৪.১ শব্দ ও পদের পার্থক্য

চতুর্থ অধ্যায় – শব্দ-প্রকরণ

প্রথম পরিচ্ছেদ – শব্দ ও পদের পার্থক্য

তোমরা পড়িয়াছ, বাক্যের অর্থযুক্ত প্রতিটি অংশকে পদ বলে। পদ গঠিত হয় দুইভাবে—শব্দের সহিত শব্দবিভক্তিযোগে নামপদ এবং ধাতুর সহিত ধাতুবিভক্তিযোগে ক্রিয়াপদ। এই শব্দ কাহাকে বলে?

১৬৬। শব্দ : নামপদের বিভক্তিহীন মূল অংশ‍ই শব্দ।

প্রতিটি শব্দই অর্থবাচক হওয়া চাই। এক বর্ণেও শব্দ হয়, একাধিক বর্ণের সুষ্ঠু সংযোগেও শব্দ হয়। অ, আ, এ, ও ইত্যাদি এক বর্ণের শব্দ। একাধিক বর্ণের অর্থহীন সংযোগে কখনই শব্দ গঠিত হয় না।

শব্দ ও পদের পার্থক্য এই যে, শব্দ বিভক্তিযুক্ত হইয়া পদে পরিণত হইলে তবেই বাক্যে স্থানলাভের যোগ্যতা পায়। বাক্যে স্থানলাভের যোগ্যতা শব্দের নাই, মাত্র পদেরই আছে। এই দিক্ দিয়া বিচার করিলে বিশেষ্য বিশেষণ সর্বনাম অব্যয় প্রভৃতি নামপদ এবং সমাসবদ্ধ পদকে পদ না বলিয়া শব্দ বলা উচিত। অতএব প্রত্যেকটি নামপদই মূলতঃ শব্দ; কিন্তু কেবল শব্দ কদাপি পদ নয়।

গঠনরীতির দিক্ দিয়া শব্দ দুইপ্রকার—মৌলিক ও সাধিত।

১৬৭। মৌলিক শব্দ : যে শব্দকে বিশ্লেষণ করা যায় না তাহা মৌলিক শব্দ। মা, ভাই, হাত, পা, নাক, কান, ঘোড়া, উট, এক, দুই, হাঁ, রে, না, উঃ, ওঃ, ইশ্, ধিক্ ইত্যাদি। প্র, পরা, অপ, সম, নি, অব প্রভৃতি উপসর্গগুলিও মৌলিক শব্দ, কারণ ইহাদের নিজস্ব অর্থ আছে এবং ইহাদের বিশ্লেষণও করা যায় না। বাংলায় ব্যবহৃত বিদেশী শব্দগুলিরও বিশ্লেষণ চলে না, তাই তাহাদের মৌলিক শব্দ বলিয়া গণ্য করা হয়। বাস, রেল, দোয়াত, কাগজ, পেনসিল, চেআর, টেবিল, স্কুল, ক্লাস, সিনেমা, বেহালা, থিয়েটার ইত্যাদি।

১৬৮। সাধিত শব্দ : সমাসের দ্বারা গঠিত অথবা ধাতু বা শব্দের উত্তর প্রত্যয়যোগে গঠিত শব্দকে সাধিত শব্দ বলে। সাধিত শব্দমাত্রই বিশ্লেষণযোগ্য।

(ক) লজ্জার সহিত বিদ্যমান = সলজ্জ; মনঃরূপ কোকনদ = মনঃকোকনদ; কাগজে ও কলমে = কাগজেকলমে। আয়তাক্ষর শব্দগুলি সমাসের সাহায্যে গঠিত সাধিত শব্দ।

(খ) গম্ (ধাতু) + অনট্ (প্রত্যয়) = গমন; মুচ্ (ধাতু) + ক্তি (প্রত্যয়) = মুক্তি; পড় (ধাতু) + অন্ত (প্রত্যয়) = পড়ন্ত; খা (ধাতু) + আ (প্রত্যয়) = খাওয়া। এখানে আয়তাক্ষর শব্দগুলি কৃৎ-প্রত্যয়-যোগে গঠিত সাধিত শব্দ।

(গ) দশরথ (শব্দ) + ষ্ণি (প্রত্যয়) = দাশরথি; ঘর (শব্দ) + ওয়া (প্রত্যয়) = ঘরোয়া; ধূর্ত (শব্দ) + আমি (প্রত্যয়) = ধূর্তামি; রূপা (শব্দ) + আলি (প্রত্যয়) = রূপালী। এখানে আয়তাক্ষর শব্দগুলি তদ্ধিত-প্রত্যয়ের সাহায্যে গঠিত সাধিত শব্দ।

প্রত্যয়নিষ্পন্ন শব্দের দুইটি অংশ। প্রথম অংশ শব্দ কিংবা ধাতু, দ্বিতীয় অংশ প্রত্যয়। প্রথম অংশকে বলা হয় প্রকৃতি।

১৬৯। প্রকৃতি : প্রত্যয়নিষ্পন্ন শব্দের প্রথম অংশ যে শব্দ বা ধাতু তাহাকে প্রকৃতি বলে। প্রকৃতি দুইপ্রকার—(১) শব্দ-প্রকৃতি বা প্রাতিপদিক, (২) ক্রিয়া—প্রকৃতি বা ধাতু।

বিভক্তিযুক্ত নয় এমন বিশেষ্য, সর্বনাম ও বিশেষণই হইল প্রাতিপদিক।

শব্দের অর্থগত বা ব্যুৎপত্তিগত বিভাগ

সাধিত শব্দকে অর্থের দিক্ দিয়া তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়।—যৌগিক, রূঢ় ও যোগরূঢ়।

১৭০। যৌগিক শব্দ : যে সাধিত শব্দের অর্থ প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের সম্মিলিত অর্থ হইতে পাওয়া যায়, তাহাই যৌগিক শব্দ।

বাংলা ভাষায় যৌগিক শব্দের সংখ্যাই সর্বাপেক্ষা বেশী। কৃ ধাতুর অর্থ করা; অনীয় প্রত্যয়টি উচিত অর্থে প্রযুক্ত হয়। এখন উভয়ের সম্মিলনে করণীয় শব্দটির সৃষ্টি। এই শব্দটির অর্থ হইতেছে ‘করা উচিত’। এই অর্থটি প্রকৃতি-প্রত্যয়ের সম্মিলিত অর্থের সহিত মিলিয়া যাইতেছে। অতএব করণীয় শব্দটি যৌগিক। গা ধাতুর অর্থ গান করা; ইয়ে প্রত্যয়টি চলিত ভাষায় দক্ষতা বুঝাইতে কর্তৃবাচ্যে প্রযুক্ত হয়। এখন গা + ইয়ে = গাইয়ে শব্দটির অর্থ ‘গান করিতে পটু যে’। শব্দটির অর্থ প্রকৃতি ও প্রত্যয়ের সম্মিলিত অর্থের সহিত এক হইতেছে বলিয়া গাইয়ে শব্দটি যৌগিক। পুত্র শব্দটির অর্থ সন্তান; অপত্য অর্থে ষ্ণ প্রত্যয়টি প্রযুক্ত হয়। এখন পুত্ৰ + ষ্ণ = পৌত্র (পুত্রের পুত্র)। ঠাকুর শব্দটির অর্থ দেবতা; আলি প্রত্যয়টি ভাব বুঝাইতে প্রযুক্ত হয়। এখন ঠাকুর + আলি ঠাকুরালি (ঠাকুরের ভাব)। পৌত্র, ঠাকুরালি শব্দ দুইটিরও অর্থ ইহাদের প্রকৃতি-প্রত্যয়ের সম্মিলিত অর্থের সহিত মিলিয়া যাইতেছে। বৃক্ষ = গাছ; শাখা = ডাল। বৃক্ষের শাখা সমাসবদ্ধ হইয়া বৃক্ষশাখা (গাছের ডাল) শব্দটির সৃষ্টি করিয়াছে। সুতরাং পৌত্র, ঠাকুরালি, বৃক্ষশাখা প্রভৃতি যৌগিক শব্দ। মনে রাখিও, প্রকৃতি-প্রত্যয়লব্ধ অর্থ ব্যতীত অন্য কোনো অর্থে যৌগিক শব্দ ব্যবহৃত হয় না।

১৭১। রূঢ় শব্দ : যে-সকল সাধিত শব্দ প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থ বহন না করিয়া মাত্র লোকপ্রচলিত অর্থই বহন করে, তাহাদিগকে রূঢ় (রূঢ়ি) শব্দ বলে।

রূঢ় শব্দের সংখ্যা বাংলা ভাষায় অত্যন্ত অল্প। মণ্ডপ (= মণ্ড—√পা + ক) শব্দের প্রকৃতি-প্রত্যয়ের অর্থ ‘মণ্ড বা ফেন পান করে যে’ কিন্তু ‘মণ্ডপ’ শব্দটি এই অর্থে কোথাও প্রযুক্ত হয় না; ‘দেবালয়’ বা ‘গৃহ’ অর্থেই শব্দটির প্রয়োগ সীমাবদ্ধ। অথচ ‘দেবালয়’ বা ‘গৃহ’-এর সঙ্গে ফেনের কোনো সম্পর্ক নাই। কুশল (= কুশ-√লা + ড) শব্দের প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থ ‘যজ্ঞের জন্য কুশ আহরণ করে যে’। কিন্তু শব্দটি এই অর্থে কোথাও প্রযুক্ত হয় না; ‘নিপুণ’ বা ‘মঙ্গল’ অর্থেই ইহার প্রয়োগ সীমাবদ্ধ। অথচ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থের সঙ্গে নিপুণ বা মঙ্গল কথাটির কোনো সম্পর্ক নাই। হরিণ (= √ হৃ + ণিন্) শব্দটির প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থ ‘যে হরণ করে’। কিন্তু শব্দটির দ্বারা আমরা এক নিরীহ ও নিরুপম পশুবিশেষকেই বুঝি, যাহার সহিত ‘হরণ করার কোনো সম্পর্ক নাই। সেইরূপ সন্দেশ (= সম্-√দিশ্ + অল্)—ব্যুৎপত্তিগত অর্থ সংবাদ, প্রচলিত অর্থ মিষ্টান্নবিশেষ; শ্বশুর (= আশু—√ অশ্ + উর : নিপাতনে)—প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থ ‘যিনি অতি শীঘ্র খান’, কিন্তু প্রসিদ্ধ অর্থ স্বামী বা স্ত্রীর পিতা; প্রবীণ (= প্র—√বীণি+অচ্)—শব্দটির প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থ বীণাবাদনে দক্ষ’, প্রসিদ্ধ অর্থ বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন বৃদ্ধ।

১৭২। যোগরূঢ় শব্দ : যে-সকল শব্দ প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থগুলির মধ্যে একটি বিশেষ অর্থেই প্রসিদ্ধ, তাহাদিগকে যোগরূঢ় শব্দ বলে।

একাধারে যৌগিক ও রূঢ় বলিয়াই নাম যোগরূঢ়। প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থের সহিত যোগ থাকায় যৌগিক, অথচ প্রত্যয়জাত অর্থগুলির মধ্যে একটি বিশেষ অর্থে সীমাবদ্ধ বলিয়া রূঢ়। পঙ্কজ (= পঙ্ক—√জন্ + ড) শব্দটির প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থ ‘যাহা পঙ্কে জন্মে’। শেওলা, শামুক, শালুক, কেঁচো, মাগুর, পাঁকাল, পদ্ম—অনেককিছুই পঙ্কে জন্মে। অথচ ‘পঙ্কজ’ শব্দটির অর্থ কেবল পদ্মফুলেই সীমাবদ্ধ হইয়া গিয়াছে। পদ্ম পঙ্কে জন্মে, তাই পঙ্কজ যৌগিক; আবার পঙ্কজ শব্দটি অন্য সমস্ত অর্থ বাদ দিয়া মাত্র পদ্ম অর্থেই লোকপ্রসিদ্ধ হওয়ায় শব্দটি রূঢ়ও বটে। বারিধি (= বারি—√ধা + কি) ‘বারি ধারণ করে যে’ প্রকৃতি-প্রত্যয়গত এই অর্থটির দ্বারা পুষ্করিণী, নদী, সমুদ্র ইত্যাদি অনেককিছুই বুঝায়; অথচ ‘সমুদ্র’ এই বিশেষ অর্থেই কথাটি সীমাবদ্ধ। সেইরূপ—জলদ (= জল-√দা + ক, জল দেয় যে—বিশেষ অর্থ মেঘ); রাজপুত (< রাজপুত্র, রাজার পুত্র—বিশেষ অর্থ রাজস্থানের অধিবাসী); বীণাপাণি (বীণাধারণকারী—বিশেষ অর্থ সরস্বতী); আদিত্য (= অদিতি + ষ্ণ্য, অদিতির সন্তান—বিশেষ অর্থ সূর্য); বাঁশি (বংশনির্মিত যেকোনো বস্তু—বিশেষ অর্থ ফুৎকার-বাদ্যযন্ত্রবিশেষ); সম্বন্ধী (= সম্বন্ধ + ইন্, যাহার সম্বন্ধ আছে, বিশেষ অর্থ—স্ত্রীর ভ্রাতা); অন্ন (= √অদ্ + ন্ত) প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থ খাদ্য, কিন্তু বাঙালীর প্রধান খাদ্য ভাত, তাই শব্দটি এখন ভাত অর্থেই সীমায়িত। (মিষ্টান্ন শব্দে প্রত্যয়গত আদি অর্থটি পাওয়া যায়।)

রূঢ় ও যোগরূঢ় শব্দের পার্থক্যটি লক্ষ্য কর।—রূঢ় শব্দের প্রচলিত অর্থটির সহিত শব্দটির প্রকৃতি-প্রত্যয়গত অর্থের কোনো সম্বন্ধ নাই। কিন্তু যোগরূঢ় শব্দের প্রচলিত অর্থটি প্রকৃতি-প্রত্যয়জাত অর্থগুলির মধ্যে বিশেষ একটিতেই সীমাবদ্ধ।

শব্দের মূল অর্থের পরিবর্তন : শব্দার্থতত্ত্ব

ভাষা প্রবাহিতা নদীরই মতো। নদী যেমন তাহার গতিপথ প্রায়ই পরিবর্তন করে, ভাষারও তেমনই রূপের পরিবর্তন ঘটে, অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে-সঙ্গে বাংলার মতো জীবন্ত ভাষায় শব্দার্থের এরূপ পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক। ফলে এই ভাষার বেশকিছু শব্দ তাহাদের মূল অর্থটিকে প্রসারিত করে, কখনও-বা সংকুচিত করে, কখনও মূল অর্থটির উন্নয়ন ঘটে, আবার অবনমনও ঘটে, এমনকি সময়-সময় সম্পূর্ণ নূতন অর্থও ব্যঞ্জিত হয়।

১৭৩। শব্দার্থতত্ত্ব : ভাষাতত্ত্বের যে শাখায় শব্দের অর্থপরিবর্তন-সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা করা হয়, সেই শাখার নাম শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics)। তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থটিই আদি অর্থ।

(ক) শব্দ যেখানে মূল অর্থ পরিত্যাগ করিয়া উন্নততর অর্থ বহন করে, সেখানে শব্দার্থের উৎকর্ষ হইয়াছে বলা হয়। (১) সম্ভ্রান্ত : মূল অর্থ—সম্যক্‌ ভ্রান্ত, কিন্তু এখন প্রচলিত অর্থ—মর্যাদাসম্পন্ন। (২) মন্দির : মূল অর্থ—শয়নগৃহ, প্রচলিত অর্থ—দেবালয়। “দুতর পন্থ-গমন ধনি সাধয়ে মন্দিরে যামিনী জাগি” (গৃহ)। “তোমারই প্রতিমা গড়ি মন্দিরে মন্দিরে” (দেবালয়)। অনুরূপ আরও কয়েকটি শব্দের উদাহরণ দেখ। বন্ধনীমধ্যে মূল অর্থটি দেওয়া হইল : (৩) ধ্যান (চিন্তা)—ঈশ্বরচিন্তা। (৪) মান (পরিমাপ)—মানমর্যাদা। (৫) হরিণ (যে হরণ করে)—আদরণীয় নিরীহ জীব মৃগ। (৬) চরাচর (সচল ও অচল)—বিশ্বজগৎ। (৭) বিধি (নিয়ম)—ভগবান্। (৮) মার্জনা (পরিষ্কার করা)—ক্ষমা। (৯) পঞ্চশর (পঞ্চবাণ)—পঞ্চবাণের অধিকারী প্রেমের দেবতা মদন। (১০) সতী (বিদ্যমানা)—পতিব্রতা, দক্ষরাজকন্যা। (১১) ওজন (ভার বা পরিমাণ)-মর্যাদা। (১২) বিদগ্ধ (পক্ব)—বিদ্বান্। (১৩) অগুরু (হালকা)—পীতবর্ণের সুরভিবিশেষ। (১৪) অখণ্ড (গোটা)—অব্যর্থ। (১৫) ঝাল (লঙ্কাদির কটুরস)—আক্রোশ। (১৬) হিরণ্ময় (সোনালী)—ব্রহ্মা।

(খ) মূল অর্থ পরিহার করিয়া শব্দ যখন নিম্নমানের অর্থ বহন করে, তখন শব্দার্থের অপকর্ণ হয়। (১) মহাজন : মূল অর্থ—প্রাচীন পদকার বা ধার্মিক ব্যক্তি, কিন্তু প্রচলিত অর্থ—সুদখোর। (২) ইতর : মূল অর্থ—অন্য, কিন্তু প্রচলিত অর্থ—নীচ। (৩) লক্ষ্মী : মূল অর্থ—ধনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী, কিন্তু প্রচলিত অর্থ—শান্তশিষ্ট। “মহাজ্ঞানী মহাজন যে পথে করে গমন হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়” (মনীষী)। মহাজন-ভয়ে দেনদার রহে সদা যে গা ঢাকা দিয়া (উত্তমর্ণ)। অনুরূপ আরও কয়েকটি উদাহরণ দেখ। বন্ধনীমধ্যে মূল অর্থটি দেওয়া হইল : (৪) বর (বরণীয়, উৎকৃষ্ট)—বিবাহের পাত্র। (৫) অথর্ব (চতুর্থ বেদ)-অতিশয় জরাগ্রস্ত। (৬) ঐশ্বর্য (ঈশ্বরের ভাব)—বিষয়বৈভব। (৭) সভ্য (সভায় সজ্জন)—সদস্য। (৮) মৌন (মুনির ভাব)—নীরবতা। (৯) প্রজাপতি (ব্রহ্মা)–পতঙ্গবিশেষ। (১০) সুধা (অমৃত, জ্যোৎস্না)—চুন। (১১) ঝি (কন্যা)—দাসী। (১২) অজ (ব্রহ্মা, বিষ্ণু)—ছাগ। (১৩) অংশু (প্রভা)—আঁশ। (১৪) পাণ্ডা (তীর্থস্থানের পূজারী)—সর্দার। (১৫) চাতুর্য (সৎকার্যে নৈপুণ্য)—চালাকি। (১৬) সমাধি (ধ্যানে তন্ময়তা)–কবর!

(গ) শব্দের মূল অর্থ যখন প্রসারিত হয়, তখন তাহাকে শব্দার্থের সম্প্রসারণ বলা হয়। (১) বর্ষ : মূল অর্থ—বর্ষাকাল, কিন্তু এখন অর্থ দাঁড়াইয়াছে—বৎসর। (২) গঙ্গা : মূল অর্থ—শ্রীবিষ্ণুর পাদবিগলিত ধারা, কিন্তু গঙ্গা হইতে জাত গাঙ শব্দটিতে প্রসারিত অর্থ দাঁড়াইয়াছে—যেকোনো নদী। “বর্ষে বর্ষে দলে দলে আসে বিদ্যামঠতলে” (বৎসর)। শহুরেজীবন ছেড়ে দীর্ঘকাল পরে খোলামেলা গাঙে স্নান করছি (নদী)। আরও কয়েকটি উদাহরণ—(৩) তৈল (তিল হইতে নিষ্পেষিত স্নেহজাতীয় পদার্থ)—সরিষা নারিকেল ইত্যাদি হইতে প্রাপ্ত তৈল, এমনকি মাটির বুক হইতে পাওয়া কেরোসিনও তৈল হইয়া দাঁড়াইয়াছে। (৪ কালি (কালো রঙ)—লাল নীল সবুজ বেগুনে ইত্যাদি যেকোনো রঙের কালি। (৫) ক্ষীর (যাহা ক্ষরিত হয়)—দুগ্ধ চিনিসহযোগে প্রস্তুত ঘনীভূত সুপেয় মিষ্টান্ন (৬) সৌধ (সুধাধবলিত অট্টালিকা)—যেকোনো প্রাসাদ। (৭) রমণী রমণীয় নারী)—যেকোনো স্ত্রীলোক। (৮) বেনারসী (বেনারসে উৎপন্ন যেকোনো জিনিস, বিশেষভাবে শাড়ি)—বেনারস ছাড়া অন্যত্র উৎপন্ন অনুরূপ শাড়ি। (৯) চামার (চর্মকার মুচি)—যেকোনো নীচাশয় ব্যক্তি। (১০) পরশু (আগামী কালের পরদিন)—গতকালেরও আগের দিন। (১১) কুশীলব (রামায়ণ গানের প্রথম গায়ক রামচন্দ্রের পুত্রদ্বয়)—যেকোনো নাটকের পাত্রপাত্রী। (১২) অচল (পর্বত)—যাহা প্রচলিত নহে। (১৩) ভাস্কর (সূর্য)—প্রস্তর কাষ্ঠাদি কুঁদিয়া কুঁদিয়া মনোরম মূর্তি নির্মাণকারী প্রতিভাদীপ্ত শিল্পী। (১৪) হাতেখড়ি (বিদ্যারম্ভ)—যেকোনো বিষয়ে প্রথম অভিজ্ঞতা। (১৫) মধুর (মধুযুক্ত) মিষ্ট। (১৬) টাকা (মুদ্রা-বিশেষ)—সম্পদ।

(ঘ) শব্দের মূল অর্থটি যখন সঙ্কুচিত হয়, তখন শব্দার্থের সংকোচন ঘটিয়াছে বুঝিতে হয়। (১) স্নেহ : মূল অর্থ ছিল—যেকোনো ধরনের প্রীতি, সঙ্কুচিত অর্থ দাঁড়াইয়াছে—কনিষ্ঠে প্রীতি। (২) মৃগ : মূল অর্থ—যেকোনো পশু, এখন সঙ্কুচিত অর্থ দাঁড়াইয়াছে—হরিণ। আরও কয়েকটি অনুরূপ উদাহরণ–(৩) সন্ধ্যা (প্রতিটি প্রহরের মিলনক্ষণ)—রাত্রি বা যুগের আরম্ভ। (৪) কাগজ (লিখিবার কাগজ)—-খবরের কাগজ। (৫) অন্ন (যেকোনো খাদ্য)-ভাত। (৬) পঙ্কজ (পঙ্কজাত যেকোনো জিনিস)—পদ্ম। (৭) ভৃত্য (যাহার ভরণের ভার গ্রহণ করা হয়) চাকর। (৮) সৈকত (বালুকাময় স্থান)—নদীতট, সমুদ্রতট। (৯) সিংহ (হিংস্র)—পশুরাজ কেশরী। (১০) ঘাস (যেকোনো খাদ্য)—পশুখাদ্য তৃণ। (১১) রাজভোগ (রাজার ভোগ্যসামগ্রী)—’রাজভোগ’ নামীয় রসযুক্ত মিষ্টান্ন-বিশেষ। (১২) ঘর্ম (গ্রীষ্মকাল)—ঘাম। (১৩) অসুখ (সুখের অভাব)-অসুস্থতা। (১৪) যবনিকা (পর্দা)–শেষপর্দা। (১৫) বিজ্ঞান (বিশেষ জ্ঞান)—পদার্থ রসায়ন গণিত প্রভৃতি বিদ্যা। (১৬) ভীম (ভীষণ)—মধ্যমপাণ্ডব ভীমসেন।

(ঙ) শব্দের মূল অর্থ এবং পরিবর্তিত অর্থের মধ্যে বিপুল ব্যবধান দেখা দিলে তাহাকে অর্থের রূপান্তর বা অর্থসংশ্লেষ বলা হয়। (১) শুশ্রূষা : মূল অর্থ—শ্রবণ করিবার ইচ্ছা, পরিবর্তিত অর্থ—সেবা। (২) শ্বশুর : মূল অর্থ—যিনি খুব শীঘ্র খান, কিন্তু পরিবর্তিত অর্থ—স্বামী বা স্ত্রীর পিতা। অনুরূপ আরও কয়েকটি উদাহরণ—(৩) মণ্ডপ (মণ্ড বা ফেন পান করে যে)-পূজাস্থান বা সভাসমিতির জন্য সাময়িকভাবে নির্মিত মিলনস্থান। (৪) মন্বন্তর (এক মনুর শাসনকালের শেষ এবং অন্য মনুর শাসনকালের আরম্ভ)—দুর্ভিক্ষ। (৫) সমাচার (সম্যক্ আচার)—সংবাদ। (৬) কৃপণ (নিন্দার যোগ্য)—ব্যয়কুণ্ঠ। (৭) সাঙ্গ (অঙ্গের সঙ্গে বিদ্যমান)—শেষ। (৮) আহ্নিক (অহ্নসম্বন্ধীয় বা দৈনিক)—জপ। (৯) গবাক্ষ (গোরুর চক্ষু)—জানালা। (১০) তিরস্কার (অদৃশ্য হওয়া)—ভর্ৎসনা। (১১) তাৎপর্য (তৎপরতা)-মর্মার্থ। (১২) সমুদয় (সম্যক্‌ উদয়)—সমস্ত। (১৩) নিলয় (আলয়)—নিঃশেষে ধ্বংস। (১৪) অবশ্য (বশীভূত নয়)—নিশ্চয়। (১৫) মাস (দুইপক্ষকাল সময়)—মাংস। (১৬) ভূমিকা (গ্রন্থাদির মুখবন্ধ)—নাটকের চরিত্র।

নিম্নলিখিত শব্দগুলির আদি অর্থ (যাহা বন্ধনীমধ্যে দেওয়া হইল) পরিবর্তিত হইয়া কী নূতন অর্থ দাঁড়াইয়াছে, লক্ষ্য কর। প্রতিটি ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন ঘটিয়াছে, নির্ণয় কর : (১) কুশল (যজ্ঞের জন্য কুশ আহরণ করে যে)—মঙ্গল বা নিপুণ। (২) ম্রিয়মাণ (মরণাপন্ন)—বিষণ্ণ। (৩) স্নিগ্ধ (স্নেহযুক্ত)—শীতল ও সুখস্পর্শযুক্ত। (৪) বারিধি (বারিধারণ করে যে)—সমুদ্র। (৫) প্রশস্ত (উৎকৃষ্ট)—বিস্তৃত। (৬) আদৌ (আদিতে)—মোটেই। (৭) অবরোধ (অন্তঃপুর)—প্রতিবন্ধক। (৮) পেশল (সুকুমার)–পেশীবহুল। (৯) শশধর (খরগোশধারী)-চন্দ্র। (১০) গ্রাম (লোকের গমনস্থান)-সমূহ। (১১) বীণাপাণি (বীণাধারী)—সরস্বতী। (১২) প্রবীণ (বীণাবাদনে দক্ষ)—বৃদ্ধ। (১৩) বাধিত (বাধাপ্রাপ্ত)—অনুগৃহীত। (১৪) কলম (লেখনী)-কাটা ডাল হইতে প্রস্তুত ফুল বা ফলের তেজালো চারা। (১৫) পাষণ্ড (বেদবিরোধী ধর্মসম্প্রদায়)—নির্দয়। (১৬) দারুণ (দারুনির্মিত বস্তুর মতো কঠিন)—ভীষণ। (১৭) সহসা (অবিচারপূর্বক)—শীঘ্র। (১৮) প্রদীপ (যেকোনো আলো)—তৈলপলিতা—সহযোগে সজ্জিত দীপ। (১৯) যথেষ্ট (ইষ্টকে অতিক্রম না করিয়া)—প্রচুর। (২০) স্ত্রী (গর্ভধারণক্ষমা নারী)—পত্নী। (২১) বাড়ন্ত (যাহা বৃদ্ধি পাইতেছে)—নিঃশেষিত। (২২) দ্বিধা (দুইটি ভাগে বিভক্ত)—সংশয়-সংকোচ। (২৩) অদৃষ্ট (যাহাকে দেখা যায় না)—ভাগ্য। (২৪) সৎ (বিদ্যমান)—ভালো। (২৫) বিবাহ (বিশেষভাবে বহন)—পরিণয়। (২৬) আদিত্য (অদিতিনন্দন)—সূর্য। (২৭) সামান্য (সমানের ভাব)—অত্যন্ত অল্প। (২৮) ভারী (ভার আছে যাহার)—খুব। (২৯) নাগর (নগরবাসী)—অবৈধ প্রেমিক। (৩০) অভিজ্ঞান (সম্যক্ জ্ঞান)—স্মারকচিহ্ন। (৩১) রাজপুত (রাজার পুত্র)—রাজস্থানের অধিবাসী। (৩২) কেচ্ছা (কাহিনী)—কুৎসা। (৩৩) সচরাচর (চরাচরের সহিত বিদ্যমান)—সাধারণতঃ। (৩৪) বিলম্ব (ঝুলাইয়া দেওয়া)—দেরি। (৩৫) বাঁশি (বংশনির্মিত যেকোনো বস্তু)–ফুৎকার—বাদ্যযন্ত্রবিশেষ। (৩৬) নির্ঘাত (প্রবল বাতাসের পরস্পর সংঘাতধ্বনি—বি)—নিষ্ঠুর, অব্যর্থ (বিণ)। (৩৭) পরিবার (সংসারের পোষ্যবর্গ)—পত্নী। (৩৮) গোধূলি (গোরুর ক্ষুরের চাপে উত্থিত ধূলি)—সূর্যাস্তকাল। (৩৯) রাগী (অনুরাগযুক্ত)—ক্রোধী। (৪০) পলাশ (পল অর্থাৎ মাংস যাহার খাদ্য)—পুষ্পবিশেষ। (৪১) সম্বন্ধী (যাহার সম্বন্ধ আছে)-স্ত্রীর ভ্রাতা। (৪২) সাশ্রয় (আশ্রয়যুক্ত)–ব্যয়লাঘব। (৪৩) ফলার (কেবল ফল খাওয়া)—যেকোনো ভোজ। (৪৪) মহোৎসব (বিরাট্ উৎসব)—বৈষ্ণবদিগের সংকীর্তন ও ভোজের উৎসব। (৪৫) উপন্যাস (মুখবন্ধ)—কথাশিল্প। (৪৬) দক্ষিণ (নিপুণ)—ডান। (৪৭) মুমূর্ষু (মরিতে ইচ্ছুক)—মরণাপন্ন (৪৮) ছেঁচড়া (দেনা পরিশোধে অনিচ্ছুক, প্রতারক)—মাছের কাঁটা তেল ইত্যাদির সঙ্গে শাকসবজি-মিশ্রিত ব্যঞ্জন। (৪৯) সংঘাত (সংহতি, সমষ্টি)—সংঘর্ষ। (৫০) দুহিতা (দুগ্ধদোহনকারিণী)—কন্যা। (৫১) রৌদ্র (রুদ্র-সম্বন্ধীয়)—সূর্যকিরণ, রৌদ্ররস। (৫২) ধামাধরা (ধামা ধরে যে)—খোশামুদে। (৫৩) সন্তান (বিস্তার)– পুত্র বা কন্যা। (৫৪) ক্রন্দসী (চিৎকারকারী বিপক্ষ সেনাদল)—অন্তরীক্ষ (বৈদিক ‘রোদসী’ শব্দটির অনুকরণে রাবীন্দ্রিক সৃষ্টি)। (৫৫) অভ্যর্থনা (প্রার্থনা)–সংবর্ধনা। (৫৬) নিষণ্ণ (অবস্থিত, উপবিষ্ট, শয়িত)—পণ্যবিক্রয়শালা। (৫৭) অকিঞ্চন (নিঃস্ব)-সংসারবিরাগী। (৫৮) মালা (হার)—সমূহ। (৫৯) শিখা (চূড়া)—শিরস্থ ক্ষীণ কেশগুচ্ছ। (৬০) বৃংহণ (পুষ্টিকর)—হাতির ডাক। (৬১) সগর (বিষের সঙ্গে বিদ্যমান)—সূর্যবংশের নৃপতিবিশেষ। (৬২) মায়া (মমতা)—ছলনা। (৬৩) হঠাৎ (অকস্মাৎ)—বলপূর্বক। (৬৪) আপত্তি (প্রাপ্তি)—বিপদ্, অসম্মতি। (৬৫) দক্ষিণা (পূজাশেষে গুরু পুরোহিতের প্রাপ্য পারিশ্রমিক)–দক্ষিণ দিক্ হইতে প্রবাহিত। (৬৬) অংশ (ভাগ)—রূপ। (৬৭) নীরজ (পদ্ম)– ধূলিশূন্য। (৬৮) দিব্য (দেবভাব-সমন্বিত)—শপথ। (৬৯) বিপ্লব (ভাসিয়া থাকা)–বিধ্বংস। (৭০) দত্ত (দাঁত)—পর্বতশৃঙ্গ। (৭১) দাক্ষিণ্য (মাহাত্ম্য)—পটুতা। (৭২) ঠাট (আড়ম্বর)—সৈন্যশ্রেণী। (৭৩) অকস্মাৎ (অকারণ)—সহসা। (৭৪) অক্ষম (অসমর্থ)—ক্ষমাহীন। (৭৫) বরাত (কর্মভার)-অদৃষ্ট। (৭৬) বুজরুক (বিজ্ঞজন)—ঠকবাজ। (৭৭) ক্ষমা (তিতিক্ষা)–বিরতি। (৭৮) ঘাট (জলাশয় বা নদীতে নামিবার স্থান)—ত্রুটি। (৭৯) ধন্য (কৃতার্থ)—প্রশংসনীয়। (৮০) ওঘ (সমূহ)—প্রবাহ, উপদেশ। (৮১) আতর (অস্ত্র, সুগন্ধি পুষ্পসার)– খেয়ার কড়ি। (৮২) সম্ভাবনা (ভবিষ্যতের আশা)—পূজা। (৮৩) অজন্মা (দুর্ভিক্ষ)–জারজ। (৮৪) অঞ্চল (বস্ত্রপ্রান্ত)—ভূভাগ। (৮৫) সন্নিপাত (একত্র মিলন)–সম্যক্ পতন। (৮৬) পরিবাদিনী (নিন্দাকারিণী)—সপ্ততন্ত্রী বীণা। (৮৭) প্রকোষ্ঠ (কনুই হইতে মণিবন্ধ পর্যন্ত হস্তাংশ)—দরজার পার্শ্বস্থ কক্ষ। (৮৮) উদ্বর্তন (জীবনসংগ্রামে বাঁচিয়া থাকা)—গন্ধদ্রব্যাদির দ্বারা বিলেপন। (৮৯) অন্তেবাসী (গুরুগৃহবাসী)—গ্রামপ্রান্ত—বাসী চণ্ডাল। (৯০) বিটঙ্ক (পায়রা প্রভৃতির খোপ)—পাখি ধরিবার ফাঁদ। (৯১) বর্বর (অসভ্য জাতি)—নিষ্ঠুর। (৯২) ব্যাঘ্র (বিশেষভাবে ঘ্রাণগ্রহণকারী)—হিংস্র পশুবিশেষ। (৯৩) শ্বাপদ (কুকুরের পদতুল্য পদবিশিষ্ট জন্তু)—মাংসাশী জন্তু॥ (৯৪) প্রবাস (বিদেশে বসবাস করা)–নির্বাসন। (৯৫) হেলা (একপাশে নত হওয়া)-অশ্রদ্ধা। (৯৬) বিলোচন (শিব)—চক্ষু। (৯৭) হাল (লাঙ্গল, অবস্থা—বি)—আধুনিক (বিণ)। (৯৮) সরস (রসযুক্ত)—সরোবর। (৯৯) মৌল (মূল-সম্বন্ধীয়)—মুকুল, মহুয়া। (১০০) বেশ (উত্তম)-সাজসজ্জা। (১০১) হেলে (নির্বিষ ভুজঙ্গবিশেষ)—হালে জোতা হয় এমন গোরু। (১০২) মাপ (ক্ষমা)—পরিমাণ। (১০৩) যম (মৃত্যুর অধিদেবতা)—সংযম। (১০৪) বৃক (নেকড়ে বাঘ)—শৃগাল, কাক। (১০৫) হুতাশ (হতাশা বা আতঙ্কের অভিব্যক্তি)-হোমাগ্নি। (১০৬) সঙ্গতি (মিল)—সম্পদ। (১০৭) বীচি (বীজ)-ঢেউ। (১০৮) শ্রুতি (কর্ণ)—বেদ। (১০৯) মান (অভিমান)—গানে তালের বিরামস্থান। (১১০) বিলাত (ইংলন্ড)—অনাদায়ী টাকা। (১১১) ভাল (ললাট)—উত্তম। (১১২) লাজ (খই)-লজ্জা। (১১৩) মোট (সার)–সমষ্টি, বোঝা। (১১৪) ভোর (তন্ময়)—প্রত্যুষ। (১১৫) সার (পঙ্ক্তি)—শ্রেষ্ঠ। (১১৬) হৈম (স্বর্ণনির্মিত)–হিম-সম্বন্ধীয়। (১১৭) মাত (মুগ্ধ, বিভোর)—স্বপক্ষের জিত। (১১৮) ভৃগু (মুনিবিশেষ)—পর্বতোপরিস্থ সমতলস্থান। (১১৯) ভব (শিব)—জগৎ। (১২০) বিভূষণ (ভূষণহীন—বিণ)—বিশেষ অলংকার (বি)। (১২১) হার (কণ্ঠের অলংকারবিশেষ)—পরাজয়, অনুপাত। (১২২) সম্পন্ন (সমাপ্ত)—যুক্ত। (১২৩) মুড়া (অগ্রভাগ)—মুণ্ডিত, নেড়া। (১২৪) লাট (রসজ্ঞ পণ্ডিত)—ধরাশায়ী! (১২৫) স্থাণু (নিশ্চল)—শিব। (১২৬) সঙ্গত (উপযুক্ত : অ-কারান্ত উচ্চারণ)—সঙ্গীতের সঙ্গে মিলনযুক্ত বাজনা (তখন উচ্চারণ : সংগৎ)। (১২৭) শালা (গৃহ)—শ্যালক। (১২৮) রস (নির্যাস)—আদি বীর করুণ হাস্য ইত্যাদি সাহিত্যের নয় প্রকার বর্ণনাবৈশিষ্ট্য বা শান্ত দাস্য সখ্য বাৎসল্য মধুর ইত্যাদি বৈষ্ণব-সাহিত্যের পাঁচ প্রকার বর্ণনাবৈশিষ্ট্য। (১২৯) মাল (মালা)—জিনিসপত্র। (১৩০) ভূত (দেবযোনিবিশেষ—উচ্চারণ : ভুৎ)—অতীতকাল (উচ্চারণ অ-কারান্ত)। (১৩১) ভাব (অবস্থা)—প্রীতি, আবেশ। (১৩২) বিলুণ্ঠিত (গড়াগড়ি দিতেছে এমন)—অপহৃত। (১৩৩) ভরতি (পূর্ণ)–নিযুক্ত, প্রবিষ্ট। (১৩৪) স্তোক (ঈষৎ)-মিথ্যা আশ্বাস। (১৩৫) শাসন (দমন)—রাজদত্ত ভূসম্পদ। (১৩৬) সেবা (শুশ্রূষা)—ভোজন, পূজা। (১৩৭) মেটে (মাটির তৈয়ারী)—মেষ ও ছাগের যকৃৎ। (১৩৮) সহজ (সহোদর)-সোজা। (১৩৯) শ্রুত (প্রসিদ্ধ)—জ্ঞান। (১৪০) রতি (এক কুঁচের সমান ওজন)—আসক্তি। (১৪১) সাধ্য (যাহা করা সম্ভব—বিণ)—ক্ষমতা (বি)। (১৪২) মশক (মশা)—ভিত্তি। (১৪৩) ভৈরব (শিব)—ভীষণ, নদবিশেষ। (১৪৪) ব্যাস (বৃত্তের কেন্দ্র ভেদ করিয়া দুইদিকের পরিধি পর্যন্ত প্রসারিত সরলরেখা)—মহাভারত—প্রণেতা বেদব্যাস। (১৪৫) বৃত্তি (প্রবৃত্তি)–পেশা। (১৪৬) ভান (ছল)—দীপ্তি। (১৪৭) ভাত (উদ্ভাসিত—উচ্চারণ অ-কারান্ত)—অন্ন (উচ্চারণ : ভাত্)। (১৪৮) মর্মর (শুষ্ক পত্রাদির শব্দ)—মারবেল পাথর। (১৪৯) সারা (সমস্ত)—ক্লান্ত, শেষ। (১৫০) লয় (বিনাশ)-নৃত্যগীতবাদ্যে তালের নির্দিষ্ট কালপরিমাণ। (১৫১) বিলয় (বিশেষ বিনাশ)—যাহা লয়বহির্ভূত। (১৫২) ভাবিত (উদ্বিগ্ন)—রঞ্জিত। (১৫৩) বেল (শ্রীফল)—পাটের গাঁট। (১৫৪) ব্যঙ্গ (বিকলাঙ্গ)-বিদ্রূপ। (১৫৫) শেজ (শয্যা)—কাচের আবরণের মধ্যে অবস্থিত দীপ। (১৫৬) বৃহন্নলা (দীর্ঘভুজা)—অজ্ঞাতবাসকালে অর্জুনের ছদ্মনাম। (১৫৭) ভারতী (সরস্বতী)—বাণী, সংবাদ, সন্ন্যাসিসম্প্রদায়বিশেষের উপাধি। (১৫৮) ব্যামোহ (অজ্ঞানতা)—অতিমুগ্ধতা। (১৫৯) বিষাণ (শৃঙ্গনির্মিত বাদ্যযন্ত্র)—হস্তিশূকরাদির বৃহৎ দন্ত। (১৬০) সাজা (শাস্তি)—সজ্জিত হওয়া। (১৬১) ভাঁড় (বিদূষক)—ক্ষুদ্র মৃৎপাত্রবিশেষ, ভাঁড়ার। (১৬২) বৃদ্ধি (অভ্যুদয়)—সুদ। (১৬৩) বেতাল (ভূতাবিষ্ট শব)—সঙ্গীতে তালভঙ্গ। (১৬৪) সংস্কৃত (সজ্জিত)-দেবভাষা। (১৬৫) বিহার (বিচরণ)—পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমে অঙ্গরাজ্যবিশেষ। (১৬৬) সর্ব (সকল)—বিষ্ণু, শিব। (১৬৭) বেলা (সমুদ্রতীর—আদ্য এ স্বাভাবিক)—বেলফুল। (১৬৮) ভাগ (বাটোয়ারা)—ভাগ্য। (১৬৯) ভাগী (ভাগ পাইবার অধিকারী)—ভাগ্যবান্। (১৭০) সহিত (সঙ্গে)—হিতকর (বিণ)। (১৭১) ব্যবহার (আচরণ)—মকদ্দমা। (১৭২) সম্পাত (পতন)—প্রবেশ। (১৭৩) ব্যতীত (বিগত—বিণ)—বিনা (অব্যয়)। (১৭৪) বলি (পূজায় নিবেদ্য বস্তু)–দৈত্যরাজবিশেষ। (১৭৫) ছত্র (ছাতা)—গুরুর দোষ-আবরণ। (১৭৬) দ্বন্দ্ব (মিলন)—কলহ, রহস্য। (১৭৭) বসন্ত (ঋতুবিশেষ)—সঙ্গীতের রাগ। (১৭৮) ভব্য (বর্তমান, ভবিষ্যৎ)—শিষ্ট। (১৭৯) হাওয়া (বায়ু)—সাধারণের মতিগতি। (১৮০) তারা (নক্ষত্র, চক্ষুতারকা)—উমা।

শব্দদ্বৈত-প্রয়োগেও শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে। (১) গরম (উষ্ণ), কিন্তু গরম-গরম (মৃদু উত্তাপ অথবা তীব্র উত্তাপ)। (২) সঙ্গে (সাথে) কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গে (তৎক্ষণাৎ)। (৩) সকাল (প্রাতঃকাল), কিন্তু সকাল-সকাল (নির্দিষ্ট সময়ের আগেভাগে ও বেলাবেলি)। (৪) ভিতরে (মধ্যে), কিন্তু ভিতরে-ভিতরে (মনে—মনে—বাহির হইতে বুঝা যায় না এমনভাবে)। (৫) হাড়ে (অস্থিতে), কিন্তু হাড়ে-হাড়ে (অণুতে পরমাণুতে—সর্বাংশে)। তোর গা-টা গরম-গরম লাগছে যেন। গরম-গরম সিঙাড়া এনেছি বাবু। ইস্কুলেও পৌঁছলাম, সঙ্গে-সঙ্গে বৃষ্টিও নামল। বর্ষাবাদলের দিন, সকাল-সকাল ফিরবেন। বাব্বা। তোমার ভিতরে-ভিতরে এত! বেটা হাড়ে হাড়ে বদমাস দেখছি।

কান, চোখ, গা, হাত, পা, পেট, মাটি, মুখ, নাক প্রভৃতি বিশেষ্যপদ, কাঁচা, পাকা, নরম, মোটা, বড়ো, ছোটো প্রভৃতি বিশেষণপদ এবং উঠা, করা, কাটা, পড়া, ধরা, তোলা, লাগা প্রভৃতি ক্রিয়াপদের বিশিষ্ট ব্যবহারেও অর্থের আমূল পরিবর্তন ঘটে। কান ভাঙানো (কু-পরামর্শ দেওয়া); গা করা (উৎসাহী হওয়া); গায়ে ফুঁ দেওয়া (দায়িত্ব এড়ানো); পেটের কথা (মনোভাব); মাটি করা (পণ্ড করা); মুখ করা (তিরস্কার করা); কাঁচা (ত্রুটিপূর্ণ) কাজ; কাঁচা মাল (শিল্পদ্রব্যের উপাদানবস্তু); নাক গলানো (অনধিকার চর্চা); পাকা (পীচঢালা) রাস্তা; পাকা (চূড়ান্ত) রসিদ; নরম (পচা) মাছ; কড়া (উগ্র) গন্ধ; বড়ো (খুব) শান্ত; মোটা (জড়) বুদ্ধি; ছোটো (নীচ) মন; জাতে উঠানো (সামাজিক মর্যাদা দেওয়া); মন উঠা (মনোমতো হওয়া); দাগ কাটা (প্রভাব পড়া); নাম করা (সুনাম কেনা); বৃষ্টি ধরা (বন্ধ হওয়া); আঁচ ধরা (রান্নার জন্য উনুন ঠিক-ঠিক প্রজ্বলিত হওয়া); বই কাটা (বিক্রীত হওয়া); দাম পড়া (নামিয়া বা কমিয়া যাওয়া); পিছনে লাগা (শত্রুতা করা); চাঁদা তোলা (সংগ্রহ করা); গায়ে হাত তোলা (প্রহার করা); কাজে লাগা (উপকারে আসা)।

আরও কয়েক ধরনের শব্দ ॥

কিছু কিছু বিদেশী শব্দ দীর্ঘদিন এদেশীয় জনগণের মুখে মুখে প্রচলিত থাকায় কিছুটা নূতন রূপ পাইয়াছে। স্থানবিশেষে অর্থেরও কিঞ্চিৎ পরিবর্তন ঘটিয়াছে; এরূপ শব্দকে লোকব্যুৎপত্তিজাত শব্দ বলে। যেমন, ইংরেজী arm-chair শব্দ হইতে আরামচেআর শব্দটির উৎপত্তি (হাত দুইটি আরামে রাখিবার জন্য হাতল—বিশিষ্ট তথা আরামদায়ী যে চেআর)। মার্তাবান দ্বীপ হইতে আমদানীকৃত কদলীর নাম মর্তমান হইয়া গিয়াছে। বাটাভিয়ায় উৎপন্ন লেবু বাতাবি নাম পাইয়াছে। তুর্কী উজবেগ জাতির লোকেরা শারীরিক পটুতার অধিকারী ছিল কিন্তু তাহাদের বৌদ্ধিক উৎকর্ষ তেমন-কিছু ছিল না; তাই উজবেগ হইতে জাত উজবুক শব্দটি নির্বোধ অর্থে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে।

দুইটি শব্দের কিছু অংশ বর্জন করিয়া অবশিষ্ট অংশদ্বয় জোড়া দিয়া যে নূতন শব্দ গঠিত হয় তাহাকে জোড়কলম শব্দ বলে। পৃথু + স্থূল = পৃথুল; পটোল + লতা = পলতা; উন্মুখ + মুখর = উন্মুখর; চন্দ্রিকা + চন্দ্রমা = চন্দ্ৰিমা। এইসব শব্দের প্রয়োগ সাহিত্যে নির্বাধ। “উন্মুখর তরঙ্গিণী ধায় অধীরা।”—রবীন্দ্রনাথ।

কোনো শব্দের একটি খণ্ডিত অংশ বা সংক্ষেপিত রূপ স্বাধীনভাবে যখন কথোপকথনে বা সাহিত্যে ঠাঁই পায় তখন তাহাকে খণ্ডিত শব্দ বলে। টেলিফোন > ফোন; টেলিগ্রাম > গ্রাম; মাইক্রোফোন > মাইক; বাইসিকল > বাইক।

যেকোনো ভাষার শব্দ বিকৃত হইয়া কেবল অঞ্চলবিশেষের লোকমুখে প্রচলিত থাকিলে সেই শব্দকে অপশব্দ বলা হয়। কোন্ দিকে > কম্‌দে; এই দিকে > অ্যাম্‌দে; কোন্ স্থিতে > কোথা থেকে > কুন্ঠে। এই ধরনের শব্দ সাহিত্যে সাধারণত ঠাঁই পায় না।

অনুশীলনী

১। সংজ্ঞার্থ লিখ ও উদাহরণযোগে বুঝাইয়া দাও : মৌলিক শব্দ, সাধিত শব্দ, যৌগিক শব্দ, প্রকৃতি, রূঢ় শব্দ, যোগরূঢ় শব্দ, শব্দার্থের উৎকর্ষ, শব্দার্থের অপকর্ষ, শব্দার্থের সংকোচন, শব্দার্থের প্রসারণ, লোকব্যুৎপত্তিজাত শব্দ, খণ্ডিত শব্দ, জোড়কলম শব্দ, অপশব্দ, প্রাতিপদিক।

২। শব্দ, পদ ও বিভক্তি কাহাকে বলে? ইহাদের পারস্পরিক সম্পর্ক কী? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।

৩। গঠনরীতির দিক্ দিয়া শব্দকে কয়টি ভাগে ভাগ করা হয়? প্রত্যেকটি ভাগের দুইটি করিয়া উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।

৪। পার্থক্য দেখাও : শব্দ ও পদ; যৌগিক শব্দ ও যোগরূঢ় শব্দ; যোগরূঢ় শব্দ ও রূঢ় শব্দ।

৫। শব্দার্থতত্ত্ব কাহাকে বলে? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।

৬। কোন্ শ্রেণীর শব্দ, বল এবং সেই সঙ্গে প্রয়োজনস্থলে শব্দার্থের উৎকর্ষ-অপকর্ষ অথবা সংকোচন-প্রসারণ কোটি ঘটিয়াছে তাহাও দেখাও : মনসিজ, নীরদ, রাখাল, জলধি, বরদা, অন্ন, কালি, হাতি, টেকোমাথা, ঝরনা, তৈল, শুশ্রূষা, রান্না, জলযোগ, বাঁশি, বাড়ন্ত, লাবণ্য, সতর্ক, পাঞ্জাবি, ধীবর, গো, রাজকন্যা, অর্ধচন্দ্র, বাধিত, মাংস, পীতাম্বর, প্রসাদ, রাজপুত, মহাজন, সন্দেশ, ঝি, পেশল, সৎ, সামান্য, প্রজাপতি, ব্যক্তি, তিরস্কার, সংঘাত, নির্ঘাত, সিংহাসন

৭। প্রতিটি শব্দের মূল অর্থ ও পরিবর্তিত অর্থ বল এবং শব্দার্থের উৎকর্ষ, অপকর্ষ, সঙ্কোচন-প্রসারণ বা সংশ্লেষণ—কী ঘটিয়াছে উল্লেখ কর : বিলাত, রক্ত, প্রাচীন, বেচারা, ভূত, জটিল, ঠাকুর, রাগ, ব্যাঘ্র, ভুজঙ্গ, গবেষণা, বিরক্ত, পুত্র, যবনিকা, কোকনদ, বজ্র, করী, শ্বশুর, পঙ্কজ, মণ্ডপ, হরিণ, মৃগ, ঝি, পেশল, সতী, সচরাচর, নির্ঘাত, ঘর্ম, লোক, রেওয়াজ, অবরোধ, ঐশ্বর্য, গুণ, স্নেহ, সুলভ, ডানহাত, সৈকত, ভাই, কালিয়া, ছত্র, বলি, বৃদ্ধি, তারা, কেষ্টবিষ্টু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *