কৃপাচার্য
অন্ধকার রাত্রিতে কিছুক্ষণ আগেই পাণ্ডবদের বিজয়োল্লাসও স্তব্ধ হয়ে গেছে। দীর্ঘ যুদ্ধশ্রমে পাঞ্চাল-যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্ন ঘুমে অচেতন হয়ে আছেন আপন শিবিরে। ঘুমিয়ে আছেন পাণ্ডবদের পাঁচ পুত্র—দ্রৌপদীর গর্ভজাত। এইরকম ঘুমন্ত অবস্থায় রাতের অন্ধকারে অশ্বত্থামা পাণ্ডবদের শিবিরে ঢুকে ধৃষ্টদ্যুম্নকে লাথি মেরে জাগিয়ে হত্যা করলেন। হত্যা করলেন নিরীহ অপ্রস্তুত প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শতানীক—ইত্যাদি দ্রৌপদেয় পাণ্ডবদের। ভীত ত্রস্ত পাণ্ডবশিবিরের অন্যান্য অবশিষ্টরা চিৎকার করতে করতে শিবিরের বাইরে বেরোতে চাইলেন প্রাণে বাঁচতে, শুধু প্রাণে বাঁচতে—শিবিরান্নিষ্পতন্তি স্ম ক্ষত্রিয়া ভয়পীড়িতাঃ। ঠিক এই অবস্থায় এক-একজন শিবিরের বাইরে বেরোচ্ছেন, আর তাঁদের প্রত্যেকের গলা কাটা যাচ্ছে শিবিরের দরজার দুই দিকে দাঁড়ানো কৃতবর্মা এবং কৃপাচার্যের হাতে—কৃতবর্মা কৃপশ্চৈব দ্বারদেশে নিজঘ্নতুঃ।
এইসব নিরীহ ক্ষত্রিয় যোদ্ধা—যারা কেউ কৌরবপক্ষের কারও চিহ্নিত শত্রু নয়, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে বলে যারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল, তারা শুধু বেঘোরে প্রাণ দিল এই কারণে যে, তারা পাণ্ডবপক্ষের সৈনিক। এবং তাদের মারা হল কোন অবস্থায়? তখনকার দিনে অস্ত্রপাতের নিয়ম মহাভারতে, মনুতে যেমনটি আছে, তাতে নিদ্রিত, সুপ্তজনকে মারাটা যেমন বীর যোদ্ধার নীতি-বিরোধী, তেমনই যে প্রাণ হাতে নিয়ে পালাচ্ছে, তার ওপরে অস্ত্র প্রয়োগ করাটাও ছিল যুদ্ধনীতির প্রবল বিরুদ্ধ কর্ম। অথচ অশ্বত্থামা ঘুমন্ত পাণ্ডবপুত্রদের এবং ধৃষ্টদ্যুম্নকে মেরে ফেললেন বিনা দ্বিধায়। তবু তাঁর এই প্রতিহিংসার কারণ আমরা সমান-হৃদয়তায় বুঝতে পারি। পাঞ্চাল যুবরাজ ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর পিতা দ্রোণাচার্যকে নিরস্ত্র এবং প্রায় ধ্যানস্থ অবস্থায় বধ করেছিলেন। কিন্তু কৃপাচার্যের কী আক্রোশ ছিল পাণ্ডবদের ওপর? দুর্যোধনের প্ররোচনায় অশ্বত্থামা যে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিরস্ত্র অবস্থায় মেরেছিলেন, তারও আক্রোশটুকু আমরা বুঝতে পারি। অপমান, প্রত্যপমান, হিংসা-প্রতিহিংসার একটা বৃত্ত সেখানে আবর্তিত হয়েছে। কিন্তু কোনও যুক্তি দিয়েই যে আমরা কৃপাচার্যের কর্মটুকু বুঝতে পারি না।
সন্ধ্যা থেকে রাত্রি হতে যতটুকু সময় লাগে, তারমধ্যেই কত বড় একটা পার্থক্য হয়ে গেল। এই সন্ধ্যার আগেই ভীমের গদাঘাতে ভগ্ন-ঊরু দুর্যোধনের পতন ঘটেছে। এখনও প্রাণ আছে তাঁর দেহে এবং প্রাণ আছে বলেই তাঁর প্রতিহিংসাবৃত্তি তখনও নিবৃত্ত হয়নি। সেই প্রতিহিংসা সংক্রামিত হয়েছিল গুরুপুত্র অশ্বত্থামার মধ্যে—যিনি পিতৃবধের প্রতিশোধ নেবার জন্য অদ্ভুত এবং অবীরোচিত এক পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।
এতে অবাক হবার কিছু নেই, কেননা শত্রুবধের জন্য অনেক অন্যায়ই ক্ষত্রিয়রা করে থাকেন এবং সেরকম অন্যায় পাণ্ডবরাও করেছেন, কৌরবরাও করেছেন। কিন্তু এই অন্যায়-সংঘটনার মধ্যে কাকে দেখছি আমরা? কৃপাচার্য, যিনি চিরকাল ন্যায়পক্ষে কথা বলেছেন, চিরকাল যিনি বঞ্চিত পাণ্ডবদের হিতচিন্তা করে গেছেন, সেই কৃপাচার্যকে আমরা অন্ধকার রাত্রিতে যে অদ্ভুত অন্যায়ের মধ্যে শামিল হতে দেখলাম, তাতে মনুষ্যচরিত্রের বিচিত্র একটি দিক আমাদের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
রাজবাড়ির ভেতরটায় এ-রকম থাকে। একান্নবর্তী বড় পরিবারেও এরকম হত। এক-একটা বাড়িতে দু-তিনটি বুড়ো মানুষ, গুরুঠাকুর পুরোহিত, ছোট স্কুলের মাস্টারমশাই, বড় কাকা, মেজ, ছোট, ন কাকা, দাসদাসী পুরনো চাকর, কোচোয়ান—সবকিছু মিলে এক বিরাট সংসার। লক্ষ করলে দেখে থাকবেন—এই সব বড় বড় সংসারে এক-এক জনের মূল্য এবং ওজন এক এক রকম। মানুষ তো সকলে একরকম হন না, একই সংসারে সমান ব্যক্তিত্বপূর্ণ, সমান ধুরন্ধর, সমান সম্মানিত পুরুষ তো বেশি হয় না। বিশেষ একটি রাজপরিবারে যদি দু-তিনটি অসাধারণ ব্যক্তিত্ব থাকেন, তবে দু-একটি ব্যক্তিত্ব চাপা পড়ে যায়।
এরমধ্যে আরও একটি গুরুতর ব্যাপার আছে, সেটা হল রাজবাড়ির অন্ন। রাজবাড়ির অন্নভোজী ব্যক্তিদের মনস্তত্ত্ব বহু বহু ঘটনা এবং দানাদানের মধ্য দিয়ে স্থিতিশীলতা লাভ করে। মহাভারতের কৌরববাড়িতে দ্রোণাচার্যও ধৃতরাষ্ট্রের অন্নভোজী পুরুষ। কিন্তু তিনি যেহেতু তাঁর অস্ত্রশিক্ষার ভাণ্ডার কুরুবাড়ির সকল রাজকুমারদের জন্য উজাড় করে দিয়েছিলেন, তাই প্রতিদানের মাপকাঠিতে তাঁর ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ ঘটেছে অনেক বেশি। অন্যদিকে কৃপাচার্য কিন্তু কুরুবাড়িতে দ্রোণাচার্যেরও অনেক আগে থেকে অবস্থিত, কিন্তু তিনি যেহেতু চিরকাল দ্রোণাচার্যের উপগ্রহবৃত্তি করে গেলেন, তাই ব্যক্তিত্বের মাত্রাটা সীমিত হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ব্যক্তিত্ব কম হলে সে ব্যক্তি সমকালীন ঘটনার দ্বারা এতটাই প্রভাবিত হন যে, পদে পদে তিনি দ্বিধাদ্বন্দ্বে আকীর্ণ হতে থাকেন। বিশেষত তিনি যদি উপগ্রহবৃত্তিতে এক প্রধান ব্যক্তিত্বের ছায়ানুসারে চলতে থাকেন, তবে গ্রহস্বরূপ প্রধান ব্যক্তিত্বের অবর্তমানে তিনি অন্য কোনও প্রধান ব্যক্তিত্বের ছায়াতেই চলতে থাকেন। তিনি নিজে আর স্বনির্ভর হয়ে চলতে পারেন না। কৃপাচার্যের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। দ্রোণাচার্য বেঁচে থাকতে তিনি প্রায় সদাসর্বদা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার ব্যক্তিত্ব এড়াতে পারলেন না। অশ্বত্থামার কথা মানতে গিয়ে তিনি এমন একটা কাজ করে বসলেন, যা তাঁর সুপরিচিত অমরত্বকেও সকলঙ্ক করে তুলল।
তবে এই যে কৃপাচার্যের ব্যক্তিত্বহীনতা, এটা এক দিনে তৈরি হয়নি। কৃপাচার্যের জন্ম থেকে আরম্ভ করে সমস্ত জীবন ধরে যত ঘটনা ঘটেছে এবং সেইসব ঘটনায় যাঁরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের ব্যক্তিত্ব এতই বেশি যে, তাঁদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসে কৃপের পক্ষে নিজস্ব স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভবই হয়নি। সেখানে কীভাবেই বা তিনি আর নিজেকে প্রকটিত করতে পারতেন! নইলে দেখুন জন্মের ব্যাপারে তাঁর অবস্থাটা বিখ্যাত দ্রোণাচার্যের থেকে কিছু অন্যরকম নয়। কিন্তু জন্মের পরে দ্রোণ যতটুকু পিতার সাহচর্য পেয়েছিলেন, কৃপ তা পাননি। জন্মলগ্নেই তিনি পরের ঘরে, পরান্নপ্রতিপালিত। সহজেই অন্ন জুটে যাবার ফলে জীবনে কোনও লড়াই ছিল না তাঁর, ছিল না কোনও জ্বালাও। কিন্তু দ্রোণাচার্যের জ্বালা ছিল, দারিদ্র্যের পীড়ন তাঁকে বিবাহ-পরবর্তী সময়েও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছে। জীবনযন্ত্রণা এবং জীবনের সঙ্গে লড়াই ব্যাপারটাই শেষ পর্যন্ত দ্রোণাচার্যের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটিয়েছে। কিন্তু কৃপাচার্যের জীবনে পরান্নের সুখ, মর্যাদা এবং শান্তি তাঁকে চিরকাল দ্রোণাচার্যের অন্তরালবর্তী করে রেখেছে। এই নির্মোক থেকে তিনি কোনও দিন বেরোতে পারেনওনি, বেরোতে চাননি এবং বোধ হয় বেরোনোর মতো কারণও তিনি তাঁর বুদ্ধিমতো খুঁজে পাননি।
কৃপাচার্যের জন্মের মধ্যে সামাজিকতার স্বভাবসিদ্ধি ছিল না। বংশমর্যাদার দিক থেকে বিচার করলে কৃপাচার্যের পিতৃপরিচয় কিছু কম ছিল না এবং পিতার শাস্ত্রীয় তথা শস্ত্রীয়—দুয়েরই উত্তরাধিকার তিনি পেয়েছিলেন। তবু কৃপাচার্য অন্যান্য কুরুবৃদ্ধদের চেয়ে হীন রয়ে গেলেন। এর কারণ তাঁর জন্মলগ্ন এবং তাঁর প্রতিপালনের জগৎ। নইলে ভাবুন, জগন্মান্য মহর্ষি গৌতম তাঁর পিতামহ, সে কি কম কথা হল! গৌতমের পুত্র হলেন শরদ্বান্। শোনা যায়—ধনুকের প্রধান সহায় ‘শর’ সঙ্গে নিয়েই তিনি জন্মেছিলেন অথবা বলা যায়—ছোটবেলা থেকেই ধনুকবাণই তাঁর সবচেয়ে বড় বন্ধু ছিল বলেই তাঁর নাম ছিল শরদ্বান্—জাতঃ শরবরৈর্বিভো। সেকালের ব্রাহ্মণদের স্বভাব অনুযায়ী বেদাদি শাস্ত্রে তাঁর আবেশ ছিল না, যেমনটি ছিল ক্ষত্রিয়ের ব্যবহার্য অস্ত্রশস্ত্রে। ব্রহ্মচারী অবস্থায় অন্যান্য ব্রাহ্মণবালকেরা যখন বেদবিদ্যা অধিগত করে ফেলল, সেই সময়ের মধ্যে শরদ্বান্ ধনুর্বিদ্যা শিখে ফেললেন চমৎকারভাবে—তথা স তপসোপেতঃ সর্বাণ্যস্ত্রান্যবাপ হ৷
ঋষি-ব্রাহ্মণের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও শরদ্বান্ যে ধনুর্বিদ্যায় মন দিলেন তার দুটো কারণ থাকতে পারে। এক, ব্রাহ্মণের কুলোচিত অধ্যয়ন, অধ্যাপনা, যজন-যাজনের থেকে ক্ষত্রিয়ের সাধ্য অস্ত্রবিদ্যা তাঁর কাছে বেশি ‘চ্যালেঞ্জিং’ এবং বেশি ভাল লেগেছিল। আর দ্বিতীয় কারণটা দ্রোণাচার্যের সঙ্গে মেলে, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতে জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, ঐহিকলাভ তেমন ছিল না, প্রতিযোগিতাও সেখানে অনেক বেশি; সেখানে সুশিক্ষিত অস্ত্রবিদ্যার শেষে অর্থলাভের কোনও ঝুকি ছিল না। অতএব শরদ্বান্ এমনভাবেই অস্ত্রশিক্ষার তপস্যায় নিজেকে নিযুক্ত করেছিলেন যে, স্বর্গের দেবরাজও তাঁর তপস্যায় শঙ্কিত হলেন—বুঝি বা ভবিষ্যতে তাঁর ইন্দ্ৰত্বও চলে যাবে, চলে যাবে স্বর্গের নিরঙ্কুশ রাজত্ব। চিন্তিত দেবরাজ জানপদী নামে এক অপ্সরাকে গৌতম শরদ্বানের কাছে পাঠালেন তাঁর তপস্যার বিঘ্ন করার জন্য—ততে জানপদীং নাম দেবকন্যাং সুরেশ্বরঃ।
‘দেবকন্যা’ বা ‘অপ্সরা’ শব্দটার মধ্যে যতই স্বর্গের মাহাত্ম্য লুকোনো থাকুক, অপ্সরা আসলে স্বৰ্গবেশ্যা। তবে এক্ষেত্রে ‘জানপদী’ নামটি দেখে আমাদের আরও সন্দেহ হয় যে, সে তেমন উত্তমা প্রকৃতির কোনও স্বর্গসুন্দরীও নয়। উর্বশী, মেনকা, রম্ভার মতো এর কোনও বিশ্রুত নামও নেই, সে জানপদী। অর্থাৎ যেখানে শরদ্বান্ তপস্যা করছিলেন অথবা ধনুর্বাণের অভ্যাসে নিরন্তর যেখানে তিনি নিযুক্ত ছিলেন, সেই জনপদেরই কোনও বিলোভিনী রমণী হবে এই জানপদী। দেবরাজ তাকেই খুঁজে বের করেছেন জনপদ থেকে এবং তাকে পাঠিয়েছেন শরদ্বানকে প্রলুব্ধ করার জন্য—প্রাহিণোৎ তপসো বিঘ্নং কুরু তস্যেতি কৌরব।
দেবরাজের পরামর্শে জানপদী সেই রমণী শরদ্বানের নির্জন আশ্রমে উপস্থিত হয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা আরম্ভ করল। তার পরিধানে সুসূক্ষ্ম বসন। যদিও সেইকালে রমণীর অধমাঙ্গ এবং উত্তমাঙ্গের আবরণ হিসেবে দুটি পৃথক বসনের ব্যবহার চালু ছিল। কিন্তু প্রলুব্ধ করাই যার উদ্দেশ্য, সেই জানপদী রমণী উত্তমাঙ্গ মুক্ত করে একটিমাত্র বসন পরিধান করেই ঋষি শরদ্বাকে আকর্ষণ করতে আরম্ভ করল—তাম্ একবসনাং দৃষ্ট্বা গৌতমো’স্পরসং বনে। দেবরাজ-প্রেরিত এই রমণী জানপদী হলে কী হবে, তার উদ্ভিন্ন অঙ্গসংস্থান এতই মনোহর যে, শরদ্বান্ যদিও তখন ধনুকবাণ হাতে নিয়েই তাঁর অভ্যস্ত বিদ্যা পুনরভ্যাস করছিলেন, তবু উত্তমাঙ্গের বসনমুক্ত একবসনা এই সুন্দরীর অঙ্গলাবণ্য দেখে একেবারে বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন—লোকে’প্রতিমসংস্থানাং প্রোৎফুল্লনয়নো’ভবৎ। এই প্রলুব্ধতা, এই দুনির্বার আকর্ষণে কখন যে শরদ্বানের হাত থেকে তাঁর প্রিয় ধনুকবাণটি নিঃসাড়ে খসে পড়ল, তা তিনি নিজেও জানতে পারলেন না—ধনুশ্চ হি শরাস্তস্য করাভ্যাম্ অপতন্ ভুবি। সাময়িক প্রফুল্লতায় তাঁর শরীরটিও কেঁপে উঠল এবং সেটাও তিনি বুঝতে পারলেন না বোধ হয়।
খুব তাড়াতাড়িই অবশ্য চেতনা লাভ করলেন শরদ্বান্। নিরন্তর অভ্যাস-তপস্যায় যিনি ধনুর্বেদের চরম লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছেন, তিনি ক্ষণিক বিচলিত হলেও পূর্বসঞ্চিত জ্ঞানগরিমায় এবং তপস্যার শক্তিতে নিজেকে সংযত করলেন। তাঁর হস্তস্খলিত ধনুঃশর যেমন পড়েছিল, তেমনই পড়ে রইল, পড়ে রইল অদূরেই তাঁর গায়ের চাদর, কৃষ্ণাজিন। সব ফেলে রেখে তিনি জানপদী রমণী এবং আশ্রম দুইই ত্যাগ করে চলে গেলেন অন্যত্র। কিন্তু ওই যে ক্ষণিকের তরেও তাঁর শরীরের যে বিকার দেখা দিয়েছিল, ক্ষণিকের তরে তাঁর শরীরটি যে কেঁপে উঠছিল, তাতেই তাঁর শরীরান্তঃস্থিত তেজোবিন্দু নির্গত হয়ে পতিত হয়েছিল একটি শরস্তম্বের ওপর। শরস্তম্বের ওপর পতিত সেই তেজোবিন্দু দ্বিধা হয়ে যায় এবং তার থেকেই জন্মায় এক মিথুন—একটি যমজ ভাইবোন। জানপদী অপ্সরার প্রলোভন থেকে মুক্ত হবার তাড়ায় তিনি এও বুঝতে পারলেন না যে, তিনি মুহূর্তের জন্য হলেও স্খলিত হয়েছেন—জগাম রেতস্তৎ তস্য শরস্তম্বে পপাত চ।
‘শর’ মানে এক ধরনের ঘাস, যাকে আমরা কুশ বলি, আর ‘শরস্তম্ব’ কুশের গুচ্ছ, যেখানে প্রচুর কুশের গাছ ছিল। বস্তুত ‘শরস্তম্ব’ কথাটা আমাদের কাছে এক ধরনের মহাকাব্যকল্প। দেবসেনাপতি কার্তিক শরবনে জন্মেছিলেন, ওদেশে মোজেস শরবনে পরিত্যক্ত হয়েছিলেন, শরদ্বানের তেজও শরস্তম্বে পতিত হল। মহাকাব্যের কবি কোনওভাবে বোঝাতে চান—জানপদী রমণীর সঙ্গে শরদ্বানের শারীরিক কোনও মিলন হয়নি যেন, শুধু কামলুব্ধ ব্রাহ্মণের মুগ্ধ তেজ অতিক্রান্ত হয়েছিল অজ্ঞাতসারে এবং যেন সেই মহাসত্ত্ব ব্যক্তির বীজটুকুই বড় কথা, সেই বীজের এমনই প্রভাব যা মাতৃগর্ভের আধার ছাড়াই সন্তানের জন্ম দেয়।
আমাদের বাস্তববোধে এই বক্তব্য তাই মহাকাব্যকল্প। আমরা মনে করি—আপন অন্তরের কোনও তাড়না ছাড়াই শুধুমাত্র সাময়িক এবং দৈহিক তাড়নায় শরদ্বান্ অবশ্যই এই জানপদী রমণীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর মন এবং বুদ্ধি নিরন্তর তাঁকে বাধা দিচ্ছিল, তবুও যতই তিনি অবিচল থাকুন, শারীরিক বিধান অনুসারেই তাঁর শরীর কেঁপে উঠেছিল, তাঁর অনিচ্ছারূপ অজ্ঞানের মধ্য দিয়েই তাঁর তেজোবিন্দু প্রবেশ করেছিল জানপদীর শরীরে এবং ঠিক এমন ঘটনার পরেই তো মুহূর্তেই চৈতন্য ফিরে আসে। অতএব মানসিক অনিচ্ছার প্রাবল্যেই শরদ্বান্ আপন তেজ অনুৎস্পৃষ্ট ভেবেই মুহূর্তের মধ্যে তিনি জানপদী রমণীকেও ত্যাগ করে গেছেন। ত্যাগ করেছেন আশ্রমও। মহাভারতের কবি মন্তব্য করেছেন—জানপদীর প্রলুব্ধতায় তাঁর শরীরে যে বিকার দেখা গিয়েছিল, তাতেই তাঁর তেজ নির্গত হয়েছিল, যদিও সম্পন্ন-চৈতন্য মুনি নিজস্ব তর্কেই শুধু ভেবেছেন যে, তাঁর বীজ নিঃসৃষ্ট হয়নি—তেন সুস্রাব রেতো’স্য স চ তন্নাববুধ্যত।
আমরা মনে করি—জানপদীর গর্ভেই শরদ্বানের নিঃসৃষ্ট বীজ থেকে তাঁর যমজ পুত্রকন্যা জন্মেছে, এবং জানপদী বেশ্যার যেহেতু এখানে কোনও মায়া ছিল না, তাই দেবকার্য সম্পন্ন হতেই সে তার গর্ভমুক্ত পুত্রকন্যাদুটিকে কুশতৃণের অন্তরালে ফেলে রেখে প্রস্থান করেছে। শরস্তম্ব ব্রাহ্মণ্য যাগযজ্ঞের প্রধান উপকরণ, শরস্তম্বের ওপর পুত্রকন্যাকে পরিত্যাগ করে জানপদী বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, ব্রাহ্মণের অভীপ্সিত সন্তানকে ব্রাহ্মণ্যের প্রতীক শরস্তম্বের কাছেই সে রেখে গেল। কুশের আঘাতে দ্বিধাভূত তেজোবিন্দু থেকে একটি যমজ সন্তানের জন্মরহস্য এখানেই। হয়তো জানপদী তার মৌহূর্তিক কামবলি শরদ্বানের ধনুকবাণ আর কৃষ্ণসার মৃগের আবরণ-চর্মটুকু সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তাঁর পরিত্যক্ত শিশু পুত্রকন্যার পাশে। হয়তো ওইটুকু মায়া তার অন্তরে ছিল।
এদিকে হস্তিনাপুরের রাজা প্রাতিপেয় শান্তনু বনের মধ্যে মৃগয়া করতে বেরিয়েছিলেন অল্পসংখ্যক পাত্রমিত্র সঙ্গে নিয়ে। এই পাত্রমিত্রের মধ্যে রাজরক্ষী সৈন্যও যেমন কিছু থাকত, তেমনই থাকত সেনাচর। মৃগয়ার সময় যেসব লোক নিশ্চুপে গিয়ে অরণ্যভূমিতে পশুর অবস্থান এবং তাদের গতিবিধি তথা সংখ্যা দেখে এসে রাজাকে খবর দিত, তারাই হল সেনাচর। এইরকমই একটি সেনাচর অরণ্যে পশু দেখতে গিয়ে দেখল দু-দুটি শিশু অরক্ষিত অবস্থায় কুশঘাসের মধ্যে পড়ে আছে। শরদ্বানের ফেলে যাওয়া ধনুকবাণ এবং ব্রাহ্মণের ব্যবহার্য কৃষ্ণাজিন দেখে সেনাচর ব্যক্তি অনুমান করল—শিশুদুটি নিশ্চয়ই কোনও ব্রাহ্মণের সন্তান এবং সে ব্রাহ্মণ অবশ্যই ধনুকবাণের রসিক—জ্ঞাত্বা দ্বিজস্য চাপত্যে ধনুর্বেদান্তগস্য চ।
বুদ্ধিমান সেনাচর পুরুষটি সেই পরিত্যক্ত ধনুঃশর এবং অজিন-আবরণখানি সংগ্রহ করে শিশুদুটিকে কোলে তুলে নিল। তারপর মহারাজ শান্তনুর কাছে এসে সবকিছুই দেখলি সেনাচর। অনুমান করি, মহারাজ শান্তনুর সঙ্গে তখনও গঙ্গার দেখা হয়নি, অথবা দেখা হয়ে থাকলেও গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম তখনও গঙ্গার তত্ত্বাবধানেই ছিলেন; অর্থাৎ গঙ্গা তখনও কুমার দেবব্রতকে পিতা শান্তনুর হাতে তুলে দেননি। ফলে শান্তনুর পিতৃহৃদয় তখনও অননুভূত বাৎসল্যে বিদীর্ণ ছিল। দ্বিতীয় অনুমানই যথোচিত মনে হয়। কেননা সমস্ত মহাভারতের মধ্যে বিভিন্ন ইঙ্গিত থেকে কখনও মনে হয় না—দ্রোণ, কৃপ—এঁরা কেউ পিতামহ ভীষ্মের চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। অতএব একবার পুত্রমুখ দেখেও যে মহারাজ পুত্রকে কাছে পাননি, সেই মহারাজ শান্তনু সেনাচরের কোলে দুটি শিশু দেখেই তাদের পরম করুণায় নিজের কোলে তুলে নিয়েছেন—স তদাদায় মিথুনং রাজা চ কৃপয়ান্বিতঃ। শুধু তাই নয়, সেই মুহূর্তেই মৃগয়ার সমস্ত কৌতূহল নিবারণ করে তিনি রাজধানীতে ফিরলেন এবং কেউ প্রশ্ন করলেই বলতে লাগলেন—এরা আমারই ছেলেমেয়ে—আজগাম গৃহানেব মম পুত্ৰাবিতি ব্রূবন্।
মহারাজ শান্তনু পরম আদরে নিজের বাৎসল্যরসেই শিশুদুটিকে মানুষ করতে লাগলেন। তখনকার দিনে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মালে জাতকর্ম থেকে যেসব সংস্কার প্রাপ্য হত, মহারাজ শান্তনু তাঁর পুত্রপ্রতিম বালকটিকে সেইসব সংস্কারকর্ম থেকে বঞ্চিত করেননি। শিশুদুটিকে তিনিই যেহেতু নিজের পিত্রুচিত মায়ায় (কৃপা) বড় করে তুলেছিলেন—কৃপয়া যন্ময়া বালাবিমৌ সম্বর্ধিতাবিতি—সেই জন্য তিনি তাদের নামও রাখলেন কৃপ এবং কৃপী—সার্থক নাম, শান্তনুর কৃপা বা মায়াই কৃপের নামকরণের মধ্যে অন্বর্থক হয়ে উঠল। কিছুদিনের মধ্যেই নামগোত্রহীন কৃপ ধনুর্বেদে এবং অন্যান্য অস্ত্রচালনায় অত্যন্ত কৌতুহলী হয়ে উঠলেন। পিতার বীজ কীভাবেই না কাজ করে! ব্রাহ্মণ হয়েও তাঁর পিতা শরদ্বান্ যেভাবে আপন আনন্দে ধনুর্বিদ্যা শিখেছিলেন, কিন্তু কৃপ—তিনি ব্রাহ্মণ, না ক্ষত্রিয়, বৈশ্য না শূদ্র—কেউ তা এখনও জানে না, তবু পিতার অন্তর্গত মানসিক গতি কীভাবে যেন তাঁকেও একই পথে প্রবৃত্ত করল।
কৃপের জাতি-গোত্র অবশ্য কিছুকালের মধ্যেই জানা গেল। মহাভারত বলেছে—গৌতম শরদ্বান্ ধ্যানযোগে জানতে পারলেন যে, তাঁর দুটি পুত্রকন্যা মহারাজ শান্তনুর রাজবাড়িতে মানুষ হচ্ছে—গোপিতৌ গৌতমস্তত্র তপসা সমবিন্দত। আমার ধারণা—এই ধ্যানটুকু চর্মাসনে বসে ঈশ্বর-প্রণিধানের মতো কিছু নয়। বৃহৎসত্ত্ব মানুষ যে কাজটুকু করে ফেলেন, তারমধ্যে যদি অন্যায়ের লেশ থাকে, স্খলন থাকে, ত্রুটি থাকে, তবে সেটা তাঁকে ভাবায়। অন্তরের অন্তঃস্থলে পূর্বকৃত দোষ বা দোষাভাস বার বার ফিরে আসে এবং মিলিয়ে যায়। মিলিয়ে যাবার জন্য দেরি হয়, কিন্তু বারম্বারোত্থিত দোষাভাস একবার তাঁকে প্রবৃত্ত করে ত্রুটিমুক্ত হবার জন্য। এই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটাকেই আমি ধ্যান বলি। এই ধ্যান কৃতপূর্ব কর্মের ভাবনা। শরদ্বান্ বুঝেছেন—জানপদী রমণীর সঙ্গে তাঁর ক্ষণিক মিলনের ফলশ্রুতি কিছু ঘটেছেই। হয়তো নিরন্তর ধনুর্বেদের সাধন-তপস্যার মধ্যে জানপদীর সঙ্গে তাঁর মিলন যে ব্যাঘাতটুকু ঘটিয়েছিল, তাতে তিনি সাময়িক অনুতাপ, নিস্পৃহতা, এবং আত্মধিক্কারে পলায়নে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের গতি এবং নিরন্তর অনুধ্যানে তিনি বুঝেছিলেন যে, পূর্বের সেই মিলন এখন যতই অনীপ্সিত লাগুক, কিন্তু মিলনের সেই ক্ষণটুকু মিথ্যে নয়। তার ফলশ্রুতি ঘটেছেই এবং কোনও না কোনওভাবে তাঁর কাছে খবর এসেছে যে, মহারাজ শান্তনু সেই পূর্বমিলনের স্থানেই দুটি শিশুকে পেয়েছেন এবং তাদের তিনি মানুষও করছেন।
গৌতম শরদ্বান্ শেষ পর্যন্ত হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে এসে শান্তনুর সঙ্গে দেখা করে সমস্ত ঘটনা জানালেন। জানালেন যে, কৃপা-করুণায় যাঁকে তিনি মানুষ করেছেন এবং কৃপ বলে যাঁর নামকরণ করেছেন, তিনি অজ্ঞাতকুলশীল নন। মহর্ষি গৌতমের গোত্রে তাঁর জন্ম এবং তিনি তাঁরই ছেলে গৌতম শারদ্বত। শরদ্বানের কৃতজ্ঞতাবোধ যথেষ্ট। একবারের তরেও তিনি শান্তনুর কাছে ছেলে ফেরত চাইলেন না। শান্তনু তাঁর আত্মজ পুত্রকন্যাকে মানুষ করেছেন, বাৎসল্য দিয়েছেন, অতএব সেই বাৎসল্যের বাঁধন থেকে মুক্ত করে তিনি মহারাজ শান্তনুকেও পীড়িত করলেন না, অন্যদিকে রাজগৃহে অভ্যস্ত পুত্রকে আরণ্যক আশ্রমে নিয়ে গিয়েও তাঁর সুখভঙ্গ করলেন না শরদ্বান্। কিন্তু বীজপ্রদ পিতা হিসেবে যে কাজটি তিনি করলেন, সেটিই শরদ্বানের উপযুক্ত ছিল। অস্ত্রচালনায় পুত্রের মতিগতি দেখে শরদ্বান্ ঠিক করলেন তাঁর ধনুর্বেদের স্বাধীত গূঢ় তত্ত্বগুলি কৃপকে শিখিয়ে যাবেন। মহারাজ শান্তনুর অনুমতি নিয়ে বেশ কিছু দিন সময় নিয়ে শরদ্বান্ তাঁর গৃঢ় অস্ত্রনৈপুণ্যগুলি কৃপকে শিখিয়ে দিয়ে গেলেন।
কিছু সময়ের মধ্যেই কৃপ অস্ত্রবিদ্যায় পরম নৈপুণ্য লাভ করলেন এবং নিঃসন্দেহে একজন অস্ত্রগুরু হবার উপযুক্ত হয়ে উঠলেন—সো’চিরেণৈব কালেন পরমাচার্যতাং গতঃ। এরপর হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে। মহারাজ শান্তনু মারা গেছেন এবং বিচিত্রবীর্য তাঁর সিংহাসনে বসেছেন। আমরা জানি বিচিত্রবীর্য রাজা হলেও তাঁর রাজ্যের শাসনসংক্রান্ত সমস্ত ব্যাপারেই ভাবনাচিন্তা করতে হত ভীষ্মকে। শাসনের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটালেও ভীষ্ম কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও পিতৃপালিত কৃপাচার্যের সম্বন্ধে কোনও প্রশ্ন তোলেননি। বয়সে কৃপ হয়তো ভীষ্মের চেয়ে একটু ছোটই ছিলেন, কিন্তু কৌরবগৃহের অন্ন-প্রতিপালিত এই মানুষটির প্রতি ভীষ্ম যেমন কখনও অনাদর প্রকাশ করেননি, তেমনই তাঁর বৈমাত্রেয় বিচিত্রবীর্যও কোনওদিন কৃপকে আচার্য ছাড়া আর কিছু ভাবেননি।
নামে আচার্য হলেও কৃপাচার্যের খুব একটা কাজ ছিল না প্রথমদিকে। এমনকী বিচিত্রবীর্যের অকালপ্রয়াণের পর ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডু এবং বিদুরদের অস্ত্রশিক্ষার ভারও কৃপাচার্যকে নিতে হয়নি। সে কাজটা ভীষ্ম স্বয়ংই করেছেন, পিতৃহীন ভ্রাতুষ্পুত্রগুলিকে অসীম মমতায় মানুষ করেছিলেন বলে অস্ত্রশিক্ষার ভারটুকুও ভীষ্ম কারও হাতে ছাড়েননি। তবে এই সময়টার মধ্যেই কৃপের জীবনে কতগুলি ঘটনা ঘটে গেছে। মনে থাকার কথা যে, কৃপের সঙ্গে তাঁর যমজা ভগ্নী কৃপীও এসেছিলেন হস্তিনাপুরে মহারাজ শান্তনুর সমাদরে। কিন্তু কৃপীর যে কী হল, কবে অথবা কেমন করে তিনি বড় হলেন, হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে তিনি কোথায় কাদের সঙ্গে অন্তঃপুরবাসিনী হয়েছিলেন, তার কোনও খবর মহাভারতের কবি দেননি। মহাভারতের প্রমাণে আমরা শুধু এইটুকু জানি যে, গুরুকুলের ব্রহ্মচর্য্যকাল অতীত হলে পাঞ্চাল দ্রুপদ ওদিকে সিংহাসন পেলেন আর আচার্য দ্রোণ কঠিন তপস্যা আরম্ভ করলেন পিতৃবিয়োগের পর। পিতা ভরদ্বাজ পূর্বেই দ্রোণকে বিবাহ করতে বলেছিলেন, কিন্তু তপস্যার কারণে এই বিবাহ বিলম্বিত হল। কিন্তু বিবাহ করা যখন তিনি মনস্থ করলেন তখন হস্তিনাপুরে অবস্থিত কৃপাচার্যের ভগিনী কৃপীর সঙ্গেই তাঁর বিবাহ হল—শারদ্বতীং ততো ভাৰ্য্যাং কৃপীং দ্রোণো’ন্ববিন্দত।
কীভাবে পাঞ্চালনিবাসী দ্রোণের সঙ্গে হস্তিনার অন্তঃপুরনিবাসিনী কৃপীর যোগাযোগ হল, মহাভারতের কবি সে খবর দেননি। তবে আমার ধারণা, গৌতম শরদ্বান্ তাঁর পূর্বজাত পুত্রকন্যার মায়ায় হস্তিনাপুরে এসে শান্তনুর বাড়িতে থেকে যখন প্রিয়পুত্রের অস্ত্রশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই সময় এই কন্যাটিকে পাত্রস্থ করার কথাও তিনি ভেবেছিলেন। হয়তো এ বাবদে বৈবাহিক কথাবার্তা হয়েছিল কৃপীর পিতা শরদ্বান্ এবং দ্রোণের পিতা ভরদ্বাজের মধ্যেই। কেননা মহাভারতে দেখেছি—দ্রোণপিতা ভরদ্বাজ স্বৰ্গত হবার পরেও এই কথা বলা হচ্ছে যে, অতঃপর পিতার দ্বারা নিযুক্ত হয়ে দ্রোণাচার্য শারদ্বতী কৃপীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করলেন—ততঃ পিতৃনিযুক্তাত্মা পুত্রলোভান্মহাযশাঃ। তার মানে, ভরদ্বাজের সঙ্গে কথা হয়েই ছিল, তাই পিতৃবিয়োগের পর দ্রোণের যখন ইচ্ছা হল তখন তিনি পিতার ইচ্ছার প্রতি মর্যাদা দিয়েই শারদ্বতী কৃপীকে বিয়ে করেছিলেন।
যে কথায় কথাটা এল। কৃপীর সঙ্গে দ্রোণের বিয়েটা যে ঠিক কোন সময় হল, তা ঠিক বোঝা যায় না বটে, তবে দ্রোণাচার্যের জীবনী থেকে আন্দাজ করি যে, পাঞ্চাল দ্রুপদের সঙ্গে সেই অপমানজনক সাক্ষাৎকারের অনেক আগেই দ্রোণের সঙ্গে কৃপীর বিবাহ হয়ে গিয়েছিল; কেননা ওই সাক্ষাৎকারের আগেই অশ্বত্থামা জন্মে গেছেন এবং তিনি তখন যথেষ্টই সাবালক। যাই হোক, আপন ভগিনীকে সুপাত্রস্থ করার কাজটুকু কৃপের পিতাই করে যাওয়ায় কৃপাচার্য কুরুবাড়িতে নিশ্চিন্ত আয়েসেই দিন কাটাচ্ছিলেন বলে মনে করি।
কিন্তু এই আয়েস এবং নিশ্চিন্ততার মধ্যে সেই শুভসংবাদটুকু আমরা পাইনি, যাতে বোঝা যায় যুবক কৃপের বিবাহ সম্পন্ন হয়েছিল। ভীষ্ম তার নিজস্ব কারণে বিবাহ করেননি, কিন্তু তার নিশ্চিন্ততা দেখে প্রলুব্ধ কৃপ আর নিজেও মায়ার বাঁধনে জড়াননি। হয়তো বা এখানেও বৃহত্তর ব্যক্তিত্বের আচরণের প্রতি তাঁর বশ্যতা আছে। এরমধ্যে অবশ্য অনেক ঘটনা ঘটে গেছে। মহারাজ শান্তনুর শেষ বংশধর বিচিত্রবীর্য মারা গেছেন এবং তাঁর ক্ষেত্রজ পুত্র পাণ্ডুও মারা গেছেন অল্প সময়ের ব্যবধানে। অন্তত মহাকাব্যিক সময়ের হিসেবে সেটা অল্প সময়ই বটে। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের সঙ্গে নিয়ে কুন্তী ততদিনে হস্তিনাপুরীতে ধৃতরাষ্ট্রের রাজবাড়িতে অবস্থিত হয়েছেন। কিন্তু এরই মধ্যে বালক অবস্থাতেই ধার্তরাষ্ট্র দুর্যোধন পাণ্ডবদের সঙ্গে শত্রুতা আরম্ভ করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, এই প্রতিহিংসা চরিতার্থতার চরম দৃষ্টান্ত ইতিমধ্যেই প্রকট হয়ে পড়েছে—দুর্যোধন ভীমকে বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছেন।
এই খবর খুব প্রকট এবং প্রত্যক্ষভাবে ধৃতরাষ্ট্রের কানে আসেনি বটে, তবে তিনি যে কিছুই জানতেন না, তাও বিশ্বাস করা কঠিন। দুর্যোধনের প্রতি যতই প্রশ্রয় থাক, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু লক্ষ করছিলেন যে, কৌরব-পাণ্ডবদের সমস্ত রাজকুমারেরাই বড় আলস্যে দিন কাটাচ্ছে এবং সেই অলসতায় কারও কারও মস্তিষ্ক আসুরিক তথা আভিচারিক বুদ্ধিতে ভরপুর হয়ে উঠছে। ধৃতরাষ্ট্র অনুধাবন করলেন যে, কুমারদের বিদ্যাশিক্ষা এবং অস্ত্রশিক্ষার প্রয়োজন, তিনি ভাবলেন—বাড়িতে কৃপাচার্যের মতো একজন অস্ত্রগুরু রয়েইছেন, অতএব তাঁকে ডেকে কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দিলেন ধৃতরাষ্ট্র—গুরুং শিক্ষার্থমন্বিষ্য গৌতমং তান ন্যবেদয়ৎ। কৌরব এবং পাণ্ডবদের নিয়ে গৌতম কৃপাচার্যের অস্ত্রপাঠশালা আরম্ভ হল বটে, কিন্তু এমন উপযুক্ত গুরুর খবর অন্য দেশেও রটে গেল। ফলে মথুরা-শূরসেন অঞ্চল থেকে বৃষ্ণি-যাদবেরা এবং অন্যান্য কিছু দেশ থেকেও অনেকে অস্ত্রশিক্ষা নিতে এলেন কৃপাচার্যের কাছে—বৃষ্ণয়শ্চ নৃপাশ্চান্যে নানাদেশ-সমাগতাঃ।
গুরু হিসেবে কৃপাচার্য হয়তো যথেষ্ট অস্ত্রজ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন, কিন্তু তার শিক্ষাদানের পদ্ধতি হয়তো এতটা উচ্চমানের ছিল না, যাতে শিষ্যেরা গ্রহণ, ধারণ, স্মরণ, বর্জন এবং অবশেষে আত্মসাৎ-করণের মাধ্যমে অধীত বিদ্যাকে যথাযথ প্রয়োগ-সুকর করে তুলতে পারে। প্রধানত পাণ্ডব-কৌরব কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার মান দিন দিন কতটা উন্নত হচ্ছে, সেদিকে প্রখর দৃষ্টি রেখে চলেছিলেন সেকালের পরমাস্ত্রবিদ আরও একজন। তিনি ভীষ্ম, কুরুবৃদ্ধ পিতামহ। তিনি নিজে এই অস্ত্রশিক্ষার ভার নেননি, কারণ—গভীর আত্মীয়তার সম্বন্ধ, বিশেষত পৌত্র-পিতামহের সম্বন্ধ বিদ্যাশিক্ষার ক্ষেত্রে সস্নেহ প্রশ্রয় তৈরি করতে পারে। কিন্তু পাণ্ডব-কৌরব কুমারদের কার কী সম্ভাব্য ক্ষমতা, সেটা তিনি আপন অভিজ্ঞতায় বুঝতে পারেন। ভীষ্ম বুঝতে পারছিলেন যে, কৃপাচার্য নিজে জ্ঞানী এবং অস্ত্ৰকুশল ব্যক্তি, কিন্তু তাঁর শিক্ষায় কুমারেরা যা শিখছেন, তা সাধারণ মানের। অন্তত যে শিক্ষা এক-একটি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ করে তুলবে, সেই শিক্ষায় ঠিকমতো ‘মোটিভেট’ করতে পারছেন না কৃপাচার্য। ভীষ্ম বুঝেছেন—ধনুর্বেদে অর্জুনের মেধা আছে অথবা গদাযুদ্ধে মেধা আছে ভীম-দুর্যোধনের।কিন্তু কোথায় যেন কৃপাচার্যের শিক্ষায় এই বিষয়-বিশেষজ্ঞতা ফুটে উঠছে না, অথচ তিনি চান এই বিশেষজ্ঞতা বিকশিত হোক উপযুক্ত আধারে—বিশেষার্থী ততো ভীষ্মঃ পৌত্রাণাং বিনয়েপ্সয়া।
ভীষ্ম কিন্তু মানীর মান বোঝেন। তিনি নিজে কৃপাচার্যের মান বজায় রেখে কিচ্ছুটি তাকে বলেননি। কিন্তু অন্যান্য অস্ত্রবিদ পণ্ডিত গুরু, যারা হস্তিনায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, ভীষ্ম তাঁদের সামনে কুমারদের দাঁড় করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করতেন—কার কোথায় খামতি—ইষ্বস্ত্রজ্ঞান্ পর্যপৃচ্ছদ্ আচার্যন্ বীর্যসম্মতান্। এই বাস্তব পরীক্ষায় ভীষ্ম কিন্তু বুঝে গিয়েছিলেন যে, কৃপাচার্যকে দিয়ে ঠিক হচ্ছে না। আসলে এমন শিক্ষক আগেও ছিলেন, এখনও ভূরি ভূরি আছেন। এমন শিক্ষক, যাঁরা এককালে নিজেরা ভালো মেধার পরিচয় দিয়ে ভালো ফল করেছেন, তারপর চাকরির নিশ্চিন্ত আরামে তাঁদের মেধা ‘গেঁজিয়ে’ গেছে। মেধা এমনই এক বস্তু যা থাকলেই শুধু হয় না, তাকে শান দিতে হয় ছুরির মতো। নিয়মিত শাস্ত্রাভ্যাস এবং উন্নত-উন্নততর পরিচর্যার মাধ্যমে মেধাকে শানাতে হয়। কিন্তু নিয়মিত অর্থপ্রাপ্তি এবং নিশ্চিন্ততায় যেমন বহুতর উপযুক্ত শিক্ষকও অনুপযুক্ত হয়ে যান, কৃপাচার্যেরও তাই হয়েছিল। কুরুবাড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয় এবং আরাম এই মহান আচার্যকে আজকের দিনের বহুতর তমোগুণী শিক্ষকের মতো জড় করে তুলেছিল।
ভীষ্ম বুঝতে পারছিলেন যে, কৃপাচার্যকে দিয়ে হবে না। কেন হবে না, তা স্পষ্টত কৃপাচার্যের নাম করে তিনি বলছেন না, কিন্তু ঠিক কৃপাচার্যের প্রসঙ্গের পরেই তিনি বলছেন—এমন গুরুর দ্বারা পাণ্ডব-কৌরবের শিক্ষা হতে পারে না, যিনি অল্পধী অর্থাৎ যাঁর মেধা কম। কৃপাচার্যের কি মেধা কম ছিল? তা নয়, কিন্তু অনভ্যাসে অচর্চায় শিক্ষকের মেধায় জড়তা আসে, সেখানে যেমন বহুপূর্বের মেধাস্ফুরণের অজুহাত দিয়ে চলে না, কৃপাচার্যেরও সেই অবস্থা। ভীষ্ম বলেছেন—যিনি মহাভাগ নন, তাঁর দ্বারা শিক্ষাদান চলে না, যিনি নানাবিধ অস্ত্রে কুশল, তার দ্বারাই শিক্ষাদান কর্ম সম্ভব। ‘মহাভাগ’ কথাটা রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণে খুব পাওয়া যায়। কথাটার সাধারণ অর্থ—যার খুব ভাগ্য আছে। কিন্তু আমরা যখন বলি—সরস্বতি মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে—তখন এই অর্থ হবে কি যে, সরস্বতী ঠাকুরের খুব ভাগ্য আছে? আসলে মহাভাগ শব্দের অর্থ হল—যাঁর মধ্যে খুব বড় বড় কিছু গুণ আছে, সেটা পরম ঔদার্যও হতে পারে, পরম ঐশ্বর্য-ধনশালিত্বও হতে পারে, এমনকী দয়া, ক্ষমা, অহিংসা, ঋজুতা ইত্যাদি অষ্ট মহাগুণ যাঁর আছে, তাঁকেও মহাভাগ বলা যেতে পারে।
একজন শিক্ষককে ‘মহাভাগ’ বলতে পারি কখন? যিনি নিজে অসাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া সত্ত্বেও সদা সর্বদা ভাবেন—আমার ছাত্রকেও এই অধীত গুরুপরম্পরালব্ধ বিদ্যা শিখিয়ে যেতে হবে। আমার জীবনেই আমি এমন ‘মহাভাগ’ শিক্ষক দেখেছি। দেখেছি সংস্কৃত কলেজের ভবানীচরণ মুখোপাধ্যায়কে, দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রবাল সেনকে। বিদ্যাদানের ব্যাপারে সকাল পাঁচটা থেকে রাত একটা পর্যন্ত সব সময় এঁদের সময় ছিল। এই উদারতা, অকার্পণ্য, অবিচ্ছিন্ন বিদ্যাব্যসনিতা যার মধ্যে আছে তিনিই তো ‘মহাভাগ’। ভীষ্ম লক্ষ করেছেন যে, কৃপাচার্য শেখান বটে, কিন্তু সেই শেখানোর মধ্যে পুষ্টি, তুষ্টি এবং উছলে পড়ার ভাবটুকু নেই। ভীষ্ম এই ‘মহাভাগ’ শব্দের অর্থটাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন আরও একটি অসাধারণ শব্দ ব্যবহার করে। বলেছেন—যাঁর মধ্যে দেবতার মতো সামর্থ্য নেই, তিনি কখনও কুরুকুমারদের বিদ্যা-শিক্ষা দিতে পারেন না—নাদেবসত্ত্বো বিনয়েৎ কুরূনস্ত্রে মহাবলান্।
আসলে ভাল ছাত্র, মন্দ ছাত্রেরও একটা ব্যাপার আছে। যে কলেজে বেশির ভাগ ছাত্ৰই মেধাবী, সেই কলেজের মাস্টাররা যদি জড় হন, যদি শিক্ষাদানের পরম্পরা তাঁদের আত্মগত না হয়, অথবা যদি তাঁরা নিজেরাই অল্পধী অসমর্থ হন, তবে তাঁরা মেধাবীকে উত্তরাধিকার দেবেন কী প্রকারে। বস্তুত ‘দেব’ শব্দের অর্থ যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন; ‘সত্ত্ব’ মানে প্রাণ, প্রাণশক্তি। যে শিক্ষকের অঘটন-ঘটন-পটীয়সী প্রাণশক্তি আছে তিনিই মেধাবী ছাত্রকে পড়াতে পারেন। মেধাবী ছাত্রদের পড়ানোর জন্য অথবা তাঁদের অস্ত্রশিক্ষা দানের জন্য যে তিনটি অসাধারণ গুণের কথা বলেছেন ভীষ্ম, সেই গুণগুলি তিনি কৃপাচার্যের মধ্যে দেখতে পাননি। কৃপ বহুকাল কুরুবাড়িতে আছেন, তাঁর আচার্যের সম্মানও অটুট রইল, কিন্তু দ্রোণাচার্যের কথা শোনার পর তাঁর মধ্যে এই তিনটি গুণের সমবায় লক্ষ করেই ভীষ্ম কৃপাচার্যের গুরুত্ব লঘু করে দিয়ে বলেছেন—অল্পধী, অনুদার অথবা অল্পপ্রাণ অসমর্থ গুরু কখনও কুরু-পাণ্ডবদের মতো মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষক হতে পারেন না—নাল্পধীর্নামহাভাগস্তথা নানাস্ত্রকোবিদঃ। নাদেবসত্ত্বো বিনয়েৎ কুরূনস্ত্রে মহাবলান্ ॥ এই কথা ভেবে কুমারদের অস্ত্রবিশেষজ্ঞতার আশায় ভীষ্ম ভারদ্বাজ দ্রোণাচার্যের হাতে কুরু-পাণ্ডবদের সঁপে দিলেন—পাণ্ডবান্ কৌরবাংশ্চৈব দদৌ শিষ্যান্নরর্ষভঃ।
বড় বলে কৃপাচার্যের নিজেরও কোনও গুমোর ছিল না; ছিল না এমন কোনও আত্মসচেতনতা যাতে করে খুব অপমানবোধে ক্লিষ্ট হবেন তিনি। দ্রোণ যখন অন্ধকূপ থেকে পাণ্ডবদের খেলার বীটা তুলে দিয়েছিলেন, তখন সবার বড় হিসেবে চমৎকৃত যুধিষ্ঠির তাঁকে পরম অভ্যর্থনায় বলেছিলেন—আমাদের গুরু কৃপাচার্যের অনুমতি হলে আপনি প্রত্যেক দিনই আমাদের কুরুবাড়িতে ভক্ষ্য-ভোজন পাবেন—কৃপস্যানুমতে ব্রহ্মন্ ভিক্ষাম্ আপ্নুহি শাশ্বতীম্। বালক যুধিষ্ঠির জানতেন না যে, হস্তিনাপুরে আসা ইস্তক কৃপের বাড়িতেই আছেন দ্রোণ এবং কৃপ মনেপ্রাণে চান যে, রাজবাড়িতে দ্রোণের একটা চিরন্তনী ব্যবস্থা পাকা হোক। আসলে কৃপাচার্যের মনে কোনও জ্বালা নেই, তিনি দ্রোণাচার্যকে একটুও হিংসে করেন না। শিশু অবস্থা থেকে রাজবাড়িতে থেকে থেকে, ভক্ষ্য-ভোজন, সম্মান-ঐশ্বর্য সব পেয়ে পেয়ে তিনি এমনই অভ্যস্ত যে, কোনও কিছুতেই তিনি অসন্তুষ্ট বোধ করেন না। রাজবাড়ির দ্বিতীয় অস্ত্রগুরু হিসেবে দ্রোণাচার্যের যে অধিকতর মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে—এর জন্য তাঁর মনে বিন্দুমাত্রও ক্ষোভ-প্রতিহিংসা নেই। হয়তো এই প্রতিহিংসা, প্রতিযোগিতা এবং উচ্চাভিলাষ কিছু ছিল না বলে তিনি তাঁর অধ্যাপনা বৃত্তিতেও খানিকটা জড় হয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু এই সন্তুষ্টিই তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
অন্যদিকে দ্রোণাচার্যকে দেখুন। ক্ষুধা, তৃষ্ণা, উচ্চাভিলাষ এবং অভিমান তাঁকে পঞ্চাল রাজ্য থেকে হস্তিনাপুরে তাড়িয়ে এনেছে। উপরন্তু ভীষ্ম যখন কৃপাচার্যকে অতিক্রম করে একবারও তার অনুমতি না নিয়ে নির্দ্বিধায় কৃপাচার্যের শিষ্যদের দ্রোণের হাতে তুলে দিলেন, সেদিন কিন্তু শঙ্কিত দ্রোণাচার্য তাঁর মুগ্ধ-সন্তুষ্ট শ্যালকটির জন্য শঙ্কিত হয়ে ভীষ্মকে প্রশ্ন করেছিলেন—আপনার গৃহে অস্ত্রাভিজ্ঞ কৃপাচার্য তো রয়েইছেন। তাকে সকলেই আচার্য হিসেবে মানে—কৃপস্তিষ্ঠতি চাচাৰ্য্যঃ শস্ত্রজ্ঞঃ প্রাজ্ঞসম্মতঃ। এই অবস্থায় আমি যদি রাজবাড়ির বৃত্তি গ্রহণ করে কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার ভার নিই, তা হলে তাঁর মনে বড় লাগবে। তাই নয় কি—ময়ি তিষ্ঠতি চেদ্ বিপ্রো বৈমনস্যং গমিষ্যতি। দ্রোণাচার্য কৃপের কথা ভেবে ভীষ্মকে আরও বললেন—তারচেয়ে বরং এই ভাল, আমি আপনার কাছ থেকে কিছু ধন যাচনা করে নিই, তারপর আমি যেমন এখানে এসেছিলাম, তেমনই চলে যাব।
মুশকিল হল—দ্রোণাচার্য নিজের হৃদয়-অনুমানে কৃপকে যেমন বিচার করছেন, কৃপ তেমন নন। সবচেয়ে বড় কথা—দ্রোণাচার্য তাঁর শ্যালক কৃপকে যতখানি চেনেন, তারচেয়ে ভীষ্ম তাঁকে চেনেন অনেক বেশি। দ্রোণ তাঁকে যতখানি কাছ থেকে যতদিন দেখেছেন, তার চেয়ে ভীষ্ম তাঁকে অনেক বেশি কাছ থেকে অনেক বেশি দেখেছেন। দ্রোণাচার্যের আশঙ্কা একেবারে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে ভীষ্ম বললেন—আরে! কৃপাচার্যের কথা ভেবে আপনি একটুও চিন্তিত হবেন না। তিনি কুরুবাড়ির আচার্যস্থানে আছেন, তিনি আচার্যই থাকবেন, তার সম্মান রক্ষা করা, তার ভরণপোষণ—সে সব আমার দায়িত্ব—কৃপস্তিষ্ঠতু পূজ্যশ্চ ভর্তব্যশ্চ ময়া সদা। আমি আপনাকে আমার নাতিদের অস্ত্রগুরু হিসেবে ঠিক করেছি, আপনিই তঁদের গুরু হবেন। কৃপকে নিয়ে আপনার কোনও ভাবনা নেই।
কুরুবাড়ির এলাকাতেই দ্রোণাচার্যের বাসস্থান নির্ধারিত হল, তাঁর ভোজন-শয়নের ব্যবস্থা হল এবং কৃপকে অতিক্রম করেই কুরু-পাণ্ডবদের অস্ত্রশিক্ষার ভার দেওয়া হল দ্রোণাচার্যের ওপর। কুমারদের ওপর নতুন গুরু দ্রোণের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণও অনেক বাড়ল। কিন্তু এসবে কৃপাচার্যের কোনও ব্যত্যয় হল না। তিনি যেমন ছিলেন, তেমনই রইলেন। মাঝখান থেকে যেটা হল—দ্রোণাচার্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে কৃপাচার্য একসময় দ্রোণের ব্যক্তিত্বের অনুগামী হয়ে পড়লেন। এটা আশ্চর্য কিছু নয়, কেননা, যে ব্যক্তি পঞ্চাল দেশ থেকে হস্তিনায় এসে, কৃপের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে, কদিনের মধ্যে নিজের ব্যক্তিত্বে আপন আশ্রয়দাতার চাকরি খেয়ে নিয়ে তাঁরই পদে বসে যেতে পারেন বিনা প্রতিরোধে, হয় তিনি অধিগুণসম্পন্ন অধিকতর ব্যক্তিত্বের অধিকারী, নয়তো অন্যজন ঈর্ষাহীন, মানাপমানে সমদর্শী ভালো মানুষ। আমরা দুই আচার্যকে এই দৃষ্টিতেই দেখতে পেয়েছি, ফলে ভালোমানুষ কৃপাচার্য আস্তে আস্তে একদিন দ্রোণাচার্যের উপগ্রহে পরিণত হয়েছেন।
সমগ্র কুরুবাড়ি যে কৃপাচার্যকে আচার্য বলে মানত, সেটা প্রধানত কুরুবাড়ির গুণ এবং সেটা গুরু বলে কুরুবাড়িতে কৃপাচার্যের চিরকালীন অভ্যস্ততা। লক্ষ করে দেখুন, দ্রোণাচার্য যখন কুমারদের অস্ত্রশিক্ষার প্রদর্শনী আরম্ভ করলেন, তখন প্রারম্ভেই মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আচার্যের উপযুক্ত যে উপচার সংগ্রহ করেছিলেন, সেই সুবর্ণ-মণি-রত্ন এবং বস্ত্রের একতর সম্ভার তিনি যেমন দ্রোণাচার্যের হাতে তুলে দিলেন, তেমনই অন্যতর সম্ভারটি তিনি তুলে দিলেন কৃপাচার্যের হাতে—প্রদদৌ দক্ষিণাং রাজা দ্রোণায় চ কৃপায় চ। কৃপাচার্য নিরভিমান, তিনি দ্রোণ-আয়োজিত অস্ত্রশিক্ষার আসরে দ্রোণকে সাহায্য করতে এসেছেন। অস্ত্ররঙ্গ প্রদর্শনের সময় হঠাৎই যখন কর্ণ এসে প্রতিযোগীর মতো মঞ্চ জুড়ে দাঁড়ালেন, তখন দ্বিধাভূত রঙ্গস্থলে ধৃতরাষ্ট্রপুত্রেরা কর্ণের সাহায্যে এগিয়ে এলেন, কিন্তু কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম এবং দ্রোণের পন্থা অবলম্বন করে কৃপ কিন্তু এসে দাড়ালেন অর্জুনের পাশে—ভারদ্বাজঃ কৃপো ভীষ্মো যতঃ পার্থস্ততো’ভবন্।
তবে বৃদ্ধ এবং সম্মানিতের অনুগামিতা সত্ত্বেও কৃপাচার্যের কোনও স্বাতন্ত্র ছিল না, তা ঠিক নয়। তবে এই স্বাতন্ত্র্য তাঁর ব্যক্তিত্বের নয়, বহুকাল কুরুবাড়িতে থাকার ফলে এবং ব্রাহ্মণ আচার্য হিসেবে প্রথম থেকেই সম্মানিত হওয়ার ফলে মাঝে মাঝে তিনি নিজের সিদ্ধান্ত-মতো কথা বলতেও পারতেন। তবু লক্ষণীয় যে, সেই সিদ্ধান্ত কখনও ভীষ্ম-দ্রোণাচার্যের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের মানসলোক অতিক্রম করেনি। রঙ্গ-প্রদর্শনীর সময় যখন অর্জুন-কর্ণের দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রায় আসন্ন হয়ে উঠল, সেই সময় কর্ণকে চরমভাবে নিবৃত্ত করার জন্য ভীষ্ম-দ্রোণ চুপ করে থাকলেও কৃপাচার্য নিজের বুদ্ধিতেই কথা বলেছিলেন—অর্জুনের পিতৃ-মাতৃ-পরিচয় শুনলে তো? এবার তোমার মাতা-পিতা এবং তাঁদের রাজকৌলীন্যের পরিচয় তুমি বলো। সেটা জানার পর অর্জুন তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতেও পারেন, আবার নাও পারেন। কিন্তু এটা ঠিক যে, হীনবংশজ ব্যক্তির সঙ্গে রাজার ছেলেরা কখনও দ্বন্দ্বযুদ্ধ করে না—বৃথাকুলসমাচারৈর্ন যুধ্যন্তে নৃপাত্মজাঃ।
কথাটা শুনে কর্ণের মাথা নিচু হল, আবার দুর্যোধনের দিক থেকে তর্কযুক্তিও আরম্ভ হল। কিন্তু আমাদের ধারণা—কৃপাচার্য কর্ণের এই দুর্বলতার কথা জানতেন, কেননা দ্রোণাচার্যের পাঠশালায় কর্ণও ছাত্র ছিলেন প্রথম দিকে এবং তাঁর সূতপুত্রতার প্রবাদ তখন থেকেই লোক-প্রচারিত। কিন্তু চরম একটি মুহূর্তে যখন দুই মহাবীরের দ্বন্দ্বযুদ্ধ প্রায় লাগে লাগে, এবং বিশেষত কর্ণের আস্ফালন যখন অস্ত্ররঙ্গের মূল আকর্ষণ দ্রোণাচার্যের প্রশিক্ষণটুকুই নস্যাৎ করতে উদ্যত, তখনই কৃপাচার্যের এই স্বানুভাব-প্রযুক্ত ভূমিকা ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্য উভয়কেই অসীম লজ্জা থেকে মুক্তি দিয়েছে। কৃপাচার্য কর্ণকে যা বলেছিলেন, তা ঠিক বলেছিলেন, না ভুল বলেছিলেন, সে তর্ক এখানে অবান্তর। কিন্তু এই যে গুরুস্থানীয় মর্যাদা—যাঁর একটি কথা তর্কযুক্তি দিয়ে প্রতিহত করতে চাইলেও—যেমন দুর্যোধন তা করেইছিলেন কর্ণের সম্মান বাঁচাতে—কিন্তু এই মর্যাদা লঙ্ঘন করা যায় না। কৃপাচার্যের এই অলঙ্ঘনীয়তা তৈরি হয়েছিল দুটি কারণে। এক, তিনি ব্রাহ্মণ, ঋষি শরদ্বানের পুত্র; দুই তিনি কুরুবাড়িতে আছেন প্রায় ভীষ্মের সমকাল থেকে। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রও তাঁকে আচার্যের সম্মানে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছেন শিশুকাল থেকে এবং এই অভ্যস্ততা সংক্রান্ত হয়েছে কুরু-পাণ্ডবকুলের কুমারদের মধ্যেও। দ্বিতীয়, আচার্যবরণের প্রশ্নে যুধিষ্ঠির তাই দ্রোণাচার্যকে পরিষ্কার বলেছিলেন—আচার্য কৃপের অনুমতি হলে—আপনি প্রতিদিনই কুরুবাড়িতে ভোজন-আহার লাভ করবেন—কৃপস্যানুমতে ব্রহ্মন্ ভিক্ষামাপ্নুহি শাশ্বতীম্।
অন্তত যুধিষ্ঠির কৃপাচার্যের এই সুচিরাভ্যস্ত সম্মান কোনও দিনও লঙঘন করেননি। তিনি যে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞের বিশাল আয়োজন করেছিলেন, সেখানে যে পাঁচটি প্রধান মানুষকে চরম মর্যাদায় নকুলের মাধ্যমে নিমন্ত্রণ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে তিনজন বৃদ্ধপ্রায়, অন্য দুজন প্রৌঢ়। এই পাঁচজনের প্রথম হলেন ভীষ্ম, তার পরেই এসেছে দ্রোণের নাম। কৃপাচার্যের নাম এসেছে ধৃতরাষ্ট্র এবং বিদুরের পরে—
নকুলং হস্তিনপুরং ভীষ্মায় পুরুর্ষভঃ।
দ্রোণায় ধৃতরাষ্ট্রায় বিদুরায় কৃপায় চ॥
প্রাথমিক দৃষ্টিতে মনে হয়—কৃপের নামটা দ্রোণের ঠিক পরে দিলে সংস্কৃতের ছন্দোনিয়মে অনুষ্টুভ ছন্দটি ধরে রাখা কঠিন হত। কিন্তু মহাভারতের কবি, যিনি শত-সহস্র অনুষ্টুভ ছন্দ গেঁথেছেন, তাঁর কাছে এটা কোনও সমস্যাই নয়। আসলে শ্লোক-সংস্থানের মধ্যেই কৃপের প্রকৃত অবস্থানটি লুকিয়ে আছে। লক্ষ করে দেখবেন—কুরুসভায় যত সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেখানে স্বতন্ত্র এবং প্রধান মতামতগুলি আবর্তিত হয়েছে ভীষ্ম, দ্রোণ, ধৃতরাষ্ট্র এবং বিদুরের মধ্যেই। আচার্যস্থানীয় হওয়া সত্ত্বেও কৃপ কখনও ভীষ্মের অনুবর্তী হয়েছেন, কখনও বা দ্রোণের। কৃপাচার্য কখনও নিজেকে খুব ‘একজার্ট’ করেন না, অথচ তিনি অন্য প্রবীণদের মতোই সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত। কুরুবাড়ির অন্যতম সদস্যের মতোই তাঁর ওপরে সকলের অগাধ বিশ্বাস। রাজসূয়ের বিশাল আয়োজনে যুধিষ্ঠির তাঁকে যে গুরু দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তারমধ্যে বিশ্বাসের সঙ্গে মর্যাদার এক অপূর্ব মিশ্রণ ঘটেছে। যজ্ঞের আয়োজন প্রযুক্ত যত সোনাদানা, মণিমুক্তো এবং অন্যান্য রত্ন ছিল, সেসবের সুরক্ষার ভার যুধিষ্ঠির ন্যস্ত করেছিলেন কৃপের ওপর। পুনশ্চ কৃপ যেহেতু ক্ষত্রিয়ের প্রশাসনিক কাজে বহুকাল যুক্ত আছেন অথচ ব্রাহ্মণ বলে যজ্ঞাদিকর্মও বোঝেন ভাল, তাই যুধিষ্ঠির তাঁকে অন্য একটি ধৈর্যবহুল কাজেও নিযুক্ত করেছেন। রাজসূয়ের মতো বিশাল যজ্ঞকর্মে যত ব্রাহ্মণ-পুরোহিত নিযুক্ত করতে হয়, তাঁদের প্রত্যেকের দক্ষিণাদানের ক্লিষ্টকর্মভারটুকুও ছিল কৃপাচার্যের ওপরেই—দক্ষিণানাং প্রদানে চ কৃপং রাজা ন্যযোজয়ৎ। আপনজনের মতো নির্ভর না করতে পারলে যেমন কারও ওপর এই ভার ন্যস্ত করা যায় না, তেমনই বিশ্বাস এবং মর্যাদাও এখানে নিতান্ত অপেক্ষিত।
যেকথা বলছিলাম—কুরুসভার অন্যতম প্রবীণ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও কৃপাচার্য কখনও নিজেকে খুব বেশি প্রয়োগ করেন না। পাণ্ডবরা যখন জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে দ্রুপদের রাজসভায় দ্রৌপদীকে লাভ করলেন, সেই সময় ধৃতরাষ্ট্রের ওপর প্রবীণ মন্ত্রীদের প্রবল চাপ এল যাতে পঞ্চাল থেকে পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনা হয়। এই সময় ভীষ্ম এবং দ্রোণাচার্যকে আমরা নামভূমিকায় দেখছি এবং তাঁরা দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে স্বাধীন মত ব্যক্ত করছেন। এখানে বিদুরও কথা বলছেন ভীষ্ম-দ্রোণের পরেই। কিন্তু কৃপাচার্যকে আমরা তাঁর স্বভাবসিদ্ধ তৃতীয় বক্তার ভূমিকায় দেখছি না। ভীষ্ম-দ্রোণের পরেই বিদুরের বক্তব্য শুনতে পাচ্ছি আমরা, কিন্তু কৃপাচার্যের কোনও কথা নেই। থাকলেও হয়তো তা ভীষ্ম-দ্রোণের অনুগামিতায় অনুক্তই থেকে গেছে। ঘটনা হল—কৃপাচার্য ন্যায়-নীতি এবং ধর্মের পক্ষেই থাকেন। কিন্তু কঠিন ধর্মসংশয়েও তাঁর তেমন বাক্যস্ফুর্তি হয় না, যেমনটি ভীষ্মের হয়, দ্রোণের হয়, অথবা বিদুরের হয়।
কুরুসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের মতো অসভ্যতা ঘটল। তাতে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ—কেউই কোনও কথা বলতে পারেননি। তাঁদের প্রত্যেকের রক্তচাপ বৃদ্ধি হয়েছিল এবং তাঁরা শুধুই বসে বসেই ঘেমেছিলেন—ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপাদীনাং স্বেদশ্চ সমজায়ত। তবু যখন কৌরবসভায় কুরুমুখ্যদের উত্তর চেয়ে দ্রৌপদী প্রশ্ন করলেন, তখন তিনি বুঝি জানতেনই যে, ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুর যদি বা কিছু বলেন, কিন্তু কৃপাচার্য কিছু বলবেনই না। সেই জন্য কুরুমুখ্যদের ধর্মবোধ নিয়ে গালাগালি দেবার সময়ও দ্রৌপদী ভীষ্ম-দ্রোণ-বিদুরের নাম করেছেন, কিন্তু কৃপাচার্যের নামও করেননি। কৃপ বুঝি এতটাই উদাসীন, কোনও কিছুতেই তাঁর তেমন বিকার হয় না। দ্রৌপদীর প্রশ্নে অবশ্য নমো নমো করে যতটুকু উত্তর দিয়েছিলেন, তা ভীষ্মই দিয়েছিলেন। দ্রোণও কোনও কথা বলেননি, ফলত বোধ হয় কৃপাচার্যও নিশ্চুপ ছিলেন। কিন্তু এঁদের এই তুষ্ণীংভাব নিয়ে কথা উঠেছে। দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ দ্রৌপদীর লাঞ্ছনায় উদ্বেলিত হয়ে দ্রৌপদীর যুক্তিসঙ্গত প্রশ্নের উত্তর দেবার সময় দ্রোণ এবং কৃপ—দুজনের দিকেই আঙুল তুলেছেন। বলেছেন—আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি—এখানে সকলের সম্মানিত দুই আচার্য আছেন—ভারদ্বাজো হি সর্বেষমাচার্যঃ কৃপ এব চ—তাঁরা কেন দ্রৌপদীর প্রশ্নের জবাব দিচ্ছেন না?
বিকর্ণের কথা থেকে বোঝা যায় যে, এইধরনের সংকটে কৃপ এবং দ্রোণের কথা বলাটাই স্বাভাবিক ছিল এবং তাঁদের সেই মান্যতাও ছিল যাতে বিকর্ণ মনে করেছেন—কৃপ-দ্রোণের কথা দুর্যোধনের অসভ্যতার বিরুদ্ধে একটা প্রতিরোধ তৈরি করত। তবে ঠিক এই মুহূর্তে আমাদের ধারণা—দ্রৌপদীর চরম লাঞ্ছনার সময়েও যে দ্রোণ-কৃপের মতো আচার্যরা কথা বললেন না, তার কারণ এঁরা মহামতি বিদুরের করুণ অবস্থা দেখেছেন। দুর্যোধন-কৰ্ণরা সেদিন খুব ‘হাই’ দিলেন; বিশেষত দুর্যোধন যে ভাষায় বিদুরকে অপমান করেছেন, কর্ণ যেভাবে ভীষ্ম-দ্রোণকে পরান্নভোজী প্রবঞ্চকের আসনে বসিয়েছেন, সেখানে সাধারণত বিকারহীন কৃপ কী কথা বলবেন? সে প্রশ্নই ওঠে না। শেষমেশ তিনজনেই—ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এবং অন্যান্য গুরুস্থানীয় ব্যক্তিরাও কুরুসভা ছেড়ে চলে গেছেন নিজেদের সম্মান বাঁচাতে।
কর্ণ যে ভীষ্ম, দ্রোণ এবং বিদুরকে পরান্নভোজী প্রবঞ্চক বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছিলেন—এই অভিযোগ দ্রোণাচার্য সম্বন্ধে যদি বা খাটে, কিন্তু ভীষ্ম এবং বিদুরের সম্বন্ধে তা খাটে না। আর কৃপাচার্যকে কর্ণ পাত্তাই দেননি। শক্তিমত্তা এবং অস্ত্রনৈপুণ্যের ক্ষেত্রে কৃপাচার্য কোনও ভাবেই ভীষ্ম-দ্রোণের সমকক্ষ ছিলেন না, সেই জন্য কর্ণ হয়তো তাঁকে স্মরণও করেননি। এমনকী যুধিষ্ঠিরও বনপর্বে যখন কৌরবদের যুদ্ধসহায় যোদ্ধাদের নাম করে নিজেদের সম্বন্ধে দুর্বলতা ব্যক্ত করছেন, তখন তিনিও কৃপাচার্যের নাম করছেন না। কিন্তু একটা কথা তিনিও মনে রাখছেন। অর্থাৎ যুধিষ্ঠিরের দৃষ্টিতে—ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপরা কর্ণকথিত পরান্নভোজী না হলেও এঁরা রাজবাড়ির বৃত্তিভোগী অর্থাৎ রাজোপজীবী। যুধিষ্ঠিরের মার্জিত ভাষায় ‘রাজপিণ্ডদ’। যুধিষ্ঠির মনে করেন—যুদ্ধ যখন লাগবে তখন ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপ—এঁরা কৌরব এবং পাণ্ডবদের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন হলেও যেভাবে হোক, প্রাণ দিয়েও এঁরা রাজার ঋণ চুকোবেন অর্থাৎ ‘রাজপিণ্ড’ দেবেন—দ্রোণস্য চ মহাবাহো কৃপস্য চ মহান্তনঃ। অবশ্যং রাজপিণ্ডস্তৈর্নিবেশ্য ইতি মে পতিঃ।
বোঝা যায়, ভীষ্ম-দ্রোণের সমকক্ষায় যুদ্ধবীর্য প্রকাশ না করতে পারলেও এই দুইজনের সঙ্গে যুক্ত হলে কৃপাচার্যের শক্তিও কম নয়। কিন্তু কৃপের ব্যক্তিগত মানসিক শক্তি তথা যুদ্ধক্ষমতা কম ছিল বলেই হয়তো ‘রাজপিণ্ডদ’ হওয়া সত্ত্বেও ভীষ্ম-দ্রোণ অন্যায়ের যতটুকু কঠিন প্রতিবাদ করতে পেরেছেন, কৃপাচার্য তা কখনওই পারেননি। তাই বলে অন্তরে তাঁর কোনও প্রতিবাদ ছিল না, এমন নয়। তিনি আচার্যস্থানীয় গুরু, চিরকাল ভীষ্মের ছত্রছায়ায় থেকেছেন। কিন্তু তবু স্থিরবুদ্ধি এই ব্যক্তিটি নিজেকে খুব জড়াতেন না রাজনীতির পক্ষপাতে। একবারই অবশ্য আমরা তাঁকে ভীষণ ক্রুদ্ধ-ক্ষুব্ধ হতে দেখেছি এবং সেটা বোধ হয় সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হয়েছিল বলেই। নইলে এই ক্রোধ রাজবাড়ির প্রথম আচার্যের স্বাভাবিক নয়।
তখন দুর্যোধনের প্ররোচনায় ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ সকলেই বিরাট রাজ্যে গেছেন বিরাট রাজার গোধন হরণ করতে। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস তখন কেবল শেষ হয়ে গেছে। অর্জুন উত্তরকে সারথি করে একাকী যুদ্ধে এসেছেন। এদিকে দ্রোণাচার্য প্রিয়শিষ্য অর্জুনের রথশব্দ শুনে একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলেন। এমনকী সে কথা সরলভাবে বলেও ফেললেন একটু প্রশংসা করে। বললেন—এই যেমন রথের শব্দ শুনতে পাচ্ছি তাতে এ অর্জুন না হয়ে যায় না—যথা রথস্য নির্ঘোষো…নৈষো’ন্যঃ সব্যসাচিনঃ। অর্জুনের উপস্থিতি অনুমান করে ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপরা একটু নিরুৎসাহ হয়েই বসেছিলেন। এতকাল বনবাস, অজ্ঞাতবাস ইত্যাদি যন্ত্রণার পর অর্জুনের এই উপস্থিতি তাঁদের মনে যুদ্ধের উত্তেজনা প্রশমিত করে দিয়েছিল। দুর্যোধন ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপদের অবস্থা দেখে খানিকটা যুদ্ধোন্মাদনা সৃষ্টি করতে চাইলেন। বলেও ফেললেন—এ কী? রথের ওপর আপনারা এমন জড়ের মতো বসে আছেন কেন? এই যে আপনারা—ভীষ্মো দ্রোণঃ কৃপশ্চৈব বিকর্ণ দ্রোণিরেব চ।
দুর্যোধন কথার রেশ ধরে এবার টিটকিরি কাটলেন কর্ণ। বললেন—আরে! অর্জুনের ঘোড়ার গলা শুনেই দ্রোণের সব গণ্ডগোল হয়ে গেছে। দুর্যোধন তুমি সৈন্যদের ঠিক রাখো। এই দ্রোণের কাছে পাণ্ডবরা আমাদের চেয়ে অনেক প্রিয়তর। নইলে কেউ ঘোড়ার চিঁহি-শব্দ শুনেই তার সওয়ারির প্রশংসা করতে থাকে—অশ্বানাং হ্রেষিতং শ্রুত্বা কঃ প্রশংসাপরো ভবেৎ? কর্ণ অনেকক্ষণ আচার্য দ্রোণের ওপর কটূক্তি বর্ষণ করে এবার আত্মশ্লাঘা আরম্ভ করলেন। আমি ‘এই করব, সেই করব’, আমার শরধারে অর্জুনের মাথা ঘুরিয়ে ছাড়ব—ইত্যাদি অনন্ত আত্মশ্লাঘা। দ্রোণাচার্য কর্ণের একটি কথারও উত্তর দিলেন না। কিন্তু প্রথম রীতিমতো ক্ষিপ্ত হতে দেখলাম কৃপাচার্যকে। তিনি বোধ হয় দ্রোণাচার্যকে নিয়ে কর্ণের উপহাসটুকুও সহ্য করতে পেরেছিলেন, কিন্তু কর্ণের আত্মশ্লাঘা যখন সীমাহীন হয়ে পড়ল, কৃপাচার্য তখন আর সহ্য করতে পারলেন না।
সত্যিই কেন যেন কৃপাচার্য কর্ণকে একেবারেই সহ্য করতে পারেন না। যে দুবারই তিনি ভীষ্ম-দ্রোণের নিরপেক্ষতায় নিজের মত ব্যক্ত করেছেন, সেই দুবারই কিন্তু তিনি কথা বলেছেন কর্ণের বিরুদ্ধে। সেই একবার বালক বয়সেও কর্ণের আত্মশ্লাঘা শুনে অস্ত্ররঙ্গভূমিতে কৃপাচার্য থামিয়ে দিয়েছিলেন কর্ণকে। আজ আরও একবার দ্রোণের প্রতি কর্ণের তাচ্ছিল্য-টিটকিরি এবং আত্মশ্লাঘা শুনে কৃপ বললেন—তোমার বুদ্ধিটাই বড় কুটিল হে৷ তাই এত যুদ্ধ যুদ্ধ করছ। তুমি যা চাইছ অথবা যা তোমার লক্ষ্য, তা কী করে পেতে হবে তাও তুমি বোঝ না, এবং তার আরম্ভ-পরিণামও তুমি বোঝ না—নার্থানাং প্রকৃতিং বেত্সি নানুবন্ধমপেক্ষসে। এটা জেনে রেখো—যুদ্ধের মতো খারাপ জিনিস আর দ্বিতীয় নেই। তাও বা যুদ্ধ যদি করতেই হয় এবং সেই যুদ্ধে যদি জয়লাভ করতে হয়, তার স্থানকালের ভেদ আছে। এখন যুদ্ধের সময়ই নয়।
আসলে কর্ণ দ্রোণ-কৃপকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলেছিলেন—আয়ুষ্মান যুদ্ধবীরদের সবাইকে এত ভীত দেখছি কেন, সবাই যেন কাবু হয়ে আছে—সর্বানায়ুষ্মতো ভীতান্ সন্ত্রস্তানিব লক্ষয়ে। কৃপাচার্য সেই কথারই উত্তর দিয়ে বলছেন—এটা যুদ্ধের সময়ই নয়। বস্তুত সেই সময়ে গ্রীষ্মকাল চলছিল। শ্রান্তি এবং জলাভাবে এই সময় রথের সারথি এবং বাহন মৃত্যুর মুখে এসে দাঁড়ায়। তারমধ্যে এই যুদ্ধের প্ররোচনা নিয়ে দুর্যোধন-কৰ্ণরা যেখানে যুদ্ধ করতে এসেছেন, সে জায়গাটা হল বিরাট রাজ্য, যেটা এখনকার রাজস্থানের জয়পুর-ভরতপুর অঞ্চল। পাহাড়ঘেরা এই গিরিদুর্গে এসে বাইরের সমতলের বীরপুরুষদের যে কী দুর্গতি হতে পারে, সেটা কৃপাচার্য জানেন বলেই কর্ণকে বলেছেন—যুদ্ধের ব্যাপারে যদি দেশ এবং কালের বোধ থাকে, তবেই যুদ্ধটা জয় করা যায়—দেশকালেন সংযুক্ত যুদ্ধং বিজয়দং ভবেৎ।
কৃপাচার্য বললেন আরও। বললেন—আমরা যে এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি, তার কোনও অনুকূল পরিস্থিতিই নেই এখানে। আর কর্ণ! তোমার অবস্থাটা হয়েছে সেই প্রাবাদিক রথকারের মতো। যে রথ বানায়, সে দিব্যি একটা রথ বানিয়ে যোদ্ধাকে বলে—একখানা রথ দিলুম, কত্তা! এই রথে চড়ে যে যুদ্ধই করবেন, সেই যুদ্ধই জিতবেন। তুমি হচ্ছ সেই রথকারের মতো। সেই তোমার ভরসায় স্থানকাল কিছুই না বুঝে আমাদের মতো লোকেরা যুদ্ধ করতে পারেন না—ভারং হি রথকারস্য ন ব্যবস্যন্তি পণ্ডিতাঃ। কৃপ স্থানকালের কথা বলে এবার কর্ণের প্রতিতুলনীয় যুদ্ধের পাত্র বিবেচনা করে বললেন—আর কার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছি আমরা? না, অর্জুনের সঙ্গে। যে অর্জুন একা সমগ্র উত্তরকুরু দেশ জয় করে রাজসূয় যজ্ঞের সহায়তা করেছিলেন, যিনি একা খাণ্ডববন দহন করে অগ্নিদেবের ক্ষুধা-তর্পণ করেছিলেন, যিনি একা সুভদ্রাকে হরণ করে যদু-বৃষ্ণিদের যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন, যিনি একা মহাদেবকে তুষ্ট করে পাশুপত অস্ত্র লাভ করেছেন এবং যিনি একা গন্ধর্ব চিত্রসেনকে জয় করে দুর্যোধনের লজ্জা নিবারণ করেছিলেন…।
একটার পর একটা অর্জুনের বিজয়বার্তা শুনিয়ে কৃপাচার্য এবার কর্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন—কর্ণ! তুমি একা-একা কোন যুদ্ধটা জিতেছ—একেন হি ত্বয়া কর্ণ কিন্নামেহ কৃতং পুরা? তুমি কী করছ জান?—একটি ক্রুদ্ধ সর্পের দিকে আঙুল তুলে শাসানোর চেষ্টা করছ এবং মুক্ত অবস্থায় সেই একটি ক্রুদ্ধ সর্পকে তর্জনী তুলে শাসাচ্ছ, আর ভাবছ সেই শাসানি দিয়েই তুমি তার বিষদাঁত উপড়ে নেবে—অবমুচ্য প্রদেশিন্যা দংষ্ট্রামাদাতুমিচ্ছসি। ব্যাপারটা অত সোজা নয় কর্ণ! যে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্রও চান না, তুমি তাঁর সঙ্গে একা যুদ্ধ করবে কর্ণ! এর চাইতে বরং বল—আমি গলায় পাথর বেঁধে সমুদ্রে নামব, তারপর হাত দিয়ে সাঁতার কেটে সমুদ্র পার হব। তেরোটা বছর বনে বনে ঘুরে যে কষ্ট পেয়েছে পাণ্ডবরা, আজ তার প্রতিশোধ নেবার জন্য ক্ষুধার্ত সিংহের মতো আসছে অর্জুন। অতএব কর্ণ, একা একা বেশি সাহস কোরো না, যুদ্ধ করতে হয় সবাই মিলে করব, এসব তোমার বড় বড় কথা থাক—সর্বে যুধ্যামহে পার্থং কর্ণ মা সাহসং কৃথাঃ।
কৃপাচার্য এই প্রথম খুব বড় বিকার দেখালেন কর্ণের বিরুদ্ধে অথবা দুর্যোধনের বিরুদ্ধে এবং এর কারণ নিশ্চয়ই দ্রোণাচার্যের অপমান। এই মহাস্ত্রবিদ জামাইবাবুটির জন্য কারণে-অকারণে কৃপের এত মায়া এবং প্রীতি ছিল যে, তাঁর কোনও আচরণেই তিনি কোনও দিন বাধা দেননি এবং সব সময় তাঁর উপযুক্ত মর্যাদা রেখেছেন নিজেকে অতিক্রম করে। কৃপাচার্যের কথার সূত্র ধরে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাও খুব একহাত নিলেন কর্ণকে এবং ব্যাপারটা এমন এক তুমুল পর্যায়ে পৌঁছোল যে, পিতামহ ভীষ্মকে এগিয়ে আসতে হল এই দুই প্রবীণ-নবীন ব্রাহ্মণকে থামাতে। ভীষ্ম অবশ্য কৃপের মত মেনে নিয়েও কর্ণকে একটু বাঁচাবার চেষ্টা করলেন—কারণ অর্জুন আসছেন—যুদ্ধ করতে হবে সবাইকেই। পরিশেষে ভীষ্ম এবং দুর্যোধন দুজনেই ক্ষমা চাইলেন কৃপাচার্যের কাছে এবং অশ্বত্থামার কাছেও—আচার্য এষক্ষমতাং শান্তিরত্র বিধীয়তাম্।
অর্জুনের কারণেই সাময়িক শান্তি এল যুদ্ধক্ষেত্রে। যুদ্ধে অবশ্য প্রথম পালাতে হল কর্ণকে যিনি প্রচুর আত্মশ্লাঘা করেছিলেন, তারপর সমবেত যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার মুখে মহাবীর অর্জুন বিরাটপুত্র কুমার উত্তরকে পরম শ্রদ্ধায় যাঁকে প্রথম চিনিয়ে দিলেন, তিনি হচ্ছেন তাঁর প্রথম পাঠশালার গুরু কৃপাচার্য। অর্জুন উত্তরকে বললেন—ওই যে দেখছ—লালচে রঙের ঘোড়াগুলি, বাঘের চামড়া-মোড়া রথ, নীল পতাকা—ওটা কৃপাচার্যের রথ। কৃপাচার্যের রথের চিহ্নটাও চিনে নাও। দেখো, রথের মাথায় সোনার যজ্ঞবেদি বসানো, তুমি ওই রথের দক্ষিণে স্থাপন করো আমার রথ—তস্য দক্ষিণতো যাহি কৃপঃ শারদ্বতো যতঃ।
অর্জুন প্রথমে কৃপাচার্যের রথ প্রদক্ষিণ করে সম্মান জানালেন তাঁকে। তারপর উভয়ের প্রবল শঙ্খধ্বনির সূচনায় তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হল। এই যুদ্ধে প্রত্যাশিতভাবেই কৃপাচার্য অর্জুনের কাছে হেরে গেলেন। তাঁর রথ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে, ধনুক ছিন্ন, অশ্ব-সারথি মৃত্যু বরণ করেছে। অন্যান্য যোদ্ধারা কৃপের করুণ অবস্থা দেখে কোনওরকমে তাঁকে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছে—ততঃ কৃপমুপাদায় বিরথং তে নরর্ষভাঃ। আমরা জানি—এই যুদ্ধে শুধু কৃপ কেন, কৌরবপক্ষের সবাই হেরে গিয়েছিলেন এবং অর্জুনের বাণাচ্ছন্ন মূর্ছায় সকলের মতো কৃপের মাথার শুক্ল আবরণখানিও খোয়া গিয়েছিল। তবু অর্জুনের কাছে এই পরাজয়ে আচার্য কৃপ বিষণ্ণও হননি, বিস্মিতও হননি।
বার বার যা দেখা গেছে, তা হল—অনবস্থিত এবং বঞ্চিত পাণ্ডব ভাইদের ওপর ভীষ্ম-দ্রোণের যেমন পক্ষপাত ছিল, কৃপাচার্যেরও ছিল সেইরকমই। কিন্তু সোচ্চারে, জোর গলায় কখনওই কিছু বলেন না কৃপাচার্য। এই যে যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে এত কাণ্ড ঘটে গেল, কৃষ্ণ এলেন শান্তির দূত হয়ে, ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর এমনকী ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত সংযত হতে বললেন দুর্যোধনকে, কিন্তু কোথাও আমরা কৃপাচার্যের গলা শুনলাম না। কৌরবসভায় ভীষ্ম এবং দ্ৰোণ খুব কড়া ভাষায় হৃতরাজ্য ফিরিয়ে দেবার পরামর্শ দিয়েছিলেন দুর্যোধনকে, কিন্তু ভীষ্ম-দ্রোণের কণ্ঠস্বরে কৃপাচার্যের কণ্ঠ সেখানে মিলিয়ে গেছে। কিন্তু অন্যান্যদের মতো কৃপও যে পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধ চাননি, সে কথা ধৃতরাষ্ট্রের কথা থেকেই প্রমাণিত হয়। তিনি একসময় দুঃখ করে সহযোগী সঞ্জয়কে বলেছিলেন—তবু সেই যুদ্ধ হল। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, গান্ধারী, কেউ চাননি যুদ্ধ হোক, তবু সেই যুদ্ধ হল—ন কৃপো ন চ গান্ধারী নাহং সঞ্জয় রোচয়ে।
কৃপাচার্যকে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে দ্রোণ-ভীষ্মের কারণেই। এঁরা প্রত্যেকেই কুরুবাড়ির অন্নঋণ চুকোচ্ছেন। ফলে দুর্যোধন যখন এক অক্ষৌহিনী সেনার ভার দিয়ে কৃপকে নিজের স্বপক্ষে যুদ্ধ করতে বলেছেন, তখন তিনি প্রত্যাখ্যান করেননি দুর্যোধনকে। স্বপক্ষের যুদ্ধনায়কেরা কে কত শক্তিধর এবং কে কত দিনে পাণ্ডবসৈন্যের বিনাশ ঘটাতে পারেন, এই প্রশ্নে কৃপাচার্যের সততা এবং সচেতনতা পরম কৌতূহল জাগায়। এই প্রশ্নে কর্ণ বলেছিলেন—আমার পাঁচ দিন লাগবে; অশ্বত্থামা দশ দিন সময় চেয়েছেন, ভীষ্ম-দ্রোণ বলেছেন—আমাদের এক-একটি মাস সময় লাগবে; সেখানে কৃপাচার্য নিজের ওজন বুঝে পুরো দু মাস সময় চেয়েছেন পাণ্ডবসৈন্য শাতন করার জন্য।
পাণ্ডবদের রাজ্যলাভের ব্যাপারে তাঁর পূর্ণ সমর্থন থাকা সত্ত্বেও যে তাঁকে দুর্যোধনের পক্ষে অংশগ্রহণ করতে হল, তার কারণ কৃপাচার্য নিজেই জানিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। যুদ্ধারম্ভে গুরু এবং আচার্যের আশীর্বাদ লাভ করার জন্য যুধিষ্ঠির ক্রমান্বয়ে ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপের কাছে এসেছেন এবং এঁরা প্রত্যেকেই যুধিষ্ঠিরকে একই কথা বলেছেন। ভীষ্ম-দ্রোণের পরেই কৃপ বলেছেন—যুধিষ্ঠির! কৌরবপক্ষে থেকেই আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে আমি নিরুপায়। কেন জান? কেননা, মানুষ অর্থের দাস, অর্থ কারও দাস নয়, আর ঠিক সেই জন্যই কৌরবপক্ষে আমি বাঁধা পড়ে আছি। আমি জানি—আমি ক্লীব ব্যক্তির মতো কথা বলছি। তবু এই সত্যটা জেনে আমাকে যুদ্ধত্যাগের পরামর্শ ছাড়া আর তুমি যা চাও, তাই তোমাকে দেব, যুধিষ্ঠির—অতস্ত্বাং ক্লীববৎ ব্রূয়াং যুদ্ধাদন্যৎ কিমিচ্ছসি?
তিন বৃদ্ধের মুখেই এই অসহায় উক্তি আমাদের আশ্চর্য করে। এই এক পরম আশ্চর্য নীতিবোধ—অন্নের ঋণ চুকোতে হবে। সেই কবে মহারাজ শান্তনুর কোলে চেপে কুরুবাড়িতে এসেছিলেন কৃপাচার্য। এই বাড়িতে তিনি মানুষ হয়েছেন, স্থিত হয়েছেন মর্যাদার আসনে। চিত্রাঙ্গদ, বিচিত্রবীর্য এবং পাণ্ডু—এই তিন রাজাকে তিনি মরতে দেখেছেন। তারপর এই ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধনের আমলে ভীষ্ম-দ্রোণের মতো কৃপাচার্যও তাঁদের নৈতিকতায় সন্দিহান, কিন্তু সেই শান্তনুর সময় থেকে এতাবৎ কালের রাজবৃত্তিভোগের ঋণ কৃপাচার্যও ভোলেননি। ভীষ্ম বলেছিলেন—নিজের প্রাণের পরিবর্তেও কৃপাচার্য তোমার শত্রুদের বধ করে যাবেন, সে কথাটা বড়ই ঠিক। দুর্যোধনের পক্ষে তাঁকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে রাজপিণ্ড দানের দায়ে। তাই যুধিষ্ঠিরের কাছে তাঁকে মাথা নিচু করতে হচ্ছে ক্লীবের মতো। কেননা তিনি যুধিষ্ঠিরকে এবং তাঁর নীতিধর্মকে সমর্থন করছেন একদিকে। অন্যদিকে শরীর দিয়ে তাঁকে যুদ্ধ করতে হচ্ছে দুর্যোধনের পক্ষে, বলা উচিত প্রাতীপেয় শান্তনুর উত্তাধিকারীর পক্ষে, কেননা হস্তিনাপুরের রাজলক্ষ্মী তখনও যুধিষ্ঠিরের অঙ্কশায়িনী নন।
যুধিষ্ঠির বুঝেছেন, এই অসহায়তা যুধিষ্ঠির বোঝেন। বুঝেই তিনি জিজ্ঞাসা করতে চাইলেন—কী উপায়ে কৃপাচার্য বধ্য হবেন। ঠিক এই কথাগুলো তিনি ভীষ্ম এবং দ্ৰোণকেও জিজ্ঞাসা করেছেন, উত্তরও পেয়েছেন একভাবে। কিন্তু কৃপকে জিজ্ঞাসা করেই তিনি লজ্জায় পড়ে গেছেন। সবাই জানে কৃপাচার্য চিরজীবী। তিনি কারও বধ্য নন। কেমন করে, কী উপলক্ষে অথবা কোন তপস্যায় কৃপাচার্য এই চিরজীবিতার বরলাভ করেছিলেন, সে প্রসঙ্গ মহাভারতে কোথাও পাইনি। হয়তো বা মহাভারতের বিশাল যুদ্ধে যেখানে ভীষ্ম-দ্রোণের মতো মহাবীরের পতন ঘটেছে, অথচ কৃপাচার্যের সেই গতি হয়নি, হয়তো এই সৌভাগ্যই তাঁকে চিরজীবিত্বের মহাকাব্যিক স্থিতি জুগিয়েছে। নইলে তাঁর জন্মলগ্নেও পিতা শরদ্বানের কাছ থেকে নেমে আসেনি আশীর্বাদ অথবা পরেও কোনও তপস্যার ফলে বর্ষিত হয়নি এই দৈববাণী। অথচ লোকপ্রবাদ—কৃপাচার্য চিরজীবী। আমাদের ধারণা—মহাভারতের কবি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পরেও কৃপাচার্যকে বেঁচে থাকতে দেখে কাব্যিক অভিসন্ধিতেই কৃপাচার্যের এই চিরজীবিতার অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর কালজয়ী মহাকাব্যে।
যুধিষ্ঠির তাই কথাটা বলে লজ্জাই পেলেন—ইত্যুক্ত্বা ব্যথিতো রাজা নোবাচ গতচেতনঃ। যুধিষ্ঠিরের মুখে কথা জোগাচ্ছে না দেখে কৃপ বললেন—তুমি তো জানই আমি অবধ্য। তবে আমার আশীর্বাদ—এ যুদ্ধে তোমারই জয় হবে। তুমি এখানে এসেছ, আমার আশীর্বাদ চেয়েছ—এতেই আমি পরম প্রীত হয়েছি, তোমার জয় হোক—প্রীতস্তে’ভিগমেনাহং জয়ং তব নরাধিপ।
যুদ্ধ একটা মানুষকে কেমন চিনিয়ে দেয়, এমনকী তাঁর ব্যক্তিচরিত্রের দ্বিধা-দ্বন্দ্বগুলির দিকেও কেমন অঙ্গুলিসংকেত করে। এই যে বিরাট যুদ্ধ লাগল এবং তাতে ভীষ্মের মতো মহাবীরও শরশয়নে স্থিত হলেন, এই পুরো দশ দিন সময় জুড়ে কৃপাচার্যের উপস্থিতি আমরা টেরই পাই না। মাঝে মাঝে এর-ওর-তার সঙ্গে কৃপাচার্যের যুদ্ধ হচ্ছে, কিন্তু তাতে পাণ্ডবদের এমন কিছু ক্ষতি হচ্ছে না, অথবা দুর্যোধনেরও কিছু বৃদ্ধি ঘটছে না। ভীষ্মের পর কৃপের অতি-কাছের মানুষ দ্রোণাচার্যের সেনাপতিত্বকালেই বা কৃপাচার্যের কী ভূমিকা! দ্রোণের সেনাপতিত্বকালে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে চক্রব্যূহে অভিমন্যুবধ, সেই যুদ্ধেও কৃপাচার্য সপ্তরথীর অন্যতম রথী বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে যুদ্ধেও অভিমন্যুর কোনও সমস্যা হয়নি। কৃপাচার্যের অশ্বগুলি অভিমন্যুর হাতে মারা যায় বটে, তবে তিনি বেশি মার খানও না, আবার মারেনও না তত।
অভিমন্যুবধের প্রতিক্রিয়ায় কৌরবপক্ষে ধৃতরাষ্ট্রের জামাই জয়দ্রথ মারা গেলেন। এবারে এই নক্ষত্ৰ-পতনের ভয়ংকর প্রভাব এসে পড়ল দ্রোণাচার্যের ওপর। দ্রোণ দুর্যোধনের কাছে চরম গালাগালি খেলেন এবং তিনি গালাগালি দিলেনও। তবু যুদ্ধ চলল যুদ্ধের মতো। দ্রোণ পাণ্ডবদের কাউকে হত্যা করলেন না। ঠিক এই সময় সেই পুরনো ঝগড়াটা আবার চেতিয়ে উঠল। দুর্যোধন দ্রোণের ব্যাপারে হতাশ হয়ে কর্ণকে ধরলেন পরিত্রাতার মর্যাদায়। এবার আবার শুরু হল সেই আত্মশ্লাঘা-অর্জুনকে মারব, ভীমকে মারব, সমস্ত পাণ্ডবদের মারব, পাঞ্চালদের মারব—তারপর দুর্যোধন! তোমার হাতের মুঠোয় এনে দেব বিজয়লক্ষ্মী—জয়ং তে প্রতিদাস্যামি বাসবস্যেব পাবকিঃ। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তোমার দুঃখ করার কোনও কারণ নেই—ময়ি জীবতি কৌরব্য বিষাদং মা কৃথাঃ ক্বচিৎ।
এই সব বারফাট্টাই কথা কৃপের সামনেই হচ্ছিল বলে তিনি আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। অনেকক্ষণ তিনি শুনছেন এবং আগেও একবার শুনেছেন সেই বিরাট রাজ্যে গোহরণের সময়। সেবার আগুয়ান অর্জুনের কারণে প্রসঙ্গটা ধামাচাপা পড়েছিল। আজ সে দায় নেই বটে, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে একের পর এক মহাবীরের পতন ঘটেছে। সদ্য মারা গিয়েছে জয়দ্রথ। অতএব এই বিষম মুহূর্তে দ্রোণাচার্যের গুরুত্ব হ্রাস করে, কর্ণের এই মৌখিক আস্ফালন সহ্য করতে পারলেন না কৃপ। তিনি প্রায় হাততালি দিয়ে বললেন—আরে বাঃ। দারুণ খবর! দারুণ খবর এটা! এতদিনে আমাদের দুর্যোধন তাঁর পরিত্রাতাকে খুঁজে পেয়েছেন—শোভনং শোভনং কর্ণ সনাথঃ কুরুপুঙ্গবঃ। তবে হ্যাঁ, যুদ্ধজয়ের কাজটা যদি বাক্যি দিয়েই সিদ্ধ হত, তা হলে তো ভালই ছিল। বহুকাল ধরে এই বাক্যি শুনছি, আর এই হামবড়াইটাও শুনছি, কিন্তু কোনও দিন তেমন কোনও ফল দেখলাম না যাতে তোমার বিক্রম জয় এনে দিল দুর্যোধনকে। বহুবার পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গে তোমার মুখোমুখি লড়াই হয়েছে, কিন্তু একটা উদাহরণও তুমি দিতে পারবে না যেখানে তুমি না হেরে জিতে এসেছ—সর্বত্র নির্জিতশ্চাসি পাণ্ডবৈঃ সূতনন্দন।
কৃপাচার্য এবার একটি একটি করে উদাহরণ দিলেন—যেখানে যেখানে কর্ণ দ্বৈরথ-যুদ্ধে হেরেছেন অর্জুনের সঙ্গে। তারপর কঠিন ব্যঙ্গোক্তি মিশিয়ে কৃপ বললেন—তুমি একা অর্জুনের সঙ্গেই এঁটে উঠতে পার না, যেখানে নাকি সমস্ত পাণ্ডবদের যুদ্ধে হারাবে তুমি। তারচেয়ে ভাল কথা বলি শোনো, কর্ণ—তুমি কথা কম বলো, আর যুদ্ধের কাজটা করে দেখাও—অব্রুবন্ কর্ণ যুধ্যস্ব কত্থসে বহু সূতজ—নইলে এই মেলা বকবকানি শরৎকালের মেঘের মতো শুধু গর্জায়, বর্ষায় না। তোমার এত মেজাজ, এত গর্জন, সবই চলবে যতক্ষণ না অর্জুন তোমার সামনে আসছে—যাবৎ পার্থং ন পশ্যসি—আর অর্জুন সামনে এলেই এই গর্জন তোমার ছুটে যাবে—দুর্লভং গর্জিতং পুনঃ।
কৃপের ব্যঙ্গোক্তি শুনে কর্ণ কিন্তু একটুও দমলেন না। বললেন—বীরেরা যে কাজটা করে, সেটা মনে মনে আগে ভেবে নেয়,—মনসা হি ব্যবস্যতি—তারপর কাজটা করে দেখায়, আর আমি নিজের ক্ষমতা জানি বলেই গর্জন করছি। তা ছাড়া কৃষ্ণকে এবং পাণ্ডবদের হত্যা করার ব্যাপারে যদি আমি গর্জন করেই থাকি, তাতে বামুন ব্যাটা! তোর কী ক্ষতি হচ্ছে—গর্জামি যদ্যহং বিপ্র তব কিং তত্র নশ্যতি। কৃপ বললেন—চিরকাল এই কাজটাই করে গেলি, সারথির পো! চিরটা কাল ওই কৃষ্ণকে, ওই যুধিষ্ঠিরকে আর ওই অর্জুনকে গালাগালিই দিয়ে গেলি, আর জয়ের ইচ্ছাটা তোর মনেই রয়ে গেল—আমি তোর এই মনের প্রলাপ গ্রাহ্যই করি না—মনোরথপ্রলাপা মে ন গ্রাহ্যাস্তব সূতজ। কৃপাচার্য এবার পাণ্ডবদের শক্তিমত্তা ছাড়াও যুদ্ধে উপস্থিত কোন কোন মহাবীরের সঙ্গে কর্ণকে লড়াই করে জিততে হবে, তার একটা তালিকা দিয়ে বললেন—এঁদেরও সবাইকে তুই জয় করবি ভাবছিস। তবে সবচেয়ে আশ্চর্য—তুই ভাবিস—তুই কৃষ্ণকেও জয় করবি—যস্ত্বমুৎসহসে যোদ্ধুং সমরে শৌরিণা সহ।
এই প্রথম কর্ণ স্বীকার করলেন যে, পাণ্ডবদের সঙ্গে যুদ্ধজয়ের হিসেব কষাটা দেবতাদের পক্ষেও কঠিন, কিন্তু কর্ণ যে কখনও ভেঙেও পড়েন না এবং তিনি মচকানও। অতএব সঙ্গে সঙ্গেই বললেন—আমার কাছে ইন্দ্রের দেওয়া সেই একবীরঘাতিনী অব্যর্থ শক্তিটি আছে, সেটা দিয়ে আমি একটি লোককেই মারব এবং সেটা হবে অর্জুন সব্যসাচী। আর তাকে যদি একবার মারতে পারি তা হলে কোনও ভাবেই এই অনর্জুন পৃথিবী অন্য পাণ্ডবরা ভোগ করতে পারবে না। তখন আপনিই এই পৃথিবী দুর্যোধনের করায়ত্ত হবে। নিজের মৌখিক আড়ম্বরের পিছনে বেশ যেন একটা বাস্তব সত্যের ভিত্তি আছে—এমন একটা আভাস দিয়েই কর্ণ আবার নেমে এলেন তাঁর তিরস্কারের গণ্ডীতে। বললেন—আমার রাজনৈতিক কৌশল (এ ক্ষেত্রে একাঘ্নী বাণ) আমারই হাতে আছে বলেই আমি গর্জাচ্ছি—ততো গর্জামি গৌতম। এর পরেই গালাগালি—আর তুই তো ব্যাটা বুড়োহাবড়া, তার ওপরে বামুন, তার ওপরে তোর ক্ষমতাও কিছু নেই—ত্বন্তু বিপ্রশ্চ বৃদ্ধশ্চ অশক্তশ্চাপি সংযুগে। পাণ্ডবদের ব্যাপারে তোর রসও আছে যথেষ্ট। কিন্তু এইবার শেষ কথা বললাম—ফের যদি আমার ব্যাপারে এমন উলটোপালটা কথা শুনি, তা হলে এই খড়্গ দিয়ে তোর জিবটাই কেটে নেব—ততস্তে খড়্গমুদ্যম্য জিহ্বাং ছেৎস্যামি দুর্মতে।
ঘটনা যেটা ঘটল—কর্ণ তাঁর মৌখিকতার মধ্যেই খড়্গ দিয়ে কৃপাচার্যের জিব কাটার কথা বলেছিলেন, কিন্তু মাতুল কৃপাচার্যের অপমান দেখে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা একেবারে খড়্গ নিয়ে তেড়ে গেলেন কর্ণের দিকে। মারামারি লাগে প্রায়। এই অবস্থায় স্বয়ং দুর্যোধন এসে দু’পক্ষকেই থামালেন এবং শান্তিপ্রক্রিয়ায় অংশ নিলেন স্বয়ং কৃপাচার্য। বললেন—আমরা তোকে ক্ষমা করে দিলাম, তবে এই যে তোর অহঙ্কার, এই যে সকলকে ছোট করে দেখা স্ফীতভাব, এই অহঙ্কার তোর চূর্ণ করে দেবে অর্জুন—দর্পমুৎসিক্তমেতত্তে নাশয়িষ্যতি ফাল্গুনঃ।
এই প্রথম আমরা কৃপাচার্যকে অনেকক্ষণ ধরে কোনও ঘটনার মধ্যে আকুল হতে দেখলাম। আমরাও যে এই দীর্ঘ উতোর-চাপান উল্লেখ করলাম, তার দুটো কারণ আছে। প্রথমত এটা তো পরিষ্কার যে, পাণ্ডব অর্জুন এবং তাঁর সূত্রে সমস্ত পাণ্ডবদের ওপর কৃপাচার্যের একই স্নেহ-মমতা আছে যা দ্রোণাচার্য এবং ভীষ্মের সমগোত্রীয়। দ্বিতীয়ত লক্ষণীয় অন্যতর এক চক্র, যা পাণ্ডব-কৌরব নিরপেক্ষ একটি উপদলের মতো। আগেও সেই বিরাট রাজার গোধন হরণের সময়েও দেখেছি যে, অর্জুনকে কেন্দ্র করে কর্ণের সঙ্গে ঝগড়া লাগার সময় দ্রোণাচার্য-কৃপাচার্য এবং অশ্বত্থামার অর্থাৎ এক দল পিতা-পুত্র-মাতুলের সমীকরণ ঘটছে। এখনও দেখলাম সেই সমীকরণ, আরও দৃঢ়, আরও ঘনিষ্ঠভাবে।
এর পরে দ্রোণ মারা গেছেন এবং সেখানে প্রধান নিমিত্ত কারণ হয়ে রইলেন পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন। দ্রোণি অশ্বত্থামা পিতার মৃত্যুর পর সমগ্র পাঞ্চালবাহিনীর ওপর পরম রুষ্ট হয়ে রইলেন, যদিও পাণ্ডব অর্জুন নিজেই গুরুহত্যার প্রক্রিয়ায় ধৃষ্টদ্যুম্নের ওপরে ক্ষুব্ধ থাকায় অশ্বত্থামা তাঁর রোষাগ্নিবেষ্টনীর মধ্যে ছিলেন না। যুদ্ধপর্বে যখন কর্ণের মৃত্যুর সময় আসন্ন হয়ে আসছে, সেই সময় অশ্বত্থামা কিন্তু দুর্যোধনকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে বলেছিলেন—দুর্যোধন! তুমি শেষ করো এই ভয়ংকর যুদ্ধ। তোমার-আমার সকলের গুরু ব্রহ্মার সমান দ্রোণাচার্য মারা গেছেন। মারা গেছেন ভীষ্ম। আমি এবং আমার মাতুল কৃপাচার্য দুজনেই অবধ্য কাজেই আমাদের জন্য নয়, সকলের মঙ্গলের জন্যই বন্ধ হোক এই যুদ্ধ। দুর্যোধন শোনেননি। এরপর মারা গেছেন কর্ণও, দুর্যোধনের প্রধান সহায়। কৌরবদের সেনা-পরিবারে সর্বত্র হতাশা নেমে এসেছে। মদ্ররাজ শল্য তখনও সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হননি এবং কোনওভাবে পাণ্ডবদের ঠেকানো যাচ্ছে না। দুর্যোধনের প্রিয়তম ভাই দুঃশাসন, কুরুবাড়ির জামাতা জয়দ্ৰথ, দুর্যোধনের পুত্র লক্ষ্মণ এবং দুর্যোধনের অন্যান্য ভাইরাও মারা গেছেন। ঠিক এই পরিস্থিতিতে বৃদ্ধ কৃপাচার্য দুর্যোধনের কাছে আসছেন একান্তে।
কৃপাচার্যের বয়স হয়েছে। কর্ণ সেটা টিটকিরি দিয়ে বলেছিলেন, কিন্তু কথাটা তো মিথ্যে নয়। তার মধ্যে কৃপের স্বভাবটাও অন্য যোদ্ধাদের মতো উগ্র নয়। কর্ণ তাঁকে অনেক গালাগালি দেবার সময়েও তাঁর যে চরিত্র প্রকাশ পেয়েছে, তা মহাভারতের কবিকে উল্লেখ করতে হয়েছে। অশ্বত্থামার মতো সাংঘাতিক বীরকে নিজের পক্ষে পেয়েও তিনি যে তাঁকে কর্ণের বিরুদ্ধে থামিয়ে দিতে পেরেছিলেন, সেটা সেই স্বভাবেরই বিবর্তনে। ক্রুদ্ধ হলেও তাঁর রাগ পড়ে যেত খুব তাড়াতাড়ি—সোম্যস্বভাবাদ্ রাজেন্দ্র ক্ষিপ্রমাগতমার্দবঃ। আজকে সেই সৌম্যতা এবং মৃদুতা নিয়েই তিনি দুর্যোধনের কাছে এসেছেন ‘বয়ঃশীলসমন্বিত’ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণঃ। বিশেষত দ্রোণাচার্য বেঁচে নেই বলেই আজ যেন তিনি অধিকতর দায়িত্ব বোধ করছেন দুর্যোধনকে শান্ত করার।
কৃপ বললেন—আমার কথাটা মন দিয়ে শোনো, দুর্যোধন! তারপর যা তোমার মনে হয়, করো। এটা তো ঠিকই যে, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যুদ্ধ করা এবং যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হওয়াটা অধর্ম বটে। কিন্তু যারা বাঁচতে চায়, তাদের কাছে বড় কঠিন এই ক্ষত্রিয়জীবিকা—তস্মাদ্ ঘোরাং সমাপন্না জীবিকাং জীবিতার্থিনঃ। বস্তুত কৃপাচার্য নিজেই এক জীবনকামী ব্রাহ্মণ। এই যুদ্ধ, এত যুদ্ধ তাঁর ভাল লাগে না। বয়সের ভারে ক্লান্ত ব্রাহ্মণ মৃত্যু দেখে দেখে বিপর্যস্ত হয়ে দুর্যোধনকে বলছেন—তোমার ভালর জন্যই বলছি, বাছা! দেখ, ভীষ্ম শরশয্যায় পড়ে আছেন, দ্রোণ মারা গেছেন এবং তোমার প্রিয়তম সহায় কর্ণও চলে গেছেন। আজ জয়দ্রথ নেই, তোমার ভাইরা বেঁচে নেই, তোমার পুত্রটিও মারা গেছে। আর বাকি রইল কে—কিং শেষং পর্য্যুপাস্মহে? যাদের ভরসায়, যাদের আশায় তুমি এই রাজ্য শাসন করবে ভেবেছিলে—যেষু ভারং সমাসজ্য রাজ্যে মতিমকুর্মহি—তারা সবাই একে একে চলে গেছে।
কৃপাচার্য কৌরবপক্ষের এই অদ্ভুত অবস্থা সহ্য করতে পারছেন না। আজকে যুদ্ধের সতেরোতম দিন। অষ্টাদশতম দিবসের পরিণতি কৃপাচার্য চোখে দেখতে পাচ্ছেন যেন। কুরুবাড়ির এই দামাল ছেলে দুর্যোধনকে তিনি বুঝি শুধু অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের শেষ সান্ত্বনার জন্য বাঁচিয়ে রাখতে চান। কৃপ বললেন—এত বড় বড় যোদ্ধারা সব যুদ্ধে মারা গেলেন, তাঁদেরকে বাদ দিয়ে আমরা বড় করুণ অবস্থায় এসে ঠেকেছি এবং আরও করুণ অবস্থায় থাকব—কৃপণং বর্তয়িয্যামঃ পাতয়িত্বা নৃপান্ বহূন্। অথচ ব্যাপারটা যুক্তিতে এনে দেখো। এত বড় বড় যোদ্ধারা বেঁচে থেকেও কিন্তু কেউ অর্জুনকে আটকাতে পারেননি। তোমার সেনারা আজ চোখে আঁধার দেখছে, সব সময় কাঁপছে অর্জুনকে দেখে। অথচ কোথায় আজ তোমার সহায় সূতপুত্ৰ কৰ্ণ, কোথায় তোমার সহায় দ্রোণ, কোথায় ভাই দুঃশাসন? অথচ বিপরীত দেখো, ভীম! সেই নষ্টচরিত্র কৌরবসভায় দ্রৌপদীর অপমানের সময় ভীম যা যা বলেছিল, সব কিন্তু সে করেছে এবং আরও করবে—কৃতঞ্চ সকলং তেন ভূয়শ্চৈব করিষ্যতি।
পূর্ব-ঘটনার প্রমাণে ভবিষ্যতে দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গের কথাটাও বুঝি স্মরণ করিয়ে দিতে চাইলেন কৃপাচার্য—আরও কিন্তু করবে—ভূয়শ্চৈব করিষ্যতি। কৃপাচার্য এবার রাজনীতিকে দর্শনের পর্যায়ে উন্নীত করে বললেন—তুমি তোমার নিজের সুরক্ষার জন্য দিগ্বিদিক থেকে সহায় সংগ্রহ করেছিলে, কিন্তু সেই তোমার অস্তিত্বই পরম সংশয়িত—স চ সংশয়িতস্তাত আত্মা চ ভরতৰ্ষভ। দুর্যোধন তুমি নিজের জীবনটুকু অন্তত বাঁচাও, কেননা তোমার এই জীবনই সুখ-দুঃখ, ভাল-মন্দের আধার। কৃপাচার্য যুদ্ধ ছেড়ে ‘ডিপ্লোম্যাসি’র উপদেশ দিলেন দুর্যোধনকে। বললেন—যখন যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল, তখন ধরে নিই, তোমার বলাবল, সেনাক্ষমতা পাণ্ডবদের চেয়ে ভাল ছিল, যুদ্ধ চলাকালীন তা সমান হয়েছিল এবং তা এখন প্রতিতুলনায় ক্ষীণ। কূটনীতিতে সমানে সমানে সন্ধি হয়, আর হীন অবস্থায় তো হয়ই—হীয়মানেন বৈ সন্ধি পর্যেষ্টব্যঃ সমেন চ—এটাই বৃহস্পতি-কথিত কূটনীতি। এখন যেহেতু তোমার অবস্থা পাণ্ডবদের চেয়ে খারাপ, তাই আমি বলছিলাম—যুদ্ধ থামিয়ে আপাতত সন্ধি করো পাণ্ডবদের সঙ্গে—তদত্র পাণ্ডবৈঃ সার্ধং সন্ধিং মন্যে ক্ষমং প্রভো।
কৃপাচার্য উপদেশ দিয়ে যাচ্ছিলেন বটে, কিন্তু কেমন যেন বুঝতে পারছিলেন যে, দুর্যোধন তাঁর কথা শুনবেন না। আর এত কথা বলার পরেও কেউ যদি তা না শোনে, তবে একটু খারাপ তো লাগবেই। কৃপাচার্য সেই মনখারাপের কথাটাও প্রকাশ করে দুর্যোধনকে বললেন—দেখ বাছা! যে তার নিজের ভাল বোঝে না এবং ভাল বললে শোনেও না, তার রাজ্য থাকলেও ধ্বংস হয়ে যায়। আর আমি বলি কী, এইভাবে মূর্খের মতো ধ্বংস হয়ে যাবার কোনও অর্থ নেই, যুধিষ্ঠিরের কাছে একটু নিচু হলেই যদি তুমি রাজ্য পাও, তো সেটাই তো সবচেয়ে ভাল। একটা কথা জেনো—যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের কথা কখনও ফেলবেন না। তিনি চাইলে যুধিষ্ঠির এই হস্তিনাপুরে আবার তোমাকে রাজা করবেন এবং মহামতি কৃষ্ণেরও সে ব্যাপারে সম্মতি থাকবে—বিনিযুঞ্জীত রাজ্যে ত্বাং গোবিন্দবচনেন চ। এই সপ্তদশ দিবস যুদ্ধের পরেও কৃপাচার্য তাঁর বিরুদ্ধপক্ষের যোদ্ধাদের ওপরেই আস্থা রাখেন। তিনি মনে করেন—কৃষ্ণই পাণ্ডবপক্ষের প্রকৃত নেতা এবং ধৃতরাষ্ট্র যদি কৃষ্ণকে একটা কথা বলেন তিনি তা অমান্য করবেন না, আবার কৃষ্ণও যা বলবেন যুধিষ্ঠির তা অমান্য করবেন না—নাতিক্রমিষ্যতে কৃষ্ণো বচনং কৌরবস্য চ।…নাপি কৃষ্ণস্য পাণ্ডবঃ।
দুর্যোধনকে সদুপদেশ দিয়েও কৃপ শান্তি পেলেন না। তিনি বুঝলেন যে, দুর্যোধনের কাছে এগুলো বলাটা অনেকটা নিজে নিজেই বিলাপ করে চুপ করে যাওয়ার মতো—ইতি বৃদ্ধো বিলপ্যেতৎ কৃপঃ শারদ্বতো বচঃ। এতক্ষণ কথা বলে তাঁর শ্বাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হল, আর দুর্যোধন শুনবেন না বুঝে কষ্টও হল যথেষ্ট। পরিশেষে নিজের ব্যাপারেও তাঁর অবস্থানটুকু তিনি পরিষ্কার জানিয়ে বললেন—যা আমি এতক্ষণ ধরে বললাম, তা যুধিষ্ঠিরের প্রতি মায়া বা করুণায় বলিনি, অথবা নিজে বেঁচে থাকার জন্যও বলিনি—ন ত্বাং ব্রবীমি কার্পণ্যাৎ ন প্রাণপরিরক্ষণাৎ। যা বলেছি, তোমার ভালর জন্য বলেছি এবং হয়তো তুমি মরার পরে তা বুঝবে—পথ্যং রাজন্ ব্রবীমি ত্বা তৎপরাসুঃ স্মরিষ্যসি।
দুর্যোধন কৃপের কথা শুনলেন না। তবে যুদ্ধের এই সপ্তদশতম দিবসে তাঁর যত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যত নিকট জন তাঁর মারা গেছেন, তার নিরিখে দুর্যোধন এখন কিছু আবেগপ্রবণ। বিশেষত যাঁরা তাঁর জন্য যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন, তাঁদের বিনিময়ে এখন তিনি নিজে বেঁচে থেকে রাজ্য ভোগ করবেন—এমনটি তিনি চাইলেন না এবং সেটা এই মুহূর্তে সত্যিই খুব অযৌক্তিক নয়। যুদ্ধের সতেরোতম দিনটি শল্যের সেনাপতিত্বে কাটল এবং অষ্টাদশ দিবসেই ঊরুভগ্ন দুর্যোধন দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরদেশে পড়ে রইলেন নিঃসহায়, ভীমের গদাঘাতে দীর্ণ অবস্থায়। আত্মকৃত দোষের জন্য তিনি বিলাপও করলেন, আবার ভীমের অন্যায় আঘাতের জন্য ক্রুদ্ধও হলেন যথেষ্ট। কৌরবপক্ষে তখন জীবিত শক্তিধর বীর মাত্র তিনজন—কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং যদুবংশীয় হৃদিকের পুত্র কৃতবর্মা। দুর্যোধন যখন ভীমের গদাঘাতে ধরাশায়ী হলেন, তখনও কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা যুদ্ধক্ষেত্রে রয়েছেন। বার্তাকথকদের কাছ থেকে দুর্যোধনের আর্ত সংবাদ শুনে তাঁরা দ্রুতগামী অশ্বে ত্বরিতে উপস্থিত হলেন দুর্যোধনের কাছে—অশ্বত্থামা কৃপশ্চৈব কৃতবর্মা চ সাত্বতঃ।
ভগ্নোরু দুর্যোধনের করুণ অবস্থা দেখে তিন জনেই তাঁর পাশে মাটিতে বসে পড়লেন। অশ্বত্থামা দুর্যোধনের প্রায় সমবয়সি, সেই ছাত্রকাল থেকে তিনি দুর্যোধনের সঙ্গে আছেন। প্রবল প্রতাপী অহঙ্কারী রাজা দুর্যোধনের করুণ অবস্থা দেখে অশ্বত্থামার হৃদয় একেবারে উত্তাল হয়ে উঠল। বিশেষত ভীমের অন্যায় গদাঘাত তাঁকে তাঁর পিতার অন্যায় মৃত্যু স্মরণ করিয়ে দিল। বিশেষত অস্ত্ৰত্যক্ত অবস্থায় পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁর পিতার প্রতি যে আচরণ করেছেন, তাতে এখন যেন আরও জ্বলে উঠলেন অশ্বত্থামা। তিনি দুর্যোধনের হাতখানি সজোরে চেপে ধরে বললেন—আমার পিতাকে এই ক্ষুদ্র অসভ্যেরা যেভাবে অন্যায়ের আশ্রয় নিয়ে হত্যা করেছিল, তাতেও আমার তেমন দুঃখ হয়নি, যেমনটি হচ্ছে তোমাকে দেখে। আমি এর প্রতিশোধ নেব রাজা। আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে এই পাঞ্চালদের আমি যমের বাড়ি পাঠাব। তুমি আদেশ করো—অদ্যাহং সর্বপাঞ্চালান…প্রেতরাজ নিবেশনম্৷
লক্ষণীয়, অশ্বত্থামা কিন্তু পাণ্ডবদের নাম করেননি, মনে থাকলেও মুখে বলেননি, শুধু উপলক্ষণে তিনি পাঞ্চালদের কথা বলেছেন। কিন্তু তাতেও পরম প্রীত হলেন দুর্যোধন। ভাবলেন—তা হলে এখনও একটি লোক আছে যে, পাণ্ডবদের ক্ষতি চায় অন্তত। তিনি সানন্দে সামনে দাঁড়ানো বৃদ্ধ কৃপাচার্যকে বললেন—আচার্য! আমাকে তাড়াতাড়ি এক কলস জল ভরে এনে দেবেন দয়া করে—আচার্য শীঘ্রং কলসং জলপূর্ণং সমানয়। দুর্যোধনের এই বিপন্ন মুহূর্তে এই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাজ করছেন। দুর্যোধনের কথা শুনে কৃপাচার্য দ্বৈপায়ন হ্রদ থেকে কলস ভরে নিয়ে আসলেন জল। দুর্যোধনের সামনে দাঁড়াতেই তিনি বললেন—আমার আজ্ঞায় আপনি এই দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামাকে সেনাপতির কর্মে অভিষিক্ত করুন, আচার্য। এই মরণমুহূর্তে আমার প্রিয় কিছু যদি কিছু করার ইচ্ছে থাকে, তবে রাজাজ্ঞা পালন করুন, আচার্য। রাজার আদেশের পূর্ণ মর্যাদা দিয়ে কৃপাচার্য পূর্ণ কলসের জল ঢেলে দিলেন অশ্বত্থামার মাথায়—রাজ্ঞস্তু বচনং শ্রুত্বা কৃপঃ শারদ্বতস্ততঃ।
সেনাপতি অশ্বত্থামা শেষবারের মতো রাজা দুর্যোধনকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিলেন। সঙ্গে কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা। যেতে যেতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। সামনে বিস্তীর্ণ বন। এই বন পার হতে গেলে রাত্রির অন্ধকারে আর পথ চেনা যাবে না। অতএব তিনজনই একটি বটগাছের তলায় এসে ঘোড়া ছেড়ে দিলেন। মাটিতে বসে একটু বিশ্রাম নিতেই বৃদ্ধ কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মা—দিনশ্রান্ত দুই যোদ্ধার চোখ একেবারে ঘুমে জড়িয়ে এল—ততো নিদ্রাবশং প্রাপ্তৌ কৃপভোজৌ মহারথৌ। যাঁদের সুখশয্যায় শয়ন করার কথা, তাঁরা দুজনেই মাটিতে শুয়েই ঘুমিয়ে পড়লেন অঘোরে। জেগে রইলেন শুধু অশ্বত্থামা, ক্রোধে, রোষে, আত্মগ্লানিতে দগ্ধ দ্রোণির ঘুম আসে না। তিনি জেগে বসে রইলেন। হঠাৎই অন্যদিকে তাঁর মন চলে গেল। দেখলেন—এতক্ষণ যে শত শত কাকেরা উপনীত-সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার আয়োজনে চিৎকার করে উড়ছিল, রাত্রির অন্ধকার ঘনিয়ে আসতেই তারা শান্ত হল। কিন্তু এই সময় এক রাত্রিচর পেচক এসে বসল বটগাছের ডালে, আর রাত্র্যন্ধ কাকেদের একটি একটি ধরে তার ভোজন সম্পূর্ণ করল। ত্বরিতে বুদ্ধি খেলে গেল অশ্বত্থামার মাথায়।
একেবারে চমকে উঠলেন তিনি। ঠিক করলেন—এইভাবেই তিনি পাণ্ডব-পাঞ্চালদের আয়ুঃশেষ করবেন। সামনাসামনি যুদ্ধে পাণ্ডবদের সঙ্গে তিনি পেরে উঠবেন না জানেন, অতএব এই উপায়—ইত্যেবং নিশ্চয়ং চক্রে সুপ্তানাং নিশি মারণে—তিনি সুপ্ত অবস্থায় রাত্রির অন্ধকারে পাণ্ডব-পাঞ্চালের শেষ করে দেবেন। এই মানসিক সিদ্ধান্তে এত উত্তেজনা হল অশ্বত্থামার যে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাতুল কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মাকে গভীর ঘুম থেকে জাগালেন—সুপ্তৌ প্রাবোধয়ত্ তৌ তু মাতুলং ভোজমেব চ। সুপ্তোত্থিত দুই বীরকে তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথা জানালেন। জানালেন রাগের কথাও—পিতা দ্রোণাচার্যকে অন্যায়ভাবে মারা হয়েছে, অন্যায়ভাবে ঊরুভঙ্গ করা হয়েছে দুর্যোধনের। তার ওপরে ভীমসেন পদাঘাত করেছেন দুর্যোধনের মাথায়, যিনি একাদশ অক্ষৌহিনী সেনার অধিপতি ছিলেন।
এসব কথা শুনে হার্দিক্য কৃতবর্মার কোনও বিকার হল না, কিন্তু কৃপাচার্য অশ্বত্থামার পরিকল্পনার কথা ভেবে একেবারে বিমূঢ় হয়ে গেলেন। তার পরেই তাঁর মনে হল—এই ক্রুদ্ধ অশ্বত্থামাকে কিছু বোঝানো দরকার। আজ প্রবলপ্রতাপী দুর্যোধনকে ভূমিশয়ান দেখে অশ্বত্থামার যে করুণা হচ্ছে, কৃপাচার্য এই করুণার অংশীদার নন। তিনি সবিস্তারে অশ্বত্থামার কাছে দৈব এবং পুরুষকারের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করে দুর্যোধনের অপব্যবহারগুলি স্মরণ করতে বললেন অশ্বত্থামাকে। কৃপ মনে করেন—যে দুর্যোধন কারও কথা পূর্বে শোনেননি এবং নিজে শত রকম অন্যায় করার পরেও সমস্ত গুরুজন এবং বৃদ্ধবাক্য অনাদর করে অভদ্র ইতরজনের মন্ত্রণায় এই বিরাট যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন, তার প্রতি এত মায়ার কোনও প্রয়োজন নেই এবং তার অভীষ্ট পালনের জন্যও অশ্বত্থামার এত উদ্গ্রীব হয়ে ওঠার কারণ নেই। অশ্বত্থামার এই আকস্মিক পরিবর্তনে কৃপ শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন—আজকে যে অন্যায়-অপনয় আমাদের এসে স্পর্শ করেছে, তার কারণ—চিরটা কাল এই পাপী দুর্যোধনের পিছন পিছন যেতে হয়েছে আমাদের—অনুবর্তামহে যত্তু বয়ং তং পাপ-পূরুষম্।
বৃদ্ধ কৃপাচার্য এতকাল কৌরব রাজসভায় থেকেছেন। মন্ত্রণা দেবার কালে তিনি সব সময় পাশে পেয়েছেন ভীষ্ম-দ্রোণের মতো বিশাল ব্যক্তিদের। আজকে তাঁরা কেউ নেই বটে, কিন্তু কৃপাচার্য কী করে একাকী সিদ্ধান্ত দেবেন। এটা তাঁর অভ্যাসই নয়। তিনি অশ্বত্থামাকে বললেন—এই দুর্যোধনের মতো অন্যায়ী লোকের জন্যই আজকে আমাকে অদ্ভুত বুদ্ধিবিপাকের মধ্যে পড়তে হয়েছে—অনেন তু মমাদ্যাপি ব্যসনেনোপতাপিতা—এখন যে বুদ্ধি মাথায় আসছে, তাতে কোনটা ঠিক আমার নিজের ভাল, তা আমি ঠিক করতে পারছি না।
কৃপ এটা সম্যক অনুভব করছেন যে, অশ্বত্থামার প্রস্তাবটা খুব আকস্মিক এবং এটা তাঁদের এতকালের নৈতিকতার বিরুদ্ধচারী। তিনি এটাও বুঝতে পারছেন যে, তাঁরা একটা ঘোরের মধ্যে দিয়ে চলছেন। কৌরবপক্ষের কেউ বেঁচে নেই। ভগ্নোরু দুর্যোধন ভূমিশয়ান, অথচ সেই ব্যক্তিত্বশালী রাজার করুণ পরিণতি দেখে অশ্বত্থামার মধ্যে এক আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে। নইলে, যে অশ্বত্থামা পিতার মৃত্যুর পরেও এমন অন্যায় প্রতিশোধের কথা ভাবেননি এবং কোনও দিনই দুর্যোধনের অন্যায় কর্মগুলি সমর্থন করেননি, সেই তিনি আজ ঘুমিয়ে থাকা পাণ্ডব-পাঞ্চালদের মারতে চাইছেন। কৃপ বললেন—দেখ, নানা কারণেই আমাদের এখন মাথার ঠিক নেই, আর এমন অবস্থা হলে সুহৃদ-বন্ধুদের কাছে ইতিকর্তব্যতা নিয়ে প্রশ্ন করতে হয়—মুহ্যতা তু মনুষ্যেণ প্রষ্টব্যাঃ সুহৃদো জনাঃ। তাঁরা স্থিরমস্তিষ্কে যে বুদ্ধি দেন, তাতেই মঙ্গল সম্পন্ন হয়।
আসলে কৃপ অশ্বত্থামার এই আকস্মিক আকুল ভাবটুকু মেনে নিতে পারছেন না। এত কাল কুরুসভায় থেকে থেকে তাঁর কেশ পক্ক হয়েছে। সমস্ত ঘটনার সঙ্গেই তিনি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত। কোন মূল থেকে ঘটনারাশি বিবর্তিত হতে হতে আজ এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ পরিণতি ঘটেছে এবং কেনই বা আজ দুর্যোধনের এই পরিণতি, কৃপাচার্য তার মূল অন্বেষণ করতে বলছেন অশ্বত্থামাকে। তিনি নিজেকে অশ্বত্থামার সঙ্গে জড়িয়ে বললেন—দেখ, আমরা খানিকটা মোহগ্রস্ত অবস্থায় আছি। চলো, আমরা সুহৃদ-বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করি। তাঁরা সমস্ত ঘটনার মূল কারণ কী, তা স্থির বুদ্ধিতে বিচার করে আমাদের সিদ্ধান্ত দেবেন। আমরা যেতে পারি প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্রের কাছে, যেতে পারি দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীর কাছে, অথবা যেতে পারি মহামতি বিদুরের কাছে। তাঁরা এ অবস্থায় যা কার্যনির্ণয় করবেন, আমরা তাই করব—তদস্মাভিঃ পুনঃ কাৰ্য্যমিতি মে নৈষ্ঠিকী মতিঃ। যারা পুরুষকারের দ্বারা নিজের কাজ সিদ্ধ করতে পারে না, দৈব কিন্তু তাদের আরও বিপদে ফেলে—সেটা মনে রেখো।
অশ্বত্থামা কৃপের কোনও ভাল কথা শুনতে চাইলেন না। কাউকে তিনি জিজ্ঞাসা করার পক্ষপাতী নন। তিনি বললেন—পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষই একটা ব্যাপার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, সেটা হল নিজের বুদ্ধি—তুষ্যন্তি চ পৃথক্ সর্বে প্রজ্ঞয়া তে স্বয়া স্বয়া। অতএব আমার বুদ্ধি যখন এই কাজ করতে বলছে, আমি তবে তাই করব। আমি বামুন হয়ে ক্ষত্রিয়ের কাজ করে যাচ্ছি, অতএব আমার পিতার মৃত্যুর প্রতিশোধ গ্রহণ করাটাই উপযুক্ত কর্ম, নইলে লোকের কাছে আমি বলব কী—পিতরং নিহতং দৃষ্ট্বা কিং নু বক্ষ্যামি সংসদি। এটা অবশ্যই ঠিক যে, পিতা দ্রোণের অন্যায়প্রযুক্ত অভাবিত মৃত্যু তাঁর অন্তরের মধ্যে তুষের আগুনের মতো জ্বলছিল, কিন্তু দুর্যোধনের করুণ অবস্থা নৈমিত্তিকভাবে তাঁর ক্রোধাগ্নি উদ্দীপিত করেছে। নিজের মধ্যে চিরন্তন বৈরিতা পুষ্ট করে রাখা যাঁর স্বভাব, সেই দুর্যোধন ভগ্ন অবস্থাতেও অশ্বত্থামাকে সেনাপতিত্বে অভিষিক্ত করেছেন—এই দুরূহ সৌভাগ্য বহন করতে গিয়েই আজ যেন তিনি দুর্যোধনের সব অন্যায় ভুলে যাচ্ছেন। কৃপাচার্য সেই মূলটাই স্মরণ করাচ্ছেন অশ্বত্থামাকে।
অশ্বত্থামা অবশ্য কিছুই মানলেন না। তিনি এই অন্যায় প্রতিশোধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জেনে কৃপাচার্য খানিকটা কালক্ষেপ করতে চাইলেন, অর্থাৎ যদি এর মধ্যে অশ্বত্থামার মাথা ঠান্ডা হয় এবং এই অন্যায় নিরুদ্ধ হয়। তিনি বললেন—বেশ তো, ভাল কথা, তুমি প্রতিশোধ নিয়ো। কিন্তু এই রাতটা অন্তত যেতে দাও। মুক্ত করো এই লৌহবর্ম, এই রাতটুকু তুমি বিশ্রাম নাও। তারপর সকাল হলে আমি এবং কৃতবর্মা তোমার সহগামী হব—অহং ত্বামনুযাস্যামি কৃতবর্মা চ সাত্বতঃ। কৃপাচার্য একটু স্তুতিবাদও শোনালেন অশ্বত্থামাকে। বললেন—কে তোমাকে যুদ্ধে আটকাবে। তবে কী, সামান্য একটু বিশ্রাম নিলে শক্তিটা আরও বেশি পাবে। তা ছাড়া তোমার অস্ত্রশস্ত্র তো আর খুব সাধারণ অস্ত্র নয়, সব দিব্য অস্ত্র। আমার অস্ত্রও তাই এবং কৃতবর্মাও কিছু কম নয়। অতএব আজকে রাতটা তুমি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করো, ঘুমোও ভাল করে—বিশ্রমস্ব ত্বমব্যগ্রঃ স্বপ চেমাং নিশাং সুখ্ম। আর কালকে দেখো, পাণ্ডব-পাঞ্চালদের যুদ্ধে না হারিয়ে আমি কিংবা কৃতবর্মা কেউ যুদ্ধ থেকে ফিরব না—ন চাহং সমরে তাত কৃতবর্মা ন চৈব হ। কিন্তু আজ তুমি ঘুমোও।
কৃপ বোধ হয় চাইছিলেন—অন্তত কিছু না হোক, সোজাসুজি যুদ্ধ করে প্রাণ দেওয়াও ভাল। কিন্তু অশ্বত্থামা কৃপের কথা শুনে আরও রেগে বললেন—কীসের ঘুম, কীসের সুখ? যে দুঃখার্ত, যে ক্রোধী, যে অর্থ লাভের চিন্তা করে আর যে নাকি কামুক, তারা কখনও ঘুমোয় না। অশ্বত্থামা এক এক করে পাণ্ডবদের তথাকথিত অন্যায়-যুদ্ধের প্রসঙ্গ তুললেন—শিখণ্ডীর মাধ্যমে ভীষ্মের পতন, কর্ণের মৃত্যু, দুর্যোধনের ঊরুভঙ্গ এবং বিশেষভাবে পিতা দ্রোণকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, তাতে অশ্বত্থামা যেন স্থির থাকতে পারছেন না—যথা চ নিহতঃ পাপৈঃ পিতা মম বিশেষতঃ। অশ্বত্থামা বললেন—আমাকে আজ কেউ রোধ করতে পারবে না। আজ রাত্রেই আমি পাণ্ডব-পাঞ্চালদের শেষ করে তবে ঘুমোব। আমার এই উদ্যত ক্রোধাগ্নি প্রশমিত করার শক্তি কারও নেই—ন তং পশ্যামি লোকে’স্মিন্ যো মাং কোপান্নিবর্তয়েৎ।
এই কথার পরেও কৃপ চেষ্টা করেছেন অশ্বত্থামাকে বোঝাতে। বেশ একটু গালাগালিও দিয়েছেন তাঁকে। বলেছেন—ডাল-তরকারির মধ্যে হাতা ডুবিয়ে রাখলেও সে হাতা যেমন ব্যঞ্জনের সরসতা বোঝে না, তেমনই জড় ব্যক্তি বহুকাল ধরে পণ্ডিতজনের সঙ্গ করলেও, তার কথার মর্ম বুঝতে পারে না। আমি বার বার বলছি, অশ্বত্থামা! তুমি ভেবে কাজ করো, আমার কথা শোনো, পরে যাতে তোমাকে অনুতাপ করতে না হয়—কুরু মে বচনং তাত যেন পশ্চান্ন তপ্স্যসে। একটা কথা মনে রাখো—যে ঘুমিয়ে আছে, তাকে কখনও মেরো না। পাঞ্চালরা সব আজকে যুদ্ধের বর্ম খুলে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। এই ঘনান্ধকার রজনী কত বিশ্বস্ত, সকলে মৃতজনের মতো নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন—বিশ্বস্তা রজনীং সর্বে প্রেতা ইব বিচেতসঃ। আর এই অবস্থায় তুমি তাদের মারবে?
অশ্বত্থামা আবারও পুরনো কথা তুললেন এবং শেষ কথা বললেন—আমি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবই নেব। এই আমার সংকল্প। কথাটা বলেই তিনি রথে ঘোড়া জুতলেন এবং একা রথ ছুটিয়ে দিতে চাইলেন শিবিরের উদ্দেশে—একান্তে যোজয়িত্বাশ্বান্ প্রায়াদভিমুখঃ পরান্। কৃপ এবং কৃতবর্মা দুজনেই বুঝলেন যে, অশ্বত্থামাকে আটকানো যাবে না এবং যা করবার, তা এই অন্ধকার রাত্রেই সম্পন্ন করবেন অশ্বত্থামা। সেদিক থেকে একক অশ্বত্থামার বিপদও অনেক বেশি। অতএব দুজনেই বললেন—হঠাৎ করে তুমি একাই রথ নিয়ে দৌড়োচ্ছ কেন? আমরা একই স্বার্থ বহন করে তিনজনেই একসঙ্গে বেরিয়েছি—একস্বার্থপ্রয়াতৌ স্বস্ত্বয়া সহ নরর্ষভ। কাজেই একযাত্রায় পৃথক ফল হতে পারে না এবং যাই বলে থাকি তাতে তোমার ওপর সহমর্মিতার ক্ষেত্রে আমাদের সন্দেহ কোরো না—নাবাং শঙ্কিতুমর্হসি৷
এতক্ষণ কথা যা বলেছিলেন, তা কৃপই বলেছিলেন। অতএব একথাগুলিও কৃপাচার্যেরই উক্তি, কৃতবর্মা এখানে শ্রোতা-সাক্ষীমাত্র। নিরুপায় কৃপাচার্য কৃতবর্মাকে নিয়ে অশ্বত্থামার পিছন পিছন চললেন—তমন্বগাৎ কৃপো রাজন্ কৃতবর্মা চ সাত্বতঃ! কৃপাচার্য কোনও মানসিকতাতেই অশ্বত্থামার সঙ্গে ছিলেন না, একা ভাগিনেয়কে সহায়তা দেবার জন্য তিনি নিজের ভাবনা থেকে চ্যুত হলেন। আগে বলেছিলাম—কৌরবদের মধ্যে বাস করেও দ্রোণ-কৃপ-অশ্বত্থামার একটা ঘনিষ্ঠ গোষ্টীচেতনা ছিল। অপিচ দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যে কৃপ দ্রোণের মতানুসারী উপগ্ৰহমাত্র ছিলেন, এখন দ্রোণের মৃত্যুর পর তিনি তাঁর পুত্রের ব্যক্তিত্বকেও অতিক্রম করতে পারছেন না। এতকাল অন্যের মতে স্থিত থেকেও কৃপাচার্য ন্যায়ধর্মে স্থিত ছিলেন, কিন্তু আজ অনিচ্ছাসত্ত্বেও পরম প্রিয় ভাগিনেয়র মত অনুবর্তন করে তিনি বিমূঢ় হয়েছেন বটে, কিন্তু অশ্বত্থামার উপগ্রহবৃত্তি ত্যাগ করতে পারলেন না।
সুপ্ত পাণ্ডবশিবিরের দ্বারে কৃপ এবং কৃতবর্মাকে রেখে ভিতরে প্রবেশ করলেন অশ্বত্থামা। যাবার আগে বললেন—আপনারা সম্মুখ সমরেই বহু ক্ষত্রিয়-নিধনে সমর্থ, সেখানে এরা তো সমস্ত যোদ্ধাদের অবশেষ এবং তারা ঘুমিয়ে আছে। শুধু একটাই কথা, এই শিবিরের দ্বার দিয়ে যারা বেরোবে, তাদের একজনও যেন বেঁচে না ফেরে—যথা ন কশ্চিদপি বাং জীবন্ মুচ্যেত মানবঃ। অশ্বত্থামা শিবিরের প্রতিষ্ঠিত দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেন না, কারণ দ্বারদেশে রক্ষী পুরুষেরা ছিল। তিনি প্রবেশ করলেন শিবিরের ফাঁকফোকর দিয়ে। শিবিরে প্রবেশ করার পর অশ্বত্থামার আচরণ হল মহাকালের মতো। একে একে তাঁর হাতে মারা পড়লেন ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী এবং দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র। কালান্তক যমের মতো অশ্বত্থামার বিচরণে, বাধায়, প্রত্যাঘাতে শিবিরের সমস্ত স্তিমিত প্রদীপগুলিও নিবে গেছে। এমন বিমূঢ় অবস্থা হল যে, এ ওকে শত্রু ভেবে অস্ত্রাঘাত করছিল, অথচ সে হয়তো তার অতি কাছের মানুষ। চিৎকার, অন্ধকার, ভয়, ত্রাস মাথায় নিয়ে ছাউনির সৈন্যরা শিবিরের দ্বারদেশ দিয়ে বেরোতে চাইল। কিন্তু যারাই বেরোল, তারা প্রত্যেকে কাটা পড়ল কৃপাচার্যের হাতে অথবা কৃতবর্মার হাতে—কৃতবর্মা কৃপশ্চৈব দ্বারদেশে নিজঘ্নতুঃ। তাদের কারও হাতে অস্ত্র নেই, গায়ে বর্ম নেই, সবাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আসন্ন বিপদে হাত জোড় করে শিবির থেকে বেরোচ্ছিল, কিন্তু কেউ তারা কৃপ কিংবা কৃতবর্মার অসিধারা থেকে মুক্ত হল না—নামুচ্যত তয়োঃ কশ্চিন্নিষ্ক্রান্তঃ শিবিরাদ্ বহিঃ।
এই মুহূর্তে মহাভারতের কবি কৃতবর্মার বিশেষণ হিসেবে যে শব্দটা ব্যবহার করেছেন, সে শব্দটা কৃপাচার্যের বিরুদ্ধে সলজ্জে ব্যবহার করতে পারেননি। তিনি বলেছেন—দুর্মতি কৃতবর্মা এবং কৃপের খড়্গাঘাত থেকে কেউ তারা বাঁচল না—কৃপস্য চ মহারাজ হার্দিক্যস্য চ দুর্মতেঃ। কৃতবর্মা কৃষ্ণের নারায়ণী সেনার সঙ্গে কৌরবপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তিনি ‘মার্সেনারী’ যোদ্ধার একজন। কাজেই যুদ্ধের সময় তাঁর মায়াদয়া, আত্মভাব কিছুই নেই। কিন্তু কৃপ! যে কৃপ এতকাল ভীষ্ম-দ্রোণাচার্যের সঙ্গে সমান মর্যাদায় বসেছেন, সেই কৃপ এখন ব্যাসের দৃষ্টিতে দুর্মতি কৃতবর্মার সঙ্গে একাত্মক। শুধু অশ্বত্থামা যেমন বলেছিলেন, তাই পালন করা নয়—দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে পলায়মান নিরীহ সৈনিকদের শুধু হত্যা করাই নয়, অশ্বত্থামার সুবিধা এবং অধিক সন্তোষ বিধানের জন্য—ভূয়শ্চৈব চিকীর্ষন্তৌ দ্রোণপুত্রস্য তৌ সুখম্-কৃপের মতো ব্যক্তি কৃতবর্মার সহায়তায় সেই সুপ্ত শিবিরের তিন দিকে আগুন ধরিয়ে দিলেন। তাতে অশ্বত্থামার বড় সুবিধে হল, অন্ধকার কেটে যাওয়ায় তিনি দ্বিগুণ বিক্রমে গণহত্যা চালিয়ে গেলেন।
অশ্বত্থামার সংকল্প-পূরণ হওয়ার পর তিনি পরম উল্লাসে মিলিত হলেন কৃপ এবং কৃতবর্মার সঙ্গে। ভাগ্যিস সে শিবিরে পাণ্ডবরা সেদিন ছিলেন না। থাকলে অশ্বত্থামা-কৃপদের অথবা পাণ্ডবদের কী অবস্থা হত, তা সহজে অনুমেয় নয়। সুপ্ত শিবির ধ্বংস করার পর কৃপাচার্য অশ্বত্থামার অনুবর্তী হয়েই ভূলুণ্ঠিত দুর্যোধনের সামনে এলেন। তাঁর মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে তখন। চিরদর্পী দুর্যোধনকে দেখে কৃপাচার্যের মনে খুব ব্যথা লাগল। বললেন—এখন দেখছি, দৈবের থেকে বড় কিছু নেই। নইলে একাদশ অক্ষৌহিণী সেনার অধিপতি এইভাবে রক্তমাখা অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকেন। আর এই যে সুবিশাল গদাটি, কোনও যুদ্ধে যে গদা হাত থেতে নামাননি দুর্যোধন, সেই গদা তাঁর কাছটিতে পড়ে আছে শয়ানা বধূটির মতো। সেই দুর্যোধন, যিনি সমস্ত যোদ্ধাদের মাথার ওপরে বসে ছিলেন, তিনি আজ মুমূর্ষ অবস্থায় ধুলো খাচ্ছেন শুয়ে শুয়ে। যাঁকে দেখলে পরে বড় বড় রাজারা ভয়ে মাথা নোয়াত, আজ তাঁর মৃত শরীরের জন্য অপেক্ষা করে আছে মাংসাশী পশুর দল—উপাসতে চ তং হ্যদ্য ক্ৰব্যাদ্যা মাংসহেতবঃ।
তখনও দুর্যোধনের জ্ঞান ছিল। অতএব অশ্বত্থামা তাঁকে মরণঘুম থেকে জাগিয়ে পাঞ্চালদের সমূলে বিনাশের খবর তথা পাণ্ডবদের শেষ বংশলুপ্তির সুখ-সংবাদ দিলেন দুর্যোধনকে। দুর্যোধন ভূলুণ্ঠিত অবস্থাতেও মাথাটি ঈষৎ তুলে অশ্বত্থামাকে বললেন—মহামতি ভীষ্ম, কর্ণ, এমনকী তোমার পিতাও যা পারেননি, আজ কৃপ আর কৃতবর্মার সঙ্গে সেই কাজটি তুমি করেছ, ভাই—যত্ত্বয়া কৃপভোজাভ্যাং সহিতেনাদ্য মে কৃতঃ। তোমাদের মঙ্গল হোক, আজ মরেও আমার সুখ।
উপগ্রহবৃত্তিতে যে কৃপাচার্য অন্যায়ী দুর্যোধনকে শোধরাবার চেষ্টা করেছেন, সেই অন্যায়ের সঙ্গে কৃপাচার্যের নাম জড়িয়ে গেল তাঁর দুর্ভাগ্যবশত। একথা বুঝি যে, এই অন্যায়কর্মে তাঁর সায় ছিল না, যথাসাধ্য তিনি বারণও করার চেষ্টা করেছেন অশ্বত্থামাকে, কিন্তু ঘটনার চক্ৰচাল এমনই যে, শেষ পর্যন্ত তিনি পরম প্রিয় ভাগিনেয়টিকে নিঃসঙ্গ করে দিতে পারেননি। অথবা পারেননি তাঁরও ব্যক্তিত্ব অতিক্রম করতে। অশ্বত্থামাকে এই ঘটনার ফল ভোগ করতে হয়েছিল। চরম অপমান সহ্য করে তাঁকে নির্বাসনে যেতে হয়েছিল, কিন্তু এই সম্পূর্ণ ঘটনার মধ্যে কৃপাচার্য যে নিতান্ত অসহায় ছিলেন—সেকথা পাণ্ডবরা সবাই বুঝেছিলেন। এমনকী অশ্বত্থামা যে উত্তরার গর্ভ লক্ষ্য করে পাণ্ডবদের শেষ সন্তানবীজ ধ্বংস করার জন্য অস্ত্রমোচন করেছিলেন, তখনও কৃষ্ণ বলেছিলেন-আমার তপস্যায় তোমার অস্ত্রহত সন্তানও বেঁচে উঠবে, সে বড় হবে এবং সমরকালে সে শারদ্বত কৃপের কাছে অস্ত্রশিক্ষাও লাভ করবে—কৃপাচ্ছারদ্বতাচ্ছূরঃ সর্বাস্ত্রাণ্যুপলপ্স্যতে।
কৃষ্ণের এই কথা থেকেই বোঝা যায় যে, কৃপাচার্য সাময়িকভাবে ভুল করলেও পাণ্ডবরা তাঁদের প্রথম গুরুর হৃদয় বুঝতেন। অবশ্য পাণ্ডবরা যাই বুঝুন, কৃপ কিন্তু নিজেই বুঝতে পারেননি যে, পাণ্ডবরা তাঁকে কী চোখে দেখেন। রাত্রির দুর্ঘটনায় পাণ্ডবদের মনে যে ক্রোধ তৈরি হবে, সেই ক্রোধাগ্নি থেকে বাঁচবার জন্য কৃপ এবং কৃতবর্মা অশ্বত্থামার সঙ্গেই পালাচ্ছিলেন। পথে পাণ্ডবরা অশ্বত্থামাকে ধরে ফেলায় কৃতবর্মা তাঁকে ফেলে চলে যান এবং অপেক্ষা করতে থাকেন। পরে মণিহীন, চরম অপমানিত অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য এবং কৃতবর্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে এগোতে থাকেন গঙ্গার দিকে। ঠিক এই পথেই প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে দেখা হয় কৃপাচার্যের। অশ্বত্থামা এবং কৃতবর্মা তাঁর সঙ্গে।
কুরুক্ষেত্র-যুদ্ধের সর্বশেষ পতনের সংবাদ পেতে ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী—সবাই তখন যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে চলেছেন। কৃপাচার্যের সঙ্গে দেখা হতেই তিনি বললেন—সব শেষ মহারাজ! দুর্যোধনের সমস্ত বাহিনীর মধ্যে আমরা এই তিনজনেই মাত্র বেঁচে আছি। আর সব শেষ—দুর্যোধন-বলান্মুক্তা বয়মেব ত্রয়ো রথাঃ। এর পরে পুত্রহারা ক্ষত্রিয় জনক-জননীকে যা বলে সেকালের দিনে সান্ত্বনা দিত লোকে, কৃপাচার্য সেই সম্মুখ-সমরে মৃত্যুবরণ করার মাহাত্ম্য স্মরণ করিয়ে দুর্যোধনের প্রভূত প্রশংসা করলেন এবং এই প্রশংসা বেশি করে শোনালেন গান্ধারীকে। আশ্চর্য হল, এই সপ্রশংস উচ্চারণের পরে কৃপাচার্য গান্ধারীকে বললেন—মহারানি! আমরা কিন্তু কৌরবদের শত্রু পাণ্ডবদের ছাড়িনি, তাদেরও বিজয়োৎসব ম্লান করে দিয়েছি আমরা—ন চাপি শত্রবস্তেষামৃধ্যন্তে রাজ্ঞি পাণ্ডবাঃ। আমরা যেই ভীমের অন্যায় গদাঘাতে দুর্যোধনকে ধূলিপতিত হতে দেখেছি, তার পরেই তাদের সুখসুপ্ত শিবিরে প্রবেশ করে দ্রুপদের ছেলেদের এবং দ্রৌপদীর ছেলেদের শেষ করে দিয়েছি এবং তা করেছি এই অশ্বত্থামার সেনাপতিত্বে—শৃণু যৎ কৃতমস্মাভিরশ্বত্থাম-পুরোগমৈঃ।
এই সোৎসাহ ভাষণে বৃদ্ধ কৃপাচার্যের কতটা মর্যাদা বাড়ল, আর দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীই বা এই রাত্রিবধের চক্রান্তে কতটা খুশি হলেন, তা মহাভারতের কবি লেখেননি, তবে এই কথায় বোঝা যায়—কৃপাচার্য এখনও অশ্বত্থামার ব্যক্তিত্বে আচ্ছন্ন আছেন। গান্ধারীকে তাঁর পুত্রবধের প্রতিশোধ-গ্রহণের সংবাদ দিয়েই কৃপ বলেছেন—আমরা পালিয়ে যাচ্ছি রানি। কেননা, পুত্রবধের প্রতিশোধস্পৃহায় পাণ্ডবরা খুব শীঘ্রই আমাদের পিছনে তাড়া করবে এবং তাদের সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নেই—প্রাদ্ৰবাম রণে স্থাতুং ন হি শক্যামহে ত্রয়ঃ। পাণ্ডবদের শিবিরে আমরা যে অভিযান চালিয়েছি এবং তাতে যা ক্ষতি হয়েছে তাদের, তার পরে আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই আমাদের, তারা আসবেই। আপনি ভাল থাকুন, শোক করবেন না কোনও। ভাল থাকুন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র। আমাদের আজ্ঞা দিন, আমরা পালাব—অনুজানীহি নো রাজ্ঞি মা চ শোকে মনঃ কৃথাঃ।
কৃপ অন্তর্যন্ত্রণায় ভুগছেন, তাই সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করলেন গান্ধারীর কাছে। বস্তুত তিনি জানেনও না যে, পাণ্ডবরা তাঁদের গুরু কৃপাচার্যকে কোনও ভাবেই দায়ী করেননি। পথ চলতে চলতে সেটা বুঝি উপলব্ধিও করলেন কৃপাচার্য। কোনও দিন তো তিনি পাণ্ডবদের অমঙ্গল চাননি, সাময়িকভাবে তিনি অশ্বত্থামার দুর্মন্ত্রণায় আচ্ছন্ন হয়েছিলেন বটে, কিন্তু সেটা হার্দিক সত্য নয়। পাণ্ডবদের হাতে অশ্বত্থামার শাস্তি হবার পরেও কেউ যখন তাঁকে ধরতে এল না এবং অশ্বত্থামাও যখন প্রায়শ্চিত্ত ভোগ করার জন্য ব্যাসের আশ্রমের দিকে রওনা দিলেন, তখন এই বৃদ্ধও বুঝি আবিষ্কার করলেন নিজেকে। অশ্বত্থামা চলে গেলেন, কৃতবর্মাও চলে গেলেন স্বস্থানে দ্বারকায়। সঙ্গে সঙ্গে কৃপও ভাবলেন নিশ্চয়—কেনই বা তিনি ফিরবেন না হস্তিনায়! যেখানে তিনি শিশুকাল থেকে আজ বৃদ্ধ হয়েছেন, সেই প্রিয় আবাস ছেড়ে তিনি কোথায় যাবেন। কাজেই ক্লান্ত পদক্ষেপ আবার তিনি নির্দিষ্ট করলেন হস্তিনাপুরীর দিকে—জগাম হাস্তিনপুরং কৃপঃ শারদ্বতস্তদা।
কৃপাচার্য হস্তিনাপুরে ফিরলেন বটে, কিন্তু তাঁর খবর আর তেমন করে পাই না আমরা। হয়তো তিনি খানিকটা নিশ্চেষ্ট, নির্বিকার হয়ে গিয়েছিলেন, হয়তো বা থাকলেনও একটু দূরে দূরেই। পাণ্ডবদের রাজত্বকালে তাঁকে রাজসভাতেও বসতে দেখিনি, অথবা তাঁকে দেখিনি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সন্নিকটে কোনও স্থানে, কোনও মন্ত্রণায়, কোনও যন্ত্রণায়ও তাঁকে দেখিনি। এমনকী যুধিষ্ঠিরের অশ্বমেধকালে যখন আমরা কৃপের অন্যায়কর্ম-সহচারী কৃতবর্মাকেও ভীমের কাছে অভ্যর্থনা লাভ করতে দেখেছি, কিন্তু কৃপাচার্যকে কোথাও দেখিনি। একেবারে মহাভারতের শেষ পর্বে যখন যুধিষ্ঠির সপরিবারে মহাপ্রস্থানে বেরোচ্ছেন, তখন কৃপাচার্যকে দেখছি আকস্মিকভাবে। মহাপ্রস্থানের সময় কুমার পরীক্ষিৎকে রাজ্য দিয়ে তিনি কৃপাচার্যকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বলেছেন—এই আপনার শেষ শিষ্যকে আপনার হাতে তুলে দিলাম, আপনি দেখে রাখবেন—শিষ্যং পরিক্ষিতং তস্মৈ দদৌ ভরতসত্তমঃ। কৃপাচার্য পাণ্ডবদেরও গুরু ছিলেন, তিনি শেষও করলেন পাণ্ডবদের বংশগুরু হিসেবে।
আমি বলি—ঠিক এইখানেই কৃপাচার্যের চিরজীবিতার রহস্য রয়ে গেছে যা বুঝতে হবে আজকের দিনের আলোকে। চিরন্তন শ্লোকপ্রবাদ—অশ্বত্থামা, বলি, ব্যাস, হনুমান, বিভীষণ, পরশুরাম এবং কৃপাচার্য চিরজীবী—যাঁরা কেউ মরেননি। এখানে অন্যের কথা থাক। কিন্তু কৃপের কথা যদি বলি, তা হলে বলতে হবে—দেখুন, কৃপ কোনও অসাধারণ ব্যক্তি নন। ভীষ্ম-দ্রোণাচার্যের মতো অমানুষী শক্তি কিংবা অস্ত্ৰক্ষমতা কোনওটাই তাঁর নেই, তিনি ব্যাসের মতো মহাকবিও নন, ঋষিও নন। বিদুরের মতো মহাপ্রাণও তিনি নন। অথচ তিনি চিরজীবী।
কৃপাচার্যের এই চিরজীবিতার কারণ যদি মহাভারতের ভাবনাতেই ভাবতে হয়—কেননা তাই ভাবা উচিত—তা হলে একটাই কথা বলতে হবে। সেটা হল—সমগ্র মহাভারত জুড়ে কৃপাচার্যের অবস্থান। কোনও অলৌকিক ঐশ-শক্তিতে তিনি অমর, এমন হদিশ মহাভারতে কোথাও নেই এবং তিনি মরণের ভয়ও পেয়েছেন একাধিকবার, মরণের ভয়ে তিনি পালিয়েও গিয়েছিলেন। কিন্তু যেটা গ্রহণযোগ্য যুক্তি, তা হল—সেই শিশুকালে হস্তিনাপুরের মহারাজ শান্তনু তাঁকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। সেই থেকে কুরুবাড়ির সমস্ত সুখে-দুঃখে, আনন্দে-বিপদে, তিরস্কারে-পুরস্কারে সব সময়েই তিনি আছেন। হয়তো খুব প্রগাঢ়ভাবে, মহান একাত্মতায় তিনি কারও সঙ্গেই নেই, কিন্তু তিনি আছেন। সবচেয়ে বড় কথা, কুরুক্ষেত্রের বিশাল যুদ্ধে যেখানে সব ধ্বংস হল, সেখানেও তিনি অক্ষত রইলেন। ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রের মৃত্যুর কথা লিখলেন, বিদুরের মৃত্যুর কথা লিখলেন, এমনকী মৌষল-মহাপ্রস্থানিকে ভগবত্তার চিহ্নে চিহ্নিত কৃষ্ণ এবং পাণ্ডব পরিবারেরও তিরোভাব ঘটালেন, কিন্তু কৃপের মৃত্যুর কথা তিনি লিখতে পারলেন না। কুরুবংশবীজ পরীক্ষিতের সঙ্গে কৃপাচার্য যুক্ত হয়ে রইলেন শেষ আচার্য হিসেবে এবং এই যোগের ফলেই মহাভারত শেষ হয়ে গেল, কিন্তু কৃপ শেষ হলেন না। মহাকাব্যের এই বিশাল ‘প্যানোরমা’র মধ্যেও মহাকাল যাঁকে গ্রাস করল না, তাঁর মাথায় চিরজীবিতার প্রাবাদিক বরটুকু তো জুটবেই, নইলে ভীষ্ম-দ্রোণের সঙ্গে একাসনে তিনি বসবেন কোন লজ্জায়!