৪.৪ উপসর্গ

৪.৪ উপসর্গ – চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১৮৭। উপসর্গ : যে-সকল অব্যয় কোনো প্রত্যয়যুক্ত হয় না, যাহারা ধাতুর পূর্বে বসিয়া ধাতুর অর্থের পরিবর্তন ঘটায়, তাহাদিগকে উপসর্গ বলে।

উপসর্গ ধাতুর পূর্বে বসিয়া কখনও ধাতুর অর্থটিই প্রকাশ করে, কখনও-বা ধাতুটির অর্থের পুষ্টিসাধন করে, আবার কখনও-বা বলপূর্বক ধাতুর অর্থটির উৎকর্ষ-অপকর্ষ-বিধান করিয়া নানারূপে অর্থান্তর ঘটায়। এইজন্য নূতন নূতন শব্দসৃষ্টির ক্ষেত্রে উপসর্গের সাহায্য একান্ত অপরিহার্য। √বস্ (বাস করা), আ—√বস্ (বাস করা), √নম্ (নত হওয়া), প্র—√নম্ (ভক্তিশ্রদ্ধার সঙ্গে নত হওয়া)।

সংস্কৃত উপসর্গ—প্র, পরা, অপ, সম্, নি, অব, অনু, নির্ (নিঃ), দুর্ (দুঃ), বি, অধি, সু, উদ্*, পরি, প্রতি, অভি, অতি, অপি, উপ, আ—এই কুড়িটি। একই ধাতুর পূর্বে বিভিন্ন উপসর্গ যুক্ত হইলে অর্থের কী রকম পরিবর্তন ঘটে, দেখ।—

কৃ ধাতুর অর্থ হইতেছে “করা”। কিন্তু আ + কৃ = আকার (মূর্তি), বি + কৃ বিকার (প্রলাপ), প্র + কৃ = প্রকার (রকম), উপ + কৃ = উপকার (মঙ্গল), অপ + কৃ = অপকার (ক্ষতি), অধি + কৃ = অধিকার (দখল), অনু + কৃ অনুকরণ (নকল), উপ + কৃ = উপকরণ (দ্রব্য), পরি + কৃ = পরিষ্কার (নির্মল), সম্ + কৃ সংস্কার (শুদ্ধি) ইত্যাদি।

[* উপসর্গটি উৎ নয়, উদ্। সাধারণতঃ ‘উৎ’-রূপে উচ্চারিত হইলেও বৈয়াকরণেরা ইহাকে—কারান্ত বলিয়া উল্লেখ করিয়া থাকেন। “উদঃ স্থাস্তম্ভোঃ পূর্বস্য”–পাণিনি]

হৃ ধাতুর অর্থ হইতেছে ‘হরণ করা’। কিন্তু আ + হৃ = আহার (খাওয়া), প্র + হৃ = প্রহার (মার), বি + হৃ = বিহার (ভ্রমণ), উদ্ + হৃ = বিহার (ভ্রমণ), উদ্ + হৃ = উদ্ধার (মুক্তি), সম্ + হৃ = সংহার (ধ্বংস), উপ + হৃ = উপহার (উপঢৌকন), পরি + হৃ পরিহার (ত্যাগ বা উপেক্ষা)।

গম্ ধাতুর অর্থ হইতেছে ‘যাওয়া’। কিন্তু আ + গম্ = আগমন (আসা), নিঃ + গম্ = নির্গমন (বাহির হওয়া), বি + গম্ = বিগত (অতীত), সম্ + গম্‌ = সংগত (ঠিক), দুঃ + গম্ = দুর্গতি (দুরবস্থা), সু + গম্ = সুগত (বুদ্ধদেব)।

একটি ধাতুর পূর্বে একই কালে একাধিক উপসর্গ যুক্ত হইতে পারে। বি-অব-হৃ + ঘ = ব্যবহার। সম্-আ-লোচ্ + অন + স্ত্রীলিঙ্গে আ = সমালোচনা। প্রতি—উদ্‌-গম্ + অন = প্রত্যুদ্‌গমন। অনু-সম্-ধা + সন্ + অ + আ = অনুসন্ধিৎসা। সম্-অভি-বি-আ-হৃ + ঘ = সমভিব্যাহার।

উপসর্গগুলি কোন্ কোন্ অর্থে ধাতুর পূর্বে বসিয়া কোন্ কোন্ বিশেষ্য বা বিশেষণপদ গঠন করিয়া থাকে, পরপৃষ্ঠায় তাহার একটি ক্ষুদ্র তালিকা দেখ।

প্র—(১) উৎকর্ষ : প্রভাব, প্রখ্যাত, প্রগতি, প্রতাপ, প্রণত, প্রকৃষ্ট, প্রভাত। (২) আধিক্য : প্রগাঢ়, প্রচণ্ড, প্রকোপ, প্রসক্তি, প্রখর, প্রকট। (৩) আরম্ভ : প্রবেশিকা, প্রদোষ, প্রজা। (৪) দক্ষতা : প্রবীণ, প্রবণতা। (৫) বৈপরীত্য : প্রস্থান, প্রবাসী, প্রোষিতভর্তৃকা, প্রসাধন। (৬) পূর্ববর্তী : প্রপিতামহ। (৭) পরবর্তী : প্রজন্ম, প্ৰশিষ্য।

পরা—(১) আধিক্য : পরাক্রম, পরাকাষ্ঠা। (২) বৈপরীত্য : পরাভব, পরাজয়, পরাক্রান্ত, পরাবর্তন, পরাঙ্মুখ। (৩) সম্যক্ : পরামর্শ, পলায়ন।

,

অপ—(১) বৈপরীত্য : অপচয়, অপজ্ঞান, অপযশ, অপকীর্তি, অপকার, অপমান, অপলাপ। (২) কুৎসিত অর্থে : অপকর্ম, অপবাদ, অপপ্রয়োগ, অপমৃত্যু, অপব্যবহার, অপভাষা। (৩) স্থানান্তরিত অর্থে : অপনয়ন, অপহরণ, অপসৃত।

অপ উপসর্গটির যেন অপপ্রয়োগ না ঘটে সেদিকে সতর্ক থাকা উচিত। যেসব শব্দে কেবল অবস্থা বা ঘটনা বুঝায়, কোনো বস্তুগর্ভতা নাই, সেইসব শব্দের বিপরীতার্থক শব্দসৃষ্টি করিতে নঞ-তৎপুরুষের অ বা অন্ যথেষ্ট। যেমন, সংগতি—অসংগতি, সংযম-অসংযম, বিশ্রান্ত—অবিশ্রান্ত, সভ্য—অসভ্য, বিদ্যা—অবিদ্যা, দৃষ্ট—অদৃষ্ট, শ্লীল-অশ্লীল, সংস্কৃতি—অসংস্কৃতি।

সম্—(১) সম্যক্ : সমুচিত, সমাগত, সমাদর, সমালোচনা, সম্প্রদান, সন্তাপ, সম্মতি, সংজ্ঞা, সংবিৎ, সংবেদন, সমীক্ষা, সংস্কার, সংকীর্তন। (২) আভিমুখ্য : সম্মুখ, সমক্ষে। (৩) একতা : সংকলিত, সংকলন, সমাবর্তন, সংবাদ, সম্মিশ্রণ, সংহিতা। (৪) সত্বরতা : সংবেগ।

নি—(১) আতিশয্য : নিগূঢ়, নিতল, নিদান, নিদারুণ। (২) সম্যক্ : নিপীত, নিয়োগ, নিস্তব্ধ, নিরত, নিষণ্ণ, নিষ্ণাত, নিবিষ্ট, নিক্ষেপ। (৩) বিরত : নিবৃত্ত, নিষেধ, নিবারণ। (৪) নিন্দা : নিকৃষ্ট, নিগ্রহ। (৫) বিন্যাস : নিবেশ, উপনিবেশ। (৬) অভাব : নিচ্ছিদ্র।

অব—(১) নিশ্চয় : অবধান, অবধারণ, অবক্ষয়, অবগতি, অববোধ (বিশেষ—জ্ঞান), অবরোধ। (২) হীনতা : অবনতি, অবজ্ঞাত। (৩) নিম্নতা : অবতরণ, অবগাহন, অবরোহণ। (৪) বিযুক্ত : অবচ্ছেদ, ব্যবধান, অবকাশ।

অনু—(১) পশ্চাৎ : অনুজ, অনুচর, অনুতাপ, অনুব্রজন, অনুসরণ, অনুরাগ, অনুকরণ, অনুশোচনা, অনুস্বর। (২) সাদৃশ্য : অনুরূপ, অনুদান, অনুগুণ, অনুলিপি। (৩) পৌনঃপুন্য : অনুদিন, অনুক্ষণ, অনুধ্যান। (৪) অভ্যন্তর : অনুপ্রবেশ। (৫) আভিমুখ্য : অনুকূল। (৬) সম্যক্ : অনুমোদন

নির্—(১) সম্যক্ : নিরীক্ষণ, নির্ণয়, নির্ধারণ, নিরাকুল (সম্যক্ আকুল), নিশ্চুপ, নিষ্পিষ্ট, নির্মুক্ত, নির্দেশ। (২) নাই বা নয় অর্থে : নিরক্ষর, নিশ্ছিদ্র, নীরত, নির্বংশ, নিস্তরঙ্গ, নিরুপমা, নীরব, নির্ভীক, নির্বাক্, নিস্পন্দ, নিরানন্দ, নিরাহার, নিরন্ন, নির্বেদ, নিরবলম্ব, নিরবদ্য, নিরাকুল (আকুল নয়), নীরদ, নিরগল, নিরভিমান, নিরপরাধা। (৩) বাহির : নির্গত, নিশ্বাস, নির্মোক। আতিশয্য : নিরতিশয়।

দুর্― (১) নিন্দার্থে : দুরদৃষ্ট, দুর্নাম, দুর্মুখ, দুরভিসন্ধি, দুঃশাসন, দুষ্প্রবৃত্তি, দুশ্চরিত্র, দুষ্কৃতি (দুষ্কার্য), দুষ্কৃতী (দুষ্কার্যকারী)। (২) অভাব : দুর্ভিক্ষ, দুর্বল। (৩) দুঃখ অর্থে : দুর্গম, দুর্গ, দুর্জয়, দুষ্কর, দুস্তর, দুষ্প্রাপ্য, দুরবস্থা, দুঃসাধ্য, দুশ্চর, দুরবগাহ, দুরবগম্য, দুরধিগম্য, দুরন্বয়।

বি—(১) বৈপরীত্য : বিয়োগ, বিপক্ষ, বিক্রয়, বিকৃতি, বিসর্জন, বিবাদ। (২) বিশিষ্টতা : বিজ্ঞান, বিকাশ, বিজয়, বিচূর্ণ, বিন্যাস, বিখ্যাত, বিনম্র, বিনয়, বিনীত, বিনত, বিনিয়োগ, বিবর্তন। (৩) অভাব : বিশ্রান্ত (বিগতশ্রম), বিতৃষ্ণা, বিনিদ্র। (৪) প্রতিক্রিয়া : বিক্রিয়া। (৫) আতিশয্য : বিশ্রান্ত (অতিশয় শ্রান্ত)।

অধি—(১) আধিপত্য : অধিনায়ক, অধিপতি, অধিগ্রহণ, অধ্যাদেশ, অধিরাজ, অধিবাস, অধিকার। (২) ঊর্ধ্বস্থিতি : অধিত্যকা, অধিরোহণ। (৩) আধিক্য : অধ্যয়ন।

স—(১) শোভনার্থ : সুযোগ, সুদর্শন, সুকোমল, সুশীল, সুচারু, সুকণ্ঠ, সুসময়, সুদিন, সুগীত। (২) আধিক্য : সুদক্ষ, সুকঠিন, সুতীক্ষ্ণ। (৩) সহজ : সুকর, সুসাধ্য, সুলভ, সুগম। (৪) তীক্ষ্ণতা : সুদর্শন (শকুন)। “সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে।”—জীবনানন্দ দাশ।

উদ—(১) আতিশয্য : উৎকৃষ্ট, উৎকর্ষ, উত্তাল, উদ্বেল, উচ্ছ্বাস। (২) ঊর্ধ্বস্থিতি : উদ্‌বর্তন, উৎক্ষেপণ, উত্তীর্ণ, উৎসঙ্গ, উত্থান। (৩) স্থানচ্যুতি : উদ্বাস্তু, উৎপাটন, উন্মার্গ, উন্নিদ্র।

পরি—(১) বিরোধ : পরিবাদ, পরিপন্থী। (২) আতিশয্য : পরিম্লান, পরিক্ষীণ, পরিবেদন, পরিক্লিষ্ট। (৩) চিহ্ন : পরিচায়ক, পরিপত্র (circular), পরিচিতি। (৪) ব্যাপ্তি : পরিকেন্দ্র। (৫) সম্যক্ : পরিপূর্ণ, পরিপক্ক, পরিতুষ্ট, পরিস্ফুট, পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা, পরিভাষা, পরীক্ষা, পরিচর্যা, পরিচালনা, পরিবহণ, পরিপুষ্ট, পর্যুদস্ত, পরিপৃক্ত, পরিভ্রষ্ট।

প্রতি—(১) সাদৃশ্য : প্রতিমূর্তি, প্রতিবিম্ব, প্রতিনিধি, প্রতিকায়, প্রতিকৃতি, প্রতিচ্ছবি, প্রতিচ্ছায়া, প্রতিলিপি, প্রতিবেদন, প্রতিধ্বনি। (২) বীপ্সা : প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ। (৩) বিরোধ : প্রতিপক্ষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিকূল, প্রতিলোম, প্রতিঘাত, প্রতিক্রিয়া, প্রত্যুত্তর, প্রতিবিধান, প্রতিযোগিতা, প্রতিবাদ। (৪) উৎকর্ষ : প্রতিজ্ঞা, প্রতিপালন, প্রত্যুদ্‌গমন, প্রত্যুত্থান। (৫) সত্বরতা : প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব।

অভি—(১) সম্যক্ : অভিজ্ঞ, অভ্যুদয়, অভ্যুত্থান, অভ্যাগত, অভিশাপ, অভিজ্ঞান, অভিলাষ, অভিনন্দন, অভিজাত। (২) আভিমুখ্য : অভিসার, অভিঘাত, অভিযান, অভিষেক, অভিমুখ। (৩) বিরোধ : অভিযোগ, অভিভব (পরাভব বা ভাবাবেশ)। (৪) সমস্ত : অভিধান।

অতি—(১) অতিক্রম অর্থে : অতিপ্রাকৃত, অতিমানব। (২) আতিশয্য : অতিশয়, অতিকায়, অতিভক্তি, অতিভোজন, অতিবৃষ্টি, অতিদর্প, অতিবুদ্ধি। (৩) উৎকৃষ্ট : অতিনাগর। “সো অতি নাগর।”

অপি—এই উপসর্গযোগে গঠিত শব্দ বাংলায় বিরলদৃষ্ট। অপিনদ্ধ—পিনদ্ধ (পরিহিত), অপিধান—পিধান (আচ্ছাদন)।

উপ–(১) সামীপ্য : উপকণ্ঠ, উপকূল, উপনীত, উপস্থিত, উপনয়ন। (২) সম্যক্ : উপপত্তি, উপন্যাস, উপশম, উপকার। (৩) ক্ষুদ্রার্থে : উপদ্বীপ, উপাহার, উপসাগর, উপমহাদেশ, উপমন্ত্রী, উপরাজ্যপাল, উপগ্রহ। (৪) হীনতায় : উপদেবতা, উপনেত্র, উপভোগ। স্বেচ্ছাচারপ্রসূত ভোগের নামই উপভোগ

আ—(১) পর্যন্ত : আসমুদ্র, আকর্ণ, আমরণ, আমৃত্যু, আজানু, আকণ্ঠ, আবক্ষ (২) সম্যক্ : আশঙ্কা, আকাঙ্ক্ষা, আকর্ষণ, আসিক্ত, আরক্ত, আসেচন, আবণ্টন, আনৃশংস্য, আপীড়ন (সম্যক্ আলিঙ্গিত), আপীত (সম্যক্ পান করা হইয়াছে যাহা)। (৩) ঈষৎ অর্থে : আপক্ব, আরক্ত, আভাস, আনত, আতপ্ত, আকুঞ্চিত, আনীল, আপীত (হরিদ্রাভ), আকম্পিত, আপিঙ্গল, আসিক্ত, আবাসন, আহরিৎ, আতিক্ত। (৪) বৈপরীত্য : আনৃশংস্য (দয়া করুণা)। (৫) চতুর্দিক অর্থে : আসার।

“প্র পরা অপ সম্ নি।
অব অনু নির্ (নিঃ) দুর্ (দুঃ) বি ॥
 অধি সু উদ্ পরি প্রতি।
উপ আ অপি অভি অতি ॥”

এই কুড়িটি উপসর্গের মধ্যে মাত্র প্রতি ও অতি উপসর্গ দুইটিরই অব্যয়রূপে স্বাধীন প্রয়োগ দৃষ্ট হয়। অন্যান্য উপসর্গগুলির স্বাধীন প্রয়োগ নাই।

কুড়িটি উপসর্গ ছাড়াও অন্তঃ, আবিঃ, বহিঃ, প্রাদুঃ, তিরঃ, পুরঃ, সাক্ষাৎ, অলম্, পূর্ব প্রভৃতি উপসর্গ-স্থানীয় অব্যয়ও ধাতুর পূর্বে উপসর্গের মতো ব্যবহৃত হয়।

অন্তঃ—অন্তরাত্মা, অন্তর্জগৎ, অন্তর্গত, অন্তর্ধান, অন্তঃপুর, অন্তঃপাতী,! অন্তঃকরণ, অন্তঃশিলা, অন্তঃসলিলা, অন্তঃসার, অন্তঃস্থ, অন্তর্হিত, অন্তরীক্ষ, অন্তর্গঢ়, অন্তর্দাহ, অন্তর্নিহিত, অন্তর্বর্তী, অন্তর্বেদনা, অন্তর্ভূত, অন্তস্তল, অন্তর্জাতীয়, অন্তরায়, অন্তরাল, অন্তরীপ, অন্তর্গ্রহ, অন্তর্দৃষ্টি, অন্তর্বাণিজ্য, অন্তরঙ্গ।

আবিঃ–আবির্ভাব, আবিষ্কার, আবিষ্কর্তা, আবিষ্করণ, আবিষ্কৃত।

বহিঃ–বহিরঙ্গ, বহিরাগমন, বহিরাবরণ, বহির্গমন, বহির্জগৎ, বহির্দেশ, বহির্বাটী, বহির্বাণিজ্য, বহির্ভূত, বহিষ্কার, বহিষ্করণ, বহিষ্কৃত, বহিষ্ক্রান্ত, বহিরিন্দ্রিয়, বহির্মুখী, বহিলোক, বহির্দ্বার, বহির্ভবন, বহির্বিশ্ব।

প্রাদুঃ—প্রাদুর্ভাব, প্রাদুর্ভূত।

তিরঃ–তিরোভাব, তিরোধান, তিরোহিত, তিরস্করণী, তিরস্কার, তিরস্কৃত।

পুরঃ—পুরস্কার, পুরোহিত, পুরোভাগ, পুরোবর্তী, পুরোভূমি, পুরোযায়ী।

অলম্—অলংকার, অলংকর্তা, অলংকরণ, অলংকৃতি, অলংকৃত।

সাক্ষাৎ—সাক্ষাৎকার, সাক্ষাদ্দর্শন।

পূর্ব–পূর্বকাল, পূর্বজন্ম, পূর্ববর্তী, পূর্বপদ, পূর্বপুরুষ।

সংস্কৃত উপসর্গ ধাতু ব্যতীত বিশেষ্য, বিশেষণ ইত্যাদি পদের পূর্বেও বসে। (ক) বিশেষ্যের পূর্বে : (১) প্র + পিতামহ = প্রপিতামহ; (২) অভি + মুখ অভিমুখ; (৩) পরি + কেন্দ্র = পরিকেন্দ্র; (৪) প্রতি + অহ = প্রত্যহ; (৫) দুঃ + মুখ = দুর্মুখ।

(খ) বিশেষণের পূর্বে : (১) প্র + খর = প্রখর; (২) অতি + অধিক = অত্যধিক; (৩) আ + নীল = আনীল।

বাংলা উপসর্গ

বাংলা উপসর্গগুলির বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহারা ধাতুর পূর্বে না বসিয়া বিশেষ্য বা বিশেষণের পূর্বে বসে।

অ, আ, অনা—(১) না, নয় বা নাই অর্থে : অচেনা, অজানা, অনড়, অনামা, অদেখা, অকেজো, অকাট্য, অফুরন্ত, আকাড়া, অনাবৃষ্টি, অঢেল, অখুশী, আখোলা, আলুনী, আধোয়া, আচালা, আপাকা (ঈষৎ অর্থে), আছাঁটা। (২) মন্দ অর্থে : অনাছিষ্টি, অনাসৃষ্টি, অবেলা, অঘাট, অকাজ, অকাল, আকাল, আঘাটা। (৩) অতিশয় বা প্রকৃষ্ট অর্থে : অপলকা (ঠিক-ঠিক পলকা), অবর, আকাট (মূর্খ, আক্লান্ত!

কু–-মন্দ অর্থে : কু-কাজ, কুচুটে, কুনজর, কুদিন, কুকথা, কুপথ্য, কুপুত্ৰ, কুপথ, কু-অভ্যাস।

সু—ভালো অর্থে : সুনজর, সুডৌল, সুঠাম, সুরাহা, সুপুত্র, সুদিন, সুখবর।

নির্, নি—নাই অর্থে : নিলাজ, নির্ঝঞ্ঝাট, নিঠুর, নিটোল, নিখুঁত, নিখাদ, নিটুট, নিখরচা, নিখরচে, নিখোঁজ, নিভাঁজ, নির্ভেজাল, নির্ভরসা, নির্ভুল, নিটাল।

না–না বা নয় অর্থে : না-টক, না-মিষ্টি, নাছোড়, নাবালক, নামঞ্জুর, নারাজ, না—লায়েক।

বি—নাই বা নিন্দার্থে : বিভুঁই, বিজোড়, বিকল, বিটোল।

পাতি—ক্ষুদ্র অর্থে : পাতিহাঁস, পাতিলেবু, পাতিকুয়া > পাতকো।

ভর—পূর্ণ অর্থে : ভরসন্ধে, ভরপেট, ভরদুপুর, ভরদিন।

হা—অভাবার্থে : হাঘরে, হা-ভাতে, হা-পিত্যেশ (অতি লোভাতুর প্রত্যাশা), হাহুতাশ।

ভরা—পূর্ণ অর্থে : ভরাডুবি, ভরাযৌবন, ভরানদী, ভরাকোল।

স—সহার্থে : সবুট, সজোর।

বিদেশী উপসর্গ

বিদেশী উপসর্গগুলিও ধাতুর পূর্বে না বসিয়া বিশেষ্য ও বিশেষণের পূর্বে বসে।

(ক) ফারসী : গর–না, অভাব ও অন্যথা অর্থে : গরমিল, গরহাজির, গরজমা, গররাজী, গরবনেদী, গরকবুল, গরকায়েম।

বদ—নিন্দার্থে : বদলোক, বদনাম, বদমেজাজ, বদহজম, বদগন্ধ।

ফি—প্রত্যেক অর্থে : ফি-সন, ফি-বছর, ফি-হপ্তা।

দর—অল্প অর্থে : দরকাঁচা, দরকচা, দরদালান, দরপত্তনি।

বে—(১) নয় অর্থে : বেগতিক, বে-আইনী, বেপরোয়া, বেরসিক, বেকায়দা, বে-আক্কেল, বে-সুরো, বেঢপ, বেইজ্জত, বেইমান, বেকসুর, বেআদব, বেঅকুফ, বেওয়ারিস, বেজায়, বেজার, বেদখল, বেঠিক, বেধড়ক, বেনাম, বেশরম, বেহিসাব, বেহুঁশ, বেপাত্তা, বেসামাল, বেতাল, বেহায়া, বেহাল, বেঘোর (অচেতন, সংকটময়), বেগোছ, বে-বলগা। (২) মৃদু অর্থে : বে-আন্দাজ (যথাযথ আন্দাজ করা হয় নাই), বে-আন্দাজী। (৩) মন্দ বা অন্য অর্থে : বেপাড়া।

নিম—প্রায় বা অর্ধ অর্থে : নিমরাজী, নিমখুন।

হর—প্রত্যেক অর্থে : হররোজ, হরবোলা, হরেক।

(খ) ইংরেজী : হেড—প্রধান অর্থে : হেডমাস্টার, হেড-অফিস, হেডক্লার্ক, হেড-কোয়ার্টার্স, হেড-কনস্টেবল।

সাব—অধীন অর্থে : সাবজজ, সাব-ডেপুটি, সাব-ইন্সপেক্টর।

ফুল—ফুলপ্যান্ট, ফুলহাতা, ফুলমোজা।

হাফ–অর্ধ অর্থে : হাফ-টাইম, হাফ-ডে, হাফ-জানতা, হাফ-রোজ, হাফ-টিকিট।

মিনি—মিনিবাস, মিনিছাতা, মিনিখাতা, মিনিমঠ, মিনিহোটেল।

অনুসর্গ ও উপসর্গের সাদৃশ্য ও পার্থক্যটুকু দেখিয়া লও। অনুসর্গ ও উপসর্গ উভয়েই অব্যয়—উভয়ের মধ্যে ক্ষীণ সাদৃশ্য এইটুকুই; কিন্তু বিভেদটুকুই বড়ো :

(১) উপসর্গ সবই অব্যয়, কিন্তু অনুসর্গ কিছু অব্যয় আর কিছু ক্রিয়াজাত

(২) অনুসর্গ বিশেষ্য বা সর্বনামের পরে বসিয়া শব্দবিভক্তির কাজ করে; কিন্তু উপসর্গ ধাতুর পূর্বে বসিয়া তাহার অর্থটির পুষ্টিসাধন বা বৈশিষ্ট্য-নিদর্শন করে, আবার কখনও-বা অর্থের পরিবর্তন, উৎকর্ষ বা অপকর্ষও ঘটায়। (৩) অনুসর্গ পূর্বস্থিত পদটির পরে পৃথভাবে অবস্থান করে, পদটির সহিত একাঙ্গ হইয়া যায় না, কিন্তু উপসর্গ পরবর্তী ধাতুটির সহিত একাঙ্গ হইয়া অবস্থান করে। (৪) অনুসর্গ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শব্দের পরে বসে, ক্বচিৎ শব্দের পূর্বে বসে, (২০৫-২০৭ পৃষ্ঠায় অনুসর্গের প্রয়োগ লক্ষ্য কর) কিন্তু তৎসম উপসর্গ ধাতুর পূর্বেই বসে, পরে নয়। (৫) অনুসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ আছে, কিন্তু উপসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ নাই। (অবশ্য প্রতি ও অতি উপসর্গের স্বতন্ত্র প্রয়োগ আছে।) অনুসর্গের স্বাধীন প্রয়োগের উদাহরণ : সেই বাগবাজার থেকে থেকে-থেকেই দক্ষিণেশ্বরে ছুটে আসে। মনের মাঝে উদ্দীপনা মাঝে-মাঝে জাগে বইকি। এদেশে মাটির দোষে চারাগাছ বনস্পতি হতে-হতেই এরণ্ড হয়ে যায়। আদেশ পাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গেই তিনি পদত্যাগ করেছেন।

অনুশীলনী

১। (ক) উপসর্গ কাহাকে বলে? উপসর্গের বৈশিষ্ট্য কী? উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।

(খ) সংস্কৃত উপসর্গ বিশেষ্য ও বিশেষণের পূর্বেও বসে, উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।

২। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত উপসর্গগুলিকে কয়টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়? প্রত্যেকটি শ্রেণীর দুইটি করিয়া উপসর্গের উল্লেখ কর এবং প্রতিটি উপসর্গ দিয়া একটি করিয়া শব্দগঠন করিয়া শব্দগুলিকে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।

৩। উদাহরণের সাহায্যে অনুসর্গ ও উপসর্গের পার্থক্য বুঝাইয়া দাও।

৪। (ক) সংস্কৃত উপসর্গগুলির নাম উল্লেখ কর। ইহাদের মধ্যে কোন্ কোটির স্বাধীন প্রয়োগ রহিয়াছে উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দাও।

(খ) সংস্কৃত উপসর্গ-স্থানীয় যে অব্যয়গুলি বাংলায় উপসর্গের মতো ব্যবহৃত হয়, সেগুলির নাম কর এবং প্রত্যেকটির দ্বারা একটি করিয়া শব্দগঠন কর।

(গ) বাংলা উপসর্গ ও সংস্কৃত উপসর্গের পার্থক্য উদাহরণসহ বুঝাইয়া দাও।

৫। পাঁচটি বাংলা উপসর্গ ও পাঁচটি বিদেশী উপসর্গের উল্লেখ করিয়া প্রতিটি উপসর্গ দিয়া একটি করিয়া শব্দগঠন কর। এই উপসর্গগুলির বৈশিষ্ট্য কী?

৬। (ক) কৃ, হৃ, গম্, পদ্—প্রত্যেকটি ধাতুর পূর্বে বিভিন্ন উপসর্গ যোগ করিয়া একে একে দেখাও যে, উপসর্গ ধাতুর অর্থের পরিবর্তন ঘটায়।

(খ) স্থা, দিশ্, ভূ, বদ্, চর্, জ্ঞা—প্রত্যেকটি ধাতুর পূর্বে কমপক্ষে দুইটি করিয়া উপসর্গ পৃথভাবে যোগ করিয়া মোট বারোটি শব্দগঠন কর।

(গ) প্র আ সম্ অধি অব উদ্ বে অভি নির্ দুর্ বি সু উপ না ভর বদ নি অনু—প্রতিটি উপসর্গের দ্বারা একটি শব্দরচনা করিয়া প্রতিটি শব্দকে বাক্যে প্রয়োগ কর।

৭। উদাহরণ দাও : বিদেশী উপসর্গযুক্ত তৎসম শব্দ, সংস্কৃত উপসর্গযুক্ত বিদেশী শব্দ, সম্যক্ অর্থে ‘আ’ উপসর্গ, মৃদু অর্থে ‘বে’ উপসর্গ, সংস্কৃত উপসর্গ-স্থানীয় অব্যয়, একাধিক উপসর্গযুক্ত শব্দ।

৮। (ক) শব্দের আদিতে স্থিত উপসর্গটির স্থানে পাশের বন্ধনীমধ্যস্থ উপসর্গটি বসাইয়া যে নূতন শব্দটি পাও, সেটির সঙ্গে মূল শব্দটির অর্থের কী পার্থক্য ঘটে, দেখাও : আগমন (নির্), নিক্ষেপ (প্র), আহার (উপ), উপকার (সম্), আনয়ন (প্র), নিবৃত্তি (আ), সম্পন্ন (প্ৰ), প্রসন্ন (বি)।

(খ) √ নী + ক্ত = …..? শব্দটির পূর্বে প্র, আ, উপ, অভি, পরি, বি—উপসর্গগুলি একে একে বসাইয়া মোট ছয়টি শব্দরচনা কর ও সেগুলির অর্থ বল।

(গ) √ পদ + ক্তি = …. ? শব্দটির পূর্বে উদ্, প্রতি, বি, নিঃ, সম্, আ, উপ, প্র—উপসর্গগুলি একে একে বসাইয়া মোট আটটি শব্দরচনা কর এবং সেগুলির অর্থ বল।

(ঘ) √ সদ্ + ক্ত = ….? শব্দটির পূর্বে প্র, আ, নি, উদ্, বি, অব—উপসর্গগুলি একে একে বসাইয়া মোট ছয়টি শব্দরচনা কর এবং সেগুলির অর্থ বল।

(ঙ) ‘আসন্ন’ কথাটির ‘আ’ উপসর্গ বাতিল করিয়া সেইস্থানে ‘বি’ উপসর্গ বসাইয়া যে শব্দটি পাইবে সেটিকে বাক্যে প্রয়োগ কর।

(চ) ‘উৎপত্তি’ কথাটির পূর্বে ‘বি’ উপসর্গ বসাইয়া যে শব্দটি পাইবে সেটিকে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর।

৯। সমালোচিত, প্রত্যুদ্‌গত, সমভিব্যাহার, ব্যবহৃত, প্রত্যুত্থান, ব্যুৎপত্তি, বিপরীত, সমবেত, ব্যত্যয়, উপনিষৎ—প্রতিটি শব্দে ব্যবহৃত উপসর্গগুলি পর পর দেখাও।

১০। চূড়ান্ত রূপ দেখাও এবং শব্দটিকে স্বরচিত বাক্যে প্রয়োগ কর : অনু + সঙ্গী, অনু + সন্ধান, অনু + সিদ্ধান্ত, পরি + সেবা, নিঃ + নেয়, পরি + নয়, সু + সিদ্ধ, নি + সিদ্ধ, প্র + নতি, পরি + মান, প্র + নাম, দুঃ + নাম, অভি + সেক, দুঃ + নীতি, সু + সুপ্তি, দুঃ + বি + সহ, নি + ছিদ্র, নিঃ + ছিদ্র, বি + সন্ন, পরি + নাম।

১১। (ক) ‘তাপ’ কথাটির পূর্বে প্র, সম্, নিঃ, অনু, পরি, উদ্ উপসর্গগুলি একে একে বসাইয়া ছয়টি শব্দরচনা করিয়া প্রতিটি শব্দকে নিজস্ব বাক্যে প্রয়োগ কর।

(খ) ‘মান’ কথাটির পূর্বে প্র, সম্, অপ, অভি, নিঃ, পরি, অনু, উপ এই উপসর্গগুলি একে একে বসাইয়া মোট আটটি শব্দ রচনা কর।

(গ) ‘নত’ শব্দটির পূর্বে প্র, সম্, অব, বি, উদ্, পরি, আ উপসর্গগুলি একে একে বসাইয়া সাতটি শব্দরচনা কর।

১২। শুদ্ধ কর : প্রতি গৃহে গৃহে গিয়ে আবেদন জানিয়েছি। আবহমান কাল থেকেই এ প্রথা এই দেশে চলে আসছে। অপসংস্কৃতিতে দেশটা যে ছেয়ে গেল হে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *