1 of 2

১৬. একটি স্পেশাল ট্রেনে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য

একটি স্পেশাল ট্রেনে মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য এসে পৌঁছলেন শিয়ালদা স্টেশনে। সঙ্গে পারিষদ এবং খিদমতগাবদের বেশ বড় একটি দল। মহারাজের প্রধান দেহরক্ষী এখন মহিম ঠাকুর, তাকে কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়েছে, সে মহারাজের স্নেহভাজন বয়সও বটে। আঠাশ বৎসর বর্ষায় এই যুবা মহিম ঠাকুর সুঠাম দেহের অধিকারী, পড়াশুনোও করে যথেষ্ট। মহারাজ তার ওপর অনেকখানি নির্ভর করেন।

মহারাজের শরীর এখন প্রায়ই সুস্থ থাকে না, চিকিৎসার জনা কলকাতায় আসতে হয়! ত্রিপুরার রাজপ্রাসাদেও অশান্তি লেগেই আছে। রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত, ইংরেজ রাজপুরুষদের আধিপত্য ঠেকাবার জন্য চাণক্যসম ধুরন্ধর রাধারমণ ঘোষ বুদ্ধির খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু প্রাসাদের অভ্যন্তরে তিনি মাথা গলান না। মহারাজ একটু অসুস্থ হয়ে পড়লেই তাঁর উত্তরাধিকারের প্রশ্নটি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। কুমার সমরেন্দ্র ও কুমার রাধাকিশোরের পক্ষ নিয়ে দুটি দল ভাগ হয়ে যায়। রাধাকিশোর অনেক আগেই যুবরাজের পদ পেয়েছেন, সিংহাসনের ওপর তাঁর পরিপূর্ণ দাবি রয়েছে, কি? মহারাজ ইচ্ছে করলে অন্য কারুকেও মনোনীত করতে পারেন। মহারাজের ব্যবহারে সে বকম একটা কিছু যেন প্রকাশ পায় মাঝে মাঝে। প্রথমা পত্নী ভানুমতীর স্মৃতি তিনি এখনও ভোলেননি, ভানুমতীর সেই স্বেচ্ছামৃত্যুর কথা তাঁর মনকে পীড়া দেয়, ভানুমতীর প্রিয় সন্তান সমরেন্দ্রচন্দ্রকে সেই জন্য তিনি কাছাকাছি রাখেন। সমরেন্দ্রচন্দ্রের আশা, পিতা শেষ পর্যন্ত তাকেই সিংহাসনে বসাবেন।

বীরচন্দ্র মাণিক্য দুই পুত্রের দাবি সম্পর্কে নিজে এখনও মৌখিক ভাবে কোনও পক্ষপাতিত্ব দেখাননি। কিছুদিন রোগভোগের পর একটু সুস্থ হয়ে উঠেই মুচকি হেসে বলেন, আমি তো এবারেও মরিনি। মাত্র ঊনষাট বছর বয়েস, যদি একশো বৎসর বাঁচি? ততদিন কে ধৈর্য ধরে থাকতে পারে দেখা যাক!

মহিম ঠাকুরের কাঁধে ভর দিয়ে স্টেশন চত্বর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মহারাজ বললেন, মহিম, আমার কাছে ত্রিপুরার চেয়ে বেশি প্রিয় স্থান আর কোথাও নেই, ত্রিপুরার বাতাসে আমার শরীর জুড়োয়, কিন্তু কলকাতায় এলেও বেশ ভাল লাগে হে! কলকাতার বাতাস বিশুদ্ধ নয়, দৃষিতই বলতে পার, রাস্তায় কত ধুলা, অনেক কল্প-কারখানা গজিয়ে উঠেছে, সেগুলির চোঙা থেকে গল গল করে ধোঁয়া বেলোয়, তাতে চক্ষু জ্বালা করে, অনবরত ঘোড়ার গাড়ির শব্দ, তবু কলকাতায় এলে চাঙ্গা বোধ করি কেন জানো? এখানকাব বাতাসে মিশে আছে বহু বিদ্বান, জ্ঞানী-গুণী, কবি, সঙ্গীতজ্ঞ মানুষের নিশ্বাস। এমনটি আর ভু-ভাবতে কোথায় আছে?

মহিম বলল, তা ঠিক। মহারাজ, আপনার হাত এত ঘামছে কেন?

মহারাজ বললেন, ওইটাই তো আমার প্রধান রোগের লক্ষণ! শরীরের কলকজায় কোথাও কিছু গোলযোগ ঘটেছে। এখানে যে ওই এক নামজাদা ডাক্তার আছে, কী যেন নাম, মহীন, মহীনলাল, তাই না!

মহিম বলল, মহেন্দ্রলাল সবকাবের কথা বলছেন?

মহারাজ বললেন, ঠিক ঠিক, মহেন্দ্রলাল, তাকে ডেকে আনিস, তার ওষুধ খাওয়ার চেয়েও তার কথাবাতা শুনে আমি বেশ মজা পাই।

তারপব মহারাজ উচ্চহাসা করে বললেন, ওই একটিমাত্র ডাক্তার, যে আমাকেও ধমকে কথা বলে।

স্টেশনের বাইরে অনেকগুলি জুড়িগাড়ি মহারাজ ও তাঁর দলবলের জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। এ যাত্রায় কনিষ্ঠা রানি মনোমোহিনীকেও সঙ্গে আনা হয়নি, তিনি এর মধ্যেই দুটি সন্তানেব জননী। কুমার বাধাকিশোর কলকাতায় আসার জন্য বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন, তিনি কলকাতার উচ্চবর্গীয় সমাজের সঙ্গে পবিচিত হতে চান, তার আসার ব্যবস্থা সব ঠিক ছিল, শেষ মুহূর্তে কোনও করেণে মহারাজ তাঁকে ত্রিপুরাতেই থাকতে বলেছেন।

গাড়িতে ওঠার আগে মহারাজ একটুক্ষণ সামনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই নগরী যেন সদাই ব্যস্ত। মানুষজন হাঁটে না, দৌড়ায়। কোথায় যায়, এদের এত কীসের কাজ? এই তুলনায় ত্রিপুরায় জীবন কত শান্তু, ঢিলেঢালা। কলকাতার মানুষ একে অপরকে ঠেলেঠুলে ছুটছে, যেন জীবন যাপনের মধ্যে সর্বক্ষণই রয়েছে এক প্রতিযোগিতা।

সার্কুলার বোডের বাড়িটিতে মহারাজ বীরচন্দ্র যখন প্রথমবার আসেন, তখন শশিভূষণ তাঁর সাড়ম্বর অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখন শশিভূষণ নেই, মহারাজও আসছেন ঘন ঘন, তাই সে রকম কিছু ঘটল না। মহারাজ এসেই ওপরে উঠে গেলেন বিশ্রাম নিতে। একেই তো শবীর সুস্থ নয়, তার ওপর দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি, প্রথম দিন তিনি বাইরের কারুর সঙ্গে দেখা করবেন না। রানিদের কারুকে সঙ্গে আনেননি, কিন্তু দুজন কাছুয়া তরুণী সঙ্গে এসেছে সেবার জন্য। সারাদিনে ও রাত্রে কিছু সময়ের জন্য অন্তত নারীসঙ্গ তাঁর চাই-ই, না হলে প্রাণ উচাটন হয়। পুরুষরা কাছাকাছি এসে দাঁড়ালে কেমন একটা রুক্ষতার বাতাস এসে গায়ে লাগে, নাবীদের অলঙ্কারের সামান্য রিনিঝিনি, তাদের কটাক্ষ, তাদের বিলোল হাস্যে মধুর রসের সৃষ্টি হয়।

প্রভারতী ও গিরিধারা নাম্নী যে যুবতী দুটি এসেছে, তারা সেবাকার্যে ও অঙ্গসংবাহনে খুবই নিপুণ, কিন্তু দুজনের একজনও গান জানে না। আসর জমিয়ে বড় বড় ওস্তাদদের গান শুনতে মহারাজ পছন্দ করেন, কীর্তনীয়ারা তাঁকে প্রায়ই পদাবলী সঙ্গীত শোনায়, কিন্তু মহারাজের বড় শখ, বিশ্রাম নেবার সময় শয্যায় শুয়ে শুয়ে তিনি রমণীকন্ঠের গান শুনরেন। সে শখ আর মিটল না। তাঁর রানিরা কেউ গান জানে না, ত্রিপুরায় স্ত্রীলোকেরা গান বাজনার চর্চা করে না।

মহারাজকে বিশ্রাম নেবার জন্য পাঠিয়েই বেরিয়ে পড়ল মহিম। কলকাতা শহর তার খুব পরিচিত। সে এই শহরে থেকে পড়াশুনো করেছে। হেয়ার স্কুলে তার সহপাঠী ছিল ঠাকুরবাড়ির ছেলে বলেন্দ্রনাথ। কলেজ স্ট্রিটে শ্রীহট্ট মেসে থাকার সুখস্মৃতি আছে। সেই মেসের সহবাসীরা ত্রিপুরার ছেলে বলে মহিমকে বিশেষ খাতির করত। সুরেন বাড়জ্যের গরম গরম বক্তৃতা শুনে ছাত্রদের মধ্যে তখন রাজনৈতিক চেতনা জাগছে, ত্রিপুরা রাজ্য প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনের বাইরে একটি স্বাধীন দেশ, সে জন্য সকলেরই কৌতূহল ছিল ত্রিপুরা সম্পর্কে।

মহিম কলেজ স্ট্রিটের সেই মেসে গিয়ে পুরনো আমলের কাউকেই পেল না। আবাসিকরা সব নতুন তো বটেই, ম্যানেজার-ঠাকুর-চাকরবাও বদলে গেছে। শুধু একজন দারোয়ান এখনও রয়ে গেছে, সে মহিমকে চিনতে পাল বলেই তার বড় আনন্দ হল।

সেখান থেকে সে গেল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। খবর পেয়ে নেমে এল বলেন্দ্র, মহিমকে দেখে আলিঙ্গন কবল সাদরে। দুই কৈশোরের বন্ধু মেতে উঠল গল্পে।

মহিম ছাত্রজীবনে এ বাড়িতে আগেও এসেছে। বলেন্দ্রর কাকা কবিবর রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গেও পরিচয় আছে বিলক্ষণ। মহারাজ এই রবীন্দ্রবাবুকে খুব পছন্দ করেন, কলকাতায় এলেই তাঁকে ডেকে নেন। রবীন্দ্রবাবু এখন বাড়িতে নেই, মহিম বলেন্দ্রকে বলল, আর একদিন সে নিজে এসে রবীন্দ্রবাবুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে যাবে।

এরপর সে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের চেম্বারে গিয়ে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে এল।

মহেন্দ্রলাল এলেন পরদিন বিকেলে।

কলকাতায় এসেই শরীরে বেশ অস্বস্তিবোধ করছেন মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য, তিনি শয্যা ছেড়ে আর ওঠেননি। ডাক্তারকে নিয়ে আসা হল অন্দরমহলে।

মহেন্দ্রলালের যা স্বভাব, দরজার সামনে কিছুক্ষণ গ্যাঁট হয়ে দাঁড়িয়ে, ওয়েস্ট কোটের পকেটে দুটি হাত দিয়ে, ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন সারা ঘর। রোগীর চিকিৎসা করার আগেই কক্ষের মধ্যে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দেখলে তিনি ধমক দিতে শুরু করেন।

এখানে সে রকম কিছু পেলেন না, কিন্তু বোগীব দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর তাঁকে বেশ অসন্তুষ্ট মনে হল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, হুঁ!

পালঙ্কের পাশে একটি চেয়ারে বসে তিনি মহারাজের একটি হাত ধরে নাড়ি দেখতে দেখতে বললেন, গতবারে আপনাকে যেমনটি দেখেছি, তার চেয়ে আপনার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। মুখের চামড়ার রং ভাল নয়। খুব অনিয়ম করছেন বুঝি?

মহারাজা বললেন, অনিয়ম কাকে বলে? বাপ-ঠাকুরদারা যেরকম ভাবে জীবন কাটিয়েছেন, আমিও সেইভাবে কাটাই।

মাহেন্দ্রলাল বললেন, বাপ ঠাকুরদার মতন। হুঁ! রাজা-মহারাজাদের অনেক রকম বদ অভ্যেস থাকে শুনেছি। আপনাব সে রকম কী কী আছে শুনি?

মহারাজ হেসে বললেন, তা কিছু কিছু আছে বটে। এমনকী ‘আমার বাপ-ঠাকুরদার যে সব দোষ ছিল না আমার সে কমও কিছু আছে। সেগুলিই আগে বলি?

মহেন্দ্রলাল বললেন, বেশ, তাই শোনা যাক। কগির সম্পর্কে সব কিছু না-জানলে চিকিৎসা করা যায় না।

মহারাজ দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বললেন, আমি কবিতা রচনা করি।

মহেন্দ্রলাল প্রায় আঁতকে উঠে বললেন, আঁ। কবিতা লেখেন? কেন?

মহারাজ বললেন, কেন লিখি? মাথায় মাঝে মাঝে কবিতা এসে যায়, তাই না লিখে পারি না।

মহেন্দ্রলাল বললেন, এত ভারী অন্যায়, ভারী অন্যায়। একজন রাজার মাথায় কবিতা আসবে কেন? রাজকার্যে পুরোপুবি মন না দিয়ে কবিতা লিখে সময় নষ্ট করা তত ভাল কথা নয়। কবিরা কবিতা রচনা করবে, রাজারা বাজত্ব চালাবে, এটাই তো ঠিক।

মহারাজ বললেন, রাজার মস্তিষ্কে যদি কবিতা সেঁধিয়ে পড়ে তা হলে কী করা যাবে?

মহেন্দ্রলাল বললেন, বিদেয় করে দিতে হবে। উহঁ, এ লক্ষণ ভাল নয়। ইদানীংকালে দুজনের কথা জানি। কবিতা লিখে বিপদে পড়েছে। দিল্লির মোঘল বাদশা বাহাদুর শাহ আর আওয়েধের নবাব ওয়াজির আলি শাহ, এই দুজনেরই কবিতা লেখার বাতিক ছিল, সেই জন্য দুজনেই রাজ্য খুইয়ে নির্বাসিত হয়েছে। ঠিক কিনা?

মহারাজ বললেন, আমার ক্ষেত্রে সে সম্ভাবনা নেই। আমি লিখি, দু চারজন মাত্র শোনে। ইংরেজরা আমার কবিতা রচনার কথা টের পায়নি, পাবেও না।

মহেন্দ্রলাল গম্ভীরভাবে বললেন, যদি লিখতেই হয়, ও দোষ একেবারে কাটাতে না পারেন, তা হলে শুধু দিনের বেলায়। রাত্তির জেগে লেখা চলবে না একেবারেই। শরীরে সইবে না।

মহারাজ বললেন, রাতে লিখি না বটে, কিন্তু গানবাজনা শুনি। কোনও কোনও দিন শুনতে শুনতে রাত ভোর হয়ে যায়।

মহেন্দ্রলাল বললেন, দিনেরবেলা কাব্যি করবেন, রাত্তিরে গান-বাজনা, তা হলে প্রজাদের দেখবেন কখন! রাজকার্য কখন সামলাবেন?

মহারাজ বললেন, আমার রাজত্বে রাজকার্য তৈমন গুরুতর নয়। ঈশ্বরের ইচ্ছায় সবই তো ঠিক চলে যায়। প্রজারাও আমাকে মানা করে। দিনের বেলা আমি আর একটি কাজও করি। ছবি আঁকি, ছবি তুলি। আঁকার কাজটি এখন তেমন হয় না, তবে ফটোগ্রাফির শখ রয়েছে পুরোপুরি। এবারে গঙ্গার ধারের কতকগুলো ফটো তুলব ঠিক করেছি।

মহেন্দ্রলাল বললেন, আপনি দেখছি এক মড়নি মহারাজ। দিনকাল পাল্টেছে, এখনকার রাজা কিংবা নবাবরা প্রজাদের পিটিয়ে আনন্দ পায় না। অন্য রকম শখে মেতেছে। তা বেশ। মদপান করা হয় কতখানি?

মহারাজ বললেন, জীবনে কখনও স্পর্শ করিনি!

মহেন্দ্রলাল ভুরু প্রায় ব্রহ্মতালু পর্যন্ত তুলে বললেন, আঁা? রাজা হয়েও মদ খায় না, এমন তো কখনও শুনিনি। এ যে দেখছি দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ।

মহারাজ বললেন, মদ্য পান করি না বটে, তবে তামাক বেশি খাই। দেখছেনই তো। গড়গড়ার মল হাতে না নিয়ে একটুক্ষণও থাকতে পারি না। এমনকী যখন পথ দিয়ে হেঁটে যাই, তখনও কোবরদার সঙ্গে ছোটে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, তামাক তো রাজা-প্রজা সকলেই খায়। এমনকী দক্ষিণেশ্বরের যে সাধু ছিলেন, রামকৃষ্ণ ঠাকুর, তিনিও খুব তামাক টানতেন। গলায় ক্যানস্বার হল, তাও বন্ধ করেননি, তাঁর শিষ্যরাও খুব তামাকের ভক্ত। মহারাজ, আপনার রানির সংখ্যা কত?

মহারাজ একটু চিন্তা করতে লাগলেন। তারপর বললেন, ঠিক বলতে পারি না। ঠিকঠাক হিসেব করে পরে আপনাকে সংখ্যাটা জানাব।

মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, আর রাজকীয় ভোজনবিলাস? সেটা কী রকম?

মহারাজ বললেন, সেটা বলার মতন কিছু নয়। এককালে খেতে পারতাম বটে। খিচুড়ি বড় প্রিয় ছিল, একগামলা উড়িয়ে দিতে পারতাম। এখন আর পেটে তত সয় না। বিশ-পঁচিশটা লুচি পাই বড় জোর, তাও দুপুরবেলা, রাত্তিরে চাট্টি গরম ভাত আর মাংসের জুস, একটা মাছের মাথা আর গোটাকতক সন্দেশ। কলকাতা এলে রসগোল্লা খাই। বড় ভাল এখানকার রসগোল্লা।

মহেন্দ্রলাল বললেন, হুঁ, বুঝলাম। এবার আমার কথাটা বলি? আপনি পদ্য লিখে, গান শুনে, ফটোগ্রাফির চচা করেও কী ভাবে রাজা শাসন করবেন, সে চিন্তা আপনার, আমার নয়। আপনি সিংহাসনে বসেছেন বলেই তো সৃষ্টিকর্তা আপনার শরীরটা অন্যভাবে গড়েননি? রাজা আর প্রজা, সকলেই মানুষ, সকলেরই শরীরের গঠন এক প্রকার। আমাকে যখন চিকিৎসা করতে হবে, তখন আপনার এই শরীরটাই চিকিৎসা করতে হবে, একজন মহারাজের শরীর বলে আলাদা কিছু নয়। কিছু কিছু নিয়ম মেনে না-চললে যত বড় ডাক্তারই ডাকুন আর যত দামি ওষুধই খান, আপনার রক্তমাশা সারবে না। আপনার হৃদযন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়েছে। আপনাকে খাওয়া কমাতে হবে, লুচি চারখানার বেশি না, আর সন্দেশ একটা। মাছের মুড়ে এখন অল্পবয়েসীদের পাতে তুলে দিন। তামাক টানাও কমাতে হবে, বন্ধ করতে পারলেই ভাল হয়। অধিক রাত্রি জাগরণ একেবারে নিষিদ্ধ। গান-বাজনা শোনা ভাল, মন প্রফুল্ল হয়, আমিও খুব পছন্দ করি, কিন্তু রাত বারোটার পর একেবারেই নয়। এই সব মানলে ওষুধের ফল পাওয়া যাবে। নচেৎ না। কোথাও বায়ু পরিবর্তনের জন্য যেতে পারলে ভাল হয়।

মহারাজ বললেন, ত্রিপুরা থেকে কলকাতায় এসেছি, এই তো বায়ু পরিবর্তন হল।

মহেন্দ্রলাল হেসে উঠে বললেন, কলকাতার বায়ু ও পরিবর্তন মানে ভাল ছেড়ে মন্দের দিকে নয়। আপনার দেশে উঁচু কোনও পাহাড় আছে? যেখানে বরফ জমে?

মহারাজ বললেন, পাহাড় আছে অগুনতি, কিন্তু তেমন উঁচু নয়।

মহেন্দ্রলাল বললেন, কোনও শৈলনিবাসে গেলে আপনার উপকার হতে পারে। দার্জিলিং কিংবা কার্শিয়াং যেতে পারেন, ঠাণ্ডায় আপনার উপকার হবে।

উঠে দাঁড়িয়ে, চলে যাবার জন্য উদ্যত হয়ে মহেন্দ্রলাল আবার বললেন, হ্যাঁ ভাল কথা। আমি এখানে আসব শুনে আনন্দমোহন বসু আমাকে বললেন, ত্রিপুরায় নাকি এখনও সতীদাহ হয়? ইংরেজের আইন আপনার রাজ্যে খাটে না। এখানে যারা বিধবা বিবাহের জন্য প্রচুর পরিশ্রম করছে, তারা আপনার দেশে সতীদাহ এ যুগেও চালু আছে শুনে খুব মনঃক্ষুন্ন হয়েছে।

মহারাজ বললেন, না, না, ওই প্রথা ছিল এক সময়। আমি বছর কয়েক আগে তা রদ করে দিয়েছি।

মহেন্দ্রলাল বললেন, আপনি সিংহাসনে বসেছেন অনেককাল আগে, তবু এতদিন চালু ছিল? হঠাৎ বদলাতে গেলেনই বা কেন?

মহারাজ বললেন, অনেক দিনের ধর্মীয় প্রথা। বদলানো সহজ নয়। আমার সচিব রাধারমণ ঘোষ এই নিয়ে অনেকদিন ধরে খুঁচিয়েছে আমাকে। তারপর হল কী। আমার সেনাপতি চরণ, সে হঠাৎ মারা গেল। তার স্ত্রী নিছবতী পরমাসুন্দরী। নিছবতী নিজেই সতী হতে চাইল। আমি কিছুই জানি না, এমন তো কতই হয়। আমি জঙ্গলে ফটোগ্রাফি করতে গেছি, এমন সময় ঘোষমশাই এসে বলল, মহারাজ, একবার শ্মশানে চলুন। প্রায় জোর করেই নিয়ে গেল আমাকে। গিয়ে দেখি কী, লোক জড়ো হয়েছে অনেক, ঢাক-ঢোলকাঁসর বাজছে, একটা লাল পাড় শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছে নিছবতী, চুল খোলা, চোখে কাজল, টকটকে গৌরবর্ণ, ঠিক দেখাচ্ছে এক দেবীর মতন। এই অপরূপ রমণী জীবিত অবস্থায় পুড়ে ছাই হয়ে যাবে? আমি হাত তুলে বললাম, ওরে রাখ, রাখ! বন্ধ কর! নিছবতী তবু মানতে চায় না, জ্বলন্ত চিতায় সে উঠবেই। তখনই আমি আদেশ জারি করলাম, আজ থেকে ত্রিপুরা রাজ্যে সতী হওয়া নিষিদ্ধ হল। কেউ স্বেচ্ছায় সতী হতে চাইলেও আমার সেনা তাকে আটকাবে।

মহেন্দ্রলাল বললেন, তারপর আপনি সেই নিছবতীকে বিয়ে করে ফেললেন?

মহারাজ ঈষৎ লজ্জা পেয়ে বললেন, আরে না না।

মহেন্দ্রলাল বললেন, একটি সুন্দরী রমণীকে দেখে আপনার মন গলে গিয়েছিল। ওই নিছবতী যদি এক কুচ্ছিত বুড়ি মাগি হত, তা হলে আপনি মুখ ফিরিয়ে চলে যেতেন, তাই না?

মহেন্দ্রলাল কাছে এসে মহারাজের বাহুর চামড়া দু আঙুলে টেনে ধরে বললেন, একবার কল্পনা রুন তো, আপনার একখানা বানি মারা গেছে, তারপর আপনাকে জ্যান্ত অবস্থায় সেই চিতায় চড়ানো হয়েছে, সতীর পুংলিঙ্গ কী জানি না, আপনাকে পুরুষ-সতী করা হল, পটপট করে পুড়ছে গায়ের চামড়া, মাথার চুল জ্বলছে দাউ দাউ করে, গলে যাচ্ছে চোখ, ভাবুন তো একবার সেই অবস্থাটা? সতী! যত সব শয়তান, বদ, গুখেকোর বাচ্চারা এই প্রথা চালু করেছি, আপনার মতন লোকেরা সেই সব কুচরিত্তির পুরুতগুলোর কথায় নেচেছেন, তাদের মদত দিয়েছেন!

মহারাজ স্তম্ভিতভাবে ডাক্তারটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তাঁর রাজ-অঙ্গ এই ভাবে স্পর্শ করার সাহস নেই কারুর। তাঁর সামনে এ রকম দাঁত কিড়মিড়িয়ে আজ অবধি কেউ কথা বলেনি। এটা ব্রিটিশ রাজত্ব, নিজের রাজ্যে কেউ এমন বেয়াদপি করলে তিনি তাকে জীবন্ত অবস্থায় মাটিতে পুঁতে মাথাটা কুকুর দিয়ে খাওয়াতে পারতেন।

ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে মহেন্দ্রলাল বললেন, আমি যে সংযমগুলি পালন করতে বলেছি, তা মানতে পারেন তো ভাল। আর যদি না মানেন, তা হলে আর আমাকে কল দেবার দরকার নেই। শুধু ওষুধে কোনও কাজ হয় না। যে রুগি আমার নির্দেশ মানে না, হাজার টাকা ফি দিলেও আমি তাকে দেখতে আসি না।

মহিম দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে। সে ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেল।

ওই অবস্থায় খানিকক্ষণ বসে থাকার পর মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য পালঙ্ক থেকে নামলেন। তাঁর শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্রোধের জ্বালা। নাগরা পায়ে দিয়ে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন ঘরের মধ্যে।

একটু বাদে তিনি উঁচু গলায় ডাকলেন, মহিম! মহিম!

মহিম ছুটে এল এদিকে। হাত জোড় করে প্রণাম জানিয়ে বলল, কিছু আনতে হবে?

মহারাজ হাত নেড়ে বললেন, না। ওই হারামজাদা ডাক্তারটা আমাকে কী রকম কথা শুনিয়ে গেল দেখলি? এত সাহস।

মহিম চুপ করে রইল। এই ডাক্তার বরাবরই দুমুখ, সবাই জানে। তবে এতটা বাড়াবাড়ি কখনও করেননি। বিশেষত দু আঙুল চিমটের মতন করে মহারাজের চামড়া টেনে ধরা, মহিম তখন শিউরে উঠেছিল।

খাঁচায় বন্দি সিংহের মতন ঘরের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে মহারাজ বললেন, তোর কাছে পিস্তল ছিল না? তুই ওকে গুলি করে মারতে পারলি না?

মহিম ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বলল, আজ্ঞে—

মহারাজ বললেন, ডাক্তার হয়েছে বলে ও যেন ধরাকে সরা জ্ঞান করে। এতবড় কলকাতা শহরে আর বুঝি ডাক্তার নেই? কত সাহেব ডাক্তার আছে, মাদ্রাজি ডাক্তার আছে, টাকা ছড়ালে ডাক্তারের অভাব!

পায়চারি করতে করতে হঠাৎ এক জায়গায় থেমে গেলেন মহারাজ। ক্রোধের বদলে তাঁর মুখে এবার ফুটে উঠল বিস্ময়।

তিনি বললেন, মহিম, একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিস?

মহিম বলল, কী মহারাজ?

মহারাজ ধমক দিয়ে বললেন, চোখ নেই? দেখতে পাস না? প্রায় দু মাস ধরে আমি ভাল করে হাঁটতে পারি না। বুক ধড়ফড় করে। কাল সন্ধে থেকে আমি মাটিতে পা ফেলতেই পারিনি। কিন্তু এখন আমি কী করছি? নিজে নিজে হেঁটে বেড়াচ্ছি, কারুর কাঁধে ভর দিতে হচ্ছে না।

তারপর হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, এ ব্যাটা ডাক্তারের গুণ আছে বাবা, স্বীকার করতেই হবে। ওষুধ লাগল না, শুধু কথা বলে বলেই আমাকে খাড়া করে দিলে! আঁ? এতক্ষণ তামাকও খাইনি। ওকেই বারবার ডাকবি। আসতে না-চায়, ধরে বেঁধে আনবি। তবে দেখিস, ও যখন আসবে, আমার ঘরের আশেপাশে কেউ যেন না থাকে। ও ব্যাটা যখন আমাকে অপমান করবে, আর যেন কেউ তা শুনতে না-পায়। আজ ও আমার সঙ্গে যেমন ব্যাভারটা করে গেল, সে কথা তুই যদি কারুকে বলিস, তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব। যা এবার একটু তামাক সাজতে বল।

মহারাজ আপন মনে হাসতে লাগলেন।

এরপর ক্রমশই বেশ সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য। শহরে তাঁর আগমনবার্তা প্রচারিত হয়ে গেল। অনেকেই তার কাছে প্রার্থী হয়ে আসে। বাইরের লোকের সঙ্গে তার ব্যবহার বেশ মধুর, ধনী বা দরিদ্রের প্রভেদ করেন না। তাঁর দানের মধ্যে প্রকাশ্য অহমিকা নেই। দীনেশচন্দ্র সেন নামে এক নবীন গ্রন্থকার নিক্সের বই ছাপার খরচ পেয়েছে মহারাজের কাছ থেকে, কৃতজ্ঞতাবশত সে গ্রন্থখানি মহারাজের নামে উৎসর্গ করতে চায়। মহারাজ বিনম্রভাবে বলে উঠলেন, না, না আবার কেন, তা আবার কেন?

রবীন্দ্রবাবুর কবিতা তিনি বরাবরই পছন্দ করেন, এবারও এই কবির নতুন কবিতা শুনে মুগ্ধ হলেন। চিত্রা’ নামে রবীন্দ্রবাবুর একটি নতুন কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। বড় সরেস এর কবিতাগুলি।

রবীন্দ্রবাবু উচ্চবংশের সন্তান, তিনি মহারাজের কাছে কখনও কিছু চাইবেন না। কিন্তু মহারাজের কিছু দিতে ইচ্ছে করে। ‘চিত্রা’ গ্রন্থখানি নাড়াচাড়া করতে করতে মহারাজ বললেন, আপা বাঁধাই তেমন ভাল নয়। এমন উত্তম কবিতা, সোনার জলে ছাপানো উচিত ছিল। চিত্র-শোভিত করে মরক্কো চামড়ায় বাঁধালে এর উপযুক্ত হয়।

রবির গ্রন্থগুলির প্রকাশক পাওয়া যায় না। নিজেদেরই ব্রাহ্ম মিশন প্রেসে ছাপা হয়, দাম কমাবার জন্য বাঁধাইয়ের যত্ন নেওয়া হয় না।

মহারাজ বললেন, রবিবাবু, আমার ইচ্ছে হয়, আপনার যে কটি বই বেরিয়েছে, সব একত্র করে একটি শোভন সংস্করণ প্রকাশ করি। আপনি কী বলেন?

রবি সলজ্জ সম্মতি জানিয়ে বললেন, মহারাজ, আপনার আনুকুল্যে যদি একটি সমগ্ৰ বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশ করা যায়, তা হলে অনেকের উপকার হয়। পদাবলীগুলি এক একটি রত্ন, কিন্তু কত জায়গায় ছড়িয়ে আছে।

মহারাজ উৎসাহিত হয়ে বললেন, অতি উত্তম প্রস্তাব। আপনি সংগ্রহ করতে লেগে যান। যদি লক্ষ টাকাও লাগে, আমি দিতে প্রস্তুত আছি।

বৈষ্ণব পদাবলীর ব্যাপারে রাধারমণেরও বিশেষ আগ্রহ। তিনি রবির সঙ্গে বসে গেলেন সম্পাদনার পরিকল্পনায়। মহিমের অনুরোধে কয়েকখানা গানও গাইলেন রবি। তার মধ্যে বিশেষত একখানা গান শুনে মহারাজ বলে উঠলেন, কথা? শুধু কথা বিষয়ে একখানি গান? এমন কথা কে কবে শুনেছে? আর একবার শোনান তো! রবি দ্বিতীয়বার গাইলেন;

কত কথা তারে ছিল বলিতে
চোখে চোখে দেখা হলো পথ চলিতে
বসে বসে দিবারাতি বিজনে সে কথা গাঁথি
কত যে পুরবী বাগে কত ললিতে।
যে কথা ফুটিয়া ওঠে কুসুমবনে
সে কথা ব্যাপিয়া যায় নীল গগনে…

নিজের বুকে হাত বুলাতে বুলাতে মহারাজ বললেন, এমন গান শুনলে বয়েস কমে যায়। কী গান শোনালেন রবিবাবু, আমার সব রোগ সেরে গেল। কাব্য আর গানের কাছে ওষুধ-বিষুধ কোন ছার! এক ডাক্তার বলে কী, রাজা হলে নাকি কবিতা ভালবাসতে নেই।

বাংলার সাহিত্য জগৎ সম্পর্কে মহারাজের স্পষ্ট ধারণা নেই। কিছু কিছু বই পড়েছেন শুধু। রবি প্রতিটি লেখক, প্রতিটি পত্র-পত্রিকার খুঁটিনাটি খবর রাখেন। রবির সঙ্গে আলোচনা করতে করতে মহারাজ অনেক কিছু জেনে নেন। মহারাজ স্বয়ং কবিতা রচনা করেন, রবি তার কয়েকটি ‘ভারতী’ কিংবা ‘সাধনা’য় প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন, মহারাজ কিছুতেই তাতে সম্মত হন না। তাঁর যশের বাসনা নেই।

কথায় কথায় রাধারমণ এক সময় বললেন, শুনছি এখন দ্বিজুবাবু নামে একজনও বেশ ভাল লিখছেন, আমাদের কৃষ্ণনগরের ওদিককার ছেলে।

রবি বললেন, হ্যাঁ, খুব ভাল লিখছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় আমার বন্ধু মানুষ, নিজের রচিত গান গাইতেও পারেন খুব ভাল।

রাধারমণ বললেন, একদিন তাকে ডেকে তার গান শুনলে হয়!

মহারাজ মাথা দোলাতে দোলাতে বললেন, আমি একনিষ্ঠ। আমি রবিবাবু ছাড়া আর কারুর গান শুনতে চাই না। তোমরা শুনে দেখো।

রবি এ কথা শুনে শ্লাঘা বোধ করলেও জোর দিয়ে বললেন, না, মহারাজ, আপনি একবার শুনে দেখুন। দ্বিজেন্দ্রবাবুর গান অতি উচ্চাঙ্গের।

রবি মহারাজকে জোড়াসাঁকোর বাড়িতে একদিন আমন্ত্রণ জানালেন। সেখানে ওকে সুরঙ্গা ও ইন্দিরার গান শোনান হবে।

মহারাজ বললেন, যাব, আপনাদের সুবিখ্যাত ঠাকুরবাড়িতে গেলে আমি ধন্য হব। তবে একটা শর্ত আছে। আমি যদি হাওয়া পরিবর্তনের জন্য দার্জিলিং বা কার্শিয়াং যাই, আপনাকে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।

কাব্য ও সঙ্গীত ছাড়া মহারাজের অপর শখ নাটক দেখা। শরীর বেশ সুস্থ আছে, এখন মহারাজ এক এক সন্ধ্যায় এক একটি থিয়েটারে যান। এখন দুটি মঞ্চে গিরিশবাবু ও অর্ধেন্দুশেখর জোর পাল্লা দিয়ে নাটক নামিয়ে যাচ্ছেন। স্টারে অমৃতলাপের দলটিও বেশ জনপ্রিয়। তুলনামূলক বিচার করার জন্য মহারাজ দেখতে লাগলেন সবগুলি।

এমারাল্ড থিয়েটারে গিয়ে একটি ঘটনা ঘটল।

ব্যবসাবুদ্ধিহীন অর্ধেন্দুশেখর অনেক আর্থিক দণ্ড দিয়ে থিয়েটারের মালিকানা খুইয়েছেন। অংশীদাররাও ত্যাগ করেছে তাঁকে। এমারান্ড এখন ভাড়া নিয়েছে বেনারসী দাস নামে এক মারোয়াড়ি, অধ্যক্ষ ও নাট্য-পরিচালক রয়েছেন অর্ধেন্দুশেখরই। নাটক চলছে রমেশ দত্তর বঙ্গ বিজেতা’।

অভিনয় চলাকালীন নায়িকার মুখে একখানি গান শুনে মহারাজ চমকিত হলেন।

মহারাজের স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর নয়, অনেক পরিচিত মানুষেরও তিনি নাম ভুলে যান। কিন্তু গান কখনও ভোলেন না। গানের বাণী তাঁর সহজে মুখস্থ হয়ে যায়, একবার শোনা গানের সুরও তাঁর কানে লেগে থাকে।

এই নাটকের গানটি তাঁর চেনা চেনা লাগল। অথচ কোথায় শুনেছেন, কবে শুনেছেন ঠিক মনে পড়ছে না। এই নাটক তিনি আগে দেখেননি, সবে মাত্র শুরু হয়েছে। এ নাটকের জন্য লিখিত গান তিনি পুর্বে শুনরেনই বা কী করে? অনেকে অবশ্য নতুন গানেও পরিচিত সুর লাগিয়ে দেয়। অন্যান্য দৃশ্যগুলির বদলে, যে সব দৃশ্যে ওই মেয়েটি আসছে মহারাজ শুধুই সেগুলিই দেখছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে।

নায়িকাটি বেশ জনপ্রিয় বোঝা যায়। তার চোখা চোখা সংলাপে ও গানে দর্শকরা ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছে। মেয়েটি অভিনয়ও কাছে খুব দাপটের সঙ্গে। তার মুখে আর একটি গান শুনেই মহারাজ বুঝতে পারলেন, এই গান নয়, এই কণ্ঠস্বর তার পরিচিত।

মহারাজের দু পাশে বসেছে রাধারমণ ও মহিম। ইন্টারভ্যালের সময় মহারাজ রাধারমণকে জিজ্ঞেস করলেন, ঘোষঙ্গা, এই প্রধান অভিনেত্রীটিকে চিনতে পারলে?

রাধারমণ বললেন, আমি আগে ওর অভিনয় দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।

মহারাজ বললেন, এ মেয়ে এক সময় আমাদের এই কলকাতার বাড়ির পাসী ছিল। কী যেন ওর নাম?

রাধারমণ বাড়ির দাসীদের খোঁজখবর রাখেন না। তিনি তাকালেন মহিমের দিকে। মহিমের অন্দরমহলে যাতায়াত আহে। কিন্তু মহিম কলকাতার বাড়িতে এবারেই প্রথম এসেছে। সেও দেখেনি ও মেয়েটিকে।

মহারাজ ভুরু কুঞ্চিত করে স্মৃতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে করতে বললেন, নাম মনে করতে পারলে না? কী যে করো। ও যে আমার বাড়ির দাসী ছিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

রাধারমণ উঠে গিয়ে থিয়েটারের একটা হ্যান্ডবিল জোগাড় করে এনে বললেন, এর নাম তো দেখছি নয়নমণি।

মহারাজ মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, না, না, ও নাম নয়। ও নাম নয়। অন্য, কী যেন। সেই যে শশীমাস্টার যে-মেয়েটাকে নিয়ে ভেঙ্গে পড়েছিল।

রাধারমণের সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। তিনি বললেন, ভূমিতা? না, শশিভূষণ ওকে নিয়ে পালায়নি। আমি নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, সে চন্দননগরে অন্য এক বউ নিয়ে থিতু হয়েছে। সে তুমি তার কোনও খবর রাখে না। এই সেই ভূমিসূতা?

মহারাজ গভীর বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, শশিভূষণ ওকে নিয়ে জাগেনি। তা হলে…আমি এই মেয়েটিকে চেয়েছিলাম, তবু সে চলে গেল কেন?

এ প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন রাধারমণ। তিনি চুপ করে রইলেন।

অভিনয় শেষ হবার পর মহারাজ নট-নটীদের কিছু পারিতোষিক দৈবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন।

মঞ্চের পেছনে এসে দাঁড়ালেন মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য। সমস্ত নট-নটীরা সার-বদ্ধ হয়ে রইল তাঁর সামনে, মধ্যিখানে অর্ধেন্দুশেখর।

মহারাজ নাটকটির অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করে অর্ধেন্দুশেখরকে উপহার দিলেন একটি হিরের আংটি। এক হাজার রুপোর টাকা দিলেন নট-নটীদের মধ্যে বণ্টন করে দেবার জন্য।

সরাই মহারাজকে প্রণাম করে যেতে লাগল। নয়নমণি যেই নিচু হয়ে মহারাজের পায়ে হাত দিয়েছে, তখনই মহারাজ রাধারমণকে বললেন, ঘোমশাই, জিজ্ঞেস করো, এই মেয়েটি আমার বাড়ির দাসী ছিল কিনা।

নয়নমণির মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। মহারাজ তাকে চিনতে পারবে সে কল্পনাও করতে পারেনি। এত বছর বাদে, তাও তার মখে রং মাখা।

নয়নমণির সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন না মহারাজ। তিনি আবার রাধারমণের দিকে চেয়ে বললেন, ওকে জিজ্ঞেস করো, আমাকে কিছু না জানিয়ে এই মেয়ে আমার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল

নয়নমণি এবারেও কোনও উত্তর না দিয়ে দৌড়ে চলে গেল।

মহারাজ অর্ধেন্দুশেখরের দিকে ফিরে বললেন, মুস্তফিমশাই, কাল সোমবার বোধকরি আপনাদের থিয়েটার খোলা থাকে না। কাল সন্ধেবেলা এই মেয়েটিকে আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন তো। আমি নিভৃতে ওব গান শুনব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *