মোগলসরাই স্টেশনে ট্রেন থেকে নামল দ্বারিকা আর বসন্তমঞ্জরী। দ্বারিকার পরনে পুরো দস্তুর সাহেবি পোশাক, মাথায় টুপি পর্যন্ত। বসন্তমঞ্জরীর রেশমি শাড়ির ওপর জামেয়ার জড়ানো, ঘোমটায় মুখ অনেকখানি ঢাকা। অন্য সময়ের তুলনায় এই রেলওয়ে স্টেশনে এখন জনসমাগম অনেক বেশি, চতুর্দিকে শোনা যাচ্ছে কোলাহল। একটা চুরুট ধরিয়ে দ্বারিকা ভিড়ের মধ্যে তার এক কর্মচারীকে খুঁজতে লাগল। যেখানেই সে যায়, সেখানে আগে থেকে সে একজন কর্মচারীকে পাঠিয়ে দেয় সব কিছু বন্দোবস্ত করে রাখার জন্য।
অল্পক্ষণ পরেই রতিকান্ত নামে সেই কর্মচারীটি ছুটতে ছুটতে এসে দ্বারিকার সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বলল, বাইরে গাড়ি তৈরি আছে হুজুর। বাড়ি ভাড়া করে রেখেছি, ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি হবে না।
স্টেশনের বাইরে এসে দ্বারিকা সস্ত্রীক বগি গাড়িতে চড়ে বসল, গাড়ি ছুটল এলাহাবাদের দিকে।
দ্বারিকার জেদ সফল হয়েছে, বসন্তমঞ্জরীর সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে তার বিবাহ। এর মাঝখানে অন্তরায় ছিল অনেক। বসন্তমঞ্জরীর মানসিক বাধা কাটাতেই বেশ সময় লেগেছে। শেষ পর্যন্ত বসন্তমঞ্জরী রাজি হয়েছিল, কিন্তু দ্বারিকার এক বছরের কালাশৌচ পালন করার আগে নয়। অন্য বাধা এসেছিল সমাজের কাছ থেকে। দ্বারিকার সাধ ছিল, ধুমধাম করে হিন্দুমতে বিবাহ হবে, কিন্তু একজনও পুরুত পাওয়া যায়নি। বসন্তমঞ্জরী শুধু বিধবা নয়, সে কুলভ্রষ্টা, হাড়কাটার গলির এক বারবনিতা, হিন্দু সমাজ থেকে সে ব্রাত্য। হিন্দু সমাজ অন্য ধর্ম থেকে মানুষ টেনে এনে দীক্ষা দিয়ে হিন্দুত্বে বরণ করে না। বরং নিজের সমাজ থেকে নানান ছুতোনাতায় অনেককে বিতাড়নের ব্যবস্থা রেখেছে। দ্বারিকার বন্ধু যাদগোপালের আশঙ্কাও সত্যে পরিণত হয়েছিল, এই বিবাহ প্রস্তাবে দ্বারিকার জমিদারিতে অনেক কর্মচারী ও প্রজাদের মধ্যে দারুণ অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, নায়েব-গোমস্তারা চাকরি ছেড়ে দিতেও উদ্যত হয়েছিল। এই আক্রার বাজারে চাকরি জোটানো সহজ নয়, তবু তারা এই অনাচার সহ্য করবে না।
ক্রোধের বশে দ্বারিকা জমিদারি বিক্রিই করে দিল। ওসব ঝঞ্ঝাট সে আর রাখতে রাজি নয়। সে নিজে হিন্দুত্নে গর্ব করে, অনেক শাস্ত্র পাঠ করেছে, সে জানে বসন্তমঞ্জরী নির্দোষ, তার জীবন বিড়ম্বিত হয়েছে তার পিতার দোষে, যে পিতা এক মূর্খ, লোভী ব্রাহ্মণ। সমাজ তার পিতাকে কোনও শাস্তি দেবে না, দেবে শুধু এক অসহায় নারীকে?
রেজিষ্ট্রি করে সিভিল ম্যারেজে বাধা নেই। সমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাবার জন্য দ্বারিকা এক মস্ত ভোজের আয়োজন করেছিল, মানিকতলার বাড়ির চৌহদ্দি ঘিরে ম্যারাপ বাঁধা হয়েছিল বিশাল, নিমন্ত্রিত ছিল দেড় হাজার বিশিষ্ট নারী-পুরুষ, কিন্তু উৎসবের দিনে হাজির হয়েছিল মাত্র পঁয়ষট্টিজন, রাশি রাশি খাদ্যদ্রব্য বিলিয়ে দেবার জন্য যথেষ্টসংখ্যক কাঙালিও পাওয়া যায়নি। বহু পরিচিত ব্যক্তি, যারা দ্বারিকাকে মৌখিক সমর্থন জানিয়েছিল, তারাও প্রকাশ্যে দ্বারিকার পাশে দাঁড়াতে চায়নি বলেই বেশি আঘাত পেয়েছিল দ্বারিকা।
এখন সে নানান তীর্থস্থান পরিভ্রমণ করে বেড়াচ্ছে।
জেদ বজায় রেখেছে বটে, কিন্তু বিবাহ করে দ্বারিকা পরিপূর্ণ সুখী হতে পারেনি। বসন্তমঞ্জরীর মনের মেঘ কিছুতে কাটে না। এই বিবাহের জনা দ্বারিকাকে অনেক কিছু হারাতে হয়েছে, জমিদারি বিক্রি করেছে, অনেক বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছে, এ জন্য বসন্তমঞ্জরী নিজেকে দায়ি করে। মাঝে মাঝে সে আপনমনে কাঁদে। শত্ত অনুরোধ করলেও গান গাইতে চায় না।
শীতের অপরাহ্ন, বাতাসে মেদুর ভাব, আকাশে সূর্যাস্তের লাল আভা। পথে অনেক তীর্থযাত্রী পদব্রজে চলেছে, প্রয়াগ সঙ্গমে অর্ধকুম্ভের পবিত্র স্নান শুরু হবে আগামীকাল থেকে। গাড়িটা চলেছে ধীরে ধীরে।
দ্বারিকা এক সময় বলল, বাসি, ঘোমটা একটু তোলে। বাইরেটা দেখো, দেখো কত ঝাঁক ঝাঁক পাখি উড়ে যাচ্ছে।
বসন্তমঞ্জরী অবগুণ্ঠন কিছুটা সরাল, তার চক্ষু দুটি জলে ভেজা। সে পাখি খুব ভালবাসে, কিন্তু আকাশে ঝাঁক ঝাঁক পাখি নেই, মাত্র পাঁচ-সাতটি বক দেখা গেল।
দ্বারিকা জিজ্ঞেস করল, বাসি, আবার তুমি কাঁদছ? তোমার কী কষ্ট হচ্ছে আমায় বলো?
বসন্তমঞ্জরী আঁচল দিয়ে চক্ষু মুছে বলল, কষ্ট কিছু নেই। আমি ভাবছিলাম, আমার জীবনখানি চলেছে ছোট নদী থেকে ক্রমশ বড় নদীর দিকে। এরপর কী হবে?
দ্বারিকা বিস্মিতভাবে বলল, তার মানে! ছোট নদী বড় নদী? ওঃ হো, নবদ্বীপের গঙ্গার চেয়ে কলকাতার গঙ্গা ছিল বড়।
বসন্তমঞ্জরী বলল, এখানে ত্রিবেণীসঙ্গম।
দ্বারিকা বলল, নামেই ত্রিবেণী, আসলে গঙ্গা-যমুনা মিশেছে বোঝা যায়, আর সরস্বতী নদীকে দেখাই যায় না। তিনি নাকি পালবাহিনী।
সমঞ্জরী বলল, এরপর আমার জীবন কোন দিকে যাবে?
দ্বারিকা বলল, মানুষ কত জায়গায় বেড়াতে যায়, কত নদী দেখে, তার সঙ্গে জীবনের কী সম্পর্ক? এরপর আমরা পুরীতে গিয়ে সমুদ্র দর্শন করব।
বসন্তমজ্ঞরী বলল, সমুদ্র, সমুদ্রে যদি আমি মিলিয়ে যাই? আচ্ছা, সমুদ্রের চেয়ে আরও বড় কিছু হয় না?
দ্বারিকা বলল, হ্যাঁ, হয়। পুরীর কাছে উপসাগর, তারপর সাগর, মহাসাগর। আমরা যদি কন্যাকুমারী যাই, সেখানে ভারত মহাসাগর দেখতে পাব। তাও যেতে পারি।
বসমঞ্জরী অস্ফুট স্বরে বলল, মহাসমুদ্র আমাকে কোলে টেনে নেবে।
দ্বারিকা বলল, কী পাগলের মতন কথা বলছ! কত লোক সমুদ্র দর্শন করে ফিরে আসে। তোমাকে টেনে নেবে কেন? তোমার মাথায় এই সব চিন্তা আসে কী করে?
বসন্তমঞ্জরী বলল, তা জানি না। তবু আসে। কত কী-ই যে মনে আসে, আমি নিজেই নিজের মনের নাগাল পাই না। যে সব জায়গায় কখনও যাইনি, সে সব জায়গারও ছবি দেখতে পাই।
দ্বারিকা বলল, অনেকের জালের ফাঁড়া থাকে। তুমি জলে নামবে না। প্রয়াগেও স্নান করার দরকার নেই, মাথায় জল ছিটিয়ে নেবে।
বসন্তমঞ্জরী ম্লান হেসে বলল, আমি সাঁতার জানি।
গাড়ি এলাহাবাদ শহরে পৌঁছল প্রায় মধ্যরাত্রে। নুরগঞ্জে একটি সুদৃশ্য দ্বিতল বাড়ির সামনে অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রতিকান্ত, একটি দ্রুতগামী টাঙ্গায় সে আগেই পৌঁছে গেছে। দ্বারিকা দু-একদিনের মধ্যেই কোনও তীর্থ দর্শন করে পরবর্তী স্থানের জন্য যাত্রা পছন্দ করে না। সে ধীরেসুস্থে স্থানমাহাত্ম অনুভব করতে চায়, তাই এখানে মাসাধিক কাল থাকবে বলে মনস্থ করেছে। বাড়িটি তার পছন্দ হল।
আহারাদি সমাপনের পর সে এসে দাঁড়াল দোতলার অলিন্দে। এত রাতেও রাজপথে জনস্রোত অব্যাহত। দূর দূরান্ত থেকে আসছে হাজার হাজার তীর্থযাত্রী, এই শীতের রাতে এত মানুষ কোথায় মাথা গোঁজার আশ্রয় পাবে কে জানে! কাছাকাছি একটা ধরমশালায় মানুষ গিসগিস করছে, শোনা যাচ্ছে তাদের কোলাহল। অনেকে নাকি নদীর ধারে বালির ওপর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে।
ঘরের মধ্যে গুনগুনিয়ে গান গাইছে বসন্তমঞ্জরী। অনেকদিন পর তার গলায় গান শুনে পুলকিত হয়ে উঠল দ্বারিকা। তা হলে বসন্তমঞ্জরীর মন ভাল হয়েছে। এই গান তারিফ করতে গেলে সে হয়তো থেমে যাবে, তাই দ্বারিকা চুপ করে শুনতে লাগল।
যবে দেখাদেখি হয় হেন তার
মনে লয়
নয়ানে নয়ানে মোরে পীয়ে।
পিরীতি আরতি দেখি হেন মনে লয় সখি
আমি তারে চাহিলে সে জীয়ে।।
আহা মরি মরি মুঞি কী কব আরতি
কী দিয়ে শোধিব শ্যাম বঁধুর
পীরিতি…
ঘাড় ফিরিয়ে দ্বারিকা দেখল। একবস্ত্রা বসন্তমঞ্জরী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আলুলায়িত চুলে চিরুনি চালনা করছে। দেওয়ালে ঝোলানো লণ্ঠনে তার মুখের এক পাশ দেখা যাচ্ছে না, অন্য পাশ উদ্ভাসিত। তার শরীরের গড়নটি মৃৎ প্রতিমার মতো ঢলোঢলো, তার মুখে অভিজ্ঞতাজনিত কোনও ক্লিষ্ট রেখা নেই।
দ্বারিকার মনে হল, বসন্তমঞ্জরী একটি নারীরত্ন হলেও যে-কোনও রত্নই তো অর্থ দিয়ে কেনা যায়। এ দেশে সমস্ত নারীই পণ্যা। সে এখন যথেষ্ট ধনবান, ইচ্ছে করলে, বসন্তুমঞ্জরীর চেয়েও কোনও বেশি রূপসী নারীকে সে নিজের ঘরনি করে নিয়ে আসতে পারত। একজন কেন, এরকম একাধিক রমণীকেও যদি সে নিজের অধীনে রাখত, তা হলেও সমাজ তাকে বাধা দিত না।
অর্থ থাকলে রমণীরত্ন যত খুশি ক্রয় করা সম্ভব, কিন্তু তাদের মন জয় করা যে কত কঠিন, তা কজন জানে? অনেকে মনের খবরই রাখে না। অথচ মন না পাওয়া গেলে শরীরেরও ঠিক স্বাদ থাকে না। বসন্তমঞ্জরীর মন পাওয়ার জনা দ্বারিকা কত কিছু স্বেচ্ছায় মেনে নিয়েছে। একবার ওর বিয়ে হয়েছিল, সে অবশ্য খুবই বৃদ্ধ বরের সঙ্গে, তবু সে তো কুমারী নয়। বৈধব্যের পর অপহৃতা হয়েছিল বসস্তমঞ্জরী। তারপর সে অত্যাচারী পুরুষদের রিরংসার শিকার হয়েছিল, সেই আড়াই বছরের ইতিহাস দ্বারিকা জানতে চায় না কখনও। বসস্তুমঞ্জরী যে ক্লেদাক্ত পরিবেশেও তার সারল্য হারায়নি, এইটাই তো যথেষ্ট। তার কথাবার্তা অনেকেই বুঝতে পারে না, সে মাঝে মাঝেই দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন ভবিষ্যতের ছবি দেখে বিস্ময়ে বিভোর হয়ে। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বলে একটা কথা আছে, সত্যিই কি তা মানুষের পক্ষে সম্ভব? দ্বারিকা জ্যোতিষীদের বিশ্বাস করে না, কিন্তু বসন্তমঞ্জরীর কথা শুনে সে প্রায়ই হকচকিয়ে যায়।
দ্বারিকা নরম গলায় বলল, বাসি, এখানে এসো, আমার পাশে একটু দাঁড়াও।
বসন্তমঞ্জরী বলল, ও মা, ওখানে যাব কী? আমার সাজ খুলে ফেলেছি, লোকে যে দেখবে?
দ্বারিকা বলল, লণ্ঠনটা নিবিয়ে দাও, তা হলে অন্ধকারে আমাদের কেউ দেখতে পাবে না।
দ্বারিকার একাধিকবার সাধাসাধিতে বসন্তমঞ্জরী অলিন্দে এসে দাঁড়াল। পথে কোনও বাতি নেই, যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ লণ্ঠন ঝুলিয়ে চলেছে, অস্পষ্টভাবে দেখা যায় চলমান মানুষের মিছিল। আকাশ তারাখচিত, নির্মেঘ, বেশ শীত আছে। দ্বারিকা নিজের শালটা দিল বসন্তমঞ্জরীর গায়ে।
একটুক্ষণ নীরবে পথের দিকে চেয়ে থাকার পর বসন্তমঞ্জরী বলল, এই যে এত মানুষ, এর মধ্যে আমাদের চেনা কেউ আছে?
দ্বারিকা বলল, কী করে থাকবে? এখানে পশ্চিমের মানুষই বেশি আসে। বাংলার মানুষ গঙ্গাসাগরে ডুব দিতে যায়। এত দূরের পথ, তবে দু-চারজন বাঙালি আসতেও পারে।
বসন্তুমঞ্জরী বলল, আমাদের চেনা একজন মানুষকে আমি দেখতে পেলাম মনে হল।
দ্বারিকা হেসে বলল, যাঃ পাগলি! কোনও মানুষের মুখই দেখা যাচ্ছে না, এর মধ্যে তুই লোক দেখবি কী করে?
বসন্তমঞ্জরী বলল, মুখ দেখিনি, কিন্তু একজন মানুষের হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গিটা যেন চেনা চেনা। সে কে আমি জানি না, কিন্তু চেনা লেগেছে ঠিকই।
দ্বারিকা বলল, তুই পারিস বটে। এই অন্ধকারে কে কীরকমভাবে হাঁটছে, তাও কি বোঝা যায় নাকি!
বসন্তমঞ্জরী বলল, এখন একবার সঙ্গমে গেলে হয় না?
দ্বারিকা বলল, এত রাতে? কোচোয়ান ছুটি নিয়ে চলে গেছে, হাঁটার পক্ষে অনেক দূর। শীতের মধ্যে এতটা পথ হাঁটা যায়?
বসন্তমঞ্জরী বালিকাসুলভ আবদারের ভঙ্গিতে তবু বলল, আমরা আস্তে আস্তে হেঁটে যাব, বেশ মজা হবে, এই অন্ধকারে আমাদের মুখ কেউ দেখতে পাবে না, কিন্তু আমরা নদী দেখতে পাব।
দ্বারিকা তবু উৎসাহ বোধ করে না। এই শীতের রাতে আরামের শয্যার প্রলোভন ছেড়ে হাঁটাহাঁটি করতে চায় না সে। বসন্তমঞ্জরীর কাঁধে হাত রেখে বলল, কাল বরং ভোর হতে না হতেই যাব, ত্রিবেণীসঙ্গমে সূর্য ওঠা দেখব!
বসন্তমঞ্জরী বলল, অত ভোরে কী করে আমাদের ঘুম ভাঙবে? তা হলে এসো আমরা সারা রাত জেগে থাকি।
দ্বারিকা বলল, যদি তুমি গান শোনাও, তা হলে জাগতে পারি।
অলিন্দে দাঁড়িয়ে গান গাওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। ধারালো শীতের বাতাসের ঝাপটা লাগছে গায়ে। ওরা চলে এল কক্ষের মধ্যে। বিছানার ওপর পা ছড়িয়ে বসল বসন্তমঞ্জরী। তার কোলে মাথা রেখে দ্বারিকা শুয়ে পড়ল। আপনমনে বলে উঠল, আঃ, বড় ভাল লাগছে।
বসন্তমঞ্জরী বলল, যদি কোনও গাছের তলায়… আর কোথাও কেউ নেই, তুমি আমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছ, গাছের পাতাগুলোয় বাতাসে ঝিলিমিলি শব্দ হচ্ছে, তা হলে আরও ভাল লাগত না?
শীতের রাতে বিছানার উষ্ণতাই বেশি পছন্দ হল দ্বারিকার, সে বলল, আমরা যখন বৃন্দাবন যাব, তখন বসন্তকাল এসে যাবে, তখন না হয় কোনও গাছতলায়… এখন তুই গান ধর, বাসি।
বসন্তমঞ্জরী গুনগুন করে গান শুরু করল। একটা পুরো গানও শেষ হল না, তার আগেই দ্বারিকার নাসিকাগর্জনে তাল ভঙ্গ হতে লাগল। একটু পরে দ্বারিকার মাথাটি খুব সন্তর্পণে নামিয়ে বালিশের ওপর স্থাপন করে দিল বসন্তমঞ্জরী। তারপরেও নিজে শুয়ে পড়ল না, বসেই রইল। অনেকদিন পর আজ তাকে গানে পেয়েছে, মৃদু কণ্ঠে সে গেয়ে চলল একটার পর একটা গান, নিজেকেই শোনাচ্ছে না, তন্ময় হয়ে যেন সে কোনও অদৃশ্য দেবতার কাছে নিবেদন করছে তার সঙ্গীত।
প্রথম কুক্কুটের ডাক ধ্বনিত হতে না হতেই সে জাগিয়ে তুলল দ্বারিকাকে। নিজে দ্রুত তৈরি হয়ে নিল। সঙ্গমে গিয়ে সূর্যোদয় দেখতে হবে। দ্বারিকার ঘুমের জড়তা সহজে কাটে না, সে বিলাসী পুরুষ, ভোরে জেগে ওঠার কথাটা ছিল নিতান্তই কথার কথা, বিলাসী পুরুষরা সূর্যের তোয়াক্কা করে না। গড়িমসি করতে করতে সে বলল, আমরা তো এখানে বেশ কয়েকদিন থাকব, ব্যস্ততার কী আছে, না হয় আর একদিন দেখব সূর্য ওঠা!
বসন্তমঞ্জরী অনুনয় করে বলতে লাগল, না, আজই ইচ্ছে করছে, তুমি কথা দিয়েছিলে, তুমি আমাকে নিয়ে যাবে না?
দ্বারিকাকে শেষ পর্যন্ত উঠতেই হল। বসন্তমঞ্জরী তার চোখ-মুখ প্রক্ষালনের জন্য এনে দিল ঈষদুষ্ণ জল, পরিধানের জন্য জুগিয়ে দিল কুর্তা-পাজামা। কোচোয়ানকে তলব করে তারা যাত্রা করল প্রয়াগের দিকে।
পথে তীর্থযাত্রীদের স্রোত এখনও অব্যাহত। হিন্দুদের বিশ্বাস ত্রিবেণীসঙ্গমের জলে অমৃত মিশে আছে। ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত অসুরদের ছলনা করে যখন অমৃতের কুম্ভ বহন করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন তার থেকে কয়েক ফোঁটা অমৃত পড়ে যায় এখানে। অমৃত অনিঃশেষ, তাই এখানে স্নান করলে সেই অমৃতের স্পর্শে সব পাপ ধুয়ে যায়। মৎস্যপুরাণে আছে যে, সমুদ্র মন্থনের পর অমৃতকুম্ভ নিয়ে স্বর্গের নন্দনকাননে পৌঁছতে জয়ন্তর দীর্ঘ বারো দিন সময় লেগেছিল। দেবতাদের বারো দিনে মানুষের বারো বৎসর, তাই জয়ন্তর সেই যাত্রার স্মৃতিতে এখানে প্রতি দ্বাদশ বৎসরে পুণ্যস্নান হয়। ইদানীং আর বারো বছর অপেক্ষা করার ধৈর্য থাকছে না, তাই ছ’ বছর অন্তর অর্ধকুম্ভের প্রবর্তন হয়েছে।
তীর্থের পুণ্য সঞ্চয়ের সঙ্গে শারীরিক কষ্ট সহ্য করার ব্যাপারটাও যেন জড়িত আছে। যাদের গাড়ি-ঘোড়া চড়ার সামর্থ্য আছে, তারাও ইচ্ছে করে পদব্রজে আসে, তাও নগ্ন পদে। নদীর চড়ায় অসংখ্য ছোট ছোট তাঁবু, তার মধ্যেই তীর্থযাত্রীরা কোনওক্রমে মাথা গুঁজে থাকে। অনেকে তাঁবুর আশ্রয়ও পায়নি, খোলা আকাশের নীচে শুয়ে থাকতেও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। নানান সম্প্রদায়ের সাধুরাও সমবেত হয়েছে আগে থেকে, তাদের মধ্যে নাগা সন্ন্যাসীরা সম্পূর্ণ নিরাবরণ।
দ্বারিকারা যখন এসে পৌঁছল, ততক্ষণে সূর্যদেব জল ছেড়ে উঠে এসেছেন। জবাকুসুম বর্ণের বদলে তাঁর রূপ এখন স্বর্ণাভ। এরই মধ্যে কনকনে ঠাণ্ডা জলে বহু লোক নেমে পড়েছে স্নানে। সাধুদের তাঁবু থেকে ভেসে আসছে নানারকম সঙ্কীর্তনের ধ্বনি। নাগা সন্ন্যাসীরা সার বেঁধে ছুটছে, ত্রিশূল হাতে, কয়েকজন চ্যাঁচাচ্ছে হঠ যাও, হঠ যাও।
ভারতীয় নারীরা অন্য সময় যতই আব্রু রক্ষা করুক, তীর্থস্থানে এসে সব বিধিনিষেধ যেন ঘুচে যায়। এখানে হাজার হাজার মানুষের মধ্যে নারীদের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। তাদের জন্য পৃথক কোনও ঘাট নেই, পুরুষদের সঙ্গেই তারা নদীতে স্নান করছে, অনেকে ভিজে শাড়ি পরেই অসংখ্য চক্ষুর দৃষ্টিপথ দিয়ে ফিরে যাচ্ছে।
বসন্তমঞ্জরী ওড়নায় মুখ ঢেকে রেখেছিল, গাড়ি থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে দ্বারিকা বলল, ঘোমটা খুলে ফেল, বাসি, এখানে স্ত্রীলোকের খোলা মুখ দেখাতে কোনও আপত্তি নেই। ঘোমটায় চক্ষু ঢাকা থাকলে তুমিই বা সব কিছু দেখবে কী করে?
বসন্তমঞ্জরী সঙ্গে সঙ্গে ওড়না সরিয়ে বলল, জায়গাটা কত চেনা লাগছে, যেন আগে দেখেছি।
দ্বারিকা বলল, অনেক লোকের মুখে গল্প শুনেছি তো, শুনতে শুনতে চেনা লাগে।
বসন্তমঞ্জরী হাত তুলে বলল, ওই ডান দিকটায় চলো যাই।
দ্বারিকা সেদিকে তাকিয়ে বলল, ওখানে বড় বেশি মানুষের জটলা। ধুলো আর ধোঁয়া উড়ছে। ওদিকে গিয়ে কী হবে? বরং বাঁ দিকটা নিরিবিলি। এদিক দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত যাওয়া যাবে।
আপত্তি না করে সেদিকেই খানিকটা এগোল বসন্তমঞ্জরী। তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল, ওই দিকটাই কিন্তু ভাল ছিল। আমাদের ওদিকেই যেতে হবে।
দ্বারিকা লঘু হাস্যে বলল, শোনো পাগলির কথা! তুই তো সত্যিই আগে এখানে আসিসনি, তুই কী করে জানলি ওদিকটা ভাল?
বসন্তমঞ্জরী বলল, আমার মন বলছে!
কাশী না এলাহাবাদ, মোগলসরাই থেকে যে-কোনও দিকেই যাওয়া যায়, দ্বারিকার ইচ্ছে ছিল আগে কাশীতে গিয়ে কিছুদিন থাকার। বসন্তমঞ্জরী তখন বলেছিল, আগে প্রয়াগ দর্শন করে আসি চলো। তখনও কিন্তু সে কুম্ভমেলার এই স্নানের কথা জানত না, দ্বারিকারও জানা ছিল না, হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে নদীতে ডুব দিয়ে পুণ্য অর্জনের স্পৃহাও তার নেই। মেলার কথা জেনেই সে বলেছিল, অত ভিড়ের মধ্যে এখন এলাহাবাদ না গিয়ে আগে কাশী যাওয়াই তো শ্রেয়। বসন্তমঞ্জরী তবু জেদ ধরেছিল, না, আগে এলাহাবাদ, তার মন বলছে, এখন এলাহাবাদ যেতে হবে।
ওর মন কী করে এসব কথা বলে? এই মনের নিরিখ পাওয়া বেজায় কঠিন।
দ্বারিকা বলল, ঠিক আছে। চল ডান দিকেই যাই, দেখি সেখানে কী আছে!
সেদিকে ক্রমশই ভিড় বাড়ছে, মানুষজন ঠেলে ঠেলে এগুতে হচ্ছে। এদিকটায় গা ঘেঁষাঘেষি অসংখ্য তাঁবু, মাঝখান দিয়ে সরু পথ, তার ওপর আবার ভিখিরির উৎপাত। বসন্তমঞ্জরী এক পথ ছেড়ে অন্য পথ ধরে যাচ্ছে নিজে নিজে, যেন সব তার চেনা, সে-ই দ্বারিকার পথ প্রদর্শক।
আরও কিছুটা যাবার পর দেখা গেল সারি সারি দোকান। গরম গরম জিলিপি আর কচুরি ভাজার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তা দেখে দ্বারিকা বেশ উৎফুল হয়ে উঠল। সে পেটুক মানুষ, খাবারের সুগন্ধে তার খিদে চাগাড় দিয়ে উঠেছে। তা হলে তো ঠিক দিকেই নিয়ে এসেছে বসন্তমঞ্জরী।
এদিকে চায়ের বিশেষ চল নেই। দোকানগুলির সামনে বিশাল বিশাল কড়াইতে ফুটছে খাঁটি দুধ। বড় এক ভাঁড় দুধের দাম দশ পয়সা। বাঙালিরা ছোট ছোট জিলিপি বানায়, এখানে এক একটি জিলিপি তার চার গুণ বড়, রসে একেবারে টুসটুসে। পদ্মপাতায় করে বিক্রি হচ্ছে কচুরি আর হালুয়া। দ্বারিকার একেবারে জিভে জল আসার উপক্রম।
বসন্তমঞ্জরী কিন্তু খাবারের জন্য আকৃষ্ট হয়ে এদিকে আসেনি। এত সকালে সে কিছুই খেতে চায় না। কচুরি কিংবা জিলিপি কিছুই সে খাবে না। দ্বারিকার অনেক পীড়াপীড়িতে সে এক টুকরো জিলিপি ভেঙে মুখে দিল শুধু। গরম দুধ দ্বারিকার খুব প্রিয়, বসন্তমঞ্জরীর মুখে দুধ একেবারে রোচে না। একটা মস্ত ভাঁড় ভর্তি দুধ নিয়ে চুমুক দিতে দিতে দ্বারিকা আবার হাঁটতে শুরু করল। দোকানগুলির পর জায়গাটা ফাঁকা, এদিক দিয়েও নদীর ধারে পৌঁছনো যায়।
দ্বারিকার চেয়ে একটু এগিয়ে গিয়েছিল বসন্তুমঞ্জরী, পিছিয়ে এসে বলল, কাল রাতে তোমাকে বলেছিলাম, এখানে আমাদের একজন চেনা মানুষ আছে? আমি ভুল বলিনি।
দ্বারিকার গোঁফ দুধ লেগে সাদা হয়ে গেছে। শেষ চুমুক দিয়ে ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, কই?
বসন্তমঞ্জরী চোখের ইঙ্গিতে একদিক দেখাল।
সেদিক তাকিয়ে আরও বিস্মিত হল দ্বারিকা। একটা পাথরের চাঙড়ের ওপর বসে আছে একজন মানুষ, পবনে মলিন গেরুয়া বস্ত্র, মুখভর্তি দাড়ি গোঁফে জঙ্গল, হাতে একটি লাঠি। এই লোকটিকে দ্বারিকা কস্মিনকালেও দেখেনি।
দ্বারিকা বসন্তমঞ্জরীর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, ও কে?
বসন্তমঞ্জরী পালটা প্রশ্ন কল, তুমি ওকে চেনো না?
দ্বারিকা বলল, বাপের জন্মেও চিনি না।
বসন্তমঞ্জরী হাসল।
দ্বারিকা গোঁয়ারের মতন উপবিষ্ট লোকটির কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, নমস্কার, মহাশয় কি বাঙালি?
লোকটি মুখ তুলে দ্বারিকার দিকে নীরবে তাকিয়ে রইল।
দ্বারিকার বুকটা হঠাৎ কেঁপে উঠল। বিস্ময়ে বা পুলকে নয়, অজানা আশঙ্কায়। নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে সে চিনতে পারেনি, অথচ বসস্তুমঞ্জরী চিনল কী করে? এই মানুষটিকে সে মাত্র একবার দুবার দেখেছে, তাও অল্প সমযের জন্য। এই মানুষটি যে এখানে বসে থাকবে, তাই বা বসন্তমঞ্জরী কেমনভাবে জানল? সে এদিকেই আসবার জন্য বারবার বলছিল কেন? বসন্তমঞ্জরীর কি অলৌকিক ক্ষমতা আছে? এত কান্ডের পর যাকে সে বিবাহ কবল, সে সাধারণ মানবী নয়?
দাড়ি-গোঁফে মুখমণ্ডল ঢাকা থাকলেও চোখ দেখে মানুষকে চেনা যায়! দ্বারিকা অস্ফুটভাবে বলল, ভরত।
ভরতের দৃষ্টিতে বিস্ময় নেই, সামান্য চাঞ্চল্যও নেই। সে কোনও কথা না বলে চেয়ে রইল শান্তভাবে।
দ্বারিকা তার কাঁধে চাপড় মেরে বলল, ভরত, তুই এখানে? কতকাল তোর কোনও সন্ধান নেই, তুই এখানে আছিস কতদিন? এখানে কী করিস? কথা বলছিস না কেন? আমাকে চিনতে পারিসনি। আমি দ্বারিকা, দ্বারিকা!
ভরত এবার শুধু বলল, দ্বারিকা।
দ্বারিকা বলল, ওই দ্যাখ বসন্তমঞ্জরী, আমার বাসি। মনে আছে ওর কথা? আমি এখন ওকে বিয়ে করেছি। সমাজের মুখের ওপর তুড়ি মেরে দিয়েছি। বাসিই দেখাল যে তুই এখানে একলা বসে আছিস।
ভরত বসন্তমঞ্জরীর দিকে এক পলক তাকিয়েই ফিরিয়ে নিল মুখ। কোনওরকম সম্ভাষণ জানাল না।
দ্বারিকা জিজ্ঞেস করল, তুই এলাহাবাদে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রয়েছিস কেন রে? কতদিন হল?
ভরত বলল, কাল এসেছি।
কাল? কাল কখন?
রাতে পৌঁছেছি
বসন্তমঞ্জরী তোকে হাঁটতে দেখেছিল রাস্তায়। দেখেই চিনেছে। আমি দেখতে পাইনি। ব্যাটা, তুই সাধু হয়েছিস নাকি?
না।
তা হলে গেরুয়া ধারণ করেছিস কেন?
চলাফেরায় সুবিধা হয়।
চলাফেরায় সুবিধা হয় মানে? তুই কি ঘুরে ঘুরে বেড়াস নাকি? কাল রাতে এসে পৌঁছেছিস, তোর কোনও আস্তানা ঠিক হয়েছে?
ভরত আবার চুপ করে গেল।
দ্বারিকা বলল, বুঝেছি, তুই সন্ন্যাসী সেজেছিস, খোলা মাঠে পড়ে থাকতে চাস! ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে, তাই না? ওসব চলবে না, ওঠ, আমাদের সঙ্গে চল।
ভরত ঈষৎ কাতরভাবে বলল, এই বেশ বসে আছি।
দ্বারিকা প্রবল বেগে মাথা দুলিয়ে বলল, উহুঃ, ও কথা শুনব না। এতদিন পর দেখা হল, তোকে সহজে ছাড়ছি নাকি? পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস কেন রে, তোর কী হয়েছে?
ভরত বলল, কিছু না।
দ্বারিকা তার কুর্তার জেব থেকে চুরুটের বাক্স বার করল। একটি চুরুট ভরতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে। আমি এলাহাবাদে বাসা ভাড়া করেছি, অনেক ঘর আছে, তুই সেখানে থাকবি চল। অনেক গল্প আছে। এর মধ্যে কত কী যে ঘটে গেল।
ভরত চুরুট নিতে আপত্তি করল না।
বসন্তমঞ্জরী মুখ নিচু করে আছে, এবার সে ফিসফিস করে স্বামীকে বলল, আগে ওর জন্য কিছু খাবারের ব্যবস্থা করো। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অনেকদিন উনি ভাল করে খাননি।
দ্বারিকা বলল, ঠিক কথা। আগে কিছু খাওয়া দরকার। চল ভরত, এখানে খুব ভাল দুধ পাওয়া যাচ্ছে, খেলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবি, আমিও আর এক ভাঁড় খাব।
ভরত যেন একটি চাকা লাগানো কাঠের পুতুল, তার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল দ্বারিকা। দুধের ভাঁড় দেওয়া হলে সে পান করতে লাগল যন্ত্রের মতন।
দ্বারিকা আরও অনেকগুলি জিলিপি কিনল, বসন্তমঞ্জরী এখনও কিছু খেতে রাজি নয়। স্নানের আগে সে কিছু খেতে চায় না।
দ্বারিকা বলল, বাসি কিছু না খেলেও তুই তা নিয়ে ভাবিস না ভরত। ওর পাখির আহার। সারাদিনে কখন যে চুটিমুটি কী একটু খায় তা টেরই পাওয়া যায় না। তুই জিলিপি ভালবাসতি, মনে আছে, মানিকতলা বাজারের কাছে এক দোকান থেকে আমরা প্রায়ই গরম গরম জিলিপি খেতাম, তখন তোরও পয়সা ছিল না, আমারও তেমন পয়সা ছিল না, ইচ্ছে হলেও দু-চার খানার বেশি কেনার ক্ষমতা থাকত না। এ জিলিপি অতি সরেস!
ভরত বসন্তমঞ্জরীর উপস্থিতির প্রতি কোনও মনোযোগই দিচ্ছে না, গোটা চারেক জিলিপি সে খেয়ে ফেলল। দোকানির কাছ থেকে এক ঘটি জল চেয়ে নিয়ে পান করল সবটা। সে যে খুবই ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত ছিল তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
চুরুটে টান দিয়ে বলল, এবার আমি যাই?
দ্বারিকা বলল, যাই মানে, কোথায় যাবি? বললাম যে, তুই আমাদের সঙ্গে থাকবি?
দ্বিধাগ্রস্তভাবে ভরত বলল, বাড়ি? আমি তো কারুর বাড়িতে থাকি না।
দ্বারিকা প্রায় ধমক দিয়ে বলল, কারুর বাড়ি আর আমার বাড়ি কি এক হল? এতদিন পর তোকে পেয়ে আমি ছাড়ছি আর কি! এত হাজার হাজার মানুষের মধ্যে একজন চেনা মানুষকে খুঁজে পাওয়া কী আশ্চর্য ব্যাপার। বাসির চোখ আছে বটে, ঠিক তোকে দেখেছে। জানিস ভরত, অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার, আমাদের প্রয়াগে আসার কোনও ঠিক ছিল না। কাশীতেও চলে যেতে পারতাম। কাশীতে গেলে আর তোর সঙ্গে দেখা হত না। তারপর এখানে এসেও আমরা প্রথমে জটাধারী আশ্রমের দিকটায় যাচ্ছিলাম, বাসির কী খেয়াল হল, বলল, ওই দোকানগুলোর দিকে চলল। ও ঠিক বুঝেছিল, জিলিপি আর গরম দুধ পেলে আমি খুশি হব। এদিকে এলাম বলেই তো দেখা হয়ে গেল তোর সঙ্গে। তোর সঙ্গে আর কেউ এসেছে?
ভরত দু দিকে মাথা নাড়ল।
দ্বারিকা বলল, তবে আর কী, চল, চল। আমি এত মানুষের ভিড়ে স্নান-টান করব না। বাড়ি ফিরে ওসব সেরে নেওয়া যাক। বিকেলের দিকে আবার না হয় এদিকে আসা যাবে। সম্রাট আকবরের তৈরি ফোর্টটা দেখেছিস? ও দেখবি কী করে, তুই তো কাল রাত্তিরে এসেছিস। ফোর্টটা ভাল করে ঘুরে দেখার ইচ্ছে আছে। তারপর ভরদ্বাজ মুনির আশ্রম…
নিমরাজি অবস্থায় ভরতকে ভাড়াবাড়িতে নিয়ে এল দ্বারিকা। ভরত হুঁ-না ছাড়া কথাবার্তা বিশেষ বলে না। তার মুখখানি উদাসীনতায় মাখা। দ্বারিকা অবশ্য তা লক্ষ করছে না বিশেষ। এতদিন পর পুরনো বন্ধুকে পেয়ে সে নিজের কথাই বলে যাচ্ছে সাতকাহন।
দুপুরবেলা গরম জল আনিয়ে দ্বারিকা নিজেও যেমন স্নান করল, তেমনি বন্ধুকেও স্নান করতে বাধ্য করাল। ভরতের গেরুয়া বসন ছাড়িয়ে পরাল নিজের পরিষ্কার ধুতি ও কুর্তা। কালই সে পরামানিক ডেকে ভরতের দাড়ি কামিয়ে দেবে শাসিয়ে রাখল।
তারপর চর্ব্য-চোষ্য লেহ্য-পেয় নানা পদের মধ্যাহ্ন ভোজ চলল অনেকক্ষণ ধরে। নারী-পুরুষের একসঙ্গে খেতে বসার রীতি নেই, দ্বারিকা অনেক সাধাসাধি করলেও বসন্তমঞ্জরী তার সঙ্গে আহারে বসে না, আজ অতিথি রয়েছে, আজ তো প্রশ্নই ওঠে না। বসন্তমঞ্জরী পরিবেশন করল সব। ভরত নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ শেষের দিকে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল থালার ওপরে। দ্বারিকা তার কাঁধ ধরে টেনে তুলে বলল, একী, কী হল তোর?
ভরতের দু চক্ষু ঘুমে জড়ানো। শুধু তৃষ্ণার্ত ও ক্ষুধার্ত নয়, বোঝা গেল, অনেকদিন সে ভাল করে ঘুমায়নি। আজ উদর পূর্ণ হওয়ার পর রাজ্যের ঘুম ঝাঁপিয়ে পড়েছে তার চোখে। তখনই তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরটিতে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বিশ্রামের জন্য।
দ্বারিকাও নিজের বিছানায় এসে পান মুখে দিয়ে গড়গড়া টানল খানিকক্ষণ। তার দিবানিদ্রার অভ্যেস আছে। বসন্তমঞ্জরী নিজের কাজ টাজ সেরে এল খানিক পরে। বসন্তমঞ্জরী মাথার চুলে বিলি কেটে দিলে দ্বারিকার সহজে ঘুম আসে।
আরামে চোখ বুজে দ্বারিকা বলল, বাসি, তোর নজরের জোর আছে বটে। আমার বন্ধু, আমি তাকে চিনতে পারিনি, তুই ঠিক চিনেছিস।
বসন্তমঞ্জরী বলল, মানুষটা বড় দুঃখী।
দ্বারিকা বলল, বরাবরই ওর দুঃখী দুঃখী ভাব। অল্প বয়স থেকেই ওর বাপ-মা নেই, আপনজনও কেউ নেই। দুঃখ তো থাকবেই। স্বাভাবিক। তবে কী জানিস, ক্রমান্বয়ে দুঃখী দুঃখী ভাব করলে ওই ভাবটাই শেষপর্যন্ত পেয়ে বসে। এবার ওর ঘাড় থেকে এই দুঃখের ভূতটা ছাড়াতে হবে। এবার জোরজার করে ওর একটা বিয়ে দেওয়া দরকার। বিয়ে করে থিতু হলে ওসব কেটে যাবে।
বসন্তমঞ্জরী বলল, উনি কি রাজি হবেন? মনে হল যেন, কিছুদিন আগেই ওর বউ মারা গেছে।
দ্বারিকা সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলল, তার ভুরু কুঁচকে গেল। সে বলল, আঁ? কী বললি? ভরতের বিয়ে হল কবে যে তার বউ মারা যাবে। ভরত তো ওর বিয়েতে আমাকে নেমন্তন্ন করেনি। তোকে নেমন্তন্ন করেছিল? তা হলে তুই জানলি কী করে?
বসন্তমঞ্জুরী কাঁচুমাচুভাবে বলল, না, আমি জানি না। কিন্তু ওকে দেখে মনে হল, উনি সদ্য বড় একটা শোক পেয়েছেন। স্ত্রীবিয়োগের মতন শোক।
উঠে বসে রীতিমতন রাগত স্বরে দ্বারিকা বলল, কী উদ্ভট পাগলের মতন কথা বলিস! কোনও মানুষকে দেখেই বলা যায় যে তার বউ মা গেছে? মনে হল আর মনে হল, তোর এই মনে হওয়া নিয়ে আর পারি না।
এর আগের সব ব্যাপারগুলো কাকতালীয় বলে ধরে নিয়ে দ্বারিকা অনেকটা স্বস্তি বোধ করেছিল। কিন্তু এবারে বসন্তমঞ্জরীর ব্যবহার খুব বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। যাকে সে প্রেম ও নর্ম সহচরী রূপে পেতে চায়, সে জাদুকরীর ভূমিকা নেবে কেন? জাদুকরীকে নিয়ে কেউ সংসার বাঁধার স্বপ্ন দেখে না।
সে ক্রুদ্ধস্বরে বলল, আমি এখুনি ভরতকে জিজ্ঞেস করে আসছি।
বসন্তমঞ্জরী ব্যাকুলভাবে দ্বারিকার হাত চেপে ধরে বলল, না, না, এখন থাক, উনি বিশ্রাম করছেন। হয়তো আমার ভুল হয়েছে।
দ্বারিকা বলল, ভুল হয়েছে না ঠিক হয়েছে এখুনি তার সমাধান হয়ে যাবে।
দপদপিয়ে সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
একতলায় ভবতের ঘরেও তাকে পাওয়া গেল না। তার বিছানা শূন্য। হাঁকাহাঁকির পর একজন খিদমতগারের কাছ থেকে জানা গেল যে ভরতকে সে তার লাঠি ও পটুলি নিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখেছে।
শয্যার ওপর ভরত খুলে রেখে গেছে দ্বারিকার দেওয়া পোশাক।