তৃতীয় অধ্যায় – পদ-প্রকরণ
প্রথম পরিচ্ছেদ – পদের প্রকারভেদ
ব্ আ ণ্ ঈ–এই চারিটি বর্ণ পরপর যোগ করিলে বাণী কথাটি পাওয়া যায়। বাণী’ বলিলে কাহারও নাম বুঝিয়া থাকি। সুতরাং বাণী’ কথাটির অর্থ আছে। উপরের বর্ণগুলিকে একটু ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া যোগ করিলে বীণা কথাটি পাওয়া। যায়। এই বীণা’ কথাটির অর্থ আছে; এই কথাটির দ্বারা কাহারও বা কোনোকিছুর নাম বুঝায়। একাধিক বর্ণের সুষ্ঠু সংযোগে এই যে বাণী ও বীণা কথা দুইটি পাইলাম, ইহাদিগকে ব্যাকরণে শব্দ বলা হয়।
৫৭। শব্দ ও একাধিক বর্ণ সুষ্ঠুভাবে যোগ করিয়া অর্থপূর্ণ ও শ্রুতিমধুর যে কথাটি পাওয়া যায়, তাহার নাম শব্দ।
নিছক শব্দ বাক্যে স্থান পায় না। শব্দটিতে অ, এ, কে, র্ প্রভৃতি অতিরিক্ত কোনো-না-কোনো অংশ যোগ করিলে শব্দটি তখন পদ হইয়া উঠে, এবং নবজাত সেই পদটি বাক্যে স্থান পায়। এখন দেখ–
(ক) বাণী কবিতাটি পড়িয়াছে। (খ) বড়দিমণি বাণীকে ডাকিলেন। (গ) বীণা। এখনও লিখিতেছে। (ঘ) বীণার লেখাটি চমৎকার।
প্রথমটিতে ‘বাণী’ শব্দ + অ (শূন্যবিভক্তি) = বাণী পদটির সৃষ্টি হইয়াছে, এবং পদটি বাক্যে স্থান পাইয়াছে। দ্বিতীয়টিতে বাণী’ শব্দ + কে বিভক্তি = বাণীকে পদটির সৃষ্টি হইয়াছে, এবং পদটি বাক্যে স্থান পাইয়াছে। তৃতীয়টিতে ‘বীণা’ শব্দের সঙ্গে অ (শূন্যবিভক্তি) যুক্ত হইয়া বীণা পদটির সৃষ্টি করিয়াছে, শেষেরটিতে ‘বীণা’ শব্দটিতে র্ বিভক্তি যুক্ত হওয়ায় বীণার পদটি গঠিত হইয়াছে।
উপরের বাক্যগুলির দিকে আবার লক্ষ্য কর–’পড়িয়াছে’, ‘ডাকিলেন’ এবং ‘লিখিতেছে’–এই তিনটি কথাও পদ। এই পদগুলি কীভাবে গঠিত হইয়াছে, দেখ–
পড়িয়াছে = পড় (ধাতু) + ইয়াছে (বিভক্তি)।
ডাকিলেন = ডাক্ (ধাতু) + ইলেন (বিভক্তি)।
লিখিতেছে = লিখ (ধাতু) + ইতেছে (বিভক্তি)।
ধাতুকে (√) চিহ্ন দ্বারা বুঝানো হয়। নিছক শব্দ যেমন বাক্যে স্থান পায় না, ধাতুও তেমনি বাক্যে স্থান পায় না। প্রত্যেকটি ধাতুতে কোনো-না-কোনো কাজ করা বুঝায়। ধাতুর সহিত ধাতুবিভক্তিযোগে যে পদটি পাওয়া যায় তাহাতেও সেই কাজ করা বুঝায়; তাই সেই পদটির নাম ক্রিয়াপদ। ক্রিয়াপদ ছাড়া বাক্যে আর যেসব পদ থাকে তাহাদের সাধারণ নাম নামপদ। তাহাদের কোনোটিতে ব্যক্তির নাম, কোনোঠিতে বস্তুর নাম, কোনোটিতে গুণ বা অবস্থার নাম বুঝায়। উপরের বাক্যগুলিতে বাণী, কবিতাটি, বড়দিমণি, বাণীকে, বীণা, এখনও, বীণার, লেখাটি, চমৎকার–প্রত্যেকটিই নামপদ। এইবার পদ কাহাকে বলে দেখ।–
৫৮। পদ : শব্দ বা ধাতু বিভক্তিযুক্ত হইয়া বাক্যে স্থানলাভের যোগ্যতা পাইলে বিভক্তিযুক্ত সেই শব্দ বা ধাতুকে পদ বলা হয়। প্রতিটি পদই বাক্যের এক-একটি অঙ্গ।
পূর্বপৃষ্ঠায় প্রদত্ত প্রথম তিনটি বাক্যের প্রত্যেকটিতে তিনটি করিয়া পদ আছে। (ঘ)-চিহ্নিত বাক্যে হয় ক্রিয়াপদটি উহ্য রহিয়াছে। সুতরাং এই বাক্যে পদের সংখ্যা হইল চার। এখন দেখিলে, পদ প্রধানতঃ দুইপ্রকার–নামপদ ও ক্রিয়াপদ।
৫৯। নামপদ ও শব্দের সহিত শব্দবিভক্তিযোগে গঠিত পদকে নামপদ বলে।
৬০। ক্রিয়াপদ ও ধাতুর সহিত ধাতুবিভক্তিযোগে যে কাৰ্যবাচক পদের সৃষ্টি হয়, তাহার নাম ক্রিয়াপদ।
নামপদ আবার চারিটি ভাগে বিভক্ত–বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ ও অব্যয়। অতএব পদ মোট পাঁচপ্রকার–বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, অব্যয় ও ক্রিয়া।
মনে রাখিও–নামপদের বিভক্তিহীন মূল অংশটি যেমন শব্দ, ক্রিয়াপদের বিভক্তিহীন মূল অংশটি তেমনি ধাতু। যতক্ষণ না শব্দকে শব্দবিভক্তিযোগে নামপদে এবং ধাতুকে ধাতুবিভক্তিযোগে ক্রিয়াপদে পরিণত করিতেছ, ততক্ষণ বাক্যে উহাদের স্থান নাই।
শব্দ অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিক বর্ণের সুষ্ঠু সংযোগে গঠিত হয়; আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটিমাত্র বর্ণেও একটি শব্দ হয়, এবং সেই শব্দটি শূন্যবিভক্তিযোগে পদে পরিণত হইয়া বাক্যে স্থান পায়। (ক) অ ভাই, একবারটি শুনুন না। (খ) “আ মরি বাংলা ভাষা!” (গ) এ গান কোথায় শিখেছ? (ঘ) ঐ যা, তোমার বইখানা আজও আনতে ভুলে গেছি। (ঙ) “ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা।”
এতক্ষণ দেখিলে, শব্দ বা ধাতুকে পদে পরিণত করিতে বিভক্তির একান্ত প্রয়োজন। বিভক্তি কাহাকে বলে, দেখা–
৬১। বিভক্তি : যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দ বা ধাতুর সহিত যুক্ত হইয়া পদ গঠন করে, সেই বর্ণসমষ্টিকে বিভক্তি বলে। যেমন-অ, কে, রে, এর, ইয়াছে, ইলেন, ইতেছে, ই প্রভৃতি। বিভক্তি দুইপ্রকার–শব্দবিভক্তি ও ধাতুবিভক্তি।
৬২। শব্দবিভক্তি : যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি শব্দের সহিত যুক্ত হইয়া শব্দটিকে নামপদে পরিণত করিয়া বাক্যে স্থানলাভের যোগ্যতা দেয়, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে শব্দবিভক্তি বলা হয়। যেমন–অ, কে, রা, এর, এ, তে, এতে ইত্যাদি। শব্দবিভক্তি নামপদের বচন, সম্বন্ধ ও কারক নির্দেশ করে।
৬৩। ধাতুবিভক্তিঃ যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি ধাতুর সহিত যুক্ত হইয়া কার্যবাচক ক্রিয়াপদের সৃষ্টি করে, সেই বর্ণ বা বর্ণসমষ্টিকে ধাতুবিভক্তি বলা হয়। যেমন–অ, ও, এ, এন, ই, ইল, ইতেছি, ইয়াছেন ইত্যাদি। ধাতুবিভক্তি ক্রিয়াপদের কাল ও পুরুষ নির্দেশ করে।
এখন, বাক্য কাহাকে বলে, দেখ:
৬৪। বাক্য ও যে-সমস্ত সুসজ্জিত পদের দ্বারা মনের কোনো একটি ভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা যায়, সেই পদসমষ্টিকে বাক্য বলে।
সুসজ্জিত কথাটির উপর বিশেষ লক্ষ্য রাখিবে। এলোমেলো শব্দসমষ্টিতে বাক্য হয় না। “নরেন টেবিল গোরু মাঠ”–বাক্য নয়। কিংবা যদি বলি–“দলিলটি কাটিয়াছে মূল্যবান্ পোকায়”–ইহাও বাক্য নয়। বলিতে হইবে—”মূল্যবান দলিলটি পোকায় কাটিয়াছে।”–এইবার বক্তব্য বিষয়টি পরিস্ফুট হইল।
বাক্যে প্রযুক্ত পদের সংখ্যা যাহাই হউক না কেন, প্রত্যেকটি বাক্যের দুইটি প্রধান অংশ থাকে? (১) উদ্দেশ্য ও (২) বিধেয়।
“বাঁশি বাজে বনমাঝে কি মনমাঝে!”–কী বাজে?–বাঁশি। অতএব বাক্যটিতে ‘বাঁশি’-কে উদ্দেশ করিয়া কিছু বলা হইতেছে। সেইজন্য “বাঁশি” উদ্দেশ্য। আবার, বাঁশি কী করে?–বাজে বনমাঝে কি মনমাঝে। এই অংশটির। দ্বারা বাঁশির সম্বন্ধে কিছু বলা হইতেছে। অতএব “বাজে বনমাঝে কি মনমাঝে এই অংশটি বিধেয়।
৬৫। উদ্দেশ্য : যাহাকে উদ্দেশ করিয়া কিছু বলা হয়, তাহাই বাক্যের উদ্দেশ্য।
৬৬। বিধেয় উদ্দেশ্য-সম্বন্ধে যাহাকিছু বলা হয়, তাহাই বাক্যের বিধেয়।
অতএব দেখিলাম, একাধিক বর্ণের সার্থকসমন্বয়ে যেমন পদের সৃষ্টি, তেমনি একাধিক পদের সুষ্ঠু বিন্যাসে বাক্যের সৃষ্টি।
এইবার বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ, ক্রিয়া ও অব্যয়–ইহাদের সাধারণ। পরিচয়টুকু আলোচনা করিব।
বিশেষ্য
৬৭। বিশেষ্যঃ যে শব্দে কোনো ব্যক্তি, বস্তু, স্থান, জাতি, গুণ, ধর্ম, অবস্থা, কার্য, সমষ্টি ইত্যাদির নাম বুঝায়, তাহাকে বিশেষ্যপদ বলে।
বিশেষ করিয়া বলা হয় বলিয়াই নামটি বিশেষ্য। আর, একটিমাত্র শব্দের দ্বারা কাহাকেও বিশেষ করিতে হইলে তাহার নামটি বলা ছাড়া উপায় নাই। সুতরাং ‘বিশেষ্য’ কথাটির অর্থ হইতেছে কোনোকিছুর নাম। যেমন–রবীন্দ্রনাথ, কাশী, কাঞ্চী, বেদ, আকাশ, বাতাস, সোনা, পা, ব্রাহ্মণ, হিন্দু, খ্রীষ্টান, বৃক্ষ, ব্যাঘ্র, সভা, পাঠাগার, সোনা, মহত্ত, যৌবন, শৈত্য, গৌরব, আচরণ, শ্রবণ, শুশ্রষা ইত্যাদি। এই নয় শব্দ বিভক্তিযুক্ত হইয়া বাক্যে প্রযুক্ত হইলেই তাহাকে বিশদ বলে। যেমন, “কাব্যজগতে যার নাম আনন্দ, তারই নাম (না।” যার বাহুতে শক্তি নেই, তার হৃদয়ের ভক্তিও নিরর্থক। “আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি।” বিজ্ঞান মানবসমাজকে দিচ্ছে জীবনীরস, সাহিত্য দিচ্ছে আনন্দরস। “ভারতের উদারতার সীমা আকাশ, তার সহ্যের সীমা সম্ভবতঃ হিমালয়।” “কবির সিংহাসন তৈরী হয় না, নিজের থেকে জন্মায়।” পতিত জমিতে পড়া বীজ বসন্তের হাওয়ায় ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে। “আত্মশক্তির আবিষ্কারই শিক্ষার উদ্দেশ্য।” “ক্রিস্টোফার ঈশারউডের মতে শ্রীরামকৃষ্ণ হচ্ছেন অত্যাশ্চর্য একটি ঘটনা (Phenomenon)।”
সর্বনাম
যশোদা বেশ শান্ত মেয়ে। যশোদা প্রতিদিন মন দিয়া যশোদার পড়াশুনা। করে। এইজন্য যশোদার শিক্ষিকাগণ যশোদাকে খুবই ভালোবাসেন।–এই বাৰ্যগুলিতে বারবার যশোদা বলায় আদৌ শুনিতে ভালো লাগিতেছে না। কিন্তু যদি বলি, “যশোদা বেশ শান্ত মেয়ে। সে প্রতিদিন মন দিয়া তাহার পড়াশুনা করে। এইজন্য তাহার শিক্ষিকাগণ তাহাকে খুবই ভালোবাসেন।” তাহা হইলে শুনিতে ভালোই লাগিবে। যশোদা’ বিশেষ্যপদটি প্রথমে একবার উল্লেখ করিয়া। যশোদা’ পদটির পরিবর্তে সে, যশোর সদাটর পরিবর্তে তাহার এবং ‘যশোদাকে’ পদটির পরিবর্তে তাহাকে ব্যবহার করা হইয়াছে। এই সে, তাহার, তাহাকে–এক-এটি সর্বনামপদ।
৬৮। সর্বনাম : পুর্বে উল্লিখিত কোনো বিশেষ্যপদের পুনরুল্লেখ না করিয়া তাহার পরিবর্তে যে পদ ব্যবহার করা হয়, তাহাকে সর্বনামপদ বলে। যেমন–আমি, তুমি, তাহারা, উনি, যাহা, যিনি, কে, কাহারা, সে, নিজ, আপনি, উভয়, সকল ইত্যাদি। সকলরকম বিশেষ্যপদের পরিবর্তে এইসকল পদ ব্যবহৃত হয় বলিয়াই ইহাদের নাম সর্বনামপদ। যেমন—”যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?”
বিশেষণ
বিনয়ী ছাত্রকে সব শিক্ষকই ভালোবাসেন। দুনিয়ায় পয়সাওয়ালা লোকেরই। সম্মান বেশী। “সাত ভাই চম্পা, জাগো রে।” মধ্যম পাণ্ডব অভিমন্যুর পশ্চাতেই ছিলেন। “সুরনদীর কুল ডুবেছে সুধানিঝর-ঝরা।”
‘বিনয়ী’ পদটি ‘ছাত্রকে’ পদের পূর্বে বসিয়া ছাত্রটির গুণ প্রকাশ করিতেছে। ‘পয়সাওয়ালা’ পদটি লোকটির অবস্থা দেখাইয়া দিতেছে। বেশী’ পদটি সম্মানের পরিমাণ প্রকাশ করিতেছে। সাত’ পদটি ভাই-এর সংখ্যা জানাইয়া দিতেছে। ‘মধ্যম’ পদটি পাণ্ডবের ক্ৰম বুঝাইয়া দিতেছে। সুধানিঝর-ঝরা’ পদটি সুরনদীর গুণ প্রকাশ করিতেছে। এইজন্য বিনয়ী, পয়সাওয়ালা, বেশী, সাত, মধ্যম, সুধানিঝর-ঝরা এক-একটি বিশেষণপদ।
৬৯। বিশেষণ : যে পদ বিশেষ্যের গুণ, ধর্ম, অবস্থা, পরিমাণ, সংখ্যা ইত্যাদি জানাইয়া দেয়, সেই পদকেবিশেষণপদ বলে। বিশেষণপদ যে পদটিকে বিশেষিত করে সাধারণতঃ তাহার পূর্বেই বসিয়া থাকে।
ক্রিয়াপদ
“ঝুরু ঝুরু পাতাগুলি কাঁপছে সমীরে।” “ডিঙাখানি বেঁধে কূলে জেলে ঘরে যায়।” “বন্ধ নাশিবে, তারাও আসিবে, দাঁড়াবে ঘিরে।” “দেখিতে দেখিতে নেত্র হইল নিশ্চল।” “ঘুম ভেঙেছে, আর কি ঘুমাই।”–এখানে কাপিছে, যায়’, ‘নাশিবে’, ‘আসিবে’, ‘দাঁড়াবে’, হইল’, ‘ভেঙেছে’, ‘ঘুমাই’ দ্বারা কোনো-না কোনো কাজ করা বুঝাইতেছে। ইহাদিগকে ক্রিয়াপদ বলে।
৭০। ক্রিয়া : বাক্যের অন্তর্গত যে পদের দ্বারা বিশেষ্যের যাওয়া, আসা, করা, থাকা, খাওয়া ইত্যাদি কোনো কাজ করা বুঝায় সেই পদকে ক্রিয়াপদ বলে।
ক্রিয়ার মূল হইতেছে ধাতু। ধাতুর সহিত ধাতুবিভক্তিযোগে ক্রিয়াপদ গঠিত হয়। ক্রিয়াপদে মূল ধাতুর অর্থটি অটুট থাকে। লক্ষ্য কর, উপরের ক্রিয়াপদগুলির দ্বারা কোনো কাজ শেষ হওয়া বুঝাইতেছে। এই ধরনের ক্রিয়াকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে।
৭১। সমাপিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়াতে বাক্য শেষ হইয়া যায়, আর বলিবার বা শুনিবার কিছু থাকে না, তাহাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে।
সমাপিকা ক্রিয়া বাক্যের অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ। ইহা বাক্যের বিধেয় অংশের মূল। ইহা ব্যতীত বাক্যরচনা অসম্ভব।
সমাপিকা ক্রিয়া সাধারণতঃ বাক্যের শেষে বসে। কিন্তু কবিতায় ছন্দোমাধুর্য রক্ষা করিবার জন্য সমাপিকা ক্রিয়াকে সুবিধামতো যেকোনো স্থানে বসানো হয়। আবার গদ্য রচনাতেও বিশেষ জোর দিয়া বলিবার সময় কিংবা বাক্যটিকে সুমিষ্ট করিবার জন্য সমাপিকা ক্রিয়াটিকে অন্যত্র বসানো হয়।
কবিতায় : “পোয় রজনী, জাগিছে জননী বিপুল নীড়ে।” “এসো ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন।” “ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।” “পড়িছে গভীর শ্বাস গানের বিরামে।” “বুকে আছে আঁকা বৈশাখী ঝঞ্ঝায় কার কবে হায় ভেঙ্গেছিল শাখা।” “দেখেছি নিজের জ্ঞাতি দুর্যোগের মায়ার আড়ালে।” ঝঙ্কারিল মুহুর্মুহুঃ বকুলগন্ধে পাগল-করা নিদহারা এক পিক। “আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকামালতী।”
গদ্য-রচনায় ও “আমাদের বাসার নিকটে ছিল একটি মুদিখানা।” “তার পাশে থাকত দুটি মেয়ে।” “বৃদ্ধ পড়ছিল রামচন্দ্রের সেই সেতুবন্ধনের কথা।” “লর্ড লিটনের সময় লিখিয়াছিলাম পদ্যে।” “খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ অব্দেও সুদূর পশ্চিমে…
ক্রীট দ্বীপের সঙ্গে চলত বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক।”–অধ্যাপক লর্ড বেশাম। “বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শরৎচন্দ্রের ভিতর ঘটিয়াছে যুগসন্ধি।”–শশিভূষণ। খ্রীষ্টের জন্মের উনিশ বছর আগে শেষ হয়েছিল ভার্জিলের এনিড মহাকাব্য।
মাঝে মাঝে সমাপিকা ক্রিয়া ঊহ্য রাখিয়াও বাক্যরচনা করা যায়।–”তথাপি দেশে ফিরিবার নামে তাহার বড়োই আনন্দ।” নেতাজী ভারতগৌরব। “শাস্ত্রমতে : যেটা সর্বাপেক্ষা অখাদ্য সেইটাতে তার বিশেষ পরিতৃপ্তি।” আকাশ যে এখনও মেঘাচ্ছন্ন। এই বাক্যগুলিতে যথাক্রমে হইল’, ‘হন’, ‘ছিল এত রহিয়াছে। সমাপিকা ক্রিয়াপদগুলি উহ্য আছে।
সমাপিকা ক্রিয়া ছাড়া আর এক ধরনের ক্রিয়া আছে, যাহার দ্বারা বাক্য শেষ হয় না। এই শ্রেণীর ক্রিয়াকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে।
৭২। অসমাপিকা ক্রিয়া : যে ক্রিয়া বাক্য শেষ করিতে পারে না, আরও কিছু শুনিবার বা বলিবার আকাঙ্ক্ষা থাকিয়া যায়, সেই ক্রিয়াকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। “রামকানাই কাগজ-কলম লইয়া প্রস্তুত হইলেন।” “দেশলাই তৈরি করিতে হইবে, তাহার কাঠি পাওয়া শক্ত।” মন দিয়া পড়াশুনা করিলে ভালো ফল পাইবে। “উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে।” “বিশ্বভুবন আঁধার করে তোর রূপে মা সব ভূবালি।” “বার বার তার ললাট চুমিয়া জুড়ায়ে দিলেন ক্ষত।” “আর কোনো রাজা সিংহাসনে চড়িয়া বসিয়া রাজত্বের পেখম সমস্তটা ছড়াইয়া দিয়া এমন অপূর্ব নৃত্য করে নাই।” গোলাপ দেখে মনটা আমার গুনগুনিয়ে ওঠে। “সোনালী মেঘ কাজল হয়ে ঘিরল অবনীরে।”
অসমাপিকা ক্রিয়া চিনিবার সহজ উপায়–এই ক্রিয়ার শেষে সাধু ভাষায় -ইয়া, -ইলে, -ইতে বিভক্তি এবং চলিতে -এ, -লে, -তে বিভক্তি যুক্ত থাকে। মনে রাখিও, অসমাপিকা ক্রিয়া কোনোদিনই উহ্য থাকে না।
আমরা এতক্ষণ বিশেষ্য, সর্বনাম, বিশেষণ ও ক্রিয়া এই চারিকার পদের আলোচনা করিলাম। ইহাদিগকে সব্যয়পদ বলে। কেননা লিঙ্গ, বচন, পুরুষ, কারক ইত্যাদি ভেদে স্থলবিশেষেইহাদের রূপান্তর ঘটে। রাম’ এই বিশেষ্যপদটি রামেরা, রামকে, রামেদের ইত্যাদি রূপে পরিবর্তিত হয়। তুমি’ সর্বনামপদটিও তেমনি তোমরা, তোমাকে, তোমাদের ইত্যাদি বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। ‘করি’ ক্রিয়াপদটি ওইভাবে করিবে, করিলাম, করুন, করতিস, করিয়াছিলেন ইত্যাদি রূপে পরিবর্তিত হয়। ধনবান্ বিশেষণটি ধনবতী রূপ লাভ করে। ব্যয় বা পরিবর্তন আছে বলিয়াই এই-সকল পদ সব্যয়।
৭৩। সব্যয়পদ? লিঙ্গ বচন পুরুষ ও বিভক্তিভেদে বিশেষ্য সর্বনাম ক্রিয়া ও বিশেষণপদের রূপান্তর ঘটে বলিয়া এই পদগুলিকে সব্যয়পদ বলে।
অব্যয়
কিন্তু বাংলা ভাষায় অথচ, এবং, বরং, তথাপি, মরি মরি, যেহেতু, গমগম, ছলছল, কেন, স্বয়ং ইত্যাদি এমন এক ধরনের পদ আছে, কোনো অবস্থাতেই যাহাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। এই শ্রেণীর পদকে অব্যয় বলে। তোমরা কি কখনও অথচরা, এবংদের, তথাপিকে, যেহেতুগণ ইত্যাদি শুনিয়াছ, না বলিয়াছ?
৭৪। অব্যয় সকল লিঙ্গ বচন পুরুষ ও বিভক্তিতে যে পদ একই রূপে থাকে, কোনো অবস্থাতেই যাহার কোনোরূপ পরিবর্তন হয় না, তাহার নাম অব্যয়।
কয়েকটি অব্যয়ের উদাহরণ দেখ–“শত ধিক্ তোরে, রে লক্ষ্মণ, ক্ষত্ৰকুলগ্নানি।” “শ্রীকৃষ্ণ বলশালী, সুতরাং ক্রোধশূন্য এবং ক্ষমাশীল।” “আমি কহিলাম, আরে রাম রাম, নিবারণ সাথে যাবে। আপনি তো বলেই খালাস, কিন্তু ঠেলা সামলাবে কে? “অপিচ দুঃখের সম্মুখে আসিবামাত্র তাহার ব্যক্তিত্ব একেবারে অভিভূত হইয়া যাইত।” “হাসে কাঁদে সদাই ভোলা জানে না সে আমা বই।” ভগবান্ কি তপস্যার জিনিস, না ভালোবাসার?
অনুশীলনী
১। সংজ্ঞার্থ বল : শব্দ, পদ, শব্দবিভক্তি, ধাতুবিভক্তি, বাক্য, উদ্দেশ্য, বিধেয়, অব্যয়, সব্যয়পদ।
২। শব্দ ও ধাতু কী করিয়া পদে পরিণত হয়? উদাহরণদ্বারা বুঝাইয়া দাও।
৩। বাক্যের সহিত পদের সম্পর্ক কী? পদ কয় প্রকার? প্রত্যেক প্রকার পদের একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
৪। নামপদ কয়টি ভাগে বিভক্ত? পাঠ-সংকলনের অদ্যকার পাঠ হইতে প্রত্যেক প্রকার নামপদের যতগুলি পার উদাহরণ সংগ্রহ কর।
৫। ক্রিয়াপদ কাহাকে বলে? ক্রিয়াপদ কী প্রকারে গঠিত হয়? পাঠ-সংকলনের অদ্যকার পাঠ হইতে ক্রিয়াপদগুলি সংগ্রহ কর। উহাদের মধ্যে কোন্গুলি সমাপিকা ও কোন্গুলি অসমাপিকা নির্দেশ কর।
৬। ‘বেশ’ শব্দটিকে বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়া-বিশেষণ ও অব্যয়-রূপে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।
৭। বন্ধনীমধ্য হইতে উপযুক্ত অংশটি বাছিয়া লইয়া শুনাস্থান পূর্ণ কর :
(i) ….. ক্রিয়াপদ বাক্যে উহ্য থাকিতে পারে। [ সমাপিকা / অসমাপিকা ]
(ii) ধাতুর সঙ্গে ….. যোগ করিয়া ক্রিয়াপদ পাই। [ শব্দবিভক্তি ধাতুবিভক্তি )
(iii) শব্দের সঙ্গে শব্দবিভক্তি যোগ করিয়া … পাই। [ ক্রিয়াপদ / নামপদ ]
৮। নীচে পাঁচটি করিয়া শব্দ, শব্দবিভক্তি, ধাতু ও ধাতুবিভক্তি ছড়ানো রহিয়াছে। শব্দবিভক্তিযোগে শব্দগুলিকে নামপদ ও ধাতুবিভক্তিযোগে ধাতুগুলিকে ক্রিয়াপদে পরিণত করিয়া প্রত্যেকটি পদ দিয়া এক-একটি বাক্যরচনা করঃ ইতেছিল, এরা, খে, রে, খা, দের, এ, ইলাম, লোক, শুন, রুমা, তুমি, ইবে, পড়, উক, আমি, ইলে, কর, কে, বালক।
৯। নিম্নলিখিত বাক্যগুলির অন্তর্গত প্রতিটি পদের শ্রেণীনির্দেশ কর।
‘সুদূর প্রাচ্যের শ্যামল ক্ষেত্রে পড়িয়াছিল পশ্চিমের সোনালী আলো।”–শশিভূষণ। বিপ্লবের মূলে থাকবে বলিষ্ঠ দেশপ্রেম, কোনো রাজনীতিক ইজ নয়। ব্যক্তিত্ব জিনিসটি যে কী, তা সুধাংশুবাবুর সান্নিধ্যে এলেই বোঝা যেত। “সেই বাগবাজার থেকে থেকে-থেকেই ছুটে আসে পাগলের মতো।” “ওমা, এ কী! এ তুই কী হয়েছিস?” “তোমার হাতের মোহনবাঁশি বাজল ভূবনময়।” “বেদের প্রত্যেকটি শব্দ পবিত্র।” পালিশ-করা সভ্যতায় প্রাণ ভরে না, কেবল চোখ ধাঁধিয়ে যায়। চন্দন ঘষতে ঘষতে তার দারুত্ব লোপ পায়, কিন্তু তার সৌরভ চারুত্বমণ্ডিত হয়ে ওঠে। কমেডির হাস্য এবং ট্রাজেডির অশ্রুজল দুঃখের তারতম্যের উপর নির্ভর করে। “এক ঘরে মানুষের মেলা, অন্য ঘরে থাকুক ঈশ্বর।” চিনতে পেরেই উৎফুল্ল হাসি ছড়িয়ে দিলেন তিনি আমার ক্লান্ত চোখেমুখে। সিলেবাস-মাফিক শিক্ষাদানটুকুই সাহিত্যশিক্ষকের কর্তব্য নয়, সাহিত্যের উদার অঙ্গনে প্রবেশের সবুজপত্র ছাত্রের হাতে তুলে দিতে হবে। “সকল কার্যেই ভ্রমপ্রমাদ আমাদের একমাত্র শিক্ষক।” “আত্মবোধ জাগিলেই মানুষ হিংসা ভুলিয়া যায়। বন্ধুর সঙ্গে প্রয়োজন হলে আমাদের বন্ধুর পথেও চলতে হবে। কান্না যদি অকৃত্রিম হয়, তাহলে তা নিরালার সম্প। “মৈত্রেয়ীকে নিয়ে বনে যাওয়া চলে, কিন্তু কাত্যায়নীকে ছেড়ে ঘরকন্না চলে না।” “পাথরের চাপ চারিদিকে পড়ে বলিয়াই উৎস ঊর্ধ্বগামী।” “শান্তিনিকেতনের প্রকৃতি রবীন্দ্রকাব্যের টীকাকার আর স্বয়ং বিশ্বপ্রকৃতি বুধীন্দ্রকাব্যের মল্লিনাথ।” “উন্নততম সভ্যতায় সর্বোত্তম আনন্দ হচ্ছে গ্রন্থ।”-ইমার্সন। “বুকের ব্যথায় আসন পাতা, বস মা সেথা দুখদুলালী।” “জীবনে মহতের আর বৃহতের শেষ সীমাই ঈশ্বর।” ধর্মের উদ্দেশ্য চিত্তে আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্ৰৎ করা, পারস্পরিক ঘৃণা জাগানো নয়। আত্মচেতন মানুষই আত্মনির্ভর হয়। “সহজ কথা যায় না বলা সহজে।”সমস্ত বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান ঈশ্বর। “যথার্থ ভদ্রতার স্বভাবই হচ্ছে অপ্রগভ।” রসালো শাঁস ভিতরে থাকে, বাইরে যেটা দেখি সেটা ছোবড়া। সহনশীলতাই সহজসাধন। কবিরা সমকালের প্রেক্ষাপটে চিরকালের ছবি আঁকেন। বিত্তবানেরা কঠোর জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলে দরিদ্ররাও দুঃখকষ্ট সহ্য করার মানসিকতা পাবে। স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে পরের জন্য ত্যাগস্বীকার ও অধিক পরিশ্রমের অঙ্গীকার। পরকে সুখী করিবার চেষ্টাতেই মানুষের নিজের সুখ নিহিত। “সত্যের চেয়েও হিতকথাই বেশী বলবে।” “যেখানে সংযম সেখানেই শক্তি, আর যেখানে শক্তি সেখানেই শাস্তি।” “বাণে ক্রুসে বা ক্যানসারে কোনো প্রভেদ নেই।” “মর্ত-তনুদ্বারাই দিব্যগতি লাভ করা যায়।” উৎসবের আরেক নাম সংযম। “শুদ্ধান্ন থেকেই সত্ত্বশুদ্ধি, সত্ত্বশুদ্ধিতেই ধ্রুবস্মৃতি।”–উপনিষৎ। “তুমি মরণ ভুলে কোন্ অনন্ত প্রাণসাগরে আনন্দে ভাস।” মনুষ্যত্বের চেয়ে মনস্বিতা বড়ো। ইওরোপে জীবনের মূল্য যত, প্রাণের মূল্য তত নয়।” সহ্য করে যাওয়াই তো সাধন করে যাওয়া। যে বাক্যদ্বারা জীবের সমধিক মঙ্গল সাধিত হয় তাহাই। সত্যবাক্য। “যেটিতে তোমার রতি সেটিতেই ভগবানের আরতি।” “তোমার উতলা উত্তরীয় তুমি আকাশে উড়ায়ে দিও।”