ধৃতরাষ্ট্র – ১১

॥ ১১ ॥

হস্তিনাপুরে পাঞ্চাল, যাদব, পাণ্ডবদের একক দূত এসে উপস্থিত হলেন। তিনি দ্রুপদের পুরোহিত স্পষ্টবক্তা এক ব্রাহ্মণ। তিনি এসে নরমে-গরমে পাণ্ডবদের বক্তব্য এবং শক্তিমত্তার কথা শোনালেন, ধৃতরাষ্ট্রকে। প্রথমে তো আইনের কথা উঠল। তিনি বললেন—যদি উত্তরাধিকারের কথাও বলেন, তবে পাণ্ডু এবং ধৃতরাষ্ট্রের আধাআধি সম্পত্তি পাবার কথা। সেদিক দিয়ে দেখলে পাণ্ডুর ছেলেরা তো কিছুই পেলেন না, সবটাই বেদখল করে রাখলেন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা—ন প্রাপ্তং পৈতৃকং দ্রব্যং ধাতর্রাষ্ট্রেণ সংবৃতম্।

আইনের কথা সেরে দ্রুপদের পুরোহিত এবার অন্যত্র বঞ্চনার কথা তুলে বললেন—আপনারা তাঁদের সঙ্গে কপট পাশা খেলে রাজ্য কেড়ে নিয়েছেন। তারপর বনবাসেও পাঠিয়েছেন। সস্ত্রীক বনবাস এবং অজ্ঞাতবাসেও তা দের কষ্টের কোনও সীমা ছিল না। কিন্তু আপনার ছেলেদের যে সব পাপের কথা তাঁরা অতীত ঘটনা বলে ছেড়ে দিয়েছেন সব—তে সর্বে পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা তৎসর্বং পূর্বকিল্বিষম্‌৷ জেনে রাখুন—পাণ্ডবরা কোনও যুদ্ধ চান না, তাঁরা ভালভাবেই সবকিছু মিটিয়ে নিতে চান। কিন্তু যদি মনে করেন আপনার ছেলেরা তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করবেনই, তাহলে যেন এটা মনে করবেন না যে, আপনার ছেলেরা সব দিক দিয়ে অধিকতর শক্তিমান, সেই জন্য যুদ্ধ করছেন—স চ হেতু র্ন মন্তব্যো বলীয়াংসস্তথা হিতে।

দ্রুপদের পুরোহিত এবার পাণ্ডবদের অপরিসীম শক্তির পরিচয় দিলেন। ভীম-অর্জুনের মতো যুদ্ধ-বীরের প্রসঙ্গ ছাড়াও পাঞ্চাল-যাদবদের রাজনৈতিক মিত্রতার কথা বলে তিনি ধৃতরাষ্ট্রের অন্তর কম্পিত করে তুললেন। দ্রুপদের পুরোহিতকে কর্ণ কিছু কথা শোনাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র এই প্রথম তাঁকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। তাঁর রাজনৈতিক কূটচারিতা অসাধারণ। তিনি নিজের বৃদ্ধ বয়স এবং আত্মীয়-সম্পর্কের মর্যাদা ভাঙিয়ে এমন চেষ্টা করলেন যাতে পাণ্ডবদের রাজ্যও দিতে না হয়, আবার তাঁরা যেন যুদ্ধও না করেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—আমি সঞ্জয়কে দূত করে পাঠাব। সে সব কথা বুঝিয়ে বলবে।

ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের মাধ্যমে পাণ্ডবদের অনেক মঙ্গল কামনা করলেন, অনেক আশীর্বাদ করলেন, অনেক ভয় পাবার অভিনয় করলেন, কিন্তু রাজ্য ফিরিয়ে দেবার কথা একবারও বললেন না। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রের কথা মতো পাণ্ডবদের সব জানালেন, ধৃতরাষ্ট্রের অকুণ্ঠ আশীর্বাদ আর মোহময়ী স্নেহেচ্ছা জানিয়ে ভাইতে ভাইতে যুদ্ধ যে একদম প্রশস্ত নয়, অস্ত্রের হানাহানিতে লোকক্ষয় যে অত্যন্ত অন্যায়—এই সব গভীর তত্ত্বকথা যুধিষ্ঠিরকে বোঝাতে লাগলেন। কিন্তু এই মত্ন তত্ত্ব-বোধনের কোনও উপপত্তি ছিল না। ধৃতরাষ্ট্র একবারও রাজ্য ফিরিয়ে দেবার কথা সঞ্জয়কে বলে দেননি। অতএব সঞ্জয়ও শুধু যুদ্ধ না করার উপযোগিতা নিয়ে বাগ্মিতা প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন।

যুধিষ্ঠির সব কথা শুনে ঠান্ডা মাথায় বললেন—সঞ্জয়! আমরা যুদ্ধের কথা একবারও কি বলেছি, যাতে যুদ্ধ বন্ধ করার ভাবতে হচ্ছে—কা নু বাচং সঞ্জয় মে শৃনোষি যুদ্ধৈনিণীং যেন যুদ্ধাদ্‌বিভেষি। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র বিরাট ঐশ্বর্য ভোগ করছেন, তিনি তাঁর দুর্বুদ্ধি পুত্রকেও শাসন করছেন না, আবার এদিকে অসহায় দীনের মতো নানা ভাষণ দিচ্ছেন। আমাদের কথা হল—যুদ্ধ এড়িয়ে গিয়ে যে শান্তির কথা আপনি বলছেন, সে শান্তি আমরাও চাই। তবে কিনা আমাদের ইন্দ্রপ্রস্থ আমাদের ফিরিয়ে দিক দুর্যোধন, তাতে শান্তির পথ সবচেয়ে বেশি প্রশস্ত হবে—ইন্দ্রপ্রস্থে ভবতু মমৈব রাজ্যং সুযোধনো যচ্ছতু ভারতাগ্রাঃ।

ধৃতরাষ্ট্রের কূটচারিতা মাথায় রেখেই সঞ্জয় এবার কথা ঘোরালেন। বললেন—দেখ, যুদ্ধ ছাড়া কৌরবরা তোমাদের ভাগ তোমাদেরই ফিরিয়ে দেবে বলে মনে হয় না। আর যুদ্ধই আমরা চাই না। মহান পাণ্ডবরা ধর্মের পথে চলেন বলেই তাঁদের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন যুদ্ধ করে লোকক্ষয় না করেন। মানুষ কতদিন আর বাঁচে, তার মধ্যে এই মারামারি, কাটাকাটি ভাল লাগে না বাপু। আমার তো মনে হয়—এর থেকে অন্য রাজ্যে গিয়ে ভিক্ষা করাও ভাল, তোমাদের যশ এবং কীর্তির নিরিখে এই যুদ্ধ করে জ্ঞাতি-গুষ্টির সর্বনাশ করা তোমাদের মানায় না—মহাশ্রাবং জীবিতঞ্চাপ্যনিত্যং সংপশ্য ত্বং পাণ্ডব মা বানীনশঃ।

সঞ্জয় যুদ্ধ-নিবৃত্তির সম্বন্ধে অনেক জ্ঞানের কথা বললেন এবং এগুলি তাঁর কথা নয়, ধৃতরাষ্ট্রের কথা। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর বচন-বিভঙ্গে রাজ্যভাগের কথাটা চেপে রেখে যত বড় বড় কথা বলতে চেয়েছিলেন, হুবহু তাইই বলে গেছেন সঞ্জয়। কিন্তু তাতে—যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই—স্লোগানটাই খুব বড় হয়ে উঠেছিল, বাস্তবে যে বুদ্ধিতে যুদ্ধ বন্ধ করা যায়, সেই বুদ্ধির সততাটুকু ছিল না ধৃতরাষ্ট্রের দিক থেকে। যুধিষ্ঠির সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিষ্কারভাবে। শেষে তিনি ইন্দ্রপ্রস্থের দাবিও ছেড়ে দিয়েছেন। কুশস্থল, বৃকস্থল; বারণাবত ইত্যাদি পাঁচখানিমাত্র গ্রামের ভাগ চেয়ে যুধিষ্ঠির তাঁর সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলেন যে, শান্তি এবং সহাবস্থান এর কমে সম্ভব নয়—শান্তিরেবং ভবেদ্‌ রাজন্ প্রীতিশ্চৈব পরম্পরম্।

সঞ্জয় ফিরে এলেন যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে। সকলের কুশলবার্তা জানিয়ে বললেন—আমি আপনাকেই সর্বাপেক্ষা দোষী সাব্যস্ত করছি, কারণ আপনার কারণেই ভরতবংশের মধ্যে পারস্পরিক এই হানাহানি তৈরি হয়েছে, যা সমস্ত রাজ্যের সর্বনাশ ডাকে আনবে। এই আপনি, ছেলের কথায় নেচে যে সর্বনেশে পাশাখেলার মদত দিয়েছিলেন—তমেবৈকো জাতু পুত্রস্য রাজন্‌/বশং গত্বা সর্বলোকে নরেন্দ্র—তার ফল এখন ভুগবেন। আপনার পক্ষে এই কুরুবংশ রক্ষা করা আর সম্ভব নয়—ন শক্তস্ত্বং রক্ষিতুং কৌরবেয়। আমি সারা দিন রথ চালিয়ে এসেছি, বড় শ্রান্ত, বড় ক্লান্ত আমি। কাল সকালে আমি সব সবিস্তারে বলব। এখন আপনি আমার শয়নের অনুমতি করুন।

সঞ্জয় অতিসংক্ষেপে যত রাগ দেখিয়ে শুতে চলে গেলেন, তাতেই বোঝা যায় যে, ধৃতরাষ্ট্রের বাস্তব-আচরণহীন মৌখিকতায় কোনও কাজই হয়নি। একজন অসাধারণ দূতের পক্ষেও সেটা বাস্তব অসুবিধের সৃষ্টি করেছে। ধৃরাষ্ট্রের সঞ্জয়ের ক্রোধের অভিব্যক্তি শুনে বুঝেছেন, তাঁর চতুরতায় কোনও কাজ হয়নি। উপরন্তু এই তেরো বছর ধরে তিনি যে সব বিপদের আশঙ্কা করেছেন, তা যে সত্যি হতে চলেছে, সেটাও সঞ্জয়ের অভিব্যক্তি দেখেই বুঝে গেলেন ধৃতরাষ্ট্র। তাঁর মন ভীষণ চঞ্চল হয়ে উঠল। পুত্রদের বিপত্তির আশঙ্কায় এবং নিজের অসহায়তা বুঝে তিনি ভীষণ ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। মানুষ পাপ করে আসার পর যেমন ভাগবত শোনে, মরণকালে যেমন মানুষ হরিনাম করে, প্রায় সেই মানসিকতাতেই ধৃতরাষ্ট্র ডেকে পাঠালেন বিদুরকে।

বিদুর আসার সঙ্গে সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্র তাঁকে বললেন—বিদুর! সঞ্জয় এসে আমাকে একটু তিরস্কার করেই চলে গেল—গর্হয়িত্বা চ মাং গতঃ। যুধিষ্ঠির তাকে কী বলেছেন, সে কথা কাল সভাস্থলেই জানাবে সঞ্জয়। কিন্তু যেহেতু আমি কিছুই জানতে পারলাম না, তাই চিন্তায় আমার ঘুমও আসছে না, মনের জ্বালায় শরীরও পুড়ে যাচ্ছে—তন্মে দহতি গাত্রণি তদাকার্ষীৎ প্রজাগরম্‌। বিদুর বললেন—মহারাজ! ঘুম আসে না কাদের? দুর্বল লোকের ওপর যদি বলবান আক্রমণ করে সেই দুর্বল লোকের ঘুম আসে না। যার ধন-সম্পদ চুরি গেছে, তার ঘুম আসে না। যে স্ত্রী-চিন্তায় মত্ত, তার ঘুম আসে না, আর যে চোর, তার ঘুম আসে না—হৃতস্বং কামিনং চৌরমাবিশন্তি প্রজাগরাঃ। আশা করা যায়—এগুলোর মধ্যে একটা দোষও নিশ্চয়ই আপনার নেই। তবে আবার এমন হয়নি তো যে, কোনওভাবে পরের দ্রব্যে লোভী হয়ে এখন আপনি অনুতাপ করছেন—কচ্চিচ্চ পরদ্রব্যেষু গৃধ্যান্ন পরিতপ্যসে?

বিদুরের ইঙ্গিতটা স্পষ্টতই পাণ্ডবদের রাজ্যহরণের দিকে। কিন্তু তিনি যেন একটু বোকা সেজে বলছেন। ধৃতরাষ্ট্রও এ কথার সোজাসুজি উত্তর দেননি। তিনি বিদুরের কাছে ধর্মকথা শুনতে চেয়েছেন। বিদুর ধর্মকথা শোনানোর আগে যুধিষ্ঠিরের ন্যায্য প্রাপ্য মিটিয়ে দিতে বলেছেন, তারপর আরম্ভ করেছেন তত্ত্বোপদেশ। তার মধ্যে নীতিকথা, রাজনীতি, ধর্মনীতি সবই আছে। সে সব কথা শুনে ধৃতরাষ্ট্রের কোনও শান্তি হল কিনা জানি না, তবে প্রজাগর-কৃশ রাতটি পোহাল।

পরের দিন সভা বসল। কৌরব-ভাইরা সবাই, ভীষ্ম-বিদুর ইত্যাদি কুরুবৃদ্ধেরা, দ্রোণ-কৃপের মতো আচার্যরা এবং অবশ্যই ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের বক্তব্য শোনার জন্য উপস্থিত হলেন। ধৃতরাষ্ট্র প্রথমেই অর্জুনের কথা শুধোলেন। তিনি কী বলেছেন না বলেছেন সে সব কথা শুনতে চাইলেন। অর্জুনের সম্বন্ধে এমনিতেই ধৃতরাষ্ট্রের ভয় ছিল। সে ভয় আরও বাড়ল অর্জুনের বক্তব্য শোনার পরে। অর্জুন বলে দিয়েছেন—দুর্যোধন যদি রাজ্যভাগ না দেন, তবে যুদ্ধই হবে—উপৈহি যুদ্ধং যদি মন্যসে ত্বম্। অর্জুন এরপরে নিজের এবং অন্যান্য যুদ্ধবীরের অসাধারণ যুদ্ধক্ষমতা বর্ণনা করে তাঁরা কীভাবে কৌরবদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বেন এবং তারপর কীভাবে কৌরবদের অনুতাপ করতে হবে—তার একটা ভীষণ চিত্র এঁকে দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। ধৃতরাষ্ট্র একে একে যুধিষ্ঠির, ভীম এবং অন্যান্য বীরদের প্রাথমিক বিনয় এবং সেই পথ ধরেই তাঁদের উগ্র বচনও শুনেছেন। তবে ভীমের বক্তব্য শোনার আগে তিনি নিজেই ভীমের শক্তিমত্তা সম্পর্কে এত বর্ণনা দিয়েছেন এবং ভীমের সম্বন্ধে ভীত হয়ে তিনি নিজেই এত বিলাপ করেছেন যে, সঞ্জয়কে আর ভীমের কথা বেশি বলতেই হয়নি।

ধৃতরাষ্ট্র নিজপুত্রদের ভবিষ্যৎ সর্বনাশের কথা চিন্তা করে আর কূল পাচ্ছেন না কোনও। বারেবার বলছেন—কী করি, কোথায় যে যাই, সঞ্জয়! কেমন করেই বা এই দুরন্ত বিপদ পার হব। এবারে সত্যিই মনে হচ্ছে—কৌরবরা একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে—কিংনু কুর্য্যাং কথং কুর্য্যাং ক্ক নু গচ্ছামি সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্র সভাস্থলে সবার সামনেই বললেন—আমি সবদিক থেকে যুদ্ধ না করাটাই সবচেয়ে ভাল মনে করি। যদি তোমরা সকলেই এই কথা মান তো আমরা পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তি এবং মিত্রতার সম্বন্ধই গড়ে তোলার চেষ্টা করব—বয়ং শান্ত্যৈ যতামহে। সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ সমর্থন করে বললেন—আপনি এক্কেবারে ঠিক কথাটি বলেছেন, তবে আপনার ছেলে এ কথা মেনে নেবে কি না যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মহারাজ! আপনারই কি দোষ কম? ভেবে দেখুন সেই পাশাখেলার দিনটির কথা। শকুনি একটা একটা পাশার দান জিতছিল, আর আপনি বাচ্চা ছেলের মতো আনন্দে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিলেন—জিতেছি, ওটাও জিতেছি—ইদং জিতম্‌ ইদং লব্ধং…স্ময়সে স্ম কুমারবৎ।

সঞ্জয় খুব ছেড়ে কথা বললেন না ধৃতরাষ্ট্রকে। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষকে সঠিক পথে আনবার এই তো সময়। তিনি বললেন—মহারাজ! আপনার দোষ কি কম? পাশাখেলার পর তাঁদের কত কটু কথাই না বলেছে আপনার ছেলেরা। কিন্তু আপনি তখন সে সব উপেক্ষা করেছেন। ভেবেছেন—ছেলেরা আপনার কত লায়েক হয়েছে, রাজ্য জয় করে এনে দিচ্ছে আপনার হাতে—কৃৎস্নং রাজ্য জয়ন্তীতি। কিন্তু মহারাজ! আপনি ভুলে গেছেন—পাণ্ডবরা তাঁদের বাহুবলে অর্জিত ভূমি সৌজন্যবশে আপনার হাতেই নিবেদন করেছিল। আর আপনি ভেবেছিলেন যেন আপনিই অনেক যুদ্ধ জয় করে সেই ভূমি লাভ করেছেন—ময়েদং কৃতমিত্যেব মন্যসে রাজসত্তম। এখন মনে রাখবেন ভীম কি অর্জুন শুধু নয়, মৎস্যরাজ বিরাট, পাঞ্চাল দ্রুপদ, শূরসেন যাদবরা, শাল্ব, কেকয়—এই সমস্ত দেশের রাজারা পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করবেন। আপনি রক্ষা পাবেন না। আমি এখনও বলছি—আপনার সেই ছেলেটিকে কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণ করুন, যে আগেও পাণ্ডবদের বহু কষ্ট দিয়েছে এবং এখনও তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে যাচ্ছে। মনে রাখবেন—এতক্ষণ ধরে যে এত অনুশোচনা করলেন, এত বিলাপ করলেন—এ সব কিছুই একেবারে নিরর্থক, যদি না আপনার পুত্রকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন—অনীশেনেব রাজেন্দ্র সর্বমেতন্নিরর্থকম্‌।

সঞ্জয়ের সদুপদেশ এবং ভীতিপ্রদর্শন একবারে একফুঁয়ে উড়িয়ে দিলেন দুর্যোধন। তিনি বললেন—ভয় পাবেন না, মহারাজ—ন ভেতব্যং মহারাজ—যুদ্ধ আরম্ভ হলে আমরাও খুব ছেড়ে কথা কইব না, ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ কর্ণের কথা উল্লেখ করে দুর্যোধন একদিকে যেমন কৌরবদের শক্তিমত্তার কথা প্রচার করলেন পিতার কাছে, তেমনই অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রকে বোঝালেন—এই যে পাণ্ডবরা ইন্দ্রপ্রস্থের দাবি ছেড়ে দিয়ে আজকে পাঁচখানি মাত্র গ্রাম চেয়েছেন, সেটা কীসের জন্য জান? আমার ভয়ে—ভীতো হি মামকাৎ সৈন্যাৎ প্রভাবাচ্চৈব মে বিভো। পিতা! আপনি যে পাণ্ডবদের খুব সমর্থ মনে করছেন, আমাদের যে খুব একটা আমল দিচ্ছেন না—সেটা কিন্তু মিথ্যে। কেননা আমাদের শক্তিমত্তা এবং ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার ধারণা সম্পূর্ণ নয় বলেই আপনি এইরকম ভেবেছেন। শত্রুপক্ষের শক্তির মধ্যে সেই উৎকর্ষ নেই, যা আমাদের আছে। ওদের যা সৈন্যসামন্ত আছে, শক্তিতে এবং সামর্থে আমাদের আছে তার তিনগুণ—পরেভ্যস্ত্রিগুণা চেয়ং মম রাজন্ননীকিনী।

দুর্যোধন সঞ্জয়কে প্রায় ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে বসলেন—তুমি কী এত দেখছ, সঞ্জয়! যাতে সাত অক্ষৌহিণী মাত্র সৈন্য নিয়ে ওরা আমাদের সঙ্গে স্পর্ধা করতে আসে। সঞ্জয় যতক্ষণে পঞ্চপাণ্ডবের কীর্তিরাশি শোনাচ্ছেন, ততক্ষণে কিন্তু ধৃতরাষ্ট্র প্রিয় পুত্রের সম্মোহিনী বক্তৃতায় বিমোহিত হয়ে গেছেন। তিনি ততক্ষণে পাণ্ডবদের এবং কৌরবদের সামরিক শক্তি সম্বন্ধে একটা তুলনামূলক বিচারে প্রবৃত্ত হয়েছেন। দুর্যোধনের কথাটাই যদি সত্যিও হয়, তবু পুত্রের শুভার্থে পাণ্ডবদের সঠিক শক্তি কতটা, সেটা ভাল করে জেনে নেবার প্রয়োজন বোধ করেছেন ধৃতরাষ্ট্র। সঞ্জয়কে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন—তুমি সেখানে কাদের দেখলে সঞ্জয়—যারা আমার ছেলের যুদ্ধবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নামবে—যে যোৎস্যন্তে পাণ্ডবার্থে পুত্রস্য মম বাহিনীম্‌।

সঞ্জয় একে একে সব বলতে আরম্ভ করেছেন—কারা পাণ্ডবদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন, কারা পাণ্ডবদের সমর্থন করছেন। এমনকী পাণ্ডবরা এবং তাঁদের পক্ষপাতী রাজারা কৌরববাহিনীর কাকে কাকে কে মারবেন বলে ভাগ করে নিয়েছেন—সে কথাও সবিস্তারে জানালেন সঞ্জয়। ধৃতরাষ্ট্র আবার যেন একটু ভয় পেলেন। কিন্তু তাঁকে আবারও ঠিক করার জন্য দুর্যোধনের আত্মম্ভরী বক্তৃতা শুরু হল। ধৃতরাষ্ট্র খুব যে এবার জোর পেলেন তা নয়, খুব যে বুঝে গেলেন তাও নয়। সঞ্জয়ের মুখে সমস্ত কিছু শুনে তিনি বরং সবিনয়ে অনুরোধই করলেন দুর্যোধনকে—আমি এত যে চ্যাঁচাচ্ছি, তাও এরা কেউ শোনে না সঞ্জয়—মন্দা বিলপতো মম। বাছা দুর্যোধন! তুমি যুদ্ধের দূরাগ্রহ ত্যাগ করো—দুর্যোধন নিবর্তস্ব যুদ্ধাদ্‌ ভরতসত্তম।

ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা—সবার মত উদ্ধার করে ধৃতরাষ্ট্র বললেন—দেখো বাছা! এরা কেউ যুদ্ধ চান না, তুমিও সেই উপদেশটা মেনে নাও। আমি জানি—এই দুরাগ্রহ তোমার নিজের ইচ্ছেয় নয়। তোমাকে এ ব্যাপারে মদত দিচ্ছে তোমার বন্ধুবর কর্ণ—ন ত্বং করোষি কামেন কর্ণঃ কারয়িতা তব। আর আছে ওই সর্বনেশে শকুনি আর দুঃশাসন, যারা তোমাকে যুদ্ধে প্ররোচিত করছে। অর্থাৎ দুর্যোধনের ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্রের মোহ এতটাই যে, তাঁর পুত্রটিই যে যুদ্ধের ব্যাপারে প্রধান হোতা, সেটা তিনি ভাবতেই পারেন না। দুর্যোধন অবশ্য তাঁর এই মোহ ভেঙে নিজেই যুদ্ধের দায়িত্ব স্বীকার করেছেন, কিন্তু তাতেও ধৃতরাষ্ট্রের মোহভঙ্গ হয়নি। দুর্যোধন বলেছিলেন—এই তুমি যাঁদের নাম করলে, ওই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, অথবা সঞ্জয় আমি এঁদের কারও ভরসায় যুদ্ধে নামছি না—অন্যেষু বা তারকেষু ভারং কৃত্বা সমাহ্বয়ে। আমি যুদ্ধে নামছি আমার নিজের ক্ষমতায়। কর্ণ, দুঃশাসন—এঁরা আমার সহায়তা করবেন নিশ্চয়ই। কিন্তু সার কথা জেনো—হয় আমি যুদ্ধে জিতে এই পৃথিবী শাসন করব, নয়তো পাণ্ডবরা। একত্র আমরা কিছুতেই থাকব না—ন জাতু পাণ্ডবৈঃ সার্ধং বসেয়মহমচ্যুত।

যুদ্ধ ছাড়া পাণ্ডবদের সূচ্যগ্র ভূমিও দেবেন না বলে ঘোষণা করে দিলেন দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্র আর কী করেন! একবার সঞ্জয়ের কাছে পাণ্ডবদের শক্তির কথা শোনেন, একবার দুর্যোধনের কথা শোনেন। একবার কর্ণের বীরমানিতা শোনেন। কিন্তু কিছুতেই তাঁর শান্তি হয় না। শেষে সঞ্জয়ের পরামর্শে নিজ পিতা ব্যাস এবং গান্ধারীকেও সভাস্থলে ডেকে এনে বোঝানোর চেষ্টা করেন দুর্যোধনকে। কিন্তু কিছুতেই কোনও কাজ হল না। দুর্যোধন নিজের গোঁ ধরে বসে রইলেন।

ধৃতরাষ্ট্র যখন এদিকে কিছুতেই ছেলেকে নিজের মতে আনতে পারছেন না, তখন ওদিকে আরেক চিত্র চলছে। পাণ্ডব শিবিরে তখন সঞ্জয়ের মুখে শোনা ধৃতরাষ্ট্রের নানা বক্তব্য নিয়েই আলোচনা চলছে। যুধিষ্ঠিরের মতো সরল মানুষও বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, তাঁদের সমস্ত কষ্টের জন্য ধৃতরাষ্ট্রই মূলত দায়ী। তিনি নিজেই লোভী এবং পাণ্ডুপুত্রদের প্রতি তিনি অসম ব্যবহার করেন—লুব্ধঃ পাপেন মনসা চরন্নসমমাত্মনঃ—সঞ্জয়ের মুখে ধৃতরাষ্ট্র যা বলে পাঠিয়েছেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা পোষণ করেও নিজেকে স্তব্ধ করতে পারছেন না যুধিষ্ঠির। তিনি বলছেন—ধৃতরাষ্ট্র মোটেই ন্যায়-নীতি মেনে চলছেন না। তাঁর কথা শুনে আমরা এত বছর বনবাস, অজ্ঞাতবাস সব করলাম। কিন্তু পুত্রের মতে মত দিয়ে—বশ্যত্বাৎ পুত্রগৃদ্ধিত্বাৎ—তিনি একটি কথাও রাখছেন না। তিনি আমাদের রাজ্যটিও ফেরত দেবেন না, অথচ যুদ্ধশান্তি চাইছেন। এ কেমন কথা হল—অপ্রদানেন রাজ্যস্য শান্তিমস্মাসু মার্গতি।

দুই পক্ষের অনমনীয় অবস্থা দেখে পরমপুরুষ কৃষ্ণ ঠিক করলেন—তিনি শান্তির দূত হয়ে কৌরব-রাজসভায় যাবেন। যুধিষ্ঠিরের কথাটা তো সত্যিই খুব মিথ্যে নয়। ধৃতরাষ্ট্র যতই পাণ্ডবদের ভয় পান, তিনি কিন্তু দুযোর্ধনের ওপর নিজের শাসন চালাচ্ছেন না। তাঁর যদি যুদ্ধনিবৃত্তির ব্যাপারে সত্যিই আন্তরিকতা থাকত, তা হলে দুর্যোধনের কথা না শুনেই তাঁর বলা উচিত ছিল যে, পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্য দিতেই হবে। তাঁর মনের ইচ্ছা—রাজ্যও দেব না, যুদ্ধও না হোক। এইরকম মনোবৃত্তি প্রকাশ পেয়েছে কৃষ্ণ আসবার সময়েও। কৃষ্ণ যখন প্রায় হস্তিনাপুরের কাছাকাছি বৃকস্থলীতে এসে পৌঁছেছেন, তখন বিদুরকে ধৃতরাষ্ট্র জানাচ্ছেন—কীভাবে তিনি আতিথেয়তায় ভুলিয়ে কৃষ্ণকে তুষ্ট করবেন। রাজ্যের কথাটা কিন্তু একবারও বলছেন না।

দুর্যোধন অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রের এই অতিথিসৎকারের মানসিকতা মেনে নেননি। কৃষ্ণ যদি ভেবে বসেন—দুর্যোধন ভয় পেয়েছেন, তাই এমন আতিথেয়তা করছেন—এই ভাবনায় তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে আতিথেয়তা বন্ধ করতে বলেছেন। দরকার হলে যে কৃষ্ণকে বন্দি করতেও তিনি পিছুপা হবেন না সেটাও তিনি কঠিন স্বরে জানিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। ভীষ্ম এবং ধৃতরাষ্ট্র দু’জনেই দুর্যোধনের এই কথায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের উচিত ছিল—দুর্যোধনকেও অনুরূপ কঠিনভাবেই শাসন করা, কিন্তু তা তিনি করেননি। তাঁর পুত্রস্নেহ এমনই দুরবগ্রহ।

কৃষ্ণ গিয়ে দুর্যোধনের সঙ্গে কথা বলেননি। যা বলেছেন ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করেই বলেছেন। কৃষ্ণ বলেছেন—আপনি পারেন, একমাত্র আপনিই পারেন আপনার ছেলেদের নিয়ন্ত্রণে আনতে। আর যদি না পারেন, তবে এই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি দুই পক্ষের দিকে তাকিয়েই বলছি—যুদ্ধ না হওয়াটা কিন্তু সম্পূর্ণ নির্ভর করছে আপনার ওপর এবং আমার ওপর—ত্বয্যধীনো শমো রাজন্‌ ময়ি চৈব বিশাম্পতে। শুধু রাজনৈতিক বা সামরিক শক্তির তুলনা-প্রতিতুলনা নয়, কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের অন্তর এবং সুবুদ্ধির কাছে নিজের যুক্তি নিবেদন করেছেন। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর ধৃতরাষ্ট্রই যে পাণ্ডবদের পিতা এবং অভিভাবক—সে কথা খুব আন্তরিকভাবেই জানিয়েছেন কৃষ্ণ—বালা বিহীনাঃ পিত্রা তে ত্বয়ৈব পরিবর্দ্ধিতঃ।

কৃষ্ণ অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলেও মাঝখান থেকে তার উত্তর দিয়েছেন দুর্যোধন এবং বলা বাহুল্য সে উত্তরের মধ্যে অহংমানিতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কৃষ্ণও মোটেই ছেড়ে দেননি এবং উত্তেজনার তুঙ্গ মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন—দুর্যোধন-কৰ্ণ-শকুনিদের বন্দি করে আপনি পাণ্ডবদের হাতে ছেড়ে দিন, তাতে আপনি অনেক ভাল থাকবেন—বদ্ধ্বা দুঃশাসনঞ্চাপি পাণ্ডবেভ্যঃ প্রযচ্ছত। কৃষ্ণের মানসিকতা দেখে ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়ে বিদুরকে বলেছেন—গান্ধারীকে ডেকে আনো, বিদুর! তিনি যদি ছেলেকে সামলাতে পারেন—অপি সাপি দুরাত্মানং শময়েদ্‌ দুষ্টচেতসম্‌। বিদুর তৎক্ষণাৎ ডেকে এনেছেন গান্ধারীকে। ধৃতরাষ্ট্র অনুযোগ করে বলেছেন—তোমার ছেলে সমস্ত শাসনের বাইরে চলে গেছে গান্ধারী—এষ গান্ধারী পুত্রস্তে দুরাত্মা শাসনাতিগঃ।

‘তোমার ছেলে’! খট করে যেন কানে লাগল গান্ধারীর। চিরকাল ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে যিনি মাথায় তুলেছেন, সেই মাথায় তোলার কুফল ফললে ভদ্রলোককেও এমন শুনতে হয়—‘তোমার ছেলে’। গান্ধারী তবু শুনে গেলেন। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—ঐশ্বর্যের লোভে সে পাগল হয়ে গেছে। এখন বাকি ঐশ্বর্যও যাবে, প্রাণও যাবে। আর কী ব্যবহার! কাকে কী বলতে হয় জানে না, কার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে জানে না। ভাল কথা বলা হল, কিন্তু সে তার অশিষ্ট বন্ধুদের নিয়ে সভা ছেড়ে চলে গেল—অশিষ্টবদ্‌ অমর্যাদঃ পাপৈঃ সহ দুরাত্মবান্‌।

গান্ধারী পুত্রের উদ্দেশে প্রথমে একবারমাত্র তিরস্কারবাণী উচ্চারণ করেই ধৃতরাষ্ট্রকে একহাত নিয়েছেন। বলেছেন—এখানে ছেলের থেকেও তোমাকেই বেশি নিন্দা করতে হয়, মহারাজ! তোমাকেই সকলে ছেলে-সর্বস্ব বলে জানে—ত্বং হ্যেবাত্র ভৃশং গর্হ্যো ধৃতরাষ্ট্র সুতপ্রিয়ঃ। এই ছেলের সম্পর্কে দুষ্কর্মগুলি জেনেও তুমি তারই বুদ্ধি অনুসারে চল। লোভ, ক্রোধ আর অহংকারে তার বুদ্ধি নষ্ট হয়ে গেছে। এতদিন তাকে যথেষ্ট প্রশ্রয় দিয়েছ, আজকে তাকে জোর করে ঠিক পথে নিয়ে আসাটা অনেক কঠিন কাজ হবে—অশক্যো’দ্য তয়া রাজন্ বিনিবর্তয়িতুং বলাৎ। দেখো, এখন কিছুতেই সেই মূর্খ তার স্বাদের জিনিস, রাজ্যটি ছেড়ে দেবে না। তার সঙ্গে জুটেছে তাকে উত্তেজনা জোগানোর মতো কুসহায়। এখন সেই লোভী দুরাত্মাকে আশ্রয় জোগানোর ফল পাবেন ধৃতরাষ্ট্র—দুঃসহায়স্য লুব্ধস্য ধৃতরাষ্ট্রো’শ্নুতে ফলম্‌।

গান্ধারী ধৃতরাষ্ট্রকে তিরস্কার করেছেন স্ত্রীসুলভ কোনও কপট কোপে নয়, রীতিমতো রাজনৈতিক তত্ত্বের কথা বলে তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, যা সময়কালে অনেক সহজেই তিনি করতে পারতেন, তাই না করার জন্য আজ এই বিপদ নেমে এসেছে। গান্ধারী বলেছেন—মধুর বাক্যে নাই হোক, কারণ দুর্যোধন সেটা সইতে পারবে না, কিন্তু পাণ্ডবদের আলাদা রাজ্য দিয়ে আলাদা করে দিয়েও যদি এই সমস্যা মেটানো যেত, তবে তাই করা উচিত ছিল—যা হি শক্যা মহারাজ সাম্না ভেদেন বা পুনঃ—এখন শুধু শুধু যুদ্ধের উন্মাদনায় কারও মত থাকতে পারে না। আর লোকেই বা তোমায় কী বলবে—তোমার আপন ভাইয়ের ছেলে, অতি নিকট স্বজন বলে কথা, তাঁদের সঙ্গে তোমার বিভেদ সৃষ্টি হল—তোমার এই কাণ্ড দেখে শত্রুরা হাসবে শুধু, আর কিছু নয়—ভিন্নং হি স্বজনেন ত্বাং প্রহসিষ্যন্তি শত্রবঃ।

গান্ধারী তাঁর পুত্রকেও ডেকে যথেষ্ট নিন্দা করেছেন, যথেষ্ট সাবধানবাণী শুনিয়েছেন, কিন্তু পাণ্ডবদের অসহায়তা এবং তাঁদের সঙ্গে আজকের এই যুদ্ধ-সম্ভাবনার মূলে যে ধৃতরাষ্ট্রই আছেন—সে কথা তিনি একটুও রেখেঢেকে বলেননি। দুর্যোধন কারও কথা শোনেননি। সভা থেকে বেরিয়ে গিয়ে তিনি কৃষ্ণকে বন্দি করবার ফন্দি আঁটছিলেন। ব্যাপারটা প্রকাশ হয়ে গেলে কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রকে আবারও সাবধান করেছেন ভয়ংকর ফলাফলের জন্য। কৃষ্ণ বলেছেন—আপনার এই ছেলেগুলিকে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে আমার সময় বেশি লাগবে না। আমি এক্ষুনিই এই পাপিষ্ঠগুলোকে বেঁধে নিয়ে পাণ্ডবদের হাতে তুলে দিতে পারি, আমার কাছে এটা কিচ্ছু না—নিগৃহ্য রাজন্ পার্থেভ্যো দদ্যাং কিং দুস্করং ভবেৎ। কিন্তু আমি তা করব না। আপনার সম্মানেই আপনার সামনে আমি কোনও ক্রোধের বিকার প্রদর্শন করতে চাই না।

ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণের কথায় ভীষণ ভয় পেয়েছেন এবং দুর্যোধনকে সভায় ডেকে এনে যারপরনাই তিরস্কার করেছেন। কিন্তু দুর্যোধনকে শাস্তি দেবার মতো কিছু করেননি। কৃষ্ণকে অতঃপর বিশ্বরূপ দর্শন করাতে হয়েছে, যদিও তাতেও দুর্যোধনের বোধোদয় হয়নি। কৃষ্ণ কুরুসভা ছেড়ে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছেন এবং ধৃতরাষ্ট্র সেই মুহূর্তে তাঁর অসহায়তা জ্ঞাপন করেছেনমাত্র; অবশ্য সেই অসহায়তার মধ্যেও অন্ধ পুত্রস্নেহের পরিব্যাপ্তিই ছিল সবটুকু জুড়ে। পাণ্ডবরা যে শাস্তি পেয়েছেন বনবাসে আর অজ্ঞাতবাসে, এমন কোনও শাস্তি দুর্যোধনকে তিনি দিতে পারেননি, যা অনেকে চেয়েছিলেন।

ধৃতরাষ্ট্র কৃষ্ণের কাছে নিজের দোষ স্খালন করতে চেয়ে বলেছেন—ছেলের ওপর আমার কতটুকু প্রভাব, দেখলে তো? সামনাসামনিই দেখলে—প্রত্যক্ষং তে ন তে কিঞ্চিৎ পরোক্ষং শত্ৰুকর্ষণ। শান্তির জন্য আমার যতখানি করার, সে চেষ্টা আমি করেছি। আমাকে কিন্তু কোনওভাবেই দোষ দিয়ো না, বাছা—নাভিশঙ্কিতুমর্হসি। পাণ্ডবদের প্রতি আমার যে কোনও বিদ্বেষ নেই সেটা আমি নিশ্চিত বলতে পারি। আর আমার দিক থেকে আমি কত কথা বললাম দুর্যোধনকে, সে তো তুমি স্বচক্ষেই দেখলে—জ্ঞাতমেব হি তদ্‌বাক্যং যন্ময়োক্তঃ সুযোধনঃ। আর দুপক্ষের মধ্যে শান্তির জন্য আমার যে কত চেষ্টা, সেটা অন্যান্য কুরুপ্রধানরাও জানেন। কৃষ্ণ ধৃতরাষ্ট্রের কথার জবাব দিয়েছেন বেশ কড়া করেই। তিনি বলছেন—দ্রোণ, ভীষ্ম, বিদুর এবং আপনি—এঁরা সকলেই জানেন আজকে কুরুসভায় কী ঘটেছে। আপনার অসভ্য ছেলেটি যেভাবে বার বার সক্রোধে সভাস্থল ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, তাতেই বেশ বোঝা যায় আপনার ছেলের ওপরে আপনার কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই—বদত্যনীশমাত্মানং ধৃতরাষ্ট্রো মহীপতিঃ। কৃষ্ণ এরপর ধৃতরাষ্ট্রের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুন্তীর কাছে গেছেন ঘটনার বিবরণ দিতে।