1 of 2

২৭. অর্ধেন্দুশেখর এখন কর্মহীন

অর্ধেন্দুশেখর এখন কর্মহীন। বাংলা রঙ্গমঞ্চের এই বহুরূপী নট নিজে থিয়েটার চালাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তিনি জাত শিল্পী, কিন্তু থিয়েটার চালানো তো একটা ব্যবসারই মতন, সেই ব্যবসাদারি তাঁর ধাতে নেই। থিয়েটার ছেড়ে দিলেও পাওনাদাররা তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল, একদিন তিনি নিজের সব সোনা রূপোর মেডেল ও স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে সব দেনা মিটিয়ে দিলেন। সংসাব চালাবার দায় অবশ্য তাঁর নেই, ছেলে বড় হয়েছে, সে বাবাকে এই দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিয়েছে।

বাড়িতে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেন না অর্ধেন্দুশেখর, পথে পথে ঘুরে বেড়ান। সাতচল্লিশ বছর বয়েস, শরীর এখনও বেশ মজবুত আছে, হাঁটতে তাঁর ভাল লাগে। মঞ্চে অভিনয়ের সময় অর্ধেন্দুশেখর এতরকম ভূমিকায় এত বিভিন্ন ধরনের মেকআপ নিয়েছেন যে তাঁর আসল চেহারা বহু মানুষই চেনে না। রাস্তায় কোথাও জটলা দেখলে তিনি উঁকি মারেন, কোথাও দাঁতের মাজনের ফেরিওয়ালা ম্যাজিক দেখাচ্ছে, কোথাও সাপুড়ে দেখাচ্ছে সাপ-খেলা। অর্ধেন্দুশেখর জানেন না এমন বিষয় যেন নেই, ম্যাজিকওয়ালাকে হতচকিত করে তিনি নিজেই একটা ম্যাজিক দেখিয়ে ফেলেন, সাপুড়ের পাশে বসে পড়ে তার হাত থেকে পেট-ফুলো বাঁশিটি নিয়ে এমন চমৎকার ভাবে বাজাতে থাকেন যে পথচারীরা তাজ্জব বনে যায়।

সবাই জানে, অর্ধেন্দুশেখর নিরহঙ্কার, দিলখোলা, কৌতুকপ্রবণ মানুষ। কিন্তু তাঁর আত্মমর্যাদা জ্ঞান যে কত সুক্ষ্ম, সে খবর অনেকেই রাখে না। থিয়েটার-অন্তপ্রাণ এই মানুষটি এখন কোনও থিয়েটারে ধারে কাছেও যান না একেবারেই। থিয়েটারের কোনও পরিচিত ব্যক্তিকে রাস্তায় দূর থেকে দেখতে পেলেই তিনি ফুটপাথ বদল করেন। নট-নটীরা এক থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেলে অন্য থিয়েটারে যায় কাজের সন্ধানে, অর্ধেন্দুশেখর নিজে থেকে কোথাও যাবেন না, এ তো জানা কথাই। পাছে অন্য কোনও দল থেকে কোনও অসঙ্গত প্রস্তাব আসে, সেই জন্যই তিনি মঞ্চ-সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের এড়িয়ে যান। যে-কোনও নাটকে যে-কোনও ছোটখাটো ভূমিকায় নামতে তিনি কখনও আপত্তি করেননি, অনেক ক্ষুদ্র ভূমিকায় তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু কিছুদিন আগে তিনি ছিলেন এক মঞ্চের মালিক, তারপর নাট্য-পরিচালক, এখন শুধুমাত্র অভিনেতা হিসেবে কোনও দল তাঁকে আহ্বান জানালেও তিনি যাবেন কেন? তিনি এক নম্বর হয়েছিলেন, সেখান থেকে আবার তিন-চার নম্বরে নেমে যাওয়া যায় না। ফেল করা নাট্য পরিচালককে আবার কেইবা ওই পদ দিতে চাইবে?

অর্ধেন্দুশেখক বেকার হয়ে রইলেন তো বটেই, বাংলার রঙ্গমঞ্চও তাঁর প্রতিভার স্ফুরণ থেকে বঞ্চিত্ হয়ে রইল।

সারাদিনে বোতল তিনেক দেশি মদ লাগে, সেই খরচটা তিনি ছেলের কাছ থেকে চাইতে পাবেন না। ঘড়ি-আংটি বিক্রি করে এখনও কোনওক্রমে চলে যায়। দিশি ছাড়া বিলিতি পানীয় কেউ সেধে দিলেও তিনি খান না। পরিচিত সবাইকে বলে রেখেছেন, তাঁর মৃত্যুর পর শবের ওপর কয়েক বোতল দিশি মদ ঢেলে দিয়ে যেন দেশলাই জ্বেলে দেওয়া হয়, চন্দন কাঠ-ফাটের দরকার নেই।

একদিন অর্ধেন্দুশেখর পীরুর হোটেলে ঢুকে একজোড়া হাফ বয়েলড হাঁসের ডিমের অর্ডার দিয়ে একটা চুক টানছেন, দু’জন লোক তাঁকে দেখে এগিয়ে এল টেবিলের দিকে।

অর্ধেন্দুশেখর মুখটা ব্যাজার করলেন। আবার থিয়েটারের লোক। এদের বলা যায় স্রোতের শ্যাওলা, ছোটখাটো ভূমিকায় অভিনয় করে, জীবনে কোনওদিনই বড় পার্ট পাবে না, এক থিয়েটার থেকে অন্য থিয়েটারে যায়, মাঝে মাঝে কোনও কাজই জোটে না। অর্ধেন্দুশেখর প্রায় সবকটা রঙ্গমঞ্চে কখনও না কখনও ছিলেন, ছোট বড় সবাইকেই চেনেন। এদের দুজনের নাম ব্যোমকেশ আর নীলধ্বজ, ব্যোমকেশকে তিনি একবার এক অভিনেত্রীর সঙ্গে রিহাসলের সময় খুনসুটি করার অপরাধে বরখাস্ত করেছিলেন।

অর্ধেন্দুশেখর মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রেখে বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ওদের সঙ্গে কথা বলতে চান না। ওরা তা মানবে কেন? কাছে এসে হেসে বিগলিত ভাবে বলল, নমস্কার, নমস্কার, গুরু, বড় ভাগ্যে আপনার দর্শন পেলুম!

অর্ধেন্দুশেখর শুকনো গলায় বললেন, আমি এখন আর কারুর গুরু-ফুরু নই!

ব্যোমকেশ আর নীলধ্বজ ধপ ধপ করে বসে পড়ল দুটি চেয়ারে। অর্ধেন্দুশেখর আঙুল দিয়ে ছবি আঁকতে লাগলেন টেবিলে। একটুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ব্যোমকেশ বলল, গুরু, কী ভাবছেন?

অর্ধেন্দুশেখর বলল, এমন কিছু না। কী ভাবব, তাই-ই ভাবছি।

নীলধ্বজ বলল, ক্লাসিক থিয়েটারে কী কাণ্ড হচ্ছে শুনেছেন?

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, না শুনিনি, শুনতেও চাই না।

হোটেলের এক ছোকরা প্লেটে দুটি অর্ধসিদ্ধ ডিম এনে রাখল টেবিলে। অর্ধেন্দুশেখর তাড়াতাড়ি উঠে পড়ার উপক্রম করে বললেন, ওরে, পয়সা নিয়ে যা। কত দিতে হবে?

ছোকরাটি বলল, আজ্ঞে দু’আনা।

অর্ধেন্দুশেখর আঁতকে উঠে বললেন, দু’আনা? বলিস কী? এত দাম কেন, ডিমের জোড়া তো চার পয়সা।

ছোকরাটি বলল, আজ্ঞে, কী করব বলুন, অজিকাল ডিম বড় মাগগি হয়েছে।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, কেন, হাঁসেরা আজকাল সব পরমহংস হয়ে উঠেছে নাকি?

ব্যোমকেশ ও নীলধ্বজ অট্টহাসি করে উঠল। ওদের একজন টেবিল চাপড়ে বলল, যা বলেছেন, আজকাল পরমহংসদের বড় রবরবা। দক্ষিণেশ্বরের সেই পাগলাটার কথা তো লোকে ভুলোই গেলো, এখন তাঁর কোন এক শিষ্য নাকি বিলেত আমেরিকায় তার খুব নাম রটাচ্ছে। এদিকে গিরিশবাবুর কাণ্ডটা দেখুন, বাইরে এমন ভাব দেখান যেন পরমহংসের ভক্ত হয়ে একেবারে গদ্গদ, মুখ দিয়ে নাল গড়ায়। অথচ আগে যা যা চালাচ্ছিলেন, সবই তো চলছে। মদ-মাগি কিছুই বাকি নেই, টাকা পয়সার ব্যাপারেও সেয়ানা! এ যে বড় সুবিধাবাদের ভক্তি, কেমন কিনা!

নীলধ্বজ বলল, পরশু গিরিশবাবুর কাছে গেলুম, বুঝলেন? বললুম যে, ক্লাসিকে ওই যে এক ছোকরা যা খুশি তাই করছে, আপনারা এর যযাগ্য উত্তর দিন। আপনি আর অর্ধেন্দুবাবু এক জোট হয়ে কোনও স্টেজে দাঁড়ালে ও ছোকরা এক ফুয়ে উড়ে যাবে! তা গিরিশবাবু কী বললেন জানেন? মাছি তাড়াবার মতন বাঁ হাত নেড়ে বললেন, যা যা, আমার সামনে অর্ধেন্দুর কথা উচ্চারণ করবিনি! সে একেবারে গোল্লায় গেছে।

ব্যোমকেশ বলল, গিরিশবাবু আপনাকে বেদম হিংসে করেন। গিরিশবাবু তো বুড়ো ঘোড়া। পাবলিক এখনও আপনাকে চায়। উনি সেটাই সহা করতে পারেন না।

অর্ধেন্দুশেখর নিঃশব্দে ডিম দুটি শেষ করে বললেন, কেউ একলা খেতে বসলে যে তার মুখের সামনে হাঁ করে বসে থাকতে নেই, সে ভদ্রতা-সভ্যতাটুকুও তোরা জানিস না! তোদের আমার চিনতে বাকি নেই। ভাবছিস, আমার সামনে গিরিশের নিন্দে করলে আমি খুশি হব। আবার গিরিশের কাছে গিয়ে আমার নামে কান ভাঙাবি! ওরে হারামজাদা, গিরিশ যদি আমাকে হিংসে করে থাকে, তা হলে সে তো যোগ্য লোককেই করে। তোদের মতন হেঁজিপেঁজি চুনোপুঁটিদের কি সে। হিংসে করতে যাবে? আমি মরলে ওই গিরিশই সবচেয়ে বেশি কাঁদবে। আর গিরিশ যদি আগে যায়, আমিই সত্যিকারের কাঁদব তার জন্য।

অর্ধেন্দুশেখর উঠে দাঁড়াতেই ব্যোমকেশ ঝপাস করে তার পায়ে পড়ে বলল, ‘স্যার, আমাদের দু’জনকে উদ্ধার করুন। দুমাস কোনও কাজ নেই। আপনি গিরিশবাবুর সঙ্গে জয়েন করছেন না। জানি, আপনি কি তবে ক্লাসিকে যাচ্ছেন? আমরা আপনার পায়ের ধুলো, আমাদেরও সঙ্গে নিয়ে চলুন!

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, কী আপদ। ওঠ ওঠ। হোটেলের মধ্যে আর নাটক করতে হবে না। তোদের কে বলল, আমি ক্লাসিকে জয়েন করছি?

ব্যোমকেশ বলল, লাইনের সবাই বলাবলি করছে, অর্ধেন্দু মুস্তৃফি কি চুপচাপ বসে থাকবে? ক্লাসিক তাকে লুফে নেবে!

অর্ধেন্দুশেখর এবার ফিকে ধরনের হাসালেন। ক্লাসিক থিয়েটার থেকে তাঁকে লুফে নেওয়া দূরের কথা, কোনও প্রস্তাবই আসেনি। ক্লাসিকের নবীন পরিচালক পুরনো বয়স্ক অভিনেতা-অভিনেত্রী সবাইকে বাদ দিয়ে চলতে চায়।

তিনি বললেন, যদি কোনও থিয়েটারে যোগ দিই, তা হলে কি আর ধুলো পায়ে যাব সেখানে? কেউ এসে পায়ে জল ঢেলে ধুইয়ে বরণ করে নেবে, তবে না! যা যা, ভাগ!

অর্ধেন্দুশেখর ওদের এড়িয়ে পথে নেমে পড়লেন, কিন্তু ওদের কথায় তাঁর মনের মধ্যে একটু একটু জ্বালা করতে লাগল। ক্লাসিক থেকে তাঁকে ডাকেনি, মিনার্ভাও ডাকেনি। আর কেউ সাধাসাধি করবে না? নিজে থিয়েটার খোলার সাধ্য আর নেই, এখন থেকে তিনি বাতিলের দলে।

রক্তে যাঁর থিয়েটারের নেশা ঢুকেছে, সে আর কিছুতেই ছাড়তে পারে না। অর্ধেন্দুশেখর একা একা পথ চলতে চলতে বিড়বিড় করে কোনও একটা পার্ট বলে যান। মানুষের সঙ্গ সহ্য হয় না বলে সন্ধের পর একা এসে বসে থাকেন গঙ্গার ধারে। সঙ্গে একটি বোতল। মাঝে মাঝে একটা করে চুমুক দেন আর একটা গোটা নাটকের সবকটা ভূমিকা গলার স্বর বদলে আবৃত্তি করে যান। অন্ধকার নদী আর এলমেলো বাতাস তাঁর শ্রোতা। এক সময় সেখানেই শুয়ে পড়েন তিনি। কলের জাহাজের ভোঁতে ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে পড়ে দেখেন ভোর হয়ে গেছে। অর্ধেন্দুশেখর দু’হাত ছড়িয়ে অ্যাঁ শব্দ করে আড়মোড়া ভাঙেন।

একটু দূরে একটা পাগল শুয়ে আছে, সেও বলে উঠল, অ্যাঃ।

অর্ধেন্দুশেখর তার দিকে একবার তাকিয়ে একটা গান ধরলেন, ‘পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গে মা—

গো পাগলটি ভেঙচে উঠে গেয়ে উঠল, মা গো, মাগো!

সেই উন্মাদের গলাটি বেশ গম্ভীর, সুরেলা। গান থামিয়ে অর্ধেন্দুশেখর বলেন, কে হে তুমি বাপধন, তুমিও থিয়েটার থেকে ছাঁটাই নাকি?

পাগল বলল, বোম কালী কলকাত্তাওয়ালী!

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, ও তো সবাই পারে! আমি এইটে ধরছি, আমার সঙ্গে গলা মেলা দেখি।

হাম বড়া সাব হয় ডুনিয়ামে
None can be compared হামারা সাট
Mr Mustafee name হামারা
চাটগাঁও মেরা আছে বিলাট
Rom-ti-tom-ti-tom…

পাগল হাঁ করে চেয়ে রইল। অর্ধেন্দুশেখর গান শেষ করে বললেন, বুঝলি কিছু? বেশ তাগড়া চেহারা করেছিস তো। ওই দুনিয়া সত্যি বিচিত্র স্থান। তোরও নিশ্চয়ই দু’বেলা আহার্য জুটে যায়। আয় তো কাছে আয়, তোর জীবন কথা শুনি!

তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে সেই উন্মাদ তরতর করে নেমে গিয়ে জলে ঝাঁপ দিল। অর্ধেন্দুশেখর পকেট থেকে একটা আধ পোড়া চুরুট বার করে ধরালেন। এত সকালেই বেশ কিছু মানুষ গঙ্গায় স্নান করতে এসেছে। ভরা বর্ষার নদীকে মনে হয় যেন এক যৌবন-মদ-মত্তা রমণীর মতন। ছলাৎ ছলাৎ করে ঢেউ এসে ভাঙছে পাড়ে। অনেকগুলি ইলিশ মাছ ধরা নৌকো ছড়িয়ে আছে এধারে ওধারে।

অর্ধেন্দুশেখরের শরীরে এখনও নেশার আলসা রয়ে গেছে, এমন সকাল সকাল তাঁর স্নান করার অভ্যেস নেই, গঙ্গা স্নানে পুণ্য অর্জন করারও প্রবৃত্তি নেই। তিনি কিছুটা বিস্মিত ভাবে পাগলটির ডুব দেওয়া দেখতে লাগলেন। তাঁর ধারণা ছিল, পাগলরা সহজে জল ছুঁতে চায় না।

কয়েকবার ডুব দিয়ে পাগলটি দ্রুত গতিতে উঠে এসে অর্ধেন্দুশেখরের সামনে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বলল, দে। কিছু দে।

পাগলটির পরনে একটি ছেঁড়া ধুতি, খালি গা, মুখভর্তি দাড়ি। চোখের দৃষ্টিতেই বোঝা যায়, তার মস্তিষ্কের স্থিরতা নেই।

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, কী দেব?

পাগলটি আবার বলল, দে, কিছু দে!

অর্ধেন্দুশেখর রুক্ষ স্বরে বললেন, আমি ভিক্ষে দিই না, যা ভাগ হিঁয়াসে।

আপন মনে বললেন, আমি নিজেই এখন ভিখিরি, অন্যকে দেব কী?

পাগলটি তবু গেল না। অর্ধেন্দুশেখর এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইলেন। এ লোকটা ভিক্ষে চাইবার আগে গঙ্গায় ডুব দিয়ে শুদ্ধ হয়ে এল কেন? ঘাড়টা একটু বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখের মণিদুটো যেন ঘুরছে, ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। এ কী কোনও পাগল, না ছদ্মবেশী মহাপুরুষ!

হঠাৎ অর্ধেন্দুশেখরের মনে হল, তিনি বেশ কয়েকবার মঞ্চে পাগল সেজেছেন, দর্শকদের হাততালিও পেয়েছেন, কিন্তু এমন ঘাড় বেঁকিয়ে তো দাঁড়াননি। ঠোঁটের হাসিটায় ওর পাগলামি যেন অন্য একটা মাত্রা পেয়েছে। এই লোকটাকে স্টাডি করলে ভবিষ্যতে তিনি পাগলের ভূমিকা অনেক নিখুঁত করতে পারবেন। তিনি যেন অভিনয় কলার একজন ছাত্র, এই হিসেবে পাগলটিকে নতুন আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।

এক সময় উঠে এসে ওর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, চলো দোন্ত, গরম গরম জিলিপি খাবে নাকি? আমার কাছে এখনও দু’আনা পয়সা আছে।

পরদিনও অর্ধেন্দুশেখর ওই জায়গাটিতে এসে পাগলটির পাশে বসে তাকে দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করতে লাগলেন অনেকক্ষণ ধরে। পাগলটি মাঝে মাঝে দচারটি বাকা বলে, হাসে, হঠাৎ হঠাৎ মাটিতে গড়াগড়ি দিতে দিতে কাঁদে। অর্ধেন্দুশেখর তার জন্য খাবার কিনে আনেন, গরম রাধাবল্লভী হাতে নিয়ে সে মাঝখানে একটা ফুটো করে ফু দেয়, তারপর যেন প্রেমিকাকে অনুনয় করছে এই ভঙ্গিতে বলে, তোমাকে একটু খাই?

অর্ধেন্দুশেখর তার প্রতিটি কথা, প্রতিটি ভঙ্গি মনে একে রাখেন। মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্ক না থাক, তবু তিনি অভিনয় শিখে চলেছেন। মঞ্চের বাইরেই তো প্রকৃত অভিনয় শিক্ষা করা যায়।

দিন চারেক তিনি পাগলটির সঙ্গে অনেক সময় কাটালেন। তারপর পাগলটি কোথায় উধাও হয়ে গেল। তারপর তিনি ভিড়ে গেলেন শশ্মশানের পাশে এক সাধুর আখড়ায়। এখানে মদ-গাঁজা সবই চলে, সাধুটি যে এক নম্বরের ভণ্ড তা বুঝে যেতে অর্ধেন্দুশেখরের একটুও বিলম্ব হল না, সম্ভবত কোনও ফেবার ডাকাত বা খুনি আসামি সাধু সেজে আছে। তা হোক না, এরকমও তো কোনও নাটকের চরিত্র হতে পারে। সব ধরনের চরিত্রই নাটকের কাজে লেগে যায়।

প্রতি সন্ধেবেলা কলকাতা শহরের বিভিন্ন মঞ্চে যখন জ্বলে ওঠে পাদপ্রদীপের আলো, মুখে রং মেখে নট-নটীবা যখন হাসি-কান্নার অভিনয় করে যায়, অর্ধেন্দুশেখর বসে থাকেন অন্ধকার গঙ্গার ধারে। বেশির ভাগ দিনই একা, নিঃসঙ্গ। তাঁর অভিমানের দীর্ঘশ্বাস আর কেউ টের পায় না।

গঙ্গার ধারে যাবার জন্য তাঁকে রামবাগানের মধ্য দিয়ে আসতে হয়। সন্ধের সময় এই অঞ্চলটাতে বেশ ভিড় থাকে। একটু অন্ধকার হবার পরই যেন এখানে অনেক ফুল ফোটে, সেই সব ফুলের টানে ছুট আসে অনেক বসের নাগব। একদিন একটা বাড়ির মধ্যে খুব চ্যাঁচামেচি শোনা গেল, একটি স্ত্রীলোক ডুকরে কাঁদছে, আর গর্জন করছে দু’তিনটি পুরুষ, মনে হয় যেন একটা খুনোখুনি কাণ্ড ঘটতে চলেছে। সে বাড়িটার দরজার সামনে জড়ো হয়েছে অনেক মানুষ। যেন এক্ষুনি কোনও সাংঘাতিক নাটকীয় কাণ্ড ঘটে যাবে।

কৌতূহলী হয়ে অর্ধেন্দুশেখর জনতার পেছনে দাঁড়িয়ে গোড়ালি উঁচু করে উঁকি দিলেন। ও হরি, নাটকীর কাণ্ড কিছু নয়, সত্যি সত্যি নাটক। একটি শখের নাট্যদল ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মহড়া দিচ্ছে।

অর্ধেন্দুশেখর সেখান থেকে আর নড়তে পারলেন না। এই নীলদর্পণে তিনি কতবার কত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। শেষবাব নীলদর্পণ মঞ্চস্থ হবার পরই তাঁর এমারাল্ড থিয়েটার উঠে যায়। তারপর থেকেই তো তাঁব কপাল পুড়েছে।

লম্বা একটি হলঘরের মেঝেতে সতরঞ্চি পাতা, দুচারটে চেয়ার ছড়ানো, দশ-বারোজন লোক বিভিন্ন পার্ট মুখস্থ বলে যাচ্ছে, মাঝখানে পবিচালকের হাতে খাতা। দরজা বন্ধ রেখেও বাইরের লোকদের আটকানো যায় না, তারা জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারে, বাইরে গোলমাল করে, তাই দ্বার উন্মুক্ত করে পাবলিককে রিহার্সাল দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখবে এই শর্তে। “ঝে মাঝে তাদের মধ্যে ফিসফিসানি শুরু হলে পরিচালক চেঁচিয়ে ওঠে, সাইলেন্স! সাইলেন্স!

গঙ্গার ধারে আর যাওয়া হল না অর্ধেন্দুশেখরের। সেখানে জনতার মধ্যে সেঁটে রইলেন। একটু একটু করে এগোচ্ছেন সামনের দিকে। পাড়ার ক্লাবের শখের অভিনয়, কেউ-ই তেমন তৈরি নয়, এক একজন তোতলাচ্ছে, এক একজন পার্ট ভুলে যাচ্ছে, তবু তাই-ই দেখে যাচ্ছেন নটচুড়ামণি অর্ধেন্দুশেখর। হঠাৎ এক সময় তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, চোপ! তুম শালা নালায়েক আছে।

সবাই চমকে ফিরে দাঁড়াল। পরিচালক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কে? কে বললে?

দর্শকরা এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। ঠিক কে যে বলেছে, তা বোঝা যায়নি। অর্ধেন্দুশেখর লজ্জা পেয়ে মুখটা নিচু করে ফেলেছেন। এ ভাবে মহড়ায় বিঘ্ন ঘটানো তাঁর উচিত হয়নি।

পরিচালক আবার ধমকে উঠে বলল, এমন ভাবে ডিসটার্ব করলে কিন্তু আমি কারুকে অ্যালাউ করব না। একদম স্পিকটি নট হয়ে থাকতে হবে।

আবার শুরু হল। অর্ধেন্দুশেখর ঠেলে ঠুলে একেবারে সামনে এসে পড়লেন একসময়। হলঘরের অভিনেতারা পার্ট বলে যাচ্ছে, তিনিও ঠোঁট নেড়ে চলেছেন। প্রত্যেকটি ভূমিকাই তার মুখস্থ, কতবার কতজনকে তিনি এইসব অভিনয় শিখিয়েছেন। শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে গেলেন তিনি, কাণ্ডাকাণ্ড জ্ঞান রইল না, মনে মনে পার্ট বলে যাচ্ছিলেন, আবার এক সময় গর্জন করে উঠলেন, আমি তুমার বাপ কেন হব, হামি তুমার ছেলিয়ার বাপ হইটে চাই।

সাহেবের ভূমিকায় যে ব্যক্তিটি অভিনয় করছে তার বাচনভঙ্গি একেবারে ভেতো বাঙালির মতন। না আছে তেজ, না আছে দার্ট। যে-কোনও সাহেবের ভূমিকায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা অর্ধেন্দুশেখরের তা সহ্য হবে কেন?

এবারে গণ্ডগোল সৃষ্টিকারীকে শনাক্ত করতে দেরি হল না। তোরাপের ভূমিকাভিনেতাটি ছুটে এসে অর্ধেন্দুশেখরের টুটি চেপে ধরে বলল, শালা, তুই আমাদের ভাঙচাচ্ছিস? মারব এক রদ্দা–

অর্ধেন্দুশেখর আত্মস্থ হয়ে বললেন, না, না, ভ্যাওচাইনি, ভুল হয়ে গেছে, মাপ করে দিন। ঘণ্ডামাকা সেই লোকটি অর্ধেন্দুশেখরকে এক ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ভুল হয়ে গেছে? তুই কোন ক্লাবের? আমাদের থিয়েটার ভণ্ডুল করতে এসেছিস!

অর্ধেন্দুশেখর বললেন, আজ্ঞে না, আমি কোনও ক্লাব থেকে আসিনি। সত্যি ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা চাইছি, ক্ষমা চাইছি…

লোকটি তবু অর্ধেন্দুশেখরকে চপেটাঘাত করতে উদ্যত হল। অন্য দর্শকরাও বলতে লাগল, এ লোকটাকে দুর করে দাও! ভাগাও।

পরিচালকটি শুধু একদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল অর্ধেন্দুশেখরের দিকে, সে এবার বলল, আই, মারিস না। ওকে আমার সামনে নিয়ে আয়।

অর্ধেন্দুশেখরকে হিড় হিড় করে টেনে আনা হল মাঝখানে। পরিচালক ভালভাবে নিরীক্ষণ করে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে?

দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ অর্ধেন্দুশেখরের মুখে খোঁচাখোঁচা পাঁচ দিনের দাড়ি। ধুতির ওপর উড়ুনিটা বেশ মলিন, মাথার চুল অবিন্যস্ত। তিনি নিরীহ গলায় বললেন, আজ্ঞে আমি কেউ না, এমনিই রাস্তার লোক, নীলদর্পণ দু’তিনবার দেখেছি কি না, তাই মুখ ফস্কে বেরিয়ে এসেছে।

পরিচালকটি বলল, আমার নাম ছোনে মিত্তির। ছোটবেলা থেকেই আমি থিয়েটারের নামে পাগল। আপনার গলা শুনে যদি চিনতে না পেরে থাকি, তা হলে আমি থিয়েটারের কিছুই বুঝি না! আপনি যে সে লোক নন, আপনি মুস্তৃফিসাহেব!

তখন এক সঙ্গে আরও চার পাঁচজন লোক বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক ঠিক। ইনিই তো মুস্তুফি সাহেব বটে!

অগত্যা অর্ধেন্দুশেখর অধোবদনে দাঁড়িয়ে রইলেন।

ছোনে মিত্তির হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাত জোড় করে বলল, গুরু, আমি দূর থেকে আজীবন আপনার শিষ্য। আপনি দ্রোণাচার্য, আমি একলব্য। আজ এত সামনাসামনি আপনাকে দেখলাম, আমার জীবন ধন্য হল।

বস্ত্রহরণের পর শ্রীকৃষ্ণের সামনে গোপিনীরা যেমন ভাবে স্তব করেছিল, সেই ভাবে অন্য অভিনেতা-অভিনেত্রীরা হাঁটু গেড়ে বসে বলতে লাগল, আপনাকে চিনতে পারিনি। ক্ষমা করুন, গুরুদেব। আমাদিগে আপনি আশীবাদ করুন।

অর্ধেন্দুশেখরের বুকটা ভরে গেল। অনেকদিন তিনি এমন চাটুকারিতা শোনেননি। টানা বেশ কিছুদিন হাততালি বা প্রশংসা না পেলে শিল্পীর মন স্তিমিত হয়ে যায়। অর্ধেন্দুশেখর আবার চাঙ্গা বোধ করলেন।

ছোনে মিত্তির উঠে দাঁড়িয়ে নাটকের খাতাটা অর্ধেন্দুশেখরের হাতে ধরিয়ে দিয়ে গল্প কণ্ঠে বলল, একবার আপনাকে পেয়েছি যখন, আর ছাড়ছি না। আপনি আমাদের একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিন। আপনি স্বয়ং নাট্যাচার্য, আর নীলদর্পণ তো আপনার কাছে জলভাত।

তোরাপবেশী লোকটি দুকানে হাত দিয়ে বলল, আপনার ‘মুকুল মঞ্জুরা’, ‘আবু হোসেন’, ‘প্রতাপাদিত্য’, ‘পাগুব নিবার্সন’ এরকম কত প্লে দেখেছি, তবু আপনাকে চিনতে পারিনি। এমন গুখুরির কাজ কোনও মানুষে করে! আমি হেন নরাধম আপনার গায়ে হাত তুলেছি, আমার নরকেও স্থান হবে না। আমি এক মাইল রাস্তা নাকে খত দিয়ে যাব, সাতদিন জল স্পর্শ করব না, তারপরেও আমাকে যা শাস্তি দেবার দিন।

অর্ধেন্দুশেখর তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, মনের অগোচরে দোষ নেই। ওসব কিছু করতে হবে না। তুমি যে তখন পার্ট বললে, “শালার কান আমি কামড়ে কেটে দিয়েছিলাম গো’, ও জায়গাটা অন্য ভাবে বললে দর্শকেব ক্ল্যাপ পাবে। ট্যাঁক থেকে একটা ছোট কোনও জিনিস বার করে দর্শকদের দিকে দেখিয়ে চোখে আগুন ঢেলে এইভাবে বলবে, ‘হালার কানের খানিকড়া কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছি…’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *