ভীষ্ম – ৪

॥ ৪ ॥

হস্তিনাপুরে শান্তনুর দ্বিতীয় পুত্র মহারাজ বিচিত্রবীর্য যখন মারা গেলেন, তখন এক বিশাল পারিবারিক সংকট উপস্থিত হল। একটিমাত্র পুত্র থাকা, আর পুত্র না থাকা—এই দুটিকে একইরকম প্রমাণ করে যে শান্তনু লজ্জার মাথা খেয়ে বিয়ে করলেন তাঁর একটি পুত্রও বাঁচলেন না; শুধু বেঁচে রইলেন ভীষ্ম এবং সেটাও পিতা শান্তনুর ইচ্ছামৃত্যু বয়ে যতখানি, তার চেয়ে বেশি নিজের মানসিক জোরে। মহারাজ বিচিত্রবীর্যকে একটি কঠিন যুদ্ধেও বিপন্ন, এমনকী বিব্রতও যিনি হতে দিলেন না, সেই ভীষ্ম কিন্তু বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু আটকাতে পারলেন না। হস্তিনাপুরের রাজসিংহাসন খালি পড়ে রইল। বিচিত্রবীর্যের শ্রাদ্ধশান্তি ঠিক ঠিক হয়ে গেল, কিন্তু এরপর বিশাল কুরুবংশের পরম্পরা কীভাবে রক্ষা হবে—সেই কথা ভেবে মহামতি ভীষ্মের মন চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে উঠল—ধর্মাত্মা স তু গাঙ্গেয়শ্চিন্তাশোকপরায়ণঃ।

মনস্বিনী সত্যবতীও যে প্রসিদ্ধ কুরু-ভরতবংশের এই সংকট তীব্রভাবে অনুভব করছিলেন না, তা নয়। শান্তনু ভীষ্মের প্রতি যে বঞ্চনা করেছেন, সে ব্যাপারে সত্যবতী ভীষ্মের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন। হয়তো সেই কারণেই বিচিত্রবীর্যের শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে গেলে সত্যবতী ভীষ্মকে একান্তে ডেকে বললেন—মহারাজ শান্তনুর দুই পুত্রই যেহেতু মারা গেল অতএব তাঁর পিণ্ডদাতা হিসেবে একমাত্র তুমিই রইলে। তাঁর কীর্তি এবং সন্তান-পরম্পরা রক্ষার দায়ও এখন তোমার। এসব কথা ভেবেই তোমার কাছে আমার একটি প্রস্তাব আছে জেনো। আমি যা বলছি, তা সম্পূর্ণ ধর্মসম্মত এবং সংসার সমাজের নিয়মনীতির ধর্মতত্ত্ব যেহেতু সবই তোমার জানা—ব্যবস্থানঞ্চ তে ধর্মে কুলাচারঞ্চ লক্ষয়ে—অতএব একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমি তোমাকে নিয়োগ করতে চাই—কার্যে ত্বাং বিনিযোক্ষ্যামি তচ্ছ্রুত্বা কর্তুমর্হসি।

সত্যবতী বললেন—আমার পুত্র বিচিত্রবীর্য সম্পর্কে তোমার ছোট ভাই। তার প্রতি তোমার ভালবাসাও ছিল যথেষ্ট—মম পুত্ৰস্তব ভ্রাতা বীর্যবান্ সুপ্রিয়শ্চ তে। আমার সেই পুত্র অকালে স্বর্গবাসী হল এবং তাঁর দুই মহিষীর গর্ভে কোনও পুত্রকন্যাও জন্মায়নি। কাশীরাজের দুটি মেয়েরই বয়স অল্প এবং যথেষ্ট রূপযৌবনসম্পন্ন। আমি চাই, তুমি আমার আদেশ মান্য করে তোমার ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে উপযুক্ত পুত্র উৎপাদন করো। সত্যবতীর কথা শুনে ভীষ্ম কিছু বিস্মিত হলেন না। কেননা, সমাজ সংসারের নীতিনিয়ম যাঁর জানা, তিনি জানেন যে, বিধবা ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবার জন্য প্রথমে ঘরের দেবর ভাসুরদেরই নিয়োগ করেন গুরুজনেরা। এখানে গুরুজন হিসেবে সত্যবতীই সেই আদেশ দিয়ে বলেছেন—আমিই তোমাকে এই কুলসম্মত ধর্মকার্যে নিযুক্ত করছি—মন্নিয়োগান্মহাবাহো ধর্মং কর্তুমিহার্হসি।

সত্যবতীর আদেশে ভীষ্ম একটুও বিস্মিত হলেন না বটে, কিন্তু একমুহূর্তের মধ্যে তিনি নিজের যন্ত্রণা এবং তাঁর প্রতি বঞ্চনাটুকুও শুনিয়ে দিলেন সত্যবতীকে। বললেন—মা! তুমি এতক্ষণ যা বললে। তাকে তো ধর্ম বলতে হবে নিশ্চয়ই—অশংসয়ং পরো ধর্মস্ত্বয়া মাতুরুদাহৃতঃ—কেননা, অপুত্রক অবস্থায় পুত্র স্বর্গবাসী হলে কুলধর্মের নিয়মে এই বিচারই স্বাভাবিক। কিন্তু পুত্রলাভের ব্যাপারে আমার প্রতিজ্ঞাটুকু তো তোমার অজানা নয়। কেননা, তোমারই জন্য আমাকে সেই কঠিন প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করতে হয়েছিল। আমি বলেছিলাম—আমি আমৃত্যু ব্রহ্মচারী হয়ে থাকব, আমার পুত্রলাভের প্রয়োজন নেই—জানাসি চ যথা বৃত্তং শুল্কহেতোস্ত্বদন্তরে। তোমার বিবাহের জন্য তোমার পিতার এই শর্ত মানতে গিয়ে সেদিন যে প্রতিজ্ঞা আমি করেছিলাম, আজ কোনওভাবেই সেই সত্য থেকে আমি চ্যুত হতে পারি না—ন ত্বহং সত্যমুৎস্রষ্ঠুং ব্যবসেয়ং কথঞ্চন।

আমাদের ধারণার কথা বলি। সত্যবতী এতদিন ধরে ভীষ্মের সঙ্গে মিশেছেন। তিনি তাঁর স্বভাব জানতেন না এমন নয়। তিনি জানতেন যে, তাঁর এই অনুনয় ভীষ্ম প্রত্যাখ্যান করবেন এবং তাঁকে দুটো কথাও শোনাবেন। তিনি জানতেন এসব। কিন্তু জানলেও তিনি মনস্বিনী সত্যবতী, কুরুবাড়ির সমস্ত ব্যাপারে—সে রাজনীতিই হোক অথবা পারিবারিক সমস্যা—সর্বত্রই তাঁর সূক্ষ্ম বুদ্ধি প্রসারিত ছিল। ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা জানা সত্ত্বেও যে তিনি ভীষ্মকে অনুনয় করছেন, তার কারণ একটাই—কুরুবংশের কুলবধূদের গর্ভে যে পুত্র উৎপাদন করার প্রস্তাব তিনি করবেন, সে প্রস্তাব যেন ভীষ্মের মুখ দিয়েই বেরোয়। পিতা শান্তনু বেঁচে থাকতেই মহামতি ভীষ্ম কুরুবাড়ির অভিভাবকের ভূমিকায় কাজ করেছেন। তিনি রাজসিংহাসনের দাবিদার হননি বটে, আপন বংশরক্ষার চেষ্টা করেননি বটে, কিন্তু তাঁর অভিভাবকত্বের ‘ইগো’টুকু নিয়ে তাঁর পিতা থেকে আরম্ভ করে সত্যবতী এবং বিচিত্রবীর্য কেউই কোনও প্রশ্ন তোলেননি। আজও সত্যবতী যেটা করতে চাইছেন, তা শুধু ভীষ্মকে দিয়ে অনুমোদন করানো নয়, তাঁর মুখ থেকেই সেটা বার করতে চাইছেন। কারণ কুরুবাড়ির কীর্তি এবং সন্তান-পরম্পরা রক্ষার দায়িত্ব প্রধানত তাঁর। তিনিই এখন কুরুবংশের একমাত্র জীবিত ব্যক্তি। অন্তত যে কারণ দেখিয়ে ভীষ্মকে বঞ্চিত করে শান্তনু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন, সেই কারণে সত্যবতীর নিজের ওপরে দায় আসে বলেই সত্যবতীর এই ভনিতা।

অতএব সত্যবতী বললেন—তোমার প্রতিজ্ঞা থেকে তুমি যে একটুও নড়বে না, সে আমি ভাল করেই জানি—জানামি তে স্থিতিং সত্যে। আর আমারই জন্য যে এই কঠিন প্রতিজ্ঞা তোমার, তাও আমি ভুলে যাইনি—জানামি চৈবং সত্যং তন্মদর্থে যচ্চ ভাবিতম্‌। কিন্তু এখন যে বাপু বিপদের সময়। এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশের কুলতন্তু যাতে ছিন্ন হয়ে না যায়, কুলধর্ম রাজধর্ম যাতে উৎসন্ন না হয়, সমস্ত মন্ত্রী-অমাত্য প্রজাদের মুখে যাতে আবার হাসি ফোটে, সেরকম একটা ব্যবস্থা তো করতেই হবে, বাপু! জননী সত্যবতীর উদ্‌বেগ বুঝে ভীষ্ম এবার নিজেই প্রস্তাব দিলেন ত্যাগী ব্রতী এবং উপযুক্ত কোনও ব্রাহ্মণকে দিয়ে যাতে বিচিত্রবীর্যের দুই মহিষীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করানো যায়। তার জন্য ভীষ্ম কিছু টাকাপয়সা খরচা করতেও রাজি, অন্তত তাতে যদি গুণশালী কোনও ব্রাহ্মণকে দিয়ে বিচিত্রবীর্যের বংশ রক্ষা করা যায়—ব্রাহ্মণো গুণবান্ কশ্চিদ্ ধনেনোপনিমন্ত্র্যতাম্।

আবারও সুযোগ এল সত্যবতীর। ব্রাহ্মণ অথবা কোনও মুনি-ঋষিকেই যদি ডাকতে হয়, তবে তাঁর আপন কানীন পুত্র স্বয়ং পরাশর ব্যাস নন কেন। দ্বৈপায়ন ব্যাস সত্যবতীর কন্যাকালে জাত পুত্র। তিনি মহাজ্ঞানী ঋষি। সত্যবতী ব্যাসের জন্মকাহিনী শোনালেন ভীষ্মকে। ভীষ্ম ব্যাসকে চিনতেন না, এমন নয়। তখনই তিনি বিখ্যাত ব্রহ্মর্ষি। ভীষ্মের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েই ব্যাসের অনেক আলাপ হয়েছে। সত্যবতী ভীষ্মকে শুধু জানালেন যে, ব্যাস তাঁকে কথা দিয়েছেন—জননী সত্যবতীর বিপদের দিনে তিনি নিশ্চয়ই তাঁর ডাকে সাড়া দেবেন। সত্যবতী বললেন—তুমি যদি অনুমতি কর ভীষ্ম, তবেই তাঁকে আমি ডাকতে পারি—তং স্মরিষ্যে মহাবাহো যদি ভীষ্ম ত্বমিচ্ছসি। তোমার অনুমতি পেলে আমার আশা—আমার সেই ছেলে বিচিত্রবীর্যের মহিষীদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করবে—তব হ্যনুমতে ভীষ্ম…পুত্রানুৎপাদয়িষ্যতি।

মহাভারত-না বোঝা কিছু মানুষ আছেন, যাঁরা এই ঘটনার মধ্যে সত্যবতীর স্বার্থান্বেষিতা দেখতে পেয়েছেন। তাঁদের জানাই—নিয়োগ প্রথার কিছু নিয়মকানুন আছে, তাতে কুল সম্বন্ধে মৃত ব্যক্তির যথাসম্ভব কাছের মানুষই মৃত ব্যক্তির স্ত্রীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করার পক্ষে শ্রেয় বলে গণ্য হতেন। পিতার সম্বন্ধে ভীষ্ম যেমন বিচিত্রবীর্যের ভাই, তেমনই মায়ের সম্বন্ধে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসও বিচিত্রবীর্যের ভাই, ভীষ্ম এবং ব্যাস দুজনকেই বাদ দিলে নিয়োগ ঘটত বহিরাগত কোনও গুণবান ব্রাহ্মণকে দিয়ে। অতএব ভীষ্মের প্রত্যাখ্যানের পর বিচিত্রবীর্যের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে ব্যাসই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি নিয়োগের উপযুক্ত পাত্র হতে পারেন! সত্যবতী সেই প্রস্তাব দিয়েই ভীষ্মের অনুমতি চেয়েছেন এ ব্যাপারে। ভীষ্মের না করবার কোনও হেতু ছিল না। মহর্ষি ব্যাসের নাম শোনামাত্রই ভীষ্মের মাথাটি সম্মানসূচকভাবে নত হল। দুই হাত জোড় করে ভীষ্ম সত্যবতীর প্রস্তাব মেনে নিলেন—মহর্ষেঃ কীর্তনে তস্য ভীষ্মঃ প্রাঞ্জলিরব্রবীৎ। বললেন—ধর্ম, অর্থ, কামের সমস্ত অভিসন্ধি যিনি সর্বতোভাবে জানেন, তিনিই তো সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষ। তুমি যে কথা বলেছ তাতে আমাদের এই প্রসিদ্ধ বংশের হিত এবং ধর্ম দুইই হবে। তুমি যে প্রস্তাব দিয়েছ, তা শ্রেয় তো বটেই এবং তা আমার ভীষণ ভীষণ ভালও লাগছে—উক্তং ভবত্যা যচ্ছ্রেয়-স্তন্মহ্যং রোচতে ভৃশম্‌। সত্যবতীর প্রস্তাব ভীষ্ম মেনে নেবার সঙ্গে সঙ্গেই—ততস্তস্মিন্‌ প্রতিজ্ঞাতে ভীষ্মেণ কুরুনন্দন—সত্যবতী তাঁর প্রিয় পুত্রকে স্মরণ করলেন আপন পুত্রবধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য।

যথাসময়ে অম্বিকার গর্ভে জন্মালেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, অম্বিকার গর্ভে পাণ্ডু এবং এক দাসীর গর্ভে জন্মালেন বিদুর। কুরুবংশের এই তিন সন্তানকে নিয়ে আবারও ভীষ্মের তপস্যা আরম্ভ হল। যিনি নিজের পিতার সময় থেকে কুরুবংশের অভিভাবক নিযুক্ত হয়েছিলেন আবার সেই অভিভাবকত্ব আরম্ভ হল ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরকে নিয়ে। তাঁদের অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া, বেদ বেদাঙ্গ ইতিহাস পড়ানো, শ্রম-ব্যায়াম নীতিশাস্ত্র শেখানো—এ সব কিছুই ভীষ্ম নিজেই সম্পন্ন করলেন। জন্ম থেকে এই তিন বালকের মতিগতি এবং বিশিষ্টতা বুঝে ভীষ্ম যেভাবে বিশেষ বিশেষ শিক্ষার ব্যবস্থা করলেন, তা এক পিতা শুধু পুত্রের জন্য করেন—জন্ম প্রভৃতি ভীষ্মেণ পুত্রবৎ প্রতিপালিতাঃ। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলে তাঁকে অস্ত্রশিক্ষা দেওয়া তেমন সম্ভব হল না বটে, কিন্তু প্রভূত পরিশ্রমব্যায়ামের মাধ্যমে ধৃতরাষ্ট্রকে অন্যতম শক্তিমান পুরুষে পরিণত করলেন ভীষ্ম।

এইভাবে ভীষ্মের শিক্ষায় রাজপুত্রেরা বড় হবার পর পাণ্ডু কুরুরাজ্যের সিংহাসনে বসলেন। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলে সেকালের চিরাচরিত আইনে তাঁকে সিংহাসনের অধিকার দেওয়া গেল না। অন্ধ, বধির কিংবা ক্লীব ব্যক্তি সেকালে সিংহাসনে বসে রাজকার্য চালাবার উপযুক্ত বলে গণ্য হতেন না। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের বুকে এই দুঃখ কাঁটার মতো বিঁধে রইল, কিন্তু তাতে তাঁর রাজসুখে কোনও বাধা ঘটল না। কারণ, মহারাজ পাণ্ডু যথোচিত মর্যাদায় ধৃতরাষ্ট্রের পালন পোষণ করতে লাগলেন।

রাজকার্য যখন ভালভাবে চলতে লাগল, তখন ভীষ্মের মনে কথঞ্চিৎ আত্মতৃপ্তি বিরাজ করতে লাগল। আর যখনই এই পুত্ৰকল্প রাজাদের দেখে ভীষ্মের আত্মতৃপ্তি আসে, সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মন এক অজানা আশঙ্কায় পীড়িত হতে থাকে। বার বার মনে হয়—কুরুবংশের এই অঙ্কুরগুলি ঠিক ঠিক বর্ধিত হয়ে ফুলে ফুলে শোভিত হবে তো! নাকি আবারও সেই বিপদ আসবে, যেমনটি এসেছিল চিত্রাঙ্গদ বিচিত্রবীর্য মারা যাবার পর।

এই আশঙ্কা থেকেই একদিন বিদুরকে ডেকে আনলেন ভীষ্ম। একান্ত আলোচনার জন্য। বিদুর বিচিত্রবীর্যের মহিষীদের গর্ভে জন্মাননি। স্বয়ং পরাশর ব্যাস তাঁকে সৃষ্টি করেছেন আপন আৰ্ষমাহাত্ম্যের গৌরবে। জন্ম থেকেই বিদুর পরম ধর্মজ্ঞ। বেদ বেদাঙ্গ ছাড়াও রাজনীতিশাস্ত্র, নীতিশাস্ত্র এবং আইন-সংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারে বিদুরের শাস্ত্রগত তথা বাস্তব জ্ঞান অত্যন্ত প্রখর। ভীষ্ম সেই বিদুরকে ডেকে বললেন—দেখো বাছা! আমাদের এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশ পৃথিবীর সমস্ত রাজবংশের মহিমা অতিক্রম করেছে। আমাদের অগ্রজন্মা সব রাজারা হস্তিনাপুরের রাজ্যকে সম্যকভাবে রক্ষা করে গেছেন। আমি চাই—এই মহান বংশ যাতে কোনওভাবেই লুপ্ত হয়ে না যায়। তুমি তো জান বিদুর—বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুর পর আমাদের এই প্রসিদ্ধ বংশ প্রায় উৎসন্ন হয়ে যেতে বসেছিল। কিন্তু আমি, সত্যবতী এবং কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস—তিনজনে মিলে—ময়া চ সত্যবত্যা চ কৃষ্ণেন চ মহাত্মনা—এই বংশের কুলতন্তুগুলি পুনঃস্থাপন করেছি। এখন তোমায় আমায় মিলে সেই চেষ্টা করতে হবে যাতে এই বংশ ফুলে ফেঁপে সাগরের মতো বড় হয়ে ওঠে—তচ্চৈতদ্‌ বর্ধতে নিত্যং কুলং সাগরবদ্‌ যথা।

ভীষ্ম আবারও বিয়ের কথা বলছেন। ভ্রাতুষ্পুত্রদের বিয়ের কথা। সেই পিতা শান্তনুর সময় থেকে আরম্ভ হয়েছিল। শান্তনু বংশবৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে নিজে বিবাহ করেছিলেন। তাঁর জন্যই ভীষ্মের জীবনে প্রথম সমস্যা তৈরি হয় এবং সেই তাঁর আত্মত্যাগ শুরু। তারপর তাঁর পুত্র বিচিত্রবীর্যের বিবাহের জন্য কাশীরাজের স্বয়ংবরসভায় গিয়ে নিজের মরণসমস্যা তৈরি করলেন। এখন বিচিত্রবীর্যের ক্ষেত্রজ সন্তানদের বংশবৃদ্ধির বিষয়েও আবারও তাঁর চিন্তা আরম্ভ হয়েছে। নিজে বিবাহ করতে পারেননি, সন্তানলাভ করতে পারেননি, তার জন্য তাঁর কোনও দুঃখ নেই। কিন্তু পিতার বংশকে ঠিক ঠিক বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তাঁদের বংশবৃদ্ধি ঘটাতে হবে। এ কেমন এক অভিমান! যে পিতা ভীষ্মের মতো এক পুত্রকে পুত্রের মধ্যে গণ্য না করে তাঁকে বঞ্চিত করে বিবাহ করেছেন, ভাগ্যের কী নিষ্ঠুর পরিহাস—তাঁর দুটি পুত্রই বাঁচলেন না এবং তাঁরা পুত্র পর্যন্ত রেখে যেতে পারলেন না। এই পরিহাসই ভীষ্মকে কুরুবংশের মায়ায় জড়িয়েছে। সব সময় তাঁর আশঙ্কা—আবার কোনও দুর্ঘটনা না হয়। অন্তত কোনও দুর্ঘটনা ঘটার আগে কুলের উত্তরাধিকারীরা জন্ম নিক এই পৃথিবীতে।

ভীষ্ম এবার আর কোনও ‘রিস্‌ক’ নিলেন না। নানা তীর্থে রাজ্যে রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো ব্রাহ্মণ সজ্জনেরা তাঁকে দুটি কন্যারত্নের কথা জানিয়ে গেছেন। একটি যাদবঘরের কন্যা বসুদেবের ভগিনী কুন্তী, দ্বিতীয়া হলেন গান্ধার দেশের রাজা সুবলের কন্যা গান্ধারী। শুধু এই বংশপরিচয়, আর এই দুই কন্যার রূপগুণের কথা শুনেই যে ভীষ্ম কন্যাদুটিকে ভরতবংশের কুলবধূ করে আনতে চান, তা নয়। ভীষ্ম চান যে, পাণ্ডু ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা সংখ্যায় এতই বেশি থাকুন, যাতে রাজবংশের উত্তরাধিকারী নির্ণয়ে কোনও সমস্যা তৈরি না হয়।

কুন্তী এবং গান্ধারী-র কথা বিদুরকে জানানোর পর বিদুর ভীষ্মকে বলেছেন—এই বংশের মাতা, পিতা এবং গুরু—সবই আপনি। আপনি আমাদের বংশের হিতের জন্য যেটা ভাল মনে করবেন, সেটাতেই আমাদের ভাল হবে—ভবান্ পিতা ভবান্‌ মাতা ভবান্নঃ পরমো গুরুঃ। সত্যি কথা বলতে কী, কুন্তী এবং গান্ধারীকে কুলবধূ হিসেবে ভাবনা করার সময় ভীষ্ম শুধু বলেছিলেন—এই কুলের সন্তান-পরম্পরা ঠিক রাখার জন্য এই দুজনকেই বরণ করে নিয়ে আসাটা ঠিক হবে বলে আমার মনে হয়। তবে এ বিষয়ে তোমার মতটাও জানতে চাই বিদুর—সন্তানার্থং কুলস্যাস্য যদ্বা বিদুর মন্যসে।

বিদুর একবারও জিজ্ঞাসা করেননি—কেন? কেন এই ভারতবর্ষের সমস্ত রাজকন্যাকে ছেড়ে এই দুটি কন্যাই আপনার পছন্দ হচ্ছে? বিদুর এই প্রশ্ন না করলেও তিনি জানতেন যে, বিশেষ কিছু ভেবেই ভীষ্ম এই দুজনকে কুলবধূর মর্যাদা দিতে চাইছেন। বস্তুত এই ভাবাটা ভীষ্ম আগেই ভেবে নিয়েছিলেন। ব্রাহ্মণদের মুখে তিনি শুনেছিলেন যে, সুবলাত্মজা গান্ধারী মহাদেবের কাছে শত পুত্র লাভের বর পেয়েছেন। অন্যদিকে দুর্বাসার মন্ত্রবলে দৈব পুত্রলাভের সমস্ত অভিসন্ধিই যে যাদবী কুন্তীর করায়ত্ত—এ কথাও নিশ্চয়ই জানতেন ভীষ্ম। কেননা, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় শরশয্যায় শুয়ে মহাবীর কর্ণকে ভীষ্ম বলেছিলেন—আমি দেবর্ষি নারদের কাছে আগেই শুনেছি যে, তুমি অধিরথসূতপুত্র রাধাগর্ভজাত নও, সূর্যের ঔরসে কুন্তীর গর্ভে যে তোমার জন্ম হয়েছে, তা আমি জানতাম—সূর্যজস্ত্বং মহাবাহো বিদিতো নারদান্ময়া।

এই খবর থেকে বোঝা যায় যে, পুত্রলাভের ব্যাপারে কুন্তীর দৈবী ক্ষমতা ভীষ্ম আগে থেকেই জানতেন। একই সঙ্গে আরও একটা সন্দেহ আমাদের মনে আসে। পাণ্ডুর বধূ হিসেবেই তিনি কুন্তীর কথা ভাবলেন কেন? মিলনসময়ে ব্যাসের তেজে অম্বালিকার শরীর পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গিয়েছিল বলে তাঁর পুত্রটি পাণ্ডুবর্ণ হয়েই জন্মালেন। কিন্তু পাণ্ডুবর্ণতা তেমন কোনও রোগ নয়। আমাদের ধারণা—পাণ্ডু যে সন্তানলাভের ব্যাপারে অক্ষম ছিলেন, সে কথা ভীষ্ম জানতেন এবং জানতেন বলেই এমন একটি বধূর কথা তিনি ভেবেছেন, যাঁর অন্য কোনও উপায়ে সন্তান লাভের উপায় করায়ত্ত।

মহাভারতে কুন্তীর বিবাহ উপলক্ষে একটি স্বয়ংবরসভার আয়োজন আমরা দেখি বটে, কিন্তু সেখানে কুন্তী যে পাণ্ডুকেই স্বামী হিসেবে নির্বাচন করলেন, তার একটা বড় কারণ মনে হয় ভীষ্মের পূর্ব যোগাযোগ। ভীষ্ম হয়তো আগেই কুন্তীর কথা শুনেছিলেন নারদের মুখে এবং স্বয়ংবরের পূর্বেই হয়তো মহারাজ কুন্তিভোজের সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করে থাকবেন। পাণ্ডু এবং কুন্তীর বিবাহও হয়ে যায় পূর্বকল্পিত উপায়ে। কুন্তীর ব্যাপারে আমাদের এই ভাবনা বা দ্বিধার কথা তেমন স্পষ্ট করে লেখেননি মহাভারতের কবি। কিন্তু শুধুমাত্র সংখ্যায় পুত্রসন্তান বেশি লাভ করতে পারেন—প্রধানত এই চিন্তাতেই যে ভীষ্ম গান্ধারীকে কুরুকুলের বন্ধু নির্বাচন করেছিলেন, সে কথা খুব স্পষ্টভাবেই লিখেছেন মহাভারতের কবি—ইতি শুশ্রাব তত্ত্বেন ভীষ্মঃ কুরুপিতামহঃ। গান্ধারী এবং কুন্তীর নির্বাচনের কথা মহাভারতের একই জায়গায় লিখিত আছে। অপিচ নারদের মুখে কর্ণের সংবাদ ভীষ্ম যেহেতু আগেই জানতেন, তাই আমাদের ধারণা—ব্যাস স্পষ্ট করে না বললেও কুন্তীর পূর্ব কথা বিশেষত দুর্বাসার মন্ত্রবলের কথাও ভালভাবেই জানতেন ভীষ্ম।

তথাকথিত যে স্বয়ংবরে পাণ্ডুকে বরণ করলেন কুন্তী, সৌভাগ্যের বিষয় পাণ্ডু নিজেই সেখানে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে হস্তিনাপুর থেকে অন্য কোনও রাজপুরুষকে গান্ধার রাজ্যে পাঠিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের জন্য নির্বাচিত বধূটিকে নিয়ে আসা হল এবং শাস্ত্রমতে তাঁর বিবাহ হল হস্তিনাপুরেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, সন্তানলাভের ক্ষেত্রে কুন্তীর দৈবী শক্তি এবং গান্ধারীর বরলাভের কথা জেনেও সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হলেন না ভীষ্ম। অন্তত সিংহাসনে উপবিষ্ট রাজা পাণ্ডুর দ্বিতীয় একটি বিবাহ দেবার কথা ভাবলেন স্বয়ং ভীষ্ম। এমন হতেই পারে যে, সন্তানলাভের ব্যাপারে পাণ্ডুর অক্ষমতার কথা খুব স্পষ্টভাবে কখনওই ধারণা করা যেত না, অন্তত বিবাহের পূর্বে তা ধারণা করা তো উচিতও নয়। সেক্ষেত্রে কুন্তীর সঙ্গে বিবাহ দিয়ে পাণ্ডুর পুত্রলাভের পথ মসৃণ রেখেও ভীষ্ম যে দ্বিতীয়বার মাদ্রীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ স্থির করলেন, তা হয়তো পাণ্ডুর আপন পৌরুষে আস্থা ফেরানোর জন্য। পাণ্ডুর স্বল্পায়ু জীবন লক্ষ করলেও বোঝা যাবে পাণ্ডু কুন্তীর চেয়ে মাদ্রীকে বেশি ভালবাসতেন। পুত্রলাভের ক্ষমতা যে রমণীর আপন করায়ত্ত তাঁকে নিয়ে অলৌকিক গৌরব বোধ করা যেতে পারে নিশ্চয়ই, কিন্তু যেকোনও পুরুষেরই, তা সে যত অক্ষমই হোক, পুরুষকারে আঘাত লাগে।

পাণ্ডুর জন্য দ্বিতীয় বধূ নির্বাচনের সার্থকতা হয়তো সেইখানেই এবং মাদ্রীকে নির্বাচন করেছেন ভীষ্ম নিজে গিয়ে। এটা অনেকটাই সেই বিচিত্রবীর্যের সময়ের মতো। যদিও এখানে কোনও স্বয়ংবরের ব্যবস্থা ছিল না এবং ভীষ্ম গিয়ে সোজা মদ্রেশ্বরকে বলেছিলেন—আমি পাণ্ডুর সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য এ রাজ্যের রাজকন্যাটিকে বধূ হিসেবে চাই—তামহং বরয়িষ্যামি পাণ্ডোরর্থে যশস্বিনীম্‌। মদ্ররাজ সানন্দে রাজি হয়েছেন এবং ভীষ্মও মাদ্রীকে নিয়ে হস্তিনাপুরে পৌঁছেছেন শ্বশুরের মতো। পাণ্ডুর বিবাহের পর ভীষ্ম বিদুরের বিয়েও দিয়েছেন এবং তা একেবারে জাত মিলিয়ে। বিদুর ব্যাসের ঔরসে শূদ্রা দাসীর গর্ভজাত সন্তান। এই ধরনের বর্ণসংকর জাতক তখনকার সমাজে ‘পারসব’ বলে পরিচিত ছিলেন। মহামতি ভীষ্ম বিদুরের সঙ্গে একটি ‘পারসবী’ কন্যারই বিবাহ দিয়েছেন, যাতে অভিভাবক হিসেবে তাঁকে কেউ কিছু বলতে না পারে।

বিচিত্রবীর্যের পুত্র বলে কথিত ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু এবং বিদুরের বিয়ে দিয়ে ভীষ্ম বেশ সন্তুষ্ট মনেই দিন কাটাচ্ছিলেন। রাজা হিসেবে পাণ্ডুও ছিলেন যথেষ্ট সার্থক। বিশেষত জ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র এবং কনিষ্ঠ বিদুরের প্রতি পাণ্ডুর ব্যবহার এতই মধুর ছিল যে, অন্তত ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষে তাঁকে কোনও দোষ দেওয়া সম্ভব হত না বলেই মনে হয়। কিন্তু এরই মধ্যে কী ঘটল কে জানে, অতৃপ্ত ধৃতরাষ্ট্রকে খানিকটা রাজ্যশাসনের সুযোগ দেবার জন্যই হোক অথবা নিজের পুত্রলাভের অক্ষমতা সবার কাছে ঢেকে রাখবার জন্যই হোক, পাণ্ডু তাঁর দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে চলে গেলেন। ভারপ্রাপ্ত রাজা হিসেবে পাণ্ডুর রাজ্যশাসন চালাতে লাগলেন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র।

ভারপ্রাপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য চালাতে চালাতে রাজত্বের স্বাদ পেলেন বোধহয়। যদিও এখনও পর্যন্ত তিনি হস্তিনাপুর থেকে নানা ভোগবিলাসের উপকরণ বনবাসী পাণ্ডুকে পাঠিয়ে যাচ্ছিলেন এবং পাণ্ডু তা গ্রহণও করছিলেন। কিন্তু কিন্দম মুনির অভিশাপের রূপকে পাণ্ডু যখন নিজের পুত্রলাভের অক্ষমতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হলেন, তখন তিনি ব্রাহ্মণ সজ্জনদের হস্তিনাপুরে পাঠিয়ে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, তিনি আর রাজ্যে ফিরে আসবেন না, তিনি এখন থেকে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে বনে বনে, তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াবেন—গত্বা নাগপুরং বাচ্যং পাণ্ডুঃ প্রব্রজিতো বনম্‌। কথাটা শুনে ভারপ্রাপ্ত রাজা ধৃতরাষ্ট্রকেও আমরা অত্যন্ত শোকক্লিষ্ট হতে দেখেছি, কিন্তু এই শোক তাঁর একান্ত আন্তর শোক কি না, সেটা মহাভারতের শব্দপ্রমাণ থেকে তেমন বোঝা যায় না।

যাই হোক, এসব খবরে কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে আমরা আন্দাজ করতে পারি। ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, ভীষ্মেরও সেই অবস্থা হল নিশ্চয়ই। হস্তিনাপুরের রাজ্যশাসন এক অদ্ভুত অনিশ্চয়তার মধ্যে এসে পড়ল। দেশের রাজা প্রব্রাজক হয়ে গেলেন। অন্যদিকে ভারপ্রাপ্ত রাজা অন্ধ এবং পূর্বে তিনি রাজ্যলাভে উৎসুক ছিলেন। এরমধ্যে আবার নতুন বিপদ তৈরি হল। পাণ্ডু তখন শতশৃঙ্গ পর্বতের অধিবাসী এবং সেখান থেকেই খবর এসে পৌঁছোল পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুধিষ্ঠির জন্মগ্রহণ করেছেন। ধৃতরাষ্ট্রের তখনও পুত্র হয়নি। গান্ধারী আপন উদরে আঘাত করে এক মাংসপেশি প্রসব করলেন বটে, কিন্তু সে খবর পেয়ে স্বয়ং ব্যাস এসে পৌঁছোলেন হস্তিনাপুরে। ব্যাস যথানিয়মে সেই মাংসপেশি শতধা বিদীর্ণ করে একশোটি কলসি সাজিয়ে গান্ধারীর শত পুত্র জন্ম সুনিশ্চিত করলেন বটে, কিন্তু হিমালয়ের আশ্রমে ফিরে যাবার আগে তিনি মহামতি ভীষ্ম এবং বিদুরকে জানিয়ে গেলেন যে, জন্মসময়ের প্রমাণে মহারাজ পাণ্ডুর প্রথম পুত্র যুধিষ্ঠিরই কিন্তু জ্যেষ্ঠ—তদাখ্যাতন্তু ভীষ্মায় বিদুরায় চ ধীমতে।

কুরুকুলের সর্বজ্যেষ্ঠ অভিভাবকের কাছে কুরুবংশের প্রতিস্থাপক কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস কী ইঙ্গিত করে গেলেন, তা দুর্বোধ্য কিছু নয় এবং যথাসময়ে তা অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের কানেও এল। তিনি নিজে রাজা হতে পারেননি এবং যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠতার কারণে তাঁর পুত্রও যে রাজা হতে পারবেন না—এ বিষয়ে তাঁর বিষাদ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছিল। যুধিষ্ঠিরের জ্যেষ্ঠত্ব তিনি কোনওমতে গলাধঃকরণও করতে পারছেন না, আবার বমনও করতে পারছেন না। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র দুর্যোধন যেদিন জন্মালেন, সেদিন ভীষ্ম বিদুরকে সভায় ডেকে আনলেন ধৃতরাষ্ট্র। নিজের বক্তব্য এবং ভীষ্ম বিদুরের প্রতি বক্তব্যের প্রমাণ রাখবার জন্য অন্যান্য কুরুবংশীয় তথা বন্ধুবান্ধবদেরও সভায় ডেকেছিলেন ধৃতরাষ্ট্র।

ধৃতরাষ্ট্র বলেছিলেন—মানলাম। এ কথা মানলাম যে, যুধিষ্ঠিরই রাজপুত্রদের মধ্যে বয়সে সবার বড় এবং সেইজন্য সে নিজের গুণেই রাজ্য পাবে। আমাদের কিছু বলার নেই এখানে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের পর আমার পুত্র দুর্যোধন এই রাজ্যের রাজা হবে তো—অয়ত্বনন্তরস্তস্মাদ্‌অপি রাজা ভবিষ্যতি।

ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রশ্নের উত্তর ভীষ্ম দিতে পারেননি। পারেননি, কারণ তিনি এই নবোদ্গত কুলাঙ্কুরগুলির পিতামহ। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের এই কথার মধ্যে কী সর্বনাশা ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে, তা তিনি ভালই বুঝেছেন। দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের চেয়ে এক বছরের মাত্র ছোট। দুজনকেই দীর্ঘায়ু পুরুষ ধরে নিলে যুধিষ্ঠিরের পর কবে দুর্যোধন রাজা হবেন? এক যদি আগেই অকালে কুলজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের মৃত্যু না হয়। ধৃতরাষ্ট্র কি তাঁর মৃত্যু চান। ধৃতরাষ্ট্রের এই অদ্ভুত প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে হস্তিনাপুরে নানা দুর্নিমিত্ত দুর্লক্ষণ দেখা গিয়েছিল। এই দুর্লক্ষণ যতখানি প্রাকৃতিক, অন্তত মহাভারতে তাই বর্ণিত আছে, এই দুর্লক্ষণ তার চেয়েও বেশি পারিবারিক এবং অবশ্যই রাজনৈতিক। ভীষ্ম বিদুরের মতো মানুষেরা এই দুর্লক্ষণটাই দেখতে পেয়েছিলেন ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্নে। কিন্তু ভীষ্ম কথা না বললেও বিদুর তাঁর ভয়ভাবনা জানিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন—আপনার এই পুত্রের জন্য শেষপর্যন্ত এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশের বিনাশ ঘটবে—ব্যক্তং কুলান্তকরণো ভবিতৈষ সুতস্তব। আপনি এই পুত্র ত্যাগ করুন, মহারাজ।

দুর্যোধন সবেমাত্র জন্মেছেন, কিন্তু সেই পুত্রকে নিয়েই ধৃতরাষ্ট্র যে উচ্চচূড় স্বপ্ন দেখছেন, প্রাকৃতিক দুর্লক্ষণের তাৎপর্য এইখানেই। বিদুরের কথায় ধৃতরাষ্ট্র পুত্রত্যাগ করেননি। ক্রমান্বয়ে ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্র রাজকীয় মর্যাদায় মানুষ হতে লাগলেন। বছর পনেরো এইভাবেই কেটে গেল এবং কুরুবংশের বিপদসূচক সেই দুর্লক্ষণ ঘনিয়ে এল শতশৃঙ্গ পর্বতে পাণ্ডুর দেহান্ত হবার পর। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর শতশৃঙ্গবাসী মুনি-ঋষিরা কুন্তী এবং তাঁর পাঁচ পুত্রকে নিয়ে হস্তিনাপুরে এলেন। সঙ্গে পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃতদেহ।

সেদিন কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্মের মনের অবস্থা কীরকম হয়েছিল, তার কোনও বর্ণনা নেই মহাভারতে। কিন্তু পৌর-জনপদেরা রাজসভার বাইরে ভেঙে পড়েছে। পাঁচ পুত্রের হাত ধরে অসহায় কুন্তী রাজসভায় দাঁড়িয়ে আছেন আর সমস্ত কুরুমুখ্যদের মধ্যে অন্যতম এক ব্যক্তি হিসেবে ভীষ্ম বসে আছেন রাজসভায় মুনি-ঋষিদের মুখে কুন্তীর পুত্র-পরিচয় শোনার জন্য। কেমন লেগেছিল ভীষ্মের? কুলবৃদ্ধ হিসেবে ভীষ্মই মুনি-ঋষিদের রাজসভায় আমন্ত্রণ জানালেন এবং তারপরেই শুনতে পেলেন সেই ভয়ংকর সংবাদ—পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃত্যু হয়েছে। কুন্তী ও মাদ্রীর গর্ভে পঞ্চ দেবতার ঔরসজাত পাঁচ পুত্রই স্বর্গত মহারাজ পাণ্ডুর পুত্র। তাঁরাই মহারাজ পাণ্ডুর উত্তরাধিকারী।

রাজসভায় আসীন সমস্ত রাজন্যবর্গ এবং সুহৃদ্‌বর্গ এবং কুরুবংশীয়রা সকলেই পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের স্বীকার করে নিলেন এবং ঠিক এই ঘটনার পরেই ভারপ্রাপ্ত মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের মুখে প্রথম রাজশাসন বিজ্ঞাপিত হল—বিদুর! পাণ্ডু এবং মাদ্রীর শব-সৎকার এবং শ্রাদ্ধক্রিয়া রাজোচিতভাবে সম্পন্ন করো। ধৃতরাষ্ট্রের এই আদেশের পর আমরা কুরুবৃদ্ধ ভীষ্মকেও বিদুরের সঙ্গে রাজাদেশ পালনে নিযুক্ত দেখছি—বিদুরস্তং তথেত্যুক্ত্বা ভীষ্মেণ সহ ভারত। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর সৎকার এবং শ্রাদ্ধক্রিয়া সমস্ত সময়টা জুড়ে ভীষ্মকে মাঝে মাঝেই পাণ্ডব-বালক এবং বিদুরের সঙ্গে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখছি—ক্রোশন্তঃ পাণ্ডবাঃ সর্বে ভীষ্মো বিদুর এব চ।

পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ হয়ে গেলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস জননী সত্যবতীকে কৌরবদের সংসার ছেড়ে বনবাসী হবার পরামর্শ দিয়ে বললেন—মা! তোমার দেখা সেই যৌবনবতী পৃথিবী এখন বৃদ্ধা। নানা অন্যায় অনীতিতে ভরে উঠবে এই সংসার। তোমার সুখের দিন শেষ হয়ে গেছে, মা! তুমি তপোবনে তপস্যা করবে চলো—অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ পৃথিবী গতযৌবনা। পুত্রের কথা শুনে সত্যবতী ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডুর জননী অম্বিকা এবং অম্বালিকাকে নিয়ে বনগমনের জন্য প্রস্তুত হলেন। এই মুহূর্তে যাঁর কাছে সত্যবতী বিদায় চাইলেন, তিনি ভীষ্ম—ভীষ্মমামন্ত্র্য সুব্রতা। আপন বিবাহের দিন থেকে আজ পর্যন্ত যে ব্যক্তি তাঁর সুখদুঃখের সঙ্গী ছিলেন, তাঁরই কাছেই শুধু বিদায় নেবার দায় রইল সত্যবতীর। সত্যবতী একবারও বুঝলেন না, হয়তো বা বুঝেও বুঝলেন না, যে—ভরতবংশ বৃদ্ধির যে অছিলায় ভীষ্মকে রাজ্য এবং সংসার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল, আজও তিনি শুধু সেই দায়িত্ব নিয়েই কুরুবাড়ির সংসারে রয়ে গেলেন।

আগের মতো অভিভাবকত্ব আজ আর চলে না। ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর বিবাহসময় পর্যন্ত ভীষ্ম যে মর্যাদায় ছিলেন, আজ আর তিনি সেই মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত নেই। কালের নিয়মেই সেই মর্যাদা প্রতিষ্ঠা তাঁর টলে গেছে। যে পৃথিবী এককালে ভীষ্মের কাছেও যৌবনবতী ছিল, সে কিন্তু ভীষ্মের চোখেও তার যৌবন হারিয়েছে। তাঁরও কিন্তু সুখের দিন অতিক্রান্ত। কিন্তু তবু ভীষ্ম সত্যবতীর মতো চলে যেতে পারলেন না। পিতা শান্তনু ভরতবংশের মূল দৃঢ়প্রোথিত করার জন্য দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছিলেন বটে, কিন্তু রাজ্যশাসন সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে তিনি দেবব্রত ভীষ্মকে অতিক্রম করেননি। তাঁর পুত্র বিচিত্রবীর্যও অতিক্রম করেননি ভীষ্মকে। এমনকী সত্যবতীও তেমন পরামর্শ কখনও দেননি।

কিন্তু আজ যখন দ্বৈপায়ন ব্যাসের ইঙ্গিতে জননী সত্যবতী কুরুবাড়ির সংসার ছেড়ে চললেন, তখন তাঁরই প্রায় সমবয়সি অথবা বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও ভীষ্ম এই কুরুবাড়ি ছেড়ে যেতে পারলেন না কেন? সে কি শুধুই মায়া? আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাঁর মতো মনস্বী ব্যক্তি শুধু মায়ায় জড়িয়ে পড়ে ভবিষ্যতের অপমান হজম করার জন্য কুরুবাড়িতে বসে রইলেন না। বরঞ্চ ব্যাস যে সত্যবতীকে বলেছিলেন—কুরুবংশীয় জাতকদের অন্যায়ে এই পৃথিবী এখন দুঃখাবাস হয়ে উঠবে—সেই ভবিষ্যদ্‌বাণী মনে রেখে ভীষ্ম এখনও রয়ে গেলেন সেই অন্যায়ের প্রতিরোধের জন্য। যথাসম্ভব প্রতিরোধের জন্য। অন্যায় হবে, খারাপ দিন আসবে, সেই ভয়ে অন্য সকলে, এমনকী কুরুবংশের জননী সত্যবতীও পালিয়ে যেতে পারেন, কিন্তু ভীষ্ম পালিয়ে যেতে পারেন না। যে বংশের হিতের জন্য তিনি রাজ্য এবং সংসারসুখ জলাঞ্জলি দিয়েছেন, তিনি তার শেষ দেখে যাবেন।

ভীষ্মের হাতে আছে ইচ্ছামৃত্যুর বর। কাজেই পলায়ন করে তিনি সেই মৃত্যু বরণ করবেন না। পিতা শান্তনুর বিবাহের সময়েও তিনি পালাননি, আজও তিনি পালাবেন না। সংসারের চরম বঞ্চনা যৌবনকালেই যাঁর গা-সওয়া হয়ে গেছে, তাঁকে এই বৃদ্ধ বয়সে আর কোন বঞ্চনা কোন অপমান আরও বেশি করে পীড়িত করবে! তিনি অন্তত এইটুকু দেখে যাবেন যে, তাঁকে বঞ্চিত করে পিতা শান্তনু অন্যতর যে ধারায় কুরুবংশের বৃদ্ধি কামনা করেছিলেন, সে ধারায় কেমন চলে কৌরববংশ? তিনি দেখে যাবেন। সব দেখে যাবেন। সে দেখার সাধ এবং সাহস সত্যবতীর নেই। তাই তিনি পালালেন। কিন্তু ভীষ্ম থাকলেন সেই পুরাতন সাক্ষী-চৈতন্যের মতো, পিতা শান্তনুর বীজবপন থেকে বৃক্ষ ধ্বংস পর্যন্ত প্রত্যক্ষ করার জন্য। তিনি থাকলেন আরও একটি কারণে। ধ্বংসের অনিবার্য যে প্রক্রিয়া ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন থেকেই শুরু হয়েছিল সেই প্রক্রিয়ার মধ্যেই তিনি তাঁর প্রতিরোধ এবং সুপরামর্শ রেখে যাবেন, যাতে সেই ধ্বংস-প্রক্রিয়ার সমান্তরাল ভূমিতে তাঁরই মতো এক বঞ্চিত মানুষ, এক বঞ্চিত পরিবারের জয় উৎপন্ন হয়। ভীষ্ম তাই কুরুবাড়িতেই থেকে গেলেন।