২.৩ সন্ধি

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – সন্ধি

পাশাপাশি দুইটি পদ থাকিলে দ্রুত উচ্চারণ করিবার ফলে প্রথমপদটির শেষবর্ণ ও পরপদটির প্রথমবর্ণ পরস্পরের সন্নিহিত থাকায় উভয়ের মধ্যে মিলন ঘটে। ইহার ফলে কখনও বর্ণ দুইটির যেকোনো একটির, কখনও-বা দুইটি বর্ণেরই কিছু কিছু পরিবর্তন হয়।

৫০। সন্ধি : পরস্পর সন্নিহিত দুইটি বর্ণের মিলনকে সন্ধি বলে।

বাংলা ভাষায় বহু তৎসম (খাঁটী সংস্কৃত) শব্দ প্রবেশলাভ করিয়াছে। লিখন-পঠনে এইসমস্ত শব্দের শুদ্ধতা রক্ষা করিবার জন্য সংস্কৃত সন্ধি-সম্বন্ধে সম্যক্ ধারণা থাকা একান্ত আবশ্যক। সুতরাং প্রথমেই আমরা সংস্কৃত সন্ধির আলোচনা করিব। সন্ধির ব্যাপারে প্রত্যেকটি শব্দের অন্তর্গত বর্ণগুলির ক্রমাবস্থান, ণত্ব-বিধি ও ষত্ব-বিধি সম্পর্কে তোমাদের সচেতন থাকিতে হইবে।

সংস্কৃত সন্ধি

সংস্কৃত সন্ধি তিন প্রকার–স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি ।

স্বরসন্ধি

৫১। স্বরসন্ধি : স্বরবর্ণের সঙ্গে স্বরবর্ণের যে মিলন তাহাকে স্বরসন্ধি বলা হয়। পূর্বপদের শেষবর্ণ ও পরপদের প্রথমবর্ণ উভয়েই যদি স্বরবর্ণ হয়, তখন তাহাদের মধ্যে যে সন্ধি হইবে তাহাই স্বরসন্ধি। স্বরসন্ধির সূত্রাবলী দেওয়া হইল।–

(১) অ-কার কিংবা আ-কারের পর অ-কার কিংবা আ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া আ-কার হয়; সেই আ-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়।–

অ + অ = আ : বেদ + অন্ত = বেদান্ত; রাম + অয়ন রামায়ণ (ণত্ব-বিধি দেখ); পর (পরম) + অয়ন = পরায়ণ (বিষ্ণু); অপর + অহ্ন = অপরাহ্ণ (হ্ন হ্ল হইয়াছে); স্বদেশ + অনুরাগ = স্বদেশানুরাগ; দিবস + অন্তে = দিবসান্তে; রক্ত + অক্ত (লিপ্ত) = রক্তাক্ত; পার (ওপার) + অবার (এপার) = পারাবার; রোম + অঞ্চিত (উত্থিত) = রোমাঞ্চিত; গৌর + অঙ্গিনী = গৌরাঙ্গিণী; পর (শ্রেষ্ঠ) + অবর (নিকৃষ্ট) = পরাবর; হিম্ + অদ্রি = হিমাদ্রি। সেইরূপ পরান্ন, চরাচর, ক্ষীরার্ণব, সর্বস্বান্ত, কৃতার্থ, কূর্মাচল, উত্তরাধিকার, চিরাভ্যস্ত, চরণামৃত, সূত্রানুসারে, সূত্রানুযায়ী, জীবাণু, সিতাসিত, স্বাধীনতা, রক্ষণাবেক্ষণ, পুষ্পাঞ্জলি, স্নেহান্ধ, শুভানুধ্যায়ী, নবান্ন, পুষ্পার্ঘ্য, ভীমার্জুন, হিতাহিত, ধর্মাধর্ম, শুভাশুভ, সুরাসুর, চিত্রাঙ্কন, যুগান্তর, নরাধম, জ্ঞানার্জন, জ্ঞানাতীত, দেহাতীত, প্রমাণাতীত, সন্দেহাতীত, মতানৈক্য, সমার্থক, ভিন্নার্থক, ক্লেদাক্ত, রসায়ন, ভাবান্বিত, দেবানুগৃহীত, নবানুরাগ, সূর্যাস্ত, পাদ্যার্ঘ্য, পূর্বাচল, অস্তাচল, দিব্যাস্ত্র, ঋতায়ন।

অ + আ = আ : স্ব + আয়ত্ত স্বায়ত্ত; বিবেক + আনন্দ = বিবেকানন্দ; পুষ্প + আসার পুষ্পাসার; হিম + আলয় = হিমালয়; শোক + আবেগ শোকাবেগ; সিংহ + আসন = সিংহাসন। সেইরূপ স্নেহার্দ্র, দেবালয়, পদ্মাসন, চিরাগত, চিরাচরিত, রত্নাকর, পরমানন্দ, পদানত, প্রেমাবেশ, চরণাশ্রিত, ধ্বংসাত্মক, রসাশ্রিত, শ্লেষাত্মক, দেহাশ্রিত, শয়নাগার, স্নানাগার, জলাধার, জ্ঞানাশিস্, চিত্তাকর্ষক, গতায়াত, ধ্যানাসীন, দেবাহুতি, স্নেহাশিস্, বরাসন, দূরাগত, যজ্ঞাগার, হিতাকাঙ্ক্ষী, গ্রন্থাগার, জলাশয়, পদ্মাসন, দৈবাদেশ, শুভাশিস্, মারাত্মক, জলাতঙ্ক, সূর্যালোক, চন্দ্রাতপ, চন্দ্রালোক, চন্দ্রাপীড়, দেবাশ্রিত, দেবাদৃতা, বিশ্বাত্মা।

আ + অ = আ : পূজা + অৰ্চনা = পূজার্চনা; যথা + অর্থ = যথার্থ; মহিমা + অন্বিত = মহিমান্বিত; তন্দ্রা + অভিভূত = তন্দ্রাভিভূত। সেইরূপ বিদ্যার্জন, কারাবরুদ্ধ, কথামৃত, আশাতিরিক্ত, শিক্ষানুরাগ, মায়াঞ্জন, শ্রদ্ধাঞ্জলি, বেদনানুভূতি, দ্বারকাধীশ, ধারণাতীত, তথাপি, শ্রদ্ধার্ঘ্য, শোভান্বিত, সুধামৃত, চুড়ান্ত, বিদ্যাভ্যাস, চিন্তান্বিত, সুধার্ণব, স্পর্ধান্বিত, ঈর্ষান্বিত, মহার্ঘ, নিদ্রাভিভূত, মুক্তাধিক।

আ + আ আ : পরীক্ষা + আগার = পরীক্ষাগার; বিদ্যা + আলয় বিদ্যালয়; মহা + আহব (যুদ্ধ) = মহাহব; কল্পনা + আলোক = কল্পনালোক; নিদ্রা + আবিষ্ট = নিদ্রাবিষ্ট; সুধা + আধার সুধাঁধার। সেইরূপ ক্ষুধাতুর, দয়ার্দ্র, পূজাহ্নিক, নিদ্রাচ্ছন্ন, সুধাকর, শিক্ষায়তন, আশাহতা, ছায়াবৃতা, বিদ্যালোচনা, সন্ধ্যারতি, মহাশয়, চিন্তাবিষ্ট, সন্ধ্যাহ্নিক, মহালয়া, তন্দ্ৰাবেশ, তন্দ্রাচ্ছন্ন, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, কমলালয়, হিংসাত্মক, মহাকাশ, কারাগার, সদানন্দ, বিদ্যায়তন, মাত্রাধিক্য।

“হায় ছায়াবৃতা, কালো ঘোমটার নীচে অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ।”–রবীন্দ্রনাথ। “রাজান্তঃপুরের মহিলাদের শিক্ষা ও আনন্দের জন্য চিত্রশালা ছিল।”–সুবোধ ঘোষ। “ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন।”–নজরুল। “দুর্ভাগ্যের ঘন তমিস্রা ভেদ করে ভাগ্যাচলের শিখরে সুখসূর্যের প্রথম রশ্মি পড়েছে মাত্র।”–প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। “ঘন তমসাবৃত অম্বর ধরণী।”–দ্বিজেন্দ্রলাল। “রবীন্দ্রনাথের চিত্ররচনার প্রথম প্রচেষ্টা লেখনীর ব্যবহার ও লিপিরূপ প্রভাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।”–চিন্তামণি কর। “রথযাত্রা লোকারণ্য মহাধুমধাম।”–রবীন্দ্রনাথ। “সদাকারা সদানন্দা স্বয়ংপ্রভা প্ৰতিমা।”

(২) ই-কার কিংবা ঈ-কারের পর ই-কার কিংবা ঈ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া ঈ-কার হয়; সেই ঈ-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়।

ই + ই = ঈ : রবি + ইন্দ্র = রবীন্দ্র; অভি + ই = অভীষ্ট; রবি + ইন্দু (চাঁদ) = রবীন্দু: প্রতি + ইতি = প্রতীতি। তদ্রপ মণীন্দ্র, অতীব, গিরীন্দ্র, মুনীন্দ্র, কবীন্দ্র, ক্ষিতীন্দ্র, বারীন্দ্র, অতীত, অতীন্দ্রিয়।

ই + ঈ = ঈ ও গিরি + ঈশ = গিরীশ; পরি + ঈক্ষা = পরীক্ষা; পরি + ঈক্ষিত = পরীক্ষিত; ক্ষৌণি (পৃথিবী) + ঈশ্বর = ক্ষৌণীশ্বর। সেইরূপ পরীক্ষক, পরীক্ষিকা, পরীক্ষণ, প্রতীক্ষা, বারীশ্বর, অদ্রীশ, অভীপ্সা, অধীশ, ক্ষিতীশ, মণীশ, মতীশ, মুনীশ, ক্ষৌণীশ, অতীশ, কবীশ, নীতীশ, সমাধীশ, অধীশ্বরী।

ঈ + ই = ঈ ও সুধী + ইন্দ্র = সুধীন্দ্র; সতী + ইন্দ্র = সতীন্দ্র; রথী + ইন্দ্র = রথীন্দ্র। সেইরূপ যতীন্দ্র, শচীন্দ্রাণী, মহীন্দ্র, যোগীন্দ্র।

ঈ + ঈ = ঈ ও পৃথ্বী + ঈশ = পৃথ্বীশ; শচী + ঈশ = শচীশ; সতী + ঈশ = সতীশ। সেইরূপ গৌরীশ, কাশীশ্বরী, দেবীশ্বরী, শ্রীশ, সতীশ্বর, পৃথিবীশ্বরী, গোপীশ্বর (শিব), ফণীশ্বর। [ ঈক্ষণ, ঈক্ষা, ঈক্ষক, ঈক্ষিকা, ঈক্ষণীয়, ঈক্ষিত, ঈপ্সা, ঈশ, ঈশান, ঈশ্বর, ঈশ্বরী শব্দগুলির বানানে ঈ-কার লক্ষ্য কর।]

“হে কাশি, কবীশ-দলে তুমি পুণ্যবান।”–মধুসূদন। “আজি পরীক্ষা জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ।”–নজরুল। “দুচোখে প্রতীক্ষা তার স্বপ্ন তাকে করাঘাত করে।”–সুভাষ মুখোপাধ্যায়। “তোমাদের কত অতীত দিনের মায়া ও মমতা কাঁদে।”–জসীমউদ্দিন। “যোগীশ্বর-পুণ্যপরশে মূর্ত রাগ উদিল হরষে।”–রজনীকান্ত সেন। “পুষ্পসার বরষিল মুনীন্দ্রে আচ্ছাদি।”

(৩) উ-কার কিংবা উ-কারের পর উ-কার কিংবা উ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া ঊ-কার হয়; সেই ঊ-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়।

উ + উ = ঊ : কটু + উক্তি = কটুক্তি; মরু + উদ্যান = মরূদ্যান; সু + উক্ত = সূক্ত; ভানু + উদয় = ভানুদয়; মৃত্যু + উত্তীর্ণ = মৃত্যুত্তীর্ণ। সেইরূপ বিধূদয়, সূক্তি, সাধূক্তি, মধূৎসব।

উ + ঊ = ঊ : লঘু + ঊর্মি = লঘূর্মি; তনু + ঊর্ধ্ব = তনূর্ধ্ব। তদ্রপ সিন্ধুর্মি।

ঊ + উ = ঊ : বধূ + উদয় = বধূদয়; বধূ + উৎসব = বধূৎসব। তদ্রূপ বধূক্তি।

ঊ + ঊ = ঊ : সরযূ + ঊর্মি = সরযুর্মি; ভূ + ঊর্ধ্বে = ভুধ্বে।

মরুভূমির মধ্যে অবস্থিত গাছপালা ও জলপূর্ণ স্থানই মরূদ্যান। সীতার কটুক্তি শুনে লক্ষ্মণ তাকে কুটিরে একাকিনী রেখেই রামকে খুঁজতে গেলেন।

(৪) অ-কার কিংবা আ-কারের পর ই-কার কিংবা ঈ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া এ-কার হয়; সেই এ-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়।–

অ + ই = এ : স্ব + ইচ্ছা = স্বেচ্ছা; পূর্ণ + ই = পূর্ণেন্দু; মানব + ইতর == মানবেতর; বল + ইন্দ্র = বলেন্দ্র। সেইরূপ সূর্যে, শুভেচ্ছা, নরেন্দ্র, মানবেন্দ্র, পুষ্পেন্দু, শুভেন্দু, সুরেন্দ্র, পঞ্চেন্দ্রিয়, দেবেন্দ্র, সূর্যে, দর্শনেন্দ্রিয়, জিতেন্দ্রিয়, অর্ধেন্দু, অরুণেন্দু, রামেন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্র, জ্ঞানেন্দ্রিয়, ঘ্রাণেন্দ্রিয়।

অ + ঈ = এ : রাজ্য + ঈশ্বর = রাজ্যেশ্বর; ভব + ঈশ = ভবেশ; অপ + ঈক্ষা = অপেক্ষা; হৃষীক (জ্ঞানেন্দ্রিয়) + ঈশ = হৃষীকেশ; ধন + ঈশ্বরী ধনেশ্বরী। তদ্রূপ রাসেশ্বর, রামেশ্বর, ধনেশ, দেবেশ, গণেশ, প্রাণেশ, অখিলেশ, নরেশ, গোপেশ, যোগেশ্বর, যজ্ঞেশ্বর, দনুজেশ্বর, সত্যেশ্বর, কমলেশ (সূর্য), জ্ঞানেশ, জ্ঞানেশ্বরী, প্রাণেশ্বর, জলেশ্বর, বীরেশ্বর, দিনেশ, দীনেশ, নাগেশ্বর, বিশ্বেশ্বরী, সুরেশ্বরী, ভুবনেশ্বর, ভবনেশ্বরী, হৃদয়েশ ।

আ + ই = এ : যথা + ইষ্ট = যথেষ্ট; সুধা + ইন্দু = সুধেন্দু; রসনা + ইন্দ্রিয় = রসনেন্দ্রিয়। সেইরূপ মহেন্দ্র, দ্বারকেন্দু।

আ + ঈ = এ : রাকা (প্রতিপদযুক্ত পূর্ণিমা তিথি) + ঈশ রাকেশ; মহা + ঈশান = মহেশান; দ্বারকা + ঈশ্বর = দ্বারকেশ্বর; সারদা + ঈশ্বরী = সারদেশ্বরী। তদ্রূপ উমেশ, কমলেশ (বিষ্ণু), মিথিলেশ, মহেশ্বর, সিদ্ধেশ্বরী, মহেশ, রমেশ, বসুধেশ্বর। “হে ভবেশ, হে শংকর, সবারে দিয়েছ ঘর।”–রবীন্দ্রনাথ। “সব যাঁর হস্তগত, রাজ্যেশ্বর পদানত।”–ঐ। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনেতিহাস যাঁহারা অবগত আছেন, তাঁহারা জানেন।” রামেন্দ্রসুন্দর। “হত সে বীরেশ আজি অন্যায় সমরে।”–মধুসূদন। “দীনেশ প্রতাপে নিশানাথ সাজে।”–রায়গুণাকর। “একমাত্র মহাযজ্ঞ–স্বধর্ম-সাধন, যজ্ঞেশ্বর–নারায়ণ।”–নবীনচন্দ্ৰ।

(৫) অ-কার কিংবা আ-কারের পর উ-কার কিংবা ঊ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া ও-কার হয়; সেই ও-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়।–

অ + উ = ও : কাব্য + উদ্যান = কাব্যোদ্যান; দাম + উদর = দামোদর; রাস + উৎসব = রাসোৎসব; রস + উত্তীর্ণ = রসোত্তীর্ণ; সময় + উপযোগী সময়োপযোগী; দিব্য + উদক = দিব্যোদক। তদ্রূপ পুণ্যোদক, লম্বোদর, সূর্যোদয়, পাদোদক, প্রথমোক্ত, পুরুষোত্তম, সর্বোচ্চ, জলোচ্ছ্বাস, গাত্রোত্থান, স্নানোৎসব, পুষ্পোদ্যান, অঙ্গোপাঙ্গ, স্নাতকোত্তর, সর্বোত্তম, পরোপকারী, নরোত্তম, নীলোৎপল, অর্থোপার্জন, বধোদ্যত, নবোদ্যম, মাঘোৎসব, শয়িতোত্থিত, উদয়োন্মুখ, দেবোৎসব, পরমোৎসব, অস্ত্রোপচার।

অ + ঊ = ও : চঞ্চল + ঊর্মি = চঞ্চলোর্মি; পর্বত + ঊর্ধ্বে = পৰ্বতোর্ধ্বে। তদ্রূপ সাগরোমি, চলোর্মি।

আ + উ = ও : কথা + উপকথন কথোপকথন; যথা + উচিত যথোচিত; বিদ্যা + উপার্জন = বিদ্যোপার্জন; মহা + উপকার = মহোপকার; দুর্গা + উৎসব = দুর্গোৎসব। সেইরূপ বিদ্যোদয়, পূজোপাসনা, স্বাধীনতোত্তর, মহোৎসব, গীতোক্ত, যথোপযুক্ত, মহোপাধ্যায়, পূজোৎসব, স্পর্যোক্তি, গঙ্গোদক।

আ + ঊ = ও : নবা + ঊঢ়া = নবোঢ়া; মহা : ঊমি = মহোমি; নর্মদা + ঊর্মি = নর্মদোমি। তদ্রূপ গঙ্গোর্মি, যমুনোমি। “বাজবে যে আজ মহোল্লাসে তোমার মহাশঙ্খ।”–রবীন্দ্রনাথ। “যাদঃপতি রোধঃ যথা চলোর্মি আঘাতে।” –মধুসূদন। “ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি।”–রবীন্দ্রনাথ। “স্বভাবতঃ অন্ধ আমি নাহি জ্ঞানোদয়।”–ঈশ্বর গুপ্ত। “অম্বরে অরুণোদয়, তলে দুলে দুলে বয় তমসা তটিনী-রানী কুলুকুলু স্বনে।”–বিহারীলাল চক্রবর্তী।

(৬) অ-কার কিংবা আ-কারের পর ঋ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া অর্ হয়; অর্-এর অ পূর্ববর্ণে যুক্ত হয় এবং র্ রেফ ( ́) হইয়া পরবর্ণের মস্তকে চলিয়া যায়।–

অ + ঋ = অর্ : দেব + ঋষি = দেবর্ষি; বিপ্র + ঋষি = বিপ্রর্ষি; উত্তম + ঋণ = উত্তমর্ণ; ভরত + ঋষভ = ভরতর্ষভ। তদ্রূপ ব্রহ্মর্ষি, অধমর্ণ, যুগর্ষি।

আ + ঋ = অর্ : মহা + ঋষি = মহর্ষি; মহা + ঋষভ (শ্রেষ্ঠ) = মহর্যভ; রাজা + ঋষি রাজর্ষি। “মহত্তম প্রতিভা সর্বশ্রেষ্ঠ অধমর্ণ।” সীতা রাজর্ষি জনকের পালিতা কন্যা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

কিন্তু অ-কার বা আ-কারের পর ‘ঋত’ (পীড়িত : √ ঋ + ক্ত) শব্দের ঋ থাকিলে করণ-তৎপুরুষ সমাসে উভয়ে মিলিয়া আর্ হয়; আর্-এর আ-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয় এবং র্ রেফ্ (′) হইয়া পরবর্ণের মস্তকে চলিয়া যায়।–

অ + ঋত = আর্ত : শীত + ঋত = শীতার্ত; দুঃখ + ঋত = দুঃখার্ত; ভয় + ঋত = ভয়ার্ত; হিম + ঋত হিমার্ত। তদ্রূপ স্নেহার্ত, শোকার্ত।

আ + ঋত = আর্ত : বেদনা + ঋত = বেদনার্ত; পিপাসা + ঋত পিপাসার্ত; ক্ষুধা + ঋত = ক্ষুধার্ত। তদ্রূপ তৃষ্ণার্ত, শঙ্কার্ত, বন্যার্ত।

“শিশির-আসারে নিত্য সরস কুসুমে নিদাঘার্ত।”–মধুসূদন। “হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি–তব গৃহক্রোড়ে চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।”–রবীন্দ্রনাথ। “দহনশয়নে তপ্ত ধরণী পড়েছিল পিপাসার্তা।”–ঐ।

(৭) অ-কার কিংবা আ-কারের পর এ-কার কিংবা ঐ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া ঐ-কার হয়; সেই ঐ-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়।

অ + এ = ঐ : জন + এক = জনৈক; হিত + এষণা (কামনা) = হিতৈষণা; সর্ব + এর = সর্বৈব। সেইরূপ হিতৈষী, শুভৈষী!

অ + ঐ = ঐ : মত + ঐক্য = মতৈক্য; বিত্ত + ঐশ্বর্য = বিত্তৈশ্বর্য; চিত্ত + ঐশ্বর্য = চিত্তেশ্বর্য। সেইরূপ ধনৈশ্বর্য, রাজৈশ্বর্য, বিশ্বৈক্য।

আ + এ = ঐ : সদা + এব = সদৈব; তথা + এব = তথৈব; বসুধা + এব = বসুধৈব। তদ্রূপ ক্ষমৈব, বিদ্যৈব।

আ + ঐ = ঐ : মহা + ঐশ্বর্য = মহৈশ্বৰ্য; মহা–ঐরাবত = মহৈরাবত। “মেয়েটা তো রক্ষে পেলে, আমি তথৈবচ।”–রবীন্দ্রনাথ। কেমব্রিজের জনৈকা হিতৈষী শ্রীমতী অলি বুল প্রতিশ্রুতিমান্ দরিদ্র মেধাবী বিজ্ঞনতপস্বী আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে প্রভূত ধনৈশ্বর্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

(৮) অ-কার কিংবা আ-কারের পর ও-কার কিংবা ঔ-কার থাকিলে উভয়ে মিলিয়া ঔ-কার হয়; সেই ঔ-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়।–

অ + ও = ঔ : বন + ওষধি = বনৌষধি; মাংস + ওদন (ভাত) = মাংসৌদন; জল + ওকা = জলৌকা (জোঁক)। তদ্রূপ বিম্বৌষ্ঠ।

অ + ঔ = ঔ : অমৃত + ঔষধ = অমৃতৌষধ; চিত্ত + ঔদাস্য = চিত্তেীদাস্য; চিত্ত + ঔদার্য = চিত্তৌদার্য। সেইরূপ পরমৌদাস্য, পরমৌষধ।

আ + ও = ঔ : গঙ্গা + ওঘ (ঢেউ) = গঙ্গৌঘ; মহা + ওষধি = মহৌষধি।

আ + ঔ = ঔ : মহা + ঔদার্য = মহৌদার্য; মহা + ঔৎসুক্য = মহৌৎসুক্য। কবিরাজ মুমূর্ষ রোগীকে অব্যর্থ মহৌষধ মকরধ্বজ খাইয়ে সুস্থ করলেন।

(৯) ই-কার কিংবা ঈ-কারের পর ই-কার কিংবা ঈ-কার ভিন্ন অন্য স্বরবর্ণ থাকিলে পূর্ববর্তী ই-কার কিংবা ঈ-কার স্থানে হত; সেই য য্‌-ফলা হইয়া পূর্ববর্ণে যুক্ত হয় এবং পরের স্বর য্‌-ফল-তে যুক্ত হয়।

আদি + অন্ত = আদ্যন্ত; প্রতি + আগমন = প্রত্যাগমন; ইতি + আদি = ইত্যাদি; অধি + অয়ন = অধ্যয়ন; অধি + আরূঢ় = অধ্যারূঢ়; অনুমতি + অনুসারে = অনুমত্যনুসারে; প্রতি + অর্পিত = প্রত্যর্পিত; ইতি + অবসরে = ইত্যবসরে; অধি + উষিত = অধ্যুষিত; প্রতি + উ = প্রত্যুষ*; প্রতি + আবর্তন = প্রত্যাবর্তন; মূর্তি + অন্তর = মূর্ত্যন্তর; অভি + আগত = অভ্যাগত; পরি + অটন = পর্যটন; অগ্নি + উৎসব = অগ্ন্যুৎসব; অগ্নি + অস্ত্র = অগ্ন্যস্ত্র; যদি + অপি = যদ্যপি; নদী + অম্বু = নদ্যম্বু; বৃদ্ধি (সুদ) + আজীব = বৃদ্ধ্যাজীব; অনাদি + অন্ত = অনাদ্যন্ত; পরি + অবসান = পর্যবসান। সেইরূপ অত্যাশ্চর্য, সূচ্যগ্র, ব্যুৎপত্তি, অত্যুন্নতি, অগ্ন্যাশয়, অগ্ন্যাধান, অগ্নদগম, অগ্ন্যুৎপাত, অগ্নদগার, প্রত্যাখ্যান, প্রত্যুত্তর, প্রত্যুপকার, অত্যৈশ্বর্য, বহু্যৎসব, অধ্যারোপ, অভ্যুদয়, গত্যন্তর, অধ্যশন, অভুত্থান, প্রত্যহ, অত্যাচার, প্রত্যাশা, প্রত্যেক, অত্যল্প, অধ্যাসন, অধ্যাসীন, পর্যন্ত, উপর্যুপরি, পর্যাপ্ত, পর্যবসিত, পর্যটক, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা।

[* উষা শব্দের বৈদিক বানান উষা।]

দ্রষ্টব্য : পরি, উপরি প্রভৃতি পূর্বপদ হইলে সন্ধিজাত। য্‌-ফলা না হইয়া নিজরূপেই থাকে, পূর্ববর্তী র্‌ রেফ () হইয়া য্‌-কারের মাথায় চলিয়া যায় এবং পরপদের প্রথম স্বর–কারে যুক্ত হয়। উপরে শেষ সাতটি উদাহরণ দেখ।

“এরা সহস্র সহস্র বৎসর অত্যাচার সয়েছে।”–বিবেকানন্দ! “আমাদের অত্যুক্তি অলস বুদ্ধির বাহ্য প্রকাশ।”–রবীন্দ্রনাথ। “সমাজের অত্যূর্ধ্বে স্বভাবের স্বর্গ ক্রমশঃ সরিয়া পড়িতেছে।”–দীনেশচন্দ্র। “বিনাযুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।” “বহু বছর পরে এর এই প্রথম অগ্ন্যুৎপাত।”–বিভূতিভূষণ।

(১০) উ-কার কিংবা উ-কারের পর উ-কার কিংবা উ-কার ভিন্ন অন্য স্বরবর্ণ থাকিলে পূর্ববর্তী উ-কার কিংবা ঊ-কার স্থানে ব্ হয়; সেই ব্ ব্-ফলা হইয়া পূর্ববর্ণে যুক্ত হয় এবং পরের স্বর ব্-ফলায় যুক্ত হয়।

অনু + অয় = অন্বয়; সু + অল্প = মন্বন্তর; সু + স্বল্প; সু + অচ্ছ = স্বচ্ছ; মনু + অন্তর = মন্বন্তর; সু + আগত = স্বাগত; অনু + ইত = অন্বিত; অনু + এষণ = অন্বেষণ; পশু + অধম = পশ্বধম; পশু + আচার = পশ্বাচার; সু + অস্তি = স্বস্তি; ধাতু + অর্থক = ধাত্বর্থক; ধাতু + অবয়ব = ধাত্ববয়ব।

“মন্বন্তরে মরি না আমরা মারী নিয়ে ঘর করি।”–সত্যেন্দ্রনাথ। “বাকি কি রাখিলি তুই বৃথা অর্থ অন্বেষণে।”–মধুসূদন। তিনি স্বচ্ছ ভাষায় স্বল্প সময়ের যে স্বাগত ভাষণ দিলেন, তা শুনে শ্রোতৃমণ্ডলীর সকলেই স্বস্তি পেলেন।

(১১) ঋ-কারের পর ঋ ভিন্ন স্বরবর্ণ থাকিলে ঋ-স্থানে র্ হয়। এই র্ র্-ফলা হইয়া পূর্ববর্ণের পদতলে বসে; পরবর্তী স্বর র্-ফলায় যুক্ত হয়। পিতৃ + অনুমতি = পিত্ৰনুমতি; মাতৃ + আদেশ = মাত্রাদেশ। তদ্রূপ পিত্ৰালয়, ভ্রাত্রুপদেশ, দাত্রাদর্শ। বিদ্যাসাগর মহাশয় মাত্রাদেশ পালন করতে উত্তাল দামোদর সাঁতরে পার হয়েছিলেন। কৈলাস থেকে শিবগৃহিণী মা দুর্গার পিত্রালয়ে আগমনে দুর্গাপূজা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়।

(১২) অন্য স্বর পরে থাকিলে পূর্ববর্তী এ-কার স্থানে অর্, ঐ-কার স্থানে আহ্, ও-কার স্থানে অব্, ঔ-কার স্থানে আব্ হয়। পরবর্তী স্বরবর্ণটি য় কিংবা ব্-এর সহিত যুক্ত হয়। নে + অন নয়ন; শে + আন = শয়ান; গৈ + অক = গায়ক; নৈ + ইকা = নায়িকা; ভো + অন = ভবন; গো + এষণা = গবেষণা; পৌ + অক = পাবক; দ্রৌ + অক = দ্রাবক; ভৌ + উক = ভাবুক; পো + ইত্ৰ = পবিত্র; পৌ + অন পাবন; গো + আদি = গবাদি। তদ্রূপ শায়ক, নায়ক, গায়িকা, শয়িত, পবন, নাবিক।

“জ্বলন্ত-পাবক-শিখা-লোভে তুই কাল-ফাঁদে উড়িয়া পড়িলি!”–মধুকবি। “অস্তগামী সূর্যপানে চাহিয়া চাহিয়া নাবিক তাহার ক্ষুদ্র কুটিরটি স্মরে।”–কবিশেখর। অসংখ্য গায়ক-গায়িকা নায়ক-নায়িকা পবিত্র পূজা উপলক্ষ্যে তাঁহার ভবনে সমাগত হইয়াছিলেন। “বৈতালিকদল সুপ্তিতে শয়ান।”–বিশ্বকবি

৫২। নিপাতন-সন্ধি : যে-সমস্ত শব্দ সন্ধিসূত্রের মধ্যে পড়ে না অথচ সন্ধিবদ্ধ হয় কিংবা যে-সমস্ত শব্দ সন্ধির নিয়মমতো সুনির্দিষ্ট রূপ না পাইয়া অন্যপ্রকার রূপলাভ করে, নিয়ম-বহির্ভূত সেই সন্ধিকে নিপাতন-সন্ধি বলা হয়। নিপাতন-সিদ্ধ স্বরসন্ধি : কুল + অটা = কুলটা (কুলাটা নয়); সম + অর্থ = সমর্থ (সমার্থ নয়); গো + ইন্দ্ৰ = গবেন্দ্র (গবিন্দ নয়); প্র + ঊঢ় = প্রৌঢ় (প্রোঢ় নয়); শুদ্ধ + ওদন (অন্ন) = শুদ্ধোদন (শুদ্ধৌদন নয়); গো + অক্ষ = গবাক্ষ (গবক্ষ নয়); সার + অঙ্গ সারঙ্গ (সারাঙ্গ নয়); মার্ত + অণ্ড = মার্তণ্ড (মার্তাণ্ড নয়); স্ব + ঈর = স্বৈর (স্বের নয়); অন্য + অন্য = অন্যোন্য (‘পরস্পর’ অর্থে), কিন্তু ‘অপরাপর’ অর্থে “অন্যান্য” শব্দটি সন্ধিসূত্র মানিতেছে; অক্ষ + ঊহিনী (সমষ্টি)=অক্ষৌহিণী (অক্ষোহিণী নয়, ণত্ব-বিধি লক্ষ্য কর); বিম্ব + ওষ্ঠ = বিম্বোষ্ঠ (কিন্তু “বিম্বৌষ্ঠ” সন্ধিসূত্ৰজাত শব্দ); সীমন্ + অন্ত = সীমন্ত (‘সিঁথি’ অর্থে), কিন্তু ‘সীমার শেষ’ অর্থে “সীমান্ত” সন্ধিসূত্রে পড়িতেছে। “আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর সীমন্তসীমা-’পরে।”–রবীন্দ্রনাথ। “প্রিয়ার কোলেতে কাঁদে সারঙ্গ ঘনায় নিশীথ মায়া।”–প্রেমেন্দ্র মিত্র। কুলটা রমণীকে প্রৌঢ় আশ্রয় দিলেন।

ব্যঞ্জনসন্ধি

৫৩। ব্যঞ্জনসন্ধি : ব্যঞ্জনবর্ণের সহিত ব্যঞ্জনবর্ণের কিংবা স্বরবর্ণের সহিত ব্যঞ্জনবর্ণের মিলনকে ব্যঞ্জনসন্ধি বলে।

পূর্বপদের শেষবর্ণ ও পরপদের প্রথমবর্ণ–ইহারা উভয়েই যদি ব্যঞ্জন হয়, কিংবা ইহাদের যেকোনো একটি যদি ব্যঞ্জন হয়–অপরটি তখন স্বরবর্ণ হইবেই–তখন ইহাদের মধ্যে যে সন্ধি হইবে, তাহাই ব্যঞ্জনসন্ধি।

(১) স্বরবর্ণ, বর্গের তৃতীয় বা চতুর্থবর্ণ কিংবা য্ র্ ল্ ব্ হ্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ক্ স্থানে গ্, চ্ স্থানে জ্, ট্ স্থানে ড্ এবং প্ স্থানে ব্ হয়। দিক্ + অন্ত = দিগন্ত; দিক্ + ভ্রম = দিগ্‌ভ্রম; দিক্ + বিজয়ী = দিগ্‌বিজয়ী; বাক্ + ঈশ্বরী = বাগীশ্বরী; দিক্ + গজ = দিগ্‌গজ; পৃথক্ + অন্ন = পৃথগন্ন; দিক্‌ + অঙ্গনা দিগঙ্গনা; বাক্ + আড়ম্বর = বাগাড়ম্বর; প্রাক্ + উক্ত প্রাগুক্ত; অচ্ + অন্ত = অজন্ত (স্বরান্ত অর্থে); বাক্ + ব্রহ্ম = বাগ্‌ব্ৰহ্ম; বাক্ + দেবী = বাগ্‌দেবী; ঋক্ + বেদ = ঋগবেদ; ণিচ্ + অন্ত = ণিজন্ত; সুপ্ + অন্ত = সুবন্ত; অপ্ + জ্‌ = অব্জ; ষট্ + ঋতু = ষড়ঋতু; ষট্ + যন্ত্র = ষড়যন্ত্র; ষট্ + অঙ্গক = ষড়ঙ্গক; ষট্ + ঐশ্বর্য = ষড়ৈশ্বর্য; ষট্ + দর্শন = ষড়দর্শন। [ ষট্, বাক্, পৃথক্, দিক্ শব্দগুলি হস্-চিহ্নযুক্ত, সর্বদা স্মরণে রাখিবে।] তদ্রূপ পৃথগ্‌বিধ, পৃথগ্‌ভাব, ষড়ক্ষর, ষড়ানন, বাগিন্দ্রিয়, বাগ্‌রোধ, বাগীশ, দিগঞ্চল, ষড়্‌রস। [ দ্রষ্টব্য : ড্‌ পদের আদিতে না থাকিলে ড়্‌ হয। ষড়ঋতু, ষড়ভুজ, ষড়বিংশ, ষড়দর্শন, ষড়যন্ত্র, ষড়বিঘ্ন প্রভৃতি শব্দে ড়্‌ ব্যঞ্জনান্ত রহিয়াছে, দেখ।]

“ষড়্‌রিপু হল কোদণ্ড-স্বরূপ।”–দাশরথি রায়। “জন কালী বলে বলি দাও ষড়্‌রিপুগণে।”–রামপ্রসাদ সেন। “ওড়না ওড়ায় বর্ষার মেঘে দিগঙ্গনার নৃত্য।”–রবীন্দ্রনাথ। “বিদায়বাঁশির সুরে বিধুর সাঁঝের দিগঞ্চল।”–ঐ। “উত্তাল তরঙ্গমালায় দিগ্‌গজ ভাসিয়া গিয়াছিল।”–বঙ্কিমচন্দ্র। “দিগন্তের বনস্পতি হাত নাড়ে।”–সুভাষ মুখোপাধ্যায়। “এল দিজয়ী দিগ্‌গজ বীর পণ্ডিত ব্রজধামে।”

(২) স্বরবর্ণ, গ্‌ ঘ্‌ দ্‌ ধ্‌ ব্‌ ভ্‌ কিংবা য্‌ র্‌ ব্‌ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্‌ বা দ্‌ স্থানে দ্‌ হয়। জগৎ + ঈশ্বর = জগদীশ্বর; উদ্‌ * + যোগ = উদ্‌যোগ; বিদ্যুৎ + বেগে = বিদ্যুবেগে; সৎ + বংশীয় = সদ্‌বংশীয়; হরিৎ + বর্ণ = হরিদ্‌বর্ণ; উদ্ + ভিদ্‌ = উদ্ভিদ; পশ্চাৎ + আগত = পশ্চাদাগত; উদ্ + দীপ্ত = উদ্দীপ্ত; উদ্ + বিগ্ন = উদ্বিগ্ন; সৎ + আশয় = সদাশয়; জগৎ + ইন্দ্র = জগদিন্দ্র; উদ্‌ + যত = উদ্যত; শরৎ + অম্বর = শরদম্বর; হৃৎ + রোগ = হৃদরোগ; চিৎ (চৈতন্য) + অম্বর = চিদম্বর; শরৎ + ইন্দু = শরদিন্দু; তড়িৎ + আলোক = তড়িদালোক; ভগবৎ + গীতা = ভগবদ্গীতা; বৃহৎ + রথ = বৃহদ্রথ। তদ্রপ বৃহদন্ত্র, সদসৎ, মৃগর্ভ, বিপদাপন্ন, জগদম্বা, জগদানন্দ, উদ্বেল, সদর্থক, কদৰ্থ, হৃদাকাশ, সদ্ভাব, চিদানন্দ, চিদাভাস, চিদাকাশ, চিদমৃত, চিপ, জগদ্‌গৌরী, জগদ্ধাত্রী, জগদ্বরেণ্য, জগদতীত, জগদ্‌বন্ধু, কৃদন্ত, চি্দ্‌ঘন, কদন্ন, কদর্য, হৃদ্‌বিকাশ, হৃদ্‌গত, হৃ্দ্‌যন্ত্র, হৃদ্‌বোধ, বিদ্যুদগ্নি, বিদ্যুদালোক, সদাচার, পশ্চাদপসরণ। [ দ্রষ্টব্য : য্‌ পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনে যুক্ত হইলে য্‌-ফলা হয়, এবং র্‌ পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনে যুক্ত হইলে র-ফলা হয়। ]

স্মরণ রাখিও, ত্‌ (ৎ)-ই সন্ধিসূত্রানুসারে দ্‌ হয়, ত কখনও দ হয় না। ভগবৎ + গীতা = ভগবদ্‌গীতা হইয়াছে, কিন্তু ভগবদ্‌গীতা অশুদ্ধ প্রয়োগ। অনুরূপভাবে, শ্রীমৎ + ভাগবত = শ্রীমদ্‌ভাগবত।

“তোমার চিদাকাশে ভাতে সূরয-চন্দ্র-তারা।”–রবীন্দ্রনাথ। “উদ্‌বেগে তাকায়ো না বাইরে।”–ঐ। “মহেন্দ্ৰ দেখিলেন, অপরূপ জগদ্ধাত্রী মুর্তি।”–বঙ্কিমচন্দ্র। “পান করি চিদমৃত জিনেছিলে মৃত্যুর শাসন।”–কবিশেখর। “মুহূর্তে তখন পশিনু বিদ্যুদ্‌বেগে কংস-কারাগারে।”-নবীনচন্দ্র সেন। “নব উদ্যমে পর্বতে আরোহণ করিতে লাগিলাম।”–জগদীশচন্দ্র বসু।

[* “বৈয়াকরণেরা ইহাকে দ্‌-কারান্ত বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন।”––দুর্গাচরণ সাংখ্যবেদান্ততীর্থ।]

(৩) চ্‌ কিংবা ছ্‌ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্‌ বা স্থানে দ্‌ হয়। উদ্ + চারণ = উচ্চারণ; সৎ + চরিত্র = সচ্চরিত্র; সৎ + চিদানন্দ (চিৎ + আনন্দ) = সচ্চিদানন্দ; শরৎ + চন্দ্র = শরচ্চন্দ্র [ বাংলায় কিন্তু আমরা সন্ধি না করিয়া শরৎচন্দ্র রূপটি অক্ষুণ্ণ রাখি ]; চলৎ + চিত্র = চলচ্চিত্র; উদ্ + চকিত = উচ্চকিত; অসৎ + চিন্তা = অসচ্চিন্তা; উদ্ + ছেদ = উচ্ছেদ। তদ্রূপ বিদ্যুচ্চমক, উচ্ছিন্ন। সচ্চরিত্র সচ্চিদানন্দবাবু অন্তিম-শয়নে ইষ্টমন্ত্র উচ্চারণ করা ছাড়া কোনো অসচ্চিন্তা করেন নি। উচ্ছেদ করার আগেই হকারদের পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে।

(৪) জ্‌ কিংবা খ্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্ বা দ্‌ স্থানে জ্‌ হয়। অসৎ + জন = অসজ্জন; যাবৎ + জীবন = যাবজ্জীবন; উদ্ + জ্বল = উজ্জ্বল; বিপদ্ + জনক = বিপজ্জনক; বিদ্বৎ + জন = বিদ্বজ্জন; জগৎ + জননী = জগজ্জননী; জগৎ + জীবন = জগজ্জীবন; উদ্ + জীবিত = উজ্জীবিত। সেইরূপ সজ্জন, তজ্জন্য, জগজ্জন, জগজ্জয়ী, জগজ্জ্যোতি ।

“জগৎ উজ্জ্বল যার রজত-কিরণে”–গোবিন্দচন্দ্র দাস। মারাত্মক বিপজ্জনক দুষ্কার্যের শাস্তিস্বরূপ অসজ্জন লোকটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে।

(৫) ট্ কিংবা ঠ্‌ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্ বা দ্‌ স্থানে ট্ হয়। তদ্‌ + টীকা = তট্টীকা।

(৬) ড্‌ কিংবা ঢ্‌ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্ বা দ্‌ স্থানে ড্ হয়। উদ্ + ডীন = উড্ডীন।

(৭) ল্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্ বা দ্ স্থানে ল্ হয়। উদ্ + লাস = উল্লাস; তদ্ + লিপি = তল্লিপি; উদ্ + লিখিত = উল্লিখিত; বিদ্যুৎ + লেখন = বিদ্যুল্লেখন। সেইরূপ উল্লেখ, বিদ্যুল্লিপি, উল্লসিত, বিদ্যুল্লেখা, বিদ্যুল্লসিত।

“বক্ষের পাশে ঘন উল্লাসে অসি বাজে ঝনঝন।”–রবীন্দ্রনাথ

(৮) ক্ খ্ ত্ প্ প্ ফ্ স্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত দ্‌ বা ধ্‌ স্থানে ত্ (ৎ) হয়। বিপদ্ + পাত = বিপৎপাত; তদ্ + সম = তৎসম; উদ্ + ত্যক্ত = উত্ত্যক্ত (বানানটি বিশেষভাবে লক্ষ্য কর); ক্ষুধ + পিপাসা = ক্ষুৎপিপাসা; হৃদ্ + কম্প = হৃৎকম্প; হৃদ্ + কমল = হৃৎকমল; হৃদ্ + পদ্ম = হৃৎপদ্ম; আপদ্ + কাল = আপৎকাল; বিপদ্ + সঙ্কুল = বিপৎসঙ্কুল; তদ্ + কালীন = তৎকালীন; তদ্ + পুরুষ = তৎপুরুষ; তদ্ + পরতা = তৎপরতা; সুহৃদ্ + সভা = সুহৃৎসভা; তদ্ + ত্ব = তত্ত্ব; তদ্ + সন্নিধানে = তৎসন্নিধানে; এতদ্ + সত্ত্বেও = এতৎসত্ত্বেও। সেইরূপ চিৎপুরুষ, হৃৎসমুদ্র, হৃৎস্পন্দন, হৃৎকমল, হৃৎপিণ্ড, চিৎসম্পদ। “আমার হৃৎপদ্ম আলো করে দাঁড়িয়ে আছেন এলোকেশী।” “আমার বিপৎকালে ব্রহ্মময়ী আসেন কি না আসেন দেখি।” “ব্যক্তিত্বহারা অস্তিত্বের গণিততত্ত্ব নিয়ে।” “কে কোথা দেখিবে ঘটিবে তাহলে বিষম বিপৎপাত।”

(৯) শ্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্ বা দ্‌ স্থানে চ্ এবং শ্‌ স্থানে ছ্‌ হয়। উদ্ + শ্বাস = উচ্ছ্বাস; উদ্ + শ্বসিয়া = উচ্ছ্বসিয়া; উদ্ + শৃঙ্খল = উচ্ছৃঙ্খল; উদ্ + শ্বসিত = উচ্ছ্বসিত; চলৎ + শক্তি = চলচ্ছক্তি। “প্রেমে উচ্ছ্বসিত সেই আনন্দ-কাননে আসি ছদ্ম-গোপবেশে নাগ শত শত”।–নবীনচন্দ্ৰ। “শত বরনের ভাব-উচ্ছ্বাস, কলাপের মতো করেছে বিকাশ।”-–রবীন্দ্রনাথ।

(১০) হ্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত্ বা দ্ স্থানে দ্‌ এবং হ্‌ স্থানে ধ্ৰ হয়। উদ্ + হৃত = উদ্ধৃত; উদ্ + হার = উদ্ধৃত; উদ্ + হার = উদ্ধার; উদ্ + হৃতি = উদ্ধৃতি; উদ্ + হত = উদ্ধত; তদ্ + হিত = তদ্ধিত; পদ্ + হতি = পদ্ধতি; জগৎ + হিত = জগদ্ধিত। “আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে।”–রঙ্গলাল । “উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন-গুচ্ছ।”–রবীন্দ্রনাথ। “আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?”–দ্বিজেন্দ্রলাল।

(১১) পূর্বপদের অন্তস্থিত হ, ধ্‌ কিংবা ভ্-এর পরে ত্ থাকিলে হ্‌ত হইবে গ্ধ, ধ্‌ত হইবে দ্ধ, ভ্‌ত হইবে ব্ধ। বিমুহ্ + ত = বিমুগ্ধ; বুধ্‌ + ত = বুদ্ধ; দুহ্ + ত = দুগ্ধ; লভ্ + ত = লব্ধ; রুর্ + ত = রুদ্ধ। সেইরূপ মুগ্ধ।

“কক্ষে আমার রুদ্ধ দুয়ার সে কথা যে যাই পাসরি।”–রবীন্দ্রনাথ। “উদিল যেখানে বুদ্ধ-আত্মা মুক্ত করিতে মোক্ষদ্বার।”–দ্বিজেন্দ্রলাল।

(১২) পূর্বপদের অন্তস্থিত স্বরবর্ণের পরে ছ্‌ থাকিলে ছ্‌ স্থানে চ্ছ হয়। স্ব + ছন্দ = স্বচ্ছন্দ; পূর্ণ + ছেদ = পূর্ণচ্ছেদ; সুবর্ণ + ছবি = সুবর্ণচ্ছবি; পরশু + ছিন্ন = পরশুচ্ছিন্ন; হেম + ছত্ৰ হেমচ্ছত্র; বর্ণ + ছত্র = বর্ণচ্ছত্র; বি + ছেদ = বিচ্ছেদ; আ + ছাদিত = আচ্ছাদিত; বৃক্ষ + ছায়া = বৃক্ষচ্ছায়া; স + ছিদ্ৰ সচ্ছিদ্র; নি + ছিদ্র = নিচ্ছিদ্র; আ + ছন্ন = আচ্ছন্ন; পরি + ছন্ন = পরিচ্ছন্ন। সেইরূপ মধুচ্ছন্দা, আচ্ছাদন, পরিচ্ছদ, পরিচ্ছেদ, পরিচ্ছিন্ন, বিচ্ছিন্ন।

কিন্তু আ-কার ভিন্ন দীর্ঘস্বরের পর ছ্‌ অথবা চ্ছ উভয়ই হয়। গায়ত্রী + ছন্দ = গায়ত্রীছন্দ বা গায়ত্রীচ্ছন্দ; লক্ষ্মী + ছায়া = লক্ষ্মীছায়া বা লক্ষ্মীচ্ছায়া।

“রেখেছ আমার বোধ ক’রে আচ্ছাদিত।”–ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। “বিচিত্র আলোকোদয়, ম্রিয়মাণ রবিচ্ছবি, ভুবন উজলে।”–বিহারীলাল চক্রবর্তী।

(১৩) পূর্বপদের অন্তস্থিত চ্ বা জ্-এর পর ন্ থাকিলে ন্ স্থানে ঞ্‌ হয়। যাচ্ + না (যাচ্ ঞা) = যাচ্‌ঞা; রাজ্ + নী (রাজ্ ঞী) = রাজ্ঞী; যজ্ + ন্‌ (যজ্‌ ঞ) = যজ্ঞ। “জগতের আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ।”–রবীন্দ্রনাথ। “শুনাইলে দেবরাজে, ‘মানুষেরো চাই যজ্ঞভাগ’।”–কবিশেখর কালিদাস রায়।

(১৪) ন্ কিংবা ম্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ক্ স্থানে ঙ্ ট্ স্থানে ণ্, ত্ বা দ্‌ স্থানে ন্ এবং প্ স্থানে ম্ হয়। দিক্ + নিরূপণ = দিঙ্‌নিরূপণ; দিক্‌ + মণ্ডল = দিঙ্‌মণ্ডল; জগৎ + নাথ = জগন্নাথ; মৃৎ + ময় = মৃন্ময়; চিৎ + ময়ী = চিন্ময়ী; ষট্ + মাস ষণ্মাস; তদ্ + ময় = তন্ময়; তদ্ + মধ্যে = তন্মধ্যে; উদ্ + নতি = উন্নতি; উদ্ + নয়ন = উন্নয়ন; কিঞ্চিৎ + মাত্ৰ কিঞ্চিন্মাত্র; সৎ + মতি = সন্মতি; তদ্ + নিমিত্ত = তন্নিমিত্ত; বাক্ + নিষ্পত্তি = বাঙ্‌নিষ্পত্তি; পরাক্ (পশ্চাতে) + মুখ = পরাঙ্মুখ; হৃদ + মর্ম = হৃন্মর্ম। তদ্রূপ জগন্নিবাস, জন্মণ্ডল, জগন্ময়ী, জগন্মোহন, দিঙ্‌নির্ণয়, জগন্মাতা, জীবন্মৃত, বাঙ্‌নিষ্ঠ, বিদ্যুন্ময়, দিঙ্‌নাগ, দিঙ্‌মণ্ডল, ষণ্ণবতি।

“তরঙ্গ-ফুৎকারে প্রকম্পিত দিঙ্মণ্ডল করি বিধূনিত”–নবীনচন্দ্র। “গাইল, ‘জয় মা জগন্মোহিনী, জগজ্জননী ভারতবর্ষ’।”–দ্বিজেন্দ্রলাল। “জগন্নাথ স্বামী নয়নপথগামী।” “জাগো যোগমায়া, জাগো মৃন্ময়ী, চিন্ময়ী রূপে জাগো।”

(১৫) শ্‌ স্‌ হ্‌ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ন্ স্থানে অনুস্বর হয়। দন্ + শন = দংশন; হিন্ + সা = হিংসা; প্রশন্‌ + সা = প্রশংসা; জিঘন্ + সা = জিঘাংসা; বৃন্ + হিত = বৃংহিত। তদ্রপ বৃংহণ।

“লোভ সংবরণ কর, হিংসা পরিহার কর, ক্রোধ জয় কর, দেখিবে সমগ্র পৃথিবী তোমার পদানত হইবে।” “দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ-সনে।”

(১৬) ঢ্‌ হইতে ম্ পর্যন্ত যেকোনো বর্ণ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ম্‌ স্থানে পরবর্তী বৰ্গীয় বর্ণটির পঞ্চমবর্ণ হয়। সম্ + চয় (সঞ্‌ চয়) = সঞ্চয়; সম্ + চিত = সঞ্চিত; সম্ + জয় = সঞ্জয়; মৃত্যুম্ + জয়ী = মৃত্যুঞ্জয়ী; সম্ + ত্রস্ত (সন্ত্রস্ত) = সন্ত্রস্ত; সম্ + ধান = সন্ধান; সম্ + ধি = সন্ধি; সম্ + তাপ = সন্তাপ; শাম্ + তি = শান্তি; কিম্ + তু = কিন্তু; সম্ + ন্যাসী = সন্ন্যাসী; সম্ + পূর্ণ = সম্পূর্ণ; গম্ + তব্য = গন্তব্য; কিম্ + নর = কিন্নর; ক্ষাম্‌ + ত্‌ = ক্ষান্ত; পরম্ + প = পরন্তপ; নিয়ম (নি যম্‌) + তা = নিয়ন্তা; সম্ + মান = সম্মান; সম্ + মতি = সম্মতি; সম্‌ + দেশ = সন্দেশ; বসুম্‌ + ধরা = বসুন্ধরা; সম্ + নিহিত = সন্নিহিত; সম্‌ + বন্ধ = সম্বন্ধ; সম্ + বল = সম্বল; সম্ + বোধন = সম্বোধন। [ শেষ তিনটিতে বা পদান্তস্য সূত্রানুযায়ী বিকল্পে যথাক্রমে সংবন্ধ, সংবল, সংবোধন রূপও হয়। তবে বাংলায় এরূপ বানান বিরলদৃষ্ট। মনে রাখিও–এই তিনটি শব্দে ম্‌-এর সঙ্গে যুক্ত ব সবই বর্গীয় ব। অন্তঃস্থ ব কখনও ম্‌-এর সঙ্গে ব-ফলারূপে যুক্ত হয় না।] সেইরূপ সন্তুষ্ট, সন্তুষ্টি, সন্তোষ, সন্তপ্ত, সন্তাড়িত, সন্তর্পণ, সন্তরণ, সঞ্চার, সন্ন্যাসিনী, শান্ত, সন্দেহ। “কহ রে সন্দেশবহ”–মধুকবি। “শকুনিকে বিতাড়িত করে আমাকে গান্ধার রাজ্য দেবেন তাতেই আমি সন্তুষ্ট।”–রাজশেখর। “সঞ্চার কর সকল কর্মে শান্ত তোমার ছন্দ।”–রবীন্দ্রনাথ। “অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া জানেনা সন্তরণ।”–নজরুল। “আইস আমার পুর সন্তাপ করিব দূর”–মুকুন্দরাম।

(১৭) ক্‌ খ্‌ গ্‌ ঘ্‌ যেকোনো একটি বর্ণ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে ঙ্‌ কিংবা অনুস্বর (ং) হয়। সম্ + কীর্ণ = সঙ্কীর্ণ, সংকীর্ণ; সম্ + কীর্তন = সঙ্কীর্তন, সংকীর্তন; সম্ + গোপন = সঙ্গোপন, সংগোপন; কিম্ + কর = কিঙ্কর, কিংকর; অহম + কার = অহঙ্কার, অহংকার; সম্ + গীত = সঙ্গীত, সংগীত; সম্ + কল্প = সঙ্কল্প, সংকল্প; সম্ + ঘাত = সঙ্ঘাত, সংঘাত; শম্ + করী = শঙ্করী, শংকরী; সম্ + কলন = সঙ্কলন, সংকলন; সম্ + কেত = সঙ্কেত, সংকেত। “জাঁকজমকে করলে পূজা অহঙ্কার হয় মনে মনে।”–রামপ্রসাদ। “কাহারে তুই পুজিস সঙ্গোপনে।”–রবীন্দ্রনাথ। “সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান, সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।”–ঐ। “যিনি কাব্যরসাদিতে বঞ্চিত, সঙ্গীতে দগ্ধকোকিলাহারী … তিনিই বাবু।”–বঙ্কিমচন্দ্র। “আমায় দে মা তবিলদারী, আমি নিমকহারাম নই শংকরী।”

(১৮) য্ র্ ল শ ষ্ স্ হ্ পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বর হয়। সম্ + যত সংযত; সম্ + রক্ষণ সংরক্ষণ; সম্ + লগ্ন = সংলগ্ন; সম্ + বাদ = সংবাদ; কিম্ + বা = কিংবা; সম্ + শয় = সংশয়; সম্ + বিৎ = সংবিৎ; বশম্ + বদ = বশংবদ; স্বয়ম্ + বরা = স্বয়ংবরা; কিম্ + বদন্তি কিংবদন্তি; প্রিয়ম্ + বদা = প্রিয়ংবদা; সম্ + বলিত = সংবলিত; সম্ + হতি = সংহতি; সম্ + বরণ সংবরণ [ কিন্তু সম্ + রাজ = সম্রাজ্–ম্ অক্ষত ]। তদ্রূপ সংযুক্ত, সংযোগ, সংযম, সর্বংসহা, সংহার, সংহরণ, সংসার, সংহৃত, সংহিতা, সংঘটন, সংবেগ, সংমিশ্রণ, সংযোজন, সংরুদ্ধ, সংলিপ্ত, সংহৃষ্ট, সংস্পর্শ, সংস্থাপন, সংস্থিতি, সংস্কৃষ্ট। “এ দেশের কুলধর্ম করহ সংহার।”–ঈশ্বর গুপ্ত। “যার সঙ্গে করে খেলা, তার হয় জীবন সংশয়।”–মুকুন্দরাম। “সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত।”–রবীন্দ্রনাথ। “পরান আমার বধূর বেশে চলে চির-স্বয়ংবরা।” বৃক্ষ-সংহার সংবরণ করে অরণ্য-সংরক্ষণ আশু কর্তব্য।

(১৯) ফ্-এর পর ত্ কিংবা থ্ থাকিলে ত্ স্থানে ট্ এবং থ্ স্থানে ঠ্‌ হয়। হৃষ্ + ত্‌ = হৃষ্ট; বৃষ্ + তি = বৃষ্টি; উৎকৃষ্ + ত = উৎকৃষ্ট; ইষ্ + তক = ইষ্টক; ষষ্ + থ = ষষ্ঠ; ইষ্ + ত = ইষ্ট। সেইরূপ ইষ্টি (অভিলাষ)।

“ইষ্টক উপরে করি ইষ্টক স্থাপন।”–নবীনচন্দ্র। “রবীন্দ্র-সংগীতের সুর বেজেছে বৃষ্টির সেতারে।” উৎকৃষ্ট সার প্রয়োগ করে বেশ হৃষ্টপুষ্ট ফসল পেয়েছি। “কুশাসনে ইন্দ্রজিৎ পূজে ইষ্টদেবে।”–মধুকবি।

(২০) উদ্‌ উপসর্গের পরে স্থা ও স্তন্‌ভ্ ধাতুর স্ লোপ পায়। উদ্ + স্থাপন = উত্থাপন; উদ্ + স্থাপক = উত্থাপক; উদ্ + স্থান = উত্থান; উদ্ + স্থিত = উত্থিত; উদ্ + স্তম্ভ = উত্তন্ত (স্তম্ভীভাব বা নিবৃত্তি অর্থে)। “ঔরংজীব, এবার তোমার উত্থান, না পতন?”–দ্বিজেন্দ্রলাল। সভায় প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হলেও একমাত্র উত্থাপক ছাড়া আর কেউই উত্থিত প্রস্তাব সম্পর্কে কিছু বললেন না।

(২১) সম্ ও পরি উপসর্গের পরে কৃ ধাতু (অর্থাৎ ওই ধাতুনিষ্পন্ন কার, করণ, কারক, কারিকা, কৃত, কৃতি, ক্রিয়া ইত্যাদি) থাকিলে ধাতুর পূর্বে স্-র আগম হয় এবং ম্ অনুস্বর হইয়া যায়। সম্ + কার = সংস্কার; সম্ + কৃত = সংস্কৃত; পরি + কার পরিষ্কার [ পরি উপসর্গের পরে স্ ষত্ব-বিধিমতে ষ্ হইয়া গিয়াছে ]। সেইরূপ সংস্কর্তা, সংস্ক্রিয়া, সংস্কৃতি, সংস্কারক, সংস্করণ, পরিষ্কৃত, পরিষ্করণ, পরিষ্কারক। “আচার্য শংকরের ভাষ্য দেখ, আর অর্বাচীন কালের সংস্কৃত দেখ।”–বিবেকানন্দ। “রাষ্ট্রীয় বিপ্লব করা বরং সহজ, কিন্তু সামাজিক বিপ্লব বা সংস্কারসাধন করা তদপেক্ষা কঠিন।”–নেতাজী সুভাষচন্দ্ৰ।

[ (২০) ও (২১) নং সূত্রদ্বয়ে পরস্পর বিপরীত ফল ফলিতেছে, লক্ষ্য কর। প্রথমটিতে স্-র লোপ, দ্বিতীয়টিতে স্-র আগম। ]

নিপাতন-সিদ্ধ ব্যঞ্জনসন্ধি : তদ্ + কর = তস্কর; ষট্ + দশ = ষোড়শ; এক + দশ = একাদশ; দিব্‌ + লোক = দ্যুলোক; আ + চর্য = আশ্চর্য; আ + পদ = আস্পদ; হরি + চন্দ্র = হরিশ্চন্দ্র; বৃহৎ (বাক্য) + পতি = বৃহস্পতি; গো + পদ = গোষ্পদ; পর + পর = পরস্পর; বন + পতি = বনস্পতি; পতৎ + অঞ্জলি = পতঞ্জলি (পতদঞ্জলি নয়); হিন্‌স্‌ + অ = সিংহ; পুম্‌স্‌ + লিঙ্গ = পুংলিঙ্গ; মনস্ + ঈষা = মনীষা; পশ্চাৎ + অর্ধ = পশ্চার্ধ; বিশ্ব + মিত্র = বিশ্বামিত্র; প্রায় + চিত্ত = প্রায়শ্চিত্ত। “যুঝিতেছে কোন্ দুই মহাবল দ্যুলোকের দূর পন্থে।”–মোহিতলাল। “আজিকে যতেক বনস্পতির ভাগ্য দেখি যে মন্দ।”–ঐ। “আশ্চর্য তোমাদের লজ্জাবোধ, মোহনলাল!”–শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। “ষোড়শ সহস্র সেই অনাথার সহ ত্যজিলাম ব্রজভূমি।”–নবীনচন্দ্ৰ। “পারাবার পার হয়ে শেষে ডুবিব কি গোষ্পদে?”–কবিশেখর কালিদাস রায়।

বিসর্গসন্ধি

৫৪। বিসর্গসন্ধি : বিসর্গের সহিত স্বরবর্ণের বা ব্যঞ্জনবর্ণের যে সন্ধি, তাহাকে বিসর্গসন্ধি বলে। [ বিসর্গকে ব্যঞ্জনবর্ণের অন্তর্ভূত ধরিলে বিসর্গসন্ধিকে ব্যঞ্জনসন্ধিও বলা যায়। ] পূর্বপদের শেষবর্ণ বিসর্গ এবং পরপদের প্রথমবর্ণ স্বর কিংবা ব্যঞ্জন হইলে এই দুই পদের মধ্যে যে সন্ধি হয়, তাহাই বিসর্গসন্ধি

বিসর্গ দুইপ্রকার–(১) স্-জাত ও (২) র্-জাত বিসর্গ।

৫৫। স্-জাত বিসর্গ : পদের শেষে স্-এর স্থানে যে বিসর্গ হয় তাহাই স্-জাত বিসর্গ। যেমন–মনস্ = মনঃ; সরস্ = সরঃ; বয়স্ = বয়ঃ; শিরস্ = শিরঃ; যশস্ = যশঃ; আশিস্ = আশিঃ; পুরস্ = পুরঃ; তেজস্ = তেজঃ; জ্যোতিস্ = জ্যোতিঃ; ধনুস্ = ধনুঃ; চক্ষুস্ = চক্ষুঃ।

৫৬। র্-জাত বিসর্গ : পদের শেষে র্-এর স্থানে যে বিসর্গ হয় তাহাকে র্-জাত বিসর্গ বলে। যেমন–অন্তর্ = অন্তঃ; নির্ = নিঃ; পুনর্ = পুনঃ; প্রাতর = প্রাতঃ; স্বর = স্বঃ; দুর = দুঃ। অহন শব্দের স্থানে র্‌ হয়; এই র-এর স্থানে বিসর্গ হয় বলিয়া তাহাকেও র-জাত বিসর্গ বলে। বিসর্গসন্ধিতে স-জাত ও র-জাত বিসর্গ-সম্বন্ধে ধারণা থাকা প্রয়োজন। এইবার সূত্রাবলীর আলোচনা।

(১) চ্ বা ছ্‌ পরে থাকিলে পূর্ববর্তী বিসর্গের স্থানে শ হয়। নিঃ + চল = নিশ্চল; নভঃ + চর = নভশ্চর; নিঃ + চিহ্ন = নিশ্চিহ্ন; দুঃ + চিন্তা = দুশ্চিন্তা; বনঃ + চক্ষু = মনশ্চক্ষু; শিরঃ + চুম্বন = শিরম্বন; শিরঃ + চূড়ামণি = শিরশূড়ামণি; শিরঃ + ছেদ = শিরচ্ছেদ। সেইরূপ নিশ্চয়, নিচ্ছিদ্র, নিশ্চিন্ত, দুশ্চরিত্র, দুচ্ছেদ্য, সদ্যচ্ছিন্ন, নভশ্চক্ষু, দুশ্চেষ্টা, পুরশ্চরণ।

“বিন্ধিছে কি না বিন্ধিছে কে জানে নিশ্চয়।”–কাশীরাম। “উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে।” দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা কৃতী নভশ্চর সন্তানের প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষায় আহার-নিদ্রা ত্যাগ করিয়া নিশ্চল হইয়া বসিয়া রহিলেন।

(২) ট্‌ বা ঠ্‌ পরে থাকিলে পূর্ববর্তী বিসর্গের স্থানে ষ্‌ হয়। ধনুঃ + টঙ্কার = ধনুষ্টঙ্কার; চতুঃ + টয় = চতুষ্টয়। [ ‘নিষ্ঠুর’ সন্ধিজাত নয়, প্রত্যয়সিদ্ধ (নি- √স্থা + ডুর); ধাতুর স্‌ ষত্ব-বিধিমতে ষ্‌ হওয়ায় থ ঠ হইয়াছে। ]।

ধনুষ্টঙ্কারের প্রতিষেধক টিকা সকলেরই নেওয়া উচিত। শ্‌ ষ্‌ স্‌ হ্‌–এই বর্ণ চতুষ্টয়কে উষ্মবর্ণ বলা হয়।

(৩) ত্ বা থ্‌ পরে থাকিলে পূর্ববর্তী বিসর্গের স্থানে স্ হয়। ইতঃ + ততঃ = ইতস্ততঃ; মনঃ + তাপ = মনস্তাপ; নভঃ + তল = নভস্তল; নিঃ + তেজ = নিস্তেজ; নিঃ + তার = নিস্তার; দুঃ + তর = দুস্তর; মনঃ + তুষ্টি = মনস্তুষ্টি; মনঃ + তত্ত্ব = মনস্তত্ত্ব; শিরঃ + ত্রাণ = শিরস্ত্রাণ।

“নিস্তার লাভের আর নাহি রে উপায়।” “এতেক কহিয়া স্তব্ধ হইল রাক্ষস মনস্তাপে।”–মধুকবি। লৌহ-শিরস্ত্রাণ না থাকায় যোদ্ধা ইতস্তত করতে লাগলেন।

(৪) পূর্বপদের শেষে যদি অ-কার ও বিসর্গ থাকে এবং পরপদের প্রথমণও যদি অ-কার হয়, তবে সেই অ-কার ও বিসর্গ উভয়ে মিলিয়া ও-কার হয়। ও-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়, এবং পরবর্তী অ-কার লোপ পায়। ততঃ + অধিক = ততোধিক; বয়ঃ + অধিক = বয়োধিক; মনঃ + অভিলাষ = মনোভিলাষ; যশঃ + অভীপ্সা = যশোভীপ্সা।

“গুণের নাহিক সীমা রূপ ততোধিক।”–রায়গুণাকর। যশোভীপ্সাই তার উন্নতির মূল। “ততোধিক শূলপাণি ভাবে উমা-মারে।”–কমলাকান্ত।

(৫) পূর্বপদের শেষে যদি অ-কার ও জাত বিসর্গ থাকে এবং বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চমবর্ণ অথবা য্‌ র্‌ ল্‌ ব্‌ হ্‌–ইহাদের যেকোনো একটি যদি পরপদের প্রথমবর্ণ হয়, তাহা হইলে অ-কার ও বিসর্গ উভয়ে মিলিয়া ও-কার হয়; ও-কার পূর্ববর্ণে যুক্ত হয়। মনঃ + দীপ = মনোদীপ; তপঃ + বন = তপোবন; তিরঃ + ধান = তিরোধান; সদ্যঃ + জাত = সদ্যোজাত; অধঃ + মুখ = অধোমুখ; ছন্দঃ + বদ্ধ = ছন্দোবদ্ধ; পুরঃ + হিত = পুরোহিত; বয়ঃ + বৃদ্ধ = বয়োবৃদ্ধ; সরঃ + জ্‌ সরোজ; মনঃ + মোহিনী = মনোমোহিনী; নভঃ + মণ্ডল = নভোমণ্ডল; যশঃ + লিপ্সা = যশোলিপ্সা; শিরঃ + রত্ন শিরোরত্ন। সেইরূপ ত্রয়োদশ, ভূয়োদর্শী, শিরোদেশ, যশোরশ্মি, শিরোধার্য, যশোদা, পুরোধা, তেজোদৃপ্ত, শ্রেয়োধর্মী, সদ্যোমৃত, সর্বতোভাবে, তেজোময়ী, সরোবর, অকুতোভয়, পয়োধি, মনোহরণ, মনোযোগ, মনোগামী, মনোনির্ভর, মনোমোহন, মনোরুদ্ধ, যশোলাভ, নভোলোভী, অধোরেখ, স্বতোবিরুদ্ধ।

“যমুনার সদ্যোবিপ্লাবিত, সদ্য বরিষায় ধৌত, সদ্য সুসজ্জিত স্বভাব-মন্দিরে।”–নবীনচন্দ্র সেন। “যশোলাভ-লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়!”–শ্রীমধুসূদন। “অবশ্য প্রামাণ্য করি শিরোধার্য তাহা।”–ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। “জীবন-স্বরূপা সে স্বামী শিরোমণি।”–ভারতচন্দ্র। “কত নদী সরোবর কিবা ফল চাতকীর?” –রামনিধি গুপ্ত। “তুমি মনোময় প্রতিমা করি বসাও হৃদি পদ্মাসনে।”–রামপ্রসাদ সেন। “অপরূপ জ্যোতিঃ ওই পুণ্য তপোবন।” বিহারীলাল। “মনোমন্দিরসুন্দরী! মণিমঞ্জীর গুঞ্জরি।”–রবীন্দ্রনাথ।

(৬) পূর্বপদের শেষস্থ অ-কারের পর যদি র্-জাত বিসর্গ থাকে এবং স্বরবর্ণ, বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চমবর্ণ, কিংবা য্ ল্ ব্ হ্‌–ইহাদের যেকোনো একটি যদি পরপদের প্রথমবর্ণ হয়, তাহা হইলে র্-জাত বিসর্গের স্থানে র্ হয়; সেই নবজাত র্ পরবর্তী স্বরবর্ণের সহিত যুক্ত হয় কিংবা রেফ হইয়া পরবর্তী ব্যঞ্জনের মস্তকে চলিয়া যায়। অন্তঃ + লোক = অন্তর্লোক; অন্তঃ + নিহিত অন্তর্নিহিত; অন্তঃ + আত্মা = অন্তরাত্মা; অন্তঃ + ঈক্ষ = অন্তরীক্ষ; অন্তঃ + গত = অন্তর্গত; অন্তঃ + ভূত = অন্তর্ভূত; অন্তঃ + হিত = অন্তর্হিত; প্রাতঃ + আশ (ভোজন) = প্রাতরাশ; প্রাতঃ + ভ্ৰমণ = প্রাতরাশ; প্রাতঃ + ভ্রমণ = প্রাতভ্রমণ; প্রাতঃ + উত্থান = প্রাতরুখান; পুনঃ + অপি = পুনরপি; পুনঃ + ঈক্ষণ = পুনরীক্ষণ; পুনঃ + উদ্ধার = পুনরুদ্ধার; পুনঃ + যাত্রা = পুনর্যাত্রা; স্বঃ + গত = স্বর্গত; অহঃ + অহঃ অহরহঃ; অন্তঃ + ইন্দ্রিয় = অন্তরিন্দ্রিয়। সেইরূপ অন্তর্লঘু, পুনর্বার, অধরূর্ধ্ব, অহর্নিশ, অন্তর্ভেদী, অন্তর্লিখিত, অন্তর্মুখী, অন্তর্যামী, পুনরবগতি।

“অর্জুনের সম্মুখে অস্ত্র আইল পুনর্বার।”–কাশীরাম দাস। “তোমার আহ্বানে অন্তরাত্মা জাগিয়াছে।”–রবীন্দ্রনাথ। “আমা নিতে ভরত আইলে পুনর্বার।” কৃত্তিবাস ওঝা। প্রাতভ্রমণ সেরে তিনি প্রাতরাশ গ্রহণ করেন। “দৈন্য নির্বে বিষাদে হৃদয়ের অবসাদে পুনরপি পড়ে এক শ্লোক।”–কৃষ্ণদাস কবিরাজ।

(৭) পূর্বপদের শেষে অ-কার ও আ-কার ভিন্ন স্বরের পরে যদি বিসর্গ থাকে, এবং স্বরবর্ণ, বর্গের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চমবর্ণ বা য্ ল্ ব্ হ্–যেকোনো একটি যদি পরপদের প্রথমবর্ণ হয়, তবে বিসর্গের স্থানে র্ হয়; সেই নবজাত র্ পরবর্তী স্বরের সঙ্গে যুক্ত হয় কিংবা রেফ হইয়া পরবর্তী ব্যঞ্জনের মস্তকে চলিয়া যায়। নিঃ + অঙ্কুশ = নিরঙ্কুশ; নিঃ + আনন্দ = নিরানন্দ; নিঃ + আকার = নিরাকার; নিঃ + অর্থক = নিরর্থক; নিঃ + উদ্যম = নিরুদ্যম; দুঃ + অবস্থা = দুরবস্থা; নিঃ + উৎসাহ = নিরুৎসাহ; নিঃ + আমিষ = নিরামিষ; নিঃ + ঈশ্বর = নিরীশ্বর; নিঃ + ঈক্ষণ = নিরীক্ষণ; নিঃ + ঈহ = নিরীহ; নিঃ + ঝর = নির্ঝর; নিঃ + নয় = নির্ণয়; নিঃ + দ্বন্দ্ব = নির্দ্বন্দ্ব; নিঃ + উপমা = নিরুপমা; দুঃ + আত্মা = দুরাত্মা; নিঃ + আয়োজন = নিরায়োজন; দুঃ + অভিমান দুরভিমান; দুঃ + অদৃষ্ট = দুরদৃষ্ট; নিঃ + বিকল্প = নির্বিকল্প; চতুঃ + অঙ্গ = চতুরঙ্গ; চতুঃ + আনন = চতুরানন; চতুঃ + বেদ = চতুর্বেদ; জ্যোতিঃ + ইন্দ্ৰ = জ্যোতিরিন্দ্র; চক্ষুঃ + উন্মীলন = চক্ষুরুন্মীলন; আবিঃ + ভাব = আবির্ভাব; আশীঃ + বাদ = আশীর্বাদ; বহিঃ + অঙ্গ = বহিরঙ্গ; নিঃ + অবধি = নিরবধি। সেইরূপ দুর্বল, নিরবয়ব, নিরাভরণা, নিরলঙ্কার, নিরুদবেগ, নিরুদ্দেশ, দুর্নিবার, দুর্ধর্ষ, চতুর্দিক, বহির্ভূত, বহিরিন্দ্রিয়, জ্যোতিরীশ, নিরাময়, নিরর্গল, নির্বেদ (অনুতাপ), নিরতিশয়, বহির্জগৎ, ধনুর্বেদ, নিরাসক্ত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতির্বলয়, নিরুপাধিক, নিরৌৎসুক্য, নিরাড়ম্বর, নিরনুরক্ত।

“একদিঠ করি ময়ূর-ময়ূরী-কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।”–চণ্ডীদাস। “অনির্বাহে নির্বাহ করয়ে কত দায়।”–রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। “চতুরঙ্গে রণরঙ্গে ভুলিব এ জ্বালা”–মধুসূদন। “সহসা ললাটভাগে জ্যোতির্ময়ী কন্যা জাগে।”–বিহারীলাল। “বিরাট-মূরতি এক পদ্মে অধিষ্ঠিত–চতুর্ভুজ, চতুর্দিক শোভিতেছে করে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম।”–নবীনচন্দ্র। “ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা।” বাণীকুমার। “নিরাভরণ বক্ষে তব নিরাবরণ দেহে।”–রবীন্দ্রনাথ।

(৮) পরপদের প্রথমবর্ণ যদি র্ হয়, তাহা হইলে পূর্বপদের শেষস্থ র্-জাত বিসর্গের (বা অ আ ভিন্ন স্বরের পরস্থিত বিসর্গের) লোপ হয় এবং বিসর্গের পূর্বস্থ স্বরবর্ণটি দীর্ঘ হয় অর্থাৎ অ স্থানে আ, ই স্থানে ঈ, উ স্থানে ঊ হয়। নিঃ + রব = নীরব; নিঃ + রক্ত = নীরক্ত; নিঃ + রদ (দত্ত) = নীরদ [ শব্দটির উচ্চারণ ও বানান-সম্বন্ধে সাবধান থাকিবে ]; নিঃ + রন্ধ্র = নীরন্ধ্র; নিঃ + রজ = নীরজ (ধূলিশূন্য); স্বঃ + রাজ্য = স্বারাজ্য; চক্ষুঃ + রত্ন = চক্ষুরত্ন; জ্যোতিঃ + রূপা = জ্যোতীরূপা। তদ্রূপ চক্ষুরোগ, নীরোগ, নীরস, নীরত (বিরত)। “সে সত্যটি স্বারাজ্য নয়, স্বাদেশিকতা নয়, সে সত্য বিশ্বজাগতিকতা।” রবীন্দ্রনাথ। “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম।”–ঐ। “নীরদ নয়নে নীর ঘন সিঞ্চনে পুলক-মুকুল-অবলম্ব।”–গোবিন্দদাস। নীরন্ধ্র অন্ধকারে পথঘাট কিছুই বোধগম্য হইল না ।

(৯) অ-কার বা আকারের পর বিসর্গ থাকিলে এবং পরপদের প্রথমবর্ণ ক্‌ খ্‌ প্‌ ফ্‌–যেকোনো একটি হইলে সেই বিসর্গ-স্থানে স্ হয়। নমঃ + কার = নমস্কার; বাচঃ + পতি = বাচস্পতি; পুরঃ + কার = পুরস্কার; তিরঃ + কৃত = তিরস্কৃত; অয়ঃ + কান্ত = অয়স্কান্ত; শ্রেয়ঃ + কর = শ্রেয়স্কর; যশঃ + কর। = যশস্কর; ভাঃ + কর = ভাস্কর; মনঃ + কামনা = মনস্কামনা; তেজঃ + ক্রিয়তা = তেজস্ক্রিয়তা; তিরঃ + করণী = তিরস্করণী (অদৃশ্য হওয়ার বিদ্যা)।

“ভারত কহিছে মা গো কত বল আর, শিবের যে তিরস্কার সেই পুরস্কার।”–ভারতচন্দ্র। নমস্কার বাচস্পতিমশাই, ভালো আছেন তো? তেজস্ক্রিয়তা-বিষয়ে গবেষণা করার মনস্কামনা ভাস্করবাবু এতদিনে পূর্ণ করলেন।

(১০) ক্‌ খ্‌ প্‌ ফ্‌–যেকোনো একটি বর্ণ পরপদের প্রথমবর্ণ হইলে নিঃ, আবিঃ, বহিঃ, দুঃ, চতুঃ প্রভৃতি শব্দের বিসর্গ-স্থানে হয়। নিঃ + প্রয়োজন = নিষ্প্রয়োজন; নিঃ + ভ্‌ = নিষ্প্রভ; নিঃ + করুণ = নিষ্করুণ; নিঃ + কাম = নিষ্কাম; নিঃ + কৃতি = নিষ্কৃতি; আবিঃ + কার = আবিষ্কার; বহিঃ + কৃত = বহিষ্কৃত; দুঃ + কৃতি = দুস্কৃতি; দুঃ + পাচ্য = দুস্পাচ্য; চতুঃ + পদ = চতুষ্পদ; চতুঃ + পার্শ্বস্থ = চতুম্পার্শ্বস্থ; ধনুঃ + পাণি = ধনুষ্পণি; আয়ুঃ + কাল = আয়ুষ্কাল; ভ্রাতুঃ + পুত্র = ভ্রাতুস্পুত্র।

কিন্তু নিম্নলিখিত কয়েকটি ক্ষেত্রে বিসর্গ অক্ষত থাকে—স্‌ বা ষ্‌ কিছুই হয় না। স্রোতঃ + পথ = স্রোতঃপথ; জ্যোতিঃ + পুঞ্জ = জ্যোতিঃপুঞ্জ; মনঃ + কষ্ট = মনঃকষ্ট; মনঃ + পীড়া = মনঃপীড়া; শিরঃ + পীড়া = শিরঃপীড়া; মনঃ + প্রাণ = মনঃপ্রাণ; মনঃ + ক্ষোভ = মনঃক্ষোভ; স্বতঃ + প্রবৃত্ত = স্বতঃপ্রবৃত্ত। সেইরূপ অন্তঃপুর, অন্তঃপাতী, অন্তঃকরণ, শিরঃকম্প, মনঃক্ষুণ্ণ।

শরৎচন্দ্রের ‘নিষ্কৃতি’ উপন্যাসটি মর্মস্পর্শী। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র কী এক আবিষ্কারের নেশায় দিনরাত গবেষণা করছেন। কঠিন শিরঃপীড়াজনিত মনঃকষ্টে তিনি অন্তঃপুর থেকে বহির্গত হন না। কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে নিষ্করুণ দুষ্কৃতিটাকে বহিষ্কার করলেন। চিকিৎসক বুঝিলেন–চতুষ্পদ প্রাণীটির আয়ুষ্কাল শেষ হইয়াছে।

(১১) প্রথমপদের অন্তে অ-কারের পর যদি বিসর্গ থাকে এবং পরপদের প্রথমবর্ণ যদি অ-কার ভিন্ন অন্য স্বরবর্ণ হয়, তখন বিসর্গের লোপ হয়, লোপের পর আর সন্ধি হয় না। অতঃ + ব্‌ = অতএব; শিরঃ + উপরি = শির-উপরি; বক্ষঃ + উপরি = বক্ষ-উপরি; মনঃ + আশা = মন-আশা। “অতএব দয়া করি কহে দয়াবতি, কী চিত্রে রঞ্জিছ আজি শ্বেতসেনাপতি।”–নবীনচন্দ্র।

(১২) পরপদের প্রথমে স্ত, স্থ, স্প থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত বিসর্গ বিকল্পে লুপ্ত হয়। নিঃ + স্পন্দ = নিঃস্পন্দ, নিস্পন্দ; বক্ষঃ + স্থল = বক্ষঃস্থল, বক্ষস্থল; নিঃ + স্পৃহ = নিঃস্পৃহ, নিস্পৃহ মনঃ + স্থ = মনঃস্থ, মনস্থ; অন্তঃ + স্থ = অন্তঃস্থ, অন্তস্থ; দুঃ + স্থ = দুঃস্থ, দুস্থ; মনঃ + স্থিত = মনঃস্থিত, মনস্থিত।

“নিমেষ গণিছে তাই কি তাহারা সারি সারি নিস্পন্দ?”–মোহিতলাল।

নিপাতন-সিদ্ধ বিসর্গসন্ধি : গীঃ + পতি = গীষ্পতি, গীর্পতি, গীঃপতি; অহঃ + রাত্র অহোরাত্র (র্-জাত বিসর্গ বলিয়া ৫নং সূত্রে পড়িল না)।

সন্ধি-সম্বন্ধে বিশেষ মন্তব্য

সংস্কৃত ভাষায় সন্ধির খুবই প্রাধান্য। কিন্তু সন্ধি বাংলা ভাষার প্রকৃতিবিরুদ্ধ। কোমলতা ও শ্রুতিমাধুর্যই বাংলা ভাষার বিশেষত্ব। সন্ধির মর্যাদারক্ষা অপেক্ষা ভাষার মাধুর্যরক্ষার প্রশ্নটি অধিকতর বিবেচ্য। এইজন্য নিম্নলিখিত নির্দেশগুলি ছাত্রছাত্রীদের মনে রাখা অত্যাবশ্যক।–

(ক) সংস্কৃতে পাশাপাশি পৃথক্ পৃথক্ পদেরও সন্ধি হয়, বাংলায় এরূপ সন্ধি চলেই না। স্ত্র্যাচারান্তে বরবধূকে প্রীত্যুপহারাশীর্বাদী দেওয়া হইল। বাজার হইতে কচ্বাল্বাদৌলাঙুরাতাপেলাখামানারসেত্যাদ্যানানো হইয়াছে।–এইরূপ বাক্য বাংলায় চলেই না। বলিতে হইবে–স্ত্রী-আচার-অন্তে বরবধূকে প্রীতি-উপহার ও আশীর্বাদী দেওয়া হইল। বাজার হইতে কচু আলু আদা ওল আঙুর আতা আপেল আখ আম আনারস ইত্যাদি আনানো হইয়াছে। সন্ধির ফল যেন মারাত্মক হইয়া না উঠে, সেদিকে লক্ষ্য রাখিতেই হইবে।

(খ) তদ্‌ভব দেশী বা বিদেশী শব্দের সহিত তৎসম শব্দের সন্ধি না করাই উচিত। কতকাংশ, তোমাপেক্ষা, টাকাভাব, থালাচ্ছাদন, নদীয়াভিমুখে, ট্যাক্সাদায়, বরফাচ্ছন্ন, চাদরাবৃত, উড়িষ্যেশ্বর, ইংলন্ডেশ্বরী, চাষাবাদ, এতাধিক, আপনাপনি, পছন্দানুযায়ী, আইনানুসারে, রাগাগুন, ডেকোপরি, রুট্যাহার ইত্যাদি সন্ধিবদ্ধ রূপে না লিখিয়া পদসংযোজক চিহ্নদ্বারা সমাসবদ্ধ করাই ভালো; প্রয়োজনস্থলে পৃথক্ পৃথক্ পদরূপে নির্দেশ করাও চলে। যেমন–কতক অংশ, তোমার অপেক্ষা, টাকার অভাব, থালায় ঢাকা, নদীয়া অভিমুখে, ট্যাক্স আদায়, চাদরে মোড়া, উড়িষ্যা-ঈশ্বর, চাষ-আবাদ, এত অধিক, আপনা-আপনি, জগৎ-জোড়া, পছন্দ অনুযায়ী, আইন-অনুসারে, রাগের আগুন, গ্যাসের আলো, ডেকের উপর; রুটি আহার ইত্যাদি।

অবশ্য অধিকাংশ, ফলাহার, তদপেক্ষা, অন্নাভাব, বস্ত্রাচ্ছাদন, স্থানাভিমুখে, তুষারাচ্ছন্ন, দনুজেশ্বর, বঙ্গেশ্বরী, সূত্রানুযায়ী, নিয়মানুসারে, ক্রোধাগ্নি, পর্বতোপরি প্রভৃতি শব্দ তৎসম সন্ধিসিদ্ধ বলিয়া যে শিষ্টপ্রয়োগ তাহা তো বলা বাহুল্য। কিন্তু দিল্লীশ্বরী, যশোরেশ্বরী, ইংলন্ডেশ্বর, বাঘাম্বর প্রভৃতি শব্দ সংস্কৃত ব্যাকরণ-সম্মত শিষ্ট-প্রয়োগ না হওয়া সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরিয়া বাংলা ভাষায় চলিতেছে।

(গ) যে-সমস্ত তৎসম সন্ধিবদ্ধ বা সমাসবদ্ধ পদ পূর্ণ শব্দরূপে বাংলায় ব্যবহৃত হইতেছে, সেগুলির আভ্যন্তর সন্ধি অক্ষুণ্ণ রাখাই উচিত। আচার্য সুনীতিকুমার বলিয়াছেন, “এগুলি যেন বাঙ্গালা ভাষার পক্ষে স্বয়ংসিদ্ধ।” যেমন–প্রত্যহ, অত্যাচার, ইতস্ততঃ, মহাশয়, বিদ্যালয়, অন্তরাত্মা, যদ্যপি, অতএব, অদ্যাপি, সংবাদ, সরোবর, স্বতঃসিদ্ধ, অতঃপর ইত্যাদি।

শ্রুতিকটু বা উচ্চারণে ক্লেশকর হইবার সম্ভাবনা থাকিলে দুইটি তৎসম শব্দ ও সন্ধিবদ্ধ না করাই ভালো । শব্দদ্বয়কে পাশাপাশি বসাইয়া পদসংযোজক চিহ্নদ্বারা যুক্ত করা বিধেয়।–নাম-উচ্চারণ (নামোচ্চারণ নয়); গ্রীষ্ম-ঋতু (গ্রীষ্মর্তু নয়); শরৎ-ঋতু (শরদৃতু নয়); পিতৃ-ঋণ (পিতৃণ নয়); বাণী-অৰ্চনা (বাণ্যৰ্চনা নয়); গুরুর আদেশ (গুর্বাদেশ নয়–এখানে গুরু ও আদেশ শব্দ দুইটিকে সমাসবদ্ধ ও করা হয় নাই, লক্ষ্য কর); শরৎচন্দ্র (শরচ্চন্দ্র নয়); শ্রীঈশ্বরচন্দ্র (শ্রীশ্বরচন্দ্র নয়); প্রতিষ্ঠা-উৎসব (প্রতিষ্ঠোৎসব নয়)।

ভাষার এই শ্রুতিমাধুর্যের দিকে লক্ষ্য রাখিয়াই (কবিতায় ছন্দের খাতিরেও বটে) কবি-সাহিত্যিকগণ বহু বাংলা শব্দ, এমন-কি তৎসম শব্দকেও সন্ধিবদ্ধ করেন নাই।–“কানু-অনুরাগরাঙা বসন পরিব।”–চণ্ডীদাস। “প্রতিঅঙ্গ লাগি কান্দে প্রতিঅঙ্গ মোর।”–জ্ঞানদাস। “অতুল ঐশ্বর্যে রত তাঁর ভিখারীর ব্রত।”–রবীন্দ্রনাথ। “জীবন-উদ্যানে তোর যৌবনকুসুমভাতি কতদিন রবে?”–মধুকবি। “হায় রে, ভুলিবি কত আশার কুহকছলে!”–ঐ। “উষ্ণ বিয়োগ-উৎস-সরিৎ দরবিগলিত চক্ষে।”–করুণানিধান। “হরো জগতের বিরহ-আঁধার।”–ঐ। “ফুটুক আঁখি দিব্য-আলোক-সম্পাতে।”–বিজয়লাল । “অরুণ-আলোয় শুকতারা গেল মিলিয়ে।”–রবীন্দ্রনাথ। “চরণে পদ্ম অতসী অপরাজিতায় ভূষিত দেহ।”–সত্যেন্দ্রনাথ। “দিবসে থাকে না কথার অন্ত চেনা অচেনার ভিড়ে।”–যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। “কানন-আনন পাণ্ডুর করি ….. গগন ভরিল কে!”–মোহিতলাল। “নীল-অঞ্জন-গিরি-নিভ কায়া।”–ঐ। “স্পর্ধিছে অম্বরতল অপাঙ্গ-ইঙ্গিতে উৎসব-উচ্ছ্বাসে …. বিজয়-উল্লাসে।”–রবীন্দ্রনাথ। “সর্ব-উপদ্রব-সহা আনন্দ ভবন।”–ঐ। “প্রিয়-উপহারে ভুলেও কি মোরে ডাক?”–যতীন্দ্রমোহন। “মুক্ত-হস্তে করি দান ভ্রাতৃ-অভিষেকে সুখী তুমি বীর।”–প্রিয়ংবদা দেবী। নয়ন-আনন্দ তুমি ভুবন-ঈশ্বরী। “কাহারই বা সে পদধ্বনি সেখানে আহ্বান-ইঙ্গিত করিয়া এইমাত্র সুমুখে মিলাইয়া গেল।”–শরৎচন্দ্র। “এই অনন্ত সুন্দর জগৎ-শরীরে যিনি আত্মা, তাঁহাকে ডাকি।”–বঙ্কিমচন্দ্র। “তাঁহার কথাগুলি এত…..হৃদয়গ্রাহী যে তৎশৰণে পাষাণহৃদয়েও ভক্তির বেগ উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে।”–কৃষ্ণানন্দ স্বামী।

বাংলা সন্ধি

তৎসম শব্দের সন্ধির নিয়ম আর খাঁটী বাংলা শব্দের সন্ধির নিয়ম–উভয়ের মধ্যে প্রচুর ফারাক। কারণ জীবন্ত বাংলা ভাষা সন্ধি-সমাস-প্রত্যয়-বিভক্তি-সম্বন্ধে তাহার নিজস্ব একটা প্রকৃতি গড়িয়া তুলিতেছে। এই প্রকৃতি-বৈশিষ্ট্যটি এখনো পর্যন্ত গবেষণার স্তরেই রহিয়াছে। সুতরাং তৎসম শব্দের সন্ধিসূত্র দিয়া খাঁটী বাংলা শব্দের সন্ধি নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব নয়, বিহিতও নয়।

বাংলা সন্ধি প্রধানতঃ মৌখিক উচ্চারণজাত সমীকরণেরই সগোত্র। দ্রুত উচ্চারণের ফলে পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি ধ্বনির কোথাও মিলন হয়, কোথাও

ধ্বনি দুইটির একটি লোপ পায়, আবার কোথাও-বা তাহাদের কিছুটা বিকৃতি ঘটে। ইহাই খাঁটী বাংলা সন্ধি। এই সন্ধিজাত শব্দাবলী চলিত ভাষার বিশিষ্ট সম্পদ। কোনো-কোনোটি অবশ্য সাধু-ভাষাতেও সমাদর পাইতেছে।

বাংলা সন্ধি দুইপ্রকার-স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধি। বিসর্গসন্ধি বাংলায় নাই; কারণ বিসর্গযুক্ত তৎসম শব্দের বিসর্গ ললাপ করিয়া শব্দটিকে স্বরান্ত রাখাই বাংলা ভাষার রীতিতে দাঁড়াইয়াছে। যেমন–মন, শির, স্রোত, বক্ষ, স্বত, সদ্য, জ্যোতি, চক্ষু ইত্যাদি। প্রথম তিনটি শব্দ উচ্চারণে মন্ শির স্রোত্ হওয়া সত্ত্বেও রূপে যে অ-কারান্ত, তাহা মনে রাখিবে।

বাংলা স্বরসন্ধি

(১) পাশাপাশি দুইটি স্বরবর্ণ থাকিলে একটির লোপ হয়।

(ক) পূর্বর লোপ : বার + এক = বারেক; শত + এক = শতেক; খান + এক = খানেক; এত + এক = এতেক; দশ + এক = দশেক; আধ + এক = আধেক; তিল + এক = তিলেক; যত + এক = যতেক; অর্ধ + এক = অর্ধেক; মিথ্যা + উক = মিথ্যুক; নিন্দা + উ = নিন্দুক।

(খ) পরস্বর লোপ : যা + ইচ্ছেতাই = যাচ্ছেতাই (কদর্য অর্থে); কোটি + এক = কোটিক; গুটি + এক = গুটিক; খানি + এক = খানিক; কুড়ি + এক = কুড়িক; ছেলে + আমি = ছেলেমি; মেয়ে + আলী = মেয়েলী; ঘোঁট +, এর = ছোটর; বড় + এর = বড়র; দাদা + এর = দাদার; ভাল + এর = ভালর। “তাহারি খানিক মাগি আমি নতশিরে।”

(২) অ, আ, ই, উ, এ, ও প্রভৃতি স্বরের পর এ-কার থাকিলে সেই এ-কার বিকৃত হইয়া য় (য়ে) হয়। ভাল + এ = ভালয়; আলো + এ = আলোয়; নদে + এ = নদেয়; পাতা + এ = পাতায়; মা + এ = মায়ে; ঝি + এ = ঝিয়ে; দই + এ = দইয়ে; মু + এ = মুয়ে; পো + এ = পোয়ে; জো + এতে = জোয়েতে। “মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া, জামাই বলে মানব না।”

[একটু লক্ষ্য করিলেই বুঝিবে যে এই স্বরবিকৃতির মূলে য়-শ্রুতি রহিয়াছে।]

(৩) সংস্কৃত সন্ধির অনুকরণে বাংলা স্বরসন্ধি (তৎসম শব্দের সহিত অতৎসম শব্দের মিলন) : বাপ + অন্ত = বাপান্ত; মত + অন্তর = মতান্তর; দিল্লি + ঈশ্বর দিল্লীশ্বর; নেপাল + অধীশ = নেপালাধীশ; ঢাকা + ঈশ্বরী = ঢাকেশ্বরী; যশোর + ঈশ্বরী = যশোরেশ্বরী; চিতোর + উদ্ধার = চিতোরোদ্ধার; ঝুলন + উৎসব = ঝুলনোৎসব; পোস্ট + আপিস = পোস্টাপিস; বয়স + উচিত = বয়সোচিত; উপর + উক্ত = উপরোক্ত; মন + অন্তর = মনান্তর; যশ + আকাঙ্ক্ষা = যশাকাঙ্ক্ষা; শির + উপরি = শিরোপরি; বক্ষ + উপরি বক্ষোপরি; মন + উপযোগী = মনোপযোগী; স্বত + উৎসারিত = স্বতোৎসারিত; সদ্য + উত্থিত = সদ্যোখিত।

শেষের কয়েকটি শব্দ-সম্বন্ধে আমাদের একটু বিশেষ বক্তব্য আছে। বাংলা ভাষার প্রকৃতি-পরিচয়ের অপেক্ষা না রাখিয়াই অনেক প্রাচীনপন্থী মনঃ, যশঃ, প্রাতঃ, তেজঃ, রজঃ, নভঃ, শিরঃ, শ্রেয়ঃ, বক্ষঃ, জ্যোতিঃ, ছন্দঃ প্রভৃতি শব্দকে বিসর্গযুক্ত রাখিতে চান। সেই হিসাবে মনান্তর, বক্ষোপরি, স্বতোৎসারিত প্রভৃতি শব্দগুলি তাঁহাদের কাছে শিষ্ট প্রয়োগের মর্যাদা হইতে বঞ্চিত। কিন্তু একটি প্রশ্ন।–”তোমার নামটি তো মনে পড়ছে না হে।” “শিরে সংক্রান্তি।” “বক্ষের নিচোল বাস…..ভূমিতে লুটায়।” প্রভৃতি স্থলে তাঁহারা কি সংস্কৃত সন্ধিসূত্রের মর্যাদা রাখিবার জন্য মনঃ + এ > মনএ, শিরঃ + এ > শিরএ, বক্ষঃ + এর > বক্ষএর উচ্চারণ করেন? তখন তো দেখি সাধারণ অ-কারান্ত শব্দের মতোই উক্ত শব্দগুলিতে এ বা এর বিভক্তি যোগ করিয়া মনে, মনের, শিরে, শিরের, বক্ষের, প্রাতে ইত্যাদি বলেন। উপরোক্ত শব্দগুলিকে বিসর্গশূন্য করিয়া মাত্র অ-কারান্ত করিবার দিকেই বাংলা ভাষার যে সহজ প্রবণতা, এ সত্যই কি তাঁহারা প্রকারান্তরে স্বীকার করিতেছেন না? অবশ্য মনঃকষ্ট, মনশ্চক্ষু, মনস্তুষ্টি, মনোরম, শিরোধার্য, শিরচুম্বন, বক্ষোরত্ন, বক্ষঃপঞ্জর, নভশ্চক্ষু, নভোমণ্ডল, প্রাতভ্রমণ, জ্যোতিরিন্দ্র, যশোমন্দির, যশোদা, তপশ্চর্যা, শ্রেয়োবোধ, স্রোতোহীন প্রভৃতি শব্দ স্বরূপে অবস্থান করিয়া সংস্কৃত সন্ধি-সূত্রের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখুক, তাহাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু মাত্র খাঁটী বাংলা সন্ধিজাত হওয়ার অপরাধেই মনান্তর, বক্ষোপরি প্রভৃতি শব্দকে সাহিত্যে অপাঙ্ক্তের রাখিব কী সাহসে? বাংলা ব্যাকরণ যে পুরাদস্তুর সংস্কৃত ব্যাকরণ নয়, এই কথাটি বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ প্রভৃতি দরদী সাহিত্যিকগণ বিস্মৃত হন নাই। “সারাদিন কাটে তাঁর জপে তপে।”–রবীন্দ্রনাথ। “দিগ্বারণেরা বেদনা-অধীর বিদারিছে নভ দন্তে।”–মোহিতলাল। “চারি চক্ষুর ধারায় তিতিল নৃপাবনের রজ।”–কালিদাস রায়। “তোমার বিপুল বক্ষপটে নিঃশঙ্ক কুটিরগুলি।”–রবীন্দ্রনাথ। “তাহা সদ্যশোকের বিলাপ নহে।”–ঐ। “উচ্চরবে শিরোপরি ঘনগর্জন হইতেছে।”–বঙ্কিমচন্দ্র। “পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল।”–সত্যেন্দ্রনাথ। “বিশ্বতনুতে অণুতে অণুতে যে নৃত্য চলেছে ঠাকুরের ভুবনস্পন্দন নৃত্য তারই স্বতোৎসার।”–অচিন্ত্যকুমার।

বাংলা ব্যঞ্জনসন্ধি

(১) পরপদের প্রথমবর্ণ ব্যঞ্জন হইলে পূর্বপদের শেষস্বর লোপ পায়।

অ লোপ : বড় + দাদা = বড়দাদা > বড়দা; কাল + শিটে = কাল্‌শিটে।

আ লোপ : কাঁচা + কলা = কাঁচকলা; ঘোড়া + গাড়ি = ঘোড়গাড়ি; কোথা + থেকে = কোত্থেকে; টাকা + শাল = টাক্‌শাল।

ই-বর্ণ লোপ : মিশি + কালো = মিকালো; পানি + ফল = পাফল; বেশী + কম = বেশ্‌কম; চিরুনি + দাঁতী = চিরুন্‌দাঁতী; ঢেঁকি + শাল = ঢেঁক্‌শাল; মাসী + শাশুড়ী = মাস্‌শাশুড়ী।

উ-বর্ণ লোপ : উঁচু + কপালী = উঁচ্কপালী; সরু + চাকলি = সর্‌চাকলি।

এ লোপ : পিছে + মোড়া = পিছমোড়া; পিসে + শ্বশুর = পিস্‌শ্বশুর।

(২) পরপদের প্রথমবর্ণ ঘোষবর্ণ হইলে পূর্বপদের শেষ ব্যঞ্জনের লোপ হয়। জগৎ + জন = জগজন (সংস্কৃত-মতে জগজ্জন); জগৎ + মোহন = জগমোহন (সং–জগন্মোহন); জগৎ + বন্ধু = জগবন্ধু (সং–জগদ্বন্ধু)।

(৩) পরপদের প্রথমবর্ণ ঘোষবর্ণ হইলে পূর্বপদের শেষ অঘোষ ব্যঞ্জনটির স্থানে ঘোষ হয়। ডাক + ঘর = ডাগর; এক + গুণ = এগুণ; হাত + ধরা হাদ্ধরা; নাত + বউ = নাউ; বট + গাছ = বড়গাছ > বড়গাছ; ছোট + দাদা = ছোড়দাদা > ছোড়দা; যত + দিনে = যদ্দিনে; কত + দিন = কদ্দিন; এত + দিন = এদ্দিন (অ্যাদ্দিন)।

(৪) পরপদের প্রথমবর্ণ অঘোষ হইলে পূর্বপদের শেষস্থ ব্যঞ্জনবর্ণটি স্বরশূন্য অঘোষ হয়। রাগ + করেছে = রাক্করেছে; বড় + ঠাকুর = বঠাকুর; কাজ + চালানো = কাঁচালানো।

(৫) শ, ষ, স পরে থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত চ্‌ স্থানে শ্ হয়। পাঁচ + শ পাঁশ্শ; পাঁচ + ষোলং = পাঁশষোলং; পাঁচ + সের = পাঁসের।

(৬) পরপদের প্রথমে চ-বর্গের বর্ণ থাকিলে পূর্বপদের অন্তস্থিত ত-বর্গের বর্ণটি চ-বর্গের বর্ণের সহিত মিলিয়া যায়। সাত + জন্ম = সাজ্জম্ম; হাত + ছানি = হাচ্ছানি; নাত + জামাই = নাজ্জামাই।

(৭) স্বরবর্ণের পর ছ্‌ থাকিলে ছ্‌ স্থানে সংস্কৃত ব্যঞ্জনসন্ধির অনুরূপ চ্ছ হয়। বি + ছিরি = বিচ্ছিরি।

(৮) পরপদের প্রথমবর্ণ ব্যঞ্জন হইলে পূর্বপদের শেষবর্ণ র্‌ সেই ব্যঞ্জনে পরিণত হয়। চার + টি = চাট্টি; কর + না = কন্না; আর + না = আন্না; কর + তাল = কত্তাল; চার + শ = চাশ্‌শ; বেটার + ছেলে = বেটাচ্ছেলে।

বাংলা সন্ধিজাত শব্দগুলির প্রত্যেকটি না হউক কিছু কিছু অন্ততঃ সাহিত্যেও ঠাঁই পাইয়া আসিতেছে এবং ইহাদের সংখ্যা সাহিত্যে ক্ৰমশঃ বাড়িয়াই চলিয়াছে।–“শতেক বর পরে বঁধু ফিরে এল ঘরে।”–চণ্ডীদাস। “এতেক সহিল অবলা বলে।”–ঐ। “না জানি কতেক মধু শ্যামনামে আছে গো?”–ঐ। “কোটিকে গুটিক হয়।” “বড়র পিরীতি বালির বাঁধ।”–ভারতচন্দ্র। কলিতে কি আর ভালর কাল আছে ভাই! “ভালোয় ভালোয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই।” “শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার।”

–রবীন্দ্রনাথ। “উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে।”–ঐ। “জয় শচীনন্দন ভবভয়খণ্ডন জগজনমোহন লাবণি রে।” “শিরোপরি শত বজ্র গর্জিবে গর্জুক।”–গোবিন্দ দাস। “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই।”–রজনীকান্ত। “সব সময় মনোপযোগী শ্রোতা পাওয়া যাইত না।”–প্রমথনাথ বিশী। “নারীর এ আরেক রূপ।”–মোহিতলাল। “কী জানি কোনোদিন সামান্য কারণে মনান্তর ঘটিতে পারে।”–রবীন্দ্রনাথ। “করেছ কি ক্ষমা যতেক আমার স্বলন-পতন-ত্রুটি?”–ঐ। “শেষ জোয়েতে রুইব বলে বেরিয়েছিলাম আজ।” “শতেক বিধবা হয় একেক মরণে।–ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত। . “দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গসুখ তায় হে।”–রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। “মুহূর্তেকে সব যেন ফেলিবেক গ্রাসি।”–বিহারীলাল চক্রবর্তী।

এতক্ষণ সন্ধি-সম্বন্ধে যে আলোচনা করা হইল, তাহাতে একাধিক পদকে কীভাবে সন্ধিবদ্ধ করা হয়, তাহা শিখিলে। পরীক্ষায় সন্ধিবদ্ধ শব্দকে বিচ্ছিন্ন করিবার নির্দেশই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আসিয়া থাকে। তখন কীভাবে উত্তর দিবে, দেখ।—

স্নেহাশিস্ = স্নেহ + আশিস্ (অ + আ = আ); পরীক্ষিকা = পরি + ঈক্ষিকা (ই + ঈ = ঈ); গবেষণা = গো + এষণা (ও + এ = ও-স্থানে অব); গবাক্ষ = গো + অক্ষ (নিপাতনসন্ধি ও-স্থানে নিয়মমতো অনা হইয়া অব হইয়াছে); বিদ্যুদালোক = বিদ্যুৎ + আলোক (স্বরবর্ণ পরে থাকায় স্থানে দু হইয়াছে); মৃন্ময় = মৃৎ + ময় (ম্ পরে থাকায় স্থানে ত-বর্গের পঞ্চমবর্ণ হইয়াছে); উচ্ছ্বসিত = উদ + শ্বসিত (শ পরে থাকায় স্থানে চূ, শ-স্থানে ছ); যজ্ঞ = যজ + ন্‌ (ন্‌-স্থানে ঞ্‌); সংস্কৃতি = সম্‌ + কৃতি (ম্-স্থানে ং, কৃ ধাতুর পূর্বে স্‌ আগম); বনস্পতি = বন + পতি (নিপাতনসন্ধি—প্‌-র পূর্বে অকারণে স্‌ আগম); নিরুদক = নিঃ + উদক (স্বরবর্ণ পরে থাকায় স্থানে র্‌); জ্যোতীরেখা = জ্যোতিঃ + রেখা (র্‌ পরে থাকায় ঃ স্থানে র্‌ এবং তাহার লোপ, পূর্ববর্তী ই-স্থানে ঈ); বাচস্পতি = বাচঃ + পতি (ঃ-স্থানে স্); ভ্রাতুষ্পুত্র–ভ্রাতুঃ + পুত্র (উ-কারের পর :-স্থানে ষ্); ঘোড়্‌গাড়ি = ঘোড়া + গাড়ি (বাংলা সন্ধিতে পূর্বপদের শেষস্থ আ লোপ); বাপান্ত = বাপ + অন্ত (সংস্কৃতের অনুসরণে খাঁটী বাংলা সন্ধি); ষোড়শ = ষট্ + দশ (নিপাতনসন্ধি); সরোবর = সরঃ + বর (ব্ পরে থাকায় অঃ ও-কার হইয়াছে); পাবন = পৌ + অন (অন্য স্বর পরে থাকায় ঔ-স্থানে আব্); পর্যটন = পরি + অটন (অ পরে থাকায় ই-স্থানে য্, পূর্ববর্তী র্ রেফ হইয়া পরবর্তী ব্যঞ্জন ফ্-এর মাথায় গিয়াছে); জগবন্ধু = জগৎ + বন্ধু (বাংলা সন্ধি–ঘোষবর্ণ পরে থাকায় পূর্বপদের শেষ ব্যঞ্জন লুপ্ত); আধেক = আধ + এক (পূর্বপদের শেষস্বর লোপ, বাংলা সন্ধি); উত্থাপন উদ্ + স্থাপন (উদ্-এর পর স্থা ধাতুর স্ লোপ); আবির্ভাব = আবিঃ + ভাব (বর্গীয় চতুর্থবর্ণ ভ্ পরে থাকায় ই-র পরস্থিত :-স্থানে র্, সেই র্ রেফ হইয়া পরবর্তী ব্যঞ্জনের মাথায় গিয়াছে); হৃৎকমল = হৃদ্ + কমল (ক্ পরে থাকায় দ্ স্থানে ত্); শুদ্ধসত্ত্বান্বিত = শুদ্ধসত্ত্ব + অনু + ইত (প্রথমে অ + অ আ; পরে–দ্বিতীয় পদের প্রথমবর্ণ ই, তাই প্রথমপদের শেষবর্ণ উ-স্থানে ব্)।

সন্ধিবিচ্ছেদের প্রশ্নে নিপাতন সন্ধি ও বাংলা সন্ধির ক্ষেত্রে যথাক্রমে নিপাতন সন্ধি ও বাংলা সন্ধি বলিয়া অবশ্যই উল্লেখ করিবে।

অনুশীলনী

১। সন্ধি কাহাকে বলে? সন্ধি প্রধানতঃ কয় প্রকার? প্রত্যেক প্রকারের দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

২। স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি কাহাকে বলে? স্বরসন্ধি ও ব্যঞ্জনসন্ধির পার্থক্য কী? বিসর্গসন্ধিকে ব্যঞ্জনসন্ধির অন্তর্ভূত করা কতদূর সমীচীন?

৩। বন্ধনীমধ্যস্থ ভুল উত্তরটি বাতিল কর : (ক) স্বরসন্ধিতে (স্বরের সঙ্গে ব্যঞ্জনের সন্ধি/ স্বরের সঙ্গে স্বরের সন্ধি)। (খ) ব্যঞ্জনসন্ধিতে (ব্যঞ্জনের সঙ্গে ব্যঞ্জনের সন্ধি/ব্যঞ্জনের সঙ্গে স্বরের সন্ধি/স্বরের সঙ্গে ব্যঞ্জনের সন্ধি/স্বরের সঙ্গে স্বরের সন্ধি)। (গ) বিসর্গসন্ধিতে (বিসর্গের সঙ্গে বিসর্গের সন্ধি/বিসর্গের সঙ্গে স্বরের সন্ধি/বিসর্গের সঙ্গে ব্যঞ্জনের সন্ধি)।

৪। (ক) নিপাতন-সন্ধি কাহাকে বলে? স্বরসন্ধি, ব্যঞ্জনসন্ধি ও বিসর্গসন্ধি–প্রত্যেকটির দুইটি করিয়া নিপাতন সন্ধিজাত শব্দের উল্লেখ কর এবং সেগুলিকে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর। (খ) র্-জাত বিসর্গ ও স্-জাত বিসর্গ কী? উদাহরণ দাও। র্-জাত ও স্-জাত বিসর্গসন্ধির দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

(গ) সন্ধিবদ্ধ কর : শরৎ + চন্দ্র, প্রতিষ্ঠা + উৎসব; এরূপ ক্ষেত্রে আমরা শব্দগুলিকে সাধারণতঃ কীভাবে প্রয়োগ করি?

৫। সন্ধিতে (ক) কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ও-কার হয়, (খ) কোন্ ক্ষেত্রে স্ আগম হয়, (গ) কোন্ ক্ষেত্রে স্ লোপ পায়, (ঘ) কোন্ ক্ষেত্রে আগত স্ মূর্ধন্য ষ্ হইয়া যায়, (ঙ) কোন্ ক্ষেত্রে বিসর্গ স্থানে শ্ বা য্ বা স্ হয়, (চ) কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে ং হয়–উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও ।

৬। সূত্র নির্দেশ করিয়া সন্ধিবিচ্ছেদ কর : পশ্বধম, গীষ্পতি, প্রৌঢ়, গণেন্দ্র, শীতার্ত, পাবক, অক্ষৌহিণী, ক্ষুধার্ত, উচ্ছ্বাস, বাঙ্ময়, তরুচ্ছায়া, উত্তমর্ণ, মনোরম, মন্বন্তর, নবোঢ়া, মৃত্যুঞ্জয়, অধস্তন, অব্জ, পরিচ্ছদ, উপর্যুপরি, অয়স্কান্ত, দুর্ঘটনা, অভয়ারণ্য, কমলেশ (সূর্য), পৃথ্বীশ, সপ্তর্ষি, যুধিষ্ঠির, তদ্ধিত, ধনুষ্টঙ্কার, ঠাকুরালি, পাবন, অধমর্ণ, মহৌষধ, নমস্কার, শান্ত, স্বাধীন, পুনরাবির্ভাব, বাগাড়ম্বর, নীরব, বশংবদ, প্রাতরাশ, ইতস্ততঃ, সঞ্চয়, নিরাকার, দিঙ্কাগ, কিন্নর, পুরোহিত, গোষ্পদ, অন্বেষণ, প্রত্যাখ্যান, পর্যবেক্ষণ, গবেষণা, উচ্ছেদ, দূরপনেয়, স্বর্গত, উদ্ধত, তপোবন, শয়ন, ণিজন্ত, নিষ্ফল, নিস্তব্ধ, নিষ্কৃতি, নীরোগ, শুদ্ধোদন, জগন্নাথ, মনীষা, হিতৈষণা, যদ্যপি, পরাঙ্মুখ, বনৌষধি, যথেষ্ট, গায়ক, প্রত্যাশা, নায়িকা, জীবদ্দশা, সদ্যোজাত, নীরস, পুরস্কার, তৎসম, চিন্ময়, মুনীন্দ্র, স্বাবলম্বী, জগম্ভাতি, বিশ্বামিত্র, নিশ্চেষ্ট, ষোড়শ, ত্রয়োদশী, গবাক্ষ, তিলেক, বৃহস্পতি, ঢাকেশ্বরী, দিমণ্ডল, স্বার্থান্ধ, স্বৈর, কোত্থেকে, দুঃখার্ত, উত্থান, পরীক্ষিত, চতুষ্টয়, মনোমোহিনী, মহৌষধি, তন্ময়, স্বস্তি, স্বাগত, পুনরাগমন, বাগিন্দ্রিয়, উল্লাস, নিশ্চিহ্ন, বিপন্মুক্ত, প্রত্যুষ, জগদম্বা, উল্লেখ, কুজ্‌ঝটিকা, কাব্যোদ্যান, মনোমন্দির, শিরশুড়ামণি, অত্যাশ্চর্য, পিত্রালয়, বাগীশ, নদ্যম্বু, চলচ্চিত্র, উদ্ধৃত, দুস্ত্যজ, ব্যুৎপত্তি, বহিশ্চর, ত্র্যহস্পর্শ, সন্ধি, বানিষ্পত্তি, দুশ্চর, ভাস্কর, অহোরাত্র, প্রতীক্ষা, রাজর্ষি, নীরন্ধ্র, যৎপরোনাস্তি, বিদ্যুল্লেখা, নীরক্ত, স্বচ্ছ, উচ্ছ্বসিত, শিরশ্ছেদ, শাখাচ্ছেদ, উদয়াস্ত, নিরিন্দ্রিয়, মীমাংসা, নিঃস্বেশ্বর, ইত্যবসরে, প্রত্যুদ্‌গমন, রজনীশ, সুধেন্দু, ভেদাত্মিকা, আত্মোন্মোচন, পিপাসার্ত, শোকোচ্ছ্বাস, গোপেশ, শৌরীন্দ্র, জ্যোতিরিন্দ্র, বহিরিন্দ্রিয়, আদ্যন্ত, অপেক্ষা, সুক্তি, কিঞ্চিৎ, মরূদ্যান, কারাবরুদ্ধ, সংস্কৃতি, নির্জল, নিরাবরণ, চক্ষুরত্ন, চক্ষুরুন্মীলন, চিদমৃত, উচ্‌চ্কপালী, অন্তর্মুখী, বহিমণ্ডল, বয়সোচিত, ভ্রাত্রাদেশ, পঠদ্দশা, অধোমুখ, অভ্যন্তর, শ্রদ্ধার্ঘ্য, শ্রীশ, দেবর্ষি, দিব্যোদক, দিগাকাশ, দুশ্ছেদ্য, হরিশ্চন্দ্র, অপরাহ্ণ, পুনরেবণা, বাষ্পায়ন, প্রাণেশ, ক্রীড়ামোদী, শতেক, জীবিকার্জন, অত্যুক্তি, আশীর্বচন, স্নেহাশিস্, বীরেন্দ্রর্যন্ত, প্রাগুক্ত, প্রাহ্ণ, কমলেশ (নারায়ণ), নিরুদ্বেগ, সদসৎ, দ্ব্যর্থ, জগদানন্দ, জগজ্জ্যোতি, জ্যোতিরীশ, পরীক্ষণ, নীরাকার, সংস্করণ, শিরোদেশ, চতুরশ্ব, বিপজ্জনক, শিরস্ত্রাণ, চিরন্তনী, নিরাকৃত, অহর্নিশ, অপেক্ষক, অবাত্মনসগোচর, সদাচারী, সদানন্দ, আদ্যোপান্ত, শুভৈষী, মধুৎসব, ষড়শীতি, ভগবদারাধনা, শিরোরুহ, বর্ষান্তে, সায়ন্তনী, মাত্রাধিক্য, মায়াধীশ, বহিরুচ্ছ্বাস, পরেশ, বাগর্থ।

৭। সন্ধিবদ্ধ কর এবং কোন্ বর্ণের সঙ্গে কোন্ বর্ণের সন্ধি হইল, পাশে বন্ধনীর মধ্যে দেখাইয়া দাও : বাক্ + দত্তা, বহিঃ + গত, হিত + এষণা, ষট্ + দশ, তরু + ছায়া, বন + পতি, দিক্ + নাগ, উদ্ + স্থান, মনঃ + কষ্ট, সার + অঙ্গ, রবি + ছায়া, বহু + আরম্ভ, নৈ + অক, তদ্ + সম, উদ্ + স্থাপিত, স্বঃ + গত, জ্যোতিঃ + প্রভা, গো + অক্ষ, ততঃ + অধিক, যথা + উচিত, শরৎ + চন্দ্ৰ, পিতৃ + আলয়, জগৎ + ঈশ্বরী, নিঃ + রোগ, চলৎ + চিত্র, রাজ + ছত্র, বাক্ + জাল, প্রিয়ম্ + বদা, বড় + ঠাকুর, সদ্যঃ + জাত, জ্যোতিঃ + ময়, তদ্ + হিত, পৃথক্ + অম্ল, গাত্র + উদ্ + স্থান, শুদ্ধি + অশুদ্ধি, পরি + আলোচনা, অতি + ইন্দ্রিয়, ভো + অন, গো + ইন্দ্ৰ, সৎ + চিৎ + আনন্দ, বরম্ + চ, সম্ + চিত, বট + ছায়া, ষষ্ + থী, হৃদ্ + পিণ্ড, অন্তঃ + অঙ্গ, নিঃ + অপরাধ, দুঃ + অক্ষর, অভি + উদয়, শির + উপরি, ছন্দঃ + কুশল, অনু + ইত, পৌ + অন, পরি + অবেক্ষণ, মুষ্টি + আঘাত, অধঃ + পতন, বিদুৎ + আধার, শুভ + এষী, জ্বলৎ + অগ্নি, পুনঃ + চর্বণ, বিদ্যুৎ + মালা, চরিত্র + অয়ন, পরি + অটন, পর + অয়ন, উদ্ + অগ্র, নিঃ + রস, সম্ + ধি, উদ্ + নদ্ধ, অধি + ঈক্ষক, অর্ধনারী + ঈশ্বর।

৮। (ক) রাম, উত্তর, দক্ষিণ, রূপ, ঋত, চিত্র, মূল্য, পার, শিল্প, বাষ্প, বিদ্যুৎ ও চরিত্র–প্রত্যেকটি পদের সঙ্গে ‘অয়ন’ সন্ধি করিলে প্রত্যেক ক্ষেত্রে কী ফল পাইবে?

(খ) র্‌ পদটির সঙ্গে একে একে রিপু, কুল, বৃন্দ, রাজ, ভূমি, পুরী, রথী, পতি, চমু, বীর, সৈন্য, মণি, শ্রেষ্ঠ, শুর–সন্ধি করিলে প্রত্যেক স্থানে সন্ধিবদ্ধ রূপটি কী দাঁড়াইবে, লিখ।

(গ) জগৎ’ কথাটির সঙ্গে আনন্দ, ময়, জীবন, ঈশ, ইন্দ্র, বন্ধু, জ্যোতি, ধাত্রী, নাথ ও মাতা যোগ করিয়া যে শব্দগুলি পাইবে, সেগুলিকে নিজস্ব বাক্যে প্রয়োগ কর।

(ঘ) য’ কথাটির সঙ্গে কোন্ কথাটি সন্ধিবদ্ধ করিলে যথাক্রমে ষড়ানন, ষড়জ, ষড়যন্ত্র, ষড়ঙ্গ, ষড়দর্শন, ষড়ঋতু, যগ্মস, ষড়বিংশ, ষড়ভুজ, ষড়রস, যবতি, যদী, যড়গুণ, ষডুবিধ শব্দগুলি পাওয়া যায়?

(ঙ) উন্নীত, উজ্জ্বল, উদ্যম, উচ্ছ্বাস, উত্থাপন, উজ্জ্বল, উদ্যান, উত্থিত–প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রথম অংশ উদ বাদ দিলে অবশিষ্ট অংশটি কী দাঁড়াইবে?

(চ) হৃদ কথাটির সঙ্গে যন্ত্র, পিণ্ড, বিপ্লব, কম্প, রোগ, গত, পদ্ম, রসায়ন, মর্ম, ধর্ম, স্পন্দন প্রভৃতি একে একে যোগ করিলে প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে কী ফল পাইবে?

(ছ) পুনর্বাসন, পুনরপি, পুনরাদেশ, পুনর্জীবিত, পুনরুজ্জীবন, পুনরুদ্ধার, পুনশ্চেতনা, পুনরীক্ষণ–শব্দগুলিতে ‘পুনঃ’ শব্দের সঙ্গে কোন্ কোন্ শব্দের সন্ধি হইয়াছে?

(জ) অক্ষৌহিণী, শরদিন্দু হৃঙ্গত, দিগি, হৃৎপিণ্ড, সংস্কৃত, হৃর্ম, তড়িদাহত, হৃদবিপ্লব, জ্যোতিরিন্দ্র, শরদম্বর–শব্দগুলি হইতে যথাক্রমে অক্ষ, ইন্দু, গত, ইন্দ্র, পিও, স, মম, আহত, বিপ্লব, জ্যোতিঃ, অম্বর বাদ দিলে প্রত্যেক স্থলে অবশিষ্ট অংশ কী দাঁড়াইবে?

(ঝ) সূত্রসহ সন্ধিবদ্ধ করঃ প্র + ছন্ন, উদ্ + ছেদ, আ + ছাদিত, নি + ছিদ্র, নিঃ + ছিদ্র, সৎ + চিন্তা, উদ্ + শৃঙ্খল।

৯। বন্ধনীমধ্য হইতে উপযুক্ত অংশটি নির্বাচন করিয়া শূন্যস্থান পূরণ কর?

(i) প–ক্ষক (রি / রী); (ii) নী–দ (র / রো); (iii) ম্‌ দ্যান (রূ / রু); (iv) স–ন (ম্ম / ন্মা); (v) নী–শ (তি / তী)–শ্রেষ্ঠ নীতি অর্থে); (vi) শির–দন (চ্ছে / শ্চে); (vii) প্রো–ল (জ্জ্ব / জ্ব); (viii) দু–বস্থা (রা / র); (ix) স–খীন (ম্মু / ন্মু); (x) হৃ–পিণ্ড (ৎ /দ্‌); (xi) বিদ্যু–বিভা (ৎ / দ); (xii) জগ–ত্ৰী (ধা / দ্ধা); (xiii) প্রিয়–বদা (ং/ম্‌ ); (xiv) স–সী (ন্যা / ন্ন্যা); (x) ক–ক্তি (টু/টূ); (x) শি–পীড়া (রো/ রঃ); (xvii) বা–শ্বরী (গে / গী); (xviii) ম–ক্ষোভ (নঃ / নো); (xix) উ–ক্ত (ত্য /ত্ত্য); (xx) প–ধম (শ্ব / শ্বা); (xxi) প–টন (র্য / র্যা); (xxi) ভগব–গীতা (দ / ৎ); (xxiii) শ্রীমদ–গবত (ভ / ভা); (xxiv) ম–ন্তর (ন্ব/ন্ন); (xxv) ত–(দু। দু); (xxvi) অপরা—(হ্ন / হ্ণ); (xxvii) চ–রত্ন (ক্ষু/ক্ষূ); (xxviii) ত–পরায়ণ (পো / পঃ); (xxix) পুন–ভিনয় (র / রা); (xxx) অনুম–নুসারে (ত্য / ত্যা)।

১০। মনান্তর, শিরোপরি, বক্ষোপরি, স্বগতোক্তি–শব্দগুলির শুদ্ধতা বাংলা ব্যাকরণমতে সমর্থন কর।

১১। শুদ্ধ কর? মধ্যাহ্ণ, স্বতোসিদ্ধ, দুরাদৃষ্ট, পর্যাটন, শিরোপীড়া, জাত্যাভিমান, সম্মান, যদ্যপিও, কথপোকথন, পূর্বাহ্ন, বাগেশ্বরী, লজ্জাস্কর, অনুমত্যানুসারে, শিরচ্ছেদ, এতদ্বারা, নীরোদ, ভূম্যাধিকারী, উচ্ছসিত, উজ্জল, সন্মুখে, শিরমণি, পুরহিত, সদ্যঃজাত, পরিস্কার, দুরাবস্থা, পরিক্ষা, তথাপিও, জ্যোতীন্দ্র, জগদীন্দ্র, এতদ্‌সত্ত্বেও, জ্বলতর্চি, এতৎবিষয়ে, দিগাঙ্গনা, প্রাক্-রবীন্দ্র, রবীন্দ্রায়ন, বিদ্যুতালোক, হৃদ্‌পিণ্ড, জ্যোতির্পদার্থ, বাকধারা, বিদ্যুদায়ন।

১২। শুদ্ধ কি অশুদ্ধ বিচার কর : লজ্জাকর, সদ্যোজাত, জগবন্ধু, নিচ্ছিদ্র, বক্ষোপরি, শরচ্চন্দ্র, শ্রীমদ্ভাগবত, শ্রীমল্লগবদ্গীতা, জ্যোতিঃপ্রভা, স্বগতোক্তি, মনাত্তর, চাদরাচ্ছন্ন, মু’খানি, অভ্যুদয়, রব্যুদয়, তেজঃময়ী, শিরম্বন, সদ্যপাতী, সদ্যমৃত, বক্ষমাঝে, উপযুক্ত, উপরোক্ত, মনঃকষ্ট, মনঃবল, তপোসিদ্ধ, মনযোগ, মনতোষ, বিদ্যুতাগ্নি, অগ্নার, সদ্যোখিত, শিরোপরি, মন্মোহন, মনোস্কামনা, মনোম, প্রাতকৃত্য, অত্যন্ত, বিদ্যুভ, সম্বিৎ, মৃন্ময়, কটুক্তি, ভগবদ্ভক্ত, ভগবদপ্রেমিক, হৃৎরোগ, হৃমল, হৃৎপদ্ম, হৃৎপিণ্ড, হৃদ্‌গত, মনোবাঞ্ছা, পশ্চাদপদ, নভোচর, শ্রেয়বোধ, মনোশ্চিকিৎসক, পুরাধিশ্বরী, মনশ্চক্ষু, মনস্তনু, বহূৎসব, পুনরেক্ষণ, তড়িদাগ্নি, সুহৃৎসম্মিত, সুহৃদদর্শন, সুহৃদসাক্ষাৎ, বিদ্বৎত্মণ্ডলী, বিদ্বসমাজ, বিদ্বদ্বল্লভ, বাম্পায়ণ, নিরন্ন, সদ্যঃপ্রয়াত, হৃদ্‌গগন, বাপতি, বাগবিন্যাস, শ্রেয়োফল, বাকসিদ্ধ, বাশুদ্ধি, শ্রেয়োলাভ।

১৩। কোনটি নিপাতনসিদ্ধ, যুক্তি দিয়া দেখাও : প্রৌঢ় / জলৌকা; বিষৌষ্ঠ / বিঘোষ্ঠ; ভ্রাতুস্পুত্র। গীতি; সিংহ / হিংসা; পুস্পাঞ্জলি। পতঞ্জলি; অন্যান্য / অনন্যান্য; একাদশ / এয়োদশ।

১৪। সন্ধিজাত বিকল্প রূপটি দেখাও : কিঙ্কর, সংঘাত, গায়ত্ৰীচ্ছন্দ, মনস্থির, অহঙ্কারী, লক্ষ্মীছায়া, অন্তঃস্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *