সপ্তম পরিচ্ছেদ – কারক ও তাহার বিভক্তি : অনুসর্গ
কারকের আলোচনা করিবার পূর্বে আমাদের একটু ভূমিকা সারিয়া লইতে হইবে। তোমরা ১৫৯ পৃষ্ঠায় ৬২ নং সূত্রে শব্দবিভক্তি কাহাকে বলে তাহা পড়িয়াছ। কে, রে (কেবল কবিতায়), তে (এতে), এ, র (এর) প্রভৃতি আসলে শব্দবিভক্তিচিহ্ন, সাধারণভাবে সংক্ষেপে ইহাদিগকে শব্দবিভক্তি বলা হয়।
বিভক্তিচিহ্ন হইল শব্দ বা ধাতুর হাতে বাক্যে প্রবেশলাভের ছাড়পত্র শব্দবিভক্তি শব্দকে নামপদে পরিণত করে, পদটির সংখ্যা ও কারক বুঝাইয়া দেয় এবং বাক্যস্থ অন্য কোনো পদের সঙ্গে সেই পদটির কী সম্বন্ধ তাহাও নির্দেশ করে। [ ধাতুবিভক্তির কথা নবম পরিচ্ছেদে আলোচনা করা হইবে। ]
বাংলা ভাষায় বিভক্তিচিহ্ন মাত্র পাঁচটি—এ, কে, রে (কেবল কবিতায়), তে (এতে), র (এর); এগুলির মধ্যে র (এর) সম্বন্ধপদের নিজস্ব চিহ্ন; তাহা হইলে ছয়টি কারকের জন্য অবশিষ্ট রহিল মাত্র চারিটি বিভক্তিচিহ্ন। অতএব দেখা যাইতেছে যে, বাংলা ভাষায় শব্দবিভক্তিচিহ্নের নিদারুণ অভাব। এই অভাব—পূরণের জন্য বাংলা ভাষা একটি অমূল্য পন্থা আবিষ্কার করিয়াছে। শূন্যবিভক্তির প্রয়োগ সেই অভিনব আবিষ্কার।
॥ শূন্যবিভক্তি ॥
(ক) “না চাহিতে প্রভু কত না সুধায় (সুধা+এ) হৃদয় দিয়েছ ভরে।” (খ) “রাজার (রাজা+র) কাননে (কানন +এ) ফুটেছে বকুল পারুল রজনীগন্ধা। “ (গ) “এমন কত মণি পড়ে আছে চিন্তামণির (চিন্তামণি +র) নাছদুয়ারে (নাছদুয়াব +এ)।” (ঘ) “বুলবুলিতে (বুলবুলি + তে) ধান খেয়েছে।” (ঙ) “তার (সে + র) ললাটের (ললাট + এর) সিঁদুর নিয়ে ভোরের (ভোব +এর) রবি ওঠে; আলতা-পরা পায়ের (পা + এর) ছোঁয়ায় (ছোঁয়া + এ) রক্তকমল ফোটে।”
উপরের বাক্যগুলিতে সুধায়, রাজার, কাননে, চিন্তামণির, নাছদুয়ারে, বুলবুলিতে, তার, ললাটের, ভোরের, পায়ের, ছোঁয়ায় প্রভৃতি পদগুলিতে কী বিভক্তিচিহ্ন রহিয়াছে, স্পষ্ট দেখা যাইতেছে। আর প্রভু, হৃদয়, বকুল, পারুল, রজনীগন্ধা, মণি, ধান, সিঁদুর, রবি, রক্তকমল-আয়তাকার এই দশটি পদে আপাততঃ মনে হয় কোনো বিভক্তিচিহ্ন নাই। কিন্তু তাহা তো সম্ভব নয়। বিভক্তিহীন শব্দ তো বাক্যে স্থান পায় না। পদগুলিতে বিভক্তিচিহ্ন আছেই, তবে শূন্য অবস্থায় রহিয়াছে। প্রভু (প্রভু শব্দ + অ বিভক্তি), হৃদয (হৃদয় শব্দ + অ বিভক্তি), মণি (মণি শব্দ + অ বিভক্তি)—প্রতিটি আয়তাকার পদ অ বিভক্তিযোগে গঠিত হইয়াছে। অ বিভক্তিচিহ্নকে শূন্যবিভক্তি বলা হয়।
৮৭। শূন্যবিভক্তি : যে শব্দবিভক্তিচিহ্নটি শব্দে যুক্ত হইয়া শব্দটিকে পদে পরিণত করিয়া নিজে অপ্রকাশিত থাকে, তাহাকে শূন্যবিভক্তি বলা হয়। শূন্যবিভক্তিযোগে মূল শব্দটির কোনো পরিবর্তনই হয় না।
পদে পদে শব্দবিভক্তির ধাক্কা সামলাইতে সামলাইতে বাক্যের গতি বড়োই শ্লথ হইয়া পড়ে। শূন্যবিভক্তি সেই জড়তা হইতে বাক্যকে মুক্তি দেয়। ফলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় এবং ভাষার গতিশক্তিও বৃদ্ধি পায়। সংস্কৃতে মাত্র কয়েকটি শব্দের ক্ষেত্রে প্রথমার একবচনে শূন্যবিভক্তির সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলা ভাষা ব্যাপকভাবে শূন্যবিভক্তির প্রচলন করিয়া ভাষার শ্রুতিমাধুর্য-সম্পাদন তথা গতিশক্তি বৃদ্ধি করিয়াছে।
বাংলা ভাষা আরেকটি উপায়েও শব্দবিভক্তিচিহ্নের অভাব কিছুটা পরিমাণে মিটাইয়া লইয়াছে। সে উপায়টি হইল অনুসর্গ।
॥ অনুসৰ্গ ॥
(ক) “ওপাড়া হইতে আয় মায়েঝিয়ে।” (খ) “বিনে শ্রীহরি কেমনে করি নয়নবারি সংবরণ।” (গ) “কার তরে তুই কাঁদিস মাসী?” (ঘ) “ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর।” (ঙ) “আজ অবধি আমি দূরবর্তিনী হইলাম।” (চ) “রঞ্জন বই আমার একদণ্ড চলে না।” (ছ) “করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর!” (জ) “ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার তিলে তিলে আইসে যায়।” (ঝ) “বিনা কাজে বাজিয়ে বাঁশি কাটবে সকল বেলা।” (ঞ) “স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ, স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।” (ট) এমন কথা কার কাছ থেকে শুনলে?
উপরের বাক্যগুলিতে আয়তাক্ষর হইতে, বিনে, তরে, মতন প্রভৃতি পদগুলি মূলতঃ অব্যয়। ইহারা বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে বসিয়া পূর্ববর্তী পদটির সহিত অন্বিত হইতেছে। এই পদগুলি এক ধরনের বিভক্তিচিহ্নের কাজ করিতেছে। ইহাদিগকে অনুসর্গ, পরসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয় (Post-Position) বলা হয়। বিশেষ্য বা সর্বনামের পর বসে বলিয়া অনুসর্গ নামটিই বাংলা ব্যাকরণে গৃহীত হইয়াছে।
৮৮। অনুসর্গ : যে-সকল অব্যয় বিশেষ্য বা সর্বনামপদের পরে পৃথভাবে অবস্থান করিয়া শব্দবিভক্তির কাজ করে তাহাদিগকে অনুসর্গ, পরসর্গ বা কর্মপ্রবচনীয় বলে।
অনুসর্গের পূর্ববর্তী বিশেষ্যপদটি কখনও বিভক্তিযুক্ত হয়, কখনও-বা হয় না। কিন্তু পদটি সর্বনাম হইলে বিভক্তিযুক্ত হইবেই। আমাদের প্রদত্ত উদাহরণগুলিতে ওপাড়া, শ্রীহরি, আজ, রঞ্জন, কেষ্টা, স্বপ্ন, স্মৃতি প্রভৃতিতে বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয় নাই। কিন্তু ভূতের (ভূত+এর), ঘরের, কাজে (কাজ+এ) পদ তিনটি বিভক্তিচিহ্নযুক্ত। কিন্তু কার (কে+র) পদটি সর্বনাম বলিয়া বিভক্তিচিহ্নযুক্তই রহিয়াছে [ (গ)-চিহ্নিত ও (ট)-চিহ্নিত দুইটি বাক্যেই ]।
(খ)-চিহ্নিত বাক্যে বিনে অনুসর্গটি, এবং (ঝ)-চিহ্নিত বাক্যে বিনা অনুসর্গটি বিশেষ্যপদের পূর্বেই বসিয়াছে। কবিতায় ছন্দের খাতিরে অনুসর্গটি বিশেষ্য বা সর্বনামের পূর্বেও বসিতে পারে। আবার, কী কবিতায়, কী গদ্যরচনায় বিশেষ্য বা সর্বনামের উপর জোর দিবার জন্য অনুসর্গটি সেই বিশেষ্য বা সর্বনামের পূর্বেই বসে। বিনা সারে এর চেয়ে বেশী ফসল ফলে না। ধিক্! শত ধিক্ তোরে, রামানুজ।
অনুসর্গগুলির অধিকাংশই অব্যয়, কিছু কিছু অসমাপিকা ক্রিয়াপদও আছে। যেমন—করিয়া (চলিতে করে), ধরিয়া (ধরে), বলিয়া (বলে), থাকিয়া (থেকে) ইত্যাদি। পাঁচদিন ধরিয়া বৃষ্টি হইতেছে। এমন সাহস করে সব কথা বলতে পারতিস? শরীর অসুস্থ বলিয়া তিনি আসিতে পারেন নাই। চেহারায় ছোটো হলে কী হবে, চৈতন্যে উনি আমাদের সবার থেকে বড়ো।
আপাতদৃষ্টিতে শব্দবিভক্তি ও অনুসর্গ অভিন্ন বলিয়া মনে হয় বটে, কিন্তু উভয়ের মধ্যে পার্থক্যটুকু বিশেষভাবে লক্ষণীয় :
(১) শব্দবিভক্তিচিহ্নের নিজস্ব কোনো অর্থ নাই, অনুসর্গের নিজস্ব অর্থ আছে। (২) শব্দবিভক্তিচিহ্নের স্বতন্ত্র প্রয়োগ নাই, অনুসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ আছে। বাসস্ট্যান্ডে আমার জন্য একটু অপেক্ষা করো (অপেক্ষা অনুসর্গ নয়, ক্রিয়ার অঙ্গ)। এমন পাণ্ডববর্জিত দেশে পাঁচদিন থেকে (অসমাপিকা ক্রিয়া) লাভ কী? (৩) শব্দবিভক্তিচিহ্নটি শব্দের সঙ্গে একেবারে একাঙ্গ হইয়া যায়, কিন্তু অনুসর্গ শব্দটির ডানদিকে একটু তফাতে বসে—কদাপি শব্দটির সঙ্গে যুক্ত হইয়া বসে না। (৪) শব্দবিভক্তিচিহ্ন সবসময়ে শব্দটির অন্তেই বসে, কিন্তু অনুসর্গ শব্দটির পরেও বসে, আবার স্থলবিশেষে শব্দটির পূর্বেও বসে [ পূর্ব-পৃষ্ঠায় প্রদত্ত (খ)-চিহ্নিত ও (ঝ)-চিহ্নিত বাক্য দুইটি দেখ ]। (৫) একটি শব্দবিভক্তি দ্বারাই পদটির সংখ্যাকারক-সম্বন্ধে আমাদের ধারণা স্পষ্ট হইয়া উঠে, অতিরিক্ত কোনো শব্দবিভক্তিচিহ্নের জন্য আর অপেক্ষা করিতে হয় না; কিন্তু অনুসর্গ থাকা সত্ত্বেও পূর্ববর্তী পদটি অন্য বিভক্তিচিহ্নের বা আরেকটি অনুসর্গের অপেক্ষা করে, এমনকি অনুসর্গটিও ক্বচিৎ শব্দবিভক্তিযুক্ত হইয়া নামপদটির পরে বসে।
আবার, একবচন বুঝাইবার জন্য টি, টা, খানি, খানা এবং বহুবচন বুঝাইবার জন্য গুলি, গুলা, গুলো প্রভৃতি যে পদাশ্রিত নির্দেশক শব্দটির শেষে যোগ করি, সেই পদাশ্রিত নির্দেশকগুলিকে বিভক্তিও বলা যায় না, অনুসর্গও বলা যায় না; অথচ বিভক্তি ও অনুসর্গ—প্রত্যেকটির সঙ্গেই নির্দেশকগুলির কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রহিয়াছে।
বিভক্তিচিহ্ন ও নির্দেশক : বিভক্তিচিহ্নের মতো নির্দেশকও শব্দের অন্তে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত থাকে, শব্দের পরে স্বতন্ত্রভাবে বসে না। কিন্তু বিভক্তিচিহ্ন যেখানে পদটির সংখ্যাকারক নির্দেশ করে, নির্দেশকটি সেখানে ব্যক্তি বা বস্তুর সংখ্যা-পরিমাণ নির্দেশ তো করেই, উপরন্তু ব্যক্তি বা বস্তুটিকেও বিশেষভাবে নির্দেশ করে। বিভক্তিচিহ্ন কখনই শব্দের পূর্বে বসে না, কিন্তু নির্দেশকটি পরিমাণবাচক বা সংখ্যাবাচক বিশেষণের সহিত যুক্ত হইয়া স্বতন্ত্রভাবে শব্দের পূর্বেও বসিয়া থাকে। শব্দে একটি শব্দবিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হইলেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়, কিন্তু অনেক সময় শব্দে নির্দেশক যোগ করার পরও সেই নির্দেশকের অন্তে আবার বিভক্তিচিহ্ন যোগ করিতে হয়। (ক) খানআষ্টেক লুচি আনতে বলুন। (খ) “একখানি ছোটো ক্ষেত, আমি একেলা।” (গ) গোরুগুলোকে একটু দেখিস, মা।—এখানে (ক) ও (খ)-চিহ্নিত বাক্যে সংখ্যাবাচক বিশেষণযুক্ত খান ও খানি নির্দেশক যথাক্রমে লুচি ও ক্ষেত-এর পূর্বে বসিয়াছে। (গ)-চিহ্নিত বাক্যে গোরু শব্দে গুলো নির্দেশকটি যোগ করার পরও কে বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হইয়াছে।
অনুসর্গ ও নির্দেশক : অনুসর্গ মাঝে মাঝে শব্দের পূর্বে স্বতন্ত্রভাবে বসে, নির্দেশকও সংখ্যাবাচক বা পরিমাণবাচক বিশেষণযুক্ত হইয়া স্বতন্ত্রভাবে শব্দের পূর্বে বসে। মিল এই পর্যন্ত; গরমিলটাই বেশী। অনুসর্গ স্বতন্ত্রভাবে শব্দের পরেই বেশীর ভাগ বসে; নির্দেশক কখনই স্বতন্ত্রভাবে শব্দের পরে বসে না—শব্দটির অন্তে সংযুক্তভাবে অবস্থান করে। অনুসর্গ নিজের অঙ্গে কদাচিৎ কোনো বিভক্তিচিহ্ন ধারণ করে—অনুসর্গের পূর্ববর্তী পদটিতে প্রয়োজন হইলে বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয়। কিন্তু নির্দেশক অনেক ক্ষেত্রেই শব্দবিভক্তিযুক্ত হয়। নতুন বইখানাকে এর মধ্যেই ছিঁড়ে ফেললি? বই শব্দে একই সঙ্গে নির্দেশক ও বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হইয়াছে।
কারক
রানী ভবানী প্রতিদিন প্রভাতে ভাণ্ডার হইতে স্বহস্তে দীনদুঃখীকে ধনরত্ন দান করিতেন।
উপরের বাক্যটিতে দান করিতেন এই সমাপিকা ক্রিয়াটিকে প্রশ্ন কর—কে দান করিতেন? উত্তর পাইবে—রানী ভবানী। কী দান করিতেন? ধনরত্ন। কীভাবে দান করিতেন?—স্বহস্তে। কাহাদিগকে দান করিতেন?—দীনদুঃখীকে। কোথা হইতে দান করিতেন?—ভাণ্ডার হইতে। কখন দান করিতেন?-প্রভাতে। অতএব দান করিতেন ক্রিয়াটির সহিত রানী ভবানী, ধনরত্ন, স্বহস্তে, দীনদুঃখীকে, ভাণ্ডার হইতে, প্রভাতে—প্রতিটি পদেরই কোনো-না-কোনো সম্পর্ক রহিয়াছে। আর, এই সম্পর্কগুলি যে একইপ্রকারের নয়, প্রশ্নের বিভিন্ন ধরনেই তাহা প্রকাশ পাইতেছে। ক্রিয়ার সহিত বাক্যান্তর্গত নামপদের এই যে সম্পর্ক ইহাই কারক।
৮৯। কারক : বাক্যের ক্রিয়ার সহিত বাক্যান্তর্গত বিশেষ্য বা সর্বনামপদের যে সম্পর্ক, তাহাকে কারক বলে।
এই সম্পর্ক প্রধানতঃ ছয় প্রকারের বলিয়া কারকও ছয়টি—কর্তৃ, কর্ম, করণ, সম্প্রদান, অপাদান ও অধিকরণ। আমাদের প্রদত্ত উদাহরণে রানী ভবানী—কর্তৃকারক, ধনরত্ন—কর্মকারক, স্বহস্তে—করণকারক, দীনদুঃখীকে—সম্প্রদানকারক, ভাণ্ডার হইতে—অপাদানকারক, প্রভাতে—অধিকরণকারক।
মনে রাখিও, কেবল বিশেষ্য ও সর্বনামপদেরই কারক হয়। তবে, বিশেষণপদ বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত হইলে তাহারও কারক হইবে। আমি, তোমাদের সাতেও নেই, পাঁচেও নেই। “দশে মিলি করি কাজ।” কানাকে কানা বললে রাগ হওয়াই তো স্বাভাবিক। বড়োদের শ্রদ্ধাভক্তি করবে। “আমি রব নিষ্ফলের হতাশের দলে।” মৃতের আবার মৃত্যু কি? এখানে সাত, পাঁচ, দশ, কানা, বড়ো, নিষ্ফল, হতাশ প্রভৃতি বিশেষণে বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হওয়ায় পদগুলি বিশেষ্যের মতো ব্যবহৃত হইয়াছে। “নইলে তোর মনের কালো (বিশেষণে শূন্যবিভক্তিযোগে) ঘুচবে না রে।”
কারকবিভক্তি আলোচনা করিবার পূর্বে একটি মূল্যবান্ আলোচনা সারিয়া লওয়া একান্ত আবশ্যক। সংস্কৃতে কর্তৃকারকে প্রথমা, কর্মে দ্বিতীয়া, করণে তৃতীয়া, সম্প্রদানে চতুর্থী, অপাদানে পঞ্চমী, অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি এবং সম্বন্ধপদে ষষ্ঠী বিভক্তি হয়। সে ভাষায় প্রথমা হইতে সপ্তমী পর্যন্ত প্রতিটি বিভক্তির একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচনের বিভক্তিচিহ্ন সুনির্দিষ্ট। ফলে কোনো পদের বিভক্তিচিহ্ন দেখিয়াই পদটির কারক ও বচন বেশ বুঝা যায়। কিন্তু বাংলায় বিভক্তিচিহ্নের নিদারুণ অভাব। তদুপরি সম্বন্ধপদের জন্য নির্দিষ্ট র (এর), কবিতায় ব্যবহার্য রে বাদ দিলে অবশিষ্ট থাকে এ (য়, য়ে), তে (এতে), কে এই তিনটি বিভক্তিচিহ্ন। ইহার সঙ্গে শূন্যবিভক্তি (অ) ধরিলে সংখ্যা দাঁড়ায় চার। ছয়টি কারকের জন্য মাত্র চারিটি বিভক্তিচিহ্ন! তাহার উপর রহিয়াছে একবচন-বহুবচনের প্রশ্ন, রহিয়াছে সাধু-চলিতের প্রশ্ন। ফলে একই বিভক্তিচিহ্ন দুইটি বা তাহার বেশী কারকে, এমনকি ছয়টি কারকেও ব্যবহৃত হয়। তাই বিভক্তিচিহ্ন দেখিয়া বাংলায় কারক—নির্ণয় করায় বিপদ্ বেশী। দুই-একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সহজে বুঝা যাইবে।—
শিশু হাসে (কর্তৃকারকে শূন্যবিভক্তিযোগে একবচন)। “শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে।” (বহুবচনের বিভক্তি রা যোগে কর্তৃকারক) উদাহরণ দুইটিতে যথাক্রমে একবচন ও বহুবচনের বিভক্তিপ্রয়োগে একই সঙ্গে পদ দুইটির কারক ও বচনসম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট হইতেছে। বাংলা কর্তৃকারক-সম্বন্ধে কথাটি যত সহজে বলা যায়, অন্যান্য কারকের একবচন ও বহুবচন-সম্বন্ধে তত সহজে সিদ্ধান্ত সম্ভব নয়। কেননা, বাংলায় রা (এরা) ছাড়া বহুবচনের আর বিভক্তিচিহ্ন নাই। সেইজন্য গণনীয় কোনো শব্দে গণ দিগ সকল প্রভৃতি যোগ করিয়া শব্দটিকে বহুবচনে রূপান্তরিত করার পর আবার তাহাতে একবচনের বিভক্তিচিহ্ন যোগ করিতে হয়। যেমন—বালকগণকে, মা-সকলকে, বইগুলোকে ইত্যাদি।
আবার, সর্বপাপ হরিল গঙ্গায় (কর্তৃকারকে এ বিভক্তি)। ভক্তিভরে পূজিনু গঙ্গায় (কর্মে এ বিভক্তি)। বর্ষায় জেলেরা গঙ্গায় ইলিশ ধরে (অপাদানে এ বিভক্তি)। গঙ্গায় মাঝে মাঝে হাঙর দেখা দেয় (অধিকরণে এ)। চারিটি কারকেই এ বিভক্তি। আমরা চোখে (করণ) দেখি। চোখে (অপাদান) জল পড়ছে কেন? চোখে কুটি পড়েছে (অধিকরণ)। এক পলকের দেখায় চোখে (কর্তৃ) কি তৃপ্তি পায়? এখানে বিভক্তিচিহ্ন দেখিয়া নয়, অর্থ বুঝিয়াই কারক নির্ণয় করিতে হইতেছে। বস্তুতঃ বাংলায় কারক-নির্ণয়ের ইহাই একমাত্র পথ। বাংলা ভাষার এই আন্তর বৈশিষ্ট্যের জন্যই রবীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর প্রভৃতি দিক্পালগণ বাংলা ব্যাকরণকে সংস্কৃত ব্যাকরণের কবল হইতে মুক্তি দিতে চাহিয়াছিলেন। অতি—সম্প্রতি মাননীয় মধ্যশিক্ষা-পর্ষদের আনুকূল্যে বিভক্তিনির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রথমা দ্বিতীয়া তৃতীয়া ইত্যাদি উল্লেখ না করিয়া কেবল বিভক্তিচিহ্নের উল্লেখ করাই স্বীকৃত হইয়াছে।
মনে রাখিও—আ-কারান্ত, ই-কারান্ত, এ-কারান্ত এবং ও-কারান্ত শব্দে যুক্ত হইলে এ বিভক্তিটি য় (যে) হইয়া যায়। লতা +এ =লতায়; ঝি+এ=ঝিয়ে; বেদে +এ =বেদেয়; বুড়ো +এ = বুড়োয় ইত্যাদি।
এইবার বিভিন্ন কারকের বিস্তৃত আলোচনা। আমাদের দেওয়া প্রতিটি উদাহরণে শব্দবিভক্তিচিহ্ন ও অনুসর্গের প্রয়োগ ভালোভাবে লক্ষ্য করিবে। যেকোনো কারক পাঠ করিবার সময় প্রদত্ত প্রতিটি উদাহরণে পূর্ববর্তী কারকগুলির কোটি কোটি কোন্ কোন্ বিভক্তিচিহ্নসহ বিদ্যমান, তাহাও লক্ষ্য কর।
কর্তৃকারক
“দুনয়নে অভাগার বহিতেছে নীর।” “চাতক কাতরে ডাকে।” “পোহায় রজনী, জাগিছে জননী বিপুল নীড়ে।” “মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।” “এক যে ছিল পাখি।” “সে তার জ্যাঠার বিষয় নেবে না!” “স্বভাব সকলের আগে আগে যায়।” এই বাক্যগুলিতে ক্রিয়াপদগুলি লক্ষ্য কর। কী বহিতেছে?—নীর। কে ডাকে?—চাতক। কী পোহায়?—রজনী। কে জাগিছে?—জননী। কী লোটে?–মুক্তবেণী। কে ছিল?-পাখি। কে নেবে না? –সে। কী যায়?—স্বভাব। প্রতিটি ক্রিয়াকে প্রশ্ন কর—কাজটি কে করিতেছে, কী হইতেছে ইত্যাদি। এই প্রশ্নগুলির যে উত্তর পাওয়া গেল, তাহাই কর্তৃকারক।
৯০। কর্তৃকারকঃ যে বা যাহারা স্বয়ং কোনো ক্রিয়া সম্পাদন করে তাহাকে বা তাহাদিগকে কর্তৃকারক বলে। কর্তৃকারকই বাক্যের মূল উদ্দেশ্য।
॥ কর্তৃকারকের প্রকারভেদ ॥
(ক) ঊহ্য কর্তা : মধ্যমপুরুষ ও উত্তমপুরুষ কর্তা অনেক স্থলেই উহ্য থাকে। সমাপিকা ক্রিয়াকে প্রশ্ন করিয়া এই ঊহ্য কর্তাকে উদ্ধার করিতে হয়। (১) “ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া।” [কর্তা আমি বা আমরা উহ্য] (২) “ভুলতে পারি হোলির দিবস, ফাগের দাগ যে তুলতে নারি।” [ দুই জায়গাতেই আমি বা আমরা ঊহ্য ] (৩) “মার অভিষেকে এসো এসো ত্বরা।” [ কর্তা তোমরা ঊহ্য ] (৪) “বৈরাগীর উত্তরীয় পতাকা করিয়া নিয়ো।” [ তুমি ঊহ্য ] (৫) “হরো জগতের বিরহ-আঁধার, দাও গো অমৃতদীক্ষা।” [ দুইটি ক্রিয়ারই কর্তা তুমি ঊহ্য ] (৬) “পূজা করে পাইনি তোরে, এবার চোখের জলে এলি।” [ উত্তমপুরুষের কর্তা আমি এবং স্নেহার্থক মধ্যমপুরুষের কর্তা তুই দুইটিই ঊহ্য ] (৭) “বনের পাখি, আয়, খাঁচায় থাকি নিরিবিলে।” [ যথাক্রমে তুই ও আমরা ঊহ্য 1 (৮) লীলাময়ীর লীলাখেলা কেমন করে বুঝব, বল্। [ উত্তমপুরুষ আমি ও তুচ্ছার্থক মধ্যমপুরুষ তুই ঊহ্য ] (৯) “ওপাড়া হইতে আয় মায়েঝিয়ে।” [ কর্তা তোরা ঊহ্য ] (১০) “তোমার লাগিয়া তখনি, বন্ধু, বেঁধেছিনু অঞ্জলি।” [ আমি ঊহ্য ]
প্রথমপুরুষের কর্তাও ঊহ্য থাকে। “যে-সব জিনিস সঙ্গে আনিয়াছিলেন [তিনি ঊহ্য ] সবই বিকাইয়া গিয়াছে। তাহার বদলে যাহা পাইয়াছেন [ তিনি ঊহ্য ], তত ভালো জিনিস, আর তত বেশী জিনিস আর কখনও পান নাই [ তিনি ঊহ্য]।”
(খ) বহু ক্রিয়ার এক কর্তা : (১) “আবার সাতগাঁ যাইবে, আবার পুরানো খেলুড়িদের সঙ্গে খেলা করিবে, আবার গঙ্গায় স্নান করিবে।”। তিনটি সমাপিকা ক্রিয়ার একই কর্তা সে—তাহাও আবার ঊহ্য। ] (২) “ইহা স্থির করিয়া সকাতরচিত্তে হস্ত হইতে হুঁকা নামাইয়া, অনেক অনুসন্ধানে এক ভগ্ন যষ্টি আবিষ্কৃত করিয়া সগর্বে মার্জারীর প্রতি ধাবমান হইলাম।” [ প্রথমের দিকে তিনটি অসমাপিকা ও শেষের একটি সমাপিকা ক্রিয়ার একই কর্তা আমি—ঊহ্য রহিয়াছে] (৩) “ভৎসিয়া গর্জিয়া উঠি কহিলা ব্রাহ্মণ, ‘আমি তোর রক্ষাকর্তা!’ “ [ দুইটি অসমাপিকা ও একটি সমাপিকার একই কর্তা ব্ৰাহ্মণ। ]
(গ) এক ক্রিয়ার বহু কর্তা : নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দর, সাধারণলোকের দুঃখদুর্দশা, দেশে চুরি-ডাকাতির সংখ্যা, দুর্নীতিদমনে সরকারের অক্ষমতার বোঝা তথা স্বভাবলজ্জার ভার একই সঙ্গে বাড়িয়া চলিল। [ একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া বাড়িয়া চলিল-র পাঁচটি কর্তা। ]
(ঘ) সমধাতুজ কর্তা : অকর্মিকা ক্রিয়াটি যে ধাতু হইতে নিষ্পন্ন সেই ধাতু—নিষ্পন্ন কোনো বিশেষ্য যদি সেই ক্রিয়ার কর্তা হয়, তখন সেই কর্তাকে সমধাতুজ কর্তা বা সগোত্র কর্তা বলে। (১) “শিমুলগাছটার বড়ো বাড় বেড়েছে!” [ একই ‘বাড়’ ধাতু হইতে বাড় (√বাড় + অ) বিশেষ্যপদটি এবং বেড়েছে (√বাড় + এছে) ক্রিয়াপদটি নিষ্পন্ন, এবং বাড় পদটি বেড়েছে ক্রিয়ার কর্তা। (২) পাপের ফল এমন চমৎকারভাবেই ফলে। [ ফল (√ফল্ + অ) বিশেষ্যপদটি ও ফলে (√ফল্ + এ) ক্রিয়াপদটি একই ‘ফল্’ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন, এবং ফল পদটি ফলে ক্রিয়ার কর্তা ] (৩) এমন অনুকূল ঘটনা সাধারণতঃ ঘটে না। [ ঘটনা (√ঘট্ + অন + আ), ঘটে (√ঘট্ +এ) ] (৪) “আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি।” [ বাজনা (√বাজ্ + না), বাজি—বাজিয়া (√বাজ + ইয়া) অসমাপিকা ক্রিয়ার সংক্ষিপ্ত রূপ—কেবল কবিতায়। ]
(ঙ) প্রযোজক কর্তা ও প্রযোজ্য কর্তা : যে কর্তা নিজে না করিয়া অন্যকে দিয়া কাজটি করাইয়া লয় তাহাকে প্রযোজক কর্তা বলে। আর প্রযোজক কর্তা যাহাকে দিয়া কাজটি করাইয়া লয় তাহাকে প্রযোজ্য কর্তা বলে। (১) কেয়া কুঙ্কুমকে পড়াইবে। এখানে পড়া কাজটি কেয়া নিজে করিবে না, কুঙ্কুমকে দিয়া করাইবে। এইজন্য কেয়া প্রযোজক কর্তা। আবার, পড়া কাজটি কুঙ্কুম করিবে বটে কিন্তু নিজেই করিবে না, কেয়ার প্রেরণায় করিবে। তাই কুঙ্কুম হইতেছে প্রযোজ্য কর্তা। (২) মা শিশুকে চাঁদ দেখাইতেছেন।—এখানে মা প্রযোজক কর্তা, শিশুকে প্রযোজ্য কর্তা। (৩) কঙ্কা চন্দ্রাকে দিয়ে আমায় কথাটা বলাল। কঙ্কা প্রযোজক কর্তা, চন্দ্রাকে দিয়ে প্রযোজ্য কর্তা। লক্ষ্য কর, প্রথম দুইটি উদাহরণে প্রযোজ্য কর্তায় কে বিভক্তি হইয়াছে, কিন্তু শেষেরটিতে কে বিভক্তির অতিরিক্ত দিয়ে অনুসর্গটি যুক্ত হইয়াছে।
(চ) নিরপেক্ষ কর্তা : একই বাক্যে সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা বিভিন্ন হইলে অসমাপিকা ক্রিয়ার কর্তাকে নিরপেক্ষ কর্তা (Nominative Absolute) বলে। (১) “তুমি মাতৃহীন হইলে আমি তোমায় প্রতিপালন করিয়াছিলাম।”—বিদ্যাসাগর। [ ‘হইলে’ অসমাপিকা ক্রিয়াটির কর্তা তুমি—নিরপেক্ষ কর্তা, কিন্তু ‘করিয়াছিলাম’ সমাপিকা ক্রিয়ার কর্তা আমি। ] (২) “আঁখি গেলে মোর সীমা চলে যাবে।”—রবীন্দ্রনাথ। (৩) “আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?”—দ্বিজেন্দ্রলাল। (৪) দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্যাদা বোঝে না।
(ছ) কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তা : বাক্যে ক্রিয়ার কর্তার উল্লেখ না থাকিলে কৰ্মই যখন কর্তার প্রাধান্যলাভ করে বলিয়া মনে হয়, তখন সেই কর্মটিকে বলা হয় কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তা। পরমরসের দ্বার নিমেষে খুলিল (√খুল্)। [ অন্য কেহ দ্বার খুলিল, অতএব সেই অন্য কেহ কর্তা, দ্বার কর্ম। কিন্তু কর্তার উল্লেখ না করিয়া বাক্যটি এমনইভাবে গঠিত হইয়াছে যেন দ্বারই কর্তৃপদ অধিকার করিতেছে। কর্তৃপদ অধিকার করিয়া কর্মটি কর্মকর্তৃপদ হইয়াছে, এবং মূলের সকমিকা ক্ৰিয়া খুলিল অকর্মিকারূপে প্রতীয়মান হইতেছে। ] বালতিটা ভরেনি (√ভর্) এখনও? খদ্দর ছেঁড়ে (√ছিঁড়) কম। “শিশিরবিমল প্রভাতের ফল বিকালবেলায় বিকায় (√বিকা) হেলায়।” “ভাঙল (√ভাঙ্) সুখের হাট।”
(জ) অনুক্ত কর্তা : কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যের কর্তা প্রধানরূপে উক্ত হয় না বলিয়া সেই কর্তাকে অনুক্ত (উক্ত নয়) কর্তা বলে। ক্রিয়াটিকে কর্তৃবাচ্য হইতে কর্মবাচ্যে বা ভাববাচ্যে রূপান্তরিত করিলে কর্তৃবাচ্যের কর্তা তখন দ্বারা দিয়। কর্তৃক প্রভৃতি অনুসর্গযুক্ত হয় এবং ভাববাচ্যের কর্তা সম্বন্ধপদের বিভক্তিযুক্ত হয়। (১) কর্মবাচ্যে : আমার দ্বারা এ কাজ হতে পারে না। বাল্মীকি কর্তৃক পৃথিবীর আদি মহাকাব্য রচিত হইয়াছে। (২) ভাববাচ্যে : আপনার থাকা হয় কোথায়? আমার আজ আর আপিস যাওয়া হলই না।
(ঝ) ব্যতিহার কর্তা : পারস্পরিক ক্রিয়া-বিনিময় বুঝাইলে সেই ক্রিয়ার কর্তা দুইটিকে ব্যতিহার কর্তা বলে। রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে, উলুখাগড়ার প্রাণ হরে। ছেলেটিকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি করছে। বাপ-ব্যাটাতে হাতাহাতি করছে, দেখে নাতিপুতি। ছেলেয় ছেলেয় ঝগড়া অমন করেই।
(ঞ) সহযোগী কর্তা : দুইটি কর্তার মধ্যে সহযোগিতার ভাবটি পরিস্ফুট হইলে কর্তা দুইটিকে সহযোগী কর্তা বলে। এখানে বাঘে বলদে একঘাটে জল খায়। [ বাঘ ও বলদ যথাক্রমে শত্রুতাজনিত আক্রমণ ও ভয় ভুলিয়া মিলিতভাবে জল খায়। ] বুনছে কাঁথা গুনগুনিয়ে শাউড়ী-বউয়ে।
ব্যতিহার কর্তা ও সহযোগী কর্তার পার্থক্যটি মনে রাখিও।—ব্যতিহারে প্রতিযোগিতার ভাব, আর সহযোগী কর্তায় সহযোগিতার ভাব প্রকাশ পায়।
(ট) সাধন কর্তা : উপকরণকে কর্তৃরূপে ব্যবহার করিলে সাধন, কর্তা হয়। ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে। পাড়াগাঁয়ে এখনও কিছু কিছু ঘানি সরষে ভাঙে বইকি। এখানে ধান ভানিবার ও সরিষা ভাঙিবার উপকরণ যথাক্রমে ঢেঁকি ও ঘানি নিজেরাই কর্তৃপদ দখল করিয়াছে
(ঠ) বাক্যাংশ কর্তা (Noun Phrase as a Subject) : সমাপিকা ক্রিয়াবিহীন পদসমষ্টি বিশেষ্যধর্মী হইয়া একটি অখণ্ড ভাব প্রকাশ করিলে বাক্যের কর্তৃপদ পাইতে পারে।—পরের মাথায় কাঁঠাল ভাঙা মানুষের চিরকালের স্বভাব। সৎপথে জীবনযাপন করা আদৌ সহজ নয়।
(ড) উপবাক্যীয় কর্তা (Noun Clause as a Subject) : বাক্যের বিশেষ্যধর্মী উপাদান-বাক্য কর্তৃপদ পাইলে তাহাকে উপবাক্যীয় কর্তা বলে। সে আমায় এমন করে ফাঁকি দেবে মনে তো হয় না। নিজেকে জানতে চেষ্টা করো-সক্রেটিসের জীবনবেদ ছিল। “ভয় কারে কয় নাইক জানা।”
কর্তৃকারকের বিভক্তি—কর্তৃকারকে প্রধান বিভক্তিচিহ্ন অ (শূন্যবিভক্তি) শব্দের সঙ্গে যুক্ত হইলে শব্দটি অপরিবর্তিত থাকে। শূন্যবিভক্তিযুক্ত কর্তৃকারকের উদাহরণ পূর্বে অনেকগুলি দেওয়া হইয়াছে, আরও কয়েকটি দেখ : “বাবু কহিলেন, বুঝেছ উপেন?” “ “কত বেদ, কত মন্ত্র, মহাযজ্ঞ কত পবিত্ৰিলা এই দেশ “কত শুকতারা যে স্বপ্নে তাহার রেখে গেছে স্পর্শ।” এ সংসারে লোভই ভিখারী, সন্তুষ্টিই রাজা। “জাগে আকাশ, ছোটে বাতাস, হাসে সকল ধরা।” “এত আলো কে ছড়াল এ কালো আঁধার মনে।” “কারাগার করে অভ্যর্থনা।” কর্তৃকারকের অন্যান্য বিভক্তিচিহ্ন হইল এ (য়, য়ে), তে (এতে)। এই বিভক্তি—চিহ্নগুলি পদটিতে সর্বদাই যুক্ত থাকে। নীচের উদাহরণগুলি লক্ষ্য কর।—
এ (অ-কারান্ত ও ব্যঞ্জনান্ত শব্দে) : গ্রামের জমিজমা পাঁচভূতে লুটছে। লোকে তো কত কথাই বলে। “নীরব আকাশ মুখর করে শঙ্খচিলের ডাকে।” “বল বল বল সবে শতবীণাবেণুরবে।” “যাহা জগদীশ্বরের হাত, তাহা পণ্ডিতে বলিতে পারে না।” “তাহারে ধরিল জ্বরে।” “তাকে তখন বৈরাগ্যে পেয়ে বসেছে।” “প্রভাতে পরের দিন পথিকে এসে সব তুলে নিয়ে গেল আপন দেশে।” “স্মৃতিভ্রংশে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশে নষ্ট নরাধম।” [ ঘটিলে অসমাপিকা ক্রিয়ার লোপে তাহার কর্তৃকারকে এ বিভক্তি। ]
য়, য়ে (আ-কারান্ত, ই-কারান্ত, এ-কারান্ত, ও-কারান্ত শব্দে এ বিভক্তির রূপান্তর) : খুড়োভাইপোয় আপস করছে। মায়ে বলে, “পড় পুত।” “সাপের হাসি বেদেয় চেনে।” ক্ষমতায় মানুষের বিকৃতি ঘটায়, অজ্ঞতায় বিচ্ছিন্নতা আনে। বুড়োর কাজ কি ছেলেয় পারে? পুরনো ঘিয়ে অনেক রোগের উপশম করে।
তে (ই-কারান্ত, উ-কারান্ত শব্দে) : ট্যাক্সিতে আর কত ধকল সয়? আমাদের দেশে গোরুতে লাঙ্গল টানে। “টুনটুনিতে টুনটুনাল।”
এতে (অ-কারান্ত ও ব্যঞ্জনান্ত শব্দে) : “মূর্খেতে বুঝিতে নারে বছর চল্লিশে।” বণিকেতে গলা কাটে ভালো।
কর্মবাচ্য ও ভাববাচ্যের কর্তায় কে (কবিতায় রে) : সব কবিতাই গান নয়, কিন্তু সব গানকেই কবিতা হতে হয়। “এখন কিনা হিন্দুকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলে পুতুলগড়া শিখিতে হয়।” “হেথায় সবারে হবে মিলিবারে।” “সীতেনাথের সংসারে সবকিছুই রূপোকে দেখতে হয়।”
র (এর) : মৌমাছির মধুসঞ্চয় পরেরই জন্যে। তদ্রূপ, সভাপতির ভাষণ, নরপতির দান, মায়ের স্নেহ, শিক্ষকের উপদেশ ইত্যাদি।
অনুসর্গ—দ্বারা, দিয়া, দিয়ে, হইতে, কর্তৃক প্রভৃতি অনুসর্গগুলি কর্মবাচ্যের কর্তায় (অনুক্ত কর্তায়) প্রযুক্ত হয়। আমা হতে এই কার্য হবে না সম্ভব। পুলিস কর্তৃক চোর ধৃত হইল।
কর্মকারক
“গুরু কাছে লব গুরু দুখ।” “মোর অশ্রু তোমারে কাঁদায়।” “ভুলি দ্বারাবতীর ঘটা, কংসবধের গৌরবও।” তোমাকেই খুঁজছিলাম। “তার ললাটের সিঁদুর নিয়ে ভোরের রবি ওঠে।” “আমাদিগকে জ্ঞানবৃক্ষের ফল খাওয়াইলেন।” “রূপকথা শুনছি না, শুনছি মানবজীবনের অপরূপ কথা।”—এই বাক্যগুলির ক্রিয়াগুলিকে একে একে প্রশ্ন কর—কী লইব?—দুখ। কাহাকে কাঁদায়?—তোমারে। কী ভুলি?—ঘটা ও গৌরব। কাহাকে খুঁজিতেছিলাম?—তোমাকেই। কী লইয়া?
সিঁদুর। কী খাওয়াইলেন?—ফল। কী শুনিতেছি?—রূপকথা, কথা। এই দুখ, তোমারে, ঘটা, গৌরব, তোমাকেই, সিঁদুর, ফল, রূপকথা, কথা—কর্মকারক। ৯১। কর্মকারক : কর্তা যাহাকে আশ্রয় করিয়া ক্রিয়া সম্পাদন করে তাহাই কর্মকারক। কর্মকে অবলম্বন করিয়াই ক্রিয়া পূর্ণতা পায়।
কর্মকারক চিনিতে হইলে ক্রিয়াটিকে কী, কাহাকে, কোটি ইত্যাদি প্রশ্ন করিয়া যে উত্তর পাইবে সেই উত্তরই কর্মকারক।
কর্ম-সম্বন্ধে আমাদের একটু প্রাথমিক আলোচনা সারিয়া রাখা প্রয়োজন। বাংলায় ব্যবহৃত সকল ক্রিয়ারই কর্ম থাকে না। সে-সমস্ত ক্রিয়ার কর্ম থাকে তাহাদিগকে সকর্মিকা ক্রিয়া বলা হয়। পূর্বের বাক্যগুলিতে লব, কাঁদায়, ভুলি, খুঁজছিলাম, নিয়ে, খাওয়াইলেন, শুনছি প্রভৃতি সকর্মিকা ক্রিয়া। কিন্তু যে ক্রিয়ার কর্ম নাই, যে ক্রিয়ার দ্বারা কেবল সত্তা, অবস্থা বা ঘটনা বুঝায় তাহাকে অকমিকা ক্রিয়া বলে। দিব্যেন্দু খুব ভোরে ওঠে। ছেলেটি অঘোরে ঘুমাইতেছে। “জ্যোৎস্না নামে মৃদুপদে।”-স্থূলাক্ষর ক্রিয়াগুলি অকর্মিকা। কোনো ক্রিয়া সকর্মিকা, না অকর্মিকা জানিতে হইলে ক্রিয়াটিকে কী বা কাহাকে বা কোটি প্রশ্ন কর; প্রশ্নের যদি উত্তর পাও তবে ক্রিয়াটি সকর্মিকা, নচেৎ অকর্মিকা।
কর্মকারকে কে, এ, তে, রে, এরে প্রভৃতি বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয়।—
কে (রে বা এরে কেবল কবিতায়) : ভগবানকে চাইবার আবার সময়-অসময় আছে নাকি? “পাখিটাকে আনো তো।” “বীর্য কার ক্ষমারে করে না অতিক্রম?” “ঐ পাথুরে কান্নাই মমতার নির্ঝরিণীকে ডেকে আনে।” “এক হাতে মোরা মগেরে রুখেছি, মোগলেরে আর হাতে।” “কেশরী কি কভু ক্ষুদ্ৰ শশকে (শশ + কে) বধে?”
এ (স্থলবিশেষে য়, য়ে) : “পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী।” “নিশ্চয় জানিও মুই ভখিমু গরলে।” “মুক্ত দীপ্ত সে মহাজীবনে চিত্ত ভরিয়া লব।” “নৃপে হেরি ছেলে মেয়ে ভয়ে ঘরে যায় ধেয়ে।” তোমায় কতদিন দেখিনি, মা। “ক্ষণপ্রভা প্রভাদানে বাড়ায় মাত্র আঁধার পথিকে ধাঁধিতে।” “নাহি খায় ক্ষীরননীসরে।” “কেশরী কি কভু ক্ষুদ্র শশকে (শশক + এ) বধে?” “এমন লক্ষ্মণে মোর মারিল রাক্ষসে।”
তে, দের : “কাছারিতে কত সেলামি দিলেন?” এবার তোমাদের একটা কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি। “ইউরোপীয়দের (বহুবচনাত্মক ‘দের’-যোগে) আমরা যতই নিন্দা করি-না, অনেক বিষয়ে তাঁহারা খাঁটি মানুষ।” “মাঝে মাঝে প্রাণে তোমার পরশখানি দিয়ো।” (“খানি’ এই পদাশ্রিত নির্দেশকযোগে কর্মকারক)
“আমি কি ডরাই সখি ভিখারী রাঘবে?” “জন্মভূমি-রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?” এই দুইটি উদাহরণে যথাক্রমে রাঘবে (= রাঘবকে) ও মরিতে (= মরণকে) কর্মকারকই বলিতে হইবে। সংস্কৃতে লজ্জা ও ভয়ার্থক ধাতুর যোগে অপাদানকারক হয়। কিন্তু বাংলায় এক্ষেত্রে অপাদানের কোনো লক্ষণই নাই। লজ্জা করা, লজ্জা পাওয়া, ভয় করা, ভয় পাওয়া–সকর্মিকা ক্রিয়া। ভাশুরকে ভ্রাতৃবধূরা স্বভাবতঃই লজ্জা করে। দুর্জনকে সকলেই কি ভয় করেন? “দুখের বেশে এসেছ বলে তোমারে নাহি ডরিব হে।” “বিপদে আমি না যেন করি ভয়।”
শূন্যবিভক্তি : কর্মে শূন্যবিভক্তির প্রয়োগ বেশ ব্যাপক। মুখ্য কর্মে, বিধেয় কর্মে, অপ্রাণিবাচক বিশেষ্যপদ কর্ম হইলে, অনির্দিষ্ট প্রাণী বা জাতি কর্ম হইলে, এবং সাহিত্যকৃতি বুঝাইতে বিখ্যাত সাহিত্যিকের নামে শূন্যবিভক্তির প্রয়োগ হয়। “নহিলে বিষাদময় এ জীবন কেবা ধরে?” “বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া।” “অনুরোধ তার এড়ানো কঠিন বড়ো।” “কিন্তু কোথা পাব রত্নরাজি?” “জীবের মাঝারে দেখেছিলে তুমি রূপ পরমানন্দ।” মামলায় জিততে হলে ভালো উকিল দিও। মা এখন খাবার তৈরি করছেন। “কপালকুণ্ডলা লিখিবার সময় শেক্সপিয়র (শেক্সপিয়রের রচনাবলী) বড় বেশী পড়িতাম।” “বুলবুলিতে ধান খেয়েছে।” “অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু।”
কিন্তু কর্মটি সর্বনামপদ হইলে বিভক্তিচিহ্ন লোপ পায় না। “আমারে কিনিয়া লহ।” “কতদিন দেখিনি তোমায়।”
একই ক্রিয়ার একই জাতীয় একাধিক কর্ম থাকিলে শেষেরটিতে বিভক্তি যোগ করা হয়। সুরেন, জিতেন, জীবেন আর হরেনকে ডাক তো গজেন।
অনেক সময় প্রাণিবাচক বিশেষ্যে বিভক্তির যোগে ও বিভক্তির লোপে অর্থের পার্থক্য দেখা যায়। (ক) ট্রেন থামলেই কুলি ডাকবে (কুলি = যেকোনো কুলি); কিন্তু—রিক্শাওয়ালাকে ডাক। (নির্দিষ্ট বা পূর্বপরিচিত রিক্শাওয়ালা) (খ) বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ডাক্তার ডাকতে যাচ্ছি। (ডাক্তার যেকোনো ডাক্তার); কিন্তু—ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনো। (ডাক্তারবাবুকে নির্দিষ্ট ডাক্তারকে
॥ কর্মের প্রকারভেদ ॥
(ক) মুখ্য কর্ম ও গৌণ কর্ম : কতকগুলি সকর্মিকা ক্রিয়ার দুইটি করিয়া কর্ম থাকে, একটি প্রাণিবাচক, অন্যটি বস্তুবাচক। প্রাণিবাচক কর্মটিকে গৌণ কর্ম ও বস্তুবাচক কর্মটিকে মুখ্য কর্ম বলে। এইরূপ দ্বিকর্মবিশিষ্ট ক্রিয়ার নাম দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া*। মৃণালবাবু শচীনকে ইতিহাস পড়ান। তুমিই তো আমাকে ওকথা বললে। এখানে শচীনকে ও আমাকে গৌণ কর্ম; ইতিহাস ও ওকথা মুখ্য কর্ম। পড়ান ও বললে দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া।
[* দ্বিকর্মিকা নামটি রাজশেখর বসু-র ‘চলন্তিকা’ অভিধানে (ত্রয়োদশ সংস্করণ : ৩৪৭ পৃষ্ঠায়) দ্রষ্টব্য।]
মুখ্য ও গৌণ কর্ম চিনিবার উপায় : দ্বিকর্মিকা ক্রিয়াটিকে কাহাকে প্রশ্ন করিয়া যে উত্তর পাইবে তাহা গৌণ কর্ম; আর কী প্রশ্নের উত্তরটি হইতেছে মুখ্য কর্ম। গৌণ কর্ম বিভক্তিযুক্ত হইয়া প্রথমে বসে, মুখ্য কর্মটি শূন্যবিভক্তিযুক্ত হইয়া পরে বসে।
(খ) উদ্দেশ্য কর্ম ও বিধেয় কর্ম : একশ্রেণীর ক্রিয়া আছে যাহাদের কর্মের পরিপূরক হিসাবে অন্য পদ ব্যবহার করিতে হয়। এই পরিপূরক পদটিকে বিধেয় কর্ম বলে। আসল কর্মটি তখন উদ্দেশ্য কর্ম। উদ্দেশ্য কর্ম বিভক্তিযুক্ত হইয়া প্রথমে বসে। বিধেয় কর্মটি শূন্যবিভক্তিযুক্ত হইয়া পরে অবস্থান করে। ( ১) “তোমাবে (উদ্দেশ্য কর্ম) করিল বিধি ভিক্ষুকের প্রতিনিধি (বিধেয় কৰ্ম)।” (২) পরমহংসদেব টাকাকে (উদ্দেশ্য কর্ম) মাটি (বিধেয় কর্ম), আর মাটিকে (উদ্দেশ্য কর্ম) টাকা (বিধেয় কর্ম) মনে করিতেন। (৩) “আমার কিবা দিবা কিবা সন্ধ্যা, সন্ধ্যাকে বন্ধ্যা করেছি।” (৪) অর্থকেই লোকে পরমার্থ জ্ঞান করে। (৫) “দূরকে করিলে নিকট, বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।” (৬) “রাতি (উদ্দেশ্য কর্ম) কৈনু দিবস (বিধেয় কর্ম), দিবস (উদ্দেশ্য কর্ম) কৈনু রাতি (বিধেয় কর্ম)।” (এই উদাহরণটির উদ্দেশ্য কর্মেও বিভক্তিচিহ্ন নাই, লক্ষ্য কর।) (৭) রমেশকে রমেন মনে করেছিলাম।
(গ) সমধাতুজ বা ধাত্বর্থক কর্ম : ক্রিয়াটি যে ধাতু হইতে নিষ্পন্ন সেই ধাতু হইতে নিষ্পন্ন কোনো বিশেষ্যপদ ওই ক্রিয়ার কর্ম হইলে সেই কর্মকে সমধাতুজ কর্ম (Cognate Object) বলে। সমধাতুজ কর্মটি শূন্যবিভক্তিযুক্ত থাকে, এবং ইহার পূর্বে একটি বিশেষণ বা বিশেষণ-স্থানীয় পদ বসে; মাঝে মাঝে বিশেষণপদ ও কর্মটি সমাসবদ্ধও হইয়া যায়। (১) “অসীম স্নেহের হাসি হাসিছেন বসে।”
ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হাসি (√হাস্ + ই) এবং ক্রিয়া হাসিছেন (√হাস্ + ইছেন) একই হাস্ ধাতু হইতে উৎপন্ন বলিয়া হাসি সমধাতুজ কর্ম, এবং কর্মটির পূর্বে বিশেষণ-সম্বন্ধবাচক স্নেহের পদটি বসিয়াছে। (২) ছেলেবেলার বেলেখেলা আপনমনে খেলছি দিবারাতি। [ খেলা (√খেল্ + আ) এবং খেলছি (√খেল্ + ছি) একই খেল্ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন; পূর্ববর্তী বিশেষণ বেলে ও কর্ম খেলা সমাসবদ্ধ হইয়াছে। ] (৩) “ভক্তিভরে জন্মশোধ শেষ পূজা পূজিয়াছে তারে।” [ পূজা (√পুজ্জ্ + অ + আ) এবং পূজিয়াছে (√পূজ্ + ইয়াছে); পূর্ববর্তী বিশেষণ শেষ। ] (৪) “প্ৰলয়নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে, হে নটরাজ।” [ নাচন (√নাচ্ + অনট্) এবং নাচলে (√নাচ্ + লে); পূর্ববর্তী বিশেষণ প্রলয় সমাসবদ্ধ। ] (৫) এখন এক ঘুম ঘুমিয়ে নাও। [ ঘুম (√ঘুমা + অ) এবং ঘুমিয়ে ( √ঘুমা + ইয়ে); পূর্ববর্তী বিশেষণ এক। ] (৬) আর মায়াকান্না কাঁদিস নে বাপু। এখানে লক্ষ্য কর—খেলছি, পূজিয়াছে সকর্মিকা ক্রিয়া, আর হাসিছেন, নাচলে, ঘুমিয়ে, কাঁদিস অকর্মিকা ক্রিয়া। অতএব অকর্মিকা ও সকর্মিকা উভয়প্রকার ক্রিয়ারই সমধাতুজ কর্ম থাকিতে পারে।
(ঘ) অসমাপিকা ক্রিয়ারূপ কর্ম : অসমাপিকা ক্রিয়া ভাববিশেষ্যের অর্থে প্রযুক্ত হইলে মাঝে মাঝে কর্মভাব পায়। “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে।” বাঙালী কি হাসতে ভুলেছে? আমরা বাঁচতে চাই—বাঁচার মতো বাঁচা
(ঙ) বাক্যাংশ কর্ম (Noun Phrase as an Object) : সমাপিকা ক্রিয়াবিহীন পদসমষ্টি বিশেষ্যধর্মী হইয়া একটি অখণ্ড ভাব প্রকাশ করিলে বাক্যটির প্রধান সকর্মিকা ক্রিয়ার কর্ম হইতে পারে। আমতা আমতা করে কথা বলা পছন্দ করি না। কোকিলের মিষ্টি সুরে কুহু কুহু ডাকা আমি বড়ো ভালোবাসি।
(চ) উপবাক্যীয় কর্ম (Noun Clause as an Object) : জটিল বাক্যের অপ্রধান উপাদান-বাক্য বিশেষ্যধর্মী হইলে সেটি প্রধান উপাদান-বাক্যের অন্তর্গত—সকর্মিকা ক্রিয়ার কর্ম হইতে পারে। “কে না জানে অম্বুবিম্ব অম্বুমুখে সদ্যঃপাতী?” সাধুতাই শ্রেষ্ঠ পন্থা জানিহ নিশ্চয়। “শুন ধনি, রাজকাজ দরিদ্র-পালন।”
(ছ) ঊহ্য কর্ম : আপনি এখনও খাননি (সকর্মক খা ধাতুর কর্ম ভাত বা রুটি ঊহ্য)। “মনমাঝি তোর বইঠা নে রে, আমি আর বাইতে পারি না।” (বাইতে সকর্মিকা ক্রিয়ার কর্ম দাঁড় উহ্য)। ঘোড়াটা বছরদশেক টানছে (কর্ম গাড়ি উহ্য)।
(জ) অক্ষুণ্ণ কর্ম : কর্তৃবাচ্যের দুইটি কর্ম কর্মবাচ্যেও অপরিবর্তিত থাকিলে, সেই কর্মকে অক্ষুণ্ণ কর্ম বলা হয়। মহর্ষি শকুন্তলাকে শাশ্বত নারীধর্মের কথাহ বলিয়াছেন (কর্তৃবাচ্য : শকুন্তলাকে ও কথা—দুইটি কর্ম)। (মহর্ষির দ্বারা) শকুন্তলাকে শাশ্বত নারীধর্মের কথাই বলা হইয়াছে (কর্মবাচ্য—দুইটি কর্মই অক্ষুণ্ণ রহিয়াছে)।
(ঝ) কর্মের বীপ্সা (পুনরাবৃত্তি) : “জনে জনে ডাকিয়াছি, করেছে বিমুখ।” কী কী চাও, বল। যা যা বলেছিলুম, করেছ?
করণকারক
“আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর সীমন্তসীমা-’পরে।” “পূজা হোম যাগ প্ৰতিমা—অৰ্চনা—এ সকলে এবে কিছুই হবে না।” “ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।” “একসূত্রে বাঁধিয়াছি সহস্রটি মন।” “মা মেনকার অশ্রুকণায় বিশাল গিরীশ পড়ল ঢাকা।” “অরুণ আলোয় শুকতারা গেল মিলিয়ে।” “আশার ছলনে ভুলি কী ফল লভিনু হায়!” উদাহরণগুলি লক্ষ্য কর। কেমন করিয়া আঁকিতেছিল?—যত্নে। কিসে কিছুই হইবে না?—এ সকলে। কী দিয়া তৈয়ারী?—-স্বপ্ন দিয়ে। কী দিয়া ঘেরা?—স্মৃতি দিযে। কিসে বাঁধিয়াছি?—একসূত্রে। কিসের দ্বারা ঢাকা পড়িল?-অশ্রুকণায়। কিসের দ্বারা মিলাইয়া গেল?—আলোয়। কিসের দ্বারা ভুলিয়া?—ছলনে (ছলনায়)। স্থূলাক্ষর পদগুলির সাহায্যে সংশ্লিষ্ট ক্রিয়াগুলি সম্পাদিত হইতেছে। এইজন্য ইহারা করণকারক।
৯২। করণকারক : কর্তা যাহার সাহায্যে ক্রিয়া সম্পাদন করে তাহাকে করণকারক বলে।
করণকারকে বিভক্তিচিহ্ন-এ (স্থলবিশেষে য়, য়ে), তে (এতে), র (এর) প্রভৃতি বিবিধ বিভক্তিচিহ্নের প্রয়োগ হয়। “বিহঙ্গ বাঁটুলে বিন্ধে লতায় জড়িয়া বান্ধে।” “তোমারে করিবে বন্দী নিত্যকাল মৃত্তিকা-শৃঙ্খলে সাধ্য আছে কার।” আবৃত্তির মাধুর্য আবৃত্তিকারের অঙ্গসঞ্চালনে নয়, তাঁর কণ্ঠস্বরের সুডৌল উত্থান-পতনে। “সবুজ ঘাসে ছেয়ে গেছে মাঠ।” “আপনার হাতে দিতেন জ্বালায়ে কনক-প্রদীপমালা।” “পুরবীতে (পুরবী রাগিণী-যোগে) ধরি তান গাহিতে লাগিল রামদাস।” “নিবাও বাসনাবহ্নি নয়নের নীরে।” “দুই ধারে তৃণের মঞ্জরী সিক্ত মোর আঁখিজলে।” “প্লাবিয়াছ চারিধার কি সৌরভে, লাবণ্যজোয়ারে।” দেখো, ছুরিতে যেন আঙুল কেটো না। ট্যাক্সিতে এলাম, বাসে যা ভিড়। টাকায় বাঘের দুধ পাওয়া যায়। মুখে আমরা অনেকেই রাজা-উজির মারি। চোখে দেখি, কানে শুনি। হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলিয়ো না। এত মোটা কলমে লেখা যায়? “গৈরিকে আজ কে ছোপালে কমলাফুলী চেলী?” “আলতাপরা পায়ের ছোঁয়ায় রক্তকমল ফোটে।” স্বর্ণসীতা সোনায় গড়া, না অশ্রুতে? তৃপ্তির প্রসাদে তাঁর ভরে গেল বুক। “উদ্যান উজ্জ্বল শত শ্বেতপুষ্পহাসে।” চাই শুধু একটা কলমের (কলম দিয়া অর্থে) খোঁচা। পুলিসের রুলের (রুল দিয়া অর্থে) গুঁতো কত গুণ্ডাকে যে ঠাণ্ডা করল। “যে হয় আপনজনা, নয়নে তারে যায় গো চেনা।”
দ্বারা, দিয়া (দিয়ে), করিয়া (করে), কর্তৃক, হইতে (হতে) প্রভৃতি অনুসর্গের প্রয়োগ : নিজে না গিয়ে লোক দিয়ে তত্ত্ব পাঠাও না। “সাত মাসের বাছুরকে দিয়ে ওই জানালা না চাটাতে পারলে শোধন হবে না।” (বিচিত্র উদাহরণ অনুসর্গ থাকা সত্ত্বেও মূল শব্দে কে বিভক্তির প্রয়োগ) “নৌকা করে বউ এল রে।” জল কাচের গ্লাসে করে দাও। “কাশী শুধু মাটি দিয়ে গড়া নয়, মন্ত্ৰ দিয়েও।” এ সন্তান হতে (সন্তানের দ্বারা অর্থে) তব বৃদ্ধি পাবে বংশের গৌরব। “এ কার্য বীরেন্দ্রসিংহ হইতে হইবে না।” জগৎকে বই দিয়ে না ছুঁয়ে মন দিয়ে ছুঁতে চেষ্টা কর।
করণে শূন্যবিভক্তি : ক্রীড়ার্থক ও প্রহারার্থক ক্রিয়ার করণে বিভক্তি লোপ পায়। যুধিষ্ঠির আবার পাশা (পাশা দিয়া) খেলিতে বসিলেন। তাস খেলা ছেড়ে ফুটবল খেলা ও লাঠি খেলা শেখ। গাধাকে হাজার চাবুক (চাবুক দিয়া অর্থে) মারো, সে গাধাই থাকবে। শিক্ষকমহাশয় ছাত্রটিকে বেত মারিলেন। সেইরূপ লাঠি মারা, ঢিল মারা, ঘুষি মারা ইত্যাদি। এখানে দ্বারা বা দিয়া অনুসর্গের লোপে স্থূলাক্ষর পদগুলিতে করণকারকে শূন্যবিভক্তি হইয়াছে।
ক্রিয়াটিকে কাহার দ্বারা, কিসে, কী দিয়া ইত্যাদি প্রশ্ন করিলে যে উত্তর পাইবে, তাহাই করণকারক।
॥ করণের শ্রেণীবিভাগ ॥
(ক) যন্ত্রাত্মক করণ : ক্রিয়াসম্পাদনের ইন্দ্রিয়গোচর উপায়কে যন্ত্রাত্মক করণ বলে। “অস্থিতে তার গড়িছে মুকুতা সাগরের জলপরী।” রঙীন চশমায় সবকিছুই রঙীন দেখায়। আকাশ কি ধোঁয়ায় মলিন হয়? “আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে।” (ধনুকের ছিলায়)
(খ) উপায়াত্মক করণ : ক্রিয়াসম্পাদনের উপায়টি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য না হইলে তাহাকে উপায়াত্মক করণ বলে। বলে না হোক, ছলে বা কৌশলে কার্যসিদ্ধি চাই-ই। অন্তর যাদের ঘৃণায় পূর্ণ, তারা করবে জনকল্যাণ? “কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি খুলি।” বক্তৃতার বাহাদুরিতে পেট ভরে না। “আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে।” (চারিত্রিক উৎকর্ষে
(গ) সমধাতুজ করণ : কোনো ক্রিয়া বা ক্রিয়াজাত বিশেষণ যে ধাতু হইতে সৃষ্ট, করণকারকটিও যদি সেই ধাতুনিষ্পন্ন হয়, তাহা হইলে সেই করণকে সমধাতুজ করণ বলে। পৃথিবী আমাদের কী মায়ার বাঁধনেই না বেঁধেছে। (বাঁধন বিশেষ্যপদটি এবং বেঁধেছে ক্রিয়াপদটি একই বাঁধ ধাতু হইতে নিষ্পন্ন)। বৃদ্ধাটি জরায় জীর্ণ দেহখানা নিয়ে জগন্নাথদর্শনে চলেছেন (বিশেষ্য জরা ও বিশেষণ জীর্ণ একই সংস্কৃত জ্, ধাতুনিষ্পন্ন)। ঝাড়ন দিয়ে চেআর-টেবিলগুলো ঝেড়ে দাও (ঝাড়ন ও ঝেড়ে একই ঝাড়ু ধাতু হইতে নিষ্পন্ন)। বড়ো জ্বালায় জ্বলছি। “তোমার মতো এমন টানে কেউ তো টানে না।”
(ঘ) করণের বীপ্সা : “রঞ্জিয়াছ পুষ্পে পুষ্পে ধরিত্রীর বিচিত্র অলক। “ তারায় তারায় ভরা নিশীথ-আকাশ। রোগে রোগে দেহটা জীর্ণ হয়ে গেল। জলে জলে পচে গেল দেশটা। “গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে।”
সম্প্রদানকারক
স্বচ্ছতোয়া ভিখারীকে ভিক্ষা দিতেছে। “তোমায় কেন দিইনি আমার সকল শূন্য করে?” “অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ।” “আমাদিগকে কাহার হস্তে সমর্পণ করিলে, বল।” উদাহরণগুলি দেখ।—স্বচ্ছতোয়া কাহাকে ভিক্ষা দিতেছে?—ভিখারীকে। এই ভিক্ষা সে কি আবার ফেরত লইবে?—নিশ্চয়ই না। সে কি বাধ্য হইয়া ভিক্ষা দিতেছে?—না, অন্তরের টানে দিতেছে। অতএব দেখা গেল যে, এই ভিক্ষাদান স্বচ্ছতোয়ার নিঃস্বার্থ দান এবং ভিখারীটি হইতেছে তাহার এই পবিত্র দানের পাত্র। সেইজন্য ভিখারীকে সম্প্রদানকারক। সেইরূপ তোমায়, অন্ধজনে, মৃতজনে, হস্তে–সম্প্রদানকারক।
৯৩। সম্প্রদানকারক : যাহাকে কোনোকিছু নিঃস্বার্থভাবে দান করা যায়, দানের সেই পবিত্র পাত্রকে সম্প্রদানকারক বলে।
সম্প্রদানকারক হইলে একই বাক্যে সম্প্রদানকারক ও মুখ্য কর্ম পাশাপাশি থাকে। সম্প্রদানকারক মুখ্য কর্মের পূর্বে বসে।
সম্প্রদানে কে (রে, এবে—কবিতায়), এ (য়, য়ে), তে, র (এর) ইত্যাদি বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয়।—দীনদুঃখীকে অন্নবস্ত্রদান পরমধর্ম। “যে ধন তোমায় দিব সে ধন আমার তুমি।” মহিলা সমিতিতে কত চাঁদা দেবেন? “বঙ্কিমচন্দ্ৰ সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ, সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সঙ্কুচিত বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন।” “সর্ব কর্মফল শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ কর।” “ক্ষুধিতে যোগায় অন্ন, পিপাসিতে শীতল পানীয়।” কন্যা যদি দিতে হয় তো সৎপাত্রেই দেব। “আচার্যে দক্ষিণা দিল নিষাদকোঙর।” “শিবাজি সঁপিছে অদ্য তাঁরে নিজ রাজ্য—রাজধানী।” “এই সে রমণী দেবতারে সঁপি দিয়া আপনার ছেলে চুরি করে নিয়ে যায়।” দেবতার (দেবতাকে নিবেদন করিবার) নৈবেদ্য এখনও সাজানো হয় নাই। “দেহো তাঁরে নিজ সর্বশ্রেষ্ঠ দান যতনে।” “কত বসন্ত যে ঢেলেছে তায় অকারণের হর্ষ।” “সবাই যারে সব দিতেছে তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।”
মাঝে মাঝে সম্প্রদানকারকে শূন্যবিভক্তি হয়। অখিলবাবু পিতৃশ্রাদ্ধে হাজারখানেক কাঙালী বিদায় দিয়াছেন (কাঙালী—কাঙালীকে)।
সম্প্রদান ও গৌণ কর্মের বিভক্তিচিহ্ন এক হওয়ার ফলে অনেক সময় কারকনির্ণয়ে সংশয় জাগে। একই ক্রিয়া দেওয়া আবার সেই সংশয়কে বাড়াইয়া তোলে। যেমন, বৃষ্টি হচ্ছিল বলে গজেন আমায় (গৌণ কর্ম) ছাতাখানা দিল। সেইরূপ—জমিদারকে খাজনা দেওয়া, চাকরকে মাইনে দেওয়া, দোকানীকে টাকা দেওয়া, খদ্দেরকে সওদা দেওয়া, চোরাকারবারীকে মুনাফা দেওয়া, ডাকাতকে সর্বস্ব দেওয়া, পুলিসকে ঘুষ দেওয়া প্রভৃতি স্থলে জমিদার, চাকর ইত্যাদি সম্প্রদান নয়, গৌণ কর্ম। কারণ, এখানে দেওয়া কাজটি আদৌ পবিত্র নয়। এই দেওয়ার পশ্চাতে বাধ্যবাধকতা, ভীতি, অসহায়তা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি কাজ করিতেছে। স্বেচ্ছাপ্রণোদিত নিঃস্বার্থ দানের নামগন্ধও এখানে নাই। সুতরাং মাত্র আকৃতি দেখিয়া কারক নির্ণয় করিলে ভুল হইবার যথেষ্ট সম্ভাবনা।
আচার্য সুনীতিকুমার বাংলায় সম্প্রদানকারক তুলিয়া দিবার পক্ষপাতী। এ সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন, “বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে যাঁহারা বাঙ্গালা ভাষার ব্যাকরণ লইয়া আলোচনা করিয়াছেন, তাঁহারা প্রায় কেহই বাঙ্গালাতে সম্প্রদানকারক বলিয়া পৃথক্ একটি কারক স্বীকার করেন নাই। বস্তুতঃ বাঙ্গালাতে সম্প্রদানকারককে কর্মকারকের অন্তর্গত করিয়া দেখিলে ক্ষতি নাই, এবং তাহাই সমীচীন।” এ বিষয়ে তিনি রাজা রামমোহন রায়, আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এমনকি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেরও সমর্থন উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় বাংলা ভাষায় সম্প্রদানকারকের স্বতন্ত্র অস্তিত্বস্বীকারের প্রয়োজন আছে বলিয়াই মনে হয়। গৌণ কর্ম আর সম্প্রদানের একাসনে স্থান পাওয়া উচিত নয়। গৌণ কর্ম গৌণই। গৌণ কর্মযুক্ত দ্বিকমিকা ক্রিয়াটির আসল লক্ষ্য এই অপ্রধান কর্মটির দিকে নয়—মুখ্য কর্মের দিকে। সেক্ষেত্রে কী দেওয়া হইতেছে–সেইটাই বড়ো কথা, কাহাকে দেওয়া হইতেছে—তাহা গৌণ, হীনমূল্য। কিন্তু সম্প্রদানে কী দেওয়া হইতেছে তাহা তত বিবেচ্য নয়; কাহাকে দেওয়া হইতেছে, পবিত্র দানের সেই পাত্রটিই বড়ো হইয়া উঠে। সুতরাং গৌণ কর্ম ও সম্প্রদান সমমর্যাদার দাবি করিতে পারে না।
নিমিত্তকারক *
[* মাননীয় পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ ১৯৮৯ সাল হইতে প্রবর্তিত পাঠ্যসূচীতে সম্প্রদান কারকের পরিবর্তে নিমিত্তকারক চালু করিয়াছেন। তাই লেখকের সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে লেখা বই হইতে সেই বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা-অংশটি এখানে সংযোজিত হইল।]
রাজগুরু দুর্গদ্বারে এলেন ভিক্ষায়। খুকুর জন্য দোলনা আনলাম। “সাজিয়াছ যোগী বল কার লাগি।” “বেলা যে পড়ে এল জলকে চল।” “গেরুয়া সাজের জন্য নয়, কাজের জন্য।” “সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
প্রদত্ত বাক্যগুলিতে ক্রিয়াপদকে কী জন্য প্রশ্ন করিলে, কী উত্তর মেলে, দেখ। কী জন্য আসিলেন?-ভিক্ষায় (ভিক্ষার জন্য), এবং ‘এলেন’ অকর্মিকা ক্রিয়া। কাহার জন্য আনিলাম?-খুকুর জন্য (দোলনা কর্মকারক, তাই ‘আনলাম’ সকৰ্মিকা ক্রিয়া)। তুমি কার লাগি (লাগিয়া) যোগী সাজিয়াছ জানিতে চাওয়া হইয়াছে। কী জন্য চল?—জলকে (জল আনিবার জন্য), ‘চল’ অকর্মিকা ক্রিয়া। পরের বাক্যে, কী জন্য?—সাজের জন্য নয়, কাজের জন্য এবং ‘নয়’ ও (ঊহ্য) ‘হয়’ ক্রিয়াদুইটি অকর্মিকা। তাই ভিক্ষায়, খুকুর জন্য, কার লাগি, জলকে, সাজের জন্য, কাজের জন্য, সকলের তরে, পরের তরে—নিমিত্তকারক।
৯৪। নিমিত্তকারকঃ যে কারকে নিমিত্ত বা জন্য অর্থটি প্রকাশ পায় তাহাকে নিমিত্তকারক বলে।
নিমিত্তকারকে এ (য়), কে বিভক্তিচিহ্ন এবং জন্য, জন্যে (তরে, লাগিয়া কেবল কবিতায়) অনুসর্গের প্রয়োগ হয়। অনুসর্গের ঠিক আগের পদটিতে র (এর) বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হয়। যেমন, খুকুর = খুকু + র; কার কে (সর্বনাম) + র; সাজের = সাজ + এর; সকলের = সকল (সর্বনাম) + এর ইত্যাদি।
এখন দেখা যাক, গৌণ কর্ম ও নিমিত্তকারকে তফাত কী?—গৌণ কর্ম ও নিমিত্তকারক—দুইটি ক্ষেত্রেই কে বিভক্তিচিহ্নের প্রয়োগ বেশী। এই পর্যন্ত মিল। এবার গরমিল। দ্বিকর্মিকা ক্রিয়ারই গৌণ কর্ম থাকে, কিন্তু নিমিত্তকারক সকর্মিকা ক্রিয়ারও হয়, অকর্মিকা ক্রিয়ারও হয়। যেমন—
চন্দনাকে নতুন ধরনের টর্চটা দেখালাম। এখানে চন্দনাকে গৌণ কৰ্ম, টর্চটা মুখ্য কর্ম এবং দেখালাম দ্বিকর্মিকা ক্রিয়া। কিন্তু (i) গলিটা বড্ড অন্ধকার, চন্দনাকে টর্চটা দেখাও (সাহায্যের নিমিত্ত)। এখানে চন্দনাকে নিমিত্তকারক, কদাপি গৌণ কর্ম নয়। আর, সেইজন্য দেখাও ক্রিয়াটি কেবল সকর্মিকা। (ii) রাত্রি তো অনেক হল, একলা যাবে, তোমাকে একটু দাঁড়াব কি? (সাহায্যের জন্য নিশ্চয়ই) তাই তোমাকে নিমিত্তকারক, এবং দাঁড়াব অকর্মিকা ক্রিয়া। অতএব, সকর্মিকা অকর্মিকা দুইরকম ক্রিয়ার বেলাতেই নিমিত্তকারক থাকিতে পারে। চন্দনাকে = চন্দনা + কে, তোমাকে = তুমি + কে—দুইটি নিমিত্তকারকেই কে বিভক্তি হইয়াছে।
আমাদের দেওয়া নিমিত্তকারকের উদাহরণযুক্ত বাক্যগুলিতে কর্তৃকারক খুঁজিয়া বাহির কর এবং সেগুলিতে কী বিভক্তিচিহ্ন হইয়াছে, খাতায় লিখিয়া রাখ।
অপাদান কারক
তাঁর খেয়ালে মায়ের বুকে ঝরে সুধা, মেঘের বুকে জল। রাজকন্যে সোনার থালায় খান। নাহি ঝরে বারি আর জনার নয়নে। “মুখের গ্রাস মুখ হইতে পড়িয়া যাইতেছে।” প্রতিটি বাক্যের ক্রিয়াকে প্রশ্ন কর : কোথা হইতে সুধা ঝরে ও জল ঝরে?—মায়ের বুকে (বুক হইতে অর্থে), মেঘের বুকে (বুক হইতে কিসে খান?—থালায়। কোথা হইতে বারি ঝরিতেছে না?—নয়নে (নয়ন হইতে)। কোথা হইতে পড়িয়া যাইতেছে?—মুখ হইতে। এখানে দেখিলে যে, সুধা ঝরা, খাওয়া, বারি ঝরা প্রভৃতি কার্যগুলি যথাক্রমে বুক, থালা, নয়ন ইত্যাদি হইতে সম্পন্ন হইতেছে। এইজন্যই বুকে, থালায়, নয়নে, মুখ হইতে–অপাদানকারক। ৯৫। অপাদানকারক : যাহা হইতে কোনো ব্যক্তি বা বস্তু পতিত চলিত ভীত গৃহীত রক্ষিত উৎপন্ন মুক্ত অন্তর্হিত বঞ্চিত বিরত ইত্যাদি হয়, তাহাকে অপাদানকারক বলে।
॥ অপাদানের প্রকারভেদ ॥
(ক) স্থানবাচক : কথাটা শুনে ভদ্রলোক যেন আকাশ থেকে পড়লেন। টাকাটা পকেট থেকে খোয়া গেল। ছাদ দিয়ে এখনো কি জল ঝরে?
(খ) কালবাচক : তিনি রাত্রি ন’টা থেকে গান গেয়ে চলেছেন। “সকাল থেকে বাদল হল ফুরিয়ে এল বেলা।”
(গ) অবস্থানবাচক : দেবতারা স্বর্গ থেকে (স্বর্গে অবস্থান করিয়া) পুষ্পবৃষ্টি করলেন। শোভাযাত্রা বারান্দা থেকে (বারান্দায় অবস্থিত থাকিয়া) দেখবে। ছাদ থেকে তাঁকে আসতে দেখেছি। ছেলেরা ছাদে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।
স্থানবাচক অপাদানে কর্তার স্থানচ্যুতি ঘটে, কিন্তু অবস্থানবাচকে কর্তার স্থানচ্যুতির প্রশ্ন নয়, কর্মটিই অবস্থানবাচক স্থান হইতে দূরে রহিয়াছে বা বিচ্ছিন্ন হইয়াছে।
(ঘ) দূরত্ববাচক : “বুঁদির কেল্লা চিতোর হতে যোজন তিনেক দূর।” “উদয়পুর থেকে পাঁচ ক্রোশ হবে নাহরামুংরা।”
(ঙ) বিকৃতিবাচক : দুধে দই হয়। টাকায় কী না হয়? শুধু কি তিলেহ তৈল হয়?
(চ) অসমাপিকা ক্রিয়াবাচক : আমরা কেউ মরতে (মরণে) ভীত নই। হঠাৎ তিনি বলতে (বলায়) বিরত হলেন।
অপাদানে এ (য়), তে (এতে), কে, র (এর) প্রভৃতি বিভক্তিচিহ্ন ও দিয়া, অপেক্ষা, হইতে (চলিত ভাষায় থেকে, চেয়ে) প্রভৃতি অনুসর্গ যুক্ত হয়।—“তোমার চোখে জল পড়ছে কেন, গোলাম হোসেন?” “বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা।” “গাঁথিব নূতন মালা তুলি সযতনে তব কাব্যোদ্যানে ফুল।” পরশু তোমাদের পুকুরে মাছ ধরতে যাচ্ছি। “গণ্ডে ঝরে জাহ্নবী উতলা।” দধিতে ঘোল হয়। “কোথা হইতে আসিয়াছ নদী?” “মহাদেবের জটা হইতে।” “তব মেঘধারাযন্ত্রে ঝরঝর ঝরিছে অমিয়।” “কার্থেজ ইতিহাসে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।” আশ্রমে অন্নকূট উৎসব উঠে গেছে। “অর্জুনজননীকণ্ঠে কেন শুনিলাম আমার মাতার স্নেহস্বর।” “মুক্ত হইব দেবঋণে মোরা মুক্তবেণীর তীরে।” এ কথা কার কাছে শুনলে? “অমনি চারিধারে (চারিধার হইতে) নয়ন উঁকি মারে।” “মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মুখে ঝরে।” “আশ্চর্য, কিছুই কি তাঁকে (তাঁহার কাছ হইতে) লুকোবার নেই কোনোদিন!” মরিতে জানে যে, মরণে বা রণে ভয় তার কভু নাহি রে। পশুপাখির হাতে খাদ্যশস্য রক্ষা করাও বেশ কঠিন ছিল। “সজ্জাহীনের লজ্জা নাইকো, দারিদ্র্যে নাই ভয়।” “মরুৎ-পাথারে বারুদের ঘ্রাণ।” “আলোকের মুখে কালো যবনিকা এতখনে হল ছিন্ন।” “শুনি টঙ্কার তাহার পিনাকে।” খাবারের দোকানে টাকায় টাকা লাভ। ছেলেবেলায় অভিভাবকের ভয়ে শরৎচন্দ্র পড়তাম লুকিয়ে লুকিয়ে। রোজ রোজ ভূতের গল্প শুনি, তাই তো আর ভূতের ভয় হয় না। এখন মরতে পারলেই রোগের (রোগ হইতে অর্থে) শান্তি। সংবাদ শুনেই তিনি আহারে বিরত হলেন। একথা সবার মুখেতে শুনে এসেছি জ্ঞান হয়ে অবধি। ক্ষতমুখ দিয়া রক্তস্রোত বহিছে এখনো “অন্তর হতে বিদ্বেষ-বিষ নাশো।” নোটখানা রাস্তায় কুড়িয়ে পেলাম। “আমি তাঁর মুখের সেই জ্যোতিষের ব্যাখ্যা লিখে তাঁকে শুনিয়েছিলুম।” “খুড়ো—ভাইপোতে আজ এক থালেই খাবে।” মৌমাছি ফুলে ফুলে মধু লুটে যায়। তোমার মতো ডাকাবুকো ছেলের বিপদকে (বিপদ্ হইতে) ভয় কেন? আমাকে (আমা হইতে) লজ্জা কিসের? [ এখানে ভয় বা লজ্জা বিশেষ্যপদ; সেইজন্য যথাক্রমে বিপদকে, আমাকে অপাদান। ] “সে মরণে ভীত নয়।”—কবিশেখর। মাঝিমাল্লার আবার নদীতে ভয়? “একেবারে মরা ভালো জ্যান্তে মরার চাইতে।” “একমাত্র বাস নিল গাত্র হতে।” “ঠিক ঠিক ত্যাগ আর বিশ্বাস ভাবসমাধির চেয়েও বড়ো সম্পদ।” “সান্তাহার স্টেশনে আসাম মেলে চড়লুম।” “হাতের থেকেই মাছগুলো খাবার তুলে নেয়।”
শূন্যবিভক্তি : “তখন আমি কেবলই ইস্কুল (ইস্কুল থেকে) পালিয়েছি।” “করিলাম মন, শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিবু ফিরি।” “সমস্ত দুপুর দোকান পালিয়ে কোথায় ছিলি রে কেষ্ট?” রাত্রি বারোটায় ট্রেন বর্ধমান (বর্ধমান হইতে) ছাড়িল। “কে কোথা (কোথা হইতে) দেখিবে, ঘটিবে তাহলে বিষম বিপদ্পাত।”
ক্রিয়াটিকে কোথা হইতে, কাহার কাছে, কিসে, কার থেকে প্রভৃতি প্রশ্ন করিয়া যে উত্তর পাইবে তাহাই অপাদানকারক।
অধিকরণকারক
“লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে।” “সুরলোকে বাজে জয়শঙ্খ।” “ফেনাইয়া উঠে বঞ্চিত বুকে পুঞ্জিত অভিমান।” “ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর।” “সকলের এতে সম অধিকার।” “আর কি ভারতে আছে সে যন্ত্র?” “তোমার বকুলফুলে, তোমার ও রজনীগন্ধায় কী জাদু লুকানো আছে!” এই বাক্যগুলির সমাপিকা ক্রিয়াকে প্রশ্ন কর : কখন লঙ্ঘিতে হইবে?—রাত্রি-নিশীথে। কোথায় জয়শঙ্খ বাজে?—সুরলোকে। কোথায় পুঞ্জিত অভিমান ফেনাইয়া উঠে?—বুকে। কোথায় ডুবিয়াছে? গঙ্গায়। কিসে সমান অধিকার?—এতে। কোথায় আছে?—ভারতে। কোথায় লুকানো রহিয়াছে?—বকুলফুলে ও রজনীগন্ধায়। ক্রিয়াটি কখন বা কোথায় অনুষ্ঠিত হইতেছে, উল্লিখিত আয়তাক্ষর পদগুলি হইতে জানা যাইতেছে। সেইজন্য রাত্রি-নিশীথে, সুরলোকে, বুকে, গঙ্গায়, এতে, ভারতে, বকুলফুলে, রজনীগন্ধায়—অধিকরণকারক।
৯৬। অধিকরণকারক : যে স্থানে বা যে সময়ে কোনো ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, ক্রিয়ার সেই আধারকে অধিকরণকারক বলে
।। অধিকরণের প্রকারভেদ ।।
অধিকরণকারক তিন প্রকারের—(১) স্থানাধিকরণ, (২) কালাধিকরণ এবং (৩) বিষয়াধিকরণ।
(১) স্থানাধিকরণ : যে স্থানে ক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হয় সেই স্থানকে স্থানাধিকরণ বলে। স্থানাধিকরণ আবার ত্রিবিধ—(ক) একদেশসূচক, (খ) ব্যাপ্তিসূচক ও (গ) সামীপ্যসূচক।
(ক) একদেশসূচক : সমগ্র স্থান ব্যাপিয়া নয়, মাত্র কোনো বিশেষ অংশে কোনোকিছুর অবস্থান বুঝাইলে একদেশসূচক স্থানাধিকরণ হয়। “আকাশেতে (সর্বত্র নয়, কোথাও কোথাও) মেঘের মাঝারে শরতের কনক তপন।” “আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।” “রাজার পূজা আপনদেশে, কবির পূজা বিশ্বময়।” “শতমুক্তাধিক আয়ু কালসিন্ধুজলতলে ফেলিস পামর।” “জাগিছে জননী বিপুল নীড়ে।” “হপ্তমালার দেশে তারা গাইবলদে চষে।” টাকাটা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি। চেকটা ব্যাগে রাখ। “নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা।” “স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটিমায়ের কোলে।” “ছাতুর গুঁড়া কিছু মেঝেয় পড়িয়াছিল।” বুকভরানো ছবিটাকে সেলুলয়েডের ফিতেয় ধরে রাখ না কেন? “চোখের কোণে একটু হাসল মণিদীপা।” “আলয়ে কুলায়ে তন্দ্রা ভুলায়ে গগন ভরিল কে!”
(খ) ব্যাপ্তিসূচক : কোনো বিশেষ অংশে নয়, সর্বত্র ব্যাপিয়া থাকা বুঝাইলে ব্যাপ্তিসূচক স্থানাধিকরণ হয়। দুগ্ধে (দুগ্ধের সর্বত্রই) মাধুর্য আছে। “অগ্নিতে দাহিকাশক্তি, বরফে শীতলতা, নিম্বে তিক্ততা, লৌহে কাঠিন্য ও তিলে তৈল আছে।” “বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মনিঃশ্বাস পবনে।” “আমার হিয়ায় চলছে রসের খেলা।” (রসের খেলায় হৃদয় পূর্ণ অর্থে ব্যাপ্তিসূচক স্থানাধিকরণ) “আমার মনে নাইক কোনো দ্বন্দ্ব।”
(গ) সামীপ্যসূচক : নৈকট্য বুঝাইলে সামীপ্যসূচক স্থানাধিকরণ হয়। “আজকে মাসের পয়লা, দুয়ারে (ঠিক দ্বারে নয়, দ্বারের নিকটে) দাঁড়ায়ে গয়লা।” পৌষসংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগরে (সাগরের জলে নয়, নিকটস্থ তীরে) মেলা হয়। দরজায় পর্দা নেই কেন? জানালায় এত ভিড় কিসের! গেটে দাঁড়িয়ে কার অপেক্ষা করছেন? “সে যে কাছে এসে বসেছিল।”
(২) কালাধিকরণ : যে সময়ে ক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হয়, সেই সময়কে কালাধিকরণ বলে।
কালাধিকরণ দ্বিবিধ—(ক) ক্ষণমূলক ও (খ) ব্যাপ্তিমূলক।
(ক) ক্ষণমূলক : অতি অল্পসময়ের মধ্যে ক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হইলে ক্ষণমূলক কালাধিকরণ হয়। বিকাল পাঁচটায় অনুষ্ঠান আরম্ভ হল। রবিবার সকালে আপনাদের ওখানে যাচ্ছি। “বিকালবেলায় বিকায় হেলায় সহিয়া নীরব ব্যথা।” রাত্রি বারোটা পঞ্চাশে মহাষ্টমী পড়েছে। “চাঁদমুখের মধুহাসে তিলেকে জুড়াই।”
(খ) ব্যাপ্তিমূলক : দীর্ঘ সময় ব্যাপিয়া ক্রিয়াটি অনুষ্ঠিত হইলে ব্যাপ্তিমূলক কালাধিকরণ হয়। “পৌষে প্রবল শীত।” শীতকালে দিন ছোটো। “পথে অবিরল ছিটাইয়া জল বর্ষায় গাঁথ মালিকা।” “দিবসে সে ধন হারায়েছি, পেয়েছি আঁধার রাতে।”
(৩) বিষয়াধিকরণ : কোনো বিষয়ে বা ব্যাপারে ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হইলে বিষয়াধিকরণ হয়। ন্যায়শাস্ত্রে তিনি পারঙ্গম। বুদ্ধিতে বৃহস্পতি, রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। বরুণ লেখাপড়ায় যেমন, গানবাজনায় আর খেলাধুলাতেও তেমনি। “তেজে বজ্র তুমি রাজা, স্নেহে তুমি জলদ সজল।” “ক্ষমায় সুন্দর, ঔদার্যে বিশাল, স্নেহে বিপুল দক্ষিণ।” সে পাশায় পোক্ত ও লাঠিতে ওস্তাদ। “ধনপতির স্বজাতীয়েরা কুৎসায় মুখর, দণ্ডে নির্মম, সন্দেহে তীক্ষ্ণ।”
অধিকরণে বীপ্সা : “মেঘে মেঘে সোনা, ও ভাই, যায় না মানিক গোনা।” (এখানে মেঘে মেঘে = প্রতি মেঘে)। “কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি!” “জাগায়েছ অঙ্গে অঙ্গে অপরূপ অপূর্ব পুলক।” “চরকার ঘর্ঘর পড়শীর ঘর ঘর।” “মন্দিরে মন্দিরে শাঁখ মা বলিয়া দেয় ডাক।” “এই বাংলার তৃণে তৃণে ফুল, ফুলে ফুলে মধুমতী।” “পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি।” “দেশে দেশে মোর দেশ আছে, আমি সেই দেশ লব যুঝিয়া।”
অধিকরণে এ (য়), কে, তে (এতে) প্রভৃতি বিভক্তিচিহ্ন ও দিয়ে, করে ইত্যাদি অনুসর্গ যুক্ত হয়। কয়েকটি উদাহরণ দেখ : “কুসুমেতে গন্ধ তুমি, আঁধারেতে আলো।” “হাম কুলবালা, বিপথে পড়ল যৈছে মালতী মালা।” “চিরদিনে মাধব মন্দিরে মোর।” “নীরবিন্দু দূর্বাদলে নিত্য কি রে ঝলমলে?” ঠাকুরের পায়ের ধুলো মাথায় করে নে, বাবা। ময়দা ঠোঙায় নিয়ো না, ব্যাগে করে নিয়ো। রাস্তা দিয়ে (রাস্তায়) যখন যাবে হুঁশিয়ার হয়ে যাবে। “হে মোর চিত্ত, পুণ্য তীর্থে জাগো রে ধীরে।” “এ কেবল দিনে রাত্রে জল ঢেলে ফুটা পাত্রে বৃথা চেষ্টা তৃষ্ণা মিটাবারে।” “অবশেষে দিবসান্তে নগরের এক প্রান্তে নদীকূলে সন্ধ্যাস্নান সারি।” “বিমলাতে দাসীর লক্ষণ কিছুই ছিল না।” “বুদ্ধির ভুলে এই অপরাধ আজিকে জননী ক্ষমিতে হবে।” “আজিকে যতেক বনস্পতির ভাগ্য দেখি যে মন্দ।” “ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।” “রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে কেন আছিস ওরে?” “রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে, ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে।” “প্রাণ-প্রবাহিণী বইছে তাদের শিরায়।” “শেষ জোয়েতে রুইব বলে বেরিয়েছিলাম আজ।” “নীল আকাশের অসীম ছায়ে ছড়িয়ে গেল চাঁদের আলো।” “তব পদতলে বসিয়া বিরলে শিখিব তোমার শিক্ষা।” “ওই আকাশে বাতাসে দোলা লাগল, জীবনে জোয়ার বুঝি জাগল।” “তোমার কাছে থেকে (‘থেকে’ চলিত অসমাপিকা ক্রিয়া) তোমার সেবা করব।” “স্তূপপদমূলে নিবিল চকিতে শেষ আরতির শিখা।” “বৃন্দাবনে রসিক ময়রা দোকান পেতেছে।” “আমি ধন্য, সে মোর অঙ্গনে যে কত প্রদীপ জ্বালল!” বৃষ্টিধারায় আগুন থাকে, জানতে কি?
একসঙ্গে একই জাতীয় একাধিক অধিকরণের উল্লেখ থাকিলে শেষেরটিতেই বিভক্তি যুক্ত হয়। “রাধার নাম মহাভারত, হরিবংশ, ব্রহ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও ভাগবতে নেই।”—হীরেন্দ্র দত্ত।
অধিকরণে শূন্যবিভক্তি : অনেকেই তখন রোজ আমাদের বাড়ি আসতেন। এ শনিবার দেশে যাচ্ছ নাকি? মহাশয়ের নিবাস কি বালিচক? এ বছর ফসল কেমন ফলল? “রেড-সি পার হয়ে জাহাজ সুয়েজ পৌঁছল।” “কেহ-বা সারারাত্রি ঘোর নিদ্রায় অভিভূত।” “বাটী (বাটীতে অর্থে) বসিয়াও সেইরূপ হইতে পারে।”
অধিকরণকারক চিনিবার উপায়টি হইল—ক্রিয়াটিকে কোথায়, কখন, কোন্ বিষয়ে, কিসে প্রভৃতি প্রশ্ন করিয়া যে উত্তর পাইবে, তাহাই অধিকরণকারক।
একাধিক কারকে একই বিভক্তিচিহ্ন
এতক্ষণ কারকের আলোচনায় লক্ষ্য করিয়াছ যে, কোনো কোনো বিভক্তিচিহ্ন একাধিক কারকে ব্যবহৃত হইতেছে। এই ধরনের বিভক্তিকে তির্যক্ বিভক্তি বলা হয়।
৯৭। তির্যক বিভক্তি : যে বিভক্তিচিহ্ন একাধিক কারকে প্রযুক্ত হয় তাহাকে তির্যক বিভক্তি বলে। যেমন–এ (য়, য়ে), কে, তে (এতে), রে বা এরে (কেবল কবিতায়), র (এর), শূন্যবিভক্তি (অ)। বিভিন্ন কারকে এইসমস্ত বিভক্তিচিহ্নের প্রয়োগ সাজাইয়া দেওয়া হইল।—
এ, য়, য়ে : (১) কর্তৃকারক—”সব দেবে মেলি সভা পাতিল আকাশে।” “পিতৃভক্তি কি আমায় আপনার কাছে শিখতে হবে!” “মায়ে ঝিয়ে করব ঝগড়া, জামাই বলে মানব না।” (২) কর্মকারক—”দুঃখে যেন করিতে পারি জয়।” তোমায় অনেকক্ষণ খুঁজছি। মায়ে পুছে পুত সংশয়-ভূত দুরিতে। (৩) করণকারক—”আর তো কিছু নেই কো পুঁজি, গঙ্গাজলে গঙ্গা পূজি।” টাকায় কি মনুষ্যত্ব কেনা যায়? “পুণ্যতীর্থোদকে স্নান করিয়ে দিলেন।” ( 4) সম্প্রদানকারক—বিহঙ্গের কলকণ্ঠে কে দিল অমিয়! “ আমায় কিছু দাও গো’ বলে বাড়িয়ে দিলে হাত।” (৫) অপাদান–”মুগ্ধ কমলাকান্তচরণে জাহ্নবী জনম পান।” “কেন বঞ্চিত হব চরণে?” হিন্দু-মুসলমান একই ঠোঙ্গায় খাচ্ছে। “নয়নে ঘুম নিল কেড়ে।” (৬) অধিকরণ—ব্যথিত কিশোরীহৃদে চিরন্তনী রাধা কাঁদে। পাতায় পাতায় রোদের নাচন। “বিপদে কে একান্ত নির্ভীক?”
কে : (১) কর্তৃকারক—পিতামাতার কাছে সব ছেলেমেয়েকেই নত হতে হয়। (২) কর্মকারক—মাকে আর দেশের মাটিকে ভালোবাসতে শেখো। (৩) করণকারক—এতটুকু ছেলেকে দিয়ে এমন ভারী কাজ করায়? (৪) সম্প্রদান—দুর্দিনেও কুন্তী প্রার্থীকে দুমুঠো দিতেন। (৫) অপাদান—মাতৃমন্ত্রীর আবার বিপদকে ভয়? (৬) অধিকরণ—”ওগো পবনে গগনে সাগরে আজিকে কী কল্লোল!”
তে (এতে) : (১) কর্তৃকারক—”বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে!” মানুষেতে এত দুঃখ কি সইতে পারে, বাবা? (২) কর্মকারক—ট্রেজারিতে সেলামি দেবেন উনি? (৩) করণকারক—এমন ধারপড়া বঁটিতে এতবড়ো মাছ কি কোটা যায়? (৪) সম্প্রদান—শরৎ-সমিতিতে কিছু তো দিতেই হবে। (৫) অপাদান—”হাসিতে তার মুক্তো ঝরে, কান্নায় ঝরে মানিক।” (৬) অধিকরণ—“বাঁশেতে ঘুণ ধরে, সখি, বাঁশিতে ঘুণ ধরে না।”
রে (এরে) : (১) কর্তৃকারক—প্রভুরে আজিকে আসিতে হইবে দীনার কুটিরে (আসিবার কর্তা প্রভু, কবিতা বলিয়া রে বিভক্তি, নচেৎ কে বিভক্তি হইত)। (২) কর্মকারক—“দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।” (৩) সম্প্রদান–”দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই প্রিয়জনে। “
শূন্যবিভক্তি : (১) কর্তৃকারক—”বাঙালীর ছেলে ব্যাঘ্রে-বৃষভে ঘটাবে সমন্বয়।” (২) কর্মকারক—”গঙ্গার জলে প্রয়াগে কুম্ভ ভরি সাধু চলেছেন দক্ষিণাপথে।” (৩) করণ—ছেলেরা আশ মিটিয়ে ফুটবল খেলুক। (৪) সম্প্রদান—অক্ষয়বাবু মাতৃশ্রাদ্ধে হাজারখানেক কাঙালী (কাঙালীকে) বিদায় করলেন। (৫) অপাদান—”কে কোথা (হইতে অনুসর্গের লোপ) দেখিবে, ঘটিবে তাহলে বিষম বিপপাত।” (৬) অধিকরণ—মিত্তিরমশায় বাড়ি (বাড়িতে অর্থে) আছেন কি?
॥ একাধিক কারকে একই অনুসর্গের প্রয়োগ ॥
দ্বারা (সাধু চলিত দুই রীতিতেই) : (১) কর্তৃকারক—তাঁর দ্বারা এ কাজ হতে পারে না। (২) করণ—কেবল চক্ষুদ্বারা দেখা নয়, চৈতন্যদ্বারা দেখতে হবে।
দিয়া (চলিতে দিয়ে) : (১) করণ—দড়িটা দাঁত দিয়ে না ছিঁড়ে ব্লেড দিযে কেটে নাও। (২) অপাদান—চোখ দিয়ে ঝরে জল জননীর অবিরল। (৩) অধিকরণ—রাস্তা দিয়ে যখন যাবে চোখ-কান সজাগ রেখে যাবে।
করিয়া (চলিতে করে) : (১) করণ–ডোঙা করে শেষে নদী পার হলাম। (২) অধিকরণ-দেবতার দান মাথায় করিয়া রাখ।
হইতে (চলিতে হতে) : (১) করণ—এই পুত্র হতে তব বৃদ্ধি পাবে বংশের গৌরব। (২) অপাদান—স্বর্গ হতে এক টুকরো আলো শচীমায়ের কোলে নেমে এল।
আশা করি, এতক্ষণে বুঝিতে পারিয়াছ যে, অর্থ বুঝিয়া কারকনির্ণয় করিতে হয়। বিভক্তিচিহ্ন বা অনুসর্গ তো দেখামাত্র চিনিতে পারিবে। এখন সম্বন্ধপদ ও সম্বোধনপদের আলোচনা।
সম্বন্ধপদ
“মাতার কণ্ঠে শেফালিমাল্য গন্ধে ভরিছে অবনী।” “আমি তব গুণপনা হেরি চুপে চুপে।” “গাঙ্গুড়ের নীরে ভাসাইয়া ভেলা চলে অসহায়া।” “তুমি যেন অমরার পুঞ্জীভূত দূর্বা আর ধান।” “আমি মানুষের দুঃখের সমানবয়সী।” উদাহরণগুলিতে আয়তাক্ষর বিশেষ্য বা সর্বনামপদের সহিত ঠিক পরবর্তী বিশেষ্য পদটির একটি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রহিয়াছে। কাহার কণ্ঠে?—মাতার। কাহার গুণপনা?—তব। কাহার নীরে?—গাঙ্গুড়ের। কোথাকার দূর্বা আর ধান?—অমরার এই মাতার, তব, গাঙ্গুড়ের, অমরার ও মানুষের—পদগুলি সম্বন্ধপদ।
৯৮। সম্বন্ধপদ : পরবর্তী বিশেষ্যের সহিত কোনো সম্বন্ধ থাকিলে ‘র’ বা ‘এর’ বিভক্তিযুক্ত পূর্ববর্তী বিশেষ্য বা সর্বনামকে সম্বন্ধপদ বলা হয়। সম্বন্ধপদের বিভক্তিচিহ্ন কখনই লোপ পায় না।
ইংরেজীতে Possessive Case কারকের অন্তর্ভূত। কিন্তু বাংলায় সম্বন্ধপদ কারকপদবাচ্য নয়। কারণ, ক্রিয়ার সহিত ইহার কোনো সম্বন্ধ নাই। সম্বন্ধপদ হইতেছে একটি নামপদের সঙ্গে আরেকটি নামপদের বিশেষ সম্বন্ধ। বাংলায় প্রচলিত নানাপ্রকার সম্বন্ধপদের মধ্যে বিশেষ কয়েকটির উল্লেখ করিতেছি—
(ক) কারক-সম্বন্ধ : কারক ছয়টি বলিয়া কারক-সম্বন্ধও ছয় প্রকার :—
(১) কর্তৃ-সম্বন্ধ : “এ কাজীর বিচার, আমার আজ্ঞা নয়।” (বিচারের কর্তা কাজী র বিভক্তিযুক্ত হইয়াছে) অন্ধকারে কার না ভয় করে? (কে স্থলে কার : অন্ধকারে—কর্মে এ) এমন ভায়ের প্রীতি, মায়ের স্নেহ আর কোথায় পাব? সেইরূপ—শিক্ষকের উপদেশ, মুখ্যমন্ত্রীর অভিভাষণ, ধনীর দান, নেতার পরিচালনা, গোরুর ডাক।
(২) কর্ম-সম্বন্ধ : নিয়ত সজাগ মন নিয়ে ভাই আর্তের (আর্তকে) সেবা করিও। “আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে চাঁদের লোভে লোভে।” সেইরূপ—শাস্ত্রের আলোচনা, অতিথির আপ্যায়ন, বিদ্যার চর্চা, দেবতার বিদায়, বিজয়ীর অভ্যর্থনা, গুণীর অভিনন্দন, ঈশ্বরের উপাসনা, চোরের শাস্তি, পরের নিন্দা, নিজের প্রশংসা।
(৩) করণ-সম্বন্ধ : এক কলমের (কলম দিয়া) আঁচড়েই তার চাকরি খতম। রুলের গুঁতোয় কত গুণ্ডা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। সেইরূপ—দাঁতের কামড়, চোখের ইশারা, চোখের দেখা, তুলির টান, তর্জনীর ইঙ্গিত, হাতের কাজ, খাঁড়ার ঘা, তাসের খেলা।
(৪) সম্প্রদান-সম্বন্ধ : “দেবতার (দেবতাকে নিবেদিত) ধন কে যায় ফিরায়ে লয়ে?” ভিখারীর (ভিখারীদের দিবার) চাল সদর-ঘরে নিয়ে যাও। ঠাকুরের (ঠাকুরকে নিবেদন করিবার) নৈবেদ্য কি এখনো সাজানো হয়নি? সেইরূপ—গুরুর প্রণামী, পুরোহিতের দক্ষিণা।
(৫) অপাদান-সম্বন্ধ : মায়ের চোখের (চোখ হইতে পড়া) জল ছেলের পক্ষে অকল্যাণকর। যেখানে বাঘের (বাঘ হইতে) ভয়, সেখানেই সন্ধে হয়। সেইরূপ—বাবার ভয়, মুখের কথা, ঘরের বাইরে, লেখার বিরাম, বাজারের জিনিস।
(৬) অধিকরণ-সম্বন্ধ : “সংকোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।” “চিনতে যদি না পারিস মা, চিনবি গলার ফাঁসি।”—পীতাম্বর দাস। নেতাজীর ডাকে দেশের (দেশে বসবাসকারী) প্রতিটি লোক সাড়া দিল। বনের (বনে বিচরণকারী) হরিণ মাঝে মাঝে লোকালয়েও আসে। এখানকার মেয়েরাই সেই ভার নেবে। সেইরূপ—মধ্যাহ্নের আহার, রাত্রির নিদ্রা, খাঁচার পাখি, জলের মাছ, গাঁয়ের লোক, স্বর্গের দেবতা, নরকের কীট, মুখের (মুখে ফুটিয়া উঠা) হাসি, পুকুরের পাড় (সামীপ্য), সমুদ্রের তীর, ইংরেজীর এম-এ।
(খ) অভেদ-সম্বন্ধ : দুঃখের সাগর কেমন করে পার হব! “টলমল সারা বাড়ী প্রেমের তরঙ্গে।” কে তারে সহসা মর্মে মর্মে আঘাতিল বিদ্যুতের কশা।” “মানুষের নারায়ণে তবুও কর না নমস্কার।” “এর কথা ঢাকা পড়ে থাকবেই কালো রাত্রির খামে।” “রামধনুর বিচিত্র রঙ খেলা করছে তার মুখের আকাশে।” “মুক্তকেশের পুঞ্জমেঘে লুকায় অশনি।” “অহংকারের খোলসটারে টান মেরে দে ফেলে।” পথের দু-ধারে ফুটেছে আলোর ফুল। “চূড়ায় শশধরের মুকুট।” “ক্ষেপা তুই জড়িয়ে গেলি ভুলের জালে।” “পাখি তুই ঠিক বসে থাক রামকৃষ্ণনামের মাস্তুলে।” সেইরূপ-পাথরনুড়ির কাঁকনচুড়ি, বিভূতির আচ্ছাদন, আলোর বন্যা, বিদ্যার সাগর, স্নেহের ডোর, বিলাসের ফাঁস, দুর্নীতির চোরাবালি, পরাধীনতার শৃঙ্খল, আগুনের পরশমণি, অভিজ্ঞতার নিকষ, কথার তুবড়ি, ঘুষের ঘুণ, চিন্তার ঢেউ, জ্ঞানের আলো, শোকের সিন্ধু, মেঘের মাদল।
(গ) বিশেষণ-সম্বন্ধ : এমন গুণের (গুণবান্) দেবর আর কোথা পাব? এ তো অতি আনন্দের (আনন্দজনক) কথা। এত পরিশ্রমের (পরিশ্রমসাপেক্ষ)) কাজ তাঁর ধাতে এ বয়সে সইবে কি? “দেয় ডুব টুপটুপ ঘোমটার (ঘোমটাঢাকা) বউটি।” সামনের (সম্মুখবর্তী) সোমবার আসছি। সেইরূপ—আইনের (আইনসম্মত) জটিলতা, কাজের (কাজকর্মে দক্ষ) লোক, দুধের বাছা, রূপের মেয়ে, স্বপ্নের ভারত, সুখের হাসি, দুঃস্বপ্নের রাত্রি, নিন্দার ব্যাপার, লজ্জার বিষয়, রসের কথা, দুঃখের সংসার, শান্তির নীড়, মনের মানুষ, সম্মানের উচ্চাসন, “সহানুভূতির চিঠি”, আভিজাত্যের ঝাঁজ, বিলাসের জীবন, গৌরবের কথা, সন্দেহের বিষয়।
(ঘ) উপাদান-সম্বন্ধ (একমাত্র বা প্রধান উপাদান অর্থে) : ছানার (ছানা দিয়া তৈয়ারী) পায়স আর চাউলের পায়সে অনেক তফাত। ফুলশয্যার তত্ত্বে ক্ষীরের ময়ূর আর সন্দেশের প্রজাপতি পাঠানো হল। সেইরূপ—আলুবোখরার চাটনি, বেলের মোরব্বা, সোনার আংটি, হীরের দুল, লৌহের শৃঙ্খল, পশমের শাল, চিনেমাটির বাসন, পিতলের ঘড়া, বেতের চেআর, খড়ের ল্যাজ, সিল্কের শাড়ি।
(ঙ) সামান্য-সম্বন্ধ (সাধারণ সম্বন্ধ) : অরুণার শাশুড়ী কি সিউড়ীতেই থাকেন? সেইরূপ—ইভার কাকা, আমার ভাই, রমার বাবা, প্রফুল্লর পিসেমশায়, জয়ার খুড়শ্বশুর, “সই-এর বউ-এর বকুলফুলের বোন-পো-বউ-এর বোনজামাই”।
(চ) অধিকার-সম্বন্ধ : “চাঁদের রাজ্য সুনীল আকাশ, ফুলের রাজ্য বন। মায়ের কোলটি খোকার রাজ্য, রাজা খোকন-ধন।” সেইরূপ–তোমার শাড়ি, কৃপণের ধন, আমার দেশ, খুকুর খেলনা, মামার জামা, বাপের বাড়ি, পাঞ্জাবীর দোকান, ইংরেজের কুঠি।
(ছ) জন্যজনক-সম্বন্ধ (যিনি জন্ম দেন তিনি জনক, যিনি জন্মলাভ করেন তিনি জন্য, তাই সম্বন্ধটি জন্যজনক) : পিতার পুত্র, মায়ের ছেলে, গাছের ফল (গাছ ফল ফলায় তাই সে জনক, ফল জন্মলাভ করে তাই, সে জন্য), ক্ষেতের ফসল, জমির ধান, হাঁসের ডিম, শঙ্খের নিনাদ।
(জ) নির্ধার-সম্বন্ধ (অনেকের মধ্যে বাছিয়া লওয়া অর্থে) : সবার সেরা, দলের পাণ্ডা, পালের গোদা, ক্লাসের ওঁছা, নাটের গুরু।
(ঝ) যোগ্যতা-সম্বন্ধ : একেই বলে বাপের বেটা। সেইরূপ-মনের মানুষ, কাজের কাজী, সেপাই-এর ঘোড়া।
(ঞ) হেতু-সম্বন্ধ : টাকার গরম, বিদ্যার অহংকার, পাণ্ডিত্যের অভিমান, পয়সার দেমাক, পদের আভিজাত্য, রূপের গর্ব।
(ট) নিমিত্ত-সম্বন্ধ : খেলার মাঠ, খাবার জল, বলির পাঁঠা, জপের মালা, মুড়ির চাল, রান্নার জোগাড়, চিঠির কাগজ
(ঠ) উদ্দেশ্য-সম্বন্ধ : এসব বিক্রির বহু নয়, সৌজন্যসংখ্যা। একটু বেঁকেই পাবেন দিল্লির রাস্তা। মহাজনের টাকায় হাত দেবেন না। সেইরূপ—চলার পথ, বলার কথা।
(ড) নিবারণ-সম্বন্ধ : রোগের ওষুধ, তৃষ্ণার পানীয়, পাপের প্রায়শ্চিত্ত।
(ঢ) প্রকৃতি-বিকৃতি-সম্বন্ধ : ছানাব দুধ, খাটের কাঠ, চুড়িব সোনা, জামাৰ কাপড়।
(ণ) কার্যকারণ-সম্বন্ধ : সূর্যের তাপ, মেঘের ছায়া, বিদ্যুতের আলো।
(ত) উপযোগিতা-সম্বন্ধ : যাইবার বেলা, খাবার সময়।
(থ) অঙ্গি-অঙ্গ-সম্বন্ধ : (যাহার অঙ্গ আছে, সে অঙ্গী, অঙ্গীটি প্রথমেই) : শাড়ির পাড়, মন্দিরের দরজা, হাতের আঙ্গুল, পায়ের পাতা, বাঘের ছাল, পর্বতের চূড়া, রবির মাথা, দরজার শিকল
(দ) ব্যাপ্তি-সম্বন্ধ : গ্রীষ্মের ছুটি, দু-দিনের পথ, ছ-মাসের ঝোল, বছরের খোরাক, যুগের সমস্যা।
(ধ) গুণধর্মাদি-সম্বন্ধ : তুলার কোমলতা, প্রাণের সজীবতা, বরফের শীতলতা, তুষারের শুভ্রতা, বিদ্যুতের ক্ষিপ্রতা, আবহাওয়ার আর্দ্রতা, সর্পের ক্রুরতা, শয়তানের খলতা, সুরের মাধুর্য, আলোর তীব্রতা।
(ন) উপলক্ষ-সম্বন্ধ : শনিবারের ছুটি, পূজার অবকাশ, অমাবস্যার উপবাস, রথের মেলা।
(প) ক্রম-সম্বন্ধ : ছয়ের পাতা, নয়ের অধ্যায়, পনরর পরিচ্ছেদ, তেতলার ঘর, বারো নম্বরের বৈঠকখানা।
(ফ) দক্ষতা-সম্বন্ধ : পরিবেশনের চাঁই, ঘটকালির ওস্তাদ, ঝগড়ার ঝানু, গানবাজনার শিরোমণি।
(ব) আধার-আধেয়-সম্বন্ধ [ আধার (পাত্রটি) আগে, আধেয় (জিনিসটি) পরে বসে ] : টিনের দুধ, খামের চিঠি, ঘড়ার জল, বোতলের তেল, শিশির ওষুধ।
(ভ) আধেয়-আধার-সম্বন্ধ [ আধেয় (জিনিসটি) পূর্বে, আধার (পাত্রটি) পরে বসে ] : জলের বালতি, লেবুর ঝুড়ি, সাবানের বাক্স।
(ম) অবলম্বন-সম্বন্ধ : অন্ধের ষষ্টি, দীনের সহায়, ক্ষীণের শরণ, নিরাশ্রয়েব আশ্রয়, দুর্বলের বল, ভবের কাণ্ডারী।
(য) বাহ্যবাহন-সম্বন্ধ : গমের জাহাজ, চিনির বলদ, তীর্থযাত্রীর বাস, বালির লরি, জলের গাড়ি, সাজিমাটির নৌকা।
(র) ব্যবসায়-সম্বন্ধ : পাটের দালাল, আদার ব্যাপারী, সোনার বেনে, মাছের আড়তদার, লোহার কারবারী।
(ল) অসম্ভব-সম্বন্ধ : ঘোড়ার ডিম, সাপের পাঁচ পা, সোনার পাথরবাটি, বেঙের সর্দি, কাঁঠালের আমসত্ত্ব, বাঁঝার ছেলে।
(শ) কৃতিকারক-সম্বন্ধ : বঙ্কিমচন্দ্রের রসরচনা, রবীন্দ্রনাথের কাব্য, শরৎচন্দ্রের উপন্যাস, আচার্য নন্দলালের ছবি, আচার্য রায়ের আবিষ্কার।
(ষ) উৎপাদক-সম্বন্ধ : সুবোধের চা, বিলাতের জিনিস, জাপানের শিল্প, দুলালের দই, গাঙ্গুরামের চমচম, ভীমনাগের সন্দেশ।
(স) ভোগ্য-সম্বন্ধ : শ্যামলের চা, রামবাবুর ডিশ (চা এবং ডিশের জিনিসগুলি যথাক্রমে শ্যামলের ও রামবাবুর উপভোগ্য)।
(হ) বীপ্সা-সম্বন্ধ : এ রোগ আমার সঙ্গের সাথী। এমন ব্যথার ব্যথী, সুখী, দুখের দুখী মিলবে কোথা বল্?
॥ সম্বন্ধপদে বিভক্তি ॥
সম্বন্ধপদে র বা এর দুইটি বিভক্তিচিহ্নেরই সমান প্রাধান্য। আমাদের প্রদত্ত উদাহরণগুলি সেই কথাই বলে। সাধারণতঃ স্বরান্ত শব্দে র এবং ব্যঞ্জনান্ত শব্দে এর চিহ্ন যুক্ত হয়। আবার, যে-সমস্ত শব্দের অন্ত্য অ অনুচ্চারিত সেইগুলিতে এর যুক্ত হয়। তবে শব্দটি সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্য হইলে (চলিত ভাষায়) বিকল্পে র চিহ্নও যুক্ত হয়। কিংবা সংজ্ঞাবাচক বিশেষ্যের শেষে যদি অ-কারযুক্ত যুক্তব্যঞ্জন থাকে, তাহার সম্বন্ধ বুঝাইতে বিকল্পে র বিভক্তিচিহ্নও যুক্ত হয়। যথা—অমিতের বা অমিতর, প্রফুল্লের বা প্রফুল্লর, দত্তের বা দত্তর, মৈত্রের বা মৈত্রর ইত্যাদি।
কার (চলিতে কের) বিভক্তিচিহ্ন : কাল, স্থান ও সমষ্টিবাচক কতকগুলি শব্দের উত্তর এই বিভক্তিচিহ্নের প্রয়োগ হয়। কখনও কখনও মূল শব্দে এ বিভক্তিচিহ্নের প্রয়োগ হইয়া পরে কার (বা কের) যুক্ত হয়। (১) কালবাচক শব্দে : তখনকার, এবেলাকার, আগেকার, যখনকার, অদ্যকার, আজিকার (আজকের), সেদিনকার, কালকেকার, আজকালকার, ছেলেবেলাকার ইত্যাদি। (২) স্থানবাচক শব্দে : এদিক্কার, কোথাকার, মাঝখানকার, এখানকার, ওখানকার, ভিতরকার, বাইরেকার, উপরকার, নীচেকার ইত্যাদি। (৩) সমষ্টিবাচক শব্দে : সকলকার, সরাকার, সব্বাইকার, পাঁচজনকার, দোঁহাকার, আপনকার।
প্রয়োগ : “চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা।” “আমা সবাকার পুণ্য জন্মভূমি এই।” “আপনকার আর অধিকদূর সঙ্গে আসিবার প্রয়োজন নাই।” ভিতরকার খবর বাইরেকার লোক পায় কী করে? রোগীর অবস্থা পূর্বেকার চেয়ে ভালো। এঁদের উপরকার ঘরে নিয়ে যাও। যখনকার কথা বলছি, তখনকার দিনে মানুষ অত্যন্ত অতিথি-বৎসল ছিল, আজকালকার মতো আত্মকেন্দ্ৰিক স্বার্থসর্বস্ব হয়ে ওঠেনি। “আজিকার কোনো ফুল, বিহঙ্গের কোনো গান”।
খাঁটী বাংলায় সম্বন্ধপদের প্রয়োগ খুব ব্যাপক। বিশিষ্টার্থক শব্দগুচ্ছ-গঠনে ইহার অবদান কম নয়। আমড়াকাঠের ঢেঁকি, কলুর বলদ, গোকুলের ষাঁড়, পিতলের কাটারি, ডুমুরের ফুল, চাঁদের হাট, ডানহাতের ব্যাপার, হাতের পাঁচ, হরি ঘোষের গোয়াল, পালের গোদা, নারদের নিমন্ত্রণ, মগের মুলুক, মিছরির ছুরি, ভিক্ষার চাল, দয়ার শরীর ইত্যাদি। সমাসবদ্ধ পদকে বিচ্ছিন্ন করিয়া পূর্বপদটিতে র বা এর বিভক্তিচিহ্ন-প্রয়োগে অনেকক্ষেত্রে ভাষার সরলতাও সম্পাদন করা হয়।—স্বর্ণবণিক্—সোনার বেনে; সর্বশ্রেষ্ঠ—সবার সেরা; বিদ্যুল্লিখন—বিদ্যুতের লেখা।
সম্বন্ধপদে টি বা টা নির্দেশকযোগে পরবর্তী বিশেষ্যপদটি লোপ পায়। সবাকার বই-ই তো রয়েছে, আমারটা গেল কোথা? (আমারটা = আমার বইটা)।
সম্বোধনপদ
“মা, আমায় মানুষ কর।” ওরে ভজা, দেখে যা। “ভাগিনা, এ কী কথা শুনি!” “না সখি! ভীত হইও না।” “হে অতীত, তুমি হৃদয়ে আমার কথা কও, কথা কও।”
সম্বোধন কথাটির অর্থ হইতেছে বিশেষভাবে ডাকা। প্রথম বাক্যে মাকে ডাকা হইতেছে; তাই মা পদটি সম্বোধনপদ। কিন্তু এই ‘মা’ পদটির সঙ্গে বাক্যের অন্য কোনো পদের কোনো সম্পর্ক নাই। বাক্যটির উদ্দেশ্য (কর্তৃকারক) তুমি ঊহ্য আছে। দ্বিতীয় বাক্যে ভজাকে ডাকা হইতেছে বলিয়া ওরে ভজা সম্বোধনপদ। এখানেও বাক্যটির কর্তা তুই ঊহ্য। তৃতীয় ও চতুর্থ বাক্যে যথাক্রমে ভাগিনা ও সখি সম্বোধনপদ; কর্তা যথাক্রমে আমি ও তুমি উহ্য। শেষ বাক্যের সম্বোধনপদ হে অতীত; কর্তা তুমি।
৯৯। সম্বোধনপদ : যে পদে কাহাকেও আহ্বান করা বুঝায়, সেই পদকে সম্বোধনপদ বলে।
ইংরেজীতে Vocative Case কারকের অন্তর্গত। বাংলায় কিন্তু সম্বোধনপদকে আমরা সঙ্গতভাবেই কারকের দলে ফেলি না। বাক্যের ক্রিয়াপদের সহিত সম্বোধনের কোনো সম্পর্ক নাই বলিয়া ইহা কারকপদবাচ্য নহে।
সম্বন্ধপদ ও সম্বোধনপদ কারক নয় কেন, ২৩৩ পৃষ্ঠার চিত্রটি দেখিয়া বুঝিয়া লও। আমাদের দেওয়া মা, ভজা, ভাগিনা, অতীত প্রভৃতি সম্বোধনপদে শূন্যবিভক্তি হইয়াছে। সখি সংস্কৃত রীতির সম্বোধন বলিয়া প্রথমা বিভক্তিচিহ্ন রহিয়াছে।
সম্বন্ধ ও সম্বোধনপদ ক্রিয়ার সহিত সম্পর্কহীন বলিয়া কেবল পদ। উভয়ের মধ্যে এইটুকুই সাদৃশ্য। উভয়ের পার্থক্য কিন্তু বিরাট্। (১) পরবর্তী বিশেষ্য বা সর্বনামপদের সঙ্গে পূর্ববর্তী সম্বন্ধপদের একটা সম্পর্ক থাকেই, কিন্তু বাক্যস্থিত কোনো পদের সঙ্গেই সম্বোধনপদের কোনো সম্পর্ক থাকে না। (২) সম্বন্ধপদটি সম্পর্কযুক্ত বিশেষ্য বা সর্বনামের পূর্বে বসে, কিন্তু সম্বোধনপদটি বাক্যের যেকোনো স্থানে বসে। (৩) সম্বন্ধপদে বিভক্তিচিহ্ন কখনই লোপ পায় না, কিন্তু খাঁটী বাংলারীতির সম্বোধনপদে চিরকালই শূন্যবিভক্তি।
সম্বোধনপদটি বাক্যের প্রথমে বসিলে পদটির পরে একটি পাদচ্ছেদ (,) বা বিস্ময়সূচক চিহ্ন ( 1) বসে; বাক্যের শেষে বসিলে পদটির পরে কেবল বিস্ময়সূচক চিহ্ন, বাক্যের অন্যত্র বসিলে পদটির পূর্বে ও পরে একটি করিয়া পাদচ্ছেদ বসাইতে হয়; এরূপ ক্ষেত্রে পদটির পরে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাদচ্ছেদ না বসাইয়া বিস্ময়সূচক চিহ্নও বসানো হয়।
সংস্কৃত রীতির সম্বোধনপদ বাংলায় প্রচুর প্রযুক্ত হয়। “হে মাতঃ বঙ্গ, শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।” “পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।” তৎসম শব্দের সম্বোধনে অ-কারান্ত শব্দ ভিন্ন অন্য স্বরান্ত শব্দের শেষ স্বরবর্ণের পরিবর্তন হয়।—
আ স্থানে এ — শকুন্তলা—শকুন্তলে, বৎসা–বৎসে।
ই স্থানে এ –- হরি—হরে, সখি-সখে।
ঈ স্থানে ই –- নদী—নদি, জননী—জননি।
উ স্থানে ও — গুরু—গুরো, প্রভু–প্রভো।
ঋ স্থানে অঃ – পিতৃ–পিতঃ, মাতৃ—মাতঃ।
বৎ ও মৎ ভাগান্ত শব্দ সম্বোধনে পুংলিঙ্গে যথাক্রমে বন্ ও মন্ এবং স্ত্রীলিঙ্গে যথাক্রমে বতি ও মতি হয়। ভগবন্, শ্রীমন্, ভগবতি, শ্রীমতি ইত্যাদি।
ইন্, বিন্, অন্-ভাগান্ত শব্দ সম্বোধনে অবিকৃত থাকে—গুণিন্, তপস্বিন, রাজন। খাঁটী সংস্কৃত রীতিতে সম্বোধনপদ ব্যবহার করিতে হইলে শব্দটির পূর্বে অধিকাংশ স্থলে সম্বোধনসূচক অব্যয় বসে। (ক) “সন্ন্যাসী কহে করুণ বচনে, ‘অয়ি লাবণ্যপুঞ্জে, …… সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে। “—রবীন্দ্রনাথ। (খ) “ভয় শুধু তোমা-’পরে বিশ্বাসহীনতা, হে রাজন্।”—ঐ। (গ) “অদৃশ্য দু বাহু মেলি টানিছ তাহাকে অহরহ, অয়ি মুগ্ধে, কী বিপুল টানে।”—ঐ। (ঘ) “ভগবন্, গোত্র নাহি জানি।”—ঐ। (ঙ) “হে পিতঃ, কেমনে কবিতারসের সরে …… করি কেলি আমি না শিখালে তুমি?”—মধুকবি। (চ) “অতএব দয়া করি কহ দয়াবতি!”—নবীনচন্দ্র। (ছ) “বৎসে! বেলা হইতেছে, প্রস্থান কর।”—বিদ্যাসাগর। (জ) “অনসূয়ে। প্রিয়ংবদে! তোমরা কি পাগল হইলে?”—ঐ। (ঝ) “বৎস, তোমার এ বেশ কেন?”—দীনেশচন্দ্র। (ঞ) “অয়ি শ্যামাঙ্গিনি, ধনি, অয়ি বর্ষা করুণারূপিণি!” (ট) একবার মুখ তুলে চাও মা জগন্ময়ি! (ঠ) “জগৎপালিনি! জগত্তারিণি! জগজ্জননি! ভারতবর্ষ!”—দ্বিজেন্দ্রলাল। (ড) “দুর্দশা আর দুর্গতিতে, দুর্গে, আজি দুঃখীদলে পাগল হয়ে বেড়ায় তোরি ভবনতলে। তোরে চাই না মোরা সর্বনাশি!”—যতীন্দ্রমোহন বাগচী। (ঢ) “চিরক্রন্দনময়ী গঙ্গে!”—যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত।
কিন্তু এই রীতির শৈথিল্যও যথেষ্ট দৃষ্ট হয়। শব্দকে সেখানে শূন্যবিভক্তিযুক্ত রাখিয়াই সম্বোধন-রূপে প্রয়োগ করা হয়। (ক) “হে রাজা, রেখেছি আনি তোমারি পাদুকাখানি।”—রবীন্দ্রনাথ। (খ) “প্রভু, আমি চণ্ডাল, নাভা আমার নাম।”—ঐ। (গ) “তুমি যদি, দেবী, পলকে কেবল একটি বিন্দু ফেল আঁখিজল!”
ঐ। (ঘ) “তুমি সকল সোহাগ সয়েছিলে, সখী, হাসিমুকুলিত মুখে!”—ঐ। (ঙ) “হে মাটি, হে স্নেহময়ী, অয়ি মৌনমুক, অয়ি স্থির, অয়ি ধ্রুব, অয়ি পুরাতন, সর্ব-উপদ্রবসহা আনন্দভবন শ্যামলকোমলা।”—ঐ। (চ) “ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে দয়াহীন সংসারে।”—ঐ। (ছ) “কবি, তব মনোভূমি রামের জনমস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।” (জ) “খোলো খোলো, হে আকাশ, স্তব্ধ তব নীল যবনিকা।” (ঝ) “মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন।” (ঞ) “হে নিরুপমা, গানে যদি লাগে বিহ্বল তান করিয়ো ক্ষমা।”
ইহা তো একবচনের কথা, বহুবচনে মূল শব্দের সঙ্গে রা, এরা প্রভৃতি বিভক্তি বা গণ বৃন্দ প্রভৃতি বহুবচনাত্মক শব্দ যুক্ত হয়। ইহাই খাঁটী বাংলা রীতি। তবে অ-তৎসম শব্দটির পূর্বে প্রয়োজনমতো ও, ওগো, এই, ওলো, ওহে, ওরে, রে, হাঁরে, হাঁলো ইত্যাদি সম্বোধনসূচক অব্যয়ও মাঝে মাঝে বসানো হয়।—”হুজুর, আগেই বলেছিলুম, ও বেটা জাদু জানে।” “মেজবউ, তোমার তো বুদ্ধিনাশের সময় হয় নাই।” “ওরে, ইতিমধ্যে মামা কি বাগানে আসিয়াছিলেন?” (এখানে অব্যয়পদটি নিজেই সম্বোধনের কাজ করিতেছে) “এখন আয় পাখি! তোতে আমাতে পঞ্চম গাই।” “ও ভাই, এ তো বড়ো কাজটা খারাবি হল।” “আঁধার করে ঘরের আলো সত্য কি তুই চললি উমা।” “মুষ্টি-ভিক্ষা চাই, রানী-মা, মুষ্টি-ভিক্ষা চাই।” “ওমা, তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি।” “তুমিই ঠাকুর, কর মীমাংসা।” “পাঁচ মিনিট না যেতেই ঘুমিয়ে গেলি, নেতিয়ে গেলি ছেঁড়া একটা মাদুরে, ওরে আমার জাদু রে!” “এই যে আমি, ও ভাই নেয়ে, ভিড়াও তরী।” মেয়ের আমার বিদ্যে দেখেছ, ন’দি? ও ভাই মাস্তু, তোর কার্পেটের সূচটা একবারটি দে না ভাই। গরিবকে একটু দয়া করুন, বাবারা! “সোনা আমার, জাদু আমার, মানিক আমার, ঘুমা।” “ওরে চিনি হওয়া ভালো নয় (মন), চিনি খেতে ভালবাসি।”
সম্বোধনপদ মাঝে মাঝে অব্যয়-রূপেও প্রযুক্ত হয়।—(ক) “আমি কহিলাম, ‘আরে রাম রাম, নিবারণ সাথে যাবে। “—রবীন্দ্রনাথ। (খ) “রাধে! স্ত্রীবুদ্ধি কি শাস্ত্রে বলে সাধে!”—ঐ। (গ) “রাধামাধব! সে কি কথা! গামছা পর্যন্ত খদ্দরের কিনেছি।” (ঘ) বাপরে! কী বিরাট্ সাপ রে! (ঙ) মাগো মা! এমন কাজ মানুষে করে!
অ-কারকে বিভক্তি
বাক্যে ব্যবহৃত সকল বিশেষ্য বা বিশেষ্যস্থানীয় পদের সঙ্গেই যে ক্রিয়ার সাক্ষাৎ সম্বন্ধ থাকিবে, এমন নয়। সুতরাং কারক বলা চলে না এমন বিশেষ্য বা সর্বনামপদও বিভক্তিযুক্ত হইয়া বাক্যে স্থান পায়। (কারণ, বিভক্তিহীন শব্দ বাক্যে থাকিতেই পারে না।) এই সমস্ত পদকে অ-কারক বা উপ-কারক পদ বলা হয়। সম্প্রতি আলোচিত সম্বন্ধ ও সম্বোধনপদও এই উপ-কারক পদের পর্যায়ভূত। এইসমস্ত উপ-কারক পদ বিভক্তিচিহ্নযুক্ত হইয়া বাক্যের অশেষ বৈচিত্র্যসম্পাদন করে।
অ-কারকে বিভক্তি বলিলে বিভক্তিচিহ্ন এবং বিভক্তিস্থানীয় অনুসর্গও বুঝিতে হইবে। বিভক্তির মধ্যে এ (য়), তে, এতে, কে, র, এর, শূন্যবিভক্তি এবং অনুসর্গের মধ্যে করিয়া (চলিতে করে), দিয়া (দিয়ে), ধরিয়া (ধরে), বলিয়া (বলে), চাইতে (চেয়ে), হইতে (হতে), থাকিয়া (থেকে), তরে, জন্য, বিনা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।—
(১) এ (য়), তে, এতে :
(i) হেতু অর্থে—”হস্তপ্রভায় কুসুম মলিন হইয়াছে।” গুরুদেব সশিষ্য স্নানে চলেছেন। লজ্জায় আপনার কাছে আসতে পারিনি। জোর বাতাসে ঢেউগুলি ফুলে ফুলে উঠছে। “সদ্যোমৃত অবস্থায় সে যে পিওনাশ-আশঙ্কায় কিছুমাত্র বিচলিত হইবে এমন সম্ভাবনা নাই।” “তবু স্বভাবদোষে সকালবেলায় আলোর দিকে পাখি চায়।” কুয়াশায় চোখে কিছু দেখা যাচ্ছিল না। “দুজনে মুখোমুখি গভীর দুখে দুখী।” আনন্দে তিনি কাঁদিয়া ফেলিলেন। ভয়ে আমার মুখ দিয়ে আর কথা বেরুল না। অভাবে মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়। “তিনি আপনার শিক্ষাগর্বে বঙ্গভাষার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিলেন না।”
(ii) ক্রিয়াসমাপ্তি ও ফলপ্রাপ্তি বুঝাইলে কালবাচক শব্দে—”ছয়দিনে উত্তরিল অশ্ব মনোরথ।” এক রাত্রিতেই বইখানা শেষ? একুশ বছরে তাজমহল গড়া শেষ হয়।
(iii) যে চিহ্ন বা লক্ষণদ্বারা ব্যক্তি বা বস্তুর স্বরূপ চেনা যায়—শিকারী বিড়াল গোঁফেই চেনা যায়। চন্দনতিলকে বুঝলাম তিনি বৈষ্ণব। পৈতাতেই চেনা যাবে উনি ব্রাহ্মণ। খদ্দরেই বুঝবেন তিনি কংগ্রেসী।
(iv) শরীরের কোনো অঙ্গের বিকার বুঝাইলে সেই অঙ্গবাচক শব্দে—কানে খাটো, চোখে কানা, পায়ে খোঁড়া—এমন খুনীকে খুঁজে বার করা তেমন কিছু শক্ত নয়। (লক্ষণ ও অঙ্গবিকারের পার্থক্য : লক্ষণ নেহাত সাময়িক, তাই সহজে পরিত্যাজ্য, কিন্তু অঙ্গবিকার স্থায়ী, তাই প্রতিবিধানের অতীত।)
(v) জাতি ধর্ম বর্ণ আকৃতি প্রকৃতি পেশা ইত্যাদিবাচক শব্দে—তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ, কিন্তু আচরণে চণ্ডাল। “ধর্মে আমি মুসলমান কিন্তু জাতিতে তো বাঙালী।” ধর্মে খ্রীষ্টান আর আচার-ব্যবহারে ইউরোপীয় হওয়া সত্ত্বেও শ্রীমধুসূদন প্রকৃতিতে ছিলেন খাঁটী বাঙালী। কাপড়ের টুকরোটা বহরে বেশ খাটো। রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী এমন মেয়ে বড়ো-একটা দেখা যায় না।
(vi) প্রতিযোগিতা বা সহযোগিতা বুঝাইলে—ছেলেটাকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি চলেছে। “রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়।” মায়েতে মেয়েতে এখনও ঝগড়া চলেছে। এদের দুটি ভাইয়ে বেশ ভাব। “তোমায় আমায় মিলন হবে বলে।” “পণ্ডিতে পণ্ডিতে তৰ্ক মুখে নাহি বুঝে।” “ও মন, তোর মতো যে নেইকো তাদের মায়ে-পোয়ে আলাপন।” [ প্রতিযোগী কর্তা বা সহযোগী কর্তার সঙ্গে এই অ-কারকে বিভক্তি-প্রয়োগটির পার্থক্য ভালোভাবে লক্ষ্য কর : সেখানে যমে মানুষে টানাটানি কৰে, তাই কর্তৃকারক, এখানে যমে মানুষে টানাটানি হয়, তাই অ-কারক। ]
(vii) ক্রিয়াবিশেষণে—সাবধানে থাকিস বাবা। “দশ হাজার লোকের বাহবার সামনে কাপুরুষও অক্লেশে প্রাণ দেয়।” “রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে।” “ধীরে, রজনী, ধীরে।” “পুরুষেরা নিঃশব্দে দুর্গানাম জপ করিতে লাগিলেন।” “স্মিতহাস্যে নাহি চল সলজ্জিত বাসরশয্যাতে।” “পুষ্পশর বক্ষে মম হানিল সে মৃদুমন্দ হাসে।”—রুমানিয়ান কবি এমিনেস্কু।
(viii) নিমিত্ত বা প্রয়োজন বুঝাইলে—”আপনারে অপরেরে নিয়োজিতে তব কাজে।” ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়ায় দরকার কী? টাকায় সবারই অল্পবিস্তর প্রয়োজন। রাজগুরু দুর্গদ্বারে এলেন ভিক্ষায়।
(ix) নিবারণার্থে—চাই ক্ষুধায় অন্ন, পিপাসায় পানীয়, রোগে ঔষধ, হতাশায় সান্ত্বনা আর বিপদে ধৈর্য। “কুসুমেতে গন্ধ তুমি, আঁধারে যে আলো।”
(x) সহার্থে—”সুদূর গ্রামখানি আকাশে (সহ শব্দের লোপ, কিন্তু ব্যঞ্জনায় অর্থটি সহজলভ্য) মেশে।” আগে গোরুটাকে খোঁটায় কষে বাঁধি, তারপর।
(xi) যোগ বা সমষ্টি বুঝাইলে—বারো ইঞ্চিতে এক ফুট হয়। অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন নষ্ট। দশচক্রে ভগবান্ পর্যন্ত ভূত হয়ে যান।
(xii) যে অসমাপিকা ক্রিয়াদ্বারা অন্য একটি ক্রিয়া অনুষ্ঠিত হয়, সেই অসমাপিকা ক্রিয়াটি ভাববাচক বিশেষ্যে পরিণত হইলে—”আনন্দময়ীর আগমনে (আগমন হইলে আগমনে) আনন্দে গিয়াছে দেশ ছেয়ে।” “বঙ্কিমসূর্যের আবির্ভাবে (আবির্ভাব ঘটিলে = আবির্ভাবে) বাঙালীর হৃৎপদ্ম বিকশিত হইল।”
(xiii) উদ্দেশ বুঝাইতে—“সাধু চলেছেন দক্ষিণাপথে।”
(২) কে :
(i) উদ্দেশ্য উদ্দেশ প্রয়োজন ইত্যাদি অর্থে—”বেলা যে পড়ে এল জলকে (জল আনিবার উদ্দেশ্যে) চল।” এটি আমার ছাতাকে ছাতা, লাঠিকে লাঠি (ছাতা ও লাঠি দুইটি প্রয়োজনই একসঙ্গে মিটায়)। তোমাকে আমার প্রয়োজন আছেই। এ ব্যাপারে মাকে এখনই চিঠি লিখছি (মায়ের উদ্দেশে)।
(ii) নিমিত্তার্থে—গলিটায় বড্ড অন্ধকার, মন্দ্রিতাকে টর্চটা দেখাও (সাহায্যের নিমিত্ত)। অন্ধকারে তোমাকে একটু দাঁড়াব কি (সাহায্যের জন্য)?
(iii) ধিক্ ধন্যবাদ বিনা ছাড়া ইত্যাদি শব্দযোগে—কেষ্টকে ছাড়া আমার একতিলও চলে না। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। এমন অকৃতজ্ঞ সন্তানকে ধিক্
(৩) র, এর, এদের :
(i) সহার্থক শব্দযোগে—কুকুরটি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গে চলল। “অসতের সহ নয় বসতের বিধি।” “বসত-বিধান সদা সতের সহিত।” “পুষ্পসহ কীট উঠে দেবতার শিরে।” “বসন্তের রানী যবে হাসিয়া বসন্তসহ করে চুপে মধুর আলাপ।” (শেষ দুইটি উদাহরণে কবিতায় ছন্দের খাতিরে বিভক্তিচিহ্নের লোপ।)
(ii) নিবারণার্থে—”শীতের ওড়নী পিয়া গিরীষির বা। বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।” (প্রিয়তম আমার শীত নিবারণের ওড়না, গ্রীষ্ম নিবারণের মলয়বাতাস, বর্ষা নিবারণের ছত্র।)
(iii) উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনার্থে—”বরিষার ছত্র পিয়া দরিয়ার না।” (দরিয়া পার হওয়ার জন্যই নৌকার প্রয়োজন) পুজোর ফুল, ঘোড়ার ঘাস, গোরুর বিচালি সব তো আমাকেই জোগাড় করতে হয়। এ আমাদের বাঁচার (বাঁচিবার উদ্দেশ্যে) লড়াই।
(iv) অনেকের মধ্যে একের উৎকর্ষ বা অপকর্ষ দেখাইতে—কবিদের মধ্যে কালিদাস শ্রেষ্ঠ। নরের মধ্যে নরেন, যেমন পর্বতের মধ্যে হিমালয়। মেয়েদের মধ্যে মাধুরীই যা মেধাবিনী। মহেন্দ্র সবার বড়ো। ভ্যাবলা দলের ওঁছা।
(v) তুল্যার্থক শব্দযোগে—মায়ের মতো হিতৈষিণী আর কে আছে? বিদ্যার তুল্য সম্পদ নেই, বিনয়ের তুল্য গুণ নেই।
(৪) শূন্যবিভক্তি :
(i) ব্যাপ্তি অর্থে পথবাচক বা কালবাচক শব্দে—তিন মাইল পথ এতটুকু ছেলে হাঁটতে পারে? পুজোপলক্ষে বিদ্যালয় পাঁচদিন বন্ধ থাকবে। সারাটা জীবন সংসারের ঘানি টেনেই গেলাম! “মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে …… সারাদিন বাজাইলি বাঁশি।” হিউয়েন সাঙ নালন্দায় পাঁচ বছর অধ্যয়ন করেন।
(ii) ক্রিয়াবিশেষণে—তুমি তো বাঁ হাতে বেশ তাড়াতাড়ি লিখতে পার! এত আস্তে আস্তে চললে ট্রেন পাবেন? “শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে কুটির হতে এস্ত এল তাই।”
(iii) উদ্দেশ—বাবা কাল কাশী যাচ্ছেন। ঝড়বৃষ্টিতেও আমাদের ট্রেন দিল্লি রওনা হল। (তিনি কাশীতে বা দিল্লিতে থাকেন বা আছেন—অধিকরণকারক; কিন্তু কলিকাতা বা পুরী গিয়াছেন, যাইবেন বা গেলেন—উদ্দেশ বুঝাইতে বাংলায় উপ-কারক পদ—সংস্কৃতে কর্মকারক হইলেও।) “যাও যমুনার তীর।”
(iv) সম্বোধনে—”নিন্দ বিধাতায় তুমি নিন্দ, বিধুমুখী।” “সকলে বলিল, “ভ্যালা রে নন্দ বেঁচে থাক্ চিরকাল।’ “ “ঠাঁই দিয়েছি অন্তরে আমার, প্রভু, ডাকতে কেন হবে বারে বার!”
(v) ওজন ও গণনায় কম বুঝাইতে—মাছটা পঞ্চাশ গ্রাম কম এক কেজি। লেবু দুটো কম একশ হয়েছে।
(৫) অনুসর্গ :
(ii) অপেক্ষার্থে বা তারতম্য (উৎকর্ষ) বুঝাইতে—জননী ও জন্মভূমি স্বর্গ হইতেও গরীয়সী। মোহন থেকে শোভন বেশী বুদ্ধিমান্। প্রাচীন ভারতে বিত্তবান্ থেকে চিত্তবানের কদর বেশী ছিল। তোমার দেখছি এখন খাওয়া থেকে শোয়ার দরকারটাই বড়ো। ধনের চেয়ে প্রাণ বড়ো. প্রাণের চেয়ে মান। “কোন্ দেশেতে তরুলতা সকল দেশের চাইতে শ্যামল।” (চেয়ে চাইতে থেকে প্রভৃতি অনুসর্গের পূর্ববর্তী উপ-কারকে র, এর যোগ হয়।
(ii) মর্যাদা (সীমা) ও অভিবিধি (ব্যাপ্তি) বুঝাইতে-ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা কর। ধৃতরাষ্ট্র জন্ম থেকেই অন্ধ। “জনম অবধি হাম রূপ নেহারলু।” আপনার আদেশ আজীবন পালন করব।
মর্যাদা ও অভিবিধির পার্থক্যটুকু ভালো করিয়া বুঝিয়া লও। সীমার নিদর্শন বক্তব্যের অন্তর্ভূত হইলে অভিবিধি (inclusion), আর বহির্ভূত হইলে মৰ্যাদা (exclusion) হয়। আজীবন শব্দটিতে জীবনের শেষ সীমা পর্যন্ত বুঝায় বলিয়া অভিবিধি। কিন্তু আমরণ শব্দটিতে মরণ পর্যন্ত অর্থাৎ মরণের পূর্ব পর্যন্ত বুঝায়; এখানে মরণকে বক্তব্যের বহির্ভূত ধরা হইতেছে, তাই মর্যাদা।
(ii) নিমিত্তার্থে—জ্বর হইয়াছে বলিয়া তিনি সভায় আসিতে পারিলেন না। “তোমায় আমায় মিলন হবে বলে।” “পাতকী বলিয়া কি গো ঠেলিবে চরণে?” খোকার জন্য খেলনা আর খুকুর জন্য দোলনা আনবে। “সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।” “গেরুয়া সাজের জন্য নয়, কাজের জন্য।”
(iv) ক্রিয়াবিশেষণে—কর্তব্যপরায়ণ লোক কাজকর্ম যত্ন করেই করেন। “চিরচঞ্চলের মাঝে কেন তুমি শান্ত হয়ে রও!” এমনিধারা ভুল করে নিজের সর্বনাশটা আর করো না। বাজারে এতক্ষণ ধরে কী করছিলি? দেশকে সবাই প্রাণ দিয়ে ভালোবাসবে। রাগ করে সে বাড়ি চলে গেছে।
(v) মনে করা, বলিয়া ইত্যাদি যোগে—রাজকুমার পর্বত বলিয়া (নামে অর্থে) কোনো ছেলে এ সেকশনে নাই।
(vi) দিগ্বাচক শব্দযোগে—দেবগিরি দিল্লি হইতে (দিল্লির—বিকল্পে র বিভক্তিও হয়) দক্ষিণে। দিল্লি কলিকাতা হইতে (কলিকাতার) পশ্চিমে।
শব্দরূপ
বাংলা শব্দবিভক্তির নিজস্ব চিহ্ন খুবই অল্প বলিয়া শব্দরূপ নির্ণয় করিবার সময় অনুসর্গ, নির্দেশক ইত্যাদির সাহায্য একান্ত অপরিহার্য। কোথাও শব্দটির মূল রূপের সঙ্গে শব্দবিভক্তি যুক্ত হয়, কোথাও বা শব্দটিকে প্রথমে বহুবচনাত্মক শব্দযোগে বহুবচনান্ত করিয়া পরে বিভক্তিচিহ্ন বা অনুসর্গ যুক্ত হয়। শব্দরূপের সুবিধার জন্য একবচনের (চলিত ও সাধু) এবং বহুবচনের (চলিত ও সাধু) বিভক্তিস্থানীয় পদগুলি সাজাইয়া দিলাম। ইহাদের মধ্যে (i) অ এ তে কে র রা এরা প্রভৃতি বিভক্তিচিহ্ন, (ii) গণ বৃন্দ প্রভৃতি বহুবচনাত্মক শব্দ, (iii) হইতে চেয়ে দ্বারা দিয়া কর্তৃক তরে জন্য প্রভৃতি অনুসর্গ এবং অবশিষ্টগুলি পদাশ্রিত নির্দেশক।—
একবচনের বিভক্তিচিহ্ন
কারক | চলিত ভাষায় | সাধু ভাষায় |
কর্তৃ | অ (শূন্য), এ (য়, য়ে), তে (এতে) | অ (শূন্য), এ (য়, য়ে), তে (এতে) |
কর্ম | শূন্য, এ (য়, য়ে), কে, রে (এরে) | শূন্য, এ (য়, য়ে), কে, রে (এরে) |
করণ | শূন্য, এ (য়, য়ে), তে (এতে), দ্বারা, দিয়ে, কর্তৃক | শূন্য, এ (য়, য়ে), তে (এতে), দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক |
সম্প্রদান | শূন্য, এ (য়, য়ে), কে, রে (এরে), তরে, জন্যে | শূন্য, এ (য়, য়ে), কে, রে (এরে), তরে, জন্য, লাগিয়া |
অপাদান | শূন্য, এ (য়, য়ে), তে (এতে), হতে, চেয়ে, থেকে | শূন্য, এ (য়, য়ে), তে (এতে), হইতে, চেয়ে |
অধিকরণ | শূন্য, এ (য়, য়ে), তে (এতে), কাছে, মধ্যে | শূন্য, এ (য়, য়ে), তে (এতে), কাছে, মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | র (এর), কার, কের | র (এর), কার, কের |
সম্বোধন | শূন্য | শূন্য |
বহুবচনের বিভক্তিচিহ্ন
(রা এরা বিভক্তিচিহ্ন, অবশিষ্টগুলি বহুবচনাত্মক শব্দ, অনুসর্গ বা পদাশ্রিত নির্দেশক)
কারক | চলিত ভাষায় | সাধু ভাষায় |
কর্তৃ | রা, এরা, গুলি, গুলো, গণ, বৃন্দ | রা, এরা, গুলি, গুলা, বৃন্দ, গণ |
কর্ম | দের, গুলিকে, গুলোকে, গণকে, বৃন্দকে | দের, গুলিকে, গুলাকে, দিগকে, গণকে, বৃন্দকে |
করণ | দের দ্বারা, দের দিয়ে, গুলি দিয়ে, গুলো দিয়ে | দের দ্বারা, দের দিয়া, গুলি দিয়া, গুলা দিয়া, গণ কর্তৃক, বৃন্দ কর্তৃক, দিগের দ্বারা |
সম্প্রদান | দের, দের জন্য, দের জন্যে, দের তরে, গুলিকে, গুলোকে | দের, দের জন্য, দের তরে, দিগকে, বৃন্দকে, গণকে, গুলিকে, গুলাকে |
অপাদান | দের হতে, দের থেকে, দের, চেয়ে, গুলোর চেয়ে, গুলি, থেকে, গুলো, থেকে | দের হইতে, দিগ হইতে, গণ হইতে, বৃন্দ হইতে |
অধিকরণ | গুলিতে, গুলোতে, গুলোয়, দের কাছে, গুলির মধ্যে, গুলোর মধ্যে | গুলিতে, গুলাতে, দিগেতে, গুলির মধ্যে, গুলার মধ্যে, গণের মধ্যে, দিগের মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | গুলির, গুলোর, দের | গণের, দিগের, বৃন্দের |
সম্বোধন | শূন্য, গণ, বৃন্দ, রা | শূন্য, গণ, বৃন্দ, রা |
কোনো শব্দে শব্দবিভক্তিচিহ্ন যোগ করিলে মূল শব্দটির কিছু কিছু রূপান্তর ঘটে। এখন শব্দরূপ কাহাকে বলে, দেখ।—
১০০। শব্দরূপ : কর্তৃকারক হইতে আরম্ভ করিয়া অধিকরণকারকে, এবং সম্বন্ধপদ ও সম্বোধনপদে একবচন ও বহুবচনের বিভক্তিচিহ্নগুলি যথাযথ যোগ করিলে মূল শব্দটির যে পরিবর্তন হয়, ধারাবাহিকভাবে তাহা দেখাইয়া দেওয়ার নাম শব্দরূপ।
সংস্কৃতে স্বরান্ত-ব্যঞ্জনাত্তভেদে এবং স্ত্রীপুরুষক্লীবলিঙ্গভেদে শব্দরূপের যে-সব বৈচিত্র্য দেখা যায়, বাংলায় সে-রকমটি হয় না। তৎসম-অতৎসমভেদে বা সাধুচলিতভেদে বাংলা শব্দের রূপে কিছুটা পার্থক্য থাকিলেও লিঙ্গভেদে বা স্বরান্ত-ব্যঞ্জনান্তভেদে শব্দরূপের বিশেষকিছু পার্থক্য দেখা যায় না।
অতি-পরিচিত কয়েকটি শব্দের রূপ দেওয়া হইল। প্রদত্ত রূপ দেখিয়া নিজে নিজে নূতন নূতন শব্দের রূপ সম্পূর্ণ করিতে চেষ্টা কর।
বিশেষ্য
ছাত্র শব্দ (পুংলিঙ্গ)—সাধু
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | ছাত্র, ছাত্রে | ছাত্রগণ, ছাত্রবৃন্দ, ছাত্রেরা |
কর্ম | ছাত্রকে | ছাত্রগণকে,—দিগকে,—বৃন্দকে, ছাত্রদের |
করণ | ছাত্রদ্বারা, ছাত্রকে দিয়া, ছাত্র কর্তৃক | ছাত্রদের দ্বারা, ছাত্রদিগের দ্বারা, ছাত্রদের দিয়া, ছাত্রগণকে দিয়া, ছাত্রগণ কর্তৃক, ছাত্রবৃন্দ কর্তৃক |
সম্প্রদান | ছাত্রকে, ছাত্রের জন্য | ছাত্রদিগকে, ছাত্রগুলিকে, ছাত্রগণকে, ছাত্রবৃন্দকে, ছাত্রদের, ছাত্রদের জন্য |
অপাদান | ছাত্র হইতে | ছাত্রদের হইতে, ছাত্রদিগ হইতে, ছাত্রগণ হইতে, ছাত্রবৃন্দ হইতে |
অধিকরণ | ছাত্রে, ছাত্রতে | ছাত্রদিগেতে, ছাত্রগণের মধ্যে, ছাত্রদের মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | ছাত্রের | ছাত্রগণের, ছাত্রবৃন্দের, ছাত্রদিগের |
সম্বোধন | ছাত্র | ছাত্রগণ, ছাত্রবৃন্দ, ছাত্রেরা |
স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে প্রাণিবাচক সমস্ত তৎসম বিশেষ্য শব্দের সাধুরূপ ছাত্র শব্দের মতো। অ-কারান্ত শব্দে এ, এর, এতে, এদের ইত্যাদি বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হইলে শব্দটির শেষস্থ অ-কার লোপ পায়।
বালক শব্দ (পুংলিঙ্গ)—চলিত
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | বালক, বালকে | বালকেরা, বালকগণ |
কর্ম | বালককে | বালকদিগকে, বালকগণকে, বালকবৃন্দকে, বালকদের |
করণ | বালকদ্বারা, বালককে দিয়ে | বালকদের দ্বারা, বালকদের দিয়ে |
সম্প্রদান | বালককে | বালকদের, বালকদের জন্য |
অপাদান | বালক থেকে, বালকের চেয়ে | বালকদের থেকে, বালকদের চেয়ে |
অধিকরণ | বালকে, বালকেতে | বালকদের মধ্যে, বালকদের কাছে |
সম্বন্ধপদ | বালকের | বালকদের, বালকগণের |
সম্বোধন | বালক | বালকগণ, বালকেরা |
মা শব্দ (স্ত্রীলিঙ্গ)—সাধু
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | মা, মায়, মায়ে | মায়েরা |
কর্ম | মাকে | মায়েদের, মাদিগকে |
করণ | মায়ের দ্বারা, মাকে দিয়া | মায়েদের দ্বারা, মাদিগের দ্বারা |
সম্প্রদান | মাকে, মায়ের জন্য | মাদিগকে, মায়েদের জন্য |
অপাদান | মা হইতে | মায়েদের হইতে |
অধিকরণ | মায়ে, মায়েতে | মায়েদের মধ্যে, মাদিগের মধ্যে, মাদিগেতে |
সম্বন্ধপদ | মায়ের | মাদিগের, মায়েদের |
সম্বোধন | মা | মায়েরা |
প্রাণিবাচক সমস্ত খাঁটী বাংলা বিশেষ্য শব্দের সাধুরূপ স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে মা শব্দের মতো।
মেয়ে শব্দ (স্ত্রীলিঙ্গ)—চলিত
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | মেয়ে, মেয়েতে | মেয়েরা, মেয়েগুলো |
কর্ম | মেয়েকে | মেয়েদের, মেয়েগুলোকে |
করণ | মেয়ের দ্বারা, মেয়েকে দিয়ে | মেয়েদের দ্বারা, মেয়েগুলোকে দিয়ে |
সম্প্রদান | মেয়েকে | মেয়েদের, মেয়েগুলোকে |
অপাদান | মেয়ের থেকে, মেয়ের চেয়ে | মেয়েদের থেকে, মেয়েদের চেয়ে, মেয়েগুলোর থেকে |
অধিকরণ | মেয়েতে | মেয়েগুলোতে, মেয়েদের মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | মেয়ের | মেয়েদের, মেয়েগুলোর |
সম্বোধন | মেয়ে | মেয়েরা |
বই শব্দ (ক্লীবলিঙ্গ)—চলিত
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | বই, বইখানা, বইখানি | বইগুলো |
কর্ম | বই, বইখানিকে | বইগুলো, বইগুলোকে |
করণ | বইয়ের দ্বারা, বই দিয়ে | বইগুলোর দ্বারা, বইগুলো দিয়ে |
অপাদান | বই থেকে, বইয়ের থেকে | বইগুলোর থেকে, বইগুলোর চেয়ে |
অধিকরণ | বইয়ে, বইতে, বইয়েতে | বইগুলোতে, বইগুলোয়, বইগুলোর মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | বইয়ের, বইখানার, বইখানির | বইগুলোর |
[ অপ্রাণিবাচক শব্দের সম্প্রদান ও সম্বোধনপদের রূপ হয় না। ]
বস্তুবাচক যাবতীয় ক্লীবলিঙ্গ শব্দের চলিত রূপ বই শব্দের মতো।
জল শব্দ (ক্লীবলিঙ্গ)-নিত্য একবচন সাধু/ চলিত
কারক | একবচন |
কর্তৃ ও কর্ম | জল |
করণ | জলে, জল দিয়া/জল দিয়ে |
অপাদান | জল হইতে/জল থেকে, জলের চেয়ে |
অধিকরণ | জলে, জলেতে, জলের মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | জলের |
সম্বোধন | জল |
সর্বনাম
আমি শব্দ (উত্তমপুরুষ)—সাধু
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | আমি | আমরা, মোরা* |
কর্ম সম্প্রদান | আমাকে, আমায়, আমারে *, মোরে* | আমাদিগকে, আমাদের, মোদেরে* |
করণ | আমার দ্বারা, আমাকে দিয়া, আমা কর্তৃক | আমাদিগের দ্বারা, আমাদের দিয়া |
অপাদান | আমা হইতে, আমার চেয়ে | আমাদের হইতে, আমাদের চেয়ে |
অধিকরণ | আমায়, আমাতে, আমার মধ্যে | আমাদিগেতে, আমাদের মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | আমার, মোর*, মম * | আমাদের, মোদের* |
* আমি, তুমি, সে, আপনি, নিজ, সব প্রভৃতি সর্বনাম শব্দের তারকাচিহ্নিত রূপগুলি কেবল কবিতায় চলে। [ সর্বনাম শব্দের সম্বোধন হয় না। ]
তুমি শব্দ (মধ্যমপুরুষ সাধারণার্থে)–চলিত
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | তুমি | তোমরা |
কর্ম সম্প্রদান | তোমাকে, তোমায়, তোমারে* | তোমাদের, তোমাদেরে* |
করণ | তোমার দ্বারা, তোমাকে দিয়ে | তোমাদের দ্বারা, তোমাদের দিয়ে |
অপাদান | তোমার থেকে, তোমার চেয়ে, তোমার কাছ থেকে | তোমাদের থেকে, তোমাদের চেয়ে, তোমাদের কাছ থেকে |
অধিকরণ | তোমাতে, তোমায়, তোমার মধ্যে, তোমার মাঝে | তোমাদের মধ্যে, তোমাদের মাঝে |
সম্বন্ধপদ | তোমার, তব* | তোমাদের |
আপনি শব্দ (মধ্যমপুরুষ সম্ভ্রমার্থে)–সাধু
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | আপনি | আপনারা |
কর্ম সম্প্রদান | আপনাকে, আপনায়, আপনারে* | আপনাদিগকে, আপনাদের |
করণ | আপনাকে দিয়া, আপনার দ্বারা, আপনা কর্তৃক | আপনাদের দ্বারা, আপনাদের দিয়া, আপনাদিগ কর্তৃক |
অপাদান | আপনা হইতে, আপনার চেয়ে | আপনাদিগের হইতে, আপনাদের চেয়ে |
অধিকরণ | আপনায়, আপনাতে, আপনার মাঝে | আপনাদিগেতে, আপনাদের মাঝে |
সম্বন্ধপদ | আপনার | আপনাদের, আপনাদিগের |
সে শব্দ (প্রথমপুরুষ সাধারণার্থে)-সাধু
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | সে | তাহারা |
কর্ম সম্প্রদান | তাহাকে, তাহারে * | তাহাদিগের, তাহাদের |
করণ | তাহার দ্বারা, তাহাকে দিয়া | তাহাদের দ্বারা, তাহাদের দিয়া |
অপাদান | তাহার অপেক্ষা, তাহার চেয়ে, তাহার হইতে | তাহাদের অপেক্ষা, তাহাদের চেয়ে, তাহাদের হইতে |
অধিকরণ | অধিকরণ তাহাতে, তাহায়, তাহার মধ্যে, তাহার মাঝে | তাহাদিগেতে, তাহাদের মধ্যে, তাহাদের মাঝে |
সম্বন্ধপদ | তাহার | তাহাদিগকে, তাহাদের |
তিনি শব্দ (প্রথমপুরুষ সম্ভ্রমার্থে)—চলিত
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | তিনি | তাঁরা |
কর্ম সম্প্রদান | তাঁকে, তাঁরে*, তাঁয়* | তাঁদেরকে, তাঁদের, তাঁদেরে* |
করণ | তাঁর দ্বারা, তাঁকে দিয়ে | তাঁদের দ্বারা, তাঁদের দিয়ে |
অপাদান | তাঁর থেকে, তাঁর চেয়ে, তাঁর কাছে | তাঁদের থেকে, তাঁদের চেয়ে, তাঁদের কাছ থেকে |
অধিকরণ | তাঁতে, তাঁর মাঝে, তাঁর মধ্যে | তাঁদিগেতে, তাঁদের মাঝে, তাঁদের মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | তাঁর | তাঁদের |
ইনি, যিনি প্রভৃতি সম্ভ্রমার্থক সর্বনামের রূপ তিনি শব্দের মতো।
নিজ শব্দ—সাধু
কারক | একবচন | বহুবচন |
কর্তৃ | নিজে | নিজেরা |
কর্ম সম্প্রদান | নিজেকে, নিজকে, নিজেরে* | নিজদিগকে, নিজেদেরকে, নিজেদের |
করণ | নিজের দ্বারা, নিজেকে দিয়া, নিজ কর্তৃক | নিজেদের দ্বারা, নিজেদের দিয়া, নিজদিগের দ্বারা |
অপাদান | নিজ হইতে, নিজের অপেক্ষা, নিজের চেয়ে | নিজদিগের হইতে, নিজদিগের অপেক্ষা, নিজদিগের চেয়ে |
অধিকরণ | নিজে, নিজেতে, নিজেয়, নিজের মধ্যে, নিজের মাঝে | নিজদিগেতে, নিজেদের মধ্যে, নিজদিগের মধ্যে, নিজদিগের মাঝে |
সম্বন্ধপদ | নিজের, নিজেকার, নিজকার | নিজদিগের, নিজেদের |
সব শব্দ (সাকল্যবাচক সর্বনাম)—চলিত
কারক | বহুবচন |
কর্তৃ | সব, সবাই, সবে* |
কর্ম সম্প্রদান | সবাইকে, সবারে*, সবে |
করণ | সবার দ্বারা, সবাইকে দিয়ে |
অপাদান | সব থেকে, সবার থেকে, সবার চেয়ে, সবের থেকে, সবাকার থেকে |
অধিকরণ | সবেতে, সবার মাঝে, সবার মধ্যে |
সম্বন্ধপদ | সবের, সবার, সবাইয়ের, সবাইকার, সব্বাইকার |
কারক-বিভক্তি-নির্ণয়
বিভিন্ন কারকে কোনো শব্দের মূল রূপটির কী ধরনের পরিবর্তন হয়, এতক্ষণ লক্ষ্য করিলে। এখন, কারক-বিভক্তি নির্ণয় করিতে বলিলে কীভাবে করিবে? মূল শব্দটিতে অতিরিক্ত কোন্ অংশটি যুক্ত হইয়াছে, বাহির কর; সেই অতিরিক্ত অংশটিই বিভক্তি। কয়েকটি উদাহরণ দেখ।—
(ক) আমাকে যেতেই হবে। এখানে ‘আমাকে’ পদটির মূল অংশ ‘আমি’, এবং অতিরিক্ত অংশ ‘কে’; সুতরাং কর্তৃকারকে বিভক্তি হইল কে।
(খ) এ ঘরে কত ছেলেমেয়ে আছে? ‘ছেলেমেয়ে’ পদটির মূল অংশ ‘ছেলেমেয়ে’, আর কোনোকিছু অতিরিক্ত অংশই এখানে যুক্ত হয় নাই; সুতরাং পদটিতে কর্তৃকারকে শূন্যবিভক্তি হইয়াছে।
(গ) ছেলেটিকে একটু দেখো। এখানে ‘ছেলেটিকে’ পদটির মূল অংশ ‘ছেলে’ অতিরিক্ত অংশ ‘টিকে’ (টি নির্দেশক + কে বিভক্তি); সুতরাং কর্মকারকে বিভক্তি এখানে কে।
(ঘ) আপনাদের খাবার দেওয়া হয়েছে। মূল শব্দ ‘আপনি’ + অতিরিক্ত অংশ ‘দের’; অতএব এখানে সম্প্রদানে বহুবচনের বিভক্তি দের হইয়াছে।
পরীক্ষার উত্তরপত্রে কারকের নামটি সর্বদাই পুরাপুরি লিখিবে, বিভক্তিচিহ্নটি স্পষ্ট করিয়া উল্লেখ করিবে; কখনই প্রথমা বিভক্তি, দ্বিতীয়া বিভক্তি ইত্যাদি রূপে লিখিবে না।
অনুশীলনী
১। শব্দবিভক্তি কী? অনুসর্গের সহিত শব্দবিভক্তির তুলনা কর।
২। শূন্যবিভক্তি কাহাকে বলে? শূন্যবিভক্তির উপযোগিতা কী? উদাহরণদ্বারা বুঝাইয়া দাও।
৩। অনুসর্গ কাহাকে বলে? অব্যয় ও অসমাপিকা ক্রিয়া অনুসর্গরূপে ব্যবহৃত হইয়াছে, দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও। অনুসর্গের পূর্ববর্তী শব্দে বিভক্তিচিহ্ন যুক্ত হইয়াছে, এমন তিনটি উদাহরণ দাও।
৪। অনুসর্গ ও নির্দেশক, শব্দবিভক্তি ও নির্দেশক, শব্দবিভক্তি ও অনুসর্গের মধ্যে সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য দেখাও।
৫। কারক কাহাকে বলে? প্রত্যেক প্রকার কারকের একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
৬। বিশেষণপদের কারক হইয়াছে এমন দুইটি উদাহরণ দাও। বিশেষণপদে শূন্যবিভক্তিযোগে কারক হইয়াছে, দুইটি উদাহরণ দাও।
৭। প্রত্যেকটি কারকে শূন্যবিভক্তি হয়, একটি করিয়া উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। কোন্ কোন্ কারকে শূন্যবিভক্তির ব্যাপক প্রয়োগ হয়, উদাহরণ দিয়া বুঝাও।
৮। এমন একটি বাক্য রচনা কর যাহাতে প্রত্যেকটি কারকের প্রয়োগ রহিয়াছে। রচিত বাক্যটিতে কোন্ কারকে কোন্ বিভক্তিচিহ্ন হইয়াছে, দেখাইয়া দাও।
৯। অধিকরণকারক কাহাকে বলে? অধিকরণ কয় প্রকার? প্রত্যেক প্রকারের একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
১০। তির্যক্ বিভক্তি কাহাকে বলে? এ, কে, তে বিভক্তিচিহ্নের ব্যাপক প্রয়োগ উদাহরণসহ উল্লেখ কর।
১১। এ (য়), তে, দিয়া—প্রত্যেকটি বিভক্তিচিহ্ন বা অনুসর্গযোগে করণ ও অধিকরণকারকের উল্লেখ করিয়া দেখাও যে, করণ ও অধিকরণকারকের পার্থক্য বিভক্তিচিহ্নে নহে, কেবল অর্থে।
১২। কর্তৃকারক ও অধিকরণকারকে কোন্ কোন্ বিভক্তিচিহ্ন হয়, উদাহরণ দিয়া বুঝাও।
১৩। (ক) অপাদানকারক বুঝাইতে বিভিন্ন বিভক্তিচিহ্ন-প্রয়োগের উদাহরণ দাও। (খ) বিভিন্নপ্রকার অপাদানকারকের উল্লেখ করিয়া উদাহরণসহ বুঝাইয়া দাও।
১৪। (ক) সম্বন্ধপদ ও সম্বোধনপদ কাহাকে বলে? প্রত্যেকটির উদাহরণ দাও। ইহাদের কারক বলা যায় কি না, আলোচনা কর।
(খ) প্রতিটি কারক-সম্বন্ধের একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
১৫। পার্থক্য দেখাও : কারক ও সম্বন্ধপদ, ব্যতিহার কর্তা ও সহযোগী কর্তা, গৌণ কর্ম ও সম্প্রদানকারক, যোগ্যতা-সম্বন্ধ ও দক্ষতা-সম্বন্ধ, হেতু-সম্বন্ধ ও নিমিত্ত-সম্বন্ধ, উপাদান—সম্বন্ধ ও অঙ্গাঙ্গি-সম্বন্ধ, নিমিত্ত সম্বন্ধ ও নিবারণ-সম্বন্ধ, বিশেষণ-সম্বন্ধ ও গুণধর্মাদি-সম্বন্ধ, সম্বন্ধপদ ও সম্বোধনপদ, মর্যাদা ও অভিবিধি।
১৬। (ক) বিভিন্ন কারকের একবচনের বিভক্তিচিহ্ন ও অনুসর্গের তালিকা সাধু ও চলিত ভাষারীতি-অনুযায়ী লিপিবদ্ধ কর।
(খ) বিভিন্ন কারকের বহুবচনের বিভক্তিচিহ্ন ও অনুসর্গের তালিকা সাধু ও চলিত ভাষারীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ কর।
(গ) কখন ‘এ’ বিভক্তি য় (য়ে) হইয়া যায়? উদাহরণ দাও।
১৭। (ক) কোন্ কোন্ কারকে ‘এ’ বিভক্তিচিহ্ন হয়, একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
(খ) ‘কে’ বিভক্তিচিহ্নযোগে কোন্ কোন্ কারক নিষ্পন্ন হয়, উদাহরণ দাও।
(গ) কর্মকারকে ‘কে’ বিভক্তিচিহ্নের যোগে ও লোপে অর্থের পরিবর্তন ঘটে, দুইটি উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।
১৮। (ক) কর্তৃকারক কাহাকে বলে? বিশেষ উল্লেখযোগ্য কয়েকপ্রকার কর্তৃকারকের উল্লেখ কর ও উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।
(খ) কর্মকারক কাহাকে বলে? বিভিন্নপ্রকার কর্মকারকের উল্লেখ করিয়া উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও।
(গ) করণকারক কাহাকে বলে? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। বিভিন্নপ্রকার করণের উল্লেখ করিয়া উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও।
(ঘ) সম্প্রদানকারক কাহাকে বলে? উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও। কর্মকারক ও সম্প্রদানকারকের পার্থক্য উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও।
(ঙ) “আজি রজনীতে হয়েছে সময়, এসেছি বাসবদত্তা!”—দুইটি কর্তৃকারক, দুইটি অধিকরণকারক ও একটি সম্বোধনপদ চিহ্নিত করিয়া সেই পদগুলিতে কোন্ বিভক্তিচিহ্ন রহিয়াছে, বল।
(চ) “তোমার সবুজ আঁচল ফুলে ফুলে সোনার ধানে ভরব।”—একটি কর্মকারক, দুইটি করণ ও দুইটি সম্বন্ধপদ নির্দেশ কর; সম্বন্ধ দুইটি কোন্ প্রকার সম্বন্ধ?
১৯। উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও : করণে ‘তে’ বিভক্তি; বিভক্তিচিহ্নের পরিবর্তে অনুসর্গ; অপাদানে ‘এ’ বিভক্তি; ব্যতিহার কর্তা; সমধাতুজ কর্ম; প্রযোজ্য কর্তা 45 গৌণ কর্ম; মুখ্য কর্ম; প্রযোজক কর্তা; বিভক্তিশূন্য অধিকরণ; বিধেয় কর্ম; সম্প্রদানকারক; উদ্দেশ্য কর্ম; সম্প্রদানে শূন্যবিভক্তি; বিষয়াধিকরণ; সমধাতুজ কর্তা; অপাদানে ‘কে’; করণে ‘য়’ ও ‘এতে’; অপাদানে শূন্যবিভক্তি; তির্যক্ বিভক্তি; সমধাতুজ করণ; কর্মকর্তৃবাচ্যের কর্তা; কর্মরূপে অসমাপিকা ক্রিয়ার প্রয়োগ; সাধনকর্তা; উপবাক্যীয় কর্ম; করণে ‘এর’ বিভক্তি; বিকৃতিবাচক অপাদান; সামীপ্যাধিকরণ; এক ক্রিয়ার বহু কর্তা; বহু ক্রিয়ার এক কর্তা; একদেশসূচক অধিকরণ; কর্মে বীপ্সা; নিরপেক্ষ কর্তা; কালবাচক অপাদান; ব্যাপ্তিমূলক স্থানাধিকরণ; ব্যাপ্তিমূলক কালাধিকরণ; কর্মে ‘রে’ বিভক্তি; প্রয়োজনার্থে ‘কে’; অপাদান-সম্বন্ধ; সহযোগী কর্তা; অনুক্ত কর্তা; উদ্দেশ্য কর্মে শূন্যবিভক্তি; অকর্মিকা ক্রিয়ার ধাতুর্থক কৰ্ম; উপায়াত্মক করণ; সম্প্রদান-সম্বন্ধ; কর্তৃকারকে ‘তে’ ও ‘এতে’; সম্প্রদানে ‘এ’ ও ‘তে’; বিশেষণ-সম্বন্ধ; অব্যয়রূপে সম্বোধনপদ; অভেদ-সম্বন্ধ; ক্ষণমূলক কালাধিকরণ; করণে শূন্যবিভক্তি; ব্যাপ্তি-সম্বন্ধ; বিধেয় বিশেষণরূপে সম্বন্ধপদ; অধিকরণে বীপ্সা; অধিকরণে ‘কে’ বিভক্তি; যন্ত্রাত্মক করণ; সম্প্রদানে ‘রে’ বিভক্তি; ঊহ্য কর্তা; করণে বিভক্তিচিহ্ন ও অনুসর্গের যুগ্মপ্রয়োগ; কর্তৃকারকে ‘রে’ বিভক্তি; করণে বীপ্সা; অপাদানরূপে অসমাপিকা ক্রিয়া; করণে ‘হইতে’ অনুসর্গ; অপাদানে ‘দিয়া’ অনুসর্গ; অধিকরণে ‘দিয়া’ অনুসর্গ; খাঁটী বাংলা সম্বোধনপদ; উপবাক্যীয় কর্তা; স্থানবাচক অপাদান; অধিকার-সম্বন্ধ; বাংলায় সংস্কৃত রীতির সম্বোধনপদ; আধার-আধেয় সম্বন্ধ; বাক্যাংশ কর্তা; অসম্ভব-সম্বন্ধ; দূরত্ববাচক অপাদান; বাক্যাংশ কর্ম; অধিকরণ-সম্বন্ধ; সম্বোধনরূপে অব্যয়ের প্রয়োগ; উপাদান-সম্বন্ধ; করণ-সম্বন্ধ; অবস্থানবাচক অপাদান; তারতম্য বুঝাইতে অনুসর্গের প্রয়োগ; মর্যাদা ও অভিবিধি বুঝাইতে অনুসর্গের প্রয়োগ; ব্যাপ্তি ও হেতু অর্থে শূন্যবিভক্তি; নিবারণার্থে ‘র’; ক্রিয়াবিশেষণে ‘এ’ বিভক্তি ও অনুসর্গ; ঊহ্য কর্ম; বিশেষণে শূন্যবিভক্তি।
২০। আয়ত পদগুলির কারকবিভক্তি নির্ণয় কর অথবা কারক-ভিন্ন স্থলে বিভক্তি প্রয়োগের কারণটি দেখাও : “ঝুলি হতে দিলেম তুলে একটি ছোটো কণা।” “আমি নয়নে বসন বাঁধিয়া বসে আঁধারে মরি গো কাঁদিয়া।” “কল্পতরু, তুমি এ কোন্ খেয়ালে আমারে কাঙ্গাল করিলে!” এতক্ষণে গাড়ি বর্ধমান ছাড়ল। বন্যাত্রাণ সমিতিতে তিনি চাঁদা দিলেন না। “নিশীথের তারা শ্রাবণগগনে ঘন মেঘে অবলুপ্ত।” “এ বাগানে ফুল তুলবে না বলছি।” পাণ্ডুলিপিতে কাটাকুটির আঁচড়েও রবীন্দ্রনাথ সুন্দরকে ধরে রেখেছেন। দুধের স্বাদ কি ঘোলে মেটে? “ফুলদল দিয়া কাটিলা কি বিধাতা শাম্মলী-তরুবরে!” রবীন্দ্রসংগীতে চিত্তশুদ্ধি ঘটে। রবীন্দ্রসংগীতে চিত্তশুদ্ধি ঘটায়। “হেরিয়া আজিকে ঘরে পরে সবে হাসিছে হেলার হাসি।” “তোমার আলোক পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান।” “মা, তোর রাঙা পায়ে কত ভ্রমর ঠাঁই পেয়েছে ফুলের সাথে।” “বেলাজুই ছড়িয়ে দেব বৈশাখের এই সন্ধ্যাবেলা।” “নতুন প্রভাত উঠবে জেগে রঙ ছড়াবে মেঘে মেঘে।” “মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি।” খাদ্যের মিষ্টত্ব কি খাদ্যেই নিহিত? “এমনি করে কালো কাজল মেঘ জ্যৈষ্ঠমাসে আসে ঈশানকোণে।” “এমনি করে কালো কোমল ছায়া আষাঢ়মাসে নামে তমালবনে।” “সুখ জগতের কোথাও নেই, আছে নিজের মনে।” এ তথ্য রামায়ণে পেয়েছি। এ তথ্য রামায়ণে দেখেছি। “অন্ধকারে লুকিয়ে আপনমনে কাহারে তুই পূজিস সঙ্গোপনে?” কথাটা শুনেই তিনি আহারে বিরত হলেন। গা দিয়ে দরদর ঘাম ঝরছে যে! অন্ধজনে দয়া কর! সে কি এখনও তাস খেলছে? ছিঃ! ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া করে না। “মায়ের পায়ে জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন।” সব মেঘেই বৃষ্টি হয় না। ছেলেদের খাবার দিয়েছেন? টাকাতে কী না হয়? ডাক্তারে যা বলেন বলুন। হাতে মাথা কাটবে না কি? নতুন কলমে ভালো লেখা যায় না। মহাশয়ের থাকা হয় কোথায়? “তারে মোহনমন্ত্ৰ দিয়ে গেছে কত ফুলের গন্ধ।” রঘুবংশে পারস্যদেশকে বনায়ু বলা হয়েছে। “কর্মীরে শিখালে তুমি যোগযুক্তচিতে সর্বফলস্পৃহা ব্রহ্মে দিতে উপহার।” “কালো মৌমাছি জানে মধুর খবর, গুবরেপোকা জানে না।” “বজ্রশিখা একপলকে মিলিয়ে দিল সাদাকালো।” “কৈলাসে পার্বতীহরে ভিক্ষা করে কাল হরে।” “খোকা মাকে শুধায় ডেকে, ‘এলেম আমি কোথা থেকে। “বিশ্বভুবন আঁধার করে তোর রূপে মা সব ডুবালি।” “ধুলায় ধ্রুপদী সত্তা, আকাশেরে কেন তবে ডর?” “তাহারা গরিব, তাই তাহাদের বাড়ী ভাল খাওয়াদাওয়া হয় না।” “এ বয়সে গীতাপাঠ ছেড়ে ফুটবল খেল।” ৰীজে গাছ জন্মে। “সেই ক্ষীণবায়ু দেবধূপের সৌরভে পরিপূর্ণ।” “তীর্থদর্শনে যেরূপ পরকালের কর্ম হয়, বাটী বসিয়াও সেরূপ হইতে পারে।” “বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইবের খঞ্জর!” “কীর্তনে আর বাউলের গানে আমরা দিয়েছি খুলি মনের গোপনে নিভৃত ভুবনে দ্বার ছিল যতগুলি।” “এই পাদুকা সেই অপূর্ব রাজশ্রী ভরতকে প্রদান করিল।” “ছিঁডুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি।” “অট্টহাস্য হাসিয়া উঠিল পণ্ডিত অভিমানী।” অকস্মাৎ তিনি অধ্যাপনায় বিরত হলেন। মা নিজের হাতে শিশুটিকে ঝিনুকে খাইয়ে দিচ্ছেন। জনে জনে প্রেম বিলায়ে প্রেমের গোরা নেচে যায়। “আলোর নাচ নাচায় চাঁদ সাগরজলে যবে।” “আলোকে শিশিরে কুসুমে ধান্যে হাসিছে নিখিল অবনী।” “দুখিনীর দিন দুখেতে গেল।” “হৃদয়ে হৃদয়ে তবু ভিক্ষা মাগি ফির প্রভু।” “আমি ঔরঙ্গজেবকে ভজিয়াছি, যেমন বিড়ালে ইন্দুর ভজে।” “আমি আজ পুকুরে যাচ্ছি না, তোলাজলেই স্নান করব।” অজামিল প্লুতস্বরে উঠিল ফুকারে শুধু নারায়ণনাম। “রাবণনন্দন আমি না ডরি শমনে।” “ক্লান্তিহরণ হাসি হাসলেন ঠাকুর।” “জানি তুমি মোরে করিবে অমল যতই অনলে দহিবে।” সব ঘর ঘুরে এলে তবেই না ঘুঁটি চিকেয় ওঠে। “চরকার দৌলতে মোর দুয়ারে বাঁধা হাতি।” “কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।” এমন খোঁচানো রাস্তা দিয়ে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়? “সম্পদে কে থাকে ভয়ে, বিপদে কে একান্ত নির্ভীক।” “অন্যের সুখেই তো তোমার সুখের নিশ্চিস্ততা।” “কোন্ আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আস!” তোমাকে দিয়ে এ কাজ হবে না দেখছি। খোদার এ জীবে আহার কে দিবে? “একদা প্রভাতে ভানুর প্রভাতে ফুটিল কমলকলি।” ইশ্! ছোড়দায় আবার ভয়! রাত্রির মুম্বাই মেলটা এলাহাবাদ দিয়ে যায়। “নূতন ধান্যে হবে নবান্ন তোমার ভবনে ভবনে।” “বেদবেদান্ত পায় না অন্ত, খুঁজে বেড়ায় অন্ধকারে।” পাদস্পর্শে কার এ পথের ধূলিকণা সোনা হয়ে গেছে। তখন চোখ দিয়ে দেখেছি, এখন চৈতন্য দিয়ে দেখছি। “মাছি করে রাখলি মাগো, মৌমাছি তো করলি না।” “মৃত্যুর পঙ্ক থেকে চলেছি সেই অমৃত-অঙ্কে।” প্রাণ মন বুদ্ধি বাক্য দিয়ে সর্বদা জীবের কল্যাণসাধন কর। “বজ্রে তোলো আগুন করে আমার যত কালো।” বইগুলো মেলায় কিনলাম। বালতির জলে হাত দিও না, কলের জলে ডালটুকু ধুয়ে নাও। “নিরন্তর ত্যাগের পুটপাকেই প্রেমের বিশুদ্ধি।” “যেথা সোনার কাঠির জাদুর ছোঁয়ায় ফুল ফোটে ডালে ডালে।” “আমি রূপে তোমায় ভোলাব না, ভালোবাসায় ভোলাব।” মায়ের পরিবেশিত মুষ্টিমেয় অন্নেই সন্তানের পুষ্টি। “তুমি মরণ ভুলে কোন্ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।” “আমি অকৃতী অধম বলেও তো কিছু কম করে মোবে দাওনি।” আগামীকাল হরিদ্বার যাচ্ছি। বাবা কয়েক মাস হরিদ্বারে আছেন। এত টাকা কার কাছ থেকে এনেছ? চোখে চোখ পড়তেই সে ফিক করে হেসে ফেলল। আমি বিষ্ণুপুর দিয়ে বাঁকুড়া যাচ্ছি, তুমি দুর্গাপুর হয়ে যাও। “এই অকূল সংসারে দুঃখ-আঘাত তোমার প্রাণে বীণা ঝঙ্কারে।” “গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, তখন তারে চিনি আমি।” দিনেদুপুরে এ পথে কতবার যে চলেছি! এ পথে পরশপাথর কুড়িয়ে পেলাম। এই পথেই তিনি আসন পেতে বসেছেন। আমাদের মুখের কথায় বুকের সায় আছে কি? সমস্তটা পথ এমনি ধারা ভিজে ভিজে এসেছ? আমি তোমার চেয়ে মাথায় বড়ো, মগজে নই। “বেত মেরে কি মা ভোলাবে, আমি কি মার তেমন ছেলে?” “আমার অহংকারের মূল কেটে দে কাঠুরিয়ার মেয়ে।” “সবাই যারে সব দিতেছে তার কাছে সব দিয়ে ফেলি।” “তৰ পদতলে বসিয়া বিরলে শিখিব তোমার শিক্ষা।” “ঘোর বিপদমাঝে কোন্ জননীর মুখের হাসি দেখিয়া হাস।”
২১। আয়তাক্ষর পদগুলি সম্বন্ধপদ, না সম্বোধনপদ, দেখাও। সম্বন্ধ হইলে কোন্ শ্রেণীর সম্বন্ধ, তাহাও দেখাও : “দুলিতেছে বিদ্যুতের দুল।” “যেখানে বিজ্ঞানের শেষ সেইখানেই ধর্মের আরম্ভ।” “উচ্ছ্বাসে কহিলা কৃষ্ণ, অর্জুন! অর্জুন! আমরা বীরের জাতি। “ “বুগেনভিলিয়া লতাটি শিশিরের নোলক পরেছে।” এই বুৰুল, তোর সব অঙ্ক হয়েছে? করেছ কি ঠাকুর! ছানার পায়সে নুন দিয়েছ? বক্তাদের বিবৃতির মেঘ যত গর্জায় তত বর্ষায় না। কর্তব্যের দৃঢ় চিত্তে ঘুষের ঘুণ স্থান পায় না। “সে থাকিবে সুখে মার চেয়ে আপনার মাসীমার বুকে।” “হে কাশী! কবীশদলে তুমি পুণ্যবান্।” “জানি প্রভু, তব পাণির পরশে ননীর পুতলি জাগিবে হরষে।” “বাঙালীর কবি গাহিছে জগতে মহামিলনের গান।” “কাণ্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ?” “কত রাজ্য, কত রাজা, গড়িছ নীরবে, হে পূজ্য!” “চির-ক্রন্দনময়ী গঙ্গে!” “পাতায় পাতায় হাসি, ও ভাই, পুলক রাশি রাশি।” “আয় জল ঝেপে, ধান দেব মেপে।” “রবীন্দ্রসংগীতের সুর বেজেছে বৃষ্টির সেতারে।” “তুমি অরূপ সরূপ সগুণ নির্গুণ দয়াল ভয়াল হরি হে!” “তারার অক্ষরে ঠিকানা তো লেখাই আছে।” “চিঠিখানায় ভক্তির টিকিটটা শুধু এঁটে দিয়ো।” “প্রভু, আমাকে তুমি অবসন্ন হতে দিও না।” “সূর্য, তোমার সোনার তোরণ খোল।” “লোকাচারের চশমা এঁটে কেবল চলি উলটো পথে।” “না চাহিতে প্রভু কত-না সুধায় হৃদয় দিয়েছ ভরে।”
২২। শব্দরূপ বলিতে কী বুঝায়? নীচের শব্দগুলির পূর্ণরূপ লিখ : আমি, তুমি, আপনি, তিনি, নিজ, ভূমি, মানুষ, নদী, কলম, মা, মেয়ে, কালি, তাহা, যিনি।
২৩। শূন্যস্থান পূরণ কর : যে + র =….. ; তিনি + দের = …..; যিনি + র = …..; সে + কে =; আমি + দিগকে = …..; তুমি + রে = ……; যিনি + এ = ….. ; তুই + দের = ……; তুমি + এ = …..; সে + দিগকে = …..; সে + এ = ……; আপনি + কে = ……; তিনি + রা = …; আমি + তে = ……; আপনি + এ = …… ; তুই + রা = …..; আপনি + তে = …..; সুতো + এ = …..; ইনি + কে = …..; উনি + দের = …..; জগৎ + এর =……; ইন্দ্রজিৎ + কে = …..; পর্ষৎ + এর = ….. কি + এ =; উপনিষৎ + এর = ……।
২৪। বিশেষণ-সম্বন্ধগুলিকে বিশেষণপদে পরিণত কর : লজ্জার ব্যাপার; স্বপ্নের দেশ; দুধের বাছা; শান্তির সংসার; আনন্দের সংবাদ; অনুরোধের আসর; গুণের মেয়ে; আভিজাত্যের ঝাঁজ; রসের আলোচনা