দ্রোণাচার্য – ৮

॥ ৮ ॥

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন আরম্ভ হয়েছে, দ্রোণের বয়স তখন পঁচাশি। আজকের দিনে এই বয়সে যুদ্ধের কথা শুনে হাসি পেতে পারে, কিন্তু মহাভারতের যুগে অনেকেরই আয়ুর পরিমাণ অনেক বেশি দেখছি, কাজেই হয়তো যুদ্ধ করার ক্ষমতাও অনেক বেশি দিন থাকত। বিশেষত দ্রোণের যুদ্ধক্ষমতা যেহেতু অনেকটাই অভিজ্ঞতানির্ভর, তাই মহাভারতীয় আয়ুষ্কালের নিরিখে তাঁর যুদ্ধ করাটা মোটেই আশ্চর্যের নয়। ভীষ্মের সেনাপতিত্বকালে দ্রোণ যথেষ্ট যুদ্ধ করেছেন বটে, তবে তাঁর অস্ত্ৰক্ষমতা এবং অভিজ্ঞতা প্রদর্শনের সময় এল তিনি নিজে সেনাপতি নিযুক্ত হওয়ার পর।

লক্ষণীয় ঘটনা হল, যেদিন থেকে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে, সেদিন থেকেই দুর্যোধন ভীষ্ম-দ্রোণের মতো সর্বস্বীকৃত ব্যক্তিত্বদের যথেষ্ট সম্মান দিয়েই চলছিলেন। যুদ্ধের উদ্যোগকালেই দুর্যোধন দ্রোণাচার্যকে এক অক্ষৌহিণী সেনার নায়কত্বে নিযুক্ত করেছিলেন এবং দ্ৰোণও সে ভার বহন করছিলেন সানন্দে এবং দুর্যোধনের প্রীতি-ব্যবহারে খানিকটা অভিভূত হয়েই। দশদিন ভয়ংকর যুদ্ধ করে ভারত যুদ্ধের প্রথম সেনাপতি ভীষ্ম যখন শরশয্যা গ্রহণ করলেন, দুর্যোধন তখন বড় সমস্যায় পড়লেন। তাঁর পক্ষাশিত সম্মিলিত সেনার অধিপতিত্ব কাকে দেওয়া যায়, এই নিয়ে দুর্যোধনের মনে অনেক দুর্ভাবনা ছিল। এই সমস্যা নিয়ে যাঁর সঙ্গে তাঁর বিস্তারিত আলোচনা হয়, তিনি হলেন কর্ণ। সেই কর্ণ যিনি চিরকাল দ্রোণাচার্যকে বিদ্বেষ করে এসেছেন, সেই কর্ণ যিনি চিরকাল কুরুদের অন্নভোজী দ্রোণাচার্যকে কৃতঘ্নতার দায়ে অভিযুক্ত করেছেন।

আসলে বিপদ এবং বাস্তব পরিস্থিতি মানুষকে অনেক শিক্ষা দেয়। রাজনীতিতে যে নেতা বিরোধী পক্ষে দাঁড়িয়ে সরকারের আদ্যশ্রাদ্ধ করেন তিনিই সরকারি মন্ত্রী হলে কেমন নিশ্চুপ হয়ে যান। এখানেও সেইরকমই ঘটেছে। যে কর্ণ দ্রোণাচার্যের বিরোধিতায় সর্বদা মুখর ছিলেন, তিনিই আজ ভীষ্মকে শরশয্যা গ্রহণ করতে দেখে প্রখর বাস্তববোধে অন্য কথা বলছেন। কাকে সেনাপতি করা যায়—দুর্যোধনের এই সমস্যার মধ্যে কর্ণকেই সেনাপতি করার ইঙ্গিত ছিল। কিন্তু কর্ণ বললেন—এখানে সেনাপতি হবার মতো গুণ অনেকেরই আছে। সমস্যা হল—সবাইকে তো আর একসঙ্গে সেনাপতি করতে পারবে না এবং সেনাপতি হবেন তিনিই যাঁর মধ্যে বিশেষ গুণ আছে—এক এব তু কর্তব্যো যস্মিন্ বৈশেষিকাঃ গুণা। কিন্তু সেই একজনকে সেনাপতি করলে সমগুণসম্পন্ন অন্যজন ব্যথিত হবেন এবং তিনি তোমার ভাল করবেন না মোটেই। অতএব সমাধান হল—এখানে সমস্ত বড় বড় যোদ্ধাদের আচার্যস্থানীয় দ্রোণ আছেন। সেনাপতি করো তাঁকেই। তাঁর অভিজ্ঞতা বয়স কোনওটাই কম নয়—স এব সর্বযোধানামাচাৰ্য্যঃ স্থবিরো গুরুঃ। শুক্রাচার্য এবং বৃহস্পতির মতো তাঁর রাজনীতির জ্ঞান। অপিচ দ্রোণ যদি সেনাপতির কাজ করেন, তবে দুনিয়ায় এমন যোদ্ধা নেই, যে নাকি তাঁর অনুগামী না হবে—দ্রোণং যঃ সমরে যান্তং নানুযাস্যতি সংযুগে।

আজ এই পরম বিপন্নতার সময় একজন চিরন্তন দ্রোণবিরোধীর মুখে দ্রোণের যে মর্যাদার কথা শোনা গেল সেটা সত্য না হয়ে পারে না। কর্ণের কথা দুর্যোধনের পছন্দ হয়েছে এবং কৌরববাহিনীর সেনাপতিত্ব গ্রহণ করার জন্য তিনি দ্রোণকে সবিনয়ে অনুরোধ করেছেন। সেই মুহূর্তে তাঁর নিয়োগের কারণ হিসেবে দুর্যোধন দ্রোণের যে গুণগুলির কথা উল্লেখ করেছেন, তাতে বোঝা যায় যে, ভীষ্মের পতনের পর কৌরবদের মধ্যে এমন অধিগুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন না, যিনি দ্রোণের সমমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

দুর্যোধনের সেনাপতি-বরণ মেনে নিলেন দ্রোণ। তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, তাঁর সেনাপতিত্বের কালটুকু পাণ্ডবদের পক্ষে সুখকর হবে না মোটেই। দ্রোণ যুদ্ধ করবেন, যুদ্ধে পাণ্ডবসৈন্য ধ্বংস করবেন—এসব ব্যাপারে অনেক কথা দিলেন। কিন্তু একেবারে শেষে দৃঢ়ভাবে দুর্যোধনকে জানালেন যে, তিনি কোনও ভাবেই দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধ করবেন না। কারণ দ্রোণবধের জন্যই ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম। বেশ বুঝতে পারি, আচার্যের মনে সেই ‘গিল্টি কনশিয়েনস’ কাজ করে—একদিন তিনি দ্রুপদকে বেঁধে এনে তাঁর রাজ্যার্ধ কেড়ে নিয়েছিলেন। এই ঘটনায় দ্রুপদ যে কত অপমানিত, কত ক্ষুন্ন হয়েছিলেন—দ্রোণ তা অনুভব করেন। আজ এই বৃদ্ধ বয়সে হয়তো তিনি তাঁর পূর্বকৃত হঠকারিতার প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। যেদিন থেকে তিনি শুনেছেন যে, দ্রুপদ তাঁরই বধের জন্য যজ্ঞাগ্নি থেকে লাভ করেছেন ধৃষ্টদ্যুম্নকে, সেদিন থেকেই পরম আদরে তিনি বরণ করেছেন এই নিয়তিকে। ধৃষ্টদ্যুম্ন শত্রুর পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে অস্ত্রশিক্ষা দিতেও দ্বিধা করেননি দ্রোণ। আর আজ তিনি সেই নিয়তির পথ প্রশস্ত করে রাখলেন দুর্যোধনের কাছে—কুমার ধৃষ্টদ্যুম্নকে তিনি বধ করবেন না।

দুর্যোধন দ্রোণের শেষ কথাটা শুনেছেন না শোনার মতো করে। দ্রোণাচার্য তাঁর সেনাপতিত্বের উপযোগ আরম্ভ করলেন যুদ্ধের একাদশ দিবস থেকে। দ্রোণাচার্য তাঁর বিশাল অভিজ্ঞতায় এটা ভালভাবেই জানতেন যে, শুধু অস্ত্র প্রয়োগ করে যুদ্ধ জেতা যায় না। যুদ্ধ জেতার জন্য সেনা সাজানোর কৌশলটাও অত্যন্ত জরুরি। সেনা সাজানোর কৌশলকে প্রাচীন রাজনীতির ভাষায় বলে ব্যূহ। রাজনীতির অনেক বিষয়েই দ্রোণ অভিজ্ঞ ছিলেন এবং সেই অভিজ্ঞতা এতটাই যে, প্রবীণ এবং প্রাচীন রাজনীতিক হিসেবে যে একজন ভারদ্বাজের কথা উল্লেখ করেছেন কৌটিল্য, তাঁকে আমাদের দ্রোণ বলেই মনে হয় এবং পণ্ডিতরাও তাই বলেছেন। যুদ্ধের সময় শুধু সেনা-সংস্থানের এদিক ওদিক করে বিচিত্র ব্যূহ রচনার মাধ্যমে দ্রোণাচার্য যে পাণ্ডবদের কত বিপদে ফেলেছেন, তা বলে বোঝানো যাবে না। এক্ষেত্রে অবশ্য দ্রোণের ব্যূহরচনা শক্তির যেমন প্রশংসা করতে হবে, তেমনই একই সঙ্গে বলতে হবে যে, এই ব্যূহরচনার বাহ্য আড়ম্বর অনেকটাই দুর্যোধনকে ফাঁকি দেবার জন্য। বিচিত্র ব্যূহ রচনা করে দ্রোণাচার্য পাণ্ডবদের সৈন্য শাতনের ব্যবস্থা করেছেন বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের ব্যক্তিগত ক্ষতি করার যে ব্যক্তিগত উদ্যোগটুকু দ্রোণাচার্য নিতে পারতেন, ব্যূহরচনার আড়ম্বরে সেই উদ্যোগটুকুই গেছে হারিয়ে এবং সেটাই দ্রোণাচার্যের ঈপ্সিত ছিল।

যেমন দুর্যোধন খুব করে আচার্যকে ধরেছিলেন, যাতে তিনি যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত নিয়ে আসেন দুর্যোধনের কাছে। তবে তাঁর এই আকাঙ্ক্ষার মধ্যে ‘কু’ ছিল, সরলমতি আচার্য তা ধরতে পারেননি। আসলে কৌরববাহিনীর সেনাপতিত্ব লাভ করে আচার্য প্রথমে বেশ খুশিই হয়েছিলেন। এতকাল কুরু রাজ্যে আশ্রিত, ওদিকে অর্বাচীন কৌরবরা মনে মনে খুব যে তাঁকে মানেন, তাও তিনি মনে করেন না। এমন অবস্থায় চিরবিরোধী কর্ণের প্রস্তাবমতো দুর্যোধন তাঁকে সেনাপতিত্বে বরণ করায় দ্রোণাচার্য বেশ খুশি এবং গর্বিতও হয়ে পড়েছিলেন। দুর্যোধনকে তিনি বলেও ফেলেছিলেন যে—সেনাপতিত্বের ভার দিয়ে তুমি যথেষ্টই সম্মান দেখিয়েছ আমাকে—সৈনাপত্যেন মাং রাজন্ অদ্য সৎকৃতবানসি। অতএব বলো তুমি, কী বর চাও। দুর্যোধন গদ্গদ হয়ে বলেছিলেন—যদি বরই দিতে চান, আচার্য! তা হলে যুধিষ্ঠিরকে আপনি জীবন্ত ধরে এনে দিন আমার কাছে—জীবগ্রাহং যুধিষ্ঠিরম্… মৎসমীপমিহানয়।

দ্রোণ যুগপৎ আশ্চর্য হলেন এবং খুশিও হলেন। ভাবলেন—দুর্যোধনের সুমতি হয়েছে, তিনি যুধিষ্ঠিরকে বধ করতে চান না এবং তাঁকে জীবন্ত ধরে আনার পেছনে দুর্যোধনের কোনও সদুদ্দেশ্য নিশ্চয়ই আছে। সরলমতি আচার্য শেষ পর্যন্ত খুশি হয়ে যুধিষ্ঠিরেরই প্রশংসা করতে লাগলেন। বললেন—আহা! কীরকম মানুষ তিনি! দুর্যোধন তাঁর বধাকাঙ্ক্ষা করেন না, শুধু ধরে আনতে চান—ধন্যঃ কুন্তীসুতো রাজা যস্য গ্রহণমিচ্ছসি। আচার্য দুর্যোধনের এই ইচ্ছার মধ্যে অনেক মহৎপ্রাণতার আভাস পেলেন। বললেন—তুমি তাঁকে এইভাবে ধরে নিয়ে এসে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চাইছ বুঝি। বুঝি ভাইতে ভাইতে ঝগড়া মিটিয়ে নিয়ে তাঁকে রাজ্য ফিরিয়ে দিতে চাইছ—রাজ্যং সম্প্রতি দত্ত্বা তু সৌভ্রাত্ৰং কর্তুমিচ্ছসি?

দুর্যোধনের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ল এক মুহূর্তের মধ্যে। তিনি জানালেন—যুধিষ্ঠিরকে জীবন্ত ধরে এনে তিনি আবারও তাঁর সঙ্গে পাশা খেলে তাঁকে বনে পাঠাতে চান। দ্রোণাচার্য দুর্যোধনের মনের কথা শুনে একেবারে ফাঁপরে পড়ে গেলেন। এদিকে তিনি দুর্যোধনকে বর দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অতএব কথা ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। দ্রোণ তাই বললেন-দেখো বাপু! যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনা কোনও কঠিন কাজ নয়। তবে হ্যাঁ, অর্জুন যদি তাঁকে বাঁচিয়ে চলতে থাকেন ক্রমাগত, তবে আমি কেন, স্বর্গের দেবতারা নেমে এলেও যুধিষ্ঠিরকে তোমার কাছে এনে দিতে পারবেন না—গ্রহীতুং সমরে রাজন্ সেন্দ্রৈরপি সুরাসুরৈঃ। তবে হ্যাঁ, তোমরা একটা কাজ করো। তোমরা যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যত্র অস্ত্রশস্ত্রের তীব্রতা বাড়িয়ে প্রভূত সৈন্য ধ্বংস করে অর্জুনকে সেই দিকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করো এবং সে যদি যুধিষ্ঠিরকে ছেড়ে একবার চলে যায়, তবেই জেনে রাখো যুধিষ্ঠির তোমার হাতে এসে গেছেন—অপনীতে ততঃ পার্থে ধর্মরাজো জিতস্ত্বয়া। কিন্তু জেনে রেখো অর্জুন যুধিষ্ঠিররের পাশে থাকলে এসব কিছুই সম্ভব হবে না।

দ্রোণ যেহেতু দুর্যোধনকে বর দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তাই সরলভাবে তাঁর সুবিধে অসুবিধে সবই তিনি দুর্যোধনকে জানিয়েছেন। কিন্তু কুটিল দুর্যোধন যে তাঁকে সর্বাংশে বিশ্বাস করেছেন, তা নয়। দ্রোণ যাতে কথা রাখেন, তার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাদের মধ্যে দ্রোণের কথা রটিয়ে দিলেন যে, আজ যুধিষ্ঠিরকে ধরা হবে। নির্বোধ সৈন্যরা নতুন উত্তেজনা পেয়ে হা-রে-রে-রে করে ছুটল বটে, কিন্তু গুপ্তচরদের মারফত দ্রোণের আলোচনার সমস্তটাই যুধিষ্ঠিরের কানে চলে এল। আচার্যও দুর্যোধনের এই প্রচারে অখুশি হননি, কেননা পাণ্ডবরা এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে যান—এটাই তিনি চান।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির দ্রোণের প্রতিজ্ঞা শুনে প্রমাদ গণেছেন এবং সভয়ে অর্জুনকে বলেছেন—তা হলে এখন কী হবে? অর্জুন আশ্বস্ত করেছেন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে। বলেছেন—আচার্যকে আমি কখনও বধ করব না, এটা যেমন সত্য, তেমনই তোমাকেও একা ফেলে যাব না—এটাও তেমনই সত্য। আমি কোনওদিন আচার্যের বিরুদ্ধাচরণ করিনি, কিন্তু তাই বলে তিনি যদি দেবতাদের নিয়েও যুদ্ধে আসেন, তবু জেনো, তিনি তোমাকে নিয়ে যেতে পারবেন না—এও আমার প্রতিজ্ঞা।

সেদিনকার যুদ্ধে সত্যিই অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে আগলে আগলে রাখলেন এবং দ্রোণের ক্ষমতা হল না যুধিষ্ঠিরকে ধরার। দ্রোণ একটু লজ্জাই পেলেন এবং দুর্যোধনের সামনে সাফাই গেয়ে বললেন—আগেই বলেছিলাম বাপু!—উক্তমেতন্ময়া পূর্বং—অর্জুন থাকলে পারব না যুধিষ্ঠিরকে ধরতে। তা তোমরা কাউকে দিয়ে অর্জুনকে একটু অন্যদিকে নেবার চেষ্টা করো—কশ্চিদাহূয় তং সংখ্যে দেশমন্যং প্রকর্ষতু—তা হলেই তো যুধিষ্ঠিরকে ধরে আনতে পারি আমি। দ্রোণের কথার পরের দিন ত্রিগর্তরাজ সুশৰ্মা তাঁর তীব্র যুদ্ধের ব্যপদেশে অর্জুনকে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। অর্জুন পাঞ্চাল রাজকুমার সত্যজিৎ এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের ওপর যুধিষ্ঠিরকে রক্ষার ভার দিয়ে যুধিষ্ঠিরের অনুমতি নিয়েই অন্যত্র গেলেন যুদ্ধ করতে।

স্বাভীষ্ট প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য দ্রোণ এগিয়ে এলেন যুধিষ্ঠিরের দিকে। পাঞ্চাল সত্যজিৎ সেদিন প্রাণ দিয়েছিলেন দ্রোণের সঙ্গে যুদ্ধে। পাণ্ডব পক্ষের বড় বড় যোদ্ধা, এমনকী ধৃষ্টদ্যুম্ন পর্যন্ত সেদিন দ্রোণকে আটকাতে পারেননি। কিন্তু শেষমেষ দ্রোণ যখন সকল প্রতিরোধ করে যুধিষ্ঠিরকে ধরতে যাবেন, তখন যুধিষ্ঠির ক্ষত্রিয়ের ধর্ম মাথায় রেখে একটি শীঘ্রগতি অশ্বের সহায়তায় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন। যুদ্ধ চলল যুদ্ধক্ষেত্রের রীতি অনুযায়ী। ভয়ংকর সে যুদ্ধ, তাতে দ্রোণ এবং তাঁর স্বপক্ষের অন্য যোদ্ধাদেরও কৌশল কিছু কম ব্যক্ত হল না, অন্যদিকে পাণ্ডব অর্জুন যেভাবে সংশপ্তক বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে চলেছিলেন, তাঁরও সুনাম কিছু কম প্রকট হল না। যুদ্ধের সম্বন্ধে সাধারণ যে অভিব্যক্তি ছিল, তা হল—ইদং ঘোরম্, ইদং চিত্রম্, ইদং রৌদ্রম্ ইতি প্রভো।

কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে এখনও ধরা হল না। কেন, সেদিন কি আচার্য পারতেন না তাঁকে ধরতে। রথ ছেড়ে শীঘ্রগামী অশ্বের পিঠে চড়বার মধ্যে যে অবকাশ ছিল, তার মধ্যে আচার্য দ্রোণের মতো কুশলী যোদ্ধা কি পারতেন না যুধিষ্ঠিরকে ধরতে! হয়তো পারতেন। কিন্তু তিনি নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণের স্বার্থেও তাঁকে ধরে ফেলেননি। তাঁর এই ব্যবহারের পিছনে যে দুর্বলতাটুকু আছে, তা ধরে ফেলতে দুর্যোধনের দেরি হয়নি। পরের দিন সকালে যখন কৌরবসৈন্যদের মধ্যেও অর্জুনের প্রশংসা চলছিল, তখন দুর্যোধন আর সহ্য করতে পারলেন না। তিনি অন্যান্য কৌরবযোদ্ধা এবং সৈন্যদের সামনেই দ্রোণাচার্যকে বললেন—আপনি যাঁদের বধ করবেন বলে ঠিক করেছেন, আমরা সেই বধ্যদের দলেই পড়ি। নইলে আপনি যুধিষ্ঠিরকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ছেড়ে দিয়েছেন? আমি এটা বিশ্বাস করতে পারব না যে, আপনি যে শত্রুকে ধরতে চাইছেন, সে আপনার চোখের সামনে এসেছে অথচ আপনার অস্ত্রের ফাঁস ফসকে বেরিয়ে গেল—এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না—ইচ্ছতস্তে ন মুচ্যেত চক্ষুঃপ্রাপ্তো রণে রিপুঃ।

দুর্যোধন সাভিমানে বললেন—আপনি আমাকে আগে বর দান করে পরে নিজেই সেটা উলটে দিচ্ছেন। আপনার একান্ত অনুগত ভক্তের আশাভঙ্গ করাটা কি আপনার মতো আর্যপুরুষের শোভা পায়? দ্রোণ কী করেছেন দ্রোণই জানেন। তবুও অজুহাত হিসেবে সেই অর্জুনের কথাই আবারও তুললেন আচার্য। বললেন—যা ঘটেছে, তা থেকেই শুধু আমার বিচার কোরো না, দুর্যোধন! কী বলব, সত্যিই তো অৰ্জুন আর কৃষ্ণ যাঁকে রক্ষা করছেন তাঁকে ধরা কি মানুষের সাধ্য—বিশ্বসৃগ্ যত্র গোবিন্দঃ পৃতনানীস্তথাৰ্জুনঃ।

বেশ ‘ফিলসফারের’র মতো কথা। আকাশে উড়িয়ে দিলেই হল। দুর্যোধন মিথ্যা অবিশ্বাস করেননি দ্রোণকে। তিনি সত্যিই ধরতে পারতেন যুধিষ্ঠিরকে। অর্জুন বা কৃষ্ণ তখন ধারেকাছে ছিলেন না। কিন্তু মনে মনে তিনি জানেন—যুধিষ্ঠিরকে ধরার গুরুত্ব কী অথবা পাণ্ডবদের বিপদ তাতে কোথায়? সারা জীবন পাণ্ডবদের পক্ষপাতী হয়ে থেকেও তাঁকে যুদ্ধ করছে হচ্ছে অন্যায়পরায়ণ দুর্যোধনের সপক্ষে। কেন ধরবেন তিনি যুধিষ্ঠিরকে, আবার কেন পাণ্ডব ভাইদের বনবাসে পাঠাবার নিমিত্ত হবেন তিনি। অতএব আবারও সেই একই কথা বললেন দ্রোণ—আজকে আমি পাণ্ডবপক্ষের এক মহারথ যোদ্ধাকে শেষ করে ছাড়ব—অদ্যৈষাং প্রবরং কঞ্চিৎ পাতয়িষ্যে মহারথম্। তোমরা আরও একবার কায়দা করে অর্জুনকে যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাও—অর্জুনস্তু অপনীয়তাম্।

দ্রোণাচার্যের কথায় দুর্যোধনের সংশপ্তক বাহিনী আবারও ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ করে অর্জুনকে ব্যস্ত করে তুললেন যুদ্ধক্ষেত্রের দক্ষিণ দিকে। এদিকে দ্রোণ চক্রব্যূহ রচনা করলেন, যে ব্যূহের বিভিন্ন স্থানে ভয়ংকর যোদ্ধারা সন্নিবিষ্ট হলেন চক্রের নেমির মতো—দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, জয়দ্রথ ইত্যাদি মহাবীরেরা। ব্যূহের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁরা পাণ্ডব পক্ষের প্রাণান্তক যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। দ্রোণের শররাশিতে পাণ্ডব পাঞ্চালদের সমস্ত সৈন্য বিধ্বস্ত বিপর্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এবং পাণ্ডবপক্ষের কোনও যোদ্ধা দ্রোণকে কিছুই করতে পারছেন না। ধৃষ্টদ্যুম্ন, ভীম, সাত্যকি সকলে ব্যূহভেদ করা দূরে থাকুক, দ্রোণের সামনেই দাঁড়াতে পারছেন না—ন শেকুঃ প্রমুখে স্থাতুং ভারদ্বাজস্য পাণ্ডবাঃ।

চক্রব্যূহ এমনই এক কঠিন সৈন্যসজ্জা যার ভিতরে প্রবেশ করা সকলের সাধ্য নয়। পাণ্ডবপক্ষে অর্জুন, কৃষ্ণ, কৃষ্ণের ছেলে প্রদ্যুম্ন এবং অর্জুনের ছেলে সৌভদ্র অভিমন্যু যুদ্ধ করতে করতে এই ব্যূহে প্রবেশ করতে পারেন। প্রদ্যুম্নের প্রশ্নই আসে না, তিনি যুদ্ধে যোগ দেননি। কৃষ্ণার্জুন যুদ্ধক্ষেত্রের অন্যত্র ব্যস্ত। অতএব বাকি রইলেন অভিমন্যু। নিরুপায় যুধিষ্ঠির বালক কিশোর অভিমন্যুকেই অনুরোধ করলেন চক্রব্যূহ ভেঙে ঢুকতে। অভিমন্যু সোৎসাহে বললেন—আমার পিতৃস্থানীয়দের জয়াকাঙক্ষায় এই সেনাসমুদ্রে অবগাহন করব আমি। কিন্তু কোনও বিপদ হলে এই বৃহ থেকে বেরোনোর উপায় আমি জানি না। অভিমন্যুর কথা শুনে যুধিষ্ঠির এবং ভীম দুজনেই তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন—তুমি সেনাচক্র ভেঙে ব্যূহের দ্বার তৈরি করো, আমরা তোমার পিছনে পিছন ঢুকব—ভিন্ধ্যনীকং যুধাং শ্রেষ্ঠ দ্বারং সংজনয়স্ব নঃ।

যুধিষ্ঠির, ভীম, ধৃষ্টদ্যুম্ন, সাত্যকি—সবারই সমস্ত চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। ধৃতরাষ্ট্রের জামাই শিবের বরে অতুল পরাক্রমী হয়ে উঠেছিলেন এই সময়। তিনি সমস্ত মহাবীরদের পথ আটকে দিলেন। অভিমন্যুকে সাহায্য করার শত চেষ্টা করেও কেউ সফল হলেন না জয়দ্রথের পরাক্রমে। অভিমন্যু মারা গেলেন সপ্তরথীর জালে পড়ে। এই সপ্তরথীর মধ্যে দ্রোণও একজন বটে এবং অভিমন্যুর সঙ্গে যে তিনি যুদ্ধও করেননি, তাও নয়। তবু দুর্যোধন দ্রোণকে সন্দেহ করে বলেছিলেন—আর যাই হোক অর্জুনের ছেলেকে তিনি মারবেন না। শিষ্যকে যেহেতু গুরুরা ছেলের মতো ভালবাসেন, অতএব শিষ্যের ছেলেকে তিনি কখনওই মারবেন না—অর্জুনস্য সুতং মূঢ়ো নায়ং হন্তুমিহেচ্ছতি।

কথাটা একদিকে সত্যি, অন্যদিকে সত্যি নয়। সত্যি এইজন্য যে, দুর্যোধনের এই মনোভাবের নিরিখে অভিমন্যুকে মারবার দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছিলেন অন্য সব মহারথীরা—কর্ণ, দুঃশাসন প্রভৃতিরা। দ্রোণকে সেখানে কমই অস্ত্রাঘাত করতে হয়েছে অভিমনুর শরীরে এবং তা হয়তো অর্জুনের কথা মনে রেখেই। আবার সত্যি নয় এইজন্য যে, সপ্তরথীর মধ্যে দ্রোণ প্রথম স্মরণীয় নাম এবং তিনি জানতেন যে, এই ব্যূহ ভেদ করে যে ঢুকবে, সে অর্জুন ছাড়া অন্য কেউ হলে তাঁর কপালে দুঃখ আছে। আরও একটা উদ্দেশ্য এখানে কাজ করেছে দ্রোণের মনে। দুর্যোধনের বারংবার উপরোধে তিনি তিক্তবিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। যুধিষ্ঠিরকে তিনি ধরবেন না অথবা পঞ্চ পাণ্ডবের একতমের মৃত্যুর দায়ও তিনি নেবেন না—এটা ঠিকই ছিল। কিন্তু দুর্যোধনকে তিনি যেহেতু কথা দিয়েছেন, অতএব পাণ্ডবদের এমন একটা ক্ষতি তিনি করে দিয়েছেন, যা তাঁদের কাছে আপন মৃত্যুর চেয়েও দুঃসহ।

দুর্যোধনের কাছে তিনি কথা রেখেছেন এইভাবেই। কিন্তু তাতেও দুর্যোধন খুশি হননি। অভিমন্যুর মৃত্যুতে ক্রোধান্বিত হয়ে অর্জুন যখন পরের দিন জয়দ্রথ বধের প্রতিজ্ঞা নিলেন, তখনও প্রায় অভেদ্য এক শকটব্যূহ তৈরি করে ব্যূহমুখেই দাঁড়িয়ে ছিলেন দ্রোণ। তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রমোক্ষণের আগে অর্জুন অনেক সম্মান করে তাঁকে বলেছিলেন—আমার প্রতি স্বস্তিবাচন করুন, আচার্য। আপনার আশীর্বাদ নিয়েই এই সেনাব্যূহের ভিতরে প্রবেশ করতে চাই আমি। আপনি আমার পিতার মতো এবং সম্মানে আমার জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির অথবা কৃষ্ণের মতো। পুত্র অশ্বত্থামাকে যেমন আপনি সদাসর্বদা রক্ষা করেন, আমিও তেমনই আপনার রক্ষণীয়। আপনি আশীর্বাদ করুন, ভিতরে প্রবেশ করি আমি—তব প্রসাদাদিচ্ছামি প্রবেষ্টু দুর্ভিদাং চমূম্।

দ্রোণ আশ্চর্য হলেন। অভিমন্যুর মতো পুত্রের মৃত্যুশোক পেয়েও অর্জুন আচার্যের মর্যাদা ভোলেননি, তবু দ্রোণের কোনও উপায় নেই যে। তিনি পরান্নের ঋণ শোধ করতে প্রতিপক্ষে যুদ্ধ করছেন। অতএব ধৰ্মত এবং ন্যায়ত তিনি বাধা দিলেন অর্জুনকে। ভয়ংকর যুদ্ধ আরম্ভ হল। পরস্পরের মহাযুদ্ধ চলল কতক্ষণ। অর্জুন দেখলেন—মহা বিপদ! সূর্যাস্তের আগে জয়দ্রথবধ করতে হবে। অতএব অদ্ভুত বুদ্ধিতে অর্জুন অস্ত্রমোক্ষণ থামিয়ে দিয়ে আচার্যকে প্রদক্ষিণ করে সসম্মানে এড়িয়ে গেলেন তাঁকে। দ্রোণ বললেন—কর কী? কর কী? শত্রুকে না জয় করে কোথায় যাচ্ছ তুমি—ক্বেদং পাণ্ডব গম্যতে? অর্জুন সস্তোকে বললেন—আরে আপনি হলেন আমার গুরুমশাই। কবে আমার শত্রু হলেন আপনি? তা ছাড়া, কে আছে এই পৃথিবীতে, যে আপনাকে যুদ্ধে জয় করবে—ন চাস্তি স পুমাল্লোকে যসং যুধি পরাজয়েৎ।

অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন দ্রোণ। অর্জুন শকটব্যূহে প্রবেশ করলেন শরবর্ষণ করতে করতে। দুর্যোধনের সেনা মরছে, যোদ্ধা মরছে, এবং কিছুতেই প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না অর্জুনকে। দুর্যোধন ফিরে এলেন আচার্যের কাছে। সক্রোধে সাভিমানে বললেন—অর্জুন যে ঢুকে গেল—গতঃ স পুরুষব্যাঘ্রঃ। আমার একপাশের সমস্ত সেনা নষ্টপ্রায়। সমস্ত মানুষ ভেবেছিল—অর্জুন জীবন থাকতে আপনাকে টপকে যাবে না—নাতিক্রমিষ্যতি দ্রোণং জাতু জীবন্ ধনঞ্জয়ঃ। কিন্তু এ কী হল। একটা কিছু ব্যবস্থা করুন জয়দ্রথকে বাঁচানোর জন্য। দুর্যোধন এতক্ষণ যা বলেছেন তাতে আবেগ থাকলেও অন্যায় নেই। কিন্তু এবার তিনি কঠিন সুরে বিদ্রূপ করতে আরম্ভ করলেন দ্রোণকে। বললেন—জানি, বেশ জানি আপনি পাণ্ডবদের ভাল চান—পাণ্ডবানাং হিতে রতম্। আমাদের ক্ষমতা অনুসারে আপনাকে আমরা ভালই একটা বৃত্তি দিয়ে থাকি এবং আপনাকে তুষ্ট করারও চেষ্টা করি কম না—যথাশক্তি চ তে ব্রহ্মন্ বর্তয়ে বৃত্তিমুত্তমাম্। প্রীণামি ত্বাং যথাশক্তি—কিন্তু আপনি দেখছি, সেসব কিছুই মনে রাখেন না।

আজকে ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে আছেন। দ্রোণাচার্যের আর বলার উপায় নেই যে,—আমি ভীষ্মের বৃত্তি নিয়ে চলি, তোর নয়। অথচ সমস্ত শক্তি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রধানত ভীষ্মের মুখের দিকে তাকিয়েই তিনি কুরুবাড়ির আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছেন। তাঁর সবচেয়ে যেটা দুর্বলতার জায়গা, আজ সেইখানেই আঘাত করছেন দুর্যোধন। তাও কী ভাষায়? দুর্যোধন বলছেন—আপনি আমাদেরই খেয়ে-পরে আমাদেরই সর্বনাশ করছেন—অম্মানেবোপজীবংস্ত্বম্ অস্মাকং বিপ্রিয়ে রতঃ। আমি ভাবতে পারিনি—আপনার হৃদয় এমন মধুমাখানো ক্ষুরের মতো।

দুর্যোধন বুঝলেন—একটু বেশি হয়ে গেছে। তাঁর মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ। অতএব খানিকটা অনুযোগের স্বরে এবার প্রকৃত করণীয় বিষয়ে ফিরে এসে বললেন—আপনি যদি আমাদের আশ্বাস না দিতেন যে, জয়দ্রথ সুরক্ষিত অবস্থায় বেঁচে থাকবে, তা হলে সে যখন ভয় পেয়ে বাড়ি ফিরে যেতে চেয়েছিল, আমি তাকে আটকাতাম না। আপনার অভয় দেবার কথা বলেই আমি তাকে আশ্বস্ত করেছি। এখন দেখছি, আমি তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছি। যমের দাঁতের মধ্যে পড়েও মানুষ ফিরে আসতে পারে, কিন্তু অর্জুনের হাত থেকে নয়। অর্জুন ব্যূহভঙ্গ করে ঢুকে পড়েছেন। টপকে গেছেন আচার্য দ্রোণকে। দুর্যোধনের সত্যিই মাথার ঠিক নেই। এত খারাপ খারাপ কথা বলার পরেও তিনি তাই পুনরায় সলজ্জে বলেছেন—আমি আর্ত বিপন্ন হয়ে কী বলতে কীই না বলেছি। সেসব আপনি ক্ষমা করুন আপনি জয়দ্রথকে বাঁচান।

শাস্ত্র বলে—কথা আর তির—একবার যদি ছুটল, তো সে আঘাত করেই ছাড়বে। তাকে শত চেষ্টা করলেও আর ফেরানো যায় না। দুর্যোধন যে ভাষায়, বিশেষত বৃত্তির কথা তিনি যেভাবে সশব্দে আচার্যকে শুনিয়েছেন, তাতে তাঁর হৃদয় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। তিনি কি কৌরবদের ভাড়াটে সেনাপতি, ‘মার্সেনারি’! এতকাল কুরুবাড়িতে থেকে, তাঁদের ভালমন্দে জড়িয়ে থেকে তাঁকে এই ভাষা শুনতে হল? তবু দ্রোণাচার্য তত রাগ করলেন না, যতটা এইসব অভিযোগের পরে প্রত্যাশিত ছিল। তা ছাড়া, দুর্যোধন সত্যিই বিপন্ন, তাঁর এক এবং অদ্বিতীয় ভগ্নীপতি অর্জুনের কোপে পড়েছেন। অতএব যথাসাধ্য ধৈর্য রেখেই দ্রোণাচার্য বললেন—তোমার কথায় আমি রাগ করিনি, বাছা। তুমি তো আমার কাছে অশ্বত্থামারই মতো। তবে সমস্যাটা কী জান—অর্জুনের সারথি হলেন বিশালবুদ্ধি কৃষ্ণ। আমার ব্যূহের মধ্যে সামান্য একটু ফাঁক তৈরি করে, সেখান দিয়ে কী দ্রুত বেরিয়ে গেল অর্জুন—অল্পঞ্চ বিবরং কৃত্বা তূর্ণং যাতি ধনঞ্জয়ঃ।

দ্রোণ এবার নিজের বৃদ্ধবয়সের কথা দুর্যোধনকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন—যে তাড়াতাড়ি অর্জুন চলে গেছে, তাতে তার পিছন পিছন তাড়া করে তার গতি রুদ্ধ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমার বয়স হয়েছে, সেই শীঘ্রতা আমার থাকবে কী করে—ন চাহং শীঘ্রযানে’দ্য সমর্থো বয়সান্বিতঃ। দ্রোণ একটু অজুহাতও দিয়ে বললেন—তা ছাড়া আমি ভাবছিলাম, যুধিষ্ঠিরকে ধরতে হবে আমায়, কাজেই ব্যূহমুখ ত্যাগ করে সরে যেতে পারিনি আমি। এবারে সেই অপমানের কথা মনে পড়ল—কুরুদের কাছ থেকে বৃত্তি নেওয়ার খোঁটা। দ্রোণ ছাড়লেন না। বললেন—তুমি তো রাজা বটে। অস্ত্রশস্ত্রেও তোমার মতো কুশলী বীর কজন আছে? পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার শত্রুতাও তো আর আমার তৈরি নয়। সে তোমারই তৈরি। তা তুমি যাও না একটু যুদ্ধ করে এসো অর্জুনের সঙ্গে—বীরঃ স্বয়ং প্রযাহি অত্র যত্র যাতো ধনঞ্জয়ঃ।

দ্রোণের এই একটি কথায় দুর্যোধন একেবারে চুপসে গেলেন। স্বীকার করলেন যে, অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা তাঁর নেই। মাথা নিচু করে বললেন—আমি আপনার সেবক, সেবকের যশ রক্ষা করা আপনারই কাজ। দ্রোণ যে খুব গলে গেছেন, তা নয়। অর্জুনের ক্ষমতার কথা স্বীকার করে নিয়েও তিনি বলেছেন—আরে আমি তোমাকে বর্ম পরিয়ে মন্ত্র পড়ে দিচ্ছি। দেখবে—তোমার সঙ্গে অর্জুন পারবে না। দ্রোণ খুব করে দুর্যোধনের বর্ম এঁটে অস্ত্রশস্ত্র হাতে দিয়ে অনেক মন্ত্র পড়ে পাঠিয়েছেন দুর্যোধনকে। দাম্ভিক দুর্যোধন আচার্যের পরীক্ষা বুঝতে পারেননি। দুর্যোধন জয়দ্রথকে রক্ষা করতে এসে হেরে পালিয়েছেন অর্জুনের কাছে। দুর্যোধন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে এদিকে দ্রোণাচার্য আবারও যুধিষ্ঠিরকে ধরে ফেলেছিলেন প্রায়। কিন্তু বিপদ বুঝে পালাতে যুধিষ্ঠিরের জুড়ি নেই, তিনি পালিয়েই বেঁচেছেন।

দুর্যোধন যতই তিরস্কার করুন দ্রোণকে, তাঁর সেনাপতিত্বকালে তিনি যুদ্ধ কিছু কম করেননি। কিন্তু করলে কী হবে, অভিমন্য অসহায়ভাবে নিহত হওয়ায় সমস্ত পাণ্ডবপক্ষ একেবারে তপ্ত হয়ে ছিল। দু-এক জায়গায় তাঁদের সাময়িক পরাজয় ঘটলেও সামগ্রিকভাবে তাঁরা কৌরবপক্ষের মাথার ওপর দিয়ে চলছিলেন। অর্জুনের অস্ত্রশিষ্য সাত্যকি এই সময়টায় এমন যুদ্ধ করেছেন যে, কৌরবপক্ষের মহা-মহাবীর রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাচ্ছিলেন। যুদ্ধ চলাকালীন এই সময়টাতে যথেষ্ট কৌতুক বোধ করেছেন আচার্য। একজন সেনাপতি হিসেবে তাঁর সমস্ত গাম্ভীর্য এবং কার্যক্ষেত্রে তাঁর অপেক্ষিত সফলতা দিয়েই দ্রোণাচার্যের চরিত্রবিচার হয় না। ভৎসনা শুনেও দুর্যোধনকে তিনি যে মধুরতায় অর্জুনের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেছিলেন, তাতে ওই বৃদ্ধ বয়সেও তাঁর রসিকতাবোধ এবং দুষ্টুমি বেশ প্রকট হয়ে ওঠে।

অর্জুনশিষ্য সাত্যকির পরাক্রমে কৌরববীরেরা যখন প্রায় বিধ্বস্ত, এই সময় যুদ্ধক্ষেত্রের একান্তে দুঃশাসনের সঙ্গে দেখা হয়েছ দ্রোণের। কুচক্রী এই মানুষটির পীড়িত অবস্থা দেখে এবং অবশ্যই সব জেনে বুঝেই আচার্য সকৌতুকে বললেন—সবাই এমন পালিয়ে যাচ্ছে কেন, দুঃশাসন? দুর্যোধন ভাল আছে তো, জয়দ্রথের অবস্থা ঠিক আছে তো? তা হলে তুমি এমন পালিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? তুমি রাজপুত্র বলে কথা, রাজার ভাইও বটে, তাতে আবার এই কুরু রাজ্যের যুবরাজ হয়ে তোমার কি পালিয়ে যাওয়া শোভা পায়? তুমি একদিন দ্রৌপদীকে দাসী বলে গালি দিয়েছিলে। তাঁকে বলেছিলে—তোমার কোনও স্বামী নেই, তারা সব নপুংসক। তা আজকে এমন করে পালাচ্ছ কেন? যেদিন পাশার ঘুটি নিয়ে খেলেছিলে, সেদিন বোঝনি যে, ঘুটিগুলো সব বাণ হয়ে ফিরে আসবে। তখন পাণ্ডবদের নিয়ে অনেক হাস্যকৌতুক করেছিলে, তর্জনগর্জনও কম নয়। তো এখন সেসব কোথায় গেল—ক্ক তে মানশ্চ দর্পশ্চ ক্ক তে তদ্‌বীরগর্জিতম্। এখন এই অর্জুনের শিষ্য সাত্যকিকে দেখেই পালাচ্ছ, তা হলে অর্জুন এলে কী করবে, ভীম এলে কী করবে? যাও শিগগির, যুদ্ধে যাও। যুদ্ধের মুখে তুমি এমন করে পালালে সমস্ত সৈন্য পালিয়ে যাবে, সেটা কি ভাল হবে?

দুঃশাসন পুনরায় যুদ্ধে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দ্রোণ নিজেও নিযুক্ত হয়েছেন সংগ্রামে। মহাভারতের কবি একাধিক অধ্যায় জুড়ে দ্রোণাচার্যের পরাক্রম বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কুমার অভিমন্যুর মৃত্যু পাণ্ডবপক্ষের প্রত্যেকটি বীরের মনে এমনই এক ইন্ধনের কাজ করেছিল যে, শত চেষ্টা করেও দ্রোণাচার্য কৌরবপক্ষের অনেক বড় বড় যোদ্ধাকে বাঁচাতে পারেননি। মারা গেছেন ভূরিশ্রবা। মারা গেছেন জয়দ্রথ। জয়দ্রথের মৃত্যুর সমস্ত দায় দ্রোণাচার্যের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন দুর্যোধন। সমস্ত দিনের যুদ্ধক্লান্তির পর সন্ধ্যার আলোচনা সভায় এমন নিদারুণ কথা শুনে আচার্য আর নিজেকে রোধ করতে পারলেন না। বললেন—কেন দুর্যোধন! বার বার আমাকে এইভাবে বাক্যবাণে জর্জরিত করছ—বাক্‌ছরৈরভিকৃন্তসি? কেন, জয়দ্রথ যেখানে মারা গেছেন, সেখানে অর্জুনকে তো তোমরা সবাই মিলে ঘিরে ধরেছিলে। তুমি ছিলে, কর্ণ ছিল, কৃপ ছিলেন এবং আমার পুত্র মহাবীর অশ্বত্থামাও ছিল, তা হলে জয়দ্রথ মরল কেন—সিন্ধুরাজানমাশ্ৰিত্য স বো মধ্যে কথং হতঃ?

দ্রোণাচার্য ভীষ্মের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন দুর্যোধনকে। বলেছেন—তিনি তো কম বীর ছিলেন না। অর্জুনের পরাক্রমে তাঁরও পতন ঘটেছে এই যুদ্ধে। তা ছাড়া সারা জীবন যাঁদের বিরুদ্ধে অন্যায় আচরণ করেছ, যাঁদের কুলবধূকে রাজসভায় ধরে এনে যথেচ্ছ অপমান করেছ, যাঁদের পাশা খেলে বনে তাড়িয়ে দিয়েছ—সেইসব অন্যায়ের ফল ঘটছে এখন—তদিদং বৰ্ততে ঘোরম্ আগতং বৈশসং মহৎ। দুর্যোধনের সহস্র অন্যায় স্মরণ করিয়ে দিয়ে শেষে নিজেকে ধিক্‌কার দিয়ে দ্রোণ বললেন—যাঁরা আমার পুত্রের মতে, সারা জীবন যাঁরা ন্যায়ের পথে সত্যের পথে চলেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আজ আমার যুদ্ধ করতে হচ্ছে। আমার মতো যারা বামুনের ঘরে জন্মেও বামুনের কাজ করে না, তাদেরই এমন অসহায়ভাবে ন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়—দ্রুহ্যেৎ কো নু নরো লোকে মদন্যঃ ব্রাহ্মণব্রুবঃ।

প্রসিদ্ধ ভরদ্বাজের পুত্র হওয়া সত্ত্বেও দ্রোণ যে ব্রাহ্মণের স্বাধীন বৃত্তি ছেড়ে পরাধীন যুদ্ধবৃত্তি গ্রহণ করেছেন এবং সেই জন্যই যে তাঁকে আজ এক অন্যায়কারী কুচক্রীর পক্ষ হয়ে সদাচারী সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হচ্ছে—সেই কথা ভেবে ভীষণ অনুতাপ ভোগ করেন দ্রোণ। কিন্তু হাজার অনুতপ্ত হলেও পরান্ন-ঋণ তাঁকে ক্লিষ্ট করে, দুর্যোধনের বৃত্তিভোগ তাঁকে আত্মহত্যার কষ্ট দেয়। তিনি আবারও উদ্‌যুক্ত হন যুদ্ধে জয়দ্রথের মৃত্যুর পর দুর্যোধনের বাক্যবাণ শুনে দ্রোণাচার্য তাঁকে তিরস্কার করেন বটে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে আবারও অঙ্গীকার করেন—তোমার বাক্যশূলে দগ্ধ হয়ে আবারও আমি যুদ্ধ করতে যাচ্ছি, দুর্যোধন—রণায় সহতে রাজংস্ত্বয়া বাক্‌ছল্যপীড়িতঃ।

জয়দ্ৰথবধের দিন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ভয়াবহ সংগ্রাম চলেছে। সারাদিনের পরিশ্রমের পর পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ এখন ক্লান্ত, শ্রান্ত। তবু শুধু অপরের বৃত্তির দায় শোধ করার জন্য তিনি রাত্রিকালেও যুদ্ধের আদেশ দিলেন—রাত্রাবপি যোৎস্যন্তে সংরব্ধাঃ কুরুসৃঞ্জয়াঃ। পুত্র অশ্বত্থামার সঙ্গে নিজেও চললেন যুদ্ধে। আচার্যের এই আকুল ব্যবহারেও অবশ্য দুর্যোধনের সন্দেহ গেল না। বন্ধু কর্ণের কাছে তিনি সসন্দেহে বলেছেন—সব গেল। সব গেল। একা অর্জুন আমার সৈন্য এবং যোদ্ধাদের যা ক্ষতি করে গেল, তা সবই দ্রোণের জন্য। আমার বিশ্বাস হয় না—যদি আচার্য সেই দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিরোধ করতেন অর্জুনকে, তা হলে অর্জুনের পক্ষে অসম্ভব ছিল ব্যূহ ভেঙে ঢোকা। অর্জুনকে তিনি অতিরিক্ত ভালবাসেন এবং সেই জন্যই শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ না করে তিনি ব্যূহের দ্বার মুক্ত করে দিয়েছেন অর্জুনের কাছে—ততো’স্য দত্তবান্ দ্বারম্ অযুদ্ধেনৈব শত্রুহন্।

কথাটা সত্যিই একেবারে মিথ্যে নয়। অর্জুন যেভাবে অস্ত্র ত্যাগ করে আচার্যকে প্রদক্ষিণ করে সস্তোকে রথ নিয়ে ব্যূহের ভিতরে প্রবেশ করেছেন, তাতে তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করে সত্যিই যে তিনি তাঁর গতিরোধ করতে পারতেন না—এটা বিশ্বাস্য নয়। কিন্তু ওই যে বলেছি—আচার্যের মনে অদ্ভুত এক দ্বৈরথ কাজ করে। যুধিষ্ঠির-অর্জুনের মতো কষ্টক্লিষ্ট ধর্মনিষ্ঠদের বিপক্ষে যুদ্ধ করার যে অনুতাপ তাঁর আছে, তিনি সেই অনুতাপের সান্ত্বনা লাভ করেন যুধিষ্ঠিরকে না ধরে তাঁকে পলায়ন করতে দিয়ে, অর্জুনকে ব্যূহমুখে প্রবেশ করতে দিয়ে এবং পশ্চাদ্ধাবন না করে। অপরদিকে অন্নঋণ শোধ করার জন্য এই বৃদ্ধ বয়সেও প্রাণান্তক যুদ্ধ করেন তিনি। অন্তত লোকচক্ষুতে সে যুদ্ধের ভয়াবহতা কম লক্ষণীয় হয়ে ওঠে না।

সেই জন্যই দুর্যোধনের যথাযথ সন্দেহের উত্তরে কর্ণের মতো এককালের দ্রোণবিরোধী মানুষের মুখেও সান্ত্বনা শুনি—এমন করে আচার্যকে দোষ দিয়ো না, দুর্যোধন! নিজের ক্ষমতা অনুসারে তিনি যথেষ্টই চেষ্টা করছেন, নিজের জীবন পণ করে যুদ্ধও করে যাচ্ছেন তোমার জন্য—আচাৰ্য্যং মা বিগর্হস্ব শক্ত্যাসৌ যুধ্যতে দ্বিজঃ। কর্ণ আরও বললেন—দেখো, আচার্য বুড়ো হয়েছেন—আচাৰ্যঃ স্থবিরো রাজন্—তুলনায় অর্জুন কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন! অসাধারণ যুদ্ধক্ষমতা থাকায় অর্জুনের পক্ষে তাঁকে অতিক্রম করে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। কোন শক্তিতে আচার্য অর্জুনের মতো শীঘ্রগামী যোদ্ধাকে ধরবেন। অস্ত্রচালনায় হাতের যে শীঘ্রতা চাই, যে ক্ষমতা চাই, আচার্য দ্রোণের কাছে তা আশা করা যায় না—বাহুব্যায়ামচেষ্টায়াম্ অশক্তস্তু নরাধিপ। আমি এখানে সত্যিই বৃদ্ধ দ্রোণের দোষ দেখতে পাচ্ছি না।

দ্রোণের পরিচালনায় রাত্রি-যুদ্ধ আরম্ভ হল কুরুক্ষেত্রে—যা এতকাল হয়নি। কিন্তু রাত্রি-যুদ্ধে কৌরবদের কাল হয়ে উঠলেন ভীমপুত্র ঘটোৎকচ। কর্ণের বাণে তিনি শেষ পর্যন্ত মারা গেছেন বটে, কিন্তু ক্ষতি হয়ে গেছে কৌরবদেরই বেশি। সবচেয়ে বড় কথা, কর্ণ যে একাগ্নী বাণ রেখেছিলেন অর্জুনকে মারার জন্য, সেটিও খরচ হয়ে গেল ঘটোৎকচবধের জন্য। দ্রোণ তাঁর প্রিয়তম শিষ্যের জীবন সম্বন্ধে মনে মনে আশ্বস্ত হলেন কি না, সে খবর মহাভারতের কবি দেননি। কিন্তু রাত্রিদিন অবিরাম যুদ্ধ করে পাণ্ডবদের যথাশক্তি ক্ষতি করেও দ্রোণ কোনও মর্যাদা পাননি দুর্যোধনের কাছে। দিনের পর অবিরাম রাত্রি-যুদ্ধ করার শেষে সমস্ত সেনাবাহিনী নিদ্রালাভের জন্য কাতর হয়ে গিয়েছিল। নিদ্রাতুর সৈন্যরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে স্বপক্ষীয়দের শরীরেই অস্ত্রমোক্ষণ করছিল। এই অবস্থায় অর্জুন জোর করে যুদ্ধ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, যাতে সাধারণ সৈন্যরা খানিকক্ষণ অন্তত ঘুমিয়ে নিতে পারে।

পাণ্ডব সেনানীরা পরস্পর চেঁচিয়ে একসময় দুর্যোধন-কর্ণকে জানিয়ে দিতে পেরেছিল যে তারা অস্ত্রত্যাগ করে যুদ্ধক্ষেত্রেই ঘুমিয়ে নিতে চাইছে। কুরু সৈন্যদের কাছেও এই সংবাদ ছিল আশীর্বাদের মতো। তারাও ঘুম চায়। দিনরাত পরিশ্রমের পর তারাও ঘুম চায়। সেনাপতি হিসেবে দ্রোণ এই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সমস্ত সৈন্যদের তখন কী অবস্থা! আলস্যে অবসাদে যে যেখানে ছিল, রথে, অশ্বপৃষ্ঠে, হস্তিপৃষ্ঠে, ভূমিতে—যে যেখানে পেরেছে ঘুমের আয়োজন করেছে। পূর্ব দিগ্‌বধূর মুখখানি রাঙিয়ে দিয়ে একা জেগে ছিল শুধু আকাশের চাঁদ আর যুদ্ধক্ষেত্রে জেগেছিলেন ক্রোধান্বিত দুর্যোধন।

সমস্ত রণভূমি উচ্চকিত করে আবারও তিনি এসেছেন দ্রোণের কাছে। আবারও অভিযোগ—যুদ্ধবিরতির এই আবদার কেন মেনে নিলেন আচার্য। দুর্যোধন রুক্ষস্বরে বললেন—শত্রুপক্ষকে এইভাবে বিশ্রাম দেওয়াটা মোটেই সহ্য করা যায় না—ন মর্ষণীয়াঃ সংগ্রামে বিশ্রমন্তঃ শ্ৰমান্বিতাঃ। ক্ষতি হয়েছে আমাদেরই বেশি এবং বিশ্রান্তি লাভ করলে আরও বলবান হয়ে উঠবে আমার শত্রুপক্ষ। জগতে আপনার মতো ধনুর্ধর দ্বিতীয় নেই। তবু যে বার বার আপনি এদের ছেড়ে দিচ্ছেন, সে কি আপনার শিষ্যের প্রতি স্নেহে, নাকি আমার ভাগ্য খারাপ বলে। কত কত দিব্য অস্ত্রের সন্ধি আপনার জানা আছে, সেসব প্রয়োগ করুন এই শত্রুদের ওপর।

দ্রোণ ভীষণ ভীষণ বিরক্ত হলেন দুর্যোধনের অযৌক্তিক কথা শুনে। ক্রুদ্ধও বটে। যথেষ্ট কর্কশ এবং কটুভাবেই দুর্যোধনকে তিনি বললেন—আমি বুড়ো বয়সেও সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি যুদ্ধ করতে। এই যে সব সাধারণ মানুষ, যারা অস্ত্রের প্রয়োগ জানে না, একজন অস্ত্রবিদ হয়ে কীভাবে এদের ওপর আমি দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগ করতে পারি? তোমার কথায় হয়তো এখন তাই করতে হবে আমাকে, ভাল হোক বা মন্দ হোক, তাই করতে হবে আমাকে—যদ্ভবান্ মন্যতে চাপি শুভং বা যদি বাশুভম্। আজ মনে পড়ছে দ্রোণের—মহর্ষি অগ্নিবেশ্যের কাছে, মহর্ষি অগস্ত্যের কাছে দিব্যাস্ত্র লাভ করেছিলেন তিনি, পরম্পরাক্রমে সেই অস্ত্র তিনি দিয়েছেন প্রিয়তম শিষ্য অর্জুনকে আর পুত্র অশ্বত্থামাকে। কই শত বিপদ সত্ত্বেও সেই যুবক তো দুর্যোধনের এই একাদশ অক্ষৌহিণী সৈন্যের ওপরে, কিংবা লোকপ্রসিদ্ধ কৌরব যোদ্ধাদের ওপরে দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করেনি। অথচ পরান্ন গ্রহণের কী জ্বালা যে, আজ সমস্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও দ্রোণাচার্যকে দুর্যোধনের অঙ্গুলীহেলনে আপন স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হচ্ছে। এতৎ সত্ত্বেও হয়তো তিনি ওই অস্ত্রপ্রয়োগ ঘটাবেন না, কিন্তু তবু এই মুহূর্তে দুর্যোধনের অযাচিত উপদেশ শ্রবণ করে চলতে হচ্ছে তাঁকে।

দ্রোণাচার্য তবু সাবধান করে দিয়েছেন দুর্যোধনকে। বিশেষত অর্জুনের প্ররোচনায় যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে এবং বিশ্রাম লাভ করে সে আরও শক্তিমান হয়ে উঠবে—এই অভিযোগের উত্তরে দ্রোণ বলেছেন—তুমি এটা মনে কোরো না যে, দিনরাত্রির অবিরাম যুদ্ধের পর অর্জুন বড় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে—মন্যসে যচ্চ কৌন্তেয়ম্ অর্জুনং শ্রান্তমাহবে। তার ক্ষমতার কথা যদি না শুনে থাক তো শোনো। দ্রোণাচার্য আবারও অর্জুনের অস্ত্রক্ষমতা, বহুত্র তাঁর যুদ্ধজয়ের কথা বলতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু দুর্যোধন বৃদ্ধ আচার্যের সমস্ত আবেগ থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—অর্জুনের জন্য আপনাকে ভাবনা করতে হবে না। আমি আছি, দুঃশাসন আছে, কর্ণ আছেন, শকুনি আছে, আমরা শেষ করে ছাড়ব অর্জুনকে—হনিষ্যামো’জুনং সংখ্যে দ্বিধা কৃত্বাদ্য ভারতীম্।

হো হো করে হাসতে ইচ্ছা করছিল আচার্যের—ভরদ্বাজো হসন্নিব। সেই অস্ত্রপরীক্ষার দিন থেকে এই যুদ্ধারম্ভ পর্যন্ত কতবার তিনি ওই অর্জুনের সম্বন্ধে একই কথা বলেছেন। কতবার অর্জুনের কাছে প্রত্যক্ষ পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছেন দুর্যোধন-কৰ্ণরা, তবু সেই দম্ভ, সেই আত্মতুষ্টি। বার বার এই দুর্যোধনের কাছে তিনি ধিক্কার লাভ করেছেন, বার বার শুনেছেন কুরুবাড়ির বৃত্তিভোগের বিদ্রূপ। আজ আর তাঁর লজ্জা, ভয় কিছুই নেই। যে বৃত্তি ভোগ করে তাকে বৃত্তিভোগী বললে তার মানসিক যন্ত্রণা বাড়ে, কারণ বৃত্তিভোগের অসহায়তা তাকে অবচেতনে পীড়িত করে সব সময়। আচার্য তাই দুর্যোধনের দম্ভোক্তি একেবারে নস্যাৎ করে দিয়ে বললেন—দেখো বাছা! তুমি স্বর্গের রাজা ইন্দ্র নও, যম, বরুণ, কুবেরের মতো প্রভাবশালী কোনও দেবতাও নও। এমনকী অসুর রাক্ষস হলেও চলত, তাও নও তুমি। সত্যি কথা বলতে কী, তোমাদের মতো অবুঝ এবং বোকা আমি দেখিনি যে, এই ধরনের সাহংকার বচন এখনও আউড়ে যাচ্ছ—মূঢ়াস্তু এতানি ভাষন্তে যানীমান্যাত্থ ভারত। যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে প্রতিপক্ষে দেখে কেউ বাপু স্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবে না—স্বস্তিমান্ কো ব্রজেদ্ গৃহান্—ফিরলেও ভাববে—আজকে কিছু হল না বটে, কিন্তু কালই তার অন্তকাল ঘনিয়ে না আসে।

আচার্য এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে এলেন। বার বার পক্ষপাতের অভিযোগ শুনতে শুনতে আজ তিনি রূঢ় কঠিন হয়ে উঠেছেন। বৃত্তিভোগীকে বৃত্তিভোগী বললে যেমন রাগ হয়, দুর্যোধনকেও তিনি তাই তাঁর বাস্তব চরিত্রটি উদ্‌ঘাটন করে লজ্জা দিতে চাইলেন। দ্রোণ বললেন—তুমি শুধুই সকলকে সন্দেহ কর, দুর্যোধন! এত নিষ্ঠুর তোমার হৃদয়, এতই তা পাপের সঞ্চয়ে স্ফীত যে, বাস্তব পরিস্থিতিটা কী, তা কখনওই তুমি বোঝনি, আর সেই জন্য সন্দেহের বশে পরকে কটু কথা বলতে তোমার একটুও বাধে না—ত্বন্তু সর্বাভিশঙ্কিত্বান্ নিষ্ঠুরঃ পাপনিশ্চয়ঃ। তুমি স্বয়ং যাও অর্জুনের সামনে, তোমার নিজের কারণেই তো তাঁকে তোমার বধ করা দরকার, অন্যদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ কেন? পাণ্ডবদের সঙ্গে সমস্ত শত্রুতার মূলে আছ তুমি, অতএব তুমি তার মুখোমুখি হও—ত্বমস্য মূলং বৈরস্য তস্মাদাসাদয়াৰ্জুনম্। তুমি ক্ষত্রিয় বীর, এটাই উপযুক্ত ব্যবহার হবে তোমার।

সারা জীবন নিজের বিরুদ্ধে যেসব কথা শুনেছেন সেই সমস্ত বিদ্রুপ, বক্রোক্তি আজ দুর্যোধনকে ফিরিয়ে দিতে চান আচার্য। বললেন—তবে হ্যাঁ, যুদ্ধে তুমি একা যেয়ো না, সঙ্গে তোমার মামা ওই পাশাড়ে শকুনিকে নিয়ে যেয়ো। ব্যাটা কুটিল, প্রবঞ্চক, শুধু ঘুটি চালিয়ে গেল জীবন ভরে। ওকে নিয়ে যেয়ো, ও হারিয়ে দিয়ে আসবে পাণ্ডবদের—দেবিতা নিকৃতিপ্রজ্ঞো যুধি জেষ্যতি পাণ্ডবান্। দ্রোণাচার্য এবার ফেটে পড়লেন ক্রোধে। কত কাল ওই একই দম্ভোক্তি শুনে আসছেন। আজকে আর ছাড়লেন না দুর্যোধনকে। শোনালেন কর্কশ কঠিন প্রত্যুত্তর। বললেন—শুধু আজকে নয়, দুর্যোধন! শুধু আজকে নয়। ধৃতরাষ্ট্রের কানের কাছে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে অনেকবার তুমি এই কথা বলেছ যে, তুমি, কর্ণ, আর দুঃশাসন—এই তিনজন মিলে নাকি পাণ্ডব ভাইদের অন্ত করে ছাড়বে। একবার নয়, তোমার এই দম্ভস্ফীত শূন্য গর্জন কুরুসভার প্রত্যেক আলোচনায় শুনেছি—ইতি তে কত্থমানস্য শ্রুতং সংসদি সংসদি। আজকে সেই সুযোগ তোমার এসেছে, যাও পাণ্ডব অর্জুনকে মেরে যশ ছিনিয়ে নাও। তোমার তো ভয় নেই কোনও, যাও যুদ্ধ করো—মা ভৈর্যুদ্ধস্ব পাণ্ডবম্।

কথাগুলো বলে দ্রোণ আর দাঁড়ালেন না। রাত্রির তিন ভাগ তখন কেটে গেছে। এক ভাগ বাকি। দুর্যোধনের ওপর যে দুর্দম্য রাগ হয়েছিল, আচার্য সেই রাগের পথ উন্মুক্ত করে দিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কৌরব-পাণ্ডব পক্ষের কোনও সৈন্যই আর সম্পূর্ণ বিশ্রাম পেল না। ধুন্ধুমার যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল শেষ রজনীতে মশাল জ্বালিয়ে—ত্রিভাগমাত্রশেষায়াং রাত্র্যাং যুদ্ধমবর্তত। রাত্রিশেষের এই যুদ্ধের মধ্যে এক করুণ ঘটনা আছে, যদিও মহাভারতের কবি সেই ঘটনার প্রতি তাঁর কবিজনোচিত মর্মবেদনা প্রকাশ করেননি।

লক্ষণীয় ব্যাপার হল, সমগ্র দ্রোণপর্বের মধ্যে দ্রোণ যখনই যুদ্ধে গেছেন অথবা তিনি যখন ভয়ংকর লোকক্ষয়ে লিপ্ত, তখনই দেখেছি—যুদ্ধের অধিকাংশ সময়েই দ্রোণের বাণ-লক্ষ্য হলেন পাঞ্চালরা। পাণ্ডবরা নন। দুর্যোধনকে কথা দিয়েও তিনি যুধিষ্ঠিরকে হাতের মুঠোয় পেয়েও ধরেননি। ভীম, নকুল কিংবা সহদেবও অতি মাত্রায় কখনও তাঁর লক্ষ্য নন। অর্জুন তো ননই। অথচ দুর্যোধন এঁদেরই মৃত্যু চেয়েছিলেন। সেনাপতি হিসেবে দ্রোণ যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, তা হল—যথাসম্ভব পাঞ্চাল সৈন্য ধ্বসং করা এবং সেই সূত্রে পাঞ্চাল-প্রধানদের সংখ্যা কমানো। যেখানেই দ্রোণ যুদ্ধ করছেন, সেখানেই বর্ণনা পাচ্ছি—তিনি শত শত পাঞ্চাল সৈন্য বিনাশ করছেন।

আশ্চর্যের কথা আরও আছে। জয়দ্রথ এবং ভূরিশ্রবা যখন মারা গেলেন, তখন দুর্যোধন দ্রোণকে দোষ দিয়েছিলেন যে, তিনি শিষ্যের প্রতি অনুকম্পায় তাঁকে ঠিকমতো শাস্তি দিচ্ছেন না—ভবানুপেক্ষাং কুরুতে শিষ্যত্বাদ্ অর্জুনস্য হি। উত্তরে যদি সত্যিই দ্রোণ পুনরায় যুদ্ধোদ্যোগী হয়ে ওঠেন তা হলে দ্রোণের কী বলা উচিত ছিল? উচিত ছিল এই বলা যে—আচ্ছা! অর্জুনকে এবার আমি দেখছি। কিন্তু না দ্রোণ এ কথা বলেননি। তিনি অর্জুনের ক্ষমতার কথা খুব বলেটলে দুর্যোধনের কাছে প্রতিজ্ঞা করে বললেন—তোমায় কথা দিচ্ছি, দুর্যোধন! আমি সমস্ত পাঞ্চালদের না মেরে এই যুদ্ধবর্ম খুলব না দেহ থেকে—নাহত্বা যুধি পাঞ্চালান্ কবচস্য বিমোক্ষণম্। শুধু নিজে নয়, পাঞ্চালদের প্রতি তাঁর এই বিদ্বেষ তিনি তাঁর পুত্র অশ্বত্থামার মধ্যেও অনুস্যূত করতে পেরেছিলেন। দুর্যোধনের কাছে কথা দেবার সময় তিনি পুত্রকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন—দুর্যোধন! তুমি আমার ছেলেকে বলো যে, নিজের জীবন থাকতে একটি পাঞ্চালও যেন তার হাত থেকে বেঁচে না ফেরে—ন সোমকাঃ প্রমোক্তব্যা জীবিতং পরিরক্ষতা।

বেশ বুঝতে পারি—কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধটা দ্রোণের কাছে কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ নয়, সে যুদ্ধ কুরু আর পাঞ্চালদের যুদ্ধ। কথাটা ঐতিহাসিক দিক থেকে মিথ্যেও নয়, কিন্তু পাঞ্চালরা যে কারণেই কুরুদের শত্রু হোন, দ্রোণাচার্যের পাঞ্চাল-বিদ্বেষ নিতান্তই ব্যক্তিগত। সেই যে যৌবনসন্ধির কালে তিনি পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে অপমানিত হয়েছিলেন, সে অপমান তিনি কোনও দিন ভোলেননি। দ্রুপদকে প্রতি-অপমান করার পরেও, তাঁর রাজ্যার্ধ ছিনিয়ে নেবার পরেও দ্রুপদের ওপর রাগ তাঁর যায়নি। কুরুবাড়ির মর্যাদা এবং মন্ত্রিত্ব লাভ করে অপমানিত দ্রুপদের ওপর তাঁর মায়া হয়েছে বটে কখনও কখনও, কিন্তু তাঁর ক্রোধের যে মূল ঘটনা—দ্রুপদ তাঁর বন্ধুত্ব অস্বীকার করেছিলেন—এ অপমান তিনি কখনও ভোলেননি আর ভোলেননি বলেই সমস্ত সেনাপতিত্বের কাল ধরে পাঞ্চালদের প্রতি তাঁর শত আক্রোশ দেখেছি আর আগ্রহ দেখেছি শুধুই পাঞ্চালবধে।

আজ যখন রজনী শেষে দুর্যোধনের কাছে অপমানিত হয়ে দ্রোণ সাক্রোশে যুদ্ধ করতে গেলেন, তখনও তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল পাঞ্চালরাই। দুর্যোধনের কাছে অপমানিত হওয়ার ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রোণ ভয়ংকর হয়ে উঠেছিলেন এবং স্বদেশের মর্যাদা রক্ষার তাগিদে সেদিন দ্রুপদ এবং বিরাট দ্রোণের মুখোমুখি হয়েছিলেন। পাণ্ডবদের এই দুই চিরবন্ধু সেদিন দ্রোণকে রুখতে পারেননি এবং এই যুদ্ধের ফলও হয়েছিল ভয়ংকর। রাজা বিরাট এবং পাঞ্চাল দ্রুপদ দুজনেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন দ্রোণের ভল্লক্ষেপণে। বড় আশ্চর্য এখানে মহাভারতের অকরুণ কবি! খুব স্বল্পসংগ্রামের পর কৈশোরগন্ধী বয়সের দুই বন্ধুর দেখা হল যুদ্ধক্ষেত্রে, আর কী অল্প কথায় তাঁদের একতরের নিধন-সংবাদ পাওয়া গেল—দ্রুপদ এবং বিরাটকে মৃত্যুর পথ দেখালেন দ্রোণ—-দ্রুপদঞ্চ বিরাটঞ্চ প্রেষয়ামাস মৃত্যবে।

মহাভারত খুলে দেখবেন—এইরকমই এক সংগ্রামমুখর অবস্থায় দুর্যোধন আর সাত্যকির দেখা হয়েছিল। সেখানে দুর্যোধনের মতো প্রতিহিংসাপরায়ণ ব্যক্তিও যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে নিজেদের শৈশব কৈশোরের বাল্যক্রীড়ার কথা স্মরণ করেছেন। এমনকী সাত্যকিও সেখানে পূর্বানুস্মরণে মোহিতপ্রায়। অথচ এই বাল্য বন্ধুত্বের কথা মহাভারতের কবি পূর্বে কোথাও বলেননি। সেখানে এই দ্রোণ এবং দ্রুপদের বাল্য বন্ধুত্বের কথা কত সাড়ম্বরে বর্ণনা করেছেন মহাকবি। অথচ আজ যখন বিনা কোনও আড়ম্বরে মারা গেলেন পাঞ্চাল দ্রুপদ, একটি পূর্বানুস্মরণের কথাও শুনলাম না দ্রোণের মুখে, অথবা দেখলাম না বাল্য বন্ধুর জন্য দ্রোণের কপোলে এক বিন্দুও অশ্রুপাত।

মহাভারতের কবিরও কোনও দোষ নেই। আসলে পাঞ্চালদের ওপর দ্রোণের পূর্বজাত ক্রোধ দুর্যোধনের ক্রোধের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। যৌবনবয়সে পরের পর দারিদ্র্যের আঘাত সহ্য করতে করতে দ্রোণের মতো মানুষ যখন মর্যাদা, ধন, সম্পত্তির তুঙ্গবিন্দুতে পৌঁছোন, তখন সেই পূর্বকৃত অপমান-বোধ আরও প্রখর হয়, আরও ক্ষুরধার হয়। আর সুযোগ পেলে—সুযোগটা এমনই যে দুর্যোধনের প্রতিহিংসা এবং প্রয়োজনের সঙ্গে কত সূক্ষ্মভাবে দ্রোণ মিশিয়ে দিতে পেরেছেন নিজের প্রতিহিংসা এবং প্রয়োজন, যাতে সুযোগ পেলে দ্রুপদকে হত্যা করতে তাঁর এতটুকু হাত কাঁপে না অথবা হৃদয়ে রেখাপাত করে না বন্ধুত্বের শোণিতবিন্দু। এমন কঠিন মনস্তত্ত্ব বর্ণনা করতে মহাভারতের কবির বেধেছে, তাই কোনও বর্ণনা, কোনও করুণার স্পর্শ তিনি লাগতে দেননি পাঞ্চাল দ্রুপদের মৃত্যুতে।

শেষরজনীর আলোআঁধারি যুদ্ধে দ্রুপদ মারা গেলেন। প্রাতঃ সূর্যের প্রথম রক্তরাগ যখন দ্রুপদের রক্তের সঙ্গে মিশে গেল, তখন যুদ্ধ একটু থামল বটে, কিন্তু সূর্যের আলো প্রকট হতে আবারও আরম্ভ হল ভয়ংকর যুদ্ধ। দ্রুপদের জন্য শোক করারও সুযোগ পেলেন না পাণ্ডবরা, এমনকী পাঞ্চালকুমার ধৃষ্টদ্যুম্নও। সকালে যে যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছিল তা একসময় দ্রোণ এবং অর্জুনের যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াল এবং এ যুদ্ধ অর্জুনের গুরু-গৌরবে অথবা দ্রোণের শিষ্য-ভাবনায় প্রায় অমীমাংসিতই রইল। দ্রোণ আবারও পাঞ্চালদের নিয়ে পড়লেন—পাঞ্চালানাং ততো দ্রোণো’প্যকরোৎ কদনং মহৎ। দ্রোণ পাণ্ডবদের দিকে তাকিয়েও দেখলেন না আর। তাঁর দৃষ্টি এবং লক্ষ্য শুধুই পাঞ্চাল-নিধন।

সর্বত্র, যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বত্র দ্রোণের শরবৃষ্টিতে শুধু পাঞ্চালরাই নিহত হচ্ছে। তাঁকে কেউ কোনওভাবে প্রতিরোধ করতে পারছে না। শিশিরের কাল চলে গেলে ঘরের চাল যেমন শুকনো খড়খড়ে হয়ে থাকে এবং তাতে আগুন লাগলে যেমন মুহূর্তে তা ভস্মীভূত হয়, দ্রোণের শরবর্ষণে পাঞ্চালদের অবস্থাও হল সেইরকম। পাণ্ডবরা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলেন—পাণ্ডবান্ ভয়মাবিশৎ। দ্রোণ এমনই মেতে উঠেছিলেন এই নিধনযজ্ঞে যে, তাঁকে প্রতিরোধ করাটা অন্য কারও পক্ষে সম্ভবই হচ্ছিল না, আর যিনি এই প্রতিরোধ করতে পারতেন, সেই পাণ্ডব অর্জুন কোনও ভাবেই আগ বাড়িয়ে গিয়ে গুরুর সঙ্গে যুদ্ধ করবেন না—ন চৈনম্ অর্জুনো জাতু প্রতিযুধ্যেত ধর্মবিৎ।

ফলে এই যুদ্ধে পাঞ্চালদের অসংখ্য ক্ষতি ছাড়া অন্য কোনও পৃথক ফল দেখা যাচ্ছিল না। পাণ্ডবরা ভাবছিলেন যে, এইভাবে যদি পাঞ্চাল-নিধন চলতে থাকে এবং বাড়তে থাকে দ্রোণের বিক্রম, তা হলে যুদ্ধ জয় তো দূরের কথা, পাণ্ডবপক্ষের সকলেই না এক সময় শেষ হয়ে যায়—ক্কচিদ্ দ্রোণঃ ন নঃ সর্বান্ ক্ষপয়েৎ পরমাস্ত্রবিৎ। দ্রোণের আক্রমণ আরও কঠিন, তীক্ষ্ণ এবং প্রায় সর্বনাশা হয়ে উঠলে পার্থসারথি কৃষ্ণ, যিনি পাণ্ডবদের সমস্ত ভালমন্দে বন্ধু এবং পরামর্শদাতা, তিনি অর্জুনকে বললেন—দেখো ভাই! যুদ্ধ করে এই মানুষটিকে শায়েস্তা করতে পারবে না—নৈব যুদ্ধেন সংগ্রামে জেতুং শক্যঃ কথঞ্চন। অতএব এই আচার্যই যেমন বলেছিলেন যে, কোনও বিষাদ-সংবাদে যদি তাঁকে অস্ত্রত্যাগ করানো যায়, তবেই এঁকে হত্যা করা যাবে।

হ্যাঁ, এ পর্যন্ত দ্রোণই বলে দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে যুদ্ধারম্ভের মুহূর্তে। কিন্তু কী সেই কঠিন সংবাদ যা আচার্যের কানে দিলে তিনি অস্ত্রত্যাগ করবেন—এ ব্যাপারে কেউ ভাবেননি, যুধিষ্ঠির তো ননই, অর্জুন তো কখনওই নয়, যত বিপর্যয়ই ঘটুক তবু এই পরম প্রিয় আচার্যের মৃত্যু হোক—এ অর্জুন চান না। অথচ তাঁকে সত্যিই চিরশান্ত করা দরকার—এই বাস্তব পরিস্থিতি অন্য কেউ না বুঝলেও কৃষ্ণ বুঝেছেন। যার জন্য কথার পৃষ্ঠে কথার তাড়নায় সেই মৃত্যুর উপায় সৃষ্টি করতে দূরদর্শী কৃষ্ণের বাধেনি। কৃষ্ণ বলেছেন—দেখো অর্জুন! এখন যুদ্ধ জয়টাই সমূহ প্রয়োজন, ধর্মরক্ষা বা ন্যায়বিধিতে তা সম্ভব নয়, অতএব দরকার হলে অন্যায়ই করতে হবে—আস্থীয়তাং জয়ে যোগো ধর্মমুৎসৃজ্য পাণ্ডবাঃ। আমাদের মনে রাখতে হবে—দ্রোণ যেন আমাদের সবাইকে শেষ করে না ফেলেন। তা হলে আর যুদ্ধক্ষেত্রে আসা কেন?

সামান্য ভনিতা করেই আসল কথাটা পেড়ে ফেলেছেন কৃষ্ণ। তিনি বলেছেন—এঁকে তাঁর প্রিয় পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ দিতে হবে। কেউ গিয়ে তাঁর সামনে মিছিমিছিই এই কঠিন সংবাদ শুনিয়ে আসুক—তং হতং সংযুগে কশ্চিদ্ অস্মৈ শংসতু মানবঃ। অন্যান্য রাজন্যবর্গ এবং পাঁচ পাণ্ডব ভাইদের সামনে যখন কৃষ্ণের প্রস্তাবটা পরিবেশিত হল, তখন নিজেদের বিপন্ন অবস্থা বুঝে সকলেই সেটা মেনে নিলেন। পাণ্ডব-পাঞ্চালদের এই বিপন্নতা যে অর্জুনও বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু কৃষ্ণের এই বজ্রকঠিন অন্যায় পরামর্শ কিছুতেই তিনি মেনে নিতে পারলেন না—এতন্নারোচয়দ্ রাজন্ কুন্তীপুত্রো ধনঞ্জয়ঃ। ন্যায়নিষ্ঠ যুধিষ্টির—তিনি নিজেই দ্রোণকে মৃত্যুর উপায় জিজ্ঞাসা করার সময় দ্রোণের কাছে ওইরকমই একটা উত্তর শুনেছিলেন বলে তাঁর শুধু এইটুকু মানসিক প্রস্তুতি ছিল যে—আচার্যকে কোনও দুঃসংবাদ দিয়ে অস্ত্রত্যাগ করাতে হবে। কিন্তু সেটা যে তাঁর পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ—এই প্রস্তাব তাঁকে মেনে নিতে হল খুব কষ্ট করেই—কৃচ্ছ্রেণ তু যুধিষ্ঠিরঃ। কষ্ট করে এইজন্য যে, অন্য কোনও দুঃসংবাদ সইবার মতো মানসিক দৃঢ়তা দ্রোণের আছে। অতএব অগত্যা—।

এই মিথ্যা সংবাদ দেবার মধ্যে সত্যের একটু প্রলেপ দেওয়া হল এবং সেটা হয়তো যুধিষ্ঠির অত বড় ডাহা মিথ্যেটা সইতে পারছিলেন না বলেই। ভীম একটা হাতিকে মেরে ফেললেন যার নাম ছিল অশ্বত্থামা। তারপর ভীম উদ্বাহু হয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে—দ্রোণ যাতে শুনতে পান—সেইভাবে বললেন—অশ্বত্থামা মারা গেছে। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দ্রোণের মনে একটা তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হল বটে, তাঁর শরীরও খানিকটা ঠান্ডা হয়ে এল, কিন্তু ধৈর্য হারালেন না। প্রিয় পুত্রের অস্ত্ৰক্ষমতা এবং শক্তির কথা তাঁর মনে পড়ল এবং সভয়েই ভাবলেন—-খবরটা মিথ্যা—শঙ্কমানঃ স তন্মিথ্যা বীর্যজ্ঞঃ স্বসুতস্য বৈ। এই ভাবনা তাঁকে নতুন শক্তি যোগাল। ক্ষণিকের হারানো চেতনা ফিরে এল নতুন প্রাণশক্তি নিয়ে। তিনি ধেয়ে গেলেন পাঞ্চালকুমার ধৃষ্টদ্যুম্নের দিকে। ভাবলেন বুঝি—তাঁর পূর্বশত্রু পাঞ্চালরা ছাড়া এত বড় ক্ষতি তাঁর আর কেউ করতে পারে না।

দুর্দম্য প্রতিশোধস্পৃহায় তিনি আবারও পাঞ্চাল-হত্যায় মনোনিবেশ করলেন। ক্রোধ তাঁকে অন্ধ করে তুলল। যে অস্ত্র সাধারণ মনুষ্যের ওপর প্রয়োগ করতে তিনি বারংবার বারণ করেছিলেন অর্জুনকে, সেই ব্রহ্মাস্ত্র তিনি তুলে নিলেন হাতে। পাঞ্চালদের তিনি শেষ করে ছাড়বেন। তাঁদের জন্যই আজ তাঁর এই দুর্গতি। যৌবনে তিনি অপমানিত হয়েছেন, আর সারা জীবন ধরে তাঁকে কৌরবদের বৃত্তিভোগী হয়ে থাকতে হয়েছে। অপিচ সেই পরাধীনতা মাথায় নিয়েই আজ তাঁকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাণ্ডবদের বিপক্ষে যুদ্ধ করতে হচ্ছে। অতএব ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে পাঞ্চালদের অবশেষটুকুও শেষ করে দিতে চান তিনি—বধায় তেষাং শূরাণাং পাঞ্চালানামমর্ষিতঃ।

অগণিত পাঞ্চালসৈন্য মারা গেল দ্রোণের হঠকারিতায়। তাঁর এই বিপরীত আচরণ দেখে যুদ্ধদর্শী সমবুদ্ধি ঋষিরা উপস্থিত হলেন দ্রোণের কাছে। তাঁরা নিজেদের ক্ষোভ চেপে রাখলেন না দ্রোণের কাছে, এবং অনুরোধ করলেন দ্রোণকে অস্ত্র ফেলে দেবার জন্য। ঋষিরা বললেন—যারা এই অস্ত্রের ক্ষমতা এবং শক্তি সম্বন্ধে অচেতন এবং কোনও ভাবেই যারা এই ভয়ংকর ব্রহ্মাস্ত্রের প্রতিরোধ জানে না, সেইসব সাধারণ সৈন্যের ওপর এই দিব্যাস্ত্রের প্রয়োগ অত্যন্ত অন্যায়। দ্রোণ তাই করেছেন—ব্রহ্মাস্ত্রেণ ত্বয়া দগ্ধা অনস্ত্রজ্ঞা নরা ভুবি।

ঋষিদের তিরস্কারবচন শুনে দ্রোণ শান্ত হলেন। পরিত্যাগ করলেন সমস্ত অস্ত্র। কিন্তু শারীরিকভাবে শান্ত হলেই তো আর সব সময় মানসিক শান্তি আসে না। বরঞ্চ অন্য কর্মে ব্যস্ততার অভাবে সেই পূর্ব সন্দেহ জোরদার হয়ে উঠল আবার—অশ্বত্থামা বেঁচে আছে তো—অহতং বা হতং বেতি। দ্রোণের মনে হল—আর যেই হোক, যুধিষ্ঠির কখনও মিথ্যে কথা বলবে না, তিন ভুবনের সমস্ত ঐশ্বর্যের প্রলোভন দেখালেও যুধিষ্ঠির মিথ্যা কথা বলবে না। দ্রোণ অতএব যুধিষ্ঠিরকেই সংকেত করলেন কাছে আসবার জন্য। দ্রোণের আকারইঙ্গিত দেখেই মহামতি কৃষ্ণ ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন দ্রোণের মতিগতি, ভাবনা। যুধিষ্ঠিরকে তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেছেন—দেখো দাদা! দ্রোণাচার্য যদি আর আধবেলা এই ক্রোধ-রক্ত ভঙ্গিতে যুদ্ধ চালিয়ে যান—যদি অর্ধদিবসং দ্রোণো যুধ্যতে মন্যুমাস্থিতঃ—তা হলে কেউ আর বেঁচে থাকবে না। এখন শুধু আপনিই আছেন, যিনি আমাদের সকলকে এই মৃত্যুর মতো বিপদ থেকে ত্রাণ করতে পারেন।

কৃষ্ণ জানতেন যে, যুধিষ্ঠিরকে মিথ্যা বলতে বললেই তিনি বলবেন না, তাঁকে বোঝাতে হবে দার্শনিকভাবে। কৃষ্ণ বললেন—দেখুন কখনও কখনও সত্যের চেয়ে মিথ্যা ভাষণই মঙ্গল ঘটায়। এখানে মিথ্যা বললে এতগুলো লোক বাঁচবে। আপনি একটা মিথ্যা উচ্চারণ করলে যদি এতগুলি মানুষের জীবন বাঁচে, তো সে মিথ্যা স্পর্শ করে না বক্তাকে—অনৃতং জীবিতস্যার্থে বদন্ন স্পৃশ্যতে’নৃতৈঃ। কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের কথার ফাঁকে মধ্যম পাণ্ডব ভীম ঢুকে পড়লেন হঠাৎ করে। তিনি বললেন—এই তো আমি অশ্বত্থামা নামে একটা হাতিকে মেরে আচার্যের সামনে চেঁচিয়ে বললাম—অশ্বত্থামা মারা গেছে, আপনি যুদ্ধ থেকে বিরত হোন। কিন্তু তিনি আমার কথা বিশ্বাস করেননি। ভীম এবার সানুরোধে বললেন—তোমাকে সকলেই সত্যবাদী বলে জানে, তুমি অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দাও দ্রোণকে।

কৃষ্ণের উপরোধ, ভীমের অনুরোধ এবং সবার ওপরে পাণ্ডবপক্ষীয় পাঞ্চাল সেনাদের দুর্গত অবস্থা দেখে মনে মনে অসত্য-বিধ্বস্ত যুধিষ্ঠির দ্রোণের সামনে উচ্চারণ করলেন অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ, সঙ্গে নীচ অব্যক্ত স্বরে বললেন—হাতি কিন্তু। সে শব্দ প্রবেশ করল না দ্রোণের কর্ণপুটে। সত্যভাষী যুধিষ্ঠিরের মুখে প্রিয় পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন আপন জীবনের প্রতি। ঋষিদের কথায় আগেই তিনি অস্ত্রত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মুখে অশ্বত্থামার মৃত্যুর কথা শুনে পঁচাশি বছরের বৃদ্ধ একেবারেই ভেঙে পড়লেন। তাঁর শরীরে আর যুদ্ধ করবার শক্তি রইল না যেন—পুত্ৰব্যসনসন্তপ্তো নিরাশো জীবিতে’ভবৎ।

দ্রোণাচার্যের এহেন নির্জীব অবস্থা দেখে পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুন্ম তৎপর হয়ে উঠলেন। তিনি জানতেন যে, তাঁরই হাতে দ্রোণাচার্যের মৃত্যু। তিনি হাতে তুললেন ধনুঃশর এবং বাণবর্ষণ করতে আরম্ভ করলেন দ্রোণের ওপর। জীবনে সম্পূর্ণ নিরাশ হয়ে উঠলেও আত্মরক্ষার এমন এক স্বাভাবিক প্রবণতা মানুষের থাকে যে, মৃত্যু যদি একান্ত অভীষ্টও হয়, অথবা নিশ্চিত, তা হলেও মানুষ শারীরিক আঘাত রোধ করার চেষ্টা করে। সেই যে গল্প শুনেছি—এক বৃদ্ধ জীবনে বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাতের অন্ধকার নদীতে ডুবে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছিল। এদিকে তার হাতে একটি লণ্ঠন। একজন পথচারী তাকে জিজ্ঞাসা করল—কোথায় চললেন ঠাকুর? বৃদ্ধ বললেন—আত্মহত্যা করতে! পথচারী অবাক হয়ে বলল—তা, হাতে লণ্ঠন কেন? বৃদ্ধ বললেন—যদি আবার অন্ধকারে সাপখোপ বেরোয়, তাই।

এই গল্পের মর্ম হাসিতে নয়। মৃত্যু অভীষ্ট হলেও চিরাভ্যস্ত আত্মরক্ষার প্রবণতা কীভাবে নিজের অজান্তেই কাজ করতে থাকে, এ গল্প তারই উদাহরণ। পুত্রের জন্য শোকসন্তপ্ত হয়ে জীবনে নিরাশ হয়ে উঠেছিলেন দ্রোণ। কিন্তু ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন তাঁর ওপরে অস্ত্রবৃষ্টি আরম্ভ করলেন, তখন দ্রোণও থেমে থাকলেন না। আবারও অস্ত্র হাতে নিয়ে তিনি যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। অস্ত্রের বিনিময় চলতে লাগল এবং এতটাই ধৃষ্টদ্যুম্নকে প্রতিরুদ্ধ করে রাখতে সমর্থ হলেন তিনি যে, ধৃষ্টদ্যুম্ন তাঁকে সোজাসুজি হত্যা করতে সমর্থ হলেন না। একটা সময় এল, যখন ওই শোকাচ্ছন্ন অবস্থাতেও তিনি ধৃষ্টদ্যুম্নের ধনুকটি কেটে ফেলে দিলেন।

মধ্যম পাণ্ডব ভীমকে এই সময় দুই ধনুর্ধরের কাছাকাছি আসতে দেখা গেল। ভীম মহাবলবান এবং প্রকৃতিতে রুক্ষ এবং কঠিন। কোনও কথাও তাঁর মুখে আটকায় না। ছিন্নধনু ধৃষ্টদ্যুম্নের বিহ্বল অবস্থায় চিন্তিত হয়ে ভীম এসে আচার্যের রথখানিকেই জাপটে ধরলেন। রণভূমিতে দ্রোণের রথ চলাচল বন্ধ হয়ে গেল। ভীম এবার নির্লজ্জভাবে কথা শুনিয়ে আচার্যকে বললেন—যাঁরা ব্রাহ্মণের যজন-যাজন-অধ্যাপনায় শিক্ষিত হয়েও ব্রাহ্মণের আচরণ করেন না, নিজের পরম্পরাগত ব্রাহ্মণ্যবৃত্তিতেও যাঁরা কোনও দিন সন্তুষ্ট হননি, এবং ধ্বজাধারী, নামে-বামুন লোকগুলো যদি অন্তত যুদ্ধ না করে এমনিই বসে থাকত, তা হলে অন্তত এই পরিমাণ ক্ষত্রিয় নিধন হত না—ন স্ম ক্ষত্রং ক্ষয়ং ব্রজেৎ।

কথাটার মধ্যে অসম্মানও আছে, সম্মানও আছে। অসম্মান এইখানে যে, ভীম দ্রোণকে স্বকর্মত্যাগী, ব্রাহ্মণ্যের বৃত্তিত্যাগী বলে উপহাস করলেন। আর সম্মান এইখানে যে, যজ্ঞযাজী বামুন আজ ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করে সমস্ত ক্ষত্রিয়ের মহাকাল হয়ে উঠেছেন। ভীমের সম্মান-আচরণ অবশ্য বেশিক্ষণ থাকল না। বললেন—কাদের এতদিন ধরে মেরেছেন আপনি? সাধারণ সৈন্য। দুটো পয়সার জন্য যেসব ম্লেচ্ছ, কিরাত যুদ্ধ করতে এসেছে, সৈন্যদলে যোগ দিতে এসেছে, তাদের এবং অবশ্যই পাঞ্চালদের অনেককে মেরেছেন আপনি। কেন মেরেছেন, তাও জানি। অজ্ঞান বোধশূন্য ব্যক্তির মতো এবং তা মেরেছেন নিজের পুত্র পরিবার ভরণপোষণের জন্য, ধনের জন্য—আজ্ঞানান্‌মূঢ়বদ্ ব্ৰহ্মন্ পুত্রদার ধনেপ্সয়া। আপনার লজ্জা হওয়া উচিত যে, শুধুমাত্র নিজের ভবিষ্যৎ ভাল রাখার জন্য আপনি অন্যায়ভাবে এতগুলি সাধারণ সৈন্য বধ করে গেলেন—একস্যার্থে বহূন্ হত্বা পুত্রস্যাধর্মবিদ্যয়া।

কথাগুলির মধ্যে মর্মান্তিক খোঁচা ছিল দ্রোণের প্রতি। দ্রোণ দুর্যোধনের বৃত্তিভোগী আপাতত। পুত্র-পরিবার ভরণপোষণের জন্যই তিনি কুরুবাড়িতে প্রথম এসেছিলেন, এবং পুত্র-পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্যই তিনি কুরুবাড়িতে গেছেন এবং তাঁদের মন্ত্রীও হয়েছেন একসময়। তারপর তিনি যে এই যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছেন, তাতেও তো এই প্রমাণই হয় যে, এখনও তাঁর ঐশ্বর্যের আকাঙ্ক্ষা আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে স্ত্রীকে অক্লেশে রাখার। পুত্রকে প্রতিষ্ঠিত দেখার।

কী করে বোঝাবেন দ্রোণ। কথাটা যে সত্যও বটে অসত্যও বটে। যখন তিনি পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছে অপমানিত হয়ে কুরুবাড়িতে এসেছিলেন তখন তো সত্যি বৃত্তিরই প্রয়োজন ছিল তাঁর। ব্রাহ্মণের সমাজে তিনি যে পরিত্যক্ত হয়েছিলেন একসময়। পুত্রের মুখে সামান্য দুধ তুলে দেবার জন্য একটি দুগ্ধবতী গাভীও যে তিনি পাননি। তাঁর দোষ কী ছিল, ব্রাহ্মণের যজনযাজন, অধ্যয়ন অধ্যাপনা তাঁর ভাল লাগত না—শুধু এই দোষে তিনি ব্রাত্য হয়ে গেলেন। ভীম এসব বুঝবেন কী করে? আবার ভীমের কথাও যে সত্যিও বটে খানিকটা। ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি গ্রহণ করেও তিনি তো কুরুবাড়িতে ব্রাহ্মণের সম্মানই পেয়েছেন এবং তাঁর মন্ত্রিত্বও জুটেছে হয়তো সেই মর্যাদাতেই। কিন্তু অসত্যটা যেখানে, সেটা ভীমের মতো অসংবেদনশীল মানুষের বোধগম্য নয় একটুও। নিজের ক্ষমতায় দ্রুপদকে অপমানিত করে তিনি তো অর্ধেক পাঞ্চাল পেয়েই গিয়েছিলেন। তখন তো পুত্ৰ-পরিবার পোষণের অসুবিধে ছিল না। কিন্তু যেতে যে পারেননি, সে তো এই কুরুবাড়ির প্রতি মায়ায়, আর সম্ভবত বৃদ্ধ ভীষ্মের উপরোধে। তিনি স্বোপার্জিত বৃত্তি দ্রোণকে দান করে রেখে দিয়েছিলেন কুরুবাড়িতে এবং সেই জন্যই কুরুদের হিত চিন্তার ক্ষেত্রে সব সময় ভীষ্মের সঙ্গে একত্রে উচ্চারিত হয়েছে তাঁর নাম।

কিন্তু মনের গভীরের এইসব জটিলতা তিনি শুষ্কবুদ্ধি ভীমকে বোঝাবেন কী করে? বিশেষত ভীষ্মের শরশয্যা-শয়নের পরে এসব কথা আজ তাঁকে বড় পীড়িত করছে, অবলুপ্ত করে দিচ্ছে জীবনধারণের অবশিষ্ট অভিলাষ। ভীম তো থামেন না, প্রবল জয়াভিলাষদিদ্ধ ক্ষত্রিয়ের নীচ নির্লজ্জ তাড়না তাঁর মুখের আগল ভেঙে দেয়। তিনি নির্লজ্জভাবে আবার সেই অসত্য উচ্চারণ করেন,—আরে, কার জন্য আর বাঁচতে চান আপনি। যার জন্য এমন ধনুকবাণ হাতে ধরে যুদ্ধ করছেন, যার জন্য বাঁচতে চাইছেন এ জীবনে, সেই তো মরে গেছে। বললাম, তবু বিশ্বাস হল না—স চাদ্য পতিতঃ শেতে পৃষ্ঠেনাবেদিতস্তব। অন্তত যুধিষ্ঠিরের কথায় তো বিশ্বাস করুন।

যুধিষ্ঠির নিজে তাঁর জীবনের একতম মিথ্যা কথা বলে কোথায় গিয়ে লুকিয়েছেন কে জানে? কিন্তু ভীম ঠিক চালিয়ে যাচ্ছেন। নির্লজ্জ নীচতর বশংবদ রাজশক্তি এমনই নির্মোহ হয়। দ্রোণাচার্য আর সহ্য করতে পারলেন না। এই নিয়ে তিনবার তাঁর সামনে উচ্চারিত হল সেই কঠিন প্রাণঘাতী শব্দরাশি—যার জন্য তিনি বেঁচে আছেন, সেই অশ্বত্থামা মারা গেছে। একমুহূর্তের মধ্যে দ্রোণ রথের ওপর নামিয়ে রাখলেন অস্ত্রশস্ত্রের ভার, তূণীর, জৈত্র ধনুকবাণ—যা তাঁর শত শত শিষ্যকে পরমাস্ত্রে শিক্ষিত করেছে। অস্ত্রত্যাগ করার মুহূর্তেও তিনি তাঁর অধিনায়কের কর্তব্য বিস্মৃত হলেন না। সেনাপতির কর্মভার অন্য কারও ওপরে ন্যস্ত করার আশায় সেই বিশাল যুদ্ধনাদী রণক্ষেত্রের মধ্যে দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে ডাকলেন—কর্ণ! কোথায় আছ তুমি কর্ণ! কৃপ! তুমি শুনতে পাচ্ছ। বৎস দুর্যোধন! আমি এই অস্ত্রত্যাগ করে সেনাপতির ভারমুক্ত হলাম। বার বার এ কথা বলছি, শুনতে পাচ্ছ তো? তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও—সংগ্রামে ক্রিয়তাং যত্নে ব্রবীম্যেষ পুনঃ পুনঃ। কর্তব্য এবং কর্তব্যের বোধেই কর্ণ-কৃপ-দুর্যোধনের উদ্দেশে এই সংবাদ রেখে গেলেন দ্রোণ। আর পাণ্ডব ভাইরা—যাঁদের মধ্যে তাঁর পুত্রাধিক প্রিয়তম শিষ্য অর্জুন আছেন, যাঁদেরকে তিনি ন্যায়পক্ষ বলে মনে করেন, তাঁদের উদ্দেশে বললেন—মঙ্গল হোক তোমাদের, অস্ত্র ত্যাগ করলাম আমি।

সমস্ত কর্তব্য-শব্দ উচ্চারিত হবার পরে দ্রোণের মুখ দিয়ে হাহাকার ধ্বনির মতো দুটি শব্দ হৃদয় থেকে বেরিয়ে এল—অশ্বত্থামা! অশ্বত্থামা আমার—ইতি তত্র মহারাজ প্রাক্রোশদ্ দ্রোণিমেব চ। যে পুত্রের মুখে সামান্য দুগ্ধ তুলে দেবার জন্য পাঞ্চালের চিরাবাস ছেড়ে পরবাসে কুরুদের আশ্রয়ে এসেছিলেন দ্রোণ, সেই পুত্রের মৃত্যুসংবাদ যখন পরম সত্যের মতো ঘনিয়ে এল জীবনে, তখন তাঁর উদ্দেশে দুটি শব্দে স্নেহাঞ্জলি উচ্চারণ করা ছাড়া আর কীই বা করতে পারতেন দ্রোণ। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তাঁর মৃত্যুকাল উপস্থিত।

ক্ষত্রিয়ের সমস্ত রজোবৃত্তি নিরস্ত করে এখন তিনি শান্ত সমাহিত। ব্রাহ্মণের চিরাভ্যস্ত যোগ-ধ্যান-প্রাণায়াম তাঁরও পূর্বায়ত্ত ছিল। যোগ-প্রাণায়ামে সমস্ত জাগতিক চিত্তবৃত্তির নিরোধ ঘটে। দ্রোণ সেই যোগনিরুদ্ধ অবস্থায় সমাহিতের মতো বসে থাকলেন রথের ওপরে—অভয়ং সর্বভূতানাং প্রদদৌ যোগমীয়িবান। যুদ্ধজয়ের দিক দিয়ে দেখলে এই তো বিবৃত ছিদ্র। পাঞ্চাল ধৃষ্টদ্যুম্ন এরই অপেক্ষায় ছিলেন এতদিন। তিনি খড়্গ হাতে লাফিয়ে পড়লেন রথ থেকে। সমস্ত সাধারণ মানুষ হাহাকার করে উঠল। যুদ্ধেরও তো একটা নিয়ম আছে। শান্ত সমাহিত নিরস্ত্র যোগাচ্ছন্ন পুরুষ—যিনি ক্ষণিক আগে ধৃষ্টদ্যুম্নের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন—তাঁকে এখন এইভাবে সদর্পে লাফিয়ে আসতে দেখে সাধারণ যুদ্ধদর্শী মানুষেরা ধিক ধিক করতে লাগলেন—হাহাকারং ভূশং চক্রুরহো ধিগিতি চাব্রুবন্।

অস্ত্ৰত্যাগী দ্রোণ তখনও সমাহিত। তিনি যোগজ ভাবনায় মনের মধ্যে আধান করার চেষ্টা করছেন পুরাণ-পুরুষ বিষ্ণুকে—সহস্ৰশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ—সর্বব্যাপ্ত, সর্বময়, জ্যোতিঃস্বরূপ সেই পুরুষ—পুরাণং পুরুষং বিষ্ণুং জগাম মনসা পরম্। এই অসাধারণ মুহূর্তেও দ্রোণের পূর্বাগত এবং পরম্পরাপ্রাপ্ত দৈবসিদ্ধির বিশেষত্বটুকু বলতে ভুল করেননি মহাভারতের কবি। যাঁরা দর্শনের ইতিহাস নিয়ে বিবেচনা করেন, তাঁরা কী বলবেন জানি না, তবে দ্রোণের দিনশেষের এই পারম্য ভাবনা ব্যাস যেভাবে প্রকাশ করেছেন, তাতে মনে হয়—বৈদান্তিক, ব্রহ্মভাবনা, অথবা বেদান্ত দর্শনের মোক্ষভাবনার চেয়েও পুরাতন সাধন বোধ হয় সাংখ্য-যোগ। বৈদান্তিক ব্রহ্মের অতল গভীর দার্শনিক কাঠিন্যের চাইতে জীবনের ক্ষেত্রে আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ইত্যাদি ত্রিবিধ দুঃখের নিবৃত্তি এবং সেই দুঃখ নিবারণের জন্য যোগ ধারণ—এইগুলিই বোধ হয় অতি প্রাচীন ব্রাহ্মণ্যের স্বভাবসিদ্ধ ছিল। নইলে কী আশ্চর্য—পরম ব্রহ্মের জ্যোতিঃস্বরূপ অদ্বৈত-ভাবনা—যা নাকি পরবর্তী সাহিত্যে সিদ্ধমৃত্যুর লক্ষণ হয়ে গেছে—মহাভারতের কবি দ্রোণের ক্ষেত্রে তার আভাসমাত্র দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর মূল বক্তব্য অন্য। তিনি বললেন—সমস্ত অস্ত্র ত্যাগ করে দ্রোণ পরম সাংখ্যে আহিত হলেন এবং নিজেকে ধারণ করলেন যোগের দ্বারা—তথোক্ত্বা যোগমাস্থায়…পরমং সাংখ্যমাস্থিতঃ। আর এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বৈদিক বিষ্ণুর অক্ষর স্বরূপ—তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদম্। ভাবে বুঝি—বেদান্তের চেয়েও সাংখ্য-যোগের দার্শনিক প্রস্থান বোধ হয় আরও পুরাতন।

যাই হোক, এতসব দর্শনতত্ত্বের আলোচনার অবসর এটা নয়—আমরা দ্রোণকে এখন দেখছি—তাঁর মুখটি সামান্য উঁচু করা—মুখং কিঞ্চিৎ সমুন্নাম্য—চক্ষু নিমীলিত, দুটি হাত বুকের ওপর, তাঁর সত্ত্বোদ্রিক্ত হৃদয়ে জ্যোতিঃস্বরূপ অক্ষরপুরুষের ভাবনা জেগে উঠল। মৃদুস্বরে নিনাদিত হল ওঙ্কার শব্দ—ওমিত্যেকাক্ষরং ব্রহ্ম জ্যোতির্ভূতো মহাতপাঃ। দ্রোণের প্রাণজ্যোতি উৎক্রান্ত হল আকাশে। সাংখ্য-যোগের সাধনেপায়ে এমন ব্ৰহ্ম নিলয় সাধ্যকে আত্মগত করা—এ বুঝি এক দ্রোণের পক্ষেই সম্ভব, আর তা বর্ণনা করা সম্ভব ব্যাসের পক্ষেই—সাংখ্য, যোগ এবং বেদান্তকে যিনি একাকার করে দিয়েছেন দ্রোণের মৃত্যুতে।

যোগের দ্বারা যাঁর প্রাণজ্যোতিঃ উৎক্রান্ত হল, সেই দ্রোণের স্থূল শরীরের দিকে ধৃষ্টদ্যুম্নের নজর পড়ল এবার। তিনি এগিয়ে গেলেন খড়্গ-তরবারি হাতে নিয়ে। সমস্ত সাধারণের ধিক্কারের মধ্যে দিয়ে এগোতেও তাঁর লজ্জা হল না। লজ্জা হল না দ্রোণের প্রাণহীন নিশ্চল স্থূল শরীর থেকে তরবারির আঘাতে বৃদ্ধ অবসন্ন মস্তকটি কেটে ফেলার উদ্যোগে। দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন অর্জুন। যোগারূঢ় আচার্যকে এতক্ষণ তিনি দেখছিলেন, ভাবছিলেন তাঁর পরমা বিভূতির কথা। হঠাৎ ধৃষ্টদ্যুম্নকে ওইভাবে তরবারি হাতে আসতে দেখে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন—মেরো না, মেরো না যেন, তুমি আচার্যকে জীবন্ত ধরে আনতে পার তো আনো। কিন্তু মেরো না যেন আচার্যকে। তাঁর কথা শুনে সাধারণ সৈনিকেরাও একইভাবে চেঁচাতে লাগল। এতক্ষণ ধরে মার খেলেও তারা আচার্য দ্রোণের মর্যাদা জানে—ন হন্তব্যো ন হন্তব্য ইতি তে সৈনিকাশ্চ হ।

কিন্তু এই মর্যাদার কোনও মূল্য নেই ধৃষ্টদ্যুম্নের কাছে। তিনি রথের কাছে পৌঁছোতেই তাঁর দিকে নিষেধাত্মক ভঙ্গীতে ধেয়ে চললেন অর্জুন। কিন্তু অর্জুন এবং অন্যান্য রাজাদের নিষেধাত্মক চিৎকার অগ্রাহ্য করে নিশিত তরবারির এক কোপে দ্রোণের মাথা কেটে ফেললেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। তখন কী তাঁর গৌরব, কী দর্প, কী অভিমান! যিনি বেঁচে থাকতে তাঁর বৃদ্ধপলিত কেশের অগ্রটুকুও স্পর্শ করতে পারেননি, আজ তিনি সেই পলিত-শ্যাম মস্তকটি আকাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সাবজ্ঞে ফেলে দিলেন কৌরবদের মাঝখানে—তাবকানাং মহেষ্বাসঃ প্রমুখে তৎ সমাক্ষিপৎ। এমন একজন অধিনায়কের মৃত্যুতে সমস্ত কৌরব সৈন্যই শুধু নয়, যুদ্ধে নিরস্ত হল সকলে কুরু পাণ্ডব পাঞ্চাল সকলে—হতে দ্রোণে নিরুৎসাহা কুরু পাণ্ডব সৃঞ্জয়াঃ।

দ্রোণাচার্যের মৃত্যুর রেশ বহু দূর পর্যন্ত গড়িয়েছে; একেবারে কুরুক্ষেত্রের শেষ যুদ্ধ পর্যন্ত দ্রোণাচার্য ভর করে ছিলেন কুরু পাণ্ডবদের ওপর। প্রথমত দ্রোণের মৃত্যুর পর দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা যখন নিদারুণ ক্রোধে পাণ্ডব পক্ষের দিকে ধেয়ে এলেন, তখনও নিদারুণ শোকে মগ্ন হয়ে রয়েছেন অর্জুন। তাঁকে জানানোও হল যে, অশ্বত্থামা ক্রোধাগ্নি-রুষিত হয়ে ধৃষ্টদ্যুম্নকে বধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে আসছেন। স্বয়ং যুধিষ্ঠিরই এ কথা সভয়ে জানালেন অর্জুনকে। কিন্তু অর্জুনের প্রতিক্রিয়া হল একেবারেই নেতিবাচক। দ্রোণের মৃত্যু, বিশেষত ধৃষ্টদ্যুম্নের ওই নৃশংস আচরণ কিছুতেই তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।

আর সত্যিই তো, কী করেছেন ধৃষ্টদ্যুম্ন! মহাভারতের কবি কী অদ্ভুত উপায়ে প্রকট করে দিয়েছেন তাঁর অন্তঃসারশূন্য আচরণ। বুঝিয়ে দিয়েছেন—অনেক নাম-ডাকের বাজনা বাজিয়ে এক এক জন মানুষ এইরকমই উচ্চচূড় সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত হয়, অথচ তার কর্মক্ষমতা নেই, প্রতিভা নেই, শক্তি নেই। মহাভারতের কবি দ্রুপদের যজ্ঞের কথায় ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম-সজ্জা বর্ণনা করেছেন। পাঞ্চাল দ্রুপদের গৌরবে পাণ্ডবপক্ষের সেনাপতিও নিযুক্ত হয়েছেন ধৃষ্টদ্যুম্ন। অথচ সম্পূর্ণ ভীষ্মপর্ব এবং দ্রোণপর্ব জুড়ে তাঁকে এমন একটি কঠিন শত্রুও মারতে দেখিনি, যা পাণ্ডবদের কাছে স্পৃহনীয় ছিল। দ্রোণাচার্যকে তিনি মারলেন বটে, কিন্তু সে প্রায় নিমিত্তের মতো; যজ্ঞাগ্নির অমোঘ পবিত্রতা হয়তো রক্ষা পেল তাতে, কিন্তু মহাভারতের কবি প্রকট করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, এত বাজনা আর নাম-ডাক নিয়ে যাঁরা অধিনায়কের আসনে বসেন, তাঁদের দ্বারা কাজের কাজ তো হয়ই না, যা হয়, তা অপকর্ম। ধৃষ্টদ্যুম্ন সেই অপকর্ম করেছেন, আর দ্রোণশিষ্য অর্জুন তা সইবেন কী করে? তিনি যে অস্ত্রজ্ঞ, তিনি যে মর্যাদা বোঝেন।

অর্জুন খুব রাগ করে যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—আসুক এবার অশ্বত্থামা। যে নাকি আমার আচার্যের চুলের মুঠি ধরে অপমান করেছে—গুরুং মে যত্র পাঞ্চাল্যঃ কেশপক্ষে পরামৃশৎ—তাকে ক্ষমা করবে না অশ্বত্থামা। অর্জুন ক্ষোভে দুঃখে যুধিষ্ঠিরকেও গালাগালি দিয়েছেন কম না। বলেছেন—আপনি অমন করে মিথ্যাচারণ করলেন কী করে? এখন আপনি গিয়ে রক্ষা করুন ধৃষ্টদ্যুম্নকে। তা ছাড়া আমি অত করে চেঁচিয়ে বারণ করলাম ধৃষ্টদ্যুম্নকে সে আমার কথাটা কানেই নিল না—অপাকীৰ্য্য স্বয়ং ধর্মং শিষ্যেণ নিহতো গুরুঃ। রাগে ক্ষোভে অর্জুনের চোখে জল এসে গেল। স্মরণের পথ ধরে মনে এল সুখস্মৃতি কত।

অর্জুন বললেন—তিনি আমাকে ভালবাসতেন পিতার মতো। শৈশবে আমি পিতাকে হারিয়েছি, অতএব ধর্মতও তিনি ছিলেন আমার পিতা। সেই পিতৃকল্প বৃদ্ধকে সামান্য রাজ্যের জন্য বধ করেছি আমরা। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অনেক দোষ থাকতে পারে, কিন্তু তিনি ভীষ্ম এবং দ্রোণের ওপর যথেষ্ট বিশ্বাস রেখেছেন, তাঁর রাজ্যের ভালমন্দও তাঁদের ওপরেই ন্যস্ত ছিল। আর আমার কথা যদি বলি, তবে বলতে হবে—তিনি তাঁর পুত্র এবং শিষ্যের মধ্যে আমাকেই বেশি ভালবেসেছিলেন—অবৃণীত সদা পুত্রান্ মামাভ্যধিকং গুরুঃ। সেই গুরুকে আমরা মেরেছি, আমাদের আর বেঁচে থাকার মানে হয় না।

অর্জুনের মনোবেদনা যুধিষ্ঠিরের মতো মহাপ্রাণ সংবেদনশীল মানুষ অবশ্যই বুঝতে পারেন এবং পারেন বলেই অর্জুনের কথার একটা জবাবও তিনি দেননি। কিন্তু ভীম অর্জুনের এই বিলাপ শুনে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারেননি। তিনি পালটা গালাগালি দিয়েছেন অর্জুনকে। কৌরবদের চিরকালীন অপমানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছেন—যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি যখন কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করতে এসেছেন, তখন তাঁকে বধ করাই আমাদের ধর্ম। এরজন্য তুমি ধৃষ্টদ্যুম্নকে অপমান করতে পারো না। সুযোগ বুঝে ভীমের পিছন পিছন ধৃষ্টদ্যুম্নও গলা বাড়িয়েছেন। অজুহাত সৃষ্টি করেছেন দ্রোণকে হত্যা করার। সমস্ত রাজন্যবর্গের সামনে অর্জুন ধৃষ্টদ্যুম্ন ভীম সাত্যকি—তাঁরা নিজেদের মধ্যেই ঝগড়াঝাটি করতে আরম্ভ করলেন দ্রোণাচার্যকে নিয়ে। মহাভারতের কবি বুঝিয়ে দিলেন—একজন সার্থক শিক্ষকের মর্যাদা কতখানি। শুধু নিজের পক্ষে নিজের ঘরে নয়, শত্ৰুপুরীর হৃদয়ের মধ্যেও তিনি নির্বাধে বিচরণ করেন।

দ্রোণাচার্য নিজের কারণে পাঞ্চালদের শত্রুপক্ষে পরিণত করেছিলেন। সেই শত্রুতা মিশে গিয়েছিল কুরুদের সাধারণ পাঞ্চাল-বিরোধিতার সঙ্গে। কিন্তু তাঁর যখন মৃত্যু হল, সেই মৃত্যুর রেশ শুধুমাত্র পাঞ্চাল-নিধনেই শেষ হল না। যুদ্ধের শেষ পর্বে দুর্যোধনও যখন মৃত্যুর দিন গুনছেন, তখন অশ্বত্থামা পাঞ্চাল-শেষ ধৃষ্টদ্যুম্নকে তো মেরেই ছিলেন, আরও মেরে ফেলেছিলেন পাণ্ডবদের ঔরসে পাঞ্চালীর গর্ভজাত পঞ্চ পুত্রকে। অর্থাৎ পাঞ্চালী দ্রৌপদীর মাধ্যমে যদি বা পঞ্চাল দেশের রক্তধারা কুরু দেশে কিছু বইত, তাও স্তব্ধ হয়ে গেল দ্রোণমৃত্যুর প্রতিশোধস্পৃহায়।

কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ কৌরব পাণ্ডবের জ্ঞাতিযুদ্ধ বলে সর্বত্র চিহ্নিত, কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মতে এই মহাযুদ্ধে দ্রোণের কারণতা কিছু কম নয়। কিন্তু বিপদ হল—প্রথম জীবনে দ্রোণাচার্যের স্বার্থ-প্রণোদনা কিছু থাকলেও কুরুবাড়ির আন্তর রাজনীতিতে জড়িয়ে যাবার পর দ্রোণাচার্য পুরোপুরি আপন স্বার্থে চালিত হননি। কিন্তু ঘটনার গতি রুদ্ধ করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। অগত্যা যুদ্ধ যখন লাগল—তখন হয়তো শুধু বৃত্তিভোগের কারণেই নয়, দ্রুপদ-বিরোধিতার পূর্ব কারণবশতও তিনি কৌরবপক্ষেই থেকে গেছেন। পাঞ্চালদের ধ্বংস করে পূর্বের ক্রোধও তিনি প্রশমন করেছেন কিছুটা। কিন্তু লক্ষ করে দেখুন, যুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব ভাইদের তিনি স্পর্শও করেননি। যুধিষ্ঠিরকে ধরব বলে কথা দিয়েও ধরেননি, ভীমকে হাতের নাগালে পেয়েও কিছু করেননি। আর অর্জুন! তাঁর কথা সারা জীবন ধরে তারস্বরে গাইতে গাইতে সারা জীবন ধরেই দুর্যোধনের লাঞ্ছনা লাভ করে গেলেন। আসলে অর্জুনের মধ্যেই দ্রোণাচার্য নিজেকে দেখতে পেয়েছিলেন। আচার্য হিসেবে তাই শত অপমান লাঞ্ছনা ভোগ করেও উপযুক্ত শিষ্যের মধ্যে নিজেকে রেখে যাওয়ার উপভোগটুকু ত্যাগ করতে পারেননি দ্রোণ।