দ্রোণাচার্য – ৬

॥ ৬ ॥

দ্রোণের দুঃখী জীবনের অবসান ঘটল। তিনি কুরুকুমারদের আচার্য নিযুক্ত হলেন। এখন থেকে তাঁকে আমরা দ্রোণাচার্য বলব। তাঁকে আর কৃপাচার্যের আশ্রয়ে ফিরে যেতে হল না। সেই কখন অগ্নিহোত্র সারবার সময় বালকদের অনুরোধে তাঁদের খেলার বীটা তুলে দিয়েছিলেন, তারপর বালকদের পীড়াপীড়িতেই ভীষ্মের সঙ্গে তাঁকে দেখা করতে হয়েছে। এখন জীবিকার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে কুরুবাড়িতেই খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিলেন তিনি। ভীষ্ম যাঁকে সম্মান করে নাতিদের আচার্য পদে বরণ করেছেন, কুরুবাড়ির লোকে সেই মর্যাদা বুঝেই তাঁর বিশ্রামের ব্যবস্থা করেছে—বিশশ্রাম মহাতেজাঃ পূজিতঃ কুরুবেশ্মনি। খানিকক্ষণ বিশ্রাম হলে পাণ্ডব-কৌরব সকল কুমারদের দ্রোণাচার্যের হাতে তুলে দিয়ে ভীষ্ম তাঁর প্রাথমিক প্রয়োজনগুলির সুব্যবস্থা করলেন সবার আগে। নগদ টাকাপয়সা তো কিছু দিলেনই, সঙ্গে সঙ্গে একটি সুসজ্জিত গৃহের ব্যবস্থা করলেন আচার্যের জন্য। দ্রোণ সেখানে পুত্র-পরিবার নিয়ে থাকবেন সসম্মানে। অন্ন-পান-ভোজন যাতে তাঁকে যাচনা করে না নিতে হয় সেজন্য তাঁর গৃহের মধ্যেই মজুদ রইল ধনধান্যের ভাণ্ডার—গৃহঞ্চ সুপরিচ্ছন্নং ধনধান্যসমাকুলম্।

এমন একটি দিনের স্বপ্ন দেখেছেন দ্রোণ। এতকাল ধরে দেখেছেন। কিন্তু কোনও দিন যে স্বপ্ন সফল হবে এমনটি কি ভেবেছেন কখনও। এই একটু আগেই যখন কৃপাচার্যের বৃত্তিলোপের ভাবনা হল তাঁর মনে, তখনও তিনি ভীষ্মকে বলেছেন—তার চেয়ে এই ভাল। আমি কিছু ধন যাচনা করে নিই আপনার কাছ থেকে। তারপর খুশি হয়ে চলে যাই নিজের সেই পুরাতন আশ্রমে—স্বমাশ্রমপদং রাজন্ গমিয্যামি যথাগতম্‌। দ্রোণ যে এর চেয়ে বেশি ভাবতে পারেন না। খানিকটা অর্থলাভ এবং তাত ক’দিন সংসার চালিয়ে দারিদ্র্য নিবৃত্তি করা, এই তো তাঁর অভ্যাস হয়ে গেছে। সেখানে আজ তাঁর একটি সুসজ্জিত গৃহ, ধনধান্য, দাসদাসী সব হয়েছে। আজ কি তাঁর পূর্বস্মৃতি জেগে উঠছে একটুও। মনে পড়ছে কি বালক অশ্বত্থামা দুগ্ধবোধে পিষ্টরস সেবন করছেন, আর অন্য ধনী বালকেরা তাই দেখে হাসছে। ভাবতে পারছেন কি—সারা পঞ্চাল দেশ ঘুরে ব্রাহ্মণ দ্রোণাচার্য একটি দুগ্ধবতী গাভীর দানটুকুও পেলেন না।

সত্যি কথা বলতে কী, দ্রোণাচার্যের মনে এসব পুরাতন স্মৃতি দাগ কাটে না। কষ্ট করে যাঁরা প্রতিষ্ঠিত হন, তাঁরা জীবনে একবার ‘ব্রেক-থ্রু’ পেলে আর দুঃখের স্মৃতি মনে রাখেন না, বরঞ্চ দরিদ্র জীবনে যাঁদের কাছ থেকে লাঞ্ছনা গঞ্জনা লাভ করেছেন, তাঁদের ওপর প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা এবং তাঁদেরকে ছাড়িয়ে যাবার একটা নেশা তাঁদের মনের মধ্যে কাজ করতে থাকে। আর ঠিক সেই জন্যই পাণ্ডব-কৌরব-সকলকে শিষ্যত্বে স্বীকার করার পরেই তিনি তাঁদের একান্তে নিয়ে গেলেন নির্জনে, যেখানে তাঁর নবপাঠে আগ্রহী শিষ্যরা ছাড়া আর কেউ নেই—রহস্যেকঃ বিনীতাত্মা কৃতোপসদনাংস্তদা। দ্রোণ বললেন—আমার মনে একটা গভীর গোপন ইচ্ছে আছে, সে ইচ্ছে দিন-রাত ঘুরপাক খায় আমার মনের মধ্যে—কাৰ্যং মে কাঙ্ক্ষিতং কিঞ্চিদ্‌ হৃদি সম্পরিবর্ততে—তোমাদের অস্ত্রশিক্ষা সম্পূর্ণ হয়ে গেলে, তোমরা আমার অভিলাষ পূর্ণ করবে, কথা দাও—কৃতাস্ত্রৈস্তৎ প্রদেয়ং মে তদৃতং বদতানঘাঃ।

আচার্যের সমস্ত আকুলতা সত্ত্বেও কেউ কিন্তু কথা দিলেন না। একশো ভাই কৌরবরা একেবারে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন—তচ্‌শ্রুত্বা কৌরবেয়াস্তু তুষ্ণীমাসীৎ বিশাম্পতে। একমাত্র পাণ্ডব অর্জুন কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে না রেখে—গুরু বলেছেন অতএব করতে হবে—এইরকম এক দৃঢ়তায় জবাব দিলেন সপ্রতিজ্ঞ ভঙ্গিতে—আমি আপনার ইচ্ছা পূরণ করব আচার্য—অর্জুনস্তু ততঃ সর্বং প্রতিজজ্ঞে পরন্তপ। দ্রোণাচার্যের কী বাঞ্ছিত, তা অর্জুন জানেন না, কী তাঁকে করতে হবে, তাও তিনি জানেন না। শুধু জানেন—গুরু বলেছেন অতএব করতে হবে। অর্জুনের এই মানসিক দৃঢ়তা দ্রোণাচার্য বুঝেছেন। অসাধারণ বীরতা যে একতমত্ব সৃষ্টি করে, মানসিক শৌর্য যে ‘হিরোয়িক আইসোলেশন’ তৈরি করে, সেই বীরতা এবং মানসিক শৌর্য যে এই ছেলেটির মধ্যে আছে, সেটা পুরোপুরি অনুভব করেই এক মুহূর্তেই যেন অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতগ্রস্ত হয়ে পড়লেন দ্রোণাচার্য। কেউ তো জানে না, কত বড় অপমান হৃদয়ের মধ্যে পুষে রেখে দ্রোণাচার্য শিষ্যদের কাছে এই প্রতিদান কামনা করেছেন। অতএব যে মুহূর্তে অর্জুনের মুখে তাঁর প্রতিজ্ঞাবাক্য শুনেছেন, সেই মুহূর্তে তাঁর কল্পিত ইচ্ছাপূরণের ভাবনায় দ্রোণাচার্য জড়িয়ে ধরেছেন অর্জুনকে। বার বার সস্নেহে তাঁর মস্তকাঘ্রাণ করে আনন্দে কেঁদে ফেলেছেন। দ্রোণাচার্য—প্রীতিপূর্বং পরিষ্বজ্য প্ররুরোদ মুদা তদা। সঙ্গে সঙ্গে প্রিয় পুত্র অশ্বত্থামাকে ডেকে তাঁর হাতখানি অর্জুনের হাতে দিয়ে বলেছেন—বাছা! আজ থেকে এই অর্জুনকে তোমার প্রিয় সখা বলে জানবে। অর্জুন সখার মতো তাঁকে একবার জড়িয়ে ধরলেন বটে, কিন্তু ধর্মানুসারে গুরুপুত্র গুরুবৎ পূজ্য বলে সঙ্গে সঙ্গেই অশ্বত্থামার চরণ স্পর্শ করে বলেছেন—আজ থেকে দ্রোণাচার্যের মতো আমি আপনারও অধীন হলাম, আমি আপনারও শিষ্য বটে—শিষ্যো’হং তৎপ্রসাদেন…পরবানস্মি ধর্মতঃ।

মহাভারতের কথা প্রসঙ্গে অনেকে আমার কাছে অনুযোগ করে বলেন—এই দ্রোণাচার্য বড় পক্ষপাতগ্রস্ত মানুষ, বড়ই একপেশে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। পাণ্ডব অর্জুনের ব্যাপারে তিনি একেবারে অন্ধ। এই অর্জুনের কারণে কর্ণ তাঁর কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে গিয়েও ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন, এই অর্জুনের জন্য নিষাদ একলব্যের বুড়োআঙুল কাটা গেছে…ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি কথাগুলো শুনি আর ভাবি। ভাবি, মানবতার জন্য এই ব্যক্তিদের কত দরদ, কত ভাবনা। মানবতার কারণে যাঁদের এত সমানদর্শিতা তাঁরা কি মানবমনের গহন কথা একটুও বোঝেন? বোঝেন কি, যাঁরা গুরু হন, শিক্ষক হন, আচার্য হন, তাঁরা আগে একজন মানুষ, তারপরে তাঁরা গুরু শিক্ষক অথবা আচার্য। ভাবুন তো, দ্রোণের মনে দ্রুপদের ওপর প্রতিশোধ নেবার যে ভাবনা বার বার আবর্তিত হচ্ছিল—দ্রোণের নিজের ভাষায়—হৃদি সম্পরিবর্ততে—কই সে ব্যাপারে কেউ তো না বুঝে, না শুনে কথা দিলেন না। অর্জুন তো সে কথা দিলেন। তা হলে দ্রোণাচার্যের সুচিরদগ্ধ মানস লোকের কথা ভেবে বলুন—অর্জুনের প্রতি তিনি পক্ষপাতগ্রস্ত হবেন কি না?

এর পরেও কথা আছে। অর্জুন যখন দ্রোণের অস্ত্র-পাঠশালার ছাত্র হলেন, তখন তো সকলের মধ্যে তিনি একজনমাত্র। সেখানে কৌরব-পাণ্ডবরাই শুধু নন, দ্রোণের শিক্ষা পদ্ধতির প্রশংসা এত দূর পৌঁছেছিল যে শূরসেন-মথুরা অঞ্চলের বৃষ্ণি-অন্ধক বংশীয় রাজকুমারেরা তথা অন্যান্য দেশ থেকেও বহু রাজকুমার এসে দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ করলেন—বৃষ্ণয়শ্চান্ধকাশ্চৈব নানাদেশ্যাশ্চ পার্থিবাঃ। এঁদের মধ্যে কর্ণও তো ছিলেন। কর্ণের ব্যথায় বিগলিত হৃদয় কিছু অল্পশ্রুত পাঠক আমাকে জিজ্ঞাসা করেন—দ্রোণাচার্য কর্ণকে সূতপুত্র বলে শিক্ষাদান অসম্পূর্ণ রেখে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেন। আমি বলি—ওরে! কর্ণকে প্রত্যাখ্যানের কারণ অন্য। তাঁকে যদি সূতপুত্র বলে প্রত্যাখ্যান করতেন দ্রোণ, তা হলে তিনি তাঁকে পাঠশালাতেই ঢোকাতেনই না। অথচ এটা জলের মতো পরিষ্কার যে, পাণ্ডব-কৌরবদের সঙ্গে কর্ণও অস্ত্রশিক্ষা করতে ঢুকেছিলেন দ্রোণের কাছে—সূতপুত্ৰস্তু রাধেয়ো গুরুং দ্রোণমিয়াত্তদা।

পাণ্ডব, কৌরব, কর্ণ এবং নানা দেশ থেকে আগত রাজপুত্রদের মধ্যে যিনি অস্ত্রশিক্ষায় সকলকে পিছনে রেখে এগিয়ে যেতে লাগলেন, তিনি কিন্তু সেই অর্জুন। কেমন করে এই এগোনো সম্ভব হল? মহাভারতের কবি বলেছেন—সে তাঁর নিজের গুণ। শিক্ষা, বাহুবল, উদ্যোগ এবং যা তিনি শিখছেন, তার প্রতি ভালবাসা ছিল বলেই শিক্ষাভুজবলোদ্যোগৈঃ…অস্ত্রবিদ্যানুরাগাচ্চ—অর্জুন সবার আগে এগিয়ে গেছেন। দু হাজার বছর আগে একজন শিক্ষকের অনুভূতিতে ব্যাস যা বলে গেছেন, তা এই বিংশ শতাব্দীর শেষ কল্পে দাঁড়িয়ে থাকা একজন শিক্ষকের অনুভূতির সঙ্গে সমান মিলবে। আমরা বলে থাকি—ক্লাসের মধ্যে মাস্টারমশাই পঞ্চাশ জন ছাত্রকে একই পাঠ পড়ান, কিন্তু সকলের মধ্যে থেকেও এগিয়ে যায় সেই ছাত্র যার অনুসন্ধিৎসা, জিজ্ঞাসা বলবতী এবং শিক্ষিতব্য বিষয়ের প্রতি অনুরাগ প্রবল। মহাভারতের কবি তাই লিখেছেন—সকলকে একরকমভাবে শিক্ষা দিলেও—তুল্যেষ্বস্ত্রপ্রয়োগেষু—তির চালানোর শীঘ্রতা এবং শিল্পীজনোচিত সৌষ্ঠবে অর্জুন সবার আগে এগিয়ে রইলেন—সর্বেষামেব শিষ্যানাং বভূবাভ্যধিকো’র্জুনঃ।

এবারে আপনারা বলুন, এইরকম ছাত্রের প্রতি দ্রোণাচার্যের মতো অসাধারণ শিক্ষকের পক্ষপাত তৈরি হবে কি না। দ্রোণাচার্য নিজেও কি কম চেষ্টা করেছেন? মানুষ তো! মানুষের মনের গহনে কতরকম টানাপোড়েন থাকে। ভুলে গেলে চলবে না—দ্রোণের নিজের পুত্রটিও কিছু কম নন। যে সময় পাণ্ডব কৌরবরা কৃপাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করছেন, সেই সময় অশ্বথামা তাঁদের অস্ত্রের তালিম দিতেন। কিন্তু সবার সঙ্গে যখন একত্র অস্ত্রবিদ্যার আসর বসল, তখন দ্রোণ সবিস্ময়ে লক্ষ করলেন—তাঁর প্রিয় পুত্র অশ্বত্থামা অন্তত একজনের চাইতে পিছনে পড়ে যাচ্ছেন, তিনি অর্জুন। হাজার হলেও পিতা তো? কোন পিতা পিতার ধর্মে এমন ঘটনা সইতে পারবেন যে, অসাধারণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর পুত্রটি তাঁর শিষ্যের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে।

দ্রোণ চেষ্টা আরম্ভ করলেন, যাতে অশ্বত্থামাকে আলাদা করে একটু বেশি শিখিয়ে দেওয়া যায়। ওই ‘স্পেশাল কোচিং’ বলি যাকে তাই। তিনি করলেন কী—সকালবেলায় বালকেরা যখন সন্ধ্যাআহ্নিক করার জন্য জল আনতে যায়, তখন তাঁদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে কমণ্ডলু দিয়ে দিলেন। আর অশ্বত্থামাকে দিলেন একটি কলসি। কমণ্ডলুর মুখ ছোট, গুবগুব করে জল ভরতে সময় লাগে, বালকেরা তাতে মজাও পায়, এবং তাতে আরও সময় যায়। আর অশ্বত্থামা কলসিতে ঘপাত করে জল ভরে আগে চলে আসেন পিতার কাছে। যতটুকু সময় এতে একান্তে পাওয়া যেত, তাতে ধনুর্বিদ্যার কিছু নতুন কৌশল অশ্বত্থামাকে শিখিয়ে দিতেন দ্রোণ। আপনারা কি এটাকেও পুত্রের প্রতি পক্ষপাত বলবেন না? বললেও ক্ষতি নেই, কেননা একজন স্নেহশীল পিতা নিশ্চয়ই কোনও ধর্মাধিকরণের ‘জজসাহেব’ নন, যে তাঁকে শত্রু এবং মিত্রের প্রতি সমান ব্যবহার করে ধর্মবিপ্লব রোধ করতে হবে।

কিন্তু শিক্ষার প্রতি অর্জুনের কী অসামান্য ধ্যান দেখুন, দ্রোণাচার্যের মতো পক্ষপাতগ্রস্ত পিতাও শেষপর্যন্ত পুত্রকে ছেড়ে শিষ্যের প্রতি অধিক পক্ষপাতী হতে বাধ্য হলেন। বিষয়ের প্রতি অনুরাগ এবং ধ্যান অর্জুনের এতই বেশি যে, দু’দিনেই তিনি অশ্বত্থামার কলসি-রহস্য ধরে ফেললেন। এরপর থেকে তিনি অস্ত্রের সাহায্যে কমণ্ডলুতে জল ভরে অশ্বত্থামার সঙ্গেই উপস্থিত হতে লাগলেন আচার্যের কাছে—সমমাচার্যপুত্রেণ গুরুমভ্যেতি ফাল্গুনঃ। দ্রোণের আর উপায় রইল না। যেটুকু তিনি বাড়তি শেখাচ্ছিলেন অশ্বত্থামাকে, তা শেখাতে হল অর্জুনকেও। ফলে নিজ পুত্রের অস্ত্রবিদ্যার সঙ্গে অর্জুনের ক্ষমতার কোনও তফাত রইল না—ন ব্যহীয়ত মেধাবী পার্থো’স্ত্রবিদুষাং বরঃ।

রামকৃষ্ণ মিশনের এক সাধুমহারাজ ছাত্রদের বলতেন—ওরে! যেখানে যা ভাল পাবি, চুরি করে নে। যে ছাত্র এমন করে চুরি করতে পারে, তার ওপরে শিক্ষক-গুরুর পক্ষপাত হবে না! তবু দ্রোণ শেষ চেষ্টা করেছিলেন যাতে প্রিয় পুত্রের সঙ্গে প্রিয় শিষ্যের অন্তত একটা ব্যাপারে তফাত থাকে। অন্তত একটা বিশেষ কলা, একটা বিশেষ কৌশল, যেখানে অর্জুনের একটু কমতি থেকে যাবে। প্রিয় পুত্র যাতে বলতে পারে—আমি মহামতি দ্রোণাচার্যের পুত্র। অস্ত্রকৌশলে আমার সমকক্ষ কেউ নেই। দ্রোণাচার্য চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু হল কই।

দ্রোণাচার্যের শিষ্যদের মধ্যে যাঁরা ধনুর্বিদ, তাঁদের পাঠ তখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ধনুর্বিদ্যার চরম কৌশল হল শব্দভেদ—অর্থাৎ লক্ষ্যবস্তু চোখে না দেখে শুধুমাত্র শব্দ শুনে লক্ষ্যভেদ করা। শিক্ষার পাট যখন শেষ হয়ে আসে, তখন কেউ বা এ বিদ্যা শেখার চেষ্টা করে, কিন্তু বিদ্যা শেষের সঙ্গে ধৈর্যও শেষ হয়ে আসে বলে অনেকেরই আর এ বিদ্যা শেখা হয় না। শব্দভেদের সবচেয়ে বড় কৌশল হল অভ্যাস, নিরন্তর অভ্যাস। বিদ্যা শেষে যে ধানুষ্ক হয়ে ওঠে, সে ভাবে—যথেষ্ট হয়েছে, আর কত। এই তৃপ্তিই শেষপর্যন্ত শব্দভেদের বাধা হয়ে ওঠে। ওদিকে আরেক আশ্চর্য, দ্রোণাচার্য এ বিদ্যা শেখানোর নামও করছেন না। কিন্তু যে ছাত্র ধ্যানী, যে মেধাবী এবং সতত চেষ্টাশীল, সে কিন্তু নিজের মধ্যেই বুঝতে পারে—কতটুকু তার শেখা হল, আর কতটুকু তার বাকি রইল অথবা এতটুকুও বা বাকি থাকবে কেন? দ্রোণ বুঝতে পারছিলেন—অর্জুন এমনভাবেই এগোচ্ছেন, যাতে শব্দভেদের দিকে তাঁর নজর আছে। অথচ দ্রোণ কিছুতেই রহস্যটা বলছেন না। তিনি চাইছিলেনও না যাতে এ বিদ্যা অর্জুনের করায়ত্ত হয়।

দ্রোণাচার্যের আবাসস্থল হিসেবে যে গৃহখানি ভীষ্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, সেখান থেকে তাঁর শিষ্যদের আবাসস্থল খুব দূরে নয়। সে আবাসস্থল অনেকটা এখনকার রেসিডেনশিয়াল কলেজের হোস্টেলের মতো। সেখানে ছাত্রদের খাবারদাবার ব্যবস্থা করে একজন পাচকঠাকুর। দ্রোণাচার্যকে সে ভালমতোই চেনে। একদিন ছাত্ররা যখন ঘরে নেই, তখন দ্রোণ এসে পাচকঠাকুরকে ডেকে বললেন—তুমি কখনও অন্ধকারের মধ্যে অর্জুনকে খেতে দিয়ো না—অন্ধকারে’র্জুনায়ান্নং ন দেয়ং তে কদাচন—আবার আমি যে এ কথা তোমাকে বলে গেলাম, সেটাও যেন অর্জুনকে বোলো না। পাচকঠাকুর আচার্যের কথার কোনও মাথামুণ্ডু বুঝল না। পূর্বেও সে যে কখনও অন্ধকারে অর্জুনকে খেতে দিয়েছে। এবং সেই জন্যই এই সতর্কীকরণ কি না—তাও তার তেমন ঠাহর হল না। অথবা আচার্য-বিদ্বানদের কখন কী মনে হয়, কী ভেবে তাঁরা আদেশ দেন—এসব ব্যাপারে তার যথেষ্ট মর্যাদাবোধ থাকায় সে সঙ্গে সঙ্গে দ্রোণাচার্যের আদেশ মেনে নিল।

কিন্তু দ্রোণাচার্য মনে মনে যা ভেবেই কথা বলুন, মেধাবী এবং উদ্যোগী পুরুষের কাছে ভাগ্যদেবী স্বয়ংবরা হন। সেদিন সারাদিন অস্ত্রাভ্যাসের পর পাঁচ ভাই পাণ্ডব খেতে বসেছেন। অন্ধকার রাত্রি বটে, তবে এই আবাসগৃহে তৈলপূর প্রদীপখানি যথেষ্টই ভাল জ্বলছিল। এই অবস্থায় কোথা থেকে উতলা হাওয়া এল আর প্রদীপখানি নিভে গেল—তেন তত্র প্রদীপঃ স দীপ্যমানো নিবাপিতঃ। ক্ষণিকের জন্য হতচকিত হলেও প্রদীপের অপেক্ষায় না থেকে অবশিষ্ট অন্ন যথাসম্ভব খেয়ে নেওয়াই ভাল—এই বুদ্ধিতে অর্জুন তাঁর ভোজনপর্ব চালিয়ে যেতে লাগলেন। অভ্যাসবশত খাবার গ্রাস ঠিক মুখেই যেতে লাগল। অন্নের আধারে হস্ত প্রসারণ থেকে আরম্ভ করে মুষ্টিবদ্ধ অন্ন মুখে প্রবেশ করানোর মধ্যে পর্যন্ত যতগুলি ক্রিয়াকলাপ আছে, তার কোনওটাই তো আটকে রইল না অন্ধকারে—ভুক্ত এব তু কৌন্তেয়ো নাস্যাদন্যত্র বৰ্ততে।

অর্জুন প্রথমটায় অত ভাবেননি, তার পরেই খেয়াল হল—আরে তাই তো। কোনওই তো অসুবিধে হচ্ছে না। তা হলে অভ্যাসই হল সেই রহস্য যা তাকে শব্দভেদেও সাহায্য করবে। সেই অন্ধকার রাত্রে অন্য বালকেরা যখন শ্রান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ল, অর্জুন তখন রাত্রিভেদী শব্দ শুনে কল্পিত লক্ষ্যের ওপর বাণক্ষেপ করতে লাগলেন। বাণক্ষেপের শন শন শব্দ ঠিক যাঁর কানে পৌঁছোল, তিনি আর কেউ নন, দ্রোণাচার্য ছাড়া—তস্য জ্যাতলনির্ঘোষং দ্রোণঃ শুশ্রাব ভারত। কথায় বলে—সাপের হাঁচি বেদেয় চেনে। দ্রোণ বুঝতে পারলেন—নব-নবোন্মেষশালিনী প্রজ্ঞা যাঁর অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে, সে আপনিই সেই অপ্রতিপাদিত বিদ্যা করায়ত্ত করে। দ্রোণাচার্য এই অমানুষী প্রতিভার স্বীকৃতি দিয়েছেন বিনা দ্বিধায় এবং সঙ্গে সঙ্গে। রাত্রির প্রৌঢ়তা এবং আপন প্রৌঢ়তার সমস্ত অবসাদ মুছে ফেলে তিনি সেই রাতের অন্ধকারেই শয়ন ছেড়ে উঠে এসেছেন নির্জন বনভূমিতে, যেখান থেকে আওয়াজ আসছিল শন শন করে ছুটে যাওয়া অর্জুনের শব্দভেদী বাণের। দ্রোণ অর্জুনকে আলিঙ্গন করে বললেন—বাছা। আজ থেকে আমি তোমার শিক্ষার জন্য এমনই চেষ্টা করব, যাতে আর কেউ পৃথিবীতে তোমার সমকক্ষ ধনুর্ধর না হয়ে ওঠে—ত্বৎসমো ভবিতা লোকে সত্যমেতদ্‌ ব্রবীমি তে।

এই ঘটনার পরে আবারও আমি জিজ্ঞাসা করছি—এমন শিষ্যের ওপর শিক্ষক-গুরুরা পক্ষপাতী হবেন কি না? হবেনই, তিনি যদি মানুষ হন, মানুষের হৃদয় যদি তাঁর দেহে থাকে, তবে এমন উপযুক্ত গুণী শিষ্যের ওপর তাঁর পক্ষপাত আসবেই। শিক্ষকের পক্ষপাত-দোষকে গুণ বলে না মানলে অনেক ভাল ছেলেই আজকে আরও ভাল হতে পারত না। ভাল ছেলের ওপর পক্ষপাত আসবেই। আমাদের মাস্টারমশাইদেরও এই পক্ষপাত ছিল, আমাদেরও আছে। আর এখানে অর্জুনের মতো মেধাবী শিষ্যের প্রতি দ্রোণাচার্য যা করেছেন, তাতে আমার তো রামদাস বাবাজিমশায়ের কীর্তনের আখর মনে পড়ে। চৈতন্যদেব আর যবন হরিদাসের গুণকীর্তন করতে গিয়ে তিনি গাইতেন—‘গাইব বলো কার গুণ প্রভুর গুণ কি দাসের গুণ? গুণেতে কেহ নহে ঊন। গাইব বলো কার গুণ? অর্জুন নিজের অভ্যাসে অধ্যবসায়ে যা করেছেন, তাঁর প্রত্যেক পদক্ষেপে দ্রোণাচার্য তাঁর প্রিয় শিষ্যের মর্যাদা দিতে ভপলেননি এবং এই মর্যাদাবোধ আচার্য তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত পোষণ করেছেন। সেটা পরের কথা, অতএব সে কথা পরেই হবে।

আপাতত আরও দুটো কথা পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেটা হল, অর্জুনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে তিনি দুটি তথাকথিত অন্যায় করেছেন, যাতে বিংশ শতাব্দীর পরিশীলিত যুক্তিতে তিনি অশ্রদ্ধেয় হয়ে পড়েছেন। এর একটি কর্ণকে প্রত্যাখ্যান এবং অন্যটি একলব্যের প্রতি তাঁর নিষ্ঠুর ব্যবহার। এই দুটি ঘটনার মধ্যে প্রথমটি আমার চোখে একেবারেই অন্যায় নয় এবং দ্বিতীয়টি অবশ্যই অন্যায়, কিন্তু শিক্ষকের পক্ষপাত-দোষের মহিমায় তা ব্যাখ্যাও করা যায়। প্রথমে কর্ণের কথা বলি। কর্ণ দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন কৌরব-পাণ্ডবদের সঙ্গেই। তিনি যে অধিরথ সূতপুত্র, সেইভাবেই অন্যেরাও যেমন জানত, তেমনই দ্রোণাচার্যও তাই জানতেন। সূতজাতীয় বলে দ্রোণাচার্যের শিক্ষাশ্রমে প্রবেশ করতে তাঁর কোনও অসুবিধে হয়নি। কিন্তু দ্রোণের কাছে ঢুকে কৌরব-পাণ্ডবদের সতীর্থ হওয়ার আরও একটি বড় কারণ ছিল কর্ণের; সেটা হল, তিনি দুর্যোধনের বন্ধু। দুর্যোধনের মনের মধ্যে যে জ্ঞাতিশত্রুতার বিষ ছিল, যে পাণ্ডববিদ্বেষ তাঁর শোণিত-শিরায় ব্যাপ্ত হয়েছিল সেই বিদ্বেষবিষ তিনি সফলভাবে সংক্রমিত করতে পেরেছিলেন বন্ধু কর্ণের হৃদয়ে।

পাণ্ডব-কৌরবরা যখন দ্রোণের কাছে আসেননি, হয়তো তাঁরা তখনও কৃপাচার্যের পাঠশালায়, সেই তখন থেকে কর্ণ অর্জুনের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে আসছেন। কারণে অকারণে অস্ত্রশিক্ষা নিয়ে অর্জুনকে কটু কথা শোনান, যখন তখন তাঁকে অপমান করে অনর্থকভাবে প্রতিযোগী করে তুলতে কর্ণ মজা পেতেন এবং এ সবই তিনি করতেন দুর্যোধনের প্রশ্রয়ে—স্পর্ধমানস্তু পার্থেন সূতপুত্ৰো’মৰ্ষণঃ। দুর্যোধনমুপাশ্ৰিত্য সো’বমন্যত পাণ্ডবান্‌॥ যিনি আগে থেকেই এই ধরনের হীনতা করে আসছেন, তিনি যে দ্রোণের কাছে শিক্ষা নিতে এসেছেন সেই প্রতিযোগী মনোভাব নিয়েই, সেটা মহাভারতের কবি লুকোননি। তিনি লিখেছেন—যে কর্ণ অর্জুনের সঙ্গে সবসময় টক্কর দিতে চাইতেন, তিনি একই সঙ্গে ঢুকলেন দ্রোণের অস্ত্র-পাঠশালায়।

যে কর্ণ আগে এইভাবে অর্জুনের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন, তিনি যে দ্রোণের শিক্ষাশ্রমে ঢুকে হঠাৎ ভদ্রলোক হয়ে যাবেন, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই এবং দ্রোণাচার্যও তা ভাবতেন না। কর্ণ অর্জুনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিলেন না। নারদমুনি সেই শান্তিপর্বে আমাদের জানিয়েছেন যে, অর্জুন এবং ভীমের অস্ত্ৰক্ষমতা দেখে কর্ণের রাগ বেড়েই চলছিল—চিন্তয়ানো ব্যদহ্যত। অন্যদিকে দুর্যোধন জ্ঞাতিশত্রুতার কারণে পাণ্ডবদের ওপর যে হিংসা করতেন, সেই হিংসার সাধারণ ধর্মটুকু মিলে গেল কর্ণের হিংসার সঙ্গে। কর্ণ যেহেতু অর্জুনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছিলেন না, অতএব তাঁর হিংসার প্রতিফলন ঘটল ওই প্রতিযোগী মনোভাবের মধ্যেই। দ্রোণাচার্যের অস্ত্রবিদ্যার পাঠশালায় কর্ণ এমন কিছু খারাপ ছাত্র ছিলেন না, আর তা ছিলেন না বলেই মনে মনে তিনি নিজের খামতিটুকু বেশ বুঝতে পারছিলেন।

দ্রোণাচার্য এসব খবর জানতেন। একজন গুরুমশাই যখন একটি পরিবার এবং তাঁর ঘরের আবাসিক হয়ে যান, তখন সেই পরিবারের সুখ দুঃখ, ভাল মন্দ, মান অপমান তাঁকে একটু একটু করে স্পর্শ করতে থাকে। তিনি নিজে সরাসরি কোনও ব্যাপারে না জড়ালেও ঘরের মধ্যে জ্ঞাতিশত্রুতার পর্বতখানি যদি বহ্নিমান হয়, তবে তার আঁচটুকু পরবাসী আবাসিকের গায়ে লাগতে থাকে। কুরুবাড়ির ছত্রছায়ায় থাকতে থাকতে কুরুবাড়ির পারিবারিক রাজনীতি দ্রোণাচার্য একটু একটু করে বেশ বুঝতে পারছিলেন। দুর্যোধনের মনে যে পাণ্ডববিদ্বেষ ছিল, তা দ্রোণের পাঠশালায় আসা-মাত্র স্তব্ধ হয়ে শান্ত রসে পরিণত হবে—এটা যদি ভাবা না যায়, তবে দ্রোণাচার্য যে সেটা বুঝতেও পারতেন, এটা ভাবাই স্বাভাবিক। একইভাবে কর্ণ তাঁর প্রতিযোগী মনোভাবে অর্জুনকে যে সবসময়ই অতিক্রম করার চেষ্টা করছিলেন, সেটাও দ্রোণের মতো বুদ্ধিমান গুরুর অজানা থাকার কথা নয়।

তা হ্যাঁ, প্রতিযোগিতা খুবই ভাল জিনিস, দুই ছাত্রের প্রতিযোগিতায় দুজনেরই উপকার হয়, এটাও দ্রোণগুরু ভালই বুঝতেন। কিন্তু সময় যত যেতে লাগল, ততই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, কর্ণ অর্জুনের সঙ্গে অস্ত্রশিক্ষায় পেরে উঠছেন না। কর্ণ নিজেও মনে মনে এটা বেশ বুঝতে পারছিলেন—সর্বথাধিকমালক্ষ্য ধনুর্বেদে ধনঞ্জয়ম্‌। এরকম একটা অবস্থা যখন হয়, তখন অসফল প্রতিযোগী, কূট উপায় এবং কূট কৌশল অবলম্বন করে সফল প্রতিযোগীকে যে কোনওভাবে হারাতে চায়, বিশেষত তার মনে যদি প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে থাকে।

এই কূট কৌশল কী? মারণাস্ত্র। কর্ণ যদি এমন কোনও মারণাস্ত্রের উপযোগ করতে পারেন, যার কাছে অর্জুনের অস্ত্রকৌশল খাটবে না, রণনৈপুণ্য বা অস্ত্রচালনার ক্ষিপ্রতা কোনই কাজে লাগবে না, তবে অর্জুনকে সর্বদা ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখতে পারেন কর্ণ। কর্ণ সেই মারণাস্ত্র চান এবং তা দ্রোণের কাছেই আছে। একদিন যখন দ্রোণাচার্য আপন গৃহে বসে আছেন একাকী, তাঁর শিষ্য, অনুগামী এমনকী তাঁর পুত্র পর্যন্ত যখন তাঁর ঘরে নেই, তখন কর্ণ দ্রোণাচার্যের কাছে এসে বসলেন নিভৃতে। বললেন—গুরুদেব। আমি ব্রহ্মাস্ত্র মোক্ষণ করার কৌশল শিখতে চাই। শিখতে চাই এই অস্ত্র সংবরণের উপায়ও। কেন শিখতে চাই জানেন? এই বিদ্যা শিখলে আমি অর্জুনের সমান হতে পারি, তার সঙ্গে সমানে সমানে যুদ্ধও করতে পারি—অর্জুনেন সমং চাহং যুধ্যেয়ম্‌ ইতি মে মতিঃ।

অর্জুন নিজে এতদিন গুরু দ্রোণাচার্যের কাছ থেকে ব্রহ্মাস্ত্র চালনার অন্ধিসন্ধি শিখেছেন কি না, তা পরিষ্কার নয়। যদি তা না শিখেও থাকেন, তবে দ্রোণাচার্যের যত পক্ষপাত আছে অর্জুনের ওপর, তাতে এই বিদ্যা যে একদিন তাঁর অধিগত হবে, সে কথা কর্ণ ভালভাবেই জানতেন। গুরু হিসেবে দ্রোণ যেন একের প্রতি পক্ষপাতী হয়ে অন্যের প্রতি বিষমদর্শী না হন, কর্ণ তাই বললেন—গুরুদেব! সমস্ত শিষ্যের ওপর আপনার সমদৃষ্টি, আপনি নিজের পুত্রের সঙ্গে পর্যন্ত শিষ্যদের ভেদ করেন না—সমঃ শিষ্যেষু বঃ স্নেহঃ পুত্রে চৈব তথা ধ্রুবম্‌।

কর্ণ দ্রোণাচার্যের এই সমদর্শিতার কথা এত সাড়ম্বরে উল্লেখ করলেন এইজন্য যাতে তিনি বিগলিত হয়ে কর্ণকে সে যুগের চরম এবং পরম অস্ত্রের প্রয়োগসন্ধি শিখিয়ে দেন। কিন্তু দ্রোণাচার্য কিছু কম বুদ্ধিমান মানুষ নন। সেই ছোটবেলা থেকে যাঁকে অন্নের জন্য এবং অস্তিত্বের জন্য ‘স্ট্রাগল’ করতে হয়েছে, তিনি বেশ বোঝেন, কে, কী ভেবে কথা বলছে। বিশেষত কৌরবদের ঘরে পিতৃহীন পাণ্ডবদের অবস্থিতি এবং মর্যাদার কথা তাঁর অজানা নয়। দুর্যোধন-কৰ্ণরা অর্জুন-ভীমদের কী নজরে দেখেন, তাঁদের প্রতি কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র এবং সমস্ত রাজযন্ত্রের কতটুকু সমমর্মিতা আছে, দ্রোণাচার্য তা নিজের জীবনের নিরিখেই বুঝতে পারেন। কুরুগৃহে বহুদিন আবাসিক হবার দরুন সবই তাঁর কানে আসে। পাণ্ডব অর্জুন কেন যে অমন অসামান্য দৃঢ়তায় নিজেকে অসম্ভব রকমের প্রস্তুত করে তুলছেন, দ্রোণাচার্য তা হৃদয়ঙ্গম করেন বলেই অর্জুনের ওপর দ্রোণাচার্যের আলাদা মায়া আছে।

ফলে কর্ণের ওই চাটুকারিতা দ্রোণাচার্যের পছন্দ হল না, তাঁর হৃদয়ও সমদর্শিতার নীতিকথায় বিগলিত হল না। বিনয়ী এবং মেধাবী অর্জুনের ওপর যে পক্ষপাতে তাঁর চিত্তবৃত্তি মুগ্ধ ছিল, সেই মুগ্ধতাতে কিছুতেই তিনি ভাবতে পারলেন না যে, বিনা আয়াসে লব্ধ ব্রহ্মাস্ত্র তাঁর প্রিয় শিষ্যের ওপর প্রযুক্ত হোক। যে কর্ণ এখনও পর্যন্ত অস্ত্রকৌশলে অর্জুনের সমকক্ষ হতে পারেননি, তিনি অনুপযুক্ত অবস্থায় ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করে অর্জুনের সমকক্ষ হয়ে উঠবেন—দ্রোণের ভাবনায় এটা কোনও সমদর্শিতা নয়। অর্জুনের ওপর তাঁর অতি পৃথক এক মায়ালু অভিব্যক্তিতেই—সাপেক্ষঃ ফাল্গুনং প্রতি—দ্রোণাচার্য যেমন কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্রের কৌশল শেখাতে চান না, তেমনই কর্ণের দুষ্ট অভিসন্ধির কথাও তিনি বেশ ভাল করে অনুধাবন করেছিলেন বলেই অপরিশীলিত-বুদ্ধি কর্ণের হাতে এই মারাত্মক অস্ত্রের প্রযুক্তি তিনি তুলে দিতে চাননি—দৌরাত্মঞ্চৈব কর্ণস্য বিদিত্বা তমুবাচ হ।

তবে হ্যাঁ, যাঁকে তিনি প্রত্যাখ্যান করছেন, তিনিও তাঁর শিষ্য বটে। অন্তত শিষ্য বলেই তাঁকে এমন কথা বলা যায় না যে,—দেখো হে! তুমি অতি অসভ্য বদমাশ, তোমার মনের পাপ আমি জানি, অতএব তোমাকে ব্রহ্মাস্ত্রের কৌশল শেখাব না। দ্রোণাচার্য তাই কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করার অন্য উপায় গ্রহণ করলেন। তিনি কর্ণকে ঘুরিয়ে বললেন—কী বললে বৎস। ব্রহ্মাস্ত্র। ব্রহ্মাস্ত্রের সন্ধি জানবার অধিকার আছে শুধু ব্রাহ্মণের, সচ্চরিত্র ব্রতচারী ক্ষত্রিয়ের, এমনকী সর্বত্যাগী সন্ন্যাসীও ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করতে পারেন, কিন্তু অন্য কেউ নয়—নানো বিদ্যাৎ কথঞ্চন।

ঠিক এই শব্দগুলির উচ্চারণ থেকেই আজকের দিনের বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন—কর্ণ সূতপুত্র বলে চিহ্নিত বলেই দ্রোণ তাঁকে বিদ্যাদান প্রত্যাখ্যান করেছেন। এঁরা বোঝেন না—দৈব তথা মারণাস্ত্র লাভ করার জন্য যে নিষ্কাম নিরপেক্ষতা দরকার, কর্ণের তা ছিল না। ব্যক্তিগত স্বার্থ, ব্যক্তিগত ক্রোধ চরিতার্থ করার জন্য মারণাস্ত্রের প্রযুক্তি সেকালে শেখানো হত না। সমস্ত মহাভারত ভাল করে পড়লে দেখা যাবে—মারণাস্ত্র ঠিক তাঁদের কাছেই আছে, যাঁরা অস্ত্রপ্রয়োগের ক্ষেত্রে সংযমী এবং বিনয়শিক্ষায় শিক্ষিত। ঠিক এইজন্যই ব্রাহ্মণ, ব্রতচারী ক্ষত্রিয় অথবা সন্ন্যাসীর নাম করেছেন দ্রোণ এবং তা করেছেন সংযমের প্রতীক হিসেবে।

লক্ষ করে দেখুন, দ্রোণ অর্জুনকে ব্রহ্মাস্ত্রের প্রযুক্তি দান করেছেন। তিনি তাঁর গুরুদত্ত ব্ৰহ্মশির অর্জুনকে দান করবার সময় অর্জুনকে যথেষ্ট সংযত জানা সত্ত্বেও বলেছিলেন—দেখো বৎস! এই অস্ত্র সকলের শ্রেষ্ঠ অস্ত্র এবং অপ্রতিরোধ্য। তুমি কোনও ভাবেই মানুষের ওপর এই অস্ত্র প্রয়োগ করবে না। তা করলে জগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে। তুমি এই অস্ত্র ধারণ করবে যথেষ্ট সংযত হয়ে এবং যা এতক্ষণ বললাম তা যেন তুমি শুনো—তদ্‌ধারয়েথাঃ প্রযতঃ শৃণু চেদং বচো মম। দ্রোণ আরও একটা কথা বলেছেন এবং সেটা অনেকটা এখনকার ‘নিউক্লিয়ার ডেটারেন্টে’র মতো শোনাবে। দ্রোণ বলেছেন—মানুষ ছাড়া অন্য কোনও অসামান্য শত্রু যদি তোমাকে আক্রমণ করে তবে বাধা দেবার জন্যই শুধু এই অস্ত্র যুদ্ধের সময় প্রয়োগ করবে—তদ্‌বাধায় প্রযুঞ্জীথা স্তদাস্ত্ৰমিদমাহবে।

ভারতের পরমাণু বিস্ফোরণের পর বিরোধী পক্ষের অনেক কুশলীদের বলতে শুনলাম—যে অস্ত্র প্রয়োগ করাই যাবে না, কেননা অনেক পরমাণু শক্তিধর দেশই অনেক প্ররোচনা সত্ত্বেও পরমাণু শক্তি হাতে নিয়েই বসে আছেন, কিন্তু প্রয়োগ করেন না, তবে ভারত এই বিস্ফোরণ ঘটাল কেন? এই বিরোধীদের সবিনয়ে সেকালের পরমাস্ত্র-গুরু দ্রোণাচার্যের কথাটাই স্মরণ করিয়ে দিই। দ্রোণ বার বার বলেছেন—একজনের কাছে ব্রহ্মাস্ত্র আছে, এইটাই পরম সম্মানের কথা এবং শত্রুর কাছে তা ভয়ের কথা। এই অস্ত্র প্রয়োগ করতে বারণ করছেন দ্রোণ—ন চ তে মানুষেষ্বেতৎ প্রয়োক্তব্যং কথঞ্চন। কিন্তু শত্রুকে বাড়তে না দেবার জন্য অথবা তাকে সংযত রাখার জন্য দ্রোণ শুধু বলছেন—তুমি সংযত হয়ে শুধু এই অস্ত্র ধারণ করো—তদ্‌ধারযেথাঃ প্রযতঃ। বস্তুত অস্ত্রবিদ্যার চরম কৌশল এইটাই—সমস্ত বিশ্বে, সমস্ত যুগে এ কথা সত্য যে, সব শ্রেষ্ঠ অস্ত্র ধারণ করেই তবে শান্তির কথা বলা যায়। এখানে ‘ডিফেন্স;টাই ‘অফেন্সে’র কাজ করে—মারণাস্ত্র ধারণের সেইটাই কৌশল। ব্রহ্মাস্ত্র আছে—এই অস্তিত্ব ভাবনা যদি শত্রুর মনে প্রকট করে তোলা যায়, তবে সেটা ‘অফেন্সিভ ওয়র’-এর থেকেও কাজ দেয় বেশি। দ্রোণ তাই বলেছেন—ধারয়েথাঃ—ধারণ করো, কিন্তু—ন প্রযোক্তব্যম্‌—প্রয়োগ কোরো না।

অর্জুন শেষপর্যন্ত তাঁর গুরুর কথা রেখেছিলেন। আগেই তো বলেছি—দ্রোণাচার্যও মানুষ। মানুষের মমত্ব এবং মায়া সমস্ত নীতিকে অতিক্রম করে বলেই তিনি নিজ পুত্র অশ্বত্থামাকেও ব্রহ্মশির অস্ত্র দিয়েছিলেন। হয়তো অৰ্জুনকে দ্রোণ যেমন উপদেশ করেছিলেন, তেমনই করেছিলেন অশ্বত্থামাকেও। কিন্তু চরিত্রগতভাবেই অশ্বত্থামা কিছু ক্ৰোধী মানুষ ছিলেন, মহাস্ত্র ধারণের চুড়ান্ত সংযম তাঁর ছিল না। নইলে অত বড় কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে রথী মহারথীদের মারবার জন্যও যেখানে অর্জুন কোনও ব্রহ্মশির, পাশুপত অস্ত্রের স্মরণও করেননি, অশ্বত্থামা সেই অস্ত্র মোক্ষণ করেছিলেন জগদ্‌ধ্বংসের প্রতিজ্ঞায়। অন্যদিকে অশ্বত্থামার ব্রহ্মশিরকে বাধা দেবার জন্য অর্জুন পাশুপত অস্ত্র মুক্ত করলেও বিশ্বজনহিতায় তিনি তা সংবরণও করে নিয়েছিলেন, কিন্তু দ্রোণের প্রশ্রয়লব্ধ প্রিয় পুত্র অশ্বত্থামার ব্রহ্মশির শেষপর্যন্ত জগদ্‌ধ্বংস না করলেও, তা পাণ্ডব কৌরবের শেষ সন্তান-বীজটিকে ধ্বংসই করে দিয়েছিল প্রায়। বেশ বোঝা যায়, অশ্বত্থামার সেই সংযম ছিল না, যা অর্জুনের ছিল এবং দ্ৰোণ সেটা বেশ বুঝতেও পেয়েছিলেন অনেক আগে থেকেই এবং তাঁর ভুল হয়নি। অর্জুন অশ্বথামার ব্রহ্মশির বাধা দিতে গিয়েই অন্যতম মারণাস্ত্র মুক্ত করেছিলেন এবং সময় তা সংবরণও করে নিয়েছিলেন।

অশ্বত্থামার মতো এক বিশাল মাপের মানুষও যেখানে সংযম সাধনায় ব্যর্থ হন, সেখানে কর্ণকে ব্রহ্মাস্ত্র দিলেও যে ভুল হত, তার প্রমাণ কর্ণের অন্য ব্যবহারে। কর্ণ ইন্দ্রের দেওয়া অস্ত্র সযত্নে তুলে রেখেছিলেন অর্জুনকে মারার জন্য। কিন্তু যেদিন ভীমপুত্র ঘটোৎকচের প্রবল আক্রমণে কৌরববাহিনী পর্যুদস্ত হয়ে উঠল, সেদিন অন্যের প্ররোচনায় কর্ণ তা প্রয়োগ করলেন ঘটোৎকচের ওপর। কাজেই ব্যক্তিগত অসংযম এবং প্রধানত দুর্যোধনের প্ররোচনায় যিনি চলছিলেন, তাঁকে দ্রোণাচার্যের মতো আচার্য চিনতে পারবেন না, এমন হয় না। তিনি ঠিকই করেছিলেন।

দ্রোণাচার্যের আর এক কলঙ্ক হলেন একলব্য। অন্যান্য রাজপুত্রেরা যখন এখান ওখান থেকে এসে দ্রোণাচার্যের অস্ত্র-পাঠশালায় ভর্তি হতে লাগল, তখন নিষাদ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্যও এসেছিলেন দ্রোণের শিষ্য হতে। কিন্তু দ্রোণাচার্য তাঁকে প্রত্যাখ্যান করলেন এই কথা ভেবে যে, রাজপুত্রদের সঙ্গে একত্রে নৈষাদি একলব্যকে শিক্ষা দেওয়া ঠিক হবে না—ন স তং প্রতিজগ্রাহ নৈষাদিরিতি চিন্তয়ন্। স্বাভাবিকভাবেই আজকের বিংশ শতাব্দীর পরিশীলিত যুক্তিতে আমাদের মনে হবে যে, দ্রোণাচার্য উচ্চনীচ ভেদ এবং জাতিভেদকে প্রশ্রয় দিয়ে নিষাদ একলব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এসব কথা বলাই যায় এবং বললে দ্রোণাচার্যের সমর্থনে যুক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। তবে হ্যাঁ, একলব্যকে প্রথম প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে দ্রোণের দিক থেকেও একটু ভেবে দেখার আছে। ভেবে দেখুন, এই মুহূর্তে ভীষ্মের আনুকূল্যে দ্রোণাচার্য কুরু রাজবাড়ির আশ্রিত। রাজপুত্রদের শিক্ষা সফলভাবে শেষ হলেই তবে দ্রোণাচার্যের ভবিষ্যতও সংরক্ষিত হবে। অতএব কুরুবাড়ির রাজপুত্রদের সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষার্থী রাজপুত্রদের একত্রে শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে দ্রোণ কিছু স্বারোপিত স্বাধীনতা ব্যবহার করলেও নিষাদপুত্র একলব্যকে একসঙ্গে শিক্ষা দিলে রাজবাড়ির উচ্চ পর্যায়ে যদি বিরূপতা সৃষ্টি হয়, সেটা স্বয়ং আচার্যের ভবিষ্যত গঠনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে। যে কোনও স্বার্থানুসন্ধিৎসু মানুষ এমন নির্বুদ্ধিতা করবেন না, অতএব দ্রোণও একলব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এ ছাড়া শিক্ষাদানের অনুকূল পদ্ধতি নিয়েও দ্রোণের দিকে কিছু যুক্তি আছে। মহাভারতের শব্দ-ব্যবহারটি খেয়াল করে দেখুন—নৈষাদিরিতি চিন্তয়ন্—ছেলেটা নিষাদ এই কথা ভেবে এবং দ্বিতীয়ত—তেষামেব অন্ববেক্ষয়া—অর্থাৎ রাজপুত্রদের সামাজিক মর্যাদার অনুক্রম অবেক্ষণ করে—দ্রোণ একলব্যকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন না। এখানে শিক্ষাপদ্ধতি নিয়েও দুটো কথা আসে। আধুনিক যুগেও যাঁরা ‘এজুকেশন’ বা শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে মাথা ঘামান, তাঁদের কাছে ছাত্ৰসমস্যা নিয়ে কিছু কথা শুনেছি। তাঁরা বলেন—শিক্ষাবিদেরা একটি শ্রেণীতে ছাত্রদের মধ্যে যথাসম্ভব সমতা রাখা পছন্দ করেন। যার জন্য একটি-দুটি বেশি বয়সের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সিদের পঠনপাঠন তাঁরা পছন্দ করেন না। সিজোফ্রেনিয়া ইত্যাদি মানসিক রোগগ্রস্ত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে স্বাভাবিক ছাত্রছাত্রীদের একত্র পঠনপাঠন তাঁরা চান না। অনেক মেয়েদের স্কুলে ছাত্রীদের সম্ভাব্য পক্কতার ভয়ে বিবাহিতা মেয়েদের সঙ্গে অবিবাহিতা বয়ঃসন্ধিনীদের পড়তে দেওয়া পছন্দ করেন না শিক্ষাবিদেরা।

ভেবে দেখবেন, বেশিবয়স্ক বা রোগগ্রস্ত অথবা বিবাহিতরা কি সামাজিকভাবে অশুচি? তা তো নয়। দ্রোণাচার্যও যে নৈষাদি একলব্যকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করতে মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন না, তা আমি মনে করি না। তবে রাজা এবং রাজপুত্রদের সামাজিক পরিচয় সেকালের দিনে যেহেতু অত্যন্ত সচেতনভাবেই ব্যবহার করা হত, সেখানে নৈষাদি একলব্য ছাত্র হিসেবে হাজার গুণ ভাল হলেও রাজপুত্রদের কাছে জাতি বিষয়ক অবমাননা তাঁকে শুনতেই হত হয়তো। এতে ছাত্রদের মধ্যে এক ধরনের ‘টেনশন’ তৈরি হওয়াও অসম্ভব নয়। দ্রোণাচার্য এই অসমতা চাননি। এতে তাঁর নিজের ক্ষতি, নৈষাদি একলব্যেরও ক্ষতি এবং সংখ্যাধিক রাজপুত্ররাও দ্রোণাচার্যের এই স্বাধীন ব্যবহারে খুশি হতেন না। অতএব একলব্যকে শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলেন না দ্রোণ।

এই পর্যন্তও কিন্তু দ্রোণাচার্যকে আমরা ক্ষমা করতে পারি। কিন্তু যেদিন পাণ্ডব কৌরবরা মৃগয়া করতে গিয়ে নৈষাদি একলব্যের অসাধারণ অস্ত্রগুণ দেখে এলেন, সেদিন অন্যেরা অবাক হলেন বটে, কিন্তু দ্রোণাচার্যের শিষ্যপ্রধান অর্জুন কিন্তু ঈর্ষাকাতর হলেন। নৈষাদি একলব্য দ্রোণাচার্যের মৃন্ময় মূর্তি স্থাপন করে আপন প্রতিভায় আপনিই সিদ্ধ হয়েছিলেন। পাণ্ডব-কৌরবেরা একলব্যকে দেখেছিলেন—নিকষ কালো শরীর মেদহীন এক যুবা, মলিন বসন, ধূলিধূসরিত গায়ে একটানা অস্ত্রাভ্যাস করে যাচ্ছে মৃন্ময় দ্রোণাচার্যের সামনে। এতটুকু অমনোযোগ সে সহ্য করতে পারে না। রাজকুমারদের মৃগয়া-সহায় শিকারি কুকুরটি ডেকে উঠেছিল বলে শব্দভেদী বাণে কুকুরটির মুখ বন্ধ করে দিয়েছিলেন নৈষাদি একলব্য। তাঁর অস্ত্রচালনার ক্ষিপ্রতা এবং প্রখর শব্দানুমানের শক্তি যে কারও সঙ্গে তুলনীয় নয়, সেটা আর কেউ না বুঝুক অর্জুন বুঝেছিলেন। তাই অন্যেরা যখন কেউ বিস্মিত, কেউ বা তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, অথবা সকলেই যখন একযোগে এই অস্ত্র নৈপুণ্যের কাহিনী সপ্রশংসভাবে দ্রোণের কাছে বর্ণনা করছেন, তখন অর্জুন শুধু ফাঁক খুঁজেছেন আচার্যকে একান্তে পাবার।

অর্জুন জানতেন, একজন ভাল ছাত্র যেমন নিজের ওপরে শিক্ষকের আস্থা এবং অনুরাগ বুঝতে পারে, সেই বোঝাটুকু থেকেই অর্জুন একান্তে দ্রোণাচার্যকে তাঁর দুর্বলতার সম্পূর্ণ সুযোগ নিয়ে বলেছিলেন—গুরুদেব! আমাকে আপনি একসময় সপ্রণয়ে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন—অর্জুন! আমার কোনও শিষ্য তোমার থেকে শ্রেষ্ঠতর হবে না—ভবতোক্তো ন মে শিষ্যস্তদ্‌বিশিষ্টো ভবিষ্যতি। কিন্তু এই এখনই নিষাদ হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্যকে দেখে এলাম; সে আপনার অন্য শিষ্যদের চেয়ে এমনকী আমার চেয়েও অনেক বড় ধনুর্ধর এবং সবচেয়ে বড় কথা সে আপনারই শিষ্য—অন্যো’পি ভবতঃ শিষ্যঃ নিষাদাধিপতেঃ সুতঃ।

দ্রোণ একেবারে অবাক হলেন। নৈষাদি একলব্যের কথা তাঁর মনেও নেই ভাল। আবার মনে আছেও। প্রত্যাখ্যাত হয়েও বনের মধ্যে সে তাঁকে গুরুর মর্যাদায় স্থাপন করে আপন যোগ্যতায় এবং প্রতিভায় অর্জুনের থেকেও বড় ধনুর্ধর হয়ে গেল—এই ঘটনায় একদিকে তাঁর গর্ব হবারই কথা, কেননা প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও যাঁকে গুরু বলে কেউ মানে, তখন সে গুরুর যশ এবং মান অনেক উচ্চ পর্যায়ের বলেই বুঝতে হয়। অন্যদিকে এতে দ্রোণাচার্যের মতো মানী লোকের ক্রোধও হবার কথা। গুরুমুখী বিদ্যায় গুরুর কোনও প্রয়োজনই হল না এবং গুরু যাকে নিরন্তর হাতে ধরে অস্ত্রবিদ্যা শিখিয়েছেন, সেই অর্জুনের থেকেও সে ভাল ধনুর্ধর হয়ে গেল নিজের একক ক্ষমতায়—এমনটি দেখলে অনিরপেক্ষ তথা বিশেষ কোনও শিষ্যের প্রতি পক্ষপাতী গুরুর রাগই হবে, বিশেষত সে গুরু যখন পূর্বে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

আমাদের ধারণা, গর্ব নয়, দ্রোণাচার্য খানিকটা অপমানিতই বোধ করেছেন। তার ওপর অর্জুন যখন এসে সাভিমানে তাঁকে তাঁর পূর্ব প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন, তখন একটু ভেবেই তিনি ইতিকর্তব্যতা স্থির করে নিয়েছেন। ক্রোধ কিংবা অপমানবোধের কোনও বহিঃপ্রকাশ হল না তাঁর ব্যবহারে। ক্ষণমাত্র ভাবনা করে—মুহূর্তমপি তং দ্রোণশ্চিন্তয়িত্বা বিনিশ্চয়ম্‌—কী করবেন ঠিক করে নিয়েই দ্রোণাচার্য অর্জুনকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন নৈষাদি একলব্যের বাসভূমিতে। দ্রোণ দেখতে পেলেন—মলিন বসন ধূলিধূসর জটাধারী একলব্য এক ধ্যানে শরক্ষেপ অভ্যাস করে যাচ্ছে—একলব্যং ধনুষ্পাণিমস্যন্তম্‌ অনিশং শরান্‌।

চিরকালের ধ্যানাবস্থিত গুরুকে নিজের আবাসে আসতে দেখে একলব্য সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসে দ্রোণাচার্যের পায়ে মাথা নোয়ালেন। নৈষাদি একলব্য বিধিনিয়ম অনুসারে গুরুপূজা করে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করলেন গুরুর কাছে। কিন্তু দ্রোণাচার্য তো ঠিক করেই এসেছেন যে তিনি কী করবেন। অর্জুনকে তিনি কথা দিয়েছেন যে তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠতর ধনুর্ধর তাঁর শিষ্যদের মধ্যে থাকবে না। অতএব দ্রোণাচার্য যাঁকে নিজে কোনও শিক্ষাই দেননি, সে তাঁর আপন শিক্ষিত শিষ্যের চেয়ে বেশি হবে—এই অপমান সহ্য করতে না পেরেই বোধ হয় অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় একলব্যকে বললেন—তুমি যদি নিজেকে আমার শিষ্য বলেই মান, তবে আমার শিক্ষাদানের বেতন গুরুদক্ষিণা দিতে হবে তোমাকে—যদি শিষ্যোসি মে বীর বেতনং দীয়তাং মম।

সরল নৈষাদি এক বিন্দুও দ্বিধা না রেখে উত্তর দিলেন—কী দিতে হবে আজ্ঞা করুন, গুরুদেব! এই পৃথিবীতে আপনার মতো গুরুকে আমার অদেয় কিছু নেই—ন হি কিঞ্চিদ্‌ অদেয়ং মে গুরবে ব্রহ্মবিত্তম। দ্রোণ একবারও ভাবলেন না যে, তাঁর অহৈতুকী গুরুভক্তিরও কোনও মর্যাদা দিলেন না তিনি। অকম্পিত কণ্ঠস্বরে শীতল মস্তিষ্কে দ্রোণ বললেন—তোমার ডান হাতের বুড়োআঙুলটি আমার দক্ষিণা চাই—অঙ্গুষ্ঠো দীয়তামিতি। এত বড় সাংঘাতিক কথাটা শুনেও একলব্য দ্বিতীয়বার ভাবলেন না। গুরুকে দেখার পর যেমন হর্ষোৎফুল্ল মুখটি হয়েছিল তাঁর, দক্ষিণা দানের কথায় যেমন উদার অকাতরতায় প্রসারিত হয়ে গিয়েছিল তাঁর হৃদয়খানি, ঠিক সেইরকম সানন্দ বদনে, সেইরকম হৃদয়বৃত্তিতেই নিজের দক্ষিণ হস্তের অঙ্গুষ্ঠ কর্তন করে দ্রোণের সামনে রাখলেন গুরুদক্ষিণা।

ঠিক এর পরেই অতিমেধাবী বঞ্চিত জনের যে ভাবনা হয়, সেই ভাবনাই স্বাভাবিকভাবে অধিকার করল একলব্যের মন। এতদিন ধরে নিরন্তর যিনি অস্ত্রবিদ্যা অভ্যাস করেছেন, সেই মানুষটি শরচালনার সাধকতম বুড়োআঙুলটি হারিয়ে বার বার পরীক্ষা করে দেখতে লাগলেন—তর্জনী, মধ্যমা অথবা অনামিকার উপযোগে বাণচালনার সেই ক্ষিপ্রতা আসে কি না। এমনটি হয় না যে, তা তিনিও জানেন, তবু দেখছেন—যদি হয়—ততঃ শরন্তু নৈষাদিরঙ্গুলীভির্ব্যকর্ষত। গুরুর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত যে ব্যক্তি সারা জীবন ধরে নিজের চেষ্টায় স্বপ্ন দেখেছে সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হবার, তার সমস্ত স্বপ্ন চুরমার হয়ে গেল। তার বাণক্ষেপণে যে অসাধারণ ক্ষিপ্রতা ছিল, তা নষ্ট হয়ে গেছে—ন তথা চ শীঘ্রো’ভূৎ যথাপূর্বং নরাধিপ।

অর্জুন খুশি হলেন। একজন ‘প্রোফেশনাল’ মানুষ স্বার্থলাভ করলে যেমন খুশি হয়, তেমনই খুশি হলেন অর্জুন। কিন্তু দ্রোণাচার্য এটা কী করলেন। যাঁকে তিনি কোনওদিন কিছু শেখানইনি, তাঁর কাছে তিনি শিক্ষাদানের বেতন চাইলেন কোন মর্যাদায়, কোন অধিকারে? এ কি তাঁর মৃন্ময় প্রতিমূর্তি সেবার মূল্য দিলেন একলব্য? দ্রোণাচার্যের মাথায় যে যুক্তিই থাকুক, যে প্রতিজ্ঞাই থাকুক প্রিয়তম শিষ্য অর্জুনের কাছে, দ্রোণাচার্যের এই ব্যবহার কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। তবে হ্যাঁ, প্রিয়তম শিষ্যের প্রতি পক্ষপাতে এমন ব্যবহার যে গুরুরা করেন না, তা মোটেই নয়। এই আধুনিক তর্কযুক্তিময় শিক্ষিত জগতে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্তরে আমি এ-হেন অধ্যাপক অনেক দেখেছি, যাঁরা অকারণ সন্তুষ্টিতে—মেধা নয়, বিদ্যাবুদ্ধি নয়—অল্পশ্রুত ব্যক্তির সেবার সন্তুষ্টিতেই অনেক অধ্যাপক বশংবদ ছাত্রকে এমন করুণা করেন, যাতে অনেক ছাত্রেরই ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়। সেখানে দ্রোণাচার্যের দিকে একটাই বিশাল ‘প্লাস পয়েন্ট’, তিনি যে গর্হিত অন্যায় করেছেন, তা অর্জুনের মতো অসাধারণ মেধাবী ছাত্রের প্রতি পক্ষপাতী হয়ে করেছেন। এই পক্ষপাতকে একেবারে গর্হিত অন্যায় বলে চিহ্নিত করা মুশকিল, কেননা মেধার প্রতি এই পক্ষপাত সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক নয়।

যাই হোক, দ্রোণাচার্যের প্রশিক্ষণ একভাবে শেষ হল। একেবারে প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করতে হয়নি, কারণ সে শিক্ষা কৃপাচার্যই দিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু অস্ত্রবিদ্যার ক্ষেত্রে যে ‘হায়ার কোর্স’ থাকে নীতি এবং কৌশল সংক্রান্ত, তা একভাবে শেষ হল দ্রোণাচার্যের চূড়ান্ত সফল প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই। অর্জুন, অশ্বত্থামার মতো বীরেরা যেখানে ধনুর্বিদ্যায় প্রাধান্য লাভ করলেন, তেমনই নিজেদের ‘ন্যাক’ এবং প্রবৃত্তি অনুযায়ী ভীম এবং দুর্যোধন গদাযুদ্ধে উৎকর্ষ দেখাতে লাগলেন। এইভাবে কেউ অসিযুদ্ধে, কেউ বা রথযুদ্ধে কেউ বা গুপ্ত অস্ত্র ব্যবহারে নিপুণ হয়ে উঠলেন। সকলেই নিজের নিজের মতো করে অস্ত্রবিদ্যায় সুশিক্ষিত হয়ে ওঠার পর দ্রোণাচার্যের দিক থেকে এবার দায় আসে রাজবাড়িতে কুরুকুলের প্রধানদের সামনে রাজপুত্রদের শিক্ষা প্রদর্শন করার। একেবারে ‘ফাইনাল স্টেজে’ অস্ত্র প্রদর্শনী করতে গিয়ে নিজেদের লোকের সামনে রাজকুমারদের যে মানসিক চাপের সম্মুখীন হতে হবে, তার আগে তাঁদের সম্পূর্ণ একটি পরীক্ষা নিয়ে নিতে চাইলেন দ্রোণ। এর জন্য তিনি কুমারদের চক্ষু এড়িয়ে একদিন হস্তিনানগরের বাজার অঞ্চলে গেলেন এবং উপযুক্ত একজন শিল্পীকে দিয়ে একটি পক্ষী বানালেন।

পাণ্ডব কৌরবদের কাছে পরীক্ষার দিনক্ষণ বলে দিয়ে নির্দিষ্ট কর্মকারের সাহায্যে কৃত্রিম পক্ষীটিকে একটি উচ্চচূড় বৃক্ষের শাখায় স্থাপন করলেন—কৃত্রিমং ভাসমারোপ্য বৃক্ষাগ্রে শিল্পিভিঃ কৃতম্‌। রাজকুমারেরা একে একে সারি বেঁধে দাঁড়ালেন এবং দ্ৰোণ তির ধনুক নিয়ে সকলকে লক্ষ্যভেদ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বললেন। সকলকে এও বলে দিলেন যে, তাঁর আদেশ পাওয়ামাত্র আদিষ্ট ব্যক্তি যেন পক্ষীটির মাথা কেটে মাটিতে ফেলে দেন।

প্রথমেই সকলের জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের পালা এল এবং শরক্ষেপণের আদেশ দেবার আগে দ্রোণ তাঁর মানসিকতা পরীক্ষার জন্য বললেন—রাজপুত্র। তুমি এই পাখিটা দেখতে পাচ্ছ তো? যুধিষ্ঠির বললেন—হ্যাঁ আচার্য! দেখতে পাচ্ছি—পশ্যামীতি। দ্রোণ বললেন—তুমি কি ওই গাছটাকে, আমাকে এবং তোমার ভাইদেরও দেখতে পাচ্ছ? যুধিষ্ঠির সরলভাবে উত্তর দিলেন—হ্যাঁ আচার্য। আমি সবাইকেই দেখতে পাচ্ছি। এই গাছ, এই আপনি, এই আমার ভাইয়েরা, আর ওই পাখিটাও দেখতে পাচ্ছি। দ্রোণাচার্য যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে আর কষ্ট করালেন না। আচার্য হিসেবে তিনি জানেন যে, লক্ষ্যভেদ করতে গিয়ে অন্য সব দিকেই যার চোখ পড়ে, তার সেই একাগ্রতাই নেই, যা দিয়ে চরম ক্ষিপ্রতায় নির্দিষ্ট লক্ষ্য বিদ্ধ করা যায়।

দেখুন, এই গল্পটা শতবার শতমুখে বলা হয়েছে, কিন্তু কেউ কি একবারও দ্রোণাচার্যের কথা ভেবেছেন, যিনি একটি কৃত্রিম পক্ষীর মস্তকচ্ছেদনের পরীক্ষাকে অবলম্বন করে অতীত অনাগত সমস্ত ছাত্রকুলের সামনে শুধু এই প্রতিবেদন রেখেছেন যে, শুধু লক্ষ্য মাথায় রেখে পরিশ্রম করে গেলে লক্ষ্য তার করতলগত হবেই। জীবনে যে কেউ তার লক্ষ্যে পৌঁছোতে চায়, তার কাছে ভাই বন্ধু, পরিজন, পরিবেশ এমনকী গুরুর মুখাপেক্ষী হয়েও বসে থাকলে চলবে না। লক্ষ্যে পৌঁছোতে হলে সেই একাগ্রতা চাই যে একাগ্রতায় অর্জুনের মতো শুধু বলা যায়—এই গাছপালা, ভাই-বেরাদর, এমনকী আচার্য! আপনাকেও আমি দেখতে পাচ্ছি না। শুধু ওই পাখিটাকে দেখতে পাচ্ছি। না পাখিটাও পুরো নয়, শুধু তার মাথাটা দেখতে পাচ্ছি, যা আমার ছেদন করে মাটিতে ফেলতে হবে—শিরঃ পশ্যামি ভাসস্য ন গাত্রমিতি সো’ব্রবীৎ।

লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠির সকল ভাইদের মধ্যে জ্ঞানী গুণী ব্যক্তি বলে তিনি যা দ্রোণাচার্যকে বলেছিলেন, অন্যান্য পাণ্ডব কৌরব ভাইরাও তাঁর দেখাদেখি একই কথা বলে গেছেন এবং বলা বাহুল্য দ্রোণাচার্য কারও কথায় সন্তুষ্ট হননি এবং প্রত্যেককে ওই একই কথা বলে তিরস্কার করে গেছেন—তোমার দ্বারা এই লক্ষ্যভেদ করা সম্ভব হবে না—ততো সর্বে চ তৎ সর্বং পশ্যাম ইতি কুৎসিতাঃ। দ্রোণাচার্য বুঝিয়ে দিলেন—যে মানুষ অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে চায়, তাকে অন্যের দেখাদেখি কাজ করলে চলে না। অভীষ্ট সাধনের জন্য স্বতন্ত্রতা লাগে। লাগে স্বাধীন চিন্তা। কাজেই অন্য সমস্ত ব্যাপারে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের শিষ্যের মতো হওয়া সত্ত্বেও—ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য—অর্জুন কিন্তু উত্তর দিলেন আপন স্বাতন্ত্র্যে। এই স্বাতন্ত্র্য মহাবীরের স্বাতন্ত্র্য, এই স্বাতন্ত্র্য তৈরি হয় নিরলস পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং একাগ্র ভাবনায়। ফলে অর্জুন যখন উত্তর দিলেন, তখন দ্রোণাচার্যের শরীর আনন্দে রোমাঞ্চিত হল—অর্জুনেনৈবমুক্তন্তু দ্রোণো হৃষ্টতনূরুহঃ।

অতঃপর দ্রোণাচার্যের আদেশে কৃত্রিম পক্ষীর শিরচ্ছেদ করলেন অর্জুন—এটা কোনও খবর নয়। বরঞ্চ অর্জুনের অসাধারণ উত্তরে দ্রোণাচার্য যে রোমাঞ্চিত হলেন, এই সানন্দ রোমাঞ্চের মধ্যে স্বয়ং দ্রোণাচার্য যে একাগ্রতায় তাঁর নিজস্ব লক্ষ্যপূরণের দিকে এগোচ্ছিলেন, তারই ইঙ্গিত আছে। পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে তিনি যে অপমান প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, সেটিও ওই কৃত্রিম পক্ষীর মস্তক ছেদনের মতোই একটা ঘটনা। কুরু পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষাদান করার মতো বিশাল কর্মকাণ্ডের অন্তরাল থেকে তিনি শুধু একাগ্র ভাবনায় একই লক্ষ্যের ওপর দৃষ্টি রেখে চলেছিলেন—দ্রুপদকে পরাজিত করে তাঁরই প্রতিজ্ঞাত রাজ্য লাভ করতে হবে। এবং তাও নিজে তাঁর রাজ্য আক্রমণ করে যুদ্ধ করে নয়, এ কাজ তিনি করবেন শিষ্যদের দিয়ে, অর্থাৎ এতটাই সাবহেলে যে—আমি তো অনেক বড় কথা, আমার শিষ্যরাই এই সাধারণ কাজটা পারে। অতএব অর্জুন যখন কৃত্রিম পক্ষীর শিরচ্ছেদ করলেন, দ্রোণ তখন এই ভেবে আনন্দ পেলেন যে, দ্রুপদের পরাজয় হয়েই গেছে—মেনে চ দ্রুপদং সংখ্যে সানুবদ্ধং পরাজিতম্। এই ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই দ্রোণাচার্য অর্জুনকে ব্রহ্মশির অস্ত্র দান করেছেন, এবং আবারও আশীর্বাদ করে বলেছেন—এ জগতে তোমার মতো ধনুর্ধর দ্বিতীয় কেউ হবে না—ভবিতা ত্বৎসমো নান্যঃ পুমাল্লোঁকে ধনুর্ধরঃ।