ভীষ্ম – ২

॥ ২ ॥

ভীষ্মের জীবনকথা আরম্ভ করতে গেলে আমাদের একটু আগে থেকে আরম্ভ করতে হবে। যে পিতার আশীর্বাদে তিনি ইচ্ছামৃত্যু, সেই পিতার কথাও ভীষ্মের প্রসঙ্গ ধরে সামান্য জানাতে হবে, এমনকী অতি সামান্য করে হলেও ভীষ্মের ঠাকুরদাদা মহারাজ প্রতীপের কথাও একটু জানাতে হবে। মহামতি ভীষ্মের জন্মসূত্র তাঁর ঠাকুরদাদা প্রতীপের সঙ্গে একভাবে আবদ্ধ বলেই আমাদের আরম্ভ করতে হচ্ছে একেবারে সেখান থেকেই। আমরা তাঁর রাজকীয় জীবনের একান্ত বিস্তারের মধ্যে প্রবেশ করব না, কিন্তু যে মুহূর্তে মহারাজ প্রতীপকে আমাদের প্রয়োজন, ঠিক সেই মুহূর্তে প্রতীপ হস্তিনাপুরীতে নেই। তিনি রাজধানীর বাইরে।

মহারাজ প্রতীপ, ভরত-কুরুর মতো বিখ্যাত রাজবংশের শেষ জাতক মহারাজ প্রতীপ হস্তিনাপুরের রাজা। তিনি হস্তিনাপুরী ছেড়ে গঙ্গাদ্বারে এসেছেন। ‘গঙ্গাদ্বার’ জায়গাটাকে পণ্ডিত সজ্জনেরা অনেকেই হরদ্বার বা হরিদ্বার বলেও চিহ্নিত করেন এবং কে না জানে এই জায়গাটির প্রাকৃতিক শোভা অতি মনোরম। হয়তো মহারাজ প্রতীপ হৃদয় বিনোদনের জন্য এখানে এসেছেন, হয়তো বা ধর্মকর্মের জন্য। মহাভারত বলেছে—মহারাজ প্রতীপ বেশ কয়েক বছর রয়ে গেলেন গঙ্গাদ্বারে। স্নানআহ্নিক সেরে তিনি গঙ্গার তীরে এসে বসেন, মন্ত্র জপ করেন, আর প্রবাহিণী গঙ্গার শোভা দর্শন করেন—নিষসাদ সমা বহ্বীর্গঙ্গাদ্বারগতো জপন্‌।

বেশ বোঝা যায়, নদী-নগরীর নির্জনতা মহারাজ প্রতীপের মনে ঐশ্বরিক অনুভব এনে দেয়। মনোহারিণী প্রকৃতি তাঁকে এতটাই আকুল করে তুলেছে যে, তিনি এই জায়গা ছেড়ে যেতে পারছেন না। হস্তিনাপুরের রাজকীয় ভোগবিলাস ছেড়ে জপধ্যানের মুগ্ধতায় তিনি প্রসন্ন দিবস কাটিয়ে চলেছেন গঙ্গাদ্বারে। আর ঠিক এইরকমই এক আকুল বৈরাগ্যমুখর দিনে হঠাৎই এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটল।

সেদিনও তিনি গঙ্গার তীরে বসে আছেন। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে হরজটাভ্ৰষ্টা গঙ্গা, জটামুক্তির প্রথম আস্বাদনে আপ্লুতা। হঠাৎই এক অপূর্বদর্শনা রমণী মহারাজ প্রতীপের রূপে গুণে মুগ্ধ হয়ে শীতল তরল জলের মাঝখান থেকে উঠে এল। প্রবাহিণী গঙ্গা মনুষ্য-রমণীর রূপ ধারণ করে জল থেকে উঠে এলেন। তিনি নদী থেকে নায়িকা হলেন। যাঁর রূপ দেখলে পুরুষের হৃদয় টলে, শরীর উদ্বেলিত হয়, তিনি জল থেকে উঠে এলেন। নদী নায়িকা গঙ্গা—উত্তীর্য সলিলাত্তস্মাল্‌ লোভনীয়তমাকৃতিঃ।

সংস্কৃত সাহিত্যে অচেতনা নদীর মধ্যে সচেতনা রমণীর আবিষ্কার নতুন কোনও ঘটনা নয়। বিশেষত যে নদী উচ্ছল তরঙ্গভঙ্গে প্রবাহিণী, তাঁর মধ্যে উচ্ছলা রমণীর চলা হাসা এবং তার অপরূপ ভাববিভঙ্গের সাযুজ্য কল্পনা করে সংস্কৃত কবিরা অসাধারণ রসসৃষ্টি করেছেন। কালিদাসের লেখনীতে নদী-নায়িকারা সমুদ্র-নায়কের সঙ্গে মিলিত হবার সময় লজ্জার মাথা খেয়ে ‘স্বয়ং তরঙ্গাধরদান-দক্ষ’ সমুদ্রের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে উপল-ব্যথিতগতি বেত্রবতী নদীর মধ্যে যখন জলের ঘূর্ণি তৈরি হয়, তখন সেই ঘূর্ণির মধ্যে রমণী-শরীরের অন্তর্গত নাভিমূল আবিষ্কার করেই ক্ষান্ত হননি কালিদাস, তিনি তাঁর সখাসম মেঘকে পরামর্শ দিয়েছেন—যাতে সে অলকাযাত্রার পথে ক্ষণেক দাঁড়িয়ে সেই প্রকটিত নাভিমূল একবারটি হলেও দেখে যায়। কাজেই কবিকল্পনার জগতে চঞ্চল নদী-দেহের সঙ্গে উচ্ছল রমণী-শরীরের কোনও তফাত নেই। আর আজ থেকে বিশ বছর আগেও যাঁরা গঙ্গাদ্বারে অথবা হরিদ্বারে আমাদের এই নদী নায়িকাকে দেখেছেন, তাঁরা বুঝবেন যে, এই নদীর ওপর রমণী-শরীরের আরোপণ কতটা যুক্তিযুক্ত।

যাই হোক, আমরা কিন্তু শুধু এই কবিকল্পের মাধ্যমেই মনুষ্যরূপিণী নদী-নায়িকার রূপ বর্ণনা করেই ক্ষান্ত হব না। কারণ রমণীর রূপ তো স্পর্শমাত্র গভীর এক উষ্ণ অনুভূতি, কিন্তু তার হাবভাব এবং মানসিকতা দেখে আমাদের কিছু গম্ভীর বিচার করতে হবে। কেন না এই নদী-নায়িকার সঙ্গে মহামতি ভীষ্মের সম্বন্ধ ঘটবে ভবিষ্যতে।

আপাতত এই রমণী জল থেকে উঠেই আপন বিলোভন প্রক্রিয়ায় মহারাজ প্রতীপকে যে একেবারে মোহিত করে তুললেন, তা মোটেই নয়। তিনি এতটুকুও ভণিতা না করে মহারাজ প্রতীপের শালবৃক্ষসম দক্ষিণ ঊরুর ওপর বসে পড়লেন—দক্ষিণং শাল-সঙ্কাশম্‌ ঊরুং ভেজে শুভাননা।

মহারাজ প্রতীপের বয়স হয়েছে। যৌবনের উত্তেজনায় এক অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীর আত্মনিবেদন মাত্রেই তিনি উৎসুক হয়ে ধরা দেবেন, এমন বয়স তাঁর নেই। অতএব নদী-নায়িকার উষ্ণ আলিঙ্গনে তিনি আকুলিত হলেন না। তিনি বিচলিত হলেন না, বরং একটু গম্ভীর হলেন। মুখে বললেন—কল্যাণী! কী করতে পারি তোমার জন্য? কী তোমার ইচ্ছে, খুলে বলো দেখি—করোমি কিন্নু কল্যাণি প্রিয়ং যত্তে’ভিকাঙ্ক্ষিতম্‌? প্রতীপের সম্বোধনটুকু খেয়াল করেছেন নিশ্চয়ই। সমান আবেগে আপ্লুত হলে প্রতীপ এই রমণীকে ‘রম্ভোরু’ কিংবা ‘পীনস্তনী’ বলে সম্বোধন করতেন। কিন্তু ‘কল্যাণী’! কল্যাণী সম্বোধনে কাকে ডাকা যায়? মেয়েকে, পুত্রবধূকে, স্নেহাস্পদকে।

প্রতীপের কথা শুনে নদী-নায়িকা জাহ্নবী একটুও দ্বিধাগ্রস্ত হলেন না। তিনি বললেন—মহারাজ! তুমি কুরুবংশের শ্রেষ্ঠতম পুরুষ। আমি তোমাকে আমার ঈপ্সিততম নায়ক হিসেবে পেতে চাই। আর জান তো—কোনও রমণী যদি স্বেচ্ছায় মিলনেচ্ছা প্রকাশ করে, তবে তাকে প্রত্যাখ্যান করাটা মোটেই ভদ্রলোকের কাজ নয়—ত্যাগঃ কামবতীনাং হি স্ত্রীণাং সদ্ভির্বিগহিতঃ। রমণীর প্রগল্‌ভতায় মহারাজ প্রতীপ একটুও বিচলিত না হয়ে বললেন—তোমাকে ভাল লেগেছে বলেই আমি পরস্ত্রীর প্রতি আসক্ত হব এবং এক অসবর্ণা রমণীকে বিবাহ করে বসব—এ হঠকারিতা আমার দ্বারা হবে না। হলেও সেটা যে অধর্ম হবে, কল্যাণী—ন চাসবর্ণাং কল্যাণি ধৰ্মং তদ্ধি ব্রতং মম।

মাত্র দুটি শব্দ, মহারাজ প্রতীপের প্রত্যাখ্যানের মধ্যে মাত্র দুটি শব্দ—‘পরস্ত্রী’ এবং ‘অসবর্ণা’—এই দুটি শব্দ শুনলেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সমাগতা রমণী কোনও নদীও নন অথবা অলৌকিক ভাবসম্পন্না কোনও দেবীও নন। জাতিবর্ণের হিসেব করলে হয়তো এই রমণী মহারাজ প্রতীপের তুলনায় কিছু হীনই বটে। নইলে নিজের থেকে উচ্চতর বর্ণ হলে অসবর্ণার গ্লানি অনুভব করতেন না মহারাজ প্রতীপ। উচ্চতর বর্ণের অনুক্রমে এই রমণী ব্রাহ্মণী হয়ে থাকলে অথবা দেবী হয়ে থাকলে প্রতীপের ভাষার শব্দরাশি অন্যরকম হত। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের প্রতিলোম সংসৃষ্টি জগতে যত অন্যায়ই ঘটাক, কন্যা ব্রাহ্মণী এবং বর ক্ষত্রিয় হলে ক্ষত্রিয়ের পক্ষে ব্রাহ্মণীকে উপেক্ষা করা যে কত কঠিন, তা পুরাকালে দেবযানীর সঙ্গে মহারাজ যযাতির পূর্বরাগ এবং বিবাহের সময়েই দেখা গেছে।

কাজেই জল থেকে উঠে আসা এই সুন্দরী রমণীকে আমরা দেবীও বলব না, নদীও বলব না। জাতিকুলের মাত্রায় তিনি কিঞ্চিৎ হীনও বটেন, যে হীনতা হস্তিনাপুরের রাজার কাছে তেমন আদরণীয় নয়। তা ছাড়া তিনি যে এই ‘পরস্ত্রী’ কথাটা ব্যবহার করেছেন, তাতে বোঝা যায় যে, এই রমণী সাধারণী অর্থাৎ ‘পর’ বা অন্য পুরুষের দ্বারা তিনি পূর্বাহ্নেই উপগতা। এই ‘পর’ বা অন্য পুরুষটি যে কে, রাজাও তাঁর ঠিকানা জানেন না; তাঁর গোত্র-প্রবরও জানেন না এবং হয়তো রাজা সে সব পরিচয় জানতেও চান না। জানলে যদি নিজেই বিব্রত বোধ করেন! কাজেই এই অজ্ঞাতকুলশীলা রমণী যখন দ্বিধাদ্বন্দ্বহীনভাবে হঠাৎই তাঁর দক্ষিণ ঊরুদেশ স্পর্শ করে বিবাহের প্রস্তাব করল, তখন মহারাজ প্রতীপ খানিকটা অপ্রতিভ বোধ করলেন। আর সেই জন্যই তাঁর বিমূঢ় মুখখানিতে যে শব্দরাশি উচ্চারিত হল, তার মধ্যে প্রত্যাখ্যানের কাঠিন্য যতখানি, তার থেকে বেশি হয়ে উঠল তাচ্ছিল্য—জাতিবর্ণ ঠিক নেই, কার না কার বউ-ঝি হবে—তাকে কি আমার বিয়ে করা মানায়—নাহং পরস্ত্রিয়ং কামাদ্ গচ্ছেয়ং বরবৰ্ণিনি।

প্রতীপের মুখে এমন তাচ্ছিল্যভরা কথা শুনে সপ্রতিভভাবে রমণী বললেন—কেন? আমি কি দেখতে এতই খারাপ! কোনও দুর্লক্ষণও তো নেই আমার শরীরে—উঁচু কপাল কী খড়ম-পা, চুল নেই অথবা পুরুষমানুষের মতো রোম আছে—এসব তো আমার কিছুই নেই। আর অসবর্ণা বলে কি আমি অগম্যা হলাম নাকি। কাজেই অমন করে তাচ্ছিল্য কোরো না, রাজা—নাশ্রেয়স্যাস্মি নাগম্যা ন বক্তব্যা চ কর্হিচিৎ। আমি রীতিমতন সুন্দরী এক দিব্যা রমণী। সবচেয়ে বড় কথা—সেই সুন্দরী রমণী তোমাকে ভালবেসে চাইছে, অতএব তুমিও তাকে ভালবেসে চাইবে, এ তো সোজা হিসেব—ভজন্তীং ভজ মাং রাজন্ দিব্যাং কন্যাং বরস্ত্রিয়ম্।

মহারাজ প্রতীপ মোটেই স্বচ্ছন্দ বোধ করলেন না। তাঁর এই পশ্চিমে ঢলে-পড়া বয়সে এক সুন্দরী রমণী এসে পা জড়িয়ে ধরে বসে রইল—এই আত্মনিবেদন ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। অন্যদিকে হস্তিনাপুরের পাটরানির মুখখানি মাথায় রেখে, নিজের প্রৌঢ় বয়সের কথা মাথায় রেখে প্রতীপ এবার রমণীকে একটু প্রশ্রয় দিয়েই গম্ভীরভাবে বললেন—শুধু ভাল লাগার জন্য যে কাজ তুমি করতে বলছ, সেই ভাল লাগার বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি, কন্যে—মমাতিবৃত্তমেতত্‌তু যন্মাং চোদয়সি প্রিয়ম্‌। আমার এই বয়সে তোমাকে যদি এখন আমি বিয়ে করে বসি, সে বড় অধর্ম হবে।

প্রতীপ এবার একটু কৌশল করে বললেন—তার চেয়ে একটা ভাল কথা বলি শোনো। তুমি কিনা জল থেকে উঠে এসেই আমার ডান ঊরুদেশের ওপর বসে পড়লে। তা পুরুষের ডান ঊরুটি কাদের বসার আসন জান? আত্মজ পুত্র আর পুত্রবধূকে আদর করে বসাতে হয় ডান ঊরুতে—অপত্যানাং স্নুষাণাঞ্চ ভীরু বিদ্ধ্যেতদাসনম্‌। আর তুমি কিনা বোকার মতো আমার বাম ঊরুটি বাদ দিয়ে বসলে গিয়ে আমার দক্ষিণ ঊরুদেশে। যাক সে কথা, যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন আর কোনও উপায় নেই। তবে তুমি যদি আমার পুত্রবধূ হতে চাও, তা হলে সেই সম্মানটুকু অন্তত আমি তোমাকে দিতেই পারি। আমার দক্ষিণ ঊরুদেশে উপবেশন করে তুমি আমার পুত্রবধূর স্নেহ লাভ করেছ জেনো। অতএব আমার পুত্রের জন্য তোমাকে আমি বন্ধু হিসেবে বরণ করছি, কন্যে—স্নুষা মে ভব কল্যাণি পুত্ৰার্থং ত্বাং বৃণোম্যহম্।

নদী-নায়িকা সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন—তবে তাই হোক মহারাজ! তাই হোক। তোমাকে দেখেই আমি মনে মনে প্রখ্যাত ভরতবংশের বধূ হবার কামনা করেছি—ত্বদ্‌ভক্ত্যা তু ভজিষ্যামি প্রখ্যাতং ভরতং কুলম্। পৃথিবীতে যত রাজা আছেন, তোমরা হলে তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। শত বৎসর ধরে গান গাইলেও তোমাদের গুণের কথা শেষ হবে না। আশা করি, তুমি তোমার পুত্রের হয়ে যে কথা দিলে, সে কথা তোমার ছেলে ফেলবে না অথবা বৃথা তর্ক বিচার করে সে আমাকে প্রত্যাখ্যান করবে না—তৎ সর্বমেব পুত্ৰস্তে ন মীমাংসেত কর্হিচিৎ। মহারাজ প্রতীপ ভরতবংশের বধূমর্যাদাপ্রার্থিনী নদী-নায়িকার কাছে পুত্রের জন্য বাগদত্ত হয়ে রইলেন।

এই ঘটনার পর মহাভারতের কবি অলৌকিক কল্পনা আশ্রয় করে পুত্রের জন্য প্রতীপের সস্ত্রীক তপস্যা বর্ণনা করেছেন। তপস্যার ফলে প্রতীপের পুত্রও জন্মাল। তাঁর নাম শান্তনু। তারপর শান্তনু বড় হয়ে যৌবনে পদার্পণ করলে প্রতীপ তাঁকে সেই অপরিচিতা রমণীর কথা বলে তাকে বিয়ে করার কথা বললেন। সত্যি কথা বলি, আমরা এইসব কল্প কাহিনীতে তেমন করে বিশ্বাস নাও রাখতে পারি। বস্তুত এক যৌবনবতী রমণী যার সঙ্গে মিলিত হবার জন্য অপেক্ষা করছে, তার জন্ম হবে, বয়স হবে, বিয়ে হবে—এসব পুরাকল্প আধুনিকের মন দ্বিধাগ্রস্ত করে। আপনারা তো জানেন যে, শুধু ভীষ্ম জন্মাবেন, এবং বহুদিন বেঁচে থাকবেন বলেই শান্তনুর জীবনে আরও অন্তত দুটি কাহিনীর ‘কবিকল্প’ ব্যবহার করতে হয়েছে। একটি মহাভিষ রাজার কাহিনী, অন্যটি অষ্টবসুর উপাখ্যান।

মহাভিষ ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা ছিলেন এবং একসময়ে তিনি গিয়েছিলেন ভগবান ব্রহ্মার সঙ্গে দেখা করতে। সেই ব্রহ্মসভায় দেবতারাও এসেছিলেন। এসেছিলেন নদী-নায়িকা গঙ্গাও। কীসের থেকে কী হল, উতলা বাতাসে সুন্দরী গঙ্গার আবরণবস্ত্রখানি উড়ে গেল। অবস্থা দেখে দেবতারা সব লজ্জায় মাথা নিচু করলেন। কিন্তু মহাভিষ রাজা—কী করবেন, হাজার হলেও মানুষ তো—তিনি হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন অসংবৃতা গঙ্গার দিকে। ব্রহ্মা মহাভিষ রাজার এই নির্লজ্জ আচরণ দেখে পুনরায় মর্তলোকে জন্মানোর অভিশাপ দিলেন।

পিতামহের অভিশাপ শুনে মহাভিষ রাজা অনেক ভেবে ঠিক করলেন যে, তিনি কুরুবংশীয় রাজা প্রতীপের পুত্র হয়েই জন্মাবেন। নদী-নায়িকা গঙ্গা কিন্তু অভিশাপ শুনেও মহাভিষ রাজার কথা চিন্তা করতে করতেই স্বস্থানে ফিরে গেলেন।

আমরা কিন্তু এই অভিশপ্ত ঘটনার মধ্যেই মহারাজ শান্তনুর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি। বস্তুত, ব্রহ্মার ওই অভিশাপের কথা এবং পরবর্তীকালে অষ্টবসুরা নিজেদের অভিশাপ মুক্তির জন্য যেভাবে গঙ্গার কাছে তাঁদের মাতৃত্ব স্বীকার করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন—এই দুটি কাহিনীই আমাদের কাছে অলৌকিক মাত্রায় চিহ্নিত, আর ঠিক সেই জন্যই এই কাহিনী আমাদের কাছে তত আদরণীয় নয়। মহারাজ প্রতীপের সঙ্গে যখন তথাকথিত গঙ্গার দেখা হয়েছে, তখনও তাঁর পুত্র শান্তনুর জন্ম হয়নি, একথা আমাদের তেমন বিশ্বাস হতে চায় না। খুব বেশি হলে যতটুকু হতে পারে যে, শান্তনু তখনও রাজা হননি।

বরঞ্চ শান্তনুর ওপর তথাকথিত ইক্ষ্বাকুবংশীয় মহাভিষের ছবিটি ‘সুপার ইমপোজ’ করলে দেখা যাবে—অসংবৃতবসনা যৌবনবতী গঙ্গার রূপে মুগ্ধ হয়ে শান্তনু তাঁর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছেন। কোনও স্বর্গলোকে বা ব্রহ্মলোকে নয়, এই মর্তলোকেই মর্তবাসিনী এক অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীর রূপে মুগ্ধ হয়ে শান্তনু দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন নির্জন নদীতীরে। হয়তো রমণীর কুলশীলের কথা চিন্তা করে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর সঙ্গ কামনা করতে দ্বিধা করেছেন এবং কেন দ্বিধা করেছেন, সে কথায় পরে আসছি। তবে মহাভিষের রূপকল্পটি মনে রেখে যদি গঙ্গার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করি, তা হলে বলাই যায় যে, আসলে মহাভিষরূপী শান্তনুর ধৈর্যচ্যুতি দেখে তাঁরই কথা চিন্তা করতে করতে গঙ্গা তাঁর নিজ আবাসে ফিরে গিয়েছিলেন সেদিন—তমেব মনসা ধ্যায়ন্ত্যুপাবর্তৎ সরিদ্‌বরা।

নির্জন গঙ্গাতীরে ভরতবংশের এক প্রসিদ্ধ জাতককে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নদী-নায়িকা গঙ্গা তখনকার মতো লজ্জা পেয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেইদিনই তাঁর সিদ্ধান্ত ঠিক হয়ে যায় যে, তিনি ভরতবংশের কুলবধূ হবেন। হয়তো সেই কারণেই—আমরা অন্তত তাই বিশ্বাস করি—হয়তো সেই কারণেই, তিনি যেদিন প্রথম শান্তনুপিতা প্রতীপকে দেখতে পেলেন, সেদিনই তাঁর দক্ষিণ পা-খানি জড়িয়ে ধরেছিলেন। এটা তাঁর বোকামি না, স্বেচ্ছাশ্রিত বুদ্ধি। শান্তনুকে প্রিয়তম হিসেবে পাবার জন্যই হয়তো এই কুটিল বিহ্বল ইচ্ছাকৃত আচরণ।

আমরা জানি, মহারাজ প্রতীপ এই অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীকে পুত্রবধূর মর্যাদা দিয়েছেন। রমণী মহারাজ প্রতীপের কাছে সানুরোধে বলেছেন—তুমি তোমার পুত্রের হয়ে কথা দিয়েছ, তিনি যেন তোমার কথা না ঠেলেন—তৎসর্বমেব পুত্ৰস্তে ন মীমাংসেত কর্হিচিৎ। প্রতীপ এই অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীর কথা সস্নেহে মনে রেখেছেন এবং হস্তিনাপুরে ফিরে এসে পুত্রকে তিনি বলেও ছিলেন—কোনওদিন যদি গঙ্গাদ্বারবাসিনী এক সুন্দরী রমণী তোমার প্রণয়প্রার্থিণী হয়ে তোমাকে কামনা করে—ত্বমাব্রজেদ্‌ যদি রহঃ সা পুত্র বরবর্ণিনী—তবে যেন তুমি তাকে প্রত্যাখ্যান করো না। তাকে যেন তুমি জিজ্ঞাসা কোরো না—তুমি কে, কার মেয়ে ইত্যাদি। আমার আদেশে তুমি সেই অনুরক্তা রমণীর ইচ্ছাপূরণ করো। সে যা করতে চায়, তাতে তুমি বাধা দিয়ো না। মহারাজ প্রতীপ এই কথা বলে পুত্র শান্তনুকে নিজের রাজ্যে অভিষিক্ত করে বাণপ্রস্থ অবলম্বন করলেন—স্বে চ রাজ্যে অভিষিচ্যৈনং বরং রাজা বিবেশ হ।

ঘটনাগুলি যখন এইভাবে বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে, তখনই বোঝা যায় ভারতবর্ষের প্রাণদায়িনী গঙ্গাকে আর্যসভ্যতার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য কী আকুল চেষ্টা করেছেন মহাভারতের কবি। তার জন্য ইক্ষ্বাকুবংশীয় মহাভিষের কাহিনী, অষ্টবসুর কাহিনী সব জুড়ে দিতে হয়েছে এবং তা জুড়তে হয়েছে প্রধানত ভরতবংশের ধুরন্ধর মহামতি ভীষ্মের জননীকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য। বাস্তবে সেই অজ্ঞাতকুলশীলা রমণীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা তত ছিল না বলেই হয়তো অত শত অভিশাপ কাহিনীর পরম্পরা, মহাভিষ এবং অষ্টবসুর রূপক আখ্যান।

হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসনে মহারাজ শান্তনুর উত্তরাধিকার নিয়ে গণ্ডগোল ছিল। কারণ তিনি ছিলেন মহারাজ প্রতীপের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র। শান্তনুর বড় দাদা দেবাপি রাজা না হয়ে মুনিবৃত্তি অবলম্বন করেন। তাঁর মেজদাদা বাহ্লীকও তাঁর মাতুলবংশের উত্তরাধিকারে রাজা হন অন্যত্র। অতএব শেষপর্যন্ত হস্তিনাপুরে রাজা হন শান্তনু। মহারাজ যযাতির বংশে কনিষ্ঠের রাজা হওয়াটা কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। যোগ্যতম ব্যক্তি হিসেবেই যে তিনি সিংহাসনের অধিকার পেয়েছিলেন, সেকথা আমি অন্যত্র আলোচনা করেছি।

জ্যেষ্ঠ দেবাপি বা মধ্যম বাহ্লীক রাজ্য না পাওয়ায় মহারাজ প্রতীপের অন্তরে কোনও দুঃখ হয়েছিল কি না, মহাভারতের কবি তা স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করেননি; কিন্তু, অজ্ঞাতকুলশীলা সেই রমণীকে মহারাজ প্রতীপ যে কথা দিয়েছিলেন, তা সর্বক্ষণ জাগরুক ছিল শান্তনুর মনে। তাঁর মনে ছিল পিতাঠাকুরের অনুরোধ-আদেশ—পরমাসুন্দরী এক রমণী তোমার কাছে বিবাহের যাচনা নিয়ে আসবে। তুমি তার পরিচয় জিজ্ঞাসা কোরো না বা তার কোনও কাজে বাধাও দিয়ো না। আমার আদেশে তুমি সেই রমণীর ইচ্ছাপূরণ কোরো—মন্নিয়োগাদ্‌ ভজন্তীং তাং ভজেথা ইত্যুবাচ তম্‌।

আমাদের ধারণা—শান্তনু তখন সদ্যই রাজা হয়েছেন, এবং রাজা হয়েছেন বলে মনে পরম শান্তি আসায় তিনি কিছুদিন মৃগয়া করে দিন কাটাবার পরিকল্পনা করলেন। মৃগয়ার বিলাসটুকু শান্তনুর স্বভাবের মধ্যে ছিল এবং অন্তত এইবার মৃগয়ায় যাবার পিছনে তাঁর কিছু গোপন উদ্দেশ্যও থেকে থাকবে হয়তো। যাই হোক, মৃগয়া চলতে লাগল রাজার ইচ্ছামতো। তারপর একদিন স্বেচ্ছাবিহারী রাজা চললেন গঙ্গার তীর বেয়ে। একাকী, ধনুক বাণ হাতে। কোনও বনহরিণীর শরীর এবং হৃদয় সন্ধান করার লক্ষ্য রেখে। সত্যি কথা বলতে কী, লক্ষ্যবস্তু তাঁর আগে থেকেই জানা ছিল। অতএব জায়গামতো এসে পৌঁছোতে কোনও অসুবিধা হল না তাঁর।

একাকী যেতে যেতে, সেই অপূর্বদর্শন রমণীর দেখা মিলল। তাঁর রূপে গঙ্গার তীর আলো হয়ে গেছে। মনোহরণ শরীরে অলংকারের শোভা, পরিধানের বস্ত্র কিছু সূক্ষ্ম, গায়ের রং পদ্মকোষের মতো গৌরাভ। শান্তনুর শরীর রোমাঞ্চিত হল। ভাবলেন বুঝি—এমন এক রূপসীর প্রেমে ধরা দেবার জন্য পিতাঠাকুরের আদেশের কোনও প্রয়োজন ছিল না। মুগ্ধ হয়ে এমনভাবেই তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন শান্তনু যেন মনে হচ্ছিল—চোখ দিয়ে তিনি পান করছিলেন রমণী-শরীরের প্রত্যঙ্গ রূপ-রস। অন্যদিকে সেই রমণীর মুগ্ধতাও কিছু কম চোখে পড়ল না। হস্তিনাপুরের রাজাকে দেখে অনুরাগে এতটাই তিনি উদ্বেল যে, বিলাসিনী রমণীর মতো তিনিও রাজার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সপ্রণয় দৃষ্টিতে। বস্তুত, ইক্ষ্বাকুবংশীয় মহাভিষের মুগ্ধতার ছবিটি এইখানেই শান্তনুর ওপর সুপার-ইমপোজ করতে হবে।

মহারাজ শান্তনু আর দেরি করলেন না। মৃগয়ার কারণে তিনি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছেন, অতএব মৃগ্যবস্তুর দর্শন-মুগ্ধতা কাটতেই তিনি বাক্য-সন্ধান করলেন—তুমি দেবী না মানবী? গন্ধর্বী না অপ্সরা? তুমি যে হও সে হও, তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে বরণ করতে চাই আমি—যাচে ত্বং সুরগর্ভাভে ভার্যা মে ভব শোভনে। রমণী এককথায় রাজি হলেন, কিন্তু একটা শর্তও দিলেন সঙ্গে সঙ্গে। বললেন—আমি তোমার বশবর্তিনী স্ত্রী হতেই পারি, মহারাজ। কিন্তু একটা কথা—আমি যা কিছুই করব তুমি তাতে বাধা দেবে না, মহারাজ! কিংবা আমার কোনও কাজের জন্য আমাকে কটু কথাও বলবে না। আমাকে বাধা দিলে বা কটু কথা বললে আমি তখনই তোমাকে ছেড়ে চলে যাব, মহারাজ—বারিতা বিপ্রিয়ঞ্চোক্তা ত্যজেয়ং ত্বামসংশয়ম্‌। শান্তনু রমণীর শর্ত মেনে নিলেন বিনা দ্বিধায়।

সেকালের দিনের সামাজিক অবস্থার নিরিখে এই রমণীর মুখে যে শর্তের কথা শুনি, তাতে বোঝা যায়—তিনি চালিকার আসনে বসেছিলেন, আর হস্তিনাপুরের অধিরাজ শান্তনু এই মোহিনী জাদুকরির হাতে পুত্তলিকামাত্র। রমণী নিজের কোনও পরিচয় দিলেন না, শান্তনুও তাঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে পারেননি, তাঁর পিতাঠাকুরও রমণীর পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে বারণ করেছেন। এই যে পরিচয় না দেওয়া, না নেওয়া এবং পরিচয় জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে বারণ—এই সবকিছু থেকে আমাদের ধারণা হয়—পরিচয় দেবার মতো কোনও পরিচয় এই রমণীর ছিল না।

নজর করার মতো আরও একটা জিনিস হল রমণীর ভাবভঙ্গি। নির্জন নদীতীরে অপূর্ব-দর্শনা রমণীকে দেখে শান্তনু মুগ্ধ হলেন, বা তাঁর দিকে একদৃষ্টে লোভীর মতো তাকিয়ে রইলেন—পুরুষমানুষের এই নির্লজ্জ ব্যবহার তবু সহ্য করা যায়; কিন্তু মহাভারতের কবি লিখেছেন—শান্তনুকে দেখে নদী-নায়িকা গঙ্গা তাঁর অন্তরস্থিত আবেগ ধারণ করে রাখতে পারেননি। একজন ‘বিলাসিনী’ রমণীর শরীর মন যেভাবে কামনায় উদ্বেলিত হয়, শান্তনুকে দেখে সেই ব্যবহারই করেছিলেন গঙ্গা। শান্তনুকে দেখে তাঁর তৃপ্তি হচ্ছিল না—নাতৃপ্যত বিলাসিনী।

হস্তিনাপুরের নায়ক আর এই অজ্ঞাতপরিচয় রমণীর মিলন-কৌতুকের পিছনে আরও একটি বড় ঘটনা হল—মহারাজ শান্তনু কিন্তু এই মুগ্ধা রমণীকে হস্তিনাপুরের রাজধানীতে নিয়ে আসেননি। বিবাহের যজ্ঞধূমে শান্তনুর নয়নযুগল যেমন অরুণিত হয়নি, তেমনই হস্তিনাপুরের কোনও মাঙ্গলিক শঙ্খধ্বনিতে রাজরানি বলে বধূ পরিচয় হয়নি নদী-নায়িকা জাহ্নবীর। মহাভারতের কবি এই রমণীর ওপর দেবনদীর মাহাত্ম্য আরোপ করে তাঁর নাম দিয়েছেন গঙ্গা। কিন্তু ওই যে নীতিশাস্ত্র বলে, নদীনাঞ্চ নখিনাঞ্চ ভারতস্য কুলস্য চ—নদী আর নখীর (নখযুক্ত জন্তুর) জন্মমূল খুঁজতে যেয়ো না, খুঁজতে যেয়ো না ভরতবংশের মূল পুরুষকে। তাতে ধন্দ বাড়বে, রহস্য রহস্যই থেকে যাবে।

মহাভারতের কবি অনেক সম্মানপুরঃসর নিবেদন করেছেন যে, স্বর্গের দেবী বা দেবনদী হওয়া সত্ত্বেও শুধু শান্তনুর সৌভাগ্যে তাঁর সঙ্গে কাম-ব্যবহার করতেন গঙ্গা। সে সৌভাগ্য এমনই যে, শান্তনু যাতে গঙ্গার সঙ্গে রমণসুখ অনুভব করেন, তার জন্য গঙ্গার সকাম প্রয়াস ছিল যথেষ্ট। কখনও রমণপূর্ব শৃঙ্গার, কখনও সম্ভোগ, কখনও নৃত্যগীত, হাস্যলাস্য—সম্ভোগ-স্নেহ-চাতুর্যে-হার্ব-লাস্যমনোহরৈঃ—যখন যেটি প্রয়োজন সেইরকম রমণ-নৈপুণ্য দেখিয়ে শান্তনুকে তুষ্ট করতেন গঙ্গা।

আমরা যে ভীষ্মের জীবন আলোচনার পূর্বেই সাতকাহন করে তাঁর জননীর আচার ব্যবহার নিয়ে ভাবছি, তার কারণ একটাই। ভরতবংশের এক প্রসিদ্ধ জাতকের জন্মমূলে যে রহস্য, তা সামান্য করে হলেও ভেদ করা যায় কিনা। আচ্ছা, এই যে নদী-নায়িকার শৃঙ্গার-মাধুরীর সামান্য ইঙ্গিত দিলাম, তাতে এমন দোষারোপ করার কোনও কারণ নেই যে, সেটা খুব ছোটলোকের মতো ব্যবহার। যৌবনবতী এক রমণীর এতাদৃশ ব্যবহার একান্ত প্রত্যাশিত। আমাদের খটকা লাগে—এই মধুর শৃঙ্গার-বর্ণনার পরেই মহাভারতের কবি মন্তব্য করেন—গঙ্গা শান্তনুর সঙ্গে যে সম্ভোগ-ব্যবহার করে চলেছিলেন, তা নাকি পরিণীতা পত্নীর মতো—ভার্য্যেবোপস্থিতাভবৎ। তার মানে—পরিণীতা স্ত্রীর সম্ভোগ-সার ব্যবহারের নির্দোষ তাৎপর্যটুকু এখানে আছে, কিন্তু পরিণীতা স্ত্রীর গৌরবের তাৎপর্যটুকু এখানে নেই। ভাষাটা দেখুন—ঠিক বিবাহিতা স্ত্রী নয়, বিবাহিতা স্ত্রীর মতো—ভাৰ্য্যা ইব।

সামান্য এই ‘মতো’ শব্দটির মধ্যেই নদী-নায়িকা গঙ্গার আসল পরিচয় নিহিত আছে বলে আমরা মনে করি। শান্তনু তাঁকে রাজবধূর মর্যাদায় হস্তিনাপুরে নিয়ে আসতে পারেননি অথবা আরও স্পষ্ট করে বলি—নিয়ে আসেননি। ভাবে বুঝি, যত দেবরূপিণীই হোন অথবা ‘বিলাসিনী’—তাঁর দেবরূপিতার মধ্যে ‘বিলাসিনী’ রমণীর আঙ্গিকটাই বড়, দেবরূপিতা সেখানে উপাখ্যানমাত্র। উপাখ্যানের বহিরঙ্গে অষ্টবসুর ক্রমান্বয়ে গঙ্গাগর্ভে জন্মলাভের ঘটনাও উপন্যাসেরই অন্য এক আঙ্গিক, যে আঙ্গিকে গঙ্গাকে দেবনদীর মর্যাদা দিয়ে তাঁর গর্ভজাত সন্তান নাশের ঘটনাগুলি সকারণ করে তোলা যায়।

বাস্তবে সন্তান নাশ করে কারা? সেই ‘বিলাসিনী’ রমণীরাই, যাঁরা ভার্যার মতো ব্যবহার করেন, কিন্তু ভার্যা নন। সত্যি কথা বলতে কী, মহাত্মা ভীষ্মদেব যে অজ্ঞাতপরিচয় রমণীর গর্ভে জন্মাবেন, তাঁকে অসামান্য গৌরব প্রদান করার জন্যই গঙ্গা নাম্নী এক রমণীকে যেমন অষ্টবসুর জননী হতে হয়েছে, তেমনই অষ্টবসুর উপাখ্যানেরও জননী হতে হয়েছে। বাস্তবে এমন হতেও পারে যে, রূপমুগ্ধ মহারাজ শান্তনুর চালিকার আসনে বসে সেই ‘বিলাসিনী’ রমণী ক্রমান্বয়ে তাঁর সন্তানগুলিকে জলে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন নিজের অপবাদমুক্তির জন্য এবং হয়তো একসময় অপবাদ নিন্দাবাদের পরোয়া না করে মহারাজ শান্তনু তাঁর ‘ভার্যার মতো’ প্রিয়তমাকে স্বেচ্ছাচার করতে বাধা দিয়েছেন।

আমরা যেন বেশ বুঝতেই পারি যে, ভীষ্ম জন্মাবেন বলেই তাঁর মাতৃদেবী গঙ্গার মাহাত্ম্যে ভূষিত, আর ভীষ্ম জন্মাবেন বলেই অভিশপ্ত অষ্টবসুর মর্ত্যভূমিতে জন্মলাভের আয়োজন। আটটি সন্তানের সাতটিকে পর পর জলে ডুবিয়ে মারা হল বলে শান্তনুর ধৈর্য অতিক্রান্ত হল শেষপর্যন্ত। অষ্টবসুর তেজে সমৃদ্ধ হয়ে গঙ্গার অষ্টম গর্ভের যে পুত্রটি জন্মালেন, গঙ্গা তাঁকে দেখে হেসে উঠলেন—অথ তামষ্টমে জাতে পুত্রে প্রহসতীমিব। শান্তনু প্রমাদ গুণলেন—এও কি সেই ক্রূর হাসিটি যা তাঁকে অষ্টমবার পুত্রশোক দেবে। শান্তনু বাধা দিয়ে বললেন—আর নয়। আর আমার সন্তান বধ করা চলবে না। তুমি কে, কার মেয়ে, কেনই বা তুমি এমন করে আমার ছেলেদের মেরে ফেলছ।

উপাখ্যানের গৌরবমণ্ডিতা গঙ্গা এবার গম্ভীর হয়ে বললেন—আর তোমার পুত্রবধ করব না, কিন্তু তোমার সঙ্গে এতকালের মধুর সহবাসও আজ আমার শেষ হয়ে যাবে। তুমি কথা দিয়েছিলে—আমার কোনও কাজে তুমি বাধা দেবে না—জীর্ণো’স্তু মম বাসো’য়ং যথা স সময়ঃ কৃতঃ। গঙ্গা এবার নিজের পরিচয় দিলেন। দেবকার্য সিদ্ধ করার জন্যই যে তিনি মনুষ্যরূপিণী হয়েছেন, সে কথা জানিয়ে অষ্টবসুর প্রতি বশিষ্ঠের অভিশাপ, তাঁদের অনুরোধ এবং শেষপর্যন্ত তাঁদের মুক্ত করার জন্যই যে তিনি শান্তনুর স্ত্রীত্ব স্বীকার করেছেন—এইসব বৃত্তান্ত শান্তনুকে জানালেন গঙ্গা।

আপন স্ত্রীর ‘মতো’ ব্যক্তিটির এমন মাহাত্ম্য শুনে মহারাজ শান্তনুর চক্ষুদুটি বিস্ময়ে বিস্ফারিত হল যতটুকু, কিন্তু সেই কাহিনীর চমৎকারে আধুনিক গবেষকের হৃদয় গলল না। তাঁরা গঙ্গার আচারআচরণ এবং সামাজিক স্থিতি লক্ষ করে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন—Other instances of Gandharva marriage, such as Ganga and Santanu…also present the free love union of some nymphs and dolphins, very probably women from some non-Aryan tribes.

গবেষকের কথা শুনে সুরসরিৎ গঙ্গাকে সোজাসুজি অনার্যজাতীয়া রমণী বলব কি না, সে সম্বন্ধে তর্কযুক্তি দেওয়া যেতেই পারে নানারকম। কিন্তু এটাও তো ঘটনা যে, শান্তনু তাঁকে হস্তিনাপুরের রাজধানীতে নিয়ে যেতে পারেননি। হস্তিনাপুরের রাজলক্ষ্মীকে রাজধানীতে রেখে বার বার তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছে গঙ্গাদ্বারের তীরভূমিতে গৃহলক্ষ্মীর খোঁজে। তিনি এখানে রমণীর সঙ্গলাভ করেছেন স্বামীর মতো, কিন্তু স্বামী ঠিক নন। আর কোন ধরনের রমণীর পক্ষেই বা এক প্রসিদ্ধ রাজপুরুষকে রাজধানীর বাইরে শুধুমাত্র সম্ভোগ-চাতুর্যে ব্যস্ত রাখা সম্ভব! এমনই সেই সন্তুষ্টির প্রক্রিয়া, যাতে ওই গঙ্গা ছাড়া আর কোনও ইতর বিষয়ে শান্তনুর পক্ষে মন দেওয়া সম্ভবই ছিল না—রাজানং রময়ামাস যথা রেমে তয়ৈব সঃ। এ ছাড়া মহারাজ শান্তনুর কোষ্ঠীতে স্ত্রীভাগ্যটাই বুঝি এইরকম। তাঁর জীবনে যে দুটি প্রেম এসেছে, তার একটি তো এইরকম; আর দ্বিতীয়টি জেলের ঘরে মানুষ হওয়া মেয়ে। কাজেই অনার্যজাতীয় রমণীর সঙ্গেই তাঁর ঠিকুজি-কুষ্ঠির স্ত্রীভাব জড়িত।

লক্ষণীয় বিষয় আছে আরও একটা। শান্তনুর অনুরোধে এবং উপরোধে যে পুত্রটিকে বাঁচিয়ে রাখলেন গঙ্গা, রাজা সেই পুত্রকে নিয়ে রাজধানীতে ফিরতে পারলেন না। হয়তো রাজার গৌরবহানি করতে না চেয়েই গঙ্গা তাঁকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নিজের পছন্দমতো জায়গায় চলে গেলেন—আদায় চ কুমারং তং জগামাথ যথোপ্সিতম্‌। অলৌকিক উপাখ্যানের মাঝখানে ঠিকই একবার মহাভারতের কবির মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল—গঙ্গা নিজের পছন্দমতো জায়গায় চলে গেলেন—জগাম। অনুবাদক পণ্ডিতেরা গঙ্গার মাহাত্ম্য বৃদ্ধি করার জন্য সাধু অনুবাদে বললেন—বালকটিকে লইয়া সেইখানেই অন্তর্হিত হইলেন। কিন্তু ওই যে বলেছি—মুখ ফসকে সত্য কথাটিই বেরিয়েছে কবির মুখে। কবি বলেছেন—জগাম—চলে গেলেন। এই সংস্কৃত শব্দটির মধ্যে কোনও অলৌকিক অন্তর্ধান না লক্ষ করাই ভাল। তাতে যথার্থতা থাকে না।

চলে যাবার আগে গঙ্গা বলেছিলেন—তোমার যে ছেলেটিকে আজ আমি নিয়ে চললাম, সে বড় হলে তোমার কাছে আবার ফিরে আসবে—বিবৃদ্ধঃ পুনরেষ্যতি। গঙ্গা আরও বললেন—কখনও যদি এমন হয় যে, আমাকেও তুমি ডাকলে, তা হলে সেই ডাক শুনে আমিও সঙ্গে সঙ্গে তোমার কাছে উপস্থিত হব, মহারাজ—অহঞ্চ তে ভবিষ্যামি আহ্বানোপগতা নৃপ। গঙ্গার এই দুটি পরিষ্কার লৌকিক প্রতিজ্ঞার মধ্যে ‘বালকটিকে লইয়া’ অলৌকিক অন্তর্ধানের কথাও আসে না, তাঁর আবির্ভাবের কথাও আসে না। যে ছেলের মা স্বয়ং হস্তিনাপুরে প্রবেশ করতে পারেননি, তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করলে যে মহারাজ শান্তনুর স্বস্তি বিঘ্নিত হবে, সে কথা এই নদী-নায়িকা বুঝতেন। আর ‘বিবৃদ্ধঃ পুনরেষ্যতি’—এই কথাটির মানে সিদ্ধান্তবাগীশ যে কী করে—‘আপনার পুত্র এই বালক অত্যন্ত বৃদ্ধ হইয়া পুনরায় স্বর্গে যাইবেন’—এইরকম করলেন, তা আমার সংস্কৃত জ্ঞানে কুলোয় না। কেন না ‘পুনঃ’ অর্থাৎ পুনরায় শব্দটাই এখানে ব্যর্থ হয়ে যায়, যদি না বলি—তোমার এই পুত্র বড় হয়ে পুনরায় তোমার কাছে ফিরে আসবে।

মহাভারতের তথাকথিত অনার্য রমণী বলে যাঁদের চিহ্নিত করা যায়, তাঁরা হলেন হিড়িম্বা, উলূপী ইত্যাদি। এঁরাও কিন্তু তাঁদের স্বামীদের ওই একই কথা বলেছেন—তোমরা ডাকলেই আমরা চলে আসব। গঙ্গার মুখেও সেই একই কথা—ডাকলেই আসব—আহ্বানোপগতা নৃপ। তা ছাড়া, হিড়িম্বা উলূপীদের পুত্রেরাও হস্তিনাপুরের রাজধানীতে আসেননি, তাঁরা মায়ের কাছেই ছিলেন। গঙ্গার মাহাত্ম্য এবং গৌরব যদি হিড়িম্বা, উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদার থেকে বেশি না হয়, তা হলে অলৌকিক চমৎকারসৃষ্টির চেয়েও বাস্তবের যুক্তিগ্রাহ্যতা বেশি আসে। মহাভারতের কবির আশাও হয়তো তাই। হিড়িম্বা যেমন ভবিষ্যতে ঘটোৎকচ নামে পুত্র লাভ করে ভীমকে আপন প্রণয়বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবেন, তেমনই গঙ্গাও পুত্রকে নিজের কাছে রেখে শান্তনুর প্রেমবন্ধন ছিন্ন করে দিলেন। প্রথমজাত গূঢ় পুত্রটিকে নিজের সঙ্গে না নিয়ে যেতে পেরে দুঃখিত মনে হস্তিনাপুরীতে ফিরে এলেন শান্তনু—শান্তনুশ্চাপি শোকার্তো জগাম স্বপুরং ততঃ।

তারপর বেশ কিছু সময় কেটে গেছে। শান্তনু এতাবৎ পর্যন্ত বিবাহও করেননি, অন্য কোনও রমণীর প্রতিও তিনি আর সাভিলাষে তাকাননি। হিড়িম্বা কিংবা উলূপী প্রভৃতির ক্ষেত্রে ভীম অর্জুনের সান্ত্বনা ছিল যে, এদের ছেড়ে আসার অচিরকালের মধ্যেই এঁরা নতুন আলোয় নবতরা রমণীর সন্ধান পেয়েছেন। কিন্তু মহারাজ শান্তনু বিরহী প্রেমিক। এখনও গঙ্গার মোহিনী মায়া তাঁর মন জুড়ে আছে, উপরন্তু মনে পড়ে সেই প্রথমজাত পুত্রটির কথা—তাঁরই আগ্রহাতিশয্যে যে পুত্রের প্রাণরক্ষা হয়েছে। রাজধানীতে বেশ কিছু কাল অতীত হয়ে যাবার পর শান্তনুর মন আবারও চঞ্চল হয়ে উঠল।

মহাভারতের কবি শান্তনুর চাঞ্চল্য উপশম করার জন্য তাঁকে মৃগয়ায় নিয়ে এসেছেন এবং তা অবশ্যই একাকী। এ কেমন মৃগয়া, যেখানে একটি মৃগের প্রতি শরসন্ধান করার পর সেই বাণবিদ্ধ মৃগের অনুসরণ-ক্রমে সেই গঙ্গার তীরভূমিতে বার বার এসে উপস্থিত হতে হয়! আমরা বেশ জানি—এই মৃগয়ার মধ্যে মৃগবধের তত্ত্ব কিছু নেই, যা আছে, তার সবটাই সেই হরিণ-আঁখি নদী-নায়িকার অন্বেষণ। বস্তুত, তাঁকেই তিনি প্রেমের বাণে বিদ্ধ করে রেখেছিলেন, হয়তো সেই বাণবিদ্ধা হরিণীর অন্বেষণেই বার বার এই মৃগয়া। ‘মৃগ্‌’ ধাতুর অর্থই যে খোঁজা, সে খোঁজা এখানে যতখানি না মৃগের জন্য, তার চেয়ে অনেক বেশি সেই মার্গীতব্যা রমণীর জন্য।

শান্তনু অবাক হয়ে দেখলেন—গঙ্গার জল বড় অল্প। কী ব্যাপার, এমন তো হবার কথা নয়। নদী-নায়িকা গঙ্গার জলপ্রবাহ শীর্ণ হল কী করে, এমনটি তো আগে দেখা যায়নি! গঙ্গা যেন আর আগের মতো বইছে না—স্যন্দতে কিং ত্বিয়ং নাদ্য সরিচ্ছ্রেষ্টা যথা পুরা। অন্তরে অদম্য কৌতূহল নিয়ে শান্তনু গঙ্গার তীর ধরে এগোতে লাগলেন। খানিক এগোতেই তিনি এক বালককে দেখতে পেলেন। বালকের শরীরে এখনও কৈশোরের গন্ধমাখা। কিন্তু কৈশোরগন্ধী বয়সেও বড় সুঠাম তার শরীর, মহাবলবান, মহাতেজস্বী। শান্তনু দেখলেন—বালক একটার পর একটা বাণ গেঁথে গঙ্গার স্রোতোরাশি রুদ্ধ করে দিয়েছে—কৃৎস্নাং গঙ্গাং সমাবৃত্য শরৈস্তীক্ষ্নৈরবস্থিতম্‌।

একটি বালকের এই অতিমানুষ কর্ম দেখে শান্তনু একেবারে অবাক হয়ে গেলেন, কিন্তু কোনও মতেই সেই কৈশোরগন্ধী প্রায়-যুবক পুরুষটিকে তিনি চিনতে পারলেন না। কিন্তু বালক বুঝি তাঁকে চিনতে পারল। হয়তো মায়ের কাছে এই মানুষটির বর্ণনা সে বহুবার শুনেছে। কত শত কথা প্রসঙ্গে হস্তিনাপুরের রাজার চিত্রকল্প সে দেখতে পেয়েছে মায়ের কল্পনামাধুরীতে। অতএব শান্তনুকে দেখামাত্রই বালকের হৃদয় উদ্বেলিত হল। সে বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়াল না। শান্তনুকে দেখে অতিপ্রিয়জনের সান্নিধ্য মনে মনে অনুভব করেই বালক যেন কী ভেবে কোথায় উধাও হয়ে গেল।

শান্তনুর বোধহয় মনে পড়ল সেই শিশু পুত্রটির কথা, যাকে তিনি কোনও শৈশবকালে মায়ের অঞ্চলছায়ায় লুক্কায়িত দেখেছেন। কিন্তু এখন এই আশ্চর্য সময়সন্ধিতে কিছুতেই সেই শিশু-মুখখানি ভাল করে মনে পড়ল না শান্তনুর—নোপলেভে স্মৃতিং ধীমানভিজ্ঞাতুং তমাত্মজম্‌। ভাবলেন বুঝি—এই সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন সেই পুরাতনী প্রেয়সী, যিনি তাঁর ডাক শুনলেই সামনে উপস্থিত হবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। শান্তনু তাই গলা ছেড়ে ডাকতে আরম্ভ করলেন—গঙ্গা! গঙ্গে!

বালকটি যেমন করে ঘটনাস্থল থেকে অন্তর্হিত হয়েছিল, তাতে সন্দেহ করি—সে তার মাকে ডেকে আনতেই গিয়েছিল। মায়ের মুখে যাঁর এত বর্ণনা শুনেছে, তাঁকে সামনে উপস্থিত করে দিয়ে জননীকে বিস্মিত করে দেবার প্রয়াস নিয়েছিল বালক। অতএব শান্তনুর ডাক শুনেই হোক অথবা পুত্রের বিস্ময়-মুকুলিত মুখখানি দেখেই হোক, গঙ্গা আপন পুত্রের হাতখানি ধরে উপস্থিত হলেন শান্তনুর সামনে।

এখনও সেই পুরাতনী নায়িকার রূপ কম নয়। সর্বাঙ্গে অলংকার, পরিধানে নির্মল শুভ্র বসন—অলঙ্কৃতামাভরণৈ-র্বিরজো’ম্বরসংবৃতাম্। অপূর্ব রূপরাশির মধ্যে এই নির্মল শুভ্রতা তাঁর মধ্যে এমনই এক গাম্ভীর্য এবং আভিজাত্য এনে দিয়েছে যে, শান্তনুর মনে হল—এই কি সেই রমণী, যিনি হাবেভাবে লাস্যে রঞ্জিত করতেন তাঁকে। শান্তনু যেন ভাল করে চিনতে পারলেন না রমণীকে। কতবার কত শত ঘন আলিঙ্গনের মধ্যে যাঁকে প্রত্যক্ষ করেছেন, তাঁকে যেন আজকে ঠিক চিনতে পারলেন না শান্তনু—দৃষ্টপূর্বামপি স তাং নাভ্যজানৎ স শান্তনুঃ।

শুধু এই একটিমাত্র পঙ্‌ক্তি থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে গঙ্গা কোনও অলৌকিক দেবী বা নদী নন। যদি হতেন, তা হলে তাঁকে চিনতে কোনও অসুবিধে হত না রাজার। অলৌকিক দেবীদের রূপযৌবন একইরকম থাকে। বেশ বুঝতে পারি, এই কয়েক বছরে এই রমণীর বয়স হয়েছে, তাঁর রূপে পরিবর্তন এসেছে, উচ্ছল উজ্জ্বল রূপরাশির মধ্যে নির্মল গাম্ভীর্য অনুপ্রবিষ্ট হয়েছে। মহারাজ শান্তনুকে অবাক করে দিয়ে গঙ্গা তাঁর ডান হাতে ধরা পুত্রটিকে দেখিয়ে বললেন—মহারাজ! এই তোমার সেই অষ্টম পুত্র; বহুকাল আগে আমারই গর্ভে তোমার এই পুত্রের জন্ম হয়েছিল—যং পুত্রমষ্টমং রাজন্ ত্বং পুরা ময্যমবিন্দথাঃ। আমি এতকাল ধরে এই পুত্রকে বড় করেছি, মানুষ করেছি। এবারে তুমি একে তোমার ঘরে নিয়ে যাও—গৃহাণেমং মহারাজ ময়া সংবর্ধিতং সুতম্।

প্রশ্ন উঠতে পারে—এতদিন মায়ের ঘরে থাকা একটি গূঢ় পুত্রকে মহারাজ রাজধানীতে নিয়ে যাবেন কী করে! শান্তনু হস্তিনাপুরের রাজা। একজন রাজপুত্রের যেসব সংস্কার প্রাপ্য সেগুলি যদি না হয়ে থাকে, তবে এই প্রায়-যুবক একটি পুত্রকে রাজধানীতে নিয়ে গিয়ে কীভাবে মন্ত্রী-পুরোহিতের কাছে জবাবদিহি করবেন শান্তনু? মহাভারতে যাঁরা শকুন্তলা-দুষ্যন্তের কাহিনী পড়েছেন, তাঁদের মনে পড়বে—মহাভারতের শকুন্তলাও যখন তাঁর অরণ্যজাত রাজপুত্রকে নিয়ে গিয়ে দুষ্যন্তের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন দুষ্যন্ত তাঁর রাজমন্ত্রী-পুরোহিতদের ভয়েই সেই গূঢ়জাত পুত্রের জন্ম স্বীকার করেননি। এখানেও সেই একই সমস্যা। কিন্তু মহারাজ শান্তনু আর দুষ্যন্ত এক নন। বিশেষত এই রমণীর সঙ্গে তাঁর সঙ্গতি ঘটেছে তাঁর পিতার সম্মতিক্রমেই। আর গঙ্গাও শকুন্তলা নন, আশ্রমবালিকার মতো নত-নম্রাও তিনি নন।

অতএব শান্তনুর দিক থেকে কোনও প্রশ্ন ওঠবার আগেই অসামান্য ব্যক্তিত্বময়ী গঙ্গা বললেন—আমি তোমার ছেলেকে উপযুক্তভাবেই মানুষ করেছি মহারাজ! সমস্ত বেদ এবং বেদাঙ্গ পড়বার জন্য আমি একে বশিষ্ঠমুনির কাছে পাঠিয়েছিলাম। তাঁর কাছ থেকে সাঙ্গ বেদ শিখে এসেছে তোমার পুত্র—বেদানধিজগে সাঙ্গান্‌ বশিষ্ঠাদেষ বীর্যবান্‌। ক্ষত্রিয়ের শিক্ষণীয় যে অস্ত্রবিদ্যা, তাতে এই পুত্রের এতটাই অধিকার যে, দেবতা এবং অসুর কারও পক্ষে এর সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব হবে না। সুরাসুর-নমস্য জামদগ্ন্য পরশুরাম এই পুত্রের অস্ত্রগুরু। পরশুরাম যে অস্ত্রবিদ্যা জানেন তার সবটাই এই যুবকের আয়ত্ত। আর বাকি থাকে রাজনীতিশাস্ত্রের কথা। দেবতাদের রাজনীতি একরকম, অসুরদের আর একরকম। দেবতাদের রাজনীতিশাস্ত্রের প্রবক্তা হলেন বৃহস্পতি আর অসুরদের রাজনীতিশাস্ত্র লিখেছেন শুক্রাচার্য। কিন্তু তোমার এই পুত্র সুরাসুর দুই পক্ষেরই রাজনীতি জানে। আমি অপার চেষ্টায় তোমার এই পুত্রকে সমস্ত শাস্ত্রে পরম অভিজ্ঞ করে তুলেছি। আজকে তুমি যখন এসেছ, তখন আমার হাতে-গড়া এই পুত্রকে তুমি রাজধানীতে নিয়ে যাও—ময়া দত্তং নিজং পুত্ৰং বীরং বীর গৃহং নয়।

গঙ্গার মুখে পুত্রের যেসব শিক্ষাগুরুর নাম শুনেছেন শান্তনু, তাতে আর কোনও কথা চলে না। তিনি বিনা দ্বিধায় তাঁর পুরাতনী প্রেয়সীর হাত থেকে পুত্রকে গ্রহণ করলেন এবং ফিরে এলেন রাজধানীতে। রাজধানীর মন্ত্রী-অমাত্য-পুরোহিতেরা কেউ কোনও অস্বস্তিকর প্রশ্ন তাঁকে করল না। আমাদের ধারণা—মহারাজ প্রতীপের সম্মতিক্রমে বহু পূর্বে শান্তনু যে গঙ্গাবিহার সম্পন্ন করেছিলেন, তা রাজধানীর কারও অবিদিত ছিল না। রাজধানীর সকলেই জানতেন—রাজা কী করছেন অথবা কোথায় আছেন। হয়তো এই কারণেই রাজধানীর মন্ত্রী অমাত্যদের সামনে কোনও জবাবদিহি করতে হয়নি শান্তনুকে।

গঙ্গার তীরভূমি থেকে পুত্রকে রাজধানীতে নিয়ে এসে শান্তনু যথেষ্ট সপ্রতিভ হয়ে উঠলেন। তাঁর জ্ঞাতিগুষ্টি, মন্ত্রী-অমাত্যদের সঙ্গে শান্তনু নিজেই তাঁর পুত্রের পরিচয় করালেন। প্রখর বাস্তববোধে আরও একটি কাজ শান্তনু করলেন। পুত্রকে সটান যুবরাজের পদে বসিয়ে দিলেন। হয়তো তাঁর মনে কিছু চিন্তা ছিল। পুরু-ভরতবংশের লতাপাতায় জন্মানো কেউ যদি শান্তনুর ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তাই সেই অধম প্রয়াস মূলেই স্তব্ধ করে দিলেন শান্তনু। বিশেষ যুবরাজ-পদে অধিষ্ঠিত পুরুষটির আদেশ-অনুশাসনও যেহেতু মন্ত্রী-অমাত্যদের কাছে অনতিক্ৰমণীয় ছিল, অতএব এতকাল অপরিচিত আপন পুত্রকে রাজ্যশাসনের এই গুরুত্বপূর্ণ পদে প্রতিষ্ঠিত করে শান্তনু তাঁকে প্রথমেই অলংঘনীয় করে তুললেন—গুণবন্তং মহাত্মানং যৌবরাজ্যে, ভ্যষেচয়ৎ।