ভীষ্ম – ১

॥ ১ ॥

সংসারধর্মে তিতিবিরক্ত বীতশ্রদ্ধ একটি মানুষের সঙ্গে আমার কথা হচ্ছিল। তিনি বলছিলেন—আমি যদি ভীষ্মের মতো ইচ্ছামৃত্যু হতাম, তা হলে এখনই আমি মৃত্যুবরণ করতাম। যা দুঃখকষ্ট সইলাম এতদিন ধরে, যত আমার ভোগান্তি হল, তার জন্য কোনও সহানুভূতি তো পেলামই না, বরং উলটে নানা কটু কথা শুনি। কাজেই মরে যাওয়াটা যদি আমার হাতের মুঠোয় থাকত, তা হলে এখনই মরে যেতাম, মশাই!

বুঝলাম, ভদ্রলোকের সাংসারিক জ্বালাযন্ত্রণা প্রশ্নাতীত। সাময়িক কোনও উদ্দীপনা-উত্তেজনায় সে কষ্ট হয়তো আরও বেড়েছে। ভদ্রলোক সুইসাইড করতে চান না, কিন্তু ইচ্ছামৃত্যুর মতো নিশ্চিন্ত কোনও মসৃণ মরণ যদি তাঁর হাতে থাকত, তবে এইরকমই কোনও উত্তেজনার দিনে মরণকে শ্যাম-সমান বলে ডেকে নিতেন হয়তো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম—আপনার বয়স কত, মশাই? ভদ্রলোক বললেন—এই ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ। আমি বললাম—ইচ্ছামৃত্যু ব্যাপারটা বর না অভিশাপ, অনুগ্রহ না শাস্তি, সেটা বোঝা কিন্তু অত সহজ নয়। অথবা ইচ্ছামৃত্যু হাতের মুঠোয় থাকলে আপনি সত্যি হয়তো মরার কথা ভাবতেনও না, যেমন ভীষ্মও ভাবেননি এবং সেই অবস্থায় ইচ্ছামৃত্যু ব্যাপারটা কিন্তু সমাধানের থেকে সমস্যাই বেশি তৈরি করবে, যেমন ভীষ্মেরও করেছিল।

আমি আধুনিক কায়দায় একটু ‘ডাটা’ দিয়ে বললাম—আচ্ছা! কতকগুলি চূড়ান্ত সময়ের কথা স্মরণ করুন। পিতা শান্তনু যেদিন ভীষ্মের মতো উপযুক্ত পুত্র এবং উপযুক্ত উত্তরাধিকারী থাকা সত্ত্বেও সত্যবতীকে বিবাহ করতে চাইলেন এবং তাও চাইলেন ভীষ্মের মূল্যে, সেদিন নিশ্চয়ই ভীষ্মের মরতে ইচ্ছে হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তখনও তিনি ইচ্ছামৃত্যুর বর লাভ করেননি। কিন্তু ধরুন, যেদিন শান্তনুপুত্র চিত্রাঙ্গদ এবং বিচিত্রবীর্য মারা যাবার পর রাজমাতা সত্যবতী বিচিত্রবীর্যের বিধবা বউদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করার জন্য ভীষ্মকে অনুরোধ করলেন, সেদিন নিশ্চয়ই তাঁর মরতে ইচ্ছে হয়েছিল। আপন পিতার বিবাহ-কণ্ডূয়নের কারণে যাঁকে রাজ্য ত্যাগ করতে হল, সত্যবতীর পিতার শর্ত মেনে যেদিন তাঁকে যৌবনের সমস্ত সুখস্বপ্ন চুরমার করে দিতে হল, আজ তাঁকে বিবাহের অনুরোধ শুনতে হচ্ছে, পুত্রলাভের বায়না শুনতে হচ্ছে। তাও কার মুখে? যে সত্যবতীর জন্য তাঁকে এই ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছিল, সেই সত্যবতীই আজ স্বামী-পুত্র হারিয়ে নিরূপায় অবস্থায় বিখ্যাত ভরত-কুরুবংশের উত্তরাধিকার রক্ষার জন্য ভীষ্মকেই অনুরোধ করছেন। ভাগ্যের কী বিচিত্র পরিহাস! অথচ এই বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজা হতে পারতেন ভীষ্মই। আমার জিজ্ঞাসা হয়, সত্যবতীর এই অনুরোধের সময় ভীষ্ম কি তাঁর ইচ্ছামৃত্যুর বরটুকু ব্যবহার করে চরম শোধ নিতে পারতেন না সত্যবতীর ওপর।

বলতে পারেন, এ সব মান-অভিমানের মাদকতা নিয়ে মৃত্যুবরণ করা যায় না। মৃত্যুর জন্য চাই সংসারের জ্বালাযন্ত্রণা, অপমান যা একটি বড় মানুষকে পদে পদে দীর্ণক্লিষ্ট করে তোলে। আমার সম্মুখস্থিত ভদ্রলোকেরও তো সেই ক্লিষ্ট অবস্থা। কিন্তু ভদ্রলোককে আমি নিরাশ করতে বাধ্য হলাম। বললাম—দেখুন, ভীষ্ম পাণ্ডবদের রাজ্যের অধিকার দিতে বলেছিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। ধৃতরাষ্ট্র দেননি। তিনি ভরতবংশের সুচিরধৃত রাজ্যকে খণ্ডিত করে পাণ্ডবদের বাসস্থান দিয়েছিলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। আমাদের জিজ্ঞাসা—ভীষ্মের মনের তখন কী অবস্থা হয়েছিল? মরতে ইচ্ছে হয়নি তো?

ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় পাশাখেলার যে আসর বসেছিল, কুলবধূ দ্রৌপদীর যে ঘোর অপমান হয়েছিল, তাতে পাণ্ডব-কৌরবের এক পিতামহ কী মানসিক অবস্থায় ছিলেন? তাঁর মরতে ইচ্ছে হয়নি তো?

যেদিন দুর্যোধনের অনন্ত প্রশ্রয় লাভ করে কর্ণ ভীষ্মকে বলেছিলেন—ইনি কুরুদের ঘরে খান, আর মঙ্গল চান পাণ্ডবদের—সেদিন মহামতি ভীষ্মের কেমন লেগেছিল? কর্ণের এই কথার প্রতিবাদও কেউ করেননি কুরুসভায়। ভীষ্মের কি মরতে ইচ্ছে করেনি সেদিন? দ্যুতক্রীড়ায় পরাজিত পাণ্ডবদের বনবাস হল যেদিন, সেদিন এই ভীষ্মের মানসিক যন্ত্রণা কোন চূড়ান্ত বিন্দুতে পৌঁছেছিল? তাঁর কি বেঁচে থাকতে ইচ্ছে হয়েছিল?

বনবাস, অজ্ঞাতবাসের পর ভীষ্ম যে কতবার ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্যাধিকার ফিরিয়ে দিতে, ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধন তাঁর কথা কানেও তোলেননি। কেমন লেগেছিল ভীষ্মের? তাঁর কি আরও বেঁচে থাকার ইচ্ছে ছিল? তারপর অন্তিম পর্যায়ে সেই ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল। সে যুদ্ধে ভাই ভাইকে মারছে, শিষ্য গুরুকে মারছে, পিতৃস্থানীয়রা পুত্রস্থানীয়দের মারছে, নাতি-ঠাকুরদা পরস্পরে একে অন্যের শরীরে অস্ত্রাঘাত করছে। যুদ্ধের এই ভয়ংকর পরিণতির কথা ভেবে কেমন লেগেছিল ভীষ্মের? তাঁর কি খুব বাঁচতে ইচ্ছে করেছিল?

মৃত্যুকামী ভদ্রলোককে বলেছিলাম—এইরকম আরও কিছু ঘটনা আমরা ভীষ্মের জীবন থেকে উল্লেখ করতে পারি। স্বাভাবিক এবং নির্দিষ্ট আয়ু নিয়ে তিনি যদি বাঁচতেন তবে অনেক আগেই তাঁর মৃত্যু হতে পারত। কিন্তু ইচ্ছামৃত্যু যার হাতের মুঠোয় থাকে, সে কিছুতেই নিজে মরতে চায় না। এক একটি ঘটনা দুর্ঘটনা ঘটে, ঘটে যায়, আর তখনই তার মনে হয়—এর পরের ঘটনাটি বুঝি আশাপ্রদ হলেও হতে পারে। এমন দুর্ঘটনা, এমন অন্যায় বোধহয় আর হবে না কোনও দিন। অন্যায় তবু ঘটেই চলে, দুর্ঘটনাও ঘটে চলে তারই পূর্বনির্দিষ্ট পথ ধরে। যন্ত্রণায় দীর্ণ শীর্ণ বৃদ্ধ তবু বেঁচে থাকেন সমস্ত শুভৈষণা নিয়ে। ভাবেন—আর নিশ্চয় এমনটি হবে না, সমাধান এবার আসবে।

বস্তুত সবচেয়ে খারাপ দুর্ঘটনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না ইচ্ছামরণ ভীষ্মের মৃত্যু ঘটায়, ভীষ্ম ততক্ষণই মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বসেই থাকেন। স্বেচ্ছামৃত্যুর স্বাধীন উপায় কিছুতেই তাঁর পক্ষে প্রয়োগ করা সম্ভব হয় না। নব নব আশা দুরাশার নব নব বন্ধন শ্রান্ত ক্লান্ত বৃদ্ধকে বাঁচতে সাহায্য করে এবং কী আশ্চর্য, যতক্ষণ না মৃত্যুর সেই বলাৎকার ঘনিয়ে আসে, ততক্ষণ ভীষ্ম বেঁচেই থাকেন। কাজেই ইচ্ছামৃত্যু হাতের মুঠোয় থাকলেও সেই ইচ্ছামৃত্যুকে কাজে লাগিয়ে যখন তখন মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়া যেখানে ভীষ্মের মতো মহামতি পুরুষের পক্ষেই সম্ভব হয় না, সেখানে অন্য সাধারণ জনের কথা কী বলব? এবং ঠিক এই নিরিখেই ভীষ্মের ইচ্ছামৃত্যু সত্যিই কোনও মধুর আশীর্বাদ কি না, তা আমাদের ভাবনার বিষয় হয়ে ওঠে।

অথচ এই আশীর্বাদ ভীষ্মকে দিয়েছিলেন তাঁর পিতা। পিতা শান্তনু। ভীষ্মের আত্মত্যাগে পরম প্রীত হয়ে, পিতার কারণে পুত্রের অসাধারণ ত্যাগ প্রতিজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে পিতা শান্তনু ভীষ্মকে স্বেচ্ছামৃত্যুর বর দিয়েছিলেন এবং সেই বরই তাঁর জীবনে এমন এক কাঁটা হয়ে রইল যে, জীবনের বিভিন্ন সময়ে—যখন তাঁর মরা উচিত ছিল, তখনও তিনি বেঁচে রইলেন ভরত-কুরুবংশের সাক্ষি-চৈতন্যের মতো, বিবেকের মতো। আপন পিতার কামনাবৃত্তি তুষ্ট করার জন্য পুত্রের এই বেঁচে থাকাটা যে কত কষ্টকর, তা মহারাজ শান্তনু কী করে বুঝবেন! অথচ যেদিন তিনি এই পুত্রের জীবনের জন্য এক রমণীর পায়ে ধরেছিলেন প্রায়, সেদিন তো এমন করে তিনি ভাবেননি যে, তাঁর পরম প্রিয় জ্যেষ্ঠ পুত্র অন্তহীন শুষ্ক কতকগুলি দায়িত্ব পালন করার জন্য একটি লম্বা জীবন নিয়ে বেঁচে থাকবেন শুধু। অথবা এর নামও জীবন, পৃথিবীর বৃদ্ধতম মানুষের জীবন-প্রতীক এক করুণ জীবন।