৩.১১ সমাস

একাদশ পরিচ্ছেদ – সমাস

বৃক্ষের ছায়া—পদ দুইটির মধ্যে একটি অর্থ-সম্বন্ধ রহিয়াছে। ‘বৃক্ষের ছায়া’ না বলিয়া বৃক্ষচ্ছায়া বলিলে শুধু যে সংক্ষেপে বলা হইল তাহা নয়, সুন্দর করিয়াও বলা হইল। বাগ্যন্ত্রের সুবিধা ও শ্রবণেন্দ্রিয়ের আনন্দ একই সঙ্গে বিধান করার এই পথটি ব্যাকরণে সমাস বলিয়া পরিচিত।

১৩৯। সমাস : সংক্ষেপে সুন্দর করিয়া বলিবার উদ্দেশ্যে পরস্পর অর্থ—সম্বন্ধযুক্ত দুই বা তাহার বেশী পদকে এক পদে পরিণত করার নাম সমাস।

১৪০। সমস্ত-পদ : সমাসে একাধিক পদ মিলিত হইয়া যে একটি নূতন পদ গঠন করে, তাহাকে সমস্ত-পদ বা সমাস-বদ্ধ পদ বলে। [ অবশ্য সমাস-বদ্ধ পদও আসলে শব্দই। বিভক্তিযুক্ত হইয়া বাক্যে স্থানলাভের যোগ্যতা পাইলে তবেই ইহাকে পদ বলা চলে। ]

সমস্ত-পদটি একটিমাত্র পদ, তাই পদটিকে একমাত্রায় লেখা চাই-ই। পদটি যেখানে বেশ বড়ো হইবার সম্ভাবনা, সেখানে পদসংযোজক রেখা (হাইফেন) দ্বারা যুক্ত করা উচিত। যেমন—হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ; অমর-দানব-যক্ষ-মানব।

১৪১। সমস্যমান পদ : যে-সমস্ত পদের সমন্বয়ে সমস্ত-পদের সৃষ্টি, তাহাদের প্রত্যেকটিকে সমস্যমান পদ বলে।

আমাদের প্রদত্ত উদাহরণটিতে বৃক্ষচ্ছায়া হইতেছে সমস্ত-পদ; বৃক্ষের এবং ছায়া এক-একটি সমস্যমান পদ; বৃক্ষের পদটি পূর্বে আছে বলিয়া ইহাকে পূর্বপদ এবং পরে থাকার জন্য ছায়া পদটিকে উত্তরপদ বলে।

বীণা পাণিতে যাঁহার তিনি বীণাপাণি। এখানে ‘বীণাপাণি’ সমস্ত-পদ, ‘বীণা’ সমস্যমান পূর্বপদ, ‘পাণিতে’ সমস্যমান উত্তরপদ, ‘যাঁহার তিনি’ সমস্যমান সহায়ক অন্য পদ।

বিপরীতক্রমে বৃক্ষচ্ছায়া এবং বীণাপাণি পদকে বুঝাইয়া বলিবার জন্য বিস্তৃত করিয়া যথাক্রমে বৃক্ষের ছায়া এবং বীণা পাণিতে যাঁহার তিনি বলা হয়। সমাসবদ্ধ পদকে এইভাবে বিস্তৃত করার নাম ব্যাসবাক্য।

১৪২। ব্যাসবাক্য : সমস্ত-পদের বিশ্লেষণ করিয়া সমাসের অর্থটি যে বাক্য বা বাক্যাংশের দ্বারা ব্যাখ্যা করিয়া দেখানো হয়, তাহাকে ব্যাসবাক্য বা বিগ্রহবাক্য বা সমাসবাক্য বলে।

‘সমাস’ শব্দের অর্থ সংক্ষেপ, আর ‘ব্যাস’ শব্দের অর্থ বিস্তার। মনে রাখিও ব্যাসবাক্যে সমস্যমান পদগুলি বিচ্ছিন্নভাবে থাকে, কিন্তু সমাসে (সমস্ত-পদে সেইগুলি অবিচ্ছিন্নভাবে থাকে।

পূর্বপদের বিভক্তিলোপ বা বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গের লোপ (কোথাও-বা দুইটিরই লোপ) সমাসের প্রধান লক্ষণ। বিভক্তিলোপের পর সন্ধিসূত্রের আওতায় পড়িলে পূর্বপদের শেষবর্ণের সহিত পরপদের প্রথমবর্ণের সন্ধি হইবে। প্রদত্ত প্রথম উদাহরণে ‘বৃক্ষের’ পদটির বিভক্তিচিহ্ন ‘এর’ লোপ পাইবার পর বৃক্ষ ও ছায়া পদ দুইটি সন্ধিবদ্ধ হইয়া বৃক্ষচ্ছায়া হইয়াছে। কিন্তু সন্ধিজাত শব্দটি যদি দৃষ্টিকটু হইবার সম্ভাবনা থাকে, তখন সন্ধি না করিয়া পদসংযোজক চিহ্নদ্বারা পদদ্বয়কে যুক্ত করা হয়। যেমন—শিশুদের জন্য উদ্যান = শিশু-উদ্যান (সন্ধিজাত ‘শিশূদ্যান’ নয়)।

সন্ধি ও সমাস

বাক্‌সীমিতি অথচ সৌন্দর্যসৃষ্টি—এই দুইটি উদ্দেশ্য সিদ্ধ করিবার জন্য সন্ধি ও সমাসের সৃষ্টি। উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য এইটুকুই। উভয়ের পার্থক্য কিন্তু বেশ ব্যাপক। (১) সন্ধিতে বর্ণের সঙ্গে বর্ণের মিলন, সমাসে পদের সঙ্গে পদের মিলন। (২) সন্ধিতে প্রত্যেকটি পদেরই অর্থ অক্ষুণ্ণ থাকে, কিন্তু একমাত্র দ্বন্দ্ব সমাসেই যা প্রত্যেকটি পদের অর্থ অক্ষুণ্ণ থাকে; তৎপুরুষ ও কর্মধারয়ে পরপদের অর্থপ্রাধান্য, অব্যয়ীভাবে পূর্বপদের অর্থপ্রাধান্য, বহুব্রীহিতে অনুল্লিখিত অথচ ইন্সিতিত তৃতীয় একটি পদের অর্থপ্রাধান্য। (৩) সমাসে অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্বপদের বিভক্তিচিহ্ন লোপ পায়, সন্ধিতে পূর্বপদের বিভক্তিলোপের প্রশ্নই উঠে না। (৪) সন্ধিতে পদগুলির ক্রম অক্ষুণ্ণ থাকে, সমাসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পদদ্বয় পারস্পরিক স্থান পরিবর্তন করে। রাত্রির পূর্ব = পূর্বরাত্র। (৫) সমাসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি শব্দের স্থানে অন্য শব্দ আসে, সন্ধিতে এ-রকমটি হয় না। অন্য যুগ = যুগান্তর। [ এখানে ‘অন্য’ পদের স্থানে ‘অন্তর’ পদটির আবির্ভাব ঘটিয়াছে এবং নবাগত পদটি স্থান পরিবর্তন করিয়া শেষে বসিয়া সন্ধিবদ্ধ হইয়াছে। ]

সংস্কৃতে সমাস প্রধানতঃ চারিপ্রকার—দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, বহুব্রীহি ও অব্যয়ীভাব। কর্মধারয় তৎপুরুষের অন্তর্ভূত, এবং দ্বিগু আবার কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভূত। কিন্তু আমরা বাংলা সমাসকে মোটামুটি ছয় প্রকার ধরিয়া লইয়াছি—দ্বন্দ্ব, তৎপুরুষ, কর্মধারয়, দ্বিগু, বহুব্রীহি ও অব্যয়ীভাব।

দ্বন্দ্ব সমাস

১৪৩। দ্বন্দ্ব : যে সমাসে প্রত্যেকটি সমস্যমান পদের অর্থ প্রধানভাবে বুঝায়, তাহাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। দ্বন্দ্ব সমাসের ব্যাসবাক্যে সমস্যমান পদগুলি ও, এবং, আর প্রভৃতি সংযোজক অব্যয়দ্বারা পরস্পর যুক্ত থাকে।

(ক) দ্বন্দ্ব সাধারণতঃ বিশেষ্যপদের সমাস—ভীম ও অর্জুন = ভীমার্জুন; ভাই আর বোন = ভাইবোন; ধর্ম ও কর্ম = ধর্মকর্ম (কিন্তু ধৰ্মমূলক কর্ম মধ্যপদলোপী কর্মধারয়); দুধ ও ভাত দুধভাত (কিন্তু দুধমিশ্ৰিত ভাত মধ্যপদলোপী কর্মধারয়); আদি ও মধ্য এবং অন্ত = আদিমধ্যান্ত; মন ও তনু = মনস্তনু; কায়, মনঃ ও বাক্য =  কায়মনোবাক্য; কোপ, প্রেম আর গর্ব ও সৌভাগ্য = কোপপ্রেমগর্বসৌভাগ্য। তদ্রূপ যুগযুগান্তর, বল্লরীপল্লব, দেবতাদনুজ, নিশিদিন, ধান্যদূর্বা, সোনারূপা, অশনবসন, জাতিধর্মবৃত্তিবর্ণ, ক্রিয়াকর্ম, দোলদুর্গোৎসব, সত্য-শিব-সুন্দর, অমর-দানব-যক্ষ-মানব, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্ম, ভয়-বিস্ময়-শ্রদ্ধা-কৌতূহল, হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ, তনুমন, রবিশশী, মন্তরতন্তর, নাড়িভুঁড়ি, কায়দাকানুন, ঝোলাঝুলি।

(খ) দুইটি বিশেষণপদ বিশেষ্যবৎ ব্যবহৃত হইলে—সিত ও অসিত সিতাসিত; পণ্ডিত ও মূর্খ = পণ্ডিতমূর্খ (বিভিন্ন ব্যক্তি; একই ব্যক্তিকে বুঝাইলে ব্যাসবাক্য হইবে—পণ্ডিত অথচ মূর্খ—কর্মধারয়); শীত ও উষ্ণ = শীতোষ্ণ; গত এবং আয়াত = গতায়াত। তদ্রূপ হিতাহিত, নরমগরম, ন্যায়ান্যায়, কোমলশ্যামল, লালনীল, সরুমোটা, দীনদুঃখী, চেনা-অচেনা, কানাকানী, ঝলসাপোড়া। [ কিন্তু বিশেষণ দুইটি যদি একই বস্তু বা ব্যক্তিকে বুঝায়, তাহা হইলে দ্বন্দ্ব না হইয়া কর্মধারয় হইবে। ]

(গ) দুইটি সর্বনামেও দ্বন্দ্ব সমাস হয়—তুমি আর আমি = তুমি-আমি। সেইরূপ যে-সে, যাকে-তাকে, যার-তার ইত্যাদি।

(ঘ) ক্রিয়ায় ক্রিয়ায় দ্বন্দ্ব সমাস—হাসি ও খেলি = হাসি-খেলি। সেইরূপ নাচ-গাও, মারধর, ছুঁয়ে-ধরে, চলো-ফেরো, দেখ-শোন ইত্যাদি।

(ঙ) দ্বন্দ্ব সমাসে স্ত্রীলিঙ্গ পদ, অল্পস্বরবিশিষ্ট পদ এবং অপেক্ষাকৃত পূজনীয় ব্যক্তিবাচক পদ পূর্বে বসে। মাতাপিতা, মা-বাপ, স্ত্রীপুরুষ, রামলক্ষ্মণ, রামসীতা, সৈন্যসামন্ত, ভীষ্মার্জুন, লক্ষ্মীজনার্দন, গুরুশিষ্য, পার্বতীপরমেশ্বর, বামুন-শূদ্র—বৃহৎ-ক্ষুদ্র ইত্যাদি। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে—যজমান-শিষ্য, সীতারাম, কিশোর-কিশোরী, হরগৌরী, পিতামাতা, বাপ-মা, ভাইবোন, বরবধূ।

কিন্তু ছেলেমেয়ে, খোকাখুকু, দেবদেবী, নদনদী, নরনারী, মানবমানবী, বরকনে, দাসদাসী, সখাসখী প্রভৃতি কয়েকটি শব্দের উপাদান-শব্দগুলির ক্রম অক্ষুণ্ণ থাকে।

(চ) দুইটি সমার্থক শব্দের মধ্যেও দ্বন্দ্ব সমাস হয়।—আত্মীয়-স্বজন, জপতপ, সাধনভজন, পোষ্য-পরিজন, দীনদরিদ্র, লোকজন, ব্যবসায়বাণিজ্য, সন্তান-সন্ততি, যুদ্ধবিগ্রহ, কাজকর্ম, দয়ামায়া, ছাইভস্ম, বসবাস, মামলামকদ্দমা, ভয়ডর, খোঁজখবর, পাহাড়-পর্বত, ঠাকুর-দেবতা, ধরপাকড়, জন্তুজানোয়ার, কাঙাল-গরীব, চালাক-চতুর, বলা-কওয়া, ছেলে-ছোকরা, লজ্জাশরম, ফন্দিফিকির, খড়কুটা।

(ছ) প্রায়-সমার্থক শব্দের মধ্যেও দ্বন্দ্ব সমাস হয়।—গ্রাস ও আচ্ছাদন গ্রাসাচ্ছাদন; হাট ও বাজার হাটবাজার; পাঁজি ও পুঁথি পাঁজিপুঁথি। সেইরূপ গীতবাদ্য, দানধ্যান, অন্নজল, ঔষধপত্র, পঠনপাঠন, চাষাবাদ, ভাত-কাপড়, চাষবাস, আদর-অভ্যর্থনা, গানবাজনা, দইসন্দেশ, নামধাম, টাকাপয়সা, ইস্কুল-কলেজ, খালবিল, গল্প-গুজব, মানইজ্জত, বিন্দুবিসর্গ, আদব-কায়দা, হাসিঠাট্টা।

(জ) বিপরীতার্থক শব্দযোগে দ্বন্দ্ব সমাস—ধনী ও দরিদ্র = ধনিদরিদ্র; দিবস ও রজনী = দিবস-রজনী। সেইরূপ বেচাকেনা, বিকিকিনি, জানা-অজানা, লাভ-লোকসান, দেনা-পাওনা, ক্ষুদ্র-বৃহৎ, ছোটোবড়ো, বাঁচামরা, জলস্থল, ক্রয়বিক্রয়, পাপ-পুণ্য, স্বর্গনরক, শীতগ্রীষ্ম, ভালোমন্দ, সন্ধিবিগ্রহ, আয়ব্যয়, রাজাপ্রজা, আদ্যন্ত, আকাশ-পাতাল, চুনকালি, দিনরাত, ভাঙাগড়া, কমবেশী, অল্প-বিস্তর, অগ্রপশ্চাৎ, আগাগোড়া।

দ্বন্দ্ব-সমাসনিষ্পন্ন এই ধরনের অধিকাংশ শব্দই বিশিষ্টার্থক শব্দের অংশরূপে ব্যবহৃত হয়। ভরত কৈকেয়ীর ষড়যন্ত্রের বিন্দুবিসর্গও জানতেন না। এমন করে বাপমায়ের মুখে চুনকালি দেয়? অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে তাঁকে রাজী করানো গেছে। লেখাপড়া যখন শিখেছে তখন ভাতকাপড়ের অভাব হবে না। ছাইভস্ম কী সব লিখেছ, বোঝাই যাচ্ছে না। ডুবন্ত লোক খড়কুটা ধরিয়াও বাঁচিতে চায়।

(ঝ) একশেষ দ্বন্দ—সমস্যমান পদগুলির বহুবচনান্ত একটিমাত্র পদ অবশিষ্ট থাকে। তুমি ও আমি = আমরা; তুমি, আমি ও সে = আমরা; তুমি ও সে তোমরা।

কয়েকটি তৎসম সমাসবদ্ধ পদের ব্যবহার সম্বন্ধে আমাদের সচেতন থাকা উচিত। সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়মানুসারে পূর্বপদ ও উত্তরপদ সগোত্র হইলে অথবা পুত্র শব্দ পরে থাকিলে ঋ-কারান্ত পূর্বপদ আ-কারান্ত হইয়া যায়। মাতা (মাতৃ) ও পিতা = মাতাপিতা; পিতা (পিতৃ) ও পুত্র = পিতাপুত্র; সেই হিসাবে পূর্বপদটিকে বিভক্তিশূন্য অবস্থায় ঋ-কারান্ত করিলে অর্থপার্থক্য ঘটে। পিতামাতা (অর্থ বাপমা–দ্বন্দ্ব) কিন্তু মাতৃপিতা = মাতার পিতা (সম্বন্ধ-তৎপুরুষ)। সুতরাং “বাপ-মা নাই” এই অর্থে পিতামাতৃহীন (পিতামাতার দ্বারা হীনকরণ-তৎপুরুষ) বা মাতাপিতৃহীন (মাতাপিতার দ্বারা হীন—করণ-তৎপুরুষ) লেখাই শিষ্টরীতি। কিন্তু অনেকেই মাতৃপিতৃহীন লিখিয়া থাকেন। মাতৃপিতৃহীন বলিতে মাতার পিতা (মাতামহ) নাই যাহার, এবং পিতৃমাতৃহীন বলিতে পিতার মাতা (পিতামহী) নাই যাহার বুঝায়—ইহাই ব্যাকরণসম্মত অর্থ। জামাতা ও পুত্র = জামাতাপুত্র [. কিন্তু জামাতার পুত্র = জামাতৃপুত্র (সম্বন্ধ-তৎপুরুষ) : পূর্বপদের বিভক্তির লোপ ]।

জায়া ও পতি = জায়াপতি বা দম্পতি (জম্পাত বাংলায় একেবারে অচল)।

অহঃ ও রাত্রি = অহোরাত্র; অহঃ ও নিশা = অহর্নিশ; রাত্রি ও দিবা রাত্রিন্দিব; সেইরূপ দিবারাত্র। বাংলায় দিবানিশি কথাটির বহুল প্রয়োগ রহিয়াছে। [ কিন্তু রাত্রি অর্থে নিশি অশুদ্ধ প্রয়োগ। ] প্রয়োগ : “নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে।”—রবীন্দ্রনাথ। “ভোলানাথের ঝোলাঝুলি ঝেড়ে ভুলগুলো সব আরে বাছা বাছা।”—ঐ। “আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে মা।” “জপ-যজ্ঞ-পূজা—আয়োজন আর কিছু তো নাহি চায়।” “বামুন-শূদ্র-বৃহৎ-ক্ষুদ্র কৃত্রিম ভেদ ধুলায় লোটে।” “আকাশ-বাতাস স্বর্গ-মর্ত পরিব্যাপ্ত করিয়া আঁধারের প্লাবন বহিয়া যাইতেছে।” “সোণা রূপা নহে বাপা এ বেঙা পিতল।”—মুকুন্দরাম।

তৎপুরুষ সমাস

১৪৪। তৎপুরুষ সমাস : যে সমাসে পূর্বপদের কর্ম করণ অপাদান ইত্যাদি কারকের বিভক্তিচিহ্ন কিংবা বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গের লোপ হয় এবং পরপদের অর্থটি প্রধানভাবে বুঝায়, তাহাকে তৎপুরুষ সমাস বলে। এই সমাসের ব্যাসবাক্য গঠন করিবার জন্য পূর্বপদে অর্থানুসারে কর্ম করণ অপাদান অধিকরণ ইত্যাদি কারকের বিভক্তিচিহ্ন অথবা বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গ যোগ করিতে হয়।

তৎপুরুষ সমাসকে ছয়টি উপশ্রেণীতে ভাগ করা হয়।—

(১) কর্ম-তৎপুরুষ : পূর্বপদের কর্মকারকের বিভক্তিচিহ্ন ‘কে’ লোপ পাইলে কর্ম-তৎপুরুষ সমাস হয়। রথকে দেখা = রথদেখা; দেশকে উদ্ধার = দেশোদ্ধার; লুচিকে ভাজা = লুচিভাজা; কলাকে বেচা = কলাবেচা; লোককে দেখানো লোকদেখানো; তরীকে বাওয়া তরীবাওয়া; গাঁটকে কাটা গাঁটকাটা (কাজটা—মানুষটা বুঝাইলে ব্যাসবাক্য হইবে : গাঁট কাটে যে = গাঁটকাটা—উপপদ তৎপুরুষ); ছেলেকে ভুলানো = ছেলেভুলানো (কাজটাই বুঝায়—ছড়া বা লোক বুঝাইলে ব্যাসবাক্য—ছেলে ভুলায় যে বা যাহা—উপপদ তৎপুরুষ)। তেমনি বধূবরণ, গাড়িচালানো, ঘরমোছা, মালাবদল, বাসনধোয়া ইত্যাদি।

(২) করণ-তৎপুরুষ : পূর্বপদের করণকারকের ‘এ’ (য়), ‘তে’ প্রভৃতি বিভক্তিচিহ্ন বা দ্বারা দিয়া কর্তৃক প্রভৃতি অনুসর্গের লোপ হইলে করণ-তৎপুরুষ সমাস হয়। অস্ত্রের দ্বারা আহত = অস্ত্রাহত; গুরু-কর্তৃক দত্ত = গুরুদত্ত; তৃষ্ণার দ্বারা ঋত = তৃষ্ণার্ত; জবায় রাঙা = জবারাঙা; দারিদ্র্যে ক্লিষ্ট = দারিদ্র্যক্লিষ্ট; পরান্নের দ্বারা প্রতিপালিত = পরান্নপ্রতিপালিত; আশার দ্বারা আহত = আশাহত (আশা কিছুটা মিটিয়াছে); আশার দ্বারা হত আশাহত (আশা আদৌ মিটে নাই); পরের দ্বারা ভূত (পালিত) = পরভূত; শস্যে আঢ্য (সমৃদ্ধ) = শস্যাঢ্য; ঋণ দ্বারা প্রস্ত ঋণগ্রস্ত; শোণিতে লিপ্ত = শোণিতলিপ্ত; অশ্রুতে ভরা অশ্রুভরা; প্রথার দ্বারা বদ্ধ প্রথাবদ্ধ; ছাতা দিয়া পেটা ছাতাপেটা; গোঁজার দ্বারা মিল গোঁজামিল; লক্ষ্মীর দ্বারা ছাড়া = লক্ষ্মীছাড়া; ট্রেনে করিয়া ভ্রমণ ট্রেনভ্রমণ। সেইরূপ বিধিবদ্ধ, নারদোক্ত, দ্বিজদত্ত, শোকাকুল, কুসুমাকীর্ণ, সর্বজননন্দিত, নিপাতনসিদ্ধ, শতকণ্টকিত, বায়ুপূর্ণ, ছায়াস্নিগ্ধ, মায়াবদ্ধ, অগ্নিশুদ্ধা, ঘটনাবহুল, বাগদত্তা, অর্থসাহায্য, সর্পদষ্ট, জরাজীর্ণ, দুগ্ধপোষ্য, দুগ্ধধৌত, রোগগ্রস্ত, রসপুষ্ট, বিদ্যুদমিশ্রিত, শস্যশ্যামল, ভিক্ষালব্ধ, ধনাঢ্য, বর্ণাঢ্য, স্নেহশীতল, মলয়জস্নিগ্ধ, প্রীতিবিকশিত, লিপিবদ্ধ, মন্ত্রপুত, বেদনার্ত, শোকার্ত, ভক্তিবিগলিত, রৌদ্রতপ্ত, কীটদষ্ট, যন্ত্রচালিত, স্নানসিক্ত, বন্যাবিধ্বস্ত, চন্দনচর্চিত, শিশিরসিক্ত, ছায়াবৃতা, মায়াচ্ছন্ন, যৌবনদীপ্ত, সুরসিদ্ধ, যুগজীর্ণ, রোগাক্রান্ত, ধীশক্তিসম্পন্ন, প্রলয়ঝটিকা-মুখর, দানব-অমর-যক্ষ-বানরঘৃণিত, কৌতুক-প্ৰফুল্ল, উদয়রবি-রশ্মি-সমুজ্জ্বল, পারাবত-কাকলিসঙ্কুল, ছায়াঘেরা, কিস্তিবন্দি, পাতাছাওয়া, ঢেঁকিছাঁটা, বাদুড়চোষা, সোনামোড়া, জাঁতাভাঙ্গা, পাথরচাপা, দর্শকঠাসা, মধুমাখা

(৩) সম্প্রদান-তৎপুরুষ : পূর্বপদের সম্প্রদানকারকের ‘কে’ বিভক্তিচিহ্নটি লোপ পাইলে সম্প্রদান-তৎপুরুষ হয়। দেবকে দত্ত দেবদত্ত; দেবতাকে নিবেদিত = দেবতানিবেদিত।

(৪) অপাদান-তৎপুরুষ : পূর্বপদের অপাদানকারকের ‘এ’ ‘তে’ ইত্যাদি বিভক্তিচিহ্ন কিংবা হইতে চেয়ে থেকে প্রভৃতি অনুসর্গের লোপ হইলে অপাদান—তৎপুরুষ হয়। ঐশ্বর্য হইতে ভ্রষ্ট = ঐশ্বর্যভ্রষ্ট

ঐশ্বর্যভ্রষ্ট; স্বাধিকার হইতে বঞ্চিত স্বাধিকারবঞ্চিত; বাম হইতে ইতর = বামেতর; শতমুক্তা হইতে অধিক শতমুক্তাধিক; শিখরতুষার হইতে নিঃসৃত = শিখরতুষারনিঃসৃত; পারী (সমুদ্র) হইতে জাত = পারিজাত; স্নাতক হইতে উত্তর = স্নাতকোত্তর; অশীতি হইতে পর = অশীতিপর; পাঠ হইতে বিরত = পাঠবিরত; আহারে নীরত = আহারনীরত; ব্যক্তি হইতে নিরপেক্ষ = ব্যক্তিনিরপেক্ষ; মায়া হইতে মুক্ত = মায়ামুক্ত; জন্ম হইতে স্বাধীন জন্মস্বাধীন; দূর হইতে আগত = দূরাগত; পাঠশালা হইতে পলায়ন = পাঠশালা-পলায়ন; মৃত্যু হইতে উত্তীর্ণ = মৃত্যুত্তীর্ণ; বৃত্ত হইতে চ্যুত বৃত্তচ্যুত; দুগ্ধ হইতে জাত = দুগ্ধজাত; দত্ত-বংশ হইতে জাত = দত্তজা; জল হইতে আতঙ্ক = জলাতঙ্ক; রাজা হইতে ভয় = রাজভয়; বিলাত হইতে ফেরত = বিলাতফেরত; জেল হইতে খালাস = জেলখালাস। সেইরূপ পদচ্যুত, শ্রীভ্রষ্ট, লোকভয়, মৃত্যুভয়, স্বর্গচ্যুত, জন্মান্ধ, বিদেশাগত, ঋণমুক্ত, ব্রাহ্মণেতর, মেঘমুক্তি, যূথভ্রষ্ট, আহারক্ষান্ত, বর্ষণক্ষান্ত, বীণানিঃসৃত, বিপন্মুক্তি, বন্যাত্রাণ, দলছাড়া, দেশছাড়া, সৃষ্টিছাড়া, ইস্কুলফেরতা, খাপখোলা, হারছেঁড়া, চাকভাঙা, থলিঝাড়া।

(৫) অধিকরণ-তৎপুরুষ : পূর্বপদের অধিকরণকারকের ‘এ’ (য়), ‘এতে’ প্রভৃতি বিভক্তিচিহ্নের লোপ হইলে অধিকরণ-তৎপুরুষ হয়। ধূলিতে লুণ্ঠিতা ধুলিলুণ্ঠিতা; সভায় আসীন = সভাসীন; অগ্রে গণ্য = অগ্রগণ্য; গঙ্গায় স্নান = গঙ্গাস্নান; স্বার্থে পর (আসক্ত) = স্বার্থপর; অন্তরে স্থিত = অন্তরস্থিত; গ্রীষ্মে কৃশ = গ্রীষ্মকৃশ; পদে আনত = পদানত; বিদ্যায় উৎসাহী = বিদ্যোৎসাহী; ধ্যানে লীন = ধ্যানলীন; সংসারে বিরাগী = সংসারবিরাগী; শ্রমে কুণ্ঠ = শ্রমকুণ্ঠ; ছায়ায় সুপ্ত = ছায়াসুপ্ত; প্রাতে ভ্রমণ = প্রাতভ্রমণ; নরগণে প্রীতি = নরপ্রীতি; ক্ষমায় সুন্দর = ক্ষমাসুন্দর; মৃৎ-এ প্রোথিত = মৃৎ-প্রোথিত; সর্বাঙ্গে সুন্দরী সর্বাঙ্গসুন্দরী; মাতার প্রতি ভক্তি = মাতৃভক্তি; গৃহে প্রবেশ = গৃহপ্রবেশ; তর্কে পটু = তর্কপটু; মৰ্মে আহত = মর্মাহত; আহারে নিরত (ব্যাপৃত) = আহারনিরত; গৃহে আগত. = গৃহাগত; পাঠে অনুরাগী = পাঠানুরাগী; বিশ্বে বিশ্ৰুত বিশ্ববিশ্রুত; শয্যায় শায়ী = শয্যাশায়ী; বনে বাস বনবাস; বনে গমন = বনগমন; ক্ষমতায় আসীন = ক্ষমতাসীন; শীর্ষে স্থিত = শীর্ষস্থিত; কারায় অবরুদ্ধ = কারাবরুদ্ধ; একে নিষ্ঠা = একনিষ্ঠা (কিন্তু একে নিষ্ঠা যাহার একনিষ্ঠ—বহুব্রীহি, স্ত্রী একনিষ্ঠা); রোদনে প্রবণতা = রোদনপ্রবণতা; সর্ববিদ্যায় বিশারদ = সর্ববিদ্যা-বিশারদ; গীতায় উক্ত = গীতোক্ত; নীরে মজ্জন = নীরমজ্জন; দ্বিজগণের মধ্যে সুলভ = দ্বিজসুলভ; দাঁতে কপাটি (রুদ্ধ কপাটের মতো অবস্থা—দাঁতকপাটি; মনে মরা = মনমরা; রাতে কানা = রাতকানা; বাটায় ভরা বাটাভরা; গলাতে ধাক্কা = গলাধাক্কা। সেইরূপ সিংহাসনাসীন, গৃহবাস, শীলবৃদ্ধ, বক্ষলীন, কর্মব্যস্ত, বচনবাগীশ, রণবীর, বিশ্ববিখ্যাত, তীর্থাগত, মনোরুদ্ধ, ভ্রাতৃস্নেহ, রূপানুরাগ, সাহিত্যপ্রীতি, অকালপক্ক, ধ্যানসমাহিত, শিরঃস্থিত, যোগরত, ওষ্ঠাগত, ধরাশায়ী, ক্রীড়ামত্ত, শিল্পনৈপুণ্য, যৌবনযোগিনী, কর্মকুশল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, আকাশ-ভ্রমণ, হাড়বজ্জাত, গাছপাকা, কোণঠাসা, কণ্ঠাগত, দিনকানা, কোলকুঁজো, ঘরপাতা (দই), তালকানা, পাড়াবেড়ানো, লিস্টভূত।

কয়েকটি ক্ষেত্রে অধিকরণ-তৎপুরুষ সমাসে পূর্বপদের পরনিপাত হয়। পূর্বে দৃষ্ট = দৃষ্টপূর্ব; পূর্বে শ্ৰুত = শ্রুতপূর্ব। সেইরূপ ভূতপূর্ব।

অনেকের মধ্যে একের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ বুঝাইলেও অধিকরণ-তৎপুরুষ হয়। কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ = কবিশ্রেষ্ঠ; কবিদের মধ্যে ঈশ = কবীশ; পুরুষের মধ্যে উত্তম = পুরুষোত্তম; সরস্-এর মধ্যে বর (শ্রেষ্ঠ) = সরোবর; বিশ্বের মধ্যে বখাটে = বিশ্ববখাটে। সেইরূপ কবিসম্রাট্, পুরুষশ্রেষ্ঠ, নরাধম, নরোত্তম।

এইবার অ-কারক বা উপকারক-তৎপুরুষ। পূর্বপদের অ-কারক বা উপকারক—পদটির লোপ হইলে অ-কারক-তৎপুরুষ সমাস হয়। কয়েক প্রকার অ-কারক তৎপুরুষের উদাহরণ দেখ।—

(ক) গত, প্রাপ্ত, আপন্ন, আশ্রিত, আরূঢ়, অতীত প্রভৃতি শব্দযোগে পূর্বপদের ‘কে’ বিভক্তিচিহ্নের লোপ হয়। ব্যক্তিকে গত = ব্যক্তিগত; যৌবনকে প্রাপ্ত যৌবনপ্রাপ্ত; বিস্ময়কে আপন্ন = বিস্ময়াপন্ন; দেবকে আশ্রিত = দেবাশ্রিত; সংখ্যাকে অতীত = সংখ্যাতীত; গৃহকে প্রবিষ্ট = গৃহপ্রবিষ্ট; অশ্বে আরূঢ় অশ্বারূঢ়; বৃদ্ধিকে প্রাপ্ত = বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। সেইরূপ যুগাতীত, শরণাগত, দিনগত, স্বর্গপ্রাপ্ত, সাহায্যপ্রাপ্ত, রথারূঢ়, চরণাশ্রিত, স্মরণাতীত, সঙ্কটাপন্ন, শিক্ষাসংক্রান্ত, বিপদাপন্ন, মজ্জাগত, শয্যাগত, পুঁথিগত, বয়ঃপ্রাপ্ত, মরণাপন্ন ইত্যাদি।

(খ) পূর্বপদের ব্যাপ্ত্যর্থক শব্দটির লোপে—চির (দীর্ঘ) কাল ব্যাপিয়া সুখী চিরসুখী; নিত্যকাল ব্যাপিয়া আনন্দ = নিত্যানন্দ; বিশ্ব ব্যাপিয়া যুদ্ধ = বিশ্বযুদ্ধ; পক্ষ ব্যাপিয়া অশৌচ = পক্ষাশৌচ; ক্ষণকাল ব্যাপিয়া স্থায়ী = ক্ষণস্থায়ী। সেইরূপ চিরস্থায়ী, চিরযুবা, চিরশত্রু, মাসাশৌচ, চিররুগ্‌ণ, চিরসুন্দর। [ পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ২০০৫ সাল হইতে প্রবর্তিত পাঠ্যসূচীতে এটিকে ব্যাপ্তি তৎপুরুষ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে।]

(গ) ক্রিয়াবিশেষণবাচক পূর্বপদটির ভাবে’, ‘রূপে’ অংশটির লোপে—অর্ধভাবে উন্মীলিত = অর্ধোন্মীলিত; দৃঢ়ভাবে বদ্ধ = দৃঢ়বদ্ধ; নিম (অর্থ) রূপে রাজী = নিমরাজী; আধাভাবে মরা = আধমরা। সেইরূপ অর্ধমৃত, অর্ধস্ফুট, ঘনসন্নিবিষ্ট, আধপাকা। [ পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ২০০৫ সাল হইতে প্রবর্তিত পাঠ্যসূচীতে এটিকে ক্রিয়াবিশেষণ তৎপুরুষ বলা হইয়াছে। ]

(ঘ) হীন রহিত শূন্য ঊন প্রভৃতি অভাবার্থক ও যুক্ত অন্বিত বিশিষ্ট প্রভৃতি যুক্তার্থক শব্দযোগে পূর্বপদের বিভক্তিচিহ্ন ও দ্বারা অনুসর্গের লোপে—জ্ঞানের দ্বারা হীন = জ্ঞানহীন; জনের দ্বারা শূন্য = জনশূন্য; পিতার দ্বারা হীন = পিতৃহীন; শোভার দ্বারা অন্বিত শোভান্বিত; পিতামাতার দ্বারা হীন পিতামাতৃহীন; শ্রীর দ্বারা যুক্ত = শ্রীযুক্ত; বলের দ্বারা হীন = বলহীন (কিন্তু হীন হইয়াছে বল যাহার = হীনবল—বহুব্রীহি); এক দ্বারা ঊন = একোন; ছটাকের দ্বারা কম = ছটাক-কম। সেইরূপ বিদ্যাহীন, অঙ্গহীন, শ্রীহীন, সদ্যোমাতৃহীন, রবিশশিহীন, যুক্তিযুক্ত, মায়াযুক্ত, মহিমান্বিত, গুণসম্পন্ন, নীলচন্দ্রাতপমণ্ডিত, প্রতাপান্বিত, আদিমধ্যান্তশূন্য, নজিরহীন, লেজবিশিষ্ট।

(ঙ) নিমিত্ত, উদ্দেশ্য, উদ্দেশ, জন্য প্রভৃতি নিমিত্তবাচক অংশগুলি যখন পূর্বপদে লোপ পায়, তখন নিমিত্ত-তৎপুরুষ সমাস হয়। স্বদেশের জন্য প্রেম স্বদেশপ্রেম; শিশুদের জন্য সাহিত্য = শিশুসাহিত্য; জপের জন্য মালা = জপমালা; জলের জন্য কর = জলকর; ছাত্রদের জন্য আবাস = ছাত্রাবাস শিক্ষার জন্য আয়তন শিক্ষায়তন; উন্নতির জন্য বিধান = উন্নতিবিধান তীর্থের উদ্দেশে যাত্রা = তীর্থযাত্রা; মেয়েদের জন্য স্কুল = মেয়েস্কুল; ধানের জন্য জমি = ধানজমি; শয়নের জন্য ঘর = শয়নঘর; মালের জন্য গুদাম = মালগুদাম; ডাকের নিমিত্ত মাশুল = ডাকমাশুল। সেইরূপ অনাথ-আশ্রম, লোকহিত, শিশুবিভাগ, রক্ষাকবচ, তপোবন, বিশ্রামকক্ষ, সত্যাগ্রহ, জীয়নকাঠি, ঘরপাগল, মড়াকান্না, বিয়েপাগল, রান্নাঘর, মাপকাঠি, সাজনঘর। অনাথ-আশ্রম—সংলগ্ন শিক্ষায়তনের ছাত্রাবাসে একটি বিশ্রামকক্ষ নির্মিত হল।

(চ) সম্বন্ধ-তৎপুরুষ : পূর্বপদের সম্বন্ধের বিভক্তিচিহ্ন ‘র’ (এর), ‘দের’ প্রভৃতি লোপ পাইলে সম্বন্ধ-তৎপুরুষ সমাস হয়। জগতের জন লোপ করিয়া ‘জগজন’ করাও চলে); দেবের অনীকিনী বিমাতার নন্দন = বিমাতৃনন্দন; রাজার ধানী (আবাসস্থল) = রাজধানী; যশের লিপ্সা = যশোলিপ্সা; সুধার আকর = সুধাকর; ঘনের (মেঘের) ঘটা = ঘনঘটা; কালীর পদ = কালীপদ; শ্রীর ঈশ = শ্রীশ; কমলার ঈশ = কমলেশ (নারায়ণ); বহ্নির ভোজ্য = বহ্নিভোজ্য; বিদ্যুতের দীপ্তি = বিদ্যুদ্দীপ্তি; মহতের প্রাণ = মহৎপ্রাণ (কিন্তু মহান্ প্রাণ যাঁহার মহাপ্রাণ—বহুব্রীহি); স্ব-র অধীন = স্বাধীন; মহতের ধন = মহদ্‌ধন (কিন্তু মহৎ যে ধন = মহাধন—কর্মধারয়); ব্রাহ্মণের ভোজন = ব্রাহ্মণভোজন (কর্তৃসম্বন্ধ বলিয়াই সম্বন্ধ-তৎপুরুষ); আঁখির লোর = আঁখিলোর; গুণীর সমাজ = গুণিসমাজ (বানানটি লক্ষ্য কর); পণ্ডিতগণের মহল = পণ্ডিতমহল; বিদ্বানের সভা = বিদ্বৎসভা; গল্পের গুচ্ছ = গল্পগুচ্ছ; বীরের পূজা = বীরপূজা (কর্ম-সম্বন্ধ); মা’র (লক্ষ্মীর) ধ (স্বামী) মাধব; বুধের (পণ্ডিতগণের) মণ্ডলী = বুধমণ্ডলী; পরীক্ষার অর্থী = পরীক্ষার্থী; ভ্রাতার দ্বয় = ভ্রাতৃদ্বয়; বসন্তের সখা = বসন্তসখ (কোকিল) [ কিন্তু বসন্ত সখা যাহার বসন্তসখা (মদন)—বহুব্রীহি ]; উদয়রবির রশ্মি = উদয়রবিরশ্মি ক্রিয়াকর্মের উপলক্ষ = ক্রিয়াকর্মোপলক্ষ; ধনির গৃহ = ধনিগৃহ; স্বামীর সন্দর্শন = স্বামিসন্দর্শন; পিতার মাতা = পিতৃমাতা; মাতার মূর্তি = মাতৃমূর্তি; যুবার সংঘ = যুবসংঘ; তপের বল = তপোবল; মধুকের মালা = মধুকমালা; নরকুলের ধন = নরকুলধন; মানিকের গুচ্ছ = মানিকগুচ্ছ। সেইরূপ স্বক্ষেত্র, বন্ধুদ্বয়, বিষজ্বালা, দিগন্ত, পৌরসভা, গঙ্গাধর, বিদ্বৎসমাজ, মাতৃভাষা, রাধাবল্লভ, নীরাকার, কলিঙ্গরাজ, মহদাশয়, পাঠচক্র, অর্থগৌরব, চন্দ্রোদয়, বিশ্বভারতী, দেশনেতা, রজনীশ, গিরীশ, বনফুল, অনিলসখ, কমলেশ (সূর্য), রাধেশ, রাকেশ, মৃত্যুপথযাত্রী, পুত্রচতুষ্টয়, মন্ত্রিসভা, বিশ্বনাথ, বিশ্বামিত্র, ইষ্টদর্শন, ব্রাহ্মণপাড়া, শ্বশুরবাড়ি, ধানক্ষেত, ফুলবাগান, রথতলা, ভোটদাতা, জাহাজঘাটা, ঠাকুরপো। “মজলো আমার মনভ্রমরা কালীপদ নীলকমলে।”

‘শ্রেষ্ঠ’ অর্থে রাজা-পদটি ব্যাসবাক্যের শেষের দিকে বসে। পথের রাজা =  রাজপথ (রাজার নির্মিত পথ = রাজপথ—মধ্যপদলোপী কর্মধারয় করা খুব সংগত নয়; কেননা, রাজার নির্মিত সকল পথই তো আর রাজপথ নয়); হংসের রাজা = রাজহংস; তরুদিগের রাজা = রাজতরু (কর্ণিকার বৃক্ষ); মিস্ত্রীদের রাজা = রাজমিস্ত্রী। সেইরূপ রাজযক্ষ্মা, রাজরোগ, রাজসর্প, রাজসর্ষপ।

‘দাস’ শব্দ পরে থাকিলে কালী দেবী চণ্ডী ষষ্ঠী প্রভৃতি স্ত্রীবাচক শব্দের অন্ত্য ঈ-কার ই-কার হয় (“ড্যাপোঃ সংজ্ঞাছন্দসোবহুলম্” সূত্রানুযায়ী) : কালীর দাস কালিদাস; দেবীর দাস = দেবিদাস। সেইরূপ ষষ্ঠিদাস, চণ্ডিদাস (কিন্তু বিকল্পে চণ্ডীদাসও হয় এবং চণ্ডিদাস অপেক্ষা চণ্ডীদাস রূপটিই বেশী প্রচলিত)।

শিশু, শাবক, দুগ্ধ, ডিম্ব প্রভৃতি শব্দ পরপদ হইলে কয়েকটি জাতিবাচক শব্দের স্ত্রীলিঙ্গের স্থানে পুংলিঙ্গ হয়। মৃগীর শিশু = মৃগশিশু; হস্তিনীর শাবক = হস্তিশাবক; হংসীর ডিম্ব = হংসডিম্ব; ছাগীর দুগ্ধ = ছাগদুগ্ধ। সেইরূপ শার্দূলশাবক, মেষশিশু, পক্ষিশাবক।

কয়েকটি ক্ষেত্রে সম্বন্ধপদের বিভক্তিযুক্ত পদটি শেষে বসে : রাত্রির মধ্য = মধ্যরাত্র; রাত্রির পূর্ব (প্রথমাংশ) = পূর্বরাত্র [ কিন্তু পূর্বা যে রাত্রি = পূর্বরাত্রি (গতরাত্রি)—কর্মধারয় ]; ‘অহ’র (দিনের) পূর্ব (প্রথমাংশ) = পূর্বাহ্ণ (ণত্ব-বিধ লক্ষ্য কর); ‘অহ’র মধ্য মধ্যাহ্ন; ‘অহ’-র অপর (শেষাংশ) = অপরাহ্ণ (ণত্ব-বিধি); ‘অহ’-র সায় (সমাপ্তি) = সায়াহ্ন; দরিয়ার মাঝ = মাঝদরিয়া। সেইরূপ প্রাহু, মাঝপথ ইত্যাদি। “আসনে বসে ধ্যাননিরত হয়ে পূর্বরাত্র কাটিয়ে দিল শুকদেব।” ভারতে যখন বেলা বারোটা, ওআশিংটনে তখন পূর্বরাত্রি একটা ত্রিশ মিনিট। “অব্রাহ্মণ নহ তুমি তাত, তুমি দ্বিজোত্তম, তুমি সত্যকুলজাত।” মাঝদরিয়ায় প্রবল দুর্যোগ দেখে মাঝিরা মাঝপথ থেকেই নৌকো ফিরিয়ে আনল।

বহুর মধ্যে একের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ দেখাইতে, তুল্য সম সদৃশ পাৱা ইত্যাদি সাদৃশ্যবাচক শব্দ কিংবা গণ কুল সমূহ রাজি প্রভৃতি বহুত্ববোধক শব্দের প্রয়োগেও সম্বন্ধ-তৎপুরুষ সমাস হয়। বীরগণের অগ্রগণ্য = বীরাগ্রগণ্য; ধনীর গণ = ধনিগণ; পিতার তুল্য = পিতৃতুল্য; নরের উত্তম = নরোত্তম; অমৃতের সমান = অমৃতসমান; কবীশদের দল = কবীশদল; তোমার সদৃশ = ত্বৎসদৃশ; তাহার তুল্য = তত্তুল্য; যোগিনীর পারা (মতো) = যোগিনীপারা। সেইরূপ দ্বিজশ্রেষ্ঠ, রত্নরাজি, যমসম, দেবতুল্য, মেঘমালা, গুণিগণ, শিশুগণ, রাজগণ, মহাত্মগণ, কবিকুল ইত্যাদি। “যম-সম শীত তাহে নিরমিল বিধি।”—মুকুন্দরাম। “বিরতি আহারে রাঙ্গা বাস পরে যেমত যোগিনী-পারা।”—চণ্ডীদাস। “মহাভারতের কথা অমৃত সমান। হে কাশি, কীশ-দলে তুমি পুণ্যবান্।”

একই পদ নির্ধারণে সম্বন্ধ-তৎপুরুষ হয়, আবার অধিকরণ-তৎপুরুষও হয়; কিন্তু ব্যাসবাক্যের ভঙ্গিমাটি পৃথক্। কবিশ্রেষ্ঠ = কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ (অধিকরণ—তৎপুরুষ); কিন্তু কবিদের শ্রেষ্ঠ (সম্বন্ধ-তৎপুরুষ)।

আরও দুইপ্রকার তৎপুরুষ আছে—উপপদ তৎপুরুষ ও নঞ-তৎপুরুষ।

উপপদ তৎপুরুষ সমাস

উপপদ কাহাকে বলে, আগে জানা দরকার।

১৪৫। উপপদ : যে-সকল পদের পরস্থিত ধাতুর উত্তর বিশেষ বিশেষ কৃৎ—প্রত্যয় হয়, সেইসকল পদকে উপপদ বলে।

পঙ্কে জন্মে যাহা = পঙ্কজ। “পঙ্কজ” কথাটি বিশ্লেষণ করিলে পাওয়া যায় : পঙ্ক-√জন্ + ড। এখানে ‘পঙ্ক’ নামপদটির পরস্থিত জন্ ধাতুর উত্তর ড কৃৎ-প্রত্যয়টি যুক্ত হইয়াছে। এইজন্য পঙ্ক পদটিকে উপপদ বলে। মনে রাখিও উপপদটি ধাতুর পূর্বে বসে। আর, √জন্ + ড = জ। এই “জ” পদটিকে কৃদন্ত পদ বলে। কৃৎ-প্রত্যয় অন্তে আছে বলিয়াই নাম কৃদন্ত। সুতরাং কৃদন্ত পদের পূর্ববর্তী পদটিই উপপদ। এইবার উপপদ তৎপুরুষের সংজ্ঞার্থটি সহজেই নির্দেশ করিতে পারি।—

১৪৬। উপপদ তৎপুরুষ : উপপদের সহিত কৃদন্ত পদের যে সমাস, তাহাকে উপপদ তৎপুরুষ সমাস বলে। এই সমাসে উপপদের বিভক্তি লোপ পায় এবং কৃদন্ত পদের অর্থটিই প্রাধান্য পায়। আমাদের উদাহরণটিতে “পঙ্ক” উপপদের সহিত “জ” কৃদন্ত পদের সমাস হওয়ায় “পঙ্কজ” সমস্ত-পদটির সৃষ্টি হইয়াছে। ব্যাসবাক্যে “পঙ্ক” উপপদে অধিকরণের “এ” বিভক্তি ছিল, সমাসে তাহার লোপ হইয়াছে। সমাসে “জন্মে যাহা” অর্থে “জ” কৃদন্ত পদটিরই অৰ্থ প্ৰাধান্য পাইতেছে। রমণ, মোহন, রঞ্জন, কর, ধর, ধারী, চর প্রভৃতি উল্লেখ্য কৃদন্ত পদ।

উপপদ তৎপুরুষ সমাসের ব্যাসবাক্য বলিবার সময় কৃদন্ত পদটিকে ক্রিয়ায় পরিবর্তিত করিতে হয়—সমাসের উত্তরপদ হিসাবে ইহার পৃথক্ সত্তা আর থাকে না। কৃদন্ত পদটিকে ক্রিয়ায় পরিবর্তিত করিতে হইলে পূর্বপদটির সহিত ইহা কর্ম, করণ, অপাদান বা অধিকরণ কারক-সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়। গৃহে থাকে যে = গৃহস্থ; মধু করে যে = মধুকর; বসু (ধন) ধরে যে = বসুন্ধরা; গণিত জানেন যিনি=গণিতজ্ঞ; গুপ্তভাবে চরে যে = গুপ্তচর; সার দেন যে দেবী = সারদা; সন্দেশ (সংবাদ) বহন করে যে = সন্দেশবহ; নৃ (নরগণকে) পালন করেন যিনি = নৃপ; সহ (সঙ্গে-সঙ্গে) জন্মে যাহা = সহজ; সুযোগের সন্ধান করে যে = সুযোগসন্ধানী; অগ্রে জন্মে যে = অগ্রজ; রস জানেন যিনি = রসজ্ঞ; এক দেশ (অংশ) দেখে যে = একদেশদর্শী; সর্বত্র গমন করে যে = সর্বত্রগামী; মনকে মোহিত করে যে = মনোমোহী (স্ত্রীলিঙ্গে মনোমোহিনী); গো পালন করে = গোপ; সূত্র ধারণ করেন যিনি = সূত্রধার; কৌপীন ধারণ করে যে = কৌপীনধারী; একান্নে বর্তন করে যে = একান্নবর্তী; মৃৎ (মৃত্তিকা) ভেদ করে যে = মৃদভেদী; অণ্ড হইতে জন্মে যে = অণ্ডজ; জলে চরে যে = জলচর; শাস্ত্র জানেন যিনি = শাস্ত্রজ্ঞ; নীর দান করে যে = নীরদ [ কিন্তু নিঃ (নাই) রদ (দন্ত) যাহার = নীরদ—বহুব্রীহি ]; মুখে থাকে যে = মুখস্থ; নিশা করে যে = নিশাকর; পাদদ্বারা পান করে যে = পাদপ; বর দান করেন যিনি = বরদ (স্ত্রীলিঙ্গে বরদা); নানা চিহ্ন ধারণ করে যে = নানাচিহ্নধারী; পয়ঃ ধারণ করে যে = পয়োধর [ কিন্তু গঙ্গাধর, বংশীধর, বংশধর ইত্যাদি সম্বন্ধ-তৎপুরুষ; ব্যাসবাক্য হইবে—গঙ্গার ধর (ধারক), বংশীর ধর ইত্যাদি ]; নভঃ (আকাশে) চরে যে = নভশ্চর; পত্রে পত্রে চরে যে = পত্রচর; দ্বি (দুইয়ের দ্বারা) পান করে যে = দ্বিপ (হস্তী); ত্রি (তিন) পথে গমন করে যে = ত্রিপথগ (স্ত্রীলিঙ্গে—ত্রিপথগা); পুরে বাস করে যে নারী = পুরবাসিনী; মিথ্যা বলে যে = মিথ্যাবাদী; বিহায়সে (আকাশে) গমন করে যে = বিহগ [ নিপাতনে ]; শত্রুকে বধ করে = শত্রুঘ্ন; বিশ্ব জয় করিয়াছে যে = বিশ্বজিৎ; মাতাকে হত্যা করিয়াছে যে = মাতৃঘাতী; রুচি করে যে = রুচিকর; আত্মা হইতে জন্মে যে = আত্মজ; সব্য (বাম)-দ্বারা সচন (কার্য) করেন যিনি = সব্যসাচী; মলয়ে জন্মে যে মলয়জ; গিরিতে শয়ন করেন যিনি = গিরিশ (মহাদেব) [ কিন্তু গিরির ঈশ গিরীশ (হিমালয়)—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ ]; পার (সীমা) দর্শন করে যে = পারদর্শী; ভূমিতে থাকে যে = ভূমিষ্ঠ; সর্বনাশ করে যে = সর্বনাশা; পাস করিয়াছে যে পাসকরা [ কিন্তু পাস করা হইয়াছে যাহার দ্বারা (ব্যক্তি) বা পাস করা যায় যাহার দ্বারা (বুদ্ধি) পাসকরা-বহুব্রীহি ]; বর্ণ চুরি করে যে = বর্ণচোরা (আম); বোল ধরিয়াছে যে = বোলধরা (পাখি); বাস্তু হারাইয়াছে যে বাস্তুহারা; বালককে ভুলায় যে = বালকভুলানো; মন লুব্ধ করে যে = মনোলোভা; ডাণ্ডা পিটিয়া থাকে যে = ডানপিটিয়া > ডানপিটে; পুঁথি পড়ে যে = পুঁথিপড়ো; কাঠে ঠোকরায় যে = কাঠঠোকরা; একঘরে বাস করে যে = একঘরিয়া > একঘরে; দুনিয়া জুড়িয়া থাকে যে = দুনিয়াজোড়া (যশ); কুল মজায় যে নারী = কুলমজানী; লুচি ভাজে যে = লুচিভাজা (বামুন) [ কিন্তু লুচি ভাজে যাহাতে = লুচিভাজা (কড়াই অথবা ঘি)—বহুব্রীহি; লুচিকে ভাজা লুচিভাজা—কর্ম-তৎপুরুষ ]। সেইরূপ দিবাকর, কুম্ভকার, ইন্দ্রজিৎ, মদ্যপ, অনুজ, অগ্রজ, মৃত্যুঞ্জয়, ভুজঙ্গ, চমকপ্রদ, সর্বশব্দগ্রাহী, সর্ব-উপদ্রবসহা, শোলোকবলা, আলোকরা, অর্থবহ, তাপসহ, সুখপ্রদ, শশধর, সরোজ, মনোজ, হৃদয়গ্রাহী, মর্মদাহী, ধারাধর, হৃদয়হরণ, সর্বগ্রাসী, দনুজ, সত্যবাদী, মাতৃহারা, মৃত্যুজিৎ, হাস্যাবহ, পার্শ্বচর, মিতভাষী, স্তন্যপায়ী, অরিন্দম, সর্বংসহা, ভূচর, জাদুকর, মালাকার, মুখরোচক, দিগ্‌বিজয়ী, সূত্রধর, অভ্রভেদী, নভোলোভী, গগনচুম্বী, নভশ্চারী, বিমানবিধ্বংসী, শ্রুতিধর, অন্তোজ, চিত্তাকর্ষক, নিশাচর, ভুবনমোহন, ক্লেশহর, শুভবহা, অম্ভোদ (মেঘ), পথিকৃৎ, হিতকর, ভবঘুরে, ধাননাচানো, সবজান্তা, গলাকাটা (দোকানী), পকেটমার, ধামাধরা, পা-চাটা, সর্বহারা, নিদহারা, হাড়ভাঙা, মাছিমারা (কেরানী), ভাতখেকো, ঘরভাঙা, কর্তাভজা, পাড়াবেড়ানী, ঘরজ্বালানী, সাঁঝঘুমানী, ঘুমভাঙানে, কাঠকুডুনী, কানভাঙানী, কপালজোড়া, আঁধারভাঙা, তল্পিবহা, মনচোরা, ঘরছাড়া, চুলচেরা, কর্মনাশা, মানুষছাঁকা (রাজা), ছাপোষা, মিছ-কহনিয়া, দুখ-জাগানিয়া, ভুবনভোলানো, বউলধরা (গাছ), দিশাহারা ইত্যাদি।

কয়েকটি উদাহরণ দেখ—”তারি লাগি আকাশরাঙা আঁধারভাঙা অরুণরাগে।” “ওগো দুখজাগানিয়া, তোমায় গান শোনাব।” “তোমার ওই শিকলভাঙা এমন রাঙা মূর্তি দেখি নাই।” “আলো নয়নধোয়া, আমার আলো হৃদয়হরা।” “রেখে যাব এই নামগ্রাসী আকারগ্রাসী সকল পরিচয়গ্রাসী ধূলিরাশির মধ্যে।” সহজ হওয়াই শক্তিমানের তপস্যা। “প্রতিমার মাটি গলে দীঘির গভীরজলে পঙ্ক হয়ে পঙ্কজ ফুটায়।” “হে দীপপ্রদ, এই অন্ধকার বিদীর্ণ করে দাও।” “ও পারেতে সোনার কূলে আঁধারমূলে কোন্ মায়া গেয়ে গেল কাজভাঙানো গান।” “আজ আমার মতো সর্বহারা কে আছে?” “হারিয়ে গেছে, ওরে! হারিয়ে গেছে বোলবলা সেই বাঁশি।” “মালাকার তার মাল্য যোগায় স্বর্ণকারেরা ভূষিছে সোনায়।” “হে পুরবাসিনী, সবে ডাকি কয়, ‘হয়েছে প্রভুর পূজার সময়।”

মনে রাখিও—উপপদের ব্যাসবাক্যের শেষপদটি হইবে কর্তৃকারক ‘যে’ বা ‘যিনি, কিন্তু ‘যাহার’, ‘যাহার দ্বারা’ বা ‘যাহাতে’ হইবার সম্ভাবনা থাকিলেই সমাস হইবে বহুব্রীহি।

নঞ্‌-তৎপুরুষ সমাস *

[* পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ২০০৫ সাল হইতে প্রবর্তিত পাঠ্যসূচীতে এটিকে না-তৎপুরুষ সমাস বলা হইয়াছে। ]

নঞ্ একটি অব্যয়। ইহার অর্থ “না, নহে (নয়), নাই।”

১৪৭। ন-তৎপুরুষ সমাস : নঞ অব্যয়কে পূর্বপদ করিয়া উত্তরপদ বিশেষ্য বা বিশেষণের সহিত যে সমাস হয়, তাহাকে নঞ-তৎপুরুষ সমাস বলে। এই সমাসে পরপদেরই অর্থ প্রাধান্য পায়। মনে রাখিও, নঞ তৎপুরুষ সমাসে নঞ অব্যয়টি না ও নহে (নয়) অর্থে ব্যবহৃত হয়, কিন্তু নঞর্থক বহুব্রীহি সমাসে কেবল নাই অর্থে ব্যবহৃত হয়। সুতরাং নঞ-তৎপুরুষের ব্যাসবাক্যে না বা নহে (নয়) লেখা উচিত।

উত্তরপদের প্রথমবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ হইলে নঞ স্থানে অ, আর স্বরবর্ণ হইলে অন্ হয়। ম্লান নয় অম্লান; আবশ্যক নয় = অনাবশ্যক; আময় (অসুস্থতা) নয় = অনাময়; অবদ্য (নিন্দনীয়) নয় = অনবদ্য; রসিক নয় = অরসিক; নিবার্য নয় = অনিবার্য; ঋত (সত্য) নয় = অনৃত; গণ্য নয় = অগণ্য (যাহার সংখ্যা গণনা করা যায় না); এক নয় = অনেক; মোঘ (নিষ্ফল) নয় = অমোঘ; ঈহা (ইচ্ছা বা চেষ্টা) নয় = অনীহা; অটন (গমন) নয় = অনটন; আহূত নয় = অনাহুত; ঋণী নয় = অঋণী, অনুণী; ধৃষ্ট (প্রগল্ভ) নয় = অধৃষ্ট; নির্বচনীয় নহে = অনির্বচনীয়; অন্বিত নয় = অনন্বিত; উন্নীত নয় = অনুন্নীত; ব্রাহ্মণ নয় অব্রাহ্মণ। সেইরূপ অকুণ্ঠিত, অধীর, অভাব, অনাকাঙ্ক্ষিত, অনভিপ্রেত, অনীপ্সিতা, অনাস্বাদিত, অনবনত, অননুমোদিত, অননুভূত, অননুকূল, অনমনীয়, অনুজ, অনায়ত্ত, অনাস্থা, অরতি, অনলস, অব্যক্ত, অজ্ঞাত, অসঙ্গত, অনভিজ্ঞ, অস্থির, অনতিতীক্ষ্ণ, অনৈশ্বর্য, অনাচার, অনুচিত, অসাধু, অক্ষম, অনাসক্ত, অনাদর, অকাল, অবেলা, অনর্থ, অশুভ, অসৎ, অকাতর, অনাঘ্রাতা, অনশন, অনিচ্ছা, অনাবাদী, অশরীরী, অনচ্ছ, অজানা, অকাট্য, অকাজ, অফুরন্ত।

কখনও কখনও নঞ-এর ন সমস্ত-পদটিতে থাকিয়া যায়। অতি বৃহৎ নয় নাতিবৃহৎ; অতিশীতোষ্ণ নয় = নাতিশীতোষ্ণ (শব্দটিতে দ্বন্দ্ব ও কর্মধারয়ও রহিয়াছে); গণ্য নয় = নগণ্য (তুচ্ছ); ক্ষত্ৰ নয় নক্ষত্র। সেইরূপ নাতিদুর, নাতিদীর্ঘ, নাতিতীক্ষ্ণ।

খাঁটী বাংলা সমাসে নঞ-স্থানে অ, না, নি, বি, বে, অনা, গর, নির্ প্রভৃতি হয়। কাল নয় = অকাল; রাজী নয় = নারাজ; বলা নয় = না-বলা (কথা); খরচা নয় = নিখরচা [কিন্তু খরচ নাই যাহার = নিখরচিয়া > নিখরচে—বহুব্রীহি ]; মামা নয় = নেই-মামা; তাল নয় = বেতাল; মিল নয় = গরমিল; সৃষ্টি নয় = অনাসৃষ্টি; ভরসা নয় = নির্ভরসা। সেইরূপ আভাঙা (গম), আছোলা (বাঁশ), আধোয়া (চাল), আবাঁধা (চুল), আখোলা (দরজা), আলুনী (তরকারী), আফোটা (দুধ), আকাচা (কাপড়), আগাছা, না-পাওয়া (বেদনা), বেটাইম, গরমঞ্জুর, গরহাজির, গররাজী, বেমানান, বেবন্দোবস্ত, বেগতিক, বেচাল, বেহিসাবী, বেসরকারী (সংবাদ), বে-অকুফ, বেরসিক, নির্ঝঞ্ঝাট, বিজোড়, বেঢপ (ঢপ গঠন)। প্রয়োগ : “অস্বাদিতমধু যেমন যূথী অনাঘ্রাতা।” “শারদনিশির স্বচ্ছ তিমিরে তারা অগণ্য জ্বলে।” “আমার না-বলা বাণী।”

কর্মধারয় সমাস

১৪৮। কর্মধারয় সমাস : যে সমাসে পূর্বপদ পরপদের বিশেষণ-রূপে অবস্থান করে এবং পরপদেরই অর্থ প্রাধান্য পায়, তাহা কর্মধারয় সমাস। কর্মধারয় সমাসে উভয় পদে কর্তৃকারকের একই বিভক্তি (শূন্য) হয়। এইজন্য সংস্কৃতে এই সমাসটি তৎপুরুষ সমাসের অন্তর্ভূত।

কর্মধারয় সমাস পাঁচ প্রকারের : (১) সাধারণ, (২) মধ্যপদলোপী, (৩) উপমান, (৪) উপমিত ও (৫) রূপক।

সাধারণ কর্মধারয় সমাস

(ক) বিশেষণ + বিশেষ্য : পীত যে অম্বর = পীতাম্বর (অম্বরটিকে বুঝাইতেছে); শুদ্ধ যে অন্ন = শুদ্ধান্ন; মিষ্ট যে অন্ন (খাদ্য) = মিষ্টান্ন; খুল্ল (ক্ষুদ্র) যে তাত = খুল্লতাত; শুচি যে বস্ত্ৰ = শুচিবস্ত্র; সুদৃঢ় যে সংকল্প = সুদৃঢ়সংকল্প; পূর্বা যে রাত্রি = পূর্বরাত্রি (আগের দিনের রাত্রি, কিন্তু রাত্রির পূর্ব পূর্বরাত্র—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ—রাত্রির প্রথমাংশ অর্থে); নব যে যৌবন = নবযৌবন; বাহ্য যে আড়ম্বর = বাহ্যাড়ম্বর; রক্ত (লাল) যে উৎপল = রক্তোৎপল; কাল (ভয়ঙ্কর) যে ফাঁদ = কাল-ফাঁদ; রুদ্র যে বীণা = রুদ্রবীণা; কম (কমনীয়) যে কলেবর = কম-কলেবর; বালা (প্রাথমিক অবস্থায়) যে গঙ্গা = বালগঙ্গা; বর (বরণীয়) যে বপু = বরবপু; ভর (পরিপূর্ণ) যে সন্ধ্যা ভরসন্ধ্যা; বিশ্ব (সকল) যে মানব = বিশ্বমানব; পুণ্য যে অহ = পুণ্যাহ; গুপ্ত যে চর = গুপ্তচর; পাণ্ডু (খসড়া) যে লিপি = পাণ্ডুলিপি; উড়ো যে জাহাজ = উড়োজাহাজ; খাস যে মহল খাসমহল; হেড যে মাস্টার = হেডমাস্টার; কু (কুৎসিত) যে অন্ন কদন্ন (কু-স্থানে কৎ); কু যে পুরুষ কুপুরুষ (শ্রীহীন) এবং কাপুরুষ (ভীরু); রক্ত (লাল) যে চন্দন রক্তচন্দন; পরমা যে ঈশ্বরী = পরমেশ্বরী; বি (ভিন্ন) যে মাতা = বিমাতা; প্রিয় যে সখা = প্রিয়সখ; গণ্ড (বর্ধিষ্ণু) যে গ্রাম : গণ্ডগ্রাম; দুঃ এমন অবস্থা = দুরবস্থা; রাম (বড়) যে ছাগল = রামছাগল; কাঁচা যে কলা = কাঁচাকলা; আলগা (অগভীর) যে চটক (সৌন্দর্য) = আলগাচটক; জিবে (<জিবিয়া—জিবের আকৃতি-বিশিষ্ট) যে গজা = জিবেগজা। সেইরূপ পুণ্যতিথি, পূর্ণচন্দ্র, সজ্জন, শ্বেতপদ্ম, নীলকমল, কদক্ষর, স্নিগ্ধদৃষ্টি, শুভোৎসব, বিকম্পিত-চেলাঞ্চল, নবপল্লব, পরমসুন্দরী, শ্বেতশ্মশ্রু, দুরাকাঙ্ক্ষা, নষ্টনীড়, দুশ্চেষ্টা, বদহজম, কানাকড়ি, হেঁড়েগলা, কড়াপাক, নীলশাড়ী, রাঙাবউ, ভরপেট, ভরাযৌবন, ফুলবাবু, হাফমোজা, হেডপণ্ডিত, নতুন-গিন্নী।

কর্মধারয় (ও বহুব্রীহি) সমাসে মহৎ শব্দের স্থানে মহা হয়। মহান্ যে মনীষী = মহামনীষী; মহান্ যে উপাধ্যায় = মহোপাধ্যায়; মহতী যে সভা = মহাসভা; মহতী যে অষ্টমী = মহাষ্টমী; মহৎ যে বল = মহাবল; মহৎ যে ধন = মহাধন [ কিন্তু মহতের ধন = মহধন—সম্বন্ধ-তৎ ]; মহান্ যে রাজা = মহারাজ [ ‘মহারাজা’ পদটিও বাংলায় চলে : সন্তোষের মহারাজা, দ্বারভাঙ্গার মহারাজা ইত্যাদি ]। সেইরূপ মহর্ষি, মহারাত্রি, মহারানী। প্রয়োগ : “মহোৎসবে রত সবে আজি নিশা-কালে।”—মধুসূদন। “বাজবে যে আজ মহোল্লাসে তোমার মহাশঙ্খ। “ “হে রুদ্রবীণা, বাজো।” মহাবিদ্যাতে মহতী বিদ্যা আছে, মহতী অবিদ্যাও আছে। কয়েকটি ক্ষেত্রে পূর্বপদটি বিশেষ্য হওয়া সত্ত্বেও বিশেষণ-রূপে ব্যবহৃত হয়। মূল যে সুর = মূলসুর; সত্য যে বার্তা = সত্যবার্তা; জোর যে বরাত = জোরবরাত; আঁধার যে ঘর = আঁধারঘর। সেইরূপ মিথ্যাভাষণ, সারসত্য।

মাঝে মাঝে বিশেষণপদটি উত্তরপদ এবং বিশেষ্যপদটি পূর্বপদ হয়। সাধারণ যে জন = জনসাধারণ; বৃদ্ধ যে ঋষি = ঋষিবৃদ্ধ; অধম যে নর = নরাধম; উত্তম যে পুরুষ = পুরুষোত্তম; প্রবর যে সাধক = সাধকপ্রবর; কিশোর যে কৃষ্ণ কৃষ্ণকিশোর; বাটা যে লঙ্কা = লঙ্কাবাটা; ভাজা যে পটোল = পটোলভাজা Į কিন্তু লঙ্কাবাটা বন্ধ করে পটোলভাজায় হাত দাও—এখানে “লঙ্কাকে বাটা”, “পটোলকে ভাজা” অর্থে কর্ম-তৎপুরুষ সমাস হইবে; ক্রিয়ার অর্থই এখানে প্রাধান্য পাইতেছে ]; ছন্ন (আচ্ছন্ন) যে মতি = মতিচ্ছন্ন; সিদ্ধ যে আলু = আলুসিদ্ধ; পোড়া যে কচু = কচুপোড়া। সেইরূপ পণ্ডিতপ্রবর, লোকবিশেষ, বেগুনপোড়া, মাছভাজা ইত্যাদি।

(খ) বিশেষ্য + বিশেষ্য (একই বিশেষ্যকে বুঝাইতে) : যিনি চিৎ তিনিই আনন্দ = চিদানন্দ; যিনি রাজা তিনি ঋষি = রাজর্ষি; যিনি শিব তিনিই নাথ = শিবনাথ; যিনি পিতা তিনিই দেব = পিতৃদেব; যিনি কারু তিনি শিল্পী কারুশিল্পী; যাহা মলয় তাহাই অনিল = মলয়ানিল; জ্ঞাতি যিনি শত্রুও তিনি জ্ঞাতিশত্রু; যিনি নৃপ তিনিই শিষ্য = নৃপশিষ্য; বউ অথচ ঠাকুরানী বউঠাকুরানী; যিনি মা তিনিই ঠাকরুন = মা-ঠাকরুন; যিনি শশী তিনি বাবু শশীবাবু; যাহা হল (Hall) তাহাই ঘর = হলঘর। সেইরূপ ঋষিকবি, মাতৃদেবী, ঠাকুরদাদা, ঠানদিদি, মৌলবীসাহেব, দারোগাবাবু, গুরুদেব, মাস্টারমশায়, কথকঠাকুর, রাজসন্ন্যাসী, কলিকাতানগরী, বৈদ্যনাথ, রামকৃষ্ণ, শিবশঙ্কর।

দুইটি বা তাহার বেশী বিশেষ্যপদে দ্বন্দ্ব সমাসও হয়, কিন্তু সেখানে প্রতিটি পদেরই অর্থপ্রাধান্য থাকে।

(গ) বিশেষণ + বিশেষণ (দুইটি গুণ একসঙ্গে একই বস্তুতে বিদ্যমান অর্থে) : যিনি গণ্য তিনিই মান্য = গণ্যমান্য; যাহা স্নিগ্ধ তাহাই উজ্জ্বল স্নিগ্ধোজ্জ্বল; কাঁচা অথচ মিঠে = কাঁচামিঠে; তাজা অথচ মরা তাজামরা; সরল অথচ উন্নত = সরলোন্নত; যে হৃষ্ট সেই পুষ্ট সরলোন্নত; যে হৃষ্ট সেই পুষ্ট = হৃষ্টপুষ্ট; মধুর যাহা শ্যামল তাহা = মধুরশ্যামল; বিষণ্ণ অথচ মধুর = বিষণ্নমধুর; ভীষণ অথচ মধুর = ভীষণমধুর; আগে গত পরে আয়াত = গতায়াত; পূর্বে স্নাত পরে অনুলিপ্ত = স্নাতানুলিপ্ত; (কণ্ঠে) নীল অথচ (কেশে) লোহিত = নীললোহিত (শিব); আগে বাছা পরে ধোয়া = বাছাধোয়া (মাছ)। সেইরূপ চালাক-চতুর, সুপ্তোত্থিত, শয়িতোখিত, দত্তাপহৃত, জীবনাত, করুণকোমল, কান্তকোমল, ধোয়ামোছা (ঘর), কাঁচাপাকা (চুল), মিঠেকড়া, কচিকাচা, ক্লিষ্টক্লান্ত, অম্লমধুর, পণ্ডিতমূর্খ।

দুইটি বিশেষ্য বা বিশেষণ বিভিন্ন বস্তু বা ব্যক্তিকে বুঝাইলে দ্বন্দ্ব সমাস হয়। সেখানে প্রতিটি পদেরই অর্থপ্রাধান্য থাকে। রামকৃষ্ণ = যিনি রাম তিনি কৃষ্ণ (একই ব্যক্তি)–কর্মধারয়, কিন্তু রাম ও কৃষ্ণ = রামকৃষ্ণ (বিভিন্ন ব্যক্তি)—সমাস তখন দ্বন্দ্ব। পণ্ডিতমূর্খ = পণ্ডিত (জ্ঞানে) অথচ মূৰ্খ (ব্যবহারে)—একই ব্যক্তি, তাই কর্মধারয়; কিন্তু পণ্ডিত ও মূর্খ = পণ্ডিতমূর্খ (বিভিন্ন ব্যক্তি)—তাই দ্বন্দ্ব। মহাপ্রভুর কাছে ধনিদরিদ্র পণ্ডিতমূর্খের বালাই ছিল না।

সাধারণ কর্মধারয় সমাসনিষ্পন্ন কয়েকটি পদ বিশিষ্ট অর্থ প্রকাশ করে। আপনার মতো রাঙামুলো (দেখিতে সুন্দর অথচ অপদার্থ) নিয়ে আমার আপিস চলবে না দেখছি। পরীক্ষার সময় স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখবে, অসুখবিসুখ করলেই ভরাডুবি (সাফল্যের মুখে সর্বনাশ)। ছেলের বিয়ে দেবার বেলায় অনেক মাটির মানুষও রাঘববোয়াল সেজে বসেন (অত্যধিক লোভী)।

মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস

১৪৯। মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস : যে কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যকার পদটি লুপ্ত হয়, তাহাকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস বলে।

সিংহ-লাঞ্ছিত আসন = সিংহাসন (‘লাঞ্ছিত’ পদটি লুপ্ত); ভিক্ষালব্ধ অন্ন ভিক্ষান্ন; বৃত্রনামক অসুর = বৃত্রাসুর; কর্ণিকার-নামক বৃক্ষ = কর্ণিকার বৃক্ষ উদয়-নামক গিরি = উদয়গিরি; মরুময়ী ভূমি = মরুভূমি; (শ্রীকৃষ্ণের) জন্মসংলগ্না অষ্টমী = জন্মাষ্টমী; গীতিভূয়িষ্ঠ নাট্য = গীতিনাট্য; স্পর্শসিদ্ধ মণি = স্পর্শমণি; আদিভূত পিতা = আদিপিতা; স্বর্ণনির্মিত আভরণ = স্বর্ণাভরণ; উদয়কালীন রবি উদয়রবি; চিরস্থায়ী সৌন্দর্য = চিরসৌন্দর্য; আকাশ-মারফত প্রেরিত বাণী আকাশবাণী; ধন্যবাচক ধ্বনি = ধন্যধ্বনি; মাতার মৃত্যুজনিত দায় = মাতৃদায়; জীবনহানির আশঙ্কায় বীমা = জীবনবীমা; রাজকার্যে নিযুক্ত পুরুষ = রাজপুরুষ; রাজার অনুসৃত নীতি = রাজনীতি; রাজার পৃষ্ঠপোষিত কবি = রাজকবি; আকাশে (ঊর্ধ্বে) প্রদত্ত প্রদীপ = আকাশপ্রদীপ; পদচালিত ব্রজ (পথ) = পদব্রজ; পদ-সংরক্ষণের আয়ুধ (অস্ত্রশস্ত্র) = পদায়ুধ; পথে অনুষ্ঠিত সভা = পথসভা; বেণুধারী গোপাল = বেণুগোপাল; বরের অনুগামী যাত্রী = বরযাত্রী; জামাইয়ের কল্যাণার্থে ষষ্ঠী = জামাইষষ্ঠী; ননীলোভী গোপাল = ননীগোপাল; রজতনির্মিত মুদ্রা = রজতমুদ্রা; মৌ-সঞ্চয়কারী মাছি = মৌমাছি; আক্ষেপ-দ্যোতক অনুরাগ—আক্ষেপানুরাগ; স্বর্ণনির্মিত দ্বীপ = স্বর্ণদ্বীপ; প্রাণিবিষয়ক বিদ্যা = প্রাণিবিদ্যা; কনকপূর্ণা অঞ্জলি = কনকাঞ্জলি; রহস্যপূর্ণ আলাপ = রহস্যালাপ; কস্তুরীযুক্ত মৃগ কস্তুরীমৃগ; লোকসমাজে প্রচলিত গীতি = লোকগীতি; মাননির্দেশক পত্ৰ = মানপত্র; পল-মিশ্রিত অন্ন = পলান্ন; মায়াপ্রকাশক কান্না = মায়াকান্না; ফল-নিষ্পন্ন আহার = ফলাহার; ভ্রাতৃকল্যাণ—সূচক দ্বিতীয়া = ভ্রাতৃদ্বিতীয়া; জ্ঞানলাভের ইন্দ্রিয় = জ্ঞানেন্দ্রিয়; লক্ষ্মীযুক্তা শ্রী = লক্ষ্মীশ্রী; যজ্ঞলব্ধ উপবীত = যজ্ঞোপবীত; বহিঃস্থিত আবরণ = বহিরাবরণ; পাদে (পৃষ্ঠার নিম্নদিকে) লিখিত টীকা = পাদটীকা; দাসযোগ্য মনোভাব = দাসমনোভাব; আয়ুবিষয়ক বেদ = আয়ুর্বেদ; বিম্বসদৃশ অধর = বিম্বাধর; ছাত্র থাকাকালীন জীবন = ছাত্রজীবন; অস্তকালীন রাগ অস্তরাগ; সন্ধ্যাকালীন আহ্নিক = সন্ধ্যাহ্নিক; প্রভাতকালীন নিদ্রা = প্ৰভাতনিদ্রা; ব্যোমে (ব্যোমপথে) যাইবার যান = ব্যোমযান; ছায়া-দানকারী তরু = ছায়াতরু; শোকপ্রকাশিকা সভা = শোকসভা; প্রতিজ্ঞাসূচক পত্র = প্রতিজ্ঞাপত্ৰ; বজ্রসদৃশ মুষ্টি = বজ্রমুষ্টি; জয়যুক্ত নাদ = জয়নাদ; রুচি-অনুযায়ী সম্পন্ন = রুচিসম্পন্ন; পাটে অধিষ্ঠিতা রানী = পাটরানী; অগ্নিবর্ষী বীণা = অগ্নিবীণা; স্পর্ধাজনিত উক্তি স্পর্থোক্তি; মাৎসর্য-বিষযুক্ত দশন = মাৎসর্যবিষদশন; পদ্মচিহ্নিত বেদী পদ্মবেদী; দারুময় ব্রহ্ম = দারুব্রহ্ম; ত্রিতাপাত্মক দুঃখ = ত্রিতাপদুঃখ; পাদস্পৃষ্ট উদক = পাদোদক; দর্শনবিষয়ক শাস্ত্র = দর্শনশাস্ত্র; মধুময় ব্ৰহ্ম মধুব্ৰহ্ম; বিজয়সূচক শঙ্খ বিজয়শঙ্খ; কাঞ্চনময় কোকনদ = কাঞ্চনকোকনদ; নাতি-সম্পৰ্কীয় জামাই = নাতজামাই; আমের আকৃতিবিশিষ্ট (বা গন্ধবিশিষ্ট) সন্দেশ = আমসন্দেশ; আমের গন্ধবিশিষ্ট আদা = আম-আদা; গন্ধদ্রব্য-বিক্রয়কারী বণিক্ = গন্ধবণিক্; খ্রীষ্টপ্রবর্তিত ধর্ম = খ্রীষ্টধর্ম; সিঁদুর রাখিবার কৌটা সিঁদুরকৌটা; (শ্বশুরের) ঘরে পালিত জামাই = ঘরজামাই; কীর্তিজ্ঞাপক মন্দির কীর্তিমন্দির; এক অধিক দশ = একাদশ; ষট্ অধিক দশ = ষোড়শ; নাভিজাত পদ্ম = নাভিপদ্ম; ষট্ অধিক নবতি = ষণ্ণবতি (সন্ধি এবং ণত্ববিধি লক্ষণীয়); হাতে পরিবার ঘড়ি = হাতঘড়ি; হাত দিয়া চালানো পাখা = হাতপাখা; বয়ন-নামক শিল্প = বয়নশিল্প; সূচিসাধ্য শিল্প = সূচিশিল্প; ধান্যদূর্বায় ভরা মুষ্টি = ধান্যদূর্বা মুষ্টি; শববাহকের যাত্রা = শবযাত্রা; বাক্যের মাধ্যমে আলাপ = বাক্যালাপ; অন্দরস্থিত মহল = অন্দরমহল; গ্যাসপ্রতিরোধক মুখোশ = গ্যাসমুখোশ; গাড়ি দাঁড়াইবার বারান্দা = গাড়িবারান্দা; হাঁটু-পরিমাণ জল = হাঁটুজল; গোবর-মিশ্রিত জল = গোবরজল; সকড়িমাখা হাত = সকড়িহাত; তেল মাখিবার ধুতি = তেলধুতি; (অলংকারের) নকশা-চিত্রিত বড়ি = নকশা-বড়ি; চিনিযোগে পাতা = চিনিপাতা (দই)। সেইরূপ নলরাজা, মধ্যাহ্নভোজন, জলযান, অর্ণবযান, ইচ্ছামৃত্যু, সপ্তদশ, বায়ুরোগ, গৃহদেবতা, কেশতৈল, দুধভাত, ডাকগাড়ি, স্বর্ণমুদ্রা, রাষ্ট্রনীতি, অশ্রুআঁখি, স্বাধীনতাদিবস, দিবানিদ্রা, হস্তশিল্প, ধর্মসভা, সাহিত্য-অধিবেশন, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, ঝাঁকামুটে, কোমরজল, মাসমাহিনা, রাজধানী এক্সপ্রেস, সুটকেস, কাঁটাপেরেক। “ত্বরা করে তবে নিয়ে এসো সাজ—হেমকুণ্ডল, মণিময় তাজ, কেয়ূর কনকহার।”—রবীন্দ্রনাথ। “অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে।” “উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরি ভালে।” “মাৎসর্যবিষদশন কামড়ে রে অনুক্ষণ।” “আকাশপ্রদীপ জ্বলে দূরের তারার পানে চেয়ে।” “আকাশের অস্তরাগে আমারই স্বপ্ন জাগে।” “নাই যে সেথায় ছায়াতরু।” “চমকিবে ফাগুনের পবনে, পশিবে আকাশবাণী শ্রবণে।” তিনি ছাত্রজীবনে আয়ুর্বেদ ও দর্শনশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন।

মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাসে দশ, বিংশতি ও ত্রিংশৎ শব্দ পরে থাকিলে প্রথম পদ দ্বি, ত্রি ও অষ্টন্ শব্দের স্থানে যথাক্রমে দ্বা, ত্রয়ঃ ও অষ্টা হয়। কিন্তু চত্বারিংশৎ, পঞ্চাশৎ, ষষ্টি, সপ্ততি ও নবতি শব্দ পরে থাকিলে দ্বি, ত্রি ও অষ্টন্ শব্দ বিকল্পে দ্বা, ত্রয়ঃ ও অষ্টা হয়। দ্বি অধিক দশ দ্বাদশ; দ্বি অধিক বিংশতি দ্বাবিংশতি; ত্রি অধিক দশ = ত্রয়োদশ (সন্ধি লক্ষ্য কর); ত্রি অধিক ত্রিংশৎ ত্রয়স্ত্রিংশৎ; অষ্ট অধিক দশ = অষ্টাদশ; দ্বি অধিক চত্বারিংশৎ = দ্বিচত্বারিংশৎ বা দ্বাচত্বারিংশৎ; ত্রি অধিক ষষ্টি = ত্রিষষ্টি বা ত্রয়ঃষষ্টি; অষ্ট অধিক সপ্ততি অষ্টসপ্ততি বা অষ্টাসপ্ততি।

মনে রাখিও-তৎপুরুষ সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত যে অংশটির লোপ হয়, তাহা বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গ। কিন্তু মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত এক বা একাধিক পদ লোপ পায়। সুতরাং ব্যাসবাক্যের কোনো একটি অংশ লোপ পাইলেই সমাসবদ্ধ পদটিকে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় বলা সঙ্গত নয়। লুপ্ত অংশটি বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গ, না ব্যাসবাক্যের অন্তর্গত কোনো পদ—তাহা ভালো করিয়া লক্ষ্য করিতে হইবে।

উপমান, উপমিত ও রূপক কর্মধারয় সমাস

এই তিনটি সমাসের আলোচনা একসঙ্গে করা ভালো। আমরা অনেক সময় দুইটি বিজাতীয় বস্তুর মধ্যে তুলনা করিয়া থাকি। প্রধান বক্তব্যবিষয় যেটি তাহাকে উপমেয় বলে। একটি বিজাতীয় বস্তু আনিয়া তাহার সহিত উপমেয়ের তুলনা দেওয়া হয়। এই বিজাতীয় বস্তুটিকে উপমান বলে। কাল্পনিক যে গুণটি লইয়া উপমানের সহিত উপমেয়ের তুলনা দেওয়া হয়, তাহাকে সাধারণধর্ম বলে। তুলনা বুঝাইবার জন্য ন্যায়, মতো, সম ইত্যাদি যেসব কথা ব্যবহার করি তাহাদিগকে সাদৃশ্যবাচক শব্দ বলে। একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি সহজতর হইয়া উঠিবে।—

তাঁহার হৃদয়টি কমলের মতো কোমল। এই বাক্যে প্রধান আলোচ্যবিষয় হৃদয় = উপমেয়। “কমল” কথাটির সঙ্গে “হৃদয়” কথাটির তুলনা দেওয়া হইয়াছে। সুতরাং কমল = উপমান। কমল কোমল, হৃদয়ও কোমল; অতএব কোমল পদটি হইতেছে উপমেয় ও উপমানের সাধারণধর্মবাচক পদ। আর মতো হইতেছে সাদৃশ্যবাচক শব্দ। মনে রাখিও, এখানে হৃদয় ও কমল দুইটি বিজাতীয় বস্তু। রামের সঙ্গে রহিমের বা নদীজলের সঙ্গে সাগরজলের তুলনা দিলে উপমান—উপমেয় সম্পর্কটি আদৌ আসিবে না। চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, তারা, সাগর, নদী, পদ্ম, অগ্নি, বজ্র, পুষ্প, বিদ্যুৎ প্রভৃতি শব্দগুলি বিখ্যাত উপমান।

১৫০। উপমান কর্মধারয় সমাস : উপমানের সহিত সাধারণধর্মবাচক পদের সমাসকে উপমান কর্মধারয় সমাস বলে।

এই সমাসের ব্যাসবাক্যে উপমান পদটি প্রথমে, তৎপরে সাদৃশ্যবাচক শব্দ ও শেষে থাকে সাধারণধর্মবাচক পদ। উপমেয়ের কোনো উল্লেখ এখানে থাকে না। সমস্ত-পদটি বিশেষণ হইয়া যায়। কাজলের মতো কালো = কাজলকালো [ কোন্ জিনিসটি কাজলকালো?-মেঘ বা চুল। কিন্তু তাহার উল্লেখ এখানে করা হয় নাই ]; সিঁদুরের মতো রাঙা = সিঁদুররাঙা; শঙ্খের মতো ধবল = শঙ্খধবল; শিশিরের ন্যায় বিমল = শিশিরবিমল; দধির মতো থলথল = দধিথলথল; জ্যোৎস্নার মতো স্নিগ্ধ = জ্যোৎস্নাস্নিগ্ধ; মিশির মতো কালো = মিশকালো; ঘনের (মেঘের) ন্যায় শ্যাম = ঘনশ্যাম; শশের (শশকের) ন্যায় ব্যস্ত = শশব্যস্ত; ফুটির মতো ফাটা = ফুটিফাটা (মাঠ); শালের মতো প্রাংশু (দীর্ঘ) = শালপ্রাংশু; শৈলের মতো উন্নত = শৈলোন্নত। সেইরূপ কমলকোমল, আলতারাঙা, তমালশ্যামল, অয়স্কঠিন, পরাগপবিত্র, ভ্রমরকৃষ্ণ, কর্পূরধবল, কুমুদশুভ্র, চন্দনস্নিগ্ধ, নীরদনীল, ইন্দীবরসুন্দর, কুন্দশুভ্র, মলয়জশীতল, ভ্রূকুটিকুটিল, জলদগম্ভীর, কজ্জলকালো, শঙ্খশুভ্র, নবদূর্বাদলশ্যাম, নভোনীল, দূর্বাকোমল, কণ্টকতীক্ষ্ণ, অনলোজ্জ্বল, তুষারশুভ্র (কেশ), বজ্রকঠিন (হৃদয়), পল্লবপেলব (বাহু), নবনীতকোমল (শয্যা), বিদ্যুদ্দীপ্ত (ব্যক্তিত্ব), তুহিনশীতল, হীরকোজ্জ্বল, স্ফটিকস্বচ্ছ, মেঘমেদুর, স্বপ্নমধুর, সুধাধবল, মুক্তাধবল, কম্বুগম্ভীর, লতানমনীয়, লৌহদৃঢ়, অরুণরাঙা, গোবেচারা, ঘনকৃষ্ণ, বরফি-কাটা (মাঠ), রেশমচিকন (চুল), অশোকলাল, ফেনাধবধবে, আপেলরাঙা, পান্নাসবুজ, বান্ধুলিরাঙা, ধুলোগুঁড়ো, আবলুস কালো, বরফসাদা, বিড়ালবেহায়া, পালকনরম।

প্রয়োগ : “শোণিত-রাঙা বেদনার উৎসার পাঠক-সমাজকে অভিভূত করিয়াছিল।” “চাই লৌহদৃঢ় মাংসপেশী, ইস্পাতকঠিন স্নায়ু, বজ্রভীষণ মনোবল “কুন্দশুভ্র নগ্নকান্তি সুরেন্দ্রবন্দিতা তুমি অনিন্দিতা।” সদ্যভাঙা জামাকাপড় পরে সেই আয়নামসৃণ রকেই বসে গেলাম। “বীরসিংহের সিংহশিশু! বিদ্যাসাগর! বীর!” “সকল সম্পদ মম দূর্বাদলশ্যাম।” “শিশিরবিমল প্রভাতের ফল শত হাতে সহি পরখের ছল।” “ও কোকিলকালো কন্যা তোমার ভ্রমরকালো আঁখি।” “প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম।” “আলতারাঙা পায়ের ছোঁয়ায় রক্তকমল ফোটে।”

১৫১। উপমিত কর্মধারয় সমাস : সাধারণধর্মের উল্লেখ না করিয়া উপমেয় পদের সহিত উপমানের যে সমাস, তাহাকে উপমিত কর্মধারয় সমাস বলে।

ব্যাসবাক্যে সাধারণতঃ উপমেয় পদটি প্রথমে, তৎপরে উপমান এবং সর্বশেষে সাদৃশ্যবাচক শব্দটি বসে। কথা অমৃতের তুল্য = কথামৃত; পুরুষ সিংহের ন্যায় = পুরুষসিংহ; নর দেবের তুল্য নরদেব; চরণ পদ্মের ন্যায় = চরণপদ্ম; নয়ন কমলের ন্যায় = নয়নকমল; মুখ চন্দ্রের ন্যায় = মুখচন্দ্র; পুরুষ ঋষভের ন্যায় = পুরুষষভ (সন্ধি লক্ষ্য কর)। সেইরূপ নরশার্দূল, পুরুষপুঙ্গব, পাদপদ্ম, পদাম্বুজ, করপল্লব, ভরতর্ষভ, কালাচাঁদ, বদনকমল, রাজচন্দ্র, অধরপল্লব, মুখশশী। [ এখানে সিংহ, শার্দূল, ব্যাঘ্র, ঋষভ, পুঙ্গব প্রভৃতি শব্দ শ্রেষ্ঠত্ববাচক। ]

এই সমাসে পূর্বপদ ও উত্তরপদ উভয়েই বিশেষ্য। আর, সমস্ত-পদটিও বিশেষ্য। সমস্ত-পদে উপমেয় পদটি সাধারণতঃ পূর্বে বসিলেও অনেক সময় পরেও বসে। আলু শাঁখের ন্যায় শাঁখ-আলু; সন্দেশ আমের মতো = আমসন্দেশ [ মধ্যপদলোপী কর্মধারয় হইলে ব্যাসবাক্য হইবে—আমের গন্ধযুক্ত বা আকৃতি—বিশিষ্ট সন্দেশ; আবার আম (সাধারণ) যে সন্দেশ (সংবাদ) = আমসন্দেশ (সাধারণ কর্মধারয়—একটু গূঢ়ার্থে) ]; অন্ন সুধার মতো = সুধান; বৈশাখী (বৈশাখমাসের ঝড়বৃষ্টি) কালের (মহাকালের) মতো = কালবৈশাখী; পোকা কাঁচের মতো = কাঁচপোকা; বেদী পদ্মের ন্যায় = পদ্মবেদী; মুখ সোনার মতো সোনামুখ; অধর বিম্বের ন্যায় বিম্বাধর; কণ্ঠ কম্বুর ন্যায় কম্বুকণ্ঠ [ আকৃতির প্রাধান্য, কিন্তু কম্বুর ন্যায় গভীর কণ্ঠ যাহার = কম্বুকণ্ঠ—বহুব্রীহি ]। সেইরূপ ফুলকুমারী, ফুলবাতাসা, ফুলবাবু, ফুলকপি, ফুলঝুরি, চাঁদমুখ, কাঁটাপেরেক, কদমছাঁট, চন্দ্রপুলি। “সে আসি নমিল সাধুর চরণকমলে।” “নববর্ষের পুণ্যবাসরে কালবৈশাখী আসে।” “নমি নরদেবতারে।” “সোনালি ঊষায় সোনামুখ তার আমার নয়নে ভরি।”

উপমিত কর্মধারয় সমাসে সাধারণধর্মটি সর্বত্রই কল্পনাসাপেক্ষ।

১৫২। রূপক কর্মধারয় সমাস : উপমেয় ও উপমানের মধ্যে অভেদ কল্পনা করিয়া পূর্বপদ উপমেয়ের সহিত পরপদ উপমানের যে সমাস হয়, তাহাকে রূপক কর্মধারয় সমাস বলে।

এই সমাসের ব্যাসবাক্যে উপমেয় ও উপমানের মধ্যে ‘রূপ’ কথাটি বসিয়া উভয়ের মধ্যে অভেদটিকে পরিস্ফুট করে। সমস্ত-পদটি এখানেও বিশেষ্য। আঁখিরূপ পাখি = আঁখিপাখি; মনরূপ মাঝি = মনমাঝি; সংসার-রূপ সমরাঙ্গন = সংসার-সমরাঙ্গন; প্রাণরূপ প্রবাহিণী = প্রাণপ্রবাহিণী; যৌবনরূপ কুসুম যৌবনকুসুম; নদীরূপ জপমালা = নদীজপমালা; মাৎসর্য-রূপ বিষ = মাৎসর্যবিষ; মানবমনঃরূপ মন্দির = মানবমনোমন্দির। সেইরূপ সুখদীপ, করুণামন্দাকিনী, ভাবসিন্ধু, ক্রোধানল, স্নেহসমুদ্র, জীবনযুদ্ধ, সুখসায়র, পঞ্জরপিঞ্জর, হৃদয়কুসুম, কথামৃত, মায়াডোর, হিংসাবিষ, আলোক-ঝরনা, দেহ-আকাশ, জীবন-উদ্যান, চিত্তপট, দিলদরিয়া। “হাতে মসী মুখে মসী মেঘে ঢাকা শিশুশশী।” “জীবন-উদ্যানে তোর যৌবনকুসুমভাতি কতদিন রবে?”—মধুকবি। “সে সুখসায়র দৈবে শুকায়ল তিয়াসে পরাণ যায়।” “অশান্ত আকাঙ্ক্ষা-পাখি মরিতেছে মাথা খুঁড়ে পঞ্জরপিঞ্জরে।” “দেখিবারে আঁখিপাখি ধায়।” এ শোকানল নির্বাপিত হবার নয়, মা। “অঙ্কুরিল ভক্তিবীজ পাষণ্ডের পাষাণ পরানে।” “পিরীতিকণ্টক হিয়ায় ফুটল পরাণপুতলী যথা।” “ভাসল আমার কুলকলসী শ্যামলঙ্কসায়রে।” “কবে তাপিত এ চিত করিব শীতল তোমার করুণাচন্দনে।” আমরা তো প্রত্যেকেই জীবনযুদ্ধের সৈনিক। “উথলে ওঠে দিলদরিয়া কোন্ সে চাঁদের টানে!”—বিধিচক্র। “সে সুরের মায়াডোরে রাধা বিবশা।”

অভেদ-সম্বন্ধ ও রূপক কর্মধারয় সমাস মূলে একই, কেবল আকারে পার্থক্য রহিয়াছে। অভেদ-সম্বন্ধ সম্বন্ধ বলিয়া পূর্বপদে সম্বন্ধপদের বিভক্তিচিহ্নটি অক্ষুণ্ণ থাকে; আর উত্তরপদটি পাশাপাশি বসিয়া যায়। পদ দুইটি কদাপি সংযুক্ত হইয়া একপদে পরিণত হয় না। কিন্তু রূপক কর্মধারয়ের ব্যাসবাক্যস্থ পূর্বপদে সর্বদাই বিভক্তির স্থলে রূপ কথাটি যুক্ত থাকে, উত্তরপদটি পাশাপাশি বসিয়া যায়। সমস্ত-পদে রূপ কথাটি লুপ্ত হয়, পূর্ব ও উত্তরপদ সংযুক্ত হইয়া একপদে পরিণত হয়। জ্ঞানের আলোক—অভেদ-সম্বন্ধ; জ্ঞানরূপ আলোক = জ্ঞানালোক—রূপক কর্মধারয়; স্নেহের সমুদ্র—অভেদ-সম্বন্ধ; স্নেহরূপ সমুদ্র-স্নেহসমুদ্র—রূপক কর্মধারয়। “আজ আলোকের এই ঝরনাধারায় ধুইয়ে দাও।” আয়তাক্ষর সম্বন্ধ পদটি পরবর্তী ‘ঝরনাধারা’ পদটির সহিত অভেদ-সম্বন্ধে আবদ্ধ [ অলংকার-নির্ণয় করিতে হইলে, কী অভেদ-সম্বন্ধ, কী রূপক কর্মধারয়—উভয় ক্ষেত্রেই রূপক অলংকার হইবে। (পৃঃ ৭২৯-৭৩২ দ্রষ্টব্য) ]

(অ) উপমিত কর্মধারয় ও রূপক কর্মধারয়ের পার্থক্যটি ভালো করিয়া লক্ষ্য কর। উভয় ক্ষেত্রেই সমাসবদ্ধ পদটি বিশেষ্য, উভয় ক্ষেত্রেই উপমান-উপমেয়ের তুলনা বুঝায় এবং কোনোটিতেই সাধারণধর্মবাচক পদের উল্লেখ থাকে না। এই পর্যন্ত উভয়ের মিল। কিন্তু গরমিলটাই বেশী

(১) রূপক কর্মধারয়ে উপমান-উপমেয়ের তুলনাটি যেরূপ নিবিড়, উপমিত কর্মধারয়ে সেরূপ নিবিড় নয়। (২) উপমিত কর্মধারয়ে সমাসবদ্ধ পদের পূর্বাংশটি অধিকাংশক্ষেত্রে উপমেয়, মাঝে মাঝে উপমান হইয়া যায়, কিন্তু রূপকে উপমেয়টি সর্বদাই পূর্বে থাকে এবং উত্তরাংশে থাকে উপমান। (৩) উপমিত কর্মধারয়ে উপমেয়ের প্রাধান্য, কিন্তু রূপকে উপমানের প্রাধান্য। কয়েকটি উদাহরণ দেখ :—

(১) তনয়ের মুখচন্দ্র উজলিল জননীহৃদয়। (২) তনয়ের মুখচন্দ্র চুম্বিল জননী। এখানে দেখা যাইতেছে, উভয় ক্ষেত্রে একই মুখচন্দ্র রহিয়াছে। আর সমাস-বদ্ধ পদদ্বয়ের প্রথমাঙ্গ উপমেয় এবং উত্তরাঙ্গ উপমান। সুতরাং বহিরঙ্গের বিচারে উভয় ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখিতেছি না। কিন্তু অন্তরঙ্গের বিচারে পার্থক্যটি স্পষ্ট হইয়া উঠিবে। শব্দের অন্তরঙ্গ হইতেছে অর্থ। এই অর্থবিচার করিয়া আমাদের সিদ্ধান্তে আসিতে হইবে। প্রথম বাক্যে কাহার প্রাধান্য রহিয়াছে?—মুখের, না চন্দ্রের? বাক্যমধ্যে কাহার প্রাধান্য জানিতে হইলে ক্রিয়াকে প্রশ্ন কর। ক্রিয়া হইতেছে উজলিল। কে উজ্জ্বল করিল? মুখ, না চন্দ্র? মুখের পক্ষে উজ্জ্বল করা সম্ভব নয়, চন্দ্রের পক্ষেই সম্ভব। আর চন্দ্র হইতেছে উপমান। অতএব এখানে উপমানের প্রাধান্য। সুতরাং সমাস হইল রূপক কর্মধারয়। তাই ব্যাসবাক্য হইবে, মুখচন্দ্র = মুখরূপ চন্দ্র।

এইবার দ্বিতীয় বাক্য। এখানে কাহার প্রাধান্য আছে, দেখ। ক্রিয়া চুম্বিল-কে প্রশ্ন কর : কী চুম্বন করিল?—মুখ, না চন্দ্র? চন্দ্র অসম্ভব। মায়ের পক্ষে সন্তানের মুখচুম্বনই সম্ভব। অতএব বাক্যে প্রাধান্য রহিয়াছে উপমেয় মুখের। সুতরাং সমাস হইবে উপমিত কর্মধারয়। ব্যাসবাক্য হইবে, মুখচন্দ্র = মুখ চন্দ্রের ন্যায়।

ঠাকুরের মুখে ভক্তগণ কথামৃত শ্রবণ করছেন। এখানে কথামৃত কথা অমৃতের তুল্য—উপমিত কর্মধারয়। ভক্তগণ আচার্যের কথামৃত পান করে ধন্য হলেন। এখানে কথামৃত = কথারূপ অমৃত—রূপক কর্মধারয়।

আর দুই-একটি উদাহরণ দিয়া আমরা এই প্রসঙ্গের ছেদ টানিব। “নমি আমি, কবিগুরু, তব পদাম্বুজে।”—মধুকবি। ‘পদাম্বুজে’ কথাটির কী সমাস হইবে? নমি ক্রিয়াটিকে প্রশ্ন কর : কোথায় প্রণাম করি?—পদে, না অম্বুজে? নিঃসন্দেহে পদে। পদ হইতেছে উপমেয়; অতএব বাক্যে প্রাধান্য রহিয়াছে উপমেয়ের সুতরাং সমাস হইবে উপমিত কর্মধারয়। ব্যাসবাক্য হইবে পদ অম্বুজের ন্যায়। “বন্দি তাঁর পাদপদ্ম শিবাজি সঁপিছে অদ্য তাঁরে নিজ রাজ্য-রাজধানী।” রবীন্দ্রনাথ। এখানেও পাদপদ্ম কথাটিতে উপমেয়ের প্রাধান্য রহিয়াছে বলিয়া ব্যাসবাক্য হইবে পাদ পদ্মের তুল্য—উপমিত কর্মধারয়।

কিন্তু, আনন্দে হেরিলা মাতা সন্তানের বদনকমল –এখানে হেরিলা (দেখিলেন) ক্রিয়াটিকে প্রশ্ন কর : কী দেখিলেন? বদন, না কমল? বদন দেখাও সম্ভব, আবার কমল দেখাও সম্ভব। এখানে নিশ্চিতরূপে একক উপমেয় (বদন) বা উপমান (কমল) কোনোটিই প্রাধান্য পাইতেছে না, অথচ দুয়েরই তুল্য মূল্য রহিয়াছে। এরূপস্থলে সমাস দুইপ্রকার—(১) বদন কমলের মতো—উপমিত কর্মধারয় এবং (২) বদনরূপ কমল—রূপক কর্মধারয়। [ অলংকারের ক্ষেত্রে উপমা-রূপকের সংকর অলংকার হইবে ]। অনুরূপ আরেকটি উদাহরণ—যাত্রীরা এখন ভক্তিভরে মায়ের পাদপদ্ম দেখতে ব্যস্ত।

(আ) উপমান কর্মধারয় ও উপমিত কর্মধারয়ের পার্থক্য বাহির করা কিছু কঠিন নয়। (১) উপমান কর্মধারয়ের সমস্ত পদটি বিশেষণ, আর উপমিত কর্মধারয়ের সমস্ত-পদটি বিশেষ্য। (২) উপমান কর্মধারয়ে সমস্ত-পদের পূর্বাংশে উপমান পদ এবং উত্তরাংশে সাধারণধর্মবাচক বিশেষণ থাকে। কিন্তু উপমিত কর্মধারয়ে সমস্ত-পদের পূর্বাংশে সাধারণতঃ উপমেয় এবং উত্তরাংশে উপমান থাকে। (৩) উপমান কর্মধারয়ে সাধারণধর্মের প্রাধান্য, উপমিত কর্মধারয়ে উপমেয়ের প্রাধান্য। (৪) উপমান কর্মধারয়ে উপমেয় থাকে না, উপমিত কর্মধারয়ে সাধারণধর্মবাচক পদ থাকে না।

(ই) এইবার উপমান কর্মধারয় ও রূপক কর্মধারয়ের পার্থক্যটি দেখিয়া লও। (১) উপমান কর্মধারয়ের সমস্ত পদটি বিশেষণ, কিন্তু রূপকের সমস্ত পদটি বিশেষ্য। (২) উপমান কর্মধারয়ের সমস্ত পদটির পূর্বাংশে উপমান পদ আর উত্তরাংশে সাধারণধর্মবাচক বিশেষণ থাকে। কিন্তু রূপকে সমস্ত-পদের পূর্বাংশে উপমেয়, আর উত্তরাংশেই উপমান থাকে। (৩) উপমান কর্মধারয়ে সাধারণধর্মবাচক পদের প্রাধান্য, রূপকে উপমানের প্রাধান্য। (৪) উপমান কর্মধারয়ে উপমেয় উহ্য থাকে, রূপকে সাধারণধর্মবাচক পদটি উহ্য থাকে।

দ্বিগু সমাস

১৫৩। দ্বিগু সমাস : যে সমাসে পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ, উত্তরপদটি বিশেষ্য এবং সমাসবদ্ধ পদটির দ্বারা সমষ্টি বা সমাহার বুঝায়, তাহাকে দ্বিগু সমাস বলে।

পঞ্চ প্রদীপের সমাহার = পঞ্চপ্রদীপ; দুই নয়নের সমাহার = দুনয়ন; ত্রি (তিন) ভুবনের সমাহার = ত্রিভুবন; সপ্ত অহ (দিন)-এর সমাহার = সপ্তাহ; পঞ্চ রাত্রির সমাহার = পঞ্চরাত্র; ত্রি প্রান্তরের সমাহার = ত্রিপ্রান্তর > তেপান্তর; নব (নয়টি) রাত্রির সমাহার = নবরাত্র; পঞ্চ নদীর সমাহার পঞ্চনদ; দুইটি গোরুর সমাহারে ক্রীত = দ্বিগু; চতুঃ (চারিটি) অক্ষরের সমাহার = চতুরক্ষর; ছয় মাতার সন্তান = ষাণ্মাতুর; চতুঃ অঙ্গের সমাহার = চতুরঙ্গ; তিনটি কড়ির বিনিময়ে ক্রীত = তিনকড়ি। সেইরূপ ত্রিতাপ, ত্রিরাত্র, চৌদিক, পঞ্চভূত, পঞ্চামৃত, পাঁচফোড়ন, সপ্তসুর, সাতঘাট, সাতসমুদ্র, ষড়রিপু, অষ্টবসু, অষ্টধাতু, নবরত্ন, দশচক্র, দশাবতার, দশদশা, তেরোনদী, চতুর্দশভুবন, চৌচির, দ্বৈমাতুর, ষোলকলা, চৌহদ্দি, পঞ্চশস্য, পঞ্চগব্য, পঞ্চকন্যা, পঞ্চরত্ন, নবদুর্গা, সপ্তর্ষি, পঞ্চগু

দ্বিগু সমাসে সমস্ত-পদটি কখনও আ-কারান্ত, কখনও-বা ঈ-কারান্ত হয়। ত্রি ফলের সমাহার = ত্রিফলা; পঞ্চ বটের সমাহার = পঞ্চবটী। সেইরূপ ত্রিলোকী, ত্রিপদী, তেমোহনা, চৌপদী, চতুষ্পদী, চৌমোহনী, সপ্তশতী, বারোমাসী, দশ-আনি, শতাব্দী, শতবার্ষিকী।

“শতেক শতাব্দী ধরে নামে শিরে অসম্মানভার।” “আপনারে বেঁধে রাখো চৌদিকে জড়ায়ে অভিমান।” “শ্মশানের বুকে আমরা রোপণ করেছি পঞ্চবটী।” “আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে।” “পঞ্চতন্ত্র-কথা পঞ্চমুখে পঞ্চমুখ কহেন উমারে।”—মধুকবি। সাতসমুদ্র তেরোনদীর পারে মন্দিরে অষ্টধাতুর দশাবতার-মূর্তির গলায় নবরত্নের মালা শোভা পায়।

কর্মধারয় সমাসের সহিত দ্বিগু সমাসের কিছুটা সাদৃশ্য আছে। উভয় সমাসেই সমস্যমান পদ দুইটিতে সমান বিভক্তি (কর্তৃকারকের) থাকে। তাই সংস্কৃতের অনুসরণে কোনো কোনো বৈয়াকরণ দ্বিগু সমাসকে কর্মধারয় সমাসের অন্তর্ভূত করিবার পক্ষপাতী। কিন্তু উভয় সমাসের পার্থক্যটুকুও আমাদের মনে রাখিতে হইবে।—(১) দ্বিগু সমাসে পূর্বপদটি সর্বদাই সংখ্যাবাচক বিশেষণ আর উত্তরপদটি সর্বদাই বিশেষ্য। অথচ কর্মধারয়ে সমস্যমান পদ দুইটি কখনও বিশেষ্য, কখনও-বা বিশেষণ; বিশেষণ হইলেও তাহা সাধারণ বিশেষণ, কখনই সংখ্যাবাচক বিশেষণ নয়। আবার মধ্যপদলোপী কর্মধারয়ে স্থানবিশেষে পূর্বপদ এবং উত্তরপদ উভয়েই সংখ্যাবাচক বিশেষণ। (২) দ্বিগু সমাসে সমাসবদ্ধ পদটির দ্বারা সমাহার বুঝায়, কিন্তু কর্মধারয়ে উত্তরপদের অর্থপ্রাধান্য, সমাহারের প্রশ্ন সেখানে জাগে না।

বহুব্রীহি সমাস

১৫৪। বহুব্রীহি সমাস : যে সমাসে সমস্যমান পদগুলির কোনোটিরই অর্থ প্রধানভাবে না বুঝাইয়া তাহাদের দ্বারা লক্ষিত অন্য পদের অর্থ প্রধানভাবে বুঝায়, তাহাকে বহুব্রীহি সমাস বলে।

পীত অম্বর যাহার = পীতাম্বর (শ্রীকৃষ্ণ)। পীতাম্বর সমাসবদ্ধ পদটিতে পীত পদটির প্রাধান্য নাই, অম্বর পদটিরও প্রাধান্য নাই। পীত ও অম্বর পদ দুইটির দ্বারা লক্ষিত অথচ সমস্যমান পদের অন্তর্ভূত নয় এমন একটি পদ শ্ৰীকৃষ্ণহ এখানে প্রাধান্য পাইতেছে। কিন্তু পীতবর্ণের বস্ত্রখানিকে বুঝাইলে পীতাম্বর পদটি হইবে কর্মধারয় সমাসনিষ্পন্ন পদ। তখন ব্যাসবাক্য হইবে–পীত যে অম্বর। অনুরূপভাবে নষ্টনীড় পদটিকেও দুইভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।—(১) নষ্ট হইয়াছে নীড় যাহার বহুব্রীহি (ব্যক্তিটিকে বুঝাইবে); আর (২) নষ্ট যে নীড় কর্মধারয় (নীড়টিকে বুঝাইবে)। বহুব্রীহি পদটিই বহুব্রীহি সমাস নিষ্পন্ন। বহু হইয়াছে ব্রীহি (ধান্যবিশেষ) যাহার = বহুব্রীহি (সঙ্গতিপন্ন কৃষক—যাহার প্রচুর ধান্য ফলিয়াছে)।

এখন বহুব্রীহি সমাসের প্রকারগুলি লক্ষ্য কর।—

১৫৫। সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস : পূর্বপদ বিশেষণ ও পরপদ বিশেষ্যে যে বহুব্রীহি সমাস হয়, তাহাকে সমানাধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলে। এই সমাসে উভয় পদে একই শূন্যবিভক্তি (অ) বলিয়া নাম সমানাধিকরণ।

সহোদর বা সোদর; সমান জাতি যাহার

সু (শোভন) হৃদয় যাহার = সুহৃদ্; প্র (আরব্ধ) দোষা (রাত্রি) যেখানে = প্রদোষ; দৃঢ় ধনু যাহার = দৃঢ়ধন্বা (ধন্বন্ শব্দের কর্তৃকারকের একবচন); দৃঢ়া প্রতিজ্ঞা যাহার = দৃঢ়প্রতিজ্ঞ; সু (শোভনা) ধী যাহার = সুধী; কৃতা হইয়াছে বিদ্যা যাহার দ্বারা = কৃতবিদ্য; বিশাল অক্ষি যাহার = বিশালাক্ষ (অক্ষি স্থানে অক্ষ—স্ত্রীলিঙ্গে বিশালাক্ষী); বিশিষ্ট লোচন যাহার = বিলোচন; হরি (হরিণ) অক্ষি যাহার = হর্যক্ষ; সু অর্ণ (বর্ণ) যাহার = স্বর্ণ; শুভ্র মুখ যাহার = শুভ্রমুখ (স্ত্রী—শুভ্রমুখী); সমান (একই) ধর্ম যাহার = সধর্মা; সমান উদর (মাতৃগর্ভ) যাহার = সহোদর বা সোদর; সমান জাতি যাহার = সজাতি; সু গন্ধ যাহার সুগন্ধি (পুষ্প) বা সুগন্ধ (বায়ু) [ গন্ধটি পুষ্পের নিজস্ব বলিয়া সুগন্ধি, কিন্তু বায়ুর বা তৈলের নিজস্ব নয় বলিয়া সুগন্ধ ]; চারু গন্ধ যাহার চারুগন্ধি (চন্দন), চারুগন্ধ (বায়ু); ছিন্ন হইয়াছে শাখা যাহার = ছিন্নশাখা (বৃক্ষ) [ কিন্তু ছিন্ন যে শাখাঁ = ছিন্নশাখ—কর্মধারয় ]; বি (বহু) হইয়াছে বিধা (প্রকার) যাহার বিবিধ; সিদ্ধ হইয়াছে অর্থ যাহার = সিদ্ধার্থ; সৎ অর্থ যাহার = সদর্থক; প্রিয় সখা যাহার = প্রিয়সখা [ কিন্তু প্রিয় যে সখা = প্রিয়সখ–কর্মধারয় ] মুঢ়া মতি যাহার = মুঢ়মতি; পূর্ণা আকাঙ্ক্ষা যাহার = পূর্ণাকাঙ্ক্ষ; প্রোষিত (বিদেশস্থ) ভর্তা যাহার = প্রোষিতভর্তৃকা; প্রোষিতা ভার্যা যাহার = প্রোষিতভার্য; যুবতী জায়া যাহার = যুবজানি; খুশ মেজাজ যাহার = খুশমেজাজ; বহু পত্নী যাহার = বহুপত্নীক; সু (তীক্ষ্ণ) দর্শন যাহার = সুদর্শন (শকুন); ভীম দর্শন যাহার ভীমদর্শন; কু (কুৎসিত) বের (শরীর) যাহার = কুবের; শ্যাম অঙ্গ যাহার শ্যামাঙ্গ; অপ (বিচিত্র) রূপ যাহার = অপরূপ; নষ্ট হইয়াছে কীর্তি যাহার নষ্টকীর্তি; হীন হইয়াছে শক্তি যাহার = হীনশক্তি [ কিন্তু শক্তির দ্বারা হীন শক্তিহীন—করণ-তৎপুরুষ ]; হীন হইয়াছে প্রভা যাহার = হীনপ্রভ; জিতা নিদ্রা যৎকর্তৃক = জিতনিদ্র; সমান পতি যাহাদের = সপত্নী [ কিন্তু স্ব (নিজ)-র পত্নী—স্বপত্নী—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ ]; লব্ধা হইয়াছে প্রতিষ্ঠা যাহার = লব্ধপ্ৰতিষ্ঠ; পরাক্ মুখ যাহার = পরান্মুখ; ছন্ন হইয়াছে মতি যাহার = ছন্নমতি [ কিন্তু ছন্ন যে মতি = মতিচ্ছন্ন—কর্মধারয় ]; মধ্য (মধ্যম) বিত্ত যাহার = মধ্যবিত্ত; দুঃ অবস্থা যাহার = দুরবস্থ; দুঃ হইয়াছে আকাঙ্ক্ষা যাহার = দুরাকাঙ্ক্ষ [ কিন্তু দুঃ যে আকাঙ্ক্ষা = দুরাকাঙ্ক্ষা—কর্মধারয় ]; কু আকার যাহার = (কদাকার (কু স্থানে কৎ); অল্প সংখ্যা যাহার = অল্পসংখ্যক; বহু বীজ যাহার = বহুবীজক (দাড়িম্ব)। সেইরূপ ভগ্নশাখা (বৃক্ষ), সুধন্বা, দৃঢ়ধন্বা, জিতক্রোধ, শ্রুতকীর্তি, দীর্ঘায়ু, লঘুভঙ্গিম, বিলুপ্তসংজ্ঞ, অল্পবিদ্য, প্রিয়জানি, বাসন্তদুকূলা, স্বচ্ছসলিলা, একাগ্রচিত্ত, শ্লথবৃত্ত, সগোত্র, নীলপ্রভ, প্রোষিতপত্নীক, নীলাম্বর, নষ্টবুদ্ধি, সতীৰ্থ, পক্ককেশ, নতশির, ছিন্নতন্ত্রী, অনন্তযৌবনা, সলোক, হতশ্রদ্ধ, নীলকণ্ঠ, তীক্ষ্ণবুদ্ধি, ক্ষীণপ্রাণ, সুরভিগন্ধি, সবর্ণ, হাফহাতা (শার্ট), লালপাগড়ি (পুলিস), ভাঙাহাতা (চেআর), হতভাগা, লালপেড়ে, অল্পেয়ে, পাকাচুলো, কালোবরন। “ছিনু মোরা সুলোচনে, গোদাবরী-তীরে।”—মধুকবি। “এ কী অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লীজননী।”—নজরুল। “উত্তরজীবনে নীলকুন্তলা সাগরমেখলা ধরণীর সঙ্গে তাহার খুব ঘনিষ্ঠ পরিচয় ঘটিয়াছিল।”—বিভূতিভূষণ। “তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো….।”—বিশ্বকবি। “বহে মাঘ মাসে শীতের বাতাস স্বচ্ছসলিলা বরুণা।”—ঐ। “হে অনন্তযৌবনা উর্বশী।”-ঐ। “ক্ষণপ্রভা প্রভাদানে বাড়ায় মাত্র আঁধার পথিকে ধাঁধিতে।”—মধুসূদন।

বহুব্রীহি (ও কর্মধারয়) সমাসে মহৎ শব্দের স্থানে মহা হয়। মহান্ প্রাণ যাহার মহাপ্রাণ [কিন্তু মহতের প্রাণ = মহৎপ্রাণ—-সম্বন্ধ-তৎপুরুষ]; মহৎ আশয় (চিত্ত) যাহার = মহাশয় [ কিন্তু মহতের আশয় = মহদাশয়—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ ]; মহান্ মহিমা যাহার = মহামহিম; মহতী মতি যাহার মহামতি। সেইরূপ মহাবল, মহামনা। “যুঝিতেছে যেন দুই মহাবল দ্যুলোকের দূর পন্থে।”—মোহিতলাল। “মহাশয়, যাহা জগদীশ্বরের হাত, তাহা পণ্ডিতে বলিতে পারে না।”-বঙ্কিমচন্দ্র। “মহাপ্রাণ সহিয়াছে পলে পলে সংসারের ক্ষুদ্র উৎপীড়ন।” বিশেষ্যপদটি পূর্বেও বসে : মা মরা যাহার মা-মরা; হীরে বসানো যাহাতে হীরেবসানো (আংটি); ফুল (নকশা) কাটা যাহাতে ফুলকাটা (জামা); কান কাটা যাহার = কানকাটা; বুক ফাটে যাহার দ্বারা = বুকফাটা (কান্না); পাখি ডাকে যেখানে = পাখিডাকা; পদ্ম কাঁপে যেখানে = পদ্মকাঁপা (বিল); পাস করা যায় যাহার দ্বারা = পাসকরা (বুদ্ধি); মাছ ধরা যায় যাহাতে = মাছধরা (জাল); পেট ভরে যাহার দ্বারা = পেটভরা (খাদ্য); বুক ভরে যাহাতে = বুকভরা (স্নেহ); লক্ষ্মী ছাড়িয়াছে যাহাকে = লক্ষ্মীছাড়া; পাতা ছিঁড়িয়াছে যাহার = পাতাছেঁড়া (বই); সরিৎ উত্তম যে নদীর = সরিদুত্তমা; স্বার্থই পর (পরম) যাহার = স্বার্থপর। সেইরূপ ভুবনভরা (আলো), গালভরা (বুলি), আদর্শপর, পেটমোটা, দিলখোশ, হাড়বেরুনো, মনরাখা (কথা), দাগলাগা, রাসভারী (লোক), মধ্যপদলোপী (সমাস), আরামপ্রিয় (সর্দার), ঘরপোড়া (গোরু), পিঠভরা (চুল), চোখভরা (জল)। “হাতভরা কোমল ভক্তি।” “নয়নভরা জল গো তোমার আঁচলভরা ফুল!”—নজরুল। “কোলভরা যার কনকধান্য বুকভরা যার স্নেহ।”—সত্যেন্দ্রনাথ। “ডাহুকডাকা মাঠ পেরিয়ে একলা যেও না।”

দুইটি পদই বিশেষ্য (কিন্তু পূর্বপদটি কখনও-বা বিশেষণ-ভাবাপন্ন) : সীতা জায়া যাহার = সীতাজানি; গাণ্ডীব ধনু যাহার = গাণ্ডীবধন্বা; পদ্ম আসন যাহার পদ্মাসন; কৃষ্ণই কান্ত যাহার = কৃষ্ণকান্ত; ক্ষীর হইয়াছে উদ (জল) যাহার ক্ষীরোদ; চন্দ্র হইয়াছে শেখর (মুকুট) যাহার = চন্দ্রশেখর (শিব); চন্দ্ৰ হইয়াছে আপীড় (শিরোভূষণ) যাহার = চন্দ্রাপীড়; অহি হইয়াছে ভূষণ যাহার = অহিভূষণ; গর (বিষ) আভরণ যাহার = গরাভরণ (মহেশ্বর); তুষার হইয়াছে মৌলি (কিরীট) যাহার = তুষারমৌলি; তপস্যাই ধন যাহার = তপোধন; পতিই ব্রত যাহার = পতিব্রতা; রাজা সখা যাহার = রাজসখা [কিন্তু রাজার সখা = রাজসখ—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ ]; বসন্ত সখা যাহার = বসন্তসখা (কামদেব) [কিন্তু বসন্তের সখা = বসন্তসখ (কোকিল)—সম্বন্ধ-তৎপুরুষ ]; দিক্‌ (শূন্য) অম্বর যাহার = দিগম্বর; মিলনই আত্মা যাহার = মিলনাত্মক; নদী মাতা যাহার = নদীমাতৃক; ধূম কেতু (কেতন) যাহার = ধূমকেতু; ঘৃতই অন্ন যাহার = ঘৃতা (অগ্নি); উদ্ভিদ্ বিষয় যাহার = উদ্ভিদ্‌বিষয়ক (প্রবন্ধ); মৃগ আজীব (জীবিকা) যাহার = মৃগাজীব; চিন্তাই শীল (স্বভাব) যাহার = চিন্তাশীল; ভুঁড়িই সার যাহার = ভুঁড়িসার। সেইরূপ পুষ্পধন্বা, ব্যবহারাজীব, অস্ত্রাজীব, পুষ্পাজীব, তেজোমূর্তি, ব্যোমকেশ, পয়োব্রতা, ইন্দুমৌলি, শিখিবাহন, অর্ধেন্দুশেখর, সুধাংশুশেখর, সিতাংশুভূষণ, চন্দ্রভূষণ, শশিশেখর, দিগম্বরা, নৃমুণ্ডমালিনী, পুষ্পাভরণা, বেদনাত্মক, পেটসর্বস্ব ইত্যাদি। “পাণ্ডব আমি অর্জুন গাণ্ডীবধন্বা। “—বিশ্বকবি।

সমানাধিকরণ বহুব্রীহি ও কর্মধারয় সমাসনিষ্পন্ন পদ দেখিতে একই প্রকার সুতরাং চেহারা দেখিয়া নয়, অর্থ বুঝিয়া সমাস ও ব্যাসবাক্য নির্ণয় করিতে হয়। “তোমার এমন দুর্বুদ্ধি হল কেন?”—এখানে দুর্বুদ্ধি = দুঃ (দুষ্টা) যে বুদ্ধি—কর্মধারয় সমাস। কারণ উত্তরপদ বুদ্ধিরই অর্থপ্রাধান্য রহিয়াছে। কিন্তু “তুমিই ওই দুর্বুদ্ধিকে বোঝাবার চেষ্টা কর।” এখানে দুর্বুদ্ধি = দুঃ (দুষ্টা) বুদ্ধি যাহার– বহুব্রীহি সমাস। কারণ এখানে দুঃ কিংবা বুদ্ধি কোনোটির অর্থপ্রাধান্য নাই দুষ্টা বুদ্ধি যাহার এমন লোককেই (দুর্যোধনকে) বুঝাইতেছে। সেইরূপ কদাচার ও কদাকার পদ দুইটিতে যথাক্রমে আচার ও আকার-এর অর্থপ্রাধান্য থাকিলে সমাস হইবে কর্মধারয়। কিন্তু কু-আচার বা কু-আকারবিশিষ্ট ব্যক্তিকে বুঝাইলে সমাস হইবে বহুব্রীহি।

আবার সমানাধিকরণ বহুব্রীহি ও উপপদ তৎপুরুষের সমস্ত-পদের চেহারা একই। তাহা হইলে উভয়ের পার্থক্য বুঝিবে কী প্রকারে? কৃদন্ত উত্তরপদটিতে যদি ক্রিয়ার অর্থপ্রাধান্য থাকে, তখন ব্যাসবাক্যের শেষ পদটি হইবে কর্তৃকারক যে যিনি যাহারা যাঁহারা, সমাস হইবে উপপদ তৎপুরুষ; আর যদি বিশেষণের অর্থ পরিস্ফুট হয়, তবে বহুব্রীহি সমাস হয়। কান কাটা যাহার কানকাটা (বহুব্রীহি); এখানে কাটা কৃদন্তপদে বিশেষণের অর্থ পরিস্ফুট; কিন্তু কান কাটে যে = কানকাটা (উপপদ)। এখানে কৃদন্ত পদে ক্রিয়ারই অর্থপ্রাধান্য রহিয়াছে। ঘরপোড়া (বুদ্ধি বা গোরু)–বহুব্রীহি; কিন্তু ঘরপোড়া (হনুমান)—উপপদ।

১৫৬। ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস : যে বহুব্রীহি সমাসে সমস্যমান পদদ্বয় পৃথক্ বিভক্তিযুক্ত বিশেষ্যপদ হয়, তাহাকে ব্যধিকরণ বহুব্রীহি সমাস বলে। এই সমাসের পূর্বপদটি শূন্যবিভক্তিযুক্ত এবং উত্তরপদটি অধিকরণের এ বা তে বিভক্ত্যন্ত হয়। পূর্বপদ ও উত্তরপদের বিভক্তি পৃথক্ বলিয়াই নাম ব্যধিকরণ (বি + অধিকরণ)।

বীণা পাণিতে যাহার = বীণাপাণি; পদ্ম নাভিতে যাহার = পদ্মনাভ (বিষ্ণু); চন্দ্র চূড়ায় যাহার = চন্দ্রচূড়; ঊর্ণা নাভিতে যাহার = ঊর্ণনাভ; ণিচ্ অন্তে যাহার ণিজন্ত; কৃৎ অন্তে যাহার = কৃদন্ত; তি অন্তে যাহার = তিঙন্ত; মধু কণ্ঠে যাহার = মধুকণ্ঠ; কল (সুমধুর ধ্বনি) কণ্ঠে যাহার = কলকণ্ঠ; পদ্ম পদে যাহার = পদ্মপাদ; প্রণাম পূর্বে যাহার = প্রণামপূর্বক; তুলনা মূলে যাহার = তুলনামূলক মানব আদিতে যাহার = মানবাদি; ইতি আদিতে যাহার = ইত্যাদি; হাসি মুখে যাহার = হাসিমুখো; ছেলে কাঁখে যাহার = ছেলেকাখী (স্ত্রী)। সেইরূপ দণ্ডপাণি, বজ্রপাণি, ধনুষ্পাণি, পিনাকপাণি, গবাদি, খড়্গহস্ত; মিলনান্তক, শশাঙ্ক, সুবন্ত, অজন্ত, প্রদানপূর্বক, বর্ণনামূলক, কলসকক্ষা, সারগর্ভ, রত্নগর্ভা, নোলকনাকী, বেদনান্তক, জ্ঞানগর্ভ, চাঁদকপালে, ছাতাহাতে, ছেলেকোলে, হাঁড়িহাতে, লকড়িঘাড়ে, বোঁচকামাথায়, চশমানাকে, কোঁচাকাঁধে, চাদরগলায়, পাঞ্জাবিগায়ে, গামছাকাঁধে। “চন্দ্রচূড় জটাজালে আছিলা যেমতি জাহ্নবী।”—মধুসুদন। “বল দেখি চশমা-নাকে বাবু, ইহাদের কি মঙ্গল হইয়াছে?”—বঙ্কিমচন্দ্ৰ। “ততোধিক শূলপাণি ভাবে উমা-মারে।”-কমলাকান্ত ভট্টাচার্য।

কখনও কখনও এ, তে বিভক্তিযুক্ত পদটি পূর্বেও বসে। (শুভ) ক্ষণে জন্ম যাহার = ক্ষণজন্মা; সত্যে সন্ধা (স্থিরনিষ্ঠা) যাহার = সত্যসন্ধ; পাপে মতি যাহার = পাপমতি; আশীতে (দন্তে) বিষ যাহার = আশীবিষ (সর্প); ধর্মে বুদ্ধি যাহার = ধর্মবুদ্ধি; অন্য বিষয়ে মন যাহার = অন্যমনস্ক; নেই (ন্যায়ে) আঁকড় (আগ্রহ) যাহার = নেই-আঁকড়া [ অথবা, নেই-তে (নাভিতে) আঁকড় যাহার নেই—আঁকড়ে ]’; নিম্নে রেখা যাহার = নিম্নরেখ; অন্তঃ (অন্তরে—শেষে) অপ্ যাহার = অন্তরীপ [ অপ্-স্থানে ঈপ্ ]। তদ্রূপ সত্যনিষ্ঠ, একনিষ্ঠ, অধোরেখ, পাছাপেড়ে ইত্যাদি। “কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।” আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণে উত্তমাশা অন্তরীপ অবস্থিত। সীতাকে অবিলম্বে সসম্মান মুক্তি দেবার জন্য ধর্মবুদ্ধি বিভীষণের প্রস্তাব পাপমতি রাবণকে ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল।

১৫৭। নঞর্থক বহুব্রীহি সমাস : নঞর্থক পদের সহিত বিশেষ্যপদের যে বহুব্রীহি সমাস, তাহাকে নঞর্থক বহুব্রীহি সমাস বলে। [ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের নূতন পাঠ্যসূচীতে ইহাকে না-বহুব্রীহি বলা হইয়াছে। ] নিঃ (নাই) রদ (দন্ত) যাহার = নীরদ [ সন্ধির ফলে ই-কার ঈ-কার হইয়াছে; কিন্তু “নীর দান করেন যিনি” ব্যাসবাক্য করিলে নীরদ—উপপদ তৎপুরুষ হইবে ]; নিঃ (নাই) শঙ্কা যাহার নিঃশঙ্ক; নাই অর্থ যাহার নিরর্থক; নিঃ রজঃ (ধুলি) যাহার = নীরজ; নিঃ (নাই) কলঙ্ক যাহার = নিষ্কলঙ্ক; নাই অন্ত যাহার = অনন্ত; নাই ঈশ যাহার = অনীশ; নাই নিশা (বিরামকাল) যাহাতে = অনিশ; বি (বিগত)) হইয়াছে ধব (স্বামী) যাহার = বিধবা; বিগতা পত্নী যাহার = বিপত্নীক; বিগত হইয়াছে রাগ (অনুরাগ) যাহার বীতরাগ; বিগত হইয়াছে শ্রদ্ধা যাহার বীতশ্রদ্ধ; নাই কুল যাহার নকুল (মহাদেব); বিগত হইয়াছে নিদ্রা যাহার = বিনিদ্র; নাই তন্দ্রা যাহাতে = অতন্দ্র; বিগত ক্লম (ক্লান্তি) যাহার = বিগতক্লন; নিঃ (নাই) অপেক্ষা যাহাতে = নিরপেক্ষ; বিগত হইয়াছে শ্ৰী যাহার = বিশ্রী; নিঃ (নাই) দায় যাহাতে = নির্দায়; নাই ঈহা (ইচ্ছা) যাহার = অনীহ; বিগত ধর্ম যাহার = বিধর্মা; নাই লাজ যাহার = নিলাজ; নাই লজ্জা যাহার = নির্লজ্জ; নিঃ (নাই) বিকল্প (বিশেষ) যাহাতে = নির্বিকল্প; নিঃ (নাই) প্রতিভা (বুদ্ধি) যাহার = অপ্রতিভ; নিঃ (নাই) খিল (অকর্ষিত জমি) যেখানে = নিখিল; বিগত অর্থ যাহার = ব্যর্থ; কোথা হইতেও ভয় নাই যাহার = অকুতোভয়; নাই চার (চার = চারা = উপায় বা প্রতিকার) যাহার = নাচার; বে (নাই) ইমান (বিশ্বস্ততা) যাহার = বেইমান; বে (নাই) কার (কর্ম) যাহার বেকার; বে (নাই) তার যাহাতে = বেতার (যন্ত্র); নাই ছোড় (ছাড়ান) যাহার নিকট হইতে = নাছোড় (বান্দা); নাই নাড়ী (নাড়ীজ্ঞান) যাহার = আনাড়ী; নাই থই যাহার = অথই; নিঃ (নাই) আমিষ যাহাতে নিরামিষ; নাই সহায় যাহার = নিঃসহায়; নিঃ (নাই) জীব (জীবন) যাহার = নির্জীব; নিঃ (নাই) বিশেষ যাহাতে = নির্বিশেষ। সেইরূপ নিরাকাঙ্ক্ষ, নির্দ্বন্দ্ব, নির্দ্বিধ, নিরক্ষর (অনক্ষর), নিরুপাধি (নিরুপাধিক), নির্বিবেক, নির্বাধ, নিশ্চেষ্ট, অমূলক, নিশ্চিন্ত, অনাদি, অনিবার, নীরক্ত, নীরস, অসীম, নিরিন্ধন, নির্বান্ধব, নিরবদ্য, নিরাবেগ, নিরবয়ব, নিরিন্দ্রিয়, অনর্থক, বিশৃঙ্খল, বিচ্ছায়, বীতশোক, অপয়া (বউ বা মেয়ে), বেহায়া, বেহাল, বেচারা, বে-নজির, নির্ভুল, নিটোল, নিখুঁত, নির্জলা (দুধ), বেহুঁশ, বে-আদব, বেপরোয়া, বে-ওয়ারিশ (মাল), বে-দরজা (ঘর), বেপাত্তা (লোক), নিখরচে। “রক্ত যা ছিল করেছে শোষণ, নীরক্ত দেহে হাড় দিয়ে রণ!”—নজরুল। “অনন্ত এ দেশকালে অগণ্য এ দীপ্ত লোকে”—রবীন্দ্রনাথ। “অনাদি অনন্ত অরূপ হে অক্ষয়।”

ন-তৎপুরুষ ও নঞর্থক বহুব্রীহি সমাসের সমস্ত-পদের চেহারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে একই। তাই অর্থ বুঝিয়া ব্যাসবাক্য ও সমাস নির্ণয় করিতে হয়। নঞ-তৎপুরুষে পূর্বপদ অ, অন্ বা নিঃ-এর অর্থ ‘না’, ‘নয়’। কিন্তু নঞর্থক বহুব্রীহিতে পূর্বপদ অ, অন্ বা নিঃ-এর অর্থ “নাই”। অজ্ঞানে করেছি কত পাপ (জ্ঞান নয় = অজ্ঞান—ন-তৎপুরুষ)। কিন্তু অজ্ঞানের অপরাধ ক্ষমা কর প্রভু। (জ্ঞান নাই যাহার = অজ্ঞান–নঞর্থক বহুব্রীহি)।

১৫৮। মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস : বহুব্রীহি সমাসে ব্যাসবাক্যের মধ্যস্থিত পদের লোপ হইলে তাহাকে মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি সমাস বলে। এই জাতীয় সমাসে অধিকাংশ স্থলে উপমানের সহিত সমাস হয় বলিয়া ইহাকে উপমাত্মক বহুব্রীহি সমাসও বলা হয়। আবার ব্যাসবাক্যটি মাঝে মাঝে ব্যাখ্যামূলক হয় বলিয়া ইহাকে ব্যাখ্যাত্মক বহুব্রীহি সমাসও বলে।

কমলের মতো অক্ষি যাহার = কমলাক্ষ (স্ত্রীলিঙ্গে কমলাক্ষী); কপোতের অক্ষির ন্যায় অক্ষি যাহার—কপোতাক্ষ; মৃগের নয়নের ন্যায় চঞ্চল নয়ন যাহার =  মৃগনয়না; কাঞ্চনের প্রভার ন্যায় প্রভা যাহার কাঞ্চনপ্রভ; অগ্নির ন্যায় উগ্রমূর্তি প্রকাশে শর্ম (সুখ) হয় যাহার = অগ্নিশর্মা; কুশের অগ্রভাগের মতো তীক্ষ্ণ ধী যাহার = কুশাগ্রধী; চন্দ্রের ন্যায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল মুখ যে নারীর = চন্দ্ৰমুখা বা চন্দ্রমুখী; বিড়ালের অক্ষির মতো অক্ষি যাহার = বিড়ালাক্ষ (স্ত্রীলিঙ্গে—বিড়ালাক্ষী); কম্বুর (শঙ্খ) ন্যায় গম্ভীর কণ্ঠ যাহার = কম্বুকণ্ঠ; ধর্মের (আদর্শ) উদ্দেশে ঘটস্থাপন-পূর্বক যে আন্দোলন ধর্মঘট; (নতুন) বউয়ের দ্বারা ভাত পরিবেশনের যে উৎসব = বউভাত; ভাইয়ের কপালে কল্যাণসূচক ফোঁটা দেওয়ার যে অনুষ্ঠান = ভাইফোঁটা; শুকের নাসার মতো তীক্ষ্ণ নাসা যাহার শুকনাস; বিম্বের ন্যায় রঞ্জিত অধর যে নারীর = বিম্বাধরা; দন্তের ন্যায় শুভ্র বীজ যাহার = দন্তবীজ (দাড়িম্ব-ফল); এক চেটীর (শ্রেষ্ঠীর) অধিকার যাহাতে একচেটিয়া; শ্বার (কুকুরের) পদের মতো পদ যাহার শ্বাপদ; নাদার (বড়ো জালার) মতো পেট যাহার = নাদাপেটা; পাঁচ সের ওজন যাহার পাঁচসেরি (বাটখারা); মৃতের গন্ধের মতো গন্ধ যাহার = ঘৃতগন্ধী (মিষ্টান্ন); এক বুক গভীরতা যেখানে = একবুক (জল); হাঙরের মুখের মতো মুখ যাহার হাঙরমুখো (নৌকা বা বজরা); টিয়ার ঠোঁটের মতো রঙ যাহার = টিয়াঠোঁটা (আম); মীনের অক্ষির মতো অক্ষি যে নারীর = মীনাক্ষী; দুধের মতো নাক যাহার = দুধনেকো (বাঁদর); দেখনমাত্র হাসি যাহার = দেখনহাসি; দেড়গজ পরমাণ যাহার = দেড়গজী (গামছা); গোঁফে খেজুর পড়িয়া রহিয়াছে যাহার = গোঁফখেজুরিয়া > গোঁফখেজুরে; ডাকাতের বুকের মতো বুক (সাহস) যাহার = ডাকাবুকো; চিরুনির দাঁতের মতো দাঁত যাহার = চিরুনদাঁতী। সেইরূপ কমললোচন, বিদ্যুৎপ্রভ, হেমপ্রভা, ক্ষুরধার (বুদ্ধি), খঞ্জননয়নী, বিদ্যুদ্বরণী, তড়িরণী, এণাক্ষী, পদাগন্ধী, বিধুমুখী, চন্দ্রাননা, চাঁদবদনী, হরিণাক্ষ, চন্দ্রবদন, সূর্যতেজা, ধামাপেটা, নীলচোখো, হলুদচুলো, বাঁদরমুখো, হাতিশুঁড়ো।

কয়েকটি প্রয়োগ দেখ : “তড়িতবরণী হরিণনয়নী দেখিনু আঙিনা-মাঝে।” “কিংবা বিম্বাধরা রমা অম্বুরাশিতলে।” “বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ফুটে।”

১৫৯। ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস : পরস্পর একজাতীয় ক্রিয়ার বিনিময় বুঝাইলে একই বিশেষ্যের দ্বিত্বের দ্বারা যে বহুব্রীহি সমাস হয়, তাহার নাম ব্যতিহার বহুব্রীহি সমাস। এই সমাসের পূর্বপদের অন্ত্যস্বর অধিকাংশ স্থানে আ (স্থানবিশেষে ও) এবং উত্তরপদের অন্ত্যস্বর সর্বদাই ই হয়।

যুদ্ধ, বিবাদ প্রভৃতি অর্থে : হাতে হাতে যে যুদ্ধ = হাতাহাতি; কেশে কেশে আকর্ষণ করিয়া যে যুদ্ধ = কেশাকেশি; পরস্পরকে হানা = হানাহানি; দণ্ডে দণ্ডে (দণ্ড লইয়া) যে যুদ্ধ = দণ্ডাদণ্ডি; (বাস্তব অভাব ও আর্থিক সংগতির) পরস্পরকে টানা = টানাটানি; পরস্পর গালিবর্ষণ করিয়া যে বিবাদ = গালাগালি; পরস্পর দর হাঁকা = দরাদরি; পরস্পরকে কাটা = কাটাকাটি; পরস্পর যোঝা (যুদ্ধ করা) = যোঝাবুঝি; পরস্পরের মধ্যে আড়ি = আড়াআড়ি। সেইরূপ তর্কাতর্কি, নখানখি, লাঠালাঠি, রক্তারক্তি, খুনাখুনি (খুনোখুনি), কাড়াকাড়ি, ঘুষাঘুষি (ঘুষোঘুষি), গুঁতাগুঁতি (গুঁতোগুঁতি), চুলাচুলি, ঝাঁকাঝাঁকি।

[ কিন্তু তাড়াতাড়ি, বেলাবেলি (বেলা থাকিতেই), রাতারাতি, বাড়াবাড়ি, আড়াআড়ি (বাঁকাভাবে স্থিত অর্থে), সোজাসুজি প্রভৃতি শব্দে পারস্পরিক ক্রিয়া—বিনিময় বুঝায় না বলিয়া এই শব্দগুলি বহুব্রীহি সমাসজাত নয়, শুদ্ধ শব্দদ্বৈত।]

প্রীতিবিনিময় বা আলাপ-পরিচয় অর্থে : গলায় গলায় যে মিল = গলাগলি; কানে কানে যে মন্ত্রণা = কানাকানি [ কিন্তু কানা ও কানী = কানাকানী : দ্বন্দ্ব]; কোলে কোলে যে মিলন = কোলাকুলি; হাসিয়া হাসিয়া যে আলাপ = হাসাহাসি, পরস্পর সরা = সরাসরি পরস্পর জানা = জানাজানি। সেইরূপ (মুখ) চাওয়াচাওয়ি, দেখাদেখি, চোখোচোখি, মুখোমুখি, বলাবলি। “তখনি ইতিহাস কানাকানি করে উঠেছিল।” হাতাহাতি করে (একই কাজে সহযোগিতা অর্থে পরস্পর হাত লাগাইয়া) মালগুলো বয়ে নাও। বোঁচকাকুঁচকি বাঁধাবাঁধি হল?

১৬০। সহাৰ্থক বহুব্রীহি সমাস : পূর্বপদ বিশেষ্যের সহিত সহার্থক উত্তরপদের বহুব্রীহি সমাস হইলে তাহাকে সহার্থক বহুব্রীহি সমাস বলে।

পুত্রের সহিত বর্তমান = সপুত্র; বেগের সহিত বর্তমান = সবেগ; ত্বরার সহিত বর্তমান = সত্বর; টীকার সহিত বর্তমান = সটীক; মন্ত্রের সহিত বর্তমান = সমন্ত্রক; গর (বিষ)-এর সহিত বিদ্যমান = সগর; অমর্ষের (ক্রোধ) সহিত = বিদ্যমান = সামর্ষ; শঙ্কার সহিত বর্তমান = সশঙ্ক; অবলীলার সঙ্গে বর্তমান = সাবলীল; অবয়বের সহিত বিদ্যমান = সাবয়ব; ঘৃণার সহিত বর্তমান = সঘৃণ; ক্রিয়ার সহিত বর্তমান = সক্রিয়; শ্রদ্ধার সহিত বর্তমান = সশ্রদ্ধ; অর্থের সহিত বর্তমান = সার্থক; বাক্-এর সহিত বর্তমান = সবাক্ (চিত্র); তর্কের (বিচারণার সহিত বিদ্যমান = সতর্ক; হর্ষের সহিত বর্তমান = সহর্ষ; সম্ভ্রমের সহিত বিদ্যমান = সসম্ভ্রম; ধবের (ধব = স্বামী) সহিত বিদ্যমানা = সধবা (নিত্য স্ত্রী); অবধানের সহিত বিদ্যমান = সাবধান; অপরাধের সঙ্গে বিদ্যমান = সাপরাধ; চরাচরের সহিত বিদ্যমান সচরাচর; চকিতের (ভয়ের) সহিত বিদ্যমান সচকিত : প্রতিভার সহিত বিদ্যমান = সপ্রতিভ; অন্তের সঙ্গে বর্তমান = সান্ত; অম্বরের সহিত বিদ্যমান = সাম্বর; সত্ত্ব (ভ্রূণ)-এর সহিত বিদ্যমানা = সসত্ত্বা (নিত্য স্ত্রী)। তদ্রূপ সসম্মান, সশিষ্য, সোল্লাস, সাষ্টাঙ্গ, সনিষ্ঠ, সাশ্রয়, সস্পৃহ, সদয়, সবান্ধব, সমাতৃক, সপ্রশংস, সস্ত্রীক, সপুত্র, সাকাঙ্ক্ষ, সতৃষ্ণ, সফেন, সানুজ, সবিশেষ। কিন্তু পূর্বপদ বিশেষণ হইলে সহার্থক বহুব্রীহি হয় না। সলজ্জিত, সকাতর, সশঙ্কিত, সকম্পিত প্রভৃতি শব্দ ব্যাকরণসিদ্ধ নয়, অথচ সাহিত্যে শব্দগুলির প্রয়োগ প্রচুর। “স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে স্তব্ধ অর্ধরাতে।”—রবীন্দ্রনাথ।

এই সমাসসিদ্ধ পদগুলি এ-কারান্ত করিয়া প্রয়োগ করা উচিত নয়। “সকলে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করতে লাগল।” অসময়ে দুর্বাসা সশিষ্য এসে উপস্থিত! আকাশবাণীর ‘সবিনয় নিবেদন’ অনুষ্ঠানটি বেশ উপভোগ্য।

১৬১। সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি সমাস : বহুব্রীহি সমাসের পূর্বপদটি সংখ্যাবাচক বিশেষণ হইলে সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি সমাস হয়।

দশটি আনন যাহার দশানন (রাবণ); ত্রি লোচন যাহার ত্রিলোচন (মহাদেব); চতুঃ মুখ যাহার = চতুর্মুখ (ব্রহ্মা); ষট্ আনন যাহার = ষড়ানন (কার্তিকেয়); ত্রি নয়ন যাহার = ত্রিনয়ন (শিব), স্ত্রীলিঙ্গে ত্রিনয়না (দুর্গা, কালী প্রভৃতি); সে (তিন = ফারসী শব্দ) তার যাহার = সেতার (বাদ্যযন্ত্র); দুই দিকে হার পরিমিত যাহার = দোহারা; দুইদিকে অপ্ (জল) যাহার = দ্বীপ [ অপ্-এর অ স্থানে ঈৎ হয়, ৎ লোপ পায়, ফলে অপ্ ঈপ্ হয় এবং সমাসান্ত অ যুক্ত হয়]; দুইটি নল যাহার দোনলা (বন্দুক); একটি ডাল যাহার একডালিয়া > একডেলে; একদিকে রোখ যাহার = একরোখা (মানুষ); একদিকে চোখ যাহার একচোখো; সহস্র লোচন যাহার = সহস্রলোচন (ইন্দ্র); সহস্ৰ বিধা যাহার = সহস্রবিধ; তিনটি তলা যাহার = তেতলা (বাড়ি); আটটি চালা যাহার আটচালা (ঘর); দুইবার ফল ফলে যাহার দোফলা (গাছ)। দুইবার ফসল হয় যেখানে = দোফসলী (জমি); দুই দিকে ধার যাহার = দোধারী; ছয়টি ঘর যাহার = ছয়ঘরা (রিভলবার); চৌ (চারটি) রাস্তার মিলন যেখানে = চৌরাস্তা [ কিন্তু সমষ্টি বুঝাইলে চৌরাস্তা—দ্বিগু ]। সেইরূপ পঞ্চানন, চতুর্ভুজ, দশভুজা, তেমাথা (রাস্তা), চতুষ্পদ, তেপায়া, সাতরঙা, একতারা, দোতলা (বাড়ি, বাস, ট্রেন), তেশিরে (মনসা), নবপত্রিকা (মূর্তি), নবদ্বার (দেহ)। “বৃথা গঞ্জ দশাননে তুমি, বিধুমুখী।” “একমনে তোর একতারাতে একটি যে সুর সেইটি বাজা।” “অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়।” “ত্রিনয়নী দুর্গা, মা তোর রূপের সীমা পাইনা খুঁজে।” “সাতরঙা এক পাখি পাতায় পাতায় ডালে ডালে করছে ডাকাডাকি।”

দ্বিগু ও সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি সমাসের সমস্ত-পদের আকৃতি একই। সুতরাং আকৃতি দেখিয়া নয়, অর্থ বুঝিয়া সমাস ও ব্যাসবাক্য নির্ণয় করিতে হয়। যেখানে সমষ্টি বা সমাহার বুঝায় সেখানে দ্বিগু আর যেখানে সমস্যমান পদদ্বয়ের কোনোটিরই অর্থ না বুঝাইয়া অতিরিক্ত একটি পদের অর্থ বুঝায় সেখানে সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি হয়। তোমার মহিমা, মাতা, পঞ্চানন (বহুব্রীহি) পঞ্চাননে (দ্বিগু) বর্ণিতে না পারে। এখানে প্রথম পঞ্চানন “পঞ্চ আনন যাহার” সেই অর্থে শিবকে বুঝাইতেছে। অতএব সমাস সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি। দ্বিতীয় পঞ্চানন “পঞ্চ আননের সমাহার” অর্থে দ্বিগু সমাস; এখানে পাঁচটি মুখের সমষ্টিকেই বুঝাইতেছে (বাক্যটির অর্থ : শিব পাঁচমুখেও বলিয়া শেষ করিতে পারেন না)।

অব্যয়ীভাব সমাস *

 [ * পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ২০০৫ সাল হইতে প্রবর্তিত পাঠ্যসূচীতে ইহাকে উপসর্গ তৎপুরুষ বলা হইয়াছে। ]

১৬২। অব্যয়ীভাব সমাস : পূর্বপদ অব্যয়ের সহিত পরপদ বিশেষ্যের যে সমাস হয়, তাহাকে অব্যয়ীভাব সমাস বলে। এই সমাসে অব্যয়েরই অর্থপ্রাধান্য। সমস্ত-পদটি অব্যয়ের ভাব প্রাপ্ত হয় বলিয়াই নাম অব্যয়ীভাব।

সংস্কৃতে সামীপ্য, অভাব, বীপ্সা, অনতিক্রম, সাদৃশ্য, সীমা, যোগ্যতা, ক্ষুদ্ৰতা, সম্মুখ, পশ্চাৎ, বিরুদ্ধতা প্রভৃতি বিবিধ অর্থে অব্যয়ীভাব সমাস হয়। বাংলা অব্যয়ীভাব সমাসেও এইগুলি লক্ষিত হয়।

সমীপ্য (নিকট) : কূলের সমীপে = উপকূল; অক্ষির সমীপে = সমক্ষ; সকালের কাছাকাছি = সকালনাগাত। সেইরূপ উপকণ্ঠ, অনুগঙ্গ, উপনগরী, সন্ধ্যানাগাত।

অভাব : ভিক্ষার অভাব = দুর্ভিক্ষ; বিঘ্নের অভাব = নির্বিঘ্ন; মক্ষিকার অভাব = নির্মক্ষিক; ভাতের অভাব হাভাত; মিলের অভাব = গরমিল মানানের অভাব = বেমানান; টকের অভাব = না-টক; হায়ার (লজ্জা) অভাব = বেহায়া। সেইরূপ অনর্থ, নিরামিষ, আলুনী, হা-ঘর, বেগোছ, বেবন্দোবস্ত।

বীপ্সা (পুনঃপুনঃ) : দিনে দিনে = প্রতিদিন; অঙ্গে অঙ্গে প্রতি-অঙ্গ (প্রত্যঙ্গ নয়); ক্ষণে ক্ষণে = প্রতিক্ষণ বা অনুক্ষণ; গৃহে গৃহে = প্রতিগৃহ; জনে জনে = প্রতিজন, জনপ্রতি, জনপিছু, জনা-কি; সেরে সেরে = প্রতিসের, সেরকরা, সেরপ্রতি; দমে দমে = হরদম; রোজ রোজ = প্রতিরোজ বা হররোজ; মাসে মাসে = প্রতিমাস, ফি-মাস; সনে সনে = ফি-সন; প্রতি মাঠ = মাঠকে-মাঠ। সেইরূপ গাঁকে-গাঁ, দিনকে-দিন, বছরকে-বছর ইত্যাদি।

অনতিক্রম (অতিক্রম না করিয়া) : শক্তিকে অতিক্রম না করিয়া = যথাশক্তি; আয়কে অতিক্রম না করিয়া = আয়মাফিক। সেইরূপ যথাবিধি, যথারীতি, যথাজ্ঞান, যথার্থ, যথাসাধ্য, যথেষ্ট, যথেচ্ছ, যথারুচি, যথাক্রম, যথাশাস্ত্র, যথাপূর্ব, নিয়মমাফিক।

সাদৃশ্য : দ্বীপের সদৃশ = উপদ্বীপ; মূর্তির সদৃশ = প্রতিমূর্তি; দানের সদৃশ অনুদান; আচার্যের সদৃশ = উপাচার্য; কথার সদৃশ = উপকথা; ধ্বনির সদৃশ প্রতিধ্বনি; ধ্যানের সদৃশ = অনুধ্যান; লক্ষ্যের সদৃশ = উপলক্ষ্য। তদ্রূপ উপবন, উপভাষা, উপাধ্যক্ষ, উপমন্ত্রী, উপরাষ্ট্রপতি।

সীমা ও ব্যাপ্তি : কণ্ঠ পর্যন্ত = আকণ্ঠ; বাল্য হইতে = আবাল্য; আদি হইতে অন্ত পর্যন্ত = আদ্যন্ত; বালক হইতে বৃদ্ধ ও বনিতা পর্যন্ত = আবালবৃদ্ধবনিতা; জীবন পর্যন্ত = আজীবন, যাবজ্জীবন; পদ হইতে মস্তক পর্যন্ত = আপাদমস্তক; দিন ব্যাপিয়া = দিনভর; আশ্বিন পর্যন্ত = আশ্বিনতক; গলা পর্যন্ত = গলানাগাল। সেইরূপ আশৈশব, আকর্ণ, আমৃত্যু, আমরণ, আযৌবন, আচণ্ডাল, আজানু, আ-মরা, আমূল, আসমুদ্রহিমাচল। আবার, কুঁচকি হইতে কণ্ঠা পর্যন্ত = কুঁচকিকণ্ঠা (অব্যয় লুপ্ত)। তদ্রূপ আপাদশীর্ষ, আশিরপদনখ, আগাগোড়া, আগাপাছতলা।

ক্ষুদ্রতা : ক্ষুদ্র গ্রহ = উপগ্রহ; ক্ষুদ্র শাখা = প্রশাখা; ক্ষুদ্র জাতি = উপজাতি; ক্ষুদ্র নদী = উপনদী; ক্ষুদ্র অঙ্গ = প্রত্যঙ্গ; ক্ষুদ্র সাগর = উপসাগর; ক্ষুদ্র বিভাগ = উপবিভাগ। তদ্রূপ উপহার, উপপ্রধান, উপপদ, উপপর্ব।

যোগ্যতা : রূপের যোগ্য অনুরূপ; গুণের যোগ্য = অনুগুণ।

সম্মুখ : অক্ষির সম্মুখে প্রত্যক্ষ; কূলের সম্মুখে = অনুকূল।

পশ্চাৎ : গমনের পশ্চাৎ = অনুগমন; গৃহের পশ্চাৎ = অনুগৃহ; ইন্দ্রের পশ্চাৎ = উপেন্দ্র। সেইরূপ অনুতাপ, অনুকরণ, অনুরণন।

বিরুদ্ধ বা বিপরীত : কূলের বিরুদ্ধে = প্রতিকূল; অক্ষির অগোচর = পরোক্ষ; পক্ষের বিরুদ্ধে = প্রতিপক্ষ; ফলের বিপরীত = প্রতিপক্ষ; ফলের বিপরীত = প্রতিফল। সেইরূপ প্রতিক্রিয়া, প্রতিবাদ, প্রতিঘাত, প্রতিদান, প্রতিশোধ।

বিবিধ অর্থে : আত্মাকে অধিকার করিয়া = অধ্যাত্ম; দৈবকে অধিকার করিয়া = অধিদৈব; মুখের অভিমুখে = সম্মুখ; পিতামহের পূর্ব = প্রপিতামহ; পৌত্রের পরে = প্রপৌত্র; বেলাকে অতিক্রান্ত = উদ্বেল; ক্রমের অনুসারে = অনুক্রম; বাস্তু হইতে উৎখাত = উদ্বাস্তু; নিদ্রা হইতে উত্থিত = উন্নিদ্ৰ; শৃঙ্খলাকে অতিক্রান্ত = উচ্ছৃঙ্খল; হীন দেবতা = উপদেবতা; ঝুড়িকে বাদ না দিয়া = ঝুড়িসুদ্ধ; কাজ চালাইবার মতো = কাজচলাগোছ; দস্তুর অনুযায়ী = দস্তুরমতো; প্রত্যাশার আধিক্য = হাপিত্যেশ।

[ অনু প্রতি উপ প্রভৃতি পদ একাধিক অর্থে প্রযুক্ত হইতেছে, লক্ষ্য কর। ] অব্যয়ীভাব সমাসের যে উদাহরণগুলি দিলাম, তাহার মধ্যে সংস্কৃত ও বাংলা দুই-ই আছে। অব্যয়ীভাব সমাসনিষ্পন্ন সংস্কৃত শব্দগুলি সংস্কৃতে অব্যয়, ক্রিয়াবিশেষণ এবং ক্বচিৎ বিশেষ্যরূপে (দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে) ব্যবহৃত হয়। বাংলায় এইসমস্ত শব্দ এবং বাংলা অব্যয়ীভাব সমাস নিষ্পন্ন শব্দাবলী ক্বচিৎ অব্যয়রূপে ব্যবহৃত হয়-নাম-বিশেষণ, ক্রিয়াবিশেষণ ও বিশেষ্যরূপেই ইহাদের প্রয়োগ বেশী দেখা যায়। উপকূল, উপকণ্ঠ, উপভাষা, উপবন, উপকথা, উপনদী, উপদেবতা, প্রতিমূর্তি, অনুকরণ, অনুগমন, অনুতাপ, প্রতিপক্ষ, দুর্ভিক্ষ, গরমিল, প্রতিধ্বনি, প্রতি-অঙ্গ প্রভৃতি বিশেষ্যরূপে; নির্বিঘ্ন, নির্মক্ষিক, অনুরূপ, অনুকূল, অধ্যাত্ম প্রভৃতি নামবিশেষণরূপে এবং অবশিষ্টগুলি ক্রিয়াবিশেষণরূপে ব্যবহৃত হয়।

প্রয়োগ : “বিধাতার রুদ্ররোষে দুর্ভিক্ষের দ্বারে বসে ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান।” “নৌকা ফি-সন (ক্রি-বিণ) ডুবিছে ভীষণ।” “প্রকাশ্য রাজপথে কালোবাজারীদের আপাদমস্তক (অব্যয়) চাবকানোই ওদের একমাত্র মহৌষধ।” তার কথা শুনে আমার আপাদমস্তক (বি) জ্বলে গেল। “ধ্বনিটিরে প্রতিধ্বনি (বি) সদা ব্যঙ্গ করে।” “প্রতিদিবসের (বি) কর্মে প্রতিদিন (ক্রি-বিণ) নিরলস থাকি।” “প্রতি-অঙ্গ (বি) লাগি কান্দে প্রতি-অঙ্গ (বি) মোর।” জ্ঞানদাস। “তবে সৌভাগ্য এই যে উপকূল (বি) নিকটে।” প্রতিকূল (বিণ) পরিবেশে উন্নতি করা দুরূহ বইকি। যথাসাধ্য (ক্রি-বিণ) চেষ্টা করো, ফলাফল ঈশ্বরের হাতে। “হাঁটু-নাগাল (বিণ) ধানের জমি গলা-নাগাল (বিণ) পাট।” বইখানি যথাস্থানে (বি) রাখ।

অব্যয়ীভাব সমাসনিষ্পন্ন সমস্ত-পদ যেখানে অব্যয় না হইয়া নামপদ-রূপে ব্যবহৃত হইতেছে, সেখানে ব্যাকরণগত বৈশিষ্ট্য দেখাইতে হইলে অব্যয়ীভাব সমাসের ব্যাসবাক্য করিয়া, যে পদরূপে শব্দটি ব্যবহৃত হইতেছে তাহার উল্লেখ করিতে হইবে।

অলুক্ সমাস

১৬৩। অলুক্ সমাস : যে সমাসের সমস্ত-পদে পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পায় না, তাহাকে অলুক্‌ সমাস বলে।

লুক্ কথাটির অর্থ লোপ; পূর্বপদের বিভক্তির বা অনুসর্গের লোপ হয় না বলিয়াই নাম অলুক্। বিভিন্ন প্রকার অলুক্ সমাসের উদাহরণ দেখ।

(ক) অলুক দ্বন্দ্ব : বুকে ও পিঠে = বুকেপিঠে। সেইরূপ চোখেমুখে, আগেপিছে, পথেঘাটে, হাটেবাটে, দুধেভাতে, ঘরে বাহিরে, মায়েঝিয়ে, হাতেকলমে, ভয়েবিস্ময়ে, দিনেরাত্রে, বনেবাদাড়ে, ঠারেঠোরে। “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।” “অন্তহীন প্রাণের বিকাশতীর্থে যাত্রা করব রৌদ্রে-বাদলে দিনে-রাত্রে।” “হাটে-মাঠে-বাটে এই মত কাটে বছর পনেরো ষোলো।”

(খ) অলুক্ তৎপুরুষ : (১) করণ (পূর্বপদের করণের বিভক্তিলোপ হয় না)—-তমসা (তমস্ শব্দের করণ একবচন) আচ্ছন্ন = তমসাচ্ছন্ন; হাতে কাটা হাতেকাটা (সুতো)। সেইরূপ দুধেধোয়া, কলেছাঁটা, পায়েঠেলা (ঘট), বাপে—খেদানো-মায়ে-তাড়ানো (ছেলে), ঘিয়েভাজা (জিলিপি), তেলেভাজা (বেগুনি), হাতে আঁকা (ছবি), হাতেগড়া (রুটি), ছিপেগাঁথা (মাছ), সাপেকাটা, রোদেপোড়া, পায়েচলা, চোখেদেখা, গন্ধেভরা, মেঘেঢাকা, কানেকালা, নাকেকান্না, বালির বাঁধ, কাঠের সিঁড়ি, তাসের ঘর, মাটির মানুষ, আলুর চপ, চিঁড়ের পায়স। (২) সম্প্রদান (পূর্বপদের সম্প্রদানের বিভক্তি লোপ পায় না)—আত্মনে (আত্ম শব্দের সম্প্রদানের একবচন) পদ = আত্মনেপদ; পরস্মৈ (পরের জন্য) পদ পরস্মৈপদ; মুড়ির জন্য চাল = মুড়ির চাল। তদ্রূপ জামার কাপড়, পড়ার ঘর, ভুলের মাসুল, খেলার মাঠ, পেটের ভাত, পেটের খোরাক, চায়ের বাটি, ভাতের হাঁড়ি। (৩) অপাদান (পূর্বপদের অপাদানের বিভক্তিলোপ হয় না) –– সারাৎ (সার হইতে) সার = সারাৎসার; পরাৎ পর পরাৎপর। সেইরূপ চোখের জল, ঘানির তেল, বিদেশ থেকে আনা, আকাশ থেকে পড়া। (৪) সম্বন্ধ (পূর্বপদের সম্বন্ধপদের বিভক্তি লোপ পায় না)—ভ্রাতুঃ (ভ্রাতৃ শব্দের সম্বন্ধপদের একবচন) পুত্র = ভ্রাতুষ্পুত্র; ত্বিষাম্ (সম্বন্ধের বহুবচন) পতি = ত্বিষাম্পতি; বাচঃ (বাক্যের) পতি = বাচস্পতি; মামার বাড়ি = মামার বাড়ি। সেইরূপ ভুলের বোঝা, ভাগের মা, রাজার মেয়ে, তুষের আগুন, লাভের কড়ি, অনুরোধের আসর, হাতির খোরাক, ঘরের ছেলে, পরের মা, পরের ধন [ কিন্তু পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পাইলে হইবে পরধন—-সাধারণ সম্বন্ধ-তৎপুরুষ সমাস : “পরধন-লোভে মত্ত”—মধুকবি ]। (৫) অধিকরণ (পূর্বপদের অধিকরণের বিভক্তি লোপ পায় না)—যুধি (যুদ্ধে) স্থির = যুধিষ্ঠির; কস্মিন্ কালে = কস্মিন্কালে; দিনে ডাকাতি দিনেডাকাতি। সেইরূপ গোড়ায়গলদ, অন্তেস্থিত, অঙ্কেকাঁচা, অরণ্যেরোদন, ছাঁচেঢালা, দঁকে পড়া, বাহিরে সরল, ভিতরে গরল, দুধে-আলতা, ইঁচড়ে (ইঁচড় অবস্থায়)-পাকা, জলেডোবা, টিউবে-রাখা। পায়েচলা এই মেঠো পথটা দিয়ে কস্মিনকালে যাইনি। “ঘুঘুডাকা ছায়ায়-ঢাকা গ্রামখানি কোন্ মায়াভরে।” “ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া।”

অলুক তৎপুরুষ সমাসজাত শব্দগুলির মধ্যে অধিকাংশই বিশেষ অর্থে প্রযুক্ত হয়। সাম্রাজ্যলোভীর কাছে স্বরাজের আবেদন অরণ্যেরোদন ছাড়া আর কিছুই নয় (নিষ্ফল)। ভারতের শ্রমজীবীর দল চিনির বলদের মতো বিশ্বসভ্যতার ভার বহন করেই চলেছে। (ভারবাহী কিন্তু ফলভোগী নয়) “বড়োর পিরীতি বালির বাঁধ” (নিতান্ত দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী)। পরের ধনে পোদ্দারি করবার লোক অনেক পাবে। পঞ্চাশ টাকার বইটা আশি টাকা চাইছেন? এ যে দিনেডাকাতি!

(গ) অলুক্ উপপদ : সরসি (সরস্ শব্দের অধিকরণের একবচন) জন্মে যে = সরসিজ; খে (আকাশে অর্থে অধিকরণ-বিভক্তির লোপ হয় নাই) চরে যে = খেচর; জালে পড়িয়াছে যাহা = জালেপড়া (কলসী); কলেজে পড়িয়াছে (পাঠ করিয়াছে) যে = কলেজেপড়া; অন্তে (গুরুগৃহে) বাস করে যে = অন্তেবাসী। সেইরূপ মনসিজ, গায়েপড়া, রোদেপোড়া। [ কিন্তু সরোজ, মনোজ প্রভৃতি অলুক্ উপপদ নয়—শুদ্ধ উপপদ তৎপুরুষ—যেহেতু পূর্বপদের বিভক্তি লোপ পাইয়াছে। ] “বাদলের কালো ছায়া স্যাঁৎসেঁতে ঘরটাতে ঢুকে কলে-পড়া জন্তুর মতন মূর্ছায় অসাড়।”—রবীন্দ্রনাথ।

(ঘ) অলুক বহুব্রীহি : গায়ে হলুদ দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = গায়েহলুদ; (শিশুর) মুখে প্রথম ভাত দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে = মুখেভাত; মুখে মধু যাহার মুখেমধু; গলায় মালা যাহার = গলায়মালা। সেইরূপ হাতেখড়ি, পিঠে-পালান, সবপেয়েছির দেশ, মাথায়ছাতা। গায়েহলুদ, মুখেভাত, হাতেখড়ি প্রভৃতিকে অনুষ্ঠান-বাচক বহুব্রীহিও বলা হয়। [ এই সমাসের অধিকাংশ সমাসবদ্ধ পদ বিচ্ছিন্নভাবে রহিয়াছে, লক্ষ্য কর। ]

নিত্য সমাস

১৬৪। নিত্য সমাস : যে সমাসের ব্যাসবাক্য হয় না, অথবা যে সমাসের ব্যাসবাক্য করিতে হইলে অন্য পদের প্রয়োজন হয়, তাহাকে নিত্য-সমাস বলে।

কৃষ্ণ সৰ্প = কৃষ্ণসৰ্প [ কৃষ্ণ যে সৰ্প ব্যাসবাক্য করিলে শুধু কালো রঙের সাপকেই বুঝাইবে, কিন্তু বিশেষ ধরনের বিষধর সর্পকে বুঝাইবে না। ফলে কৃষ্ণসর্প কথাটির আসল অর্থটি মাঠে মারা যাইবে। এইজন্য ব্যাসবাক্য হয় না।

কাঁচা কলা = কাঁচকলা (কারণ পাকিলেও কাঁচকলা কাঁচকলাই থাকে, পাকাকলা হয় না)। সেইরূপ দাঁড়কাক, ইচ্ছাবসন্ত।

অন্য গ্রাম = গ্রামান্তর; অন্য মনু = মন্বন্তর (সন্ধি লক্ষ্য কর); দুগ্ধফেনের তুল্য = দুগ্ধফেননিভ; মর্মরের তুল্য = মর্মরনিভ; জবাকুসুমের তুল্য = জবাকুসুমসঙ্কাশ; কমলকোরকের মতো = কমলকোরকসন্নিভ; শুধুই চিহ্ন = চিহ্নমাত্র; কেবল দর্শন = দর্শনমাত্র; কেবল তৎ = তন্মাত্র; কেবল চিৎ = (চিৎ-শক্তি) = চিন্মাত্র; শুধু কিছু = কিছুমাত্র; কেবল একটি একটিমাত্র; কেবল হাঁটা = হাঁটাহাঁটি; কেবল বলা = বলাবলি। তদ্রূপ শূলীশম্ভুনিভ, ইন্দুনিভ, রজতগিরিনিভ, বজ্রসন্নিভ, অনলসঙ্কাশ, জন্মান্তর, দেহান্তর, যুগান্তর, গত্যন্তর, সময়ান্তর, ধর্মান্তর, দিনান্তর, দৃশ্যান্তর, জলমাত্র, ভিক্ষামাত্র, কালসাপ, খাটাখাটি, ঘোরাঘুরি, বকাবকি, ঝোলাঝুলি, দাপাদাপি। “তার দেয়াল ছাদ মর্মরনিভ বরফের।” সারাদিন হাঁটাহাঁটি আর খাটাখাটি করে এতই ক্লান্ত ছিলাম যে সামনে দুগ্ধফেননিভ কোমল শয্যায় শোয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়লাম। “সহোদর রক্ষঃশ্রেষ্ঠ, শুলীশম্ভুনিভ কুম্ভকর্ণ।”—মধুকবি।

সমাসান্ত প্রত্যয়

১৬৫। সমাসান্ত প্রত্যয় : যে-সমস্ত প্রত্যয় সমাসবদ্ধ পদের অন্তে বসে, তাহাদিগকে সমাসান্ত প্রত্যয় বলে।

যথা—অ, আ, ই, ঈ, ইয়া (এ), উয়া (ও), ক ইত্যাদি। সমাসান্ত প্রত্যয়ের নিদর্শন পূর্বে প্রদত্ত অসংখ্য উদাহরণে লক্ষ্য কর। এখানেও কয়েকটির উল্লেখ করিতেছি।—

অ—পুণ্ডরীকাক্ষ, মহামহিম, অনুজপ্রতিম, ঊর্ণনাভ, প্রত্যক্ষ, দুর্ভিক্ষ, অন্তরীপ।

আ–নির্জলা, ত্রিফলা, একরোখা, অন্যমনা, চৌচালা, দোনলা, নিষ্ফলা, তেভাগা, লাউপেটা, দোহারা, আগাছা।

হ—সুগন্ধি, চারুগন্ধি, রক্তারক্তি, সীতাজানি।

ঈ—শতাব্দী, বেহিসাবী, ত্রিলোকী, পঞ্চবটী, বিশগজী, পদ্মগন্ধী, শতবার্ষিকী।

ইয়া (এ)—বিশবছরিয়া > বিশবছুরে, একগুঁয়ে, চাঁদকপালিয়া > চাঁদকপালে, গোঁফখেজুরিয়া > গোঁফখেজুরে।

উয়া (ও)—পেঁচামুথুয়া > পেঁচামুখো, দুধনাকুয়া > দুধনেকো, ডাকাবুকো, ঘরমুখো, হাতিকেনো

ক—অপুত্রক, নিরর্থক, সার্থক, সস্ত্রীক, সমাতৃক, নদীমাতৃক, প্রোষিতপত্নীক, বর্ণনামূলক, উদ্ভিদবিষয়ক, আদান-প্রদানভিত্তিক ইত্যাদি।

অসংলগ্ন সমাস—সমাসবদ্ধ পদটিকে একমাত্রায় লেখাই শিষ্টরীতি; অন্ততঃ পদ-সংযোজক চিহ্নদ্বারাও সংযুক্ত করিয়া লেখা উচিত। কিন্তু বাংলা ভাষায় কয়েকটি ক্ষেত্রে সমাসের অন্তর্গত পদগুলিকে বিচ্ছিন্নভাবে লেখা হয়। বিচ্ছিন্নভাবে লিখিত সমাসকে অসংলগ্ন সমাস বলে। [ অলুক্ সমাসের অধিকাংশ উদাহরণ দেখ। ] রাজার ছেলে, রাঘব বোয়াল, ষাঁড়ের গোবর, চায়ের দোকান, পশ্চিমবঙ্গ প্রধান শিক্ষক সমিতি, নিখিল ভারত শিল্প-সংস্কৃতি সংস্থা।

দ্রষ্টব্য : সমাস-সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দিবার সময় ব্যাসবাক্য যথাযথ লিখিয়া সমাসের নামটি সুনির্দিষ্টভাবে পুরাপুরি উল্লেখ করিবে; বিশেষতঃ তৎপুরুষ, কর্মধারয়, বহুব্রীহি ও অলুক্ সমাসের ক্ষেত্রে কোন্ তৎপুরুষ, কোন্ কর্মধারয়, কোন্ বহুব্রীহি ইত্যাদি উল্লেখ করিতেই হইবে। প্রদত্ত শব্দটিতে একাধিক সমাস থাকিলে ব্যাসবাক্যসহ প্রতিটি সমাসের উল্লেখ করা চাই। যেমন,—(ক) নাতিশীতোষ্ণ : শীত ও উষ্ণ—শীতোষ্ণ (বিপরীতার্থক শব্দের দ্বন্দ্ব), অতি যে শীতোষ্ণ—অতিশীতোষ্ণ (সাধারণ কর্মধারয়), অতিশীতোষ্ণ নয়—নাতিশীতোষ্ণ (নঞ্-তৎপুরুষ)। (খ) কোমরজলে : কোমর-পরিমাণ জল—কোমরজল (মধ্যপদলোপী কর্মধারয়), তাহাতে। (গ) রাজতরু : তরুগণের রাজা (শ্রেষ্ঠ অর্থে)—রাজতরু (সম্বন্ধ-তৎপুরুষ)। (ঘ) ক্লেশহর : ক্লেশ হরণ করেন যিনি—ক্লেশহর (উপপদ তৎপুরুষ)। (ঙ) কথামৃত : কথা অমৃতের মতো—কথামৃত (উপমিত কর্মধারয়)। (চ) দিলদরিয়া : দিল-রূপ দরিয়া—দিলদরিয়া (রূপক কর্মধারয়)। (ছ) দরাদরি : পরস্পর দর হাঁকা—দরাদরি (ব্যতিহার বহুব্রীহি)। (জ) সাষ্টাঙ্গ : অষ্ট অঙ্গের সঙ্গে বিদ্যমান—সাষ্টাঙ্গ (সহার্থক বহুব্রীহি)। (ঝ) মনোজ : মনে জন্মে যে—মনোজ (উপপদ তৎপুরুষ)। (ঞ) মনসিজ : মনসি (মনেতে) জন্মে যে—মনসিজ (অলুক্ উপপদ তৎপুরুষ—পূর্বপদে অধিকরণের বিভক্তি অটুট রহিয়াছে)। (ট) দৃশ্যান্তর : অন্য দৃশ্য—দৃশ্যান্তর (নিত্য সমাস—‘অন্য’ স্থানে ‘অন্তর’, এবং পদ্বয়ের পারস্পরিক স্থান-পরিবর্তন)। (ঠ) হাতেখড়ি : লিখিবার জন্য (শিশুর) হাতে প্রথম খড়ি দেওয়া হয় যে অনুষ্ঠানে—হাতেখড়ি (অলুক বহুব্রীহি বা অনুষ্ঠানবাচক বহুব্রীহি)।

অনুশীলনী

১। সমাস কাহাকে বলে? সমাস প্রধানতঃ কয় প্রকার ও কী কী? প্রত্যেকটি সমাসের দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

২। উদাহরণসহ ব্যাখ্যা কর : দ্বন্দ্ব, খাঁটি বাংলা দ্বন্দ্ব, কর্মধারয়, উপপদ তৎপুরুষ, বহুব্রীহি, বিগ্রহবাক্য, ব্যধিকরণ বহুব্রীহি, নিত্য-সমাস, অলুক্ অব্যয়ীভাব, সমাসান্ত প্রত্যয়, বীপ্সার্থে অব্যয়ীভাব, সমাসান্ত ক, দ্বিগু, নঞর্থক বহুব্রীহি, ব্যতিহার বহুব্রীহি, সমানাধিকরণ বহুব্রীহি, মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি, উপমান কর্মধারয়, রূপক কর্মধারয়, নঞ্-তৎপুরুষ, মধ্যপদলোপী কর্মধারয়, তৎপুরুষ, অপাদান-তৎপুরুষ, অধিকরণ-তৎপুরুষ, অলুক তৎপুরুষ, বিশেষণপদের দ্বন্দ্ব, প্রায়-সমার্থক শব্দের দ্বন্দ্ব, সমার্থক শব্দের দ্বন্দ্ব, ক্রিয়ায় ক্রিয়ায় দ্বন্দ্ব, সর্বনামপদের দ্বন্দ্ব, সামীপ্যার্থে অব্যয়ীভাব, অনতিক্রমার্থে অব্যয়ীভাব, অলুক বহুব্রীহি, সম্বন্ধ-তৎপুরুষ, সাদৃশ্যার্থে অব্যয়ীভাব, ব্যাপ্তি-অর্থে অব্যয়ীভাব, অভাবার্থে অব্যয়ীভাব, সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি, উপমিত কর্মধারয়, বিশেষণে বিশেষণে কর্মধারয়, বিশেষ্যে বিশেষ্যে কর্মধারয়, অলুক্ উপপদ, বিপরীতার্থক শব্দের দ্বন্দ্ব, কর্ম—তৎপুরুষ, সম্প্রদান-তৎপুরুষ, নিমিত্ত-তৎপুরুষ, সমাসান্ত অ, সমাসাত্ত আ, একশেষ দ্বন্দ্ব।

৩। কর্মধারয় সমাস কাহাকে বলে? উপমান কর্মধারয়, উপমিত কর্মধারয় ও রূপক কর্মধারয় সমাসের মধ্যে পার্থক্য উদাহরণসহ বুঝাইয়া দাও।

৪। তৎপুরুষ সমাস কাহাকে বলে? প্রত্যেক প্রকার তৎপুরুষের দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

৫। বহুব্রীহি সমাস কাহাকে বলে? অন্ততঃ পাঁচপ্রকার বহুব্রীহির নাম উল্লেখ করিয়া প্রত্যেক প্রকারের দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।

৬। উদাহরণযোগে পার্থক্য দেখাও : সন্ধি ও সমাস, বহুব্রীহি ও কর্মধারয়, ব্যধিকরণ ও সমানাধিকরণ বহুব্রীহি, উপমিত ও রূপক কর্মধারয়, কর্মধারয় ও দ্বিগু, দ্বিগু ও সংখ্যাপূর্বক বহুব্রীহি, নঞর্থক বহুব্রীহি ও নঞ তৎপুরুষ, সমানাধিকরণ বহুব্রীহি ও কর্মধারয় সমাস, সমানাধিকরণ বহুব্রীহি ও উপপদ তৎপুরুষ সমাস, মধ্যপদলোপী কর্মধারয় ও মধ্যপদলোপী বহুব্রীহি, নিত্য-সমাস ও ব্যতিহার বহুব্রীহি।

৭। ব্যাসবাক্য উল্লেখ করিয়া সমাস নির্ধারণ কর : দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, রত্নাকর, অপয়া, অর্ধস্ফুট, ঘর্মাক্ত, ঘোড়দৌড়, রাতকানা, চৌরাস্তা, কটূক্তি, সদসৎ, নদীমাতৃক, হাতেখড়ি, মড়াকান্না, দেবর্ষি, ভিঙ্কান্ন, করকমল, প্রাণপাখি, যথাশক্তি, দ্বিপ, বিমনা, সুপ্তোত্থিত, অধৈর্য, কানাকানি, বিগতা, মারমুখো, দম্পতি, শতবার্ষিকী, বিষাদসিন্ধু, মিঠেকড়া, কুম্ভকার, সীতারাম, কানাকানী, চুলোচুলি, অগ্নিভয়, দিগ্বিদিক, সংসারচক্র, অমৃতবাণী, অকুতোভয়, অন্নমুষ্টি, দেশানুরাগ, প্রত্যহ, রবাহূত, ঢেঁকিছাঁটা, পঞ্চভূত, উকিল-ব্যারিস্টার, মাথাপিছু, রান্নাঘর, বীরপূজা, হৃৎপন্ন, ঘরজামাই, সপ্তাহ, ভূতপূর্ব, তেলেভাজা, আটচালা, নরসিংহ, মিশকালো, কাঁচকলা, অরুণরাঙা, ত্রিমূর্তি, নামঞ্জুর, গাছপাকা, শোকাকুল, পদ্মনাভ, ফি-বছর, জমাখরচ, স্নানযাত্রা, বর্ণচোরা, নীলোৎপল, সোনামুখী, প্রতিদিন, রোদেপোড়া, জিতেন্দ্রিয়, অষ্টাদশ, আঁখিপাখি, অহোরাত্র, পুরুষসিংহ, নিখোঁজ, আসমুদ্র, মধুমাখা, আগাগোড়া, গরমিল, গোবেচারা, তেমাথা, লাঠালাঠি, আকর্ণ, হাটে-বাটে, মনমাঝি, নীলদর্পণ, রাজর্ষি, ধর্মান্তর, বিয়েপাগলা, সটান, বিশৃঙ্খল, মাতামাতি, দশানন, যথাশক্তি, লোকপিছু, রাজপথ, আকাল, জলজ, লক্ষ্মীছাড়া, ফুলবাবু, মুখচন্দ্র, শতাব্দী, বীণাপাণি, গলাগলি, পরীক্ষার্থী, অনর্থক, পাদপদ্ম, মাঝনদী, মাধব, বেবন্দোবস্ত, কাজলকালো, সপ্তদশ, মুখপোড়া, প্রোষিতভর্তৃকা, বিপত্নীক, বিদ্যুদ্দীপ্ত, বিদ্যুদ্দীপ্তি, কামনাপ্রমত্ত, হরিচরণ-চ্যুতা, মধ্যবিত্ত, ছ-ঘরা, রাগগর্ভ, দুধেভাতে, সেতার, পদাম্বুজ, হারামণি, রোগমুক্ত, নোলক-নাকে, শিক্ষাপ্রদ, সারদা, শ্মশান, হৃদয়মৃদঙ্গ, সূচীভেদ্য, কাজের লোক, ছেলেধরা, হরিহর, শ্রীহীন, সুশ্রী, তলায়-ফুটো, যথাবিধি, হাতাহাতি, চন্দ্রচূড়, আকাশপট, দুধসাগু, পানসাজা, নৌকা-বোঝাই, শত্রুঘ্ন, মামার বাড়ি, ত্রিভুবন, শীতোষ্ণ, খ্যাতনামা, ধামাধরা, বাজার-সরকার, মুখপদ্ম, হাতেকাটা, বিলাতফেরত, তেলধুতি, চন্দ্রভূষণ, কালসাপ, মধুপ, কাপুরুষ, বউভাত, হাটবাজার, দশগজী, জন্মান্ধ, জনপিছু, কোলকুঁজো, ডাকমাসুল, চালাকচতুর, গ্রামান্তর, লুচিভাজা, পিছপা, রাজনীতি, উপকণ্ঠ, নিলাজ, চড়ামেজাজ, মাথাভাঙ্গা, হাড়কাঁপানো, হতভাগী, সাঁজঘুমুনে, ঘিয়েভাজা, ছড়িহাতে, নাপিতপুরুত, ছিঁচকাঁদুনে, জ্ঞানহীন, অনুচ্ছিষ্ট, বিড়ালাক্ষী, নির্জলা, উপবন, কুয়োয়পড়া, পাকাচুলো, ঘরপালানো, দধি-থলথল, রণবীর, আদায়-কাঁচকলায়, হীরককঠিন, পূর্ণকাম, শীলবৃদ্ধ, তপস্যানির্মল, নরশার্দূল, ডাকাবুকো, উটকপালী, ফি-সন, যথাকর্তব্য, ধামাসুদ্ধ, সস্ত্রীক, কালসিন্ধু, গালাগালি, একচোখো, চিনির বলদ, পরাৎপর, পাপাসক্তি, সচিত্র, কৃতবিদ্য, নয়নলোভন, হংসডিম্ব, দুখ-জাগানিয়া, দেশভ্রমণ, শয়নরত, শরণাগত, মনোজিৎ, কবিরাজ, পাতাচাটা, নীড়হারা, সর্বহারা, আকাশভরা, গোলাভরা, ধর্মঘট, অনিশ, অনীশ, লাভের গুড়, শাপমুক্ত, ঘৃতপক্ক, শতদল, ত্রুটিপূর্ণ, অগ্নিশর্মা, বহুব্রীহি, মধ্যপদলোপী, পারিজাত, অজ, রাধিকারমণ, ঘুমপাড়ানী, ফিবার মিক্সচার, তদূর্ধ্ব, নরাধম, দ্বিগু, পিঠভরা, বিগতাশ্রু, শ্রীমান্, শ্রীভ্রষ্ট, নয়নভরা, বুকভরা, বেহায়া, শ্রীবৃদ্ধি, গবাদি, গত্যন্তর, শ্রীযুক্ত, হা-ঘর, হাফহাতা, চন্দ্রমৌলি, উপমহাদেশ, লাটকে-লাট, শিশুফুল, আধাসরকারী, তেতলা, আজানু, শোকম্লান, কেনাকাটা, হাতি-কাঁদা, নিখরচে, তাঁতশিল্প, হয়গ্রীব, শরম-সাধ্বস, কাজের কাজ, মনরাখা, সহজ, অব্যয়, অলুক্, শয়নঘর, গবাক্ষ, তারানেভা, ফলাহার, শ্রীশ, তৎসদৃশ, কোকিলথামা, ভয়মুক্ত, পিছপা, ধস্তাধস্তি, নবান্ন, বিমাতা, ঘিভাত, স্বগত, তেপান্তর, জয়যুক্ত, সগর, ঘৃতান্ন, দুরবস্থ, দুরবস্থা, গোষ্ঠগোপাল, গোষ্ঠবিহারী, দৃষ্টিকটু, ফলান্বিত, গোষ্পদ, চৌকাঠ, আহারনীরত, আহারনিরত, শিবনাথ, চন্দ্রনাথ, বেণুগোপাল, সনিষ্ঠ, নাড়ুগোপাল, পদব্রজ, কৃষিগান, অস্পৃহা, নিস্পৃহ, ভুলচুক, ভোলানাথ, বিশ্বনাথ, দাঁতকপাটি, খগ, কালবৈশাখী, নগ, নভশ্চুম্বী, নাতিঘন, হরগৌরী, শ্যামসুন্দর, নৌকাভ্রমণ, মণিকুন্তলা, বালগঙ্গাধর, বিশ্বমাতা।

৮। সমাসের সাহায্যে একপদে পরিণত কর : যাহার দুইপ্রকার অর্থ; বিগত হইয়াছে মেঘ যাহা হইতে; বালিকাদের জন্য বিদ্যালয়; যাহার পুত্র হয় নাই; যাহার কুলশীল জানা নাই; উপায় নাই যাহার; পা হইতে মাথা পর্যন্ত; যে ইন্দ্রিয় জয় করিয়াছে; অক্ষরজ্ঞান নাই যাহার; যাহার অন্য গতি নাই; মহান্ রাজা; মুখ চন্দ্রের ন্যায়; হস্তিনীর শাবক; পঞ্চ বর্ষের সমাহার; কর্ম করে যে; বোঝাই নৌকা যাহার দ্বারা; কমলের মতো অক্ষি যাহার; শক্তিকে অতিক্রম না করিয়া; জীবিত অথচ মৃতবৎ; যাহা চিরস্থায়ী নয়; বোধ নাই যাহার; নদী মাতা যাহার; যাহার কোনও কর্ম নাই; জায়া ও পতি; পঞ্চনদীর সমাহার; হাল নাই যাহার; সমান ধৰ্ম যাহার; সুন্দর গন্ধ যাহার; কুৎসিত আচার; শোভন হৃদয় যাহার; পুরুষ ঋষভের ন্যায়; অমৃতের ন্যায় মধুর; জলে চরে যে; ঘৃতের দ্বারা পক্ব; গমনের পশ্চাৎ; অতিবিরল নয়; নাই ক্রিয়া যাহার; ষট্ আনন যাঁহার।

৯। সমাসের নাম করিয়া সমাসবদ্ধ কর : বিদ্বান্ + সমাজ; ছাগী + দুগ্ধ; অন্য + জন্ম; পূর্ব + অহন্; খর + স্রোতঃ; শত + অব্দ; কু (কুৎসিত) + অন্ন; ছিন্ন + শাখা; জ্ঞানী + গণ; পক্ষী + শাবক; শ্রোতা + বর্গ; ভ্রাতা + প্রেম; রজনী + ঈশ; হস্তী + যূথ; ধৃত + অন্ন।

১০। অর্থপার্থক্য দেখাও : পূর্বাহ্, পূর্বাহ্ণ; মহদাশয়, মহাশয়; শশাঙ্ক, সশঙ্ক; পিতামাতৃহীন, পিতৃমাতৃহীন; অগণ্য, নগণ্য; সুগন্ধি, সুগন্ধ; পূর্বরাত্রি, পূর্বরাত্র; সজাতি, স্বজাতি; বসন্তসখা, বসন্তসখ; স্বপত্নী, সপত্নী; অনর্থ, অনর্থক; গতিহীন, হীনগতি; মতিচ্ছন্ন, ছন্নমতি; মহাধন, মহদ্ধন; স্বরূপ, সরূপ; স্বপুত্র, সপুত্র; দ্বিপ, দ্বীপ; ভগ্নশাখ, ভগ্নশাখা; জবারাঙা, রাঙাজবা,; মহেন্দ্ৰসখা, মহেন্দ্ৰসখ; মহাপ্রাণ, মহৎপ্রাণ; মহাপরাক্রম, মহৎপরাক্রম; চারুগন্ধি, চারুগন্ধ; জামাতৃপুত্র, জামাতাপুত্র; মিলনাত্মক, মিলনান্তক; সোদর, স্বোদর; পূর্ণাকাঙ্ক্ষা, পূর্ণাকাঙ্ক্ষ; স্বরর্ণ, সবর্ণ; নীরাকার, নিরাকার; দুরবস্থা, দুরবস্থ।

১১। ব্যাসবাক্যসহ সমাসের নাম বল ও সন্ধিবিচ্ছেদ কর : মন্বন্তর, হর্ষক্ষ, বিদ্যানুরাগ, গত্যন্তর, যথার্থ, বিদ্যোৎসাহিনী, স্পর্ধোক্তি, শ্রীশ, কাঁচকলা, পিত্রাদেশ, পুরুষর্ষভ, সুপ্তোত্থিত, ণিজন্ত, সরলোন্নত, অজ, বিদ্যুদ্‌বিভা, নীরদ, ত্রয়োদশ, নদ্যুদক, চতুরানন, আদ্যন্ত, পয়োদ, সদসৎ, মনোবল, জীবস্মৃত, সরোবর, হতোদ্যম, যথেষ্ট, সুবন্ত, গবাক্ষ, দুরবস্থা, নীরাকার, গ্রাসাচ্ছাদন, দুরাকাঙ্ক্ষা, চাটূক্তি, গবাদি, দুর্বৃত্ত, দেশোদ্ধার, মনোজ, ষোড়শ, রাজর্ষি, নীরজা, সিংহাসন, নিরীহ, সূর্যেন্দু, শুদ্ধসত্ত্বান্বিত, ছায়াবৃতা, মহাবিদ্যা, সুরাসুর, কৃষ্ণার্জুন, চিদানন্দ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *