৬. অলংকার

অলংকার *

[* এই গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত চালু থাকা পূর্বতন উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় (একাদশ শ্রেণীর পর গৃহীত) পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভূত ছিল। মাননীয় মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ ১৯৭৬ সাল হইতে প্রবর্তিত (১০+২) মাধ্যমিক পরীক্ষার পাঠ্যসূচীতে বিষয়টি অন্তর্ভূত করেন নাই; ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালে সেই পাঠ্যসূচীর ব্যাপক পরিবর্তনের সময়ও বিষয়টি পাঠ্যসূচী-বহির্ভূতই থাকিয়া গিয়াছে। এমন-কি, উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষার (দ্বাদশ শ্রেণীর পরে গৃহীত) পাঠ্যসূচী হইতেও বিষয়টি ১৯৭৬ সালের পর হইতে এখনও পর্যন্ত বাদই রাখা হইয়াছে।]

২১১। অলংকার : সাহিত্যস্রষ্টার যে রচনাকৌশল কাব্যের শব্দধ্বনিকে শ্রুতিমধুর এবং অর্ধধ্বনিকে রসাপ্লুত ও হৃদয়গ্রাহী করিয়া তোলে, তাহাকে অলংকার (Figure of speech) বলে।

কেয়ূর কঙ্কণ কণ্ঠী প্রভৃতি স্বর্ণালংকার যেমন রমণীদেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, অনুপ্রাস-যমক উপমা-রূপক প্রভৃতি সাহিত্যালংকারও তেমনি কাব্যদেহের অঙ্গলাবণ্য ও আন্তর সৌন্দর্যকে নয়নলোভন ও চিত্তবিমোহন করিয়া তোলে। তবে মণিময় অলংকার ও বাণীময় অলংকারের পার্থক্যটি মনে রাখিও।—রমণীদেহের অলংকার একান্তই বাহিরের জিনিস, কিন্তু কাব্যালংকারের সহিত কাব্যের অন্তরের যোগ অবিচ্ছিন্ন।

বাণী বহিরঙ্গে শব্দময়ী, অন্তরঙ্গে অর্থময়ী। অলংকারও তাই দ্বিবিধ—শব্দালংকার ও অর্থালংকার।

২১২। শব্দালংকার : শব্দের বহিরঙ্গ ধ্বনির আশ্রয়ে যে কাব্য-সৌন্দর্যের সৃষ্টি তাহাকে শব্দালংকার বলে।

২১৩। অর্থালংকার : শব্দের অন্তরঙ্গ অর্থের আশ্রয়ে যে কাব্য-সৌন্দর্যের সৃষ্টি তাহাকে অর্থালংকার বলে।

শব্দালংকার ও অর্থালংকারের পার্থক্যটুকু মনে রাখিও। শব্দালংকারে বাক্যের সংগীতধর্মের প্রকাশ, অর্থালংকারে তাহার চিত্রধর্মের প্রকাশ। শব্দালংকারের আবেদন ইন্দ্রিয়ের দ্বারে, অর্থালংকারের আবেদন বোধের দ্বারে। শব্দালংকার শব্দের পরিবর্তন সহ্য করিতে পারে না, অথচ শব্দের পরিবর্তনে অর্থালংকারের কোনো ক্ষতিই হয় না।

“কুলায়ে কাঁপিছে কাতর কপোত।”—এখানে ক-এর আশ্রয়ে সৌন্দর্যসৃষ্টি হইতেছে। কিন্তু “কুলায়ে”, “কাতর” ও “কপোত” শব্দত্রয়ের প্রতিশব্দ বসাইয়া পঙ্ক্তিটিকে যদি এইভাবে লেখা যায়—”বাসায় কাঁপিছে ব্যথিত পায়রা” তাহা হইলে অর্থ অটুট থাকে, ছন্দও অটুট থাকে; কিন্তু ক ধ্বনির আশ্রয়ে যে সৌন্দর্যের সৃষ্টি হইয়াছিল, তাহার কি অপমৃত্যু ঘটে নাই? শব্দালংকার একান্তভাবে শব্দনির্ভর বলিয়াই শব্দ-পরিবর্তন সহ্য করিতে পারে না।

কিন্তু “আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত প্রভাতরশ্মিসম”—পুর্ণোপমার এই উদাহরণটিকে যদি “এনেছি ছুরিকা শাণিত দীপ্ত প্রভাতরৌদ্রসম” বলিয়া লেখা যায় তাহা হইলেও অলংকার পূর্ণোপমাই রহিয়া যায়। অর্থালংকার অর্থের উপর নির্ভরশীল, শব্দের উপর নয়; সেইজন্য শব্দের পরিবর্তনেও ইহার অঙ্গলাবণ্য অক্ষতই থাকে।

শব্দালংকার

শব্দালংকার প্রধানতঃ তিন প্রকারের-(১) অনুপ্রাস, (২) যমক ও (৩) শ্লেষ।

অনুপ্রাস

২১৪। অনুপ্রাস : একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যুক্তভাবেই হউক আর বিযুক্তভাবেই হউক, একাধিকবার আবৃত্ত হইলে অনুপ্রাস অলংকার (Alliteration) হয়।

অনুপ্রাস মূলতঃ ব্যঞ্জনধ্বনির অলংকার। সেই ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে মিলিত স্বরধ্বনি এক হইল, কি বিভিন্ন হইল, সেইদিকে লক্ষ্য রাখার কোনো প্রয়োজন নাই।

“গুরুগুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে,
গরজে গগনে।”

—রবীন্দ্রনাথ।

—এখানে গ মোট বারো বার ধ্বনিত হইয়াছে। কিন্তু গ-এর সহিত মিলিত স্বর কখনও উ কখনও বা অ। র ধ্বনিটিও বিভিন্ন স্বরধ্বনি-সংযোগে ছয় বার ধ্বনিত হইয়াছে।

আবার, একই ব্যঞ্জনধ্বনি বলিতে সদৃশ ব্যঞ্জনও বুঝিতে হইবে। “এখনি, অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা।”—এখানে একই ন্ধ একাধিকবার ধ্বনিত হইয়া সৌন্দর্য সৃষ্টি করিতেছে। কিন্তু—”বাঁশী বাজে মনমাঝে”–এখানে জ ও ঝ সদৃশ ধ্বনির অনুপ্রাস হইয়াছে। সেইরূপ ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ; ট, ঠ; ত, থ, ণ, ন, প, ফ, ব, ভ; জ, য; র, ড়; শ, ষ, স প্রভৃতি সদৃশ ধ্বনি।

আদ্যানুপ্রাস, মধ্যানুপ্রাস ও অন্ত্যানুপ্রাস—এই তিন প্রকার অনুপ্রাস হয়। (ক) আদ্যানুপ্রাস—শব্দের আদিবর্ণের আবৃত্তিতে আদ্যানুপ্রাস হয়।

(১) “তৈল তূলা তনূনপাৎ তাম্বুল তপনে। “ —মুকুন্দরাম।

(২) “আজি উতরোল উত্তর বায়ে উতলা হয়েছে তটিনী।”—রবীন্দ্রনাথ।

(৩) “কেতকী-কেশরে কেশপাশ করো সুরভি।”

(৪) “আনো মৃদঙ্গ মুরজ মুরলী মধুরা।”

(৫) “স্বাধীন সবল শান্ত সরল সন্তোষ।”

(৬) “শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে।”

(৭) “নিঃশেষ নির্মল নীলে বিকাশিছে নিখিল গগন।”

(৮) “ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে।”

(৯) “নেত্র হইল নিশ্চল, নাসিকা নিঃশ্বাসশূন্য নিস্পন্দ ধমনী।”—হেমচন্দ্ৰ

(১০) “শাপলা-শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া।”

(১১) “করুণাঘন ধরণীতল করো কলঙ্কশূন্য।

(খ) মধ্যানুপ্রাস—শব্দের মধ্যস্থিত বর্ণের আবৃত্তিতে মধ্যানুপ্রাস হয়।

(১) “আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি।”—রবীন্দ্রনাথ।

(২) “নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ রেলে কলিশন হয়।”—দ্বিজেন্দ্রলাল।

(৩) “গালি দিয়া সবে গদ্যে পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির।”

(৪) “কুঞ্জ দেয় ফুলপুঞ্জে পাদপদ্মে পরান অঞ্জলি।” – প্রমথনাথ।

(৫) “সজ্জাহীনের লজ্জা নাইকো।” —যতীন্দ্রমোহন বাগচী।

(৬) “বাদ্যঘটা লক্ষ বলি অলক্ষ্যে সব যায় যে চলি—বক্ষে জাগে দৃষ্টি মায়ের মিষ্ট হাসি চন্দ্ৰাননে।” —কুমুদরঞ্জন।

(৭) “লাউডস্পীকারগুলি গানকে বাণে পরিণত করিয়া আমাদের কানকে নির্মমভাবে বিদ্ধ করে।” —কবিশেখর।

(৮) “অবিলম্বে চল অম্বে বিলম্ব সহে না আর।”

(৯) “লঙ্কার পঙ্কজরবি গেলা অস্তাচলে।”

(১০) “এ নহে কুঞ্জ কুন্দকুসুমরঞ্জিত
ফেনহিল্লোল কলকল্লোলে দুলিছে।”

(১১) “অশোক রোমাঞ্চিত মঞ্জরিয়া
দিল তার সঞ্চয় অঞ্জলিয়া।
মধুকর-গুঞ্জিত
কিশলয়-পুঞ্জিত
উঠিল বনাঞ্চল চঞ্চলিয়া।” —রবীন্দ্রনাথ।

(১২) মনোমন্দিরসুন্দরী! মণিমঞ্জীর গুঞ্জরি
স্খলদঞ্চলা চলচঞ্চলা! অয়ি মঞ্জুলা মুঞ্জরি।
রোযারুণরাগরঞ্জিতা! বঙ্কিম-ভুরু-ভঞ্জিতা!
গোপন-হাস্য-কুটিল-আস্য কপটকলহগঞ্জিতা!….
চুম্বনধনবঞ্চিনী দুরূহগর্বমঞ্চিনী!
রুদ্ধকোরক-সঞ্চিত-মধু কঠিনকনককঞ্জিনী।—রবীন্দ্রনাথ।

(১৩) “মঞ্জুবিকচকুসুমপুঞ্জ মধুপশব্দগুঞ্জিগুঞ্জ
কুঞ্জরগতি গঞ্জিগমন মঞ্জুলকুলনারী।
ঘনগঞ্জন চিকুর-পুঞ্জ মালতীফুলমালে রঞ্জ
অঞ্জনযুক্ত কনয়নী খঞ্জনগতিহারী।” —জগদানন্দ।

(গ) অন্ত্যানুপ্রাস—পাদান্তের সঙ্গে পাদান্তের বা চরণান্তের সঙ্গে চরণান্তের যে ছন্দোমিল, তাহাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে।

(১) “রক্তমাখা অস্ত্রহাতে যত রক্ত আঁখি
শিশুপাঠ্য কাহিনীতে থাকে মুখ ঢাকি।”

(২) “দিঘির কালো জলে সাঁঝের আলো ঝলে।”

(৩) “এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা।”

(৪) “আসে গুটি গুটি বৈয়াকরণ
ধূলিভরা দুটি লইয়া চরণ।”

(৫) “গগনে ছড়ায়ে এলোচুল
চরণে জড়ায়ে বনফুল।”

(৬) “ওগো নটী, চঞ্চল অপ্সরী,
অলক্ষ্য সুন্দরী,
তব নৃত্যমন্দাকিনী নিত্য ঝরি ঝরি
তুলিতেছে শুচি করি
মৃত্যুস্নানে বিশ্বের জীবন।” —রবীন্দ্রনাথ।

সর্বকালের কবির প্রিয় অলংকার এই অনুপ্রাসের আরও কিছু উদাহরণ :

(১) “ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি।”—রবীন্দ্রনাথ। (২) “যত করি তাড়া নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।”—ঐ। (৩) “নূপুর গুঞ্জরি যাও আকুল-অঞ্চলা বিদ্যুৎ-চঞ্চলা।”—ঐ। (৪) “নিরাবরণ বক্ষে তব নিরাভরণ দেহে চিকন সোনা-লিখন উষা আঁকিয়া দিল স্নেহে।”—ঐ। (৫) “একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু।”—ঐ। (৬) “কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।” (৭) “না মানে শাসন, বসন বাসন অশন আসন যত।” (৮) “লয়ে রশারশি করি কষাকষি।” (৯) “কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া পাণি সজল চক্ষে, “করুণ রক্ষে গরিবের ভিটেখানি।’ “ (১০) “মধু মাসে মলয় মারুত মন্দ মন্দ মালতীর মধুকর পিয়ে মকরন্দ।” (১১) “পতঙ্গ যে রঙ্গে ধায়।” শ্রীমধুসূদন। (১২) “কুন্তলে অশোকগুচ্ছ, কমকণ্ঠে কর্ণিকারমালা।” দেবেন্দ্রনাথ। (১৩) “সে দিন সজনি এমনি রজনী আঁধিয়ার।”—কুমুদরঞ্জন। (১৪) “বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে কাঁপে নৃত্যের ছায়া।” (১৫) “তোমার নৃত্য অনুপ্রাস অলংকার অমিত বিত্ত ভরুক চিত্ত মম।” (১৬) “বৈদ্যবাটীর বাবুরামবাবু বড় বৈষয়িক লোক ছিলেন।”—টেকচাঁদ ঠাকুর। (১৭) “কেতকী কত কি কহিতেছে কথা কামিনীর কানে কানে।”—কবিশেখর। (১৮) “নন্দপুর-চন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার।”—ঐ। (১৯) “যমুনার তীরে তমাল তরুর তল।”—ঐ। (২০) “শৃঙ্খলা রক্ষা-সম্বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা করা হয়, কেবল পাঠের বেলাতে নয়, মাঠের খেলাতেও। … কেবল ভজনালয়ে নয়, তাহাদের ভোজনালয়েও শৃঙ্খলা।”—ঐ। (২১) “কত না ছিন্ন চরণচিহ্ন ছড়ানো সে ঠাঁই ঘিরে।”—যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। (২২) “ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহিক আর।”—নজরুল। (২৩) “আবাদ করে বিবাদ করে সুবাদ করে তারা।”—যতীন্দ্রমোহন বাগচী। (২৪) চিত্তে অজস্র ক্ষোভ আর পিত্তে সহস্র রাক্ষসীর ক্ষুধা নিয়ে শ্রীযুক্ত সত্যচন্দ্র দত্তমিত্রমশায় নিত্য অধিক রাত্রে বাড়ি ফিরতেন। (২৫) এরূপ যুক্তিপূর্ণ উক্তি আর নির্জল ভক্তিবাদ এরকম কিছুদিন শুনলে মুক্তি পেতে দেরি হবে না শক্তিদা। (২৬) শুধু শৌর্য নয়, সৌকুমার্যও চাই। (২৭) “দীপ্তি কহিল, কাজটা তো খাজনা আদায়, তার মধ্যে আবার বাজনা-বাদ্য কেন?” (২৮) ছুটির সঙ্গে রুটির ব্যবস্থা হলে দুটিই পরিপাটী হয়। (২৯) “দেউলগুলোর দুয়ার ভেঙ্গে ঢেউ ঢুকেছে হল্লা করে।” (৩০) “নৃত্যে মঞ্জীর-গুঞ্জন, গীতে মদন-মাধুরী, হাস্যে নয়ন-শোভন, লাস্যে মোহন চাতুরি।”—জাহ্নবীকুমার। (৩১) “সশঙ্ক লঙ্কেশ শূর স্মরিলা শঙ্করে।”—শ্রীমধুসূদন। (৩২) “চলচপলার চকিত চমকে করিছে চরণ বিচরণ।” (৩৩) “এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ তবু রঙ্গে ভরা”। (৩৪) “ভয়ে ভগ্নোদ্যম আমি ভাবিয়া ভবেশে।” (৩৫) “বিরূপ শ্রীরূপে কহিলেন চুপে।” (৩৬) “ভৃত্য নিত্য ধুলা ঝাড়ে যত্ন পুরামাত্রা।” (৩৭) স্নানশেষে যোগিনীবেশে রাগিণীদেবী মুক্তকেশে রিক্তহস্তে সিক্তবস্ত্রে যুক্তকরে ভক্তবরে শক্ত করে ধরে ধরে পা রাখলেন তক্তা-’পরে। (৩৮) “বাবুদের তাল-পুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে, / সে কি বাস্ করলে তাড়া, বলি থাম্ একটু দাঁড়া।”—নজরুল। (৩৯) মৌলিনাথ মৌলিক আর মল্লিনাথ মল্লিক মল্লিকা কোলে ও কাকলি মালিকের সঙ্গে মৌলালির মোড়মাথায় মিলনের আনন্দে মাতল। (৪০) বাইশে বৈশাখ কালবৈশাখীর বৃষ্টিবিঘ্নিত বিকেলে বুকের বেদনায় ব্যথিত বড়োসাহেব বিবেকবাবু ও তাঁর বনিতা বৃন্দাবনবিলাসিনীকে বাবার নামাঙ্কিত ‘বৃন্দাবিপিনব্রজবীথি’ বলে বনবিবির বাথানে বিশাল বাগানবাড়িতে দেখতে এসে বাক্যবাগীশ বাল্যবন্ধু বৃক্ষবিলাস বটব্যাল আর বভ্রুবাহন বাঁড়জ্যে বাইরের বিরাট বারান্দায় বসে বিরাট্ জামবাটিতে বিশটা বকফুলের বড়া বেমালুম খেয়ে বেশ বিব্রত বোধ করলেন। (৪১) “ পর্ণের পাত্রে ফাল্গুনরাত্রে মুকুলিত মল্লিকা-মাল্যের বন্ধন।”—রবীন্দ্রনাথ।

যমক

২১৫। যমক : দুইটি বা ততোধিক ব্যঞ্জনবর্ণ একই স্বরধ্বনিসহ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে দুই বা ততোধিকবার ব্যবহৃত হইলে যমক অলংকার হয়।

“গুরু-কাছে লব গুরু দুখ।”—প্রথম গুরু মন্ত্রদাতা আচার্য; দ্বিতীয় গুরু গভীর। একই গুরু দুইবার দুইটি পৃথক্ অর্থে প্রযুক্ত হইয়া চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করিতেছে। অতএব অলংকার যমক।

বাংলাভাষায় আদ্য, মধ্য, অন্ত্য এবং সর্ব—এই চারিপ্রকার যমকের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।

আদ্য যমক : (১) “ভারত ভারতখ্যাত আপনার গুণে।”—ভারতচন্দ্র। এখানে প্রথম ভারত = কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়। দ্বিতীয় ভারত = ভারতবর্ষ।

(২) গিরিশ করে গিরীশ করে কন্যা সম্প্রদান। গিরিশ-করে মহাদেবের হস্তে; গিরীশ করে = হিমালয় করিতেছেন।

(৩) সাঙ্গ রূপকের পালাটা আজই সাঙ্গ করা চাই।

মধ্য যমক : (১) “পাইয়া চরণতরী তরি ভবে আশা।”—ভারতচন্দ্র। তরী = নৌকা; তরি পার হই।

(২) “কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত! আমি বসন্তে মরি।”—রবীন্দ্রনাথ। প্রথম বসন্ত = ঋতুবিশেষ; দ্বিতীয় বসন্ত = রোগবিশেষ।

(৩) এমন ধরা গলায় গান ধরা যায় না।

প্রথম ধরা = বদ্ধ; দ্বিতীয় ধরা = আরম্ভ করা।

অন্ত্য যমক : (১) “আটপণে আটসের কিনিয়াছি চিনি।
অন্যলোকে ভুরা দেয় ভাগ্যে আমি চিনি।”

প্রথম চিনি = শর্করা; দ্বিতীয় চিনি = জানি।

(২) “যাইতে মানসসরে কারো না মানস সরে।”—দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

প্রথম সরে = সরোবরে; দ্বিতীয় সরে = চাহে।

(৩) রমলা যদি বা ভাঙা গলাতেই গানটি গায়;
কী এমন জ্বালা ধরিবে তোমার সোনার গায়?

প্রথম গায় (ক্রি) = গান করে; দ্বিতীয় গায় (বি) = গায়ে, গাত্রে।

(৪) “কৈলাসে পার্বতীহরে ভিক্ষা করে কাল হরে।”

প্রথম হরে = মহাদেব; দ্বিতীয় হরে (ক্রি) = হরণ করে, কাটায়।

অন্ত্য যমক একাধারে যমক ও অনুপ্রাস দুইই। কিন্তু অন্ত্যানুপ্রাস অন্ত্য যমক না হইতেও পারে।

সর্ব যমক :

“কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে।
কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত সহকারে।“

প্রথম পঙ্ক্তি : কান্তার = বনভূমি; আমোদ = সৌরভ; কান্ত = বসন্তকাল। বনভূমি বসন্ত-সমাগমে সৌরভপূর্ণ হইয়াছে।

দ্বিতীয় পঙ্ক্তি : কান্তার (কান্তা শব্দের সম্বন্ধপদের একবচন) = দয়িতার; = আমোদ = আনন্দ; কান্ত = প্রেমিক। প্রেমাস্পদের সাহচর্যে দয়িতার আনন্দ পূর্ণতা পাইয়াছে।

আমাদের প্রদত্ত মধ্য যমকের দ্বিতীয় উদাহরণে বসন্ত ও বসন্তে যমকই বলিতে হইবে, অনুপ্রাস নয়। কারণ বসন্ত পদটির প্রাতিপদিক বসন্ত; এ বিভক্তি-চিহ্ন যুক্ত হওয়ায় প্রাতিপদিকটি বসন্তে হইয়াছে। এ বিষয়ে আলংকারিক আচার্য শ্যামাপদ চক্রবর্তীর মন্তব্যটি প্রণিধানযোগ্য : “কোনো শব্দালঙ্কারে বিভক্তি যদি বাধা সৃষ্টি করে, সেখানে অলঙ্কারত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে হয় বিভক্তি-চিহ্নকে উপেক্ষা ক’রে প্রাতিপদিককে পূর্ণ মূল্য দিয়ে।”

অনুপ্রাস ও যমকের পার্থক্যটি মনে রাখা দরকার। (১) অনুপ্রাসে ব্যঞ্জনধ্বনির সঙ্গে মিলিত স্বরধ্বনি সর্বত্র একও হইতে পারে, আবার বিভিন্নও হইতে পারে, কিন্তু যমকে স্বরধ্বনি সর্বত্রই সমান। (যেমন ধরা, ধরি—অনুপ্রাস; ধরা, ধরা—যমক)।

(২) অনুপ্রাসে বর্ণধ্বনির সাম্য থাকায় সৌন্দর্যের সৃষ্টি, যমকে ধ্বনিসাম্য আর অর্থ-পার্থক্য—এই দুইয়ের সম্মিলনে সৌন্দর্যের সৃষ্টি।

(৩) এক ব্যঞ্জনে অনুপ্রাস হয়, কিন্তু এক ব্যঞ্জনে যমক হয় না।

যমকের আরও কয়েকটি উদাহরণ : (ক) ধূলিধূসরিত ধরার (পৃথিবীর) মাঝে স্বর্গ তখন দেয় গো ধরা (ধারণ বা গ্রহণ করা—ক্রি)। (খ) “কাহনেতে সের দরে কিনিনু সন্দেশ (মিষ্টান্ন)। আনিয়াছি আধসের পাইতে সন্দেশ (সংবাদ)।” (গ) “যত কাঁদে বাছা বলি সর সর (দুধের সর)। আমি অভাগিনী বলি সর সর (সরিয়া যা)।” (ঘ) “তার (ধাতুনির্মিত সূত্র বা রজ্জু) ছিঁড়ে গেছে তার (তাহার), কোণে আছে টাঙানো।”—কুমুদরঞ্জন। (ঙ) “একদা প্রভাতে (সকালে) ভানুর প্রভাতে (কিরণ-স্পর্শে) ফুটিল কমলকলি।” (চ) তিনি খোলার (গৃহ-আচ্ছাদনের জন্য মৃত্তিকানির্মিত উপকরণ) ঘরে বাস করলেও মনটি তাঁর বড় খোলা (সাদাসিধা)। (ছ) “মুরারি-মুরলীধ্বনিসদৃশ মুরারি মনোহর।” মধুকবি। প্রথম মুরারি = শ্রীকৃষ্ণ; দ্বিতীয় মুরারি = ‘অনর্ঘরাঘব’-রচয়িতা। (জ) “জীবে দয়া তব পরম ধর্ম, জীবে দয়া তব কই?”—কবিশেখর। প্রথম জীবে = জীবজগতের প্রতি; দ্বিতীয় জীবে = শ্রীজীব গোস্বামীর প্রতি। ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীজীব গোস্বামীকে পরিত্যাগ করায় শ্রীরূপের প্রতি সনাতন গোস্বামীর উক্তি। (ঝ) “ভোজন কর কৃষ্ণজীরে (কালোজিরে), ভজন কর কৃষ্ণজীরে (কৃষ্ণজীকে)।” অসুস্থ শ্রীকৃষ্ণের জন্য কবিরাজ ডাকিতে চলিয়াছেন বৃন্দা। পথে কবিরাজবেশী শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে দেখা। বৃন্দার আবার নিজেরই এক ব্যারাম আছে।—সবকিছুই তিনি কালো দেখেন। তাই কবিরাজ তাঁহাকে ঔষধ বাতলাইয়া দিলেন—কালোজিরে খাও আর কৃষ্ণের ভজনা কর। (ঞ) বড়লোক হলেই মনটা কি আর বড় হয়? ( ধনী, উদার)। (ট) “কবিতার বই বাজারে কাটে (বিক্রয় হয়) কম, পোকায় কাটে (নষ্ট করে) বেশী।” (ঠ) “কুসুমের বাস (সৌরভ) ছাড়ি কুসুমের বাস (আশ্ৰয়), বায়ুভরে এসে করে নাসিকায় বাস (অধিষ্ঠান)।” গুপ্তকবি। (ড) “জেতে (জাতিতে) নারী (মহিলা), যেতে (যাইতে) নারি (পারি না) আমি হে।”—গুপ্তকবি। (ঢ) “গোঠে না গেলে গোপাল, যাবে না গোপাল (বালক শ্ৰীকৃষ্ণ, গোরুর পাল)।” (ণ) “মা আমার অন্তরে (মনে) ছিলে, বুঝি দোষ দেখে অন্তরে (দূরে) গেলে।”—রামপ্রসাদ। (ত) “করি তুই আপন আপন (নিজের), হারালি যা ছিল আপন, এবার তোর ভরা আপণ (দোকান) বিলিয়ে দে তুই যারে তারে।”—অতুলপ্রসাদ। (থ) “আশার আশা (আকাঙ্ক্ষা) ভবে আসা (আগমন) আসামাত্র হল।” (দ) “বাজনা দিয়ে গান (গেয়ে থাকেন) তিনি গান (সংগীত), গলায় নাকি গান না।” (ধ) ছেলের মনের কালি (কলঙ্ক) সর্বাঙ্গে মেখেই তো বিশ্বমাতা কালী (দেবী কালিকা) হয়েছেন। (ন) সাক্ষর (অক্ষর-জ্ঞানসম্পন্ন) ব্যক্তিরাই স্বাক্ষর (দস্তখত) করতে উঠে এলেন। (প) বিনা (ব্যতীত) তারে বীণা (বাদ্যযন্ত্র) বাজবে কেমন করে? (ফ) “ভক্তের ভালোবাসা (প্রেম) যাঁর সবচেয়ে ভালো বাসা (শ্রেষ্ঠ আশ্রয়), তিনিই তো পীতবাস।” (ব) দৈত্যরাজ বলি (প্রহ্লাদের পৌত্র অসুরবিশেষ) আন্তর বলে প্রচণ্ড বলী (বলবান্) ছিলেন। (ভ) আকাশভরা কত তারা (নক্ষত্র), সেই দিকে চেয়ে বলে তারা (তাহারা), রক্ষা করো ও মা তারা (দেবী কালী), তারা (চোখের মণি) বেয়ে বয় অবিরল ধারা। (ম) “অবিচারের শতেক জ্বালা (বি—যন্ত্রণা), এবার তাতেই আগুন জ্বালা (ক্রি—প্রজ্বলিত কর্)।”

কখনও কখনও আবৃত্ত বর্ণগুচ্ছের একটি সার্থক আর অপরটি নিরর্থক হইতে পারে। (ক) “যৌবনের বনে মন হারাইয়া গেল।”—জ্ঞানদাস। এখানে যৌবনের আয়তাংশ বনে অর্থহীন, কিন্তু দ্বিতীয় বনে স্বয়ংসম্পূর্ণ বলিয়া সার্থক। (খ) “শেফালি রায়ের সঙ্গে আমার এক ফালি পরিচয়ও নেই।”—অচিন্ত্যকুমার। (গ) “আছি গো তারিণী ঋণী তব পায়।” রিণী—নিরর্থক, ঋণী—সার্থক।

শ্লেষ

২১৬। শ্লেষ : কোনো শব্দ একবারমাত্র ব্যবহৃত হইয়া একাধিক অর্থপ্রকাশ করিলে শ্লেষ অলংকার হয়।

(১) “এনেছে তোমার স্বামী বাঁধি নিজগণে।”—মুকুন্দরাম।

এখানে গুণে = চারিত্রিক মাধুর্যে, ধনুকের ছিলায়। ফুল্লরার কাছে ছদ্মবেশিনী দেবী চণ্ডী আত্মপরিচয়দানকালে যাহা বলেন, তাহার প্রথম অর্থ : “তোমার স্বামীর চারিত্রিক উৎকর্ষই আমাকে মুগ্ধ করে এনেছে।” দ্বিতীয় অর্থটি : “তোমার স্বামী আমাকে ধনুকের ছিলায় বেঁধে এনেছে।” (স্বর্ণগোধিকা—রূপিণী চণ্ডীকে কালকেতু ধনুকের ছিলায় বাঁধিয়া আনিয়াছিলেন।—চণ্ডীমঙ্গল-কাহিনী)

(২)

“কে বলে ঈশ্বর গুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর,
যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর?”

ঈশ্বর = ভগবান, কবিবর ঈশ্বরচন্দ্র। গুপ্ত = অপ্রকাশিত বা অখ্যাত, পদবী—বিশেষ। ব্যাপ্ত = প্রকাশিত, বিখ্যাত। প্রভা = জ্যোতিঃ, প্রতিভা। প্রভাকর = সূর্য, ‘প্রভাকর’ নামীয় সংবাদপত্র। চরণ দুইটির প্রথম অর্থ : “ঈশ্বরকে দেখিতে পাওয়া যায় না, এই কথা কে বলে? তিনি তো বিশ্বময় পরিব্যাপ্ত হইয়া রহিয়াছেন। তাঁহার আলোকেই তো সূর্য আলোকিত।” দ্বিতীয় অর্থটি এই : “গুপ্তবংশজ কবি ঈশ্বরচন্দ্রকে অখ্যাতনামা কে বলে? ‘সংবাদ প্রভাকর’ কাগজটি তো তাঁহার প্রতিভার উজ্জ্বল আলোকে দীপ্তিমান।”

(৩) “মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।”—শ্রীমধুসূদন।

মধু = পুষ্পমধু, মধুকবির মধুময় নাম। পঙ্ক্তিটির প্রথম অর্থ : পদ্মকে মধুশূন্য করিও না। দ্বিতীয় অর্থ : তোমার মন হইতে বরেণ্য কবি মাইকেল মধুসূদনের ‘মধু’ নামটি মুছিয়া দিয়ো না।

(৪) পূজাশেষে কুমারী বললে, “ঠাকুর, আমাকে একটি মনের মতো বর দাও।” বর = আশীর্বাদ, স্বামী।

(৫) “অতি বড় বৃদ্ধ পতি সিদ্ধিতে নিপুণ।
কোন গুণ নাই তার কপালে আগুন ॥
কুকথায় পঞ্চমুখ কণ্ঠভরা বিষ।
কেবল আমার সঙ্গে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ।”

বৃদ্ধ = প্রবীণ, জ্ঞানী; সিদ্ধি = ভাঙ, মুক্তি; গুণ নাই = নির্গুণ, সত্ত্বরজস্তমঃ এই ত্রিগুণাতীত; কপালে আগুন = পোড়াকপাল, শিবের ললাটস্থিত অগ্নিনেত্র; কুকথা = কটূক্তি, আগম-নিগম-তত্ত্ব; পঞ্চমুখ = মুখর, পঞ্চানন; কণ্ঠভরা বিষ মুখে যেন বিষ মাখানো রহিয়াছে এমনই জ্বালাময়ী বাণী; সিতকণ্ঠ নীলকণ্ঠ হইয়াছেন, তাহারই ইঙ্গিত; দ্বন্দ্ব = ঝগড়া, মিলন। পক্তি-চতুষ্টয়ের প্রথম অর্থ : আমার স্বামী খুবই বৃদ্ধ, সিদ্ধি-ভাঙ খাইতে অত্যন্ত ওস্তাদ, কোনো গুণই তাহার নাই, এমন অপদার্থ স্বামীর মুখে আগুন লাগুক। তাহার মুখর মুখে কটুভাষা লাগিয়াই রহিয়াছে; যখন কথা বলে, মনে হয় মুখ দিয়া অনর্গল বিষ ঝরিতেছে। তাহার সহিত আমার দিনরাত ঝগড়া হয়।—এই বাহ্য অর্থের অন্তরালে আর একটি অন্তরঙ্গ অর্থ রহিয়াছে। সেই অর্থটি এই : আমার স্বামী দেবাদিদেব মহাদেব। সাধককে অষ্টসিদ্ধিদানে তিনি সিদ্ধহস্ত। সত্ত্বরজস্তমঃ এই ত্রিগুণাতীত পুরুষ তিনি। তাঁহার ভালে অগ্নিনেত্র বিরাজিত। তিনি পঞ্চানন, পঞ্চমুখে আমার সঙ্গে আগম-নিগম-তত্ত্ব আলোচনা করেন। সমুদ্রমন্থনজাত বিষ হইতে সৃষ্টিকে রক্ষা করিবার জন্য সিতকণ্ঠ তিনি বিষ পান করিয়া নীলকণ্ঠ নাম কিনিয়াছেন। তিনি আর আমি অর্ধনারীশ্বররূপে চিরন্তনমিলনে আবদ্ধ। [ নিন্দাচ্ছলে এইরূপ স্তুতিকে ব্যাজস্তুতি অলংকারও বলে। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ঈশ্বরী পাটনীর নিকট অন্নদার কৌশলে আত্মপরিচয়দানের দশম চরণ হইতে ষড়বিংশ চরণ পর্যন্ত অংশটুকু শ্লেষ তথা ব্যাজস্তুতি অলংকারের চমৎকার উদাহরণ। ]

(৬) “বাজে পূরবীর ছন্দে রবির শেষ রাগিণীর বীন।” রবীন্দ্রনাথ। পূরবী = গোধূলির রাগিণীবিশেষ, ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ। রবি = সূর্য, রবীন্দ্রনাথ। প্রথম অর্থ : পূরবী রাগিণীতে বিদায়কালীন সূর্যের বিষণ্ণ মূর্ছনা শোনা যাইতেছে। দ্বিতীয় অর্থ : ‘পূরবী’ কাব্যরচনার সময়ে কবির দিনগুলি জীবনসায়াহ্নের গোধূলি—আলোকে রঞ্জিত। [ পূরবীর প্রথম প্রকাশ বাংলা ১৩৩২ সালে—রবীন্দ্রনাথের বয়স তখন চৌষট্টি বৎসর। ]

(৭) গরিবের ভাঙা কুঁড়েয় জ্যোৎস্নার এমন প্রসন্ন পদার্পণ—এ যে আশাতীত! জ্যোৎস্না = চাঁদের আলো, জ্যোৎস্না-নাম্নী বালিকা।

(৮) “ছাত্রগণ পরীক্ষার পাসের হারকে উচ্চে তুলে সরস্বতীর গলায় পরিয়ে দিক, এটাই কামনা করি।” —কবিশেখর।

(৯) বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের মুখে বেদের বাণীই বটে!

বেদের বাণী = বেদোক্ত সূক্তি, নীচ বেদে-সুলভ অশ্লীল উক্তি।

(১০) “বুঝহ ঈশ্বরী আমি পরিচয় করি।”

ঈশ্বরী = পরমেশ্বরী অন্নদা, ঈশ্বরী পাটনী।

যমক ও শ্লেষ অলংকারের পার্থক্য : যমক অলংকারে একটি শব্দ একাধিকবার প্রযুক্ত হইয়া ভিন্ন ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে; কিন্তু শ্লেষে শব্দটি একবারমাত্র প্রযুক্ত হইয়া একাধিক অর্থ প্রকাশ করে।

[ ইংরেজী Pun-এর সহিত যমক ও শ্লেষ অলংকারের কিছুটা সাদৃশ্য রহিয়াছে। ]

অর্থালংকার

অর্থালংকার বহুসংখ্যক; তন্মধ্যে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক, ব্যতিরেক ও সমাসোক্তি প্রধান। এগুলি সবই সাদৃশ্যমূলক অলংকার।

উপমা

উপমা অলংকার আলোচনা করিবার পূর্বে কয়েকটি সংজ্ঞা জানিয়া লওয়া প্রয়োজন।

২১৭। উপমেয় : প্রধান আলোচ্য বিষয়—যাহাকে তুলনার বিষয়ীভূত করা হয়—তাহাকে উপমেয় বলে। চাঁদের মতো সুন্দর মুখ। বক্তা এখানে মুখ-এর সম্বন্ধেই বলিতে চান; মুখ হইতেছে উপমেয়।

২১৮। উপমান : যে বিজাতীয় বস্তুটির সহিত উপমেয়ের তুলনা দেওয়া হয় তাহাকে উপমান বলে। মুখটি কত সুন্দর তাহা বুঝাইবার জন্য বিজাতীয় বস্তু চাঁদকে আনা হইয়াছে। সুতরাং চাঁদ এখানে উপমান। চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, তারা, নদী, সাগর, পদ্ম, পাখি, দীপ, অগ্নি, বজ্র, বিদ্যুৎ, সিন্ধু, শার্দূল, ক্ষেত্র, মন্দির, ভ্রমর, মধুকর, মৌমাছি, পিঞ্জর প্রভৃতি শব্দগুচ্ছ বিখ্যাত উপমান।

মনে রাখিও, একজনের মুখের সঙ্গে আর একজনের মুখের তুলনা দিলে বা নদীজলের সঙ্গে সাগরজলের তুলনা দিলে উপমেয়-উপমান সম্পর্কটি আদৌ আসিবে না।

২১৯। সাধারণধর্ম : যে গুণটি উপমেয় উপমান উভয়েতেই বিদ্যমান তাহাকে সাধারণধর্ম বলে। আমাদের দেওয়া উদাহরণটিতে সুন্দর কথাটি হইতেছে সাধারণধর্ম। মুখও সুন্দর, চাঁদও সুন্দর। অতএব সুন্দর কথাটিই উপমানের সহিত উপমেয়ের তুলনা সম্ভব করিতেছে। “সুন্দর” এই সাধারণধর্মটি এখানে গুণগত। সাধারণধর্ম শুধু গুণগতই হয় না, অবস্থাগত, ক্রিয়াগত অথবা গুণ-অবস্থা-ক্রিয়ার মিশ্রণগতও হইতে পারে।

মনে রাখিও, দুইটি বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে এই যে গুণগত বা ক্রিয়াগত বা অবস্থাগত সাধারণধৰ্ম, ইহা কৰিকল্পনালব্ধ; বাস্তবের সহিত ইহার সম্পর্ক থাকিতে পারে, নাও থাকিতে পারে।

২২০। সাদৃশ্যবাচক শব্দ : উপমানের সহিত উপমেয়ের তুলনা বুঝাইবার জন্য ন্যায়, মতো, সম, পারা, নিভ, তুল, যথা, যেমতি, মতন, হেন, তুল্য, সঙ্কাশ, যেন, বৎ প্রভৃতি যে-সব শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহাদিগকে সাদৃশ্যবাচক শব্দ বলে।

এইবার উপমা অলংকার কাহাকে বলে দেখা যাক—

২২১। উপমা : একই বাক্যে দুইটি বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে তুলনা করিয়া যে চমৎকারিত্ব সৃষ্টি করা হয় তাহাকে উপমা অলংকার (Simile) বলে। উপমায় বিজাতীয় বস্তু দুইটির বিরুদ্ধ ধর্মের কোনো উল্লেখই থাকে না।

(১) “ননীর মতো শয্যা কোমল পাতা।”—কবিশেখর। এখানে আলোচ্য বিষয় শয্যা = উপমেয়। বিজাতীয় বস্তু ননীর সহিত শয্যার তুলনা করা হইতেছে, অতএব ননী = উপমান। উপমেয় উপমান একই বাক্যে রহিয়াছে। কোমল সাধারণধর্ম (গুণগত)। মতো = সাদৃশ্যবাচক শব্দ। অতএব অলংকার হইতেছে উপমা। উপমার চারিটি অঙ্গই এখানে উল্লিখিত রাইয়াছে বলিয়া অলংকারটি পুর্ণোপমা।

২২২। পূর্ণোপমা : যে উপমায় উপমেয়, উপমান, সাধারণধর্ম এবং সাদৃশ্যবাচক শব্দ—এই চারিটি অঙ্গই উল্লিখিত থাকে তাহাকে পূর্ণোপমা (পূর্ণ + উপমা) বলে।

(২) “আনিয়াছি ছুরি তীক্ষ্ণ দীপ্ত প্রভাতরশ্মিসম।”—রবীন্দ্রনাথ।

ছুরি = উপমেয়; প্রভাতরশ্মি = উপমান; তীক্ষ্ণ, দীপ্ত = সাধারণধর্ম; সম সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

(৩) “শুভ্র ললাটে ইন্দুসমান ভাতিছে স্নিগ্ধ শান্তি।” —রবীন্দ্রনাথ।

শান্তি = উপমেয়; ইন্দু = উপমান; সাধারণধর্ম = শোভা পাইতেছে (ভাতিছে)—ক্রিয়াগত। সমান = সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

(৪) “হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে, ময়ূরের মতো নাচে রে, হৃদয় নাচে রে।” —রবীন্দ্রনাথ।

হৃদয় = উপমেয়; ময়ূর = উপমান; নাচে = সাধারণধর্ম (ক্রিয়াগত); মতো সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

(৫) “জ্যোৎস্না নামে মৃদুপদে ঝাঁপি লয়ে লক্ষ্মীর মতন।”—প্রমথনাথ। জ্যোৎস্না = উপমেয়; লক্ষ্মী = উপমান; নামে = সাধারণধর্ম (ক্রিয়াগত); মতন = সাদৃশ্যবাচক শব্দ

(৬) “যখনই দাঁড়াবে তুমি সম্মুখে তাহার, তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে।”—রবীন্দ্রনাথ।

সে (অত্যাচারী) = উপমেয়; পথকুকুর = উপমান; মিশে যাবে = সাধারণ—ধর্ম (ক্রিয়াগত); মতো = সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

(৭) “ইংরেজীসমুদ্রে তাঁহারা যে কাঠবিড়ালির মতো বালির বাঁধ নির্মাণ করিতেছেন সেটুকু বুঝিবার শক্তিও তাঁহাদের ছিল না।”—রবীন্দ্রনাথ।

তাঁহারা = উপমেয়; কাঠবিড়ালি = উপমান; বাঁধ নির্মাণ করিতেছেন সাধারণধর্ম (ক্রিয়াগত); মতো = সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

(৮) “ছিনু মোরা সুলোচনে! গোদাবরী-তীরে,
কপোত-কপোতী যথা উচ্চ বৃক্ষচূড়ে—
বাঁধি নীড় থাকে সুখে।” —মধুকবি

মোরা (রাম ও সীতা) = উপমেয়; কপোত-কপোতী = উপমান; যথা = সাদৃশ্যবাচক শব্দ; সুখে থাকে = সাধারণধর্ম (অবস্থাগত)।

(৯) “বরিষার ধারামত অজস্র জননীপ্রেম।” —নবীনচন্দ্ৰ।

জননীপ্রেম = উপমেয়; বরিষার ধারা = উপমান; অজস্র = সাধারণধর্ম; মত = সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

(১০) বিদ্যুৎ-ঝলা সম চমকি
উড়িল কলম্বকুল অম্বর-প্রদেশে।” —মধুসূদন।

কলম্বকুল (বাণগুলি) = উপমেয়; বিদ্যুৎ-ঝলা = উপমান; চমকি (চকমক করে—অসমাপিকা ক্রিয়া) = সাধারণধর্ম (ক্রিয়াগত); সম = সাদৃশ্যবাচক শব্দ।

পূর্ণোপমার আরও কয়েকটি উদাহরণ : (ক) “চঞ্চল আলো আশার মতন কাঁপিছে জলে।”—রবীন্দ্রনাথ। (খ) “খণ্ডমেঘগণ মাতৃস্তন্যপানরত শিশুর মতন।”—ঐ। (গ) “আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগলপারা। “ (সাদৃশ্যবাচক শব্দ পারা)–ঐ। (ঘ) “এও যে রক্তের মতো রাঙা দুটি জবাফুল।”—ঐ। (ঙ) “বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি সন্ধ্যাতারাসম রহে ফুটি।”—ঐ। (চ) “তুই শুধু, ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো ….. সারাদিন বাজাইলি বাঁশি।”—ঐ। (ছ) “অঙ্গপরিমল সুগন্ধি চন্দনকুঙ্কুমকস্তুরীপারা।”—চণ্ডীদাস। (জ) “জনগণে যারা জোঁকসম শোষে তারে মহাজন কয়।”—নজরুল। (ঝ) “সিন্দুরবিন্দু শোভিল ললাটে, গোধূলিললাটে, আহা! তারারত্ন যথা।”—মধুকবি। (ঞ) “হাজার হাজার সৈন্য পলাশীর মাঠে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল।”—শচীন সেনগুপ্ত। (ট) “নাচায় পুতুল যথা দক্ষ বাজিকরে, নাচাও তেমতি তুমি অর্বাচীন নরে।” নবীনচন্দ্র। (ঠ) বিকশিত পদ্মসম এই নীল আঁখিদুটি অর্পিব চরণে তব। (ড) “রবীন্দ্রনাথের গান সিন্ধুপারের পাখির মতো ঝাঁক বাঁধিয়া আসিত।—এক এক ঝাঁকে এক এক জাতের পাখি।”—প্রমথনাথ বিশী। (ঢ) “পক্ষ্ম অগ্রভাগে দুলিল অশ্রুর বিন্দু, শিশির যেমতি শিরীষ-কেশরে।”—মোহিতলাল।

২২৩। লুপ্তোপমা : যেখানে উপমেয়, উপমান, সাধারণধর্ম ও তুলনাবাচক শব্দ—এই চারিটি অঙ্গের যেকোনো একটি বা একাধিক অঙ্গ অনুল্লিখিত থাকে, সেখানে লুপ্তোপমা (লুপ্ত + উপমা) হয়।

(১) “পিছন হইতে দেখিনু কোমলগ্রীবা
লোভন হয়েছে রেশমচিকন চুলে।” —রবীন্দ্রনাথ।

চুল = উপমেয়; রেশম = উপমান; চিকন = সাধারণধর্ম; সাদৃশ্যবাচক শব্দ লুপ্ত রহিয়াছে। রেশমচিকন এই উপমান কর্মধারয় সমাসবদ্ধ পদটিকে ভাঙিলে (রেশমের মতো চিকন) সাদৃশ্যবাচক শব্দ মতো পাওয়া যাইবে।

(২) “তিলেক না দেখি ও চাঁদবদন মরমে মরিয়া থাকি।”—চণ্ডীদাস। বদন = উপমেয়; চাঁদ = উপমান; সাধারণধর্ম ও সাদৃশ্যবাচক শব্দ এখানে লুপ্ত। চাঁদবদন এই উপমিত কর্মধারয় সমাসবদ্ধ পদটিকে ভাঙিয়া (বদন চাঁদের মতো) সাদৃশ্যবাচক পদটি পাওয়া যায়। কিন্তু সাধারণধর্মটি (সুন্দর বা লাবণ্যময় এখনও কল্পনাসাপেক্ষ।

(৩) “বন্দি তাঁর পাদপদ্ম শিবাজি সঁপিছে অদ্য
তাঁরে নিজ রাজ্য-রাজধানী।“ -রবীন্দ্রনাথ।

উপমেয়; পদ্ম = উপমান; সাধারণধর্ম ও সাদৃশ্যবাচক শব্দ লুপ্ত। পাদপদ্ম এই উপমিত কর্মধারয় সমাসবদ্ধ পদটি বিশ্লেষণ করিয়া (পাদ পদ্মের মতো) সাদৃশ্যবাচক পদ মতো পাওয়া গেল। সাধারণধর্ম (পবিত্র ও সুন্দর) এখনও কল্পনাসাপেক্ষ।

(৪) “বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।” —সঞ্জীবচন্দ্র।

এখানে সাদৃশ্যবাচক শব্দ যেমন লুপ্ত রহিয়াছে।

(৫) “যম-সম শীত তাহে নিরমিল বিধি।” -কবিকঙ্কণ।

এখানে বেদনাদায়ক এই সাধারণধর্মটি লুপ্ত।

(৬) লতানমনীয় পরশ তোমার রাখ কপোলের ‘পরে।

এখানে সাদৃশ্যবাচক শব্দটি লুপ্ত।

(৭) “কমলদলজল জীবন টলমল।” -গোবিন্দদাস।

এখানে সাদৃশ্যবাচক শব্দটি লুপ্ত।

(৮) “বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।” —জীবনানন্দ দাশ।

চোখ = উপমেয়; পাখির নীড় = উপমান; মতো = সাদৃশ্যবাচক শব্দ; (শান্তস্নিগ্ধ) সাধারণথমটি লুপ্ত।

(৯) “মৃত্যুর গর্জন শুনেছে সে সঙ্গীতের মতো।” -রবীন্দ্রনাথ।

এখানে মধুর সাধারণধর্মটি লুপ্ত।

(১০) “আয় বিধু আয় বুকে, চুমা খাই চাঁদমুখে।” —রবীন্দ্রনাথ।

(১১) “কণ্টক গাড়ি কমলসম পদতল
মঞ্জীর চীর হি ঝাঁপি।” -গোবিন্দদাস।

(১২) “শিবপুজো করে শিবের মতো স্বামী পেয়েছিলাম।”—গিরিশচন্দ্র। এখানে আত্মভোলা এই সাধারণধর্মটি লুপ্ত।

(১৩) “তড়িত-বরনী হরিণ-নয়নী দেখিনু আঙিনা-মাঝে।”—চণ্ডীদাস। এখানে উপমান, সাধারণধর্ম, সাদৃশ্যবাচক শব্দ কোনোটাই নাই। আছে মাত্র উপমেয়—রাধা, তাও বিশেষিত অবস্থায়। তড়িত-বরনী ও হরিণ-নয়নী এই দুইটি উপমাত্মক বহুব্রীহি সমাসনিষ্পন্ন পদ বিশ্লেষণ করিয়া যথাক্রমে “তড়িতের বরনের ন্যায় শুভ্র বরন যাহার” এবং “হরিণীর নয়নের ন্যায় চঞ্চল নয়ন যাহার” ব্যাসবাক্য দুইটিত্বে উপমার পূর্ণরূপটি পাইলাম। বিচিত্র একটি উদাহরণ।

(১৪) “রঞ্জিত মেঘের মাঝে তুষার-ধবল
তোমার প্রাসাদ-সৌধ। “

—রবীন্দ্রনাথ।

তুষার-ধবল = তুষারের মতো ধবল (উপমান কর্মধারয়); প্রাসাদ-সৌধ : উপমেয়, তুষার = উপমান, ধবল = সাধারণধর্ম; এখানে সাদৃশ্যবাচক শব্দটি (মতো) লুপ্ত।

(১৫) “এ ব্রহ্মাণ্ডে যাহা যত গভীর, যত সীমাহীন—তাহা ততই অন্ধকার। অগাধ বারিধি মসিকৃষ্ণ।”—শরৎচন্দ্র। এখানেও সাদৃশ্যবাচক শব্দ লুপ্ত।

(১৬) “হে অমর পরীক্ষিৎ, শালপ্রাংশু মহাভুজ রথী।”—কবিশেখর। সাদৃশ্যবাচক শব্দটি এখানেও লুপ্ত।

(১৭) “আমাদের প্রিয়তমা অগ্নিকল্পা কবিতাকল্পনা।”—বুদ্ধদেব বসু কল্পা

মতো। এখানে সাধারণধর্ম লুপ্ত।

(১৮) “শরদিন্দুনিভাননী প্রমীলা সুন্দরী।”—মধুকবি। এখানে আনন (মুখ) = উপমেয়; শরদিন্দু (শরতের চাঁদ) = উপমান; নিভ (মতো) = সাদৃশ্যবাচক শব্দ; সাধারণধর্মটি (লাবণ্যপূর্ণ, সুন্দর) এখানে লুপ্ত।

(১৯) “দুগ্ধফেনশয়ন করি আলা
স্বপ্ন দেখে ঘুমায়ে রাজবালা।” —রবীন্দ্রনাথ।

দুগ্ধফেনশয়ন দুগ্ধফেনের মতো শয়ন (শয্যা) (উপমান কর্মধারয়)। সাদৃশ্যবাচক শব্দ (মতো) এবং সাধারণধর্ম (শ্বেতশুভ্র ও কোমল) উভয়ই লুপ্ত।

(২০) “ মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে
কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।” —রবীন্দ্রনাথ।

এখানে উপমান ও সাদৃশ্যবাচক শব্দ দুটিই লুপ্ত।

উৎপ্রেক্ষা

২২৪। উৎপ্রেক্ষা : উপমেয়কে প্রবল সাদৃশ্যবশতঃ যদি উপমান বলিয়া উৎকট সংশয় হয়, তাহা হইলে উৎপ্রেক্ষা অলংকার হয়।

উৎপ্রেক্ষায় উপমেয় উপমান দুইই উল্লিখিত তাকে। তবে উপমেয়টি এমনই উৎকর্ষ পায় যে ইহাকে উপমান বলিয়া প্রবল সংশয় জন্মে। এই সংশয়ই হইতেছে উৎপ্রেক্ষা অলংকারের প্রাণ। একটি উদাহরণ লওয়া যাক।—

(১) “গ্রাসগুলি তোলে যেন তে-আঁঠিয়া তাল।”—কবিকঙ্কণ। এখানে প্রধান বক্তব্যবিষয় গ্রাস = উপমেয়। কিন্তু এই গ্রাসগুলি এমনই বৃহদাকার যে ইহাদিগকে গ্রাস বলিয়া মনে হইতেছে না, উপমান তে-আঁঠিয়া তাল বলিয়া দারুণ সংশয় জাগিতেছে। যেন শব্দটি সেই সংশয়কে আরও ঘনীভূত করিয়া তুলিতেছে।

উৎপ্রেক্ষা দুই রকমের—বাচ্যোৎপ্রেক্ষা ও প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা।

২২৫। বাচ্যোৎপ্রেক্ষা : যেখানে সম্ভাবনা-সূচক যেন, মনে হয়, মনে গণি, জনু (যেন) ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ থাকে, সেখানে বাচ্যোৎপ্রেক্ষা হয়।

২২৬। প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা : যেখানে সংশয়বাচক শব্দের উল্লেখ থাকে না, অথচ অর্থ হইতে এই সংশয়ের ভাবটি বেশ বুঝিতে পারা যায়, সেখানে প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা অলংকার হয়।

বাচ্যোৎপ্রেক্ষার উদাহরণ

(২) “বসিলা যুবতী
পদতলে। আহা মরি, সুবর্ণদেউটি
তুলসীর মূলে যেন জ্বলিল।” —শ্রীমধুসুদন।

রক্ষোবধূ সুন্দরী সরমা আসিয়া অশোককাননে বন্দিনী পূতচরিত্রা সীতার পদতলে বসিলেন। দেখিয়া কবির মনে হইল—পবিত্র তুলসীর মূলে যেন একটি স্নিগ্ধ সোনার প্রদীপ শোভা পাইল। দীপ্তির ঔজ্জ্বল্যে ও স্নিগ্ধতায় উপমেয় যুবতীকে উপমান সুবৰ্গদেউটি বলিয়া দারুণ সংশয় জাগিতেছে। তদ্রূপ পবিত্রতার উৎকর্ষে উপমেয় সীতাকে উপমান তুলসীবৃক্ষ বলিয়া মনে হইতেছে। সংশয়বাচক শব্দ যেন উল্লিখিত থাকিয়া উপমান-পক্ষে সংশয়টিকে আরও ঘনীভূত করিয়া তুলিতেছে।

(৩) “সন্ধ্যারাগে ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা
আঁধারে মলিন হল, যেন খাপে ঢাকা
বাঁকা তলোয়ার।” —রবীন্দ্রনাথ।

উপমেয় হইতেছে বক্রগতি ঝিলমের স্রোত ও আঁধার। উপমান যথাক্রমে তলোয়ার ও খাপ। বঙ্কিমগতি ঝিলমের আলোঝলমল স্রোতের উপর আঁধার নামিল দেখিয়া কবির মনে হইল বাঁকা ঝকঝকে তলোয়ারটিকে কে যেন খাপে পুরিয়া দিল। সংশয়বাচক শব্দ যেন বাক্যে উল্লিখিত রহিয়াছে।

(৪) “চঞ্চল লোচনে বঙ্ক নেহারনি অঞ্জন শোভন তায়,
জনু ইন্দীবর পবনে ঠেলল অলিভরে উলটায়।” -বিদ্যাপতি।

কবি রাধার অঞ্জনশোভিত চঞ্চল লোচনের বক্র দৃষ্টি দেখিতেছেন। কিন্তু তাঁহার মনে হইতেছে—অলির ভরে উলটাইয়া-পড়া বায়ু-আন্দোলিত ইন্দীবর দেখিতেছেন। এখানে উপমেয় অঞ্জন, চঞ্চল লোচন ও বঙ্ক নেহারনিকে প্রবল ভাবসাদৃশ্যবশতঃ উপমান যথাক্রমে অলি, বায়ু-আন্দোলিত ইন্দীবর ও উলটাইয়া-পড়া ভাব বলিয়া উৎকট সংশয় জাগিতেছে। সংশয়বাচক শব্দ জনু উল্লিখিত রহিয়াছে।

(৫) “এল দিয়ী দিগ্‌গজ বীরপণ্ডিত ব্ৰজধামে,
যেন রণমদে মত্ত দন্তী পঙ্কজবনে নামে।” —কবিশেখর।

উপমেয় পণ্ডিত ও ব্রজধামকে প্রবল সাদৃশ্যবশতঃ উপমান যথাক্রমে দন্তী ও পঙ্কজবন বলিয়া দারুণ সংশয় জাগিতেছে। সংশয়বাচক শব্দ যেন উল্লিখিত। (৬) “ওর কপালখানা যেন সাতমহলা বাড়ির সিংহদ্বার। বাহুদুটো যেন কোন্ দুর্গম দুর্গের লোহার অর্গল।” —রবীন্দ্রনাথ।

(৭) “ধরণী এগিয়ে এসে দেয় উপহার;
ও যেন কনিষ্ঠা মেয়ে দুলালী আমার।” -নজরুল।

(৮) সজল চোখে সে নীরবে চেয়ে রইল আমার দিকে—যেন শিশির-টলমল দুটি নীলপদ্ম!

(৯) “কাঁপিয়া ক্ষীণস্বর মরিয়া যায় বৃহৎ সভাগৃহকোণে
ক্ষুদ্রপাখি যেন ঝড়ের মাঝে উড়িতে নারে প্রাণপণে।”

(১০) “অর্ধনগ্ন বালুচর
দূরে আছে পড়ি—যেন দীর্ঘ জলচর
রৌদ্র পোহাইছে।” —রবীন্দ্রনাথ।

উপমেয় অর্ধমগ্ন বালুচরকে উপমান জলচর বলিয়া দারুণ সংশয় জাগিতেছে। সংশয়বাচক শব্দটিও উল্লিখিত।

(১১) “ননুঞাবদনী ধনী বচন কহসি হসি
অমিয় বরষে যেন শরদপূণিমশশী।”

—বিদ্যাপতি।

(১২) “যখন এই তরণীসকল শুভ্র পাল তুলিয়া শ্রেণীবদ্ধভাবে সমুদ্রযাত্রায় বাহির হয়, তখন মনে হয় রাজহংসশ্রেণী পক্ষবিস্তার করিয়া নীল আকাশে ভাসিয়া চলিয়াছে।” —শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়।

(১৩) “সীতাহারা আমি যেন মণিহারা ফণী। —কৃত্তিবাস ওঝা

(১৪) “এ নিদাঘ যেন প্রেমাভিনয়ের বিরহ অঙ্কখানি;
দুৰ্ব্বাসা যেন অভিশাপ হানি দেয় ব্যবধান আনি।” –কালিদাস।

এখানে কবির বর্ণনীয় বিষয়টি হইতেছে প্রচণ্ড গরম।

(১৫) “পড়ুক দুফোঁটা অশ্রু জগতের ‘পরে
যেন দুটি বাল্মীকির শ্লোক!“ —রবীন্দ্রনাথ।

যে অশ্রু ঝরিয়া পড়িবে, তাহা বাল্মীকির শ্লোকের মতোই পবিত্র এবং লাবণ্যরসে পূর্ণ।

-প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষার উদাহরণ—

প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষায় সম্ভাবনাসূচক শব্দ উল্লিখিত থাকে না বলিয়া উপমান কর্তৃক উপমেয়কে গ্রাসের মাত্রা আরও একটু বেশী বলিয়া মনে হয়।

(১) “কি পেখলু নটবর গৌরকিশোর।
অভিনব হেমকল্পতরু সঞ্চরু
সুরধুনীতীরে উজোর।” —গোবিন্দদাস।

নটবর গৌরকিশোরকে ভাগীরথীতীরে সঞ্চরণ করিতে দেখা গেল। কবির মনে হইল যেন কোনো স্বর্ণকল্পবৃক্ষ সুরধুনীতীর উজ্জ্বল করিয়া চলিয়াছে। ‘যেন’র ভাবটি ব্যঞ্জনায় পাওয়া গেল বলিয়া অলংকার প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা।

(২) “সুন্দর মুখে নিলীন হাসিটি তব
বিকচ পদ্মে লাবণ্য অভিনব।”

সুন্দর মুখে নিলীন হাসি হইতেছে উপমেয়। কিন্তু সেই হাসিটি এমনই মধুর ও লাবণ্যময় যে কবির মনে হইতেছে, সুন্দর মুখের মধুর হাসি তিনি দেখিতেছেন না, বিকচ পদ্মের অভিনব লাবণ্যকেই দেখিতেছেন। উপমেয় সুন্দর মুখের হাসিটিকে উপমান বিকচ পদ্মের লাবণ্য বলিয়া দারুণ সংশয় জাগিতেছে। কিন্তু সংশয়বাচক শব্দটি বাক্যে উল্লিখিত না থাকায় অলংকার প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা।

(৩) “এসেছে বরষা, এসেছে নবীনা বরষা,
গগন ভরিয়া এসেছে ভুবনভরসা—
দুলিছে পবনে সনসন বনবীথিকা,
গীতময় তরুলতিকা
শতেক যুগের কবিদলে মিলি আকাশে
ধ্বনিয়া তুলিছে মত্তমদির বাতাসে,
শতেক যুগের গীতিকা
শতশতগীতমুখরিত বনবীথিকা।” —রবীন্দ্রনাথ।

ঘনগৌরবে নবযৌবনা বর্ষা আসিয়াছে। তাই বিশ্বে আনন্দগান বাজিয়া উঠিয়াছে। “এত গভীর, এত বিপুল, এত ব্যাপক” সে সঙ্গীত যে কবির মনে হইতেছে যেন যুগযুগান্তরের অসংখ্য কবি একসঙ্গে যুগযুগান্তরের সঙ্গীত ধ্বনিত করিয়া তুলিতেছেন। সম্ভাবনাবাচক যেন উল্লিখিত না থাকিলেও প্রতীয়মান হইতেছে।

(৪) “লুটায় মেখলাখানি ত্যজি কটিদেশ
মৌন অপমানে।” —রবীন্দ্রনাথ।

সুন্দরী তরুণী কটিদেশের অলংকার মেখলাখানি খুলিয়া শিলাতলে রাখিয়া স্নানের জন্য সরসীতে নামিয়াছেন। মেখলাখানি নিঃশব্দে সেখানে পড়িয়া রহিয়াছে। মেখলার এই মৌনী-ভাবের কারণ কী? কবি কল্পনা করিলেন, সুন্দরীর কটিতট হইতেছে মেখলার গৌরবময় আসন; সেই আসন হইতে সে বিচ্যুত। সেই অপমানবোধহেতু তাহার এই মৌনী-ভাব। কিন্তু কটিদেশের অলংকার মেখলার পক্ষে তো অপমানবোধ সম্ভব নয়, তাই ‘(যেন) মৌন অপমানে।’

(৫) “অন্যপাশে বিশাল শিমূল
সবটুকু বক্ষোরক্ত নিঙাড়িয়া ফুটাইয়া ফুল
অর্ঘ্য দেয় দিবাকরে।” —কবিশেখর

(৬) “বাইরে আলো, দুষ্ট ছেলে— মাঠে মাঠে বেড়ায় খেলে—
ধরার নয়ন ভরে স্বপন-আবেশে,
হেথায় আলো, লক্ষ্মী মেয়ে—করুণ চোখে রয় যে চেয়ে,
যায় কি পারা থাকতে ভাল না বেসে!” —প্রভাতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়।

রূপক

২২৭। রূপক : উপমেয়কে অস্বীকার না করিয়া তাহার উপর উপমানের অভেদ আরোপ করিলে রূপক অলংকার হয়। [ ইংরেজীর Metaphor অলংকারের সঙ্গে রূপকের কিছুটা মিল রহিয়াছে। ]

উপমেয় উপমান বস্তুগতভাবে পৃথক্ হইলেও উভয়ের মধ্যে অতিসাম্য বুঝাইবার জন্য কবিকল্পনায় উপমেয়ের উপর উপমানের অভেদ আরোপ করা হয়। উপমান উপমেয়কে আচ্ছন্ন করে বলিয়া রূপক অলংকারে উপমেয় স্নান হইয়া যায়; বাক্যমধ্যে উপমানেরই প্রাধান্য লক্ষিত হয়। বাক্যমধ্যে প্রাধান্য যাহার, ক্রিয়াটি তো তাহারই অনুগামী; সুতরাং রূপকে ক্রিয়াপদটি উপমানের অনুগত হয়। একটি উদাহরণ লওয়া যাক।—

(১) একথা শুনিয়া ক্রোধের আগুন জ্বলিয়া উঠিল তাঁহার।—এখানে উপমেয় ক্রোধ, কারণ ‘ক্রুদ্ধ হওয়া’ ভাবটিই বক্তার প্রধান বক্তব্যবিষয়। কিন্তু বাক্যমধ্যে ক্রোধের ভূমিকা গৌণ হইয়া গিয়াছে। উপমান আগুন ক্রোধকে আচ্ছন্ন করিয়া প্রাধান্য পাইতেছে। কারণ, জ্বলিয়া উঠা আগুনেরই পক্ষে সম্ভব, ক্রোধের পক্ষে নয়। ক্রোধ-এর উপর আগুন-এর অভেদ এমনভাবে আরোপিত হইয়াছে যে, ক্রোধে-আগুনে আর কোনো ভেদাভেদ থাকিতেছে না। অতএব অলংকার এখানে রূপক।

রূপক কর্মধারয় সমাসবদ্ধ পদ ও অভেদ-সম্বন্ধবাচক পদকে আশ্রয় করিয়া রূপক অলংকার হয়। রূপক কর্মধারয় সমাসবদ্ধ পদের পূর্বপদটি উপমেয় এবং উত্তরপদটি উপমান [৩৫০ পৃষ্ঠায় ১৫২ নং সূত্র দ্রষ্টব্য]। মাঝে মাঝে রূপক কর্মধারয় সমাসের ব্যাসবাক্যকে আশ্রয় করিয়াও রূপক অলংকার হয়। অভেদ—সম্বন্ধবাচক পদের ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্ত্যন্ত পদটি উপমেয় এবং পরপদটি উপমান হয়। [২৩০ পৃষ্ঠায় অভেদ-সম্বন্ধ দ্রষ্টব্য]

(২) “দয়াহীন সভ্যতানাগিনী তুলেছে কুটিল ফণা।”

—রবীন্দ্রনাথ।

উপমেয় সভ্যতা-র উপর নাগিনী-র অভেদ আরোপ করা হইয়াছে। বাক্যে এই উপমানেরই প্রাধান্য; কারণ ফণা তোলা নাগিনীর পক্ষেই সম্ভব।

(৩) খবর পেতেই মালতীর মুখে উঠল ফুটে খুশির শতদল।

(৪) “শোকের ঝড় বহিল সভাতে!” —শ্রীমধুসুদন।

(৫) “প্রবাসে দৈবের বশে জীবতারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে, নাহি খেদ তাহে।” —শ্রীমধুসুদন।

এখানে উপমেয় জীব ও দেহ, এবং ইহাদের উপমান যথাক্রমে তারা ও আকাশ। এখানে উপমানগুলিরই প্রাধান্য, কারণ আকাশ হইতে খসিয়া পড়া তারার পক্ষেই সম্ভব।

(৬) “প্লাবিয়াছ চারিধার কি সৌরভে লাবণ্যজোয়ারে।”—দেবেন্দ্ৰনাথ উপমেয় লাবণ্য; তাহার উপর উপমান জোয়ার-এর অভেদ আরোপ করা হইয়াছে। বাক্যমধ্যে জোয়ার-এর প্রাধান্য, কারণ প্লাবিত করা জোয়ারের পক্ষেই সম্ভব।

(৭) “জীবন-উদ্যানে তোর যৌবনকুসুমভাতি কতদিন রবে?” –মধুকবি।

(৮) “জীবনপ্রবাহ বহি কালসিন্ধু-পানে ধায় ফিরাব কেমনে?” –ঐ উপমেয় জীবন ও কাল; ইহাদের উপমান যথাক্রমে প্রবাহ ও সিন্ধু।

(৯) “আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনই পুড়িতে হয়।”

(১০) “এমন মান-জমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা।”

(১১) “বিরহপয়োধি পার কিয়ে পাওয়ব।” —বিদ্যাপতি।

এখানে উপমেয় হইতেছে বিরহ, তাহার উপমান পয়োধি। সাগর যেমন অতল, অন্তহীন, এই বিরহও তেমনি সুগভীর আর নিঃসীম। কিন্তু বাক্যমধ্যে প্রাধান্যটি কাহার? “পার হওয়া” ক্রিয়াটি পয়োধি-রই প্রাধান্য সূচিত করিতেছে। অতএব অলংকার এখানে রূপক।

(১২) “শিশুফুলগুলি তোমারে ঘেরিয়া ফুটে।” —যতীন্দ্রমোহন।

ফুটে ক্রিয়াটি উপমান ফুলগুলি-রই প্রাধান্য সূচিত করিতেছে।

(১৩) “আসল কথাটা চাপা দিতে ভাই কাব্যের জাল বুনি।”

(১৪) “দেহদীপাধারে জ্বলিত লেলিহ যৌবন—জয়শিখা।”—অচিন্ত্যকুমার। উপমেয় দেহ ও যৌবন, ইহাদের উপমান যথাক্রমে দীপাধার ও জয়শিখা।

(১৫) “যদিও সকল হাস্য-ফেনপুঞ্জ-তলে
জানি ক্ষুব্ধ ব্যথাসিন্ধু দোলে।” –প্রেমেন্দ্র মিত্র।

উপমেয় হাস্য ও ব্যথা, উপমান যথাক্রমে ফেনপুঞ্জ ও সিন্ধু।

(১৬) “বিকশিত বিশ্ববাসনার
অরবিন্দ-মাঝখানে পাদপদ্ম রেখেছ তোমার।” —রবীন্দ্রনাথ।

(১৭) “সংসার-সমরাঙ্গনে যুদ্ধ কর দৃঢ়পণে
ভয়ে ভীত হয়ো না মানব।“ -হেমচন্দ্ৰ।

(১৮) “শঙ্খধবল আকাশগাঙে শুভ্রমেঘের পালটি মেলে
জ্যোৎস্নাতরী বেয়ে তুমি ধরার ঘাটে কে আজ এলে।” —যতীন্দ্রমোহন বাগচী।

উপমেয় আকাশ, মেঘ ও জ্যোৎস্না; উপমান যথাক্রমে গাঙ, পাল ও তরী।

(১৯) “কালামানিকের মালা গাঁথি নিজগলে।
কানুগুণযশ কানে পরিব কুণ্ডলে ॥
কানু-অনুরাগ-রাঙাবসন পরিব।
কানুর কলঙ্কছাই অঙ্গেতে লেপিব।” —চণ্ডীদাস।

লুপ্তোপমায় যেখানে মাত্র উপমেয় ও উপমান উল্লিখিত থাকে, সেখানে রূপক অলংকারের সঙ্গে দ্বন্দ্ব লাগিবার সম্ভাবনা। কারণ, রূপকেও তো মাত্র উপমেয় আর উপমান উল্লিখিত থাকে। এরূপ ক্ষেত্রে সন্দেহ নিরসন করিবার উপায়টি জানিয়া রাখ। ক্রিয়াটিকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়া লও—বাক্যমধ্যে কাহার প্রাধান্য?—উপমেয়ের, না উপমানের? যদি উপমেয়ের প্রাধান্য থাকে, তবে অলংকার লুপ্তোপমা; যদি উপমানের প্রাধান্য থাকে, তবে অলংকার রূপক। আর যদি উপমেয় উপমান তুল্যমূল্য হয় তবে অলংকার হইবে উপমা-রূপকের সঙ্কর।

(ক) “নমি আমি, কবিগুরু, তব পদাম্বুজে।”—এখানে পদাম্বুজে পদটির আশ্রয়ে অলংকার হইয়াছে। কিন্তু পদটিকে কীরূপে ভাঙিব?—পদ অম্বুজের ন্যায় (উপমিত কর্মধারয়)? না, পদরূপ অম্বুজ (রূপক কর্মধারয়)? নমি ক্রিয়াটিকে জিজ্ঞাসা করিলেই আমাদের সন্দেহ দূর হইবে। প্রণাম করা কোথায় সম্ভব? পদে, না অম্বুজে? নিশ্চয় অম্বুজে নয়; পদেই প্রণাম সম্ভব। অতএব উপমেয় পদই প্রাধান্য পাইতেছে। অলংকার হইবে উপমা। সমাস হইবে “পদ অম্বুজের ন্যায়”—উপমিত কর্মধারয়। এ বিষয়ে ৩৫১-৩৫২ পৃষ্ঠায় প্রদত্ত আলোচনা দ্রষ্টব্য। কিন্তু—

(খ) বঙ্কিম-সূর্যের আবির্ভাবে বাঙালীর চিত্তশতদল প্রস্ফুটিত হইল।

প্রস্ফুটিত হওয়া শতদলের পক্ষেই সম্ভব বলিয়া অলংকার এখানে রূপক

(গ) সন্তানের মুখচন্দ্র মাতা হেরিলা আনন্দে।—এখানে দেখিলেন (হেরিলা) ক্রিয়াটিকে প্রশ্ন কর—কী দেখিলেন? মুখ? না, চাঁদ? মুখও দেখা সম্ভব, আবার চাঁদও দেখা সম্ভব। এখানে নিশ্চিতরূপে একক উপমেয় বা উপমানের প্রাধান্য নাই। অথচ দুই-এরই মূল্য রহিয়াছে। সুতরাং এরূপস্থলে অলংকার হইবে উপমা-রূপকের সঙ্কর।

রূপক ও উৎপ্রেক্ষার পার্থক্যটি অতি সূক্ষ্ম। উৎপ্রেক্ষা সন্দেহ-সংশয়মূলক অলংকার, কিন্তু রূপকে উপমানেরই প্রাধান্য সংশয়াতীতরূপে প্রতিষ্ঠিত।

ব্যতিরেক

২২৮। ব্যতিরেক : উপমান অপেক্ষা উপমেয়ের উৎকর্ষ (কখনও বা অপকর্ষ) দেখানো হইলে ব্যতিরেক অলংকার হয়। [ ইংরেজীর Hyperbole-এর সঙ্গে ব্যতিরেকের সাদৃশ্য রহিয়াছে। ]

ব্যতিরেক কথাটির অর্থ হইতেছে ভেদ বা পৃথকীকরণ; এইজন্য ব্যতিরেক হইতেছে ভেদপ্রধান অলংকার। উপমান অপেক্ষা উপমেয় কেন উৎকৃষ্ট বা নিকৃষ্ট হইতেছে, সেই কারণটি কোথাও উল্লিখিত থাকে, কোথাও বা অনুক্ত থাকে। ব্যতিরেক বুঝাইবার জন্য সাধারণতঃ জিনি, ছার, গঞ্জি, নিন্দী, নিন্দিত, বিনিন্দী, বিনিন্দিত প্রভৃতি শব্দের প্রয়োগ হয়। সাদৃশ্যবাচক শব্দেরও উল্লেখ কোথাও কোথাও থাকে।

ব্যতিরেক বুঝা যায় তিনটি উপায়ে—(১) ব্যতিরেকজ্ঞাপক শব্দ বা সাদৃশ্যবাচক শব্দের দ্বারা, (২) অর্থের সাহায্যে ও (৩) ব্যঞ্জনায়।

(১) “অকলঙ্ক মুখ তব কলঙ্কী চন্দ্রের মতো নহে।” –শ্যামাপদ চক্রবর্তী। উপমান চন্দ্র অপেক্ষা উপমেয় মুখের উৎকর্ষ দেখানো হইয়াছে। কারণ চাঁদ কলঙ্কী (কলঙ্ক আছে যাহার), মুখ অকলঙ্ক। সাদৃশ্যবাচক শব্দটিও উল্লিখিত।

(২) “কে বলে শারদশশী সে মুখের তুলা—
পদনখে পড়ে তার আছে কতগুলা!” –ভারতচন্দ্র।

উপমান শারদশশী অপেক্ষা উপমেয় মুখের উৎকর্ষ দেখানো হইতেছে। যাঁহার পদনখে কয়েকটি শারদশশী পড়িয়া আছে, তাঁহার মুখের সহিত শারদশশীর তুলনাই হইতে পারে না। এখানে লক্ষ্য কর—ব্যতিরেকবাচক কোনো শব্দের প্রয়োগ নাই, অথচ ব্যঞ্জনায় উপমেয়ের উৎকর্ষ বুঝা যাইতেছে।

(৩) “বরঞ্চ ত্যজিয়ে মণি ক্ষণেক বাঁচয়ে ফণী;
ততোধিক শূলপাণি ভাবে উমা-মারে।” –কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।

উপমান ফণী ও মণি অপেক্ষা উপমেয় যথাক্রমে শূলপাণি ও উমার উৎকর্ষ দেখানো হইতেছে। ফণীর পক্ষে মণিশূন্য অবস্থায় বাঁচিয়া থাকা বরং সম্ভব, কিন্তু শূলপাণির পক্ষে আমার উমাকে ছাড়িয়া বাঁচিয়া থাকা আদৌ সম্ভব নয়। [ রানী মেনকার প্রতি গিরীশের উক্তি ]

(৪) “নবীননবনীনিন্দিত করে দোহন করিছ দুগ্ধ।” —রবীন্দ্রনাথ।

উপমান নবীন নবনী অপেক্ষা উপমেয় কর-এর উৎকর্ষ দেখানো হইতেছে। কারণ, কর কোমলতায় নবীন নবনীকেও ছাড়াইয়া যাইতেছে (নিন্দিত)। [ নিন্দিত শব্দটি ব্যাকরণ-সঙ্গত না হইলেও বহু শতাব্দী ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে। হওয়া উচিত বিনিন্দী। ]

(৫) “দশন কুন্দকুসুমনিন্দু, বদন জিতল শারদ-ইন্দু।” —জগদানন্দ।

উপমেয় বদন ও দর্শনের উৎকর্ষ দেখানো হইতেছে; কারণ, বদন তাহার উপমান শারদ-ইন্দুকে সৌন্দর্য-সুষমায় হারাইয়া দিয়াছে (জিতল); আর দশন তাহার উপমান কুন্দকুসুমকে কান্তিদ্যুতিতে ছাড়াইয়া গিয়াছে (নিন্দু)।

(৬) “দেখ আসি সুখে
রোহিণীগঞ্জিনী বধূ; পুত্র যার রূপে
শশাঙ্ক কলঙ্কী মানে।“ —শ্রীমধুসূদন।

বধূর রূপ রোহিণীকেও গঞ্জনা দেয়; আর পুত্রের রূপের কাছে শশাঙ্ক ও নিজেকে কলঙ্কযুক্ত মনে করে (কলঙ্কী)। সুতরাং উপমান রোহিণী ও শশাঙ্ক অপেক্ষা যথাক্রমে উপমেয় বধূ (প্রমীলা) ও পুত্র ( মেঘনাদ) উৎকর্ষ পাইতেছে।

(৯) “এই দুটি
নবনীনিন্দিত বাহুপাশে সব্যসাচী
অর্জুন দিয়াছে আসি ধরা।” —রবীন্দ্রনাথ।

অর্জুনের প্রতি চিত্রাঙ্গদার উক্তি।

(৮) “গতি জিনি গজরাজ,
কেশরী জিনিয়া মাঝ,
মোতিপাঁতি জিনিয়া দশন ॥
দুই চক্ষু জিনি নাটা
ঘুরে যেন কড়ি ভাঁটা,
কানে শোভে স্ফটিক-কুণ্ডল।” —কবিকঙ্কণ।

এখানে জিনি ও জিনিয়া এই ব্যতিরেকজ্ঞাপক শব্দের প্রয়োগে উপমেয়গুলির উৎকর্ষ দেখানো হইতেছে।

(৯) “বিমল হেম জিনি তনু অনুপাম রে।”

(১০) “কণ্ঠস্বরে বজ্ৰ লজ্জাহত।”

রাজপুতনারীর কণ্ঠস্বর কঠোরতায় বজ্রকেও হার মানায়

(১১) “এল ওরা…
নখ যাদের তীক্ষ্ণ তোমার নেকড়ের চেয়ে,
এল মানুষ-ধরার দল।

গর্বে যারা অন্ধ তোমার সূর্যহারা অরণ্যের চেয়ে।” –রবীন্দ্রনাথ তোমার = আফ্রিকার; ওরা, মানুষ-ধরার দল = ইংরেজ। উপমেয় ইংরেজের নখ উপমান নেকড়ের নখকে তীক্ষ্ণতায় হারাইয়া দেয়; উাদের গর্বান্ধতা আফ্রিকার অরণ্যের নিবিড় অন্ধকারকেও অতিক্রম করিয়া যায়।

(১২) “নবমেঘ জিনি কণ্ঠধ্বনি যে গম্ভীর।” —চৈতন্যচরিতামৃত’।

(১৩) “এ পুরীর পথমাঝে যত আছে শিলা
কঠিন শ্যামার মতো কেহ নাহি আর।” —রবীন্দ্রনাথ।

বন্দী বজ্রসেনের প্রতি মুক্তিদাত্রী শ্যামার উক্তি।

(১৪) “হীরক নিন্দিয়ে জ্বলে নয়ন উজ্জ্বল।”

(১৫) “দিনে-দিনে শশধর হয় বটে তনুতর,
পুন তার হয় উপচয়
নরের নশ্বর তনু ক্রমশ হইলে তনু
আর ত নূতন নাহি হয়।”

—হরিশ্চন্দ্র কবিরত্ন।

এখানে উপমান শশধর অপেক্ষা উপমেয় নরের তনুর নিকৃষ্টতা বর্ণিত হইয়াছে। [এই জাতীয় ব্যতিরেক অলংকারে সৌন্দর্য কম বলিয়া ইহা কবিদের তেমন প্রিয় নয়।]

(১৬) “যৌবন বসন্তসম সুখময় বটে,
দিনে দিনে উভয়ের পরিণাম ঘটে।
কিন্তু পুনঃ বসন্তের হয় আগমন,
একবার গেলে আর না ফেরে যৌবন।”

উপমান বসন্ত অপেক্ষা উপমেয় যৌবনের নিকৃষ্টতা বর্ণিত হইয়াছে। কারণটিও উল্লিখিত। বসন্তের পুনরাবির্ভাব হয়, কিন্তু বিগতযৌবন আর ফিরে না।

সমাসোক্তি

২২৯। সমাসোক্তি : উপমানের কোনো উল্লেখ না করিয়া উপমেয়ের উপর উপমানের ব্যবহার বা অবস্থা আরোপ করিলে সমাসোক্তি অলংকার হয়। সমাসে অর্থাৎ সংক্ষেপে উপমান-উপমেয়বিষয়ে উক্তি থাকে বলিয়া নাম সমাসোক্তি। এই অলংকারের প্রধান লক্ষণ হইতেছে অচেতন পদার্থে মানবধর্ম আরোপ। [ইংরেজীর Personification ও Metaphor অলংকারের সহিত সমাসোক্তির খানিকটা মিল রহিয়াছে।]

(১) “ঘুরে ঘুরে ঘুমন্তী চলে ঠুম্রী তালে ঢেউ তোলে!”—সত্যেন্দ্ৰনাথ। উপমেয় ঘুমতী নদীর উপর অনুক্ত উপমান নর্তকীর ব্যবহার আরোপিত হইয়াছে।

(২) “তৃণ ক্ষুদ্র অতি,
তারেও বাঁধিয়া বক্ষে মাতা বসুমতী
কহিছেন প্রাণপণে, ‘যেতে নাহি দিব।’ ” —রবীন্দ্রনাথ।

(৩) “রাত্রি গভীর হলো,
ঝিল্লীমুখর স্তব্ধ পল্লী, তোলো গো যন্ত্র তোলো।
ঠকা ঠাঁই ঠাঁই কাঁদিছে নেহাই, আগুন ঢুলিছে ঘুমে,
শ্রান্ত সাঁড়াশি ক্লান্ত ওষ্ঠে আলগোছে ছেনি চুমে,
দেখ গো হোথায় হাপর হাঁপায়, হাতুড়ি মাগিছে ছুটি।”

—যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত

উপমেয় নেহাই, আগুন, সাঁড়াশি, হাপর, হাতুড়ি—সেই কোন্ ভোরে কামারের সঙ্গে কাজ আরম্ভ করিয়াছে। এখন গভীর রাত, ইহারা আর পারিতেছে না। শ্রান্ত শ্রমিকের ব্যবহার আগুন ও যন্ত্রগুলির উপর আরোপিত হইয়াছে।

(৪) শরতের আগমনী গাহিয়া
এল যে রে শুকতারা, শেফালী।
রুপোলী শিশিরে কষে নাহিয়া
হেসে ওঠে রাঙাধূলি সোনালী।

(৫) “বসুন্ধরা, দিবসের কর্ম-অবসানে
দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া আছে চাহি
দিগন্তের পানে।” —রবীন্দ্রনাথ।

উপমেয় বসুন্ধরায় উপমান (অনুল্লিখিত) পল্লীবধূর ব্যবহার আরোপিত হইয়াছে।

(৬) “ধ্যানগম্ভীর এই-যে ভূধর, নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর।”—রবীন্দ্রনাথ

অচেতন ভূধরে ধ্যানী ঋষির ব্যবহার আরোপিত।

(৭) “স্বচ্ছসলিলা কল্লোলিনী বিরূপা নদী নীল বারিরাশি লইয়া সমুদ্রাভিমুখে চলিয়াছে।” – বঙ্কিমচন্দ্ৰ।

(৮) “অতএব দয়া করি কহ দয়াবতি,
কী চিত্রে রঞ্জিছ আজি শ্বেতসেনাপতি?” —নবীনচন্দ্ৰ।

(৯) “বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণ-হাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ আকুল করিয়া দিল।” —রবীন্দ্রনাথ।

অচেতন কিশলয়ের উপর সমবেদনাকাতর মানবের ব্যবহার আরোপিত।

(১০) “কেরোসিন-শিখা বলে মাটির প্রদীপে,
‘ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে।’ —রবীন্দ্রনাথ।

(১১) “ললিতগতি মৃদুলহাস সিন্ধু আজ ঘটে প্রবেশ করিয়াছে, ঘট তাহাকে সামলাইবে কিরূপে?”

(১২) “শুনিতেছি আজো আমি প্রাতে উঠিয়াই,
‘আয় আয়’ কাঁদিতেছে তেমনি সানাই।” —কাজী নজরুল।

সমাসোক্তি ও রূপকের পার্থক্যটুকু মনে রাখিও। রূপকে উপমেয় উপমান দুইই উপস্থিত, সমাসোক্তিতে মাত্র উপমেয় উপস্থিত। রূপকে উপমেয়ের উপর উপমানের অভেদ আরোপিত, সমাসোক্তিতে উপমেয়ের উপর উপমানের ব্যবহার বা অবস্থা আরোপিত হয়।

অলংকার নির্ণয়-সম্বন্ধে একটি কথা

কোনো উদ্ধৃতির অন্তর্গত অলংকার নির্ণয় করিতে হইলে মাত্র অলংকারের নাম উল্লেখ করিলেই চলে না, যুক্তির অনুসরণে সিদ্ধান্তে আসিতে হয়। একই উদাহরণে একাধিক অলংকার থাকিলে প্রত্যেকটি অলংকারেরই উল্লেখ করিতে হইবে। শব্দালংকার ও অর্থালংকার একসঙ্গে থাকিলে গুরুত্বানুসারে প্রথমে অর্থালংকার ও পরে শব্দালংকারের উল্লেখ করিবে। একাধিক অর্থালংকার একসঙ্গে থাকিলে পর পর প্রত্যেকটির উল্লেখ করিতে হইবে। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দেখ—

(ক) “অশান্ত আকাঙ্ক্ষা-পাখি
মরিতেছে মাথা খুঁড়ে পঞ্জর-পিঞ্জরে।” —রবীন্দ্রনাথ।

কবির বক্তব্য আকাঙ্ক্ষা ও পঞ্জর—ইহারা উপমেয়; ইহাদের উপমান যথাক্রমে পাখি ও পিঞ্জর। বাক্যমধ্যে এই উপমানদ্বয়েরই প্রাধান্য। কারণ, পাখিই পিঞ্জরে মাথা খুঁড়িয়া মরে। এখানে আকাঙ্ক্ষা ও পঞ্জর এই উপমেয় দুইটির উপর ইহাদের উপমান যথাক্রমে পাখি ও পিঞ্জরের অভেদ আরোপ হওয়ায় উপমেয় দুইটি ম্লান হইয়া গিয়াছে। অলংকার রূপক।

আবার, পঞ্জর ও পিঞ্জর পদদ্বয়ে অনুপ্রাস অলংকারও হইয়াছে।

(খ) “কাঁদে রাজবধূ অনাথিনী আজ মলিন বদন-শতদল।” –কুমুদরঞ্জন এখানে উপমেয় বদন, উপমান শতদল; বাক্যমধ্যে কাহার প্রাধান্য, নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতেছে না। সুতরাং অলংকার রূপকও হইতে পারে, লুপ্তোপমাও হইতে পারে অর্থাৎ উপমা-রূপকের সঙ্কর। [ বদন-রূপ শতদল = রূপক কর্মধারয় সমাস; বদন শতদলের ন্যায় = উপমিত কর্মধারয় ]

(গ) “শিশিরবিমল প্রভাতের ফল শতহাতে সহি পরখের ছল

বিকাল বেলায় বিকায় হেলায় সহিয়া নীরব ব্যথা।”—যতীন্দ্রনাথ। উপমেয় ফলের উপর উপমান (অনুক্ত) মর্যাদা-না-পাওয়া মানুষের ব্যবহার আরোপ করায় সমাসোক্তি অলংকার হইয়াছে।

ইহা ছাড়া শ, ল, ত, ব প্রভৃতি ব্যঞ্জনের অনুপ্রাসও লক্ষণীয়।

অনুশীলনী

১। অলংকার কাহাকে বলে? অঙ্গালংকার ও কাব্যালংকারে পার্থক্য কী?

২। শব্দালংকার কাহাকে বলে? অর্থালংকার ও শব্দালংকারের পার্থক্য দেখাও।

৩। শব্দালংকারের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য নির্দেশ কর। তোমাদের পঠিত প্রত্যেকটি শব্দালংকারের দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

৪। “শব্দালংকার শব্দের পরিবর্তন সহ্য করিতে পারে না”–এই মন্তব্যটি উদাহরণসহ বুঝাইয়া দাও। অর্থালংকার শব্দ-পরিবর্তন সহ্য করিতে পারে কিনা, বুঝাইয়া দাও।

৫। নিম্নলিখিত অলংকারগুলি কাহাকে বলে, ইহাদের বিশেষ বিশেষ লক্ষণই বা কী, তাহা দৃষ্টান্ত দেখাইয়া বুঝাইয়া দাও : অনুপ্রাস (এইচ এস ‘৬৮, ‘৬০); সমাসোক্তি (এইচ এস ‘৭०, ‘৬৮, ‘৬৭, ‘৬৩, ‘৬১ কম্পার্ট, ‘৬০ কম্পার্ট); যমক (এইচ এস ‘৬৯, ‘৬৮ কম্পার্ট, ‘৬২ কম্পার্ট, ৬০ কম্পার্ট); ব্যতিরেক (এইচ এস ‘৭০, ‘৬৮ কম্পার্ট, ‘৬৫, ‘৬৩ কম্পার্ট, ৬১ কম্পার্ট, ‘৬০); শ্লেষ (এইচ এস ‘৬৭, ‘৬৩, ‘৬২ ৰুম্পাৰ্ট, ‘৬১ কম্পার্ট, ‘৬০); উপমা (এইচ এস ‘৬৯ কম্পার্ট, ‘৬৭ কম্পার্ট, ‘৬৫ কম্পার্ট, ‘৬০ কম্পার্ট); উৎপ্রেক্ষা (এইচ এস ‘৬৯ কম্পার্ট, ‘৬৭ কম্পার্ট, ‘৬৫ কম্পার্ট, ‘৬৩ কম্পার্ট, ৬১ কম্পার্ট, ‘৬০); রূপক (এইচ এস ‘৬৯, ‘৬৫, ‘৬০ কম্পার্ট); পূর্ণোপমা; অন্ত্যানুপ্রাস; মধ্য যমক; লুপ্তোপমা; আদ্য যমক; প্রতীয়মানোৎপ্রেক্ষা; সর্ব যমক; বাচ্যোৎপ্রেক্ষা।

৬। পার্থক্য দেখাইয়া উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও : অনুপ্রাস ও যমক (এইচ এস ‘৬৬ কম্পার্ট, ‘৬৪ কম্পার্ট); যমক ও শ্লেষ (এইচ এস ‘৬১); উপমা ও রূপক (এইচ এস ‘৬৬, ‘৬১); রূপক ও উৎপ্রেক্ষা; সমাসোক্তি ও রূপক; লুপ্তোপমা ও রূপক।

৭। অলংকার নির্ণয় কর :

(১) কেবল সঙ্গীতে নয়, ইঙ্গিতে ও ভঙ্গিতেও অরূপসত্তার পূজা হয়।

(২) “সাহিত্যের স্বরূপ নিয়ে বিদ্যাবান্ বিচক্ষণদের মধ্যে বিলক্ষণ মতপার্থক্য বিদ্যমান।” —সাধনকুমার।

(৩) অর্থবাদে পরমার্থবাদ ভেসে যাচ্ছে, ফল অনৰ্থবাদ।

(৪) কেবা মরুর বালুতে তরুর মমতা জাগাল!

(৫) “উড়ে কুন্তল, উড়ে অঞ্চল, উড়ে বনমালা বায়ুচঞ্চল,
বাজে কঙ্কণ, বাজে কিঙ্কিণী—মত্তবোল।
দে দোল্ দোল্ ॥” —রবীন্দ্রনাথ।

(৬) “বড়লোক যারা—খেতে বলে কেউ? মিছে এত বড় হলি!” – যতীন্দ্ৰনাথ।

(৭) “মাঠের কোণে যাবে দেখা বৃষ্টিধারার ‘চিকে’—ঢাকা
কেয়াঝাড়ের মাথার ‘পরে নারিকেলের সারি।” —করুণানিধান।

(৮) “তরিবারে ভবসিন্ধু ভব যে ভরসা।”

(৯)  “বামুন বাদল বান দক্ষিণা পেলেই যান।”

(১০) “কাঙালীর মা ইহারই মধ্যে ছোটো একখানা রথের চেহারা যেন স্পষ্ট দেখিতে পাইল।” —শরৎচন্দ্র।

(১১) “পুতুলগুলাও আধুনিক হিন্দুর মত অঙ্গহীন হইয়াছে।” —বঙ্কিমচন্দ্ৰ।

(১২) “সঙ্গে তব অঙ্গনে কে এল রণরঙ্গিণী।” —দাশরথি রায়।

(১৩) “অভাগীর জীবননাট্যের শেষ অঙ্ক পরিসমাপ্ত হইতে চলিল।” -শরৎচন্দ্র।

(১৪) “না, না, ক্ষুণ্ণ হব কেন? শূন্য হয়ে গেলাম।” —অচিন্ত্যকুমার।

(১৫) “মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ।” —রবীন্দ্রনাথ।

(১৬) “ভূত নাচাইয়া পতি ফেরে ঘরে ঘরে।
না মরে পাষাণ বাপ দিল হেন বরে।” —ভারতচন্দ্র।

(১৭) “বিধাতার বরে ভরিবে ভুবন বাঙালীর গৌরবে।” -সত্যেন্দ্রনাথ।

(১৮) “নদীর বাতাস ছাড়ে প্রশ্বাস পার্শ্বে পাকুড়শাখে।” —যতীন্দ্রনাথ।

(১৯) “সুলতান মামুদের সময় একজন …… পণ্ডিতব্যক্তি সেই ছিন্ন তার যোজনা করিয়া আবার মোহন সুরে সংগীত আরম্ভ করিয়াছিলেন।” —রেজাউল করিম।

(২০) “গোত্রের প্রধান পিতা মুখবংশজাত।
পরম কুলীন স্বামী বন্দ্যবংশখ্যাত ॥
পিতামহ দিলা মোরে অন্নপূর্ণা নাম।
অনেকের পতি তেঁই পতি মোর বাম॥” -ভারতচন্দ্র।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *