ধৃতরাষ্ট্র – ১০

॥ ১০ ॥

পাণ্ডবরা বনে চলে যাবার পর পৌর-জনপদবাসীদের বিক্ষোভ যেমন দেখা দিয়েছিল, তেমনই বহিরাগত মুনি-ঋষিরাও ধৃতরাষ্ট্রকে কথা শোনাতে ছাড়ছিলেন না। এমনই একদিন ব্যাস এসেছিলেন মৈত্রেয় ঋষিকে সঙ্গে করে। ধৃতরাষ্ট্র ব্যাসের আত্মজ পুত্র। পাণ্ডু ও বিদুরও তাই। ভরতবংশের ওপরে এই মুনির প্রাণের টান আছে। ব্যাস কাম্যকবনে পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করে তবেই এসেছেন হস্তিনাপুরে। তিনি এসেই ধৃতরাষ্ট্রকে একহাত নিলেন। বললেন—এইভাবে পাণ্ডবরা বনে গেছে—আমার কিন্তু মোটেই ভাল লাগেনি। অন্যায়ভাবে পাশা খেলে তোমার ছেলেরা যে কাজ করেছে, আজ থেকে তেরো বছর পরে কিন্তু তার ফল ভুগতে হবে তোমার ছেলেদের। আমি এখনও বলছি—তোমার ছেলেকে সামলাও এবং সে পাণ্ডবদের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করুক—বার্য্যতাং সাধ্বয়ং মূঢ়ঃ শমং গচ্ছতু পাণ্ডবৈঃ। তা নইলে, তোমার ছেলেকেও বনে পাঠাও। সে একা গিয়ে পাণ্ডবদের সঙ্গে থাকুক। সেখানে থাকতে থাকতে সে যদি যুধিষ্ঠিরের স্নেহ লাভ করে, তবেই বুঝবে তুমি বাঁচলে, নইলে সব যাবে। জান তো, স্বভাবের দোষ না মরলে যায় না, কাজেই তুমি কী ঠিক করবে আমি জানি না।

পিতা ব্যাসের ধমক খেয়ে ধৃতরাষ্ট্র একেবারে নিজের হৃদয়ের কথাটুকু উজাড় করে দিলেন। বললেন—আমি কী করব? আমি কিছুতেই চেতনাহীন দুর্যোধনকে ছেড়ে দিতে পারি না। এই যে পাশাখেলা নিয়ে যা হল, তা আমি চাইনি, কিন্তু কেমন করে যেন দৈবলিখনের মতো সব ঘটে গেল। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর গান্ধারী—কেউই চাননি এমন ঘটনা ঘটুক, কিন্তু কেমন করে যেন পুত্রস্নেহের বশেই আমি এসব করে বসলাম—তচ্চ মোহাৎ প্রবর্তিতম্‌। কী করব, দুর্যোধনকে আমি কিছুতেই মন থেকে দূরে রাখতে পারি না। সে যে অন্যায় করছে তা আমি বেশ বুঝতে পারি। কিন্তু সব বুঝেও—এমনই আমার অপার স্নেহ—আমি তাকে বারণও করতে পারি না, কিংবা তাকে ত্যাগও করতে পারি না—পুত্রস্নেহেন ভগবন্‌ জানস্নপি প্রিয়ব্রত।

ধৃতরাষ্ট্র পুত্রের কথা বলছেন, ব্যাস কি সেই পুত্রস্নেহের কথা জানেন না? ধৃতরাষ্ট্র কাকে বোঝাচ্ছেন? আজকের দিনেও যে এমনই হয়—পুত্র পুত্রবধূ তাঁদের পুত্রটির কথা বোঝেন, কিন্তু সংসারে যে জনক-জননী দুটি রয়েছেন, তাঁদের আরও যে দু-তিনটি পুত্রকন্যা রয়েছে, তাঁদের ওপরেও যে জনক-জননীর স্নেহ থাকতে পারে, সেটা কেউ বোঝে না। ব্যাসের কাছে ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু, বিদুর এঁরা সকলেই সমান। সেখানে এক পুত্র রাজার হালে আছেন, আরেক ছেলের পুত্রেরা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে ব্যাসের কি তা ভাল লাগে। ব্যাস তাই বললেন—বুঝি, যথেষ্ট বুঝি। ঠিক বলেছ তুমি, এই পৃথিবীর পুত্রের চেয়ে বড় আর কীই বা আছে—দৃঢ়ং বিদ্মঃ পর পুত্রং পরং পুত্ৰান্ন বিদ্যতে। তবে কিনা তোমাকে একটা গল্প বলি শোনো।

মহর্ষি ব্যাস তিন ভুবনের গাভী-মাতা সুরভির গল্প বললেন ধৃতরাষ্ট্রকে। বললেন—দেখো, একদিন স্বর্গের দুয়ারে বসে গাভী-মাতা সুরভি খুব কাঁদছিলেন। তাঁর করুণ কান্না শুনে দেবরাজ ইন্দ্র এসে বললেন—তুমি কাঁদছ কেন মা জননী। স্বর্গের দেবতাদের কি কোনও অমঙ্গল হয়েছে? নাকি মর্ত্যলোকে অথবা নাগলোকে কোনও বিশেষ বিপদ ঘটেছে? সুরভিকে পৃথিবীর সমস্ত গাভীর আদি জননী বলা হয়। পৃথিবীর যত গোরু, সব তাঁরই সন্তান। সুরভি বললেন—স্বর্গে-মর্ত্যে কোনও অমঙ্গল নেই দেবরাজ, আমি আমার একটি ছেলের দুঃখে বসে বসে কাঁদছি—অহং তু পুত্রং শোচামি তেন রোদিমি কৌশিক। এই দেখো না, মর্ত্যলোকে ওই কৃষকটির ঘরে ওই ছোট্ট এঁড়ে গোরুটিকে দেখতে পাচ্ছ। দেখো কৃষকের হাতে কীরকম চাবুক খাচ্ছে দেখো। কীরকম করে ওর কাঁধে লাঙল চাপিয়ে দিচ্ছে, দেখো? দেখো, লাঙল বইতে পারছে না, বসে পড়ছে, তবু তাকে দিয়ে লাঙল বওয়ানোর জন্যে চাবুক মারছে কৃষক—নিষীদমানং সোৎকণ্ঠং বধ্যমানং সুরাধিপ।

যে কৃষকের ঘরের দিকে দেখিয়ে দিচ্ছেন সুরভি, সেখানে আরও একটি এঁড়ে গোরু রয়েছে। সে দিব্যি হৃষ্টপুষ্ট, তার গায়েও অনেক শক্তি। সুরভি তাকে দেখিয়ে বললেন—দেখো দেবরাজ! আমার ওই ছেলেটির জন্য কোনও দুঃখ নেই। ওর গায়ে শক্তি আছে, অনেক ভার বইতে পারে, শরীরটাও শক্ত সমর্থ। কিন্তু ওর পাশেরটিকে দেখো, ওর গায়ে মাংস নেই, শিরা বেরিয়ে গেছে সমস্ত শরীরে। আর গায়ে শক্তি বলতে কিছু নেই। আর তাকে কিনা চাবুক মারছে, লাঙল চাপিয়ে দিচ্ছে ঘাড়ে! ভার বইতে ওর বড় কষ্ট বলেই ওই দুর্বল ছেলেটির জন্য আমি কেঁদে মরছি—ততো’হং তস্য শোকার্তা বিরৌমি ভৃশদুঃখিতা।

ইন্দ্র বললেন—কেন এত কাঁদছ মা জননী। পৃথিবীতে তো এত গোরু আছে, সবই তো তোমার পুত্রকন্যা। হাজার হাজার পুত্র থাকতে, ওই একটা দুর্বল ছেলে তোমার কোথায় চাবুক খেল, কোথায় লাঙল তুলতে পারল না, তার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছ কেন—কিং কৃপায়ি তবেত্যত্র পুত্র একত্র হন্যতে? সুরভি বললেন—শোনো, দেবতার কথা শোনো। হাজার ছেলের ওপর আমার সমান দৃষ্টি থাকলেও, যে ছেলেটা আমার দুর্বল, রোগাভোগা, তার জন্যেই যে মায়ের সবচেয়ে বেশি কষ্ট গো—দীনস্য তু সতঃ শক্র পুত্রস্যাভ্যধিকা কৃপা।

সুরভির গল্প শুনিয়ে ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে এবার বললেন—তুমি যেমন আমার ছেলে, তেমনই পাণ্ডুও আমারই ছেলে, বিদুরও তাই। সবার ওপরে আমার সমান ভালবাসা আছে। কিন্তু ভেবে দেখো—তোমার একশোটা ছেলে, এবং তারাও বড় ভাল আছে, সুখে আছে। তা থাকুক, সুখেই থাকুক। কিন্তু পাণ্ডুর কথা ভাবো। সে মারা গেছে। আর তার পাঁচটি মাত্র ছেলে, কিন্তু তারা আজকে কত কষ্টে আছে, বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেমন করে ওরা বাঁচবে, কেমন করে ওরা বড় হবে—এত সব চিন্তা আমায় কষ্ট দিচ্ছে। ওরা কষ্টকর অবস্থায় পড়েছে বলেই ওদের জন্য আমার মনে বড় ব্যথা লাগছে। ওই সুরভি যেমন বলেছিলেন—দুর্বল অবস্থায় আছে বলেই ওদের জন্য আমার বেশি মায়া—তদ যথা সুরভিঃ প্রাহ…হীনেষ্বভ্যধিকা কৃপা। ব্যাস ‘আলটিমেটাম’ দিলেন—তুমি যদি তোমার ছেলেদের বাঁচিয়ে রাখতে চাও, তবে এক্ষুনি দুর্যোধনকে বলো—পাণ্ডবদের সঙ্গে সমস্ত বিবাদ মিটমাট করে নিতে—দুর্যোধনস্তব সুতঃ শমং-গচ্ছতু পাণ্ডবৈঃ।

আজকের দিনের সমস্ত একপুত্রক পুত্রময়তার জগতে ব্যাসের বলা এই সুরভি-উপাখ্যানের তাৎপর্যই হয়তো নেই। কিন্তু আমাদের যুগে ছিল। আমাদের দিনের বাবা মায়ের সংসারের বৈচিত্রও ছিল অদ্ভুত। এক সংসারে একজন ইঞ্জিনিয়ার, একজন কেরানি এবং অন্যজন মুদিখানার দোকানদার হলেও ওই কেরানিটি অথবা দোকানদারটি ব্যাস-কথিত অর্থনৈতিক দুর্বলতার কারণে বাবা মায়ের স্নেহ পেতেন বেশি। তাঁরা আবার মুখে বলতেন—বট্‌টার জন্য চিন্তা করি না, ও নিজেরটা নিজে চালাতে পারবে, কিন্তু ছোট্‌টার দোকানদারির যা কষ্ট! যেন ইঞ্জিনিয়ারটির কষ্ট নেই। আমরা জানি—ওঁরাও বুঝতেন কষ্ট আছে, কিন্তু নিজেদের স্নেহ মমতা দিয়ে অর্থ-দুর্বল পুত্রটির মানসিক জটিলতা ঘুচিয়ে দেওয়াটাই ছিল আমাদের কালের সুরভি জনক-জননীর কাজ। ব্যাসও ঠিক এই কাজটাই করেছেন। স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি বনবাসক্লিষ্ট পাণ্ডবদের পক্ষে।

পিতার মতো এমন করেই বা কে বোঝাতে পারে। সেই মুহূর্তে স্নেহান্ধ ধৃতরাষ্ট্রও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বলেছেন—আপনি যা বলেছেন, তা সর্বাংশে ঠিক। এমনকী ভীষ্ম দ্রোণ বিদুররাও আমাকে এই কথা বলেন। তা আপনার যদি সত্যি কৌরবদের ওপর সামান্যও দয়া থাকে, তবে ওই দুরাত্মা দুর্যোধনকে একটু শাসন করে যান, পিতা—অন্বশাধি দুরাত্মানং পুত্রং দুর্যোধনং মম।

ব্যাস শাসন করলেন না। ইচ্ছাকৃতভাবেই করলেন না। কেননা শাসন করতে গিয়ে যদি তাঁর ক্রোধ উদ্ৰিক্ত হয়, তবে আপন বংশের ওপরেই তাঁর অভিশাপ নেমে আসবে। সেও তো ভাল কথা নয়। ধৃতরাষ্ট্রও যে তাঁর বড় ছেলে। ব্যাসের কথায় মৈত্রেয়ঋষি দুর্যোধনকে অনেক শাসন করলেন। এমনকী শেষ পর্যন্ত ভীমের সেই ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞাও মনে করিয়ে দিলেন। অভিশাপ দিয়ে বললেন—ভীমের গদাঘাতেই তোর প্রাণ যাবে। দুর্যোধন যখন কোনও কথাই শুনলেন না তখন ধৃতরাষ্ট্রই মুনিকে শান্ত করে, তাঁর কাছে কির্মীরবধের ঘটনা শুনতে চাইলেন। কানাঘুষোয় তিনি শুনেছেন—কির্মীর রাক্ষস জাতির এক প্রধান পুরুষ এবং তাঁকে মেরেছেন ভীমসেন। মৈত্রেয় কোনও কথা না বলেই রাগ করে চলে গেলেন। অতএব কির্মীর-বধের কথা তাঁকে শোনালেন বিদুর। ভীমের শক্তি প্রদর্শনের কাহিনী শুনে ধৃতরাষ্ট্র আপন পুত্রের অনিষ্টাশঙ্কায় গম্ভীর হয়ে গেলেন। শুধু দীর্ঘনিশ্বাসেই বোঝা গেল তিনি কতটা শঙ্কিত—শ্রুত্বা ধ্যানপরো রাজা নিঃশ্বশাসার্তবৎ তদা।

ব্যাস এবং মৈত্রেয়ঋষির কাছে ধৃতরাষ্ট্র যেমন কির্মীর-বধের খবর পেয়েছিলেন, তেমনই সেই ব্যাসের কাছেই পরবর্তী সময়ে তিনি অর্জুনের অস্ত্রলাভের কথা শুনেছিলেন। অর্জুন তপস্যা করে পাশুপত এবং অন্যান্য দিব্য অস্ত্র লাভ করেছেন—এ কথা শোনা অবধি ধৃতরাষ্ট্রের মনে অশান্তি ঘনিয়ে উঠল। অর্জুনের ওপর রাগে তিনি দুর্যোধনের ওপরেই খানিকটা হম্বিতম্বি করলেন। বললেন—আমার এই ছেলে, যতরকম বদমায়েশি আছে, তাই করে। কোনদিন দেখব এই বদমাশ গোটা পৃথিবীটাকেই সর্বনাশের পথে ঠেলে দিয়েছে—মম পুত্র সুদুর্বুদ্ধিঃ পৃথিবীং ঘাতয়িষ্যতি। এই যে অর্জুন, তাঁর যা শক্তি-বলের পরিচয় পাচ্ছি তাতে ভীষ্ম দ্রোণ কর্ণের মতো যোদ্ধারাও তাঁর কিছু করতে পারবে না। আমি তো ভূ-ভারতে এমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না, যে অর্জুনকে মারতে পারবে অথবা তাঁকে যুদ্ধে জয় করতে পারবে।

ধৃতরাষ্ট্র এখন ভীষণ ভয় পাচ্ছেন। প্রাজ্ঞ মন্ত্রী সঞ্জয় তাঁকে দুর্যোধন কর্ণ দুঃশাসনের অপকীর্তির কথা শুনিয়ে অর্জুনের পাশুপত অস্ত্রলাভ এবং তাঁর সঞ্চিত ক্রোধের কথা বুঝিয়ে দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র বলেন—যার বড় ভাই যুধিষ্ঠির সমস্ত শিক্ষায় শিক্ষিত তাঁর সামনে আমার এই দুর্বুদ্ধি ছেলেগুলো তো দাঁড়াতেই পারবে না। আমার চোখ নেই, সবকিছু আমি দেখতেও পাই না, আর সেই সুযোগ নিয়ে আমাকে ওরা আমলই দেয় না কোনও—দৃষ্ট্বা মাং চক্ষুষা হীনং… ন শুশ্রূষতি মন্দভাক্‌। ধৃতরাষ্ট্র নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতি হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছেন। বুঝতে পারছেন—ভীম-অর্জুনের শক্তির সঙ্গে যদি কৃষ্ণ-বাসুদেবের বুদ্ধি সংযুক্ত হয়, তবে তাঁর প্রিয় পুত্রেরা সকলেই বিমর্দিত হবে—ক্রুদ্ধে ভীমে চ পার্থে চ বাসুদেবে চ সাত্ত্বতে। ধৃতরাষ্ট্র বুঝতে পারছেন যে হস্তিনাপুরের কৌরবদের বিরুদ্ধে নতুন এক রাজনৈতিক বলয় তৈরি হয়েছে। পাঞ্চাল এবং যাদবদের প্রধান পুরুষেরা কাম্যকবনে এসে কৌরবদের ওপর প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে গেছেন। এই সমস্ত খবর, রাজপুরীতে বসেই পাচ্ছেন ধৃতরাষ্ট্র। যত খবর পাচ্ছেন, তত তাঁর ভয় হচ্ছে। দিনে রাতে তাঁর ঘুম আসে না। বার বার এখন তাঁর মনে হচ্ছে—কেন ওই সাংঘাতিক পাশাখেলার মধ্যে গেলাম—সঞ্চিন্ত্য দুর্নয়ং ঘোরম্‌ অতীতং দ্যূতজং হি তৎ।

ধৃতরাষ্ট্র যতই ভয় পান, দুর্যোধন-দুঃশাসনদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ তত ছিল না বলেই তাঁরা বনবাসী পাণ্ডবদেরও ক্ষতি করার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। একবার তো দুর্বাসা মুনিকে পাণ্ডবদের অরণ্য-আবাসে সশিষ্য ভোজন করতে পাঠিয়েও কোনও লাভ হল না, অবশ্য তাঁদের সেই দুর্বুদ্ধি চেপেছিল পাণ্ডবদের বনবাসের শেষের দিকে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। তারও আগে আরও একটা দুর্ঘটনা তাঁরা ঘটিয়েছিলেন। তাতে ফল হয়েছিল বিপরীত। পাণ্ডবরা তখন যেখানে বাস করছেন, তার কাছেই কৌরবদের একটি খামারবাড়ি ছিল। সেখানে গোপালন হত। দুর্যোধন শকুনি কর্ণরা বুদ্ধি করলেন—সেইখানে গিয়ে বনবাসক্লিষ্ট পাণ্ডবদের রাজঐশ্বর্য প্রদর্শন করে তাঁদের মনে জ্বালা ধরাতে হবে। অজুহাত হিসেবে একটি গয়লাকে খাড়া করে বলা হল—এ চায় খামারবাড়িতে কতগুলি গোরু আছে, তাদের বাড়বৃদ্ধি কেমন হচ্ছে, সেসব খবর নিতে রাজবাড়ির কেউ যাক। দুর্যোধন কৰ্ণরা ধৃতরাষ্ট্রকে জানালেন—এই সুযোগে একটু মৃগয়াও করে আসা হবে, গোপালনেরও খবর নেওয়া হবে।

ধৃতরাষ্ট্র এখন যেহেতু পাণ্ডবদের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আছেন, অতএব খুব করে তিনি বললেন—দেখো বাপু! মৃগয়াও বেশ ভাল কথা, গোরু দেখে আসাটাও বেশ ভাল কথা। কিন্তু আমি জানি—তোমরা যেখানে যাবে, ঠিক সেইখানেই ওই বাঘের মতো বীরপুরুষেরা এখন বাস করছেন। তোমরা তাঁদের প্রতি অনেক অন্যায় করেছ। কপট পাশা খেলে তাঁদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছ, তাঁদের বনেও পাঠিয়েছ—ছদ্মনা নিৰ্জিতাস্তে তু কর্শিতাশ্চ মহাবনে। মনে রেখো, সেখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কোপোদ্রেক না হয় কোনও কারণে। কোনও কারণে যেন ক্রোধী ভীম খেপে না ওঠেন। আর ওই যে রমণীটি যাকে তোমরা অবলা বলে ভাব, সে কিন্তু তেজঃপুঞ্জ ছাড়া আর কিছু নয়। তোমরা যেতে পার, কিন্তু তোমরা বা তোমাদের সৈন্যসামন্তরা যাতে কোনওভাবে তাঁদের কোনও ক্ষতি না করে, সে ব্যাপারে তোমাদের কথা দিতে হবে। মনে রেখো—অর্জুন কিন্তু কোনও দিব্যাস্ত্র ছাড়াই এই পৃথিবী জয় করেছিলেন, এখন তিনি দিব্যাস্ত্র লাভ করে সম্পূর্ণ শক্তিশালী। তোমরা যদি কোনওভাবে তাঁদের পিছনে লাগতে যাও, তবে কিন্তু জেনে রেখো সেটা ভাল তো হবেই না, আর ক্ষমতায়ও কিন্তু কুলোবে না—অনার্য্যং পরমং তৎ স্যাদ্‌ অশক্যঞ্চ বৈ মতম্‌।

দুর্যোধন-কৰ্ণরা ধৃতরাষ্ট্রের কথা শোনেননি। শকুনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে মিথ্যা প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তাঁরা কোনও মতেই পাণ্ডব-ভাইদের জ্বালাতন করবেন না। কিন্তু বাস্তবে তাঁরা নিজেদের ক্রূর পরিকল্পনা মতোই কাজ করতে গিয়েছিলেন এবং তার ফলও পেয়েছিলেন। বনবাসে থেকেও পাণ্ডবরা দুর্যোধনের অত্যাচার কিছু কিছু সইলেন; সব ঘটনা ধৃতরাষ্ট্রের মতে হয়নি ঠিকই, কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রের পূর্ব প্রশ্রয় এতই বেশি ছিল যে, শেষের দিকটায় দুর্যোধন আর জিজ্ঞাসা টিজ্ঞাসা কিছু করছিলেন না। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় দুর্যোধন যে কুরু-প্রধানদের নিয়ে বিরাট রাজার গোধন হরণ করতে গেলেন, তাতে ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি-প্রার্থনার অবকাশ ছিল না কোনও। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাসের সময় পেরিয়ে যেতেই পাণ্ডব এবং কৌরব শিবিরে নতুন করে রাজনৈতিক তৎপরতা শুরু হল।