পঞ্চম পরিচ্ছেদ – বচন
৮০। বচন : যাহার দ্বারা ব্যক্তি, বস্তু, গুণ ইত্যাদির সংখ্যা বুঝায় তাহাকে বচন বলে।
ইংরেজীর মতো বাংলায় বচন দুটি—একবচন ও বহুবচন। সংস্কৃতের দ্বিবচন বাংলায় নাই।
৮১। একবচন : একটি বস্তু বা একজনকে বুঝাইলে একবচন হয়। মেয়েটি কাঁদিতেছে। বইখানা খাসা লিখেছ। চোরটাকে আচ্ছা ধোলাই দিল।
৮২। বহুবচন : একটির বেশী বস্তু বা ব্যক্তিকে বুঝাইলে বহুবচন হয়। মেয়েদের ডাকো। বইগুলো তুলতে পার না? “আমার সুরগুলি পায় চরণ, আমি পাই নে তোমারে।”
বচন-সম্বন্ধে আলোচনার পূর্বে পদাশ্রিত নির্দেশক-সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন।
৮৩। পদাশ্রিত নির্দেশক : যে কয়েকটি শব্দ বা শব্দাংশ বিশেষ্যের উত্তর বা বিশেষ্যের পূর্বে ব্যবহৃত সংখ্যাবাচক বা পরিমাণবাচক বিশেষণের উত্তর প্রযুক্ত হইয়া সেই বিশেষ্য বা বিশেষণ শব্দগুলির আকার প্রকার সংখ্যা পরিমাণ ইত্যাদি বিশেষভাবে নির্দেশ করে, তাহাদিগকে পদাশ্রিত নির্দেশক বলা হয়। টি, টা, টু, টুক, টুকু, টুকুন, টুকুনি, খান, খানা, খানি, গাছ, গাছা, গাছি, গুলি, গুলা, গুলো ইত্যাদি বাংলা নির্দেশক। এই নির্দেশকগুলি প্রত্যয়ের মতোই শব্দের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশিয়া যায়। এই নির্দেশকগুলি বাংলা ভাষার বিশেষ সম্পদ। সংস্কৃত, ইংরেজী বা হিন্দীতে অনুরূপ প্রয়োগ একেবারে অনুপস্থিত।
অপ্রাণিবাচক ও প্রাণিবাচক দুইপ্রকার শব্দেই টি, টা যুক্ত হয়। টি আদর ও ক্ষুদ্রার্থে, টা অনাদর ও ব্যাপকার্থে ব্যবহৃত হয়। আমাদের ছেলেটি খায় যেন এতটি, ওদের ছেলেটা খায় যেন এতটা। “তরুশাখা হতে লতাগুলি বাড়ায়ে পেলব বাহু শুধাইত পথটি আগুলি পুষ্পিত কুশলবাণী।” “প্রতিটি কুটির ছিল মোর পরিচিত।” “মিঠার লোভে তিত মুখে সারাদিনটা গেল।”
বিশেষণ শব্দে টি টা যুক্ত হইলে বিশেষণটি বিশ্লেষ্য হইয়া যায়। আমরা কেবল ভালোটি চাই, মন্দটা এড়িয়ে যেতে চাই। এতটা না হলেও চলত। সামনের বইটায় হাত দিও না, পাশেরটা সাবধানে তুলে নাও। বই দুটো গেল কোথায়? বাতাবি তিনটে কেটে ফেল। চারটে বেজে গেল যে!—শৈষ তিনটি-উদাহরণে টা “টো” বা “টে” হইয়াছে; “টি”-এর এরূপ ধ্বনিপরিবর্তন হয় না।
সম্বন্ধপদের পরবর্তী বিশেষ্যপদটি যখন লুপ্ত হয় তখন সম্বন্ধপদটিতেই টি টা প্রভৃতি নির্দেশক যুক্ত হয়। তোমাদের ছেলেরা তো সবাই রয়েছে দেখছি, আমাদেরটা গেল কোথা?
আজকাল সমাপিকা ক্রিয়াতেও টা যোগ হইতেছে। এতসব করে হবেটা কী? এখানে ফালতু বসে না থেকে যাবটা কোথায়?
টুক টুকু টুকুন টুকুনি—নির্দিষ্ট আকার নাই এমন ক্ষুদ্র বা অল্পপরিমাণ জিনিস বুঝাইতে এই নির্দেশকগুলি প্রযুক্ত হয়। লক্ষ্মী সোনা, দুধটুকু খেয়ে নাও। “বাঁধনটুকু কেটে দেবার তরে।” মরণোন্মুখ রোগীর প্রতি কি আপনাদের এতটুকুন মায়াও জাগে না? এইটুকুনি ছেলে বটে বুকের পাটা কত!
খান খানা সাধারণতঃ ভারী ও চওড়া জিনিস বুঝাইতে বা অবজ্ঞার্থে, আর খানি ক্ষুদ্র জিনিস বুঝাইতে বা আদরার্থে ব্যবহৃত হয়। “তিনখানা দিলে একখানা রাখে।” “আমার এই দেহখানি তুলে ধরো তোমার ওই দেবালয়ের প্রদীপ করো।” “খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়।” মুখখানি ভার করে সে চলে গেল। “চলেছে পথখানি কোথায় নাহি জানি।” “চুমাটি খাইতে মু’খানি গেল যে নড়ে।”
গাছ গাছা লম্বা সরু জিনিস বুঝাইতে আর গাছি আদরার্থে ব্যবহৃত হয়। আখগাছা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দাও। “সপ্তদশ বসন্তের একগাছি মালা।” “চিনিল না মোরে, নিয়ে গেল ধরে কাঁধে তুলি লাঠিগাছ।”
নির্দেশকযুক্ত সংখ্যাবাচক বিশেষণ যখন বিশেষ্যের পূর্বে বসে তখন তাহাতে বিশেষ্যের সংখ্যা নির্দেশ করে বটে, কিন্তু বিশেষ্যটিকে নির্দেশ করে না। কিন্তু ওই বিশেষণটি যখন বিশেষ্যের পরে বসে, তখন সংখ্যাও বুঝায় আবার পূর্বনির্দিষ্টতাও বুঝায়। তিনখানা থালা আন (যেকোনো তিনখানা, কম নয়, বেশীও নয়)। থালা তিনখানা ধুয়ে আন (পূর্বনির্দিষ্ট তিনখানা থালা)। দুটো ছেলে সঙ্গে নিলেই চলবে (অনির্দিষ্ট)। ছেলেদুটো গেল কোথা (পূর্বনির্দিষ্ট দুইটি ছেলে)?
নির্দেশক প্রত্যয়ের মতো অনির্দেশক প্রত্যয়ও রহিয়াছে। “এক” হইল সেই একমাত্র অনির্দেশক প্রত্যয়। সাধারণতঃ সংখ্যাবাচক বা পরিমাণবাচক শব্দের উত্তর ইহা যুক্ত হয়। গরম গরম লুচি খানআষ্টেক (আষ্টেক = ঠিক আটখানা নয়, কিছু কমবেশী) আনতে বলুন। জনাদুয়েক মজুর হলেই চলবে। পোয়াটাক দুধের ছানা কাটাও। ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করিস। আমায় দিনপাঁচেকের ছুটি দিন।
এইবার বচনভেদে রূপভেদের আলোচনা। বাংলায় বচনভেদে বিশেষ্য ও সর্বনামের রূপভেদ হয়, বিশেষণ ও ক্রিয়াপদের সাধারণতঃ হয় না। অব্যয়ের রূপভেদের তো প্রশ্নই উঠে না। তবে বিশেষণপদ যখন বিশেষ্যপদের মতো ব্যবহৃত হয় তখন উহার বচন হয়।
বয়োজ্যেষ্ঠকে (একবচন) সম্মান দেখাবে। ছোটোদের (বহুবচন) জায়গা সামনে, বড়োদের (বচন) পিছনে। “কচিকাঁচাগুলি (বহুবচন) ডাঁটো করে তুলি।
এত ছেলে ফেল করেছে? কত টাকা তুমি চাও? অনেক লোক একসঙ্গে দেখলে বক্তার উদ্দীপনা হয়। তত দিন অপেক্ষা করা চলবে না।—এখানে আয়তাকার বিশেষণপদগুলি স্বভাবতঃই বহুবচন প্রকাশ করিতেছে।
আবার, ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে অনেকগুলো টাকা জলে দিয়েছি। সবগুলো মাছই কুটে ফেলেছ?—এখানে বহুবচনাত্মক বিশেষণপদে পদাশ্রিত নির্দেশক ‘গুলো’ যুক্ত হইয়াছে।
সমাপিকা ক্রিয়া একবচনেও যেমন বহুবচনেও তেমন। কামনার জালে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছি (একবচন)। “আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ” (বহুবচন) কিন্তু অসমাপিকা ক্রিয়া? পৌনঃপুন্য বুঝাইতে অসমাপিকা ক্রিয়ার দ্বিত্ব হয়।—সোনামণি কাঁদিয়া কাঁদিয়া ঘুমাইয়া পড়িল। মরিতে মরিতে বাঁচিয়া গিয়াছি। তাকে বলে বলে যে হয়রান হয়ে গেলে!
একবচন
বাংলায় একবচনের জন্য বিশেষ কোনো প্রত্যয় বা বিভক্তি নাই; মূল শব্দের রূপটিতেই একবচন বুঝায়। শব্দটিকে অবিকৃত রাখিয়া, শব্দটির পূর্বে এক, একটি, একটা, একখানি, একখানা ইত্যাদি বিশেষণ বসাইয়া, অথবা শব্দটির সঙ্গে একবচনের শব্দবিভক্তি বা টি, টা, খানি, খানা, গাছি, গাছা প্রভৃতি নির্দেশক বসাইয়া একবচন বুঝানো হয়। টি, খানি, গাছি আদরার্থে, আর টা, খানা, গাছা অনাদরে যুক্ত হয়।
মৌমাছি সারাদিন পরিশ্রম করে। “এক পয়সায় কিনেছে সে তালপাতার এক বাঁশি।” হারছড়াটির গড়ন বড়ো চমৎকার। মেয়েটি বেশ লজ্জাশীলা। “সারাদিন একখানি জলভরা কালো মেঘ রহিয়াছে ঢাকিয়া আকাশ।” “ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি, পরখ করে সবে, করে না স্নেহ।” “বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।” “একজাতি একপ্রাণ একতা।” “ধবলীরে আনো গোহালে।” “এখনি আঁধার হবে বেলাটুকু পোহালে।” “বসন্তেরে পরাস আকুলকরা আপন গলার বকুলমাল্যগাছা।”
বহুবচন
শব্দকে বহুবচনের রূপ দিবার জন্য কয়েকটি উপায় অবলম্বন করা হয়।—(১) প্রাণিবাচক শব্দে রা এরা দিগ প্রভৃতি বহুবচনের বিভক্তিচিহ্ন যোগ করিয়া : “ভেদি মরুপথ গিরিপর্বত যারা এসেছিল সবে তারা মোর মাঝে সবাই বিরাজে।” ভালো কথা, তোমরা আসছ কখন? ছেলেমেয়েদের খাওয়া হয়েছে? “বন্দীরা ধরে সন্ধ্যার তান।” “মেঘেরা দল বেঁধে যায় কোন্ দেশে?” [ অপ্রাণিবাচক ‘মেঘ’-এ প্রাণসত্তা আরোপিত হইয়াছে। ]
(২) বিশেষ্য বা সর্বনামের পূর্বে বহু বিস্তর অজস্র অসংখ্য কত যত এত প্রভৃতি বহুবচনাত্মক বিশেষণ, দুই তিন পাঁচ প্রভৃতি সংখ্যাবাচক বিশেষণ, সব সকল অনেক প্রভৃতি সর্বনামীয় বিশেষণ বসাইয়া : এ বৎসর অজস্র আম ফলেছে। “এত কথা আছে, এত গান আছে, এত প্রাণ আছে মোর!” এমন কত আমি সেই পরম ‘আমি’-তে বিলীন হয়ে গেছে। তিন দিনে পাঁচশ টাকা খরচ! “কর্মধারা ধায় অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়।” “আজ আসিয়াছে অনেক যন্ত্রী শুনাতে গান অনেক যন্ত্র আনি।” “এবার সকল অঙ্গ ছেয়ে পরাও রণসজ্জা।” “সব বেটাকেই চিনি।” “দূরে দূরে গ্রাম দশবারোখানি, মাঝে একখানি হাট।” “শারদ নিশির স্বচ্ছ তিমিরে তারা অগণ্য জ্বলে।” “ক’বিঘা চোতেলি করেছিস এই সন?” “মার খেয়েছে বিস্তর, জাম খেয়েছে আরো অনেক বেশি।”
(৩) প্রাণিবাচক ও অপ্রাণিবাচক শব্দে “গুলি” “গুলা” “গুলো”—এই বহুবচনাত্মক নির্দেশকযোগে : “নন্দী স্বয়ং আসিয়া কামানের গোলাগুলি লুফিয়া লইয়া গিয়াছে। কৈলাসে গণপতি ও কার্তিকেয় ভাঁটা খেলিবেন।” “নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন বেঁধেছে।” ফেলে-আসা দিনগুলি মোর সোনার হরিণ, দেয় না ধরা কভু। বাছুরগুলোর দিকে একটু নজর রেখো। তোমাকে কাল যে কয়েক-শ টাকা দিলাম, সেগুলো রেখেছ কোথা?—লক্ষ্য কর, বহুবচনাত্মক নির্দেশকগুলি সংশ্লিষ্ট পদের পূর্বে বসে না। প্রয়োজন হইলে ইহাদের উত্তরও আবার শব্দবিভক্তি যুক্ত হয়। বইগুলোর কী অবস্থা করেছ! (সম্বন্ধপদের র বিভক্তি যুক্ত হইয়াছে
(৪) প্রাণিবাচক ও তৎসম শব্দে গণ, কুল, জন, দল, বর্গ, বৃন্দ, মণ্ডলী প্রভৃতি যোগ করিয়া : সরকারী সিদ্ধান্তে মহিলামহল উৎফুল্ল। “কোকিলগণ আম্রমুকুলের রসাস্বাদে বিমুখ হইয়া নীরব হইয়া আছে।” “বাষ্পাকুল শিষ্যবৃন্দ।” শ্রোতৃবর্গ তখন আনন্দে করতালি দিয়া উঠিলেন। শিক্ষকমণ্ডলী প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। ছাত্রদলের সম্মুখে কঠোর কর্তব্য। “বৈতালিকদল সুপ্তিতে শয়ান।
(৫) অপ্রাণিবাচক তৎসম শব্দে রাশি, সমূহ, মণ্ডল, পুঞ্জ, মালা, গুচ্ছ, শ্রেণী, রাজি (রাজী), আবলী (আবলি), চয়, জাল, নিকর, কলাপ, দাম, সমুদয়, কুল, ব্রজ, গ্রাম প্রভৃতি যোগ করিয়া : “তরুশ্রেণী চাহে পাখা মেলি চকিতে হইতে দিশাহারা।” শব্দগুচ্ছ তুচ্ছ হয়ে আসে। “পুষ্পরাশি পড়িয়াছে খসি।” তারকার দীপাবলী নীরব আকাশে জ্বলে। “শরজালে আচ্ছন্ন গগন।” “কুঞ্জ দেয় ফুলপুঞ্জে পাদপদ্মে পরান অঞ্জলি।” (অতৎসম ‘ফুল’-এ পুঞ্জ যুক্ত হইয়াছে।) “পড়িয়াছে বীরবাহু …….. চাপি রিপুচয় বলী।” তদ্রূপ পত্রসমূহ, বিপণীকুল, গ্রন্থসমুদয়, গুণগ্রাম, তরঙ্গনিকর, ক্রিয়াকলাপ, গগনমণ্ডল, তারাদল, দ্বীপপুঞ্জ, বিদ্যুদ্দাম, গিরিব্রজ, কেশদাম।
(৬) সমার্থক বা প্রায়-সমার্থক শব্দযোগে : ছেলেপিলেকে মানুষ করতে হবে তো। জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছ মিতা? মাঝে মাঝে চিঠিপত্র দিস বাবা, নইলে ভাবনাচিন্তার আর শেষ থাকে না।
(৭) একই পদ পাশাপাশি দুইবার বসাইয়া :
(ক) বিশেষ্যের দ্বিত্ব-প্রয়োগে—“বৃক্ষে বৃক্ষে ফল ধরে না, ফুলে ফুলে গন্ধ নাই, মেঘে মেঘে বৃষ্টি নাই, বনে বনে চন্দন নাই, গজে গজে মৌক্তিক নাই।”—বঙ্কিমচন্দ্র। “মাঠে মাঠে ধান ধরে নাকো আর।” “গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে।” “আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো।”
(খ) বিশেষণপদের দ্বিত্ব-প্রয়োগে বিশেষ্যের বহুবচন হয়। “শিলা রাশি রাশি পড়িছে খসে।” [ বিশেষণের দ্বিত্ব-প্রয়োগে ‘শিলা’র বহুবচন ] এমন কচি কচি আম! ওরে নুন-লঙ্কা আন্। [ অনেক আম—সবই কচি ] বাছা বাছা খেলোয়াড় এনেছে রে মাড়োয়ার। [ একাধিক খেলোয়াড়—সবই বাছাইকরা] এক-একদিন মনটা বেজায় কুঁড়ে বনে যায়। “যাঁহারা বড় বড় সাধু চোরের নামে শিহরিয়া উঠেন, তাঁহারা অনেকে চোর অপেক্ষাও অধার্মিক।”—বঙ্কিমচন্দ্ৰ।
(গ) সর্বনামের দ্বিত্ব-প্রয়োগে—শনিবার যে যে অনুপস্থিত ছিলে, দাঁড়াও। আমার সঙ্গে কে কে যেতে চাও? কেউ কেউ একথা বলেন। কেহ কেহ এখনো গ্রাম্য জীবনই পছন্দ করেন
(ঘ) ক্রিয়া-বিশেষণের দ্বিত্ব-প্রয়োগে—”আসে দলে দলে তব দ্বারতলে দিশি দিশি হতে তরণী।” [ তরণী নিঃসন্দেহে একাধিক ]
(ঙ) অসমাপিকা ক্রিয়ার দ্বিত্ব-প্রয়োগে—ছবি দেখিয়া দেখিয়া সময়টা কোথা দিয়া কাটিয়া গেল। [ অনেক ছবি ] রত্নাকর বলল, “মানুষ মেরে মেরে বুকখানা আমার পাষাণ হয়ে গেছে।” [ মানুষ = একাধিক মানুষ ]
॥ একবচনের দ্বারা বহুবচনের প্রকাশ ॥
চেহারায় একবচনের লক্ষণ, কিন্তু অর্থে বহুবচন প্রকাশ পায়, এরূপ প্রয়োগ আমরা প্রায়ই করিয়া থাকি। স্বর্গের নন্দনে কি কেবল দেবতারই অধিকার, মানুষের নয়? বাঙালী আজ কাঙালী বনতে চলেছে। বাসরঘরে সারারাত গান চলল (একটা গান নয় নিশ্চয়ই)। চাকরি না পেয়ে ছেলে (একাধিক ছেলে)) পড়াচ্ছি। “নেমেছে ধুলার তলে হীন পতিতের ভগবান্।” (পতিতের পতিতদিগের) “ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি!” (ফুল = অনেক ফুল) “তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি পাখির ডাকে জেগে।” (পাখি নিশ্চয়ই একটা নয়—একাধিক) পিউ তোমার কী কথাই না বলতে শিখেছে, ন’দি।
॥ বহুবচনের দ্বারা একবচনের প্রকাশ ॥
সাধারণতঃ সমালোচক, পত্রিকা-সম্পাদক, সভাপতি বা প্রতিনিধি-স্থানীয় ব্যক্তি ‘আমি’ প্রয়োগ না করিয়া গৌরবে বা বিনয়প্রকাশের জন্য ‘আমরা’ বলিয়া থাকেন।
(ক) “এবিষয়ে আমরা বহুবার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছি।” (পত্রিকা সম্পাদকের উক্তি~~গৌরবে বহুবচন) (খ) আমাদের কুঁড়েতে পায়ের ধুলো দিন না একদিন। (বিনয়প্রকাশ)
॥ বহুবচন নিষেধ ॥
(ক) সাধারণতঃ সংজ্ঞাবাচক, বস্তুবাচক, গুণবাচক ও ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের বহুবচন হয় না। চিনিরা, দিল্লিগুলি, ব্রহ্মপুত্রদের, করুণাগণ, গমনসমূহ—এইপ্রকার প্রয়োগ বাংলায় চলে না। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ইহাদেরও বহুবচন হয়। (১) পাশের গ্রামের ঘোষেরা (ঘোষ উপাধিধারী ব্যক্তিগণ) বেশ সঙ্গতিপন্ন। (২) দেশের বুকে কখনই বিভীষণদের (বিভীষণের মতো দেশদ্রোহীদের) ঠাঁই হওয়া উচিত নয়। (৩) সকলেই এসেছেন, শুধু টগাইবাবুরা (টগাইবাবু ও তাঁহার বাড়ির লোকজন অথবা তাঁহার সঙ্গীরা) এখনও আসেননি। (৪) চালগুলো (বিভিন্ন প্রকারের চাউল) পর পর সাজিয়ে রাখ। (৫) ফেরার পথে গাঙ্গুরাম থেকে তিনটে দই আনবে। (৬) মনের ভাবগুলোকে (বিচিত্র ভাব) রসরূপ দেওয়াতেই শিল্পীর আনন্দ। (৭) “চিরকালের রাধারা সেই অভিসারের পথেই চলে।”—আশাপূর্ণা দেবী।
(খ) বহুবচনের আর বহুবচন হয় না–সংস্কৃত ও ইংরেজীতে বহুবচনাত্মক বিশেষণের পর বিশেষ্যটিরও বহুবচন করিতে হয়; বাংলায় কিন্তু বহুবচনাত্মক বিশেষণের পর বিশেষ্যটিকে একবচনে রাখাই শিষ্টরীতি। (i) সকল বালকগণকে ডাক-বাক্যটি ভুল। বলিতে হইবে–(১) সকল বালককে ডাক বা (২) বালকগণকে ডাক। (ii) সমস্ত চিঠিগুলো ডাকে দিয়েছ তো?-অশুদ্ধ। বলিতে হইবে–সমস্ত চিঠিই ডাকে দিয়েছ তো? (iii) “বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষসকল” না বলিয়া বলা উচিত—(১) বৃহৎ বৃক্ষসকল, অথবা (২) বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষ। (iv) যত সব উজবুকের দল পৃথিবীটাকে জাহান্নামে পাঠাচ্ছে। (v) অধিবর্ষে ফেব্রুআরি মাস উনত্রিশ দিনে (দিনগুলিতে নয়) হয়। (vi) “খণ্ড খণ্ড এমনি কতই চিত্র নিয়ে বনপথ মনে মোর জাগিছে স্বতই।”
Apposition হিসাবে সকলে, সবাই ইত্যাদি সর্বনামপদ বহুবচনাত্মক বিশেষ্যের পরে বসিতে পারে, কদাপি পূর্বে নয়। ইচ্ছা করলে তোমরা সবাই আমার সঙ্গে আসতে পার। “যাত্রীরা সকলেই নৌকার বাহিরে আসিয়া দেখিতে লাগিলেন।” ছেলেরা সব গেল কোথা? [ লক্ষ্য রাখ—সবাই তোমরা নয়, সকল যাত্রীরা নয়, সব ছেলেরা নয়। এখানে সবাই সকলে সব—সর্বনামপদ, কদাপি সমষ্টিবাচক বিশেষণ নয়। ]
অনুশীলনী
১। বচন কথাটির অর্থ কী? বাংলা ভাষায় কয়টি বচন আছে? প্রত্যেকটির দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।
২। বাংলায় কোন্ কোন্ পদের বচন হয়? ক্রিয়াপদের বচন হয় কি?
৩। পদাশ্রিত নির্দেশক কাহাকে বলে? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। টি, টা, খানি, খানা—অর্থগত পার্থক্য উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।
৪। বাংলায় একবচন কী করিয়া প্রকাশ করা হয়? একবচনকে বহুবচনে রূপায়িত করার নিয়মগুলি বল। কোথায় কোথায় বহুবচন হয় না? প্রত্যেকটির উদাহরণ দাও।
৫। উদাহরণ দাও : বিশেষ্যপদের দ্বিরুক্তির দ্বারা বহুবচন-গঠন, বিশেষণের দ্বিত্বের দ্বারা বিশেষ্যের বহুবচননির্দেশ, অসমাপিকা ক্রিয়ার দ্বিত্ব-প্রয়োগে বিশেষ্যের বহুবচন, সর্বনামের দ্বিত্ব-প্রয়োগে বহুবচন, রূপে বহুবচন অর্থে একবচন, রূপে একবচন অর্থে বহুবচন, সম্বন্ধপদে নির্দেশকযোগ।
৬। আয়ত পদগুলিতে একবচন বা বহুবচনের প্রয়োগবৈশিষ্ট্য দেখাও : “গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে।” এমন মরণ মরতে পারে কয়জনা? ভালোগুলো খেয়ে নাও, খারাপগুলো ফেলে দাও। “সম্মুখে চরণ নাহি চলে।” “তেমন সৌন্দর্য কিছু দেখি নাই শিশুর হাসিটি যেমন মিষ্ট।” রক্তে-কেনা স্বাধীনতা দেব নাকো হতে বৃথা। মাঝে মাঝে চিঠিপত্র দিস, বাবা। মানুষের চোখের জল কখনও কখনও ফুল হয়ে ফুটে ওঠে, দেখেছ?
৭। শুদ্ধ, না অশুদ্ধ বল, অশুদ্ধ হইলে শুদ্ধ কর : সকল বালকেরা; ছেলেগণ; ফুলসমূহ; গাছশ্রেণী; গুণরাজি; পত্রাবলী; পাকা পাকা ফলগুলি; সকল ছাত্রগণের; মা-গণ; শিক্ষকরাশি; ছাত্রগণেরা; হাসিটুকু; চিন্তারাশি; ভাবনাবৃন্দ; জলগুলো; সবটা দুধ; গজেনদের; অনুভূতিগুলো; মায়ারা; রানী-বউদিদের; আলোকমালা; পাকা চুলগুলো; পচা পচা আঙুরগুলো; প্রত্যেক বাড়ি গিয়ে খোঁজ করেছি; প্রতি ছত্রে ছত্রে তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত ঋজুভঙ্গির প্রকাশ; প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা রুটি পাচ্ছে না। তালপাতার কুঁড়েগুলি সমস্তই পুড়ে শেষ।
৮। পার্থক্য দেখাও : পাঁচটি ছেলে, ছেলে পাঁচটি; আটখানা লুচি, খানআষ্টেক লুচি; দুটো দই, গোটাদুই দই; একদিন, এক-এক দিন; ঝুড়িখানেক আম, একঝুড়ি আম।
৯। অধিবাসী, মনীষি, গুণি, সঙ্গী, কর্মি, প্রতিদ্বন্দ্বী, সহযোগি, সহচরী, ভ্রাতৃ, মনীষিণী, মনীষী—প্রদত্ত শব্দগুলোর কোনোরকম পরিবর্তন না ঘটাইয়া প্রত্যেকটিতে সরাসরি (i) গণ, বৃন্দ, (ii) রা, দের, কে প্রভৃতির যতগুলি বসে, যথাযথ বসাও।