ব্যাস দ্বৈপায়ন – ৬

॥ ৬ ॥

সম্পূর্ণ যুদ্ধকাল জুড়ে ব্যাস কিন্তু খুব দূরে যাননি। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বলেছিলেন—কৌরবদের, পাণ্ডবদের যশ, কীর্তি সব আমি জগৎকে জানাব। হয়তো কবিজনোচিত এই মহাকাব্যিক প্রতিজ্ঞা রাখার জন্যই যুদ্ধটাকেও তিনি প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন এবং দু-পক্ষের সংশয়-সংকটে তিনি বক্তব্যও পেশ করেছেন সর্বাঙ্গীণ মমতায়। তাঁর বাস্তববোধ এমনই অসাধারণ যে, যুদ্ধক্ষেত্রে কে কখন কোন মহাস্ত্র ব্যবহার করছে এবং তার কারণই বা কী—তাও তিনি খবর রাখেন। যুদ্ধক্ষেত্রে অন্তত তিনবার তাঁকে যেভাবে দেখেছি, তাতেও বোঝা যায় যে, তিনি এতকাল বঞ্চিত বিড়ম্বিত পাণ্ডবদের জয় চেয়েছিলেন। পাণ্ডবপক্ষে অভিমন্যু যখন মারা গেছেন এবং অর্জুন, যুধিষ্ঠির—প্রত্যেকে যখন শোকে মুহ্যমান, সেদিন ব্যাস এসেছিলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। যুধিষ্ঠির জানিয়েছিলেন—কীরকম অন্যায় করে মারা হয়েছে অভিমন্যুকে।

আতপ্ত ব্যাস সেদিন মৃত্যুর রহস্য শুনিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। ব্যাস বলেছিলেন—এমন অকালমৃত্যুর সংকটেও তোমার মতো মানুষের মোহগ্রস্ত হয়ে পড়াটা মানায় না—ব্যসনেষু ন মুহ্যন্তি ত্বাদৃশা ভরতর্ষভ। মৃত্যু তো এমনই এক অনতিক্ৰমণীয় বিধান, যা দেবতা, দানব, মানব, গন্ধর্ব—সকলের ক্ষেত্রে একরকম। ব্যাস সেদিন এমন ধৈর্য নিয়ে মৃত্যুর রহস্য শুনিয়েছিলেন যাতে মনে হবে মৃত্যু যেন চরম এক বৈজ্ঞানিক সত্য। সত্যিই তো, পৃথিবীতে যা কিছুই জন্মাচ্ছে তার যদি কোনও বিনাশ না ঘটত, সবই যদি থেকে যেত অটুট অব্যর্থ হয়ে, তবে এই পৃথিবীও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসযোগ্য হত না। যুধিষ্ঠির ব্যাসের কথা বুঝেছিলেন। ব্যাস বলেছিলেন—মৃত্যু দেখে ভেঙে পড়লে চলবে না, সামনে যা করণীয় আছে, তা করে যেতে হবে—তস্মাচ্ছোকং পরিত্যজ্য শ্রেয়সে প্রযতেদ্‌ বুধঃ।

ব্যাসের এই উপদেশের মধ্যে আমি বিরাট দার্শনিকতা কিছু দেখিনি, কেননা ভারতবর্ষের মানুষ ভগবদ্‌গীতা শ্রবণ করেছে, মৃত্যুর শোক অপনোদন করে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে হবে—এই উপদেশ ভারতবর্ষের মানুষ জানে। কিন্তু ব্যাস বুঝি এর চেয়েও একটা দামি কথা বলেছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। বলেছিলেন—শোক যদি করতেই হয়, তবে তাদের জন্যই শোক করতে হয়, যারা বেঁচে আছে। পৃথিবীতে এত দুর্গতি, এত রোগ-ভোগ, এত ব্যর্থতা! তাই ভাবতে যদি হয়, কষ্ট যদি পেতে হয় তো জীবিত মানুষের জন্যই শোক করা উচিত; মরে গেলে আর কী, তার তো সব শেষ হয়ে গেল—জীবন্ত এব নঃ শোচ্যা ন তু স্বর্গগতানঘ। একজন ঋষির মুখে এই বক্তব্যটুকু আমার কাছে যতখানি আবেগহীন ঋষির অনুশাসন, তার থেকে অনেক বেশি কবিজনোচিত জীবনের জয়গান। জীবনের যাত্রাপথে যত বাধা, যত বিপদ, আশা-আকাঙ্ক্ষার যত অন্যায় তাড়না, তার মধ্যে ন্যায় অনুসারে জীবনযুদ্ধ জয় করে নিজেকে যারা প্রতিষ্ঠা করতে পারে—চিন্তা করতে হয় তাদের জন্যই—জীবন্ত এব নঃ শোচ্যাঃ।

জীবিত জনের জন্য ভাবার মধ্যে একটা প্রখর বাস্তববোধও কাজ করে এবং এই বাস্তব-বোধটুকু ব্যাসের একটু বেশিই ছিল। লক্ষ করে দেখুন—অভিমন্যুর শোকে অধীর যুধিষ্ঠির ব্যাসের কাছে মৃত্যুর দার্শনিকতা শুনে খানিকটা শোকমুক্ত হয়েছেন এবং ভাবছেন—অভিমন্যুর পিতা অর্জুনকে তিনি কী বলবেন, তাঁকেও কি এখন তিনি ব্যাসোক্ত উপদেশ শোনাবেন—কিংস্বিদ্‌ বক্ষ্যে ধনঞ্জয়ম্‌। ব্যাস কিন্তু যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথা বলেই চলে গেছেন, কেননা অর্জুনকে শোকমুক্ত করতে তিনি চানইনি। তিনি জানতেন—অভিমন্যুর মৃত্যুতে অর্জুন যতখানি শোকার্ত হবেন, তারচেয়ে অনেক বেশি ক্রুদ্ধ হবেন তিনি। জীবনের বাধা-বিপত্তি উত্তীর্ণ হতে গেলে এই ক্রোধই এখন তাঁকে চালনা করবে এবং পাণ্ডবপক্ষে এটির প্রয়োজন আছে।

ব্যাসের এই বাস্তববোধটুক আবারও বোঝা যাবে—যখন ভীমের পুত্র ঘটোৎকচ মারা গেলেন। ঘটোৎকচ মারা গেলে যুধিষ্ঠির যখন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে আছেন, তখন ঘটোৎকচের মৃত্যুর কারণ বুঝিয়ে কৃষ্ণ কতগুলি অদ্ভুত যুক্তি সাজিয়ে তোলেন—যে যুক্তি যুধিষ্ঠিরের কাছে একান্তই অগ্রাহ্য ছিল। কৃষ্ণ বলেছিলেন—ঘটোৎকচ বহু ব্রাহ্মণদের ওপর অত্যাচার করেছেন, তার জন্যই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। যুধিষ্ঠির রীতিমতো বিরক্ত হয়েছেন কৃষ্ণের যুক্তিতে, কেননা ঘটোৎকচ ঠিক এই প্রকৃতির ব্যক্তি নন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণের মুখের ওপরেই বলেছেন—ধর্মের যে নিয়ম, যে পথে চললে কৃতকর্ম ধর্মসঙ্গত হয়, সে আমি যথেষ্টই জানি, কৃষ্ণ! কিন্তু ব্রাহ্মণহত্যার অন্যায় অভিসন্ধিটুকু কী করে ঘটোৎকচের ক্ষেত্রে ঘটছে, তোমার এই যুক্তি আমার বোধগম্য হয়নি, হবেও না—ব্রহ্মহত্যাফলং তস্য যৎ কৃতং নাববুধ্যতে।

কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরকে যে কথাটা বলতে পারেননি—তা হল—ঘটোৎকচ মারা যাওয়ায় অর্জুনের জীবন রক্ষা পেয়েছে। কবচ-কুণ্ডল দান করার বিনিময়ে কর্ণ ইন্দ্রের কাছ একাঘ্নী বাণ পেয়েছিলেন—যা পঞ্চপাণ্ডবদের একজনকে হত্যা করতই। কর্ণ সেই বাণ একান্তে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন অর্জুনকে বধ করার জন্য। কৃষ্ণ এটা জানতেন বলেই ঘটোৎকচকে এমনভাবেই যুদ্ধে প্রোৎসাহিত করেছিলেন, যাতে কর্ণ একাঘ্নী মুক্ত করতে বাধ্য হন ঘটোৎকচের ওপর। কিন্তু কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কাছে তেমন করে একথা বলতে পারেননি। কেননা পুত্রতুল্য ঘটোৎকচের মৃত্যুতে যুধিষ্ঠির এতটাই মর্মাহত ছিলেন যে, অর্জুনের প্রাণের জন্য ঘটোৎকচকে মরতে হবে—এই ভাবনা তাঁকে বোঝানো যেত না। যুধিষ্ঠির সমস্ত ঘটনা সোজাসুজি বোঝেন। কর্ণের ওপর তাঁর ক্ষোভ এতই উদ্বেলিত হল যে, তিনি একা রওনা হলেন কর্ণকে মারবার জন্য। বললেন—এই কর্ণই অভিমন্যু হত্যার মূলে এবং এই কর্ণই ঘটোৎকচকে মেরেছে, আমি তাকে ছাড়ব না। আমি নিজে যাব প্রতিশোধ নিতে—ততো যাস্যাম্যহং বীর স্বয়ং কর্ণজিঘাংসয়া।

যুধিষ্ঠিরের এমন রাগ আগে কেউ দেখেনি। যুধিষ্ঠির এগোতেই অনেক সৈন্য-সেনাপতিরা তাঁর পিছন পিছন চলল বটে, কিন্তু কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ করাটা যে অত সহজ ব্যাপার নয়, সেটা বুঝেই কৃষ্ণ অর্জুনকে নিয়ে রওনা হলেন যুধিষ্ঠিরের সাহায্যে। বস্তুত যুদ্ধেরও তো একটা রীতিনীতি, পরিকল্পনা আছে। এখানেও হঠাৎ কিছু করতে গেলে উলটো ফল ফলতে পারে। ঠিক এই অদ্ভুত বাস্তবটুকুও কিন্তু ব্যাস জানেন এবং সেই কারণেই—তিনি যখন যুধিষ্ঠিরকে কর্ণবধের জন্য দৌড়োতে দেখলেন এবং তাঁর পিছন পিছন অন্যদেরও—তং দৃষট্বা সহসা যান্তং সূতপুত্রজিঘাংসয়া—তখন তিনি তাড়াতাড়ি এসে যুধিষ্ঠিরের পথ রোধ করে দাঁড়ালেন। বললেন—তুমি এ কী করতে চলেছ, যুধিষ্ঠির? তুমি কি জান আজ কী হতে পারত? তুমি ঘটোৎকচের জন্য শোক করছ, সে তো নিশ্চয়ই শোক পাবার মতোই ঘটনা। কিন্তু আজ যদি অর্জুন মারা যেত? অর্জুন যে আজকে ভাগ্যবশত বেঁচে আছে, সে শুধু এই ঘটোৎকচ মারা গেছে বলেই—কর্ণমাসাদ্য সংগ্রামে দিষ্ট্যা জীবতে ফাল্গুনঃ। যুধিষ্ঠিরের কাছে সোজাসুজি এই ঝটিকা-সত্যের প্রয়োজন ছিল। হয়তো মুহূর্তের মধ্যে তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল মৃত অর্জুনের দেহকল্প। ব্যাস বললেন—তুমি কি জান—শুধু অর্জুনকে বধ করার জন্যই কর্ণ ইন্দ্রের দেওয়া সেই শক্তি রেখে দিয়েছিল। যেকোনও দ্বৈরথ যুদ্ধ হলে কর্ণ যদি অর্জুনের সঙ্গে এঁটে না উঠত, তা হলেই এই শক্তি সে মোচন করত অর্জুনের ওপর—বাসবীং সমরে শক্তিং ধ্রুবং মুঞ্চেদ্‌ যুধিষ্ঠির। আর তা হলে কী হত বলো তো? আমি তো বলব—ঘটোৎকচ নিজের প্রাণ দিয়ে অর্জুনকে বাঁচিয়েছে। ইন্দ্রদত্ত শক্তিকে নিমিত্ত করে মহাকাল ঘটোৎকচের প্রাণ নিয়েছে বটে, তবে সে তোমাকেই বাঁচিয়ে দিয়ে গেছে—তবৈব কারণাদ্‌ রক্ষো নিহতং তাত সংযুগে। তাই বলছিলাম এইভাবে ক্রুদ্ধ হয়েও লাভ নেই, শোক করেও লাভ নেই। তোমরা পাঁচ ভাই মিলে সমস্ত সৈন্য-সেনাপতিদের নিয়ে কৌরবদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো। আমার বিশ্বাস আর কিছুদিনের মধ্যেই তোমাদের জয় নিশ্চিত। শুধু মনে রেখো ধর্মের অনুশানসটুকু। কারও ওপরে পক্ষপাত রেখো না। তপস্যা, দান, ক্ষমা, সত্য—এই হল ধর্মের মূল কথা! আর ধর্ম যেখানে জয়ও সেখানে।

এত দ্বিধাহীন, এত স্পষ্টভাবে ব্যাস সেদিন বুঝিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে, যাতে মনে হতেই পারে—যুধিষ্ঠির এবং অন্যান্য পাণ্ডবদের ওপরে তাঁর পক্ষপাতই আছে যেন। আমরা বলব, মনে হওয়া নয়। আছেই। আছেই এই পক্ষপাত এবং এই পক্ষপাত তৈরি হয়েছে ওই একটা শব্দেরই কারণে—ধর্ম। ধর্ম যেখানে, সেখানে যেমন জয়, তেমনই ধর্ম যেখানে, সেখানে ব্যাসও। পাঠকরা বলবেন—আবার সেই শব্দটা! ধর্ম, ধর্ম আর ধর্ম! কান ঝালাপালা হয়ে গেল মহাভারতের ওই বহু-আবৃত্ত শব্দটা শুনে শুনে। আমরা বলি—উপায়? মহাভারতের এই ধর্ম তো শুধু ফুল-বেলপাতা-নৈবেদ্যর ধর্ম নয়। এ-তো জীবনের ধর্ম, যেখানে উত্থান-পতন, ছলনা, হতাশা, সম্পদ-গৌরব—সব কিছুর মধ্যে সত্য, দয়া, তিতিক্ষা, ত্যাগ—এইসব একান্ত মানবিক ধর্মগুলি অনুস্যূত। ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনেরা এতকাল যে ছলনা বঞ্চনা করেছেন পাণ্ডবদের সঙ্গে, তাতে ক্ষাত্রোচিত যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে অন্যায়কে সিংহাসন থেকে টেনে নামানোটাই ব্যাস ধর্ম বলে মনে করেন। ব্যাস সেই ধর্মের পিছনে আছেন বলেই প্রত্যক্ষ যুদ্ধ দেখতে দেখতে ফিরে আসছেন পাণ্ডবদের কাছে। হতাশ ক্লিষ্ট যুধিষ্ঠিরকে তিনি বার বার প্রোৎসাহিত করছেন নিজের ন্যায্য প্রাপ্য ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে ঋদ্ধি লাভ করার জন্য।

যুদ্ধ যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য সব কৌরবসেনাপতি যখন ভূপতিত, তখন সেই ভয়ংকর কাণ্ডটা ঘটল। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা দ্রোণবধের প্রতিশোধ নেবার জন্য পাণ্ডবদের পাঁচটি ছেলেকেই ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে ফেলেছেন। এই অবস্থায় অশ্বত্থামাকে মেরেই ফেলার আবেদন করেছিলেন পুত্রহারা দ্রৌপদী। ভীম দুর্দম শক্তি নিয়ে এগিয়েছিলেন অশ্বত্থামার দিকে। বিপদ বুঝে কৃষ্ণ এবং অর্জুন—দুজনেই ছুটলেন ভীমকে সাহায্য করতে। পাণ্ডবদের ওইভাবে ক্রুদ্ধ অবস্থায় নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে অশ্বত্থামা পিতৃদত্ত ব্রহ্মশিরা অস্ত্র মোচন করলেন। ব্রহ্মশিরা এমনই এক অস্ত্র যার তেজে ধ্বংস হয়ে যায় সমস্ত জগৎ। অশ্বত্থামার এই জগদ্‌বিধ্বংসী চেষ্টা দেখে কৃষ্ণের পরামর্শে অর্জুনও গুরু দ্রোণের দেওয়া ব্রহ্মশিরা মুক্ত করলেন। উদ্দেশ্য—অস্ত্রের দ্বারা প্রশমিত হোক অস্ত্র।

আসন্ন ধ্বংসের ভয়ে প্রমাদ গণল সকলে। মহর্ষি নারদ এবং পিতামহ ব্যাস দুই পক্ষের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন। দুইজনেই অনুরোধ করলেন যাতে দুই বীরই তাঁদের অস্ত্র ফিরিয়ে নেন। অর্জুন মহর্ষিদের দর্শনমাত্রেই অস্ত্র সংহারে মন দিলেন। বললেন—আমার কোনও উপায় ছিল না। অশ্বত্থামার এই অস্ত্র আমাদের সবাইকে ধ্বংস করত। সেখানে অস্ত্র দিয়ে যাতে অস্ত্র প্রতিহত করা যায়, আমি সেই চেষ্টা করেছি। অর্জুন অস্ত্র সংযত করার সঙ্গে সঙ্গে অশ্বত্থামা দ্বৈপায়ন ব্যাসের উদ্দেশে বললেন—এই অস্ত্র ফেরানোর ক্ষমতা নেই আমার। আমি ভীমসেনের ভয়ে নিজের প্রাণরক্ষার জন্য এই অস্ত্র ত্যাগ করেছি এবং এ অস্ত্র অবশ্যই পাণ্ডবদের হত্যা করে ছাড়বে। আমি পাণ্ডবদের ওপরে ক্রোধবশতই এই পাপকর্ম করেছি। এখন আর কিছুই আমার হাতে নেই।

ব্যাস যথেষ্ট ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন—পার্থ অর্জুনও এই অস্ত্রের অভিসন্ধি জানে। সে কিন্তু কোনওভাবে ক্রুদ্ধ হয়ে তোমাকে হত্যা করার জন্য এই অস্ত্র ত্যাগ করেনি। তোমার অস্ত্র প্রতিরোধের জন্যই তার এই অস্ত্রমোক্ষণ, এবং প্রয়োজন হতেই সে অস্ত্র প্রতিসংহারও করেছে। অথচ এই মানুষটাকে তুমি ভাইদের সঙ্গে একত্রে মেরে ফেলতে চাও? কেন এমন ব্যবহার তোমার? তুমি কি জান না—যেখানে ব্রহ্মশিরার মতো অস্ত্র ব্রহ্মশিরার দ্বারাই প্রতিহত হয়, সেখানে এই দুই অস্ত্রের সংহারশক্তিতে রাষ্ট্রের এমন অবস্থা হয় যে, বৃষ্টি পর্যন্ত বর্ষায় না বহুদিন। ঠিক সেই জন্যই অর্জুন তার অস্ত্র উপসংহৃত করেছে। আর তাতে পাণ্ডবরাও বাঁচবে, তুমিও বাঁচবে, আর বাঁচবে এই রাষ্ট্র—পাণ্ডবাস্ত্বঞ্চ রাষ্ট্রঞ্চ সদা সংরক্ষম্যেব হি৷ অতএব তুমিও তোমার অস্ত্র সংবরণ করো।

পরকে বাঁচানোর জন্য নিজের আত্মত্যাগ তখনই সম্ভব যখন আর মানুষ নিজের কথা ভাবে না। কিন্তু ব্যাস এই তত্ত্ব জানেন যে, মানুষের আত্মরক্ষার ‘ইন্‌স্টিঙ্‌ক্ট’ এমনই যে মানুষ আগে নিজে বাঁচার চেষ্টা করে। ব্যাস বুঝেছেন অশ্বত্থামা বাঁচতে চাইছেন যে কোনও উপায়ে। তিনি তাই বলেছেন—তোমারও ক্রোধ শান্ত হোক, পাণ্ডবরাও বাঁচুক। আর তুমি তোমার সহজাত মস্তকমণিটি দিয়ে দাও পাণ্ডবদের এবং তার বদলে নিজের প্রাণ বাঁচাও। পাণ্ডবরা ঠিকই করেছিলেন—গুরুপুত্র বলেই অশ্বত্থামাকে মারা চলবে না, অতএব তাঁর চরম সম্মানের প্রতীক ওই মণিটি নিয়েই তাঁরা ছেড়ে দেবেন গুরুপুত্রকে। অশ্বত্থামা আত্মরক্ষার জন্যই মণি দিতে সম্মত হলেন কিন্তু এই মুহূর্তেও তিনি এতটাই ক্রূর যে, পাণ্ডবদের একমাত্র সন্তানবীজ, যা নাকি অভিমন্যুর পত্নী উত্তরার গর্ভে এখনও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনা হয়ে বেঁচে রয়েছে, অশ্বত্থামা সেটিকে অঙ্কুরেই বিনাশ করতে চাইলেন—কেননা অস্ত্র সংবরণের ক্ষমতা অশ্বত্থামার নেই। ব্যাস বললেন—উপায় কী, তাই হোক, উত্তরার গর্ভস্থ শিশুকেই হত্যা করুক এই অস্ত্র, তুমি যেন আর অন্য বুদ্ধি করার চেষ্টা কোরো না—এবং কুরু ন চান্যা তু বুদ্ধিঃ কার্যা ত্বয়ানঘ।

ব্যাস অশ্বত্থামার এই শিশুঘাতক প্রস্তাবে অগত্যা রাজি হয়েছেন এই কারণেই যে, এটাও এক মনস্তত্ত্বের পরিসর। গর্ভবতী স্ত্রীকে যদি বিকল্প দিয়ে বলা যায়—তুমি তোমার এই জীবন্ত স্বামীটির মৃত্যু চাও, নাকি গর্ভস্থ ছয় মাসের অজাতকের মৃত্যু চাও, তবে হাজার স্নেহ থাকা সত্ত্বেও গর্ভবতী কিন্তু জীবন্ত লোকটিকে বাঁচাতে চাইবে। লৌকিক প্রতিক্রিয়াতেও দেখেছি—যে শিশু গর্ভস্থ অবস্থায় স্রস্ত হয়ে গেল, সেই শিশুর চেয়ে এক দিন, দুদিনের জাতকও মায়ের কাছে অন্য মূল্য পায়, ছয় মাস এক বছরের জাতক হলে তো কথাই নেই। ব্যাস চেয়েছেন—যারা বেঁচে আছে, তারা বেঁচে থাক। উত্তরার গর্ভস্থ শিশুর বিনিময়ে প্রাণ রক্ষা হোক আর সকলের। উত্তরার গর্ভস্থ শিশুকে মরতে হয়নি অবশ্য। স্বয়ং কৃষ্ণ তার ভার নিয়েছেন। যেভাবেই হোক তিনি তাকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু শিশুহত্যায় অভ্যস্ত অশ্বত্থামার এমন ব্যবস্থা করেছিলেন কৃষ্ণ, যাতে তাঁকে অত্যন্ত হীন জীবন কাটাতে হয় এবং তা প্রায় নির্বাসনে। ব্যাস কৃষ্ণের এই ব্যবস্থা সমর্থন করে অশ্বত্থামাকে বলেছেন—তুমি একজন ব্রাহ্মণ হয়েও যে অন্যায় ক্রূর কর্মটি আজ করেছ, তাতে এইরকমটাই অবস্থা হওয়া উচিত তোমার। ব্যাসের এই প্রতিবচন শোনার পর অশ্বত্থামা কিন্তু বলেছেন—আমি আপনার সঙ্গেই থাকব, মহর্ষি! এই পৃথিবীতে থাকতে হলে আপনার সঙ্গেই আমি বাস করব—সহৈব ভবতা ব্ৰহ্মণ্‌ স্থাস্যামি পুরুষেষ্বিহ।

কী আশ্চর্য, যে ব্যক্তি অশ্বত্থামার ওপর বিরক্ত হয়েছেন, অশ্বত্থামা তাঁরই আশ্রয় নিচ্ছেন। এই হল ধর্ম। প্রায় নির্বাসিত এক ঘৃণিত ব্যক্তিত্ব এই ধর্মের কাছে আশ্রয় খুঁজে পায়। ব্যাস অবশ্যই অশ্বত্থামাকে নিয়ে এখনই বনে যেতে পারেননি। এখন এখানে অনেক কাজ বাকি আছে তাঁর। আপাতত কৃষ্ণ এবং পাণ্ডব ভাইরা সকলে ব্যাসকে সবার সামনে রেখে দ্রৌপদীর কাছে গেলেন। পুত্ৰহন্তা অশ্বত্থামার শাস্তি হওয়ায়, দ্রৌপদী একটু যেন শান্ত হলেন এবং পাণ্ডবশিবিরে যুদ্ধোত্তর সুস্থিতি ফিরে আসতেই ব্যাস কিন্তু ছুটেছেন হস্তিনাপুরে। সেখানে তাঁর আত্মজ পুত্র ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্রের বিয়োগব্যথায় কাতর হয়ে পড়ে আছেন। আছেন পুত্রহীনা গান্ধারী। তাঁদের সান্ত্বনা দিতে হবে। বোঝাতে হবে জীবনের রহস্য এবং অবশ্যই ধর্ম। হস্তিনাপুরে ব্যাসের এই পৌর্বাহ্নিক গমনের পরোক্ষ সুবিধে পেয়েছিলেন যুধিষ্ঠির, যিনি পুত্রহারা জননী গান্ধারীর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেও ভয় পাচ্ছিলেন। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বলেছিলেন—তুমি আগে যাও গান্ধারীর কাছে, তাঁর ক্রোধ প্রশমন করো। দেখবে সেখানে আমাদের পিতামহ কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসও আছেন—পিতামহশ্চ ভগবান্ কৃষ্ণস্তত্র ভবিষ্যতি।

কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের শেষ নায়ক দুর্যোধনের পতনের পর পরই অশ্বত্থামার এই ক্রূরকাণ্ডটি ঘটে। যেভাবেই হোক পাণ্ডবপক্ষের ভয়ংকর বিপদ রোধ করেই ব্যাস হস্তিনাপুরে চলে যান ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। শত পুত্রের মৃত্যুতে মুহ্যমান ধৃতরাষ্ট্রকে বিদুর এবং সঞ্জয় যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিচ্ছেন। দ্বৈপায়ন ব্যাস দেখলেন—বিদুর-সঞ্জয়ের কথায় ধৃতরাষ্ট্র শান্ত হচ্ছেন না। বার বার তিনি অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন এবং পরমুহূর্তেই বিলাপ আরম্ভ করছেন পুত্রের জন্য। ব্যাস এবারে বলতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু ব্যাসের কথার মধ্যে নির্দোষ সান্ত্বনাবাক্যই শুধু ছিল না। আত্মজ ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি ছেড়ে দেননি। ধৃতরাষ্ট্র ব্যাসকে বলেছিলেন—পুত্ৰনাশ, অর্থনাশ এবং জ্ঞাতিনাশে যে বিপর্যয় আমার ঘটেছে, তাতে এখন মরে যাওয়া ছাড়া আমার আর কোনও শান্তি নেই—যস্যান্তং নাধিগচ্ছামি ঋতে প্রাণবিপর্যয়াৎ। পিতা! আমি মরতে চাই।

আজকে এমন বললে তো হবে না। নিজের হাতে সব ধ্বংস করে আজকে মরতে চাইলে তো হবে না। যা পূর্বে করা যায়, তার ফল ভোগ করে ঋণ শোধ করে যেতে হবে—এই তো নিয়ম। ব্যাস তো ছেড়ে দেবার লোক নন। এই শোকমুহূর্তেও তিনি ধর্মসঙ্গত এবং ন্যায়সঙ্গত কথা শোনাচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। বললেন—তুমি তো নির্বুদ্ধি মানুষ নও, পুত্র! যা জানবার আছে এই পৃথিবীতে, তাও তুমি সব জান। কাজেই এই পৃথিবীতে সবই যখন নশ্বর এবং অধ্রুব, তখন এই অযথা শোক করছ কেন—জীবিতে মরণান্তে চ কস্মাচ্ছোচসি ভারত। এ-তো চিরাচরিত সান্ত্বনার কথা। কিন্তু এখানে ব্যাসের বক্তব্য তা নয়। তিনি বোঝাতে চাইলেন—এখন যা ঘটেছে, তার বীজ ধৃতরাষ্ট্রই পুঁতে রেখেছেন বহুকাল আগে। ব্যাস বলেছেন—তোমার চোখের সামনেই এই ভয়ংকর শত্রুতার উদ্ভব ঘটেছে—প্রত্যক্ষং তব রাজেন্দ্র বৈরস্যাস্য সমুদ্ভবঃ। দুর্যোধনকে কারণ সাজিয়ে মহাকাল তার খেলা খেলেছে। কুরুদের যে এই পরিণতি হবে, সে তোমার জানাই ছিল। কাজেই এখন শোক করে লাভ কী?

ব্যাস বিদুরের প্রসঙ্গ টেনে বললেন—যদি এমন ভাব কর যে, না, এই পরিণতির কথা তোমার জানা ছিল না, তা হলে বলব—বিদুর তো তোমাকে অনেক সাবধান করে সতর্কবাণী শুনিয়েছিলেন, সে চেষ্টাও করেছিল যাতে কৌরবরা শান্তির পথ বেছে নেয়—যতিতং সর্বযত্নেন শমং প্রতি জনেশ্বর। কিন্তু এমনই দুর্দৈব—কেউ সে কথা শোনেনি।

মানুষ যখন এইভাবে ঘটনার অনুবর্তী হয়, তখন তাকে রোধ করা যায় না। ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে খানিকটা ব্যঙ্গের সুরেই বলেছেন—যে দেশে যেমন রাজা, তার লোকজনও তেমন হয়—যাদৃশো জায়তে রাজা তাদৃশো’স্য জনো ভবেৎ।

ব্যাসের এই কথাটি গভীর রাষ্ট্রনীতির কথা। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে সপ্তাঙ্গ রাজ্যের সমস্ত অঙ্গগুলি অর্থাৎ অমাত্য, জনপদ, দুর্গ, কোশ, দণ্ড, মিত্র—ইত্যাদির ব্যাখ্যা শেষ করে বলেছেন—রাজা যেমনটি হন, তার সমস্ত ছায়াটি পড়ে অন্যান্য রাজ্যাঙ্গের ওপর। ব্যাস কৌটিল্যের বহু আগেই এ কথা জানিয়ে বলছেন—কোনও রাজ্যের রাজা যদি ধার্মিক হন তবে অধর্মও ধর্মে পরিণত হতে পারে। কেননা রাজ্যাধিকারী স্বামীর সব দোষ-গুণ তাঁর ভৃত্যদের মধ্যেও অনুপ্রবিষ্ট হয়—স্বামিনো গুণদোষেণ ভৃত্যা স্যুর্নাত্র সংশয়ঃ। দুষ্ট রাজার আশ্রয় নিয়ে তোমার সব ছেলেরা আজ বিনাশ লাভ করেছে।

‘দুষ্ট রাজা’—এই শব্দদুটি ধৃতরাষ্ট্রকেও বোঝাতে পারে, দুর্যোধনকেও বোঝাতে পারে। ব্যাস হয়তো ধৃতরাষ্ট্রকেই বুঝিয়েছেন—কেননা তিনি তাঁর আত্মজ পুত্র। পিতা পুত্রকেই শোধরানোর চেষ্টা করেন। নানা উপদেশ দিয়ে ব্যাস যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের প্রসঙ্গ ধরে বলেছেন—দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে এসে কৌরব-পাণ্ডবদের ভবিষ্যৎ কলহের বীজটি দেখতে পেয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। তুমি কি জান ধৃতরাষ্ট্র! আমি সেই কলহের কথা যুধিষ্ঠিরকে বলতে তিনি বড় ব্যথা পেয়েছিলেন মনে। ধর্মপ্রাণ যুধিষ্ঠির সেই দিন থেকে চেষ্টা করে গেছেন যাতে কৌরবদের সঙ্গে তাঁর কোনও ঝগড়া-বিবাদ না হয়। কিন্তু কী করা যাবে, দৈবই এ ব্যাপারে বলবান—যতিতং ধর্মপুত্রেণ ….. দৈবন্তু বলবত্তরম্। ব্যাস শেষ কথা বলে ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন—বিধির বিধান দুরতিক্রমনীয়। যা হবার তা হয়ে গেছে। তুমি বুদ্ধিমান মানুষ। জীবন অনিত্য জেনে তুমি এই শোকমোহ ত্যাগ করো। তুমি তোমার প্রজ্ঞার জলসেচন করে পুত্রশোকের জ্বলন্ত অগ্নি নিভানোর চেষ্টা করো। সবচেয়ে বড় কথা, তুমি যেভাবে শোকগ্রস্ত হয়েছ, তাতে তোমার এই কষ্টকর অবস্থা দেখলে যুধিষ্ঠির নিজেই প্রাণত্যাগ করবেন। তাই বলছি—আমার কথা তোমায় শুনতেই হবে। কেননা, আবারও বলছি—দৈব অপরিবর্তনীয়। তুমি শান্ত হও এবং পুত্ৰতুল্য পাণ্ডবদের প্রতি করুণা করে তুমি তোমার এই অদম্য শোক ত্যাগ করো—এখনও তো বাঁচতে হবে—পাণ্ডবানাঞ্চ কারুণ্যাৎ প্রাণান্ ধারয় ভারত।

ব্যাসের কথায় ধৃতরাষ্ট্র অনেকটাই শান্ত হয়েছেন। এই জায়গাটায় আমাদের একটু আশ্চর্য লাগে—এই পুত্রশোকের মুহূর্তে, যখন চরম বৈরাগ্য এসেছিল ধৃতরাষ্ট্রের মনে, ব্যাস তো তখন ধৃতরাষ্ট্রকে রাজ্য ছেড়ে বানপ্রস্থে যাবার উপদেশ দিতে পারতেন, যেমনটি তিনি করেছিলেন জননী সত্যবতীর বেলায়। কিন্তু ব্যাস তা করেননি। হয়তো করেননি ধৃতরাষ্ট্রের কারণেই। তিনি বুঝেছিলেন—ধৃতরাষ্ট্রের মধ্যে এক অদম্য ভোগবাসনা আছে। অন্ধত্বের কারণেই হোক অথবা অন্য কোনও জন্মান্তরীণ কারণে বিষয়ভোগ ধৃতরাষ্ট্রকে প্রলুব্ধ করত। এটা একটা কারণ তো বটেই। আর একটা কারণ—যেন ধৃতরাষ্ট্রকে জীবন দিয়ে বুঝতে হবে যে, তিনি যদি বহু আগে যুধিষ্ঠিরকে রাজা মনোনীত করতেন, তা হলেও তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি কিছু কমত না এবং তাঁর বিষয়ভোগও অতৃপ্ত থাকত না, অথচ রাষ্ট্র চলত ধর্মের অনুশাসন মেনে। পরবর্তী কালে যুধিষ্ঠির একটি কর্মও ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া করেননি এবং ব্যাস এই দৃষ্টান্তটি বোঝাতে চেয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অনুভবের মাধ্যমে। ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু পরবর্তী কালে পুত্রশোকে অধীর হয়ে বনগমন করেননি, বহু কাল তিনি যুধিষ্ঠিরের রাজ্যে ছিলেন উপযুক্ত সুখভোগ লাভ করেই।

মানুষের অন্তরকে ব্যাস এতটা পড়তে পারেন বলেই তিনি এত বড় কবি। আত্মজ পুত্রের ভোগবাসনাকে ব্যাস ঋষিজনোচিত নির্বিণ্ণতায় উড়িয়ে দেননি, বরঞ্চ এই বাসনার ধর্মসঙ্গত পূরণের জন্য তাঁর মানবিক বেদনা আছে। ঋষি ব্যাস জন্মলগ্নেই মায়ের স্নেহ ছেড়ে পিতার সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন তপস্যায়, কিন্তু এই তপস্যা তাঁকে মানুষের মর্মবেদে সিদ্ধি দান করে মানুষকে দেখতে-চিনতে শিখিয়েছে। মানুষ ব্যাস সেই যে মায়ের টানে হস্তিনাপুরে মমতায় জড়িয়ে পড়লেন, সেই মমতার টান তিনি ঋষির বৈরাগ্য-ধিক্কারে এড়িয়ে যাননি। রাজা পাণ্ডু, অর্থাৎ তাঁর রাজা ছেলের মৃত্যু হলে অনাথ পাণ্ডুপুত্রদের ওপর তিনি অন্তরের টান অনুভব করেছেন এতটাই যে, সে টান অনেকটাই যুক্তিসিদ্ধ পক্ষপাতে পরিণত হয়েছে। আবার দেখুন, এই ধৃতরাষ্ট্র—তিনি অন্ধ বলেই হোক, অবুঝ বলেই হোক এবং অন্যায়ী বলেই হোক—চিরটা কাল ব্যাস তাঁর প্রতি এক উলটো টান অনুভব করেছেন। যতবার তিনি এই পুত্রের হৃদয়ের কাছাকাছি আসতে চেয়েছেন, ততবারই এই পুত্রের রাজ্যলোভ, মতিভ্রংশ তাঁর মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে ঋষি ব্যাসকে। তিনি শোধরাতে চেয়েছেন পুত্রকে। পারেননি। বার বার তিনি ছিটকে গেছেন, বার বার ধৃতরাষ্ট্রকে ডেকেছেন রাজার সম্বোধনে—‘বৈচিত্রবীর্য নৃপতে’। অর্থাৎ তুমি যেন আমার আত্মজ পুত্র নও, তুমি বিচিত্রবীর্যের ছেলে, বিচিত্রবীর্যের জীবনের অসংযমের পরম্পরা তুমি ধরে আছ, আমার নয়।

এইবার সে পালাও শেষ হল। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যে অনেক সুখ-ভোগ প্রতিপত্তি লাভ করেও ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয় তৃপ্ত হল না। পুত্রশোকে তাঁর হৃদয় দীর্ণ পর্যুদস্ত। যুদ্ধের পর পনেরো বছর কেটে গেছে। বিদুর, সঞ্জয় এখনও তাঁকে বোঝান। পিতা ব্যাস বার বার তাঁর কাছে আসেন তাঁর শোকতপ্ত হৃদয় শান্ত করতে—ব্যাসশ্চ ভগবান্নিত্যম্‌ আসাঞ্চক্রে নৃপেণ হ। কিন্তু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ধৃতরাষ্ট্র বুঝেছেন—এই নিস্তরঙ্গ রাজত্ব তিনি চাননি, যুধিষ্ঠির তাঁকেই এখনও রাজা বলে মানেন, এই রাজশব্দ তাঁর কাছে এখন শাস্তি বলে মনে হয়। ধৃতরাষ্ট্রের বিষয়ভোগের ইচ্ছা স্তিমিত হয়ে গেছে—এবার তিনি বনে যেতে চান। আর তাঁর ভাল লাগে না। যুধিষ্ঠিরের কাছে এবার তিনি বানপ্রস্থে যাবার অনুমতি চাইলেন।

যুধিষ্ঠির তো হায় হায় করে বিলাপ করতে লাগলেন। ধৃতরাষ্ট্রকে ছাড়া তিনি যে অনাথ হয়ে যাবেন, সে কথাও তিনি বার বার জানালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। ব্যাস কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে আর অনুরোধ করতে বারণ করলেন। তিনি মনে করেন—বানপ্রস্থের জন্য একটি মানুষের আরও আগেই প্রস্তুত হওয়া উচিত। ধৃতরাষ্ট্র সংসার ভোগ করেছেন অনেককাল। অধর্ম এবং অন্যায়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালনাও তিনি দেখেছেন, আবার ন্যায়সঙ্গত রাষ্ট্ৰচালনা দেখার জন্য তাঁকে থাকতে হয়েছে এতকাল। আর তাঁর কিছুই ভাল লাগে না। ব্যাস সেটা বুঝেই যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—ধৃতরাষ্ট্র যেমনটি বলেছেন, তুমি তেমনটি করো, বাছা! ইনি বৃদ্ধ হয়েছেন, তার ওপরে অন্তরে তাঁর পুত্রশোকের জ্বালা আছে—অয়ং হি বৃদ্ধো নৃপতি-র্হতপুত্রো বিশেষতঃ। ওদিকে গান্ধারীর অবস্থাও দেখো। এই প্রাজ্ঞ পুত্রবধূ আমার। কত ব্যথাই না সয়েছে। আমিও তাই এই কথাই বলব—এবার তুমি এঁদের ছেড়ে দাও। এঁরা তোমার অনুমতি লাভ করে বানপ্রস্থ অবলম্বন করুন। এখানে, বিনা কোনও তপস্যায় এঁরা মৃত্যুবরণ করুন—এ আমি চাই না—অনুজ্ঞাং লভতাং রাজা মা বৃথেহ মরিষ্যতি। ব্যাস একটা নীতির প্রতিভূ। তিনি বিশ্বাস করেন—রাজারা সঠিক রাজধর্ম পালন করে গেলেও ভোগ এবং ঐশ্বর্য ভোগ করাটা তাঁদের জীবনের অঙ্গ হয়ে যায়। ঐশ্বর্যের এই প্রয়াস বুড়ো বয়সেও যেতে চায় না রাজাদের। ব্যাস তাই মনে করেন—রাজাদের জীবনশেষের দিনগুলিতে ত্যাগ-বৈরাগ্যের বৃত্তি গ্রহণ করা উচিত। মোক্ষবৃত্তির কোনও সন্ধান না করেই শুধু ভোগবৃত্তিতে একটি জীবন কেটে যাবে, এমনটি ব্যাসের মনঃপূত নয়।

সেই জন্যই তিনি বলেছেন—পুরাতন প্রসিদ্ধ রাজারা বৃদ্ধবয়সে যা করেছেন, ধৃতরাষ্ট্রেরও তাই করা উচিত, কেননা রাজা যাঁরা হবেন, তাঁদের শেষ আশ্রয় হওয়া উচিত বন—তা হলেই একজন রাজা ঋষিতে পরিণত হতে পারেন—রাজর্ষীণাং হি সর্বেষাম্‌ অন্তে বনমুপাশ্রয়ঃ। সারা জীবন ভোগৈষণায় দিন-কাটানো ধৃতরাষ্ট্রকে অন্তত কিছুদিনের জন্য নিজের দিকে তাকানোর জন্য আত্মৈষণার পথ ধরতে বলছেন ব্যাস। তাঁর জীবনটা যেন বৃথা না হয়ে যায়—না বৃথেহ মরিষ্যতি।

ব্যাস কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে এই মোক্ষানুসন্ধানে প্রবৃত্ত করেননি। যুধিষ্ঠির এমনিতেই শম-দমাদি চতুঃসাধন-সম্পন্ন ব্যক্তি। তিনি তো শত্রুবিয়োগেও এত দুঃখিত ছিলেন যে, হস্তিনাপুরের রাজপদবিই তিনি গ্রহণ করতে চাননি। কেউ তাঁকে বোঝাতেও পারেননি, কিন্তু ব্যাস বুঝিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন—সংসারের মধ্যে যে দাঁড়িয়ে আছে, যার মধ্যে স্নেহ-মায়া-মমত্বের অপেক্ষা আছে, সে যদি এক লাফে মোক্ষলাভ করতে চায় তো মুশকিল হয়ে যায়। যৌবনের যে বিষয়ৈষিতা—যা নাকি রাজধর্মের মূল মন্ত্র, সেই রাজা যদি মোক্ষধর্ম অবলম্বন করেন, তবে প্রজারা, সাধারণ মানুষেরা কী করবে! ব্যাস মহাভারতের মধ্যে এই জীবনের ধর্মপরম্পরা ব্যাখ্যা করেছেন নিজের বংশপরম্পরার আখ্যান সাজিয়ে দিয়ে। ব্যাস মোক্ষকামী যুধিষ্ঠিরকে জীবনের কর্তব্য মেনে রাজ্যসমৃদ্ধি তথা অর্থলাভের রাজপ্রয়োজন বুঝিয়েছেন, আর চিরতরে অর্থকামী আত্মজ পুত্রকে সর্বহারা অবস্থায় বনের পথ দেখাচ্ছেন।

ধৃতরাষ্ট্রের কর্তব্যবিষয়ে যুধিষ্ঠির ব্যাসের কথা মেনে নিয়েছেন এবং তাঁর প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করে এমন একটি সুন্দর কথা বলেছেন—যা ব্যাস শুনতে চেয়েছিলেন তাঁর আত্মজ পুত্র ধৃতরাষ্ট্রের মুখে, কিন্তু শুনতে পাননি কোনও দিন। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—মুনিবর! আপনিই আমাদের মান্য গুরু। এই রাজ্য এবং প্রসিদ্ধ বংশের আপনিই পরম আশ্রয়—ভগবানস্য রাজ্যস্য কুলস্য চ পরায়ণম্‌। আমি আপনার পুত্র এবং আপনি আমার গুরু এবং পিতা। পুত্র তো সব সময় পিতার নির্দেশ মেনেই চলে, আমিও তাই চলব। যুধিষ্ঠির সম্বন্ধে ব্যাসের পুত্র নন বটে, কিন্তু ওই যে শাস্ত্রে বলে—‘আত্মা বৈ পুত্ৰনামাসীৎ’ অর্থাৎ পিতার অন্তরাত্মাই পুত্ররূপে জন্মায়, সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে ব্যাসের ধর্মশুদ্ধ অন্তরাত্মাই তো যুধিষ্ঠির। তিনি পিতামহের কথা মেনে ধৃতরাষ্ট্রকে বানপ্রস্থে ব্ৰতী হবার জন্য সংসারমুক্তি দিয়েছেন এবং ধৃতরাষ্ট্রের বনগমনের পথ ধরে সংসারমুক্তি গ্রহণ করেছেন গান্ধারী, কুন্তী এবং বিদুরও।

যুধিষ্ঠির যে বলেছিলেন—আপনি এই মহান কুলের আশ্রয়—কথাটা বোধ হয় ব্যাসের ক্ষেত্রে সর্বাংশে সত্যি। ঋষির অন্তরগত মানুষ ব্যাস জানেন—সারা জীবন ধরে স্নেহ-মমতার যে টানাপড়েন চলে, তাকে যেমন প্রশ্রয়ও দিতে নেই, তেমনই তাকে অবহেলাও করা যায় না। কতবার তো তিনি চলে গেছেন তপস্যায়, তীর্থে, মুনিসঙ্গমে, তবু ততোধিকবার তিনি ফিরেও এসেছেন হস্তিনায়—যেখানে তিনি ভরতবংশের কুলতন্তু বদ্ধ করে গেছেন নিজের সঙ্গে। পিতার ভূমিকা থেকে তিনি চ্যুত হন না। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তীরা বনের মধ্যে তপশ্চর্যা আরম্ভ করলেন, সেখানেও তিনি ফিরে এসেছেন আশ্রয়দাতা পিতার ভূমিকায়। তিনি বোঝেন—এঁরা ত্যাগ-বৈরাগ্য সহকারে তপশ্চর্যা করছেন বলেই, ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী-কুন্তীরা দশদিনেই মুনি ঋষি হয়ে যাবেন না। তিনি বোঝেন—মমতা, মমত্ব এখনও তাঁদের হৃদয়কে পীড়িত করে। তপশ্চারী পুত্র-পুত্রবধূরা একদিন দয়ালু শ্বশুরের কাছে বলেই ফেললেন—ব্যাসের যদি কোনও বিভূতি থাকে তবে সেই শক্তিতে তিনি যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত পুত্রদের দেখাতে চেষ্টা করেন।

সেদিন সেখানে অনেকেই ছিলেন—দ্রৌপদী সুভদ্রা সবাই। ব্যাস সেদিন কল্পতরুর ভূমিকায়। তাঁর যত যোগবল আছে সব একত্র করে তিনি প্রত্যেকের চোখের সামনে হাজির করেছিলেন তাঁদের প্রিয়জনকে। গান্ধারী দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর পুত্রদের, কুন্তী দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর প্রথমজ কর্ণকে, সুভদ্রা দেখতে পেয়েছিলেন অভিমন্যুকে, এবং দ্রৌপদী দেখতে পেয়েছিলেন তাঁর পঞ্চপুত্র এবং পিতা দ্রুপদ তথা ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নকে। দিব্য চক্ষু পেয়ে ধৃতরাষ্ট্র প্রাণ ভরে দেখে নিলেন তাঁর মৃত পুত্রদের। বস্তুত সেদিন যিনি যতটুকু দেখতে চেয়েছিলেন, তারচেয়ে অনেক বেশি দেখতে পেয়েছিলেন। ব্যাস তাঁর অলৌকিক শক্তির সর্বময় স্ফুরণ ঘটিয়ে যুদ্ধমৃত ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ একটা আসর বসিয়ে দিয়েছিলেন জীবিত শোকার্ত সকলের সামনে।

এই অলৌকিকতার মধ্যে কতটুকু সত্য আছে জানি না। কেননা ব্যাসের মতো অতুলপ্রভাবশালী ব্যক্তি—যিনি মহাভারত রচনা করতে পারেন, তিনি যে আরও অনেক কিছুই করতে পারেন, সে ব্যাপারে সংশয়ের বদলে নিশ্চয় থাকাই ভাল। লক্ষণীয়, এই সম্পূর্ণ পিতৃলোক চোখের সামনে উজ্জাগরিত করে দেবার পরেই কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রকে আমরা যথার্থ নির্বিণ্ণ দেখতে পাচ্ছি। তিনি বুঝেছেন—এতকাল বিষয়ের সঙ্গে সংযোগ ছিল বলেই বিষয় বিয়োগ তাঁকে শোক-তাপে দগ্ধ করেছে। তিনি এবার যথার্থ তপশ্চর্যায় মন দিয়েছেন এবং প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছেন সত্যে। ব্যাস বুঝিয়ে দিলেন—যার হৃদয়ের মধ্যে কাম, ক্রোধ, লোভ তথা বিষয়ের অপ্রাপ্তি ঘটলেই শোক বাসা বেঁধে থাকে, তার দ্বারা আর যাই হোক শুদ্ধ জ্ঞান লাভ করা সম্ভব হয় না। তাই বলে ব্যাস এও চান না যে, মানুষের ভিতর থেকে যদি সে তাগিদ না আসে, তবে কাম-লোভের গলায় হঠাৎ নিবৃত্তির খড়্গ চালিয়ে দিয়ে ভণ্ড-বৈরাগী হয়ে যাক মানুষ।

মহাভারতের মধ্যে ব্যাস এমনই এক জীবনচিত্র এঁকেছেন—যার মধ্যে হঠাৎ-বৈরাগ্য অথবা হঠাৎ-সন্ন্যাসী হওয়ার অভিসন্ধি নেই। বৈরাগ্য অথবা সত্যপ্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাস এক নিয়ম-সংযত ক্রমিকতার কথা বলেন। ইন্দ্রিয়ের যে আহার প্রয়োজন, ব্যাস সেই আহার যুগিয়ে দেবার পক্ষে, কিন্তু তারমধ্যে যেন অতিরেক না থাকে, তারমধ্যে যেন ন্যায় থাকে। ধর্মসঙ্গত আসক্তির পথ ধরেই ব্যাসকথিত অনাসক্তির পথে পা বাড়াতে হবে। পণ্ডিতেরা বলেন—মহাভারতের প্রধান অঙ্গী রস নাকি শান্তরস—যা নাকি মোক্ষ বা মুক্তির রসসিদ্ধ মূর্তি। ব্যাস কিন্তু মহাভারতের পাঠককে এক ডিগবাজিতে মোক্ষভূমিতে পৌঁছে যাবার উপদেশ দেন না। সম্পূর্ণ মহাভারত ধরে তিনি যা দেখাচ্ছেন তা হল—মানুষের জীবনে সব আছে—কাম আছে, ক্রোধ আছে, লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য সব আছে। এগুলিকে বুঝে নিয়েই তবে মোক্ষভূমিতে পৌঁছোতে হবে।

মহাভারতের প্রথমেই তিনি এ কথা বলে নিয়েছেন মহাভারতের তাৎপর্য নির্ণায়ক দুটি শ্লোকে। তিনি বলছেন—দুর্যোধন একটা প্রকাণ্ড গাছের মতো। এই গাছ এই পৃথিবীতেই সুলভ—যে গাছ লোভ, ক্রোধ আর পরশ্রীকাতরতা দিয়ে তৈরি এবং এই গাছের মূল হলেন শুভবুদ্ধিহীন ধৃতরাষ্ট্র। অন্যদিকে যুধিষ্ঠিররূপী গাছটি হল ধর্মময়, যে গাছ দয়া, ক্ষমা এবং আত্মত্যাগ দিয়ে তৈরি এবং এই গাছের মূল হলেন ব্রহ্মস্বরূপ কৃষ্ণ, যিনি ভগবদ্‌গীতার উপদেশে মোক্ষের সন্ধান দেন অনাসক্ত কর্মের মাধ্যমে। ব্যাস ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনকে ঘৃণা করেন না, তাঁরাও ব্যাসের আত্মজ, আবার যুধিষ্ঠিরকেও তিনি অতিবৈরাগ্যে রাজধর্ম ত্যাগ করে রাজ্য ছেড়ে বৈরাগী হতে বলেন না। ব্যাস মনে করেন—প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মুক্তির চিন্তা অনুপ্রবিষ্ট আছে। একজনের এটা বেশি, ওটা কম। অন্যজনের এটা কম, ওটা বেশি। ধৃতরাষ্ট্রকে নিজের ঔরসে জন্ম দিয়ে এবং তার পরম্পরায় দুর্যোধনকে প্রসব করাতে সাহায্য করে তিনি এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, অন্যায়ী ব্যক্তিকে তিনি হেয় জ্ঞান করেন না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধন যেভাবে অর্থ-সমৃদ্ধি এবং কামনার পিছনে ধাবিত—এই প্রধাবনের সঙ্গে তিনি যুক্ত করতে চান ধর্মকে—যে ধর্মের মধ্যে ইন্দ্রিয়জয় থেকে আরম্ভ করে ন্যায়, নীতি, সংযমের মন্ত্রগুণ মিশ্রিত আছে। অর্থ এবং কামের সঙ্গে ধর্মের বোধটাকে যুক্ত করার জন্য মহাভারতের শেষে তিনি কান্নাধরায় গলায় চেঁচিয়ে উঠে বলেছেন—আমি দুহাত তুলে কেঁদে কেঁদে বলে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কেউ আমার কথা শোনে না—ঊর্ধবাহু-র্বিরোম্যেষ ন চ কশ্চিৎ শৃণোতি মাম্—আমি বলে বেড়াচ্ছি—ওরে তোরা অর্থ, কাম—যার পিছনে ছুটে চল না কেন, তার সঙ্গে যুক্ত কর ধর্মকে। ধর্ম এবং ন্যায়ের পথে যদি চলিস, তবে অর্থ-সমৃদ্ধিও ঘটবে, কামনাও পূরণ হবে—তবু মানুষ অর্থ এবং কামের পিছনেই দৌড়োয়, ধর্মের সেবা করে না।

এত যে বার বার ধর্মের কথা বলছেন ব্যাস—তার একটা কারণ আছে। ধর্মের কথা বলে ব্যাস সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছোতে চাইছেন। তিনি জানেন—মোক্ষধর্ম সবার জন্য নয়। ইহলোকে কোনও ফলাকাঙক্ষা থাকবে না, পরলোকেও স্বর্গাদিবাসনা থাকবে না, অহং-মম থাকবে না,—এমন মানুষ, অথবা শম-দমের সাধনে যাঁরা দৃঢ় এবং যাঁরা মুক্তিলাভ করতে চান—তাঁরা যে সংখ্যায় গুটিকয়েক মাত্র, ব্যাস তা জানেন। মহাভারতে এই মোক্ষধর্মের কথা অবশ্যই আছে—কিন্তু সেটা এখানে প্রধান নয়। মোক্ষের কথাটা এখানে আছে চতুর্বর্গসাধনের অন্য তিন উপায় ধর্ম, অর্থ, কামের সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে। মহাভারতের প্রধান অঙ্গুলি-সংকেত তা হলে কোন দিকে? আমি যতটুকু বুঝেছি, তাতে বার বার মনে হয়েছে—মহাভারতের সমস্ত ঝোঁকটাই ধর্মের দিকে। আগেও বার বার বলেছি—ব্যাসের ধর্ম ফুল, বেলপাতা বা নৈবেদ্যের ধর্ম নয়। তাঁর ধর্ম বিশাল এই অনাদি-অনন্ত সংসার-পরম্পরা ধারণের ধর্ম। এমন এক শাল্বত ধর্ম, যা শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত, গাণপত্যের শৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়—এই ধর্ম মানুষকে মানুষ করে তোলে। এই ধর্মকে কামের জন্য, ভয়ের জন্য, লোভের জন্য এমনকী জীবনের জন্যও ত্যাগ করা যায় না। অপর দিকে এই ধর্মের জন্য কাম, লোভ, ভয়—সব ত্যাগ করা যায়। ব্যাস সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কথা ভেবে এই ব্যবস্থা দিয়েছেন।

মানুষের চরিত্র, বৃত্তি এবং কর্মভেদে এই ধর্মের ব্যবস্থা স্বতো বিভিন্ন, কিন্তু প্রত্যেক জায়গাতেই একটা সাধারণ মিল আছে—অর্থাৎ ক্ষেত্রবিশেষে সেটাই পরম নৈতিক বলে মনে হয়। যিনি জন্মমাত্রেই পিতার সঙ্গে তপস্যায় চলে গিয়েছিলেন, যিনি মোক্ষবৃত্তির সমস্ত তত্ত্ব সম্পূর্ণ অবগত, তিনি যে কেমন করে সর্বস্তরের মানুষের ধর্মের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পেরেছিলেন, সেটা ভেবে অবাক হই। মোক্ষমার্গের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করা সত্ত্বেও তিনি কিন্তু সাধারণের জীবনে ধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন বেশি। মহাভারতের চরিত্রগুলির দিকে একবার তাকান। ভাবুন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথা। তিনি মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র। ধর্মের প্রতীক হিসেবে তিনি চিহ্নিত। বারংবার তিনি ত্যাগবৈরাগ্যযুক্ত মুনিবৃত্তি এবং মোক্ষধর্মের পথে যেতে চেয়েছেন, তিনি তার উপযুক্তও ছিলেন বটে, কিন্তু ব্যাসের চরিত্র-চিত্রণে তাঁকে সংসারের আবর্তের মধ্যেই বেঁধে রাখা হয়েছে, এমনকী রাজা হবার সাধ এবং হয়তো বা উপযুক্ততাও কিছু না থাকা সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরকে রাজা হতে হয়েছে এবং তা শুধু এইটুকু বোঝানোর জন্য যে, কাম কিংবা অর্থ নয়, একমাত্র ধর্মই রাজসিংহাসনে বসবার পক্ষে উপযুক্ত। কারণ কুরুক্ষেত্রের যে যুদ্ধ হয়েছে, তা আসলে অন্যায়-অশুভের বিরুদ্ধে ধর্মের জয়। যুধিষ্ঠির সেই ধর্মের প্রতীক। ধর্মরূপী ধর্মরাজ হস্তিনাপুরের সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়েছেন।

বিদুরকে দেখুন। কী প্রয়োজন ছিল বিদুরের। তিনি ক্ষত্রিয় নন, ব্রাহ্মণীর গর্ভজাত নন, তিনি স্বয়ং ব্যাসের পুত্র এবং পূর্বজন্মে তিনি দেবস্বরূপ ধর্ম। সারাটা মহাভারত জুড়ে তিনি বিবেকের মতো দণ্ডায়মান, অন্যায় এবং অনীতির বিরুদ্ধে তিনি সার্বক্ষণিক এক প্রতিবাদ। তাঁর রাজশক্তি নেই, তবু তাঁর কথা না শুনে পারা যায় না। নৈতিকতার সমস্ত সংকটে তাঁকে ডাকতে হয়, তাঁর পরামর্শ নিতে হয়। আর আছেন কৃষ্ণ। তিনি ধর্মের কর্তা, বক্তা এবং অভিরক্ষিতা। মহাভারতের এই তিন প্রধান চরিত্রের বিপরীতে যাঁরা আছেন—তাঁদের কাছে কোন বস্তুটা পুরুষার্থ বলে গণ্য ছিল? ধৃতরাষ্ট্র, দুর্যোধন বা কর্ণের কাছে পুরুষার্থ হল অন্যায় কাম-লোভ এবং অবৈধ অর্থ এবং কপট-বিজিত রাজ্য। কিন্তু সেই বিপরীত পক্ষেও এক ওজস্বিনী নারীশক্তি সর্বদা জাগ্রত রয়েছে—তিনি স্বামীর লোভে প্রশ্রয় দেন না, পুত্রের অন্যায় বাড়-বাড়ন্তে তিনি কোনও স্নেহের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন না। পুত্র যুদ্ধজয়ের আশীর্বাদ চাইলেও গান্ধারী জননী বলেন—বাছা। যেখানে ধর্ম সেখানেই জয় হবে—যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ।

মহাভারতের তাৎপর্য-নির্ণায়ক যে শ্লোকদুটি আছে, তাতেও ধর্ম এবং অধর্মের প্রতীকী চরিত্রদুটির প্রাধান্যই ব্যাসের ভাবনাটুকু প্রকাশ করে দেয়। একটি শ্লোকে বলা হচ্ছে—দুর্যোধন হলেন সেই অধর্মের প্রতিরূপ এক প্রকাণ্ড বৃক্ষের মতো—দুর্যোধনো মন্যুময়ো মহাদ্রুমঃ—যে বৃক্ষ সৃষ্টিই হয়েছে ক্রোধ-দ্বেষ আর অসূয়া দিয়ে। এই বৃক্ষের কাণ্ড হলেন কর্ণ এবং শাখা হলেন শকুনি। দুঃশাসন ইত্যাদি ভাইয়েরা এই বৃক্ষের ফুলফল। আর এই লোভ-মোহ-সমন্বিত বৃক্ষের মূল হলেন শুভবুদ্ধিহীন স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্র। ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের বিপরীত কোটিতে যে বিশাল বৃক্ষটি, সেটি হল ধর্মময়—যুধিষ্ঠিরো ধর্মময়ো মহাদ্রুমঃ। এই বৃক্ষের কাণ্ড হলেন অর্জুন। শাখা হলেন ভীম আর নকুল-সহদেব তার ফুলফল। এই ধর্মদ্রুমের মূল হলেন ব্রহ্মস্বরূপ কৃষ্ণ এবং সত্যব্রত ব্রাহ্মণেরা।

ধর্মের দিকে যাঁরা আছেন—তাঁদের প্রত্যেকে, কেউ প্রত্যক্ষভাবে, কেউ পরোক্ষভাবে, কেউ শক্তি দিয়ে, কেউ বুদ্ধি দিয়ে—প্রত্যেকেই ধর্মের প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন। তার মধ্যে কোথাও অনীতির আভাস থাকলেও তা বৃহত্তর ধর্ম-প্রতিষ্ঠার কারণেই ব্যবহৃত এবং তা যুক্তি দিয়ে নির্ণয়ও করা যায়। ব্যাস এই ধর্মপ্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিখছেন এবং তা লিখছেন সাধারণ মানুষের ন্যায়ধর্মের প্রতীতিগম্য করে।

সংসারের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে থেকেও অর্থ-কামের অন্যায় আকর্ষণ যেখানে বার বার মানুষকে প্রলুব্ধ করবে, সেই প্রলোভনের বিরুদ্ধে ধর্মের বর্ম পরে লড়াই করা—এটাই মহাভারত রচনার উদ্দেশ্য। কারণ সাধারণ মানুষের কাছেও অর্থ-কামের অবৈধ হাতছানিটাই বড় হয়ে ওঠে, ব্যাস তাই সাধারণ মানুষের কথা ভেবেই মহাভারত লিখেছেন। সাংসারিক সত্য এবং সংসারের সঠিক প্রয়োজন বোঝবার জন্য আজন্ম তপস্বী ব্যাস মাঝে মাঝেই ফিরে এসেছেন সংসারের ঠিকানায়। কেন ফিরেছেন, তার জন্য অসাধারণ যুক্তি আছে তাঁর, এবং যে যুক্তি তিনি প্রকাশ করেছেন এমন একটি জায়গায়, যেখানে স্বয়ং তাঁর পুত্র শুকদেব মোক্ষকামী হয়ে সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

যুধিষ্ঠির শরশয়ান ভীষ্মের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন—কেমন করে বৈয়াসকি শুক এমন নির্বিণ্ণ ব্রহ্মানন্দী হয়ে উঠলেন? ভীষ্ম ব্যাসের জীবনচর্যা উল্লেখ করে বলেছেন—ব্যাস তাঁর পুত্রকে বেদ-স্বাধ্যায় সমস্ত শিখিয়ে একদিন তাঁকে জীবন এবং অহং-মমতার অনিত্যতা বোঝাতে বসলেন। ব্যাসের সেই উপদেশের মধ্যে বেদ-বেদান্তের সারাৎসার দার্শনিকতা আছে। সেই দার্শনিকতায় সাধনসম্পন্ন উপযুক্ত ব্যক্তি অবশ্যই মুক্তিকামী হতে পারেন, কিন্তু ব্যাস তাঁর দার্শনিকতার আরম্ভ করেছিলেন ধর্ম থেকেই। বলেছিলেন—ধর্মং পুত্র নিষেবস্ব—তুমি ধর্মের সেবা করো। বলেছিলেন—সমস্ত জীবনের মধ্যেই একটা অন্ধকার আছে; আছে মৃত্যুর শীতলতা, কামনা-বাসনার হাতছানি। এই অন্ধকারের মধ্যে প্রবেশ করতে হলে ধর্মময় একখানি প্রদীপ হাতে করে ঢুকতে হবে, আর মাঝেমধ্যেই ধর্মবুদ্ধির সলতেটুকু উসকে দিতে হবে—ক্রমশঃ সঞ্চিতশিখো ধর্মবুদ্ধিময়ো মহান্‌।

ব্যাস অনেক উপদেশ দিয়েছেন—মুক্তোর মতো এক-একটি উপদেশ। সবগুলির আলোচনার অবকাশ নেই এখানে। তবে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যাসের যা বক্তব্য ছিল, তাতে এইটুকু বোঝা যায় যে, এই মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করে যে মানুষ ন্যায়-নীতি-ধর্মের পথ প্রশস্ত করে নিজের কাজটুকু মন দিয়ে করে যেতে পারে সেই ব্যক্তিই ব্যাসের কাছে বুদ্ধিমান উপাধি পাবেন এবং তা না পারলে সে মোহগ্রস্ত মূর্খ—ধর্মং হি যো বর্ধয়তে স পণ্ডিতো/ য এব ধর্মাচ্চ্যবতে স মুহ্যতি। ঠিক এই উপদেশটাই বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি গৃহস্থ আশ্রমে থাকা কর্মপরায়ণ ব্যক্তিটির সঙ্গে আরণ্যক নির্বিণ্ণ মুমুক্ষু ব্যক্তির একটা তুলনা করেছেন—যে তুলনা ব্যাসের মতো সাহসী যুক্তিবাদী ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়, মনে হয়।

আমরা কী ভাবি? আমরা ভাবি—যাঁরা অরণ্যে মুনিবৃত্তি গ্রহণ করে আজন্ম ত্যাগ-বৈরাগ্যের সাধন করছেন, তাঁদের চেয়ে মহত্তর সত্তা পৃথিবীতে থাকতেই পারে না। ব্যাস বললেন—কথাটা সর্বাংশে ঠিক নয়। তিনি যুক্তি দিয়ে বললেন—তপোবনেই যাঁরা জন্মালেন এবং ত্যাগ-বৈরাগ্যের সাধনশেষে তপোবনেই যাঁদের দেহপাত ঘটল—তাঁরা যে ধর্মের সাধনে খুব বড় মানুষ—তা বলব না। কেননা মনুষ্যলোকের স্বাভাবিক যে কাম-লোভ-ভোগের বাসনা—সে তো তাঁরা উপলব্ধিই করতে পারলেন না। কামনা-বাসনা মানুষকে কতটা আকর্ষণ করে, ভোগসুখ মানুষকে কতটা মোহিত করে—এ ব্যাপারটাই যাঁরা জানেন না—তাঁদের জিতেন্দ্রিয়তার পরীক্ষাটাই তো হল না। নির্বিণ্ণ ভোগবিরক্ত ব্যক্তি আরও বৈরাগ্য করলেন—এতে কী হল? ব্যাস তাই বললেন—বৈরাগ্যের পরিবেশে জন্মে যাঁরা বিরাগী হয়েই মারা গেলেন তাঁদের ধর্ম সাধিত হল অল্পই, কেননা যেহেতু কামনা-বাসনাকে অতিক্রম করে তাঁদের উর্দ্ধ্বারূঢ় হতে হয়নি, তাই ধর্মের সাধনে তাঁরা পরীক্ষিত নন—তেষামল্পতরো ধর্মঃ কামভোগান্‌ অজানতাম্।

এই শ্লোকের সাধারণগম্য অর্থ করতে গিয়ে স্বয়ং মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশও মহা ফাঁপরে পড়েছেন এবং শ্লোকটির ভুল অর্থ করেছেন। তিনি লিখেছেন—“যাঁহারা তপোবনেই জন্মিয়া সেখানেই মরিয়া যান, তাঁহারা কামভোগ জানেন না বলিয়া তাঁহাদের ধর্ম অল্পতর হইলেও তাহাই শ্লাঘ্য।” এখানে এই শেষ কটা কথা তিনি কোথা থেকে পেলেন? মূল সংস্কৃতে তো এমন কথা নেই যে, “তাঁহাদের ধর্ম অল্পতর হইলেও তাহাই শ্লাঘ্য” বা প্রশংসনীয়। আসলে মহামহোপাধ্যায় ভাবতেই পারেননি যে, আরণ্যক মুনিবৃত্তি মানুষের ধর্মের কোনও খামতি হতে পারে। তিনি তাই ব্যাসের দার্শনিকতা বুঝতে না পেরে ভাবলেন বুঝি ব্যাস একখানা জব্বর ভুল করে বসে আছেন এবং সাধারণ মানুষ ব্যাসকে ভুল বুঝবে। অতএব তিনি সাধারণ মানুষ এবং ব্যাস দুজনকেই সংশোধন করার গুরু দায়িত্ব অনুভব করে মূল শ্লোকের বাড়তি অর্থ দিলেন—তাঁদের ধর্ম অল্পতর হলেও তাঁদের প্রশংসা করতে হবে।

বস্তুত ব্যাস যা লিখেছেন, তাই যে তিনি ‘মিন’ করেছেন, তা তাঁর পরবর্তী শ্লোক দেখলেই বোঝা যায়। তাঁর ভাবটা এই যে—যার টাকাপয়সা কিছু নেই, সেই হতদরিদ্র মানুষ যদি বৈরাগ্য এবং ত্যাগ দেখায় তার মানে কী? যে কোনও দিন স্ত্রীলোকের স্তন-জঘনের বন্ধুরতা চোখে দেখেনি, সে যদি বলে যে, আমি কামনা জয় করেছি, তার মানে কী? পরের শ্লোকে ব্যাস বলেছেন—যিনি ভোগ্যবস্তুর ভোগ পরিত্যাগ করে শরীরের দ্বারা তপশ্চরণ করেন—কেউ যেন না ভাবেন—তিনি কিছু পাননি। আমি সেই তপস্যার বলকেই বিশেষ আদর করি—তন্মে বহুমতং ফলম্‌।

আসলে এইখানেই ব্যাসের জয়কার ঘোষণা করতে হয়। সংসারী গৃহস্থ—কম হোক, বেশি হোক—কিছু-না-কিছু কাম্য সুখ, ভোগ্যবস্তু লাভ করেই। ধর্মাচরণ করতে হলে তাঁকে কামনা-বাসনা অতিক্রম করে মনকে বশীভূত করে শারীরিক তপস্যায় নিজেকে নিয়োজিত করতে হয়। ব্যাস মনে করেন—সংসারী গৃহস্থের এই আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাটা কম প্রশংসনীয় নয় এবং এই চেষ্টাটুকু হয়তো নির্বিণ্ণ সন্ন্যাসীর চেয়েও বেশি প্রশংসনীয়। ব্যাস বলেছেন—গার্হস্থের এই সাধনায় সে যেন না ভাবে যে, সে কিছু পায়নি—ন তেন কিঞ্চিন্ন প্রাপ্তম্‌—সে নিশ্চয়ই ধর্মলাভ করেছে।

এর পরেও ব্যাসের অনেক উপদেশ আছে এবং তা প্রায় বৈদান্তিক। ব্যাসপুত্র শুক পিতার উপদেশ শুনেও সংসার আশ্রম ত্যাগ করে মোক্ষের উপদেশ গ্রহণ করার জন্য মোক্ষারূঢ় গুরুর অন্বেষণে বেরিয়ে পড়েছিলেন। ব্যাস পুত্রকে উপদেশ দিয়েছিলেন—আমি কে এবং কার? আমি যার, এমন লোক আমি দেখি না, আবার যে আমার, তেমন লোককেও আমি দেখি না—ন তং পশ্যামি যস্যাহং তং ন পশ্যামি যো মম। কিন্তু এই উপদেশ বুঝি তাঁর নিজের সম্বন্ধেই খাটে না। মহাভারতের সমস্ত ধর্মসংকটে যতবার তাঁকে উপস্থিত থাকতে দেখেছি, ততবারই তাঁকে বিরক্ত সন্ন্যাসীর মতো দেখিনি। সর্বত্র ব্যাস এসেছেন অসীম মমতা নিয়ে—যদি কিছু করা যায়, যদি ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করা যায়!

মহাভারতের কথারম্ভে ব্যাস জানিয়েছিলেন যে, তিনি মহাভারতের মধ্যে কুরুবংশের বিস্তার সম্বন্ধে আলোচনা করবেন। বলবেন—গান্ধারীর ধর্মশীলতার কথা, বিদুরের প্রজ্ঞার কথা এবং কুন্তীর ধৈর্যের কথা। ব্যাস আরও প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, কৃষ্ণবাসুদেবের সর্বাতিশয়ী মাহাত্ম্য, পাণ্ডবদের সত্যবোধ এবং ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের দুবৃত্ততা—এগুলিও তাঁর মহাকাব্যের পরিসরে আসবে। কিন্তু একবারও ব্যাস বললেন না যে, তিনি কোনওদিন ঋষি মুনির নির্বিণ্ণতা নিয়ে মহাভারতের অন্তরে উপস্থিত হবেন; তিনি আসবেন একান্ত মনুষ্যজনোচিত মমতা এবং বেদনাবোধ নিয়ে। কেউ হয়তো এ কথা তেমন জোর দিয়ে বলবেন না; কিন্তু মহাভারত পড়তে গিয়ে বার বার আমার মনে হয়েছে যে, ব্যাসের মধ্যে নির্বিণ্ণ ঋষিসত্তার চেয়ে মানুষের মমত্বময়ী সত্তাটাই অনেক বেশি বড়।

বাস্তবিকপক্ষে এই মমত্বের ভাগ যে ব্যাসের মধ্যে কতটা, তা সবচেয়ে ভাল বুঝতে পারলাম ভাগবত পুরাণ পড়তে গিয়ে। ভাগবত পুরাণের আরম্ভে রৌমহর্ষণি উগ্রশ্রবা সূত ব্যাসের মহিমাকীর্তন করতে গিয়ে শুকের মহিমা কীর্তন করে বলেছিলেন—সমস্ত প্রাণীর হৃদয়-সমান সেই দ্বৈপায়নপুত্র শুকদেবকে নমস্কার। পুত্র শুক সংসারবিরাগী হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে চাইলে পিতা ব্যাস বিরহব্যথায় কাতর হয়ে কেঁদে বলেছিলেন—পুত্র আমার। আমাকে ছেড়ে যেয়ো না—দ্বৈপায়নো বিরহকাতর আজুহাব। পুত্র শুক পিতার স্নেহানুবন্ধ ছিন্ন করার জন্য নিজে কোনও উত্তর দেননি। মোক্ষগন্ধী অরণ্যের ভিতর দিয়ে তিনি প্রস্থান করেছিলেন, আর সম্মুখস্থ বৃক্ষকুল বায়ুতাড়িত পল্লবাঙ্গুলি উত্তোলন করে উত্তর দিয়ে বলছিল—না, না, তোমার পুত্র এই স্নেহ-মমতার বন্ধনে ধরা পড়বেন না—তোমার পুত্র আছেন, তিনি আছেন, এইটুকুই। শুক ফিরে আসেননি। কিন্তু ব্যাস প্রব্রজিত অবস্থাতেও মায়ের ডাক শুনতে পেয়ে ফিরে এসেছিলেন।

আমি কেন, সকলেই বলবেন—এ কেমন ঋষি যিনি সংসার সন্ন্যাস এবং মুক্তির সমস্ত রহস্য জেনেও পুত্রের বিরহব্যথায় কাতর। আমি বলি—এই মমতা আর মর্মবেদনা ছিল বলেই শুকদেব শুধু শুকসদৃশ বক্তা, তিনি স্রষ্টা নন। অন্যদিকে বিশ্বসংসারের সকলের প্রতি প্রখর মমতাবোধ আছে বলেই সেই জাতিভেদ-দীর্ণ সমাজে বসেও তিনি একদিকে ঋষির মতো বলতে পারেন—এই পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু নেই—ন মানুষাৎ শ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ—অন্যদিকে সেই মমতাবোধেই তিনি সংসারের সুখ-দুঃখে অংশগ্রহণ করেন। সংসারে এই সাক্ষাৎ অংশগ্রহণই তাঁর ভিতরে কবিজনোচিত বেদনাবোধ সৃষ্টি করে—এই বেদনাবোধ থেকেই মহাকাব্যের সৃষ্টি হয়। তিনি বোঝাতে চান—কী হবে তার সেই টাকাপয়সা, ধনসম্পত্তি দিয়ে, যে নাকি কাউকে একটু দিতেও পারে না আবার নিজেও ভোগ করতে পারে না। কী হবে সেই বিরাট শক্তি-ক্ষমতা দিয়ে—যে শক্তি অন্যায়ী শত্রুকে বাধা দিতে পারে না—ধনেন কিং যন্ন দদাতি নাশ্নুতে/ বলেন কিং যেন রিপুং ন বাধতে। অত-শত শাস্ত্রজ্ঞান দিয়ে কী হবে, যে শাস্ত্রজ্ঞান ধর্ম বা নীতি বোঝাতে পারে না। আর কীই বা হবে সেই দেহ দিয়ে—যে দেহ নিজের অধীন নয় অথবা যে দেহ ইন্দ্রিয় সংযত করতে পারে না।

বেশ বোঝা যায়—জীবনের জন্য যা যা প্রয়োজন—ধন-জন, বিদ্যা-বুদ্ধি, শক্তি-তেজ এবং এই শরীর—ব্যাস এগুলির সব কটিকেই বিশ্বাস করেন, কোনওটাকেই তিনি মায়াময় কাষ্ঠতুল্য ভাবেন না—কিন্তু এই সব কিছুই যেন জীবনের প্রয়োজনে ন্যায়ত পরিশীলিত হয়। জীবনের এই প্রয়োজনগুলি বুঝতে পারেন বলেই ব্যাস কবি হতে পেরেছেন, শুক তা পারেননি। সৃষ্টিকর্তা বিধাতাও ব্যাসকে বুঝি এইভাবে তৈরি করেছেন। তাঁর হাত দিয়ে মহাকাব্য সৃষ্টি করাবেন বলেই বুঝি তিনি নিজের বিভূতিময় সত্ত্ব দিয়ে নিজেরই অংশে তাঁকে সৃষ্টি করেছিলেন, কিন্তু তাঁকে শুষ্ক-রুক্ষ মুক্ত মুনি হতে দেননি।

মহাভারতের মোক্ষধর্মপর্বে ব্যাসের একটা পূর্বজন্ম-কথা আছে। সেখানে বলা হয়েছে—স্বয়ং বিশ্বাধার নারায়ণের অংশে ব্যাসের জন্ম। মহাভারতের কথক-ছাত্র বৈশম্পায়নের জিজ্ঞাসা ছিল এ ব্যাপারে। তিনি সময় বুঝে প্রশ্নও করেছিলেন। মহাভারতের মৌল অংশ ভারতাখ্যান বলা শেষ হয়ে গেছে তখন। ব্যাস তখন বেশ ক্লান্ত। ব্যাসের চার শিষ্য সুমন্ত, জৈমিনি, পৈল, বৈশম্পায়ন এবং মুনিপুত্র শুক ক্লান্ত ঋষির শুশ্রূষা করছেন। সেই সময় সবাই মিলে ব্যাসকে জিজ্ঞাসা করলেন—আচ্ছা আপনার জন্ম নিয়ে দুরকম কথা শুনি কেন। সবাই জানে—জন্মের প্রমাণে ভগন্নারায়ণ থেকে আপনি ষষ্ঠ পুরুষ, মহর্ষি পরাশরের ঋষিসত্তা নিয়ে আপনি জন্মেছেন—পিতামহাদ্যং প্রবদন্তি ষষ্ঠং/ মহর্ষিমাৰ্ষেয়-বিভূতিযুক্তম্‌—কিন্তু আবার অনেকেই বলছেন—ভগবন্নারায়ণের পুত্র আপনি, তাঁরই অংশে আপনার জন্ম—এই দুরকম কথা কেন?

শিষ্যদের প্রশ্ন শুনে ব্যাস মহাভারতের শেষাংশে এসে নিজের কথা বলছেন সলজ্জে। ব্যাস বললেন—সে হল পুরাকল্পের কথা। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সপ্তম জন্ম হল যখন, তখন প্রভু নারায়ণ তাঁকে নিজের নাভিকমল থেকে উৎপন্ন করলেন। ব্রহ্মাকে তিনি প্রজাসৃষ্টির আদেশ দিলে তিনি দেবতা, দানব, মানব, যক্ষ-রাক্ষস সব সৃষ্টি করলেন। সেই সৃষ্টির মধ্যে যখন শুভ এবং অশুভ শক্তির পারস্পরিক হিংসা-দ্বেষ আরম্ভ হল, তখন প্রভু নারায়ণ মৎস্য-কূর্ম-নৃসিংহাদি নানা অবতার গ্রহণ করে অশুভের বিনাশ ঘটাবেন—সেটাও প্রভু নারায়ণের সিদ্ধান্ত। কিন্তু যা কিছুই এতদিন হল—তা সৃষ্টি এবং তার পালনের সঙ্গে যুক্ত এবং তা অনেকটাই রাজনৈতিক সামাজিক ব্যাপার। প্রভু নারায়ণের মনে হল—এ ছাড়াও একটা জগৎ আছে—তা হল সারস্বত জগৎ—সেখানে সাংখ্য, যোগ, পঞ্চরাত্র, বেদ-বেদান্ত, আরণ্যক—ইত্যাদি দর্শন এবং শাস্ত্রের নিষ্পত্তির জটিলতা আছে। রেষারেষি আছে সেখানেও, অতএব পৃথিবীর রাজনৈতিক এবং সামাজিক সুস্থিরতা সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান-নিষ্ঠারও নিষ্পত্তি প্রয়োজন।

পরম ঈশ্বর এই প্রয়োজন মেটানোর ভার ব্রহ্মাকে দিলেন না এবং তিনি নিজেও সে ভার নিলেন না। জ্ঞানের তত্ত্ব এবং প্রয়োগ সুস্থির করার জন্য প্রভু নারায়ণ তখন—ওহে কে আছ এখানে—এই বলে একটি বাক্য উচ্চারণ করলেন। সেই বাণীরূপা সরস্বতী থেকেই তাঁর এক সারস্বত পুত্র জন্মাল—যার নাম অপান্তরতমা—অর্থাৎ যাঁর মধ্যে অজ্ঞানের অন্ধকার একটুও নেই। আদেশের প্রতীক্ষায় অবনতমস্তকে দাঁড়ানো সেই পুত্রকে নারায়ণ বললেন—জ্ঞানিশ্রেষ্ঠ! তুমি জ্ঞানস্বরূপ বেদের ভাবনাগুলি ভাল শ্রবণ করে বেদকে বিভাগ করো তুমি। তাঁদের আদেশে নারায়ণের পুত্রপ্রতিম অপান্তরতমা সম্মিলিত বেদ এবং দর্শনগুলিকে বিভক্ত করলেন। পুত্রের সারস্বত কর্মে প্রভু নারায়ণ তুষ্ট হয়ে বললেন—ভবিষ্যতে যখন কুরুবংশের রাজারা জন্মাবেন তখন এক সময় তোমার থেকে উৎপন্ন কৌরব-বংশধরদের মধ্যেই বিবাদ সৃষ্টি হবে। সেই সময় আবারও তুমি বেদ বিভাগ করবে এবং ধর্মনিরূপক বিভিন্ন শাস্ত্র রচনা করবে। কৃষ্ণবর্ণযুক্ত কলিকালে জন্ম নিয়ে তোমার গায়ের রংও হবে কালো। তবে হ্যাঁ যতই তুমি বিরাগী তপস্বী হও তুমি কিন্তু পার্থিব মমত্বময় অনুরাগ-বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে যাবে না—ভবিষ্যসি তপোযুক্তো ন তু রাগাদ্‌ বিমোক্ষ্যসে। অথচ তোমার যে পুত্র হবে—সেই শুকদেব কিন্তু মহাদেবের বরলাভ করে বিতরাগ সন্ন্যাসী হবেন।

নারায়ণের আশীর্বাদে তাঁরই অংশজ অপান্তরতমা পরজন্মে পরাশরের পুত্র ব্যাসদেব হয়ে জন্মালেন—তবু এ কথা আমার কাছে অবান্তর। তিনি নারায়ণের অংশ কিনা, অথবা সারস্বত বেদ-বিভাজন কর্ম করে নারায়ণের উক্তি তিনি সার্থক করেছিলেন কিনা, তাও আমার কাছে তত গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ শুধু একটি বাক্য—তুমি তপস্বী হবে বটে, তবে তোমার স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধন ঘুচে যাবে না—ন চ রাগাদ্‌ বিমোক্ষ্যসে। আপন পুত্রের প্রতি সেকালে এই নারায়ণীয় আশীর্বাদ অতি-আশ্চর্যজনক। জন্মান্তরে পুত্রকে দিয়ে বহু ধর্মসংকট সমাধা করিয়ে নেবেন এবং তাঁর মাধ্যমে মানুষকে জরামরণহীন মুক্তির পথ দেখাবেন—এই আশীর্বাদই তো নারায়ণের পক্ষে করণীয় এবং দেয় ছিল। অথচ তিনি সে আশীর্বাদ করেননি। আর ঠিক এইখানেই বুঝি প্রভু নারায়ণ ব্যাসের হৃদয়ের মধ্যে মহাকবির শক্তি-বীজ বপন করে দিয়েছিলেন—কেননা যার মধ্যে রাগ-অনুরাগ, শুভাশুভ, মায়া-মমতার খেলা নেই, সে কখনও বড় কবি হতে পারে না। সংসারবিচ্ছিন্ন, বীতরাগ, বীতশ্রদ্ধ ব্যক্তির মধ্যে সৃষ্টির বীজ থাকতে পারে না। সেই জন্যই প্রভু নারায়ণের ইচ্ছাকৃত বন্ধনের আশীর্বাদে ব্যাস হলেন স্রষ্টা, আর শুক হলেন বক্তা।

ব্যাসের জীবনে শুকের জন্মও তাঁর মানসিক পরিমণ্ডলটুকু বুঝিয়ে দেবে। একটি সুসন্তানের জন্য ব্যাস রীতিমতো তপস্যা করেছিলেন। শরশয্যায় শুয়ে ভীষ্ম-পিতামহ যুধিষ্ঠিরকে তাঁর এই অন্য পিতামহের তপশ্চর্যার কথা শুনিয়েছেন। মেরুশৃঙ্গ পর্বতের কর্ণিকার বনে—সেই যেখানে মহাদেব আর পার্বতী প্রণয়রসে ভ্রাম্যমাণ ছিলেন—সেই বনেই যোগপ্রবিষ্ট হয়ে সুপুত্রের আশায় তপস্যা করছিলেন ব্যাস। তাঁর কামনা—পুত্রটি যেন তাঁর ধৈর্যে পঞ্চভূতের মতে স্থিতিশীল হয়। তপস্তুষ্ট মহাদেব শেষ পর্যন্ত বর দিলেন ব্যাসকে—যেমনটি তোমার ঈপ্সিত, ঠিক তেমনই পুত্র হবে তোমার।

ব্যাস তপস্যা থেকে বিরত হলেন বটে—কিন্তু পুত্রলাভের যে মাধ্যম, যাকে স্ত্রী বলি আমরা, সেই স্ত্রীই তো নেই ব্যাসের। মনুষ্যলোকে পুত্রলাভ করতে হলে মনুষ্যধর্মের মধ্য দিয়েই তা পেতে হবে। অবশ্য ব্যাস অত চিন্তা করেননি। তিনি নিশ্চিন্ত আছেন—দেবাদিদেব বর দিয়েছেন, পুত্র তিনি নিশ্চয়ই পাবেন। বরলাভের পর প্রতিদিনের অগ্নিহোত্র সম্পাদন করার জন্য ব্যাস অগ্নি উৎপাদনে মন দিলেন। দুটি কাষ্ঠখণ্ড, যাকে যাজ্ঞিকেরা বলেছেন অরণি—ব্যাস সেই অরণিমন্থন করতে আরম্ভ করলেন অগ্নি উৎপাদন করার জন্য। ঠিক এই সময় যদৃচ্ছাক্রমে সেখানে উপস্থিত হলেন স্বর্গসুন্দরী অপ্সরা ঘৃতাচী। ঘৃতাচী যে তাঁর সামনে খুব ঢঙ-ঢাঙ করে তাঁকে আকর্ষণ করবার চেষ্টা করছিলেন তাও নয়; কিন্তু তবু অপ্সরাসুন্দরীর শরীর-সৌন্দর্যে তিনি মোহিত হলেন। আসলে শাস্ত্রকারেরা যেমন বলেন—শুকের মতো মহদাশয় মহামুনি জন্মাবেন, তার একটা অজুহাত তো চাই। সাময়িকভাবে কামী না হলে তো পুত্রলাভ করা যায় না। জীবনের ঋণ তো মেটাতে হবে। সেই জন্যই মনোহরণ ঘটল ব্যাসের—ঘৃতাচীর শরীর তাঁর মন হরণ করল—ভাবিত্বাচ্চৈব ভাবস্য ঘৃতাচ্যা বপুষা হৃতঃ।

সংরূঢ় কামবেগ সংযমের বলে নিরুদ্ধ করার জন্য ব্যাস অরণিমন্থনে অধিকতর মনোযোগ দিলেন। অগ্ন্যাধানের অগ্নি তাতে উৎপাদিত হল না বটে কিন্তু হৃদয়ের আগুন তার কর্ম করে দিল। ঘৃতাচীর শরীর-স্মরণে যে আগুন জন্মেছিল, তাতে তপ্ত ব্যাসের শরীর থেকে তেজবিন্দু নির্গত হয়ে পতিত হল সেই মথ্যমান যজ্ঞকাষ্ঠ অরণিদ্বয়ের ওপর। আর সেই অরণির ঘর্ষণ থেকেই জন্মালেন আগুনের মতো তেজস্বী শুকদেব।

শুকের জন্মের ঔপনিষদিক কোনও প্রতীক আছে নাকি কোনও? বৃহদারণ্যক উপনিষদের শেষে একবার বলা হয়েছিল—পুত্ৰাকাঙক্ষী ব্যক্তি যেন স্ত্রী-পুরুষের দেহদুটিকে অগ্নিমন্থনের দুটি অরণিকাষ্ঠ ভাবেন। আমার তো মনে হয়—সেই প্রতীক এখানে ব্যবহৃত হয়েছে—নইলে এই অরণিমন্থনের প্রক্রিয়া যেন সযৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যাত হয় না। অরণি-শরীর মন্থন করে যে অগ্নি উৎপাদন করার প্রয়াস করছিলেন ব্যাস, সেই অগ্নি থেকেই জন্মালেন অগ্নিপ্রতিম শুকদেব—অরণীং মমন্থ ব্রহ্মর্ষিস্তস্যাং জজ্ঞে শুকো নৃপঃ। জীবনসৃষ্টির জন্য যে অগ্নিটুকুর প্রয়োজন হয়, ব্যাস সেই জীবনের ধর্ম অতিক্রম করলেন না। এই অতিক্রম হয়তো তিনি চানওনি। প্রভু নারায়ণও তাঁকে এই আশীর্বাদই—করেছিলেন—ন চ রাগাদ্‌ বিমোক্ষ্যসে।

শুক জন্মালেন। জন্মমাত্রেই তিনি ব্রহ্মবিৎ। স্বয়ং মহাদেব তাঁর উপনয়ন-সংস্কার করেছেন। তাঁর তপস্যার জন্য আকাশ থেকে উড়ে পড়েছিল সন্ন্যাসীর দণ্ড এবং কৃষ্ণাজিন মৃগচর্ম। দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর জন্য স্বর্গের কমণ্ডলু পাঠিয়েছিলেন। তাঁকে ঘিরে নির্ভয়ে উড়ে বেড়ায় হাঁস, সারস, কাঠঠোকরা আর চাষপক্ষীর সমাজ। ব্রহ্মচারী শুকদেবের প্রথম অধ্যাপক হলেন বৃহস্পতি। তাঁর কাছে পাঠ নেওয়া শেষ হলে মোক্ষকামী শুকদেব পিতার কাছে এসে বললেন—আপনি মোক্ষধর্মের সব তত্ত্ব জানেন, আপনি আমাকে সেই ধর্ম উপদেশ করুন—মোক্ষধর্মেষু কুশলো ভগবান্ প্রব্রবীতু মে।

এই মুহূর্তে ব্যাসের প্রতিক্রিয়াটুকু দেখবার মতো। সত্যিই তো তিনি মোক্ষধর্ম জানেন। তত্ত্বত তিনি তার উপদেশও দিতে পারেন, কিন্তু যেহেতু তিনি স্বয়ং মুক্তিকামী নন, অথচ পুত্রের তীব্র মুমুক্ষুত্ব তিনি বুঝতে পারেন, তাই তিনি শুধু মোক্ষধর্মের প্রয়োগজ্ঞানহীন শিক্ষক হয়ে থাকতে চাইলেন না। পুত্রকে তিনি রাজর্ষি জনকের কাছে যেতে বললেন। জনক জীবন্মুক্ত রাজর্ষি, তিনি মুমুক্ষু ব্যক্তিকে সঠিক উপদেশ দিতে পারবেন। শুকদেব মিথিলায় রাজর্ষি জনকের কাছে যাবার উপক্রম করলে ব্যাস তাঁকে পুনরায় উপদেশ দেবার প্রয়োজন বোধ করলেন। তার কারণও আছে। আসলে রাজর্ষি জনক জীবন্মুক্ত মোক্ষারূঢ় ব্যক্তি হলেও সাধারণ মানুষ যাতে তাঁর দৃষ্টান্তে স্বধর্ম এবং স্বকর্ম তাগ না করে সেই জন্য বৈদিক যজ্ঞাদি তথা নিত্য-নৈমিত্তিক কর্মগুলি করে যেতেন, মুক্ত ব্যক্তির পক্ষে এগুলি অপ্রয়োজনীয় হলেও করে যেতেন।

জনকের এইসব শ্রৌতকর্মে ব্যাস তাঁর ঋত্বিক হিসেবে কাজ করতেন। ফলে এইখানে ব্যাস তাঁর গুরুস্থানীয় এবং জনক ব্যাসের যজমান। ব্যাস জনকের গুরুস্থানীয় হলেও রাজর্ষি জনকের আধ্যাত্মিক সিদ্ধির কথা তিনি জানেন এবং এ বাবদে তিনি শিষ্যকেও সম্মান করেন। এখন শুক যেহেতু একভাবে জনকের গুরুপুত্র হবেন, তাই কোনওভাবে শুক যদি জনকের কাছে গুরুপুত্রের অধিকার ব্যক্ত করে কোনও ঔদ্ধত্য প্রকাশ করে ফেলেন, সেটাতে পিতা ব্যাসের মনে অনর্থক আশঙ্কা আছে। আশঙ্কা এই জন্য যে, শুকদেব স্বয়ং কিছু কম ব্যক্তিত্ব নন। মোক্ষধর্মের সিদ্ধিতে তিনি জন্মগতভাবে অধিকারী। এই অস্বাভাবিক ক্ষমতার জোরে যদি কোনও উচ্চতাবোধ জন্মে থাকে তাঁর মনে অথবা এমন যদি হয় যে, আপন তপঃসিদ্ধির প্রভাবে শুক যদি কোনও অলৌকিক ক্ষমতার আশ্রয় নিয়ে রাজর্ষি গুরু জনকের কাছে পৌঁছোন—তা হলে সেটা অভব্যতা হবে। ব্যাস মনে করেন—তুমি যত বড় উত্তম মানের শিষ্যই হও, গুরুর কাছে যেতে হবে বিনীত হয়ে।

ঠিকই এইখানেই ব্যাসের ধর্মবোধ। ব্যাস পুত্রকে বললেন—তোমার তপস্যার যত প্রভাবই থাকুক, তুমি সেইভাবে মোক্ষগুরু জনকের কাছে উপস্থিত হবে, যেভাবে একজন সাধারণ মানুষ পায়ে হেঁটে গুরুর কাছে উপস্থিত হয়। সরলভাবে তাঁর কাছে যাবে, রাজার বাড়ি বলে ভালমন্দ খাওয়া অথবা সুখে থাকার কথা ভেবো না। আর একটা কথা—মহারাজ জনক আমার যজমান, তিনি গুরুপুত্র বলে তোমাকে গুরুর মতোই সম্মান করবেন, কিন্তু তুমি যেন তাই বলে তাঁর কাছে ব্রাহ্মণ্য অথবা গুরুপুত্রের অহঙ্কার প্রকাশ কোরো না—অহঙ্কারো ন কর্তব্যো যাজ্যে তস্মিন্নরাধিপে। তিনি যা বলবেন তাই করবে।

অত্যন্ত উত্তম মানের অধিকারীকেও যে পার্থিব ভূমিকায় প্রতিষ্ঠিত থাকতে হবে—এই ধ্রুব সত্যটা তাঁর অতিপ্রাকৃত গুণী পুত্রকে ভুলতে দেননি ব্যাস। এটা যেহেতু ধর্ম অতএব এখানে তাঁর কোনও স্নেহান্ধতা নেই। অথচ তিনি শুকদেবের মতো নিঃস্পৃহ, উদাসীন, বন্ধনহীনও নন। শুকদেব জনকের কাছে মোক্ষধর্মের পরম তত্ত্ব শুনেও বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু এর পরে দেবর্ষি নারদের কাছে পুনরায় মোক্ষসাধনের সমাধান শুনে শুক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবেন বলে পিতার আদেশ চাইলেন। মোক্ষকামী পুত্রের কথা শুনে ব্যাস সন্তুষ্টও হলেন আবার কষ্টও পেলেন। বললেন—তুমি অন্তত আজকের দিনটা এখানে থাকো, বাছা! অন্তত আজকের দিনটা তোমার লাল্য মুখখানি দেখে চোখ জুড়োই—ভো ভোঃ পুত্র স্থীয়তাং তাবদদ্য/ যাবচ্চক্ষুঃ প্রীণয়ামি ত্বদর্থে।

পিতার কথায় বন্ধনমুক্ত শুকের কোনও বিক্রিয়া হল না। নিরপেক্ষ নিঃস্নেহ শুক মোক্ষকামনাতেই পিতার আশ্রম ছেড়ে ঊর্ধ্বমার্গে চললেন। পিতার জন্য যে তিনি কোনও নৈকট্য বোধ করেন না, তা নয়। তিনি বুঝলেন যে, তাঁর স্নেহশীল পিতা তাঁর পিছন পিছন আসছেন, স্নেহের বন্ধন তিনি এড়াতে পারছেন না। শুক দেবতাদের কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বললেন—আমার পিতা যদি এইভাবেই আমাকে অনুসরণ করে এমন সস্নেহে আমার নাম ধরে ডাকতে থাকেন, তবে আপনারা তাঁর কথার প্রত্যুত্তর দেবেন—পিতা যদ্যনুগচ্ছেন্মাং ক্রোশমানঃ শুকেতি বৈ। শুকের কথা শুনে বন, সমুদ্র, নদী, পর্বত—সব দিক থেকে ব্যাসের পুত্র-সম্ভাষণের প্রত্যুত্তর দিল—যেন শুকই কথা বলছেন—আমি আছি, পিতা! আমি আছি—পুত্রেতি তন্ময়তয়া তরবো’ভিনেদুঃ। শুক কিন্তু থেমে নেই, তিনি চলেছেন চরৈবেতির মধুমন্ত্র ধারণ করে।

পিতা ব্যাস পুত্রের পিছন পিছন চলছেন। তিনি দেখলেন—তার পুত্র দিগম্বর নগ্ন যুবা মন্দাকিনীর নির্ঝর-শীকর উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছেন। মন্দাকিনীর নির্মল জলে তখন স্বর্গসুন্দরী অপ্সরারা নগ্ন বিবৃত হয়ে অলসে স্নান করছিল। কিন্তু পুরুষ শুককে দেখে তাঁদের কোনও ভাববিকার হল না। স্ত্রীলোকের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়ায় তারা কাপড়চোপড়ও ঠিক করল না, একটু বিব্রতও হল না। এমন একটা ভাব—যেন কিছুই হয়নি—শূন্যাকারং নিরাকারাঃ শুকং দৃষ্ট্বা বিবাসসঃ। বায়ুর বেগে শুক হেঁটে চলেছেন পাহাড় থেকে পাহাড়ে, উঁচু থেকে আরও উঁচুতে। এক জায়গায় ব্যাস দেখলেন—পুত্রটি তাঁর একাকার হয়ে গেল পরম জ্যোতির সঙ্গে। ব্যাস সোৎকণ্ঠে ডাকতে লাগলেন—ওরে বাছা, বাছা আমার। কোনও প্রত্যুত্তর এল না।

এতক্ষণ ব্যাস চলছেন শুকের পিছন পিছন, যদিও তিনি অনেক দূরে ছিলেন। চলতে চলতে এবার তিনি সেই জায়গায় এসে পৌঁছোলেন, সেই মন্দাকিনীর তীরে যেখানে স্বর্গসুন্দরী অপ্সরারা জলতরঙ্গে আদুড় গা ভাসিয়ে স্নান করছিল। কুমার শুকদেবকে দিগম্বর অবস্থায় দেখেও যাঁরা নড়াচড়া করেননি, তাঁরাই কিন্তু বয়স্ক ব্যাসকে দেখে কেউ জলে লুকোলেন, কেউ লতাবৃক্ষের আড়াল খুঁজলেন, কেউ বা পরিধেয় বসন পরে নিলেন—জলে নিলিল্যেরে কাশ্চিৎ কাশ্চিদ্‌ গুল্মান্‌ প্রপেদিরে। মহাভারতের কথকঠাকুর ভারী সুন্দর একটি মন্তব্য করেছেন এখানে। বলেছেন—ব্যাস বুঝতে পারলেন—তাঁর পুত্র ব্রহ্মসমাধি লাভ করেছেন। কেননা পার্থিব বস্তুপিণ্ডে জড়বৎ বোধ সম্পন্ন হওয়ার ফলেই শুককে নগ্ন দেখেও স্বর্গসুন্দরীদের ভাববিকার হল না, অথচ বৃদ্ধপ্রায় ব্যাসকে দেখে তাঁরা লজ্জায় বিব্রত হলেন। পুত্রের মুক্তজ্ঞানের পরিচয় পেয়ে এবং আপন সীমাবদ্ধতার কথা অনুভব করে ব্যাস যুগপৎ আনন্দিতও হলেন, আবার লজ্জাও পেলেন—প্রীতো’ভূদ্‌ ব্রীড়িতশ্চ হ।

ভগবান শঙ্কর পুত্রশোকপীড়িত ব্যাসের সামনে এসে দাঁড়ালেন এবার। বললেন—মহর্ষি তুমিই তো আমার কাছে এমন একটি নিত্যশুদ্ধ, বুদ্ধ-মুক্ত পুত্র চেয়েছিলে, তা হলে এখন তার জন্য শোক করছ কেন। তবে হ্যাঁ, তোমার অবস্থা দেখে আমি এই অনুগ্রহ করছি যে, তোমার পুত্র পরম মুক্তিপদবী লাভ করলেও সর্বত্র তুমি তার প্রতিবিম্ব দেখতে পাবে। মহাদেবের কৃপায় ব্যাস সর্বত্র পুত্রের প্রতিবিম্ব দেখতে পেলেন। পরম আনন্দিত হলেন তিনি—ছায়াং পশ্যন্‌ সমাবৃত্তঃ স মুনিঃ পরয়া মুদা।

পিতার আশ্রম থেকে শুকের প্রব্রজিত হবার যতটুকু কাহিনী এখানে বললাম, তারমধ্যে ব্যাসকে নিয়েই আমাদের বক্তব্য আছে। দেখুন, ব্রহ্মর্ষি শুকদেব কেমন নিঃস্পৃহভাবে চলে গেলেন পিতাকে ছেড়ে। কিন্তু পিতা ব্যাস মুক্ত মানুষের মতো তাঁকে ছেড়ে দিতে পারলেন না। লাস্যময়ী অপ্সরারা শুককে দেখে লজ্জা পেলেন না, অথচ ব্যাসকে দেখে লজ্জা পেলেন। আবার তাঁদের লজ্জা দেখে ব্যাসও যে আবার নিজের সম্বন্ধে লজ্জা পেলেন, এই ছোট্ট ছোট্ট লজ্জা এবং ছোট্ট ছোট্ট মায়ার মধ্যেই মহাভারতের কবির কবিত্বের রহস্য লুকিয়ে আছে। আবিল সংসারের মধ্যে তিনি প্রবেশ করেছেন, কিন্তু সীমা অতিক্রম করেননি কখনও। এর ফলে সব কিছুই দূর থেকে কবির দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব হয়েছে তাঁর পক্ষে। জননী সত্যবতীর আদেশে তিনি ক্ষত্রিয়কুলে পুত্রোৎপাদন করেছেন, আবার শুকও তাঁর পুত্র—দুই জায়গাতেই তাঁর পিতৃজনোচিত মায়া আছে, অথচ তিনি স্নেহান্ধ নন। এইখানেই ধর্মের জগৎ। এমনটি না হয়ে যদি ব্রহ্মবাদী নির্গ্রন্থ ঋষি হতেন তিনি, তা হলে আর যাই হোক মহাভারত নামের মহাকাব্যখানি তাঁর পক্ষে রচনা করা সম্ভব হত না।

সংসার-সীমান্তে দাঁড়ানো ব্যাসের মায়ামমতা, সীমাবদ্ধতার কথা আরও পরিষ্কার করে বলেছে আমাদের ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ। এখানে শুকের মায়ের নাম বীটিকা। এই পুরাণে দেখছি—ব্যাস তখনও বিবাহ করেননি বলে জননী সত্যবতী তাঁকে পিতৃঋণের দায়ে দায়ী করছেন। মায়ের তাড়নায় পিতৃঋণ থেকে মুক্তি পাবার জন্য ব্যাস শেষ পর্যন্ত জাবালীর মেয়ে বীটিকাকে বিয়ে করেন। বহুকাল তাঁর সঙ্গে তপশ্চরণ করে একদিন ব্যাস বুঝলেন—বীটিকার গর্ভে তাঁর সন্তান আসছে। কিন্তু সে পুত্র আর কিছুতেই জন্ম নেয় না। এগারো বছর পার হয়ে গেল, তখনও ব্যাসপত্নী বীটিকা গর্ভধারণের কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত বারো বছর বয়সি গর্ভস্থ সন্তানকে ব্যাস বললেন—পুত্র! তুমি কেন এমন করে তোমার মাকে কষ্ট দিচ্ছ? তুমি জন্মগ্রহণ করো। পেটের ভিতর থেকে শুক বললেন—আমি প্রসূত হতে চাই না। মায়াময়ী এই পৃথিবীতে জন্ম নিলেই মায়া আমাকে আক্রমণ করবে। আমি তাই গর্ভের মধ্যেই ঈশ্বরের ধ্যানে নিমগ্ন আছি।

ব্যাস অত্যন্ত উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন—তুমি জন্মগ্রহণ করো, পুত্র! মায়া তোমাকে কিছুই করতে পারবে না। আমার কথা প্রমাণ মেনে তুমি বাইরে এসো। আমার প্রিয় পত্নীটিকে তুমি আর কষ্ট দিয়ো না। গর্ভস্থ শুক বললেন—আপনার কথা প্রমাণ মানলে এইটাই মানতে হয় যে, নিজ পত্নী এবং পুত্রের ওপর আপনার যথেষ্ট আসক্তি আছে, মায়া আছে। কাজেই আপনার কথা প্রমাণ বলে মানি কী করে? আপনার ওপর আমার সে ভরসা নেই। শুক আরও বললেন—মায়া যাঁর সৃষ্টি, সেই ঈশ্বর যদি এসে আমাকে ভরসা দেন, তবেই আমি গর্ভমুক্ত হয়ে জন্ম নিতে পারি। নিরুপায় ব্যাস শেষ পর্যন্ত দ্বারাবতীতে গিয়ে ঈশ্বর-স্বরূপ কৃষ্ণকে ধরে আনলেন এবং কৃষ্ণের বাক্য মেনে শুক জন্মালেন এই ধরাধামে।

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শুকের এই জন্মকথায় মহাভারতের অনুধ্বনি নেই হয়তো, কিন্তু এই কাহিনীটুকু এখানে উদ্ধার করলাম শুধু এইটুকু বোঝানোর জন্য যে, ব্যাসের এই মায়াটুকু শুধু তাঁর পত্নী এবং পুত্রের জন্যই পুরো ব্যয়িত হয়নি, সমস্ত সংসার, সমস্ত মানুষের জন্য তাঁর এই মায়া আছে এবং এই মায়াটুকু তাঁর ঋষিত্ব এবং ব্রহ্মজ্ঞানকে অতিক্রম করে নতুন এক মাত্রা নিয়ে ধরা দিয়েছে আমাদের কাছে। এটাই আমাদের উপরি পাওনা। এই মায়াটুকু না থাকলে মহাভারতের মধ্যে পাঁচটি কালো মানুষের মাহাত্ম্য এমন করে ফুটে উঠত না; ফুটে উঠত না গান্ধারীর ধর্মের সম্ভাবনা—যে গান্ধারী অসহায় পুত্রের মুখের ওপর নির্মমভাবে বলতে পারেন—যেখানে ধর্ম, সেইখানেই জয় হবে পুত্র। ব্যাসের মমত্বটুকু না থাকলে প্রকাশ পেত না দাসীপুত্র বিদুরের প্রজ্ঞা। যে প্রজ্ঞা এতকাল এবং চিরটাকাল ব্রাহ্মণেরাই বিতরণ করেছেন, বিদ্যাবিনয়-সম্পন্ন হলে সেই প্রজ্ঞা যে দাসীপুত্রের মুখেও স্ফুরণ হতে পারে, সেটা ব্যাসের সর্বত্রগামী মমত্ব ছাড়া অসম্ভব ছিল।

আরও একটা কথা। প্রভু নারায়ণ ব্যাসকে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন—কৃষ্ণযুগ অর্থাৎ কলিযুগ আসলে পরে তুমি আবার কৃষ্ণবর্ণ কালোবরণ হয়ে জন্মাবে। তখন তুমি ভারতাখ্যান রচনা করবে। আমাদের ধারণা—নিজে কৃষ্ণবর্ণ হয়ে জন্মেছিলেন বলেই সেই বেদাবশিষ্ট ব্রাহ্মণ্যের যুগেও কৃষ্ণবর্ণ মানুষগুলিকে তিনি অসীম মমতায় অঙ্কিত করেছেন। রসিক সুজনের মতে মহাভারতের পাঁচটি কালো মানুষ হলেন—ব্যাসজননী সত্যবতী, স্বয়ং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, বাসুদেব কৃষ্ণ—যিনি গোপীশতকেলিকার এবং মহাভারত-সূত্ৰধার একাধারে, চতুর্থ কৃষ্ণ হলেন অর্জুন এবং পঞ্চমী কৃষ্ণা দ্রৌপদী। ভেবে দেখবেন—এঁদের ছাড়া মহাভারত অন্ধকার।

আবার অন্যদিকে তাঁর ধর্ম-খ্যাপনের ক্ষেত্রগুলি তিনি এঁকেছেন অদ্ভুত বিপ্রতীপভাবে। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পুত্ৰ-জ্যেষ্ঠ বলে কথা। অন্ধতার জন্য রাজ্য না পাওয়ায় তিনি যে মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়েছিলেন, সে যন্ত্রণা ব্যাস দেখিয়েছেন একজন নিরপেক্ষ মনস্তাত্ত্বিকের মতো। অন্ধতার জন্য ঐশ্বর্যহানি ধৃতরাষ্ট্রকে উন্মাদ করে তুলছিল এবং সেই উন্মত্ততা তাঁর পুত্র দুর্যোধনের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে একটি রাজবংশের ধ্বংস ডেকে এনেছিল—কিন্তু সেই অন্ধ উন্মত্ততার বিপরীত দিকে ব্যাসকে যুধিষ্ঠির এবং বিদুরের চরিত্র সৃষ্টি করতে হয়েছে। লোকে ধার্মিক চরিত্রের সরল আখ্যান পাঠ করে তৃপ্তি পায় না, কিন্তু ধর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি যখন পাপ কুটিলতার চাপে পদে পদে বঞ্চিত লাঞ্ছিত হতে থাকে, মানুষ তখন সেই বঞ্চনা-লাঞ্ছনার বিরুদ্ধে ধর্মনিষ্ঠের পক্ষপাতী হতে থাকে। মহামতি ব্যাস গান্ধার দেশ থেকে দ্যূতশৌণ্ড শিখণ্ডীকে ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় নিয়ে এসে যেভাবে পাণ্ডব ভাইদের দুর্ভাগ্য রচনা করেছেন, মহাভারতের পাঠক এর প্রতিশোধ নেবার জন্য উপায় খুঁজতে থাকে। অবধারিতভাবে যুদ্ধের সম্ভাবনা ঘনিয়ে আসে। কিন্তু সে যুদ্ধ শুধুই প্রতিশোধের ভাবনায় সংকীর্ণ হয়ে ওঠে না। যুধিষ্ঠিরের ত্যাগ-বঞ্চনা এবং পরিশেষে পাঁচটিমাত্র গ্রামের অধিকার থেকেও যখন তিনি বঞ্চিত হন, তখন পাণ্ডবদের যুদ্ধ ধর্মযুদ্ধ হয়ে ওঠে—যে যুদ্ধের সমস্ত পাপটুকু আত্মস্থ করেন স্বয়ং ভগবান রূপে চিহ্নিত সেই মানুষটি—মহাভারতের পরোক্ষ নায়ক কৃষ্ণ।

ন্যায় পক্ষ এবং অন্যায় পক্ষ—মহাভারতের বিশাল এই সংসারটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন ব্যাস—তিনি কোথাও সম্পূর্ণ জড়িয়ে পড়েন না। তিনি কোথাও পক্ষে থাকেন, কোথাও বা বিপক্ষে। কিন্তু সম্পূর্ণ জড়িয়ে পড়বার জন্যও তাঁর আরও দুটি ধর্মনিষ্ঠ প্রতিনিধি আছেন মহাভারতের সংসারের মধ্যে। একজন ভীষ্ম, অন্যজন বিদুর। প্রথম জন ব্যাসের সমসাময়িক, সম্পর্কে তিনি ভাই। সংসারে থেকেও তিনি সন্ন্যাসী। জীবনের প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিষ্কামভাবে রাজধর্ম পালন করে গেলেন। চিরটাকাল তিনি ন্যায়-নীতি-ধর্মের পক্ষে দাঁড়িয়ে নিজের পুত্র-পৌত্র-প্রতিম ব্যক্তিদের দুবৃত্ততার বিরুদ্ধে আন্তরিক লড়াই করে গেলেন, কিন্তু যুদ্ধ করে প্রাণ দিলেন তাঁদেরই জন্য। অন্যদিকে বিদুর—তিনি মহাভারতের কবির আত্মজ পুত্র। ধর্ম, রাজনীতি, সমাজনীতি—ইত্যাদির দুরূহ অভিসন্ধিগুলি এমন নির্বিকারভাবে তিনি আত্মস্থ করেছিলেন যে কৌরব-সংসারের মধ্যে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থেকেও কোনও দিন তিনি লোভ, মোহ, ঈর্ষা, অসূয়ার বিকারে দীর্ণ হলেন না। সম্পূর্ণ মহাভারতের মধ্যে তিনি যে শুধু বিবেকের মতো মূর্তিমান হয়ে রইলেন, তাই নয়, ব্যাস তাঁকে আপন অন্তর এবং দেহ থেকে সৃষ্টি করেছেন ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধির মতো। যিনি নিজে ব্রাহ্মণের ঔরসে ধীবর-কন্যার সাঙ্কর্যে জন্মলাভ করেছিলেন, তিনি নিজের আর্য তেজ মিলিত করেছিলেন ভারতীয় জনতার প্রতিনিধি-স্বরূপিণী শূদ্রা-শক্তির সঙ্গে। বিদুর তাই একদিকে ধর্মস্বরূপ, অন্যদিকে রাজশক্তিকে তিনি চালিত করেন আম-জনতার ঔচিত্যবোধে।

মহাভারতে বিদুরের সর্বাতিশায়িনী প্রজ্ঞার কথা যেমন সিংহনাদ করে ঘোষণা করেছেন ব্যাস, তেমনই অসাধারণ দৃষ্টি ছিল তাঁর নারী চরিত্রগুলির ওপর। আজকাল যাঁরা অনেকেই মহাভারতের দ্রৌপদীকে আত্মকল্পে বঞ্চিত-নিপীড়িত মনে করে সমগ্র পুরুষ সমাজকে যুধিষ্ঠির-কল্প উদাসীন ভেবে যুক্তি চিৎকার প্রসারিত করেন, তাঁদের জানাই—চিৎকার করাটা অনেক সোজা এবং যুগোপযোগীও বটে। মহাভারত পড়াটা তার চেয়ে অনেক কঠিন এবং সেটা তার সামগ্রিকতায় বোঝা আরও অনেক অনেক কঠিন। অন্তত চিৎকার যাঁরা করেন তাঁরা মহাকাব্যের গভীর সামগ্রিকতা একটুও বোঝেন না—সেটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। যুধিষ্ঠিরের মতো মহাসত্ত্ব ধর্মবিক্রমী মানুষকে যাঁরা উদাসীন ধর্মধ্বজী বলে ভাবেন, তাঁরা মহাভারতের কবিকে কিছুই বোঝেন না এবং বুঝবেনও না। সবচেয়ে বড় কথা, কৌরবসভায় দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার জন্য যাঁরা যুধিষ্ঠিরকে পুরুষ সমাজের প্রতিনিধি ভেবে প্রস্ফুটিত নেত্রে চিৎকার করতে থাকেন, তাঁরা এটা বোঝেন না যে, ব্যাসই এই লাঞ্ছনার চিত্র এঁকেছেন, কারণ মহাকাব্যের মধ্য দিয়ে সমাজকে প্রতিবিম্বিত করাই তাঁর কাজ।

ব্যাসও তো পুরুষ সমাজেরই প্রতিনিধি। মহাকাব্য লিখবার সময় তিনি তো নারীর এই অবমাননা চেপে যেতে পারতেন। তা হলে আর আজকের নারীবাদিনীরা পৌরুষেয়তার বিরুদ্ধে মহাভারতের রশদটুকু পেতেন কোথায়? নারীবাদিনীরা যেটা বুঝতে চান না, সেটা হল—মহাভারতের কালে নারীত্বের যে অবমাননা ঘটেছে—তার দোষ যতখানি যুধিষ্ঠিরের, তার থেকে অনেক বেশি তৎকালীন সমাজের। ব্যাস এই অবমাননা দেখানোর জন্য ধর্মমূর্তি যুধিষ্ঠিরকেও রেহাই দেননি। অন্যদিকে অন্যত্র এই দ্রৌপদী, এই কুন্তী অথবা গান্ধারী সত্যবতীর যে চরিত্রগুলি ব্যাস সমাজের রশদ দিয়ে পুষ্ট করেছেন, তাতে মহাভারতীয় রমণীদের যে ব্যক্তিত্ব এবং স্বাধীনতা প্রকাশিত হয়েছে, তা এককথায় মহাভারতীয় সমাজের উচ্চতা সূচনা করে—আজকে প্রগতিশালীরা সেসব না বুঝেই ব্যাস-যুধিষ্ঠিরকে গালমন্দ করেন।

যুধিষ্ঠির ভাল লোক না মন্দ লোক, তার বিচার যুধিষ্ঠিরের চরিত্রালোচনায় প্রকটিত হবে। কিন্তু আর্থ-সামাজিকের সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে বিচার করলেও এ কথা কি একবারও বলা যাবে যে, মহাভারতের কবির পক্ষপাত আছে দুর্যোধন-কর্ণের ওপর, অথবা তাঁর যোগসাজস আছে দুঃশাসন-শকুনির সঙ্গে। কিন্তু যে যুধিষ্ঠিরের ওপর কবির প্রত্যক্ষ পক্ষপাত আছে সেই যুধিষ্ঠিরও যখন পাশাখেলায় উন্মত্তের মতো আচরণ করলেন, তখন কবি বোঝাতে চাইলেন যে, নারীত্বের অবমাননায় যুধিষ্ঠিরের মতো ব্যক্তিও কখনও কখনও অসহায় হয়ে পড়েন। সমাজে যখন পশুশক্তির প্রাবল্য দেখা দেয়, তখন যুধিষ্ঠিরের ধীরতাও নষ্ট হয়ে যায়। এর জন্য যুধিষ্ঠির যতখানি দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী তাঁর অসহায়তা। ব্যাস-নির্দিষ্ট ধর্মের পরীক্ষা হয়ে যায় এখানেই। অবশ্য এত অল্প কথায় যুধিষ্ঠিরের ওপর বা মহাভারতের কবির ওপর অর্বাচীনের সমস্ত আক্ষেপগুলি মিটিয়ে দিতে পারব—এমন ভরসা করি না, তবে আজকাল উজানে চলে চমক সৃষ্টি করার প্রবণতা এত বেড়েছে তাতে এটা আমাকে বলতেই হবে যে, ব্যাসের মর্মসৃষ্ট চরিত্রগুলি যদি বুঝতেই হয়—বিশেষত ভীষ্ম, বিদুর এবং যুধিষ্ঠিরকে যদি বুঝতেই হয়, তবে তা বুঝতে হবে বৃহত্তর সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে এবং ধর্মের পরিপ্রেক্ষিতে, কেননা সেই ধর্মের জন্যই ব্যাস মুক্তি চাইলেন না, ব্রহ্মবাদী হতে চাইলেন না। বরঞ্চ বলা উচিত, সেই ধর্মের জন্যই ব্যাস মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে ভারত-সংসারের মধ্যে প্রবেশ করে নিজের পুত্র-পৌত্রদের দৃষ্টান্তে ধর্মাধর্মের যৌক্তিকতা স্থাপন করলেন—মহাভারতের ইতিহাস রচনা করে।

আজকাল ধর্মের নতুন অর্থ বেরিয়েছে। নব নব পণ্ডিত এবং নব নব রাজনীতিকেরা নব-নবোন্মেষশালিতায় নব নব ধর্মের ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু সেই সেকালের ব্যাস কতটা জীবনের ধর্মে বিশ্বাস করতেন, ধর্মের বোধেও তিনি কতটা বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ঋষি ছিলেন যে, মহাভারত রচনা করবার আগেই তিনি প্রতিজ্ঞা করে বলেছেন—আমার এই মহাভারতকে শুধু যেন মুক্তিকামীর সাধন-গ্রন্থ মনে কোরো না—আমার মহাভারত তেমন লোকের কাছে যেমন অর্থশাস্ত্রও বটে, তেমনই বিশেষ জনের কাছে তা ধর্মশাস্ত্রও বটে। আমার মহাভারত কামশাস্ত্রও বটে, আবার তেমন দৃষ্টি দিয়ে বুঝলে আমার মহাভারত মোক্ষকামীর কাছে পরম মোক্ষশাস্ত্রও বটে। সত্যি বটে ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—এই পুরুষার্থ চতুষ্টয়ের মিশেল দিয়ে কীভাবে মহাকাব্যের উপন্যাস রচনা করতে হয়, তা যে কালে, যে প্রাচীন সময়ে তিনি দেখিয়ে গেছেন, এ কালেও সেই মহাকাব্য অতিক্রম করার সাধ্য কারও নেই। অতএব জয় হোক সেই পরাশর ঋষির অন্তরজন্মা পুরুষের, জয় হোক সত্যবতীর হৃদয়ানন্দন ব্যাসের—জয়তি পরাশরসূনুঃ সত্যবতীহৃদয়-নন্দনো ব্যাসঃ।