ব্যাস দ্বৈপায়ন – ৪

॥ ৪ ॥

লোককথায় শুনেছি—আজন্ম ব্রহ্মচারী বেদান্তী শঙ্করাচার্যকেও নাকি কোনও এক বিচারসভায় হেরে যাবার পর কামশাস্ত্র পড়তে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর সমস্ত পাঠটুকুই ছিল প্রয়োজনের তাড়নায় সম্পন্ন, অতএব যান্ত্রিক। ব্যাসকে সেদিক দিয়ে আমি এক খাঁটি মানুষ মনে করি। তাঁর এক অযান্ত্রিক মন ছিল বলেই তিনি অত বড় কবি। সত্যবতীর নিয়োগ সম্পূর্ণ হয়ে গেলে ব্যাসের আর রাজবাড়িতে থাকবার উপায় ছিল না। তিনি থাকেনওনি। নিজের পূর্ববিহিত ধর্মকার্য সম্পন্ন করার জন্য তিনি নিশ্চয়ই তাঁর আশ্রমে ফিরে গেছেন। কিন্তু অন্যান্য মহা মহা ঋষির ক্ষেত্রে যা দেখেছি, এক্ষেত্রে যেন তার অন্যথা হল। অন্যান্য ঋষিরা আপন কামনার উপসর্গেই হোক, অথবা অন্যতরা রমণীর সকাম লাস্যে আমোদিত হয়েই হোক, মিলন সমাধা হলেই তাঁদের আর প্রায়ই উপস্থিত দেখি না। স্বয়ং ভরতমাতা শকুন্তলাকেই আমরা পিতামাতার লালনহীন অবস্থায় পক্ষীর পক্ষছায়ায় অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। কিন্তু ব্যাসের মনে অদ্ভুত এক মায়া আছে। এ মায়া হয়তো ঋষি ধর্মের বিপরীত ধর্ম, কিন্তু ভবিষ্যতে যিনি মহাভারতের মতো মহাকাব্য লিখবেন, তাঁর হৃদয়ে আর্যভাব যতখানি আছে, তার চেয়ে বেশি আছে কবিজনোচিত বেদনাবোধ। ঠিক সেই কারণেই বোধ হয় আপন নিক্ষিপ্ত বীজের প্রতি তাঁর মমতা আছে, মায়া আছে। এ মায়া আবার ঠিক বন্ধনও নয়, যাতে বলা যায়—তিনি মোহগর্ভে নিপতিত হয়েছিলেন। কিন্তু মাতা সত্যবতী যেহেতু তাঁকে পুত্রোৎপত্তিতে নিযুক্ত করেছিলেন, তাই সেই পুত্রদের বীজসম্বন্ধের দায়টুকু তিনি কখনওই এড়িয়ে যান না। তিনি বার বার ফিরে আসেন হস্তিনাপুরীতে। নিস্তব্ধ আশ্রম ছেড়ে বার বার তিনি আসেন ধর্মের গার্হস্থ্য প্রয়োগটুকু ঘটানোর জন্য, বোঝানোর জন্য।

মহামতি ভীষ্ম, যিনি ব্যাসের গৃহস্থ ‘কাউন্টার-পার্ট’, তিনি হস্তিনাপুরে তাঁর অভিভাবকত্বের কাজটুকু সুসম্পন্ন করেছেন দুইভাবে। প্রথমত বালকদের যেভাবে শিক্ষা দেবার দরকার, তা তিনি দিয়েছেন এবং সে শিক্ষা এমনই যে ধৃতরাষ্ট্রের মতো অন্ধ ব্যক্তিও তাতে রাজা হবার মানসিক শক্তি লাভ করেছেন। রাজা অবশ্য তিনি হতে পারলেন না অন্ধত্বের কারণেই। রাজা হলেন পাণ্ডু। দ্বিতীয়ত রাজকুমারদের বিবাহের ব্যাপারটা ভীষ্ম খুব ভালভাবে চিন্তা করেছিলেন। পিতা শান্তনুর অপর দুই পুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য যেভাবে নিঃসন্তান অবস্থায় স্বর্গত হয়েছেন এবং কুরু-ভরতবংশের পরম্পরাগ্রন্থি রক্ষা করার জন্য তাঁর যত দুশ্চিন্তা গেছে, তেমনটি যাতে আর না হয়, সেজন্য তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রদের জন্য এমন ধরনের বধূ নির্বাচন করতে চাইলেন, যাঁদের পুত্রলাভের ক্ষমতা পূর্বাহ্নেই নিশ্চিত।

কুমারদের বিবাহকর্ম সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পর পরই আমরা মহামতি ব্যাসকে হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে দেখছি। নিজের আশ্রমে গিয়ে হয়তো সম্পূর্ণ থিতু হয়ে বসার তাঁর উপায় হয়নি। এতদিন নানা আশ্রম নানা তীর্থ তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। লোকমুখে তাঁর নিয়োগজাত সন্তানদের বিবাহ-বার্তাও কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর কানে পৌঁছে গেছে। তাঁরই নিহিত বীজ পুনরায় পরম্পরা লাভ করবে হয়তো এই চিন্তাই তাঁকে টেনে এনেছে হস্তিনাপুরে। সেদিন তিনি বড়ই শ্রান্ত ছিলেন, পথশ্রমে ক্ষুধায় পিপাসায় দীর্ণ হয়ে তিনি রাজবাড়িতে উপস্থিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে উঠেছেন। পুত্রবধূ গান্ধারী তাঁকে পরম যত্নে আপ্যায়ন করে তৃষ্ণার জলপান দিয়েছেন, ক্ষুধার অন্ন দিয়েছেন। গান্ধারীর সেবায় মহর্ষি ব্যাস এতই খুশি হয়েছেন যে, তিনি বর চাইতে বলেছেন গান্ধারীকে। গান্ধারী লোভী নন। তিনি বিবাহের আগেই শিবের কাছে শতপুত্রের জননী হবার বর পেয়েছিলেন। দ্বিতীয় এই সুযোগ আসতে তিনি অন্ধ স্বামীর মর্যাদা সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করে বর চেয়েছিলেন—যেন তিনি স্বামীর মতোই সমগুণী পুত্র পান— সা বব্রে সদৃশং ভর্তুঃ পুত্ৰাণাং শতমাত্মনঃ।

গান্ধারীকে বর দিয়েছেন বেদব্যাস। কিন্তু সেটা খুব বড় কথা নয়। আমাদের জিজ্ঞাসা হয়—ব্যাসের বিভিন্ন যাত্রাপথে আর কি আশ্রম, জনপদ বা রাজ্য ছিল না! যদি বা তিনি এলেন—তাও কারও সঙ্গে দেখা না করে, জননী সত্যবতীর মহলে না উঠে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে উঠেছেন কেন? ঠিক এইখানেই ব্যাসকে ঋষির চেয়েও, কবির চেয়েও বড় বেশি এক মানুষ মনে হয়। তিনি বার বার ফিরে আসেন সেই রাজগৃহের মহলে যেখানে তাঁর পুত্রেরা আছেন। অদ্ভুত তাঁর এই মায়া, এই মমতাবোধ, মাতা স্মরণ করার আগে যাঁকে একবারও দেখা যায়নি হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে, তাঁকেই এখন সামান্য ছুতোয়, ক্ষুধা-তৃষ্ণার সামান্য অন্নপানের অছিলায়—ক্ষুৎশ্রমাভি-পরিগ্লানম্‌—ধৃতরাষ্ট্রগৃহে উপস্থিত দেখছি। শুধু এখনই নয়, এরপর থেকে কুরুবাড়ির অনেক সুখে, দুঃখে, আপদে, বিপদে, উৎসবে, যজ্ঞে ব্যাসের এই চংক্রমণ ঘটবে, যেখানে মানুষ ব্যাসকে আমরা দেখতে পাব।

এই যে এখনও তিনি কুরুবাড়ির অন্দরমহলে গান্ধারীর সেবাসুখ গ্রহণ করছেন, এর জন্য তাঁর ক্ষুধাতৃষ্ণা যতখানি দায়ী, তার থেকে অনেক বেশি মনে হয়—তিনি তার আত্মজাত পুত্রদের বধূমুখ দর্শন করতে এসেছেন। গান্ধারীকে তিনি যে বর দিলেন, তা বুঝি জ্যেষ্ঠা পুত্রবধূর প্রতি তাঁর প্রথম উপহার। কুন্তী-মাদ্রীর কাছে তাঁর যাওয়া হয়নি, কারণ ততদিনে দাদা ধৃতরাষ্ট্রের হাতে রাজ্যভার ন্যস্ত করে পাণ্ডু বনবাসী হয়েছেন। অবশ্য বনবাসী হলেও পাণ্ডুর কোনও খবর ব্যাস জানতেন না, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

কারণ মুনি-ঋষিমাত্রেই বিভিন্ন স্থান পর্যটন তাঁদের স্বভাবসিদ্ধ ছিল। অতএব পাণ্ডুর খবর অবশ্যই তাঁর কানে পৌঁছেছে। বিশেষত গান্ধারীর কাছে তিনি যখন উপস্থিত হয়েছিলেন, পাণ্ডু তখন রাজ্য ছেড়ে বনবাসী হওয়ায় তাঁর মনে সংশয়েরও অবকাশ ঘটেছে নিশ্চয়ই। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধতার জন্য জ্যেষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও রাজা হতে পারেননি, অথচ পাণ্ডু রাজা হয়েও স্ত্রীদের নিয়ে বেশ কিছু কাল বনবাসী হয়েছেন এবং কিছুতেই ফিরছেন না—এই ঘটনার ইঙ্গিত কোন দিকে, ক্রান্তদর্শী ঋষি-কবি তা ঠিক বুঝতে পারেন এবং সেই বোধ নিয়েই তিনি প্রস্থান করেছেন।

শিবের বর এবং শ্বশুরের বর-পাওয়া গান্ধারী গর্ভধারণ করলেন অনতিকাল পরেই। কিন্তু দু বছর প্রায় চলে যায়, অথচ তাঁর গর্ভও মুক্ত হয় না, পুত্রও হয় না। এরই মধ্যে হস্তিনাপুরে গান্ধারীর কাছে খবর এল যে, কুন্তীর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুধিষ্ঠির জন্ম গ্রহণ করেছেন। খবরটা গান্ধারীর কাছে সুখকর ছিল না এবং তা হয়তো ধৃতরাষ্ট্রের কারণেই। ধৃতরাষ্ট্র নিজে অন্ধতা নিবন্ধন রাজ্য পাননি বলে তিনি নিশ্চয়ই বারংবার আক্ষেপ করতেন যে, তাঁর পুত্র কোনওমতে বংশ-জ্যেষ্ঠ হলেই সে রাজ্য পাবে। কিন্তু কুন্তীর পুত্র হওয়ায় সে আশা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল ভেবে গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে কিছু না জানিয়েই নিজের গর্ভপাত ঘটানোর চেষ্টা করলেন। অমন যে ধৈর্যশীলা গান্ধারী—মহাভারতের প্রারম্ভেই যাঁর ধৈর্যের গুণগান করেছেন স্বয়ং ব্যাস, সেই গান্ধারী কুন্তীর প্রতি ঈর্ষায়, অসূয়ায় গর্ভে অকারণ আঘাত করে গর্ভপাত ঘটালেন—সোদরং পাতয়ামাস গান্ধারী দুঃখমূৰ্ছিতা।

গর্ভপাতের ফলে লৌহপিণ্ডের মতো কঠিন একটি মাংশপেশি জন্মাল। দুই বৎসর পর্যন্ত যা তিনি গর্ভে ধারণ করে ছিলেন, সেটিকে একটি মাংসপিণ্ডমাত্র মনে করে গান্ধারী ফেলেই দিচ্ছিলেন। কিন্তু এই সময়েই ব্যাসকে আমরা ত্বরিতে উপস্থিত দেখছি হস্তিনাপুরে। মহাভারত বলেছে—ব্যাস মাংসপেশি প্রসবের খবর পেয়েই তাড়াতাড়ি ছুটে এসেছেন হস্তিনাপুরে—অথ দ্বৈপায়নো জ্ঞাত্বা ত্বরিতঃ সমুপাগমৎ। মহাভারতে প্রবীণ অনুবাদকেরা শ্লোকার্ন্তর্গত ‘জ্ঞাত্বা’ শব্দের অর্থ করেছেন—‘ধ্যানে জানিতে পারিয়া’। হয়তো ব্যাসের প্রতি মর্যাদাবশতই এই ধ্যানযোগের কথা এসেছে। কিন্তু আমরা মনে করি—গান্ধারীর প্রসবকালে তিনি হয়তো দূরে অবস্থিত ছিলেন না। স্থূল কঠিন মাংসপেশি প্রসবের পরেই তাঁকে খবর দেওয়া গেছে এবং তিনি ত্বরিতে এসেছেন গান্ধারীকে বিপন্মুক্ত করতে, কেননা তিনি নিজে যাঁকে শতপুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ করেছিলেন, সেখানে তাঁর কিছু দায় আছে।

কতরকম বিদ্যাই না সেকালের ঋষিরা জানতেন। বেদজ্ঞান এবং ‘মিড্‌ওয়াইফারি’র মধ্যে অনেকটাই পার্থক্য আছে। কিন্তু বেদজ্ঞান আছে বলেই অথর্ববেদের অন্তর্গত এই প্রসব পরিচর্যা তিনি জানেন। তিনি এসেই মাংশপেশিটি দেখলেন এবং গান্ধারীকে জিজ্ঞাসা করলেন—এটাকে নিয়ে তুমি কী করতে যাচ্ছিলে-কিমিদং তে চিকীর্ষিতম্‌? সত্যবাক্‌ গান্ধারী অকপটে সব কবুল করলেন ঋষি শ্বশুরের কাছে। একটু অভিমান করেও বললেন—কুন্তীর অমন সুন্দর একটি ছেলে হয়েছে শুনে আমি ঈর্ষায় কাতর হয়ে আপন গর্ভপাত ঘটিয়েছি। কিন্তু আপনি যে আমাকে শতপুত্রের জননী হবার আশীর্বাদ করেছিলেন, সেই শতপুত্রের কী পরিণতি হয়েছে দেখুন, একটি মাংসপেশি মাত্র জন্মেছে—ইয়ঞ্চ মে মাংসপেশী জাতা পুত্রশতায় বৈ। গান্ধারীর কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাসের বিভূতিময় ঋষিসত্তা উজ্জীবিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন—আমি যা বলেছি, তার অন্যথা হতে পারে না। আমি তো সামান্য আলাপের মধ্যেও কখনও মিথ্যে কথা বলিনি। সেখানে আমার ওই আশীর্বাদও মিথ্যে হবে না—বিতথং নোক্তপূর্বং মে স্বৈরেষ্বপি কুতো’ন্যথা।

ব্যাস আর সময় নষ্ট না করে কাজের কথায় এলেন। বললেন—খুব শীঘ্র ঘিয়ে ভরা কলসি নিয়ে এসো একশোটা। সেগুলো সব আলাদা আলাদা রাখো। তারপর এই মাংসপিণ্ডটি খুব ঠান্ডা জলে ভিজোতে থাকে। যেমনটি ব্যাস বলেছিলেন, তেমনটি করতে করতেই সেই মাংসপিণ্ডটি অনেকগুলি ভাগে বিশ্লিষ্ট হয়ে গেল। বিশ্লিষ্ট ভাগগুলিকে পৃথক পৃথক ঘৃত কুম্ভে স্থাপন করলেন গান্ধারী। ব্যাস সেগুলিকে সুরক্ষিতস্থানে সাবধানে রেখে গান্ধারীকে বললেন—ঠিক এক বৎসর পরে এই কলসিগুলির মুখগুলি খুলবে, দেখবে তুমি শতপুত্রের জননী হয়েছ।

ব্যাসের এই সন্তান-সৃষ্টির প্রক্রিয়া অদ্ভুত মনে হতে পারে, হয়তো এই প্রক্রিয়ার উপাদানগুলি আধুনিক ভাবনার সঙ্গে মেলে না; কিন্তু আধুনিক যেসব পণ্ডিতেরা ‘টেস্টটিউব’ বেবি’ নিয়ে গবেষণা করেন, তাঁরা কিন্তু এই কথা ভেবে আশ্চর্য হন যে, আড়াই-তিন হাজার আগের যুগে একটি ঋষি মানুষ নালিকা-সন্তানের বদলে কৃত্রিমভাবে অন্তত কুম্ভ-সন্তানের কথা ভেবেছিলেন। এমনকী তাঁর প্রক্রিয়ার মধ্যে শীতল জলের প্রস্তাবটুকুও এখনকার দিনের বীজ রক্ষার ধরনটা স্মরণ করায়। কিন্তু কী জানেন, ঘি মানে প্রাচীনশাস্ত্রে শুধুই ঘি নয়। যা কিছুই সেকালে প্রাণদায়ী ছিল, সেগুলিও ঘৃতের অভিধায় চিহ্নিত হত—আয়ুর্বৈ ঘৃতম্‌। তবে এই ঘৃত শব্দের দ্যোতনার ওপরেও কিন্তু আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ওই ‘কুম্ভ’ শব্দটি। মহাভারতে বলা হচ্ছে—সেই একশোটি কুম্ভের মধ্যে গর্ভগুলিকে স্থাপন করা হল—ততস্তাংস্তেষু কুম্ভেযু গর্ভান্‌ অবদধে তথা। এই কুম্ভের মধ্যে গর্ভ স্থাপন ব্যাপারটা অন্য কোনও মাতৃগর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের বীজস্থাপন নয় তো?

আশ্চর্য কী জানেন—কুম্ভ, কুণ্ড এই ধরনের শব্দগুলি প্রাচীন সংস্কৃতে বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া অন্য অবৈধ মিলনের আধার কোনও দাসী বা বেশ্যাকে বোঝাত। এখন এই কুম্ভ যদি অবৈধ মাতৃগর্ভ হয় তা হলে কিছু বলার নেই, কিন্তু অন্য দাসীগর্ভে যদি এই বীজ স্থাপন করা হয়ে থাকে, বিশেষত ব্যাস যেহেতু একটি প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন, তা হলে এই কুম্ভের গুরুত্ব বাড়ে।

একই সঙ্গে বলি—দেখুন, আমি প্রাচীন প্রক্রিয়ার অতিবাদী কোনও প্রচারক নই—আমি পরমার্থত বিশ্বাস করি না যে, পুষ্পক রথের প্রমাণে সেকালে বিমান চলাচল করত বলে মনে করা যায়, অথবা পৃথিবীধ্বংসী ব্রহ্মাস্ত্রের প্রয়োগকে পরমাণু-বিস্ফোরণের সমতুল্য মনে করা যায়। কাজেই আমি একবারও বলছি না যে, ব্যাস নালিকা-সন্তানের সৃষ্টিবিধি জানতেন অথবা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা সব নালিকা-সন্তান। আমি শুধু এইটুকু মানি যে, ‘টেস্টটিউব বেবি’ সৃষ্টি করার মধ্যে যদি কোনও ‘সায়েন্স’ থাকে—যে ‘সায়েন্স’ সত্যিই আছে, তবে সেই ‘সায়েন্সে’র ‘ফিকশন’টা ব্যাসদেবই প্রথম লিখেছেন। দা ভিঞ্চি বিমান দেখেননি বটে তবে বিমানের যে চিত্রকল্পনা তাঁর মনে ছিল, সেও কিছু কম নয়।

এইচ. জি. ওয়েলস চাঁদের মাটিতে যে মানুষের পদসঞ্চার ঘটিয়েছিলেন, তা তখন বাস্তব ছিল না নিশ্চয়ই, কিন্তু তাই বলে ওয়েলসকে বাহবা না দিয়ে যেমন পারা যায় না, তেমনই ব্যাসদেবকে অন্তত নালিকা-সন্তানের প্রথম কল্পসৃষ্টিকারী হিসেবে অভিনন্দন জানাতেই হবে। আর যদি এমন একটা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির শতাংশের পাঁচ ভাগও তিনি কোনও-না-কোনওভাবে বাস্তবে রূপায়িত করে থাকেন, অথবা যদি ‘থিয়োরি’ হিসেবেও লিখে থাকেন এসব কথা, তবে বলতেই হবে যে, তাঁর কবিজনোচিত ক্রান্তদর্শিতার মধ্যে বিজ্ঞানীর ‘ভিশন’টুকুও ছিল যথেষ্ট।

যাই হোক, গান্ধারীকে পুত্রজন্মের বিষয়ে নিশ্চিন্ত করে ব্যাস তপস্যার জন্য হিমালয়ে চলে গেলেন। হঠাৎ এই ভাব পরিবর্তনে আমাদের একটু আশ্চর্য লাগে। গান্ধারীর পুত্রজন্ম সফল করার জন্য তাঁকে যে গান্ধারীর প্রয়োজন হবে—এ কথা নিশ্চয় তিনি বুঝেছিলেন বলেই তিনি খুব দূরে কোথাও চলে যাননি। কিন্তু এই মুহূর্তে যে তিনি তপশ্চর্যার জন্য হিমালয়ে চলে গেলেন, তাতে মনে হয় তাঁর মনে কিছু অস্থিরতা এসেছিল এবং তা কুরুবাড়ির ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই। মহাভারতে যে শ্লোকে ব্যাসের হিমালয় যাত্রার প্রসঙ্গ আছে, তার অব্যবহিত পরের শ্লোকেই বলা হচ্ছে—জন্ম সময়ের প্রমাণে পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠিরই যে কুল-জ্যেষ্ঠ হলেন—সে কথা ভীষ্ম এবং বিদুরকে বলে দেওয়া হল। কে বললেন? কেন বললেন? ভীষ্ম এবং বিদুর এ কথা জানতেন না নাকি?

মহামতি সিদ্ধান্তবাগীশের বঙ্গানুবাদ এখানে যথাযথ মনে হয় না। ব্যাস তপস্যার জন্য হিমালয়ে গেলেন, তার পরের শ্লোকে আছে—কিন্তু যুধিষ্ঠির যে জন্মের প্রমাণে সকলের বড়, সে কথা ভীষ্ম এবং বিদুরকে বলে দেওয়া হল—জন্মতস্তু প্রমাণেন জ্যেষ্ঠো রাজা যুধিষ্ঠিরঃ। তদাখ্যাতন্তু ভীষ্মায় বিদুরায় চ ধীমতে॥ হরিদাস লিখেছেন—সুতরাং জন্ম অনুসারে যুধিষ্ঠিরই জ্যেষ্ঠ হইলেন। তাহার পর, কোনও লোক যাইয়া ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের সেই জন্মবৃত্তান্ত ভীষ্ম এবং বিদুরের নিকট বলিল। এই বাংলা ঠিক হয়নি। ব্যাসের হিমালয় যাত্রার পরেই এই শ্লোক থাকায়, বিশেষত এখানে যুধিষ্ঠিরই সকলের বড়—এই পঙক্তির পরেই ‘তদ্‌’ শব্দ থাকায় এই শ্লোকের মধ্যে ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রদের জন্মের খবর দেওয়া হচ্ছে—এ প্রসঙ্গ আসেই না। যা আসে, তা হল—স্বয়ং ব্যাসই তাঁর হিমালয় যাত্রার পূর্বে এ কথা ভীষ্ম এবং বিদুরের মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে গেলেন যে, জন্মের হিসেবে যুধিষ্ঠিরই দুর্যোধনের থেকে বয়সে বড় এবং রাজা হওয়ার যোগ্যতাও তাঁরই—তদাখ্যাতস্তু ভীষ্মায় বিদুরায় চ ধীমতে।

মনে রাখতে হবে—নিজের কারণেই হোক অথবা ধৃতরাষ্ট্রের প্ররোচনায়—পরম ধৈর্যশীলা গান্ধারীও যে পুত্রজন্মের ব্যাপারে কুন্তীর প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েছিলেন, তাঁর প্রথমতম সাক্ষী ছিলেন ব্যাস। তিনি গান্ধারীর এই স্বীকারোক্তি প্রথম শ্রবণ করেন। পাণ্ডু বনবাসী হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রপরিচালনকারীমাত্র ধৃতরাষ্ট্রের পত্নীর মুখে এই তথ্যভাষণে ব্যাস সুখী হতে পারেননি। আপাতদৃষ্টিতে কুরু-পাণ্ডবের এই মুনি-পিতামহ রাজ্যের শাসন সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে না জড়ালেও সত্য এবং ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাসই এ কথা কুরু রাষ্ট্রের প্রশাসক পিতামহকে জানিয়ে গেছেন। আর জানিয়ে গেছেন সত্যধর্মের চিরভাষক আপন পুত্র বিদুরকে—প্রশাসনের সঙ্গে তিনিও সমানভাবে জড়িত। যুধিষ্ঠির এবং দুর্যোধনের জন্মনক্ষত্রের অস্পষ্ট আলোকে ব্যাস শান্তনুবংশের ভবিষ্যৎ-বিপদের কথা প্রত্যক্ষ পাঠ করতে পেরেছিলেন বলেই সত্য এবং ন্যায় বিধানের জন্য তিনি সেই দুটি মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে গেছেন, যাঁরা প্রশাসনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। খেয়াল করে দেখবেন—ব্যাসের ভবিষ্যৎ-ভাবনা কতটা ছিল। ধৃতরাষ্ট্র প্রথম পুত্র দুর্যোধন জন্মাবার সঙ্গে সঙ্গে সভা ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—যুধিষ্ঠিরের পর তাঁর পুত্রটিই রাজা হবেন তো? যুধিষ্ঠির তখন হস্তিনাপুরের দৃশ্যপটেই আসেননি, অথচ ধৃতরাষ্ট্র চিন্তা করছেন তাঁর পরে কে রাজা হবে। ধৃতরাষ্ট্রের ঘরে এসে, তাঁর পুত্রজন্মের ব্যাপারে সাহায্য করতে গিয়ে ব্যাস যে ভয়ংকর ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছিলেন, তাতে শঙ্কিত হয়েই তিনি হয়তো হিমালয়ে তপস্যা করে উদ্‌বিগ্ন মনকে শান্ত করতে চেয়েছিলেন।

ঘটনার গতি পরিবর্তিত হল খুব আকস্মিকভাবে এবং খুব শীঘ্র। পঞ্চপুত্রের মুখদর্শন করে বনবাসী পাণ্ডু বনেই মারা গেলেন। শতশৃঙ্গ পর্বতের আরণ্যক ঋষিরা পঞ্চপাণ্ডব এবং পাণ্ডুর প্রথমা স্ত্রী কুন্তীকে সঙ্গে নিয়েই ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় এলেন। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শবাধার ধৃতরাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত করে তাঁরা পাণ্ডুপুত্রদের পরিচয় দিয়ে গেলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ যখন মিটে গেল, তখন মহামতি ব্যাসকে আমরা আবার হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে প্রবেশ করতে দেখছি। পাণ্ডু তাঁর নিয়োগজাত সন্তান হলেও বীজী পিতা হিসেবে পুত্রের এই অকালমৃত্যু নিশ্চয়ই তাঁর হৃদয় স্পর্শ করেছিল। নইলে এই সময় তিনি ফিরে আসবেন কেন? তবে হস্তিনাপুরে এসে ধৃতরাষ্ট্রের মতিগতি দেখে তাঁর নিশ্চয়ই ভাল লাগেনি। বুঝতে তাঁর সময় লাগে না। বিশেষত ঋষিরা সেকালে রাজনীতির চর্চা যথেষ্ট করতেন, হস্তিনাপুরের রাজনীতি বুঝতে ব্যাসের সময় লাগেনি। তিনি যখন হস্তিনাপুরে এসেছেন, যুধিষ্ঠিরের বয়স তখন যোলো। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর রাজ্যের কার্যনির্বাহক রাজা হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরকে তাঁর পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দেবার নামও করেননি, এবং তিনি তাঁর পুত্র দুর্যোধনের ভবিষ্যৎ নিয়ে অঙ্ক কষছেন।

ব্যাস সব বুঝেছেন। এবার তিনি ধৃতরাষ্ট্রের ঘরেও ওঠেননি, প্রশাসনের কোনও কর্তাব্যক্তির সঙ্গেও তিনি কথা বলেননি। তিনি উপস্থিত হয়েছেন জননী সত্যবতীর কাছে। সত্যবতীকে তিনি ভাল চেনেন, তাঁর পিতৃবংশের তেমন কৌলিন্য না থাকলেও তিনি যে অত্যন্ত বুদ্ধিমতী এবং রাজনীতিও যে তিনি খুব ভাল বোঝেন এটা ব্যাস জানেন। বিশেষত সত্যবতীর ব্যক্তিত্ব এতটাই অসাধারণ যে তিনি বেঁচে থাকলে হস্তিনাপুরে কোনও রাজনৈতিক সংকট উপস্থিত হলে সেখানে মাথা গলাবেন না, এটা হতেই পারে না, কেননা এতকাল তিনি মাথা ঘামিয়ে এসেছেন। কিন্তু ব্যাস শঙ্কিত হচ্ছিলেন, বুঝি এইবার তিনি অপমানিত না হন। যে সত্যবতীর কথা ভীষ্ম পর্যন্ত কোনওদিন অবহেলা করেননি, সেই সত্যবতী তাঁর বৃদ্ধ বয়সে যদি কোনও অনভ্যস্ত রূঢ়তার মুখোমুখি হন, এবং তা যদি হন ব্যাসেরই আত্মজ পুত্রের কাছ থেকে—তা হলে সত্যবতী যেমন তা সহ্য করতে পারবেন না, তেমনই পারবেন না ব্যাসও।

ব্যাস তাই জননীর কাছে এসেছেন। তাঁর দ্বিতীয় পুত্রবধূ অম্বালিকার পুত্র পাণ্ডুর মৃত্যুতে তিনি শোকস্তব্ধ মূৰ্ছিতপ্রায়। ব্যাস এই সময়টাই বেছে নিয়েছেন জননীকে সংসারের ক্লিন্ন মোহ থেকে মুক্ত করার জন্য, কেননা সংসারে যেকোনও প্রিয়জনের মৃত্যুতে মন আপনিই খানিকটা বৈরাগ্যযুক্ত থাকে। বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার এই উপযুক্ত সময়। ব্যাস জননীকে গিয়ে বলেছেন—তোমার সুখের কাল চলে গিয়েছে, মা! সামনে যে সময় আসছে, সে ভীষণ খারাপ। ভীষণ ভীষণ খারাপ সময় আসছে—অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ পর্যপস্থিতদারুণাঃ। দিনকে দিন পাপে ভরে যাবে এই পৃথিবী। নানা কপটতা আর শঠতা তুমি দেখতে পাবে, নানা দোষে আকীর্ণ হয়ে উঠবে এই সমাজ। পৃথিবীর যৌবনকাল চলে গেছে, মা। দিনের পর দিন পাপে ভরে উঠবে পৃথিবী—শ্বঃ শ্বঃ পাপিষ্ঠদিবসাঃ পৃথিবী গতযৌবনা।

পৃথিবীর যৌবন শেষ হয়ে গেছে—এই একটিমাত্র পঙ্‌ক্তি যে কালে, যে ব্যঞ্জনায়, যে উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, তা শুধু মহাকবি বলেই ব্যাস বলতে পেরেছেন। বস্তুত পৃথিবীর যৌবন কখনও যায় না। আসলে মানুষ যখন বৃদ্ধ হয়ে যায়, তখন পুত্রের যৌবনারূঢ় কালকে অথবা নাতি-নাতনিদের সময়টাকে আর পছন্দ করতে পারে না, নিজের বৃদ্ধ মানসিকতাকে মেলাতেও পারে না সমকালীন আধুনিকতার সঙ্গে। ফলে একটা ‘ক্ল্যাশ্‌’ তৈরি হয়, খটাখটি বাধতে থাকে পূর্বজ বৃদ্ধের সঙ্গে উত্তরজন্মা আধুনিকের এবং তাতে বৃদ্ধই মানসিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন পরবর্তী প্রজন্মের তুলনায়—কেননা তাঁর সময়ের যৌবনবতী পৃথিবী কালের নিয়মে বিশ্বাসঘাতিনী হয়ে আলিঙ্গনে ধরা দেয় যৌবনারূঢ় প্রজন্মের কাছে। ঠিক এই বাস্তব কারণেই সেকালে বানপ্রস্থের ব্যবস্থা ছিল—পঞ্চাশোর্ধ্বে বন ব্রজেৎ। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও আমি অনেক বৃদ্ধা-বৃদ্ধাকে কাশী কিংবা বৃন্দাবনবাসী হতে দেখেছি স্বেচ্ছায়। আজ স্বেচ্ছায় যাঁরা যাননি, মায়া-মোহের কারণে যাঁরা থেকে গেছেন পুত্র-পুত্রবধূর সংসারে, তাঁদের অনেককেই দেখেছি পরবর্তী প্রজন্মের চাপে কুঁকড়ে যেতে; দুঃখ-কষ্ট এবং অসহ্য বিড়ম্বনা-অবহেলায় কাল কাটাতে দেখেছি তাঁদের। নিজের বয়ঃপরিণতির সঙ্গে পৃথিবী এইভাবেই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে বৃদ্ধা হয়ে যায়।

ব্যাস তাই জননী সত্যবতীকে পৃথিবীর পঙ্কিল আবর্ত থেকে, সংসারের মোহ থেকে মুক্ত করতে এসেছেন। বলেছেন—চলো মা, বেরিয়ে পড়ো এখান থেকে। নানা দোষ, নানা অধর্মে কলুষিত এই সংসার থেকে বিদায় নাও। খুব খারাপ সময় আসছে—ঘোরঃ কালো ভবিষ্যতি। এখানে যত থাকবে, ততই খারাপ দেখতে পাবে—কৌরবদের অন্যায়-অধর্মে এই পৃথিবী আর সুস্থ থাকবে না। তার চেয়ে চলো তুমি, তপোবনে বসে যোগ অবলম্বন করো। এই কৌরব বংশের অনিবার্য অবক্ষয় এখানে বসে বসে দেখতে যেয়ো না, তাতে তোমার কষ্ট বাড়বে, তুমি আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ো—মা দ্রাক্ষীস্ত্বং কুলস্যাস্য ঘোরং সংক্ষয়মাত্মনঃ।

সত্যবতী পুত্র ব্যাসের কথার মূল্য অনুভব করলেন। যিনি এককালে অতি অল্প সময়ের জন্য মহাঋষি পরাশরের জাগতিক তৃপ্তি ঘটিয়ে নির্লিপ্তভাবে ঋষিপুত্রের জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁর এই নির্লিপ্তির সংস্কার থাকবারই কথা। ব্যাসের কথা শুনেই তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছেন এবং অন্দরমহলে গিয়ে শেষবারের মতো ধৃতরাষ্ট্রের মা অম্বিকাকে বললেন—শোনো হে বউ! আমার ছেলে যা বলল, তোমার নাতি দুর্যোধনের অন্যায়-অধর্মে এই বংশ এবং এই রাষ্ট্র-জনপদ নাকি ধ্বংস হয়ে যাবে। অতএব তুমি যদি চাও, তবে এই মৃতপুত্রা পাণ্ডুজননী অম্বালিকাকে নিয়ে চলো আমরা তপোবনে চলে যাই। পুত্রবধূ অম্বিকা শাশুড়ি সত্যবতীর প্রখর বাস্তববোধকে শ্রদ্ধা করে তাঁকে মেনে এসেছেন চিরকাল। তিনি কোনও আপত্তি না করে ছোট বোন অম্বালিকাকে নিয়ে প্রাগ্রসরা সত্যবতীর সঙ্গে উপস্থিত হয়েছেন কুরুবংশের প্রশাসক ভীষ্মের কাছে।

ভীষ্মের অনুমতি পেতে দেরি হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য, রাজাসনে অধিষ্ঠিত ধৃতরাষ্ট্রের একটি বিলাপবাক্যও শোনা যায় না এখানে, অথচ তাঁর মা অম্বিকা, অপরা জননী অম্বালিকা এবং কুরুবংশধারিণী সত্যবতী—যাঁরা এককালে এই কুরুবংশের চালিকাশক্তি ছিলেন—তাঁরা সকলেই ব্যাসের বাক্য মান্য করে তপশ্চর্যার জন্য বনে চলে গেলেন। ভারী কৌতূহল অনুভব হয় একটি কথা ভেবে যে, অম্বিকা এবং অম্বালিকা—এই দুই কাশী-রাজকন্যাকে ভীষ্ম প্রায় অপহরণ করে নিয়ে এসে বিয়ে দিয়েছিলেন বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে, কিন্তু বিচিত্রবীর্যের স্বামিত্বের অংশ তাঁদের জীবনে কতটুকু? যাঁর শক্তিতে এঁরা সন্তানবতী হয়ে সার্থক জননী হলেন, এঁরা কিন্তু তাঁদের পুত্রের জনক সেই স্বামীর অনুগামিনী হয়েই ঘর ছাড়লেন তপস্যার জন্য। পাণ্ডব-কৌরবের এক পিতামহ এই দুই রমণীকে হস্তিনার রাজবধূ করে নিয়ে এসেছিলেন, পাণ্ডব-কৌরবের আর এক পিতামহ তৎকালীন দিনের সার্থক স্বামীর মতো তাঁদের নিয়ে গেলেন গৌরবজনক মুক্তির পথে। সঙ্গে নিয়ে গেছেন জননী সত্যবতীকে—যিনি হস্তিনার রাজবাড়িতে থাকলে আরও কষ্ট পেতেন, কেননা অতিব্যক্তিত্বময়ী সেই বৃদ্ধার পক্ষে সব কিছু সয়ে যাওয়া সম্ভবপর হত না। ক্রান্তদর্শী ব্যাস এইভাবে জননীর কষ্টও দূর করেছেন, দূর করেছেন দুই রাজবধূর আবিবাহ যন্ত্রণা—ব্যাসই যে তাঁদের আসল স্বামী।

ব্যাস বুঝেছিলেন যে, ধৃতরাষ্ট্রকে অচক্ষুত্বের কারণে রাজা না করাটা ন্যায়সঙ্গত হলেও ধৃতরাষ্ট্রের মনে এ বিষয়ে ক্ষোভ আছে। এদিকে পাণ্ডু মারা গেছেন। হস্তিনার সাময়িক ভার বহুদিনই ন্যস্ত হয়েছে ধৃতরাষ্ট্রের ওপর এবং এখনও সে ভার চলছে। ব্যাস বুঝেছিলেন যে, এরপরে যখন জ্যেষ্ঠতা-কনিষ্ঠতার বিচারে রাজ্যের ওপর পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের উত্তরাধিকার জোরদার হয়ে উঠবে, তখনই বিবাদ-বিগ্রহের সূত্রপাত হবে। ব্যাস এটা বুঝেছিলেন বলেই হস্তিনাপুরের ভাবী-পঙ্কিল রাজনীতি থেকে আপন জননী সত্যবতীকে তথা গর্ভাধানের সূত্রে ক্ষণপরিচিতা স্ত্রীপর্যায়িনী দুই কুলবধূকে সংসারমুক্ত করে নিয়ে গেছেন বনে। ব্যাস মুনি বলে কথা, মোক্ষধর্মে তিনি আরূঢ় ব্যক্তি। তিনি যে আপন প্রিয়জনকে সংসার-বৈরাগ্যের পথ দেখাবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! কিন্তু শুদ্ধ-বুদ্ধ মুনির এ আবার কেমন ভাব যে, তিনি বার বার কী এক টানে হস্তিনাপুরের রাজ্যসভায় ফিরে আসেন, এবং অংশও নেন পাণ্ডব-কৌরবের গার্হস্থ্য কার্যকলাপে!

ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভায় তিনি সর্বক্ষণের কোনও পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন না, কিন্তু মাঝে মাঝেই তিনি ধৃতরাষ্ট্রের সভায় এমনভাবে বসে থাকেন যে, তাঁকে দেখে সভাসদবর্গের একজন বলে মনে হয় যেন। সেকালের দিনে ব্রাহ্মণ মন্ত্রীর কোনও অভাব ছিল না, কিন্তু সেই অর্থে ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার তিনি কেউ নন। সব চেয়ে বড় কথা, এই যে তিন-তিনটি মুমুক্ষু স্ত্রীলোককে তিনি দুরন্ত ভাষণে সংসার-বৈরাগ্যের পথ দেখালেন, তার কিছুদিন পরেই কিন্তু সেই ব্যাসকে আমরা ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় চুপটি করে বসে থাকতে দেখছি। পাণ্ডব-কৌরব কুমারদের অস্ত্রশিক্ষা তখন শেষ হয়ে গেছে, গুরু দ্রোণাচার্য ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় এসে ধৃতরাষ্ট্রকে যখন কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার প্রদর্শনী আয়োজন করতে বলছেন, তখন ভীষ্ম, বিদুর এবং বাহ্লীকের মতো রাজমন্ত্রীদের সঙ্গে ব্যাসকেও আমরা উপস্থিত দেখছি—গাঙ্গেয়স্য চ সান্নিধ্যে ব্যাসস্য বিদুরস্য চ। জিজ্ঞাসা হয়—এটা কি কোনও জরুরি সভা তলব করা হয়েছিল, যেসব জরুরি সভায় মাঝে মাঝে উপস্থিত হতেন ব্যাস। অস্ত্রশিক্ষার প্রকৃত প্রদর্শনী যখন হয়েছিল, তাতে শব্দত ব্যাসের নাম পাই না বটে, কিন্তু ব্যাস নিশ্চয়ই তাঁর নাতিদের অস্ত্রশিক্ষা ঋষির বিস্ময় নিয়ে দেখে থাকবেন। নিজের ঔরসপুত্রদের সন্তানেরা যেখানে নিবিড় অস্ত্রশিক্ষা প্রদর্শন করছেন, সেখানে তিনি হিমালয়ের পাদদেশে বসে বৈরাগ্যসাধনা করছিলেন না।

আসলে বৈরাগ্যসাধনা তাঁর শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু সংসারও তাঁর কাছে অতীত বিষয়। কিন্তু মহামুনি হলেও ব্যাসের হৃদয়ে এমনই এক মমতা-মাখানো প্রত্যয় থেকে থাকবে, যাতে সর্বদাই তিনি অনুভব করতেন যে, তিনি পাণ্ডব-কৌরব বংশের বীজী জনক। রাজসভায় মাঝে মাঝে তিনি ভাবলেশহীন সাক্ষিচৈতন্যের মতো বসে থাকেন। দেখাতে চান বুঝি—মুনির ঔরসে মুনিই জন্মায় না, রাজনীতি, সমাজনীতি, পরিবেশ এবং সংসার-কূট একেক জনকে একেক ভাবে তৈরি করে এবং আপন প্রকৃতি অনুযায়ী তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় মহাকাল। ব্যাস ক্রান্তদর্শী কবি, কবির মতো করেই তিনি জানেন—মহাকালের চাতুরি কাকে কোন দিকে বয়ে নিয়ে যাবে। তবু তিনি নিরপেক্ষ সাক্ষী নন সব সময়; কবি যখন, অতএব কবিজনোচিত বেদনাবোধে তিনি অত্যাচারিতের পক্ষপাতী হয়ে পড়েন এক সময়। ঠিক সেই কারণেই তাঁকে এবার দেখছি প্রবঞ্চিত পাণ্ডবকুলের সঙ্গে গোপনে মিলিত হতে।

তখন জতুগৃহ দগ্ধ হয়ে গেছে। জননী কুন্তীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের দগ্ধ হয়ে মরার খবর তখন বেশ প্রচারিত। আমরা জানি—ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনদের এই কূটকৌশল এখানে সফল হয়নি। পাণ্ডবরা তখন তপস্বী ব্রাহ্মণের বেশে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছেন এবং রাক্ষসী-সুন্দরী হিড়িম্বার সঙ্গে ভীমের বিয়ে পর্যন্ত তখন হয়ে গেছে। কিন্তু এখনও তাঁদের একটা স্থায়ী আবাস তৈরি হয়নি অথবা অন্তত কিছু দিনের জন্য থাকা যায়, এমন একটা জায়গাও তাঁরা খুঁজে পাননি এখনও। মাথায় জটা, পরিধানে বল্কল-অজিন, আর কাজটাও তাঁরা করছেন তপস্বীর মতোই—তাঁরা বেদ, বেদাঙ্গ, নীতিশাস্ত্র পড়েন, আর দিনান্তে ভিক্ষান্নের দ্বারা ক্ষুন্নিবৃত্তি করেন। ঠিক এইরকমই এক অধ্যয়নকালে তাঁরা দূর থেকে পিতামহ ব্যাসকে দেখতে পেলেন—দদৃশুস্তে পিতামহম্‌।

এমন হতে পারে—যে মুনি ‘চরৈবেতি’র মন্ত্রে পরিব্রাজকতা করে বেড়ান, তিনি আপনিই ঘুরতে ঘুরতে আসছিলেন বনপথে এবং পাণ্ডবরা তাঁদের পরিচিত পিতামহকে দেখতে পান। কিন্তু এমনটা না হওয়াই সম্ভব। কেননা ব্যাসকে দেখামাত্রই পাণ্ডবরা যখন জননী কুন্তীকে নিয়ে তাঁর সামনে হাতজোড় করে দাঁড়ালেন, তখন ব্যাস বললেন—তোমাদের এই বিপদের কথা আমি আগেই মনে মনে জানতে পেরেছি—ময়েদং ব্যসনং পূর্বং মনসা বিদিতং নৃপাঃ। ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা যে অন্যায়ভাবে তোমাদের বারণাবতে নির্বাসিত করেছিল—সেটা জেনেই আমি এসেছি তোমাদের এখানে। তোমাদের সুপরামর্শ দিয়ে যদি তোমাদের ভাল কিছু করতে পারি, সেইজন্যই এখানে আমার আসা—তত্‌বিদিত্বাস্মি সম্প্রাপ্তশ্চিকীর্যুঃ পরমং হিতম্‌।

আমাদের ধারণা-পিতৃহীন পাণ্ডবদের বারণাবতে নির্বাসন এবং জতুগৃহের আগুনে তাঁদের মৃত্যুর কথা যখন প্রচারিত হয়ে গেল, তখন সেকথা ব্যাসের কানেও নিশ্চয়ই পৌঁছেছে। হস্তিনাপুরে তাঁর যথেষ্টই যাতায়াত ছিল, অতএব ঘটনার সত্যতা বোঝাবার জন্য নিশ্চয়ই তিনি সেখানে এসেছিলেন। চিন্তিত ব্যাসকে নিশ্চয়ই আশ্বস্ত করেছিলেন তাঁর আত্মজ পুত্র বিদুর এবং তিনি নিশ্চয়ই পাণ্ডবদের সম্ভাব্য গতিপথ সম্বন্ধেও তাঁকে অবহিত করে থাকবেন। কারণ বিদুরই তাঁদের গুপ্তপথের সন্ধান দিয়েছিলেন। ব্যাস যে পাণ্ডবদের বলেছেন—মনে মনে তোমাদের বিপদের কথা জেনেছি—মনসা বিদিতং নৃপাঃ—আমরা বাস্তববুদ্ধিতে বুঝি—বিদুরই তো ব্যাসের মনোময় দেহ। বিদুর পাণ্ডবদের বাঁচার উপায় বলে দিয়ে, তাঁদের গভীর সুড়ঙ্গপথ দিয়ে বার করে দিয়ে এবং গঙ্গা পার করিয়ে দিয়ে বিপন্মুক্ত করে দিয়েছেন। অতএব অর্ধেক পথ তাঁর জানা থাকায় গঙ্গার পরপারের সম্ভাব্য গতিবিধিটুকু ব্যাসের পক্ষে বুঝে নেবার অসুবিধে হয়নি। নইলে অমন ‘ক্যাসুয়াল’-ভাবে তিনি বলতেন না—তোমাদের ভালর জন্যই আজ আমি এখানে এসেছি।

বনে বনে ভ্রাম্যমান পাণ্ডব-রাজপুত্রদের দেখে তিনি তাঁদের প্রতি সমব্যথায় বলেছেন—তোমরা দুঃখ পেয়ো না একটুও। জেনে রেখো—সব তোমাদের মঙ্গলের জন্যই ঘটছে—ন বিষাদো’ত্র কর্তব্যঃ সর্বমেতৎ সুখায় বঃ। ব্যাস পাণ্ডব-কৌরবদের জন্মমূল পিতামহ, কাজেই প্রশ্ন হতে পারে হস্তিনাপুরের ভারপ্রাপ্ত শাসকের বিপরীত ক্ষয়স্থানে তিনি উপস্থিত হলেন কেন, সে বংশও তো তাঁরই সৃষ্টি। বাস নিজেই এর উত্তর দিয়ে বলেছেন—হস্তিনাপুরের ওরা এবং তোমরা—দুই পক্ষই যদিও আমার কাছে সমান—সমাস্তে চৈব মে সর্বে যুয়ং চৈব ন সংশয়ঃ—কিন্তু তোমরা এখনও বালক। আত্মীয়স্বজনের স্নেহ এবং পক্ষপাত তাদের ওপর বেশি হয়, যারা দুর্বল অবস্থায় আছে অথবা যারা অসহায়,—দীনতো বালতশ্চৈব স্নেহং কুর্বন্তি বান্ধবাঃ। ব্যাস বুঝিয়ে ছিলেন—তিনি কেবলমাত্র পিতামহের নিম্নগামিনী স্নেহধারায় সিক্ত হয়ে এখানে আসেননি, পিতৃহীন পাণ্ডবদের যেভাবে বঞ্চনা করা হয়েছে, যেভাবে অন্যায়-অধর্মের পথে কূটকৌশলে তাঁদের নিগৃহীত করা হয়েছে, তাতে তিনি খুশি হননি। খুব বাস্তব কারণেই তাঁর স্নেহ-পক্ষপাত বর্ষিত হয়েছে পাণ্ডবদের ওপর এবং এতে আশ্চর্য কিছু নেই, কেননা আত্মীয়-পরিজনেরা এইভাবেই বঞ্চিত ব্যক্তির পক্ষপাতী হয়ে পড়েন। সাধারণ সংসারের নিয়ম উল্লেখ করেই ব্যাস নিজের কথা বললেন। বললেন—সংসারে এমনটি হয় বলেই তোমাদের ওপরেই এখন আমার স্নেহ পক্ষপাত উদ্বেল হয়ে উঠেছে—তস্মাদভ্যধিকঃ স্নেহঃ যুস্বাসু মম সাম্প্রতম্‌। আমি সেই স্নেহেই তোমাদের কিছু উপকার করতে এসেছি।

বেদ-উপনিষদের শাস্ত্রীয় জ্ঞানে যাঁর বুদ্ধি পরিনিষ্ঠিত হয়েছে, সেই তপস্যাশান্ত মুনির দৃষ্টিতে তো মল-চন্দন, দুঃখ-সুখ, জয়-পরাজয় সব একরকমই হওয়া উচিত ছিল এবং সত্যই ব্যাসের কাছে তা একরকমই। কিন্তু ব্যাস যেহেতু কুরুবংশে পুত্রের জন্ম দিয়ে সংসারধর্মের সীমার মধ্যে এসেছেন, অতএব সংসারের ধর্মই তাঁকে স্নেহের পক্ষপাতে লীলায়িত করেছে। ঠিক এইখানেই ব্যাস অন্য অন্য শুষ্ক-রুক্ষ মুনি-ঋষির মতো নির্লিপ্ত নন। তিনি এখানে বড়ই সজীব এবং সেই জন্যই তিনি মহাকাব্যের কবি। পাণ্ডবদের ওপরে বঞ্চনার জন্য তিনি গিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে গালাগালি দেননি, কিংবা ওপক্ষের নাতি দুর্যোধন-দুঃশাসনকে তিনি কান ধরে ওঠবোস করাননি। তিনি মহাকালের গতি রোধ করেন না, কিন্তু যে ভাল, যে নীতিযুক্ত, যে দীন-বঞ্চিত—তিনি তাঁর পক্ষে এসে দাঁড়ান।

ব্যাসের এই পাণ্ডব-পক্ষপাতিতা নিরীক্ষণ করে বেশ সযৌক্তিক একটা আলোচনা করেছিলেন সালিভান সাহেব—Bruce M. Sullivan. মিথলজির দিক থেকে ব্যাসের চরিত্র বিচার করতে গিয়ে তিনি বলেছেন—ব্যাসের সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিল আছে লোকপিতামহ ব্রহ্মার। দেবতা এবং অসুর, দুই পক্ষকেই তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং দুই পক্ষই তাঁকে পিতামহ বলেই ডাকে। একইভাবে পাণ্ডব-কৌরবদের মধ্যে যে ভয়ংকর কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধ হয়েছিল, সাহেব তার পৌরাণিক প্রতিকল্প খুঁজেছেন দেবাসুর যুদ্ধের মধ্যে। মহাভারতের অংশাবতরণ পর্বে প্রথমেই পাণ্ডব-কৌরবদের দেবাসুরকল্পগুলি দেওয়া আছে। পাণ্ডবরা দেবতার অংশে এবং কৌরবরা সবাই পৌলস্ত্য রাক্ষসদের অংশে দুর্যোধনের সহায় হয়ে এই পৃথিবীতে জন্মেছিলেন, দুর্যোধন নিজে ছিলেন বিবাদের প্রতীক কলির অংশজাত। কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডব-কৌরবের যুদ্ধ ব্যাপারটাকেও মাঝে মাঝে দেব-দৈত্যের ‘মিথলজিক্যাল’ যুদ্ধের উপমায় দেখানো হয়েছে—দৈতেন্দ্রসেনেব চ কৌরবাণাং/ দেবেন্দ্রসেনেব চ পাণ্ডবানাম্‌।

যদিও ব্যাসকে মহাভারতে কোথাও সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি, তবুও ব্রহ্মা যেমন দেবতা এবং দৈত্য-রাক্ষসদের পিতামহ, ব্যাসও তেমনই দেবকল্প পাণ্ডবদের তথা দৈত্যাসুরকল্প কৌরবদেরও পিতামহ। অন্যদিকে দেখুন—দেবাসুর যুদ্ধের চরম পরিণতিরও একটা ‘মিথলজিক্যাল প্যাটার্ন’ আছে এবং সে ‘প্যাটার্ন’ পাণ্ডব-কৌরবের চরম যুদ্ধ-পরিণতির সঙ্গে বেশ মেলে। অসুর-রাক্ষসদের ক্ষেত্রে যেমন হয়—তাঁদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীতে অমঙ্গল সূচিত হয় এবং তেমনটিই দুর্যোধনের ক্ষেত্রেও হয়েছে। রাক্ষস-দৈত্যরা কী করেন? তাঁরা স্বর্গরাজ্যের সার্বভৌমত্ব লাভ করার জন্য চেষ্টা করেন। এই প্রক্রিয়ায় সাফল্যের জন্য তাঁরা ব্রহ্মাকে তপস্যায় তুষ্ট করেন এবং ব্রহ্মার কাছে প্রায় অজেয়ত্বর বরলাভ আসে এবং দেবতারা রাজত্ব হারিয়ে গিরি-গুহা নদী-পর্বতে ঘুরে বেড়াতে থাকেন। অবশেষে শ্রান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে ব্রহ্মার শরণাগত হন। প্রাঞ্জলি হয়ে তাঁর পরামর্শ চান করণীয় বিষয়ে। প্রথাগতভাবেই অসুর-রাক্ষসদের বরদানের ব্যাপারে ব্রহ্মার একটা কৌশল থেকে যায়—অথবা সেটাকে ‘লুপ্‌হোল’ বলাই ভাল। ব্রহ্মা সেই কৌশলগত দিকটা জানিয়ে দেন দেবতাদের এবং পরামর্শ দেন—কী উপায়ে অসুর-রাক্ষসেরা পরাজিত হবেন। দেবতারা সেই পরামর্শমতো চলে পুনরায় স্বর্গের অধিকার লাভ করেন।

এই হল ‘মিথলজিক্যাল প্যাটার্ন’। ব্রহ্মার সঙ্গে ব্যাসের অনুপুঙ্খ স্বরূপ নিশ্চয়ই মেলে না, কেননা তিনি মনুষ্য-সত্তায় বিরাজিত। কিন্তু ব্যাসের ক্রিয়াকর্মও তাই। যজ্ঞক্রিয়ার সম্পূর্ণতা এবং চতুর্বর্গের প্রথম বর্গ ধর্মের সম্পূর্ণতাও নির্ভর করে ব্রহ্মার ওপর। এই ধর্ম গার্হস্থ্য ধর্ম এবং সে ধর্মও প্রবৃত্তিমূলক। প্রবৃত্তিমূলক বলেই সেই ধর্ম থেকে সৃষ্টি হয়। প্রজাপতি ব্রহ্মা প্রথম লোক সৃষ্টি করেন তপস্যায় বসে। ব্যাসও তপস্যায়, বেদাধ্যাপনায় রত ছিলেন। সেই অবস্থা থেকে তিনি মায়ের আদেশে প্রবৃত্তিমূলক ধর্মে নিযুক্ত হন এবং সন্তান সৃষ্টি করেন। ব্রহ্মার চতুর্মুখ থেকে চার বেদের সৃষ্টি, ভগবান ব্যাস চতুর্বেদ বিভক্ত করে বেদব্যাস নামে পরিচিত। ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যে নিযুক্ত বলেই তাঁর চরিত্র মোক্ষানুসন্ধানী নয়। ব্যাসকেও মহাভারতে আমরা এক বানপ্রস্থী পরিব্রাজকের ভূমিকায় দেখি। মাঝে মাঝেই তিনি রাজবাড়িতে আসেন, বিভিন্ন যজ্ঞে প্রাধান্যের সঙ্গে পৌরোহিত্যও করেন—যজ্ঞের প্রধান পুরোহিতকে কিন্তু যাজ্ঞিকেরা ‘ব্রহ্মা’ নামে ডাকেন।

এবারে দেবাসুর যুদ্ধের ‘প্যাটার্নে’ পাণ্ডব-কৌরবদের দেখুন। গান্ধারী কিন্তু ব্যাসকে তুষ্ট করেই শতপুত্রের জননী হবার বর লাভ করেন এবং তাঁর সেই পুত্রজন্মে প্রধান সহায় কিন্তু ব্যাস। ঠিক যেমনটি দৈত্য-রাক্ষসরাও তপস্যার মাধ্যমে ব্রহ্মার প্রথম সহায়তাটুকু পান, তেমনই কৌরবরাও পিতামহ ব্যাসের প্রথম সহায়তা লাভ করে রাজ্য লাভ করেছেন এক সময়ে এবং দেবতাদের স্বর্গ থেকে তাড়ানোর মতোই দেবকল্প পাণ্ডবদেরও তাঁরা নির্বাসিত করেছেন হস্তিনার রাজ্যাধিকার থেকে। কিন্তু এই যে পাণ্ডবরা বনে বনে ঘুরে কষ্ট পাচ্ছেন—এইবার কিন্তু পিতামহ ব্যাস বঞ্চিত নির্বাসিত দেবকল্প পাণ্ডবদের সাহায্য করতে এবং সুপরামর্শ দিতে চলে এসেছেন বনের মধ্যে। বলেছেন—কীভাবে সস্নেহে তোমাদের মঙ্গল সাধন করতে এসেছি, শোনো—স্নেহপূর্বং চিকীর্ষামি হিতং বস্তু নিবোধত।

অসুরকল্প কৌরবরা জানতেও পারলেন না যে তাঁদের অন্যায়-অধর্মে অসন্তুষ্ট ব্যাস এবার পিতৃহীন নির্বাসিত পাণ্ডবদের পক্ষ নিয়েছেন। পথের দিশাহীন পাণ্ডবদের তিনি পথ দেখাচ্ছেন সস্নেহে। ব্যাস বললেন—সামনেই একটা সুন্দর শহর আছে। শহরটি ভাল, রোগ-ব্যাধির প্রকোপও তত নেই সেখানে। তোমরা সেইখানে ছদ্মবেশেই থাকবে এবং কবে আমি আবার ফিরে আসি—তার প্রতীক্ষা করবে—বসতেহ প্রতিচ্ছন্না মমাগমনকাঙিক্ষণঃ। ব্যাস আঙুল তুলে উদাসীনের মতো শহরের রাস্তা দেখিয়ে চলে যাননি। তিনি সমাতৃক পাণ্ডবদের নিয়ে নিকটবর্তী নগরের দিকে চললেন। দৈত্যতাড়িত দেবকুলকে ব্রহ্মা যেভাবে আশ্বস্ত করে সমৃদ্ধির পথ দেখান, ব্যাসও তেমনই পথে যেতে যেতে কুন্তীকে বললেন—তুমি বেঁচে থাক বাছা! তোমার এই যে পুত্রটি যুধিষ্ঠির, সে সদাসর্বদা ধর্মের পথে চলে—জীবপুত্রি সুতস্তে’য়ং ধর্মনিত্যো যুধিষ্ঠিরঃ। সে একদিন ধর্মের পথেই এই পৃথিবী জয় করে ধর্মরাজ হয়ে রাজসিংহাসনে বসবে। যুধিষ্ঠিরের এই ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যে ক্ষাত্রশক্তির প্রয়োজন, তার জোগান দেবে ভীম এবং অর্জুন। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো—তোমার এবং মাদ্রীর ছেলেরা একদিন সমস্ত ভোগ এবং সম্পদ-সুখ লাভ করে পিতৃপিতামহের রাজ্য শাসন করবে—পিতৃপৈতামহং রাজ্যমিমে ভোক্ষ্যন্তি তে সুতাঃ।।

কুন্তীকে তাঁর পুত্রদের রাজ্যলাভের ব্যাপারে আশ্বস্ত করে চলতে চলতেই যে নগরীতে এসে পৌঁছোলেন ব্যাস—তার নাম একচক্রা পুরী। ব্যাস সেখানে এক ব্রাহ্মণের সঙ্গে কথা বলে তাঁর বাড়িতেই পাণ্ডবদের থাকার ব্যবস্থা করলেন। যাবার সময় বলে গেলেন—আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত তোমরা এই বাড়িতেই অপেক্ষা করবে। আমি আবারও আসব—ইহ মাং সম্প্রতীক্ষধ্বম্ আগমিষ্যাম্যহং পুনঃ। শেষে বললেন—দেশ এবং কাল যদি ঠিক ঠিক বুঝতে পার, তবে এক সময় পরম সুখ লাভ করবে তোমরা।

শব্দ দুটি শুনতে সহজ বটে, তবে এ একেবারে রাজনৈতিক উপদেশ। দেশ এবং কালকে বুঝতে হবে। দুর্যোধন পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করেছেন কূট কৌশলে অথচ তাঁরা বেঁচে আছেন। কাজেই এই সময়টা বুঝে চলতে হবে। হঠাৎ করে আত্মপ্রকাশ করলে এই সময়ে ধৃতরাষ্ট্র-দুযোর্ধনেরা তাঁদের সহজে ছেড়ে দেবেন না—এটা এককথায় বুঝিয়েছেন ব্যাস এবং সেটাই কাল-বোধ। দ্বিতীয়ত, দেশ। নির্বাসিত পাণ্ডবরা এই সময়েই ভিন্ন দেশের, বিশেষত কুরুরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন কোনও শক্তিশালী রাজশক্তির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে নিজেদের শক্তি বাড়িয়ে নিতে পারেন। ব্যাস তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন—‘দেশ’ শব্দটি উল্লেখ করে। পাণ্ডবরাও পিতামহের এই সংক্ষেপোক্তি বুঝেছেন এবং বলেছেন—বেশ আমরা তাই করব।

মহাভারত বলেছে-ব্যাস তাঁর পূর্বোক্ত উপদেশ শুনিয়ে যেখান থেকে এসেছিলেন, সেখানেই চলে গেলেন—জগাম ভগবান্ ব্যাসো যথাগতমৃষিঃ প্রভুঃ। কোথা থেকে এসেছিলেন ব্যাস, কোথায়ই বা গেলেন? এর কিছুদিন পরেই দেখছি, ব্যাস আবার পাণ্ডবদের দেখতে এসেছেন—আজগামাথ তান দ্রষ্ট্রং ব্যাসঃ সত্যবতীসুতঃ। এসেই তো সেই পিতামহের মতো সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন—সব ভাল চলছে তো বাছারা! ধর্মের পথ আর শাস্ত্রবাক্য মেনে চলছ তো? সাধারণ কুশল বিনিময়ের পরেই বাস পঞ্চাল-রাজ্যের মেয়ে দ্রৌপদীর কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন। কেমন করে যজ্ঞের আগুন থেকে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী জন্মেছেন, দ্রোণাচার্যের সঙ্গে কীভাবে পাঞ্চাল দ্রুপদের শত্রুতা হল এবং সেই শত্রুতার প্রতিশোধ-স্পৃহা থেকে কীভাবে দ্রৌপদীর সৃষ্টি হল—সে-সব কথা পাণ্ডবদের বললেন ব্যাস।

ঘটনা হল—পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর কথা কিছুদিন আগেই শুনেছেন। দ্রৌপদীর স্বয়ংবর উপলক্ষে রাজারা যেমন পঞ্চালে এসে পৌঁছোচ্ছিলেন, তেমনই দক্ষিণাকামী, ভোজনকামী ব্রাহ্মণরাও দূর-দূরান্ত থেকে দ্রুপদের রাজ্যে এসে পৌঁছোচ্ছিলেন। এমনই এক ব্রাহ্মণ পঞ্চালে যাবার আগে একচক্রানগরীতে ওই পাণ্ডবদের বাড়িতেই রাত্রিবাসের জন্য সাময়িক আশ্রয় নিয়েছিলেন। দ্রৌপদীর কথা তিনিই বলে গেছেন সবিস্তারে, ব্যাস সেই ব্রাহ্মণের মুখে-বলা দ্রৌপদীসম্ভব-কাহিনী পুনরাবৃত্তি করেছেন মাত্র—বিচিত্রাশ্চ কথাস্তাস্তাঃ পুনরেবেদমব্রবীৎ। ব্যাস দ্রৌপদীর সম্বন্ধে বিশেষ বার্তা যেটুকু দিলেন, সেটা হল—তিনি নাকি পূর্বজন্মে তপস্যাতুষ্ট শিবের কাছে পাঁচ পাঁচ বার স্বামী-লাভের বর চেয়েছিলেন। তাতে শিব তাঁকে বলেছিলেন—পাঁচবার যখন একই কথা বললে, তখন তোমার স্বামীও হবে পাঁচজন। কাহিনী জানিয়ে ব্যাস বললেন—সেই মেয়েই দ্রৌপদী হয়ে জন্মেছে। তোমাদের পাঁচজনের সেই একমাত্র স্ত্রী হিসেবে নির্দিষ্ট হয়ে আছে—নির্দিষ্টা ভবতাং পত্নী কৃষ্ণা পাৰ্ষত্যনিন্দিতা। তাই বলছিলাম তোমরা পঞ্চাল নগরে যাও। তাকে লাভ করলে তোমরা সব দিক থেকেই সুখী হবে বলে আমি মনে করি—সুখিনস্তামনুপ্রাপ্য ভবিষ্যথ ন সংশয়ঃ।।

ব্যাস যেভাবে পাণ্ডবদের একচক্রায় অপেক্ষা করতে বলে গিয়েছিলেন এবং যেভাবে ফিরে এসে কথাগুলি বললেন, তাতে বেশ মনে হয়—তিনি এতদিন পঞ্চালেই ছিলেন। পঞ্চালরাজ দ্রুপদ যে দ্রোণাচার্যের কারণে কুরুরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন, তাও তিনি জানতেন। অতএব শত্রুরাজ্যে বসতি করলে পাণ্ডবরা একদিকে যেমন দুর্যোধনের গুপ্তঘাতকদের বিরুদ্ধে রাজকীয় সুরক্ষাও পাবেন, তেমনই বৈবাহিকসূত্রে পঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবদের বন্ধুত্ব স্থাপিত হলে পাণ্ডবদের যে রাজনৈতিক দিক থেকে মান্য করে চলতে হবে কৌরবদের—সেকথাও ব্যাস বুঝেছিলেন। সেই কারণেই ব্যাস বলেছিলেন—দ্রৌপদীকে লাভ করলে তোমরা সুখী হবে।

অসুরকল্প কৌরবদের বিরুদ্ধে পিতামহ ব্যাস পাণ্ডবদের কীভাবে সহায়তা করছেন দেখুন। ধৃতরাষ্ট্রের অন্যায় ব্যবহারে ক্ষুব্ধ পাণ্ডবদের সঙ্গে একান্তে মিলিত হয়ে ব্যাস যে শুধু তাঁর পক্ষপাত দেখালেন তাই নয়, তাঁদের রাজনৈতিক সিদ্ধির পথ পরিষ্কার করে দিয়ে পরম স্নেহে নিজের নাতবউটিকেও পছন্দ করে দিয়ে গেলেন। পাণ্ডবদের কাছে অসামান্যা এক কন্যার খবর দিয়ে তিনি যে সেখানে বসে থাকলেন, তা নয় মোটেই। তিনি স্বয়ং উপস্থিত হলেন দ্রুপদের রাজ্যে। না, দ্রুপদকে তিনি কিছুই বলেননি, বলা তাঁর স্বভাবও নয়। বিধাতার মতো ঘটনা ঘটার পথ পরিষ্কার করে দিয়ে তিনি নির্লিপ্ত বসে থাকেন, যা ঘটবার তা ঘটতে থাকে ব্যক্তির কর্ম এবং উদ্যোগ অনুযায়ী।

পঞ্চালে যাওয়ার কথাটা পাণ্ডবদের আগে থেকেই ঠিক ছিল। ব্যাস চলে যেতেই পাণ্ডবরা সেখানে যাবার তোড়জোড় শুরু করলেন এবং পঞ্চালে পৌঁছে খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরির পরেই কিন্তু ব্যাসের সঙ্গে পাণ্ডবদের দেখা হয়ে গেল—দদৃশুঃ পাণ্ডবা বীরা মুনিং দ্বৈপায়নং তদা। পঞ্চাল রাজ্যে পাণ্ডবদের প্রথম স্বাগত জানালেন ব্যাসই। তাঁর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল এবং কথার শেষে পাণ্ডবরা দ্রুপদের মূল রাজধানীর ভিতরে প্রবেশ করলেন এবং নিজেদের সাময়িক আবাস হিসেবে এক কুম্ভকার-গৃহে আশ্রয় নিলেন। তাঁদের ছদ্মবেশ ব্রাহ্মণের মতো, অতএব তাঁদের বৃত্তিও ব্রাহ্মণী বৃত্তি—ভিক্ষা করে দিন চালানো।

দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে অর্জুন লক্ষ্যভেদ করলেন, কিন্তু অন্য রাজাদের হতাশা এবং অহংকারে স্বয়ংবরসভা যুদ্ধমঞ্চে পরিণত হল। এদিকে পঞ্চাল রাজ্যের দরিদ্র পর্ণকুটিরে বসে জননী কুন্তী মনে মনে ভাবছেন—বেলা পড়ে এল, তবু ছেলেরা ভিক্ষা নিয়ে ফিরল না। রাস্তায় কী ওদের অসুর-রাক্ষসে ধরল, নাকি, ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা ওদের খুন করল? এত সব দুর্ভাগ্যের আশঙ্কা করতে করতেই কুন্তী ব্যাসের কথা স্মরণ করলেন। তাঁর এই বৃদ্ধ শ্বশুরমশাই তাঁকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন—তোমার ছেলেরা ধর্মের পথেই একদিন এই সসাগরা পৃথিবী জয় করবে। তা হলে কি ব্যাসের মতো মহাজনের কথাও মিথ্যে হয়ে গেল—বিপরীতং মতং জাতং ব্যাসস্যাপি মহাত্মনঃ। সেই বৃষ্টিঝরা অন্ধকার দুর্দিনে জননী কুন্তী যে কোনওমতে পুত্রদের বিপদাশঙ্কা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন সে শুধু ব্যাসের ভরসায়। তাঁর ছেলেরা ফিরে এসেছিলেন তাঁর পুত্রবধূকে সঙ্গে নিয়ে।

দ্রৌপদীকে চোখে না দেখেই কুন্তী যে বলে দিয়েছিলেন—ভিক্ষা যা এনেছ, সবাই একসঙ্গে ভাগ করে নাও—সেই কথার মধ্যে দৈবের অভিসন্ধি যতই থাকুক, বাস্তব প্রয়োজন ছিল অনেক বেশি। যুধিষ্ঠির দেখেছিলেন—কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে যিনি লক্ষ্যভেদ করে জিতেছেন সেই অর্জুন ছাড়া আর সব ভাইয়েরাই দ্রৌপদীকে লাভ করার জন্য যথেষ্ট উৎসুক এবং সে ঔৎসুক্য এতটাই যে, অর্জুন বীরোচিত ভদ্রতায় দ্রৌপদীর ওপর তাঁর প্রেমের দাবি ছেড়ে দিলে অন্য পাণ্ডব ভাইরা যেভাবে, যে কামনায় দ্রৌপদীর ওপর দৃষ্টি-নিবেশ করেছিলেন, তার মধ্যে গভীর বিপদের আশঙ্কা ছিল। ঠিক এই মুহূর্তে ব্যাসের কথাই প্রথম স্মরণে আসে যুধিষ্ঠিরের—দ্বৈপায়নবচঃ কৃৎস্নং সস্মার মনুজর্ষভঃ। কেননা তিনিই একমাত্র ব্যক্তি—যিনি সমস্ত লৌকিক লজ্জার ঊর্ধ্বে উঠে বলেছিলেন—তোমাদের পাঁচজনেরই পত্নী হবেন দ্রৌপদী। অসম্ভব তাঁর বাস্তব বুদ্ধি এবং সেই বাস্তব বুদ্ধিতেই তিনি বুঝেছিলেন যে, দ্রৌপদীর মতো অসামান্যা এক রমণী পঞ্চ পাণ্ডবের একজনের স্ত্রী হলে, অন্য ভাইরা সেই সৌভাগ্যবান ভ্রাতার প্রতি ঈর্ষাযুক্ত হয়ে পড়বেন এবং তাতে নিজেদের মধ্যেই বিভেদ তৈরি হবে। যুধিষ্ঠির ব্যাসের এই মর্মকথা স্মরণ করেই সিদ্ধান্ত দিলেন—আমাদের সকলেরই স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী।

অবশ্য যুধিষ্ঠিরের এই সিদ্ধান্ত দ্রৌপদীর পিতা দ্রুপদ এবং ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নকে সহজে মানানো যায়নি। যুধিষ্ঠির এবং দ্রুপদের তর্ক-প্রতর্ক চলছে, ঠিক এই সময় দ্বৈপায়ন ব্যাস এসে দ্রুপদের রাজসভায় উপস্থিত হলেন। মহাভারত বলেছে—‘যদৃচ্ছয়া’ অর্থাৎ এই ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই তিনি উপস্থিত হলেন যেন। কিন্তু আমরা জানি মোটেই তা নয়। তিনি পঞ্চাল রাজ্যেই এতদিন ছিলেন এবং দ্রৌপদীর স্বয়ংবরের খবর তিনি আগেভাগে পাণ্ডবদের কাছে পৌঁছে দিয়ে ঘটকালিও করে গেছেন খানিকটা। আবারও তিনি নিশ্চয়ই পঞ্চালেই ফিরে এসেছেন, নইলে পঞ্চালের মূল রাজধানীতে ঢোকবার আগেই পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়ে গেল কেমন করে? তার ওপরে দ্রুপদের স্বয়ংবরের আয়োজনে যেখানে নানা দিগ্‌দেশ থেকে ব্রাহ্মণ এবং মুনি ঋষিরা এসে উপস্থিত হয়েছেন, সেখানে ব্যাসের মতো শীর্ষস্থানীয় মহর্ষি দ্রুপদসভায় উপস্থিত ছিলেন না, তা হতেই পারে না। অর্জুনের লক্ষ্যভেদে নিশ্চয়ই তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে গেছেন এবং ঠিক সেই সময় রীতিমতো অঙ্ক কষেই তিনি দ্রুপদসভায় উপস্থিত হয়েছেন। কারণ তিনি বুঝেছেন—দ্রুপদের মতো এক ব্যক্তিত্বকে সামাল দেওয়া একা যুধিষ্ঠিরের কর্ম নয় অথবা এই সময় যুধিষ্ঠিরের সাহায্য প্রয়োজন বলেই তিনি ‘যদৃচ্ছয়া’ উপস্থিত হয়েছেন দ্রুপদসভায়। সেই ব্রহ্মার স্বরপে এখন তিনি দেবকল্প যুধিষ্ঠিরকে সাহায্য করছেন।

যুধিষ্ঠির মায়ের কথা বলে দ্রুপদকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন এবং এই সমস্যার ক্ষেত্রে তাঁর আপন ধর্মবিষয়িনী বুদ্ধি তথা সজ্জনের আত্মতুষ্টির প্রমাণ দাখিল করে দ্রুপদকে নিজের অনুকূলে আনার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দ্রুপদ তা বোঝেননি এবং বোঝার কথাও নয়। যুধিষ্ঠির ব্যাসের কথা দ্রুপদকে বলেননি, কিন্তু দ্রৌপদীর ওপর পাঁচ ভাইয়েরই যে একটা অধিকার বোধ তৈরি হয়েছিল, সে তো ব্যাসেরই কথায়। ব্যাস নিজে এসে যেখানে বলেছিলেন—দ্রৌপদীই তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের একতমা পত্নী নির্দিষ্ট হয়ে আছেন—সেখানে অন্য ভাইরা পিতামহের এই প্রসাদবাক্য থেকে বঞ্চিত হবেন কেন, কেনই বা তাঁরা মোহমুক্ত হবেন দ্রৌপদীর ভোগাংশ থেকে। দ্রৌপদী যতই বীরভোগ্যা হোন, ব্যাসের কথায় নকুল-সহদেবের মতো বালখিল্যের মনেও যে দ্রৌপদীর রসসঞ্চার ঘটে থাকবে, তাতে আশ্চর্য কী! ঠাকুরদাদা ব্যাস বিয়ের আগেই ঘটকালি করে গেছেন, অতএব সেই দায়িত্ব নিয়েই তিনি ঠিক সময়মতো উপস্থিত হয়েছেন দ্রুপদসভায়।

দ্রুপদ প্রায় ধমকের সুরেই জ্যেষ্ঠ জামাতৃ-পদের দাবিদার যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—একটিমাত্র মেয়ে, সে পাঁচজনের ধর্মপত্নী হবে—এ কেমন কথা? ‘সংকর’-এর প্রশ্ন আসবে না—কথমেকা বহূনাং স্যাৎ ধর্মপত্নী ন সংকরঃ? ‘সংকর’ শব্দটা শুনেই বুঝি ব্যাসের অন্তর্হৃদয় উদ্বেলিত হয়ে উঠল। নিজের কথা, আত্মজ বিদুরের কথাও বুঝি বা মনে হল তাঁর। মনে হল—সেই তুলনায় এ তো অনেক পরিষ্কার ব্যাপার—এখানে আবার সংকরের প্রশ্ন কোথায়? অন্য ক্ষেত্র হলে ঋষি মুনিদের অভ্যাস—প্রশ্ন শুনেই তাঁরা উপদেশ দিতে আরম্ভ করেন। এক্ষেত্রে ব্যাস কিন্তু তা করলেন না, বরঞ্চ দ্রুপদ রাজার মুখে তথাকথিত লোক-বেদ-বিরোধী বিবাহের তত্ত্ব শোনার আগে তাঁদেরই বাজিয়ে নিতে চাইলেন। বললেন—যাঁরা যাঁরা মনে করছেন—এখানে ধর্মের চ্যুতি ঘটছে, বেদধর্ম এবং লোকধর্ম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাঁরা যা বলবার আগে বলুন, আমি শুনছি—যস্য যস্য মতং যদ্‌ যচ্ছ্রোতুমিচ্ছামি তস্য তৎ!

দ্রুপদ তাঁর সংশয় জানালেন, ধৃষ্টদ্যুম্নও এই অদ্ভুত বিবাহে তাঁর অস্বস্তির কথা জানালেন। যুধিষ্ঠির জানালেন তাঁর সুচিন্তিত বক্তব্য। এমনকী কুন্তীও কী বলতে কী বলে দিয়েছেন—এইভাবে নিজের অসহায়ত্ব জ্ঞাপন করলেন। ব্যাস কোনও উত্তর দেবার আগে কুন্তীকে সর্বপ্রথম সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—তুমি যে মিথ্যাচারের ভয় পাচ্ছ, সেই দুশ্চিন্তা থেকে তুমি এখনই মুক্ত হবে, ভদ্রে—অনৃতান্মোক্ষ্যসে ভদ্রে ধর্মশ্চৈয সনাতনঃ। কুন্তীর সঙ্গে কথা শেষ করেই ব্যাস পঞ্চাল দ্রুপদকে সম্বোধন করে বললেন—আমরা এখানে ধর্মের চ্যুতি ঘটাতে আসিনি। যাতে ধর্ম রক্ষিত হয়, সেই কথাই তোমাকে বলব এবং কৌন্তেয় যুধিষ্ঠির যা বলেছেন—তার মধ্যে অধর্মও আমি কিছু দেখছি না।

দ্বৈপায়ন ব্যাস এইভাবে সাধারণ নির্দেশ জারি করেই দ্রুপদ পঞ্চালের হাত ধরে তাঁর রাজকক্ষে প্রবেশ করলেন—হয়তো একান্তে তাঁকে কিছু বোঝানোর জন্য। খানিকক্ষণের মধ্যেই কুন্তী তাঁর পুত্রদের নিয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে সেই কক্ষে প্রবেশ করলেন—যেখানে অপেক্ষা করছিলেন ব্যাস এবং দ্রুপদ। ব্যাস এবার দিব্য আবেশে পাণ্ডবদের দৈবজন্মের কথা বলতে আরম্ভ করলেন। প্রসঙ্গত কৃষ্ণ-বলরাম ইত্যাদি অবতার পুরুষের কথাও এল। ব্যাস প্রমাণ করে ছাড়লেন যে যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন—এঁরা সব দেবরাজ ইন্দ্রেরই অংশভূত, আর দ্রৌপদী হলেন স্বর্গলক্ষ্মীর স্বরূপ, কাজেই তিনি পাণ্ডবদের জন্যই সৃষ্ট হয়েছেন—কেননা, স্বর্গলক্ষ্মীকে দেবরাজ ইন্দ্রের অংশভূত পাণ্ডবদেরই স্ত্রী হতে হবে, এই তো বিধাতার বিধান। ব্যাস দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের কথাও শোনালেন—যে কথার মধ্যে ভগবান শঙ্করের কাছে তাঁর পাঁচবার বর চাওয়ার অভিসন্ধিও ব্যক্ত হল।

এসব তো গেল তত্ত্বের কথা, ধর্মবিরোধ নিরসনের জন্য পৌরাণিক নীতিযুক্তি। এইসব নীতিযুক্তি ব্যবহার করেই তন্ত্রবার্তিকের লেখক ভট্টকুমারিল দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামিত্ব স্থাপনও করেছেন। কিন্তু সাধারণ্যে লোকবিরোধী বলে যা পরিচিত, তার থেকেও বড় সত্য হল বাস্তব। ব্যাস দ্রুপদকে যা বলেননি অথচ যুধিষ্ঠিরকে নিশ্চয়ই বলেছিলেন, তা হল—দ্রৌপদীর রূপ এবং ব্যক্তিত্ব এমনই যে, তাঁর অধিকার থেকে যে ভাই-ই বঞ্চিত হবেন, তিনিই মনে মনে ক্রুদ্ধ হবেন। অপিচ যুধিষ্ঠির দেখেছিলেন—অর্জুন ভদ্রতা করে নিজের অধিকার ছেড়ে দিলে কীভাবে তাঁর ভাইরা প্রত্যেকে দ্রৌপদীর দিকে সকাম দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন এবং কীভাবে সমস্ত ইন্দ্রিয়গ্রাম মথিত করে দ্রৌপদীকে লাভ করার মোহ তাঁদের আতপ্ত করে তুলেছিল—সংপ্রমথ্যেন্দ্রিয়গ্রামং প্রাদুরাসন্মনোভবঃ। অতএব ভাইদের মধ্যে বিরোধ ঘটাবে যে জিনিস—মিথো ভেদভয়াৎ—তার থেকে মুক্তির জন্যই পিতামহ ব্যাস দ্রৌপদীকে পাঁচ পাণ্ডবেরই একতমা পত্নী হতে বলেছেন। যতই ‘লোক-বেদ বিরোধী’ হোক না কেন, ব্যাসের মধ্যে সেই ব্যক্তিত্ব ছিল, যাতে করে আপাত লোকাচার বিরোধী বস্তুকেও তিনি নীতিপক্ষে স্থাপন করতে পেরেছিলেন প্রয়োজন অনুযায়ী। দ্রুপদ পাঞ্চাল অবশ্য নিজ কন্যার বিভূতিময় সত্ত্ব তথা ভগবান শঙ্করের আশীর্বাদের কথা শুনেই ব্যাসের কথা মেনে নিয়ে বললেন—আপনার কথা না শুনেই—অশ্রুত্বৈবং বচনং তে মহর্ষে—আমি অনেক কথা বলেছি, কিন্তু ভগবান শঙ্কর যখন এমন বর দিয়েছেন, তাতে ধর্ম হোক, অধর্ম হোক, আমার কোনও অপরাধ থাকল না—ধর্মো’ধর্মো বা না মমাপরাধঃ।

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যেদিন বারণাবতে পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন, সেদিন থেকেই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস মনে মনে পাণ্ডবদের পক্ষে চলে গিয়েছিলেন। ইতিমধ্যে ব্যাস যেভাবে কৌরবদের শত্রুরাষ্ট্র পঞ্চালের সঙ্গে পাণ্ডবদের যোগ ঘটালেন, একই সঙ্গে বৃষ্ণি-যাদব গোষ্ঠীর প্রধান কৃষ্ণের সঙ্গেও যেভাবে পাণ্ডবদের যোগাযোগ ঘটল, তাতে এমন একটা রাজনৈতিক ‘অ্যাক্সিস’ তৈরি হল, যাতে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের রাজ্যভাগ বুঝিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। খাণ্ডবপ্রস্থের যে জায়গায় পাণ্ডবদের রাজ্য দিলেন ধৃতরাষ্ট্র সে জায়গাটা ছিল উষর, শস্যহীন জঙ্গল। কিন্তু সেই নগরেই যখন নগর প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তিঘট স্থাপন করতে চললেন পাণ্ডবরা তখন নগর স্থাপনের মঙ্গলমন্ত্র উচ্চারণ করতে দেখছি ব্যাসকেই—নগরং স্থাপয়ামাসুদ্বৈপায়ন-পুরোগমাঃ।

সেকালের দিনে যিনি যত বড় রাজাই হোন না কেন, বড় বড় মুনি, ঋষি এবং ব্রাহ্মণেরা যদি তাঁর অনুকূলে না থাকতেন, তবে বোঝা যেত—সে রাজা অন্যায় কার্যে জড়িত এবং ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধতা থাকলে তিনি জনপ্রিয়তা হারাতেন। যুধিষ্ঠির যখন খাণ্ডবপ্রস্থকে ইন্দ্রপ্রস্থে পরিণত করে ময়নির্মিত রাজধানীতে আবাস প্রতিষ্ঠা করলেন, তখন ব্রাহ্মণেরা অনেকেই চলে এলেন ইন্দ্রপ্রস্থে—তত্রাগচ্ছন্‌ দ্বিজা রাজন্ সর্ববেদবিদাং বরাঃ। শুধু ব্রাহ্মণেরাই নন, তাবড় তাবড় মুনি ঋষিরাও অনেকেই চলে এলেন যুধিষ্ঠিরের সভায়। এই স্বেচ্ছাগত ঋষিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়েন ব্যাস। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর আত্মজ হওয়া সত্ত্বেও ব্যাস তাঁর ব্রহ্মবাদী পুত্র শুকের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সভায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন—বকো দাল্‌ভ্যঃ স্থূলশিরাঃ কৃষ্ণদ্বৈপায়নঃ শুকঃ। মহাভারতের বক্তা বৈশম্পায়ন পূর্বকথা স্মরণ করে পাণ্ডবদের নাতি জনমেজয়কে সগর্বে বলেছিলেন—আমরা যাঁরা ব্যাসের শিষ্য হয়েছিলাম—আমার সহাধ্যায়ী সুমন্তু, জৈমিনি, পৈল এবং আমিও—আমরা সবাই তখন যুধিষ্ঠিরের রাজসভায় সদস্য হিসেবে ছিলাম—সুমন্তুর্জৈমিনিঃ পৈলো ব্যাসশিয্যা স্তথা বয়ম্। এই কথা থেকে বোঝা যায়—শুধু ব্যাসের কারণেই তখনকার অনেক পণ্ডিত ঋষি-ব্রাহ্মণেরা যুধিষ্ঠিরের সভায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন।

ইন্দ্রপ্রস্থের সভারম্ভের উৎসব শেষ হয়ে গেলে অনেক মুনি ঋষিই হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন, ব্যাস কিন্তু যুধিষ্ঠিরের রাজসভাতেই থেকে গেছেন। এটা বোঝা যায়। কেননা এর পরেই ভবঘুরে নারদমুনি যখন যুধিষ্ঠিরের কাছে রাজ্যশাসনের নানান প্রক্রিয়া-প্রণালীর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে শেষমেশ যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে বললেন, তখন দেখছি—যুধিষ্ঠির অন্যান্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে প্রধান তাঁর কুলপুরোহিত ধৌম্য এবং তার পরেই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের সঙ্গে আলোচনা করছেন রাজসূয়ের ইতিকর্তব্যতা নিয়ে। পরে দিগ্‌বিজয়ের শেষে যুধিষ্ঠির যখন কৃষ্ণ-বাসুদেবের কাছে আপন ঋণ স্বীকার করছেন, সেখানেও যুধিষ্ঠির এবং তাঁর ভাইদের পাশে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে আমরা দেখতে পাচ্ছি। রাজসূয় যজ্ঞে পুরোহিত ধৌম্যের সঙ্গে দ্বৈপায়ন ব্যাসই যে অতিথি-ঋত্বিক্‌ হিসাবে কাজ করেছেন, সেটা বুঝতেও সময় লাগে না—ধৌম্য-দ্বৈপায়নমুখৈঃ ঋত্বিগ্‌ভিঃ পুরুষর্ষভ। আবার রাজসুয়ের শেষে মহামতি ভীষ্মের উপদেশে যুধিষ্ঠির যখন কৃষ্ণকে সম্মান-অর্ঘ্য দান করলেন, তখনও দ্বৈপায়ন ব্যাস সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কেননা কৃষ্ণকে, অর্ঘ্যদান করায় শিশুপাল ক্ষিপ্ত হয়ে যাঁদের অর্ঘ্য লাভের যোগ্যতা প্রমাণ করার চেষ্টা করলেন, সেখানে অনেক নামের মধ্যে ব্যাসের নামও আছে। শিশুপাল কৃষ্ণের উদ্দেশে সোপহাস মন্তব্য করে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—যদি তুমি মনে কর একজন মহান ঋত্বিক্‌কে অর্ঘ্যদান করবে, তা হলেও কি কোনওভাবে কৃষ্ণের কথা ভাবা যাবে, বিশেষত যেখানে দ্বৈপায়ন ব্যাসের মতো মহান ব্যক্তিত্ব উপস্থিত রয়েছেন—দ্বৈপায়নে স্থিতে বৃদ্ধে কথং কৃষ্ণো’ৰ্চিতস্ত্বয়া। অনুমান করা যায়—এই রাজসূয়ের আসরেই নিজের চোখের সামনে কৃষ্ণের চক্রনিক্ষেপে শিশুপালের মৃত্যুও দেখেছেন ব্যাস।

শিশুপাল বোঝেননি—ব্যাসের জন্মভূমি যমুনার অন্তর্গত এক দ্বীপ এবং সেই যমুনার তটভূমিতে যিনি এককালে মধুর মুরলীর পঞ্চম খেলিয়ে দিয়েছিলেন—সেই কৃষ্ণ নামের মানুষটি তাঁর কাছে কত প্রিয়। নতুন যুগের এই নায়কের কথা তিনি সবিস্তার পূর্বেই শুনিয়েছিলেন পঞ্চাল রাজ্যের দ্রুপদ-সভায়। পাণ্ডবদের সঙ্গে তখন কৃষ্ণের দেখা হয়ে গেছে। এখন এই রাজসূয়ের আসরে নতুন নায়ক কৃষ্ণকে অভিবাদিত হতে দেখে তিনি নিশ্চয়ই পুলকিত হয়েছেন। ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ মহাভারত জুড়ে কৃষ্ণের অসামান্যতা বর্ণনা করবেন তিনি। মহাভারতের শেষে তাঁকে বলতে হবে—আমি এতক্ষণ যা বলেছি, তা বাসুদেব কৃষ্ণেরই কীর্তিকাহিনী—বাসুদেবো’ত্র কীর্ত্যতে। সেই বাসুদেব কৃষ্ণকে যখন পাণ্ডবদের পথপ্রদর্শক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা গেল, ব্যাস তখন থেকেই নিশ্চিন্ত হয়েছেন অনেকটা। আমার কাছে সবচেয়ে যেটা আশ্চর্য লাগে, সেটা হল—কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস হলেন মহাভারতের সবচেয়ে বৃদ্ধ কালো মানুষ। তিনি কৃষ্ণবর্ণা কালী সত্যবতীর ছেলে। সেই কালো মানুষটি কালোবরণ অর্জুনের সঙ্গে মিলন ঘটিয়েছেন ‘সুশ্রোণী শ্যামা’ কৃষ্ণা পাঞ্চালীর সঙ্গে এবং সেই কালো মানুষটিই মথুরার ‘নীরদঘনকান্তি’ চিকন-কালা কৃষ্ণের উত্থান দেখে নিশ্চিন্ত হলেন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে। মহাভারতে কৃষ্ণবর্ণের পূর্ণ জয়কার ঘোষণার কবি-ই হলেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস।