৩.০৩ সর্বনামের শ্রেণীবিভাগ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – সর্বনামের শ্রেণীবিভাগ

সর্বনামপদকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।–

(১) ব্যক্তিবাচক (Personal)–যে সর্বনামে কোনো ব্যক্তিকে বুঝায়, তাহা ব্যক্তিবাচক (বা পুরুষবাচক) সর্বনাম। আমি, আমরা, আমাকে, আমাদের, তুমি, তোমরা, তোমাকে, তাকে, তাহার, তুই, তোকে, আপনি, আপনাকে, সে, তাহারা, তাহাকে, তিনি, তাহাদের, তার ইত্যাদি। তিনি, আপনি ইত্যাদি সম্মানীয় ব্যক্তির পরিবর্তে বসে। তোর, তুই, তোকে ইত্যাদি অবজ্ঞাসূচক বা খুব অন্তরঙ্গ ব্যক্তির পরিবর্তে বসে। তব, মম, তোমা, মোদের, মোরা–শুধু কবিতায় ব্যবহৃত হয়।

(২) নির্দেশক (Demonstrative)–যে সর্বনাম কোনো ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করে, তাহাকে নির্দেশক সর্বনাম বলে। এ, এরা, ইহা, ইহারা, এই, ইনি, ইহারা, এঁরা, এঁকে, এটা, এগুলি নিকটের ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করে বলিয়া সামীপ্যবাচক নির্দেশক। ও, ওরা, উহা, উহার, ওই, উনি, উহারা, ওঁরা, ওঁকে, ওটা, ওগুলি দূরের ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করে বলিয়া দূরত্ববাচক নির্দেশক।

ইনি, উনি, এঁরা, ওঁরা মাননীয় ব্যক্তিকে; এরা, ওরা, এদের, ওদের সাধারণ ব্যক্তিকে; ইহা, উহা, এটা, এইটা, ওটা তুচ্ছ ব্যক্তি বা বস্তুকে নির্দেশ করে।

সংস্কৃত ‘এতদ’ শব্দ হইতে বাংলা এ, ইহা আসিয়াছে; এইজন্য সমাসে বা সন্ধিতে পূর্বপদ হিসাবে এতদ্-এর ব্যবহার চলিয়া আসিতেছে–এতদবিষয়ে, এতদ্বারা, এতৎসত্ত্বেও, এতৎসম্পর্কে, এতৎসন্নিধানে, এতদঞ্চলে, এতদবস্থায়। :

(৩) অনির্দেশক (Indefinite)–যে সর্বনাম কোনো অনির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বস্তু বা ভাবের পরিবর্তে বসে, তাহাকে অনির্দেশক সর্বনাম বলে। কেহ, কেউ, কিছু, যে-কেহ, কিছু-কিছু, আর-কেউ, যা-কিছু, কেউ-কেউ, অমুক, কোনোকিছু।

একাধিক সর্বনামপদের সংযোগে গঠিত কোনো যৌগিক পদ যখন অনির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা ভাবের পরিবর্তে বসে, তখন তাহাকে যৌগিক সর্বনাম বলে। যেমন–যে-কেহ, যাহা-কিছু, কোনোকিছু ইত্যাদি।

(৪) প্রশ্নবাচক (Interrogative)-যে সর্বনামপদে কোনোকিছু জানিবার ইচ্ছা থাকে, তাহাকে প্রশ্নবাচক সর্বনাম বলে। কে, কী, কোন্টা, কাহারা, কারা, কাহারা, কিসে, কে কে, কী কী, কোলা, কোগুলি, কোগুলো ইত্যাদি।

আপনারা কী খেলেন? “কী হবে, মা, এমনতরো রাজার মতো সাজে।” এখন দেখা যাক কী হয়। [ প্রতিটি “কী” এখানে সর্বনাম। ] কিন্তু, আপনারা কিছু খেয়েছেন কি? [ এখানে “কি” “শ্নবাচক অব্যয়–বানানের পার্থক্য দেখ।]

কী সর্বনামটি মাঝে মাঝে বিশেষণ ও বিশেষণের বিশেষণ হিসাবেও ব্যবহৃত হয়। কী রঙ চান বলুন। [ “রঙ” পদটির বিশেষণ ]। কী প্রচণ্ড রাগ! [“প্রচণ্ড” বিশেষণটির বিশেষণ ]। রাজধানী এক্সপ্রেস কী প্রচণ্ড বেগেই না চলে! [ “প্রচণ্ড” বিশেষণের বিশেষণপদটির বিশেষণ ]। “সেদিন তুমি কী ধন দিবে উহারে?” “ধন” বিশেষ্যপদটির বিশেষণ ]।

(৫) সংযোগবাচক (Relative)–যে সর্বনামপদে দুই বা তাহার বেশী ব্যক্তি বা বস্তুর মধ্যে সংযোগ বুঝায়, তাহাকে সংযোগবাচক বা সম্বন্ধবাচক সর্বনাম বলে। যে, যাহারা, যাহা, যে যে, যা যা প্রভৃতি সাধারণ সম্বন্ধে; যিনি, যাঁহারা, যাঁহাকে, যার প্রভৃতি সম্মানীয় ব্যক্তির সম্বন্ধে; আর যাহা, যা, যেটা, যেটি, যেগুলো, যে-সমস্ত-অপ্রাণী বা ইতর প্রাণীর সম্বন্ধে ব্যবহৃত হয়।

অনেক সময় একটি সংযোগবাচক সর্বনাম ভাবের পূর্ণতার জন্য আরেকটি সংযোগবাচক সর্বনামের অপেক্ষায় থাকে। পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এইপ্রকার সংযোগবাচক সর্বনামকে সাপেক্ষ সর্বনাম (Correlative) বলে। যে….সে, যা….তা, যিনি….তিনি, যাহা….তাহা ইত্যাদি এই শ্রেণীর সর্বনাম। যে পরিশ্রম করবে, সে-ই সুফল পাবে। যা মনে করেছিলাম তা তো হল না। “ত্রেতায় যিনি রাম, দ্বাপরে যিনি কৃষ্ণ, কলিতে তিনিই তো শ্রীরামকৃষ্ণ।” “যাহা নাই ভারতে, তাহা নাই ভারতে।” “কেহ নাই যার তুমি আছ তার।”-রজনীকান্ত।

(৬) আত্মবাচক (Reflexive)-যে সর্বনামে কাহারও সাহায্য না লওয়ার ভাবটি বিশেষ জোরের সঙ্গে বুঝানো হয়, তাহাকেআত্মবাচক স্বকর্তৃত্বজ্ঞপক সর্বনাম বলে। নিজ, নিজে, আপনি, আপনারা, নিজেদের, আপন ইত্যাদি।

(৭) সাকল্যবাচক (Inclusive)-যে সর্বনাম সমষ্টিবাচক ব্যক্তি, বস্তু বা ভাবের পরিবর্তে প্রয়োগ করা হয়, তাহাকে সাকল্যবাচক সর্বনাম বলে। সর্ব, সব, সকল, উভয়, সবাই, সব্বাই, সবকিছু প্রভৃতি।

সব সর্বনামটির বিচিত্র প্রয়োগ : (ক) “বল বল বল সবে (সর্বনাম) : শতবীণা-বেণুরবে।” (খ) “পাখী সব (বিণ) করে রব।” (গ) দ্রৌপদী সবে (ক্রি-বিণ) আহারাদি শেষ করেছেন, এমন সময় দুর্বাসা সশিষ্য এসে হাজির। (ঘ) সভায় সবে (মাত্র অর্থে অব্যয়) একশো লোক হাজির হয়েছে।

(৮) অন্যাদিবাচক (Denoting Others)–অন্য, অপর, অমুক প্রভৃতি কয়েকটিকে অনাদিবাচক সর্বনাম বলে।

কেহ-কেহ “স্বয়ং”, “আপনা-আপনি”, “খোদ” প্রভৃতিকে সর্বনাম বলিয়াছেন। কিন্তু এইসমস্ত শব্দের বিভক্তিযুক্ত অন্য কোনো রূপ আমরা পাই না; সেইজন্য শব্দগুলিকে আমরা অব্যয়পদের অন্তর্ভূত করিবার পক্ষপাতী।

পূর্ববর্তী বিশেষ্যপদের বিরক্তিকর পুনরুল্লেখ পরিহার করিবার জন্যই সর্বনামের ব্যবহার। কিন্তু আমি, আমরা, তুমি, তুই, আপনি, প্রত্যেকে–এই কয়েকটি সর্বনামের উল্লেখ করিতে হইলে পূর্বে কোনো বিশেষ্যের আবশ্যক হয় না।

আবার সে, তিনি, যাহা, ইহা, উহা, তাহা প্রভৃতি সর্বনামের ব্যবহার করিতে হইলে পুর্বে কোনো বিশেষ্যপদ প্রয়োগ করিতেই হয়।

সর্বনামপদ শুধু যে বিশেষ্যপদের পরিবর্তে বসে তাহা নয়, বাক্যাংশ বা একটি সমগ্র বাক্যের পরিবর্তেও প্রযুক্ত হয়। “মহারাজ পরাজিত হয়ে ফিরে। এসেছেন? এ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না।” এখানে এ সর্বনামটি পূর্ববর্তী সমগ্র বাক্যটির পরিবর্তে প্রযুক্ত হইয়াছে।

কয়েকটি সর্বনামের প্রয়োগ দেখঃ “এ দুখবহন করো মোর মন।” “তব চরণনিম্নে উৎসবময়ী শ্যামধরণী সরসা।” “গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে?” “সকলই দিলাম তুলে থরে বিথরে।” “মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।” “ঐটি আমার গ্রাম, আমার স্বর্গপুরী।” “নাবালক ছেলেটির কী করিবে তবে?” যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে। গুরুজনকে যা-তা বলতে নেই। যে যে আসতে চাও, আসতে পার। ঠাকুরের প্রসাদ সব্বাইকে দিয়েছ তো? “এ জগতে মানুষ আপনার ঘর আপনি রচনা করে।” যে-কেউ একজন এলেই চলবে। ছুরিটুরি কিছু আছে কাছে? না হলে পেনসিলটা কাটবে কিসে? “কেন গো মা তোর ধুলায় আসন?” “কে গায় কে গায় গো বৃন্দাবনের পথে পথে।” “যিনি দেহাতীত তিনি দেহেই স্থিত।” “স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটি-মায়ের কোলে।” “দিনেরাত্রে সুখেদুঃখে আলোয়-আঁধারে তুমি সাধো মৃত্যুহীন প্রাণের ঝঙ্কার।” “আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা।” “যার মন ভালো তার সব কাজই শুভান্বিত।” যার-তার কাছে ঘরের কথা বল কেন? “সেই সত্য যা রচিবে তুমি।”

অনুশীলনী

১। সর্বনামপদ কাহাকে বলে? সর্বনামপদ কয় প্রকার? প্রত্যেক প্রকারের নাম বল ও দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

২। পাঠ-সংকলনের অদ্যকার পাঠ হইতে বিভিন্ন প্রকার সর্বনামের উদাহরণ চয়ন কর।

৩। (ক) চারিটি সর্বনামের উল্লেখ কর যেগুলির পুর্বে বিশেষ্যের উল্লেখ করিতে হয় না।

(খ) বাক্যাংশ এবং পূর্ণ বাক্যের পরিবর্তে বসিয়াছে, এমন দুইটি সর্বনামের উল্লেখ কর।

(গ) কেবল কবিতায় যুক্ত হয়-এমন চারিটি সর্বনামের উল্লেখ কর।

৪। (ক) সাপেক্ষ সর্বনাম কাহাকে বলে? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। এরূপ নামকরণের কারণ কী?

(খ) ব্যক্তিবাচক, সাকল্যবাচক, আত্মবাচক, সংযোগবাচক সর্বনাম কাহাকে বলে? প্রত্যেকটির দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

৫। কিসের, উনি, যার-সেই, কেহ, যে, কাহারা, ইনিই, উভয়, যে-সে, যে…সে, যাহারা, মোরা, সকলকে, যা-তা, যাহা….তাহা, মা…তাই, অমুক, অন্য, আর-কেউ, সক্কলে কোন্ শ্রেণীর সর্বনাম উল্লেখ করিয়া প্রত্যেকটিকে নিজস্ব বাক্যে প্রয়োগ কর।

৬। সর্বনামপদগুলি বাছিয়া লইয়া কোন্ শ্রেণীর সর্বনাম বল? “তোরে হেথায় করবে সবাই মানা।” “ভেদি মরুপথ, গিরিপর্বত যারা এসেছিল সবে তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে, কেহ নহে নহে দুর।” “বাহিরপানে তাকায় না যে কেউ!” “অনল পুষিতে চাহি আপনার হিয়া-মাঝে, আপনারে অপরেরে নিয়োজিতে তব কাজে।” “কেহ হাসে, কেই গান গায়।” “কাহারও বড় সুখ, এজন্য আসিতে পারিলেন না।” “ওটির মাতৃদায়, একটু রস দাও,–এটি একখানি পুস্তক লিখিয়াছে, একটু রস দাও,–সেটি পেটের দায়ে একখানি সংবাদপত্র করিয়াছে, উহাকেও একটু রস দাও।” রাজনীতি ছাড়িয়া তিনি যে এখন যোগসাধনায় আত্মনিয়োগ–করিয়াছেন, তাহা অনেকেই জানেন না। গৌরীর কাছে অন্য সব থেকে শাখা আর সিদুরের দাম, ছিল বেশী। “এর বেশী চাইতে কে কবে শেখালে তাকে?” “তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা।” “পৃথিবীর সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে।” “যা সত্য তার। জিওগ্রাফি নাই।” মুখে যাদের চ্যাটাংচ্যাটাং বুলি, কাজে তাদের ক্রটি হয় কেন? “আমরা সকলেই সীতার সন্তান।” “যাহার বিদ্যা প্রকাশ পায় না, সে-ই যথার্থ পণ্ডিত।” “কারে দয়াল কখন কী দেয় কে জানে তা কে জানে।” সুখকে উপভোগ্য কর সবার সাথে ভাগ করে। জীবনের সবকিছু না ছাড়লে কি সুরসঙ্গমে পৌঁছনো যায়? যিনি আঘাত দিয়েছেন, তিনিই প্রলেপ দিচ্ছেন।” অন্যের অনুগ্রহের দানগ্রহণে নিজের ব্যক্তিত্ব ক্ষুণ্ণ হয়ই। “যাঁর মৃত্তিকা ও কাঞ্চনে সমজ্ঞান তিনিই। কৃতকার্য।” “দেহপট সনে নট সকলই হারায়।” “চলতে ওরা চায় না মাটির ছেলে।” “যারে খুশি তারে দাও।” “যার কথা হাজার হাজার মানুষ শোনে, তার মধ্যে ঈশ্বরের বিভূতি কিছু আছেই।” “বসন্তেরে পরাস আকুল-করা আপন গলার বকুলমাল্যগাছা।” “সবাই যারে সব দিতেছে তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।” “আমার অভিমানের বদলে আজ নেবো তোমার মালা।”

৭। বামদিকে সর্বনামের সংজ্ঞার্থানুসারে ডানদিকের যে পক্তির প্রতিটি উদাহরণ নির্ভুল, সেই পঙক্তির শেষে টিকচিহ্ন (v) দাও; এবং যে পঙুক্তির যেটি সংজ্ঞার্থের সঙ্গে মিলিল না, সেগুলির প্রত্যেকটির শ্রেণীনির্দেশ করিয়া পৃথক একটি অনুচ্ছেদে লিখিয়া রাখ।

(ক) ব্যক্তিবাচক–তারা তোমাদের আপনাকে তুই কোনোকিছু এগুলি

(খ) নির্দেশক–এঁকে ঐগুলি উনি এইটা ওঁরা উহারা

(গ) অনির্দেশক–কেউ কিছু যে-কেউ যে-কেহ আর-কেহ অমুক

(ঘ) প্রশ্নবাচক–কী কারা কোষ্টা কাহাকে কিসে কাহারা

(ঙ) সংযোগবাচক–যে যিনি যাঁর যাহাকে যে-সমস্ত যাতা

(চ) সাপেক্ষ–যাহা…তাহা যে..সে যিনি…তিনি যেটি সেটি যার-তার

(ছ) আত্মবাচক–নিজে আপনি আপনারা স্বয়ং

(জ) সাকল্যবাচক–সর্ব উভয় সব্বাই সকল সবে

(ঝ) অনাদিবাচক–অমুক অন্য অপর সকলে

৮। (ক) “কী” পদটিকে প্রশ্নবাচক সর্বনাম, বিশেষণ ও বিশেষণের বিশেষণ-রূপে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।

(খ) “সবে” পদটিকে সর্বনাম, অব্যয় ও ক্রিয়াবিশেষণ-রূপে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *