1 of 2

৪৬. বাল গঙ্গাধর তিলকের কারাদণ্ড

বাল গঙ্গাধর তিলকের কারাদণ্ড উপলক্ষে খোদ লন্ডনেও আলোড়ন শুরু হয়েছিল। তিলক প্রকৃতই দোষী না নির্দোষ? র‍্যান্ড ও আয়ার্স্টের হত্যাকারীরা ধরা পড়েছে, তাদের ফাঁসি হয়ে গেছে, ওই হত্যাকারীদের সঙ্গে তিলক কোনও রকম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন এমন কোনও তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিনা প্রমাণে একজন বিশিষ্ট, শিক্ষিত নাগরিক ও জননেতাকে শাস্তি দেওয়া ব্রিটিশ রুল অব ল-এর বিরোধী। লন্ডনের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বিচার ব্যবস্থার ব্যভিচার সম্পর্কে স্পর্শকাতর।

প্লেগ উপলক্ষে বম্বে গভর্নমেন্ট সাধারণ মানুষের ওপর অহেতুক অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়েছে, নারীদের সম্ভ্রম হরণ করেছে, তিলক তার সমালোচনা করেছেন নিজের পত্রিকায়, সেটা কি অপরাধ? বিলিতি পত্রপত্রিকাগুলি সরকারের সমালোচনা করে না?

স্যার উইলিয়াম ওয়েডারবার্ন নামে একজন উদারপন্থী পার্লামেন্ট সদস্য এই নিয়ে পার্লামেন্ট প্রশ্ন উত্থাপন করলেন। জ্বলন্ত ভাষায় তিনি বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা করে বললেন, এই ধরনের অত্যাচার শুধু মানবতা-বিরোধী নয়, এর ফলে জগতের চক্ষে ইংরেজদের মর্যাদাও কি কিছুটা হেয় হয়ে যাবে না?

প্রধানমন্ত্রী গ্ল্যাডস্টোন এর উত্তরে জানালেন যে কলোনিগুলিতে অকারণ দমন-পীড়নের নীতি ইংরেজ সরকারের নেই। ভারতের মহারাষ্ট্রে যে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে, তার কোনও রিপোর্ট সরকার পায়নি। সত্যিই যদি এরকম কিছু ঘটে থাকে, তাহলে মাননীয় সদস্য স্যার ওয়েডারবার্ন তথ্যপ্রমাণ পেশ করুন। সেগুলি বিবেচনা করে দেখার পর অবশ্যই বম্বে গভর্নমেন্টকে নির্দেশ পাঠানো হবে।

ভারতের এই ঘটনাগুলির বিষয়ে ওয়েডারবার্ন-এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। ভারতের বহু সংবাদই লন্ডনে পৌঁছয় না, নেটিভদের পত্রপত্রিকাও স্বরাষ্ট্র দফতর ছাড়া অন্য কেউ দেখে না। ওয়েডারবার্ন এসব শুনেছেন গোখলে নামে ভারতীয় কংগ্রেসের এক নেতার কাছ থেকে। গোখলেই তাঁকে উত্তেজিত করেছেন। এখানকার কয়েকটি পত্রিকাতেও গোখলের উক্তি ছাপা হয়েছে।

গোখলে কিছুদিন ধরে রয়েছেন লন্ডনে, তিনি নিজেও প্রত্যক্ষদর্শী নন। তাকে ওই সব ঘটনা সবিস্তারে লিখে জানিয়েছেন আর এক কংগ্রেস নেতা রানাডে। রানাডে একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি, তার বিবরণ অসত্য মনে করার কোনও কারণ থাকতে পারে না। ওয়েডারবার্ন যখন গোখলের কাছে প্রমাণ চাইলেন, তখন ওই চিঠিখানা দিলেই চুকে যেত, কিন্তু গোখলে অনেক বিবেচনা করে ওই চিঠির কথা প্রকাশ করলেন না। রানাডে কংগ্রেস রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও পেশায় তিনি হাইকোর্টের জজ, এই ঘটনার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িত হলে তিনি সরকারের কোপে পড়বেন।

গোখলের মুখের কথাই যথেষ্ট নয়, পরবর্তী পার্লামেন্টের অধিবেশনে ওয়েডারবার্ন তাঁর অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে না পারায় কিছুটা অপদস্থ হলেন, সে প্রসঙ্গ সেখানেই চাপা পড়ে গেল। এর পর গোখলে যখন স্বদেশে ফিরলেন, তখন জাহাজঘাটাতেই বম্বের পুলিশ কমিশনার এসে দাঁড়ালেন তাঁর মুখোমুখি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি বম্বে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে লন্ডনে অযথা অপবাদ ছড়িয়েছেন, ভিত্তিহীন অভিযোগ দাখিল করেছেন। এজন্য তাকে ক্ষমা চাইতে হবে।

গোখলে বললন, বিলেতে আমি বম্বে গভর্নমেন্টের বিরুদ্ধে যা বলেছি, তা আমি নিজে সত্য বলে জেনেছি বলেই বলেছি। কিন্তু তার প্রমাণ দিতে আমি অপারগ। সে জন্য যদি আমাকে ক্ষমা চাইতে হয়, আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

এই ক্ষমা প্রার্থনার কথা চতুর্দিকে রটে যাওয়ায় অনেকে ছি ছি করতে লাগল। গোখলে নিজে যে-সব ঘটনাকে সত্য বলে মনে করেছেন, তা প্রকাশ করার জন্য তিনি ক্ষমা চাইতে যাবেন কেন? বিলেতে বসে তিনি প্রমাণ দাখিল করতে পারেননি, কিন্তু মহারাষ্ট্র পৌঁছনোর পর সেই সব অত্যাচারের প্রমাণ তো সব দিকে জাজ্বল্যমান। অমরাবতীতে কংগ্রেসের অধিবেশনে গোখলে যখন বক্তৃতা দিতে উঠলেন, তখন বহুসংখ্যক প্রতিনিধি হিস হিস শব্দ করতে লাগল, অপমানিত হয়ে গোখলে মধ্যপথে বসে পড়লেন।

এই অমরাবতী কংগ্রেসে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করলেন, আমরা তিলককে নিরপরাধ মনে করি। প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত তিলক দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর কংগ্রেসের এই অভিমত। কিন্তু তিলককে অবিলম্বে কারামুক্ত করতে হবে, সরকারের কাছে এরকম দাবি জানাবার মতন মনোবল কংগ্রেস নেতাদের নেই। তিলকের জন্য তাঁরা অশ্রুবর্ষণ করতে পারেন মাত্র।

বিলেতের পার্লামেন্টে কোনও সুরাহা না হলেও বুদ্ধিজীবীদের ক্ষোভ মিটল না। তাদের মুখপাত্র হিসেবে ঋষিকল্প পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার স্বয়ং মহারানি ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন জানালেন। তিনি লিখলেন, তিলকের কারাদণ্ড শুধু একজন ব্যক্তি বিশেষকে শাস্তি দেওয়া নয়, সমগ্র মানবজাতির পক্ষে গ্লানিকর।

মহারানি তাঁর এই ভারতীয় প্রজাটিকে অবিলম্বে মুক্তি দেবার আদেশ জারি করলেন।

সেই আদেশ বম্বে গভর্নমেন্টের কাছে পৌঁছবার পরও তারা একটা শর্ত প্রয়োগ করতে চাইল। তিলককে বলা হল, তিনি তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাঁকে এক্ষুনি বাড়ি ফিরতে দেওয়া হবে।

ক্ষমা চাইবেন তিলক? কারাগারে বসেই তিনি গোখলের ক্ষমা প্রার্থনার কথা শুনে মর্মাহত হয়েছিলেন। যারা রাজনীতি করে, তাদের যখন তখন বিপদের সম্ভাবনা অনিবার্য। সে জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। যা জনসাধারণের সেবক, কোনও সঙ্কটের সময় তারা শোচনীয় ভীরুতা দেখালে সেই জনসাধারণের সামনে আর কোনও আদর্শ থাকে না। ইংরেজ সরকার ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব দিয়ে ভারতীয় নেতাদের অপমানিত করতে চাইছে। তিলক সরাসরি সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেন।

কিন্তু মহারানির নির্দেশ অমান্য করা যায় না। তিলকের মেয়াদ পূর্ণ হতে তখনও ছ’মাস বাকি, তাঁকে বিনা শর্তে ছেড়ে দেওয়া হল। সসম্মানে, মাথা উঁচু করে তিলক বেরিয়ে এলেন কারাগারের বাইরে।

প্লেগ মামলায় তিলকের মুক্তির পর অনান্য কয়েদিদেরও একে একে ছেড়ে দেওয়া হতে লাগল। দু মাস বাদে ছাড়া পেয়ে গেল ভরত সিংহ।

কারাগারের লৌহদ্বার থেকে বেরিয়ে আসার সময় ভরত বেশ বিস্মিত হয়েছে। শুধু মুক্তিই পায়নি সে, তার সমস্ত জিনিসপত্র ফেরত দেওয়া হয়েছে তো বটেই, একটি নতুন কম্বল এবং বেশ কিছু অর্থও দেওয়া হয়েছে তাকে। জেলখানার বন্দিদের প্রতিদিন ঘানি ঘুরিয়ে তেল বার করার কাজ করতে হয়, সেই পরিশ্রমের বেতনও নির্দিষ্ট আছে। সেই বেতন হিসেবে ভরত পেয়েছে একশো কুড়ি টাকা। বিচিত্র এই সরকারের নীতি। এরা বিনা অপরাধে মানুষকে জেলে ভরে রাখে, আবার ছেড়ে দেবার সময় অযাচিতভাবে কিছু টাকাও হাতে তুলে দেয়।

এই এক বছরের কিছু বেশি সময়ে ভরত একবারও চুল কাটেনি, মুখ মুণ্ডন করেনি। তার মাথা ভর্তি চুলে জট বাঁধা, মুখখানি দাড়ি গোঁফে প্রায় ঢাকা। জেলখানার বাইরে তার অন্য কারুর অপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না, পুণা শহরের একজন মানুষকেও সে চেনে না, শহরটিও তার অজানা, সে একটা কাপড়ে পুঁটুলি বগলে নিয়ে অনির্দিষ্টভাবে হাঁটতে লাগল। মনে মনে সে ভাবছে, চুলদাড়ি সব কেটে ফেলবে, না রাখবে? তার ভবিষ্যত জীবনের ধারার ওপর সেটা নির্ভর করছে। যদি আগের মতন তীর্থে তীর্থে ভ্রাম্যমাণ হয়, তা হলে এগুলি রেখে দেওয়াই সুবিধাজনক। সাধু হও বা না হও, অঙ্গবস্ত্র গেরুয়া রঙে ছুপিয়ে নিলে আর বড় বড় চুল দাড়ি রাখলেই লোকে সাধু বলে ধরে নেয়, কিছুটা মান্য করে, যে-কোনও মন্দিরে আশ্রয় নিলে আহার জুটে যায়। এইভাবে ভ্রমণের একটা নেশা আছে। সংসারচিন্তা নেই, কোন দায়িত্ববোধ নেই, শোক-তাপ ভোগ করতে হয় না। সারাটা জীবনই ঘুরতে ঘুরতে কাটিয়ে দেওয়া যায়।

অথবা, সমাজের মধ্যেও ফিরে আসতে পারে ভরত। আপাতত তার অর্থসঙ্কট নেই, নিজের সঞ্চিত কিছু এখনও আছে, উপরন্তু জেলখানা থেকে আরও কিছু পেয়েছে, কোথাও ঘর ভাড়া নিয়ে বৎসরখানেকের মতন তার চলে যেতে পারে। এর মধ্যে কিছু উপার্জনের ব্যবস্থা করাও অসস্তুব নয়। কিন্তু কোথায় যাবে সে? তার ভাগ্যই যে বিড়ম্বিত। যেখানেই সে ভিত গাড়তে যায়, সেখানেই কিছু না কিছু বিপদ ঘটে। তাকে যারা জড়িয়ে থাকে, তারাই বিপর্যস্ত হয় বেশি। ত্রিপুরা থেকে সে বিতাড়িত, বাংলাদেশে তার স্থান হল না, ওড়িশায় সে চরম আঘাত পেয়েছে। এই পুণাতেই সে থেকে যাবে? এই অচেনা শহরে সে শুরু করতে পারে নতুন জীবন।

চুলে শুধু জটই পড়েনি, উকুনও হয়েছে। জেলখানায় ঘ্যাস ঘ্যাস করে মাথা চুলকোতে চুলকোতে একটা একটা উকুন ধরে পুট পুট করে টিপে মারা ছিল সময় কাটাবার একটা উপায়। উকুনগুলি এখন দাড়ির মধ্যেও ঘুরে বেড়ায়। এক চৌরাস্তার মোড়ে একজন ক্ষৌরকারের সামনে দুটি লোককে উবু হয়ে বসে থাকতে দেখে ভরত মনস্থির করে ফেলল। আপাতত এই কেশরাজি সম্পূর্ণ নির্মূল না করে নিলে উকুন তাড়ানো যাবে না। ভরত বসে পড়ল সেখানে।

এক ঘণ্টা আগে পরে ভরতের চেহারা সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে গেল। ন্যাড়া মাথায় রোদ পিছলে যাচ্ছে, চকচকে গাল, শুধু গোফটি রেখে দিয়েছে, না হলে পুরুষত্ব বজায় থাকে না। শরীর বেশ হালকা বোধ হল এবং সাধু হয়ে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছেটাও চলে গেল। কারাগারে এই শরীর অনেক নির্যাতিত হয়েছে, এখন কিছুদিন আরাম করা যাক।

গণেশখিণ্ডের কাছে একটি মাঝারি ধরনের হোটেলে সে ঘর ভাড়া নিল।

সেপ্টেম্বর মাস, বাতাসে তাপ নেই। আবহাওয়া অতি মনোরম বলে সাহেব-মেমরা এই শহরটি বেশ পছন্দ করে। সাহেবদের অনেক বাড়ি চোখে পড়ে, এখানে হোটেলের সংখ্যাও কম নয়। বিলিতি কেক-বিস্কুট-পাঊরুটির দোকান যত্রতত্র। কিছু কিছু ধনী পার্শিও এখানে অট্টালিকা নির্মাণ করেছে, বাদবাকি মহারাষ্ট্রীয় অধিবাসীরা অধিকাংশই বড় গরিব। দু’দিন ধরে পুণার পথে পথে ঘুরে ভরত ঠিক করল হোটেল ছেড়ে সে এখানেই একটা বাসা ভাড়া নেবে। বেশ কয়েকটি বাড়ির দরজায় সে টু-লেট লেখা বোর্ড ঝুলতে দেখেছে।

সেই দিনই সন্ধেবেলা পুলিশের এক সেপাই এসে বলল, ভরতকে একবার কোতোয়ালিতে যেতে হবে। প্রত্যেক হোটেলের রেজিস্ট্রারে পুলিশ এসে নবাগতদের নামধাম পরীক্ষা করে। সাহেব-হত্যার জের এখনও চলছে, চতুর্দিকে গোয়েন্দারা ঘুরছে ষড়যন্ত্র আবিষ্কারের জন্য।

কোতোয়ালিতে নিয়ে আসার পর ভরতকে জিজ্ঞেস করা হল, সে কোথা থেকে এসেছে এবং পূণায় কী উদ্দেশ্যে আগমন।

মিথ্যে কথা বললে আরও জটিলতা বাড়তে পারে, তাই ভরত জানাল যে সে জেলখাটা কয়েদি, তাকে ধরা হয়েছিল নাগপুরে, চাপেকর ভাইদের সঙ্গে তার কোনও রকম সম্পর্ক প্রমাণিত হয়নি, তাদের সে চেনে না, সে মারাঠি ভাষা জানে না, তাকে ধরে রাখা হয়েছিল সন্দেহের বশে। সে। সদ্য বেকসুর খালাস পেয়েছে।

এখানে অবশ্য ভরতকে মারধর করা হল না। একজন দারোগা মোটামুটি ভদ্রভাবেই তাকে জেরা করতে লাগল। এক সময় সে জিঞ্জেস করল, তুমি ইংরেজি জানা যুবক, তুমি ছাড়া পাবার পর কর্মস্থলে ফিরে না গিয়ে পুণায় রয়ে গেলে কেন?

ভরত এবারও সত্য কথা বলল, আমার উপস্থিত কোনও জীবিকা নেই। পুণায় চাকরি খুঁজব ঠিক করেছি।

দারোগটি বলল, বেশ। তুমি যদি সরকারের বাধ্য প্রজা হয়ে শান্তিপূর্ণ জীবন কাটাতে চাও, তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। তবে তোমাকে প্রতি সপ্তাহে একদিন করে থানায় হাজিরা দিয়ে যেতে হবে। হোটেল কিংবা বাসা বদল করলে থানায় অবশ্য জানিয়ে যাবে, এর ব্যত্যয় ঘটলে তোমার কপালে আবার দুঃখ আছে।

ভরত জিজ্ঞেস করল, আর আমি যদি পুণা ছেড়ে একেবারেই চলে যেতে চাই, তার অনুমতি পাব কী?

দারোগাটি বলল, অবশ্যই পাবে। তা হলে তো আমাদের ঝঞ্ঝাট চুকে যায়। এর পর তুমি যেখানে যাবে, সেখানকার পুলিশের দায়িত্ব তোমার ওপর নজর রাখার। আমার পরামর্শ যদি শোনো, মহারাষ্ট্র থেকে অনেক দূরে চলে যাও যাওয়াই তোমার পক্ষে মঙ্গল। এখানে আবার কোনও গোলযোগ হলে তোমার মতন লোকদেরই প্রথমে সন্দেহ করে ধরা হবে। দিল্লি যাও, লাখনউ যাও, কলকাতা যাও, সেখানে কেউ তোমাকে দাগি বলে চিনবে না।

অতএর পুণার পাট চুকে গেল। আর একটি প্রদেশও ভরতের পক্ষে অপয়া। তা হলে সে কোথায় যাবে? ভরতের মনে পড়ল পাটনার কথা। সেই শহরটি তার ভাল লেগেছিল, সেখানে গিয়ে একবার ভাগ্য পরীক্ষা করলে কেমন হয়?

এক প্রস্থ বিলাতি পোশাক কিনে ভরত ধুতি-কুর্তা ছাড়ল। পুরনো জামা-কাপড়গুলো ফেলেই দিল সে। আগেকার কিছুই আর রাখবে না, পুলিশের নজর এড়াবার জন্য তাকে ভদ্দরলোক সাজতে হবে। ইংরিজিতে কথা বলার জন্যই থানার দারোগাটি তাকে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করতে পারেনি।

থার্ড ক্লাসের বদলে সেকেন্ড ক্লাসের টিকিট কেটে ভরত পশ্চিম ভারত ছেড়ে রওনা দিল পূর্ব ভারতের দিকে।

ট্রেনের কামরার এক কোণে উপবিষ্ট একটি যুবকের দিকে তার দৃষ্টি আকৃষ্ট হল প্রথম থেকেই। যুবকটির চেহারায় অবশ্য কোনও বৈশিষ্ট্য নেই, রোগা-পাতলা, মধ্যমাকৃতি, মুখে অস্পষ্ট বসন্তের দাগ, ঢিলে-ঢালা প্যান্ট ও কোট পরা, মাথায় টুপি। কিন্তু তার ধরন-ধারন বিচিত্র, সে একটার পর একটা সিগারেট টেনে যাচ্ছে, সঙ্গ দু’তিনখানি বই। একবার একটি বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে আবার অন্য বই খুলছে, কথনও তার হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে দেশলাই, কখনও বই খসে পড়ছে, কেউ তার পাশে বসলে সে সঙ্কুচিতভাবে সরে যাচ্ছে এক পাশে, কেউ তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে সে মাথা নেড়ে ইংরিজিতে শুধু বলছে, নো, নো।

ভরত বোঝার চেষ্টা করল, যুবকটির কোন জাত। ট্যাঁস ফিরিঙ্গি? একটা স্টেশনে দু পয়সার চিনে বাদাম কেনার সময়ও সে বাদামওয়ালার সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলেছে। একবার সে বাথরুমে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াতেই তার কোল থেকে বইগুলো পড়ে গেল মেঝেতে, সেগুলো তুলতে গিয়ে তার কোটের পকেট থেকে পড়ে গেল রুমাল। তারপর সে যখন ভরতের পাশ দিয়ে যাচ্ছে, ভরত দেখল, তার প্যান্টের পকেট থেকে মানিব্যাগটা বেরিয়ে অনেকখানি ঝুলে আছে। ভরত বলল, মাইন্ড ইয়োর পার্শ।

যুবকটি থমকে দাঁড়িয়ে, মানিব্যাগটা ভাল করে ঢুকিয়ে বলল, থ্যাঙ্কস।

কামরায় বেশি লোক নেই। বাইরের আকাশে শেষ বিকেলের আলো। ট্রেন চলেছে একটা জঙ্গলের পাশ দিয়ে। ভরত উঠে এসে জানলার পাশে বসল। তারপর যুবকটির রেখে যাওয়া বইগুলির দিকে তাকিয়ে সে চমকে উঠল। ওপরের বইটি বঙ্কিমচন্দের ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। টাস ফিরিঙ্গিরাও এখন বাংলা উপন্যাস পড়ছে নাকি?

ভরত কতদিন বাংলা পড়েনি। কোনও বইই পড়েনি। বই দেখার পরই তার জেগে উঠল পাঠ-তৃষ্ণা। ইচ্ছে হল প্রিয় লেখকের বইখানি নিয়ে একবার উল্টেপাল্টে দেখতে, কিন্তু না জিজ্ঞেস করে নেওয়া উচিত নয়। যুবকটি ফিরে আসার পর ভরত বিনীতভাবে বলল, আমি আপনার এই বইটি কিছুক্ষণের জন্য দেখতে পারি?

যুবকটি ভরতের কথা বুঝতে না পেরে বলল, হোয়াট?

এ আবার কী, বাংলা বই সঙ্গে রেখেছে, অথচ বাংলা বোঝে না? ভরত এবার ইংরিজিতে বলল, মে আই বরো দিস বুক ফর সাম টাইম?

ভরতের ন্যাড়া মাথা দেখে বোধ হয় যুকটির একটু খটকা লেগেছে, তাই কয়েক পলক তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর বলল, ইয়েস, অফ কোর্স।

তারপর সে ভরতকে জিজ্ঞেস করল, গোয়িং ফার?

ভরত বলল, আপ টু পাটনা।

যুবকটি এবার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আই অ্যাম এ ঘোষ, কামিং ফ্রম বরোদা, গোয়িং টু দেওঘর।

ভরত বলল, আমার নাম ভরতকুমার সিংহ। পুণা থেকে আসছি। আপনি বাঙালি, তা আগে বুঝতে পারিনি। ঘোধ পদবি তো বাঙালি ছাড়া হয় না।

যুবকটি আবার বুঝতে না পেরে বলল, সে দ্যাট এগেইন।

ভরত পুনরুক্তি করার পর সে বলল, ইয়েস, বেঙ্গলি বাই বার্থ।

এবার সে ভরতের দিকে সিগারেটের প্যাকেটটি এগিয়ে দিল।

ভরত এককালে চুরুট টানা অভ্যেস করেছিল, ছেড়েও দিয়েছে অনেক দিন। জেলখানায় বিড়ি জোগাড় করার জন্য অন্য কয়েদিদের কত কান্ডই না করতে দেখেছে সে। ভরতের আর নেশা নেই, তবু সে প্রত্যাখ্যান করল না, একটি সিগারেট নিল। কৌতূহল দমন করতে না পেরে, সে জিজ্ঞেস করল, আপনি বাংলা বই পড়েন, আর বাংলা বুঝতে পারেন না?

যুবকটি দু দিকে মাথা নেড়ে বলল, নো।

ভরত তবু বলল, বাংলা না বুঝলে বাংলা পড়েন কী করে? বাংলা পড়েন, তাও বঙ্কিমচন্দ্রের বই, অথচ বাংলা বলেন না?

যুবকটি এবারেও ইংরিজিতে বলল, আমি বাংলা ভাষা পড়ে বুঝতে পারি, কিন্তু বলতে গেলে অনেক ভুল হয়। অশিক্ষিতের মতন ভুল-ভাষা বলার চেয়ে না বলাই ভাল। বাঙালিরা বড় দ্রুত কথা বলে, তাই তাদের মুখের ভাষা বুঝতে আমার অসুবিধে হয়। আমি বহুকাল দেশ ছাড়া।

কথায় কথায় যুবকটির সঙ্গে ভরতের বেশ ভাব হয়ে গেল। তার পুরো নাম অরবিন্দ ঘোষ, বরোদায় বড় চাকরি করে। গাইকোয়াড়ের ব্যক্তিগত সচিব এবং একটি কলেজেও পড়ায়। দেওঘরে সে তার অসুস্থ মাতামহকে দেখতে যাচ্ছে।

ভরত জিজ্ঞেস করল, আপনি কত বছর বরোদায় আছেন?

অরবিন্দ বলল, এই বছর সাতেক হল।

ভরত বলল, এর মধ্যে বাংলা ভুলে গেলেন? আমিও প্রায় সাত বছর বাংলার বাইরে আছি।

অরবিন্দ হাসল। তাঁর জীবনকাহিনী অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে।

জীবনে মাতৃস্নেহ কাকে বলে সে জানে না। প্রায় জ্ঞান হবার পর থেকেই সে দেখেছে যে তার মা পাগল। বাবা ছিলেন বিলেত ফেরত বিখ্যাত ডাক্তার, খুলনার সিভিল সার্জন, আচার-ব্যবহারে পাক্কা সাহেব। সঙ্কানদের তিনি পুরোপুরি ইংরেজ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। অরবিন্দর ছ’ বছর বয়েসে তাকে তার দুই দাদার সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দার্জিলিং-এর লরেটো কনভেন্টে। সেখানে দু বছর পড়াশুনা করার পর সমগ্র ঘোষ পরিবার চলে আসে লন্ডনে। সেখানেই জন্মায় অরবিন্দর আর একটি ভাই বারীন্দ্র। সেই শিশুটিকে নিয়ে বাবা-মা ফিরে এলেন দেশে, তিনটি সন্তান ইংল্যান্ডেই রয়ে গেল। অরবিন্দ তখন মাত্র সাত বছর বয়েস। তারপর টানা চোদ্দো বছর অরবিন্দ থেকে গেল ইংলান্ডে, মাঝখানে একবারও দেশে ফেরার সুযোগ ঘটেনি, প্রথম প্রথম বাবা টাকা পাঠাতেন, পরের দিকে তাও বন্ধ হয়ে যায়। বাবার সঙ্গে আর কখনও দেখা হয়নি অরবিন্দর। বিলেতেই পরিচয় হয় বরোদার রাজা গাইকোয়াড়ের সঙ্গে। তিনি চাকরি দিয়ে এই দুর্ধর্ষ ছাত্রটিকে নিজের রাজ্যে নিয়ে আসেন।

একেবারে বাচ্চা বয়েসে হাতেখড়ির সময় বাংলা অক্ষরজ্ঞান হয়েছিল, সেটাকে সে অতি কষ্টে স্মৃতিতে ধরে রেখেছে। বিলেতে প্রথম দিকে বেশ কয়েক বছর সে ছিল এক ইংরেজ পরিবারে, তখন থেকে আর বাংলায় কথা বলার সুযোগ হয়নি, ববোদাতেও বাঙালি কোথায়? কথা বলার চর্চা নেই বলে বাংলা বলতে একেবারে ভুলে গেছে কিন্তু বাংলা বই পড়া সে ছাড়েনি।

এবারে ভরত মুগ্ধ হয়ে বলল, আশ্চর্য, খুবই আশ্চর্য। চোদ্দো বছর বিলেত থেকেও আপনি বাংলা ভাষা ভোলেননি, অথচ দু’চার বছরের জন্য গিয়েও তো দেখি অনেকে ভুলে যায়।

অরবিন্দ আবার ইংরিজিতেই বলল, বঙ্কিমবাবুর মতন উপন্যাস পৃথিবীতে ক’জন লিখেছেন? বাংলা সাহিত্য আমাদের গর্বের বিষয়।

ভরত জিজ্ঞেস করল, আপনি রবিবাবুর কবিতা পড়েছেন?

অরবিন্দ বলল, নাম শুনেছি। এখনও পড়া হয়নি। এবার কলকাতায় গিয়ে গোটাকতক বাংলা বই কিনে আনতে হবে। আপনি পাটনায় কোন কার্যের সঙ্গে জড়িত?

এবার ভরত আপন মনে হাসল। তার জীবনকাহিনীও কম বিচিত্র নয়। সে মাতৃস্নেহ পায়নি, পিতৃপরিচয় দেয়ার উপায় নেই। নিজের জীবনটাকে নিজের সাধ্যে গড়ে তোলার কত চেষ্টা করেছে সে, বারবারই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু এসব কথা সদ্য পরিচিত একজনকে শোনাবার কোনও মানে হয় না।

সে বলল, আপাতত কিছু নেই। সেখানে আমি চলেছি জীবিকার সন্ধানে।

অরবিন্দ সরল কৌতূহলে জিজ্ঞেস করল, পাটনা শহরে বুঝি চাকরি-বাকরির অনেক সুযোগ আছে?

ভরত বলল, না, সে রকম কিছু না। তবে কোথাও তো যেতে হবে, এক সময় পাটনায় কিছুদিন ছিলাম। তাই সেখানে গিয়ে কিছু একটা জোটাবার চেষ্টা করব।

অরবিন্দ উৎসাহের সঙ্গে বলল, আপনি বরোদায় চলে আসুন। সেখানে ইংরিজি-জানা লোকের চাকরির অভাব হয় না। মহারাজের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, তিনি আমার সুপারিশ অমান্য করেন না। আমারও সুবিধে হবে আপনার সঙ্গে বাংলা কথা বলার চর্চা করা যাবে। আপনি বরং আমার সঙ্গেই বরোদা চলুন, দেওঘরে আমার মামার বাড়িতে কয়েকদিন থেকেই আমি ফিরব। আপনিও দেওঘরে আমার মামার বাড়িতে থাকবেন।

ভরত বলল, আমার যে পাটনা পর্যন্ত টিকিট।

অরবিন্দ বলল, তাতে কী, টিকিট পরীক্ষককে বলে সেটা অনায়াসে জসিডি পর্যন্ত বাড়িয়ে নেওয়া যায়। খুব ভাল হবে, আমি উত্তমরূপে বাংলা শেখার জন্য একজন লোক খুঁজছিলাম।

ভরত রাজি হয়ে গেলেও আরও কিছুক্ষণ গল্প করার পর সে মত বদলে ফেলল। এই যুবকটির সঙ্গে সঙ্গে তার মাতুলালয় পর্যন্ত যাওয়া তার মনঃপূত হল না। তাছাড়া, সে যে একজন জেল-ফেরত দাগি, সে কথাটা জানালে এর কী রকম প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে। সেই পরিচয়টা এখনই জানানো উচিত কি না, সে সম্পর্কেও মনস্থির করতে পারল না ভরত। আবার সে কথা সম্পূর্ণ গোপন করে যাওয়াও ন্যায়সঙ্গত নয়।

ভরত এক সময় বলল, আপনার প্রস্তাব খুবই আকর্ষণীয়, তবে পাটনায় আমার কিছু ব্যক্তিগত কাজ আছে। আমি পরে কোনও সময় বরোদায় গিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করব।

পাটনায় নেমে গেল ভরত।

অরবিন্দ জসিডি পৌঁছুল ভোরবেলা, একটা টাঙ্গা ভাড়া নিয়ে সে চলল দেওঘরের দিকে। সঙ্গে একটি সুটকেস, আর একটি কাগজের বাক্স ভর্তি সিগারেটের প্যাকেট। মাতুলালয়ে পৌঁছে সে স্নান সেরে নিয়ে পোশাক বদল করল। কোট-প্যান্টের বদলে আমেদাবাদ মিলের কর্কশ সুতোর মোটা ধুতি, গায়ে সেরকমই একটা মোটা কাপড়ের মেরজাই, টুপি খোলা মাথায় ইংরেজ কবিদের মতন ঘাড় ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা বাবরি চুল। তাড়াতাড়ি একটা সিগারেট টেনে নিতে নিতে সে এ বাড়ির একজনকে জিজ্ঞেস করল, বাবিন কোথায়? তাকে দেখছি না?

লোকটি অবজ্ঞার সঙ্গে ঠোঁট উল্টে বলল, সে কি বাড়িতে থাকে? ছুটে ছুটে বেরিয়ে যায়। গেছে বুঝি সেই বেশ্যাটার কাছে! সে মাগিটা যে বারবার আসে এখানে।

অরবিন্দ একটুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে গেল। এই ছোট ভাইটিকে বহু বছর অরবিন্দ চোখেই দেখেনি। দেশে ফেরার পরও দেখা হয়েছে মাত্র দু-একবার, তাও অল্প সময়ের জন্য। ভাল করে পরিচয়ই হয়নি, তবু তো রক্তের সম্পর্কে নিজের আপন ভাই! বারীন এখন কৈশোর ছাড়িয়ে যৌবনে পদার্পণ করতে চলেছে, দেওঘরে এলেই তার নামে অনেক নালিশ শুনতে হয়।

সিগারেটটা ফেলে নিয়ে অরবিন্দ তার দাদামশাইয়ের ঘরে ঢুকল।

অরবিন্দর মতামহ বাজানারায়ণ বসু কিছুদিন যাবৎ পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী। চুল-দাড়ি কাশফুলের মতন সাদা। চেহারাটা ছোট্ট হয়ে গেছে, ডান দিকটা একেবারে অবশ, কোনওরকমে বাঁ হাতটা তুলতে পারেন। কিন্তু তাঁর চোখ মুখ দেখলে কে বলবে, তিনি অসুস্থ! সর্বদা হাস্যময়, এখনও যেন তিনি পরিপূর্ণ জীবনরস উপভোগ করে যাচ্ছেন।

নাতিকে দেখে তিনি সোল্লাসে বললেন, কে রে, অরা নাকি, অরা? তুই এসেছিস, আমি খবর পেয়ে গেছি। আয়, আয়, আর একটু কাছে আয়, বোস একটু ছুঁয়ে দেখি। কত বড় বিদ্যাদিগগজ নাতি আমার।

বৃদ্ধ তাঁর পুরনো স্নেহমাখা বা হাতখানি তুলে দৌহিত্রের চিবুক ছুঁয়ে আদর করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোর বসে কত হল রে?

অরবিন্দ বলল, এই সাতাশ চলছে।

রাজনারায়ণ চক্ষু বিস্ফারিত করে বলেন, সাতাশ? বলিস কী? এখনও মেয়ের বাপেরা তোকে আস্ত রেখেছে? একে তো বিদ্যের জাহাজ, তার ওপরে রাজ সরকারে চাকরি, এমন সুপাত্রের গলায় কেউ ফাঁস পরায়নি? তুই যে মেম বিয়ে করে আসিসনি, এই আমার সাত পুরুষের ভাগ্যি। তা হলে তোর জন্যে পাত্রী দেখি! তোর বেশ ধুমধাম করে বিয়ে হবে, অনেক দিন পর কবজি ডুবিয়ে মাংস খাব, অ্যাঁ, কী বল!

অরবিন্দ বলল, এখনও আমার বিয়ে করার সময় হয়নি, দাদামশাই।

রাজনারায়ণ সে কথা শুনতে না পারার ভান করে বললেন, আমাদের সমাজ থেকে তা হলে একটি উপযুক্ত পাত্রী ঠিক করে ফেলা যাক। বাঙালি মেয়েরা এখন অনেকে লেখাপড়া শিখছে, তোর অযোগ্য হবে না। তোর বাপের সঙ্গে তোর মায়ের কত ঘটা করে বিয়ে দিয়েছিলুম, আমাদের ব্রাহ্মসমাজে অত জাকজমকের বিয়ে আগে হয়নি। কত আশা ছিল, তোর বাপ ব্রাহ্মসমাজের একজন নেতা হবে। কিন্তু বিলেতে গিয়ে তার যে কী মতিভ্রম হল, ধর্মকর্ম সব গোলায় গেল। তুই যে এত বচ্ছর বিলেতে কাটিয়ে এলি, তুই তো সাহেব সাজিসনি। এই তো দিব্যি ধুতি পরেছিস বাপু। তবে, তোকে ভাল করে বাংলা শিখতে হবে। আমার সঙ্গে ইংরিজি বলছিস, তা বলে কি বউয়ের সঙ্গেও বলবি নাকি? বাঙালি মেয়ের সঙ্গে ইংরিজি বাক্যে কি প্রণয় হয়? তুই মাস্টার রেখে বাংলা শিখবি? সুকুমার বলছিল, দীনেন্দ্রকুমার রায় নামে এক ছোকরা পত্রপত্রিকায় লেখেটখে, তার বড় অভাব, সে কাজ খুঁজছে। তাতে বরোদায় নিয়ে যা না। খোরাকি আর কিছু মাস মাইনে দিবি–

বৃদ্ধ আপন মনে অনেক কথা বলে যেতে লাগলেন। অরবিন্দ শ্রোতা। রাজনারায়ণ শুধু নিছক ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কথাই বলেন না, এই অশক্ত শরীরেও দেশ ও সমাজের কথা চিন্তা করেন। প্রসঙ্গত ব্রাহ্মসমাজের বর্তমান হাল, তিলকের মুক্তি, শ্রীশিক্ষা, দুর্ভিক্ষ এসবও এল। নরেন নামে ছেলেটি বিবেকানন্দ না নিয়ে বিদেশে দিগবিজয় করে এসেছে, সে দেওঘরে প্রায়ই আসে, এলেই দেখা করে যায় একবার এই তো কিছুদিন আগেই এসেছিল, বারান্দায় নিজে রান্না করে খেল, যেমন তেজস্বী, তেমনি বিনীত ছেলেটি, অরবিন্দ একবার যাক না তার সঙ্গে আলাপ করতে।

কথায় কথায় রাজনারায়ণ জিজ্ঞেস বলেন, হ্যাঁ রে, অরা, কংগেসের নেতারা তোকে ডাকেনি? সেটা তো ইংরিজি বলিয়ে কইয়েদেরই আখড়া। তার মতন একজন বিলেতফেরতাকে তারা দলে টেনে নিতে চায়নি?

অরবিন্দ ওষ্ঠ উল্টে বলল, এই কংগ্রেসের দ্বারা দেশের কিঞ্চিৎ মাত্র উপকার হবে না। এরা সরকারের কাছে শুধু ভিক্ষে চায়।

রাজনারায়ণ বললেন, তুই কি রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করিস নাকি?

অরবিন্দ উঠে দাঁড়িনে কনলেন, অনেকক্ষণ কথা বলেছ, দাদামশাই। তুমি ক্লান্তু, এখন একটু ঘুমোও।

বাইরে এসে সিগারেট ধরিয়ে অরবিন্দ ছোট ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। বারীন ফিরল প্রায় দুপুরের দিকে। শাসনের সুরে নয়, শান্ত ভাবে অরবিন্দ জিজ্ঞেস করল, কোথায় গিয়েছিলি ঘুম থেকে উঠেই?

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নতমুখো বারীন বলল, রাঙা মার কাছে। আপনি যে আসবেন তা আমাকে কেউ বলেনি।

অরবিন্দি জিজ্ঞেস করল, তোর আজ ইস্কুল নেই?

বারীন বলল, কী করব, রাঙা মা যে কিছুতেই না খাইয়ে ছাড়ল না। সেজদাঁ, আমার এ বাড়িতে থাকতে ইচ্ছে করে না। মামারা আমাকে মারে। বুড়ো দাদু ছাড়া আর কেউ ভাল করে কথা বলে না। আমি রাঙা মা’র কাছে চলে যাব? আপনি বলে দিলে হয়!

অরবিন্দ কোনও উত্তর দিতে পারল না। এই ছোট ভাইটির ভাগ্য তার চেয়েও অনেক বেশি বিড়ম্বিত। বারীন মাতৃস্নেহ তো পায়নি বটেই, তার বদলে পেয়েছে অত্যাচার। মা তার কাছে বিভীষিকা। অনেক চিকিৎসা করেও পাগল বউকে সুস্থ করা গেল না দেখে ডাক্তার কুষ্ণধন ঘোষ তাঁর স্ত্রী স্বর্নলতা আর দুটি ছেলেমেয়েকে দূরে সরিয়ে দিলেন। আত্মাভিমানবশত বউকে বাপেরবাড়ি পাঠালেন না। এই দেওঘরের কিছুটা দূরে রোহিণীতে একটি বাগানবাড়ি ভাড়া করে স্বর্ণলতার সঙ্গে বারীন ও তাঁর বোনকে রাখার ব্যবস্থা করলেন। উন্মাদিনী সেই দুটি ছোট ছোট ছেলেমেয়েকেই এক এক সময় অসম্ভব মারধর করতেন, তাদের কান্না দেখলে খল খল করে হাসতেন। কেই তাকে বাধা দিতে সাহস করত না। পাগলি মেমসাহেব বলে সবাই তাকে ভয় করত, বাড়ির মধ্যে দৈবাৎ, কেউ ঢুকে এলে স্বর্ণলতা ছুরি নিয়ে তাকে তাড়া করতেন। ছেলেমেয়ে দুটির লেখাপড়া শেখাবারও কোন ব্যবস্থা হল না।

কে ডি দোষ তখন কলকাতায় একটি রক্ষিতা রাখলেন ও মদের বোতলকে নিত্যসঙ্গী করে নিলেন। অবশ্য খুলনায় গরিবদের মধ্যে কিছু কিছু দানধ্যান করতেন বলে তাঁর বেশ জনপ্রিয়তাও ছিল। শিশু দুটি অনাদরে, অবহেলায় বর্ধিত হতে লাগল আগাছার মতন। তাদের পালাবারও উপায় ছিল না, দারোয়া নদির বাঁক থেকে, মাঠের মধ্য থেকে সেই ভীত-সন্ত্রস্ত বালক-বালিকা দুটিকে চুলের মুঠি ধরে টেনে আনা হত।

কে ডি ঘোষ মাঝে মাঝে আসতেন রোহিণীতে। ছেলেমেয়ে দুটির অবস্থা দেখে বুঝলেন, এদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার, ক্ৰমে অকালকুষ্মাণ্ডে পরিণত হবে। তাঁর তিন ছেলে ছাত্র হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করছে ইংল্যান্ডে, আর বাকি দুটি লোমের লেখাড়াই শিখছে না। স্বর্ণলতার কাছ থেকে তিনি ছেলেমেয়ে দুটিকে কলকাতায় নিয়ে যেতে চাইলেন, স্বর্ণলতা রাজি নন। কৃষ্ণধন মাঝে মাঝে এই প্রস্তাব দিয়ে লোক পাঠান, শেষ পর্যন্ত স্বর্ণলতা কিছু টাকার বিনিময়ে মেয়েটিকে নিয়ে দিলেন বটে, কিন্তু বারীনকে কিছুতেই ছাড়বেন না। পাগল মাকে কাছে বারীন আবও নিপীড়িত হতে লাগল।

একদিন শীতকালে বারীন বাগানে খেলা করছে, তার পাগল মা বসে আছে অদূরে একটা বেঞ্চিতে, একটা গুণ্ডামতন লোক বাগানে ঢুকে এসে স্বর্ণলতাকে জিক্সেস করল, মেমসাহেব, গুল লেগা? সে ঝপ করে এক কোঁচড় ফুল স্বর্ণলতার সামনে ছুঁড়ে দিয়েই বারীনের হাত ধরে টানতে টানতে দে দৌড় দে দৌড়। স্বর্ণলতা ভেতর থেকে একটা লম্বা ছোরা এনে গুণ্ডাটাকে তাড়া করলেন, আরও কিছু লোক ছুটে গেল, গুণ্ডাটা তবু বারীনকে ছ্যাঁচড়াতে ছ্যাঁচড়াতে টেনে নিয়ে চলল, তার মুখ চেপে ধরে তুলে ফেলল ট্রেনে।

সেই গুণ্ডাটি কলকাতায় গোমেস লেনে বালক বারীনকে যখন এনে তুলল, তখন তার প্রায় অজ্ঞান অবস্থা। এক সময় তার শরীরে একটা নরম হাতের স্পর্শ অনুভব করল, এক তরুণী তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলতে লাগল, আহারে বাছার না জানি কত কষ্ট হয়েছে, সোনা আমার, মানিক আমার—। এমন স্নেহপূর্ণ সুর বারীন কোন রমণীর কাছ থেকে আগে শোনেনি, এমন আদর সে কখনও পায়নি।

রক্ষিতা তরুণীটিকে কৃষ্ণধন কোথা থেকে সংগ্রহ করেছিলেন তা জানা যায় না। কিন্তু বহু ভাগ্যে তিনি এমন একটি রমণীরত্ন পেয়েছিলেন। সেই দীঘঙ্গিনীটি যেমন রূপসী, তেমনই, তার গুণ, তার অন্তরটি দয়ামায়ায় পূর্ণ। আপ্রাণ চেষ্টায় সে কৃষ্ণধনের মদ্যপানের নেশা প্রায় ছাড়িয়ে এনেছিল, অসুখী ডাক্তারটির ছন্নছাড়া সংসারে একটা শ্ৰী আনার চেষ্টা করেছিল। স্বর্ণলতার ছেলেমেয়ে দুটিকে সে আপন সন্তানের মতন বুকে টেনে নিল। মেয়েটি কিছুটা বড়। সে মুখ গোঁজ করে থাকলেও বারীন জীবনে প্রথম স্নেহ মমতার স্পর্শ পেয়ে তাকে আকড়ে ধরল। তখন থেকে সেই তরুণীটি হল বারীনের রাঙা মা।

কয়েকটি বছর এইভাবে বেশ চলছিল, হঠাৎ কুষ্ণধনের মৃত্যুর পর সব আবার ওলটপালট হয়ে গেল। কৃষ্ণধন সুবিবেচকের মতন উইল করে গিয়েছিলেন, তার পাগল পত্নীর আজীবন ভরণপোষণের জন্য কিছু টাকা আলাদা করে রেখে বাকি সব কিছু লিখে দিয়েছেন তার দ্বিতীয় জীবনসঙ্গিনীর নামে, তার তত্ত্বাবধানেই ছেলেমেয়ে দুটি মানুষ হবে। কিন্তু ব্রাহ্মসমাজের সুনীতির ধ্বজাধারীদের এটা পছন্দ হল না। কৃষ্ণধন শেষজীবনে ব্রাহ্মদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখলেও এক সময় তো ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন। তাঁর ছেলেমেয়ে থাকবে এক রক্ষিতার কাছে? এক ব্রাহ্ম নেতা একদিন সেই রমণীর কাছে এসে অতি স্নেহময় কণ্ঠে বললেন, কৃষ্ণধনের উইলটা একবার দেখাও তো মা। সরল বিশ্বাসে সেই রমণী উইলটি এনে দিলেন। সেটি সঙ্গে সঙ্গে পকেট ভরে ব্রাহ্ম নেতাটি এবার রক্তচক্ষে ধমক দিয়ে বললেন, খবরদার, এর কথা আর উচ্চারণও করবে না। তা হলে আদালতে প্রমাণ করে ছাড়ব যে, এই উইল জাল, আর তুমি একটা বাজারের বেশ্যা মাগি। বিষয়সম্পত্তিতে তোমার কোনও অধিকার নেই।

সর্ব বিষয়ে স্ত্রীর মতন হলেও যেহেতু কৃষ্ণধনের সঙ্গে তার বিবাহ হয়নি তাই সে রমণীকে সব কিছু থেকে বঞ্চিত করা হল। তাঁকে মোট পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে কেড়ে নিয়ে যাওয়া হল ছেলেমেয়ে দুটোকে। ছেড়ে যাবার সময় বারীন ও তার রাঙা মা, দু জনেরই কান্নার অন্ত নেই।

সেই থেকে বারীন আছে দেওঘরের এ বাড়িতে, তাকে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু পড়াশুনোয় তার মন নেই। এ বাড়িতে কেউ তার আদরযত্ন করে না। রাঙামা বারীনকে ভুলতে পারেননি, মাঝে মাঝেই তিনি দেওঘরে ছুটে আসেন বারীনকে শুধু একবার চোখে দেখার জন্য। কৃষ্ণধনের মৃত্যুর পর তিনি বিধবার বেশ ধারণ করেছেন, অন্য কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, আর বারীনই তাঁর সন্তান। এখানে এসে তিনি একটি ধর্মশালায় ওঠেন, যে কয়েকটা দিন থাকেন, বারীন তার কাছ ছাড়া হয় না। রাঙা মার কাছে গিয়েই সে সত্যিকারের আনন্দে থাকে। কিন্তু বারীনকে সন্তান হিসেবে পাবার আইনসঙ্গত কোনও অধিকার নেই রাঙা মা’র।

অরবিন্দ এই সব ঘটনার কিছু কিছু শুনেছে মাত্র, সব জানে না। রাঙা মাকে সে কখনও দেখেনি। শেষের দিকের কাহিনী শুনিয়ে বারীন ব্যর্থ কন্ঠে বলল, সেজদা, আপনি একবার রাঙা মা’র সঙ্গে দেখা করতে যাবেন? এই তো কাছেই ধর্মশালা। দেখবেন, তিনি মানুষ নন, দেবী।

অরবিন্দ দু’দিকে মাথা নেড়ে শুকনো গলায় বলল, না, আমি গিয়ে কী করব? আমি তার কথা বুঝব না, তিনি আমার কথা বুঝবেন না। তা ছাড়া, তিনি তোর রাঙা মা হতে পাত্ৰেন, আমার তো কেউ নন। আমি আমার পাগল মায়ের পাগল ছেলে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *