নবম পরিচ্ছেদ – ক্রিয়াপদ
ক্রিয়াপদ কাহাকে বলে সে বিষয়ে তোমাদের একটু মোটামুটি ধারণা আছে। [ ১৬২ পৃষ্ঠায় ৭০ নং সূত্র দেখ ]। ক্রিয়ার গঠন, প্রকৃতি ও রূপ-সম্বন্ধে এইটুকু বুঝিয়াছ যে (১) ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তিযোগে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়; (২) ক্রিয়াপদ বাক্যের প্রধানতম উপাদান, ক্রিয়া ব্যতীত ক্ষুদ্রতম বাক্যও রচনা করা সম্ভব নয়; এবং (৩) পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপভেদ হয়। [ ২০১-২০২ পৃষ্ঠায় “পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপভেদ” দ্রষ্টব্য ]
ধাতু ও প্রত্যয়
‘কর’ একটি ক্রিয়া। এই ক্রিয়াটি কাল ও পুরুষভেদে করি, করে, করিতেন, করিবে, করিলাম, করাইতেছে ইত্যাদি বিভিন্ন রূপে পরিবর্তিত হয়। এই রূপগুলি বিশ্লেষণ করিলে আমরা পাই।—
করি = কর্ ধাতু + ই বিভক্তি [ উত্তমপুরুষের ক্রিয়া—সাধু ও চলিত ]
করে = কর্ ধাতু + এ বিভক্তি [ প্রথমপুরুষের ক্রিয়া—সাধু ও চলিত ]
করিতেন = কর্ ধাতু + ইতেন বিভক্তি [ ‘প্রথম ও মধ্যমপুরুষের (গুরু) ক্রিয়া—সাধু ]
করিবে = কর্ ধাতু + ইবে বিভক্তি [ প্রথম ও মধ্যমপুরুষের (সাধারণ) ক্রিয়া—সাধু ]
করিলাম = কর্ ধাতু + ইলাম বিভক্তি [ উত্তমপুরুষের ক্রিয়া—সাধু ]
করাইতেছে = করা ধাতু (কর্ + আ প্রত্যয়) + ইতেছে বিভক্তি [ প্রথমপুরুষের (সাধারণ) ক্রিয়া—সাধু ]
এই ছয়টি ক্রিয়ার একটি সাধারণ অংশ কর্। ইহাই ধাতু। কর্ ধাতুর অর্থ কাজ করা। বিভিন্ন ধাতুবিভক্তিযোগে কর্ ধাতুর যে-কয়েকটি রূপ দেখিলে তাহাদের প্রত্যেকটিরই মূল অর্থ কাজ করা। সুতরাং একই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন প্রত্যেকটি ক্রিয়াপদেই মূল ধাতুটির অর্থ অক্ষুণ্ণ থাকে।
আবার, এই ধাতুটিকে অন্য কোনোপ্রকারে ভাঙা যায় না। বর্ণবিশ্লেষণ করা যায় বটে, কিন্তু তাহাতে ধাতুর মূল অর্থটি নষ্ট হইয়া যায়। সুতরাং ধাতু অবিভাজ্য।
১০৯। ধাতু : ক্রিয়ার মূল-অর্থপ্রকাশক অবিভাজ্য মৌলিক অংশই ধাতু।
নিছক শব্দ যেমন বাক্যে স্থান পায় না, ধাতুও তেমনি বাক্যে স্থান পায় না। শব্দকে শব্দবিভক্তিযোগে পদে পরিণত করিয়া যেমন বাক্যে স্থান দিতে হয়, ধাতুকেও তেমনি ধাতুবিভক্তিযোগে ক্রিয়াপদে পরিণত করিয়া তবে বাক্যে স্থান দিতে হয়। ধাতুবিভক্তি কাহাকে বলে, দেখ।—
১১০। ধাতুবিভক্তি : কাল ও পুরুষভেদে যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতুর উত্তর যুক্ত হইয়া ক্রিয়াপদ গঠন করে, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে ধাতুবিভক্তি বা ক্রিয়াবিভক্তি বলে।
পূর্বের উদাহরণগুলিতে ই, এ, ইতেন, ইলাম প্রভৃতি ধাতুবিভক্তি লক্ষ্য কর। ধাতুবিভক্তিগুলি ধাতুর মূল অর্থের গতি, প্রকৃতি, কাল, পুরুষ প্রভৃতি নির্দেশ করে।
১১১। ধাত্ববয়ব প্রত্যয় : যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতু বা শব্দের উত্তর যোগ করিয়া নূতন ধাতু গঠন করা হয়, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে ধাত্ববয়ব প্রত্যয় বলে। কর্ (ধাতু) + আ (ধাত্ববয়ব প্রত্যয়) = করা (ধাতু –করানো অর্থে)। জ্ঞা (ধাতু) + সন্ (ধাত্ববয়ব প্রত্যয়) = জিজ্ঞাস্ (ধাতু)। বিষ (শব্দ) + আ (ধাত্ববয়ব প্রত্যয়) = বিষা (ধাতু—বিষাক্ত করা অর্থে)।
১১২। ক্রিয়া : মূল ধাতুর উত্তর কিংবা ধাত্ববয়ব প্রত্যয়যোগে গঠিত ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তি যোগ করিয়া যাওয়া, আসা, করা, থাকা, খাওয়া প্রভৃতি যে কার্যবাচক পদের সৃষ্টি হয়, তাহার নাম ক্রিয়াপদ।
ধাতুবিভক্তি ও ধাত্ববয়ব প্রত্যয়ের পার্থক্যটুকু মনে রাখিও। ধাতুবিভক্তিযোগে ধাতু ক্রিয়াপদে পরিণত হইয়া বাক্যে স্থানলাভের যোগ্যতা পায়; কিন্তু ধাত্ববয়বযোগে ধাতু ধাতুই থাকে আর শব্দটি ধাতুতে পরিণত হয়, বাক্যে স্থানলাভের যোগ্যতা সেই নবগঠিত ধাতুর নাই। পুনরায় ধাতুবিভক্তি যোগ করিয়া সেই ধাতুকে ক্রিয়াপদে পরিণত না করা পর্যন্ত বাক্যে ব্যবহার্য পদগৌরব সে পায় না। প্রয়োজন হইলে ধাতু বা শব্দের উত্তর আগে ধাত্ববয়ব যোগ করিয়া পরে ধাতুবিভক্তি যোগ করিতে হয়। কিন্তু ধাতুতে ধাতুবিভক্তি একবার যোগ করিবার পর তাহাতে আর প্রত্যয়যোগ চলে না।
উৎপত্তি ও প্রকৃতির দিক্ হইতে বিচার করিয়া ধাতুকে চারিটি ভাগে ভাগ করা যায়। (১) সিদ্ধ বা মৌলিক, (২) সাধিত, (৩) সংযোগমূলক ও (৪) যৌগিক।
১১৩। সিদ্ধ বা মৌলিক ধাতু : যে-সকল ধাতু স্বয়ংসিদ্ধ, যাহাদের বিশ্লেষণ করা যায় না, তাহাদিগকে সিদ্ধ বা মৌলিক ধাতু বলে। এই সিদ্ধ ধাতু হইতে অন্যপ্রকার ধাতু ও নানাবিধ শব্দ গঠিত হয়। সিদ্ধ ধাতুকে আবার উৎসের বিচারে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।—
(ক) সংস্কৃত ধাতু : চল্, চর্, পাল্, ভজ্, লিখ্, জ্বল্, ফল্, যা, ঘট্, দুহ্, সাধ্, বাধ্, দুল্, পিষ্, শুষ্ ইত্যাদি। এই ধাতুগুলিতে সরাসরি বাংলা ধাতুবিভক্তি যোগ করিয়া বাংলা ক্রিয়াপদ পাই।
(খ) তদ্ভব ধাতু : কৃ > কর্, মৃ > মর্, ধৃ > ধর্, দা > দি, পর্ > পড়্, জ্ঞা > জান্, পত্ > পড়, গৈ > গাহ্, খাদ্ > খা, বুধ > বুঝ্, জাগৃ > জাগ্, হন্ > হান্, যুধ্ > যুক্, স্থাপি > থো, রক্ষ্ > রাখ্, হস্ > হাস্, ক্রন্দ্ > কাঁদ্, শ্ৰু > শুন্, দৃশ্ > দেখ্, উদ্ + ড > উড়্, উদ্ + স্থা > উঠ, স্ফুট্ > ফুট্, চর্ব > চিবা, সিচ্ > সিঞ্চ, স্তন্ভ্ + আ > থামা, প্র + ভা > পোহা, বি + ক্ৰী > বিকা, পরি + ধা > পর্, আ + নী > আন্ ইত্যাদি।
(গ) অজ্ঞাতমূল খাঁটী বাংলা ধাতু : ভাস্, ডাক্, নড়, হাঁট্, বাঁচ্, খাট্, এড়, রুখ্, ফেল্, খুঁজ্, কাট্, বল্, ঠেল্, ঘির্, জুড়, টুট্ ইত্যাদি।
(ঘ) সংস্কৃত বিশেষ্য বা বিশেষণ হইতে উৎপন্ন ধাতু : গর্ত > গাড়ু, পাক > পাক্, ভ্রষ্ট > ভড়কা, মত্ত > মাত্ ইত্যাদি।
(ঙ) ধন্যাত্মক ধাতু : ধুঁক্, ফুঁক্, হাঁচ্, ঠুক্, ফুঁস্ ইত্যাদি।
(চ) কেবল কবিতায় ব্যবহৃত ধাতু : বধূ, প্র + বিশ্ > পশ্, দহ্, বি-রাজ্ > বিরাজ্, দশ্, চুম্বু, নম্, বন্দ্, হের্, নেহার্, কুহর্, ত্যজ্, স্মর্, প্র + স্মর্ > পাসর্ ইত্যাদি।
১১৪। মৌলিক ক্রিয়া : অন্য কোনো ধাতু বা প্রত্যয়ের সাহায্য না লইয়াই সিদ্ধ ধাতুর উত্তর সরাসরি ধাতুবিভক্তি যোগ করিয়া যে ক্রিয়াপদ পাওয়া যায়, তাহাকে মৌলিক ক্রিয়া বলে।
ফল্ + ইল = ফলিল; পোহা + এ = পোহায়; যুঝ্ + ই = যুঝি; খাট্ + ইতেছি = খাটিতেছি; জুড়্ + ইয়া = জুড়িয়া; ধুঁক্ + ইতেছিল = ঝুঁকিতেছিল; পাক্ + ইলে = পাকিলে; মাত্ + ইতেন = মাতিতেন; পশ্ + ইল = পশিল; নেহার্ + এন = নেহারেন; গা + ইল = গাইল; সার্ + ইতে = সাধিতে; স্মর্ + ইছে = স্মরিছে।
প্রয়োগ : “বাকি কী রাখিলি তুই বৃথা অর্থ-অন্বেষণে, সে সাধ সাধিতে?” “পোহায় রজনী।” ত্যজ লাজ ভয় ঘৃণা সংশয় উপাধি ও অভিমান। “কানে তাই পশিতেছে আসি।” “একবার বাল্মীকিরে আরবার সে ক্রৌঞ্চীরে নেহারেন ফিরে ফিরে যেন উন্মাদিনী!” “তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজ্বালা সেই পাসরে।” “স্মরিব সত্যে।” “দংশিল কেবল ফণী।” “উদিল যেখানে বুদ্ধ-আত্মা মুক্ত করিতে মোক্ষদ্বার।” কুহরিছে বারে বারে। “সে আসি নমিল সাধুর চরণকমলে।” “বাঁচিবার তরে সমান যুঝি।” “জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে।”
১১৫। সাধিত ধাতু : কোনো সিদ্ধ ধাতু বা শব্দের সহিত এক বা একাধিক প্রত্যয় যোগ করিয়া যে ধাতু গঠিত হয়, তাহা সাধিত ধাতু।
সাধিত ধাতুকে বিশ্লেষণ করিলে মূলে একটি সিদ্ধ ধাতু বা বিশেষ্য, বিশেষণ, অব্যয় ইত্যাদি যেকোনো একটি নাম-শব্দ এবং এক বা একাধিক প্রত্যয় পাওয়া যায়। সাধিত ধাতুকে আবার অর্থ ও সাধন-অনুসারে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়— (ক) প্রযোজক বা প্রেরণার্থক ধাতু, (খ) নামধাতু ও (গ) কর্মবাচ্যের ধাতু।
=
খাও
(ক) প্রযোজক বা প্রেরণার্থক ধাতু : অন্যকে দিয়া কোনোকিছু করানো অর্থে সিদ্ধ ধাতুর উত্তর আ প্রত্যয়যোগে গঠিত ধাতুকে প্রযোজক ধাতু বলে। সিদ্ধ ধাতুটি স্বরান্ত হইলে আ প্রত্যয়টি ওয়া হইয়া যায়। √খা + আ = √খাওয়া (অর্থ—খাওয়ানো); √কর্ + আ = √করা (অর্থ—করানো); √পড় + আ = √পড়া (অর্থ—পড়ানো); √পাড়্ + আ = √পাড়া (অর্থ—পাড়ানো); √কম + আ = √কমা (অর্থ–কমানো); √বস্ + আ √বসা (অর্থ—বসানো)। √হাস্ + আ = √হাসা (অর্থ—হাসানো); √শুন্ + আ = √শুনা (অর্থ—শুনানো); √জ্বল্ + আ = √জ্বালা (অর্থ—জ্বালানো); √গা + আ = √গাওয়া (অর্থ—গাওয়ানো); √সাজ্ + আ = √সাজা (অর্থ—অন্যকে সাজানো); √দেও + আ = √দেওয়া (অর্থ—দেওয়ানো) ইত্যাদি।
১১৬। প্রযোজিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়ার দ্বারা কাহাকেও কোনো কাজে প্রবৃত্ত করা বুঝায়, তাহাকে প্রযোজিকা ক্রিয়া বলে। প্রযোজক ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তি যোগ করিয়া এই ক্রিয়াপদ পাওয়া যায়। প্রযোজিকা ক্রিয়ার গঠনপ্রণালী লক্ষ্য কর।–
সিদ্ধ ধাতু | প্রত্যয় | প্রযোজক ধাতু | ধাতুবিভক্তি | প্রযোজিকা ক্রিয়া |
দেখ্ | আ | দেখা | ইব | দেখাইব |
কাঁদ্ | আ | কাঁদা | ইয়াছেন | কাঁদাইয়াছেন |
শুন্ | আ | শুনা | ইল | শুনাইল |
চর্ | আ | চরা | ইবে | চরাইবে |
খেল্ | আ | খেলা | ইতেছিল | খেলাইতেছিল |
দি | আ | দেওয়া | ইলেন | দেওয়াইলেন |
প্রয়োগ : স্বামীজীর একটি নূতন ছবি তোমাদের দেখাইব। শুধু শুধু ছেলেটাকে কাঁদালেন তো। “কেবা শুনাইল শ্যামনাম।” উপমন্যু আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত গে__ চরাইবে। সাপুড়ে সাপ খেলাচ্ছিল। “বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি।” “ছুটেছে সমীর আঁচলে তাহার নবীন জীবন উড়ায়ে।” ঘুমেতে বিভোর জাতিরে তোমার জাগাও কবি মাতাও মায়ের নামে। “তুমি যেমন নাচাও তেমন নাচি।” “শাপলা শালুকে সাজাইয়া সাজি শরতে শিশিরে নাহিয়া।” “কোন্ মা আমারে দিলি শুধু এই খেলাবার বাঁশি।” “শিখাইলে এই সত্য তুচ্ছ নয় মনুষ্যত্ব।” “আমি দেখি নাই কিছু বুঝি নাই কিছু দাও হে দেখায়ে বুঝায়ে।”
ণিচ্ প্রত্যয়যোগে সংস্কৃতে প্রযোজিকা ক্রিয়া গঠিত হয় বলিয়া এই ধরনের ক্রিয়াকে সংস্কৃতে ণিজন্ত ক্রিয়াও বলে। কিন্তু বাংলায় ধাতুর উত্তর ণিচ্ প্রত্যয় যুক্ত হয় না। তবে ণিচ্ প্রত্যয়ের প্রভাব অর্থাৎ স্বরের বৃদ্ধি বাংলা ধাতুতেও কিছু কিছু মেলে। √নড়্ + আ √নাড়া (নাড়ানো অর্থে—স্বরের বৃদ্ধি না হইলে √নড়া হইবে); √চল্ + আ = √চালা; √জ্বল্ + আ = √জ্বালা। “যেমন চালাও তেমনি চলি।” আচ্ছা, পুতুলটা নাড়াস নে যেন। দিনরাত জ্বালাও কেন বল তো? “বিকাল বেলায় বিকায় হেলায় সহিয়া নীরব ব্যথা।”
(খ) নামধাতু : বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়—এই নাম-শব্দের উত্তর আ প্রত্যয়যোগে যে সাধিত ধাতু পাওয়া যায় তাহাকে নামধাতু বলে।
(১) বিশেষ্য হইতে—বিষ + আ = √বিষা (বিষানো অর্থে); হাত + আ √ হাতা (হাতানো অর্থে); ডর + আ = √ডরা (ভয় করা অর্থে); জুতা + আ = √জুতা (জুতানো অর্থে); ঘাম + আ = √ঘামা (ঘামানো অর্থে); বেত √বেতা (বেত মারা অর্থে); চোট + আ √চোটা (চোট লাগানো অর্থে); লতা + আ = √লতা (লতার মতো প্রসারিত হওয়া বা এলাইয়া পড়া)।
(২) বিশেষণ হইতে—ঘন + আ √ঘনা (ঘনানো অর্থে); বাঁকা + আ √বাঁকা (বাঁকানো অর্থে); রাঙা + আ = √রাঙা (রাঙানো অর্থে); টক + + আ = √টকা (টকানো অর্থে)।
(৩) ধ্বন্যাত্মক অব্যয় হইতে—ধিকধিক + আ = √ধিকধিকা; ধড়ফড় + আ = √ধড়ফড়া; টলমল + আ = √টলমলা; ছলছল + আ =√ছলছলা। সেইরূপ √কনকনা, √লকলকা, বকবকা, রিনরনা ইত্যাদি।
১১৭। নামধাতুজ ক্রিয়া : নামধাতুর উত্তর ক্রিয়াবিভক্তিযোগে যে ক্রিয়াপদ পাওয়া যায়, তাহাকে নামধাতুজ ক্রিয়া বলে।
বিষা + ইল = বিষাইল; হাতা + ইয়াছিল = হাতাইয়াছিল; ঘনা + এ ঘনায়; রাঙা + ইব = রাঙাইব; টকা + ইয়া = টকাইয়া; কিলা + ইয়া কিলাইয়া; কড়মড়া + এ = কড়মড়ায়; ছলছলা + ইয়া = ছলছলাইয়া; ধিকধিকা + ইবে = ধিকধিকাইবে; বকবকা + ইতেছে = বকবকাইতেছে।
প্রয়োগ : “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু।” বাসে পেনটা কে যে হাতাল টেরই পেলাম না। বেটা ডাকুকে আচ্ছাসে জুতিয়ে দাও; কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দাও। “লতাইবে বক্ষে মোর।” “ইন্দ্রে নিঃশঙ্কিলা।” “চিন্তারাশি ঘনায় ললাটে।” “আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?” “শুধু হরির রঙেই রঙে (উচ্চারণ রোঙে) আছি আমরা।” “শেফালির বৃত্ত দিয়া রাঙাইব রানী বসন বাসন্তী রঙে।” ফাঁকা হাওয়ায় চুলটা শুকিয়ে নে না, জয়া। ডিঙিখানা টলমলিয়ে ছুটছে। সকাল থেকে ধড়ফড়িয়ে লাম। মেজাজটা এমন টকিয়েছে কেন? কথার উত্তর না দিয়েই ছেলেটা হনহনিয়ে চলে গেল। ঝাঁপির ভিতর সাপটা ফোঁসফোঁসাচ্ছে। “ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে।” ফুটপাথের হকারগুলো খদ্দের ধরবার জন্যে মুখিয়েই রয়েছে। এঞ্জিনটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু ধোঁয়াচ্ছে। “ধ্বনিল আহ্বান মধুর গম্ভীর প্রভাত-অম্বর-মাঝে।” “লোহসহ মিশি অশ্রুধারা আর্দ্রিল মহীরে।” “কপালে নেইকো ঘি ঠকঠকালে হবে কী?” “ছায়া ঘনাইছে বনে বনে।” “রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো এবার যাবার আগে।”
বাংলা সাহিত্যে যুগান্তর-সৃষ্টিকারী দত্তকবি শ্রীমধুসূদন বাংলা কাব্যে এক নূতন ধরনের নামধাতুজ ক্রিয়ার বহুল প্রয়োগ করেন। (অবশ্য তাঁহার পূর্বেও বাংলা কাব্যে নামধাতুর প্রয়োগ ছিল, তবে ক্বচিৎ।) সেখানে নামপদের উত্তর কোনো প্রত্যয় তো যুক্ত হয়ই না, উপরন্তু শব্দের শেষ স্বরটিকে লোপ করিয়া দিয়া তবে ধাতুবিভক্তি যোগ করা হয়। পবিত্র (শেষ স্বর লুপ্ত) + ইল = পবিত্রিল; ব্যয়্ + ইলি = ব্যয়িলি; উত্তর্ + ইব = উত্তরিব; ঝলমল্ + ইয়া = ঝলমলিয়া। মধুকবির এই পদাঙ্ক বহু কবিই অনুসরণ করিয়াছেন।
মাইকেলী নামধাতুজ ক্রিয়ার প্রয়োগ : “উমার অঙ্গের ছায়া শীতলে শংকরকায়া।” “পবিত্রিলা আনি মায়ে এ তিন ভুবন।” “যশোলাভ-লোভে আয়ু কত যে ব্যয়িলি হায়!” “উত্তরিলা কাতরে রাবণি।” “নীরবিলা তরুরাজ।” “আজ্ঞা কর দাসে, শাস্তি (শাস্তি = শাস্তি দিই) নরাধমে।” “ঝলমলি ঝলে অঙ্গে নানা আভরণ।” “পশিয়াছে কত যাত্রী যশের মন্দিরে, দমনিয়া ভবদম দুরন্ত শমনে।” “নড়িছে বিষাদে মর্মরিয়া পাতাকুল!” “আঁধারিয়া ওড়ে শূন্যে ঝোড়ো এলোচুল!” “বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে।” “ছিলে কিনা তুমি আমারি জীবনবনে সৌন্দর্যে কুসুমি।” “উঠিল বনাঞ্চল চঞ্চলিয়া।” হাসি মাতা আশিসিয়া তনয়ারে চুম্বিল বদন। উজলিল দশ দিশ অমল আলোয়। লাঘবিতে রাঘবের বীরগর্ব রণে। “কে তারে সহসা মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা।” “ক্রূর হাস্যে পাণ্ডবের বন্ধুগণ সবে ধিক্কারিল।” “ঝঙ্কারিব জয় জগদীশ’ প্রাণের একতারাতে।” “দিশি সাহেবিত্ব লুভিয়েছিল আর কি!”—স্বামীজী! “বৃথা গঞ্জ দশাননে।” “মনেরে বুঝায়ে বল, নয়নেরে দোষ (উচ্চারণ দোষো—দোষ দেওয়া অর্থে) কেন?” “বীর বলি, যে তোমারে আশিসিল, অর্জুনজননী সে যে।”
বাংলা নামধাতুর প্রয়োগ কবিতার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। ক্যচ্ ক্যঙ্ প্রভৃতি ধাত্ববয়ব প্রত্যয়যুক্ত খাঁটী সংস্কৃত নামধাতুর প্রয়োগ বাংলায় নাই। তবে এইরূপ ধাতু হইতে জাত শানচ্ প্রত্যয়ান্ত দণ্ডায়মান, শ্যামায়মান, ঘনায়মান, ধূমায়মান, শব্দায়মান প্রভৃতি কৃদন্ত শব্দের সমাদর বাংলায় যথেষ্ট রহিয়াছে।
(গ) কর্মবাচ্যের ধাতু : মূল ধাতুর সহিত আ প্রত্যয়যোগে এই কর্মবাচ্যের ধাতু পাওয়া যায়। মান্ + আ = মানা; দেখ্ + আ = দেখা; শুন্ + আ = শুনা ইত্যাদি। এইসমস্ত ধাতুর সহিত ধাতুবিভক্তি যুক্ত হইলেই কর্মবাচ্যের ক্রিয়া পাওয়া যায়। “মহামায়ায় যতই মানাক সিংহ এবং সিংহাসনে।” “বিকাল বেলায় বিকায় হেলায় সহিয়া নীরব ব্যথা।” কথাটা কি ভালো শোনাচ্ছে? দূর থেকে চাঁদকে ছোট্ট দেখায়।
১১৮। সংযোগমূলক ধাতু : বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের সহিত কর্, হ, দি, পা প্রভৃতি কয়েকটি মৌলিক ধাতুর সংযোগে যে ধাতু গঠিত হয়, তাহাকে সংযোগমূলক ধাতু বলে।
কর্ ধাতুর যোগে—জিজ্ঞাসা কর্, দর্শন কর্, পাস কর্, মানা কর্, বিরাজ কর্, তামাশা কর্, শ্রবণ কর্, গমন কর্, ভোজন কর্, বরখাস্ত কর্, মিশ্রিত কর্, টিকটিক কর্, আনচান কর্, টোটো কর্, ঢিপঢিপ কর্, জ্বলজ্বল কর্, শব্দ কর্, ঘরসংসার কর্, সমবেত কর্, আঁচ কর্, ভয় কর্ ইত্যাদি।
হ ধাতুর যোগে—বড় হ, একমত হ, ছোটো হ, রাজী হ, ফেল হ, ধাবিত হ, শামিল হ, মানুষ হ, কাল হ, একত্র হ, প্রবাহিত হ, ভালো হ, মন্দ হ, সম্মিলিত হ, উদয় হ, হাওয়া হ ইত্যাদি।
পা ধাতুর যোগে—মন পা, সাজা পা, জবাব পা, ঘুম পা, ক্ষুধা পা, ব্যথা পা, লজ্জা পা, কান্না পা, ভূতে পা, প্রয়াস পা, বৃদ্ধি পা, ক্ষয় পা, আলো পা, প্রমোশন পা ইত্যাদি।
দি ধাতুর যোগে—দোল দি, ডুব দি, লাফ দি, জ্বাল দি, তা দি, ঢেউ দি, তাল দি, দৌড় দি, ছুট দি, চম্পট দি, লম্বা দি, শিস দি, জবাব দি, উত্তর দি, শিক্ষা দি, মন দি, ধরা দি, সামাল দি, ব্যথা দি, শান্তি দি, তালিম দি, চমক দি, গোল দি, সায় দি, লজ্জা দি ইত্যাদি।
কাট্ ধাতুর যোগে—জিভ কাট্, সাঁতার কাট্, সুতো কাট্, তিলক কাট্, ছানা কাট্, চরকা কাট্ ইত্যাদি।
খা ধাতুর যোগে—মাথা খা, লাট খা, মার খা, কিল খা, ঘুষ খা, মিশ খা, ধাক্কা খা, নুন খা, চাকরি খা, হাবুডুবু খা, হিমশিম খা, খাবি খা ইত্যাদি।
মার্ ধাতুর যোগে—মুখ মার্, মটকা মার্, ছাপ মার্, ডুব মার্, চোট মার্, দাঁও মার্, মার্কা মার্, পকেট মার্, ঘাপটি মার্, লাফ মার্, উঁকি মার্, দাগ মার্, চুপ মার্ ইত্যাদি।
উত্তরাংশে বিবিধ ধাতুর যোগে—ভালো বাস্, মন্দ বাস্, পর বাস্, ভয় বাস্, অস্ত যা, তাল রাখ্, ওত পাত্, মারা পড়, ঢোক গেল, ঝাল ঝাড়, গলা ছাড়, হাঁফ ছাড়, মুখ খোল্, জন্ম নে, সাক্ষী মান্, হার মান্ ইত্যাদি।
১১৯। সংযোগমূলক ক্রিয়া : বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ের উত্তর কর্, হ, দি, পা প্রভৃতি মৌলিক ধাতু যখন ধাতুবিভক্তিযোগে একটিমাত্র ক্রিয়ার অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাহাকে সংযোগমূলক ক্রিয়া বলে।
প্রাচীন বাংলায় নিদ গেল (নিদ্রা গেল), ভান্তি ন বাসসি (ভুল করিস না), করঅ অহারা (আহার করে), করউ কংখা (আকাঙ্ক্ষা করে), কহন ন জাই (বলা যায় না)—প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। আধুনিক বাংলার নিজস্ব বাগ্ধারাতেও সংযোগমূলক ক্রিয়ার প্রচুর অবদান রহিয়াছে।—
“বাহাল-বরখাস্ত করিলেন! ব্যবসায়ের পথ ফলাও করিলেন।” তখন হেডমাস্টারমশায় ক্লাস নেবেন শুনে আমাদের বুক ঢিপঢিপ করতে লাগল। কেমন করে টের পেল, তাই ভাবছি। “ডুৰ দে না মন জয় কালী বলে।” “বল ক’ বিঘৎ নাকে দিব খত।” “শাস্তি দেওয়া তারেই সাজে সোহাগ করে যে।” তেলে জলে মিশ খায় না। পাঁচখানা লুচিতেই মুখ মেরে দিল? গলা ছেড়ে আবৃত্তি কর। কিন্তু কিন্তু করো না, রাজী হয়ে যাও। দশটা অঙ্ক নিয়েই যে হাবুডুবু খাচ্ছিস রে? কোনো মা-ই ছেলেকে মন্দ বাসেন না। পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে যা পেয়েছ তাতেই সন্তুষ্ট হও। বুড়ো লোকটাকে সাক্ষী মেনে ঝুটমুট ঝামেলায় ফেলবেন কেন? প্রথম চেষ্টা ফলবতী না হলেও নিরাশ হয়ো না। চকচক করলেই তো আর সোনা হয় না। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করা কারো কারো স্বভাব। “শিবের বুকে পা-টি দিয়ে বেটী আবার জিবটি কেটেছে!” “পীতাম্বর প্রজাদের দলে নাম লেখালেন।” “দ্বিজ চণ্ডীদাসে কয়, মরণে সে বাসে ভয় কালা যার হিয়া মাঝে রহে!” “লজ্জা পাওয়ার পায় নি অবকাশ।” “মা, তোর রাঙা পায়ে কত ভ্রমর ঠাঁই পেয়েছে ফুলের সাথে।”
১২০। যৌগিক ধাতু :—ইয়া ও—ইতে বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়ার সহিত সমাপিকা ক্রিয়ার ধাতুযোগে যে ধাতু গঠিত হয়, তাহাকে যৌগিক ধাতু বলে। যৌগিক ধাতুর উত্তরাংশে পড়, নে, থাক্, ফেল্, দি, লাগ্, রাখ্, পা, উঠ প্রভৃতি ধাতুরই প্রয়োগ বেশী হয়।
১২১। যৌগিক ক্রিয়া :—ইয়া বা—ইতে বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়া যখন সমাপিকা ক্রিয়ার অব্যবহিত পূর্বে বসিয়া উভয়ে মিলিয়া একটিমাত্র ক্রিয়ার অর্থ প্রকাশ করে, তখন তাহাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। যৌগিক ধাতুর উত্তরাঙ্গে ধাতুবিভক্তি যোগ করিলেই যৌগিক ক্রিয়া পাওয়া যায়। “অত বড়ো মোষটার মাথা এক কোপে কেটে ফেলল।” তোমরা দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসে পড়। পিছনের ছেলেদের বসিয়ে দাও। “ভিজে গেল মন।” “কী বলিতে চাই, সব ভুলে যাই।” ছেলেরা সুর করে নামতা পড়তে লাগল। পাহাড়টা ভিতরে ভিতরে এত ব্যথিয়ে উঠেছে! তুমি এতদূর নেমে গেছ! “রঞ্জার মুখ দেখব না” বলে প্রতিজ্ঞা করে বসলেন মহামদ। “খুশিতে উছলে উঠল গদাধর।” ক্রমে ক্রমে সে গলা কান্নায় গলে পড়ল। “কেন চেয়ে আছ গো মা মুখপানে।“ প্রাচীন বাংলাতেও এই ধরনের ক্রিয়ার নিদর্শন মেলে। দিল ভণিয়া (বলিয়া গেল), টুটি গেল (টুটিয়া গেল), গুণিআ লেহুঁ (গুনিয়া লই)।
যৌগিক ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যটি লক্ষ্য কর।—অসমাপিকা ও সমাপিকা—দুইটি বিভিন্ন ক্রিয়ার সংযোগে গঠিত বলিয়াই ইহার নাম যৌগিক ক্রিয়া। ইহা মৌলিক ক্রিয়ার ঠিক বিপরীত। দুইটি ক্রিয়া সম্মিলিতভাবে একটিমাত্র ক্রিয়ার অর্থই প্রকাশ করে। এখানে অসমাপিকা ক্রিয়াটিরই অর্থপ্রাধান্য লক্ষিত হয়; সমাপিকা ক্রিয়াটির নিজস্ব অর্থ কিছুই থাকে না। তবে, অসমাপিকা ক্রিয়াটির অর্থকে পূর্ণতা, বিশদতা, নিশ্চয়তা দিয়া বিশিষ্ট করাই ইহার একমাত্র কাজ।
সংযোগমূলক ক্রিয়া ও যৌগিক ক্রিয়ার পার্থক্যটুকু ভালো করিয়া লক্ষ্য কর। সংযোগমূলক ক্রিয়ার পূর্বাংশে কোনো বিশেষ্য, বিশেষণ বা ধ্বন্যাত্মক অব্যয় পদ এবং উত্তরাংশে একটি সমাপিকা বা অসমাপিকা ক্রিয়া থাকে। যৌগিক ক্রিয়ার পূর্বাংশে একটি নিত্য অসমাপিকা ক্রিয়া ও উত্তরাংশে একটি সমাপিকা (ক্বচিৎ অসমাপিকা) ক্রিয়া থাকে। সংযোগমূলক ক্রিয়ার দুইটি অংশেরই অর্থপ্রাধান্য থাকে। কিন্তু যৌগিক ক্রিয়ার পূর্বাংশ অসমাপিকা ক্রিয়াটিরই অর্থ প্রধানভাবে বুঝায়। (ক) সাঁতার কাটা (সংযোগমূলক) বন্ধ করে (ঐ) একটু জিরিয়ে নিলে (যৌগিক) ভালো হয় (সংযোগমূলক)। (খ) একটা ছেলেকে মানুষ করতেই (সংযোগমূলক) হিমশিম খাচ্ছেন (ঐ)? (গ) শেষে হাল ছেড়ে (সংযোগমূলক) বসে পড়বেন (যৌগিক) নাকি? “তিনি বলে বসতেন (যৌগিক), ‘ঢের হয়েছে (সংযোগমূলক), ঢের হয়েছে!”
দেখিলাম, ধ্বন্যাত্মক ধাতু কখনও মৌলিক ধাতুরূপে, কখনও আ-প্রত্যয়যোগে সাধিত ধাতুরূপে, কখনও-বা সংযোগমূলক ধাতুর পূর্বাঙ্গরূপে ব্যবহৃত হইতেছে।
(১) মৌলিক : কারো যাবার সময় এমন করে হেঁচো না। গোরুটা গরমে __ড়া ধুঁকছে। “মর্মে যবে মত্ত আশা সর্পসম ফোঁসে।”
(২) সাধিত : “বক্ষ তোর উঠে রনরনি।” বৃষ্টি আসে ঝমঝমিয়ে নূপুর বাজে পায়। “পায়স-পয়োধি সপসপিয়া পিষ্টকপর্বত কচমচিয়া…..।”
(৩) সংযোগমূলক : খিদেয় পেট চুঁইছুঁই করলে পড়াশোনায় মন লাগে? __ন সিং শিঙে ফুঁকেছে, এতদিনে পাড়ার হাড় জুড়িয়েছে।
যৌগিক ধাতুরূপে ধ্বন্যাত্মক ধাতুর ব্যবহার ক্বচিৎ দেখা যায় : বছর না ঘুরতেই বাপের লাখো টাকা ফুঁকে দিয়েছ? কিন্তু “ঘরেতে ভ্রমর এল গুণগুনিয়ে”–এখানে “গুনগুনিয়ে” পদটি “এল” ক্রিয়াটিকে বিশেষিত করিতেছে বলিয়া ক্রিয়াবিশেষণ। গুনগুনিয়ে এল—অসমাপিকা ও সমাপিকা ক্রিয়ার সমন্বয়ে গঠিত যৌগিক ক্রিয়া নয়। কারণ, এল সমাপিকার প্রাধান্য আদৌ হ্রাস পায় নাই, আর গুনগুনিয়ে এই অসমাপিকার প্রাধান্য মোটেই সূচিত হয় নাই। সেইরূপ টলমলিয়ে, দপদপিয়ে প্রভৃতি ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়াগুলি ক্রিয়াবিশেষণ-রূপেই ব্যবহৃত হয়, যৌগিক ক্রিয়ার পূর্বাঙ্গ হিসাবে নয়।
ধাতু-নির্ণয়ের উপায়—ক্রিয়ার মূল অংশ ধাতু। এই ধাতু-নির্ণয় করিতে হইলে ক্রিয়াটিকে আমি কর্তার সাধারণ বর্তমানে রূপান্তরিত করিয়া শেষ স্বরটি লোপ করিয়া দাও। অবশিষ্ট অংশই ঈপ্সিত ধাতু। “করিতেছে” ক্রিয়াটিকে “আমি” কর্তার সাধারণ বর্তমানে রূপান্তরিত করিলে পাওয়া যায় “করি”। শেষ স্বর হ লোপ করার পর পাই কর্।—ইহাই ধাতু। করাইতেছিলেন (করাই > করা), ঝনঝনাইয়া (ঝনঝনাই > ঝনঝনা), শুয়েছেন (শুই > শু) ইত্যাদি। কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য ক্রিয়াটিকে তুচ্ছার্থক মধ্যমপুরুষের (তুই) বর্তমান অনুজ্ঞায় রূপান্তরিত করিলেও ধাতুটি পাওয়া যায়। খেলছিল (খেল্), হাসালেন (হাসা)। কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। শুলাম (শো—ধাতু কিন্তু শু); দিচ্ছেন (দে—ধাতু কিন্তু দি); শেখাল (শেখাস—ধাতু কিন্তু শিখা)।
ধাতু-নির্ণয়—(ক) মদনা, একছিলিম তামাক সাজ তো (√সাজ্–সকর্মক ধাতু)। (খ) তিনি এখন সাজতে (√সাজ্—অকর্মক) ব্যস্ত। (গ) নাপিত এখন বরকে সাজাচ্ছে (√সাজা—ণিজন্ত)।
সকর্মিকা, অকর্মিকা ও দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া
গঠনভঙ্গীর দিক্ দিয়া আমরা মৌলিক, প্রযোজিকা, নামধাতুজ, সংযোগমূলক ও যৌগিক—এই পাঁচপ্রকার ক্রিয়াপদের পরিচয় পাইয়াছি। বাক্যে অন্য পদের সহিত সম্পর্কের বিচারে ক্রিয়াকে আবার সকর্মিকা, অকর্মিকা ও দ্বিকর্মিকা—এই তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়।
১২২। সকর্মিকা ক্রিয়া : কর্মকে অবলম্বন করিয়া যে ক্রিয়া পূর্ণতা পায় তাহাই সকর্মিকা ক্রিয়া।
“কুসুমটি তার ভুলতে নারি।” “শ্মশানের বুকে আমরা রোপণ করেছি পঞ্চবটী।”—এখানে প্রথম বাক্যে ভুলতে নারি ক্রিয়াটি কর্তা “আমরা”-কে (ঊহ্য) লইয়া সম্পন্ন হইতেছে না—কর্তা হইতে প্রসারিত হইয়া কর্ম কুসুমটি-কে অবলম্বন করিয়া সম্পন্ন হইতেছে। অতএব “ভুলতে নারি” সকর্মিকা ক্ৰিয়া। দ্বিতীয় বাক্যে রোপণ করেছি ক্রিয়াটিও সেইরূপ কর্তৃপদ “আমরা”-কে লইয়া পূর্ণতা পাইতেছে না; কর্ম পঞ্চবটী-কে অবলম্বন করিয়া সম্পন্ন হইতেছে বলিয়া ইহা সকর্মিকা ক্রিয়া।
কোনো ক্রিয়া সকর্মিকা কিনা জানিতে হইলে ক্রিয়াটিকে কী বা কাহাকে প্রশ্ন কর। প্রশ্নের যদি উত্তর পাও, তবে ক্রিয়াটি সকর্মিকা জানিবে। “না জন্মিতে করিয়াছ মঙ্গলকামনা।” এক মনে ডাক ভগবানে! “তোমার প্রীতি বনে বনে ফুল ফোটায়।” এখানে আয়তাক্ষর ক্রিয়াগুলিকে প্রশ্ন কর। কী করিয়াছ? মঙ্গলকামনা। কাহাকে ডাক?—ভগবানে। কী ফোটায়?—ফুল। প্রতিটি প্রশ্নেরই উত্তর পাওয়া গেল। অতএব করিয়াছ, ডাক ও ফোটায় –সকর্মিকা ক্রিয়া এবং মঙ্গলকামনা, ভগবানে ও ফুল যথাক্রমে ইহাদের কর্ম। “তোর সেই কিছু-না-দেওয়া আমি ললাটে পরে চলে যাব”– এই বাক্যে পরে (পরিয়া ক্রিয়ার চলিত রূপ) সকর্মিকা ক্রিয়াটির কর্মের বৈশিষ্ট্যটুকু লক্ষ্য কর।
১২৩। অকর্মিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়ার কর্ম নাই, যে ক্রিয়ার দ্বারা কেবল সত্তা, অবস্থান বা ঘটনা বুঝায়, তাহা অকর্মিকা ক্ৰিয়া।
মেঘ ডাকে আর ময়ূর নাচে। “বীরসন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটেছে জগৎময়।” “তিষ্ঠ কেশরী, দোলা হতে এসো নেমে।” এখানে আয়তাক্ষর ক্রিয়াগুলি নিজ নিজ কর্তৃপদকে আশ্রয় করিয়াই সম্পন্ন হইতেছে—অন্য কোনো পদের অপেক্ষা করিতেছে না। এইজন্য ডাকে, নাচে, ছুটেছে, তিষ্ঠ ও নেমে এসো অকর্মিকা ক্রিয়া।
মাঝে মাঝে অকর্মিকা ক্রিয়া সমধাতুজ কর্মযোগে সকর্মিকা হইয়া যায়। (ক) পাঠে অবহেলা করেছ, কি মরেছ (অকর্মিকা)। এমন সুখের মরণ কে মরিতে পারে? (মরণ সমধাতুজ কর্মযোগে মরিতে সকর্মিকা হইয়াছে)। (খ) ছেলেটা ঘুমিয়েছে (অকর্মিকা)। চমৎকার একটা ঘুম ঘুমিয়ে নিলাম। (সমধাতুজ কর্ম ঘুম—তাই ঘুমিয়ে আসলে অকর্মিকা হওয়া সত্ত্বেও এখানে সকর্মিকা)! সকর্মিকা ক্রিয়ারও সমধাতুজ কর্ম থাকিতে পারে (২১৬-২১৭ পৃষ্ঠায় দ্রষ্টব্য)।
সকর্মিকা ক্রিয়াও তেমনি মাঝে মাঝে অকর্মিকা হইয়া যায়। “মনমাঝি তোর বইঠা নে রে আমি আর বাইতে পারি না” (কর্ম দাঁড় ঊহ্য)। যে সহে সে রহে! “ভয় করব না, ভয় করব না।” খাজাঞ্চীবাবু হিসেব মিলিয়ে (সকর্মিকা) তাড়াতাড়ি হাওয়ায় মিলিয়ে গেলেন (অকর্মিকা)। “তোমায় নতুন করে পাব বলে হারাই ক্ষণে ক্ষণ।” “পীড়িয়া পীড়িত হওয়া—এই কাঁদাইয়া কাঁদাই তো গভীর প্রেমের ধর্ম।” আয়তাকার পদগুলি আসলে সকর্মিকা, কিন্তু এখানে কর্মশূন্য অবস্থায় রহিয়াছে। এত বেলা হল, এখনও খাননি? (কর্ম ভাত বা রুটি ঊহ্য) দেখ (অকর্মিকা–কেবল মনোযোগ আকর্ষণ), আমরা সকলেই কি নিষ্ঠাবান্?
১২৪। দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া : যে-সমস্ত সকর্মিকা ক্রিয়ার একটি প্রাণিবাচক ও অন্য একটি বস্তুবাচক কর্ম থাকে, তাহাদের দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া বলে।—তিনি আমাকে তখন একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলেন। কালীকৃষ্ণবাবু মনোরমাকে ইংরেজী পড়ান।—এখানে জিজ্ঞাসা করিলেন ও পড়ান দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া। প্রাণিবাচক কর্ম আমাকে ও মনোরমাকে গৌণ কর্ম এবং বস্তুবাচক কর্ম প্রশ্ন ও ইংরেজী মুখ্য কর্ম। (দ্রষ্টব্য : পৃষ্ঠা ২১৬)
মনে রাখিও—দ্বিকর্মিকা ক্রিয়ামাত্রই সকর্মিকা, কিন্তু সব সকর্মিকা ক্রিয়াই সকর্মিকা নয়। মুখ্য ও গৌণ—এই দুই শ্রেণীর কর্ম থাকিলে তবে ক্রিয়াটি দ্বিকর্মিকা হয়। কিন্তু একই শ্রেণীর দুইটি কর্ম থাকিলে সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াটিকে আর দ্বিকর্মিকা বলা চলে না। দীপেন আর নীরেনকে ডাক। কিছু লুচি, মিষ্টান্ন আর দই আনবে। প্রথম বাক্যে ডাক ক্রিয়ার দুইটি কর্ম, কিন্তু দুইটিই প্রাণিবাচক। সেইজন্য ডাক দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া নয়। দ্বিতীয় বাক্যে আনবে ক্রিয়ার তিনটি কর্ম—কিন্তু সবই অপ্রাণিবাচক। সেইজন্য আনবে দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া নয়।
ক্রিয়ার সকর্মকত্ব-বিধানে প্রযোজিকা ক্রিয়ার ভূমিকাটিও বিশেষ উল্লেখনীয়।
প্রযোজক ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তিযোগে গঠিত ক্রিয়াকে প্রযোজিকা ক্ৰিয়া বলে। প্রযোজক কর্তার ক্রিয়া বলিয়াই নাম প্রযোজিকা ক্রিয়া। মেনকা উমাকে চাঁদ দেখাইতেছেন। দেখাইতেছেন প্রযোজিকা ক্রিয়া। কে দেখাইতেছেন?–মেনকা। অতএব মেনকা হইতেছেন প্রযোজক কর্তা। কারণ, দেখা কাজটি উমা করিতেছে বটে, কিন্তু নিজেই করিতেছে না, মেনকার প্রেরণায় করিতেছে। এইজন্য উমাকে প্রযোজ্য কর্তা।
অকর্মক, সকর্মক ও দ্বিকর্মক—তিনপ্রকার ধাতুকেই প্রযোজক ধাতুতে রূপান্তরিত করা যায়। অতএব অকর্মিকা, সকর্মিকা ও দ্বিকর্মিকা—তিনপ্রকার ক্রিয়াই প্রযোজিকা ক্রিয়ায় রূপান্তরিত হয়।
(ক) অকর্মিকা ক্রিয়া প্রযোজিকায় রূপান্তরিত হইলে সকর্মিকা হইয়া যায়।—
অকর্মিকা ক্রিয়া | প্রযোজিকা ক্রিয়া |
শিশু হাসে। | মা শিশুকে হাসান। |
খোকন নাচিতেছে। | কানন খোকনকে নাচাইতেছে। |
রোগী শুইল। | ডাক্তারবাবু রোগীকে শোয়াইলেন। |
ওটা হল। | “শরৎচন্দ্র যেভাবে ও যে-রূপে ওটাকে হইয়েছেন, সেটা আমার মনঃপুত নয়।” —শিশিরকুমার ভাদুড়ি। |
লক্ষ্য কর, অকর্মিকা ক্রিয়ার কর্তা শিশু, খোকন, রোগী ও ওটা কর্মকারকের বিভক্তিযোগে যথাক্রমে শিশুকে, খোকনকে, রোগীকে, ওটাকে ইত্যাদি রূপ লইয়া প্রযোজিকা ক্রিয়ার কর্মরূপে অবস্থান করিতেছে।
(খ) সকর্মিকা ক্রিয়া প্রযোজিকায় রূপান্তরিত হইলে দ্বিকর্মিকা হইয়া যায়।–
সকর্মিকা ক্রিয়া | দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া |
দিব্যেন্দু ভাত খাইতেছে। | রমা দিব্যেন্দুকে ভাত খাওয়াইতেছে। |
রঞ্জন ইংরেজী লিখেছে। | মা রঞ্জনকে ইংরেজী লিখিয়েছেন। |
যোগীন্দ্ৰ অঙ্ক শিখিবে। | রাজেন্দ্র যোগীন্দ্রকে অঙ্ক শিখাইবে। |
লক্ষ্য কর, সকর্মিকা ক্রিয়ার কর্তা কর্মকারকের বিভক্তিযুক্ত হইয়া দ্বিকমিকা ক্রয়ার গৌণ কর্মপদ পাইয়াছে।
(গ) দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া প্রযোজিকা ক্রিয়ায় রূপান্তরিত হইলে দ্বিকমিকাই থাকিয়া যায়। (১) কঙ্কা আমাকে এই কথা বলল (দ্বিকর্মিকা)। চন্দ্ৰা কঙ্কাকে দিয়ে আমাকে সেই কথা বলাল (প্রযোজিকা)। (২) মাখনবাবু পুলিসকে পাঁচশো টাকা দিলেন (দ্বিকর্মিকা)। তুমিই তো মাখনবাবুর দ্বারা পুলিসকে পাঁচশো টাকা দেওয়াইলে (প্রযোজিকা)—এখানে দ্বিকর্মিকা ক্রিয়ার কর্তা প্রযোজিকা ক্রিয়ার ক্ষেত্রে করণের বিভক্তি (বা অনুসর্গ)-যুক্ত হইয়াছে। (৩) প্রশ্নটা সে করেছে, না অন্য কেউ তাকে দিয়ে করিয়েছেন?
সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়া
অর্থ-সম্পর্কের দিক্ দিয়া ক্রিয়াকে আমরা দুইটি ভাগে ভাগ করিতে পারি।—(১) সমাপিকা ও (২) অসমাপিকা। এবিষয়ে ১৬২-১৬৩ পৃষ্ঠায় যথাক্রমে ৭১ ও ৭২ নং সূত্রে কিছু কিছু পড়িয়াছ। এখানে বিস্তৃত আলোচনা করা হইল।
ছুটিতে বাইরে যাচ্ছি না, বাড়িতেই থাকব, স্থির করলাম। আয়তাক্ষর ক্রিয়াগুলি এক-একটি ভাবের পরিসমাপ্তি ঘটাইতেছে বলিয়া সমাপিকা ক্রিয়া।
সমাপিকা অকর্মিকা : “এল মানুষ-ধরার দল।” “শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে।” “দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে।” আয়তাক্ষর পদগুলি কর্তৃনির্ভর বলিয়া অকর্মিকা সমাপিকা ক্রিয়া।
(খ) সমাপিকা সকর্মিকা : “বাঁধলে তোমাকে বনস্পতির নিবিড় পাহারায়।” স্রষ্টা…..নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত।” “সে লিখবে তোমাকে চিঠি রাগিণীর আবছায়ায় বসে।”
এইবার অসমাপিকা ক্রিয়া। একাধিক অসমাপিকা ক্রিয়া বাক্যে থাকিলেও অর্থ-সমাপ্তির জন্য অন্ততঃ একটি সমাপিকা ক্রিয়ার প্রয়োজন।—
“বিদারিয়া
এ বক্ষপঞ্জর, টুটিয়া পাষাণবন্ধ
সংকীর্ণ প্রাচীর …… হিল্লোলিয়া, মর্মরিয়া,
কম্পিয়া, স্খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া,
শিহরিয়া, সচকিয়া আলোকে পুলকে,
প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভূলোকে।”
—রবীন্দ্রনাথ।
উপরের আয়তাক্ষর এগারোটি অসমাপিকা ক্রিয়াতেও ভাব পূর্ণতা পায় নাই। একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া চলে যাই ভাব-সমাপ্তি ঘটাইতেছে।
অসমাপিকা ক্রিয়াও সকর্মিকা ও অকর্মিকা—দুই-ই হইতে পারে। বিদারিয়া ও টুটিয়া সকর্মিকা অসমাপিকা, বাকিগুলি অকর্মিকা অসমাপিকা
ধাতুর উত্তর—ইয়া,—ইলে, ইতে (চলিতে যথাক্রমে—এ,—লে,—তে) ধাতু—বিভক্তিযোগে অসমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়। কাল ও পুরুষভেদে অসমাপিকার রূপভেদ হয় না বলিয়া কোনো কোনো বৈয়াকরণ ইহাকে অব্যয়ধর্মী বলিয়া থাকেন। কবিতায় ছন্দের খাতিরে প্রয়োজন হইলে ‘ইয়া’ বিভক্তির স্থানে ই বিভক্তি বসে। যেমন, “আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজগুণে।” “একদিঠ করি ময়ূরময়ূরী—কণ্ঠ করে নিরীক্ষণে।” “কঠোরে গঙ্গায় পূজি ভগীরথ ব্রতী….. পবিত্ৰ লা আনি মায়ে এ তিন ভুবন।”
এখন অসমাপিকা ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য কর।—
(১) ধাতু + ইয়া (চলিতে এ) :
ক) যৌগিক ক্রিয়ার পূর্বাঙ্গ-রূপে—দাঁড়াইয়া রহিলে কেন? বসিয়া পড়। দারুণ গ্রীষ্মে পুষ্করিণীগুলি শুকাইয়া গিয়াছে।
(খ) সমাপিকা ক্রিয়ার পূর্বকালীনতা বুঝাইতে—ইস্কুল থেকে ফিরে, বইপত্র রেখে, হাতমুখ ধুয়ে, কিছু খেয়ে আবার পড়তে বসি (চারিটি অসমাপিকা ও একটি সমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা মাত্র একটি—আমি : সেইটিও উহ্য)।
(গ) সমাপিকা ক্রিয়ার সমকালীনতা বুঝাইতে-”কোমর-জলে দাঁড়িয়ে কষে কাস্তে চালায় চাষী।” বসেই লেখ।
(ঘ) আতিশয্য, পৌনঃপুন্য ও বিরামহীনতা বুঝাইতে দ্বিত্ব-প্রয়োগ—তোমায় বলে বলে হয়রান হয়ে গেছি (অনেকবার বলিয়া)। লিখে লিখে হাত পাকাও। “ঘুরিয়া ঘুরিয়া কত তীর্থ হেরিলাম!” খেটে খেটে জীবনটাই তো গেল (বিরামহীনভাবে খাটিয়া)।
(ঙ) ক্রিয়াবিশেষণ-রূপে (সংযোগমূলক ক্রিয়ার উত্তরাঙ্গ হিসাবে অথবা অসমাপিকার দ্বিত্ব-প্রয়োগে)—”কেমন করে হরহৃদে দাঁড়িয়েছ মা পদ দিয়ে?” “এমন করে কি মরণের পানে ছুটিয়া চলিতে আছে!” নেচে নেচে চলে নদীয়ার গোরা কেঁদে কেঁদে সবে নাম বিলায়। ছেলেটিকে একটু দেখিস তো মা, আমি এলুম বলে (এত শীঘ্র আসিব যে আসিয়াই গিয়াছি বলা চলে—এই অর্থে অতি-সত্বরতা-বোধক ক্রিয়াবিশেষণ)। “ঘনঘোর ধূম ঘুরিয়া ঘুরিয়া ফুলিয়া ফুলিয়া উড়িল।” ধরে ধরে লেখ, লেখার ডৌল ফিরে যাবে।
(চ) অনুসর্গ-রূপে—”আমার বঁধুয়া আন বাড়ী যায় আমার আঙিনা দিয়া।” “সুখের লাগিয়া এ ঘর বাঁধিনু অনলে পুড়িয়া গেল।” ট্রেনখানা অন্ডাল হয়ে যায়। দেরি হবার সম্ভাবনা থাকলে রিক্শা করে যেয়ো।
(ছ) অব্যয়-রূপে—এ ক্লাসে রাজকুমার পর্বত বলে (নামে অর্থে) কোনো ছেলে নেই। “পাতকী বলিয়া (হেতু অর্থে) কিগো ঠেলিবে চরণে?”
(জ) ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের পরিবর্তে (বিভিন্ন কারকে)—তুমি কি কেঁদেই (কান্না দিয়া—করণ) জিতবে ভেবেছ? শুয়েও (শয়নেও—অধিকরণ) স্বস্তি নেই,বসেও (উপবেশনেও—অধিকরণ) তাই। এবার মরেই (মরণেই—অধিকরণ) শান্তি। “মরিয়া হবে জয়ী আমার ‘পরে এমনি করিয়াছ ফন্দি!”
(ঝ) ভাববাচক বিশেষণের পরিবর্তে—এমন অসময়ে শুয়ে (শয়িত অর্থে) আছ কেন? আমার নয়নমণি কি আর বেঁচে (জীবিত অর্থে) আছে মা! “হেরো ওই ধনীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া (দণ্ডায়মান) কাঙালিনী মেয়ে।”
(ঞ) কার্য-কারণ-সম্বন্ধ বুঝাইতে-বর্ষার স্পর্শ পেয়ে গাছপালা সব সতেজ হয়ে উঠেছে। (অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা ও বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা একই—গাছপালা।) আগুন লেগে বাজারের চালাঘরগুলো ছাই হয়ে গেছে (সমাপিকার কর্তা চালাঘরগুলো, কিন্তু অসমাপিকার কর্তা আগুন)।
(ট) ইয়া বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়া কবিতায় ছন্দের খাতিরে ‘য়া’-শূন্য হয়। “হাসি হাসি পরব ফাঁসি দেখবে জগদ্বাসী।”
(২) ধাতু + ইলে (চলিতে লে) :
(ক) সমাপিকা ক্রিয়ার পূর্বকালীনতা বুঝাইতে (সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার ভিন্ন কর্তা)—”চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে।” তুমি বললে তবে আমি আসব। কেবু ডাকলে খবরদার সাড়া দিবি না।
(খ) সমাপিকা ক্রিয়ার সমকালীনতা বুঝাইতে—বড়োবাবু খেতে বসলে পাখাটা একটু নাড়িস তো মাখন। “হাসলে পরে মুক্তো ঝরে, কাঁদলে ঝরে মানিক।”
(গ) ইচ্ছা, সম্ভাবনা প্রভৃতি অর্থে—করলে (করিবার ইচ্ছা থাকিলে) কাজটা করা যেত। ভালো লাগলে (যদি ভালো লাগে) আবার চেয়ে নেবো। সময়মতো এলে একমুঠো শাকভাত পাবে বইকি। খাতকদের কাছে টাকা পেলে (যদি পাওয়া যায়) আপনাদের চাঁদা দেব।
(ঘ) কার্য-কারণ-সম্বন্ধ বুঝাইতে—পড়াশোনায় অবহেলা করলে ফল পাবে বইকি (সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা একই তুমি বা তোমরা)। আলো জ্বললে আঁধার দূরে যাবেই (সমাপিকা ও অসমাপিকার কর্তা বিভিন্ন)। অতিরিক্ত বৃষ্টি হইলে খেলা বন্ধ হইবেই (ভিন্ন কর্তা)।
(ঙ) ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের পরিবর্তে—”বেল পাকলে (পাকায়) কাকের কী?” এত ভাবলে (ভাবনায়) হবে না। দিনরাত শুধু খেললে (খেলায়) হবে কিছু? সে হঠাৎ এসে পড়লে (আসায়) আমায় আর যেতে হল না।
(৩) ধাতু + ইতে (চলিত ভাষায় তে) :
(ক) যৌগিক ক্রিয়ার পূর্বাঙ্গ-রূপে—”প্রভুর আদেশে সে সত্য, হায়, ভাঙিতে হবে কি আজ?” পাখাটা এখন চলতে থাকুক। “দেখিতে পাও না তুমি মৃত্যুদূত দাঁড়ায়েছে দ্বারে?”
(খ) উদ্দেশ্য ও নিমিত্ত অর্থে—”কেমন সুখে সিরাজ রাজত্ব করছে তাই দেখতে এলাম।” “আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী ‘পরে।” আমরা বাঁচতে চাই—বাঁচার মতো বাঁচা। নয়নচাঁদ, বড়োবাবুকে বসতে একটা চেআর দে। লেখাপড়া শিখতে চেষ্টা ও অধ্যবসায় চাই। “যাইতে মানস-সরে, কারো না মানস সরে।”
(গ) কর্ম-রূপে—”মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” (‘চাহি’ ক্রিয়ার কর্ম) বাবা ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। আপনি কি এখনই দেখতে চান? চোখের দেখা একবারটি দেখতে দাও। সংসারে সুখী হতে কে না চায়?
(ঘ) সামর্থ্য ও সম্ভাবনা অর্থে—আজ ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। শুভদা চমৎকার গান গাইতে পারে। আপনি কি ছবি আঁকতে পারেন?
(ঙ) বিধি-নিষেধ ও বাধ্যতা বুঝাইতে—বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান করতে হয়। গুরুজনদের সামনে এত জোরে হাসতে নেই। এমন করে কি নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে আছে? আমাকে ভোরে উঠতেই হয়।
(চ) সমাপিকা ক্রিয়ার কারণ-রূপে—”আজ সেকথা ভাবতে মনে সুখের চেয়ে ব্যথাই বেশী।” “স্মরিতে সে-সব কথা মরমে জনমে ব্যথা।” শক্তিমান হয়েও কী করতে অন্যের উপর নির্ভর করছ?
(ছ) সত্ত্বেও অর্থে—ঘর থাকতে বাবুই ভেজে। আমি থাকতে তোমার ক্রান দুরবস্থা হল! হাত থাকতে মুখে কেন? সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়।
(জ) সমাপিকা ক্রিয়ার সমকালীনতা বুঝাইতে—”দাঁত থাকতে নির্বোধরা দাঁতের মর্যাদা বোঝে না।” “ঠগ বাছতে গাঁ উজাড়।” এখনো বাবার সামনে দাঁড়াতে ভয় লাগে।
(ঝ) সমাপিকার অল্প-পূর্বকালীনতা বুঝাইতে—জাতীয় সংগীত আরম্ভ হতেই সকলে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ভাষণ আরম্ভ করতেই সবাই চুপ করে গেল।
(ঞ) অসমাপিকার পরকালীনতা বুঝাইতে—সরকারী সাহায্য আসতে দেরি করে বইকি। পরীক্ষা আরম্ভ হতে আর সবে পাঁচদিন বাকী।
(ট) ভাববাচক বিশেষণের পরিবর্তে—আমি তাহাকে মধ্যাহ্নে পথে দাঁড়াইতে (দণ্ডায়মান) দেখিলাম। আমাকে লাঠি চালাতে (সঞ্চালনরত) কেউ দেখেছে কি?
(ঠ) বিরামহীনতা বুঝাইতে (দ্বিত্ব-প্রয়োগ)—”জপিতে জপিতে নাম অবশ করিল গো।” ভাবতে ভাবতে শেষে পাগল না হয়ে যাই।
(ড) ক্রিয়াবিশেষণ-ৰূপে (দ্বিত্ব-প্রয়োগ)—তুমি তো হাসতে হাসতে বললে বেশ! লাফাতে লাফাতে কোথা চললি রে ফেলনা? “দেখিতে দেখিতে (খুব অল্প সময়ের মধ্যে) গুরুর মন্ত্রে জাগিয়া উঠেছে শিখ।” এ বিদ্যে তো আমি শুধু শুনতে শুনতে শিখেছি; এ অভিজ্ঞতা যে কেবল করতে করতে জেনেছি আর আপনার গভীর জ্ঞান তো আপনি পড়তে পড়তে অর্জন করেছেন।
(ঢ) বিশেষণের বিশেষণ-রূপে—”দেখতে শুনতে ভালো হলেই পাত্র হল—রাধে।” (“ভালো’ বিশেষণটির বিশেষণ)
ক্রিয়ার কাল
১২৫। ক্রিয়ার কাল : যে সময়ে ক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হয় তাহাকে ক্রিয়ার কাল বলে। কাল শুধু সমাপিকা ক্রিয়ারই হয়। ক্রিয়ার কাল প্রধানতঃ তিনটি—(১) বর্তমান, (২) অতীত ও (৩) ভবিষ্যৎ।
১২৬। বর্তমান কাল : যে ক্রিয়া চিরকালই ঘটে বা এখনও ঘটিতেছে, সেই ক্রিয়ার কালকে বর্তমান কাল বলা হয়। বর্তমানের চারিটি উপবিভাগ—
(ক) সাধারণ (নিত্য বা সামান্য) বর্তমান—যে ক্রিয়ার কাজ সাধারণতঃ বা বরাবর ঘটিয়া থাকে, তাহার কালকে সাধারণ বা নিত্য বা সামান্য বর্তমান বলে। “ঘুমায় অরুণ সুদূর অস্ত-অচলে।” “কেহ কাঁদে, কেহ গাঁটে কড়ি বাঁধে ঘরে ফিরিবার বেলা।” “ওরা চিরকাল টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল।” “দুঃখ সুখ দিবসরজনী মন্দ্রিত করিয়া তোলে জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি।” “দিনেরাতে সুখেদুঃখে আলোয়-আঁধারে তুমি সাধো মৃত্যুহীন প্রাণের ঝঙ্কার।” ঈশ্বর আমাদের মনটুকুই দেখেন। “যামিনী জোছনামত্তা।” [ হয় ক্রিয়াটি ঊহ্য ] “ঐ মহামানব আসে, দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে মর্তধুলির ঘাসে ঘাসে।”
(খ) ঘটমান বর্তমান—যে ক্রিয়াটি এখন অনুষ্ঠিত হইতেছে তাহার কালকে ঘটমান বর্তমান বলে। “পরম এক চৈতন্যস্বরূপ সৃষ্টির মধ্য দিয়া, রূপে রূপে আপনাকে আস্বাদন করিতেছেন।” “দুলিতেছে বিদ্যুতের দুল।” “পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।” “তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।” “ঘটে ঘটে ক্ষরিতেছে ক্ষীর।” “আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা।” “ঝরিছে মুকুল, কূজিছে কোকিল।” “পশিতেছে কানে দূর গগনের বজ্রঘোষণ ছন্দ।” “ভরিয়া পরান শুনিতেছি গান।” “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে।”
আসছে বছর আপনাদের ওখানে পুজো দেখতে আমায় একবার যেতেই হবে (‘আগামী’ অর্থে বিশেষণরূপে ঘটমান বর্তমানের বিচিত্র প্রয়োগ)।
(গ) পুরাঘটিত বর্তমান—কাজটি শেষ হইয়া গিয়াছে অথচ তাহার ফল এখনও বর্তমান রহিয়াছে বুঝাইলে ক্রিয়ার পুরাঘটিত বর্তমান হয়। “নৃপতির গর্ব নাশি করিয়াছ পথের ভিক্ষুক।” “কত পে সাজায়েছ এ ভুবন, কত রঙে রাঙায়েছ ফুলবন।” “মুকুলিত জীবনের রেণুগুলি রয়েছে ছড়ানো ও পথের ধূলি ‘পরে।” “বিজয়রথের চাকা উড়ায়েছে ধূলিজাল।” “সে যে প্ৰাণ পেয়েছে পান করে যুগ-যুগান্তরের স্তন্য।” অলংকারে কাহিনী রসবন্ত হয়ে উঠেছে। “দেখেছি নিত্যের জ্যোতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে।” “সাজিয়াছ যোগী বল কার লাগি।” “মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে।” “চাহিতে এসেছি শুধু একখানি মালা।” “নেমেছে ধুলার তলে হীনপতিতের ভগবান।”
(ঘ) বর্তমান অনুজ্ঞা—ক্রিয়ার দ্বারা বর্তমান কালে কোনো আদেশ, অনুরোধ, প্রার্থনা, উপদেশ বা আশীর্বাদ বুঝাইলে বর্তমান অনুজ্ঞা হয়। “উঠুক চিত্ত করিয়া নৃত্য।” একটা গল্প বলুন না। “পুচ্ছটি তোর উচ্চে তুলে নাচা।” “মা, আমায় মানুষ করো।” সীতা-সাবিত্রীর মতো আদর্শ হও মা। “এসো যুগান্তের কবি….. দাঁড়াও ওই মানহারা মানবীর দ্বারে।” “জীবন-বীণার তার অশিথিল শক্তি দিয়ে বাঁধো।” ধর ধর, পেনটা এখনি পড়ে যাবে (‘উৎকণ্ঠা’ অর্থে বর্তমান অনুজ্ঞার দ্বিত্ব-প্রয়োগ)। “বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো।” “একটি নমস্কারে সকল দেহ লুটিয়ে পড়ুক তোমার এ সংসারে।” নিখিলবিশ্বের প্রতি অমেয় প্রেমে প্রসারিত হও। বয়োধর্মে যেটা খুব স্বাভাবিক সেটাকে সইতে শেখ, ধীরে ধীরে সংশোধনের চেষ্টা কর। “একবার আন্তরিক কাতর হও না মায়ের জন্য।”—শ্রীরামকৃষ্ণ। “ধবলীরে আনো গোহালে।” “হেরো, অন্ধকার ব্যাপিয়াছে দিগ্বিদিকে।” “দেহখানি তুলে ধরো, তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো।”
১২৭। অতীত কাল : যে ক্রিয়ার কাজ পূর্বেই শেষ হইয়া গিয়াছে, তাহার কালকে অতীত কাল বলে। অতীত কালেরও চারিটি উপবিভাগ—
(ক) সাধারণ বা নিত্য (সামান্য) অতীত—কাজটি অল্পক্ষণপূর্বে শেষ হইয়াছে বুঝাইলে ক্রিয়ার সাধারণ বা নিত্য বা সামান্য অতীত কাল হয়। “করিলাম বাসা, মনে হল আশা।” মহর্ষি দেখলেন নরেনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ভাগবতী দীপ্তি। “চারি চক্ষুর ধারায় তিতিল বৃন্দাবনের রজ।” “অপরিচিত ছিল তোমার মানবরূপ উপেক্ষার আবিল দৃষ্টিতে।” “অশ্রুধারা আর্দ্রিল মহীরে।” “অভিশাপ-রাত্রির আয়ু হল ক্ষয় রে।”
গেল বছরেও ঠিক এরকমই ঝড়বৃষ্টি হয়েছিল (‘গত’ অর্থে বিশেষণ-রূপে সাধারণ অতীতের বিচিত্র প্রয়োগ)।
(খ) ঘটমান অতীত—অতীতে কিছু সময় ধরিয়া কাজটি চলিতেছিল বুঝাইলে ক্রিয়ার ঘটমান অতীত হয়। “আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর সীমন্তসীমা-’পরে।” “বিদ্রূপ করছিলে ভীষণকে …… শঙ্কাকে চাচ্ছিলে হার মানাতে।” “শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে, কবির সঙ্গীতে বেজে উঠছিল সুন্দরের আরাধনা॥
(গ) পুরাঘটিত অতীত—কাজটি অতীত কালে শেষ হইয়াছে, তাহার কোনো ফলই বর্তমান নাই বুঝাইলে ক্রিয়ার পুরাঘটিত অতীত কাল হয়। “লর্ড লিটনের সময় লিখিয়াছিলাম পদ্যে।” “তাঁহার মধ্যে নানা বৈপরীত্যের সমাবেশ ঘটিয়াছিল।” “লোকটাকে কেমন ঠেসে ধরেছিলুম।” “নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন ঋষি রবীন্দ্রনাথ, কবি রবীন্দ্রনাথ নন।” “খ্রীষ্টপূর্ব ১৪৩০ অব্দে মহাভারতের যুদ্ধ হইয়াছিল।” “মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে।”
(ঘ) নিত্যবৃত্ত অতীত—অতীতে কাজটি প্রায় হইত, কিংবা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল বুঝাইলে নিত্যবৃত্ত অতীত হয়। (i) অভ্যস্ত : “রাজবধূ রাজবালা আসিতেন ফুল সাজায়ে ডালায …… আপনার হাতে দিতেন জ্বালায়ে কনকপ্রদীপমালা।” “বুড়োকে ভালো বলে জানতুম।” “লাফাইত, উড়িত, জানিত না কায়দাকানুন কাকে বলে।” “আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে বিশ্ব-ঘরে পেতাম না ঠাঁই।” (ii) সম্ভাবনা : যদি মন দিয়ে পড়তে, আরো ভালো ফল পেতে। আশানুরূপ ফলের সম্ভাবনা না থাকলে তিনি কি সাধারণ সভার অধিবেশন এমন অসময়ে হঠাৎ ডাকতেন? “আমি যদি তোমার অমঙ্গল কামনা করিতাম, তবে বলিতাম।” আপনিও তখন প্রতিবাদ করতে পারতেন।
১২৮। ভবিষ্যৎ কাল : যে কাজ ভবিষ্যতে হইবে তাহার কালকে ভবিষ্যৎ কাল বলে। ভবিষ্যতেরও চারিটি উপবিভাগ—
(ক) সাধারণ (নিত্য বা সামান্য) ভবিষ্যৎ—যে ক্রিয়া ভবিষ্যতে ঘটিবে, তাহার কালকে সাধারণ ভবিষ্যৎ বলে। “দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, যাবে না ফিরে।” “বরিব সত্যে, দূরিব মিথ্যা ভয়।” “কোথায় ভাসায়ে দেবে সাম্রাজ্যের দেশ-বেড়াজাল।” “প্রণমি তোমারে চলিব নাথ সংসার কাজে।” “পণ্যবাহী সেনা . রেখামাত্র চিহ্ন রাখিবে না।” “মুক্ত হইব দেবঋণে মোরা।” “এইখানে পদাম্বুজ পূজিব তাঁহার।” “তব পদতলে বসিয়া বিরলে শিখিব তোমার শিক্ষা।” “পথের ধারে বাজবে বেণু, নদীর কূলে চরবে ধেনু।”
(খ) ঘটমান ভবিষ্যৎ—কাজটি ভবিষ্যতে হইতে থাকিবে বুঝাইলে ক্রিয়ার ঘটমান ভবিষ্যৎ হয়। সেই সুর কর্ণে মোর আমরণ ধ্বনিতে থাকিবে। আপনি গাহিতে থাকিবেন, আমি বাজাইতে থাকিব, তাহারা দেখিতে থাকিবে।
(গ) পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ—অতীতে কোনো কাজ হয়তো হইয়াছিল, বা বর্তমানে হয়তো হইয়াছে—এরূপ সন্দেহ বুঝাইলে ক্রিয়ার পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ কাল হয়। রূপে ভবিষ্যতের ক্রিয়া হইলেও অর্থে ইহা অতীতমুখী। আবার তাহাতে সন্দেহের ভাবটি বর্তমান। এইজন্য এই কালকে সন্দিগ্ধ অতীতও বলে। এতক্ষণে তাঁরা স্টেশনে পৌঁছে থাকবেন। হয়তো আমিই কথাটা তোমাদের বলে থাকব। গেলাসটা মীরাই বোধ হয় ভেঙে থাকবে
(ঘ) ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা—ভবিষ্যতের জন্য কোনো আদেশ, অনুরোধ, প্রার্থনা, উপদেশ ইত্যাদি বুঝাইলে ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা হয়। “সৌভাগ্যগর্বে গর্বিত হইও না।” দয়া করে একবারটি আসবেন। ওখানেই অপেক্ষা করিস।
অসমাপিকা ক্রিয়ার কাল—বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়ার কালের উপরই অসমাপিকার কাল নির্ভর করে। বৃষ্টি হলে যাব না (ভবিষ্যৎ অর্থে)। ট্রেন ছাড়িলে বাড়ি ফিরিলাম (অতীত অর্থে)। গালে হাত দিয়ে কী ভাবছ? (বর্তমান)
মৌলিক কাল ও যৌগিক কাল
গঠনভেদে বা উৎপত্তির দিক্ দিয়া এই বারোটি কালকে দুইটি প্রধান ভাগে ভাগ করা হয়।—(১) সরল বা মৌলিক কাল, (২) যৌগিক কাল।
১২৯। মৌলিক কাল : যে কালে ধাতু স্বয়ং বিভক্তিযোগে বা প্রত্যয় ও বিভক্তিযোগে ক্রিয়াপদের সৃষ্টি করে—অন্য কোনো ধাতুর সাহায্যের আবশ্যক হয় না, সেই কালকে মৌলিক কাল বলে। সাধারণ বর্তমান, সাধারণ অতীত, নিত্যবৃত্ত অতীত ও সাধারণ ভবিষ্যৎ—এই চারিটি কাল মৌলিক। ওই সঙ্গে বর্তমান অনুজ্ঞা ও ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা ধরিলে মৌলিক কালের সংখ্যা দাঁড়ায় ছয়।
সাধারণ বর্তমান : √কর্ + ই (বিভক্তি) = করি; করা (কর্ + আ প্রত্যয় + ও (বিভক্তি) = করাও; √খা + এ = খায়।
সাধারণ অতীত : √কর্ + ইল + আম = করিলাম; করা + ইল + এ = করাইলে; √খা + ইল + অ = খাইল।
নিত্যবৃত্ত অতীত : √কর্ + ইত + আম = করিতাম; করা + ইত + এন = করাইতেন; √খা + ইত + অ = খাইত।
সাধারণ ভবিষ্যৎ : √করা + ইব + অ = করাইব; √কর্ + ইব + এ করিবে; √খা + ইব + এন = খাইবেন।
বর্তমান অনুজ্ঞা : √খা + ই = খাই; √কর্ + ও = করো; করা + ন = করান।
ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা : √করা + ইব + অ = করাইব.; √খা + ইব + এ = খাইবে; √কর্ + ইব + এন করিবেন।
[ দ্রষ্টব্য : ইল + অ = ইল, ইত + এন = ইতেন, ইব + এ = ইবে প্রভৃতি স্থলে পূর্বস্বরের লোপ হইয়াছে বুঝিতে হইবে। ]
১৩০। যৌগিক কাল : যে কালে ‘ইয়া’ বা ‘ইতে’ বিভক্তিযুক্ত মূল ধাতুটি ‘আছ’ বা ক্ষেত্রবিশেষে ‘থাক্’ ধাতুর সহিত যুক্ত হইয়া প্রত্যয় ও বিভক্তি গ্রহণ করিয়া ক্রিয়াপদের সৃষ্টি করে, সেই কালকে যৌগিক কাল বলে। ঘটমান বর্তমান, পুরাঘটিত বর্তমান, ঘটমান অতীত, পুরাঘটিত অতীত, ঘটমান ভবিষ্যৎ এবং পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ—এই ছয়টি যৌগিক কাল।
ঘটমান বর্তমান : (√কর্ + ইতে) + (√আছ্ + ই)—-করিতেছি; (√খেলা + ইতে) + (√আছ্ + অ) = খেলাইতেছ; (√ যা + ইতে) + (√আছ্ + এন) = যাইতেছেন।
পুরাঘটিত বর্তমান : (√খেল্ + ইয়া) + (√আছ্ + ই) = খেলিয়াছি; (√কর্ + ইয়া) + (√আছ্ + ইস) = করিয়াছিস; (√লিখ্ + ইয়া) + (√আছ্ + এন) = লিখিয়াছেন।
ঘটমান অতীত : (√খা + ইতে) + (√আছ্ + ইল + আম) = খাইতেছিলাম; (√কর্ + ইতে) + (√আছ্ + ইল + এন) = করিতেছিলেন; (√লিখ্ + ইতে) + (√আছ্ + ইল + ই) = লিখিতেছিলি।
পুরাঘটিত অতীত : (√শুন্ + ইয়া) + (√আছ্ + ইল + আম) = শুনিয়াছিলাম; (√গাহ্ + ইয়া) + (√আছ্ + ইল + এ) = গাহিয়াছিলে; (√খেলা + ইয়া) + (√আছ্ + ইল + এন) = খেলাইয়াছিলেন।
ঘটমান ভবিষ্যৎ : (√পড় + ইতে) + (√থাক্ + ইব + অ) পড়িতে থাকিব;(√লিখ্ + ইতে) + (√থাক্ + ইব + এ) = লিখিতে থাকিবে; (√যা + ইতে) + (√থাক্ + ইব + ই) = যাইতে থাকিবি।
পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ : (√গাহ্ + ইয়া) + (√থাক্ + ইব + অ) = গাহিয়া থাকিব; (√কর্ + ইয়া) + (√থাক্ + ইব + এন) = করিয়া থাকিবেন; (√শুনা + ইয়া) + (√থাক্ + ইব + ই) = শুনাইয়া থাকিবি।
ক্রিয়ার কালনির্ণয়
ক্রিয়ার বারোটি কালের জন্যই নির্দিষ্ট বিভক্তিচিহ্ন রহিয়াছে। সেই বিভক্তিচিহ্ন দেখিয়া সাধারণতঃ ক্রিয়াপদের কালনির্ণয় করা হয়। কিন্তু সবসময় বিভক্তিগত এই বাহ্যরূপ দেখিয়া ক্রিয়ার কালনির্ণয় সহজ নয়। একই রূপের ক্রিয়া একাধিক কালের অর্থ প্রকাশ করে। সুতরাং রূপ দেখিয়া নয়, ক্রিয়াটির অর্থের উপর নির্ভর করিয়া কালনির্ণয় করাই নিরাপদ।
॥ রূপে বর্তমান, অৰ্থে অতীত ॥
(১) সাধারণ বর্তমান কালের ক্রিয়ার দ্বারা কোনো ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক ঘটনা বা বিবৃতির পুনরুক্তিকে ঐতিহাসিক বর্তমান বলে। ইংরেজ প্রায় দুশো বৎসর ভারতবর্ষ শাসন করে (করিয়াছিল অর্থে)। নেতাজী আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেন (করিয়াছিলেন অর্থে)। চাণক্য বলেন, “বিদ্বানের আদর সর্বত্র।” “প্রাচীন ফারসী ভাষা পহ্লবীর মাধ্যমে পঞ্চতন্ত্র প্রথমে ভারতের বাইরে পদার্পণ করে।” “ঈশপ নামে খ্যাত গ্রীক ক্রীতদাসকে হেরোডোটাস পারস্য থেকেই ইওরোপে নিয়ে যান।” “কৃষ্ণলীলা ভাগবতে কহে বেদব্যাস।” ১৬৯০ খ্রীষ্টাব্দের ২৪শে অগস্ট জব চার্নক কলিকাতার প্রতিষ্ঠা করেন।
(২) বাক্যের আদিতে যেবার, যখন, যতক্ষণ, পাছে ইত্যাদি থাকিলে কিংবা অতীত কালের উল্লেখ থাকিলে সাধারণ বর্তমানের ক্রিয়ার দ্বারা অতীত ঘটনা বুঝায়। সেবার যখন খুব বন্যা হয় (হইয়াছিল অর্থে), আমি তখন কাশ্মীরে থাকি (ছিলাম অর্থে)। সে কথা যখন শুনি (শুনিলাম অর্থে), তখন বলবার কিছু ছিল না। অঙ্কটা ও কেমন করে করে (করিতেছিল অর্থে), তাই দেখছিলাম। সভাপতি-মহাশয় যতক্ষণ বক্তৃতা করেন (করিয়াছিলেন অর্থে), আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিলাম। পাছে কেউ মনঃক্ষুণ্ণ হয়, এইজন্যে অপ্রিয় সত্য তিনি বড়ো একটা বলতেন না। গত বৎসর সর্বজনীন পূজায় কাঙালীদের একখানা করে কাশ্মীরী কম্বল দেওয়া হয় (হইয়াছিল অর্থে)।
(৩) ঘটমান বর্তমানের দ্বারা ঘটমান অতীতের প্রকাশ হয়। “ঝড় যখন খুব জোরে আসিতেছে (আসিতেছিল অর্থে), তখন সেই পিপার সমস্ত তেল সমুদ্রের মধ্যে ঢালিয়া দিতে লাগিল।” রানার সৈন্যদল পিছু হঠছে (হঠছিল অর্থে), এমন সময় পৃথ্বীরাজ সসৈন্য এসে পড়লেন।
(৪) রূপে সাধারণ বর্তমান অথচ অর্থে নিত্যবৃত্ত অতীত—”চেয়ে চেয়ে দেখতে বেলা কাটে।” (কাটত অর্থে)—অবনীন্দ্রনাথ।
(৫) অতীত কালের ক্রিয়া বুঝাইতে সাধারণ বর্তমানের উত্তর নিষেধার্থক ‘নাই’ (চলিত রীতিতে ‘নি’) অব্যয়ের যোগ হয়। আমি সেখানে আদৌ যাই নাই। না ভাই, তোমার দাদু তো সকালে এখানে আসেননি।
(৬) সাধারণ অতীত অর্থে পুরাঘটিত বর্তমান—দশ বছর হল বাবা মারা গিয়েছেন (কদাপি মারা গিয়েছিলেন—লিখিবে না)।
॥ রূপে বর্তমান, অর্থে ভবিষ্যৎ ॥
(১) আসন্ন ভবিষ্যৎ বুঝাইতে ঘটমান বর্তমানের প্রয়োগ হয়। দিল্লি মেল—ভায়া গ্র্যান্ড কর্ড—ছাড়ছে (ছাড়বে অর্থে) কখন স্যার? একটু দাঁড়াও, এখনই আসছি (আসব অর্থে)। তুমি যতক্ষণ থাকবে, এক পাও নড়ছি (নড়ব অর্থে) না।
(২) বাক্যে যখন, যেমন, যেন, যদি, যতক্ষণ ইত্যাদি থাকিলে কিংবা সংশয় বুঝাইলে সাধারণ বর্তমানের ক্রিয়ার দ্বারা ভবিষ্যৎ কাল বুঝায়। ইস্কুলে স্যারেরা যখন যেমন বলেন (বলবেন অর্থে), সেই মতো চলো। আশীর্বাদ করুন পরাজিত মুখ নিয়ে যেন ফিরতে না হয়। তিনি যান তো ভালোই, কিন্তু যাবেন বলে তো মনে হয় না। আপনি বলেন তো নিশ্চয়ই আসব।
(৩) অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ অর্থে পুরাঘটিত বর্তমানের প্রয়োগ হয়। সেও আর এসেছে, তোমারও যাওয়া হয়েছে! রাধাও নেচেছে, আর সাত মন তেলও পুড়েছে। তার মতো মিথ্যেবাদী নেমন্তন্নও করেছে, আর আমরাও খেয়েছি!
॥ রূপে অতীত, অৰ্থে বৰ্তমান ॥
(১) সাধারণ অতীতের ক্রিয়ার দ্বারা সাধারণ বা ঘটমান বর্তমানের প্রকাশ হয়। সংসারের ঠেলা সামলাতেই প্রাণটা গেল (যাইতেছে অর্থে)। ছেলেপিলেগুলো রইল ভাই, দেখো। এই তো এলাম দিল্লি থেকে (আসছি অর্থে)। শারীরিক শ্রম-সম্বন্ধে এই উন্নাসিক ধারণা হইল (হইতেছে অর্থে) এক ধরনের সংক্রামক ব্যাধি। বর্তমান হল (হইতেছে অর্থে) অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে ছোটো একটা হাইফেন। চরিত্রগঠনের প্রথম পাঠ হল (হয় অর্থে) আনুগত্যের শিক্ষা। “মীরজুমলাকে তোমার সাহায্যে রেখে গেলাম (যাচ্ছি অর্থে)।” ইনি হলেন (হন অর্থে) আমাদের প্রিয় বন্ধু প্রিয়তোষ পোদ্দার।
(২) ঘটমান অতীতের দ্বারা ঘটমান বর্তমানের প্রকাশ হয়। এই যে আইভিদি, আপনার কথাই তো ভাবছিলাম (ভাবছি অর্থে) এতক্ষণ।
॥ রূপে অতীত, অর্থে ভবিষ্যৎ ॥
(১) আসন্ন ভবিষ্যৎ অর্থে সাধারণ অতীতের প্রয়োগ হয়। কাপড়চোপড় তুলে নাও, বৃষ্টি এল বলে। একটু অপেক্ষা কর ভাই, এলাম বলে। এখনও এলেন না, অহীনবাবু আমায় ডোবালেন (ডোবাবেন অর্থে) দেখছি। আমি না হয় তাঁকে গিয়ে ধরলাম, কিন্তু ফল কিছু হবে কি?
(২) সম্ভাবনার বা নিশ্চয়তার ভাব থাকিলে ভবিষ্যৎ বুঝাইতে নিত্যবৃত্ত অতীতের প্রয়োগ হয়। তুমি অপেক্ষা করলে আমি যেতাম (যাওয়ার সম্ভাবনা অর্থে)। এ ঘটনা আজ ঘটেছে ভালোই হয়েছে, নইলে দুদিন পরে ঘটতই (নিশ্চয়তা অর্থে)।
॥ রূপে ভবিষ্যৎ, অর্থে অতীত ॥
(১) সাধারণ ভবিষ্যৎ-দ্বারা অতীত কালের ক্রিয়া বুঝায়। আসবেন বলে এলেন না কেন? নিতান্ত গ্রহের ফের, নইলে সে সময় সেখানেই-বা থাকব (ছিলাম) কেন? কাজে বেরব, এমন সময় মুসৌরীর মাসীমারা এসে গেলেন।
॥ রূপে ভবিষ্যৎ, অৰ্থে বৰ্তমান ॥
(১) সংশয় বুঝাইলে বর্তমানের অর্থে ভবিষ্যতের প্রয়োগ হয়। ঠাকুর যদি এমন দয়ালই হবেন (হন অর্থে), তাঁর প্রেমের রাজ্যে এমন হিংসার ঠাঁই হল কেন?
ক্রিয়ার ভাব (Mood)
১৩১। ক্রিয়ার ভাব : যে বিশিষ্ট ভঙ্গীর দ্বারা সমাপিকা ক্রিয়ার কাজটি কীভাবে ঘটিতেছে তাহা বুঝিতে পারা যায়, সেই বিশিষ্ট ভঙ্গীকে ক্রিয়ার ভাব বা প্রকৃতি (Mood) বলে। *
[* মহাত্মা রামমোহন রায় তাঁহার গৌড়ীয় ব্যাকরণে Mood-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসাবে প্রকার কথাটি প্রয়োগ করিয়াছেন।]
বাংলায় ক্রিয়ার তিনটি ভাব আছে—(১) নির্দেশক ভাব (Indicative Mood), (২) অনুজ্ঞা ভাব (Imperative Mood) ও (৩) সংযোজক বা সদভাবক ভাব (Subjunctive Mood) |
(১) নির্দেশক ভাব : কোনো সমাপিকা ক্রিয়ার দ্বারা কাজটি সাধারণভাবে নির্দিষ্ট হইলে সেই ক্রিয়ার ভাবকে নির্দেশক ভাব বলা হয়। যেমন, শেফালীর মিষ্টি হাসি বলে গেল, মা আসছেন। গোলাপে যে নামে ডাক, গোলাপই সে থাকে। নামে কিবা আসে যায় বল? ছাতাটাকে সারলাম, জুতোটাকে সারালাম। বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ—তিনটি কালের ক্রিয়ারই নির্দেশক ভাব হয়। এই নির্দেশক ভাবই বাংলা ক্রিয়াপদের নিত্য প্রকৃতি।
(২) অনুজ্ঞা ভাব : ক্রিয়াটির দ্বারা বক্তার আদেশ অনুরোধ আমন্ত্রণ প্রার্থনা আশীর্বাদ উপদেশ উপেক্ষা ইত্যাদি সূচিত হইলে ক্রিয়ার সেই ভাবটিকে অনুজ্ঞা ভাব বলে। মাত্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ কালেরই অনুজ্ঞা ভাব হয়। অনুজ্ঞা ভাবের প্রকাশবৈচিত্র্য লক্ষ্য কর।
(ক) প্রার্থনা—”দাও হস্তে তুলি তোমার অমোঘ শরগুলি, তোমার অক্ষয় তৃণ।” (খ) আবেদন—”একবার তোরা মা বলিয়া ডাক্।” (গ) উদাত্ত আহ্বান—”জাগ জাগ কুলকুণ্ডলিনী মূলাধারে সঙ্গীতুল্য অপারশকতি!” (ঘ) আদেশ—”আরে, ওরে দস্যু ছেলে, নেমে আয়।” দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ভারতবর্ষ’ কবিতাটি আবৃত্তি কর। “আপনাকে এখনই একবার পাটনায় যেতে হবে, সেখানে রাজা জানকীরাম আছেন।” (ঙ) অনুমতি-প্রার্থনা—আপনারা তো এতক্ষণ অনেককিছুই বললেন, এবার আমি একটু বলি? [ উত্তমপুরুষের অনুজ্ঞায় অনুমতি-প্রার্থনায় বাক্যটি মৃদু প্রশ্নাত্মক রূপলাভ করে। ] (চ) অনুরোধ—গরিবের বাড়িতে একদিন আসবেন কিন্তু। (ছ) আমন্ত্রণ—”আয় আয় আয়, আছ যে যেথায়, আয় তোরা সবে ছুটিয়া।” (জ) উপদেশ—মন দিয়ে পড়াশোনা কর (বর্তমান)। দিদিমণিরা যখন যা বলবেন, মন দিয়ে শুনো (ভবিষ্যৎ)। ঠিকানাটা হারাস নে যেন (ভবিষ্যৎ)। (ঝ) আশীর্বাদ—সতীসাবিত্রীর মতো হও, মা। (ঞ) অভিশাপ—দেশদ্রোহীদের সর্বনাশ হোক। (ট) উপেক্ষা বা অনাসক্তি—চুলোয় যাক টাকাকড়ি, প্রাণে যে বেঁচেছে, এই ঢের। গোল্লায় যায় যাক না, তার জন্যে অত মাথাব্যথা কিসের?
(৩) সংযোজক ভাব : কোনো ক্রিয়া একই বাক্যস্থিত অন্য একটি ক্রিয়ার উপর নির্ভরশীল হইলে, যে ক্রিয়াটির উপর নির্ভরশীল হয়, সেই ক্রিয়ার ভাবকে সংযোজক ভাব বলে। ঘটনান্তর অপেক্ষা করে বলিয়া ইহাকে ঘটনান্তরাপেক্ষিত ভাবও বলা হয়।
বাংলায় নির্দেশক ভাব ও অনুজ্ঞা ভাবের জন্য নির্দিষ্ট বিভক্তিচিহ্ন আছে। কিন্তু সংযোজক ভাবের কোনো নির্দিষ্ট বিভক্তিচিহ্ন নাই। সংযোজক ভাবের বিভক্তি নির্দেশক ভাবেরই মতো। নির্দেশক ভাবের ক্রিয়ার সঙ্গে যদি যেন প্রভৃতি অব্যয় যোগ করিয়া সংযোজক ভাবের রূপ দেওয়া হয়।
অভিলাষ সম্ভাবনা আক্ষেপ সংশয় ইত্যাদি বুঝাইলে ক্রিয়াটি নিত্যবৃত্ত অতীতের রূপে থাকে। এমন তিলে তিলে মরার চেয়ে যদি একেবারে মরতে পারতাম, বেঁচে যেতাম। ভগবান্ যদি ঠিক সময়ে বৃষ্টি দিতেন, তবে ফসল ভালোই হত। “লক্ষ্মণ ভাই যদি আমার থাকত সাথে সাথে!” [ তাহা হইলে কী হইত সে সম্ভাবনাটি ঊহ্য রহিয়াছে। ] হায়, সময় থাকতে যদি সাবধান হতিস! যদি লোভ জয় করতে পার, সসাগরা বসুন্ধরা তোমার হবে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বা আশঙ্কা বুঝাইলে ক্রিয়াটি সাধারণ বর্তমানের রূপে থাকে। যদি সুবিধে বোঝ একবারটি চলে এস। সময় পাই তো আসব। সে যদি যায় তো ভালোই হয়। ভগবান্, এমনটা যেন শত্রুরও কখনো না হয়। [ ভবিষ্যৎ আশঙ্কা ]
ক্রিয়ার রূপ
১৩২। ক্রিয়ার রূপ : পুরুষ ও কালভেদে সমাপিকা ক্রিয়ার রূপ—পরিবর্তনকেই ক্রিয়ার রূপ বলা হয়।
উত্তমপুরুষের একটি রূপ, মধ্যমপুরুষের সাধারণ, তুচ্ছ ও সম্ভ্রম—এই তিনটি অর্থে তিনটি রূপ এবং প্রথমপুরুষের সাধারণ ও সম্ভ্রম এই দুইটি অর্থে দুইটি রূপ—পুরুষভেদে ক্রিয়ার মোট এই ছয়টি রূপ। ইহাদের মধ্যে মধ্যমপুরুষ সম্ভ্রমার্থে ও প্রথমপুরুষ সন্ত্রমার্থে ক্রিয়ার একই রূপ ব্যবহৃত হয়। সুতরাং পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপ হইতেছে পাঁচটি। এই পাঁচটি রূপই সকল লিঙ্গ ও বচনে ব্যবহৃত হয়।
বারোটি কালের বিভিন্ন পুরুষের যেসব বিভক্তিযোগে ধাতু ক্রিয়াপদে পরিণত হয়, সেই বিভক্তিগুলির মধ্যে মৌলিক-যৌগিক ভেদাভেদ না রাখিয়া শুধু বিভক্তিচিহ্ন বলিয়া উল্লেখ করিলাম। সাধু রূপের ধাতুবিভক্তি ও চলিত রূপের ধাতুবিভক্তি পৃথক্ করিয়া দেখানো হইল। যেকোনো ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তি—চিহ্নযোগে সমাপিকা-অসমাপিকা-নির্বিশেষে ক্রিয়াটির সাধু রূপ পাইবে। কিন্তু ধাতুতে চলিত ধাতুবিভক্তি যোগ করিলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে (বিশেষভাবে স্বরান্ত ধাতুর ক্ষেত্রে) ধ্বনির যে লোপ-পরিবর্তনাদি ঘটিয়া থাকে, তাহা বিশেষভাবে লক্ষ্য কর।
[ দ্রষ্টব্য : কোনো ধাতুর ক্রিয়ারূপ সাধন করিতে বলিলে সাধু এবং চলিত দুইটি রূপই দেখাইতে হইবে। অবশ্য যেখানে সাধু কিংবা চলিত নির্দেশ করাই থাকে, সেখানে নির্দেশমতো রূপসাধন করিবে। কিন্তু প্রতিক্ষেত্রেই অসমাপিকা ক্রিয়ার রূপটি উল্লেখ করিতে হইবে। ]
পৃষ্ঠা ২৯৫-৩০৬ সংশোধন করা হয়নি
ক্রিয়ার রূপসাধনে শূন্যবিভক্তির অর্থ একেবারেই শূন্য (০) অর্থাৎ ধাতুটিতে কোনো বিভক্তি যুক্ত না হওয়া—ধাতুটি তখন নিজের চেহারাতেই থাকে। √খেল্ + শূন্যবিভক্তি = খেল্; √যা + শূন্যবিভক্তি = যা; √সাজা (ণিজন্ত) + শূন্যবিভক্তি = সাজা; √উলটা (ণিজন্ত—সাধু) + শূন্যবিভক্তি = উলটা; √ওলটা (ণিজন্ত—চলিত) + শূন্যবিভক্তি = ওলটা।
একই কালে একই পুরুষে একই ক্রিয়ার দুইটি বিভিন্ন রূপ হইতে পারে—সাধু রূপ ও চলিত রূপ। সাধু রূপটি সুনির্দিষ্ট, কিন্তু চলিত রূপটি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপে প্রচলিত। কর্ ধাতুর সাধারণ অতীতের উত্তমপুরুষে সাধু রূপ ‘করিলাম’। চলিতে কোথাও ‘করলাম’, ‘করলেম’, আবার কোথাও-বা ‘করলুম’ হইয়া যায়। তবে চলিত রূপগুলির মধ্যে গ্রন্থাদিতে যে রূপটির প্রাধান্য লক্ষিত হয়, ক্রিয়া-রূপাদর্শে সেই ‘লাম’ বিভক্তিযুক্ত রূপটিকেই গ্রহণ করিয়াছি। তোমরা ইচ্ছা করিলে ‘লেম’ ও ‘লুম’ বিভক্তিযুক্ত বিকল্প রূপগুলিও দিতে পার।
অতীত কালের উত্তমপুরুষের অন্য তিনটি উপবিভাগেও এই ধরনের বিকল্প রূপ হইতে পারে। খাচ্ছিলাম (খাচ্ছিলেম, খাচ্ছিলুম), গিয়েছিলাম (গিয়েছিলেম, গিয়েছিলুম), খেলতাম (খেলতেম, খেলতুম) ইত্যাদি।
সকর্মিকা ক্রিয়ার সাধারণ অতীতে প্রথমপুরুষে চলিত রূপে ‘ল’ এবং ‘লে’ দুইটি বিভক্তিই হয়। সারাটা সকাল সে বই পড়ে কাটাল / কাটালে (সকমিকা), অথচ একবারের জন্যও বাজারে গেল (অকর্মিকা) না। বাড়ি থেকে বেরচ্ছি, হঠাৎ সে ভূতের মতো সামনে এসে দাঁড়াল (অকর্মিকা)। অধিকতর প্রচলিত বলিয়া আমরা ‘ল’ বিভক্তির রূপটিই দিলাম।
১৩৩। অসম্পূর্ণ (পঙ্গু) ধাতু : যে-সকল ধাতুর সকল কালের ও সকল ভাবের রূপ পাওয়া যায় না, অন্য ধাতুর সাহায্যে সেই অসম্পূর্ণ রূপ সম্পূর্ণ করিয়া লইতে হয়, সেইসকল ধাতুকে অসম্পূর্ণ বা পঙ্গু ধাতু বলে। যেমন আছ, যা, গ, বট্, আ, নহ্, নার্ ইত্যাদি। আছ ধাতুর পরিপূরক হিসাবে থাক্ ধাতু কাজ করে। পূর্বপৃষ্ঠায় প্রদত্ত আছ ধাতুর পূর্ণ রূপটি দেখিয়া লও। যা ধাতুর পরিপূরক হিসাবে গ ধাতুর ব্যবহার হয়। নীচে রূপটি দেওয়া হইল—বন্ধনী-মধ্যস্থ রূপটি চলিত ভাষার।
যা ধাতুর পুরাঘটিত বর্তমান—গিয়াছে (গিয়েছে), গিয়াছ (গিয়েছ), গিয়াছিস (গিয়েছিস), গিয়াছেন (গিয়েছেন), গিয়াছি (গিয়েছি); সাধারণ অতীত—যাইল (গেল), যাইলে (গেলে), যাইলি (গেলি), যাইলেন (গেলেন), যাইলাম (গেলাম); পুরাঘটিত অতীত—গিয়াছিল (গিয়েছিল), গিয়াছিলে (গিয়েছিলে), গিয়াছিলি (গিয়েছিলি), গিয়াছিলেন (গিয়েছিলেন), গিয়াছিলাম (গিয়েছিলাম); পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ—গিয়া থাকিবে (গিয়ে থাকবে), গিয়া থাকিবে (গিয়ে থাকবে), গিয়া থাকিবি (গিয়ে থাকবি), গিয়া থাকিবেন (গিয়ে থাকবেন), গিয়া থাকিব (গিয়ে থাকব); অসমাপিকা—যাইয়া বা গিয়া (গিয়ে), যাইতে (যেতে), যাইলে (গেলে)। অন্যত্র ধাতুটি নিজের রূপেই থাকে।
বট্ (হওয়া) ধাতুর সাধারণ বর্তমানের রূপই মাত্র পাওয়া যায়—বটে, বট, বটিস, বটেন, বটি। বট্ ধাতুর ব্যবহার অত্যন্ত কম। “একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি।” “গরিব ব্রাহ্মণ বটি, কিন্তু ভিখারী নই।” কে আসে? নারান নয়?—সে-ই বটে। “হ্যাঁ, ইনিই সপ্তম এডওয়ার্ড বটেন।” “ইঁহারা দেবকন্যাই বটেন।” আ (আস্) ধাতুর চলিত রূপই পাওয়া যায়। পুরাঘটিত বর্তমান—এয়েছে, এয়েছ, এয়েছিস, এয়েছেন, এয়েছি; বর্তমান অনুজ্ঞা—আয়; সাধারণ অতীত—এল, এলে, এলি, এলেন, এলাম; পুরাঘটিত অতীত—এয়েছিল, এয়েছিলে, এয়েছিলি, এয়েছিলেন, এয়েছিলাম; অসমাপিকা—এলে। “আমি এলেম, তাইতো তুমি এলে” (সমাপিকা)। তুমি এলে তবে একসঙ্গে যাব (অসমাপিকা)।
প্রাচীন ও আধুনিক কবিতায় আইল (আইলা), আইলে, আইলি, আইলেন, আইলাম (আইনু) প্রভৃতি রূপ বেশ দেখা যায়। “জননীরা, আয় তোরা সব।” “এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে।” “মন্দির তেজি যব পদ চারি আওলু নিশি হেরি কম্পিত অঙ্গ।” “এ কথা শুনি আমি আইনু পূজিতে পা-দুখানি।” “আমা নিতে ভরত আইলে পুনর্বার।” “আইল মধুঋতুরাজ বসন্ত।“
নহ্ ধাতুর মাত্র সাধারণ বর্তমানের রূপই প্রচলিত। নহে (নয়), নহ (নও), নহিস (নস), নহেন (নন), নহি (নই); অসমাপিকা—নহিলে (নইলে)। নহ্ ধাতুর অন্য কালের রূপ নাই, ইহার কোনো পরিপূরক ধাতুও নাই। “গগন নহিলে তোমারে ধরিবে কেবা?” “আমি নইলে মিথ্যা হত সন্ধ্যাতারা ওঠা।” আমি রমেশ নই, উমেশ (নই < নহি—না’ ও ‘হই’ এই দুইটি পদের সংহত রূপ)। “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হত যে মিছে।” “আমি চিত্রাঙ্গদা, নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।” “আমায় নহে গো, ভালোবাসো শুধু মোর গান।” “নহ মাতা নহ কন্যা নহ বধূ সুন্দরী রূপসী হে নন্দনবাসিনী ঊর্বশী।”
নার্—না অব্যয়ের সঙ্গে পার্ ধাতুর ভাব-যোগে এই নার্ ধাতুর সৃষ্টি। সাধারণ বর্তমান—নারে, নার, নারিস, নারেন, নারি; সাধারণ অতীত নারিল (নারল), নারিলে (নারলে), নারিলি (নারলি), নারিলেন (নারলেন), নারিলাম (নারলাম—নারিনু); সাধারণ ভবিষ্যৎ—নারিবে (নারবে), নারিবে (নারবে), নারিবি (নারবি), নারিবেন (নারবেন), নারিব (নারব)। নার্ ধাতুর প্রয়োগ কবিতাতেই হয়, গ্রামাঞ্চলের মৌখিক ভাষায় ক্বচিৎ দৃষ্ট হয়। “নারিলি হরিতে মণি।” “ফাগের দাগ যে তুলতে নারি।” “ভাগ্যহীন আমি, শেষ বেলা জননীরে নারিনু সেবিতে।”—’বিধিচক্র’। “নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি।” “পিপাসায় দিতে নার একবিন্দু জল।”
নহ্ ও নার্ ধাতু “না” অর্থটি বহন করে বলিয়া ইহাদের নঞর্থক ধাতু বলে। নঞর্থক ধাতু বিভক্তিযুক্ত হইয়া ক্রিয়াপদে পরিণত হইলে তাহাকে নঞর্থক ক্রিয়া বলা হয়। নারিনু, নহিস, নারি ইত্যাদি নঞর্থক ক্রিয়া।
না (অব্যয়) এবং হয় ক্রিয়াটির সংযুক্ত রূপ হইল নয় ক্রিয়া। ইহার বিচিত্র প্রয়োগ লক্ষ্য কর।—
(ক) এসব ছবি ছোটোদের দেখা উচিত নয় (হয় না)—ক্রিয়াপদ। (খ) তিনি হয়-কে নয় করতে ওস্তাদ—বিশেষ্যপদ। (গ) হয় তুমি নয় তোমার ভাই এর জন্য দায়ী—নিত্য-সম্বন্ধী অব্যয়।
নাই ক্রিয়াটির প্রয়োগ-বৈচিত্র্য লক্ষ্য কর—
নাই (চলিতে নেই, কবিতায় নাহি) ক্রিয়াটি অন্ত্যর্থক আছ (থাক্)-র বিপরীত নাস্ত্যর্থক বর্তমান কালের ক্রিয়া। তিন পুরুষেই ইহার একটিমাত্র রূপ। নাহি মোর পিতামাতা আত্মীয়স্বজন। আমার হাতে তবু কিছুটা কাজ আছে, দাদার হাতে কিচ্ছু নেই। জগতে তুমি নাই, আমি নাই, কেহ নাই, আছেন শুধু নিত্যলীলাময়। বাড়িতে তিনিও নেই, তাঁর ছেলেটিও নেই। “নাহি বাজে কানে যুদ্ধভেরী জয়শঙ্খ।” “নাহি সোয়াস্তি নাহি কোনো সুখ।” “নাই চন্দন লেখা শ্রীরাধার মুখে।” “ওদের কিছু নেই, থিত নেই ভিত নেই রীতি নেই নীতি নেই আইন নেই কানুন নেই বিনয় নেই ভদ্রতা নেই শ্লীলতা-শালীনতা নেই। “—অচিন্ত্যকুমার। “আজি নাহি নাহি নিদ্ৰা আঁখিপাতে।”
কবিতায় পাদপূরণে বা জোর দিবার সময় ক্রিয়াটির ক-যুক্ত নাইক (নাহিক বা নেইক) রূপটির প্রয়োগ বেশ মধুর। নাহি রাজ্য, নাহিক সম্পদ। “আমার মনে নাইক কোনো দ্বন্দ্ব।” “নাকছাবিটি হারিয়ে গেছে সুখ নেইক মনে।”
‘ইতে’ বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা ক্রিয়ার সহিত নাই বসিলে উচিত নয় অর্থটি প্ৰকাশ পায়। ইহা বিধিবাচক হয়-এর বিপরীত। এমন রূঢ় কথা বলিতে নাই।
এত তাড়াতাড়ি খেতে নেই, আস্তে আস্তে খেতে হয়।
পুরুষানুসারে সাধারণ বর্তমান কালের ক্রিয়ার সঙ্গে নাই (চলিতে নি) বসিলে নাস্ত্যর্থক অতীত কালের ক্রিয়া বুঝায়। সেদিন তুমি কিছুই খাও নাই (চলিতে নি)। আপনি এখনও খাননি? দীর্ঘকাল তিনি এখানে আসেননি। [ এরূপ ক্ষেত্রে পুরাঘটিত অতীত বা পুরাঘটিত বর্তমান কালের ক্রিয়ার সহিত কদাপি নাই (নি) প্রয়োগ করিও না—তুমি খাইয়াছিলে না, আপনি খাইয়াছেন না, তিনি আসিয়াছিলেন না ইত্যাদি প্রয়োগ বাংলা ভাষার রীতিবিরুদ্ধ। ]
নাই-এর বর্তমান কালের রূপ না। ইহা মূলতঃ অব্যয়। পুরাঘটিত বর্তমান ছাড়া অন্য তিনটি বর্তমানকালে সব পুরুষের ক্রিয়ার সহিত ইহার প্রয়োগ বেশ ব্যাপক। তিনি আমিষ খান না (সাধারণ বর্তমান)। তুমি তো এখন লিখছ না (ঘটমান বর্তমান)? এলাকায় একটা নতুন ধরনের জ্বর জাঁকিয়ে বসেছে, এখন এখানে এসো না (নাস্ত্যর্থক)। কিন্তু, এখানে একদিন এসো না। আমার সঙ্গে একবারটি যাবি কিনা বল্ না। একটা গল্প বলুন না। পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য একবারটি কোমর বেঁধে লাগ না। এমন চমৎকার আম, একটুখানি খান না। শেষের পাঁচটি বাক্যেই বর্তমান অনুজ্ঞায় নঞর্থক অব্যয়টি কর্ম-পণ্ড-করিবার মৌলিক দুর্বুদ্ধি হারাইয়া অনুরোধ বা উপদেশের গাঢ়ত্ব প্রকাশ করিতেছে।
চলিত রীতির ক্রিয়ার সব পুরুষেই না, কেবল উত্তমপুরুষে ও মাঝে মাঝে তুচ্ছার্থক মধ্যমপুরুষে বিকল্প রূপ নে-ও হয়। “দেহ স্নিগ্ধ হল বটে কিন্তু নিৰ্মল হল বলতে পারি নে।” সাড়া দিবি নে সৰ্বনাশী?
পুরাঘটিত অতীত ছাড়া অন্য তিনটি অতীত কালের ক্রিয়ার সহিত না-এর প্রয়োগ কী সাধুতে কী চলিতে বেশ ব্যাপক। এত অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি আসিলেন (এলেন) না। এমন চমৎকার আম একটু খাইলে (খেলে না কেন? [ এখানে ক্রিয়াটির অর্থ কিন্তু সাধারণ বর্তমানের দিকেই ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে। ] উনি তখন লিখছিলেন না, ভাবছিলেন। উত্তরটা জানা থাকলেও বলতাম না। [ এরূপ স্থলে কদাপি নাই ব্যবহার করিও না। ]
১৩৪। পঙ্গু ক্রিয়া : যে ধাতুর সকল কালের ও সকল ভাবের রূপ পাওয়া যায় না, সেই অসম্পূর্ণ (পঙ্গু) ধাতুর উত্তর ধাতুবিভক্তির যোগে যে ক্রিয়াপদ পাওয়া যায়, তাহাকে পঙ্গু ক্রিয়া বলে। গেলে, বট, আইনু, নারিবে, থাকব, নইলে, এলেন, নারিলি, নহ ইত্যাদি পঙ্গু ক্রিয়া। “তিনি চিন্ময়ও বটেন, আবার চিদ্ঘনও বটেন।” “নারিবে শোধিতে ধার কভু গৌড়ভূমি।”—মধুকবি। “নারিলি হরিতে মণি।” “একা দেখি কুলবধূ কে বট আপনি।”—ভারতচন্দ্র। “আইনু পুজিতে পা-দুখানি।”
অনুশীলনী
১। ক্রিয়াপদ কাহাকে বলে? ক্রিয়াপদ কীভাবে গঠিত হয়? ক্রিয়াকে বাক্যের প্রধান উপাদান বলা হয় কেন?
২। ধাতুবিভক্তি ও ধাত্ববয়ব প্রত্যয় কাহাকে বলে? উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কী? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।
—
৩। ধাতু কাহাকে বলে? উদাহরণ সাহায্যে বুঝাইয়া দাও। উৎপত্তি ও প্রকৃতির বিচারে ধাতুকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়? প্রত্যেক প্রকারের দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।
৪। সিদ্ধ ধাতু কাহাকে বলে? উৎসের বিচারে সিদ্ধ ধাতুকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়? প্রত্যেক ভাগের দুইটি করিয়া ধাতুর উল্লেখ করিয়া সেগুলিকে ক্রিয়াপদে পরিণত করিয়া বাক্যে প্রয়োগ কর।
৫। কেবল কবিতায় ব্যবহৃত হয় এমন চারিটি সিদ্ধ ধাতুর উল্লেখ করিয়া সেগুলি কবিতায় প্রযুক্ত হইয়াছে এমন নিদর্শন উল্লেখ কর।
৬। সাধিত ধাতু কাহাকে বলে? অর্থ ও সাধন-অনুসারে সাধিত ধাতুকে কয়টি ভাগে ভাগ করা যায়? প্রত্যেক ভাগের অন্ততঃ তিনটি উদাহরণ উল্লেখ কর।
৭। খাঁটী বাংলা ধাতু কাহাকে বলে? উহাদের উৎসমূল কী? চারিটি খাঁটী বাংলা ধাতুর উল্লেখ করিয়া তাহাদিগকে ক্রিয়াপদে পরিণত করিয়া স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।
৮। প্রযোজিকা ক্রিয়া কাহাকে বলে? এই ক্রিয়াকে ণিজন্ত ক্রিয়া বলা চলে কি? অকর্মিকা, সকর্মিকা ও দ্বিকর্মিকা ক্রিয়াকে প্রযোজিকা ক্রিয়ারূপে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।
৯। অকর্মিকা ক্রিয়া ও সকর্মিকা ক্রিয়ার সংজ্ঞার্থ বল। কখন অকর্মিকা ক্রিয়া সকর্মিকারূপে ব্যবহৃত হয়? উদাহরণ দাও। সকর্মিকা ক্রিয়া অকর্মিকারূপে ব্যবহৃত হইয়াছে, এমন উদাহরণ উল্লেখ কর।
১০। সমধাতুজ কর্ম কাহাকে বলে? সকর্মিকা অকর্মিকা উভয়প্রকার ক্রিয়ারই সমধাতুজ কর্ম থাকিতে পারে, উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।
১১। নামধাতু কাহাকে বলে? কোন্ কোন্ নামপদ হইতে নামধাতুর সৃষ্টি হয়? দুইটি উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। নামধাতুকে সাধিত ধাতু বলে কেন?
১২। মাইকেলী নামধাতুজ ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য কী? বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বন্যাত্মক নামশব্দ হইতে মাইকেলী নামধাতুজ ক্রিয়ার উৎপত্তি হইয়াছে, একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
১৩। যৌগিক ক্রিয়া ও সংযোগমূলক ক্রিয়ার সংজ্ঞার্থ বল। যৌগিক ক্রিয়ার বৈশিষ্ট্য কী? যৌগিক ক্রিয়ার সহিত সংযোগমূলক ক্রিয়ার পার্থক্য প্রতিষ্ঠা কর।
১৪। ধাতু ও ক্রিয়াপদের সম্পর্ক কী? ক্রিয়াপদ হইতে কী প্রকারে ধাতুনির্ণয় করা যায়? উদাহরণ দাও।
১৫। সিদ্ধধাতু, নামধাতু ও সংযোগমূলক ধাতুরূপে ধ্বন্যাত্মক শব্দের প্রয়োগ দেখাও।
১৬। গঠনভঙ্গীর দিক্ দিয়া ক্রিয়াপদকে যে পাঁচটি ভাগে ভাগ করা হয় তাহাদের নাম বল। প্রত্যেকটির একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
১৭। বাক্যের অন্যান্য পদের সহিত সম্পর্কবিচারে ক্রিয়াপদকে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়? তাহাদের নাম বল। প্রত্যেকটির একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
১৮। দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া কাহাকে বলে? দ্বিকর্মিকা ক্রিয়াকে প্রেরণার্থক ক্রিয়ারূপে ব্যবহার করিলে ইহার কয়টি কর্ম থাকে? নিম্নলিখিত বাক্যগুলির ক্রিয়াপদকে সকর্মিকা বলা যায় কি না, কারণ দেখাও : (ক) বাবা প্রধানশিক্ষিকাকে পত্র লিখিতেছেন। (খ) আমি তো বাজার থেকে শুধু আম আর লিচু আনলাম। (গ) বাবলুকে বাজারের টাকাটা দিয়ে দাও। (ঘ) শিক্ষকমাত্রই কি ভালো ছেলে আর মন্দ ছেলেকে সমান চোখে দেখেন? (ঙ) একটা ঠেলা আর দুটো রিক্শা ডাকবি।
১৯। (ক) ক্রিয়ার কাল কাহাকে বলে? ক্রিয়ার কাল বলিতে কোন্ ক্রিয়ার কাল বুঝায় সমাপিকা, না অসমাপিকা? ক্রিয়ার প্রধান তিনটি কালের নাম কর ও প্রত্যেকটির দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও। (খ) পাঠ-সংকলনের অদ্যকার পাঠ হইতে ক্রিয়ার প্রধান তিনটি কালের যতগুলি সম্ভব উদাহরণ সংগ্রহ কর। অসমাপিকা ক্রিয়ার কালনির্ণয়ের উপায় কী? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।
২০। (ক) বর্তমান কালের ক্রিয়াপদের উপবিভাগগুলির নাম বল ও উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। (খ) ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়ার উপবিভাগগুলির নাম বলিয়া উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও।
(গ) নিত্য অতীত, নিত্যবৃত্ত অতীত, পুরাঘটিত অতীত, ঘটমান অতীত—এই চারিটি কালের পার্থক্য বুঝাইয়া প্রত্যেকটির একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
২১। (ক) মৌলিক কাল ও যৌগিক কাল কী? কোন্ কোন্ কালকে কেনই-বা মৌলিক কাল এবং কোন্ কোন্ কালকে কেনই-বা যৌগিক কাল বলা হয়?
(খ) লিখিয়াছিস, ভালোবাসিও, ভেঙে থাকব, লিখিতেছে, খেলিয়াছেন, শুনিয়ে থাকবেন, চালাব, খাওয়াতেন, যাবেন, ধরলাম—কোটির কাল মৌলিক, কোটির যৌগিক বল।
২২। পার্থক্য দেখাও : মৌলিক ক্রিয়া ও যৌগিক ক্রিয়া; মৌলিক কাল ও যৌগিক কাল; যৌগিক ক্রিয়া ও সংযোগমূলক ক্রিয়া।
২৩। শূন্যস্থান পূর্ণ কর :
(i) যেকোনো পুরুষের একবচন ও বহুবচনে ক্রিয়াপদের রূপ ……হয়।
(ii) সম্ভ্রমার্থক মধ্যমপুরুষ ও সম্ভ্রমার্থক প্রথমপুরুষের ক্রিয়ার রূপ—… |
(iii)—ক্রিয়ার রূপ সকল পুরুষে একই হয়।
(iv) …… কালের ক্রিয়ার দ্বারাও অতীত কালের ক্রিয়ার প্রকাশ হয়।
(v) অনুজ্ঞা…… কালের ক্রিয়ায় হয় না।
(vi) ……ক্রিয়ার কাল …… ক্রিয়ার কাল……ক্রিয়ার কালের উপর নির্ভর করে।
(vii) পুরাঘটিত ভবিষ্যতের আরেকটি নাম……অতীত।
(viii) সংযোজক ভাবের আরেকটি নাম…… ভাব।
(ix) দুই-একটি ক্রিয়াপদ….. পদরূপেও ব্যবহৃত হয়।
২৪। প্রতিটি পঙ্ক্তিতে প্রদত্ত ক্রিয়াপদগুলির মধ্যে যে ক্রিয়াটি সেই পঙ্ক্তির বামদিকে নির্দেশিত ক্রিয়ার কালের সহিত মিলিতেছে না, সেটিকে বাতিল কর; বাতিল ক্রিয়াটি কোন্ কালের ক্রিয়া, পৃথক্ অনুচ্ছেদে তাহাও লিখিয়া রাখ :
ক্রিয়ার কাল — ক্রিয়াপদ
(১) ঘটমান বর্তমান — খেলিতেছে, খাচ্ছে, পড়াইতেছেন, হেসেছে, হাসছে
(২) পুরাঘটিত অতীত — খাইলেন, ঘটিয়াছিল, পড়েছিলাম, বলিয়াছিলেন
(৩) সাধারণ ভবিষ্যৎ — আসবে, খাইবেন, পড়িব, খেলিবে, খেও
(৪) ঘটমান অতীত — খেলছিল, খেলাচ্ছিলেন, হাসিয়াছিলাম, যাইতেছিলে
(৫) পুরাঘটিত বর্তমান — হেসেছে, লিখছেন, গিয়াছি, দেখেছেন, এনেছিস
(৬) নিত্যবৃত্ত অতীত — করতাম, খেলতেন, যেতে, এলেন, পড়তিস
(৭) ঘটমান ভবিষ্যৎ — খেলতে থাকব, লিখে থাকবেন, বলিতে থাকিবি
(৮) সাধারণ অতীত -– বলিলেন, করলাম, ভাঙিলে, বলেছিলে, এলে
(৯) বর্তমান অনুজ্ঞা — করিস, করুক, খা, আসুন, বসাও, বল
(১০) ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞা — খেলিস, খাবেন, যাস, হইও, বলাও
২৫। (ক) ক্রিয়ার ভাব কাহাকে বলে? ইহা কয় প্রকার? প্রত্যেক প্রকারের একটি করিয়া উদাহরণ দিয়া প্রত্যেকটি ভাবের বৈশিষ্ট্য বুঝাইয়া দাও।
(খ) ক্রিয়াপদগুলির তাব নির্দেশ কর : এবার যদি বেঁচে ফিরি, তোমার একদিন কি আমার একদিন। “দর্শকমণ্ডলী আপনাকেই অভিনন্দন জানাচ্ছে।” “খাও হে চক্রবর্তী।” “এখন বসিয়াছি দাঁড়ে—পায়ের শিকল কাটিল না।” এবার খেতে বসি? “ঠ মা ওঠ, মোছ তোমার আঁখিজল।” “মা তোর রঙ্গ দেখে, রঙ্গমণি, অবাক্ হয়েছি।” আপনার মুখে ফুলচন্দন পড়ুক।
২৬। উদাহরণযোগে ব্যাখ্যা কর : অকর্মিকা ক্রিয়া, যৌগিক ক্রিয়া, ঘটমান অতীত, অনুজ্ঞা, পুরাঘটিত অতীত, মৌলিক ধাতু, মৌলিক ক্রিয়া, নিত্যবৃত্ত অতীত, নামধাতু, পুরাঘটিত ভবিষ্যৎ, পুরাঘটিত বর্তমান, সিদ্ধ ধাতু, সাধিত ধাতু, ধ্বন্যাত্মক ধাতু, ঘটমান ভবিষ্যৎ, ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া, প্রযোজিকা ক্রিয়া, ণিজন্ত ক্রিয়া, ঐতিহাসিক বর্তমান, দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া, নিত্য অতীত, ধাতুবিভক্তি, ধাত্ববয়ব প্রত্যয়, বাংলায় প্রচলিত পাঁচটি তৎসম ধাতু, চারিটি তদ্ভব ধাতু, পাঁচটি খাঁটী বাংলা ধাতু, ধ্বন্যাত্মক সিদ্ধ ধাতু, তৎসম বিশেষণ হইতে উৎপন্ন সিদ্ধ ধাতু, তৎসম বিশেষ্য হইতে উৎপন্ন নামধাতু, প্রযোজক ধাতু, অকর্মিকা ক্রিয়ার সকর্মিকাত্ব, সকর্মিকা ক্রিয়ার অকর্মিকত্ব, প্রযোজিকা ক্রিয়ারূপে সকর্মিকার ব্যবহার, বিশেষণ হইতে নামধাতুজ ক্রিয়া, প্রযোজিকা ক্রিয়ারূপে দ্বিকর্মিকার ব্যবহার, প্রযোজিকা ক্রিয়ারূপে অকর্মিকার প্রয়োগ, ধ্বন্যাত্মক শব্দ হইতে নামধাতুজ ক্রিয়া, কর্মবাচ্যের ধাতু, উপসর্গযুক্ত তৎসম ধাতু হইতে উদ্ভূত তদ্ভব ধাতু, সংযোগমূলক ধাতু, সংযোগমূলক ধাতুর অঙ্গরূপে ধ্বন্যাত্মক শব্দ, মুখ্য কর্ম, গৌণ কর্ম, সকর্মিকা অসমাপিকা ক্রিয়া, অকর্মিকা সমাপিকা ক্রিয়া, ক্রিয়াবিশেষণরূপে অসমাপিকা ক্রিয়া, অব্যয়রূপে ‘ইয়া’ বিভক্তিযুক্ত অসমাপিকা, ভাববাচক বিশেষ্য ও বিশেষণের পরিবর্তে অসমাপিকা ক্রিয়া, কার্যকারণ-সম্বন্ধ বুঝাইতে অসমাপিকার প্রয়োগ, সমাপিকার পূর্বকালীনতা ও সমকালীনতা বুঝাইতে অসমাপিকা ক্রিয়া, অতীত-অর্থে সাধারণ বর্তমান, সন্দিগ্ধ অতীত, ঘটমান অতীত-অর্থে ঘটমান বর্তমান, ভবিষ্যৎ-অর্থে ঘটমান বর্তমান, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-অর্থে পুরাঘটিত বর্তমান, ঘটমান বর্তমান—অর্থে সাধারণ অতীত, ঘটমান বর্তমান-অর্থে ঘটমান অতীত, ভবিষ্যৎ-অর্থে নিত্যবৃত্ত অতীত, অতীত-অর্থে সাধারণ ভবিষ্যৎ, ভবিষ্যৎ-অর্থে সাধারণ অতীত, ভবিষ্যতের দ্বারা বর্তমানের প্রকাশ, অসম্পূর্ণ ক্রিয়া, নঞর্থক ধাতু, ঘটমান অতীত-অর্থে সাধারণ বর্তমান, বর্তমান কালের ক্রিয়া হিসাবে ‘নাই’, ‘নয়’ ক্রিয়াটিকে নিত্য-সম্বন্ধী অব্যয়রূপে, ঘটমান বর্তমান ও নিত্য অতীতের ক্রিয়াপদকে বিশেষণরূপে।
২৭। (ক) ‘নাই’ ক্রিয়াটির প্রয়োগবৈশিষ্ট্য দেখাও।
(খ) ‘নাই’ ক্রিয়াটির বর্তমান কালের রূপটি কী? ইহার বিচিত্র প্রয়োগ দেখাও।
২৮। আয়ত ক্রিয়াগুলি কোন্ শ্রেণীর ক্রিয়া উল্লেখ করিয়া উহাদের পুরুষ ও কাল নির্ণয় কর : আজকাল প্রায়ই এখানে আসছ শুনলাম। “যদি এক যুগ পরে সে ফিরে আসে, আমি সেই এক যুগ পরের কথাই ভাবছি।” “বাহিরিনু হেথা হতে উন্মুক্ত অম্বরতলে।” যিনি সমস্ত দিক্ থেকে জগৎকে প্রকাশিত করছেন তিনি হলেন আকাশ। “মোর জীবনে বিচিত্র রূপ ধরে তোমার ইচ্ছা তরঙ্গিছে।” “দুবেলা মরার আগে মরব না, ভাই মরব না।” “সেই কথাটি কবি পড়বে তোমার মনে বর্ষামুখর রাতে, ফাগুন সমীরণে।” “মসমসিয়ে তারি মাঝে ডিঙা আমার চলে।” “পদযুগ ঘিরে জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্রভানু।” “বিশ্ব জুড়ে শুধু দেওয়ার দেওয়ালী চলেছে।” “ছি ছি চোখের জলে ভেজাস নে আর মাটি।” কুড়িতেই যে বুড়িয়ে গেলি রে! “প্রভুর কর্মে বীরের ধর্মে বিরোধ বাধিল আজ।” “ঊষা রাঙাইছে আঁখি পূর্বাশার দ্বারে।” ভাস্বতীও গাইবে না, আমরাও ছাড়ব না, শেষে সমাপ্তিদি ওকে গাইয়ে তবে ছাড়লেন। স্টোভ ধরেছে? না, এইমাত্র ধরাচ্ছি। “বিশ্বরূপের খেলাঘরে কতই গেলেম খেলে।” “ফাল্গুনে রাঙা ফুলের আবীরে রাঙাও নিখিল ধরণী।” “আজি আসিয়াছ ভুবন ভরিয়া গগনে ছড়ায়ে এলোচুল, চরণে জড়ায়ে বনফুল।” “তাহারে নাচায় প্রিয়া করতালি দিয়া দিয়া, রুনুরুনু বাজে তায় বালা।” তুই তো অবুঝ নস, বাবা। চললাম রে রেবতী, তাহলে রবিবারে আমাদের ওখানে আসছিস, কেমন? “নবীন গরিমা ভাতিবে আবার ললাটে তোর।” “মা, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও।” ‘কহিল, অবোধ কী সাহসবলে এনেছিস পূজা, এখনি যা চলে।” “কালো মায়ের রূপের আলোয় ঝরনাধারা বয়।” “জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।” “তালে তালে দুটি কঙ্কণ কনকনিয়া ভবনশিখীরে নাচাও গনিয়া গনিয়া।” “সখি, কেমনে জীব গো আর।” চণ্ডীদাস। “তব লাগি ব্যথা ওঠে গো কুসুমি।” “সে বাণী মন্দ্রিল সুখতন্দ্রারত ভবনে।” “মহৈশ্বর্যে আছে নম্র, মহাদৈন্যে কে হয়নি নত।” “ওহে তুমি জানাও যারে, সেই জানে।” “যে দেশে রজনী নাই, সে দেশের এক লোক পেয়েছি।” হাড়মাস জ্বালিয়ে খাচ্ছে। গুজরাট এখন শিল্পের দিক্ দিয়ে পশ্চিমবঙ্গকে টপকে গিয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। “আকাশজোড়া প্রকাণ্ড প্রশ্নের একটিমাত্র উত্তর হল—ভালবাসা।” ট্রয়ের যুদ্ধ ঘটেছিল খ্রীষ্টপূর্ব ১২০০ সালে। “লোহ-সহ মিশি অশ্রুধারা….. আর্দ্রিল মহীরে।” অবস্থা খারাপ দেখে আগেভাগেই কেটে পড়লেন যে! “তরুবর, কেহ নাহি তোমারে বিরাগে।” “জগৎকে জ্ঞানরূপে পাওয়া, শক্তিরূপে পাওয়া ও আনন্দরূপে পাওয়াকেই মানুষ হওয়া বলে।” “তুমি আমাকে অবসন্ন হতে দিও না।” “চাহিয়া দেখ রসের স্রোতে রঙের খেলাখানি।” “দুঃখ জানে শরীর জানে, মন, তুমি আনন্দে থাক।” “তোর প্রাণের ওই একতারাতে কোন্ সুরকার সুর ছড়াল!” মিষ্টি আমটা খেয়ে ফেলেছি। টকো আমটা একটুখানি খেয়ে ফেলে দিয়েছি। “তোমার রাগিণী ধ্বনিছে নিখিলে।” কার্থেজের সবচেয়ে বাড়বাড়ন্ত হয় খ্রীষ্টপূর্ব ৮৪০ সালে। সংকটকে সুযোগে রূপান্তরিত করতে সচেষ্ট হও। “বিষয়ী লোকেরা হচ্ছে দই-পাতা হাঁড়ি, দুধ রাখলেই নষ্ট।” “আমার হৃদয় তোমার বাসের যোগ্য করে তোল।”
২৯। চূড়ান্ত রূপ লিখ : √হ + ছিল; কর্ + ইয়া থাকিবে; খেলা + শূন্যবিভক্তি (সাধু); √ধর্ + শূন্যবিভক্তি (চলিত); শিখ্ + অ; √পড়া + এ; √লিথ্ + এন; √শুন্ + এ (অসমাপিকা); √দি + ও; √দি + ই; √ছুঁ + এছিল; √দেখ্ + এ থাকব; দেখা + ইলি; √যা + বেন; √কহ্ + ছিলাম; শিখা + ছ; √দৌড়া + ইয়াছেন; শোয়া + এছি; √পাড় + ইব।
৩০। নির্দেশমতো উত্তর দাও : (ক) কর্ ধাতুর পুরাঘটিত বর্তমান কালের সকল পুরুষের রূপ। (খ) হ অথবা শুন্ ধাতুর পুরাঘটিত বর্তমান, ঘটমান অতীত, বর্তমান অনুজ্ঞা, ঘটমান ভবিষ্যতের প্রথমপুরুষের সাধু ও চলিত রূপ। (গ) √শুন্ (সাধু) ঘটমান বর্তমান, পুরাঘটিত অতীত, ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার রূপ। (ঘ) √পা (চলিত) পুরাঘটিত বর্তমান, ঘটমান ভবিষ্যৎ, নিত্যবৃত্ত অতীতের রূপ। (ঙ) √চল্ (সাধু) সাধারণ বর্তমান, পুরাঘটিত অতীত, ঘটমান ভবিষ্যতের রূপ। (চ) √ফল্ (চলিত) পুরাঘটিত বর্তমান, সাধারণ অতীত, সাধারণ ভবিষ্যতের রূপ। (ছ) √কহ্ (চলিত) সম্পূর্ণ রূপ। (জ) √গাহ্ (সাধু) সম্পূর্ণ রূপ। (ঝ) √উলটা (চলিত) বর্তমান অনুজ্ঞা, ঘটমান অতীত, সাধারণ ভবিষ্যতের রূপ। (ঞ) √পড় (সাধু) ঘটমান বর্তমান, সাধারণ অতীত, ভবিষ্যৎ অনুজ্ঞার রূপ। (ট) √পড়া (চলিত) সাধারণ বর্তমান, পুরাঘটিত অতীত, ঘটমান ভবিষ্যতের রূপ।
৩১। নিম্নলিখিত ধাতুগুলির পূর্ণরূপ লিখ : (ক) √পাড় (সাধু); (খ) √পাড়া (চলিত); (গ) √গাহ্ (চলিত); (ঘ) √দাঁড়া (সাধু); (ঙ) তলা (সাধু); (চ) √হারা (To lose); (ছ) √হারা (To defeat); (জ) √হার্ (পরাজিত হওয়া); (ঝ) √গালা (তরল করা); (ঞ) √চালা (চালনা করা)।
৩২। শুদ্ধ কর : সে এখানে আসিয়াছিল না। তুমি এখনও কেন যাইয়াছ না। তিনি এরূপ করিয়াছিলেন নাই। জানিলেও আমি উত্তরটা বলিতাম নাই। আপনি কি এই কথাটা আমাকে বলিয়াছিলেন নাই? এমন কাজ করিতে হয় না। তিনি পঁচিশ বছর পূর্বে মারা গিয়েছিলেন। উনি আমাদের কারোরই জানাশোনা নয়।