দ্রোণাচার্য – ১

॥ ১ ॥

এখনকার দিনের ভগ্নদীৰ্ণ সংসারগুলির মধ্যে এমন মানুষ যে দেখতে পাবেন, তা মনে হয় না। কিন্তু আমার জীবনের সীমিত পরিসরেও এমন মানুষ আমি নিজের চোখে দেখেছি। তিনি যে আমাদের শোণিত সম্বন্ধে কোনও আত্মীয় গুরুজন নন, অথবা জ্ঞাতি সম্বন্ধেও তিনি যে আমাদের কোনও স্বজন ছিলেন না, সে কথা জেনেছি অনেক পরে। কিন্তু আত্মীয়, গুরুজন বা স্বজন না হলেও তাঁরা পরিজন বটে। কোথা থেকে যে তাঁরা এসেছিলেন, তা জানি না। বাড়িতে দোল কিংবা দুর্গোৎসব ছিল হয়তো। সেই অনাত্মীয় মানুষটিকে উপস্থিত হতে দেখলাম, কিন্তু উৎসব মিটে গেলে তিনি আর ফিরে গেলেন না। তিনি আমাদের হয়ে গেলেন। সে এমনই এক হয়ে ওঠা যে, তাঁর কথার মূল্য দিতে হত, তাঁর ইচ্ছে অনিচ্ছেরও মূল্য দিতে হত। সংসারের আত্মীয় গুরুজনের চেয়ে তাঁর মূল্য কিছু কম ছিল না।

এইরকম পরিজনকে আমরা কখনও সংসারের গুরুত্বপূর্ণ সমাধান করতে দেখেছি, কখনও রাত জেগে বৃদ্ধ বা রোগীর সেবা করতে দেখেছি, কখনও বা গিন্নিমার অসুস্থতায় হেঁসেলে ঢুকতে দেখেছি, আবার কখনও বা বাড়ির কচিকাঁচাদের নিয়ে পাঠশালা বসাতেও দেখেছি। একান্নবর্তী পরিবারের অখণ্ড একাত্মতার মধ্যে এঁরা যদি কেউ কখনও বাইরে যেতেন তা হলে তাঁর শূন্যতা আমাদের পীড়িত করত। আবার এমনও কখনও হয়েছে যে, আমাদের বাড়িতে থেকেই তাঁর বিবাহাদি সম্পন্ন হল, তারপরে আস্তে আস্তে নববধূর সংক্রমণে কোথা থেকে যেন কী হত—সংসারের বহ্বারম্ভিক লঘুক্রিয়ায়—একদিন দেখতাম—দুটি ফুলকাটা টিনের বাক্স হাতে নিয়ে তাঁরা গোরুর গাড়িতে উঠতেন। বাড়ির মা মাসিরা কেঁদে লুটোতেন, বাড়ির কর্তা তাঁদের সামনে আসতে না পেরে আপন রক্তচাপ প্রশমনের জন্য বেশি করে হুঁকোয় টান দিতেন, আর বাড়ির ছেলেপিলেরা গভীর চোখে শুধু তাকিয়ে থাকত—ঘটনার আকস্মিকতা কিছুই বুঝতে না পেরে। আমাদের পরবর্তী জীবনে এই মানুষগুলি বার বার ফিরে এসেছেন বিভিন্ন ঘটনায়, স্মরণে, মননে। আমরা তাঁদের ভুলিনি, ভুলতে পারি না। তাঁরা এখনও আমাদের পরম আত্মীয়ের চেয়েও বড়, অনেক রক্ত সম্বন্ধীর চেয়েও বেশি মূল্যবান আমাদের কাছে।

মহামতি দ্রোণাচার্যের সঙ্গে আমার স্মরণিকার শেষাংশ মিলবে না। আমাদের সেই অনাত্মীয় পরিজনেরা কখনও যে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তার কারণ হয়তো ব্যক্তিগত জীবনে আত্মলাভের চেষ্টা, কখনও বা নিজেকে ঠিক মতো খুঁজে পাওয়ার জন্য, কিন্তু দ্রোণাচার্য কুরুবাড়ি ছেড়ে আর যেতে পারেননি। অন্যত্র চলে গেলে তাঁর স্বার্থলাভ বা আত্মপ্রতিষ্ঠা আরও বেশি হত কি না, তা বলা অত্যন্ত কঠিন। কিন্তু জীবনের শেষ দিনটি পর্যন্ত কুরুবাড়িতে থেকে তাঁদেরই জন্য মৃত্যু বরণ করার মধ্যে যে তাঁর চরম স্বার্থহীনতা ধরা পড়ে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আবার অন্যদিকে তিনি যে কুরুবাড়িতে সপুত্র-পরিবারে সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন সেটাও যে একেবারে চরম স্বার্থহীন কোনও ভাবনা, তাও কিন্তু নয়। বস্তুত তখনকার দিনের সামাজিক নিরিখে দেখতে গেলে দ্রোণাচার্যের মধ্যে স্বার্থান্বেষিতার প্রমাণ যথেষ্টই মিলবে, যদিও সেই স্বার্থান্বেষিতা একেবারেই অকারণ নয়, হয়তো বা অত্যন্ত স্বাভাবিকও বটে। নিজের জীবনযন্ত্রণার প্রশমন খুঁজতে এসে কুরুবাড়ির ভাল মন্দ এবং সমস্ত সুখ দুঃখের সঙ্গে তিনি এমনভাবেই জড়িয়ে গেলেন যে, একান্ত নিশ্চিন্ত কোনও সুখভোগ, যা তিনি শুধু নিজের পুত্র-পরিবারের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারতেন, তা আর কোনও দিনই তাঁর প্রাপ্য হল না, মরণ পর্যন্তও না। তিনি একেবারেই কুরুবাড়ির হয়ে গেলেন, তাঁদের ভাল মন্দে সদা সংবেদনশীল এবং উত্থানপতনে সতত বিকাৰ্যমন।

দ্রোণাচার্যের সামগ্রিক চরিত্র বুঝতে গেলে অবশ্য শুধু তাঁর কুরুবাড়ির আবাসকাল অথবা তাঁর হস্তিনাপুরে আগমনের সময় থেকে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত সময় ধরলেই চলবে না, তাঁকে ধরতে হবে তাঁর জন্মের সময় থেকে একেবারে মৃত্যুর পরের সময় পর্যন্ত। কেননা দ্রোণাচার্য এমনই এক মানুষ যিনি মৃত্যুর পরেও আরেকভাবে বেঁচে থাকেন এবং সেই বেঁচে থাকার মধ্যে অন্যতর এক ধ্বংস আছে, তা সময়মতো বলব। অবশ্য একই সঙ্গে এ কথাও জানিয়ে রাখা ভাল যে, শুধু এইজন্যই দ্রোণাচার্যের চরিত্র গুরুত্বপূর্ণ নয়। দ্রোণাচার্যের চরিত্র অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ আরও একটি সজীব কারণে। আধুনিক জগতে যেসব জীবনযন্ত্রণার কথা আমরা শুনি, সেইসব যন্ত্রণা দ্রোণাচার্যের জীবনে এত বেশি মাত্রায় ঘটেছে যে, তার ফলে তাঁর জীবনটাই হয়ে উঠেছে ভয়ংকর রকমের আধুনিক। অবশ্য সে আধুনিকতা বুঝতে গেলেও আবার তাঁর সমকালীন সমাজে ফিরে যেতে হবে এবং বুঝতে হবে সেই সমাজটাকেও।