ধৃতরাষ্ট্র – ৩

॥ ৩ ॥

অথচ একটি মানুষ, যাঁর মধ্যে এক বিরাট যুদ্ধবীরের সম্ভাবনা ছিল, যাঁর মধ্যে রাজা হবার বীজ এবং স্বপ্ন দুইই ছিল, শুধুমাত্র শারীরিক কারণে সেই ব্যক্তি পরিপূর্ণ রূপ পেলেন না—এটা ইতিহাসের অবিচারও নয়, খুব যে বড় সামাজিক অবিচার, তাও নয়, নিতান্তই এক কঠিন বাস্তব তাঁর স্বপ্ন ধূলিসাৎ করে দিয়েছে।

কেমন করে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল আমরা জানি। তাঁর জননী অম্বিকা এমন করে বোধ হয় তাঁর এই সন্তানটি চাননি। অম্বিকার স্বামী বিচিত্রবীর্য অকালে মারা গেছেন। স্ত্রীর প্রতি তাঁর প্রেমের কোনও অভাব ছিল না। বরঞ্চ অতিরিক্ত আসক্তি এবং দেহজ সম্ভোগ বিচিত্রবীর্যকে রোগে আক্রান্ত করল। স্ত্রী-সম্ভোগের ফল পরিণত হওয়া দূরে থাক, তার সম্ভাবনাই ঘটল না। বিচিত্রবীর্য অকালে মারা গেলেন। তাঁর অতি-রতির স্মৃতি নিয়ে দুই যৌবনবতী রমণী হস্তিনাপুরীর অন্তঃপুরে কোনওমতে বেঁচে রইলেন।

বিচিত্রবীর্যের জননী সত্যবতী তখনও বেঁচে। দুই বিধবা পুত্রবধূকে দেখে তাঁর অন্তর দগ্ধ হয়—ততো সত্যবতী দীনা কৃপণা পুত্রগৃদ্ধিনী। কেবলই ভাবেন—এই তরুণীদুটির কোলে একটি পুত্রসন্তানও যদি থাকত! সত্যবতী রাজমাতা বলে কথা। পুত্রের পরিবর্তে পৌত্র নিয়ে সুখী হওয়াটা তাঁর পারিবারিক সুখের কারণ হত নিশ্চয়ই। কিন্তু এই সুখের চেয়েও তাঁর কাছে বৃহত্তর স্বার্থ ছিল আরও একটি বিখ্যাত পুরু-ভরত বংশের কোনও উত্তরাধিকারী রইল না। যে মানুষটি তাঁর পিতার বিবাহের সুখ সম্পাদন করতে গিয়ে নিজে অবিবাহিত থাকলেন, এবং তাঁর বিমাতা সত্যবতীর সন্তানের রাজসুখের স্বার্থে নিজে রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করলেন, সেই ভীষ্মের কাছেও দায় আছে সত্যবতীর।

সব ভাবনা ভেবে—বধূদের মনের শূন্যতা, পিতৃ-মাতৃবংশের শূন্যতা এবং রাজপরিবারের উত্তরাধিকারের কথা ভেবে—ধর্মঞ্চ পিতৃবংশঞ্চ মাতৃবংশঞ্চ ভাবিনী—জননী সত্যবতী ভীষ্মের সঙ্গে গূঢ় আলোচনায় বসলেন। ভীষ্মের সম্মান, তাঁর বঞ্চনা এবং তাঁর সঙ্গে মৃত বিচিত্রবীর্যের ভ্রাতৃসম্পর্কের নিরিখে সত্যবতী প্রথমে ভীষ্মকেই অনুরোধ করলেন তাঁর বিধবা পুত্রবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে। কিন্তু ভীষ্ম তাঁর পূর্বকৃত ভীষণ প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন সত্যবতীকে এবং কোনওভাবেই তিনি সত্য থেকে চ্যুত হতে চাইলেন না। অবশ্য তাই বলে যে তিনি প্রসিদ্ধ পুরু-ভরতবংশের বিপৎকাল সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন না, তা মোটেই নয়। পিতৃ-পিতামহের গৌরবোজ্জ্বল বংশ যাতে চিরতরে উৎসন্ন না হয়ে যায়, সে জন্য তিনি বিকল্প ব্যবস্থা দিলেন সত্যবতীকে। বললেন—আপনি অর্থের বিনিময়ে একজন গুণবান বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে দিয়ে পুত্রবধূদের গর্ভাধান করান—ব্রাহ্মণো গুণবান্ কশ্চিদ্ধনেনোপমন্ত্র্যতাম্। তিনি আপনার পুত্রবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করে এই প্রসিদ্ধ কূলের বৃদ্ধি ঘটাবেন।

কথাটা সত্যবতীর বেশ পছন্দই হল। সেকালের দিনে নিয়োগপ্রথা ছিল সমাজ-সচল প্রথা। বহু বড় বড় রাজবংশ এইভাবেই পুত্রসন্তানের মুখ দর্শন করেছে—যে পুত্রেরা বংশ পরম্পরায় রাজার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। সত্যবতী তাই ভীষ্মের প্রস্তাবে রাজি হলেন বটে, কিন্তু অর্থধনের বিনিময়ে কোনও গুণবান ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ জানানোর আগেই তিনি একটি পালটা প্রস্তাব দিলেন। সত্যবতী মহর্ষি ব্যাসের কথা জানালেন ভীষ্মকে। জানালেন যে, সেই অমিততেজা মহর্ষি তাঁর বৈবাহিক জীবনের পূর্বলব্ধ সন্তান—কন্যাপুত্রো মম পুরা দ্বৈপায়ন ইতি শ্রুতঃ। সত্যবতী ভীষ্মকে জানালেন যে, তিনি যদি তাঁর পুত্রকে এই বিপন্ন সময়ে ডেকে পাঠান, তবে তিনি অবশ্য আসবেন এবং জননীর অনুরোধ তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন না। তিনি অবশ্যই তাঁর ভ্রাতৃকল্প বিচিত্রবীর্যের পত্নীদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবেন—ভ্রাতুঃ ক্ষেত্রেষু কল্যাণম্ অপত্যং জনয়িষ্যতি।

ভীষ্ম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসকে যথেষ্টই চেনেন এবং তাঁর ক্রিয়াকলাপ তথা মাহাত্ম্য সম্বন্ধেও যথেষ্টই অবহিত। শুধু এটাই তিনি এতকাল জানতেন না যে, মহর্ষিও একভাবে তাঁর ভ্রাতৃকল্প। সত্যবতীর কথা শুনে তিনি মহানন্দে তাঁকে আমন্ত্রণ করার প্রস্তাব সমথর্ন করলেন—উক্তং ভবত্যা যচ্ছ্রেয়ং স্তন্মহ্যং রোচতে ভূশম্। জননী সত্যবতী স্মরণ করলেন তাঁর পুত্র দ্বৈপায়ন ব্যাসকে এবং তিনি অবিলম্বে উপস্থিত হলেন জননীর কাছে। সত্যবতী তাঁকে বহু সমাদর করে নিজের তথা রাজবংশের সমস্যার কথা জানালেন। সত্যবতী পুত্রের কাছে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানালেন যাতে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস বিচিত্রবীর্যের বিধবা পত্নীদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করেন—তয়োরুৎপাদয়াপত্যং সমর্থো হ্যসি পুত্রক।

ব্যাস মায়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেননি। কেননা এই প্রথা সমাজ-সচল এবং বিশেষত এই কর্মে জননী সত্যবতী তথা মহামতি ভীষ্মের মতো ব্যক্তির অনুমতি। ব্যাস শুধু বললেন—একটাই কথা আছে, মা! তুমি তোমার পুত্রবধূদের এক বৎসর আমারই দেওয়া বিধানে ব্রতনিয়ম পালন করতে বলো। তারপর তাঁদের সঙ্গে আমার মিলন হবে। কেননা ব্রতনিয়মের শুদ্ধতা ছাড়া আমার সঙ্গে তাঁদের সঙ্গতি হতে পারে না—ন হি মাম্ অব্রতোপেতা উপেয়াৎ কাচিদঙ্গনা।

জননী সত্যবতী বললেন—এক বছর! সে তো অনেক কালের কথা, বাবা! তুমি এখন এখনই ব্যবস্থা না করলে যে এ রাজ্য উচ্ছন্নে যাবে, বাবা! রাজ্যে রাজা না থাকলে কি বেশিদিন চলে? তুমি বাপু সেই ব্যবস্থা করো, যাতে সদ্য সদ্যই আমার পুত্রবধূরা সন্তানবতী হয়—সদ্যো যথা প্রপদ্যেতে দেব্যৌ গর্ভং তথা কুরু। ব্যাস বলেছিলেন—তাই যদি করতে হয় মা, তা হলে আমার এই বিরূপ বীভৎস রূপ সহ্য করতে হবে তোমার পুত্রবধূদের। আমার গায়ের দুর্গন্ধ, বিকট রূপ, মলিন বেশ এবং সবার ওপরে এই বিচ্ছিরি শরীরটা! এসব যদি তোমার পুত্রবধূরা সহ্য করতে পারেন—যদি মে সহতে গন্ধং রূপং বেষং তথা বপুঃ—তা হলে আজই তাঁরা গর্ভলাভ করতে পারেন।

ব্যাস তাঁর নিজের ছেলে বলেই হয়তো সত্যবতী তাঁর আকৃতি এবং বেশভূষা নিয়ে মাথাই ঘামাননি। হয়তো ভেবেছেন—ছেলে আমার ঋষি হয়েছে, যোগী হয়েছে—পারাশর্য মহাযোগী সব বভুব মহানৃষিঃ—তার আবার বেশভূষা কী, চেহারা কী? এ সব নিয়ে কীসের মাথাব্যথা? ভরতবংশের সন্তান-ভাবনা নিয়ে তাঁর মাথাখারাপ হয়ে যাচ্ছে, সেখানে কি এ সব ভাবলে চলে? অর্থাৎ ব্যাস তাঁর সহৃদয় বুদ্ধিতে বধূদের যন্ত্রণা যতটুকু আশঙ্কা করেছিলেন, সত্যবতী মেয়ে হয়েও সেটা তেমন করে বুঝলেন না।

তিনি সোজা গিয়ে উপস্থিত হলেন বিচিত্রবীর্যের প্রথমা স্ত্রী অম্বিকার কাছে। বললেন—মা! একটা ধম্মোকথা বলছি শোনো—ধর্মতন্ত্রং ত্বাং যদ্‌ব্রবীমি নিবোধ তৎ। আমার পোড়া কপালে এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশ তো নির্মূল হয়ে যাবার জোগাড়। তো আমার মনের দুঃখ বুঝে, আর ভরতবংশের দুরবস্থা বুঝে মহামতি ভীষ্ম আমাকে একটা বুদ্ধি দিয়েছেন—ভীষ্মো বুদ্ধিমাদান্-মহ্যং কুলস্যাস্য বিবৃদ্ধয়ে। কিন্তু যে বুদ্ধিটা তিনি দিয়েছেন, সেই বুদ্ধি কাজে পরিণত করতে হলে তোমার সাহায্য ছাড়া হবে না—সা চ বুদ্ধিস্ত্বয্যধীনা। তুমি তো বোঝ এই বংশের অবস্থা। অতএব এই উচ্ছিন্নপ্রায় ভরতবংশ উদ্ধার করবার ভার তোমার ওপরে। তুমি একটি পুত্রের জননী হও এবং সে এই হস্তিনাপুরের রাজ্যপাট সামলাক—স হি রাজ্যধুরং গুর্বীমুদ্‌বক্ষ্যতি কুলস্য নঃ।

সত্যবতীর অনুরোধ শুনেই বিচিত্রবীর্যের প্রথম বধূটি বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁকে নিয়োগপ্রথায় পুত্র উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু কে সেই ভাগ্যবান পুরুষটি, যাঁর সঙ্গে তাঁকে মিলিত হতে হবে—এই প্রয়োজনীয় খবরটুকু তিনি জানতে পারলেন না। সেকালের দিনে গুরুজনদের অনুমতি নিয়ে এই নিয়োগ সম্পন্ন হত এবং এটা অনেকটাই ছিল শুষ্ক কর্তব্যরক্ষার দায়ের মতো। কিন্তু যে বধূটি এই কার্যে নিযুক্তা হতেন, তাঁর মানসিকতা নিয়ে গুরুজনেরা যে খুব ভাবতেন তা মোটেই নয়। রাজবাড়ির প্রথমা বধূটির যন্ত্রণাটা তাই রয়েই গেল।