ব্যাস দ্বৈপায়ন – ২

॥ ২ ॥

ব্রাহ্মণ পিতা পরাশরের পূর্ণ পুত্রাভিলাষ ধীবরকন্যা সত্যবতীর গর্ভমাধ্যমে সঞ্চারিত হল এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মধ্যে, যেখানে তিনি একাকী অথচ সেখান থেকে আর সকলকে তিনি দেখতে পাচ্ছেন। জন্মলগ্নে শূদ্রা ধীবরজননীর হৃদয়-দহন ব্যাসের মনে ছিল; ব্রাহ্মণ পিতার গৌরবের সঙ্গে তাই মায়ের হৃদয় মিশে এমন এক মহামানবের সৃষ্টি হয়েছিল, যাঁর পক্ষে মহাভারতের মতো বিচিত্র গ্রন্থ লেখা সম্ভব হয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ একটি অদ্ভুত সুন্দর কথা বলেছে। বলেছে—স্ত্রী, শূদ্র এবং পতিত ব্রাহ্মণদের বেদ শ্রবণ করবারও অধিকার ছিল না, ব্যাস শুধু এঁদের প্রতি করুণা করেই মহাভারত গ্রন্থখানি লিখেছেন—ইতি ভারতমাখ্যানং কৃপয়া মুনিনা কৃতম্‌। মায়ের দৃষ্টান্তেই হোক কিংবা শূদ্রদের সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই হোক, ব্যাসের মনে যে সংকরজাত সন্তানের সহানুভূতি ছিল, সেকথা মেনে নেওয়াটাই সযৌক্তিক হবে। এ কথা ঠিক যে, সেকালের ব্রাহ্মণপ্রধান সমাজের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার তাঁকে মানতে হয়েছে এবং মাঝে মাঝেই তাঁকে ভারতকথা বিলম্বিত করতে হয়েছে সদর্থক ব্রাহ্মণ্যের জয়কারে। সেটা অন্যায়ও নয়, অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু সময় সুযোগ যখনই এসেছে, তখনই কিন্তু বার বার তাঁর মুখে শুনেছি যে, ব্রাহ্মণ পিতার ঔরসে ব্রাহ্মণীর গর্ভে জন্মালেই ব্রাহ্মণ হওয়া যায় না; প্রকৃত প্রয়োজন ব্রাহ্মণের গুণ—ত্যাগ, দয়া, ধর্ম, চরিত্র। আর এই সাংঘাতিক প্রশ্ন তিনি সেইসব বিপন্ন মুহূর্তেই তুলেছেন, যখন মানুষ সত্য বই মিথ্যা বলে না।

মহাভারতের বনপর্বে শেষ মুহূর্তটি স্মরণ করুন। ধর্মরূপী যক্ষের প্রভাবে চার পাণ্ডববীর বিষপুষ্করিণীর তীরে শুয়ে আছেন। যক্ষের কথার উত্তর না দিয়ে পুষ্করিণীর জলস্পর্শ করার ফল ভোগ করছেন। যুধিষ্ঠির এলেন সর্বশেষে। মৃত ভাইদের দেখে করুণ বিলাপ করবার পরেই তিনি যক্ষের প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন। মহামতি ব্যাস যক্ষের মুখে যেসব প্রশ্ন রেখেছেন, চিরাচরিত ক্লিশে হয়ে গেলেও যুধিষ্ঠিরের উত্তরগুলি কিন্তু একেবারেই চিরাচরিত নয়। বেশ বুঝতে পারি—সমাজের বিভিন্ন স্তরে এই প্রশ্নগুলি উঠত, ব্যাস সময়মতো সুযোগ বুঝে এক অলৌকিক সত্তা যক্ষের মাধ্যমে এই প্রশ্নগুলি রেখেছেন এবং উত্তর দেবার জন্য তিনি এমন একজনকে বেছেছেন যিনি বিপন্ন অবস্থাতেও ধর্মের নিয়ম থেকে চ্যুত হন না। যক্ষ বললেন—বংশ, চরিত্র, না বেদপাঠ, নাকি আচার্যের মুখে শোনা বেদার্থবোধ—কোনটি দিয়ে ব্রাহ্মণত্বের নির্ণয় হবে। যুধিষ্ঠির কাটা জবাব দিয়ে বললেন—বংশ নয়, কুল নয়, নিয়ত বেদপাঠ অথবা গুরুর কাছে বেদার্থের ব্যাখ্যা শুনেও ব্রাহ্মণত্ব তৈরি হয় না। ব্রাহ্মণত্বের কারণ গুণ এবং চরিত্র—কারণং হি দ্বিজত্বে চ বৃত্তমেব ন সংশয়ঃ।

যক্ষ-যুধিষ্ঠিরের যুগলবন্দিতে পরিস্ফুট হয়েছে ব্যাসের মর্মকথা। যুধিষ্ঠিরের মুখ দিয়ে তিনিই বলেছেন—চারখানা ঢাঁই ঢাঁই বেদ পড়েও যে ব্রাহ্মণ দুশ্চরিত্র, সে শূদ্রের বাড়া—চতুর্বেদো’পি দুবৃত্তঃ স শূদ্রাদ্‌ অতিরিচ্যতে। এই উত্তরে তবু ব্রাহ্মণত্বের সংজ্ঞা অস্পষ্ট থেকে যায়। কারণ, অন্যায় অধর্ম এখানে ব্রাহ্মণকে অধঃপতিত শূদ্রে পরিণত করছে, অন্যায় থেকে মুক্ত হলেই সে আবার ব্রাহ্মণত্বের গর্ব করবে। ব্যাস এই প্রশ্নটাকে তাই অত সহজে ছাড়েননি। এই প্রশ্ন তিনি আবারও তুলেছেন শান্তিপর্বে, আরও সমাহিত অবস্থায় ভূগু-ভরদ্বাজ সংবাদে। ভৃগু বললেন—বর্ণের ভিত্তিতেই যদি এমন চতুর্বর্ণের বিভাগ—ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়… এইসব বিভাগ, তা হলে তো বড়ই বিপদ। আকছার দেখছি এক বর্ণ আর এক বর্ণের মেয়ে বিয়ে করে সংকর হয়ে যাচ্ছে—সর্বেষাং খলু বর্ণানাং দৃশ্যতে বর্ণসংকরঃ। এসব ক্ষেত্রে আপনি জাতি ঠিক করবেন কী করে—কুতো বর্ণবিনিশ্চয়ঃ?

সংকরজন্মা ব্যাসের মহাভারতে এ প্রশ্ন উঠবেই। ভরদ্বাজ তো তো করে বললেন—তা ঠিক বটে। এমন করে বিশেষ বর্ণ ভেদ করা সম্ভবই নয়। কাজকর্ম, জীবিকা, বৃত্তি পালটে ব্রাহ্মণও অনেক সময় ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এমনকী শূদ্রও বনে যায়। প্রশ্নকর্তা ভৃগু এই উত্তরে তুষ্ট হননি, ভৃগুর ওরফে তুষ্ট হননি ব্যাসও। ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ্যের শূদ্রগতির কথা বলেছেন, কিন্তু সে তো জাতিব্রাহ্মণের শূদ্রসংজ্ঞা। যিনি সমগ্র ভারতের হৃদয় নিয়ে মহাভারত রচনা করছেন, সেই ব্যাস এই সংজ্ঞায় তুষ্ট হবেন কী করে? ব্রাহ্মণ যে অধঃপতিত শূদ্ৰাধম হয়ে গেলেও ব্রাহ্মণত্বের গর্ব করে।

বর্তমান লেখক একবার বাজারে কলা কিনতে গিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছিল। দোকানে কলা বেশি ছিল না। অতিনিকৃষ্ট কতগুলি বৃন্তহীন কনিষ্ঠিকা-প্রমাণ কলা দেখিয়ে দোকানদার সেগুলির চড়া দাম হেঁকে বসল। আমি বললাম—এই জঘন্য কলা! তার এত দাম? চটুল হেসে দোকানদার জবাব দিল—বাবু! এ কলা জাতে বামুন। মর্তমান কলা।

এই মুহূর্তে আমার ব্যাসের অসন্তুষ্টির কথা মনে এল। এ হল সেই পূর্বোক্ত ভরদ্বাজের কথা—চেহারা, রং, বৃত্তি সব পালটে ব্রাহ্মণ শূদ্র হয়ে গেলেও সে বলে—আমি জাতে বামুন। সংরক্ষণশীল পণ্ডিতের তুষ্টি হতে পারে এই জবাবে, কিন্তু যিনি মহান ভারতের গণহৃদয় আপন হৃদয়ে ধারণ করে শূদ্রা সত্যবতীর হৃদয়নন্দন ব্যাস হয়েছেন তিনি এই জবাবে তুষ্ট হবেন কী করে। তিনি প্রশ্নকর্তা ভৃগুর অন্তরশায়ী হয়ে প্রশ্ন করলেন—বেশ তো, ব্রাহ্মণ কী করে শূদ্র হয়ে যায়, সে তো বললেন। এবারে বলুন তা হলে ব্রাহ্মণ হওয়া যায় কেমন করে—ব্রাহ্মণঃ কেন ভবতি? ভরদ্বাজের আর উপায় রইল না, কারণ এবারে যে তিনি সমাজের মর্মজ্ঞ কবি ব্যাসের মুখোমুখি। ব্যাসই তো ভৃগুর অন্তরশায়ী হয়ে প্রশ্ন করছেন মহাকাব্যের ছত্রচ্ছায়ায় বসে। ভরদ্বাজ প্রথমে অনেকগুলি সদগুণের তালিকা দিলেন—ত্যাগ, তিতিক্ষা, সমদৃষ্টি, দয়া, সত্য, দান অদ্রোহ—যা ব্রাহ্মণের মধ্যে থাকতে হবে। তারপর বললেন—এই সত্যাদি সপ্ত গুণ যাঁর মধ্যে থাকবে, তিনিই ব্রাহ্মণ। যদি মানুষটি জাতি-জন্মে শূদ্র হন এবং তাঁর মধ্যে যদি এই গুণগুলি থাকে, অপিচ যদি মানুষটি জন্ম-জাতিতে ব্রাহ্মণ হন এবং তাঁর মধ্যে যদি এই গুণগুলি না থাকে, তা হলে শূদ্রও শূদ্র হবেন না, ব্রাহ্মণও ব্রাহ্মণ হবেন না।

ব্যাসের বুঝি শান্তি হল। আদিপর্বের সেই প্রথম দিকে মহর্ষি বৈশম্পায়নের মুখে ব্যাসের জন্মকথা শোনা গেছে। ব্যাস জানতেন—তাঁর এই প্রিয় শিষ্যটি গুরু ব্যাসের জন্মকথা বলেই গুরুবন্দনা করবে। কাজেই আদিপর্বে শূদ্রা মাতার সেই বেদনা-অভিমান সেই শান্তিপর্ব পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এসে ভরদ্বাজের মুখে পরিষ্কার কথা আদায় করে ভারত হৃদয়ের সহৃদয় কবি শান্তি পেলেন। বেশ বুঝি, সংকরজন্মের বেদনা বা অভিমান ব্যাসের মনে কোনও মিশ্রক্রিয়া তৈরি করে থাকবে। গীতায় স্বয়ং ভগবানের মুখেও তিনি জন্মগত ব্রাহ্মণ্যের জয়কার ঘোষণার কোনও সুযোগ দেননি। ভগবানকে বলতে হয়েছে—জন্ম নয়, গুণ এবং জীবিকা কর্মের ভিন্নতায় আমি চতুর্বর্ণের সৃষ্টি করেছি—চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ।

এমনকী গীতার আরম্ভে তাঁর হাঁটুর বয়সি অর্জুন যে সর্বনাশা বর্ণসংকরের বিপদ উল্লেখ করে দুনিয়ার দুষ্টু মেয়েদের দায়ী করেছিলেন—স্ত্রীষু দৃষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসংকরঃ—সেদিন ব্যাসের নিশ্চয় মায়ের কথা মনে পড়েছিল। পাণ্ডবদের স্নেহময় ঠাকুরদাদাটি সেদিন মহান এবং ভারী মহাভারতের আড়াল থেকে মুচকি হেসেছিলেন। ভেবেছিলেন—দুষ্টুমি তো শুধু তাঁর মা-ই করেননি পিতা পরাশরও করেছিলেন। এরপর কৃষ্ণ যখন পার্থসারথির ভূমিকায় দাঁড়িয়ে চতুর্বর্ণের বিচারে জন্মের কথা উল্লেখই করলেন না, সেদিন ব্যাস মনে মনে হাততালি দিয়ে বলেছেন—কেমন পাকা ছেলে, হল তো এবার। দুষ্টুমির কথা যদি বলি, তো তোর মা-ঠাকুমা—কুন্তী, অম্বালিকা—এঁরা কোথায় যাবেন! এরপর শান্তিপর্বে এসে কৌরব-পাণ্ডবের আর-এক পিতামহ ভীষ্মের মুখে ভৃগু-ভরদ্বাজের সংবাদ শুনিয়ে সেই বর্ণসংকরের প্রশ্নই তুলেছেন আরও সোজাসুজি এবং চরম সমাধান দিয়েছেন ভরদ্বাজের মুখে। নিশ্চয়ই আহ্লাদিত হয়েছেন ব্যাস—তাঁর আপন সংস্কৃত (নাকি সংকৃত!) রক্ত পাণ্ডব-কৌরবের রাজরক্তের সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পেরেছেন বলে।

কষায়-স্বভাব পণ্ডিতজন তবু সমালোচনা করে বলবেন—মহাভারতে জাতিমাত্রেই ব্রাহ্মণের মাহাত্ম-ঘোষণাও যথেষ্ট আছে, তার কী? আমরা বলি—আছে নিশ্চয় আছে। কিন্তু আপনারা মহাভারত খুঁজে খুঁজে সেইগুলিই বার করে দাখিল করবেন, আর এগুলি বাদ দিয়ে বলবেন—এগুলি ঠিক, এগুলি প্রক্ষিপ্ত, তা হলে মানব না। এঁরা আবার দিব্যচক্ষে মহাভারতের স্তরবিন্যাস করেন—‘স্টাইলে’র নিরিখে, সমাজ পরিবর্তনের নিরিখে। আমরা বলি—একই সমাজে দুইরকম ভাবনাই থাকতে পারে। সংরক্ষণশীল এবং প্রগতিশীল, দুইই থাকতে পারে একই সমাজে। মহাকাব্য সেই সমাজেরই চিত্রণ করে যার মধ্যে সব আছে—এত আছে, অত আছে।

পুরাণ-ইতিহাসকে যাঁরা ব্রাহ্মণ্য অত্যাচারের দলিল বলে মনে করেন, তাঁদের বলি—অমন একচক্ষু হরিণের মতো একদিকে মুখ গুঁজে গবেষণা করবেন না, সবটা দেখুন। আমি বিশ্বাস করি—স্ত্রী-শূদ্রজনের প্রতি ব্যাসের হৃদয়ে অদ্ভুত এক মমতা ছিল। তার প্রমাণও আছে বহু জায়গায়—মহাভারতে তো আছেই, পুরাণগুলিতেও সেকথা বহুবার উচ্চারিত। বিষ্ণুপুরাণে দেখি—দেখি একসময়ে মুনি ঋষিদের মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়েছিল। তাঁদের তর্ক ছিল—কোন সময়ে ঈশ্বরীয় ধর্মের স্বল্পমাত্র অনুষ্ঠানেও ফল বেশি হয়। মীমাংসু ঋষিরা যখন এই প্রশ্ন নিয়ে মহামতি ব্যাসের কাছে উপস্থিত হলেন, তখন তিনি গঙ্গায় স্নান করতে নেমেছেন। মুনিরা যতক্ষণে জাহ্নবীর তীরে এসে পৌঁছোলেন ব্যাস ততক্ষণ অর্ধেক জলে। মুনিরা প্রশ্ন করার আগেই ব্যাস জলে ডুব দিলেন। এক ডুব দেবার পরেই ব্যাস বলে উঠলেন—কলিকালই দেখছি ভাল, কলিই ভাল। তীরে অপেক্ষমাণ মুনিরা অবাক হলেন ব্যাসের কথা শুনে। ব্যাস ততক্ষণে দ্বিতীয়বার ডুব দিয়ে উঠে বললেন—শূদ্ররাই দেখছি ভাল, শূদ্রই ভাল। মুনিদের আরও অবাক হবার ছিল। ব্যাস তৃতীয়বার গঙ্গায় ডুব দিয়ে বললেন—স্বীলোকই দেখছি ভাল, স্ত্রীলোকই ভাল—সত্যিই তো স্ত্রীলোকের চেয়ে ভাল আর কে আছে—যোষিতঃ সাধুধন্যাস্তা-স্তাভ্যো ধন্যতরো’স্তি কঃ?

ব্যাস স্নান সেরে উঠতেই মুনিরা তাঁকে ঘিরে ধরে তাঁর অভিনব এবং অশ্রুতপূর্ব বাণীগুলি ব্যাখ্যা করতে বললেন। কেননা, তাঁদের সমকালের ব্রাহ্মণ্য-বিস্তৃত সমাজে এসব কথা তাঁদের কাছে নতুন লাগছে। ব্যাস বললেন—হাজারো ধ্যানযোগ করে সত্যযুগে যা হয় না, নানারকম যজ্ঞ করে ত্রেতাযুগে যা হয় না, বহুতর অর্চনা-বন্দনায় দ্বাপরে যে পুণ্য মেলে না, কলিযুগে শুধুমাত্র ভগবানের নাম করলেই তা পাওয়া যায়। তাই বলেছি—কলিই সাধু। এই একইভাবে শূদ্র এবং স্ত্রীলোকরাও কেন ভাল, সে কথাও ব্যাস ব্যাখ্যা করেছেন, যদিও তাঁর স্ত্রী-শূদ্রের গুরুত্বব্যাখ্যায় চিরাচরিত ব্রাহ্মণ্য আদর্শের ছাপ পড়েছে, তবুও স্ত্রী-শূদ্রের অধিক মান্যতা ব্যাখ্যা করা—তা যেভাবেই হোক—ব্যাস ছাড়া অন্য কারও পক্ষে বলাই সম্ভব হত না হয়তো। ব্যাস বলছিলেন—ব্রাহ্মণেরা শত ব্রহ্মচর্য আর যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান করে যা পায় না, শূদ্ররা শুধু তিন বর্ণের সেবা করেই সেই উত্তম গতি লাভ করেন, ঠিক যেমনটি স্ত্রীলোকেরা সেই উত্তম গতি লাভ করে শুধু স্বামীর সেবা করেই।

জানি, সমাজ সংস্কারকেরা এই কথার কী মানে করেছেন। তারা বলেছেন—এ হল সেই ধান্ধা, যাতে করে শূদ্ৰজনকে খানিকটা তোল্লাই দিয়ে উচ্চবর্ণের সেবায় আরও ভাল করে নিযুক্ত করা যায় এবং স্ত্রীলোককেও স্বামীর দাসীতে পরিণত করা যায়। মানি, একথা মানি যে, সমাজ সংস্কারকের এই অভিযোগ মিথ্যা নয়। কেননা সেকালের সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাসের কথায় স্ত্রী-শূদ্রের আপন মর্যাদা কিছু প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কেননা ব্যাসও তাঁর সমকালীন সমাজের বাইরে নন এবং চিরন্তন ‘অর্ডার’কে তিনি এক ফুৎকারে উড়িয়েও দেন না। কিন্তু তাঁর কথাটা যদি কলিধর্ম হরিনামের মাহাত্ম্য অনুযায়ী বিচার করেন তা হলে দেখবেন—এই সেই উদার ধর্মের প্রচার আরম্ভ হয়েছে, যেখানে হরিনাম-উচ্চারণের সহজ উপায়ে স্ত্রী-শূদ্রের সামাজিক বিড়ম্বনা কমতে আরম্ভ করেছে—মহাভারতের অন্তর্গত গীতার মধ্যে এই কথার প্রতিধ্বনি শুনছি—ভগবান নামে চিহ্নিত সেই পুরুষোত্তমের মুখে—আমাকে একান্তভাবে আশ্রয় করলে স্ত্রী, শূদ্র, বৈশ্য সকলেই পরমা গতি লাভ করে—স্ত্রিয়ো বৈশ্যাস্তথা শূদ্ৰাস্তে’পি যান্তি পরাং গতিম্।

আরও একটা কথা লক্ষ করতে হবে পূর্বোক্ত বিষ্ণুপুরাণের প্রসঙ্গে। দেখা যাচ্ছে—স্ত্রী-শূদ্রের কথা বলতে গিয়ে ব্যাস তথাকথিত আচারমার্গীদের ত্রুটির উল্লেখ করছেন। এই উল্লেখ এমনই, যাতে মনে হবে—ব্রাহ্মণ্য আচারের আয়াস এবং পরিশ্রম ব্যাসকে যেন ক্লান্ত করে তুলেছিল। সমস্ত ব্যাপারেই শাস্ত্রীয় বাধ্যবাধকতা তাঁকে যেন বিরক্ত ক্লিষ্ট করে তুলছে কোথায়। তিনি বলেছেন—ব্রাহ্মণকে বড় কষ্টে এবং বড় পরাধীনতার মধ্যে দিয়ে নিজের পারলৌকিক গতি লাভ করতে হয়—পারতন্ত্রং সমস্তেষু… ক্লেশেন মহতা দ্বিজাঃ। ব্যাসের বক্তব্য ব্যাখ্যা করতে গেলে আরও অনেক কথা বলতে হয় পুরাণগুলি থেকে এবং সেই পরম্পরার শেষে এসে পাবেন শ্রীচৈতন্যকে—যিনি কালধর্ম হরিনাম এবং স্ত্রী-শূদ্রের সেতুবন্ধন করেছিলেন ব্যাসের ধারণামতো। আমাদের বক্তব্য—বিষ্ণুপুরাণের কাল থেকে চৈতন্য মহাপ্রভুর কালভেদ হাজার-বারোশো বছরেরও বেশি। যে বক্তব্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হাজার-বারোশো বছর কেটে গেছে, সেই বক্তব্য ব্যাস প্রকাশ করেছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনভাবে প্রায় বৈপ্লবিক রীতিতে। আমি বিশ্বাস করি—সেকালের সমাজে জাহ্নবীর বুকে দাঁড়িয়ে সমবেত মুনি-মহাজনের সামনে কলি, শূদ্র এবং স্ত্রীলোকের জয়ঘোষ রচনা করার জন্য যে বুকের পাটা দরকার, সেই বুকের পাটা তাঁর তৈরি হয়েছিল সংকর-জন্মের বিড়ম্বনায়। সেই জন্মঋণ তিনি শোধ করে গেছেন উদার এবং স্বাধীন মত প্রতিষ্ঠা করে।

আর্য পুরুষদের যেসব বহিরঙ্গীয় ব্যাপারে গর্ব ছিল—ফরসা গায়ের রং, টিকোলো নাক, শুদ্ধ বংশধারা—ইত্যাদি সবকিছুর মুখে তিলাঞ্জলি দিয়ে ভারতবর্ষের মাটিতে জন্মালেন কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস। তাঁর নাসিকার সংস্থান সূচ্যগ্র ছিল কিনা, সে খবর আমরা সঠিক কোথাও পাইনি, কিন্তু এটা খুব ভালভাবে জানি যে, তিনি দেখতে বেজায় কালো ছিলেন এবং তাঁর জন্মের মধ্যেও যে তথাকথিত আর্যজনোচিত বিশুদ্ধতা ছিল না, সেকথা যেমন মহাভারত থেকে প্রমাণিত হয়, তেমনই প্রমাণিত হয় পরবর্তী পৌরাণিকদের সংশয়াকুল মন্তব্যে। পুরাণগুলির এখানে ওখানে দেখবেন যে, ব্যাসের জন্মবিবরণ বর্ণনা করার পরেই পুরাণবক্তা কথকঠাকুর শংকিত হচ্ছেন—এই বুঝি সাধারণ মানুষ ব্যাসকে খারাপ ভাবে, অথবা তাঁর পিতা-মাতার আচরণে লজ্জিত হয়। দেবী ভাগবতের পৌরাণিক তো শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন—এই আমি ভগবান ব্যাসের জন্মকথা বললাম। কিন্তু দেখো বাপু! তাঁর জন্মের বিষয়ে কোনও সন্দেহ রেখো না মনে। বড় মানুষ আর মুনিদের চরিত্রের মধ্যে গুণটুকুই গ্রহণ কোরো, দোষটুকু নয়—মহতাং চরিতে চৈব গুণা গ্রাহ্যা মুনেরিতি।

পৌরাণিকের এই শংকাসংকুল মন্তব্য থেকে বুঝতে পারি যে, সাধারণ্যে ব্যাসের জন্মকথা যদি সম্ভ্রম না জাগায়, তার জন্য তাঁরা আগে থেকেই সাফাই গাইছেন এবং ভবিষ্যতে ব্যাসের মহত্ব এবং বিশালত্বের কথা মনে রেখে তাঁরা অলৌকিকতার আশ্রয় নিয়ে বলছেন—যে, ব্যাসের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি হবে বলেই হয়তো কোনও অলৌকিক কারণে সত্যবতীর জন্ম হয়েছিল জেলের ঘরে, আর তেমন কারণ না থাকলে মহামুনি পরাশরই বা কেন মুহূর্তের জন্য কামাকুল হয়ে উঠলেন—অন্যথা তু মুনেশ্চিত্তং কথং কামাকুলং ভবেৎ। সেই অলৌকিক কারণ কী? না, সকলের চমৎকার সৃষ্টি করে বিশালবুদ্ধি ব্যাস জন্মাবেন বলেই পরাশর-সত্যবতীর অমন আশ্চর্য নিয়মবহির্ভূত মিলন—সকারণেয়ম্যুৎপত্তিঃ কথিতাশ্চৰ্য্যকারিণী।

দেবীভাগবত পুরাণের কথকঠাকুর যদি আজকের দিনের মানুষ হতেন, তা হলে ব্যাসের এই জীবন-বীজ বর্ণনায় তাঁকে এত দ্বিধাগ্রস্ত হতে হত না। তিনি বুঝতেন যে, মহাভারতের মতো মহাকাব্যের সৃষ্টি করতে যিনি পারেন, তাঁকে জন্ম থেকেই সমাজের প্রচলিত এবং অভ্যস্ত চলমানতার বাইরে দিয়ে চলতে হয়। তাঁর জন্মই শুধু নয়, সংক্ষেপে তাঁর জীবন যদি কোনওভাবে পুনর্গঠন করতে পারি, তা হলে দেখবেন ব্যাস কখনওই সাধারণ চলতি পথের পথিক নন। তাঁকে যদি বিরাট এক ঋষি হিসেবে দেখেন, তা হলে দেখবেন—তিনি প্রচলিত ঋষির চেয়েও বড়—অনেক বড় এক মানুষ। তাঁকে যদি ভগবানের ঐশ্বর্যময়তায় দেখেন, তা হলে দেখবেন—তিনি ভগবানের চেয়েও বড় ঐশ্বর্যশালী এক মানুষ। তাঁকে যদি কবির দৃষ্টিতে দেখেন, তা হলে দেখবেন—তিনি কবির চেয়েও বড় এক মানুষ কবি। অর্থাৎ যতখানি তিনি কবি, তার চেয়েও অনেক বড় এক মানুষ।

আসলে মানুষ, একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হওয়াই সবচেয়ে কঠিন কাজ। শম-দমাদি সাধন আর মুমুক্ষুত্বের জোরে একজন যদি ঋষিপদবাচ্য হয়ে ওঠেন, তবে তাঁর মধ্যেও ঋষিত্ব বিরাগিত্বের অহং জন্মাতে পারে, ক্ষত্রিয় বীরপুরুষের তো অহঙ্কার স্বাভাবিক, এমনকী দাসত্বেরও অভিমান আছে, কিন্তু ঋষি কবি যাকে বলেছিলেন—সবার রঙে রং মেশাতে হবে—তেমন একজন মানুষ পাওয়া বড় কঠিন। ব্যাস তাঁর মহাভারতের মধ্যে হংসগীতা নামে অসাধারণ একটি কথোপকথন সংকলিত করেছেন। এমন হতে পারে—এই সংকলনটুকু তাঁর নিজের লেখা নয়, কিন্তু প্রাচীন এই সংবাদটুকু তাঁর এতই পছন্দ ছিল, যে তা তিনি মহামতি ভীষ্মের মুখে বসিয়ে দিয়েছেন—শান্তিপর্বে যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দেবার সময়। যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে জিজ্ঞাসা করে বলেছিলেন—বিদ্বান-সজ্জনেরা সত্য, দম, ক্ষমা, প্রজ্ঞা—এসবের খুব প্রশংসা করেন, তা এ সম্বন্ধে আপনার কী মত? ভীষ্ম নিজে এর সোজাসুজি জবাব দেননি। এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি ব্যাস সংকলিত একটি অসাধারণ কথোপকথনের উল্লেখ করে প্রজাপতিরূপী হংসের উপদেশের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—দেখো! আমাকে অভিশাপ দিলেই আমি উলটে অভিশাপ দিই না। কাম-ক্রোধ-লোভ দমন করার যে ক্ষমতা, তাই হল অমৃতলাভের দ্বারস্বরূপ। আর সবচেয়ে গূঢ়-গোপন, সবচেয়ে বড় কথাটা কী জান—এ জগতে মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠতর কিছু নেই—গুহ্যং ব্রহ্ম তদিদং বো ব্রবীমি/ ন মানুষাচ্ছ্রেষ্ঠতরং হি কিঞ্চিৎ।

ব্রাহ্মণ্য-চর্চার সবচেয়ে উর্বর সময় এবং পরিবেশের মধ্যে দাঁড়িয়ে যিনি মানুষ, জাতি-বর্ণ-বিশেষহীন মানুষের শ্রেষ্ঠত্ববাচক এই শব্দগুলি মন্ত্রের মতো উচ্চারণ করতে পারেন, সেই কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মধ্যে ঋষিত্ব, কবিত্ব, দেবত্বের চেয়েও মানুষের সত্তাটুকু বেশি আছে। তাঁর ঋষিত্ব তাঁকে এই পৃথিবীর মানুষকে বুঝবার গভীরতা এবং দার্শনিকতা দিয়েছে। তাঁর দেবত্ব তাঁকে মানুষের চিরন্তন কাম-ক্রোধ-লোভাক্রান্ত হৃদয়কে ক্ষমা করতে শিখিয়েছে। আর তাঁর কবিত্ব তাঁকে কবিজনোচিত বেদনা এবং সমান-হৃদয়তায় মানুষের বিচিত্র কর্মাবলি নির্বিন্নভাবে দেখতে শিখিয়েছে। কারণ মানুষ হয়ে ওঠার মধ্যে যে ব্যথা, যন্ত্রণা এবং অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্য থাকে, জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত সেই ব্যথা, যন্ত্রণা এবং মানুষের বিষম-বৃত্তি দেখে দেখেই তাঁর কবির অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ হয়েছে। সেই জন্যই অন্য পাঁচটা শাস্ত্রগ্রন্থের মতো মহাভারতকে তিনি সম্পূর্ণ মোক্ষশাস্ত্র বানিয়ে তুলতে পারেননি। মহাভারতকে তিনি ভারতবর্ষের ইতিহাস তৈরি করে ফেলেছেন, বলতে চেয়েছেন—দেখো বাপু! ভারতবর্ষের মানুষ এইরকম ছিল—ইতি হ আস—তোমরা কি অন্যরকম কিছু! আর এই মহাভারতের ইতিহাস তাঁর পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছে এই কারণেই, যেহেতু এই ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নিজের জীবনের যোগ আছে। যোগ আছে প্রতিকর্ম প্রতিমর্মের সঙ্গে।