ধৃতরাষ্ট্র – ৯

॥ ৯ ॥

রাজসভায় প্রবেশ করলেন ধৃতরাষ্ট্র। তাঁর পিছন পিছন অন্যান্য রাজারা এবং অবশ্যই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর, যাঁরা ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে এলেন—নাতিপ্রীতেন মনসা—অর্থাৎ অপছন্দ হলেও নিয়মরক্ষা করতে এলেন। খেলা আরম্ভ হল। পণ রাখা আরম্ভ হল। যুধিষ্ঠির একের পর এক বাজি হারতে আরম্ভ করলেন। ধন রত্ন সম্পত্তি অনেক জিতে নিলেন শকুনি। ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চয়ই যথেষ্ট আনন্দ পাচ্ছিলেন। মহাভারতের কবি স্পষ্ট করে ধৃতরাষ্ট্রের কথা এখন বলেননি, কিন্তু দ্যূতসভার প্রক্রিয়ায় একের পর এক জয়ের খবর যখন আসছে, তখন তাঁর অন্তরাত্মা তাঁর প্রিয় পুত্রের অন্তরাত্মার সঙ্গে একাত্মতা লাভ করেছে। তিনি মুখে কিছু প্রকাশ করেননি বটে এবং আকার-ইঙ্গিতে প্রকাশ না করে তিনি যে বেশ ভালই অভিনয় করতে পারেন, সেটা আমরা আগেই টের পেয়েছি। কিন্তু অন্তরের এই অস্থির আনন্দের পরিমাণ কতটা, সেটা বোঝা যাবে তাঁর পরবর্তী আচরণে।

শকুনির জয়ের নেশা এবং যুধিষ্ঠিরের হারার নেশা দেখে প্রমাদ গুণলেন মহামতি বিদুর। তিনি নানা উদাহরণ দেখিয়ে পাশাখেলা বন্ধ করতে বললেন ধৃতরাষ্ট্রকে। এই পাশাখেলাই যে শেষ পর্যন্ত এক ভয়ংকর যুদ্ধে পরিণত হবে, সে সম্বন্ধেও তিনি দুই অধ্যায় জুড়ে সাবধানবাণী উচ্চারণ করলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য! যে ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের প্রজ্ঞা এবং ভবিষ্যদ-বুদ্ধির উদাহরণ দিয়ে দুর্যোধনকে পাপকর্ম থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছিলেন, সেই বিদুরের সাবধানবাণীতে ধৃতরাষ্ট্র কর্ণপাতও করলেন না। তাঁর কথার উত্তরও দিলেন না। উলটে বিদুরের সমস্ত সম্মান নস্যাৎ করে দিয়ে দুর্যোধন এমন ভাষায় বিদুরকে গালাগালি দিলেন, যার প্রতিবাদ করা উচিত ছিল ধৃতরাষ্ট্রের।

দুর্যোধন বিদুরকে কুরুবাড়ির অন্নধ্বংসী এক পরজীবী মার্জার বলে চিহ্নিত করলেন এবং দুর্যোধনের ওপর সর্দারি না করার পরামর্শ দিয়ে তাঁকে নিজের সম্মান নিজে রাখতে বললেন—যশো রক্ষস্ব বিদুর সম্প্রনীতং মা ব্যাপৃতঃ পরকার্যেষু ভূস্ত্বম্। দুর্যোধন বিদুরকে উপহাস করতে করতে একসময় বাড়ি ছেড়ে চলেও যেতে বলেছেন—স যত্রেচ্ছসি বিদুর তত্র গচ্ছ—কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তাঁর প্রিয় পুত্রকে বাধা দেননি। বিদুর এরপরেও ধৃতরাষ্ট্রকে তাঁর প্রিয় পুত্রের দোষ স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র একটি কথারও উত্তর দেননি। বিদুরকে তিনি ভদ্রতাবশেও শান্ত করার চেষ্টা করেননি, অন্যদিকে দুর্যোধনকেও তিনি শাসন করেননি। ভাবে বুঝি—শকুনির ওই বঞ্চনা এবং দুর্যোধনের ওই পৈশাচিক উল্লাস তাঁর ভাল লাগছিল।

খেলা আবারও আরম্ভ হল। শকুনি যুধিষ্ঠিরের সমস্ত ভাইদের একে একে জিতে নিলেন। যুধিষ্ঠির নিজেকেও পণ রেখে হেরে যাবার পর দ্রৌপদীর পালা এল। দ্রৌপদীকে বাজি ধরার কথা যুধিষ্ঠিরের মনে ছিল না। কিন্তু শকুনি কথার চালে শেষপর্যন্ত যুধিষ্ঠিরকে পথে নিয়ে আসেন। যুধিষ্ঠির বাজি ধরলেন দ্রৌপদীকে। সমস্ত রাজসভা হায় হায় করে উঠল ধিক্কারে। এ ধিক্কার যুধিষ্ঠিরের প্রতি, নাকি কুরুরাজ দুর্যোধনের প্রতি তা ভাল করে বোঝা না গেলেও কুলবধূর এই অপমানে ধৃতরাষ্ট্রের সভার বৃদ্ধজনেরা যখন হায় হায় করে উঠলেন, ভীষ্ম দ্রোণ কৃপাচার্যের কপালে যখন ঘাম জমে উঠেছে উত্তেজনায়, বিদুর যখন অসহ্য বেদনায় কপাল টিপে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, তখন ধৃতরাষ্ট্র আর তাঁর আকার ইঙ্গিত চেপে রাখতে পারলেন না। সমস্ত অভিনয়-দক্ষতায় জলাঞ্জলি দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন—জিতেছে কি, আমার পুত্র কি দ্রৌপদীকে জিতেছে—কিং জিতং কিং জিতমিতি হ্যাকারং নাভ্যরক্ষত। সভার মাঝখানে কর্ণ-দুর্যোধনেরা সাট্টহাসে চিৎকার করছেন এবং সেই হাসির রোল স্তব্ধ হবার আগেই শকুনি বললেন—জিতেছি।

এবার সেই চরম অপমানের দৃশ্য। বিদুর দুর্যোধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন বলেই দ্রৌপদীকে বাজি জেতার পর দুর্যোধন প্রথম তাঁকে অপমান, উপহাস করে বললেন—এই যে মশাই বিদুর! যাও এবার দ্রৌপদীকে এখানে নিয়ে এসো। আমাদের বাড়িঘর পরিষ্কার করুক। আমাদের ঝিদের সঙ্গে পরিচয় করে নিক। বিদুর দুর্যোধনকে ছেড়ে দেননি। কড়া ভাষায় তিনি দুর্যোধনের নিন্দা করেছেন এবং প্রত্যেক জায়গায়, যেখানে দুর্যোধনকে সম্বোধন করতে হয়েছে অথবা নিন্দাবাক্য রচনা করার সময় বিদুরের মুখে যখন দুর্যোধনই কর্তৃকারকে প্রথমা বিভক্তি, সেইসব সময়ে বিদুর ইচ্ছাকৃতভাবে দুর্যোধনের নামও উচ্চারণ করেননি। দুর্যোধনের অপব্যবহার স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর মাধ্যমে অন্য কজনকে উদ্দেশ করার জন্য বিদুর এই মুহূর্তে অত্যন্ত সচেতনভাবে দুর্যোধনের বদলে ‘ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র’ শব্দটি ব্যবহার করতে লাগলেন। হয়তো ভাবলেন—স্থূলচর্ম দুর্যোধনের তো কিছুই গায়ে লাগে না, অন্তত এতে যদি ধৃতরাষ্ট্রের কিছু বোধোদয় হয়। বিদুর যখন বারে বারে বলছেন—মূঢ়ো রাজা ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রঃ—তখন ওই মূঢ়তা প্রধানত ধৃতরাষ্ট্রকে উদ্দেশ করেই বলা, আর রাজা শব্দটা এমনভাবেই প্রয়োগ করা হয়েছে, যাতে সেটা দুর্যোধনের বিশেষণ না হয়ে সোজাসুজি ধৃতরাষ্ট্রকেই বোঝাতে পারে।

কিন্তু অভিধা-ব্যঞ্জনায় যতকিছুই বোঝানো যোক ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চুপে দুর্যোধনের বিকট সরসতাগুলি উপভোগ করতে লাগলেন। দুর্যোধন বিদুরকে গালাগালি দিলেন, ধৃতরাষ্ট্র কিছু বললেন না। সারথিজাতীয় এক প্রতিকামী রাজকুলবধূ দ্রৌপদীকে ভিতর বাড়ি থেকে আনতে গেল, ধৃতরাষ্ট্র কিছু বললেন না। দুঃশাসন দ্রৌপদীকে চুলের মুঠি ধরে উন্মুক্ত রাজসভায় নিয়ে এলেন, ধৃতরাষ্ট্র টুঁ-শব্দটি করলেন না। সভায় সকলের মধ্যে দ্রৌপদীকে নিয়ে হাসাহাসি আরম্ভ হল, দ্রৌপদী কুরুবৃদ্ধদের কাছে ন্যায়বিচার চেয়ে কত কাঁদলেন, ধৃতরাষ্ট্রের হৃদয় এতটুকু বিগলিত হল না। তাঁর নিজের ছেলে বিকর্ণ পর্যন্ত দ্রৌপদীর পক্ষ হয়ে কথা বললেন, ধৃতরাষ্ট্র তাঁকেও কোনও সমর্থনের আভাস দিলেন না এবং কর্ণ যখন বিকর্ণকে থামিয়ে দিলেন তাতেও ধৃতরাষ্ট্রের কিছু হল না।

হবেই বা কী করে, কুলবধূ দ্রৌপদীর গায়ের কাপড় খুলে নিচ্ছিল তাঁরই ছেলে, সেই বস্ত্ৰ উন্মোচনের সময়েও একজন বৃদ্ধ রাজা যখন তাঁর নিস্তব্ধ অন্ধত্বের আড়াল থেকে চুপ করে বসে সব দেখছিলেন, সেই ধৃতরাষ্ট্র কথা বলবেন কী, প্রতিবাদ করবেন কী, বারণ করবেন কী, পুত্রদের সঙ্গে তিনি মনশ্চক্ষে এই দৃশ্য উপভোগ না করলে সভার নিয়ন্তা রাজার পক্ষে চুপ করে বসে থাকা কোনওভাবেই সম্ভব ছিল না। দুর্যোধনের লোভ, ক্রোধ সবটাই প্রকট, তার মানেও বোঝা যায়, কিন্তু অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের লোভ, মোহ, বাসনা প্রত্যক্ষত বোঝা যায় না। তিনি কোনও কথা না বলে, দুর্যোধনকে কোনও বাধা না দিয়ে নিজের রুচিবিকার উপভোগ করে যাচ্ছেন।

ধৃতরাষ্ট্রের টনক নড়ল যখন ভীম দুঃশাসনের রক্ত পান করার প্রতিজ্ঞা করলেন এবং দুর্যোধনের উরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করলেন। সভায় নানারকম উৎপাত দেখা দিল, শৃগাল ডাকল, শকুন উড়ে গেল—এতসব দেখে গান্ধারী-বিদুর আর্ত চিৎকার করে উঠলেন এবং সেই জন্যই যে এবার ধৃতরাষ্ট্র ক্ষমাসুন্দর অন্ধচোখে দ্রৌপদীকে বরদানে প্রবৃত্ত হলেন, তা মোটেই নয়। আমরা তা মনে করি না। আমরা পরিষ্কার মনে করি—ধৃতরাষ্ট্র আপাতত ন্যায়পথে ফিরে এলেন ভীমের কারণে, তাঁর মরণান্তক ভয়ংকর প্রতিজ্ঞার কারণে। আসলে এই ভীমকেই তিনি যা একটু ভয় পেতেন। ভবিষ্যতে যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হবে, তার আগে তিনি এই ভয় প্রকট করে বলেছেন—ভীমের দিক থেকেই আমার যত ভয়। হরিণ যেমন ক্রুদ্ধ বাঘকে ভয় পায় আমিও তেমনই ক্রুদ্ধ ভীমকে ভয় পাই—ভীমসেনাদ্ধি মে ভুয়ো ভয়ং সংজায়তে মহৎ।

কাজেই শেয়াল-শকুনের অলক্ষণ দেখে নয়, আপন দুই পুত্রের জঘন্য আচরণ এবং তারই পৃষ্ঠে ভীমের ভয়ংকর প্রতিজ্ঞায় ভীত হয়েই ধৃতরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীকে বর-দানে প্রবৃত্ত হলেন। দ্রৌপদী প্রথম বরে তাঁর জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্ঠিরকে দাসত্ব থেকে মুক্ত করে নেন এবং দ্বিতীয় বরে ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেবকে। ধৃতরাষ্ট্র দ্রৌপদীর ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে তৃতীয় বরও দিতে চেয়েছেন এবং বর দেবার সময় তাঁর দিক থেকে স্তোকবাক্যেরও কোনও অন্ত ছিল না। হয়তো এই স্তোকবাক্যও ভীম-অর্জুনের ভয়েই। কেননা, দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে আসার পূর্বাহ্নে যাঁর কোনও লজ্জা বা অপমানবোধ কাজ করেনি, তাঁকে আপন পুত্রের হাতে হৃতবস্ত্রা হতে দেখার পর খুব তাঁকে সতীলক্ষ্মী মনে হচ্ছে, সকল পুত্রবধূদের মধ্যে তাঁকে শ্রেষ্ঠতমা মনে হচ্ছে—বধূনাং হি বিশিষ্টা মে ত্বং ধর্মপরমা সতী—ধৃতরাষ্ট্রের এই ব্যবহার যুক্তিযুক্ত নয় বলেই আরও মনে হয়—তিনি স্তোকবাক্য দিচ্ছেন।

তবে ধৃতরাষ্ট্র যখন দ্রৌপদীকে তৃতীয় বর দেবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন, তখন সেই বরদান প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদী এমন একটি কথা বলেছেন, যা সেই মুহূর্তে তাঁর নিজের সম্বন্ধে প্রযোজ্য তো বটেই, তেমনই ধৃতরাষ্ট্রকে শুনিয়ে দেবার পক্ষে সেটা ছিল যথেষ্ট। দ্রৌপদী বলেছিলেন—আপনি দুটি বর দিয়েছেন, ওই যথেষ্ট। লোভ মানুষের ধর্ম নষ্ট করে—লোভে ধর্মস্য নাশায়—আমার তৃতীয় বরের কোনও প্রয়োজন নেই। ধৃতরাষ্ট্র যে লোভের বশেই তাঁর ধর্ম নষ্ট করেছেন—এই উপদেশটা ধৃতরাষ্ট্রকে সব্যঙ্গে শুনতে হল পুত্রবধূর মুখে, কিন্তু তবু তাঁর চেতনা হয়নি। পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থে আর ফিরে যেতে পারেননি। রাস্তা থেকেই তাঁদের আবারও ফিরতে হল, আবারও দ্যূতক্রীড়ার জন্য।

অথচ প্রথমবার দ্যূতক্রীড়ার পর যুধিষ্ঠিরকে কত বড় বড় কথা, কত প্রলেপবাক্য দিয়ে ভুলিয়ে ছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। তোমার মতো ধর্মপরায়ণ মানুষ হয় না। দুর্যোধনের অসৌজন্যের কথা মনে রেখে না। এই বৃদ্ধ পিতার কথা মনে রেখে—এইরকম ইনিয়েবিনিয়ে কত কথাই না যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র। কিন্তু দুর্যোধনের স্বার্থ উপস্থিত হলে ধৃতরাষ্ট্র যে সমস্ত কিছু ভুলে যান, ধর্ম, সৌজন্য, এমনকী চোখের লজ্জাটুকুও যে তাঁর নষ্ট হয়ে গেছে, সেটা বোঝা যায় তাঁর পরবর্তী ব্যবহারে।

পাণ্ডবরা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্যোধন এসে ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়েছেন—এটা কী করলেন মহারাজ! আমরা পাণ্ডবদের অপমান করে ক্রুদ্ধ করে ফেলেছি। বিশেষত দ্রৌপদীর অপমান তারা জীবনে ভুলবে না। এখন তাঁদের ছেড়ে দিলে তাঁদের ক্রোধবহ্নিতেই প্রজ্জলিত হব আমরা। কাঁধে বিষাক্ত সাপ নিয়ে ঘোরাঘুরি করাও যা, পাণ্ডবদের ছেড়ে দেওয়াও তাই। পাশের রাজ্যে বসেই তাঁরা আমাদের ওপর ক্রোধে ফুঁসতে থাকবেন। আমরা তাই ভাবছি—আবার পাশা খেলব। এবার শর্তও একটা। বারো বছরের বনবাস আর এক বছরের অজ্ঞাতবাস।

ধৃতরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে রাজী হলেন। তাঁকে বোঝাতেও হল না বেশি। পাণ্ডবদের কাছ থেকে ভয়ের কথা দুর্যোধনের মুখে উচ্চারিত হতেই তাঁর নিজের ভয় প্রকট হয়ে উঠল—এই যুক্তিটা মোটেই গ্রাহ্য নয়। কারণ ধৃতরাষ্ট্র জানতেন—মিষ্টি কথার মাধ্যমে, সামনীতির দ্বারা পাণ্ডবদের দমিত করে রাখা তাঁর পক্ষে কিছুই নয়। অতএব ভয় নয়, তিনি রাজি হলেন তাঁর পুত্রের স্বার্থেই। কারণ দুর্যোধন বলেছিলেন—আমরা পাণ্ডবদের বনবাসে পাঠিয়ে এই রাজ্যে দৃঢ়মূল হয়ে বসব, বিপুল সৈন্যসামন্ত সংগ্রহ করে আরও শক্তিমান হয়ে বসব আমরা।

ধৃতরাষ্ট্র সঙ্গে সঙ্গে বললেন—পাণ্ডবরা এখনও যদি রাস্তাতেই থাকে, তবে সেই অবস্থাতেই ধরে নিয়ে এসে তাদের—তূর্ণং প্রত্যানয়ম্বেতান্ কামং বাধ্বগতানপি। আবার পাশাখেলা হবে। কুরুবাড়ির বৃদ্ধরা ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, দীর্ঘদর্শী মন্ত্রী বিদুর সকলেই ধৃতরাষ্ট্রকে আবারও যথেষ্ট বারণ করলেন। কিন্তু সবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি পাণ্ডবদের ডেকে পাঠালেন এই কারণে যে, দুষ্টমতি ছেলের কথা তিনি ফেলতে পারবেন না—অকরোৎ পাণ্ডবাহ্বানং ধৃতরাষ্ট্রো সুতপ্রিয়ঃ। আমরা গান্ধারীকেও এই মুহূর্তে বেশ দু-কথা শোনাতে দেখছি। তিনি দুর্যোধনকে অনেক গালাগালি দিলেও মূলত দায়ী করেছেন কিন্তু প্রশ্রয়দাতা ধৃতরাষ্ট্রকে। গান্ধারী মনে করেন—দুর্যোধনকে অনেক আগেই ত্যাগ করা উচিত ছিল। তা যখন হয়নি, অন্তত এখন তাকে নির্বাসন উচিত—ত্যজ্যতাং কুলপাংসনঃ। গান্ধারী বলেছেন, দুষ্টমতি বালকদের কথায় কান দিয়ে তুমি এদের মাথায় তুলো না—মা বালানাম্ অশিষ্টানাম্ অভিমংস্থা মতিং প্রভো। এইরকম একটি পুত্রের জন্য তুমি নিজেকে মহাসাগরে নিক্ষেপ করো না। গান্ধারী দুর্যোধনকে তিরস্কার করার সময় ধৃতরাষ্ট্রকেও সমভাবে তিরস্কার করে বলেছেন—শাস্ত্রকথা বলে কখনও দুর্বুদ্ধি ব্যক্তিকে শাসন করা যায় না, তাতে উলটো ফল হয়। কিন্তু মহারাজ! একটি বৃদ্ধ যদি বালকের মতো ব্যবহার করে, সেটা কি খুব উপযুক্ত হয়—ন বৈ বৃদ্ধো বালমতি-র্ভবেদ্ রাজন্ কথঞ্চন। যা আমি চিরকাল বলেছি, অন্ধ পুত্রস্নেহে তুমি তা কখনও করনি। কিন্তু এখন তার ফল পাচ্ছ, তুমি সমস্ত বংশটাকে ছারখার করে দিলে।

তবু ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারীর কথা শুনলেন না। পুত্রস্নেহে অন্ধ রাজা ধ্বংসের পূর্বমুহূর্তে চরম উক্তি করলেন গান্ধারীর প্রতি—এই বংশের ধ্বংস রোধ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ওদের যেমন ইচ্ছে করছে, তাই হবে। পাণ্ডবরা আবার পাশা খেলুক—অন্তঃ কামং কুলস্যান্তু ন শক্নোমি নিবারিতুম্। ধর্মময় যুধিষ্ঠির এবার অন্তত পাশাখেলার ভালবাসায় খেলতে আসেননি, এসেছেন ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছা এবং অভিলাষকে সম্মান করার জন্য—নিয়োগাৎ স্থবিরস্য চ। জানন্নপি ক্ষয়করং নাতিক্রমিতুমুৎসহে।

স্বাভাবিক কারণেই যুধিষ্ঠির আবারও হেরে গেলেন। পাণ্ডব-ভাইরা এবং দ্রৌপদী তৈরি হলেন বনবাসে যাবার জন্য। ভীম, অর্জুন, নকুল সহদেব ভয়ংকর সব প্রতিজ্ঞা করলেন কৌরবদের ধ্বংস সাধনের জন্য। যুধিষ্ঠির কুরুবাড়ির সকলকে বিদায় জানিয়ে বনের পথে পা বাড়ালেন। নির্দোষ পাণ্ডুপুত্রদের এইভাবে বনে যেতে দেখে জননী কুন্তীর বিলাপের অন্ত রইল না। তাঁর সঙ্গে কুরুবাড়ির অনেক মেয়েই কাঁদল এবং উচ্চৈঃস্বরে দোষ দিতে লাগল কৌরব-ভাইদের। পৌর-জনপদবাসীরা ধৃতরাষ্ট্র এবং তাঁর পুত্রদের নিন্দা করতে লাগল সর্বতোভাবে। ধৃতরাষ্ট্র বেশ চিন্তিত হলেন। পুত্রদের অন্যায় আচরণের কথা চিন্তা করে তিনি এখন আর খুশি হতে পারছেন না কিছুতেই—ধ্যায়ন্নুদ্বিগ্নহৃদয়ো ন শান্তিমধিজগ্মিবান্। পাণ্ডবরা এইভাবে বনে যাচ্ছেন দেখে তাঁর কষ্টও হল বেশ। নিজের অন্যায়ে নিজেই ক্লিষ্ট হয়ে তিনি ডেকে পাঠালেন বিদুরকে।

বিদুর এলেন অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্রের ডাক পেয়ে। ধৃতরাষ্ট্র শঙ্কান্বিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—পাঁচ ভাই পাণ্ডবরা আর দ্রৌপদী কীভাবে বনে যাচ্ছেন। বিদুর বর্ণনা দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে—যুধিষ্ঠির বস্ত্রাঞ্চলে মুখ ঢেকে, ভীম হাত উঁচিয়ে, অর্জুন রাস্তা দিয়ে বালি ছড়াতে ছড়াতে—এইরকম প্রত্যেক পাণ্ডব এবং দ্রৌপদী একেকটি বিশেষ ভঙ্গিতে একেকটি বিশেষ আচরণ করতে করতে বনে চলেছেন। এইসব আচরণের মধ্যে কৌরবকুলের ভবিষ্যদ্-ধ্বংসের ব্যঞ্জনা ছিল, বিদুর সে ব্যঞ্জনা বুঝিয়েও দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। ধৃতরাষ্ট্র যথেষ্ট চিন্তিত হলেন। ধৃতরাষ্ট্র এবং বিদুর যখন কথা বলছিলেন, তখন ঋষি-মুনিদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন নারদ। তিনি প্রায় অভিশাপ উচ্চারণ করলেন কুরুবংশের ভবিষ্যৎ আশঙ্কায়।

ধৃতরাষ্ট্র মোটেই শান্তি পাচ্ছেন না। বাড়িতে স্ত্রীলোকের চিৎকার, বাইরে পৌর-জনপদবাসীদের আন্তরিক ক্ষোভ এবং ব্রাহ্মণ-মুনি-ঋষিদের আকস্মিক আক্ষেপ—সবকিছু বার বার ধৃতরাষ্ট্রকে চিন্তাকুল করে তুলল। একবার তিনি বিদুরকে ডেকে খানিকক্ষণ কথা বলে শান্তি পেতে চেয়েছেন, এবার তিনি ডেকে পাঠালেন সঞ্জয়কে। সঞ্জয় একজন রথচালক সূত। কিন্তু তিনি অসাধারণ পণ্ডিত। তিনি ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রীও বটে। কিন্তু সঞ্জয় এসে ধৃতরাষ্ট্রের মন রেখে কথা বললেন না মোটেই। সঞ্জয় এসে দেখলেন—ধৃতরাষ্ট্র বসে বসে দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ছেন। চিন্তায় আকুল হয়ে খানিকটা বিমূঢ়ও বোধ করছেন তিনি। সঞ্জয় এসেই তাঁকে বললেন—কী মহারাজ! পাণ্ডবদের রাজ্যভ্রষ্ট করে তাড়িয়ে দেওয়ার ফলে সমস্ত রত্নময়ী এই বসুন্ধরা এখন আপনারই করতলগত। এমন সুখে আপনি এমন ব্যাকুল হচ্ছেন কেন—প্রব্রাজ্য পাণ্ডবান্ রাজ্যাদ্রাজন্ কিমনুশোচসি? ধৃতরাষ্ট্র বললেন—ব্যাকুল হব না? পাণ্ডবরা মহাবীর এবং যথেষ্ট যুদ্ধবাজ। তাঁদের সাহায্যকারী রাজারাও কেউ কম যান না। তো তাঁদের সঙ্গে শত্রুতা তৈরি হয়েছে, অথচ ব্যাকুল হব না আমি?

সঞ্জয় বললেন—শত্রুতা সৃষ্টির এই অসাধারণ সুন্দর কাজটা তো আপনিই করেছেন, মহারাজ—তবেদং সুকৃতং রাজন মহদ্ বৈরম্ উপস্থিতম্। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর—কেউ আপনাকে কম বারণ করেননি। কিন্তু কারও কথা আপনি গ্রাহ্য করেননি। আপনার গুণধর পুত্রটি একটি প্রাতিকামীকে অন্তঃপুরে পাঠাল কুলবধূ দ্রৌপদীকে ধরে আনার জন্য। আসলে এইরকমই হয়, মহারাজ! পরমেশ্বর যাঁকে ধ্বংস করতে চান, তার মাথায় এইরকমই মন্দ বুদ্ধি জুগিয়ে দেন তিনি। যেটা ঠিক, তখন সেটাকে সে বেঠিক ভাবে, আর যেটা বেঠিক, সেটাকেই সে ভাবে ঠিক করছে—অনর্থাশ্চার্থরূপেণ অর্থাশ্চানর্থরূপিনঃ। মহারাজ! আরও একটা কথা বলি—মহাকাল বা যম কখনও লাঠি উঁচিয়ে ধ্বংসসাধন করতে আসেন না, বা কারও মাথা কেটে ফেলেন না, মহাকালের অভিশাপ নেমে আসে এইরকম বিপরীত বুদ্ধির মধ্যে, যাতে ঠিক জিনিসটাকে বেঠিক মনে হয় আর বেঠিকটাকে মনে হয় ঠিক—কালস্য বলমেতাবদ্ বিপরীতার্থদর্শনম্।

সঞ্জয় পর পর ধৃতরাষ্ট্রের অন্যায়গুলি বলে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র এখন দারুণ ভয় পাচ্ছেন। একবস্ত্রা রজস্বলা পাঞ্চালীকে সভায় আনতে দেখে স্বয়ং গান্ধারীও যে কুরুস্ত্রীদের সঙ্গে ভৈরব চিৎকার করে উঠেছিলেন—সে কথা এখন ধৃতরাষ্ট্রের মনে পড়ছে। মনে পড়ছে জরাসন্ধহন্তা ভীমের কথা, গাণ্ডীবধন্বা অর্জুনের কথা। নৈতিক এবং শক্তির দিক দিয়ে পাণ্ডবরা যে কৌরবদের চেয়ে ভাল জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন—কুরুভ্যো হি সদা মন্যে পাণ্ডবান্ বলবত্তবান—সে কথা সময়মতো বলেও ছিলেন বিদুর। ধৃতরাষ্ট্রের এখন সেসব কথা মনে হচ্ছে। কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে যেভাবে সভার মধ্যে অপমান করা হয়েছে, তাতে পাণ্ডবদের মিত্রপক্ষ পাঞ্চালরা, যাদবরাও যে মোটেই ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের ছেড়ে দেবে না—সেটা ধৃতরাষ্ট্রকে খুব ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বিদুর। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র তখন সেকথা শোনেননি। এখন পাণ্ডবদের দৃঢ়বদ্ধ শত্রুতার কথা স্মরণ করে ধৃতরাষ্ট্র নানা অনুশোচনায় ভুগছেন। বার বার বলছেন—আমি ছেলের স্বার্থ দেখতে গিয়ে বিদুরের ভাল কথাগুলোও শুনিনি, এখন আমি কী করি—উক্তবান্ ন গৃহীতং বৈ ময়া পুত্ৰহিতৈষিণা।

ধৃতরাষ্ট্রের এই কথাগুলো অনুতাপের মতো শোনাচ্ছে বটে, তবে তাঁর পরবর্তী আচরণ লক্ষ করলে বোঝা যাবে—এই অনুতাপ তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়নি। পাণ্ডবরা বনে যাবার পর তাঁদের নির্বাসনজাত কোনও দুঃখ তাঁকে পীড়া দেয়নি। যা তিনি ভাবছেন, তা পাণ্ডবদের দিক থেকে ভাবছেন না, ভাবছেন দুর্যোধনের দিক থেকেই। ক্রুদ্ধ ভীম-অর্জুন কী বিপত্তি বাধাবেন, তাতে তাঁর পুত্রদের কত ক্ষতি হবে—সেই অনিষ্ঠাশঙ্কায় তিনি একবার সঞ্জয়কে ডেকে, একবার বিদুরকে ডেকে ভবিষ্যদ্-বিপদের পরিমাপ করতে চাইছেন। মনে আছে—একসময় দুর্যোধন পিতাকে বলেছিলেন—পৌরজানপদ অথবা মন্ত্রী-অমাত্যদের টাকাপয়সা খাইয়ে নিজের পথে নিয়ে আসবেন তিনি। কিন্তু পাণ্ডবরা বনে যাবার পর সহানুভূতির হাওয়ায় চিত্রটা একেবারে পালটে গেছে। পৌর জনপদবাসীদের নিরন্তর বিক্ষোভের মুখে পড়েই ধৃতরাষ্ট্র আবার ডেকে পাঠালেন বিদুরকে। তাঁকে বললেন—বিদুর! তোমার প্রজ্ঞা এবং ধর্মবোধ অসামান্য। পাণ্ডব এবং কৌরব—দু’ পক্ষই তোমার কাছে সমান। তো এই অবস্থায় কী করলে সমস্ত ব্যাপারটা ঠিক হয়, সেটাই তুমি বলো—পথ্যঞ্চৈষাং মম চৈব ব্রবীহি৷ তা ছাড়া পুরবাসীরা আবার কীভাবে আমাদের অনুকূলে আসে, তারা যাতে আমাদের সমূলে উৎপাটিত না করে—সে ব্যাপারে তুমি ভাল পরামর্শ দিতে পার বলে আমার মনে হয়—পৌরাশ্চেমে কথমস্মান্ ভজেরন্। তে চাস্মান্নোদ্‌ধরেয়ুঃ সমূলান্ ত্বং ব্রুয়াঃ সাধু কার্যানি বেৎসি॥

বিদুর ভাবলেন বুঝি ধৃতরাষ্ট্রের সুমতি হয়েছে। তিনি বুঝি বিদুরের পথ্য-বচন শুনতে চান। বিদুর তাই নিজের বুদ্ধিমতো বললেন—মহারাজ! ধর্ম বা ন্যায় অনুসারে চললেই একমাত্র বাঁচার উপায় আছে আপনার। কিন্তু সে ধর্ম তখনই নস্যাৎ হয়ে গেছে যখন আপনার ছেলে শকুনিকে সঙ্গে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের মতো মহান ব্যক্তিকে পাশার চালে হারিয়েছে। এখন বিপদ থেকে বাঁচতে হলে উলটো দিকে হাঁটতে হবে অর্থাৎ পাণ্ডবদের কাছ থেকে যা যা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, সেগুলো সব তাঁদের ফিরিয়ে দিন। পরের ধনে এমন করে লোভ করবেন না। যেটা সবচেয়ে বেশি করতে হবে, সেটা হল—তাঁদের সন্তুষ্টির চেষ্টা এবং শকুনিকে অপমান করবেন—এতৎ কার্যং তব সর্বপ্রধানং তেষাং তুষ্টিঃ শকুনেশ্চাবমানঃ।

বিদুর আবারও ভীম-অর্জুনের ভয় দেখালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। তারপর বললেন—পৌর জনপদবাসীকে শান্ত করার এখন একটাই উপায় আপনার। আপনি দুর্যোধনের প্রভাব খর্ব করে যুধিষ্ঠিরকে আপন রাজ্যের আধিপত্যে স্থাপন করুন। দুর্যোধন কর্ণ শকুনি—এঁরা সব যুধিষ্ঠিরের কাছে আত্মসমর্পণ করুক। দুঃশাসন ভীম এবং দ্রৌপদীর কাছে ক্ষমা চাক উন্মুক্ত রাজসভায়—দুঃশাসনো যাচতু ভীমসেনং সভামধ্যে দ্রুপদস্যাত্মজাঞ্চ। এইভাবে যদি আপনি চলেন, তবেই আপনি যা চান, তাই সম্ভব হবে—এতৎ কৃত্বা কৃতকৃত্যো’সি রাজন্‌।

বিদুর ভেবেছেন—ধৃতরাষ্ট্র বুঝি সত্যিই পাণ্ডবদের কিছু ছেড়ে দিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে চান। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র পুত্রস্নেহে এতটাই কাতর যে বিদুরের কথা তিনি ততক্ষণই শুনবেন, যতক্ষণ তাঁর পুত্রদের স্বার্থে ব্যাঘাত না ঘটছে। বিদুর যেভাবে তাঁর ছেলেপিলেদের ক্ষমাটমা চাইতে বলেছেন, তাতে যে তাঁর পুত্রদের মানসম্মান থাকবে না, উপরন্তু ওইভাবে পড়ে-পাওয়া ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যখণ্ডটিও যে ফিরিয়ে দেওয়া অসম্ভব, সেটা ধৃতরাষ্ট্র নিজেই বিশ্বাস করতেন। ফলে বিদুরের কথা শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া হল সাংঘাতিক। কথা শোনা তো দূরের কথা, তিনি এমনভাবেই বিদুরকে অপমান করলেন যে অপমান বিদুর সয়েছিলেন দুর্যোধনের কাছে। সেই বস্ত্রহরণের সময়—দ্যূতসভায়।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন—তুমি এখনই যেসব কথা বললে, সেগুলি তুমি সেই পাশাখেলার সময়ও বলেছিলে। যা বলেছিলে, তাতে বেশ বোঝা যায়, তুমি পাণ্ডবদের ভাল চাইছ এবং আমাদের অনিষ্ট চাইছ—তেষাং হিতম্‌ অহিতং মামকানাম্‌। পাণ্ডবদের জন্য তোমার এই ওকালতি থেকেই এটা আজ নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, তুমি আমার কোনও হিত চাও না। তুমি কী করে ভাবলে যে পাণ্ডবদের জন্য আমি নিজের ছেলেকে ত্যাগ করব—কথং হি পুত্রং পাণ্ডবার্থে ত্যজেয়ম্‌। পাণ্ডবরাও আমার পুত্রের মতো হলেও এটা মনে রেখো সব সময় যে, আমারই শরীর থেকে দুর্যোধন জন্মেছে—অশংসয়ং তে’ পি মমৈব পুত্রাঃ/দুর্যোধনন্তু মম দেহাৎ প্রসূতঃ। যত সমদৃষ্টিই দেখাও—নিজের দেহ বাদ দিয়ে পরের দেহ নিয়ে থাকো—এই কি তোমার সমতার উপদেশ হল? ধৃতরাষ্ট্র শেষ কথা যেটা বললেন, সেটা পূর্বে দুর্যোধনও বলেছিলেন দ্যূতক্রীড়ার সময়ে। আজকে তিনি পুত্রের বলা তিরস্কারবাক্য পুনরুচ্চারণ করে বুঝিয়ে দিলেন যে, ছেলের সঙ্গে তাঁর কোনও আন্তরিক ভেদ নেই। পুত্র দুর্যোধন হঠকারিতার বশে যা করেন, ধৃতরাষ্ট্র সেটা করতে চান সময় নিয়ে, সাভিনয়ে।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন—বিদুর! আমি যা কিছুই করি, তুমি সেটাকেই কুটিলতা এবং অন্যায় বলে চিহ্নিত কর। তোমাকে এত দিন আমি যথেষ্ট সম্মান দিয়েছি—মানঞ্চ তে’হমধিকং ধারয়ামি। আর নয়। তুমি যেখানে খুশি চলে যেতে পার, নচ্ছার চরিত্রহীন স্ত্রীলোককে যেমন যতই বোঝাও শোনে না, তেমনই তোমাকে যতই বোঝাই তুমি আমার কথা বোঝ না—সুসান্ত্বমানাপ্যসতী স্ত্রী জহাতি।

ঠিক এই কথাটিই বিদুরকে শুনতে হয়েছিল ভাইপো দুর্যোধনের কাছে, আর আজকে তিনি সেটা শুনলেন দাদার কাছে। কী ভেবেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র—তিনি যেটা বলবেন, সেটাই সবাইকে তাঁরই অনুকূলে বুঝতে হবে? আসলে পুত্রের প্রতি শৃঙ্খলাহীন মমতা এবং প্রথাগতভাবে রাজ্য না পাওয়ার ঘটনা তাঁর মানসিক গঠন এমনই জটিল করে তুলেছিল যে, তিনি যে অন্যায় করছেন, অন্যায় বলছেন—সে ব্যাপারেও তাঁর বোধ ছিল না। দুর্যোধন যা বলেছিলেন, বিদুর তাও সহ্য করেছিলেন কোনওমতে, কিন্তু আজকে যখন তাঁর অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্র বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বললেন, তখন তিনি আর এক মুহূর্তও রইলেন না হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন স্বেচ্ছানিক্ষিপ্ত বনবাসে, যেখানে পাণ্ডবভাইরা আছেন, ধমর্ময় যুধিষ্ঠির আছেন। বনের পর বন পেরিয়ে হস্তিনাপুরের পশ্চিম দিকে যেখানে কাম্যকবনে পাণ্ডবরা বনবাসের কষ্টকর দিন কাটাচ্ছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিতে চললেন বিদুর।

কাম্যকবনে পাণ্ডবদের সঙ্গে বিদুরের দেখা হল। ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে যা যা কথা হয়েছিল সব জানালেন বিদুর এবং সেইসঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের স্বভাব সম্বন্ধে একটি অসাধারণ মন্তব্য করেছেন তিনি। বলেছেন—পদ্মপাতার ওপর একফোঁটা জল পড়লে সে যেমন স্থায়ী হয় না, ভাল কথা পথ্য বচন তেমনই ধৃতরাষ্ট্রের মনে দাগ কাটে না। যৌবনবতী কুমারী মেয়ে যেমন ষাট বছরের বুড়ো বর পছন্দ করে না, ধৃতরাষ্ট্রও তেমনই ভাল কথা সহ্য করতে পারেন না। তিনি নিজেই নিজের বিনাশ ডেকে আনছেন।

ধৃতরাষ্ট্র কী সাংঘাতিক ভাষা ব্যবহার করে বিদুরকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, সে কথাও বিদুর জানালেন। অন্যদিকে হস্তিনাপুরে দেখছি—ধৃতরাষ্ট্র আবারও ছটফট করছেন। বিদুর চলে যাবার পর আর যখন তিনি ফিরে এলেন না, ধৃতরাষ্ট্রের তখন নানা ভয় ধরল। বিদুর হস্তিনাপুরের রাজসভার মন্ত্রী ছিলেন—এটাই খুব বড় কথা নয়। ছোটবেলা থেকেই তাঁর বুদ্ধি, প্রজ্ঞা এবং তর্ক যুক্তি এতই বেশি প্রখর ছিল যে, মহামতি ভীষ্ম পর্যন্ত তাঁর মত নিয়ে চলতেন। বিশেষত বিদুরের পররাষ্ট্রনীতি এবং রাজনৈতিক বুদ্ধি তাঁর জীবৎকালেই প্রাবাদিক পর্যায়ে পৌঁছেছিল। ধৃতরাষ্ট্র ভাবলেন—বিদুর যদি পাণ্ডবদের সঙ্গে যোগ দিয়ে তাঁদের প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাজ করতে থাকেন, তা হলে হস্তিনাপুরের অন্তকাল ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিকভাবেই। সেক্ষেত্রে দুর্যোধন দুঃশাসনদের আর সুখে রাজ্যভোগ করতে হবে না।

বিদুরের প্রভাব এবং পরামর্শে পাণ্ডবদের যে বিরাট বাড়বাড়ন্ত হবে—সে কথা ভেবেই ধৃতরাষ্ট্র আবার বিদুরের জন্য অনুতাপ করতে আরম্ভ করলেন—বিবৃদ্ধিং পরমাং মত্বা পাণ্ডবানাং ভবিষ্যতি। বিদুরের কথা ভাবতে ভাবতে একদিন রাজসভার দ্বারের কাছে এসে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলেন ধৃতরাষ্ট্র। জ্ঞান ফিরলে তিনি সঞ্জয়কে ডেকে তাঁর সামনেই কান্নাকাটি করতে আরম্ভ করলেন। অন্ধ চোখ বেয়ে অনেক জল পড়ল। ধৃতরাষ্ট্র অনেক অনুতাপ করলেন—বিদুরের মতো এমন ভাই আর হয় না। কোনও দিন সে আমার কোনও অপ্রিয় কাজ করেনি। কিন্তু সেই পরম প্রাজ্ঞ ব্যক্তিটিকে আমি এইভাবে দুঃখ দিলাম—স ব্যলীকং পরং প্রাপ্তো মত্তঃ পরমবুদ্ধিমান্‌। সঞ্জয়! তুমি তাড়াতাড়ি যাও, বিদুরকে নিয়ে এসো। তাকে ছাড়া আমি বাঁচব না।

সঞ্জয় বিদুরকে নিয়ে এলেন কাম্যকবন থেকে। বিদুরও এলেন, কারণ তিনি জানতেন তাঁর পরম প্রিয় বড় ভাইটিকে যথাসম্ভব সামাল দিয়ে না চললে বিখ্যাত ভরতবংশ অন্ধকারে ডুবে যাবে। বিদুর ফিরে এলে ধৃতরাষ্ট্র খুব আদর করলেন বিদুরকে। বললেন—ভাগ্যিস তুমি ফিরে এসেছ। ভাগ্যিস আমাকে তোমার এখনও মনে পড়ে। তুমি জান—এই কদিন ছিলে না। দিন রাত আমার না ঘুমিয়ে কেটেছে। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে কোলের কাছে নিয়ে এসে মস্তক আঘ্রাণ করলেন। এতে দুর্যোধন-দুঃশাসনরা খুশি হলেন না মোটেই। ধৃতরাষ্ট্রও ভ্রাতৃমিলনে মহান কোনও আনন্দ লাভ করলেন তা নয়। তবে বিদুরের রাজনৈতিক বুদ্ধি পাণ্ডবদের কোনও সাহায্যে আসবে না ভেবেই ধৃতরাষ্ট্র পরিতৃপ্ত হলেন।