ধৃতরাষ্ট্র – ৬

॥ ৬ ॥

সেকালের দিনে ভাল পাত্রীর খবর পাওয়া যেত মুনি ঋষিদের কাছে। তাঁরা তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াতেন, এ-রাজা সে-রাজার যাগযজ্ঞে উপস্থিত হতেন, কখনও বা স্বেচ্ছায় আতিথ্য গ্রহণ করতেন রাজাদের বাড়িতে। এইভাবেই রাজবাড়ির রাজকন্যার খবর হয়ে যেত। ভীষ্ম গান্ধারীর খবরও পেলেন এইভাবে। ভীষ্ম ব্রাহ্মণদের কাছে শুনতে পেলেন—গান্ধার দেশের রাজা সুবলের একটি ভারী লক্ষ্মীমতী মেয়ে আছে। শিবের আরাধনা করে সে শত পুত্রের জননী হবার বর লাভ করেছে—গান্ধারী কিল পুত্রাণাং শতং লেভে বরং শুভা।

এই পুত্রসংখ্যার ওপর ভীষ্মের কিছু দুর্বলতা আছে। এতকাল ভরতবংশের কর্ণধার হয়ে তাঁর বড় দুর্ভাবনা গেছে। তিনি এইরকমই একটি সৌভাগ্যবতী রমণী চান, যে তাঁকে ভাবনামুক্ত করবে। সমস্ত দিক বিবেচনা করে ভীষ্ম একটি বিশ্বস্ত দূত পাঠালেন গান্ধার রাজা সুবলের কাছে। দূতের মুখে ধৃতরাষ্ট্রের সমস্ত বর্ণনা শুনে বড় দ্বিধায় পড়লেন গান্ধাররাজ। যাঁর সঙ্গে গান্ধারীর সম্বন্ধ ঘটালেন ঈশ্বর, তিনি অন্ধ। একটি অন্ধ রাজপুত্রের হাতে চিরজীবনের মতো মেয়েকে সঁপে দেবার ইচ্ছে হল না তাঁর—অচক্ষুরিতি তত্রাসীৎ সুবলস্য বিচারণা। অন্যদিকে এই কথাটাও বার বার সুবলের মনে ক্রিয়া করতে লাগল যে, ছেলেটি বিখ্যাত ভরতবংশের জাতক। এই বংশের খ্যাতিতেই একটি বিশাল দেশ আজ ভারতবর্ষ নামে চিহ্নিত হয়েছে। অনেক ভাবনা, অনেক দুশ্চিন্তার পর ভরতবংশের খ্যাতির কথাই তাঁর মনে ক্রিয়া করতে লাগল। মহামতি ভীষ্ম তাঁর কন্যাকে চেয়ে পাঠিয়েছেন, এই গৌরবও তাঁকে ইতিবাচক সিন্ধান্ত নেবার ব্যাপারে ত্বরান্বিত করল। ধৃতরাষ্ট্রের কুল, তার প্রসিদ্ধি এবং ভরতবংশীয়দের চরিত্র স্মরণ করে মহারাজ সুবল রাজি হলেন বিবাহে। তিনি দূতের কাছে কথা দিলেন—এ বিয়ে হবে—দদৌ তাং ধৃতরাষ্ট্রায় গান্ধারীং ধর্মচারিণীম।

যথাসময়ে এই বিয়ের কথা গান্ধারীর কানেও গেল। তিনি যখন বুঝলেন যে, তাঁর পিতামাতা ভরতবংশের খ্যাতি-কীর্তিতে মুগ্ধ হয়ে একটি অন্ধ রাজপুত্রের সঙ্গেই তাঁর বিবাহ ঠিক করেছেন, তখন তিনি মাতাপিতাকে যেমন অতিক্রম করলেন না, তেমনই তাঁর ভাবী স্বামীর প্রতিও একই সঙ্গে সমব্যথী হয়ে উঠলেন। যাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে, তিনি এই সুন্দর ভুবনের রূপ রস কিছুই অনুভব করতে পারবেন না, আর তাঁরই সহধর্মিণী হয়ে তিনি চক্ষুর বিষয়গুলি ভোগ করবেন—এমনটি তিনি চাইলেন না। ভাবী স্বামীর প্রতি সমব্যথায় তিনি একটি পট্টবস্ত্র বেঁধে নিলেন নিজের চোখের ওপর। স্বামীর উপযুক্ত হবার জন্য এই ছিল তাঁর প্রথম সাধন। তাঁর ধারণা—চক্ষুদুটি দিয়ে দেখতে পেলে, সেও এক ধরনের অতিক্রম করা হবে স্বামীকে। গান্ধারী কোনও ব্যাপারেই স্বামীকে অতিক্রম করতে চান না—নাতিশিষ্যে পতিমহম্ ইত্যেবং কৃতনিশ্চয়া। স্বামীর দুঃখ গান্ধারী যেন আগে থেকেই আত্মসাৎ করে নিলেন।

গান্ধার রাজ্যটা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমে এখনকার পাকিস্তান ছাড়িয়ে আরও কিছু দূরে। সেখান থেকে হস্তিনাপুরে আসা তো খুব কম কথা নয়। পাহাড়ি পথ নদ নদী, পথের ভয়। কিন্তু সেকালের দিনে এই নিয়মও ছিল—মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে উঠিয়ে এনে বিয়ে দেওয়া হত। অতএব যুবতী এবং সুন্দরী গান্ধারীকে নিয়ে তাঁর ভাই শকুনি রওনা দিলেন হস্তিনাপুরের পথে। সঙ্গে চলল গান্ধাররাজ্যের রথ, অশ্ব, পদাতিক—স্বসারং পরয়া লক্ষ্ম্যা যুক্তামাদায় কৌরবান্। হস্তিনায় পৌঁছে শকুনি ভীষ্মের অনুমতি নিলেন। বিবাহের দিন ঠিক হল তাঁর সঙ্গে আলোচনা করে। তারপর পরম আদরে ভগিনী গান্ধারীকে ধৃতরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলেন শকুনি। সঙ্গে দিলেন রাজকীয় উপহার—রথ, অশ্ব, হাতি, বহুমূল্য বস্ত্র।

শকুনি ভগিনীকে রেখে আপাতত ফিরে গেলেন গান্ধারে। আর রাজকন্যা গান্ধারী নিজের চরিত্র এবং আচারব্যবহারে মুগ্ধ করে দিলেন কুরুবাড়ির সকলকে। তাঁর স্বামীনিষ্ঠার মধ্যে যে শুধু কর্তব্যের বাহ্য আড়ম্বর ছিল, তা মোটেই নয়। তিনি যে স্বামীর মন বা মনস্তত্ত্ব কতটা বুঝতেন, তার পরিচয় আমরা সেইদিনই বুঝেছি, যেদিন গান্ধারী তাঁর চোখদুটি বেঁধে নিয়েছিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চয়ই মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। অন্ধত্বের জন্য রাজ্য পাননি বলে তাঁর মনের মধ্যে যে অনন্ত জটিলতা ছিল, সেই জটিলতা হয়তো আরও বাড়ত, যদি তিনি দেখতেন তাঁর একান্ত সহধর্মিণী জগতের রূপ, রস, গন্ধ স্বাধীনভাবেই ভোগ করছেন, আর তিনি পড়ে আছেন সেই অন্ধত্বের কূপগৃহে। অতএব গান্ধারীর এই স্বারোপিত অন্ধত্ব ধৃতরাষ্ট্রকে খুশি করেছিল অন্তরে।

ধৃতরাষ্ট্রের বিয়ের পর পর পাণ্ডুরও বিয়ে হয়ে গেল কুন্তী এবং মাদ্রীর সঙ্গে। লক্ষণীয় ব্যাপার হল, বিয়ের পর ঠিক এক মাস যেতে না যেতেই পাণ্ডু দিগ্‌বিজয়ে বেরোলেন। নানা দেশ জয় করে পাণ্ডু যে ধনরত্ন সঞ্চয় নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলি ভাগ করে দেবার সময় পাণ্ডুকে কিন্তু আমরা ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিতে দেখছি—ধৃতরাষ্ট্রাভ্যনুজ্ঞাতঃ স্ববাহুবিজিতং ধনম্। হয়তো পাণ্ডুর এই ব্যবহারের মধ্যে রাজোচিত উদারতার সঙ্গে বড় দাদার প্রতি মায়াও কিছু ছিল। যিনি অন্ধত্বের জন্য রাজ্য পাননি, তাঁকে অতিরিক্ত মর্যাদা দিয়ে যদি তাঁর ক্ষোভ কিছুটা কমানো যায়—এই চেষ্টাই হয়তো করেছেন পাণ্ডু।

পাণ্ডুর এই দান মানের প্রক্রিয়ায় ধৃতরাষ্ট্র যে অখুশি হয়েছেন তা মোটেই নয়, তবে এই মায়ার দান তাঁর মনে যে কোনও জটিলতার সৃষ্টি করেনি, তা বলা যাবে না। পাণ্ডুর দানে মানে পুলকিত হয়ে তাঁর লব্ধ অর্থ দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র যজ্ঞটজ্ঞ অনেক করেছেন। তবে এই প্রকট আনন্দ প্রকাশের অন্তরালে হতাশার এক বিচিত্র অন্তঃক্রিয়া চলছিলই, যা ধৃতরাষ্ট্র নিজেও খুব যে বুঝতে পারছিলেন, তা নয়।

সঠিক কী যে হল, তা জানি না, কিন্তু দিগ্‌বিজয় সেরে কিছুদিনের মধ্যেই পাণ্ডু রাজভোগ রাজসুখ ত্যাগ করে দুই স্ত্রীকে নিয়ে বনে চলে গেলেন। জ্যেষ্ঠ দাদার ওপর কোনও অভিমান ছিল কি না, কোনও নিঃশব্দ ক্রোধ ছিল কি না, মহাভারতের কবি তা স্পষ্টত বলেননি। শুধু বলেছেন—মৃগয়ার ব্যপদেশে পাণ্ডু দুই স্ত্রীকে নিয়ে অকালে বনবাসী হলেন। এই অবস্থায় ধৃতরাষ্ট্রকে আমরা অস্থায়ী এক কার্যনির্বাহী রাজার ভূমিকায় দেখতে পাচ্ছি, আরও দেখতে পাচ্ছি, পাণ্ডুর বনবাসের প্রথম কল্পে ধৃতরাষ্ট্র যথেষ্ট আদর করার চেষ্টা করছেন বনবাসী পাণ্ডুকে। উৎসাহী লোক দিয়ে পাণ্ডুর চিরাভ্যস্ত বিলাসদ্রব্য অথবা প্রিয় ভোজ্যদ্রব্য ধৃতরাষ্ট্র পাঠিয়ে দিচ্ছিলেন বনে—তস্য কামাংশ্চ ভোগাংশ্চ নরা নিত্যমতন্দ্রিতাঃ। উপাজহ্রু-বর্নান্তেষু…

পাণ্ডু বন থেকে মোটেই ফিরে এলেন না। কিন্তু এক ভাই বনে এবং আরেক ভাই রাজধানীতে থাকলেও তাঁদের দুজনের মধ্যেই যে সাধারণ প্রচেষ্টা দেখা গেল, সেটা হল যত শীঘ্র সম্ভব পুত্রলাভের চেষ্টা। ধৃতরাষ্ট্রপত্নী গান্ধারী পূর্বে মহাদেবকে তুষ্ট করে শত পুত্র লাভের বর পেয়েছিলেন, সে বর আরও পরিপুষ্ট হল কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের কৃপায়। কোনও এক সময় ক্ষুধাশ্রান্ত ব্যাসকে অতিরিক্ত শুশ্রূষা করে গান্ধারী তাঁর পূর্বান্বিষ্ট বরই ব্যাসের কাছে পুনরায় চাইলেন। তিনি শতপুত্রের জননী হতে চান। এর পরেই গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রবীজ ধারণ করলেন আপন গর্ভে।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, মহারাজ পাণ্ডু শতশৃঙ্গ পর্বতে থেকেও এই গর্ভধারণের খবর পেয়েছেন মনে হয়। দুর্ভাগ্য, এরই মধ্যে তাঁর প্রজননক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। এর জন্য তথাকথিত মৃগ-মুনির অভিশাপই দায়ী, নাকি আদতেই তাঁর প্রজননক্ষমতা ছিল না, সে অন্য তর্ক। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হল, গান্ধারীর গর্ভধারণের অনুরূপ সময়েই পাণ্ডুও কিন্তু আপন পুত্রলাভের জন্য পাগল হয়ে উঠলেন। যে কোনও কারণেই হোক গান্ধারীর পুত্রলাভে বিলম্ব হচ্ছিল, এদিকে পাণ্ডুর প্রথমা পত্নী কুন্তী দুর্বাসার দেববশীকরণ মন্ত্রের সুযোগ নিয়ে গর্ভধারিণী গান্ধারীর পূর্বেই পুত্রলাভ করলেন—পাণ্ডুর অনুমতিক্রমে, নিয়োগপ্রথায়। পাণ্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্র—এই দুই পরস্পরস্পর্ধী রাজভ্রাতার মধ্য পাণ্ডুর প্রথম পুত্র যুধিষ্ঠিরই যে পরবর্তী প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ পুত্র, সে কথা সেই শতশৃঙ্গ পর্বত থেকে একজন এসে জানিয়েও গেল ধৃতরাষ্ট্রের রাজধানী হস্তিনাপুরে। পাণ্ডুর অরণ্যনিবাস থেকে যে লোকটি এসেছিল, সে এই কথাদুটি গুরুত্বপূর্ণ লোকের কানে দিয়ে গেল। তাঁদের একজন কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীষ্ম, অপরজন কুরুরাষ্ট্রের বিবেক বিদুর—তদাখ্যাতন্তু ভীষ্মায় বিদুরায় চ ধীমতে। তবে আমাদের ধারণা এ খবর দিয়েছিলেন স্বয়ং মহামতি ব্যাস।

খবরটা ছড়িয়ে পড়তে দেরি হল না। গান্ধারী যখন কুন্তীর পুত্রলাভের কথা শুনলেন, তখন তাঁর মতো মনস্বিনী ধীরা রমণীও ঈর্ষায় কাতর হলেন। বোধ করি—ধৃতরাষ্ট্রের মানসিক জটিলতা তাঁরও অন্তরে কোনওভাবে প্রবেশ করেছিল। অন্ধত্বের জন্য নিজে রাজ্য পাননি বলে ধৃতরাষ্ট্র নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন—তাঁর পুত্রটি অন্তত রাজ্য লাভ করুক, হস্তিনাপুরে জ্যেষ্ঠের পরম্পরা থাকুক। হয়তো গান্ধারীকে তিনি বার বার এই ব্যাপারে সচেতন করেছিলেন। এই উদ্দেশেই গান্ধারী কুন্তীর পূর্বে গর্ভধারণ করেন। কিন্তু তাঁর দুর্ভাগ্য কুন্তীর গর্ভেই পাণ্ডুর প্রথম পুত্র জন্মাল।

ঈর্ষায়, দুঃখে অধীর হয়ে গান্ধারী তাঁর নিশ্চল গর্ভে আঘাত হানলেন পুত্রলাভের আশায়। মহাভারতের কবি লিখেছেন—ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতসারেই গান্ধারী এই কাজটি করেন—অজ্ঞতাং ধৃতরাষ্ট্রস্য। কিন্তু কেন গান্ধারী এই অধৈর্যের পরিচয় দিলেন, তা আমরা জানি। ধৃতরাষ্ট্র যে খুশিটুকু চেয়েছিলেন, সেই খুশিটুকু দিতে পারলেন না বলেই স্বামীকে না জানিয়ে কুন্তীর ওপর অক্ষম ঈর্ষা মেটালেন তিনি—সোদরং ঘাতয়ামাস গান্ধারী দুঃখমূৰ্ছিতা। গর্ভে আঘাত করেও গান্ধারী পুত্র পেলেন না। লোহার মতো শক্ত একটি মাংসময়ী পেশি প্রসব করে গান্ধারী নিরাশ হয়ে বসে রইলেন। মাংসপেশিটি ফেলেই দিতেন তিনি, কিন্তু সেই মুহূর্তেই বেদব্যাস এসে পড়লেন গান্ধারীর কাছে। কুন্তীর ওপর পুনরায় তাঁর ঈর্ষা সুব্যক্ত হল। ব্যাসকে তিনি জানালেন—কুন্তীর ছেলে হয়েছে শুনেই আমি এই আকালিক গর্ভপাত ঘটিয়েছি—দুঃখেন পরমেনেদম্ উদরং পাতিতং ময়া।

আমরা জানি—ব্যাস অসীম করুণায় ঘৃতপূর্ণ কলসিতে শীতল জলের মধ্যে সেই মাংসপেশি রক্ষণ করেছিলেন এবং সেই শীতল-কলসির প্রক্রিয়ায় একদিন তা থেকেই গান্ধারীর শত পুত্র জন্ম লাভ করেছিল। ধৃতরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র যেদিন জন্মাল, সেদিন কবির বর্ণনায় অনেক অলক্ষণ দুর্লক্ষণ দেখা গেছে। কিন্তু সেগুলিকে আক্ষরিক অর্থে না ধরাই ভাল। আসলে এইসব দুর্লক্ষণ ধৃতরাষ্ট্রের প্রথমজন্মা পুত্রের ব্যাপারে সমকালীন মানুষের দুশ্চিন্তা এবং দুর্ভাবনা সূচনা করে। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর পুত্রটিকে রাজসিংহাসনে অভিষিক্ত দেখতে চান বলেই, কুরুবাড়ির কর্তাব্যক্তিদের মনে নতুন এক বিপন্নতা তৈরি হয়েছে এবং এই বিপন্নতাই দুর্লক্ষণের প্রতিরূপে মহাভারতে বর্ণিত হয়েছে।

দুর্যোধন নাকি জন্মের সময়েই একটি গর্দভের মতো কর্কশ স্বরে কেঁদে উঠেছিলেন এবং তাঁর সেই ক্রন্দনধ্বনির উত্তর শোনা গিয়েছিল শেয়াল শকুন কাকের চিৎকারে। কিন্তু এগুলি বড় কথা নয়। দুর্যোধন জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রীপ্রতিম ব্রাহ্মণদের ডেকে এবং বিশেষত ভীষ্ম এবং বিদুরকে ডেকে একটি সভায় মিলিত হন—সমানীয় বহূন বিপ্রান্ ভীষ্মং বিদুরমেব চ। সভায় তাঁর বক্তব্য ছিল একটাই। সমবেত মন্ত্রীদের তিনি জিজ্ঞাসা করলেন—আমাদের বংশের ভূষণ যিনি, সেই যুধিষ্ঠির তো নিজের গুণে রাজ্য পেয়েই গেছেন। অতএব সে ব্যাপারে আমার কিছু বলার নেই—প্রাপ্তং স্বগুণতো রাজ্যং ন তস্মিন্ বাচ্যমস্তি নঃ। এই কথা থেকে যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে ধৃতরাষ্ট্রের যে বড় তৃপ্তি ছিল, এটা ভাবার কোনও কারণ নেই। কেননা ধৃতরাষ্ট্র সভা ডেকেছিলেন সভয়ে—ততন্তু ভীতবদ্ রাজা ধৃতরাষ্ট্রো’ব্রবীদিদম্—তাঁর মনে ভয় ছিল—তিনি যা বলছেন, ভীষ্ম-বিদুররা তা সমর্থন করবেন তো? যুধিষ্ঠিরের কথা বলেই ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করেছিলেন—যুধিষ্ঠির এখন না হয় রাজ্য পেলেন, কিন্তু তাঁর পরেই আমার ছেলেটি রাজ্য পাবে তো—অয়ন্তু অনন্তর-স্তস্মাদ্ অপি রাজা ভবিষ্যতি?

ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্ন শুনে তাঁর মন্ত্রী, ব্রাহ্মণরা, ভীষ্ম, বিদুর সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। আবার সেই শেয়াল শকুনের দুর্লক্ষণ রূপক বর্ণনা করতে হয়েছে মহাভারতের কবিকে। মহামতি বিদুর তাঁকে সদুপদেশ দিয়ে বলেছিলেন—যেসব দুর্লক্ষণ দেখছি, তাতে আপনার এই ছেলেটি আমাদের বংশনাশের কারণ হয়ে উঠবে। অতএব আপনি একে পরিত্যাগ করলেই অনিষ্ট হবার সম্ভাবনাটা কম থাকবে। একে রাখলে অনেক অনর্থ ঘটবে—ব্যক্তং কুলান্তকরণো ভবিতৈষ সুতস্তব।

বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বোঝানোর জন্য একটু ভাবাবেগও প্রয়োগ করলেন। বললেন—একশোটার জায়গায় আপনার বরং নিরানব্বইটি ছেলে থাকুক মহারাজ! কিন্তু একটা ছেলেকে আপনি ত্যাগ করুন। এতে এই বংশেরও মঙ্গল হবে, জগতেরও মঙ্গল হবে—একেনৈব কুরু ক্ষেমং কুলস্য জগত স্তথা। আসলে শেয়াল শকুনের দুর্লক্ষণ নয়, ধৃতরাষ্ট্রের মনের মধ্যেই সেই ভয়ংকর চাওয়াটুকু দেখা দিয়েছিল, যাতে ভবিষ্যতের জ্ঞাতি-বিরোধ স্পষ্টভাবে অনুমান করা যাচ্ছিল। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরের কথা শোনেননি, হয়তো শোনা সম্ভবও ছিল না। আজকের আধুনিক দৃষ্টিতে এবং মানবিক ভাবনায় ধৃতরাষ্ট্রের এই ব্যবহার হয়তো স্বাভাবিকই ছিল। সে-কালের দিনের প্রজারঞ্জক রাজার সুউচ্চ আদর্শের নিরিখে ধৃতরাষ্ট্রের এই মানসিকতা ঠিক ছিল না। প্রসিদ্ধ ভরতবংশে স্বার্থান্বেষী রাজার স্থান হয়নি কোনওদিন। স্বয়ং ভরত দৌষ্মন্তি তাঁর নিজের ছেলেগুলিকে রাজকর্মের অযোগ্য দেখে তাঁদের রাজসিংহাসনের অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন—নাভ্যনন্দত তান্ রাজা নানুরূপা মমেত্যুত। ভরতের তিন রানি রাগে দুঃখে নিজেদের ছেলেগুলিকে মেরে ফেলেছিলেন, সে খবরও আমরা মহাভারতেই পাই—ততস্তান্ মাতরঃ ক্রুদ্ধাঃ পুত্রান্ নিন্যুর্যমক্ষয়ম্।

কিন্তু সেই ভরতবংশের জাতক হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু তাঁর প্রথম পুত্রটির মায়া ত্যাগ করতে পারলেন না—ন চকার তথা রাজা পুত্রস্নেহ-সমন্বিতঃ। ধৃতরাষ্ট্রের একশো পুত্রই রইল, সঙ্গে একশো ভাইয়ের এক বোন, ধৃতরাষ্ট্রের একটি কন্যাও জন্মাল। তার নাম দুঃশলা। গান্ধারী যখন গর্ভের ভারে শ্রান্তক্লান্ত, তখন ধৃতরাষ্ট্র তাঁর কামবেগ প্রশমনের জন্য একটি বৈশ্যজাতীয়া দাসীর সঙ্গে মিলিত হন। তাঁর গর্ভেও ধৃতরাষ্ট্রের একটি পুত্র হয়। তাঁর নাম যুযুৎসু। সে কালের দিনের সমাজে এই জাতীয় মিলনের বৈধতা সম্পূর্ণ নির্ভর করত পিতামাতার স্বীকৃতির ওপর। কাজেই বৈশ্যা রমণীর গর্ভজাত পুত্রটির সামাজিক কোনও সমস্যা হয়নি।

ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রসংখ্যা ঠিক একশো কি না এই সংখ্যাতত্ত্বের সত্যতার মধ্যে আমরা যাচ্ছি না। এমন হতেও পারে ধৃতরাষ্ট্র অনেকগুলি পুত্রের জনক ছিলেন বলেই হয়তো শতসংখ্যার গৌরবটুকু তিনি পেয়েছেন। যাই হোক এতগুলি পুত্রকন্যা নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র সানন্দে দিন কাটাচ্ছিলেন। ওদিকে সেই শতশৃঙ্গ পর্বতের অরণ্য-আবাসে পাণ্ডু তাঁর পঞ্চপুত্র নিয়ে বাৎসল্য রস চরিতার্থ করছেন। কিন্তু সেই পুত্রদের নিয়ে হস্তিনায় ফিরে আসার কথা এখনও ভাবেননি পাণ্ডু। অতএব হস্তিনাপুরের রাজসুখের অধিকার এখনও সম্পূর্ণভাবেই ধৃতরাষ্ট্রের। পূর্বে তিনি ভৃত্যজনের মাধ্যমে পাণ্ডুর প্রিয় বিলাসদ্রব্য পাণ্ডুর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু এখন পাণ্ডু কোথায় আছেন—ধৃতরাষ্ট্রও তা ভাল করে জানেন না। আসলে একটা সময় ছিল যখন মৃগ-মুনির অভিশাপগ্রস্ত পাণ্ডু পুত্র হবে না ভেবে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলেন এবং সে খবর তিনি সাড়ম্বরে ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়েও দিয়েছিলেন। এমনকী হস্তিনার রাজবাড়ি থেকে আসা যেসব ধনরত্ন পাণ্ডুর কাছে অবশিষ্ট ছিল, তাও তিনি এক ভৃত্যের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ধৃতরাষ্টের কাছে—কথয়াঞ্চক্রিরে রাজ্ঞ-স্তব্ধনং বিবিধং দদুঃ।

পাণ্ডু তখন নানা বনপর্বত এবং তীর্থগুলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। কাজেই ধৃতরাষ্ট্রের খুব দোষ ছিল না। পাণ্ডুর প্রব্রজ্যা গ্রহণে তিনি দুঃখও পেয়েছিলেন যথেষ্ট। অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে একবার একরকম বলে, তারপর পঞ্চপুত্র লাভের পর হস্তিনায় ফিরে আসাটা পাণ্ডুর রুচিতে বেধেছে। আর তারপর তো পাণ্ডু মারাই গেলেন।

তথ্যের দিকে তাকিয়ে দেখুন—পাণ্ডু মারা যাবার পর কুন্তী যখন তাঁর পঞ্চ পুত্রের হাত ধরে হস্তিনায় এসে পৌঁছোলেন, তখন যুধিষ্ঠিরের বয়স ষোলো, তার মানে, আগের প্রবজ্যা গ্রহণের সময় থেকে ধরলে অন্তত কুড়ি-বাইশ বছর ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর কোনও খবর পান না। আর এই কুড়ি-বাইশ বছরে রাজসুখ তাঁর এতটাই অভ্যস্ত হয়ে যেতে পারে যাতে আশঙ্কা করার মতো কিছু থাকে না। ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররাও মানুষ হচ্ছিলেন রাজবাড়ির বাতাবরণে। বিশেষ জ্যেষ্ঠ দুর্যোধনের সম্বন্ধে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বলতা ছিল। জ্যেষ্ঠ পুত্র বলেই হোক অথবা তার জন্মের সময় অন্য লোকে অকথাকুকথা বলেছিল বলেই হোক, দুর্যোধনের প্রতি ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহ প্রশ্রয় ছিল বাঁধভাঙা। ধৃতরাষ্ট্রের প্রশ্রয়ে দুর্যোধন ভবিষ্যতের রাজা হবার স্বপ্ন দেখছিলেন এবং সে স্বপ্ন ধৃতরাষ্ট্রের ছিল, যা আমরা দুর্যোধনের জন্মের সময়েই দেখেছি।

দীর্ঘ পনেরো-কুড়ি বছরের অন্তর থাকায় ধৃতরাষ্ট্র ভুলেই গিয়েছিলেন যে পাণ্ডুরও পাঁচটি পুত্র আছে। তিনি আপন রাজসুখের বিলাসে যত না ব্যস্ত ছিলেন, তারচেয়ে অনেক বেশি আচ্ছন্ন ছিলেন সেই ভ্রান্তিবিলাসে, যাতে তিনি হয়তো ভেবেছিলেন—পাণ্ডু আর দেশে ফিরবেন না, তিনি প্রব্রজিত। বাস্তবে পাণ্ডু সত্যিই ফিরলেন না বটে, কিন্তু তাঁর মৃতদেহ ফিরে এল হস্তিনাপুরে। শতশৃঙ্গ পর্বতের আরণ্যক ঋষি মুনিরা পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃতদেহ নিয়ে হস্তিনাপুরে এসেছেন; তাঁদের সঙ্গে এসেছেন কুন্তী এবং পাণ্ডুর পঞ্চ পুত্র, সহায়হীন, সম্বলহীন, হস্তিনার রাজবাড়ির দুয়ারে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা।

সমস্ত রাজধানী ভেঙে পড়েছিল তাঁদের দেখবার জন্য। ভীষ্ম বিদুর ধৃতরাষ্ট্র সকলে শশব্যস্তে বাইরে এসেছিলেন সমাগত মুনি ঋষিদের বক্তব্য শোনার জন্য। গান্ধারী এবং অন্তঃপুরের রমণীরা যে যেভাবে ছিলেন সে অবস্থাতেই এসে দুখিনী কুন্তীর হাত ধরেছিলেন। কিন্তু দুর্যোধনরা শত ভাই যেভাবে সালংকারে সেজেগুজে পিতৃহীন পাণ্ডবদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহান্ধতার অবধিটুকু বিচার করা যায়।

পাণ্ডুর মৃত্যুতে ধৃতরাষ্ট্র যে যথেষ্ট কষ্ট পেয়েছিলেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মুনি ঋষিদের সাক্ষীপ্রমাণ শুনে কুন্তী এবং তাঁর পঞ্চ পুত্রের ভরণপোষণের ব্যবস্থাও তিনি করেছেন এবং প্রয়াত পাণ্ডুর সৎকারের ব্যবস্থাও তিনি এমন রাজকীয়ভাবে করেছেন যে, তাতে ছোট ভাইয়ের প্রতি তাঁর যে কোনও অসদ্ দৃষ্টি ছিল, তা বোঝা যাবে না। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের মানসিকতা পরিবর্তিত হতে সময় লাগেনি। হয়তো সেদিনকার কথা তিনি ভাবতে পারেননি, যেদিন পাণ্ডুর পঞ্চ পুত্র তাঁদের মায়ের হাত ধরে আশ্রয়প্রার্থীর মতো হস্তিনার রাজবাড়িতে প্রবেশ করেছিলেন। হয়তো এমন তিনি ভেবেছিলেন যে, রাজকীয় মর্যাদা নয়, সাধারণ ভরণপোষণের সুবিধা দিলেই মৃত পাণ্ডুর হাত থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। কিন্তু তিনি একবারের তরেও হয়তো মনে রাখেননি যে, পাণ্ডুর জ্যেষ্ঠ পুত্রের জন্ম-সংবাদ হস্তিনাপুরে জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিল একটি অজ্ঞাতনামা লোক এবং তাও কুরুবংশের অলিখিত কর্ণধার ভীষ্মের কাছে এবং নীতিবিদ বিদুরের কাছে।

পাণ্ডব-ভাইরা-কৌরব ভাইদের সঙ্গেই বড় হচ্ছিলেন। তফাত শুধু এইটুকুই যে, দুর্যোধনরা যে রাজকীয়তার মধ্য দিয়ে বড় হচ্ছিলেন, পাণ্ডব-ভাইরা তা হচ্ছিলেন না হয়তো। খাবারদাবার বা সাধারণ অন্নবস্ত্রের ভোগ থেকে পাণ্ডবরা নিশ্চয়ই বঞ্চিত হচ্ছিলেন না—সংব্যর্ধন্ত ভোগাংস্তে ভুঞ্জানাঃ পিতৃবেশ্মনি। কিন্তু ষোলো-সতেরো বছরের দুর্যোধন যে ব্যক্তিত্ব নিয়ে রাজকীয় কায়দায় জলক্রীড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, তা পাণ্ডবদের ভাবনার মধ্যেও ছিল না। বালকোচিত নানা ক্রীড়াকৌতুকের সময় ভীম কিছু শারীরিক অত্যাচার করে ফেলতেন কৌরব-ভাইদের ওপর। দুর্যোধন এতে অসন্তুষ্ট হয়ে ভীমকে বিষ খাওয়ানোর মতো সাংঘাতিক পরিকল্পনা করলেন। ধৃতরাষ্ট্রের পরোক্ষ প্রশ্রয় ছাড়া দুর্যোধনের পক্ষে এতটা কি ভাবা সম্ভব ছিল? ভীমকে বিষ খাওয়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে দুর্যোধন রাজধানীর বাইরে গঙ্গার তীরে এক অস্থায়ী আবাস গড়ে তুললেন এবং অস্থায়ী আবাসের গঠন-পরিকল্পনা এবং ভক্ষ্য ভোজ্য পেয়র ব্যবস্থা—সবটাই ছিল রাজকীয়। সেই কৈশোরগন্ধী যুবক বয়সেই এই কাজের জন্য দুর্যোধন রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। কারও কাছে তাঁর অনুমতি নেবার প্রয়োজন হয়নি। ধৃতরাষ্ট্রের নিঃশব্দ নিরুচ্চার প্রশ্রয় ছাড়া এই কাজ কি সম্ভব ছিল? তাই বলছিলাম, পাণ্ডবরা কৌরব-ভাইদের মতো একই সমতায় মানুষ হচ্ছিলেন না। ধৃতরাষ্ট্রের পক্ষপাত তখন থেকেই সুস্পষ্ট ছিল।

ধৃতরাষ্ট্রের এই মানসিকতা আরও পরিষ্কার করে বোঝা যাবে ভীমের বিষ পানের পর। পাণ্ডব-ভাইরা যখন ভীমের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন, তখন জননী কুন্তী বিদুরকে ডেকে এনে ভীমের হারিয়ে যাবার ঘটনা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি কিন্তু সঠিক সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন—ভীমের অস্তিত্ব দুর্যোধনকে কখনও খুশি করে না। কারণ দুর্যোধন খলস্বভাব, দুষ্টবুদ্ধি, রাজ্যলোভী এবং নির্লজ্জ—ক্রূরো’সৌ দুর্মতিঃ ক্ষুদ্রো রাজ্যলুব্ধো’নপত্রপঃ। কুন্তীর আশঙ্কা থেকে বোঝা যায়, ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যলিপ্সা ষোলো-সতেরো বছরের দুর্যোধনের মধ্যে এরই মধ্যে সংক্রমিত হয়ে গেছে।

এমনকী কুন্তী যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন—এটা উচ্চ স্বরে বলাটাও পাণ্ডবদের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। কারণ বিদুর কুন্তীকে বলেছিলেন—আপনার কথাগুলি বড় করে জোর গলায় বলবেন না, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদেরকে অন্তত বাঁচান। কারণ চেঁচিয়ে তিরস্কার করলে এই দুরাত্মা দুর্যোধন পরে আরও ক্ষতি করবে আপনার—মৈবং বদস্ব কল্যাণি শেষ-সংরক্ষণং কুরু। তার মানে, দুর্যোধন তখনই ধৃতরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অথবা ধৃতরাষ্ট্র তখনই দুর্যোধনের সমস্ত ব্যবহার সমর্থন করেন; তা না হলে কুন্তী তাঁর ভাশুরের কাছেও নিজপুত্রের জীবনরক্ষার আর্জিটুকুও জানাতে পারছেন না কেন?

লক্ষ করে দেখুন, ভীম যখন বিষমুক্ত হয়ে ফিরে এসেছেন এবং তিনি দুর্যোধনের সমস্ত অসদ ব্যবহার চিৎকার করে বলছেন, তখন যুধিষ্ঠির তাঁকে থামতে বলেছেন। বলেছেন, কারণ ধৃতরাষ্ট্র ও দুর্যোধনের কানে গেলে এ ঘটনা বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। আজকের দিনের গুন্ডা-রাজনীতিতে দেখেছি—সাধারণ একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সাধারণ মানুষ খুন হয়ে যাবার পরেও, সে বাড়ির অন্য লোকেরা চেঁচিয়ে পাড়ামাত করেন না। খুন হয়ে গেছে—এ যেন তাঁদেরই দোষ; লোক জানাজানি হয়ে নিজেদের ক্ষোভের কথা গুন্ডা-রাজনীতির নেতার কানে গেলে যদি আবারও হামলা হয়, সেই ভয়ে চুপ করে সিঁটিয়ে থাকতে হয় পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্যকে। এখানেও ঠিক তাই। নিজের জ্যাঠা ধৃতরাষ্ট্রের শাসনে যুধিষ্ঠিররা পাঁচ ভাই পরস্পরকে পরস্পর রক্ষা করার ভার নিয়েছেন, কিন্তু সন্দেহতীতভাবে দুর্যোধন এখানে খুনি বলে জানা থাকলেও রাজা হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রকে তা জানানো সম্ভব হয়নি। ধৃতরাষ্ট্র যদি সমদর্শী হতেন, তা হলে যুধিষ্ঠিরকে শাসন করে ভীমকে বলতে হত না—তুমি চুপ করো ভীম। এ কথা কেউ যেন জানতে না পারে। আজ থেকে কুন্তীর পুত্রেরা নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করবেন—অদ্য প্রভৃতি কৌন্তেয়া রক্ষতান্যোন্যমাদৃতাঃ। তার মানে, দেশের রাজা এবং পাণ্ডবদের রক্ষাকর্তা হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রের যে ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হবার কথা ছিল, তা নস্যাৎ হয়ে গেল।