ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – পুরুষ
পুরুষ শব্দটির অর্থ হইল ক্রিয়ার আশ্রয়। ব্যাকরণে পুরুষ কথাটির সহিত স্ত্রী-পুরুষ-লিঙ্গবোধের কোনো সম্পর্ক নাই। ইহা একটি পারিভাষিক নামমাত্র পৃথিবীর সমস্ত ব্যক্তি বা বস্তু ব্যাকরণ-মতে কোনো-না-কোনো পুরুষ।
ইংরেজী ও সংস্কৃতের মতো বাংলাতেও পুরুষ তিনটি—(১) উত্তমপুরুষ, (২) মধ্যমপুরুষ ও (৩) প্রথমপুরুষ।
উত্তমপুরুষ (First Person)
৮৪। উত্তমপুরুষ : বক্তা নিজ নামের পরিবর্তে যে সর্বনাম প্রয়োগ করেন তাহাই উত্তমপুরুষ। সর্বনাম ‘আমি’ ও তাহার একবচন-বহুবচনের বিবিধ রূপ হইতেছে উত্তমপুরুষ।
প্রাচীন বাংলায় ‘মুই’ ছিল একবচনের, ‘আমি বহুবচনের। এখন একবচনে ‘আমি’ আর বহুবচনে ‘আমরা’ দাঁড়াইয়াছে। “মুই” কথাটি প্রাচীন কাব্যে যথেষ্ট লক্ষ্য করা যায়, অবশ্য বানানে কখনও কখনও মুঞি’ লেখা হইত।—”জগ-বাহির নহ মুঞি ছার।” বৈষ্ণব কবিতায় “আমি” স্থলে “হাম”, “আমার” স্থলে “মঝু”, “আমায়” স্থলে “মোয়” প্রভৃতি প্রয়োগ খুবই দেখা যায়। “মাধব হাম পরিণাম নিরাশা।” “হরি গেও মধুপুর হাম কুলবালা।” “পিয়া যব আওব এ মঝু গেহে”। “আজু মঝু গেহ গেহ করি মানলু।” “কি পুছসি অনুভব মোয়।”
আধুনিক কবিতায় শব্দগুলির সাক্ষাৎ বড়ো-একটা পাই না, তবে বঙ্গদেশের বহু অংশে অশিক্ষিত লোকের মুখে ‘মুই’ কথাটি শোনা যায়। অথচ মোর মোরে মম মোরা মোদের আমারে—এই রূপগুলি বাংলা কবিতায় আজও আদরণীয় হইয়া রহিয়াছে। “নমোনমো নমঃ সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি।” “কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠাবিহীন নিত্যকালের ডাক।” “তব শ্রীচরণতলে নিয়ে এস মোর মত্ত বাসনা ঘুচায়ে।” “হে দারিদ্র্য! তুমি মোরে করেছ মহান।” “আমারে রাজার সাজে বসায়ে সংসার-মাঝে কে তুমি আড়ালে কর বাস!” “আমা সবাকার পুণ্য জন্মভূমি এই।” “আমায় ছ জনায় মিলে পথ দেখায় বলে পদে পদে পথ ভুলি হে।” “মোরা গৌরবেরই কান্না দিয়ে ভরেছি মার শ্যাম আঁচল।” স্বামীজী বলতেন, “আমি অশরীরী বাণী, আমি জগতের নৈর্ব্যক্তিক সত্তা।” আমি, আমরা, আমার, আমায়, আমাদের ইত্যাদি রূপগুলি গদ্যপদ্য-নির্বিশেষে সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়।
স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে যেকোনো ব্যক্তিই নিজের সম্বন্ধে উত্তমপুরুষের সর্বনাম ব্যবহার করিতে পারেন। জনার্দন যজ্ঞেশ্বরকে বলল, “আমার জ্যামিতি বইটা হারিয়ে গেছে ভাই। তোর বইখানি যদি দিনকতক আমাকে দিস।” উমাকে আসতে দেখে রুমা বলে উঠল, “কি রে, আমাদের যে একেবারেই ভুলে গেছিস, দেখছি।”
অচেতন পদার্থেও যখন প্রাণসত্তা আরোপ করা হয়, তখন উত্তমপুরুষের প্রয়োগ হইতে পারে। “কণাগুলি একে অন্যকে ডাকিয়া বলিল, ‘আইস, আমরা পৃথিবীর দেহ নূতন করিয়া নির্মাণ করি।’ ”
উত্তমপুরুষের স্থানে অহঙ্কার প্রকাশ করিতে শর্মা আর বিনয় প্রকাশ করিতে দীন, সেবক, অধীন, গরিব, অকিঞ্চন, বান্দা গ্রভৃতি দীনতাসূচক শব্দ প্ৰয়োগ করা হয়। গোড়া কেটে মাথায় যতই জল ঢাল না কেন, এ অপমানের কথা শর্মা কোনোদিনই ভুলবে না। “অমর করিয়া বর দেহ দাসে, সুবরদে।” কী কারণে অকিঞ্চনে স্মরণ হয়েছে প্রভু? প্রয়োজন হলে এ বান্দাকে স্মরণ করে কৃতার্থ করবেন, জনাব। হুজুরের চরণে একবার যখন ঠাঁই পেয়েছি, গরিবকে আর বঞ্চিত করবেন না।
তৎসম শব্দের অনুকরণে মগৃহ, অস্মভবন, মৎসদৃশ, মৎপ্রণীত প্রভৃতি সমাসবদ্ধ পদ, মদীয় অস্মদীয় প্রভৃতি সর্বনামীয় বিশেষণ এখনও বাংলা ভাষায় কিছু কিছু চলিতেছে। তবে মমত্ব, মমতা, অহমিকা, অহঙ্কার, আমিত্ব প্রভৃতি শব্দ বাংলায় বহুল প্রচলিত। “আমার আমিত্বটিকে তাঁরা এমনই আবিষ্ট করে রেখেছেন।”
মধ্যমপুরুষ (Second Person)
৮৫। মধ্যমপুরুষ : বক্তা সম্মুখস্থ কাহাকেও কিছু বলিবার সময় সেই ব্যক্তির নামের পরিবর্তে যে সর্বনাম ব্যবহার করেন তাহাই মধ্যমপুরুষ। সর্বনাম ‘তুমি’, ‘আপনি’ ও ‘তুই’—শব্দগুলির একবচন-বহুবচনের বিবিধ রূপই মধ্যমপুরুষ।
‘মুই’-এর মতো ‘তুই’ও প্রাচীনযুগে ছিল মধ্যমপুরুষের একবচন, আর ‘তুমি’ ছিল বহুবচন। আচার্য সুনীতিকুমার বলিয়াছেন, “একবচনের রূপ ‘তুই’ তুচ্ছতাবোধক হইয়া দাঁড়াইলে, বহুবচনের ‘তুমি’ গৌরবে বা আদরে একবচনের রূপ ধারণ করে। তদনন্তর ‘তুমি’-র নূতন বহুবচন রূপ ‘তোমরা’ প্রভৃতি দেখা দেয়।”
তুই : তুচ্ছতাজ্ঞাপক তুই’ সর্বনামটির কয়েকটি বিশিষ্ট প্রয়োগ লক্ষ্য কর।—(ক) অনাদরে বা তুচ্ছার্থে : তোর ব্যাপারখানা কী বল্ দেখি, মন দিয়ে কাজকর্ম করবি, না করবি না [ তুই ঊহ্য ]? তোদের কি কোনোদিনই কাণ্ডজ্ঞান হবে না? মায়ের মর্যাদা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়ে বীরত্বের বড়াই তোরাই করতে পারিস। [ নিম্নশ্রেণীর লোকেদের সম্বন্ধে ‘তুই’-এর ব্যবহার ভদ্রসমাজে উঠিয়া যাওয়াই উচিত। ]
(খ) স্নেহের গভীরতা বা সমবয়সীদের মধ্যে প্রীতির ঘনিষ্ঠতা প্ৰকাশে : “তুই প্রভাতের আলোর সমবয়সী” “কেষ্ট, আয় রে কাছে।” [তুই উহ্য] “ঘুমিয়ে গেছিস, নেতিয়ে গেছিস, বাছা আমার আদুরে!–ওরে আমার জাদু রে!” [ তুই ঊহ্য ] “কে দিল তোর মাথায় বালিশ?” “আজকে যে যা বলে বলুক তোরে।’ “সে তো গেছে এখান থেকে তোকে জাদু আমার কাছে রেখে।” তোর কলমটা একবার দে না, তাই মধু! “ওরে, তুই ভাবমুখে থাক্, আর যা পেলি তা বিলিয়ে দে।” “তুই কি না মাগো তাঁদের জননী, তুই কি না মাগো তাঁদের দেশ!” “ওলো তোরা আয় ওই দেখা যায় কুটির কাহার অদূরে।”
(গ) অপরিচিত ব্যক্তিদের প্রতি দরদভরা আহ্বানে : “আয় আয় আয় আছ যে যেথায়, আয় তোরা সবে ছুটিয়া।” “ওগো, আজ তোরা যাস্ নে গো তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।” “একবার তোরা মা’ বলিয়া ডাক্।”
(ঘ) দেবতাকে সম্বোধনে (সাধারণতঃ মাতৃশক্তির আরাধনায়) : “তোর মা কি তোর বাপের বুকে দাঁড়িয়েছিল এমনি করে?” “এবার কালী তোকে খাব।” “কালী হলি মা রাসবিহারী নটবর-বেশে বৃন্দাবনে।” [ তুই উহা ] “একবার খুলে দে মা চোখের ঠুলি, দেখি শ্রীপদ মনের মতো।” [ তুই ঊহ্য ] “তোর ছেলে মা অনাহারে ঘুরে বেড়ায় দ্বারে দ্বারে, তুই যে শ্যামা জগৎ-মাতা, নীরব হওয়া তোর কি সাজে? কানে কি তোর যায় না কাঁদন, মহাকালের শঙ্খ বাজে।” “আর লুকাবি কোথায় মা কালী (তুই উহ্য), বিশ্বভুবন আঁধার করে তোর রূপে মা সব ডুবালি … পূজা করে পাইনি তোরে এবার চোখের জলে এলি (তুই ঊহ্য), বুকের ব্যথায় আসন পাতা, বস মা সেথা দুখদুলালী” (তুহ ঊহ্য)—নজরুল।
[ তুইতোকারি, তুইমুই কেবল তুচ্ছার্থেই প্রযুক্ত হয়। ]
তুমি : সমবয়সী, বয়ঃকনিষ্ঠ, ঘনিষ্ঠ সহকর্মী বা নিম্নতমপদস্থ কর্মচারীর প্রতি তুমি সর্বনামটি ব্যবহৃত হয়। তুমি, তোমরা, তোমার, তোমাদের, তোমাকে ইত্যাদি সাধারণভাবে গদ্য-পদ্য সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়। তৰ তোমা তোরে তোমারে মাত্র কবিতায় প্রযুক্ত হয়। “তব গৌরবে গরব মানিব।” “থাকে যেন তোমা ‘পরে অখণ্ড বিশ্বাস।” “তোমারে করিল বিধি ভিক্ষুকের প্রতিনিধি।
জন্মভূমি ও দেবতাকে সম্বোধনে তুমি ব্যবহৃত হয়। “নিত্য যেথা তুমি সব কর্ম-চিন্তা-আনন্দের নেতা।” “তোমার কাছে আরাম চেয়ে পেলেম শুধু লজ্জা।” “তোমারে লইয়া শুধু করে পূজাখেলা।”
অবস্থাবিশেষে দূরস্থ বা পরলোকগত ব্যক্তির প্রতি মধ্যমপুরুষের সর্বনাম ব্যবহৃত হয়। তখন বক্তা কল্পনায় অনুপস্থিত ব্যক্তির উপস্থিতি অনুভব করেন। “চিরচঞ্চলের মাঝে তুমি কেন শান্ত হয়ে রও?” “বক্ষ তব দুলিত নিশ্বাসে।” “আমার নিখিল তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।” “শ্যামলে শ্যামল তুমি নীলিমায় নীল।” “তব সুর বাজে মোর গানে।”
প্রাচীন কবিতায় “তুমি”-র স্থলে “তুঁহুঁ”, “তোমার” স্থলে “তুয়া”, “তোমাকে” স্থলে “তোয়” প্রচলিত ছিল। এমনকি রবীন্দ্রনাথে (ভানুসিংহ ঠাকুর) পর্যন্ত “তুঁহুঁ”-র সাক্ষাৎ পাই। “তুঁহুঁ জগন্নাথ জগতে কহায়সি।” “মাধব বহুত মিনতি করি তোয়।” “তুয়া পদপল্লব করি অবলম্বন।” “কো তুঁহুঁ বোলবি মোয়।”
আপনি : সম্মানীয় ব্যক্তি, গুরুজন, উচ্চপদস্থ কর্মচারী, অল্পপরিচিত কিংবা অপরিচিত বয়ঃকনিষ্ঠদের প্রতি মধ্যমপুরুষের সন্ত্রমার্থক রূপ ‘আপনি’ যুক্ত হয়। আপনি আপনাকে আপনাদের প্রভৃতি গদ্যপদ্য-নির্বিশেষে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু আপনারে আপনায় মাত্র কবিতায় ব্যবহৃত হয়। “আপনারে অপরেরে নিয়োজিত তব কাজে।” “আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।” কিন্তু পরমগুরু পরমেশ্বর-সম্বন্ধে ‘আপনি’-র ব্যবহার কখনও হয় না।
‘আপনি’-র প্রয়োগ মধ্যমপুরুষ ছাড়া উত্তমপুরুষ ও প্রথমপুরুষেও পাওয়া যায়। “অয়ি লাবণ্যপুঞ্জে, সময় যেদিন আসিবে আপনি যাইব তোমার কুঞ্জে।” [ উত্তমপুরুষ ] আমি মৃগতৃষ্ণিকায় ভ্রান্ত হইয়া অনর্থক আপনাকে ক্লেশ দিতে উদ্যত হইয়াছি। [ উত্তমপুরুষ ] সকলেই এসে গেছেন, এখন শুধু আপনারই অপেক্ষা। [ মধ্যমপুরুষ সন্ত্রমার্থক ] “তুমি আপনি থাকো আলোর পিছনে।” “কী ধন তুমি করিছ দান না জান আপনি।” [ মধ্যমপুরুষ সাধারণার্থে ] মনুষ্য আপনি আপনার উদ্ধারকর্তা। [ প্রথমপুরুষ সাধারণার্থে ]
‘আপনি’-র স্থলে অনেক সময় প্রভু, মহারাজ, জনাব, মহাশয় প্রভৃতি ব্যবহার করা হয়। মহাশয়ের নিবাস কোথায়? “হুজুর, আমি মন্তর-তন্তর কিছুই জানি নে।” “বান্দাকে চিরকাল বান্দা বলেই জানবেন, জনাব।”
সংস্কৃতের অনুকরণে ত্বৎসদৃশ, ত্বদনুগ্রহ, ত্বদীয়, ভবদীয় প্রভৃতি শব্দও বাংলা ভাষায় চলিতেছে।
মনে রাখিও, বিশেষ্যপদ কখনও উত্তমপুরুষ বা মধ্যমপুরুষ হয় না।
প্রথমপুরুষ (Third Person)
৮৬। প্রথমপুরুষ : অনুপস্থিত কোনো ব্যক্তি বা দূরস্থিত কোনো বস্তুর সম্বন্ধে কিছু বলিবার সময় সেই ব্যক্তি বা নামের পরিবর্তে যে সর্বনাম বা বিশেষ্যপদ ব্যবহৃত হয় তাহাই প্রথমপুরুষ। উত্তমপুরুষ ও মধ্যমপুরুষ ব্যতীত বিশ্বের যাবতীয় ব্যক্তি বা বস্তু প্রথমপুরুষ।
সে, তিনি, ও, উনি, তারা, তাঁরা, তাঁহার, তাঁহাদের, তাঁহাকে, তাঁহাদিগকে, ইঁহাদের প্রভৃতি যাবতীয় সর্বনামপদ এবং সকল শ্রেণীর বিশেষ্যপদ (বিশেষ্যরূপে ব্যবহৃত অন্য পদও) প্রথমপুরুষ। সর্বনামের মধ্যে সে, ও, যে, তারা প্রভৃতি সাধারণভাবে এবং তিনি, উনি, ইনি, যিনি, তাঁহারা প্রভৃতি সম্মানার্থে ব্যবহৃত হয়। যারে, যাঁরে, তারে, তাঁরে, তাহারে, তাঁহারে, যাহারে, যাঁহারে—কেবল কবিতায় ব্যবহৃত হয়। “যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে।” “এবার তোর ভরা আপণ, বিলিয়ে দে তুই যারে তারে।”
প্রথমপুরুষ সবসময়েই যে অনুপস্থিত থাকিবে বা দূরস্থিত হইবে, এমন কথা নয়। সম্মুখে উপস্থিত কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর সহিত বক্তা যখন সরাসরি কথা না বলে, তখনও সেই ব্যক্তি বা বস্তুটি প্রথমপুরুষ। এঁকে চিনতে পার বোধিসত্ত্ব? এমন জিনিস কখনও খেয়েছি বলে তো মনে পড়ছে না।
ঈশ্বর সম্বন্ধে মধ্যমপুরুষের সম্ভ্রমার্থক ‘আপনি’ চলে না বটে, প্রথমপুরুষের ‘সে’ও আবার চলে না, কিন্তু সম্মানার্থক প্রথমপুরুষে “তিনি” “যিনি” প্রভৃতি প্রয়োগ করিতে হয়। “এই অনন্ত সুন্দর জগৎশরীরে যিনি আত্মা তাঁহাকে ডাকি।” “ওরে, মানুষ দিলে কুলোয় না, তিনি দিলে ফুরোয় না।”
“আমার অন্তরতম আমি আলস্য-আবেশে বিলাসের প্রশ্রয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।” রবীন্দ্রনাথ। [ একটি অভিনব উদাহরণ—’আমি’ এখানে প্রথমপুরুষ। ] “সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি।” “তিনিটি জ্ঞান, তুমিটি ভালোবাসা।” [ তুমিটি= তুমি ভাবটি—প্রথমপুরুষ। ]
সে তাহা তা—সর্বনামগুলি সংস্কৃত “তদ্” শব্দ হইতে আসিয়াছে। এইজন্য, সন্ধি বা সমাসের পূর্বপদরূপে এই “তদ্” শব্দটি বাংলায় খুবই প্রচলিত—তদীয়, তদ্বারা, তন্মাত্র, তৎসন্নিধানে, তৎকর্তৃক, তৎপুরুষ, তৎপরতা, তন্নিবন্ধন, তৎসম।
পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপভেদ
লিঙ্গ ও বচনভেদে ক্রিয়াপদের রূপভেদ হয় না। একই ক্রিয়া পুংলিঙ্গে যেমন চলে, স্ত্রীলিঙ্গেও তেমনি চলে। একবচনে ক্রিয়ার যে রূপটি প্রয়োগ করি, বহুবচনেও সেই রূপটি প্রযুক্ত হয়। কিন্তু পুরুষভেদে সমাপিকা ক্রিয়ার রূপের পরিবর্তন হয়। এক পুরুষের সমাপিকা ক্রিয়া অন্য পুরুষে চলে না। আমি বা আমরা লিখি। এই লিখি ক্রিয়াটি উত্তমপুরুষের। ইহাকে মধ্যমপুরুষ বা প্রথমপুরুষে ব্যবহার করা চলে না। পুরুষ-অনুযায়ী ইহাকে একটু পরিবর্তিত করিয়া লইতে হয়। তুমি বা তোমরা লেখ; আপনি বা তিনি লেখেন।
মধ্যমপুরুষের তিনটি রূপ বলিয়া মধ্যমপুরুষের সমাপিকা ক্রিয়ারও তিনটি রূপ। (১) সাধারণ, (২) সম্মানবোধক ও (৩) তুচ্ছার্থক।
(১) সাধারণ : তুমি বা তোমরা লিখিবে (চলিতে-লিখবে)। (ভবিষ্যৎ কাল)
(২) সম্মানবোধক : আপনি বা আপনারা লিখিবেন (চলিতে—লিখবেন)। (ঐ)
(৩) তুচ্ছার্থক : তুই বা তোরা লিখিবি (চলিতে—লিখবি)। (ঐ)
এখানে দেখ, সাধারণ মধ্যমপুরুনের ক্রিয়া সম্মানবোধক বা তুচ্ছার্থক মধ্যমপুরুষে চলিতেছে না। সেইরূপ, সম্মানবোধক মধ্যমপুরুষের ক্রিয়া সাধারণ বা তুচ্ছার্থক মধ্যমপুরুষে চলিতেছে না; আবার, তুচ্ছার্থক মধ্যমপুরুষের ক্রিয়াও সাধারণ বা সম্মানবোধক মধ্যমপুরুষে চলিতেছে না।
প্রথমপুরুষের দুইটি রূপ বলিয়া প্রথমপুরুষের সমাপিকা ক্রিয়ারও দুইটি রূপ হয়। (১) সাধারণ ও (২) সম্মানবোধক।
(১) সাধারণ : সে বা তাহারা লিখিল (চলিতে-লিখল)। (অতীত কাল)
(২) সম্মানবোধক : তিনি বা তাঁহারা লিখিলেন (চলিতে—লিখলেন)। (ঐ) এখানেও দেখ, সাধারণ প্রথমপুরুষের ক্রিয়া সম্মানবোধক প্রথমপুরুষে যেমন চলে না, সম্মানবোধক প্রথমপুরুষের ক্রিয়াও তেমনই সাধারণ প্রথমপুরুষে চলিতেছে না। অতএব, কেবল পুরুষ হিসাবেই যে সমাপিকা ক্রিয়ার রূপভেদ হয় তাহা নয়। একই পুরুষের গুরুত্ব-লঘুত্ব-অনুসারেও সমাপিকা ক্রিয়ার রূপ—পরিবর্তন হয়। তবে সম্মানবোধক মধ্যমপুরুষ ও সম্মানবোধক প্রথমপুরুষের ক্রিয়া সর্বত্র একই রূপে থাকে।—
সম্মানবোধক মধ্যমপুরুষ : আপনি বা আপনারা লেখেন। (বর্তমান কাল)
সম্মানবোধক প্রথমপুরুষ : তিনি বা তাঁহারা লেখেন। (ঐ)
কিন্তু অসমাপিকা ক্রিয়া তিন পুরুষেই এক : আমি পড়া শেষ করিয়া লিখিব। তুমি পড়া শেষ করিয়া লিখিবে। তাঁহারা পড়া শেষ করিয়া লিখিবেন।
মাঝে মাঝে উত্তমপুরুষ ও মধ্যমপুরুষ উদ্দেশ্য ঊহ্য থাকে। সেই অবস্থায় ক্রিয়াটির সাহায্যেই ঊহ্য উদ্দেশ্যটিকে বাহির করিতে হয়। এই তো এলাম দিল্লি থেকে। [ আমি ঊহ্য—উত্তমপুরুষ ] “ভালোবাস, প্রেমে হও বলী।” [ তুমি ঊহ্য—মধ্যমপুরুষ সাধারণ ] সকাল-সকাল আসবেন। [ আপনি উহ্য—মধ্যমপুরুষ সম্ভ্রমার্থে ] আমি না আসা পর্যন্ত কোথাও যাস না যেন। [ তুহ ঊহ্য—মধ্যমপুরুষ তুচ্ছার্থে ] প্রথমপুরুষ উদ্দেশ্য ক্বচিৎ উহ্য থাকে। “আবার সাতগাঁ যাইবে, আবার পুরানো খেলুড়িদের সঙ্গে খেলা করিবে, গঙ্গায় স্নান করিবে, ঠাকুরদের বাড়ি ঘুরিবে, তাহার ভারী আহ্লাদ।”—হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। [ সে ঊহ্য ]
অতএব আমরা দেখিলাম, বিশেষণ আর অব্যয় ছাড়া অবশিষ্ট তিনটি পদ পুরুষভেদে পরিবর্তিত হয়।
অনুশীলনী
১। ব্যাকরণে পুরুষ কথাটির অর্থ কী? পুরুষ কয় প্রকার ও কী কী? প্রত্যেকটি পুরুষের দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।
২। বাংলায় কোন্ কোন্ পদের পুরুষ আছে? বিশেষ্যপদ কোন্ পুরুষ? সর্বনামপদ কোন্ পুরুষ?
৩। উত্তমপুরুষ কাহাকে বলে? উত্তমপুরুষের সর্বনামের কোনগুলি কেবল কবিতায় ব্যবহৃত হয়? উদাহরণ দাও। স্ত্রীপুরুষ-নির্বিশেষে যেকোনো বক্তাই নিজের সম্বন্ধে উত্তমপুরুষের সর্বনাম প্রয়োগ করিতে পারেন, উদাহরণ দাও।
৪। মধ্যমপুরুষ কাহাকে বলে? মধ্যম পুরুষকে কয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়? প্রত্যেকটির নাম বল এবং একটি করিয়া উদাহরণ দাও।
৫। আপনি’ কোন্ পুরুষ? শব্দটিকে তিনটি পুরুষেই প্রয়োগ করা যায়, উদাহরণ দাও। “নিল সে আমার কালব্যাধিভার আপনার দেহ ‘পরে।”—নামপদগুলির পুরুষ নির্ণয় কর।
৬। তুচ্ছার্থক মধ্যমপুরুষ কোনটি? সেটি কি সর্বদাই তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়? সেই সর্বনামটির বিচিত্র প্রয়োগ দেখাও।
৭। প্রথমপুরুষ কাহাকে বলে? প্রথমপুরুষকে যে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়, তাহাদের নাম বল এবং প্রত্যেকটির দুইটি করিয়া উদাহরণ দাও।
৮। আপনি, তুমি, তিনি, তাহারা, সে—কোগুলি ঈশ্বর-সম্বন্ধে ও কোন্গুলি পিতামাতা—সম্বন্ধে প্রয়োগ করা হয়?
৯। (ক) উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও : অহংকার-প্রকাশে উত্তমপুরুষ, বিনয়-প্রকাশে উত্তমপুরুষ, বয়ঃকনিষ্ঠের প্রতি ‘আপনি’, পরলোকগত ব্যক্তির প্রতি মধ্যমপুরুষ, উপস্থিত ব্যক্তির প্রতি প্রথমপুরুষ, পরমপূজ্যের প্রতি ‘তুমি’।
(খ) মুই, মঝু, হাম, তোয়, মোর, মোয়, শর্মা, বান্দা, আমি (প্রথমপুরুষ), আমিত্ব, গরিব (উত্তমপুরুষ), তুঁহুঁ, মদীয়, ভবদীয়, তদ্দ্বারা, তোরে, ত্বদীয়, তদীয়—প্রয়োগ দেখাও।
(গ) বাংলা কবিতায় ব্যবহৃত হয় এমন পাঁচটি উত্তমপুরুষের সর্বনাম, চারিটি মধ্যমপুরুষের সর্বনাম ও তিনটি প্রথমপুরুষের সর্বনাম উল্লেখ কর।
১০। (ক) পুরুষভেদে ক্রিয়ার রূপভেদ হয়, উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও। এ বিষয়ে অসমাপিকা ক্রিয়া-সম্বন্ধে তোমার বক্তব্য কী?
(খ) একই পুরুষে গুরুত্ব-লঘুত্ব-অনুসারে ক্রিয়ার রূপভেদ হয়—এই কথাটি কোন্ কোন্ পুরুষে প্রযোজ্য? উদাহরণ দাও।
(গ) সম্ভ্রমার্থক মধ্যমপুরুষ ও সম্ভ্রমার্থক প্রথমপুরুষের ক্রিয়া একই চেহারায় থাকে, উদাহরণ দাও।
১১। উত্তমপুরুষ, মধ্যমপুরুষ ও প্রথমপুরুষ উদ্দেশ্য উহ্য রাখিয়া দুইটি করিয়া বাক্য গঠন কর। ১২। নীচের নির্ভুল মন্তব্যটির মাথায় টিকচিহ্ন ( /) দাও এবং ভুল মন্তব্যটির মাথায় ক্রসচিহ্ন ( ×) দাও : (i) উত্তমপুরুষকে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়। (ii) মধ্যমপুরুষকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। (iii) প্রথমপুরুষকে দুইটি ভাগে ভাগ করা হয়। (iv) কোনো পুরুষের একবচনের ক্রিয়াপদ বহুবচনেও চলে। (v) তব মম আপনারে তোরে—গদ্যপদ্য-নির্বিশেষে ব্যবহৃত হয়। (vi) বিশ্বভুবনে প্রথমপুরুষের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশী।
১৩। মোটা অক্ষরের ক্রিয়াপদগুলির পুরুষ নির্ণয় কর : ছোটো আমিটা মাঝে মাঝে বড়ো জ্বালায়, দেখছি। এ কথা শিখলি কোথা, ওরে আদরিণী! তোকে না একটু অপেক্ষা করতে বললাম? “এতদিন কোথায় ছিলেন?” “আমার এই দেশেতেই জন্ম, যেন এই দেশেতেই মরি।” এখন আসছ কোথা থেকে? “ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে।” “আঁধার রাতে আছাড় খেয়ে তর্কবাগীশমশাই অতর্কিতে ভাঙ্গলেন দুই হাত।” “তুমি যত ভার দিয়েছ সে ভার করিয়া দিয়েছ সোজা, আমি যত ভার জমিরে তুলেছি সকলি হয়েছে বোঝা।” “ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।” “সকল কালিমা মুছে দিয়ে মোরে নিয়েছ আপন করে।” “মা আছেন আর আমি আছি।”