দশম পরিচ্ছেদ – অব্যয়ের শ্রেণীবিভাগ
অব্যয়পদ কাহাকে বলে তাহা ১৬৪ পৃষ্ঠায় ৭৪ নং সূত্রে পড়িয়াছ। যখন বিশেষ্য, বিশেষণ, সর্বনাম, ক্রিয়া বাক্যের বাহিরে থাকে তখন ইহারা শব্দ বা ধাতু। বাক্যে প্রযুক্ত হইলে ইহারা পদ-রূপে গণ্য হয়। শব্দ বা ধাতু-অবস্থায় ইহাদের যে রূপ দেখা যায়, পদ-অবস্থায় সে রূপের পরিবর্তন হয়। লিঙ্গ বচন পুরুষ বিভক্তি ইত্যাদি এক বা একাধিক ভেদে রূপান্তর ঘটে বলিয়া ইহারা সব্যয়পদ।
কিন্তু অব্যয়পদ বাক্যের বাহিরে শব্দ-হিসাবে যে রূপে থাকে, বাক্যের মধ্যে পদ হিসাবেও ঠিক সেই রূপেই থাকে। লিঙ্গ-বচন-পুরুষ-বিভক্তি-ভেদে অব্যয়ের সাধারণতঃ কোনো রূপান্তর ঘটে না। ব্যয় বা রূপান্তর নাই বলিয়াই ইহারা অব্যয়।
বহু সংস্কৃত অব্যয় বাংলা ভাষায় চলিতেছে—অদ্য, অকস্মাৎ, অথবা, অর্থাৎ, অন্যথা, অবশ্য, অতএব, অতঃপর, অচিরাৎ, অতীব, অত্র, অধুনা, অন্যত্র, অপি, অপিচ, অয়ি (কবিতায়—মাধুর্যপূর্ণ সম্বোধনে), অরে, অহো, আঃ, আদৌ, আশু, ইতস্ততঃ, ইতি, ইদানীং, ঈষৎ, উচ্চৈঃ, উপরি, একত্র, একদা, কথঞ্চিৎ, কদাচ, কদাচিৎ, কদাপি, কল্য, কিংবা, কিঞ্চিৎ, কিন্তু, কুত্র, কেবল, ক্বচিৎ, ঝটিতি, তন্ত্র, তথা, তথাপি, তথৈব, তদানীং, ধিক্, নতুবা, নমঃ, নিতান্ত, পশ্চাৎ, পরশ্ব, পরন্তু, পুনশ্চ, পুনঃ, পৃথক্, প্রতি, প্রত্যহ, প্রত্যুত, প্রভৃতি, প্রাক্, প্রাতঃ, প্রায়, বরং, বা, বিনা, বৃথা, যত্র, যথা, যদি, যদ্যপি, যাবৎ, যুগপৎ, রে, সঙ্গে (গদ্য-পদ্য-সৰ্বত্ৰ), সদা, সদ্যঃ, সম্প্রতি, সম্যক্, সর্বত্র, সর্বদা, সহসা, সাক্ষাৎ, সাথে (কেবল কবিতায়), সুতরাং, সুষ্ঠু, স্বয়ং, হা, হস্ত, হে। ইহা ছাড়া ‘এবং’ শব্দটি সংস্কৃতে ‘এইরূপ’ অর্থ প্রকাশ করিলেও বাংলায় কতকটা ‘ও’ অর্থে ব্যবহৃত হয় বলিয়া অব্যয়রূপে গণ্য হইতেছে।
খাঁটী বাংলা অব্যয়ের সংখ্যা প্রচুর—না, অথচ, কাজেই, যেমন, তেমন, ওরে, ওলো, আবার, তবু, তাই, পাছে, ছি ছি, ছ্যা ছ্যা, হায় হায়, মরি মরি, বাপ রে, ইশ্, তবেই, কি, কেন, নাকি, তো, সেইরূপ, মতো, মতন, নাই, বুঝি, ভালো, মোটকথা, মানে, চমৎকার, আ মরে যাই, ও হরি, শাবাশ, আহা রে ইত্যাদি।
বাংলা অব্যয়ের প্রধান কাজ পদের সহিত পদের বা বাক্যের সহিত বাক্যের সংযোগ স্থাপন করা।
বাংলায় ব্যবহৃত অব্যয়গুলি নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়—(১) পদান্বয়ী, (২) সমুচ্চয়ী, (৩) অনন্বয়ী ও (৪) ধ্বন্যাত্মক।
পদান্বয়ী অব্যয়
১৩৫। পদান্বয়ী অব্যয় : যে অব্যয় বাক্যমধ্যস্থ এক পদের সহিত অন্য পদের অন্বয় বা সম্বন্ধ দেখাইয়া দেয়, তাহাকে পদান্বয়ী অব্যয় বলে।
এই শ্রেণীর অব্যয়ের পূর্বস্থিত পদে প্রায়ই বিভক্তিচিহ্নের প্রয়োগ হয়। এই অব্যয়ের কতকগুলি (ক) অবস্থানবাচক—সঙ্গে, সহিত, পশ্চাতে, পিছে, পিছনে, সম্মুখে, সমুখে, সামনে, আগে, ভিতর, ভিতরে, পাশে, নীচে, উপরে, মাঝে, বাহিরে, বাইরে, বামে, দক্ষিণে; কতকগুলি (খ) উপমাবাচক—মতো, মতন, ন্যায়, সম, পারা, হেন, তুল্য, যেন, প্রায়; কতকগুলি (গ) সীমাবাচক—পর্যন্ত, অবধি, তক, থেকে, পেরিয়ে, ছাড়িয়ে; কতকগুলি (ঘ) ব্যতিরেকাত্মক—বিনা, বিনে, বিহনে, বিনি, ব্যতীত, বই, ছাড়া, ভিন্ন, ব্যতিরেকে, বাদে। ইহা ছাড়া কতকগুলি (ঙ) অনুসর্গরূপে ব্যবহৃত হয়—দরুন, নিমিত্ত, তরে, জন্যে, বাবদ, উদ্দেশে, উদ্দেশ্যে, প্রতি, অভিমুখে, ছলে, মারফত, কারণে। কয়েকটি উদাহরণ দেখ—”হেথায় হোথায় পাগলের প্রায় ঘুরিয়া ঘুরিয়া মাতিয়া বেড়ায়।” “মুখপানে নির্নিমেষে রহিল চাহিয়া।” “কানু হেন গুণনিধি কারে দিয়ে যাব?” প্রাণপণ যত্ন ব্যতিরেকে বিদ্যালাভ সম্ভব নয়। সেই থেকে দু-ভায়ের মুখ দেখাদেখি বন্ধ। নাম বিলায়ে প্রেমের গোরা নিতাই সাথে নেচে যায়। “সেই আলোটি মায়ের প্রাণের ভয়ের মতো দোলে।” “আমি জগৎ প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া আকুল পাগল-পারা।” আহা মুখ নয়, যেন চাঁদ! স্বাধীনতা সহনশীলতার সঙ্গেই উপভোগ করতে হয়। “বুদ্ধের করুণ আঁখি দুটি সন্ধ্যাতারাসম রহে ফুটি।” “চুলপারা ছিদ্র দিয়ে করিল প্রবেশ।” “আছে তোর যাহা ভালো ফুলের মতো দে সবারে।” জ্ঞানের জিনিস দান করলে বাড়ে বই কমে না।
সমুচ্চয়ী অব্যয়
১৩৬। সমুচ্চয়ী অব্যয় : যে অব্যয় একাধিক পদের বা বাক্যের সংযোগ বিয়োগ সংকোচন প্রভৃতি সাধন করে, তাহাকে সমুচ্চয়ী অব্যয় বলে। সমুচ্চয়ী অব্যয়কে আবার কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়।—
(ক) সংযোজক (দুই বা তাহার বেশী বাক্য বা পদকে সংযুক্ত করে) : লিলি শ্যামলী আর শেফালীকে ডাক তো নেত্যকালী। “রচনার প্রধান গুণ এবং প্রথম প্রয়োজন—সরলতা ও স্পষ্টতা।” পলাশীর যুদ্ধ বাংলা তথা ভারত-ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কামনা ত্যাগ করলে ধনী হয়, আর লোভ ত্যাগ করলেই সুখী হয়। “মৃত্তিকা ও কাঞ্চনে যাঁর সমজ্ঞান তিনিই কৃতকার্য।” সেইরূপ মায়, বনাম, ওরফে ইত্যাদি সংযোজক সমুচ্চয়ী অব্যয়।
(খ) বিয়োজক বা বৈকল্পিক (দুই বা তাহার বেশী পদ বা বাক্যকে পৃথক্ করে অর্থাৎ দুই বা ততোধিক বিষয়ের মধ্যে একটির নির্বাচন) : তুমি আগে আমার এখানে আসবে, না আমি তোমার ওখানে যাব? “এই জীবনটা ভালো কিংবা মন্দ কিংবা যা-হোক একটা-কিছু।” “সধবা অথবা বিধবা তোমার রহিবে উচ্চশির।” তুমি নিজে যাও, না হয় ভাইকে পাঠাও। কী ধনী কী নিৰ্ধন সকলেই দেশবন্ধুর মৃত্যুতে শোকবিহ্বল। গজেন বা নিতাই একজনকে ডাকবি।
(গ) ব্যতিরেকাত্মক (অভাব বা ভেদ অর্থটি প্রকাশ করে) : “পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, নহিলে (তাহার অভাবে) খরচ বাড়ে।” সত্য বল, নতুবা (না বলিলে) শাস্তি পাইবে। মন দিয়া লেখাপড়া কর, নচেৎ (তাহার অভাবে) জীবনে উন্নতি করিতে পারিবে না। আমার ভাগ্যই যদি না মন্দ হবে, পরীক্ষার আগে বাবাই বা মারা যাবেন কেন?
(ঘ) সঙ্কোচক (স্বাভাবিক বা আশঙ্কিত ফল না বুঝাইয়া তাহার বিপরীত ফলটি বুঝায়) : জগৎ সব বুঝল, কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারল না। তোমাকে তো অনেকবারই সাবধান করে দিয়েছি, অথচ সেই একই ভুল বারবার করছ! যত শাস্তি দেবার দিন, তবু বন্দেমাতরম্ ভুলব না। তুমি বরঞ্চ একবার বিজয়বাবুকে ধর। “কেহ কহিয়া দিতেছেন না, তথাপি তপোবন বলিয়া বোধ হইতেছে।” এ অন্যায়ের প্রতিকার হবে না জানি, তবু অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে ছাড়ব কেন? আমার কাছে এলে তোমার লাভ তো হবেই না, উপরন্তু ক্ষতিরই সম্ভাবনা প্রচুর। সেইরূপ বরং, পরন্তু, প্রত্যুত, তত্রাচ, পক্ষান্তরে, আবার ইত্যাদি এই শ্রেণীর ‘অব্যয়।
(ঙ) হেতুবোধক (হেতু বুঝাইয়া দুইটি বাক্যকে সংযুক্ত করে) : তাঁর কন্যাটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বলে তিনি সভায় উপস্থিত হতে পারেন নি। “বাড়ী আমাকে যেতেই হবে, কেননা এ আমার মায়ের আদেশ।” “শাস্তি তোমাকে নিতেই হবে, যেহেতু শত্রুর গুপ্তচরের সঙ্গে তোমারও যোগাযোগ ছিল।” সেইরূপ এই হেতু, এইজন্য, কারণ, এই কারণে ইত্যাদি হেতুবোধক অব্যয়।
(চ) সিদ্ধান্তবাচক (কোনো সিদ্ধান্ত বা মীমাংসা করিয়া দুইটি বাক্যকে সংযুক্ত করে) : এ আমার মায়ের আদেশ, কাজেই আমাকে মানতেই হবে। ভিক্ষায় না বেরুলে অভিমান যায় না, তাই গুরুজী শিবাজীকে নিয়ে ভিক্ষায় বেরুলেন। দলের সকলেই একে একে সভা ত্যাগ করলেন, সুতরাং তাঁকেও ত্যাগ করতে হল। সেইরূপ অতএব, কাজেকাজেই ইত্যাদি সিদ্ধান্তবাচক অব্যয়।
(ছ) সংশয়-সূচক (কোনো সন্দেহ প্রকাশ করে) : কাজটা শেষ না করলে যদি তিনি অসন্তুষ্ট হন? “সম্মুখে চরণ নাহি চলে, পাছে লোকে কিছু বলে।” ওই বুঝি বাঁশী বাজে! লোকটা বুঝি পাগল! ছোটোবাবুকে ডাকতে গেলে তবে নাকি তিনি আসবেন?
(জ) নিত্যসম্বন্ধী (দুইটি অব্যয় নিত্যসম্বন্ধ-যুক্ত হইয়া দুইটি বাক্যকে সংযুক্ত করে) : তিনি ধনী বটে, কিন্তু অবিনয়ী নন। আপনি যদি বলেন, তবে সেখানে যাব। হয় জয়, নয় মৃত্যু। বরং ভিক্ষা করিব, তথাপি আত্মীয়ের দ্বারস্থ হইব না। “যেমন প্রভু, তেমনি তার ভৃত্য।” পাছে আপনি অসন্তুষ্ট হন, তাই আপনাকে বলিনি। একে ঘোরা নিশীথিনী তায় প্রচণ্ড ঝঞ্ঝা। যেই না পা বাড়িয়েছি, অমনি একেবারে কেউটের ঘাড়ে! হয় মন দিয়ে কাজ কর, নতুবা খসে পড়। “যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে—…তবু বিহঙ্গ, ওরে বিহঙ্গ মোর, এখনি অন্ধ, বন্ধ করো না পাখা!” সেইরূপ হয়—না হয়, মোটে—তাতে আবার, যদি–তো, যাঁহা—তাঁহা, ভাগ্যে—তাই, যেই—সেই, যত—তত, যখন–তখন ইত্যাদি এই শ্রেণীর অব্যয়। এই অব্যয়কে সাপেক্ষ অব্যয়ও বলে।
অনন্বয়ী অব্যয়
১৩৭। অনন্বয়ী অব্যয় : যে অব্যয়ের সহিত বাক্যের অন্য কোনো পদের ব্যাকরণগত কোনো অন্বয় বা সম্বন্ধ নাই, তাহাকে অনন্বয়ী অব্যয় বলে।
অনন্বয়ী অব্যয় চারিটি ভাগে বিভক্ত (১) ভাবপ্রকাশক, (২) সম্বোধনসূচক, (৩) প্রশ্নবোধক ও (৪) বাক্যালংকার।
(১) ভাবপ্রকাশক : যে অব্যয়ের দ্বারা হর্ষ, বিষাদ, ক্রোধ, ঘৃণা, বিস্ময়, লজ্জা, সম্মতি প্রভৃতি মনের বিবিধ ভাব প্রকাশ পায়, তাহাই ভাবপ্রকাশক অব্যয়।
(ক) অনুমোদন-প্রশংসা-হর্ষ-জ্ঞাপক—মরি মরি! এ কী অপূর্ব রূপের মাধুরী! “আ মরি বাংলা ভাষা!” “শাবাশ! শাবাশ! তোরা বাঙালীর মেয়ে।” “তখন সকলে বলিল, ‘বাহবা, বাহবা, বাহবা, বেশ!” “ “বাছুরটির ঐ, আ মরে যাই, চিকন নধর দেহ।” খাসা, বহুত আচ্ছা, চমৎকার, বলিহারি যাই, সুন্দর, সাধু সাধু, বাঃ, বাঃ বাঃ, বা রে বাঃ, ধন্য ধন্য, আচ্ছা, বেশ বেশ, বেশ, বেশ ভাই ইত্যাদি এই শ্রেণীর অব্যয়।
(খ) বিস্ময়ব্যঞ্জক—বটে! এত বড়ো আস্পর্ধা! [ বট্ ধাতুর প্রথম পুরুষের রূপ বটে আর এই বিস্ময়ব্যঞ্জক অব্যয় বটে—উভয়ের পার্থক্যটি লক্ষ্য করিবে।] “অবাক্ কাণ্ড একি! এমন কথা মানুষ শুনেছে কি!” অ্যাঁ! তাই না কি! বল কি ভায়া! ও বাবা! বোবা মুখে যে খই ফুটছে গো! “তাই তো! এ বড় দুঃসংবাদ দারা।” “ও মা! (সম্বোধনপদ অব্যয়রূপে) এ যে দাদা!” “ভাবিলা, একি কাণ্ড! গুরুজীর ভিক্ষাভাণ্ড!” বস্ (বাস্)! এতেই তিনি চটে আগুন! “উঃ! কী প্রচণ্ড রব!” “পুঁটে, তুই যে এখানে?”
(গ) ভয়-দুঃখ-যন্ত্রণা-প্রকাশক–”এ জগতে হায়, সেই বেশি চায় আছে যার ভূরি ভূরি!” “ওরে বাবা! এ যে সত্যি বাঘ!” “আহা আহা—চিৎকার করি রঘুনাথ ঝাঁপায়ে পড়িল জলে।” “উহু শীতে মরি।” হায় হায়! সর্বনাশ হয়ে গেল। সেইরূপ—মা গো! মা রে! বাবা গো! বাবা রে! উঃ! আঃ!
(ঘ) ঘৃণা ও বিরক্তিসূচক—”ধিক্! ধিক! শত ধিক্ শ্রীরামের নামে।” ছি ছি! এ কথা কি মুখে আনতে আছে, বাবা? এঃ! এ কী করেছ! বেটা ডাকুকে ছাড়লে কেন ছাই! দূর! দূর! একেবারে অপদার্থ সব! আ মলো! এটা বড়ো জ্বালাচ্ছে তো! কী জ্বালা! তোমাকে তো কাল আসতে বললাম! দূর ছাই! তোর অঙ্কের নিকুচি করেছে। মেয়েদের সামনে তম্বি দেখাচ্ছ, তুমি বীর বটে (ব্যঙ্গার্থে)! বটে রে! দেখাচ্ছি মজাটা (শাসনে বা ভয়প্রদর্শনে)। সেইরূপ—কি বিপদ্! কি মুশকিল!
ঙ) শোক-খেদ-বিস্মরণ-সূচক—আহা রে! কাদের বাছা রে! আহা হা! দুধের ছেলেকে এমন করে মারে! “বড় মার খেয়েছিলি―না রে শ্রীকান্ত?” “আহা মরি মরি, সঙ্কেত করিয়া কত না যাতনা দিনু।” “কোথা হা-হন্ত, চিরবসন্ত!” ওই যা! তোমার বইখানা আজও আনতে ভুলে গেছি। সেইরূপ—বালাই, ষাট ষাট, এই রে ইত্যাদি।
(চ) সম্মতি বা অসম্মতি জ্ঞাপক—আচ্ছা! তাই হবে’খন। না, ওটা পারব না! হুঁ, দেখা যাবে। কই, না তো! “এ নহে মুখর বনমর্মরগুঞ্জিত।” উঁহু, শৰ্মা আর ওমুখো হবে না। যা বলেছ ভায়া, গুণ্ডামিকে কখনও প্রশ্রয় দেয়? খবরদার, এক পা এগিয়েছ কি মরেছ।
(২) সম্বোধনসূচক : যে অব্যয়ের দ্বারা কাহাকেও সম্বোধন করা হয়, সেই অব্যয়কে সম্বোধনসূচক অব্যয় বলে। “হে বন্ধু, হে দেশবন্ধু, স্বদেশ-আত্মার বাণীমূর্তি তুমি।” “রে প্রমত্ত মন মম! কবে পোহাইবে রাতি?” “ওহে দেব! ভেঙ্গে দাও ভীতির শৃঙ্খল।” “ওগো, আজ তোরা যাসনে গো তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে!” “ওরে আমার বৃত্তচ্যুত ভূলুণ্ঠিত মন্দারকুসুম!” “ওরে ও মদনা, একটা কলকে তামাক পারিস দিতে?” “অয়ি স্বাতন্ত্র্যের ধারা! অয়ি পদ্মা! অয়ি বিপ্লাবিনী!” রে দুর্বল! অমরার অমৃত-সাধনা এ দুঃখের পৃথিবীতে তোর ব্রত নহে। “জ্বেলে দে আগুন গুলো সহচরী।” ও মশায়, শুনছেন! এই হাবলা, তোকে না কাল আসতে বলেছিলাম? “সজনী সন্ধ্যা আসবি না লো?” ওগো বাছা, শোনই না। তোকে এখানে বাহাদুরি করতে কে ডেকেছে লা? ( মেয়েদের তাচ্ছিল্যবোধক সম্বোধন) “ওগো আমার আগমনী আলো।” “এ সখি, হামারি দুখের নাহি ওর।” “ওলো তোরা আয় ওই দেখা যায় কুটির কাহার অদূরে।”
(৩) প্রশ্নবোধক : প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিবার জন্য যে অব্যয়ের ব্যবহার হয়, তাহাকে প্রশ্নবোধক অব্যয় বলে। “তোরা নাকি নিশ্চিন্দিপুর ছেড়ে যাচ্ছিস?” কেমন? হল তো? আজ ইস্কুলে যাচ্ছ না কেন? কাল থেকে তোমাদের পরীক্ষা, না? রঞ্জিতা পাস করেছে?—বটে? বেশ অল্প বয়সেই পাস করল, না? বিশ্রামটা না হয় একটু বাড়ালে, পথের দূরত্ব তাতে কমবে কি?
(৪) বাক্যালংকার অব্যয় : বাক্যের সৌন্দর্যবৃদ্ধির জন্য যে-সমস্ত অব্যয় বাক্যে ব্যবহৃত হয়, তাহাদের বাক্যালংকার অব্যয় বলে। এই অব্যয়গুলি বাক্যে প্রয়োগ করিলে নিজস্ব কোনো অর্থই প্রকাশ করে না, কিন্তু সামগ্রিকভাবে বাক্যটির অর্থের চমৎকার একটি বৈচিত্র্য সম্পাদন করে। আপনি যে কাল বড়ো এলেন না? “এ তো মেয়ে মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়।” “কত না দিনের দেখা, কত না রূপের মাঝে!” এটা যে নেহাত তোমাদের ঘরগড়া ব্যাপার, আমি কি আর বুঝি না গো? বোঝাবার ত্রুটি তো করিনি, কিন্তু বোঝে না যে!
ধ্বন্যাত্মক অব্যয়
১৩৮। ধ্বন্যাত্মক অব্যয় : যে-সকল অব্যয় বাস্তব ধ্বনির ব্যঞ্জনা দেয় অথবা অনুভূতিগ্রাহ্য অনির্বচনীয় কোনো সূক্ষ্ম ভাব বা অবস্থার দ্যোতনা দেয়, তাহাদিগকে ধ্বন্যাত্মক বা অনুকার অব্যয় বলে। এইপ্রকার অব্যয়ের কোনো প্রতিশব্দ নাই।
কলকল, ধুপধাপ, ছলছল, গুপগাপ, ছটফট, টনটন, দাউদাউ, কনকন, ঝমঝম, টপাটপ, ঝুমঝুম, গপাগপ, টসটস, দরদর, টুপটাপ, ঝরঝর, ফিসফিস, সনসন, ফোঁসফোঁস, রনরন, টুংটাং, প্যানপ্যান, বকবক, ঘ্যানঘ্যান, খাঁখাঁ, হুহু, হাহা, ধুধু ইত্যাদি। “হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি।” “বিষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর।” “ডাকে কুবো কুবকুব লুকায়ে কোথায়!” মায়ের জন্য মনটা টনটন করছে। “আজকে আমার মনের মাঝে ধাঁইধপাধপ তবলা বাজে।”
ধ্বন্যাত্মক শব্দ বাংলা ভাষার এক বিশিষ্ট সম্পদ। অল্প পরিসরের মধ্যে ভাবের এমন অব্যর্থ ও সার্থক চিত্রধর্মিতা পরিস্ফুট করিয়া তুলিতে কোনো আভিধানিক কৌলীন্যধর্মী শব্দই পারে না। এই শ্রেণীর শব্দ-সম্বন্ধে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের সারগর্ভ মন্তব্যটি বিশেষভাবে স্মরণীয়। “ধ্বনির অনুকরণে ধ্বনির বর্ণনা ইংরেজী ভাষাতেও আছে। কিন্তু বাংলা ভাষার একটি অদ্ভুত বিশেষত্ব আছে।….যে-সকল অনুভূতি শ্রুতিগ্রাহ্য নহে, আমরা তাহাকেও ধ্বনি-রূপে বর্ণনা করিয়া থাকি। …..সৈন্যদলের পশ্চাতে যেমন একদল আনুযাত্রিক থাকে, তাহারা রীতিমতো সৈন্য নহে, অথচ সৈন্যদের নানাবিধ প্রয়োজন সরবরাহ করে, ইহারাও (ধ্বন্যাত্মক শব্দাবলী) বাংলা ভাষার পশ্চাতে সেইরূপ ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরিয়া সহস্র কর্ম করিয়া থাকে, অথচ রীতিমতো শব্দশ্রেণীতে ভরতি হইয়া অভিধানকারের নিকট সম্মান প্রাপ্ত হয় নাই। ইহারা অত্যন্ত কাজের, অথচ অজ্ঞাত অবজ্ঞাত। ইহারা না থাকিলে বাংলাভাষায় বর্ণনার পাঠ একেবারে উঠাইয়া দিতে হয়।”
ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলিকে প্রধানতঃ দুইভাগে ভাগ করা যায়—(১) অনুকার ধ্বন্যাত্মক, (২) ভাবপ্রকাশক ধ্বন্যাত্মক।
(১) অনুকার ধ্বন্যাত্মক শব্দ শ্রুতিগ্রাহ্য ধ্বনিকে প্রকাশ করে। কখনও ইহারা একক বসে, কখনও-বা ইহাদের দ্বিত্ব প্রয়োগ হয়। কয়েকটি উদাহরণ দেখ।—
(ক) হাসির প্রকারভেদ—হিহি, হাহা, হোহো, খিলখিল, খলখল, ফিকফিক, ফিক। (খ) নাচের প্রকারভেদ–ধেইধেই, ধিনধিন, তাধিন-তাধিন, তাতাথই-থই, তাথই-তাথই, তাথেইয়া-তাথেইয়া। (গ) কাসির প্রকারভেদ—খংখং, ঘংঘং, খুকখুক, খকখক। (ঘ) বাতাসের প্রকারভেদ—সাঁ, সোঁ, সাঁই সাঁই, সোঁ সোঁ, সনসন, ঝিরঝির, ঝুরঝুর ঝুরুঝুরু (ঙ) বৃষ্টির প্রকারভেদ—ঝিরঝির, ঝমঝম, টিপটিপ, টুপটাপ, টাপুর-টুপুর। (চ) পানের প্রকারভেদ–ঢকঢক, ঢুকটুক, টুকুটুকু, চুকচুক, চকচক। (ছ) জলের গতির প্রকারভেদ—দরদর, তরতর, ঝরঝর, কলকল, কুলকুল, ছলছল, ঝরোঝরো। (জ) বীণা সেতার প্রভৃতি তারযন্ত্রের শব্দ—টুংটাং, টুংটুং, টুংটং, চিনচিন, চনচন, ক্রিংক্রিং, ক্রাংক্রাং, ঝিনঝিন, ঝনঝন। (ঝ) আরও কয়েকটি ধ্বন্যাত্মক শব্দ—কচকচ, কচাকচ, কুচকুচ, কচমচ, কচর-কচর, কচর-মচর, কটাকট, কটকট, কুটকুট, কটাস, কটমট, কটর-মটর, কড়াৎ-কড়, কিচকিচ, কিচমিচ, কিড়মিড়, কিচির-মিচির, কুপকাপ, কুঁইকুঁই, কুরকুর, কেঁউমেউ, খচখচ, খচাখচ, খচমচ, খটাখট, খটর-মটর, খড়খড়, খটাস, খট, খড়মড়, খনখন, খিটখিট, খিটিমিটি, খুটখাট, খেইখেই, খ্যাকখ্যাক, খ্যানখ্যান, খ্যাঁচম্যাচ, গটমট, গড়গড়, গনগন, গপগপ, গরগর, গলগল, গাঁইগুই, গাঁকগাঁক, গুনগুন, গুবগাব, ঘুটঘুট ঘুটমুট, ঘুরঘুর, ঘেউঘেউ, চটপট, চটাপট, চপচপ, চপাচপ, চটচট, চটাচট, চিকমিক, চিটচিট, চোঁচো, চোঁভোঁ, ছিরিকছিরিক, ছ্যাঁকছোঁক, ছোঁকছোঁক, জ্যাবজ্যাব, জ্যালজ্যাল, ঝিকঝিক, ঝিকমিক, ঝিকিমিকি, ঝুনঝুন, টকটক, টকাটক, টিকটিক, টপাটপ, টুকটুক, টুনটুন, টুপটাপ, টুসটুস, ট্যাট্যা, ট্যাট্যাস, ঠকঠক, ঠনঠন, ঠুকঠুক, ঠুনঠুন, ঠকাঠক, ঠ্যাংঠ্যাং, ঢকঢক, ঢকাঢক, ঢিপঢিপ, ঢ্যাংচ্যাং, তাডুক-তুভুক, তিড়িং-তিড়িং, তিড়িংবিড়িং, তিড়িংমিড়িং, থপথপ থপাস, থপ, দপদপ, দমাদ্দম, দাউদাউ, দুড়দাড়, ধড়ফড়, ধপাস, ধপ, ধকধক, ধুপধাপ, ধাঁধাঁ, ধিকিধিকি, ধুকধুক, নড়বড়, নিশপিশ, পটপট, পটাস, পট, প্যাকপ্যাক, প্যানপ্যান, ফসফস, ফিটফাট, ফিনফিন, ফুটফাট, ফোফা, ফুসফাস, ফ্যালফ্যাল, ফোঁসফাঁস, বকবক, বকরবকর, বনবন, বড়রবড়র, বিজবিজ, বোঁবোঁ, ভক, ভকভক, ভসভস, ভুটভাট, ভোঁভোঁ, ভ্যানভ্যান, মড়মড়, মিনমিন, ম্যাড়ম্যাড়, ম্যাজম্যাজ, লকলক, লটপট, লিকপিক, লটাপট, সাঁইসাঁই, সপসপ, সুড়সুড়, সপাসপ, হড়হড়, হনহন, হাউমাউ, হিড়হিড়, হুসহাস, হুড়মুড়, হুড়হুড়। [এই সমস্ত অব্যয়ে হস্ চিহ্ন দিবার প্রয়োজনই নাই।]
ধ্বন্যাত্মক শব্দগুলি আসলে অব্যয়। নাম-বিশেষণ, বিশেষণের বিশেষণ বা ক্রিয়ার বিশেষণ-রূপে ইহাদের প্রয়োগ হয়। প্রয়োগের বেলায় ইহারা কখনও বিভক্তিযুক্ত হয়, কখনও-বা বিভক্তিশূন্য থাকে। কাজকর্ম চটপট সেরে নাও “একটা পতঙ্গ আসিয়া ফানুসের চারিপাশে শব্দ করিয়া বেড়াইতেছে—চোঁ-ও-ও-ও বোঁ-ও-ও।” তোর ওই প্যানপেনে কান্না থামা বাপু! মুচমুচে লুচি খানকয়েক আনতে বলুন। “রুনুরুনু বাজে তায় বালা।” ও রকম ফিসফিস করে বললে শুনতে পাওয়া যায়? “রুমঝুম ঝুমঝুম রুমঝুমঝুম, খেজুর পাতায় নুপুর বাজায়ে কে যায়।” “রুমাঝুমাঝুম বাদল ঝরে।” “রুনুঝুনু রবে বাজে আভরণ।” “ঝিরিঝিরি বাতাস কাঁদে।” “ঝিকিমিকি ঝাউয়ের ফাঁকে বাদামী রোদ ঝলকে।” “গুনগুন মনভ্রমরা কোথা যাস কিসের ত্বরা।” “টাপুর-টুপুর সারা দুপুর নূপুর বাজায় কে।” “একতারাটা গাগুৰাগুৰ বেজেই চলেছে।” “ঠুনঠুনঠুন কাঁকনেরি সুর বাজে রে।” “ঝরঝর বরিষে বারিধারা।” “তাথেইয়া তাথেইয়া নাচে ভোলা।” “মম চিত্তে নিতি নৃত্যে কে যে নাচে তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ, তাতা থৈথৈ।” “টাকডুম টাকডুম বাজে বাংলাদেশের ঢোল।” “দরদর বেগে জলে পড়ি জল ছলছল উঠে বাজি’ রে।” “হুসহুস সাঁইসাঁই বায়ুর বিরাম নাই।” “ঘচাঘচ ঘ্যাঁচ্চ হাঁচি পড়ে হ্যাঁচ্চ।” “গুডুগম গুডুগম গুডুগুডু গমগম নিশীথিনী চমচম …. বারি ঝরে ঝমঝম।” “ধিকিধিকি ধিকিধিক এইপথ ঠিক ঠিক। ধুকধুক ধুকুধুক কত ভুল কত চুক। ধুকধুকু ধুকধুকু পারিনে এ পথটুকু। ধুকুধুকু ধক্কাৎ আসিলাম নির্ঘাত।” [ শেষের উদাহরণগুলি কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের “রেলঘুম” কবিতা হইতে উদ্ধৃত। ]
বাংলায় ধ্বনিবাচক কয়েকটি শব্দ : পাখির ডাক = কাকলি; কোকিলের ডাক = কুহুকুহু; ময়ূরের ডাক = কেকা; হংসের ডাক = ক্রেংকার; বিহঙ্গের কলতান = কুজন; কঙ্কণের শব্দ = নিক্বণ; মেঘের ডাক = মন্দ্র; শুষ্ক পত্রের শব্দ = মর্মরধ্বনি; অশ্বের ডাক = হ্রেষা; বজ্রের শব্দ = নিনাদ; হস্তীর ডাক = বৃংহিত, বৃংহণ; মৌমাছির শব্দ = গুনগুন, গুঞ্জন, গুঞ্জরন; মাছির শব্দ = ভনভন; কুকুরের ডাক = বুক্কন, ঘেউঘেউ; কুকুরছানার আর্তডাক = কেঁউকেঁউ; বেঙের ডাক = মকমক; বেঙের আর্ত ডাক = ক্যাঁক; ইঁদুর বা বাঁদরের শব্দ = কিচিরমিচির; নূপুর ইত্যাদি অলঙ্কারের শব্দ = নিক্কণ, শিঞ্জন।
(২) ভাবপ্রকাশক ধ্বন্যাত্মক অব্যয় কোনো বাস্তব ধ্বনির প্রকাশ না করিয়া সূক্ষ্ম অনুভূতিগ্রাহ্য অবস্থা বা ভাবের দ্যোতনা দেয়। শব্দগুলির বিচিত্র ব্যবহার লক্ষ্য কর।—
(ক) শূন্যতা বা পূর্ণতা-জ্ঞাপক—জল থইথই করা বা টুটুবু করা, শূন্য ঘর খাঁখাঁ করা, ফাঁকা মাঠ ধুধু করা, পোড়োবাড়ি হাহা করা।
(খ) নাম-বিশেষণ বা বিশেষণের বিশেষণ-রূপে—গনগনে আগুন, থমথমে রাত, কনকনে শীত, ঘুষঘুষে জ্বর, চনচনে রোদ, গসগসে গা (জ্বরে), টিমটিমে বাতি, মিটমিটে চাহনি, ফুটফুটে চেহারা, লিকলিকে বেত, খটখটে শুকনো, সপসপে ভিজে, দগদগে ঘা, ঢুলুঢুলু আঁখি, ফিনফিনে ধুতি, কিটকিটে তেল, ঘুটঘুটে অন্ধকার, ছিপছিপে গড়ন, ঢলঢলে জামা।
(গ) অনুভূতি-প্রকাশক—চোখ ছলছল করা (অভিমানে); টং হওয়া (রাগে); ফ্যালফ্যাল করে চাওয়া (হতাশায়); গা গসগস করা (চাপা রাগে); চোখ কটমট করা (রাগে); মন টনটন করা (বেদনায়); পেট কনকন করা; মাথা ঝিমঝিম করা (দুর্ভাবনায় বা দুর্বলতায়); গা টলমল করা (দুর্বলতায়); কান ভোঁভোঁ করা; বুক ধড়ফড় করা (ভয়ে); বুক চড়চড় করা (হিংসায়); গা রিরি করা (রাগে বা ঘৃণায়); গা ছমছম করা (ভয়ে); বুক দুরুদুরু করা (আশঙ্কায়); হাত নিশপিশ করা (উত্তেজনায়)।
(ঘ) বর্ণবৈচিত্র্য-জ্ঞাপক—টকটকে বা টুকটুকে লাল; মিসমিসে বা কুচকুচে কালো; ফুটফুটে বা ধবধবে সাদা।
(ঙ) বিশেষ্যরূপে (ই-প্রত্যয়যোগে)—”হিয়া দগদগি পরাণ পোড়ান।“—চণ্ডীদাস।
প্রয়োগ : “ঢলঢল কাঁচা অঙ্গের লাবণি অবনী বহিয়া যায়।” “একি পুষ্পময় চেলী ঝিলিমিলি সবুজে সবুজে।” “রক্তে যে তার বাজে রিনিরিনি।” চারদিকেই কেমন একটা থমথমে ভাব, ঝড় ওঠার পূর্ব লক্ষণ আর কি। “ফুটফুটে জোছনায় ধবধবে আঙিনায়।” “আলসেতে আঁখি ঢুলুঢুলু।” “কোলে লুটিতেছে জল টলমল থলথল।” (একই সঙ্গে পূর্ণতা স্থূলতা ও কোমলতার বিচিত্র প্রকাশ) “বুকে বায়ু থরথর নাচে।” ব্যাকরণের কচকচি কাব্যলক্ষ্মীকে যেন খুঁচিয়ে না মারে। কাল পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হবে বলে বুক দুরুদুরু করছে। প্রকাণ্ড পড়োবাড়িটাতে ঢোকার পর থেকেই গা ছমছম করছিল। কুচকুচে কালো কুকুরটা ধবধবে সাদা বিড়ালটাকে তাড়া করেছে। “গুরুজন আগে দাঁড়াইতে নারি সদা ছলছল আঁখি।” এক নিমেষে মিলিয়ে গেল মিসমিসে ওই মেঘপুঞ্জের মাঝে। “ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে ঢেউ খেলিয়া যায় রে।” “থইথই শাওন এল ঐ।” “আমার তো কুইনাইন খেয়ে কান ভোঁভোঁ করছে।”
এবার অন্যান্য অব্যয়—কতকগুলি অব্যয় বক্তার অভ্যাসদোষে অকারণে বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত হয়। ইহাদিগকে মুদ্রাদোষজাত অব্যয় বলা চলে। ইয়ে, মানে, ভালো কথা, কথা হচ্ছে, মনে করুন, ওই যে, ধরুন গিয়ে, মোদ্দা কথা, বুঝছেন কিনা।
ইহা ছাড়া উপসর্গ অব্যয়-সম্বন্ধে পরে চতুর্থ অধ্যায়ের চতুর্থ পরিচ্ছেদে (৪৩০ পৃষ্ঠায়) আলোচনা করা হইবে।
বিভিন্ন পদরূপে অব্যয়ের প্রয়োগ
বিশেষ্য-রূপে : মা যদি বলেন, আমি তো তাঁকে না বলতে পারব না। তোমার কোনো কিন্তুটিন্তু আমরা শুনতে আসিনি। অবজ্ঞায় দূর ছাই বলবার আগে ছাইটা দূর করে দেখতে হবে কোনো রত্ন মেলে কিনা।
নামবিশেষণ-রূপে : যেমন হোক, দেখতে তো একেবারে দূর ছাই গোছের নয়। এমন ধবধবে (ধ্বন্যাত্মক অব্যয়ে এ বিভক্তিচিহ্নযোগে বিশেষণ) বিছানাটা মাটি করলি তো খোকন! কী মিসমিসে মেঘ! বেশ ঝরঝরে লেখা। এমন থলথলে দই দুলুদাদুর জন্য একটু রাখ বৌমা! আচ্ছা ঝামেলা বাধিয়েছে দেখছি। (অব্যয় এখানে শূন্য-বিভক্তিযুক্ত রহিয়াছে)
ক্রিয়ার বিশেষণ-রূপে : ঝরঝর ঝরিছে শাওনধারা। “ভগবদ্গীতা গাহিল স্বয়ং ভগবান্ যেই জাতির সঙ্গে।” ঝড়ও নেই, বৃষ্টিও নেই, বারান্দাটা আপনা-আপনি ধসে পড়ল!
[ স্বয়ং, আপনা-আপনি ইংরেজীতে Reflexive Pronoun, কিন্তু কোনো বিভক্তি-চিহ্ন গ্রহণ করে না বলিয়া বাংলায় এগুলি অব্যয়, তবে ক্রিয়ার বিশেষণ-রূপেই ইহাদের প্রয়োগ হয়। ]
বিশেষণের বিশেষণ-রূপে : এমন থসথসে পচা আম এনেছ কেন? এইরকমই কুচকুচে কালো একটি কুকুরছানা আমার চাই কিন্তু। সেইরূপ—তুলতুলে নরম, টুকটুকে লাল। লক্ষ্য কর—সর্বত্রই ধ্বন্যাত্মক শব্দে এ বিভক্তির যোগ হইয়াছে।
আজ অব্যয়পদটির বিচিত্র প্রয়োগ লক্ষ্য কর—আজ (অদ্য—অব্যয় বা ক্রি-বিণ) আপিস যাচ্ছি না। আজ (বর্তমানে—ক্রি-বিণ) আপনি সৌভাগ্যের সমৃদ্ধ শিখরে, তাই একথা বলতে পারলেন। আজ (আজকে) বেশ শুভদিন (বি)। আজকের কাগজখানায় কী বলছে (বিণ)? তাঁরা কি আজই (ক্রি-বিণ) আসছেন?
অব্যয়পদেও মাঝে মাঝে বিভক্তিচিহ্ন যোগ হয়। মহাত্মাজী, দেশবন্ধু প্রভৃতির নেতৃত্বে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হল। ফণীবাবুর সঙ্গে ব্যাকরণের কারক-বিভক্তি, সমাস, প্রত্যয় ইত্যাদির আলোচনায় কয়েকটা দিন বেশ কেটে গেল।
অব্যয়পদ নাম-বিশেষণ, ক্রিয়ার বিশেষণ বা বিশেষণের বিশেষণ-রূপে ব্যবহৃত হইলে তাহাকে অব্যয়জাত বিশেষণ বলে।
অন্যান্য পদেরও অব্যয়রূপে প্ৰয়োগ
(ক) বিশেষণপদ—”উত্তম, আপনাদের অভিমত জানলাম।” ভালো, কী যেন বলছিলেন?
(খ) সর্বনামপদ—”তার ওপর তোমার বাদলার দিন।” (কথার মাত্রাবোধক অব্যয়রূপে)
(গ) ক্রিয়াপদ—“একবার ডাকার মতো ডাক দেখি মন।” “পাটের শাড়ি পরে এলেই বুঝি তোমার হাতে জল খাব আমরা?”
(ঘ) সম্বোধনপদও মাঝে মাঝে ভাবপ্রকাশক অনন্বয়ী অব্যয়-রূপে ব্যবহৃত হয়। হরি হরি! দাদাকে দিয়ে চণ্ডীপাঠ করাবে, তাহলেই হয়েছে! “দেখতে শুনতে ভালো হলেই পাত্র হল—রাধে!”—রবীন্দ্রনাথ। “আমি কহিলাম, আরে রাম রাম! নিবারণ সাথে যাবে। ঐ |
ভাষাকে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিবার এক বিস্ময়কর ক্ষমতা রহিয়াছে এই অব্যয়পদের। আমরা কয়েকটি নিদর্শন দিলাম।—
বিভিন্ন অর্থে কয়েকটি অব্যয়ের বিশিষ্ট প্রয়োগ
ই : (১) আমি যাইবই (নিশ্চয়তা)। (২) পড়লেই জানতে পারবে (হেতু)। (৩) আহা! কী শোভাই না হয়েছে (শ্লেষ)! (৪) কী ঠকানোটাই না ঠকালে (তীব্র শ্লেষ)! (৫) তুমিই তো গেলাসটা ভেঙেছ (নির্দেশ)। (৬) ছেলে তোমার নিজের মনে বকছে তো বকছেই (বিরামহীনতা)। (৭) ছেলেমানুষ যদিহ-বা অন্যায়টা করে থাকে (নিশ্চিত)! (৮) স্যার আসতেই ছেলেরা চুপ করে গেল (সময়ের সূক্ষ্মতা)। (৯) আমি অত শত বুঝি না, আমার কাজ হলেই হল (উদ্দেশ্যসিদ্ধি)। (১০) তাঁর সময় নেই, তিনি তো বলেইছিলেন (ক্রিয়ার অঙ্গ-রূপে)।
ও : (১) “আমি যাচ্ছি, তুমিও যাবে তো?” (সংস্কৃতের অপি বা ইংরেজীর too অর্থে) রামও কাঁদেন, ভরতও কাঁদেন (ঐ)। (২) গীতুকে আমি জানতে ও দিইনি (আদৌ)। (৩) মনোরমা পড়াশোনার নামও করে না (এমন-কি)। (৪) বাবলু আজ এলেও আসতে পারে (সম্ভাবনা)। (৫) ও মশায়, শুনছেন! (সম্বোধনে) (৬) ও, মনে পড়েছে বটে (স্মরণে)। (৭) ও, মাধবী রাগ করেছে বুঝি? (বুঝিতে পারার ভাব) (৮) ভাতও খাব, লুচিও খাব? (অধিকন্তু) (৯) তুমিও যেমন, পয়লা নম্বরের চারশো বিশকে বিশ্বাস করে বসে আছ! (বাক্যালংকার) (১০) একটা নম্বরও বাদ যায়নি (নির্দেশে)। (১৭) ছেলেমানুষ যদিও-বা অন্যায়টা করে থাকে, তা হয়েছে কী? (তৎসত্ত্বেও) ( ১২) প্রাণটা বেরুব-বেরুব করেও বেরুচ্ছে না (আসন্ন সম্ভাবনা)। (১৩) আমি তো এসেওছিলাম, কিন্তু আপনারই পাত্তা পেলাম না (ক্রিয়াঙ্গ-হিসাবে)।
কি : (১) আপনি কি এখন অপেক্ষা করবেন? (প্রশ্ন) (২) কী খেলে তোমরা? (সর্বনাম অর্থে—কর্ম) (৩) আপনি মানুষ কি দেবতা বোঝাই শক্ত (অথবা)। (৪) মানুষের সাধ্য কি নিয়তির গতি রোধ করে? (নয়) (৫) আহা, কী সাজেই সেজেছ মা! (শ্লেষে—বিশেষণপদ) (৬) কী চমৎকার দৃশ্য! (বিস্ময়ে—বিশেষণের বিশেষণ) (৭) কি কল্যাণী, এমন হনহনিয়ে চলেছ কোথায়? (সম্বোধনে) (৮) কি! এত স্পর্ধা! (ক্রোধে) (৯) আমার অনুরোধ রাখবে কি না বল? (বিতর্কে) (১০) চেষ্টা করে দেখাই যাক পারি কি না (অনিশ্চয়তা)।
[ সর্বনাম বা বিশেষণ বা বিশেষণের বিশেষণ হইলে কী বানানটি লেখাই শোভন রীতি। ]
তো : (১) সে তো মস্ত পণ্ডিত! (শ্লেষ) (২) সকাল-সকাল বাড়ি ফিরছ তো? (প্রশ্ন) (৩) নম্বর আমরা দিতেই চাই, তোমরা তো নিতে জান না (কিন্তু) (৪) আর্যপুত্র তো কুশলে আছেন? (নির্দিষ্টতা) (৫) তুমি তো বেশ লোক দেখছি! (বিস্ময়ে) (৬) তুমি তো বলেই খালাস হে, ঠেলা সামলাবে কে? ( মৃদু তিরস্কার) (৭) বলি, হলো তো? –মুখের মতো, হল তো? (উদ্দেশ্যপূরণ) (৮) অঙ্কটা না পেরে থাক তো বুঝে নিও (যদি)। (৯) লিখতে তো বলছেন, সময় কোথা? (বটে—কিন্তু) (১০) যা তো সরমা, একগ্লাস জল নিয়ে আয় (অনুজ্ঞা)। (১১) “এ মেয়ে তো মেয়ে নয় দেবতা নিশ্চয়।” (বাক্যালংকার) (১২) “কিন্তু শিশু তো (অবধারণে), কত আর ছুটবে, ধরা পড়ল।”
না : (১) আমি যাব না (নিশ্চিত)। (২) এখনও রাস্তায় ঘুরছিস, ইস্কুল যাবি না? (প্রশ্ন) (৩) দুপুর গড়িয়ে গেল, না হল চান, না হল খাওয়া (খেদ) ( 4) একটা গল্প বলুন না (অনুরোধ)। (৫) ভাত খাবি, না লুচি খাবি? (বিকল্প) (৬) আপনি বললে, না করব কোন্ সাহসে? (বিশেষ্য) (৭) তোমাদের কর্তব্য কী? না, জীবসেবায় আত্মবিসর্জন করা (হ্যাঁ)। (৮) “এমনি কত-না ফুল প্রতি দিনরাতে হাসিমুখে বলে কত কথা!” (আধিক্যজ্ঞাপনে) (৯) ও চা-টুকু আর খেয়ো না (নিষেধ)। (১০) একবার চেষ্টা করে দেখই না, অঙ্কটা হয় কিনা (অনুজ্ঞার দৃঢ়তা)। (১১) গোল্লায় যায়, যাক না। (ঔদাসীন্য) (১২) আপনি প্রজাদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছিলেন, তাই না আজ ওরা জেগে উঠেছে? (দৃঢ়নিশ্চয় (১৩) তিনি কী না জানেন? (প্রশ্নের মধ্যেই উত্তর—সবকিছুই জানেন) (১৪) দাদাঠাকুর না কি? (সন্দেহ) (১৫) না যান, নাই-বা গেলেন (অভিমান)। (১৬) “কে না বাঁশী বাএ বড়ায়ি কালিনী নঈ-কূলে।” (অবধারণে) (১৭) না কালী, না কৃষ্ণ—কোনোটাই হল না (অভাব)। (১৮) দুটো ভাত না মুখে দিয়েই সে ছুটল ইস্কুলে। (অতিশয় ব্যস্ততা) (১৯) “শেষে পাণ্ডবদের অভিশাপে ভস্ম না হয়ে যাই!” (পাছে) (২০) শ্যাম রাখি, না কুল রাখি? (দ্বিধা) (২১) “আমি জানি কি না, ঠাকুরমশাই আমাদের সবসময়ে চোখে দেখতে পায় না।” (নিশ্চয় অর্থে)
নাই : (১) আমি যাই নাই (অতীত অর্থে)। (২) “রোদনভরা এ বসন্ত সখি কখনো আসে নি বুঝি আগে।” (অতীত অর্থে নাই-এর চলিত রূপ নি) (৩) কৃষ্ণ বিনা কিছু নাই এ মহীমণ্ডলে (বর্তমান কালে নাস্ত্যর্থক অর্থে)। (৪) তিনি নাই-বা গেলেন, তুমি তো যাচ্ছ? (জোর দিবার জন্য) (৫) শত্রুর প্রতিও অসদ্বব্যবহার করিতে নাহ। (নিষেধার্থে
বা : (১) গজেন বা শশাঙ্ক একজন এলেই হবে (অথবা)। (২) কেউ-বা গান করে, কেউ-বা চান সারে (অনির্দিষ্টতা)। (৩) আপনি যখন বলছেন, হবেও-বা (সংশয়যুক্ত স্বীকারোক্তি)। (৪) এমন অপদার্থ লোক, থাকলেই-বা কি, গেলেই-বা কি? (উপেক্ষা) (৫) বা, তোমাকে না পড়তে বসতে বললাম? (আপত্তিসূচক) (৬) আপনিই-বা সে সময়ে ছিলেন কোথায়? (তিরস্কার) (৭) এমনটা কেনই-বা না হবে? (বিতর্ক)
যে : (১) যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে (সর্বনাম-রূপে)। (২) যে ছেলে এত বড়ো মিথ্যা বলতে পারে, তাকে বিশ্বাস করা শক্ত (নাম-বিশেষণ)। (৩) রাম বলল যে আজ সে ইস্কুলে যাবে না (সংযোজক-রূপে)। (৪) তুমি যে আসবে বললে, তাই তো অত বেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করে রইলাম (হেতু)। (৫) ওমা! বৃষ্টি এল যে! মেলায় আর যাওয়া হল না! (বিস্ময়ে) (৬) বাবা! যে বৃষ্টি! এতে কি আর বাড়ি থেকে বেরনো যায়? (আধিক্য) (৭) সাদাসিধে দেখে তাঁকে যে-সে লোক ভেবো না (সামান্য)। (৮) এই যে ব্রজদা, আপনাকেই খুঁজছিলাম (অবধারণে)।
যেন : (১) “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।” (প্রার্থনায়) (২) আহা! মুখ যেন চাঁদ! (তুলনায়) (৩) অঙ্কটা মন দিয়ে কর, যেন ভুল না হয় (সতর্কীকরণে)। (৪) কে যেন কোথায় কাঁদে! (কল্পনায়) (৫) টাকাটা যেন টেবিলেই রেখেছিলাম মনে হচ্ছে (সন্দেহ)। (৬) চুপচাপ বসে আছে, যেন কত ভালো ছেলে (ভান বুঝাইতে)!
আর : (১) রাম আর রহিমকে সঙ্গে নিলেই হবে (এবং)। (২) শুধু নিতাই এলে হবে না, আর কাউকে ডাক (অন্য)। (৩) তুমি থাক আর যাও, আমার কাছে একই ব্যাপার (অথবা)। (৪) এতক্ষণ রইলে, আর মিনিটপাঁচেক দেখে যাও না (আরও)। (৫) লাথির ঢেঁকি কি আর টুসকিতে ওঠে? (কখনও) (৬) আর বছরে ধানটা ভালোই হয়েছিল (গত)। (৭) আর কবে দেখা হবে কে জানে (আবার)। (৮) ইস্কুলেও পৌঁছেছি আর বৃষ্টিও আরম্ভ হল (সঙ্গে-সঙ্গে)। (৯) তোমাদের রকম-সকম আমার আর জানতে বাকি আছে? (বাক্যালংকার) (১০) দুখিনীর ধন ‘আসি’ বলে সেই যে গেল আর ফিরল না (তদবধি)। (১১) “জ্ঞান সদরমহল পর্যন্ত যেতে পারে, আর ভক্তি অন্দরমহলে যায়।” (কিন্তু)
অনুশীলনী
১। অব্যয়পদ কাহাকে বলে? একটি উদাহরণ দিয়া পদটির অব্যয় নামকরণের সার্থকতা বুঝাইয়া দাও।
২। অব্যয় পদকে প্রধানতঃ কয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়? প্রত্যেকটির নাম উল্লেখ করিয়া প্রত্যেকের একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
৩। পদান্বয়ী অব্যয় কাহাকে বলে? এইপ্রকার নামকরণের সার্থকতা কী? কারক-বিভক্তির ক্ষেত্রে পদান্বয়ী অব্যয়টির কী নাম পাওয়া যায়, দুইটি উদাহরণদ্বারা বুঝাইয়া দাও।
৪। সমুচ্চয়ী অব্যয় কাহাকে বলে? এই অব্যয়টিকে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়? এবং, বরং, অতএব, নতুবা, যদি, পাছে…তাই, তবু, ও, ওরফে, আর, কাজেকাজেই, যেমন……তেমন, কেননা, নইলে, বরং….তথাপি, অথবা, না হয়, যেই না…..অমনি—সমুচ্চয়ী অব্যয়রূপে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর, এবং কোন্ অর্থে প্রয়োগ করিলে বুঝাইয়া দাও।
৫। অনন্বয়ী অব্যয় কাহাকে বলে? কোন্ অর্থে এই শ্রেণীর অব্যয়ের প্রয়োগ হয়, উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।
৬। সংজ্ঞার্থ বল ও উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও : অনন্বয়ী অব্যয়, ধ্বন্যাত্মক অব্যয়, সংযোজক অব্যয়, ব্যতিরেকাত্মক অব্যয়, নিত্যসম্বন্ধী অব্যয়, বাক্যালংকার অব্যয়, প্ৰশ্নবোধক অব্যয়, অব্যয়জাত বিশেষণ, মুদ্রাদোষজাত অব্যয়।
৭। উদাহরণ দাও : বিশেষ্য-রূপে অব্যয়ের প্রয়োগ, বিশেষণ-রূপে অব্যয়ের প্রয়োগ, ঘৃণাপ্রকাশে অনন্বয়ী অব্যয়, সূক্ষ্ম অনুভূতি-প্রকাশে অনুকার অব্যয়, সম্বোধনে অনন্বয়ী অব্যয়, ক্রিয়ার বিশেষণ-রূপে অব্যয়, বিশেষণের বিশেষণ-রূপে অব্যয়, অব্যয়-রূপে সম্বোধনপদ, অনুমোদন-জ্ঞাপক অনন্বয়ী অব্যয়, অব্যয়-রূপে ক্রিয়াপদ, অব্যয়-রূপে বিশেষণপদ।
৮। যে বক্তব্যটি ঠিক, তাহার পাশে টিকচিহ্ন (√), এবং যেটি ভুল তাহার পাশে ক্রসচিহ্ন (x) দাও :
(i) অব্যয়পদ নামপদের অন্তর্গত।
(ii) নামপদে শব্দবিভক্তিযোগে অব্যয়ের সৃষ্টি।
(iii) অনন্বয়ী অব্যয় অনুসর্গের কাজ করে।
(iv) কোনো কোনো অব্যয়কে ক্রিয়াবিশেষণ-রূপেও প্রয়োগ করা যায়।
(v) অব্যয়পদে বিভক্তি যোগ করিলে পদটি অব্যয়ই থাকে।
(vi) সম্বোধনপদ মাঝে মাঝে অনন্বয়ী অব্যয়রূপে প্রযুক্ত হয়।
৯। ফিনফিন, খিলখিল, খলখল, গমগম, ধাঁইধপাধপ, হিড়হিড়, গলগল, ছমছম, ঝমঝম, ঝলমল, কুটুসকাটুস-অনুকার অব্যয়গুলির যথাযথ প্রয়োগ কর।
১০। (ক) তো, না, ই, যেন, আর, কি, বা—প্রত্যেকটির পাঁচটি করিয়া বিশিষ্ট প্রয়োগ দেখাও।
(খ) নির্দেশমতো বাক্যরচনা কর :
(i) ওই (বিশেষণ, সর্বনাম, সম্বোধনসূচক অব্যয় ও বিস্ময়সূচক অব্যয়-রূপে।
(ii) এ (সর্বনাম, বিশেষণ, সম্বোধনসূচক অব্যয়-রূপে)।
(iii) ঝরঝর (বিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ-রূপে)।
(iv) আজ (বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ, অব্যয়-রূপে)।
১১। ‘না’ পদটির বিচিত্র পরিচয় নির্দেশ কর : সে না-কি রাগ করিয়াছিল। তাই বলিল, “আমি বেড়াতে যাব না, তুমি যাও না।” আমি বলিলাম, “না বললে ছাড়ছি নাকি?” সে বলিল, “যতই বল না কেন, আমি নাচার।” আমি বলিলাম, “অর্থাৎ কি না খোঁড়া। ন্যাকামি দেখ না।” সামনের মাসে একবারটি এদিকে আসুন না। একাদশী কহিল, “না না, আমাকেই দাও না ঠাকুর, নিজের চোখেই দেখে নিই।” “কী হে ওটা, মাছের কালিয়া না মাংস?” “তাহলে না হয় কাল বলে দেব যে, পারব না আমি।” তারাপদর কত-না সাধের বাঁশি চারুশশী এমনিধারা দুমড়ে দুমড়ে ভাঙল।
১২। বন্ধনীমধ্য হইতে উপযুক্ত শব্দটি বাছিয়া শূন্যস্থান পূর্ণ কর :
(i) ভয়ে গা…… করিতে লাগিল। [ চড়চড় ছমছম/গমগম ]
(ii) একটা….. কালো বিড়ালবাচ্চা পেয়েছি। [ কুচকুচে/টুকটুকে/ক্যাটকেঁটে ]
(iii) শীতে সারা গা…..করছে। [ ঝিলমিল/চিড়চিড়/চড়চড় ]
(iv) কাজলকালো জল……করছে। [ ছলছল/টলমল থইথই ]
(v) রাগে সর্বাঙ্গ ….. করে উঠল। [ চিড়চিড়/ঝিলমিল/রিমঝিম ]
(vi) অভিমানে চোখদুটো…..করছিল। [ ঝলমল টলমল/ ছলছল ]
(vii) গোলাপটা একেবারে …..লাল। [ টকটকে/কুচকুচে/মিশমিশে ]
(viii) হিংসায় তার বুক……করছে। [ চড়চড় চিড়চিড়/রিরি ]
(ix) দুর্বলতায় মাথাটা…. করে উঠল। [ রিরি/ঝিমঝিম/খাঁখাঁ ]
(x) জোছনায় উঠোনটা একেবারে…… করছে। [ টুকটুক/খাঁখাঁ/ধবধব ]
১৩। আয়ত পদগুলি কোন্ শ্রেণীর অব্যয় বল : “দেখ চাষাবেশে লুকায়ে জনক বলরাম এল কিনা।” “অঙ্গপরিমল সুগন্ধি চন্দন-কুমকুম-কস্তুরী পারা।” “তাহার সংশয় বাড়িল বই কমিল না।” “দুরাত্মারা এই পদ কামনা করে কিন্তু রাখতে পারে না।” এত উপার্জন করছ অথচ একটা পয়সাও জমাতে পারছ না, ভাববার কথা বটে। পড়াশোনার নাম তো নেইই, তায় ক্লাসের মধ্যে জ্বালিয়ে খায়। ডাকতে গেলে তবে নাকি তিনি আসবেন। এখানে ছিঁচকে চোরের উৎপাত যথেষ্ট, কাজেই সাবধানে থাকবে। “পাছে লোকে কিছু বলে।” “ইচ্ছার যদি চরিতার্থতা চাও, তবে ইচ্ছাকে শাসনে রাখ।” “ঝম্প দিয়া পড়ে কন্যা যেই না নদীর জলে।” বড়োবাবু এলেন বুঝি! “যেমন মা, তেমন মেয়ে হবে তো।” “জাগিল বিজলি যেন নীল নবঘনে।” “অর্ধদগ্ধ মৃগমাংস কার সাথে বসি করিনু ভক্ষণ।” “সেই আলোটি মায়ের প্রাণের ভয়ের মতো দোলে। হে, সুর অসুর নর,……এসো মিলি করি সবে মাতৃস্তুতিগান।” টাকা! তোমাকে? কক্ষনো না। “ওরে মোর সর্বনাশা দারিদ্র্য অসহ!” ঘেন্নায় মরি মা! ধেৎ, এ আবার একটা অঙ্ক নাকি! রাম কহ, অমন দুর্মুখের বাড়ি দ্বিতীয় বার কেউ যায়? হয় কর, নয় মর। “অরুশ-উদয়ে যেন কমল প্রকাশে।” “যদিও মা তোর দিব্য আলোকে ঘেরে আছে আজ আঁধার ঘোর।” দুধের সাধ কি ঘোলে মেটে? দ্বিতীয় হুগলী সেতুর পরিকল্পনা অনেকগুলো কিন্তু-যদির স্তর অতিক্রম করেছে। “পূজা করে পাই নি তোরে এবার চোখের জলে এলি।” তুমি যদি বুনো ওল আমি তবে বাঘা তেঁতুল। “কিন্তু বার ঘুরে এলেই তো নিজের ঘরের মর্যাদা।” ছবিটা আপনা-আপনি পড়ে গেল। সেদিন যে বড়ো এলেন না! “কাঞ্চন ফেলিয়ে, রে মন, কাচ নিয়ে কাল করছ যাপন।” “মণির আলো খুব উজ্জ্বল বটে কিন্তু স্নিগ্ধ আর শীতল।” “আজকে আমার মনের মাঝে ধাঁইধপাধপ তবলা বাজে।” “সাত ভাই চম্পা, জাগো রে!” কত অভ্যাস করেছ; তবেই না ঠিক-ঠিক হয়েছে। বাস্তব সত্য আর কাব্য-সত্যে অনেক তফাত। সাহেবের চক্ষু তো স্থির! অনুভূতির কথা কি ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করা যায়? শোভায় আর সংগীতে সারা বারওয়ারিতলাটা গমগম করছে। তুই যে আমার নয়নমণি। আমি বলে (‘এদিকে’ অর্থে) ভয়ে মরি, তুমি কিনা রঙ্গ করছ! তোয়ালেটা তো হাতের কাছেই রয়েছে! তাঁর কাছে জারিজুরি চলবে না। দাবির সঙ্গে দায়ও হাত ধরে চলে। শরীরটা আজ বেশ ঝরঝরে লাগছে। জোড়াসাঁকোর হরিসভায় তিনি ঠাকুরকে একবার দূর থেকে দেখেওছিলেন। এক ছিলিম তামাক সাজ না। স্বর্গ হতে সুরগণ বর্ষে আশীর্বাদ। “আমার এ হৃদয়দোলায় কে গো দুলিছে!” আপনি যে প্রথম ব্যাচেই বসে পড়লেন। কত না কষ্ট আপনাকে দিয়েছি। একে মা মনসা তায় ধুনোর গন্ধ! উনি না-হয়, আপনিই চলুন। “পেচক দিবান্ধ, আর মানুষ দিব্যান্ধ।” শিল্পী প্রতিমাকে মনের মতন সাজাচ্ছেন। “আশঙ্কা হয় পাছে একদিন আগাছাই ধানের খেতকে চাপা দেয়।” “তোমার মা-মন্ত্র তো সংসারীর কান্না দিয়ে লেখা।”