবং ভীষ্ম সেখানে সাধারণত নিজের অনুপ্রবেশ ঘটান না।

ইতিমধ্যে পাণ্ডব কৌরবদের ক্রীড়াকৌতুকের মাঝখানে দুর্যোধন যে ভীমকে বিষান্ন খাইয়ে মারবার চেষ্টা করেছিলেন, ভীষ্ম সে খবর পানইনি। এই ঘটনার পরে পরেই পাণ্ডব কৌরবদের শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে ভাবতে লাগলেন ভীষ্ম। খুব বড় সুযোগই এসে গেল। কুলগুরু কৃপাচার্যই শিক্ষার প্রাথমিক কাজগুলো চালাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু ভীষ্ম চাইছিলেন—এমন কারও কাছে তাঁর নাতিদের অস্ত্রশিক্ষা হোক যিনি মহাস্ত্রবিদ। তিনি নিজে মহাবীর পরশুরামের শিষ্য, কিন্তু তাঁর পরে এমন কেউই এ বংশে জন্মাননি, যিনি অস্ত্রশিক্ষার গভীর প্রয়োজনবোধে মহান গুরুর কাছে গেছেন অথবা সেইরকম কোনও অস্ত্রশিক্ষা করেছেন।

সুযোগ এসে গেল, পরশুরামের কাছে দিব্যাস্ত্র লাভ করা দ্রোণাচার্য যখন পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে অপমানিত হয়ে হস্তিনাপুরে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। চেহারা এবং ক্ষমতার কথা শুনেই ভীষ্ম বুঝে গেছেন যে, তিনিই দ্রোণাচার্য। দ্রোণাচার্য ভীষ্মের কাছে তাঁর ব্যক্তিগত অপমানের কথা জানালেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ তাঁর সঙ্গে যে মিথ্যাচার করেছেন, তার করুণ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন ভীষ্মের কাছে। এমনকী দ্রোণ যে প্রধানত পাঞ্চাল দ্রুপদের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যই শিষ্যকামী হয়ে হস্তিনাপুরে এসেছেন, সে কথাও তিনি গোপন রাখলেন না ভীষ্মের কাছে। সব শুনেও কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণাচার্যকে বরণ করলেন পাণ্ডব কৌরবদের অস্ত্রগুরু হিসেবে। দ্রোণের করুণ বর্ণনা এবং কঠিন প্রতিজ্ঞার কথা শুনে ভীষ্ম তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন—আপনি আপাতত ধনুকের ছিলাটি খুলে রেখে কুরুদের ঘরে বিশ্রাম করুন। খাওয়াদাওয়া করুন ভাল করে। সমস্ত কুরুদেশ আপনার পাশে আছে। প্রতিজ্ঞাপূরণের জন্য আপনি যেমনটি চান, তেমনটি হয়েই গেছে ভেবে নিন—যচ্চ তে প্রার্থিতং ব্ৰহ্মণ্‌ কৃতং তদিতি চিন্ত্যতাম্‌।

বিচিত্রবীর্যের সময় থেকে পাণ্ডুর রাজত্ব পর্যন্ত এত বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ভীষ্ম এর আগে নেননি। মনে রাখা দরকার পাঞ্চালরা বহুকাল আগে কুরুবংশ থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল। কুরুদের সঙ্গে তাঁদের শত্রুতাও চলছে বহুদিন ধরে। কখনও সে শত্রুতা যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমেও প্রকট হয়েছে, কখনও বা তা স্তিমিত থেকেছে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে—কুলগুরু কৃপাচার্যকে মহারাজ শান্তনু পাঞ্চাল থেকেই তুলে এনে পালন করেছিলেন হস্তিনায়। কুরুবংশীয় সম্বরণের সঙ্গে পাঞ্চালদের বিরাট যুদ্ধ হয়েছিল আগে, আবার পাঞ্চাল সোমকের সঙ্গে কৌরবদের যুদ্ধও ভীষ্মের সময়ে পূর্বের ইতিহাস। কিন্তু যখন যাই হোক, কৌরবদের সঙ্গে পাঞ্চালদের রাজনৈতিক সম্বন্ধটা সব সময়ই শত্রুতার সূত্রে বাঁধা। কুরুদের ভারপ্রাপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্র এই ইতিহাস যত কমই জানুন, কিন্তু পাঞ্চালদের কোনও শত্রুকে তাঁর রাজ্যে আশ্রয় দিলে কৌরব হিসেবে যে সাধারণ সুখ তিনি পাবেন—এটা ভীষ্মের জানা ছিল। কাজেই ভীষ্ম যে কাউকে জিজ্ঞাসা না করেই হস্তিনাপুরে পাঞ্চালদের এক বিরাট শত্রুকে রাজবাড়িতে আশ্রয় দিলেন, তার কারণ বংশ বংশ ধরে কৌরবদের পাঞ্চাল-বিরোধিতা এতটাই স্বতঃসিদ্ধ।

ব্যক্তিগতভাবে মহামতি ভীষ্মের পাঞ্চাল-বিরোধিতার আরও একটি প্রকট কারণ অবশ্যই সেই অম্বা। আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই যে, অম্বার মাতামহ ছিলেন সৃঞ্জয় হোত্ৰবাহন। তিনি পাঞ্চাল। হোত্ৰবাহন অত্যন্ত ব্যক্তভাবে ভীষ্মের বিরোধিতা করেছিলেন এবং পরশুরামকে দিয়ে ভীষ্মকে তিনি মার খাওয়ানোরও চেষ্টা করেছিলেন। হোত্ৰবাহনই ছিলেন অম্বার প্রথম এবং শেষ আশ্রয়দাতা। এরমধ্যে যত সময় গেছে ততদিনে অস্ত্রতপস্যা সেরে অম্বার পাঞ্চালে চলে আসবারই কথা এবং আগেই বলেছি, বিশ্বস্ত চরদের মুখে ভীষ্ম অম্বার সমস্ত খবরই রাখতেন। এক রমণী যিনি তাঁর মৃত্যুর জন্য তপস্যা করছেন, তাঁকে যদি পাঞ্চালরা আশ্রয় দিয়ে থাকে, তবে সত্যিই তো ভীষ্ম দ্রোণাচার্যকে এইরকমই আশ্বাস দেবেন যে—আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, কুরুরা সবাই আপনার পাশে আছে—সর্বে চ কুরব-স্তব।

ভীষ্ম অত্যন্ত সমাদর করে দ্রোণাচার্যের জন্য উত্তম বাসস্থান এবং উত্তম ভোজনের ব্যবস্থা করলেন। সবচেয়ে বড় কথা পাণ্ডব কৌরবদের অস্ত্রগুরু হিসেবে ভীষ্ম নিয়োগ করলেন দ্রোণাচার্যকে। অস্ত্রশিক্ষা চলাকালীন অবস্থাতেই পাণ্ডব কৌরবদের জ্ঞাতিবিরোধ রেখাটি ভীষ্মের কাছে বেশ প্রকট হয়ে উঠল। আধিরথি কর্ণ দুর্যোধনের সঙ্গে জোট বেঁধেছেন, তিনি অর্জুনের প্রতি আক্রোশে তাঁকে মারতে চান,— এসব কথা তাঁর কানে আসছিল বটে, তবে পাণ্ডব কৌরবদের এই জ্ঞাতিশত্রুতা খুব ভালভাবে প্রকট হয়ে উঠল গুরু দ্রোণের পরীক্ষাগ্রহণের সময়। উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চে কৌরব পাণ্ডবের যেমন কথা কাটাকাটি হয়েছিল, কর্ণ যেভাবে অর্জুনকে হেনস্থা করা সত্ত্বেও দুর্যোধনের কাছ থেকে অঙ্গ রাজ্যের পুরস্কার পেলেন—এসব ঘটনা মহামতি ভীষ্মকে শঙ্কিত করেছিল নিশ্চয়।

অস্ত্ৰপরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে দ্রোণাচার্য গুরুদক্ষিণা চাইলেন এবং অর্জুন তাঁর পূর্বপ্রতিজ্ঞা মতো দ্রুপদরাজাকে দ্রোণাচার্যের কাছে ধরে আনলেন জীবিত। এ ঘটনায় ভীষ্ম কতটা প্রীত হয়েছিলেন, সে খবর মহাভারতের কবি দেননি। কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিতে বিচার করলে, বিশেষত কুরু পাঞ্চালদের পূর্বশত্রুতা এবং ভীষ্মের ব্যক্তিগত কারণের কথা বিচার করলে দ্রুপদের অপমানে ভীষ্মের প্রীত হবারই কথা। ব্যক্তিগতভাবে ভীষ্ম হয়তো তত দ্রুপদবিরোধী ছিলেন না। কিন্তু পাঞ্চালরা কখনও ভীষ্মের বন্ধুস্থানীয় হতে পারেন না, এ কথা মহাভারতের রাজনীতিতে স্বতঃসিদ্ধ।

যাই হোক, দ্রুপদের মতো মহাবীর পাণ্ডব অর্জুনের হাতে পর্যদস্ত হওয়ায় অপিচ পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের মহান গুণরাশি সমস্ত পৌর-জনপদের সম্মত হওয়ায় প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র আপাতত যুধিষ্ঠিরকে যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করতে বাধ্য হলেন। এতাবৎ পর্যন্ত হস্তিনাপুরের রাজনীতি যেভাবে চলছিল, তাতে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের ভাবনালোকে তেমন কোনও আঘাত পড়েনি। মৃতপিতৃক পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর স্নেহ করুণার অন্ত ছিল না। বিশেষত তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন যখন পাঞ্চাল দ্রুপদকে যুদ্ধে জিতে গুরুদক্ষিণা দিলেন, তখন ভীষ্মের গভীর অন্তরে যে এক ধরনের তৃপ্তিই হয়েছিল সে কথা অনুমান করা যায়। অন্যদিকে সদা বিনয়ী যুধিষ্ঠির যেভাবে সকলের সম্মত আচরণ করে রাজ্য চালাচ্ছিলেন, তাতেও ভীষ্মের সন্তুষ্টির কারণ ছিল। তাঁর সন্তুষ্টির আরও বড় কারণ হল—পাণ্ডু রাজা ছিলেন এবং তিনি স্বর্গস্থ হবার পর তাঁরই জ্যেষ্ঠ পুত্র যুধিষ্ঠির যুবরাজ পদে আসীন। কুরু বংশের উত্তরাধিকার ঠিক পথেই চলেছে।

কিন্তু এই স্থিতাবস্থা এবং শান্তি বেশি দিন চলেনি। যুধিষ্ঠিরের জনপ্রিয়তা এবং ভীমার্জুনের অস্ত্রশিক্ষার প্রতিপত্তি শীঘ্রই ধৃতরাষ্ট্রের মন দূষিত করে তুলল এবং তিনি তাঁর স্বার্থান্বেষী পুত্র দুর্যোধন, শ্যালক শকুনি এবং কর্ণের পরামর্শে পাঁচ ভাই পাণ্ডব এবং তাঁদের জননী কুন্তীকে বারণাবতের জতুগৃহে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করলেন। মহামতি ভীষ্মের ব্যক্তিগত গুপ্তচরেরা বয়োবৃদ্ধ ভীষ্মের কাছে আর বেশি কাজ পেত না হয়তো, অথবা হস্তিনাপুরের রাজশাসনে অল্পবয়স্কদের গুরুত্ব বাড়তে থাকায় ভীষ্ম নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলেই হয়তো ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর এই গোষ্ঠীর কুমন্ত্রণাগুলি তিনি কিছুই জানতে পারলেন না। এমনকী বারণাবতে রওনা হবার সময় যুধিষ্ঠির যে ভীষ্মের পা জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন, তাতেও ভীষ্ম খুব ধারণা করতে পারলেন না যে, পাণ্ডবদের বারণাবতে যাওয়াটা নিজের ইচ্ছায় ঘটেনি। ঘটেছে ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছায়।

বস্তুত, এইসব সময় আমরা ধর্মাত্মা বিদুরকে অনেক বেশি কৌশলী এবং কর্মতৎপর দেখতে পাই। পাণ্ডুর মৃত্যু এবং জননী সত্যবতীর বনগমনের পর থেকে ভীষ্মকে কুরুবাড়ির অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলিতে একেবারেই মাথা গলাতে দেখি না। সমস্ত ক্ষেত্রেই তিনি আছেন, অথচ খানিকটা নির্লিপ্ত, নির্বিকারও বটে। পাণ্ডবরা বারণাবতে যাবার সময় তাঁকে যেমন বিচলিত দেখছি না, তেমনই বারণাবত থেকে যখন পাণ্ডবদের পুড়ে মরার মিথ্যা খবর সত্যের আকারেই পৌঁছোল, তখন কুচক্রী ধৃতরাষ্ট্রকেও আমরা খানিকটা বিহ্বল দেখছি, কিন্তু ভীষ্মকে তত নয়। কিন্তু তাই বলে ভীষ্ম যে কুরুবাড়ির সমস্ত ঘটনায় তাঁর দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন অথবা লোকে তাঁকে কোনও গণনার মধ্যেই আনছে না, এমনও কিন্তু মনে হচ্ছে না।

বস্তুত পাণ্ডুর মৃত্যুর পর থেকেই ধৃতরাষ্ট্র যেভাবে তাঁর নিজের স্বার্থ এবং পুত্রগোষ্ঠীর উচ্চাশায় আতপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, যেভাবে তাঁর হুকুম জারি হচ্ছিল, তাতে ভীষ্মের মতো বিশাল রাজনীতিজ্ঞ মানুষ একটু নির্বিকার ভাব দেখিয়ে নিজেকে সামান্য গুটিয়ে রেখেছিলেন মাত্র। কুরুবাড়ির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তিনি আপাতত মত প্রকাশ না করলেও সমস্ত ব্যাপারে তাঁর কৌতূহল মোটেই চলে যায়নি। লক্ষ করে দেখবেন, বারণাবতে জতুগৃহের অন্যায় নির্মাণকর্ম টের পেয়ে যাবার পর ভীম যখন সেই জতুগৃহ ত্যাগ করে যাবার কথা বলছেন, তখন যুধিষ্ঠির ওই কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের প্রতিক্রিয়ার কথাই একমাত্র ভাবছেন, অন্য কারও নয়। যুধিষ্ঠির বলছেন—আমাদের পালিয়ে যাওয়া চলবে না। এখানেই আমরা থাকব, তবে সতর্কভাবে থাকব। তারপর দেখো, আমাদের জন্য তৈরি করা বাড়ি যদি আমরাই পুড়িয়ে দিই, তবে ভীষ্ম তাতে আমাদের ওপর যেমন রাগ করবেন না, তেমনই দুর্যোধনের ওপর অন্যান্য কৌরববংশীয়দেরও তিনি সেভাবে রাগিয়ে তুলতে পারবেন না। কিন্তু আমাদের জন্য তৈরি বাড়ি যদি পুরোচন পুড়িয়ে দেয় তা হলে দুর্যোধন যেহেতু পুরোচনকে এই কাজে নিযুক্ত করেছে, তাই দুর্যোধনের ওপরেই পিতামহ ভীষ্ম এবং অন্যান্য কুরুবংশীয়রা ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবেন।

বেশ বোঝা যায়, ভীষ্মের রাগের মূল্য এখনও কিছু কমেনি। ধৃতরাষ্ট্র নন, ভীষ্ম যাঁর ওপরে ক্রুদ্ধ হয়ে উঠবেন, তাঁর প্রতিপক্ষের রাজনৈতিক সুবিধা হবে, সেটাই বোঝা যাচ্ছে যুধিষ্ঠিরের ভাবনায়। আরও একটা কথাও লক্ষ করার মতো। পাণ্ডবরা বিদুরের বুদ্ধিতে জতুগৃহে আগুন লাগিয়ে বেরিয়ে যাবার পর বারণাবতের মানুষজন যখন পাঁচ-ছটি ভস্মীভূত মৃতদেহ দেখল, তখন তারা পাণ্ডবদের মৃত্যু হয়েছে বলেই মনে করল। দুষ্টবুদ্ধি পুরোচন যে দুর্যোধনের বুদ্ধিতেই পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মেরেছে এবং ধৃতরাষ্ট্র যে তাঁকে কিছুই বাধা দেননি—এই কথা বলে পৌর-জানপদেরা ধৃতরাষ্ট্রকে খুব গালাগালি দিতে লাগল। লক্ষণীয়, এই গালাগালির প্রকোপ থেকে পিতামহ ভীষ্মও বাদ গেলেন না। গেলেন না এই জন্য যে, ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধন যদি অন্যায় অধর্ম করেন, তবে সেটাও যেন সাধারণ মানুষেরা তবু মানতে পারে, কিন্তু এই অন্যায় অধর্ম ভীষ্ম কেন হতে দিলেন, কেন তিনি তাতে বাধা দিলেন না—এটা তারা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। তারা বলেই ফেলল—আমাদের মহারাজ শান্তনুর ছেলে ভীষ্মই বা কেমন মানুষ! তাঁরও তো কোনও ন্যায়নীতি ধর্মবোধ আছে বলে মনে হচ্ছে না—নূনং শান্তনবো’পীহ ন ধর্মমনুবর্ততে।

প্রজাসাধারণের এই আপশোস হতাশা থেকে বোঝা যায় যে, ভীষ্মকে তারা ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনের সাধারণ মানে বিচার করে না। ভীষ্মের জন্য তাদের মনে আলাদা একটা জায়গা আছে এবং সে জায়গাটা এমনই যেখান থেকে কোনও অন্যায় করা যায় না, বরং অন্যায়ের প্রতিরোধ ঘটে সেখান থেকে। কুরুবাড়ির সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে ভীষ্ম এখন তেমন মাথা না ঘামালেও সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভীষ্মের ভূমিকাটা কী, সেটা এখনও সাধারণের কাছে যথেষ্ট বড় প্রশ্ন। শুধু তাই নয়, কুরুবাড়ির চূড়ান্ত রাজশক্তি যে ঘটনার জন্য দায়ী, সেখানে চূড়ান্ত মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে ভীষ্ম যে তাঁর দায় এড়াতে পারেন না—সেটা এই সাধারণ জনের আক্ষেপ থেকেই সবচেয়ে ভাল বোঝা যায়।

ভীষ্ম আর নিশ্চুপে বসে থাকেননি। জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে যাবার পর দ্রৌপদীর বিবাহসূত্রে পাণ্ডবরা যখন পাঞ্চাল দ্রুপদকে শ্বশুর হিসেবে পেলেন, রাজনৈতিকভাবে সেদিন থেকেই কুরুরাজ্যের খানিকটা পশ্চাদ্‌গতি ঘটে গেল। পাঞ্চালদের পরম শত্রু দ্রোণাচার্যকে আশ্রয় দিয়ে ভীষ্ম যে পরিকল্পনাগুলি মনে মনে লালিত করছিলেন, তা অনেকটাই বিপর্যস্ত হয়ে গেল অর্জুনের মতো মহাবীর দ্রুপদের জামাই হয়ে যাওয়ায়। ভীষ্মকে এই বাস্তব পরিস্থিতি গলাধঃকরণ করতে হল পাণ্ডবদের কারণেই। পাণ্ডবরা দ্রুপদকে সহায় হিসেবে পাওয়ায় ধৃতরাষ্ট্র নিজে ভীষণভাবে চিন্তিত হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র তথা শকুনি কর্ণদের বাস্তববোধ কম ছিল বলেই এই সময়ে তাঁরা পাণ্ডবদের আক্রমণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। প্রস্তাবটা ধৃতরাষ্ট্রের পছন্দসই হওয়া সত্ত্বেও ভীষ্ম বিদুর ইত্যাদি পরিণত রাজনীতিজ্ঞদের সঙ্গে কথা না বলে তিনি এই আক্রমণের মধ্যে যেতে চাননি।

ধৃতরাষ্ট্র কথাটা পাড়তে গিয়েছিলেন কেবল। বহুকাল পরে ভীষ্ম পূর্বের মতো তাঁর মুখ খুললেন। এতদিনে দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রের জতুগৃহ নির্মাণের হেতু তাঁর হৃদয়ঙ্গম হয়েছে। তাঁর কানে পৌঁছে গেছে কৌরবদের পূর্বকৃত পরিকল্পনা। অন্যদিকে পাণ্ডব পাঞ্চালদের এক সূত্রে অবস্থিতি ভীষ্মকে ভয়ংকর অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। এই অদ্ভুত রাজনৈতিক মেরুকরণ, যার মধ্যে বিশালবুদ্ধি কৃষ্ণের আনুগত্যে যাদবদেরও অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, এই মেরুকরণের গুরুত্ব আর কেউ তেমনভাবে না বুঝলেও ভীষ্ম বিদুর তা বুঝেছিলেন। এমনকী অনিচ্ছায় হলেও ধৃতরাষ্ট্রও তা পরে বুঝেছিলেন।

পাণ্ডবদের বেঁচে ফিরে আসা এবং পাঞ্চালদের সঙ্গে তাঁদের একত্রিত হওয়ার পর দুর্যোধন-কর্ণের মনে প্রতিহিংসার আগুন দেখতে পেলেন ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু সে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করাটা যে রাজনৈতিকভাবে ভীষণ ভুল হবে সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন এবং বুঝতে পারছিলেন বলেই ভীষ্ম বিদুর দ্রোণকে তিনি ডেকে আনলেন আলোচনাসভায়। ভীষ্ম এবার তাই অনেক দিন পরে মুখ খুললেন।

ভীষ্ম বললেন—পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ করাটা আমার মোটেই ভাল লাগছে না—ন রোচতে বিগ্রহো মে পাণ্ডুপুত্রৈঃ কথঞ্চন। আর আমার দিকে তাকিয়ে দেখলে—ধৃতরাষ্ট্র! তুমিও আমার কাছে যেমন, পাণ্ডুও তাই। গান্ধারীর ছেলেরাও আমার কাছে যেমন, কুন্তীর ছেলেরাও তাই—গান্ধার্য্যাশ্চ যথা পুত্ৰাস্তথা কুন্তীসুতা মম। আমি যা বুঝি, তাতে পাণ্ডুর ছেলেদের রক্ষা করার দায় আমার যতটুকু আছে, তোমারও ঠিক ততটুকুই। পৃথক দুটি ব্যক্তির বংশধর হলেও পাণ্ডব কৌরবদের সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা যেহেতু একইরকম, তাই পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধটা আমার কাছে মোটেই রুচিকর নয়।

পাণ্ডব কৌরবের এক পিতামহ হিসেবে ভীষ্ম নিজের নিরপেক্ষ ভাবটুকু প্রতিষ্ঠিত করেই তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন দুর্যোধনকে। সে সিদ্ধান্ত তাঁর কাছে রুচিকর না হলেও তা ছিল ভীষণ রকমের বাস্তববোধপ্রসূত এবং তর্কের দিক থেকে তা ছিল অমোঘ। ভীষ্ম বললেন—আমার ইচ্ছে, তুমি পাণ্ডবদের কাছে ডেকে নিয়ে এই কুরুরাজ্যের অর্ধেক শাসন তাদের হাতে তুলে দাও—সন্ধায় বীরৈর্দীয়তামর্ধভূমিঃ। এটা বোঝা দরকার যে, দুর্যোধন! তুমি যেমন এই রাজ্যকে তোমার পৈতৃক উত্তরাধিকার বলে ভাবছ, তেমনই পাণ্ডবরাও তো ভাবছে যে, এই রাজ্যে তাদেরও উত্তরাধিকার আছে, বিশেষত তাদের পিতা এই রাজ্যের রাজা ছিল—মম পৈতৃকমিত্যেবং তে’পি পশ্যন্তি পাণ্ডবাঃ। তাই বলছিলাম পাণ্ডবরা যদি কোনওভাবেই তাদের রাজ্যাংশ না পায়, তা হলে এ রাজ্যটা তোমাদেরই—এটা ভাবারও কোনও কারণ নেই।

ভীষ্ম এবার তাঁর সাংবিধানিক যুক্তিগুলি দিলেন। তৎকালীন দিনের উত্তরাধিকার আইন যা প্রচলিত ছিল, সেইদিকে দৃষ্টি রেখে ভীষ্ম বললেন— আমাকে যদি জিজ্ঞাসা কর, তবে বলব—এ রাজ্য তুমি আইন অনুসারে পাওনি—অধর্মেণ চ রাজ্যং ত্বং প্রাপ্তবান্ ভরতর্ষভ। অর্থাৎ ভীষ্ম বলতে চাইলেন—পাণ্ডু রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন এবং তাঁর রাজ্যের কার্যনির্বাহী রাজা ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। তৎকালীন দিনের উত্তরাধিকারের নিয়ম ধরলে পাণ্ডুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর পুত্র যুধিষ্ঠির রাজ্য পেয়ে গেছেন, যদিও বাস্তবে তা হয়নি। যুধিষ্ঠির রাজ্যও পাননি, রাজ্যের ভাগও পাননি। এখন এই পরিস্থিতিতে, যখন ভাই ভাই বিবাদ ঘটছে, সেখানে নিছক ভাল মনেই পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্যাংশ তাদের দিয়ে দেওয়া উচিত—মধুরেণৈব রাজ্যস্য তেষামর্ধং প্রদীয়তাম্‌।

ভীষ্ম এবার কিছু জ্ঞানের কথা বলে উপদেশ দিলেন দুর্যোধনকে। ক্ষত্রিয়ের কীর্তি রক্ষা করা, ধর্ম তথা ন্যায় অনুসারে নিজের রাজনৈতিক স্থিতি নির্ধারিত করা এবং সর্বশেষে নিজের হিত ভাবনা করা—এগুলি তাঁর উপদেশ ছিল দুর্যোধনের প্রতি। অবশ্য এই শাশ্বত উপদেশের সঙ্গে সাবধানবাণীও উচ্চারিত হয়েছিল—আমার কথা যদি ঠিক ঠিক না শোন তা হলে মোটেই এই কুরুকুলের কারও ভাল হবে না—অতো’ন্যথা চেৎ ক্রিয়তে ন হিতং নো ভবিষ্যতি।

অনেকদিন পর ভীষ্ম আজকে রাজসভায় তাঁর মত প্রকাশের সুযোগ পেয়েছেন। ভীষ্মের সুদূরপ্রসারিত দৃষ্টির অন্তরালে যে অন্যায়গুলি ধৃতরাষ্ট্র করেছেন, তারজন্য ধৃতরাষ্ট্রের অনুশোচনা খুব বেশি ছিল না, দুর্যোধনের তো নয়ই। কিন্তু যে পাণ্ডব ভাইদের ধৃতরাষ্ট্র মৃত ভেবেছিলেন, তারা আজ যেন বেঁচে উঠে আরও শক্তিমান হয়ে তাঁর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দুর্যোধন কৰ্ণরা যতই তাঁদের আক্রমণ করতে বলুন, এক সর্বগ্রাসী ভয় এখন পীড়িত করছে ধৃতরাষ্ট্রকে। এই ভয় অবশ্য যতখানি ভয়, তার চেয়ে বেশি লজ্জা। ভীষ্ম পিতামহের মতো মহামান্য ব্যক্তিত্বের কাছে তাঁর অন্যায় পরিকল্পনা প্রকট হয়ে পড়েছে। ধৃতরাষ্ট্র যদি ভারপ্রাপ্ত রাজা না হয়ে যদি শুধু আত্ম সম্পর্কে ভীষ্মের ভ্রাতুষ্পুত্র মাত্র হতেন, তা হলে ভীষ্মের দুর্বাক্য হত অন্যরকম। কিন্তু হাজার হলেও ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর স্থলাভিষিক্ত কার্যনির্বাহী রাজা। অতএব রাজাকে তিরস্কার করার ভঙ্গিটিও ভীষ্ম রপ্ত করেছেন রাজোচিতভাবে। সবচেয়ে বড় কথা—ভীষ্ম তাঁর কোনও কথা ধৃতরাষ্ট্রকে বলছেন না—বলছেন দুর্যোধনকে। কারণ, তিনি জানেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের ব্যক্তিত্ব দুর্যোধনের দ্বারাই পরিচালিত।

ভীষ্ম বললেন—ভাগ্যিস তাদের মায়ের সঙ্গে পাণ্ডবরা এখনও বেঁচে আছে, আর এও অনেক ভাগ্য যে পুরোচন মারা গেছে। নইলে যেদিন থেকে শুনেছি যে, পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুনে পুড়ে মারা গেছে, সেদিন থেকে আমি লজ্জায় কারও মুখের দিকে তাকাতে পারছি না—তদা প্রভৃতি গান্ধারে ন শক্লোম্যভিবীক্ষিতুম্‌। সবচেয়ে বড় কথা কী জান? জতুগৃহে আগুন লাগানোর জন্য পুরোচনকে কাজে লাগানো হয়েছিল, তাতে না হয় বোঝা গেল—পুরোচন লোকটা খুব খারাপ। কিন্তু ওই পর্যন্তই, লোকে এরপরে আর পুরোচনকে দুষবে না। দুষবে তোমাকে, দুর্যোধন! কারণ তুমিই পুরোচনকে এই কাজে নিযুক্ত করেছ—যথা ত্বাং পুরুষব্যাঘ্র লোকো দোষেণ গচ্ছতি। তাই বলছিলাম—তোমার গায়ে যে কালি লেগেছে, তা থেকে মুক্ত হবার একটাই উপায়—পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার মুখোমুখি দেখা হোক।

ভীষ্ম এবার একটু সাবধানও করে দিতে চাইলেন দুর্যোধনকে। বললেন—ভালয় ভালয় যদি তাদের প্রাপ্য রাজ্য না দাও, দুর্যোধন! তা হলে জেনে রেখো, বেঁচে থাকতে পাণ্ডবদের প্রাপ্য পৈতৃক অংশ স্বর্গের ইন্দ্র এসেও ছিনিয়ে নিতে পারবেন না—পিত্রোং’শঃ শক্যমাদাতুমপি বজ্ৰভৃতা স্বয়ম্। সোজা কথা সোজা ভাষায় বলি—যদি নিয়মনীতি অনুসারে চলতে চাও, যদি আমার পছন্দের কাজটি করতে চাও এবং যদি সবারই ভাল চাও, তো পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য দিয়ে সব কিছু মিটিয়ে নাও—ক্ষেমঞ্চ যদি কর্তব্যং তেষামর্ধং প্রদীয়তাম্‌।

ভীষ্ম যখন বললেন—যদি আমার পছন্দের কাজটি করতে চাও—যদি কাৰ্য্যং প্রিয়ঞ্চ মে—তখনই বুঝিয়ে দিলেন কৌরবদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এখনও তিনি সমস্ত আত্মবিশ্বাস নিয়েই ফিরে আসতে পারেন। অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য ভীষ্মের মত সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করলেন। বৈবাহিক সূত্রে পাঞ্চাল দ্রুপদকে সহায় হিসেবে লাভ করার ফলে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক সুবিধে যে অনেক বেশি হবে, সেই ইঙ্গিত দিয়ে দ্রোণ জানালেন যে, ভীষ্মের মতই তাঁর মত—বৃত্তমৌপয়িকং মন্যে ভীষ্মেণ সহ ভারত।

দ্রোণাচার্যের কথার প্রবল প্রতিক্রিয়া জানালেন দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণ। কিন্তু প্রতিক্রিয়া জানানোর সময় তিনি দ্রোণ এবং ভীষ্ম দু’জনকেই যে ভাষায় গালাগালি দিলেন, ভীষ্মের কাছে তা ছিল অকল্পনীয়। অনেক অপমানকর কথার মধ্যে কর্ণ একবার ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করে বলেছিলেন—টাকাপয়সা খরচা করে, আর অনেক সম্মান দিয়ে যাঁদের আপনি ঘিরে রেখেছেন, যাঁরা সমস্ত কাজেই আপনার যথেষ্ট অন্তরঙ্গ ভাব দেখান, তাঁরা মোটেই আপনার মঙ্গলের কথা বলেন না। এঁদের বুকের ভিতর বিষ, এঁরা বাইরে আপনার মঙ্গলের কথা বলেন—ব্রুয়ান্নিঃশ্রেয়সং নাম প্রচ্ছন্নেনান্তরাত্মনা। কর্ণের এই কথার প্রতিবাদ করার কোনও প্রবৃত্তি ভীষ্মের ছিল না। দ্রোণাচার্য সঙ্গে সঙ্গে কর্ণকে যথেষ্ট তিরস্কার করলেন বটে, তিরস্কার করলেন বিদুরও, কিন্তু ভীষ্ম একটি কথাও বললেন না। তিনি দেখাতে চাইলেন যে, তাঁর মতো অসাধারণ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি এই ধরনের অভদ্র কথার উত্তর দেবারও প্রয়োজন বোধ করেন না। তিনি এইসব ব্যক্তিত্বকে অবহেলা করেন।

কর্ণ যতই দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে ভীষ্মের প্রতি অকথ্য শব্দ উচ্চারণ করুন, কিন্তু এই মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্রের সাধ্য ছিল না—ভীষ্মকে অতিক্রম করে, দ্রোণ বিদুরকে উড়িয়ে দিয়ে কর্ণ দুর্যোধনের মত মেনে নেওয়া। ভীষ্মের মর্যাদা এবং নীরব প্রতিপত্তি এতটাই যে, ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে পাঞ্চালদেশে পাঠাতে বাধ্য হলেন। শুধু তাই নয়, পাণ্ডবরা তাঁদের জননী কুন্তী এবং নববিবাহিতা দ্রৌপদীকে নিয়ে যখন হস্তিনায় ফিরে এলেন, তখন কিছুদিন যাবার পর ধৃতরাষ্ট্র একদিন তাঁদের ডেকে পাঠালেন। এই সাদর আহ্বানে দ্বিতীয় অংশীদার ছিলেন ভীষ্ম; কেননা প্রধানত তাঁরই আদেশ উপদেশ মান্য করে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের রাজ্য ভাগ করে দেবার জন্য ডেকে পাঠালেন—আহূতা ধৃতরাষ্ট্রেণ রাজ্ঞা শান্তনবেন চ।

পাণ্ডব কৌরবদের রাজ্য আলাদা হল। যুধিষ্ঠির রাজ্য পেলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্ররা হস্তিনাতেই থেকে গেলেন। ভীষ্ম নিজেই যদিও এই ভাগাভাগির প্রস্তাব করেছিলেন, তবু পিতৃ-পিতামহের বংশে এই বিভাজন তাঁকে পীড়িত করল। পাণ্ডবরা অবশ্য খাণ্ডবপ্রস্থে থাকা সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র এবং ভীষ্মের অনুজ্ঞা মেনে চলছিলেন—শাসনাদ্‌ ধৃতরাষ্ট্রস্য রাজ্ঞঃ শান্তনবস্য চ। মহাভারতের কবি এই কথাটা হয়তো তত আক্ষরিক অর্থে বলেননি। কিন্তু এই কথা বলে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, অন্যত্র থাকলেও কুরুবৃদ্ধ পিতামহের ওপর পাণ্ডবদের পূর্বের শ্রদ্ধাই বর্তমান ছিল। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রকেও তাঁরা অমান্য করতেন না। ধৃতরাষ্ট্র যতটুকু রাজ্য পাণ্ডবদের দিয়েছিলেন, জায়গা হিসেবে তা মোটেই ভাল ছিল না। অর্জুন খাণ্ডববন দহন করে রাজ্যটিকে প্রজাসাধারণের বাসযোগ্য করে তুললেন। অন্যদিকে ময় দানবের শিল্পনৈপুণ্যে খাণ্ডবপ্রস্থ একেবারে ইন্দ্রপ্রস্থ হয়ে উঠল।

যুধিষ্ঠিরের রাজ্য সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হবার পথ নিল রাজসূয় যজ্ঞের মাধ্যমে। এই যজ্ঞ একজন রাজাকে সম্রাটে পরিণত করে। নারদ এসে রাজসূয় যজ্ঞ করার বুদ্ধি দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। কিন্তু তারপর এই বিশাল ক্ষত্রিয়োচিত যজ্ঞ সমাধা করার প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠলেন কৃষ্ণ। যজ্ঞের সূচনা হল তখনকার দিনের সম্রাট বলে কথিত মগধরাজ জরাসন্ধকে বধ করে এবং সেটা পুরোপুরি কৃষ্ণের বুদ্ধিতে। রাজসূয়ের অন্যান্য কল্পের মধ্যে পাণ্ডবদের দিগ্‌বিজয় পর্ব শেষ হলে বিজিত তথা সামন্ত রাজারা রাজকর এবং উপহার নিয়ে উপস্থিত হলেন ইন্দ্রপ্রস্থে।

যুধিষ্ঠির আগে থেকেই মাদ্রেয় নকুলকে পাঠিয়ে ভীষ্ম এবং অন্যান্য কুরুবংশীয়দের ইন্দ্রপ্রস্থে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সকলে সময়মতো উপস্থিতও হলেন। এখনকার দিনে হামেশাই লক্ষ করি—আমাদের পিতাঠাকুর বা ঠাকুরদাদারা যে পুত্র বা যে নাতির বাড়িতে থাকেন, সেখানে নিজেকে একটু গুটিয়েই রাখেন। পুত্র অথবা নাতির সামনে থাকে সমৃদ্ধতরা যৌবনবতী পৃথিবী। সেখানে পিতাঠাকুর অথবা ঠাকুরদাদাটি রুটিনমাফিক বাস করেন তাঁর গতযৌবনা পৃথিবীর ‘নস্টালজিয়া’ নিয়ে। তাঁর যে পুত্র বা নাতি দূরে থাকে—দূরে থাকে বলেই তাদের শ্রদ্ধাভক্তি অটুট থাকে পিতা বা ঠাকুরদাদার প্রতি। দৈবাৎ যদি কোনও দিন এই ধরনের পিতা পিতামহেরা দূরগত পুত্র বা নাতির বাড়ি যান, তবে সেখানে তাঁদের ইচ্ছা অনিচ্ছা বা আধিপত্যের ভাবটুকু কেমন করে যেন ফিরে আসে।

পিতামহ ভীষ্মেরও তাই হল। হস্তিনার সংসার এবং রাজনীতিতে তাঁকে তেমন কেউ পোঁছেই না। সেই তিনি ইন্দ্রপ্রস্থে এসে এদিক ওদিক সামান্য ঘুরেফিরে সব কিছু বুঝে ফেললেন এবং ব্যস্তসমস্ত যুধিষ্ঠিরকে বললেন—বাছা যুধিষ্ঠির! দেশবিদেশ থেকে রাজারা সব এসে পড়েছেন। এঁদের মধ্যে যিনি যেমন সম্মান পাবার উপযুক্ত তাঁকে তেমন সম্মান দেখাও, বাছা। রাজারা ছাড়াও এই রাজসূয় যজ্ঞের জন্য এক বছর ধরে যেসব যাজ্ঞিক ব্রাহ্মণ বাস করছেন এখানে, তাঁদেরও তো সম্মানদক্ষিণা দিতে হবে। আর একজন শ্রেষ্ঠ মানুষকেও তো ঠিক করতে হবে যিনি তোমার শ্রেষ্ঠ উপহার এবং রাজসূয়ের শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য পাবার যোগ্য—অথ চৈষাং বরিষ্ঠায় সমর্থায়োপনীয়তাম্‌।

যে মর্যাদা এবং স্নেহ নিয়ে ভীষ্মপিতামহ তাঁর নাতির কাছে আপন ভাবনা ব্যক্ত করেছেন, ঠিক সেই মর্যাদাতেই যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে বললেন—আচ্ছা, বলুন তো পিতামহ! কী করা যায় এ বিষয়ে? রাজসূয় অনুষ্ঠানের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহারটি কোন যোগ্যতম পুরুষ লাভ করবেন, সে বিষয়ে আপনি কী মনে করেন—কস্মৈ ভবান্ মন্যতে’র্ঘ্যমেকস্মৈ কুরুনন্দন। উপনীয়মানং যুক্তঞ্চ তন্মে ব্রুহি পিতামহ ॥ ভীষ্মপিতামহের মনে আগে থেকেই সেই নামটি ছিল। শুধু যুধিষ্ঠির না বললে কথাটা তিনি আগ বাড়িয়ে বলতে পারছিলেন না। ভীষ্ম বললেন—শক্তিমত্তা এবং পরাক্রমের দিক দিয়ে দেখতে গেলে তেজোবলপরাক্রমৈঃ—আমি বৃষ্ণিবংশীয় কৃষ্ণ ছাড়া আর কোনও শ্রেষ্ঠতর পুরুষের নাম করতে পারছি না, যিনি তোমার রাজসূয় যজ্ঞের অর্ঘ্য পাবার যোগ্য। অসীম গ্রহতারকা নক্ষত্রলোকের মধ্যে সূর্য যেমন ভাস্বর, পৃথিবীর সমস্ত রাজমণ্ডলের মধ্যে কৃষ্ণও তেমনই সকলকে তাপিত করছেন—মধ্যে তপন্নিবাভাতি জ্যোতিষামিব ভাস্করঃ।

ভীষ্ম যা বলেছেন, তা যুধিষ্ঠিরের মনোমতো কথা। ভীষ্মের কথা ফুরোবার সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়ে পাণ্ডবকনিষ্ঠ সহদেব কৃষ্ণকে রাজসূয়ের অর্ঘ্য দান করলেন, কৃষ্ণ তা গ্রহণ করলেন শাস্ত্রের বিধিনিয়ম মেনেই। এই অর্ঘ্যদানের সঙ্গে সঙ্গেই বিতর্ক বিতণ্ডা শুরু হল। কেন অন্যান্য বিখ্যাত ক্ষত্রিয়বীর অথবা গুণবৃদ্ধ ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে কৃষ্ণকেই এই অর্ঘ্যোপহারের উপযুক্ত পাত্র বিবেচনা করা হল—এই কূট প্রশ্ন উঠল পাণ্ডববিরোধী শিবির থেকে। জরাসন্ধ মারা যাবার ফলে তাঁর পক্ষের রাজারা যথেষ্টই ক্ষুব্ধ ছিলেন এবং ক্ষুব্ধ রাজাদের মুখপাত্র ছিলেন শিশুপাল। তিনি বললেন—পাণ্ডবদের তেমন দোষ নেই এখানে, কারণ তারা একেবারেই ছেলেমানুষ। কিন্তু এই বুড়ো ভাম ভীষ্মটার কী হল? ওর তো খেয়াল বুদ্ধি কিছুই নেই, দূরের জিনিস ভাল করে বুঝতেও পারে না—অয়ঞ্চ স্মৃত্যতিক্রান্তো হ্যাপগেয়ো’ল্পদর্শনঃ।

যতখানি রূঢ় ভাষায় তিরস্কার করা যেতে পারে, সেই ভাষাতেই সকলের সামনে ভীষ্মকে তিরস্কার করলেন শিশুপাল। ভীষ্ম শুনলেন, সবই শুনলেন ধৈর্য ধরে। যুধিষ্ঠির খানিকটা বোঝানোর চেষ্টা করলেন শিশুপালকে। কিন্তু এই বোঝানোয় কোনও ফল হল না।

ভীষ্ম সেদিন অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় বসেছিলেন। একবার তিনি বললেন বটে যে, শিশুপালকে অনুনয়বিনয় করে বুঝিয়ে বলে কোনও লাভ নেই—নাস্মৈ দেয়ো হ্যনুনয়ো নায়মৰ্হতি সান্ত্বনম্‌—কিন্তু পরক্ষণেই এটাও তিনি বুঝলেন যে, কৃষ্ণকে রাজসূয়ের অর্ঘ্যদানের কারণটাও সর্বসমক্ষে বুঝিয়ে বলার দায় আছে তাঁর। কেননা, যুধিষ্ঠির তাঁরই প্রস্তাবমতো আজ্ঞা পালন করেছেন। কৃষ্ণের গুণাধিক্য বলবার সময় ভীষ্ম প্রধানত তাঁর বল-বিক্রমের ক্ষমতাটাই বেশি করে বললেন। এ কথাও বললেন যে, ক্ষত্রিয়োচিত যুদ্ধগুলির একটিতেও কৃষ্ণ হারেননি। খুব সংক্ষেপে বলবার সময় ভীষ্ম বলেছিলেন—শুধু কৃষ্ণকেই বড় বলে মানবার দু’টিমাত্র কারণ আছে। এক হল—বেদ বেদাঙ্গ ইত্যাদি শাস্ত্রে কৃষ্ণের অধিকার এবং শাস্ত্রজ্ঞতা সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় কারণ হল—শক্তিতে তাঁর চেয়ে বড় কেউ নেই—বেদবেদাঙ্গবিজ্ঞানং বলঞ্চাপ্যধিকং তথা।

আরও অনেক কথা বলেছিলেন ভীষ্ম। কিন্তু তারমধ্যেও ওই দুটি কথাই কিন্তু সবচেয়ে বড় যুক্তি—শাস্ত্রজ্ঞতা এবং শক্তিমত্তা। বস্তুত এই দুটিমাত্র শব্দ খুব স্থূলভাবে উচ্চারিত হলেও ওই দুটি কারণের মধ্যেই সমস্ত রাজনীতিশাস্ত্রের সারাংশ লুকিয়ে আছে। বেদ বেদাঙ্গের জ্ঞানটা খুব আক্ষরিকভাবে এখানে নেওয়া উচিত নয়। পরবর্তিকালের রাজনীতিশাস্ত্র ঘাঁটলে দেখা যাবে—আন্বীক্ষিকী বা তর্কযুক্তি বলে একটা কথা আছে। এই আন্বীক্ষিকীর মধ্যে বেদ বেদাঙ্গ ইত্যাদি সমস্ত শাস্ত্রজ্ঞানের অন্তর্ভাব ঘটেছে। কেউ কেউ এমনও মনে করেন যে, বেদ বেদাঙ্গ জানলে বহু শাস্ত্রজ্ঞতার ফলে আপনিই তর্কযুক্তি এবং দার্শনিক বোধ তৈরি হয়—এয়ীবিশেষো হ্যান্বীক্ষিকীতি। কাজেই কৃষ্ণের বেদ বেদাঙ্গের জ্ঞান আছে—এ কথার মানে হল তর্কযুক্তি এবং দার্শনিক বোধের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছেন কৃষ্ণ।

বস্তুত, ভীষ্ম যখন কৃষ্ণকে সবচেয়ে সম্মানের আসনটি দিয়েছেন, তখনই তাঁর বোধ হয়ে গেছে যে, বৃদ্ধ স্থবির নন, জ্ঞানবৃদ্ধ নন, তাঁর সময়ে যে ধরনের রাজনীতিজ্ঞ মানুষের প্রয়োজন, সেই মানুষটি এসে গেছেন। রাজনীতিতে যে কূটনীতির প্রয়োগ ঘটে, শুধুমাত্র সেই কূটনীতির প্রয়োগ ঘটিয়ে কৃষ্ণ তাঁর সমস্ত শত্রুকে বিনাশ করেছেন। ভীষ্মের কথামতো—একটি যুদ্ধেও যে কৃষ্ণ হারেননি, তার পিছনে তাঁর দৈহিক এবং সৈন্যশক্তির কারণ যত বেশি তার চেয়ে অনেক বেশি তাঁর বুদ্ধিমত্তা এবং চাতুর্য। শুধুমাত্র কূটনৈতিক চাতুর্যের জোরেই যে একটি মানুষ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারেন, সেই বোধটুকু অন্যের না থাকলেও ভীষ্মের ছিল বলেই তিনি কৃষ্ণকে রাজসূয়ের শ্রেষ্ঠ উপহারটি দান করার প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে, তাঁর যুগে ক্ষত্রিয়ের শক্তি যেভাবে এবং যে কারণে ব্যবহৃত হত, তা অত্যন্ত সরল এবং সাদাসিধে। কিন্তু তাঁর বৃদ্ধকালে রাজনৈতিক জটিলতা যখন তুঙ্গে উঠেছে, তখনও সেই পুরনো ধ্যানধারণা আঁকড়ে থেকে লাভ নেই কোনও। সমস্ত জীবন জুড়ে কৃষ্ণ তাঁর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী রাজার প্রতিপক্ষতা করে জয়লাভ করেছেন এবং তা করেছেন রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার জোরেই। ভীষ্ম কৃষ্ণের এই সূক্ষ্ম বুদ্ধি অতিমাত্রায় লক্ষ করেছেন বলেই আগামী দিনের নায়ক হিসেবে একটি অল্পবয়স্ক যুবককে তাঁর মেনে নিতে বাধেনি এবং এইখানেই এটা ভীষ্মেরও বুদ্ধিমত্তা।

ভবিষ্যতে ভীষ্ম যখন শরশয্যায় শুয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করবেন, তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে আসবেন রাজনীতির উপদেশ শুনতে। সেখানে যে উপদেশ ভীষ্ম দেবেন, তার মূল কথা হল কোনও রাজার রাজনৈতিক সমৃদ্ধি, যাকে পারিভাষিক ভাষায় বলে ‘অর্থ’। ধর্ম অর্থ ইত্যাদি পুরুষার্থ চতুষ্টয়ের দ্বিতীয় বর্গ হল অর্থ। এই সমৃদ্ধির জন্য যে কোনও রাজাকে ন্যায় অন্যায়ের ঊর্ধ্বে উঠে আপন প্রজ্ঞার দ্বারা কালোচিত ন্যায় অন্যায়ের আশ্রয় নিতে হয়। স্বয়ং যুধিষ্ঠির তাঁর কথা শুনে চমকে উঠেছিলেন এবং বলেছিলেন—এতে তো নীতিধর্মের কোনও বালাই-ই রইল না—ধর্মবাদাঃ ক্ষয়ং গতাঃ—এমন রাজ্য আমি চাই না, পিতামহ! কিন্তু রাজনীতির অগাধ জ্ঞান নিজের মধ্যে যিনি ধারণ করেছিলেন, সেই পিতামহ কিন্তু বহু আগে থেকেই জানতেন যে বুদ্ধিবলের আধিক্যই একজনকে সর্বোত্তম রাজনীতিজ্ঞে পরিণত করে। ঠিক সেইজন্যই অত্যন্ত বয়োবৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক এক যুবককে তখনকার দিনের শ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে চরম সম্মান দিতে তাঁর বাধেনি।

যাই হোক, ভীষ্মের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় চরম গণ্ডগোল শুরু হল। শিশুপালের অকথ্য গালমন্দ শুনে মধ্যম পাণ্ডব ভীম তাঁর দিকে তেড়ে গেলেন প্রায়। নিজেরাই রাজাদের নিমন্ত্রণ করে এনে নিজেরাই তাঁদের অপমান করাটা একেবারেই রুচিসম্মত নয় বুঝে যুধিষ্ঠির পিতামহ ভীষ্মকেই অনুরোধ করলেন কিছু একটা করতে—অত্র যৎ প্রতিপত্তব্যং তন্মে ব্রুহি পিতামহ। ভীষ্ম কোনওরকমে ভীমকে আটকালেন এবং যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—সিংহ যতক্ষণ ঘুমিয়ে থাকে কুকুর-বেড়ালরা ততক্ষণই সিংহের কাছাকাছি এসে ঘেউ ঘেউ করে। ঠিক যেমন এই শিশুপাল এবং তাঁর পক্ষের রাজারা করছেন—ভসন্তে তাত সংক্রুদ্ধাঃ শ্বানঃ সিংহস্য সন্নিধৌ। কিন্তু কৃষ্ণ যখন জেগে উঠবেন তখন এরা সব যমেরবাড়ি যাবে। আমি বাপু ভাল পথ নিয়েছি। যজ্ঞ বলে কথা, আমি আগে থেকেই ঠিক করে নিয়েছি কোনওরকম গণ্ডগোলের মধ্যে যাব না—শিবঃ পন্থাঃ সুনীতো’ত্র ময়া পূর্বতরং বৃতঃ।

ভীষ্মের মুখে কৃষ্ণের প্রশংসা শুনে শিশুপালের আর মুখের কোনও আগল থাকল না। তিনি তাঁকে কৃষ্ণের স্তুতিগায়ক বলেই থামলেন না। ভীষ্মের জন্যই যে পাণ্ডব কৌরবদের অবস্থাটা একেবারে বদ্ধকূপে পরিণত হয়েছে, এই নিন্দা করে শিশুপাল বললেন—যেমন একটা নৌকো যদি আর একটা নৌকোর সঙ্গে বাঁধা থাকে, একজন অন্ধ যদি পথ দেখার ভরসায় আর একটি অন্ধকে আশ্রয় করে, তা হলে যেমন অনর্থ ঘটে, ভীষ্মকে আশ্রয় করে সমগ্র কুরুকুলেরও সেইরকম অনর্থ ঘটেছে—তথাভূতা হি কৌরব্যা যেষাং ভীষ্ম ত্বমগ্রণীঃ। কৃষ্ণের প্রশংসা করার সময় কেন ভীষ্মের জিভ খসে পড়ল না এবং এই প্রশংসা করে ভীষ্ম যে কত বড় মূর্খতার কাজ করেছেন—এসব নিন্দাবাদ তো কিছুই বাদ গেল না এমনকী কৃষ্ণের নিন্দা ছেড়ে শিশুপাল একসময় ভীষ্মেরই মৌখিক শ্রাদ্ধ করে ছাড়লেন। এই প্রসঙ্গে কাশীরাজসুতা অম্বার কথাও এল। অম্বাকে হরণ এবং পরে প্রত্যাখ্যান করার মতো অন্যায় যে করে, সে যে কত বড় অধার্মিক মানুষ তা শিশুপাল খুব ভাল করে প্রমাণ করে ছাড়লেন।

অনবরত কটুভাষণ করেও ভীষ্মের ওপর শিশুপালের ক্রোধশান্তি হল না। তাঁর নিন্দাবাদের কথা শুনে তাঁর স্বপক্ষীয় রাজারা যেমন খুশি হলেন তেমনই তাঁরাও ভীষ্মকে গালি দেবার সুযোগ পেলেন। কেউ কেউ এমনও বললেন যে, বুড়োটাকে মেরে ফেলাই ভাল ছিল, ছাগল ভেড়ার মতো গলা কেটে ফেলা উচিত এই বুড়োটার—হন্যতাং দুর্মতির্ভীষ্ম পশুবৎ সাধ্বয়ং নৃপাঃ। শিশুপাল এবং তাঁর অনুগামী রাজাদের কথা শুনে ভীষ্ম অবশ্য যুদ্ধে উত্তেজিত হলেন না। তবে এতকাল ধরে এক মহান অস্ত্রবীরের যে মর্যাদায় তিনি পৌঁছেছেন, সেখানে দাঁড়িয়ে সামান্য একটু হুংকার না ছেড়েও তিনি পারলেন না। সমবেত শিশুপালপক্ষীয় রাজা এবং স্বয়ং শিশুপালকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন—দেখো বাপু! কথার পর কথা, তারপরে কথা। কথার কোনও শেষ নেই। তোমরা আমাকে পশুর মতোই গলা কাটো, আর আগুনেই না হয় পুড়িয়ে দাও, অত সহজ হবে না ব্যাপারটা। এই আমি তোমাদের মাথার ওপর আমার এই দুই পা রেখে দাঁড়ালাম, দেখি কার কত শক্তি—ক্রিয়তাং মূর্ধ্নি বো ন্যস্তং ময়েদং সকলং পদম্‌।

ভীষ্ম মাটিতে পা ঠুকলেন সাবজ্ঞায়। আসলে ভীষ্ম নিজে কোনও যুদ্ধ করতে চাইছিলেন না। যে কৃষ্ণের বুদ্ধিবলের এত প্রশংসা করেছেন তিনি, সেই কৃষ্ণই শিশুপালকে একটু শিক্ষা দিন সবার সামনে, এটাই তিনি চাইছিলেন। নিজের দিক থেকে দৃষ্টি সরানোর জন্য শিশুপালকে উদ্দেশ করে তিনি এও বললেন—কারও যদি মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করার ইচ্ছে হয়, সে ওই কৃষ্ণের সঙ্গে খানিকক্ষণ যুদ্ধ করুক না—যস্য বা ত্বরতে বুদ্ধির্মরণায় স মাধবম্‌। ভীষ্ম জানতেন যে, হঠকারী মানুষ এইটুকু প্ররোচনাতেই নিজের সর্বনাশ ঘটাবে। শিশুপাল কৃষ্ণকে যুদ্ধে আহ্বান করলেন এবং কৃষ্ণের হাতে তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে মগধরাজ জরাসন্ধের যে আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার শেষটুকুও উচ্ছিন্ন হয়ে গেল। উত্থান ঘটল নূতন রাজশক্তির, যেখানে প্রাধান্য লাভ করল উত্তর ভারতীয় মিত্রশক্তি, যার মধ্যে কৌরব পাণ্ডবরা আছেন, পাঞ্চাল দ্রুপদ আছেন, আর আছেন পশ্চিমভারতের প্রবাদপুরুষ কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় পাণ্ডবসহায় কৃষ্ণকে সর্বোচ্চ সম্মান দেবার প্রস্তাব করে ভীষ্ম যে পরোক্ষভাবে হস্তিনাপুরের আর এক হঠকারী রাজা দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রকেও খানিকটা চাপের মধ্যে রাখলেন, সে কথা দুর্যোধন তেমন করে বুঝলেন না। কিন্তু কুরুসভায় বহিরাগত কর্ণ দুর্যোধনের বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে যেভাবে তাঁকে অপমান করেছিলেন, যুধিষ্ঠিরের সভায় ভীষ্ম তার শোধ তুললেন রাজনৈতিকভাবে। রাজনীতির ক্ষেত্রে আপন গৃহে হাত গুটিয়ে বসে থাকা বুড়ো ঠাকুরদাদার চালটা যে কতখানি, দুর্যোধন তা একটুও বুঝলেন না।

পাণ্ডবদের একখানি অনুর্বর খণ্ডরাজ্য দেওয়া সত্ত্বেও তাঁদের প্রবল উত্থান যখন রাজনৈতিকভাবে ঠেকানো গেল না, তখন দুর্যোধন ছলে-কৌশলে তাঁদের রাজ্য অধিকার করার পরিকল্পনা করলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে রাজি করিয়ে পাণ্ডবদের পাশাখেলার জন্য ডেকে পাঠানো হল। দ্যূতসভার প্রস্তুতিপর্বে পিতামহ ভীষ্মের মুখে আমরা একটা কথাও শুনতে পাই না। অনেকে আমাকে জিজ্ঞাসা করেন—কেন তাঁর মৌনতা? তিনি তো স্বমত প্রকট করে একটা বাধা সৃষ্টি করতে পারতেন। হয়তো তাতে এই চক্রান্ত বন্ধ হত। এখানে আমাদের ধারণাটা বলি। লক্ষ করে দেখবেন, যখনই হস্তিনার সিংহাসনে রাজপ্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়েছে, তখনই ভীষ্ম সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। সত্যবতীর প্রথম পুত্র যখন সিংহাসনে বসেছিলেন এবং স্বেচ্ছাতন্ত্রে রাজত্ব চালাচ্ছিলেন ভীষ্ম তখন একটি কথাও বলেননি। অন্যদিকে কুমার বিচিত্রবীর্য রাজা হয়ে সমস্ত বিষয়ে ভীষ্মের পরামর্শ নিয়েছেন, ভীষ্মও তখন পরামর্শ দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সেটা ছিল তাঁরই ‘জেনারেশন’। নিজের বয়স যতই বেশি হোক তিনি সম্পর্কে বিচিত্রবীর্যের বড় ভাই। কিন্তু হস্তিনায় যখন নতুন ‘জেনারেশনে’র রাজত্ব শুরু হয়েছে, সেখানে শুধু পুত্ৰকল্প ভ্রাতুষ্পুত্রদের বিয়ে দেওয়া ছাড়া তিনি আর কিছুর মধ্যেই যাননি। এখানে আরও একটা কথা হল—বিদুরের উপস্থিতি। বিদুর অসাধারণ রাজনীতিজ্ঞ ব্যক্তি। রাজনৈতিক এবং পারিবারিক সমস্ত ব্যাপারে বিদুর যা ভাবেন, যা বলেন, তার সঙ্গে ভীষ্মের মতান্তর হয় না। ধৃতরাষ্ট্রকে সৎ পরামর্শ দেবার ব্যাপারে বিদুর যেখানে তাঁর মতই ব্যক্ত করছেন, সেখানে তিনি অনর্থক নাক গলিয়ে নিজের মর্যাদা নষ্ট করেন না। এখানে শেষ কথাটা হল—দুর্যোধন। হস্তিনাপুরের রাজনীতি এখন তাঁর পরের ‘জেনারেশন’ ছেড়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। বিশেষত দুর্যোধন আত্মাভিমানী। নিজের বন্ধুবান্ধব এবং কুচক্রী মামা ছাড়া আর কারও কথা তিনি শোনেন না। এইরকম একটা অস্থিরতার মধ্যে ভীষ্মের মতো মর্যাদাসম্পন্ন মানুষের যে কথা বলা চলে না, এটা যে কোনও অভিজ্ঞ বৃদ্ধই বুঝবেন।

কিন্তু সব ব্যাপারে কথা না বললেও কিছু কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যেখানে কুলবৃদ্ধ ব্যক্তির চুপ করে থাকা চলে না। চুপ করে থাকলে সমাজ তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে। ঠিক সেই রকমই একটা জায়গা এল যখন পাণ্ডবরা শকুনির পাশার চালে সবই হারিয়ে বসলেন। এমনকী নিজের স্ত্রী দ্রৌপদীকে পর্যন্ত। দ্রৌপদীকে যখন উন্মুক্ত রাজসভার মধ্যে ধরে আনার আদেশ দিলেন দুর্যোধন, তখন কুলজ্যেষ্ঠ ভীষ্মও রাজসভায় বসে আছেন। দ্যূতক্রীড়ার যা ফল হল, তা তাঁর কাছে অত্যন্ত অরুচিকর হলেও তিনি নির্বিকারভাবে তা সয়ে যাচ্ছিলেন। সভায় আসবার আগে দ্রৌপদী অন্দরমহল থেকেই প্রশ্ন করে পাঠিয়েছিলেন যে, যুধিষ্ঠির আগে নিজেকে বাজিতে হেরে পরে দ্রৌপদীকে বাজি রেখেছিলেন, নাকি আগে দ্রৌপদীর বাজি হেরে পরে নিজেকে হেরেছেন।

এসব প্রশ্নের জবাব দেবার কোনও উপায় হয়নি। তার আগেই দুঃশাসন দ্রৌপদীকে সভায় টেনে এনেছেন এবং দুর্যোধন কর্ণ শকুনির উৎসাহে দুঃশাসনের চরম অসভ্যতা শুরু হয়। দ্রৌপদীর অসহায় অবস্থা দেখে এঁরা যতই আনন্দ পান, কুরুসভায় উপস্থিত বৃদ্ধ সজ্জনেরা যে লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছিলেন, সে মন্তব্য করতে ভোলেননি মহাভারতের কবি—তেষামভূদ্‌ দুঃখমতীব কৃষ্ণাং দৃষ্ট্বা সভায়াং পরিকৃষ্যমানাম্‌। অবশেষে কুলবৃদ্ধ পিতামহ আর সইতে পারলেন না। দ্রৌপদীর পূর্বপ্রশ্নের সূত্র ধরে তিনি খানিকটা পরিস্থিতি সামাল দিতে চাইলেন। ভীষ্ম বললেন—এখানে আইনের প্রশ্নটা এতখানিই জটিল যে, ভাল করে তার জবাবই দেওয়া যায় না—ন ধর্মসৌক্ষ্ম্যাৎ সুভগে বিবেক্তুং শক্লোমি তে প্রশ্নমিমং যথাবৎ। দেখো, শকুনি যুধিষ্ঠিরকে পণে জিতেছে বলেই যে তোমাকেও জিতেছে, তা কিন্তু ঠিক নয়। আবার তোমাকে জেতার পর যুধিষ্ঠির যে স্বীকার করেছেন—হ্যাঁ, আমি হেরেছি, সেখানেও তোমার বিপদ রয়ে গেছে। আবার দেখো, যুধিষ্ঠির নিজের ইচ্ছাতে তোমাকে পণ রাখেননি, শকুনি তোমাকে পণ রাখতে বলায় যুধিষ্ঠির পণ রেখেছেন। অন্যদিকে শকুনি যেমন পাশা খেলতে পারেন, যুধিষ্ঠির তেমন পারেন না, যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে শকুনি অন্যায়টি করিয়ে নিয়েছেন—কাজেই তোমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব মুশকিল—তস্মান্ন তে প্রশ্নমিমং ব্রবীমি।

ভীষ্মের মীমাংসা শুনে দ্রৌপদীর কোনও লাভ হল না। তিনি একটু রেগেও গেলেন। ভীষ্মের কথার খানিকটা প্রতিবাদও করলেন। কিন্তু ভীষ্ম যে কেন তেমন জোর দিয়ে তাঁর প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারলেন না, সেটা যেমন দ্রৌপদী বুঝতে পারলেন না, তেমনই দ্রৌপদীও যে ভীষ্মের অবস্থাটা কেন বুঝতে পারলেন না—এই দুটি না বোঝার পিছনেই কারণ ছিল সেই সময়ের কৌরবসভার অবস্থাটা। কৌরবরা যুধিষ্ঠিরের মতো অনভিজ্ঞ পাশাড়ুকে অন্যায়ভাবে হারালেও যুধিষ্ঠির সে হার স্বীকার করে নিয়েছেন। এই অবস্থায় তাঁদের জয়োন্মাদনা এমন তুঙ্গ অবস্থায় ছিল, যেখানে শকুনি দুর্যোধনদের অন্যায় কৌশলের কথা বেশি করে বললে ভীষ্মেরই অপমান চূড়ান্ত হত। একটু আগেই ভীষ্ম দেখেছেন বিদুরের চরম অপমান। যুধিষ্ঠিরের বোকামিতেই এই সুযোগ পেয়েছেন কৌরবরা। দ্রৌপদীকে পণে জিতে তাঁরা অতিমান্য কাকা বিদুরকেই পাঠাচ্ছিলেন দ্রৌপদীকে রাজসভায় ধরে নিয়ে আসার জন্য। কাজেই ভীষ্ম বিদুরের মতো নিরঙ্কুশ প্রতিবাদের মধ্যে গেলেন না। তিনি দ্রৌপদীর আইনের প্রশ্নটি সবার সামনে রেখে—যুধিষ্ঠিরও ঠিক করেননি, শকুনিও ঠিক করেননি—এমনিধারা কথা বলে একটা সমঝোতায় আসতে চেয়েছিলেন।

ভীষ্ম দেখলেন—কিছুই হল না। দুঃশাসন দ্রৌপদীর বস্ত্র-আকর্ষণ-অসভ্যতার শেষ বিন্দুতে পৌছোলেন। যুধিষ্ঠিরের সত্যের বাঁধনে বাঁধা ভীম কিছুই করতে না পেরে দুঃশাসন দুর্যোধনকে বধ করার প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করলেন বার বার। দুঃশাসন তাতেও থামলেন না। দ্রৌপদী বুঝলেন তাঁর স্বামীরা নিরুপায়। দ্রৌপদী আবারও সেই আইনের প্রশ্ন তুলে ভীষ্মের মুখের দিকেই তাকালেন। দ্রৌপদী বললেন—আপনারা শুধু বলুন এরা আমাকে জয় করেছে, কি না। আমাকে এরা দাসী দাসী বলে ডাকছে, আপনারা শুধু বলুন—মহারাজ পাণ্ডুর কুলবধূ কখনও দাসী হতে পারে কি না। পিতামহ ভীষ্ম ভীষণ বিব্রত বোধ করলেন। আবারও বললেন—এ প্রশ্নের মীমাংসা করার সাধ্য আমাদের নেই, কল্যাণী! তবে হ্যাঁ, এটুকু বলতে পারি যে, এখানে যে ঘটনা ঘটল, তাতে এ বংশের সর্বনাশ কেউ রোধ করতে পারবে না—নূনমন্তঃ কুলস্যাস্য ভবিতা ন চিরাদিব।

আপন বংশের এক কুলবধূকে সেই বংশেরই অন্যতর পুরুষেরা রাজসভায় নিয়ে এসে কাপড় ধরে টানছে—এই অসম্ভব দৃশ্য পিতামহ ভীষ্মকে দেখতে হল। পাশাখেলার আইনে পাণ্ডবরা এবং তাঁদের প্রিয়তমা পত্নীটি যতই প্যাঁচে পড়ুন, কিন্তু যে-কোনও অবস্থাতেই কুলবধূর এই অপমান যে ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনবে—ভীষ্ম সে কথা বলতে দ্বিধা করলেন না। তিনি বললেন—‘লোভ আর মোহ কুরুকুমারদের সম্পূর্ণ গ্রাস করেছে—তথাহি কুরবঃ সর্বে লোভমোহপরায়ণাঃ—যার জন্য ভদ্রঘরে জন্মেও তোমার এই বিপদ উপস্থিত হয়েছে। তবে তুমি যেভাবে এ বিপদ সইছ এবং এখনও যে তুমি ধর্মের অনুশাসনেই চলতে চাইছ, এ শুধু তোমার পক্ষেই সম্ভব—যৎ কৃচ্ছ্রমপি সম্প্রাপ্তা ধর্মমেবান্ববেক্ষসে। তোমার অবস্থা দেখে আমাদের কোনও স্বস্তি নেই জেনো। এই যে দ্রোণ বসে আছেন, কৃপ বসে আছেন; এঁরা কি কেউ ধর্ম কম বোঝেন? কিন্তু এঁরা সবাই তোমার অবস্থা দেখে প্রাণহীন মানুষের মতো শূন্য শরীরে বসে আছেন—শূন্যৈঃ শরীরৈস্তিষ্ঠন্তি গতাসব ইবানতাঃ।

বস্তুত ভীষ্ম নিজেও দ্রৌপদীর এই অবস্থা দেখে প্রাণহীন শুষ্ক শরীরে বসে ছিলেন যেন। পিতামহ হিসেবে আজ যদি তিনি স্বমত প্রকট করে দ্রৌপদীকে বিপন্মুক্ত করার চেষ্টা করতেন, তা হলে সেই দিনই অন্য এক যুদ্ধ বেধে যেত। ভীষ্ম তাই সেদিকে যাননি। কৌরবকুমারেরা যা করেছেন, তা যে নিতান্ত অসভ্যতা, সেটা তিনি বলতে ছাড়েননি; কিন্তু অন্যদিকে দ্রৌপদী যে আইনের প্রশ্ন করেছেন, সেখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির যেহেতু নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে গেছেন, তাই দ্রৌপদীর কথার সঠিক উত্তর দিলে যুধিষ্ঠির খুব সুখে থাকতেন না এবং তাতে কৌরবকুমারদের অসভ্যতা আরও বাড়ত। ভীষ্ম তাই প্রশ্নের মীমাংসায় না গিয়ে আইনের প্রশ্নটি যুধিষ্ঠিরের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, নিজের যতই বিপদ হোক, যুধিষ্ঠির সত্য থেকে বিচ্যুত হবেন না—যুধিষ্ঠিরস্তু প্রশ্নে’স্মিন্ প্রমাণমিতি মে মতিঃ।

সেকালের দিনে পাশাখেলার কিছু নিয়মকানুন ছিল। রাজা বা রাজপুত্রেরা যখন বাজি রেখে পাশা খেলতেন, সেখানেও কিছু নিয়মের বন্ধন ছিল। যুধিষ্ঠির নিজে পাশা খেলতে ভালবাসতেন কিন্তু পাশা খেলার ফন্দিফিকির ভাল জানতেন না। খেলার ঝোঁকে তিনি এমনভাবেই প্রতিপক্ষের জালে বন্দি হয়ে পড়েছিলেন, যেখানে দ্রৌপদীর অপমানের ঘটনা অশালীন হলেও অস্বাভাবিক ছিল না। কৌরবরা দ্রৌপদীর সঙ্গে যে অসভ্য আচরণ করেছেন, সেটা তাঁদের রুচির বিকার, এ বিকার তাঁরা না ঘটালেও পারতেন। কিন্তু পাশার পণ যখন তাঁরা জিতেছেন, তখন ওই রুচিহীন বিকার ঘটালে পরেও আইনের চোখে—যেটাকে একভাবে ধর্মও বলা যেতে পারে—সেই ধর্মের দৃষ্টিতে কৌরবদের খুব একটা দোষও দেওয়া যায় না। বস্তুত এখানে পণজয়ী পক্ষের আত্যন্তিক বিরোধিতা করলে শুধুমাত্র প্রতিপক্ষতার উত্তর দেবার জন্যই দুর্যোধন দুঃশাসনদের ব্যবহার তথা দ্রৌপদীর ওপরে তাঁদের অত্যাচার আরও ক্রূরতর হত। ভীষ্ম সেটা চাননি বলেই ইনিয়েবিনিয়ে দ্রৌপদীর প্রশ্ন নিজে এড়িয়ে গিয়ে যুধিষ্ঠিরের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।

বলা বাহুল্য, যুধিষ্ঠির যেমন অন্য ধর্ম বোঝেন তেমনই পাশাখেলার ধর্মও তিনি বোঝেন। নিজের পরাজয়ের ব্যাপারে তাঁর সর্বাত্মক স্বীকৃতি ছিল। সে যাই হোক, কুরুসভায় কৌরবদের বিকার মাত্রাছাড়া হতেই ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর হস্তক্ষেপে সে বিকার স্তব্ধ হয়েছে। প্রথমবার পাশাখেলায় যুধিষ্ঠির যা হেরেছিলেন তা ধৃতরাষ্ট্রের করুণায় ফিরে পেলেন বটে, কিন্তু দুর্যোধনের প্ররোচনায় আবার দ্বিতীয়বার পাশাখেলা হল এবং যুধিষ্ঠির তাঁর রাজ্যপাট হারিয়ে সকলকে নিয়ে বনবাসে যেতে বাধ্য হলেন।

বনবাসে যাবার সময় যুধিষ্ঠিরকে আমরা একবারের তরে ভীষ্মের কাছে উপস্থিত দেখছি। যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কাছে বিদায় চাইছেন। অনাড়ম্বর এই বিদায়, সাধারণ প্রথার মতো। যুধিষ্ঠিরের এই বনবাসে যাবার সময় থেকে একেবারে পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস পর্যন্ত ভীষ্মকে আমরা প্রায় কোনও কথাই বলতে দেখি না। সংসারের জ্বালাযন্ত্রণায় তপ্ত হতে হতে এক সময় যেমন বৃদ্ধ গৃহকর্তাটি নির্বিকার হয়ে সংসারে বাস করতে থাকেন, ভীষ্মকেও আমরা সেইরকম দেখছি প্রায় তেরো বছর ধরে। পাণ্ডবদের বনবাস এবং অজ্ঞাতবাস ভীষ্মপিতামহকে নিশ্চয়ই সুখ দেয়নি, শান্তি তো নয়ই। কিন্তু এই তেরো বছর ধরে তিনি কোনও উপদেশ, আদেশ বা পরামর্শের মধ্যে যাননি।

কুরুবাড়িতে তিনি নির্বিকার হয়ে বসেছিলেন—মানে অবশ্য এই নয় যে, তাঁর মন শান্ত গভীর কোনও ব্রহ্মচৈতন্যে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। কৌরবসভায় দ্রৌপদীর যে অপমান তিনি দেখেছেন, বনবাসে যাবার সময় ভীমার্জুনকে তিনি যেভাবে ভয়ংকর প্রতিজ্ঞা নিতে দেখেছেন, তাতে ভরত-শান্তনুর বংশে অন্যতম প্রধান ধারাটি যে লুপ্ত হয়ে যাবে, এ সম্বন্ধে তাঁর সন্দেহ থাকবার কথা নয়। হয়তো সেই কারণেই বিষন্ন শান্ত বৃদ্ধ তাঁর জীবনের পূর্বকথাগুলি স্মরণ করে করে খানিকটা আত্মগ্লানিতে ভোগেন, আত্মসমালোচনাও যে বাদ পড়ে, তা নয়। পিতা শান্তনুর দ্বিতীয় বিবাহের কথা শুনে তিনি সাভিমানে সিংহাসন ত্যাগ করেছিলেন, স্বাত্মারোপিত লাঞ্ছনায় আপন পুত্ৰজন্মও পরিহার করেছিলেন। কিন্তু কী হল তাঁর আত্মত্যাগে? পিতা শান্তনু এবং ভাই বিচিত্রবীর্য কামনার বশীভূত ছিলেন এবং এখন তাঁরই ক্ষেত্ৰজাত বংশধারা লোভের বশীভূত। সাধে কি আর তিনি দ্রৌপদীকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন—লোভ আর মোহে কুরুরা সব আচ্ছন্ন হয়ে গেছেন—তথাহি কুরবঃ সর্বে লোভমোহপরায়ণাঃ। অথচ তিনি সিংহাসনে বসলেন না। আবার সিংহাসনে না বসে তিনি যে উচিত পরামর্শ দিয়ে দুর্যোধন ধৃতরাষ্ট্রদের বিকার রুদ্ধ করবেন, তারও কোনও উপায় নেই।

পরামর্শ দিলে কী হত, তার প্রমাণ এই একটু আগেই পাওয়া গেছে। দুঃশাসনের অসভ্যতার প্রতিবাদ করেছিলেন বিদুর। আর ভীম যখন দ্রৌপদীর বস্ত্রাকর্ষণ দেখে অসহ্য ক্রোধে দুর্যোধন দুঃশাসনদের হাতের মুঠোয় পিষে ফেলার প্রতিজ্ঞা করছিলেন, তখন ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুরের মতো বৃদ্ধরা শুধু একবার বলেছিলেন—ক্ষমা করে দাও, বৎস! সত্যিই তো তুমি অনেক কিছু করতে পার—ক্ষম্যতামিদমিত্যেবং সর্বং সম্ভাব্যতে ত্বয়ি। বাস্‌, এই একটা কথা। কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অকথ্য অত্যাচার দেখে তিন কুলবৃদ্ধ শুধু একটি বার সমস্বরে ভীমকে থামানোর চেষ্টা করেছিলেন। আর যায় কোথা? সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের প্রশ্রয়প্রাপ্ত কর্ণ চিবিয়ে চিবিয়ে দ্রৌপদীকে বললেন—এই সভায় তিনটিমাত্র লোক আছেন যাঁরা নীতিধর্মের কোনও তোয়াক্কা করেন না। এঁদের প্রথম জন হলেন ভীষ্ম, দ্বিতীয় হলেন বিদুর, আর তৃতীয় হলেন কৌরবদের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য—ভীষ্মঃ ক্ষত্তা কৌরবানাং গুরুশ্চ। যে রাজা এঁদের পালনপোষণ করেন, সেই রাজাকেই এঁরা সবচেয়ে খারাপ বলে গালাগালি দেন, এঁরা পালক স্বামীর মূলোচ্ছেদ করতে পারলে খুশি হন এবং এই পাপের জন্য এঁদের কোনও দুঃখবোধও নেই—যে স্বামিনং দুষ্টতমং বদন্তি বাঞ্ছন্তি বৃদ্ধিং ন চ বিক্ষিপন্তি।

বিবাদ থামাতে গিয়ে যে গালাগালি কর্ণের কাছে খেলেন ভীষ্ম, এই গালাগালিই তাঁর বাক্য রুদ্ধ করে দিয়েছে। কথাগুলি দুর্যোধন বললেও হত, নাতি-ঠাকুরদাদা মিলে তার একটা সমাধান করা যেত। কিন্তু এই ধরনের তিরস্কারগুলি সব সময়েই তাঁকে শুনতে হয়েছে দুর্যোধনের বন্ধু কর্ণের কাছ থেকে। তিনি বুঝতে পারেন—এই কথাগুলির মধ্যে দুর্যোধনের সায় আছে, কারণ দুর্যোধন কখনও কর্ণকে থামাননি বা প্রতিবাদ করেননি তাঁর কথার। কুরুবংশের সবচেয়ে বৃদ্ধ মানুষটি এইসব তিরস্কার শুনতে শুনতে একেবারে চুপ করে গেছেন। পরামর্শ, উপদেশ দেওয়া দূরে থাক, যে বৃদ্ধকে তাঁর নাতির মুখ থেকে পরান্নভোজনের খোঁটা শুনতে হয়, সেই বৃদ্ধ কি কখনও আগ বাড়িয়ে দুর্যোধন দুঃশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে যাবেন? তিনি শুধু দেখছেন, মহারাজ শান্তনুর সময় থেকে আজ পর্যন্ত—সব দেখার জন্য তিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর নিয়ে বসে আছেন। তবু তাঁর মরণের সাধ জাগে না, কেননা বিচিত্রবীর্যের আর এক বংশধারায় তাঁর যে অন্য নাতিরা বনবাসে দিন কাটাচ্ছেন, তাঁরা এখনও তাঁর মুখ চেয়ে আছেন। কোনও দিন যদি সেইসব বশংবদ নাতিরা হস্তিনাপুরে ফিরে আসে আবার! ভীষ্ম তাঁদের জন্য দিন গুনছেন মনে মনে।

তেরোটা বচ্ছর জুড়ে ভীষ্মের মুখে ভাল মন্দ একটা কথা শুনলাম না। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় শেষ হয়ে আসছে। দুর্যোধন কৰ্ণরা হাজার চেষ্টা করেও পাণ্ডবদের হদিশ খুঁজে বার করতে পারলেন না। গুপ্তচরেরা সমস্ত জায়গা খুঁজে খুঁজে হাল ছেড়ে বলেছে—আমরা কিছুতেই তাঁদের গতিবিধি জানতে পারিনি। আমরা কি আবার খুঁজতে বেরুব—অন্বেষণং পাণ্ডবানাং ভূয়ঃ কিং করবামহে? গুপ্তচরদের কথা শুনে দুর্যোধন কর্ণদের সভা বসেছে আবার। প্রথামাফিক সেখানে ভীষ্ম দ্রোণরাও বসে আছেন। কর্ণ প্রস্তাব করলেন—আরও বুদ্ধিমান, আরও পাকা গুপ্তচরদের পাঠানো হোক পাণ্ডবদের খুঁজে বার করবার জন্য—অন্যে ধূর্ততরা দক্ষা নিভৃতাঃ সাধুকারিণঃ। হাট, মাঠ, বন, নদী চষে ফেলুক তারা। পাণ্ডবদের খুঁজে বার করতেই হবে। কর্ণের প্রত্যেকটি কথা সমর্থন করলেন দুর্যোধনের ভাই দুঃশাসন।

ভীষ্ম চুপ করেই বসেছিলেন। খুব ভাল করেই তিনি বুঝতে পারছিলেন—কত বড় হতাশা থেকে কর্ণ দুঃশাসনেরা দুর্যোধনকে আবারও এক বৃথা অন্বেষণে প্রবৃত্ত করছেন। একটু আগেই দুর্যোধন তাঁর অসহায়তা ব্যক্ত করেছেন ভাই বন্ধুদের কাছে। বলেছেন—আর সময় নেই। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের কাল বেশির ভাগ কেটে গেছে—অল্পাবশিষ্টং কালস্য গতং ভূয়িষ্ঠমন্ততঃ। এরপর তারা আসবে, মাতলা হাতির মতো হুড়মুড়িয়ে এসে পড়বে কৌরবদের ওপর। কৌরবদের বিপদের অন্ত থাকবে না—দুঃখা ভবেয়ুঃ সংরব্ধাঃ কৌরবান্‌ প্রতি তে ধ্রুবম্‌। ভীষ্মও জানেন—তারা আসবে। এত দুঃখের পর তাদেরও সুখের দিন আসবে। আর ঠিক সেই জন্যই এক সর্বগ্রাসী হতাশা ঘিরে ধরেছে দুর্যোধন দুঃশাসন কর্ণকে। সেই জন্যই আবারও অন্বেষণের শেষ চেষ্টা, যাতে পুনরায় তাদের বারো বছরের জন্য বনে পাঠানো যায়।

ভীষ্ম কৌরবদের এই আকুল চেষ্টার আর্তি শুনছিলেন এতক্ষণ ধরে। তখনও কিছুই বলেননি। কিন্তু কর্ণ-দুঃশাসনের কথা শেষ হবার পরেই অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য আর থাকতে না পেরে বলে উঠলেন—এত ভাবছ, বাছারা! এত গুপ্তচর লাগাচ্ছ, কিন্তু জেনো পাণ্ডবদের মতো মানুষের কখনও বিনাশ হয় না, তারা হেরেও যায় না চিরদিনের মতো—ন তাদৃশা বিনশ্যন্তি নাপি যান্তি পরাভবম্‌। গুপ্তচররা দুর্যোধনকে বলেছিল—ওরা নিশ্চয়ই মরে গেছে, নইলে তাদের আমরা খুঁজে পাব না, তা হতে পারে না—সর্বথা বিপ্রণষ্টাস্তে। দ্রোণাচার্য সেই কথারই প্রতিবাদ করেছেন—ওরা মরতেই পারে না। ওরা সময়ের অপেক্ষা করছে মাত্র। তবে এও ঠিক, তোমরা তাদের খুঁজে পাবে না—দুর্জ্ঞেয়া খলু শূরাস্তে দুষ্প্রাপাস্তপসা বৃতাঃ।

কথাটা এতই ভাল লাগল ভীষ্মের যে, চুপ করে থাকবেন ভেবেও চুপ থাকতে পারলেন না। নইলে দ্রোণাচার্যের আগেই ভীষ্মের কথা বলার কথা। বলার ইচ্ছে থাকলে প্রথমেই বলতেন তিনি। কিন্তু দ্রোণাচার্য এতই জোর দিয়ে সত্যের জয়কার ঘোষণা করেছেন যে ভীষ্ম আর কথা না বলে পারলেন না। বিশেষত এখন পাণ্ডবদের আসবার সময় হয়ে গেছে, এখন না হলেও দুদিন পরেই এই বৃদ্ধের গুরুত্ব বাড়বে। অতএব ভীষ্ম চুপ করে থাকলেন না। ভীষ্ম বললেন—পাণ্ডবদের খুঁজে বার করা মোটেই সম্ভব হবে না। যুধিষ্ঠির ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি, রাজনীতিও তাঁর ভালই জানা আছে। ওইরকম একজন নীতিজ্ঞ ব্যক্তি যদি মনে করেন—আমি ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকব—তা হলে কারও পক্ষেই তাঁকে খুঁজে বার করা সম্ভব হবে না—ন তু নীতিঃ সুনীতস্য শক্যতে’ন্বেষিতুং পরৈঃ। আমি যা বলছি, তা আমার জ্ঞান বুদ্ধি এবং অনুমানের ওপর নির্ভর করেই বলছি, তোমাদের ওপর আমার কোনও বিদ্বেষ নেই—বুদ্ধ্যা প্রযুক্তং ন দ্রোহাৎ প্রবক্ষ্যামি নিবোধ তৎ। মনে রেখো, যুধিষ্ঠির যে ধরনের নীতি নিয়ে চলেন, কোনওভাবেই আমি তার নিন্দা করতে পারি না; কাজেই এই তেরো বচ্ছর ধরে যুধিষ্ঠির কোথায় কীভাবে অবস্থান করছেন—এ ব্যাপারে অন্য লোক যেমন ভাবছে, আমি তেমন ভাবছি না—তত্র নাহং তথা মন্যে যথায়মিতরো জনঃ।

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের অনেক গুণ গাইলেন প্রসঙ্গত। যুধিষ্ঠির যে দেশে বাস করবেন, সে দেশের মঙ্গল এবং সমৃদ্ধি যে স্বতঃসিদ্ধ, সে কথাও ভীষ্ম সাতকাহন করে বললেন। গুপ্তচরেরা যে কোনওভাবেই যুধিষ্ঠিরের সন্ধান পাবে না, সে বিষয়ে নিজের পরম নিশ্চিন্ততা জ্ঞাপন করে ভীষ্ম আসলে বোঝাতে চাইলেন যে, এই ধরনের বৃথা অন্বেষণ বাদ দিয়ে নিজেদের হিত চিন্তা করাটাই কৌরবদের পক্ষে মঙ্গলকর হবে—এবমেব তু সঞ্চিন্ত্য যৎ কৃত্যং মন্যসে হিতম্‌। নিজেদের হিতভাবনাটা কীভাবে করতে হবে, সে ব্যাপারে কোনও স্পষ্ট পরামর্শ না দিলেও, তাঁর ইঙ্গিতটা বুঝতে দেরি হবার কথা নয় দুর্যোধন কর্ণদের। স্বাভাবিক কারণেই কথাটা তাঁদের ভাল লাগল না, কিন্তু এমন একটা সময় যখন পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় শেষ হয়ে আসছে, এই সময়ে এই কুলবৃদ্ধ পিতামহটিকে দুর্যোধন কৰ্ণরা চটাতেও তেমন সাহস করলেন না।

পাণ্ডবদের অন্বেষণ করার গুরুত্বটা অবশ্য এমনিই কমে গেল। গুপ্তচরেরা অনেক বৃথা সংবাদ দেবার সময় প্রসঙ্গক্রমে বলেছিল যে, মৎস্যরাজ বিরাটের সেনাপতি কীচক মারা গেছেন। কীচক দ্রৌপদীর প্রেম লাভ করার চেষ্টা করে কীভাবে ভীমের হাতে মারা পড়েছিলেন, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু বিরাটের সেনাপতি কীচক এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে, তিনি মাঝে মাঝেই তাঁর আশপাশের রাজ্য আক্রমণ করে অন্যদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন। কীচক মারা যেতে দুর্যোধনের মিত্রশক্তির অন্তর্গত ত্রিগর্তদেশের রাজা সুশর্মা বিরাটরাজার রাজ্য আক্রমণ করে তাঁর গোধন হরণ করতে বললেন। ত্রিগর্তরাজ এমনও বললেন যে, পাণ্ডবদের খোঁজার কোনও মানেই হয় না। হয় তারা হারিয়ে গেছে, নয়তো মরে গেছে। আর যদি বেঁচেও থাকে, তবে তাদের অর্থ, শক্তি, পুরুষকার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শুধু শুধু তাদের খুঁজে সময় নষ্ট করার কী দরকার—কিং বা নঃ পাণ্ডবৈঃ কাৰ্য্যং হীনার্থবলপৌরুষৈঃ।

ত্রিগর্তরাজ সুশর্মার কথা সমর্থন করে কর্ণ বললেন—ঠিক কথাই বলেছে সুশর্মা। তুমি কৌরবসৈন্য আর ত্রিগর্তরাজের সৈন্য দুই ভাগ নিয়ে বিরাট রাজ্যে যুদ্ধ চালাবে। অবশ্য এ ব্যাপারে শেষ কথা বলবেন আমাদের বৃদ্ধ পিতামহ মহাপ্রাজ্ঞ ভীষ্ম এবং অবশ্যই আচার্য দ্রোণ এবং কৃপ—প্রজ্ঞাবান্‌ কুরুবৃদ্ধো’য়ং সর্বেষাং নঃ পিতামহঃ। পরিস্থিতি পরিবর্তিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণের ভাষা কত মধুর হয়ে উঠেছে, লক্ষ করুন। যুদ্ধবিগ্রহ লাগলে ভীষ্মপিতামহের মতো বিরাট যোদ্ধাকে যে কৌরবদের প্রয়োজন হবে, সে কথা কর্ণও এখন বুঝতে পারছেন।

দুর্যোধন বিরাটরাজ্য আক্রমণের নির্দেশ দিলেন এবং এইভাবে রাজার আদেশ নেমে এলে ভীষ্মও বিনা দ্বিধায় যুদ্ধ করতে যাবেন। এইরকমই নিয়ম। তা ছাড়া যুদ্ধ জিনিসটা এই কুরুবৃদ্ধের কাছে এখনও যথেষ্ট রুচিকর। বৃদ্ধ হলেও তিনি যুদ্ধ ভয় পান না। ঠিক হল, যুদ্ধ হবে দুটো ‘সেকটরে’। প্রথমে ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা একদিক থেকে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে বিরাটের গোধন হরণ করবেন, আর কৌরবরা আক্রমণ করবেন, তার পরদিন।

হঠাৎ করে দুর্যোধন কর্ণদের কথায় বিগলিত হয়ে ভীষ্ম বিরাট রাজ্যে আক্রমণ করতে গেলেন কেন, এটা একটা রহস্য বটে। বস্তুত, বিরাট-সেনাপতি যেভাবে মারা গেছেন, তার মধ্যে পাণ্ডবদের ঠিকানা পাবার কোনও ইঙ্গিত ছিল কি না, সেটা মহাভারতের কবি একবারও স্পষ্টত উচ্চারণ করেননি। তবে মহাভারতের এই অংশটুকু উপজীব্য করে কালিদাসের পূর্ববর্তী নাট্যকার মহাকবি ভাস তাঁর ‘পঞ্চরাত্র’ নাটক রচনা করেন। সেখানে কিন্তু ওই ইঙ্গিতটা ছিল।

ভাসের পঞ্চরাত্র নাটকে দেখা যাচ্ছে—পাণ্ডবদের বনবাস এবং অজ্ঞাতবাস কালে দুর্যোধন অতিশয় ভদ্রলোক হয়ে উঠেছেন। মহাভারতেও অবশ্য অনুরূপ কথা আছে। পঞ্চরাত্র নাটকের প্রথমাংশে দুর্যোধন একটি যজ্ঞ শেষ করেছেন এবং তাতে ভীষ্ম দ্রোণ ইত্যাদি বৃদ্ধেরা দুর্যোধনের ওপর বেশ সন্তুষ্ট। যজ্ঞশেষে দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে দক্ষিণা দিতে চাইলেন। দ্রোণ অবশ্য সবিনয়ে এই প্রস্তাব এড়িয়ে গিয়ে কুলবৃদ্ধ ভীষ্মই এই দক্ষিণার উপযুক্ত পাত্র বলে দুর্যোধনকে উপদেশ দিলেন। ভীষ্ম কোনওভাবেই এই দক্ষিণা নিতে রাজি হলেন না। ভীষ্মের অনুরোধে দ্রোণ শেষপর্যন্ত দক্ষিণা গ্রহণ করতে রাজি হলেন এবং দুর্যোধনের কাছ থেকে সত্যরক্ষার প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে দক্ষিণা হিসেবে পাণ্ডবদের জন্য অর্ধরাজ্য চেয়ে বসলেন।

দ্রোণাচার্যের এই প্রার্থনা সহজে মঞ্জুর হল না। মামা শকুনি দেখলেন—তাঁর পাশাখেলায় জেতা রাজ্য কত সহজে কৌরবদের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। অথচ দুর্যোধন এমনভাবেই অঙ্গীকার করেছেন যে, প্রতিজ্ঞাত দক্ষিণা না দিলেও নয়। শকুনি তখন দ্রোণাচার্যকে একটা শর্ত দিয়ে বললেন—ঠিক আছে, যদি আপনি পাঁচ রাত্রির (পঞ্চরাত্র) মধ্যে পাণ্ডবদের খবর এনে দিতে পারেন, তবে ওই অর্ধরাজ্য প্রদানের কথাটা মানা যেতে পারে। পাণ্ডবদের কোনও খবরই যেখানে পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে এই শর্ত মেনে নেওয়া খুব কঠিন ছিল, বিশেষত বয়স্ক দ্রোণাচার্যের পক্ষে।

নাটকের ঠিক এই মুহূর্তে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ এল কৌরবসভায়। দূত এসে খবর দিল—বিরাট-সেনাপতি কীচক এক অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে মারা গেছেন এবং তাঁকে মেরে দলা পাকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই খবর শোনামাত্র অন্যদের যা প্রতিক্রিয়া হবার হল, কিন্তু দ্রোণাচার্য সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্মের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বললেন—পাঁচ রাত্রির মধ্যে পাণ্ডবদের খুঁজে বার করার শর্ত তিনি মেনে নিচ্ছেন। আসলে কীচকের মৃত্যুর রকমসকম শুনেই ভীষ্ম দ্রোণরা বুঝতে পেরেছেন যে, এটি ভীমের কাজ। সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা পাণ্ডবদের আবাসস্থল সম্বন্ধে প্রায় নিশ্চিন্ত হয়েছেন।

পঞ্চরাত্র নাটকে এর পরেই ভীষ্মের সেনাপতিত্বে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করেছে কৌরববাহিনী। মহাভারতেও এই আক্রমণ ঘটেছে, তবে ভাসের পঞ্চরাত্র নাটকের পটভূমিকার নিরিখে আমাদের সন্দেহ হয় যে, মহামতি ভীষ্ম বিরাটরাজ্যে পাণ্ডবদের উপস্থিতি একইভাবে অনুমান করেননি তো? যাই হোক, মহাভারতে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে ভীম এবং অন্যান্য পাণ্ডবদের হাতে পর্যুদস্ত হলেন ত্রিগর্তরাজ সুশর্মা। পরের দিন কৌরবরা বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে প্রথমেই বিরাটের গোশালা থেকে অন্তত ষাট হাজার গোরু তাড়িয়ে নিয়ে এলেন একদিকে। গয়লারা ঘটনা জানাল কুমার উত্তরকে। বিরাট-পুত্র প্রথমে অনেক হম্বিতম্বি করে বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে সারথি করে যুদ্ধে এলেন এবং সাগরোপম কৌরববাহিনী দেখে যুদ্ধে পরাঙ্‌মুখ হলেন। অর্জুন তখন উত্তরকে সারথি করে নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন।

দূর থেকে অর্জুনকে বিদ্যুৎবেগে একা আসতে দেখে প্রথম তাঁকে অর্জুন বলে সন্দেহ করলেন দ্রোণাচার্য। তিনি এতদিন পর প্রিয় শিষ্যকে যুদ্ধক্ষেত্রে আসতে দেখে বেশ একটু প্রশংসাই করে ফেলেছিলেন। দুর্যোধন অবশ্য এই প্রশংসায় কান না দিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন তুললেন যে, পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের কাল শেষ হয়নি, অতএব অর্জুনকে যখন দেখা গেছে তখন আবার পূর্বপ্রতিজ্ঞামতো পাণ্ডবদের বনে যেতে হবে। এরপর অবশ্য তিনি দ্রোণের অর্জুন-প্রশংসা সম্বন্ধে মন্তব্য করে দু-চার কথা শুনিয়ে দিলেন তাঁকে। তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন কর্ণ। তাঁর আত্মশ্লাঘাও বাদ গেল না। এবার ঝগড়া জমে উঠল। কৃপাচার্য এবং অশ্বত্থামা দুজনেই কর্ণকে একহাত নিলেন। ওদিকে অর্জুনকে ধেয়ে আসতে দেখা যাচ্ছে। কৌরবদের সৈন্যবাহিনী তখনও ঠিকঠাক মতো সাজানো হয়নি।

ঠিক এই অবস্থায় মহামতি ভীষ্মের প্রতিক্রিয়াটি অদ্ভুত এবং অসাধারণ। অর্জুনই হোন, আর যেই হোন, যিনি একা যুদ্ধ করতে আসছেন তিনি সাধারণ যোদ্ধা নন বলেই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বন্ধ করা উচিত বলে ভীষ্ম রায় দিলেন। তিনি কর্ণকে একবার প্রশংসা করলেন এবং অন্যদিকে দ্রোণাচার্যকে বললেন—আপনাকে যুদ্ধে উত্তপ্ত করার জন্যই কর্ণ এইসব কথা আপনাকে বলেছে—কর্ণো যদভ্যবোচত্তে তেজঃসংজননায় তৎ। ভীষ্ম সবাইকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, অর্জুন যখন যুদ্ধ করার জন্য আসছে, তখন তাঁকে সামনে দেখতে পেয়েও নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে মরার কোনও মানে নেই—নায়ং কালো বিরোধস্য কৌন্তেয়ে সমুপস্থিতে। ভীষ্ম সকলকে সন্তুষ্ট করে, বিশেষত দ্রোণ, কৃপ এবং অশ্বত্থামাকে এমনভাবে বোঝালেন যেন তিনিই সকলের কাছে কর্ণ দুর্যোধনের কারণে ক্ষমাপ্রার্থী।

উন্মুক্ত যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্যে কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিটির এই বিনীত ব্যবহারে দ্রোণ কৃপরা যে সন্তুষ্ট হলেন, এটা বড় কথা নয়। লক্ষণীয় ভীষ্মের এই মীমাংসায় দুর্যোধন নিজের ভুল বুঝে ক্ষমা চাইলেন দ্রোণাচার্যের কাছে। অন্যদিকে দ্রোণও দুর্যোধনকে ক্ষমা করলেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে কিছু গুরুতর প্রশ্ন তিনি ভীষ্মের কাছে পেশ করলেন। দ্রোণের প্রথম প্রস্তাব হল—দুর্যোধনকে কোনওভাবেই অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে না দেওয়া। তেরো বচ্ছর আগে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে, তার প্রতিশোধ তোলার জন্য দুর্যোধনকে মেরে ফেলাটা অর্জুনের পক্ষে আজ কিছুই অসম্ভব নয়। কাজেই যেভাবে হোক দুর্যোধনকে সরিয়ে রেখে নিজেরা যুদ্ধ করে তাঁকে রক্ষা করতে হবে।

দ্রোণের দ্বিতীয় প্রস্তাব হল—অর্জুনকে দেখামাত্রই দুর্যোধন যে অজ্ঞাতবাসের কাল গুনে আবার তাঁদের বারো বচ্ছরের জন্য বনে পাঠাতে চাইছেন, সেই হিসাবটা ভেঙে দেওয়া। দ্রোণ বললেন—অজ্ঞাতবাসের সময় সমাপ্ত না হলে অর্জুন এভাবে নিজেকে প্রকাশ করতেন না। কাজেই দুর্যোধন যেসব কথা ভেবে আনন্দ পাচ্ছেন, আপনি সেই ভুলটা ভেঙে দিন, ভীষ্ম—উক্তং দুর্যোধনেনাপি পুরস্তাদ্‌ বাক্যমীদৃশম্‌।

অন্তত এই শ্লোকটি বিচার করলে বোঝা যায় যে, পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সমাপ্তিকাল নিয়ে আগেই এই দুই বৃদ্ধ কিছু হিসেবনিকেশ করে রেখেছেন। এই নিরিখে পঞ্চরাত্র নাটকে ভাসের উদ্ভাবনী প্রতিভাটাও সার্থকভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। আমরা অবশ্য এই ঘটনার মধ্যে আরও গভীরতর এক তথ্য আবিষ্কার করি। এই তেরো বচ্ছর ধরে কুলবৃদ্ধ ভীষ্ম একেবারে চুপ করে গুটিয়ে রেখেছিলেন নিজেকে। কিন্তু আজ অর্জুনকে দেখার পর থেকেই তাঁর অসীম গুরুত্ব বেড়ে গেছে। নইলে প্রথমত তাঁকে অনুসরণ করে দুর্যোধন দ্রোণের কাছে ক্ষমা চাইতেন না। দ্বিতীয়ত, দ্রোণ তাঁর ক্ষমা প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে অবহেলায় বলতে পারছেন—দুর্যোধন পাণ্ডবদের বনবাসের কাল সম্বন্ধে যা বললেন, তার সম্বন্ধে আপনার সঠিক বক্তব্যটা জানিয়ে দিন তো—তদনুস্মৃত্য গাঙ্গেয় যথাবদ্‌ বক্তুমর্হসি।

গাঙ্গেয় ভীষ্ম এখন বলতে পারছেন, নির্দ্বিধায় নিজের বক্তব্য জানাচ্ছেন তিনি। ভীষ্ম এবার দিনক্ষণের কলাকাষ্ঠা হিসেব করে সৌর মাস এবং চান্দ্র মাসের তিথি-মান বিচার করে দেখালেন সবিস্তারে। ভীষ্ম বোঝালেন—আমাদের দেশে সূর্যের আহ্নিক গতি অনুসারে তিথি গণনা হয় না। হয় চন্দ্রের গতি অনুসারে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই তেরো বচ্ছরে পাঁচ পাঁচটি চান্দ্র মাস বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সেই হিসেবেই পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের কালও সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। অর্জুন সেটা জানে এবং জেনেবুঝেই সে এমন প্রকটভাবে যুদ্ধ করতে এসেছে—এবমেতদ্‌ ধ্রুবং জ্ঞাত্বা ততো বীভৎসুরাগতঃ।

এমন একটা সুযোগ পেয়ে ভীষ্ম পাণ্ডবদের গুণকীর্তন করতেও পিছুপা হলেন না। তিনি বুঝেছেন—এখনই অর্জুনের সঙ্গে সর্বশক্তি নিয়োগ করে যুদ্ধ করতে হবে এবং যুদ্ধের জন্যই তাঁর ওপরে নির্ভর করতে হবে দুর্যোধনকে। অতএব এই মুহূর্তে পাণ্ডবদের সম্বন্ধে দুটো কথা তিনি বলবেনই। ভীষ্ম বললেন—পাণ্ডবরা সকলেই মহান পুরুষ এবং ধর্মার্থ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞতাও কিছু কম নয়। বিশেষত যে পাণ্ডবদের প্রধান পুরুষ হলেন যুধিষ্ঠির, তিনি এমন অন্যায় কখনও করবেন না যাতে সময় ফুরোবার আগেই তিনি এসে রাজ্য চাইবেন। এমন ভাবারও কোনও কারণ নেই যে, তারা সব ভীষণ লোভী। যদি লোভ থাকত, তা হলে বারো-তেরো বছরের এই কষ্টকর বনবাস তারা মেনে নিত না। যে সময় তাঁদের ওপর অন্যায় করা হয়েছিল, সেই সময়েই নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়ে যা করার তারা করতে পারত। কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মের নিয়মে আবদ্ধ থাকায় তারা তাদের ক্ষত্রিয়ের ব্রত থেকে বিচ্যুত হয়নি—ধর্মপাশনিবদ্ধাস্তে ন চেলুঃ ক্ষত্রিয়ব্রতাৎ।

ভীষ্ম পাণ্ডবদের গুণগান করেই ছাড়লেন না। দুর্যোধনকে সাবধান করে দিয়ে বললেন—এখন সময় এসেছে এবং পাণ্ডবরা এখন তাদের প্রাপ্য রাজ্য ফিরিয়ে নেবেই। কাজেই আমি বলছিলাম কী, যুদ্ধ করে কখনও সম্পূর্ণ সিদ্ধি আসে না। যুদ্ধে একজন বাঁচবে, একজন মরবে, একজনের জয় হবে, অপরজনের পরাজয়—সংপ্রবৃত্তে তু সংগ্রামে ভাবাভাবৌ জয়াজয়ৌ। অতএব যুদ্ধই করবে, নাকি যেটা ধর্ম সেটাই করবে, সেটা তাড়াতাড়ি এখনই বুঝে দেখো। কেননা অর্জুন প্রায় এসে গেছে—ক্রিয়তামাশু রাজেন্দ্র সংপ্রাপ্তশ্চ ধনঞ্জয়ঃ।

ভীষ্মের মুখে অনেকক্ষণ পাণ্ডবদের গুণপনা শুনেও দুর্যোধনের মনের ভাব কিছু পরিবর্তিত হল না। বিশেষত এখন অজ্ঞাতবাসের সমাপ্তিকাল পূর্ণ হয়েছে শুনে তাঁর হতাশা আরও বেড়েছে। যুদ্ধের জন্য ভীষ্মকে তাঁর নিতান্তই প্রয়োজন। অতএব তাঁকে একটুও না চটিয়ে দুর্যোধন বললেন—আমি কিছুতেই পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দিতে পারব না—নাহং রাজ্যং প্রদাস্যামি পাণ্ডবানাং পিতামহ। বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যাপারে যা যা আপনার করণীয় আছে, আপনি তাই করুন তাড়াতাড়ি।

ভীষ্ম আর একটুও দেরি করেননি। তাঁর যা পরামর্শ দেবার তিনি দিয়েছেন। কিন্তু দুর্যোধন যখন শুনবেন না এবং হস্তিনাপুরের রাজাধিকারী হিসেবে তিনি যখন যুদ্ধের ভাবনাই ভাবছেন, অতএব হস্তিনাপুরের বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী হিসেবে তিনি এক মুহূর্তে যুদ্ধের ‘স্ট্র্যাটিজি’ গ্রহণ করেছেন। দুর্যোধনের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধ হলে আজকে যে দুর্যোধন পরাজিত হবেনই সে বিষয়ে ভীষ্মের কোনও সন্দেহ ছিল না। অতএব কৌরববাহিনীর এক চতুর্থাংশ সৈন্য সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধনকে তিনি হস্তিনার দিকে চলে যেতে বললেন। কিন্তু অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়ার আগে ভীষ্ম সেনা সাজালেন খুব বুদ্ধি করে। ভীষ্ম বললেন—দ্রোণাচার্য থাকুন সমস্ত সৈন্যের মাঝখানে, ডাইনে কৃপাচার্য, বাঁয়ে অশ্বত্থামা। এক্কেবারে সামনে থাকুন মহাবীর কর্ণ এবং আমি পিছন থেকে সবাইকে রক্ষা করার চেষ্টা করব।

একটু আগে অর্জুনকে কত বিচিত্র রকমে পর্যুদস্ত করবেন কর্ণ, সে ব্যাপারে গলা ফুলিয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। ভীষ্ম কর্ণের সমরস্পৃহা মেটানোর ভাবনা ভাবলেন তাঁকে সবার সামনে এগিয়ে দিয়ে। যুদ্ধের দৃষ্টিতে দেখলে পরে যুদ্ধের জন্য টগবগ করা লোকটিকেই সামনে দেওয়া ভাল। এতে সম্মুখস্থ ব্যক্তি তার আপ্রাণ চেষ্টাটি করবে এবং অন্যদিকে সে বিফল হলে সেটা নিয়ে কথা শোনানোর সুযোগও থাকবে যথেষ্ট। বিশেষত কর্ণের মতো অহংকারী ব্যক্তিকে এইভাবেই শিক্ষা দিতে হয়, যেমনটি ভীষ্ম দিলেন। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ হলে কর্ণ বেশিক্ষণ দাঁড়াতেই পারেননি। তাঁকে পালাতে হয়েছিল। অবশ্য বনবাসের পর এই প্রথম-যুদ্ধে অর্জুনের সঙ্গে কেউই তেমন দাঁড়াতে পারেননি। ভীষ্মের সঙ্গেও অর্জুনের এক প্রস্থ সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল। সেখানে এই বৃদ্ধ বয়সেও ভীষ্মের যে যুদ্ধোন্মাদনা দেখা গেল, তা তাঁর অল্পবয়স্ক নাতিদের চাইতে কোনও অংশে কম নয়।

ভীষ্মের সঙ্গে অর্জুনের শেষ যুদ্ধদৃশ্যটি অতীব মনোরম। অর্জুন বেশ দু-দশখানি বাণে পিতামহকে কাবু করে ফেলেছিল, কিন্তু যতটা কাতরতা এই বৃদ্ধ বাহ্যত দেখাচ্ছিলেন, ততটা কাতর তিনি হননি। অর্জুনের বাণে আহত হয়ে তিনি অনেকক্ষণ রথের মধ্যদণ্ডটি ধরে নিশ্চুপে পড়ে রইলেন—গৃহীত্বা রথকূরবম্‌। কিন্তু মহাভারতের কবি মন্তব্য করতে বাধ্য হলেন যে, ভীষ্ম এমনভাবেই অনেকক্ষণ পড়ে রইলেন যাতে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি খুব কাতর হয়ে পড়েছেন—গাঙ্গেয়ো যুদ্ধদুর্ধর্ষ-স্তস্থৌ দীর্ঘমিবাতুরঃ। মহাকবির এই শব্দব্যঞ্জনা থেকে বোঝা যায়—এতদিন পর এই প্রিয়তম নাতিটিকে দেখতে পেয়ে এই বৃদ্ধ ঠাকুরদাদাটির কোনও ইচ্ছাই আর ছিল না যুদ্ধ করার। রথের সারথিটিকে ঠাকুরদাদা আগে বলে রেখেছিলেন যে, তাঁকে সংজ্ঞাহীনের মতো পড়ে থাকতে দেখলেই সে যেন তাঁর রথ সরিয়ে নিয়ে যায়। যুদ্ধের আগে এই বৃদ্ধ ঠাকুরদাদার পূর্ব পরিকল্পনাগুলি এই মুহূর্তে আমাদের হৃদয় মথিত করে। হস্তিনাপুরের রাজনীতিরুক্ষ মরু-রাজধানীতে বসেও দূরাগত বনবাসী নাতিদের জন্য তাঁর স্নেহধারা কতটা উৎসারিত হচ্ছিল, এই ঘটনা তার প্রমাণ।

লক্ষ করে দেখুন, অর্জুন যখন আপন অস্ত্রকৌশলে কৌরবপক্ষের সমস্ত প্রধান পুরুষকে মূৰ্ছিত করে ফেলেছেন, তখন তিনি বিরাটকন্যা উত্তরার খেলার সুবিধের জন্য উত্তরকে পাঠালেন প্রত্যেক মহারথীর মাথার পাগড়ি খুলে আনার জন্য। যুদ্ধরত ক্ষত্রিয় পুরুষের মাথার পাগড়ি খুলে নেবার মতো অপমান আর হয় না। কিন্তু উষ্ণীষ খোলার জন্য কুমার উত্তরকে নির্দেশ দেবার সময় অর্জুন দ্রোণ কৃপ, কর্ণ দুর্যোধন সবাইকে চিনিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু ভীষ্মের কথা বলে তিনি কুমার উত্তরকে বললেন—আমার ওই বৃদ্ধ ঠাকুরদাদা ভীষ্মের দিকে কিন্তু যেয়ো না, বাপু। ওঁর সংজ্ঞা মোটেই লুপ্ত হয়নি এবং আমার মূর্চ্ছাস্ত্র বিফল করে দেবার অস্ত্রসন্ধিও ওই বুড়োর জানা আছে—ভীষ্মস্য সংজ্ঞান্তু তথৈব মন্যে/জানাতি সো’স্ত্রপ্রতিঘাতমেষ। কাজেই আমার ওই অমূৰ্ছিত ঠাকুরদাদাটিকে বাঁয়ে রেখে তুমি আমাদের রথটি বার করে নিয়ে যাবে।

কুমার উত্তর নির্দিষ্ট কয়জনের মাথার উষ্ণীষ খুলে নিয়ে অর্জুনকে নিয়ে যেই রথ চালালেন, অমনই ভীষ্ম পিছন থেকে আক্রমণ হানলেন অর্জুনকে। কোথায় তাঁর মূর্ছা, কোথায় কী? অবশ্য এই আক্রমণও ছিল লোকদেখানো, অর্থাৎ আমি পারতাম, কিন্তু করলাম না। অর্জুন তাঁর এই ঠাকুরদাদাটির স্নেহ-অভিব্যক্তি ভালই বোঝেন। তিনি ভীষ্মকে কিছুই করলেন না; বাণাঘাতে শুধু তাঁর সারথি এবং ঘোড়াগুলিকে খানিকটা কাবু করে দিয়ে অর্জুন রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে গেলেন এবং ভীষ্মও তাঁকে যেতে দিলেন—ততো’র্জুনো ভীষ্মমপাস্য যুদ্ধে/ বিদ্‌ধ্বাস্য যন্তারমধিজ্যধন্থা। ততক্ষণে দুর্যোধনের মূর্ছার ঘোর কেটেছে। সংজ্ঞা লাভ করেই তিনি পিতামহ ভীষ্মের বিমূঢ় অবস্থা এবং অর্জুনকে রথ ছুটিয়ে চলে যেতে দেখেই মন্তব্য করলেন—আরে! ধরুন ব্যাটাকে, ধরুন পিতামহ! একে আপনি এইভাবে ছেড়ে দিলেন? এমন করে ধরুন, যাতে আর পালিয়ে যেতে না পারে—অয়ং কথংস্বিদ্‌ ভবতা বিমুক্তস্তথা প্রমথ্‌নীহি যথা ন মুচ্যেৎ।

ভীষ্ম ভাবলেন—কী বিপরীত স্বভাবের মানুষই না এই দুর্যোধন! এই কিছুক্ষণ আগে যে অর্জুনের হাতে সমস্ত রথী মহারথীদের নিয়ে যুদ্ধে মূর্চ্ছিত হয়ে বসেছিলেন দুর্যোধন, সেই তিনি যেন ঘুম থেকে উঠেই বললেন—কী হল? এটা হয়নি কেন, ওটা হয়নি কেন ইত্যাদি। ভীষ্ম আর সহ্য করতে পারলেন না। বললেন—একটু আগে এইসব কথা তোমার কোথায় ছিল, দুর্যোধন? অর্জুনের সম্মোহন-বাণে তোমার ধনুক বাণ খসে পড়েছিল হাত থেকে। তখন তোমার এই বুদ্ধি, এত বড় বড় শক্তিমত্তার কথা কোথায় ছিল—ক্ব তে গত বুদ্ধিভূৎ ক্ব বীর্যম্‌? আমি তো বরং অর্জুনকে ভাল বলব যে, ওইরকম বেকায়দায় পেয়েও সে তোমাকে মারেনি। নেহাত এই ধরনের পাপ কাজ সে কখনও করতে পারে না বলেই এবং রাজ্যের লোভে নিজের ধর্মটাকে সে ছাড়তে পারে না বলেই আজকে এখনও তোমরা প্রাণ নিয়ে বেঁচে আছ—তস্মান্ন সর্বে নিহতা রণে’স্মিন্। আমি এখনও তোমাকে সাবধান করে বলছি—তুমি এখনই তাড়াতাড়ি হস্তিনায় ফিরে যাও—ক্ষিপ্রং কুরূন্‌ যাহি কুরুপ্রবীর। বিরাটরাজার গোরু নিয়ে ফিরে যাক অর্জুন। তোমার নিজের মোহে যেন কোনও সর্বনাশ না হয়ে যায়—মা তে’দ্য কার্যং নিপতেচ্চ মোহাৎ। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।

দুর্যোধন পিতামহ ভীষ্মের কথা শুনে চলতে বাধ্য হলেন এবং অনেক ক্রুদ্ধ দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে তিনি বাড়ি ফিরলেন। ওদিকে বিরাটগৃহে পাণ্ডবদের আত্মপ্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধের উদ্যোগ শুরু হয়ে গেল। বিরাটের রাজসভায় যাদব পাঞ্চালদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন পাণ্ডবরা। আলোচনার শেষ সিদ্ধান্ত হল—পাণ্ডবরা তাঁদের হৃত রাজ্য ফেরত চান কিন্তু এই বাবদে যুদ্ধ তাঁদের কাম্য নয়, শান্তিই তাঁদের কাম্য। অনেক আলোচনার পর দ্রুপদরাজার পুরোহিতকে পাঠানো হল কৌরবসভায় পাণ্ডবদের বক্তব্য নিবেদন করার জন্য। তিনি ভীষ্ম দ্রোণ এবং কর্ণ দুর্যোধনদের সামনে পাণ্ডবদের বনবাস-কষ্টের কথা যেমন বর্ণনা করলেন, তেমনই ভীমার্জুনের শক্তিমত্তার কথা, তাঁদের অজেয়ত্ব, কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তা—এ সবই তিনি প্রকাশ করলেন বেশ কড়া ভাষায়।

এক রাজসভার মন্ত্রীমণ্ডলীতে বসে ছিলেন ভীষ্ম। সেখানে এক ব্রাহ্মণ পুরোহিতের মুখে পাণ্ডবদের হয়ে এই কঠিন যুদ্ধাহ্বান ভাল করে সহ্য করতে পারলেন না ভীষ্ম। পাণ্ডবরা যেখানে যুদ্ধ চান না, সেখানে শান্তির মর্মকথাটাই বড় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দ্রুপদরাজার পুরোহিত সেই মর্মটা খুব হৃদয় দিয়ে বোঝেননি। ফলে তাঁর মুখে পাণ্ডবদের পেরিয়ে আসা কষ্টকর বনবাস এবং অধুনা তাঁদের শক্তির আড়ম্বরটাই বড় হয়ে উঠল। ভীষ্ম এটা ঠিক আশা করেননি আর করেননি বলেই প্রথম প্রতিক্রিয়াটা তিনিই ব্যক্ত করলেন। ভীষ্ম বললেন—এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার যে, পাণ্ডবরা সবাই ভাল আছেন। বনবাসের কাল সমাপ্তির পর তাঁরা যে যাদব পাঞ্চালদের সহায়তা লাভ করেছেন, এটা নিশ্চয়ই ভাগ্যের কথা। আর এটাও খুব বড় কথা যে, পাণ্ডবরা তাঁদের এই বনবাস-যন্ত্রণার পরেও কারও সঙ্গে সংঘর্ষ চান না। তাঁরা সন্ধি চান। মহাশয়! আপনি সব কথা ঠিকই বলেছেন, কিন্তু বলেছেন বড় তীক্ষ্ণভাবে। হয়তো এই তীক্ষ্ণতা আপনার বরণশ্রেষ্ঠতার কারণে, ব্রাহহ্মণ্যের কারণে—অতিতীক্ষ্ণং তু তে বাক্যং ব্রাহ্মণ্যাদিতি মে মতিঃ।

ব্রাহ্মণকে কথাগুলি শুনিয়ে দেবার পরেই প্রজ্ঞাবৃদ্ধ ভীষ্ম তাঁর ভাষা নরম করলেন। বস্তুত, কৌরবসভার মন্ত্রী অমাত্য এবং রাজন্যবর্গের সামনে পাঞ্চালরাজার পুরোহিত এসে পাণ্ডবদের হয়ে যতই বলুন, সে-পুরোহিত পাঞ্চালদের প্রতিনিধি। আর পাঞ্চালদের সঙ্গে কুরুবংশীয়দের চিরন্তন শত্রুতা। ভীষ্মের মৃত্যুকামী অম্বা-শিখণ্ডী পাঞ্চালরাজের পুত্র বলে পরিচিত। সেই পাঞ্চাল-পুরোহিত এসে তাঁর প্রিয়জন ভীমার্জুনের শক্তিমত্তার কথা যতই শোনান, তবুও তিনি পাঞ্চাল। ভীষ্মের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া সেইজন্যই। কিন্তু তীব্র প্রতিক্রিয়ায় যদি তাঁর কৌরব নাতিরা ভেবে বসেন যে, তিনি তাঁদের দলের লোক, তাই সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিজেকে শুধরে নিয়ে বলেছেন—আপনি যে অর্জুনের শৌর্যবীর্যের কথা বলছেন, তা আমি সর্বাংশে মানি। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনের অস্ত্রশক্তি সহ্য করবার মতো মানুষ এই পৃথিবীতে নেই—কো হি পাণ্ডুসুতং যুদ্ধে বিষহেত ধনঞ্জয়ম্‌—আমি জানি, স্বয়ং দেবরাজ এলেও তিনি যুদ্ধে এঁটে উঠতে পারবেন না অর্জুনের সঙ্গে, সেখানে অন্য সাধারণ ধনুর্ধরদের কথা আর কী বলব—কিমুতান্যে ধনুর্ভৃতঃ।

ভীষ্মের মুখে অর্জুনের এই প্রশংসা কৌরবসভার যুবকগোষ্ঠী মোটেই ভালভাবে নিতে পারলেন না। মনে রাখা দরকার, এই এত বছর ধরে ভীষ্ম তেমন করে কোনও কথাই বলেননি। কৌরবসভার অতিবৃদ্ধ মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও তিনি যখন দেখেছেন—ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধন তাঁর কথা মেনে চলেন না, তখন তিনি চুপ করে থাকাটাই সবচেয়ে ভাল মনে করেছেন। কিন্তু পুরু-ভরতের রাজবংশে আজ সেই সংকট আবার ঘনিয়ে উঠেছে যখন দুই জ্ঞাতিবংশ প্রায় যুদ্ধের সম্মুখীন। এখন যদি এক পক্ষকে অন্তত থামিয়ে দেওয়া না যায় তবে অন্য পক্ষের অবলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী। প্রসিদ্ধ ভরতবংশের এই সংকটে ভীষ্ম নিজেই নিজেকে প্রয়োজন মনে করছেন। আজ এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় যখন পাণ্ডবদের দূত এসে পৌঁছেছেন, তখন তিনি প্রথম কথা বলার প্রয়োজন অনুভব করেছেন।

কিন্তু বটবৃক্ষের মতো এই প্রাচীন বৃদ্ধের মানসিকতা কে বোঝে এই কৌরবসভায়! শুধু মহারাজ শান্তনুর বংশধারাটি হস্তিনার সিংহাসনে ধরে রাখবার জন্য এতদিন ভীষ্ম যে কষ্ট করেছেন, যত আত্মবলি দিয়েছেন, যত অপমান সহ্য করেছেন, তা অন্য কে বুঝবে! দ্রুপদের পুরোহিতের সঙ্গে গলা মিলিয়ে অর্জুনের প্রশংসা করে ভীষ্ম কৌরবসভার প্রধান পুরুষদের এই ইঙ্গিতই দিয়েছিলেন যে, সন্ধিকামী পাণ্ডবদের রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দেওয়াই ভাল, নইলে মহাবীর অর্জুনের হাতে রক্ষা থাকবে না। কিন্তু প্রাচীন বৃদ্ধ যতই ভাবুন তাঁর পরামর্শের প্রয়োজন আছে, তাঁর হাঁটুর বয়সি যুবাপুরুষেরা তাঁকে আমল দিলেন না। ভীষ্মের মুখে অর্জুনের প্রশংসা শুনে কর্ণ আর থাকতে পারলেন না। তিনি বললেন—বিরাট আর দ্রুপদের শক্তির ওপর নির্ভর করে পাণ্ডবরা আজকে যে যুদ্ধের ভয় দেখাচ্ছে, দুর্যোধন তার ধারও ধারেন না। ভয় দেখালে দুর্যোধন এক পা জমিও ছেড়ে দেবেন না। তবে হ্যাঁ, আগের কথামতো পাণ্ডবরা আবার বারো বচ্ছরের জন্য বনে যাক, তারপর যদি ফিরে আসে, নিশ্চয়ই তখন তাদের কথাটা ভাবা যাবে। কিন্তু তারা যদি বোকামি করে যুদ্ধের ভয় দেখায় তবে এই কুরুবীরদের মুখোমুখি হতে হবে এবং আমার কথাটাও তখন মনে পড়বে।

কর্ণের এই ধরনের উচ্চগ্রাম প্রতিবাদ ভীষ্ম আগেও শুনেছেন। কিন্তু সেসব সময় তাঁকে অবহেলা করেই উত্তর দেননি। বিরাটরাজার গোধন হরণের সময়ে একই পরিস্থিতি হয়েছিল। সেখানে দ্রোণ কৃপরা কর্ণকে খুব করে গালাগালি দিয়েছিলেন। ভীষ্ম তখন এই কর্ণকে খানিকটা বাঁচিয়েই দিয়েছেন। কিন্তু আর নয়। এখন যুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে, এখন আর তিনি কর্ণকে বাড়তে দেবেন না। সমবেত রাজন্যমণ্ডলীর সামনে আজকে কর্ণ যে কথা বলছেন, প্রজ্ঞাবৃদ্ধ ভীষ্ম তাঁকে বাস্তব বুঝিয়ে দেবেন। ভীষ্ম বললেন—এত বড় বড় কথা বলে লাভ নেই, কর্ণ! তুমি কত ক্ষমতা দেখিয়েছ সেইটা একটু ভাবো—কিন্নু রাধেয় বাচা তে কর্ম তৎ স্মর্তুমর্হসি। বিরাটরাজার গোরু চুরি করতে গিয়ে অর্জুনের সঙ্গে কৌরব বীরদের এত বড় যে একটা যুদ্ধ হল, সেখানে ছ-ছটা মহাবীরকে অর্জুন কীভাবে জিতেছে, তা সবাই দেখেছে। সেখানে তুমিও ছিলে, তবে হ্যাঁ, বার বার তোমাকে বাঁচিয়ে তুলতে হচ্ছিল এই যা। তোমার ক্ষমতা তখনই বেশ দেখা গেছে—বহুশো জীয়মানস্য কর্ম দৃষ্টং তদৈব তে। ভীষ্ম এবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বললেন—আমরা যদি এই ব্রাহ্মণের কথা না শুনে পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্য ফিরিয়ে না দিই, তাহলে জেনো, কর্ণ! অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে আমাদের মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ধুলো খেতে হবে, ধুলো—এবং যুধি হতাস্তেন ভক্ষয়িষ্যামো পাংশুকান্‌।

ভীষ্মকে বেশি বলতে হল না। নিজের ভবিষ্যৎ বুঝে ধৃতরাষ্ট্র কর্ণকে তিরস্কার করলেন রীতিমতো এবং ভীষ্মকে জানালেন যে, তিনি তাঁর আপ্তসহায় সঞ্জয়কে পাঠাবেন পাণ্ডবদের কাছে। ভীষ্মকেও তিনি সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন অনেক, আর মান তো দিলেন যথেষ্টই—অনুমান্য প্রসাদ্য চ। কারণটা খুব পরিষ্কার। ভীষ্মকে তাঁর নিজের পক্ষে প্রয়োজন হবে। দুর্যোধন যে কোনওভাবেই পাণ্ডবদের রাজ্য ফিরিয়ে দেবেন না, এ তিনি জানতেন এবং এ বিষয়ে তাঁর নিজেরও যথেষ্ট সমর্থন ছিল। কাজেই যুদ্ধ যদি লাগে তবে কৌরবপক্ষের এক অসামান্য বীরকে তিনি এখন ক্রোধান্বিত করবেন না। ভীষ্ম যে এই মুহূর্তে কত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন সেটা আরও বোঝা যাবে যুধিষ্ঠিরের কথা থেকেই। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে পাণ্ডবদের কাছে পাঠালে যুধিষ্ঠির ভীষ্মের কুশল জিজ্ঞাসা করে বলেছিলেন—আমাদের ঠাকুরদাদা ভীষ্ম বুড়ো হয়ে গেছেন বটে, তবে তিনি মহাপ্রাজ্ঞ এবং সমস্ত ধর্মের আধার। তিনি ভাল আছেন কি না সেটা তো জানবই, কিন্তু আমাদের প্রতি তাঁর আগের মতোই স্নেহ আছে তো, নাকি অন্যরকম—যথা পূর্বং বৃত্তিরস্ত্যস্য কচ্চিৎ?

ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে যত শান্তির কথা বলেই যুধিষ্ঠিরের কাছে পাঠিয়ে থাকুন, রাজ্য ফিরিয়ে দেবার ইচ্ছে যে তাঁর একটুও ছিল না সেটা যুধিষ্ঠিরের মতো ভাল মানুষও বুঝে গিয়েছিলেন। কাজেই সঞ্জয়কেও রাজ্য ফিরিয়ে দেবার শর্তসাপেক্ষ শান্তির কথা শুনেই ফিরে আসতে হল হস্তিনায়। রাজ্য ফিরিয়ে না দিলে যে যুদ্ধই হবে সে কথা যুধিষ্ঠিরের মুখেও বার বার শোনা গেল। সঞ্জয় ফিরে এসে পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের কঠিন বক্তব্য যথাযথভাবে পেশ করলেন কুরুপ্রধানদের বিশেষ সভায়। আবারও প্রথম বক্তব্য নিবেদন করলেন ভীষ্মই। ভীষ্ম একটু আবেগগ্রস্তই হয়ে পড়েছিলেন সেদিন। কৃষ্ণ এবং অর্জুনের অলৌকিক মাহাত্ম্য খ্যাপন করেও তিনি ক্ষান্ত হলেন না। দুর্যোধনকে রীতিমতো ভয় দেখিয়ে ভীষ্ম বললেন—যেদিন কৃষ্ণ এবং অর্জুনকে একরথে যুদ্ধের জন্য আসতে দেখবে, সেদিন আমার কথা মনে রেখো, দুর্যোধন। মুশকিল হয়েছে, তুমি শুধু তিনজনের মতেই চল—তারমধ্যে প্রথমটা হল এই সারথির পো কর্ণ, দ্বিতীয় হল শকুনি আর তৃতীয় দুঃশাসন। কিন্তু তুমি এই তিনজনের মতে চললেও রাজা হিসেবে অন্য সবার কাছে তোমার শাসন সবার আগে মান্য। কারণ কুরুরা তোমার মতেই চলবে—তবৈব হি মতং সর্বে কুরবঃ পর্যুপাসতে।

ভীষ্মের এই ভাল কথাটুকু দুর্যোধন মনে রাখলেন কি না জানি না, কিন্তু ভীষ্মের মুখে ‘কৃষ্ণ অর্জুনের প্রশংসা শুনে কর্ণ একেবারে জ্বলে উঠলেন। বললেন—আমি এমন কোনও অন্যায় করিনি, যার জন্য এমন করে আমাকে অপমান করতে পারেন আপনি। আমি তো ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের ভাল ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। ধৃতরাষ্ট্র যা করেন, তাই আমার কাছে ভাল। তাঁর ছেলে দুর্যোধন যা করেন, তাও আমার কাছে সমান ভাল। কারণ তিনি রাজা, তাঁর কথাই আমাকে শুনতে হবে—তথা দুর্যোধনস্যাপি স হি রাজ্যে সমাহিতঃ।

কর্ণের এই যুক্তির মধ্যে দুর্যোধনের জন্য অসাধারণ আন্তরিকতা থাকতে পারে, কিন্তু সে যুক্তির পরিসর বড় সীমিত। কর্ণ একটি পরিবারের সুখ-সুবিধার কথা শুধু ভাবছেন, কর্ণ তাঁর বন্ধুর নিরঙ্কুশ প্রীতির কথা ভাবছেন, কিন্তু ভীষ্ম যে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত আছেন এবং তাঁর রাজনীতি এবং সমাজনীতির বোধ যতখানি ব্যাপক, তাতে তিনি শুধু একটি পরিবারের বা একজনের ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি নিয়ে ভাবেন না। ভবিষ্যতে তিনি শরশয্যায় শুয়ে যুধিষ্ঠিরকে রাজধর্মের উপদেশ দেবেন। তখন তিনি বার বার বলবেন—দেখো বাপু! রাজার ব্যক্তিগত সুখসমৃদ্ধি মোটেই বড় কথা নয়। রাজধর্মের মর্মকথা হল মানুষের সার্বিক কল্যাণ, যাকে একবার বলা হয়েছে ‘লোকরক্ষণিকা শক্তি’ আরেকবার বলা হয়েছে ‘রাজনীতি জগদ্‌ধাত্রী’। অতএব রাজনীতির ক্ষেত্রে এমন নিয়ম অনুসরণ করতে হবে, যা সকলের মঙ্গল করে। এই মঙ্গলের জন্য সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন, সেটা হল যুদ্ধ হতে না দেওয়া। সেটা যদি ভাল কথায় না হয়, তা হলে অন্যতর পক্ষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেও যদি এক পক্ষ যুদ্ধ থামায় তবে সেই চেষ্টাই করবেন ভীষ্ম। সেই কারণেই তিনি অর্জুনের অস্ত্রনৈপুণ্য এবং কৃষ্ণের বুদ্ধিমত্তার কথা বলে সমগ্র কৌরবপক্ষকে মানসিকভাবে হীনবল করতে চেয়েছেন।

ভীষ্ম এবার কর্ণকে সোজাসুজি আমল না দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন—চিরটা কাল এই কর্ণ বলে এল—সমস্ত পাণ্ডবদের আমি একা মারব—হন্তাহং পাণ্ডবানিতি। কিন্তু আমি সোজা কথা বলছি। যুদ্ধ লাগলে এই কর্ণ পাণ্ডবদের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। তুমি জেনে রেখো ধৃতরাষ্ট্র! কুরুদের যত অন্যায়-অমঙ্গল সব এই সারথির ব্যাটার কাজ—তদস্য কর্ম জানীহি সুতপুত্রস্য দুর্মতেঃ। আর এমনই কপাল যে, তোমার ছেলে দুর্যোধন সব সময়ই কর্ণের কথায় নাচে এবং পাণ্ডবদের প্রতি অন্যায়গুলোও সে করেছে এরই কথায়। পাণ্ডবদের একেক জন বিশেষ বিশেষ সময়ে যে ক্ষমতা দেখিয়েছে, তার একটাও কি এই কর্ণ দেখাতে পেরেছে। বিরাটরাজার সঙ্গে যুদ্ধ হল, কী করতে পারল ও—কিমনেন তদা কৃতম্। অর্জুন সবাইকে পরাজিত করে ক্ষত্রিয়ের মাথার পাগড়ি পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেল। জিজ্ঞেস করো তো, তখন কি কর্ণ এ দেশে ছিল না—প্রমথ্য চাচ্ছিনদ্‌ বাসঃ কিময়ং প্রোষিতস্তদা। পাণ্ডবদের বনবাসের সময় তাদের দুঃখ দিতে গেল এই দুর্যোধন-কৰ্ণরা। গন্ধর্বদের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ লাগল, তোমার ছেলেকে ধরে নিয়ে গেল গন্ধর্বরা। তখন এই সারথির পো কোথায় লুকিয়ে ছিল? সে তো পালিয়ে বেঁচেছিল, অথচ এখন সে কেমন জ্ঞান দিচ্ছে, কেমন ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে, দেখ—ক্ব তদা সুতপুত্রো’ভূদ্‌ য ইদানীং বৃষায়তে।

ভীষ্ম নানা উদাহরণ দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিলেন যে, কর্ণের কথাগুলি বাগাড়ম্বরমাত্র, পাণ্ডবদের মারবার কথাটা কর্ণের মুখে নেহাতই মিথ্যা অহংকার। ভীষ্মের কথা সম্পূর্ণ সমর্থন করলেন দ্রোণাচার্য। যে পক্ষে অর্জুনের মতো মহাবীর আছেন, সেই কঠিন পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধবিলাস যে ঠিক হবে না, সে বিষয়ে একেবারে পরিষ্কার মতামত ব্যক্ত করলেন দ্রোণাচার্য। অন্য কোনও সময় হলে ধৃতরাষ্ট্র হয়তো দু-বার ভাবতেন, হয়তো ভীষ্মের কথা আরও একটু গভীরভাবে ভাবতেন তিনি, কিন্তু এ এমন এক সময়, যখন দুর্যোধনের স্বার্থ সম্পূর্ণ সিদ্ধ হওয়ার সময় এসেছে, পাণ্ডবদের প্রতিরোধ করার মতো শক্তি এবং বলও তাঁর করতলগত—অন্তত ধৃতরাষ্ট্র তাই ভাবছেন। অতএব যুদ্ধ নয় কেন? গণতন্ত্রে যে দল সরকার গঠন করে, সেই শাসক দল যেমন বাড়তি কিছু সুবিধা পায়, তেমনই তেরো বচ্ছর পাণ্ডবদের অনুপস্থিতিতে রাজ্য শাসন করে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরা ভাবছেন—হৃতবল ঐশ্বর্যহীন পাণ্ডবরা কিছুতেই রাজনৈতিকভাবে এবং সামরিক শক্তিতে তাঁদের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবেন না।

কিন্তু ঠিক এই পরিস্থিতিতেই ভীষ্মের পরামর্শ ছিল গুরুতর। তিনি শুধু কৃষ্ণ এবং অর্জুনের কথা উল্লেখ করে বুদ্ধি এবং বলের সমীকরণের কথা বলেছেন। ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের স্বার্থ স্মরণ করে ভীষ্মকে একটুও আমল না দিয়ে পাণ্ডবদের কাছ থেকে ফিরে আসা সঞ্জয়কেও অন্যান্য প্রশ্ন করতে আরম্ভ করলেন। কুরুসভার আলোচনাচক্রে যোগ দিতে আসা অন্যান্য কুরুপ্রধান তথা রাজন্যবর্গেরা যখন দেখলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র ভীষ্মের কথার কোনও মূল্যই দিলেন না—ভীষ্মদ্রোণৌ যদা রাজা ন সম্যগনুভাষতে—তখন তাঁরা নিজেদের জীবনের আশা ছেড়ে দিলেন। দুর্যোধনের কারণে যুদ্ধ করতেই হবে তাঁদের, কিন্তু মহাবীর অর্জুনের মুখোমুখি হওয়াটা যে তাঁদের জীবনের ওপর দিয়ে যাবে এটা তাঁরা তখনই বুঝে ফেললেন—তদৈব কুরবঃ সর্বে নিরাশা জীবিতে’ভবন্‌।

ভীষ্ম-দ্রোণকে একটুও আমল না দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের কথা শুনতে লাগলেন বটে, কিন্তু সঞ্জয়ও তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারলেন না। তিনি যেভাবে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক স্থিতি ব্যাখ্যা করলেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্রের মনে ভয়ের সঞ্চার হল। তিনি যুদ্ধে বিরত হতে চাইলেন। কিন্তু যুদ্ধের উন্মাদনা এমনই এক বিকৃত বস্তু যে, বিরাম চাইলেই তা থেকে বিরত হওয়া যায় না। দুর্যোধন তাঁকে নিজপক্ষের শক্তি সামর্থ্য বুঝিয়ে আবারও জাগিয়ে তুললেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা হল—যে ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে যুদ্ধবিরতির উপদেশ দিচ্ছিলেন, দুর্যোধন তাঁরই কথা বলে ধৃতরাষ্ট্রকে উত্তেজিত করলেন। দুর্যোধন বললেন—আমরা প্রত্যেকে একাই আমাদের শত্রু-নিধনে সমর্থ। একবার এসেই দেখুক না যুদ্ধভূমিতে। বাণ মেরে পাণ্ডবদের সমস্ত দর্প চূর্ণ করে দেব এক নিমেষে—আগচ্ছন্তু বিনেষ্যামো দর্পমেষাং শিতৈঃ শরৈঃ। দুর্যোধন এবার ভীষ্মের উল্লেখ করে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন—আপনি এই ভীষ্মের দিকেই তাকিয়ে দেখুন না। সেকালে পিতা শান্তনু মারা যাবার পর তিনি একা সমস্ত রাজাকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিলেন— পুরৈকেন হি ভীষ্মেণ বিজিতাঃ সর্বপার্থিবাঃ। সমস্ত রাজমণ্ডল তখন দেবব্রত ভীষ্মের ভয়ে তাঁকেই মেনে চলতেন সবসময়। সেই ভীষ্ম যখন শত্ৰুজয় করার জন্য যুদ্ধে আমাদের সঙ্গেই থাকবেন, তখন আপনার আর ভাবনা কী, মহারাজ—স ভীষ্মঃ সুসমর্থো’য়মম্মাভিঃ সহিতো রণে।

কী দুর্ভাগ্য ভীষ্মের। যাঁদের সঙ্গে তিনি যুদ্ধ না করার উপদেশ দিচ্ছেন, তাঁদেরই সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য অন্যতম এক হাতিয়ার খাড়া করা হচ্ছে তাঁকেই। তবু এই মুহূর্তে তাঁর প্রতিবাদ করার উপায় নেই। কারণ যে হস্তিনাপুরে পুরু ভরত কুরু থেকে আরম্ভ করে তাঁর পিতা শান্তনু পর্যন্ত রাজত্ব করেছেন, যে হস্তিনাপুরের বৃত্তি এবং অন্নপান লাভ করে তিনি জীবনধারণ করছেন, সেই হস্তিনাপুরের রাজা যদি এক প্রবল প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তবে তাঁকে যুদ্ধ করতে হবে রাজকর্মচারীর মতো। তাঁর অনিচ্ছা থাকলেও তাঁকে যুদ্ধ করতে হবে। তা ছাড়া এই যুদ্ধের পার্শ্ব-কারণ থাকবে আরও। একটু আগেই সঞ্জয় এসে পাণ্ডবদের মিত্রশক্তি মেরুকরণ শুনিয়েছেন। সেখানে কাশীর রাজা আছেন, পাঞ্চালরা আছেন এবং আছেন শাল্ব দেশের আধুনিক রাজারা—শাল্বেয়াঃ শূরসেনাশ্চ পাঞ্চালাশ্চ সকেকয়াঃ। এঁদের ব্যক্তিগত বিপক্ষতা এখন রাজনৈতিক শত্রুতার রূপ নিয়েছে। এঁরা যে পক্ষে থাকবেন, ভীষ্ম তাঁদের সপক্ষে থাকবেন না। দুর্যোধন এখন সেই সুযোগ নিচ্ছেন এবং তা নিচ্ছেন এতটাই যে, তার জন্য তিনি পাণ্ডবদের বিপক্ষে দাঁড় করাবেন ভীষ্মকে। কী করবেন ভীষ্ম! তিনি এমনটি তাঁর দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি যে, রাজনৈতিক কারণে তাঁকে শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রিয় নাতিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। দুর্যোধন রীতিমতো নির্ভর করছেন ভীষ্মের ওপর এবং ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বলেও দিলেন—পিতা শান্তনুর বরে ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু। তাঁকে মারবার মতো মানুষ এখনও জন্মায়নি—ন হন্তা বিদ্যতে চাপি রাজন্‌ ভীষ্মস্য কশ্চন। কাজেই আপনি নির্ভয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন, পিতা!

দুর্যোধন অনেক বোঝালেও স্বপক্ষের জয়-পরাজয় নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের দ্বিধা ছিল যথেষ্ট। বার বার তিনি সঞ্জয়ের কাছ থেকে বিপক্ষ শক্তির ক্ষমতা-অক্ষমতার হিসেব জেনে নিচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি হতাশও হচ্ছিলেন এবং যথারীতি দুর্যোধনকে তাঁর স্বার্থান্বেষিতার জন্য দোষ দিচ্ছিলেন। আবার পরক্ষণেই দুর্যোধন তাঁকে কুরুপ্রধানদের শক্তি-স্থিতির বিষয়ে নিশ্চিন্ত করলে ধৃতরাষ্ট্র মৌন সম্মতিতে কৌরবপক্ষের ভবিষ্যৎ জয় সম্ভাবিত করেছেন মনে মনে।

এদিকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠল। দ্রুপদের পুরোহিত যে প্রস্তাব নিয়ে কুরুসভায় এসেছিলেন অথবা মহামতি সঞ্জয় যে ভাবনা নিয়ে এসেছিলেন তা ব্যর্থ হয়ে গেল প্রধানত দুর্যোধনের সাহংকার আত্মতুষ্টিতে। এমনকী শান্তির যে বার্তা নিয়ে কৃষ্ণ এসেছিলেন হস্তিনাপুরে তাও প্রায় ব্যর্থ হতে চলল দুর্যোধনের প্রত্যক্ষ প্রত্যাখ্যানে। ধৃতরাষ্ট্র বেশ বিচলিতই হয়ে পড়েছিলেন। বিশেষত কৃষ্ণের কোমল-কবোষ্ণ এবং শেষপর্যন্ত অবশ্যই উষ্ণ বাক্যপরম্পরায় কৌরসভা যখন বেশ উত্তাল হয়ে উঠল, তখন ধৃতরাষ্ট্রও পুত্রকে শাসন করার চেষ্টা করেছিলেন যথেষ্ট। দুর্যোধন তাঁর প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কৃষ্ণকে আবারও বক্তৃতা দিতে হল। তবে তারমধ্যে এবার শান্তি-ঘোষণার সঙ্গে পাণ্ডব পক্ষের শক্তি-গরিমাও প্রকটভাবে প্রকাশিত হল। শেষ চেষ্টা হিসেবে ভীষ্ম আবারও কথা বলতে বাধ্য হলেন।

অবশ্য ভীষ্মের এই কথার মধ্যে নতুনত্ব কিছু ছিল না। হয়তো পিতৃবংশের দুই ঘনিষ্ঠ ধারার মধ্যে এই বিরোধ তাঁকে ক্লান্ত করে তুলেছিল। অতএব কোনও সালংকার নীতিঘন ভাষণ নয়, ভীষ্ম খুব সহজভাবে দুর্যোধনকে কৃষ্ণের বক্তব্য মেনে নিতে বলেছেন। ভারতবর্ষের তদানীন্তন রাজনীতিতে কৃষ্ণ যে এক ভয়ংকর রকমের ‘ফ্যাক্টর’ সেটা ভীষ্ম অনেক আগেই বুঝেছিলেন। সেই কৃষ্ণ আজকে নিজে যখন দুর্যোধনকে পাণ্ডবদের প্রাপ্য ফিরিয়ে দিতে বলছেন, সেটা যে যুদ্ধপূর্ব রাজনীতির শেষ অধ্যায়, এটা বুঝেই ভীষ্ম দুর্যোধনকে কৃষ্ণের কথা সর্বাংশে মেনে নিতে বলেছেন। শুধু তাই নয়, এক সময় তিনি বেশ ক্রুদ্ধ হয়েই ঘোষণা করেছেন যে,—দেখো বাপু! কৃষ্ণের কথা না শুনে তুমি তোমার পিতার জীবিত অবস্থাতেই এই দীপ্তিমতী রাজলক্ষ্মীর করুণা থেকে বঞ্চিত হবে। তোমার অমাত্য-বন্ধু এবং পরিজনেরা তাঁদের জীবনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন তোমারই কারণে। আমি বার বার তোমায় বলেছি, দুর্যোধন! তুমি কৃষ্ণের কথা অতিক্রম করে নিজের বাবা-মাকে শোকসাগরে ডুবিয়ে দিয়ো না—মাতরং পিতরঞ্চৈব মা মজ্জীঃ শোকসাগরে।

দুর্যোধন রাগে ফুঁসছিলেন—অমর্ষবশমাপন্নম্‌। যে ভীষণ রেগে আছে, তাকে শান্তির কথা শোনালে তার আরও রাগ হয়। অথচ পরিস্থিতি এমন যে, দুর্যোধনকে না থামালেই নয়। কাজেই ভীষ্মের কথা সমর্থন করে অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য আরও স্পষ্ট ভাষায় দুর্যোধনকে বোঝালেন যে—বাছা! যাদের কথায় তুমি আজকে যুদ্ধের জন্য নাচছ, তাদের দ্বারা কাজের কাজ কিচ্ছু হবে না—নৈতে কৃত্যায় কৰ্হিচিৎ। কৃষ্ণ এবং ভীষ্ম তোমাকে যে অনুরোধ করছেন, তা যদি না শোন, তবে ভবিষ্যতে আপশোস করে মরতে হবে তোমাকে—যদি নাদাস্যসে তাত পশ্চাত্তপ্স্যসি ভারত।

এই উত্তাল কৌরবসভায় সর্বশেষ ভাষণ দিলেন বিদুর এবং শেষপর্যন্ত ধৃতরাষ্ট্রও খুব আন্তরিকভাবেই দুর্যোধনকে শান্তির প্রস্তাব মেনে নিতে বললেন। ভীষ্ম দেখলেন, এই সুযোগ, ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে তিনিও দুর্যোধনকে আবার বোঝাতে বসলেন। ভীষ্ম বললেন—যতক্ষণ কৃষ্ণ এবং অর্জুনকে একসঙ্গে একরথে দেখা যাচ্ছে না, যতক্ষণ অর্জুনের গাণ্ডীব যুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে না, ততক্ষণ পর্যন্তই তোমার এই শত্রুতা বন্ধ করো, দুর্যোধন! যতক্ষণে না যুধিষ্ঠির তোমার সৈন্যবাহিনীর দিকে ক্রুদ্ধ চক্ষুতে তাকাচ্ছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার শত্রুতা বন্ধ থাকুক, দুর্যোধন— তাবচ্ছাম্যতু বৈশসম্। যতক্ষণ না ভীম তাঁর বীরঘাতিনী গদা দিয়ে তোমার মদমত্ত হস্তিগুলির মাথায় বাড়ি মারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার শত্রুতা বন্ধ থাকুক, দুর্যোধন—তাবচ্ছামতু বৈশসম্‌। একই কথা ধ্রুবপদে বেঁধে নিয়ে ভীষ্ম অনেকবার অনেকভাবে দুর্যোধনকে ভয় দেখালেন। তারপর একমুহূর্তে পদ-পদার্থ পরিবর্তন করে মনের ভাব সরসতায় সিক্ত করে ভীষ্ম বললেন—তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর অভিবাদনরত যুধিষ্ঠিরকে তুমি হাতে ধরে নিয়ে এসো এই রাজপ্রাসাদে—পাণিভ্যাং প্রতিগৃহ্নাতু ধর্মরাজো যুধিষ্ঠিরঃ। এতকাল যত বিবাদ-বিরোধ ঘটেছে, সব শান্ত হোক, তুমি যুধিষ্ঠিরের কাঁধে বন্ধুত্বের হাতখানি রাখো। এতদিনের কষ্টশ্রান্ত শরীর নিয়ে যুধিষ্ঠির বসে থাকুন, তুমি তোমার নিজের হাতে তাঁর পৃষ্ঠদেশ মুছে দিয়ে সব ক্লান্তি দূর করে দাও যুধিষ্ঠিরের—উপবিষ্টস্য পৃষ্ঠং তে পাণিনা পরিমার্জতু। মহাবীর ভীমকে আলিঙ্গন দিয়ে বুকে টেনে নাও একবার। অর্জুন এবং নকুল-সহদেবের মস্তক আঘ্রাণ করে সস্নেহে একবার তাঁদের সঙ্গে কথা বল—মূর্ধ্নি তান্ সমুপাঘ্রায় প্রেম্নাভিবদ পার্থিব। রাজধানীর সমস্ত রাজন্যবর্গের সামনে এই ঘোষণা করে দাও যে, সবাই একসঙ্গে ভাই ভাই মিলেই সমস্ত ভোগ লাভ করো এবং শান্তিতে থাকো—পৃথিবী ভ্রাতৃভাবেন ভুজ্যতাং বিজ্বরো ভব।

ভীষ্মের এই মর্মস্পর্শী বক্তৃতার কোনও ফল হল না। কৃষ্ণের শান্তিপ্রস্তাব সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করে দুর্যোধন বললেন—ভুল করেই হোক অথবা ভয়েই হোক, আমার বালক বয়সে পাণ্ডবদের যে রাজ্যাংশ দেওয়া হয়েছিল, এখন আজ আর তা ফেরত দেব না, অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তা ফেরত দেব না—ন স লভ্যঃ পুনর্জাতু ময়ি জীবতি কেশব। দুর্যোধনের মুখে এই চরম কথা শুনে কৃষ্ণ অবশ্যই তাঁর শেষ সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। অর্থাৎ যুদ্ধ হবে যখন, যুদ্ধ হোক। তবুও যুদ্ধ হলে যে কিছুতেই শান্তি হবে না দুর্যোধনের, সেটাও কৃষ্ণ বার বার বলে চললেন। দুর্যোধনের ভাই দুঃশাসন এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন, কিন্তু তাঁর দাদা খুব অপমানিত হয়েছেন ভেবে একটু ব্যঙ্গ করে বললেন—আজকে যদি তুমি সন্ধি না কর দাদা, তা হলে এই ভীষ্ম দ্রোণ আর তোমার শান্তিকামী বাবামশাই আমাদের সবাইকে বেঁধে পাণ্ডবদের হাতে তুলে দেবেন—পাণ্ডবেভ্যঃ প্রদাস্যন্তি ভীষ্মো দ্রোণঃ পিতা চ তে।

ভাইয়ের কথা শুনে রাগে ফুঁসতে লাগলেন দুর্যোধন। তিনি আর সভায় বসে থাকতে পারলেন না। সভা ত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেলেন। তাঁর পিছন পিছন গেলেন তাঁর ভাইয়েরা এবং কর্ণ। সভায় উপস্থিত কুরুপ্রধানদের উপেক্ষা করে এইভাবে বেরিয়ে যাওয়ার এমন উদাহরণ বুঝি কৌরবদের ইতিহাসে আর একটাও নেই। সভায় উপস্থিত মান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে মতান্তর হতেই পারে, কিন্তু শুধুমাত্র নিজের অহংকার প্রকট করে কাউকে কিছু সম্ভাষণ না করে এইভাবে চলে যাওয়ার মতো এমন অশিষ্টতা কৌরববংশে কেউ বোধহয় করেননি। অন্তত পিতা শান্তনুর সময় থেকে যতই রাজনৈতিক সংকট এসে থাকুক, এতটা বয়সেও ভীষ্ম কখনও এমন অশিষ্টতা দেখেননি। অন্যখানে অন্য পরিস্থিতিতে যেমনটিই ঘটুক, সভার একটা মর্যাদা আছে। কুরুবৃদ্ধ এবং অন্য প্রধান পুরুষদের সামনে কুরুসভাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে দুর্যোধন যখন চলে গেলেন—অশিষ্টবদ্‌ অমর্যাদো মানী মান্যাবমানিতা—ভীষ্ম তখন কিছুতেই আর সহ্য করতে পারলেন না। এতকাল তিনি রাজনীতি করেছেন, পিতা শান্তনুর সময় থেকে পাণ্ডুর সিংহাসনে বসা পর্যন্ত কুরুরাজ্য চলত প্রায় তারই নির্দেশমতো। অথচ আজ এটা কেমন হল! রাজনীতির মধ্যে এমন অশিষ্ট আচরণ তো তিনি কখনও দেখেননি।

দুর্যোধনকে ওইভাবে চলে যেতে দেখে ভীষ্ম বলে উঠলেন—ন্যায়নীতি, ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির কথা একটুও চিন্তা না করে যারা এইভাবে যুদ্ধ যুদ্ধ করে নাচে, বিপদে পড়লে নিন্দুকরা তাদের দেখে হাসবে—হসন্তি ব্যসনে তস্য দুর্হৃদো ন চিরাদিব। রাজনীতিতে ‘উপায়’ মেনে চলতে হয়। কিন্তু রাজপুত্র হয়েও ধৃতরাষ্ট্রের এই অসভ্য ছেলেটা রাজনীতির পাঠ কিছুই জানে না—দুরাত্মা রাজপুত্রো’য়ং ধার্তরাষ্ট্ৰো ’নুপায়কৃৎ।

ভবিষ্যতে শরশয্যায় শুয়ে ভীষ্ম রাজনীতির পাঠ শেখাবেন যুধিষ্ঠিরকে। সেখানে সাম, দান, ভেদ, দণ্ড ইত্যাদি চার উপায়ের কথা বলা হবে। ভীষ্ম জানেন—মধুর কথা বলে সাম-নীতিতে যেসব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয়, সেই নীতিতে অন্তত পাণ্ডবদের সমস্যা আর মিটবে না, কারণ এতকাল অনেক মধুর ব্যবহার করেও তার কোনও ফল পাননি পাণ্ডবরা। সমস্যা সমাধানের জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে দিয়ে খাণ্ডবপ্রস্থে পাণ্ডবদের যতটুকু ভূমি দান করা হয়েছিল, সেই দান-নীতির প্রস্তাবনা করেছিলেন ভীষ্ম নিজে। কিন্তু দুর্যোধন কপট পাশা খেলে সে নীতির ব্যর্থতা এনে দিয়েছেন। ভেদ-নীতি পাণ্ডবদের প্রয়োগ করতে হয়নি। সাধারণ ভেদ-নীতিতে মন্ত্রীর সঙ্গে রাজার, রাজার সঙ্গে প্রজার, প্রজাদের সঙ্গে অমাত্যের ভেদ সৃষ্টি করে সফল হয় শত্রুপক্ষ। কিন্তু সেই ভেদ-নীতি পাণ্ডবদের গ্রহণ করতেই হয়নি। তাঁদের সততা, সহিষ্ণুতা এবং শম-দমের গুণে আপনিই কুরুবৃদ্ধরা তাঁদের পক্ষপাতী হয়ে রয়েছেন। অতএব পাণ্ডবদের দিক থেকে এখন দণ্ড-নীতির সময় এসেছে।

পণ্ডিতজনেরা বলেছেন—যদি সাম দান ভেদ—এই তিন উপায়ে কাজ না হয়, তবে দণ্ড প্রয়োগ করবে। কিন্তু সেই চতুর্থ উপায় হল চরম। অতএব সেই চরম উপায় অবলম্বন করার আগে যে শেষ ভাবনা ভাবতে এসেছিলেন কৃষ্ণ, সেখানে অন্যভাবে ভাবা উচিত ছিল দুর্যোধনের। রাজা হবার আগে রাজপুত্রদের শিখতে হয় যে, কীভাবে চতুরুপায় প্রয়োগ করতে হবে কার্যকালে। পাণ্ডবরা তা সঠিকভাবেই প্রয়োগ করছেন। কিন্তু দুর্যোধন উপায়জ্ঞ নন বলেই সেটা ধরতে পারছেন না। কৃষ্ণ এবং অন্যান্য কুরুবৃদ্ধদের কথায় রাগ করে দুর্যোধন যেভাবে সভা ত্যাগ করলেন, তাতে কুরুবৃদ্ধরা আপনিই দুর্যোধনের প্রতি বিরাগগ্রস্ত হয়ে পড়লেন এবং এটাই সহিষ্ণু পাণ্ডবদের ভেদ-প্রয়োগের উদাহরণ। উন্মুক্ত সভার মধ্যে ভীষ্ম যখনই দুর্যোধনকে নিন্দা করলেন, তখনই বুঝতে হবে দুর্যোধন যতই বলুন—ভীষ্ম দ্রোণকে যুদ্ধে পাণ্ডবরা কেউ পরাজিত করতে পারবে না—দুর্যোধনের এই যুদ্ধ-গর্ভের মধ্যে ফাঁকি রয়ে গেল। ভীষ্ম-দ্রোণরা রাজার অনুশাসনে কৌরবপক্ষ অবলম্বন করবেন ঠিকই, কিন্তু আন্তরিকভাবে আত্যন্তিক ক্রোধ নিয়ে তাঁরা সতত বিনীত পাণ্ডবদের সঙ্গে লড়াই করতে পারবেন না।

ভীষ্মের মতে দুর্যোধন ‘উপায়জ্ঞ’ নন বলেই সভা ত্যাগ করেছেন। কিন্তু ভীষ্মের এই প্রকট ক্রোধকে আপন ভেদনীতির মাধ্যম করে তুললেন ‘উপায়জ্ঞ’ কৃষ্ণ। তিনি সঙ্গে সঙ্গে ভীষ্মকে বললেন—সমস্ত কুরুবৃদ্ধদের যেভাবে অপমান করল দুর্যোধন, তা অকল্পনীয়—সর্বেষাং কুরুবৃদ্ধানাং মহান্‌ অয়ম্‌ অতিক্রমঃ। ভীষ্ম দ্রোণদের ক্রোধ দেখে প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীকে ডেকে এনেছেন রাজসভায়, যাতে জননী হিসেবে তিনি অন্তত পুত্রকে শান্ত করতে পারেন। আশ্চর্য ব্যাপার, স্বয়ং গান্ধারী পর্যন্ত এখানে সেই উপায়-প্রয়োগের উৎকর্ষের কথা বলেছেন। বলেছেন—যেখানে সাম দান আর ভেদনীতিতে কাজ হয়ে যায় সেখানে দুর্যোধন যে যুদ্ধরূপ দণ্ডের কথা ভাবছে, সেটা একেবারেই ঠিক নয়—দণ্ডং কস্তত্র পাতয়েৎ।

গান্ধারী পুত্রকে পূর্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন—পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার প্রত্যক্ষ বিবাদ যাতে না বাধে সেইজন্যই ভীষ্ম এবং তোমার পিতা পাণ্ডবদের খানিকটা রাজ্য ছেড়ে দিয়েছিলেন—ভীষ্মেণ হি মহাপ্রাজ্ঞ… ভেদাদ্‌ ভীতৈররিন্দম। কিন্তু আজকে সেই রাজ্যদানের সুফল তুমি হেলায় নষ্ট করেছ। গান্ধারী এবার ভীষ্ম দ্রোণের মনের কথাটাও পরিষ্কার করে দিয়ে বললেন—তুমি যে ভাবছ বাছা, ভীষ্ম অথবা দ্রোণ তোমার হয়ে খুব যুদ্ধ করবেন—যচ্চ ত্বং মনসে মূঢ় ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপাদয়ঃ—আমার কিন্তু তা মনে হয় না। পাণ্ডব এবং তোমাদের প্রতি তাঁদের সমান ভাব, সমান সম্বন্ধ। কিন্তু ন্যায় নীতি আর ধর্মের প্রশ্নটাই এখানে বড় হয়ে দাঁড়াবে। ফলে রাজার আশ্রিত বলে তোমাদের জন্য তাঁরা জীবন দিয়ে দেবেন ঠিকই, কিন্তু তবু তাঁরা নীতি ধর্ম জলাঞ্জলি দিয়ে যুধিষ্ঠিরের মুখের দিকে তাকাতে পারবেন না। অতএব ভীষ্ম দ্রোণরা কোনওভাবেই সর্বশক্তি দিয়ে পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবেন না—যোৎস্যন্তে সর্বশক্ত্যেতি নৈতদদ্যোপপদ্যতে।

হস্তিনাপুরের সিংহাসনে শুধুমাত্র পিতৃবংশের ধারা রক্ষা করা এবং তাঁদের বিবাদবিসংবাদ বন্ধ করার জন্য ভীষ্ম যে ব্যক্তিগতভাবে কতটা উদ্‌বিগ্ন ছিলেন, তা শুধু এই গান্ধারীর আবেদন শুনে বোঝা যাবে না। মহাভারতের কবিও ভীষ্মের এই আন্তরিকতা বোঝানোর জন্য একটি ভিন্ন কাব্যরীতি গ্রহণ করেছেন। কুরুসভায় কৃষ্ণের দৌত্যকালে ভীষ্ম যে বক্তব্য পেশ করেছিলেন, তার বেশ খানিকটা সেখানে অনুক্ত রেখেছেন মহাভারতের কবি। কিন্তু এরপর কৃষ্ণ যখন বিরাটনগরে পাণ্ডবদের কাছে প্রত্যাবর্তন করে শান্তিসভার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, তখন কিন্তু ভীষ্মের বক্তব্যে আরও কিছু নতুন কথা যুক্ত হয়েছে এবং সেই কথার মধ্যেই পাণ্ডব কৌরবের বিসংবাদ মেটানোর জন্য তাঁর আন্তরিকতাটুকু বোঝা যাবে।

কৃষ্ণ কুরুসভার ক্রিয়াকর্ম নিবেদন করে পাণ্ডবদের বলেছিলেন—আমি যখন কুরুসভায় শান্তির প্রস্তাব করেছিলাম, তখন দুর্যোধন হাঃ হাঃ করে হেসে উঠেছিল—-জহাস ধৃতরাষ্ট্রজঃ। মহামতি ভীষ্ম কিন্তু এই হাসি সহ্য করতে পারেননি। তিনি বলেছিলেন—দুর্যোধন! শুধু এই বংশের হিতের জন্য তোমাকে দুটো কথা বলি শোনো—কুলার্থে যদ্‌ ব্রবীমি তে। আমার কথা শুনে তারপর তোমার যেটা ভাল মনে হয় কোরো। ভীষ্ম বলেছিলেন—দেখো বাছা! আমার বাবা ছিলেন মহারাজ শান্তনু। দুনিয়ার সমস্ত লোক তাঁকে মান্য করত। আমি তাঁর একমাত্র ছেলে ছিলাম—তস্যাহমেক এবাসং পুত্রঃ পুত্রবতাম্বরঃ—আমাকে নিয়ে তাঁর গর্বও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু যাই হোক, যে কোনও কারণেই হোক, তাঁর মনে হয়েছিল যে, আরও একটি পুত্র তাঁর প্রয়োজন। পণ্ডিতজনেরা বলেন—এক পুত্র থাকাও যা, পুত্র না থাকাও তাই। আমি আমার পিতার এই ভাবনাটুকু তাঁরই অনুকূলে বুঝেছিলাম। তিনি চেয়েছিলেন যাতে এই সুপ্রসিদ্ধ ভরতবংশ লুপ্ত না হয়ে যায় এবং যাতে এই বংশের যশ ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে—ন চোচ্ছেদং কুলং যায়াদ্‌ বিস্তীর্য্যেচ্চ কথং যশঃ। আমি তাঁর সদিচ্ছা বুঝেছিলাম বলেই জননী সত্যবতীকে নিজে রথে করে নিয়ে এসেছিলাম হস্তিনাপুরে। মনে রেখো—আমার পিতা সেদিন দ্বিতীয় সন্তান কামনা করেছিলেন বলে আমি সেই কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, আমি কোনওদিন রাজা হব না এবং চিরকাল আমি ব্রহ্মচারী থাকব—অরাজা চোর্ধ্বরেতাশ্চ যথা সুবিদিতং তব। তোমরা জানো—আমি সেই প্রতিজ্ঞা এখনও পালন করে চলেছি—প্রতিজ্ঞাম্‌ অনুপালয়ন্‌।

ভীষ্ম বলতে চাইলেন—এই বৃদ্ধ বয়সে নিশ্চয়ই আর তাঁর বিবাহের বাসনা নেই, কিন্তু যা তিনি পারতেন, সেই রাজা হওয়ার ইচ্ছাও তো কখনও তিনি করেননি। কেন করেননি? সেই পিতা শান্তনুর বংশের প্রতি মমতায়। বিবাদ বাধানোর সুযোগ কিছু কম ছিল না। প্রজাসাধারণ এবং হস্তিনার অমাত্যবর্গ এতটাই তাঁর বশবর্তী ছিলেন যে, তাঁর কনিষ্ঠ ভাই বিচিত্রবীর্য রাজা হবার পরেও যদি তিনি ভাইয়ের সঙ্গে রাজ্য নিয়ে বিসংবাদ বাধাতেন, তা হলে তাঁরা সকলে ভীষ্মের পক্ষেই থাকতেন। এই মুহূর্তে এক গোপন খবর দিয়েছেন ভীষ্ম। বলেছেন—আমি যখন পরশুরামের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন পরশুরাম যদি কিছু করেন সেই ভয়ে হস্তিনার নাগরিক প্রজারা বিচিত্রবীর্যকে দূরে এক জায়গায় রেখে এসেছিলেন—স হি রামভয়াদেভি-র্নাগরৈ-র্বিপ্রবাসিতঃ।

ভীষ্ম দুঃখ করে বলেছেন—ওই দূরে থাকাটাই বিচিত্রবীর্যের কাল হল। সে অতিরিক্ত স্ত্রী ব্যসনী হবার ফলে যক্ষ্মা ধরিয়ে ফেলল এবং শেষপর্যন্ত মারা গেল। সেই সময় অরাজক হস্তিনাতে রাজা হবার জন্য প্রজারা আমার কাছে কান্নাকাটি করেছে। তারা বলেছে—বাঁচান আপনার প্রজাদের—তাঃ পরিত্রাতুম্‌ অর্হসি। আপনি বেঁচে থাকতে এই রাষ্ট্র যেন নষ্ট না হয়। সকলের মঙ্গলের জন্যই আপনি আমাদের রাজা হোন—রাজা ভব ভবায় নঃ। সেই কালেও আমি যে সমস্ত প্রজাদের ক্রন্দন, আবেদন, নিবেদন এবং সমর্থন উপেক্ষা করেছি—নৈবাক্ষুভ্যত মে মনঃ—তা শুধু আমার পূর্বপ্রতিজ্ঞা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য। আমার মাতা সত্যবতী, অমাত্য পুরোহিত এঁরাও সকলে একযোগে হস্তিনার প্রজাদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমাকে অনুরোধ করেছিলেন রাজা হবার জন্য। আমি তাঁদের সবার সামনে হাত জোড় করে আমার পিতার সম্মানের কথা নিবেদন করেছিলাম। বলেছিলাম—আমার পিতার বংশধারার মধ্যে যাতে কোনও বিবাদ-বিসংবাদ না হয় তার জন্যই আমি রাজা হইনি এবং তার জন্যই আমি এখনও অবিবাহিত রয়েছি।

পুরাতন কথা পুনরাবৃত্তি করে ভীষ্ম বার বার বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি শুধু জ্ঞাতিবিরোধের ভয়েই তাঁর প্রতিজ্ঞা পালন করে চলেছেন। তিনি নিজে রাজা না হয়ে বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর গর্ভে কুরুবংশের ধারা রক্ষা করেছেন ব্যাসের আনুকূল্যে। ভীষ্ম দুর্যোধনকে বলেছেন—সেই বংশ রক্ষা হল। ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু জন্মালেন। অন্ধ বলে ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারেননি, রাজা হলেন পাণ্ডু। তোমরা সকলে তাঁদের ছেলেপিলে, তাঁদেরই উত্তরাধিকার বহন করছ তোমরা। কিন্তু যে বংশের সুরক্ষার জন্য আমি এতখানি করতে পেরেছি, সেই বংশের উত্তরাধিকারী হয়ে তোমরা এইভাবে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করে ম’রো না। তোমরা পাণ্ডবদের প্রাপ্য অর্ধ রাজ্য দিয়ে দাও—মা তাত কলহং কার্ষী রাজ্যস্যার্ধং প্রদীয়তাম্‌। ভীষ্ম একটা কথা বেশ জোর দিয়ে বললেন। বললেন—আমিই এই বংশের সবচেয়ে যোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলাম এবং আমি বেঁচে থাকতে অন্য কোনও পুরুষ এই হস্তিনার শাসন চালাতে পারত না—ময়ি জীবতি রাজ্যং কঃ সম্প্রশাসেৎ পুমানিহ। কিন্তু জ্ঞাতিবিরোধ থেকে সকলকে বাঁচানোর জন্য আমি যে চেষ্টা করেছিলাম, সেটা বৃথা হতে দিয়ো না, দুর্যোধন! আমার কথা অমান্য কোরো না, আমি সবার ভাল চাই, আমি শান্তি চাই—মাবমংস্থা বচো মহ্যং শমমিচ্ছামি বঃ সদা।

বিরাটরাজ্যে পাণ্ডবদের সভায় বসে যুদ্ধ থামানোর জন্য মহামতি ভীষ্মের আন্তরিকতা ব্যাখ্যা করেছিলেন কৃষ্ণ। কিন্তু আমরা জানি—এই আন্তরিকতায় দুর্যোধনের কিছু হয়নি। তিনি যুদ্ধ করবেন বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, অতএব তাঁর ইচ্ছাতেই যুদ্ধের উদ্যোগ শুরু হল। যুদ্ধ যখন আরম্ভ হবেই, তখন এই ভীষ্মকে আমরা এক অন্য মূর্তিতে দেখি। দূর্যোধনকে তিনি বলেছিলেন—আমি তোমাদের এবং পাণ্ডবদের কখনও কোনও পৃথক পক্ষপাতে বিচার করি না—ন বিশেষো’স্তি মে পুত্র ত্বয়ি তেষু চ পার্থিব। ভীষ্মের এই কথাটা যে কত সত্যি, তা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধপূর্ব সময়ে অদ্ভুতভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। একটু আগেই ভীষ্মের মুখে যেসব বক্তব্য শুনেছি, তাতে এমন হতেই পারত যে—দুর্যোধন যেহেতু ভীষ্মের কোনও কথাই শোনেননি, অতএব তিনিও তাঁকে কোনওভাবে এই যুদ্ধে সাহায্য করবেন না। কিন্তু না, ভীষ্ম এই মানসিকতার মানুষ নন। যে মুহূর্তে তিনি পিতার কাছে প্রতিজ্ঞা করে রাজত্ব ছেড়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি কুরুবংশের সবচেয়ে বিশ্বস্ত রাজকর্মচারীতে পরিণত। তিনি পরামর্শ দিয়েছেন, অনুরোধ করেছেন, ভর্ৎসনা করেছেন, কিন্তু কোনও দিন হস্তিনার সিংহাসনে বসা রাজার অবমাননা করেননি। বিশেষত যুদ্ধ যখন লাগবে বলেই স্থির হল, তখন পৌত্র দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর স্নেহ-ব্যবহার লক্ষ করার মতো।

দুর্যোধন তাঁর সমস্ত অনুগামী রাজা মহারাজাদের নিয়ে যুদ্ধের ঠিক আগে ভীষ্মের কাছে এসে হাত জোড় করে বললেন—যুদ্ধে যদি ঠিকঠাক সেনাপতি না থাকে, তবে পিঁপড়ের সারির মতো সমস্ত সৈন্যবাহিনী ধ্বংস হয়ে যায়! দুই পক্ষে দু’জন সেনাপতি থাকলেও তাঁদের দু’জনের বুদ্ধিও সমান হয় না, বিক্রমও সমান হয় না—ন হি জাতু দ্বয়োর্বুদ্ধিঃ সমা ভবতি ভারত। আমি মনে করি—পর্বতের মধ্যে যেমন সুমেরু, পক্ষীদের মধ্যে যেমন গরুড়, দেবতাদের মধ্যে যেমন কার্তিক, আমাদের মধ্যে আপনিও তেমনই। অসুরগুরু শুক্রাচার্যের কূটনৈতিক বুদ্ধি যেমন প্রখর, আপনার বুদ্ধিও তেমনই। সবচেয়ে বড় কথা, আপনি সবসময় আমার ভাল চান—ভবানুশনসা তুল্যো হিতৈষী চ সদা মম। যে কেউ কোনওভাবে আপনাকে যুদ্ধেও হারাতে পারবে না। সবদিক থেকে বিচার করে বলি—আপনিই আমাদের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি হবেন—স নঃ সেনাপতি’র্ভব।

ভীষ্ম বলতে পারতেন—অনেক হিতের কথা বলেছি তোমায়, আর তোমার হিত ভাবার দরকার নেই আমার। কিন্তু না, ভীষ্ম জানেন—এখন যুদ্ধ লাগবে। দুর্যোধনের একগুঁয়েমিতেই যুদ্ধ লাগবে। কিন্তু এইসময়ে হস্তিনার সিংহাসনে আসীন এই যুবককে তাঁর প্রাপ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তিনি কুরুবংশের প্রবীণতম বিশ্বস্ততম কর্মচারী। কুরুবংশের এক অধস্তন রাজা বিপন্ন হয়ে তাঁকে সেনাপতি নির্বাচিত করতে চাইছে। সে বলেছে—কার্তিক যেমন দেবতাদের সেনাপতি হয়ে আগে আগে যান, তেমনই আপনি চলবেন সবার আগে, আর আমরা সমস্ত কৌরববাহিনী নিয়ে আপনার পিছন পিছন যাব, ঠিক যেমন ষাঁড় চলতে থাকলে বাছুরগুলো তার পিছন পিছন চলে, তেমনই আমরা আপনার নাতিরা চলব আপনার পিছন পিছন—বয়ং ত্বামনুযাস্যামঃ সৌরভেয়া ইবৰ্ষভম্।

কোনও দিন কোনওভাবে দুর্যোধন বোধহয় এইভাবে ভীষ্মকে অনুমোদন করতে চাননি। অথচ আজকে যুদ্ধোদ্যোগের মুহূর্তে দুর্যোধনের এই অনুগমন-স্পৃহা দেখে অবাকও হন না ভীষ্ম। তিনি জানেন—তাঁকে যুদ্ধ করতে হবে এবং পাণ্ডবদের বিরুদ্ধেই করতে হবে। তা ছাড়া দুর্যোধন যে এইভাবে আত্মসমর্পণ করছেন, তাতে এই বৃদ্ধ ঠাকুরদাদাটির একটু কৌতুকবোধ অবশ্যই হয়। রাজবংশের প্রতি মর্যাদা এবং কৌতুক, এই দুয়ে মিলে ভীষ্মের প্রতিক্রিয়া যেভাবে হল, তাতে আপাতত দুর্যোধনের খুশি হবার কারণ ঘটল।

দুর্যোধনকে প্রত্যাখ্যান করলেন না ভীষ্ম। বললেন—যেমনটি তুমি চাও, দুর্যোধন! তবে আগেই বলেছি—স্নেহ-সম্পর্কে আমার কাছে তোমাদের যেমন মর্যাদা, পাণ্ডবদেরও তেমনই—যথৈব হি ভবন্তো মে তথৈব মম পাণ্ডবাঃ। আমি আগে এও বলেছি যে, যদি যুদ্ধ লাগে তবে যে কোনও যুদ্ধেই আমি তোমার হয়েই যুদ্ধ করব—সংযোদ্ধব্যং তবার্থায় যথা মে সময়ঃ কৃতঃ। দেখো, এ কথা সর্বাংশে সত্যি যে, আমি যদি যুদ্ধ করি, তবে আমার সমান যোদ্ধা এই তিন ভুবনে নেই। তবে এর একমাত্র ব্যতিক্রম মহাবীর অর্জুন। শুধু অস্ত্রচালনার নৈপুণ্যই নয়, তপস্যার দ্বারা সে লাভ করেছে অলৌকিক দিব্য অস্ত্র। সত্যি কথা বলতে কী, আমি এবং অর্জুন এক মুহূর্তেই এই পৃথিবীকে মনুষ্যহীন করে দিতে পারি। দেবতা, অসুর, রাক্ষস—কেউ এঁটে উঠতে পারবে না আমাদের সঙ্গে। অতএব আমার সঙ্গে অর্জুন ছাড়া আর কেউই সমান ক্ষমতায় যুদ্ধ করতে পারবে না—ঋতে তস্মান্নরব্যাঘ্ৰাৎ কুন্তীপুত্ৰাদ্‌ ধনঞ্জয়াৎ।

অর্জুনের যুদ্ধনৈপুণ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে পিতামহ ভীষ্ম তাঁর সীমাবদ্ধতার কথাটি জানাচ্ছেন অর্জুনেরই দৃষ্টান্ত দিয়ে। ভীষ্ম বললেন—আমার সঙ্গে অর্জুন কখনও সোজাসুজি যুদ্ধ করবে না। তার লজ্জা আছে, ঠাকুরদাদা বলেই সে লজ্জিত এবং সংকুচিত বোধ করবে—ন তু মাং বিবৃতো যুদ্ধে জাতু যুধ্যেত পাণ্ডবঃ। আর ঠিক এই লজ্জা সংকোচ এবং স্নেহ থাকার জন্য ভীষ্ম নিজেও তাঁর নাতিদের গায়ে হাত দিতে পারবেন না। অর্জুনের ঠাকুরদাদা তো একটিই, কিন্তু পাণ্ডুর ঘরে ভীষ্মের নাতি যে পাঁচজন। অতএব ভীষ্মের বক্তব্য—আমি কোনওভাবেই পাণ্ডবদের মারতে পারব না—ন ত্বেবোৎসাদনীয়া মে পাণ্ডোঃ পুত্ৰা জনাধিপ।

বিরাট একটি যুদ্ধ শুধু তার সেনানায়কদের দিয়ে হয় না। শত শত পদাতিক, অশ্বারোহী, গজারোহী আর মহারথীরা এক যুদ্ধকে পদে পদে বিপন্ন করে তোলে। ভীষ্ম দুর্যোধনকে কথা দিলেন—আমি পাণ্ডবপক্ষের অন্যান্য যোদ্ধাদের নিধন করার ভার নিলাম। পাণ্ডবরা কেউ যদি আমাকে আগেই না মেরে ফেলে—নচেত্তে মাং হনিষ্যন্তি পূর্বমেব সমাগমে—তবে এই অঙ্গীকার আমি করছি যে, পাণ্ডবপক্ষের অন্য যোদ্ধাদের আমি ছাড়ব না।

বুড়ো ঠাকুরদাদা তাঁর ঘরের নাতিটির কাছে সোচ্ছ্বাসে যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তারমধ্যে আন্তরিকতার অভাব ছিল না বটে, তবে পাণ্ডব-কৌরবের এক পিতামহ হিসেবে তিনি যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার মধ্যেই তাঁর স্নেহটুকু ভাগাভাগি করা ছিল। পাঁচ পাণ্ডবভাইয়ের কোনও ক্ষতি তিনি করবেন না এবং তিনি শুধু পাণ্ডবদের সৈন্য শাতন করবেন—এমন একটা ঘোষণায় দুর্যোধন যদি ভেবে থাকেন যে—ঠিক আছে, আপনি সৈন্য শাতনই করুন, পাণ্ডবদের মারবে সেই, যার কোনও মায়া নেই পাণ্ডবদের ওপর। তিনি মহাবীর কর্ণ। ভীষ্ম যে এ কথা তেমন করে বোঝেননি, তা নয়, তবে কথাটা দুর্যোধন যেভাবে বুঝলেন সেইভাবে তাঁকে বুঝতে না দিয়ে তাঁর নিজের প্রতি কর্ণের চিরকালীন প্রতিকূলতা এবং প্রতিরোধগুলিকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করলেন ভীষ্ম। তিনি বললেন—দেখো বাপু! আমাকে সেনাপতি করলে একটা শর্ত তোমায় মেনে নিতে হবে—সেনাপতিস্ত্বহং রাজন্ সময়েনাপরেণ তে। আমি বলি—কৰ্ণই আগে সেনাপতি হয়ে যুদ্ধ করুন অথবা আমি যদি আগে সেনাপতি হই তবে কর্ণ যুদ্ধ করুন তার পরে—কর্ণো বা যুধ্যতাং পূর্বম্‌ অহং বা পৃথিবীপতে। চিরটা কাল এই কর্ণ আমার সঙ্গে স্পর্ধা করে এসেছে, চিরটা কাল আমার সঙ্গে শত্রুতা করেছে। কাজেই সে যখন যুদ্ধ করবে, আমি তখন যুদ্ধ করব না—স্পর্ধতে হি সদাত্যর্থং সূতপুত্র ময়া রণে।

যুদ্ধ কিংবা অস্ত্রচালনার ক্ষেত্রে কর্ণের কিছু অহংমানিতা ছিল। অতএব ভীষ্মের কথা শোনামাত্রই উষ্ণমস্তিষ্ক কর্ণ দুর্যোধনকে বললেন—এই ভীষ্ম বেঁচে থাকতে আমি একটুও যুদ্ধ করব না—নাহং জীবতি গাঙ্গেয়ে রাজন্ যোৎস্যে কথঞ্চন। ভীষ্ম মারা যাবার পর আমি এই যুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করব এবং অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব। ভীষ্ম আগে বলেছিলেন—পৃথিবীতে অর্জুন ছাড়া দ্বিতীয় কেউ নেই যে আমার সঙ্গে যুদ্ধে এঁটে উঠবে। কর্ণ ভীষ্মের কথার প্রতিবাদ করে বোঝাতে চাইলেন—যে অর্জুনকে ভীষ্ম তাঁর সমকক্ষ ভাবেন, তিনি তাঁর সঙ্গেই যুদ্ধ করার জন্য মুখিয়ে আছেন—হতে ভীষ্মে তু যোৎস্যামি সহ গাণ্ডীবধন্বনা।

এই দুইজনের বিবাদে সবচেয়ে ক্ষতি হয়ে গেল দুর্যোধনের। ভীষ্ম পাণ্ডবদের গায়ে অস্ত্র নিক্ষেপ করবেন না, কিন্তু সৈন্যধ্বংস করবেন। এখানে কর্ণ যুদ্ধ করলে পাণ্ডবদের নানা বিপদ হতে পারত। অন্যদিকে কর্ণ যখন পাণ্ডবদের সঙ্গে ভবিষ্যতে যুদ্ধ করবেন, তখন পাণ্ডবরা ছাড়াও তাঁদের অনুগত যুদ্ধবীরেরা কৌরবদের অস্থির করে তুলবেন। তাঁদের সামাল দেবার জন্য ভীষ্মের মতো এক মহাবীর তখন বাদ পড়ে যাবেন দুর্যোধনের সৈন্যনায়কদের তলিকা থেকে। অতএব ভীষ্মকে সেনাপতি নির্বাচিত করে দুর্যোধন যে সুবিধে পাবেন ভেবেছিলেন সে সুবিধে তিনি পেলেন না। অন্যদিকে ভীষ্মের সেনাপতিত্বকালে কর্ণ যুদ্ধ করবেন না স্থির করায় কৌরব-পাণ্ডবের এক পিতামহ হিসেবে ভীষ্ম অন্তত এই ভেবে শান্তি পেয়ে থাকবেন যে, তাঁর সেনাপতিত্বকালে তাঁরই বিপক্ষে যুদ্ধরত নাতিদের গুরুতর কোনও ক্ষতি হবে না।

দুর্যোধন ভীষ্মকে সেনাপতিপদে বরণ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সে খবর পৌঁছে গেল যুধিষ্ঠিরের কাছে। কীভাবে কোন ধরনের স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করলে ভীষ্মের আক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে, তাও ঠিক হয়ে গেল সম্মিলিত মন্ত্রণায়। কুরুক্ষেত্রের মহাপ্রাঙ্গণে পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধ-শিবির তৈরি হল। ইতিমধ্যে দুর্যোধন পাণ্ডবদের কাছে শকুনির ছেলে উলূককে পাঠিয়ে দিলেন শুধু গালাগালি দেবার জন্য। এর ফল ভাল হল না। পাণ্ডবদের সঙ্গে কৃষ্ণ, দ্রুপদ, শিখণ্ডী সকলেই উপস্থিত ছিলেন। পাণ্ডবেরা উত্তেজিত হয়ে বড় কঠিন কথা শোনালেন উলূককে এবং শিখণ্ডী—যাঁর নাম এতদিন প্রায় শোনাই যায়নি, এতদিন ধরে যিনি নিজেকে প্রস্তুত করেছেন ভীষ্মকে বধ করার জন্য—সেই শিখণ্ডী কিন্তু একেবারে সোজাসুজি ভীষ্মবধের কথা শুনিয়ে দিলেন উলূককে। তিনি বলেই দিলেন—শুধু ভীষ্মবধের জন্যই আমাকে নির্মাণ করেছেন বিধাতা। আমি সবার সামনে ওই ভীষ্মকে মেরে ফেলব—সো’হং ভীষ্মং হনিষ্যামি মিষতাং সর্বধন্বিনাম্‌।

আমরা জানি একা শিখণ্ডীর এমন কোনও ক্ষমতা ছিল না, যাতে তিনি ভীষ্মকে যুদ্ধভূমিতে শয়ন করাতে পারেন। কিন্তু আসল কথাটা হল শকুনির ছেলে উলূক দুর্যোধনের কথা শুনে পাণ্ডবদের এতটাই কুবাক্য বলেছেন যে, অর্জুন পর্যন্ত বেশ ভাল করে শুনিয়ে দিয়েছেন যে, পরের দিন থেকেই দুর্যোধনের প্রথম সেনাপতি ভীষ্ম আর নিরাপদ নন। তিনি দুর্যোধনকে উদ্দেশ করে বলেছেন,—আমি তোমার সামনেই কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মকে হত্যা করব—তস্মাদহং তে প্রথমং সমূহে/হন্তা সমক্ষং কুরুবৃদ্ধমেব।

অর্জুনের এই প্রতিজ্ঞাবাক্য কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের কানেও গেল। দুর্যোধন তাঁর পিতামহের সামনে একটু বিচলিত ভাব দেখিয়ে জিজ্ঞাসাও করেছিলেন নিশ্চয়—এবার কী হবে, পিতামহ! পিতামহ ভীষ্ম এতটুকু বিচলিত হননি। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তাঁর অত্যন্ত প্রিয় নাতি। নাতির মুখে আপন-বধ প্রতিজ্ঞা শুনে একটুও উত্তেজিত হলেন না ভীষ্ম। বরঞ্চ অর্জুনের প্রতি অপার প্রশ্রয়ে অর্জুনের কথাটা সম্পূর্ণই এড়িয়ে গেলেন দুর্যোধনের সামনে। অন্যদিকে দুর্যোধনও যাতে একেবারে বিচলিত না হয়ে পড়েন, সেদিকেও তাঁর যথেষ্ট নজর আছে। তিনি বললেন—দেখো বাপু! দেবসেনাপতি কার্তিককে নমস্কার করে যুদ্ধ আরম্ভ করেই আমি তোমার সেনাপতির পদ গ্রহণ করব। কোনও সন্দেহ নেই যে, সেনা-পরিচালনা, ব্যূহ-নির্মাণ অথবা সৈন্যদের দিয়ে সঠিক কাজটি করিয়ে নেবার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা যথেষ্ট। আর যুদ্ধযাত্রা, যুদ্ধ এবং প্রতিপক্ষের অস্ত্র নিবারণ করার ক্ষেত্রেও আমার জ্ঞান দেবগুরু বৃহস্পতির মতো। কাজেই আমি যে তোমার জন্য প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করব তাতে সন্দেহ নেই কোনও, তুমি ভয় পেয়ো না—সো’হং যোৎস্যামি তত্ত্বেন ব্যেতু তে মানসো জ্বরঃ।

দুর্যোধন সোচ্ছ্বাসে জানালেন—আমি ভয় পাইনি, পিতামহ! আমার সেনাপতি যেখানে আপনি, সেখানে দেবতা অসুর কাউকেই ভয় পাই না আমি—কিং পুনস্ত্বয়ি দুর্ধর্ষে সৈনাপত্যে ব্যবস্থিতে। দুর্যোধন আরও ভাবলেন—পিতামহ অভিজ্ঞ লোক। যেসব রাজা এবং যেসব সেনানায়ক তাঁর পক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছেন, তাঁদের বলাবল ভীষ্ম জানেন, আবার প্রতিপক্ষে পাণ্ডবদের সঙ্গে যাঁরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তাঁদেরও সঠিক শক্তি এবং ক্ষমতা কতখানি, তাও ভীষ্ম জানেন। দুর্যোধন ভীষ্মকে একটু উসকে দিয়ে স্বপক্ষ এবং পরপক্ষের শক্তিমত্তা যাচাই করতে চাইলেন এবং সেটা একটু আংকিকভাবে। এত অল্প পরিসরে সেই আংকিক গতি তেমন করে বোঝানো যাবে না, তবে এটা বুঝলেই হবে যে, যিনি যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ শত্রু ধ্বংস করতে পারেন এবং নিজে বহু সৈন্য পরিচালনা করতে পারেন তাঁদের পারিভাষিক ভাবে বলে ‘রথ’। যাঁরা যুদ্ধে আরও দক্ষ, তাঁদের পারিভাষিক নাম ‘অতিরথ’। দুর্যোধনের পক্ষে যেসব যুদ্ধবীর রথ এবং অতিরথের পর্যায়ে পড়েন, দুর্যোধন তাঁদেরই চিহ্নিত করতে চাইলেন ভীষ্মের অভিজ্ঞতায়।

দুর্যোধনের আগ্রহ দেখে ভীষ্ম দেশ-বিদেশে সমস্ত রাজার শক্তি নির্ধারণ করার চেষ্টা করলেন। সেখানে যাদব কৃতবর্মা থেকে সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ, ভূরিশ্রবা থেকে অলম্বুষ, দুর্যোধনের ছেলে থেকে দুঃশাসনের ছেলে—সবারই বলাবল নির্ণয় করলেন ভীষ্ম। কৌরব-পাণ্ডবের অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য এবং কৃপাচার্য, দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা—এইসব বড় বড় যুদ্ধবীরের প্রসঙ্গে আবারও কর্ণের ক্ষমতার কথা এসে গেল এবং ভীষ্ম খুব রুক্ষভাবেই বললেন যে, পরশুরামের অভিশাপের নিরিখে শেষ যুদ্ধকালে যেহেতু কর্ণের বিপর্যয় হবার কথা, অপিচ কর্ণের কবচকুণ্ডলও এখন যেহেতু আর তাঁর শরীরে নেই, অতএব কর্ণকে ‘রথ’ও বলা যায় না, ‘অতিরথ’ও বলা যায় না। খুব বেশি হলে তাঁকে ‘অর্ধরথ’ বলা যায়। আমার ধারণা, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ লাগলে কর্ণ কোনও মতেই বেঁচে ফিরবে না—করণানাং বিয়োগাচ্চ তেন মে’র্ধরথো মতঃ।

ভীষ্মের কথায় কর্ণ ক্রোধে অধীর হলেন। পিতামহ ভীষ্মকে তিনি আর ছেড়ে দিলেন না। যা মুখে আসে তাই বলতে গিয়ে কর্ণ এমন কথাও বললেন যে—আমি শুধু দুর্যোধনের কারণে আপনাকে এতদিন ক্ষমা করে চলেছি—মর্ষয়ামি চ তৎ সর্বং দুর্যোধনকৃতেন বৈ। আপনি এমনভাবে কথা বলছেন যেন আমি এক কাপুরুষের অধম। সত্যি বলতে কী, আমার মতে আপনিই হলেন ‘অর্ধরথ’—ভবানর্ধরথো মহ্যং মতো বৈ নাত্ৰ সংশয়ঃ। আমাদের রাজা দুর্যোধন আপনার চরিত্র একটুও বোঝেন না। আপনি কখনওই কুরুদের ভাল চান না। নইলে, এখন এই যুদ্ধের সময় এইভাবে কেউ একজন যুদ্ধবীরের মনোবল ভেঙে দেয়, নাকি এইভাবে নিজেদের মধ্যে ভেদ সৃষ্টি করে? আমি দুর্যোধনকে বলছি—ছাড়ুন এই পাপী লোকটাকে। কাকে ‘রথ’ বলে আর কাকে ‘অতিরথ’ বলে—সেসব বোধ কোথায়? আর কোথায় এই বোকা ভীষ্ম—রথানাং ক্ক চ বিজ্ঞানং ক্ক চ ভীষ্মো’ল্পচেতনঃ? ব্যাটা বুড়ো ভাম, যমে ওর পাকাচুল ধরে টানছে। শুনেছি বুড়োমানুষের কথা সশ্রদ্ধে শোনা উচিত, কিন্তু অতি-বুড়োর কথা কখনও নয়। বেশি বুড়ো হলে তার বুদ্ধিটা আবারও বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়—পুনর্বালা হি তে মতাঃ।

কর্ণ লাগাম ছেড়ে গালাগালি দিলেন ভীষ্মকে। এমন কথাও বললেন যে, এই বুড়োটা চিরকাল নিজে নিজেই লম্বা লম্বা কথা বলে এবং অন্য কাউকে শক্তিমান মনে করে না। আমি বলে রাখছি, দুর্যোধন! তুমি একে সেনাপতি করেছ। আমরা যদি ভাল যুদ্ধ করি তবে তার গৌরব আমরা পাব না, পাবে এই বুড়ো। কাজেই ভীষ্ম বেঁচে থাকতে আমি যুদ্ধ করব না। এই বুড়ো মরলে পাণ্ডবদের একাই আমি সামাল দেব—অহমাবারয়িষ্যামি পাণ্ডবানাম্‌ অনীকিনীম্‌।

জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ভীষ্মের একটু রাগই হল। কোনও দিন তিনি নিজের কথা নিজ মুখে বড় করে বলেননি। আজকে এই মুহূর্তে দুর্যোধনের বন্ধু যখন তাঁর যুদ্ধশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, তখন কিছু কথা না শুনিয়ে পারলেন না ভীষ্ম। বিশেষত এতদিন পরে যে বিরাট যুদ্ধে তাঁর ডাক পড়েছে, তা যে ভালবাসার কারণে নয় এবং তা যে শুধুই তাঁকে ব্যবহার করার জন্য তা তিনি জানেন। অতএব আজ একটু না বললেই নয়। ভীষ্ম কর্ণকে ‘অর্ধরথ’ আখ্যা দেবার আগে কতগুলি বড় যুদ্ধের উল্লেখ করেছিলেন যেগুলির একটাতেও কর্ণ অর্জুনের সামনে দাঁড়াতে পারেননি। অনেক ক্ষেত্রে তিনি পলায়নও করেছেন। ভীষ্ম তাই নিজের জীবনের বিশাল যুদ্ধগুলি স্মরণ করিয়ে দিলেন। বিশেষ বিচিত্রবীর্যের বিয়ের সময় সমস্ত রাজাদের সঙ্গে তার যে যুদ্ধ হয়েছিল, পরশুরামের সঙ্গে তাঁর যে যুদ্ধ হয়েছিল, সেগুলো একটি একটি করে স্মরণ করিয়ে দিলেন ভীষ্ম।

কর্ণ তাঁকে স্থবিরত্বের কারণে নিন্দাবাদ করেছেন, অপিচ দুর্যোধনের জন্যই তিনি ভীষ্মকে ক্ষমা করছেন—এ কথাও বলেছেন। ভীষ্ম সে কথারও জবাব দিতে ছাড়লেন না। বললেন—যে সময় এখন এসেছে তাতে নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা উচিত নয় বলেই এখনও তুই বেঁচে আছিস, ব্যাটা সারথির পো—মিথ্যো ভেদো ন মে কাৰ্য্যস্নেন জীবসি সুতজ। আমি এই বুড়ো বয়সে তোর মতো একটা বাচ্চা ছেলেকে মেরে নিজের বিক্রম প্রকাশ করব না। আর তোর এত যুদ্ধ করার ইচ্ছে এবং তোর বেঁচে থাকার ইচ্ছে—কোনওটাই যাতে নষ্ট না হয়, সেই জন্যই তোকে মেরে ফেলছি না—যুদ্ধশ্ৰমহং ছিন্দ্যাং জীবিতাশাঞ্চ সূতজ। তুই আছিস বলেই কুরুদের আজকে এই বিপদ এসেছে। তোর এত ইচ্ছে, তো পুরুষ হওয়ার চেষ্টা কর যথাসাধ্য আর অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে তোর কী হাল হয় সেও আমি দেখব—যুধ্যস্ব সমরে পার্থং যেন বিস্পর্ধসে সহ।

দুর্যোধন দেখলেন—দুই মহাবীরের ঝগড়ায় তাঁর আসল কাজটাই পণ্ড হতে চলেছে। তিনি অনেক অনুনয়বিনয় করে ভীষ্মকে থামালেন এবং ‘রথ অতিরথে’র সংখ্যায় পাণ্ডবদের শক্তিটাও কীরকম, তা জানাতে বললেন ভীষ্মকে। ভীষ্ম আবারও প্রসঙ্গে চলে এলেন বটে, কিন্তু কৌরবপক্ষের যুদ্ধবীরদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে যত নিপুণ বিশ্লেষণ তিনি করেছিলেন, তেমন বিশ্লেষণ আর করতে পারলেন না। একটু যেন অন্যমনস্কও হয়ে গেছেন তিনি। কর্ণের কথার জবাব দিতে গিয়ে বিচিত্রবীর্যের বিবাহসময়ের সমস্ত ঘটনা আবারও কীরকম আনুপূর্বিকভাবে মনে পড়ে গেল। পাণ্ডবদের বলাবল নির্ধারণ করার সময় আবারও এল সেই কথা। অম্বা-শিখণ্ডিনীর কথা। ভীষ্ম বললেন—অর্জুন কৃষ্ণ অথবা যে কেউ আসুক যুদ্ধে আমি তাঁদের সবাইকে আটকাব, কিন্তু শিখণ্ডীকে নয়—পাঞ্চাল্যন্তু মহাবাহো নাহং হন্যাং শিখণ্ডিনম্‌।

প্রশ্ন উঠতে পারে—যুদ্ধক্ষেত্রে যে যুদ্ধ করবে, তাকেই বাণমুখে প্রতিরোধ করতে হবে। কিন্তু শিখণ্ডীর বেলায় এই বেনিয়ম কেন, সে তো যুদ্ধ করছে। ভীষ্ম বললেন—শিখণ্ডী যদি আমাকে মারবার জন্য তির ছোঁড়ে, তবে আমি বাণ-মুখেও তার অঙ্গস্পর্শ করব না। তোমরা তো জান আমি আমার পিতার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে, কোনও দিন বিবাহ করব না। চিরকাল ব্রহ্মচর্য পালন করব এবং আমি রাজাও হব না। আমি আমার ভাই চিত্রাঙ্গদকে সিংহাসনে বসিয়েছি। বিচিত্রবীর্যকে শিশু অবস্থায় যুবরাজের পদে বসিয়েছি। কিন্তু কোনওভাবেই প্রতিজ্ঞাচ্যুত হইনি। কাজেই শিখণ্ডীর গায়েও আমি অস্ত্রমোক্ষণ করব না। শিখণ্ডী আগে স্ত্রীলোক ছিল এখন পুরুষ হয়েছে—কন্যা ভূত্বা পুমান্‌ জাতঃ। স্ত্রীলোক অথবা যে আগে স্ত্রী ছিল, তাকে আমি কোনওভাবেই মারব না—নৈব হন্যাং স্ত্রিয়ং জাতু ন স্ত্রীপূর্বং কদাচন।

অনুক্রমে ভীষ্মের জীবন আলোচনা করার সময় আমরা পূর্বেই অম্বা-শিখণ্ডিনীর কথা উল্লেখ করেছি। এখানকার সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আমরা বার বার এও জানাতে চেয়েছি যে, অম্বা স্ত্রী ছিলেন এবং কোনও অলৌকিক উপায়ে তিনি ক্লীবত্ব লাভ করেছেন অথবা পুরুষ হয়েছেন—এমনটি হতে পারে না। মহাভারতে এই অলৌকিকত্বের প্রসঙ্গ আছে বটে কিন্তু বাস্তবে মহাভারতেরই নানা প্রসঙ্গ থেকে আমাদের মনে হয়েছে যে, অম্বা পূর্বেও যেমন স্ত্রী ছিলেন এখনও তিনি তেমনই স্ত্রী-ই আছেন। শুধু পুরুষের অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করার মধ্যেই তাঁর পুরুষত্ব। লক্ষণীয়, আমরা ভীষ্মের মুখেই জানতে পেরেছি, যে শিখণ্ডী দ্রুপদরাজার মেয়ে হয়েই জন্মান এবং দ্রুপদ তাঁকে পুরুষপুত্র বলে বাইরে প্রচার করেন। এমনকী দ্রুপদ তাঁর মেয়েটির লিঙ্গপরিচয় লুক্কায়িত রেখে তাঁর বিয়েও দেন।

এসব কথা থেকে আমাদের স্বাভাবিকভাবেই মনে হয়েছে যে, অম্বা দ্রুপদরাজার মেয়ে হয়ে জন্মেছিলেন—এটা আখ্যানমাত্র। অম্বার মাতামহ রাজর্ষি হোত্রবাহন এমন একটি জায়গায় অম্বার বাসস্থান ঠিক করেছিলেন যেখানে অম্বা তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে পারবেন। মহারাজ দ্রুপদ নিজের কারণেই ভীষ্মের প্রতিপক্ষতা করেছেন এবং সেই প্রতিপক্ষতায় অম্বার স্বার্থ একাত্ম হয়েছে। অম্বার স্বার্থ ভীষ্মকে হত্যা করা এবং সেই কারণেই তিনি পুরুষ হয়েছেন। কিন্তু এইভাবে যেহেতু ক্লীবত্ব বা পুরুষত্ব, কোনওভাবেই বাস্তবে হয় না, তাই আমাদের ধারণা হয় যে, অম্বর জন্মগত স্ত্রীত্ব এবং তাঁর পুরুষোচিত বেশবাস, পুরুষোচিত অস্ত্রশিক্ষা—এই দুই বিপরীত সত্তার মিশ্রচারিতাই তাঁকে অন্যের কাছে ক্লীব করে তুলেছে।

ভীষ্ম নিজ মুখেই অনেকবার শিখণ্ডীকে—আগে ইনি স্ত্রী ছিলেন পরে পুরুষ হয়েছেন—কন্যা ভূত্বা পুমান জাতঃ—এইরকমভাবে বর্ণনা করেছেন। আমরা যেমন অনেক সময় পুরুষের স্বভাবগ্রস্ত মহিলাকে মহিলা-পুরুষ বলেই চিহ্নিত করি, তেমনই ভীষ্মও শিখণ্ডীকে চিহ্নিত করেছেন ‘স্ত্রীপুমান্‌ দ্রুপদাত্মজঃ’ বলে। কখনও বা ভীষ্ম তাঁকে দ্রুপদের এই পুত্রটি আগে স্ত্রী ছিলেন—পুত্ৰং স্ত্রীপূর্বিনং তথা—এইরকম বললেও, অনেক জায়গাতেই তিনি শিখণ্ডী শব্দটাকে স্ত্রীলিঙ্গে ব্যবহার করে বলেছেন—অম্বা শিখণ্ডিনী—শিখণ্ডিনী তদা কন্যা ব্রীড়িতেব তপস্বিনী। এই কথায় বুঝি আগেও অম্বা স্ত্রী ছিলেন, এখনও তাই আছেন। শুধু ভীষ্মবধের প্রতিজ্ঞায় তাঁর বেশে, ব্যবহারে এবং শিক্ষায় পুরুষের স্বভাব আক্রান্ত হয়েছে বলেই ভীষ্ম শিখণ্ডীর স্ত্রী-স্বরূপটি ভুলে যাননি। সেই জন্যই সব কথার শেষে ভীষ্ম মন্তব্য করেছেন—স্ত্রীলোক, আগে যিনি স্ত্রীলোক ছিলেন, যার মেয়েদের নামে নাম এবং যে স্বরূপত স্ত্রীলোক—স্ত্রিয়াং স্ত্রীপূর্বকে চৈব স্ত্রীনামি স্ত্রীস্বরূপিনি—এদের গায়ে আমি কখনও বাণাঘাত করব না—এ আমার ব্রহ্মচর্যের ব্রত।

আমরা ভীষ্মের প্রসঙ্গে শিখণ্ডীর স্ত্রী-পুংভাব নিয়ে সামান্য গবেষণা করে নিলাম বটে, তবে ভীষ্মের বক্তব্যটুকু মোটেই এইরকম ছিল না। শিখণ্ডীর দিকে একটি বাণও নিক্ষেপ করব না—এই প্রতিজ্ঞার মধ্যে কোনও আক্ষেপ অথবা হৃদয় ভাঙার মতো কোনও ব্যাপার আছে কি না সেটা ভাল করে বুঝে নেবার আগেই দুর্যোধন ভীষ্মকে প্রায় আকরিক প্রশ্ন করেছিলেন—কেন তিনি শিখণ্ডীকে মারবেন না। ঠিক এই প্রসঙ্গে ভীষ্মের হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হল অম্বার সমস্ত জীবনকাহিনী। সেই বিচিত্রবীর্যের বিবাহ-সময়ে কাশীরাজকন্যা অম্বার হরণ থেকে তাঁর অনুরাগ, ক্রোধ, তপস্যা এবং শেষ পর্যন্ত দ্রুপদ রাজার ঘরে তাঁর শিখণ্ডী পুরুষের পরিণতি—এই সমস্ত কাহিনী দুর্যোধনের কাছে বললেন ভীষ্ম। আগে কোনও দিন কারও কাছে বলেননি, আজ বললেন। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তিনি আজ যে বিরাট যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছেন সে যুদ্ধে প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছেন অম্বা-শিখণ্ডিনী। সেই অম্বা, যিনি ভীষ্মের কাছে অন্য এক পুরুষের সম্বন্ধে প্রথম অনুরাগ জানিয়েছিলেন, সেই অম্বা, যিনি শাল্বরাজার কাছে প্রত্যাখ্যাত হয়ে আবারও ভীষ্মের কাছে ফিরে এসেছিলেন।

ভীষ্ম সেদিন যাঁকে পুনঃপ্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেই প্রত্যাখ্যানের দিনটি আজও মনে পড়ে ভীষ্মের। একটি রমণীর জীবনযৌবন, আশা স্বপ্ন সব ব্যর্থ হয়ে গেল। ব্যর্থ হয়ে গেল রমণীর গার্হস্থ্য সুখ এবং তা ব্যর্থ হল তাঁর কারণে। অথচ ভীষ্মের কী অসহায় অবস্থা! পর পুরুষের পূর্বানুরাগিনী এক রমণীকে তিনি তাঁর ছোট ভাই বিচিত্রবীর্যের জন্যও গ্রহণ করতে পারেননি, আবার পিতার কাছে এমনই এক কঠিন প্রতিজ্ঞায় তিনি প্রতিষ্ঠিত যে, সে প্রতিজ্ঞা ভেঙে দিয়ে নিজেও তিনি অম্বাকে গ্রহণ করতে পারেননি। গুরু পরশুরাম অম্বাকে বার বার ভীষ্মের কাছেই ফিরে যেতে বলেছিলেন; বলেছিলেন ভীষ্মকে তিনিই রাজি করাবেন অম্বাকে গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু এক প্রত্যাখ্যাত রমণীর হৃদয় আপন বীরত্ব-গরিমায় আরও সগৌরবে লাভ করেও তাঁকে তিনি প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হয়েছেন। কী অদ্ভুত এই বিপন্নতা। লাঞ্ছিতা রমণীটি তাঁর পূর্বপ্রণয়ী শাল্বরাজার ওপর রাগ করেননি, বিচিত্রবীর্যের ওপর রাগ করেননি, শুধু রাগ করেছেন ভীষ্মের ওপর।

আজ সেই দিন এসেছে—ভীষ্ম বুঝতে পারছেন, তাঁর শেষ দিন এগিয়ে এসেছে। অম্বা-শিখণ্ডিনী তাঁর অপমানের প্রতিশোধ তুলবেন ভীষ্মের ওপর আর ভীষ্ম আগে থেকেই সবাইকে বলে রাখছেন—আমি শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করব না। তিনি ভাব দেখাচ্ছেন যেন কত তার ঘৃণা, কত উপেক্ষা এই রমণীর প্রতি। কিন্তু আমরা জানি ভীষ্ম যে মর্যাদার মানুষ তাতে তিনি এই রমণীকে শুধু এক সহজ সুযোগ দেবেন তাঁর আপন অপমানের চরম প্রতিশোধ নেবার। এই আত্মসংহারের মধ্যে আত্মবলি অথবা আত্মোৎসর্গের এক আনন্দ আছে, ভীষ্ম আজ সেই আনন্দ পাচ্ছেন। হয়তো সেই আনন্দেই অম্বা-শিখণ্ডিনীর সম্পূর্ণ কাহিনী এক তৃতীয় ব্যক্তির কাছে বিবৃত করে ভীষ্ম তাঁর মানসিক ভার লাঘব করছেন।

যুদ্ধ আরম্ভ হবার ঠিক আগের দিন দুর্যোধন আবারও এলেন ভীষ্মের কাছে। কৌরবপক্ষের কোন যুদ্ধনায়ক কতদিনে পাণ্ডবদের বিশাল সৈন্যবাহিনী শেষ করতে পারবেন—এই নিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন ভীষ্মের কাছে। সব দিক ভেবে ভীষ্ম বললেন—অন্তত এক মাস সময় তাঁর লাগবে পাণ্ডবসৈন্যের অন্ত ঘটাতে—হন্যাং মাসেন ভারত। দ্রোণ বললেন—তাঁরও ওই এক মাসই লাগবে। এইভাবে কৃপ, অশ্বত্থামা ইত্যাদির ক্রমে যখন কর্ণের বক্তব্য শোনা গেল, তখন তিনি বললেন—আমার মাত্র পাঁচদিন সময় লাগবে, তার বেশি নয়। কর্ণের কথা শুনে ভীষ্ম হা হা করে হেসে উঠলেন—জহাস সস্বনং হাসম্‌। তবু এই সময় কথা কাটাকাটি বেশি হল না। কারণ, কর্ণ ভীষ্মের সেনাপতিত্বকালে যুদ্ধই করবেন না।

যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার দিন দুই পক্ষের সেনানায়কেরা পরস্পর পরস্পরের সম্মুখীন হলেন। যুদ্ধবীরদের মহাশঙ্খ বেজে উঠল চারদিকে। ঠিক এই সময়ে বড় অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। পাণ্ডবপক্ষের কর্তাঠাকুর যুধিষ্ঠির মহারাজ যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজের বুকে-আঁটা বর্মটি খুলে ফেললেন। তারপর রথ থেকে নেমে পায়ে হেঁটে কৌরবপক্ষের সেনানায়কদের দিকে এগোতে লাগলেন। হঠাৎ অস্ত্রবিহীন অবস্থায় এইভাবে যুধিষ্ঠিরকে শত্রুসৈন্যের দিকে এগোতে দেখে অর্জুনও তাড়াতাড়ি রথ থেকে নেমে পিছনে ছুটলেন। তাঁর সঙ্গে ছুটলেন ভীম, নকুল, সহদেব এবং কৃষ্ণ। কৌরবপক্ষের সাধারণ সৈনিকেরা সু-উচ্চে হেসে উঠল। সোচ্চারে বলল—মহারাজ যুধিষ্ঠির ভয় পেয়েছেন, তাই ভাইদের নিয়ে ভীষ্মের কাছে যাচ্ছেন আত্মসমর্পণ করতে—ব্যক্তং ভীত ইবাভ্যেতি রাজা’সৌ ভীষ্মমন্তিকম্‌। যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে নানা কটূক্তি বর্ষণ করার পর কৌরব সৈন্যবাহিনী হঠাৎ চুপ করে গেল। তাদের শোনা দরকার—যুদ্ধিষ্ঠির কী বলেন ভীষ্মকে, আর ভীষ্মই বা সেসব প্রশ্নের কী প্রত্যুত্তর দেন—কিংনু বক্ষ্যতি রাজাসৌ কিং ভীষ্মঃ প্রতিবক্ষ্যতি।

দেখা গেল—যুধিষ্ঠির এসে পিতামহ ভীষ্মের পা জড়িয়ে ধরলেন। মুখে বললেন—আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে আমাদের। অনুমতি দিন, পিতামহ! আশীর্বাদ করুন আমাদের—অনুজানীহি মাং তাত আশিষশ্চ প্রযোজয়। যুধিষ্ঠিরের এই মর্যাদাবোধ একমাত্র ভীষ্মের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। শত্রুপক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা এক পরম মহান ব্যক্তির এই বিনয় ব্যবহারে অত্যন্ত খুশি হলেন ভীষ্ম। পিতামহের সস্নেহ উদার আশীর্বাদে যুধিষ্ঠিরের মস্তক আঘ্রাণ করে ভীষ্ম বললেন—তুমি জয় লাভ করো, পুত্র! তোমার সমস্ত অভিলাষ পূর্ণ হোক—প্রীতো’হং পুত্র যুধ্যস্ব জয়মাপ্নুহি পাণ্ডব। আজকে আমার কাছে তুমি যা চাইবে তাই পাবে। এই যুদ্ধে তোমার পরাজয়ের কোনও সম্ভাবনা নেই।

আজকের দিনে যেখানে হিংসা আর প্রতিহিংসায় সমস্ত মানুষ জর্জরিত, এক দলের মহিমান্বিত নেতা যেখানে অন্য দলের নেতার মর্যাদা বোঝেন না, সেইখানে যুদ্ধিষ্ঠির এবং ভীষ্মের এই পারস্পরিক ব্যবহার আমাদের শুধু মুগ্ধ করে! প্রত্যেক বড় মানুষেরই একটা ‘ইগো’ থাকে, থাকে স্বারোপিত মর্যাদাবোধ, কিন্তু সেই ‘ইগো’, সেই মর্যাদাবোধ অতিক্রম করে যিনি অন্যের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন, তিনি যেমন যুধিষ্ঠিরের পর্যায়ে উন্নীত হন, তেমনই বিনীত যুধিষ্ঠিরকে যিনি নিজের থেকেও বেশি মর্যাদায় আলিঙ্গন করতে পারেন, তিনি ভীষ্মের পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন। ভীষ্ম এতটাই বড় যিনি শত্রুপক্ষের নেতাকে বলতে পারেন, যিনি যুদ্ধের প্রাঙমুহূর্তে এই বিনয়-ব্যবহার করতে পারেন, তাঁর কোনও পরাজয় হতে পারে না—এবং গতে মহারাজ ন তবাস্তি পরাজয়ঃ।

ভীষ্মের মনে সামান্য একটু পাপবোধ আছেই। পাণ্ডবরা এতদিন কৌরবদের কাছে বঞ্চিত লাঞ্ছিত হয়েছেন, তাঁরা রাজ্য পেয়েও দুর্যোধনের ছলনায় রাজ্য হারিয়েছেন, সমবেত রাজমণ্ডলীর সামনে উন্মুক্ত রাজসভায় পাণ্ডবপত্নী দ্রৌপদীকে অপমান সইতে হয়েছে, সইতে হয়েছে বনবাসের কষ্ট। এইসব কারণে পিতামহ ভীষ্মের সমব্যথা কম ছিল না এবং তাঁর সমস্ত পক্ষপাতও নির্দিষ্ট ছিল পাণ্ডবদের জন্যই। কিন্তু তবু শুধু পাণ্ডবদের নীতি-সমর্থক বলেই তিনি পাণ্ডবপক্ষে যোগ দিতে পারেননি। পারেননি যে, তার সবচেয়ে বড় কারণ হল তাঁর ধর্ম। সেই পিতা শান্তনুর আমল থেকে তিনি পিতৃপরম্পরায় আগত রাজ্যের কর্ণধার ছিলেন। হস্তিনার সিংহাসনে-বসা মূল রাজবংশের এক মৌল মন্ত্রী হিসেবে তিনি এতকাল এই রাজ্যের সেবা করে এসেছেন এবং কৌরবদের বৃত্তিও তিনি গ্রহণ করেছেন এতকাল। এই বৃত্তিভোগে তাঁর কোনও গ্লানি হয়নি, কারণ হস্তিনার রাজবংশের সুষ্ঠু প্রতিষ্ঠা এবং সুরক্ষার জন্যই তিনি নিবেদিতপ্রাণ।

তবু এই দুর্মন্ত্রণাগ্রস্ত দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রকে ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে যোগ দেওয়া যেত। সব ছেড়ে দিয়ে যাঁকে তিনি ধর্মের প্রতিমূর্তি হিসেবেই শুধু গ্রহণ করতে পারতেন, সেই যুধিষ্ঠিরের পক্ষে তিনি যোগ দিতে পারছেন না, নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে। কাশীরাজ যে পক্ষে আছেন, তাঁর কন্যা অম্বা-শিখণ্ডী যে পক্ষে যুদ্ধে করছেন শুধু ভীষ্মবধের আকাঙ্ক্ষায়, সে পক্ষে তিনি যোগ দেবেন কী করে? কিন্তু এ কথা তো পরিষ্কার করে বলা যায় না যুধিষ্ঠিরকে। অতএব আরও গভীর অর্থবহ কারণের কথা ভীষ্মকে বলতে হল, যা এতই চিরন্তন, এতই তা আপাতত যুক্তিপূর্ণ যে, শুধু যুধিষ্ঠির কেন, চিরকাল সকলে সর্বান্তঃকরণে তাঁর যুক্তি মেনে নেবেন। ভীষ্ম বলললেন—বাছা! মানুষ অর্থের দাস, কিন্তু অর্থ কারও দাস নয়—অর্থস্য পুরুষো দাসো দাসস্ত্বর্থো ন কস্যচিৎ। আমি কৌরবদের কাছে অর্থের দায়ে আবদ্ধ। কৌরবদের বৃত্তিতে আমার ভরণপোষণ আর ঠিক সেই জন্যই অনন্যোপায় ক্লীবের মতো আমাকে এই কথা বলতে হচ্ছে যে, যুদ্ধ আমাকে করতেই হবে। অতএব যুদ্ধ না করার অনুরোধ ছাড়া আর যা কিছু অনুরোধ তুমি করতে পার, আমি রাখব—ভৃতো’স্ম্যর্থেন কৌরব্য যুদ্ধাদন্যৎ কিমিচ্ছসি।

হায়! আজকের দিনের গণতন্ত্রের পূজারীরা রাজতন্ত্রের ধারক বাহকদের এই সামান্য দায়টুকুও যদি বুঝতেন! জনসাধারণের সঞ্চিত অর্থে যাঁদের ভরণপোষণ এবং সত্তা, তাঁরা যদি শুধু এইটুকু বুঝতেন যে, হস্তিনার অর্থানুকূল্যে জীবনধারণ করার কারণেই ভীষ্ম তাঁর নিজের জীবন জলাঞ্জলি দিলেন, তা হলে গণতন্ত্রের আজ এই সংকট দেখা দিত না। যেহেতু হস্তিনার লবণকর ভীষ্মের ধমনীতে আজও বয়ে চলেছে অতএব সেই লবণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না ভীষ্ম। তিনি যুদ্ধ করবেন। যুধিষ্ঠির এতটুকু রাগ করেননি। তিনি তাঁর মর্মকথা বোঝেন বলেই সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন—আপনি শুধু আমার হিতের কথা বলুন, পিতামহ। আমি সেই বর চাই। নইলে আপনি কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করবেন, এ তো স্বাভাবিক—যুধ্যস্ব কৌরবস্যার্থে মমৈষ সততং বরঃ।

ভীষ্ম বলেছেন—তবু তুমি কিছু চাও। আমি যদিও অন্যের জন্য যুদ্ধ করছি, তবু বলো, কীভাবে আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি? যুধিষ্ঠির বললেন—এই যুদ্ধে কীভাবে আপনাকে জয় করব, পিতামহ। যুদ্ধে তো আপনি অজেয়। আমার ভাল চাইলে আপনি সেই উপদেশই করুন, যাতে আপনাকে আমরা জয় করতে পারি—কথং জয়েয়ং সংগ্রামে ভবন্তমপরাজিতম্‌।

যুধিষ্ঠিরের কথার মধ্যে ভদ্রতা ছিল। তিনি সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করতে পারেননি—কীভাবে আপনাকে হত্যা করব। কিন্তু যুধিষ্ঠির যেহেতু কিছুই ভেঙে বলেননি, ভীষ্মও তাঁর উত্তর ভেঙে বললেন না। বরঞ্চ ঘুরিয়ে বললেন—তা যা বলেছ। আমি যুদ্ধ করলে সাক্ষাৎ ইন্দ্রও যুদ্ধ করে আমাকে হারাতে পারবেন না—বিজয়েত পুমান্‌ কশ্চিৎ সাক্ষাদপি শতক্রতুঃ। যুধিষ্টির এবার সব লজ্জা ভেঙে বললেন—সেই জন্যই ত জিজ্ঞাসা করছি, পিতামহ। আপনি আপনার বধের উপায় বলে দিন—বধোপায়ং ব্রবীহিত্বম্‌ আত্মনো সমরে পরৈঃ।

ভীষ্ম বলে দিতে পারতেন; তখনই তাঁর বধের উপায় বলে দিতে পারতেন যুধিষ্ঠিরকে। কিন্তু বলেননি। বলেননি এই কারণে যে, দুর্যোধনকে তিনি কথা দিয়েছেন পাণ্ডবদের না হোক, কিন্তু পাণ্ডবদের হাজার হাজার সৈন্য তিনি বধ করে দুর্যোধনের ভাবনার ভার লাঘব করবেন। তা ছাড়া কৌরবদের হয়ে যুদ্ধ করে যিনি তাঁর ভরণপোষণের ঋণ শোধ করতে চান, তাঁর কি একবেলার মধ্যে যুদ্ধে ধরাশায়ী হলে চলবে! কিন্তু দুর্যোধনের হয়ে যুদ্ধ করবেন বলেই যুধিষ্ঠিরের জয় চান না, তা নয়। এমনকী যে পাণ্ডবদের জন্য তিনি কিছু করতে পারেননি, তাঁদের কারও হাতে মৃত্যুবরণ করতেও তাঁর অনীহা নেই কোনও। কিন্তু তবু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রাজপ্রদত্ত সেনাপতির কার্যভার একটুও পালন না করে, একটুও যুদ্ধ না করে তিনি মৃত্যু চান না। তাঁর এখনই মরতে ইচ্ছে নেই, অতএব যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলেই দিলেন—তুমি আরও একবার এখানে এসো বাবা! এখনও আমার মৃত্যুকাল সমাগত হয়নি—ন তাবৎ মৃত্যুকালো’পি পুনরাগমনং কুরু। যুধিষ্ঠির এবার অন্যান্য আচার্যদের প্রণাম জানিয়ে চলে এলেন স্বস্থানে।

যুদ্ধ আরম্ভ। হল সে যুদ্ধের বর্ণনা দিয়ে কোনও লাভ নেই। একমাত্র মহাকাব্যের মহান শব্দরাশিই পারে এই যুদ্ধের সর্বাঙ্গীন বর্ণনা দিতে। আমরা যদি কোনওভাবে কোনও অর্বাচীন প্রক্রিয়ায় এই যুদ্ধের বর্ণনা করতে চাই, তা হলে সেই বর্ণনা আমাদের অনুবাদ-মাধ্যমে আমাদের কাছেই এমন জোলো শোনাবে যে, মহাভারতের কবি লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠবেন। অতএব আমরা সেই যুদ্ধ-বর্ণনায় যাচ্ছি না। তবে একেবারে প্রথম যুদ্ধারম্ভে যেটা বড় প্রকট হয়ে উঠল, সেটা হল—এই যুদ্ধে পিতার সমান ব্যক্তি পুত্রপ্রতিমকে অস্ত্রাঘাত করতে ছাড়ছেন না, পুত্রের সমানরাও ছাড়ছেন না পিতৃপ্রতিমকে। মাতুল ভাগনেকে প্রহার করছে, ভাগনে মাতুলকে, ভাই ভাইকে, সখা সখাকে, আত্মীয় আত্মীয়কে। পিতামহ ভীষ্ম আপন ইতিকর্তব্যতায় যুদ্ধ করতে করতে শুধু এই দৃশ্য দেখতে দেখতে বিনা বাণাঘাতেই আহত হতে থাকলেন। এর থেকে বড় প্রহার তিনি জীবনে লাভ করেননি।

ভীষ্মের যুদ্ধকালে পাণ্ডবদের অতি ঘনিষ্ঠ কোনও রক্ত-সম্বন্ধীয় মৃত্যু ঘটেনি। ভীষ্মও সেটা চাননি। কিন্তু বৃদ্ধ ভীষ্ম আপন প্রতিজ্ঞামতো পাণ্ডবসেনার এতটাই ক্ষতি করে ফেলছিলেন যে, পাণ্ডবরা নিতান্তই উদ্‌বিগ্নভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্মের প্রতিস্পর্ধী হলে নাতির বয়সি পাণ্ডবরাও কম প্রহার লাভ করছিলেন না। ভীষ্মের প্রথম কয়দিনের সেনাপতিত্বকালে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল—ঈশ্বর বলে কথিত সেই মানুষটির অস্ত্রধারণ। কৃষ্ণ অর্জুনের সারথি হবেন বলে কথা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন—এই যুদ্ধে আমি অস্ত্রধারণ করব না।

কিন্তু ভাবনা একরকম থাকে, বাস্তব আরেকরকম। সেদিনকার যুদ্ধে ভীষ্মের সংহারমূর্তি এমন ভয়ানক আকার ধারণ করল যে, সেদিন আর কারও রক্ষা থাকবে বলে মনে হল না। এমন নিদারুণ যুদ্ধ দেখে চিরস্থির স্থিতধীরতার উপদেশক কৃষ্ণের পর্যন্ত খেয়াল থাকল না। তিনি হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলেন—আজকেই সুদর্শন চক্র হাতে নিয়ে এই ভীষ্ম এবং তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গদের হত্যা করে আমি আমার বন্ধু অর্জুনের প্রীতিসাধন করব—প্রীতিং করিষ্যামি ধনঞ্জয়স্য। যেমন ভাব তেমন কাজ। স্মরণমাত্রেই সুদর্শনচক্র হাতে নিয়ে কৃষ্ণ নেমে পড়লেন অর্জুনের কপিধ্বজ রথ থেকে। পরম আক্রোশে ছুটতে লাগলেন ভীষ্মের রথের দিকে। এই অসামান্য পুরুষোত্তম যখন রথ থেকে নেমে অবতীর্ণ হলেন ভূমিতে, তখন মহাভারতের কবির যুদ্ধবর্ণী শব্দের মধ্যে মৃদুল অলংকারের স্পর্শ লাগল। কৃষ্ণ ছুটছেন, তাঁর স্কন্ধস্থলিত পীতবসন খানিকটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, যেন কালো মেঘের সঙ্গে আটকে রইল খানিকটা বিদ্যুতের প্রভা—ব্যালম্বিপীতান্তপটশ্চকাশে ঘনো যথা খে’চিরভাপিনন্ধঃ।

সত্যি কথা বলি—এই মুহূর্তে মহাভারতের কবির এই সব বিদগ্ধ ভনীতির মধ্যে প্রত্যেক বর্ণই এমন চমৎকার যে তা এই নৃসিংহপ্রসাদের গদ্য-গ্রন্থায় একটুও মানাবে না। এই মুহূর্তে আমি মহাভারতের পাঠক হতেই শুধু ভালবাসি; ভালবাসি সহৃদয়ের হৃদয় নিয়ে এইসব বিশাল গম্ভীর শব্দরাশি হৃদয়ে অবধারণ করতে। আপনারা ভীষ্মের কথাই ধরুন না। এই পরিস্থিতিতে তাঁর কী অবস্থা হয়েছে। এত যে অস্ত্র হানাহানি, এত যে সৈন্যবাহিনীর কুচকাওয়াজ, কিন্তু মহাভারতের কবি যেন এক বিশাল যুদ্ধ-চিত্রপটের একধারে নতুন এক ছবি আঁকছেন। এ যেন চলমান চিত্রপ্রদর্শনীর মধ্যে ছোট্ট একটি ‘ইনসেট’। কী করে বর্ণনা করব এই রচনা! এখানে যুদ্ধক্ষেত্রের বিশাল বীররসের মধ্যে হৃদয়নন্দন ভক্তিরসের মধুরতা সৃষ্টি হয়েছে। যিনি নিজে জীবনে প্রতিজ্ঞাচ্যুত হননি, তিনি তাঁর চাইতে অধিক শক্তিধর এক পুরুষোত্তমের প্রতিজ্ঞা ভেঙে দিচ্ছেন। এখানে একজন ক্রোধের ছলে অনুগ্রহ করছেন, অন্যজন অসামান্য বীরত্ব দেখাতে গিয়ে আত্মনিবেদন করছেন। এমন অদ্ভুত এবং বিপরীত রস-সমন্বয় কোন ভাষায় বোঝাব!

সুদর্শন হাতে কৃষ্ণকে ওইভাবে ছুটে আসতে দেখেই ভীষ্ম তাঁর গাণ্ডীবতুল্য ধনুকটির ছিলা টেনে ধরে বললেন—এসো গো এসো, প্রভু আমার, দেবতার দেবতা আমার! আমার প্রণাম গ্রহণ করো। এই মুহূর্তে সবার সামনে তুমি তোমার জোরে আমাকে নামিয়ে ফেলে দাও এই রথ থেকে—প্ৰসহ্য মাং পাতয় লোকনাথ/রথোত্তমাৎ সর্বশরণ্য সংখ্যে। আজকে যদি আমি মরিও, তবু সেই আমার ভাল। পাঁচজনে অন্তত বলবে—এই ভীষ্মকে মারবার জন্য লোকনাথ কৃষ্ণ অস্ত্রধারণ করে ছুটেছিলেন। তুমি এসো, প্রভু আমার—এহ্যেহি দেবেশ জগন্নিবাস।

মহাভারতের বিশাল ‘প্যানোরমার’ মধ্যে ভক্তি এবং আত্মনিবেদনের এই আপ্লুতি পাঠককে ক্ষণেকের জন্য বিচলিত করবে হয়তো, কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ আপ্লুত করতে পারবে না। কারণ, মহাভারতের পরবর্তী যুদ্ধখণ্ড সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মন অধিকার করবে। কিন্তু পাঠক যদি এই মুহূর্তে শ্রীমদ্ভাগবত মহাপুরাণে অভিনিবিষ্ট হন, তা হলে দেখবেন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ সুদর্শনচক্র হাতে রথ থেকে নামামাত্রই ভীষ্ম তাঁর ধনুকবাণ ত্যাগ করে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন রথের ওপর। তারপর আরম্ভ হল সেই অপূর্ব স্তবরাজ। ভীষ্মের সেই স্তবে আত্মনিবেদন আর শরণাগতির মহিমা এমনই উন্নতউজ্জ্বল যে, কারও যদি হরিস্মরণে সরস থাকে মন, তবে সেই স্তব তার হৃদয়ে অদ্ভুত এক আচ্ছন্নতা তৈরি করবে, আপ্লুতি তৈরি করবে। পুরুষোত্তম কৃষ্ণের মনুষ্যরূপ, ভীষ্মের আকুতি এবং অনুগত শরণাগতের জন্য পরম ঈশ্বরের আপন প্রতিজ্ঞাভঙ্গের কথা এখানে এমনই আন্তরিক স্পর্শে বর্ণিত হয়েছে যে অনুরাগী সজ্জনের হৃদয় একেবারে উদ্বেলিত হয়ে উঠবে। আমরা ভাগবত পুরাণের এই বর্ণনায় যাচ্ছি না, অনুসন্ধিৎসু পাঠক ইচ্ছা করলে এই স্তবসুধা আস্বাদন করবেন।

মহাভারতে স্খলিত-উত্তরীয় কৃষ্ণের সচক্র অভিযান দেখে অর্জুনও ত্বরিতগতিতে নামলেন রথ থেকে। কোনও রকমে আপন প্রলম্বিত বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কৃষ্ণকে। তবু কৃষ্ণের সরোষ গতিবেগ স্তব্ধ হল না। ভীষ্মের রথ তখনও একটু দূরে। অর্জুন কৃষ্ণকে ওইভাবে ধরে ফেলার পরেও আরও দশ পা এগিয়ে তাঁকে সম্পূর্ণ আটকে দিতে পারলেন—বলান্নিজগ্রাহ হরিং কিরীটী/পদে’থ রাজন্‌ দশমে কথঞ্চিৎ। অর্জুন বললেন—কী করছ তুমি, কৃষ্ণ! তুমি প্রতিজ্ঞা করেছ—এই যুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবে না। এখন এমন কর্ম করলে যাতে লোকে হাসবে। আমি আমার ছেলে, আমার ভাইদের নামে শপথ করে বলছি—এই কৌরব নায়কদের আমিই অন্ত ঘটাব। তুমি আমাকে শুধু সাহায্য করো। অর্জুনের কথা শুনে কৃষ্ণ আত্মস্থ হয়ে আবারও রথে উঠলেন। আবারও ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল।

ক্রমাগত আটদিন ভয়ংকর যুদ্ধ হবার পর কৌরব পাণ্ডব উভয় পক্ষেরই ভালরকম ক্ষয়ক্ষতি হল। তবে পাণ্ডবদের ক্ষয় অনেকটাই সৈন্যসামন্তের ওপর দিয়ে গেল, কিন্তু কৌরবপক্ষে দুর্যোধনের বেশ কয়েকটি ভাই মারা গেলেন। এবার দুর্যোধনের সহনশক্তি কমে এল। ভীমের হাতে কয়েকটি ভাইয়ের মৃত্যু হতে দেখে তাঁর ক্রোধ হল, যদিও তিনি একবারও ভাবলেন না যে, অর্জুনের পুত্র ইরাবানও এই যুদ্ধে মারা গেছেন। তবে আমাদের ধারণা, ভাইদের মৃত্যুতে দুর্যোধনের যত কষ্ট হয়েছে, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্রোধ হয়েছে নিজের অপমানে। ভীমের পুত্র ঘটোৎকচের মায়াযুদ্ধে তিনি একেবারে বোকা বনে গিয়েছিলেন এবং ক্রোধের কথা হল—ভীম সেই যুদ্ধটা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন। আর কি সহ্য হয়! দুর্যোধন ভীষ্মের কাছে এসে অনুযোগের সুরে বলেও ছিলেন—এটা কেমন হল, পিতামহ! আমার এগারো অক্ষৌহিণী সেনা আপনার হাতে দিয়েছি। সেখানে ভীমের মতো একটি লোক শুধুমাত্র ঘটোৎকচের ক্ষমতায় আমাদের হারিয়ে দিয়ে গেল! রাগে আমার গা পুড়ে যাচ্ছে, পিতামহ! শুকনো গাছে আগুন ধরলে যেমন হয়, তেমনিই গা পুড়ে যাচ্ছে আমার—তন্মে দহতি গাত্রাণি শুষ্কং বৃক্ষমিবানলঃ।

ভীষ্ম খুব বেশি আমল দেননি এসব কথার। যুদ্ধক্ষেত্রে এসব তো আছেই। কেউ কখনও এগিয়ে যাবে, কখনও বা পিছোবে, কোনও দিন জিতবে, কোনও দিন বা হারবে। দুর্যোধনের অবস্থা দেখে ভীষ্ম অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকে বলেছিলেন—দেখো বাপু! তুমি নিজেকে সব সময় বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করবে। আর ঘটোৎকচ, ভীম এদের সঙ্গে তোমার যুদ্ধ করার দরকারটা কী? তুমি সব সময় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। রাজার সঙ্গেই না রাজার যুদ্ধ করা মানায়—রাজধর্মং পুরস্কৃত্য রাজা রাজানমর্চ্ছতি। আর ভীম অর্জুন—এদের সব আমরা দেখছি! আমি, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা—এঁরা আছেন কী করতে?

ভীষ্ম দুর্যোধনকে বুঝিয়েছিলেন বটে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তবতা মনের ভাবনা অনুসারে চলে না। পরের দিনের যুদ্ধেই দুর্যোধনের কয়েক ভাই ভীমের হাতে মারা পড়লেন এবং ক্রুদ্ধ ক্ষুব্ধ দুর্যোধন গজর গজর করতে থাকলেন কর্ণের কাছে। দুর্যোধন বললেন—ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপরা মোটেই পাণ্ডবদের আটকে রাখতে পারছেন না এবং কেন তাঁরা পারছেন না, তার কারণও আমি বুঝতে পারছি না—ন পার্থান্‌ প্রতিবাধন্তে ন জানে তস্য কারণম্। পাণ্ডবরা আমার সৈন্যধ্বংস করে যাচ্ছে, আর আমিও অপমানিত হচ্ছি পদে পদে। ভীষ্ম দ্রোণ—এঁদের নিয়ে আমি বড় সংশয়ে আছি, কেমন করে যে যুদ্ধ করব তাও ঠিক জানি না।

কর্ণ তাঁর স্বাভাবিক অহমিকায় ভীষ্মকে তাচ্ছিল্য করে বললেন—এত কিছু চিন্তা কোরো না, ভাই, দুর্যোধন! এই যুদ্ধ থেকে ভীষ্ম অবসর নিন, তখন দেখো। একবার এই বুড়ো অস্ত্রশস্ত্র হাত থেকে নামিয়ে রাখুক—নিবৃত্তে যুধি গাঙ্গেয়ে ন্যস্তশস্ত্রে চ ভারত—তখন দেখো আমি একাই এই সমস্ত পাণ্ডব পাঞ্চালদের সামাল দেব। দুর্যোধন কারণ বুঝতে পারছিলেন না, কর্ণ তাই কারণ দেখিয়ে বললেন—তুমি কি জান না যে, পাণ্ডবদের ব্যাপারে ভীষ্মের দুর্বলতা আছে—পাণ্ডবেষু দয়াং নিত্যং স হি ভীষ্মঃ করোতি বৈ। তা ছাড়া তুমি কি বোঝ না—ওই বুড়ো ভীষ্ম কখনও পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারে? বুড়োর অহংকার আছে ষোলো আনা, আর যুদ্ধ করতেও বেশ ভালবাসে, কিন্তু ওই অহংকার আর ভালবাসা দিয়ে কি আর সমবেত পঞ্চ পাণ্ডবকে জয় করা যায়—স কথং পাণ্ডবান্‌ যুদ্ধে জেষ্যতি তাত সঙ্গতান্‌। তারচেয়ে আমি বলি কী, তুমি ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাকে মান্যি-মর্যাদা দিয়ে তাঁর অস্ত্রশস্ত্রগুলি শুধু নামিয়ে রাখতে বলো। তারপর আমার হাতে পড়লে, বুঝে নাও পাণ্ডবরা মরেই গেছে—নিহতান্‌ পশ্য পাণ্ডবান্।

কর্ণের কথা শুনে দুর্যোধন চললেন ভীষ্মের কাছে। বেশ একটু সেজেগুজেই চললেন। গায়ে চন্দন-কুঙ্কুম মেখে, মাথায় পাগড়ি পরে। ভাবটা এই, ভীষ্মের সামনে উপস্থিত হবার পর ভীষ্মের ব্যক্তিত্ব যেভাবেই কাজ করুক, যেভাবে, যেমনটি তিনি কর্ণের পরামর্শমতো বলবেন ভেবেছিলেন, তেমনটিই তিনি বলবেন। সেই জন্যেই সেজেগুজে ‘কনফিডেনটলি’ চললেন। তাঁর সঙ্গে ভাইরাও চলল অনুগামীর মতো। ভীষ্মকে যথেষ্ট মর্যাদা দেওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধন কিন্তু নিজের ক্ষোভ একটুও চেপে রাখতে পারলেন না। প্রথমে তিনি বললেন—আপনার ভরসাতেই তো যুদ্ধ করছি, পিতামহ! কিন্তু আমাদের বিশ্বাস, আপনার আশ্রয়ে থেকে যুদ্ধ করলে দেবতা অসুরদেরও আমরা জয় করতে পারি, সেখানে এই পাণ্ডবরা কোন ছার। তবে আপনি এবার আমাদের দিকে একটু তাকান, পাণ্ডবদের মারুন একে একে—জহি পাণ্ডুসুতান্‌ বীরান্‌। বাকি সৈন্যবাহিনী ধ্বংসের ভার আমাদের।

দুর্যোধন এবার নির্লজ্জভাবে কর্ণের কথাটা তুলে বললেন—আর যদি এমন হয় যে, পাণ্ডবদের ওপর মায়ায় আপনি তাঁদের ছোঁবেন না, অথবা যদি এমন হয় যে, আমার ওপর বিদ্বেষ থাকার জন্যই হোক কিংবা আমার কপাল মন্দ বলেই হোক, আপনি যদি পাণ্ডবদের বার বারই ছেড়ে দেন—মন্দভাগ্যতয়া বাপি দ্বেষ্যভাবান্মম প্রভো—তা হলে আপনি আজ্ঞা করুন, কর্ণ যুদ্ধ করবে। সে পাণ্ডবদের মেরে ছাড়বে।

দুর্যোধনের মুখে এমন অপমানজনক কথা শুনে ভীষ্ম একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। প্রথমে তো কথাই বলতে পারলেন না। তার যেমন দুঃখ হল, তেমনই ক্রোধ। খানিকক্ষণ তিনি চুপ করে বসেই রইলেন। নিশ্বাস পড়তে লাগল ঘন ঘন। চোখদুটি রক্তবর্ণ হয়ে উঠল ক্রোধে। তবু ভীষ্ম দুর্যোধনের মতো চক্ষুলজ্জাহীনভাবে তাঁকে প্রত্যুত্তর দিতে পারলেন না। শান্তভাবে তিনি বললেন—কেন দুর্যোধন! কেন তুমি এইভাবে কঠিন কর্কশ কথা বলে পীড়ন করছ আমাকে? সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ যেখানে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, সেখানে আমি যথাশক্তি চেষ্টা করছি তোমার প্রিয় সাধন করার জন্য। তোমারই প্রিয় কামনায় এই ভীষণ যুদ্ধে নিজের প্রাণ বলি দেবার জন্য তৈরি হয়েছি—জুহ্বানং সমরে প্রাণাংস্তব বৈ প্রিয়কাম্যয়া। তবুও তুমি যেমন চাইছ, অর্থাৎ পাণ্ডবদের আমি কেন মারতে পারছি না, তার কারণ ছড়িয়ে আছে বহু জায়গায়।

ভীষ্ম একের পর এক উদাহরণ দিয়ে চললেন—কীভাবে কখন অর্জুন তাঁর একক ক্ষমতায় সমস্ত কৌরববীরদের পর্যুদস্ত করে পাণ্ডবদের বিজয় এনে দিয়েছেন। যে কর্ণের জন্য দুর্যোধনের এত গর্ব, সেই কর্ণ কীভাবে অর্জুনের হাতে পরাজিত হয়েছেন একাধিকবার সে উদাহরণও দিতে ভুললেন না ভীষ্ম। ভীষ্ম বললেন—পাণ্ডবরা যখন খাণ্ডবপ্রস্থের বনভূমি দগ্ধ করে ইন্দ্রপ্রস্থ তৈরি করেছিল, তখন অর্জুন যেভাবে ইন্দ্রকেও পরাজিত করেছিল, সেখানেই পর্যাপ্ত নিদর্শন আছে—কেন আমি পাণ্ডবদের মারতে পারছি না। পাণ্ডবদের বনবাসের সময় গন্ধর্বরা যখন তোমাকে হরণ করেছিল, এবং তোমার ভাইবন্ধুরা, এমনকী কর্ণও পালিয়ে বেঁচেছিল, তখন যে তোমাকে গন্ধর্বদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছিল, সেখানেই পর্যাপ্ত নিদর্শন আছে—কেন আমি পাণ্ডবদের মারতে পারছি না। আবার পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় যখন আমরা সবাই মিলে বিরাটরাজার গোধন হরণ করতে গিয়েছিলাম, তখন যে আমাদের যুদ্ধ-মূৰ্ছিত করে, আমার, তোমার, কর্ণের, দ্রোণের—সবার, সমস্ত কুরুমুখ্যদের মাথার উষ্ণীষ খুলে নিয়ে গিয়েছিল, সেখানেই পর্যাপ্ত নিদর্শন আছে, কেন আমি পাণ্ডবদের মারতে পারছি না—বাসাংসি স সমাদত্ত পর্যাপ্তং তন্নিদর্শনম্‌।

অর্জুনের অলৌকিক অস্ত্ৰক্ষমতার পরিচয় দিয়ে দুর্যোধনকে একটু তিরস্কার করেই ভীষ্ম বললেন—অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে জিতবে এমন লোক কোথায়? তারমধ্যে এমন একজন তাকে সাহায্য করছেন, তিনি এই জগৎসংসারেরও রক্ষক—তস্য গোপ্তা জগদ্‌গোপ্তা শঙ্খচক্রগদাধর! অতএব সেই অর্জুনকে জিতে নেওয়া—তুমি যে কী বলছ, না বলছ—তা তুমি নিজেই ভাল করে জানো না—ন জানীষে বাচ্যাবাচ্যং সুযোধন।

দুর্যোধন যেভাবে পরোক্ষে কর্ণের সেনাপতিত্বের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন ভীষ্মের কাছে, তাতে যত অপমান এই বৃদ্ধের হয়েছিল, সেই তুলনায় এতক্ষণ যথেষ্টই কোমলভাবে তিনি দুর্যোধনকে তাঁর প্রতিবক্তব্য শুনিয়েছেন। কিন্তু এই কথার পৃষ্ঠে কথার ওপরেও তাঁর কিছু ভাবনা আছে। এতকাল ধরে তিনি এই কুরুবংশের ওঠানামা দেখেছেন। এই বংশের প্রতিটি ব্যক্তিকে তিনি বড় কাছ থেকে চেনেন। জ্ঞাতিশত্রুতা এবং অহংকার দুর্যোধনকে বড় স্ফীত করে তুলেছে। ভীষ্ম এই আস্ফোট আর সহ্য করতে পারছেন না। তিনি বললেন—দেখো দুর্যোধন! মানুষের মরণকাল উপস্থিত হলে সে তার সামনের সবুজ গাছপালাগুলিকেও সোনার বরণ দেখে—মুমূষু-র্হি নরঃ সর্বান্ বৃক্ষান্‌ পশ্যতি কাঞ্চনান্‌—তোমারও হয়েছে সেইরকম। সব কিছুই তুমি বিপরীত দেখছ। ভাবটা এই—এতটাই বিপরীত যে, সর্বজিৎ অর্জুনকেও কর্ণ মেরে ফেলবে বলে তুমি ভাবছ। ভীষ্ম বললেন—দেখো, এই যুদ্ধ বাধিয়ে নিয়েছ তুমি। তা হলে পাণ্ডব পাঞ্চালদের তুমি একাই শেষ করে দাও না। দেখি তুমি কেমন পুরু—যুধ্যস্ব তানদ্য রণে পশ্যামঃ পুরুষো ভব।

এতসব তিরস্কারের পরেও কিন্তু ভীষ্ম নিজের দায়িত্ব অস্বীকার করলেন না। তাঁকে সেনাপতি করা হয়েছে এবং সেই পদের দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি সচেতন। দুর্যোধনকে তিনি বলেই দিলেন—আজকে তুমি ভাল করে ঘুমোও, কালকে আমি এমন যুদ্ধ করব যে, বহুকাল লোকে সে কথা মনে রাখবে—সুখং স্বপিহি গান্ধারে শ্বো’স্মি কর্তা মহারণম্। দুর্যোধন একথায় অনেকটাই নিশ্চিন্ত হয়ে বাড়ি গেলেন এবং পরের দিন সমাগত রথী মহারথীদের বলে দিলেন যাতে তাঁরা ভীষ্মকে রক্ষা করে চলে। কারণ ভীষ্ম শিখণ্ডীর প্রতি অস্ত্রনিক্ষেপ করবেন না। পাণ্ডবরা শিখণ্ডীর সাহায্যে ভীষ্মকে পর্যুদস্ত করতেও পারেন।

পরের দিনের যুদ্ধ ভয়ংকরভাবে আরম্ভ হল বটে, কিন্তু কৌরবপক্ষের তাতে যে খুব সুবিধে হল, তা নয়। পরের দিন অর্জুনপুত্র অভিমন্যু এমন যুদ্ধ আরম্ভ করলেন যে, সারাক্ষণ তাঁকে নিয়েই কৌরবপক্ষকে ব্যস্ত থাকতে হল। কিন্তু দিন যখন শেষ হয়ে আসছে ভীষ্ম সেই সময় ভয়ংকর মরণরূপ ধারণ করলেন। পাণ্ডবদের সৈন্যসামন্ত ক্ষয় করে এমন তোলপাড় অবস্থা করলেন তিনি যে, অর্জুন অন্যত্র যুদ্ধে ব্যস্ত থাকলেও ভীষ্মকে আটকানোর জন্য তড়িঘড়ি ছুটে আসতে বাধ্য হলেন। অর্জুন প্রথমে দু-একবার তাঁর ধনুকটনুক কেটে দিলেন বটে এবং তার জন্য প্রতিপক্ষী ভীষ্মের প্রশংসা সম্ভ্রমও লাভ করলেন যথেষ্ট, কিন্তু অবশেষে ভীষ্মকে তিনি আর রোধ করতে পারছিলেন না।

প্রিয়সখার অবস্থা দেখে আবারও পার্থসারথি কৃষ্ণের ছটফটানি আরম্ভ হল। সৈন্যসামন্তের নাকাল অবস্থা এবং ভীষ্মের সংহারমূর্তি দেখে বাসুদেব কৃষ্ণ আবারও হঠাৎ নেমে পড়লেন রথ থেকে। ভূতাবিষ্টের মতো—কী করছেন, সেদিকে যেন তাঁর খেয়ালই নেই। সিংহের মতো গর্জন করতে করতে খালি হাতে তিনি আবারও ছুটে চললেন ভীষ্মের দিকে। বেশিরভাগ মানুষই জানেন যে, ভীষ্মের যুদ্ধকালে তার ভয়ংকর যুদ্ধোন্মাদ স্তব্ধ করবার জন্য বাসুদেব কৃষ্ণ একবারই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে যুদ্ধ করতে নেমেছিলেন। কিন্তু আসলে দেখছি—এ ঘটনা দুবার ঘটেছে। পা দাপিয়ে পৃথিবী কাঁপিয়ে ক্ষোভে ক্রোধে রক্তচক্ষু কৃষ্ণ ছুটলেন ভীষ্মের দিকে—অভিদুদ্ৰাব ভীষ্মং স ভুজপ্রহরণো বলী। সৈন্যসামন্ত সাধারণেরা কৃষ্ণের অতিলৌকিক শক্তি সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। অতএব কৃষ্ণ খালিহাতে ভীষ্মের দিকে ছুটে গেলেও তারা আগে থেকেই চেঁচাতে থাকল—মরলেন এবার, মরলেন ভীষ্ম—হতো ভীষ্মো হতো ভীষ্মস্তত্র তত্র বচো মহৎ।

কৃষ্ণকে থামানোর কৌশল ভীষ্মই সবচেয়ে ভাল জানেন। তা আগেই দেখা গেছে। কৃষ্ণের সম্বন্ধে ভীষ্মের ধারণাও ভগবত্তার চেতনায় আচ্ছন্ন। সেই যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে—যখন প্রায় কেউই কৃষ্ণকে বলে এবং বুদ্ধিতে সকলের অধিক বলে মেনে নেননি, সেদিনও এই বৃদ্ধ প্রায়-যুবক এক কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় ভূষিত করেছিলেন। আজও সেই একই মর্যাদা। কৃষ্ণ তাঁর দিকে সক্রোধে দৌড়োতে থাকেন, আর তিনি অক্লেশে নিরুপদ্রব চিত্তে অস্ত্রত্যাগ করে অক্রোধে যাচনা করেন—এই ভয়ংকর যুদ্ধে আজকে আমাকে শেষ করে দাও প্রভু। তুমি মারো আমাকে—মামদ্য সাত্ত্বতশ্রেষ্ঠ পাতয়স্ব মহাহবে।

পিতার কাছে যিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর লাভ করেছিলেন, এতকাল সংসারের বিচিত্র গতি দেখে বহুবার মরতে ইচ্ছা করেও আরও দেখার লোভে যিনি মরণেচ্ছা সংবরণ করেছেন, তিনি এইভাবে মরতে চান। ঈশ্বরকল্প কৃষ্ণের হাতে তিনি নিজেকে সঁপে দিতে চান। বার বার বলেন—কৃষ্ণ! মারো আমাকে। আমি তোমার ভৃত্যমাত্র। তুমি যদি মার, তবেই আমার লাভ, তবেই মঙ্গল—প্রহরস্ব যথেষ্টং বৈ দাসো’স্মি তব চানঘ। ভীষ্মের এই অদ্ভুত আচরণ আর ওদিকে কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে দেখে অর্জুন আবারও ছুটে চললেন কৃষ্ণের পেছন পেছন। কোনও রকমে জাপটে ধরে অনুনয় করে অর্জুন থামালেন কৃষ্ণকে। বার বার মনে করিয়ে দিলেন—তুমি না প্রতিজ্ঞা করেছিলে, যুদ্ধ করবে না। অথচ একই কাজ করে চলেছ। লোকে যে তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে উপহাস করবে—মিথ্যাবাদীতি লোকত্ত্বাং কথয়িষ্যন্তি মাধব।

কৃষ্ণ থামলেন। অর্জুন তাঁকে কথা দিলেন—ভীষ্মের অন্তিম ব্যবস্থা তিনিই করবেন। অর্জুনের কথা শুনে কৃষ্ণ নিজের গতি রুদ্ধ করলেন বটে, কিন্তু পুরোপুরি গেল না তাঁর ক্রোধ। কৃষ্ণ ফিরে এসে রথে উঠতেই ভীষ্ম আবারও শরবর্ষণ আরম্ভ করলেন আগের মতোই। কৃষ্ণকে ফেরাবার জন্যই হয়তো অৰ্জুন বলেছিলেন—আজই। আজই আমি পিতামহকে মরণের পথে নিয়ে যাব—কিন্তু সেদিন ভীষ্ম দুর্যোধনকে কথা দেবার ফলে এমন যুদ্ধই করেছিলেন যে, পাণ্ডবরা তেমন যুদ্ধ কোনও দিন দেখেননি। পাঁকের মধ্যে পা ডুবে গেলে গোরুর যে অবস্থা হয়, তেমনই আঁকুপাকু অবস্থা হয়ে গিয়েছিল পাণ্ডবপক্ষের সমস্ত সৈন্যদের। ভীষ্মের শরবর্ষণে বিপর্যস্ত হয়ে কেউ সেদিন এমন কাউকে ত্রাতা হিসেবে পায়নি যিনি সৈন্যদের বাঁচাতে পারেন।

বাঁচালেন সূর্যদেব। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। কে কার সঙ্গে যুদ্ধ করছে, তা যখন আর কিছুই দেখা যায় না, তখন দুপক্ষই সেদিনকার যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করলেন—ততো’বহারং সৈন্যানাং কৃত্বা তত্র মহারথাঃ। পাণ্ডবরা ক্ষতবিক্ষত শরীরে নিজেদের শিবিরে প্রবেশ করলেন এবং তাঁদের মনে শান্তি বলে কিছু রইল না। ভীষ্মের প্রলয়ংকর মূর্তির কথা স্মরণ করে তাঁরা রীতিমতো আতঙ্কিত হলেন। যুদ্ধবেশ ছেড়ে সারা শরীরে ভেষজ ঔষধের প্রলেপ লাগানোর পর পাণ্ডবরা যখন একটু ঝরঝরে বোধ করছেন, তখন রাত্রি হয়ে গেছে—ততো রাত্রিঃ সমভবৎ সর্বভূতপ্রমোহিনী। সেই রাতের অন্ধকারেই পাণ্ডবভাইরা কৃষ্ণকে নিয়ে ‘মিটিং’এ বসলেন।

যুধিষ্ঠির ভীষ্মের ব্যাপারে গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করলেন। বস্তুত নবম দিনের যুদ্ধে পাণ্ডবসৈন্যদের এত ক্ষতি হয়ে গেছে যে, তাতে যুধিষ্ঠির শুধু উদ্‌বিগ্নই বোধ করছেন না, তিনি অত্যন্ত শোকগ্রস্তও হয়ে পড়েছেন সাধারণ সৈন্যের করুণ অবস্থা দেখে। কৃষ্ণকে তিনি বলেই ফেললেন—ভীষ্ম আমাদের এমন মার মারছেন যে, আমার আর যুদ্ধ করার ইচ্ছে নেই একটুও—ন যুদ্ধং রোচয়ে কৃষ্ণ হন্তি ভীষ্মে হি নঃ সদা। এত লোকের মৃত্যু দেখে যুধিষ্ঠির বৈরাগ্য বোধ করছেন অন্তরে। বার বার তাঁর মনে হচ্ছে যে, শুধুমাত্র রাজ্যলাভের কারণে এই পরিমাণ লোকক্ষয় সহ্য করার চেয়ে বনে বাস করাও অনেক ভাল। জীবনের যতটুকু অবশেষ আছে—যুধিষ্ঠিরের ধারণা, ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে গেলে এত সাধের জীবনটাও আর থাকবে না—অতএব জীবনের যতটুকু অবশেষ আছে, সেই সময়টুকু ধর্মকর্ম করেই কাটানো ভাল বলে তিনি মনে করেন—জীবিতস্যাদ্য শেষেণ চরিষ্যে ধর্মমুত্তমম্।

কৃষ্ণ অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে যুধিষ্ঠিরের কথা শুনলেন। তিনি প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। যুধিষ্ঠিরের মনের অবস্থা তিনি বুঝতে পারছেন। আবার এটাও বুঝতে পারছেন যে, যুধিষ্ঠির যেভাবে মনোবল হারিয়ে বসে আছেন, তাতে সমস্ত যুদ্ধ-প্রক্রিয়াটাই ভেঙে পড়বে। কৃষ্ণ তাই প্রথমে তাঁকে উৎসাহ জোগানোর জন্য বললেন—আপনার এতগুলো পরাক্রান্ত ভাই থাকতে কীসের এত চিন্তা? তা ছাড়া আমি তো আছি। আপনি আমাকে আদেশ করুন, আমি যুদ্ধ করব ভীষ্মের সঙ্গে। আপনি আদেশ করলে আমি করতে পারব না হেন কাজ নেই। ভীষ্মকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মারব, ওঁদের কৌরবরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে মৃত্যু দেখবে—হনিষ্যামি রণে ভীষ্মমাহূয় পুরুষর্ষভম্‌। কৃষ্ণ অভয় দিয়ে বললেন—আরে দাদা! পাণ্ডবদের শত্রু যিনি, তিনি আমারও শত্রু। আপনার অর্জুন আমার সখা, সম্বন্ধী এবং শিষ্য। অর্জুনের জন্য শরীর থেকে মাংস কেটে দিতেও আমার আপত্তি নেই—মাংসানুৎকৃত্য দাস্যামি ফাল্গুনার্থে মহীপতে।

কৃষ্ণ নিজের কথা এতটা ঢাক পিটিয়ে বললেন, যাতে যুধিষ্ঠিরের মনোবল ফিরে আসে। তিনি জানতেন তাঁর কথায় অর্জুন উজ্জীবিত হবেনই এবং সত্যি তিনি যুধিষ্ঠিরের মতো ভেঙে পড়বার লোক নন। কৃষ্ণ নিজের কথা এত বলেও কিন্তু তাঁর বিকল্প হিসেবে অর্জুনের কথাটা জানিয়ে দিতে ভোলেননি। তিনি বলেছেন—ভীষ্মকে মারবার ভার তো অর্জুনের ওপরেই আছে—অথবা ফাল্গুনস্যৈব ভারো পরিমিতো রণে—আর সে ইচ্ছে করলে ভীষ্মকে মারতে পারবে না, এটা আমি বিশ্বাসই করি না—কিমু ভীষ্মং নরাধিপ।

কৃষ্ণ যে নিজে বার বার যুদ্ধ করতে চাইছেন নিজের প্রতিজ্ঞা যুদ্ধ না-করার শর্ত ভেঙে—এমনকী নিজের প্রতিজ্ঞা ভেঙে তিনি যে রথ থেকে দু-দুবার নেমেও পড়েছিলেন যুদ্ধের জন্য, তার পেছনে একটা রহস্য আছে। কৃষ্ণ বেশ বুঝতে পারছিলেন যে, অর্জুন ইচ্ছাকৃতভাবে ওই ভীষ্মবধের কষ্টকর্ম থেকে নিজেকে যত কাল সম্ভব দূরে রাখতে চাইছেন। মনে রাখতে হবে, সর্বসমেত আঠেরো দিনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শুধু ভীষ্মের পতন ঘটতেই লেগেছিল দশ দিন এবং সেটা অবশ্যই তিনি অর্জুনের পিতামহ বলেও বটে, আবার তাঁকে দিয়েই কুরুসেনাপতির নিধন শুরু করতে হয়েছিল বটে। লক্ষ করে দেখুন, কৃষ্ণ বার বার যুধিষ্ঠিরকে বলছেন—দেখুন, যদি অর্জুন ভীষ্মকে মারতে ইচ্ছা না করে—যদি নেচ্ছতি ফাল্গুনঃ—তবে আমিই মারব তাঁকে। আবার বলছেন—আপনি আমাকেই ভীষ্মবধে নিয়োগ করুন, দাদা। যদিও অর্জুন সেই যুদ্ধের উদ্যোগকালে সর্বলোকের সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে সেই মারবে ভীষ্মকে—প্রতিজ্ঞাতমুপপ্লব্যে যত্তৎ পার্থেন পূর্বতঃ। কিন্তু এখনও যখন ঘটনাটা ঘটে ওঠেনি, তখন, সে অনুমতি করলে আমিও কাজটা করে দিতে পারি—অনুজ্ঞাতস্তু পার্থেন ময়া কাৰ্যং ন সংশয়ঃ।

এই যে বার বার কৃষ্ণ বলছেন—অর্জুন চাইলে—অথবা সেই প্রতিজ্ঞা করেছিল—অথবা সে অনুমতি করলে—এই কথাগুলি থেকে বোঝা যায় যে, অর্জুন সঠিকভাবে ভীষ্মবধের উদ্যোগ নেননি এবং তা ইচ্ছাকৃতভাবেই। সেকালের দিনে একটি যুদ্ধরথের সারথি শুধু ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াতেন না, অথবা ঘোড়া চালিয়ে নিয়ে যাবার কৌশলমাত্র শিখলেই তিনি রথ চালাতে পারতেন, তাও নয়। সারথিকে প্রায় রথীর সমান যুদ্ধবিদ্যা জানতে হত। বিশেষত কৃষ্ণের মতো চতুর সারথি, যিনি নাকি পাণ্ডবদের সমস্ত কর্মোদ্যোগে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত, তিনি অর্জুনের সমস্ত ক্রিয়াকর্ম উদ্যোগ দেখে বুঝতে পারছেন যে, ভীষ্মবধের ক্ষেত্রে তাঁর অনীহা, অচেষ্টা, অবহেলা সবই আছে। এটা বোঝাতেই তিনি দু-দুবার প্রতিজ্ঞা ভেঙে যুদ্ধ করতে নেমেছিলেন এবং দু-দুবারই অর্জুনের কাছ থেকে কথা আদায় করেছিলেন যে, অর্জুনই ভীষ্মকে মারবেন। আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনেও তিনি বার বার নিজে যুদ্ধ করতে চেয়েছেন পরোক্ষে অর্জুনকে প্রোৎসাহিত করার জন্য এবং শেষ সিদ্ধান্ত করার সময় তিনি পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ভীষ্মবধের ব্যাপারে অর্জুনের ইচ্ছাকৃত অনুদ্যোগ আছে। তিনি বলেছেন—আজকে যদি স্বয়ং দেবতারা তাঁদের সমকক্ষ জ্ঞাতিভাই দৈত্য দানবদের সঙ্গে নিয়েও অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে আসেন, তবুও তাঁরা অর্জুনের কাছে হার মানবেন, সেখানে ভীষ্ম কোন ছার। তবে হ্যাঁ, যুদ্ধক্ষেত্রে অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে কোনও অসুবিধেই তাঁর হবে না, যদি তিনি ঠিক ঠিক উদ্যোগটি নেন—অশক্যমাপ কুর্যাদ্ধি রণে পার্থঃ সমুদ্যতঃ।

যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের কথায় যথেষ্ট উৎসাহিত হলেন এবং যথেষ্ট লজ্জিত হয়ে বললেন—না না, আমাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা তোমাকে সত্যচ্যুত হতে দিতে চাই না—ন ত্বামনৃতং কর্তুমুৎসহে স্বার্থগৌরবাৎ। তুমি যুদ্ধ না করেই আমাদের শুধু সাহায্য করে যাও। যুধিষ্ঠির এবার ভীষ্মবধের উপায় নিরূপণের জন্য বললেন—ভীষ্ম নিজেই আমাকে এক সময় বলেছিলেন যে, তিনি আমাদের হয়ে যুদ্ধ করবেন না বটে, তবে আমাদের উপযুক্ত পরামর্শ দিতে তিনি সংকুচিত হবেন না। যুধিষ্ঠির প্রস্তাব করলেন—অতএব তাঁর কাছে গিয়েই তাঁর মৃত্যুর উপায় জিজ্ঞাসা করতে হবে আমাদের—তস্মাদ্দেবব্রতং ভূয়ো বধোপায়ার্থমাত্মনঃ।

যুধিষ্ঠির ভয়ানক লজ্জিত এবং আরও সংকুচিত বোধ করছেন এই কথা ভেবে যে, সময়কালে ক্ষত্রিয় পুরুষকে কত নির্মম এবং নির্দয় হয়ে উঠতে হয়। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বলেছেন—ধিক! শত ধিক এই ক্ষত্রিয়ের বৃত্তিকে, যেখানে বাবার বাবা, আমাদের বুড়ো ঠাকুরদাদাকে আমরা মারার কথা ভাবছি—তঞ্চেৎ পিতামহং বৃদ্ধং হন্তুমিচ্ছামি মাধব। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব মেনে নিলেন এবং ভীষ্মের কাছে গিয়েই তাঁর বধের উপায় জানাটাই যে শ্রেয়, সে সম্বন্ধেও একমত হলেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে। সত্যি কথা বলতে কী, পাণ্ডবরা বিশেষত অর্জুন এবং কৃষ্ণ কি জানতেন না যে, শিখণ্ডীকে সামনে রেখে যুদ্ধ করলে ভীষ্ম আর অস্ত্রধারণ করবেন না? জানতেন। যথেষ্টই জানতেন। কিন্তু এটা হল মর্যাদার পন্থা। বটবৃক্ষের মতো এই বৃদ্ধ পিতামহ, যিনি বাল্যকাল থেকে স্নেহে মায়ায় পাণ্ডবকুমারদের বড় করে তুলেছেন এবং তাঁদের পিতার অভাব বুঝতে দেননি—বালাঃ পিত্রাবিহীনাশ্চ তেন সংবর্ধিতা বয়ম্‌—তাঁকে মারতে চাইতে হলে তাঁর কাছেই যদি তাঁর মরণোপায় জিজ্ঞাসা করা যায়, তবে তাঁকে খানিকটা মর্যাদা দেওয়া হয় অন্তত। অন্তত সেই বৃদ্ধের সুচিরকালসঞ্চিত অহংবোধ খানিকটা তৃপ্ত হয় তাতে। তিনি ভাবতে পারেন—আরে! বুড়ো হলে কী হবে। অর্জুনের মতো মহাপরাক্রমী বীরকেও আমার কাছে আসতে হয়েছে আমারই মৃত্যুর উপায় জানবার জন্য। ওরা পারেনি, আমার সঙ্গে ওরা পারেনি।

দেখবেন, বাস্তবে যখন যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে নিয়ে ভীষ্মের কাছে এসেছিলেন, তখন বৃদ্ধের মুখে আমরা এই অহংবোধের পরিতৃপ্তিই দেখেছি। যুধিষ্ঠির যখন মুক্তশস্ত্র অবস্থায় কৌরবশিবিরে এসে ভীষ্মের সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন—আপনিই আপনার মৃত্যুর উপায় বলে দিন, পিতামহ! নইলে স্বর্গ থেকে যদি দেবরাজ ইন্দ্রও নেমে আসেন ভূঁয়ে, তবু তিনি আপনাকে হারাতে পারবেন না—তখন বৃদ্ধ পিতামহ পরিতৃপ্তির হাসি হেসে বলেছিলেন—কথাটা এক অর্থে তুমি ঠিকই বলেছ, যুধিষ্ঠির! আমার হাতে অস্ত্র থাকতে দেবতা, অসুর কারও সাধ্য নেই আমাকে যুদ্ধে হারায়—নাহং শক্যো রণে জেতুং সেন্দ্রৈরপি সুরাসুরৈঃ। তবে হ্যাঁ, আমি যদি হাত থেকে অস্ত্র নামিয়ে রাখি, তবে তোমাদের যেসব বীর মহাবীর আছেন, তাঁরা আমাকে মারতে পারেন বটে—ন্যস্তশস্ত্রং তু মাং রাজন্নেতে হন্যুর্মহারথাঃ।

কোনও ক্ষত্রিয় বীরকে লজ্জা দেবার পক্ষে এর থেকে তাচ্ছিল্যের ভাষা আর হয় না। তিনি অস্ত্র নামিয়ে রাখবেন আর অন্যেরা তাঁকে মারবে—অর্থাৎ আমি যুদ্ধ করছি না, তাই তোরা পারলি, নইলে অসম্ভব ছিল আমাকে জেতা—এইটা বললেন ভীষ্ম। কৃষ্ণ, যুধিষ্ঠির, অর্জুন—এই কথাগুলি শ্রদ্ধা সহকারে হজম করবেন বলেই এই কথাগুলি শোনার জন্য এসেছেন। নইলে অর্জুনের বীরত্ব যেভাবে শত্রুদের মুখে, বিশেষত ভীষ্ম-দ্রোণের মুখেই প্রকাশিত হয়েছিল বারংবার, তাতে এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, অর্জুন ভীষ্মকে যুদ্ধে জয় করতে পারতেন না। তা ছাড়া শিখণ্ডীকে সামনে রেখে যুদ্ধ করলে ভীষ্ম তাকে অস্ত্রাঘাত করবেন না—এ কথা পাণ্ডবদের যথেষ্টই জানা ছিল। শিখণ্ডী যে ভীষ্মবধের জন্যই চিহ্নিত—এ কথা পাঞ্চাল দ্রুপদ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে জানতেন, সেখানে পাণ্ডবরা সেটা জানতেন না, তা হতেই পারে না।

আসলে এ এক ভিন্নতর মর্যাদাবোধ এবং মূল্যবোধ যাতে অর্জুনের মতো মহাবীরও যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের পাশে দাঁড়িয়ে ভীষ্মের মরণপূর্ব শেষ সাহংকার বীরবাক্য শুনবেন। ভীষ্ম বলবেন—স্ত্রীলোক অথবা স্ত্রী-নামধারী কোনও মানুষের ওপর অস্ত্রাঘাত করতে রুচি হয় না আমার। যেসব মানুষের একটা মাত্র ছেলে অথবা যার বংশে বাতি দিতে কেউ নেই, তেমন মানুষের ওপর অস্ত্র হানতে রুচি হয় না আমার। এইরকম অনেক বিকল্পের মধ্যে তিনি শিখণ্ডীরও ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু সেই ইঙ্গিত যদি না বোঝেন পাণ্ডবরা, তাই স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন—তোমরা তো জান—দ্রুপদের পুত্র বলে পরিচিত ওই শিখণ্ডী—সে যোদ্ধা বটে, যুদ্ধের উৎসাহও তার কম নেই। কিন্তু সে যেহেতু আগে স্ত্রী-ই ছিল এবং এখন তার পুংস্ত্ব যতই বিখ্যাত হোক, তাকে সামনে রেখে যুদ্ধ করুক অর্জুন, শরে শরে আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিক। আমি অস্ত্র তুলব না। এই একমাত্র পথ যাতে তোমাদের জয় হতে পারে, যুধিষ্ঠির! নইলে—ভেঙে যাবার মুখেও কুরুবৃদ্ধ পিতামহের শেষ সাহংকার ঘোষণা শোনা গেল—নইলে এ দুনিয়ায় এমন মানুষ নেই যে আমি খেপে উঠলে রুখতে পারে আমাকে—ন তং পশ্যামি লোকেষু যো মাং হন্যাৎ সমুদ্যতম্‌।

দুনিয়ার ওই বিশাল অক্ষম বীররাশির তালিকা থেকে ভীষ্ম কিন্তু সচেতনভাবে কৃষ্ণ এবং অর্জুনকে বাদ দিয়েছেন। অর্থাৎ এই দুজনের একজন ছাড়া অন্য কারও ক্ষমতা হবে না তাঁকে পরাস্ত করতে—ঋতে কৃষ্ণান্মহাভাগাৎ পাণ্ডবাদ্‌ বা ধনঞ্জয়াৎ। আমি আগেই বলেছিলাম—কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মহামতি ভীষ্মকে ভূমিশয্যায় শয়ান করাতে যে এত দেরি হল তার কারণ অর্জুনের অনীহা। তিনি ভাবতেই পারছিলেন না যে, কুরুবৃদ্ধ পিতামহকে তিনি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবেন। কৃষ্ণ দু-দুবার রথ থেকে নেমে গেলে তিনি কৃষ্ণের প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রক্ষার জন্য নিজে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, তিনি ভীষ্মকে মারবেন, কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা কাজে পরিণত করতে বিলম্ব হচ্ছিল। তিনি ভাবতে পারছিলেন না, ভীষ্মকে তিনি মারবেন।

ভীষ্ম নিজের বধোপায় বলে দেবার পর পাণ্ডবরা যখন সন্তুষ্ট মনে ফিরে আসছেন নিজের শিবিরে, তখন অর্জুন কৃষ্ণকে একান্তে ডেকে সখেদে বলেছেন—কী করে আমার এই ঠাকুরদাদাটির সঙ্গে এমন প্রাণঘাতী যুদ্ধ করি, বলো—পিতামহেন সংগ্রামে কথং যোৎস্যামি মাধব। অর্জুনের মনে পড়ল ছেলেবেলার কথা। পিতার মৃত্যুর পর মায়ের হাত ধরে পাঁচ ভাই পাণ্ডব হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে এসেছিলেন। সেই সেদিন থেকে শত প্রতিকূলতার মধ্যে যিনি অপার স্নেহে পাণ্ডব ভাইদের লালন করেছেন, তিনি এই ভীষ্ম। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন—ছোটবেলায় খেলা করতে করতে ধুলোমাখা গায়ে এই মহাপুরুষটির কোলে উঠে পড়তাম আমি। তাঁর সারা গা, কাপড়চোপড় সব ধুলোয় ভরে যেত—পাংশুরুষিতগাত্রেণ মহাত্মা পরুষীকৃতঃ। এই পিতামহের কোলে উঠে আমি কতবার যে তাকে বাবা বাবা বলে ডেকেছি। ঈষৎ লজ্জিত হয়ে বার বার আমার ভুল শুধরে দিয়ে আমার বুড়ো ঠাকুরদাদা বলতেন—আমি তোর বাবা নইরে, আমি তোর বাবারও বাবা—নাহং তাতস্তব পিতুস্তাতো’স্মি তব ভারত। অর্জুন সখেদে বললেন—আমার সেই স্নেহশীল ঠাকুরদাদাকে আমি কেমন করে মারব, কৃষ্ণ? তার থেকে আমার সৈন্যরা মারা যায় যাক, আমার জয় হোক, মৃত্যু হোক, যা হয় হোক আমি আমার দেবতা-সমান পিতামহের সঙ্গে যুদ্ধ করতে পারব না—নাহং যোৎস্যে মহাত্মনা।

হৃদয়ের সেই চিরকালীন দুর্বলতা যার জন্য অর্জুন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বেই বিকল হয়ে পড়েছিলেন। এই দুর্বলতার কারণেই তাঁকে আঠেরো অধ্যায় গীতা শুনতে হয়েছিল কৃষ্ণের কাছে। আমাদের মতে এই দুর্বলতা অতি স্বাভাবিক এবং মানবিক। কিন্তু সেকালের ক্ষত্রিয়ধর্ম এবং ন্যায়নীতির যে আদর্শ ছিল, তাতে এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠাটাই ছিল ধর্ম। কৃষ্ণ বুঝলেন যে, অর্জুনের মতো মহাবীর যদি এইভাবে ভেঙে পড়েন তো যুধিষ্ঠিরের যুদ্ধজয় অসম্ভব। তিনি তাই একটুও প্রশ্রয় দিলেন না অর্জুনের আবেগঘন ভাবালুতায়। কৃষ্ণ বললেন—এটা যুদ্ধক্ষেত্র, অর্জুন। এখানে প্রত্যাঘাতই তোমার ধর্ম। তুমি না প্রতিজ্ঞা করেছ সকলের সামনে, তা হলে এখন উলটো কথা বলছ কেন—প্রতিজ্ঞায় বধং জিষ্ণো…কথং নৈনং হনিষ্যসি।

কৃষ্ণ অর্জুনকে প্রত্যুদাহরণ দিয়ে বললেন—একথা মানি যে, ভীষ্ম তোমার গুরুস্থানীয়, তিনি বৃদ্ধ এবং তিনি সর্বগুণসমন্বিত মহাপুরুষ বটে। কিন্তু তিনিও তো তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন আততায়ীর মতো। তবে তাঁকে মারবে না কেন—আততায়িনম্‌ আয়ান্তং হন্যাদ্‌ ঘাতকমাত্মনঃ। তুমি এই যুদ্ধদুর্মদ ভীষ্মকে প্রথম সুযোগেই রথ থেকে নামিয়ে ভূলুণ্ঠিত করে ছাড়বে—পাতয়ৈনং রথাৎ পার্থ ক্ষত্রিয়ং যুদ্ধদুর্মদম্‌।

কৃষ্ণের কথা শুনে অর্জুন বুঝলেন যে, যুদ্ধ তাঁকে করতেই হবে এবং ভীষ্মেরও পতন ঘটাতে হবে একসময়। অর্জুন বললেন—তা হলে শিখণ্ডীই আমাদের শেষ অস্ত্র হোক। আগামী কাল শিখণ্ডীকে সামনে রেখে আমরা যুদ্ধ আরম্ভ করব। আর পিতামহ তো বললেনই যে শিখণ্ডীকে তিনি অস্ত্রাঘাত করবেন না, অতএব এই উপায়েই তাঁকে বধ করতে হবে—গাঙ্গেয়ং পাতয়িষ্যামি উপায়েনেতি মে মতিঃ।

আসলে শিখণ্ডী হলেন অর্জুনের যুদ্ধ-সাধন। ভীষ্ম বলেছেন—তিনি শিখণ্ডীর গায়ে অস্ত্রাঘাত করবেন না। আবার শিখণ্ডী তাঁর পূর্ব অপমানের প্রতিশোধ নিতে সাগ্রহে অপেক্ষা করছেন। ভীষ্মকে মারবার জন্যই তিনি পুরুষের বিদ্যা শিক্ষা করে যুদ্ধবেশে হাজির হয়েছেন কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে। কিন্তু তিনি অর্জুনের কত বড় উপকার করলেন অথবা উপকার করলেন ভীষ্মেরও—তা তিনি নিজেও জানেন না। লক্ষ করে দেখবেন, ভীষ্ম এবং দ্রোণ—এই দুজনের ওপরেই অর্জুনের গুরুবৎ মান্যতা ছিল এবং মান্যতার চেয়েও দুর্বলতা ছিল আরও অনেক বেশি। ঠিক সেই জন্যেই কৌরবপক্ষের এই দুই প্রধানকে যুদ্ধ থেকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে পাণ্ডবদের, বিশেষত অর্জুনের সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে—আঠেরো দিনের মধ্যে পনেরো দিন।

অন্যদিকে ভীষ্ম-দ্রোণেরও অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা সম্বন্ধে যে গৌরব ছিল, সেই গৌরবের চেয়েও এই মহাবীরের ওপর তাঁদের ছিল অপার দুর্বলতা। যার জন্য এঁরাও কোনওদিন দুর্যোধনকে সন্তুষ্ট করতে পারলেন না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে দুর্যোধন এঁদের সেনাপতি করেছেন, সেই গুরুভার পদে পদে লঙ্ঘিত হয়েছে অর্জুনের প্রতি তাঁদের মান্যতা এবং স্নেহে। এই মান্যতা, দুর্বলতা এবং স্নেহের মাঝখানে কার্যসাধনের উপায় হিসেবে কাজ করেছেন একত্র এক দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডী, অন্যত্র আর-এক দ্রুপদপুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন। ভীষ্মের সঙ্গে অর্জুনের শেষ যুদ্ধে শিখণ্ডী হলেন সেই সাধন, যেখানে অর্জুন প্রত্যক্ষভাবে পিতামহের গায়ে অস্ত্রাঘাত করছেন না, অথবা ভীষ্ম করছেন না অর্জুনের গায়ে। পৌত্র এবং পিতামহের মধ্যে যে পারস্পরিক মমতার বিশ্বাস, যা এই ভয়ংকর যুদ্ধে পিষ্ট এবং ধ্বস্ত হতে পারত, শিখণ্ডী সেই বিশ্বাসকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করলেন ভবিষ্যতের জন্য, আগামী পৃথিবীর পৌত্র-পিতামহের জন্য।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে দশম দিনের সূর্য আকাশে উদয় হবার সঙ্গে সঙ্গেই মৃদঙ্গ, ভেরী আর দুন্দুভি বেজে উঠল। আজকে পাণ্ডবসেনাদের সামনে দেখা গেল যুদ্ধবেশী শিখণ্ডীকে। এতদিন ধরে তিনি যুদ্ধ করেছেন কিন্তু আজকে যে প্রাধান্য তিনি লাভ করেছেন, সেই প্রাধান্য এতদিন তাঁর ছিল না। আজকে সেনা সাজানো হয়েছে তাঁরই ইচ্ছামতো, তিনি নিজেই ব্যূহ নির্মাণ করেছেন এবং সকল সেনার অগ্রভাগে তিনি চলেছেন নায়কের মতো—শিখণ্ডী সর্বসৈন্যানাং অগ্র আসীদ্‌ বিশাম্পতে।

অবশেষে সেই দিন এল, যেদিন শিখণ্ডীর সঙ্গে সোজাসুজি চক্ষু-বিনিময় হল ভীষ্মের। ভীষ্ম একবার তাঁর দিকে চোখ তুলেই নামিয়ে নিয়েছিলেন চোখ। তাঁর রাগও হল, হাসিও পেল—পুনর্নালোক ক্রুদ্ধঃ প্রহসন্নিদমব্রবীৎ। শিখণ্ডী ততক্ষণে তাঁর পূর্বোপচিত ক্রোধে ভীষ্মের বুকে তিনটি শর নিক্ষেপ করে ফেলেছেন। ভীষ্ম বললেন—তুমি আমার ওপর অস্ত্র প্রহার কর আর নাই কর, আমি কোনওভাবেই তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব না। কারণ বিধাতা তোমাকে যেমন স্ত্রী তৈরি করেছিলেন, আমার কাছে তুমি সেই স্ত্রী শিখণ্ডিনীই আছ—যৈব হি ত্বং কৃতা ধাত্রা সৈব হি ত্বং শিখণ্ডিনী।

ভীষ্ম এত সোজাসুজি কোনও দিন অম্বা-শিখণ্ডিনীর সঙ্গে কথা বলেননি। আজ বলছেন। তিনি বুঝেছেন, তাঁর শেষের দিন উপস্থিত। আর এই রমণীটি কত দিন অপেক্ষা করে আছে শুধু তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য, যে প্রতিহিংসার অন্তরে হয়তো আছে এমন এক অন্তর যা প্রকাশও করা যায় না, সহ্যও করা যায় না। ভীষ্মের কথা শুনে শিখণ্ডীর ক্রোধ আরও বেড়ে গেল। যাকে মারবার জন্য রমণীর রমণীয় লজ্জাভয় অতিক্রম করে তিনি পুরুষ সেজেছেন, তাঁকে এখনও সেই স্ত্রী সম্বোধন—সৈব হি ত্বং শিখণ্ডিনী! শিখণ্ডী সক্রোধে উত্তর দিলেন বটে, তবু তারই মধ্যে সম্ভাষণে, ভাষায়, সম্বোধনে প্রকট হয়ে উঠল এক রমণীর অন্তর। অম্বা-শিখণ্ডিনী বললেন—মহাবাহু! তুমি যে সমস্ত ক্ষত্রিয়ের কাছে কত ভয়ংকর, তা আমি জানি। স্বয়ং পরশুরামের সঙ্গে তোমার যে ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল, সে আমি শুনেওছি, দেখেওছি; সর্বত্র তোমার বীরত্বের প্রভাব যে কীরকম ছড়িয়ে পড়েছে, তাও আমার অজানা নয়—দৃষ্টশ্চ তে প্রভাবো’য়ং স ময়া বহুশঃ শ্রুতঃ। তবু এই সমস্ত কিছু জেনেও আজকে তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব আমি।

শিখণ্ডী ভীষ্মকে এবার সম্বোধন করলেন ‘পুরুষোত্তম’ বলে। বললেন, শ্রেষ্ঠ পুরুষ আমার! তুমি যুদ্ধ কর আর নাই কর, আজকে তুমি আমার হাত থেকে বাঁচবে না। আমার সেই সত্য প্রতিজ্ঞা থেকে আজকে আমি চুত হব না, তোমাকে আমি মারবই। বরঞ্চ মরার আগে এই জগৎটাকে আরও একবার ভাল করে দেখে নাও—সুদৃষ্টঃ ক্রিয়তাং ভীষ্মঃ লোকো’য়ং সমিতিঞ্জয়।

শিখণ্ডী-ভীষ্মের সংলাপ শেষ হওয়ামাত্রই অর্জুন বুঝলেন আর দেরি নয়। শিখণ্ডীকে ভীষ্মের প্রতি বাণ-মোক্ষণ করার আদেশ দিলেন অর্জুন, আর নিজে চললেন, ঠিক তাঁর পিছন পিছন। শিখণ্ডীর সঙ্গে একাধিকবার যুদ্ধ হয়েছে ভীষ্মের। প্রত্যেকবারই যোদ্ধাদের রথ-স্থিতিটা একইরকম। সামনে শিখণ্ডী, পিছনে অর্জুন, প্রতিপক্ষে ভীষ্ম। শিখণ্ডী ভীষ্মের বুকে বাণ-মোক্ষণ করেন, একইসঙ্গে পিছন থেকে অর্জুনও। আর অসহায় ভীষ্ম সামনাসামনি অস্ত্রত্যাগ না করে, কোনাকুনিভাবে পাণ্ডবদের সৈন্য শাতন করেন। এই বিচিত্র যুদ্ধচিত্র চলল অনেকক্ষণ। অর্জুন অনেকবার পিতামহ ভীষ্মের ধনুকটিকে ছেদন করলেন বলে, বার বার তাঁকে নতুন ধনুক তুলে নিয়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। ভীষ্মের একটু রাগও হল। তিনি এবার ধনুক ছেড়ে একটি মহাশক্তি নিক্ষেপ করলেন অর্জুনকে লক্ষ্য করে। অর্জুন কিন্তু আপন অস্ত্রকৌশলে সেই বীরঘাতিনী শক্তিটিকে লক্ষ্যে পৌঁছোবার আগেই কেটে ফেলতে সমর্থ হলেন।

এইবার ভীষ্মের ভাবনা হল। আজকে ন’দিন ধরে তাঁর সঙ্গে পাণ্ডবদের যুদ্ধ হচ্ছে। আজ যুদ্ধের দশম দিন। একবারের তরেও নিজেকে তিনি কোনও অংশে কম ভাবেননি। আর যুদ্ধ জিনিসটাও তাঁর বেশ পছন্দের বস্তু। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে একটি সামান্য ঘটনাকে উপলক্ষ করে তাঁর যেন মনে হল, আর নয়। কোনও দিন তাঁর অস্ত্র তো এইভাবে বিফল হয়নি। আজ কেন এমন হচ্ছে? ভীষ্ম ভাবলেন—এই কৃষ্ণ যদি পাণ্ডবদের রক্ষক না হতেন, তা হলে একটিমাত্র ধনুক দিয়েই তিনি সমস্ত পাণ্ডবদের বিনাশ করতে পারতেন।

কৃষ্ণ মানুষটির ব্যাপারে চিরকাল ভীষ্মের এক দুর্বলতা আছে। যখন কেউ তাঁকে মানতে পারেননি, সেই সময়েই কৃষ্ণকে তিনি চিনেছেন অলৌকিক দৃষ্টিতে। সে দৃষ্টির মধ্যে হয়তো ঈশ্বরভাব ছিল, যে কারণে অতি অল্প বয়সেই তাকে নতুন দিনের নায়ক হিসেবে মেনে নিতে তাঁর বাধেনি। সেই কোন কালে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে এই মানুষটিকে তিনি শ্রেষ্ঠ মানুষের মর্যাদায়, ভগবত্তার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আজকে যখন বহুতর রথী মহারথীরা চারদিক থেকে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে, অর্জুনের পুঞ্জ পুঞ্জ বাণ তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করছে, তখন এই একটি কথা তাঁর মনে হল—কৃষ্ণ। বৈষ্ণব দার্শনিকেরা এখানে ভীষ্মের পরম ভক্তি-মাহাত্ম্য স্থাপন করবেন, কিন্তু আমাদের বিচারে দেখতে পাই—একটি মানুষ যিনি এতদিন ধরে তার প্রিয় জগৎ দেখে দেখে আনন্দ লাভ করেছেন, সেই আনন্দের যেমন পূর্তিবোধ আছে, তেমনই এই জগতের দুঃখকষ্ট গ্লানি যত আছে তারও একটা সহ্যসীমা আছে। এই দুয়ে মিলেই মানুষের মনে বৈরাগ্য তৈরি করে, তৈরি করে নির্বিণ্ণতা।

ভীষ্ম অনেক দেখেছেন এই পৃথিবীতে। পিতা শান্তনুর সময় থেকে এখন পর্যন্ত। এর মধ্যে সুখ বা আনন্দ যত তাঁর ছিল, তারচেয়ে অনেক বেশি ছিল প্রাণধারণের গ্লানি আর কর্তব্যের নিরন্তর তাড়না। পিতা শান্তনু তার ভোগসুখ লাভ করেছেন, জননী সত্যবতী স্বামীসুখ, রাজ্যসুখ লাভ করে, যে তীব্র তাড়না নিয়ে বেঁচেছিলেন, তা হল নিজের পুত্রেরা যাতে হস্তিনার সিংহাসন লাভ করে। সিংহাসন তাঁরা লাভ করেছিলেন ঠিকই কিন্তু অকালে মারা গিয়ে তাঁরা সত্যবতীর যন্ত্রণা বাড়ালেন। যন্ত্রণা অতিরিক্ত বাড়ার আগেই ব্যাসের পরামর্শে তিনি বাণপ্রস্থ অবলম্বন করেছিলেন। এই অবস্থায় ভীষ্ম কুরুবাড়িতে টিকেছিলেন শুধু কর্তব্যের তাড়নায়। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু মানুষ হবার পরেও তাঁর খুব বেশি দুঃখ ছিল না। কিন্তু পাণ্ডু মারা যাবার পর থেকেই হস্তিনায় যে পরিস্থিতি তৈরি হল, তাতে এই কুরুবৃদ্ধ পিতামহের অস্বস্তি এবং মনের কষ্ট শুধু বাড়তেই থাকল।

মাঝখানে বেশ খানিকটা নির্বিণ্ণ হয়েই কুরুবাড়ির সংসারে বাস করছিলেন তিনি। কিন্তু ভয়ংকর জ্ঞাতিযুদ্ধ, কুলক্ষয়—যা তাঁর সবচেয়ে অপ্রিয় বস্তু ছিল, সেই অপ্রিয় ঘটনার মধ্যে তাঁকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে পড়তে হল পরিস্থিতির চাপে। পিতার আশীর্বাদে ভীষ্ম ইচ্ছামৃত্যু, কাজেই অন্যের অবধ্য—স্বচ্ছন্দমরণং দত্তমবধ্যত্বং রণে তথা। কিন্তু দিন দিন প্রতিদিন জীবনযন্ত্রণার চাপে ভীষ্ম এখন শ্রান্ত, ক্লান্ত, বিষণ্ণ, নির্বিণ্ণ। তিনি এখন ভূমিতে শয়ন করতে চান, বিশ্রাম চান। কৌরবদের বৃত্তি-ঋণ মেটানোর জন্য তথা দুর্যোধনের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যতটুকু তাঁর করণীয় ছিল, তা করা হয়ে গেছে। তিনি পাণ্ডবদের কোনওভাবেই বধ করবেন না, অন্যদিকে তপস্বিনী অম্বা-শিখণ্ডিনীর যৌবনের ঋণও তাকে চুকোতে হবে—অবধ্যত্বাচ্চ পাণ্ডূনাং স্ত্রীভাবাচ্চ শিখণ্ডিনঃ। ভীষ্ম তাঁর শেষ বাসরের শয্যাগ্রহণ করতে চান শিখণ্ডীর পুষ্পবাণ সমস্ত অঙ্গে অঙ্গে ধারণ করে—তস্মান্মৃত্যুম্‌ অহং মন্যে প্রাপ্তকালমিবাত্মনঃ।

‘পুষ্পবাণ’ শব্দটি যতই দ্ব্যর্থকভাবে প্রয়োগ করে থাকি না কেন, এ বাবদে কী অদ্ভুত মহাভারতের কবির সংযম! ভীষ্ম যেহেতু সারা জীবনে তাঁর ব্রহ্মচর্যের ব্রত থেকে চ্যুত হননি, অতএব একবারের তরেও তিনি সোচ্চারে বলবেন না যে, অম্বা-শিখণ্ডিনী গভীর অন্তরে ভালবাসতেন ভীষ্মকে অথবা ভীষ্ম অম্বা-শিখণ্ডিনীকে। তাঁদের আপাত ক্রোধ, পারস্পরিক দর্শনানীহা, ঘৃণা—সবই তিনি খুব ভাল করে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু সেই আপাত বর্ণনার অন্তর থেকে বেরিয়ে আসে অদ্ভুত এক অনুভূতি, যার সঙ্গে শত বসন্ত অতীত করা বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস জড়ানো আছে।

মহাভারতের কবির কৌশল কত! শিখণ্ডীকে অগ্রবর্তী করে অর্জুন ভীষ্মের সঙ্গে শেয যুদ্ধ করবার জন্য এগোচ্ছিলেন। পাণ্ডবদের অনেক সৈন্য শাতন করে, চারপাশের অনেক রথীর আঘাত সহ্য করে ভীষ্ম এখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছেন নিজেকে। এই অবস্থায় শিখণ্ডী অনেকগুলি শর-প্রহার করলেন ভীষ্মকে। মহাভারতের কবি মন্তব্য করলেন—ভূমিকম্পের সময় পর্বত যেমন বিচলিত হয় না, তেমনই শিখণ্ডীর বাণে ভীষ্মও বিচলিত হলেন না একটুও—নাকম্পত মহারাজ ক্ষিতিকম্পে যথাচলঃ।

আপাতত শুনলে মনে হবে যেন বহু যুদ্ধের নায়ক ভীষ্ম শিখণ্ডীর বাণে একটুও কাতর হলেন না এবং তা যেন ভীষ্মের বীরত্ব এবং সমর-সহিষ্ণুতার ফল। কিন্তু এই আপাত বহির্ভাবটুকুই বোধ হয় সব নয়। লক্ষ করে দেখুন, শিখণ্ডীর পরেই তাঁর পিছন থেকে ভীষ্মের ওপরে বাণবর্ষণ করলেন অর্জুন। ভীষ্ম আপন অস্ত্রকৌশলে যথাসম্ভব আত্মরক্ষা করার চেষ্টা করতে লাগলেন বটে কিন্তু ততক্ষণে শিখণ্ডীর বাণ এসে পড়ছে ভীষ্মের ওপর। মহাভারতের কবি আবারও মন্তব্য করে বললেন—শিখণ্ডীর স্বর্ণমুখ শিলায়-শান-দেওয়া বাণগুলিতে অবশ্য ভীষ্মের তেমন কোনও কষ্ট হচ্ছিল না—ন চক্রুস্তে রুজং তস্য রুক্মপুঙ্খাঃ শিলাশিতাঃ।

কোন মহারথী যোদ্ধা এমন করেন? শত্রুর বুকে বেঁধানোর জন্য আপনার লৌহমুখ বাণগুলিকে সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে রাখেন? শিখণ্ডী রেখেছেন আর ভীষ্মের তাতে ব্যথা লাগছে না। বলতে পারেন—শিখণ্ডী তেমন শক্তিশালী যোদ্ধা নন, সেইজন্যই তাঁর বাণাঘাতে তেমন জর্জরিত নন ভীষ্ম। কিন্তু কেমন করে এ কথা বলি? এই কিছুক্ষণ আগে পাণ্ডবদের যোদ্ধা নায়কদের মধ্যে যাঁরা ‘রথ-অতিরথ’ আছেন, তাদের চিহ্নিত করার সময়ে ভীষ্ম নিজের মুখে শিখণ্ডীকে ‘মহারথ’ যোদ্ধা বলে স্বীকার করেছেন। আর এখন তাঁর বাণাঘাতে কোনও ব্যথা লাগছে না ভীষ্মের। এও কি বিশ্বাস্য কথা?

শিখণ্ডীকে অগ্ররথে স্থাপন করে অর্জুনের অস্ত্রবর্ষণ চলতে লাগল। দুর্যোধনের ভাই দুঃশাসন ভীষ্মের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন অসহায় বালকের মতো, প্রায় দর্শকের ভূমিকায়। ভীষ্ম অর্জুনের প্রশংসা করে বললেন—অর্জুন যেমন যুদ্ধ করছেন, তাতে স্বর্গের ইন্দ্রও যদি বজ্র হাতে নেমে আসেন ভুঁয়ে, তবু তাঁর এমন সাধ্য নেই যে, অর্জুনকে আটকে রাখতে পারবেন। ঠিক এই সময়ে যখন শিখণ্ডীও বাণমুক্ত করছেন এবং অর্জুনও বাণ-মোক্ষণ করছেন—ঠিক এই সময়ে যুগপৎ দুই বীরের বাণাঘাতে বিদীর্ণ হতে হতেও ভীষ্ম হাসিমুখে পাশে দাঁড়ানো দুঃশাসনকে বুঝিয়ে বললেন—এই যে পর পর ছুটে আসা বাণগুলো, যার আঘাত বজ্র এবং বিদ্যুতের সমান—এই বাণগুলো সব অর্জুনের। শিখণ্ডীর নয়, কোনও মতেই—নেমে বাণাঃ শিখণ্ডিনঃ। এই যে বাণগুলো সব আমার লোহার বর্ম ভেদ করে একেবারে মর্মে এসে লাগছে, এই বাণগুলো সব অর্জুনের। শিখণ্ডীর নয়, কোনও মতেই—নেমে বাণাঃ শিখণ্ডিনঃ।

অন্তত ছ’টি শ্লোকে ভীষ্ম একই কথা বলে গেলেন—এই বাণগুলি অর্জুনের। শিখণ্ডীর নয় কোনও মতেই। সন্দেহ থাকতে পারে না যে, বারংবার একই ধরনের কথা বলে অর্জুনের অস্ত্রভেদ-ক্ষমতার প্রশংসা করছেন ভীষ্ম। কিন্তু উলটো দিকে এই পৌনঃপুনিক প্রশংসায় এই কথাই কি প্রমাণ হয় না যে—এমন কঠিন বাণ অন্তত শিখণ্ডী মারতে পারেন না ভীষ্মের বুকে। কারণ যাই হোক। হতেই পারে এ তাঁর অক্ষমতা এবং সে অক্ষমতা যদি স্ত্রীজনোচিত হয়, তবে সে অক্ষমতাকে স্ত্রীজনোচিত মায়ামমতা বলতেই বা দোষ কী। মনটা যদি সামান্য উদার হয় এবং তাঁরা যদি অতীতে অম্বা-শিখণ্ডিনী অন্তঃপাতী হৃদয়টুকু সমান হৃদয় দিয়ে বুঝে থাকেন, তবে বুঝবেন—এই বাণমোক্ষণের মধ্যেই মহাভারতের কবির এক কোমল ইঙ্গিত আছে। শিখণ্ডীর সোনামুখী বাণে ভীষ্মের কোনও কষ্টই হয় না এবং অর্জুনের মতো মর্মঘাতী কঠিন বাণ তিনি মুক্তও করতে পারেন না—এই কথাগুলির মধ্যে শিখণ্ডীর অদক্ষতার প্রমাণ যতটুকুই থাকুক, তারমধ্যে অম্বা-শিখণ্ডিনীর স্ত্রী-হৃদয়ও ততটাই আছে।

লক্ষ করে দেখবেন—এরপরেই অর্জুনের কঠিন বাণে শরবিদ্ধ কুরুবৃদ্ধ পিতামহ আপন অভ্যস্ত যুদ্ধরথ থেকে লুটিয়ে পড়বেন ভূমিতে। তারপরেই পাণ্ডবপক্ষে জনে জনে সিংহনাদ শোনা যাবে, কৌরবপক্ষে শোনা যাবে বিষণ্ণ ক্রন্দনধ্বনি। কিন্তু এই বিরাট যুদ্ধক্ষেত্রে কোথাও এরপর শিখণ্ডীর নাম শুনতে পাবেন না আপনারা। তাঁর সুখ হল, না দুঃখ হল, তাঁর ক্রোধশান্তি হল, নাকি বৈরাগ্য হল কোনও খবরই আর মহাভারতের কবির কাছে পাব না। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটা উচিত ছিল? যে অম্বা ভীষ্মের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য নিজের স্ত্রীভাব ত্যাগ করে পুরুষের বিদ্যা-বেশ অভ্যাস করেছিলেন, ভীষ্মের শরশয্যা গ্রহণে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া হবে না? আমরা জানি, প্রতিক্রিয়া নিশ্চয়ই হয়েছে, কিন্তু মহাভারতের কবির মুখে তা একবারও উচ্চারিত হবে না। হবে না, তার কারণ এই যে, মহাকবি কুরুবংশীয় মহাবীরদের বীরত্বগাথা গাইতে বসেছেন। শরশয্যায় শুয়ে যে মহাবীরের নীচ-লম্বিত মস্তকটি স্বস্থানে স্থাপন করার জন্য মস্তকের নীচে আরও একটি শরস্থাপনের প্রয়োজন হয়, সেই মহাবীরের শেষ অবস্থা বর্ণনা করার জন্য মহাকাব্যের কবি অন্তত অম্বা-শিখণ্ডিনীর উপরুদ্ধ ক্রন্দনধ্বনি শোনাবেন না। অতএব শিখণ্ডিনী কী অবস্থায় রইলেন, তা অব্যক্ত থাকল আমাদের কাছে। কুরুবৃদ্ধ পিতামহ দশ দিন অসাধারণ যুদ্ধ করে শরশয্যায় শুয়ে পড়লেন, কিন্তু প্রাণত্যাগ করলেন না।

কতকাল আগে অম্বা-শিখণ্ডিনীর উপরোধে পড়ে ক্ষত্রিয়ান্তক পরশুরামও যাঁকে পরাভূত করতে পারেননি, তিনি মারা গেলেন শিখণ্ডীর হাতেই, ভাগ্যের কী বিচিত্র পরিহাস! আপাতদৃষ্টিতে এরমধ্যে আশ্চর্য কিছু নেই। একজন অস্ত্রপ্রহার করছেন না, অন্যজন করছেন। এমন অবস্থায় একসময় যে শরবিদ্ধ ব্যক্তির পতন ঘটবে, এ তো সম্পূর্ণই নিশ্চিত। আসলে শিখণ্ডী হলেন মহাভারতের কবির এক অসামান্য সৃষ্টি। কত দিক দিয়ে যে তিনি মহাকবির স্বার্থ রক্ষা করেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। অর্জুন আর ভীষ্মের মধ্যে যে স্নেহ-গৌরবের সম্বন্ধ ছিল, যুদ্ধের সময়ে শিখণ্ডী যেমন সেই সম্বন্ধের আবরণ-স্বরূপ হয়ে উঠেছিলেন, সেইরকমই শিখণ্ডী হলেন ভীষ্মের জীবনে প্রকৃতির প্রতিশোধ-স্বরূপ।

জননী সত্যবতীর কারণে এবং হয়তো বা পিতার ওপর অভিমানে ভীষ্ম যে কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তা শুধু তাকেই ধ্বংস করেনি, প্রসিদ্ধ ভরতবংশের প্রধান শাখাটিকেই তা ধ্বংস করে দিয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কী, সত্যরক্ষা যত বড় ধর্মই হোক, সেই সত্যরক্ষা যদি শুষ্ক-স্বাধীন এক নিয়মতন্ত্রে পরিণত হয় এবং তা যদি জগতের কল্যাণসাধন না করে, তবে তা বর্জনীয়ই হয়ে ওঠে। সেকথা মহাভারতের কবি বহু উদাহরণ প্রত্যুদাহরণের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন অন্যত্র। বিশেষত মহাভারতে যিনি সত্যধর্মের প্রতীক বলে চিহ্নিত, সেই যুধিষ্ঠিরের জীবনের নানা সমস্যায় এই সত্য বার বার উচ্চারিত হয়েছে, উচ্চারিত হয়েছে মহামতি কৃষ্ণের শতাধিক পরামর্শে। দেখা গেছে, উত্তম কার্যের অনুরোধে, বৃহত্তর স্বার্থে এবং মানবকল্যাণের জন্য ব্যক্তিগত সত্যের সামান্য চ্যুতিও মহান ধর্ম বলে গণ্য হয়েছে। আমরা যুধিষ্ঠিরের মতো ব্যক্তিকেও কুত্রাপি বৃহত্তর স্বার্থে সামান্য নমনীয় দেখেছি, কিন্তু ভীষ্মকে দেখিনি।

সত্যিই তো, সত্যবতীর বিবাহ এবং তাঁর স্বার্থরক্ষার জন্য দাসরাজা যে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন ভীষ্মকে দিয়ে, তার কোনও তাৎপর্যই রইল না যখন সত্যবতীর গর্ভজাত শান্তনুর দুটি পুত্রই মারা গেলেন। সত্যবতী নিজেও একথা বুঝেছিলেন বলেই ভীষ্মকে বারবার বিবাহের জন্য অনুরোধ করেন। এবং সিংহাসনে বসার জন্যও। ভীষ্ম শোনেননি এবং সেই না-শোনাটা প্রায় গোঁয়ার্তুমির পর্যায়ে চলে গেছে। ঠিক এইরকম একটা পরিস্থিতিতে মহাভারতের কবি কাশীরাজকন্যা অম্বাকে ভীষ্মের জীবনে নিয়ে এসেছিলেন প্রায় নিয়তির মতো। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল শাল্বরাজার অম্বা-প্রত্যাখ্যানে, যাতে তিনি বিবাহ করতে বাধ্য হন জ্যেষ্ঠা কাশীরাজনন্দিনীকে। ভীষ্ম শোনেননি। অম্বার অনুরোধ অনুনয়ও শোনেননি, গুরু পরশুরামের উপরোধ অস্ত্রাঘাতেও অবিচল থেকেছেন। এর ফল কী হল? বিবাহ না করে, সিংহাসনে না বসে ভীষ্ম যে অনমনীয়তার সৃষ্টি করলেন, তার ফলে প্রসিদ্ধ ভরতবংশে অযোগ্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ঘটল। ঘটল ছলনা বঞ্চনা এবং শুধুমাত্র সত্যরক্ষার অভিমানে ভীষ্ম রাজার মতো ব্যক্তিত্বে সেসব ছলনা বঞ্চনা রোধও করলেন না, তিনি বিশ্বস্ত রাজকর্মচারী হয়ে শুধু বেঁচে রইলেন প্রসিদ্ধ এক রাজবংশের ধ্বংস দেখবার জন্য।

সত্যরক্ষার প্রতি ভীষ্মের এই অবুঝ অনমনীয়তার বিপ্রতীপ ভূমিতে অম্বা-শিখণ্ডিনী দাঁড়িয়ে আছেন ভীষ্মের প্রকৃতির প্রতিশোধ নেবার জন্য। অম্বাকে যেদিন ভীষ্ম প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, সেদিন তিনি সুসময়ে স্বয়মাগতা স্বাভাবিক প্রকৃতিকেই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সে পলে পলে প্রতিশোধ নেবার জন্য তৈরি হয়েছে, পলে পলে সে নিজেকেও তৈরি করেছে চরম প্রতিশোধ নেবার জন্য। বাহ্যত ভীষ্ম যতই ঘৃণা প্রদর্শন করুন, যতই অরুচি প্রদর্শন করুন স্ত্রীশরীরে অস্ত্রাঘাত করব না বলে—জীবনে একটা সময় আসে, যখন প্রকৃতি নিজেই অস্ত্র তুলে নেয় হাতে। অম্বা-শিখণ্ডিনীর রূপ ধরে সে যখন অস্ত্রবর্ষণ করতে থাকে, ভীষ্মকে তখন চোখ ঘুরিয়ে তেরছা চোখে অন্যদিকে অস্ত্রবর্ষণ করতে হয়। নিজের অপরাধেই সে দিকে আর প্রতি-অস্ত্রের আঘাত করা যায় না। উন্মুক্ত রেখে দিতে হয় নিজের বুকখানি, যেখানে প্রকৃতির শরবর্ষণ চলে অবিরাম, স্বেচ্ছায়, অবিরোধে মেনে নিতে হয় প্রকৃতির শেষ প্রতিশোধ, পরিণাম। অম্বা-শিখণ্ডিনী আসলে ভীষ্মের অনমনীয়তার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি। ভীষ্মও সারাজীবন তাঁর ভয়ে ভয়ে থাকেন আর সে বাড়তে থাকে আপন অস্ত্রে সজ্জিতা হয়ে। অবশেষে এই পরিণাম। শত শত অস্ত্রে বিদ্ধ হয়ে, সংসারের শত জ্বালায় দীর্ণ হয়ে তিনি শরশয্যায় লুণ্ঠিত হয়েও বেঁচে থাকেন বংশের সম্পূর্ণ ধ্বংস দেখবার জন্য। তার সত্যরক্ষার প্রতিজ্ঞায় খুশি হয়ে পিতা যে তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিয়েছেন। তিনি মরতে পারেন না, সম্পূর্ণ না দেখে তাঁর মরবারও উপায় নেই। একে প্রকৃতির পরিহাস ছাড়া কী বলব?

লক্ষ করে দেখুন, সম্পূর্ণ কুরুবংশ ধ্বংস হয়ে যাবার পর হস্তিনাপুরের সিংহাসনে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের রাজ্যপ্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু রাজা হলে কী হবে, রাজনীতির তিনি কিছুই জানেন না। কৃষ্ণ তাঁকে বললেন—রাজনীতি শিখতে হবে ভীষ্মের কাছ থেকে।

ভীষ্মের শরশয্যাগ্রহণের মানে হল—কুরুবংশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাপুঞ্জের ভূমিশয্যাগ্রহণ। এতদিন যে মহীরুহ শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে হস্তিনার ভূমিখণ্ডের ওপর ছায়া ফেলে দাঁড়িয়েছিল, সেই মহীরুহের পতন ঘটল ভীষ্মের পতনে। মহাভারতের কবি প্রতীকীভাবে লিখেছেন—সমস্ত আকাশ ভরে গেল অন্ধকারে, সহস্ররশ্মি সূর্য একেবারে নিষ্প্রভ হয়ে পড়লেন—খং তমঃসংবৃতং হ্যাসীদ্‌ আসীদ্‌ ভানুর্গতপ্রভঃ। কৌরবপক্ষের সমস্ত সৈন্যবাহিনী সেনাপতির পতনে নিস্তেজ হয়ে পড়ল। ভীষ্মের পতনে পাণ্ডবপক্ষে দু-চারবার তূর্যধ্বনি-শঙ্খনাদ হল বটে, অতিসরল ভীমসেন দু-একবার জয়ানন্দে নেচেও নিলেন বটে—আক্রীড়মানং কৌন্তেয়ম্‌—কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পাণ্ডব-কৌরব—দুই যুদ্ধবাহিনীর মধ্যেই অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা নেমে এল, নেমে এল শোকাচ্ছন্ন পরিবেশ।

দুর্যোধন-কর্ণ একান্তে দীর্ঘনিশ্বাস মুক্ত করছিলেন। দুঃশাসন ঘোড়া থেকে নেমে ছুটে চললেন দ্রোণাচার্যকে খবর দিতে। তিনি দূরে যুদ্ধ করছিলেন, সেখানকার সৈন্যরা জানেও না যে, সেনাপতির পতন ঘটেছে। দুঃশাসনের মুখে এই নিষ্ঠুর খবর শুনে দ্ৰোণ প্রায় অজ্ঞানের মতো হয়ে গেলেন। তার এতকালের বন্ধু, তাঁর নিয়োগকর্তা, তাঁর এতকালের বৃত্তিদাতা। রাগ হলেই কৌরবদের তিনি বলতেন—আমি তোদের খাই না, পরি না। আমি ভীষ্মের দেওয়া বৃত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করি। সেই ভীষ্মের পতন ঘটেছে। দ্রোণাচার্য শোকে আকুল হলেন। সংজ্ঞালাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে সেনাদের ফিরে যেতে বললেন শিবিরে।

দুই পক্ষের সৈন্যই একসময় প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পারল এবং সেই ভয়ংকর স্তব্ধ শোকাচ্ছন্ন পরিবেশের মধ্যে পাণ্ডব-কৌরব সকলেই বুকে-আঁটা ভারি যুদ্ধবর্মটি নামিয়ে রেখেই একত্রে ঘিরে ধরলেন ভীষ্মকে। শরশয্যায় শুয়েও কোনওমতে হাত জোড় করে ভীষ্ম অভিবাদন জানালেন কুরুদের এবং পাণ্ডবদের। বললেন—তোমরা সকলে এসেছ। বড় ভাল লাগছে তোমাদের দেখে—তুষ্যামি দর্শনাচ্চাহং…স্বাগতং বো মহারথাঃ। ভীষ্মের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। শিখণ্ডী আর অর্জুনের শত শত বাণ তাঁর শরীরে। শরের শয্যায় শুয়ে থাকা ভীষ্মের পা থেকে পৃষ্ঠ অবধি শরবিদ্ধ, শুধু মাথাটি বাদ গেছে। মাথায় শিরস্ত্রাণ থাকার জন্যই হোক, অথবা উষ্ণীষের কারণে, অথবা শিখণ্ডী-অর্জুন তাঁর মস্তকে কোনও আঘাত করেননি বলেই হোক, সারা শরীরের ইতস্তত বিদ্ধ শররাশি মোটামুটি সমভাবেই তাঁর শরশয্যা রচনা করেছিল, কিন্তু মাথায় কোনও শর না থাকায় মাথাটি লম্বমান অবস্থায় ঝুলছিল। দেহের সঙ্গে মস্তকের এই বিষমতায় বড় কষ্ট হচ্ছিল বৃদ্ধের।

পাণ্ডব-কৌরব সমস্ত পৌত্রদের একত্রে দেখে বৃদ্ধ পিতামহ বললেন—আমার মাথাটা কেমন ঝুলছে, অন্তত একটা বালিশের ব্যবস্থা কর ভাই—শিরো মে লম্বতে’ত্যর্থম্‌ উপাধানং প্রদীয়তাম্‌। কথা শুনে—সকলে ছুটল। মরণকালে বৃদ্ধের যন্ত্রণা মোচন করতে সূক্ষ্ম কোমল তুলোর বালিশ নিয়ে হাজির হলেন অনেকেই। বালিশ দেখে সামান্য উপহাসের ভঙ্গিতেই জবাব দিলেন ভীষ্ম। এই অবস্থাতেও তাঁর আত্মসচেতনতা কম নেই। বললেন—আমি বীরের শয্যায় শুয়ে আছি মহান ক্ষত্রিয়ের মতো। এমন শয্যায় কী মৃদু-কোমল তুলোর বালিশ মানায়—নৈতানি বীরশয্যাসু যুক্তরূপাণি পার্থিবাঃ। ভীষ্ম অর্জুনকে দেখে তাঁকে কাছে ডেকে বললেন—দেখো তো বাছা, কেমন ঝুলছে আমার মাথাটা। তুমি একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা করো। বীরোচিত শরশয্যায় শুয়ে আছেন ভীষ্ম। একটি বাণও তাঁর পৃষ্ঠদেশ দিয়ে প্রবেশ করেনি। সমস্ত বাণই প্রবেশ করেছে শরীরের সম্মুখভাগ দিয়ে এবং তার বহুলতা এতই যে, তাঁর শরীর এখনও ভূমি স্পর্শ করেনি। তিনি এই বীরশয্যার উপযুক্ত উপাধান চান। সমান-হৃদয় বীর হিসেবে অর্জুন বুঝেছেন—কেমন বালিশ দিতে হবে পিতামহের মাথায়।

অর্জুন কেঁদে আকুল হচ্ছেন। শিখণ্ডীর বাণ নয়, অর্জুনের কঠিন শরবর্ষণেই আজ পিতামহের এই দশা। শিখণ্ডীর কারণে পিতামহ তাঁকে প্রায় প্রত্যাখ্যানই করেননি। অতএব বিশাল ঔদার্যময় মহাবীরের এই পতনে তিনি কেঁদে আকুল হচ্ছেন—নেত্রাভ্যাম অশ্রুপূর্ণাভ্যাম্‌ ইদং বচনমব্রবীৎ। অর্জুন যে শিখণ্ডীর পিছন থেকে যুদ্ধ করেই পিতামহকে জিতেছেন, এই নীচতাটুকু স্বীকার করে নিয়েই তিনি ভীষ্মের গৌরব অতিশয়িত করে বললেন— আপনি আজ্ঞা করুন, কুরুশ্রেষ্ঠ! সমস্ত অস্ত্রধারী বীরদের মধ্যে আপনার মতো আর কে আছে—আজ্ঞাপয় কুরুশ্রেষ্ঠ সর্বশস্ত্রভৃতং বরঃ—আমি আপনার ভৃত্য, আজ্ঞা করুন আমাকে কী প্রয়োজন? পিতামহ আবারও তাঁর লম্বমান মস্তকটি দেখিয়ে বললেন—আমার এই বীরশয্যার উপযুক্ত একটি উপাধান দাও আমাকে।

অর্জুন গাণ্ডীবে অস্ত্রযোজনা করে ভীষ্মের মাথার তলায় তিনটি বাণ মেরে তাঁর মাথাটি শরীরের সমানুপাতে শুইয়ে দিলেন। ত্রিভিস্তীক্ষ্ণৈ-র্মহাবেগৈরন্বগৃহ্নাচ্ছিরঃ শরৈঃ। ভীষ্ম ভারী খুশি হলেন। অন্যদের বোঝাতে চাইলেন—মহাবীরের অভিপ্রায় মহাবীরই শুধু বোঝে। ভীষ্ম বললেন—এই ভাল হয়েছে। এই শরশয্যায় শুয়ে এখন আমি নিশ্চিন্তে সূর্যের উপাসনা করব। আরও বললেন—আমার চিরকালীন বাসস্থানের সামনে একটি পরিখা নির্মাণ করে দাও। সেইখানে এমন শরশয্যায় শুয়ে আমি সূর্যের দক্ষিণায়নের অপেক্ষা করব, সূর্যের তপস্যা করব—উপাসিয্যে বিবস্বন্তমেবং শরশতাচিতঃ।

ভীষ্মকে শরকণ্টক থেকে মুক্ত করে তাঁর ক্ষতস্থানে ওষধির প্রলেপ বুলিয়ে দেবার জন্য বৈদ্যরা এসেছিলেন। তাঁরা প্রত্যাখ্যাত হলেন। ভীষ্ম দুর্যোধনকে আদেশ দিলেন—বৈদ্যদের আগমন-দক্ষিণা দিয়ে সসম্মানে বিদায় করো। আমার যে অবস্থা হয়েছে, তাতে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনুযায়ী এই শরাঘাতের দহনযন্ত্রণা সহ্য করাটাই আমার ধর্ম—এভিরেব শরৈশ্চাহং দগ্ধব্যো’স্মি নরাধিপাঃ—আমি দগ্ধ হতেই চাই। কৌরব-পাণ্ডব এবং সমবেত অন্যন্য রাজারা ভীষ্মের এই ব্যবহারে একেবারে অবাক হয়ে গেলেন। ক্ষত্রিয়ের বীরোচিত ধর্ম এবং তার পালনীয়তা সম্বন্ধে এঁদের জ্ঞান কম নেই। কিন্তু বাস্তবেও কেউ যে এমন কঠিনভাবে ক্ষত্রিয় ধর্ম পালন করতে পারেন তা ভীষ্মকে না দেখলে তাঁরা বুঝতেন না। সেই কবে সিংহাসনে বসবেন না, বিবাহ করবেন না—ইত্যাদি বলে ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞা-রক্ষার ধর্মে উত্তরিত হয়েছিলেন, আজ এই শেষের বেলাতেও সেই ধর্ম একইভাবে আচরিত। শরশয্যায় শুয়ে ভীষ্ম যত আত্মতৃপ্তি লাভ করেছেন, তা বুঝি সিংহাসনে বসলে হত না। শর-ক্ষতের এই দহন তাঁকে রাজধর্মের চরম সিদ্ধি দান করেছে, তিনি সম্মুখসমরে ভূলুণ্ঠিত হয়েছেন। তিনি দহন সহ্য করতে থাকবেন। পাণ্ডব-কৌরবরা শরশয্যায় শয়ান ভীষ্মের সুরক্ষা বিধান করে একে একে শিবিরে ফিরে গেলেন। নক্ষত্রখচিত রাত্রিতে উন্মুক্ত আকাশের নীচে শরবিদ্ধ একটি শরীরের সঙ্গে একটি বিশাল হৃদয়ও পড়ে রইল শরবিদ্ধ জীবনের শত শত দহন রোমন্থন করার জন্য।

পরের দিন সকাল হতেই হস্তিনায় সমাগত ক্ষত্রিয়েরা সব আবারও এলেন ভীষ্মকে দেখবার জন্য। রাজবাড়ির মেয়েরা চন্দনের গুঁড়ো ছিটিয়ে, খই ছিটিয়ে ক্ষত্রিয়বীরের সংবর্ধনা জানালেন ভীষ্মকে—কন্যাশ্চন্দনচূর্ণৈশ্চ লাজৈর্মাল্যৈশ্চ সর্বশঃ। পৌর-জানপদ আবালবৃদ্ধবনিতা খবর পেয়ে দেখতে এলেন ক্ষত্রিয়বীরের আদর্শ বিশ্রাম কেমন হয়। কিছু কৌতূহলী প্রেক্ষকও দাঁড়িয়ে গেল সদ্যখনিত পরিখার চার ধারে—তারা শুধুই সালস্যে দেখে, কিছুই করে না—স্ত্রিয়ো বৃদ্ধাস্তথা বালং প্রেক্ষাকাশ্চ পৃথগ্‌জনাঃ।

ভীষ্মের পতনে সেদিনকার যুদ্ধ আরম্ভ হতে দেরি হল। পাণ্ডব-কৌরবরা সকলে অস্ত্রবর্মহীন অবস্থায় পিতামহকে দেখতে এলেন সকালবেলায়। চরম প্রতিপক্ষ হলেও এখন তাঁরা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছেন, সমবয়সিরা একত্রে আগের মতো প্রীতিযুক্ত সম্ভাষণ করছেন পরস্পরকে—অন্যোন্যং প্রতিমন্তস্তে যথাপূর্বং যথাবয়ঃ। মহান মৃত্যু পারস্পরিক বিসংবাদ ভুলিয়ে কাছে এনে দেয় শত্রুকেও। ভীষ্মকে দেখে বোঝা যাচ্ছে, তিনি অশেষ যন্ত্রণা সহ্য করছেন। দশ দিনের যুদ্ধের পরিশ্রম, তার ওপরে এই শর-দহন, তৃষ্ণায় তাঁর কণ্ঠতালু শুষ্কপ্রায়। তিনি জল খেতে চাইলেন।

রাজারা একসঙ্গে পৃথক পৃথক আধারে ভরে নিয়ে এলেন শীতল সুগন্ধী জল। ভীষ্ম বললেন—এই জল কি আমার জন্য? মানুষের যা ভোগ্য, তাই কি আর আমার যোগ্য হতে পারে? এই শরশয্যায় শয়নের পর থেকেই আমি এই মর্ত মানুষের রীতিনীতির বাইরে চলে গেছি—অপক্রান্তো মনুষ্যেভ্যঃ শরশয্যাং গতো হ্যহম্। সত্যিই তো, ভীষ্ম এমন শরবিদ্ধ হস্তপদে, মনোহর উদকুম্ভের জল পান করবেন কী করে? রাজারা আবার জলের সঙ্গে খাবারদাবারও এনেছিলেন—ভক্ষ্যান্‌ উচ্চাবচান্ রাজন্‌ বারিকুম্ভাংশ্চ শীতলান্‌।

আবারও অর্জুনের ডাক পড়ল। পিতামহের তৃষ্ণাকুল কণ্ঠস্বর শুনে অর্জুন আবারও বাণ জুড়লেন গাণ্ডীবে। বারুণ অস্ত্রে বিদ্ধ হল পৃথিবী, বেরিয়ে এল অমর্ত্য জলধারা—শীতল, অমৃতকল্প, গন্ধবতী পৃথিবীর দিব্যগন্ধভরা নির্মল জলধারা—শীতস্যামৃতকল্পস্য দিব্যগন্ধরসস্য চ। সেই জলধারা ছড়িয়ে পড়ল ভীষ্মের দহনদিগ্ধ শরীরে, সিঞ্চিত করল তাঁর মুখমণ্ডল, আপূর্ণ করল শুষ্ক শ্রান্ত তৃষ্ণালু কণ্ঠ। ধরণীতে শয়ান ভীষ্ম ধরণীর উপাদানে তৃপ্ত হলেন। কোনও কৃত্রিম বস্তু, যা রাজভোগ্য, তা আর কখনওই ভীষ্মের তুষ্টিদায়ক হয়ে উঠছে না। বসুন্ধরার কোলে শত শরের আধারে যাঁর শয়ন রচিত হয়েছে, তাঁর মস্তক ধারণ করার জন্য যেমন শরাকীর্ণ উপাধান চাই, তেমনই তাঁর তৃষ্ণার মুক্তি ঘটানোর জন্য প্রকৃতির উপাদান চাই।

কিন্তু বীরের এই অভিপ্রায় বোঝবার জন্য বার বার যাঁর ডাক পড়ছে, তিনি অর্জুন, যিনি পিতামহের প্রায় অগম্য ইঙ্গিতগুলি বুঝতে পারছেন এবং কাজগুলিও করছেন তাঁরই অভীষ্ট অনুযায়ী। কেন বার বার অর্জুনকেই ডাকছেন পিতামহ? এই শেষ শরশয্যায় শুয়েও কিছু যেন বোঝাতে চাইছেন তিনি। যা বোঝাতে চাইছেন, তা যে একেবারে বোঝা গেলও না, তাও নয়। পৃথিবী বিদ্ধ করে অর্জুন যখন শীতল জলধারা আকর্ষণ করে আনলেন পিতামহের তৃষ্ণাকুল মুখে, তখন এই অমানুষিক কর্মে কৌরবপক্ষের বীরেরা সব কেঁপে উঠেছিলেন। মহাভারতের কবি লিখেছেন—প্রচণ্ড শীত লাগলে গোরুর গায়ে যেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে, অর্জুনের কাণ্ড দেখে সমস্ত কৌরবরা তেমনই কেঁপে উঠেছিলেন—সম্প্ৰাবেপন্ত কুরবঃ গাবঃ শীতার্দিতা ইব। শৈত্যতাড়িত গাভীর প্রায় গা-ঝাড়া দিয়ে কেঁপে ওঠা যাঁরা লক্ষ করেছেন, তাঁরা যেমন ওই কাঁপুনির শরীরময় এক অস্বস্থ পরিণাম উপলব্ধি করবেন, তেমনই সঙ্গে সঙ্গে এটাও যেন বুঝবেন যে—এই নির্বোধ নিরীহ পশু বোধ হয় তার এই কাঁপুনির কারণটা কিছুতেই বোঝে না। শৈত্য অপনোদনের জন্য সে ডাক ছেড়ে মালিককে জানান দেয় না এবং সে নিজেও কিছু করতে পারে না আপন কষ্ট লাঘব করার স্বার্থে। সে শুধুই নিরীহ চোখে এদিক ওদিক জ্বল্‌ জ্বল্‌ করে তাকায়, আর কেঁপেই যায়, কেঁপেই যায়। হয়তো গোরু বলেই।

কৌরবদের অবস্থাও প্রায় একইরকম। অর্জুনের অমানুষিক অস্ত্র-কর্ম দেখে তাঁদের গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, কিন্তু তাঁদের এই বোধ নেই যে, যুদ্ধে তাঁদের কী পরিণাম ঘটবে। অথবা শুধু অর্জুনের কারণেই যে তাঁদের দুর্গতি ঘনীভূত হচ্ছে—ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্মকেও আজ শরশয্যায় শয়ান হতে হল—এই গভীর বোধটা তাঁদের কাজ করছে না। অথচ প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অর্জুনের একান্ত অস্ত্রনিপুণতা দেখে সাশ্চর্যে কেঁপে উঠছেন। অথচ নিরীহ নির্বোধ গাভীর মতো কেউ তাঁরা ডাক ছেড়ে জানান দিচ্ছেন না যে, তাঁদের সমস্ত দুর্গতির কারণ ঘটাবেন অর্জুন, অথবা তাঁরা নিজেও কোনও চেষ্টা করছেন না দুষ্ট যুদ্ধ নিবারণ করার জন্য।

ভীষ্ম বার বার আপন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ইঙ্গিতাকারের মাধ্যমে অর্জুনকে কৌরবদের সামনে এক অপ্রকাশিত মহিমায়, অদৃষ্টপূর্ব গরিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন। আরও পরিষ্কার করে বলা যায়, শৈত্যতাড়িত নির্বোধ গাভীর মধ্যে যে স্পষ্ট বোধটুকু থাকে না, ভীষ্ম সেই বোধটুকুই নিবিষ্ট করতে চাইছেন কৌরবদের মনে। বসুন্ধরার অন্তর ফুঁড়ে যখন সেই অমৃতনিঃস্যন্দী শীতল জল ভীষ্মের তৃষ্ণাতাড়িত মুখে এসে পড়ল, তখন এই অত্যাশ্চর্য কর্ম প্রত্যক্ষ করে উপস্থিত সকলে অর্জুনের জয়কার ঘোষণা করে শঙ্খধ্বনি করে উঠল। দেখুন, লৌকিকভাবে দেখতে গেলে শরশয্যায় শয়ান পিতামহের লম্বমান মস্তকের তলায় শরের উপাধান রচনা করাটা অসম্ভব কোনও কর্ম না হলেও মাটির গর্ভ থেকে শীতল পানীয় আহরণ করাটা নিতান্তই অলৌকিক কাজ। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রেই যেটা তাৎপর্যময়, সেটা হল অর্জুন ইঙ্গিতজ্ঞ, মর্মজ্ঞ। যুদ্ধক্ষেত্রেও অর্জুন তাঁর প্রতিপক্ষের ইঙ্গিত, আকার এবং চেষ্টা বুঝেই বাণক্ষেপণ করতে পারেন। এই ক্ষমতাটাই অলৌকিক প্রতিভার প্রমাণ। পর পর দুটি অভাবনীয় কর্মের মাধ্যমে ভীষ্ম তাঁর প্রিয়তম পৌত্রের এই ভাবতা এবং ইঙ্গিতজ্ঞতার পরিচয় সবার সামনে প্রকটিত করতে চাইছেন, বস্তুত ওই কর্মগুলির অলৌকিক স্থূলতাটুকু ভীষ্মের কাছে বা মহাভারতের কবির কাছেও এক উপলক্ষমাত্র।

শীতল জলধারায় তৃষ্ণা নিবারণ করেই ভীষ্ম তাঁর চারধারে উপস্থিত সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে অর্জুনকে প্রশংসা করে বললেন—তোমার পক্ষে এসব কাজ করাটা কিছুই আশ্চর্য নয়—নৈতচ্চিত্রং মহাবাহো ত্বয়ি কৌরবনন্দন। অনেককাল আগেই দেবর্ষি নারদ আমাকে বলে গেছেন যে, তুমি সাধারণ মানুষ নও। তুমি ঋষি। আরও বলে গেছেন—দেবরাজ ইন্দ্রও যে কর্ম করতে পারবেন না, বাসুদেব কৃষ্ণের সহায়তায় তুমি সেই কর্ম করবে।

অর্জুনের প্রশংসায় শুধু এই অলৌকিক স্পর্শ লাগিয়েই ভীষ্ম ক্ষান্ত হলেন না, এমনকী সমস্ত ধনুর্ধর পুরুষের মধ্যে অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করেও ভীষ্ম বিরত হলেন না, কারণ অর্জুনের অমানুষিক কর্ম অথবা তাঁর অপার শ্রেষ্ঠত্ব স্থাপন করাটা তাঁর উদ্দেশ্যই নয়। তাঁর উদ্দেশ্য, দুর্যোধন এবং তাঁর স্বপক্ষীয় রাজাদের যুদ্ধ থেকে বিরত করা। সেই উদ্দেশেই ভীষ্ম অর্জুনের প্রশংসা শেষ করেই আসল কথাটা বলতে আরম্ভ করলেন। ভীষ্ম বললেন—আমি অনেক বলেছি, দুর্যোধন শোনেনি—ন বৈ তং ধার্তরাষ্ট্রেণ বাক্যম্। আর শুধু আমি কেন, পাণ্ডবদের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে নেবার কথা অনেকেই বলেছেন। বিদুর বলেছেন, দ্রোণ বলেছেন, পরশুরাম বলেছেন, কৃষ্ণ বলেছেন এবং সঞ্জয়ও বলেছেন। দুর্যোধন কারও কথা শোনেনি। তার বুদ্ধি বিপরীত, সমস্ত শাসন সে লঙ্ঘন করেছে। অতএব অচেতন পুরুষের মতো একদিন তাকে ভীমের হাতে নাকাল হয়ে মরতে হবে—স শেষ্যতে বৈ নিহতশ্চিরায়/শাস্ত্রাতিগো ভীমবলাভিভূতঃ।

শরশয্যায় শায়িত ভীষ্মের মুখ দিয়ে শত্রুপক্ষের এক প্রধানতম শত্রু ভীমের এত প্রশংসাও দুর্যোধনের সহ্য হল না, কিন্তু মৃত্যুন্মুখ বৃদ্ধ পিতামহের প্রতি সাধারণ সৌজন্যবশতই তিনি বড় বিষণ্ণ হলেন মনে মনে—দুর্যোধনো দীনমনা বভূব।

কিন্তু এবার ভীষ্ম পরোক্ষে কথা বলা ছেড়ে দিয়ে সোজাসুজি দুর্যোধনকে আক্রমণ করে বললেন—দেখলে তো দুর্যোধন—অর্জুন কীভাবে অমৃতগন্ধী জলের ধারা এনে ফেলল আমার মুখে। এ কাজ কি অন্য কেউ পারবে? বিচিত্র অস্ত্রের এইসব অদ্ভুত প্রয়োগ—এ জানে শুধু অর্জুন। আর জানেন কৃষ্ণ। আমি পরিষ্কার বলছি, বাছা! তুমি অর্জুনকে কোনও দিন যুদ্ধে জিততে পারবে না। যে এমন অলৌকিক অস্ত্রের সন্ধি জানে, আমি চাই সেই অর্জুনের সঙ্গে তোমার সন্ধি হোক অবিলম্বে—সন্ধির্ভবতু মা চিরম্।

ভীষ্মের কথায় ধ্রুবপদ বাঁধা হয়ে গেল—অবিলম্বে সন্ধি হোক—সন্ধির্ভবতু মা চিরম্‌। একবার তিনি কৃষ্ণের কথা বলেন, যুধিষ্ঠিরের কথা বলেন, ভীমের কথা বলেন, আর প্রত্যেকবার শেষে বলেন—অবিলম্বে সন্ধি হোক। ভীষ্মের ধারণা—এখনও কৃষ্ণ পাণ্ডবদের অধীনতা মেনে, তাঁদের মতে মত দিয়েই চলছেন। কিন্তু তিনি যদি একবার স্বাধীনভাবে নিজের মতে চলেন, তার আগেই যেন সন্ধিটা হয়ে যায়—যাবৎ কৃষ্ণো মহাবাহুঃ স্বাধীনঃ কুরুসত্তমঃ। যুধিষ্ঠিরের মতো শুদ্ধসত্ত্ব ব্যক্তির ক্রোধপ্রজ্জ্বলিত নয়ন ভীষ্মকে উদ্‌বিগ্ন করে। মহাবলী ভীমসেনের প্রতিজ্ঞাগুলি তাঁকে আশঙ্কিত করে। অতএব এখনও কৌরবদের যে কটি ভাই বেঁচে আছে এবং যত সৈন্য এখনও জীবিত আছে, তাদের সবাইকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বৃদ্ধ পিতামহ দুর্যোধনকে পরামর্শ দেন—আমি মরতে চলেছি, অতএব আমার এই মৃত্যুই এ যুদ্ধের শেষ মৃত্যু বলে চিহ্নিত হোক। তুমি পাণ্ডবদের সঙ্গে সন্ধি করে শান্ত হও—যুদ্ধং মদন্তমেবাস্তু তাত সংশাম্য পাণ্ডবৈঃ। তুমি ক্রোধ ত্যাগ করো। এই বুড়ো ভীষ্ম মারা যাচ্ছে, তাতে কোনও দুঃখ নেই আমার। কিন্তু অবশিষ্ট আর সব যোদ্ধারা ভালভাবে বেঁচে থাকুন। পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার মিটমাট হয়ে যাক—ভীষ্মস্যান্তাদস্তু বঃ সৌহৃদঞ্চ/জীবন্তু শেষাঃ সাধু রাজন্‌ প্রসীদ।

বারংবার ভীষ্মের মুখ দিয়ে এই একই কথা বেরিয়েছে—আমার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই এই ভীষণ যুদ্ধ শেষ হোক। মহাসত্ত্ব বিশালহৃদয় মানুষের মুখ দিয়েই বস্তুত এমন উদার আহ্বান শোনা যাবে। ভীষ্মের স্মরণ হয়ে থাকবে যে, একদিন এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশ প্রায় লুপ্ত হয়ে যেতে বসেছিল। জননী সত্যবতীর কথায় তিনি কীভাবে এই ভরতবংশের প্রথমোদগত অঙ্কুরগুলিকে লালন করেছিলেন এবং তাও দু-তিনটি ‘জেনারেশন’ ধরে, কী অপার পরিশ্রমে, কত অনাকুল ধৈর্য নিয়ে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে-বসা রাজাদের তিনি সেবা করে গেছেন, সেকথা তাঁর মতো করে কেই বা বুঝবে! তিনি নিজে রাজা হননি, হতে চাননি, কিন্তু তাই বলে চিত্রাঙ্গদ-বিচিত্রবীর্যের মতো অনুপযুক্ত রাজারা যখন সিংহাসনে বসেছেন; তখন তিনি তাদের লঙ্ঘনও করেননি অথচ তাঁদের অনুপযুক্ততা ঢেকে দিয়েছেন নিজের দায়বদ্ধতায়, নিজের পরিশ্রমে। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুকেও মানুষ করেছেন তিনি। কিন্তু পাণ্ডুর মৃত্যুর পর যখন হস্তিনাপুরের রাজনীতি জ্ঞাতিবিরোধের পঙ্কে নিমজ্জিত হল, তখনও তিনিই প্রধানত বংশের মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন—রাজ্য ভাগ করে পাণ্ডবদের পৃথক অধিকার স্থাপন করার প্রস্তাব করে।

দুর্যোধনের হিংসায়, ক্ষুধায়, স্বার্থৈষণায় শেষ পর্যন্ত তাঁর সমস্ত সম্ভাবনা যখন তাৎপর্য হারিয়ে ফেলেছে, তখন তিনি বুঝে গেছেন যে, প্রসিদ্ধ ভরতবংশের একাংশ একেবারে লুপ্ত হয়ে যাবে। এই বিশাল বিলুপ্তি তিনি এখনও চান না। চান না বলেই তিনি আপন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ চেষ্টা করে যাচ্ছেন যাতে ভরতবংশের লুপ্ত গৌরব পুনরুদ্ধৃত হয়। তা ছাড়া এই সর্বনাশা যুদ্ধ, যেখানে ভারতবর্ষের সমস্ত রাজারা সাধারণ এক জ্ঞাতিবিরোধের কারণে এবং শক্তিমত্ত রাজার প্রতি আনুগত্যবশতই আপাতত দ্বিধা বিভক্ত, ভীষ্ম জানেন—তাঁরা বিনা কারণে শুধুমাত্র এই ভীষণ যুদ্ধের বলি হবেন। অতএব ইচ্ছামৃত্যুর বর লাভ করা সত্ত্বেও আজকে যে এই কুরুবৃদ্ধ পিতামহ মৃত্যুবরণ করতে চাইছেন, তার একমাত্র কারণ তিনি চান যে, এই অবসানের মধ্য দিয়ে পাণ্ডব-কৌরব আবারও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করুন এবং যুদ্ধ বন্ধ হোক।

নিজের প্রগাঢ় অভিজ্ঞতায় ভীষ্ম জানেন যে, দুর্যোধনের মতো অহংকারী ব্যক্তির পক্ষে যুধিষ্ঠিরের আনুগত্য স্বীকার করা সম্ভব হবে না। কিন্তু রাজনীতির ভাষায় যাকে ‘স্টেটাস কুয়ো’ বলে, তিনি সেই পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে বলছেন দুর্যোধনকে। বড় আন্তরিকভাবে তিনি বললেন—পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ, তাদেরই ফিরিয়ে দাও, বাছা! যুধিষ্ঠির চলে যাক সেখানে—রাজস্যার্ধং দীয়তাং পাণ্ডবানাম্‌/ইন্দ্রপ্রস্থং ধর্মরাজো’ ভিযাতু। একমাত্র এই ব্যবস্থা হলেই লোকে আর তোমার ওপর আত্মীয়-বিরোধিতার কলঙ্ক লেপন করতে পারবে না। ভীষ্ম এবার যুদ্ধের সামগ্রিক নাশকতার ভাবনা মাথায় রেখে বলছেন—আমার এই মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই শান্তি হোক আমাদের প্রজাদের, রাজারা প্রতিমন্ত হয়ে ফিরে যান আপন আপন রাজ্যে। পিতা ফিরে পাক তার পুত্রকে, মামা ফিরে পাক আদরের ভাগনেকে, ভাই ফিরে পাক ভাইকে—পিতা পুত্ৰং মাতুলো ভাগিনেয়ং/ভ্রাতা চৈব ভ্রাতরং প্রৈতু রাজন্‌।

দুর্যোধনকে ভীষ্ম খুব ভালভাবেই চেনেন। তিনি জানেন—তাঁর এই আন্তরিক ভাবনা—প্রজাদের জন্য, করদ রাজাদের জন্য, এমনকী যুদ্ধের কারণে ব্যাকুল হয়ে থাকা প্রত্যেকটি পরিবারের পিতামাতা, ভাইবন্ধুর জন্য তাঁর এই সামগ্রিক ভাবনা দুর্যোধন হয়তো বুঝবেন না। হয়তো কেন, যিনি এতদিন কিছু বোঝেননি, তিনি এখনও বুঝবেন না। অতএব এতদিন চিরকুমারের ব্রত পালন করার শক্তি, এতদিন রাজা না হয়েও রাজবংশের প্রতি দায়বদ্ধতার ভক্তি এবং এতদিনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার তৃপ্তি নিয়ে ভীষ্ম দুর্যোধনের প্রতি শেষ সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন প্রায় বাক্‌সিদ্ধের মতো। বললেন—এত কথার পরেও নির্বুদ্ধিতাবশত যদি তুমি আমার কথা না শোন, যদি তোমার সেই মোহ এখনও থেকে থাকে যে—তুমি এই যুদ্ধ জিতবে বলে ভাবছ, তা হলে সত্য কথাটা শুনে রাখো—আমার মৃত্যু দিয়েই যে যুদ্ধ শেষ হতে পারত, সেই যুদ্ধ শেষ হবে তোমাদের সবাইকে শেষ করে—তপ্স্যস্যন্তে এতদন্তাঃ স্থ সর্বে/সত্যামেতাং ভারতীমীরয়ামি।

ভীষ্মের মুখে ‘শেষ সত্য কথা’—এখানে ‘কথা’ শব্দটার সংস্কৃত দিয়েছেন মহাভারতের কবি—ভারতী। ভারতী মানে কথা, শব্দ, সরস্বতী। কিন্তু সে যাই হোক, ভারতবর্ষ, ভরতবংশ এবং সেই প্রাচীন রাজা ভরত দৌষ্যন্তির সঙ্গে একাত্মতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ‘ভারতী’ বলতে এখানে শুধু কথামাত্র বোঝায় না। তাঁর কথার মধ্য দিয়ে ভীষ্ম প্রসিদ্ধ ভরতবংশের বিশাল এক ভাবনাকে বোঝাতে চাইছেন, বোঝাতে চাইছেন চিরন্তন ভারতবর্ষের প্রিয়তম ভাবনাকে। বোঝাতে চাইছেন—যুদ্ধ নয়, শান্তি; ধ্বংস নয়, ধারণ; বিভেদ নয়, অন্তত একত্র শান্তিপূর্ণ সহবাসেও ভারতবর্ষের মর্মরক্ষা হতে পারে। মহাভারতের কবির কী নিপুণ শব্দপ্রয়োগ! ভীষ্মের ‘ভারতী’ শোনানো হচ্ছে কাকে? না,—রাজ্ঞাং মধ্যে ভারতং শ্রাবয়িত্বা। ভরতবংশের অধস্তন শেষ ‘ভারত’কে ভীষ্ম তাঁর ‘ভারতী’ শোনাচ্ছেন। সমস্ত শব্দব্যঞ্জনায় ‘ভারত’, ‘ভারতী’ এমনই এক মর্মবাণী প্রকাশ করে, যার অন্তর্গত তাৎপর্য বহু অতীতাগত এবং বহু দূরগামী। ভীষ্ম তাঁর শেষ বাক্য উচ্চারণ করে নিজের কঠিন শরশয়নের যন্ত্রণা মানসিক শক্তিতে নিরুদ্ধ করে, মনকে দেহের ঊর্ধ্বে স্থাপন করলেন পরমেশ্বরের ভাবনায়—যোজ্যাত্মানং বেদনাং সংনিয়ম্য।

ভীষ্ম আর একটি কথাও বললেন না। একে একে উপস্থিত রাজারা পাণ্ডবরা, কৌরবরা সকলেই নিজের নিজের শিবিরের দিকে চললেন। ভীষ্মের পরামর্শ যতই হিতকর হোক, মৃত্যুপথের পথিক যেমন পথ্য খেতে চায় না, ওষুধ খেতে চায় না, ভীষ্মের পরামর্শও তেমনই রুচিকর হল না দুর্যোধনের কাছে—নারোচয়ত পুত্রস্তে মুমূর্ষরিব ভেষজম্।

সমস্ত লোক চলে গেলে ভীষ্মের শরশয়নের স্থানটুকু নিস্তব্ধ হয়ে উঠল। দু-চারজন রক্ষী পুরুষ যারা কুরুরাজার নির্দেশে ভীষ্মকে পাহারা দিচ্ছিল, তারাই শুধু জেগে রইল রাতের অন্ধকারে। পাণ্ডব-কৌরবপক্ষের সমস্ত রাজারা যখন চলে গেছেন, তখন সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে একাকী ভীষ্মের কাছে এসে দাঁড়ালেন কর্ণ। ভীষ্মের পতন-কাহিনী শুনে তাঁর একটু ভয়ও হয়েছে, এবং বিশেষত হয়েছে অস্বস্তি। কারণ ভীষ্মের সম্পূর্ণ সেনাপতিত্বকালে কর্ণ যুদ্ধ করবেন না বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। কর্ণের অভিমান ছিল—ভীষ্ম তাঁকে সকলের সামনে বড় খাটো করেন, অর্জুনের প্রতিতুলনায় তাঁর বীরত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কর্ণ তাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—ভীষ্মের সেনাপতিত্বকালে তিনি অস্ত্র তুলবেন না হাতে। ভীষ্মের মৃত্যু হোক, তবে তিনি যুদ্ধ করতে নামবেন কৌরবদের হয়ে।

কিন্তু আজ যখন ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করে মৃত্যুর দিন গুণছেন, তখন কর্ণ অনুতপ্ত হচ্ছেন মনে মনে। পাণ্ডবদের প্রতি সখা দুর্যোধনের অন্যায় আচরণগুলি তিনি অন্তর্গত চিত্তে অনুধাবন করতে পারেন না, এমন বুদ্ধিহীন মানুষ তিনি নন। অন্যদিকে নিজের প্রতি দুর্যোধনের অকৃত্রিম বন্ধুত্ব এবং দুর্বলতাকেও তিনি কোনওভাবেই ছোট করে দেখতে পারেন না। পিতামাতার পরিত্যক্ত জীবনে দুর্যোধনের আন্তরিক সহায়তাই তাঁকে মানুষের মর্যাদা দিয়েছে। সেই মর্যাদার প্রতি বাইরের আঘাত এসেছে বার বার, সে আঘাত এসেছে ভীষ্মের কাছ থেকেও। তাতে তাঁর অনেক অভিমান পুঞ্জীভূত হয়েছে বটে। কিন্তু আজ যখন পিতামহ ভীষ্মের মতো মহাবীরও ভূমিলুণ্ঠিত হয়েছেন, তখন কর্ণ অবশ্য বুঝতে পারছেন যে, পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় করা এত সহজ হবে না। এখন তিনি বুঝতে পারছেন যে, কৌরবকুলের বৃদ্ধ পিতামহের সঙ্গে এতকাল ধরে তিনি যে রূঢ় ব্যবহার করেছেন, সকলের মধ্যে এই বৃদ্ধকে তিনি যেভাবে অপমান করেছেন, তা সর্বাংশে ঠিক হয়নি। তাই ভীষ্মের শরশয্যার পাশে আজকে যত রাজারা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদের সবার সামনে বিশেষত কৌরব-পাণ্ডবদের সামনে দাঁড়িয়ে এই বৃদ্ধের কাছে অনুতাপ প্রকাশ করতে তাঁর লজ্জা করেছে। অতএব সকলে চলে যেতেই তিনি তাড়াতাড়ি ভীষ্মের সামনে এসে করজোড়ে দাঁড়িয়েছেন সলজ্জে, সানুতাপে—ঈষদাগতসন্ত্রাসসস্ত্বরয়োপজগাম হ।

কর্ণ দেখতে পেলেন—এক মহাবীর ক্ষত্রিয়োচিত বীরশয্যায় শয়ন করে আছেন, ঠিক যেমন দেবসেনাপতি কার্তিক তাঁর জন্মশয্যায় শুয়েছিলেন শরবনে। দেহের সমস্ত যন্ত্রণা তিনি সহ্য করছেন চোখ বুজে মানসিক দৃঢ়তায়। ভীষ্মের অবস্থা দেখে কর্ণের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে এল। চোখে ভরে এল জল। তিনি ভীষ্মের পা জড়িয়ে ধরলেন নিদারুণ অপরাধবোধে—অভ্যেত্য পাদয়োরস্য নিপপাত মহাদ্যুতিঃ। বললেন—আমি রাধেয় কর্ণ। আমি যুদ্ধ করিনি বটে, কিন্তু সদাসর্বদা যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার চোখের সামনে থেকেছি। আমি নিরপরাধ হওয়া সত্ত্বেও চিরটা কাল আপনার বিদ্বেষের পাত্র হয়েই রইলাম। কোনও সময় আমি আপনার সমর্থন বা প্রশংসা লাভ করিনি—দ্বেষ্যো’ত্যন্তমনাগাঃ সন্‌…নিত্যমক্ষিগতস্তব।

গলার স্বর শুনে, কথার ভঙ্গি শুনে পিতামহ ভীষ্ম বুঝলেন যে, কর্ণ এসেছেন। অনেক কষ্টে তিনি চোখ খুললেন। রাতের অন্ধকার আরও ঘনীভূত হয়েছে। দূরে, বহুদূরে পাণ্ডব-কৌরবদের সেনাশিবির থেকে মশালের আলো জ্বলতে দেখা যায়। ভীষ্ম চোখ খুলে দেখলেন—এক কর্ণ ছাড়া আর কেউই কাছাকাছি নেই। শুধু দুর্যোধনের নিযুক্ত রক্ষী পুরুষেরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। ভীষ্ম ইশারায় তাদের একেবারে নজরের বাইরে, অন্যত্র সরে যেতে বললেন। পাহারাদারেরা কর্ণের কথা শুনেছে, কিন্তু ভীষ্মের আকার ইঙ্গিত এবং ইচ্ছা কিছুই বুঝতে পারল না। বস্তুত কর্ণ এবং ভীষ্মের পারস্পরিক বিরুদ্ধ সম্পর্কের কথা অনেকের মতো তারাও জানত। সেই দৃষ্টিতে কর্ণের ব্যবহারেই তারা আশ্চর্য হয়েছে, সেখানে ভীষ্ম আর তাদের আশ্চর্য এবং কৌতূহলী হয়ে ওঠার সুযোগ দেননি।

রক্ষী পুরুষেরা যখন বহুদূরে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল, তখন ভীষ্ম কোনও দিন যা করতে পারেননি, কোনও দিন যা বলতে পারেননি, ভীষ্ম তাই করলেন, তাই বললেন। আপন শরবদ্ধ হস্তদুটির একটি অন্তত প্রসারিত করে কর্ণের অবনত কণ্ঠখানি জড়িয়ে ধরলেন ভীষ্ম, ঠিক যেমন পিতা গাঢ় স্নেহে জড়িয়ে ধরেন পুত্রকে—পিতেব পুত্রং গাঙ্গেয়ঃ পরিরভ্যৈকপাণিনা। কত অপমান, কত কটু কথা তিনি বলেছেন এই ছেলেটিকে। আজ সেই সমস্ত অপমানের ওপর স্নেহের প্রলেপ মাখিয়ে দিয়ে বৃদ্ধ পিতামহ স্নিগ্ধ চক্ষুতে কর্ণের দিকে তাকিয়ে বললেন—বাছা! তুমি যে সবসময় আমার সঙ্গে আড়াই-আড়াই করে টক্কর দিয়ে চল, তার জন্যই যে আমি তোমার বিরুদ্ধাচরণ করি, তা কিন্তু নয়—ন বিপ্রিয়ং মমৈবেহ যৎ স্পর্ধেথা ময়া সহ। এমনকী সেসব কথা মনে রেখে আজ যদি তুমি আমার কাছে না আসতে, তা হলে কি কোনও ভাবেই ভাল হত তোমার?

কর্ণ ভীষ্মের কাছে নিজের সর্বজনপরিচিত পরিচয় দিয়ে সাভিমানে বলেছিলেন—আমি রাধেয় কর্ণ এসেছি। ভীষ্ম সেই অভিমানের ওপর প্রলেপ দিয়ে বলেছেন—তুমি যে রাধার ছেলে নও, কুন্তীরই ছেলে, সে-কথা আমার জানতে বাকি নেই এবং আমি এও জানি যে, অধিরথ সূত তোমার পিতা নন। আমি দেবর্ষি নারদের কাছে শুনেছি তুমি ভগবান সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে জন্মেছ—কৌন্তেয়স্ত্বং ন রাধেয়ো ন তবাধিরথঃ পিতা। শুধু নারদই নন, আমার ঋষি-ভ্রাতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কাছেও আমি এই কথা শুনেছি। তা ছাড়া তোমার অস্ত্রক্ষমতা এবং সাহস দেখেও তোমার জন্ম সম্বন্ধে আমার কোনও সন্দেহ নেই—তেজসা চ ন সংশয়ঃ।

ভীষ্ম এসব কথা বললে অবধারিত প্রশ্ন আসে যে, কর্ণের জন্মরহস্য সব জানা সত্ত্বেও কেন এই বৃদ্ধ এত কটু কথা তাঁকে বলে এসেছেন এতদিন। ভীষ্ম জবাব দিচ্ছেন—দেখো! তুমি যে বললে—চিরটা কাল আমি তোমাকে বিদ্বেষ করে এসেছি, কথাটা একেবারেই সত্য নয়। বস্তুত তোমার ওপর আমার কোনও বিদ্বেষই নেই—ন চ দ্বেষো’স্তি মে তাত ত্বয়ি সত্যং ব্রবীমি তে। তবু যে এতকাল ধরে তোমাকে হাজারো নিষ্ঠুর কথা বলেছি, তা শুধুমাত্রই খানিকটা দমিয়ে রাখার জন্য। কারণ আমার বিশ্বাস—তুমি যে এতকাল ধরে পাণ্ডবদের ওপর তোমার রাগ দেখিয়ে আসছ, এই রাগ তুমি বিনা কারণেই দেখিয়েছ—অকস্মাৎ পাণ্ডবান্‌ হি ত্বং দ্বিষসীতি মতির্মম। আমি বেশ বুঝি—পাণ্ডবদের ওপর তোমার এই বিদ্বেষ তৈরি করেছেন দুর্যোধন। তাঁর নিজস্ব পাণ্ডব-বিদ্বেষে তিনি তোমাকে ব্যবহার করেছেন—যেনাসি বহুশো রাজ্ঞা চোদিতঃ কুরুনন্দনঃ। ব্যবহৃত হবার সময় তুমি যে কিছুই বোঝনি, তা নয়। তুমি বুঝেছ এবং সেটাই তোমার পক্ষে অধর্ম হয়েছে।

মৃত্যুশয্যায় শুয়ে ভীষ্ম বড় স্পষ্ট ভাষায় কথা বলছেন। কৌরব-পাণ্ডবের এক পিতামহ হিসেবে এই জ্ঞাতিযুদ্ধ তাঁর মনঃপূত ছিল না। তিনি এটাও বেশ ভালভাবে জানেন যে, দুর্যোধন যতটা বাড় বেড়েছেন, তা অনেকটাই কর্ণের জন্য। পুনশ্চ এই যুদ্ধ লাগার আগে তিনি যে পাঁচখানি গ্রামও পাণ্ডবদের ছেড়ে না দিয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নিলেন, তা ওই কর্ণের ভরসায়। কর্ণ তাঁর এই বুদ্ধিতে ইন্ধন জুগিয়েছেন। ভীষ্ম কর্ণকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলেন যে, কর্ণের প্রতি তাঁর কোনও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ নেই, কারণ কর্ণ কাজ করেছেন দুর্যোধনের জন্য এবং তা অনেকটাই যান্ত্রিকতায়। কিন্তু যান্ত্রিকভাবে করলেও সেই অন্যায়গুলি তিনি বুঝেসুঝেই করেছেন—ভীষ্মের আপত্তি সেইখানেই। তিনি বলেছেন—কর্ণ! তোমার এই বিপরীত বুদ্ধির কারণও তুমি নিজে নও। সমাজের সংস্কার না মেনেই তোমার জন্ম হয়েছিল বলেই তোমার এই বিপরীত বুদ্ধি—জাতো’সি ধর্মলোপেন যতস্তে বুদ্ধিরীদৃশী। তারওপরে তুমি যাকে বন্ধুভাবে আশ্রয় করে আছ, সে নিজে নীচ এবং পরশ্রীকাতর বলে, তোমার বুদ্ধিটা আরও বিপরীত হয়ে গেছে। তুমিও পরশ্রীকাতর হয়ে উঠেছ এবং তুমি গুণী মানুষের মধ্যেও গুণ দেখতে পাও না—নীচাশ্রয়ান্‌ মৎসরেণ দ্বেষিণী গুণিনামপি।

আধুনিকেরা অনেকে বলেন—সেকালের সমাজ ছিল স্থূল। ‘সোস্যাল সাইকোলজি’ কিংবা মনস্তত্বের কোনও বৈজ্ঞানিক বোধ সেকালে ছিল না। আমরা বলব—অন্তত ভীষ্ম এখানে যেভাবে কর্ণের মনস্তত্ত্ব বিচার করেছেন, তা ভেবে দেখলে অবাক হতে হয়। লক্ষণীয়, জীবনের এই অন্তিম মুহূর্তে যখন তিনি খুব স্পষ্টভাবেই সত্য উচ্চারণ করছেন, সেই অবস্থাতেও তিনি কর্ণকে একটুও ব্যক্তিগতভাবে দোষী করছেন না। বরঞ্চ তিনি বেশ সহৃদয়ভাবে বোঝেন যে, একটি শিশুপুত্র যদি পিতার পরিচয় লাভ না করে, অপিচ জননীও যদি আপন স্বার্থবোধে তাকে পরিত্যাগ করেন, তবে সেই পুরুষের জীবনে নানা দ্বিধাদ্বন্দ্ব, বিকার এবং আন্দোলন তৈরি হয়। বিশেষত তার যদি বুদ্ধি থাকে এবং শক্তিও থাকে তবে জগতের সমস্ত সমাজসম্মত গুণী ব্যক্তির ওপর তার এক অহেতুক আক্রোশ তৈরি হয়। যেকোনও ভাবেই হোক, ওই সামাজিক গুণী ব্যক্তিদের সাহংকারে অতিক্রম করার একটা নেশা তাকে পেয়ে বসে।

কর্ণেরও তাই হয়েছে। ভীষ্ম তাঁকে বলেছেন—তোমকে যে সব সময় বিপরীত বুদ্ধিগুলি পেয়ে বসে, তার কারণ, তোমার জন্ম হয়েছে ধর্মের অতিক্রমের মধ্য দিয়ে—জাতো’সি ধর্মলোপেন যতস্তে বুদ্ধিরীদৃশী। ধর্ম বলতে এখানে ফুল-বেলপাতা-নৈবেদ্যের ধর্ম বোঝায় না। বোঝায় সামাজিক আইন, সামাজিক নিয়ম, সামাজিক শৃঙ্খলা। আমরা জানি—নিয়োগপ্রথার মাধ্যমেও যদি কর্ণের জন্ম হত, অথবা কুন্তী যদি পাণ্ডুর কাছে কর্ণের কথা বলতেন এবং পাণ্ডু যদি কর্ণের পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতেন, তা হলেও কোনও অসুবিধে ছিল না। কারণ, নিয়োগপ্রথা, সে-যুগের সমাজ-সচল প্রথা এবং পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরাও প্রত্যেকেই নিয়োগজাত সন্তান। কিন্তু কর্ণ জন্মেছেন সমাজের সকল প্রথা ভেঙে—কুন্তীর অদম্য কৌতূহলে, সূর্যের আসঙ্গলিপ্সায়। নিয়োগপ্রথার কোনও নিয়মই এখানে খাটে না। ফলে সামাজিক শৃঙ্খলা অতিক্রমের মধ্যে দিয়েই যেহেতু কর্ণের জন্ম, অতএব সামাজিক অস্বীকৃতি থেকে যে বিকারগুলির সৃষ্টি হয়, কর্ণেরও তাই হয়েছে।

ভীষ্ম ঠিক এই কথাটাই বলছেন। তিনি কর্ণকে দায়ী করছেন না, কারণ, তাঁর আপন জন্মের জন্য কর্ণ দায়ী নন। কিন্তু কর্ণের জন্মের সময়ে সামাজিক নিয়মের বিলুপ্তি ঘটেছিল বলেই সেই অন্যায় কর্ণকে আক্রান্ত করেছে বিপরীতভাবে। জন্মের শোধ নেবার জন্যই যেন তিনি ভীষণ অহংকারী এবং গুণী মানুষের মধ্যেও তিনি গুণ দেখতে পান না। ভীষ্ম বুঝেছেন যে, এমন এক বিপরীতবুদ্ধি মানুষও যদি কোনও মহাশয় ব্যক্তির আশ্রিত হতেন, কোনও শুদ্ধহৃদয় ব্যক্তির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা থাকত, তা হলেও কর্ণ বেঁচে যেতেন হয়তো। কিন্তু দৈবক্রমে তাও হয়নি। ভীষ্ম বলেছেন—একে তোমার জন্ম হয়েছে ধর্মলুপ্তির মাধ্যমে, তার ওপরে তুমি এমনই এক নীচ ব্যক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেছ যে, তার পরশ্রীকাতরতা, তার মাৎসর্য সব তোমার মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। এর ফলেই তুমি গুণী মানুষের গুণ বোঝো না, তাঁকে বিদ্বেষ করার মধ্যেই তুমি সার্থকতা খুঁজে পাও—নীচাশ্রয়ান্মাৎসরেণ দ্বেষিণী গুণিনামপি।

ভীষ্ম বোঝাতে চাইলেন—আমি যে চিরটা কাল তোমাকে কঠিন রুক্ষ ভাষায় তিরস্কার করেছি তা শুধু এই কারণে যে, তুমি একজন বুদ্ধিমান পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও দুর্যোধনের মতো নীচ এবং পরশ্রীকাতর ব্যক্তির কথায় তুমি চালিত হয়েছ—তেনাসি বহুশো রুক্ষং শ্রাবিতঃ কুরুসংসদি। ভীষ্ম এতকাল ধরে অর্জুনের তুলনায় কর্ণকে সবার সামনে খাটো করে এসেছেন, আজকে সেই তুলনা বাদ দিয়ে তিনি সরাসরি কর্ণের প্রশংসা করতে আরম্ভ করলেন। আবারও বোঝাতে চাইলেন কর্ণের ওপর তাঁর কোনও ব্যক্তিগত ক্রোধ নেই, যত রুক্ষ কথাই তিনি বলে থাকুন না কেন, তা শুধুই চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁকে বলতে হয়েছে। এমনিতে তিনি কর্ণের গুণগ্রাহী।

ভীষ্ম বললেন—সত্যি কথা বলতে কী, যুদ্ধে যে তুমি কত শক্তি প্রকাশ করতে পার এবং সে শক্তি যে তোমার শত্রুদের কাছে কত দুঃসহ, তা আমি বেশ ভাল করেই জানি—জানামি সমরে বীর্যং শত্ৰুভিদুঃসহং তব। তা ছাড়া বেদ এবং ব্রাহ্মণ্য সম্বন্ধে তোমার স্পষ্ট ধারণা আছে, দানধর্মের নীতিতেও তোমার চিরন্তনী নিষ্ঠার কথা আমি জানি। আর বীরত্বের তো কথাই নেই। তোমার মতো দেবোপম পুরুষ এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ নেই—একথা জানা সত্ত্বেও যে তোমাকে কঠোর বাক্যে তিরস্কার করেছি, তা শুধুই এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশ যাতে ভেঙে না যায় সেই স্বার্থে—কুলভেদভয়াচ্চাহং সদা পুরুষমুক্তবান্।

কুলভেদ, কৌরব-পাণ্ডবের মধ্যে জ্ঞাতিভেদ—বৃদ্ধ পিতামহের কাছে এ যে কত বড় ভয়ের, কত দুঃখের, তা শুধু তিনিই জানেন। এই শরশয্যার শত দহনের মধ্যে শুয়ে থেকেও এখনও তিনি ভাবেন—তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই শেষ হোক সর্বান্তক শত্রুতা। কর্ণকে একান্তে পেয়ে বার বার তিনি বোঝাতে চেয়েছেন যে, একজন বীর হিসেবে এবং মানুষ হিসেবে তিনি কর্ণকে অর্জুন কিংবা কৃষ্ণের থেকে কম শ্রদ্ধা করেন না। সেই কর্ণের মতো মানুষও যেখানে দুর্যোধনের প্ররোচনায় পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতায় মত্ত এবং জ্ঞাতিভেদ যেখানে যুদ্ধে পরিণত হয়েছে, তখন ভীষ্ম শেষ সিদ্ধান্ত করে বলেন—পুরুষকার এবং শক্তি দিয়ে অনেক কিছু লাভ করা সম্ভব বটে, কিন্তু সেই পুরুষকারের সাহায্যে দৈব অতিক্রম করা যায় না—দৈবং পুরুষকারেণ ন শক্যমতিবর্তিতুম্।

কথাটা দুদিকেই খাটে—ভীষ্মের নিজের জীবনেও, কর্ণের জীবনেও। কর্ণই চিরকাল বলতেন—কোন ঘরে, কোন বংশে মানুষ জন্মাবে সেটা দৈবাবত্ত বটে, কিন্তু আমার আয়ত্তে আছে পুরুষকার—দৈবায়ত্তং কুলে জন্ম মমায়ত্তং তু পৌরুষম্‌। কর্ণ এই পুরুষকারের দ্বারা জগদ্‌জয়ী হবেন বলে ভেবেছিলেন। কিন্তু আজ এই ভয়ংকর যুদ্ধে প্রথম সেনাপতির পতনের পরে সেই আত্মবলে নিশ্চয় আঘাত লেগেছে। ভীষ্ম সেটা আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলেন নিজের জীবনের উদাহরণে। বোঝাতে চাইলেন—তিনিও একটা মহৎ উদ্দেশের পিছনে কম পুরুষকার অপচয় করেননি। প্রসিদ্ধ ভরত বংশের ধারা অক্ষুন্ন রাখার জন্য রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করেছেন, আজীবন ব্রহ্মচর্যে স্থিত থেকেছেন এবং একের পর এক রাজপুত্রদের—সেই কুমার চিত্রাঙ্গদ-বিচিত্রবীর্য থেকে আরম্ভ করে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু, দুর্যোধন-যুধিষ্ঠির পর্যন্ত সকলকেই মানুষ করবার চেষ্টা করেছেন একটাই আদর্শ নিয়ে—হস্তিনাপুরের রাজার সিংহাসন যেন সামান্য ব্যক্তিস্বার্থে কলুষিত না হয়। কিন্তু এখন তাই হতে চলেছে। স্বার্থচালিত দুর্যোধনের প্ররোচনায় এখন যুদ্ধ বেধেছে এবং কর্ণের মতো মহাবীরও সেই স্বার্থেরই যান্ত্রিকতায় চালিত। এর পরে দৈব ছাড়া আর কাকে চরমভাবে দায়ী করতে পারেন ভীষ্ম।

কোনও দিক থেকেই কোনও আশা নেই—এটা বেশ ভাল করেই বুঝে গেছেন ভীষ্ম। দুর্যোধনকে যুদ্ধ বন্ধ করার মিনতি জানিয়েছেন তিনি। এখন শেষ চেষ্টা হিসেবে কর্ণের হৃদয়ের কাজেও তিনি মিনতি করে বলছেন—বাছা! পাণ্ডবরা তোমার মায়ের পেটের ভাই—সোদর্য্যাঃ পাণ্ডবা বীরা ভ্রাতরস্তে’রিসূদন। তাদের সঙ্গে তোমার মিলন হোক, এই আমি চাই। আমার পতনের সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হোক এই সর্বনাশা যুদ্ধ। সমস্ত রাজারা আজ মুক্ত হোন এই যুদ্ধের বিপদ থেকে—পৃথিব্যাং সর্বরাজানো ভবন্ত্বদ্য নিরাময়াঃ।

কর্ণ বহুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে এই বৃদ্ধ পিতামহের আদর্শ, আকৃতি এবং সম্ভাবনার কথা শুনলেন। কিন্তু এতদিন ধরে যে বিশ্বস্ততায় তিনি বন্ধু দুর্যোধনকে সেবা করেছেন, আজ হঠাৎই সেখান থেকে সরে আসা তাঁর পক্ষেও অসম্ভব ছিল। প্রায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত ভীষ্মের অনুরোধ তাঁকে লঙ্ঘন করতে হচ্ছে—এজন্য তিনি লজ্জিতও বোধ করছেন যথেষ্ট। তিনি বললেন—আপনি যা বলছেন, সব আমি বুঝি। আমি যে কুন্তীরই ছেলে এবং তিনি আমাকে পরিত্যাগ করার পর পিতা অধিরথ যে আমাকে পালন করেছেন, তাও আমি জানি। কিন্তু পিতামহ! এতকাল ধরে আমি দুর্যোধনের ঐশ্বর্য ভোগ করে যাচ্ছি, তাঁর অকৃত্রিম বন্ধুত্ব আজ আমি ঠেলে দিই কী করে—ভুক্ত্বা দুর্যোধনৈশ্বৰ্য্যং ন মিথ্যা কর্তুমুৎসহে। বাসুদেব কৃষ্ণ যেমন পাণ্ডবদের জন্য সমস্ত স্বার্থ ত্যাগ করেছেন, আমিও তেমনই গৃহ বিত্ত দারা সমস্ত কিছুর পরিবর্তে দুর্যোধনের স্বার্থরক্ষায় আত্মবলিদান করেছি।

শেষ পর্যন্ত কর্ণও ভীষ্মের মতোই সিদ্ধান্ত করলেন—যা ঘটবার তা ঘটবে, কেউ তা রোধ করতে পারবে না। সত্যিই পুরুষকার দিয়ে দৈবকে রোধ করা যায় না। চারদিকে এই পৃথিবীর বিপদাশঙ্কা ঘনিয়ে আসছে, সেই ভীষণ ক্ষয়ের লক্ষণ আমি চোখে দেখতে পাচ্ছি। আপনি এই বিপদ বহু আগেই বুঝতে পেরেছিলেন এবং কুরুসভায় তার সংকেতও দিয়েছেন বহুবার—ভবদ্ভিরুপলব্ধানি কথিতানি চ সংসদি। কর্ণ বললেন—আমি বেশ জানি—অর্জুন-কৃষ্ণদের যুদ্ধে জয় করা অসম্ভব। কিন্তু তবুও আমাকে যুদ্ধ করতেই হবে। এতদিনের সযত্নলালিত এই শত্রুতা আমি হঠাৎই বাদ দিয়ে বসি কেমন করে—ন শক্যমবস্ৰষ্টুং বৈরমেতৎ সুদারুণম্। অর্জুনের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতেই হবে এবং আপনি তাতে অনুমতি দিন, পিতামহ। আপনি অনুমতি দিলেই তবে আমি নির্দ্বিধায় এই যুদ্ধ করতে পারি—অনুজ্ঞাতস্ত্বয়া বীর যুধ্যেয়মিতি মে মতিঃ।

কর্ণ এবার মৃত্যুপথযাত্রী ভীষ্মের কাছে ক্ষমা চেয়ে বললেন—আমি চপলতাবশত অথবা কখনও হঠাৎই বিনা কারণে যেসব কটু কথা আপনাকে বলেছি, তার জন্য আমাকে ক্ষমা করুন, পিতামহ—যন্ময়েহ কৃতং কিঞ্চিৎ তন্মে ত্বং ক্ষন্তমর্হসি। ভীষ্ম বুঝতে পারলেন কর্ণ যুদ্ধ ত্যাগ করবেন না। ভীষ্ম এতে দুঃখ পেলেন না খুব। কারণ সত্যিই তো এই প্রারব্ধ যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আশা কর্ণের পক্ষে খুব কঠিন। ভীষ্ম ভাল করেই বোঝেন যে, একজন ক্ষত্রিয় বীরের কতগুলি নীতিনিয়ম আছে, কতগুলি দায়বদ্ধতা আছে এবং সে দায়বদ্ধতা নিজের কাছেই সবচেয়ে বেশি। কর্ণ নিজেও ভীষ্মকে বলেছিলেন—অর্জুনের সঙ্গে আমাকে যুদ্ধ করতেই হবে। আধি-ব্যাধির দ্বারা জীর্ণ হয়ে ক্ষত্রিয়ের দেহ বিনষ্ট না হয়, আমি সেই জন্যই দুর্যোধনকে আশ্রয় করে এতকাল পাণ্ডবদের ক্রোধ বাড়িয়ে তুলেছি—মা চৈতদ্‌ ব্যাধিমরণং ক্ষত্ৰং স্যাদিতি কৌরব। কাজেই এইরকম যাঁর মানসিক গঠন সেই কর্ণ হঠাৎ দুর্যোধনকে ত্যাগ করে স্বার্থপ্রণোদিত হয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে মিটমাট করে নেবেন—এতটা ভীষ্ম চাইলেও, তা যে হবার নয়, সেটাও তিনি বেশ ভালভাবেই জানেন।

ভীষ্ম তাই বললেন—একান্তই যদি তুমি এই ভয়ংকর শত্রুতা ত্যাগ না করতে পার, তবে যুদ্ধ করো। আমি অনুমতি দিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, যুদ্ধ কর ক্ষত্রিয়ের স্বধর্মপালনের নীতিতে। কারও ওপরে রাগ করে বিকট উৎসাহে যুদ্ধ করো না। ভীষ্ম কর্ণকে উপদেশ দিচ্ছেন প্রায় ভগবদগীতার নিষ্কাম ভাবনায়। অর্থাৎ ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম যুদ্ধ করা, অতএব যুদ্ধ কর। কিন্তু সেখানে যেন কোনও অহংকার না থাকে। না থাকে স্বার্থোন্মাদী স্ব-সুখ-পরায়ণ যুদ্ধবীরের মৎসর ভাবনা। ভীষ্ম নিজেও এই যুদ্ধই করেছেন। শুধু যুদ্ধের জন্যই যুদ্ধ করেছেন তিনি। উৎকট উৎসাহে ক্ষত্রিয়ের স্বধর্ম অতিক্রম করার মধ্যে ভীষ্ম ক্ষত্রিয়ের সার্থকতা দেখতে পান না। নিরহংকার নিষ্কাম শক্তি-প্রদর্শনের মধ্যে বীরের সদ্‌গতি এবং স্বর্গ দেখতে পান ভীষ্ম। গীতার কৃষ্ণের মতো করেই তিনি বলেন—যুধ্যস্ব নিরহঙ্কারো বলবীর্যব্যপাশ্রয়ঃ—ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চাইতে ক্ষত্রিয়ের বৃহত্তর শ্রেয়-কর্ম কিছু নেই। ভীষ্ম কর্ণকে সেই যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়ে নিজের অন্তরতম কষ্টবোধ প্রকট করলেন কর্ণের সামনে। বললেন—কৌরব-পাণ্ডব—এই দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিস্থাপন করার জন্য আমি সারা জীবন চেষ্টা করেছি—প্রশমে হি কৃতো যত্নঃ সুমহান্ সুচিরং ময়া—কিন্তু পারলাম না, কর্ণ! আমি কিছুই করতে পারলাম না।

ভীষ্মের এই আকুল আর্তি বোঝবার মতো সহৃদয়তা কর্ণের ছিল না, তা নয়। কিন্তু সমকালীন পরিস্থিতি, দুর্যোধনের কাছে তাঁর বন্ধুত্বের দায়, বিশ্বস্ততা রাখবার দায় এবং নিজের সারা জীবনের যন্ত্রণা—সব কিছু মিলে তাঁর হৃদয়টি এমনই বিপন্ন ছিল যে, ভীষ্মের কথা সমস্ত হৃদয়ঙ্গম করেও তিনি যুদ্ধের জন্য ভীষ্মের কাছে অনুমতি চাইলেন এবং ভীষ্মও সে অনুমতি দিলেন।

কর্ণকেও যখন ভীষ্ম থামাতে পারলেন না, তখনই তিনি বুঝে গেলেন যে, তাঁর মৃত্যু ঘটলেও এই ভয়ংকর কুলক্ষয়ী যুদ্ধ চলতে থাকবে এবং কোনও উপায়েই দুর্যোধনকে বিরত করা যাবে না। অতএব কর্ণ চলে গেলে তিনি আগেরই মতো বুদ্ধিকে নিয়ন্ত্রিত করলেন। অর্জুনের ছোঁড়া শরকন্টকের ওপর শুয়েও সমস্ত শরীরটাকে যেন তাঁর মন বুদ্ধি থেকে পৃথক করে নিতে পারলেন তিনি। শরীরের মতো শরীর বেদনা পেতে থাকল, কিন্তু নিজের মন বুদ্ধি তিনি নিযুক্ত করলেন ঈশ্বরের ভাবনায়—যোজ্যাত্মানং বেদনাং সংনিয়ম্য।

ভীষ্ম মৃতবৎ শরশয্যা গ্রহণ করলেন, কিন্তু প্রাণত্যাগ করলেন না। এই কষ্টকর মরণাপেক্ষার পিছনে তাঁর ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষমতা প্রদর্শন করাটাই যে খুব বড় ছিল, তা মোটেই নয়। আসলে ভীষ্ম যখন বুঝলেন যে, তিনি কোনওভাবেই দুর্যোধনকে বোঝাতে পারবেন না, তখনই তিনি মনে করেছেন যে, এই যুদ্ধের পরিণতি তিনি দেখে যাবেন। একদিন জননী সত্যবতী এবং দ্বৈপায়ন ব্যাসের শুভৈষণায় যে কুরুকুলকে তিনি অঙ্কুর থেকে বিবর্ধিত করেছেন, সেই কুলের শেষ পরিণতি কী হয়—তা দেখে যাবার কৌতূহল এই শরশয্যায় শুয়েও তিনি রোধ করতে পারেননি।

ভীষ্ম বুঝেছেন ন্যায় নীতি এবং ধর্মের যে সংজ্ঞায় এই প্রসিদ্ধ কুরুবংশ আধারিত ছিল, তা থেকে কবে থেকেই তো ভ্রষ্ট হয়েছেন কুরুবংশের অধস্তন পুরুষেরা। তাঁর পিতা শান্তনু যেদিন স্বকামসিদ্ধির জন্য এক অতি উপযুক্ত পুত্রকে বঞ্চিত করে বিবাহসুখ অনুভব করেছিলেন, সেদিন থেকেই নিশ্চয় তাঁর অভিমান ছিল যে, তাঁকে বাদ দিয়ে তাঁর পিতৃবংশের প্রতিষ্ঠা কেমন হয়—দেখে যাবেন তিনি। কিন্তু এই অভিমান নিয়ে তিনি থাকতে পারেননি। শান্তনু সত্যবতীর জ্যেষ্ঠ পুত্র চিত্রাঙ্গদের সাহংকার মৃত্যু হবার সঙ্গে সঙ্গেই সত্যবতীর সনির্বন্ধ অনুরোধে তাঁকে বিচিত্রবীর্যের সব দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আবার তিনিও মারা গেলে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর দায়িত্বও নিতে হয়েছে তাঁকেই। কুরুবংশীয় পুরুষদের নিজে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠা করে দেবার পর তাঁদের কোনও কাজে তিনি চরম কোনও বাধা দেননি, তাঁর পরামর্শ চাইলে তিনি তা সবসময়ই দিয়েছেন নিজের সাধ্য এবং বুদ্ধিমতো। কিন্তু সবসময় নিজের ইচ্ছাকে অতিক্রম করেও তিনি রাজপদে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির আজ্ঞা পালন করেছেন বিশ্বস্ত রাজকর্মচারীর মতো। কিন্তু তবু মনে তাঁর সদাজাগ্রত বাসনা থেকে গেছে—রাজপদাধিকারী ব্যক্তির শেষ পরিণতি দেখবার।

ভীষ্ম পালিয়ে যাননি। কুরুবংশের প্রতি চিরন্তনী সেই মায়াই তাঁকে পালিয়ে যেতে দেয়নি। কুরুক্ষেত্রের শেষ পরিণতি তিনি দেখেছেন এবং বেঁচে থেকেছেন ততদিন পর্যন্ত, যতদিন না যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা সম্পূর্ণ হয়। শরশয্যায় কন্টকিত হয়েও এই অপেক্ষার তাঁর কী প্রয়োজন ছিল? প্রয়োজন ছিল। মনে রাখা দরকার, তাঁর পিতা শান্তনু যখন বেঁচে ছিলেন, তখনও তিনিই রাজ্য চালিয়েছিলেন যৌবরাজ্যের অধিকারে। তারপর পিতার মৃত্যু হলে চিত্রাঙ্গদের রাজত্বকালটুকু বাদ দিয়ে বিচিত্রবীর্যের রাজ্যও তিনিই চালিয়েছেন বকলমে। প্রেমে আর কামে যে ব্যক্তির যক্ষ্মা ধরে গেল, তিনি বেঁচে থাকতেও ভীষ্মের যেমন ব্যস্ততা গেছে, তাঁর মৃত্যুর পরেও বহুদিন তাঁর সেই ব্যস্ততাই গেছে, যতদিন না পাণ্ডু মানুষ হন।

পাণ্ডু রাজপাটে আসীন হবার পর ওই কিছুদিন মাত্র তাঁকে কথঞ্চিৎ নির্লিপ্ত দেখা গেছে। পাণ্ডুর সময় থেকেই তিনি কুরুবংশের বৃত্তিভোগী মন্ত্রীতে পরিণত হন। কিন্তু বৃত্তিভোগীর নিশ্চিন্ততা তাঁর কপালে জোটেনি। ধৃতরাষ্ট্র যেদিন থেকে স্বঘোষিত রাজা হয়ে গেছেন, সেদিন থেকেই তাঁর রাজকার্য এবং রাজনীতির অভিজ্ঞতা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। সেই শান্তনুর সময় থেকে পাণ্ডুর সময়কাল পর্যন্ত তিনি রাজ্যপাট সামলেছেন বটে, কিন্তু সে রাজকর্মচারী ভৃত্যের মতো। কিন্তু তাঁর রাজনীতিশাস্ত্রের জ্ঞান এবং প্রযুক্তি বিষয়ে যে বিশাল অভিজ্ঞতা আছে, তা তিনি কোনও দিনই স্বাধীনভাবে কাজে লাগাতে পারেননি। অথচ তাঁর এই অভিজ্ঞতাপুঞ্জের উত্তরাধিকার তিনি দিয়ে যেতে চান। বলে যেতে চান, তিনি কীভাবে রাজত্ব চালাতে চেয়েছিলেন, আর কীভাবে তা চলল। ঠিক এই জন্যই শরশয্যায় শুয়েও তিনি ইচ্ছা করে বেঁচে রইলেন যুধিষ্ঠিরের ধর্মরাজ্যের প্রতিষ্ঠার অপেক্ষায়।

বলতে পারেন—ভীষ্মের শরশয্যায় শোয়ার কথাটা এবং ইচ্ছামৃত্যুর কথাটা একেবারেই বুজরুকি। সত্যিই তো, লৌকিকভাবে এ কথাটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয় যে, একটা মানুষ শরশয্যায় শয়ন করেও ইচ্ছামৃত্যুর ক্ষমতায় বেঁচে আছে! কথাটা বিশ্বাস নাই করলেন। কিন্তু মহাভারতের কবি, যিনি এক চিরকালীন মহাকাব্য লিখতে বসেছেন, তাঁর হৃদয়ের জল্পনাটুকু বোঝবার চেষ্টা করুন। বরঞ্চ লৌকিক দৃষ্টিতেই বুঝে নিন না কেন যে, বৃদ্ধ পিতামহ অর্জুনের শরাঘাতে আহত হয়েছিলেন যথেষ্ট, কিন্তু সে আঘাত তাঁকে সেনাপতিত্ব থেকে বিচ্যুত করলেও, তা বৃদ্ধের মরণ ডেকে আনেনি সঙ্গে সঙ্গে। এতে তো কবির যুক্তিটাই প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্জুনও তো বৃদ্ধ পিতামহকে মেরে ফেলতে চাননি। এই মানুষটির ওপর তাঁর এতটাই শ্রদ্ধা এবং মমতা ছিল যে, তিনি তাঁকে বাণাঘাত করতেই কুণ্ঠিত ছিলেন। ফলত তাঁর বাণের আঘাত সেইটুকুমাত্র ছিল যা বৃদ্ধ পিতামহকে যুদ্ধ থেকে বিরত করে। অতএব তিনি আহত হয়েছেন কিন্তু মরেননি। অর্জুনের শরকন্টক তাঁকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে বলেই হয়তো শরশয্যার অভিসন্ধি তৈরি করেছেন বর্ণনানিপুণ মহাকাব্যের কবি।

ভীষ্মের পতনের পর আরও যে আট দিন ভয়ংকর যুদ্ধ হল, দ্রোণ, কর্ণ, দুর্যোধনের মতো মহারথীরা যে যুদ্ধে আত্মাহুতি দিলেন, কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গন জুড়ে বিধবা স্ত্রী আর পুত্রহারা মায়েদের করুণ ক্রন্দন অনুরণিত হল—এই সমস্ত পর্ব জুড়ে মহামতি ভীষ্মকে একবারও চোখের সামনে আনলেন না মহাভারতের কবি। অতিপ্রসিদ্ধ কুরুমুখ্যদের শ্রদ্ধশান্তিও হয়ে গেল। সময় এল যুধিষ্ঠিরের রাজা হবার। আত্মীয়স্বজনের বিয়োগব্যথায় ক্লিষ্টদিগ্ধ যুধিষ্ঠির সিংহাসনে বসতে চাইলেন না। তাঁকে বোঝানোর পালা চলল কতদিন ধরে। পাঁচ ভাই বোঝালেন, দ্রৌপদী বোঝালেন, কৃষ্ণ বোঝালেন, অবশেষে বোঝালেন বিশালবুদ্ধি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। যুধিষ্ঠিরের মন শেষপর্যন্ত শান্ত হল। কিন্তু মন শান্ত হলেও রাজা হবার ব্যাপারে তাঁর সংশয় আছে। প্রশ্ন আছে।

একবার তো তিনি রাজ্য পেয়েছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থে, কিন্তু সে রাজ্য তো তিনি ধরে রাখতে পারেননি। যুধিষ্ঠিরের তাই সংশয় আছে। তিনি ভাবেন—তাঁর মনটা ত্যাগবৈরাগ্য মুনিবৃত্তি বোঝে ভাল। কিন্তু রাজা হতে গেলে যে সমস্ত গুণ লাগে, রাজোচিত কূটনীতি, ষাড়্‌গুণ্যের যে বোধ লাগে, তা বুঝি তাঁর নেই। তাঁর সদাজাগ্রত ধর্মবোধ, ন্যায়নীতিবোধের সঙ্গে রাজনীতির চাতুর্য যেন কিছুতেই মিলতে চায় না। ব্যাসকে তিনি সে কথা বলেও ফেললেন। বললেন—দেখুন, মানুষের ধর্মবোধ এবং ধর্মচর্যার সঙ্গে রাজনীতির কূটকচালিটা একেবারেই বিরুদ্ধ—ধর্মচর্য্যা চ রাজ্যঞ্চ নিত্যমেব বিরুধ্যতে। এবারে নিজের দুর্বলতার কথাটা ব্যাসের সামনে বলেই ফেললেন যুধিষ্ঠির। বললেন—মুনিবর! আপনি আমাকে রাজনীতি, রাজধর্মের তত্ত্বগুলি বিস্তারিত জানান। আমি সব শুনতে চাই। শুনতে চাই—রাজার করণীয় কর্তব্যগুলি, ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় ইত্যাদি চতুর্বর্ণের সামাজিক স্থিতি, শুনতে চাই আপদকালের কর্তব্য এবং সব শেষে জানতে চাই—ধর্মকে অতিক্রম না করেও কীভাবেই আরও রাজ্যজয় সম্ভব—ধর্মমালক্ষ্য পন্থানং বিজয়েয়ং কথং মহীম্।

যুধিষ্ঠির যখন এই প্রশ্ন করছেন, তখন ব্যাসের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন নারদ—যে নারদ রাজনীতিশাস্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন সেকালে এবং লৌকিক সমস্ত বিষয়েই তাঁর জ্ঞান ছিল অসামান্য। যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন শুনে ব্যাস একবার নারদের দিকে তাকিয়েও ছিলেন, যেন তিনি নারদকেই যুধিষ্ঠিরের প্রশ্ন সমাধান করতে বলবেন—নারদং সমভিপ্রেক্ষ্য সর্বজ্ঞানাং পুরাতনম্‌। কিন্তু না, নারদকে তিনি বলতে বললেন না, এবং নিজেও তিনি বললেন না কিছু। চরম পরামর্শ দিয়ে ব্যাস বললেন—রাজধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি—যা যা তুমি শিখতে চাও বললে, তা সবকিছু ভালভাবে জানতে হলে তোমাকে যেতে হবে কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মের কাছে—উপৈহি ভীষ্মং মহাবাহো বৃদ্ধং কুরুপিতামহম্।

শুধু এই সৎপরামর্শটুকু দিয়েই ব্যাস চুপ করে গেলেন না। তিনি বললেন—সুরনদী গঙ্গার গর্ভে যাঁর জন্ম, দেবতাদের যিনি সামনে থেকে দেখেছেন, দেবতাদের জন্য তৈরি বৃহস্পতিপ্রণীত রাজনীতিশাস্ত্র এবং অসুরদের জন্য তৈরি শুক্রাচার্যপ্রণীত রাজনীতিশাস্ত্র—দুটোই যিনি ভালভাবে জানেন—উশনা বেদ যচ্ছাস্ত্রং যচ্চ দেবগুরু-র্দ্বিজঃ—যিনি পরশুরামের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখেছেন এবং যিনি অধ্যাত্মতত্ত্ব, আত্মতত্ত্বও খুব ভালভাবে জানেন, তুমি সেই বৃদ্ধ পিতামহের কাছে যাও। তিনিই তোমার সমস্ত প্রশ্নরহস্য সমাধান করে দেবেন—স তে বক্ষ্যতি ধর্মজ্ঞঃ সূক্ষ্মধর্মার্থতত্ত্ববিৎ।

এখানে ভাল একটা প্রশ্ন ওঠে। প্রশ্ন ওঠে—আত্মতত্ত্ব, অধ্যাত্মতত্ত্ব, রাজনীতিশাস্ত্র—এগুলো কি ব্যাস নিজে কম জানেন। ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় বহুবার তাঁকে উপস্থিত হতে দেখেছি এবং দেখেছি সার্থক রাজনৈতিক পরামর্শদাতার ভূমিকায়। তা তিনি কি রাজনীতি রাজধর্মের উপদেশ নিজে দিতে পারতেন না যুধিষ্ঠিরকে? তা ছাড়া নারদও তো ছিলেন। মহাভারতের মধ্যেই তাঁকে রাজনীতিশাস্ত্রের বিশাল বোদ্ধা হিসেবে কীর্তন করা হয়েছে। যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে প্রথমবার রাজপদবি লাভের পর নারদ এসেছিলেন তাঁর সভায়। সেখানে নারদের যেসব গুণবর্ণনা আছে, তাতে তাঁকে রাজনীতিশাস্ত্রের এক পরম বোদ্ধা বলে মনে করা যেতে পারে। রাজনীতিশাস্ত্রের অন্যতম মহান প্রবক্তা হিসেবে নারদের যে নিজস্বতা ছিল তা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকেও প্রমাণ করা যায়। কিন্তু সেই নারদের দিকে একবার তাকিয়েও তাঁকে ব্যাস অনুমতি করেননি যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দেবার জন্য। তিনি ভীষ্মের কাছে যেতে বললেন যুধিষ্ঠিরকে। এর একটা রহস্য আছে।

মনে রাখতে হবে—কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস যখন পরাশরের ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে জন্মাচ্ছেন, ভীষ্মও প্রায় ঠিক সেই সময়েই জন্মাচ্ছেন শান্তনুর ঔরসে গঙ্গার গর্ভে। ভীষ্ম পিতার সূত্রে আর ব্যাস মাতার সূত্রে পরস্পরের ভাই। ব্যাস পরাশরের তেজোজাত, তাঁর প্রধান সংস্কার ব্রাহ্মণের। ভীষ্ম শান্তনুর ঔরসজাত, তাঁর প্রধান সংস্কার ক্ষত্রিয়ের। রাজধর্মের বিষয়ে ব্রাহ্মণ হিসেবে ব্যাস এবং নারদের যে জ্ঞান আছে, তা প্রধানত তাত্ত্বিক জ্ঞান, রাজনীতি বা বিশেষত পররাষ্ট্র বিষয়ে যে ষাড্‌গুণ্যের প্রয়োগ ঘটত সেকালে, সেই প্রায়োগিক রাজনীতির সঙ্গে ব্যাস বা নারদের পরিচিতি ছিল কম। বহু বহু রাজার মন্ত্রণাসভায় তাঁরা মন্ত্রণা দিতেন বটে, কিন্তু রাজনীতির তাত্ত্বিক মন্ত্রণা এবং তার প্রয়োগে আকাশপাতাল তফাত আছে।

এবারে ভীষ্মের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ অস্ত্রগুরু পরশুরামের কাছ থেকে তিনি অস্ত্রবিদ্যার পাঠ লাভ করেছিলেন, অন্যদিকে রাজনীতির বিষয়ে তিনি যে তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভ করেছেন, তা দুভাবে। দেবতাদের শাসন চালানোর জন্য বৃহস্পতি-কথিত বাৰ্হস্পত্য রাজনীতি তিনি শিখেছেন তাঁদেরই কাছ থেকে যাঁরা বৃহস্পতি সম্প্রদায়ের রাজনীতি জানেন। শিখেছেন বেশ যত্ন করে, টাকাপয়সা দিয়ে এবং গুরুদের তুষ্ট করে—বৃহস্পতিপুরোগাংস্তু দেবর্ষীনসকৃৎ প্রভুঃ। তোষয়িত্বোপচারেণ রাজনীতিমধীতবান্॥ কিন্তু রাজনীতির এই এক পিঠ জেনেই তিনি ক্ষান্ত হননি। দেবতাদের রাজনীতির বিরুদ্ধ কোটিতে রয়েছে অসুর রাক্ষসদের রাজনীতি। ভীষ্ম সেটাও যত্ন করে শিখেছেন এবং তা শিখেছেন অসুরগুরু শুক্রাচার্যের সম্প্রদায়ের গুণী আচার্যদের কাছ থেকে। এই পরস্পর বিরোধী রাজনীতির তত্ত্ব সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম করে ভীষ্ম যে নিজেও রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রসম্বন্ধী বিভিন্ন বিষয়ে একেবারে নিজস্ব তত্ত্ব সৃষ্টি করেছিলেন, তার প্রমাণ আছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে। কৌটিল্য কৌণপদন্ত নামে যে পূর্বাচার্যের মত উল্লেখ করেছেন মাঝে মাঝে, তিনি আসলে ভীষ্ম। রাজনীতিশাস্ত্রের পরম্পরায় ভীষ্মের এই নামই প্রসিদ্ধ।

তা হলে যেটা দাঁড়াল সেটা হল—রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তাত্ত্বিকতার বিচারে ভীষ্মের জ্ঞান পরস্পরবিরোধী শুক্র-বৃহস্পতিমতের সমন্বয়ী এবং সেখানেও তাঁর নিজস্বতা আছে। ব্যাস এবং নারদ এখানে তাঁর সমকক্ষ নন। এরসঙ্গে বাড়তি যেটা ভীষ্মের মধ্যে আছে সেটা হল রাজনীতির প্রায়োগিক জ্ঞান, যা ব্যাস এবং নারদের একটুও নেই। ব্যাস নারদ কোনওদিন রাজ্যপাট চালাননি, অতএব রাজ্যশাসনের বাস্তব সমস্যাগুলি শুধুমাত্র তাত্ত্বিকের বুদ্ধিগোচর হয় না বলেই ব্যাস নারদের চেয়ে ভীষ্মের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। অন্যদিকে ভীষ্মের আরও একটা বিশেষত্ব আছে। ভীষ্ম রাজ্য চালিয়েছেন রাজা না হয়ে। তিনি যদি রাজা হতেন, তা হলে তাঁর স্বামীত্বের প্রভাবে সাধারণের সুখ দুঃখ তাঁর নজরে পড়ত না। কিন্তু তাঁকে রাজ্য চালাতে হয়েছে চিরকালই এক বিশ্বস্ত রাজকর্মচারীর মতো—সম্পূর্ণ নিষ্কামভাবে, যথাবিধি, যথান্যায়ে এবং তাও শুধু প্রসিদ্ধ ভরত-কুরুবংশের মান মর্যাদা মাথায় রেখে, সেই মর্যাদার স্থায়িত্বের তাগিদে।

আর কোন কাল থেকে তিনি রাজ্যপাট সামলাচ্ছেন! সেই পিতা শান্তনু যখন বেঁচে আছেন, তখন থেকে। শান্তনুর রাজ্যে তিনি প্রথমে যুবরাজ ছিলেন এবং সেই যৌবরাজ্যের কালেই রাজকার্যের সমস্ত ভারই তাঁর হাতে ন্যস্ত ছিল। রাজা নন বলেই রাজার চরম ক্ষমতা তিনি ভোগ করছেন না, অথচ তিনি রাজ্যশাসন চালাচ্ছেন। ঠিক এই অবস্থায় ন্যায়নীতির ভাবনাটাই বড় হয়ে ওঠে বলে স্বেচ্ছাচারের কোনও অবসর থাকে না। পিতার বিবাহের পর এবং তাঁর সন্তানলাভের পর রাজ্যচালনার সেই নিষ্কাম কৌশল আরও এক নতুন মাত্রা লাভ করল। কোনও দিন বিবাহ করবেন না এবং কোনও দিন রাজা হতে চাইবেন না—এই প্রতিজ্ঞার পাশাপাশি তাঁকে রাজ্যশাসন চালিয়ে যেতে হচ্ছিল। কুমার বিচিত্রবীর্য যখন রাজাসনে বসেও বিবাহোত্তর জীবনে কামনার আধিক্যে ধর্মের শাসন ভুলে রইলেন, তখনও ভীষ্মকেই হস্তিনাপুরের শাসনভার গ্রহণ করতে হয়েছে এবং সেই রাজ্য তিনি চালিয়ে গেছেন ন্যস্তকর্ম রাজভৃত্যের মতো।

‘ন্যাস’, ‘ন্যস্ত’, ‘নিক্ষেপ’, ‘নিক্ষিপ্ত’—এই শব্দগুলির একটা অদ্ভুত তাৎপর্য আছে সংস্কৃতে। একটা জিনিস একজনের কাছে রাখতে দেওয়া হল বিশ্বাস করে—বিশ্বাসটা এই যে, সে বস্তুটিকে সুরক্ষিত রাখবে, কিন্তু নিজের ভোগে লাগাবে না এবং প্রয়োজনমতো সে জিনিসটা প্রত্যর্পণও করবে। সম্পূর্ণ এই প্রক্রিয়াটাকে বলে ন্যাস অথবা নিক্ষেপ। তা শান্তনুর মৃত্যুর পর ভরত-কুরুবংশের পরম্পরাগত রাষ্ট্রশাসনের ভার ভীষ্মের ওপরেই ন্যস্ত হয়েছিল। তিনি রাজ্যখণ্ড সুরক্ষিত করেছেন, বিবর্ধিত করেছেন, কিন্তু ভোগ করেননি। আবার যখনই প্রয়োজন পড়েছে একবার চিত্রাঙ্গদের হাতে, একবার বীচিত্রবীর্যের হাতে, আবার তাঁরাও মারা গেলে শেষবারের মতো পাণ্ডুর হাতে কুরুরাষ্ট্রের শাসনভার তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন। এর ফলে কী হয়েছে—কুরুরাষ্ট্র তিনি কখনওই রাজার অধিকারে ভোগ করেননি, একটা বিশাল সময় ধরে তিনি সে রাষ্ট্র সুরক্ষিত রেখেছেন এবং পালন করেছেন।

এই যে ভোগ না করে পালন করা—এই নির্লিপ্তির মধ্যে থেকে রাজনীতির তত্ত্ব এবং প্রয়োগ ব্যাপারটা সবচেয়ে ভাল বোঝা যায়। ভীষ্মের মতো করে সেটা আর কেউ বোঝেননি। ব্যাসও না, নারদও না এবং ঠিক সেই কারণেই রাজধর্মের উপদেশ দেবার জন্য ভীষ্মের চেয়ে উপযুক্ত মানুষ মহাভারতের কবি খুঁজে পাননি। ভীষ্মকে তিনি দেখেছেন অত্যন্ত কাছে থেকে। সত্যবতীর স্মরণমন্ত্রে যেদিন তিনি পাণ্ডু-ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম দান করার জন্য হস্তিনাপুরে এসেছিলেন, সেদিনই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন তাঁর ঔরসজাত সন্তানদের লালনপালন তথা মানুষ করার জন্য তাঁর প্রতিনিধিস্থানীয় অপরাংশ রয়ে গেছেন হস্তিনাপুরে। এই আত্মসম্বন্ধ শুধু নয়, রাজনীতির ক্ষেত্রে ভীষ্মের সম্পূর্ণতা তিনি উপলব্ধি করেছেন পদে পদে। পাণ্ডুর রাজা হবার পর থেকে ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের স্বার্থভাবনার প্রতিবাদী স্থানে ভীষ্মকে ব্যাস যেভাবে নির্লিপ্ত পরামর্শদাতার ভূমিকায় দেখেছেন, তাতে রাজনীতির তাত্ত্বিক এবং প্রায়োগিক ক্ষেত্রে ভীষ্মের পরম মাহাত্ম্য তিনি উপলব্ধি করেছেন বলেই যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—যিনি কথা বললে ব্রহ্মর্ষি ঋষিরা পর্যন্ত মন দিয়ে শোনেন, ধর্মতত্ত্ব এবং রাজনীতি অর্থনীতি যিনি অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে জানেন, তুমি তাঁর কাছে যাও, বৎস। এখনও তিনি প্রাণত্যাগ করেননি, তোমাকে উপদেশ করার পরেই তিনি প্রাণত্যাগ করবেন—তমভ্যেহি পুরা প্রাণান্ স বিমুঞ্চতি ধর্মবিৎ।

ব্যাসের কথা শুনে যুধিষ্ঠির বিমনা হয়েছিলেন। লজ্জায় নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিলেন—কোন মুখে তাঁর সঙ্গে আমি কথা কইতে যাব। এক সরল মানুষকে আমরা ছল করে মেরেছি। এর পরে কী করে তাঁর কাছে এটাওটা জিজ্ঞাসা করব—উপসম্প্রষ্টুমর্হামি তমহং কেন হেতুনা? যুধিষ্ঠিরের এই দুর্ভাবনায় কোনও উত্তর দেননি ব্যাস। কিন্তু এখানে উত্তর দিয়েছেন কৃষ্ণ। প্রায় ধমক দিয়ে তিনি বলেছেন—এখন শোক করার সময় নয়, মহারাজ! বরঞ্চ মহর্ষি ব্যাস যা বলেছেন, তাই আপনি নির্দ্বিধায় পালন করুন—যদাহ ভগবান ব্যাসস্তৎ কুরুষ্ব নৃপোত্তম। কথাটা বলেই কৃষ্ণ তাঁকে আগে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে বসতে বলেছেন। বলেছেন—ব্রাহ্মণরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা করছেন রাজন্যবর্গ, অপেক্ষা করছেন পৌর-জনপদবাসীরা। আপনি আগে রাজা হয়ে সিংহাসনে বসুন।

কৃষ্ণ মনে করিয়ে দিলেন যে, ব্যাস তাঁকে আগে সিংহাসনে বসতে বলেছেন, তার পরে ভীষ্মের কাছে যেতে বলেছেন রাজধর্মের উপদেশ গ্রহণ করার জন্য। কিন্তু রাজা হবার পর রাজকর্মের প্রাথমিক সমস্যাগুলি সামলাতে যুধিষ্ঠিরের বেশ কয়েকদিন চলে গেল। পাঁচ পাণ্ডব ভাই কে কোন প্রাসাদে থাকবেন তা নিয়েও কয়েকদিন গেল। যুধিষ্ঠির এবারে একটু অবসর পেয়েছেন কিন্তু ভীষ্মের কাছে যাবার কথাটা আর তিনি বলছেন না। হয়তো লজ্জায়, হয়তো আত্মধিক্কারে সেখানে যাবার কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি।

এইরকম অবসরপ্রাপ্ত একটি দিনে যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সঙ্গে দেখা করে কৃষ্ণের ঘরে এলেন। সেখানে কুশল প্রশ্নের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রশংসায় যুধিষ্ঠির প্রায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠলেন। এই প্রশংসায় কৃষ্ণের দিক থেকে একটা সলজ্জ আত্মতৃপ্তির উদ্ভাসই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু একেবারেই আনমনা হয়ে আছেন, যুধিষ্ঠিরের কথা যে তাঁর কানে যাচ্ছে, তাও মনে হল না। তিনি কোনও উত্তরও দিচ্ছেন না—নোবাচ ভগবান্ কিঞ্চিদ্‌ ধ্যানমেবান্বপদ্যত—কেবলই কী যেন চিন্তা করছেন বলে মনে হল। যুধিষ্ঠির জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন। বললেন—কী? অদ্ভুত কিছু ভাবছ নাকি বসে বসে? এই পৃথিবীতে কি কেউ বড় অসুখে আছে যে, এত কিছু চিন্তা করছ তুমি—কিমিদং পরমাশ্চৰ্য্যং ধ্যায়স্যমিতবিক্রম? কেমন যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে আছ, বাক্য মন সব যেন বুদ্ধিতে সন্নিবিষ্ট করে কেমন যেন নিবাত নিষ্কম্প প্রদীপের মতো জ্বলছ—যথা দীপো নিবাতস্থো নিরিঙ্গো জ্বলতে পুরঃ। যুধিষ্ঠির জানতে চাইলেন কী এমন ঘটে গেল হঠাৎ, যাতে এত চিন্তান্বিত দেখাচ্ছে কৃষ্ণকে।

কোনও সন্দেহ নেই, অন্তত এই জায়গায় মহাভারতের কবির লেখনীতে কিছু অলৌকিকতা এসেছে। কৃষ্ণ বলেছেন—শরশয্যায় শয়ান ভীষ্ম ব্যগ্র হয়ে আমারই কথা ভাবছেন, আমি তাই মনে মনে তাঁর কাছেই চলে গেছি—মাং ধ্যাতি পুরুষব্যাঘ্ৰস্ততো মে তদ্‌গতং মনঃ। কৃষ্ণ একের পর এক ভীষ্মের গুণের কথা বলেছেন, তাঁর শৌর্যবীর্যের ঘটনাগুলি এক এক করে উল্লেখ করেছেন এবং সবশেষে ধ্রুবপদের মতো একই বাক্য উচ্চারণ করে বলেছেন—আমি মনে মনে তাঁর কাছে চলে গেছি—তমস্মি মনসা গতঃ। কৃষ্ণ এবার মহর্ষি ব্যাসের কথাটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। বলেছেন—তিনি হচ্ছেন সমস্ত বিদ্যার আধার, তিনি ক্রান্তদর্শী—ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান তিনি জানেন। আজকে দৈববশে ভীষ্মের শেষ কাল উপস্থিত। অন্ধকার রাত্রিতে চাঁদ না উঠলে রাত্রির যে অবস্থা হয়, ভীষ্ম না থাকলে এই পৃথিবীও তেমনই অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে—ভবিষ্যতি মহী পার্থ নষ্টচন্দ্রেব শর্বরী। সমস্ত জ্ঞান, সমস্ত বিদ্যা এই পৃথিবী থেকে লুপ্ত হয়ে যাবে।

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে বললেন—ভীষ্মের কাছে তোমার যাওয়া দরকার। তাঁর কাছে গিয়ে তোমার যেসব জিজ্ঞাসা আছে সেসব নিয়ে প্রশ্ন করো। তিনি বেদ বেদাঙ্গ জানেন, তর্কযুক্তি দর্শন জানেন, অর্থনীতি জানেন, রাজনীতি জানেন এবং জানেন এই সমাজকে, যে সমাজ দাঁড়িয়ে আছে চতুর্বর্ণ এবং চতুরাশ্রমের ওপর ভিত্তি করে। তুমি আজ সিংহাসনে বসেছ, অতএব এই নিখিল রাজধর্ম তাঁর কাছ থেকে জেনে নাও—রাজধর্মাংশ্চ নিখিলং পৃচ্ছৈনং পৃথিবীপতে। আজকে ভীষ্মের মতো সূর্যগ্রহটি যদি অস্ত যান, তা হলে সমস্ত জ্ঞানও অস্ত যাবে।

একবার চন্দ্র এবং একবার সূর্যের সঙ্গে তুলনা করে কৃষ্ণ ভীষ্মকে স্বপ্রকাশ আলোর স্বরূপে প্রতিষ্ঠা করলেন। কৃষ্ণের মুখে ভীষ্মের কথা শুনে যুধিষ্ঠির চোখের জল রাখতে পারলেন না। হয়তো সেই দৃশ্যটি তাঁর চোখের সামনে ভেসে এল যেভাবে প্রায় নিরুদ্যোগী সৈনিকের মতো অস্ত্ৰত্যক্ত অবস্থায় শিখণ্ডী-অর্জুনের বাণে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বললেন—ভীষ্ম যে কত বড় মানুষ, কত যে তাঁর প্রভাব, তা আমি জানি। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা বার বার তাঁর কথা সশ্রদ্ধে উল্লেখ করেন। তা ছাড়া তুমি এমন করে বলছ, আমি কি না গিয়ে পারি? আমরা তোমাকে সামনে রেখে সবাই যাব সেই ভীষ্মের কাছে—ত্বামগ্রতঃ পুরস্কৃত্য ভীষ্মং যাস্যামহে বয়ম্। যেন কৃষ্ণকে সামনে রাখলেই ভীষ্মকে অস্ত্রাঘাতে পাতিত করার লজ্জা থেকে মুক্তি পাবেন যুধিষ্ঠির!

কৃষ্ণ সাত্যকিকে ঘোড়া যুততে বললেন রথে। মহাভারতে এরপরে এক অধ্যায় জুড়ে ভীষ্মের মুখে কৃষ্ণের স্তুতি এবং ধ্যানবর্ণনা আছে। সে বর্ণনায় কৃষ্ণ সম্পূর্ণ ভগবত্তায় প্রতিষ্ঠিত। এটাকে যাঁরা প্রক্ষেপ ভাবেন ভাবুন, কিন্তু কৃষ্ণকে পুরুষোত্তমের মর্যাদা প্রথম দিয়েছিলেন ভীষ্মই—সেই যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে প্রথম পূজার অর্ঘ্যটি কৃষ্ণকে নিবেদন করে। কাজেই ভীষ্মের মুখে এই কৃষ্ণস্তুতি আমাদের কাছে বেমানান লাগে না, কেননা কৃষ্ণের মধ্যে সেই অলোকসামান্য প্রতিভা এবং বুদ্ধি ছিল এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এই ধুরন্ধর ব্যক্তিত্বকে ভীষ্মই প্রথম চিনিয়ে দিয়েছিলেন; অতএব এক্ষেত্রে ভীষ্মের মানুষ চেনবার ক্ষমতাটাও বুঝে নিতে হবে। মহাভারতে ভীষ্মের এই স্তবরাশি ‘ভীষ্মস্তবরাজ’ নামে চিহ্নিত হয়েছে এবং তারমধ্যে কৃষ্ণ একাত্ম হয়ে গেছেন নারায়ণ-বিষ্ণুর সঙ্গে, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা—ভীষ্মের মুখে কৃষ্ণ পরিচিত হয়েছেন এক অনন্তকর্মা মহাশক্তিমান সর্বব্যাপ্ত পুরুষ হিসেবে, যে পুরুষের প্রণামমন্ত্রটি এখনও চলে আসছে সমস্ত ভারতবাসীর শত শত মুখে—এবং সেটা ভীষ্মই উচ্চারণ করেছিলেন—

নমো ব্ৰহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ।

জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ॥

যুধিষ্ঠির এবং তাঁর আর চার ভাইকে নিয়ে কৃষ্ণ যখন ভীষ্মের কাছে চললেন, তখন যেতে যেতে আবারও সেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রেই এসে উপস্থিত হতে হল। এখানে সেখানে মৃতের অস্থিকঙ্কাল এখনও ছড়িয়ে আছে। ছড়িয়ে আছে হাতি ঘোড়ার বড় বড় হাড়গোড়, মানুষের মাথার খুলি ইতস্তত। মহাভারতের কবি উপমা দিয়েছেন—যেন মদমত্ত যমরাজ খুব করে মদ্যপান করে এখানে ওখানে ছড়িয়ে রেখে গেছেন মৃত্যুরস পান করার পানপাত্রগুলি এবং সঙ্গে খাবারের উচ্ছিষ্ট মাংসের হাড়—আপানভূমিং কালস্য তথা ভুক্তোজ্ঝিতামিব। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমি পেরিয়ে পাণ্ডবরা কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে ভীষ্মের কাছে পৌঁছোলেন ওঘবতী নদীর তীরে। যুদ্ধস্থল থেকে তাঁকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আগেই। আমরা আগেই বলেছি যে, ভীষ্মের ইচ্ছামতো তাঁর শয়নভূমির চারদিকে পরিখা খনন করে দেওয়া হয়েছিল এবং এখন দেখছি ভীষ্ম যেখানে শরশয়নে শুয়ে আছেন, সে জায়গাটা ওঘবতী নদীর তীরে—দেশে পরমধর্মিষ্ঠে নদীমোঘবতীমনু।

ওঘবতী নদীকে এখন চিনতে পারবেন না। পণ্ডিতজনেরা এই নদীটিকে সরস্বতী নদীর নামান্তর বলে গবেষণা করেছেন এবং মহাভারতের শল্যপর্বে সে প্রমাণ আছেও। সরস্বতীর জল রাজস্থানের মরুভূমিতে হারিয়ে গেছে। শিবালিক পর্বতমালার বহির্ভাগ শিরমুর অঞ্চল থেকে এই নদী বেরিয়েছে বলে বরফগলা জলে এই নদীর প্রবাহ চলে না। চলে বৃষ্টির জলে। ফলে এই আছে এই নেই করতে করতে নদীটাই গেছে হারিয়ে। কিন্তু ঋগ্‌বেদের যুগে সরস্বতীর প্রবাহ বর্তমান ছিল এবং তা নাকি সমুদ্রেও পড়েছিল। হয়তো বা মহাভারতের যুগেও সরস্বতীর প্রবাহ লুপ্ত হয়নি। অন্যেরা বলেন সরস্বতীর শাখানদী ওঘবতী, এমনকী ওঘবতীকে সরস্বতীই বলা চলে। সে যাই হোক, শাখাই হোক, আর পুরোপুরি নদীই হোক, ঘটনা হল, পুণ্যতমা নদীর মধ্যে সরস্বতী অথবা ওঘবতী হল পুণ্যতমা। হয়তো বা ভীষ্মের ইচ্ছামতেই আর্যদের বহুকীর্তিত এই পুণ্যনদীর তীরে তাঁর শেষশয্যা রচিত হয়েছিল।

ভীষ্ম যেখানে শুয়ে ছিলেন, সেখানে আজ আর কোনও নির্জনতা নেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মুনিঋষিরা ভীষ্মের পাশে এসে উপস্থিত হয়েছেন। এমনকী ব্যাস যে ব্যাস, যিনি যুধিষ্ঠিরকে সিংহাসনে বসবার আগে ভীষ্মের কাছে যাবার উপদেশ দিয়েছিলেন, তিনিও আর বেশি দেরি করেননি। যুধিষ্ঠিরের অভিষেককালেও তাঁকে আমরা দেখতে পাইনি। তিনি ভীষ্মের শরশয্যার পাশে এসে উপস্থিত হয়েছেন অনেক আগেই। তিনি ভীষ্মের ভাই। হস্তিনাপুরে তিনটি পুত্রের জন্মই তিনি দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন, কেননা ভীষ্মের মতো সংসারে থাকা সন্ন্যাসী নিষ্কামভাবে তাঁর পুত্রগুলিকে লালন পালন করবেন শুধু ইতিকর্তব্যের তাড়নায়। এমন করে যিনি কর্মযোগ পালন করতে পারেন, তাঁর শেষসময়েই তো ব্যাসের মতো ক্রান্তদর্শী পুরুষ পাশে এসে বসেন শিক্ষার তাড়নায়। পাশে এসে বসেন পুরুষোত্তম কৃষ্ণ একান্ত শুশ্রূষুর ভূমিকায়। উন্মুখ হন যুধিষ্ঠির ধর্মরাজ রাজনীতি শিক্ষার জন্য।

ব্যাসের সঙ্গে আরও যেসব মুনি-ঋষিরা সঙ্গত হয়েছিলেন ওঘবতীর তীরে, তাঁদের অনেকের মধ্যে ছিলেন নারদ, জৈমিনি, পৈল, দেবল, বশিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র, হারীত, অত্রি, শুক্র, বৃহস্পতি, গৌতম, লোমশ, মার্কণ্ডেয়, কপিল এবং আরও শত শত মুনি-ঋষি। জিজ্ঞাসা হবে—এই যে সব নাম শুনছি, এঁরা কি অমর নাকি। সব যুগেই কি এঁরা বেঁচে থাকেন? এর উত্তর খুব সোজা। পূর্বোক্ত এবং আমার অনুক্ত নামগুলির মধ্যে অনেক নামই আছে, যেসব ঋষির নাম শুধু বলার জন্যই বলা হয়েছে, কেননা তাতে ভীষ্মের গৌরব বাড়ে। আর মহাকাব্যের বিশাল পটভূমির কথা মনে রাখলে এটাই স্বাভাবিক যে, যেখানে বিশজন এসেছেন, সেখানে একশোজনের বর্ণনা করতে হবে। কিন্তু এই সমস্ত অস্বাভাবিকতা এবং সংখ্যাভ্রান্তি চলে যাবে, যদি বোঝেন যে, এইসব মহান ঋষির নাম শ্রবণমাত্রেই তাঁদের ব্যক্তিগত উপস্থিতি কল্পনীয় নয়। মনে রাখা দরকার—এইসব ঋষিরা অনেকেই বিশিষ্ট বিদ্যাসম্প্রদায়ের প্রবর্তক। কেউ ধর্মে, কেউ দর্শনে, কেউ সমাজ এবং রাষ্ট্রের আইনসংক্রান্ত ব্যাপারে, কেউ বা রাজনীতিশাস্ত্রে—এই সব মুনিঋষিরা এক-একজন দিকপাল। জীবন, সমাজ এবং রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য এঁরা সব বিশিষ্ট গ্রন্থ রচনা করেই ক্ষান্ত হননি, নিজেদের ভাবনা সজীব রাখবার জন্য তাঁরা বিশিষ্ট সম্প্রদায়ও প্রবর্তন করেছিলেন। কাজেই যেসব ঋষি-মুনিরা ভীষ্মের শেষশয্যার পাশে উপস্থিত হয়েছেন বলে শব্দত উচ্চারিত হয়েছেন, আসলে তাঁরা সকলেই ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন তাঁদের বিশিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত এবং পরম্পরাগত শিষ্য-প্রশিষ্যরা এবং তাঁদের উপস্থিতিই কীর্তিত হয়েছে তাঁদের সম্প্রদায়-প্রতিষ্ঠাতা গুরুর নামে। অর্থাৎ জৈমিনি, কপিল, বৃহস্পতি—এঁরা কেউই নামমাত্র নন, এঁরা প্রত্যেকে এক-একটা ‘ইনস্টিটিউশন’।

দূর থেকে ভীষ্মকে দেখেই কৃষ্ণ, সাত্যকি এবং পাণ্ডবরা সবাই নিজেদের বাহন থেকে নামলেন। নিজেদের চঞ্চল মন যথাসম্ভব স্থির সংযত করলেন স্থিতধী মুনিদের দেখে—অবস্কন্দ্যাথ বাহেভ্যঃ সংযম সচলং মনঃ। ব্যাস ইত্যাদি মুনি-ঋষিদের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে তাঁরা সকলে ভীষ্মকে ঘিরে বসলেন চারধারে। কৃষ্ণ ধীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন—আপনার শরীরে যত কষ্ট তাতে সমস্ত জ্ঞান এবং বিদ্যা এখনও আপনার হৃদয়ে সম্পূর্ণ প্রতিভাত হয় তো? আপনার বুদ্ধির কোনও বৈকল্য ঘটেনি তো—ক্কচিজ্‌ জ্ঞানানি সর্বানি প্রসন্নানি যথা পুরা। শরসন্তপ্ত হলেও ভীষ্মের জ্ঞানবুদ্ধি যে আগের মতোই উজ্জ্বল আছে, সেটা কৃষ্ণ জানতেনই। কারণ বাহ্য শরীরের কষ্ট কখনও স্থিতধী ব্যক্তির আত্মতেজ নাশ করে না। কৃষ্ণ কিন্তু তবুও প্রচুর সমব্যথা প্রদর্শন করে বললেন—এই শরাঘাতের ফলে নিশ্চয়ই বড় কষ্ট হচ্ছে আপনার শরীরে। আর শরীরের কষ্ট এমনই এক বাস্তব যা মনের কষ্টের চেয়ে বেগ দেয় বেশি—মানসাদপি দুঃখাদ্ধি শরীরং বলবত্তরম্‌।

সাধারণ এই কথাগুলি বলার পরেই ভীষ্মের সমস্ত জীবনের শৌর্য, বীর্য, ধৈর্য তথা তাঁর অধিগত বিদ্যার প্রশংসা করে কৃষ্ণ বললেন—পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির আপনার সামনে উপস্থিত হয়েছেন শুশ্রূষু হয়ে। যুদ্ধের ফলাফলে তাঁর মন শোকাচ্ছন্ন। আপনি উপযুক্ত উপদেশের মাধ্যমে তাঁর শোক অপনোদন করুন। পণ্ডিতেরা যাকে একত্রে চতুর্বিদ্যা বলেন, সেই ত্রয়ী (তিনটি বেদের জ্ঞান), আন্বীক্ষিকী, (যুক্তি, তর্ক, দর্শন), বার্তা (অর্থনীতি) এবং দণ্ডনীতি (রাষ্ট্রবিজ্ঞান) সবই আপনার জানা আছে। জানা আছে সামাজিক নিয়মনীতি অর্থাৎ চতুর্বর্ণের ধর্মাধর্ম। সাংখ্যযোগের মতো দর্শন যেমন আপনার জানা আছে, তেমনই জানা আছে এই সম্পূর্ণ দেশের ভৌগোলিক, কৌলিক এবং জাতিগত ব্যবহার—দেশ-জাতি-কুলানাঞ্চ জানীষে ধর্মলক্ষণম্‌। সবচেয়ে বড় কথা, যে-সমস্ত বিষয়েই মানুষের সংশয় সন্দেহ দেখা দেয়, সেখানেই আপনার কথাই হল সংশয়চ্ছেদী প্রমাণ। অতএব এই শোকাচ্ছন্ন জ্যেষ্ঠ-পাণ্ডবের সমস্ত দুঃখ-মোহ আপনিই একমাত্র দূর করে দিতে পারেন।

ভীষ্মকে অনেকটাই মানসিকভাবে প্রস্তুত করে কৃষ্ণ সেদিন পাণ্ডব ভাইদের নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। পরের দিন আবারও সবাই এসে ভীষ্মের শেষশয্যার পাশে উপস্থিত হলেন বটে, কিন্তু যুধিষ্ঠির কিছুতেই ভীষ্মকে প্রশ্ন করতে সাহস পেলেন না। তিনি শুধুই কৃষ্ণকে ঠ্যালাঠেলি করতে আরম্ভ করলেন প্রশ্ন করবার জন্য। কৃষ্ণ আবারও সেই পুরনো কথা তুলে একটু অলৌকিকতার সাহায্যে বলতে আরম্ভ করলেন—ভীষ্ম! আপনি আপনার জ্ঞানরাশি উজাড় করে দিয়ে আজ থেকে যত উপদেশ করবেন, সব এই পৃথিবীতে থাকবে বেদপ্রবাদের মতো—সেইজন্যই অলৌকিকভাবে আমি আপনার শারীরিক কষ্ট দূর করে দিয়েছি। দিয়েছি সেই দিব্যদৃষ্টি। আপনি সবিস্তারে আপনার সমস্ত বক্তব্য বলুন।

ঈশ্বরপ্রসাদাৎ ভীষ্ম এখন দেহেমনে বেশ প্রফুল্ল বোধ করছেন। তবে একটু অসহজও বোধ করছেন—বার বার কৃষ্ণই তাঁকে বলতে বলছেন বলে। ভীষ্ম জানেন—কৃষ্ণের জ্ঞানের অভাব নেই। রাজনীতি, ধর্মনীতি এবং প্রখর বাস্তববোধ তাঁর এতই বেশি যে, তিনি অতি অল্পবয়সেই বিশাল ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। ভীষ্ম বলেওছেন সে কথা। বলেছেন—তোমার সামনে আমি রাজনীতি ধর্মনীতি কী বলব, কৃষ্ণ। আমি যা বলব, সবই তোমার জানা আছে—কিং চাহমভিধাস্যামি বাক্যং তে তব সন্নিধৌ। ঠিক এই কারণেই কৃষ্ণের প্রশ্ন করাটা কিছুতেই পছন্দ করছিলেন না ভীষ্ম। তিনি এবার বলেই ফেললেন—তুমি যাঁর কথা বার বার বলছ, সেই পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির প্রশ্ন করুন আমাকে।

মহাপণ্ডিত ব্যক্তিকে প্রশ্ন করার জন্যও একটা এলেম দরকার হয়। আজকাল সভাসমিতি, বিদ্বৎসভা, সেমিনার, কনফারেন্সে বক্তার বক্তব্যের পরে একটা ‘কোয়েশ্চেন-আওয়ার’ থাকে। সেসব জায়গায় দেখেছি—পণ্ডিত বিদ্বান তাঁদের সুচিন্তিত বক্তব্য পেশ করার পর শ্রোতাদের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে এমন বোকা বোকা প্রশ্ন করা হয়, যে বক্তার মাহাত্ম্যই যেন তাতে নষ্ট হয়ে যায়। এইসব শ্রোতাদের মধ্যেও অনেক পণ্ডিত সজ্জন, বিদ্বান বুদ্ধিমান থাকেন। কিন্তু অনেক সময়েই তাঁরা—শুধু প্রশ্ন করে নিজেকে পরম আলোকিত বোধ করেন বলেই নাকি—এমন সব প্রশ্ন করেন, যাতে বক্তার অস্বস্তি অনেক সময় চরমে পৌঁছোয়। এঁরা বোঝেন না যে, তাঁদের প্রশ্ন কতটা অপ্রাসঙ্গিক, কতটা খাপছাড়া এবং কতটা তাঁদের নিজেদেরই ফাঁকি ধরিয়ে দেয়। তবুও এঁরা প্রশ্ন করেন। বস্তুত কারা প্রশ্ন করবেন এবং কী প্রশ্ন করবেন—সেটা ঠিক করে দেবার জন্যও একজন অধিকারী-বোধ-সম্পন্ন ‘মডারেটর’ থাকা দরকার।

ভীষ্ম সেই অধিকারের কথাটাই তুলেছেন এখানে। তিনি বলেছেন—যার মধ্যে ধৈর্য, সংযম, ব্রহ্মচর্য, ক্ষমা, ধর্ম সবই একত্র প্রতিষ্ঠিত, যার মানসিক তেজ অন্যকে প্রদীপ্ত করে, সেই যুধিষ্ঠির আমাকে প্রশ্ন করছে না কেন? যে স্বেচ্ছাচারের দ্বারা প্রণোদিত হয়ে কোনও কাজ করে না, ভয়ে বা স্বার্থে কারও কাছে মাথা নোয়ায় না, সেই যুধিষ্ঠির আমাকে সোজাসুজি প্রশ্ন করুক—স মাং পৃচ্ছতু পাণ্ডবঃ। ভীষ্ম আরও বললেন—যিনি চিরকাল সত্যে প্রতিষ্ঠিত, যিনি চিরকাল ক্ষমার মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত, যিনি চিরকাল জ্ঞানের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত, সেই পাণ্ডব যুধিষ্ঠির আমাকে প্রশ্ন করুক—স মাং পৃচ্ছতু পাণ্ডবঃ।

ভীষ্ম এইভাবে বার বার যুধিষ্ঠিরের শত গুণের উল্লেখ করে বার বারই ওই এক কথা বললেন—যুধিষ্ঠির আমাকে প্রশ্ন করুক। ঠিক এই মুহূর্তে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের হয়ে বললেন—যুধিষ্ঠির আপনার সামনে আসতেই পারছেন না লজ্জায়—লজ্জয়া পরয়োপেতো ধর্মরাজো যুধিষ্ঠিরঃ। এমন একটা জ্ঞাতিক্ষয়ী যুদ্ধের নিমিত্ত হওয়ার ফলে আপনি তাঁকে যদি নিন্দা তিরস্কার করেন, সেই ভয়ে তিনি আপনার সামনে আসতেই পারছেন না। তাঁর প্রতিপক্ষে যত পূজ্য এবং মাননীয় ব্যক্তি ছিলেন, তাঁদেরও শরাঘাতে দমিত করতে হয়েছে বলে লজ্জায় যুধিষ্ঠির আপনার সামনে আসতে পারছেন না।

ভীষ্ম প্রতিক্রিয়া জানালেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন—এটা আবার কেমন কথা হল! ব্রাহ্মণের ধর্ম জানি—দান, অধ্যয়ন আর তপস্যা, তেমনই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম হল যুদ্ধে জীবনপাত করা। ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অন্যায় রোধ করা। পিতাই হোক, আর পিতামহ, ভাই-ই হোক অথবা আত্মীয়, এমনকী গুরুও যদি হন—কিন্তু কেউ যদি এঁরা অন্যায়পক্ষে থেকে মিথ্যাকে প্রশ্রয় দেন, যুদ্ধে তাঁকে হত্যা করাটাই ধর্ম। যাঁরা লোভের বশবর্তী হয়ে, সদাচার ত্যাগ করে ধর্মের সেতু লঙ্ঘন করেন, তাঁরা গুরুস্থানীয় হলেও ক্ষত্রিয় ব্যক্তি তাঁদের মেরেই ধর্মলাভ করবেন—নিহন্তি যস্তং সমরে ক্ষত্রিয়য়া বৈ স ধর্মবিৎ।

এতক্ষণ ভীষ্ম যেভাবে বললেন, তাতে বোঝা যায় যে, দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করার মধ্যে যে কিছু অন্যায় ছিল, সে বিষয়ে তিনি সচেতন ছিলেন। কিন্তু সেই সচেতনতা সত্ত্বেও তিনি ভরতবংশের সিংহাসনের প্রতি অবিশ্বস্ত হতে চাননি। বরঞ্চ যুদ্ধে প্রাণ দিয়ে সেই বিশ্বস্ততার মূল্য চুকিয়েছেন। পাণ্ডবদের হাতে যুদ্ধে অবদমিত হওয়ায় তাই কোনও দুঃখ নেই তাঁর, কোনও রাগও নেই যুধিষ্ঠির বা অর্জুনের ওপর। ভীষ্ম খুশি মনে যুধিষ্ঠিরকে বললেন—তুমি প্রশ্ন করো নিঃসংকোচে, একটুও ভয় পেয়ো না—মাং পৃচ্ছ তাত বিশ্রদ্ধং মা ভৈস্ত্বং কুরুসত্তম।

যুধিষ্ঠির প্রশ্ন আরম্ভ করলেন। ভীষ্মও উত্তর দিতে আরম্ভ করলেন একে একে। আমি এই প্রশ্নোত্তরপর্বের মধ্যে যাচ্ছি না। কেননা মহাভারতের শান্তিপর্বের এই অংশে ভীষ্মের সমসাময়িক এবং তাঁর অপেক্ষাকৃত প্রাচীন রাজনীতির বিষয় এমন কিছু নেই, যা ভীষ্ম জানাননি। তৎকালীন দিনের সামাজিক গঠন থেকে আরম্ভ করে সেকালের বর্ণধর্ম, আশ্রম ধর্ম, রাজার ইতিকর্তব্য, বিভিন্ন প্রকারের রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রসংরক্ষণ, অমাত্য, কোশ, সৈন্যবল, পররাষ্ট্রনীতি এবং সবার ওপরে জনকল্যাণের কথা এমন সূক্ষ্মতা এবং নিপুণতার সঙ্গে ভীষ্ম পরিবেশন করেছেন যে তা নিয়ে পৃথক এবং বিশদ আলোচনার প্রয়োজন। যদি সংক্ষিপ্তভাবেও সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা করি, তা হলে ভীষ্মের ওপরেও সুবিচার করা হবে না, রাজনীতির সেই বিশাল ভাবনার ব্যাপারও সেখানে তুচ্ছীকৃত এবং লঘুতাপ্রাপ্ত হবে।

রাজনীতি এবং সমাজনীতির সমস্ত রহস্য তত্ত্বগতভাবে যুধিষ্ঠিরের কাছে বিবৃত করার পর ভীষ্ম বুঝেছেন যে, রাজনীতির তত্ত্ব এক বস্তু এবং প্রয়োগ অন্যতর এক বিজ্ঞান এবং এই প্রায়োগিক বিজ্ঞান যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মরাজ মানুষটির পক্ষে অবধারণ করা সহজ নয়, হয়তো বা সম্ভবও নয়। পরিশেষে তাই তিনি বললেন—দেখো! আর বুঝি আমার সময় নেই। শরাঘাতে কষ্টক্লিষ্ট এই দেহের মুক্তি ঘটবে অচিরেই, আমার দিন শেষ হয়ে আসছে—দেহন্যাসো নাতিচিরান্মতো মে/ ন চাতি তূর্ণং সবিতাদ্য যাতি। আমি তোমাকে ব্রাহ্মণ-শূদ্র নির্বিশেষে সমস্ত মানুষের করণীয় কর্তব্যের কথা বলেছি। আর যা কিছু জানবার, তা তুমি এই কৃষ্ণের কাছ থেকে শিখবে—শেষং কৃষ্ণাদুপশিক্ষস্ব পার্থ।

সেই যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের আগে থেকে কৃষ্ণের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ দেখে আসছেন ভীষ্ম। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বে এবং যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেও কৃষ্ণের রাজনৈতিক কৌশল দেখে তিনি বুঝেছেন যে, রাজনীতির প্রায়োগিক ক্ষেত্রে কৃষ্ণের চেয়ে বেশি কুশলী আর দ্বিতীয় কেউ নেই। এই সত্যটা উপলব্ধি করেই এই মরণকালে তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন কৃষ্ণের প্রকৃত তত্ত্ব আমি জানি, তাঁর শক্তিও আমার অজানা নয়। সত্যি কথা বলতে কী, কৃষ্ণকে সাধারণ কোনও মাপকাঠি দিয়ে মাপাই যায় না, মাপাই যায় না তাঁর বুদ্ধিকে। অতএব যখনই কর্তব্য বিষয়ে তোমার দ্বিধা বা সংশয় উপস্থিত হবে, তখনই কৃষ্ণ তোমাকে পথনির্দেশ করবেন—অমেয়াত্মা কেশবঃ কৌরবেন্দ্র/ সো’য়ং ধর্মং বক্ষ্যতি সংশয়েষু।

এতক্ষণ, এতদিন ধরে এই বিশাল কথোপকথন অথবা ‘গ্রেট ডায়ালগ’ শেষ হবার পর ভীষ্ম যখন আর কথা বললেন না, তখন সেই ওঘবতী নদীর তীরে এক ভয়ংকর স্তব্ধতা নেমে এল। সমস্ত রাজা-রাজড়ারা, যাঁরা ভীষ্ম-যুধিষ্ঠিরের আলোচনা শুনতে এসেছিলেন, তাঁরা নিশ্চুপ হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত রাজা এবং ঋষিদের সমাবেশটাকে যেন পটে আঁকা ছবির মতো দেখতে মনে হল। এই নিস্তব্ধতার অবসরেই দ্বৈপায়ন ব্যাস বললেন—আমার মনে হয়—এতক্ষণ আপনার কথা শুনে যুধিষ্ঠির অনেকটাই প্রকৃতিস্থ হয়েছেন। হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসে রাজ্যপাটের নতুন ভার বুঝে নেওয়াটাও তাঁর পক্ষে এখন ভীষণ জরুরি। অতএব এখন আপনি অনুমতি করুন—ভাইদের নিয়ে, কৃষ্ণকে নিয়ে তিনি এখন রাজ্যে ফিরে যান।

ভীষ্ম সুমধুর আশ্বাসে যুধিষ্ঠিরকে রাজ্যে গিয়ে প্রজাপালনের বিষয়ে তৎপর হতে বললেন। তাঁর সমস্ত রাজনীতি-উপদেশের শেষ তাৎপর্যও তো তাই—রঞ্জয়স্ব প্রজাঃ সর্বাঃ প্রকৃতীঃ পরিসান্ত্বয়। আর এই প্রজাপালন এবং সপ্তাঙ্গ রাজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন—ভরত কুরুবংশের মূল পুরুষ যযাতির কথা, যিনি প্রথম হস্তিনাপুরকে ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রভূমিতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভীষ্ম নিজে রাজা হননি, কিন্তু হননি বলেই হয়তো নেতিবাচক দিক থেকে হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন সম্বন্ধে অন্য সতর্কতা, অন্য এক দুর্ভাবনা তাঁর হৃদয়ে কাজ করত। মহারাজ যযাতি তাঁর অন্যতমা প্রিয়তমা শর্মিষ্ঠার গর্ভজাত সন্তান পুরুর মাধ্যমে যে বংশটিকে মূল বংশ বলে হস্তিনাপুরের সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই যযাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে নিজের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন করে দিলেন ভীষ্ম।

সকলকে মৌখিকভাবে বিদায় জানানোর পর ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বললেন—আমার দিন শেষ হয়ে আসছে। সূর্য যখন আবারও উত্তরায়ণে ফিরে আসবেন, সেই সময়ে আমার মৃত্যুকালে আরও একবার তুমি এসো এইখানে—আগন্তব্যঞ্চ ভবতা সময়ে মম পার্থিব। যুধিষ্ঠির সবিনয়ে স্বীকার করলেন ভীষ্মের এই অনুরোধ এবং রাজ্যে ফিরে গিয়ে রাজ্যশাসনের যথাযোগ্য ব্যবস্থা করেই ঠিক পঞ্চাশ দিন পর তিনি সেই ওঘবতী নদীর তীরে ফিরে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। দক্ষিণায়ণের গতিপথ শেষ করে সূর্য তখন উত্তরায়ণে ফিরে এসেছেন। যুধিষ্ঠির ভীষ্মের শেষ সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় আয়োজন সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন। কী নিষ্কাম উদাসীন এই মৃত্যু। একজন ধ্রুবমৃত্যুর দিনক্ষণের জন্য নিস্পৃহভাবে অপেক্ষা করছেন, আর একজন তাঁকে তরী থেকে তীরে পৌঁছে দেবার জন্য, নতুন আলোয় নতুন সিন্ধুপারে পৌঁছে দেবার জন্য সাংস্কারিক আয়োজন নিয়ে চলেছেন। মৃত্যুর উত্তরকালে শবদেহে ঘৃত মাখিয়ে দেবার জন্য ঘি, গলায় পরিয়ে দেবার মালা, নানাবিধ গন্ধ, নতুন ক্ষৌমবসন, অগুরুচন্দন আর তখনকার দিনের সবচেয়ে দামি ‘এসেন্স’ ‘কালীয়ক’ সুরভির একখানি ভাণ্ড নিয়ে যুধিষ্ঠির চললেন ওঘবতীর তীরে।

তখনকার দিনের অদ্ভুত একটি নিয়মের পরিচয় পাই এখানে। মৃতের শেষ সংস্কারের জন্য যেমন মালাচন্দন, বসন নিয়ে যাওয়া হত, তেমনই বয়ে নিয়ে যেতে হত আগুন। সেকালের দিনে ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের বাড়িতে প্রতিদিন অগ্নিহোত্র করাটা রীতিসম্মত ছিল এবং বিবাহও হত যজ্ঞের আগুন সাক্ষী করে। মানুষ যখন মারা যেত, তখন ঘরের মধ্যে জিইয়ে রাখা এই সব আগুন নিয়ে গিয়েই মৃত ব্যক্তির শেষ সংস্কার করা হত। এখানে আমরা যুধিষ্ঠিরকে দেখছি—তিনি ভীষ্মের শেষসংস্কারের জন্য অনেক সাজসরঞ্জাম নিয়ে চলেছেন বটে, কিন্তু সবার আগে চলেছে কতগুলি পৃথকসঞ্চিত আগুন, যা হয়তো কোনও বিশেষ আধারে স্থাপন করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হস্তিনাপুর থেকে। যুধিষ্ঠির তার ভাইবন্ধু, আত্মীয়পরিবার, ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী এবং কুন্তী সকলকে নিয়ে ভীষ্মের শেষসংস্কারক সেই অগ্নিপাত্রগুলির অনুসরণ করে চলেছেন—স্তূয়মানো মহাতেজা ভীষ্মস্যাগ্নীননুব্রজন্‌।

মহাভারতের এই শ্লোকটি দেখে টীকাকার নীলকণ্ঠ ভীষণ বিপদে পড়েছেন। যেহেতু সাধারণত মৃত ব্যক্তির শবসংস্কারের জন্য বৈবাহিক অগ্নিই নিয়ে যাওয়া হত, অতএব নীলকণ্ঠের মতো পণ্ডিত টীকাকারও অতি সহজেই লিখে ফেললেন—‘ভীষ্মের অগ্নি কথাটা থেকে বোঝা যায় যে, তা হলে তাঁরও পত্নী ছিল। পাণিনির ব্যাকরণসূত্র অনুযায়ী যজ্ঞাগ্নিসংযোগেই স্ত্রীকে পত্নী নামে ডাকা যায়—পত্যুর্ন যজ্ঞসংযোগে। অর্থাৎ পতি শব্দের মধ্যে ‘ন’ আগম হয়ে পত্নীশব্দ নিষ্পন্ন হবে। এই ধারণা থেকে নীলকণ্ঠ সপাটে লিখে ফেললেন—তা হলে তাঁরও পত্নী ছিল—ভীষ্মস্যাগ্নীনিতি, তেন তস্যাপি পত্নী আসীৎ। কথাটা লিখেই নীলকণ্ঠ বুঝেছেন যে, এখানে একটু সন্দেহ জিইয়ে রাখা উচিত। অতএব বিকল্প দিয়ে বললেন—অবশ্য এটা শেষসংস্কারের অগ্নিও হতে পারে—যদ্বা সংস্কারকানগ্নীন্।

আমরা বলি—বিকল্পের কথা যাই বলুন, তাতে নীলকণ্ঠের ভুল বোঝাটা কিছু কমেনি। তাঁর দুটি কথাই ভুল এবং পণ্ডিত টীকাকারের দায়িত্ব এখানে তিনি পালন করেননি। প্রথম কথাটা তো রীতিমতো অন্যায়। তাঁর গোপনেও কোনও পত্নী ছিল না এবং থাকলে কুমার দেবব্রত ভীষ্মে পরিণত হতেন না। সাধারণ ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের মরণের সময় বৈবাহিক বয়ে নিয়ে যাওয়া হত বলেই, এখানেও তাই হচ্ছে, এটা ভাবা ভুল। আবার সাধারণ অন্তিম সংস্কারের অগ্নি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এটা ভাবাও এখানে ভুল। নীলকণ্ঠের টীকা দেখে অবাক হয়ে আমার প্রশ্নটা করেছিলাম মহামতি অনন্তলাল ঠাকুরমশায়কে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে মহাভারতের মৌষল পর্বে মনোনিবেশ করতে বললেন।

সেখানে দেখা যাচ্ছে—কৃষ্ণপিতা বসুদেব দেহ রেখেছেন এবং তাঁর শবযাত্রায় প্রথমে যাঁরা চলেছেন তাঁরা হলেন বসুদেবের যজ্ঞকারী যাজক ব্রাহ্মণেরা। বসুদেব কোনও সময় অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন, যাজকরা সেই আশ্বমেধিক ছত্রখানি এবং সেই যজ্ঞের অনির্বাণ অগ্নি বসুদেবের শবদেহের সামনে নিয়ে চলেছেন—তস্যাশ্বমেধিকং ছত্রং দীপ্যমানাশ্চ পাবকাঃ। এখানেও ‘পাবক’ শব্দে বহুবচন আছে। তার মানে আশ্বমেধিক যজ্ঞাগ্নির সঙ্গে হয়তো বিবাহিত বসুদেবের বৈবাহিক অগ্নিও আছে। আবার মহারাজ পাণ্ডুর অন্তিম সংস্কারের সময়েও লক্ষ করে দেখবেন যে, সেখানেও পাণ্ডুকৃত অশ্বমেধ যজ্ঞের অগ্নি আহরণ করে নিয়ে এসেছেন মুনিবর কাশ্যপ—অশ্বমেধাগ্নিমাহৃতা যথান্যায়ং সমন্ততঃ। ভীষ্মের ক্ষেত্রেও যেটা বুঝতে হবে, সেটা হল—বৈবাহিক অগ্নি নয়, তিনি তাঁর জীবৎকালে যেসব বিরাট যজ্ঞ করেছিলেন, সেইসব যজ্ঞাগ্নিই এবং তারমধ্যে হয়তো অশ্বমেধ যজ্ঞের অগ্নিও আছে—সেই অগ্নিগুলিই যুধিষ্ঠির নিয়ে চলেছেন যাজকদের পিছন পিছন—অনুব্রজন্‌।

হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে চিরসঞ্চিত এই অগ্নি যে ভীষ্মের ‘সেন্টিমেন্টে’র সঙ্গে জড়িত ছিল, সেটা আমরা যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি। যুধিষ্ঠির কুরুক্ষেত্রে এলেন, কাছেই ওঘবতী নদীর তীরে শরশয়ানে শুয়ে আছেন ভীষ্ম। যুধিষ্ঠির এসেই বললেন—আমি এসেছি, পিতামহ। আপনি যে সময়ে আসতে বলেছিলেন সেই সময়েই এসেছি এবং সঙ্গে নিয়ে এসেছি আপনার উপাস্য যজ্ঞাগ্নি—প্রাপ্তো’স্মি সময়ে রাজন্ অগ্নীন্‌ আদায় তে বিভো—আমার সঙ্গে আছেন হস্তিনাপুরের আচার্য, ব্রাহ্মণ এবং ঋত্বিকেরা।

ভীষ্ম খুশি হলেন। দেখলেন—হস্তিনাপুরের সকলেই এসে উপস্থিত হয়েছেন তাঁর প্রয়াণকালে। এসেছেন ব্রাহ্মণ ঋষি রাজন্যবর্গ। এসেছেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস এবং বাসুদেব কৃষ্ণ। যুধিষ্ঠিরের দুই হাত নিজের হাতে নিয়ে ভীষ্ম বললেন—আজ আটান্ন দিন ধরে আমি এই ক্ষুরধার শরশয়নে শুয়ে আছি—অষ্টপঞ্চাশতং রাত্রঃ শয়নস্যাদ্য মে গতাঃ। এখন মাঘ মাস, আমার শেষসময় উপস্থিত, বৎস!

যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বলেই ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রের দিকে তাকালেন। নিশ্চয় মনে পড়ল জননী সত্যবতীর কথা। তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করেই কুরুবংশের এই জাতকটির জন্ম-সন্দর্ভে ভীষ্মকে যোগ দিতে হয়েছিল। প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করলে তিনিই হয়তো এই ছেলেটির পিতা হতেন। কিন্তু পিতা না হলেও পিতার যত্নেই তিনি ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুকে মানুষ করেছিলেন। তারপর কী থেকে কী হয়ে গেল! পাণ্ডুর জীবনযন্ত্রণা তাঁকে দেখতে হয়েছে এবং তাঁর মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্রের লুব্ধ রাজ্য পরিচালনার সময়ে তাঁকে মন্ত্রিত্বও করতে হয়েছে। শত উপদেশেও তিনি পুত্রকল্প ধৃতরাষ্ট্রকে সুপথে আনতে পারেননি এবং হস্তিনাপুরের নীতিহীন অর্বাচীন দুর্যোধনের লোভলালসাই তাঁকে শেষপর্যন্ত মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে, যদিও এই মৃত্যুযন্ত্রণা তিনি জীবতকালেই বহুদিন ধরে সহ্য করেছেন। কিন্তু সেই যন্ত্রণার মধ্যেও তাঁর আশা বলবতী ছিল যে, একদিন হয়তো তিনি তাঁর পুত্রকল্প ধৃতরাষ্ট্রকে বোঝাতে পারবেন। জ্ঞাতিযুদ্ধের লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারবেন ভরতবংশকে।

ভীষ্ম পারেননি। অতএব এখন এই মৃত্যুকালেও ধৃতরাষ্ট্রের দিকে তাকিয়ে তিনি তাঁর সত্যবাক্য উচ্চারণ করে বললেন—রাজা! করণীয় কার্য এবং ধর্ম সম্বন্ধে তুমি যথেষ্টই জানো এবং তোমার আচার্যস্থানীয় ব্রাহ্মণেরাও ধর্মাধর্মের উপদেশে যথেষ্ট অভিজ্ঞ। বেদশাস্ত্র তোমার সম্পূর্ণ অধিগত বলেই তোমাকে বলছি—এই দুঃখময় পরিণতির জন্য তুমি কষ্ট পেয়ো না। ভীষ্ম সারা জীবন ধরে যা বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে আবারও সেই একই কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে এবং সেই স্মরণটুকুই এখন ধৃতরাষ্ট্রের ওপর নিয়তির মতো নেমে এসেছে। ভীষ্ম বললেন—পাণ্ডুর যারা ছেলে তারা ধর্মত তোমারও ছেলে। তাদের তুমি পালন করো। আর এই যে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, ইনি গুরুজনের সম্মান জানেন এবং ইনি তোমার আদেশের অনুবর্তী হয়ে থাকবেন চিরকাল—ধর্মরাজো হি শুদ্ধাত্মা নিদেশে স্থাস্যতে তব। সত্য কথাটা বলেই যুধিষ্ঠিরের ধীরনম্র স্বভাবের বিপরীতে দুর্যোধনের অসভ্যতার প্রশ্নটাও বলতে ছাড়লেন না ভীষ্ম, কারণ তারই কারণে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। ভীষ্ম ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন—তোমার পুত্রেরা যেমন ক্রোধ, লোভ আর ঈর্ষায় জর্জরিত ছিল, অতএব সেই মৎসর পুত্রদের কথা স্মরণে এনে আর দুঃখ পাবার কোনও মানে হয় না।

ভীষ্ম এবার কৃষ্ণের দিকে তাকালেন। তাঁকেই তিনি সর্বজ্ঞানের আধার, পরম তত্ত্ব বলে মনে করেন। অতএব চিরভক্তের মতো স্তুতি-নতির নম্রতায় কৃষ্ণের জয়গান করলেন ভীষ্ম। পরিশেষে বললেন—আমায় এবার অনুমতি দাও—অণুজানীহি মাং কৃষ্ণ—আমার সময় হয়েছে। আর এই পাণ্ডবদের তুমি রক্ষা কোরো। তারা তোমাকে ছাড়া আর কাউকে জানে না। ভীষ্ম আবার পুরাতন প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বললেন—দুষ্টবুদ্ধি দুর্যোধনকে আমি বার বার সাবধান করেছি। বলেছি—দেখো বাছা! যেখানে কৃষ্ণ সেখানেই ধর্ম, আর যেখানে ধর্ম সেইখানেই জয়। বার বার তাকে বলেছি—কৃষ্ণ যাদের উপদেষ্টা সেই পাণ্ডবদের জয় করা অত সহজ নয়। অতএব তাদের সঙ্গে সন্ধি করার এই প্রকৃষ্ট সময়। কিন্তু মূর্খ দুর্যোধন আমার কথা কানে নেয়নি। সে এই সমস্ত পৃথিবীকে ধ্বংস করে নিজেও মরল—ঘাতয়িত্বেহ পৃথিবীং ততঃ স নিধনং গতঃ। যা হবার তা হয়ে গেছে, কৃষ্ণ! তুমি এবার অনুমতি করো যাতে এই শরীর ত্যাগ করে আমি পরমাগতি লাভ করতে পারি।

কৃষ্ণ গদগদবাক্যে ভীষ্মকে দেহত্যাগের জন্য অনুমতি দিলেন। অনুমোদন করলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডবরা সকলে। ভীষ্ম এবার যোগবলে মনবুদ্ধিকে স্থির করলেন মূলাধারে। যোগসাধনার পরম্পরায় একে একে স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত ইত্যাদি স্থানে নিজেকে স্থাপন করে ভীষ্ম আজ্ঞাচক্রে প্রতিষ্ঠা করলেন নিজের বুদ্ধি মন অহংকার—ধারয়ামাস চাত্মানং ধারণাসু যথাক্ৰমম্‌। লক্ষণীয় বিষয় হল, আধুনিক বৈদ্যশাস্ত্র অনুসারেও সম্পূর্ণ দেহ একই সময়ে প্রাণহীন হয় না, এক একটি অঙ্গ নির্জীব হতে হতে শেষে বুদ্ধিবৃত্তি লুপ্ত হয়। এখানে আশ্চর্য দেখা গেল— ভীষ্মের যে যে অঙ্গ শরবর্যায় বিদ্ধ হয়ে ছিল, ক্রমে ক্রমে প্রাণমুক্ত হবার সঙ্গে সেই সেই অঙ্গ থেকে বাণগুলি খসে খসে পড়ে যেতে লাগল।

এই অদ্ভুত ঘটনা দেখে উপস্থিত মুনি-ঋষিরা, কৃষ্ণ এবং পাণ্ডবেরা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এদিকে শেষ মুহূর্তে যখন ভীষ্মের দেহের সমস্ত বিচরণস্থান থেকে সন্নিরুদ্ধ জীবাত্মা তাঁর ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে আকাশে উঠে গেল তখন দেবতারা পূষ্পবৃষ্টি করলেন আকাশ থেকে। ভীষ্মের প্রাণ উল্কার আলোর মতো আকাশে উঠে মিলিয়ে গেল—মহোল্কেব চ ভীষ্মস্য মূর্ধদেশাজ্জনাধিপ। ইচ্ছামৃত্যু ভীষ্ম স্বেচ্ছায় আপন মরণ সম্পূর্ণ করলেন।

পূর্বভাবিত উপায়েই ভীষ্মের অন্তিমসংস্কারের কাজ আরম্ভ হল। চন্দনকাঠের চিতা সাজিয়ে তাতে কালীয়ক এবং কালাগুরুর গুরু গন্ধ ঢেলে দেওয়া হল। যুধিষ্ঠির এবং বিদুর পট্টবন্ত্র এবং ফুলের মালায় আচ্ছাদিত করলেন ভীষ্মের মরদেহ। যুযুৎসু ভীষ্মের মাথায় মেলে ধরলেন সেই আশ্বমেধিক ছত্র। ভীম অর্জুন দোলাতে লাগলেন শুভ্র চামর। নকুল সহদেব ধরে রইলেন রাজকীয় উষ্ণীষ। এদিকে যুধিষ্ঠির এবং ধৃতরাষ্ট্র—দুই বংশের দুই প্রধান পুরুষ দাঁড়িয়ে রইলেন ভীষ্মের পদতলে। যাজকের হোমযজ্ঞ আর সামগায়ীদের সামগানের মধ্যেই ভীষ্মের চিতায় আগুন দিলেন পুত্রপ্রতিম ধৃতরাষ্ট্র এবং অবশ্যই ক্রমান্বয়ে অন্যেরাও।

দাহ-সংস্কার শেষ হলে সকলেই ভীষ্মের তর্পণ করবার জন্য উপস্থিত হলেন ভাগীরথীর তীরে, তর্পণ শেষ হলে অলৌকিকভাবে সকলের সম্মুখে আবির্ভূত হলেন জননী জাহ্নবী—ভীষ্মের গর্ভধারিণী মাতা। পুত্রশোকে তিনি যতখানি পীড়িত এবং অনুতপ্ত, তার চেয়েও তিনি যেন অপমানিত বোধ করছেন এবং এই অপমানের কারণও তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে অবশ্য সেই পুরাতন কথাটি আসবেই। লৌকিক দৃষ্টিতে দেখলে এখানে গঙ্গার আবির্ভাবের কথাটা একেবারেই গল্প মনে হতে পারে। আবার লৌকিক দৃষ্টিতে আমরা যেভাবে গঙ্গার একটা পরিচয় দেবার চেষ্টা করেছিলাম, তাতে এক লৌকিক রমণীর পক্ষে এতকাল পর্যন্ত বেঁচে থাকার কথা নয়। কারণ ভীষ্ম নিজেই যথেষ্ট বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণ করেছেন।

ভীষ্মের তর্পণকালে জননী জাহ্নবীর এই আবির্ভাব আসলে মহাকাব্যের কবির জবাবদিহি। মনে রাখতে হবে, ভীষ্ম মানুষ হয়েছিলেন জননীর কাছেই। তাঁর বিদ্যাশিক্ষা, অস্ত্রশিক্ষা এবং অন্যান্য শিক্ষার ক্ষেত্রেও সমস্ত প্রযত্ন গ্রহণ করেছিলেন তাঁর জননী। বিশেষত আর্যগোষ্ঠীর রাজকীয় বিদ্যা-পরিমণ্ডলের বাইরে থেকেও যিনি তাঁর ছেলেকে পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে পাঠিয়েছিলেন, তাঁর দৃষ্টিতে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীর হাতে ভীষ্মের অস্বাভাবিক পতন একটা প্রশ্ন জাগরিত করে বই কী। মহাকাব্যের কবি তাই জননী জাহ্নবীর অলৌকিক আবির্ভাব ঘটিয়ে সহৃদয় পাঠক-শ্রোতার প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন। নদীরূপিণী গঙ্গা তাঁর পুত্রের জীবনের এক একটি মহিমান্বিত বিক্রমের ঘটনা উল্লেখ করেছেন, আর বার বার ক্ষোভ সহকারে বলেছেন—আর এই পরাক্রান্ত মানুষটাকে নাকি শিখণ্ডী হত্যা করেছে—স হতো’দ্য শিখন্ডিনা। বার বার তিনি বলতে চাইলেন—প্রিয় পুত্রের মৃত্যুতে তিনি তেমন বিচলিত নন—কেননা অবশ্যম্ভাবী মৃত্যু তো ঘটবেই—কিন্তু তাঁর এমন প্রবল পরাক্রান্ত পুত্র শেষ পর্যন্ত এক রমণীর হাতে মারা গেল—এতে যেন বীরপ্রসূ জননীর অপমান ঘটেছে।

জাহ্নবীর আর্তি শুনে বাসুদেব কৃষ্ণ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন—তুমি আশ্বস্ত হও জননী। তোমার পুত্র তো সাধারণ মানুষ নন, অষ্টবসুর এক বসু, ঈপ্সিত মরণের পর তিনি পুনরায় বসুলোকে প্রয়াণ করেছেন। আর তুমি যে বার বার বলছ—শিখণ্ডী হত্যা করেছে তোমার পুত্রকে, সে কথাটা ঠিক নয়। তোমার পুত্র ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনুযায়ী রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করতে করতে অস্ত্রদিগ্ধ হয়েছেন ধনঞ্জয় অর্জুনের হাতে। নইলে সামনাসামনি যুদ্ধে তোমার পুত্রকে জয় করতে পারেন, এমন বীরপুরুষ দুনিয়ায় নেই। দেবরাজ ইন্দ্রও হার মানবেন তাঁর কাছে—ন শক্তঃ সংযুগে হন্তং সাক্ষাদপি শতক্রতুঃ। অতএব তুমি দুঃখ করো না। শিখণ্ডীর মতো এক ক্লীবশ্রুতি মানুষের হাতে তাঁর মৃত্যু হয়নি। তিনি বীরের মতো যুদ্ধ করে পুনরায় বসুত্ব লাভ করেছেন।

কৃষ্ণের কথায় নদীরূপা জাহ্নবী আশ্বস্ত হলেন বটে কিন্তু আমরা জানি যে, বীরোচিত যুদ্ধ করতে গিয়েই এক রমণীকে যুদ্ধক্ষেত্রে আগুয়ান হতে দেখেই ভীষ্ম তাঁর অস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন। অর্জুনের সঙ্গে বীরের যুদ্ধ করার অবসরে যে অবহেলিত বাণগুলি তাঁকে বিদ্ধ করছিল, ভীষ্ম সেগুলি আত্মস্থ করেছেন বীরের মর্যাদায়, অথবা কোনও গভীর অনুতাপে ইচ্ছাকৃতভাবে। কাশীরাজের স্বয়ংবরসভার আয়োজন পণ্ড করে যে জ্যেষ্ঠা রমণীকে তিনি বিচিত্রবীর্যের কারণে রথে নিয়ে এসেছিলেন, তাঁকে পরিশেষে প্রত্যাখ্যান করে ব্রহ্মচারিত্বের প্রতিজ্ঞায় অটল ছিলেন ভীষ্ম। কিন্তু সেই স্বেচ্ছাকৃত প্রত্যাখ্যান তাঁর হৃদয়ে কোনও আবেশ তৈরি করেছিল কি না, তা মহাকাব্যের কবি সোচ্চারে একবারও বলেননি। কিন্তু ভীষ্মের নিজের এবং সেই প্রত্যাখ্যাতা অম্বা-শিখণ্ডিণীর পারস্পরিক ক্রোধ যেভাবে মহাকাব্যের অন্তর জুড়ে আছে, তাতে ক্ৰান্তমনোদর্শী সহৃদয়মাত্রেই এই সংশয়ে আকৃষ্ট হবেন যে, এই দুই পুরুষ রমণীর মধ্যে নেতিবাচক কোনও সরসতা ছিল। কিন্তু সে যাই থাকুক, মহাভারতের কবি যা স্বকণ্ঠে বলেননি, আমরাও তা সোচ্চারে বলব না।

ভীষ্মের দাহ-তপর্ণ শেষ হয়ে গেলে ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরেরা সব হস্তিনাপুরে ফিরলেন। এরপর যুধিষ্ঠির অশ্বমেধ যজ্ঞ করলেন এবং তাঁর রাজ্যও নিরুপদ্রবে চলতে আরম্ভ করল। কিন্তু কুরুরাজ্যের সমৃদ্ধি, আড়ম্বর এবং মান্যতা আর কখনও সেই পৰ্য্যায়ে পৌঁছোল না, যা ভীষ্মের জীবদ্দশায় ছিল। আর কী সেইসব ক্ষত্রিয়বীরের চমৎকার! পিতার বিবাহের জন্য এক পিতৃভক্ত যুবকের আমৃত্যু ব্রহ্মচারী থাকার প্রতিজ্ঞা, সিংহাসন ত্যাগের প্রতিজ্ঞা, অথচ সেই সিংহাসনে-বসা প্রত্যেকটি নাবালক পুত্রকে শিক্ষায় দীক্ষায় বড় করে তুলে ভরতবংশের উপযুক্ত রাজা করে তোলা—এই সমস্ত কিছুর মধ্যে যে ক্ষত্রিয়োচিত আড়ম্বর আছে, ভীষ্মের মৃত্যুর পর সেই মহান বৈচিত্র্য আর ভরতবংশের ইতিহাস উত্তাল করে তোলেনি তেমন করে।

আসলে মহামতি ভীষ্ম নিজেই এক ইতিহাস। মহাভারতে প্রথম যখন ভীষ্মের পরিচয় দিচ্ছেন মহাভারতের কথকঠাকুর বৈশম্পায়ন, তখন তিনি বলেছেন—আমি সেই কুমার দেবব্রতর কাহিনী বলব, যিনি গুণে তাঁর পিতা শান্তনুকে সর্বাংশে অতিক্রম করেছেন। আমি সেই প্রকৃষ্ট ভরতবংশীয় রাজার কথা বলব, যাঁর জীবনের ইতিহাসই আসলে মহাভারত—যস্যেতিহাসসা দ্যুতিমান্ মহাভারতমুচ্যতে। দেখুন, আমি চমৎকার শব্দটা ব্যবহার করেছিলাম, আর কথকঠাকুর বলেছেন ‘দ্যুতিমান্‌’ অর্থাৎ উজ্জ্বল। ইতিহাস উজ্জ্বল হয়ে ওঠে কখন? যখন ইতিহাসের মধ্যে বিচিত্র ঘটনার বাহুল্য এবং বৈচিত্র্য থাকে। সেই বৈচিত্র্য ভীষ্মেরই সৃষ্টি। আশ্চর্য হতে হয়—সারা মহাভারত জুড়ে তাঁকে সম্মানসূচকভাবে ‘নৃপতি’ বলা হয়েছে, ‘রাজা’ বলা হয়েছে। অথচ কোনওদিন তিনি সিংহাসনে বসেননি এবং সে লোভও তাঁর ছিল না।

অন্যদিকে তাঁর বিশাল ব্যাপ্তির দিকে তাকিয়ে দেখুন। সেই পিতা শান্তনুর সময় থেকে তিনি রাজ্য চালাচ্ছেন। শান্তনুর পর চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য। তাঁদের পর ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডু এবং তাঁদেরও পরে দুর্যোধন এবং পরিশেষে যুধিষ্ঠিরকে তিনি সিংহাসনে বসে যেতে দেখলেন। পরপর চারটি ‘জেনারেশন’কে ভরতবংশের মর্যাদা বহন করে নিয়ে যেতে দেখলেন যিনি, পরপর চারটি জেনারেশনের ভালমন্দ, আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং সুখদুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে রইলেন যিনি, তিনিই তো এক ব্যাপ্ত ইতিহাস, মহাভারতের দ্যুতিমান ইতিহাস।

ভরতবংশের ইতিহাস যিনি লিখেছেন সেই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস শান্তনুর অন্যতমা স্ত্রী সত্যবতীর গর্ভজাত। আর স্বয়ং যিনি মহাভারতের ইতিহাস তিনি শান্তনুরই অন্যা স্ত্রী জাহ্নবীর গর্ভজাত। একজন সংসারের বাইরে রইলেন মুনিবৃত্তি গ্রহণ করে, আর অন্যজন সংসারে রইলেন সন্ন্যাসীর মতো। সন্ন্যাসী ব্যাস ভরতবংশীয় রাজমহিষীর গর্ভে পুত্রসন্তান উৎপাদন করে ভরতবংশের ধারা অক্ষত রাখলেন গৃহস্থের মতো কর্তব্য পালন করে। আর অন্যজন হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে থেকে নিষ্কামভাবে সেই ভরতবংশের অঙ্কুরগুলিকে পালন করে বিবর্ধিত করলেন সন্ন্যাসীর মতো রাজ্যভোগে নির্লিপ্ত থেকে। মোহ যদি তাঁর কিছু থেকে থাকে, তো তা ছিল ভরতবংশের মর্যাদার প্রতি। কামনা যদি কিছু থেকে থাকে ভীষ্মের, তো তা ছিল পাণ্ডব কৌরবের নির্বিরোধ সহবাসের প্রতি ক্রোধ যদি তিনি কখনও করে থাকেন, তো তা করেছেন অন্যায় অসত্যকে প্রতিরোধ করার জন্য। আর জীবনের চেয়েও যে বস্তুর মূল্য তাঁর কাছে বেশি ছিল, তা হল ধর্ম। যে ধর্ম মানুষকে ধারণ করে, যে ধর্ম রাজা-প্রজার পারস্পরিক বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করে, যে ধর্ম একটি বৃহৎ পরিবারকে ত্যাগের মূল্যে একত্র সহবাসে সাহায্য করে এবং যে ধর্ম মানুষকে নিষ্কাম কর্তব্যপালনে অনুরক্ত করে, সেই ধর্মই ভীষ্মের ধর্ম। সেইজন্যই সারা জীবন কুরু-ভরতবংশের বিশ্বস্ত রাজকর্মচারীর ইতিকর্তব্য পালন করা সত্ত্বেও তিনিই প্রকৃত রাজা এবং তিনিই মহাভারতের ইতিহাস।

আমাদের একটাই দুঃখ আছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধশেষে ভীষ্মের রাজনৈতিক উপদেশ শুনে খানিকটা সুস্থ হয়ে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজা হলেন বটে, কিন্তু আমাদের প্রশ্ন জাগে—সমস্ত শান্তিপর্ব এবং অনুশাসন পর্ব জুড়ে যুধিষ্ঠির এত যে উপদেশ পেলেন, স্বয়ং যুধিষ্ঠির—যিনি মনেপ্রাণে মোক্ষধর্মী ব্রাহ্ণণের মতে প্রায়শই—প্রশ্ন জাগে—সেই যুধিষ্ঠির কি এই বিশাল রাজনীতি-উপদেশের উপযুক্ত আধার ছিলেন? উলটো দিকে ভেবে দেখুন—ভীষ্ম নিজে যদি প্রকৃত রাজা হতেন, তা হলে ভরত-কুরুবংশের ইতিহাস হয়তো অন্যরকম হত এবং হয়তো ভরত-কুরুর মতো প্রসিদ্ধ নামের প্রতিস্থাপন ঘটে যেত ভীষ্মের নামে। মহাভারতের রাজবংশকে সকলে যে সম্মানে ভরতবংশ, কুরুবংশ অথবা কৌরববংশ বলে গৌরব দান করেন, ঠিক সেই গৌরবে কেউ একবারও বলেন না যে, মহাভারত যুধিষ্ঠির কিংবা অর্জুনের বংশকথা। কিন্তু ভীষ্ম যদি রাজা হতেন, তা হলে পুরু ভরত কুরুদের গৌরব ম্লান হয়ে যেত নিশ্চয় এবং নিঃসন্দেহে পুরাতন ব্যাসের লেখনীতে এই মহাকাব্য মোটেই ভরতের গৌরবে শুধুই মহাভারত হয়ে উঠত না। সেই মহাকাব্যের নাম হয়তো নতুন মাত্রা পেত ভীষ্মের নামেই—যার ইঙ্গিত না দিয়ে থাকতে পারেননি মহাভারতের কবি। তাঁকে বলতে হয়েছে—এই ভীষ্মের ইতিহাসই মূলত মহাভারত নামে কথিত—যস্যেতিহাসো দ্যুতিমান্ মহাভারতমুচ্যতে।