দ্রোণাচার্য – ৩

॥ ৩ ॥

দ্রোণাচার্যের জন্মের মধ্যে কোনও মহিমা নেই, কোনও গৌরবও নেই। সেকালের কোনও ব্রাহ্মণগৃহে বা ক্ষত্রিয়গৃহে একটি পুত্রসন্তান জন্মালে পরে যে আনন্দের কলধ্বনি শোনা যেত সে ধ্বনি ওঠেনি কোথাও; দ্রোণের জন্মলগ্নে কোনও শঙ্খরব বা রমণীকুলের জয়কারে উচ্চকিত হয়ে ওঠেনি কোনও গৃহকোণ। দ্রোণাচার্য জন্মগ্রহণ করেছিলেন পিতামাতার ক্ষণিকের উৎসুকতায়, বাধাবন্ধহীন শারীরিক চপলতার অন্যতম গতিসূত্র ধরে। আপনারা এখন যে জায়গাটাকে হরিদ্বার বলেন, সে জায়গাটাকে মহাভারতের কালে গঙ্গাদ্বার বলতেন অনেকেই। এই গঙ্গাদ্বারের কাছেই ছিল মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রম। আশ্রমে যজ্ঞ চলছিল। মহর্ষি নিজেও সংযম নিয়মে নিজেকে রুদ্ধ করে ব্রতচারণ করছিলেন। শুধু যজ্ঞক্রিয়ার জন্যই অবশ্য এই যম-নিয়ম নয়, নিজের স্বভাবেই তিনি সংযতেন্দ্রিয়, সমস্ত বাহ্য সুখ থেকে নিজেকে তিনি সংবৃত করে রেখেছেন—ভরদ্বাজঃ ইতি খ্যাতঃ সততং সংশিতব্রতঃ। আজকে অবশ্য এতক্ষণ তিনি আশ্রমের হবির্ধান-মণ্ডপে যজ্ঞক্রিয়ায় ব্যাপৃত ছিলেন। যজ্ঞক্রিয়ার পরিশ্রম কম নয়। খানিকটা কাজ এগিয়ে রেখে তিনি একাই বেরিয়ে এসেছিলেন গঙ্গাদ্বারের শীতল স্রোতে স্নান করার জন্য। আর তখনই এই বিপত্তি ঘটল।

সারাজীবন কঠোর নিয়ম-ব্রতের মধ্যে দিয়ে যিনি চলেন, প্রকৃতি তার ওপরে এমন করেই বুঝি প্রতিশোধ নেয়। মহর্ষি আগে এসেছিলেন নদীতে স্নান করতে—পূর্বমেবাগমন্নদীম্‌। তখন কেউ সেখানে ছিল না। কিন্তু স্নান করে উঠে তিনি যা দেখলেন, তাতে তাঁর পক্ষে আর নিজেকে ধারণ করা সম্ভব হল না। স্বর্গসুন্দরী ঘৃতাচী, যিনি অপ্সরা সুন্দরীদের মধ্যে অন্যতম প্রধান—ভরদ্বাজ তাঁকে দেখতে পেলেন উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে, গঙ্গার তীরে উতলা হাওয়ার মধ্যে। সমস্ত শরীরের মধ্যে তাঁর সৌন্দর্যের দীপ্তি ফুটে উঠছে, তার সঙ্গে রয়েছে রমণীয় হাবভাবলাস্য—রূপযৌবনসম্পন্নাং মদদৃপ্তাং মদালসাম্‌। শুধু এমন হলেও হত। এমন সুন্দরী রমণী ভরদ্বাজ পূর্বে কখনও দেখেননি, তা তো নয়। কিন্তু ঘৃতাচী ভরদ্বাজকে দেখে এমন সরস আপ্লুত ভাব প্রকাশ করতে লাগলেন, যাতে মুনির সংযম বিঘ্নিত হয়। তাও যদি শুধু এইটুকুই হত, তবু কথা ছিল। ঘৃতাচী মুনিকে দেখেই তাঁর পরিধানের সুসূক্ষ্ম স্বর্গীয় বসনখানি পরিবর্তন আরম্ভ করেছিলেন—বসনং পর্যবর্তত। ঠিক সেই সময়েই উন্মুক্ত প্রকৃতির মধ্যে কোথা থেকে উতলা হাওয়া এসে এক দ্বিধাদ্বন্দ্বসমাযুক্ত অসম্পূর্ণ চিত্রকে সম্পূর্ণ করে দিল। ভরদ্বাজ ঘৃতাচীকে দেখতে পেলেন নগ্না প্রকৃতির মতোই। ইন্দ্রিয়ের এতাবদ্‌-রুদ্ধ সংযম মুহূর্তে স্খলিত হল, ভরদ্বাজ কামনা করলেন ঘৃতাচীকে মানসিক শরীরে—ব্যাপকৃষ্টাম্বরাং দৃষ্টা তাং ঋষিশ্চকমে তদা।

ঘৃতাচীর সঙ্গে মহর্ষি ভরদ্বাজের কোনও শারীরিক মিলন হয়নি বলেই বোঝাতে চেয়েছেন মহাভারতের কবি। কিন্তু মানস-শরীরে যে চাঞ্চল্য এসেছিল, তাতেই শরীরের তেজ নির্গত হল মহর্ষি ভরদ্বাজের। মহর্ষি সে তেজ মৃত্তিকায় বিলীন হতে দিলেন না, তিনি তা ধারণ করলেন একটি আধারে—যাকে কবি বলেছেন দ্রোণ। সংস্কৃতে দ্রোণ বলতে বোঝায় চাল মাপার কৌটোর মতো কোনও আধার। কিন্তু এই শ্লোকের অব্যবহিত পরেই দ্রোণ শব্দটি ব্যবহার না করে কবি বলেছেন কলশ। টীকাকার নীলকণ্ঠ শব্দদুটি এক জায়গায় করে বলেছেন—দ্রোণ-কলশ মানে হল যজ্ঞীয় পাত্র। এমন হতেই পারে মহর্ষি ভরদ্বাজ হবির্ধান মণ্ডপ ছেড়ে স্নান করতে এসেছিলেন গঙ্গাদ্বারে। সেখানে নদীস্রোতের যা খরতর রূপ, তাতে সেকালের দিনে একটি যজ্ঞকলশ বয়ে নিয়ে এসে তাই দিয়ে জল তুলে স্নান করাটাই কম ভয়ের ছিল। কিন্তু স্নান করার সেই দ্রোণকলশ কাজে লাগল মহর্ষির শরীরতেজ ধারণের জন্য। দ্রোণের মধ্যে জন্মেছিলেন বলেই ভরদ্বাজের এই পুত্রের নাম হল দ্রোণ—ততঃ সমভবদ্‌ দ্রোণঃ কলশে তস্য ধীমতঃ।

দেখুন, মহামতি দ্রোণাচার্য ভবিষ্যতে যে মর্যাদা ভোগ করবেন, সেইজন্যই হয়তো ঘৃতাচী উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাঁকে স্পষ্টত অপ্সরা রমণীর গর্ভশায়ী করেননি মহাভারতের কবি। কিন্তু ‘কলশ’ শব্দটি স্ত্রীলোকের অধমাঙ্গের পরিবর্ত হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া অসম্ভব নয়। এবং এই পুত্র জন্মের কারণ যেহেতু অপ্সরা ঘৃতাচী, অতএব তাঁর গর্ভকলশেই যে দ্রোণাচার্যের জন্ম হয়েছিল লৌকিক দৃষ্টিতে সেটা বিশ্বাস করাটাই স্বাভাবিক হবে। তাতে মহর্ষি ভরদ্বাজের মাহাত্ম্য কিছু কমে না এবং দ্রোণাচার্যের জন্মদাত্রী হিসেবে ঘৃতাচীকে একেবারে হেঁটে ফেলার অস্বাভাবিকতাও কিছু থাকে না। তবে অপ্সরা সুন্দরীরা স্বৰ্গবেশ্যা বলে সকলেই চিহ্নিত, অতএব পুত্রের জন্ম দেবার পর তাদের ওপর দয়া মায়া, তাদের মানুষ করার দায়িত্ব এসব বোধহয় স্বর্গবেশ্যাদের কাছে আশা করা যায় না। এমন নির্দয় উদাহরণ আমরা মহাভারতের মধ্যেই বহু দেখেছি।

অতএব এটা বোঝা যায় শৈশব থেকেই জননীর পরিত্যক্ত ছিলেন শিশু দ্রোণ। যদি পরিত্যক্ত শব্দটা নাও ব্যবহার করি, তবু বলতে হবে—জননীর স্নেহযত্নহীন অবস্থায় দ্রোণের শিশুকাল কেটেছে পিতার আশ্রমে। অনন্ত-ব্যাপ্ত যজ্ঞক্রিয়ার কোনও অবসরে পিতার ক্রোড়ে তাঁর স্থান হত কি না—কখনও বা হতও নিশ্চয়ই—তবু সে কথা একেবারেই জানাননি মহাভারতের কবি। তবে হ্যাঁ, সেকালের দিনের একটি তপঃসিদ্ধ মুনির আশ্রমে একটি বালকের দিন যেভাবে কাটতে পারে, সেইভাবেই দিন কেটেছিল দ্রোণের। কোনও আশ্রম-বাড়িতে একটি বালকের শৈশব কাটতে থাকলে তার শিশুমনে কী প্রতিক্রিয়া হয়, সে সম্বন্ধে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা সামান্য হলেও কিছু আছে। অন্যের দৃষ্টিতে এমন বাল্যজীবন যতই কষ্টকর মনে হোক, খুব যে খারাপ লাগে তা নয়। এমনকী বৈচিত্র্যও যে খুব কম, তাও নয়। বিভিন্ন প্রকার সাধু মহান্তের আগমন, বিচিত্র চরিত্র মানুষের সমাগম, পুজোআর্চা, ভোগরাগ, মহোৎসব ইত্যাদির মাধ্যমে কোনও দিনই একরকম কাটে না। তারমধ্যে সাধন সম্পন্ন সাধুসজ্জনদের বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতার কথাও কিছু কম আকর্ষণীয় নয়। তবে এই সমস্ত কিছুর মধ্যেই আশ্রম-বাড়িতে কিছু নিত্য করণীয় পুজার্চনা, ব্রতনিয়ম থাকেই এবং একটি বালক ছোট বয়স থেকেই সেগুলিতে অধিকার পেলে, সে মনে মনে একটু গৌরবান্বিতও বোধ করে। একটি আশ্রমের আচার্য হিসেবে মহর্ষি ভরদ্বাজ তাঁর শিশুপুত্রকে আর কিছু দিতে না পারলেও তাঁর আশ্রমে প্রচলিত বৈদিক ব্রাহ্মণ্যের উত্তরাধিকারটুকু অবশ্যই দিতে পেরেছিলেন।

অতএব ক্ষণিকের চাপল্যে দ্রোণের জন্ম হলেও মহর্ষি ভরদ্বাজ তাঁকে যে সান্নিধ্য দিয়েছিলেন, তাতে ব্রাহ্মণোচিত অধ্যয়ন দ্রোণের ওপর ভারী হয়ে চেপে বসছিল এবং দ্ৰোণকে বেদবেদাঙ্গও বেশ ভালভাবেই পড়তে হচ্ছিল—অধ্যগীষ্ট স বেদাংশ্চ বেদাঙ্গানি চ সর্বশঃ। কিন্তু বহুতর অধ্যয়ন সম্পন্ন করা সত্ত্বেও ব্রাহ্মণের স্বধর্ম—অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, যজনযাজন অথবা দানপ্রতিগ্রহ—এগুলি দ্রোণের ভাল লাগছিল না। হয়তো তখন তাঁর কিশোর বয়স কেটেছে কেবল। যৌবনসন্ধির পূর্বকালে অন্য কোনও চমৎকার তাঁর মন অধিকার করেছিল নিশ্চয়ই। যজনযাজন আর দক্ষিণার ওপর নির্ভর করে জীবন চালানোর মধ্যে ব্রাহ্মণের যে ত্যাগ ভোগের গৌরব ছিল, সে গৌরব দ্রোণ তেমন করে আত্মসাৎ করতে পারেননি। হয়তো এর পিছনেও জননীর অনুপস্থিতি একটা বড় কারণ হয়ে থাকতে পারে। কারণ, সেকালের দিনে পিতাঠাকুররা যে বৃত্তি গ্রহণ করতেন, গৃহমধ্যস্থিত জননীরা সেই বৃত্তিজীবিকায় সেভাবে অংশ নিতে না পারলেও স্বামীর বৃত্তির গৌরব বোধ করতেন আপন মনে এবং সে বৃত্তির গৌরব শিশুকাল থেকেই পুত্রদের মনে অনুস্ত করতেন অদ্ভুত মহিমায় এবং আন্তরিকতার সঙ্গে।

দ্রোণের কাছে জননীর এই অন্তরাল নিবেদন একেবারেই অস্পষ্ট ছিল। কিন্তু বেদ ব্রাহ্মণ্যের দিকে দ্রোণের যে শেষপর্যন্ত কোনও রুচি হল না, তার কারণ বোধহয় দ্রোণ-পিতা ভরদ্বাজের স্বকীয় বৃত্তিবৈচিত্র্য। সেকালের দিনে বেশ কিছু মুনিঋষির সন্ধান আমরা পাব, যাঁরা ব্রাহ্মণের যাগযজ্ঞ নিয়ে ব্যাপৃত থাকলেও ক্ষত্রিয়ের ধনুর্বাণচালনা অভ্যাস করতেন অবসর সময়ে। রামায়ণের মধ্যে কত মুনিঋষির নাম পাবেন, যাঁদের কাছ থেকে মহাভাগ রামচন্দ্র বিচিত্র অস্ত্ররাজি লাভ করেছেন রাক্ষসবধের জন্য। সেইসব ঋষিনামের মধ্যে আমাদের আলোচ্য ভরদ্বাজের নামও পাবেন। হয়তো সেই ভরদ্বাজ আর এই ভরদ্বাজ এক নয়। কেননা, শিষ্যপ্রশিষ্য ক্রমে ঋষিদের বংশ পরম্পরা তৈরি হত সেকালে এবং মূল ঋষির নামেই তৈরি হয়ে যেত এক একটি ইনস্টিটিউশন বা সম্প্রদায়। ভরদ্বাজরাও সেইরকম। যদিও ভরদ্বাজদের মূল আচার্যকে অবশ্যই ভরদ্বাজ বলা হত।

তবে হ্যাঁ, মহাকাব্যের অন্য ঋষিমুনিদের তুলনায় ভরদ্বাজদের একটু আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল বলেই মনে হয়। চাকুরিজীবী লোক যদি ছবি আঁকে ভাল বা গান ভাল করে, তবে যেমন একসময় তার জীবিকার মুখ্যতা অঙ্কন বা গানের প্রতিভায় ঢাকা পড়ে যায়, মহর্ষি ভরদ্বাজেরও তাই হয়েছিল। তাঁর অস্ত্রশিক্ষার চমৎকার এতটাই বেশি ছিল যে কিছু কিছু শিক্ষার্থী ভরদ্বাজের কাছে অস্ত্রশিক্ষা লাভ করার জন্যই আসত। একবার ভেবে দেখুন, দ্রোণের শিশুমনে এর কী প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে। দৈনন্দিন বেদ পাঠ অধ্যয়ন এবং যাগযজ্ঞের প্রক্রিয়ার মধ্যে যে একঘেয়েমি আছে, অবসরকালীন অস্ত্রচালনার নৈপুণ্য এবং বিচিত্রতা সেই একঘেয়েমি ধুয়ে মুছে দেয়। হয়তো মহর্ষি ভরদ্বাজের কাছে তাঁর এই অস্ত্রচালনার গৌণী বৃত্তি অবসরকালীন মধুরতায় ধরা দিত, চাকুরিজীবী ব্যক্তির কাছে যেমন অবসরকালীন ছবি আঁকার মুক্তি অথবা গীতবাদ্যের হৃদয়হরণ আবেদন। কিন্তু একবার ভাবুন তো, দ্রোণের শিশুমনে এর কী প্রতিক্রিয়া হয়ে থাকতে পারে। মুখ্য বৃত্তির দৈনন্দিন চিরাচরণ যখন পদে পদে একটি পুরুষকে খণ্ডিত করে, খণ্ডিত করে এবং খণ্ডিত করে, গৌণী বৃত্তির সরসতা তখন একটু একটু অধিকার করে বালকের মন, তাকে আপ্লুত করে, মুগ্ধ করে। দ্রোণেরও ঠিক তাই হয়েছিল।

আপনারা যাঁরা মহর্ষি ভরদ্বাজের অস্ত্রচালনার বুদ্ধিকে ‘সাইড-বিজনেসে’র বুদ্ধি বলে ভাবছেন, তাঁরা নিজের মুখ্য জীবিকাও ঠিক মতো পালন করেন বলে মনে করি না। কিন্তু নিজের স্বধর্ম পালন করেও যাঁরা সন্ধ্যার অবসরে তানপুরা নিয়ে বসেন, অথবা বসেন রং তুলি আর প্যালেট নিয়ে, তাঁরা বুঝবেন—প্রধান বৃত্তি ক্ষুধার অন্ন যোগায় বটে, কিন্তু সন্ধ্যার সেই অবকাশ বিনোদন শুধু বিনোদনমাত্র নয়, ওইটিই তাঁদের প্রাণের আরাম, আত্মার আনন্দ। দৈনন্দিনতার গ্লানি-ক্ষুব্ধ অন্তরে ওই আপাত গৌণ ব্যবহারটুকু যে কেমন করে জ্বলতে থাকে, কেমন করে যে সকলের অজান্তেই তা ভীষণ রকমের মুখ্য হয়ে ওঠে, তা বুঝবেন শুধু তাঁরাই, যাঁরা মনের তাগিদে ওই মুক্তিটুকু খোঁজেন। খেয়াল করে দেখবেন—এই জাতীয় পিতামাতার সন্তান যদি কোনওভাবে কোনও শিল্প চেতনার দ্বারা আকৃষ্ট হন, তবে সেই পিতামাতারা আপন পুত্রকন্যার মধ্যে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করেন এবং যে কোনও মূল্যে তাঁরা সেই পুত্রকন্যাদের প্রতিভা আবিষ্কারে ব্যস্ত হন।

না হলে মহর্ষি ভরদ্বাজের ক্ষেত্রেই বা এমন হবে কেন! তিনি ‘সংশিতব্রত’ ঋষি, সারা জীবন যজ্ঞকর্ম, যজনযাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনায় তাঁর দিন কেটেছে। প্রিয় পুত্র দ্রোণকেও তিনি বেদ বেদাঙ্গের সম্পূর্ণ শিক্ষা দিয়েছেন আপন ঋষি বংশের ধারা অনুযায়ী। কিন্তু এই বেদ বেদাঙ্গের শিক্ষার কথা এক লাইনে বলেই মহাভারতের কবি বললেন—অগ্নিবেশ্য নামে ভরদ্বাজের এক অতি প্রিয় শিষ্য ছিলেন। সকলে তাঁকে অগ্নির পুত্র বলেই মনে করতেন—অগ্নেস্তু জাতঃ স মুনিস্তুতো ভরতসত্তম। সেই অগ্নিসম্ভব অগ্নিবেশ্যকে ভরদ্বাজ অস্ত্রশিক্ষা দিয়েছিলেন একসময় এবং তাঁর অস্ত্রচালনার প্রতিভায় মহর্ষি এতটাই প্রীত হয়েছিলেন যে, অস্ত্রশিক্ষার চরম আগ্নেয় অস্ত্রের শিক্ষাটি একমাত্র অগ্নিবেশ্যকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ভরদ্বাজ। হয়তো উপহার হিসেবে নিজ গৃহে রক্ষিত একটি আগ্নেয় অস্ত্রও তাঁকে। দিয়েছিলেন মহর্ষি—প্রত্যপাদয়দ্‌ আগ্নেয়ম্‌ অস্ত্রমস্ত্রবিদাং বরঃ।

ভরদ্বাজ যখন অগ্নিবেশ্যের গুরু হিসেবে উপস্থিত, তখন মহাভারতের কবি তাঁর বিশেষণ দিচ্ছেন অস্ত্রবিদাং—বরঃ, অর্থাৎ অস্ত্রবিদ ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ, অথচ এই একটু আগেই ঘৃতাচী অপ্সরার সঙ্গে মিলনপূর্ব সময়ে কবি তাঁর বিশেষণ দিয়েছেন—‘মহান্‌ ভগবান্ ঋষিঃ।’ ঠিক এইখানেই ওই জীবিকা আর আত্মানন্দের কথাটি আসে। অথচ ভরদ্বাজ অন্যতম প্রধান অস্ত্রবিদ হলেও তিনি ব্রাহ্মণের বৃত্তি ত্যাগ করেননি। ত্যাগ করেননি হবির্ধান মণ্ডপের করণীয় কর্তব্যগুলি। কিন্তু আনন্দের অনুশীলনীটুকু যেহেতু শিল্পীর মনে অনুক্ষণ জ্বলতে থাকে, তাই যে মুহূর্তে তিনি দ্রোণের মধ্যে অস্ত্রশিক্ষার মুগ্ধতা লক্ষ করেছেন, সেই মুহূর্তেই তিনি তাঁকে পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রিয় শিষ্য অগ্নিবেশ্যের কাছে।

ভরদ্বাজ নিজে পুত্রকে অস্ত্রশিক্ষা দেননি, কারণ তাতে কথা উঠত। কথা উঠত—ঋষি ব্রাহ্মণ হয়ে পিতা তাঁর পুত্রকে নিজেই স্বধর্ম ত্যাগ করতে শেখাচ্ছেন, ব্রাহ্মণের বৃত্তি ত্যাগ করতে শেখাচ্ছেন। অতএব তিনি তাঁর প্রিয় শিষ্য অগ্নিবেশের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখতে পাঠিয়েছেন। এর পিছনে অবশ্য অন্য উদ্দেশ্যও থেকে থাকবে। পিতা পুত্রকে নিজেই শিক্ষা দিলে অনেক সময় অসুবিধেও হয়। স্নেহবৃত্তি প্রবল থাকার ফলে যেসব জায়গায় ক্রোধ প্রকাশ করা উচিত, সেসব জায়গায় তিনি মুখর নাও হতে পারেন তত, কখনও বা অতি স্নেহের দরুন ছাত্রের করণীয় পরিশ্রমসাধ্য অনুশীলন কর্ম তিনি বাদ দিয়েও দিতে পারেন। কিন্তু অন্যের কাছে পাঠালে, বিশেষত ‘প্রোফেশনাল’ লোকের কাছে বিদ্যা শিখতে পাঠালে কাজটি সুসম্পন্নও হয়। কারণ ছিল আরও। আগ্নেয় অস্ত্রের যে শিক্ষা তিনি অগ্নিবেশ্যকে শিখিয়েছিলেন, তা যেহেতু অন্য কাউকে তিনি শেখাননি, অতএব পিতা হিসেবে ভরদ্বাজ চেয়েছিলেন। যে, তাঁর প্রিয় পুত্রের শিক্ষা সম্পূর্ণ হোক সেকালের চরম বিদ্যা আগ্নেয়াস্ত্রের অনুশীলনেই এবং তা হোক অগ্নিবেশ্যের কাছ থেকেই। এতে করে বিদ্যাও যেমন অধিগত হবে, অন্যদিকে দ্রোণের বুদ্ধি ক্ষমতা থাকলে অগ্নিবেশ্যকে দেওয়া ভরদ্বাজের সেই আগ্নেয়াস্ত্রের উপহার আবারও ফিরে আসবে দ্রোণের কাছেই—শিষ্য পরম্পরাক্রমে আবারও পুত্র পরম্পরায়।

যাই হীক, বালক দ্রোণ বেদ বেদাঙ্গের পাঠ শেষ করে অস্ত্রশিক্ষার জন্য উপস্থিত হলেন অগ্নিবেশের শিক্ষাশ্রমে। সেকালের গুরুগৃহে শিক্ষার্থী বালকের আবাস খুব সুখকর হত না। আরমপ্রদ তো নয়ই। গুরুর সংসারসাধন এবং ধর্মক্রিয়া এই দুয়েতেই বিদ্যার্থীর আন্তরিক ভূমিকা ছিল। ফলে শারীরিক পরিশ্রম হত যথেষ্টই। গুরুকুলে স্থায়ী হওয়ার প্রথম শর্ত ছিল ব্রহ্মচর্য অর্থাৎ বহিরিন্দ্রিয় এবং অন্তরিন্দ্রিয় দমন করে সমস্ত বাহ্যসুখ দমন করে মনকে অন্তর্মুখী করে তোলা। এর সঙ্গে ছিল বিনয়শিক্ষা। বিনয় শব্দটাকে আভিধানিক বুদ্ধিতে বিনয় বা ‘মডেস্টি’ ভাবার কোনও কারণ নেই। পণ্ডিত শাস্ত্রকারেরা বলেছেন—শিষ্য যা শিখতে চায় সে সম্বন্ধে শোনবার ইচ্ছে, গুরুর কাছ থেকে বিদ্যা সম্বন্ধে আনুপূর্বিক শোনা, সেগুলি গ্রহণ করা, বুদ্ধিতে ধারণ করা, তার সম্বন্ধে মানসিক তর্ক, ভ্রান্তির নিরাস এবং পরিশেষে তত্ত্বের প্রতি অভিনিবেশ—এই এতগুলি ধাপের মধ্যে দিয়ে বিনয়শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় এবং এই শিক্ষার বলে বাহ্য এবং অন্তরিন্দ্রিয়ও সংযত হয়।

ভরদ্বাজপুত্র দ্রোণ পরবর্তীকালে নিজের মুখে জানিয়েছেন যে, অস্ত্রশিক্ষার জন্য তিনি যখন মহর্ষি অগ্নিবেশের আশ্রমে থেকেছেন, তখন তাঁকে কঠোর পরিশ্রম করে গুরুসেবা করতে হয়েছে, পালন করতে হয়েছে ব্রহ্মচর্য এবং শিক্ষা করতে হয়েছে বিনয় ব্রহ্মচারী বিনীতাত্মা…গুরুশুশ্রূষণে রতঃ। অগ্নিবেশ্যের আশ্রমে থাকতেও হয়েছে অনেক কাল, অনেক বৎসর। কষ্ট সহনের দিক থেকে সময়ের এই দীর্ঘতাও কিছু কম নয়। দ্রোণ বলেছেন—এক নয়, দুই নয় বহু বৎসর আমি গুরুর আশ্রমে থেকেছি, থাকতে থাকতে তৈলহীন মলিনতায় আমার মাথায় জমেছিল জটাজুট—অবসং সুচিরং তত্র জটিলো বহুলাঃ সমাঃ। তবু সেই গুরুগৃহবাস কষ্টকর হয়ে ওঠেনি দ্রোণের কাছে। কষ্টকর হয়ে ওঠেনি যে, তার আপাতগ্রাহ্য কারণ আছে মাত্র দুটি। এক তো মনের মধ্যে সেই দুর্নিবার ইচ্ছা-অস্ত্রের শিক্ষায় সকলকে ছাড়িয়ে গিয়ে গুরু অগ্নিবেশের কাছ থেকে আগ্নেয় অস্ত্র লাভ করতে হবে তাঁকে। কিন্তু অনন্ত পরিশ্রমসাধ্য এই অস্ত্রশিক্ষার মধ্যেও যা তাঁকে শান্তি দিত, অথবা যা তাঁকে মুগ্ধ করত, সে হল এক অসাধারণ বন্ধুত্ব—মহর্ষি অগ্নিবেশের আশ্রমে ওই বন্ধুত্বই ছিল তাঁর নিশ্বাস এবং বিশ্বাস দুইই।

গুরুগৃহের অন্তেবাসী দ্রোণের এই বন্ধুর পরিচয় দিতে গেলে আবারও দ্রোণের পিতা ভরদ্বাজের কথা আসবে। পঞ্চাল রাজ্যের বিখ্যাত যেসব রাজা ছিলেন, সেই সৃঞ্জয় সোমকদের বংশধারার অধস্তন পুরুষ হলেন মহারাজ পৃষত। তিনি ছিলেন মহর্ষি ভরদ্বাজের অতি প্রিয় সখা—ভরদ্বাজসখা চাসীৎ পৃষতো নাম পার্থিবঃ। একজন শাসক রাজার সঙ্গে ব্রাহ্মণ-ঋষি ভরদ্বাজের বন্ধুত্ব কেন গড়ে উঠেছিল, সেটা ভালই অনুমান করা যেতে পারে। আমরা জানি ভরদ্বাজ ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রবিদ্যা খুব ভালই জানতেন। সবচেয়ে বড় কথা সে যুগের চরম এবং পরম যে অস্ত্রসন্ধি, সেই আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার জানতেন ভরদ্বাজ। হয়তো এই অস্ত্রকৌশল জানার প্রয়োজন ছিল মহারাজ পৃষতের। তাঁর নিজের বয়স বা আভিজাত্য ভরদ্বাজের সমানুপাতিক হওয়ায় পৃষত স্বয়ং ভরদ্বাজের কাছে শিষ্যবৎ আনত হননি। কিন্তু তিনি তাঁর বালক পুত্রকে ভরদ্বাজের কাছে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। পৃষতের পুত্রের নাম দ্রুপদ।

না, এ কথা কখনওই বলব না যে, পড়ার অছিলায় ভরদ্বাজের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করানোটাই পৃষতের মূল উদ্দেশ্য ছিল। কেননা উদ্দেশ্য থাকলেও তিনি তা প্রকট করেননি। তিনি দ্রুপদকে বন্ধু-ঋষি ভরদ্বাজের কাছে পাঠিয়েছিলেন বেদ বেদাঙ্গ পড়বার জন্য। সেকালের দিনের রাজপুত্রদের ঋক সাম যজুর্বেদ জানা ত্রৈবিদ্য ব্রাহ্মণের কাছে বেদ বেদাঙ্গ শিখতে হত সবিনয়ে। পৃষত সেই কারণেই পুত্র দ্রুপদকে প্রতিদিন নিয়ে আসতেন বন্ধু ভরদ্বাজের কাছে অথবা পাঠিয়ে দিতেন শিক্ষার জন্য। কিন্তু মুখে না বললেও তিনি মনে মনে জানতেন যে, ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্র শিক্ষার প্রতি ভরদ্বাজের এতটাই আগ্রহ আছে যে, একসময় না একসময়ে নিজ পুত্র দ্রোণকে তিনি অস্ত্রশিক্ষা দেবেনই। ঠিক সেই সুযোগে দ্রুপদও যাতে ভরদ্বাজের মতো মহান অস্ত্রগুরুর শিক্ষা লাভ করতে পারেন, সেইজন্যই শিশু অবস্থা থেকে বন্ধু ভরদ্বাজের সঙ্গে বালক দ্রুপদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন পৃষত।

তা হলে সেই বালক অবস্থায় পিতার আশ্রমে নিত্য আসা দ্রুপদের সঙ্গে বালক দ্রোণের পরিচয়—স নিত্যাশ্রমং গত্বা দ্রোণেন সহ পার্ষতঃ। প্রতিদিন তাঁদের লেখাপড়া চলত একসঙ্গে—বেদপাঠ এবং বেদ-বিদ্যার সহকারী শিক্ষা, কল্প, জ্যোতিষ, ব্যাকরণের অভ্যাস। এতসব পড়াশুনোর ফাঁকে যখন অবসর মিলত, তখন খেলাধুলোও চলত যথেষ্ট—চিক্রীড়াধ্যয়নঞ্চৈব চকার ক্ষত্রিয়র্ষভঃ। বালক দ্রোণ যখন বড় হলেন, অপিচ পিতার কাছে বেদ বেদাঙ্গের প্রাথমিক পাঠও যখন শেষ হয়ে গেল, তখন পিতা ভরদ্বাজ তাঁকে পাঠিয়ে দিলেন প্রিয় শিষ্য অগ্নিবেশের আশ্রমে। পঞ্চালরাজ পৃষতের অভীষ্ট অনুসারে দ্রুপদেরও স্থান হল একই গুরুর কাছে। ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করার জন্য দ্রোণের মতো তিনিও হলেন আশ্রমের দ্বিতীয় আবাসিক—ইষ্বস্ত্ৰহেতো-র্ন্যবসত্তস্মিন্নেব গুরৌ প্রভুঃ।

এ কথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, রাজপুত্র বলে গুরুগৃহে দ্রুপদের কিছু কম পরিশ্রম ছিল। সেকালের ব্রাহ্মণ গুরুরা এখনকার মতো ছিলেন না। রাজশক্তির কাছে আপন শিক্ষার গৌরব বিকিয়ে দিয়ে এখনকার শিক্ষকেরা যেমন সরকার এবং তার অনুগামী দলনেতাদের পদলেহন করেন, তখনকার দিনের শিক্ষায় এত অগৌরব ছিল না। রাজা হও বা রাজপুত্র, শিক্ষকের অনুগামী হতে হবে তাকেই। ফলে গুরুগৃহের যাগযজ্ঞ সমাধানের জন্য শারীরিক যেসব খাটুনি আছে, তা দ্রোণকেও যেমন খাটতে হত, তেমনই খাটতে হত দ্রুপদকেও। এই পরিশ্রমের ওপরে ছিল অস্ত্রশিক্ষার পরিশ্রম এবং তাও এক বছর দু বছর নয়, বহু বছর ধরে।

ছাত্রাবস্থায় পিতামাতার ঘর ছেড়ে গুরুর আবাসে যারা থাকে, সেই আবাসিক ছাত্রদের মধ্যে এমনই এক বন্ধুত্ব হয়, যে বন্ধুত্ব সাধারণভাবে অকল্পনীয়। সমস্ত দিনের বিদ্যাশিক্ষার তন্ময়তা এবং পরিশ্রম যখন শেষ হয়, তখন ক্লান্ত অবসরে একজন আবাসিক সতীর্থ যে কতখানি বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, একমাত্র আবাসিক ছাত্রেরই সেটা উপলব্ধিগম্য। নিজের জীবনের সুখ, দুঃখ, বঞ্চনা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, পূর্বলব্ধ কষ্ট এবং ভবিষ্যতের ঈপ্সিত—এই সব কিছুই কোনও না কোনও সময় একজন আবাসিক ছাত্র তার সমানহৃদয় সতীর্থের কাছে বলে ফেলে। বলে ফেলে অন্তরঙ্গ মুহূর্তে, অবসরে, একাকিত্বের যন্ত্রণায় অথবা যন্ত্রণাবিলাসে।

ব্রাহ্মণ দ্রোণের সঙ্গেও পাঞ্চাল রাজপুত্র দ্রুপদের এমনই একটা বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। একই গুরুগৃহে থেকে একই শিক্ষা লাভ করতে গিয়ে যখন পরিশ্রম করতে হয়, হয়তো তখন উচ্চ নীচ ভেদ থাকে না, ধনী-দরিদ্রেরও ভেদ থাকে না, কিন্তু ভেদ যেটুকু থাকে সেটাকে ব্যাখ্যা করাও খুব কঠিন। আমি শিক্ষাক্ষেত্রে সতীর্থতার মধ্যে এমনটি দেখেছি যে, একজন মেধাবী অথচ দরিত্র ছাত্রের সঙ্গে যদি একজন অপেক্ষাকৃত অল্পমেধা অথচ ধনী ছাত্রের অন্তরঙ্গতা ঘটে, সেক্ষেত্রে পারস্পরিকভাবেই অদ্ভুত এক অল্প বয়সের রোমান্টিকতা কাজ করতে থাকে। ধনী ছাত্রটি তীক্ষ্ণধী দরিদ্র ছাত্রটিকে যথাসম্ভব অর্থের স্বাচ্ছন্দ্য দেবার চেষ্টা করে—বন্ধুকে সে ভাল খাওয়ায়, বড় বড় জায়গায় নিয়ে যাবার চেষ্টা করে এবং মাঝে মাঝে মহার্ঘ্য বস্তু উপহার দিয়ে তার দারিদ্র্যের গ্লানি মুছে দেবার চেষ্টা করে। অন্যদিকে তীক্ষ্ণধী দরিদ্র—সে যেহেতু আর কিছুই পারে না—সে তাই যতটা সম্ভব লেখাপড়ার সাহায্য করে ধনী বন্ধুকে কৃতজ্ঞতা পাশে বেঁধে রাখতে চায়।

একটা কথা অবশ্য জানিয়ে রাখা ভাল। ধনী দরিদ্রের এই প্রগাঢ় বন্ধুত্বের মধ্যে—বন্ধুত্বটা অসমান বলেই—একটা অন্তৰ্গূঢ় অহংবোধ কিন্তু থেকেই যায়। যে ধনী সে তার উপকার বিতরণ করে এক রকমের তুষ্টি লাভ করে। অন্যদিকে দরিদ্র তার দারিদ্র্যের অহংকার অথবা মেধার অহংকার নিয়ে তুষ্ট থাকে আরও একভাবে। প্রগাঢ় বন্ধুত্বের অন্তরালে, পারস্পরিক আদানপ্রদানের আবরণে ওই অহংবোধটুকু কিন্তু বাইরে থেকে ভাল করে বোঝাও যায় না, অন্তত বন্ধুরা সেভাবে বুঝতে পারে না সেই অহংবোধের প্রবহমানতা।

একেবারে অনুরূপ এই উদাহরণেই দ্রুপদ আর দ্রোণের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, সে কথা নিশ্চয়ই বলছি না। কিন্তু গুরুগৃহে থাকাকালীন সময়ে—হয়তো রাজপুত্র হওয়ার সুবিধে ছিল বলেই পার্ষত দ্রুপদ নানাভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন দ্রোণকে। দ্রোণ কীভাবে তাঁর কৃতজ্ঞতার পরিশোধ করতেন, সে কথা জানাননি মহাভারতের কবি, কিন্তু দ্রুপদের উপকার নিজ মুখেই পরে স্বীকার করেছেন দ্রোণ। এতে দ্রোণের বন্ধুত্ব এবং প্রিয়ত্ব হয়তো দ্রুপদের প্রতি গাঢ়তর হয়েছিল। তাঁর নিজের ভাষায়—স মে তত্র সখা চাসীদ্‌ উপকারী প্রিয়শ্চ মে।

ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মালে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেকালে যে দারিদ্র্য বরণ করতে হত, উত্তরাধিকার সূত্রে দ্রোণও যে সেই দারিদ্র্যের অধিকারী হবেন ভবিষ্যতে—সে কথা দ্রোণ জানতেন। হয়তো কোনও অবসরের একাকিত্বে দ্রোণ সে কথা প্রকাশও করে থাকবেন দ্রুপদের কাছে। সেই কবে বাল্যকালে পিতা ভরদ্বাজের আশ্রমে দ্রোণের সঙ্গে দেখা হয়েছিল দ্রুপদের। সে দিন থেকে একসঙ্গে খাওয়া শোওয়া, ওঠা বসা, এবং একত্রে অধ্যয়ন চলেছে নিরন্তর। এখন এই অগ্নিবেশ্যের অস্ত্র পাঠশালাতেও সেই সহাধ্যয়ন, সহভোজন এবং সহ অবসর যাপন চলছে। রাজপুত্র দ্রুপদ যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন সতীর্থ ব্রাহ্মণবন্ধুর গুরুগৃহবাসের কষ্ট লাঘব করে দিতে। কখনও প্রিয় কথা বলে, কখনও বা দ্রোণের প্রিয় কর্ম সম্পাদন করে দ্রুপদ তাঁর বাল্যবন্ধুর কষ্টসাধ্য অস্ত্রশিক্ষার দিনগুলি কথঞ্চিৎ মধুর করে তুলতেন। সবচেয়ে বড় কথা, দ্রুপদের এই প্রিয়বাদিতা অথবা দ্রোণের অভীষ্ট বুঝে কাজ করার কথাটা দ্রুপদ নিজে বলেননি। তাঁর এই সমস্ত বন্ধুত্বের কথা দ্রোণ নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন ভীষ্মের কাছে। বড় আদর করে বলেছেন—তিনি আমার আবাল্য বন্ধু, প্রিয়বাদী প্রিয়ংকর সখা—স মে সখা সদা তত্র প্রিয়বাদী প্রিয়ঙ্করঃ।

আমরা বুঝি—এইরকমই কোনও প্রিয়ত্বের মুহূর্তে দ্রুপদ দ্রোণকে কথা দিয়েছিলেন। দ্রোণ দরিদ্র ব্রাহ্মণ, অথচ ব্রাহ্মণ্যের অহংকারও তাঁর ছিল না, কারণ ব্রাহ্মণের বৃত্তিকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন না নিশ্চয়ই। পিতার গৃহে দারিদ্র্য দেখে দেখে একদিকে যেমন তিনি ক্ষত্রিয়োচিত অস্ত্রশিক্ষায় মন দিয়েছিলেন, তেমনই তাঁর অর্থস্পৃহাও ছিল দুরন্ত। জীবনে ভাল থাকব, ভাল ভোগ করব—এই আকাঙ্ক্ষা হয়তো একদিক দিয়ে স্বাভাবিক, কিন্তু সে যুগের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ে এই আকাঙক্ষার কোনও নৈতিক সমর্থন ছিল না। ত্যাগ এবং বৈরাগ্যই যেহেতু ব্রাহ্মণ্যের ভিত্তি ছিল, সেই নিরিখে দ্রোণের এই অর্থৈণা ছিল বিপরীত। গুরুগৃহবাসের ক্লান্ত অবসরে ব্রাহ্মণগৃহের ওই চিরন্তন দারিদ্র্যের কথা দ্রোণ নিশ্চয়ই কোনও সময় ব্যক্ত করেছিলেন বন্ধু দ্রুপদের কাছে। হয়তো বলেছিলেন—না, ব্রাহ্মণের যা স্বধর্ম, সেই যজনযাজন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা অথবা দানপ্রতিগ্রহের সরল জীবন তিনি চান না। এই জীবনে সম্মান থাকতে পারে অনেক, কিন্তু মুগ্ধতা নেই। দ্রোণ নিশ্চয়ই জানিয়েছিলেন যে, তিনি চান সেই উজ্জ্বল সমৃদ্ধির জীবন, যেখানে অর্থ, মান, ভোগ, দাস, দাসী, হস্তী, অশ্ব, রথ তাঁর করতলগত হবে। হয়তো দ্রোণ সুব্যক্তভাবে এসব কথা বন্ধু দ্রুপদের কাছে বলেননি, কিন্তু একটি নিশ্চিন্ত জীবন এবং অর্থৈষণার কথা প্রকটভাবে না বললেও ব্রাহ্মণ্য জীবনের অনিশ্চয়তা এবং দারিদ্র্য-চেতনা প্রকাশের মাধ্যমেও বিপ্রতীপভাবে তা প্রকট করা যায়। দ্রোণ হয়তো তাই করেছিলেন বন্ধুত্বের অবসরে অব্যক্ত হাহাকারে।

উলটো দিকে সেই কথাই আরও প্রমাণ হয় বন্ধু দ্রুপদের কৈশোরগন্ধী প্রতিজ্ঞাবাক্য থেকে। দ্রুপদ বাল্যসখাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন—আমি আমার পিতার অত্যন্ত আদরের ছেলে—অহং প্রিয়তমঃ পুত্রঃ পিতু-র্দ্রোণ মহাত্মনঃ। তিনি যখন আমাকে তাঁর রাজ্যে অভিষিক্ত করবেন, সেদিন আমার রাজ্য আমার মতো তোমারও ভোগ্য হবে। এ আমি সত্য-প্রতিজ্ঞা করে বলছি, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো—তদ্‌ভোগ্যং ভবিতা রাজ্যং সখে সত্যেন তে শপে। ‘সত্য’ শব্দটি উচ্চারণ করে প্রতিজ্ঞা করার মধ্যে সেকালের দিনে কিছু আইনি তাৎপর্য ছিল। সেকালের দিনের আইনের বই বলতে বোঝাত ধর্মসূত্র এবং ধর্মশাস্ত্রগুলিকে। এই ধর্মশাস্ত্র এবং উকিলি ব্যবহারবিধির বই থেকে বেশ তথ্য দিয়েই বলা যেতে পারে যে, উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ থাকলে প্রতিজ্ঞাত সত্যের ফয়সালার জন্য ধর্মাধিকরণের দ্বারস্থও হওয়া যেত। দ্রুপদ সেই সত্য উচ্চারণ করে বলেছেন—আমার রাজ্য তোমারও ভোগ্য হবে। তবে এই ভোগ্য বস্তুর সীমা কী হবে, সে সম্বন্ধে দ্রুপদ খুব অসচেতন ছিলেন বলে মনে হয় না। হয়তো সেই জন্যই ‘সত্য’ উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই বলেছেন—আমি যা ভোগ করব বা উপভোগ করব, তা তোমারও ভোগ্য হবে, ভাই! আমার অর্থ, ধন, আমার সুখভোগ, সেসব তোমারও অধীন হবে—মম ভোগাশ্চ বিত্তঞ্চ ত্বদধীনং সুখানি চ।

ভোগ বলতে কী বোঝায়? টীকাকার বলেছেন—যা ভোগ করে মানুষ তাই ভোগ—হাতি, ঘোড়া, রথ ইত্যাদি রাজযোগ্য বস্তু। আর কী? বিত্ত। অর্থ। আর কী? রাজার উপভোগ্য সুখ। উত্তম ভোজন, শয়ন, আসন, দাস, দাসী ইত্যাদি। মনে রাখা দরকার, দ্রুপদ কিন্তু গলিতহৃদয়ে এমন প্রতিজ্ঞা কখনও করেননি যে, তিনি তাঁর রাজ্যের ভাগ দ্রোণকেও কিছুটা দিয়ে দেবেন। তিনি যা বলেছেন তার নির্গলিতাৰ্থ এই যে, দ্রুপদের রাজযোগ্য ভোগসুখ দ্রোণও লাভ করবেন ভবিষ্যতে।

যাই হোক বন্ধুত্বের খাতিরে এই যে সব সান্ত্বনা এবং প্রতিজ্ঞা-বাক্য উচ্চারিত হয়েছে, তা হয়তো দুই সতীর্থের গুরুগৃহবাসের শেষ পর্বেই হয়ে থাকবে। কেননা এর পরেই দ্রোণ বলেছেন—এইকথা বলে দ্রুপদ অস্ত্রশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাঞ্চাল রাজধানীতে ফিরে গেছেন—এবমুক্ত্বাথ বব্রাজ কৃতাস্ত্রো পূজিতো ময়া। অর্থাৎ দ্রুপদের প্রতিজ্ঞাবাক্য শুনে দ্রোণ তাঁকে কৃতজ্ঞতাও জানিয়েছেন এবং দ্রুপদও ফিরে গেছেন রাজধানীতে। এ প্রসঙ্গে একটা কথা কিন্তু দ্রোণের জবানীতে অনুক্ত রয়ে গেল। সেটা আগ্নেয়াস্ত্র লাভের কথা। দ্রোণ এবং দ্রুপদ একইসঙ্গে অস্ত্রশিক্ষা শেষ করলেন বটে, কিন্তু মহর্ষি অগ্নিবেশের কাছ থেকে দ্রোণই শুধু আগ্নেয় অস্ত্র অথবা সেকালে চরমভাবে যাকে ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ বলা হত, সেই ব্রহ্মাস্ত্র লাভ করলেন। দ্রুপদ কিন্তু নয়। হয়তো পিতা ভরদ্বাজের কাছ থেকে অগ্নিবেশ্য স্বয়ং আগ্নেয় অস্ত্র লাভ করেছিলেন, সেই কৃতজ্ঞতাতেই পক্ষপাতগ্রস্ত হয়েছেন অগ্নিবেশ্য অথবা দ্রোণ দ্রুপদের চেয়ে অস্ত্রবিদ্যায় বেশি কৃতী ছিলেন সেইজন্য—যে কোনও কারণেই হোক, দ্রোণ তাঁর গুরুর কাছ থেকে অসাধারণ আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধান শেখার সুযোগ পেলেন, কিন্তু দ্রুপদ এই সুযোগ পেলেন না।

অবশ্য এই বাবদে দ্রুপদের কোনও দুঃখ ছিল বলেও মনে হয় না। ঈর্ষা তো নয়ই। কেননা এর যে কোনও একটা থাকলেই দ্রুপদ দ্রোণকে রাজসুখের আশা দিয়ে রাজধানীতে ফিরে যেতেন না। অন্তত গুরুর আশ্রম ছেড়ে যাবার অন্তিম মুহূর্তে দ্রুপদের বক্তব্যের মধ্যে যে দ্রোণের প্রতি তাঁর আন্তরিকতার অভাব ছিল না, সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। দ্রোণের কথা থেকেই তা বোঝা যায়, তাঁর মৌখিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন থেকেও তাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গুরুগৃহে অস্ত্রচর্যার শেষ পুরস্কার হিসেবে দ্রোণ যে অস্ত্রটি আচার্য অগ্নিবেশ্যের কাছ থেকে পেলেন, তার নাম ব্রহ্মশির। এই ব্রহ্মশির মহর্ষি ভরদ্বাজের দেওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের নামান্তর কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে। এটা মনে রাখা দরকার, মহর্ষি ভরদ্বাজ ছাড়াও অগ্নিবেশ্য অগস্ত্যেরও শিষ্য ছিলেন। হয়তো তাঁর কাছেই তিনি ব্রহ্মশির নামে অতি ভয়ংকর এবং লোকক্ষয়কারী ওই অস্ত্রটি পেয়েছিলেন। দ্রোণের অস্ত্রচর্চা এবং তাঁর অস্ত্রসাধনায় তুষ্ট হয়ে অগ্নিবেশ্য তাঁর আপন গুরুপরম্পরায় প্রাপ্ত অস্ত্রটি দ্রোণের হাতে তুলে দিলেন। এ অস্ত্র তাঁর হাতেই তুলে দেওয়া যায়, যিনি পরবর্তী প্রজন্মের গুরু হবার উপযুক্ত। অস্ত্র শিক্ষার সঙ্গে অস্ত্র প্রয়োগের সংযম যাঁর সম্পূর্ণ অধিগত তাঁকেই এই ব্রহ্মশির দান করা যায়। দ্রোণের সেই সংযম বিনয় থাকা সত্ত্বেও অস্ত্রচালনার অসম্ভব ক্ষমতা যদি কখনও তাঁকে বিচলিত করে, সেই ভয়ংকর মুহূর্তের কথা ভেবেই দ্রোণের হাতে ওই চরমাস্ত্রের সন্ধান জানানোর সময় অগ্নিবেশ্য তাঁকে বলেছিলেন—বৎস দ্রোণ! তুমি এই অস্ত্র যেন কখনও সাধারণ মানুষের ওপর অথবা অল্পশক্তি লোকের ওপর প্রয়োগ কোরো না—ভারদ্বাজ বিমোক্তব্যম্‌ অল্পবীর্যেষ্বপি প্রভো।

অমানুষী অস্ত্র লাভ করে দ্রোণ ফিরে এলেন পিতা ভরদ্বাজের আশ্রমে এবং পাঞ্চাল রাজপুত্র ফিরে গেলেন পিতা পৃষতের রাজধানীতে। দুই বন্ধুর আশা আকাঙ্ক্ষা, প্রতিজ্ঞা-বিশ্বাসের সাক্ষী হয়ে রইল শুধু অস্ত্রচর্চার সেই পাঠশালাটি, গুরু অগ্নিবেশের বিদ্যায়তন।