ব্যাস দ্বৈপায়ন – ৫

॥ ৫ ॥

ব্যাস যখন বুঝলেন—পাণ্ডবদের সখা-সহায় হিসেবে কৃষ্ণের স্থান সুদৃঢ় হয়ে উঠেছে, যখন বুঝলেন—কর্তব্যবোধহীন স্বার্থপর ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাণ্ডবরা এখন সনাথ, তখন থেকেই ব্যাসকে আমরা অনেক দায়মুক্ত দেখছি। এতদিন ব্যাসকে আমরা নিঃশব্দে পাণ্ডবদের পক্ষে বিচরণ করতে দেখেছি। জতুগৃহ-দাহের অন্যায় আরম্ভ হতেই তিনি নিঃশব্দ পদসঞ্চারে উপস্থিত হয়েছেন সেই অরণ্যভূমিতে, যেখানে পিতৃরাজ্যের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত পাণ্ডবেরা নির্বাসিত হয়ে রয়েছেন। সেই দিন থেকে এই রাজসূয় যজ্ঞ পর্যন্ত সময়ে-অসময়ে ব্যাস কিন্তু পাণ্ডবদের পাশে পাশেই আছেন। তাঁদের স্বাধীন কর্মের ক্ষেত্রে তিনি কোনও বাধা দেন না, সব জায়গায় তিনি অযাচিত উপদেশও বিতরণ করেন না, কিন্তু পিতামহের স্নেহসিক্ত পক্ষপাতটুকু ঠিক তিনি যুধিষ্ঠিরের আনত মস্তকের ওপর সঞ্চিত করে রেখেছেন।

ব্যাস যখন দেখলেন—রাজসূয় যজ্ঞের সুবাদে যুধিষ্ঠির অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত, তখন তিনি বিদায় চাইলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। কৃষ্ণ তখন দ্বারাবতীতে ফিরে গেছেন, দুর্যোধন আর শকুনি তখনও যুধিষ্ঠিরের নবনির্মিত সভা দেখে ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরছেন, ব্যাস এই অবস্থায় সশিষ্য উপস্থিত হলেন সভাসীন যুধিষ্ঠিরের কাছে। যুধিষ্ঠির তাঁকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে স্বর্ণসিংহাসনে বসিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে রইলেন নম্রভাবে। ব্যাস তাঁকে বসালেন আসনে। সভ্ৰাতৃক যুধিষ্ঠিরকে বললেন—ভাগ্যি মানি আজ তুমি এই সাম্রাজ্য পেয়েছ। তোমার জন্য সমস্ত কুরুকুল আজ সমৃদ্ধ হয়েছে। আমি এখানে থেকে তোমাদের অনেক সম্মান-সমাদর লাভ করেছি, এবার আমি তোমার কাছ থেকে বিদায় চাই—আপৃচ্ছে ত্বাং গমিষ্যামি পূজিতো’স্মি বিশাম্পতে।

যুধিষ্ঠির এতকাল ব্যাসের উত্তম সঙ্গ লাভ করে আর তাঁকে ছেড়ে দিতে চান না। বললেন—অনেক অনেক ব্যাপারে আমার সন্দেহ-সংশয় আছে পিতামহ! সেইসব সন্দেহ মুক্ত করার ব্যাপারে আপনি ছাড়া আর তো কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না—তস্য নান্যো’স্তি বক্তা বৈ ত্বামৃতে দ্বিজপুঙ্গব। যুধিষ্ঠির আরও বললেন—এই যে নারদমুনি আমায় নানান উৎপাতের কথা বলে গেলেন, তার মধ্যে রাজা-রাজড়ার উৎপাতও আছে। আমি জিজ্ঞাসা করি—রাজসূয় যজ্ঞের আসরে চেদিরাজ শিশুপাল যে মারা গেলেন, তাতেও কি প্রচ্ছন্ন কোনও উৎপাত ঘটল আমার—অপি চৈদস্য পতনাচ্ছন্নম্ ঔৎপাতিকং মহৎ।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞকে কেন্দ্র করে মগধরাজ জরাসন্ধের পতন এবং তাঁর ডানহাত শিশুপালের মৃত্যু থেকেই ভারতবর্ষের রাজনীতির যে নতুন মেরুকরণ সূচিত হয়েছে, সেটা যুধিষ্ঠির খানিকটা বুঝতে পারছিলেন হয়তো, নইলে সে প্রশ্নটা ব্যাসের সামনে তুললেন কেন? কিন্তু তাঁর রাজসূয় যজ্ঞই যে এ ব্যাপারে ‘টার্নিং পয়েন্ট’ সেটা যুধিষ্ঠির তেমন করে বোঝেননি, যেমনটি বুঝেছিলেন ব্যাস। তিনি অবশ্য এই সরল জ্যেষ্ঠ নাতিটিকে অসরল রাজনীতি বোঝাতে যাননি। বরঞ্চ খানিকটা গাণনিক জ্যোতিষীর মতো অযথা যুধিষ্ঠিরকে ভয় না দেখিয়ে বলেছিলেন—সামনের যে তেরোটা বছর, সে বড় উৎপাতের সময় তোমার। তোমাকেই কেন্দ্র করে এমন একটা যুদ্ধ ভবিষ্যতে লাগবে, যাতে সমস্ত ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস হয়ে যাবে—ত্বমেকং কারণং কৃত্বা…ক্ষয়ং যাস্যতি ভারত। ব্যাস আরও পরিষ্কার করে বললেন—ভবিষ্যতের এই যে সর্বনাশ আসছে, তার একদিকে থাকবে দুর্যোধনের অন্যায় অপরাধ আর অন্যদিকে থাকবে ভীম-অর্জুনের শক্তি—দুর্যোধনাপরাধেন ভীমার্জুনবলেন চ।

এই মহাক্ষয়ের প্রতীক হলেন প্রলয়কালীন রুদ্র-শিব। ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বললেন—রাত্রির শেষ যামে প্রলয়মূর্তি শিবকে তুমি দেখতে পাবে। অর্থাৎ এই মহাক্ষয় অবশ্যম্ভাবী। তবে আমি বলব—এর জন্য তুমি চিন্তা কোরো না; মহাকালের গতি কেউ রোধ করতে পারবে না—মা তৎকৃতে হনুধ্যাহি কালো হি দুরতিক্রমঃ। ব্যাস সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—তোমার মঙ্গল হোক। আমাকে এবার কৈলাসে ফিরে যাবার অনুমতি দাও। তুমি অহঙ্কারশূন্যভাবে তোমার কর্তব্য পালন করে যাও। ইন্দ্রিয় জয় করে স্থিরভাবে এই রাজ্য প্রতিপালন করো—অপ্রমত্তঃ স্থিতো দান্তঃ পৃথিবীং পরিপালয়।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ দেখে সমকালীন রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বেশ ভালই বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাস। তিনি বুঝেছিলেন যে, যুধিষ্ঠিরের ওই বাড়বাড়ন্ত তাঁর শত্রুপক্ষীয় নেতা-নায়কদের মোটেই সহ্য হবে না। গৃহভেদী যুদ্ধ একদিন না একদিন লাগবেই। নিজেরই আত্মজ বংশধরদের মধ্যে এই ক্রমবর্ধমান বিরোধও বোধ হয় আর তাঁর ভাল লাগছিল না। আপাতত তাই তিনি কৈলাসে গিয়ে মুক্তি পেতে চাইলেন। কিন্তু যাবার আগে যুধিষ্ঠিরের যে প্রতিষ্ঠা তিনি দেখেছেন, তার মধ্যেই যে উত্তর-ধ্বংসের বীজ নিহিত ছিল, সে কথাটা খুব ভালভাবে ধরা আছে মহাভারতের পরিশিষ্ট বলে পরিচিত হরিবংশে। সেখানে দেখছি—পাণ্ডবদের প্রপৌত্র জনমেজয় তাঁর পূর্বপুরুয যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের ব্যাপারে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। দূরনিরপেক্ষ দৃষ্টিতে ইতিহাসের ফলাফল খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে বলেই যুধিষ্ঠিরের এই উত্তরপুরুষ জনমেজয় বুঝে গেছেন যে, রাজসূয়ের যজ্ঞাগ্নি থেকেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সূচনা হয়েছে, সেখানেই কুলক্ষয়ের আরম্ভ—হেতুঃ কুরূণাং নাশস্য রাজসূয়ো মতো মম।

ক্ষুব্ধ জনমেজয় কিন্তু পিতামহের পিতামহ ব্যাসকেই দায়ী করেছেন এ ব্যাপারে। বলেছেন—কেন আপনি আমার প্রপিতামহ যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে বারণ করেননি—রাজসূয়ো মহাযজ্ঞঃ কিমর্থং ন নিবারিতঃ? জনমেজয়ের প্রশ্নবাণে জর্জরিত এই অতিবৃদ্ধ প্রপিতামহ খুব ভাল জবাব খুঁজে পাননি। শুধু বলেছেন—নিঃসন্দেহে রাজসূয় যজ্ঞই যুধিষ্ঠিরের কাল হয়ে দাঁড়াল এবং আমি বারণ করলেও যুধিষ্ঠির এই যজ্ঞ বন্ধ করতেন না। কেননা কাল হল এমনই এক বস্তু যার চালনায় মানুষ বিপরীত আচরণ করে, তোমার পূর্বপিতামহরাও কালপ্রেরিত হয়েই যা করা উচিত ছিল না তাই করেছেন—কালেন বিপরীতাস্তে তব পূর্বপিতামহাঃ।

সত্যিই, বাসের কথাই সত্যি বটে। মহাভারতে দেখি—নারদ ইত্যাদি মুনি-ঋষিরা যুধিষ্ঠিরকে রাজসূয় যজ্ঞ করতে বললেন আর যুধিষ্ঠিরও যেন নেচে উঠলেন। ভীম এবং অর্জুনের শক্তি ছিল এবং তার সঙ্গে জুটল কৃষ্ণের বুদ্ধি। কৃষ্ণের মতো অতিবুদ্ধি ব্যক্তিও যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করেছিলেন জরাসন্ধের কথা বলে। কিন্তু সতর্ক করলেও তিনি রাজসূয় বারণ করেননি। মাঝখান থেকে জরাসন্ধ কৃষ্ণের বুদ্ধিতে মারা গেলে রাজসূয় যজ্ঞের দিগ্‌বিজয় পর্ব খুব সহজ হয়ে গেল বটে, কিন্তু জরাসন্ধের মৃত্যুর পরে রাজনৈতিক একটা ‘পোলারাইজেশন’ তৈরি হয়ে গেল, যা রোধ করা সম্ভব ছিল না। ব্যাস অসাধারণ একটি কথা বলেছেন এইখানে। বলেছেন—আমাকে তো যুধিষ্ঠির রাজসূয়ের ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্বন্ধে একটি কথাও জিজ্ঞাসা করেননি। আর জিজ্ঞাসা না করলে আমি কোনও কথা বলি না—ন মাং ভবিষ্যং পৃচ্ছন্তি ন চাপৃষ্টো ব্রবীম্যহম্‌।

রাজসূয় যজ্ঞের সময় যুধিষ্ঠিরের যত জিজ্ঞাস্য ছিল, তা সবটাই রাজসূয় করা সম্ভব, না অসম্ভব, এই নিয়ে। কিন্তু এই যজ্ঞের রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া যে কত গভীরে, তা যুধিষ্ঠির ব্যাসকে তো সেই সময়ে জিজ্ঞাসা করেনইনি এবং তা নিজেও খুব একটা বোঝেননি। বুঝলে, অমন ছেলেমানুষের মতো ভাইদের কাছে গিয়ে বলতেন না—শুনলে ভাই ব্যাসের কথা! আমাকে নিমিত্ত করেই নাকি এই ক্ষত্রিয়কুল ধ্বংস হবে। এর থেকে আমার মৃত্যু ভাল। ভাইয়েরা সব! এখন থেকে কারও সঙ্গে আর আমি খারাপ ব্যবহার করব না। জ্ঞাতিদের নির্দেশ মেনে চলব। ঝগড়া-বিবাদ দূরে রেখে সকলের প্রিয় আচরণ করব। তা হলেই আর কেউ আমার নিন্দে করবে না—বাচ্যতাং ন গমিষ্যামি লোকেষু মনুজর্ষভাঃ।

যুধিষ্ঠির যেমন বুঝেছিলেন—রাজনীতি জিনিসটা যদি তেমনই সহজ হত, তা হলে কোনও কথাই ছিল না। ব্যাস দেখেছিলেন—যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ শেষ হয়ে যাবার পর সকলে বাড়ি ফিরে গেলেও দুর্যোধন আর শকুনি তখনও রয়ে গেছেন ইন্দ্রপ্রস্থের রাজবাড়িতে। সভাগৃহের এক-একটি নির্মাণকৌশল তিনি দেখছেন এবং ঈর্ষালু হয়ে উঠছেন যুধিষ্ঠিরের ওপর। দুর্যোধনের এই অধিককাল অবস্থিতি কোনও ভাবেই যে ভালবাসার কারণে নয়, এ কথা কি যুধিষ্ঠির একটুও বুঝেছিলেন? কিন্তু ব্যাস নিশ্চয়ই বুঝেছিলেন এবং এসব জ্ঞাতিবিরোধ সইতে না পেরে কৈলাসের শিবভূমিতে গিয়ে শান্তি পেতে চেয়েছিলেন। ব্যাস যেমনটি বুঝেছিলেন, দুই জ্ঞাতিরাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থ এবং হস্তিনাপুরের রাজনীতি সেই পথেই চলল। যুধিষ্ঠিরের রাজ্যশ্রী দুর্যোধনকে ঈর্ষা পরশ্রীকাতরতায় উত্তরোত্তর অসহিষ্ণু করে তুলল। পাশা খেলা হল; যুধিষ্ঠিরের সর্বস্ব হরণ করলেন দুর্যোধন। পিতা ধৃতরাষ্ট্রের সহমতে পাণ্ডবদের বনে পাঠালেন দুর্যোধন। এমনকী বনবাসেও যাতে পাণ্ডবদের ওপর চড়াও হয়ে তাঁদের হত্যা করা যায়, সেজন্য দুর্যোধন-কৰ্ণরা রথ নিয়ে বেরোলেন বনের পথে—নির্যযুঃ পাণ্ডবান্‌ হন্তুং সহিতাঃ কৃতনিশ্চয়াঃ।

পাণ্ডবদের এই অবস্থার খবর নিশ্চয়ই ব্যাসের কাছে পৌঁছেছে। মহাভারত বলেছে—ব্যাস দিব্য চক্ষুতে পাণ্ডবদের নির্বাসন-নির্যাতন দেখতে পেয়ে কৈলাস ছেড়ে চলে এসেছেন। কিন্তু আমরা জানি—ব্যাস তাঁর আত্মজ পুত্র ধৃতরাষ্ট্র এবং দুরাত্মা দুর্যোধনের অন্যায় আচরণ সহ্য করতে না পেরেই তাঁর শান্তির আবাস ত্যাগ করে আবারও নেমে এসেছেন হস্তিনাপুরে। তিনি পাণ্ডবদের কাছে না গিয়ে আগে হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রকে সম্বোধন করে যা বললেন, তার মধ্যে পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর যত মমতা প্রকাশ পেয়েছে, তারচেয়ে অনেক বেশি প্রকট হয়েছে তাঁর বাস্তব বুদ্ধি। এই বাস্তব বুদ্ধির মধ্যে আত্মজ ধৃতরাষ্ট্রের জন্য তাঁর দুশ্চিন্তাও অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বলেছেন—ধৃতরাষ্ট্র! তুমি তো প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বটে। একটু মন দিয়ে শোনো আমার কথা। এ কথা ঠিক যে, পাণ্ডবদের বনগমনের ঘটনায় আমি খুশি হইনি একটুও—ন মে প্রিয়ং মহাবাহো যদাতাঃ পাণ্ডবা বনম্‌। বিশেষত দুর্যোধন-শকুনিরা যেভাবে ছলচাতুরি করে তাদের সর্বস্ব অপহরণ করেছে, তাতে খুশি হওয়ার কারণও নেই।

ব্যাস পাণ্ডবদের ওপর অন্যায়-অত্যাচারের কথা বেশি বাড়ালেন না। কিন্তু এই অপকর্মের ভবিষ্যৎ ফল ধৃতরাষ্ট্রের এবং তাঁর পুত্রদের কতটা বিপদে ফেলবে, তার একটা আভাস দিলেন ব্যাস। বললেন—মনে রেখো, বনবাসের এই অসহ্য কষ্ট পাণ্ডবরা মনে মনে পুষে রাখবে। তারপর তেরো বছর পরে তারা যখন ফিরে আসবে, তখন এই ক্রোধবিষ তারা মুক্ত করবে কৌরবদের ওপরেই—বিমোক্ষ্যন্তি বিষং ক্রুদ্ধাঃ কৌরবেয়েষু ভারত। ব্যাস জানেন—পাণ্ডবদের ওপর এই অত্যাচারের পিছনে দুর্যোধন যতটুকু দায়ী, ধৃতরাষ্ট্রও ঠিক ততখানিই দায়ী। কিন্তু হস্তিনার শাসক রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি সোজাসুজি তিরস্কার না করে দুর্যোধনের নামে সেই তিরস্কারটুকু করেছেন। বস্তুত জন্মান্ধ তথা রাজ্যলোভী ধৃতরাষ্ট্রের ওপরে ব্যাসের অদ্ভুত এক মায়া ছিল। একটি অন্ধ পুত্র অথচ তার বিষয়ভোগের এমন অদম্য ইচ্ছা দেখে ঋষিজনোচিত করুণায় উদ্বেলিত হতেন ব্যাস। হয়তো সেই জন্যই কখনও সোজাসুজি তিনি বলতে পারতেন না যে, দুর্যোধন নয়, তুমি নিজেই আছ এই অপকর্মের পিছনে। তিনি তাই দুর্যোধনের নাম করে ধৃতরাষ্ট্রকে তিরস্কার করেন।

ব্যাস বললেন—তোমার ছেলে দুর্যোধনের বুদ্ধি অত্যন্ত খারাপ—তব পুত্রঃ সুমন্দধীঃ। রাজ্য পাবার লোভে সে সদাসর্বদা পাণ্ডবদের সঙ্গে হিংসা করে যাচ্ছে, তাদের মেরে ফেলারও চেষ্টা করছে সব সময়। আমি বলি কী—এই ছেলেকে তুমি থামতে বলো—শমং গচ্ছতু তে সুতঃ। নইলে একদিন নিজের প্রাণটাই তাকে দিতে হবে। ব্যাস অসাধারণ বাক্য-কৌশলে ধৃতরাষ্ট্রকে আপন গোষ্ঠীভুক্ত করে নিয়ে তাঁকে সাবধান করে বললেন—যেমনটি ভীষ্ম অথবা দ্রোণ, এমনকী যেমনটি আমরাও, তুমিও তো তেমনই এক ভদ্রলোক—তথা সাধুৰ্ভবানপি। কিন্তু পাণ্ডবদের ব্যাপারে তোমার ছেলে যেমন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে, তাতে উদাসীন হয়ে বসে থাকলে খুব অন্যায় হয়ে যাবে। তারচেয়ে তুমি বরং এক কাজ করো—তোমার এই মন্দবুদ্ধি ছেলেটিকে একা বনে পাঠিয়ে দাও। সে পাণ্ডবদের সঙ্গে বনেই থাকুক—অথবায়ং সুমন্দাত্মা বনং গচ্ছতু তে সুতঃ। তাতে পাণ্ডবদের সঙ্গে থাকতে থাকতে যদি তার মধ্যেও ভাব-ভালবাসা জন্মায়, তবেই তুমি বেঁচে গেলে, মহারাজ! নইলে, আমি মনে করি—জন্মানোর পর থেকেই যার যেরকম চরিত্র গঠিত হয়ে যায়, মানুষ না মরা পর্যন্ত সে চরিত্র পালটায় না—নামৃতস্যাপসৰ্পতি। আমি যা বলছি, সে সম্বন্ধে ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুরই বা কী বলেন? তুমিই বা কী মনে করছ?

ঋষি পিতার সামনে ধৃতরাষ্ট্র কোনও কুটিল আচরণ করলেন না। তিনি নিজের দোষ স্বীকার করে নিয়ে বললেন—পাশা খেলার পর যেসব বিপরীত ঘটনা ঘটেছে, তা আমিও কোনওভাবে পছন্দ করতে পারিনি। কিন্তু এ যেন দৈবের দুর্বিপাক, আমাকে দিয়ে সব করিয়ে নিল। ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, গান্ধারী কেউই চাননি পাশাখেলা হোক। কিন্তু পারিনি, দুর্যোধনকে আমি কিছুতেই ত্যাগ করতে পারিনি। পুত্রস্নেহ এমনই এক বস্তু যে, দুর্যোধনের সব অন্যায় জেনেও আমি তাঁকে ত্যাগ করতে পারিনি—পুত্রস্নেহেন ভগবন্‌ জানন্নপি প্রিয়ব্রত।

ব্যাস একটুও তিরস্কার করেননি ধৃতরাষ্ট্রকে। ত্যাগব্ৰতী মহর্ষি হয়েও পুত্রস্নেহেই তো তিনি বার বার রাজগৃহে ফিরে আসেন। মানুষের এই অমল মনের বন্ধন তিনি বোঝেন, তিনি যে কবি। কিন্তু কবির অন্তরের মধ্যে যে ঋষিটি বসে আছেন, তাঁর অন্তরের মধ্যে ভাল-মন্দ, নীতি-অনীতির পরামর্শ চলে সব সময়। তিনি চান পুত্রস্নেহ যেন কোনও পিতা-মাতাকে অন্ধ না করে, যেমনটি করেছে জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রকে। ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রের কথা সাবেগে মেনে নিয়েছেন। তবু ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি সম্বোধন করেছেন কুরুবংশীয় সেই রাজার মর্যাদায়, যাঁর জন্য আত্মজ পুত্র হওয়া সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি আপন পুত্র বলতে পারেন না। ব্যাস তাই স্বাভিমানে বলেছেন—ওহে বিচিত্রবীর্যের ছেলে! বৈচিত্রবীর্য নৃপতে! এই কথাটা তুমি একশো ভাগ সত্যি বলেছ। আমিও ঠিক একই কথাই ভাবি—সংসারে পুত্রস্নেহের বাড়া আর কিছু নেই। সংসারে পুত্ৰই সব চাইতে বড় স্বার্থের বস্তু হয়ে ওঠে—দৃঢ়ং বিদ্মঃ পরং পুত্রং পরং পুত্ৰান্ন বিদ্যতো স্নেহের রাজ্যে পুত্র-কন্যার সর্বাতিশায়িত্ব স্থাপন করেও ব্যাস কিন্তু নিজের মননটুকু ঠিকই বুঝিয়ে দিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে। এই প্রসঙ্গে এমন একটি উদাহরণ তিনি দিলেন, যা আমাদের লৌকিক জীবনে অহরহ দেখি। ব্যাস নিজের স্নেহবৃত্তি বুঝিয়ে দেবার জন্য স্বর্গবাসিনী গোমাতা সুরভির সঙ্গে দেবরাজ ইন্দ্রের যে কথোপকথন হয়েছিল, তার সার কথাটুকু ধৃতরাষ্ট্রের সামনে বললেন।

মহাকাব্যের কল্প অনুযায়ী সুরভি পৃথিবীর সমস্ত গোরুদের আদি-জননী। তিনি নাকি একদিন বসে বসে কাঁদছিলেন। দেবরাজ ইন্দ্র গোমাতার ক্রন্দন দেখে স্বর্গরাজ্যের অমঙ্গলাশঙ্কায় সুরভির উদ্দেশে বললেন কাঁদছ কেন, মা! দেবতা, মানুষ—কার কষ্ট দেখে তুমি কাঁদছ। সুরভি তির্যকভাবে বললেন—আপনার প্রজারা সবাই ভাল আছে। দেবতা, মানুষ সবারই কুশল—কিন্তু আমি কাঁদছি আমার ছেলের কষ্টে। এই বলে সুরভি মর্ত্যভূমির এক বিজন দেশে একটি কৃষিক্ষেত্রের দিকে দেবরাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন। দেখা গেল—একটি কৃষক তার জমিতে হাল দেবার জন্য দুটি বলদ নিয়ে এসেছে। একটি বলদ হৃষ্টপুষ্ট, জোয়াল কাঁধে নিয়ে জমি লাঙল করতে তার কোনও কষ্ট নেই। কিন্তু অন্য বলদটি চেহারাতেও ছোট, রোগা এবং দুর্বল। সারা শরীরে তার শিরা বেরিয়ে গেছে, কিন্তু কৃষক তাকে ছাড়ছে না। লাঙল নিয়ে সে এগোতে পারছে না দেখে কৃষক তাকে বার বার চাবুক মারছে এবং তাকে জোর করে এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে—বধ্যমানঃ প্রতোদেন তুদ্যমানঃ পুনঃপুনঃ।

সুরভি বললেন—আমার এই রোগা ছেলেটার কষ্ট সহ্য করতে পারছি না বলেই আমার চোখে এমন জল আসছে। দেবরাজ সান্ত্বনা দেবার জন্য বললেন—তোমার তো হাজার হাজার ছেলে আছে, আর কৃষকরাও তাদের প্রতিদিনই চাবুক মারছে। তবে ওই একটা ছেলের জন্য অত কষ্ট কীসের? সুরভি বললেন—নিশ্চয়ই। হাজার হাজার ছেলেও আমার আছে, তাদের প্রতি স্নেহদৃষ্টিও আমার সমান। কিন্তু যে ছেলেটা দুর্বল, যে ছেলেটা রোগা-ভোগা তার ওপরেই মায়ের বেশি স্নেহ থাকে—দীনস্য তু সতঃ শক্র পুত্রস্যাভ্যধিকা কৃপা। পুত্রস্নেহ এই রকমই।

ব্যাস এবার নিজের কথায় এলেন। যিনি ভবিষ্যতে মহাভারতের কবি হবেন লৌকিক জীবনের সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুঃখ-সুখ তাঁর নিবিড়ভাবে জানা আছে বলেই কৃষিক্ষেত্রের একটি দুর্বল পীড়িত লাঙলবাহী বৃষও তাঁর কবিজনোচিত বেদনার দৃষ্টি থেকে ভ্রষ্ট হয় না। ব্যাস বললেন—সুরভি যেমনটি জানিয়েছেন, তেমনই তোমারও সব পুত্রদের ওপর সমান ভাবটুকু থাকুক, কিন্তু দুর্বলের ওপর দয়াটা যেন বেশি থাকে তোমার। ব্যাস এবার বিচিত্রবীর্যের সামাজিক পরিচয়ের খোলসটুকু সরিয়ে দিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে পুত্র সম্বোধন করে বললেন—বাছা! আমার কাছে পাণ্ডুও যেমন ছিল, যেমনটি আমার বিদুর, তেমনই তুমিও তো আমার কাছে সেই রকমই—যাদৃশো মে সুতঃ পাণ্ডুস্তাদৃশো মে’সি পুত্রক। কাজেই আমি স্নেহবশতই এ কথা বলছি যে, তোমার তো একশোটি ছেলে, কিন্তু পাণ্ডুর মাত্র পাঁচটি। তারা শঠতা-কুটিলতাও শেখেনি, কাজেই কাজ গুছোনোর ব্যাপারে তাদের পটুত্ব নেই। তোমার ছেলেদের তুলনায় তারা দুর্বল। সেই পাণ্ডুর ছেলেরা কী করে বাঁচবে, কী করে তারা জীবনে বড় হবে—কথং জীবেয়ুরত্যন্তং কথং বধেয়ুরিত্যপি—সেই কথা ভেবে আমি বড় কষ্ট পাই—মনো মে পরিতপ্যতে। ব্যাস এবার চরম কথাটি বললেন ধৃতরাষ্ট্রকে। বললেন—তুমি যে এত পুত্রস্নেহের কথা শোনালে, তাতেই বলি—তুমি যদি তোমার ছেলেদের জীবিত দেখতে চাও, তা হলে ছেলেকে সামলাও, দুর্যোধন পাণ্ডবদের সঙ্গে এই শত্রুতা বন্ধ করুক—যদি পার্থিব কৌরব্যান্‌ জীবমানানিহেচ্ছসি।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন—আপনি যা বলছেন, সবই ঠিক। এমনকী ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুরও ওই একই কথা বলছেন। কিন্তু দুর্যোধন কোনও কথাই শুনছে না। যদি আমার ওপর আপনার অনুগ্রহ থাকে, যদি এই কৌরবকুলের ওপর আপনার দয়া থাকে, তবে আমার মন্দমতি পুত্রটিকে আপনি একটু বোঝান—অনুশাধি দুরাত্মানং পুত্রং দুর্যোধনং মম। ব্যাস বললেন—আমি নয়, দুর্যোধনকে যা বলবার বলবেন ঋষি মৈত্রেয়। তিনি পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করে এই আসছেন আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। তুমি তাঁর কথা অনুসারে চলবার চেষ্টা করো, নইলে মৈত্রেয় মুনি তোমার পুত্রকে অভিশাপ দেবেন, তাতে বিপদ বাড়বে—অক্রিয়ায়ন্তু কার্যস্য পুত্ৰস্তে শপ্স্যতে রুষা।

দ্বৈপায়ন ব্যাস দুর্যোধনের ঠাকুরদাদা। ঠাকুরদাদা জানতেন যে, দুর্যোধনকে তিনি বুঝিয়ে কিছুই করতে পারবেন না। বরঞ্চ তাঁর সঙ্গে কথা বলে যদি ক্রোধ উদ্দীপিত হয়, তবে সেই অবস্থায় কোনও অভিশাপ-বাক্য উচ্চারণ করে তিনি পিতামহের স্নেহ-মর্যাদা অথবা ঋষির গৌরব কোনওটাই নষ্ট করতে চাননি। তাঁর অনুমানও মিথ্যা নয়। মৈত্রেয় মুনি এবং দুর্যোধনের কথোপকথন শোনার জন্য ব্যাস আর কুরুবাড়িতে অপেক্ষা করেননি। অপেক্ষা করলে দেখতে পেতেন—মৈত্রেয়ের মুখে পাণ্ডবদের তথা তাঁদের বন্ধু-সহায় কৃষ্ণের প্রশংসা শুনে দুর্যোধন মাঝে মাঝে উরুতে থাপ্পড় মেরে আস্ফালন করছিলেন, আবার কখনও বা উদাসীনভাবে কিছুই শুনছিলেন না। মৈত্রেয়ের প্রতি নিদারুণ অবহেলা দেখিয়ে দুর্যোধন পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটি খুঁড়ছিলেন অথবা ঈষৎ মাথাটি ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে ছিলেন অন্যদিকে—তমশুশ্রূযমান বিলিখন্তং বসুন্ধরাম্‌।

দুর্যোধন মৈত্রেয়ের মুখে ধ্বংসের অভিশাপ শুনেছিলেন কিন্তু সেই অভিশাপ অথবা দুর্যোধনের সেই অবহেলার ভঙ্গি দেখার জন্য ধৃতরাষ্ট্রের গৃহে দাঁড়িয়ে থাকেননি ব্যাস। পায়ে পায়ে তিনি এসে পৌছেছেন দ্বৈতবনে, যেখানে যুধিষ্ঠির তাঁর ভাইদের সঙ্গে সপরিবারে বনবাসের সাময়িক আশ্রয়ে বিপর্যস্ত হয়ে আছেন। ব্যাস এবং মৈত্রেয়ের গন্তব্যের বিপর্যাস থেকে বোঝা যায়—এই দুই মহান-হৃদয় মুনি প্রথমে কৈলাস থেকে আসার পথেই ঠিক করে বেরিয়ে ছিলেন যে, একজন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যাবেন বোঝাতে, আর অন্যজন পাণ্ডবদের অবস্থা সরেজমিনে দেখে আসবেন। পরে পাণ্ডবদের কাছ থেকে মৈত্রেয় আসবেন ধৃতরাষ্ট্রের বাড়িতে—দুর্যোধনের উদ্দেশে চরম সাবধানবাণী উচ্চারণ করতে এবং ব্যাস যাবেন পাণ্ডবদের শক্তিবৃদ্ধির পথ দেখাতে।

দ্বৈতবনের বনাশ্রয়ে পাণ্ডবদের মধ্যেও তখন এক উত্তপ্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। পঞ্চস্বামী-গর্বিতা দ্রৌপদী স্বামীদের শান্ত ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে সতরক্ষী জ্যেষ্ঠ স্বামীকে খুব তিরস্কার করেছেন। তাঁর ইচ্ছে, সমস্ত সত্য শিকেয় তুলে রেখে কপটাচারী দুর্যোধনকে এখনই আক্রমণ করা হোক। দ্রৌপদীর কথার সূত্র ধরে ভীম আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে যুদ্ধের পথেই এগোতে বললেন যুধিষ্ঠিরকে। বহু-তিরস্কৃত যুধিষ্ঠির সুগভীর রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলে ভীমকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু খুব যে সফল হলেন, তা নয়। কিন্তু তাঁর কথার মধ্যে অসাধারণ কিছু যুক্তি ছিল এবং সে যুক্তি ভীম পর্যন্ত উড়িয়ে দিতে পারেননি। যুধিষ্ঠির কৌরব-রাজনীতির মেরুকরণ পরিষ্কার করে দিয়ে বলেছিলেন—ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণের মতো ভয়ংকর যোদ্ধারা দুর্যোধনের পক্ষে যুদ্ধ করবেন এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার মতো শক্তি এখনও পাণ্ডবদের নেই। কাজেই অপেক্ষা করতেই হবে। ঠিক এইরকম একটা তর্কযুক্তির উত্তপ্ত পরিবেশের মধ্যে দ্বৈপায়ন ব্যাসের আগমন ঘটেছে দ্বৈতবনে যুধিষ্ঠিরের অরণ্য-কুটিরে।

ব্যাস যুধিষ্ঠিরের দুর্ভাবনার কথাগুলি শুনেছেন মনোযোগ দিয়ে এবং যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছেন—তোমার মনের দুর্ভাবনার কথা আমি জানি—বেদ্মি তে হৃদয়স্থিতম্‌। সেই জন্যই তাড়াতাড়ি করে এলাম। দেখো, ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা অথবা স্বয়ং দুর্যোধনের যুদ্ধশক্তির ব্যাপারে যে আশঙ্কা এবং ভয় তোমার মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, আমি বেদবিহিত মন্ত্রের মাধ্যমে সে ভয় দূর করে দিচ্ছি। এরপর ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে নির্জনে নিয়ে গিয়ে বললেন—বনবাসের কাল কেটে গেলেই তোমার ভাল সময় আসবে—শ্রেয়সস্তে পরঃ কালঃ প্রাপ্তো ভরতসত্তমঃ। আমি তোমাকে ‘প্রতিস্মৃতি’ নামে এক বিদ্যা শিখিয়ে দেব এবং সেই বিদ্যা মূর্তিমতী সিদ্ধির মতো। তোমার কাছ থেকে অর্জুন এই বিদ্যা শিখে নিয়ে দিব্য অস্ত্র লাভ করার জন্য ইন্দ্র, রুদ্র, বরুণ, কুবের এবং যমের সাক্ষাৎ পাবে এবং তাঁদের কাছ থেকে দিব্য অস্ত্র লাভ করে ভবিষ্যতে যুদ্ধজয়ের অভীষ্ট কাজ সম্পন্ন করবে।

লক্ষণীয়, যে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে ‘প্রতিস্মৃতি’ বিদ্যা শিখে ভবিষ্যতে শিবকে তুষ্ট করে পাশুপত অস্ত্র লাভ করবেন, ব্যাস কিন্তু সেই অর্জুনকে সোজাসুজি ‘প্রতিস্মৃতি’-বিদ্যা শেখালেন না। শেখালেন যুধিষ্ঠিরকে। কেন? প্রশ্ন উঠেছে—কেন যুধিষ্ঠিরকে এই বিদ্যা দান করলেন ব্যাস। টীকাকারেরা উত্তর দিয়েছেন—যুধিষ্ঠির স্বভাবতই সংযতেন্দ্রিয় ব্যক্তি। বৈদিক মন্ত্র ধারণের জন্য যে শম-দমাদি সাধন প্রয়োজন, যুধিষ্ঠিরের তা এমনিই আছে। অর্জুন যদি এই মন্ত্র গ্রহণ করতে চান, তবে তাঁকে সেই শম-দমের সাধন অভ্যাস করে কিছুকাল পরে সেই মন্ত্র গ্রহণ করতে হবে। ব্যাস অতকাল পাণ্ডবগৃহে অবস্থান করবেন না। তিনি আবারও তপস্যায় মনঃসংযোগ করবেন। অতএব যুধিষ্ঠিরকে তিনি ইন্দ্রদেবতার তুষ্টিজনক ‘প্রতিস্মৃতি’-মন্ত্র দান করলেন। কেমন যুধিষ্ঠিরকে? মহাভারত বলছে—প্রপন্নায় শুচয়ে। অর্থাৎ বিদ্যালাভের জন্য যিনি প্রপন্ন, শরণাগত। আরও কেমন? যিনি দেহে মনে পবিত্র, শুচি—শুচয়ে ভগবান্ প্রভুঃ। বিদ্যালাভের পর যুধিষ্ঠির নিজে সেই বিদ্যা অভ্যাস করতে লাগলেন। সংযতচিত্তে, বিদ্যা ধারণ করলেন মেধাবী শিষ্যের মতো—ধারয়ামাস মেধাবী…তদ্‌ব্রহ্ম মনসা যতঃ।

প্রতিস্মৃতি বিদ্যা যুধিষ্ঠিরকে শিখিয়ে ব্যাস চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু যাবার আগে যুধিষ্ঠিরকে এমন সুন্দর একটি উপদেশ দিয়ে গিয়েছিলেন যা শুনলে এখনকার দিনের চিন্তাকীর্ণ মানুষেরা ব্যাসকে নতুন আলোকে চিনতে পারবেন। ব্যাস বলেছিলেন—একই বনে অনেক দিন থেকো না রাজা। এ বন সে বন ঘুরে বেড়াও। এক জায়গায় দীর্ঘকাল থাকা কারও পক্ষেই আনন্দজনক হয় না—একত্র চিরবাসো হি ন প্রীতিজনকো ভবেৎ। এই কথাটাই একটা দর্শন। ব্যাসের এই দর্শন পরিব্রাজক সন্ন্যাসীর দর্শন। সত্যি ব্যাসকে আমরা কখনও এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে দেখিনি। এই তিনি এই তীর্থে তপস্যা করছেন তো কিছুদিন পরে পরেই তিনি হস্তিনায় আসছেন। আবার সেখানেও তিনি বেশিদিন থাকেন না। কখনও বদরিকাশ্রম, কখনও কৈলাস, কখনও ইন্দ্রপ্রস্থ, কখনও বা বনে বনে নিরন্তর ঘুরে বেড়ানো। বেদোপনিষদের কবি লিখেছিলেন—চরৈবেতি, চরৈবেতি—চলো, চলতে থাকো। এক জায়গায় বসে থেকো না। চলতে চলতেই একদিন সেই মধুবিদ্যা লাভ করবে—চরন্ বৈ মধু বিন্দেত। ব্যাসকে আমরা এই চলার মন্ত্রে দীক্ষিত দেখেছি। এক জায়গায় থাকলে, সেখানকার গুণ-দোষ মানুষকে প্রভাবিত করে, জায়গাটার ওপর মায়া হয়, বন্ধন আসে, সংকীর্ণতা আসে। চৈতন্য পার্ষদ সনাতন গোস্বামীর কথা পড়েছি। তিনি এক গাছের তলায় একদিনের বেশি থাকতেন না, যদি সেই বৃক্ষতলটির ওপর মায়া জন্মায়!

ব্যাস সনাতনের মতো সন্ন্যাসী নন। মায়ের আদেশে তিনি পুত্র উৎপাদন করেছেন, কিন্তু তাঁদের মায়ায় তিনি হস্তিনায় বসে থাকেননি। তিনি পরিব্রাজকের মতো ঘুরে বেড়ান মধুতত্ত্বের সন্ধানে, আবার সংসারের গণ্ডীর মধ্যে এসে উপদেশও দেন ধর্মসংকটে। সেই উপদেশের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরকে চরৈবেতি-র মন্ত্রও শেখান—এক জায়গায় দীর্ঘকাল থাকা তাঁর পছন্দ নয়। পছন্দ না হওয়ার যে কারণটা, তা শুনলে আজকের পরিবেশবিদ পণ্ডিতেরা ব্যাসকে ধন্য ধন্য করবেন। ব্যাস বললেন—দেখ বাছা! এক বনে বেশিদিন থাকলে সে বনের পরিবেশ নষ্ট হয়, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট হয়। এক বনে বেশিদিন থাকলে খাদ্য হিসেবে পশুর বিনাশ ঘটবে। বৃক্ষ-লতা-ওষধির বিনাশ—মৃগাণামুপযোগশ্চ বীরুধোষধিসংক্ষয়ঃ। ব্যাস বলেছেন—বাছা যুধিষ্ঠির! এতদিন তোমরা একই বনে থাকছ মানে অরণ্যবাসী ঋষি মুনিদের মনে উদ্‌বেগ সৃষ্টি করছ। তপস্যাক্লান্ত মুনি ঋষিদের উদর ভরণের জন্য যতটুকু ফলমূল আহরণ করা প্রয়োজন, সেই প্রয়োজনে তাঁদের ব্যাঘাত ঘটবে, যদি তোমরাই এখানকার ফলমূল-খাদ্য শেষ করে দাও। তাই বলছিলেম—এই বন ছেড়ে এবার অন্য বনে আশ্রয় নেবার ভাবনা করো—বনাদস্মাচ্চ কৌন্তেয় বনমন্যদ্‌ বিচিন্ত্যতাম্‌।

পিতামহ ব্যাসের পরামর্শ শুনে যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে দ্বৈতবন ছেড়ে কাম্যক বনে চলে গেলেন, বনে বনে ঘুরতে থাকলেন। আমাদের ধারণা— বন থেকে বনান্তরে যুধিষ্ঠিরকে ঘুরতে উপদেশ দিয়ে ব্যাস আরও একটা কাজ সমাধা করেছেন। তিনি জানতেন—দুর্যোধন বনবাসী যুধিষ্ঠিরকেও ভয় পান। তাঁকে মারবার পরিকল্পনাও ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। এক বনে বেশি দিন থাকলে কৌরবরা অসহায় পাণ্ডবদের মাঝে মাঝেই উত্ত্যক্ত করতে পারেন এবং তাঁরা যে উত্ত্যক্ত করতে চাইছিলেনও—সে উদ্যোগ ব্যাস দেখেছেন। হয়তো দুর্যোধনের এই পূর্বপরিকল্পনার কথা মাথায় রেখেই ব্যাস পাণ্ডবদের বন থেকে বনান্তরে ঘুরে বেড়াতে বলেছেন।

বনবাস চলাকালীন সময়ে যখন দ্বিতীয়বার ব্যাস পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তখন এগারো বছর পার হয়ে গেছে। বড় কষ্টেই তাঁদের এতদিন কেটেছে। সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির তাঁর সত্য থেকে বিচ্যুত হননি। কিন্তু ভাইদের কষ্ট দেখে, দ্রৌপদীর মনোব্যথা অনুভব করে তিনিও মনে মনে কষ্ট কম পাচ্ছিলেন না। রাত্রে তাঁর ঘুম হয় না ভাল করে। পাশাখেলায় নিজের অপরাধের কথা স্মরণ করে অনুতাপে দগ্ধ হয় তাঁর হৃদয়—ন সুষ্বাপ সুখং রাজা হৃদি শল্যৈরিবার্পিতঃ। ভীম এবং দ্রৌপদী যদিও যুধিষ্ঠিরের শান্ত-বিজ্ঞ স্বভাব সব সময় মানতে পারেন না, তবুও তাঁরা যুধিষ্ঠিরের সম্মানার্থে বনবাসের কষ্ট সহ্য করে চলেছেন নিঃশব্দে। ফলমূল খেয়ে তাঁদের দিন কাটে, অশন-বসন-শয়নও ভাল জোটে না, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের দুঃখিত মুখের দিকে তাকিয়ে এবং দুঃখের দিনের অবসান ঘটতে আর তেমন দেরি নেই বলেই সমস্ত ভাইরা এবং দ্ৰৌপদীও সব দুঃখ সইছিলেন বড়মুখ করে—যুধিষ্ঠিরমুদীক্ষন্তঃ সেহুর্দুঃখমনুত্তমম্।

ঠিক এইরকমই এক দুঃখসহা দিনে মহর্ষি ব্যাস এসে পৌঁছোলেন কাম্যক বনে। দূর থেকে তাঁকে দেখতে পেয়েই যুধিষ্ঠির এগিয়ে গিয়ে তাঁকে ধরে বসালেন আসনে। পিতামহ ব্যাস দুঃখকষ্টে রোগা হয়ে যাওয়া নাতিদের দেখে মনে বড় ব্যথা পেলেন—তানবেক্ষ্য কৃশান্ পৌত্রান্‌ বনে বন্যেন জীবতঃ। অনভ্যস্ত আরণ্যক জীবন কাটাতে গিয়ে রাজপুত্রদের যে যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে, সেটা দেখে পিতামহ ব্যাসের চোখে জল ভরে এল—অব্রবীদ্‌ বাস্পগদ্‌গদম্। ব্যাস যুধিষ্ঠিরের ধৈর্য দেখে, সুখে দুঃখে তাঁর নির্বিকার চেতনা দেখে ভূয়সী প্রশংসা করে বললেন—বাছা! তপস্যার কৃচ্ছ্রতা ছাড়া জগতে কোনও সুখ লাভ করা যায় না। সবচেয়ে বড় কথা—সুখ জিনিসটা কখনও নিরবচ্ছিন্ন নয়। ক্রমিক পর্যায়ে সুখ আসে, দুঃখ আসে। সুখ যখন আসে, তখন ভোগ করবে, আবার দুঃখ যখন আসবে, তখন সেটা সহ্য করতে হবে—সুখমাপতিতং সেবেদ্‌ দুঃখমাপতিতং সহেৎ। ঠিক যেমন কৃষক। বৎসরের সব ঋতুতেই সে সমান শস্য পায় না। সে যেমন বেশি শস্য পেলে সুখ ভোগ করে এবং কম পেলে সহ্য করে, মানুষকেও তেমনই পর্যায়ক্রমে ভোগ এবং সহ্য করতে হবে—কালপ্রাপ্তমুপাসীত শস্যনামিব কর্ষুকঃ।

আজকের দিনে যাঁরা মুনি ঋষি এবং রাজাদের সামন্ত্রতন্ত্রের বাহক বলে গালাগালি দেন, তাঁরা ব্যাসের এই উপমাটির কথা ভাববেন। দৈনন্দিন জীবনে সুখ-দুঃখের ভোগ এবং যন্ত্রণায় যে কৃষকের জীবনটাই আদর্শ, সেটা কিন্তু বলছেন একজন ব্রাহ্মণ ঋষি এবং সেটা যিনি শুনছেন তাঁর চরণদুটি কিন্তু ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভায় বহু রাজন্যবৃন্দের মুকুটমণির রক্তিম আভায় রঞ্জিত হত। তবু কৃষক জীবনের এই বাস্তব সত্য বোঝানোটাই কিন্তু ঋষি-পিতামহের অভীষ্ট নয়। তিনি যুধিষ্ঠিরকে ভারতীয় ধর্ম, দর্শন, ত্যাগ, সত্য এবং তপস্যার পথ বেয়ে সুখভোগের দুয়ারে পৌঁছোতে বলেছেন। ব্যাস মনে করেন—তপস্যার কৃচ্ছ্রতা সাধন করে যা পাওয়া যায়, সেটাই হল মহৎ পাওয়া—তপসো হি পরং নাস্তি তপসা বিন্দতে মহৎ। জীবনে সুখভোগ করার জন্য যথেচ্ছাচার পছন্দ করেন না ব্যাস। অন্যায়ভাবে যে ধনসম্পত্তি উপার্জন করা যায়, তার মধ্যে কোনও মহত্ত্ব দেখতে পাননি তিনি। আর ধনলাভের জন্য অপরের দাসত্ব করা কিংবা জীবন পণ করে ধন উপার্জন করার মধ্যেও ব্যাসের কোনও সম্মতি নেই। ব্যাস যুধিষ্ঠিরকেই সমর্থন করে বলেছেন—সত্য, ঋজুতা, অনসূয়া, দান, অহিংসা এইগুলিই মনুষ্যজীবনের অঙ্গ হওয়া উচিত এবং এইগুলিই হল তপস্যা। এমন তপস্যার মাধ্যমে যিনি সুখলাভ করেন, তিনি সুখেরও অনিত্যতা বোঝেন, দুঃখেরও অনিত্যতা বোঝেন। আর এই অনিত্যতা যিনি বোঝেন, রাজ্যলাভ করেও তিনি পরমার্থ লাভ করেছেন মনে করেন না, আবার বনবাস করেও তিনি সব হারিয়েছেন বলে মনে করেন না।

প্রায় ভগবদ্‌গীতার মতো উপদেশ দিয়েও ব্যাস কিন্তু গীতার ভগবানের মতোই বাস্তববাদী। ব্যাস মনে করেন—যার যা কাজ সেটি করে যেতেই হবে। তার ফলও পাওয়া যাবে সময়ে। যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে তিনি বলেছেন—তুমি তোমার সমৃদ্ধ রাজ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়েছ বটে, কিন্তু যে কৃচ্ছ্রসাধন এবং তপস্যা তোমরা করে যাচ্ছ তাতে একদিন সে রাজ্য তুমি ফিরে পাবেই—রাজ্যাৎ স্ফীতাৎ পরিভ্রষ্টস্তপসা তদবাপ্স্যসি।

ব্যাসের কথা শুনে বনবাস-তপ্ত পাণ্ডবরা মনে শান্তি পেলেন অনেকটা। পিতামহ ব্যাসও শুষ্কপ্রায় শস্যের গায়ে বৃষ্টির ছোঁয়া লাগানোর মতো সান্ত্বনাবারি সেচন করে পাণ্ডবদের পুনরুজ্জীবিত করে পুনরায় চলে গেলেন তপস্যায়। তপস্যার একটা তেজ আছে। শম-দম-সাধনের তেজস্ক্রিয়তা এমনভাবেই কাজ করতে থাকে যাতে অন্য পক্ষ—যিনি তাঁর উপদেশ শোনেন, তাঁর মধ্যেও সেই তেজ কাজ করতে থাকে। ব্যাসকথিত সত্য এবং ধর্মের তত্ত্ব যুধিষ্ঠিরকে এমনই এক অন্তরশক্তি দিয়েছিল, যাতে যুদ্ধের উদ্যোগপর্বে আমরা তাঁকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখতে পাই। পাণ্ডবদের বনবাস, অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে যাবার পর যুদ্ধের প্রসঙ্গ বার বার উঠে আসছে এখন। ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে শান্তির জন্য পাঠালেও যুধিষ্ঠির কিন্তু এখন তাঁর প্রাপ্যটুকু সজোরে উচ্চারণ করছেন এবং তাঁর প্রাপ্য না পেলে ক্ষত্রিয়ের ধর্মানুসারে যুদ্ধ যে হবেই—সেটাও স্পষ্টই উচ্চারণ করছেন। সঞ্জয়ের সন্ধিপ্রস্তাবের পিছনে ধৃতরাষ্ট্রের যে কূট প্রস্তাব আছে অর্থাৎ তিনি মুখে সন্ধির কথা বললেও রাজ্য ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে যে তিনি নিস্তব্ধ থাকবেন—এটা যুধিষ্ঠির বুঝে গেছেন এবং তা ব্যক্ত করতেও ছাড়ছেন না। এতকাল সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকার ফলেই যে যুধিষ্ঠিরের মনে এই শক্তি এসেছে, হয়তো ব্যাস এটাকেই তপস্যা বলেছিলেন।

সঞ্জয় যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে কথা বলে ফিরে আসলে ধৃতরাষ্ট্র বার বার তাঁকে পাণ্ডবপক্ষের বলাবল সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে লাগলেন। বোঝা যায়—তাঁর সন্ধির প্রস্তাবটি মেকি ছিল এবং সঞ্জয়কে যুধিষ্ঠিরের কাছে পাঠিয়ে তাঁর যুদ্ধশক্তিটুকুই জেনে নিতে চাইছিলেন তিনি। এ-প্রসঙ্গে অবশ্যই অর্জুনের অসম্ভব যুদ্ধক্ষমতা এবং পুরুষোত্তম কৃষ্ণের শক্তির কথাও এল। ধৃতরাষ্ট্র রাজসভায় বসে সঞ্জয়ের বক্তব্য শুনেছিলেন, কিন্তু দুর্যোধনের বিজয়লাভই যেহেতু তাঁর আকাঙ্ক্ষিত ছিল, তাই সঞ্জয়কে তিনি নির্জনে ডেকে এনে একাকী অবস্থায় জিজ্ঞাসা করতে লাগলেন পাণ্ডবদের শক্তি সম্বন্ধে। জিজ্ঞাসা করে বললেন—ঠিক করে বলো তো সঞ্জয়! ওদের যুদ্ধশক্তিই বেশি, নাকি তা আমাদের চাইতে কম—কিমেষাং জ্যায়ঃ কিন্নু তেষাং কনীয়ঃ? সঞ্জয় ধৃতরাষ্ট্রকে চেনেন। তিনি জানেন—সভাস্থলে ধৃতরাষ্ট্র একরকম, নির্জনে তিনি আর একরকম। তিনি বললেন—না মহারাজ! নির্জন স্থানে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলব না, তা হলে আমার ওপর অসূয়া সৃষ্টি হবে আপনার। ভাববেন—আমি বুঝি পাণ্ডবদের পক্ষ হয়ে কথা বলছি। তারচেয়ে আপনার সামনে ডাকুন আপনার মহাতপস্বী পিতাকে, ডাকুন মহিষী গান্ধারীকে—আনয়স্ব পিতরং মহাব্রতং/গান্ধারীঞ্চ মহিষমাজমীঢ়। এঁরা দুজনেই ধর্মজ্ঞ ব্যক্তি, সমস্ত বিষয়েই তাঁরা নিপুণ। তাঁদের সামনেই আমি কৃষ্ণ এবং অর্জুনের বক্তব্য নিবেদন করতে পারি, নইলে নয়।

অগত্যা ধৃতরাষ্ট্রের কথায় বিদুর গিয়ে কোথা থেকে ধরে নিয়ে আসলেন ব্যাসকে। যুদ্ধের প্রস্তুতি যখন দুপক্ষেই চলছে, তখন আর তিনি তপস্যায় রত থাকতে পারেননি। চলে এসেছেন হস্তিনাপুরে। কিন্তু তিনি তো নিজে থেকে কিছু বলবেন না। তাঁকে ডেকে আনলেন বিদুর। গান্ধারীও এলেন সঞ্জয়ের আগ্রহাতিশয্যে। ব্যাস এসেই সঞ্জয়কে বললেন—তুমি সব বলো ধৃতরাষ্ট্রকে। যা তিনি শুনতে চান, কৃষ্ণ, অর্জুন যা যা তোমাকে বলেছে, সব বলো—আচক্ষ্ব সর্বং যাবদেষো’নুযুঙ্‌ক্তে। সঞ্জয় বলে চললেন কৃষ্ণ এবং অর্জুনের শক্তিমত্তার কথা এবং বেশি করে জানালেন কৃষ্ণের অলৌকিক দিব্য প্রভাবের কথা।

সঞ্জয় ভেবেছিলেন—মহান পিতা এবং ধর্মজ্ঞা মহিষীর সামনে ধৃতরাষ্ট্রকে সব কথা জানালে তিনি হয়তো খানিকটা আত্মস্থ হবেন। কিন্তু কিসের কী! ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী দুর্যোধনকে শত বুঝিয়েও কিছু করতে পারলেন না। ব্যাস কৃষ্ণের অলৌকিক প্রভাব নিয়ে অনেক বক্তৃতা দিলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। আপাতত মনে হল যেন ধৃতরাষ্ট্রও প্রভাবিত হয়েছেন ব্যাসের কথায়। সমকালীন সময়ে পৃথিবীর নায়কের ভূমিকায় যিনি অবতীর্ণ হন সেই নায়ককে সকলে চিনতে পারেন না, কিন্তু বয়স কম হলেও অধিদৃষ্টিসম্পন্ন ঋষি তাঁকে ঠিক চিনতে পারেন। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সেই জন্যই কৃষ্ণের প্রশংসায় তিনি পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাস জানতেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের এই আপাত চৈতন্যোদয় অথবা শ্মশান-বৈরাগ্য বড়ই সাময়িক। দুর্যোধনের ওপর তাঁর স্নেহান্ধতা এমনই দুর্দম যে সত্যকে তিনি মেনে নিতে পারবেন না। অন্যদিকে আত্মজ পুত্রের এই অন্যায় অন্ধতা ব্যাস মেনে নিতে পারেননি বলেই উপমার অঙ্গুলি-আস্ফালনে পুত্রকে সচেতন করে দিয়ে তিনি বলেছেন—একজন অন্ধ ব্যক্তি যদি আর-এক অন্ধকে পথ দেখায়—অন্ধনেত্রা যথৈবান্ধৈঃ নীয়মানাঃ স্বকর্মভিঃ—তা হলে যে অবস্থা হয়, তোমার অবস্থাও হয়েছে সেইরকম। অর্থাৎ লোভে-ক্রোধে অন্ধ দুর্যোধন স্নেহান্ধ পিতাকে যেভাবে নিজের অনুকূলে ব্যবহার করছেন, ধৃতরাষ্ট্রের তা বোঝবারও শক্তি নেই। ব্যাস বললেন—কৃষ্ণ মানুষটা তোমার অপরিচিত কোনও ব্যক্তি নয়। সে তোমাকে শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। তার ওপরে সঞ্জয়ের মতো একজন বিশ্বস্ত ব্যক্তি তোমার দৌত্যকার্য করছে, সেও কৃষ্ণকে জানে ভাল। কাজেই তোমার সামনে একটাই পথ—এষ একায়নঃ পন্থাঃ—কৃষ্ণের কথা শুনলেই এই বিশাল মৃত্যু তুমি অতিক্রম করতে পারবে।

ধৃতরাষ্ট্র সব বুঝেও দুর্যোধনের বুদ্ধিতে কিছুই শোনেননি। শান্তির কার্যে প্রেরিত কৃষ্ণের আপ্যায়নের জন্য নগর থেকে নগরনটী সবাইকে সাজিয়ে সম্পূর্ণ কপটতায় তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন কৃষ্ণের জন্য। বিদুর সব বুঝেছিলেন। বুঝেই বলেছিলেন—আপনি যে এত সব ব্যবস্থা করেছেন, এর সবটাই ছল, মায়া। ধর্মের জন্যও নয়, কৃষ্ণের ভাল লাগার জন্যও নয়, যা আপনি করেছেন, সবটাই প্রলোভনের পদ্ধতি। এই প্রলোভনে কৃষ্ণ ভুলবেন না। দুর্যোধন-ধৃতরাষ্ট্রের এই মানস-চক্রান্ত ব্যাসও বুঝেছিলেন। সেই জন্যই আর তিনি অপেক্ষা করেননি হস্তিনাপুরে। এক অন্ধকে তিনি চলতে দিয়েছেন আর এক অন্ধের সঙ্গে। তিনি জানেন—ধৃতরাষ্ট্র সেই জাতের মানুষ, যিনি দেখে কিংবা শুনে শিখবেন না, ঠেকে শিখবেন।

কোনও ভাবেই যুদ্ধ রোধ করা গেল না। কৃষ্ণের দৌত্য বিফল হল। কুরুমুখ্যদের কোনও উপদেশই দুর্যোধন শুনলেন না। যুযুধান দুই পক্ষই শেষ পর্যন্ত কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে পরস্পরের মুখোমুখি হলেন। আসন্ন যুদ্ধের খবর ব্যাসের কানে গেছে। তিনি অবিলম্বে কুরুক্ষেত্রে পৌঁছে দেখলেন—পুব দিক জুড়ে কৌরব সৈন্য-সেনাপতিরা দাঁড়িয়ে আছেন, আর পাণ্ডবরা সসৈন্যে অবস্থিত আছেন পশ্চিম দিক জুড়ে। ব্যাস সব দেখলেন অনেকক্ষণ সময় নিয়ে—ততঃ পূর্বাপরে সৈন্যে সমীক্ষ্য ভগবান্ ঋষিঃ। আসন্ন এই যুদ্ধের ফল চোখের সামনে যেন তিনি দেখতে পেলেন। যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে তিনি উপস্থিত হলেন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। এতদিন পুত্রের স্বার্থ অনুসারে পথ চলতে চলতে সামনে এই ভয়ংকর যুদ্ধ উপস্থিত হতে দেখে এখন কিন্তু তিনি উদ্‌বিগ্ন। ছেলেদের এতকালের অন্যায় এবং দুর্নীতির কথা স্মরণ করে তাঁর এখন ভয় করছে।

আর্ত, চিন্তিত ধৃতরাষ্ট্রের কাছে উপস্থিত হয়ে ব্যাস বললেন—মহারাজ! তোমার ছেলেদের এখন শেষ সময় উপস্থিত। অন্যান্য রাজারাও এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরস্পর হানাহানি করে মরবে। এমন যদি দেখ—মহাকালের বিপরীত আচরণে তোমার ছেলেদের অন্তিম কাল ঘনিয়ে এল, তা হলে যেন তুমি কষ্ট পেয়ো না। তুমি ভেবো—মহাকালের গতিতেই এই দুর্গতি ঘটেছে—কালপর্যায়মাজ্ঞায় মাস্ম শোকে মনঃ কৃথাঃ। তুমি যদি চাও, তা হলে এই সম্পূর্ণ যুদ্ধরঙ্গ দেখবার জন্য আমি তোমাকে চক্ষুদান করতে পারি—চক্ষুর্দদানি তে পুত্র যুদ্ধমেতন্নিশাময়। বড় সাংঘাতিক এই প্রস্তাব। আজন্ম যিনি অন্ধ, যিনি অন্ধতার জন্য রাজত্ব পেলেন না, অন্ধতার জন্য যিনি চক্ষুষ্মান্‌ ব্যক্তির প্রাপ্য সমস্ত সুখ থেকে বঞ্চিত, সেই ধৃতরাষ্ট্রকে এতকাল কেউ চক্ষুদান করেনি, আজ অথচ সেই প্রিয় পুত্রদের নিশ্চিত মৃত্যু দেখবার জন্য দৃষ্টি দিতে চাইছেন ব্যাস। এ কেমন সাংঘাতিক প্রস্তাব!

ব্যাসের শাস্তি বোধ হয় এইরকমই। ব্যাস জানেন—অন্ধত্বের জন্য ধৃতরাষ্ট্র রাজ্য পাননি বটে, কিন্তু হস্তিনাপুরের রাজা হয়ে আছেন তিনিই। সেই পাণ্ডবদের বনপ্রস্থানের আগে থেকে এখনও পর্যন্ত রাজ্যের অধিকার ভোগ করছেন তিনিই। কিন্তু অন্ধ অবস্থাতেও যাঁর রাজ্যলোভ এমন, তিনি চক্ষুষ্মান অবস্থায় রাজা হলে তো সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী হতেন। তা ছাড়া ব্যাস নিজ পুত্রের প্রারব্ধ কর্ম লঙঘন করার জন্য নিজের অলৌকিক বিভূতি প্রয়োগ করবেন না। চক্ষুদানের প্রস্তাব তিনি সেই সংকটকালে করেছেন, যখন প্রতি মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্রের ‘টেনশন’ থাকবে—আমার ছেলেরা যুদ্ধ জিতল কি? ব্যাস তাঁকে এই উদ্‌বেগ থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। তার চেয়েও বড় কথা বোধহয় এটাই যে, যিনি কারও কোনও বৃদ্ধমত না শুনে অন্ধের মতো নিজেকে এবং সম্পূর্ণ বংশটাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেলেন, তাঁর বোধ হয় স্বচক্ষে দেখা দরকার ধ্বংস দেখতে কেমন লাগে। কেননা এই ধ্বংস স্বচক্ষে দেখবেন ভীষ্ম, এই ধ্বংস দেখবেন বিদুর, এই ধ্বংস দেখবেন দ্রোণ, কৃপ—যাঁরা সকলে মিলে এই প্রসিদ্ধ ভরতবংশকে লালন করেছেন। আর এই ধ্বংস দেখবেন স্বয়ং ব্যাস যিনি এই বংশের জন্মদাতা পিতা। ধ্বংস দেখতে কেমন লাগে—তাই বুঝি ব্যাস চক্ষু দিতে চাইছিলেন ধৃতরাষ্ট্রকে।

ধৃতরাষ্ট্র রাজি হননি। তিনি বেশ বুঝেছেন—এই অপমৃত্যু তাঁর পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। বরঞ্চ তিনি শুনবেন। ব্যাস সেই বরই দিয়েছেন। বলেছেন—এই সঞ্জয় তোমাকে সমস্ত যুদ্ধের বিবরণ জানাবে। যুদ্ধের সমস্ত বিষয় তাঁর প্রত্যক্ষ হবে। যুদ্ধক্ষেত্রে যা সামনে ঘটছে এবং যুদ্ধ পরিকল্পনাদির বিষয়, যা পিছনে ঘটছে, রাতে, দিনে, এমনকী যোদ্ধারা যা মনে মনে ভাবছে, তা সব জানতে পারবে এই সঞ্জয়। কোনও অস্ত্র এঁকে আঘাত করবে না, কোনও শ্রম এঁকে ক্লান্ত করবে না। যুদ্ধের সমস্ত বিপন্নতা থেকে মুক্ত থাকবে সঞ্জয়। সে সব তোমাকে বলবে—কথয়িষ্যতি তে যুদ্ধং সর্বজ্ঞশ্চ ভবিষ্যতি।

আজকের দিনে বসে ভাবি—কী অসাধারণ আধুনিক ছিল এই সাংবাদিকতার প্রত্যয়। অনেকেই ব্যাসের কথামতো ভাবেন—ব্যাসের দেওয়া দিব্যদৃষ্টি লাভ করে সঞ্জয় যুদ্ধের ধারাবিবরণী দিয়েছেন ধৃতরাষ্ট্রকে। অনেকের মনে এই প্রশ্ন আছে যে, ধৃতরাষ্ট্র কি তখন হস্তিনায় বসেছিলেন আর সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়ে শুধু দিব্যদৃষ্টির ক্ষমতায় ধৃতরাষ্ট্রের কাছে ধারাবিবরণী দিয়ে গেছেন? লৌকিক দৃষ্টিতে যদি দেখেন, তবে একটা কথা বোঝা দরকার, দিব্যদৃষ্টি এমনই এক সূক্ষ্ম অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, যা সকলের থাকে না। যাঁর মধ্যে সেই অন্তর্ভেদের বীজ আছে, তাঁকেই উপযুক্ত উপদেশ দিয়ে বিশাল কর্মের জন্য প্রস্তুত করা যায়। সঞ্জয় যেমন শাস্ত্রজ্ঞ ব্যক্তি, তেমনই এই কুরুরাজ পরিবারের সঙ্গে তিনি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। তাঁর মধ্যে পক্ষপাতশূন্য নীতিদৃষ্টিও সর্বাংশে বর্তমান। অতএব ব্যাসের দেওয়া দিব্যদৃষ্টি লাভে তাঁর আন্তরশক্তি আরও সমৃদ্ধ হয়েছে মাত্র, আর কিছু নয়।

ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীরা সকলে হস্তিনাপুরীতেই ছিলেন। তাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি, কিংবা ক্যাম্প করেও সেখানে থাকেননি। কিন্তু সঞ্জয় অবশ্যই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে উপস্থিত ছিলেন এবং এক-একটা দুর্ঘটনা বা বড় ঘটনা ঘটার পর তিনি হস্তিনায় এসে ধৃতরাষ্ট্রকে জানিয়ে গেছেন, যখন যেমন ঘটেছে, তখন তেমন। যেমন রণভূমিতে ভীষ্মের পতন ঘটলে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এসে প্রথমে ধৃতরাষ্ট্রকে সেই দিনের খবরটি দিয়েছেন—ভীষ্ম মারা গেছেন। তারপর ধৃতরাষ্ট্রের ‘কোয়ারি’ বুঝে দশ দিনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু সঞ্জয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে হস্তিনায় এসেছিলেন—অথ গাবল্পনির্বিদ্বান্ সংযুগাদেষ্য ভারত’। ব্যাস যে বলেছিলেন—সঞ্জয়ের গায়ে অস্ত্রাঘাত লাগবে না, যুদ্ধক্ষেত্রে সে যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবে—এ হল সেই আমলের সাংবাদিকের স্বাধীনতা। তখন যুদ্ধের মধ্যেও একটা নীতি ছিল। যেখানে কুরুপিতামহ ব্যাস এই নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে সমস্ত যোদ্ধা এই নির্দেশ মেনে নিয়েছেন। যুদ্ধের শেষ পর্বে দেখা যাচ্ছে—সঞ্জয় অর্জুনশিষ্য সাত্যকির হাতে ধরা পড়েছেন এবং সাত্যকি তাঁকে মেরে ফেলবার কথাও ভাবছেন। ঘটনা হল—যুদ্ধের শেষ পর্বে দুর্যোধন তখন যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে পালাচ্ছেন। সাত্যকি দুর্যোধনের গন্তব্যস্থল জানার জন্য তাঁর পিছন পিছন গেছেন, তেমনই প্রত্যক্ষ সংবাদের প্রয়োজনে সঞ্জয়ও সেখানে গেছেন। কিন্তু সাত্যকি কিছু উগ্র স্বভাবের মানুষ। সঞ্জয়ের ওপরে তাঁর সন্দেহ জাগ্রত হয়। বিশেষত সঞ্জয়কে তিনি নিরন্তর ধৃতরাষ্ট্রের দৌত্য-কর্ম করতে দেখেছেন এবং নিরন্তর তিনি ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে আছেন বলেই সাত্যকির উগ্রস্বভাব উদ্বেলিত হয়েছিল। কিন্তু সাত্যকি তাঁর ইচ্ছা চরিতার্থ করতে পারেননি। মুহূর্তের মধ্যে আমরা সেখানে মহর্ষি ব্যাসকে উপস্থিত হতে দেখছি। তিনি হাত তুলে সাত্যকিকে কড়া নির্দেশ দিলেন—ছেড়ে দাও সঞ্জয়কে, একে মারবার চেষ্টা কোরো না—মুচ্যতাং সঞ্জয়ো জীবন্ন হন্তব্যঃ কথঞ্চন। ব্যাসের কথা শুনে সাত্যকি হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ছেড়ে দিয়েছেন সঞ্জয়কে এবং বলেছেন—আমার ভুল হয়েছে, সঞ্জয়! তোমার কাজ তুমি করো—স্বস্তি সঞ্জয় সাধয়।

এই ঘটনার মাধ্যমে যে দুটি কথা আমি বলতে চাই, সেটা হল ব্যাসই বোধ হয় প্রথম ব্যক্তি যিনি এই নির্ভীক এবং প্রত্যক্ষগুণসমৃদ্ধ সাংবাদিকতার সৃষ্টি করেন। শুধু তাই নয়, ব্যাস নিজেও এই সম্পূর্ণ যুদ্ধভূমির মধ্যে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন সব, নইলে সঞ্জয় এবং সাত্যকির সঙ্গে তাঁর দেখা হল কী করে? যিনি ভবিষ্যতে মহাকাব্যের কবি হবেন, তিনি যে শুধু আপন কল্পনার মিশ্রণ ঘটিয়ে কল্পকাহিনী লেখেননি শুধু, এই ঘটনা তা প্রমাণ করে। বস্তুত তিনিও যে ঘুরে ঘুরে সব কিছু দেখবেন এই প্রতিজ্ঞা তাঁর প্রথম থেকেই ছিল। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে সমস্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেবার জন্য সঞ্জয়কে যেমন নির্দেশ দিলেন ব্যাস, তেমনই একই সঙ্গে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে তিনি নিজেও বললেন—আমিও কৌরব এবং পাণ্ডব—সকলের কীর্তিকাহিনী জগতের মানুষের কাছে বলব, তুমি দুঃখ কোরো না, রাজা—অহন্তু কীর্তিমেতেষাং কুরূণাং ভরতৰ্ষভ। পাণ্ডবানাঞ্চ সর্বেষাং প্রথয়িষ্যামি মা শুচঃ।

অর্থাৎ ভবিষ্যতে যে তিনি মহাভারতের এই কাহিনী লিপিবদ্ধ করবেন সে প্রতিজ্ঞাটি এখানেই আছে। যুদ্ধের এই আরম্ভ-মুহূর্তে ব্যাস একেবারে কবিজনোচিতভাবে নির্বিকার। আত্মজ ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বার বার বলছেন—তুমি শোক ত্যাগ করো। এ তোমার কপাল, এর জন্য কষ্ট পেয়ে লাভ নেই, কেননা এই যুদ্ধ রোধ করা যাবে না, তবে হ্যাঁ, জয় তো হবে সেই পক্ষে, যেখানে ধর্ম আছে—ন চৈব শক্যং সংযন্তুং যতো ধর্মস্ততো জয়ঃ।

এই এক অদ্ভুত কশাঘাত! ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি মানসিকভাবে প্রস্তুত করে দিচ্ছেন, যাতে একবারও তিনি না ভাবেন যে, এই যুদ্ধে জয় হবে তাঁর। কেননা তিনি ধর্মের পথে থাকেননি, নীতির পথে থাকেননি। এই অন্তিম যুদ্ধারম্ভের মুহূর্তেও—যখন দুই পক্ষের সৈন্যরা যুদ্ধভূমিতে পরস্পরের সম্মুখীন—তখনও ব্যাস চাইছেন এই যুদ্ধ বন্ধ করতে। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বলেছেন—একমাত্র তুমিই পারো—কৌরব-পাণ্ডব সকলকে ধর্মের পথ দেখাতে—ধর্ম্যং দর্শয় পন্থানং সমর্থো হ্যসি বারণে। কুলক্ষয়ের সমস্ত দায় ধৃতরাষ্ট্রের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ব্যাস বলেছেন—জ্ঞাতিবধ ব্যাপারটাকে খুব ক্ষুদ্র চরিত্রের লক্ষণ বলে মনে করেন পণ্ডিতেরা। আমি বার বার বলছি—আমার অত্যন্ত অপছন্দের এই কাজ তুমি কোরো না—ক্ষুদ্রং জ্ঞাতিবধং প্ৰাহুর্মা কুরুষ্ব মমাপ্রিয়ম্‌।

যে ভাবে, যে প্রক্রিয়ায় এবং যে স্বার্থভাবনায় দুর্যোধন যুদ্ধের দিকে এগিয়েছেন, সে ব্যাপারে ধৃতরাষ্ট্র মাঝে মাঝে সচেতন হলেও পুত্রের স্বার্থকে তিনি সব সময় ভ্রাতুষ্পুত্রদের ন্যায্য প্রয়োজনের চেয়ে বেশি মনে করেছেন। মূল এই স্বার্থচেতনারই একটা পরিণতি ঘটেছে একটু একটু করে এবং তা এখন যুদ্ধে পরিণত। ব্যাস বলেছেন—কাল। ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছেন—লোকক্ষয়ের প্রতীক যে কাল, সেই কালই তোমার ছেলে হয়ে জন্মেছে। আর অনর্থই তোমার রাজ্যের রূপ ধারণ করেছে। তুমি কালের প্রভাবেই বিপদের মতো সম্পদেও বিপথেই চলেছ। ফলটা এই হয়েছে—তোমার ধর্ম, ধর্মবোধ একেবারে লুপ্ত হয়ে গেছে। রাজ্য দিয়ে তুমি কী করবে? রাজ্য শুধু তোমার পাপ বাড়াবে, পাপ—কিংতে রাজ্যেন দুর্ধর্ষ যেন প্রাপ্তো’ষি কিল্বিষম্‌৷ এখনও তোমার সময় আছে, এখনও তুমি তোমার ধর্ম, যশ, কীর্তি রক্ষা করে স্বর্গলাভ করতে পার। কিন্তু তার জন্য পাণ্ডবদের ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁদের রাজ্য এবং যুদ্ধের পথ ত্যাগ করে শান্ত হতে হবে কৌরবদেরও—লভন্তাং পান্ডবা রাজ্যং শমং গচ্ছন্তু কৌরবাঃ।

অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র একটু ক্রুদ্ধই হলেন। সম্পূর্ণ উপেক্ষার সুরে তিনি ব্যাসকে বললেন—পিতা! মঙ্গল-অমঙ্গল এবং মন্দ-ভালর যে সমস্ত বিষয় আছে, সেসব আপনি যেমন জানেন, তেমনই আমিও জানি—যথা ভবান্‌ বেত্তি তথৈব বেত্তা—কিন্তু আমি কী করব? স্বার্থ গুছোবার জন্য সমস্ত মানুষের মোহ আছে, আমিও তো এই স্বার্থময় মনুষ্যলোকের বাইরে নই। মানুষ তো আমিও, তাই স্বার্থের মোহ আমাদের গ্রস্ত করে—স্বার্থে হি সংমুহ্যতে তাত লোকো/মাঞ্চাপি লোকাত্মকমেব বিদ্ধি। তা ছাড়া আমি কী করব? আমার ছেলেরা আমার সব কথা শোনে না। তার চেয়ে আপনি—আপনি তো কুরু-পাণ্ডব সকলের ঠাকুরদাদা, আপনি পথ দেখান সকলকে—ত্বং নো গতির্দর্শয়িতা চ ধীর।

এই কথার উত্তরে কী বলবেন ব্যাস? যিনি নিজের আত্মজ পুত্রকেই পথ দেখাতে পারলেন না, তিনি দুর্যোধনকে পথ দেখাবেন কী করে। ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে আর তিরস্কার করলেন না, বরঞ্চ ছেলের এই অবোধ করুণ অবস্থায় তাঁর যেন একটু মায়াই হল। অবোধ ধৃতরাষ্ট্র কিন্তু এখনও জয়ের আশা করেন এবং ব্যাসকে তিনি জিজ্ঞাসা করছেন—কী কী লক্ষণ দেখা গেলে বুঝতে হবে যে, যুদ্ধোদ্যোগীর জয় হবে। ব্যাস পরম ধৈর্য সহকারে যুদ্ধোদ্যোগীর জয়ের রহস্য শোনালেন। কাক-পক্ষীর ডাক থেকে আরম্ভ করে সৈন্যসামন্তের গতিপ্রকৃতি, তাদের সংঘবদ্ধতা এবং নেতৃত্ব সম্বন্ধে নানা কথা বললেন ব্যাস, যাতে ধৃতরাষ্ট্রও বুঝি বুঝতে পারলেন—কোন পক্ষের জয় হবে।

ব্যাসের এই সমস্ত বক্তব্যটার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা ছিল, তার মাধ্যমেও কিন্তু ব্যাস ধৃতরাষ্ট্রকে বলতে চেয়েছেন যে, যুদ্ধ জিনিসটা বুদ্ধিমান রাজার রাজধর্ম নয়। রাজার পক্ষে সবচেয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে ‘ডিপ্লোমেসি’ বা কূটনীতির মধ্যে। অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে নিজের অনুকূলে আনা বা তাকে চাপের মধ্যে রাখার সবচেয়ে ‘এফিশিয়েন্ট এক্সপিডিয়েন্ট’ হিসেবে যুদ্ধকে মমাটেই পছন্দ করেন না ব্যাস, তাঁর মতে—বুদ্ধিমান এবং সদা-সতর্ক রাজা সব সময় নানাবিধ কূটনৈতিক উপায় প্রয়োগ করে প্রতিপক্ষকে জয় করবার চেষ্টা করবেন। ব্যাস মনে করেন—রাজা যদি সবার ওপরে নিজের কূটনৈতিক আধিপত্য স্থাপন করতে পারেন, তবে সেই জয়টাই শ্রেষ্ঠ জয়—উপায়বিজয়ং শ্রেষ্ঠম্‌—আর যুদ্ধের মাধ্যমে যে জয় আসে, সেটার মতো নিকৃষ্ট জয় আর কিছু নেই—জঘন্য এষ বিজয়ো যো যুদ্ধেন বিশাম্পতে। কেননা যুদ্ধে যে জয়লাভ ঘটে তাতে বিজেতার সৈন্যক্ষয়, রক্তক্ষয়ও কিছু কম হয় না। আর যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ের ব্যাপারটাই অনিশ্চিত, দৈবাধীন। অনেক সৈন্য-সেনাপতি থাকলেই যে জয় হবে, তারও কোনও মানে নেই। কেননা অন্যান্য যুদ্ধে যাঁরা জয়লাভ করেছেন, তাঁরাও আবার কোনও যুদ্ধে পরাজিত হন—পরাজয় যদি নাও হয়, তবু ক্ষয় তো হয় প্রচুর—জয়বন্তো হি সংগ্রামে ক্ষয়বন্তো ভবন্ত্যুত।

ব্যাস যে কেন ঋষির সঙ্গে কবিও, তা এইসব জায়গা থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যুদ্ধশৌণ্ড ব্যক্তি যুদ্ধে জয়লাভ করলেই ভাবে তার একমাত্র লাভ—সে যুদ্ধ জয় করেছে। কিন্তু বিশাল এক যুদ্ধবিজয়ের মধ্যেও যে এক ধরনের পরাজয় লুকিয়ে থাকে, সেকথা যুদ্ধশৌণ্ড বোঝে না। একটা যুদ্ধের পর বিজয়ীর পক্ষেও রক্তক্ষয় হয়, রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থাও সংকটজনক হয়ে পড়ে। ব্যাস ঠিক এই দৃষ্টি থেকেই বলেছেন—জয়ের সঙ্গেও ক্ষয় আছে—জয়বন্তো হি সংগ্রামে ক্ষয়বন্তো ভবন্ত্যুত। কিন্তু মুশকিল হল—যুদ্ধশৌণ্ড ব্যক্তির ‘ইগো’ ব্যাপারটাই এমন যে, ক্ষয়ের কথা সে বুঝতে পারলেও ভাবতে চায় না। ধৃতরাষ্ট্রও ভাবতে চাননি। আসন্ন যুদ্ধের রাশ তিনি টেনে ধরেননি। কারণ তাঁর স্বার্থ—ধৃতরাষ্ট্র নিজেই ব্যাসের কাছে স্বীকার করেছেন—অন্য সাধারণ মানুষ যেমন স্বার্থে মুগ্ধ হয়, আমিও তেমনই স্বার্থের কারণেই মোহগ্রস্ত—স্বার্থে হি সংমুহ্যতে তাত লোকঃ। অগত্যা কী করবেন ব্যাস। চলে গেছেন। যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে নিজস্ব গতিতে।