ব্যাস দ্বৈপায়ন – ৩

॥ ৩ ॥

কী অদ্ভুত এক ‘ফ্ল্যাশ্‌ব্যাক’-এর মাধ্যমেই না মহাভারতের কাহিনী কথিত হল। কুরুবংশের শেষ সন্তানবীজ জনমেজয় তখন রাজত্ব করছেন হস্তিনায়। কিছুকাল আগেই সর্পদংশনে তাঁর পিতা পরীক্ষিৎ মারা গেছেন। সমগ্র সর্পকুলের ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি সর্পমেধ যজ্ঞ আরম্ভ করেছিলেন বটে, কিন্তু আস্তীক ঋষিরা অনুরোধে সেই যজ্ঞ তিনি বন্ধ করতে বাধ্য হলেন। ওদিকে জনমেজয় শুধুমাত্র প্রতিশোধস্পৃহায় এমন নিদারুণ যজ্ঞ আরম্ভ করেছেন শুনে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস শিষ্যদের নিয়ে উপস্থিত হলেন জনমেজয়ের সভায়। এসে দেখলেন—যজ্ঞ বন্ধ হয়ে গেছে। তিনি খুশি হয়ে আসনে বসতেই একেবারে প্রপৌত্রসুলভ আবদারে জনমেজয় তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন—কুরুদের এবং পাণ্ডবদের আপনি একেবারে সামনে থেকে দেখেছেন—কুরূণাং পাণ্ডবানাঞ্চ ভবান্‌ প্রত্যক্ষদর্শিবান্‌—বলুন না পিতামহ, তাঁদের জীবনকথা, কেমন করে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি লেগেছিল তাঁদের, আর কেনই বা সেই বিরাট যুদ্ধ হল—যাতে করে সমস্ত কুলটাই ধ্বংস হয়ে গেল—ভূতান্তকরণং মহৎ।

এ কথাটা শুনতে কেমন লাগল পিতামহেরও বেশি ব্যাসদেবের। কুরু এবং পাণ্ডবদের সামনে থেকে দেখা তো সামান্য কথা, এই সমগ্র কুলের সঙ্গে যে তাঁর আত্মার যোগ আছে, এই বংশের জন্মদাতা পিতাও যে তিনি। হস্তিনাপুরের রাজবংশের পরম্পরায় তাঁর কোনও ভূমিকা থাকবার কথাই ছিল না, কিন্তু তৎকালীন সমাজের নীতি-নিয়মের বিড়ম্বনায় এবং আপন জননীর অনুরোধে দ্বৈপায়ন ব্যাস কিছুতেই নিজেকে আর বিচ্ছিন্ন রেখে দিতে পারলেন না এক দ্বীপের মধ্যে। তিনি থাকতে পারলেন না বিরাগী এক তপস্বীর বিচ্ছিন্নতায়। দ্বৈপায়ন ব্যাসকে প্রবেশ করতে হল ভারতবর্যের অন্যতম প্রধান এক রাজতন্ত্রের শরীরের মধ্যে। নিভৃতে নির্জনে মুনিবৃত্তির মধ্যেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখলে মানুষের মধ্যে যে চিরন্তন দুঃখ-সুখের খেলা চলে, তা হয়তো এমন করে বুঝতেন না ব্যাস। মায়া, মমতা, ক্রোধ, লজ্জা, অভিমান যে মানুষকে পদে পদে লীলায়িত করে, সে কথা হয়তো এমন করে বুঝতেন না ব্যাস, যদি তাঁর মা জননী সত্যবতী ‘ব্রহ্ম-সত্যে’র দ্বীপবাস থেকে তাঁকে ডেকে এনে এমন করে তাঁর অনুপ্রবেশ না ঘটাতেন সংসারের আবর্তে।

ব্যাস সত্যবতীকে কথা দিয়েছিলেন—তোমার কোনও কাজ থাকলে আমায় ডেকো, মা! স্মরণ করলেই আমি তোমার কাছে আসব—স্মৃতো’হং দর্শয়িষ্যামি কৃত্যেষ্বিতি চ সো’ব্রবীৎ। কিন্তু সে কাজ এমনতর হবে, তাকে জানত! তাঁর কুমারী জননী সত্যবতীর বিধিসম্মত বিবাহ হয়েছে হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর সঙ্গে—এ কথা ব্যাস ভালই জানতেন। জানতেন মহামতি ভীষ্মের কথাও। কিন্তু জানলেও অযথা রাজবাড়িতে গিয়ে সত্যবতীকে মা বলে সম্বোধন করে কখনও শান্তনুরও অস্বস্তি ঘটাননি ব্যাস। কিংবা যাননি তখনও, যখন তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম চিত্রাঙ্গদ বা বিচিত্রবীর্য রাজত্ব করছেন হস্তিনাপূরে। তাঁর যাবার ইচ্ছেও হয়নি, প্রয়োজনও বোধ করেননি কোনও। কিন্তু চিত্রাঙ্গদ-বিচিত্রবীর্য যখন মারা গেলেন নিতান্ত অকালে এবং সত্যবতী কিছুতেই যখন ভীষ্মকে রাজ্যগ্রহণে রাজি করাতে পারলেন না, তখনই প্রয়োজন পড়ল ব্যাসের।

সত্যবতী এখনও কারও কাছে নিজের জীবনের এই গোপন কাহিনীটুকু বলেননি—মহারাজ শান্তনুর কাছেও না, পিতা দাশরাজার কাছেও না, পুত্রদের কাছে তো নয়ই। কিন্তু আজ যখন হস্তিনাপুরের মহান বংশ উচ্ছিন্ন হতে বসেছে এবং যে ভীষ্ম তাঁরই বিবাহের কারণে রাজ্যপাট ত্যাগ করে ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করেছেন, সেই ভীষ্মের কাছে সত্যবতী কিন্তু তাঁর কন্যা-অবস্থার সেই রহস্য-মিলন-কাহিনী বিবৃত করলেন। বললেন মহর্ষি ব্যাসের কথা। ততদিনে ব্যাস অখণ্ড বেদমন্ত্রকে যথাসম্ভব বৈজ্ঞানিকভাবে সাজিয়ে ঋক্‌-সাম ইত্যাদি বিভাগ করে ফেলেছেন। এই অসম্ভব কাজ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বিশাল খ্যাতি তৈরি হয়েছিল এবং এই খ্যাতির কথা মহামতি ভীষ্মও জানতেন। কাজেই ভীষ্ম যখন নিজেই সত্যবতীর কাছে প্রস্তাব করলেন যে, গুণবান কোনও ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ করে নিয়োগপ্রথায় বিচিত্রবীর্যের স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করা হোক, তখন সত্যবতী আর ব্যাসের জন্মকথা না বলে পারেননি এবং তাঁর গুণের কথা বলতে গিয়ে গর্বিতা জননীর বুক ফুলে উঠেছে। বলেছেন—পরাশরপুত্র ব্যাস এখন এক মহাযোগী এবং মহর্যি হিসেবে বিখ্যাত হলেও সে আমারই ছেলে। চারটে বেদ ভাগ করেছে বলে এখন তার নাম ব্যাস হয়েছে বটে, কিন্তু আসলে সে আমার কন্যাকালের পুত্র, দ্বীপের মধ্যে জন্মেছিল বলে ওর নাম ছিল দ্বৈপায়ন—কন্যাপুত্রো মম পুরা দ্বৈপায়ন ইতি শ্রুতঃ।

হয়তো সত্যবতী এখন ব্যাসের যত খবর রাখেন, হস্তিনাপুরের এই মহান প্রাজ্ঞ ব্যক্তিটি ব্যাসের সম্বন্ধে তার চেয়েও আরও বেশি জানেন। পিতা শান্তনুর সময় থেকে এই বিচিত্রবীর্ষের সময় পর্যন্ত তাঁকে হস্তিনাপুরের রাজত্বভার সামলাতে হয়েছে চার দিকে তাল রেখে। অতএব তিনি এতদিনে মহর্ষি ব্যাসের কথা শোনেননি, তা হতেই পারে না। তিনি অবশ্যই শুনেছেন এবং এখন জননী সত্যবতীর সঙ্গে তাঁর একান্ত মাতৃ-সম্বন্ধ আছে শুনে ভীষ্ম মনে মনে অত্যন্ত হর্ষলাভ করলেন। সত্যবতীর মুখে ব্যাসের নাম শুনেই ভীষ্ম শ্রদ্ধায় যুক্তকর হলেন তাঁর উদ্দেশে—মহর্ষেঃ কীর্তনে তস্য ভীষ্মঃ প্রাঞ্জলিরব্রবীৎ। বললেন—দেখো মা! প্রত্যেক কাজের মধ্যেই—সে ধর্মই হোক, অর্থই হোক অথবা কাম—প্রত্যেক কাজের সঙ্গেই তার ফলটুকু ভাবতে হয়। ভাবতে হয়—সামান্য সামান্য দোষ বার করার ফলে কাজটা সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেল কিনা, অথবা কাজটা এখন যা করছি, ভবিষ্যতে তা বেশি ফল দেবে কি না। তুমি যেমনটি বলছ মা, তাতে এই বংশের হিত হবে সবচেয়ে বেশি এবং সেটা এখন অধর্মও নয়—তদিদং ধর্মসংযুক্তং হিতঞ্চৈব কুলস্য নঃ। তোমার এ প্রস্তাব খুব ভাল, তুমি ডাকো তোমার ছেলেকে।

ভীষ্মের কথায় মনে জোর পেলেন সত্যবতী। তিনি সানন্দে স্মরণ করলেন তাঁর প্রথমজন্মা কুমারীকালের পুত্রকে। একজনের স্মরণমাত্রেই অপর জন বুঝতে পারছেন—এই অলৌকিক যোগশক্তির কথা আধুনিক কালে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে, কিন্তু যোগের তত্ত্ব-দর্শন সম্বন্ধে যাঁরা অবহিত, তাঁরা বুঝবেন চিত্তবৃত্তিনিরোধের ফলে মানুষ কত অসম্ভব সম্ভব করতে পারে। ব্যাসের যোগশক্তিতে বিশ্বাসই করুন আর নাই করুন, জননী সত্যবতীর সংকল্পিত স্মরণ অনুভব করলেন ব্যাস। অথবা যে মুহূর্তে তাঁর কাছে সত্যবতীর সংকল্পদূত এসে খবর দিল যে, তাঁকে ডেকেছেন সত্যবতী, তখন তিনি বেদ পড়াচ্ছিলেন—স বেদান্‌ বিব্রুবন্‌ ধীমান্‌ মাতুর্বিজ্ঞায় চিন্তিতম্‌। কিন্তু মায়ের ডাক এসে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গে অধ্যাপনা ছেড়ে উঠে পড়লেন ব্যাস। মুহূর্তের মধ্যে উপস্থিত হলেন মায়ের সামনে। অবশ্যই যোগবলে।

কতকাল পরে সত্যবতী দেখলেন তাঁর প্রথমজ পুত্রকে। এই পুত্রই তাকে প্রথম মা বলে ডেকেছিল। কিন্তু সেদিন সেই কন্যাবস্থায় মহর্ষি পরাশরের সঙ্গে তাঁর মিলনটুকুই এমন আকস্মিক ছিল যে, পুত্রজন্মের আবেগ-মাধুর্য তিনি কিছুই অনুভব করতে পারেননি। কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজরানি হবার পরে যখন একে একে তাঁর স্বামী-পুত্র সব মারা গেছে, তখন এই পুত্রটির জন্য তাঁর মন বহুবার আকুলিব্যাকুলি করেছে। তবু বলতে পারেননি কাউকে। আজ প্রৌঢ়তার উপকণ্ঠে দাঁড়িয়ে কুরুবংশের এই বিপন্নতার সময় তাঁর এই পূর্বজাত পুত্রটির কথা বলতে সংকোচ করেননি সত্যবতী। অন্যদিকে সর্বজনমান্য এই ঋষিপুত্রকে বুকে জড়িয়ে ধরতেই তাঁর সুচিরকালসঞ্চিত রুদ্ধ স্নেহধারা এমনভাবেই উদগত হল যে তিনি যেমন কাঁদতে থাকলেন, অমনই তাঁর স্নেহকরুণ স্তনযুগল ক্ষরিত হল পুত্রস্নেহের অতিব্যাপ্তিতে—পরিষ্বজ্য চ বাহুভ্যাং প্রস্রবৈরভিষিচ্য চ।

জন্মলগ্নেই যে পুত্র সংসার ত্যাগ করে ঋষিধর্ম পালন করেছেন, ত্যাগ-বৈরাগ্যে যাঁর বুদ্ধি স্থিতপ্রজ্ঞতা লাভ করেছে, তাঁর হৃদয় জননীর স্নেহে মথিত হলেও তিনি ধীর অবিচলিত থাকলেন। তপস্বীর সর্বতোভদ্র মঙ্গলকামনায় ব্যাস তাঁর কমণ্ডলুতে ভরা সর্বতীর্থের জল ছিটিয়ে দিলেন সত্যবতীর মাথায়। সত্যবতীর অসংখ্য স্নেহবাচনের উত্তরে ব্যাস শুধু নম্র-কৃতজ্ঞ অভিবাদন জানালেন জননীকে—তামদ্ভিঃ পরিষিচ্যার্তাং মহর্ষিরভিবাদ্য চ। তার পরেই জিজ্ঞাসা করলেন—মা! তোমার যা অভীষ্ট, আমি তাই করতে এসেছি। মা, তুমি সমস্ত ধর্মের তত্ত্ব জানো। তুমি আদেশ করো—তোমার কী প্রিয়কার্য করতে পারি আমি? মহর্ষি ব্যাস সত্যবতীর পুত্র বলে তাঁর সঙ্গে যতই ব্যক্তিগত কথাবার্তা হোক, ব্যাস হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে এসেছেন, অতএব রাজবাড়িরও কিছু কৃত্য আছে তাঁর ব্যাপারে। সেই জন্য রাজপুরোহিত এসে পৌঁছোলেন মাতাপুত্রের কথোপকথনের মাঝখানেই। তিনি যথোচিত পূজা-অভ্যর্থনা করে সুখাসনে বসালেন ব্যাসকে।

জননী সত্যবতী এবার তাঁর প্রস্তাবিত বক্তব্য পেশ করলেন সামান্য ভনিতা করে। সত্যবতী বললেন—সমস্ত ছেলেরা বাপ-মায়ের সহায়ক হয়েই জন্মায়। ছেলের ওপর বাপের যেমন অধিকার, মায়েরও তেমনই—তেষাং যথা পিতা স্বামী তথা মাতা ন সংশয়ঃ। তুমি মহর্ষি পরাশরের ঔরসে শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে আমার গর্ভে জন্মেছিলে বলেই যেমন তুমি আমার প্রথম পুত্র, তেমনই বিচিত্রবীর্য ছিল আমার কনিষ্ঠ পুত্র। পিতার দিক থেকে ভীষ্ম যেমন বিচিত্রবীর্যের বড় ভাই, মায়ের দিক থেকে তুমিও তেমনই বিচিত্রবীর্যেরও বড় ভাই।

ব্যাস বোধ হয় বুঝতে পারছিলেন জননীর কথার গতিপথ। সত্যবতী বললেন—ভীষ্মকে আমি অনেক বলেছি। বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রীর গর্ভে পুত্র উৎপাদন করে বংশরক্ষা করার জন্য যথোচিত অনুরোধ করেছি তাঁকে। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের সত্যপ্রতিজ্ঞায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তাঁর পক্ষে আমার অনুরোধ রাখা সম্ভব হয়নি। সত্যবতী এবার সানুনয়ে ব্যাসকে বললেন—তাই তোমাকে বলছি, বাবা! হস্তিনাপুরের প্রজাদের দিকে তাকিয়ে, সকলের সুরক্ষার দিকে তাকিয়ে, আমার স্বামীহারা দুই পুত্রবধূর মুখের দিকে তাকিয়ে তোমায় যে অনুরোধ করছি মন দিয়ে শোনো, বাবা!

এতক্ষণে ব্যাস বুঝে গেছেন—জননী তাঁকে নিয়োগপ্রথায় বিচিত্রবীর্যের বধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করতে বলছেন। কিন্তু নিয়োগের কতগুলি নিয়ম আছে, শাস্ত্রীয় বিধি আছে, সেগুলি পূরণ করা না হলে ব্যাস যে এই কর্মে রাজি হবেন না, সেকথা হস্তিনাপুরের রাজমাতা সত্যবতীর জানা আছে। এ প্রশ্ন উঠতেই পারে এবং অনেক অর্বাচীন লেখক-লেখিকা এই ভুল সিদ্ধান্ত করেওছেন যে, সত্যবতী সুযোগ বুঝে নিতান্ত স্বার্থপ্রণোদিত উপায়ে আপন পূর্বজ পুত্রের বংশধারা হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে সংক্রমিত করেছেন। এসব অর্বাচীনেরা তৎকালীন দিনের সামাজিক নিয়মকানুন কিছুই জানেন না, শুধু মূর্খের মতো গালি দিতে পারেন। এ কথা মনে রাখা দরকার, বংশের উত্তরাধিকারের প্রয়োজনে সেকালে যখন নিয়োগপ্রথার আশ্রয় নেওয়া হত, তখন গুরুজনদের মন্ত্রণা একান্ত জরুরি ছিল। বংশ, সমাজ এবং অবশ্যই ব্যক্তিগত প্রয়োজন বুঝে বাড়ির বয়স্ক গুরুজনেরা এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেন। ক্রমান্বয়ে শান্তনু এবং তাঁর ঔরস রাজপুত্রদের মৃত্যুর পর সত্যবতী অবশ্যই কুরুকুলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

কিন্তু এটাও ঠিক, শান্তনুর ঔরসপুত্র ভীষ্ম এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছেন। শুধু তাই নয়, পিতা শান্তনুর সময় থেকে তাঁর পুত্রদের মৃত্যু পর্যন্ত সময়ে হস্তিনাপুরের রাজনীতির মূলাধার ছিলেন ভীষ্ম। হস্তিনাপুরের রাজত্বসংক্রান্ত ব্যাপারে ভীষ্মের মতই ছিল তখনও শেষ কথা। এদিক থেকেও বটে আবার শান্তনুর ঔরসজাত বলেও ভীষ্মের অধিকারও কিছু কম তো ছিলই না, বরং তা সত্যবতীর চেয়ে বেশিই ছিল। কাজেই সত্যবতী যদি স্বার্থপ্রণোদিতভাবে কিছু করতেন, তা হলে ভীষ্ম তাঁকে প্রথম বাধা দিতেন এবং তা প্রচণ্ডভাবেই দিতেন। বিশেষত হস্তিনাপুরের রাজবংশের স্বার্থে যদি ঘা পড়ত, তা হলে ভীষ্মের তখনও তাঁর যা প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল, তাতে অবশ্যই সত্যবতীকে বাধা দিতেন। ভীষ্ম বুঝেছিলেন—হস্তিনাপুরের রাজবংশের প্রয়োজনেই তখন নিয়োগপ্রথার আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। সে নিয়োগে তিনি যেহেতু সত্যরক্ষার কারণে জড়িত হবেন না, এবং যেহেতু বাইরে থেকে গণ্যমান্য একজন ব্রাহ্মণকে এনেই সেই নিয়োগ ঘটাতে হবে, সেখানে ব্যাসের মতো পরমর্ষিকে লাভ করতে পারলে তাঁর আপত্তি কী থাকতে পারে! সত্যবতীর কথায় তিনি রাজি হয়েছেন ব্যাসের কথা শুনেই।

যে দু-তিনটি কারণে ব্যাসের দিক থেকে অনৌচিত্যের আশঙ্কা ঘটতে পারে, সত্যবতী সে সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই সচেতন ছিলেন বলে পুত্র-উৎপাদনের প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি ব্যাসকে বুঝিয়ে দিলেন যে, এ বিষয়ে গৃহের গুরুজনেরা প্রয়োজন বোধ করছেন তথা এ বিষয়ে তাঁর নিরপেক্ষ ভূমিকা আছে যাকে মহাভারত বলেছে ‘আণৃশংস্যাৎ’। তিনি বললেন— তোমার ভাই বিচিত্রবীর্যের মঙ্গল এবং আমাদের বংশরক্ষার কারণে মহামতি ভীষ্ম এই নিয়োগে সম্মতি দিয়েছেন। অতএব তাঁর সম্মতি এবং আমার আদেশ মেনে আমাদের বংশরক্ষার জন্য তোমার কনিষ্ঠ ভাইয়ের বধূদের গর্ভে পুত্র উৎপাদন করো— ভীষ্মস্য চাস্য বচনান্নিয়োগাচ্চ মমানঘ।

এ নিয়োগের ক্ষেত্রে বধূদেরও যে কোনও আপত্তি নেই, সেটাও জানাতে ভুললেন না সত্যবতী। তিনি বললেন—প্রয়াত বিচিত্রবীর্যের দুই স্ত্রীর কোনও পুত্র নেই। তাঁরা রূপবতী যৌবনবতী হওয়া সত্ত্বেও স্বামীহারা এবং তাঁদের পুত্রকামনাও তৃপ্ত হয়নি। এই অবস্থায় অন্তত পুত্রলাভ করলেও তাঁরা খুশি হবেন—রূপযৌবনসম্পন্নে পুত্ৰকামে চ ধর্মতঃ। পরবর্তী সময়ে বিচিত্রবীর্যের বধূরা ব্যাসের সঙ্গে মিলনে যে অনীহা দেখিয়েছেন তাতে ব্যাসের মতো বিকট চেহারার মানুষের সঙ্গে মিলনে তাঁদের ব্যক্তিগত রুচির প্রশ্ন ওঠে বটে, কিন্তু তাঁদের পুত্রকামনার ব্যাপারে কোনও সংশয় সেখানে ওঠে না।

প্রাথমিকভাবে এই নিয়োগে ব্যাসের একটা অনিচ্ছা থাকতে পারে, সেই কথা ভেবে অন্তত দু-তিনরকমভাবে বধূদের প্রসঙ্গ ব্যাসের কাছে উপস্থাপন করলেন সত্যবতী। সত্যবতী বিদগ্ধা রমণী, প্রথমেই তিনি বললেন—তোমার ছোট ভাইয়ের দুটি স্ত্রী, স্বর্গসুন্দরীদের মতো তাদের দেখতে। যেমন রূপবতী তেমনই যৌবনবতী। সত্যবতী কি ব্যাসকে নিয়োগে প্রবৃত্ত করার জন্য সামান্য লোভ দেখালেন? হতেও পারে। কিন্তু এই দুটি শব্দের পরেই স্বামীহারা দুই পুত্রবধূর জীবনের যে হাহাকারটুকু প্রকাশ করেছেন, তাতে অর্থ দাঁড়ায় অন্যরকম। সত্যবতী বলেছেন—ওদের রূপ আছে যৌবন আছে তবু ওদের কোলে কোনও ছেলে নেই। এই নিয়োগের ক্ষেত্রে বধূদেরও যে কোনও আপত্তি নেই, সেটাও একটু প্রকট করে সত্যবতী বললেন—ওরা স্বামী হারিয়েছে বটে কিন্তু ওদের পুত্রকামনা তৃপ্ত হয়নি, ওরা পুত্র চায় এবং তা চায় ধর্মের নিয়ম মেনেই—যা নিয়োগ ছাড়া সম্ভব নয়—পুত্ৰকামে চ ধর্মতঃ।

জননীর সনির্বন্ধ অনুরোধ শুনে ব্যাস বললেন—ধর্মের দুরকম পথই তোমার জানা আছে, মা! নিবৃত্তিমূলক ধর্মও যেমন তুমি জান, তেমনই জান প্রবৃত্তিমূলক ধর্মের কথাও। আমাকে যা তুমি করতে বলছ, তা প্রবৃত্তিমূলক এবং গুরুজনদের সকলের সম্মতি আছে বলেই এখানে প্রবৃত্তিও ধর্মের মধ্যেই পড়বে। তুমিও ধর্মানুসারেই আমাকে অনুরোধ করেছ বলে তোমার ইচ্ছে আমি পূরণ করব এবং তা করব শুধু ধর্ম সিদ্ধ হচ্ছে বলেই—তস্মাদহং তন্নিয়োগাদ্‌ ধর্মমুদ্দিশ্য কারণম্। মায়ের ইচ্ছে পূরণ করবেন বলেও ব্যাস কিন্তু একটা শর্ত দিলেন। বললেন—ঠিক আছে মা! তোমার পুত্রবধূরা দেবতার মতো পুত্র লাভ করবেন। কিন্তু একটা কথা তোমার পুত্রবধূদের মেনে চলতে হবে। সেটা হল—এই এক বছর ধরে তাঁরা ব্রত-নিয়ম পালন করে নিজেদের শুদ্ধ করুন—সংবৎসরং যথান্যায়ং ততঃ শুদ্ধে ভবিষ্যতঃ। তারপর তাদের গর্ভে আমি পুত্র উৎপাদন করব।

ব্যাস যে শুদ্ধিপ্রক্রিয়ার নির্দেশ দিলেন, তার একটা কারণ আছে। জন্মলগ্নেই তিনি পিতা পরাশরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জ্ঞান এবং তপস্যার মাধ্যমে যে স্থিরতা লাভ করেছিলেন, তা ছিল নিবৃত্তিমূলক ধর্ম। কিন্তু ব্যাসের জননী যে আদেশ করেছেন, তার মধ্যে ধর্মের নির্দেশনা থাকলেও প্রবৃত্তির অভিসন্ধিও আছে। প্রবৃত্তিকে ধর্মের অনুবন্ধে স্থাপন করার জন্যই ব্যাস তাঁর প্রবৃত্তিমূলক মিলনের আধারদুটিকে ব্রত-নিয়মে শুদ্ধ করে নিতে চান। কেননা দৃষ্টিমাত্রেই হঠাৎ মিলনের মধ্যে যে কামনার প্রেরণা আছে, ব্যাস সেটাকে ধর্মের প্রেরণায় শুদ্ধ করে নিতে চান। তিনি জননীকে স্পষ্ট করে বলেছেন—যার মধ্যে ব্রত-নিয়মের কোনও শুদ্ধতা নেই, তার কোনও অধিকার নেই আমার সঙ্গে মিলিত হওয়ার—ন হি মাম্‌ অব্রতোপেতা উপেয়াৎ কাচিদঙ্গনা।

ব্যাসের কথা থেকে বোঝা যায়—বিবাহের মধ্যে যে সামাজিক ধর্ম আছে, তাতে যদি বা হঠাৎ দেহসর্বস্ব মিলনের যুক্তি থাকে, নিয়োগের ক্ষেত্রে সে যুক্তি নেই। এখানে পুত্রলাভের জন্যই মিলিত হওয়া, দেহানুসন্ধানের কোনও অবসর নেই এখানে। ঠিক সেই কারণেই বিচিত্রবীর্যের দুই বধূকে তিনি ব্রত-নিয়ম পালন করে পুত্রলাভের মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলেছেন প্রায় তপস্যার মাধ্যমে। কিন্তু পুরো এক বৎসর সময় সত্যবতী অপেক্ষা করতে রাজি হলেন না। শান্তনুর রাজ্যে বিচিত্রবীর্যের পর আর রাজা নেই কোনও। জ্যেষ্ঠপ্রতিম ভীষ্ম সত্যবতীর সঙ্গে আলোচনা করে রাজকার্য পরিচালনা করে যাচ্ছেন। রাজাহীন রাজ্যের প্রজারা নিজেদের নাথবৎ বোধ করে না, মাৎস্যন্যায় আরম্ভ হয়ে যায় যত্রতত্র। সত্যবতী রাজবাড়ির রাজমাতা, রাজ্যের শাসনযন্ত্রকে তিনি চেনেন। পুত্র ব্যাসের প্রস্তাবে একটি সম্পূর্ণ বছর তিনি অপেক্ষা করতে চাইলেন না। তার মধ্যে পুত্রটি তাঁর ঋষি মানুষ, কখন তাঁর কী মতিগতি হয়, তার কি ঠিক আছে! ব্যাসপিতা পরাশরকে তো তিনি দেখেছেন।

সত্যবতী ভরসা পেলেন না। পুত্রকে বললেন—রাজ্যে রাজা না থাকলে প্রজারা অসহায় বোধ করে। সমস্ত প্রয়োজনীয় ক্রিয়াকর্মের গতি রুদ্ধ হয়ে যায়। তার চেয়ে আমার বন্ধুরা যাতে এখন এখনই গর্ভ লাভ করতে পারে, সেই চেষ্টাই দেখো তুমি—সদ্যো যথা প্রপদ্যেতে দেব্যৌ গর্ভে তথা কুরু। তুমি যদি এখনই এই ব্যবস্থা করো তবে সময় পাওয়া যাবে খানিকটা, তার মধ্যে নিশ্চয় মহামতি ভীষ্ম এই সন্তানগুলিকে শিক্ষায়-দীক্ষায় বড় করে তুলবেন—তস্মাৎ গর্ভং সমাধৎস্ব ভীষ্ম সংবর্ধয়িষ্যতি। অর্থাৎ এক মহান ব্যক্তিত্বের বীজোদ্ভূত সন্তান মানুষ করবেন আর এক মহাপুরুষ—সত্যবতী যেন নিশ্চিন্ত করতে চাইলেন ব্যাসকে।

কিন্তু ব্যাস খুব খুশি হলেন না, জননীর এই উপরোধ অবশ্য তিনি ঠেলতেও পারলেন না। তিনি সন্তানদের পালনশৈলী নিয়ে ভাবছেন না, তাঁদের গর্ভাধান নিয়ে ভাবছেন। তিনি আবারও শর্ত দিলেন—যদি বধূদের ব্রত-নিয়মহীন অবস্থায় অকালেই এমন ব্যবস্থা করতে হয় আমাকে, তবে আমার এই বিরূপতা সহ্য করতে হবে তাঁদের—এটাই হোক তাঁদের ব্রত—বিরূপতাং মে সহতাম্‌ তয়োরেতৎ পরং ব্রতম্‌। ব্যাসকে দেখতে কতটা সুপুরুষ তা আমাদের জানা নেই। তবে তিনি নিজেই যেমন বলেছেন তাতে অন্তত সেই মুহূর্তে তাঁর মতো কদাকার ব্যক্তি রাজবধূদের ক্ষেত্রে সহনীয় ছিল বলে মনে হয় না। একে তো তাঁর গায়ের রং ঘন কৃষ্ণবর্ণ। তার মধ্যে তপস্যার রুক্ষতায় তাঁর মাথায় এখন কনকপিঙ্গ জটাকলাপ। মুখে একরাশ দাড়ি। পরনে চামড়ার আবরণ। চোখদুটি কৃষ্ণবর্ণ মুখের মধ্যে আগুনের মতো জ্বলছে। ব্যাস নিজেও তাঁর এই চেহারার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন। নিজেই তিনি সত্যবতীকে বলেছেন—আমার এই চেহারা, এই পরিধান-বেশ, গায়ের এই বিকট গন্ধ—এসব যদি তোমার বউরা সহ্য করতে পারে—যদি যদি মে সহতে গন্ধং রূপং বেশং তথা বপুঃ—তা হলে আজই হোক সেই মিলন। তবে হ্যাঁ, বধূদের তুমি শুচি বস্ত্র পরিধান করে সালঙ্কারে শয্যায় উপস্থিত থাকতে বলবে।

ব্যাস যে নিজের বিকট রূপ এবং বিকৃত গাত্রগন্ধ সহ্য করতে বললেন বধূদের, তা অনেকটাই নিয়োগপ্রথার বিধান মেনে। যাঁরা ভাবেন—সেকালে নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে সমাজের উচ্চবর্ণ পুরুষেরা প্রচুর স্ত্রীসম্ভোগের সুযোগ পেতেন, তাঁরা একেবারেই ভুল ভাবেন। একটা কথা জেনে রাখুন, যে বিকৃতমনা পুরুষ সম্ভোগে লালায়িত, তার সেকালেও মেয়েছেলের অভাব হত না, একালেও নেই। কিন্তু নিয়োগপ্রথা এই কারণে তৈরি হয়নি, তা তৈরি হয়েছে সামাজিক প্রয়োজনে। অল্প বয়সে যে স্ত্রী স্বামী হারাল, সে ব্যভিচারের মধ্যে না গিয়েও অন্তত যাতে তার বাৎসল্যের পুষ্টিসাধন করে জীবন কাটাতে পারে—এটা হল নিয়োগপ্রথার মূল উদ্দেশ্য। এর সঙ্গে জুটেছে অন্যান্য সামাজিক এবং ব্যক্তিগত কারণ। বংশরক্ষা, পিণ্ডপ্রয়োজন—ইত্যাদি স্মার্ত প্রয়োজন ছাড়াও সম্পত্তির উত্তরাধিকার যাতে আপন বংশের ধারাতেই আসে—এটাও একটা প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নিয়োগের। আরও একটা কথা—নিয়োগের ক্ষেত্রে পুরুষের কামনার উদ্রেকটি যাতে যান্ত্রিকভাবে হয়, তার দিকেও একটা অদ্ভুত লক্ষ ছিল সামাজিকদের। সাধারণ নিয়মে নিযুক্ত পুরুষকে মিলিত হবার আগে নিজের গায়ে দই, লবণ, ঘি ইত্যাদি দ্রব্য জ্যাবজাবে করে মেখে নিতে হত। এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে যে, নিযুক্তা রমণী যেন স্বামী-ভিন্ন পুরুষটির প্রতি কামনাগ্রস্ত না হয়ে পড়েন। পুরাণ মুনি বেদব্যাস নিজের গায়ে প্রথামাফিক দই লবণ মাখেননি। কিন্তু তপস্যাক্লিষ্ট শরীরের বিকট গন্ধ, বিকৃত চেহারা এবং বিকট বেশ সেই বিকর্ষণ বা ‘রিপালশন’-এর কাজটি করবে যা নিয়োগপ্রথায় অনুচ্চারিতভাবে ঈপ্সিত। অন্যদিকে ব্যাস তাঁর দুই ভ্রাতৃবধূকে যে শুচিবস্ত্রে সালংকারে শয্যায় উপস্থিত হতে বলেছেন, তার কারণ, তাঁদের দেখে নিবৃত্তির ধর্মে প্রতিষ্ঠিত মুনির যান্ত্রিকভাবেও যাতে কামনার উদ্রেক হয় সেই জন্য। তা না হলে পুত্রোৎপাদনের তাৎপর্যটাই যে ব্যর্থ হয়ে যাবে।

সত্যবতী ব্যাসের প্রস্তাব শোনামাত্রেই তাঁর পুত্রবধূদের কাছে উপস্থিত হয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের অসহায়তা এবং নিরুপায় ভাবটি প্রকাশ করে বলেছেন—আমার কপালের দোষে আজ প্রসিদ্ধ ভরতবংশ উচ্ছিন্ন হতে চলেছে। বংশে একটিও পুত্রসন্তান বেঁচে নেই। এই অবস্থায় আমাকে পীড়িত এবং দুঃখিত দেখে মহামতি ভীষ্ম আমাকে এই বুদ্ধি দিয়েছেন। কিন্তু যে বুদ্ধি আমরা করেছি, তা সফল করতে পার একমাত্র তোমরাই। তোমরাই ভরতবংশকে উদ্ধার করতে পার নিয়োগজাত পুত্রকে গর্ভে ধারণ করে—নষ্টঞ্চ ভারতং বংশং পুনরেব সমুদ্ধর। বধূদের কোনওমতে রাজি করিয়ে সত্যবতী ঋষি-মুনি-ব্রাহ্মণ-অতিথিদের খাবার ব্যবস্থা করতে গেলেন।

রাত্রির আঁধার ঘনিয়ে এলে সত্যবতী আবারও বধূদের কাছে এসে বললেন—তোমরা তৈরি হও, বাছারা! তোমাদের দেবর আসবেন তোমাদের সঙ্গে মিলিত হতে। তোমরা দ্বিধাহীনচিত্তে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থেকো শয্যায়। তিনি আসবেন রাত গভীর হলে—অপ্রমত্তা প্রতীক্ষৈনং নিশীথে হ্যাগমিষ্যতি। সত্যবতীর কথা মান্য করে জ্যেষ্ঠা বধূ সুস্নাত এবং অলঙ্কৃত অবস্থায় অপেক্ষা করতে লাগলেন শয্যায়। মনে মনে চিন্তা করতে লাগলেন ভীষ্ম, শান্তনু ইত্যাদি কুরুপুঙ্গবদের কথা, যাতে তাঁদের মতোই বীর পুত্র হয়। নির্জন শয়নকক্ষে আলো জ্বলছিল। ব্যাসের নির্দেশেই হয়তো এই ব্যবস্থা, যাতে তাঁর বিরূপ, বিকৃত চেহারা বধূদের দৃষ্টিগোচর হয়। দীপ্যমান প্রদীপালোকে ব্যাসকে যখন আপন শয়নকক্ষে উপস্থিত দেখলেন অম্বিকা তখন ঘৃণায়, অনীহায় তাঁর চক্ষু মুদে গেল। ব্যাসের ওই কালোকোলো চেহারা, মাথায় পিঙ্গল জটাভার, আগুনের ভাটার মতো দুটি তপোদীপ্ত চক্ষু কালো মুখের গহ্বরে, পাঁশুটে গোঁফ। অম্বিকা তাকে দেখে ভয়ে অনীহায় চোখ বন্ধ করে ফেললেন—বভ্রূণি চৈব শ্মশ্রূণি দৃষ্টা দেবী ন্যমীলয়ৎ। তবু মিলন সম্পন্ন হল, কেননা জননী সত্যবতীকে কথা দিয়েছেন ব্যাস।

মিলন শেষে বিশ্রান্ত ব্যাসকে সত্যবতী জিজ্ঞাসা করলেন—আমার বধূটি গুণবান একটি রাজপুত্রের জননী হবে তো? ব্যাস তাঁর অতিলৌকিক দৃষ্টিতে জবাব দিলেন—অনেক শক্তি, অনেক বুদ্ধি নিয়ে এই ছেলে জন্মাবে। সে হবে বিদ্বান এবং রাজপ্রতিম, কিন্তু এর মায়ের দোষে এ ছেলে অন্ধ হয়েই জন্মাবে। সত্যবতী হাহাকার করে বললেন—একটি অন্ধ ছেলে তো কখনও কুরুবংশের রাজা হতে পারে না। তুমি বাছা দ্বিতীয় একটি সন্তানের সম্ভাবনা করো, যে এই বংশের রক্ষক হবে, রাজা হবে। ব্যাস জননীকে কথা দিলেন, সত্যবতীও যথাসম্ভব সচেতন করে দিলেন দ্বিতীয়া বধূ অম্বালিকাকে কিন্তু তিনিও যখন ব্যাসকে তাঁর শয়নকক্ষে দেখলেন, তখন তিনি অম্বিকার দৃষ্টান্ত স্মরণ করে চোখ বন্ধ করলেন না বটে, কিন্তু সেই দীপ্তচক্ষু, জটাশ্মশ্রু দর্শন করে তিনি ভয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেলেন—বিবর্ণা পাণ্ডুসঙ্কাশা সমপদ্যত ভারত। মিলন সম্পূর্ণ হলে ব্যাস বললেন—আমাকে বিরূপ দেখে তুমি যে এমন হয়ে গেলে, তাতে তোমার ছেলেটিও পাণ্ডুবর্ণ হবে এবং ওর নামও হোক পাণ্ডু।

অম্বালিকার ঘর ছেড়ে ব্যাস যখন চলে যাবার উপক্রম করছেন তখন সত্যবতী আবারও ব্যাসকে জিজ্ঞাসা করলেন—কেমন হবে এই পুত্র? ব্যাস পূর্বোক্ত কথাগুলি বললেন সত্যবতীকে। ব্যাসের কথামতো সময় পূর্ণ হলে অম্বিকার গর্ভ থেকে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্র জন্মালেন, অম্বালিকার গর্ভে জন্মালেন পাণ্ডু। সত্যবতী ভাবলেন—দুই রানির গর্ভে দুটি পুত্র এল অথচ দুটির মধ্যেই কিছু খুঁত রয়ে গেল। তার চেয়ে ব্যাসকে তিনি আরও একবার অনুরোধ করবেন, যাতে বড় রানি অম্বিকার গর্ভে আরও একটি পুত্র লাভ করা যায়। মায়ের শেষ অনুরোধে ব্যাস রাজি হলেন। সত্যবতীও সময়কালে ঋতুমুক্তা অম্বিকাকে আবারও বলে-কয়ে রাজি করালেন। কিন্তু সত্যবতীর সামনে তিনি রাজি হলেও যখনই ব্যাসের বিকট আকৃতি আর বিকৃত গাত্রগন্ধের কথা তাঁর মনে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে সেই পূর্বতনী অনীহা জুগুপ্সা জন্ম নিল অম্বিকার মনে।

ক্রান্তদর্শী কবি রাজরানির মনের ব্যথা বোঝেন। তিনি নিজেই লিখেছেন—অম্বিকা দেবকন্যার মতো সুন্দরী, দেবোপম সুখবিলাসে তিনি অভ্যস্ত। বিকটাকার কৃষ্ণকায় দুর্গন্ধ ঋষির সঙ্গ তাঁর পছন্দ হয়নি বলেই তিনি শাশুড়ী সত্যবতীর কথা মানতে পারলেন না—নাকরোদ্‌ বচনং দেব্যা ভয়াৎ সুরসুতোপমা। অম্বিকা এই পূর্বনির্ধারিত ধর্ষণপ্রায় মিলন থেকে বাঁচবার জন্য আপন দাসীটিকে রতনে-ভূষণে সাজিয়ে পাঠিয়ে দিলেন ব্যাসের কাছে।

মনে রাখা দরকার, এই দাসী কোনও সাধারণ দাসী নয়। সেকালের দিনে রাজা-রাজড়ারা কেউ কেউ রাজরানিদের শারীরিক বিরহ একেবারেই সহ্য করতেন না। পঞ্চদিবসব্যাপী ঋতুকাল স্বচ্ছন্দে কাটানোর জন্যই দাসীগ্রহণের এই বিকল্প ব্যবস্থা। কোনও কোনও সময় বিবাহকালেই দাসীদের সরবরাহ করা হত কন্যাপিতার বাড়ি থেকে। এঁরা রাজার ভোগ্যা স্ত্রী ছিলেন বলে এঁদের প্রভাবপ্রতিপত্তিও কিছু কম হত না, এবং এঁদের সামাজিক সম্মান খানিকটা কম থাকলেও দাসীগর্ভজাত পুত্রেরা সামাজিকভাবে স্বীকৃত হতেন। রাজার ভোগ্যা স্ত্রী বলে তাঁরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যথেষ্ট রূপবতী হতেন—যেমন অম্বিকা যে দাসীটিকে সাজিয়ে দিলেন—তিনি স্বর্গের অপ্সরার মতো সুন্দরী। ঋষি ব্যাস কিছু বুঝতে পারবেন না এবং তাঁকেই বিচিত্রবীর্যের প্রথমা স্ত্রী ভেবে নেবেন—এই ভাবনায় দাসীকে নিজের রাজকীয় অলঙ্কারে সজ্জিত করে অম্বিকা তাঁকে নিজের শয়নকক্ষে পাঠিয়ে দিলেন—প্রেষয়ামাস কৃষ্ণায়..ভূষয়িত্বাপ্সরোপমাম্‌।

এতদিন যা ঘটেছে, ব্যাস মায়ের আদেশ পালন করে গেছেন বিনা বাধায়। কিন্তু যেখানে তাঁকে আমন্ত্রণ আপ্যায়ন করে ব্যক্তির প্রয়োজন এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজনে পুত্র উৎপাদনের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে, সেখানে রাজবধূদের দিক থেকে ওই ঘৃণা এবং অনীহা তাঁকে মনে মনে খানিকটা লজ্জিত এবং অপমানিত করেছে নিশ্চয়ই। নিয়োগ যেহেতু, অতএব তাঁদের দিক থেকে কামাতিশয্য ব্যাসের কাছে কাম্য ছিল না নিশ্চয়ই, কিন্তু পুত্রলাভার্থীর কাছে ঘৃণা কিংবা অনীহাও তো তাঁর প্রাপ্য ছিল না। তিনি কী দোষ করেছেন? হতে পারে, তিনি জটা-শ্মশ্রুর বিবর্ধনে কুৎসিত-দর্শন ছিলেন; হতে পারে তাঁর গায়ে বিকট গন্ধ ছিল; হতে পারে, তাঁর জটাজূটমণ্ডিত কৃষ্ণবর্ণ মুখের মধ্যে চক্ষুদুটি আৰ্ষতেজে উজ্জ্বল ছিল, কিন্তু তাতে তিনি তো নিজেকে নিজেই ঘৃণা করেন না। কোন কুৎসিত দর্শন পুরুষ বা রমণী আপন রূপে অসন্তুষ্ট হয়। কাজেই ব্যাস একটু অপমানিত বোধ করেই ছিলেন।

ঠিক সেই অপমানক্লিষ্ট মনে তিনি যখন মায়ের আদেশ পালন করার জন্যই শুধু জ্যেষ্ঠা রাজবধূ অম্বিকার শয়নকক্ষে পুনরায় উপস্থিত হলেন, তখন দেখলেন এক অপূর্ব রূপবতী রমণী তাঁকে দ্বারমুখেই এগিয়ে এসে অভিবাদন জানাল—সা তমৃষিমনুপ্রাপ্তং প্রত্যুদ্‌গম্যাভিবাদ্য চ। পূর্বে তো এমন ঘটেনি। ব্যাস অবাক হলেন নিশ্চয়। যিনি রাজবধূর দ্বিতীয় মানসিক প্রত্যাখ্যানের জন্য নিজে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন, সেই তাঁকে দুয়ার পর্যন্ত এগিয়ে এসে সাদর সম্ভাষণে অভিবাদিত করছে—এ কোন রমণী! ব্যাস মুহূর্তের মধ্যেই বুঝলেন—ইনি রাজবধূ অম্বিকা নন, তাঁর স্থলাভিষিক্তা হয়েছে অন্য কেউ।

বিচিত্রবীর্যের ভোগ্যা দাসী রাজবধূ নন বলেই তত আত্মসচেতন নয়। বিশেষত অভিবাদন-প্রত্যুদ্‌গমনেই তো সে চিরকাল অভ্যস্ত। তা ছাড়া এ তো তার কাছে স্বপ্ন। রাজবাড়িতে বিচিত্রবীর্যের বিচিত্র ভোগ সম্পূর্ণ করা ছাড়া আর তো কোনও অধিকার ছিল না তার। তারও তো রাজবধূদের মতো মা হতে ইচ্ছে করে। শরীর সে পূর্বেই নিবেদন করেছে বিবাহের বিধিনিয়মের বাইরে গিয়ে। কাজেই ব্যাসের সঙ্গে শারীরিক মিলনে সে কুণ্ঠিত নয়। কিন্তু তারও তো স্বপ্ন ছিল—কাউকে সে এমন করে চাইবে, যে তার সত্তার অন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তার কুক্ষিতে পরম কাম্য এক সন্তানের জন্ম দেবে। অন্যদিকে নিবৃত্তিমূলক মার্গ ত্যাগ করে ব্যাস আজকে মায়ের আদেশে প্রবৃত্তিমূলক ধর্মের পরিসরে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি যেখানে শারীরিক মিলনে উদ্‌যুক্ত হচ্ছেন, সেখানে নিয়োগ-মিলনের যান্ত্রিকতা থাকলেও হত, কিন্তু ঘৃণাও তো তাঁর প্রাপ্য ছিল না। অতএব আজকের এই অর্ধরাত্রের উজ্জ্বল দীপালোকে যখন তিনি অম্বিকার সুন্দরী দাসীটিকে আপন অভ্যর্থনায় নিযুক্ত দেখলেন তখন তাঁর মধ্যেও আর নিয়োগপ্রথার যান্ত্রিকতা থাকল না। তিনি দাসীর সাদর আমন্ত্রণে নন্দিত হয়ে তাঁর রমণগৃহের শয্যায় উপবিষ্ট হলেন।

কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসের মতো বিখ্যাত ঋষি মিলনকামী হয়ে এসেছেন ঘরে। অহো ভাগ্য মনে করে অস্বিকার দাসী তাঁর চরণ ধুইয়ে দিল। যিনি এই দাসীর অন্তরে ফাল্গুন বাতাসে ভেসে আসা আশার অরূপ বাণী হয়ে ছিলেন, যিনি বনের আকুল নিঃশ্বাসের মধ্যে এই দাসীর ইচ্ছে হয়ে ছিলেন, তিনি আজ এই দাসীর স্বপ্নদুয়ার ভেঙে অন্তর থেকে বাইরে এসে পৌঁছেছেন এই আকুল শয্যাতলে। দাসী অনেক আদরে তাঁর পা ধুইয়ে দিল, হয়তো এলোকেশে মুছিয়ে দিল বেদব্যাসের চরণ। হাতে ব্যজন নিয়ে বাতাস করল মনোভারাক্রান্ত ঋষিকে—সৎকৃত্যোপচাচর হ। “উপচচার বাতব্যজনাদিনা শুশ্রূষিতবতী”। রাজরানি, রাজার দুলালি যা সহ্য করতে পারে না, দাসী তা পারে। তার নাকে কোনও দুর্গন্ধও লাগল না, ব্যাসের জটাকলাপশোভিত মুখখানিও তার কাছে অশোভন কুৎসিত মনে হল না। কেননা চাওয়ার ওপরেই ভাল-মন্দ নির্ভর করে অনেকটা। মহর্ষিকে সে প্রাণ থেকে চাইল।

রাজবধূ অম্বিকা, অম্বালিকা—কেউ তো ঘৃণায় কথাই বলেনি তাঁর সঙ্গে। দাসী কথা বলল। মুনিও কথা বলতে বলতে মনের ভাব প্রকাশ করলেন। মনের ভাবপ্রকাশ করতে করতে অনুরাগ ব্যক্ত করলেন। সুস্থ মিলনের ক্রম তো এইগুলিই। বেদব্যাস মুনি হলেও তিনি তো নিশ্চয়ই মোক্ষাভিসন্ধানের জন্য রমণগৃহে প্রবেশ করেননি। ধর্মানুসারেও যে মিলন ঘটে, সেই মিলনের মধ্যেও তো সকামভাব থাকবে। দাসীর সঙ্গে মিলনে নিয়োগের যান্ত্রিকতা নেই বলেই মুনি সানুরাগে দাসীর প্রত্যঙ্গ স্পর্শ করলেন—বাগ্‌ভাবোপপ্রদানেন গাত্রসংস্পর্শনেন চ। মিলন সম্পূর্ণ হল। বেদব্যাস প্রবৃত্তিমূলক ধর্মের সম্পূর্ণ আস্বাদ গ্রহণ করে পরম তুষ্ট হলেন দাসীর সঙ্গে মিলনে—কামোপভোগেন রহস্তস্যাং তুষ্টিমগাদৃষিঃ।

যে অম্বা-অম্বালিকার দাম্পত্যসুখ দেখেছে প্রথম থেকে, যে চিরকাল বিচিত্রবীর্যের ভোগ্যা দাসী হয়ে থেকেছে, অথচ বধূর সম্মান পায়নি, তার কষ্ট ঠিক কোথায়—ক্রান্তদর্শী ঋষি তা বোঝেন। কাজেই তার সঙ্গে সারারাত্রি কাটিয়ে মিলনে সন্তুষ্ট হয়েই বেদব্যাস প্রথম যে আশীর্বাদ করলেন, তা হল—আজ থেকে আর তুমি কারও দাসী হয়ে থাকবে না—অব্রবীচ্চৈনাম্‌ অভুজিষ্যা ভবিষ্যসি। আর আজ এই যে তোমার গর্ভাধান করলাম সেই গর্ভে আসবেন এক শ্রেষ্ঠ পুরুষ। সমস্ত ধার্মিক এবং জগতের সমস্ত বুদ্ধিমান ব্যক্তির মধ্যে তিনি হবেন শ্রেষ্ঠ—ধর্মাত্মা ভবিতা লোকে সর্ববুদ্ধিমতাং বরঃ। বিচিত্রবীর্যের শূদ্রা দাসীর গর্ভে ধর্মস্বরূপ বিদুর জন্মালেন। মহাভারতের কবি এর আগে লিখেছিলেন—অম্বিকার গর্ভে জন্মালেন ধৃতরাষ্ট্র, অম্বালিকার গর্ভে জন্মালেন পাণ্ডু, কিন্তু বিদুরের জন্ম বলতে গিয়ে বললেন—আর কৃষ্ণদ্বৈপায়নের ছেলের নাম হল বিদুর—স জজ্ঞে বিদুরো নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়নাত্মজঃ। অর্থাৎ বিচিত্রবীর্যের বধূদের গর্ভে নিজের আর্ষ বীজ উপহার দিয়ে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন তাঁদের পিতৃত্ব স্বীকার করলেন বটে, কিন্তু একটি সন্তানকে ‘ওন্‌’ করার যে ভাবনা পিতার অন্তরে থাকে, দাসীর গর্ভজাত সেই সন্তানকেই তিনি প্রকৃত ‘আত্মজ’ বলে মনে করেছেন। শূদ্রা রমণীর প্রতি এ যেন বেদব্যাসের পক্ষপাত। হয়তো নিজে বংশপরিচয়হীন ধীবরের গৃহলালিতা মৎস্যাগন্ধা জননীর গর্ভে জন্মেছিলেন বলেই শূদ্রার সম্ভোগেই তিনি তৃপ্তি লাভ করেছেন এবং শূদ্রার গর্ভস্থ সন্তানের মধ্যেই তিনি আপন আর্ষ স্বরূপটি খুঁজে পেয়েছেন। এ তাঁর জননীর রক্তের উত্তরাধিকার, তিনি মাতৃঋণ পরিশোধ করেছেন ঋষিজনোচিত করুণায়, জাতিবর্ণের ঊর্ধ্বে স্থিত হয়ে।

জ্যেষ্ঠা রাজবধূ অম্বিকাকে পুনরায় পুত্রজন্মে নিযুক্ত করে সত্যবতী অধীর আগ্রহে পুত্র ব্যাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। অম্বিকার শয়নগৃহে যে অন্য কেউ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন সত্যবতী তা জানতেন না। ব্যাস যেখানে উত্তমর্ণের ভূমিকায় দাঁড়িয়ে আছেন, সেখানে রাজবাড়ি বা রাজবধূদের তোয়াক্কা করে চলার লোক তিনি নন। কাজেই শয়নগৃহ থেকে নির্গত হয়েই ব্যাস অম্বিকার প্রতারণার কথাও যেমন সত্যবতীকে জানালেন, তেমনই শূদ্রা দাসীর গর্ভে আপন—একেবারে একান্ত আপন পুত্রজন্মের সানন্দ সংবাদও তিনি সত্যবতীকে জানিয়ে গেলেন—প্রলম্ভমাত্মনশ্চৈব শূদ্রায়াং পুত্রজন্ম চ।

প্রসিদ্ধ ভরতবংশে ঋষি ব্যাসের মাধ্যমে যেভাবে বংশধারা সৃষ্টি হল তাতে ভরতবংশের প্রধান উত্তরাধিকারীর কাছে যথেষ্ট কৃতজ্ঞতা লাভ করলেন ব্যাস। মহামতি বিদুর যখন বড় হয়েছেন, রাজপুত্রদের যখন বিয়ে দেবার সময় এসেছে, তখন ভরতবংশের প্রধান উত্তরাধিকারীর—আসলে যাঁর রাজা হবার কথা ছিল, যাঁর প্রথম অধিকার ছিল বংশধারা রক্ষা করার—সেই ভীষ্ম কিন্তু মহর্ষি ব্যাসকে সম্পূর্ণ ‘ক্রেডিট’ দিয়ে চলেছেন—মহারাজ শান্তনুর বংশ আবার আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি এবং বংশপ্রতিষ্ঠায় যাঁরা প্রধানভাবে সাহায্য করেছেন, তাঁদের মধ্যে আমি তো আছিই, আছেন মাতা সত্যবতী, আর আছেন ঋষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস—ময়া চ সত্যবত্যা চ কৃষ্ণেন চ মহাত্মনা।

কী অদ্ভুত এক শৈলী কাজ করছে এখানে। রাজা এবং রানি। শান্তনু এবং সত্যবতী। তাঁদের শাস্ত্রবিধিসম্মত বিবাহের ফলে যে সন্তান দুটি হয়েছিল, তাঁরা দুজনেই মারা গেছেন। কিন্তু যে দুটি সন্তান তথাকথিতভাবে অবৈধ, শান্তনুর বংশ রক্ষা করছেন তাঁরাই। একজন সন্তান রানির। তিনি যমুনানদীর মাঝখানে অবিবাহিত অবস্থায় মহর্ষি পরাশরের মনোভীষ্ট পূরণ করতে গিয়ে কানীন অবস্থায় ব্যাসের জন্ম দিলেন। রানি সত্যবতী নিজেও জন্মলগ্নেই যমুনানদীর সঙ্গে সার্বিক সম্বন্ধযুক্ত। তিনি যমুনায় নৌকো বাইতেন আবার তাঁর পুত্রেরও জন্ম হল যমুনার মধ্যদ্বীপে। অন্যদিকে রাজার যিনি ছেলে সেই ভীষ্মও কিন্তু শান্তনুর সামাজিক নিয়মে বিবাহিত স্ত্রীর গর্ভজাত নন। শান্তনুর প্রেমে এবং স্বর্গলোকের অলৌকিক অভিসন্ধিতে গঙ্গার গর্ভে ভীষ্মের জন্ম। ভীষ্মের শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনপূর্ব বয়স পর্যন্ত জীবন কেটেছে গঙ্গার ঘরেই, হস্তিনাপুরে নয়। অন্যদিকে ব্যাসও জন্মের পরেই মায়ের স্মরণমাত্রে উপস্থিতির প্রতিজ্ঞা করে চলে গেছেন পিতা পরাশরের সঙ্গে।

তা হলে দেখুন, যমুনার অন্তরবর্তী দ্বীপজন্মা বেদব্যাস এবং গঙ্গার গর্ভজাত ভীষ্ম—রাজা ও রানির গূঢ়জাত দুই সন্তান—যাঁরা কিন্তু রাজবাড়ির সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্বন্ধে সম্বন্ধিত নন, তাঁরাই কিন্তু প্রসিদ্ধ বংশের কুলতন্ত্র স্থাপন করছেন—সমবস্থাপিতং ভূয়ো যুষ্মাসু কুলতন্তুষু। একজন ভরতবংশের বীজন্যাস করে গেলেন, অন্যজন সেই বীজাঙ্কুর বিবর্ধিত করছেন। মাঝখানে যোগাযোগটুকু ঘটাচ্ছেন সত্যবতী—যিনি ভারী সুন্দরভাবে ব্যাসকে বলেছেন— তুমি বীজ আধান করো, ভীষ্ম সেই বীজ বিবর্ধন করবেন—তস্মাদ্‌ গর্ভং সমাধৎস্ব ভীষ্মঃ সংবর্ধয়িষ্যতি। অন্যদিকে দেখুন—গঙ্গা এবং যমুনা—এই দুই নদীই তো বৈদিকোত্তর যুগে সিন্ধু-সরস্বতীর আর্য উত্তরাধিকার উত্তর এবং মধ্যভারতে প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং বিবর্ধিত করেছিল। আমরা যদি বলি—যামুনেয় নদী সভ্যতার প্রতিনিধি ব্যাস এবং গাঙ্গেয় সভ্যতার প্রতিনিধি ভীষ্ম—এই দুই পিতামহের সংযোগেই মধ্য এবং উত্তর ভারত জুড়ে ভরতবংশের সুপ্রতিষ্ঠা ঘটল—তা হলেই ঠিক বলা হয়। পাণ্ডবের কৌরবের এক পিতামহ নন, দুই পিতামহ। দু’পক্ষই ব্যাস এবং ভীষ্মকে পিতামহ বলেই ডাকতেন। অন্যদিকে মহাভারতের সময়কালীন যে রাজবংশ উত্তর-মধ্য ভারতের ব্রাহ্মণ্য এবং ক্ষাত্র সংস্কৃতি ধারণ করে রেখেছিল, তা প্রধানত যমুনানদী এবং গঙ্গানদীর আববাহিক সংস্কৃতি এবং এই সংস্কৃতির ব্রাহ্মণ্য বীজ রাজবংশের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়েছিল ব্যাসের মাধ্যমে এবং তার ক্ষত্রিয়োচিত সংস্কার ঘটেছিল ভীষ্মের মাধ্যমে।

একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে—ব্যাস যে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি বহন করে এনেছিলেন, তা ফুল-বেলপাতা-নৈবেদ্যের ব্রাহ্মণ্য নয়, কিংবা তা নয় চাতুর্বর্ণ্যের বিভেদসৃষ্টিকারী শুদ্ধীকরণের সংস্কার। তিনি নিজে শূদ্রা জননীর মায়াশোণিত ধারণ করেছেন নিজের ধমনীতে, আর আপন আত্মজ বলে তিনি যাঁর জন্ম দিয়েছেন, তিনিও শূদ্রার গর্ভজাত, অথচ তাঁর সম্পূর্ণ স্বরূপটিই ধর্মের। বিদুরের জন্ম দিয়ে তিনি সেই সর্বাশ্লেষী ধর্মের জন্ম দিয়েছেন—যে ধর্ম রাজাকে সততা এবং ন্যায়ের পথে সদা সঞ্চালিত করে এবং মানুষের কল্যাণ করে—কারণ বিদুর শূদ্র বলেই তিনি আম-জনতার প্রতিভূ। অন্য দিকে ভীষ্মকে দেখুন—তিনি ভরতবংশে শান্তনুর প্রথম উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাজা নন। তিনি গৃহস্থ হলেও বিবাহিত নন। ভরতবংশের জাতকদের নিঃস্বার্থভাবে মানুষ করা এবং তাঁদের রাষ্ট্রসংবর্ধনে সাহায্য এবং সেবা করাটাই তাঁর ধর্ম। ব্যাস সন্ন্যাসী হতে গিয়ে গৃহস্থের কাজ করে গেলেন রাজবংশ বিস্তার করে, অন্যজন ভীষ্ম গৃহস্থ হয়েও সন্ন্যাসীর মানসিকতায় রাজবংশের সেবা করে গেলেন স্বার্থহীন সেবকের মর্যাদায়। এঁরা দুজনে মাতুতো আর বাবাতুতো ভাই, সত্যবতী বলেছিলেন—যথৈব পিতৃতো ভীষ্মস্তথা ত্বমপি মাতৃতঃ—ভীষ্ম যেমন তাঁর বাবার সম্বন্ধে আমার ছেলে, তেমনই তুমিও মায়ের দিক থেকে শান্তনুর ছেলে।